What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected লীলাবতী - উপন্যাস (1 Viewer)

সিদ্দিকুর রহমান বাড়ি ফিরলেন দুপুরে। ‘গাইড়ার ভিটা’ নামে পরিচিত দেড় শ বিঘার মতো জমির জন্যে বায়না দলিল করতে তার দেরি হলো। গাইড়ার ভিটা এই অঞ্চলের দোষী জমি। এই জমি কিনে যে ভোগদখল করতে গিয়েছে তার উপরই মহাবিপদ নেমেছে— এ-ধরনের জনশ্রুতি আছে। জমির বর্তমান মালিক কাজী আসমত খাও নির্বাংশ হয়েছেন। তার একমাত্র জোয়ান ছেলে এবং ছেলের ঘরের নাতি একই দিনে নৌকাড়ুবিতে মারা গেছে। সিদ্দিকুর রহমান এইসব কারণেই গাইড়ার ভিটা নামমাত্র মূল্যে পেয়েছেন। কাজী আসমত খাঁ বায়না দলিলে সই করার সময় নিচু গলায় বলেছেন, জমিটা যে দোষী কথা সত্য। ভোগদখলের আগে মোল্লা মুসুন্ত্রি ডাইক্যা দোয়া পড়াইতে ভুল কইরেন না। বড়ই দোষ লাগা জায়গা। সিদ্দিকুর রহমান বলেছেন, মানুষ দোষী হয়। জমি দোষী হয় না। মানুষের অন্তরে দোষ লাগে। জমির অন্তরে দোষ লাগে না। কথাটা বলে তার ভালো লেগেছে। তার মনে হয়েছে কিছু না বুঝেই তিনি খুব একটা ভাবের কথা বলে ফেলেছেন। এই ভাবের কথার মর্ম সবাই ধরতে পারবে না। ভাবের কথার মর্ম বুঝতে পারার জন্যে ভাবের জগতে থাকতে হয়। বেশিরভাগ মানুষ ভাবের জগতে থাকে না।

গাইড়ার ভিটা কেনার পেছনে সিদ্দিকুর রহমানের বিশেষ একটা উদ্দেশ্য কাজ করছে। এই উদ্দেশ্যের সঙ্গে ভাবের জগতের কিছু যোগ আছে। জমি দলিলে রেজিস্ট্রি হবার পর তিনি তার উদ্দেশ্য প্রকাশ করবেন। তাও সবার সঙ্গে না। দুএকজনের সঙ্গে। সেই দুএকজন কে তা তিনি ঠিক করে রেখেছেন।

কাজী আসমত খাঁর বাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে আসতে তার একঘণ্টার মতো লাগল। সঙ্গে ছাতা নেয়া হয় নি। কড়া রোদের সবটাই মাথায় পড়েছে। তার দ্রুত হাঁটার অভ্যাস। শেষের দিকে তার হাঁটার গতি শ্লথ হয়ে এলো। বুকে চাপা। ব্যথা অনুভব করতে লাগলেন। তিনি নিজের দুর্বলতা অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করে হাঁটার গতি বাড়াতে চেষ্টা করলেন। হাঁটার গতি তেমন বাড়ল না, বুকের চাপ ব্যথাটা শুধু বাড়ল। সুলেমান চিন্তিত গলায় বলল, চাচাজির শইল কি খারাপ লাগতেছে? তিনি প্রশ্নের জবাব দিলেন না। বাড়ি পৌছানোর পর চোখ বন্ধ করে ইজিচেয়ারে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে হবে। মাথা থেকে সমস্ত দুশ্চিন্তা দূর করে পাঁচ-দশ মিনিট মরা মানুষের মতো পড়ে থাকলেই শরীর ঠিক হয়ে যাবে।

বাড়িতে পা দিয়ে তিনি ধাক্কার মতো খেলেন। বাংলাঘরের উঠানে দুই কাঠের মিস্ত্রি সমানে করাত চালাচ্ছে। তাদের তিনজন জোগালি কাঠে রান্দা দিচ্ছে। একটু দূরে লোকমান শুকনামুখে বসে আছে। তাকে অসম্ভব চিন্তিত মনে হচ্ছে। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, ঘটনা। কী? লোকমান চট করে জবাব দিতে পারল না, হড়বড় করতে লাগল। সিদ্দিকুর রহমান কড়া গলায় বললেন, ঘটনা কী বলো? এরা কী বানায়? পালঙ্ক?

লোকমান বলল, জি না।

তাহলে বানাইতাছে কী?

পালকি।

পালকি কী জন্যে?

বইনজির হুকুমে পালকি বানাইতাছে। বইনজিটা কে?

লীলা বইনজি।

সিদ্দিকুর রহমান বিস্মিত হয়ে বললেন, পালকি দিয়া কী হবে? সে কি পালকি দিয়া যাতায়াত করবে?

নতুন বউ পালকি দিয়া আসবে।

সিদ্দিকুর রহমান আরো অবাক হয়ে বললেন, নতুন বউ কে?

লোকমান ভীত গলায় বলল, মাসুদ ভাইজানের ইসাতিরি। পরীবানু।

সিদ্দিকুর রহমান ধাক্কার মতো খেলেন। মাসুদের স্ত্রীকে যে আজই এবাড়িতে আনার কথা সেটাই তার মনে নেই। মেয়েটার নাম যে পরীবানু তাও মনে ছিল না। সুলেমান বলল, চাচাজি, কাজ কি বন্ধ করে দিব?

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমার মেয়ে যে কাজ শুরু করেছে সেই কাজ আমি বন্ধ করব এটা কেমন কথা?

সুলেমান বলল, কাজ বন্ধ না কইরা উপায়ও নাই। একদিনে কাজ শেষ হইব না। অসম্ভব।

সিদ্দিকুর রহমান গম্ভীরমুখে বললেন, অসম্ভব বলে কোনো কথা নাই। দুইজন মিস্ত্রি না পারলে দশজন মিস্ত্রিরে কাজে লাগাও। জোগালি বাড়ায়ে দাও। পালকি এমন কোনো জটিল জিনিস না যে বানাতে একবছর লাগবে।

সুলেমান বিড়বিড় করে বলল, কথা সত্য। সিদ্দিকুর রহমান মিস্ত্রিদের দিকে বললেন, কী, তোমরা দিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারবো?

