What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected গর্ভধারিণী - সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

০৯.
চাপা গলায় কল্যাণ বলল, আর পারছি না, একটু উঠে বসব?

আনন্দ নাক দিয়ে যে শব্দটা করল তার অর্থ বুঝতে অসুবিধে হল না। প্রায় ঘণ্টাখানেক হয়ে গেছে ওরা দুজনে গাড়ির পেছনের সিটের পা রাখার জায়গায় হাঁটুমুড়ে বসে আছে। সামান্য নড়াচড়াও করতে পারছে না। এখন খুব মৃদু আওয়াজও জোরে শোনাবে। বসে থাকতে থাকতে দুই পা অসাড় হয়ে গেছে। কোমরে ব্যথা হচ্ছে। কল্যাণ সুদীপের কথা ভাবল? বেশ আরামে শুয়ে আছে। নিশ্চয়ই জয়িতার সঙ্গে! জয়িতার মুখটা মনে পড়তেই আবার তার অস্বস্তি হল। জয়িতা যে মেয়ে এমন ভাবার কখনও কারণ ঘটেনি। ওর শারীরিক গঠনের কথা মনেই আসত না কখনও। নিজের পরিচিত বৃত্তে এমন মেয়ে সে কখনও দ্যাখেনি। কিন্তু আজ শাড়ি পরার পর থেকেই জয়িতা যেন আচমকা পালটে গেল। হাবভাবে একটু জড়তা এসে গেছে। যখন গাড়ির সামনের সিটে বসেছিল সুদীপের পাশে তখন তো একদম অপিরিচিত বলে মনে হচ্ছিল। সুদীপের সঙ্গে, সম্ভবত এয়ারকন্ডিশন্ড ঘরে জয়িতা এখন কি করতে পারে? কুঁজো হয়ে বসে কল্যাণ দৃশ্যটা কিছুতেই কল্পনায় আনতে পারছিল না।

এইভাবে বসে থাকতে আনন্দরও কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু ভেতরে ঢোকার তত অন্য কোন উপায় ছিল না। সঙ্গে নারী না থাকলে প্রধান ফটক ওরা পেরোতেই দেবে না। এছাড়া গাড়ি অবশ্যই চাই। সুদীপ যে এই গাড়িটা সহজেই আনতে পেরেছে এটা সুলক্ষণ। ওরা এমন ভাবে বসে আছে, গাড়ির পাশ দিয়ে কেউ চলে গেলেও বুঝতে পারবে না কেউ আছে। তাছাড়া গাড়িটার কাচও ওদের সাহায্য করছে। বাইরে থেকে বোঝাও যাবে না। ওরা যদি সোজা হয়ে বসত তাহলে সামান্যই ঝুঁকি থাকত। অবশ্য সামনের কাঁচ দিয়ে যদি কেউ তাকায় তাহলেই বিপদ। কিন্তু না, কোনও ঝুঁকি নিতে চায়নি আনন্দ। কিন্তু সে বুঝতে পারছিল এইভাবে বেশিক্ষণ থাকাও যায় না। এর পরে যখন সময় আসবে তখন হয়তো অ্যাকশনে নামা দুরের কথা হাঁটাও সম্ভব হবে না। সুদীপ জয়িতা সামনের দরজায় চাবি দিয়ে নেমে গেছে। অনেকক্ষণ। এই সময়ে কোন সন্দেহজনক কিছু আশপাশে ঘটেনি। আনন্দ ফিসফিসিয়ে বলল, আমি উঠে বসছি, তুই পা ছড়িয়ে শুয়ে পড় এখানে।

ধীরে ধীরে সিটের ওপর উঠে বসতেই আনন্দ বুঝতে পারল আর দেরি করলে ভুল হয়ে যেত। কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত কোন সাড়া নেই। সে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে কিছুটা সময় নিল। তারপর একটু সুস্থ বোধ করলে সে ধীরে ধীরে জানলার নিচে চোখ রাখল। ভৌতিক ছবির মত দেখাচ্ছে সামনের রাস্তা, গাছপালা, এবং লনটাকে। ওপাশে মৃত মোষের মত পড়ে আছে গাড়ির সারি। আনন্দ সতর্ক চোখে দেখতে চেষ্টা করছিল। বাইরে আলো খুবই কম। কিন্তু তাতে দৃষ্টি ব্যাহত হচ্ছিল না। পাহারাদারদের খোঁজার চেষ্টা করল আনন্দ। কাউকেই চোখে পড়ছে না। সে নিজের শরীরটাকে গাড়ির দরজার গায়ে এমনভাবে লেপটে রেখেছিল যে একমাত্র বনেটের ওপর বসে মুখে টর্চ না ফেললে কেউ তাকে দেখতে পাবে না। এই সময় পায়ের তলায় সমস্ত শরীর যতটা সম্ভব ছড়িয়ে নিঃশ্বাস ফেলে কল্যাণ বলল, আঃ কি আরাম।

আনন্দ ঘড়ির দিকে তাকাল। এখনও অনেক দেরি আছে। তাড়াহুড়ো করে কোন লাভ নেই। শুধু দুটো জিনিস আগে থেকে পরিষ্কার রাখা দরকার। সদর দরজার তালাটা খুলে রাখতে হবে আর পাহারাদারদের কোনরকমে নিষ্ক্রিয় করে কাজ হাসিল করতে হবে। সে যে তথ্য পেয়েছিল তাতে যদি ভুল না থাকে তাহলে অসুবিধা হবার কথা নয়। এখন শুধু সঠিক সময়ের জন্যে অপেক্ষা করে থাকা। সুদীপটা ঠিক থাকলেই হল। জয়িতার ওপর গোড়া থেকেই ভাল আস্থা রাখে সে। শুধু এই কল্যাণটা ঠিক সময়ে নার্ভ না হারালেই হল।
 
আনন্দ একটা গাড়ির হর্ন শুনতে পেল। সঙ্গে দপদপ আলো জ্বলে উঠল লনে, রাস্তায়। তিনচারজন লোক ছুটোছুটি শুরু করে দিল, ওদেরই কেউ গেটের তালা খুলে দিল। আনন্দ চোখ রেখে দুটো তীব্র আলো দেখতে পেল। গাড়িটা সরাসরি এগিয়ে এসে ওদের সামনে থামতেই সে আরও নিচে নেমে এল। কল্যাণ ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করল, কি হল?

বাইরে থেকে কেউ এসেছে। পুলিস কিনা বুঝতে পারছি না।

পুলিস? কি করবি?

কিছু না। এখানেই বসে থাকব। আর কথা বলিস না। না পুলিস না, একটাই বুড়ো মতন লোক নামছে গাড়ি থেকে। দারোয়ানগুলো ওকে খুব সেলাম করছে।

যে লোকটি গাড়ি থেকে নামলেন তাকে দেখলেই বোঝা যায় তিনি ক্ষমতাবান। গম্ভীর মুখে কিছু বললেন দারোয়ানদের। ঝাঁপসা শুনতে পেল আনন্দ। তারপর ভেতরের দিকে পা বাড়ালেন ভদ্রলোক। আনন্দ এবার চিনতে পারল। প্যারাডাইস-এর মালিককে এই প্রজেক্ট শুরু করার সময় কয়েকবার দেখেছে সে দূর থেকে।

তিনি অদৃশ্য হওয়ামাত্র আলো নিবে গেল, সদরে তালা পড়ল। আনন্দ দেখল একটা দারোয়ান টুল পেতে বসে আছে পাতাবাহার গাছের পাশে। লোকটাকে এর আগে লক্ষ্য করেনি সে। বাকিরা ফিরে গেল বাঁ দিকে। তার মানে ওরা পালা করে পাহারা দেয়।

সময় হয়ে এলে আনন্দ কল্যাণকে ডাকল, শোন, আমি নামছি। তুই গাড়ির লকগুলো খুলে তৈরি থাক। গেট থেকে ফিরে আসা মাত্র তুই আমার সঙ্গে চলে আসবি ওগুলো নিয়ে।

ঠিক হ্যায়। কল্যাণ উঠে বসল। ওর গলার স্বর বেশ শক্ত এখন। কানে লাগল আনন্দর। সে মুখে কিছু না বলে লকটা খুলল। কট শব্দটা যেন রাত্রের নিস্তব্ধতায় বড় হয়ে বাজল। আর একটু অপেক্ষা করল আনন্দ। না, কেউ এদিকে মনোযোগ দিচ্ছে না। ওপাশে ডায়মন্ডহারবার রোড দিয়ে ভারী লরির কনভয় যাচ্ছে বোধ হয়। সুযোগটা হারাল না সে। টুক করে দরজা খুলে নিচে নেমে উবু হয়ে বসল। তার কাঁধে ঝোলানো সরু স্ট্র্যাপের ব্যাগে মালগুলো আছে। এবং এই প্রথম শরীরে একটা কাঁপুনি টের পেল আনন্দ।

পার্ক করা গাড়িগুলোর পেছন দিয়ে দ্রুত মাথা নিচু করে দৌড়ে এল সেখানে যেখানে পাতাবাহার গাছগুলো শুরু হয়েছে। লোকটা বসে আছে বাড়িটার দিকে মুখ করে। মাঝে মাঝে শিস দিচ্ছে। আনন্দ স্ট্র্যাপটা বের করল। তারপর শব্দহীন পায়ে পৌঁছে গেল লোকটার পেছনে। গলায় স্ট্র্যাপটা চেপে বসতেই লোকটা কো&ক করে একটা শব্দ তুলল। তারপর এলিয়ে পড়তেই ওর কাঁধ ধরে ফেলল। এত সহজে লোকটা অজ্ঞান হয়ে যাবে ভাবতে পারেনি সে। অবশ্য মরে গেছে কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না। লোকটার মাথা গাছের গায়ে এমনভাবে ঠেকিয়ে রাখল সে যাতে দূর থেকে মনে হয় ও বসে আছে। সদর দরজার চাবি ওর পকেট থেকে বের করতে সময় লাগল না। আনন্দ মুখ ফিরিয়ে দেখল? কোথাও কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি।

সদরের তালা খুলে নিঃশব্দে আনন্দ ফিরে এল গাড়ির কাছে। পাল্লা যেমন ছিল তেমনই রেখে দিল সে। যদি কারও নজর যায় কিছুই টের পাবে না। ঘড়ি দেখল আনন্দ। এখনও পাঁচ মিনিট বাকি আছে। এইসময় কল্যাণ তার পাশে এসে দাঁড়াল, সাবাস!

