অনেকক্ষণ। তোমার জন্যে ভরদুপুরে কেউ চা করতে পারবে না। শোন, তুমি পড়াশুনা করছ বলে আমি কিছু বলতে পারছি না। কলেজে যদি না যেতে ইচ্ছে করে তাহলে চাকরির চেষ্টা করো। সুজন বলছিল ও নাকি ইচ্ছে করলে পার্টিকে বলে চাকরি পাইয়ে দিতে পারে।
বিরক্ত কোর না। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।
তোমাদের সঙ্গে কথা বললেই বিরক্ত হও। আমি কি করে সংসার চালাব বলতে পার? একজন তো বিয়ে করে আমার ঘাড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন কন্যাকুমারিকা।
তুমি খামোকা মেজবউদির পেছনে লাগছ। অবশ্য এটা তোমাদের ব্যাপার।
মা যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন, আমি কি করছি না করছি তা নিয়ে তোমায় চিন্তা করতে হবে না। তুমি নিজেরটা দ্যাখো। মনে হচ্ছে জ্বরটর বাধিয়েছ, ওষুধ আনাব?
দরকার নেই। শুয়ে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে।
ভাত খাবি কি খাবি না?
না।
চোখ বন্ধ করে কল্যাণ পড়ে রইল অনেকক্ষণ। ঠিক কখন মেজবউদি ঘরে ঢুকেছিল টের পায়নি। নরম গলায় শুনতে পেল, চা।
শব্দটাকে অমৃত বলে মনে হল। চোখ খুলে সে জিজ্ঞাসা করল, কি দরকার ছিল?
মা পাঠিয়ে দিলেন। মেজবউদি বলে চলে যাচ্ছিলেন।
কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, মেজদা কবে ফিরবে?
জানি না। কেন?
তোমার ওপর যা ঝড় যাচ্ছে তা সামলানো দরকার।
এসব জেনেই তো এসেছি। মেজবউদি চলে গেল।
চা খাওয়া শেষ হলে বাবা দরজায় এসে দাঁড়ালেন, জুর কত?
দেখিনি। বেশি নয়। কল্যাণ উঠে পাঞ্জাবিটা টেনে নিল।
শুনলাম কলেজে যাবি না?
হ্যাঁ।
শরীর নিশ্চয়ই খুব খারাপ নইলে কামাই করবি কেন?
কল্যাণ জবাব না দিয়ে চুলটা আঁচড়ে নিচ্ছিল।
কোথায় বেরুচ্ছিস?
কাছেই।
কলু, তোকে নিয়ে আমার কত গর্ব। আমার বংশে কেউ ফার্স্ট ডিভিশনে স্টার পেয়ে পাস করেনি। কোনরকমে বি. এ.-টা পাস করে সরকারি পরীক্ষা দিয়ে দিলেই ঈশ্বরের আশীর্বাদে চাকরি পেয়ে যাবি।
তাতে তোমার কি লাভ হবে?
মানে? বাবা যেন হতভম্ব হয়ে গেলেন।
চাকরি করে তোমাদের হাতে চারশো টাকা ধরিয়ে দেব প্রতি মাসে বড়দা যেমন দেয়? তখন তোমার এই গর্ববোধটা থাকবে?
তা থাকবে। বলতে পারব তো চিরকাল আমার সেজ ছেলে স্টার পেয়ে প্রেসিডেন্সিতে পড়ত। তবে কিনা একটা কথা, সন্তান তার আচরণের মাধ্যমেই পিতামাতার স্নেহ অথবা ভয় আদায় করে নেয়। তোমার দুই দাদার সঙ্গে তোমার তো চরিত্রের পার্থক্য থাকবেই। হাতের পাঁচটা আঙুল সমান নয়। ঝাঁপসা চোখে শীর্ণ বৃদ্ধ দরজায় একটা হাত রেখে যেন খুব গূঢ় তত্ত্ব বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন।
বাবা, তোমার কারও ওপর রাগ হয় না? আচমকা প্রশ্নটা ছুঁড়ল কল্যাণ।
হয়। নিজের ওপরে হয়। কেন বাবা?
আর কারও ওপর হয় না? তোমার চারপাশে এত অন্যায় ঘটছে!
