What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected লীলাবতী - উপন্যাস (2 Viewers)

ট্যাঁ ট্যাঁ শব্দ হচ্ছে। লীলা চোখ মেলে দেখল তার মাথার উপর চিল উড়াউড়ি করছে। দুটা সোনালি রঙের চিল। চিল আকাশের অনেক উপরে উড়ে। এই দুজন নিচে নেমে এসেছে। চিলের গলার আওয়াজ এত কৰ্কশ হয় তাও লীলা জানত না। সে ধড়মড় করে উঠে বসল। তখনি মনে হলো সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম বেশিক্ষণ হয় নি। হয়তো পাঁচ মিনিট কিংবা দশ মিনিট। কিন্তু তার কাছে মনে হচ্ছে সে দীর্ঘসময় বেদিতে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। ঘুমাবার জন্যে জায়গাটা খুবই আরামের। লীলা বাড়ির দিকে রওনা হলো। মঞ্জু মামার খোঁজ নেয়া দরকার— বেচারা তার চা পেয়েছে কি না। কেউ কি আছে তার সঙ্গে? নাকি সে একা একাই ঘুরছে?



মঞ্জুর পা কেটেছে। তিনি শহরবাড়ি নামের পাকা দালানের বারান্দায় মোড়ায় বসে আছেন। তাঁর সামনে আরেকটা মোড়া। সেই মোড়ায় তাঁর কেটে যাওয়া পা রাখা আছে। নয়-দশ বছরের একটি মেয়ে কাটা পায়ের চিকিৎসা করছে। বেশ গুছিয়েই করছে। সে একটা কুপি জ্বলিয়েছে। কুপির আগুনে কাপড় পুড়িয়ে ছাই বানাচ্ছে। সেই ছাই পায়ের কাটা জায়গায় যত্ন করে লাগিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটার মুখ গোল। মায়া-মায়া চেহারা। মঞ্জু মেয়েটির আদর-যত্নে মোহিত হলে বললেন, নাম কী গো মা তোমার?

কইতরী।

কইতর থেকে কইতরী? বাহ সুন্দর নাম! তুমি কি সিদ্দিক সাহেবের কেউ হও?

মেয়ে হই।

বলো কী! তুমি সিদ্দিক সাহেবের মেয়ে? উনার মেয়ে হয়ে আমার পায়ের ময়লা পরিষ্কার করছ এটা কেমন কথা?

কিছু হবে না।

মঞ্জু খুশি খুশি গলায় বললেন, কিছু হবে না–এটা ঠিক। বিখ্যাত একটা কবিতা আছে—

বাদশা আলমগীর
কুমারে তাহারে পড়াইত এক মৌলভী দিল্লির…।

কবিতাটা জানো?

জি না!

আমিও তো মাত্র দুই লাইন জানি–ধুনছে আমারে। তুলা ধুনা করছে।

মঞ্জু হতভম্ব হবার মতো মুখভঙ্গি করলেন।

কইতরী এই দৃশ্য দেখে এতই মজা পেল যে, হেসে কুটি কুটি হলো।

মঞ্জু বাচ্চা মেয়েটির হাসি দেখে আনন্দে অভিভূত হলেন। তার কাছে মনে হলো— ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে এ বাড়িতে আসা সার্থক হয়েছে। আরেকটি মেয়েকে দরজার আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি দিতে দেখা যাচ্ছে।

মঞ্জু একবার বললেন, এই তুমি কে?

মেয়েটি কথা শুনে প্রায় উড়ে চলে গেল।

লীলা শহরবাড়ির দিকে রওনা হয়েছিল। মাঝপথ থেকে ফিরে এলো। অবাক হয়ে মূল বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়াল। শূন্য বাড়ি লোকজনে ভরতি হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে কোনো একটা ঘটনা ঘটেছে। সবার চোখে-মুখে সংশয়। বাড়ির খুঁটি ধরে তরুণী একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটিকে দেখেই মনে হচ্ছে সে খুব ভয় পাচ্ছে। লীলাকে ঢুকতে দেখে মেয়েটি চোখ তুলে লীলার দিকে তাকাল। লীলা সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে বলল, বাহ, সুন্দর তো মেয়েটি!
 
সিদ্দিকুর রহমানের বাড়ির উঠানে বিচারসভা বসেছে। লোকমান কিছুক্ষণ আগে কুদ্দুস মিয়া এবং তার মেয়ে পরীবানুকে নিয়ে এসেছে। সিদ্দিকুর রহমানের বড় ছেলে মাসুদ তাদের সঙ্গে এসেছে। আশপাশের কৌতূহলী কিছু লোকজন চলে এসেছে। মসজিদের ইমাম সাহেব এসেছেন। ফুটফুটে দুটি মেয়ের একটিকে দেখা যাচ্ছে। সে খুঁটির আড়ালে দাঁড়িয়ে। এই মেয়েটির মনে হয় লজ্জা বেশি।

সিদ্দিকুর রহমান তাঁর আগের জায়গাতেই আছেন। ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছেন। তাকে সামান্য বিরক্ত মনে হচ্ছে। লীলা তার বাবার পাশে দাঁড়াল। সিদ্দিকুর রহমান মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন— যাও, ভেতরে যাও। এইখানে দাড়ানোর দরকার নাই।

লীলা দাঁড়িয়েই রইল, নড়ল না।

সিদ্দিকুর রহমান হাত-ইশারায় মাসুদকে ডাকলেন। মাসুদ সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এলো। ভয়ে তার শরীর কাঁপছে। ফর্স মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সে তার বাবার দিকে তাকাচ্ছে না। সে তাকাচ্ছে লীলার দিকে। এই মেয়েটিকে সে চিনতে পারছে না। অপরিচিত একটি তরুণী মেয়ের সামনে তাকে কী শাস্তি দেয়া হবে কে জানে!, তার চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছা করছে। কাঁদতে পারছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়েছে। লীলা ছেলেটাকে চেনে না, আগে কখনো দেখে নি। তারপরেও সে স্পষ্ট বুঝল, এই ছেলেটা সম্পর্কে তার ভাই। তাদের দুজনের মা ভিন্ন হলেও তারা ভাইবোন। ছেলেটার ভীতমুখ দেখে লীলার মায়া লাগছে। বেচারা এত ভয় পাচ্ছে কেন? ভয়ঙ্কর কোনো অপরাধ কি সে করেছে? নিতান্তই বালক চেহারার একজন ভয়ঙ্কর কী করতে পারে? এর বয়স কত হতে পারে ষোল সতেরো না-কি আঠারো?

সিদ্দিকুর রহমান ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি নাকি ইদানিং গান-বাজনা শিখছ?

এই প্রশ্ন করতে করতে তিনি আধশোয়া অবস্থা থেকে বসা অবস্থায় চলে এলেন। তার গলার আওয়াজ শান্ত। যেন তিনি তার ছেলের সঙ্গে গল্পগুজব করছেন। পড়াশোনার খবর যেভাবে নিতে হয় সেভাবেই গান-বাজনার খবর নিচ্ছেন।

কথার জবাব দাও না কেন? গান-বাজনা নাকি শিখছ?

জি।

গান দু’একটা শিখেছ?

জি না।

তাহলে কি বাদ্য-বাজনায় আছ?

জি।

কী শিখছ? তবলা? ছেলেপুলে বখাটে হয়ে গেলে প্রথম শিখে তবলা। তবলা শিখেছ?

জি।

কতটুকু শিখেছি?

মাসুদ জবাব দিল না। সিদ্দিকুর রহমান লোকমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, দৌড় দিয়া যাও, কুদ্দুসের বাড়ি থেকে তবলা আর বাঁয়া নিয়ে আসো। আমার পুত্ৰ তবলা কেমন শিখেছে তার পরীক্ষা হবে। এত কষ্ট করে একটা বিদ্যা শিখেছে। দেখি সেই বিদ্যার কী অবস্থা!