আনন্দ কিছু বলল না। কয়েকদিন আগে তার একবার মনে হয়েছিল ব্যাপারটা তাদের পক্ষে বেশ ভারী হয়ে যাচ্ছে। এসব ব্যাপারে তো নেহাতই আনাড়ি, ট্রেনিং ছাড়া করতে যাওয়া বোকামি। ধরা পড়লে কোন কাজই হবে না। লোকে জানতেই পারবে না তারা ঠিক কি করতে চেয়েছিল। হয়তো সামান্য ডাকাতির চেহারা দেওয়া হবে ব্যাপারটাকে। তাছাড়া একটা বিক্ষিপ্ত ঘটনাকে কেউ গুরুত্ব দেয় না। একাধিক এই রকম ঘটনা যদি বারংবার ঘটে যায় তাহলেই সেটা একটা স্পষ্ট চেহারা নেবে। কিন্তু প্রতিদিন খুঁটিনাটি আলোচনা করে করে শেষ পর্যন্ত মনে হয়েছিল এটা পারা সম্ভব। এখন কাজে নেমে মনে হচ্ছে অভিজ্ঞতাটা উপরিভ, ইচ্ছা এবং পরিশ্রমই সার্থক হতে সাহায্য করে। এবং এই সময়ই টুপ করে আলো নিবে গেল। এবং তখনই একটা আর্ত চিৎকার ভেসে এল ভেতর থেকে।
 
দড়াম করে গেটের পাল্লা দুটো দুদিকে ছিটকে গেল এবং রাগী সিংহের মত গর্জন করে গাড়িটা দারুণ ঝাকুনি সামলে উঠে এল রাস্তায়। আনন্দ চিল্কার করে উঠল, সামলে চালা। সুদীপ এমন কিছু উচ্চারণ করল যার অর্থ বোঝা গেল না কিন্তু তাতে অবস্থার হেরফের হল না। পেছনে তখন চিৎকার অনেক কষ্ঠে ছড়িয়ে পড়েছে। প্যারাডাইসের একাংশে দাউ দাউ আগুন জ্বলছে। শেষ বোমাটা ছুঁড়ল কল্যাণ। তীব্র শব্দে সেটা বিস্ফোরিত হল প্যারাডাইসের গেটের বাইরে মুখ বাড়ানো গাড়ির ওপরে। আর সঙ্গে সঙ্গে সেটা ধাক্কা খেল রাস্তার পাশের গাছে, তারপর পাক খেয়ে উলটে পড়ল ঠিক গেটের মাঝখানে। এবং তার শরীর থেকে দপ করে একটা আগুন লাফিয়ে উঠল আকাশে। ফলে প্যারাডাইস থেকে বাইরে বেরোবার পথ বন্ধ করে দিল জ্বলন্ত গাড়িটা। ভেতরের উদ্যানে তখন নারী-পুরুষের চিৎকার এবং কান্না সমান তালে চলছে। যেসব নারীপুরুষ পাগলের মত ছুটোছুটি করছিল তাদের অনেকের শরীরের লজ্জাবস্তু শেষ মুহূর্তে টেনে-নেওয়া। মজার কথা হল, আগুন নেবানোর কোন চেষ্টা হচ্ছে না। আতঙ্ক যেন তার থাবায় সবাইকে অবশ করে দিয়েছে। এর মধ্যেই পাহারাদাররা জানতে পেরেছে বড় সাহেব নেই। সরাসরি গুলি লেগেছে তার বুকে। জ্বলন্ত ককটেল কুটিরের পাশে, তার মৃতদেহ ঘিরে ছোট্ট ভিড়। ভিড় সেই পাহারাদারের পাশে বোমায় যার মাথা উড়ে গেছে। মধ্যরাত্রের এই চিৎকার এবং আগুন দেখে আশেপাশের গ্রামের মানুষজন ছুটে এসে দাঁড়িয়েছে তফাতে। এই বিশাল দুর্গের মত ঘেরা স্বর্গোদ্যানে ঢোকার অনুমতি তারা কখনই পায়নি। চিরকাল কিছুটা বিস্ময় কিছুটা ঈর্ষায় তারা এইদিকে তাকিয়ে এসেছে। এখন অবশ্য দ্বিতীয়টি নেই কিন্তু বিস্ময় বাড়ছিল এরকম অঘটন কিভাবে ঘটল তাই ভেবে।

কলকাতার দিকে ঝড়ের মত ছুটে যাওয়া গাড়িটার গতি এক সময় স্বাভাবিক হয়ে এল। জয়িতার দুটো হাত জ্বলছিল তবু সে সুদীপকে বলল, তুই সরে আয়, আমি চালাচ্ছি।

ফোট্‌। এখন আমি স্টিয়ারিং ছাড়ব না।

জয়িতা মুখ ফিরিয়ে আনন্দকে বলল, ওর মাথা থেকে এখনও রক্ত বের হচ্ছে।

আনন্দ কিছু বলল না। ও বুঝতে পেরেছে এখন সুদীপকে কিছু বলে লাভ হবে না। এই জেদুটুকুই ওর অহঙ্কার। এবং বুঝতে পারে না সেটাই ওর ত্রুটি। যতক্ষণ শক্তি থাকবে চালাক, খামোকা তিক্ততা এনে কি লাভ! সে পিছন ফিরে তাকাল। সমস্ত চরাচর নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে ঢেকে গেছে। এখন প্যারাডাইস অনেক পেছনে। সে লক্ষ্য করল কল্যাণ তখন থেকেই ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে আছে। এরকম একটা গাড়ির জানলা দিয়ে বোমা ছুঁড়ে ঘায়েল করা সোজা কথা নয়। কল্যাণ সেটা পারল বলেই তাদের পেছনে এখনও কোন গাড়ি নেই। সে কল্যাণের কাঁধে হাত রেখে বলল সাবা!

মুখ না ফিরিয়ে কল্যাণ বলল, কি জন্যে?

সবকিছুর জন্যেই। আনন্দ হাসল।

তোকে কে সাবাস বলবে?

তোরা, যদি সাবাস পাবার মত কিছু করে থাকি। বি ইজি, আমাদের পেছনে আর কেউ নেই। উই আর সেফ। শুধু জয়িতা তুই চটপট শাড়িটা খুলে শার্টপ্যান্ট পরে ফ্যাল। যদি সামনের পুলিশ স্টেশন গাড়ি আটকায় তাহলে তোর শরীরে ওরা যেন শাড়ি না দ্যাখে। আনন্দ বলতে বলতে দেখল সামনের দিকে দুটো হেডলাইট এগিয়ে আসছে। সেদিকে তাকিয়ে সুদীপ বলল, ভ্যান!

হাইওয়ে পেট্রল দিচ্ছে বোধ হয়। ওরা যদি থামায় আমরা মাথা নামিয়ে নেব। তোদের যদি উলটোপালটা বলে, চার্জ করব, তুই ইঞ্জিন চালু রাখ। আনন্দ কল্যাণকে ইশারা করতেই সে মাথা নামাল। গাড়িটা পুলিশের। হেডলাইট নেবাচ্ছে না। বোধ হয় ইচ্ছে করেই। সুদীপ একটা গালাগালি দিয়ে গাড়িটা দাঁড় করাল। জয়িতা কাপড়টাকে টানল। কটেজেই সে ভেবেছিল জিনস পরে নেবে। কিন্তু ককটেল কুটিরে যাওয়ার পর সেই সুযোগ পাওয়া যায়নি। না পেয়ে ভালই হয়েছে বলে মনে হল এখন। পুলিসের গাড়িটা একটু থামল। কেউ একজন মুখ বাড়িয়ে কিছু দেখল। তারপর আবার গতি নিয়ে বেরিয়ে গেল। গাড়ি চালু করে সুদীপ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে পাশে ফেলে বলল, ধরিয়ে দে।

আনন্দ বলল, আমি দিচ্ছি, তুই শাড়ি ছাড় জয়িতা।

আমি এই গাড়ির মধ্যেই ছাড়ব নাকি?

