What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected গর্ভধারিণী - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

ঘুটঘুটে অন্ধকার নয়, মাঝে মাঝেই দ্বীপের মত আলো দেখা যাচ্ছে এখানে ওখানে। বাসের ভেতরে আলো জ্বলছে। আনন্দর মনে হচ্ছিল এটা নিবিয়ে রাখলেই ভাল হত। কারণ তার পরিচিত একজন অনেকক্ষণ থেকে লক্ষ্য করছেন। শেষ পর্যন্ত এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হল না। আনন্দ গলা তুলে জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছেন?

আধ-খুলন্ত প্রৌঢ়টি বললেন, আছি দেখতেই পাচ্ছ। পড়াশুনা কেমন হচ্ছে?

হচ্ছে যেমন হয়। ইচ্ছে করেই কথাটা বেঁকিয়ে বলল আনন্দ। এতক্ষণ উনি যেভাবে তাকাচ্ছিলেন তাতে মনে হয়েছিল কথা না বললে অন্যায় হবে। কিন্তু কথা শুরু করতেই কায়দা শুরু করেছেন। ওর গ্রামের কিছু মানুষকে এই কারণেই সে সহ্য করতে পারে না। প্রৌড় এবার বললেন, মন দিয়ে পড়াশুনা কর। তোমার বিধবা মায়ের কষ্ট তুমি ছাড়া আর কে দূর করবে! তোমার বাবা কি সরল মানুষ ছিলেন।

আনন্দ প্রতিটি শব্দ আলাদা উচ্চারণ করলে, আমার মা আপনাকে কষ্টের কথা বলেন নাকি? কি আশ্চর্য, আমাকে ওসব বলেন না!

মানে? কি বলতে চাইছ তুমি?

খুবই সামান্য কাকাবাবু। আমার মায়ের কি কি কষ্ট আছে সেটা তো আপনার জানার কথা নয়। কেন কথা বলার জন্যে কথা বলছেন?

সুদীপ এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা আপনি স্কুলের শেষ পরীক্ষায় কত পার্সেন্ট নম্বর পেয়েছিলেন? ও বিরাশি পেয়েছিল। কেন ফটাফট জ্ঞান দেন?

কথাটা শেষ হওয়ামাত্র একটা চাপা হাসি উঠল চারপাশে। দু-একজন আলোচনা শুরু করে দিলেন। কুড়ি বছর আগে যত ছেলেমেয়ে হায়ার সেকেন্ডারিতে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করত এখন তার দ্বিগুণ করে। যত নম্বর এরা এখন পায় তখন সেটা স্বপ্নেও ভাবা যেত না। এই সময়ের ছেলেরা বেশি ব্রিলিয়ান্ট কিনা তাই নিয়ে তর্ক শুরু হল। আনন্দ দেখল সেই প্রৌঢ় ভদ্রলোক নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু লোকটা চটেছে এবং সুযোগ দিলেই চিমটি কাটার চেষ্টা করবে। ছোবল মারার ক্ষমতা নেই। সে চাপা গলায় সুদীপকে বলল, কেন আগবাড়িয়ে কথা বলতে যাস!

গা জ্বলে যায়।

কখনও কখনও চামড়া মোটা করতে হয়।

সুদীপ কাঁধ ঝাঁকাল, যারা জীবনে কোন দায়িত্ব নেবে না তারাই নিরাপদে দাঁড়িয়ে জ্ঞান দিয়ে যায়।

আনন্দ আর কথা বাড়াল। সুদীপের বাড়ির অবস্থা সে জানে। প্রাচুর্য সেখানে দমবন্ধ করে ছড়ানো। ওর নিকট আত্মীয়স্বজন যে স্তরের তাতে ভারতবর্ষের একশ্রেণীর সুবিধের চাবি হাতে নিয়ে জন্মানো ছেলেমেয়ের মত সেইরকম জীবনটাকে গুছিয়ে নিতে পারত। ইংলিশ মিডিয়ামে ওর রেজাল্ট চোখে পড়ার মতই ছিল। ও তার নম্বরটা চেঁচিয়ে বলেছে কিন্তু নিজেরটা বলতে লোকগুলো হোঁচট খেত। অথচ সুদীপ জে ই-তে বসল না। কিন্তু তার ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হবার ইচ্ছে নেই জানার পর গ্রামের যে পেরেছে সে জ্ঞান দিয়েছে।

বাস থেকে নেমে জয়িতা বলল, জেনারেটর চলছে রাজার মতন।

আনন্দ বলল, রাজার মতনই আছে ওরা।

সুদীপ উদাস গলায় বলল, আজ রাতে রাজা যাবে বনবাসে। চক্ষুলজ্জা বলেও একটা কথা আছে, সমস্ত গ্রামে টিমটিমে হ্যারিকেন জ্বলছে আর ওখানে আলোর ফোয়ারা ছুটছে। আর এসব মানুষ মেনে নেয় চুপচাপ।

কল্যাণ বলল, এটা কোন অভিযোগ নয়। আমার সামর্থ্য থাকা অপরাধ? সেটা আমাকে অর্জন করতে হয়েছে। আলো জ্বালাবার ব্যবস্থা রাখার জন্যে তোর রাগ করার যুক্তি নেই।


ওরা ডায়মন্ডহারবার রোড ধরে কয়েক পা এগিয়ে আসার পর পুরো এলাকাটা দেখতে পেল। ঠিক রাস্তার কয়েক পা নিচে মাধবীলতার গাছে সাজানো গেট। দেড় মানুষ উঁচু পাঁচিল তার দুপাশ থেকে চলে গেছে বাড়িটাকে ঘিরতে। লোহার গেটটি বন্ধ। কিন্তু ভেতরের আলোয় বোঝা যাচ্ছে সাদা নুড়ি বিছানো পথ চলে গেছে ভেতরে। গেটের দুপাশে দুজন প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে য়ুনিফর্ম পরে। ওরা জানে লোকদুটো নেপালি এবং খুব অনুগত। গেটের সামনে গাড়ি এসে দাঁড়ালে একজন গেট খুলে দেয়, অন্যজন প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিক নির্দেশ করে। এদের বিশদ বিবরণ চারজনেই জানে। ওরা দেখল গেটের ওপর ইংরেজিতে লেখা আছে জায়গাটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অতএব প্রবেশ এবং প্রস্থান অনুমতি ব্যতিরেকে সম্ভব নয়। যারা রাত্রে থাকবেন না তাদের বলা হয়েছে সন্ধ্যে সাতটার মধ্যে উদ্যান ছেড়ে যেতে হবে নইলে নিরাপত্তার দায়িত্ব নেওয়া কর্তৃপক্ষের সম্ভব নয়। চারপাশের গভীর অন্ধকারের মধ্যে বিশাল এলাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটাকে স্বপ্নের জাহাজের মত মনে হচ্ছে। জয়িতা কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় পেছনে হেডলাইটের তীব্র আলো এবং গাড়ির গতি হ্রাস হওয়ার শব্দ কানে এল। ওরা দ্রুত সরে এল একপাশে যাতে রাস্তার ধারের বড় গাছটার আড়াল পাওয়া যায়। গাড়িতে আরোহী দুজন। চালাচ্ছেন পঞ্চাশের কাছাকাছি খুব স্মার্ট হতে চাওয়া মানুষ। ওপাশে চটকদার এক ম্যানিকিন যিনি ন্যাকা গলায় বলে উঠলেন, এই তো, প্যারাডাইস, ওঃ নটি ডিয়ার!

বাইরে থেকেই এত এক্সাইটেড হবেন না মিসেস মিত্র, তাহলে ভেতরে গিয়ে নার্ভ ঠিক থাকবে না। দেয়ার আর মোর সারপ্রাইজ। পুরুষটি হাত বাড়িয়ে টান টান চুলে আঙুলের ডগা ছোঁওয়াল।

সঙ্গে সঙ্গে কপট অভিমানে ছিটকে সরে গেলেন ম্যানিকিন, তুমি এখনও মিসেস মিত্র আপনি বলে যাচ্ছ। ডোন্ট টাচ মি।

ইউ আর রিয়েল সুইটি। গাড়িটা ধীরে ধীরে পারাডাইস সাইনবোর্ড ঝোলানো লোহার গেটের দিকে এগিয়ে যেতে একজন প্রহরী কিছু জিজ্ঞাসা করল। ভদ্রলোক উত্তর দেওয়ামাত্র সসম্ভ্রমে গেট খুলে দেওয়া হল। গাড়িটা যেন আলোর সাগরে ড়ুবসাঁতার দিয়ে মিলিয়ে গেল। গেট বন্ধ হল।

আনন্দ বলল, গাড়িতে এলে বেশি প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হয় না। অবশ্য হেঁটে খুব কম পার্টি আসে।

জয়িতা বলল, আমরা গাড়িটা কখন পাচ্ছি?

সুদীপ জানাল, এখনও ঘণ্টা আড়াই বাকি আছে। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কোন লাভ নেই। লোজন যাওয়া আসা করছে। চল, এগোই।

আনন্দও আর দাঁড়াতে চাইছিল না। একটু বাদে বড় রাস্তা ছেড়ে ওরা কাঁচা পথে নেমে এল। আনন্দর বাড়িতে যাওয়ার জন্যে একটু বেশি হাঁটতে হবে কিন্তু কারও সামনে পড়ার সম্ভাবনা কম। সুদীপ বলল, পা চালা, জব্বর খিদে পেয়ে গেছে।

কল্যাণ মাথা নাড়ল, আমারও।

জয়িতা হাসল, কি করে তোরা এইসময় খাবার কথা ভাবতে পারিস কে জানে!

সুদীপ চেঁচাল, ঈশ্বর তোমাদের শরীরে এক্সট্রা একটা যন্ত্র দিয়েছেন যা দিয়ে সবরকম প্রাকৃতিক ব্যাপার তোমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা থামিয়ে রাখতে পার, বাট উই আর হেল্পলেস!

আহা বেচারা! কিন্তু তোর মুখে তুমি খুব অশ্লীল শোনাচ্ছে। জয়িতা অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে সামলে নিল।

পালটা সুদীপ কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় স্থির হ্যারিকেনের আলো দেখা গেল। আনন্দ চাপা গলায় বলল, আস্তে!

বিশাল একটা বট কিংবা অশ্বত্থ গাছের গায়ে লম্বাটে মুদির দোকান। সেখানে হ্যারিকেন ঝুলছে। দোকানের সামনে মাটিতে পোঁতা বেঞ্চিতে বসে কয়েকজন গল্প করছে। আনন্দরা এমনভাবে হাঁটছিল যাতে জয়িতা আড়ালে থাকে। অবশ্য অন্ধকারে কেউ তাদের স্পষ্ট বুঝতে পারবে না। কিন্তু মুখোমুখি প্রশ্নটাকে এড়াতে পারল না আনন্দ, কে যায়?

আমি আনন্দ।

আনন্দ? সেন-বাড়ির ছেলে?

হ্যাঁ।

সঙ্গে কারা?

আমার বন্ধু, কলকাতা থেকে এসেছে। ভাল আছেন মেসোমশাই?

হ্যাঁ, ওই আর কি!

জায়গাটা পেরিয়ে এসেই সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, এত কৈফিয়ৎ দিলি কেন?

আনন্দ হাসল, প্রত্যেক জায়গার নিজস্ব একটা চরিত্র আছে। সেই জায়গার মানুষের ব্যবহারও সেই চরিত্রের মধ্যেই পড়ে। আমি সেটা অস্বীকার করলে সাহায্য পাব না কিন্তু সেটাকে মানিয়ে নিলে অসুবিধে হবে না, বুঝলি?

সুদীপের যে কথাটা ভাল লাগল না এটা বুঝতে পারল আনন্দ। যারা এইরকম গ্রামে আবাল্য থাকেনি তারা বুঝে উঠবে না। তাছাড়া সুদীপ সব ব্যাপারে চাচাছোলা কথা বলতে ভালবাসে। একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল ওর। ট্রামে যাচ্ছিল আনন্দ সুদীপের সঙ্গে। এক ভদ্রলোক কংগ্রেস এবং সি পি এম-এর মুণ্ডপাত করছিলেন। কংগ্রেস এইরকম সি পি এম সেইরকম। হঠাৎ সুদীপ তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি কোন্ দলের?

মানে?

