What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected গর্ভধারিণী - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

বাড়িতে এসেই শুনেছিল মা খুব অসুস্থ। পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়েছেন। নার্সিং হোম নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তখন বেশ রাত। অন্তত নার্সিং হোমে ঢোকার অনুমতি পাওয়ার মত সময় নয়। গিয়ে শুনল মাকে আই সি ইউনিটে রাখা হয়েছে। অবনী তালুকদার ভিজিটার্স রুমে বসেছিলেন, সে কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ভদ্রলোক মুখ নিচু করেছিলেন। সুদীপ জিজ্ঞাসা করেছিল, কি হয়েছে মায়ের?

সেরিব্রাল। বাহাত্তর ঘণ্টা না গেলে বলা যাবে না।

কেন? সেরিব্রাল হল কেন?

খেঁকিয়ে উঠেছিলেন অবনী তালুকদার ওই সময়েও, সেরিব্রাল হয় কেন জানো না? গো অ্যান্ড আস্ক দ্য ডক্টর। অশিক্ষিত!

সুদীপ হকচকিয়ে গিয়েছিল। তারপর সরে এসেছিল। বাবার সঙ্গে তার কোনদিনই ভাবভালবাসা তৈরি হয়নি। একটা সময় পর্যন্ত সে মায়ের সঙ্গেই শুতে। তারপর তাদের তিনজনের তিনটে আলাদা ঘর হয়েছে। মায়ের সঙ্গে বাবারও কথাবার্তা যতটা সম্ভব না হলেই নয়। তাও বাবা প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে মা জবাব দিতেন। সেই রাত্রে মায়ের সঙ্গে ওরা দেখা করতে দেবে না জানার পর সুদীপ বাড়ি ফিরে এসেছিল। অদ্ভুত একটা কান্না সমস্ত শরীরে পাক খাচ্ছিল সে-সময়। জ্ঞান হবার পর ওরকম অনুভূতি তার সেই প্রথম। মায়ের কেন সেরিব্রাল হল? মা তো কখনই উত্তেজিত হতেন না। মানুষের ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেলে, দুশ্চিন্তা বেড়ে গেলে, দুশ্চিন্তা থাকলে অথবা উত্তেজনার কারণ ঘটলে এই ব্যাপারটা হয়ে থাকে বলে জেনেছে সে। ওরকম ঠাণ্ডা নিরীহ এবং ব্যক্তিত্বহীনা মহিলার সঙ্গে ব্যাপারটা মিলছে না কিছুতেই।

সেই রাত্রে বাড়িটাও ছিল থমথমে। দরজা খুলে কার্তিকদা শুকনো মুখে প্রশ্ন করেছিল, মা কেমন আছেন?

সুদীপ কার্তিকদার দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে প্রশ্ন করেছিল, কি হয়েছিল?

কার্তিকদার মাথাটা নিচু হয়েছিল, আমি জানি না!

তুমি জানো। কার্তিকদা কিছু চেপে যাচ্ছে তা বুঝতে অসুবিধা হল না সুদীপের।

না আমি কিছু জানি না। সামনে থেকে দ্রুত সরে গেল কার্তিকা।

দোতলায় উঠে মায়ের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। ঘরটা খালি। এমন কিছু চোখে পড়ল না যা সন্দেহজনক। বাবার ঘরে ঢুকল সে। এবং সেখানেই মেয়েটিকে দেখতে পেয়েছিল সে। অবনী তালুকদারের খাটের পাশে মোজায়েক মেঝেতে পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। দোতলার ফাইফরমাশ খাটার জন্যে মেয়েটিকে রাখা হয়েছিল। চেহারায় সৌন্দর্য শব্দটির কোন ছায়া নেই। যৌবনও কখনো কখনো কুৎসিত হয়, এই মেয়েটিকে না দেখলে সে জানত না। ব্যাপারটা সত্যি অত। এই বাড়ির দোতলায় যারা এতকাল কাজ করে গেছে তাদের বয়স যোলো থেকে তিরিশের মধ্যে এবং কেউ দেখতে সামান্য ভালও নয়। এই মেয়েটি তার ঘরে যেত ঝাট দিতে এবং ঘর মুছতে। কোনদিন কথা বলার প্রয়োজন মনে করেনি সে। একবার জিজ্ঞাসা করেছিল, এত খারাপ দেখতে মেয়ে এই বাড়িতে আসে কেন মা? মা উত্তর দেননি। অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতেন না।

কি হয়েছিল এই মেয়েটা জানতে পারে। সুদীপ একটু গলা তুলে মেয়েটিকে ডাকল, এই, শুনছ? এই যে!

ডাক শুনে মেয়েটি ধড়মড়িয়ে উঠল। তারপরে বোবা চোখে সুদীপের দিকে তাকাল। এবং তখনই সুদীপ দেখল মেয়েটির কালো গালে চোখের জলের দাগ শুকিয়ে আছে এখনও। এবং আচম্বিতে মেয়েটি ঝাঁপিয়ে পড়ল সুদীপের পায়ের ওপর, আমি কোন দোষ করিনি, আমি আমি, আমাকে, আমার এখন কি হবে?

হতভম্ব হয়ে পড়েছিল সুদীপ, কি হল? কি হয়েছে তোমার?

মেয়েটি বারংবার কথা বলতে যাচ্ছে কিন্তু কান্নার দমক তাকে থামিয়ে দিচ্ছে।

শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, মায়ের কি হয়েছিল?

বাবা আমাকে–, মা তখন এসে পড়েছিল।

সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎ, সুদীপ বুঝতে পারছিল না সে কি করবে! ঠিক সেই সময় পেছন থেকে অবনী তালুকদার বলে উঠেছিলেন, এখানে কি হচ্ছে?

সুদীপ অবশ হয়ে তাকিয়ে ছিল। তারপরই একটা ক্রোধ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার সমস্ত সত্তায়। চিক্কার করে জিজ্ঞাসা করেছিল, এই মেয়েটা যা বলছে তা সত্যি?

এই বাড়িতে কোনটে সত্যি কোটে মিথ্যে তা বিচার করব আমি। নিজের ঘরে যাও।

ছিঃ, আপনি এত নোংরা! ইউ কিল্ড মাই মাদার!

নো। ডাক্তার বলেছে সে মরবে না। আর আমি নোংরা না ফরসা সে বিচারও আমি করব।

আপনার সঙ্গে কথা বলতেও প্রবৃত্তি হচ্ছে না। মা মরে গেলে আমি, আমি আপনাকে–।

গেট আউট, গেট আউট অফ মাই সাইট! বীভৎস গলায় চিৎকার করে উঠেছিলেন অবনী তালুকদার। এক ছুটে নিজের ঘরে চলে এসেছিল সুদীপ। বিছানায় উপুড় হয়ে নিজেকে কি ভীষণ প্রতারিত বলে মনে হয়েছিল। অবনী তালুকদারের কথাবার্তা ব্যবহার সে পছন্দ করত না, কিন্তু সেটা ছিল এক ধরনের খারাপ লাগা, এখন সমস্ত শরীরে কিলবিলে ঘেন্না। এমন কি মায়ের জন্যে জমে ওঠা উদ্বেগ এবং কষ্টটা মনচাপা পড়ে গেছে। একটা মনের ওপর আর একটা মন। এই দ্বিতীয় মনটা রাগে ঘেন্নায় নিজেকেই ছিড়তে চাইছে। এক মুহূর্ত নয়, এই বাড়ি ছেড়ে এখনই বেরিয়ে যেতে হবে তাকে। অবনী তালুকদারের বাড়িতে সে আর থাকতে পারে না। কোথায় যাবে সে চিন্তা না করেই সুদীপ সুটকেস নামাল এবং তখনই তার মনে হল, কেন যাবে? সে এখান থেকে চলে গেলে কারও কোনও ক্ষতি হচ্ছে না, অভিমান করে অথবা ঘেন্নায় এই বাড়ি থেকে চলে গেলে কোন প্রতিক্রিয়া হবে না কারো ওপর। আর ক্ষতি যদি হয় তো তারই। বরং মাকে ফিরিয়ে আনা পর্যন্ত তার থাকা উচিত। অবনী তালুকদারের ওপর কোন বিশ্বাস নেই। আর যদি মা না ফিরে আসে তাহলে সে নিজের হাতে অবনী তালুকদারকে খুন করবে। কোন দয়া মায়া ক্ষমা নেই। আর সামনে থেকে প্রতি মুহূর্তে লোকটাকে যদি সে বোঝাতে পারে ঘেন্নার মাত্রাটা, তার চেয়ে আর স্বস্তি কিসে আছে? চলে যাওয়াটা তো সেন্টিমেন্টাল হঠকারিতার শামিল। সুদীপ বাড়ি হাড়েনি। অবনী তালুকদার সবরকম সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। তবে মেয়েটা চলে গিয়েছিল। দোতলায় আর কোন কাজের মেয়ে আসেনি। মা ফিরে এলে, যখন নার্সিং হোমে রেখেও কোন কাজ হবে না জানা গেল, তখন বাড়িতে ফিরিয়ে আনার পর নার্স রাখা হল।

প্রথম প্রথম সুদীপ নজর রেখেছিল। না, অবনী তালুকদার কোনদিনই ওই সব সেবিকাদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেননি। এবং তখনই একটা সত্য সে আবিষ্কার করেছিল, অবনী তালুকদার ফর্সা সুন্দরী কিংবা সাধারণ মহিলার প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ বোধ করেন না। সুদীপ নার্সদের সেন্টারে ফোন করে বলেছিল, পেসেন্ট চাইছেন তাকে নার্স করতে যারা আসবেন তারা যেন ফর্সা হয়। সেন্টার যেন সেটা খেয়ালে রাখেন।
 
আয়কর বিভাগের একজন কর্মী অ্যালবামটা তুলে বললেন, কি আগলি। তারপর অবনী তালুকদারের দিকে বিস্ময়ের চোখে তাকালেন। এবং এই সময় অবনী তালুকদারের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তিনি কিছুই শুনছেন না, কোন প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না। এসবে যেন কিছুই যায় আসে না তার। এই সময় একজন অফিসার সুদীপকে ডাকলেন, ওই ঘরে আপনি থাকেন? আসুন।

যেতে যেতে সুদীপ বলল, আমার ঘরে কোন লুকনো সম্পদ নেই।

তবু আপনি দরজায় দাঁড়ান, আমরা দেখছি।

কিছুই পাওয়া গেল না। কিন্তু কিছু লিফলেট, আনন্দর দেওয়া বই হাতে নিয়ে ভদ্রলোক ওর দিকে কয়েকবার তাকালেন। তারপর হেসে বললেন, দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ!

