১১.
শ্মশান থেকে বাড়িতে ফিরে নিজের ঘরে গুম হয়ে বসে ছিল সুদীপ। একটি মানুষ, যিনি তাকে এই পৃথিবীতে এনেছিলেন, যার সঙ্গে তার শৈশব, বাল্যকাল এবং কৈশোর কেটেছে তাকে বিদ্যুৎচুল্লীতে ঢুকিয়ে ছাই করে দিয়ে এসেও বুক ভেঙে পড়ছে না, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে না। তার বদলে বারংবার মনে হচ্ছে, ভালই হল, খুব ভাল, তিনি তো এই চেয়েছিলেন। সুদীপ নিজেকে বুঝতে চাইছিল। সে কি নির্মম হয়ে গেছে খুব? স্নেহ-ভালবাসার সুতোগুলো কি পচে গেছে? মায়ের শরীরটা ছাই হয়ে যাওয়ার পর থেকেই এই কথাটা মাথায় পাক খাচ্ছিল।
কষ্টেরও কি একটা বয়স থাকে? যেই সেই সীমাটা পেরিয়ে যায় অমনি তার ধার-ভার সব লোপ পায়? যার সঙ্গে ভালবাসার সম্পর্ক, যার জন্যে জীবন দিয়ে দেওয়া যায় সে যখন অসুস্থ হয় তখন ঝাঁপিয়ে পড়তে যে ইচ্ছে করে সেই ইচ্ছেটাকে কেন সময় ঠুকরে ঠুকরে খায়? কখন যে ভালবাসা বোঝা হয়ে দাঁড়ায় তাই বোঝা যায় না বলেই গ্লানিবোধ বড় অনুভূত হয় না। সুদীপ এই নিয়ে আর ভাবতে পারছিল না। মাকে দাহ করে এসেও তার কান্না পাচ্ছিল না। মা নেই, কোনদিন আর তার সঙ্গে দেখা হবে না এই ভাবনাটাও মাথায় আসছে না। তবে কি মানুষের মনের একটি অংশ একদম অসাড়? সম্পর্কগুলো যখন সেখানে এসে পৌঁছায় তখন এমনই হয়? এইসময় কার্তিকদা এসে জানাল তার ফোন এসেছে।
উঠতে ইচ্ছে করছিল না। কথা বলতেও না। ঠিক শোক থেকে নয়, সব মিলিয়েই কিছুই ভাল লাগছিল না তার। সুদীপ বাইরে এসে ফোন ধরতেই জয়িতার গলা শুনতে পেল, ঘুমাচ্ছিলি?
না। কি ব্যাপার?
কিছু না। বাড়িতে কেউ নেই। মা এবং বাবা বলে যাদের ডেকে এসেছি এতকাল—তারা কলকাতার বাইরে। আমি কাল ছিলাম কি ছিলাম না তার খোঁজ নেবার কেউ নেই। তোর?
আমার মানে?
কিছু বলেছে কেউ?
আমি বলাবলির বাইরে।
রেডিও শুনেছিস?
না, কেন?
খবরে বলল—ওরা কি করে খবর বানায় আজ বুঝতে পারলাম। হাসতে হাসতে আমার পেটের নাড়ি ছিঁড়ে যাচ্ছিল। তবে আমরা যা চেয়েছি তাই হয়েছে।
হঠাৎ সচকিত হল সুদীপ, ইটস অলরাইট। সামনাসামনি দেখা হলে এ ব্যাপারে কথা বলব।
তোর মাথায় ওষুধ দিয়েছিস?
