জয়িতা কিছু বলল না। আনন্দ অত্যন্ত সতর্ক ছেলে। সুদীপ যে মানসিকতা নিয়ে কথাটা বলল সে-ব্যাপারে আনন্দ অনেক বেশি ওয়াকিবহাল। সে ঘড়ি দেখল। চল্লিশ মিনিট বলেছে বটে তবে পাঁচ দশ মিনিট আগেও আসতে পারে। যদিও এত রাত্রে পনেরো হাজার টাকা হাতে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়ানো শোভনীয় হবে না। কিন্তু ডিনারের পরে নিচের বাঁধানো ঘেরা চাতালে অনেকেই পায়চারি করে। সেখানে হাঁটতে হাঁটতে গেটের দিকে নজর রাখা যাবে। জয়িতা টাকাগুলো নিয়ে বলল, চল, তোকে রামানন্দবাবুর ঘরটা চিনিয়ে দিচ্ছি। যাবিই যখন তখন দেরি করে কি লাভ!
সুদীপ বলল, আমি আগে বাথরুমে যাব। এইটুকু ফ্ল্যাটে ঘর চিনতে অসুবিধে হবে না। তুই বরং নিচে যা, আনন্দ এসে পড়তে পারে।
জিনসের প্যান্টের ওপর নোংরা গেঞ্জিটা রাখা যাচ্ছিল না। বাথরুম থেকে পরিষ্কার হয়ে বাটিকের পাঞ্জাবি চাপিয়ে চুল আঁচড়ে একটু ভদ্র হয়ে নিল সুদীপ। সিগারেটের প্যাকেটটা রাখতে গিয়েও আবার পকেটে ভরে নিল। আজকাল একনাগাড়ে অনেকক্ষণ সিগারেট ছাড়া জেগে থাকতে পারে না। খাক কিংবা না খাক পকেটে সিগারেট আছে এটাই স্বস্তিদায়ক মনে হয়। ঘর থেকে বেরিয়ে ফ্ল্যাটটাকে খুব নির্জন বলে মনে হল তার। ছোট্ট ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্যটা দেখল। কোণে একটা রঙিন টিভি চলছে। কিন্তু তাকে শব্দহীন করে রাখা হয়েছে। টিভির সামনে উবু হয়ে বসে মগ্ন হয়ে দেখছে শ্রীহরিদা। লোকটা যেহেতু কানে শুনতে পায় না তাই শব্দের কোন প্রয়োজন নেই। বোবা ছবিগুলোকে অন্যরকম মনে হল সুদীপের। এর একটা আলাদা মজা আছে। যে দেখছে সে ইচ্ছেমতন সংলাপ বসিয়ে নিতে পারে পাত্রপাত্রীর মুখে। ওপাশে দুটো ঘর। তার দুটো দরজাই বন্ধ। মনে হয় ওর একটিতে রামানন্দ রায় আছেন। দুবার পিঠে চাপ দেওয়ার পর শ্রীহরিদার সম্বিত ফিরল। সুদীপ ইশারায় জিজ্ঞাসা করল, কোন ঘরটায় তাকে যেতে হবে? তৎক্ষণাৎ হাত বাড়িয়ে সঠিক দরজাটা দেখিয়ে দিল শ্রীহরিদা। তারপর আবার টিভিতে সেঁদিয়ে গেল। সুদীপ নির্দিষ্ট দরজায় টোকা মারতে ভেতর থেকে গলা ভেসে এল, ইয়েস, কাম ইন!
