সিদ্দিকুর রহমান বাড়ি ফিরলেন দুপুরে। ‘গাইড়ার ভিটা’ নামে পরিচিত দেড় শ বিঘার মতো জমির জন্যে বায়না দলিল করতে তার দেরি হলো। গাইড়ার ভিটা এই অঞ্চলের দোষী জমি। এই জমি কিনে যে ভোগদখল করতে গিয়েছে তার উপরই মহাবিপদ নেমেছে— এ-ধরনের জনশ্রুতি আছে। জমির বর্তমান মালিক কাজী আসমত খাও নির্বাংশ হয়েছেন। তার একমাত্র জোয়ান ছেলে এবং ছেলের ঘরের নাতি একই দিনে নৌকাড়ুবিতে মারা গেছে। সিদ্দিকুর রহমান এইসব কারণেই গাইড়ার ভিটা নামমাত্র মূল্যে পেয়েছেন। কাজী আসমত খাঁ বায়না দলিলে সই করার সময় নিচু গলায় বলেছেন, জমিটা যে দোষী কথা সত্য। ভোগদখলের আগে মোল্লা মুসুন্ত্রি ডাইক্যা দোয়া পড়াইতে ভুল কইরেন না। বড়ই দোষ লাগা জায়গা। সিদ্দিকুর রহমান বলেছেন, মানুষ দোষী হয়। জমি দোষী হয় না। মানুষের অন্তরে দোষ লাগে। জমির অন্তরে দোষ লাগে না। কথাটা বলে তার ভালো লেগেছে। তার মনে হয়েছে কিছু না বুঝেই তিনি খুব একটা ভাবের কথা বলে ফেলেছেন। এই ভাবের কথার মর্ম সবাই ধরতে পারবে না। ভাবের কথার মর্ম বুঝতে পারার জন্যে ভাবের জগতে থাকতে হয়। বেশিরভাগ মানুষ ভাবের জগতে থাকে না।
গাইড়ার ভিটা কেনার পেছনে সিদ্দিকুর রহমানের বিশেষ একটা উদ্দেশ্য কাজ করছে। এই উদ্দেশ্যের সঙ্গে ভাবের জগতের কিছু যোগ আছে। জমি দলিলে রেজিস্ট্রি হবার পর তিনি তার উদ্দেশ্য প্রকাশ করবেন। তাও সবার সঙ্গে না। দুএকজনের সঙ্গে। সেই দুএকজন কে তা তিনি ঠিক করে রেখেছেন।
কাজী আসমত খাঁর বাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে আসতে তার একঘণ্টার মতো লাগল। সঙ্গে ছাতা নেয়া হয় নি। কড়া রোদের সবটাই মাথায় পড়েছে। তার দ্রুত হাঁটার অভ্যাস। শেষের দিকে তার হাঁটার গতি শ্লথ হয়ে এলো। বুকে চাপা। ব্যথা অনুভব করতে লাগলেন। তিনি নিজের দুর্বলতা অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করে হাঁটার গতি বাড়াতে চেষ্টা করলেন। হাঁটার গতি তেমন বাড়ল না, বুকের চাপ ব্যথাটা শুধু বাড়ল। সুলেমান চিন্তিত গলায় বলল, চাচাজির শইল কি খারাপ লাগতেছে? তিনি প্রশ্নের জবাব দিলেন না। বাড়ি পৌছানোর পর চোখ বন্ধ করে ইজিচেয়ারে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে হবে। মাথা থেকে সমস্ত দুশ্চিন্তা দূর করে পাঁচ-দশ মিনিট মরা মানুষের মতো পড়ে থাকলেই শরীর ঠিক হয়ে যাবে।
বাড়িতে পা দিয়ে তিনি ধাক্কার মতো খেলেন। বাংলাঘরের উঠানে দুই কাঠের মিস্ত্রি সমানে করাত চালাচ্ছে। তাদের তিনজন জোগালি কাঠে রান্দা দিচ্ছে। একটু দূরে লোকমান শুকনামুখে বসে আছে। তাকে অসম্ভব চিন্তিত মনে হচ্ছে। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, ঘটনা। কী? লোকমান চট করে জবাব দিতে পারল না, হড়বড় করতে লাগল। সিদ্দিকুর রহমান কড়া গলায় বললেন, ঘটনা কী বলো? এরা কী বানায়? পালঙ্ক?
লোকমান বলল, জি না।
তাহলে বানাইতাছে কী?
পালকি।
পালকি কী জন্যে?
বইনজির হুকুমে পালকি বানাইতাছে। বইনজিটা কে?
লীলা বইনজি।
সিদ্দিকুর রহমান বিস্মিত হয়ে বললেন, পালকি দিয়া কী হবে? সে কি পালকি দিয়া যাতায়াত করবে?