মিস্ত্রিদের একজন বলল, চেষ্টা নিব।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, চেষ্টা নেওয়া-নেওয়ির কিছু নাই। হয় পারবা, না হয়। পারব না। দুই-এর মাঝামাঝি কিছু নাই।

পিনিছিং ভালো হইব না। তয় কাজ চলব।

সিদ্দিকুর রহমান আর কথা বাড়ালেন না। বকুলগাছের ছায়ার নিচে তার ইজিচেয়ার পাতা আছে। তিনি চেয়ারে শুয়ে পড়লেন। বুকের চাপা ব্যথা আরো বেড়েছে। পানির পিপাসা হয়েছে। তীব্র পিপাসা নিয়ে পানি খেতে নেই। তিনি পানির পিপাসা কমার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। শরীরটাকে ঠিক করতে হবে। মাসুদের বউ আসবে। কিছু ব্যবস্থা তাকে নিতে হবে। এখন আধমরার মতো বিছানায় শুয়ে থাকা যাবে না। সমস্যা হলো মানুষ ইচ্ছা করলেই তার শরীর ঠিক করতে পারে না। মানুষ তার শরীর যেমন ঠিক করতে পারে না, মনও ঠিক করতে পারে না। মন এবং শরীর কোনোটার উপরই মানুষের কোনো দখল নেই।

সিদ্দিকুর রহমান চাপা গলায় ডাকলেন, বদু কি আছ আশেপাশে?

বদু দৌড়ে এলো। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, নাপিত ডাক দিয়া আনো। নাপিতরে বলো সে যেন মাসুদের মাথা কামায়ে দেয়।

জি আচ্ছা।

মাসুদরে বলবা, এটা আমার হুকুম।

জি আচ্ছা।
 
সিদ্দিকুর রহমান চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। তার ঘুম পাচ্ছে। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। ঘুমের মধ্যেই মনে হচ্ছে–আল্লাহপাক মানুষ নামে এক আশ্চর্য জিনিস তৈরি করেছেন, যে-জিনিসের কোনো নিয়ন্ত্রণ তার নিজের কাছে নাই। নিয়ন্ত্রণ অন্য কোনোখানে। তিনি ইচ্ছা করলেও এখন জেগে থাকতে পারবেন না। তাকে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। সিদ্দিকুর রহমান ঘুম-ঘুম চোখে ডাকলেন, সুলেমান।

সুলে মান ভীত গলায় বলল, জি।

আমি যদি ঘুমায়ে পড়ি কেউ যেন আমার ঘুম না ভাঙায়।

জি আচ্ছা।

আমার শরীর ভালো না। আমি কিছুক্ষণ শান্তিমতো ঘুমাব।

সুলেমান বলল, জি আচ্ছা।

বড় দেখে একটা তালা জোগাড় করো।

জি আচ্ছা।

মাসুদের বউ ঘরে আসার পরে আমি মাসুদকে তালাবন্ধ করে রাখব।

জি আচ্ছা।

সিদ্দিকুর রহমানের ঠোঁটের কোনায় সামান্য হাসির আভাস দেখা গেল। তার মাথায় অন্য একটা চিন্তা এসেছে। কোনো মানুষেরই তার নিজের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু একজন মানুষ ইচ্ছা করলে অন্য একজন মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ক্ষমতা মানুষকে দেয়া হয় নি। কিন্তু অন্য মানুষকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তাকে দেয়া হয়েছে। বড়ই জটিল অঙ্ক।

সুলেমান!

জি চাচাজি?

পানি খাব। পানির পিপাসা হয়েছে।

সুলেমান ছুটে গেল পানি আনতে। পানির জগ এবং গ্লাস হাতে ফিরে এসে সে দেখে, সিদ্দিকুর রহমান গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছেন। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছেন। সুলেমান তার ঘুম ভাঙালি না। ইজিচেয়ারের পেছনে ঘাপটি মেরে বসে রইল যেন কোনো অবস্থাতেই কেউ সিদ্দিকুর রহমানের কাছে যেতে না পারে। দুনিয়া উলট-পালট হয়ে গেলেও চাচাজির ঘুম ভাঙানো যাবে না।

শহরবাড়ির বারান্দায় আনিস বসে আছে। তার শরীর পুরোপুরি সারে নি। দুপা হাটতেই শরীর ভেঙে আসে। তবে জ্বর আসছে না। খাওয়ায় রুচি ফিরে এসেছে। মজার ব্যাপার হলো, তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় নি। ময়মনসিংহ পর্যন্ত তাকে নিয়ে যেতেও হয় নি। গৌরীপুর জংশনে হঠাৎ সে উঠে বসে বলেছে, আমার শরীর ঠিক হয়ে গেছে।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, কীভাবে ঠিক হয়ে গেল?

আনিস বলল, কীভাবে ঠিক হয়েছে জানি না। কিন্তু এখন ঠিক আছে।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, ঠিক আছে বেঠিক হতে কতক্ষণ?

আনিস বলল, বেঠিক হবে না।

সতীশ ডাক্তার থার্মোমিটারে জ্বর মেপে বলল, জ্বর নাই।

সিদ্দিকুর রহমান রোগী নিয়ে ফিরে এলেন।

এখন আনিসের গায়ে একটা কম্বল। সে কম্বলের ভেতর থেকে পা বের করে খালি পা রোদে মেলে আছে। কার্তিক মাসের রোদটা খুবই আরামদায়ক মনে হচ্ছে। সে আগ্রহ নিয়ে মাসুদকে দেখছে। মাসুদ বকুলতলায় বসে আছে। একজন নাপিত তার মাথা কামিয়ে দিচ্ছে। আনিস শুনেছে মাসুদের আজ বিয়ে। যে ছেলের বিয়ে তার মাথা কামিয়ে দেয়া হচ্ছে কেন তা সে বুঝতে পারছে না। এই বাড়ির অনেক কিছুই তার কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়।
 
দিঘির পানিতে পা ড়ুবিয়ে লীলা বসে আছে। সে খুবই অবাক হচ্ছে— এই দিঘির পাড়া-ঘেঁসে সে বেশ কয়েকবার আসা-যাওয়া করেছে। অথচ কখনো চোখে পড়ে নি এই দিঘির বাঁধানো ঘাট অসম্ভব সুন্দর। আগে জানলে সে ঘাটে এসে পা ড়ুবিয়ে বসে থাকত।

রমিলা মাঝপুকুরে। তিনি মনের আনন্দে সাঁতার কাটছেন। তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না। সাঁতার কাটা কোনো পরিশ্রমের কাজ। মনে হচ্ছে মানুষটা পাখির পালকের মতো হালকা। নিজে নিজেই পানির উপর ভেসে আছেন। মাঝে মাঝে বাতাস আসছে। বাতাস মানুষটাকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে।

লীলা বলল, মা, আপনি বেশি দূরে যাবেন না। আমার ভয় লাগে।

রমিলা বললেন, কিসের ভয় গো মা?