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে একটা ছিমছাম ঘর দেখতে পেল সুদীপ। রামানন্দ রায় আরাম করে বসে আছেন। তার পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি। সামনে একটি পাশপোর্ট হুইস্কির বোতল, জলের জাগ এবং আধাভরতি গ্লাস। বোঝাই যাচ্ছে অনেকক্ষণ পান করছেন ভদ্রলোক। এক পলকেই সুদীপ বুঝল ভদ্রলোক চুলে রঙ বোলান এবং তার চোখের তলায় ব্যাগ তৈরি হয়েছে। সুদীপকে তিনি লক্ষ্য করছিলেন। এবার বললেন, এসো। তোমার কথা আমি জয়ের কাছে শুনেছি। ওখানে বসো। টেবিলের উলটোদিকে চেয়ারটা দেখিয়ে দিলেন তিনি। সুদীপ বুঝল ভদ্রলোক মদ খাচ্ছেন বটে কিন্তু এখনও নেশা হয়নি। কিংবা কোন কোন মানুষ নাকি আট-দশ পেগ খেয়েও স্বাভাবিক আচরণ করেন, ইনি হয়তো সেই শ্ৰেণীর। সুদীপ চুপচাপ চেয়ারটায় বসল।
রামানন্দ গ্লাস তুলে নিঃশব্দে চুমুক দিয়ে বললেন, হোয়াটস দ্য ট্রাবল?
কি ব্যাপার? সুদীপ শক্ত হল।
ওঃ, আমি তোমাকে এইমাত্র বললাম জয় তোমার কথা বলেছে।
তাহলে তো জেনেই গেছেন। ইনফ্যাক্ট এই মুহূর্তে আমার কোন প্রব্লেম নেই এটা ছাড়া।
হোয়াটস দ্যাট?
আপনাদের ফ্ল্যাটে থাকা। আপনারা পছন্দ না করলে সেটাই স্বাভাবিক হবে।
কেউ তোমাকে কিছু বলেছে? রামানন্দ রায়ের চোখ ছোট হয়ে এল।
না। কিন্তু আমার অস্বস্তি আছে। এত রাত্রে কোথাও যেতে অসুবিধে হবে। আমি ঠিক করেছি কাল সকালে চলে যাব। আপনি আমাকে কিছু বলবেন বলে ডেকেছেন?
ইয়েস। আমি জানতে চাই, হোয়াট ইউ পিপল আর ড়ুইং?
মানে?
জয় একটা রাত বাড়িতে ছিল না। তারপরে তুমি এখানে হঠাৎ এলে। আই নো মাই ডটার। কেউ যদি বলে সে ফুর্তি করার জন্যে বাইরে রাত কাটিয়েছিল আমি বিশ্বাস করব না। আমি মনে করি সে মনে করেছে যুক্তিযুক্ত তাই তোমাকে এই বাড়িতে থাকতে দিয়েছে। কিন্তু আমার জানা উচিত কেন সে বাইরে গিয়েছিল, কোথায় গিয়েছিল?
আপনার মেয়ের ওপর যখন এতটা আস্থা রাখেন তাহলে তাকে জিজ্ঞাসা করছেন না কেন?
জিজ্ঞাসা করেছি, সে উত্তর দেয়নি। দোষটা তার নয়, আমার। আমি কোনদিন তার কথা খেয়াল করিনি। আমার সঙ্গে চিরকাল ওর একটা কমুনিকেশন গ্যাপ রয়ে গেল। আমি ওকে বুঝতে পারি কিন্তু
রামানন্দ রায় আর এক চুমুক দিলেন, কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?
সুদীপ মানুষটিকে দেখল। লোকটা কতখানি জালি বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে। সে হাসল। এবং অম্লানবদনে বলল, আপনি মিছিমিছি চিন্তা করছেন। আমরা সবাই ক্লাসিক্যাল মিউজিকে গিয়েছিলাম।
ক্লাসিক্যাল মিউজিকে? রামানন্দ রায় হাঁ করে গেলেন।
হ্যাঁ, আমরা সব বন্ধুবান্ধবরা একসঙ্গে গিয়েছিলাম। আপনাদের বাড়িতে পাইনি বলে জয়িতা বলতে পারেনি। আপনি কখনও হোলনাইট ক্লাসিকাল মিউজিক শুনেছেন?