একটা কড়া জবাব দিতে গিয়েও সামলে নিল সুদীপ। রাজনীতি নিশ্চয়ই এঁদের আওতায় পড়ে না কিন্তু খবর পৌঁছে দিতে তো পারেন। কারণ ওই সব কাগজের কিছুটা সরকারের ভাল না লাগারই কথা।

মায়ের ঘর থেকে কিছুই পাওয়া গেল না। সরু গায় মা বারংবার প্রশ্ন করছিলেন, কি হয়েছে? এরা কারা? জড়ানো শব্দগুলো খ্যানখেনে এবং দুর্বোধ্য।

শেষ পর্যন্ত সব দেখা হয়ে গেলে অফিসার বললেন, মাকে খাট থেকে নামাতে হবে।

সঙ্গে সঙ্গে অবনী তালুকদার হুঙ্কার দিলেন, খবরদার! সেরিব্রাল কেস। বেড়সোর বেরিয়ে গেছে। ওই পেসেন্টকে নড়ালে আবার অ্যাটাক হতে পারে। তাই যদি হয় আমি ছাড়ব না বলে দিচ্ছি।

অফিসার বললেন, আমরা দুঃখিত। কিন্তু ওঁকে আমরা যত্ন করেই নামিয়ে নিচ্ছি। ব্যাপারটাকে হয়তো হার্টলেস বলে মনে হচ্ছে, বাট ইটস মাই ডিউটি।

অবনী তালুকদারের কোন আপত্তি টিকল না। আর সেই সময় সুদীপ আর একটা ব্যাপার আবিষ্কাব করল। যে মা সুস্থ অবস্থায় কোনদিন গলা তুলে কথা বলেননি, স্বামীর পক্ষে কিংবা বিপক্ষে প্রতিবাদ করেননি সেই মা হঠাৎ তারস্বরে চেঁচাতে লাগলেন। সেই চিৎকারে স্বামীর পক্ষ সমর্থন এবং আগন্তুকদেব ওপর বিদ্বেষ স্পষ্ট।

আটা কুড়ি ভরি ওজনের সোনার সাপ পাওয়া গেল হোশকের তলা থেকে। তোশকের ওপরটা বেড়োরের রসে ভিজে আছে, দাগ হয়ে গেছে কিন্তু তার তলায় সোনার সাপগুলো চুপচাপ শুয়ে ছিল। যে নার্সটি মায়ের সেবায় ছিল তার চোখ বিস্ফারিত। আর মা অদ্ভুত স্বরে কাঁদতে লাগলেন যখন সাপগুলোকে তুলে নেওয়া হচ্ছিল।

সমস্ত জিনিসের লিস্ট করে সইসাবুদ হবার পর ওরা চলে গেলে অবনী তালুকদার ছুটে এলেন এই ঘরে। সুদীপ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। টেবিলের ওপর ব্যাগটা তখনও পড়ে আছে। জিনিসটার কথা। খেয়ালই ছিল না সুদীপের। আয়কর অফিসাররা সমস্ত বাড়ি তন্নতন্ন করে দেখেছেন, কিন্তু চোখের সামনে টেবিলের ওপর রাখা ব্যাগটার কথা কারও খেয়ালে আসেনি। অবনী তালুকদার ছুটে গিয়েছিলেন ব্যাগটার কাছে। পরমতৃপ্তি ফুটে উঠেছিল তার মুখে। সেখানে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বলেছিলেন, থ্যাঙ্ক ইউ!

সুদীপ উঠে এসেছিল একটিও কথা না বলে।

মাঝে মাঝে খুব আপসোস হয়। নিজের হাতে সে ব্যাগটা আয়কর বিভাগের কর্মীদের হাতে তুলে দিতে পারেনি। কিন্তু সে এমন জায়গায় রেখেছিল যেখানে সকলের নজর আগে পড়বে। শেষে তালগোলে নিজেরও খেয়াল ছিল না কিন্তু ব্যাপারটা এমন হবে কে জানত! কি ছিল ওই ব্যাগটায় তা কোনদিন জানা যাবে না। আজ সুদীপের খুব ইচ্ছে করছিল তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে ব্যাগটার খোঁজ নিতে।



অবনী তালুকদার সেই ঘটনার পর নরম ব্যবহার করেননি ঠিক কিন্তু বিরক্তও করেননি। তবু এই বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় যে কোন মুহূর্তেই আসতে পারে। তাতে নিশ্চয়ই অবনী তালুকদার তৃপ্ত হবেন। সুদীপ আর একবার ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। নিস্তব্ধ কলকাতা। গাড়ির সংখ্যাও কমে এসেছে। কেউ নেই পথে, রাত্রের মতন যে যার বাড়িতে ফিরে গেছে। হঠাৎ সামনের রাস্তাটাকে অতিরিক্ত নির্জন বলে মনে হচ্ছিল তার।



যেন কোন নদীর ওপর থেকে কেউ তাকে ডাকছে অথবা ঝরনার শব্দের সঙ্গে পরিচিত কোন কণ্ঠ মিশে গেছে এইরকম একটা বোধ হওয়া মাত্র সুদীপের ঘুম ভাঙল। এবং তখনই স্পষ্ট একটি নারীকণ্ঠ শোনা গেল। তার নাম নয়, খুব সম্ভ্রমের সঙ্গে কেউ বলল, শুনছেন, এই যে!

সুদীপ চোখ মেলতেই নার্স-মহিলাটিকে দেখতে পেল। তার এই ঘরে এখন পর্যন্ত কোন মহিলা আসেননি। অতএব ঘোর কাটতে দুটো মুহূর্ত লাগল। ধড়মড়িয়ে উঠে বসল সে। নার্স বললেন, আপনার মা জেগেছেন। আমি আবার ঘুমের ওষুধ দেব, যদি কথা বলতে চান তাহলে আসতে পারেন।

সুদীপ বিছানা থেকে নেমে ভদ্রমহিলাকে অনুসরণ করল।

মায়ের ঘরে ঢোকামাত্র শব্দটা কানে বাজল। খনখনে স্বরে মা কাতরাচ্ছেন। এখন তাকে চিৎ করে শুইয়ে রাখা হয়েছে। হঠাৎ সুদীপ আবিষ্কার করল তার নিজস্ব কোন কথা বলার নেই। মাকে দেখতে এসেছিল আজ, নার্স বলেছিলেন, সেও মাথা নেড়েছিল মাত্র। এখনও ভোর হয়নি। ঘরে আলো জ্বলছে। সুদীপ মায়ের কাছে এসে দাঁড়াল। মায়ের চোখ সিলিংয়ের দিকে। কাতরানিটা সমানে চলছে। নার্স মায়ের মাথার পাশে দাঁড়িয়ে চুলে হাত বোলাতে বোলাতে মুখ নামিয়ে বেশ জোরে কথা বললেন, আপনার ছেলে এসেছে, দেখুন।

যন্ত্রণায় কাতর মুখে প্রথমে অন্য কোন অভিব্যক্তি ফুটল না। কিন্তু নার্স কয়েকবার শব্দগুলো উচ্চারণ করার পর মা মুখ তুললেন। নার্স আবার বললেন, ওই দিকে, আপনার ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।

এবার মুখ নামল। চোখের তারা দুটো ঘুরে ঘুরে সুদীপের মুখের ওপর স্থির হল। কোনও শব্দ নেই। একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা চট করে সমস্ত পৃথিবীকে গ্রাস করল। সুদীপের শরীরে হঠাৎ কঁপুনি এল। ওই দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি সে পাচ্ছিল না। প্রায় পরিত্রাণের চেষ্টায় সুদীপ উচ্চারণ করল, মা!

একটা শব্দ ছিটকে এল মায়ের মুখ থেকে। অস্পষ্ট উচ্চারণে বিকৃত হল শব্দ, কিছুই বোঝা গেল না। সুদীপ আর একটু এগিয়ে এসে মায়ের পাশে বসল। সঙ্গে সঙ্গে সে একটা ঘিনঘিনে গন্ধ টের পেল। পচা মাংসের গন্ধ। নার্স বললেন, গায়ে হাত দেবেন না।

তখনও চোখের দৃষ্টি সরেনি। সুদীপ মুখ নামিয়ে করুণ স্বরে প্রশ্ন করল, খুব কষ্ট হচ্ছে?

কিছু কথা বলার চেষ্টা চলছিল তখন, অথচ শব্দগুলো কিছুতেই স্পষ্ট হচ্ছিল না। মায়ের মুখ উত্তেজনায় কাঁপছিল। সুদীপ চেষ্টা করছিল কথাগুলোর একটা মানে বুঝে নিতে। শেষ পর্যন্ত নার্স বাধা দিলেন, আর ওঁর উত্তেজিত হওয়া উচিত হবে না। আজ সন্ধ্যাবেলায় কথা এত জড়ানো ছিল না। আপনি এবার যান আমি ওষুধ দেব।

একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে সুদীপ উঠে দাঁড়াল। তারপর দরজার দিকে এগোতেই মা গোঙাতে লাগলেন। হঠাৎ সে স্থির হয়ে গেল। ওই গোঙানির মধ্যে যে শব্দদুটো সে শুনতে পেয়েছে তা কি সঠিক? সে ফিরে তাকাতেই মা শান্ত হয়ে গেলেন। ঠোঁট বন্ধ। চোখে আকূতি। এবং তখনই দুচোখ বেয়ে জল নামল। মনের কথাটা ছেলের কাছে পৌঁছে দিয়ে চোখের জলে তৃপ্ত হওয়া।

সুদীপ এক দৌড়ে ব্যালকনিতে চলে এল। ভোর হচ্ছে। কলকাতার মাথায় এখনও অন্ধকার সরেনি। অদ্ভুত শীতল বাতাস বইছে পৃথিবীতে। এখনও পথে মানুষজন নামেনি। সবে ফরসা হচ্ছে আকাশ। সুদীপ চোখ বন্ধ করল। তার সমস্ত শরীরে আবার কাঁপুনিটা ফিরে এল। কানের মধ্যে দিয়ে প্রতিটি রক্তবিন্দুতে মিশে গেছে শব্দগুলো, কখন মরব খোকা?
 
০৩.
সুদীপকে ছেড়ে দেবার পর আনন্দ কফি হাউসে ঢুকেছিল।

রাত বাড়লে অল্পবয়সী ছেলেরা যারা প্রেসিডেন্সি বা য়ুনিভার্সিটিতে পড়ে তারা কফি হাউসে থাকে না। এই সময়টায় বয়স্ক মানুষের ভিড়। হৈ-চৈ হয় না। কেমন একটা গম্ভীর-গম্ভীর ভাব। শুধু রাতের আইন-কলেজের কিছু ছাত্রছাত্রী জমিয়ে আড্ডা মারে এক দিকে। আনন্দ চারপাশে একবার তাকাতেই সুরথদাকে দেখতে পেল। সুরথদা ওর দিকে তাকিয়ে হাসছেন। সুরথদার সঙ্গে যে দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক বসেছিলেন তাকে আনন্দ চেনে না। সুরথদা ইঙ্গিতে তাকে বসতে বলায় আনন্দ চেয়ার টানল।

দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক তখন বলছিলেন, চারধারে আপাত শান্তি-শান্তি ভাব কিন্তু এই ব্যাপারটাই আমার কাছে খারাপ লাগছে। খুব খারাপ ব্যাপার।

সুরথদা বললেন, খারাপ কেন?