ন্যাকা! সুদীপ বলল, আমি তোমার জন্যে গাড়ি থামাতে পারব না।

আনন্দ বলল, আমি তোর ব্যাপারটা বুঝতে পারছি জয়িতা, কিন্তু আমরা যদি এক মিনিট দেরি করি তাহলে এসট্রা ট্রাবল ইনভাইট করব। সিগারেট ধরিয়ে সুদীপের মুখে গুঁজে দিয়ে সে পেছনের সিটে শরীর এলিয়ে দিল।

একটু কাঁপন এল শরীরে। মেয়ে বলে তার কোন রক্ষণশীলবোধ নেই। কিন্তু তাই বলে চলন্ত গাড়ির সিটে বসে শাড়ি ছাড়ার কথা সে এই মুহূর্তে ভাবতে পারছে না। ব্লাউজটা না খুললেও অবশ্য চলে, ওর ওপর শার্ট গলিয়ে নিলে বোঝা যাবে না। কিন্তু সায়া? প্রচণ্ড রাগ হল নিজের ওপরে। তার মুখে যে রক্ত জমছে সেটা বুঝেই সে সোজা হয়ে বসল। তারপর কোমরে হাত দিয়ে শাড়ির গিট খুলে খানিকটা উঠে শাড়িটাকে পেঁয়াজের খোসার মত ছাড়িয়ে নিল শরীর থেকে। চোখের কোণায় সে পাশে বসা সুদীপের দিকে তাকাল। সুদীপের নজর সামনের দিকে। একটু স্বস্তি বোধ করল সে। সুদীপ একবারও মুখ ফেরায়নি। পেছনের দুজনের কোন প্রতিক্রিয়া নেই। সায়ার নিচে প্যান্টি পরা থাকায় আরও স্বচ্ছন্দ হয়ে গেল জয়িতা। সায়া শাড়ি মুক্ত হয়ে শার্টটা গলিয়ে নিল ওপরে। ব্লাউজটা না থাকলে আরও সহজ হতে পারত সে। জিপার টেনে বোম আটকে সে চটপটে হাতে শাড়ি ভাজ করে সায়া দিয়ে মুড়ে ব্যাগে চালান করে দিয়ে স্থির হয়ে বসল। এবং তখনই তার মনে অদ্ভুত নিশ্চিন্তিবোধ এল। জীবনের যে কোন সময়েই সে এই তিন বন্ধুর কাছে শুধু বন্ধু হিসেবেই গ্রহণীয় হবে, নারী বলে আলাদা কোন ব্যবহারের জন্যে তাকে কখনও আতঙ্কিত থাকতে হবে না। চোখ বন্ধ করল জয়িতা। আর সঙ্গে সঙ্গে তার শরীর ঘিনঘিনিয়ে উঠল।
 
ককটেল কুটিরে ঢোকার পরই বাজনা কানে এসেছিল। ঘরটা বিশাল। একপাশে বার কাউন্টার। এমন চমৎকার আলো-আঁধারি যে দৃষ্টি ব্যাহত হয় না, আবার কোন কিছুই কটকটে নয়। প্রায় কুড়ি বাইশজন নরনারী আলিঙ্গনবদ্ধ অবস্থায়। মদ্যপান এবং চুম্বন করে যাচ্ছে সানন্দে। এই দুটো একসঙ্গে যে সম্ভব হয় তা না দেখলে কল্পনা করতে পারত না। তাদের দেখে একটি সুন্দরী হোস্টেস এগিয়ে এসে বলল, ওয়েলকাম। সুদীপ মাথা নেড়ে সেটা গ্রহণ করতেই মেয়েটি দুটো হাত ছড়িয়ে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করল, আজকে তোমাদের জন্যে অনেক মজা অপেক্ষা করছে। তার আগে বল কি ড্রিঙ্ক তোমরা নেবে?

সুদীপ তাকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে জানাল নিজেদের দেখাশোনা তারা নিজেরাই করে নেবে, সুন্দরী স্বচ্ছন্দে অন্য গ্রাহকদের প্রতি মনোযোগ দিতে পারে। মুক্ত হয়ে সুদীপ বলল, আমাদের হাতে গ্লাস রাখা দরকার জয়, চল ওখানে যাই।

তুই ড্রিঙ্ক করবি?

আবার শালা তুই আমাকে তুই বলছিস?

তুই কি বলছিস?

সুদীপ একটা ব্রান্ডি আর সফট ড্রিঙ্ক দুজনের জন্যে নিয়ে বলল, পেয়ারগুলোকে দ্যাখ। তোর আমার বয়সী কেউ নেই।

জয়িতা গ্লাসটাকে হাতে নিয়েছিল। অন্তত চার ডাবল দাম নিয়েছে এরা। ওর দৃষ্টি এবার সামনের দিকে ছড়াল। পুরুষদের কারও বয়স চল্লিশের নিচে নয়। তাদের সঙ্গিনীরা বেশির ভাগই পঁচিশ ছোঁয়া। একজন টেকোমাথা বুড়ো উনিশ-কুড়ি বছরের সঙ্গিনীর গালে এমনভাবে কামড়ে দিলেন যে বেচারা উঃ করে চেঁচিয়ে উঠল। মহিলাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বিপরীত। বোঝাই যাচ্ছে তারা তাদের সঙ্গীদের নিয়ে এসেছেন। এবং তাদের বেশিরভাগই অল্পবয়স্ক। সেদিকে তাকিয়ে সুদীপ মন্তব্য করল, এই বুড়িগুলোই শয়তানের বউ। জয়িতার নজর তখন দুটো জোড়ার ওপর পড়েছে। একজন বয়স্কা এবং স্বল্পবসনা যাকে জড়িয়ে আদর করছেন বাজনার তালে সে পুরুষ নয়। মিনি স্কার্ট পবা মেয়েটিকে তার চেনা চেনা লাগছিল। অথচ কিছুতেই সে ঠাওর করতে পারছিল না। তখন থেকেই শরীরে ঘিনঘিনে ভাবটা চলে এল। মেয়েটি যেন খুব মজা পেয়েছে এমন গদগদ ভাব। আলিঙ্গনের সময় ওর শরীরে মহিলার হাত সাপের মত ঘুরছে এবং মেয়েটি আরও ব্যবধান কমাচ্ছে। জয়িতা বলল, আমি কটেজে ফিরে যাচ্ছি।

সুদীপ বলল, দাঁড়া। এই মানুষগুলো কলকাতা থেকে চুরি করে এসেছে।

জয়িতা বলল, চেনাস না আমাকে। সাম অফ দেম আর নোন টু মি!

চিনিস?

আমার বাবা মায়ের মত দেখতে। নির্বিকার মুখে বলল জয়িতা।

ওকে। সুদীপ হাসল, তবু আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর। এগিয়ে আয়। জয়িতার কাঁধে হাত রেখে ও এগিয়ে গেল ভিড় কাটিয়ে। জয়িতা ইঙ্গিতে দাঁড়াতে বলল তাকে। একটা সোফায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছেন সুন্দর পোশাক পরে যে দুজন তাঁদের বয়স সত্তর পেরিয়েছে অনেকদিন। বৃদ্ধর শরীরের চামড়ায় অনেক ভাঁজ। বৃদ্ধার মুখে ভাল রঙ। মুগ্ধ দৃষ্টিতে দুজনে যৌবন দেখছেন এমন ভঙ্গি। সুদীপ বলল, হা-ই। বৃদ্ধ মুচকি হাসলেন, বৃদ্ধা জবাব দিলেন, হা-ই।

তোমাদের কেমন লাগছে?

চমৎকার। আমরা তো উপভোগ করতে সপ্তাহে একদিন এখানে আসি।

উপভোগ করতে? জয়িতা প্রশ্ন না করে পারল না।

সেই সময় লোকটি ঢুকল। লম্বা, সুগঠিত শরীর, হাঁটার মধ্যেই বুঝিয়ে দিলেন কর্তৃত্ব ওঁর করায়ত্ত। চট করে একটা আলোর বৃত্ত তাকে ধরে নিল। দুটো হাত ওপরে তুলে তিনি হাতছানি দিলেন। গুঞ্জন কমে গেল, লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন। আশা করছি আপনারা আমার প্যারাডাইসে চমৎকার আছেন। এখন হল সেই সময় যখন আপনারা যা খুশী করতে পারেন। কোন সঙ্কোচ নয়, লজ্জা ত্যাগ করুন। আমাদের প্রত্যেকের মনে যে গোপন ইচ্ছা আছে সেটা ব্যক্ত করার সময় এখন। লেটস এনজয়!

দুম করে আলো নিবে গেল। বাজনা বেড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। তারপর গাঢ় নীল আলো জ্বলে উঠল হলে। জয়িতার মনে হল নীলের স্রোত বইছে যেন ঘরে। নিজেদের চেহারাই ভৌতিক হয়ে গেল আচমকা। মাঝখানে দাঁড়িয়ে লোকটি পোশাক খুলছেন। তার পাশে বিকিনি পরা দুটি মেয়ে। সযত্নে সেই পোশাকগুলো তারা সরিয়ে রাখছে। জয়িতা বিস্মিত হয়ে দেখল লোকটি সম্পূর্ণ নিরাবরণ হয়ে গেলেন। একটুও সঙ্কোচ নেই তার ভঙ্গিতে। এবার ওপাশের দেওয়ালে হেলিয়ে রাখা একটি মসৃণ তক্তা টেনে আনা হল। তক্তাটির নিচে গোটানোপায়া ছিল। সেটি সাজিয়ে দেওয়ার পর লোকটি উপুড় হয়ে তার ওপরে শুয়ে পড়লেন। দমবন্ধ করে দেখছিল জয়িতা। ককটেল রুমের অধিকাংশ মানুষ লোকটিকে কেন্দ্র করে বৃত্ত রচনা করেছে। সেই বৃদ্ধদম্পতি সবার আগে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে। লোকটি এবার মুখে শব্দ করলেন। তার মুখ অবশ্য এখন তক্তার ওপর চেপে রাখা, শব্দটা তাই বিকৃত শোনাল। সহকারিণীর একজন তখন দেওয়ালের কাছে ফিরে গেল। তারপরই বাতাসে সাঁ শব্দটাকে সাপের নিঃশ্বাসের মত সোচ্চার করে দুইঞ্চি নরম চামড়ার চাবুকটা আছড়ে পড়ল লোকটির নিতম্বে। কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া হল না তাঁর শরীরে। জয়িতা লক্ষ্য করল লোকটার সমস্ত পিঠে, নিতম্বে, হাঁটুর নিচে অজস্র সরু সরু দাগ। নিয়মিত ব্যবধানে চাবুক পড়ছে লোকটির শরীরে। সুদীপ বলল নিচু গলায়, দর্শকদের দ্যাখ।
 