কংগ্রেস না সি পি এম?

কোন দলের নয়। আমি কোন রাজনীতিফিতি করি না।

ভোট দিয়েছেন গতবার?

হ্যাঁ, দেব না কেন? আমার ডেমোক্রেটিক রাইট!

আপনিই সবচেয়ে ডেঞ্জারাস লোক। দেশের শত্রু। সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতারা হেসে উঠেছিল সজোরে। এই সুদীপের কাছে গ্রাম্য কৌতূহল তো খারাপ লাগবেই।

ক্রমশ একটা অন্ধকার দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। দুটো ঘরে হ্যারিকেনের আলো দেখা যাচ্ছে। সামনে কিছুটা বাগান। আনন্দ বলল, এই আমার বাড়ি।
 
০৭.
ঘরে হ্যারিকেন জ্বলছে। পরিষ্কার কাঁচের কারণে আলো বেশ উজ্জ্বল। ওরা তিনজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিল। জয়িতা একটা বেতের চেয়ারে বসে হ্যারিকেনের আলোয় রঙিন পত্রিকায় চোখ রেখেছিল। সুদীপ আনন্দর বিছানায় চিৎ হয়ে পড়েছে। কল্যাণ আর একটা চেয়ারে চুপচাপ বসে। এই ঘরে বিত্তের চিহ্ন নেই, কিন্তু বাঙালী মানসিকতার ছাপ রয়েছে। এখন আনন্দ বাইরে। ওরা পেছনের দরজা দিয়ে এখানে ঢুকেছে।সমস্ত তল্লাটটা অন্ধকারে ড়ুবে থাকায় ঢোকার সময় কেউ তাদের লক্ষ্য করেনি। এই ঘরে তাদের বসতে বলে আনন্দ বেরিয়েছে অনেকক্ষণ। কোথাও কোন শব্দ নেই। জয়িতা পত্রিকা থেকে মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করল, তোর শরীর ঠিক আছে?

সুদীপ সেই অবস্থায় বলল, ফার্স্টক্লাস।

জয়িতা আবার চোখ নামাল। কিন্তু সে পত্রিকা পড়তে পারছিল না। এই ঘরে আসার পর থেকেই বুকের ভেতর ছটফটানি শুরু হয়েছে। এরকম উত্তেজনা কখনও সে বোধ করেনি। এই ঘরটা যেন মেকআপ রুম। স্টেজে নামবার আগে জিরিয়ে নেবার পালা। এতক্ষণ কলকাতা থেকে আসবার আগে অথবা বাসে বসেও এরকম অস্বস্তি একবারও হয়নি। চোখ বন্ধ করল জয়িতা। তবে সকালে ঘুম থেকে উঠেই বুকের ভেতরে একটা চিনচিনে অনুভূতি শুরু হয়েছিল। কতকালের চেনা দেওয়াল, আসবার এমনকি টুকিটাকি জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা কষ্টবোধ শুরু হচ্ছিল। ঠিক সেইসময় দরজায় শব্দ হয়েছিল। সেই মুহূর্তে বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু শব্দটাকে থামাবার জন্যেই দরজা খুলতে হয়েছিল। বহুদিনের অভ্যেসে রাত্রে শোওয়ার সময় হাউসকোট থাকে ওর, দরজা খুলতেই রামানন্দকে দেখতে পেয়ে বুকের কাছটা হাত দিয়ে টেনে ধরল সে। এই ব্যাপারটার ব্যাখ্যা সে কিছুতেই করতে পারে না। এই মুহূর্তে সে একটুও দৃষ্টিকটু পোশাকে ছিল না কিন্তু হাউসকোট পরনে থাকার জন্যেই কি তার হাত বুকের ওপরে উঠে গিয়েছিল? শার্ট প্যান্ট পরে সারাদিনে কত মানুষের মুখোমুখি হয় সে, কিন্তু কখনই তো ওরকম আচরণ করে না। মেয়েলিপনা অভ্যেস নেই, মেয়েরা যা করে থাকে তা ওর ধাতে আসে না কিন্তু একথাও ঠিক কিছু মেয়েলি স্বভাব অগোচরেই রক্তে থেকে গেছে। অচেতন মুহূর্তে সেটা প্রকাশ পায় এবং এ ব্যাপারে তার কিছুই করার নেই। রামানন্দকে দেখে সে সত্যি অবাক হয়েছিল। নিশ্চয়ই তার চোখে মুখে প্রশ্ন ফুটে উঠেছিল নইলে রামানন্দ কেন কৈফিয়ৎ দেবার ভঙ্গি করে বলবেন, তোর সঙ্গে একটা কথা ছিল। ঠিক আছে, তুই ফ্রেস হয়ে নে, আমি না হয় পরে আসব। রামানন্দ বিব্রতভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়াতেই জয়িতা বলেছিল, তুমি বসতে পার, আমার দুমিনিট লাগবে। রামানন্দ চকিতে একবার ভেতরের দিকে তাকিয়েছিলেন। তারপর চট করে ঘরে চলে এলেন। জয়িতা আর অপেক্ষা করেনি। বাথরুমে নিজেকে ভদ্রস্থ করতে করতে সে ভেবে পাচ্ছিল না কি কারণে রামানন্দ অমন আচরণ করছেন! বোঝাই যাচ্ছে ওঁর এই আসাটা সীতার দৃষ্টি এড়িয়ে। কেমন একটা চোর-চোর ভাব আছে। হাউসকোটটা পালটাতে গিয়ে মত পরিবর্তন করল জয়িতা। সে এমন কিছু অশোভন পোশাকে মেই যে প্যান্ট পরতে হবে। অস্বস্তিটাকে উড়িয়ে দিতেই সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকে দেখল একমাত্র চেয়ারে রামানন্দ বসে আছেন। খাটে পা মুড়ে বসল জয়িতা, বসে বলল, বল।

রামানন্দ মাথা নামালেন। কথাটা কিভাবে বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। লক্ষ্য করল জয়িতা। কিন্তু সে কিছুই বলতে চাইল না। মিনিটখানেকের মত সময় ব্যয় করে রামানন্দ চোখ না তুলে বললেন, ইটস নট মাই ফন্ট, নট অ্যাট অল!

কি ব্যাপারে বলছ?

ঐন্দ্রিলা ব্যাপারটায় রঙ চাপিয়েছে। এটা ওর অভ্যেস। অন্তত আরও পাঁচটা ফ্যামিলিতে ও এই কাণ্ড করেছে।

হঠাৎ এতদিন পরে এইসব কথা বলতে এলে কেন?

না, মানে, আমি ব্যাপারটা ভুলতে পারছি না। তুই, তুই–।

ইটস অলরাইট। এ নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও প্রয়োজন আমার নেই।

রামানন্দ এবার চোখ তুলে তাকালেন, ঠিক আছে, তোকে অন্য একটা কথা বলতে চাই। অনেক ভেবেচিন্তে আমি একটা সিদ্ধান্তে এসেছি। তুই এখন বড় হয়েছিস, তোর কথাটা জানা দরকার। তোর মা যে জীবনযাপন করছে এটা আর আমার পছন্দ নয়। কিন্তু সে আমার নিষেধ মানতে চাইছে না। এই অবস্থায়।

জয়িতা দেখল রামানন্দ পরের কথাটা কিভাবে বলবেন সেটা ভেবে নিচ্ছেন। সে প্রশ্নটা করেই ফেলল, তুমি যা করে যাচ্ছ তা মা পছন্দ করছে?

হ্যাঁ, সে চাইছে। কারণ আমি এইরকম জীবনযাত্রায় থাকলে তার সুবিধে হয়। ও আজ দুপুরের ফ্লাইটে সান্যালের সঙ্গে বাইরে যাচ্ছে। সবকিছু ঠিকঠাক করে কাল আমাকে জানিয়েছে। এটা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।

সমস্যাটা তোমার এবং মায়ের। আমাকে বলতে এসেছ কেন?

রামানন্দ জয়িতার দিকে তাকালেন, জয়ী, তুই আমার মেয়ে, আমি যদি বিবাহবিচ্ছেদ চাই তাতে তোর আপত্তি আছে?

নোচ, নট অ্যাট অল! এটা তোমাদের ব্যাপার। তবে যদি আমার থাকা নিয়ে কোন অসুবিধে হয় তাহলে জানিয়ে দিও। ওহো, আমাকে হয়তো কয়েকদিন কিংবা অনেকদিনের জন্যে বাইরে যেতে হতে পারে। সেটা হলে তোমরা কোনরকম দুশ্চিন্তা করো না। অবশ্য তার জন্যেও তোমাদের সময় হবে না হয়তো।

কোথায় যাবি? প্রায় চমকে উঠেছিলেন রামানন্দ।

এখন কোথায় যাব আমি তোমাকে এই মুহূর্তে জানাতে চাই না।

তোরা কি আরম্ভ করেছিস? জয়ী, আমি তোকে অন্যরকম মেয়ে বলে জানতাম।

তাই? না, আমি কোন সান্যালের সঙ্গে জয়ট্রিপে যাচ্ছি না!
 
রামানন্দ এবার সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তাঁর চোখমুখ অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। প্রাণপণে নিজেকে স্থির রাখতে চেষ্টা করছিলেন বুঝতে পারছিল জয়িতা। ওর বেশ মজা লাগছিল। এই মুহর্তে অত্যন্ত দায়িত্ববান পিতার মত মনে হচ্ছে তাকে। অদ্ভুত গলায় রামানন্দ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কত টাকা সঙ্গে নিতে চাও?

নিঃশব্দে মুখ তুলে তাকালো জয়িতা। যেন প্রস্তাবটা সে ধরতে পারছে না।

রামানন্দ এবার সরল করার চেষ্টা করলেন, তাঁর মুখ এখনও লাল, বাইরে যাচ্ছ, তোমার কি টাকার দরকার আছে?

জয়িতা ঘাড় নেড়ে না বলল। রামানন্দ আর দাঁড়ালেন না। সেই মুহূর্তে ওই ঘরে নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছিল জয়িতার। একটু বড় হবার পর থেকেই একা একা থাকতে থাকতে সেটাই অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। বাড়িতে কারও সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা না বলার প্রবণতা এসে গিয়েছিল। চুপচাপ বই পড়া গান শোনা বা ঘুমোনোর মধ্যে বেশ স্বস্তি পাওয়া যেত। কিন্তু রামানন্দ বেরিয়ে যাওয়ার পর ওই শব্দহীন ঘরে বসে কিরকম একটা কাঁপুনি এল শরীরে। ও চটপট বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। এবং সেই সময় সীতার গলা কানে আসতেই কাঁপুনিটা থেমে গেল। টেলিফোনে সীতা কাউকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন এয়ারপোর্টে যাওয়ার সময় যেন তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। শব্দগুলো কানে যাওয়ামাত্র সহজ হয়ে গিয়েছিল জয়িতা। স্বচ্ছন্দে ঘরে ফিরে গিয়েছিল সে।

পত্রিকাটা বন্ধ করে চোখ তুলল জয়িতা। সুদীপ কি এর মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল? উলটোদিকে বসা কল্যাণ বলল, আনন্দ কোথায় গেল? দেখব?

জয়িতা মাথা নাড়ল, না। বেশি ঘোরাঘুরির দরকার নেই, কখন দেখে ফেলবে, তারপর—! আসবে নিশ্চয়ই কাজ সেরে। তারপর নিচু গলায় প্রশ্ন করল, তোর এখন কি মনে হচ্ছে?

ঠিক হ্যায়। তাছাড়া যাচ্ছিস তো তোরা, মনে হবে তোদেরই।

তোরাও তো একসময় যাবি।

সময়টা আসুক। এখন আমার খিদে পেয়েছে খুব।

তুই একটা পেটুক আছিস! হাসল জয়িতা।

দুপুরে কি খেয়েছিস?

লাঞ্চ। জয়িতা খানিকটা বিস্মিত কল্যাণের প্রশ্ন করার ধরনে।

বাড়িতে ফাটাফাটি হয়ে গেছে আজ। উনুন ধরেনি। ভাত আর তরকারিকে যদি লাঞ্চ বলা যায় তো সেটা আমার ভাগ্যে জোটেনি।

আই অ্যাম সরি!

দুঃখিত হবার কোন কারণ নেই। আমাদের এইসব নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়। কেন ঝগড়া হল?

