What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected গর্ভধারিণী - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

জয়িতা কিছু বলল না। আনন্দ অত্যন্ত সতর্ক ছেলে। সুদীপ যে মানসিকতা নিয়ে কথাটা বলল সে-ব্যাপারে আনন্দ অনেক বেশি ওয়াকিবহাল। সে ঘড়ি দেখল। চল্লিশ মিনিট বলেছে বটে তবে পাঁচ দশ মিনিট আগেও আসতে পারে। যদিও এত রাত্রে পনেরো হাজার টাকা হাতে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়ানো শোভনীয় হবে না। কিন্তু ডিনারের পরে নিচের বাঁধানো ঘেরা চাতালে অনেকেই পায়চারি করে। সেখানে হাঁটতে হাঁটতে গেটের দিকে নজর রাখা যাবে। জয়িতা টাকাগুলো নিয়ে বলল, চল, তোকে রামানন্দবাবুর ঘরটা চিনিয়ে দিচ্ছি। যাবিই যখন তখন দেরি করে কি লাভ!

সুদীপ বলল, আমি আগে বাথরুমে যাব। এইটুকু ফ্ল্যাটে ঘর চিনতে অসুবিধে হবে না। তুই বরং নিচে যা, আনন্দ এসে পড়তে পারে।



জিনসের প্যান্টের ওপর নোংরা গেঞ্জিটা রাখা যাচ্ছিল না। বাথরুম থেকে পরিষ্কার হয়ে বাটিকের পাঞ্জাবি চাপিয়ে চুল আঁচড়ে একটু ভদ্র হয়ে নিল সুদীপ। সিগারেটের প্যাকেটটা রাখতে গিয়েও আবার পকেটে ভরে নিল। আজকাল একনাগাড়ে অনেকক্ষণ সিগারেট ছাড়া জেগে থাকতে পারে না। খাক কিংবা না খাক পকেটে সিগারেট আছে এটাই স্বস্তিদায়ক মনে হয়। ঘর থেকে বেরিয়ে ফ্ল্যাটটাকে খুব নির্জন বলে মনে হল তার। ছোট্ট ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্যটা দেখল। কোণে একটা রঙিন টিভি চলছে। কিন্তু তাকে শব্দহীন করে রাখা হয়েছে। টিভির সামনে উবু হয়ে বসে মগ্ন হয়ে দেখছে শ্রীহরিদা। লোকটা যেহেতু কানে শুনতে পায় না তাই শব্দের কোন প্রয়োজন নেই। বোবা ছবিগুলোকে অন্যরকম মনে হল সুদীপের। এর একটা আলাদা মজা আছে। যে দেখছে সে ইচ্ছেমতন সংলাপ বসিয়ে নিতে পারে পাত্রপাত্রীর মুখে। ওপাশে দুটো ঘর। তার দুটো দরজাই বন্ধ। মনে হয় ওর একটিতে রামানন্দ রায় আছেন। দুবার পিঠে চাপ দেওয়ার পর শ্রীহরিদার সম্বিত ফিরল। সুদীপ ইশারায় জিজ্ঞাসা করল, কোন ঘরটায় তাকে যেতে হবে? তৎক্ষণাৎ হাত বাড়িয়ে সঠিক দরজাটা দেখিয়ে দিল শ্রীহরিদা। তারপর আবার টিভিতে সেঁদিয়ে গেল। সুদীপ নির্দিষ্ট দরজায় টোকা মারতে ভেতর থেকে গলা ভেসে এল, ইয়েস, কাম ইন!

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে একটা ছিমছাম ঘর দেখতে পেল সুদীপ। রামানন্দ রায় আরাম করে বসে আছেন। তার পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি। সামনে একটি পাশপোর্ট হুইস্কির বোতল, জলের জাগ এবং আধাভরতি গ্লাস। বোঝাই যাচ্ছে অনেকক্ষণ পান করছেন ভদ্রলোক। এক পলকেই সুদীপ বুঝল ভদ্রলোক চুলে রঙ বোলান এবং তার চোখের তলায় ব্যাগ তৈরি হয়েছে। সুদীপকে তিনি লক্ষ্য করছিলেন। এবার বললেন, এসো। তোমার কথা আমি জয়ের কাছে শুনেছি। ওখানে বসো। টেবিলের উলটোদিকে চেয়ারটা দেখিয়ে দিলেন তিনি। সুদীপ বুঝল ভদ্রলোক মদ খাচ্ছেন বটে কিন্তু এখনও নেশা হয়নি। কিংবা কোন কোন মানুষ নাকি আট-দশ পেগ খেয়েও স্বাভাবিক আচরণ করেন, ইনি হয়তো সেই শ্ৰেণীর। সুদীপ চুপচাপ চেয়ারটায় বসল।

রামানন্দ গ্লাস তুলে নিঃশব্দে চুমুক দিয়ে বললেন, হোয়াটস দ্য ট্রাবল?

কি ব্যাপার? সুদীপ শক্ত হল।

ওঃ, আমি তোমাকে এইমাত্র বললাম জয় তোমার কথা বলেছে।

তাহলে তো জেনেই গেছেন। ইনফ্যাক্ট এই মুহূর্তে আমার কোন প্রব্লেম নেই এটা ছাড়া।

হোয়াটস দ্যাট?

আপনাদের ফ্ল্যাটে থাকা। আপনারা পছন্দ না করলে সেটাই স্বাভাবিক হবে।

কেউ তোমাকে কিছু বলেছে? রামানন্দ রায়ের চোখ ছোট হয়ে এল।

না। কিন্তু আমার অস্বস্তি আছে। এত রাত্রে কোথাও যেতে অসুবিধে হবে। আমি ঠিক করেছি কাল সকালে চলে যাব। আপনি আমাকে কিছু বলবেন বলে ডেকেছেন?

ইয়েস। আমি জানতে চাই, হোয়াট ইউ পিপল আর ড়ুইং?

মানে?

জয় একটা রাত বাড়িতে ছিল না। তারপরে তুমি এখানে হঠাৎ এলে। আই নো মাই ডটার। কেউ যদি বলে সে ফুর্তি করার জন্যে বাইরে রাত কাটিয়েছিল আমি বিশ্বাস করব না। আমি মনে করি সে মনে করেছে যুক্তিযুক্ত তাই তোমাকে এই বাড়িতে থাকতে দিয়েছে। কিন্তু আমার জানা উচিত কেন সে বাইরে গিয়েছিল, কোথায় গিয়েছিল?

আপনার মেয়ের ওপর যখন এতটা আস্থা রাখেন তাহলে তাকে জিজ্ঞাসা করছেন না কেন?

জিজ্ঞাসা করেছি, সে উত্তর দেয়নি। দোষটা তার নয়, আমার। আমি কোনদিন তার কথা খেয়াল করিনি। আমার সঙ্গে চিরকাল ওর একটা কমুনিকেশন গ্যাপ রয়ে গেল। আমি ওকে বুঝতে পারি কিন্তু

রামানন্দ রায় আর এক চুমুক দিলেন, কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?

সুদীপ মানুষটিকে দেখল। লোকটা কতখানি জালি বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে। সে হাসল। এবং অম্লানবদনে বলল, আপনি মিছিমিছি চিন্তা করছেন। আমরা সবাই ক্লাসিক্যাল মিউজিকে গিয়েছিলাম।

ক্লাসিক্যাল মিউজিকে? রামানন্দ রায় হাঁ করে গেলেন।

হ্যাঁ, আমরা সব বন্ধুবান্ধবরা একসঙ্গে গিয়েছিলাম। আপনাদের বাড়িতে পাইনি বলে জয়িতা বলতে পারেনি। আপনি কখনও হোলনাইট ক্লাসিকাল মিউজিক শুনেছেন?

মাথা নাড়লেন দ্রুত রামানন্দ, না, না। আমি ওসব বুঝি না। হঠাৎ তোমরা ওই অনুষ্ঠানে গেলে?

আমিও ঠিক বুঝি না তাই যেতে চাইনি। কিন্তু আনন্দ বলল, না গেলে ভাল লাগার অভ্যেসটা শুরু হবে না তাই গেলাম। আপনিও একবার গিয়ে দেখুন।

রামানন্দ বাকি মদটুকু শেষ করলেন, এই কথাটা আমাকে বললে কি অসুবিধে হত? এই মেয়েটাকে কিছুতেই বুঝতে পারি না। তোমার বাড়িতে কি গণ্ডগোল হয়েছে?

মানে?

জয় বলছিল তোমার স্টেপমাদার নাকি বাড়ি থেকে চলে যেতে বলায় তুমি বেরিয়ে এসেছ!

কোনমতে হাসি চাপল সুদীপ। সে চট করে সেই কুদর্শনা দাসীটিকে স্টেপমাদারের তকমা পরাবার চেষ্টা করল। এতে হাসিটা বিস্তৃত হল, আমার কথা ছেড়ে দিন। আমি–আমি একটা সিগারেট খেতে পারি? যদি কিছু মনে না করেন!