বৃদ্ধের গাল বেয়ে লালা পড়ছে। চোখ বিস্ফারিত। বৃদ্ধা তাকে মুঠোয় শক্ত করে ধরে আছেন। দর্শকদের অনেকের চোখই জ্বলছে। এই সময় সহকারিণী আঘাত বন্ধ করল। লোকটির পেছনদিকটা এতক্ষণে রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন লোকটি। তারপর দেওয়ালের পাশে দাঁড় করানো লম্বা টুলের ওপর উঠে ইঙ্গিত করলেন সহকারিণীকে। সে চটপট ওপর থেকে ঝুলিয়ে রাখা চামড়ার স্ট্র্যাপ লোকটির মনিবন্ধে আটকে দিল। দুহাত মাথার ওপরে রেখে নগ্ন লোকটিকে দেখিয়ে সহকারিণী চিৎকার করলেন, এগিয়ে আসুন, আপনাদের মধ্যে কে প্রথম সেই সৌভাগ্যের অধিকারী হবেন যার চাবুকের আঘাতে এঁর শরীরে ঝড় উঠবে, সমুদ্র মস্থিত হবে!

সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। তিনজন সুন্দরী মধ্যবয়সিনী একই সঙ্গে এগিয়ে এলেন সামনে। প্রত্যেকেই হাত বাড়িয়ে চাবুক চাইছেন। একটা হিলহিলে নোংরা স্রোত টেনে আনল সেই চাওয়ার শব্দগুলো। সুদীপ বলল, মাথা ধরার নাম করে তুই কটেজে ফিরে যা। আমি আসছি।

জয়িতা ঘাড় বেঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, তুই কি করবি?

ফিউজ বক্সের কাছে কেউ নেই। আগে আগুন জ্বালাব তারপর লোকটাকে গুলি করে মারব। এ ব্যাটাই প্যারাডাইসের মালিক। দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করল সুদীপ।

না, আমি গুলি করব। নিঃশ্বাস বন্ধ করল জয়িতা।

যা বলছি তাই কর। কটেজের দরজায় মালগুলো রেডি করে দাঁড়িয়ে থাকবি। চাবি নে।

জয়িতা সুদীপের দিকে তাকাল। ততক্ষণে সেই মহিলা চাবুক মারার সৌভাগ্য পেয়েছেন যিনি সঙ্গিনীকে নিয়ে প্যারাডাইসে লীলা করতে এসেছেন। এই মুহূর্তে তাকে উন্মাদিনীর মত দেখাচ্ছিল। চাবি নিয়ে দ্রুতপায়ে জয়িতা ককটেল কটেজের বাইরে আসতেই সেই লোকটি এগিয়ে এল, এনি প্রব্লেম ম্যাডাম?

বমি পাচ্ছে, শরীর খারাপ লাগছে। সত্যি কথাটা বলল জয়িতা।

ও কিছু নয়, প্রথম প্রথম এরকম হয়। শরীর সুস্থ করে আবার ফিরে আসুন। এখনও অনেক আইটেম বাকি আছে। লোকটি দাঁত বের করে হাসতেই জয়িতা পা বাড়াল। নিজেদের কটেজের কাছে এসে সত্যি তার বমি হয়ে গেল। ঈষৎ ঝুঁকে সে শব্দ করে কিছুটা অস্বস্তি বের করে দিতেই একজন পাহারাদার সামনে এসে দাঁড়াল, কি হয়েছে ম্যাডাম?

শরীর খারাপ। ককটেল কুটির থেকে আসছি। বমি পাচ্ছে।

হায়! কি অবস্থা! কেন যে ওখানে যান, আপনাদের মত ভাল মেয়েদের জায়গা ওটা নয়। লোকটা অত্যন্ত সমবেদনা মাখানো স্বরে কথাগুলো বলতেই জয়িতা মুখ তুলে তাকাল। বছর পঞ্চাশেকের মত বয়স, মুখে একটা নরম ভঙ্গি আছে। সে কোনরকমে বলল, আমাকে বমি বন্ধ হওয়ার ওষুধ এনে দেবেন?

ওষুধ? দেখি। কোন্ কটেজে উঠেছেন?

আঙুল দিয়ে কটেজটা দেখিয়ে দিয়ে জয়িতা চলে এসেছিল। ঘরে গিয়ে মুখে চোখে জল দিয়ে শরীর স্থির করতে সময় লেগেছিল বড়জোর পাঁচ মিনিট। সে সুদীপের প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে উঠল। ভেতরে ভেতরে যে তার শরীর এমন বিকল হয়ে পড়েছিল তা নিজেই টের পায়নি, সুদীপ যদি জোর করে না পাঠিয়ে দিত তাহলে ওখানেই হয়তো বমি হয়ে যেত। সে যখন শাড়ি ছেড়ে জিনস পরবে বলে ভাবছে সেই সময় গুলির শব্দটা কানে এসেছিল। তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগোতেই সুদীপের দেখা পেয়েছিল। দৌড়ে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে সুদীপ বলেছিল, জেনারেটারটাকে চার্জ কর। তিন মিনিট সময় দিচ্ছি। তারপর ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেল আবার। জয়িতা নিজের ব্যাগটা তুলে বাইরে এসে দাঁড়াতেই আগুন দেখতে পেল। এবং সেইসঙ্গে পাগলের মত চিৎকার করতে করতে মাঠময় ছুটোছুটি করছে মত্ত-অর্ধমত্ত নরনারী। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়েছিল সে, সঙ্গে সঙ্গে একটা কটেজে আগুন জ্বলতে দেখল। পাহারাদাররা যে যেখানে ছিল ছুটে আসছে ককটেল কটেজের দিকে। এই সময় একটি নারীকণ্ঠে চিৎকার উঠল, সাহেব মর গিয়া। জয়িতা আর দাঁড়াল না। বাগানের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে সোজা চলে এল জেনারেটর রুমের দিকে। যে লোকটা পাহারায় ছিল সে হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে দূরের আগুন দেখছে। জয়িতা চিৎকার করে বলল, আপনাকে ডাকছে ওদিকে।

আমাকে? বলেই লোকটা দৌড়াতে শুরু করল। বোধ হয় এতক্ষণের কৌতূহল এবার মেটাতে পেরে সে খুশী হল। যেভাবে তাকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেইভাবেই বস্তুটিকে ছুঁড়ল জয়িতা খোলা দরজা দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ, আগুনের হলকা এবং সমস্ত এলাকাটি নিশ্চিদ্র অন্ধকারে ছেয়ে গেল। শুধু দূরের তিনটে কটেজে আগুন জ্বলছে। তারই লাল আলোয় চারধার ভৌতিক বলে মনে হচ্ছে। এই সময় সামনের দিকে বিস্ফোরণের আওয়াজ এবং কান্না মেশানো চিৎকাব ভেসে এল। ক্রমশ ডানদিকের ব্লকেও আগুন জ্বলে উঠল। জয়িতা দৌড়ে খানিকটা এগোতেই সুদীপের চিৎকার শুনতে পেল, লেট মি গো ব্যাক। সরে যাও সামনে থেকে। যে বাধা দেবে তার জান খতম করে দেব। এই গলা কখনও শোনেনি জয়িতা।
 
এখন সেই সুদীপ ঠোঁট টিপে স্টিয়ারিং ধরে আছে। সে ছাড়া আর কেউ আহত হয়নি। ব্যাপারটা এত সুষ্ঠুভাবে শেষ হবে তা কল্পনাতেও ছিল না। এখন কেউ কথা বলছে না। মধ্যরাত পেরিয়ে গেলেও ওরা কোনরকম ক্লান্তি বোধ করছিল না। হঠাৎ কল্যাণ বলল, বড্ড খিদে পাচ্ছে?

জয়িতা অবাক হয়ে তাকাল। এইসময় কারও খিদে পায়?

আনন্দ বলল, বাড়িতে গিয়ে খাবি।

বাড়িতে গিয়ে। আমরা কি বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি? সেরকম তো কথা ছিল না। কল্যাণের গলায় আপত্তি স্পষ্ট। আনন্দ একটু সময় নিল, তারপর বলল, যতদূর মনে হয় আমাদের কেউ দ্যাখেনি। আর কেউ যদি দ্যাখেও পরে মনে করতে পারবে না। আমরা কোন লিফলেট ফেলে আসিনি। অতএব ব্যাপারটা পুলিসকে ধাঁধায় ফেলবে। নিছক ডাকাতি নয় কারণ আমরা কিছু নিয়ে যাচ্ছি না আবার কোন পলিটিক্যাল চেহারা দেওয়াও মুশকিল। এখন আমরা যদি বাড়িতে ফিরে না যাই তাহলে খোঁজখবর হবেই। আমার হোস্টেল থেকে কিংবা তোদের বাড়ি থেকে পুলিশে খবর দিলে পুলিশ হয়তো একটা কু খুঁজে পেতে পারে। আমরা ওদের সাহায্য করব কেন? খুব ভেবেচিন্তে শান্ত গলায় কথাগুলো বলল আনন্দ।

কিন্তু আমরা ঠিক করেছিলাম বাড়িতে ফিরব না। সুদীপের আত্মীয়ার বাড়ি তো সেই কারণেই দেখে এসেছিলি। কল্যাণের প্রস্তাবটা মেনে নিতে ইচ্ছে করছিল না।

যদি আমাদের কেউ মারাত্মক আহত হত, কেউ ধরা পড়ে যেত কিংবা কাউকে ওরা চিনে ফেলত তাহলে সেই ব্যবস্থাই করতে হত। খামোখা মানুষের মনে সন্দেহ এনে কি লাভ?

