ঘুটঘুটে অন্ধকার নয়, মাঝে মাঝেই দ্বীপের মত আলো দেখা যাচ্ছে এখানে ওখানে। বাসের ভেতরে আলো জ্বলছে। আনন্দর মনে হচ্ছিল এটা নিবিয়ে রাখলেই ভাল হত। কারণ তার পরিচিত একজন অনেকক্ষণ থেকে লক্ষ্য করছেন। শেষ পর্যন্ত এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হল না। আনন্দ গলা তুলে জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছেন?
আধ-খুলন্ত প্রৌঢ়টি বললেন, আছি দেখতেই পাচ্ছ। পড়াশুনা কেমন হচ্ছে?
হচ্ছে যেমন হয়। ইচ্ছে করেই কথাটা বেঁকিয়ে বলল আনন্দ। এতক্ষণ উনি যেভাবে তাকাচ্ছিলেন তাতে মনে হয়েছিল কথা না বললে অন্যায় হবে। কিন্তু কথা শুরু করতেই কায়দা শুরু করেছেন। ওর গ্রামের কিছু মানুষকে এই কারণেই সে সহ্য করতে পারে না। প্রৌড় এবার বললেন, মন দিয়ে পড়াশুনা কর। তোমার বিধবা মায়ের কষ্ট তুমি ছাড়া আর কে দূর করবে! তোমার বাবা কি সরল মানুষ ছিলেন।
আনন্দ প্রতিটি শব্দ আলাদা উচ্চারণ করলে, আমার মা আপনাকে কষ্টের কথা বলেন নাকি? কি আশ্চর্য, আমাকে ওসব বলেন না!
মানে? কি বলতে চাইছ তুমি?
খুবই সামান্য কাকাবাবু। আমার মায়ের কি কি কষ্ট আছে সেটা তো আপনার জানার কথা নয়। কেন কথা বলার জন্যে কথা বলছেন?
সুদীপ এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা আপনি স্কুলের শেষ পরীক্ষায় কত পার্সেন্ট নম্বর পেয়েছিলেন? ও বিরাশি পেয়েছিল। কেন ফটাফট জ্ঞান দেন?
কথাটা শেষ হওয়ামাত্র একটা চাপা হাসি উঠল চারপাশে। দু-একজন আলোচনা শুরু করে দিলেন। কুড়ি বছর আগে যত ছেলেমেয়ে হায়ার সেকেন্ডারিতে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করত এখন তার দ্বিগুণ করে। যত নম্বর এরা এখন পায় তখন সেটা স্বপ্নেও ভাবা যেত না। এই সময়ের ছেলেরা বেশি ব্রিলিয়ান্ট কিনা তাই নিয়ে তর্ক শুরু হল। আনন্দ দেখল সেই প্রৌঢ় ভদ্রলোক নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু লোকটা চটেছে এবং সুযোগ দিলেই চিমটি কাটার চেষ্টা করবে। ছোবল মারার ক্ষমতা নেই। সে চাপা গলায় সুদীপকে বলল, কেন আগবাড়িয়ে কথা বলতে যাস!