হয় না। ভোররাত থেকে কেরোসিনের লাইনে গড়িয়ে পা ব্যথা হয়ে যায় অথচ দেখি সুজনের বন্ধুরা লাইন কন্ট্রোল করার নামে ব্ল্যাক করছে সমানে, তখনও রাগ হয় না। মনে হয় এই যে দাঁড়িয়ে আছি তাতেও তো সময় কেটে যাচ্ছে। পাশের বাড়ির অনিলবাবু বলছিলেন, আপনার চিন্তা কি। ছেলে প্রেসিডেন্সিতে পড়ছে, ভাল চাকরি পাবেই। আমি তখন খুশী হই। দ্যাখো, সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত, এখন আর রাগারাগি করে কি লাভ বল! তোমার কি খুব জ্বর বেড়েছে? মুখ চোখ লাল কেন?
ঠাণ্ডা লেগেছে বোধ হয়।
তোমার মায়ের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ো না। যাকে সব সামলাতে হয় তার মাথা ঠিক থাকে না। মানুষটা কোনদিন আরাম পেল না। আমিও দিতে পারিনি, এরাও পারল না।
কল্যাণ বলতে চাইল, আমার ওপর এত ভরসা কোর না বাবা। কারণ এইভাবে ইঁদুরের মত বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না আমার। কিন্তু তার জিভ আড়ষ্ট হল। বাবার পাশ কাটিয়ে সে চুপচাপ বেরিয়ে এল বাইরে। কল্যাণের মনে হচ্ছিল এইভাবে কথা বলাটা ঠিক হয়নি। বাবার জন্যে কষ্ট হয়, মায়ের জন্যেও, যে মেজবউদি এই সেদিন এল তার জন্যেও। কিন্তু সেসব কষ্ট আলাদা আলাদা। যখন সব মিলিয়ে দেখা যায় তখন আর কষ্টটা থাকে না। বরং তার বদলে একটা ক্রোধ আসে। প্রত্যেককেই স্বার্থপর বলে মনে হয় তখন। এইখানে একটু হোঁচট খেল কল্যাণ। মেজবউদিকে ঠিক স্বার্থপর বলার কোন কারণ এখনও পায়নি। কিন্তু ওই যে সব সহ্য করে এঁটুলির মত এই সংসারে লেগে থাকা তার মধ্যেও এক ধরনের জেদ কাজ করে যা কল্যাণের মোটেই পছন্দ নয়।
বেশ রোদ উঠেছে। গলি থেকে বেরিয়ে বেশ কষ্ট হচ্ছিল কল্যাণের। চা খেয়ে শরীরটাকে চাঙ্গা বলে মনে হচ্ছিল কিন্তু সেটা যে খুব সাময়িক তা বুঝতে পারেনি। কল্যাণ ধীরে ধীরে হেঁটে মোড়ের মাথায় চলে এল। বঙ্কিমদা তখন দোকান খুলে সবে বসেছে। এখনও খদ্দের আসেনি। কল্যাণকে দেখে বলল, কি হয়েছে? জ্বর?
কল্যাণ মাথা নাড়ল, বোধ হয়। কাল রাত্রে ঠিক ছিলাম, আজ সকালে উঠে দেখি কিন্তু এটাকে আজই সারিয়ে ফেলতে হবে। কালকের মধ্যে ফিট হতে হবে।
বঙ্কিমদা হাসল, ঠিক আছে। ভেতরে এসে বোস। আমি তোর জুরটা দেখি। ডাক্তার না হয়েও তোর জন্যে ডাক্তারি করছি, পুলিস জানলে–।
এই সময় একজন বৃদ্ধ এসে দাঁড়ালেন কাউন্টারে, কাল থেকে ছবার বাহ্যি গিয়েছি। একটা ওষুধ দাও তো।
কি ওষুধ দেব?
