What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected গর্ভধারিণী - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

পর মধ্যরাত্রে ডায়মন্ডহারবার রোডের একটি প্রমোদনিবাসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড হয়ে গিয়েছে। শেষরাত্রে এই অগ্নিকাণ্ডের খবর আমাদের অফিসে আসে। দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখি দমকল আপ্রাণ চেষ্টা করছে আগুন নিবিয়ে ফেলতে, কিন্তু ততক্ষণে প্রচুর ক্ষতি হয়ে গেছে। পুলিশসূত্রে জানা যায় একাধিক ব্যক্তি ডাকাতির উদ্দেশ্যে ওই প্রমোদনিবাসে প্রবেশ করে এবং নির্বিচারে প্যারাডাইসের মালিক এবং দুজন কর্মীকে হত্যা করে আগুন ধরিয়ে দেয়। প্যারাডাইস নামক ওই প্রমোদনিবাসটি সরকারের অলক্ষ্যে মধুকুঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলে গ্রামবাসীদের অভিযোগ। ওই অগ্নিকাণ্ডের ফলে ঠিক কতজন অগ্নিদগ্ধ কিংবা আহত হয়েছেন তা জানা যায়নি। কারণ সেইরাত্রে যারা মধুকুঞ্জের মধু আস্বাদন করতে গিয়েছিলেন তারা কেউ প্রকাশ্যে আসতে চাইছেন না। অনুমান সংখ্যাটি দশের কম নয়। ডাকাতরা তাদের কাজ শেষ করে নির্বিঘ্নে গা-ঢাকা দেয়। প্রকাশ, সেই রাতেই ডায়মন্ডহারবার রোডের একটি পেট্রলপাম্প থেকে গাড়ি চুরি হয় এবং অনুমান ডাকাতরা সেই গাড়ি ব্যবহার করেছে। পুলিশ সন্দেহ। করছে ডাকাতরা স্থানীয়। কিন্তু কি উদ্দেশ্যে এই ডাকাতি তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে জানা যায় ডাকাতদের সংখ্যা বেশি ছিল না, এবং তারা প্রত্যেকেই তরুণ। প্যারাডাইসের ক্রিয়াকলাপ আশেপাশের গ্রামের মানুষ কখনই ভাল চোখে দ্যাখেনি। তথাকথিত ডাকাতি হোক বা না হোক এই কাজ প্যারাডাইসকে চিরকালের জন্যে খুঁড়িয়ে দিয়েছে বলে অনেকেই খুশী, যদিও মৃত্যুর খবরে কেউ আনন্দিত হননি। পুলিশ বলেছে, অপরাধীরা দু-একদিনের মধ্যে ধরা পড়বেই কারণ তদন্ত খুব দ্রুত এগোচ্ছে।

ধীরে ধীরে কনকনানিটা স্থির হল। কোথাও তার কথা লেখা হয়নি। একটি মেয়েও যে ওই দলে ছিল তা রিপোর্টে বলা হয়নি। কেউ কি পুলিশকে এই খবরটা দেয়নি? ক্রমশ নিজেকে বেশ হালকা মনে হচ্ছিল তার। কিন্তু তারপরেই মনে হল এটা একটা চাল হতে পারে। পুলিশ তাদের নিশ্চিন্ত করতে চায় বলেই খবরটা বেমালুম চেপে গেছে। শেষের লাইনটা খুব অস্বস্তিকর। পুলিশ কি কোন সূত্র খুঁজে পেয়েছে? যদি ওরা আনন্দর বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে যায় তাহলে! যে হালকাভাবটা এসেছিল তা আচমকাই চলে গেল। কাগজটাকে ভাজ করে ঠোঁট কামড়াল জয়িতা। কাল সারা দিন এবং রাত্রে এই ব্যাপারটা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামায়নি সে। অথচ কাগজটা পড়ামাত্র ওইসব চিন্তা মাথা তুলল। সে চা শেষ করে কাগজটা নিয়ে সুদীপের ঘরের দিকে পা বাড়াল।

শুয়ে শুয়ে সুদীপ সিগারেট খাচ্ছিল। জয়িতাকে দেখে উঠে বসল, এখনই বের হব?

তোর যা ইচ্ছে। আমি তোকে যাওয়ার কথা বলতে আসিনি।

আমি একটু বাদে বের হব। মালগুলো নিয়ে তো ঘোরা যাবে না, এগুলো এখানে রাখা যাবে? মানে তোদের যদি কোন অসুবিধে না হয়?

তোদের তোদের করছিস কেন?

আই অ্যাম সরি। তোর বাবা মা ফিরেছেন?

বাবা এসেছে।

আমার কথা জানেন?

হ্যাঁ। বললেন, তার কোন আপত্তি নেই তোর এখানে থাকতে, যদি আমার বিবেক পরিষ্কার থাকে। আজকের কাগজ। জয়িতা কাগজটা ছুঁড়ে দিল। দিয়ে দেখল সুদীপের মাথার একদিক বেঢপ ফুলে উঠেছে।

কাগজের ভাজ খুলতে খুলতে সুদীপ বলল, তোর বাবা তো দেখছি চমৎকার ভদ্রলোক। কখন যে এরা ঘ্যাম ব্যবহার করে আর কখন যে জালি হয়ে যায় তা শালা অনুমান করাই মুশকিল। আই বাপ, একি রে, একদম হেডলাইন। সুদীপ এবার গম্ভীর হয়ে কাগজটা পড়া শুরু করল। শেষ লাইন অবধি খুঁটিয়ে পড়ে কাগজটাকে সরিয়ে রেখে সে মন্তব্য করল, কোন কাজ হল না।

মানে?

আনন্দ চেয়েছিল এইসব ঘটনা থেকে কাগজগুলো এমন মাতামাতি করবে যে সাধারণ মানুষ ধরতে পারবে ব্যাপারটা। একটার পর একটা ঘটনা ঘটাবো আমরা আর সাধারণ মানুষের অসাড় হয়ে যাওয়া বোধটায় টান লাগবে। এই সো-কলড ডেমোক্রেসিতে অর্থবান মানুষদের ব্যভিচার করাই সবচেয়ে সুবিধে। যত রকমের অন্যায় করেও আইনের দোহাই দিয়ে তারা পার হয়ে যায়। ঠিকঠিক পয়েন্টে ঘা দিয়ে ওদের মুখোশ খুলে দিলে মানুষ নিজেরাই এগিয়ে আসবে। কিন্তু পরশুর ঘটনাটা কাগজ কিভাবে লিখেছে দেখেছিস? যেন আমরা সত্যি ডাকাতি করতে গিয়েছিলাম! কি ডাকাতি করলাম তা লেখেনি!

তুই একটা কথা ভুলে যাচ্ছিস।

কি কথা?

আমরা সবে একটা ঘটনা ঘটালাম। পুলিশ কিংবা সাংবাদিকদের কোন সুযোগ নেই জানার, কারা করেছে কি জন্যে করেছে? আমরা কোন সূত্র রেখে আসিনি। কাগজে কোথাও লেখেনি আমার কথা, আই মিন দলে মহিলা ছিল সেইকথা। অর্থাৎ হয় পুলিশ চেপেছে নয় ওরা টোটাল ইনফরমেশন পায়নি। কিন্তু আরও কয়েকটা ঘটনা ঘটলে জনসাধারণ জেনে যাবেই। রিপোর্টটায় পরিষ্কার বলা আছে প্যারাডাইসে মধুচক্র ছিল। পাবলিক নিশ্চয়ই এই ব্যাপারটায় খুব কষ্ট পাবে না।

জয়িতার কথা শেষ হওয়ামাত্র সুদীপ শুয়ে পড়ল। জয়িতা অবাক হল, কি ব্যাপার?

ঘুম পাচ্ছে। খুব টায়ার্ড লাগছে।

একটা অ্যাকশন করেই–!

না, নিজের সঙ্গে লড়াই করে। তুই বুঝবি না। আমাকে যখন যেতে হবে ডেকে দিস।

তোর যতক্ষণ ইচ্ছে ততক্ষণ থাক।

বাঃ, হঠাৎ এই বাড়ির ওপর তোর কর্তৃত্ব এসে গেছে মনে হচ্ছে! আনন্দ ফোন করবে, বলবি বিকেলের আগে আমি ফ্রি হব না, অবশ্য কোন জরুরী ব্যাপার থাকলে আলাদা কথা। সুদীপ পাশ ফিরে শুতেই জয়িতা উঠে এল। এই মুহূর্তে ওর মনে হল সুদীপ ঠিক আগের মতন নেই। কাল রাত্রে যাকে কাঁদতে শুনেছে সে এখনও সুদীপকে ছেড়ে যায়নি, কিংবা আর একটা ব্যাপার হতে পারে—আমরা যেসব মানুষকে বাইরের জীবনে নিয়মিত দেখে থাকি, যাদের সঙ্গে বন্ধু হয়ে অথবা কর্মসূত্রে মিশি তাদের একটাই চেহারা আমাদের কাছে ধরা পড়ে। তারা যখন নিজের শোওয়ার ঘরে ফিরে যায় তখন তাদের আচরণ সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণাই থাকে না। সুদীপকে তো বাইরে থেকেই সে দেখে এসেছে। ছটফটে, টিজ করতে ভালবাসে, কোন কিছুই গায়ে মাখে না, চক্ষুলজ্জার ধার ধারে না। এইরকম ছেলেও হয়তো বাড়িতে চুপচাপ গম্ভীর, একা একা থাকতেই ভালবাসে। জয়িতা মাথা নাড়ল, কখনও কখনও একাকী নিজেকেই বিরক্তিকর মনে হয়। সুদীপ দুই ভুমিকায় থেকে নিজেকে ব্যালেন্স করে।

রামানন্দ রায় বাইরে নেই। কাগজটাকে টেবিলের ওপর রেখে পা বাড়াবার আগেই টেলিফোন বাজল। রিসিভার তুলে সাড়া দিতেই আনন্দর গলা শুনতে পেল, নম্বর জিজ্ঞাসা করছে। জয়িতা বলল, তোকে ডিজিট চিনিয়েছিল কে? মাসিমা? ঠিক শিখিয়েছিলেন। বল্ কি বলবি।

আনন্দ একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল, তারপর বলল, পারিস। শোন, সুদীপ কাল ঠিকঠাক ছিল তো?