গা জ্বলে যায়।
কখনও কখনও চামড়া মোটা করতে হয়।
সুদীপ কাঁধ ঝাঁকাল, যারা জীবনে কোন দায়িত্ব নেবে না তারাই নিরাপদে দাঁড়িয়ে জ্ঞান দিয়ে যায়।
আনন্দ আর কথা বাড়াল। সুদীপের বাড়ির অবস্থা সে জানে। প্রাচুর্য সেখানে দমবন্ধ করে ছড়ানো। ওর নিকট আত্মীয়স্বজন যে স্তরের তাতে ভারতবর্ষের একশ্রেণীর সুবিধের চাবি হাতে নিয়ে জন্মানো ছেলেমেয়ের মত সেইরকম জীবনটাকে গুছিয়ে নিতে পারত। ইংলিশ মিডিয়ামে ওর রেজাল্ট চোখে পড়ার মতই ছিল। ও তার নম্বরটা চেঁচিয়ে বলেছে কিন্তু নিজেরটা বলতে লোকগুলো হোঁচট খেত। অথচ সুদীপ জে ই-তে বসল না। কিন্তু তার ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হবার ইচ্ছে নেই জানার পর গ্রামের যে পেরেছে সে জ্ঞান দিয়েছে।
বাস থেকে নেমে জয়িতা বলল, জেনারেটর চলছে রাজার মতন।
আনন্দ বলল, রাজার মতনই আছে ওরা।
সুদীপ উদাস গলায় বলল, আজ রাতে রাজা যাবে বনবাসে। চক্ষুলজ্জা বলেও একটা কথা আছে, সমস্ত গ্রামে টিমটিমে হ্যারিকেন জ্বলছে আর ওখানে আলোর ফোয়ারা ছুটছে। আর এসব মানুষ মেনে নেয় চুপচাপ।
কল্যাণ বলল, এটা কোন অভিযোগ নয়। আমার সামর্থ্য থাকা অপরাধ? সেটা আমাকে অর্জন করতে হয়েছে। আলো জ্বালাবার ব্যবস্থা রাখার জন্যে তোর রাগ করার যুক্তি নেই।
ওরা ডায়মন্ডহারবার রোড ধরে কয়েক পা এগিয়ে আসার পর পুরো এলাকাটা দেখতে পেল। ঠিক রাস্তার কয়েক পা নিচে মাধবীলতার গাছে সাজানো গেট। দেড় মানুষ উঁচু পাঁচিল তার দুপাশ থেকে চলে গেছে বাড়িটাকে ঘিরতে। লোহার গেটটি বন্ধ। কিন্তু ভেতরের আলোয় বোঝা যাচ্ছে সাদা নুড়ি বিছানো পথ চলে গেছে ভেতরে। গেটের দুপাশে দুজন প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে য়ুনিফর্ম পরে। ওরা জানে লোকদুটো নেপালি এবং খুব অনুগত। গেটের সামনে গাড়ি এসে দাঁড়ালে একজন গেট খুলে দেয়, অন্যজন প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিক নির্দেশ করে। এদের বিশদ বিবরণ চারজনেই জানে। ওরা দেখল গেটের ওপর ইংরেজিতে লেখা আছে জায়গাটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অতএব প্রবেশ এবং প্রস্থান অনুমতি ব্যতিরেকে সম্ভব নয়। যারা রাত্রে থাকবেন না তাদের বলা হয়েছে সন্ধ্যে সাতটার মধ্যে উদ্যান ছেড়ে যেতে হবে নইলে নিরাপত্তার দায়িত্ব নেওয়া কর্তৃপক্ষের সম্ভব নয়। চারপাশের গভীর অন্ধকারের মধ্যে বিশাল এলাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটাকে স্বপ্নের জাহাজের মত মনে হচ্ছে। জয়িতা কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় পেছনে হেডলাইটের তীব্র আলো এবং গাড়ির গতি হ্রাস হওয়ার শব্দ কানে এল। ওরা দ্রুত সরে এল একপাশে যাতে রাস্তার ধারের বড় গাছটার আড়াল পাওয়া যায়। গাড়িতে আরোহী দুজন। চালাচ্ছেন পঞ্চাশের কাছাকাছি খুব স্মার্ট হতে চাওয়া মানুষ। ওপাশে চটকদার এক ম্যানিকিন যিনি ন্যাকা গলায় বলে উঠলেন, এই তো, প্যারাডাইস, ওঃ নটি ডিয়ার!
বাইরে থেকেই এত এক্সাইটেড হবেন না মিসেস মিত্র, তাহলে ভেতরে গিয়ে নার্ভ ঠিক থাকবে না। দেয়ার আর মোর সারপ্রাইজ। পুরুষটি হাত বাড়িয়ে টান টান চুলে আঙুলের ডগা ছোঁওয়াল।
সঙ্গে সঙ্গে কপট অভিমানে ছিটকে সরে গেলেন ম্যানিকিন, তুমি এখনও মিসেস মিত্র আপনি বলে যাচ্ছ। ডোন্ট টাচ মি।
ইউ আর রিয়েল সুইটি। গাড়িটা ধীরে ধীরে পারাডাইস সাইনবোর্ড ঝোলানো লোহার গেটের দিকে এগিয়ে যেতে একজন প্রহরী কিছু জিজ্ঞাসা করল। ভদ্রলোক উত্তর দেওয়ামাত্র সসম্ভ্রমে গেট খুলে দেওয়া হল। গাড়িটা যেন আলোর সাগরে ড়ুবসাঁতার দিয়ে মিলিয়ে গেল। গেট বন্ধ হল।
আনন্দ বলল, গাড়িতে এলে বেশি প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হয় না। অবশ্য হেঁটে খুব কম পার্টি আসে।
জয়িতা বলল, আমরা গাড়িটা কখন পাচ্ছি?