হল–না হয়ে কোন পথ ছিল না তাই। আসলে অভাব থেকেই তো অক্ষমতা, ঈর্ষা আসে। আর সেটাকে ঢাকতে বেশির ভাগ মানুষই গলা চড়িয়ে মেজাজ দেখানো ছাড়া কোন পথ পায় না। কল্যাণ চোখ বন্ধ করল।

এইসময় বারান্দায় শব্দ হল এবং তারপরেই আনন্দ দরজায়, একটু দেরি হয়ে গেল। মা ছিল না বাড়িতে। খবর দিয়ে এলাম, এখনই আসছে।

কল্যাণ বলল, তিনি আসুন, কিন্তু বাবারদাবার কিছু হবে?

আনন্দ বলল, তৈরি হচ্ছে। আমি যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলাম। সুদীপ কি ঘুমোচ্ছিস, কি করে পারিস?

সুদীপ কোন সাড়া দিল না। তার শরীরটা তখনও টানটান পড়ে আছে। আনন্দ এবার জয়িতার দিকে তাকাল, কি শাড়ি এনেছিস?

দক্ষিণী।

মানে? আনন্দর মুখে বিস্ময়।

তুই বুঝতে পারবি না। ভালই কাজ চলবে।

চটপট পরে নে। ওপাশে একটা ঘর আছে, চলে যা।

এক্ষুনি?

হ্যাঁ। যে মেয়েটা খাবার দেবে সে যেন তোর প্যান্ট শট না দেখে। গ্রামের কেউ যদি লক্ষ্য করেও থাকে তাহলে তোকে মেয়ে বলে চেনেননি। সবাই ভাববে তিনটে ছেলে আমার সঙ্গে এসেছিল। একে জিজ্ঞাসা করলে এ বলবে দুটো ছেলে একটা মেয়ে। দুটো মিলবে না। যা।

ব্যাগটা নিয়ে উঠল জয়িতা। তারপর পাশের ঘরে চলে গেল। এই ঘরেও একটা হ্যারিকেনের আলো কমিয়ে রাখা ছিল। দরজা বন্ধ করে সে ব্যাগটা খুলল। তারপর সাউথ ইন্ডিয়ান সিল্কটা বের করল। রঙটা সত্যি ভাল কিন্তু এইরকম জমকালো শাড়ি পরার ইচ্ছেই হয় না তার। শার্ট প্যান্ট খুলল সে। তারপর ধীরে ধীরে শাড়ি-ব্লাউজের খোলস চাপাতে লাগল। তার ছোট চুল এই শাড়ির সঙ্গে মোটেই খাপ খায় না। সুদীপের পরামর্শে নকল চুল এনেছিল সে। এখন আধা-আলোয় নিজেকে আয়নায় দেখে কেমন যেন অচেনা মনে হচ্ছিল তার। এইভাবে কোনদিন প্রসাধন করেনি জয়িতা। আজ অনভ্যস্ত হাতে খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। সাবধানী আঙুলে নকল চুলকে প্রায় আসলের চেহারায় আনল সে। নিজের দিকে তাকিয়ে হাসি পাচ্ছিল তার। কিছুতেই নিজেকে লবঙ্গলতিকা বলে মনে হচ্ছে না। কি আর করা যাবে, সবার তো সব হয় না। প্যান্টশার্ট ব্যাগের ওপরেই রাখল সে, প্রয়োজনে যেন হাতড়াতে না হয়। দরজা খুলে পাশের ঘরে যেতেই সুদীপ চেঁচিয়ে উঠল, দারুণ দেখাচ্ছে কিন্তু, তুই আমার পাশে আসবি না?

কথাটা সবাই শুনল কিন্তু কেউ কিছু বলল না। আনন্দ আর কল্যাণ জয়িতার দিকে প্রশংসার চোখে তাকিয়ে ছিল। আনন্দ এক পা এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল, দেখলে মনে হবে তত বড়লোকের মেয়ে ফুর্তি করতে এসেছিস্ বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে!

জয়িতা বলল, সেটা তোরা বল, আমার কোন অভিজ্ঞতা নেই।

কল্যাণ হাসল, ভাগ! তোদের সোসাইটিতে দেখিস নি?

আনন্দ মাথা নাড়ল, কেউ সন্দেহ করবে না। তোকে চমৎকার মানিয়েছে।

সুদীপ চুপচাপ শুনছিল মুখে হাসি রেখে। বলল, উঃ, এখান থেকেই গন্ধ পাচ্ছি!

জয়িতা চোখ ছোট করল, তখন থেকে কি বকছিস?

পারফিউম আনিসনি সঙ্গে? নাক টানল সুদীপ।

না।

এই জন্যেই তুই মেয়ে হলি না। যে মেয়ে প্যারাডাইসে যাবে তার ব্যাগে দুটো পি থাকবেই।

দুটো পি মানে। কল্যাণ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।

একাডেমিক ডিসকাশন হিসেবে নেবে সবাই। পারফিউম অ্যান্ড প্রোটেকশন।

ভাগ্‌। প্রায় চিৎকার করে উঠল জয়িতা।

যে পুজোয় যে ফুল ভাই। তোর ওই নকল চুলে বিটকেল গন্ধ ছাড়ছে নিশ্চয়ই, একটু গন্ধটন্ধ ঢাললে আমার ভাল হত। সুদীপ আবার শুতে শুতে বলল, চলবে আনন্দ?

এই সময় আনন্দ পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল, মা আসছে। কথাটা শোনামাত্র সুদীপ আবার উঠে বসল। জয়িতার মুখ তখনও লাল, নিজেকে সামলে নিতেই সে পাশের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল। আনন্দ বলল, এসো মা, এরাই আমার বন্ধু।
 
পঞ্চাশঘেরা এক মহিলা দরজায় এসে দাঁড়ালেন। কল্যাণের মনে হল আনন্দর মা এখনও সুন্দরী। জয়িতা মুগ্ধ চোখে দেখছিল। এত আঘাত, একাকী একটি মহিলার বেঁচে থাকার লড়াই সত্ত্বেও সর্বাঙ্গে কেমন স্নিগ্ধ মা-মা ভাব ফুটে উঠেছে। আনন্দর মা বললেন, তোমরা অনেকক্ষণ এসেছ শুনলাম। কিছু মনে করো না, খুব দরকারেই আমাকে বেরোতে হয়েছিল।

কল্যাণ বলল, না না, আমাদের কোন অসুবিধে হয়নি।

সুদীপ বলল, মাসীমা ঘরে এসে বসুন, আমি সুদীপ।

বাঃ, তোমাকে এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাব? তুমি কল্যাণ?

হ্যাঁ মাসীমা।

আর তুমি জয়িতা, তাই তো?

জয়িতা মাথা নাড়ল। তারপর কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করল। মাসীমা তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি তো খুব ভাল।

জয়িতাকে প্রণাম করতে দেখে আনন্দ উঠল। সুদীপ বলল, অহো, আমি তো গতবারও প্রণাম করেছি। জয়টা না এমন ভোবায়—।

না না, তোমাদের ড়ুবতে হবে না। বসো তো সবাই। তুমি এসো আমার সঙ্গে।

মাসীমা চলে গেলেন জয়িতাকে নিয়ে। কল্যাণ বলল, ভাগ্যিস ও শাড়িটা পরে নিয়েছিল, প্যান্ট পরা দেখলে হয়ে যেত চিত্তির!

আনন্দ বলল, কিছুই হত না। মাকে কনজারভেটিভ ভাবার কোনও কারণ নেই।

সুদীপ বলল, পুরো ব্যাপারটা তোর মাথায় আছে?

আছে।

তুই আর কল্যাণ খেয়েদেয়ে আধঘন্টা পরে বের হবি। তার ঠিক ঘণ্টাখানেক পরে আমি জয়িতাকে নিয়ে ডায়মন্ডহারবার রোডের সেই বটগাছটার নিচে থাকব। আবার বলছি গাড়িটা নেবার সময় কোন ঝুঁকি নিবি না। এমন পরিস্থিতি যেন না হয় যে নেওয়ামাত্র চারধারে গোলমাল শুরু হয়ে গেল!

হবে না।

এই সময় দরজায় শব্দ হল। আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, খাবার দিয়েছ?

একটি প্রৌঢ়া মাথা নেড়ে নিঃশব্দে হা বলল। আনন্দ বলল, চল খেয়ে নিই।

ওরা বারান্দায় এল। উঠোনটা অন্ধকারে ঢেকে গেছে। ওদিকটায় একটা ছোটখাটো বাগান আছে, গাছের গন্ধ বাতাসে। কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল মাসীমা ব্যাপারটা জানেন? মানে, এখন যে–।

না।

কোন প্রশ্ন করবেন না?

না। মা মনে করেন আমি কোন অন্যায় করতে পারি না।

সুদীপ চাপা গলায় মন্তব্য করল, স্নেহান্ধ!

না। যদি বুঝি কাজটা অন্যায় হয়ে গেল তাহলে এসে মাকে জানাই।

কল্যাণ ঠোঁটে শব্দ তুলল, তোকে হিংসে হচ্ছে রে! কপাল করেছিলি!





চারজনে মাটিতে আসন পেতে খাচ্ছিল। সুদীপ পা ছড়িয়ে বসেছিল। হাঁটু মুড়ে খাওয়ার অভ্যেস না থাকায় তার অসুবিধে হচ্ছিল। জয়িতা দুই হাঁটু মুড়ে শাড়ি নিয়ে জবুথবু হয়ে বসে কিছুক্ষণ বাদেই টের পেল তার দুটো পা টনটন করছে, ঝিঝি ধরে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। এইভাবে খাওয়ার অভ্যেস তারও নেই। কিন্তু ওরা দুজন মুখে কিছু বলল না। এখন তো সবরকম পরিস্থিতির সঙ্গেই মানিয়ে নিতে হবে, এইরকম একটা ভাবনা ভাবতে চেষ্টা করছিল ওরা। কল্যাণ খুব স্বছন্দ ভঙ্গিতে খেতে খেতে হঠাৎ জয়িতার আওড়ানো পেটুক শব্দটা মনে পড়ে যেতেই শ্লথ হয়ে গেল। আনন্দর কোনও উত্তাপ ছিল না। মাসীমা একটু তফাতে আসন পেতে বসেছিলেন, সুদীপের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কিছুই খাচ্ছ না–তুমিও না জয়িতা।

সুদীপ উত্তর দিল, ও ফিগার ঠিক রাখছে আর আমার খিদে পায়নি।

জয়িতা প্রতিবাদ করল, ওর কথায় একদম বিশ্বাস করবেন না মাসীমা। বড় বাজে কথা বলে।

আনন্দ বলল, ওরা কিন্তু আজকেই চলে যাবে মা।

মাসীমা অবাক হলেন, সেকি! তাহলে আসাই বা কেন? এই অন্ধকারে এসে ফিরে গেলে তোমরা তো কিছুই দেখবে না। চলে যাওয়াটা কি খুব জরুরী?

আনন্দ বলল, হ্যাঁ।

মাসীমা এবার গলার স্বর নামালেন, তুইও যাচ্ছিস?