লীলার হাসি পাচ্ছে। শুরুতে তার বাবার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল— ভয়ঙ্কর কোনো বিচার হবে। এখন সে-রকম মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে পুরো বিচার ব্যবস্থার মধ্যে হালকা মজা আছে। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, একজন আবার সত্যি সত্যি দৌড়ে তবলা আনতে গেছে। সবচে ভালো হয় ছেলেটা যদি চমৎকার তবলা বাজিয়ে সবাইকে হতভম্ব করে দেয়। সেটা মনে হয় বেচারা পারবে না। কারণ সে থারথার করে কাঁপছে। এত ভয় পাচ্ছে কেন? লীলার ইচ্ছা করছে ছেলেটাকে সে বলে— এত ভয় পােচ্ছ কেন? উনি তোমার সঙ্গে মজা করছেন। তোমাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করার চেষ্টা করছেন। হাসি-তামাশা গায়ে না। মাখলেই হয়।

সিদ্দিকুর রহমান ছেলের দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় ডাকলেন, মাসুদ!

মাসুদ ক্ষীণস্বরে বলল, জি?

তবলা এমন কঠিন বিদ্যা যে এটা শেখার জন্যে মানুষের বাড়িতে রাত কাটাতে হয় এটা জানতাম না। তুমি কি সারারাত তবলা বাজাও, নাকি তবলা শেখার পাশে পাশে কুদ্দুসের মেয়েটার সাথে তবলা বিষয়ে কথা বলে? কুদ্দুসের মেয়ে যেহেতু গান-বাজনার মধ্যে আছে সেও নিশ্চয়ই তবলা বিষয়ে জানে। এই মেয়ে, তুমি জানো না?

পরীবানু কিছু বলল না। খুঁটির আড়ালে চলে গেল।

তোমার নাম কী?

পরীবানু জবাব দিল না। পরীবানুর বাবা কুদ্দুস ভীত গলায় বলল, জনাব, আমার মেয়ের নাম পরীবানু।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, মেয়ে যেমন সুন্দর, নামও সুন্দর। এই মাসুদ, পরীবানু সুন্দর মেয়ে না?

মাসুদ পুরোপুরি পাংশুবৰ্ণ হয়ে গেছে। ভয়ঙ্কর কিছু যে আসছে। সে বুঝতে পারছে। কতটা ভয়ঙ্কর সে-সম্পর্কে তার ধারণা নেই।

সিদ্দিকুর রহমান ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, মাসুদ যাও, পরীবানুর পায়ে কদমবুসি করে বলো— তুমি আমার মা। এটা বলতে দোষের কিছু নাই। মেয়েছেলে মায়ের জাত। বয়সে ছোট মেয়েকেও মা ডাকা যায়। যাও, দেরি করবা না। দেরি আমার ভালো লাগে না। পরীবানু এখন থেকে তোমার মা।

লীলার কাছে মনে হচ্ছে বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা এখন আর হাসিতামাশা রসিকতার পর্যায়ে নেই। বাড়াবাড়ি ভালো জিনিস না। সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মাসুদ পরীবানুর কাছে এসে বসে পড়ল। হাত দিয়ে পা স্পর্শ করল না, তবে মুখ বিড়বিড় করে বলল, আপনি আমার মা।
 
পরীবানু কাঁদছে। কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে না, তবে শরীর কাপা দেখে বোঝা যাচ্ছে।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, শাস্তি সামান্য বাকি আছে। আমার এই ছেলে লজার মাথা খেয়েছে। তার এখন লাজলজা নাই। যে-মেয়ের সঙ্গে ভাব ভালোবাসার চেষ্টা করেছে তারেই মা ডাকতেছে। সুলেমান, এখন আমার বেহায়া ছেলেরে কানো ধরে সারা গ্রামে একটা চক্কর দেবার ব্যবস্থা করো। ন্যাংটা করে চক্কর দেয়াবে। গায়ে যেন একটা সুতাও না থাকে। লজ্জা যখন নষ্ট হয়েছে পুরোপুরি নষ্ট হোক। দেরি করবা না, এরে ন্যাংটা করো। এইখানেই করো। মেয়েরা উপস্থিত আছে তাতে কোনো অসুবিধা নাই। মেয়েদের মধ্যে একজন এখন সম্পর্কে তার মা হয়, মার সামনে পুত্র নগ্ন হতে পারে। এতে লজ্জা নাই।

লীলা অবাক হয়ে দেখল, সত্যি সত্যি সুলেমান নামের লোকটা মাসুদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যে-ভঙ্গিতে এগোচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে নগ্ন করার কাজটা সে করবে। লীলা সুলেমানের দিকে এক পা এগিয়ে কঠিন গলায় বলল, সুলেমান শুনুন, খবরদার! যথেষ্ট হয়েছে।

সুলেমান থমকে দাঁড়াল। হতভম্ব হয়ে তাকাল। একবার লীলার দিকে আরেকবার সিদ্দিক সাহেবের দিকে। সিদ্দিক সাহেব এখন সিগারেট ধরাবার চেষ্টা করছেন। বাতাসের কারণে সিগারেট ধরানো যাচ্ছে না। দেয়াশলাই বারবার নিভে যাচ্ছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে আশেপাশে কী ঘটছে না-ঘটছে তা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই।

মাসুদ মেঝেতে বসেছিল। লীলা তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। লীলা হাত বাড়িয়ে বলল, আসো আমার সঙ্গে। মাসুদ সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। লীলা হাত ধরে তাকে নিয়ে বাগানের দিকে রওনা হলো। মাসুদ এখন কাঁদতে শুরু করেছে। শব্দ করেই কাঁদছে।



সিদ্দিক সাহেবের সিগারেট শেষ পর্যন্ত ধরেছে। তিনি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন– এ আমার বড় মেয়ে। আমার বড় মেয়ের কথার উপরে আর কোনো কথা নাই। আজ থেকে তার কথাই খাবাড়ির শেষ কথা। তোমরা ভিড় করে থাকবে না। যাও, যে যার কাজে যাও।

অতি দ্রুত লোকজন সরে গেল। সিদ্দিকুর রহমান আবারো ইজিচেয়ারে শুয়ে পড়লেন। চোখ বন্ধ করে বললেন— সুলেমান, আমার বড় মেয়েকে কেমন দেখিলা? বাপকা বেটি না?

জি, বাপকা বেটি।

মাসুদরে আমি ন্যাংটা করে শাস্তি দিতাম না। এই শাস্তি দেয়া যায় না। তারপরেও এরকম একটা শাস্তির কথা কেন বললাম জানো?

জি না।

আমার বড় মেয়ে কী করে সেটা দেখার জন্যে। যেরকম করবে ভেবেছিলাম সে-রকম করেছে। মাশাল্লাহ! মেয়েটা হয়েছে অবিকল তার মার মতো। যেরকম চেহারা, সেরকম স্বভাবচরিত্র।

সিদ্দিকুর রহমানের চোখে দ্বিতীয়বার পানি এসেছে। তার বড় ভালো লাগছে।

সুলেমান!

জি?

আবার জিজ্ঞেস করতেছি, ভেবেচিন্তে বলো। এই মেয়ে বাপকা বেটি না?