আরে ভাই, পাড়ার মাস্তানরা উধাও, কোন পরিটিক্যাল জঙ্গী অ্যাক্টিভিটিস নেই, কলকাতার মানুষ তো ভেবেই নিচ্ছে তারা পরম শান্তিতে বাস করছে। বাট এটা তো সত্যি নয়!

কোনটে সত্যি?

সেদিন মনুমেন্টের তলায় মিটিং হয়ে গেল। অর্গানাইজেশন কাজ শুরু করেছে। আরে আমার বাড়িতেও লিফলেট দিয়ে গেছে। খুব থ্রিলিং।

থ্রিলিং?

খুব। আমার মশাই একটা হবি আছে। আমি সব দলের মিটিং অ্যাটেন্ড করি। এদেরটাও করেছিলাম। কিন্তু পাবলিক যখন শান্তিতে মজে আছে তখন এদের কথা কি কানে ঢুকবে? খুব অশান্তি, চারপাশে ধুন্ধুমার কাণ্ড, প্রাণ অতিষ্ঠ হলেই পাবলিক পরিবর্তন চায় মশাই। দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক কফিতে চুমুক দিলেন। তারপর বেয়ারাকে ডেকে একটি কফির দাম মিটিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, যাক, অনেকক্ষণ সময় কাটানো গেল। আপনি একা ছিলেন, আমিও, এখন আপনি দোকা হলেন, আমি যাই। নমস্কার।

ভদ্রলোক চলে গেলে আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, উনি কে সুরথদা?

চিনি না। তোমার জন্যে বসেছিলাম উনি এলেন। সুরথদা বললেন, তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ আমি কেন উটকো লোকের সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে কথা বলছি? লোকটা তো পুলিশের কেউ হতে পারে। আমি ইচ্ছে করেই বলেছি। আমি যে বুদ্ধিমান নই, রাজনীতি নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই, এটা লোকটাকে বোঝানোর দরকার ছিল। যাক, ছেড়ে দাও এসব কথা। তোমার খবর বল, গিয়েছিলে?

হ্যাঁ। কিন্তু এদিকে দুটো কাণ্ড ঘটেছে। আমার হোস্টেলে কেউ এসেছিল খোঁজ-খবর নিতে। আমি কখন ফিরি, কার কার সঙ্গে মিশি এইসব ব্যাপার।

দ্বিতীয়টা?

আজ মিটিং-এ আমি মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারিনি।

সুরথদা চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, কফি খাবে?

আনন্দ মাথা নাড়ল, না।

সুরথদা কাউন্টারের দিকে তাকিয়ে বললেন, অবশ্য খেতে চাইলে খাওয়াতে পারতাম না হয়তো। ওরা কফি হাউস আজকের মত বন্ধ করছে। চল বাইরে বেরিয়ে কথা বলি।


কলেজ স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে সুরথদা বললেন, প্রথমটা নিয়ে ভাবনার কোন কারণ নেই। যে কেউ তোমার খোঁজে আসতে পারে। তোমার দেশের লোকজন খবর নিতে পারেন, তুমি জানো না। কিন্তু মিটিং-এ মাথা গরম করার কোন মানে নেই। আমি তোমাকে বলেছি বিপদ ডেকে আনবে না। আমোক মানুষকে সামনাসামনি চটাবে না। মতের অমিল হলে চেপে যাবে, পরে নিজের মত করে চাপানো সিদ্ধান্তটা কাজে লাগাবে।

আনন্দ এক-চোখো ট্রামটাকে ছুটে আসতে দেখল। ঝড়ের মত শব্দ তুলে ওটা পার হয়ে গেলে সে বলল, কিন্তু আমার সঙ্গে ওঁদের মতের কোন মিল হচ্ছে না। ওঁরা যে পথে চলতে চাইছেন সেটা পথই নয়।

সুরথদা বললেন, দ্যাখো আনন্দ, পঁচাত্তর পর্যন্ত আমি জেলে ছিলাম। বাঁ চোখটায় কোনদিন দেখতে পাব না। সুতরাং আমি মূল্য দিয়েছি। পঁয়ষট্টি থেকে পঁচাত্তর এই এগারোটা বছর আমার জীবনে খুবই মূল্যবান সময়। এই অভিজ্ঞতার কোন দাম নেই কি?

আনন্দ একটু অসহিষ্ণু গলায় বলল, সুরথদা, আমি সবই বুঝতে পারছি। কিন্তু যেভাবে দলের সবাই ভাবছেন সেটাকে আমার কার্যকরী বলে মনে হচ্ছে না।

সুরথ হাসলেন, তুমি কি ভাবছ আমি জানি না, তবে তোমার বয়স অল্প, একটা কথা খুব সত্যি জেনো, হঠকারিতা থেকে কোন ফল পাওয়া যায় না। আমরাও পাইনি।

সুরথদার দিকে তাকাল আনন্দ। উত্তর কলকাতার একটা স্কুলে পড়ান সুরথদা। ঠাণ্ডা প্রকৃতির মানুষ। বিয়ে-থা করেননি। সে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি মনে করেন ওরা যেভাবে এগুচ্ছে তাতে শেষপর্যন্ত সফল হওয়া যাবে?

আশা করতে দোষ কি?

আমি ভরসা পাচ্ছি না। শুধু বিপক্ষকে গালাগাল করলেই সাফল্য পাওয়া যায় না। জনসাধারণকে কাজের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিতে হয় আমরা তাদের উপকার করতে চাই। এটা না করলে আমরা কখনও তাদের সঙ্গে পাব না।
 
সুরথদা আনন্দর কাঁধে হাত রাখলেন, তোমার হোস্টেলে কেউ খোঁজখবর করতে গিয়েছিল শুনেই তুমি নার্ভাস হচ্ছ, অথচ মাসের পর মাস পুলিশের ভয়ে আমরা কি না করেছি। সেসব গল্প তো তুমি জানো। আর শুধু পুলিশ নয়, রাজনৈতিক দলের গুণ্ডারাও আমাদের পেছনে পাইপগান নিয়ে তাড়া করেছিল। আসলে ব্যাপারটা তো ছেলেখেলা নয়। সমস্ত কিছু খতিয়ে দেখতে হবে। তুমি কি করতে চাইছ এইটে পরিষ্কার হওয়া দরকার। শুধু আবেগ নয়, রাজনৈতিক শিক্ষা সবার আগে প্রয়োজন। তুমি একটু আগে জনসাধারণকে কাছে পাওয়ার কথা বলছিলে না? তোমাকে একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ধরো, একটা দল ঠিক করল পশ্চিমবাংলার মানুষ সুখে নেই, তাদের সুখী করতে হবে। তাদের রাজনৈতিক সামাজিক এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিতে হবে, নিরাপত্তা দিতে হবে। প্রতিটি মানুষকে মানুষের মত বাঁচার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে যে পরিবর্তিত অবস্থার কথা আমরা ভাবি তাই সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু এই দেশে এখনই সশস্ত্র বিপ্লব সম্ভব নয়। সি পি এম-এর সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং কংগ্রসের শক্তির বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে দেশের মানুষ বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়বে না। নকশালরা সে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ এই দল নিশ্চেষ্ট হয়ে বসেও থাকতে চায় না। তখন তারা একটি অভিনব পরিকল্পনা নিল। নির্বাচনের পাঁচ বছর আগে ওরা প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্রের জন্য একজন প্রার্থী নির্বাচন করল। তাকে নির্দেশ দেওয়া হল এই পাঁচ বছর সে তার এলাকার মানুষের প্রতিটি সমস্যার পাশে দাঁড়াবে। নিজের ব্যবহার এবং কাজের মাধ্যমে জনসাধারণের ভালবাসা অর্জন করবে। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সে মানুষের সেবায় লাগবে। পাঁচ বছর ধীরে ধীরে সে এইভাবে মানুষের আস্থা দখল করবে। তারপর নির্বাচন এলে সে যখন প্রার্থী হয়ে সামনে আসবে তখন মানুষ তাকে ভালবেসেই ভোট দেবে। এই পাঁচ বছরে তারা জেনে যাবেই প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্রে এমনি একটি মানুষ মানুষের সেবা করে যাচ্ছে। আর সেই মানুষের দল সামগ্রিকভাবে চাইছে দেশের পটপরিবর্তন। এইবার আনন্দ, তুমিই বল, নির্বাচনের ফল কি হবে? অনেকক্ষণ একটানা কথা বলে একটু ক্লান্ত সুরথদা আগ্রহের সঙ্গে তাকালেন।

আনন্দ বুঝতে পারছিল না কি উত্তর হওয়া উচিত। তবে এটা ঠিক এই দলের সভ্যদের কেউ কেউ জিততে পারেন কিন্তু সবাই জিতবেন বা দল নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করবে এই আশা করা অন্যায়। সে এই কথাই বলল।

সুরথদা বললেন, কেন? পাঁচ বছরের সেবার কোন দাম দেবে না জনসাধারণ?

আনন্দ বলল, আসলে এখন প্রত্যেক মানুষ একটা অভ্যাসের মধ্যে এসে গিয়েছে। হয় সি পি এম নয় কংগ্রেস, ভোট দেবার সময় এই দুটোই ওদের লক্ষ্য হয়। অচেনা কোনও দলের প্রার্থী এককভাবে কিছু করছে এবং সেটা যতই ভাল কাজ হোক না কেন, ভোট দেবার সময় সেটা বোধহয় তারা ভাববে না।

সুরথদা বললেন, কথাটা অর্ধসত্য। নোন ডেভিল ইজ বেটার দ্যান আননোন! ঠিক আছে। তবে এদেশের মানুষ নির্বাচনের সময় আবেগের দ্বারাই পরিচালিত হয়ে থাকে। মিসেস গান্ধীকে যখন হত্যা করা হল তখন কংগ্রেস যদি রাজীব গান্ধীর বদলে প্রণব মুখার্জিকে প্রধানমন্ত্রী করে নির্বাচন চাইত তাহলে হেরে ভূত হয়ে যেত। আসলে দেশের মানুষ এখনও দেখতে চায় যে দলকে তারা ভোট দিচ্ছে তাদের নেতা কে? তার প্রতি আস্থা রাখা যায় কিনা। জ্যোতিবাবু যদ্দিন সি পি এম-এর নেতা থাকবেন তদ্দিন পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসবে না। পাঁচ বছর কাজ করেও ওই দল একটিও আসন পাবে না যদি তাদের নেতা জনসাধারণের শ্রদ্ধাভাজন না হন। নকশাল আন্দোলনে কি প্রকৃত অর্থে কোন নেতা ছিলেন? চারু মজুমদার কিংবা কানু সান্যাল কি জনসাধারণের কাছে গ্রহণীয় নেতা, সেই সময়ে? এখনও ব্যক্তিপূজার মানসিকতা এই দেশ থেকে দূর হয়নি। তাই তুমি যা ভাবছ তা আমাদের সেই হঠকারী ভাবনার রূপান্তর না হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত কি হল?
আমরা অ্যাকশনে নামছি।

তুমি সুদীপ কল্যাণ?