লীলা বলল, আমার শুধু মনে হচ্ছে হঠাৎ আপনি সাঁতার কাটতে ভুলে যাবেন আর টুপ করে পানিতে ড়ুবে যাবেন।

সাঁতার কেউ ভোলে না।

লীলা বলল, আপনাকে সাঁতার কাটতে দেখে আমার নিজেরও সাঁতার কাটতে ইচ্ছা হচ্ছে। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে সাঁতার কাটা খুব সহজ কাজ। আপনি কি আমাকে সাঁতার কাটা শিখিয়ে দিতে পারবেন?

হুঁ পারব।

লীলা বলল, সাঁতার কাটা শেখার পর আমি রোজ দুপুরে আপনাকে নিয়ে দিঘিতে সাঁতার কাটব।

রমিলা বলল, কুমারী মেয়ের এই দিঘিতে নামা নিষেধ আছে গো মা। তোমার বাবার কঠিন নিষেধ আছে।

লীলা অবাক হয়ে বলল, কেন?

রমিলা বললেন, দুইজন কুমারী মেয়ে এই দিঘিতে সাঁতার দিতে গিয়ে মারা গেছে। এইজন্যেই নিষেধ। তোমার বাবার ধারণা দিঘিটা দোষী। উনি নিজেও কোনোদিন দিঘিতে নামেন না।

লীলা বলল, মা, আপনি উঠে আসুন তো, আমার ভালো লাগছে না।

রমিলা বললেন, আরেকটু থাকি গো মা। কতদিন পরে দিঘিতে নামলাম। মা শোনো, কুঁজা মাসস্টার হাসপাতাল থাইকা ভালো হইয়া ফিরছে কিন্তু তুমি তারে দেখতে যাও নাই এইটা কেমন কথা!

আমি যে দেখতে যাই নাই আপনাকে কে বলল?

রমিলা হেসে দিলেন। হাসতে হাসতে পানিতে ড়ুব দিলেন। লীলার মনে হলো, দিঘির ভেতর থেকে তার হাসির শব্দ আসছে। আতঙ্কে লীলার হাত-পা জমে আসছে।

অনেকক্ষণ পরে রমিলার মাথা ভেসে উঠল। তিনি দিঘির ঘাটে উঠে এলেন। লীলার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ গলায় বললেন, মাগো, আমারে তাড়াতাড়ি ঘরে নিয়া তালাবন্ধ করে রাখো। আমার ভালো লাগতেছে না। মাথা যেন কেমন করতেছে।

লীলা মায়ের হাত ধরল। রমিলা থারথার করে কাঁপছেন।
 
সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের ঘুম ভাঙল আছরের পর। তিনি হাত-মুখ ধুয়ে আছরের নামাজ পড়লেন। সুলেমানকে বললেন, অবেলায় কিছু খাবেন না। শুধু ডাবের পানি খাবেন।

আছরের নামাজ শেষ করে তিনি পালকি দেখতে গেলেন। পালকি বানানো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। দেখতেও যে খারাপ হয়েছে তা না। তিনি লোকমানকে ডেকে বললেন, এদের প্রত্যেককে একটা করে নতুন লুঙ্গি যেন বখশিশ হিসেবে দেয়া হয়। লুঙ্গি আর পাঁচ টাকা করে বখশিশ।

সিদ্দিকুর রহমান বাড়ির উঠানে ঢুকে চমৎকৃত হলেন। উঠানের মাঝখানে জলচৌকি বসানো। জলচৌকিতে নকশা করা হয়েছে। জলচৌকির চারপাশে চারটা কলাগাছ। রঙিন কাগজের মালা দিয়ে গাছ সাজানো। বন্ধুবরণের ব্যবস্থা। তাঁর মন হঠাৎ অসম্ভব ভালো হয়ে গেল। তাঁর ইচ্ছা করতে লাগল লীলাকে ডেকে তার ভালো লাগার কথাটা বলবেন। তিনি তা না করে সুলেমানকে ডাকলেন। শান্ত গলায় বললেন, তোমারে বড় তালার জোগাড় দেখতে বলেছিলাম। দেখেছ?

সুলেমান বলল, জি চাচাজি, তালার জোগাড় হয়েছে।

মাসুদের স্ত্রীর নাম যেন কী?

পরীবানু।

পরীবাবু বাড়িতে ঢোকার পরপরই মাসুদরে তার ঘরে তালা দিয়ে আটকায়ে রাখবে।

জি আচ্ছা।

এইটা আমার হুকুম। হুকুমের যেন নড়াচড় না হয়।

জি আচ্ছা।

ভেতরবাড়ি থেকে কান্নার শব্দ আসছে। রমিলা চিৎকার করে কী যেন বলছেন। মাথা দিয়ে কাঠের দেয়ালে ধাক্কা দিচ্ছে। সন্ধ্যার আগে-আগে রমিলার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। আজ মনে হয় বেশি এলোমেলো হয়েছে।

সিদ্দিকুর রহমান বড় করে নিঃশ্বাস নিলেন। হাতের ইশারায় সুলেমানকে ডাকলেন। শান্ত গলায় বললেন, জামাইয়ের মাথা কি কামানো হয়েছে?

সুলেমান বলল, জি।

মাথা কামানোর সময় জামাই কি চোখের পানি ফেলেছে?

জি। খুব কান্নাকাটি করেছে।

এখন লীলাকে বলো, মাসুদের স্ত্রীকে আনার জন্যে যেন পালকি যায়।

জি আচ্ছা।

হিন্দুবাড়ি থেকে ঢোল করতাল বাজাবার কিছু লোকজন আনো। আমার ছেলে গানবাজনার এত বড় সমাজদার! তার স্ত্রী এই বাড়িতে ঢুকবে গানবাজনা ছাড়া— এটা হয় না। যাও বাজনাদার আনো।



মাসুদকে সত্যি সত্যি তালাবন্ধ করা হয়েছে। তার মাথা কামানো। সে হলুদ রঙের একটা চাদর গায়ে দিয়েছে। তাকে দেখাচ্ছে হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসীদের মতো।‘

বাড়ির উঠানে বাজনাদাররা এসে বাজনা বাজাচ্ছে। বাজনার শব্দ তার কানে যাচ্ছে। রমিলা চিৎকার করছেন। রমিলার ঘর মাসুদের ঘরের কাছে না। অনেকটা দূরে। তারপরেও বাজনার শব্দ ছাপিয়ে রমিলার কান্নার শব্দ মাসুদের কানে আসছে। মাসুদ একসময় চাপা গলায় ডাকল, বুবু। বুবু।