ঠিকঠাক মানে? জয়িতার গলাটা করকরে হয়ে উঠল আচমকা।

কোন অসুবিধের কথা জিজ্ঞাসা করছি।

অসুবিধের সম্ভাবনা থাকলে আমি ওকে ডেকে আনতাম না।

ওইভাবে কথা বলছিস কেন?

জয়িতা নিজেকে সামলালো। কেন যে ফট করে রাগ হয়ে যায়। সে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলবার চেষ্টা করল, ওয়েল, ঠিক আছে, কি বলবি বল।

আনন্দ চট করে কথা বলল না। যেন সময় নিয়ে কি বলবে স্থির করল, জয়িতা, তোকে একটা কথা শেষবার জিজ্ঞাসা করছি, আমাদের সম্পর্কে কোন অসুবিধে আছে?

না। নেভার। হঠাৎ এই প্রশ্ন?

তাহলে চটজলদি ভুল বুঝছিস কেন?

আই অ্যাম সরি। আসলে একটু আগে বাবার সঙ্গে–, মেজাজটা ভাল ছিল না। তারপর তুই যখন জিজ্ঞাসা করলি, ঠিকঠাক শব্দটা উচ্চারণ করলি তখন, রিয়েলি আই অ্যাম সরি। হ্যাঁ, সুদীপ ভালই ঘুমিয়েছে। একটু আগে কথা বলেছি। ও আবার ঘুমাচ্ছে।

তোর বাবা কি টের পেয়েছেন?

সুদীপকে বাবা দেখেছেন।

দূর, সুদীপের কথা বলছি না, টাকাটার কথা!

ওটা মায়ের ডিপার্টমেন্ট। শী হ্যাজ নট কাম ব্যাক।

ও। আমি সকালে বেরিয়ে যাচ্ছি। অ্যারেঞ্জমেন্ট করে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে। ইউ ক্যান মিট আফটার দ্যাট। কোন অবস্থাতেই আজ ঠাকুরপুকুরে যাওয়া হবে বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু কাল যেতেই হবে। সুদীপ আজ কোথায় থাকবে তোরা ঠিক করে নে। আর সন্ধ্যেবেলায় বসুশ্রী কফিহাউসে মিট করবি। অ্যারাউন্ড সিক্স। সুদীপকে বলবি ও যদি পারে যেটা যোগাড় করবে বলেছে যেন করে রাখে। হয়তো আজই দরকার হবে। ও কে?

কি আছে। কল্যাণ কোথায়?

ওর বাড়িতেই। কাগজ দেখেছিস?

হ্যাঁ। আনন্দবাজার।

টেলিগ্রাফটা দেখিস। স্বর্গে কি কি হত তার ডিটেলস ছেপে দিয়েছে। ওরা মন্তব্য করেছে যে বা যারাই কাজটা করুক তারা আইনের চোখে অন্যায় করেছে, কিন্তু গ্রামবাসীরা আশীর্বাদ বলে যদি মনে করে তাহলে দোষ দেওয়া যায় কি? দ্যাটস অল, তাই না? আনন্দর গলায় খুশীর সুর। সকাল থেকে এই প্রথমবার ভাল লাগল জয়িতার।
 
ট্রামে উঠেই সুদীপ টের পেল। দুজন ভদ্রলোক খবরটা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। একজন বললেন, পুলিশ লাইসেন্স দিয়েছে ওরা মধুচক্র চালিয়েছে, এতে দোষ কিসে? কলকাতায় তো কয়েক হাজার প্রস কোয়ার্টারস আছে তা নিয়ে তো হৈ-চৈ করেন না। বেশ্যাবৃত্তি কি আইনসম্মত?

ওই বৃত্তিটা আইনসম্মত কিনা সে বিষয়ে যাত্রীদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা গেল। কারোর কাছে ব্যাপারটা স্পষ্ট নয়। কেউ একজন বলল বেআইনি হলে ওরা বিধান রায়ের সময়ে মিছিল করে গিয়েছিল কি করে? সুদীপ লক্ষ্য করল, কি চটপট মানুষ প্রসঙ্গ থেকে অনেক দূরে সরে যায়। শেষ পর্যন্ত একজন বলল, না মশাই, ডাকাতরা যে দু-তিনজনকে খুন করেছে তাতে আমি একটুও দুঃখিত নই। মধুচক্রে সেদিন যারা ছিল, মানে যারা আহত হয়েছে তাদের নাম কাগজগুলো এড়িয়ে গেছে, কেন?

আর একজন বলল, আপনি এই ডাকাতি নরহত্যাকে সাপোর্ট করছেন?

এবার লোকটি জবাব না দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল। প্রথম লোকটি বলল, যাই বলুন, আমার সব পড়েটড়ে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা পলিটিক্যাল অথবা পুরোনো ঝগড়া। ওই প্যারাডাইসের অ্যান্টিপার্টি হয়তো করেছে।

পলিটিক্যাল কথাটা বললেন কেন? আপনি জানেন ওই অঞ্চলে কোন উগ্রপন্থী কার্যকলাপ বন্ধ। তাছাড়া যারা এতকাল উগ্রপন্থী হিসেবে চিহ্নিত ছিল তারা এখন নরম হয়ে গেছে।

কিন্তু ডাকাতদের উদ্দেশ্য কি ছিল?

আলোচনা এখন সেই বিষয়ে চলল। আনন্দ যা চাইছে তাই কি হতে যাচ্ছে? আঙুলে কানের পাশের ফোলা জায়গাটা স্পর্শ করল সুদীপ। জয়িতার চাপে ওর বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা টেডভ্যাক নিয়ে ওষুধ লাগাতে হয়েছে। ব্যান্ডেজটা নিশ্চয়ই খুব দৃষ্টিকটু দেখাচ্ছে। কিরকম, তাকে কি ডাকাত ডাকাত মনে হবে কারও? ও যদি এখন এই মুহূর্তে চিৎকার করে বলে, দেখুন মশাই আমিই একজন ডাকাত যাদের কথা আপনারা বলছেন তাহলে এই ট্রামের লোকগুলো কি তাকে বিশ্বাস করবে?

ধর্মতলায় নেমে হাঁটতে লাগল সুদীপ। এখন প্রায় এগারোটা। অফিসযাত্রীদের ভিড় এখন চারপাশে। সাধারণত দশটায় অফিসগুলো চালু হওয়ার কথা। কিন্তু ট্রামে-বাসে বারোটা পর্যন্ত অফিস-টাইম শব্দটা চালু থাকে। সুদীপের সামনেই একটি মধ্যবয়সী লোক হাতে রেক্সিনের ছোট ব্যাগ নিয়ে হাঁটছিল। এগুলোকে টিপিক্যাল কেরানিব্যাগ বলা হয়। ওপর থেকে টিফিনবাক্সটার সাইজ পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে। পৃথিবীর সমস্ত সময় যেন ওর সামনে পড়ে আছে এমন ভঙ্গিতে লোকটি হাঁটছিল।

বহুতল বাড়িটার সামনে এসে সুদীপ লক্ষ্য করল লোকটি সেখানেই ঢুকছে। সামনেই লম্বা কাউন্টার। সেখানে কেউ নেই। লিফটের সামনে বিরাট লাইন। লোকটি লাইনের শেষে দাঁড়াতেই সুদীপ তাকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা রেইড করে যারা গয়নাগাটি নিয়ে আসেন তাদের ডিপার্টমেন্টটা কোথায়?

লোকটি ছোট চোখে তার দিকে তাকাল। তারপর বলল, লাইনে দাঁড়ান, বলে দেব।

রাক্ষসের পেটেও বোধহয় এত জায়গা থাকে না, লিফটে দাঁড়িয়ে মনে হল সুদীপের। ভাগ্যিস সব ফ্লোরে থামছে না! হঠাৎ সুদীপ শুনল, নেমে ডানদিকে। বাইরে বেরিয়ে আসামাত্র দরজা বন্ধ হয়ে গেল। কয়েক পা এগিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল তার। পুরো ধর্মতলাটা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। দোতলা বাসগুলোকেই ছোট দেখাচ্ছে, মানুষজন লিলিপুট। অনেক উঁচু থেকে দেখলে বোধহয় এইরকম সুন্দর দেখায়।

খুঁজে খুঁজে অফিসটাকে বের করল সুদীপ। অফিসার ভদ্রলোক চমৎকার। বসতে বলে প্রশ্ন করলেন, অবনী তালুকদার আপনার কে হন?

উনি আমার বাবা। আমার মা মারা গিয়েছেন। আপনারা মায়ের গহনাগুলো নিয়ে এসেছিলেন। বাবা বলছেন তিনি সেগুলো এখনও ফেরত পাননি। কথাটা সত্যি কিনা জানতে এসেছি।

বাবার কথা অবিশ্বাস করছেন কেন?

করার কারণ আছে।

দেখুন, এটা অবনীবাবু এবং সরকারের ব্যাপার। এক্ষেত্রে আপনি থার্ড পার্টি। আপনাকে আমরা আইনত জানাতে পারি না। ওঁর অ্যাসেসমেন্ট কোথায় হয় জানেন?