মাথা নাড়লেন দ্রুত রামানন্দ, না, না। আমি ওসব বুঝি না। হঠাৎ তোমরা ওই অনুষ্ঠানে গেলে?
আমিও ঠিক বুঝি না তাই যেতে চাইনি। কিন্তু আনন্দ বলল, না গেলে ভাল লাগার অভ্যেসটা শুরু হবে না তাই গেলাম। আপনিও একবার গিয়ে দেখুন।
রামানন্দ বাকি মদটুকু শেষ করলেন, এই কথাটা আমাকে বললে কি অসুবিধে হত? এই মেয়েটাকে কিছুতেই বুঝতে পারি না। তোমার বাড়িতে কি গণ্ডগোল হয়েছে?
মানে?
জয় বলছিল তোমার স্টেপমাদার নাকি বাড়ি থেকে চলে যেতে বলায় তুমি বেরিয়ে এসেছ!
কোনমতে হাসি চাপল সুদীপ। সে চট করে সেই কুদর্শনা দাসীটিকে স্টেপমাদারের তকমা পরাবার চেষ্টা করল। এতে হাসিটা বিস্তৃত হল, আমার কথা ছেড়ে দিন। আমি–আমি একটা সিগারেট খেতে পারি? যদি কিছু মনে না করেন!
ও সিওর। রামানন্দ একটি বিদেশী সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিলেন, ছেলেমেয়েদের সিগারেট খাওয়ার সঙ্কোচ করার কি আছে? আমি শুধু জয়কে বলি সস্তা দিশি কিছু খেও না। খেতে হলে বিদেশী সিগারেট, ফিলটারটা ভাল থাকে।
সুদীপ নিজের প্যাকেটটা বেব করল না। বাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট টু হার ম্যাজেস্টি দ্য কুইন সিগারেটটা ধরাল সে। এই মানুষটির আয় কত? এই সিগারেট দিনে দুপ্যাকেট, আধবোতল স্কচ হুইস্কি, বড় হোটেলে লাঞ্চ, ক্লাবে ডিনার, দুটো গাড়ি, বিলাসবহুল ফ্ল্যাট সুচারুভাবে চালাতে গেলে মাসে কত ব্যয় হয়? চাকরি করে এসব চালানোর খরচ পাওয়া যায়? ওর এক সরকারি অফিসাবের সঙ্গে আলাপ আছে। ভদ্রলোক মাইনে পান সাতাশ শো। এক মেয়ে লরেটোতে পড়ে। ভদ্রলোক থাকেন তিনশো টাকার ফ্ল্যাটে। কিন্তু বাড়িতে কালার টিভি-ভি সি আর আছে। এটা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু পয়তাল্লিশ হাজারে অ্যামবাসাডর কিনেছেন ভদ্রলোক। গাড়ির পেছনে ড্রাইভার সমেত মাসে খরচ অন্তত দুহাজার। উনি চালান কি করে? আশেপাশের মানুষ, তার সহকর্মীরা কি নির্বোধ? কিন্তু চোখ বুজে থাকা অভ্যেস হয়ে গিয়েছে প্রত্যেকের। এখন একটু সুযোগ পেলেই মানুষ দু-নম্বরী কারবার করে। এবং সেটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। মুশকিল হল এইসব মানুষের সামনে আয়না ধরলে তারাই আগে ছি ছি করে উঠবে। যে কারণে প্রতুল চৌধুরীকে কেউ পছন্দ কবে না। আর পাঁচটা লেখকের মত ইনিয়ে বিনিয়ে গল্প লেখেন না ভদ্রলোক। সরাসরি পাঠকদের নকল সাজগুলো খুলে ফেলে দেখিয়ে দেন তারা আসলে কি এবং কি হবার ভান করে থাকে। প্রথম প্রথম লোকের মজা লাগছিল। এখন জঘন্য, অশ্লীল বলে চিৎকার শুরু করেছে। প্রতুলবাবুর সঙ্গে আলাপ করেছিল সে একদিন। খুব ভাল লেগেছিল। ভদ্রলোক বিশ্বাস করেন এই দেশটার প্রধান শত্রু এর জনসাধারণ। নিরানব্বইজনই ভণ্ড।
কি ভাবছ? রামানন্দ জিজ্ঞাসা করলেন।
প্রতুল চৌধুরীর কথা।
সে কে!