আর জয়িতা!

হোয়াই জয়িতা?

ও নিজেকে যোগ্য মনে করে। তাছাড়া আমরাও ওকে মেয়ে বলে মনে করি না।

কিন্তু আফটার অল সে মেয়ে!

হতে পারে। কিন্তু তার ব্যবহার এবং আচরণে মেয়েলিপনা নেই।

ব্যাপারটা আর কে কে জানে?

আজকে যে তিনজনের সঙ্গে কথা বলেছি তারা আর আপনি।

যদি ধরা পড়?

পড়ব। অন্তত কাগজে খবরটা বের হবে। চারটে তরুণ ছেলেমেয়ে একটা পরিকল্পিত অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়েছিল। হয়তো এই ঘটনা আমাদের মত অনেককে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। সুরথদা, আমরা পুলিশের গলা কাটতে যাচ্ছি না, মূর্তি ভাঙার বোকামিও করব না। আসল কাজ করতে না পারার অক্ষমতায় বোকার মত নকল বিদ্রোহ-বিদ্রোহ ভাব সৃষ্টি করব না। আমরা সেইসব জায়গায় আঘাত করতে চাই যা মানুষের ভাল ভাবে বেঁচে থাকার পথটাকে আইনের ফাঁকির সুযোগ নিয়ে নোংরা করে দিতে চাইছে। উই উইল ড়ু ইট ওয়ান আফটার অ্যানাদার। খুব নির্লিপ্তর মত কথাগুলো বলল আনন্দ।

সুরথদা কিছুক্ষণ ওর কঠিন মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর নিচু গলায় বললেন, ঠিক আছে। আমি সেন্ট্রাল কমিটির সঙ্গে কথা বলব। তোমাদের মত ব্রাইট ছেলেকে আমরা পেয়েছি, স্পষ্টই বলছি আমরা তোমাদের হারাতে চাই না।

ঠিক এই সময় একটি পুলিশের ভ্যান বউবাজারের দিক দিয়ে ছুটে আসছিল। ভ্যানটা এগিয়ে যেতে যেতে থমকে দাঁড়াল। সুরথদা বললেন, একসময় এই বস্তুটিকে দেখলে আমার হৃদকম্প হত। ইনি কি উদ্দেশ্যে এমন আচমকা দাঁড়ালেন?

ভ্যানটার দিকে তাকিয়ে আনন্দর অস্বস্তি হচ্ছিল। কোন কারণ নেই, তবু। ভ্যানের দরজা খুলে একজন পুলিশ অফিসার নেমেই চিৎকার করলেন, কি রে সুরথ

তারপর ট্রাম রাস্তাটা পেরিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে মাথা থেকে টুপিটা খুললেন ভদ্রলোক, কি ব্যাপার, চিনতে পারছিস না?

ও তুই! কি খবর? সুরথদাকে ঠিক স্বচ্ছন্দ বলে মনে হল না।

চলছে গুরু। পুলিশের চাকরি করলে যেমন চলে আর কি! ওঃ, কতদিন বাদে তোর সঙ্গে দেখা হল। প্রায় পনেরো বছর, তাই না? রাউন্ডে ওয়েছিলাম, হঠাৎ তোর দিকে নজর পড়ল। মনে হল এ মালকে আমি চিনি। দ্যাখ ভুল করিনি।

না, ভুল করিসনি।

সেদিন রাইটার্সে সৌমিত্রর সঙ্গে দেখা হল। আরে ইকনমিক্স পড়ত, মনে নেই? ও শালা এখন সেক্রেটারি হয়ে গেছে। আমাকে চিনতে পরেও ভাল করে কথা বলল না। মানতেই হবে, আফটার অল আমি একটা সাব-ইন্সপেক্টর, কলেজের বন্ধুরা কেউ কাউকে মনে রাখবে কেন? আমার সঙ্গে কথা বলতে তোর আবার অস্বস্তি হচ্ছে না তো? হো হো করে হাসলেন ভদ্রলোক।

না না। তুই পুলিশে চাকরি করছিস পেটের প্রয়োজনে।

ঠিক তাই। কিন্তু তুই বোধহয় একটা কথা জানিস না।

কি ব্যাপার?

সেভেনটি ওয়ানে আমি বউবাজার থানায় ছিলাম। একদিন রাত এগারোটায় হুকুম এল ডেঞ্জারাস নক্সালাইট নেতা লুকিয়ে আছে আমাদের এলাকায়। ইমিডিয়েটলি তাকে অ্যারেস্ট করতে হবে। গাড়ি নিয়ে ছুটলাম। সাফিসিয়েন্ট সেপাই ছিল সঙ্গে। নম্বর মিলিয়ে বাড়িটার সামনে গিয়ে হকচকিয়ে গেলাম। মেলোমশাইকে জিজ্ঞেস করিস আমি পনের মিনিট সময় ফালতু নষ্ট করেছিলাম। উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে মেসোমশাইকে আটকে রেখে বাড়ির সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলাম কেন এসেছি। পনেরো মিনিট পরে যখন অ্যাকশন নিলাম তখন তুই হাওয়া হয়ে গেছিস। ভদ্রলোক একটা সিগারেট ধরালেন, ওপরওয়ালা জানলে আমার চাকরি চলে যেত। কিন্তু আমি কি করে কলেজের বন্ধুকে সুযোগ না দিয়ে অ্যারেস্ট করি ব?

ধন্যবাদ। সুরথদা যেন ব্যাপারটা আনন্দের সঙ্গে নিলেন না, তুই নিজের হাতে কটা মানুষ মেরেছিস এতকাল?

হিসেব করিনি। কেউ যখন আমাকে খুন করতে চেয়েছে তাকে মেরেই আমাকে বাঁচতে হয়েছে। সুভাষচন্দ্র বোস কত মানুষকে খুন করেছেন?

মানে? আনন্দ এবার প্রশ্ন না করে পারল না।
 
আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক ছিলেন সুভাষ বসু।তারই হুকুমে ফৌজ যুদ্ধ করেছে ব্রিটিশদের সঙ্গে। অতএব প্রতিটি শত্রুর মৃত্যুর পেছনে সুভাষ বসুর নিশ্চয়ই দায়িত্ব ছিল। সুভাষ বসকে কি খুনী বলবে?

সুরথদা বললেন, চমৎকার যুক্তি। তবে তুই যা বললি তাই যদি করে থাকিস তাহলে একটা ধন্যবাদ পাওনা ছিল, দিলাম। অবশ্য তোর জাতভাইরা আমার চোখটাকে নষ্ট করেছে এটাও সত্যি ঘটনা।

হঠাৎ কথাবার্তা থেমে গেল। আনন্দ বুঝতে পারছিল যে-আবেগ নিয়ে ভদ্রলোক ভ্যান থেকে নেমে এসেছিলেন সেটা এখন উধাও হয়ে গেছে। সুরথদার কাটা কাটা কথাই এই আবহাওয়াটা তৈরি করল। শেষপর্যন্ত আনন্দই বলল, সুরথদা, আমার দেরি হয়ে গেছে অনেক। আমি কাল সম্ভব হলে আপনার সঙ্গে কথা বলব। সুরথদা নীরবে মাথা নাড়লেন।

পা চালাল আনন্দ। কিছুটা এগিয়ে ডান দিকে মোড় ঘোরার আগে সে পেছনে তাকাল। দূরে দুটো ছায়ামূর্তি এখনো কথা বলছে। আর দুটো সিগারেটের আগুন দেখা যাচ্ছে। সুরথদাও সিগারেট ধরিয়েছেন। এবং তখনই আনন্দ বুঝতে পারল সে ছিল বলেই সুরথদা ওইভাবে কথা বলছিলেন। একজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়ে কথা বললে যদি আনন্দ কিছু ভেবে বসে তাই ছাড়-ছাড় ভাব দেখাচ্ছিলেন। হঠাৎ পুরো ব্যাপারটা তেতো হয়ে গেল আনন্দর কাছে। পুলিশ অফিসার একসময় পুরোনো বন্ধুত্বের জন্যে উপকার করেছিলেন সুরথদার। অথচ নিজের ইমেজ বাচাবার জন্যে এতক্ষণ অভিনয় করলেন সুরথদা। এখন নিশ্চয়ই তার চেহারা স্বাভাবিক হয়েছে। আনন্দর সুদীপের কথা মনে পড়ল। সুদীপ সুরথাকে পছন্দ করে না। প্রসঙ্গ উঠলেই বলে, বহুৎ জালি লোক। আনন্দ ওকে বহুবার এইরকম শব্দ ব্যবহার করতে নিষেধ করেছে। কিন্তু সুরথদার মাধ্যমেই তো দলের সঙ্গে যোগাযোগ তাদের। সুদীপ বলে, দ্যাখো ভাই, নকশাল আন্দোলন যারা করেছিল তারা খুব হিম্মতবাজ, নো ডাউট। কিন্তু এখন তো সব ওই ইমেজ নিয়েই হিরো হয়ে বসে আছে। খাচ্ছে দাচ্ছে আর ফ্যাট গ্যাদার করছে। জিজ্ঞাসা করলে হিস্ট্রি ঝাড়বে। আরে তার রেজাল্ট কি হল! যা ছিল তাই রইল, মাঝখান থেকে নাম কিনল। জয়িতা এর সঙ্গে যোগ করেছিল, বাবার ক্লাবে রোজ ড্রিঙ্ক করতে আসেন এক ভদ্রলোক। জেল-টেল খেটেছেন, তাত্ত্বিক নকশাল ছিলেন, এখন পাবলিক রিলেশনস অফিসার। সবাই খুব খাতির করে। সুদীপ মাথা নাড়ে, এই মালটাও সেই সুযোগ খুঁজছে।

সুদীপ কিংবা জয়িতার সঙ্গে একমত নয় আনন্দ। ওরা সবসময় ওইরকম চড়া দৃষ্টিতে সবকিছু দ্যাখে। প্রাচুর্যের মধ্যে বাস করে চারপাশে যা দেখেছে তাতেই এই দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। কল্যাণ সেদিক দিয়ে বেশ চুপচাপ। কোন ব্যাপারে চট করে মন্তব্য করে না। শুধু মাঝে মাঝে বলে, কিছু একটা করো। এভাবে ভাল লাগছে না। সুদীপ কিংবা জয়িতার সঙ্গে ওর সম্পর্ক ভাল কিন্তু বোঝাই যায় আনন্দর ওপরেই সে নির্ভরশীল। আজ পর্যন্ত আনন্দ কল্যাণকে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। ওদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভাল নয় এটুকু সে জানে কিন্তু কোনদিন নিজের বাড়িতে ও কাউকে নিয়ে যায়নি।

হোস্টেলের সামনে এসে দাঁড়াল আনন্দ। রাস্তাটায় আলো নেই। গেট বন্ধ। কিছু দিন আগে এই হোস্টেলের একটা ছেলেকে হৃদয়ঘটিত ব্যাপারে খুন করা হয়েছে। তারপর থেকে কর্তৃপক্ষ খুব কঠোর হয়েছেন। খবরের কাগজে লেখালেখি এবং পুলিশী তৎপরতায় আনন্দর অবস্থা বেশ করুণ হয়েছিল তখন। কিন্তু এত বড় হোস্টেলের ছাত্রদের ম্যানেজ করা সুপারের পক্ষে সম্ভব নয়। শুধু আতঙ্ক সৃষ্টি করে শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা।

দরজা খোলার দরকার নেই। আনন্দ চিৎকার করে দারোয়ানকে ডাকল। তিনবারের বার সাড়া মিলল, কৌন হ্যায় জী?