না, উনি আমাকে বলেননি। কিন্তু সোনাগুলো তো আমার মায়ের।

হতে পারে। তবে যেহেতু ওইসব আনডিসক্লোজড ওয়েলথ অবনীবাবুর বাড়িতে পাওয়া গিয়েছে এবং সত্যিকারের কোন মালিক যদি প্রমাণ দেখাতে না পারেন তাহলে আমরা অবনীবাবুর সম্পদ হিসেবেই ধরব। আয়কর আইনে যা যা ব্যবস্থা নেবার তা নেওয়া হবে। তবে আমি আপনাকে আনঅফিসিয়ালি জানাচ্ছি, কিছু কিছু জিনিস আমরা ফিরিয়ে দিয়েছি। ডিটেলস জানতে চাইলে আপনাকে পরিচয় দিয়ে দরখাস্ত করতে হবে।
 
অফিসারের কাছ থেকে বাবার যেখানে অ্যাসেসমেন্ট হয় সেখানকার ঠিকানা নিয়ে সুদীপ বাইরে বের হল। কয়েকতলা ভেঙে নির্দিষ্ট তলায় আসতেই ও থমকে দাঁড়াল। অবনী তালুকদার হেঁটে যাচ্ছেন। তার সঙ্গে ফাইল বগলে একটা লোক। লোকটা যেন কিছু চাইছে আর অবনী ঘাড় নেড়ে খুব সম্মতি দিয়ে যেতে যেতে একটা ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লেন। দরজার ওপরে টাঙানো ফলক থেকে নাম পড়ল সুদীপ। গতকাল অবনী তালুকদারকে যে অবস্থায় সে দেখে এসেছিল তাতে একবারও মনে হয়নি আজ উনি সুস্থ হয়ে মামলা করতে আসতে পারেন। একটু বাদেই সেই ফাইলবাহক বেরিয়ে এল। ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লোকটি জিজ্ঞাসা করল, আজকে কেস আছে?

সুদীপ মাথা নেড়ে না বলতে লোকটি বিরক্ত হল, তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

আমার বাবা ভেতরে গেছেন তাই।

বাবা? অবনীবাবু আপনার বাবা?

হ্যাঁ।

অহো, নমস্কার নমস্কার। আপনাদের কেসটা খুব কঠিন তবে ছাড় পেয়ে যাবেন। আমাদের এই সাহেবের মনটা নরম। একটু চেপে ধরলেই হয়ে যাবে। আমি তো বললেই ফাইল এনে দিই। লোকটি কৃতার্থ হয়ে হাসল।

আমাদের বাড়িতে যে সার্চ হয়েছিল তার ফাইলটা কোথায়? সরল গলায় জিজ্ঞাসা করল সুদীপ।

ও বাবা, ওই ফাইল সাহেবের আলমারিতে। সাহেব ছাড়া কেউ হাত দেয় না। বসুন না। কথা বলতে বলতে আর একজনকে দেখেছিল, লোকটি এবার সেইদিকে ছুটল।

সুদীপ একটু ইতস্তত করল। তারপর আলতো করে দরজায় চাপ দিতেই অবনী তালুকদারের গলা শুনতে পেল, না রায়সাহেব, সৎভাবে কেউ বেঁচে থাকতে পারে না। আপনি একটু রাজী হয়ে যান দেখবেন অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

আপনি কি বলতে চাইছেন?

উই ক্যান ওয়ার্ক টুগেদার। অবনী তালুকদারের কণ্ঠস্বর রহস্যময়।

অফিসার কিছু বলতে গিয়ে গলা তুললেন, কে, কে ওখানে?

সুদীপ দরজা ফাঁক করে ভেতরে ঢুকতেই ভদ্রলোক উত্তেজিত হলেন, না বলে ঢুকলেন কেন? কে আপনি?

সুদীপ দেখল অবনী তালুকদারের মুখ সাদা হয়ে গেছে। এমন অবাক বোধহয় জীবনে হননি তিনি। সে হেসে বলল, আপনি বলে দিন আমি কে।

অবনী ঠোঁট চাটলেন, আমার ছেলে। তার গলার স্বর ফ্যাসফেসে শোনাল।

ও। অফিসার ইঙ্গিত করলেন একটা চেয়ার দেখিয়ে বসার জন্যে। কিন্তু তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালেন অবনী তালুকদার, স্যার, আজকে আমি চলি। আমাকে আর একটা ডেট দিন।

কেন? হঠাৎ ডেট চাইছেন? আমি কেসটা আর ঝুলিয়ে রাখতে চাই না।

প্লিজ স্যার! তুমি—তুমি, একটু বাইরে দাঁড়াবে?

কেন? সুদীপ হাসল।

ঠিক আছে স্যার। আমি পরে দেখা করব। কাগজপত্র তুলে অবনী তালুকদার বাইরে বেরিয়ে যেতেই সুদীপ তাকে অনুসরণ করল। সেই জানলাটা যেখান থেকে সুন্দর কলকাতা দেখা যায় সেখানে। পোঁছে অবনী উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন করলেন, এখানে এসেছ কেন? কি চাই?

আপনিই আসতে বলেছিলেন।

আমি? কই কখন? হোয়াট ড়ু ইউ ওয়ান্ট?

আমার মায়ের গহনা।

উঃ, সেটা এদের কাছে আছে, এদের কাছে চাও।

তাই তো চাইতে এসেছি।

ওয়েট। তুমি ওখানে গিয়ে কি বলবে?

যা জানি।

কি জানো? ড়ু য়ু নো আমার সবচেয়ে বড় শত্রু তুমি?

এ ব্যাপারে আমি কি করতে পারি। আমি আপনার কাছ থেকে কোন সাহায্য চাই না। আমার মা-বাপের বাড়ি থেকে যে সম্পত্তি নিয়ে এসেছিলেন তা-ই চাইছি। কারণ টাকার আমার খুব প্রয়োজন। আপনি চিন্তা করবেন না।

এতদিন তো টাকার দরকার ছিল না। ছাত্র হিসেবে তোমার যা খরচ তা আমি দেব। তুমি হোস্টেলে গিয়ে থাকে। ব্যাপারটা হচ্ছে তোমার মায়ের গয়না কবে এরা ছাড়বে জানি না। দোজ আর আনডিসাসড ওয়েলথ।

কার?

মানে?

ওসব তো আপনার নয়। আমার মায়ের। আপনার আনডিসকোসড ওয়েলথ হবে কেন?

আমার কাছে পাওয়া গেছে যখন তখন আমার। তোমার মার নাম ওতে লেখা নেই। নট ইভন এনি পেপার। তোমার মায়ের বাবা কোথেকে কিনেছিলেন প্রমাণ নেই।

তার মানে মায়ের সম্পত্তি আপনারই হয়ে যাচ্ছে! চলি।

দাঁড়াও। কত টাকা দরকার তোমার?

অন্যসব ছেড়ে দিচ্ছি। আটটা কুড়ি ভরি ওজনের সাপের দাম কত হবে? কমপক্ষে সোওয়া তিন লক্ষ টাকা। আমাকে এক লক্ষ দিলেই হবে। সুদীপ শাত মুখে বলল।

কি? এক লক্ষ? মামারবাড়ি? ব্ল্যাকমেইলিং? পুলিশে দেব তোমাকে শুয়ার।



মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ। চাপা গলায় বলল সুদীপ। সে দেখছিল কয়েকজন দাঁড়িয়ে পড়েছে ওদের কথাবার্তা শুনতে। কিন্তু এখন ঠিক কি করা যায় তা ওর মাথায় আসছিল না।

অবনী তালুকদার খুব কষ্টে নিজের উত্তেজনা সামলে বললেন, ল্যাঙ্গুয়েজ ল্যাঙ্গুয়েজ শেখাচ্ছ আমাকে! এক হাজারের বেশি এক পয়সা দিতে পারব না। ওই নিয়ে চিরজীবনের জন্যে দূর হয়ে যেতে হবে।

আমি চলি। আপনি যখন সহজে মুক্তি চাইবেন না তখন সেই ব্যাগটার কথাও আমাকে বলতে হবে।

শোন, ঠিক কত হলে চলবে তোমার?

এক লক্ষ।

অত টাকা আমি কোথায় পাব? দেখছ না এরা সব সিজ করে নিয়েছে?

তা হলে লিখে দিন আমার মায়ের গহনাগুলো আপনি নেবেন না। সেগুলোর একটা লিস্ট দিন।

ঠিক আছে। তুমি সামনের রবিবারে দেখা করো।

না, আজ। বিকেল চারটের মধ্যেই টাকা দরকার। কিভাবে দেবেন সেটা আপনার ব্যাপার।

তুমি কাল রাত্রে কোথায় ছিলে?

আপনার জানার কোন প্রয়োজন আছে?

আমি তোমার বাবা। রাগ করে তো অনেক কথাই বলতে পারি। তোমার মা আমাকে কোনদিন শান্তি দেয়নি। ঠিক যে প্লেজার চাই তা ওর পক্ষে দেওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু আমি আমার মত থাকতে চেয়েছি সবসময়। বেশ, চারটের সময় এসো। আমি যা পারব দিয়ে দেব। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু সি ইওর ফেস আফটার দ্যাট!