সুদীপ এতক্ষণে কথা বলল, তোর বাড়িতে ফিরতে এত আপত্তি কেন?

কল্যাণ নাক দিয়ে শব্দ করল, আমার আর ওখানে থাকতে ইচ্ছে করে না।

সুদীপ বলল, আমারও করে না। কিন্তু হঠকারিতা করে কোন লাভ নেই। তিনটে লাশ পড়েছে আজ।

তিনটে? জয়িতা চমকে উঠল।

সুদীপ স্টিয়ারিং ধরে মাথা দোলাল, আই অ্যাম হ্যাপি। প্যারাডাইসের লোকটাকে গুলি করেছিলাম। ঠিক সেই সময় ওই লেসবিয়ান মহিলা লোকটির নিতম্বে চুমু খাবে তা কে জানত! ফলে দ্বিতীয়বার গুলি করতে হল। বাইরে বেরিয়ে আসার পর আগুন জ্বালার পর রিসেপশনিস্ট লোকটা সামনাসামনি পড়ে গেল। গুলি করতাম না কিন্তু লোকটা চিৎকার করে উঠল, আপনি! অর্থাৎ ও আমাকে চিনতে পেরেছিল। ঢোকার সময় ও আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলেছে, জয়িতাকে লক্ষ্য করেছে। অতএব পুলিস ওর কাছ থেকে ডিটেলস পেয়ে যেত।

আনন্দ বলল, গুড। অতএব আমাদের এমন কিছু করা উচিত নয় যা বিপদ ডেকে আনতে পারে। এখন কদিন খুব নর্মাল ব্যবহার করব। অ্যাডজাস্ট করতে শেখ কল্যাণ।

সারাজীবন তো অ্যাডজাস্ট করে আসছি।

সারাজীবন? খুক করে হাসল জয়িতা। তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে সুদীপের দিকে তাকিয়ে বলল, গুলি করার সময় তোর কিরকম মনে হয়েছিল?

আনন্দ হচ্ছিল। আই অ্যাম ড়ুয়িং রাইট জব। যদি এইভাবে বাংলাদেশের নোংরা অসৎ মানুষগুলোকে গুলি করে মারতে পারতাম, আঃ, সেদিন কি আসবে! সুদীপ বলল।

আনন্দ কল্যাণের কাঁধে হাত রাখল, গুলি করতে হলে ঘরে বাইরে করতে হয়। এই পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য করতে হলে জঞ্জাল সরাতে হবেই। কোন আপোস চলবে না। কল্যাণ, তুই ইচ্ছে করলে কয়েকদিন আমার হোস্টেলেই থাকতে পারিস।

কল্যাণ মাথা নাড়ল, না, ভোরবেলায় বাড়িতে ফিরে যাব।

ওরা বেহালা চৌরাস্তা ছাড়িয়ে খানিকটা দূর আসতেই আনন্দ বলল, হাওড়া স্টেশনে চল্‌।

স্টেশনের বাইরে কার পার্কে গাড়ি রেখে খুঁটিয়ে দেখে নিল আনন্দ। সুদীপের রক্ত অনেকক্ষণ বন্ধ হয়ে গেছে। গাড়ি লক করে সুদীপ বলল, চাবিটা গঙ্গায় ফেলে দেব। তখন ভোর হয়ে আসছে। সাত সকালের ট্রেন ধরতে ট্যাকসি ঢুকছে স্টেশনে। আগামীকাল বিকেলে কোথায় দেখা হবে স্থির করে কল্যাণ আর আনন্দ উত্তরের সবে চালু হওয়া ট্রাম ধরল। সুদীপ আর জয়িতা দক্ষিণের প্রথম দোতলা বাসের সামনের আসনে উঠে বসতেই পাতলা আঁধারে মিশতে শুরু করা আলোয় মাখামাখি গঙ্গা দেখতে পেল। সেদিকে তাকিয়ে সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, বাড়ি গিয়ে বাইরে রাত কাটানোর কি কৈফিয়ৎ দিবি?

জয়িতা চুপ করে ভোরের কলকাতা দেখছিল। প্রশ্ন শুনে মাথা নেড়ে বলল, কৈফিয়ৎ নেবার জন্যে কেউ এখন জেগে নেই।
 
১০.
ভোরবেলায় কলকাতার রাস্তা বড় মোলায়েম, একটু আঁধার লেগে থাকলে আদুরে বেড়ালের মত মনে হয়। সারাদিন শহরটাকে যারা নরক করে রাখে তারা ঘরে ঘরে ঘুমিয়ে। কিছু শান্ত মানুষ গঙ্গাস্নানের জন্যে পথ হাঁটছেন। কিছু ভ্রমণবিলাসী অক্সিজেন নিচ্ছেন প্রাণভরে। জয়িতার মনে হচ্ছিল চৌবাচ্চায় জল জমার মত সারারাত যে অক্সিজেনটুকু কলকাতাকে দিয়ে থাকে তা পাওয়া যায় এই সময়টুকুতেই। যারা পথে বের হতে পারে এখন তারাই ভাগ্যবান।



সে সুদীপের দিকে তাকাল। ঠোঁট কামড়ে সুদীপ বসে আছে চোখ বন্ধ করে। ওর মাথার ক্ষতটা এখনও লালচে হয়ে আছে। এ নিয়ে কিছু বলতে যাওয়া বোকামি। সুদীপ জানে কি করে নিজের যত্ন করতে হয়। ঠিক কখন লাগল সেটাও বলতে চায়নি। জয়িতা এবার বাড়ির কথা ভাবল। কাল দুপুর থেকে অদ্ভুত একটা টেনশনের মধ্যে কেটে গেল সময়টা। এমন কি একটা গোটা রাত না ঘুমোনো সত্ত্বেও অস্বস্তি হচ্ছে না। যেন অনন্তকাল সে জেগে থাকতে পারে। একটা গোটা রাত না বলে বাড়ির বাইরে কাটাল সে এই প্রথম। বেরুবার সময় জানা ছিল আর ফেরা হবে না। কিন্তু আনন্দর কথায় যুক্তি ছিল। সমস্যা হল বাড়ি ফিরে সীতা রায়কে কি জবাবদিহি দেবে সে? মুখের ওপর ঘেন্না করে বলার পর থেকেই তো বাক্যালাপ প্রায় বন্ধ। আজ নিশ্চয়ই বদলা নেবে ওরা। জয়িতা কপালে হাত বোলাতেই টের পেল। গত রাত্রে মাসীমা টিপটা লাগিয়ে দিয়েছিলেন, এত ঝামেলাতেও স্থির ছিল এটা। ফেলে দিতে গিয়ে কেমন মায়া হল ওর। এমন ভালবেসে কেউ তাকে অনেকদিন সাজায়নি। টিপটাকে সে পকেটে রেখে দিল। তারপর সুদীপকে জিজ্ঞাসা করল, মাসীমা কিছু জানেন না, না?

কোন্ মাসীমা? সুদীপ চোখ খুলছিল না।

আনন্দর মা।

সব জানে। আনন্দ ওঁকে সব বলেছে।

আশ্চর্য! আমাকে একবারও এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন করেননি।

তোর চেয়ে যে অনেক গভীর-স্বভাবের মানুষ, তাই।

জয়িতা কথা বাড়াল। সুদীপ খোচা না দিয়ে কথা বলতে পারে না। শুনলে শরীর জ্বলে যায় কিন্তু ওর সঙ্গে ঝগড়া করার কোনও মানে হয় না। কিন্তু বাড়িতে ঢোকার পর আর একটা সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে ওকে। আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করে চুপচাপ থাকার পাত্র রামানন্দ কিংবা সীতা নন। জয়িতাকে যদি সরাসরি প্রশ্ন করে তাহলে সে না বলবে না। সত্যি কথা স্বীকার করে বলতে চাইলে পাওয়া যেত

তাই নিয়েছি। এতে যা হবার তা হবে। ক্রমশ একটা রোখ দখল করল তাকে। মনে মনে বাবা মায়ের মুখোমুখি হবার জন্যে সে তৈরি হয়ে নিল। আর তখনই সুদীপ বলল, আমি নামছি। মালগুলো নিয়ে যাচ্ছি। পারলে আজ বিকেলে কফিহাউসে আসিস।

গুরুসদয় রোডের মোড়ে দাঁড়িয়ে জয়িতা চারপাশে তাকাল। রাস্তায় লোকজন নেই। রোদুর ওঠেনি এখনও। একটা শীতল ছায়া গাঢ় হয়ে জড়িয়ে আছে পৃথিবীর গায়ে। এবং এই প্রথম মন খারাপ হয়ে গেল ওর। এটা কি ধরনের মন খারাপ তা ও নিজেই জানে না কিন্তু বুকের ভেতর একটা ভার এসে জমল। এখন কলকাতা কত ভাল, কত শান্ত। মানুষেরা যে যার ঘরে বলেই বাতাসে এখনও আদুরে ছোঁয়া। একটা হলুদ পাখি উড়ে গেল ডানা মেলে। পাখিদের কি মনখারাপ হয়?