ও সিওর। রামানন্দ একটি বিদেশী সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিলেন, ছেলেমেয়েদের সিগারেট খাওয়ার সঙ্কোচ করার কি আছে? আমি শুধু জয়কে বলি সস্তা দিশি কিছু খেও না। খেতে হলে বিদেশী সিগারেট, ফিলটারটা ভাল থাকে।

সুদীপ নিজের প্যাকেটটা বেব করল না। বাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট টু হার ম্যাজেস্টি দ্য কুইন সিগারেটটা ধরাল সে। এই মানুষটির আয় কত? এই সিগারেট দিনে দুপ্যাকেট, আধবোতল স্কচ হুইস্কি, বড় হোটেলে লাঞ্চ, ক্লাবে ডিনার, দুটো গাড়ি, বিলাসবহুল ফ্ল্যাট সুচারুভাবে চালাতে গেলে মাসে কত ব্যয় হয়? চাকরি করে এসব চালানোর খরচ পাওয়া যায়? ওর এক সরকারি অফিসাবের সঙ্গে আলাপ আছে। ভদ্রলোক মাইনে পান সাতাশ শো। এক মেয়ে লরেটোতে পড়ে। ভদ্রলোক থাকেন তিনশো টাকার ফ্ল্যাটে। কিন্তু বাড়িতে কালার টিভি-ভি সি আর আছে। এটা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু পয়তাল্লিশ হাজারে অ্যামবাসাডর কিনেছেন ভদ্রলোক। গাড়ির পেছনে ড্রাইভার সমেত মাসে খরচ অন্তত দুহাজার। উনি চালান কি করে? আশেপাশের মানুষ, তার সহকর্মীরা কি নির্বোধ? কিন্তু চোখ বুজে থাকা অভ্যেস হয়ে গিয়েছে প্রত্যেকের। এখন একটু সুযোগ পেলেই মানুষ দু-নম্বরী কারবার করে। এবং সেটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। মুশকিল হল এইসব মানুষের সামনে আয়না ধরলে তারাই আগে ছি ছি করে উঠবে। যে কারণে প্রতুল চৌধুরীকে কেউ পছন্দ কবে না। আর পাঁচটা লেখকের মত ইনিয়ে বিনিয়ে গল্প লেখেন না ভদ্রলোক। সরাসরি পাঠকদের নকল সাজগুলো খুলে ফেলে দেখিয়ে দেন তারা আসলে কি এবং কি হবার ভান করে থাকে। প্রথম প্রথম লোকের মজা লাগছিল। এখন জঘন্য, অশ্লীল বলে চিৎকার শুরু করেছে। প্রতুলবাবুর সঙ্গে আলাপ করেছিল সে একদিন। খুব ভাল লেগেছিল। ভদ্রলোক বিশ্বাস করেন এই দেশটার প্রধান শত্রু এর জনসাধারণ। নিরানব্বইজনই ভণ্ড।

কি ভাবছ? রামানন্দ জিজ্ঞাসা করলেন।

প্রতুল চৌধুরীর কথা।

সে কে!

একজন বিতর্কিত লেখক। আপনি বাংলা গল্প-উপন্যাস পড়েন?

না ভাই, অত সময় নেই আমার। তবে হ্যাঁ, ছেলেবেলায় পড়েছিলাম। খুব স্ট্রাগল করে আজ এখানে এসেছি। আমার বাবা ছিলেন গরীব মাস্টার। এসব কথা এখন তো কাউকে বলা যাবে না। আমি তো তোমাদের মত রুপোর চামচ মুখে দিয়ে জন্মাইনি। তুমি স্কচ খাও? নেবে?

পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল সুদীপ। তারপর হেসে বলল, এখনও সুযোগ পাইনি।

জয় তোমার গার্লফ্রেন্ড?

না।

না? আই সি! তাহলে কি?

আমরা বন্ধু। ওকে আমার মেয়ে বলে মনেই হয় না।

হ্যাঁ, ওর শরীরটা–আসলে ছেলেবেলায় একবার টাইফয়েড হয়েছিল। যাই হোক তাই বলে মেয়ে বলে মনে হয় না এটা ভাবা ঠিক নয়। আসলে প্যান্ট পরে বলে।

না না, আপনি ভুল বুঝছেন। ওর শরীর কোন ব্যাপারই নয়। একটি মেয়ে নয়, ও আমাদের একজন বন্ধু। এর মধ্যে মেয়ে হিসেবে কোন ভূমিকা ওর নেই।

আমি ঠিক বুঝতে পারি না। তোমার বাবা কি করেন?

শুনেছি আইনের ব্যবসা করেন।

শুনেছ মানে?

আমি কোনদিন দেখতে যাইনি।

ঠিক তখনই দরজায় শব্দ হল। আনন্দকে টাকা দিয়ে জয়িতা নিশ্চয়ই ফিরে এসেছে। রামানন্দ রায় একটু টিপসি এখন। গলার স্বর ভারী। পরিশ্রম করে চিৎকার করলেন, কাম ইন।
 
চাবুকের মত দরজাটা খুলে গেল। সীতা রায় গনগনে আঁচের মত করে ঢুকলেন। সুদীপ চমৎকার পারফিউমের অস্তিত্ব, সুগঠিত শরীরের বিদ্যুৎ এবং দাম্ভিক পদক্ষেপ দেখল। সীতা রায় সামনে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি আমার ঘরে গিয়েছিলে?

চটজলদি মাথা নাড়লেন রামানন্দ রায়, নো নো ডার্লিং।

একটু থমকে গেলেন সীতা রায়। সোজা হয়ে দাঁড়াবার সময় তাঁর শরীরে একটা ঢেউ গড়িয়ে গেল। ঠোঁট কামড়ে এক লহমা দাঁড়িয়ে একবার জিজ্ঞাসা করলেন, আমার আলমারি কে খুলেছিল?

তোমার আলমারি? স্ট্রেঞ্জ! এত সাহস কার হল? সত্যি যেন অবাক হয়েছেন রামানন্দ।

লিশ্‌ন! আমি কদিন ছিলাম না, একটু আগে লক্ষ্য করলাম আমার একটা ভাবী হার মিসিং। যাওয়ার কদিন আগে হারটা আমি ভল্ট থেকে এনেছিলাম। আমি জানতে পারি কি কে নিয়েছে? মহিলার মুখে রক্ত জমছে এবার।

রামানন্দ রায় উঠে দাঁড়ালেন, তুমি বসো ডার্লিং। বসো প্লিজ?

সীতা রায় আপত্তি করতে গিয়েও করলেন না! চেয়ারে নোংরা আছে এমন ভঙ্গিতে সেখানে শরীর বাখলেন।

রামনন্দ জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি চাবি দিয়ে যাওনি আলমারিতে?

গিয়েছিলাম। এসেও দেখছি বন্ধ আছে। শুধু গয়নাটা নেই। এই বাড়িতে কেউ কখনও আমার জিনিসে হাত দেবে ভাবতে পারিনি। হয় তুমি, জয় কিংবা ওই বুড়োটা ছাড়া আর কেউ নিতে পারে না।

আমি ফেরত চাই, কাল সকাল আটটার মধ্যে।

কথা শেষ করে উঠতে যাচ্ছিলেন সীতা রায়, হাত তুলে ইঙ্গিতে তাকে বসতে বলল সুদীপ, আপনার একটু ভুল হয়ে যাচ্ছে। আমি বাধা দিলাম বলে ক্ষমা চাইছি।

মেদহীন মসৃণ চামড়ার মুখটি স্প্রিং-এর মত ঘুরল, হোয়াটস দ্যাট?

তিনজন নয়, চারজন। আপনি আমার নামটা ইনক্লন্ড করুন। আপনার অনুপস্থিতিতে আমি এই বাড়িতে ছিলাম। সুদীপ খুব সুন্দর করে হাসল।

আর সেটা দেখে যেন সীতা রায়ের শরীর জ্বলে উঠল, আমি বুঝতে পারি না রামানন্দ এত উদার হল কি করে? মেয়ে বয়ফ্রেন্ড নিয়ে বাড়িতে থাকছে, চমৎকার!

রামানন্দ চটপট প্রতিবাদ করলেন, সুদীপ জয়ের বয়ফ্রেন্ড নয়।

কাঁধ নাচালেন সীতা রায়, ইটস নট মাই হেডেক! মেয়ের ব্যাপারে যা ভালমন্দ তুমি বুঝবে! ঠিক আছে, চারজন, চারজনের কেউ ওটা ফেরত দিলে খুশী হবো।

রামানন্দ নতুন করে হুইস্কি টানছিলেন, কিন্তু কে চুরি করবে? কার এত সাহস? তুমি একটু নেবে ডার্লিং। ওহো, তুমি তো আবার ভদকা ছাড়া কিছু খাও না!

সুদীপ বলল, আপনার সঙ্গে আমার একটু কথা আছে।

বলুন। সীতা রায় তাকালেন না।

এখানে বলাটা ঠিক হবে?

সীতা রায় এবার ঘুরে বসলেন, কি বলতে চাইছেন?

এমন কথা যা হয়তো আপনি চাইবেন না উনি শুনুন।

লুক, আপনি ভনিতা না করে বলতে পারেন।

হারটা আপনি দাজিলিং-এ ফেলে আসেননি তো?

না। সেখানে আমি হার নিয়ে যাইনি।

আপনি খুব নিশ্চিন্ত?

মোর দ্যান দ্যাট।

যিনি আপনার সঙ্গে দার্জিলিং-এ গিয়েছিলেন তাকে একবার ফোন করুন না। হয়তো তিনি এমন কিছু তথ্য দিতে পারেন–।

শুনুন, আমি বলছি হার আমি এখানেই রেখে গিয়েছিলাম। সান্যাল কিছুই জানে না।

তবু যখন বলছে সান্যালকে জিজ্ঞাসা করো না ডার্লিং। রামানন্দ বললেন। এখন ওঁর গলার স্বর আরও জড়ানো। চোখ ছোট হয়ে এসেছে।

আমি ওই স্কাউড্রেলটার সঙ্গে কথা বলতে চাই না।

সান্যাল তো স্কাউন্ড্রেল তা সবাই জানতাম। শুধু পরের বউ-এর সঙ্গে ঘুমানো ছাড়া ওর কোন কাজ নেই। তুমি বুঝেছ, বেটার লেট দ্যান নেভার ডার্লিং! রামানন্দ যেন তৃপ্তি পেলেন।

আমি কি বুঝি সেটা আমি জানি। আমি দার্জিলিং-এ গিয়েছিলাম কিছু পাহাড়ী বাটিকের জন্যে। সান্যালও ওখানে গিয়েছিল। দ্যাটস অল। আমি কাউকে কৈফিয়ত দিতে রাজী নই। সান্যাল নিশ্চয়ই স্কাউন্ড্রেল, লম্পট, কিন্তু তোমার ওই হিপো ঐন্দ্রিলা দত্ত তার চেয়ে কম নয়। আমি যাচ্ছি। শব্দ করে চেয়ার সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন সীতা রায়।
 
ওয়েল। জড়ানো গলায় বললেন রামানন্দ রায়, গুডনাইট। কি যেন নাম তোমার? সুদীপ। গুডনাইট। কালকে বিদায় হও ভাই। আমার স্ত্রী চাইছেন না যখন তখন কেটে পড়। গুডনাইট। গ্লাসের বাকিটা শেষ করে টলতে টলতে বিছানার দিকে এগোলেন রামানন্দ রায়। সুদীপ উঠে পড়ল। সীতা রায় স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, কাল সকালে আমার হার চাই। এ ব্যাপারে আমি কোন কথা শুনতে চাই না।

সুদীপ আর দাঁড়াল না। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল শ্রীহরিদা টিভির সামনে উবু হয়ে বসে। কিন্তু টিভিতে কোন ছবি নেই। স্টেশন বন্ধ হয়ে গিয়েছে, যদিও সেটটা বন্ধ করা হয়নি। নির্ঘাৎ বুড়ো ঘুমোচ্ছে। সে এগিয়ে গিয়ে নবটা ঘুরিয়ে দিতে সীতা রায় বেরিয়ে এলেন। স্মার্ট পায়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন, তুমি তখন কি বলছিলে? দার্জিলিং-এর ব্যাপারে?