জি, বাপকা বেটি।

একটা মজার কথা বলি শোনো— আমার দাদাজান একবার সন্ধ্যাকালে করলেন কী, লম্বা একটা বাঁশের মাথায় একটা হারিকেন ঝুলায়ে বাশটা বাড়ির উঠানে পুতে দিলেন। সবাই জিজ্ঞেস করল, ব্যাপার কী? দাদাজান বললেন, একটা ঘটনায় আমার মনে খুব আনন্দ হয়েছে। এইজন্যে কাজটা করলাম। সবাই জানতে চাইল, ঘটনা কী? দাদাজান বললেন— ঘটনা। কী আমি বলব না। আমার মনের আনন্দটা সবাই দ্যাখা। আনন্দের পেছনে ঘটনা জানার দরকার নাই। দাদাজানের মতো আজ আমার মনেও আনন্দ হয়েছে। বাশের আগায় একটা হারিকেন আজকেও ঝুলাও।

সুলেমান বলল, জি আচ্ছা।

কেউ যদি জানতে চায় ঘটনা কী— কিছু বলব না। সব ঘটনা সবার জানার দরকার নাই। সকখঘটনা শুধু আল্লাহপাকই জানবেন। আর কেউ না।

জি আচ্ছা।

রাতে বড়খানার ব্যবস্থা করো। মাংস রান্নার জন্যে ফজলুরে খবর দিয়া আনো।

জি আচ্ছা। পশ্চিমের পুকুরে জাল ফেলব?

হুঁ, ফেলো। জাল টানার সময় আমার মেয়েরে নিয়া যাবে। সে দেখে মজা পেতে পারে।

জি আচ্ছা।

আজি দুপুরে আমি কিছু খাব না। উপবাসে যাব। রাতে বড় মেয়ের সাথে খানা খাব।

জি আচ্ছা। উনার থাকার ব্যবস্থা কোনখানে করব?

লীলা থাকবে পুরনো বাড়িতে। শহরবাড়িতে না। আমার ঘরের উত্তরের ঘরটা তারে দেও। ঘরের তালা খুলার ব্যবস্থা করো।

জি আচ্ছা।
 
রাত আটটা বাজে।

এশার নামাজ শেষ করে সিদ্দিকুর রহমান পুরনো বাড়ির বারান্দায় চাদর গায়ে বসে আছেন। তার বসার জন্যে উঠানে পাটি পাতা হয়েছে। পাটির উপর সতরঞ্জি বিছানো। বাড়ির উঠানে মাংসের বিখ্যাত কারিগর ফজলু মিয়া মাটির বড় হাঁড়িতে খাসির মাংস বসিয়েছে। শুধুমাত্র পিয়াজের রসে মাংস দমে সিদ্ধ করা হচ্ছে। কাজটা জটিল। আগুনের আঁচ বেশি হতে পারবে না। আবার কমও হতে পারবে না। হাঁড়ির মুখের ঢাকনা আটা দিয়ে আটকানো। ফজলুর দৃষ্টি আটার দিকে— ফুটো হয়ে বাষ্প বের হয়ে যাচ্ছে কি-না।

মাছ রান্না হচ্ছে ভেতর বাড়িতে। পশ্চিম পুকুর থেকে ছটা বড় মাছ ধরা হয়েছে। একটা কাতল, ওজন আঠারো সের। আরেকটা নানিদ মাছের ওজন সাত সের। এত বড় আকৃতির নানিদ মাছ। সচরাচর পাওয়া যায় না। লীলার ভাগ্যে এত বড় নানিদ ধরা পড়েছে। এটা একটা সৌভাগ্যের লক্ষণ। কারো নাম করে পুকুরে জাল ফেললে কী মাছ ধরা পড়ে তা দিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা হয়ে যায়। একবার ময়মনসিংহের ডিসি সাহেব এসেছিলেন, তার নামে জাল ফেলার পর কয়েকটা গজার মাছ ছাড়া কিছু উঠে নি।

ভেতরবাড়ি থেকে লীলা বের হয়েছে। সে উঠানে নেমে গেল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল বাঁশবাগানের দিকে। বাঁশবাগানে লণ্ঠন ঝুলানো হয়েছে। সে লণ্ঠন থেকে চোখ নামিয়ে তাকাল বাবার দিকে। সিদ্দিকুর রহমান জানতেন তাঁর মেয়ে এই কাজ করবে। চোখে যেন চোখ না পড়ে সে-জন্যেই তিনি আগে থেকেই অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন। তবে মেয়ে কী করছে না করছে তা তিনি লক্ষ রাখছেন। মানুষ অন্যদিকে তাকিয়েও আশেপাশের কিছু দৃশ্য দেখতে পারে। লীলা ফজলু মিয়ার কাছে গেল। ফজলু মিয়া ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। এখন আবার লীলা তাকাচ্ছে বাঁশবনের দিকে। লণ্ঠনের ব্যাপারটা মনে হয়। মেয়ের মাথা থেকে যাচ্ছে না। মেয়ে এখন এগিয়ে আসছে তার দিকে। এখন মেয়ের দিকে তাকানো উচিত। লীলা বলল, বসি আপনার পাশে?

সিদ্দিকুর রহমান হাতের ইশারায় লীলার বসার জায়গা দেখিয়ে দিলেন। এই মেয়ে কত সহজেই না তার সঙ্গে কথা বলছে!

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তোমার থাকার ঘর পছন্দ হয়েছে?

লীলা কিছু বলল না। ঘর তার পছন্দ হয় নি। অন্ধকার ঘর, ছোট জানালা। বিশাল ঘরের প্রায় পুরোটা জুড়েই গাবদা এক খাট। শহরবাড়ি নামের বাংলোর ঘরগুলি অনেক সুন্দর। সেখানে থাকতে পারলে হতো। কিন্তু তাকে বলা হয়েছে এই ঘরে থাকতে।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তুমি যে ঘরে থাকবে সেই ঘরে তোমার মা থাকতেন।

লীলা বিস্মিত হয়ে বলল, সত্যি?

হ্যাঁ। তোমার মা চলে যাবার পর আমি এই ঘর তালাবন্ধ করে দেই। আজ তোমার জন্যে তালা খোলা হয়েছে।

এই গাবদা খাট মার পছন্দ ছিল?

হুঁ। এই খাটের একটা নাম আছে— ময়ূরখাট। আমার দাদা খান বাহাদুর হামিদুর রহমান সাহেব তার স্ত্রীর জন্যে বানিয়েছিলেন। তবে তিনি এই খাট কখনো ব্যবহার করেন নাই।

কেন করেন নাই?

সেটা জানি না। মানুষ সব জানতে চায়। কিন্তু জানতে পারে না। আমরা অল্পই জানি। কিন্তু ভাব করি অনেক জানি।

লীলা বাবার কথায় সামান্য চমকালো। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তুমি এখন নিজের কথা বলো। তোমার বিষয়ে জানতে ইচ্ছা করছে।

কী জানতে চান?

পড়াশোনা কতদূর করেছ?

বিএ অনার্স পরীক্ষা দিয়েছি। সামনের মাসে রেজাল্ট হবে।

বলে কি! পরীক্ষা কেমন হয়েছে?

ভালো হয়েছে।

পড়াশোনা কোথায় করেছ?

ঢাকায়। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছি ইডেন কলেজ থেকে। তারপর ঢাকা ইউনিভার্সিটি।

তুমি পড়াশোনায় কেমন?

ভালো। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় ছেলেমেয়ে সবার মধ্যে থার্ড হয়েছিলাম।

সিদ্দিক সাহেব তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার চোখে আনন্দের চেয়েও যেটা বেশি তার নাম বিস্ময়।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, হঠাৎ যে আমাকে দেখতে আসছ— এর পিছনে কি কোনো কারণ আছে?

কোনো কারণ নাই।

সিদ্দিকুর রহমান মেয়ের দিকে সামান্য ঝুঁকে এসে বললেন, সামান্য যে পশু সেও কারণ ছাড়া কিছু করে না। মানুষ তো কখনোই করে না। তবে সব কারণ মানুষ নিজে জানে না। অন্য একজন জানে।

অন্য একজনটা কে?