এখনই বলতে পারছি না, হয়তো ফিরে আসতে পারি।

জয়িতা লক্ষ্য করল আনন্দর মা আর কথা বাড়ালেন না। ভদ্রমহিলাকে সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল। বন্ধুদের কাছ থেকে সরিয়ে নিজের ঘরে এনে উনি বলেছিলেন, বোকা মেয়ে, ওভাবে শাড়ি পড়তে হয়? তোমার সায়া দেখা যাচ্ছে, পেছনদিকটা উঠে আছে।

ঘাড় ঘুরিয়ে সেটা আবিষ্কার করে লজ্জিত হয়েছিল সে শাড়ি পরার ব্যাপারে যে সে একদম আনাড়ি এটা বুঝতে ওঁর মোটেই অসুবিধে হয়নি। নিজের হাতে শাড়ি পরিয়ে দিলেন উনি। আর সেই মুহূর্তে সীতার কথা মনে হচ্ছিল খুব। অবশ্য মনে হওয়াটাও বোকামি। তারপর টুকটাক কথা। কিন্তু কখনই জয়িতার ব্যাপারে শোভনতার বেড়া ডিঙিয়ে নয়। এমন কি এই ছেলে তিন বন্ধুবান্ধবীকে নিয়ে সন্ধ্যের পর হাজির হল তাই নিয়েও বিস্ময় নেই। অথচ মহিলাকে বোকা কিংবা সরল ভাবার কোন কারণ নেই। উনি কথা বললেন সম্ভ্রম রেখে। আনন্দ বোধহয় মায়ের স্বভাবের খানিকটা পেয়েছে। তাদের বয়সী কেউ অমন গাম্ভীর্য রপ্ত করেনি, গুছিয়ে কথা বলতে শেখেনি। জয়িতা আনন্দর মায়ের মুখের দিকে তাকাল। এমন নির্লিপ্ত অথচ স্নিগ্ধ মুখ সে কোনদিন দ্যাখেনি।

খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে ছেলেরা ঘরে ফিরে গেলে জয়িতা বাথরুমে ঢুকল। হ্যারিকেনটা চৌবাচ্চার উপরে রেখে সে দেখল ঘরটা মোটামুটি পরিষ্কার কিন্তু বালতিতে জল ভোলা আছে, কলের ব্যবস্থা নেই। কমোড নেই। কথাটা মনে হতেই সে হেসে ফেলল। অভ্যেস বড় বদ জিনিস। অজান্তেই মনে কামড় দেয়।

সিগারেট ধরিয়ে সুদীপ বলল, মাসীমাকে কিছু বললি না?

না, বললে অসুবিধে অস্বস্তিতে থাকবে। হয়তো মুখে কিছু বলবে না কিন্তু মন থেকে চাইবে কিনা সন্দেহ আছে। জিনিসগুলো আলাদা কর।

ওগুলো আলাদা করাই আছে। ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে নে। এখন ঠিক সাড়ে আটটা বাজে, তোরা সাড়ে নটায় স্পটটায় চলে আসবি, আগে এলেও ক্ষতি নেই।

আনন্দ সময়টা ঠিক করে নিয়ে বলল, অন্ধকারে পৌঁছাতে পারবি তো?


রাস্তাটা পরিষ্কার মনে আছে, তবে অন্ধকাবে একটু–, আর একবার বল।

তোরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে ডানদিকে হাঁটতে শুরু করবি। মিনিট তিনেক যাওয়ার পর রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গেছে। ডানদিক দিয়ে হাঁটলেই তোরা ডায়মন্ডহারবার রোডে গিয়ে পড়বি। তারপর বাঁ দিকে খানিকটা এগোলেই গ্রামটা শেষ হয়ে যাবে। মিনিট দশেক হাঁটলে পেট্রল পাম্প দেখতে পাবি। বিশদ বুঝিয়ে আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, আমি কি তোদের কিছুটা পথ এগিয়ে দিয়ে আসব?

সুদীপ মাথা নাড়ল। তারপর সেই সযত্নে নিয়ে আসা ব্যাগটা খুলে দুটো প্যাকেট বের করল। ভারী প্যাকেটটা সে আনন্দর দিকে এগিয়ে দিল। ওর মুখে সামান্য কঁপন নেই। যেন অভ্যস্ত হাতে সে কাজ করছে। তারপর দুটো রিভলবার বের করে একটা এগিয়ে দিল আনন্দর সামনে, গুলি লোড করা আছে, ওকে আর একবার বুঝিয়ে দিস।

সুদীপ যন্ত্রটাকে লুকিয়ে নিল শরীরে। তারপর কল্যাণের দিকে তাকিয়ে বলল, চল্।

কল্যাণ উঠল। ওকে এখন বেশ নার্ভাস দেখাচ্ছিল। সেটা বুঝতে পেরে আনন্দ বলল, শোন কল্যাণ, তুই ইচ্ছে করলে এখনই কলকাতায় ফিরে যেতে পারিস।

না, মানে, তুই এই কথা বলছিস কেন?

তোর যদি মনে হয়–ইটস আপটু ইউ!

আনন্দ, আমি ঠিক আছি। কিন্তু গ্রামের পথে কেউ যদি পরিচয় জানতে চায় তাহলেই মুশকিল। আসার সময় তো দেখলাম। কল্যাণ স্বাভাবিক হতে চাইছিল।

তোরা বলবি আমার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলি। কলকাতায় ফিরে যাচ্ছিস। তবে চেষ্টা করবি যাতে সেরকম কারও সামনে না পড়িস।

ওরা বাইরে বেরিয়ে আসতেই জয়িতাকে দেখতে পেল। কল্যাণ বলল, বেরুচ্ছি।

জয়িতা হাসল, উইস ইউ গুড লাক।

সুদীপ বলল, নায়িকা নায়িকা ভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে থাকি। আমার কপালে শেষ পর্যন্ত এই জিনিস জুটল। ওরা ঢুকতে দেবে কিনা সন্দেহ।

জয়িতা তীব্র প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল কিন্তু আনন্দ বাধা দিল, আঃ সুদীপ, এই সময়টায় না হয় ঠাট্টাটা বন্ধ রাখ।

সুদীপ হাসল, পেছনে না লাগলে যেটা খেলাম সেটা হজম হত না। মাসীমা কোথায়?

আনন্দ বলল, বলে যেতে হবে না। গুড বাই।

ওরা দুজনে চুপচাপ অন্ধকারে বেরিয়ে গেল। জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, ওরা ঠিকঠাক চিনতে পারবে তো? সুদীপ তো মাত্র একবার এসেছিল!

সুদীপকে নিয়ে কোন চিন্তা নেই। চিন্তা কল্যাণের জন্যে।

কেন?

টিপিক্যাল লোয়ার মিডল ক্লাস সেন্টিমেন্ট এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি ও। বিপদে পড়লে কতটা শক্ত থাকবে বলা মুশকিল।

আমার কিন্তু কল্যাণের ওপর আস্থা আছে। ওর তো ভাল রেজাল্ট ছাড়া কোন সম্বল কিংবা পিছুটান নেই। কারও কাছ থেকে কিছু পাওয়ার সুযোগও নেই। ও যেটা করে সেটা এক ধরনের অভ্যেস থেকেই করে, বাঙালীদের অভ্যেস।

ওরা ঘরে ফিরে এল। গ্রাম এখন আরও নিস্তব্ধ। আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, তোকে কি করতে হবে সেটা আবার বলে দেবার দরকার আছে?

মাথা নাড়ল জয়িতা, তারপর বলল, এই বিদঘুটে চুলটা বড্ড ডিস্টার্ব করছে!

কিছু করার নেই। তোর অরিজিন্যাল চুল মনে রাখতে কারও অসুবিধে হবে না।

আজকাল অনেক শাড়িপরা মেয়ের চুলের কাট এইরকম, আমারটা অবশ্য একটু বেশি।

সেইটেই আমাদের বিপক্ষে যাবে। বরং এই চুলের বর্ণনা পেয়ে কেউ আন্দাজ ঠিক রাখতে পারবে। তুই ঠিক আছিস, এই নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আনন্দ দ্বিতীয় রিভলবারটা জয়িতার হাতে দিল; গুলিভরা আছে। কি করে ওপেন করবি তা জানিস? খুব প্রয়োজন না হলে ব্যবহার করিস না। ওটা শরীরে রাখিস না, অসুবিধে হবে। তোর ব্যাগের ঠিক ওপরেই রেখে দে। প্রয়োজন বুঝলে বের করিস। সুদীকেও বলে দিস তোরা যে যে জিনিস নিয়ে ভেতরে যাচ্ছিস সেগুলো যেন ওখানে পড়ে না থাকে।
 
জয়িতা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রিভলভারটা দেখছিল। এবার হেসে বলল, প্র্যাকটিসের সময় আমি ফর্টি পার্সেন্ট মার্ক পেয়েছিলাম। এবার যেন নম্বরটা একটু বাড়ে। ওটাকে ভালভাবে রেখে দিয়ে জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, তোদের এখানে পঞ্চায়েত তো সি পি এমের?

না। শুধু এই দুটো গ্রাম কংগ্রেসের। এর আগেরবার সি পি এমের ছিল।

দুটো পার্টি প্রটেস্ট করেনি?

করলে আমরা এখানে আসতাম না। পোস্টারগুলো কোথায়?

কল্যাণের ব্যাগে। এদিকে নতুন পার্টির কোন কাজকর্ম নেই?

আছে, না থাকার মতন। তুই আধঘণ্টা রেস্ট নে। আমি মায়ের কাছ থেকে ঘুরে আসি।

জয়িতা আনন্দর দিকে তাকাল। তারপর নীরবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।



কল্যাণ বড় বড় পা ফেলছিল। সুদীপ চাপা গলায় বলল, আস্তে চল্‌।

পথে মানুষ নেই তা নয়। অন্তত পাঁচজনকে ওরা পেয়েছে ইতিমধ্যে। কেউ কারও মুখ দেখতে পায়নি এই রক্ষে। শুধু কল্যাণ বারংবার বলেছে, এই, ঠিক রাস্তায় যাচ্ছিস তো? প্রথম দুতিনবার উত্তর দিয়েছিল সুদীপ, তারপর চুপ করে গেছে। অন্ধকারে পথ চেনা সত্যি অসুবিধেজনক কিন্তু ওর মনে হচ্ছে কোন ভুল করেনি। শেষপর্যন্ত গাড়ির হেডলাইট দেখতে পেয়ে নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হল। মাঝে মাঝেই অন্ধকার চিরে এক একটা গাড়ি কলকাতার দিকে ছুটে যাচ্ছে। ওরা চুপচাপ ডায়মন্ডহারবার রোডে উঠে এল। কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, পেট্রল পাম্পটা কতদূরে?

দূর আছে। তোর কি হয়েছে কল্যাণ?

কেন, কিছু না। চমকে উঠল যেন কল্যাণ।

চেপে যাচ্ছিস। নার্ভাস লাগছে?

একটু। সময় নিয়ে উত্তর দিল কল্যাণ, আসলে আমি কোনদিন ডাকাতি করিনি তো।

আমি করেছি? আনন্দ করেছে। তাছাড়া আমরা ডাকাতি করতে যাচ্ছি না।

জানি। কিন্তু লোকে তো তাই বলবে।

তা হলে কি চাস বল? মনে হয় স্টেশনে গেলে কলকাতার ট্রেন পেয়ে যাবি।

আমি স্টেশনে যাওয়ার জন্যে এখানে আসিনি। তুই ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। আমি জানি কি করতে চলেছি, সে ব্যাপারে আমার মন পরিষ্কার, কিন্তু তবু যে ছাই কেন আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছি কে জানে। তারপর নিজেই হেসে বলল, মিডলক্লাস সংস্কার! নে চল, দাঁড়াস না। আর এসব কথা আনন্দকে বলিস না।

সুদীপ কোন কথা বলল না। হেডলাইট বাঁচিয়ে কল্যাণকে নিয়ে সে এগোতে লাগল। এখন গাড়ির সংখ্যা কম আর যারা যাচ্ছে তাদের গাড়ির গতি জোরালো। রিকশা যাচ্ছে কখনও-সখনও। কিছু মানুষ ওপাশ থেকে বোধ হয় গ্রামে ফিরছিলেন বেশ হনহনিয়ে। সুদীপ একটু আশঙ্কা করছিল কিন্তু প্রশ্ন এল না কোন। শেষতক ওরা গ্রাম ছাড়িয়ে গেল। সঙ্গে কিছু নেই সুদীপের কিন্তু কল্যাণকে ব্যাগটা বইতে হচ্ছে। নিজের কথা ভেবে একটু অবাক হচ্ছিল সুদীপ। তার মনে কোন কাঁপুনি নেই। যেন খুব স্বাভাবিক কাজ সে করতে চলেছে।

এই সময় পেট্রল পাম্পের আলোটা চোখে পড়ল। উঁচুতে হ্যাজাকটাকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কাছাকাছি গিয়ে ওরা একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াল। মেইন রোড থেকে নুড়ির পথটা নেমে গেছে পাম্পের দিকে। পাম্পের ওপাশে দুটো ঘর। একটায় অফিস, অন্যটায় বোধ হয় স্টোরের কাজ চালানো হয়। কল্যাণ বলল, দুটো লোক দেখতে পাচ্ছি।

একজনের তো গলাই পাওয়া যাচ্ছিল। চিৎকার করে হিন্দী গান গাইছে সে হ্যারিকেনের আলোয় বসে। দ্বিতীয়জন প্রৌঢ়। চুপচাপ বসে আছে। এই দুজনকেই এর আগেরবার দেখে গিয়েছিল সুদীপ আনন্দর সঙ্গে এসে। কিন্তু আজ কোন গাড়ি নেই পাম্পে। সেদিন দুটো গাড়ি গ্যারাজ করা ছিল। একটু বাদে প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি ছেলেটিকে কিছু বললেন। গান থামিয়ে সে চিৎকার করল, উরে বাপ, এই অন্ধকারে আমি যেতে পারব না! কথাটা বলে সে ঘরের ভেতরে প্রৌঢ়র কাছে চলে গেল।

ওই ঘরে বিরাট কাঁচের জানলা রয়েছে। কিন্তু পথ একটাই। কল্যাণ চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, গাড়ি কোথায়?

