What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected গর্ভধারিণী - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

অনেকক্ষণ। তোমার জন্যে ভরদুপুরে কেউ চা করতে পারবে না। শোন, তুমি পড়াশুনা করছ বলে আমি কিছু বলতে পারছি না। কলেজে যদি না যেতে ইচ্ছে করে তাহলে চাকরির চেষ্টা করো। সুজন বলছিল ও নাকি ইচ্ছে করলে পার্টিকে বলে চাকরি পাইয়ে দিতে পারে।

বিরক্ত কোর না। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।

তোমাদের সঙ্গে কথা বললেই বিরক্ত হও। আমি কি করে সংসার চালাব বলতে পার? একজন তো বিয়ে করে আমার ঘাড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন কন্যাকুমারিকা।

তুমি খামোকা মেজবউদির পেছনে লাগছ। অবশ্য এটা তোমাদের ব্যাপার।

মা যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন, আমি কি করছি না করছি তা নিয়ে তোমায় চিন্তা করতে হবে না। তুমি নিজেরটা দ্যাখো। মনে হচ্ছে জ্বরটর বাধিয়েছ, ওষুধ আনাব?

দরকার নেই। শুয়ে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে।

ভাত খাবি কি খাবি না?

না।

চোখ বন্ধ করে কল্যাণ পড়ে রইল অনেকক্ষণ। ঠিক কখন মেজবউদি ঘরে ঢুকেছিল টের পায়নি। নরম গলায় শুনতে পেল, চা।

শব্দটাকে অমৃত বলে মনে হল। চোখ খুলে সে জিজ্ঞাসা করল, কি দরকার ছিল?

মা পাঠিয়ে দিলেন। মেজবউদি বলে চলে যাচ্ছিলেন।

কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, মেজদা কবে ফিরবে?

জানি না। কেন?

তোমার ওপর যা ঝড় যাচ্ছে তা সামলানো দরকার।

এসব জেনেই তো এসেছি। মেজবউদি চলে গেল।

চা খাওয়া শেষ হলে বাবা দরজায় এসে দাঁড়ালেন, জুর কত?

দেখিনি। বেশি নয়। কল্যাণ উঠে পাঞ্জাবিটা টেনে নিল।

শুনলাম কলেজে যাবি না?

হ্যাঁ।

শরীর নিশ্চয়ই খুব খারাপ নইলে কামাই করবি কেন?

কল্যাণ জবাব না দিয়ে চুলটা আঁচড়ে নিচ্ছিল।

কোথায় বেরুচ্ছিস?

কাছেই।

কলু, তোকে নিয়ে আমার কত গর্ব। আমার বংশে কেউ ফার্স্ট ডিভিশনে স্টার পেয়ে পাস করেনি। কোনরকমে বি. এ.-টা পাস করে সরকারি পরীক্ষা দিয়ে দিলেই ঈশ্বরের আশীর্বাদে চাকরি পেয়ে যাবি।

তাতে তোমার কি লাভ হবে?

মানে? বাবা যেন হতভম্ব হয়ে গেলেন।

চাকরি করে তোমাদের হাতে চারশো টাকা ধরিয়ে দেব প্রতি মাসে বড়দা যেমন দেয়? তখন তোমার এই গর্ববোধটা থাকবে?



তা থাকবে। বলতে পারব তো চিরকাল আমার সেজ ছেলে স্টার পেয়ে প্রেসিডেন্সিতে পড়ত। তবে কিনা একটা কথা, সন্তান তার আচরণের মাধ্যমেই পিতামাতার স্নেহ অথবা ভয় আদায় করে নেয়। তোমার দুই দাদার সঙ্গে তোমার তো চরিত্রের পার্থক্য থাকবেই। হাতের পাঁচটা আঙুল সমান নয়। ঝাঁপসা চোখে শীর্ণ বৃদ্ধ দরজায় একটা হাত রেখে যেন খুব গূঢ় তত্ত্ব বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন।

বাবা, তোমার কারও ওপর রাগ হয় না? আচমকা প্রশ্নটা ছুঁড়ল কল্যাণ।

হয়। নিজের ওপরে হয়। কেন বাবা?

আর কারও ওপর হয় না? তোমার চারপাশে এত অন্যায় ঘটছে!

হয় না। ভোররাত থেকে কেরোসিনের লাইনে গড়িয়ে পা ব্যথা হয়ে যায় অথচ দেখি সুজনের বন্ধুরা লাইন কন্ট্রোল করার নামে ব্ল্যাক করছে সমানে, তখনও রাগ হয় না। মনে হয় এই যে দাঁড়িয়ে আছি তাতেও তো সময় কেটে যাচ্ছে। পাশের বাড়ির অনিলবাবু বলছিলেন, আপনার চিন্তা কি। ছেলে প্রেসিডেন্সিতে পড়ছে, ভাল চাকরি পাবেই। আমি তখন খুশী হই। দ্যাখো, সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত, এখন আর রাগারাগি করে কি লাভ বল! তোমার কি খুব জ্বর বেড়েছে? মুখ চোখ লাল কেন?

ঠাণ্ডা লেগেছে বোধ হয়।

তোমার মায়ের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ো না। যাকে সব সামলাতে হয় তার মাথা ঠিক থাকে না। মানুষটা কোনদিন আরাম পেল না। আমিও দিতে পারিনি, এরাও পারল না।

কল্যাণ বলতে চাইল, আমার ওপর এত ভরসা কোর না বাবা। কারণ এইভাবে ইঁদুরের মত বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না আমার। কিন্তু তার জিভ আড়ষ্ট হল। বাবার পাশ কাটিয়ে সে চুপচাপ বেরিয়ে এল বাইরে। কল্যাণের মনে হচ্ছিল এইভাবে কথা বলাটা ঠিক হয়নি। বাবার জন্যে কষ্ট হয়, মায়ের জন্যেও, যে মেজবউদি এই সেদিন এল তার জন্যেও। কিন্তু সেসব কষ্ট আলাদা আলাদা। যখন সব মিলিয়ে দেখা যায় তখন আর কষ্টটা থাকে না। বরং তার বদলে একটা ক্রোধ আসে। প্রত্যেককেই স্বার্থপর বলে মনে হয় তখন। এইখানে একটু হোঁচট খেল কল্যাণ। মেজবউদিকে ঠিক স্বার্থপর বলার কোন কারণ এখনও পায়নি। কিন্তু ওই যে সব সহ্য করে এঁটুলির মত এই সংসারে লেগে থাকা তার মধ্যেও এক ধরনের জেদ কাজ করে যা কল্যাণের মোটেই পছন্দ নয়।

বেশ রোদ উঠেছে। গলি থেকে বেরিয়ে বেশ কষ্ট হচ্ছিল কল্যাণের। চা খেয়ে শরীরটাকে চাঙ্গা বলে মনে হচ্ছিল কিন্তু সেটা যে খুব সাময়িক তা বুঝতে পারেনি। কল্যাণ ধীরে ধীরে হেঁটে মোড়ের মাথায় চলে এল। বঙ্কিমদা তখন দোকান খুলে সবে বসেছে। এখনও খদ্দের আসেনি। কল্যাণকে দেখে বলল, কি হয়েছে? জ্বর?

কল্যাণ মাথা নাড়ল, বোধ হয়। কাল রাত্রে ঠিক ছিলাম, আজ সকালে উঠে দেখি কিন্তু এটাকে আজই সারিয়ে ফেলতে হবে। কালকের মধ্যে ফিট হতে হবে।

বঙ্কিমদা হাসল, ঠিক আছে। ভেতরে এসে বোস। আমি তোর জুরটা দেখি। ডাক্তার না হয়েও তোর জন্যে ডাক্তারি করছি, পুলিস জানলে–।

এই সময় একজন বৃদ্ধ এসে দাঁড়ালেন কাউন্টারে, কাল থেকে ছবার বাহ্যি গিয়েছি। একটা ওষুধ দাও তো।

কি ওষুধ দেব?

সে আমি কি জানি? তুমি যা ভাল বোঝ তাই দাও।

বঙ্কিমদা কয়েকটা ট্যাবলেট এগিয়ে দিয়ে কিভাবে খেতে হবে বুঝিয়ে পয়সা নিল। কল্যাণ বলল, তুমি তো ডাক্তারদের বারোটা বাজাবে, দোষ দিলে আমাকেই।

জ্বর বেশি নয়। এক পয়েন্ট চার। ওষুধ খাইয়ে বঙ্কিমদা বলল, বাড়ি গিয়ে শুয়ে থাক। দুপুর বিকেল রাত্রে বাকিগুলো খেয়ে নিস।
 
কিন্তু কাউন্টারের ভেতরের চেয়ারে বসে থাকতে ভাল লাগছিল কল্যাণের। এখান থেকে রাস্তাটা পরিষ্কার দেখা যায়। তাছাড়া প্রতি মুহূর্তে ওষুধ কিনতে লোক আসছে। তাদের কথাবার্তা শুনতে শুনতে ভুলে থাকা যায়। সে বঙ্কিমদাকে বলল, আমি একটু বসি বঙ্কিমদা।

বোস্‌। বঙ্কিমদা খদ্দের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

তখনই মনে পড়ল আজ সকালে টিউশনিতে যাওয়া হল না। বুড়ো খুব খচবে। কাউকে দিয়ে খবর দেওয়াও সম্ভব নয়। খুচুক বুড়ো, অসুখ-বিসুখ কাউকে নোটিস দিয়ে আসে না। কল্যাণ দেখছিল খদ্দেরদের। কতরকমের অসুখ মানুষের হয়। বিচিত্র সব নামের ওষুধ। প্রেসক্রিপসন দেখে বঙ্কিমদা চটপট বলে দিচ্ছে আছে কি নেই। আধ ঘণ্টা বাদে সে জিজ্ঞাসা না করে পারল না, আচ্ছা বঙ্কিমদা, তুমি কতগুলো ওষুধের নাম জানো?

একজন ভদ্রমহিলাকে প্যাকেট দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল বঙ্কিমদা, মানে?

যে যা চাইছে ফটাফট দিয়ে যাচ্ছ কিংবা নেই বলছ, এত মনে থাকে?

অব্যেস বৎস অব্যেস। মাথা নেড়ে বঙ্কিমদা আর এক খদ্দেরকে বলল, ওষুধটা নেই। তবে একই জিনিস অন্য কোম্পানির আছে, দেব?

লোকটি আপত্তি জানিয়ে চলে গেল। বঙ্কিমদা চাপা গলায় বলল, ডাক্তারের কাছে গিয়ে আবার ফিরে আসবে। ডবল খাটুনি।

কেন?

আগের ওষুধটা বন্ধ হয়ে গেছে সে-খবর ডাক্তার জানে না।

তুমি তো বেশ জানো।

আঃ এ ছোঁড়া তো দেখছি বড্ড জ্বালাচ্ছে!

বেশ বেশ, আমি উঠছি। কল্যাণ হাসল।

আমি উঠতে বলিনি। চা চলবে?

চলতে পারে। আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি। ওষুধের গুণেই হোক কিংবা এই ওষুধের ভিড়ে বসেই হোক এখন একটু ভাল লাগছিল কল্যাণের। এইসময় সে শুভব্রতকে দেখতে পেল। শুভব্রত এ পাড়ায় থাকে না। কল্যাণ হাসল, কি খবর?

আরে কল্যাণ! ব্যাপারটা কি বল তো?

কিসের ব্যাপার?

তুমি তিন মাস হঠাৎ ড়ুব মারলে কেন? বিমলেশদা তোমাকে খুব খুঁজছে। বাড়িতে লোক পাঠিয়েছিল। খুব ভাল লোল ছিল তোমার নেক্সট নাটকে। কি হয়েছে?

কিছু না।

তুমি কি আর গ্রুপে যাবে না বলে ঠিক করেছ?

হ্যাঁ।

কেন?