আল্লাহপাক। মা, তুমি কি নামাজ পড়ো?

মাঝে মাঝে পড়ি।

কোরআন মজিদ পড়তে পারো?

পারি।

তোমার নাম যে লীলাবতী রাখা হয়েছে, কেন রাখা হয়েছে সেই কারণ কি জানো?

জানি না, আমি শুধু জানি মা সবাইকে বলে রেখেছিল তাঁর যদি মেয়ে হয় তার নাম যেন লীলাবতী রাখা হয়।

ছেলে হলে কী নাম রাখা হবে বলে নাই?

না। আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি— বাঁশগাছের মাথায় হারিকেন ঝুলছে কেন?


সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমার মনে খুব আনন্দ হয়েছে এটা জানানোর জন্যে বাঁশগাছের আগায় হারিকেন। আনন্দ পেলে মানুষ তার আনন্দের খবর সবাইকে জানাতে চেষ্টা করে। মানুষ দুঃখ পেলে কিংবা কষ্ট পেলে তার খবর কিন্তু জানাতে চায় না। গোপন করে রাখে। মানুষ ছাড়া অন্যসব পশুপ্রাণীজগতের নিয়ম কিন্তু ভিন্ন। পশু বা পক্ষীজগতের নিয়ম হলো, দুঃখ-কষ্ট চিৎকার চেঁচামেচি করে সবাইকে জানাও। আনন্দের খবর গোপন রাখো।

লীলা হেসে ফেলল। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, মা, তুমি হাসো কেন?

আপনার কথা শুনে হাসি।

আমার কথা শুনে কেন হাসলে?

লীলা বলল, কী জন্যে হেসেছি তার কারণ আমি জানি না। অন্য একজন হয়তো জানেন। কিন্তু তিনি তো কিছু বলেন না।

সিদ্দিকুর রহমান মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। লীলা তাকিয়ে আছে তার বাবার দিকে। কেউ চোখের পাতা ফেলছে না। মনে হয়। একজন অন্যজনকে বোঝার চেষ্টা করছে।
 
লীলাদের বাড়ি মঞ্জুর পছন্দ হয়েছে। এ বাড়িতে আজ তাঁর তৃতীয় দিবস। পছন্দের মাত্রা প্রতিদিনই বাড়ছে। লক্ষণ ভালো নয়। চক্রবৃদ্ধি হারে যদি পছন্দ বাড়তে থাকে তাহলে একসময় দেখা যাবে তিনি এখানেই স্থায়ী হয়েছেন। তিনি কোথাও স্থায়ী হতে চান না। শিকড় বসানো গাছের স্বভাব। তিনি গাছ না, মানুষ। মানুষের কোথাও শিকড় বসাতে নেই।

তবে এই বাড়ির প্রতিটি মানুষকে তার মনে ধরেছে। সবচে মনে ধরেছে লীলার দুই বোনকে। কইতরী এবং জইতরী। আদর করে এদেরকে এখন তিনি ডাকছেন ‘কই’ এবং জই। কইতরী তার সঙ্গে আছে ছায়ার মতো। জাইতরী তাকে লক্ষ করে দূর থেকে। সে হয়। দরজার আড়াল থেকে তাকে দেখবে কিংবা গাছের আড়াল থেকে দেখবে। কইতরীর মতো রূপবতী বালিকা তিনি তাঁর জীবনে দ্বিতীয়টি দেখেন নি— এই ঘোষণা কয়েকবারই দেওয়া হয়েছে। কইতরীকে নিয়ে তিনি খানিকটা দুশ্চিন্তাও বোধ করেছেন। অতি বড় রূপসী ঘর পায় না— এই প্রবাদের কারণে। তাছাড়া মেয়েটির চুলও লাল। লাল চুলের মেয়েরা কোথাও স্থায়ী হতে পারে না। তাদের কলমিলতার মতো ঘুরে বেড়াতে হয়।

উঁচু কপালি চিড়ল দন্তী পিঙ্গল কেশ
ঘুরবে কন্যা নানান দেশ।

মঞ্জুর সেবার জন্যে যাকে নিযুক্ত করা হয়েছে তাকেও তাঁর খুব পছন্দ হয়েছে। লোকটির নাম বন্দু। বয়স ত্ৰিশের মতো। গাঢ় কৃষ্ণবর্ণের ক্ষীণকায় একজন মানুষ। ছয় ফুটের মতো লম্বা। সে মনে হয় তার শারীরিক দৈর্ঘের কারণে লজ্জিত। তার চেষ্টা কুঁজো হয়ে, বাঁকা হয়ে লম্মা শরীরটা যতটা পারে কমিয়ে রাখা। বন্দুর দোষ হলো, সে সারাক্ষণ কথা বলে। আর তার গুণ হলো, সেইসব কথা শুনতে ভালো লাগে।

দুপুরবেলা বদু মঞ্জুর সারা শরীরে সরিষার ঝাঝানো তেল মাখিয়ে দলাইমলাই করে। আরামে তার চোখ বন্ধ হয়ে ঘুম পেয়ে যায়। তখন তার মনে হয়, মানবজীবনের সার্থকতা এই দলাই-মলাইয়ে। সবচে মজার কথাগুলি বদু এই সময় বলে।

বুঝছেন স্যার, আমার চাচাজি কিন্তুক হুঁ হুঁ হুঁ…।

হুঁ হুঁ হুঁ আবার কী? পরিষ্কার করে বলো।

সবকিছু পরিষ্কার করে বলা যায় না। স্যার। কিছু ভাবে বুঝতে হয়। ভাবে বুঝেন। নজর কইরা ভাব দেখেন।

কী ভাব দেখাব?

বাঁশের আগাত লণ্ঠন জ্বালাইছে, দেখেন নাই? এখন বলেন দেখি ঘটনা!

বলতে পারছি না। কী ঘটনা?

পাকা দালান থুইয়া টিনের ঘরে থাকে, বলেন দেখি কী ঘটনা?

বলতে পারছি না। কী ঘটনা?

চাচাজির জিন-সাধনা আছে। এই হইল ঘটনা।

কী সাধনা?

জিন-সাধনা। উনার দুই পালা জিন আছে। এরা দুই ভাই।

কী উল্টা-পাল্টা কথা বলো?

শুনতে না চাইলে বলব না। জবান বন্ধ করলাম। তয় আমি ছিলাম। তার পাংখা বরদার। রাইতের পর রাইত আমি তারে পাংখা দিয়া হাওয়া দিছি। তার অনেক ঘটনা স্বচক্ষে দেখা।

কী দেখেছ?

সেটা তো বলব না।

কেন বলব না?

সব কিছু বলা ঠিক না। পাগলা হন্টন সাবের ভূত থাকে শহরবাড়িত। মাঝে মধ্যে সে গিয়া বড় স্যারের সাথে ইংরেজিতে গফসফ করে। সেই গফসফও আমি শুনেছি।

কী শুনেছ?

সেটা তো আফনেরে বলব না। আমার অন্ত শখ নাই। গোপন জিনিস। আমি লাড়াচাড়া করি না।

বড় সাহেব সম্পর্কে যত কথাই তিনি শোনেন না কেন, মানুষটাকে তাঁর পছন্দ হয়েছে। শুধু পছন্দ নয়, বেশ পছন্দ। তার কাছে মনে হচ্ছে, এমন বিনয় এবং ভদ্রতা তিনি খুব কম মানুষের মধ্যে দেখেছেন। শরীফ ঘরের মানুষদের মধ্যেই শুধু এই জিনিস দেখা যায়। লীলার বাবা যে অতি বড়ঘরের মানুষ এই বিষয়ে তিনি এখন একশ ভাগ নিশ্চিত।
 
সিদ্দিকুর রহমান গতকাল দুপুরে মঞ্জুকে বলেছেন, আপনি আমার মেয়েটাকে কষ্ট করে নিয়ে এসেছেন। আপনার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নাই। আমি আপনাকে সামান্য সম্মান করতে চাই।

মঞ্জু বিস্মিত গলায় বললেন, আপনার কথা বুঝতে পারছি না। সম্মানের মধ্যেই তো আছি। নতুন করে আর কী সম্মান করবেন?