আড়ষ্ট পায়ে বালিগঞ্জ পার্ক রোডে এল সে। বাগানওয়ালা বাড়ির দারোয়ানটা অদ্ভুত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ জয়িতার ঘুম এল। হাঁটতে হাঁটতেই মনে হল সমস্ত শরীর জুড়ে ঘুম নামছে। শুধু চোখ বন্ধ করাটাই বাকি। আর তখনই কেউ মোটা গলায় হা-ই বলে চেঁচিয়ে উঠল। চোখ বড় করে জয়িতা দেখল সাদা গেঞ্জি আর শর্ট পরে তিনতলার রবীন সেন রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে শরীর ঝাঁকাচ্ছেন প্রাণপণে। খুব বড় চাকুরে ওই ভদ্রলোকের ওজন অন্তত আড়াইশো পাউন্ড। ওকে বেশ কয়েকবার মিট করেছে সে, লিফটে ওঠার সময় কিংবা ওই চত্বরে। একদিন অবশ্য ওদের ফ্ল্যাটে এসেছিলেন মায়ের সঙ্গে কথা বলতে। মা ওকে খবর দিতে কৃতার্থ হয়ে ছুটে এসেছিলেন। কাদের সাহায্যার্থে সীতা রায়রা কি ফাংশন করবেন তার ডোনেশন দিয়ে ধন্য হয়েছিলেন। লোকটার দিকে তাকিয়ে ঘুম উবে গেল জয়িতার। খাটো প্যান্টের নিচে মাংসগুলো কি বীভৎসভাবে কাপছে থলথলিয়ে। জয়িতার শরীর গুলিয়ে উঠল।

ব্যায়াম সেরে রবীন সেন এগিয়ে এলেন, মর্নিং, তুমি রোজ সকালে বের হও জানতাম না।

জয়িতার ঠোঁট মোচড় খেল। মনে মনে বলল ব্যাঙ। রবীন সেন তখন হাত পা নেড়ে বলে যাচ্ছেন, তোমার বোজ মর্নিং ওয়াক জগিং করা উচিত। কে বলে কলকাতার বাতাসে অক্সিজেন নেই। আমি রোজ এত এত অক্সিজেন বুকভরে নিই। তুমি যদি দুমাস আমার সঙ্গে বের হও তাহলে দেখবে মিসেস রায়ের মত ফিগার হয়ে যাবে।

কার মত?

মিসেস রায়। মানে তোমার মায়ের কথা বলছি। উই মাস্ট অ্যাডমিট শী ইজ এ বিউটি। কোমর কত বল তো? দ্যাখা যায় না আজকাল! আমি অবশ্য তিন সপ্তাহ বেরুচ্ছি। খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি, বুঝলে! মাত্র সাতশ ক্যালরি ডেইলি। শুনতেই সাতশ, কি খাই জানো? ভোরে অক্সিজেন। তারপর এক চামচ চিনি দিয়ে দুধ ছাড়া চা। বিশ ক্যালরি। তারপর একটা শুকা টোস্ট, তোমাকে বোর করছি? আসলে আজকাল সারাদিন শুধু খাওয়ার চিন্তা মাথায় ঘোরে। প্রাক্টিক্যালি ভারতবর্ষের মানুষ কেন এত খায় বলতে পার? অপচয়, অপচয়। মিসেস রায় আমাকে শরীর তৈরির কারখানায় যেতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি নিজেই নিজেকে বানাবো বলে ঠিক করেছি। আত্মতৃপ্তির হাসি হাসলেন রবীন সেন।

বানাতে পারছেন?

কমছে, বেশ কমছে। তবে মনে হয় কারও কারও চুমু খেলেও ফ্যাট বাড়ে। কিছু মনে করো না, এসব অ্যাকাডেমিক ডিসকাশন। তুমি কি মনে কর চুমুতেও ফ্যাট জমে? ওতেও কি ক্যালরি আছে?

আপনি ওটা বন্ধ করে দেখুন না।

না ভাই, মিষ্টি, দুধ, মাংস, ডিম সব কমিয়ে দিয়েছি কিন্তু চুমু, ইম্পসিবল। একেই ভারতবর্ষের মানুষ কম চুমু খায়, ইটস অ্যান আর্ট। তবে ওতে কত ক্যালরি আছে সেটাই জানতে হবে। খুব ঘেমে গেছি, কিছু মনে করো না। ববীন সেন নিঃশ্বাস নিলেন।

মিসেস রায়কে জিজ্ঞাসা করুন। এ ব্যাপারে উনি আপনাকে সাহায্য করতে পারবেন। চলি।

আহা, দাঁড়াও না এক মিনিট। মিসেস রায় তো দার্জিলিং-এ। চমৎকার ওয়েদার এখন ওখানে। এয়ারপোর্টে ওদের দেখলাম। সান্যাল ছোকরাটা খুব লাকি। এত মেয়েদের সঙ্গে ঘোরে তবু ফ্যাট জমেনি শরীরে। আসলে আমার সেক্রেটারিটাই ইনফেকশান।

খুব মোটা বুঝি?

ছিল না, মাস নয়েকের মধ্যে। ওকে ছাড়াতে হবে। তুমি চাকরি-টাকরি করলে আমাকে বললা। খুব লাইট জব। ও-কে! রবীন সেন আবার ফিরে গেলেন শরীর নাচিয়ে হাঁটার জন্যে। এই ফাঁকে বোদ ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীতে। নরম আদুরে রোদ। জয়িতা লিফটের দিকে এগিয়ে গেল। সীতা রায় তাহলে সত্যি এখন দার্জিলিং-এ। ওর মনে পড়ল কিছুদিন আগে সীতা রায় কাউকে টেলিফোনে বলছিলেন, আই ডোন্ট লাইক অ্যানম্যারেড গাইস। এই বয়সে বিয়ে-থা করতে বলবে—ওরে বাব্বা! যার সম্পর্কে এই কথাগুলো উচ্চারণ করেছিলেন তাকে নিয়েই তিনি এখন দার্জিলিং-এ আরাম করছেন।

যা হোক, একজন অন্তত কৈফিয়ত নিতে সামনে দাঁড়াবে না। সে সো করে লিফটে সোজা ওপরে চলে এল সে। এখনও আলো নেবেনি বাড়িটার। বোতামে চাপ দিল জয়িতা। এই প্রথম একটা গোটা রাত বাইরে কাটিয়ে সে বাড়িতে ফিরছে। বেলের আওয়াজ বাইরে থেকে শোনা যায় না। কিন্তু একটু বাদেই দরজা খুলে গেল। তাকে দেখে শ্রীহরিদা কি করবে বুঝতে পারছিল না। তারপর কেমন গলায় জিজ্ঞাসা করল, কোথায় ছিলে সারারাত? আমি ভেবে মরি। কান খাড়া করে বসেছিলাম।

মানুষটার জন্যে কষ্ট হল জয়িতার। সে চুপচাপ ভেতরে চলে এল। এমনিতে বেল বাজালে শ্রীহরিদার হুঁশ হয় না। এই নিয়ে রামানন্দ এবং সীতার মধ্যে প্রচুর ঝগড়া হয়েছে। সীতা রায়ের জন্যেই ওকে ছাড়াতে পারছেন না রামানন্দ। অথচ আজ একবার বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিল শ্রীহরিদা। কখনও কখনও কি ও ঠিকঠাক শুনতে পায়!

পেছন পেছন আসছিল শ্রীহরিদা, তোমার মা বাড়িতে নেই, বাবা কাল রাত্রে ফেরেনি, তুমিও সেই লাইন ধরলে। আমার আর এই সংসার আগলাতে ভাল লাগছে না।

নিজের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে জয়িতা চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল, বাবা বাড়িতে নেই?

মাথা নাড়ল শ্রীহরিদা, না, বাইরে গেছে। কালকে ফিরবে। স্যুটকেস নিয়ে গেছে।

বাবা বাইরে গেছে?

হ্যাঁ। আমিই তো গাড়িতে তুলে দিয়ে এলাম স্যুটকেসটা। সেই সান্যাল ছোকরাটা গাড়ি নিয়ে এসেছিল। তুমি আবার কোন্ চুলোয় গিয়েছিলে?

জয়িতা জবাব দিল না। সত্যি, শ্রীহরিদার সঙ্গে কথা বলার কোন মানে হয় না। বাবার কথা জিজ্ঞাসা করে মায়ের সম্পর্কে শুনতে হচ্ছে। রামানন্দ কি বাইরে গেছেন কারও সঙ্গে? হাতের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে জয়িতা রামানন্দ রায়ের ঘরে এল। পাশের দরজাটা বন্ধ। সীতা রায় বাইরে গেলে ঘরের দরজার চাবি নিয়ে যান।
 
ঘরটাকে খুঁটিয়ে সে দেখল। এই ঘর দেখে অবশ্য বোঝা যাবে না কেউ বাইরে গেছে কিনা। রামানন্দ রায়ের তিনটে স্যুটকেস পাশাপাশি রয়েছে। নতুন স্যুটকেস কেনাটা অস্বাভাবিক নয়। রামানন্দের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। পরিপাটি করে সাজানো। এমন কিছু চোখে পড়ল না যা থেকে কোন সূত্র পাওয়া যায়।