ব্যাপারটা ব্যক্তিগত। বিমলেশদা বা তোমাদের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। আসলে আমার ভাল লাগছে না কিছু।

শুভব্রত একটু বাঁকা হাসল, গ্রুপ থিয়েটার করার মত মানসিকতা সবার থাকে না। ঠিক আছে, চলি। কল্যাণ ওর চলে যাওয়াটা দেখল। তারপর মাথা নেড়ে গলা তুলে বলল, বঙ্কিমদা চা থাক, আমি বাড়িতে যাচ্ছি।

আরে এসে গেল বলে! কাউন্টারের ভেতর থেকে চেঁচালো বঙ্কিমদা।

না থাক। হাঁটতে হাঁটতে কল্যাণ বুঝল তার শরীরে যে সুস্থবোধটা ফিরছিল শুভব্রতর সঙ্গে কথা বলার পর তা উধাও হয়েছে। আবার মাথাটা টিপটিপ করছে, হাত পা কামড়াচ্ছে, সমস্ত শরীরে ম্যাজম্যাজানি। আজ সারাটা দিন তাকে পড়েই থাকতে হবে।

গলির মুখে আসতেই বাবাকে উদভ্রান্তের মত বেরিয়ে আসতে দেখল। তাকে দেখতে পেয়েই তিনি চিৎকার করে উঠলেন, সর্বনাশ হয়েছে, বড় বউমার হাত পুড়ে গেছে।

সেকি! কি করে হল?

রান্না করতে গিয়ে। আমি বঙ্কিমের দোকানে যাচ্ছি ওষুধ আনতে। তারপর একটু থেমে বললেন, সঙ্গে তো বেশি পয়সা নেই, বঙ্কিম যদি–।

আমার কথা বলল, আমি দাম দিয়ে দেব বঙ্কিমদাকে।


আশ্বত হয়ে বাবা ছুটলেন দোকানের দিকে। কল্যাণ বাড়িতে ঢুকে দেখল তুলকালাম কাণ্ড চলছে। বড়দা চিৎকার করছে, মায়ের গলা শোনা যাচ্ছে। শুধু মেজবউদির অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু সুজনের উপস্থিতি টের পাওয়া গেল।

সুজন বলছে, রান্না করতে গিয়ে হাত পুড়েছে, এ নিয়ে এত চিলবার কি আছে। বাড়িটা মাইরি নরক হয়ে গেল!

সঙ্গে সঙ্গে বড়দা বেরিয়ে এল ঘর থেকে, চোপ। বড়দের সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় জানোনা? রান্না করতে গিয়ে হাত পুড়িয়েছে, ইচ্ছে করে উনুনের ওপর এমন ভাবে সসপ্যানটা রেখেছিল যাতে ছুঁলেই অ্যাক্সিডেন্টটা হয়।

কে রেখেছিল? সুজন একটু থিতিয়ে গেল যেন।

মেজ। এই পনেরো দিন তার ডিউটি নয়। বিপাকে পড়ে বলেছিলাম রান্নাঘরে যেতে। মা তীব্রস্বরে জানালেন।

কেন বলবে? তুমি যখন দুই বউকে মাসটা ভাগ করে দিয়েছ তখন কেন মেজবউদি যাবে? মেজবউদির পালা এলে কি বড়বউদি কখনও রান্নাঘরে ঢোকে?

সে বিষয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। মা ঝাঁজিয়ে উঠলেন।

এবার কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, বড়বউদির হাত কিরকম পুড়েছে?

বড়দা বলল, কি রকম মানে? আমি কি ডাক্তার?

বেশি পুড়লে হাসপাতালে নিয়ে গেলেই হত। বাবাকে কেন ছুটতে হল বঙ্কিমদার কাছে? দায়িত্বটা কার ছিল?

দায়িত্ব শেখাচ্ছে আমাকে? আমি যদি এক সময় টাকা বন্ধ করতাম তাহলে না খেয়ে মরত সবাই। দায়িত্ব! বড়দা ঘরে ঢুকে যাচ্ছিল।

সুজন হঠাৎ বলে বসল, আমার কেসটা গড়বড়ে লাগছে। কই দেখি, বড়বউদির হাত কি রকম পুড়েছে!

বড়দা ঘুরে দাঁড়াল, তার মানে? তুই সন্দেহ করছিস? মা দ্যাখো, কিরকম অপমান করছে আমাদের। এর পরে আমার কি করা উচিত?

সুজন বলল, অপমান? আরে দেওর হিসেবে বউদির হাত দেখতে চাওয়া কি অপমান করা? মা তুমি কি বল?

এবার মায়ের গলায় কান্না এল, আমার আর এই বাড়িতে এক মুহূর্ত থাকতে ইচ্ছে করছে না। কি ভুল করেছি বিয়েতে সম্মতি দিয়ে।

সম্মতি না দিলে চারশো টাকা লস করতে প্রত্যেক মাসে।

এই সময় বাবা ফিরে এলেন মলম হাতে, এই যে নাও, ভাল করে হাতে লাগিয়ে দাও। তবে বঙ্কিম বলল বেশি পুড়ে গেলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। কতটা পুড়েছে?

মা বাবার হাত থেকে মলমটা টেনে নিয়ে বললেন, হাসপাতালে যেতে হবে না।

তারপর বড়দার দরজায় এগিয়ে গিয়ে বললেন, এইটে লাগিয়ে দেখোকা। দেখিস বেশি চাপ যেন পড়ে।

বাবা কল্যাণের দিকে তাকিয়ে বললেন, বঙ্কিম আমার কাছ থেকে পয়সা নিল না। বলল, আপনার ছেলের কাছ থেকেই নেব।

সুজন হা হা করে হাসল, যাঃ বাবা, সেজদা তোরই তাহলে চোট গেল!

চোট কেন বলছিস? কল্যাণ নিজের ঘরের দিকে এগোল।

যাকে নিয়ে এত, কেন তাকে একবার নিজে দেখনি?

কাকে?

যার হাত পুড়েছে! আসলে পোড়েইনি, সব ভাঁওতা। এই হাত পোড়ার নাম করে দিব্যি পনেরো দিন কাটিয়ে দেবে খাটে বসে। রান্নাঘরে ঢুকতে হবে না। মেজবউদিকে তখন হেঁসেল ঠেলতে হবে। সব ট্যাটিস বোঝা আছে আমার?

বাবা বললেন, কি বলছিস তুই?

সুজন বলল, মিথ্যে বলছি কিনা বড়বউদি বাইরে এসে প্রমাণ দিক। হাতে কাপড় জড়িয়ে এলে চলবে না। কই আসুক।

এতক্ষণে বড়দার ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ এল, মাস্তানি করছে তোমার ভাই। বলে দাও এটা মাস্তানির জায়গা নয়। মেজর সঙ্গে ওর কি সম্পর্ক তা কি আমার জানতে বাকি আছে!

হঠাৎ সব চুপচাপ হয়ে গেল একটু সময়। তারপর সুজনের হো হো হাসি শোনা গেল, মা, তোমার বড়বউকে পার্টি করতে বল, হেভি টপে যাবে।

কেউ উত্তর দিল না। যে যার ঘরে চলে গেল। কল্যাণ মেজদার ঘরের দিকে তাকাল। সেখানে কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। সে আর পারছিল না, ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়ল। সুজন জিজ্ঞাসা করল, তোর কিছু হয়েছে সেজদা?

হ্যাঁ, জ্বর।

ওষুধ খেয়েছিস? বাড়িটা ক্রমশ নরক হয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে যে সটকাব তার উপায় নেই। একশ টাকায় কে আমাকে থাকা-খাওয়া দেবে, বল্‌?

কল্যাণ জবাব দিল না। চোখ বন্ধ করল।
 
০৫.
বিছানায় গা এলিয়ে প্রথমে মনে হয়েছিল ঘুম আসবে না, কিন্তু কখন যে রাতটা কেটে গেছে টের পায়নি জয়িতা। দরজা জানলা বন্ধ থাকায় ঘরটায় এখনও আবছা অন্ধকার। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকাতেই চমকে উঠল সে। নটা বাজতে দশ। আজ সকাল দশটায় কফি হাউসে প্রত্যেকের মিট করার কথা। এত বেলা পর্যন্ত কখনও বিছানায় থাকে না জয়িতা। আজ কেউ তাকে ডেকেও দেয়নি।

আর এই সময়েই তার মনে পড়ল আগের রাত্রের কথা। এ ঘরে চলে আসার পর সে সীতারামের কোন সাড়াশব্দ পায়নি। এখনও এই বাড়িতে কেউ আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। লাগোয়া বাথরুম থেকে তাজা হয়ে ফিরে এল জয়িতা। কিন্তু তখনই বুঝতে পারল মাথাটা সামান্য টিপটিপ করছে। এতটা ঘুমিয়েও স্থিরতা আসেনি।

জিনসের প্যান্ট আর নীল সার্টটা পরে নিল জয়িতা। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুনি বোলাল। তার মুখে একটা মিষ্টি ছাপ আছে। চোখে এবং চিবুকে সেটা মাখামাখি। কিন্তু আর কোথাও মেয়েলিপনা নেই। এই যে সে সার্ট প্যান্ট পরে আছে, কোথাও কোন ঢেউ নেই। আজ হঠাৎ ঠোঁট কামড়াল জয়িতা। তারপর মাথা ঝাকিয়ে হেসে ফেলল।

বাইরে বেরিয়ে সে শ্রীহরির মুখোমুখি হল। জয়িতা গম্ভীর মুখে বলল, আমি বেরুচ্ছি।

শ্রীহরি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, জলখাবার খাবে না?

না। সময় নেই। চলতে চলতে উত্তর দিয়ে চারপাশে তাকাল সে। না, কোথাও সীতারামকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। জয়িতা নিজেও চাইছিল না এইসময় মুখোমুখি হতে। দরজাটা টেনে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল নিঃশব্দে।

নিচে নেমেও মনে হল এই পাড়ায় দিন শুরু হয়নি। বড় লোকদের পাড়ার অদ্ভুত একটা আলস্যের ছায়া মাখামাখি হয়ে থাকে। ফুটপাতেও লোজন নেই। দোকানপাট বলতে এই পথে একটা কেক-প্যাটিসের দোকান, সেটা এখনও খোলেনি।

আরও কিছুটা এগোতেই সে অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। একটি চোদ্দপনেরো বছরের স্বাস্থ্যবতী মেয়ে হনহন করে এগিয়ে আসছে কাঁদতে কাঁদতে আর তার খানিকটা পিছনে ছুটে আসছেন একজন প্রৌঢ়। প্রৌঢ় ডাকছেন, খুকি আয়, খুকি শোন, জাস্ট এ মিনিট। হঠাৎ মেয়েটা ঘুরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল, ডোন্ট চেজ মি, ডোন্ট কল মি খুকি!

ভদ্রলোক ততক্ষণে কাছে এসে পড়লেন, আরে তুই বুঝতে পারছিস না।

আমার কিস্যু বোঝার দরকার নেই। তুমি আমার সঙ্গে এসো না।

না মানু, রাগ করিস না–।

রাগ? নো, রাগ কেন করব! হু আর ইউ? তুমি তো আমার বাবা নও। আমাকে একাই যেতে দাও। মেয়েটা চোখের জল মুছে নিয়ে আবার ফিরে দাঁড়াল। জয়িতা ব্যাপারটা বুঝতে পারছিল না। এতক্ষণে তার মনে হল ভদ্রলোককে সে দু-একবার দেখেছে তাদের ব্লকে ঢুকতে। তবে এদিকে থাকে না নিশ্চয়ই, নইলে চিনতে পারত। মেয়েটি যেরকম ভঙ্গি করছে তাতে অন্য জায়গায় ভিড় জমে যেত। জয়িতা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, এক্সকিউজ মি! মে আই হেল্প য়ু?

মেয়েটা ওর দিকে তাকাল। তারপর ঠোঁট কামড়ে মাথা নাড়ল, না।

জয়িতা এবার ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার বলুন তো? আপনি ওর কে হন?