একজন বিতর্কিত লেখক। আপনি বাংলা গল্প-উপন্যাস পড়েন?
না ভাই, অত সময় নেই আমার। তবে হ্যাঁ, ছেলেবেলায় পড়েছিলাম। খুব স্ট্রাগল করে আজ এখানে এসেছি। আমার বাবা ছিলেন গরীব মাস্টার। এসব কথা এখন তো কাউকে বলা যাবে না। আমি তো তোমাদের মত রুপোর চামচ মুখে দিয়ে জন্মাইনি। তুমি স্কচ খাও? নেবে?
পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল সুদীপ। তারপর হেসে বলল, এখনও সুযোগ পাইনি।
জয় তোমার গার্লফ্রেন্ড?
না।
না? আই সি! তাহলে কি?
আমরা বন্ধু। ওকে আমার মেয়ে বলে মনেই হয় না।
হ্যাঁ, ওর শরীরটা–আসলে ছেলেবেলায় একবার টাইফয়েড হয়েছিল। যাই হোক তাই বলে মেয়ে বলে মনে হয় না এটা ভাবা ঠিক নয়। আসলে প্যান্ট পরে বলে।
না না, আপনি ভুল বুঝছেন। ওর শরীর কোন ব্যাপারই নয়। একটি মেয়ে নয়, ও আমাদের একজন বন্ধু। এর মধ্যে মেয়ে হিসেবে কোন ভূমিকা ওর নেই।
আমি ঠিক বুঝতে পারি না। তোমার বাবা কি করেন?
শুনেছি আইনের ব্যবসা করেন।
শুনেছ মানে?
আমি কোনদিন দেখতে যাইনি।
ঠিক তখনই দরজায় শব্দ হল। আনন্দকে টাকা দিয়ে জয়িতা নিশ্চয়ই ফিরে এসেছে। রামানন্দ রায় একটু টিপসি এখন। গলার স্বর ভারী। পরিশ্রম করে চিৎকার করলেন, কাম ইন।
সুদীপ বলল, আমি আগে বাথরুমে যাব। এইটুকু ফ্ল্যাটে ঘর চিনতে অসুবিধে হবে না। তুই বরং নিচে যা, আনন্দ এসে পড়তে পারে।
জিনসের প্যান্টের ওপর নোংরা গেঞ্জিটা রাখা যাচ্ছিল না। বাথরুম থেকে পরিষ্কার হয়ে বাটিকের পাঞ্জাবি চাপিয়ে চুল আঁচড়ে একটু ভদ্র হয়ে নিল সুদীপ। সিগারেটের প্যাকেটটা রাখতে গিয়েও আবার পকেটে ভরে নিল। আজকাল একনাগাড়ে অনেকক্ষণ সিগারেট ছাড়া জেগে থাকতে পারে না। খাক কিংবা না খাক পকেটে সিগারেট আছে এটাই স্বস্তিদায়ক মনে হয়। ঘর থেকে বেরিয়ে ফ্ল্যাটটাকে খুব নির্জন বলে মনে হল তার। ছোট্ট ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্যটা দেখল। কোণে একটা রঙিন টিভি চলছে। কিন্তু তাকে শব্দহীন করে রাখা হয়েছে। টিভির সামনে উবু হয়ে বসে মগ্ন হয়ে দেখছে শ্রীহরিদা। লোকটা যেহেতু কানে শুনতে পায় না তাই শব্দের কোন প্রয়োজন নেই। বোবা ছবিগুলোকে অন্যরকম মনে হল সুদীপের। এর একটা আলাদা মজা আছে। যে দেখছে সে ইচ্ছেমতন সংলাপ বসিয়ে নিতে পারে পাত্রপাত্রীর মুখে। ওপাশে দুটো ঘর। তার দুটো দরজাই বন্ধ। মনে হয় ওর একটিতে রামানন্দ রায় আছেন। দুবার পিঠে চাপ দেওয়ার পর শ্রীহরিদার সম্বিত ফিরল। সুদীপ ইশারায় জিজ্ঞাসা করল, কোন ঘরটায় তাকে যেতে হবে? তৎক্ষণাৎ হাত বাড়িয়ে সঠিক দরজাটা দেখিয়ে দিল শ্রীহরিদা। তারপর আবার টিভিতে সেঁদিয়ে গেল। সুদীপ নির্দিষ্ট দরজায় টোকা মারতে ভেতর থেকে গলা ভেসে এল, ইয়েস, কাম ইন!