একটু বিশেষ সম্মান করতে চাই।

মঞ্জু অবাক হয়ে বলেছেন, আচ্ছা ঠিক আছে। করেন, কী করতে চান। আমি দেখতে চাই ব্যাপারটা কী? সন্মান পাওয়ার জন্যে নয়, ঘটনা কী জানার জন্যে।

মঞ্জু ঘটনার জন্যে অপেক্ষা করছেন। এখনো কিছু ঘটে নি। কবে ঘটবে বোঝা যাচ্ছে না। সিদ্দিকুর রহমান যে ব্যাপক কিছু করবেন। এটা আন্দাজ করা যাচ্ছে। যে-কোনো বড় কর্মকাণ্ডের জন্যে ব্যাপক প্রস্তুতি লাগে। সমস্যা একটাই, লীলা হয়তো হুট করে বলে বসবে–একদিনের জন্যে বাবার দেশ দেখতে এসেছিলাম। দেখা হয়েছে। এখন চলে যাই। আমার শখ মিটে গেছে।

লীলাকে অগ্রাহ্য করা অসম্ভব ব্যাপার। লীলা যদি বলে চলো যাই, তাকে যেতেই হবে। যে সব মেয়ের নাক খাড়া এবং যাদের চিবুক ঘামে তাদের নিয়ে এই সমস্যা। তাদের কথা আগ্রাহ্য করা যায় না। লীলার নাক খাড়া এবং তার চিবুক ঘামে। খুবই খারাপ লক্ষণ।

বড় সম্মান তাকে কী দেখানো হবে এটা নিয়ে তিনি একধরনের দুশ্চিন্তার মধ্যেই আছেন। কারো সঙ্গে যে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করবেন। সেই সুযোগও হচ্ছে না। তিনি যে কামরায় থাকেন তার পাশের কামরাতেই আনিসুর রহমান বলে এক যুবক থাকে। জাইতরী, কইতরী দুই বোনকে সন্ধ্যাবেলায় পড়ায়। জয়গির টাইপ ব্যাপার হবে। মঞ্জু। কয়েকবারই তার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করবার জন্যে গিয়েছিলেন। সে প্রতিবারই মুখ শুকনো করে বলেছে, আমার শরীরটা ভালো না। পরে কথা বলি?

বিরাট অভদ্রতা। মঞ্জু তার অভদ্রতা ক্ষমা করেছেন। এই যুবক লীলাদের বাড়ির কেউ নয়। বাইরের মানুষ। বাইরের মানুষের অভদ্রতা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। ব্যাটা থাকুক তার মতো। তিনি থাকবেন তার মতো।

তিনি তাঁর মতোই আছেন।

তিনি শহরবাড়ি এবং মূল বাড়িতে এমনভাবে ঘুরছেন যেন এটা তার নিজেরই বাড়িঘর। তাঁর চলাফেরা, আচার-আচরণে কোনোরকম দ্বিধা লক্ষ করা যাচ্ছে না। মূল বাড়ির দক্ষিণের আমবাগানের একটা অংশ তিনি উপস্থিত থেকে পরিষ্কার করিয়েছেন। সেখানে চৌকি পাতা হয়েছে। ছায়াময় এই জায়গা তার পছন্দ হয়েছে। তিনি ঘোষণা করেছেন— দুপুরবেলায় এখানে তিনি ঘুমাবেন। জায়গাটার তিনি একটা নামও দিয়েছেন— ছায়াবীথি। তিনি ঠিক করেছেন কেউ নেত্রকোনা শহরে গেলে ছায়াবীথি নামের একটা সাইনবোর্ড আনিয়ে বড় আমগাছটায় লাগিয়ে দেবেন।

তাঁর সবচে’ পছন্দ হয়েছে বড় পুকুর। বাড়ির সামনে দুটো পুকুর। একটার নাম বড় পুকুর, আরেকটার নাম কাঁচা পুকুর। পুকুরভর্তি মাছ। সাধারণ ছিপ ফেলে বিঘত সাইজের কয়েকটা নলা ধরে তিনি উত্তেজিত। বড় মাছ ধরার জন্যে হুইল বড়শির ব্যবস্থা করতে বলেছেন। পিঁপড়ার ডিমের সন্ধানে বদু গেছে।

বদু আবার এইসব বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানী। তার কাছে শুনেছেন— সব পিঁপড়ার ডিম মাছ খায় না। হিন্দু পিঁপড়ার ডিম মাছে খায়।

পিঁপড়াদের মধ্যেও যে হিন্দু-মুসলমান আছে তিনি জানতেন না। বদু তাঁর অজ্ঞতায় বিস্মিত হয়ে বলেছে— পিঁপড়ার যে হিন্দু-মুসলমান আছে এইটা সবেই জানে। লাল পিঁপড়া হইল হিন্দু। আর কালা পিঁপড়া মুসলমান। মুসলমান পিঁপড়া কামড় দেয় না, হিন্দু পিঁপড়া দেয়।

মঞ্জু, বড়ই বিস্মিত হয়েছেন। যতই দিন যাচ্ছে বদু নামের এই লম্বুটাকেও তাঁর ততই পছন্দ হচ্ছে। লম্বা মানুষের বুদ্ধি কম থাকে বলে তিনি শুনেছিলেন, এখন মনে হচ্ছে–এটা খুবই ভুল কথা।

বদুর কাছ থেকে অভদ্র শিরোমণি আনিসুর রহমান সম্পর্কেও কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। বদি বলেছে–লোক খারাপ না, তয় মাথা সিক্সটি নাইন আছে।

বদুর মুখে ইংরেজি সিক্সটি নাইন শুনে তিনি মজা পেয়েছেন।

সিক্সটি নাইনটা কী বদু?

মাথাত গণ্ডগোল। বেশি বই পড়ার কারণে এইটা হইছে।

বেশি বই পড়ে না-কি?

দিন রাইত বই নিয়েই আছে।

কী বই পড়ে?

ইংরেজি মিংরেজি সব কিসিমই পড়ে। রাইত ঘুমায় না, লেখে।

কী লেখে?

জানি না। কী লেখে। লেখে আর বারিন্দায় হাঁটে।

মঞ্জু লোকটির সঙ্গে পরিচয়ের জন্যে কিছু আগ্রহ এখন অনুভব করছেন। যে লোক দিন-রাত বই পড়ে, রাত জেগে লেখে, তার অভদ্রতা ক্ষমা করা যায়।

তার যে আরেকটা নাম আছে। এইটা জানেন?

কী নাম?