ভদ্রলোক জয়িতাকে যেন আমল দিলেন না। মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, খুকি, বাড়িতে চল্‌।

আমাকে তুমি খুকি বলে ডাকবে না। মেয়েটি এবার ফুঁপিয়ে উঠল।

এবার ভদ্রলোক জয়িতার দিকে খানিকটা অসহায় চোখে তাকালেন। বোধহয় এইসময় তিনি বুঝতে পারলেন সামনে আর একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন নিজের কাছেই সাফাই দেবার ভঙ্গিতে তিনি বললেন, এই পাড়াটাকে ভদ্রপাড়া বলেই জানতাম। এখানে তো আগেও কয়েকবার এসেছি, এরকমটা দেখিনি।

কি হয়েছে? জয়িতা বুঝল ভদ্রলোক খুব নার্ভাস।

ওই তো, ট্রাম থেকে নেমে মেয়েকে নিয়ে আসছিলাম।–

ভদ্রলোককে বাধা দিয়ে মেয়েটি কান্না জড়ানো গলায় ফুঁসে উঠল, মেয়ে বলবে না।

ঠিক আছে, আছে। ভদ্রলোক চাপা দিতে চাইলেন, হ্যাঁ, ওই যে ওখানে একটা পার্ক আছে, ওর পাশ দিয়ে আসার সময় তিনটে ছেলে রিমার্ক পাশ করতে লাগল।

কোন তিনটে ছেলে?

পার্কের রেলিঙে বসে ছিল। তা আমি বললাম প্রতিবাদ করার দরকার নেই, নির্জন রাস্তা, তাড়াতাড়ি চলে এস। ওসব ছেলেরা যে কি মারাত্মক হয় তা তো জানি। ভদ্রলোক জয়িতাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে হালকা করতে চাইলেন পরিবেশটাকে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি প্রতিবাদ করল, না, তুমি সব কথা বললে না। আমি আর বাবা আসছিলাম। তিনটে রোগা রোগা ছেলে রেলিঙে বসে সিগারেট খাচ্ছিল। একজন চিৎকার করে বলল–। মেয়েটি কান্না থামাতে ঠোঁট কামড়ে ধরল।

কি বলল? নির্বিকার মুখে জয়িতা প্রশ্ন করল।

আমি বলতে পারব না। খুব খারাপ কথা। ওইসব বলে ওরা আমাকে ডাকছিল। আমি বললাম ছেলেগুলোকে কিছু বলল। তুমি শুনতেই চাইলে না। বরং জোরে জোরে পা ফেলে জায়গাটাকে পেরিয়ে আসতে চাইলে। আমি বললাম, ওরা আমাদের পিছনে আসছে। তুমি বললে, তাকিও না। ওরা ডেঞ্জারাস। ওরা অবশ্য এল না কিন্তু হায়নার মতো হাসতে লাগল। নিজের মেয়ের সম্মান বাঁচাতে পার না তুমি, কি করে নিজেকে বাবা বলছ? শেষ প্রশ্নটায় স্বর উঁচুতে উঠল। কি বলি বলুন তো, ওখানে প্রতিবাদ করতে যাওয়াটা—।

ভদ্রলোক জয়িতার সহানুভূতি পাওয়ার জন্যে তাকাতেই সে শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, ছেলেগুলো যদি ওকে জড়িয়ে ধরে অত্যাচার করত তাহলে কি করতেন?

না না, সে সাহস পাবে না। নির্জন রাস্তা বটে তবে অতটা—।

যদি করত?

ভদ্রলোক জয়িতার মুখের দিকে তাকালেন। কি বলবেন তিনি বুঝতে পারছিলেন না। জয়িতা বলল, আপনি যদি তখনই প্রতিবাদ করতেন, একটি ছেলেকে মেরে অন্য দুজনের কাছে যদি মার খেয়ে মরেও যেতেন তাহলে সারা জীবন আপনার মেয়ে বলত বাবা আমাকে রক্ষা করতে প্রাণ দিয়েছিলেন। আপনি নিজের প্রাণ বাঁচাতে চাইলেন আজ কিন্তু চিরকালের জন্যে মেয়ের কাছে মরে থাকবেন।

ভদ্রলোক মাথা নিচু করে বললেন, আমি বুঝতে পারছি, এখন বুঝতে পারছি। আসলে ওরকম কিছু হলে সরে আসাই অভ্যেস হয়ে গেছে তো!

ছেলেগুলো কি এখনও আছে ওখানে?

জানি না।

চলুন তো।

অ্যাঁ! মানে—

আমার মনে হয় আপনার যাওয়া উচিত।

ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, ওরা এখন নাও থাকতে পারে। তাছাড়া আমাদের এমনিতে খুব দেরি হয়ে গেছে। আমার এক পরিচিত ভদ্রলোকের মামা পুলিশে বড় কাজ করে। তাকে রিপোর্ট করব আমি। ভদ্রলোকের কথা শেষ করার আগেই মেয়েটি গন্তব্য পথে হাঁটতে শুরু করল। ভদ্রলোক যেন তাতে বেঁচে গেলেন। আর কথা না বাড়িয়ে মেয়েকে অনুসরণ করলেন।

জয়িতা ওদের চলে যাওয়াটা দেখল। ভদ্রলোককে সে বুঝতে পারছে কিন্তু মেয়েটি? তার প্রস্তাবে সে তো সাড়া দিল না। বাবাকে সে অভিযুক্ত করছিল কিন্তু এই সময় তো বাধ্য করতে পারত বাবাকে ছেলেগুলোর সামনে যেতে। ও কেন ফিরতে চাইল না?
 
জয়িতা সতর্ক হয়ে হাঁটছিল। দুপাশে বাগানওয়ালা চমৎকার বাড়ি। এবং তারপরেই পার্কটাকে দেখতে পেল। পার্কের রেলিঙে একটি ছেলে একা বসে আছে। তিনজনের দলটাকে ধারে কাছে দেখতে পেল না জয়িতা। সে সন্ধিগ্ধ চোখে ছেলেটির দিকে তাকাল। ছেলেটি উদাসীন মুখে বসে আছে। যেন কোন গভীর চিন্তায় মগ্ন। এইসময় পার্কের ধারে ট্রাম স্টপে ট্রাম এসে দাঁড়াতেই একটি অল্পবয়সী মেয়ে নামল। মেয়েটিকে দেখেই উৎফুল্ল হয়ে ছেলেটি হাত নাড়তে আরম্ভ করল। জয়িতা আর দাঁড়াল না। এবং তখনই তার নজর গেল হাত-ঘড়িতে। সর্বনাশ, আনন্দ আজ খচে ফায়ার হয়ে যাবে! একটা উত্তরের দিকে যাওয়ার বাসের জন্যে উদভ্রান্তের মতো তাকাতে লাগল সে। দেরি হলে আনন্দ শুধু গম্ভীর চোখে তাকাবে কিন্তু চিমটি কাটার সুযোগ পেয়ে যাবে সুদীপটা।

কফি হাউসের সিঁড়ি ভেঙে দোতলার কোণের দিকে তাকাতেই ওদের দেখতে পেল জয়িতা। আনন্দর চোয়াল শক্ত, অর্থাৎ খচছে। সুদীপটা ওকে দেখাবার জন্যেই ইচ্ছে করে ঘড়ির দিকে তাকাল। কল্যাণ বসে আছে চুপচাপ। ওর পাঞ্জাবির ওপরের বোতামটাও বন্ধ। অন্যরকম দেখাচ্ছে ওকে। চতুর্থ খালি চেয়ারটায় গিয়ে বসল জয়িতা। সুদীপ বলল, আধ ঘণ্টা, এমন কিছু বেশি নয়!

আনন্দ বোধহয় শেষপর্যন্ত সামলাল নিজেকে, আমাদের প্রত্যেকের চেষ্টা করা উচিত সময়টা ঠিক রাখা। বাঙালির টাইম ব্যাপারটাকে আমি ঘেন্না করি।

সুদীপ বলল, ঠিক হ্যায়, ওর নিশ্চয়ই কিছু অসুবিধে হয়েছিল। ব্যাপারটা শোনা যাক।

আনন্দ বলল, অসুবিধে তো নিশ্চয়ই হয়েছিল, নইলে দেরি করবে কেন? তবে সেটা আমাদের শোনার কোন প্রয়োজন নেই। কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমরা ইন্টারেস্টেড নই।

জয়িতা হেসে বলল, ফাইন।

আনন্দ মুখ ফেরাল, ফাইন মানে?

জয়িতা বলল, আমি যে টেবিলে বসে সরি বলব তার সুযোগ পর্যন্ত তোরা দিলি না। আর এমন ভঙ্গিতে কথা বলে যাচ্ছিস যেন আমি কঁসির আসামী। আমি স্বীকার করছি আমার দেরি করা অন্যায় হয়ে গেছে। আর এই দেরিটা হত না যদি রাস্তায় একটা ঘটনা না ঘটত। ঠিক আছে, আমি আবার বলছি, দুঃখিত।

সুদীপ চোখ কুঁচকে তাকাল, রাস্তায় আবার কি হল?

জয়িতা তার দিকে তাকিয়ে বলল, কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমরা ইন্টারেস্টেড নই।

আনন্দ বলল, স্টপ ইট! তোরা কেউ কফি খাবি?

জয়িতা বলল, আমি সকাল থেকে কিছুই খাইনি। আমি একটা লেট-ব্রেকফাস্ট চাই।

কল্যাণ এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। সুদীপ জয়িতাকে জিজ্ঞাসা করল, পকেটে মাল আছে তো?

জয়িতা মাথা নাড়ল, দ্যাটস নট ইওর হেডেক।

এবার কল্যাণ জয়িতার দিকে তাকাল। সেটা দেখতে পেয়ে জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, তোর কি হয়েছে? গলা বন্ধ করে বসে আছিস কেন?

জ্বর, গা হাত পা ব্যথা এবং খিদে। কল্যাণ হাসল।

খিদে?

হ্যাঁ। কাল থেকে অনশনে আছি। সারাদিন জ্বরের ঘোরে উঠতে পারিনি। সকালে একটু বেটার মনে হওয়ায় চলে এলাম। বাড়িতে কেউ জিজ্ঞাসা করেনি কিছু খাব কিনা।

সেকি!

এরকমই হয়। এ নিয়ে মাথা ঘামানোর মানে যদিও হয় না তবু শালা আমি মাঝে মাঝে সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাই। তোদের ফ্রিজ ভর্তি খাবার, তুই খাসনি আর আমার বাড়িতে খাবার নেই বলে খেতে পারিনি। তুই যা বলবি তাই আমার জন্যে বলে দে কিন্তু পয়সা আমি দিতে পারব না। কল্যাণ জয়িতার দিকে তাকাল, তাকিয়ে আবার হাসল।

জয়িতা ঠোঁট কামড়াল। তারপর বলল, দ্যাখ কল্যাণ, তোকে কথাটা আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি। আমাদের জন্মের ওপর কোনও হাত ছিল না। তুই বিত্তহীন পরিবারে জন্মেছিস, আমি বড়লোকমীতে। ফলে আমি যা দরকার তার চেয়ে বেশি পেয়েছি, তুই তার তুলনায় কিছুই পাসনি। কিন্তু তার জন্যে আমরা কেউ দায়ী নই। তাছাড়া আমি সবসময় চেষ্টা করি বাড়ি থেকে দেওয়া ফেসিলিটিগুলো অ্যাভয়েড় করতে। আমার মানসিকতার সঙ্গে তাদের কোন মিল নেই। তুই জেনেশুনে আমাকে খোঁটা দিস কেন?

কথাগুলো কল্যাণ শুনছিল অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে। শেষ হওয়ার পর কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলল, আমি চাই না বলতে, কেন যে মুখ থেকে বেরিয়ে যায়!

আনন্দ বলল, আসলে তুই এখনও কমপ্লেক্সটা কাটাতে পারিনি।

কিসের কমপ্লেক্স?

জয়িতা বা সুদীপ বড়লোক।

একমিনিট, আমি বড়লোক নই, শ্রীযুক্ত বাবু অবনী তালুকদারের সঙ্গে আমার কোন আর্থিক দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক নেই ভাই। সুদীপ হাত নাড়ল।

কল্যাণ বলল, তুই আমাকে এখনও বুঝতে পারিসনি আনন্দ। ওদের সম্পর্কে আমার জ্ঞানত কোন কমপ্লেক্স নেই। আসলে আমাকে কি লড়াই করে বাড়িতে একা একা বেঁচে থাকতে হয় তা তোরা কেউ জানলি না।

সুদীপ বলল, তোকে লড়াই করতে হয় অভাবের সঙ্গে। আর আমাদের লড়াই নিজের বিরুদ্ধে। একা একা বেঁচে থাকাটা কিন্তু এক। আমরা তো সবাই আমাদের কথা জানি তাহলে আর এই আলোচনা কেন?