আপনি তো আমার কথা শুনতে চাননি!

সীতা রায় সুদীপের আপাদমস্তক দেখলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, আমার ঘরে এস। তিনি আর দাঁড়ালেন না। সুদীপ জয়িতার জন্যে তাকাল। তাকে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। হার নিয়ে ওই ভদ্রমহিলা একটা কাণ্ড না বাধিয়ে ছাড়বেন না। আপাতত জয়িতাকে সন্দেহের তালিকা থেকে সরানো দরকার। সে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মধ্যরাত্রে সীতা রায় চুলে বেশ ব্রাশ বোলাচ্ছিলেন। বললেন, সত্যি করে বলতো তুমি কে?

আমি প্রেসিডেন্সিতে পড়তাম। আমার মা বাবা ছিলেন। তাদের দেওয়া নাম সুদীপ।

তুমি পাস্ট টেলে কথা বলছ?

ব্যাপারটা আমার কাছে অতীত বলে।

সীতা রায়ের মুখে হাসি ফুটল। হাসলে এই মহিলাকে এখনও মিষ্টি দেখায়। বললেন, তোমাকে আমার বেশ অভিনব মনে হচ্ছে। শোন, দার্জিলিং-এ আমি হার নিয়ে যাইনি। শ্রীহরির কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। ও চুরি করতেই পারে না। রামানন্দর সাহস হবে না আমার জিনিসে হাত দেওয়ার, সেটা আমি জানি। বাকি থাকল জয়িতা। ওকে আমি বুঝতে পারি না আজকাল। অদ্ভুত ব্যবহার করে। অত্যন্ত উদ্ধত। মুখের ওপর যা-তা কথা বলে। আর এসবই হচ্ছে রামানন্দর প্রশ্রয়ে।

সরল মুখে সুদীপ বলল, জয়িতা তো গয়না পরতে ভালবাসে না। আমরা তো দেখিনি।

কাঁধ নাচালেন সীতা রায়, নিজের মেয়েকে সন্দেহ করতে নিশ্চয়ই আমার ভাল লাগছে না, কিন্তু এছাড়া তো আর কোন রাস্তা নেই। মাঝে মাঝে নিজেকে খুব একলা মনে হয়। আই অ্যাম রিয়েলি অ্যালোন! এবার দার্জিলিং-ট্রিপটা আমার খুব খারাপ গেল।

আমারও তাই মনে হয়। কি

মনে হয়? তুমি জানছ কি করে?

একজন স্কাউড্রেল লম্পট মানুষের সঙ্গে সময় নিশ্চয়ই ভাল কাটে না। তবে ওকে তো সবাই জানত–।

আমি শোনা কথায় বিশ্বাস করি না। তুমি সান্যালকে চেন?

অম্লানবদনে মিথ্যে বলল সুদীপ, হ্যাঁ। আমার এক পরিচিত ভদ্রলোকের স্ত্রী ওর বান্ধবী।

গুড গড! লোকটা–। অনেকদিন পরে আমি ভুল করলাম।

সান্যাল নিতে পারে না?

না না। সে ওসব ঠুনকো জিনিস চায় না। ও যে দার্জিলিং-এ আরও একটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতে যাচ্ছে তা কে জানত! আমাকে ও প্রথমে প্যারাডাইসে যেতে বলেছিল। সেখানে গেলে তো মরে যেতাম। কাগজে যা দেখলাম! শিউরে উঠলেন সীতা রায়, বড্ড বেশি রিস্ক নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। ওখানে এই হল আর বাড়িতে ফিরে এই দেখছি।

আপনি কিভাবে দার্জিলিং-এ গিয়েছিলেন?

কেন, প্লেনে! আমি ট্রেনে বেশি ট্রাভেল করতে পারি না। সান্যাল এল। আমি তৈরি হয়ে নিলাম। তারপর সোজা এয়ারপোর্ট। বাগডোগরা থেকে ট্যাকসিতে দার্জিলিং-এ। জিজ্ঞাসা করছ কেন?

সান্যাল এখানে এসেছিলেন আপনাকে নিতে?

হ্যাঁ। বলেই সীতা রায় স্থির হয়ে গেলেন। তারপরেই তার মাথা নড়ল, ও যখন এই ঘরে বসেছিল তখন আমি বাথরুমে গিয়েছিলাম। কিন্তু ও জানবে কি করে কোথায় হার আছে!

চটপট লুফে নিল সুদীপ, যারা জানার তারা জানে। আচ্ছা আমি আসি। সে আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে এল। ভদ্রমহিলার মুখ এখন রক্তশূন্য হয়ে য়ছে। দার্জিলিং-এ যে প্রতারণা তিনি সহ্য করে এসেছিলেন, হার হারানো তার চেয়ে বহুগুণ বেশি ঠেকছে। শরীরটা তো সাবান ঘষে সাফ করে নেওয়া, যায় কিন্তু স্বর্ণালঙ্কার? সুদীপ হেসে ফেলল। আনন্দ যা চেয়েছে তা করতে গেলে আজই তিনটে গুলি খরচ করতে হত। অবনী তালুকদার, রামানন্দ রায় এবং সীতা রায়দের সংখ্যা যেভাবে হু-হু করে বাড়ছে তাতে অবশ্য তিনটে গুলি বাজে খরচের মধ্যে পড়ত। এই মুহূর্তে তার ভাল লাগল প্যারাডাইসের কথা বলার সময় সীতা রায়ের শি. র ওঠা মুখটা মনে পড়ায়। আনন্দ এ ক্ষেত্রে ঠিক, ধাক্কা দেওয়া দরকার। আতঙ্ক কখনও কখনও মানুষের চেতনা ফিরিয়ে আনে। একবারে না হলে একাধিকবারে।
 
১৫.
সকাল বেলায় আনন্দ আর কল্যাণ এল। সবে ব্রেকফাস্ট খাওয়া হয়েছে ওদের।

জয়িতা দরজা খুলে নিয়ে এল এই ঘরে। সোফায় বসে কল্যাণ বলল, কি দারুণ ফ্ল্যাটে থাকিস তোরা!

জয়িতা বলল, সাবধানে বসিস, যে কোন মুহূর্তে পায় ভেঙে পড়তে পারে।

সোজা হয়ে বসল কল্যাণ, সেকি রে!

হো হো করে হেসে উঠল সুদীপ, দারুণ বললি জয়ী, কল্যাণ কথাটার ভেতরের মানে ধরতে পারেনি। ও বলছে বাইরেটাই সাজানো, ভেতরে ফাঁকা।

গতরাত্রে জয়িতার সঙ্গে এ বিষয়ে অনেক কথা হয়েছে তার। সে আর জয়িতা ডাইনিং টেবিলে খেয়েছে। বাকি দুজনের খাবার ঘরে ঘরে পৌঁছেছে শ্রীহরিদা। রামানন্দ রায় খেয়েছেন কিনা জানা নেই, তবে সীতা রায় যে খেতে পারবেন না এটা বিশ্বাস ছিল। ক্রমশ এক সময় রাগ নয়, ওই মানুষ দুটোর জন্যে কষ্ট হচ্ছিল সুদীপের। একটা সম্পর্করহিত-সম্পর্ক নিয়ে বেঁচে আছে দুজনে। শরৎচন্দ্রের একটা লেখা পড়ে আনন্দ বলেছিল একদিন, চমৎকার একটা ব্যাখ্যা পেলাম। নেতিয়ে পড়া আত্মীয়তা। সারা দেশটার মানুষের এখন ওই সম্পর্ক। টার্মসটা এখানে প্রযোজ্য।

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, তোর বাবা মা কোথায়?

জয়িতা জবাব দিল, তাঁরা তাঁদের মতো আছেন। এ ঘরে কেউ আসবে না।

কল্যাণ বলল, আমার যদি বোন থাকত তবে তার ছেলে বন্ধুরা এইভাবে বাড়িতে এলে কুরুক্ষেত্র বেঁধে যেত!

জয়িতা তাকাল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমি তোর বোন হয়ে জন্মাইনি।

কল্যাণকে থামাল আনন্দ, শোন সুদীপ, তুই ঠাকুরপুকুরে যেতে চাইছিস?

হ্যাঁ।

আরও তিনটে দিন অপেক্ষা করা যায় না?

কেন?