সুদীপ জানাল, এখনও ঘণ্টা আড়াই বাকি আছে। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কোন লাভ নেই। লোজন যাওয়া আসা করছে। চল, এগোই।
আনন্দও আর দাঁড়াতে চাইছিল না। একটু বাদে বড় রাস্তা ছেড়ে ওরা কাঁচা পথে নেমে এল। আনন্দর বাড়িতে যাওয়ার জন্যে একটু বেশি হাঁটতে হবে কিন্তু কারও সামনে পড়ার সম্ভাবনা কম। সুদীপ বলল, পা চালা, জব্বর খিদে পেয়ে গেছে।
কল্যাণ মাথা নাড়ল, আমারও।
জয়িতা হাসল, কি করে তোরা এইসময় খাবার কথা ভাবতে পারিস কে জানে!
সুদীপ চেঁচাল, ঈশ্বর তোমাদের শরীরে এক্সট্রা একটা যন্ত্র দিয়েছেন যা দিয়ে সবরকম প্রাকৃতিক ব্যাপার তোমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা থামিয়ে রাখতে পার, বাট উই আর হেল্পলেস!
আহা বেচারা! কিন্তু তোর মুখে তুমি খুব অশ্লীল শোনাচ্ছে। জয়িতা অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে সামলে নিল।
পালটা সুদীপ কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় স্থির হ্যারিকেনের আলো দেখা গেল। আনন্দ চাপা গলায় বলল, আস্তে!
বিশাল একটা বট কিংবা অশ্বত্থ গাছের গায়ে লম্বাটে মুদির দোকান। সেখানে হ্যারিকেন ঝুলছে। দোকানের সামনে মাটিতে পোঁতা বেঞ্চিতে বসে কয়েকজন গল্প করছে। আনন্দরা এমনভাবে হাঁটছিল যাতে জয়িতা আড়ালে থাকে। অবশ্য অন্ধকারে কেউ তাদের স্পষ্ট বুঝতে পারবে না। কিন্তু মুখোমুখি প্রশ্নটাকে এড়াতে পারল না আনন্দ, কে যায়?
আমি আনন্দ।
আনন্দ? সেন-বাড়ির ছেলে?
হ্যাঁ।
সঙ্গে কারা?
আমার বন্ধু, কলকাতা থেকে এসেছে। ভাল আছেন মেসোমশাই?
হ্যাঁ, ওই আর কি!
জায়গাটা পেরিয়ে এসেই সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, এত কৈফিয়ৎ দিলি কেন?
আনন্দ হাসল, প্রত্যেক জায়গার নিজস্ব একটা চরিত্র আছে। সেই জায়গার মানুষের ব্যবহারও সেই চরিত্রের মধ্যেই পড়ে। আমি সেটা অস্বীকার করলে সাহায্য পাব না কিন্তু সেটাকে মানিয়ে নিলে অসুবিধে হবে না, বুঝলি?
সুদীপের যে কথাটা ভাল লাগল না এটা বুঝতে পারল আনন্দ। যারা এইরকম গ্রামে আবাল্য থাকেনি তারা বুঝে উঠবে না। তাছাড়া সুদীপ সব ব্যাপারে চাচাছোলা কথা বলতে ভালবাসে। একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল ওর। ট্রামে যাচ্ছিল আনন্দ সুদীপের সঙ্গে। এক ভদ্রলোক কংগ্রেস এবং সি পি এম-এর মুণ্ডপাত করছিলেন। কংগ্রেস এইরকম সি পি এম সেইরকম। হঠাৎ সুদীপ তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি কোন্ দলের?
মানে?
কংগ্রেস না সি পি এম?
কোন দলের নয়। আমি কোন রাজনীতিফিতি করি না।
ভোট দিয়েছেন গতবার?
হ্যাঁ, দেব না কেন? আমার ডেমোক্রেটিক রাইট!