একা একা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সুদীপের বুকের ভেতরটা কেমন করতে লাগল। একটা যন্ত্রণা, সেটা ঠিক কি কারণে তা সে জানে না, নিঃশ্বাস ভারী করে তুলেছিল। কোন নির্দিষ্ট মানুষের জন্যে নয়, এমন কি নিজের জন্যেও নয়, অদ্ভুত শূন্যতা যে কতখানি ভারী হয়ে যন্ত্রণা ছড়ায় তা এর আগে সে কখনই টের পায়নি। চারটে বাজতে ঢের দেরি, তবু সে বাড়ির দিকে চলল। মায়ের ঘরটা তাকে চুম্বকের মত টানছিল।
 
১৩.
ব্যাপারটা বেশ মজার। সারারাত বাইরে কাটিয়ে সকালে ছেলে আর একজনকে নিয়ে ফিরল কিন্তু এ বাড়ির কেউ সেটা দেখেও দেখল না। বাবা বসেছিলেন রকে, একবার তাকালেন এবং তারপরেই উদাস হলেন। আনন্দ থাকাকালীন এই ঘরে দুকাপ চা এসেছিল। দরজার কাছে শব্দ হচ্ছে শুনে কল্যাণ উঠে গিয়ে দেখেছিল মেজবৌদি যার নাম বিনীতা সংকুচিত হয়ে দুটো কাপ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এবং সেই দেওয়ার দৃশ্যটি বড় বউদি যূথিকা নজর করছে তার দরজায় দাঁড়িয়ে। আশেপাশে কোথাও মা নেই। আনন্দ মা-বাবার সঙ্গে কথা বলতে চায়নি, সে নিজেও আলাপ করিয়ে দেয়নি। সুজন আজকাল প্রায়ই রাত্রে বাড়িতে ফেরে না। প্রথম প্রথম এই নিয়ে চেঁচামেচি হলেও এখন প্রত্যেকের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কল্যাণ কাউকে কিছু না বলে এই প্রথম রাত্রেই বাড়ির বাইরে কাটাল। অথচ কেউ তাকে একটা কথাও জিসা করল না। প্রথমে মজা লাগছিল, শেষ পর্যন্ত মনটা খারাপ হয়ে গেল।

জয়িতা আর সুদীপ চলে গেলে এই ব্যাপারটা সে আনন্দকে বলেছিল। কথাটা শুনে আনন্দ ওকে জিজ্ঞাসা করেছিল, কেউ তোকে খুব জেরা করলে, ধমক দিলে তোর ভাল লাগত?

কল্যাণ বলেছিল, সেই মুহূর্তে কিরকম লাগত জানি না, কিন্তু এটা হওয়ায় এখন মনে হচ্ছে আমি যেন বিদেশে বাস করছি।

আনন্দ বলেছিল, পারিবারিক সেন্টিমেন্টাল অ্যাটাচমেন্টগুলো না থাকলে এইরকম মনে হয়। আমার কথাই ধর, আমি হোস্টেলে আছি। অসুখ করলেও কেউ দেখার নেই। হোস্টেলের অন্য ছেলেরা যে তখন পাশে আসে না তা নয় কিন্তু তাদের ওপর তো আমি জোর করতে পারি না। এইসব করে-টরে-বেঁচেথাকা আর কি! কার লাইন রে?

কল্যাণ হেসে ফেলল, এক জীবনে যার কিছুই করা হয় না।

আনন্দ মাথা নেড়েছিল, কিন্তু এক জীবনে আমরা অনেক কিছুই করতে চাইব।

রাত্তিরে বাড়িতে ফিরে চুপচাপ এইসব কথাই ভাবছিল সে। টাকা থাকলে এই ভারতবর্ষে বসে যে কোন অস্ত্র কেনা যায়। শুধু ঠিকঠাক লোকের কাছে পৌঁছে যেতে পারলেই হল। প্রয়োজনে তারা সেইসব অস্ত্রের ব্যবহারও শিখিয়ে দিতে পারে। তার জন্যে ভাল টাকা দরকার। কিন্তু আনন্দ চাইছে গ্রেনেড, ডিনামাইট আর রিভলভার। যেগুলো সহজে বহন করা যায় এবং যার প্রতিক্রিয়া হয় মারাত্মক, প্রয়োগ করতে দীর্ঘ অনুশীলনের প্রয়োজন হয় না। জয়িতা যে টাকা এনেছে এবং সুদীপ যা ব্যবস্থা করবে তাতে বেশ কয়েকটা অ্যাকশনে অস্ত্রের অভাব হবে না। অবশ্য ততদিন যদি পুলিস তাদের ধবে না ফেলে। প্যারাডাইসের ব্যাপারটা যেরকম নির্বিঘ্নে ঘটে গেল প্রতিবার যে তাই হবে এমন আশা করা ভুল। কিন্তু তার আগে যদি নাড়া দেওয়া যায়, পাথরের মত অনড় মানুষের মনগুলোকে যদি বিচলিত করা যায়–ব্যাপারটা খুব আশাপ্রদ বলে মনে হয় না কল্যাণের কাছে। অতবড় নকশাল আন্দোলন যা পারেনি তারা চারজন বিক্ষিপ্তভাবে সেটা করতে পারবে এমন আশা করা বোকামি। কিন্তু কল্পনা করতে দোষ কি? গ্রেপ্তার এড়িয়ে যদি বুর্জোয়া শোষকদের দুর্গগুলোতে একটার পর একটা আঘাত করা যায় তাহলে হয়তো আগামীকালের জন্যে কটা কাজ আগাম করে যাওয়া হবে। এই রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন চাই, আজ কিংবা আগামীকাল।


আনন্দ বলে পশ্চিমবাংলায় একমাত্র সি পি এম এই কাজটি করতে পারত। তাদের সংগঠন-শক্তি যদি এই কাজে ব্যবহার করা হত তাহলে ফল পাওয়া যেতই। কিন্তু তারা এখন ক্ষমতালোভী এবং সংবিধানের আশ্রয়ে নিরাপদ থাকতে চায়। সুবিধে অনুযায়ী সর্বহারা শব্দটির সীমা বাড়িয়ে বাড়িয়ে লক্ষপতিকেও তারা অন্তর্ভুক্ত করেছে। আর কেউ নয়, কোন রাজনৈতিক দল নয়, একমাত্র দেশের মানুষ যদি এগিয়ে না আসে সক্রিয়ভাবে তাহলে এই সমাজব্যবস্থা অপরিবর্তিত থাকবে। যে দেশে শুধু অর্থবানরাই গণতন্ত্রের সুবিধে ভোগ করতে পারে সে দেশের মানুষ আর কতকাল শুধ দেওয়ালের কোণ খুঁজে যাবে। দিন পালটাবেই কিন্তু কবে সেটাই কেউ জানে না। সুদীপ সেদিন একটু অশ্লীল হলেও সত্যি কথা বলেছিল। পেতে হলে কিছু দিতে হয়। ত্যাগ করতে না জানলে পাওয়ার আশা অর্থহীন। সুদীপ বলেছিল, বাঙালি মল মূত্র এবং বীর্য ছাড়া আজ আর কিছুই ত্যাগ করতে জানে না। কথাটা সত্যি, হয়তো বেশিরকমের সত্যি। আনন্দর কথা অনুযায়ী পরিকল্পিত পথে মানুষের অসাড় হয়ে যাওয়া বোধগুলোকে আঘাত হেনে হেনে সক্রিয় করতে হবে। তার জন্যে যদি এক জীবন খরচ হয়ে যায় কোন আক্ষেপ নেই। চাকরির জন্যে পড়াশুনা এবং বেঁচে থাকার জন্যে চাকরি করা এবং মরে যাওয়ার জন্যে বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না। কিন্তু অস্বস্তি অন্য জায়গায়। প্যারাডাইসকে কেন্দ্র করে যে বিরাট কাণ্ডটি ওরা করে এল তার প্রতিক্রিয়া তো কিছুই হচ্ছে না। শুধু আজ একজনকে বলতে শুনেছে, ভালই হয়েছে, ওসব জায়গা পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়াই উচিত। শুনে খুব ভাল লেগেছিল। কিন্তু লোকটা কথা বলছিল কোন উত্তাপ না নিয়ে। খবরের কাগজগুলোতেও তাদের উদ্দেশ্যটা ছাপা হয়নি। অবশ্য ওরা জানেই না ঘটনাটার পেছনে কি পরিকল্পনা আছে। এ ব্যাপারে আনন্দ কাউকে জানাতে চায়নি। এখন কল্যাণের মনে হল এইটে ভুল হচ্ছে। এদেশের মানুষ নিজেদের যতই বুদ্ধিমান মনে করুক, আসলে তাদের বুঝিয়ে দিলেও তারা বুঝতে চায় না যেখানে সেখানে নীরব থাকা মানে পণ্ডশ্রম। একটা প্যারাডাইস পোড়ানো তখনই মূল্যবান হবে যখন তাই নিয়ে ঢোল পেটানো যাবে।

দরজায় শব্দ হল। কল্যাণ মুখ ফিরিয়ে দেখল মেজবউদি দরজায় দাঁড়িয়ে। সে উঠে বসতেই নিচু স্বরে প্রশ্ন হল, খাবে না?

কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল সরাসরি উত্তর না দিয়ে, সবাই খেয়ে নিয়েছে?

হ্যাঁ। তুমি রাত্রে ফেরনি বলে মা আজও খাবার রাখতে নিষেধ করেছিলেন।

তাহলে আমার খাবার আসবে কোত্থেকে?

আছে।

ভাল। কল্যাণ কথাটা বলতেই বিনীতা ফিরে যাচ্ছিল, সে আবার ডাকল, শোন, তোমার খুব ভাল লাগার কথা নয় এখানে। তাহলে আছ কেন?

বিনীতা একটু থমকে গেল। তারপর মুখ না ফিরিয়েই বলল, কেন, আমি তো ভালই আছি।

কল্যাণ হেসে ফেলল, চমৎকার! আচ্ছা তুমি প্যারাডাইস-এর ঘটনা জানো?

বিনীতা নীরবে মাথা নাড়ল।

তুমি খবরের কাগজ পড়ো না?

না। তারপর সে চলে গেল।

কল্যাণ খুব বিমর্ষ হল। বিনীতারা কি করে জানবে? ওরা যতদিন না জানছে, ওদের ভাবনা যতক্ষণ পালটাচ্ছে ততক্ষণ–!

ঠিক সেই সময় বাইরে একটি গলা শোনা গেল, কি ব্যাপার, সাতসকালে বাড়িটার এই অবস্থা কেন? মা–মা–?

গলাটা মেজদার। একটু হাঁকাহাঁকির পর বাবার কথা শোনা গেল, সে নেই।

নেই মানে? মা কোথায় গেল?