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে একটা ছিমছাম ঘর দেখতে পেল সুদীপ। রামানন্দ রায় আরাম করে বসে আছেন। তার পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি। সামনে একটি পাশপোর্ট হুইস্কির বোতল, জলের জাগ এবং আধাভরতি গ্লাস। বোঝাই যাচ্ছে অনেকক্ষণ পান করছেন ভদ্রলোক। এক পলকেই সুদীপ বুঝল ভদ্রলোক চুলে রঙ বোলান এবং তার চোখের তলায় ব্যাগ তৈরি হয়েছে। সুদীপকে তিনি লক্ষ্য করছিলেন। এবার বললেন, এসো। তোমার কথা আমি জয়ের কাছে শুনেছি। ওখানে বসো। টেবিলের উলটোদিকে চেয়ারটা দেখিয়ে দিলেন তিনি। সুদীপ বুঝল ভদ্রলোক মদ খাচ্ছেন বটে কিন্তু এখনও নেশা হয়নি। কিংবা কোন কোন মানুষ নাকি আট-দশ পেগ খেয়েও স্বাভাবিক আচরণ করেন, ইনি হয়তো সেই শ্ৰেণীর। সুদীপ চুপচাপ চেয়ারটায় বসল।
রামানন্দ গ্লাস তুলে নিঃশব্দে চুমুক দিয়ে বললেন, হোয়াটস দ্য ট্রাবল?
কি ব্যাপার? সুদীপ শক্ত হল।
ওঃ, আমি তোমাকে এইমাত্র বললাম জয় তোমার কথা বলেছে।
তাহলে তো জেনেই গেছেন। ইনফ্যাক্ট এই মুহূর্তে আমার কোন প্রব্লেম নেই এটা ছাড়া।
হোয়াটস দ্যাট?
আপনাদের ফ্ল্যাটে থাকা। আপনারা পছন্দ না করলে সেটাই স্বাভাবিক হবে।
কেউ তোমাকে কিছু বলেছে? রামানন্দ রায়ের চোখ ছোট হয়ে এল।
না। কিন্তু আমার অস্বস্তি আছে। এত রাত্রে কোথাও যেতে অসুবিধে হবে। আমি ঠিক করেছি কাল সকালে চলে যাব। আপনি আমাকে কিছু বলবেন বলে ডেকেছেন?
ইয়েস। আমি জানতে চাই, হোয়াট ইউ পিপল আর ড়ুইং?
মানে?
জয় একটা রাত বাড়িতে ছিল না। তারপরে তুমি এখানে হঠাৎ এলে। আই নো মাই ডটার। কেউ যদি বলে সে ফুর্তি করার জন্যে বাইরে রাত কাটিয়েছিল আমি বিশ্বাস করব না। আমি মনে করি সে মনে করেছে যুক্তিযুক্ত তাই তোমাকে এই বাড়িতে থাকতে দিয়েছে। কিন্তু আমার জানা উচিত কেন সে বাইরে গিয়েছিল, কোথায় গিয়েছিল?