আপনিই সবচেয়ে ডেঞ্জারাস লোক। দেশের শত্রু। সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতারা হেসে উঠেছিল সজোরে। এই সুদীপের কাছে গ্রাম্য কৌতূহল তো খারাপ লাগবেই।
ক্রমশ একটা অন্ধকার দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। দুটো ঘরে হ্যারিকেনের আলো দেখা যাচ্ছে। সামনে কিছুটা বাগান। আনন্দ বলল, এই আমার বাড়ি।
আধ-খুলন্ত প্রৌঢ়টি বললেন, আছি দেখতেই পাচ্ছ। পড়াশুনা কেমন হচ্ছে?
হচ্ছে যেমন হয়। ইচ্ছে করেই কথাটা বেঁকিয়ে বলল আনন্দ। এতক্ষণ উনি যেভাবে তাকাচ্ছিলেন তাতে মনে হয়েছিল কথা না বললে অন্যায় হবে। কিন্তু কথা শুরু করতেই কায়দা শুরু করেছেন। ওর গ্রামের কিছু মানুষকে এই কারণেই সে সহ্য করতে পারে না। প্রৌড় এবার বললেন, মন দিয়ে পড়াশুনা কর। তোমার বিধবা মায়ের কষ্ট তুমি ছাড়া আর কে দূর করবে! তোমার বাবা কি সরল মানুষ ছিলেন।
আনন্দ প্রতিটি শব্দ আলাদা উচ্চারণ করলে, আমার মা আপনাকে কষ্টের কথা বলেন নাকি? কি আশ্চর্য, আমাকে ওসব বলেন না!
মানে? কি বলতে চাইছ তুমি?
খুবই সামান্য কাকাবাবু। আমার মায়ের কি কি কষ্ট আছে সেটা তো আপনার জানার কথা নয়। কেন কথা বলার জন্যে কথা বলছেন?
সুদীপ এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা আপনি স্কুলের শেষ পরীক্ষায় কত পার্সেন্ট নম্বর পেয়েছিলেন? ও বিরাশি পেয়েছিল। কেন ফটাফট জ্ঞান দেন?
কথাটা শেষ হওয়ামাত্র একটা চাপা হাসি উঠল চারপাশে। দু-একজন আলোচনা শুরু করে দিলেন। কুড়ি বছর আগে যত ছেলেমেয়ে হায়ার সেকেন্ডারিতে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করত এখন তার দ্বিগুণ করে। যত নম্বর এরা এখন পায় তখন সেটা স্বপ্নেও ভাবা যেত না। এই সময়ের ছেলেরা বেশি ব্রিলিয়ান্ট কিনা তাই নিয়ে তর্ক শুরু হল। আনন্দ দেখল সেই প্রৌঢ় ভদ্রলোক নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু লোকটা চটেছে এবং সুযোগ দিলেই চিমটি কাটার চেষ্টা করবে। ছোবল মারার ক্ষমতা নেই। সে চাপা গলায় সুদীপকে বলল, কেন আগবাড়িয়ে কথা বলতে যাস!
গা জ্বলে যায়।
কখনও কখনও চামড়া মোটা করতে হয়।
সুদীপ কাঁধ ঝাঁকাল, যারা জীবনে কোন দায়িত্ব নেবে না তারাই নিরাপদে দাঁড়িয়ে জ্ঞান দিয়ে যায়।
আনন্দ আর কথা বাড়াল। সুদীপের বাড়ির অবস্থা সে জানে। প্রাচুর্য সেখানে দমবন্ধ করে ছড়ানো। ওর নিকট আত্মীয়স্বজন যে স্তরের তাতে ভারতবর্ষের একশ্রেণীর সুবিধের চাবি হাতে নিয়ে জন্মানো ছেলেমেয়ের মত সেইরকম জীবনটাকে গুছিয়ে নিতে পারত। ইংলিশ মিডিয়ামে ওর রেজাল্ট চোখে পড়ার মতই ছিল। ও তার নম্বরটা চেঁচিয়ে বলেছে কিন্তু নিজেরটা বলতে লোকগুলো হোঁচট খেত। অথচ সুদীপ জে ই-তে বসল না। কিন্তু তার ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হবার ইচ্ছে নেই জানার পর গ্রামের যে পেরেছে সে জ্ঞান দিয়েছে।
বাস থেকে নেমে জয়িতা বলল, জেনারেটর চলছে রাজার মতন।