লীলা এসে মাসুদের সামনে দাঁড়াল।

মাসুদ বলল, বুবু, আমি কিন্তু এর শোধ তুলব। আমি অবশ্যই শোধ তুলব।

লীলা বলল, এখনই এত অস্থির হয়ো না।

মাসুদ বলল, বাবা সব মানুষকে গরু-ছাগল মনে করে। এটা ঠিক না বুবু।

কয়েকটা দিন যাক, সব ঠিক হয়ে যাবে।

মাসুদ বলল, ঠিক হোক, বেঠিক হোক আমি এর শোধ তুলব। বাবা কী করবে না করবে সেটা যেমন আগে কেউ বুঝতে পারে না, আমি কী করব সেটাও বাবা বুঝতে পারবে না। সমানে সমান।

সমান হবার চেষ্টা করা ভালো না মাসুদ।

মাসুদ হাউমাউ করে কাঁদছে। লীলার মন খারাপ লাগছে। তার কাছে মনে হচ্ছে, জটিল একটা খেলা শুরু হয়েছে। তাকে এখানে রাখা হয়েছে দর্শক হিসেবে। এর বাইরে তার কোনো ভূমিকা নেই।

বাজনা শুরু হবার পরপরই রমিলা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছেন। তার মনে পড়েছে যে আজ এ বাড়িতে ছেলের বউ আসবে। তাকে বধূবরণ করতে হবে। তিনিও চাপা গলায় ডাকছেন, লীলা, ও লীলা।
 
পরীবানুর ডাকনাম পরী।

তার জন্মের রাতে পরীবানুর দাদি স্বপ্নে দেখেন, একটা পরী তার পাশে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। পরীর পাখার খোঁচায় তিনি খুবই বিরক্ত হচ্ছেন। তিনি পরীকে বললেন, মা গো, তোমার পাখা দুইটা খুঁইল্যা ঘুমাও। পরী মেয়েটা দুঃখিত গলায় বলল, দাদি, আমার পাখা খোলার নিয়ম নাই। তখনি তাঁর ঘুম ভািঙল। তিনি বিছানায় উঠে বসে শুনলেন— বাড়িতে নানান হৈচৈ। তার ছেলের বউয়ের প্রসববেদনা উঠেছে। ধাই এসেছে। তিনি তার ছেলেকে ডেকে বললেন, তোর কন্যা-সন্তান হবে। কন্যা-সন্তানের নাম আমি দিলাম। পরীবানু। এই নামের ইতিহাস আছে। ইতিহাস আমি পরে বলব।

পরীবানু নামের ইতিহাস এই বৃদ্ধ যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিনই বলে গেছেন। বাড়িতে ভিক্ষার জন্যে ভিনগায়ের ভিক্ষুক এলে তাকেও বলেছেন। পরীবানুকে তিনি যে আদর করেছেন তারও কোনো তুলনা নেই। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, এই মেয়েকে মারা তো দূরের কথা, কেউ কোনোদিন ধমকও দিতে পারবে না। যদি দেখেন কোনো কারণে এই মেয়ের চোখে পানি এসেছে, তাহলে তিনি বাড়িঘর ছেলে চলে যাবেন।

সত্যিকার ভালোবাসা দুদিকেই প্রবাহিত হয়। পরীবানুর ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। তার জগৎ ছিল দাদিময়। ঘরে কোনো ভালো জিনিস রান্না হলে দাদি মুখে না দেয়া পর্যন্ত সে মুখে দেবে না। ঈদের সময় সবার আগে তার দাদির জন্যে নতুন শাড়ি কিনতে হবে।

দাদির মৃত্যুর সময় পরীবানুর বয়স ছয় বছর। সে তার দাদির মৃত্যু সহজভাবেই নিল। খুব সম্ভবত মৃত্যুবিষয়ক ধারণা তার দাদি আগেভাগে তাকে দিয়ে রেখেছিলেন। তবে তার পরিবর্তন যেটা হলো তা হচ্ছে–যখন-তখন দাদির কবরের কাছে চলে যাওয়া। কবরের গায়ে হেলান দিয়ে বসে স্বাভাবিক মানুষের মতো কথা বলা—

আইজ কী ঘটনা ঘটেছে জানো দাদি? হাসির ঘটনা। ঘটনা শুনলে হাসতে হাসতে তোমার পেট-বেদনা হবে। হিহিহি…

পরীবানুর বয়স এখন পনেরো।

সে খুবই বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে। শুধু দাদির বিষয়ে তার বুদ্ধি কাজ করে না। এখনো সে দাদির কবরের কাছে যায়। মাথা নিচু করে মৃত দাদির সঙ্গে একতরফা গল্প করে।

বউ হিসেবে বড় বাড়িতে রওনা হবার ঠিক আগে আগে সে গিয়েছে দাদির কবরের কাছে। বাঁধানো কবরের গায়ে হাত রেখে চাপা গলায় বলেছে–দাদি গো, খা বাড়িতে যাইতেছি। আর কোনোদিন এইখানে আসতে পারব বইল্যা মনে হয় না। এই পর্যন্ত বলেই সে প্রতিজ্ঞা ভুলে অনেকক্ষণ কাঁদল। দাদির সঙ্গে সে প্ৰতিজ্ঞা করেছিল যত দুঃখ-কষ্টই হোক সে কোনোদিন কান্দবে না। বেশির ভাগ প্রতিজ্ঞাই মানুষ রাখতে পারে না।

নতুন বউ স্বামীর বাড়িতে কাঁদতে কাঁদতে যায়। পরীবানু কান্দল না। পালকি থেকে নামল। যখন জলচৌকিতে উঠে দাড়াতে বলল, সে দাঁড়াল। একজন মহিলা তার পায়ে দুধ ঢেলে দিল। এই মহিলা তার শাশুড়ি। মহিলার মাথার ঠিক নেই। তাকে নাকি সবসময় ঘরে তালাবন্ধ করে রাখতে হয়। পরীবানু খুব আগ্রহ করে মহিলাকে দেখল। তাকে মোটেই অস্বাভাবিক বলে মনে হলো না। সে তার শ্বশুরকে কোথাও দেখল না। নতুন বউ শ্বশুরবাড়িতে এসে শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে সালাম করবে। এটাই স্বাভাবিক। তবে শ্বশুরের সঙ্গে তার দেখা হবে না— এটা সে ধরেই নিয়েছিল। তার পরেও ক্ষীণ আশা ছিল— হয়তো এ– বাড়ির সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। এখন মনে হচ্ছে কোনো সমস্যারই সমাধান হয় নি। সব সমস্যার সমাধান তাকে করতে হবে। কেউ কি তাকে সাহায্য করবে? লীলা নামের মেয়েটা হয়তো করবে। তবে মেয়েটা তার খুব কাছে আসছে না। দূরে দূরে থাকছে।
 