সুদীপ কোন উত্তর না দিয়ে ঘড়ি দেখল। এখনও মিনিট পনেরো সময় আছে। যদি তার মধ্যে কোন গাড়ি না আসে তা হলে আনন্দরা অপেক্ষা করবে। সে চাপা গলায় কল্যাণকে বলল, মালটা বের করে হাতে রেখে দে, পরে হয়তো চান্স পাবি না। তাড়াহুড়ো করবি তখন।



কল্যাণ অন্ধকারেও হাসল, দুরকমের মাল আছে। কোটের প্রয়োজন হবে তা আগে থেকে বুঝব কি করে? চান্স তৈরি করে নেব। এই সময় ডায়মন্ডহারবারের দিক থেকে একটা গাড়ি এগিয়ে এসে পাম্পের হদিশ পেয়ে নেমে এল নিচে। প্রচণ্ড হর্ন বাজাচ্ছিল ড্রাইভার। কল্যাণ বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল গাড়িটাকে দেখে। চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, যাবি? সুদীপ মাথা নাড়ল, না। কারণ গাড়িতে ড্রাইভারকে নিয়ে অন্তত ছয়জন মানুষ বসে। প্রত্যেকেই যুবক, ক্যাসেটে গান বাজছে। ছোকরাটা বেরিয়ে এসে পনেরো লিটার তেল ভরে দিল। দাম মিটিয়ে চলে গেল ওরা কলকাতার দিকে। ছোকরা ফিরে গেল ঘরের ভেতর। বাইরেটা আবার অন্ধকার। এদিকে মশাও আছে বেশ। কানের কাছে তারা ইতিমধ্যেই পাখা বাজাতে শুরু করে দিয়েছে। সুদীপ আবার ঘড়ি দেখল। তিন মিনিট বাকি আছে। প্ল্যানটা ওরই। কল্যাণ কিংবা আনন্দ এই ঝুঁকি নিতে চায়নি। কিন্তু ওর মনে হয়েছিল এইটেই সহজ পথ। আনন্দর কাছে জেনেছিল এ তল্লাটে সন্ধ্যের পর লোডশেডিং হয় না এমন রাত খুব কমই আসে। সেইটে কাজে লাগাতে চেয়েছিল সে। কিন্তু যদি গাড়ি না আসে আজ পাম্পে তাহলেই চিত্তির। জয়িতা চেয়েছিল কোলকাতা থেকে কারও গাড়ি সরিয়ে এখানে চলে আসতে। তাহলে আর আনন্দর বাড়ি যাওয়া যেত না। সরাসরি স্পটেই ঢুকতে হত। আনন্দ সেই ঝুঁকিটা আবার নিতে চায়নি। এর মধ্যে অনেক গাড়ি বড় রাস্তা দিয়ে ছুটে গিয়েছে, কারও প্রয়োজন হয়নি তেলের। সুদীপ লক্ষ্য করল যত দেরি হচ্ছে তত কল্যাণ শান্ত হয়ে আসছে। ইতিমধ্যে সময়টা পেরিয়ে গেছে। নিশ্চয়ই আনন্দ আর জয়িতা বটগাছের নিচে অপেক্ষা করছে এতক্ষণ। সুদীপ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছিল। ওকে ঘড়ি দেখতে দেখে কল্যাণ বলল, ওদের তো অপেক্ষা করতেই হবে। যদি গাড়ি না পাই তো আনন্দর বাড়িতে ফিরে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। তখন আবার আগামীকাল ভাবতে হবে।

সুদীপ বলল, কাল যদি ইলেকট্রিক চলে আসে? যা করার আজই করতে হবে।

লোডশেডিং যে হবেই তা আজ আমরা নিশ্চিত ছিলাম না। হয়ে গিয়ে সুবিধে হয়েছে। কাল না হলে অন্য কিছু ভাবতে হবে। কিপ ইওর আইজ ওপেন। বলেই কল্যাণ হাসল। সুদীপ ঠাট্টাটা বুঝেও বুঝল না। ওর মনে হল কল্যাণ এতক্ষণে শক্ত হয়ে গেছে। ঠিক সেই সময় কোলকাতার দিক থেকে গাড়িটাকে আসতে দেখল সে। আলো দেখেই বোঝা গেছে ওটা অ্যাম্বাসাডার। গাড়িটা গতি কমাচ্ছে। সুদীপ কল্যাণকে নিয়ে গাছের এপাশে চলে এল। হেডলাইটটা বাঁক নিচ্ছে। তারপর ধীরে ধীরে নেমে এল রাস্তা ছেড়ে। পাম্পের সামনে নয়, পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়িটা। ভেতর থেকে হোকরাটা মুখ বাড়াল, মাল এনেছ? দাদুর গলা শুকিয়ে গেছে। চটপট চলে এস। রোগামতন একটা লোক গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল মদের বোতল হাতে নিয়ে। তারপর ঢুকে গেল ভেতরে। হ্যাজাকের যেটুকু আলো নাম্বার প্লেটে পড়েছিল তাতেই সুদীপ চিনতে পারল। এই গাড়িটাকেই ওরা গতবারে দেখে গেছে।
 
০৮.
ব্যাগ থেকে গ্লাভস বের করে পরে নিল সুদীপ।

এখন হঠাৎই যেন সব শব্দ মরে গেছে আচমকা। ঘন অন্ধকারে শুধু পাম্পের কাচের ঘরের আলো টিমটিম করছে। দ্বিতীয় গ্লাভসটা কল্যাণকে দিয়ে সে আর একটু সময় অপেক্ষা করল। না, ভেতর থেকে কোন মানুষ চটপট বেরিয়ে আসবে বলে মনে হয় না। যে লোকটা গাড়ি চালিয়ে এল সে নেহাতই মাসমাইনের ড্রাইভার! মালিক থাকে ডায়মন্ডহারবারে। ভাল ব্যবসা তার। অতএব কোন নিরীহ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। ওরা সেদিনই দেখে গিয়েছিল গাড়ির কাচ ওদের সুবিধে দেবে। বাইরে থেকে ভেতরটা বোঝা যায় না। অবশ্য এই গাড়িটাকেই যে পাবে এমন নাও হতে পারত। কিন্তু সম্ভাবনাটা কাজে লেগে যাচ্ছে। সে কল্যাণকে বলল, আমি গিয়ে স্টিয়ারিং-এ বসছি। তুই ঘুরে গিয়ে পাম্পের দরজায় শেকলটা তুলে দিয়ে ছুটে আসবি।

কল্যাণের গলার স্বর অন্যরকম শোনাল, যদি চাবিটা নিয়ে গিয়ে থাকে? মাঙ্কি ক্যাপ দুটো বের করব?

সুদীপ মাথা নাড়ল, না, নিয়ে যায়নি। কারণ ও যখন নামল তখন ভঙ্গি দেখলে বুঝতে পারতাম। তাছাড়া বেঢপ জায়গায় রেখেছে গাড়িটা, নিশ্চয়ই পরে পার্ক করবে বলে ভেবেছে। যা হোক, যদি চাবি

থাকে তখন ক্যাপ বের করলে চলবে। দাঁড়া, একটা গাড়ি আসছে। ওটা চলে যাক।

কল্যাণ ঘাড় নেড়ে ঘুরিয়ে দেখল আর একটা গাড়ি আসছে। ধীরে ধীরে গতি কমাচ্ছে সেটা। এবার খুব অস্বস্তি শুরু হল কল্যাণের। আনন্দরা নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে গাছটার তলায়। ওদের যদি কিছু হয় তাহলে সে সুদীপের সঙ্গে সরে এল গাছটার আড়ালে। গাড়িটা ছুটে গেল না। গতি কমিয়ে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে হর্ন বাজাল। দুবার বাজাতেই একটু আগে আসা গাড়ির ড্রাইভার দরজার এসে দাঁড়াল, কি খবর?

নতুন গাড়ির ড্রাইভার সিটে বসেই উত্তর দিল, খুব মাল টানছ দোস্ত! আমাকে এখন শালা কলকাতায় ছুটতে হবে। শোন, সাহেব বলেছে কাল ঠিক ছটায় গাড়ি নিয়ে যেতে।

ছটায়? সাহেব কোথায় আছে?

প্যারাডাইসে। কলকাতা থেকে মেহমান এসেছে। জব্বর ফুর্তি। গাড়ি আজ ডায়মন্ডহারবারে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। ভোরবেলায় চলে যেও। কথা শেষ করে লোকটা গাড়ি ঘুরিয়ে কলকাতার দিকে চলে গেল।

দরজায় দাঁড়ানো ড্রাইভারটা একটা অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ করে পেছন ফিরল, দিল শালা ফুর্তিটা জবাই করে! উনি প্যারাডাইসে মজা মারবেন আর আমাকে এখানে রাত জাগতে হবে! বিরক্ত লোকটা ফিরে গেল নিজের গ্লাসের কাছে। ওকে বা কাউকে আর দেখা যাচ্ছিল না। আবার অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছে চরাচর। সুদীপ আরও মিনিটখানেক অপেক্ষা করল। তারপর কল্যাণকে ইঙ্গিত করে বেরিয়ে এল আড়াল ছেড়ে। নিঃশব্দে সে গাড়ির পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। চাবিটা রয়েছে লটকান। সে কল্যাণকে ইশারা করে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে দরজাটা খুলল। তারপর নিচু হয়ে সিটে বসে ওপাশের দরজাটা খুলে দিল।

কল্যাণের বুকের মধ্যে এখন হাতুড়ির শব্দ। দুটো পা প্রায় নিঃসাড়। সে চোখের কোণে সুদীপের দিকে তাকাল। গাড়ির আদল ছাড়া কিছুই নজরে এল না। আর দেরি করা উচিত হবে না এমন বোধ হওয়ামাত্র সে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে ছুটে এল দরজার কাছে। ভেতরের মানুষগুলো জমিয়ে মদ্যপান করছে। দরজার দিকে মুখ করে আছে একজন। সে বিস্মিত হওয়ার আগেই দুটো পাল্লা শব্দ করে বন্ধ করে শেকলে হাত দিল। উত্তেজনায় শেকলটা হাত থেকে গলে গেল প্রথমটায়, কাঁপুনি সত্ত্বেও দ্বিতীয়বারে সেটা হস্তগত করে হুকে আটকে দিতে পারল কল্যাণ। আর তখনই চিৎকার উঠল, আই, কে রে? কল্যাণ ততক্ষণে গাড়ির কাছে চলে এসেছে।