আনন্দ বলল, রাজার মতনই আছে ওরা।
সুদীপ উদাস গলায় বলল, আজ রাতে রাজা যাবে বনবাসে। চক্ষুলজ্জা বলেও একটা কথা আছে, সমস্ত গ্রামে টিমটিমে হ্যারিকেন জ্বলছে আর ওখানে আলোর ফোয়ারা ছুটছে। আর এসব মানুষ মেনে নেয় চুপচাপ।
কল্যাণ বলল, এটা কোন অভিযোগ নয়। আমার সামর্থ্য থাকা অপরাধ? সেটা আমাকে অর্জন করতে হয়েছে। আলো জ্বালাবার ব্যবস্থা রাখার জন্যে তোর রাগ করার যুক্তি নেই।
ওরা ডায়মন্ডহারবার রোড ধরে কয়েক পা এগিয়ে আসার পর পুরো এলাকাটা দেখতে পেল। ঠিক রাস্তার কয়েক পা নিচে মাধবীলতার গাছে সাজানো গেট। দেড় মানুষ উঁচু পাঁচিল তার দুপাশ থেকে চলে গেছে বাড়িটাকে ঘিরতে। লোহার গেটটি বন্ধ। কিন্তু ভেতরের আলোয় বোঝা যাচ্ছে সাদা নুড়ি বিছানো পথ চলে গেছে ভেতরে। গেটের দুপাশে দুজন প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে য়ুনিফর্ম পরে। ওরা জানে লোকদুটো নেপালি এবং খুব অনুগত। গেটের সামনে গাড়ি এসে দাঁড়ালে একজন গেট খুলে দেয়, অন্যজন প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিক নির্দেশ করে। এদের বিশদ বিবরণ চারজনেই জানে। ওরা দেখল গেটের ওপর ইংরেজিতে লেখা আছে জায়গাটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অতএব প্রবেশ এবং প্রস্থান অনুমতি ব্যতিরেকে সম্ভব নয়। যারা রাত্রে থাকবেন না তাদের বলা হয়েছে সন্ধ্যে সাতটার মধ্যে উদ্যান ছেড়ে যেতে হবে নইলে নিরাপত্তার দায়িত্ব নেওয়া কর্তৃপক্ষের সম্ভব নয়। চারপাশের গভীর অন্ধকারের মধ্যে বিশাল এলাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটাকে স্বপ্নের জাহাজের মত মনে হচ্ছে। জয়িতা কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় পেছনে হেডলাইটের তীব্র আলো এবং গাড়ির গতি হ্রাস হওয়ার শব্দ কানে এল। ওরা দ্রুত সরে এল একপাশে যাতে রাস্তার ধারের বড় গাছটার আড়াল পাওয়া যায়। গাড়িতে আরোহী দুজন। চালাচ্ছেন পঞ্চাশের কাছাকাছি খুব স্মার্ট হতে চাওয়া মানুষ। ওপাশে চটকদার এক ম্যানিকিন যিনি ন্যাকা গলায় বলে উঠলেন, এই তো, প্যারাডাইস, ওঃ নটি ডিয়ার!
বাইরে থেকেই এত এক্সাইটেড হবেন না মিসেস মিত্র, তাহলে ভেতরে গিয়ে নার্ভ ঠিক থাকবে না। দেয়ার আর মোর সারপ্রাইজ। পুরুষটি হাত বাড়িয়ে টান টান চুলে আঙুলের ডগা ছোঁওয়াল।
সঙ্গে সঙ্গে কপট অভিমানে ছিটকে সরে গেলেন ম্যানিকিন, তুমি এখনও মিসেস মিত্র আপনি বলে যাচ্ছ। ডোন্ট টাচ মি।
ইউ আর রিয়েল সুইটি। গাড়িটা ধীরে ধীরে পারাডাইস সাইনবোর্ড ঝোলানো লোহার গেটের দিকে এগিয়ে যেতে একজন প্রহরী কিছু জিজ্ঞাসা করল। ভদ্রলোক উত্তর দেওয়ামাত্র সসম্ভ্রমে গেট খুলে দেওয়া হল। গাড়িটা যেন আলোর সাগরে ড়ুবসাঁতার দিয়ে মিলিয়ে গেল। গেট বন্ধ হল।
আনন্দ বলল, গাড়িতে এলে বেশি প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হয় না। অবশ্য হেঁটে খুব কম পার্টি আসে।
জয়িতা বলল, আমরা গাড়িটা কখন পাচ্ছি?