ঘরে ফিরে এসে স্নান করল জয়িতা। ঠাণ্ডা জলের স্পর্শ সর্বাঙ্গে মাখামাখি হওয়ার পর মন প্রফুন্ন হয়ে গেল ওর। রামানন্দ রায়ের বাড়িতে না ফেরা, সীতা রায়ের ইচ্ছে করে হারিয়ে যাওয়ায় তার কিছু এসে যায় না আর। গতরাত্রে যে কাজটা ওরা করেছে এইরকম কাজ যদি একটার পর একটা করে যেতে পারে, যদি ভণ্ড কপট মানুষগুলোর মুখোশ খুলে দিয়ে দেশের মানুষের বিবেকে কিঞ্চিৎ ঢেউ তুলতে পারে তাহলে বেঁচে থাকার একটা কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে। পোশাক পালটে জয়িতা শুয়ে পড়ল। এই সময় শ্রীহরিদা চা নিয়ে ঢুকল। দামী কাপে গরম চা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল সে। আজ যদি সুদীপের সেই আত্মীয়ার বাড়িতে তাদের থাকতে হত তাহলে কপালে কি জুটত? বালিশে মুখ গুঁজে সমস্ত শরীরে আরাম নিতে নিতে হঠাৎ ওর মনে হল এই নরম বিছানা, দামী চা, এইসব আরামদায়ক বস্তু তার জন্যে নয়। এসবই রামানন্দ রায় মারফৎ তার অভ্যেসে এতকাল মিশে ছিল। এখন চটজলদি এসব থেকে মুক্ত হওয়া দরকার। ঠিক এইসময় টেলিফোন বেজে উঠল। করিডোর ডিঙিয়ে জয়িতার ঘরে সেই আওয়াজ ঢুকল কুকুরের কুঁই কুঁই ডাকের মতন। জয়িতা উঠে বসল। আশ্চর্য, পথে আসবার সময় তার ঘুম পাচ্ছিল স্বাভাবিক ভাবেই অথচ বিছানায় গা এলিয়ে দেবার পর আর দুচোখের পাতা এক হচ্ছে না। সে নিজের ঘরের দিকে তাকাল। এই ঘরে এমন সব আসবার আছে যা অনেকের বাড়িতে নেই। এই স্বাচ্ছন্দ্য আনন্দর বাড়িতে দ্যাখেনি সে, কল্যাণের ওখানে তো কল্পনা করা যায় না। এক কথায় নিশ্চয়ই এসব ছেড়ে যাওয়া যায় কিন্তু নিরাসক্ত মন নিয়েও তো এদের সঙ্গে থাকা যায়। ভারতবর্ষের কয়েক লক্ষ মানুষ অর্ধাহারে থাকে বলেই আমাকে অর্ধাহারে থাকতে হবে তার কোন মানে নেই। বরং যা সহজ তাই মেনে নেওয়া ভাল। তাতে আর যাই হোক টেনশন থাকে না।

শেষ পর্যন্ত ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রিসিভারটা তুলল জয়িতা, হেলো।

এভরিথিং অলরাইট জয়ী?

কে বলছেন? ইচ্ছে করেই প্রশ্নটা করছে জয়িতা।

আমার গলা চিনতে পারছিস না? আমি তোর বাবা।

ও! কি বলছ? চ

আমি হঠাৎই অফিসের কাজে জামসেদপুরে চলে এসেছি। গতকাল ফোন করেছিলাম, তোরা কেউ বাড়িতে ছিলি না। কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো?

না।

খানিকক্ষণ চুপচাপ। রামানন্দ যেন কথা খুঁজছেন। জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি একাই গিয়েছ জামসেদপুরে? আই মিন, তোমার সঙ্গে কেউ নেই?

আমার সঙ্গে? নো, আর কারও তো আসার কথা ছিল না। কেন বল্ তো?

মা দার্জিলিং-এ গিয়েছে। সঙ্গে সান্যাল আছে, তাই।

জয়ী! হঠাৎ রামানন্দ রায়ের গলা রুদ্ধ হয়ে এল, আমি জানি, আমি জানি। কিন্তু এসব তো এখন নর্মাল, খুব নর্মাল–আমাকে, আমাদের মানতেই হয়। হয়তো তোর মা কোন একটা একজিবিশনের ব্যবস্থা করতে দার্জিলিং-এ গিয়েছে।

হঠাৎই চুপচাপ হয়ে গেল লাইনটা। রামানন্দ কথা বলছিলেন না। জয়িতা রিসিভারটা চুপচাপ কানে চেপে রেখেছিল। এটা কতক্ষণ? তিরিশ সেকেন্ড হতে পারে, এক মিনিটও। তারপর রামানন্দই বললেন, আমি আজ বিকেলের ট্রেনেই ফিরছি।

জয়িতা বলল, আচ্ছা।

রামানন্দ গলায় জোর আনতে চেষ্টা করলেন, আমি–আমি–আচ্ছা থাক, গিয়ে বলব। আসলে প্রত্যেক মানুষের তো কিছু না কিছু বলার থাকেই। গুডবাই।

লাইনটা কেটে গেল। এবং হঠাৎই রামানন্দ রায়ের জন্যে জয়িতার কষ্টবোধ হল। সে মুখ তুলে দেওয়ালের দিকে তাকাল। সেখানে এক বছরের জয়িতাকে শূন্যে তুলে ধরে রামানন্দ হাসছেন। মেয়ের আতঙ্কিত মুখ দেখে পিতার আশ্বস্ত করা হাসি।
 
রাস্তায় নেমে সুদীপ চারপাশে তাকাল। এই ভোরে মানুষ থাকার কথা নয়। কিন্তু এখন সবাই স্বাস্থ্য উদ্ধার করতে বেরিয়ে পড়েছে। তার কাঁধের ব্যাগটা ভারী, হাতেরটা তেমন নয়। দ্রুত পা চালাচ্ছিল সে। এই সময় একটা লোককে সে ফুটপাতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। চোখাচোখি হওয়া মাত্র আকাশের দিকে মুখ তুলল লোকটা। সুদীপের বুকের মধ্যে ছলাৎ করে উঠল। এই লোকটা কে? কখনও এপাড়ায় দ্যাখেনি ওকে! এই কি ওর খোঁজে এসেছিল বাড়িতে? যদি পুলিশের চর হয় তাহলে এই মুহূর্তে তাকে অ্যারেস্ট করলে আর কিছু করার থাকবে না। হাতের ব্যাগটায় প্রচুর রসদ পেয়ে যাবে লোকটা। কিন্তু মিনি বেড়ালের মত ধরা দেবে না সুদীপ। এখনও তার কোমরে মালটা গোঁজা আছে।

সুদীপের চোয়াল শক্ত হল। লোকটা ওর দিকে আর একবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। না, আর সন্দেহ করার কিছু নেই। নির্ঘাৎ ওরই জন্যে দাঁড়িয়ে। সুদীপের গতি কমে এল। এখনও হাত-দশেক বাকি। দূরে ঠাকুরের দোকানটা এখনও বন্ধ। হঠাৎই যেন রাস্তাটা আরও ফাঁকা হয়ে গেল। ডান কাঁধ থেকে বা কাঁধে স্ট্রাপটা বদল করে সুদীপ সরাসরি লোকটার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ওর ডান হাতটা এখন অত্যন্ত সতর্ক। লোকটা যেন তাকে দেখতেই পাচ্ছে না। সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?

চট করে মুখ ফেরাল লোকটা। তারপর দ্রুত মাথা নেড়ে না বলল। ঢ্যাঙা, রোগা লোকটার শরীরে তেমন শক্তি নেই। ময়লা পাজামা আর হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবির দুতিন জায়গায় সেলাই-এর দাগ। সুদীপ একটু সাহস পেল, তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

না, মানে, একটু দরকার ছিল। লোকটার গলার স্বরে বেশ অসহায় ভাব।

আপনি আমাকে চেনেন?

দ্রুত ঘাড় নাড়ল লোকটা, না, আমি তো এপাড়ায় থাকি না।

তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

লোকটা মুখ নামাল। ঠিক কি উত্তর দেওয়া উচিত বুঝতে পারছিল না যেন। সুদীপ বুঝতে পারল গোয়েন্দা হিসেবে লোকটা খুব ঝানু নয়। ওর খুব রাগ হচ্ছিল কিন্তু কিভাবে লোকটাকে বেশ শায়েস্তা করা যায় বুঝতে পারছিল না। এই সময় আর একটা গলা শোনা গেল, কি হয়েছে রে?

সুদীপ তাকিয়ে দেখল সীতানাথ ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে। ভাল ক্রিকেট খেলে সীতানাথ, নিশ্চয়ই সীড়াতে বেরিয়েছিল। ফাস্ট বোলার, বেশ রাগী। সুদীপ বলল, দ্যাখ না সীতানাথ, এই লোকটা কোন ধান্দা নিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছে, জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দিচ্ছে না।

সঙ্গে সঙ্গে লোকটি বলল, না ভাই, আমার কোন ধান্দা নেই।

সীতানাথ বেশ রুখু গলায় জিজ্ঞাসা করল, তাহলে কি জন্যে দাঁড়িয়ে আছেন?

লোকটার ঠোঁট নড়ল, তারপর বলল, আমি একজনকে দেখতে এসেছি।

সীতানাথ জিজ্ঞাসা করল, কাকে দেখতে এসেছেন? রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখছেন?

লোকটি মাথা নাড়ল দ্রুত, ঠিক রাস্তায় নয়। আসলে ওই ফ্ল্যাট বাড়িটায় ও আছে। বলেছিল পাঁচটা নাগাদ বেরিয়ে আসবে। তাই দাঁড়িয়ে আছি।

সুদীপ ফ্ল্যাট বাড়িটার দিকে তাকাল। সম্প্রতি কন্ট্রাক্টর জমি কিনে ফ্ল্যাট বানিয়ে বিভিন্ন মানুষকে বিক্রি করেছে। ওই ফ্ল্যাটগুলোর বাসিন্দাদের সঙ্গে পাড়ার লোকের তেমন জানাশোনা হওয়ার সুযোগ নেই। সে জিজ্ঞাসা করল, আপনি ওই ফ্ল্যাটেই গেলেন না কেন?