সে আমি কি জানি? তুমি যা ভাল বোঝ তাই দাও।
বঙ্কিমদা কয়েকটা ট্যাবলেট এগিয়ে দিয়ে কিভাবে খেতে হবে বুঝিয়ে পয়সা নিল। কল্যাণ বলল, তুমি তো ডাক্তারদের বারোটা বাজাবে, দোষ দিলে আমাকেই।
জ্বর বেশি নয়। এক পয়েন্ট চার। ওষুধ খাইয়ে বঙ্কিমদা বলল, বাড়ি গিয়ে শুয়ে থাক। দুপুর বিকেল রাত্রে বাকিগুলো খেয়ে নিস।
বিরক্ত কোর না। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।
তোমাদের সঙ্গে কথা বললেই বিরক্ত হও। আমি কি করে সংসার চালাব বলতে পার? একজন তো বিয়ে করে আমার ঘাড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন কন্যাকুমারিকা।
তুমি খামোকা মেজবউদির পেছনে লাগছ। অবশ্য এটা তোমাদের ব্যাপার।
মা যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন, আমি কি করছি না করছি তা নিয়ে তোমায় চিন্তা করতে হবে না। তুমি নিজেরটা দ্যাখো। মনে হচ্ছে জ্বরটর বাধিয়েছ, ওষুধ আনাব?
দরকার নেই। শুয়ে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে।
ভাত খাবি কি খাবি না?
না।
চোখ বন্ধ করে কল্যাণ পড়ে রইল অনেকক্ষণ। ঠিক কখন মেজবউদি ঘরে ঢুকেছিল টের পায়নি। নরম গলায় শুনতে পেল, চা।
শব্দটাকে অমৃত বলে মনে হল। চোখ খুলে সে জিজ্ঞাসা করল, কি দরকার ছিল?
মা পাঠিয়ে দিলেন। মেজবউদি বলে চলে যাচ্ছিলেন।
কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, মেজদা কবে ফিরবে?
জানি না। কেন?
তোমার ওপর যা ঝড় যাচ্ছে তা সামলানো দরকার।
এসব জেনেই তো এসেছি। মেজবউদি চলে গেল।
চা খাওয়া শেষ হলে বাবা দরজায় এসে দাঁড়ালেন, জুর কত?
দেখিনি। বেশি নয়। কল্যাণ উঠে পাঞ্জাবিটা টেনে নিল।
শুনলাম কলেজে যাবি না?
হ্যাঁ।
শরীর নিশ্চয়ই খুব খারাপ নইলে কামাই করবি কেন?
কল্যাণ জবাব না দিয়ে চুলটা আঁচড়ে নিচ্ছিল।
কোথায় বেরুচ্ছিস?
কাছেই।
কলু, তোকে নিয়ে আমার কত গর্ব। আমার বংশে কেউ ফার্স্ট ডিভিশনে স্টার পেয়ে পাস করেনি। কোনরকমে বি. এ.-টা পাস করে সরকারি পরীক্ষা দিয়ে দিলেই ঈশ্বরের আশীর্বাদে চাকরি পেয়ে যাবি।
তাতে তোমার কি লাভ হবে?
মানে? বাবা যেন হতভম্ব হয়ে গেলেন।
চাকরি করে তোমাদের হাতে চারশো টাকা ধরিয়ে দেব প্রতি মাসে বড়দা যেমন দেয়? তখন তোমার এই গর্ববোধটা থাকবে?
তা থাকবে। বলতে পারব তো চিরকাল আমার সেজ ছেলে স্টার পেয়ে প্রেসিডেন্সিতে পড়ত। তবে কিনা একটা কথা, সন্তান তার আচরণের মাধ্যমেই পিতামাতার স্নেহ অথবা ভয় আদায় করে নেয়। তোমার দুই দাদার সঙ্গে তোমার তো চরিত্রের পার্থক্য থাকবেই। হাতের পাঁচটা আঙুল সমান নয়। ঝাঁপসা চোখে শীর্ণ বৃদ্ধ দরজায় একটা হাত রেখে যেন খুব গূঢ় তত্ত্ব বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন।
বাবা, তোমার কারও ওপর রাগ হয় না? আচমকা প্রশ্নটা ছুঁড়ল কল্যাণ।
হয়। নিজের ওপরে হয়। কেন বাবা?
আর কারও ওপর হয় না? তোমার চারপাশে এত অন্যায় ঘটছে!