নতুন বউ পালকি দিয়া আসবে।
সিদ্দিকুর রহমান আরো অবাক হয়ে বললেন, নতুন বউ কে?
লোকমান ভীত গলায় বলল, মাসুদ ভাইজানের ইসাতিরি। পরীবানু।
সিদ্দিকুর রহমান ধাক্কার মতো খেলেন। মাসুদের স্ত্রীকে যে আজই এবাড়িতে আনার কথা সেটাই তার মনে নেই। মেয়েটার নাম যে পরীবানু তাও মনে ছিল না। সুলেমান বলল, চাচাজি, কাজ কি বন্ধ করে দিব?
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমার মেয়ে যে কাজ শুরু করেছে সেই কাজ আমি বন্ধ করব এটা কেমন কথা?
সুলেমান বলল, কাজ বন্ধ না কইরা উপায়ও নাই। একদিনে কাজ শেষ হইব না। অসম্ভব।
সিদ্দিকুর রহমান গম্ভীরমুখে বললেন, অসম্ভব বলে কোনো কথা নাই। দুইজন মিস্ত্রি না পারলে দশজন মিস্ত্রিরে কাজে লাগাও। জোগালি বাড়ায়ে দাও। পালকি এমন কোনো জটিল জিনিস না যে বানাতে একবছর লাগবে।
সুলেমান বিড়বিড় করে বলল, কথা সত্য। সিদ্দিকুর রহমান মিস্ত্রিদের দিকে বললেন, কী, তোমরা দিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারবো?
মিস্ত্রিদের একজন বলল, চেষ্টা নিব।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, চেষ্টা নেওয়া-নেওয়ির কিছু নাই। হয় পারবা, না হয়। পারব না। দুই-এর মাঝামাঝি কিছু নাই।
পিনিছিং ভালো হইব না। তয় কাজ চলব।
সিদ্দিকুর রহমান আর কথা বাড়ালেন না। বকুলগাছের ছায়ার নিচে তার ইজিচেয়ার পাতা আছে। তিনি চেয়ারে শুয়ে পড়লেন। বুকের চাপা ব্যথা আরো বেড়েছে। পানির পিপাসা হয়েছে। তীব্র পিপাসা নিয়ে পানি খেতে নেই। তিনি পানির পিপাসা কমার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। শরীরটাকে ঠিক করতে হবে। মাসুদের বউ আসবে। কিছু ব্যবস্থা তাকে নিতে হবে। এখন আধমরার মতো বিছানায় শুয়ে থাকা যাবে না। সমস্যা হলো মানুষ ইচ্ছা করলেই তার শরীর ঠিক করতে পারে না। মানুষ তার শরীর যেমন ঠিক করতে পারে না, মনও ঠিক করতে পারে না। মন এবং শরীর কোনোটার উপরই মানুষের কোনো দখল নেই।
সিদ্দিকুর রহমান চাপা গলায় ডাকলেন, বদু কি আছ আশেপাশে?
বদু দৌড়ে এলো। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, নাপিত ডাক দিয়া আনো। নাপিতরে বলো সে যেন মাসুদের মাথা কামায়ে দেয়।
জি আচ্ছা।
মাসুদরে বলবা, এটা আমার হুকুম।
জি আচ্ছা।
গাইড়ার ভিটা কেনার পেছনে সিদ্দিকুর রহমানের বিশেষ একটা উদ্দেশ্য কাজ করছে। এই উদ্দেশ্যের সঙ্গে ভাবের জগতের কিছু যোগ আছে। জমি দলিলে রেজিস্ট্রি হবার পর তিনি তার উদ্দেশ্য প্রকাশ করবেন। তাও সবার সঙ্গে না। দুএকজনের সঙ্গে। সেই দুএকজন কে তা তিনি ঠিক করে রেখেছেন।
কাজী আসমত খাঁর বাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে আসতে তার একঘণ্টার মতো লাগল। সঙ্গে ছাতা নেয়া হয় নি। কড়া রোদের সবটাই মাথায় পড়েছে। তার দ্রুত হাঁটার অভ্যাস। শেষের দিকে তার হাঁটার গতি শ্লথ হয়ে এলো। বুকে চাপা। ব্যথা অনুভব করতে লাগলেন। তিনি নিজের দুর্বলতা অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করে হাঁটার গতি বাড়াতে চেষ্টা করলেন। হাঁটার গতি তেমন বাড়ল না, বুকের চাপ ব্যথাটা শুধু বাড়ল। সুলেমান চিন্তিত গলায় বলল, চাচাজির শইল কি খারাপ লাগতেছে? তিনি প্রশ্নের জবাব দিলেন না। বাড়ি পৌছানোর পর চোখ বন্ধ করে ইজিচেয়ারে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে হবে। মাথা থেকে সমস্ত দুশ্চিন্তা দূর করে পাঁচ-দশ মিনিট মরা মানুষের মতো পড়ে থাকলেই শরীর ঠিক হয়ে যাবে।
বাড়িতে পা দিয়ে তিনি ধাক্কার মতো খেলেন। বাংলাঘরের উঠানে দুই কাঠের মিস্ত্রি সমানে করাত চালাচ্ছে। তাদের তিনজন জোগালি কাঠে রান্দা দিচ্ছে। একটু দূরে লোকমান শুকনামুখে বসে আছে। তাকে অসম্ভব চিন্তিত মনে হচ্ছে। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, ঘটনা। কী? লোকমান চট করে জবাব দিতে পারল না, হড়বড় করতে লাগল। সিদ্দিকুর রহমান কড়া গলায় বললেন, ঘটনা কী বলো? এরা কী বানায়? পালঙ্ক?