আপনার মেয়ের ওপর যখন এতটা আস্থা রাখেন তাহলে তাকে জিজ্ঞাসা করছেন না কেন?
জিজ্ঞাসা করেছি, সে উত্তর দেয়নি। দোষটা তার নয়, আমার। আমি কোনদিন তার কথা খেয়াল করিনি। আমার সঙ্গে চিরকাল ওর একটা কমুনিকেশন গ্যাপ রয়ে গেল। আমি ওকে বুঝতে পারি কিন্তু
রামানন্দ রায় আর এক চুমুক দিলেন, কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?
সুদীপ মানুষটিকে দেখল। লোকটা কতখানি জালি বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে। সে হাসল। এবং অম্লানবদনে বলল, আপনি মিছিমিছি চিন্তা করছেন। আমরা সবাই ক্লাসিক্যাল মিউজিকে গিয়েছিলাম।
ক্লাসিক্যাল মিউজিকে? রামানন্দ রায় হাঁ করে গেলেন।
হ্যাঁ, আমরা সব বন্ধুবান্ধবরা একসঙ্গে গিয়েছিলাম। আপনাদের বাড়িতে পাইনি বলে জয়িতা বলতে পারেনি। আপনি কখনও হোলনাইট ক্লাসিকাল মিউজিক শুনেছেন?
মাথা নাড়লেন দ্রুত রামানন্দ, না, না। আমি ওসব বুঝি না। হঠাৎ তোমরা ওই অনুষ্ঠানে গেলে?
আমিও ঠিক বুঝি না তাই যেতে চাইনি। কিন্তু আনন্দ বলল, না গেলে ভাল লাগার অভ্যেসটা শুরু হবে না তাই গেলাম। আপনিও একবার গিয়ে দেখুন।
রামানন্দ বাকি মদটুকু শেষ করলেন, এই কথাটা আমাকে বললে কি অসুবিধে হত? এই মেয়েটাকে কিছুতেই বুঝতে পারি না। তোমার বাড়িতে কি গণ্ডগোল হয়েছে?
মানে?
জয় বলছিল তোমার স্টেপমাদার নাকি বাড়ি থেকে চলে যেতে বলায় তুমি বেরিয়ে এসেছ!
কোনমতে হাসি চাপল সুদীপ। সে চট করে সেই কুদর্শনা দাসীটিকে স্টেপমাদারের তকমা পরাবার চেষ্টা করল। এতে হাসিটা বিস্তৃত হল, আমার কথা ছেড়ে দিন। আমি–আমি একটা সিগারেট খেতে পারি? যদি কিছু মনে না করেন!