মাগরিবের নামাজের পর লীলার সঙ্গে তার প্রথম কথা হলো। সে বড় একটা ঘরের পালঙ্কের উপর একা বসেছিল। শ্বশুরবাড়িতে পা দেবার পর কোনো মেয়েই সন্ধ্যারাতে একা বসে থাকে না। তাকে রাজ্যের মানুষ ঘিরে থাকে। অথচ সে বসে আছে একা। একসময় যখন তার মনে হলো, তাকে এই পালঙ্কে একা বসে থাকতে হবে কেউ তার পাশে আসবে না, তখন লীলা হাতে শরবতের গ্লাস নিয়ে ঢুকল। তার পাশে বসতে বসতে বলল, এটা চিনির শরবত না, লবণের শরবত। লেবু, কাঁচামরিচ। আর লবণ দিয়ে বানানো শরবত। আমার ধারণা আজ সারাদিন তোমার উপর দিয়ে অনেক চাপ গিয়েছে। শরবতটা খাও, দেখবে ভালো লাগবে।

নতুন বউয়ের অনেক নিয়মকানুন আছে। শরবত খাও বললেই কোনো নতুন বউ হাত থেকে টান দিয়ে শরবতের গ্লাস নিয়ে ঢাকচক করে খেয়ে ফেলে না। নতুন বাউদের সাধ্যসাধনা করে খাওয়াতে হয়। পরী সহজভাবেই হাতে গ্লাস নিল। লেবুর শরবতটা খেতে তার ভালো লাগল।

লীলা বলল, তোমার কি মাথাব্যথা করছে?

পরীবানু বলল, না।

তোমাকে দেখে কিন্তু মনে হয় তোমার মাথাব্যথা।

পরীবানু বলল, হ্যাঁ, আমার মাথাব্যথা।

লীলা বলল, আমার কাছে কিছু গোপন করবে না। আমার কাছে কেউ কিছু গোপন করলে আমার ভালো লাগে না।

পরী ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল।

লীলা বলল, তোমার কি ক্ষুধা লেগেছে?

পরী সঙ্গে সঙ্গে বলল, জি।

লীলা বলল, রান্না হয়ে গেছে। আমরা দুজন একসঙ্গে খেয়ে নেব। ক্ষুধার কারণে অনেক সময় মাথা ধরে।

পরী বলল, আমি আপনার ভাইয়ের সঙ্গে দুটা কথা বলব।

মাসুদের সঙ্গে কথা বলতে চাও?

জি।

ওর সঙ্গে কথা বলতে পারবে না। তুমি তো জানোই বাবা কেমন রাগী মানুষ, উনি মাসুদকে তালাবন্ধ করে রেখেছেন। বাবার রাগ কমার সময় দিতে হবে।

উনার রাগ কমবে?

নিজ থেকে কমবে না। কমাবার চেষ্টা করতে হবে। আমি চেষ্টা করব। তুমিও চেষ্টা করবে।

আমি কীভাবে চেষ্টা করব?

সেটা ভেবে ঠিক করা হবে।

লীলা পরীবানুর সঙ্গে কথা বলে অবাক হয়েছে। মেয়েটা গ্রামের মেয়েদের মতো কথা বলছে না। মোটামুটি শুদ্ধ ভাষা ব্যবহার করছে। মেয়েটিকে লীলার বুদ্ধিমতী বলেও মনে হচ্ছে। মেয়েটা এই বাড়ির ব্যাপারগুলি বোঝার চেষ্টা করছে। যে-পরিস্থিতিতে মেয়েটা এসেছে সেই পরিস্থিতিতে পড়লে সব মেয়েই হাল ছেড়ে দেবে। স্রোতে গা ভাসিয়ে দেবে। কোনোকিছু বোঝার চেষ্টা করবে লীলা বলল, তুমি কি শহরে কিছুদিন ছিলে?

পরী বলল, জি। আমি ময়মনসিংহে থাকি। বিদ্যাময়ী স্কুলে পড়ি। ছুটিতে বাড়িতে আসি।

কোন ক্লাসে পড়ো?

এবার ম্যাট্রিক দিব।

তোমার সঙ্গে মাসুদের পরিচয় কোথায় হয়েছে? ময়মনসিংহে?

জি না। আমাদের বাড়িতে। উনি বাবার কাছে গান শুনতে আসতেন।

তুমি গান জানো?

জি না।

লীলা বলল, তুমি কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকো। রান্না হয়ে গেলেই আমি তোমাকে নিয়ে খেতে বসব।

পরী কিছু বলল না। তবে লীলার কথামতো কুণ্ডলি পাকিয়ে খাটে শুয়ে পড়ল। দেখতে দেখতে নতুন বউ ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্নে দেখল তার দাদিকে। দাদি খাট ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তার মুখ হাসি-হাসি। তিনি বললেন, তোর শ্বশুরবাড়ি দেখতে আসছি। খুশি হয়েছি। এদের বিরাট শান-শওকত। তবে মানুষজন নাই। ঘরবাড়ি জিনিসপত্র দিয়া শান-শওকত হয় না। শান-শওকত হয় মানুষজন দিয়া। তুই একলা শুয়ে আছিস। তোর জামাই কই?

পরী হাসতে হাসতে বলল, তারে তালাবদ্ধ করে রেখেছে।

কী জন্যে?

জানি না।

তালাবদ্ধ কে করছে?

আমার শ্বশুর সাহেব করেছেন।

এই লোকের দেখি স্বভাব ভালো না! সবেরে তালাবদ্ধ করে রাখে। নিজের স্ত্রীকেও শুনেছি তালাবন্ধ করে রেখেছে।

বেশিক্ষণ দাঁড়ায়ে থাকবা না দাদি। শেষে তোমারেও তালাবন্ধ করবে।

আমারে তালাবন্ধ করে করুক, তোর জামাইরে কেন করবে? যা তারে ছুটিয়ে নিয়ে আয়।

কীভাবে ছুটায়ে আনব? আমার কাছে চাবি নাই।

চাবি আমি নিয়া আসছি। এই নে।
 
বৃদ্ধ বড় একটা পিতলের চাবি পরীর হাতে দিলেন। পরী সেই চাবি সঙ্গে সঙ্গে শাড়ির আঁচলে বেঁধে ফেলল। তখনি তার ঘুম ভাঙল। স্বপ্নটা এত বাস্তব ছিল যে ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে পরী শাড়ির আঁচল ঘুরেফিরে দেখল। রাত কত হয়েছে পরা বুঝতে পারছে না। কোনোরকম সাড়াশব্দ নেই। মনে হচ্ছে বাড়ির লোকজনের সঙ্গে সঙ্গে এই বাড়িটাও বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। তাদের নিজেদের বাড়ির অবস্থা অন্যরকম। সন্ধ্যার পর থেকে লোকজন আসতে থাকে। রাত একটু বাড়ার পর ঢোলের বাড়ি পড়তে শুরু করে। মাঝরাতে শুরু হয়। গানের আসার। বন্দনা দিয়ে শুরু হয়–

পশ্চিমে বন্দনা করি সোনার মদিনা
ঝলমল ঝলমল ঝলমল ঝলমল
সোনার মদিনা…

লীলা নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে পরীকে চমকে গিয়ে বলল, ঘুম ভেঙেছে?