জয়িতা বলল, সুদীপ, রামুকে ডাক তো, কল্যাণ আর আমার জন্যে খাবার বল্। আমি যা খাব তাই তোকে খেতে হবে কিন্তু।

সুদীপ বলল, বাঃ, আমি আর আনন্দ?

চারজনের জন্যেই খাবার বলল জয়িতা। তারপর সকালে দেখা মেয়েটার ঘটনা বলল। আনন্দ মাথা নাড়ল, এইটেই মুশকিল। পাবলিকের মেরুদণ্ডটা আটত্রিশ বছরে প্লাস্টিকের হয়ে গেছে। কেউ প্রতিবাদ করবে না। কাল আমি আর সুদীপ যখন দমদমে যাচ্ছিলাম তখন টালা ব্রিজের ওপর সব বাস মিনিবাস লরি একঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়েছিল। পাকপাড়ার কাছে ব্রিজের মুখে চারটে ছেলে টেম্পোয় সন্তোষী ঠাকুর নিয়ে যাচ্ছিল নাচতে নাচতে, কেউ তাদের সরতে বলছিল না, তারাও নেচে যাচ্ছিল।

কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, তারপর? তোরা কি করলি?

সুদীপ উত্তর দিল, আমরা আছি খালের এপাশে বাগবাজারে।

জয়িতা হাসল, সবাই ওইরকম ভাবে, আমি দূরে আছি, সামনাসামনি যারা আছে তারাই প্রতিবাদটা করুক।

আনন্দ মাথা নাড়ল, কথাটা ঠিক বলেছিস তুই কিন্তু কিছু করতে গেলে আমাদের এক মাইল দৌড়ে যেতে হত। ততক্ষণে জ্যামটা বাধিয়ে দিয়ে ছেলেগুলো হাওয়া হয়ে গেছে।

ওরা প্রায় নিঃশব্দে খেয়ে নিচ্ছিল। সুদীপ মাঝে মাজে জয়িতার দিকে তাকাচ্ছিল। গতরাত্রে ওরকম একটা ফোন করার পর সেই প্রসঙ্গ একবারও এল না। কথাটা তোলা উচিত হবে কিনা বুঝতে পারছিল না। খাওয়া শেষ হলে সে খুব স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করল, এভরিথিং নর্মাল?
 
জয়িতা তখন কল্যাণের প্লেটের দিকে তাকিয়ে। ওর যে খিদে পেয়েছিল খুব তা বোঝা যাচ্ছে। কারণ কল্যাণ খাচ্ছে খুব ধীরে ধীরে। বাকি তিনজনের শেষ হয়ে গেছে, কল্যাণ এখনও মাঝপথেই আছে। বেশ কিছুদিন আগে ও এই থিয়োরিটা জানিয়েছিল। যদি খিদে খুব বেশি থাকে এবং সেই তুলনায় খাবার কম থাকে তখন পেট ভরাবার আমেজ পাওয়ার উপায় হল ধীরে, খুব ধীরে খাওয়া। মনে হবে অনেক খেয়ে ফেলেছি। কিন্তু ওর জন্যে আবার খাবার বলাও যাবে না, সবাই যা খেয়েছে তার বেশি ওকে দিতে চাইলে স্বাভাবিক ভাবে নেবে না। সে সুদীপের প্রশ্নটা এই সময় শুনতে পেয়ে মুখ ফেরাল, কোটে নর্মাল?

সুদীপ একটু বিস্মিত, বলল, কাল রাত্রে যেটা বললি?

জয়িতা কাঁধ নাচাল, ওই বাড়িতে থাকতে হলে ওই সব প্রব্লেম নিয়েই থাকতে হবে। সরি, কাল রাত্রে তোকে ডিস্টার্ব–!

ওকে থামিয়ে দিল সুদীপ, হোয়াটস দিস?

মানে?

হঠাৎ এরকম ফর্মাল হতে আরম্ভ করলি কেন? সুদীপের গলা চড়ল।

আনন্দ এতক্ষণে জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার?

জয়িতা হেসে ফেলল, এটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, তাই না সুদীপ?

আনন্দ বলল, কাজের কথায় আসা যাক। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম কল্যাণকে নিয়ে আজ গ্রামের বাড়িতে যাব। কিন্তু তোর শরীর তো ফিট নয়, রেস্ট নিয়ে সারিয়ে তোল নিজেকে। যদি মনে হয় আমার হোস্টেলে আসতে পারিস।

কল্যাণের খাওয়া তখন শেষ পর্যায়ে। বলল, আমি আজ যেতে পারব।

পারবি তবু বিশ্রাম নে। সুদীপ চলুক। ওর কে এক আত্মীয়া থাকেন ঠাকুরপুকুর। আজই ফিরে আসার চেষ্টা করব। প্রত্যেকে কিপ ইন টাচ। আনন্দ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জানাল।

কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, কাল দমদমে কি হল? পার্টি রাজি হয়েছে?

আনন্দ মাথা নাড়ল, না, পার্টি এখনই কোন অ্যাকশনে নামবে না।

জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, কি করবে? শহিদ মিনারের তলায় দাঁড়িয়ে গরম গরম কথা বলে পার্টির অস্তিত্বের প্রমাণ দেবে? কি চায় পার্টি?

আনন্দ বলল, পার্টি এখনই এমন কাজ করতে চায় না যেটাকে হঠকারিতা বলা হয়ে থাকে। একটু একটু করে দেশের মানুষের মন দখল করার পরেই পার্টি আন্দোলনের ডাক দেবে। একাত্তর সালে একদল যে ভুল করেছিল পার্টি তা আর করতে চায় না।

কল্যাণ একটু উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করল, পার্টি ইলেকশনে দাঁড়াচ্ছে কবে?

সবাই হেসে ফেলল। আনন্দ বলল, একটা কথা ঠিক পার্টি এখনও অর্গানাইজড নয়। এদেশে এই পরিস্থিতিতে সশস্ত্র বিপ্লব সম্ভব নয়। একজন নেতা নেই যার ওপর দেশের মানুষ নির্ভর করবে, বিশ্বাস করতে পারবে।

জয়িতা বলল, পিপ্‌ল? আই ক্যান্ট বিলিভ দেম!

আনন্দ বলল, ভুলে যাস না ইউ আর ওয়ান অফ দেম।

জয়িতা হাসল, সিওর। আই বিলিভ, ঠিক আছে; ক্যারি অন।

আনন্দ মুখ নামাল, ব্যাপারটা হল, এখন শুধু বিপ্লব বিপ্লব খেলা করা যেতে পারে। উইদাউট অর্গানাইজিঙ পিল্ল ঝাঁপিয়ে পড়া বোকামি। তার জন্যে সময় লাগবে। অনেকরকম প্রস্তুতির প্রয়োজন। তাছাড়া জনসাধারণ এখন দিনকে দিন আরও ক্যালাস হয়ে পড়েছে। তাদের ইনভলভড় করা দরকার। একাত্তরের ভুল পার্টি করতে চায় না। ওই অভিজ্ঞতাই পার্টি কাজে লাগাতে চায়। যুক্তি খুঁজতে চাইলে এই বক্তব্যে আমি কোনও ফাঁক পাইনি।

জয়িতা চোখ ছোট করল, তাহলে?

কল্যাণের খাওয়া শেষ। সে জিজ্ঞাসা করল, দ্যাখ আনন্দ, পার্টির সঙ্গে তোর সম্পর্কেই আমরা সম্পর্কিত। সুদীপ বোধহয় কিছুটা। কিন্তু আমি কিংবা জয়িতা এসব মানব কেন?

আনন্দ মাথা নাড়ল, কেউ মানতে বলেনি।

কল্যাণ এমন উত্তর আশা করেনি। ও ভেবেছিল আনন্দ পার্টির পক্ষ নিয়ে তাকে বোঝাতে চাইবে। একাত্তরের আন্দোলন এখন শুধুই স্মৃতি। সেই স্মৃতি কোন কোন পরিবারের পক্ষে তীব্র বেদনাদায়ক। কিন্তু ওরা জেনেছে সেই সময় একটা বিরাট ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা চলেছিল। তখন ওদের বয়স খুবই অল্প। জয়িতা কিংবা সুদীপের কিছুই মনে নেই। আনন্দর আবছা কিন্তু কল্যাণের স্পষ্ট। তখন উত্তর কলকাতায় তাদের পাড়ায় প্রায়ই বোমা ফাটত। মা ওদের ভাইদের জড়িয়ে ধরে বসে থাকতেন। আর বাবার আসার সময় চলে যাওয়ার উপক্রম হলেই তার কান্না শুরু হত। আর মাঝে মাঝেই পুলিশের হামলা হত পাড়ায়। দুদিন তাদের বাড়ি তছনছ করেছিল পুলিশ। সেই ছবিটা এখনও কল্যাণের স্পষ্ট মনে আছে।

কিন্তু পরে একাত্তরের আন্দোলন নিয়ে ওরা অনেক আলোচনা করেছে। নকলপন্থী বলে যাদের চিহ্নিত করা হয় তারা কেন ওই কাজ করেছিল তাই নিয়ে নানান বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। সেসবও ওদের পড়া। যত জানতে চেয়েছে তত ধোঁয়াশা বেড়েছে। পরবর্তীকালে সেই-সময়ের বিখ্যাত ব্যক্তিদের কার্যকলাপ দেখে সেটা আরও ঘনীভূত হয়েছে। সেই সময়ের এক ভারতবিখ্যাত বিপ্লবী নেতা এখন দিনরাত দিশী মদ খেয়ে বেড়ান। কোন দলের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। বিপ্লব করার কল্যাণে তিনি সরকারি আনুকূল্য পেয়েছিলেন ব্যবসা করার জন্যে। সেসব উড়িয়ে দিয়ে নিঃস্ব অবস্থায় মানুষের করুণা ভিক্ষে করেন মদ খাওয়ার জন্যে। সম্প্রতি ওঁরই এলাকার একদা কমরেডদের সম্মেলন হয়ে গেল কিন্তু তাকে সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি, তার নিজেরও বোধহয় সে আকাঙ্ক্ষা ছিল না। এই মানুষটি বুদ্ধিমান নন। নিজের অর্জিত নামকে তিনি কাজে লাগাতে পারেননি। কিন্তু আন্দোলন খতম হয়ে গেলে যেসব মাঝারি নেতা জীবিত রইলেন তারা কিছুদিন অপেক্ষার পর চেহারা পালটাতে লাগলেন দ্রুত। বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে গিয়ে একে অপরের নিন্দে করা শুরু করলেন। যে আন্দোলন একটা মহৎ প্রচেষ্টার সম্মান পেতে পারত তাকে ছিন্নভিন্ন করার প্রবণতা দেখা দিল এইসব যদুনায়কদের। তারপর এঁদের অনেকেই ফিরে গেলেন সেইসব মানুষ, প্রতিষ্ঠান কিংবা ধারাব কাছে যাঁদের এতকাল এঁরা গালাগাল দিয়ে এসেছিলেন বুর্জোয়া এস্টাব্লিশমেন্ট বলে। যাঁরা এককালে নির্বাচন পদ্ধতিকে গালিগালাজ করেছেন তারাই অতঃপর নির্বাচনের দিকে ঝুঁকেছেন। মজার কথা, দু-একজন ছাড়া কাউকেই জনসাধারণ নির্বাচিত করেনি। তাও প্রথমবার, পরের নির্বাচনে তাদের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।