তোর দাদার সঙ্গে তারকেশ্বরে গিয়েছে।

সাবাস! তোমার বাড়ির হালচাল কিরকম! বা

বা কোন জবাব দিল না। মেজদা এবার তার বউকে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকল।
 
একটা প্রাণবন্ত মানুষ যার কোন লক্ষ্য নেই, যে সম্মান আদায় করতে জানে না, ভাবেও না, বাড়িতে ফিরল। মানুষটিকে খুব ভাল লাগছিল কল্যাণের। কিন্তু মা আর দাদা এই মুহূর্তে বাড়িতে নেই তা সে জানত না। হঠাৎ তারকেশ্বরে কেন? এই বাড়িটাই যেন ভারতবর্ষ। কেউ কারও খবর জানে না, জানতে চায় না। কারও সঙ্গে কারও সম্পর্ক নেই। অথচ একই বাড়িতে প্রত্যেকের বাস। খাবারটা আসছে না। যতক্ষণ মেজবউদি কথা তোলেনি ততক্ষণ খিদেটাই ছিল না। কল্যাণ দেখল বড়বউদি যূথিকা যেতে যেতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। চোখাচোখি হতে যূথিকা এগিয়ে এসে দরজায় দাঁড়াল, কি খবর? আজ বাইরে রাত কাটাবে না?

ঠোঁট কামড়াল কল্যাণ। একটা কটু কথা বলার ইচ্ছে সামলে নিল, না।

আজ তোমার ভাগ্যে আর খাবার জুটবে না। মেজকর্তা না এলে জুটতো। কেউ কি তার ভাগ ছাড়ে!

যূথিকা হাসল। তারপর ঘরে পা দিয়ে বলল, অনেকদিন এই ঘরে আসিনি। বসব?

মাথা নাড়ল কল্যাণ। যূথিকার হাতে এখনও ব্যান্ডেজ জড়ানো। কিন্তু প্রসাধনে সুখের আমেজ। খাটের একপাশে পা ঝুলিয়ে বসে যূথিকা বলল, ছোটকর্তার খবর শুনেছ?

কি খবর? কল্যাণ একটু অবাক হল।

পুলিস ধরেছে। আচ্ছাসে প্যাঁদাচ্ছে। বড্ড বাড় বেড়েছিল।

যাঃ! সুজনকে পুলিস ধরবে কেন? ও তো সরকারি দলের লোক।

অত খায় না। তোমার দাদা বলছিল ওকে পার্টি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বেলগাছিয়ার ওয়াগন ব্রেকারদের কাছ থেকে যারা হিস্যা পায় তাদের কাছে টাকা চেয়েছিল, তাই। অল্পে তো মন ভরে না সোনারষ্টাদের। এর আগে নাকি কেস ছিল থানায়, এখন ধরে নিয়ে গেছে।

কেউ জামিন দিয়ে ছাড়াতে যায়নি?

কে যাবে? তোমার দাদা তো খবর শুনে তারকেশরে চলে গেল। বাপের ক্ষমতা জানো। যাক, এইসব ফালতু কথায় আমার দরকার নেই। সেদিন তোমার কথা আমার পিসতুতো বোন বর্ষা বলছিল। অমন সুন্দরী মেয়ে যে কেন দেখা হলেই তোমার কথা বলে তা বুঝি না বাবা! যূথিকা চোখমুখ ঘুরিয়ে কথাগুলো বলে ফিক করে হেসে ফেলল। এবং তখনই দরজায় বিনীতাকে দেখা গেল একটা ডিসে রুটি আর তরকারি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। যূথিকার হাসি চট করে মিলিয়ে গেল, বিনীতা খাবারটা টেবিলের ওপর রেখে বেরিয়ে যাচ্ছিল, যূথিকা ডাকল, এই যে, এখানে তো তোমার ভাসুর নেই, দেওরদের সঙ্গে তো খুব মাখামাখি, তা এখন মুখে বাক্যি নেই কেন?

কি কথা বলব?

অ! মন খারাপ? এতকাল বাদে স্বামী ঘরে এল তাও মন ভাল হল না। তা ভাল হবে কি করে? কাউকে অত মারধর করলে কি মন ভাল থাকে? কিন্তু স্বামীকে খাবার না দিয়ে দেওরকে দিচ্ছ যে বড়! রুটি তো ওই কটাই পড়েছিল!

উনি খেয়ে এসেছেন। বিনীতা আর দাঁড়াল না।

কল্যাণ একমুহূর্ত চিন্তা করল। সুজনের জন্যে সে কখনও কোন টান তেমন বোধ করেনি। এর আগে মাস্তানি করার জন্যে কল্যাণ তাকে এড়িয়েছে যতটা সম্ভব। ও আছে থাকতে হয় বলেই, এইরকম একটা মনোভাব তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কল্যাণ চটপট খেয়ে নিল। খিদেটাকে সে কখনই এড়িয়ে যেতে পারে না। এমন কি এ বাড়ির তরকারির সেই বিদঘুটে স্বাদটাকে পর্যন্ত খেয়াল করল না।

যূথিকা বলল, অত তাড়াহুড়ো কিসের! ধীরে ধীরে খাও। এরকমভাবে গল্প করার সুযোগ তো পাওয়া যায় না। হ্যাঁ, যেকথা বলছিলাম, আজ বর্ষা এসেছিল। তুমি যদি ফার্স্ট ক্লাস পাও তাহলে ওর বাবা তোমাকে আমেরিকায় পাঠাতে রাজী আছেন। আমার পিসেমশাইকে তো জানেনা, টাকার কোন হিসেব নেই। বর্ষার সঙ্গে একটু ইয়েটিয়ে করলেই হয়ে যাবে।

তাতে এ বাড়ির কি লাভ?

এ বাড়ির কথা কে ভাবছে! তোমারই ভাল হবে, বর্ষা তত খারাপ মেয়ে না!

বড় বাজে কথা বলছ।

ইস! তুমি অমন করে বকছ কেন আমাকে? কতদিন পরে তোমার সঙ্গে নিরিবিলিতে একটু কথা বলতে এলাম। মেজ তো ছোটর সঙ্গে ভাব জমিয়েছে। আমার কপাল কেন পোড়া হবে? যেন খুব মজার কথা বলেছে এমনভাবে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল যূথিকা।

খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। কল্যাণ কোন কথা না বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। কলতলায় মুখ ধুয়ে বেরিয়ে আসতেই সে মেজাকে দেখতে পেল।

খালিগায়ে লুঙ্গি পরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছিল, জিজ্ঞাসা করল, কি খবর রে? বাড়িটা ডিপফ্রিজ হয়ে গেল কেন?

কল্যাণ বলল, অনেকদিন বাদে এলে বলে এইরকম মনে হচ্ছে। আমি একটু আসছি।

এত রাত্রে কোথায় যাচ্ছিস?
 
প্রশ্নটা শুনে কল্যাণের ভাল লাগল। এইরকম আন্তরিক গলায় এ বাড়িতে কেউ আজকাল কথা বলে। সে জবাব দিল, থানায়। শুনলাম সুজনকে ধরে নিয়ে গেছে।

সেকি? সে-ই তো এতকাল পাড়ার হিরো ছিল। কি করেছিল সে?

জানি না।

আমি যাব তোর সঙ্গে?

মাথা নাড়ল কল্যাণ, না। অনেকদিন পরে এলে, তুমি এখন রেস্ট নাও।

রাত্রের কলকাতা দিনের চেয়ে অনেক সুন্দরী। আলো-আঁধারিতে মেশা রাস্তার নির্জনতা চমৎকার শান্তি ছড়ায়। রাত হয়েছে, পথের চেহারায় মালুম হল। দু-একটা রিকশা কিংবা অলস মানুষ ছাড়া পথটা পরিষ্কার। বঙ্কিমদার ওষুধের দোকানটাও বন্ধ।

থানা বেশি দূরে নয়। বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে কল্যাণ দেখল বেশ জোরালো আলো জ্বলছে। দুজন কনস্টেবল বারান্দায় দাঁড়িয়ে। তাকে দেখে একজন মোলায়েম গলায় জিজ্ঞাসা করল, কি চাই ভাই?

কল্যাণ বলল, দারোগাবাবুর সঙ্গে দেখা করব।

ও সি সাহেব তো এখন থানায় নেই। কি ব্যাপার বলুন। লোকটি সত্যি বিনীত।

আমার ভাইকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে সেই ব্যাপারে কথা বলব।

ও, ওপাশের ঘরে যান, সেকেন্ড অফিসার আছেন।

থানা সম্পর্কে কত উলটো-পালটা ঘটনা শুনেছিল কল্যাণ, এখন মনে হল সেগুলো সব ঠিক নয়। ভেতরের ঘরে ঢুকে দেখল তিনজন মানুষ তিনটে টেবিলের ওপাশে বসে গল্প করছেন। তাদের সামনে মোটামুটি এই রাত্রেও ভিজিটারস আছে। যে যার কেস নিয়ে কথা বলছেন। তিনজনের মধ্যে যিনি বেশি সক্রিয় তাঁকেই সেকেন্ড অফিসার সাব্যস্ত করল সে। ভদ্রলোক তখন তাঁর সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে আশ্বস্ত করছিলেন, আপনার কোন চিন্তা নেই, আপনি বাড়ি যান, আমরা দেখছি। মানুষটি বিদায় হলে সেকেন্ড অফিসার চেয়ারে হেলান দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে উঁচু গলায় মন্তব্য করলেন, সত্যি, মানুষ কত সমস্যা নিয়ে বেঁচে থাকে! মানুষের কত ঝকমারি! তারপর কল্যাণের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, বলুন ভাই, আপনার কি সমস্যা?

কল্যাণ ওঁর মুখোমুখি হল, আমি শুনলাম আমার ভাইকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে।

ভাই-এর নাম?

সুজন। আমি কল্যাণ।

ও হ্যাঁ, সুজন আমাদের এখানে আছে। ও আপনার কিরকমের ভাই?