ঠাকুরপুকুর আমাদের চারজনের পক্ষে ভাল শেলটার। ওটাকে ডিস্টার্ব করতে চাই না।

সুদীপ মাথা নাড়ল, আমি আগে গেলে ভাল হবে। আত্মীয় বেড়াতে এসেছে বলে পাড়ার সবাই ধরে নেবে। তোরা যখন যাবি তখন কাউকে তো বাইরে বের হতে হবেই। সেই কাজটা আমিই করব। আগে থেকে থাকলে লোকে সন্দেহ করবে না।

কল্যাণ বলল, কথাটা ও ঠিকই বলেছে।

আনন্দ মাথা নাড়ল, বেশ। তাহলে আজ দুপুরের পর ওখানে চলে যা। সঙ্গে কল্যাণকে নিয়ে যাবি। যেন দুই বন্ধু বেড়াতে এসেছিস। কলকাতা দেখবি এমন ভান করবি। বুড়িকে ম্যানেজ করার ভার তোর। তোকে তো কেউ কেউ চেনে ওখানে। যাওয়ার সময় দুটো স্যুটকেস নিয়ে যাবি। মানে লোকে বেড়াতে গেলে যেভাবে যায় সেই রকম ভাবটা যেন থাকে।

আনন্দ একটু চুপ করল। তারপর বলল, আজকের কাগজে প্যারাডাইসের ব্যাপারটা নিয়ে কিছু নতুন খবর বেরিয়েছে। কাগজ সন্দেহ করছে এটা উগ্রপন্থীদের কাজ। কয়েক হাজার প্রায় নিরন্ন মানুষের সামনে ওখানে যা যা ঘটত তার বিশদ বিবরণ ছেপেছে ওরা। কোন সাধারণ ডাকাত হলে তারা ডাকাতি করত। কাগজ বলেছে যারা ঘটনাটা ঘটিয়েছে তারা চেয়েছিল প্যারাডাইস চিরকালের জন্যে বন্ধ হয়ে যাক। কোন আর্থিক লোভের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। বলা যেতে পারে উগ্রপন্থীরা সফল।

আনন্দ থামলে জয়িতা বলল, যাচ্চলে। কাজটা করলাম আমরা আর কৃতিত্ব পাচ্ছে উগ্রপন্থীরা! আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, উগ্রপন্থী কারা?

জয়িতা উত্তর দিল, ওই যে, মাঝেমাঝেই কাগজে দেখি উগ্রপন্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ, তারাই। আনন্দ মাথা নাড়ল, প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়ে যারা সরাসরি আঘাত হানতে চায় তারাই উগ্রপন্থী। আমাদেরও যদি ওই পর্যায়ে ফেলা হয় তাতে আপত্তি করার কি আছে? কেউ কারও কৃতিত্ব দখল করছে না, তাছাড়া তোরা নিশ্চয়ই হাততালি পাবার জন্যে কাজে নামিসনি।

সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, পুলিশ কি আমাদের খবর পেয়েছে বলে মনে হয়?

আনন্দ বলল, না। পুলিশের ধারণা ঘটনাটা যারা ঘটিয়েছে তারা স্থানীয় লোক নয়। নির্দিষ্ট ফর্মুলাতে তদন্ত চালালে কখনই ওরা আমাদের কাছে পৌঁছাবে না। তবে সুদীপ, ওই প্রস্তাবটা আমাদের মেনে নেওয়া উচিত। এই ধরনের ঘটনা ঘটাবার পরই আমরা কাগজগুলোকে টেলিফোনে জানাব কেন ঘটালাম। সরাসরি জনসাধারণের ব্যাপারটা জানা উচিত।

জয়িতা বলল, প্যারাডাইসের ঘটনাটা মাথা থেকে চলে গেছে। এবার নতুনটা শুরু কর।

আনন্দ হাসল, এবার খুব সহজে হবে না। মনে রাখিস নকশালরা পর্যন্ত ওখানে একটাও বোমা ফাটায়নি। তোদের কারোর সঙ্গে কোন ওষুধের দোকানের কর্মচারীর যোগাযোগ আছে?

চুপচাপ শুনছিল কল্যাণ, বলল, আমার আছে।

না। তোর সঙ্গে দোকানের মালিকের জানাশোনা। ব্যাপারটা ঘটে যাওয়ার পর ভদ্রলোক তোকে সন্দেহ করতে পারেন। ঠিক আছে, আমিই ম্যানেজ করব। আমি আর সুদীপ দশটা নাগাদ বড়বাজারে যাব। কল্যাণ দুটো নাগাদ সুদীপকে মিট করবি ধর্মতলায় শহীদ মিনারের সামনে। ওখান থেকে তোরা চলে যাবি ঠাকুরপুকুরে। দুদিন জায়গাটা ভাল করে ওয়াচ করতে হবে। আনন্দ বলল।

জয়িতা খানিকটা উষ্ণ গলায় জিজ্ঞাসা করল, আমি কি করব?

ঘুমুবি। চুপচাপ বাড়িতে বসে রেস্ট নে। তুই আমাদের পোস্ট অফিস। এই বাড়িতে তোর এখন ভূমিকা কেমন? তোর ঘর এটা নয় নিশ্চয়ই!

না।

তোর ঘরে প্রাইভেসি আছে?

আমি ছাড়া আর কেউ যায় না।

চমৎকার। কাল রাত্রে যে জিনিসগুলো কিনেছি সেগুলো রাখার একটা জায়গা দরকার। আমার হোস্টেল মোটেই সেফ নয়। আমি ওগুলো আজ যে-কোন সময়ে এখানে পৌঁছে দেব। তুই বাড়ি থেকে কোথাও যাস না। পুলিশের পক্ষে এতদূর চিন্তা করা সম্ভব নয়। সুদীপ, তোর কাছে আর কত টাকা আছে? টাকাগুলো সঙ্গে নিয়ে ঠাকুরপুকুরে যাবি।

সুদীপ হাত বাড়িয়ে খামটা বিছানা থেকে তুলে নিল, বেশ কয়েক হাজার আছে।

কল্যাণের চোখ বড় হল, তুই ওভাবে টাকাগুলো ফেলে রেখেছিস?

সুদীপ বলল, কী হয়েছে তাতে! এ বাড়িতে ডেকে না আনলে চোর আসে না।

কথাটা শুনে একমাত্র জয়িতাই শব্দ করে হাসল। কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার?

সুদীপ মাথা নাড়ল, ছেড়ে দে। আনন্দ, তুই ব্যাপারটা আর একবার খুলে বল।
 
মাস দুয়েক আগে আনন্দর হোস্টেলের একটি ছেলে হঠাৎ অসুস্থ হয়। সামান্য জুর। টুকিটাকি ট্যাবলেট খেয়েছিল ছেলেটি। জুর কমছিল কিন্তু অস্বস্তি ছিল। সন্ধ্যার পর জুব বাড়তে শুরু করে। ওটা এমন অবস্থা যখন লোকে ডাক্তার ডাকার কথা ভাবে কিন্তু হাসপাতালে যাওয়ার কথা চিন্তাও করে না। রাত দশটা নাগাদ ছেলেটির পেটে ব্যথা শুরু হল এবং বমি-বমি ভাব এল অথচ বমি হচ্ছিল না। তখন ছেলেরা হোস্টেলের ডাক্তারকে খবর দিল। সব হোস্টেলেই যেমন, এখানেও ভদ্রলোকের চিকিৎসা নিয়ে ঠাট্টা চালু আছে। ঘোড়া ছাড়া কেউ ওঁর ওষুধে সুস্থ হয় না। কিন্তু বৃদ্ধ ভদ্রলোক খুব যত্ন করে দেখলেন। কিছু কিছু লক্ষণ ম্যালেরিয়ার হলেও সব মিলছে না। তিনি জ্বর এবং বমি কমাবার ওষুধ দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। কিন্তু তাতেও কোন কাজ হচ্ছিল না। বাড়তে বাড়তে জ্বর চারে পৌঁছে গেল। এবং সেইসঙ্গে বমির ভাবটা বাড়ল। কাছেই মেডিক্যাল কলেজ। ভদ্রলোক একটা বমি বন্ধ এবং পেট ব্যথা সারানোর ওষুধ ইঞ্জেকশনে পুরে বলেছিলেন, মনে হচ্ছে এতে কমবে। আধঘণ্টা অপেক্ষা করি। তারপর প্রয়োজনে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে আনন্দও সেই ঘরে ছিল। অসুস্থ ছেলেটি ভদ্র ব্যবহারের জন্যে সবারই প্রিয়। কিন্তু ইঞ্জেকশনটা পুশ করার পরই অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল। ছেলেটির সমস্ত শরীরে লাল লাল দাগ ফুটে উঠল। তার জ্বর কমতে লাগল হু-হু করে। হাসপাতালে পৌঁছবার আধঘণ্টা বাদেই সে মারা গেল। হোস্টেলের ছেলেদের ধারণা হয়েছিল ব্যাপারটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। বমি এবং ব্যথার ইঞ্জেকশনে কেউ মারা যায় না। হাসপাতাল থেকে ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া হল রক্তচাপে হৃত্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে—এই কারণ দেখিয়ে। ছেলেরা বৃদ্ধ ডাক্তারের ওপর হামলা করেছিল। তিনি সমস্ত দায়িত্ব অস্বীকার করেছিলেন। ওই দুটো ওষুধের মিশ্রণ যে কোন মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর নয়। দরকার হলে তিনি আদালত পর্যন্ত যেতে রাজী হয়েছিলেন। আনন্দর খুব খটকা লেগেছিল। সে পরদিন বৃদ্ধ ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করেছিল। মৃত্যু এবং ছেলেদের আক্রমণে ভদ্রলোক তখন দিশেহারা। আনন্দ একা তার সামনে বসে জিজ্ঞাসা করেছিল, এই রকম ইঞ্জেকশন আপনি আগে কখনও দিয়েছিলেন।

বৃদ্ধ ডাক্তার মাথা নেড়েছিলেন, সারাজীবন, হাজার হাজার। কিন্তু কেন এমন হল এবার বুঝতে পারছি না।

আপনি ঠিক কি ইঞ্জেকশন দিয়েছিলেন?

ডাক্তার ইঞ্জেকশন দুটোর নাম বললেন। হঠাৎ আনন্দর মাথায় প্রশ্নটা এল, ডাক্তারবাবু, আপনি বলুন তো, ওই ইঞ্জেকশন দুটো জেনুইন ছিল কিনা? আজকাল শুনেছি জাল ওষুধ বাজারে বেরিয়েছে।

বৃদ্ধ ডাক্তারকে হতভম্ব দেখাল, তাই যদি হয় তাহলে আমি কি করব?

আপনার ইঞ্জেকশনগুলো কি স্যাম্পেল হিসেবে পেয়েছেন?

না। ফোনে যখন ছেলেটির অসুখের কথা বলা হল তখন তোমাদের ওখানে যাওয়ার সময় দোকান থেকে কিনেছিলাম। এ বাবদ বিল করলে তোমাদের হোস্টেল থেকে টাকা দিয়ে দেওয়া হয়।

কোন্ দোকান থেকে আপনি কিনেছিলেন?