ভুলে গিয়েছিলাম। ছাড়ছি।
ভুলে গিয়েছিলাম! মানে? ডোন্ট টেক রিস্ক সুদীপ। এখনই ওষুধ লাগা।
সময় পাইনি রে। বাড়িতে এসে দেখলাম মা মারা গেছেন। এইমাত্র শ্মশান থেকে ফিরছি আমরা। রাখছি, বিকেলে দেখা হবে। রিসিভারটা নামিয়ে রাখল সুদীপ।
হলঘরটায় কেউ নেই। এই ভরদুপুরে কোন শব্দও নেই। সুদীপের খিদেও পাচ্ছিল না। এখন ঠাণ্ডা জলে শরীর ড়ুবিয়ে স্নান এবং তারপর লম্বা ঘুম একমাত্র কাম্য। অবনী তালুকদারের ঘরের দিকে তাকাল সে। মায়ের শরীর বলে যা অবশিষ্ট ছিল তা চুল্লিতে ঢুকিয়ে দেওয়ামাত্র ভদ্রলোক হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করেন। অসুস্থ অবস্থায় শ্মশান নিশ্চয় বড় ভীতিকর জায়গা। তড়িঘড়ি গাড়িতে চেপে বসেছিলেন কার্তিকদাকে ভর দিয়ে। বড় দায় চুকে গেল ওঁর। এখন ফ্রি ম্যান। কিন্তু এই বয়সে এত বড় বাড়ি, প্রচুর টাকা (আয়কর বিভাগ তছনছ করার পরও), ভদ্রলোক বোধহয় কখনই একা বোধ করবেন না। টেবিলের পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে আজকের কাগজটা তুলল সে। না, কোথাও নতুন খবর নেই। ভারতবর্ষে রোজ যা হয়ে থাকে তাই ছাপা হয়েছে পাতায়। সেই কংগ্রেসের ঝগড়া, সি পি এমের হুঙ্কার, রেগনের বিবৃতি, রাজীবের প্রশস্তি। একবছর আগের কাগজটা যদি হুবহু ছেপে আজ বের করা হত তাহলে কোন প্রভেদ বুঝতে পারত না কেউ। জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন রাজীব। তার নিচেই সংবাদদাতা লিখেছেন কোন একটা কেন্দ্রীয় অফিসের সদর দপ্তর কি বিহারে উঠে যাবে কলকাতা ছেড়ে। যেন বিহার আর একটা দেশ! দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় ছোট্ট একটি সংবাদ আছে। নকশালপন্থী সন্দেহে চারজন যুবককে পিটিয়ে হত্যা করেছে জনসাধারণ। পরে পুলিশ আরও দুজনকে গুলি করে মেরেছে। ঠোঁট কামড়াল সুদীপ। ঘেয়ো কুকুর, কুখ্যাত ডাকাত, নারীধর্ষণকারী লম্পট আর নকশালদের মধ্যে যেন কোন ফারাক নেই–এমন ভাব সংবাদদাতার। আনন্দ এই দেশের মানুষের মনে বিবেকবোধ জাগাতে চায়, তাদের প্রতিবাদ করার রাস্তাটা চিনিয়ে দিতে চায়। কাদের? যেসব ছেলেমেয়েরা একাত্তরে গুলি খেয়ে মরেছিল একটার পর একটা ভুল করে তাদের ভূমিকা ছিল তো দধীচির। কিন্তু এখনও এতবছর পবে গ্রামেগঞ্জে যারা তাদেরই অনুপ্রেরণায় কাজ করছে তারা তো মূর্তি ভাঙছে না, জোতদারের গলা কাটছে না! তাহলে তাদের ডাকাত ভাবার কি কারণ আছে? কেন তারা গ্রামবাসীর সহানুভূতি পাচ্ছে না? খবরের কাগজগুলোর ভূমিকা না হয় বোঝা গেল! সুদীপ চোখ বন্ধ করল। নিশ্চয়ই এতক্ষণে ডায়মন্ডহারবার রোডে পুলিশ গিজগিজ করছে, রিপোর্টাররা ছুটোছুটি করছে। আগামীকালের কাগজে যখন খবরটা বেরুবে তখন জনসাধারণের কি প্রতিক্রিয়া হবে?