নিজের।

পার্টি করেন?

না।

ও থাক না এখানে কিছুদিন। কেন এত ব্যস্ত হচ্ছেন?

আমি জানতে চাইছি ওর বিরুদ্ধে কেসটা কি? ও জামিন পেতে পারে কিনা?

কেস যেমন হয়ে থাকে। মাস্তানদের কেস হাওয়া পালটালেই তৈরি হয়ে যায়। আর জামিন? হ্যাঁ নিশ্চয়ই পেতে পারে। কিন্তু জামিন পেলে ওর ক্ষতি হবে। সুজনও চাইছে না বাইরে বের হতে। অন্তত দিনচারেক। আপনি ওর সঙ্গে কথা বলবেন? যান না, ওপাশেই ওরা আছে। হাত বাড়িয়ে আর একটা দরজা দেখিয়ে দিলেন অফিসার।

কল্যাণ সেদিকে কিছুটা হাঁটার পর খাঁচাটাকে দেখতে পেল। জনা পনেরো বিভিন্ন বয়স এবং চেহারার মানুষ শুয়ে বসে রয়েছে। কেউ কেউ আবার তাস খেলছে! এত রাত্রে সুজন একটা সিনেমা পত্রিকা দেখছিল। তাকে দেখে বিন্দুমাত্র অসুখী মনে হচ্ছিল না। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে বটে, কিন্তু কল্যাণের মনে হল সুজন মোটেই আহত নয়। মাধরের সামান্য চিহ্ন তার শরীরে নেই। চিৎ হয়ে শোওয়া সুজনের একটা হাঁটুর ওপর আর একটা পা দুলছিল। নিঃশব্দে সরে এল কল্যাণ, অফিসার ঠিকই বলেছেন। সুজনের চেহারা এবং ভঙ্গি বলে দিচ্ছে সে মোটেই অসুখী নয়। এই অবস্থায় ওর জমে হবার কোন মানে হয় না।

অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, কি বলল?

কল্যাণ মাথা নাড়ল, ঠিক আছে।

আরে ভাই, আমরা তো চিরকাল পাবলিকের গালাগাল খেয়ে এলাম, কিন্তু মানুষের উপকারও তো কিছুটা করি। সুজন যদি বাইরে থাকত তাহলে ওর অ্যান্টিপার্টি ওকে ছিঁড়ে খেত। শেলটার নেবার জন্যে থানার চেয়ে আর ভাল জায়গা কি আছে। চার পাঁচ দিনে হাওয়া নর্মাল হয়ে গেলে হয়তো ওর অ্যান্টি পার্টি শেলটার নিতে আসবে! কথা থামিয়ে অফিসার বেজে ওঠা টেলিফোনটাকে কবজা করলেন, হ্যালো! হ্যাঁ, ইয়েস স্যার, হ্যাঁ, তিনটে ছেলে আর একটা মেয়ে, একুশ-বাইশ বছর, ও কে স্যার, ঠিক আছে।

চলে যাওয়ার আগে শব্দগুলো কানে যাওয়া মাত্র কল্যাণ শক্ত হয়ে দাঁড়াল। সেকেন্ড অফিসার খানিকক্ষণ পরে রিসিভার নামিয়ে ঘুরে দ্বিতীয় অফিসারকে জিজ্ঞাসা করল, পাল, আমাদের তল্লাটে তিনটে ছেলে আর একটা মেয়ের কোন গ্যাঙ আছে?

পাল যার নাম তিনি বললেন, মেয়ে? তিনটে ছেলে আর মেয়ে? ওই তো খালধারের হিমি আর তার নাগর। কিন্তু কেসটা কি?

প্যারাডাইসে ডাকাতি। রুটিন রিপোর্ট দিতে হবে। হিমির ফোরফাদার অবশ্য ওই কাজ করতে যাবে , তবু ওদের ডেকে পাঠাও।

কল্যাণ বলল, আমি আসছি।

সেকেন্ড অফিসার ততক্ষণে কি সব লেখা শুরু করেছেন সেই অবস্থায় মাথা নাড়লেন। নির্জন রাস্তায় নেমে কল্যাণের পা সিরসির করতে লাগল। পুলিশ তাহলে বুঝতে পেরেছে কজন ছিলে। ওরা এখন পাড়ায় পাড়ায় খোঁজ করছে। আনন্দকে খবরটা দিতে হবে। এখন কোন অবস্থায় চারজনের প্রকাশ্যে দেখা করা উচিত নয়। জোরে জোরে পা চালাতে লাগল কল্যাণ।
 
সুদীপ আর অবনী তালুকদার মুখোমুখি বসেছিল। ইতিমধ্যে বেশ কিছু উত্তেজিত শব্দ বিনিময় হয়েছে। শেষ পর্যন্ত অবনী তালুকদার বললেন, তোমাকে টাকা দিয়ে আমার কি লাভ?

আপনাকে আর কখনও আমার মুখোমুখি হতে হবে না!

তোমাকে আমি কেয়ার করি নাকি? তোমাকে আমি ভয় পাই?

পান। মা এতকাল শুয়ে থাকলেও ভয় পেতেন। শেষ কাটা আমি। এটাকে উপড়ে ফেলার সুযোগ পাচ্ছেন, সুযোগটা হাতছাড়া করার মত বোকা আপনি নন। সুদীপ নির্লিপ্ত গলায় বলল।

সুদীপ, আমি তোমার বাবা, ডোন্ট ফরগেট ইট!

আমার সন্দেহ আছে।

মানে? হোয়াট ড়ু য়ু মিন?

আমার বাবার মিনিমাম যেটুকু হৃদয় থাকা উচিত আপনার তা নেই।

অবনী তালুকদারের মুখটা বুলডগের মত হয়ে গেল, টাকা নিয়ে তুমি কি করবে?

ফুর্তি করব।

স্টপ ইট, এইভাবে কথা বলবে না আমার সঙ্গে। তুমি তাহলে এই বাড়িতে আর থাকবে না? আমার সম্পত্তির ওপর কোনদিন নজর দেবে না?

ঠিক বলেছেন।

কিন্তু এসব নিয়ে আমি কি করব? আমি মরে গেলে তো তুমি মালিক হবে। আমার ইচ্ছে না থাকলেও–।

আমার ইচ্ছে নেই। পাপের টাকা ভোগ করতে চাই না।

ও। তাহলে এখন টাকা চাইছ কেন?

পুণ্য করব বলে। অনেকক্ষণ একই কথা বলছেন, মালটা বের করুন।

ওই ভাষায় কথা বললে আমি এক পয়সা দেব না।

আপনি উত্তেজিত হচ্ছেন। নার্স কোথায়?

নার্স আমি ছাড়িয়ে দিয়েছি। আমার আয়া হলেই চলবে।

সাবাস!

ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোতমাকে টাকা দিচ্ছি আমি। কিন্তু তোমাকে এখনই লিখে দিতে হবে ভবিষ্যতে আমার সম্পত্তির ওপর তোমার কোন দাবী থাকবে না। অবনী তালুকদার উঠলেন চেয়ার ছেড়ে। রাগী এবং অন্ধ মেয়ের মত দেখাচ্ছিল তাঁকে।

সুদীপ বলল, আপনি যা ইচ্ছে লিখে আনুন আমি সই করছি।

হঠাৎ বেশ হালকা লাগল নিজেকে। সুদীপ দুবার আঙ্গুলে তবলার বোল তুলল টেবিল ঠুকে। এবং সেই সময় জলের জাগ হাতে একজন অল্পবয়সী মেয়েকে সে দেখতে পেল। মেয়েটির গায়ের রঙ শুধু কালো নয়, মুখে সৌন্দর্যের বিন্দুমাত্র ছায়া নেই। ঈশ্বর ওকে শুধু বাড়তি শরীর দিয়েছেন। মেয়েটি অবনী তালুকদারের ঘরের দিকে যাওয়ার সময় সুদীপের দিকে স্পষ্টতই অপছন্দের দৃষ্টি রেখে গেল। সুদীপের চোয়াল শক্ত হচ্ছিল, কিন্তু নিজেকে সামলে নিল সে। অবনী তালুকদার এখন যা ইচ্ছে করতে পারে। এই লোকটার পিতৃত্ব যখন সে অস্বীকার করেছে তখন এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন দরকার নেই। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে মায়ের ঘরের দিকে তাকাল। তারপর নিজের ঘরে এসে দাঁড়াল। এবং তখনই বুকের মধ্যে একটা কাঁপুনি চলে এল। এই ঘরটায় সে এতকাল একা একা ছিল। দেওয়ালের দাগগুলো পর্যন্ত তার ভীষণ চেনা, ওই দাগগুলোকে নিয়ে মনে মনে কত ছবি এঁকেছে এককালে। এখনও বুকসেলফে তার বই, ওয়ার্ডরোবে জামা প্যান্ট। সুদীপ বাইরে বেরিয়ে আসতেই দেখতে পেল অবনী তালুদার কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু তার মুখের চেহারা এখন স্বাভাবিক নয়। একটু চিন্তিত এবং আত্মপ্রত্যয়ের অভাব হচ্ছে বোঝা যাচ্ছিল। যদিও তিনি রাগত ভঙ্গিটা রাখার চেষ্টা করলেন, ওঘরে কি করছিলে?

শেষবার দেখে এলাম।


সুদীপের কথা শেষ হওয়া মাত্র অবনী তালুকদার টেবিলে ফিরে গেলেন। সেখানে একটা মোটা লম্বা খাম রাখা ছিল। সেইটে ঠেলে দিয়ে তিনি বললেন, এই নাও তোমার টাকা।

সুদীপ এগিয়ে এসে খামটা তুলে নিল, কত আছে?