পরী বলল, জি।

রান্না হয়ে গেছে। তুমি ঘুমাচ্ছিলে বলে ঘুম ভাঙাই নি। এসো খেতে বসি। মাথা ধরা এখনো আছে?

না।

বাবা-মা, ভাই-বোনদের জন্য মনখারাপ লাগছে?

না।

মনখারাপ লাগছে না কেন?

জানি না।

খাওয়ার আয়োজন ভেতরের বারান্দায়। পোলাও-কোরমা, মাছভাজি–অনেক আয়োজন। পরী কিছুই খেতে পারছে না। হাত দিয়ে শুধু নাড়াচাড়া করছে। লীলা বলল, খেতে পারছ না?

পরী বলল, না। আপনি খান। আমি বসে থাকি।

লীলা কিছুক্ষণ পরীর দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, পরী, তোমার কি সন্তান হবে?

পরী বলল, হ্যাঁ।

বিয়েটা কি এইজন্যই তাড়াহুড়া করে গোপনে করে ফেলেছ?

পরী হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

লীলা বলল, কয় মাস কী, এইসব হিসাব কি তোমার আছে?

পরী বলল, হিসাব আছে। তিন মাস।

লীলা বলল, তোমরা দু’জন যে বিরাট একটা অন্যায় করেছ, এটা কি জানো?

আমি কোনো অন্যায় করি নাই। আপনি কাউকে বলেন, শুকনা মরিচের ভর্তা বানিয়ে আমাকে দিতে। মরিচভর্তা ছাড়া অন্যকিছু দিয়ে আমি ভাত খেতে পারি না।

লীলা পরীর দিকে তাকিয়ে আছে। পরী বসে আছে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। তাকিয়ে আছে লীলার দিকে। সেই দৃষ্টিতে কোনো অস্বস্তি নেই।


রাতের খাবারের পরপরই সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল। লোকমান হুক্কার নল তার হাতে ধরিয়ে দিল। তিনি ঘুমের ঘোরে। দুটা টান দিলেন। তার মনে হলো নল-হাতেই তিনি ঘুমিয়ে পড়বেন। এই লক্ষণ ভালো না। এই লক্ষণ বার্ধক্য এবং স্থবিরতার লক্ষণ। স্থবির মানুষরাই মুখভর্তি পান নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। হুঙ্কার নল হাতে ঘুমিয়ে পড়ে।

সিদ্দিকুর রহমান ঘুম তাড়াবার চেষ্টা করলেন। ঘুমটা যাচ্ছে না। আবারো যেন চেপে আসছে। জটিল কোনোকিছু নিয়ে চিন্তা করলে কিংবা কারো সঙ্গে জটিল আলোচনা করলে ঘুমটা হয়তো কাটবে। তিনি চাপা গলায় ডাকলেন, লোকমান!

লোকমান তার ইজিচেয়ারের পেছনে বসেছিল। সেখান থেকে জবাব দিল— জি চাচাজি?

মাস্টারের খবর কী?

উনি ভালো আছেন। আজ সারাদিনে জ্বর আসে নাই।

উনারে ডেকে নিয়ে আসো।

জি আচ্ছা। সিদ্দিকুর রহমান ঘুমিয়ে পড়তে চান না। এখন ঘুমিয়ে পড়া মানে রাত দুইটা-আড়াইটার দিকে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা। খাটে বসে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকা। সাপে-কাটা রোগীকে কিছুতেই ঘুমাতে দেয়া হয় না। তিনি কল্পনা করছেন চার-পাঁচ হাত লম্বা কালো একটা চন্দ্ৰবোড়া সাপ তার পায়ে ছোবল দিয়েছে। ওঝা এসে বিষ ঝাড়বে। বিষ না নামানো পর্যন্ত তাকে জেগে থাকতে হবে।
 
আমাকে ডেকেছেন?

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, মাস্টার, জলচৌকিটার উপর বসো।

আনিস বসল। সিদ্দিকুর রহমান হঠাৎ লক্ষ করলেন, তার ঘুম পুরোপুরি চলে গেছে। তিনি সামান্যতম আলস্যও বোধ করছেন না। তার শরীর ঝনঝন করছে।

মাস্টার, কেমন আছ?

জি ভালো।

তুমি তো আমাদের মোটামুটি ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। ভালো কথা, তুমি গায়ে সেন্ট মেখেছ না-কি? সেন্টের গন্ধ পাচ্ছি।

আনিস লজ্জিত গলায় বলল, পাঞ্জাবির পকেটে কয়েকটা আমের মুকুল রেখেছি। আমের মুকুলের গন্ধ।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তুমি কি একটা জিনিস লক্ষ করেছ? ফুল যতক্ষণ গাছে থাকে তখন তার একরকম গন্ধ, যেই তুমি ফুল ছিড়ে হাতে নিবে তখনি তার অন্যরকম গন্ধ।

ব্যাপারটা আমি লক্ষ করি নাই।

লক্ষ করে দেখবে। কিছু-কিছু ফুলগাছ আছে যাদের শেকড়ের গন্ধও ফুলের গন্ধের মতো।

আমি আপনার কাছে প্রথম শুনলাম। আগে কোনোদিন শুনি নাই।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমি এমন অনেক কথাই তোমাকে বলতে পারি যেটা তুমি আগে কখনো শোনো নাই। বলার মতো মানুষ পাই না বলে বলি না। সব কথা সবাইকে বলা ঠিক না। মাস্টার, খাওয়াদাওয়া করেছ?