তবে বেশিরভাগই গুছিয়ে নিয়ে শান্ত হয়ে বসেছেন। এঁরা অবশ্য সেইসময় সম্মুখ সমরে নামেননি, বুদ্ধি চালান করে পুলিশের বিরাগভাজন এবং জনসাধারণের কাছে পরিচিত হয়েছিলেন। যদিও খুব অন্তরঙ্গ মহলে একটা গোপন রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের বাতাবরণ সৃষ্টি করে রাখেন এঁদের কেউ কেউ কিন্তু আসল সত্যিটা এতদিনে প্রকট হয়ে পড়েছে। আর যারা সম্মুখ সমরে নেমেও জীবিত আছেন তারা ক্রমশ বুঝে যাচ্ছেন কিছু করার নেই। জীবনের সবচেয়ে দামী সময় আন্দোলনে কাটিয়ে দেওয়ায় এঁদের পক্ষে এখন পায়ের তলায় মাটি পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এর ফলেই বিভিন্ন উপদলের উৎপত্তি হয়েছিল, পরস্পরকে সন্দেহ এবং গালিগালাজ করার প্রবণতা বেড়েছিল। এখন সেসবও থিতিয়ে গেছে। অতবড় একটা আন্দোলন, যৌবনের বাঁধভাঙা উচ্ছাস যেন কোন কাজেই লাগল না। জনসাধারণের জীবনযাত্রায় কোন প্রতিক্রিয়া ঘটল না। দেশের ষাট থেকে সত্তর কখনও আশিভাগ নাগরিক ভোটর বাক্সে কাগজ ফেলে নিশ্চিন্তে ঘরের কোণায় জায়গা খুঁজেছে। দেশটার দায়দায়িত্ব দুটো রাজনৈতিক দলের ওপরে দিয়ে তারা জেনে গিয়েছে কিছু করার নেই। যে তাদের পাইয়ে দেবে সেই দলই ব্যালটটা পাবে। মাঝে মাঝে আবেগের হাওয়ায় অবশ্য ভাসাভাসি চলে কিন্তু স্বার্থ শব্দটার বাইরে আর কিছুর কথা জনসাধারণ ভাবতে রাজী নয়। ক্রমশ এই স্বার্থ শব্দটার ক্ষেত্রও ছোট হয়ে আসছে। এখনও পাশের বাড়িতে আগুন লাগলে নিজেরটা বাঁচাও-এর মধ্যে সীমিত আছে। কদিন পরে পাশের ঘরে মা বাবা পুড়ে মরলে সে নিজের শরীরটাকে বাঁচাতে আগে ছুটবে।
 
এই পরিস্থিতিতে নবগঠিত পার্টি ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। বেশ কিছু অচলায়তনকে ধাক্কা দেওয়া রক্তগরম করা শব্দাবলী একত্রিত করে ছাপা একটি লিফলেট ওদের হাতে পড়েছিল। ওরা বিস্মিত হয়েছিল কিছু মানুষ এ ব্যাপারটা নিয়ে সক্রিয় ভাবনা ভাবছেন এবং খুব গোপনে সংগঠন গড়ে তুলছেন। এরপরেই আনন্দর সঙ্গে পার্টির যোগাযোগ হয়। আনন্দ প্রায় নিয়মিত যাওয়া আসা করত। বাকি তিনজন ছিল অনিয়মিত। এর পিছনে কোন নির্দিষ্ট কারণ ছিল না। শুধু একটি জনসভায় উপস্থিত থেকে ওরা কিছু জ্বালাময়ী বক্তৃতা শোনার পর ওদের মনে কিছু প্রশ্ন জাগে। সেইসঙ্গে দ্বিধা। ওরা স্থির করে নেয়, আনন্দই যোগাযোগ রাখবে। ওদের ধারণা হচ্ছিল এখন কোন অবস্থাতেই পার্টির পক্ষে সাহসী হওয়া সম্ভব নয়। এমন একজন নেতা পার্টিতে নেই যাকে জনসাধারণ বিশ্বাস করবে। অতএব আরও বিশদভাবে পরবর্তী কার্যাবলী লক্ষ্য করা দরকার বলে ওদের মনে হয়েছিল।

কল্যাণ এবার সুদীপকে জিজ্ঞাসা করল, ঠাকুরপুকুরে তোর কে থাকে?

কাফি দূরের রিলেটিভ। বুড়ি আমাকে পছন্দ করে বলে মনে হয়।

তা করুক। কিন্তু এর সঙ্গে তোর গ্রামের কি সম্পর্ক? প্রশ্নটা আনন্দর উদ্দেশ্যে।

আনন্দ হাসল, এই নিয়ে আলোচনা করার জন্যে আমরা এখানে এসেছি। তার আগে আমি প্রত্যেককে একটি প্রশ্ন করছি। যে কাজ করব বলে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাতে কারও কোন দ্বিধা বা ভয় নেই তো?

কল্যাণ মাথা নাড়ল, প্রশ্নই ওঠে না।

সুদীপ বলল, এই প্রশ্নটাই নিরর্থক।

জয়িতা আনন্দর দিকে তাকাল, এই প্ল্যানটার কথা এখন পর্যন্ত কজন মানুষ জেনেছে?

আনন্দ বলল, দমদমে কাল তিনজন ছিল আর ধর, আমরা ছাড়া আর চারজন জানে। কিন্তু নট ইন ডিটেলস। আমি স্পটটাও বলিনি তবে ওরা জানে আমরা চারজন একসঙ্গে আছি, দ্যাটস অল।

কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, এই চারজনের কেউ যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে?

আনন্দ মাথা নাড়ল, না, সেরকম হওয়ার চান্স খুব কম। তাছাড়া তোদের সঙ্গে কথা বলেই আমি গিয়েছিলাম। কখনও কখনও তো বিশ্বাস করতে হয়।

জয়িতা বলল, এই বিশ্বাসটা যেন আমাদের খুব বড় দাম দিতে বাধ্য না করে।

আনন্দ চট করে প্রশ্ন করল, তুই কি ভয় পাচ্ছিস সঙ্গে আসতে?

মোটই না। হেসে উঠল জয়িতা, আবার সেইসব বস্তাপচা শব্দগুলো যেন তোরা বলতে শুরু করিস না। তোরা যা করতে পারবি আমিও তাই পারব। এইভাবে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে মরতে আর মরা দেখতে ভাল লাগে না। ভবিষ্যতের কথা যদি ভেবে ভয় পেতাম তাহলে তো নিজের ক্যারিয়ার গোছাতাম রে। তবে এখন থেকে আমাদের চারজনের বাইরে কোন কথা আর কাউকে বলার দরকার নেই। কারও কাছে কিছু যখন পাওয়া যাবে না–।

সুদীপ গুনগুন করল, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে–।

আনন্দ চাপা গলায় বলল, বি সিরিয়াস সুদীপ!

গান থামিয়ে গম্ভীর মুখ করে সুদীপ বলল, আই অ্যাম অলওয়েজ সিরিয়াস। তারপরেই দূরের এক টেবিলের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করল, কিরে, তোদের পত্রিকা বেরিয়েছে? ওপাশ থেকে একটি ছেলে হাত নেড়ে না বলল।

জয়িতা বলল, চমৎকার নমুনা।

সুদীপ হাসল, যদি কেউ আমাদের লক্ষ্য করে তাহলে এখন ভাববে আমরা স্রেফ আড্ডা মারছি। এতক্ষণ যা গম্ভীর মুখে তোরা কথা বলছিলি যে দেখলেই সন্দেহ হত।

আনন্দ বলল, ঠিক আছে। আর ফালতু কথা নয়। শোন, আমরা বিকেলের বাস ধরে ডায়মন্ডহারবারের উদ্দেশ্যে রওনা হব। ওখানে পৌঁছতে হবে এমন সময় যাতে সন্ধ্যের অন্ধকার নেমে আসে। তোরা সবাই আমার বাড়িতে চলে আসবি। আমার এক বন্ধু ড্রাইভারি করে, মানে একসঙ্গে আমরা স্কুলে পড়তাম, তাকে বলব গাড়ি আনতে। সেই গাড়ি নিয়ে জয়িতা আর সুদীপ প্যারাডাইসে পোঁছে যাবি।

সুদীপ মাথা নাড়ল, আর একজন উইটনেস থাকছে না?

আনন্দ বলল, ব্যাপারটা নিয়ে আমি ভেবেছি। কিন্তু আমাদের একটা গাড়ি দরকার।

সুদীপ বলল, আমি গাড়ি চালাতে পারি। কাউকে কিছু বলার কোন দরকার নেই।

জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, গাড়ি পাবি কোথায়?

সুদীপ হাসল, পেয়ে যাব। রাস্তায় এত গাড়ি আর একটা গাড়ি পাব না? আমি তো আজ আনন্দর সঙ্গে যাচ্ছি, হালচাল দেখে ওটা ঠিক করে আসব।

আনন্দ বলল, ধর, তোর কিছু হল?

হঠাৎ সবাই চুপ করে গেল। আনন্দর প্রশ্নটা নিয়ে সুদীপ অবশ্য বিব্রত হচ্ছিল না। কারণ তার ঠোঁটে হাসি লেগেই ছিল। জয়িতা বলল, আমি চালাব তাহলে।


আনন্দ খুশী হল, বেশ তাহলে একটা ঝামেলা চুকল। গাড়িটা কিভাবে পাওয়া যায় তা আজ আমরা দেখে আসব। এবার কেন সুদীপের আত্মীয়ের বাড়ির কথা বলছি সে প্রসঙ্গে আসছি। সুদীপের কাছ থেকে শুনেছি যে ওই বাড়িতে ভদ্রমহিলা একা থাকেন। বেশ বড় বাড়ি। জায়গাটা কলকাতার কাছেই আবার আমাদের গ্রাম থেকে সোজা চলে আসা যায়। যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে আমরা ওই বাড়িতে শেল্টার নিতে পারি। কিন্তু এসবই নির্ভর করছে সুদীপ কিভাবে ওর আত্মীয়াকে ম্যানেজ করবে তার ওপর। যদি তিনি রাজী হন তাহলে যতদিন না সবকিছু ঠাণ্ডা হচ্ছে ততদিন আমরা নিশ্চিন্ত।

সুদীপ বলল, বুড়িকে আমি ম্যানেজ করে নেব, তুই চিন্তা করিস না।

আনন্দ বলল, হলে ভাল নইলে আমাদের চিন্তা করতে হবে। আমি বলছি না যে ওই রাত্রে শেল্টারের প্রয়োজন হবেই। খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমরা যে যার বাড়িতে ফিরে যাব হয়তো, কিন্তু সামান্য ঝুঁকি হয়ে গেলে বিকল্প ব্যবস্থা হাতে রাখতে হবে। অন্যান্য যা দরকার আমি আর সুদীপ ম্যানেজ করে নেব। শুধু জয়িতা, পাঁচ হাজার টাকা দরকার। এইটের ব্যাপারে তুই কোন হেল্প করতে পারিস?

পাঁচ হাজার? ও সিওর!

কিভাবে?

দুটো বালা আছে, হার আছে, মানে আমার কাছে যা আছে তাতেই ওই টাকা হয়ে যাবে। শুধু আমি জানি না কোথায় বিক্রি করলে ঠিকঠাক টাকা পাওয়া যায়!

ওগুলো বিক্রি না করে টাকাটা পাওয়া যাবে না?

কিভাবে? আমার মুখ দেখে পাঁচ হাজার কেউ দেবে? টু মাচ এক্সপেকটেশন!

ইয়ার্কি মারিস না। বাড়ি থেকে টাকাটা ম্যানেজ করতে পারবি?

নো! আমি কারও কাছে ভিক্ষে চাইতে পারব না।

কল্যাণ চুপচাপ শুনছিল, বলল, পাঁচ হাজার টাকা আমার কাছে আকাশের চাঁদের মত। এখন আমি কোন কাজেই লাগতে পারছি না, না?

আনন্দ বলল, তোর কাজ পরে। তারপর জয়িতার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের কিছু টাকা হাতে রাখা উচিত। বেশ কিছু টাকা, যাতে প্রয়োজন হলে কিছুদিন চুপচাপ কাটিয়ে দিতে পারি। সুদীপের সঙ্গে ওর বাবার রিলেশন অনেকদিন থেকেই খারাপ। তার ওপর ওদের বাড়িতে ইনকামট্যাক্স-রেইড হয়ে গেছে। এছাড়া আর একটা জিনিসের দায়িত্ব নিয়েছে সুদীপ। আমি জানতাম যতই তুই অপছন্দ করিস না কেন, তোদের সম্পর্ক সুদীপদের মত নয়। তুই চেষ্টা করলে

গতরাত্রে সেটা শেষ হয়ে গিয়েছে। ভুল বললাম, শেষ হয়েছিল অনেক আগেই, কাল তার শ্রাদ্ধ হল। এখন আর আমি কিছু চাইতে পারব না।

সুদীপ বলল, ঠিক হ্যায়। এখনও কিছুদিন সময় আছে হাতে। সবাই মিলে ভাবলে একটা পথ বের হয়ে যাবে। জয়িতা, আমরা যেটা করতে চাইছি সেটা এদেশের আইনের চোখে অপরাধ। কিন্তু আমরা মনে করি ওই অপরাধগুলো মানুষের বিবেকবোধ জাগ্রত করবে। আমরা মনে করি ওই অপরাধগুলো করা মানুষ হিসেবে আমাদের পবিত্র কর্তব্য। ব্যাপারটা যদি তাই হয় তাহলে ঘরের দুর্গ আক্রমণ করতে দোষ কি?