নিজের নাম বলে খাঁজে পা রেখে কাঠের গেটের ওপর উঠে বসল আনন্দ। তাকে দেখতে পেয়ে দারোয়ান ভীত গলায় বলল, আমার নোকরি খতম হয়ে যাবে বাবু।

ওপাশে একটা মই আছে। দারোয়ান সেটাকে কাছে নিয়ে আসতে চটপট নেমে এল আনন্দ। তারপর বলল, আর বেশি দিন জ্বালাব না, ভয় নেই।

লম্বা করিডোর দিয়ে নিজের ঘরের সামনে এসে দেখল দরজা বন্ধ। ড়ুপ্লিকেট চাবি আনন্দর পকেটে আছে। সুরজিৎ এখনও ফেরেনি। এখন হোস্টেল অন্ধকার। হয়তো ডাইনিং রুমে গিয়ে হুজ্জত করলে কিছু খাবার পাওয়া গেলেও যেতে পারে কিন্তু সেই ইচ্ছে করল না আনন্দর। সুপারের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভাল নেই। খাবার চাইতে গেলে নানান প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হবে। হাত মুখ ধুয়ে জামাকাপড় ছেড়ে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল সে। এবং তখনই মনে হল খিদেটা পাচ্ছে। একটা রাত না খেয়ে থাকলে কোন অসুবিধে হবার কথা নয়। তাছাড়া ভারতবর্ষের লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতি রাত্রি অনাহারে কাটায়। সুতরাং ব্যাপারটা কিছুই নয়। চোখ বন্ধ করল সে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঘুম আসছে না।

হঠাৎ এখন মায়ের কথা মনে পড়ল আনন্দর। মা শব্দটা উচ্চারণ করলে যে চেহারাটা মনে আসে তার সঙ্গে বিন্দুমাত্র পার্থক্য নেই। একা একটার পর একটা বাধা ডিঙিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে আছেন এখনও। আনন্দ যখন প্রেসিডেন্সিতে পড়তে এসেছিল তখন তিনি বলেছিলেন, আমি তোমার কাছে কোন প্রত্যাশা করি না। বড় হয়েছ, নিজে কি করবে তা নিজেই বিচার করো। কর্মফল তুমিই ভোগ করবে। আমি তোমার খাওয়া থাকা পড়ার খরচ দিতে পারব আগামী ছয় বছর।
 
মাকে কখনও আবেগের শিকার হতে দ্যাখেনি সে। বাবা ছিলেন খুব আমুদে মানুষ। কথায় কথায় মন খারাপ করতেন, মন ভাল হতেও সময় লাগত না বেশি। তখন ডায়মন্ডহারবারের বাড়িতে ওরা থাকত না। ওই বাড়ির দায়িত্ব ছিল এক কাকার ওপর। বাবা মাঝে মাঝে যেতেন সেখানে দেখাশোনার জন্যে। তখন বেশ ছোট আনন্দ। নিচু ক্লাসে পড়ে। বাবা চাকরি করত ভাল। রকমারি খাবারদাবার হত রোজ। শনি রবিবার গাড়িতে করে বেড়াবার রেওয়াজ ছিল। ওই বয়সেই আনন্দর মনে হত বাবা মাকে প্রচণ্ড ভালবাসে। তাকে যা বাসে তার চেয়েও বেশি। এবং মা-ও তাই। এটা কি করে পাঁচ বছরের ছেলের বোধে এল তা এখন বুঝতে পারে না আনন্দ। কিন্তু সেই অনুভূতিটার কথা কথা মনে আছে। মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙে দেখেছে বাবা আর মা ব্যালকনিতে পাশাপাশি বসে আছে চুপচাপ। ওদের ফ্ল্যাটটা ছিল চারতলায়। ব্যালকনিতে দাঁড়ালে অনেকটা আকাশ দেখা যেত। সেখানে একটা ছোট বেতের সোফা ছিল। মা বাবা অত রাত্রে প্রায় জড়িয়ে ধরে কেন চুপচাপ বসে থাকত তা আনন্দ তখন বোঝেনি। কিন্তু সেই সময় হিংসে হত। সে জিজ্ঞাসা করত, আমি কি তোমাদের সঙ্গে বসতে পারি?

চমকে উঠে বাবা বলতেন, আরে, হ্যাঁ, চলে এস।

আর মা উঠে দাঁড়াতেন, না। তোমাকে আসতে হবে না। চল আমি তোমার সঙ্গে শুচ্ছি। কাল সকালে স্কুল আছে। এইটুকুনি ছেলে মাঝরাত্রে জেগে বসে থাকবে!

কেমন একটা স্বপ্নের মত ছিল দিনগুলো। বাবা প্রায়ই ট্যুরে যেতেন। ফিরতেন যখন কিছু না কিছু আনতেন ওর জন্যে। আর ওর সঙ্গে অদ্ভুত সব রসিকতা করতেন যার অর্থ ও বুঝতে পারত না বেশিরভাগ সময়। একদিন গড়ের মাঠের কাছে গাড়িতে বসে ওর তেষ্টা পেয়ে গিয়েছিল। জল খেতে চেয়েছিল সে। বাবা একটা রেস্তোরাঁর দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে তাকে বলেছিলেন, শোন, বড় হয়ে কোনও মেয়ের কাছে জল চাইবে না।

মা বলেছিলেন, আঃ কি বলছ?

সে জিজ্ঞাসা করেছিল, কেন?

বাবা উত্তর দিয়েছিলেন হেসে, আনন্দ, জল দাও বললেই সে চণ্ডালিকা হয়ে যাবে। এখন কথাগুলো মনে পড়লে লোকটাকে খুব ভাল লাগে তার। নরম মনে হয়। ঘটনাটা তার মনে আছে। বাবা গিয়েছিলেন জামসেদপুরে। তিনদিনের কাজ ছিল। ঠিক একদিন পরে টেলিফোনটা বাজল। তখন টেলিফোন বাজলেই ছুটে যেত সে। কেউ তোলার আগেই হ্যালো বলতে বেশ মজা লাগত। হ্যালো বলতেই ওপাশে কেউ ইংরেজিতে প্রশ্ন করল। তদ্দিনে দুটো শব্দ শিখেছিল আনন্দ। হোন্ড অন বলে রিসিভার নামিয়ে রেখে মাকে ডাকতে ছুটেছিল। মা তখন বাথরুম থেকে বেরিয়ে তোয়ালেতে খোঁপা জড়িয়ে হাউসকোটের বোম আঁটছিলেন, সহজ পায়ে এগিয়ে এসে রিসিভার তুলে কানে দিয়ে বললেন, হেলো!

উৎসুক হয়ে তাকিয়ে ছিল আনন্দ। ওর বিশ্বাস ছিল ফোনটা বাবার। অপারেটর লাইন ধরে মাকে দিচ্ছে। ও একবার বাবার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিল। কিন্তু আনন্দ অবাক হয়ে দেখল মায়ের মুখটা রক্তশূন্য হয়ে গেল। থর থর করে কাঁপতে লাগলেন মা। রিসিভারটা টেবিলের ওপর রেখে থপ করে বসে পড়লেন পাশের চেয়ারে। দুহাতে তার মুখ ঢাকা, শরীর প্রচণ্ড কাঁপছে। আনন্দ কিছুই বুঝতে পারছিল না। সে রিসিভারটা কানে তুলে যান্ত্রিক শব্দ শুনল। সেটাকে যথাস্থানে রেখে দিয়ে মায়ের দিকে তাকাল সে। মা হঠাৎ এক পাশে ঢলে পড়লেন। তার চোখ বন্ধ। দাঁতে দাঁত লেগে গেছে। আনন্দ চিৎকার করে মায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। দৃশ্যটা স্পষ্ট মনে আছে এখনও। তাদের ফ্ল্যাটে কেউ ছিল না। কাজের লোকটাও দেশে গিয়েছিল। মায়ের শরীরটাকে আঁকড়ে ধরে সে ঝাকাতে চেষ্টা করেছিল প্রাণপণে। শেষ পর্যন্ত মা চোখ খুললেন। এবং তখন সেই মাকে তার একদম অচেনা মনে হচ্ছিল। দুহাতে তার কাঁধ ধরে তাকিয়ে ছিলেন কিছুক্ষণ। সে উদভ্রান্তের মত জিজ্ঞাসা করেছিল, তোমার কি হয়েছে মা?

মা ঠোঁট কামড়েছিলেন। তারপর অদ্ভুত গলায় বলেছিলেন, আমাদের এখনই জামসেদপুর যেতে হবে আনন্দ। তোমার বাবা–।

বাবা যেতে বলেছে?

না। তোমার বাবা নেই। আজ সকালে তাকে হোটেলে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। তিনি ঘুমের বড়ি খেয়েছেন। কেঁদো না, তুমি কাঁদলে আমি শক্ত হতে পারব না।


তাকে নিয়ে মা একা গিয়েছিলেন জামসেদপুরে। সেখানে তাদের চেনাশোনা মানুষ কেউ ছিল না। পাগলের মত মা থানাপুলিশ করে শেষ পর্যন্ত ওখানকার কয়েকজন বাবার অফিসের লোকের সাহায্যে মৃতদেহ সৎকার করেছিলেন। কলকাতায় ফিরে এসে মা ভীষণ চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন। খবর পেয়ে কলকাতার বাড়িতে যেসব আত্মীয়স্বজন এসেছিলেন তারা নিজের মত বাবার মৃত্যু নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করতেন। মা কোনদিন সেই আলোচনায় অংশ নেননি। মাস কয়েক বাদে মা কলকাতার পাট চুকিয়ে চলে এলেন ডায়মন্ডহারবারে। বাবার পৈতৃক বাড়িতে। আনন্দর বাকি স্কুলজীবন কেটেছে ডায়মন্ডহারবারে। বাবার রেখে যাওয়া টাকার সুদে কোনরকমে চলে গিয়েছে দিনগুলো। নিজেকে একদম পালটে ফেলেছেন মা। গ্রামের স্কুলে এখনও পড়াচ্ছেন। অদ্ভুত কিছু নিয়মের পরিখায় জীবনটাকে প্রবাহিত করেছেন তিনি।

আজও বাবার মৃত্যুটা আনন্দর কাছে রহস্য হয়ে রইল। একটা হাসিখুশী মানুষ, সব ব্যাপারেই যাকে তৃপ্ত বলে মনে হত, তিনি কি কারণে গাদা গাদা ঘুমের ওষুধ খেতে যাবেন বাড়ি থেকে অনেক দূরে হোটেলে বসে? সেই হোটেলে গিয়ে জানা গিয়েছিল, ঘুমোত যাওয়ার আগে মাকে টেলিফোনে ধরার চেষ্টা করেছিলেন বাবা। অপারেটর কিছুতেই লাইন দিতে পারেনি। কি কথা বলতে চেয়েছিলেন বাবা? বড় হয়ে আনন্দ একদিন সরাসরি মাকে প্রশ্নটা করেছিল। মা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, জানি না। এত চেষ্টা করলাম তবু জানলাম না। এখন মনে হয় না জানতে চাওয়াই ভাল। যে পৃথিবী থেকে অকালে স্বেচ্ছায় চলে যায় সে নিশ্চয়ই পৃথিবীতে সুখী ছিল না। তার দুঃখের কারণটা জানতে চেয়ে এখন আর আমি কি করতে পারি!
 