কুঁজা মাস্টার। কুঁজা হইয়া হাঁটে তো, এইজন্যে কুঁজা মাস্টার নাম। অনেকে আবার ডাকে হুঁজা মাস্টার।
 
কুঁজা মাস্টার নান্দাইল শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক কলেজের ইতিহাসের প্রভাষক আনিসুর রহমানের মেজাজ সকাল থেকেই খারাপ। মেজাজ বেশি খারাপ হলে তার কিছু শারীরিক সমস্যা হয়। জ্বর আসে, হাতের তালু জ্বালা করতে থাকে। একটা পর্যায়ে মাথা ঘুরতে থাকে।

তার জ্বর এসেছে, হাতের তালু জ্বালা করছে। মাথাঘোরা এখনো শুরু হয় নি। মনে হচ্ছে দুপুরের দিকে শুরু হবে। তার মেজাজ-খারাপের অনেকগুলি কারণ আছে। অনেক কারণের প্রধান কারণ হলো, গত চার মাসে কোনো বেতন হয় নি। কলেজের প্রিন্সিপাল আলহাজু আতাউল গনি সাহেবের কাছে গতকাল আনিস গিয়েছিল। ভদ্রলোক অমায়িক হাসি হেসে বলেছেন— এত অস্থির হচ্ছেন কেন? ইয়াংম্যান, লাইফের শুরুতে স্ট্রাগল করতে হবে না? যারা বড় হয় সবাইকে স্ট্রাগাল করতে হয়।

আনিস হতাশ গলায় বলল, এই মাসেও বেতন হবে না? আতাউল গনি আবারো হাসতে হাসতে বললেন, এই মাসে একটা কিছু ব্যবস্থা ইনশাল্লাহ করব। আপনার তো খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধা হচ্ছে না। বিরাট মানুষের বাড়িতে জায়গির থাকেন। শুনেছি ঐ বাড়িতে দশ পদের নিচে রান্না হলে বাবুর্চিকে কানে ধরে চক্কর দেওয়ানো হয়। সত্যি না-কি?

রান্না অনেক পদ হয় এটা সত্যি, কানে ধরে চক্কর দেওয়ার বিষয় জানি না। আপনি কি আমাকে হাতখরচের কিছু দিতে পারেন?

হাতখরচ পা-খরচ কোনো খরচই:দেয়া যাবে না। কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরতে হবে। মিনিস্টার সাহেবের কলেজ। উনি আবার একটু বেকায়দায় পড়ে গেছেন বলে আমাদের সমস্যা হচ্ছে। খুবই সাময়িক সমস্যা। মিনিস্টার সাহেবকে জানানো হয়েছে। আপনি এত অস্থির কেন? থাকা-খাওয়ার কোনো প্রবলেম তো আপনার হচ্ছে না? প্রবলেম হলে বলেন। জায়গির চেঞ্জ করে অন্য জায়গায় দিয়ে দেই।

থাকা-খাওয়ার কোনো সমস্যা আনিসের হচ্ছে না। সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের পাকা দালানের দোতলার একটা ভালো ঘর তাকে দেয়া হয়েছে। ঘরের জানালাগুলি গ্রামের পাকা বাড়ির জানালার মতো খুপরি খুপরি না। বড় বড় জানালা। দক্ষিণ দিকের জানালা খুললে হুহু করে বাতাস বয়। প্রচণ্ড গরমের সময়ও রাতে জানালা খুলে রাখলে রীতিমতো শীত লাগতে থাকে। খাওয়াদাওয়ারও কোনোরকম অসুবিধা নেই। ঘরে এসে খাবার দিয়ে যায়। এত খাবার আনে যে পাঁচ-ছয়জন মানুষ খেতে পারে। কম করে খাবার দিতে অনেকবার বলা হয়েছে, কোনো লাভ হয় নি।

পরের বাড়িতে দিনের পর দিন থাকা-খাওয়ার যে অস্বস্তি আছে সেই অস্বস্তিও আনিস এখানে বোধ করে না। কলেজের বেশিরভাগ শিক্ষক এই ধরনের ব্যবস্থায় থাকেন। গ্রামের দিকে এটা মোটামুটি চালু ব্যবস্থা। বিত্তবান মানুষরা কলেজের শিক্ষকদের বাড়িতে জায়গির রাখতে পছন্দ করেন। এতে সমাজে প্রতিপত্তি বাড়ে।

থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে আনিসকে কিছুই করতে হয় না। সিদ্দিক সাহেবের মেয়ে দুটিকে নিয়ে সন্ধ্যাবেলায় কিছুক্ষণ বসতে হয়। দুই মেয়ের সামনে থাকে দুই হারিকেন। আনিসের বাঁ-হাতে থাকে চিকন তেল মাখানো বেত। (বেতে তেল মাখানোর কাজটা বদি খুব আগ্রহের সঙ্গে করে।) মেয়ে দুটি নিজের মনে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পড়ে। আনিস তাকিয়ে থাকে। কিছুই বলে না। যেন তার কাজ বেত হাতে বসে থাকা। একসময় ভেতরবাড়ি থেকে তাদের খাওয়ার ডাক আসে। তারা আনিসের দিকে তাকিয়ে ভীত গলায় বলে, স্যার যাই? আনিস উত্তর দেয় না। তারা কিছুক্ষণ উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করে চলে যায়।

মাঝে মাঝে আনিসের মন খারাপ থাকে। তখন সে বলে, তের-এর ঘরের নামতা বলো। এই নামতা জাইতরী কইতরী কারোরই মনে থাকে না। তারা একে অন্যের দিকে তাকায়। একসময় ভয়ে ভয়ে শুরু করে— তের এক্কে তের। তের দুগোনে ছাব্বিশ। তিন তেরং…

তিন তেরং কী?

দুই বোন বলতে পারে না। মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। আনিসের হাতের বেত ঝড়ের মতো নেমে আসে।

কলেজ থেকে ফেরার পর আনিসের কিছুই করার নেই। পত্রিকায় কর্মখালি দেখে দরখাস্ত তৈরি করা তার এখন প্রধান কাজ। সে বিচিত্ৰ সব চাকরির জন্যে দরখাস্ত পাঠিয়েছে। বন বিভাগের আমিনের পদেও দরখাস্ত পাঠানো হয়েছে। কোনো হ্যাঁ-সূচক জবাব এখনো আসে নি, শুধু পাকিস্তান লাইটস নামের একটা কোম্পানি থেকে সাম্প্রতিক সময়ে তোলা তিন কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি চেয়ে পাঠিয়েছে। নেত্রকোনা থেকে ছবি তুলে ছবি পাঠানো হয়েছে। আর তাদের কোনো খোঁজ নেই।

শেরে বাংলা কলেজের প্রিন্সিপাল সাহেব অবিশ্যি তাকে ডেকে বলেছেনকর্মখালি দেখে অ্যাপ্লিকেশন পাঠিয়ে কোনো লাভ নেই। সব পাতানো খেলা। কে চাকরি পাবে, কে পাবে না। সব ঠিক করা থাকে। আই ওয়াশ হিসেবে কর্ম খালি বিজ্ঞাপন ছাপা হয়। তবে আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার রেজাল্ট ভালো। অনার্সে সেকেন্ড ক্লাস ফাস্ট আর এমএ-তে সেকেন্ড ক্লাস থার্ড হওয়া খেলা কথা না। ভিতরে জিনিস থাকতে হয়। জিনিস মাথার মধ্যে নিয়ে বিনাবেতনের কলেজে পচে মরবেন কেন? আমি শেরে বাংলাকে ধরে একটা ব্যবস্থা ইনশাল্লাহ করে দেব। আমি হাজি মানুষ। মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছি না। ধৈর্য ধরুন। ধৈর্য। আসল জিনিস ধৈর্য। শেরে বাংলার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। আমার বড়ভাই বিবাহ করেছেন চাখারে— সেইসূত্রে পরিচয়।
 
আনিস ধৈর্য ধরে আছে কারণ তার এখন অন্য কিছু ধরার নেই। সে বসে আছে পুকুরপাড়ে, নারিকেল গাছের ছায়ায়। সূর্য সরে যাওয়ায় ছায়াও সরে গেছে। আনিসের গায়ে রোদ চিড়বিড় করছে, তারপরেও সে সরে বসছে না। লাগুক রোদ। জ্বর তো গায়ে আছেই, সেই জ্বর আরো বাড়ুক। সবচে ভালো হয় অচেতন হয়ে পড়ে থাকলে। জগতে কী ঘটছে বোঝার উপায় থাকবে না।