সত্তর। এর বেশি এক পয়সা দেবার উপায় নেই আমার। গুনে নিতে পার।

সুদীপ চিন্তা করল এক লহমা। না, আর চাপ দিতে প্রবৃত্তি হচ্ছে না। সে নোটগুলোকে দেখল। বেশির ভাগই একশ টাকার বান্ডিল, দশও আছে। খামের মুখটা বন্ধ করে সে জিজ্ঞাসা করল, আপনার অঙ্কে কখনই ভুল হয় না, তবে ওর মধ্যে জালি মিশে যায়নি তো?

জালি! জালি মানে? হতভম্ব হয়ে গেলেন অবনী তালকুদার। ওঁর হাতে ধরা কাগজটা এবার কাপতে লাগল। সুদীপ প্রশ্নটার উত্তর না দিয়ে কাগজটা টেনে নিল। তারপরেই সে সোজা হয়ে দাঁড়াল। বাড়িতে টাইপরাইটার নেই। অথচ অবনী তালুকদার ইংরেজিতে টাইপ করিয়ে রেখেছিলেন। পুরো ব্যাপারাটাই তিনি পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। লেখাটা পড়ল সে। আমি সুদীপ তালুকদার, বয়স একুশ বছর দুমাস তিনদিন, শ্রীঅবনী তালুকদারের একমাত্র পুত্র, স্বেচ্ছায় এবং সানন্দে ঘোষণা করছি যে আজ এই মুহূর্ত থেকে আমি আমার পিতা শ্ৰীঅবনী তালুকদারের স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তির ওপর থেকে জন্মসূত্রে পাওয়া অধিকার ত্যাগ করছি। আজ থেকে আমি এবং আমার বংশধরগণ আর শ্রীঅবনী তালুকদারের স্থাবর অস্থাবর কোন সম্পত্তির উত্তরাধিকারী বলে বিবেচিত হবে না। এই ঘঘাষণা আমি কোন চাপের দ্বারা করতে বাধ্য হচ্ছি না। নিচে তার নাম, আজকের তারিখ এবং ঠিকানা টাইপ করা।

সুদীপ হেসে জিজ্ঞাসা করল, সাক্ষী থাকবে না কেউ? কলমটা দিন।

দরকার নেই। অবনী তালুকদার একটা সস্তা কলম টেবিলের ওপর রাখলেন।

সুদীপ বেশ যত্ন করে সই করল। তারপর কাগজ এবং কলম রেখে উঠে দাঁড়াল, এখন থেকে আপনি মুক্তপুরুষ। যা ইচ্ছে করুন কেউ বলতে আসবে না। চলি।

সুদীপ পা বাড়াতেই অন্য গলায় কথা বললেন অবনী তালুকদার, সুদীপ, এটা কি ঠিক করছ?

মানে? সুদীপ অবাক হয়ে ফিরে তাকাল।

আফটার অল উই আর ফাদার অ্যান্ড সন। এইভাবে চলে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে?
 
আপনি তো এতকাল তাই চেয়েছিলেন। মাকে আপনি কোনকালেই সহ্য করেননি। আমার সঙ্গে আপনার কোন সেতু ছিল না। চিরটাকাল আপনি নিজের জন্যে ভেবে এসেছেন। তাছাড়া আমারও এই শাবকের জীবনে থাকার বাসনা নেই। প্লিজ, শেষমুহূর্তে আর কোন নাটক তৈরি করবেন না। টাকাগুলোর জন্যে ধন্যবাদ।

সুদীপ বেরিয়ে আসছিল, পেছন থেকে অবনী তালুকদার বলে উঠলেন, টাকাগুলো সাবধানে নিয়ে যেও, দিনকাল খারাপ।

বাইরে বেরিয়ে এসে সতর্ক হল সুদীপ। এত সহজে টাকাগুলো হাতছাড়া করার মানুষ অবনী তালুকদার নন। তিনি টাকা দেবেন এটা বাড়িতে ফেরার আগেই ভেবে রেখেছিলেন, নইলে লেখাটা টাইপ করা হত না। টাকাটা যাতে হাতছাড়া না হয় তার একটা ব্যবস্থা করে রাখেনেনি তো! দিনকালের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজেকে নির্মল রাখার জনেই কি এই মন্তব্য! সুদীপ রাস্তাটা দেখল। এখন রাত হয়েছে। ঠাকুরের দোকানের সামনে দু-তিনজন খদ্দেরের ভিড়। খানিকটা দূরে একটা প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে আছে। কোন সন্দেহজনক ব্যাপার চোখে পড়ল না। বাঁ পাশের ফুটপাত দিয়ে হনহন করে হাঁটতে লাগল সে প্যাকেটটাকে হাতে ঝুলিয়ে। এত টাকা সঙ্গে নিয়ে সে কোনদিন হাঁটেনি বলে কেমন একটা ঘোর লাগছিল। প্রাইভেট কারটা দাঁড়িয়ে আছে ডান ফুটপাত ঘেঁষে। এই ব্যাপারটাও অস্বাভাবিক। সে যখন প্রায় সমান্তরাল তখন একটা লোক গাড়ির ভেs থেকে মুখ বার করে তাকে দেখল। সুদীপ আরও জোরে পা চালাতেই ইঞ্জিনের আওয়াজ কানে এল। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল এই মুহূর্তে সাবধান হওয়া উচিত। কয়েক পা দৌড়ে চট করে বাঁ দিকের গলিতে ঢুকে পড়ল সে। কোন দিকে না তাকিয়ে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছিল সুদীপ খামটাকে আঁকড়ে ধরে। এই গলিটা তার মুখস্থ। ছেলেবেলায় অনেক সুকোচুরি খেলেছে সে। ডান দিকের একটা বাড়ির পাশ দিয়ে একটা মানুষ যেতে পারে এমন পথ আছে। সুদীপ সেইটে ব্যবহার করল। এখন আর পেছনে তাকাবার সময় নেই। কেউ তাকে অনুসরণ করছে কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না। কয়েকটা কুকুরের চিৎকার কানে এল। এরা গৃহপালিত জীব। আক্রান্ত হবার ভয় নেই।

ঘড়িতে যখন এগারোটা তখন বালিগঞ্জ পার্ক রোডে পৌঁছাল সুদীপ। প্যারাডাইসে অভিযান করেও যা হয়নি এই মুহূর্তে তার চেয়ে অনেক বেশি ছিবড়ে মনে হচ্ছিল নিজেকে। বাকি পথটা অদ্ভুত আতঙ্ক নিয়ে আসতে হয়েছে তাকে। কিন্তু কেউ আক্রমণ করেনি, সামনে এসে দাঁড়ায়নি। অথচ প্রতিক্ষণই মনে হচ্ছিল কেউ না কেউ আসছে।

লিফটে চেপে জয়িতাদের ফ্ল্যাটের দরজায় চলে এল সুদীপ। বেল বাজাতেই দরজা খুলল। সুদীপ দেখল অত্যন্ত সুন্দরী এবং সুবেশা এক মহিলা তার সামনে দাঁড়িয়ে। তখনও ধাতস্থ হয়নি সুদীপ, কিছু বলার আগেই মহিলা প্রশ্ন করলেন, কাকে চাই?

জয়িতা আছে?

আছে। তুমি কে?

আমি সুদীপ। ওর সঙ্গে পড়ি।

ও। এত রাত্রে এসেছ, কি ব্যাপার?

আমি এখন এই বাড়িতে আছি।

এই বাড়িতে, মানে, আমাদের এখানে তুমি আছ অথচ আমি জানি না!

সীতা রায়ের গলায় বিস্ময় ফুটে উঠতেই ভেতর থেকে জয়িতা বলে উঠল, বাবার সঙ্গে আমার কথা হয়ে গিয়েছে, ভেতরে আয় সুদীপ।
 
১৪.
সীতা রায় দুই ভ্রূ এক করে মেয়ের দিকে তাকালেন। তারপর কোন কথা না বলে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। জয়িতা সুদীপকে জিজ্ঞাসা করল, কি খবর?

সুদীপ মাথা নাড়ল, ঠিক আছে। যে ঘরে আমি ছিলাম সেখানে যেতে পারি?

নিশ্চয়ই। উনি হলেন সীতা রায়। আমার সম্মানিত গর্ভধারিণী। এখন

মেজাজ গরম আছে। ট্রিটমেন্টের জন্যে কিছু মনে করিস না। একটু মনের-কষ্টে মেজাজ গরম আছে। ট্রিটমেন্টের জন্যে কিছু মনে কিরস না। একটু মনের কষ্টে আছেন। জয়িতা কোমরে হাত রেখে বলল। এখন ওর পরনে হলদে পাঞ্জাবি আর সাদা প্যান্ট। সুদীপ কথা বাড়াল না। জয়িতা ওকে অনুসরণ করে ঘরে এল। এসে বলল, তোর জিনিসপত্র ওই আলমারিটার মধ্যে রেখেছি।

সুদীপ চোখের কোণে আলমারিটা দেখে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল খাটে।

জয়িতা টেবিলের ওপর উঠে বসে চেয়ারে পা রাখল, টায়ার্ড?

নট অ্যাট অল। জাস্ট একটু শুয়ে নেওয়া।

ঘুমোচ্ছিস? না চোখ বন্ধ করে ভাবছি। এইরকম হল কথাটা।

খাবি কিছু?

এখন থাক। সুদীপ কনুইতে ভর দিল, অবনী তালুকদার টাকা দিয়েছেন। চাপ দিলেও আরও ম্যানেজ করতে পারতাম। কিন্তু প্রবৃত্তি হল না। আনন্দকে খবরটা জানানো দরকার।

জয়িতার মুখটা উজ্জ্বল হল, গুড। টাকাগুলো কোথায়?

সুদীপ মাথার পাশে রাখা প্যাকেটটা দেখাল।

জয়িতা একটু অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল, তুই ওইভাবে হাতে ঝুলিয়ে টাকা এনেছিস? যদি পথে কিছু হয়ে যেত?