জি করেছি।

আজ আমার বাড়িতে ছেলের বউ প্রথম এসেছে। খাওয়াদাওয়ার বিরাট আয়োজন করা উচিত ছিল। আয়োজন করা হয় নাই। মনে রাগ নিয়া উৎসবের আয়োজন করা যায় না।

রাগটা কী জন্যে? আপনাকে না জানিয়ে ছেলে বিয়ে করে ফেলেছে এই জন্যে? এটা রাগ করার মতো কোনো কারণ না।

সিদ্দিকুর রহমান হতভম্ব হয়ে বললেন, এটা রাগ করার মতো কারণ না?

আনিস বলল, জি-না। কোনো কারণ না। বিয়েটা সম্পূর্ণ আপনার ছেলের নিজের ব্যাপার। সে তার নিজের সংসার করবে। সেই সংসারে আপনি কে?

আমি কেউ না?

জি না। আপনি কেউ না। মাসুদের সংসার মাসুদের। আপনারটা আপনার।

আনিস জলচৌকিতে বসতে বসতে বলল, আপনি যদি আমাকে অনুমতি দেন মাসুদের বিষয়ে দুএকটা কথা বলব।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, অনুমতি দিলাম না।

সিদ্দিকুর রহমান হুক্কার নলে টান দিতে লাগলেন। আগুন নিভে গেছে, নলে টান দিলে গুড়ুক গুড়ুক শব্দ হয়। শব্দটা শুনতে ভালো লাগে। মনে হয় তিনি কোনো–একটা কাজের মধ্যে আছেন।

মাস্টার!

জি?

তোমার একটা ব্যাপার আমি লক্ষ করেছি। তুমি কোনো-না-কোনোভাবে আমার সঙ্গে তর্ক বাঁধায়ে দিতে চাও। কোনো-একটা বিষয়ে তুমি আমার সঙ্গে একমত হয়েছ এরকম মনে হয় না।

আনিস নিচু গলায় বলল, তার কারণ হয়তো এই যে, আপনি যে-মতের জগতে বাস করেন আমি সেই জগতে বাস করি না। আজ আপনার বাড়িতে ছেলের বউ এসেছে। এই উপলক্ষে সবাই নতুন কাপড় পেয়েছে। আমিও একটা পাঞ্জাবি পেয়েছি। অথচ এই আনন্দের দিনে আপনি আপনার ছেলেটাকে তালাবন্ধ করে রেখেছেন।

এই ছেলে তোমার হলে তুমি তাকে কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে?

তা করতাম না। কিন্তু তাকে তালাবন্ধ করেও রাখতাম না।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমি আমার ছেলের বিষয়ে পরামর্শ করার জন্যে তোমাকে ডাকি নাই। যে-কারণে ডেকেছি সেটা মন দিয়ে শোনো।

আনিস কৌতূহলী হয়ে বলল, কী কারণে ডেকেছেন?

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমি একটা আশ্রম বানাতে চাই।

আনিস বলল, আপনি কী বললেন, বুঝতে পারলাম না। কী বানাতে চান?

আশ্রম বানাতে চাই।

আশ্রম বলতে আপনি কী বোঝাচ্ছেন? অর্থটা পরিষ্কার হচ্ছে না। যেখানে আশ্রয় আছে সেটাই আশ্রম। আশ্রয় তো আপনার আছে।
 
সিদ্দিকুর রহমান আধশোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসলেন, লোকমান টিক্কায় আগুন ধরিয়ে নতুন তামাক দিয়েছে। এই আম্বরী তামাকের বিশেষত্ব হলো— প্রথম কিছুক্ষণ খুব সুন্দর গন্ধ থাকে। তারপর হঠাৎ গন্ধটা মরে যায়। তিনি তামাক টানেন গন্ধ মরে না যাওয়া পর্যন্ত। এখন তামাকে টান দিলেন না। মাস্টারের দিকে তাকিয়ে খানিকটা লজ্জিত গলায় বললেন, আশ্রম বলতে কী বোঝাতে চাচ্ছি সেটা আমিও জানি না।

আপনার কল্পনায় কী আছে?

আমার কল্পনায় আছে খুব সুন্দর একটা জায়গা। চারদিকে গাছ। চেনা অচেনা গাছ। পানির ঝরনা। অতি নির্জন। কোনো লোকজন নাই। চারদিকে শান্তি।

এরকম একটা জায়গার কথা আপনার মাথায় কী জন্যে এসেছে সেটা কি জানেন?

একটা বইয়ে এরকম পড়েছিলাম। পড়াটা মাথার মধ্যে ঢুকে গেছে।

বইটার নাম কী? লেখকের নাম কী?

কিছুই মনে নাই। বইটার ঘটনাও মনে নাই। যেটা মনে আছে সেটা হলো— একটা মানুষ আশ্রমে থাকে। মহাশান্তির মধ্যে বাস করে। পাহাড়ি একটা ঝরনা আছে। ঝরনার পানি টলটলা নীল। ঝরনা যেখানে পড়েছে সেখানে পানি জমেছে। মানুষটা নগ্ন হয়ে সেই পানিতে সাঁতার কাটে। এইটুকু মনে আছে। আর কিছু মনে নাই।

আনিস বলল, আপনি আশ্রম কী জন্যে বানাতে চান, নগ্ন হয়ে সাঁতার কাটার জন্যে?

কথাটা বলেই আনিসের মনে হলো, সে খুবই অসৌজন্যমূলক কথা মানুষটাকে বলেছে। তার কথার মধ্যে ঠাট্টার ভাব প্রবল। এমন একজন বুদ্ধিমান মানুষ ঠাট্টা বুঝবেন না তা হয় না। কেউ তাকে নিয়ে ঠাট্টা করবে এবং তিনি তা সহ্য করে যাবেন তা কখনো হবে না।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, মাস্টার, তুমি আমার সঙ্গে রসিকতা করার চেষ্টা করেছ। রসিকতাটা আমি গায়ে মাখলাম না। কারণ ঐ বইটার মানুষটা শুধু যে সাঁতারের সময় নগ্ন থাকতেন তা না। সারাক্ষণই নগ্ন থাকতেন। কে তাকে নিয়ে কী ভাবছে তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। কারণ তিনি বাস করতেন সম্পূর্ণ তার নিজের অঞ্চলে। কেউ সেখানে ঢুকতে পারত না।

আপনি এরকম একটা জায়গা বানাতে চান?

হ্যাঁ। আমি অনেকখানি জমি কিনেছি। এই বিষয়ে তোমার মতামত কী?

আনিস বলল, আমি কোনো মতামত দিতে পারছি না। কারণ আপনি কী বলার চেষ্টা করছেন আমি বুঝতে পারছি না। ভাসাভাসা ঘটনা শুনে ভাসাভাসা মত দেয়া যায়।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তোমার ভাসাভাসা মতটা কী?