ডাক্তার নাম বললেন। দোকানটাকে দেখেছে আনন্দ। মাঝারি দোকান। সে ইঞ্জেকশন দুটোর নাম লিখে নিয়ে সোজা দোকানটায় হাজির হয়েছিল। মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক ছিলেন দোকানে। দুটো ফাইল কিনল সে। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আপনারা ওষুধ কেনেন কোত্থেকে?

কেন? ভদ্রলোক সন্দিগ্ধ চোখে তাকালেন।

না, আমি জানতে চাইছি! সরাসরি কোম্পানি থেকে কিনে আনেন?

না। হোলসেলারের কাছ থেকে।

কথা বাড়ায়নি আনন্দ। ওখান থেকে সোজা প্রফেসর চ্যাটার্জীর গবেষণাগারে চলে গিয়েছিল। প্যাথলজিস্ট এই মানুষটি আত্মভোলা। আনন্দকে খুবই স্নেহ করেন। তাকে বিস্তারিত বলেছিল সে। ভদ্রলোক বাক্সসুদ্ধ ওষুধদুটো নিয়ে দেখেটেখে বললেন, তোমার এমন সন্দেহ হল কেন? ব্যাচ নম্বর পর্যন্ত দেওয়া আছে। যা যা আইনে দরকার তার সবই ছাপা আছে। জাল ভাবার কোন কারণ দেখছি না।

আনন্দ এও বলেছিল, হয়তো কোন কারণ নেই। কিন্তু এই দুটো দেওয়ামাত্র সমস্ত শরীরে চাকা চাকা লাল দাগ ফুটে উঠবে কেন? কেন মনে হবে রক্ত জমে যাচ্ছে চামড়ায়? আমার বিশ্বাস রক্তচাপ বাড়িয়ে দেবার কারণ ওটা। পোস্টমর্টেম করলে বোঝা যেত।
 
প্রফেসর চ্যাটার্জীর নির্দেশমত বিকেলবেলায় সুদীপকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হয়েছিল আবার। এর মধ্যেই তিনি পরীক্ষা করে রাখবেন। গিয়ে দেখলে চ্যাটার্জী খুব উত্তেজিত। মুখোমুখি হওয়ামাত্র জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় কিনেছ এইগুলো? ইটস ডেঞ্জারাস, রিয়েল ডেঞ্জারাস।

আনন্দ সুদীপের দিকে তাকাল। প্রফেসর বললেন, দুটো ওষুধ ওদের কোম্পানি তৈরি করতে পারে। কারণ বমির ওষুধটাতে আর যাই থাক বমি বন্ধ হবার কোন উপকরণ নেই। ব্যথারটাতেও তাই। যারা তৈরি করেছে তারা ম্যানুফ্যাকচারিং কস্ট ষাট ভাগ কমাতে পেরেছে। এই ওষুধ পুশ করলে কার যদি উপকার হয় তাহলে সেটা সম্পূর্ণ মানসিক। কিন্তু স্বতন্ত্রভাবে এই ওষুধ পেশেন্টের ক্ষতি করবে না। কোন খারাপ লক্ষণও দেখা যাবে না। ফলে এটা জাল কিনা তা বোঝার কোন উপায় রইল না। কিন্তু মুশকিল হল, ওই দুটো ওষুধ মেশালে যে রি-অ্যাকশন হবে তা মারাত্মক। সরাসরি রক্তে অ্যালার্জি শুরু হয়ে যাবে। শরীরে তার চাপ বাড়বে। এবং সেইসঙ্গে রক্ত দানা বাঁধতে শুরু করবে। এ অন্যায়, ভীষণ। অন্যায়। ডাক্তাররা না জেনে পাপের অংশীদার হচ্ছেন। ইট শুড বি স্টপড়, রাইট নাউ। আমি তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। এক্ষুনি পুলিশকে ইনফর্ম করে ওই দোকানের এই সব ওষুধ সিজ করানো উচিত। প্রফেসর খুব দ্রুত কথা বলছিলেন।

সুদীপ বলল, কিন্তু ওই ওষুধগুলো অন্য দোকানেও নিশ্চয়ই পৌঁছেছে। একটা দোকান থেকে নিয়ে কি লাভ হবে? বন্ধ করতে হলে সোর্সটাকেই আটকানো দরকার।

অফকোর্স। আই মাস্ট রাইট। সরকারকে আমি ডিটেলস দিয়ে লিখব। ওদের তো জাল ওষুধ বন্ধ করার একটা ডিপার্টমেন্ট আছে। কিন্তু তার আগে থানায় যাব। ওরা ইমিডিয়েটলি দোকানটা বন্ধ করুক। তোমরা আমার সঙ্গে যাবে? প্রফেসর উঠে দাঁড়ালেন।

ওরা প্রফেসরের সঙ্গী হয়েছিল। ও সি সবকথা শান্তভাবে শুনলেন। তারপর বললেন, দুটো ওষুধ একসঙ্গে মিশিয়ে শরীরে ঢোকাবার কি দরকার? আলাদা আলাদা ভাবে দিলেই তো হয়।

প্রফেসর থতমত হয়ে গেলেন, মানে? ওষুধগুলো তো জাল।

ওসি বললেন, এ ব্যাপারে আমরা তো অনভিজ্ঞ মশাই। আপনার অভিযোগ উপযুক্ত দপ্তরে করতে হবে।

সেকি! পুলিশ জাল ওষুধের কারবার বন্ধ করবে না? ওই ওষুধ শরীরে ঢোকালে কোন কাজ হয় না।

কিসে কাজ হয় বলতে পারেন? কোন কিছুতেই কাজ হয় না। আপনি ডায়েরি করুন। আমি ওই দোকান থেকে এই দুটো ওষুধ সিজ করে অথরিটির কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওরা অ্যানালিসিস করে যদি প্রমাণ পায় তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সব কিছুর একটা নিয়মকানুন আছে মশাই। ধরুন চোখের সামনে দেখলেন একটা লোককে কেউ খুন করল, আপনি তৎক্ষণাৎ তার ফাসি দিতে পারবেন? আপনারা ডায়েরি করে যান, তারপর যা ব্যবস্থা নেবার আমি নেব।

প্রফেসরকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে সুদীপ বলেছিল, এ তো ঠাণ্ডা মাথায় গণহত্যা! ও সি-র কথা শুনে মনে হল একশ মাসে এক বছর। কি করা যায়?

আনন্দ বলেছিল, কিছু করার নেই একথা আমি বিশ্বাস করি না।

ওরা খোঁজ নিতে আরম্ভ করেছিল। ওই দোকানটি ওষুধ কেনে কোত্থেকে? যারা ওষুধ এদের বিক্রি করে তারা তা কার কাছ থেকে পায়? শেষ পর্যন্ত বড়বাজারের সত্যনারায়ণ পার্কের পাশে একটা রাস্তার হদিশ পেয়েছিল ওরা। আনন্দ তখন ব্যাপারটা নিয়ে আর এগোতে চায়নি। কারণ ওদের সেই পরিচিত ওষুধের দোকানটি পাঁচ দিন বন্ধ থাকার পর আবার স্বাভাবিকভাবে চালু হয়েছে। সেই সময় ওই ঠিকানায় পৌঁছে কোন লাভ হত না। বরং বিপদের সম্ভাবনাই থাকত। যারা জাল ওষুধের কারবার করে তারা নিশ্চয়ই নিরীহ মানুষ হবে না। এবং তার প্রমাণও পেয়েছিল ওরা। কেউ বা কারা প্রফেসরকে টেলিফোনে হুমকি দেয়, যদি তিনি জাল ওষুধ নিয়ে বেশি মাথা ঘামান তাহলে যে কোনদিন তাকে শেষ নিঃশ্বাস নিতে হবে। সেদিনই খবরের কাগজে জাল ওষুধ বাজারে শীর্ষক একটি সংবাদ বেরিয়েছে। টেলিফোনটি পাওয়ার পর প্রফেসর সাহস হারিয়ে ফেললেন। তিনি এ ব্যাপারে কথাবার্তা বন্ধ করলেন। পশ্চিম বাংলায় যে কোন সাড়াজাগানো ঘটনার পরিণতি যা হয় এক্ষেত্রেও তাই হল, দুদিনেই লোকে বিস্মৃত হল, ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে যেতে তাই দেরি হল না।

কিন্তু এই ঘটনাটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে চারজনেব। বড়বাজার মানেই অসৎ মানুষের ডেরা নয়। সেখানে নিরীহ, ভদ্রমানুষ প্রচুর আছেন। কিন্তু মতলববাজ ব্যবসায়ীর সংখ্যা কম নয়। আনন্দর ধারণা গ্রামের একজন জোতদারের শোষণক্ষমতার চেয়ে লক্ষ গুণ ক্ষমতাবান হল এখানকার পুঁজিপতি অসৎ ব্যবসায়ীরা। ওই একটি অঞ্চল সমস্ত পূর্বদেশে শুধু অর্থনীতি নয়, মানুষের বেঁচে থাকার সামান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করছে। রাইটার্সে সরকার আছেন ঠিকই কিন্তু একটি অদৃশ্য শাসনব্যবস্থা এখান থেকেই চালু আছে। সাতষট্টি থেকে বাহাত্তর—সারাদেশ যখন তোলপাড় তখন সাধারণ মানুষের প্রাণ গিয়েছিল সিঁথি কিংবা কসবায় কিন্তু বড়বাজারে একটাও বোমা পড়েনি। পুঁজিপাতের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ থাকলে সেটাই তো স্বাভাবিক ছিল।
 
সুদীপ বলল, আমাদের জানাশোনার মধ্যে একটি প্রাণ অকারণে শেষ হয়েছিল। কিন্তু আর একজন এই জাল ওষুধের শিকার হয়েছে আমি জানি না। এসব কেউ বন্ধ করবে না। আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় বৃথাই আমরা মাথা ঘামাচ্ছি। শরীরের একটা অংশে যদি পচন ধরে সেটা কেটে বাদ দিয়ে দেহটাকে বাঁচানো যায়, কিন্তু যে দেহের সর্বত্র পচন সেখানে কোন্টা বাদ দিবি? যেদিকে তাকাবি কোরাপশন! ট্রাফিক পুলিশ থেকে সরকারী অফিসার হাত বাড়িয়েই থাকে। খাবার ওষুধ এমন কি মানুষ স্বপ্নেও ভেজালে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। যদি দশ বছর বয়সের ছেলেমেয়েগুলোকে রেখে বাকি সব সিটিজেন অফ ইন্ডিয়াকে সমুদ্রে ফেলে দিয়ে আসা যায় তাহলে হয়তো পরবর্তী প্রজন্ম সঠিক সমাজব্যবস্থা গড়ে নিতে পারবে।

আনন্দ হেসে ফেলল, তুই যেমন এই কথা বলছিস তেমনি দেশের কিছু কিছু মানুষ এই অসঙ্গতি দেখতে পাচ্ছেন। আমরা শুধু তাদের আলস্যকে বিরক্ত করব। এই সব মানুষকে কিন্তু তুই সমুদ্রে ফেলছিস না?