খিদেটা কিছুতেই মরছিল না। আর খিদে না গেলে ঘুমও আসবে না। আনন্দ উঠে বসল। গতবার যখন ডায়মন্ডহারবারে গিয়েছিল তখনই মায়ের সঙ্গে সে সোজা কথা বলে নিয়েছিল। সে যা ভাবছে, যা যা করবে বলে পরিকল্পনা করছে তার বিশদ বিবরণ মাকে জানিয়েছে। মা চুপচাপ শুনেছেন, তারপর কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বলেছিলেন, তুমি নিজে যা ঠিক মনে করবে সেটাই করবে। আমি তোমার পড়াশুনার খরচ দিচ্ছি মানে এই নয় বিনিময়ে তোমার কাছে কিছু আশা করছি। তবে শুধু আমি একটি কথা বলব, সাহস আর হঠকারিতা এক জিনিস নয়।

কথাটা আনন্দ ভালভাবেই জানে। এই দেশে, এই সামাজিক এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোয় বিপ্লব সম্ভব নয়। ঠিক এই মুহূর্তে বিপ্লবের কথা কেউ উচ্চারণও করছে না। চারপাশের বিস্তর অন্যায় অবিচারের সঙ্গে মানুষ চমৎকার খাপ খাইয়ে নিয়েছে। এমন কি সে নিজে যে দলের সঙ্গে যুক্ত তারাও বিপ্লবের কথা বলে না। অথচ ওইরকম একটা বাতাবরণ তৈরি করে নিজেদের জঙ্গী চেহারায় দেখতে ভালবাসে।

কানাঘুষো শুনেছিল কিছুদিন আগে থেকেই। এবার ডায়মন্ডহারবারে গিয়ে স্বচক্ষে দেখে এল। জায়গাটার নাম দেওয়া হয়েছে প্যারাডাইস। কয়েকটা নিরীহ গ্রামবাসীর সামনে বড় পাঁচিল তুলে বিশাল এলাকা ঘিরে রাখা হয়েছে। এই এলাকার মধ্যে তৈরি হয়েছে মনোরম উদ্যান। বিভিন্ন জায়গা থেকে নিয়ে আসা গাছের চারা এখন বড় হয়েছে। ফুল ফুটছে সারা বছর। সমস্ত বাগানটা যাতায়াতের জন্যে সিমেন্টের সরু পথ যা বিভিন্ন কটেজের গা ঘেঁষে পাক খেয়েছে। এই কটেজগুলোর অধিকাংশই এয়ার কন্ডিশনড। এক রাত্রের জন্যে প্রায় আড়াইশো থেকে চারশো টাকা দক্ষিণা দিতে হয় সেখানে থাকতে হলে। এছাড়া আছে সুইমিং পুল; টেনিস এবং ব্যাডমিন্টন খেলার জায়গা। আর আছে কুঁড়েঘর। যার দেওয়াল নেই, মাথার ওপর খড়ের চাল, চারপাশের চারটে খুটির ওপর পর্দা গোটানো আছে, ইচ্ছে করলেই দেওয়াল তৈরি করে নেওয়া যায়। কুঁড়েঘরে ফ্যান আছে, আলো আছে, মোটা গদি পাতা নিচে। উর্দিপরা শিক্ষিত বেয়ারারা খাবার নিয়ে ঘোরাঘুরি করে দিনরাত সরু প্যাসেজ দিয়ে। খুব শক্তিশালী জেনারেটর চালায় প্যারাডাইস। খাবারের দাম আশেপাশের গ্রামবাসীর কল্পনারও বাইরে। এইরকম একটা স্বর্গের মত বাগানে প্রবেশ করতে গেলেই টিকিট কাটতে হয় মোটা টাকায়। তাতে শুধু ঘুরে বেড়ানো যায়। থাকা এবং খাওয়ার জন্যে আলাদা দাম দিতে হবে। এক সপ্তাহের বাজারের দাম খুইয়ে গ্রামের কোন মানুষ এখানে ঢোকেনি আজ পর্যন্ত। এই উদ্যান গ্রামের মানুষের কাজে লাগে না। গ্রাম থেকেও উদ্যানের মালিক কোন কিছু সংগ্রহ করে না। এইরকম পাণ্ডববর্জিত জায়গা, ডায়মন্ডহারবারের বাঁক যেখানে অনেক কিলোমিটার দূরে সেখানে রাস্তার পাশে ওই উদ্যান কেন তৈরি হল? এত টাকা খবচ করে কেন আসবে লোকে এখানে থাকতে? প্রশ্নটা গ্রামের মানুষের মনে জেগেছিল। উত্তর পেতে দেবি হয়নি। দিনবাত গাড়ি আসছে। শিক্ষিত প্রহরী দিয়ে ঘেরা এই উদ্যানের গেট খুলে গাড়িগুলো ঢুকে যাচ্ছে ভেতরে। সেখানে কি হচ্ছে গ্রামের মানুষের জানা নেই। তবে বেশির ভাগ গাড়িতেই মহিলা থাকছেন। কেউ কয়েক ঘণ্টা, কেউ গোটা রাত, কেউ বা তিনটে দিন কাটিয়ে ফিরে যায় কলকাতায়। প্রথম প্রথম গ্রামের ছেলেমেয়েরা ভিড় করে দেখত এইসব মানুষদের ঢোকা বা বের হবার সময়। আইনের সাহায্যে তাদের সেখানে আসা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গ্রামের মানুষ নিষ্ফল গজরায়, মুখরোচক গল্প তৈরি করে। অতি বড়লোকদের অবৈধ কাজের বাগানবাড়ি ওটা। ছেলেমেয়েদের শাসন করে ওদিকে না যেতে। কিন্তু ব্যাপারটার প্রভাব পড়ছে অল্পবয়সীদের ওপর। অথচ কেউ নেই প্রতিবাদ করার। দুটো রাজনৈতিক দল এখন গ্রামে সক্রিয়। তারা বলেছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে কাউকে বিরক্ত না করে, শান্তি বিঘ্নিত না করে যদি স্বাস্থ্যনিবাস চালায় তাহলে প্রতিবাদ করার কোনও রাস্তা নেই। প্যারাডাইসের মালিক প্রতি মাসে তিন জায়গায় মোটা টাকা খরচ করে থাকে এটা এখন প্রচারিত। দুটো রাজনৈতিক দল এবং পুলিশের আরও হাজারটা সমস্যা আছে। স্বাস্থ্যনিবাসকে ব্যভিচারের উদ্যান ভাবার কোন কারণ তারা খুঁজে পান না।





সুদীপকে নিয়ে আনন্দ জায়গাটাকে ভাল করে দেখে এসেছে। কোন রকম ছিদ্র রাখেননি প্যারাডাইসের মালিক। সাধারণত গাড়ি ছাড়া ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। তবে সঙ্গে মেয়ে থাকলে রিকশায় কেউ কেউ ঢুকে গেছে। চোখ বন্ধ করলেই আনন্দ দেখতে পায় সমস্ত গ্রাম ঘুটঘুটে অন্ধকার আর প্যারাডাইসে আলোর ঢল নেমেছে।

সুদীপ কল্যাণের সঙ্গে সরাসরি স্পষ্ট কথা হয়ে গেছে। দ্বিধা জয়িতাকে নিয়ে। মেয়েটা কথা বলে কাট কাট। যদিও ওকে কখনও মেয়ে বলে মনে হয় না আনন্দর। কলেজে ঢোকার পর থেকেই চারজনে কখন এক হয়ে গেল টের পায়নি। মেয়ে বলে কোন সহানুভূতি দেখাতে গেলে প্রচণ্ড খেপে যায় জয়িতা। অতএব ওকে দলে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। আজ পার্টির সঙ্গে কথাবার্তা বলে কোন লাভ হল না। ওদের কথার সঙ্গে সুরথদার কোনও পার্থক্য নেই। ঠিক এই অবস্থায় চিরদিন থাকলে চারজনেই জয়েন্ট এন্ট্রেল দিয়ে সুখী ভারতীয় নাগরিক হতে পারত। সেই যোগ্যতা তাদের ছিল। কল্যাণ বলে কিছু একটা করো। সুদীপ বলে একটা ঢেউ তুলে খতম হয়ে যাই ক্ষতি নেই। যদিও রাজনৈতিক শিক্ষা এই উদ্দামতাকে সমর্থন করে না। আনন্দর টেবিলের রাজনীতির বইগুলো কখনই এই কথা বলবে না। তবু মনে হচ্ছে থিয়োরির বাইরে গেলে কেমন হয়। নিজেদের ক্ষমতানুযায়ী ধাক্কা দিতে পারলে কেউ কেউ হয়তো এগিয়ে আসবে। ভারতবর্ষের মানুষের দুরবস্থার জন্যে কোনও রাজনৈতিক দল বা সরকার দায়ী নয়। দায়ী তারা নিজেরাই। এই অলস কর্মবিমুখ শুধু পেতে-চাওয়া এবং নিজেরটা বোঝার মানুষগুলোকে একাত্তর সাল কোন নাড়া দিতে পারেনি। টুকরো টুকরো ঘটনার মাধ্যমে তারাও কিছু করতে পারবে না। কিন্তু নিজের কাছে কৈফিয়ৎ দিতে পারবে। অন্তত তৃপ্ত হতে পারবে।

ঘরে কোন খাবার নেই, কাল সকালের আগে জুটবে না, আনন্দ আর একবার ঘুমোবার চেষ্টা করল।
 
০৪.
ঘুম থেকে উঠেই কল্যাণের মনে হয়েছিল মাথা ছিঁড়ে পড়ছে, সমস্ত শরীরে ব্যথা, জুরটা বেশ জমিয়ে এসেছে। খাট থেকে নামতে গিয়েই সে টের পেল আজকের দিনটা বাড়িতেই আটকে থাকতে হবে। সে কিছুক্ষণ খাটের ধারে পা ঝুলিয়ে বসে রইল। এখন কত বেলা বোঝা যাচ্ছে না। এককালে যে টেবিল ক্লকটা সময় জানাত সেটা দুহাত ছড়িয়ে স্থির হয়ে আছে বছরখানেক। সুজন নেই। যদি এখন আটটা বেজে গিয়ে থাকে তাহলে তার থাকার কথাও নয়। নাহয় প্রথম পনেরো দিন রান্নাঘরে তিনি ঢুকবেন না, তাই বলে আমার মাথা ধরলেও উনুনে হাত পোড়াতে হবে। কেন যে ছাই এখানে পড়ে আছ তা বুঝি না! গলাটা বড়বৌদির। সঙ্গে সঙ্গে মাযের গলায় ঝাজ ফুটল, হিসেবের ডিউটি করতে এসেছেন এই বাড়িতে! সকালে উনুন ধরিয়ে জল চাপিয়েই তিনি ঘরে ঢুকেছেন।