একটাই প্রশ্ন থেকে যায়। আমরা যে সব অপরাধ, মানে ওই আইনের চোখে, করতে যাচ্ছি তা আরও অনেক বড় অপরাধকে নষ্ট করার জন্যেই। কিন্তু আমার বাবা-মায়ের জীবন তারা তাদের মত চালাচ্ছেন, আমি তা মানতে পারছি না, কিন্তু তারা অপরাধ করছেন কিনা সেটা প্রমাণিত হচ্ছে কোথায়?

জয়িতা খুব সরল প্রশ্ন করল।

সুদীপ ভাবছিল জবাবটা। আনন্দ বলল, ঠিক আছে, আপাতত এই প্রসঙ্গ থাক। তোরা একটু এগিয়ে আয়। পাশের টেবিলে লোক এসেছে। আমার প্ল্যানটা হল–।

চারটে মাথা প্রায় একহাতের বৃত্তে পৌঁছে গেল চারকোণা থেকে।
 
০৬.
অপারচুনিস্ট!

খানিকটা ঠাট্টার মিশেল দিয়ে জয়িতার দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করল সুদীপ। কল্যাণ কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু এইসময় ড্রাইভার এমন আচমকা গতি হ্রাস করল যে বেচারার হাত রড থেকে ছিটকে গেল এবং সুদীপকে আঁকড়ে ধরে সোজা হল। বাসের অন্যান্য যাত্রীরা তখন ড্রাইভার কন্ডাক্টরের মুণ্ডপাত করতে শুরু করেছে। সেই ফাঁকে সামলে নিয়ে কল্যাণ খানিকটা চেঁচিয়ে বলল, এই, সুদীপ তোকে অপরচুনিস্ট বলছে?

লেডিস সিটে বসে ওদের টালমাটাল ব্যাপারটা উপভোগ করতে করতে জয়িতা হাসল, আই ডোন্ট মাইন্ড!

সুদীপ কল্যাণকে বলল, ফুটনোট না পড়ে নিজের পায়ে দাঁড়া।

প্রাইভেট বাসটায় ওরা উঠেছে কলেজের সামনে থেকে। তখনই ভিড় ছিল, এখন আরও বাড়ছে। ওরা চারজনে কোনমতে উঠতে পেরেছিল। লেডিস সিটে একজন পুরুষ জাঁকিয়ে বসেছিলেন মহিলাদের সঙ্গে। ওরা যখন ভিড়ে সাঁতরাচ্ছে তখন জয়িতা কোনমতে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, আমাকে বসতে দিতে আপনার আপত্তি আছে?

ভদ্রলোক ভূত দেখার মত চমকে ছিলেন। জিনসের প্যান্ট আর হ্যান্ডলুমের শার্টে জয়িতাকে তিনি আবিষ্কার করে তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। কাঁধের ব্যাগটা কোলে নিয়ে আরাম করে জানলার পাশে বসে বন্ধুদের বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে বেশ মজা পাচ্ছিল। সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, এসপ্ল্যানেড থেকে মিনিট পঞ্চাশেক লাগবে, না রে?

হ্যাঁ, ওইরকম। তোর ব্যাগটা সামলে রাখিস। আনন্দ উত্তর দিল।

ডোন্ট ওরি ম্যান! আমি ঠিক আছি।

ভিড় বাসে দাঁড়িয়ে কথা বলতে মোটেই ভাল লাগে না আনন্দর। কিন্তু সুদীপের বোধহয় চেঁচিয়ে কথা না বলতে পারলে মোটেই আরাম হয় না। ক্রমশ চাপে পড়ে ওরা তিনজনেই ভেতরের দিকে সরে আসছিল। বউবাজারের মুখে তিনটি ছেলে উঠল। ওদের অস্তিত্ব জানা গেল কারণ বাসের পাদানিতে পা রেখেই ওরা কন্ডাক্টরকে অশ্লীল ভাষায় ধমকাল স্টপেজে না বাঁধার জন্যে। এত ভিড় তবু ওদের জায়গা করে দিল যাত্রীরা লেডিস সিটের সামনে যেতে। সুদীপ চাপা গলায় বলল, এটা এখন একটা কায়দা হয়েছে। খিস্তি করলে ফেসিলিটিস পাওয়া যায়। আনন্দ কিছু বলল না। তার কানে খুব বিশ্রী শব্দগুলো এখনও নোংরার মত লেগে আছে। তারপরেই ওর কানে এল উঁচু গলায় গল্প করছে তিনজন। কোন একটি মেয়ে রোজ রাত্রে বাড়ি ফেবে। পাড়ার ছেলেদের পাত্তা দেয় না বটে তবে পয়সা ফেললেই পাওয়া যায়। এইসব গল্পগুলো বলার সময় তারা সমানে অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করতে মজা পাচ্ছিল। নিজেদের অতৃপ্ত বাসনাকে ব্যক্ত করতে যে ওইসব শব্দ সাহায্য করছিল। আনন্দ দেখল বাসের সবাই এইসব বাক্য শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু কেউ কোন প্রতিবাদ করছে না। বরং প্রত্যেকে এমন ভঙ্গিতে রড ধরে দাঁড়িয়ে আছে যেন ওইসব কথা কিছুই কানে যাচ্ছে না। সবকটা মুখই যেন মুখোশ পরা।

এইসময় জয়িতার গলা শুনতে পেল, এই যে, হয় আপনারা ভদ্রভাবে কথা বলুন, নয় বাস থেকে নেমে যান। এটা আপনাদের শোওয়ার ঘর নয়।

তিনজনেই একটু থমকে গেল প্রথমটায়। তারপর একজন একটু ঝুঁকে একটা হাত বাড়িয়ে বলল, শোওয়ার ঘর করে নিলেই হয়। বাসটা আপনার কাদারের মাল নাকি যে বললেই নেমে যাব!

দ্বিতীয়জন বলল, এগরোল মাইরি, হেভি লঙ্কাঠাসা।

তৃতীয়জন বেঁকিয়ে বলল, বাঙালির মেয়ে হয়ে প্যান্ট পরেছেন লজ্জা করে না। সীতা সাবিত্রী–

তড়াক করে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সামনের ছেলেটার কলার ধরে ঠাস করে চড় মারল জয়িতা। কিন্তু সেইসময় তিনটে ছেলে বিপরীত দিক থেকে আঘাত পেল। তুমুল হইচই শুরু হয়ে গেল বাসে। যাত্রীরা ভয়ে সরে গেল যে যে-দিকে পারে। চলতে চলতে বাসটা দাঁড়িয়ে পড়ল একপাশে। ততক্ষণে তিনটে ছেলে ওদের পা জড়িয়ে ধরেছে। কল্যাণের স্বাস্থ্য ভাল, সে বিরক্তিতে একটা লাথি মেরে বলল, ভাগ, তোদের শরীরে হাত দিতেও ঘেন্না করে। এর পরের বার দেখলে মুণ্ডু ছিঁড়ে ফেলব।

তিনটে ছেলে ব্যাঙাচির মত লাফ দিয়ে নেমে গেল রাস্তায়। এইসময় জয়িতা চাপা গলায় ফুসে উঠল, তোরা কেন এলি? আমি তোদের ডেকেছিলাম?

কল্যাণ একটু অবাক হয়ে বলল, তার মানে?

আই ক্যান টেক কেয়ার অফ মাইশেল। ওই তিনটে বাইপ্রোডাক্টকে ট্যাকল করার ক্ষমতা আমার আছে। তোরা কি ভেবেছিস আমাকে? উত্তেজিত অবস্থায় জয়িতা নিজের জায়গায় ফিরে গেল।

ওর পাশে বসা একটি মধ্যবয়সিনী এবার নিচু গলায় বললেন, আমিও সহ্য করতে পারছিলাম না ভাই। কি করে যে ওইসব কথা ওরা উচ্চারণ করছিল!

চট করে মুখ ফেরাল জয়িতা, সহ্য করতে পারছিলেন না তো প্রতিবাদ করেন নি কেন?

ভয় করছিল। আসলে আমার তো বাইরে বলাকওয়ার অভ্যেস নেই।
 
ক্রমশ সরে যাওয়া ভিড়টা জমাট হল। একজন বললেন, দেশটার কি হল! এদের কিছু বলতে ভয় হয়! শুনেছি খুরটুর থাকে এদের সঙ্গে।

জয়িতার সামনে দাঁড়ানো এক প্রৌঢ় বললেন, না না, ভয় ফয কোনও ব্যাপার নয়। আমি ওদের সুযোগ দিচ্ছিলাম। কতটা বাড়ে বাড়ক তারপর প্রতিবাদ করব।

আর একজন গলা বাড়িয়ে বললেন, আমার তো হাত নিশপিশ করছিল। কিছু করব করব ভাবছি–

হঠাৎ জয়িতা চিৎকার করে উঠল, স্টপ ইট! আপনাদের প্রত্যেকের মুরোদ জানা আছে। এতক্ষণ তো ভয়ে গর্তে ঢুকে বসেছিলেন। যেই ওদের নামিয়ে দেওয়া হল অমনি বীরত্ব দেখাচ্ছেন। আপনারা ভীতু, প্রতিবাদ করতে পারেন না সেটা সহ্য করলেও করা যায়, কিন্তু নিরাপদে দাঁড়িয়ে আস্তিন গোটানো সহ্য করা যায় না।

একজন বিড়বিড় করে বলল, কিন্তু প্রতিবাদ কবলে তো আপনি, মানে, একটু আগে ওনাদের ধমকালেন কেন এসেছে এগিয়ে, তাই না?

অবজ্ঞার হাসি হাসল জয়িতা, সেটুকু যদি বুঝতে পারতেন তাহলে অবস্থাটা অন্যরকম হয়ে যেত। সবাই তো যুধিষ্ঠির হয়ে বসে আছেন দ্রৌপদীকে দুঃশাসনের হাতে ছেড়ে দিয়ে। রাবিশ!

ওপাশ থেকে সুদীপ চিৎকার করে উঠল, ইটস অলরাইট। কেউ আর কথা বাড়াবেন না। কার কত মুরোদ তা আমরা জানি।

ওয়েলিংটনের মোড়ে এসে বাসটা দাঁড়িয়ে গেল। সামনে জব্বর জ্যাম। বউবাজারের উত্তেজনাটা এখন মিলিয়ে গেছে। যাত্রীরা যে যার নিজের বিষয় নিয়ে কথা বলছে। সুদীপের সামনের সিটে বসা এক মধ্যবয়সী বললেন, জ্যাম তো হবেই। পাতাল রেলের ডাইরেক্ট রিঅ্যাকশন এটা।

তার সঙ্গী জিজ্ঞাসা করল, পাতাল রেল এখানে কোথায়?

মধ্যবয়সী বললেন, পা কেটে গেলে সমস্ত শরীরে ধনুষ্টঙ্কার হয় কেন? তাছাড়া পুলিশেরও হাত আছে। দে আর ক্যালাস। জাপানে কখনও এমন হয় না। নিউ ইয়র্কে জ্যাম হয় কিন্তু বড় জোর আধ ঘন্টা। মস্কোতে জ্যাম হলে তো কোট মার্শাল হয়ে যাবে।

চীনে?

ওয়েল, চীনে তো এত গাড়ি নেই। সবই জাতীয় সম্পত্তি। অতএব জ্যামও নেই।

এদেশে সব জাতীয় সম্পত্তি করে নিলে জ্যাম হবে না বলছেন?

তা নেবে কেন? ওই যে পাতাল রেল, যার জন্যে এখানে আমরা বসে আছি, ওটা স্রেফ আমাদের বিভ্রান্ত করার জন্যে তৈরি। চীনে পাতাল রেল আছে? নেই। না না, তুমি আমার সঙ্গে তর্ক করতে এস না। আমি সবই জানি শুধু জানি না কবে মারা যাব! অতি অমায়িক একটা হাসি হাসলেন ভদ্রলোক।

সুদীপ মুখটা নামিয়ে আনল ভদ্রলোকর সামনে, কিছু মনে করবেন না একটা কথা আমি জিজ্ঞাসা করতে পারি? রেগনের ব্রেকফাস্টের মেনুতে কি কি থাকে?