গত পরশু সে কলেজের শিক্ষক প্রণববাবুকে জিজ্ঞেস করেছিল, কপৰ্দক মানে কী? আমরা যে বলি কপর্দকহীন অবস্থা— তার অর্থটা কী? প্রণববাবু বললেন, কপর্দক হলো কড়ি। প্রাচীন আমলে মুদ্রার সর্বনিম্ন মান ছিল কড়ি। যার কাছে একটা কড়িও নাই সে-ই কপর্দকহীন।

গত এক মাস পাঁচদিন ধরে আনিস কপর্দকহীন। বাড়িতে চিঠি পাঠাতে দুই আনা লাগে, সেই দুই আনাও তার কাছে নেই। দোক গান থেকে সিগারেট বাকিতে কেনা হচ্ছে। দোকানদার এখনো বাকিতে দিচ্ছে। আর কতদিন দেবে কে জানে! জুরটা ভালোমতো এলে ভালো হয়। সিগারেট খাবার ইচ্ছা মরে যায়।

খাম কেনার টাকার অভাবে দেশের বাড়িতে মাকে চিঠি লেখা হচ্ছে না। মা চিন্তিত হয়ে চিঠির পর চিঠি পাঠিয়ে যাচ্ছেন– বাবা, তুমি পত্র দিতেছ না কেন? তোমার শরীর ভালো আছে তো? আমি অইত্যান্ত চিন্তিত। তুমি কি কোনো কারণে আমার উপর রাগ করিয়াছ?

মা চিঠিপত্র বেশ গুছিয়ে লেখেন। শুধু কিছু-কিছু বানান লেখেন অন্যরকম করে। যেমন তিনি কখনো অত্যন্ত লিখবেন না। লিখবেন আইত্যান্তি।

আনিস কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখল। মনে হয় রোদে বসে থাকার কারণে জ্বর আরো বেড়েছে। খাম কেনার টাকা থাকলে মাকে চিঠি লিখে জানানো যেত। সামান্য দুচার টাকা যোগাড় করা সমস্যা না, কিন্তু সামান্য দুচার টাকার জন্যে হাত পাতা সমস্যা।

মাকে চিঠিটা এখন লিখে রাখা যায়, তারপর যদি কলেজের বেতন হয় তাহলে খাম কিনে চিঠি পাঠানো হবে।

আনিস রোদে পুড়তে পুড়তে মাকে চিঠি লিখতে শুরু করল—

মা,

আমি অইত্যান্ত ভালো আছি। অইত্যান্ত সুখে আছি। আমার গায়ের উপর সুখ ঝরে ঝরে পড়ছে।…

কদৰ্পক জোগাড় না হওয়া পর্যন্ত মাকে লেখা চিঠি আনিস পাঠাতে পারবে না, তবে মালেক ভাইকে লেখা পোস্টকার্ডটা পাঠাতে পারবে। পোষ্টকার্ড কিনে চিঠি লেখা হয়েছে। জেলখানায় খামের চিঠি লেখা যায় না। পোস্ট কার্ডের চিঠি পাঠাতে হয়।

মালেক ভাই নিরাপত্তা আইনে বন্দি আছেন। প্রথমে ছিলেন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে, এখন তাকে পাঠানো হয়েছে রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে। জেলারের কেয়ার অফে তাকে চিঠি দিলে চিঠি পৌছানোর কথা। চিঠি দেয়া যাচ্ছে না। কারণ পোস্টকার্ডটা স্থানীয় পোস্টাপিস থেকে পাঠানো ঠিক হবে না। আইবির লোকজন গন্ধ শুকে শুকে এখানে চলে আসতে পারে। পোস্টকার্ডটা পোষ্ট করতে হবে। ময়মনসিংহ শহর থেকে। কে যাবে ময়মনসিংহ? যাওয়ার ভাড়া কোথায়?

মালেক ভাইয়ের চিঠিটা আনিস এমনভাবে লিখেছে যেন অতি ঘরোয়া চিঠি। কেমন আছেন, ভালো আছি’ গোছের চিঠি। পুলিশ এই চিঠি পড়ে যেন কিছুই না বোঝে। যেন টের না পায় চিঠিটা লিখেছে মালেক ভাইয়ের দলেরই একজন। আনিস লিখেছে–

ভাইজান গো! আসসালাম। পর সমাচার। আমি ভালো আছি। বাড়ির সকলেই ভালো আছে। ধলাগরুটির একটি বখনা বাছুর হইয়াছে। বাছুরটার রঙ কালো। কুড়িটা ডিম দিয়া রাজহাঁস বসাইয়াছিলাম। দুঃখের বিষয় মাত্র তিনটা ডিম ফুটিয়াছে। বাকি সবই নষ্ট।

আমি ভালো আছি। লেখাপড়া নিয়া আছি। সামনেই পরীক্ষা। পাশ করিব কি-না ইহা আল্লাহপাকই জানেন। আপনি আমাকে প্রচুর পড়িতে বলিয়াছেন, আমি সেইমতো পড়াশোনার চেষ্টা নিয়েছি। অজপাড়াগাঁয়ে থাকি, বইপত্র জোগাড় হয় না। শুনিলে আশ্চর্য হইবেন, সামান্য একটা ডিকশনারিও পাওয়া দুস্কর।

আপনি ভালো থাকিবেন। স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ব নিবেন। আপনাকে সালাম। মাননীয় জেলার সাহেবকেও সালাম।

ইতি–
আপনার অতি আদরের
আনিস
 
মাগরেবের নামাজ শেষ করে সিদ্দিকুর রহমান বাড়ির উঠোনে ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছেন। তার সামনে বড় একটা জলচৌকি। তিনি জলচৌকিতে পা রেখেছেন। কিছুক্ষণ আগে তিনি একটা দুঃসংবাদ পেয়েছেন। বড় ছেলে মাসুদ বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে। নান্দাইল রেলস্টেশনে তাকে ট্রেনে উঠতে দেখা গেছে। তার গায়ে ছিল। হলুদ রঙের শার্ট। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সে কোথায় যায়। উত্তরে সে বলেছে— আসামে যাই।

সিদ্দিকুর রহমান তেমন চিন্তিত বোধ করছেন না। ছেলে পালিয়ে গেছে— এটা তেমন কোনো দুঃসংবাদ না। তিনি চিন্তিত বোধ করেছেন দ্বিতীয় দুঃসংবাদটার জন্যে। দ্বিতীয় দুঃসংবাদ তিনি এখনো পান নি— তবে পাবেন। দুঃসংবাদ কখনো একা আসে না, সে সঙ্গে করে তার বড়ভাইকে নিয়ে আসে। প্রথম আসে ছোটভাই— ছােট দুঃসংবাদ। তারপর আসে বড়ভাই— বড় দুঃসংবাদ।

বড় দুঃসংবাদটা কী হতে পারে? কারো মৃত্যু-সংবাদ? সিদ্দিকুর রহমান সিগারেট ধরালেন। চাপা গলায় ডাকলেন, লোকমান!

ইজিচেয়ারের পেছন থেকে লোকমান জবাব দিল, জি। সে ইজিচেয়ারের পেছনে ঘাপটি মেরে বসে ছিল। তাকে দেখা যাচ্ছিল না। বাইরের কেউ উঠোনে পা দিলে তার কাছে মনে হবে, বিরাট উঠোনের মাঝখানে সিদ্দিকুর রহমান একা বসে আছেন।

লোকমান, আমার মেয়ে কই?

শহরবাড়িত গেছেন। ডাক দিয়া আনব?

না। মাসুদ যে পালায়ে গেছে কাউরে কিছু বলে গেছে?

জি বলেছে। মাস্টার সাবরে বলে গেছে।

সে যে পালায়ে যাবে মাস্টার সাব জানত?