কি বলতে চাইছিস?

আচ্ছা ধর, আমার মা। কোন রাজনীতি বোঝেন না, প্যাচ পয়জারে নেই, তিনি চান আমি সুস্থ থাকি, দুবেলা নিশ্চিন্তে জীবন অতিবাহিত করতে পারি। তার জন্যে আমার একটা ভাল চাকরি কিংবা ব্যবসা চাই। তিনি নিশ্চয়ই চাইবেন না যে আমি ব্যবসায় অসৎ মানুষকে ঠকাই কিংবা ফাঁকি দিয়ে চাকরি করে কর্তৃপক্ষকে ডোবাই। কিন্তু তিনি চাইবেন খাটি খাবার, ওষুধে অন্ধ-নির্ভরতা। এই মানুষটিকে তুই বর্জন করবি কোন যুক্তিতে? আর এইরকম মা-মাসী অথবা বোনের সংখ্যাই এই দেশে বেশি। পুরুষেরা যারা অর্থের জন্যে বাইরে বেরিয়ে তাল রাখতে পারছে না তারাই বাধ্য হচ্ছে অসৎ উপায় অবলম্বন করতে। দশ জন অন্ধের সঙ্গে তোকে এক ঘরে কয়েক বছর রাখলে তোর নিজেরই লজ্জা করবে চোখ চেয়ে দেখতে। তুই তখন চোখ বন্ধ করে অন্ধ সেজে সহজ হবি। চারপাশে লোকে যখন বেআইনি পথে জীবনযাপন করছে তখন নিজের অজান্তেই মানুষ তাই করে ফেলে। বেআইনটাই আইন হয়ে দাঁড়ায়।

আনন্দ থামতে জয়িতা বলল, তাহলে তুই বলছিস পুরুষরাই কোরাপটেড, মেয়েরা নয়।

তা বলিনি। তবে একথা ঠিক মেয়েদের স্থির থাকার পার্সেন্টজ নব্বই ভাগ। এবং তার কারণ আছে। আমাদের দেশে মেয়েরা বাড়ির বাইরে টাকা রোজগার করতে আসছে বড় জোর চল্লিশ বছর। মার কাছে শুনেছি কলেজে পড়ার সময় মেয়েরা অধ্যাপকের পেছন পেছন ক্লাসে ঢুকত বেরুতে। সেটা তো সাতান্ন আটান্ন সালের কথা। দীর্ঘদিন গৃহবন্দী থাকায় মেয়েদের নিজেদের আচরণ সম্পর্কে সচেতনা তৈরি হয়েছে। একটি পুরুষের চেয়ে একটি শিক্ষিত মহিলা অনেক বেশি ডিগনিফাইড়, নিজের সম্ভ্রম বজায় রাখতে অনেক বেশি সচেষ্ট। ওই পুরনো সংস্কারেই বাইরের মানুষের সংস্পর্শে এলে ওঁরা একটা পর্দা ফেলে রাখেন। জীবিকার প্রয়োজনে আজ মেয়েদের বাইরে আসতে হচ্ছে। একই অভাবী অবস্থায় দুজন কর্মচারী পাশাপাশি কাজ করলে দেখা যাবে দশজনের মধ্যে আটজন পুরুষ যেখানে ঘুষ নিচ্ছেন সেখানে হয়তো দশজনের মধ্যে দুজন মহিলা ঘুষ নিতে পারেন। আমি এখনও বিশ্বাস করি এই দেশে যদি কখনও বিপ্লব আসে, যদি সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন হয় তাহলে মেয়েরাই সেটা করবে। এখনও সততা শব্দটাকে ওরাই বাঁচিয়ে রেখেছে। অতএব সুদীপ, তোর সঙ্গে আমি একমত নই। আমাদের চার জনের পক্ষে এই দেশের ছবিটা পালটে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা ধাক্কা দিতে পারি। এই ধাক্কার কাঁপুনিটা সাধারণ মানুষের মনে পৌঁছানো দরকার। হয়তো হাতেগরম ফল পাওয়া যাবে না, কিন্তু কে বলতে পারে এটাই বীজ হয়ে দেখা দেবে না এক সময়। তবে চারটে ঘটনা ঘটনোর আগে কেউ যেন আমরা ধরা না পড়ি। ধরা পড়ার সুযোগ আছে এমন ঝুঁকি যেন না নিই। এবং যদি ধরা পড়ি তাহলে আদালতে আমরা কেউ উকিলের সাহায্য নিয়ে মিথ্যে বলব না। আদালতকে স্পষ্ট বলব আমরা কি করতে চেয়েছি কেন চেয়েছি।

কল্যাণ বলল, আগে ধরা পড়ি তারপর ওসব ভাবা যাবে।

সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, তোর এখনও এদেশের আদালতের ওপর বিশ্বাস আছে?


জয়িতা হাত তুলল, আমরা কিন্তু বারংবার পুরোনো তর্কে ফিরে যাচ্ছি। আমাদের প্রোগ্রামটা নিয়ে কথা এগোচ্ছে না। আমরা কি বড়বাজারেই প্রথম অ্যাকশন করব?

কল্যাণ বলল, আমার মনে হয় আগে রেসকোর্সটা টার্গেট করা উচিত।

আনন্দ মুখ ফেরাল, কেন?

কল্যাণ এবার সোজা হয়ে বসল, রেসকোর্সটা মোস্ট ডেঞ্জারাস, অন্তত আমাদের সামাজিক অবস্থায়। প্রথম কথা, বিশাল জায়গা খোদ শহরের বুকে ফেলে রাখা হয়েছে। কলকাতায় এত স্পেস ক্রাইসিস অথচ কতকগুলো অর্থবান সেটাকে দখল করে রেখেছে মানুষকে বধ করতে। স্পোর্টস না ছাই! হাজার হাজার মধ্যবিত্ত গরীব মানুষকে বড়লোক হবার লোভ দেখিয়ে ওখানে ডেকে নিয়ে গিয়ে নিঃস্ব করে ছেড়ে দেওয়া হয়। সরকার চোখের সামনে এই শোষণ দেখেও নির্লিপ্ত কারণ তারা শতকরা চল্লিশ ভাগ ট্যাক্স পাচ্ছেন। আমি একদিন রেসকোর্সে গিয়েছিলাম ব্যাপারটা দেখতে। অন্তত নব্বই ভাগ গরীব মানুষ এই লোভের শিকার হয়েছেন। একটা রেসে দশটা ঘোড়া দৌড়াচ্ছে। যে কোন একটা জিতবে। অর্থাৎ যে টাকা পাবে সে বাকি নজনের লাগানো টাকার একটা অংশ পাচ্ছে। যারা টাকা দিচ্ছে তারা ওই নজনের টাকার সামান্য অংশ বিজয়ীকে দিয়ে বাকিটা হাতিয়ে নিচ্ছে। হিসেব করলে দেখা যাবে দশ টাকা যদি রেসুড়েরা খরচ করে তার চার টাকা নেয় সরকার, চারটাকা রেসকোর্স আর দুটাকা পায় বিজয়ীরা। আর এই দুটাকা রোজগার করতে তাদের দুশো টাকা বেরিয়ে যায়। এই শোষণযন্ত্রের চাপে গরীব আরও গরীব হচ্ছে। হাজার হাজার সংসার তার শিকার হচ্ছে। আর আশ্চর্য ব্যাপার জানিস, রেসকোর্সে দেখলাম অল্পবয়সী ছেলেদের ভিড়। ওই বয়সেই তাদের লোভের স্বাদ দেওয়া হয়েছে। সরকার জানেন ব্যাপারটা। আইন কর্তাদের সুবিধে দিচ্ছে। এইটা বন্ধ করা দরকার। স্পোর্টসের নাম করে মানুষ মারার এই যন্ত্রটাকে অকেজো করে দেওয়া উচিত।

আনন্দ বলল, আমি তোর সঙ্গে একমত। কিন্তু রেসকোর্স বন্ধ করা সোজা ব্যাপার নয়। ওদের সিস্টেমটা ব্যাপক। প্যারাডাইসের মতো চারটে বোম ফেলে বন্ধ করা যাবে না। ব্যাপারটা আমি যেভাবে ভেবেছি তাতে কিছুটা সময় দরকার। সেদিক দিয়ে কিছুটা কাজও এগিয়েছে। আমি জানি কথা বলে কোন কাজ হবে না। তবু কথা বলব। টেলিফোনেই। ওদের সুবুদ্ধির কাছে আবেদন করব। এবং নাকচ হওয়া মাত্র সেটা খবরের কাগজে জানিয়ে দেব। সারা দেশে একটা টেনশন তৈরি হোক। কিন্তু তার আগে আমাদের আর একটি কঠিন কাজ করা দরকার। সেইটে ওই জাল ওষুধ বন্ধ করা। আমি মনে করি দুটো কারণে এটাই আমাদের প্রাথমিক কাজ হওয়া উচিত। এই মিশ্রিত ওষুধ মানুষকে মেরে ফেলছে, এককভাবে কোন উপকারেই আসছে না। দ্বিতীয়ত, এই ঘটনা পরবর্তীকালে আমাদের সম্পর্কে আতঙ্ক তৈরি করতে সাহায্য করবে। এখন কিভাবে আমরা কাজটা করব?
 