বড়দা চাপা গলায় বলল, আমি কিছু জানি না। সাড়ে নটায় বেরুবো, তার আগে খাবাব চাই। মাথা ধরলে যে তুমি সিমপ্যাথি পাবে এমন ভাবার কোন কারণ নেই।

বাবার গলা শোনা গেল, কি হচ্ছেটা কি! মেজবৌমার তো এই পনেরো দিন রান্নার ঘরে ঢোকার কথা নয়। সে উনুন ধরিয়েছে এই তো অনেক কথা।

তুমি চুপ করো। এক পয়সা দেবার মুরোদ নেই কথা বলতে আস কি সাহস! মিলেমিশে না থাকতে পারলে এই বাড়ি ছাড়তে হবে বলে দিলাম। মায়ের পায়ের আওয়াজ কানে গেল কল্যাণের। তিনি রান্নাঘরে যাচ্ছেন।

এই বাড়িতে বাবা এসেছিলেন চল্লিশ বছর আগে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর নাকি কলকাতায় খুব সস্তায় বাড়ি পাওয়া যেত। চারঘরের এই বাড়ির ভাড়া এখনও সত্তর টাকা। শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড়ের কাছাকাছি এমন বাড়ির চারখানা ঘরে থাকে কল্যাণ এবং তার ভাই সুজন, বাবা মা, বড়দা বউদি এবং মেজদা মেজবউ। চারটের মধ্যে দুটো ঘর বাসযোগ্য, একটায় কোনমতে থাকা যায়, চতুর্থটায় রান্না হত আগে। মেজদা কাণ্ডটা করে বসার পর থেকে রান্না হয় বারান্দার ঘেরা জায়গাটায়, রান্নাঘরটা একটু মেরামত করে নিয়ে মেজদার ঘর হয়েছে। বাড়িটায় ইঁদুর আছে প্রচুর। মেজদার ঘরেই বেশি যাতায়াত।

কল্যাণ বাবাকে আর কথা বলতে শুনল না। কিন্তু বড়দা বলল, বাবা, মা আমার কাছে সামনের মাসে একশ টাকা বেশি চেয়েছে। আমি ভেবে দেখলাম আমার পক্ষে আর কিছু দেওয়া সম্ভব নয়।

তোমার মাকে বল, আমি কিছু জানি না। সংসার চালান তিনি।

জানেন না তো অন্যের হয়ে ওকালতি করতে আসেন কেন? এটা বড়বউদির গলা।

ঘূথিকা, আমাকে কথা বলতে দাও। কল্যাণ এখনও বাড়িতে আছে।

আছে তো আছে। আমি কি তার খাই না পরি যে ভয় করতে যাব! তুমি কথা বলবে, দেখো আবার মিন মিন করে রাজী হয়ে যেয়ো না। বউদি বোধ হয় বারান্দা থেকে নিজের ঘরে চলে গেল। আজ যদি বাড়িতে থাকতে হয় তো সারাদিন এইসব সংলাপ শুনতে হবে। কল্যাণ উঠল। হাঁটার সময় মাথা ঘুরছিল। কিন্তু সে বারান্দায় বেরিয়ে এল। তাকে দেখামাত্র সবাই চুপ করে গেল। বড়দা কিছু হয়নি এমন ভান করে রয়েছে। তার পরনে বউদির শাড়ি, লুঙ্গির মত পরা। বাবার সামনে বসে মুঠোয় সিগারেট নিয়ে আছে বড়দা। ওটা সম্প্রতি আরম্ভ করেছে। বাবা ময়লা ধুতি পরে মোড়ায় বসে আছেন। কেউ তাকে কিছু বলল না। সোজা বাথরুমে ঢুকে গেল সে। এই জায়গাটা সবচেয়ে নোংরা এ-বাড়ির। চৌবাচ্চা পরিষ্কার করা নিয়ে নিয়মিত ঝগড়া হয়। চৌবাচ্চার দিকে তাকালেই কাদা চোখে পড়ে। সুজন সপ্তাহে একদিন কাজটা করে। কল্যাণ আর একদিন।

বাথরুম থেকে বেরুতে বেরুতে কানে এল, তোমার তিন ছেলে যদি কিছু না করে তাহলে আমার কিছু করার নেই। মেজ বিয়ে করেছে সে কত দিচ্ছে?

চারশো। বাবা বললেন, তুই যা দিস।

কল্যাণকে দেখে দাদা কিছু বলল না। সোজা ঘরে চলে এল সে। এই বাড়িতে কোন মানুষ ভদ্রভাবে থাকতে পারে না। বাবার জন্যে কষ্ট হয় কল্যাণের। চিরকাল কেমন বেচারা হয়ে রয়ে গেলেন। চাকরি করতেন সদাগরী অফিসে। মাইনে ছিল সামান্য। অথচ গর্ব ছিল, হয়তো এখনও আছে, তিনি সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ। বাড়িতে মুরগির মাংস ঢোকেনি আজ পর্যন্ত। অবসর নেবার পর হাতে যা পেয়েছিলেন তা শেষ হয়ে গেছে কোনকালে। একটা চোখে ছানি পড়েছে। চিরকাল মায়ের ছায়ায় আছেন।

বড়দা কত মাইনে পায় কেউ জানে না। খুব শৌখিন হয়ে থাকতে ভালবাসে। বউদিরও সাজগোজের দিকে ঝোক। প্রতি শনি-ববি দুটো সিনেমা দেখা চাই। একটা বাচ্চা হয়েছে। বাড়ির কাউকে সেটাকে ধরতে দেন না। চারশো টাকায় যদি দুবেলা খাবার আর চা পাওয়া যায় তো মন্দ কি। আলাদা সংসার করলে এই মজাটা থাকবে না তা দুজনেই ভাল মত জানে। তবু বউদি কথা শোনাতে ছাড়ে না। একটা ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করতে তিনি ওস্তাদ। এককালে কল্যাণের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রাখার চেষ্টা ছিল। এই বাড়িতে কল্যাণই একমাত্র ভাল ছেলে। ভাল বলতে পড়াশুনায় কখনও আশির নিচে নম্বর পায়নি। কোন প্রাইভেট টিউটর ছাড়াও অত নম্বর যে ছেলে পায় তার সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রাখতেই চাইবেন বড় বউদি। কিন্তু মেজদার বিয়ে নিয়ে যে কাণ্ড হয়ে গেল তারপর এখন সবার সঙ্গেই তার বাক্যালাপ বন্ধ। মেজদার বিয়ের আগে মায়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল প্রায় সাপে নেউলের মত। আশ্চর্য ব্যাপার, মেজবউদি বাড়িতে আসার পর কিছুদিন মা ছিলেন তার দিকে, এখন মেজবউদি তার চক্ষুশূল। সব সময় মা কথা বলেন বড়বউদির পক্ষ নিয়ে।
 
মেজদা একটু অদ্ভুত রকমের মানুষ। ও যে কখনও বিয়ে করবে তা কেউ ভাবেনি। প্রেম করার ব্যাপারটা তো বিশ্বাসেই আসেনি প্রথমে। একটু বেহিসাবী, খামখেয়ালী, পাগলাটে ধরনের মানুষ হিসাবেই সকলে জানত ওকে। যেটা মাথায় আসবে তাই করবে। বিবেকানন্দর বই পড়া থাকায় যখন তখন তার বাণী আওড়াত। পার্ট ওয়ান পর্যন্ত পড়ে ওর মনে হয়েছিল লেখাপড়া ওর জন্যে নয়। ব্যবসাপত্তর করলে কেমন হয়? বাবার কাছে টাকা চেয়েছিল। পায়নি। দাদাও দিতে চায়নি। শেষ পর্যন্ত চার বন্ধু একসঙ্গে ট্রাভেলিং এজেন্সি করেছে। ট্রাভেলিং এজেন্সি বলে বটে তবে ওটা তীর্থ স্পেশ্যাল। মেজদা ওয়ার্কিং পার্টনার। রাজগীর নালন্দা থেকে হরিদ্বার হৃষিকে নিয়ে যায় পার্টি যোগাড় করে। কত থাকে কি পায় কেউ জানে না। তবে মাসে চারশো টাকা মায়ের হাতে দিচ্ছে ছমাস। মাসের পঁচিশ দিন তাকে ওই কাজে বাইরে কাটাতে হয়। অর্থাৎ দুজনের টাকায় একজন খায়। গত মাসে তাকে টাকা বাড়াবার কথা বলায় সে সবাইকে শুনিয়ে জবাব দিয়েছিল, আমি বাড়ির সবচেয়ে খারাপ ঘর নিয়েছি। পুরো টাকা দিয়ে পঁচিশ দিন একজন খাচ্ছি না। এরপর টাকা চাইছ কোন্ মুখে! এতকাল এইসব কথা বলিনি, এখন বলব। তবে হ্যাঁ, তোমরা আমার বউকে যা ইচ্ছে বলতে পার, আমি তাকে বলে দিয়েছি সে যেন কোন প্রতিবাদ না করে। তোমরা যা বলবে তা রেকর্ড করে রাখবে, আমি এসে শুনব। কেউ কারও ঘরে ঢোকে না। বড়বউদির ধারণা হয়েছিল মেজর ঘরে বোধ হয় টেপ রেকর্ডার আছে। বড়দা বলেছিল, বাইরে বাইরে ঘোরে, টানামাল নিয়ে আসতে পারে। মেজদা চলে যাওয়ার পর মা মেজবউদিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, হ্যাগো, তোমরা আবার কবে টেপ রেকর্ডার কিনলে? এক বাড়িতে আছ যখন, তখন দেখাতেও তো পার!

মেজবউদি অবাক হয়ে বলেছিল, ওমা, কে বলেছে আমরা টেপ রেকর্ডার কিনেছি?

কেন, তোমার স্বামী যে বলল সেদিন।

আপনি তো ওকে চেনেন মা, কি বলতে কি বলে!

মিছে কথা বলছ না তো বাপু?