ইঞ্জিন চালু করে সুদীপ চিৎকার করল, উঠে আয়।

কোনরকমে সামনের আসনে বসে দরজা বন্ধ করতেই কল্যাণ টের পেল ওর শরীরে কোন সাড়া নেই। ওপাশের দরজায় যে ঘন ঘন শব্দ হচ্ছে, ঘরের ভেতরের চিৎকার কাচের দেওয়াল ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে আসছে, সুদীপ গাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে বড় রাস্তায় চলে এসেছে—এসবই ঘটে গেল অথচ টের পেল না যেন সে। ঘাম জড়ানো শরীরে শীতল অনুভূতি। একটা ছাড়া গরুকে কাটাতে সুদীপ গালাগাল করতে কল্যাণ চেতনায় ফিরল। পকেট থেকে রুমাল বের করে সুদীপের দিকে আধা অন্ধকারে তাকিয়ে বেশ লজ্জিত হল। সে কি সত্যি এতটা নার্ভাস! কই, সুদীপকে দেখে তো মনেই হচ্ছে না কিছু ব্যতিক্রম ঘটেছে। কল্যাণ মুখ ফিরিয়ে দেখল। পেট্রল পাম্প অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছে। কোন মানুষের সাড়া নেই পিছনে। দুপাশে কিছু চা-সিগারেটের দোকান এল। সেখানেও কোন সন্দেহ নেই। যখন সে দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল তখন লোকটার কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি। দরজা বন্ধ করা মাত্র চিৎকারটা উঠেছিল। সে দাঁড়িয়ে ছিল অন্ধকারে, লোকটা কি তাকে স্পষ্ট দেখেছিল? পুলিস জিজ্ঞাসা করলে হুবহু বর্ণনা দিতে পারবে? নিজের মনেই প্রশ্নগুলো নিয়ে উত্তাল হচ্ছিল কল্যাণ। সে বুঝতে পারছিল ওই আলোয় চকিতে দেখা কোন মুখ কেউ মনে রাখতে পারে না। কিন্তু যদি লোকটার স্মৃতি অসাধারণ হয়? অস্বস্তির কাটাটা কিছুতেই দূর হচ্ছিল না। এইসময় সে শিস শুনতে পেল। কোন চেনা গান নয়, অথচ বেশ খুশীর শিস দিচ্ছে সুদীপ গাড়ি চালাতে চালাতে। হেডলাইটের আলোয় সামনের পথ আলোকিত। পাম্প থেকে বেরিয়ে আসার পর ও একটাও কথা বলেনি। নিজেকে শক্ত করতে চাইছিল কল্যাণ। সুদীপ যদি নার্ভাস না হয় তবে সে কেন হবে? নড়েচড়ে বসল কল্যাণ। এইসময় সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, মালগুলো আলাদা করে রাখা আছে? আর একবার চেক করে নেয়।

সব ঠিক আছে। যতটা সম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলতে চেষ্টা করলে কল্যাণ। তারপর আবার পিছন দিকে তাকাল। অন্ধকারে কোন আলো চোখে পড়ছে না।

সুদীপ হাসল, ও নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। ওরা যখন ঘর থেকে ছাড়া পাবে তখন আমরা নাগালের বাইরে। মনে হচ্ছে প্রথম কাজটায় কোন বাধা পাব না। মর্নিং শোজ দ্য ডে।

কল্যাণ কোন জবাব দিল না। তার কেবলই মনে হচ্ছিল সুদীপ বড্ড বেশি স্মার্ট, এইটেই যেন শেষ পর্যন্ত ক্ষতির কারণ হয়ে না দাঁড়ায়।

রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেইখানে এসে বাঁ দিকে চেপে গাড়িটা দাঁড় করাল সুদীপ। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে বনেটটা খুলল। এখন যে কোন গাড়ি এই পথে গেলে ভাববে নির্ঘাৎ ইঞ্জিন খারাপ হয়েছে। আর তখনই আনন্দর গলা শুনতে পেল সে, সব ঠিক আছে?

হ্যাঁ। কল্যাণ জবাব দিল।

তুই পেছনের সিটে চলে আয়।

কল্যাণের দরজা খোলার শব্দ হল। কলকাতার দিক থেকে একটা ট্রাক আসছে। সুদীপ আরও ঝুঁকে পড়ল ইঞ্জিনের ওপর। না, কোনভাবেই মুখ দেখানো কাম্য নয়। আজকাল পথেঘাটে গাড়ি খারাপ হয়ে আছে দেখলে সাধারণ কোন ড্রাইভার পাড়াতে চায় না। ট্রাকটা বেরিয়ে যেতে স্বস্তি হল। বনেট নামিয়ে ড্রাইভারের সিটে ফিরে এল সুদীপ। পেছনের সিট থেকে আনন্দ বলল, তোদের ব্যাগে সব জিনিস আছে। আর দেরি করিস না, ভেতরে ঢোকার পর তোরা ঘন্টা চারেক সময় পাবি। তোরা লিগ্যাল পেয়ার নস, এটা মনে রাখবি। তোর ঘড়িতে কটা বাজে সুদীপ?
 
ইঞ্জিন চালু করে সুদীপ বলল, দশটা পাঁচ। লেটস গো। তারপর সে জয়িতার দিকে তাকাল। যেটুকু আলো ছিটকে আসছে তাতে জয়িতার মুখ স্পষ্ট না দেখা গেলেও বেশ রহস্যময়ী মনে হচ্ছে তাকে। জয়িতা বসেছে তার বাঁ দিকে। সে ঠাট্টার গলায় জিজ্ঞাসা করল, কিরে, সেন্ট মাখিসনি? তুই একটা হোপলেস! সেন্ট ফেন্ট না মাখলে প্রেম প্রেম ভাব আসে?

জয়িতা মাথা ঝাঁকাল, একটা সিগারেট দে তো।

পেছন থেকে আনন্দ বলল, না, সিগারেট খাবি না। ওটা দারোয়ানগুলো মনে রাখবে। আর তোরা নিজেদের তুই-তুই করে অ্যাড্রেস করবি না। এসব কাজে যারা আসে তারা তুইতোকারি করে না।

তুইতোকারি প্রেমে অচল, বুঝলি জয়ী, আমার কপালে কি মাল জুটল বল। সহানুভূতি জানা ভাই। তোকেও মেয়ে আই মিন প্রেমিকা ভাবতে হচ্ছে! জিভে শব্দ তুলল সুদীপ গাড়ি চালাতে চালাতে।

মাথা ঝাঁকাল জয়িতা, সেম টু ইউ।

আনন্দ বলল, অনেক হয়েছে, এবার রসিকতা বন্ধ কর। প্যারাডাইস দেখা যাচ্ছে।

ডোন্ট গেট এক্সাইটেড ম্যান। আমি ঠিক আছি। জয়িতা মাই হনি, তুমি ঠিক আছ?

একটা ঘুঁষি মারব সুদীপ, ন্যাকামি করিস না।

সুদীপ গাড়ির গতি কমাল। সমস্ত চরাচর অন্ধকারে ড়ুবে আছে। শুধু স্বপ্নের জাহাজের মত প্যারাডাইস আলোয় ভাসছে। ধীরে ধীরে ও বন্ধ গেটের সামনে গাড়ি নিয়ে হর্ন বাজাল দুবার। একটু বাদেই সেই দারোয়ানদের একজন সামান্য ফাঁক করল গেটের কপাট, আট বাজে বন্ধ হো যাতা হ্যায় সাব।

সুদীপ জানলায় মুখ এনে বলল, টেলিফোনসে বাত হুয়া থা হামারা।

চাপা গলায় জয়িতা বলল, জিভ দিয়ে চটকায় আহা রে, কি হিন্দী!

লোকটা এবার জিজ্ঞাসা করল, কেতনা আদমি হ্যায়?

সিরিফ দো জন।

কাঁহাসে আ রহা হ্যায়?

কলকাত্তা।

এবার লোকটা দরজা খুলল। সুদীপ গাড়িটা ঢোকাতেই লোকটা চাপা গলায় বলল, ললাটনেকা টাইমমে মুঝে ইয়াদ রাখিয়ে সাব। সুদীপ হাসল। তারপর দেখল সাদা নুড়ি বিছানো পথ চলে গেছে ভেতরে। ডানদিকে বেশ কয়েকটা গাড়ি পার্ক করা রয়েছে। দরজায় আগল তুলে লোকটা বলল, সাব, ডাইনামে গাড়ি রাখিয়ে।

আর একটু এগিয়ে সুদীপ গাড়িটা একটু মুখ বেঁকিয়ে পার্ক করল। যেন প্রয়োজনেই ইঞ্জিন চালু করে ছুটে যেতে পারে সদর গেটের দিকে। সে জয়িতাকে ইশারা করল। তারপর দুটো ব্যাগ দুজনে নিয়ে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। সুদীপ যখন দরজায় চাবি দিচ্ছিল তখন জয়িতা চারপাশে তাকাল। এপাশে সুন্দর লন আর কিছু ফুলের গাছ। ঝকঝকে আলো চারপাশে। এবার আরও তিনজন যুনিফর্ম পরা দারোয়ানকে দেখতে পেল সে। অর্থাৎ মোট চারজন এই জায়গার পাহারায় আছে। হঠাৎ কোমরে হাতের স্পর্শ পেল জয়িতা। সে ছিটকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই সুদীপ বলল, নো। কিছু মনে করিস না, ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য করতে হবে তো! এইসব জায়গায় যারা ফুর্তি করতে আসে তারা এইভাবেই হাঁটে। সুদীপের কাঁধের কাছে প্রায় তার কাধ।

জয়িতা বলল, আলগা করে রাখ, আমার সুড়সুড়ি লাগছে।

কয়েক পা হাঁটতেই একটা দারোয়ান তাদের দেখে দাঁত বার করে হাসল। ওরা কি ধান্দায় এসেছে সেটা বুঝে যেন সে গলিত হচ্ছে। হাত বাড়িয়ে একটা দিক দেখিয়ে লোকটা উচ্চারণ করল, অফিস উধার।

মগ্ন ভঙ্গিতে নুড়ির ওপর পা ফেলে খানিকটা এগোতেই সুদীপ একটা ছোট্ট বাড়ি দেখতে পেল। গাছগাছলার মধ্যে আলো জ্বেলে কাউন্টার সমেত অফিসঘর করা হয়েছে। কমপ্লিট সুট পরা একটা লোক ডটপেন হাতে নিয়ে কাউন্টারের ওপারে দাঁড়িয়েছিল। কাউন্টারে ছোট্ট বোর্ডে লেখা রিসেপশন। লোকটি ওদের দেখে উষ্ণ হাসি হাসল, গুড ইভনিং স্যার। ওয়েলকাম টু প্যারাডাইস। বাট আই অ্যাম অ্যাফ্রেড ইউ আর লিটল বিট লেট।

বেটার লেট দ্যান নেভার। আই মেড এ কল। জয়িতার কোমর থেকে হাত সরিয়ে সুদীপ পকেট থেকে দামী সিগারেটের প্যাকেটটা খুলে এগিয়ে ধরে ইঙ্গিত করল।

লোকটা মাথা নাড়ল, নো, থ্যাঙ্কস। হোয়াটস ইওর গুড নেম প্লিজ?

এম রয়। সুদীপ সতর্ক ভঙ্গিতে গ্লাভসটার দিকে তাকাল। এটা থাক হাতে, অনেকেই তো পরে। লোকটা একটা প্যাড টেনে নিয়ে নজর বোলাচ্ছিল। জয়িতা তখন কতকগুলো নোটিশের দিকে তাকাচ্ছিল। এই করে যতটা সম্ভব লোকটার চোখ এড়ানো যায়! নোটিশ বোর্ডে নিয়মকানুন লেখা রয়েছে। দিবা-ভ্রমণের জন্যে ভ্রমণার্থীদের পঁচিশ টাকা দিতে হবে। তারা সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত উদ্যানে থাকতে পারবেন, আধুনিক কুঁড়েঘর ব্যবহার করতে পারবেন কিন্তু সাঁতার কাটা নিষিদ্ধ। কাউকে বিরক্ত করা চলবে না, মদ্যপান অবৈধ। রেস্তোরাঁ থেকেই খাবার কিনতে হবে। উদ্যানে রাত্রিবাসের জন্যে এ সি এবং নন এ সি কটেজে সব রকম আধুনিক ব্যবস্থা আছে। প্রতি রাত্রির জন্যে শীততাপনিয়ন্ত্রিত কটেজের ভাড়া আড়াইশো থেকে চারশো টাকা। একমাত্র এই শ্রেণীর অতিথিরাই সাঁতারের পুল ব্যবহার করতে পারবেন। সাধারণত উদ্যানে মদ খাওয়া অবৈধ হলেও কটেজের ঘরে বাইরের মানুষকে বিরক্ত না করে সেটা খাওয়ায় আপত্তি নেই। তবে যে কোন মুহূর্তেই উদ্যান কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা থাকবে কাউকে বহিষ্কার করার।

জয়িতা আরও হুমকি দেওয়া উপদেশাবলী পড়ল। এই সময় সুদীপ খাতায় সই করছিল। এম রায় লেখবার সময় তার নিজেরই হাসি পেল। তিনশো টাকা অ্যাডভান্স নিয়ে লোকটি বলল, আপনাদের রাত শুভ হোক।

ধন্যবাদ। আচ্ছা আমরা কি একটু বাগানটা ঘুরে দেখতে পারি? খুব গল্প শুনেছি এই বাগানের। কাল ভোরেই চলে যাব তাই আর সুযোগ হবে না হয়তো। সুদীপ হাসল।

দুঃখিত স্যার। রাত্রে আটটার পর কারও বাগানে থাকা নিষেধ।

সুদীপ একটা কুড়ি টাকার নোট কাউন্টারে রাখল, দেখুন না চেষ্টা করে।

চকিতে নোটটা সরিয়ে নিয়ে চারপাশে তাকিয়ে লোকটা বলল, আধ ঘণ্টার বেশি থাকবেন না। বস আসবেন এগারোটার পরে। তার মধ্যে কটেজে ফিরে যাবেন।

ধন্যবাদ।

লোকটা বেল বাজাতেই অন্ধকার কুঁড়ে স্বাস্থ্যবান একটা বেয়ারার উদয় হল। রিসেপশনিস্ট তার দিকে একটা চাবি এগিয়ে দিয়ে বলল, কটেজ নাম্বার টুয়েলভ। সাহেবরা কিছুক্ষণ বাগানে থাকবেন, হাবিবকে বলে দিও।
 
সুদীপ খুব সহজ ভঙ্গিতে জয়িতার পাশে এসে দাঁড়াল, হনি, লেটস গো। বলে একহাতের বেড়ে জয়িতাকে টেনে কাছে এনে বেয়ারাকে অনুসরণ করল।

জয়িতা ফিস ফিস করে বলল, ইটস টু মাচ সুদীপ!