ওরা আলোচনা করল। কাজের কথায় এসে গেলে সুদীপ খুব সিরিয়াস। কল্যাণের একটু তর্ক করা অভ্যেস। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত পৌঁছে গেল ওরা। এতক্ষণ এই ঘরে কেউ আসেনি। হঠাৎ শ্রীহরিদাকে দেখা গেল। তার হাতের ট্রেতে চায়ের কাপ এবং বিস্কুট। কল্যাণ হেসে বলল, যাক, আমি ভেবেছিলাম তোদের বাড়িতে এসবের কোন ব্যবস্থা নেই।

জয়িতা বলল, আমি কাউকে চা দিতে বলিনি। ইনফ্যাক্ট দিতে চাইনিও।

কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, কেন?

তার কথা বলা শেষ হওয়ামাত্রই শ্রীহরিদা ট্রে নামিয়ে রেখে ঘোষণা করল, সাহেব বেরিয়ে যাচ্ছেন। তোমাকে একবার দেখা করতে বলল।

সুদীপ অবাক হয়ে জয়িতাকে জিজ্ঞাসা করল, ওকে বললে কথা বুঝতে পারে?

আমাদের কথা পারে। চা খেয়ে নে। ওর বলার ভঙ্গিতে উষ্ণভাব ছিল না।

কল্যাণ বলল, রাগ করিস না। আমার খুব দূর-সম্পর্কের এক আত্মীয়েব বাড়িতে রাত আটটায় যেতে হয়েছিল একবার। খুব বড়লোক, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে থাকেন। কথা বলছি এমন সময় ভদ্রমহিলা বললেন, আটটা বেজে গেছে, এখন নিশ্চয়ই তুমি কিছু খাবে না? বলাব ভঙ্গিটা এমন যে পেটে প্রচণ্ড খিদে থাকা সত্ত্বেও হ্যাঁ বলতে পারিনি।

সুদীপ বলল, আমি হলে বলতাম আজ্ঞে না, খিদে পেয়েছে খেতে দিন। আসলে তোর মধ্যেও এক ধরনের মেকি ভদ্রতা কিছুটা ঢুকে আছে।

বাজে কথা বলিস না। কল্যাণের গলা উত্তপ্ত হল, কথাটা শোনামাত্র ভদ্রমহিলাকে আমার দয়া করতে ইচ্ছে করল। এই সব বড়লোকগুলোকে আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না।

এটাও এক ধরনের কমপ্লেক্স।

তুই কিন্তু গায়ে পড়ে পেছনে লাগছিস সুদীপ!

জয়িতা উঠে পড়ল, আমি মাঝেমাঝে ভাবি আমরা চারজন একসঙ্গে মিললাম কি করে? স কিছুর পেছনে যে কারণ থাকে একথাটা বোধ হয় সব সময় সত্যি নয়।

আনন্দ মাথা নাড়ল, বেসিক বোধটা এক বলে আমরা তাড়াতাড়ি কাছাকাছি হয়েছি এবং আমি তোদের বলব ওইটেকে বাঁচিয়ে রাখতে। নইলে তোরা জয়েন্ট দিতে পারতিস, আই এ এস হতে পারতিস, এসব করার দরকার ছিল না। ভারতবর্ষের একটি ছাপ মারা নাগরিক হতে তোদের বেশি কষ্ট করতে হত না।

হঠাৎ আবহাওয়াটা থমথমে হয়ে গেল। সুদীপ হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ তুলল। জয়িতা বেরিয়ে এসে কয়েক পা হাঁটতেই রামানন্দ রায়কে দেখতে পেল। স্যুট-টাই পরে তিনি একটু অধৈর্যভঙ্গিতে অপেক্ষা করছেন। জয়িতা মুখোমখি হওয়ামাত্র জিজ্ঞাসা করলেন, এভরিথিং অলরাইট?

অভ্যস্ত প্রশ্নটি শুনে জয়িতার ঠোঁটে হাসি ফুটল, ডেকেছ?

না, মানে, তুমি আজ বেরুবে?

দেখি।

তোমার মা খুব আপসেট।

তাতে আমার কি?

আই নো, আই নো জয়, তুই আমাদের ঘৃণা করিস এটা বলেছিস। কিন্তু আমি তো কাউকে ঘৃণা করতে পারি না। কেউ একটা অন্যায় করলে আমি পালটা আর একটা অন্যায় করে নিজেকে ঠিক রাখি। আচ্ছা চলি। রামানন্দ রায় হঠাৎ কথা শেষ করে বেরিয়ে গেলেন। জয়িতা ওঁর চলে যাওয়া দেখল। এবং এই মুহূর্তে হঠাৎ তার বুকে একটা বাষ্প গুড়ি দিচ্ছিল। সে ওপাশের দরজাটার দিকে তাকাল। সীতা রায় কি করছেন সে জানে না। হার হারানো, না সান্যালের জন্যে তিনি আপসেট কে জানে! ব্যাপারটা ভাবতেই তার বুক থেকে বাষ্পটা মিলিয়ে গেল।



সুদীপ আনন্দ আর কল্যাণ য়ুনিভার্সিটির স্টপেজে নামামাত্র মনে হল কানের পর্দা ফেটে যাবে। ফুটপাত দখল করে মাইকে ছাত্ৰ-কর্মচারীরা চিৎকার করে যাচ্ছে। কাছাকাছি দুটো দল পরস্পর পরস্পরকে দোষী প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। ওরা উলটো ফুটপাতে চলে এল। সুদীপ বলল, দু-দলের ডায়ালগ এক হয়ে কানে ঢুকছে?

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, কোন ডিফারেন্স পাচ্ছিস?

না।

এদের আন্দোলনটা কিসের জন্যে?

দুদলই পরস্পরকে দোষী করছিল। এক দল উপাচার্যের কীর্তিকলাপ বন্ধ করতে লাগাতার ধর্মঘটের ডাক দিচ্ছিল। আর একদল এদের বামফ্রন্টের দালাল হিসেবে চিহ্নিত করছিল। ওরা লক্ষ্য করল প্রতিটি বক্তাই উত্তেজিত, হাত-পা নেড়ে বিশ্বরাজনীতি প্রসঙ্গ নিয়ে আসছিল বক্তৃতাকে জ্বালাময়ী করতে। এবং তখনই ঠিক মাঝখানে একটা বোমা ফাটল সশব্দে। সঙ্গে সঙ্গে দুদলে প্রচণ্ড হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেল। চিৎকার চেঁচামেচি। ভাইসব যাবেন না, কমরেড ভয় পাবেন না। পিঁপড়ের লাইন থেকে আঙুল সরিয়ে নেবার পর তারা যেমন আবার একত্রিত হয় তেমনি কিছুক্ষণ পরে আবার বক্তৃতা আরম্ভ হল। এবার দুপক্ষই পরস্পরকে বর্বর আক্রমণের জন্যে দায়ী করতে লাগল। আনন্দরা নড়েনি। পুরো ঘটনাটা দেখার পর আনন্দ বলল, ওরা কি করছে বল তো? কি ইস্যু নিয়ে এইভাবে নিজেদের শক্তি সময় অপচয় করছে? এতে কার কি লাভ হবে? আর ওরা তা জেনেই এইটে করছে। একটা নিরাপদ আন্দোলনের মধ্যে না থাকলে নেতৃত্ব হাতছাড়া হয়ে যাবে। দাদারা যা বলেছে তাই করছে ওরা। দেশ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ দূরের কথা, সহপাঠীদের জন্যও ভাবনা নেই। বোমাটা কায়দা করে এমন জায়গায় ফাটাল যাতে কারোর গায়ে আঁচ না লাগে। এসব দেখলে বমি আসে।

আনন্দকে প্রচণ্ড উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। সুদীপ বলল, তাড়াতাড়ি চল, হাতে সময় নেই।
 
১৬.
সত্যনারায়ণ পার্কের ঠিক উলটোদিকে কয়েকটা সরবতের দোকান আছে। বেশ সাত্ত্বিকভাবে দোকানদাররা গুছিয়ে বসেছে। আনন্দ এদের কথা শুনেছিল। সামান্য সিদ্ধি মিশিয়ে এই রাবড়ির চেয়ে লোভনীয় স্বাদের সরবতের জন্যে জম্পেশ ভিড় জমেছে।

কলেজ স্ট্রীট থেকে হাঁটতে হাঁটতে হ্যারিসন রোড ধরে ওরা যতই পশ্চিম দিকে এগোচ্ছিল ততই কলকাতার একটা সর্বভারতীয় চেহারা নজরে পড়ছিল। এই পথে অনেকবার যাতায়াত করেছে কিন্তু আজকের মত খুঁটিয়ে কখনও দ্যাখেনি। ব্যাপারটা একটা সময় এমন দাঁড়াল যে কল্যাণ না বলে পারল না, আমরা কোথায় এসেছি? রাজস্থান না উত্তরপ্রদেশে?

আনন্দ বলল, তুই প্রাদেশিকতাদোষে দুষ্ট। উলটোদিক দিয়ে ভাবতে পারছিস না কেন? এইসব পরিশ্রমী মানুষগুলো তাদের দেশ জমি ছেড়ে কলকাতায় এসে ধীরে ধীরে জায়গাটাকে শুধু নিজের মত করেই নেননি, এমনকি ভৌগোলিক চরিত্র বদলে দিয়েছেন। তুই এখানকার মাটি কিংবা আকাশের দিকে তাকা, দেখবি কোন বাংলাদেশী গন্ধ নেই। এটা চীনেরাও পারেনি।

সত্যনারায়ণ পার্কের সামনে দাঁড়িয়ে কল্যাণ চারপাশে খুঁটিয়ে নজর করছিল। দোকানপাট, বাড়িঘর এমন কি মানুষজনের হাঁটাচলার মধ্যে বাংলাদেশ নেই। বাইরে থেকে যারা আসে তারা সাধারণত নতুন দেশের অনেকটা গ্রহণ করে স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়। কিন্তু বিরাট একটা এলাকাকেই নিজেদের মত পালটে নেওয়া কম কথা নয়। অত্যন্ত ক্ষমতাবান না হলে সেটা সম্ভবও নয়।

এই সময় আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, কল্যাণ, সরবত খাবি?