হয় না। ভোররাত থেকে কেরোসিনের লাইনে গড়িয়ে পা ব্যথা হয়ে যায় অথচ দেখি সুজনের বন্ধুরা লাইন কন্ট্রোল করার নামে ব্ল্যাক করছে সমানে, তখনও রাগ হয় না। মনে হয় এই যে দাঁড়িয়ে আছি তাতেও তো সময় কেটে যাচ্ছে। পাশের বাড়ির অনিলবাবু বলছিলেন, আপনার চিন্তা কি। ছেলে প্রেসিডেন্সিতে পড়ছে, ভাল চাকরি পাবেই। আমি তখন খুশী হই। দ্যাখো, সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত, এখন আর রাগারাগি করে কি লাভ বল! তোমার কি খুব জ্বর বেড়েছে? মুখ চোখ লাল কেন?
ঠাণ্ডা লেগেছে বোধ হয়।
তোমার মায়ের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ো না। যাকে সব সামলাতে হয় তার মাথা ঠিক থাকে না। মানুষটা কোনদিন আরাম পেল না। আমিও দিতে পারিনি, এরাও পারল না।
কল্যাণ বলতে চাইল, আমার ওপর এত ভরসা কোর না বাবা। কারণ এইভাবে ইঁদুরের মত বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না আমার। কিন্তু তার জিভ আড়ষ্ট হল। বাবার পাশ কাটিয়ে সে চুপচাপ বেরিয়ে এল বাইরে। কল্যাণের মনে হচ্ছিল এইভাবে কথা বলাটা ঠিক হয়নি। বাবার জন্যে কষ্ট হয়, মায়ের জন্যেও, যে মেজবউদি এই সেদিন এল তার জন্যেও। কিন্তু সেসব কষ্ট আলাদা আলাদা। যখন সব মিলিয়ে দেখা যায় তখন আর কষ্টটা থাকে না। বরং তার বদলে একটা ক্রোধ আসে। প্রত্যেককেই স্বার্থপর বলে মনে হয় তখন। এইখানে একটু হোঁচট খেল কল্যাণ। মেজবউদিকে ঠিক স্বার্থপর বলার কোন কারণ এখনও পায়নি। কিন্তু ওই যে সব সহ্য করে এঁটুলির মত এই সংসারে লেগে থাকা তার মধ্যেও এক ধরনের জেদ কাজ করে যা কল্যাণের মোটেই পছন্দ নয়।
বেশ রোদ উঠেছে। গলি থেকে বেরিয়ে বেশ কষ্ট হচ্ছিল কল্যাণের। চা খেয়ে শরীরটাকে চাঙ্গা বলে মনে হচ্ছিল কিন্তু সেটা যে খুব সাময়িক তা বুঝতে পারেনি। কল্যাণ ধীরে ধীরে হেঁটে মোড়ের মাথায় চলে এল। বঙ্কিমদা তখন দোকান খুলে সবে বসেছে। এখনও খদ্দের আসেনি। কল্যাণকে দেখে বলল, কি হয়েছে? জ্বর?
কল্যাণ মাথা নাড়ল, বোধ হয়। কাল রাত্রে ঠিক ছিলাম, আজ সকালে উঠে দেখি কিন্তু এটাকে আজই সারিয়ে ফেলতে হবে। কালকের মধ্যে ফিট হতে হবে।
বঙ্কিমদা হাসল, ঠিক আছে। ভেতরে এসে বোস। আমি তোর জুরটা দেখি। ডাক্তার না হয়েও তোর জন্যে ডাক্তারি করছি, পুলিস জানলে–।
এই সময় একজন বৃদ্ধ এসে দাঁড়ালেন কাউন্টারে, কাল থেকে ছবার বাহ্যি গিয়েছি। একটা ওষুধ দাও তো।
কি ওষুধ দেব?
সে আমি কি জানি? তুমি যা ভাল বোঝ তাই দাও।
বঙ্কিমদা কয়েকটা ট্যাবলেট এগিয়ে দিয়ে কিভাবে খেতে হবে বুঝিয়ে পয়সা নিল। কল্যাণ বলল, তুমি তো ডাক্তারদের বারোটা বাজাবে, দোষ দিলে আমাকেই।
জ্বর বেশি নয়। এক পয়েন্ট চার। ওষুধ খাইয়ে বঙ্কিমদা বলল, বাড়ি গিয়ে শুয়ে থাক। দুপুর বিকেল রাত্রে বাকিগুলো খেয়ে নিস।