সুদীপ জানাল, এখনও ঘণ্টা আড়াই বাকি আছে। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কোন লাভ নেই। লোজন যাওয়া আসা করছে। চল, এগোই।
আনন্দও আর দাঁড়াতে চাইছিল না। একটু বাদে বড় রাস্তা ছেড়ে ওরা কাঁচা পথে নেমে এল। আনন্দর বাড়িতে যাওয়ার জন্যে একটু বেশি হাঁটতে হবে কিন্তু কারও সামনে পড়ার সম্ভাবনা কম। সুদীপ বলল, পা চালা, জব্বর খিদে পেয়ে গেছে।
কল্যাণ মাথা নাড়ল, আমারও।
জয়িতা হাসল, কি করে তোরা এইসময় খাবার কথা ভাবতে পারিস কে জানে!
সুদীপ চেঁচাল, ঈশ্বর তোমাদের শরীরে এক্সট্রা একটা যন্ত্র দিয়েছেন যা দিয়ে সবরকম প্রাকৃতিক ব্যাপার তোমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা থামিয়ে রাখতে পার, বাট উই আর হেল্পলেস!
আহা বেচারা! কিন্তু তোর মুখে তুমি খুব অশ্লীল শোনাচ্ছে। জয়িতা অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে সামলে নিল।
পালটা সুদীপ কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় স্থির হ্যারিকেনের আলো দেখা গেল। আনন্দ চাপা গলায় বলল, আস্তে!
বিশাল একটা বট কিংবা অশ্বত্থ গাছের গায়ে লম্বাটে মুদির দোকান। সেখানে হ্যারিকেন ঝুলছে। দোকানের সামনে মাটিতে পোঁতা বেঞ্চিতে বসে কয়েকজন গল্প করছে। আনন্দরা এমনভাবে হাঁটছিল যাতে জয়িতা আড়ালে থাকে। অবশ্য অন্ধকারে কেউ তাদের স্পষ্ট বুঝতে পারবে না। কিন্তু মুখোমুখি প্রশ্নটাকে এড়াতে পারল না আনন্দ, কে যায়?
আমি আনন্দ।
আনন্দ? সেন-বাড়ির ছেলে?
হ্যাঁ।
সঙ্গে কারা?
আমার বন্ধু, কলকাতা থেকে এসেছে। ভাল আছেন মেসোমশাই?
হ্যাঁ, ওই আর কি!
জায়গাটা পেরিয়ে এসেই সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, এত কৈফিয়ৎ দিলি কেন?
আনন্দ হাসল, প্রত্যেক জায়গার নিজস্ব একটা চরিত্র আছে। সেই জায়গার মানুষের ব্যবহারও সেই চরিত্রের মধ্যেই পড়ে। আমি সেটা অস্বীকার করলে সাহায্য পাব না কিন্তু সেটাকে মানিয়ে নিলে অসুবিধে হবে না, বুঝলি?
সুদীপের যে কথাটা ভাল লাগল না এটা বুঝতে পারল আনন্দ। যারা এইরকম গ্রামে আবাল্য থাকেনি তারা বুঝে উঠবে না। তাছাড়া সুদীপ সব ব্যাপারে চাচাছোলা কথা বলতে ভালবাসে। একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল ওর। ট্রামে যাচ্ছিল আনন্দ সুদীপের সঙ্গে। এক ভদ্রলোক কংগ্রেস এবং সি পি এম-এর মুণ্ডপাত করছিলেন। কংগ্রেস এইরকম সি পি এম সেইরকম। হঠাৎ সুদীপ তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি কোন্ দলের?
মানে?
কংগ্রেস না সি পি এম?
কোন দলের নয়। আমি কোন রাজনীতিফিতি করি না।
ভোট দিয়েছেন গতবার?
হ্যাঁ, দেব না কেন? আমার ডেমোক্রেটিক রাইট!
আপনিই সবচেয়ে ডেঞ্জারাস লোক। দেশের শত্রু। সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতারা হেসে উঠেছিল সজোরে। এই সুদীপের কাছে গ্রাম্য কৌতূহল তো খারাপ লাগবেই।
ক্রমশ একটা অন্ধকার দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। দুটো ঘরে হ্যারিকেনের আলো দেখা যাচ্ছে। সামনে কিছুটা বাগান। আনন্দ বলল, এই আমার বাড়ি।