সুদীপ সেই গলায় জানাল, এইটেই স্বাভাবিক পাঁচু।

এই আলোকিত বাড়িটাই প্রবেশপথ। কারণ দুদিকে চারটে ঘরের মাঝখানে প্যাসেজ, সেটা গিয়ে পড়েছে বাগানে। ওপাশে কোথাও জেনারেটার চলছে। তার আওয়াজ চেপে রাখার চেষ্টা সত্ত্বেও সক্রিয়। সুদীপ এবং জয়িতা বাগানাটার দিকে তাকাল। মাঝে মাঝে ছোট লন, সাজানো ফুলের গাছের মধ্যে দিয়ে বাধানো পথ চলে গেছে। গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে রাখা আলো অন্ধকারকে পাতলা করে জ্যোৎস্নার আভাস এনে দিয়েছে। এখন বাগানে কেউ নেই। বেয়ারাটা ফুলের গন্ধে ড়ুবিয়ে তাদের নিয়ে এল পেছনদিকে। পর পর কটেজগুলো রহস্যময় আলো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সুদীপ বেয়ারাটাকে জিজ্ঞাসা করল, এইগুলো?

না স্যার। এসি কটেজ ওপাশে।

নন-এসি কটেজের সামনে দিয়ে হাঁটার সময় নারী-পুরুষের সম্মিলিত হাসির শব্দ কানে এল। স্টিরিওতে বাজনা বাজছে আর তার সঙ্গে নেশায় জড়ানো হুল্লোড়। সুদীপ বেয়ারাটার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল, আজকে তোমাদের গেস্ট কি রকম?

বেয়ারা মাথা নাড়ল, আর দুটো কটেজ খালি আছে। হেভি ডিম্যান্ড। নিশ্চিন্তে ফুর্তি করার ব্যবস্থা আর কোথায় পাবেন?

ঠিক। তুমি এখানে অনেকদিন আছ?

না স্যার। আগে সার্কুলার রোডের একটা হোটেলে কাজ করতাম।

একটা রঙিন কটেজের সামনে এসে দরজায় চাবি ঢোকাল বেয়ারাটা। ভেতরে ঢুকে আলো জ্বেলে এ সি চালু করল। জয়িতা মুগ্ধ হয়ে গেল। এই অজ পাড়াগাঁয়ে এমন আধুনিক ব্যবস্থা সম্ভব? বেয়ারা বলল, আপনারা যদি রাত্রে খাবার চান বলে দিন।

সুদীপ মাথা নাড়ল, না, আমরা খেয়ে এসেছি।

বেয়ারা জিজ্ঞাসা করল, ড্রিঙ্কস? আমাদের নিয়ম হল ঘরে বসে ড্রিঙ্ক করা চলবে কিন্তু সেটা এখান থেকেই নিতে হবে। কি আনব স্যার?

সুদীপ জয়িতার দিকে তাকাল। জয়িতা সোফায় বসে পড়েছে। সে বেয়ারাটাকে নিচু গলায় বলল, মুশকিল হল মেমসাহেব ড্রিঙ্ক করেন না। একা একা খেতে আমার খুব খারাপ লাগে।

বেয়ারা হাসল, নো প্রব্লেম স্যার। আমাদের ককটেল রুমে গিয়ে খেয়ে আসতে পারেন।

ককটেল রুম! সেটা কোথায়?

ঠিক এই কটেজগুলোর পেছনে। ওখানে যাওয়ার সময় চাবিটা নিয়ে যাবেন।

অনেক ধন্যবাদ। সকালে যাওয়ার আগে তোমার দেখা পাব নিশ্চয়ই!

হ্যাঁ স্যার। আমাদের তো চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি। আপনারা কি এই রাত্রে বাগানে যাবেন?

হ্যাঁ, একটু দেখব।

ঠিক আছে, আমি হাবিবকে বলে দিচ্ছি স্যার। সঙ্গে চাবিটা রাখবেন। ওতে কটেজ নাম্বার আছে।

হাবিব কে?

হেড গার্ড। গুডনাইট স্যার। দাঁত বের করে জয়িতার দিকে হাসি ছড়িয়ে লোকটা চলে গেল।

এখন চারধার নিঃশব্দ নয়। নারীপুরুষের হুল্লোড়-ধ্বনি ছিটকে ছিটকে আসছে। সুদীপ চটপটে গলায় বলল, জয়ী, উঠে পড়।

জয়িতা উঠে দাঁড়াল, শাড়িতে আমাকে খুব বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে, না?

উঁহু! ডিলিসিয়াস!

ভদ্রভাবে কথা বল্ সুদীপ। আই উইল নট টলারেট দিস।

জাস্ট এ মিনিট, আমি লু থেকে আসছি। সুদীপ পাশের দরজা খুলে টয়লেটে চলে গেল। জয়িতার মেজাজ চড়ে যাচ্ছিল। সুদীপটার কথাবার্তা একটু লাগামছাড়াই। মনে কোনও পাপ নেই। কিন্তু এভাবে কখনও একটা ঘরে রাত্রে ওর সঙ্গে থাকেনি। শাড়িটার জন্য অস্বাচ্ছন্দ-বোধ শুরু হল জয়িতার। ভীষণ রকম মেয়ে মেয়ে বলে মনে হচ্ছে। শরীরের গঠন অনুযায়ী সে মেয়ে নিশ্চয়ই কিন্তু মেয়েলিপনা তাকে কখনই কবজা করেনি। নিজের শরীর সম্পর্কেও সে সচেতন ছিল না। তিন বন্ধুর চোখে কোনদিন সেরকম ছায়া দ্যাখেনি সে। বরং ওরা স্বচ্ছন্দে কলেজের লবঙ্গলতিকাদের সম্পর্কে রসালো আলোচনা করেছে তার সামনে। ন্যাকা মেয়েগুলোর সমালোচনার সময়ে জয়িতাও গলা মিলিয়েছে ওদের সঙ্গে। নিজেকে আলাদা করে ভাবার কোন কারণ ঘটেনি। কিন্তু আনন্দর মায়ের সঙ্গে সময় কাটানোর পর থেকেই একটা অস্বস্তি এটোর মত লেগে আছে মনে। সুদীপ যখন গাড়িতে তুলে নিয়ে রসিকতা আরম্ভ করল তখন থেকেই সেটা বেড়ে যাচ্ছে। প্রেম ফ্রেম সে জীবনে করেনি। করার কথা মাথায় আসেনি। আনন্দ আজকের প্রোগাম জানানোর পর তার হাসি পেয়েছিল। আউট অফ অল পার্সেন সুদীপের সঙ্গে তাকে প্রেমের অভিনয় করতে হবে। মজাও লেগেছিল। কিন্তু এখানে আসার পর সুদীপ এমন ভাব করছে যে, সে যেন একটি রক্তমাংসের খাদ্যবস্তু।

টয়লেট থেকে বেরিয়ে এসে সুদীপ টেবিল থেকে চাবি নিল, ফাইভ স্টার হোটেলের সঙ্গে পাল্লা দেবে, বুঝলি? বাথরুমে দি সোপ অফ বিউটিফুল ওমেন রয়েছে?

মানে? জয়িতার চোয়াল শক্ত হল।

ক্যামে হোয়াইট। ক্যানাডার তৈরি। ভাব ব্যাপারটা।–তোর কি হল?

কিছু না।

চল, ওদের বস আসবার আগেই পাক দিয়ে আসি।

জয়িতা সুদীপের দিকে তাকাল। খুব স্বাভাবিক দেখাচ্ছে ওকে। সেকি ভুল বুঝেছে? জয়িতা উঠল। দরজায় চাবি দিতে গিয়ে সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, ব্যাগগুলো এখানে রেখে যাওয়া কি সেফ হবে? ড়ুপ্লিকেট কী থাকতে পারে!

জয়িতা বলল, ব্যাগ নিয়ে বাগানে ঘুরলে তো ওরা সন্দেহ করবে।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওরা চারপাশে তাকাল। সন্দেহজনক কিছুই নজরে পড়ছে না। সুদীপ বলল, চল, আমার হাত ধর।

জয়িতা চোখের তলায় তাকাল, হাত ধরতে হবে কেন?

প্রেম প্রেম ভাব আনতে হবে না? সবাই আমাকে কেমন স্যার স্যার বলছে দেখেছিস। আমার বয়সটা যেন কোন ফ্যাক্টারই নয়। সেক্স নিয়ে যারা ব্যবসা করে তারাও কেমন অন্ধ হয়ে থাকতে পছন্দ করে।

সুদীপ কথা শেষ করা মাত্রই ওপাশের কটেজের দরজা খুলে গেল। একটি মেয়ে ছিটকে বেরিয়ে এল বারান্দায়, না আমাকে যেতে দিন, এরকম কথা ছিল না। আমি এখানে কিছুতেই থাকব না।

সেইসময় দরজায় একটি প্রৌঢ় এসে দাঁড়াল, ওসব বুজরুকি ছাড়। টাকা দিয়েছি যখন তখন যা বলব তাই করতে হবে। ভেতরে এসো বলছি, নইলে হাবিবকে ডাকব।

আপনার পায়ে পড়ি। তিনজন থাকবেন তা ওরা বলেনি আমাকে।

আমি তো একজনের টাকা দিচ্ছি না। এসো ঘরে, মিলি মিসি করি কাজ, নাকি হাবিবকে ডাকব? মেয়েটি মাথা ঝাঁকাল। তারপর পায়ে পায়ে ঘরে ঢুকে নিজেই দরজা বন্ধ করল।

সুদীপের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। ওর দৃষ্টি বন্ধ দরজার ওপর। জয়িতা নিচু গলায় বলল, বি ইজি। ছোট ঝামেলায় জড়িয়ে পড়িস না। চলে আয়।

সুদীপ নিঃশ্বাস ফেলল শব্দ করে, ইচ্ছে করছে মুণ্ডুগুলো ছিঁড়ে ফেলি। টাকা দিয়ে মেয়েটাকে কিনে নিয়েছে। আশেপাশের গ্রামের কোন গরিব মেয়ে হয়তো!

সুদীপের হাত ধরে জয়িতা বাগানে চলে এল, সব কটেজে নিশ্চয়ই একই নাটক হচ্ছে, না?
 