অ্যাঁ? ভদ্রলোকের মুখ আফ্রিকা থেকে চট করে অস্ট্রেলিয়ার ম্যাপ হয়ে গেল।

আপনার স্ত্রী কোত্থেকে কেরাসিন তেল যোগাড় করেন সে খবর রাখেন?

মানে, মানে, আপনি আমাকে অপমান করছেন?

গুল মারাটা বন্ধ করুন তো। এই হামবড়া ভাবটা, সব জেনে বসে আছেন। আপনাদের বয়সে এলে সব বাঙালি খবরের কাগজের নিউজ এডিটরকে হার মানিয়ে দেয়। অদ্ভুত।

সুদীপের কথা শেষ হওয়ামাত্র আনন্দ তাকে ডাকল, এই নেমে আয়, এখানে জগন্নাথ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। হাঁটলে দশ মিনিট লাগবে।

বাস থেকে নেমে সুদীপ কাঁধ ঝাকিয়ে বলল, আসলে বুঝলি দোষ কারও নয়, দোষটা আমাদের। একটা জাতের যদি মেরুদণ্ডটা প্লাস্টিকের হয়–।

তোর কি দরকার? সব জায়গায় নাক গলাস কেন? আনন্দ বিরক্ত হল। কয়েক পা এগিয়ে ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল, এই দ্যাখ, জ্যামটা হচ্ছে মিছিলের জন্যে আর লোকটা অবতারের মত বলে গেল পাতাল রেল এর জন্যে দায়ী। লোকটাকে নামিয়ে আনতে ইচ্ছে করছে।


জয়িতা চুপচাপ মিছিলটাকে দেখছিল। ও জানে এই মুহূর্তে সে অনেকের দ্রষ্টব্য। জিনসের প্যান্ট, শার্ট, ছেলেদের মত ছাঁটা চুলে যে লম্বা শরীরটা তারা দেখছে তাকে চট করে মেয়ে ভাবতে ওদের অসুবিধে হচ্ছে। এবং এই অসুবিধে হওয়াটা দর্শকের মনে কিলবিলে বোধের জন্ম দিচ্ছে। সংসারের গণ্ডিতে দাঁড়িয়ে থেকে নাক ঝাড়া ভাবের সঙ্গে রগরগে রহস্যের জন্যে খুশখুশ সুড়সুড়ি। দুটোই চলছে সমানে। বিভ্রান্ত হওয়ার অবশ্য যথেষ্ট কারণ আছে। বাঙালি মেয়েদের কাঁধ এত চওড়া এবং শরীর অমন লম্বা হয় না। তার বুক কিংবা নিতম্ব শৈশবের অসুস্থতার কারণে সঞ্চয়ী হয়নি। সে প্রসাধন ব্যবহার করে না। মেয়েলিপনার সঙ্গে তার অস্তিত্ব অনেক দূরের। ফলে যারা দেখে তাদের ভ্রান্তি হয়ই। পথেঘাটে চলতে মানুষের চোখে খটকা দেখেছে সে। ইচ্ছে করে সুবিধে আদায় করার সময় সে যখন ঘোষণা করে আমি একজন মহিলা তখন বেশ মজা পায় সে। পুরুষরা তো সব কিছু আগলে বসে আছে, ওদেরই ভদ্রতার সুযোগ নিয়ে যদি কিছুটা আদায় করা যায় ক্ষতি কি! একবার একটা ত্যাঁদড় ছেলে লেডিস সিট ছাড়তে চেয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি যে মহিলা তা কি করে বুঝব?

জয়িতা চটপট জবাব দিয়েছিল, নিজের দিকে তাকান, বুঝতে পারবেন। এখন আর এসব নিয়ে কোন অস্বস্তি হয় না জয়িতার। তার বন্ধুরাও এই নিয়ে মাথা ঘামায় না।

হঠাৎ জয়িতা গলা তুলে বলল, দ্যাখ সুদীপ, লোকটাকে দ্যাখ!

ওরা তিনজনেই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মিছিলটাকে দেখছিল। জয়িতা সামান্য এগিয়ে। মিছিলটা কোন কারণে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। দুসারি লোক পুরো ধর্মতলা স্ত্রীকে আগলে রেখে আকাশে হাত ছুঁড়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে বীভৎস ভঙ্গিতে। যোগ দিন যোগ দিন। আনন্দ বলল, এইভাবে ধমকে বললে কেউ যোগ দিতে সাহস পাবে? লোকগুলো নর্মাল বিহেভ করে না কেন?

কল্যাণ বলল, কেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা এটা।

সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, কোন্ লোকটার কথা বলছিস জয়?

ওই যে বোগা মতন, হাওয়াই শার্ট প্যান্ট পরা, হাতে কাপড়ের ব্যাগ! জয়িতা জানাল।

সুদীপরা দেখল। নিম্নবিত্ত বাঙালির প্রকৃষ্ট উদাহরণটি হাত তুলেছেন। কিন্তু মুখে কোন শব্দ করছেন। বোঝা যাচ্ছে ভদ্রলোকের মোটই ইচ্ছে করছে না ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে। এইসময় একটি পঙ্গু মানুষ ক্রাচে ভর করে এগিয়ে গেল অন্য ফুটপাতে যাওয়ার জন্যে। সঙ্গে সঙ্গে লোকটি খিঁচিয়ে উঠলেন, নেহি, নেহি! দেখতা নেহি হামলোগ মিছিল করতা হ্যায়। যানে নেহি দেগা। ক্রাচে ভর করা মানুষটি। কাকুতি মিনতি করতে লাগল কিন্তু লোকটা এই মুহূর্তে হিটলারের মত কঠোর হয়ে গেল।

ওপাশ থেকে কেউ চিৎকার করে উঠল, কাউকে মিছিল ভাঙতে দেবেন না। কেন্দ্রের কালো হাত ভেঙে দাও খুঁড়িয়ে দাও। ভদ্রলোক এমন ভাবে হাত চালালেন যে পঙ্গু লোকটা ভয় পেয়ে সরে এল এপাশে।

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, এই মিছিলে কত লোক অনুপ্রাণিত হয়ে এসেছে জানতে ইচ্ছে করছে।

জয়িতা বলল, ন্যাকামি করিস না। আমরা সবাই জানি। এই মিছিলগুলো হল কোরামিনের মত। নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতে বদ্ধ এবং মিছিল করতে হয় মহাপ্রভুদের। ততক্ষণে মিছিলটা আবার চলতে শুরু করেছে। এর শেষ কোথায় বোঝা যাচ্ছে না, তবে ফেস্টুন দেখে মনে হচ্ছে শহরের চেয়ে শহরতলির মানুষ বেশি সংখ্যায় এসেছেন।

আনন্দ বলল, দাঁড়িয়ে থেকে কি হবে? চল, এই ফুটপাত ধরে ধরে হাঁটা যাক, সুযোগ পেলে পার হওয়া যাবে।

সুদীপ ফুট কাটল, সুযোগ এরা দেয় না, আদায় করে নিতে হয়।

ওরা যখন জ্যোতি সিনেমার সামনে পৌঁছেছে তখন কল্যাণ দেখতে পেল, এই দ্যাখ দ্যাখ, লোকটা মিছিল থেকে সটকেছে।
 
চারজনেই লোকটাকে দেখল। একটা পানের দোকানের আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকিমেরে মিছিলটাকে দেখছে। যেন পেছনের সারিতে কোন চেনা মুখ আছে কিনা জরিপ করে নিচ্ছে। সুদীপ চট করে এগিয়ে গিয়ে বলল, নমস্কার, কেমন আছেন?

লোকটি থতমত হয়ে যেন চিনতে চেষ্টা করল, ডাল, মানে, এই একরকম।

সুদীপ বলল, কতদিন পরে দেখা হল। আপনি আমাকে চিনতে পারবেন ভাবিনি। যাক, এদিকে কেন এসেছিলেন?

এই একটু দরকার ছিল। তারপর ফ্যাকাশে হেসে বলল, ওই মিছিলের জন্যে আটকে গেছি।

সুদীপ আড়চোখে বন্ধুদের দেখে নিল, আপনাদের অফিসের লোকজন আসেনি মিছিলে?

আসেনি আবার! ঘাড় ধরে নিয়ে আসে। আমার আজ রেশন ভোলা হল না। কথাটা বলেই লোকটা সচকিত হল, মানে এই মিছিলের জন্যে আটকে গেলাম। আচ্ছা কোথায় দেখেছি আপনাকে— মানে–।

আপনার অফিসে। বড়বাবুর কাছে গিয়েছিলাম।

ও তাই বলুন। আমি সেই থেকেই ভাবছিলাম চেনা চেনা, ঠিক মানে, বয়স হয়েছে তো?

আপনি তো লোয়ার ডিভিসন ক্লার্ক?

আজ্ঞে না, আপার ডিভিসন।

চলে?

লোকটা যেন কুঁজো হয়ে গেল। তারপর বলল, চালাতে হয়।

এইসব মিছিল টিছিল করলে হয়তো মাইনে বাড়বে আপনার।

ছাই বাড়বে। শালারা নিজেদের ধান্দায় আমাদের মিছিলে টেনে আনে। যা দেবার সরকারের ইচ্ছে হলে তবেই দেয়। এখন তো কথায় কথায় কেন্দ্র দেখিয়ে দিচ্ছে। লোকটা আবার নিবে গিয়ে বলল, এদের কথা শুনলে কাজ কম করলেও চলে।

ওহো, যে কথাটা বলতে এসেছি, আপনাকে আপনার বড়বাবু ডাকছেন। উনি এদিকে আসবেন না বলে জ্যোতি সিনেমার কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, আপনাকে দেখে বললেন ডেকে দিতে।

সুদীপের কথা শেষ হওয়া মাত্রই লোকটি সচকিত হয়ে উঠল। এখন সামনে বেলঘরিয়ার ফেস্টুন। লোকটি বলল, এতক্ষণ বলেননি কেন? যাচ্চলে।

তারপর দ্রুত রাস্তায় নেমে এগিয়ে যেতেই মিছিলের একটি মানুষ বাধা দিলেন, না না, যেতে পারবেন না। দেখছেন না আমরা মিছিল করছি।

লোকটি মাথা নাড়ল, জানি, কিন্তু আমার খুব জরুরী দরকার। একটু যেতে দিন।

রিঅ্যাকশনারি কথাবার্তা বলবেন না। এই দেখিস তো, বুড়োটা যেন না পার হয়। পেছনের লোকগুলোর দিকে কথাগুলো ছুঁড়ে এগিয়ে গেল জঙ্গী মানুষটি।

হো হো করে হাসছিল সুদীপ হাঁটতে হাঁটতে। জয়িতা বলল, তুই পারিস বটে।

হাসি থামিয়ে সুদীপ বলল, দ্যাখ, যে লোকটা মিছিলে আসতে চায় না, ঘাড় ধরে নিয়ে আসা হয় সে-ই মিলিটারি মেজাজে একজন খোড়াকে রাস্তা পার হতে দেয় না। আবার নিজের বেলা বোধহয় বাপবাপান্ত করছে। এই হল আমাদের নেতাদের সৈন্যবাহিনী!

আনন্দ বলল, তুই অমন রাফ দিলি, লোকটা টের পেল না কিন্তু! অদ্ভুত!

কল্যাণ বলল, সোজা ব্যাপার। মিছিল থেকে সটকে লোকটা ভয়ে ছিল। তাছাড়া এই ধরনের মানুষ এমনিতেই সারাক্ষণ কেঁচো হয়ে থাকে। নিজের পরিবারের বাইরে একটু ভাল পোশাকের যে কোনও মানুষকেই স্যার বলতে ওদের জিভ সুড়সুড় করে। দোষ নেই, অনেক কালের অভ্যেস। এরা চ্যালেঞ্জ করতে জানে না।

জয়িতা বলল, অল রাইট। বাট আই ক্যান্ট আন্ডারস্ট্যান্ড, কি করে এই লোকটা ছেলের বয়সী সুদীপকে আপনি আজ্ঞে করে গেল!