কল্যাণ মাথা নাড়ল, খালি পেটে সরবত জমবে না। সকাল থেকে সলিড কিছু পড়ছে না। শালা জয়িতাটাও লিকুইড খাওয়াল!

হঠাৎ আনন্দ ওর দিকে ঘুরে দাঁড়াল, তোর খুব খেতে ভাল লাগে, না?

হ্যাঁ ভাই। কল্যাণ সরাসরি মাথা নাড়ল, আমি খেতে চাই, প্রাণভরে ভাল খাবার খেতে চাই। এক এক সময় ভাবতাম যখন চাকরি করব তখন খুব ভাল ভাল খাবার খাব। জেলখানায় তো যা দেবে তাতে আমার আশা কোনদিন পূর্ণ হবে না। আমার পকেটে যদি তিনশো টাকা থাকত তা হলে একটা সাধ মিটিয়ে নিতাম।

কি সেটা? এবার আনন্দ চারপাশে নজর বোলাচ্ছিল। সত্যনারায়ণ পার্কের পাশ দিয়ে রাস্তাটা চলে গেছে ভেতরে। ওখানেই ঢুকতে হবে তাদের। ঠেলা রিকশায় বেশ মন্থর হয়ে আছে পথটা।

কল্যাণ বলল, আমার কাছে একটা লিস্ট আছে। কলকাতার কোথায় কোন্ দোকানে কি পাওয়া যায়। সেই সব খাবারের কি বৈশিষ্ট্য। অনেক কষ্টে কমিয়ে কমিয়ে ষাটটা দোকান বেছেছি। অ্যাভারেজে পাঁচ টাকা খরচ করলে তিনশোয় হয়ে যাবে। বেলা দশটায় শুরু করলে রাত দশটায় শেষ করা যাবে। খুব বেশি বলে মনে হচ্ছে এই ইচ্ছেটা?

মোটেই না। চল্ হাঁটা যাক। ফেরার সময় ওই মিষ্টির দোকানটায় প্রথমে ঢুকব। কল্যাণ নামটা পড়ল। তারপর উত্তেজিত হয়ে বলল, আরে, এই দোকানটার নাম ছিল আমার লিস্টে। দারুণ মিষ্টি করে ওরা! বেনারসের ঘরানায় তৈরি ওদের একটা মিষ্টির নাম, যাঃ শালা ভুলে গেছি। হাঁটতে হাঁটতে আনন্দ বলল, তুই আজ খাবার নিয়ে খুব উত্তেজিত হচ্ছিস!

উত্তেজিত? মোটেই না। মন খারাপ হয়ে যায়। তুই কেন মনে করিয়ে দিলি? আসলে খাবারের বিষয়ে বেশি আলোচনা হতেই আমার কি রকম যেন হয়। আচ্ছা আনন্দ, তুই আজ অবধি যা যা খাবার খেয়েছিস তার মধ্যে বেস্ট কোষ্টা?

মনে নেই, বিশ্বাস কর। ভাল কিছু খেলেই মনে হয় এটাই সবচেয়ে ভাল।

তোকে একটা কথা বলি। আমি তো খুব বেশি কিছু খাইনি। কিন্তু ফুলকপি দিয়ে পোস্তর একটা তরকারি করেন মাতৃদেবী। তুলনা হয় না। দ্রুত এগিয়ে আসা একটা ঠেলার আক্রমণ শেষ মুহূর্তে সামলে নিল কল্যাণ। আনন্দ দেখল এখনও ওর মুখে তৃপ্তির চিহ্ন। ওর মনে হল এই খাদ্যবস্তুটা কল্যাণকে ওর মা নিশ্চয়ই সহজে দিতে পারেন। অন্তত শীতকালে। সে কল্যাণকে আর এ বিষয়ে কথা চালাতে উৎসাহিত করল না। এই কল্যাণকে সে এতকাল দ্যাখেনি। কোন কোন দুর্বল জায়গায় স্পর্শ পেলে বোধ হয় মানুষ এমন ক্রেজি আচরণ করে ফেলে।
 
এই রাস্তায় কোন বঙ্গসন্তান চোখে পড়ল না। হাঁটুর ওপরে কেঁচা তুলে বাণিজ্যে বের হচ্ছেন ব্যবসায়ী, মাথায় ঘোমটা তুলে স্কুলাঙ্গী মহিলারা বাজারে যাচ্ছেন। একটা পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা ভাই, মেডিসিনকা দোকান কিধার হ্যায়?

কোন্‌সা মেডিসিন?

এইবার অসুবিধেতে পড়ল আনন্দ। তার হিন্দির দৌড় খুব বেশি নয়। তাছাড়া ফ্যাক্টরির বদলে সে দোকান শব্দটা বলে ফেলেছে। চেষ্টা করে সে বলল, যাহা মেডিসিন বানাতা হ্যায়।

লোকটা হাসল, ও টিমার কোম্পানি! সিধা যাকে বাঁয়া গলি। মোহনলালজী কা কোম্পানি!

আনন্দ দোকান ছেড়ে এগিয়ে বলল, লোকটা টিমার কোম্পানি বলল কেন? ওই ঠিকানায় তো অন্য কোম্পানির নাম পেয়েছি। টিমার মানে কি? আর মোহনলাল লোকটা তার মালিক?

হবে কিছু একটা। তুই তো নম্বর জিজ্ঞাসা করলে পারতিস?

তুই লক্ষ্য করিসনি। এখানকার বাড়ির গায়ে নম্বর পর পর নেই। ফ্যাক্টরি তো ছোট নয়, তাই চেনা সহজ। জায়গাটা ভাল করে লক্ষ্য কর। এই সময় একটা ট্রাক প্রায় রাস্তা জুড়ে সামনের দিক থেকে এগিয়ে আসছিল। ওরা কোনরকমে একটা রকে উঠে দাঁড়াতে দেখতে পেল ট্রাকটা ওষুধের বাক্সে বোঝাই। ট্রাকের ওপরে দাঁড়িয়ে দুটো লোক তীব্র স্বরে চেঁচাচ্ছে যাতে সামনের রাস্তা পরিষ্কার হয়। ঠেলা এবং রিকশার কল্যাণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না যদিও। কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, আমরা যা সন্দেহ করছি তাই যদি হয় তাহলে কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার বলতে হবে।

কেন? আনন্দ ট্রাকটার ওপরে সাজানো ওষুধের বাক্সগুলোকে লক্ষ্য করছিল। খুবই নিরীহ চেহারার, আর পাঁচটা যেমন হয়। কল্যাণ বলল, এই রকম বিশ্রী জায়গায় ওরা কোম্পানি করেছে কারণ এর চেয়ে ভাল জায়গা পায়নি। ব্যবসাটা যদি খুব চালু হত তাহলে ওরা স্বচ্ছন্দে সেই জায়গায় উঠে যেত যেখানে ট্রান্সপোর্ট প্রব্লেম নেই। বেআইনি মাল এত ঝামেলার মধ্যে কেউ ট্রাকে চাপিয়ে নিয়ে যায় না।

তুই যা ভাবছিস তা সত্যি হতে পারে। কিন্তু নিজের কানেই শুনলি ওই দুটো ওষুধ হোলসেলারকে সাপ্লাই করে বড়বাজারের এই ঠিকানার কোম্পানি। আনন্দ ট্রাকটাকে এগিয়ে যেতে দেখল।

কল্যাণ মাথা নাড়ল, এইটেই আমার কাছে গোলমাল লাগছে। যে দুটো ওষুধের এরা সাপ্লায়ার সে দুটো বাজারে খুব চালু। এর যদি সেটা বাজারে ছাড়ে তাহলে অরিজিন্যাল কোম্পানির ব্যবসা মার খাবেই। তখন তারা ছেড়ে দেবে? জাল কোম্পানিকে ধরিয়ে দিতে উঠে পড়ে লাগবে তারা। খুব গোলমেলে ব্যাপার আনন্দ।

যদি হোলসেলার আর এই কোম্পানি একই কনসার্ন হয়?

আনন্দের প্রশ্নে একটু থিতিয়ে গেল কল্যাণ। তারপর বলল, আমরা আধ ঘণ্টার চেষ্টাতেই হোলসেলারের ওখান থেকে জানতে পারলাম কোত্থেকে সাপ্লাই আসছে। এত সহজে খবর বেরিয়ে যাওয়ার বিজনেস করবে বলে মনে হয় এরা?

ওষুধের হোলসেল মার্কেটে গিয়ে চমকে গিয়েছিল ওরা। বড় বড় কোম্পানির নিজস্ব বিক্রয়ের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু কলকাতার পশ্চিমের এই বাজার থেকে পূর্বাঞ্চলের বেশির ভাগ ওষুধের দোকানগুলো রসদ সংগ্রহ করে। ওই ওষুধ দুটোর সঙ্গে আরও কিছু ওষুধের বিরাট লিস্ট করে ওরা দোকানে দোকানে ঘুরেছিল। বমির ওষুধটা মার্কেটে সাপ্লাই ছিল না সেই মুহূর্তে। ওদের অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল। সেই সময় একটা টেম্পোতে নতুন মাল এল। বাক্স দেখে বোঝার উপায় নেই ভেতরে কি ওষুধ আছে। ব্যাচ নম্বর ইত্যাদি কোড তাদের জানাও ছিল না। কিন্তু তার কিছুক্ষণ বাদেই বলা হল ওষুধ এসে গেছে। টেম্পোটা তখনও দাঁড়িয়ে ছিল। আনন্দ টেম্পোর হেলপারের সঙ্গে কিছুটা খোসগল্প করে জেনেছিল ওরা আসছে বড়বাজারের এই ঠিকানা থেকে। সেখানে বিশাল কারখানা আছে। কল্যাণ বলছে এত সহজে খবর বেরিয়ে যাবে এমন কাজ ওরা করবে না। কিন্তু একটু আগে ট্রাকের ওপর ওষুধের বাক্সগুলোর গায়ে যে নম্বর পড়ল তা ওই টেম্পোর ওষুধের বাক্সের নম্বরের সঙ্গে মিলে গেছে। তাহলে সেই হেলপার ছেলেটির কথা মিথ্যে নয়।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top