এইসময় নার্স ভদ্রমহিলাকে অবনী তালুকদারের ঘর থেকে বের হতে দেখল সে। ওঁর হাতে কাঁচের জাগ, তাতে জলের তলানি। চোখাচোখি হতেই ভদ্রমহিলা ঘাড় কাত করে হাসলেন। সুদীপ অবাক হল। মা চলে যাওয়ার পরও ভদ্রমহিলার ছুটি হয়নি? সে দেখল নার্স তার দিকে এগিয়ে আসছেন, উনি ভাল আছেন।
কে? সুদীপের মুখ থেকে প্রশ্নটা বেরিয়ে এল।
আপনার বাবা। ডাক্তার এসেছিলেন। শক থেকে হয়েছে, রেস্ট নিতে বলেছেন।
ও।
আমি ভেবেছিলাম আজ চলে যাব। কিন্তু আপনার বাবা আরও কিছুদিন থেকে যেতে বললেন। বয়স্ক মানুষ, আর এই সময়—! তারপর মুখ ফিরিয়ে ভদ্রমহিলা, কার্তিক, কার্তিক বলতে বলতে আড়ালে চলে গেলেন।
সুদীপের এবার মজা লাগছিল। মা যতদিন বিছানায় শুয়েছিলেন ততদিন এরকম সক্রিয় ছিলেন না মহিলা। যেন হঠাৎ কর্তৃত্ব পেয়ে গেছেন এমন উজ্জ্বল হয়ে গেছে চোখমুখ।
একটু পরেই কার্তিকদা সামনে এসে দাঁড়াল, চা খাবে?
একটু পরে, স্নান করে নিই।
হবিষ্যি করবে কখন?
হবিষ্যি?
এখন তো তোমাকে তাই খেতে হবে কাজ না হওয়া পর্যন্ত।
কেন?
তাই নিয়ম, হিন্দুদের তাই করতে হয়।
আমি যা খাই তাই খাব।
কি বলছ তুমি?
তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতে চাই না কার্তিকদা। মা চলে গিয়ে যে ভাল হয়েছে তা আমরা সবাই বুঝতে পারছি। আর ভাল আমাদেরও। যে মানুষটার থাকাটাই আমরা চাইছিলাম না তার চলে যাওয়ার জন্যে তোক দেখিয়ে শোক করতে হবে কেন? আমি ওসব করলে মা মোটেই সুখী হতেন না। কারণ তিনি মরে যেতে চাইতেন। তাছাড়া এতকাল হিন্দুধর্মের কোন কিছু মানলাম না, ধর্ম ছাড়াই তো বেশ বেঁচে আছি, কোন অসুবিধে হচ্ছে না, তখন আজ ধর্মের চোখ রাঙানো মানববা কেন! ওসব তুমি তোমার বাবুকে করতে বল। ভণ্ডামিটা উনি ভালই জানেন। একটানা কথাগুলো সে কার্তিকদাকে বলল না নিজেকে শোনাল তা তার কাছেই স্পষ্ট নয়।
ঘরে এসে জামাকাপড় ছেড়ে উদোম হয়ে বাথরুমে ঢুকল সে। শাওয়ারটা খুলে দিয়ে দেওয়াল আয়নার দিকে তাকাল। তার স্বাস্থ্য সুগঠিত, কোথাও মেদ নেই, মুক্ত শরীর থেকে একধরনের ভিজে আভা বের হচ্ছে। বৃষ্টির ধারার মতো জলের ফোঁটা সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে নরম আদরের মত। কিছুক্ষণ নিজের দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলল সুদীপ। গতরাত্রে কি সহজে এই লোকটা মানুষ খুন করে ফেলল! কোনরকম প্র্যাকটিস ছাড়াই খুন করতে একটুও হাত কাঁপেনি। নিজেকে খুনী মনে হচ্ছে কি? নিজের ঠোঁটেই এক রহস্যময় হাসি দেখল সে।