বয়সটয়স কোন ফ্যাক্টর নয়। আসলে ব্যক্তিত্ব যাদের গড়ে ওঠেনি তারা তো এই রকম আচরণ করবেই। আনন্দ কথাটা শেষ করল এই বলে, এদের নিয়েই বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতে হচ্ছে!


কল্যাণ প্রতিবাদ করতে গেল। আনন্দ আজকাল মাঝেমাঝেই খুব উলটো-পালটা কথাবার্তা বলে। কতগুলো নিখাদ সত্য সামনে রেখে আমাদের কাজে নামাতে হয়েছে, সেটা জানার পরও এই ধরনের আক্ষেপ মনে অস্বস্তির জন্ম দেয়। সে ঠিক করল আনন্দর সঙ্গে এ নিয়ে পরে আলোচনায় বসবে। ধর্মতলার মোড়ে এসে সুদীপ চেঁচিয়ে উঠল, চলে আয় চটপট। সামনের মানুষজন তাড়াতাড়ি হাঁটায় মিছিলটা আলাদা হয়ে গেছে। সেই ফাঁক গলে ওরা পেরিয়ে এল।

এখন বেশ গুমোট। সময়টাকে আর দুপুর বলা যায় না। আবার বিকেলের ছায়াও নামেনি। ওরা চারজন আগুপিছু মেট্রোর সামনে দিয়ে হেঁটে আসছিল। হঠাৎ কল্যাণ দেখতে পেল বিমলেশদাকে। বিমলেশদা তাকে দেখে এগিয়ে এলেন, কি ব্যাপার কল্যাণ, তোমার পাত্তা নেই কেন?

আমি একদম সময় পাচ্ছি না বিমলেশদা। ইনফ্যাক্ট নাটক করার ইচ্ছেটা আমার নেই।

কেন জানতে পারি? তুমি তো একসময় খুব উৎসাহী ছিলে!

কথাগুলো শোনার পর বিমলেশদাকে খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। কল্যাণ পাজামা-পাঞ্জাবি পরা স্বপ্ন দেখতে চাওয়া মানুষটির দিকে তাকিয়ে এক পলক ভাবল রুঢ় কথা ব্যবহার করবে কিনা! তারপর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি রিয়ালইজ করেছি ওই মিডিয়ামটা আমার জন্যে নয়।

কিন্তু তুমি তো ভাল অভিনয় করতে। বুঝতে পারছি না, তুমি সত্যি লুকোতে চাইছ কিনা!

কল্যাণ হাসল, ঠিক আছে। যদি সুযোগ পাই পরে একদিন এ বিষয়ে কথা বলব। বিমলেশদা, ব্যক্তিগতভাবে আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি কিন্তু। ঠিক আছে, আজ আমাদের একটু তাড়া আছে।

একটু জোর করেই সরে এল কল্যাণ। তার মন ভাল লাগছিল না। তিনমাস হল গ্রুপে সে যায় না। খবর এসেছে অনেকবার। সে নাটক করবে না জানিয়েও দিয়েছে। কিন্তু তবু এই মানুষটির মুখোমুখি হয়ে তার এই মুহূর্তে ভাল লাগছিল না। সুদীপ আর আনন্দ কথা বলতে বলতে সামনে হাঁটছে। জয়িতা কল্যাণের পাশে চলে এল, হঠাৎ ফিউজ হয়ে গেলি কেন?

কল্যাণ কাঁধ নাচাল প্রথমে। তারপর যেন নিজের কাছেই কৈফিয়ৎ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, বিমলেশদাদের মত সিরিয়াস লোক চিরকাল লড়াই করে যান কিন্তু বুঝতেই চান না যুদ্ধটা একতরফা। ফলাফল আগেই ঠিক করা আছে।

জয়িতা বলল, সে কথা উনিও নিশ্চয়ই জানেন। তোর মন খারাপ করার কি আছে!

কল্যাণ কথাটা শুনে একটু উত্তেজিত হল, তুই ব্যাপারটা বুঝবি না। আমাদের দলের জনা পনেরো ছেলে শুধু ভাল নাটক করবে বলে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা রিহার্সালরুমে কাটিয়ে দিল। কিন্তু ভাল নাটক করব বললেই করা যায় না। কলকাতার যে দুটো হলে লোকে কাউন্টার থেকে টিকিট কিনে নাটক দ্যাখে সেই দুটো হল তুই চাইলেই পাবি না। একটা হল বিখ্যাত দলগুলোর মধ্যে বিতরিত, অন্যটি সরকারি আমলা আর ধামাধরদের খেয়ালখুশিতে চলে। উত্তর দক্ষিণে যেখানেই নাটক করবি তোকে পায়ে ধরে দর্শক ডেকে আনতে হবে। সেটা দুতিনটে শো-এর পরে অসম্ভব। বিমলেশদারা যে প্রযোজনাই করুক প্রতিটিতে ধার বেড়ে যায়। তুই বলবি মফঃস্বলে যা, গ্রামে যা। প্রযোজনার টাকাটা কে দেবে? এ তো গেল বাইরের ব্যাপার, আমরা নাটক পাব কোথায়? কলকাতায় তিনচারজন নাটক লিখতে পারতেন। বড় দলগুলো তাঁদের একচেটিয়া করে রেখেছেন। ইদানীং সেসব কলমও বন্ধ হয়ে আসছে। ফলে অনুবাদ এবং অনুসরণের জোয়ার চলছে। সেসব মঞ্চস্থ করে কি ভ হচ্ছে তা নিয়ে কেউ ভাবছে না। আমাদের দলে কেউ নেই যে নাটক লিখতে পারে। পুরোনো নাটক অভিনয় করার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু সেসব করে শুধু আত্মপ্রসাদ বাড়ানো, যৌবন এবং অর্থের অপচয়। আসলে আমাদের সব কিছুর মত এই নাটক করার মধ্যেও কোন পরিকল্পনা নেই। এসব কথা বিমলেশদাও জানেন। কিন্তু নেশা জিনিসটা বোধহয় খুব মারাত্মক, সবসময় তার চোখের পাতা বন্ধ থাকে।

জয়িতা একটু অবাক হয়ে বলল, তুই যে এসব নিয়ে ভাবছিস এতদিন জানতাম না। তারপর আবহাওয়া হালকা করার জন্যে জুড়ে দিল, চমৎকার কথা বলতে পারিস তুই। কোথাও বক্তৃতা করার প্রয়োজন হলে তোকে আগে ঠেলে দেব।

কল্যাণ হাত তুলল, ভাগ্‌!
 
ডায়মন্ডহারবারের বাসে ওরা জায়গা পেয়ে গেল। সমস্ত কিছুই আগে থেকে বারংবার ছকে নেওয়া ছিল। গত সপ্তাহে সুদীপ এবং আনন্দ একবার পাক দিয়ে এসেছে। ঠাকুরপুকুরে সুদীপের আত্মীয়ার বাড়ি বড় রাস্তার কাছাকাছি। খুবই নির্জন বাড়িটা। বৃদ্ধা বিধবা, কোনও আত্মীয়স্বজন সেখানে থাকে না। এক চিলতে বাগান আর পেছনদিকে দুঘর ভাড়াটে আছে। আনন্দের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল সুদীপ। ইঙ্গিত দিয়ে এসেছিল যদি প্রয়োজন হয় তাহলে ওরা এক-আধদিন ওখানে গিয়ে থাকতে পারে। বাড়িটার চারপাশে বেড়াবার নাম করে চিলেকোঠার ঘরটা আনন্দকে দেখিয়েছিল সে। লুকিয়ে থাকার পক্ষে চমৎকার জায়গা। শুধু পাখির ডাক ছাড়া কোন শব্দ সেখানে আসে না। আনন্দ লক্ষ্য করেছিল বৃদ্ধা নির্লিপ্ত হয়ে শুনলেন এবং নিজে যা করছিলেন করতে লাগলেন। সুদীপ বলেছিল ওটা নাকি ভাল লক্ষণ। অপছন্দ হলে এতক্ষণ চিৎকারে আকাশ ফাটাতেন। বস্তুত এই অঞ্চলে ওঁর ওই গুণের বেশ খ্যাতি আছে। অতএব এদিকটা নিয়ে ভাবনা নেই।

সন্ধ্যের পর গ্রামে পৌঁছাতে আনন্দ চেয়েছিল। এতে সুবিধে অনেক। এই লাইনে লোডশেডিং নিয়মিত ব্যাপার। রাত দশটার আগে আলো আসে না। ঠিক গ্রামের মধ্যে না নেমে মুখটায় নামলে কারও চোখে পড়ার কথা নয়। পড়লেও একটা কৈফিয়ৎ দেওয়া যাবে। কিন্তু বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেলে নিশ্চিন্তি। এসব নিয়ে চিন্তা করতে হত না যদি জয়িতা সঙ্গে না থাকত। ওর ওই পোশাক গ্রামের মানুষদের স্মরণে থেকে যাবে। সংশয়ের কথা সে বলেছিল বন্ধুদের। কিন্তু জয়িতাই কথাটা উড়িয়ে দিয়েছিল, তোর বাড়ির লোকদের নিয়ে ভাব, গ্রামের মানুষদের আমি ট্যাকল করব।

দুবছর ঘনিষ্ঠভাবে মিশে আনন্দ জেনে গেছে জয়িতার মধ্যে কোন ন্যাকামি নেই। একটা ছেলের পক্ষে যা করা সম্ভব ওর কাছে তা অসম্ভব নয়। প্রথমদিকে তাদের তিনজনেরই যে ওর সম্পর্কে দ্বিধা ছিল এটা অস্বীকার করার মানে হয় না। কিন্তু সময় এবং কাজ সেটাকে ধুয়ে মুছে দিয়ে গেছে কখন। আনন্দ ছুটন্ত বাসে বসে পেছন ফিরে তাকাল। বেশ ভিড়। কল্যাণ চোখ বন্ধ করে বসে আছে। তার ঠিক পাশে বসে জয়িতা উদাসমুখে জানলা দিয়ে দৃশ্য দেখে যাচ্ছে। সে আড়চোখে যাত্রীদের মুখ দেখল। জয়িতার দিকে তাকাচ্ছে কেউ কেউ। আনন্দর মনে বিরক্তি এল। ও যদি শাড়ি পরে আসত তাহলে ব্যাপারটা এড়ানো যেত।

ঝুপঝুপ করে অন্ধকার নামছে। এই লাইনে যেতে যেতে অনেকবার দৃশ্যটা দেখেছে সে। প্রথমে অনেক দূরে দিগন্তের কাছে উলের বলের মত অন্ধকার জমে। তারপর সেটা সুতো খোলার মত এগিয়ে আসে সামনে। এবং শেষমেশ রাত হয়ে যায়। এখন রাস্তা অনেক চওড়া হয়েছে, হু-হু করে ছুটতে পারে বাস। হঠাৎ সুদীপ ছটফটিয়ে উঠল, ওই যা!

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, কি হল?

সুদীপ বলল, সিগারেট কিনতে ভুলে গেছি। তোদের গ্রামে সিগারেট পাওয়া যাবে?

পেছন থেকে জয়িতার গলা ভেসে এল, আমার কাছে একটা প্যাকেট বাড়তি আছে। দাম দিয়ে দিস। সঙ্গে সঙ্গে বোবা যাত্রীরা উশখুশ করে উঠল।

কল্যাণ সেটা ধরতে পেরে চোখ খুলে বলল, তোর কাছে রাখতে দিয়েছি বলে প্যাকেটটা নিজের হয়ে যায়নি। ওটা আমার সিগারেট। পরের জিনিস দান করা খুব সোজা।

জয়িতা চোখ বড় করল, বাঃ, তুই এই আটটা বেশ রপ্ত করেছিস তো!

কল্যাণ কিছু বলতে যাচ্ছিল, সামনের সিট থেকে আনন্দ বাধা দিল, ঠিক আছে। ওখানে সিগারেট পেতে কারও অসুবিধে হবে না। তোরা বড় কথা বলিস।

সুদীপ ঘাড় ঘুরিয়ে জয়িতাকে বলল, এই জন্যে তোকে ভাল লাগে।

জয়িতা ঠাণ্ডা গলায় বলল, তোর নিজেকে ভাল লাগে তো? তাহলেই চলবে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top