সুদীপ বলল, হয়নি দ্যাটস অল। আমার জন্মদাতাই ছিনতাই করানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। এখন নিশ্চয়ই খুব আফসোস হচ্ছে ভদ্রলোকের। গয়নার ব্যাপার তোর গর্ভধারিণী জানতে পেরেছেন?

এখনও না। বাবা বেরিয়ে যাওয়ার পর তিনি ফিরেছেন। দার্জিলিং-এর ঘোর এখনও কাটেনি। বোধহয় প্লেন লেট ছিল। সীতা-রামের সাক্ষাৎ হয়নি অযোধ্যায়। জয়িতা চোখ বন্ধ করল, আমরা একটা প্যারাডাইস পোড়ালাম কিন্তু এখন ঘরে ঘরে প্যারাডাইসের নায়ক-নায়িকারা একই অভিনয় করে যাচ্ছে। তাদের তো জ্ঞানচক্ষু খোলাতে পারব না।

দরজার বাইরে পায়ের শব্দ এসে থামল, তোমার ফোন।

সীতা রায় ঘোষণা করে ফিরে গেলেন। চট করে নেমে পড়ল জয়িতা। তারপর কোন কথা না বলে প্রায় দৌড় লাগাল। বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করল সুদীপ। সত্যি এখন ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছে নিজেকে। কিন্তু সীতা রায়কে দেখার পর থেকে খাবারের কথাটা বলতে সঙ্কোচ লাগছে। জয়িতা যাই বলুক না কেন, এই বাড়িতে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছে। এখন যে-কোন হোটেলে থাকার সামর্থ্য আছে তার। শুধুমাত্র পুলিস যাতে সন্দেহ না করে সেই ভয়ে এইভাবে থাকা।

চুকে গেল আজ সব সম্পর্ক। বলতে গেলে পৃথিবীতে সে এখন একা। সত্যিকারের মাতৃপিতৃহীন সে কবে হয়েছিল? নিজের মনেই সে হেসে ফেলল। জীবনের শেষদিকে মা অসুস্থ ছিলেন, একেবারেই শয্যাশায়ী কিন্তু যখন তিনি সুস্থ তখন তো বাবার কোন কাজের প্রতিবাদ করেননি। বাংলাদেশের মায়েরা চিরকালই স্বামীদের মার্শাল ল মুখ বুজে মেনে নিয়ে থাকে। তাদের সময় থেকে হয়তো অবস্থাটা পালটাবে। আবার এই বাড়িতে সীতা রায় তো রামানন্দ রায়ের চেয়ে কোন অংশে কম যান না। স্বাধীন মহিলা হিসেবে তিনি যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন। বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে দার্জিলিং ঘুরে আসতে পারেন বুক ফুলিয়ে। রামানন্দ রায়ের সঙ্গে তার পাল্লা নিশ্চয়ই সমান সমান। কিন্তু তা সত্ত্বেও জয়িতা মনে করে সে একলা। তার কোন যোগাযোগ নেই মা-বাবার সঙ্গে। ওই শ্রেণীর স্বাধীনতাভোগী মহিলারা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কোনভাবে নিজেদের দায়বদ্ধ বলে মনে করেন না। মিসেস অবনী তালুকদার এবং মিসেস রামানন্দ রায় সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর মানুষ হয়েও কোথায় এক হয়ে গিয়েছেন। এবং তখনই লোকটার মুখ মনে পড়ল। প্যারাডাইসের ককটেল রুমের লোকটা। কোনদিন সে চিন্তা করেনি কোন মানুষকে গুলি করে মারতে পারবে। প্রথমবার গুলিটা ছোঁড়ার সময় হাত কেঁপেছিল। দ্বিতীয়বার সরাসরি। একটি হত্যাকাণ্ড করে ফেলল সে, অথচ নিজেকে খুনী বলে মনে হচ্ছে না তার। ওই গাঘিনঘিনে অশ্লীল ব্যাপারটা না ঘটালে হয়তো তার মন অত শক্ত হয়ে খুন করতে পারত না। আইনের চোখে সে খুনী। কিন্তু এই আইনকে কে কেয়ার করে! যে দেশের আইন মানুষকে সুস্থভাবে বাঁচার সাহায্য করে না, যে দেশের আইন শুধু অর্থবানদের পাহারাদার, সে দেশে এইরকম লক্ষটা খুন করতে সে সবসময় রাজী। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে বোকামি করলে চলবে না। ঠিক এই কারণেই হোটেল নয়, আজ রাত্রে এই বাড়িতেই থাকতে হবে মেনে নিয়ে।
 
জয়িতা ফিরে এল। ওর মুখ উজ্জ্বল। এসে বলল, আনন্দ ফোন করেছিল। ওর মা এসেছিলেন। এখনও গ্রামের বাড়িতে কেউ খোঁজখবর নিতে যায়নি।

সুদীপ চোখ বন্ধ করেই বলল, গেলেও লাভ হত না। অন্ধকারে কেউ দ্যাখেনি ভাল করে। তুই যে একটি মেয়ে এটাও কারও মাথায় ঢুকবে না। আনন্দটা লাকি।

কেন? জয়িতা প্রশ্ন করল।

না হলে এরকম মা পায়! ভদ্রমহিলা বিধবা। আনন্দ একমাত্র ছেলে। অথচ বাধা দেবার বদলে নিজে এসে সাহায্য করছেন। বিশ্বাস কর, আমার একটা কথা খুব মনে হয়। এদেশের মেয়েরা যদি চায় তাহলে বিপ্লব অনিবার্য। এই সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বৈষম্যের অবসান মেয়েরাই ঘটাতে পারে যদি প্রতিটি ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরি হয়ে যায়। সুদীপ খানিকটা উত্তেজিত হয়ে উঠে বসল।

জয়িতা হঠাৎ উঁচু গলায় হেসে ফেলল। এবং তার হাসি থামছিল না।

সুদীপের মুখটা প্রথমে অবাক পরে গম্ভীর হয়ে গেল, হাসছিস কেন?

কোনরকমে নিজেকে সামলে জয়িতা বলল, তোর মাইরি হেভি ফান্ডা। অবিকল মুজিবের মত কথা বলছিস।

মুজিব? এবার সত্যি সত্যি বিস্মিত সুদীপ।

মুজিবর রহমান। তোমরা সবাই ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।

ইয়ার্কি মারার লিমিট আছে জয়িতা। আর তাছাড়া মুজিব হলেন একটা ইন্সপিরেশন। একটা জাতকে যিনি উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। যদি তখনই শহীদ হয়ে যেতেন তাহলে বাংলাদেশে তিনি চিরকাল আগুনের পাখি হিসেবে শ্রদ্ধা পেতেন।

কি হলে কি হত ভেবে লাভ নেই। এই মানুষটাকেই শেষ পর্যন্ত জনসাধারণের বিরক্তি কুড়োতে হয়েছিল তার অতিরিক্ত স্নেহান্ধতার জন্যে। সেটাই ঘটনা। কোন জিনিস অধিকার করা যতটা শক্ত, তার চেয়ে বহুগুণ কঠিন সেটাকে ঠিকমত লালন করা। জয়িতা সিরিয়াস হল।

এইসময় শ্রীহরিদাকে দরজায় দেখা গেল। থপথপে পায়ে জয়িতার কাছে এসে একটুকরো কাগজ এগিয়ে দিল। জয়িতা সেটা পড়ে শ্রীহরিদাকে ইশারা করল, ঠিক আছে। শ্রীহরিদা যেমন এসেছিল তেমনি চলে গেলে জয়িতা ঘোষণা করল, শ্রীযুক্ত রামানন্দ রায় তোক জানাচ্ছেন যে তুই ওঁর ঘরে গেলে তিনি খুশী হবেন।

সুদীপ নীরবে চোখ তুলে জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার?

জয়িতা কাঁধ নাচাল। তারপর বলল, হয়তো তোকে আমার কথা জিজ্ঞাসা করবে। কিন্তু এবাড়ি থেকে চলে যেতে বলবে না। দাঁড়া। আনন্দ জিজ্ঞাসা করছিল তুই টাকা পেয়েছিস কিনা। আমি বলেছি। পেয়েছিস। ও মিনিট চল্লিশের মধ্যে আসবে। ট্যাকসিতেই থাকবে। আমাকে বলেছে তোর কাছ থেকে অন্তত পনেরো হাজার টাকা নিয়ে ওকে পৌঁছে দিতে। যারা মাল দেবে তারা আজ রাত্রেই টাকা চায়। আগামীকাল সকালে ও এখানে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করবে।

সুদীপ বলল, দরকার নেই। আমি ওর সঙ্গে দেখা করছি এখন। আগামীকাল সকালে আমি এই বাড়িতে থাকব তার কোন নিশ্চয়তা নেই। তোর বাবার নোটটা খুব গোলমেলে। উনি নিজেই এসে আমার সঙ্গে কথা বলতে পারতেন এই ঘরে। সুদীপ হঠাৎ হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিয়ে টাকা বের করল।

জয়িতা বলল, না, বোকামি করিস না সুদীপ। তুই এত রাত্রে গিয়ে ট্যাকসির সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলে ফিরে এলে দারোয়ানরা সন্দেহ করবে। ওরা তোকে চেনে না। দিনেরবেলায় এক কথা কিন্তু রাত্রে যাই ঘটুক লোকে তা অন্যচোখে দ্যাখে। আমাকে সবাই চেনে, আমার কোন অসুবিধে হবে না।

সুদীপ বলল, আনন্দকে বলবি আমি ঠাকুরপুকুরের বাড়িতে চলে যেতে চাই।

জয়িতা মাথা নাড়ল, বলব।

সুদীপ একবার ওর দিকে তাকাল। তারপর গুনে গুনে পনেরো হাজার টাকা আলাদা করে এগিয়ে দিল, এগুলো একটা খামে ভরে ওকে দিস। আর বলিস যাচাই করে নিতে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top