আপনি ঘরে এসে দেখুন।

তারপর থেকে আবার সোচ্চারে সংলাপ বলা হচ্ছে। মেজবউদির সঙ্গে তেমন কথাবার্তা হয় না কল্যাণের। খাবার দেওয়া নেওয়ার সময় যেটুকু! সুন্দরী তো নয়ই, তবে সুশ্রী বলা যায়। তবে অত্যন্ত রোগা। মেজদার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট হবে। এই মেয়ে যে কি করে মেজদার প্রেমে পড়ল তা কল্যাণ আজও ভেবে পায়নি। প্রেম করার মত কোন গুণ মেজদার নেই। মেজদাদের টুরিং পার্টির সঙ্গে গিয়েছিল মেজবউদির বাবা মেয়েকে নিয়ে। হরিদ্বারে গিয়ে ভদ্রলোক খুব অসুখে পড়েন। দল চলে আসার সময় তাকে রেখে আসতে হচ্ছে বলে মেজদা থেকে গিয়েছিল। একটু সুস্থ হয়ে ভদ্রলোক বলেছিলেন তিনি রিটায়ার করতে যাচ্ছেন। স্ত্রী নেই। একটি মেয়েকে নিয়ে চিন্তা। টাকাও নেই যে ওই রোগা মেয়ের বিয়ে দেবেন। মেজদা বলেছিল খাওয়াপরার দায়িত্ব সারাজীবনের জন্যে নিলে তিনি কি মেয়ের বিয়ে তার সঙ্গে দেবেন? মেজদার সেবা পেয়ে ভদ্রলোক এমন কৃতার্থ ছিলেন যে না বলতে পারেননি। আর সাতদিন একসঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে দাদার নাকি বউদিকে ভাল লেগে গিয়েছিল। মেজবউদি হরকে পিয়ারীর ঘাটে দাঁড়িয়ে বলেছিল, বাবার যদি কিছু হয় তাহলে আমার কি হবে? তখন দাদা নাকি হাত ধরে বলেছিল, কেন, আমি আছি। আমাকে তুমি পছন্দ করবে বিনীতা?

মেজবউদি নাকি জবাবে এত মাথা নুইয়েছিল যে চিবুক গিয়ে বুকে ঠেকেছিল। এখনও এই বাড়িতে মেজবউদি ওই একই ভঙ্গিতে কাজ করে যায়। সিনেমা থিয়েটার দূরের কথা, বাপের বাড়িতে যাওয়ার সময় সুযোগ হয় না। সুজনের সঙ্গে মেজবউদির বেশ ভাব। বয়সে সুজন বছর খানেকের ছোট হবে। তাই নিয়ে বড়বউদির খোটা শুরু হয়েছে সুজনের অসাক্ষাতে।

সুজন ওদের ছোটভাই। মাধ্যমিক পাস করতে পারেনি। দুবার চেষ্টা করেছিল। এখন কান ঢাকা চুল, ঘাড়ের কাছে ঈষৎ বাবরি, অমিতাভ বচ্চনের মত একটা প্যাটার্নও এবং ওর বন্ধুদের মধ্যে চালু। মাস্তানি করার প্রবণতা আছে কিন্তু পার্টি করে। এ পাড়ার অনেক বেকার ছেলে পার্টি করার দৌলতে চাকরি পেয়েছে। পাসটাস করা থাকলে সুজনও পেয়ে যেত অ্যাদ্দিনে। কিন্তু মাধ্যমিক ফেল করা যোগ্যতা নিয়ে যে চাকরি পাওয়া যায় তা সে করবে না। কিন্তু তার আয় আছে। কোথেকে টাকা পায় কোনদিন জিজ্ঞাসা করেনি কেউ। কল্যাণের ঘরেই সে শোয় যদি রাতে ফেরে। প্রত্যেক মাসে একশ টাকা মায়ের হাতে দিয়ে বলে, বিয়ে করলে চারশো দেব নইলে একশ। প্রায়ই সে কল্যাণকে শোনায়, দাদা তুই বি. এ. পাস কর, তোর চাকরির জন্যে আমি বলে রেখেছি।

কাকে বলেছিস? কৌতুক বোধ করত কল্যাণ।

অভিরামদাকে। নেক্সট ইলেকশনে পার্টির ক্যান্ডিডেট হচ্ছে।

কেন, এখন যে এম এল এ আছে সে কোথায় যাবে।

বুড়া হয়ে গেছে বহুত, চেয়ারম্যান বলেছে তরুণদের সুযোগ দেওয়া হবে।

তোর কি হবে?

আমার লাইন ফিট করা আছে। হাওয়া খারাপ বুঝলে পাল্‌টি খাব।

পাল্‌টি খাবি?

ইয়েস। ওই পার্টি থেকে দর দিচ্ছে আমাদের। মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলের প্লেয়ার ভাঙানোর কথা শুনিসনি? যে মাল দেবে আমরা তার প্লেয়ার।

কল্যাণ খানিক চুপ করে থেকে বলেছিল, আচ্ছা সুজন, তোর কখনও মনে হয়, এই সমাজব্যবস্থা, রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচার যদি পালটে যেত তাহলে কেমন হত?

অ্যাই দাদা, মজাকি করিস না। সব শালা বড়দা বড়বউদির মত। ওসব ফালতু ইমোশন কারও নেই। কেউ কিছু পালটাবে না। অতবড় নকশালরা হাপিস হয়ে গেল। মা কামাও জিন্দা রহ। এই হল শ্লোগান।

শ্লোগান?

চেঁচিয়ে বলি না। বন্দে জিন্দাবাদ!

সুজন, এই বাড়িটাকে তোর কেমন মনে হয়?

চোখ কান বুজে রাত কাটানোর পক্ষে ফাইন জায়গা।
 
মায়ের হাতে কল্যাণ দেয় দেড়শ টাকা। প্রত্যেক সকালে তাকে টিউশনি করতে যেতে হয়। দুটি এইট মাইনের মেয়েকে সপ্তাহে ছদিন পড়ালে মাসে দুশো টাকা পাওয়া যায়। কলেজের খরচ লাগছে না। নাম্বার কি করে ভাল হল কল্যাণ জানে না কিন্তু প্রেসিডেন্সিতে ভরতি হতে মোটেই অসুবিধে হয়নি।

অর্থাৎ হাজার পঞ্চাশ টাকায় মাকে এই সংসার চালাতে হয়। আটজন মানুষ ওই টাকায় খায়। সপ্তাহে একদিন মাছ আসে। কলকাতার বাজার দর এখন যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে তাতে মা কি উপায়ে যে তাদের তিরিশ দিন খাবার বেড়ে দিচ্ছেন তা সত্যি গবেষণার বিষয়। ভাত ডাল সেদ্ধ আর তরকারি। তাই বা জোটে কিভাবে! বাড়িভাড়া, ইলেকট্রিক বিল থেকে আরও দশটা খরচ আছে। এইসব ভাবলে মায়ের জন্যে এক ধরনের কষ্ট হয় কল্যাণের। চিরকাল মহিলা অভাবের সঙ্গে লড়াই করে গেলেন। তবু বাবা চাকরিতে থাকতে তাকে সহজ মনে হত। যেন রাশটা ভাল ধরা থাকত। কিন্তু বড়বউদি অন্যায় করছে দেখেও তার সঙ্গে নিজেকে জুড়ে দেওয়া কিছুতেই বরদাস্ত করা যায় না। মা জানেন বড়দাকে চটিয়ে এখন থাকা যাবে না। মেজছেলের চাকরি নয়, অর্থাগম নিয়মিত হবেই এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। ছোট দুজন চাকরি করে না। এই সময় মাকে সুজনের মতই মনে হয়। যে ক্ষমতায় তার দিকে পাল্লা ঝুলিয়ে থাকা।

এই বাড়ি কল্যাণকে কিছু দেয়নি। শুধু পরিচয় ছাড়া। স্কুল-জীবনে তার কখনও মাইনে লাগেনি। বইপত্র পেয়েছে চেয়েচিন্তে বা কখনও স্কুলের অনুগ্রহে। প্রেসিডেন্সিতে পড়ে, এখনও তার ভাল লোশাক বলতে একটা জিনসের প্যান্ট আর হ্যান্ডলুমের শার্ট। বেশির ভাগ সময় পাজামা আর খাদির পাঞ্জাবি পরে। ইদানীং সিগারেট খায় মাঝেমধ্যে। কলেজে ঢুকে প্রথম বন্ধুত্ব হয়েছিল আনন্দর সঙ্গে। তারপর সেইসূত্রে সুদীপ আর জয়িতা। অন্য ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তার এক ধরনের কমপ্লেক্স কাজ করে। তিন বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা মারার সময় সেটা হয় না। জয়েন্ট এনট্রান্স পরীক্ষা দেয়নি কল্যাণ। দিয়ে লাভ হত না। যদি মেডিক্যাল কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং-এ সুযোগ পাওয়াও যেত তাহলে সেই খরচ কে টানতো? এখন আরও কয়েক বছর পড়াশুনা করলে অধ্যাপনা কিংবা মাস্টারির ক্ষীণ সুযোগ আছে। আর বি. এ.-টা পাস করলে বি সি এস দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু এসব করে কি হবে! আনন্দ ঠিকই বলে। যেজন্যে গরু পোষে মানুষ, যত্ন করে শিশুকাল থেকে খোল-বিচুলি খাওয়ায়, তেমনি করে আমরা তৈরি হই একটা ডিগ্রি পাওয়ার জন্যে। সেই মোক্ষলাভ হলেই যদি চাকরি ভিক্ষে পাওয়া যায় তো প্রথমে কাছের আত্মীয়দের উপকার, পরে নিজের সংসার তৈরি করার জন্যে উঠে পড়ে লাগে। এই করতে করতে একদিন বুড়ো হয়ে মরে যাওয়া। আর এই সময় যত অন্যায় অবিচার মুখ বুজে সয়ে যাওয়া, নইলে নিজের দেওয়াল ভেঙে পড়তে পারে। শুধু স্বার্থপর হওয়ার জন্যে পড়াশুনা করে চাকরি জোটানো। কিংবা এদেশের ছেলেদের কিছু করার পথ খোলা নেই বলেই পড়াশুনা নামক নিয়মটার মধ্যে আটকে থাকা। কল্যাণ এতদিন কলেজ করে স্পষ্ট বুঝে গেল তেমন কোন দুর্ঘটনা না ঘটলে সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে যাবে। এবং তারপর সে তো শিক্ষিত মানুষ হিসেবে স্বীকৃত হবে। কিন্তু সে নিজে জানে তার কিছুই জানা নেই। যে বিষয় নিয়ে সে অনার্স পড়ছে তার কয়েকটা অধ্যায়, বাঁধাধরা প্রশ্ন এবং কিছু বাড়তি নোটস তাকে বৈতরণী সসম্মানে পার করে দেবে। এই শিক্ষার কোন মানে হ। একটা সুপরিকল্পিত চালাকির মধ্যে তাদের প্রতি বছর ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। আর তারা সেই খাতে ঘোলা জল হয়ে বয়ে যাচ্ছে।

কি হল, কলেজ নেই?

কল্যাণ আবার বিছানায় ফিরে এসেছিল। মুখ ফিরিয়ে মাকে দেখল। নিচু গলায় বলল, আছে।

কখন গিয়ে উদ্ধার করবে?

যাব না আজকে।

কেন? কিছু হয়েছে নাকি? মুখচোখ ওরকম কেন?

জানি না। হয়েছে কিছু। তোমাদের চা খাওয়া হয়ে গেছে?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top