বাগানটা বেশ বড়। অন্তত এই মুহূর্তে ওরা শেষ দেখতে পাচ্ছে না। একদিকে যেমন সাজানোলন, যত্নে গড়া ফুলের বিছানা তেমনি অন্যদিকে ঘনজঙ্গলের আদল তৈরির চেষ্টা হয়েছে। এরই ফাঁকে ফাঁকে ডে-হাট। চারটে খুঁটির ওপর খড়ের ছাউনি, নিচে ত্রিপল পাতা, ইলেকট্রিক লাইন আছে। এখন এইগুলো ফাঁকা। বুনো গন্ধ বের হচ্ছে সব গাছেদের শরীর থেকে। সুদীপ জরিপ করে নিল। পুরো এলাকাটা তিনটে ভাগে বিভক্ত। রিসেপশন এবং গাড়ির পার্কিং সামনের দিকে। মাঝখানে বাগান, জঙ্গল, জেনারেটর রুম এবং নন-এসি কটেজ। তৃতীয় ভাগে এসি কটেজ, সাঁতারের পুল এবং ককটেল রুম, যার কথা বেয়ারাটা বলল। এসি কটেজ থেকে দৌড়ে রিসেপশনের কাছে পৌঁছাতে তার মিনিট দুয়েক লাগবে কিন্তু জয়িতার দেরি হবে। ও নিচু গলায় বলল, আমার কোমরে হাত রাখ। জেনারেটারটা দেখে আসি। জয়িতা এবার আপত্তি করল না। ওরা যেন বেড়াতে বেরিয়েছে এমন ভঙ্গিতে বাগানের পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগল। মাঝে মাঝে জঙ্গলের গায়ে ঝুলিয়ে রাখা ইলেকট্রিক বালবের আলো তাদের গায়ে পড়ছিল বটে কিন্তু তারা কোন পাহারাদার দেখতে পাচ্ছিল না। হঠাৎ সুদীপ খড়ের ছাউনির তলায় ত্রিপলের নিচে গিয়ে বলল, মিনিট দশেক এখানে শুয়ে থাক। কেউ আমাদের লক্ষ্য করছে কিনা বোঝ যাবে। তুই বোস, তোর কোলে মাথা রেখে শুচ্ছি।

কোন দরকার আছে? কাউকে কাছাকাছি দেখছি না। জয়িতা মৃদু আপত্তি জানাল।

হাতে সময় আছে যখন তখন একটু রিল্যাক্স করা যাক।

জয়িতা হাঁটু মুড়ে বসল। সুদীপ পা ছড়িয়ে দিয়ে তার কোলে মাথা রেখে বলল, একটু গন্ধ-ফন্ধ মেখে এলে পারতিস।

তোর তাতে কি? তোকে যা করতে বলা হয়েছে তাই কর!

করছি তো। এইসময় প্রেমিকারা ঠিক কি কি করে বল তো? মানে তাদের কি কি বিজনেস থাকে? হাতটাত নিশ্চয়ই ধরে। গানও গায় চাঁদের দিকে তাকিয়ে। তুই একটা গান গা জয়ী। ঘুম ঘুম চাদ মার্কা গান। সুদীপ চোখ বন্ধ করল।

ট্র্যাস! কতক্ষণ শুয়ে থাকবি? তোর কোমরের ওপরের শক্ত মতন জিনিসটা একটু সরা তো, আমার পায়ে লাগছে। জয়িতা কথাটা বলে নিজেই সরিয়ে দেওয়ার জন্যে হাত বাড়িয়ে আবার সরিয়ে নিল। রিভলভারটা সরাতে চাইলেও সরানো যাবে না এখন। সে চোখ বন্ধ করল। তারপর মনটাকে শান্ত করার জন্যেই গুনগুন করল, ওয়ান্না বি স্টার্টিং সামথিং।

সুদীপ মাথা নাড়ল, চমৎকার। বাংলা গান ট্রাস আর মাইকেল জ্যাকসন—

নট দ্যাট। ওকে থামিয়ে দিল জয়িতা, ইট ডিপেন্ডস অন মুড।

আপনারা কে?

ঠিক এইসময় অন্ধকার ফুঁড়ে একটি বিশাল শরীর সামনে এসে দাঁড়াল। সুদীপ কোন জবাব দিল না। জয়িতা বলল, আমরা এখানে রাত কাটাতে এসেছি।

ভাল করেছেন। কিন্তু এতরাত্রে বাগানে থাকা নিষেধ। উঠুন।

কেন? আমরা তো কারও ক্ষতি করছি না। জাস্ট বসে আছি এখানে।

বসা শোওয়া সব নিজের কটেজে গিয়ে করবেন। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল লোকটা।

এবার সুদীপ উঠে বসল। তারপর পকেট থেকে চাবিটা বের করে এগিয়ে ধরল, আমাদের আধঘণ্টার জন্যে বাগানে থাকার অনুমুতি দিয়েছেন রিসেপসনিস্ট।

চাবিটা হাতে নিয়ে সেই আধ-অন্ধকারে উলটে-পালটে দেখল লোকটা। সুদীপ বলল, আমরা আধঘণ্টার মধ্যেই চলে যাব হাবিববাবু।

লোকটা হাঁ করে তাকাল। তারপর চাবিটা ফিরিয়ে দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। বাবু হয়ে বসল সুদীপ, কি বলেছিলাম একটু আগে? দিস প্লেস ইজ ওয়েল-প্রটেক্টেড। কিন্তু আজ রাত্রে ঠিক কতগুলো পাহারাদার আছে তা বোঝা যাচ্ছে না।

জয়িতা বলল, হাবিববাবু তো ছাড়পত্র দিয়েছেন। চল একটু ঘুরে দেখি।

সুদীপ জয়িতার হাত ধরে উঠল। ওরা যেদিকে হাবিব চলে গিয়েছিল সেইদিকে পা বাড়াল। না, ধারে কাছে কেউ নেই। এবং তখনই কুকুরের ডাক এবং শিস শুনতে পেল ওরা। জয়িতা সুদীপের হাতে চাপ দিতেই সে মুখ ফিরিয়ে দেখল দূরের একটা প্যাসেজ দিয়ে কেউ হাঁটছে। তার হাতের চেনে চারটে কুকুর বাঁধা। ওরা লোকটাকে যেন টেনে নিয়ে চলেছে। সুদীপ বলল, যাক, নেহাতই অ্যালসেশিয়ান! তাহলে এখানে কুকুরও আছে। লেটস গো। ওরা হাঁটতে হাঁটতে জেনারেটারের শব্দ ধরে এগিয়ে গেল কাছাকাছি। এখানে গাছের আড়াল বেশি। জেনারেটার রাখা হয়েছে একান্তে একটি ঘরে। তার দরজা খোলা, আলো জ্বলছে ভেতরে। দরজায় টুল পেতে একটি পাহারাদার বসে আছে চুপচাপ। ধারে কাছে আর কেউ নেই। সুদীপ লক্ষ্য করল ঘরটির পেছনে একটা জানলা আছে। জানলাটাও খোলা।

ওরা আবার লনে ফিরে এল। সুদীপ বোতাম টিপে ঘড়ির আলো জ্বেলে সময় দেখল। তারপর বলল, প্রচুর সময় আছে। চল ঘরে যাই।
 
ফেরার পথে ওরা দুজন পাহারাদারের দেখা পেল। গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে তারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি মানুষ সুনির্বাচিত। ওদের দেখে চারটে কুকুর একসঙ্গে ডেকে উঠল। সুদীপ জয়িতার কোমরে হাত রেখে নিবিড়ভাবে হেঁটে এল নন-এসি কটেজগুলোর সামনে দিয়ে। এবার সেখানেও একজনকে নজরে পড়ল। যাওয়ার সময় লোকটিকে দেখতে পায়নি। এখনও ঘরে ঘরে বাজনা বাজছে, হল্লোড় চলছে। নিজের কটেজে ঢুকে জয়িতা বিছানায় শরীর এলিয়ে বলল, এবার শাড়ি চেঞ্জ করি?

আর একটু বাদে। সুদীপ সোফায় বসে সিগারেট ধরালো।

জয়িতা হাত বাড়াল, আমাকে একটা দে।

সুদীপ মাথা নাড়ল, বাঙালি মেয়ের সিগারেট খেতে নেই।

জয়িতা চেঁচাল, সুদীপ!

সুদীপ প্যাকেটটা ছুঁড়ল, নিজেরে পায়ে দাঁড়াতে শেখ তো। অন্যের প্যাকেট দেখলেই সিগারেট খেতে ইচ্ছে করে, না? শোন, হাবিবকে নিয়ে আমরা বাগানে পাঁচজনকে দেখতে পেলাম। দিজ গাইজ আর রিয়েল টাফ। কিন্তু এদের সঙ্গে আমস আছে কিনা সেটা বোঝা গেল না। আমাদের প্ল্যানটা মনে আছে তো?

সিগারেট ধরিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে জয়িতা বলল, আছে।

মনে হচ্ছে কোন অসুবিধা হবে না। তুই তো বেশ মেজাজে শুয়ে আছিস, আনন্দ আর কল্যাণের কথা ভাব? পেছনের সিটের নিচে কিভাবে বসে আছে ওরা!

এসবই খেলার অঙ্গ ব্রাদার। নির্বিকার মুখে ধোওয়া ছাড়ল জয়িতা।

তোকে মাঝে মাঝে খুব নিষ্ঠুর মনে হয়।

তাই?

ভগবান তোকে মেয়েলি কোন গুণ দেয়নি।

দিলে কি তোর সঙ্গে প্রেম করতাম?

সুদীপ কাঁধ ঝাঁকিয়ে ওপরের দিকে তাকাতেই স্পিকারটা দেখতে পেল। তার নিচেই সুইচ। সে উঠে ওটা অন করতেই বাজনা শুরু হল। দারুণ গরম বাজনা। সুদীপ জিভে শব্দ করল, বাঃ, এই হল ব্যবস্থা। আমার খুব নাচতে ইচ্ছে করছে! ওয়ার্ম আপ করাই?

পারিস তুই! এখন নাচের কথা ভাবছিস? জয়িতা উঠে দাঁড়াল। তারপর ব্যাগ থেকে জিনিসগুলো বের করে আলাদা করল। দুজনের কাছে দুটো ভাগ থাকবে। সীতা রায় যখন টের পাবে তাদের কিছু হারিয়েছে তখন বেশ দেরি হয়ে যাবে। পাঁচভরি সোনার হার চুরি করার সময় অবশ্য একটা অপরাধবোধ কাজ করেছিল জয়িতার মনে। কিন্তু এখন সেটা মরে গেছে অজান্তেই।

নিজের জিনিসগুলো কাছে রেখে সে সুদীপকে বলল, এখন কি করবি?

সুদীপ বলল, একবার ককটেল রুমে যাব। মনে হচ্ছে জায়গাটা ইন্টারেস্টিং হবে। ঠিক দেড়ঘণ্টা পরে আমরা কাজ শুরু করব। তুই ততক্ষণ রেস্ট নে। এখান থেকে বেরিয়ে একটু পরে জেনারেটাবের কাছে পৌঁছাবি। যদি লোকটাকে অ্যাভয়েভ না করতে পারিস তাহলে জানলাটাকে ব্যবহাব করবি। তারপর দৌড়ে যাবি রিসেপশনের দিকে। অন্ধকার হয়ে গেলেই আমি যা করার কবব। গুড লাক! আমি এগোচ্ছি।

জয়িতা ডাকল, সুদীপ?

সুদীপ ঘুরে দাঁড়াল, কি?

জয়িতা মাথা নাড়ল, না, থাক।

কি বলবি বল্ না?

আমি তোর সঙ্গে যাব? একা থাকতে ইচ্ছে করছে না।

সুদীপ কিছু চিন্তা করল। তারপর হেসে বলল, ভয় পাচ্ছিস?

না, ভয় নয়। জাস্ট একা থাকতে চাইছি না। জানি না কি হবে আজকে, কিন্তু কিছুক্ষণ তো একসঙ্গে থাকি। জয়িতা স্পষ্ট চোখে তাকাল।

ও কে! চল্।

ওরা দুজন প্রস্তুত হয়েই ঘর থেকে বের হল। এবার উলটোদিকে যাত্রা। সেখান থেকে উল্লাস ছিটকে আসছে বাতাসে। ওরা একটি আলোকিত দরজা দেখতে পেল। কাছাকাছি যেতেই একটি সুবেশ মানুষ এগিয়ে এসে হাত বাড়াল। সুদীপ তাকে কটেজের চাবিটা দেখাতেই লোকটি ঝুঁকে হেসে বলল, গুড ইভনিং স্যার। ইউ আর ওয়েলকাম ইন দিস প্যারাডাইস।

ককটেল রুমের দরজা খুলে ঢুকন্স ওরা।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top