যাওয়া নিষেধ আছে। আমি ঠিক বোঝাতে পারব না।

সুদীপ, একে ছাড়িস না। পাড়াতে বহুৎ দুনম্বরী চলছে, এ শালার কি ধান্দা কে জানে! এই যে মশাই, বাংলা বলুন তো, ধান্দাটা কি?

এই সময় ফ্ল্যাট বাড়ির শরীর থেকে একটি মেয়ে বেরিয়ে এল। আটপৌরে পোশাক, সুন্দরী। তাকে দেখা মাত্র লোকটি চঞ্চল হয়ে উঠল, আমি যাই, ও এসেছে।

সীতানাথ বাধা দিল, দাঁড়ান। কে হন উনি আপনার? সাতসকালে পাড়ার মেয়ে বউ-এর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন অথচ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকছেন?
 
কথাটা শোনামাত্র হাসি পেল সুদীপের। এই মুহূর্তে সীতানাথকে বেশ পাড়ার গার্জেন বলে মনে হচ্ছে। পাড়ার মেয়ে বউরা সন্ধ্যেবেলায় ধ্যাষ্টামো করলে দোষ নেই, ভোরবেলায় সেটা দৃষ্টিকটু। মেয়েটি থমকে দাঁড়িয়ে গেছিল। তারপর দ্রুত পা ফেলে কাছে এল, কি হয়েছে বাবা?

কিছু না কিছু না। এখানে দাঁড়িয়ে আছি বলে এরা কারণ জানতে চাইছিলেন।

তুমি কেন সাতসকালে এখানে দাঁড়িয়ে থাক? তোমাকে রোজ আসতে নিষেধ করেছি না?

তোকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে খুকী।

এসো। ওদিকে হাঁটি। এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। মেয়েটি হাঁটতে শুরু করল।

লোকটি সুদীপদের দিকে তাকাল, আমার মেয়ে। বড়ঘরে বিয়ে দিয়েছিলাম। বরপণের টাকা পুরো মেটাতে পারিনি বলে আমার বাড়িতে আর পাঠায় না ওর স্বামী। শরীর খারাপ হয়েছিল বলে ডাক্তার মর্নিং ওয়াক করতে বলেছে। জামাই আবার সকালে বিছানা ছাড়তে পারে না। তাই আমি এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকি, মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়। আমি যাব?

সুদীপ হঠাৎ গলায় কোন স্বর পেল না। ও তাকিয়ে দেখল সীতানাথ হঠাৎ দৌড়াতে শুরু করে দিল। লোকটার উদ্দেশ্যে ঘাড় নেড়ে সে হাঁটতে শুরু করল। নিজেকে খুব খারাপ লাগছিল। খামোকা মানুষটাকে সে সন্দেহ করল। এইভাবে সবসময় আতঙ্কিত থাকায় সব সরষের মধ্যে ভূত দেখার অভ্যেস হয়ে থাকে। তাকে হয়তো কেউ অনুসরণ করেনি, কেউ তার খোঁজ করেনি এই উদ্দেশ্যে অথচ সে সবসময় ছায়া দেখছে। ধরা যদি পড়তে হয় তাহলে একবারই পড়বে। এবং পড়ার আগে কিছু কাজ করে যাবে। সে আর একবার ফ্ল্যাট বাড়িটার দিকে তাকাল। মেয়েটার স্বামী এখনও ঘুমোচ্ছে। এ শালাকে শেষ করে দেওয়া উচিত। বরপণের জন্যে বউকে বাপের সঙ্গে দেখা করতে দেয় না। সুদীপ মাথা নাড়ল। এরকম দেখলে দেশের প্রত্যেক ঘরে ঘরে এমন মানুষ পাওয়া যাবে যাদের মেরে ফেলতে হয় এখনই। আমরা বড় অপরাধগুলো দেখি, কিন্তু ছোট ঘোট অপরাধগুলো জড়ো হয়ে যাওয়ায় বড় অপরাধগুলো শক্তি পায় প্রবল হতে। তাই সব পরিষ্কার করলেই দেশ নির্মল হয়। রাষ্ট্রযন্ত্র সক্রিয় না হলে সেটা সম্ভব নয়। গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সেটা আবার অসম্ভব। অতএব সীমিত সুযোগে বড় বড় অপরাধগুলোকেই টার্গেট করতে হবে। তার প্রতিক্রিয়া যদি চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।

সুদীপের আর ঘুম পাচ্ছিল না। সে সহজভাবে হাঁটতে হাঁটতে প্যারাডাইসের কথা চিন্তা করল। ঠিক কতজন লোক মারা গেছে ঠাওর করা সম্ভব নয়। কিন্তু আগুন লেগেছে মারাত্মক, এত দ্রুত বৈদ্যুতিক আগুন যে চারপাশে ছড়িয়ে পড়বে তা ভাবতে পারেনি সুদীপ। এইভাবে কেউ আহত না হয়ে প্যারাডাইসের কোমর ভেঙে ফেলতে পেরে খুব ভাল লাগছে না। ওর মালিক যখন আর কোনদিনই ফিরে আসবে না তখন ধরে নেওয়াই যায় প্যারাডাইস বন্ধ হল।

বাড়ির সামনে এসে এক মুহূর্ত দাঁড়াল। এখন অবনী তালুকদারের মুখোমুখি হতে হবে তাকে। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনরকম ঝামেলা করার বাসনা নেই তার। অবনী তালুকদার যদি চেঁচামেচি করে কৈফিয়ত চায় তাহলে যতটা সম্ভব ভদ্রভাবে এড়িয়ে যেতে হবে। যে কদিন এখানে থাকতে হবে সে কদিন অশান্তি করে কি লাভ।

এইসময় কার্তিকদাকে দেখতে পেল সে। সিড়িতে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। দেখলেই বোঝা যায় রাত্রে ঘুমায়নি। ওকে দেখে সামান্য নড়ল না পর্যন্ত। কার্তিকদার পেছনে বাড়ির সদর দরজা আধভেজানো। সামনে দাঁড়িয়ে সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার, এখানে বসে আছ কেন?

কার্তিকদা নড়ল না। কিন্তু তার দুই চোখ জলে ভরে এল। সুদীপ আবার জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে?

এবার হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল কার্তিকা। তার শরীর কাপছে, দুটো হাতে মুখ ঢাকা। সুদীপ অবাক হয়ে বাড়িটা এবং কার্তিকদাকে দেখল। এবং তখনই কার্তিকদা কোনমতে বলতে পারল, মা নেই, মা চলে গেল।

কে চলে গেল? সুদীপ হতভম্ব।

মা। বাবু আমাকে বসিয়ে রেখেছে এখানে গাড়ি আসবে বলে।

সুদীপের মাথাটা একপাশে সামান্য ঝুঁকল। ও যেন কথাটা বুঝতে চেষ্টা করল। মা নেই? মা মারা গেছে? এক লাফে কয়েকটা সিড়ি টপকেই সুদীপের খেয়ালে এল। হাতের ব্যাগ নিয়ে এইভাবে লাফালে উলটো বিপত্তি ঘটতে পারে। ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকল সে। নিচে কেউ নেই। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল সে। আর তখনই অবনী তালুকদারকে দেখতে পেল। মায়ের ঘরের দরজার সামনে একটা বেতের চেয়ারে গালে হাত রেখে বসে আছেন। তার দৃষ্টি ভেতরের দিকে। সুদীপ যে উঠেছে তা তিনি খেয়ালই করলেন না! ব্যাগ দুটোকে টেবিলের ওপরে রেখে সুদীপ এগিয়ে গেল। এইবার ওকে দেখতে পেলেন অবনী তালুকদার। দেখে সোজা হয়ে বসতে বসতে আবার কি মনে করে আগের ভঙ্গিতে ফিরে গেলেন। বাবাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সে মায়ের ঘরে পা বাড়াল। এবং তখনই ধূপের গন্ধ পেল। মা শুয়ে আছেন। তার চিবুক পর্যন্ত সাদা চাদরে ঢাকা।

আর কাছে গিয়ে কি হবে? যে চুলোয় রাত কাটালে সেখানে থেকে গেলেই হত!

সুদীপের চোয়াল শক্ত হল। কিন্তু অবনী তালুকদারের কথার কোন জবাব দিল না। মায়ের মুখ কত পালটে গেছে। তার চেনা স্মৃতি, এমনকি জীবন্ত অবস্থায় শেষবার দেখা মানুষটির সঙ্গে এই মৃতদেহের কোন মিল নেই। যে চামড়াটুকু অবশিষ্ট আছে তা হাড়ের সঙ্গে লেপটে। এবং এখনই সেই বীভৎস পচা গন্ধ বের হচ্ছে শরীর থেকে। মহিলা বেঁচে গেলেন। হঠাৎই এইরকম বোধ হল সুদীপের। সে মুখ তুলে নার্সকে জিজ্ঞাসা করল, কখন চলে গেছেন?

রাত তিনটের সময়। যাওয়ার আগে জ্ঞান ছিল?

না।

এইসময় সুদীপ পায়ের শব্দ পেল। অবনী তালুকদার তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, কি জানতে চাইছ তুমি? না, তোমার সম্পর্কে কোন কথা জানতে চায়নি যাওয়ার আগে!

আপনি ছিলেন সে সময়?

থাকব না? সতীসাবিত্রী চলে যাচ্ছে সেই পবিত্র সময়ে থাকব না? আমি আজ লক্ষ্মীহীন হলাম। সে আমার লক্ষ্মী ছিল। ও হো! শেষদিকে গলার স্বর রুদ্ধ হয়ে গেল অবনী তালুকদারের।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top