ও সিওর। রামানন্দ একটি বিদেশী সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিলেন, ছেলেমেয়েদের সিগারেট খাওয়ার সঙ্কোচ করার কি আছে? আমি শুধু জয়কে বলি সস্তা দিশি কিছু খেও না। খেতে হলে বিদেশী সিগারেট, ফিলটারটা ভাল থাকে।
সুদীপ নিজের প্যাকেটটা বেব করল না। বাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট টু হার ম্যাজেস্টি দ্য কুইন সিগারেটটা ধরাল সে। এই মানুষটির আয় কত? এই সিগারেট দিনে দুপ্যাকেট, আধবোতল স্কচ হুইস্কি, বড় হোটেলে লাঞ্চ, ক্লাবে ডিনার, দুটো গাড়ি, বিলাসবহুল ফ্ল্যাট সুচারুভাবে চালাতে গেলে মাসে কত ব্যয় হয়? চাকরি করে এসব চালানোর খরচ পাওয়া যায়? ওর এক সরকারি অফিসাবের সঙ্গে আলাপ আছে। ভদ্রলোক মাইনে পান সাতাশ শো। এক মেয়ে লরেটোতে পড়ে। ভদ্রলোক থাকেন তিনশো টাকার ফ্ল্যাটে। কিন্তু বাড়িতে কালার টিভি-ভি সি আর আছে। এটা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু পয়তাল্লিশ হাজারে অ্যামবাসাডর কিনেছেন ভদ্রলোক। গাড়ির পেছনে ড্রাইভার সমেত মাসে খরচ অন্তত দুহাজার। উনি চালান কি করে? আশেপাশের মানুষ, তার সহকর্মীরা কি নির্বোধ? কিন্তু চোখ বুজে থাকা অভ্যেস হয়ে গিয়েছে প্রত্যেকের। এখন একটু সুযোগ পেলেই মানুষ দু-নম্বরী কারবার করে। এবং সেটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। মুশকিল হল এইসব মানুষের সামনে আয়না ধরলে তারাই আগে ছি ছি করে উঠবে। যে কারণে প্রতুল চৌধুরীকে কেউ পছন্দ কবে না। আর পাঁচটা লেখকের মত ইনিয়ে বিনিয়ে গল্প লেখেন না ভদ্রলোক। সরাসরি পাঠকদের নকল সাজগুলো খুলে ফেলে দেখিয়ে দেন তারা আসলে কি এবং কি হবার ভান করে থাকে। প্রথম প্রথম লোকের মজা লাগছিল। এখন জঘন্য, অশ্লীল বলে চিৎকার শুরু করেছে। প্রতুলবাবুর সঙ্গে আলাপ করেছিল সে একদিন। খুব ভাল লেগেছিল। ভদ্রলোক বিশ্বাস করেন এই দেশটার প্রধান শত্রু এর জনসাধারণ। নিরানব্বইজনই ভণ্ড।
কি ভাবছ? রামানন্দ জিজ্ঞাসা করলেন।
প্রতুল চৌধুরীর কথা।
সে কে!
একজন বিতর্কিত লেখক। আপনি বাংলা গল্প-উপন্যাস পড়েন?
না ভাই, অত সময় নেই আমার। তবে হ্যাঁ, ছেলেবেলায় পড়েছিলাম। খুব স্ট্রাগল করে আজ এখানে এসেছি। আমার বাবা ছিলেন গরীব মাস্টার। এসব কথা এখন তো কাউকে বলা যাবে না। আমি তো তোমাদের মত রুপোর চামচ মুখে দিয়ে জন্মাইনি। তুমি স্কচ খাও? নেবে?
পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল সুদীপ। তারপর হেসে বলল, এখনও সুযোগ পাইনি।
জয় তোমার গার্লফ্রেন্ড?
না।
না? আই সি! তাহলে কি?
আমরা বন্ধু। ওকে আমার মেয়ে বলে মনেই হয় না।
হ্যাঁ, ওর শরীরটা–আসলে ছেলেবেলায় একবার টাইফয়েড হয়েছিল। যাই হোক তাই বলে মেয়ে বলে মনে হয় না এটা ভাবা ঠিক নয়। আসলে প্যান্ট পরে বলে।
না না, আপনি ভুল বুঝছেন। ওর শরীর কোন ব্যাপারই নয়। একটি মেয়ে নয়, ও আমাদের একজন বন্ধু। এর মধ্যে মেয়ে হিসেবে কোন ভূমিকা ওর নেই।
আমি ঠিক বুঝতে পারি না। তোমার বাবা কি করেন?
শুনেছি আইনের ব্যবসা করেন।
শুনেছ মানে?
আমি কোনদিন দেখতে যাইনি।
ঠিক তখনই দরজায় শব্দ হল। আনন্দকে টাকা দিয়ে জয়িতা নিশ্চয়ই ফিরে এসেছে। রামানন্দ রায় একটু টিপসি এখন। গলার স্বর ভারী। পরিশ্রম করে চিৎকার করলেন, কাম ইন।