লোকমান বলল, জি না।
তাহলে বানাইতাছে কী?
পালকি।
পালকি কী জন্যে?
বইনজির হুকুমে পালকি বানাইতাছে। বইনজিটা কে?
লীলা বইনজি।
সিদ্দিকুর রহমান বিস্মিত হয়ে বললেন, পালকি দিয়া কী হবে? সে কি পালকি দিয়া যাতায়াত করবে?
নতুন বউ পালকি দিয়া আসবে।
সিদ্দিকুর রহমান আরো অবাক হয়ে বললেন, নতুন বউ কে?
লোকমান ভীত গলায় বলল, মাসুদ ভাইজানের ইসাতিরি। পরীবানু।
সিদ্দিকুর রহমান ধাক্কার মতো খেলেন। মাসুদের স্ত্রীকে যে আজই এবাড়িতে আনার কথা সেটাই তার মনে নেই। মেয়েটার নাম যে পরীবানু তাও মনে ছিল না। সুলেমান বলল, চাচাজি, কাজ কি বন্ধ করে দিব?
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমার মেয়ে যে কাজ শুরু করেছে সেই কাজ আমি বন্ধ করব এটা কেমন কথা?
সুলেমান বলল, কাজ বন্ধ না কইরা উপায়ও নাই। একদিনে কাজ শেষ হইব না। অসম্ভব।
সিদ্দিকুর রহমান গম্ভীরমুখে বললেন, অসম্ভব বলে কোনো কথা নাই। দুইজন মিস্ত্রি না পারলে দশজন মিস্ত্রিরে কাজে লাগাও। জোগালি বাড়ায়ে দাও। পালকি এমন কোনো জটিল জিনিস না যে বানাতে একবছর লাগবে।
সুলেমান বিড়বিড় করে বলল, কথা সত্য। সিদ্দিকুর রহমান মিস্ত্রিদের দিকে বললেন, কী, তোমরা দিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারবো?
মিস্ত্রিদের একজন বলল, চেষ্টা নিব।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, চেষ্টা নেওয়া-নেওয়ির কিছু নাই। হয় পারবা, না হয়। পারব না। দুই-এর মাঝামাঝি কিছু নাই।
পিনিছিং ভালো হইব না। তয় কাজ চলব।
সিদ্দিকুর রহমান আর কথা বাড়ালেন না। বকুলগাছের ছায়ার নিচে তার ইজিচেয়ার পাতা আছে। তিনি চেয়ারে শুয়ে পড়লেন। বুকের চাপা ব্যথা আরো বেড়েছে। পানির পিপাসা হয়েছে। তীব্র পিপাসা নিয়ে পানি খেতে নেই। তিনি পানির পিপাসা কমার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। শরীরটাকে ঠিক করতে হবে। মাসুদের বউ আসবে। কিছু ব্যবস্থা তাকে নিতে হবে। এখন আধমরার মতো বিছানায় শুয়ে থাকা যাবে না। সমস্যা হলো মানুষ ইচ্ছা করলেই তার শরীর ঠিক করতে পারে না। মানুষ তার শরীর যেমন ঠিক করতে পারে না, মনও ঠিক করতে পারে না। মন এবং শরীর কোনোটার উপরই মানুষের কোনো দখল নেই।
সিদ্দিকুর রহমান চাপা গলায় ডাকলেন, বদু কি আছ আশেপাশে?
বদু দৌড়ে এলো। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, নাপিত ডাক দিয়া আনো। নাপিতরে বলো সে যেন মাসুদের মাথা কামায়ে দেয়।
জি আচ্ছা।
মাসুদরে বলবা, এটা আমার হুকুম।
জি আচ্ছা।