জি।

মাস্টার সাব জানার পরেও আমাকে জানায় নাই কেন?

লোকমান জবাব দিল না। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, যাও মাস্টারকে খবর দিয়া আনো। তাকে বলবা তার সঙ্গে চা খাব।এইজন্যে ডেকেছি। কোনোরকম বেয়াদবি করবা না।

জি আচ্ছা।

সিদ্দিকুর রহমানের হাতের সিগারেট নিভে গেছে। তিনি নেভা সিগারেটই টান দিচ্ছেন। আজ মনে হয় পূর্ণিমা। চারদিকের জঙ্গল আলো হতে শুরু করেছে। যদি পূর্ণিমা হয় তাহলে প্রবল জোছনা হবে। আজ কুয়াশা নেই। মেঘশূন্য আকাশে পূর্ণিমা দেখার মতো জিনিস। তিনি বেলিফুলের গন্ধও পাচ্ছেন। বাগানে বেলিফুলের গাছে নিশ্চয়ই অসংখ্য ফুল ফুটেছে। পূর্ণিমায় সব বেলিগাছে ফুল ফোটে। যেসব বেলিগাছ পূর্ণিমাতেও ফুল ফোটাতে পারে না তারা বন্ধ্যা গাছ। এইসব গাছ তুলে ফেলতে হয়। সিদ্দিকুর রহমানের ইচ্ছা করছে মেয়েকে নিয়ে বেলিফুলের বাগানে যেতে। যেসব গাছে ফুল ফোটে নি সেসব গাছ টেনে তুলে ফেলতে। তবে আগে নিশ্চিত হতে হবে আজ পূর্ণিমা কি না। মাস্টার বলতে পারবে। চাঁদ–তারার হিসাব তার কাছে খুব ভালো আছে। সমস্যা হচ্ছে, এই সময়ে বেলিফুল ফুটে না। বেলি বর্ষার ফুল। তাহলে গন্ধটা আসছে কোথেকে? মনের ভুল?
 
আনিসকে দেখে সিদ্দিক সাহেব চমকে উঠলেন। চোখ টকটকে লাল। ফরসা গালও লালচে হয়ে আছে। ইটার ভঙ্গিও অন্যরকম। মাতালের মতো হেলেন্দুলে হাঁটা। হাঁটার মধ্যে তাকানোর মধ্যে কেমন যেন ডোন্ট কেয়ার ভাব। এমনিতে সে মাটির দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে কুঁজা হয়ে হাঁটে। কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তার আলাদা নাম আছে— কুঁজা মাস্টার।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আনিস, কেমন আছো?

আনিস বলল, আমি অইত্যান্ত ভালো আছি। আপনি চা খেতে ডেকেছেন, চা খাব না। আমার ধারণা। আপনি চা খেতেও ডাকেন নি। চা খাওয়াটা অজুহাত। আপনি আমাকে কিছু বলার জন্য ডেকেছেন।

সিদ্দিকুর রহমান বিস্মিত হলেন। মাস্টার এরকম ভঙ্গিতে কথা বলছে কেন? তিনি বিস্ময় প্রকাশ করলেন না। আধশোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসতে বসতে বললেন, কিছু বলার জন্য ডাকি নাই। একটা বিষয় জানার জন্যে ডেকেছি। আজ কি পূর্ণিমা?

জি, পূর্ণিমা। আশ্বিনা পূর্ণিমা। এই পূর্ণিমায় ভূত দেখা যায় আর আষাঢ়ি পূর্ণিমায় সাধু মানুষ দেখা যায়। আষাঢ়ি পূর্ণিমায় গৌতম বুদ্ধ গ্ররহত্যাগ করেছিলেন।

গৃহত্যাগ কেন করেছিলেন?

সংসার থেকে সেই রাতেই তার মন উঠে গিয়েছিল। মানুষ যখন হঠাৎ অসম্ভব সুন্দর কোনো জিনিস দেখে তখন বিচিত্র কারণে সবকিছু থেকে তার মন উঠে যায়।

আমি তো আমার দীর্ঘ জীবনে অনেক সুন্দর জিনিস দেখেছি। আমার তো মন উঠে নাই।

হয়তো উঠেছে, আপনি বুঝতে পারেন নাই। মানুষ অন্য মানুষের মন কিছুকিছু বুঝতে পারে, নিজের মন কিছুই বুঝতে পারে না।

তুমি কথা তো খুব গুছিয়ে বলো।

জি, আমি কথা গুছিয়ে বলতে পারি। এটা কোনো বড় ব্যাপার না। যে লোক ট্রেনে স্বপ্নে পাওয়া বড়ি বিক্রি করে সেও খুব গুছিয়ে কথা বলে।

বড় ব্যাপার কোনটা?

বড় ব্যাপার হলো যে কথা বলছে সে জানে কি-না কী বলা হচ্ছে।

তুমি জানো?

জি আমি জানি।

খুবই ভালো কথা। এখন আমাকে আরেকটা জিনিস বলো, আমার ছেলে যে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবে এটা তুমি জানতে। জানার পরেও আমাকে বিষয়টা জানাও নি। আমাকে জানালে আমি আমার ছেলেকে আটকাতে পারতাম। জানাও নি কেন?

আনিস বলল, বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার বুদ্ধি আমি তাকে দিয়েছিলাম। আমি বুদ্ধি দিয়েছি আবার আমি সেটা আপনাকে বলে দেব–তা তো ঠিক না। সাপ হয়ে দংশন করব, ওঝা হয়ে ঝাড়ব— তা তো হয় না।

সিদ্দিকুর রহমান অবাক হয়ে বললেন, পালিয়ে যাবার বুদ্ধি তুমি দিয়েছ?

জি।

কেন?

আপনি তার জন্যে খুবই লজ্জাজনক শাস্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। অপমানটা সে নিতে পারছিল না। আমাকে বলল। ইঁদুর-মারা বিষ খাবে। আমার কাছে মনে হলো, বিষ খাওয়ার ব্যাপারটা মাথা থেকে দূর করার জন্যে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার বুদ্ধি দেয়াই ভালো।

যে বলে ইঁদুর-মারা বিষ খাবে সে কোনোদিন খায় না। বলে কয়ে বিষ খাওয়া হয় না।

কেউ-কেউ আবার বলে-কয়ে খায়। একেকজন মানুষ একেক রকম। ভরাপূর্ণিমায় কেউ বাড়ি-ঘর ছেড়ে চলে যায়, আবার কেউ দরজা বন্ধ করে ঘুমায়।

মাসুদকে তুমি কবে ফিরে আসতে বলেছ?

আমি কিছু বলি নাই। তবে সে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে। সে গৃহী ধরনের ছেলে। বাড়ি ছেড়ে বেশি দিন বাইরে থাকতে পারবে না।

তুমি কি কোনো ফুলের গন্ধ পাচ্ছ?

জি-না। আমার নাক বন্ধ।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তোমার কি শরীর খারাপ?

আনিস বলল, সামান্য খারাপ। মনে হয় জ্বর এসেছে।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, যাও শুয়ে থাকো।

আনিস চলে যাচ্ছে। সিদ্দিকুর রহমান ভুরু কুঁচকে আনিসের দিকে তাকিয়ে আছেন। আনিস কী অদ্ভূত ভঙ্গিতে হেলেদুলে যাচ্ছে! মনে হচ্ছে পায়ের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে সে হুড়মুড়িয়ে পড়ে যাবে। লোকমান বলল, হুক্কা আইন্যা দেই? সিদ্দিকুর রহমান হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন, যদিও তার তামাক খেতে ইচ্ছা করছে না। নির্জন উঠানে বসে থাকতে ইচ্ছা করছে না, আবার উঠে যেতেও ইচ্ছা করছে না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top