আনিস বলল, আমার ভাসাভাসা মতটা হলো, আপনার শরীরটা ভালো না। আপনি অসুস্থ। আপনার ভেতর মৃত্যুচিন্তা ঢুকে গেছে।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, মাস্টার, আমার মৃত্যুচিন্তা আছে। ভয় নাই। জীবনে একবার বিরাট ভয় পেয়েছিলাম। সেই ভয় আরো একবার পাব। এর বাইরে ভয় পাব না।

কী দেখে ভয় পেয়েছিলেন?

সেটা তোমাকে বলব না। আচ্ছা তুমি এখন যাও। এখন আর কথা বলতে ইচ্ছা করতেছে না।

কথা বলার দরকার নাই। দুজন চুপচাপ বসে থাকি।

আচ্ছা থাকো বসে।

কুঁজা মাস্টার বসে আছে। সিদ্দিকুর রহমান হঠাৎ ব্যাপারটায় মজা পেয়ে গেলেন। দেখা যাক মাস্টার কতক্ষণ বসে থাকতে পারে। একটা ধৈর্যের খেলা হয়ে যাক।
 
কেউ একজন আমাকে তিনটা ডিকশনারি পাঠিয়েছে। ইংলিশ টু ইংলিশ, ইংলিশ টু বেঙ্গলি এবং বেঙ্গলি টু বেঙ্গলি। প্রেরকের নাম শরিয়তুল্লাহ। ঠিকানা— এগারো তস্তুরিবাজার ঢাকা। আমি শরিয়তুল্লাহ নামের কাউকে চিনি না। তস্তুরিবাজারের শরিয়তুল্লাহ সাহেব জানেন না যে আমার ডিকশনারি প্রয়োজন। একজন জানেন, তিনি মালেক ভাই। তিনি তস্তুরিবাজারে থাকেন না। তিনি থাকেন রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে।

আমার চিঠি তাঁর কাছে পৌঁছেছে এবং তিনি ব্যবস্থা নিয়েছেন। পৃথিবীতে অল্পসংখ্যক মানুষ আছে যারা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়। মালেক ভাই তেমন একজন।

আমি ঠিক করে ফেললাম তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব। পুলিশ ধরলে ধরবে। জেলখানায় তার সঙ্গে থাকতে পারাও হবে ভাগ্যের ব্যাপার। তিনি সব সময় বলতেন, সব মানুষেরই কিছুদিন জেলে থাকা উচিত। জেল মানুষকে শুদ্ধ চিন্তা করতে শেখায়। পৃথিবীর মহৎ চিন্তার আশি ভাগ করা হয়েছে জেলখানায়।

তাঁর কথা শুনে আমি বলেছিলাম, যে মহৎ চিন্তা জেলখানায় করা যাবে সেই চিন্তা ঘরে বসে করা যাবে না কেন? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, মানুষ যখন শারীরিকভাবে বন্দি থাকে তখন ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রকৃতি তার মন মুক্ত করে দেয়। মুক্ত মন ছাড়া মহৎ চিন্তা সম্ভব না।

আমি বললাম, খারাপ চিন্তা কিংবা নিচ চিন্তা করার জন্যে আমরা কোথায় যাব?

তিনি বললেন, জেলখানা। সৎ চিন্তা যেখানে হবে অসৎ চিন্তাও সেখানেই হবে। তাছাড়া ইকুইলিব্রিয়াম হবে না। প্রকৃতি ইকুইলিব্ৰিয়াম চায়।

ডিকশনারি হাতে পাওয়ার পর পরই আমি ঠিক করেছি, মালেক ভাই জেলখানা থেকে ছাড়া পেলেই তাকে বিশ্রামের জন্যে কিছুদিন এখানে নিয়ে আসব। জেলখানার লাপসি খেয়ে খেয়ে যে অভ্যস্ত তার সামনে সপ্তম ব্যঞ্জন দিলে সে কী করবে?

মালেক ভাই কী করবেন। আমি জানি। তিনি গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকবেন তারপর ভারী গলায় বলবেন—

নগরের এক প্রান্তে প্রচুর খাবার কিন্তু কোনো ক্ষিধে নেই।

অন্য প্রান্তে প্রচুর ক্ষিধে কিন্তু কোনো খাবার নেই।

মালেক ভাইয়ের সামনে যতবার ভালো কোনো খাবার দেয়া হয়েছে। ততবারই তিনি এই কথা বলেছেন। কিন্তু ভালো খাবার খেয়েছেন খুব আগ্ৰহ নিয়ে। কোনো এক বাড়িতে উনি হয়তো গলদা চিংড়ি খেলেন। এই গল্প তিনি করবেন কম করে হলেও পঞ্চাশবার। মুগ্ধ গলায় বলবেন— আহা কী রান্না! স্বাদ মুখে লেগে গেছে। বাবুর্চির হাত সোনা দিয়ে বঁধিয়ে দেয়া দরকার।

সমস্যা হচ্ছে, এই বাড়িতে তাকে আনা যাচ্ছে না। কারণ আমি নিজেই চলে যাচ্ছি। আমার মন টিকছে না। আমি এখানে বিশাল এক বাড়িতে বাস করি। চারদিকে খোলা প্ৰান্তর। অথচ আমার নিজেকে সারাক্ষণ বন্দি মনে হয়। কোনো রকমে যদি জেলে ঢুকতে পারতাম তাহলে হয়তো উল্টা ব্যাপার হতো। নিজেকে মুক্ত মনে হতো।

এই বাড়িতে থাকতে না চাওয়ার পিছনে আরো একটা বড় কারণ আছে। কারণটা হাস্যকর। লীলাবতী নামের মেয়েটাকে আমি প্রতিরাতেই স্বপ্নে দেখছি। অতি বিচিত্র সব স্বপ্ন। পরশু রাতে দেখেছি দুজন নৌকায় করে কোথাও যাচ্ছি। বেশ বড় পালতোলা নৌকা। নৌকা চলছে। বাইরে রোদ। আমি রোদের হাত থেকে বাঁচার জন্যে ছাঁই-এর ভেতর শুয়ে আছি। লীলাবতী ছাই-এর বাইরে। সে বলল, চারদিকে এত সুন্দর দৃশ্য আর তুমি যােচ্ছ ঘুমাতে ঘুমাতে! উঠ তো। আমি বললাম, ঘুম পাচ্ছে তো। সে বলল, আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাও। আমি বললাম, তাহলে তুমি ভেতরে আসো। আমি বাইরে যাব না। বাইরে রোদ। সে বলল, তোমার গায়ে রোদ লাগবে না। আমি শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা ঢেকে রাখব।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top