What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected এই বসন্তে - উপন্যাস (3 Viewers)

সাইফুল ইসলাম রাত এগারটার সময় এসে উপস্থিত। জহুর মশারি ফেলে ঘুমাবার আয়োজন করছিল। সাইফুল ইসলামকে দেখে অবাক হয়ে বেরিয়ে এল।

জহুর ভাই, আমি বলেছিলাম–আসব।

এত রাতে আসবেন ভাবি নি।

নান্টুর দোকানে চা খাচ্ছিলাম। এত রাত হয়েছে টের পাই নাই।

ব্যাপার কি?

সাইফুল ইসলাম ইতস্তত করতে লাগল। জহুর বলল, বসেন, ঐ বেঞ্চিটাতে বসেন।

সাইফুল ইসলাম বসল না। জহুর বলল, বলেন শুনি, কি ব্যাপার।

আপনি বুঝি বারান্দাতে ঘুমান?

হুঁ।

সাপখোপের ভয় আছে কিন্তু। সময়টা খারাপ।

জহুর সিগারেট ধরাল।

নিন, সিগারেট নিন।

সাইফুল ইসলাম সিগারেট নিল। মৃদুস্বরে বলল, সিগারেট খাওয়া আমি ছেড়ে দিয়েছি জহুর ভাই। খরচে পোষায় না। টাকাপয়সার খুব টানটানি আমার।

ছাড়তে পারলে তো ভালোই।

পুরাপুরি ছাড়তে পারি নাই। মাঝেমাঝে খাই।

জহুর বলল, কি বলতে এসেছেন, বলেন।

সাইফুল ইসলাম মৃদু স্বরে বলল, আসেন, রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে কথা বলি।

জহুর রাস্তায় নেমে এল। এতটুকু বাতাস নেই কোথাও। গাছের পাতা পর্যন্ত নড়ছে না। মেঘ-বৃষ্টি হবে এমন লক্ষণও নেই। ঝকঝক করছে আকাশ। সাইফুল ইসলাম চাপা গলায় বলল, মনটা খুব খারাপ জহুর ভাই। একটা মানুষ মেরে ফেলেছে, কিন্তু কেউ একটা কথা পর্যন্ত বলছে না।

কাকে মেরে ফেলেছে?

মনসুর। মনসুর আলি। পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।

সাইফুল ইসলাম রুমাল বের করে ঘাড় মুছতে লাগল। থেমে থেমে বলল, পরশু রাতে মনসুর আলিকে দেখলাম। মাথা নিচু করে কবরের পাশে বসে ছিল।

কাকে দেখলেন?

মনসুর আলিকো কালকেও দেখেছি।

আপনার কথা বুঝতে পারছি না।

কালকে গরমের জন্যে মাঠের মধ্যে বসে ছিলাম। তখন দেখলাম। পরিষ্কার দেখলাম। হাতে চটের একটা বস্তা ছিল।

জহুর দীর্ঘ সময় চুপ করে রইল। তারপর সিগারেট ধরাল।

নিন, আরেকটা সিগারেট নিন।

সাইফুল ইসলাম হাত বাড়িয়ে সিগারেট নিয়ে পকেটে রেখে দিল।

কাল সকালে নাশতার পরে খাব।

জহুর মৃদু স্বরে বলল, যান, বাড়িতে গিয়ে ঘুমান। সকালে কথা বলব।

আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেন নাই, না?

জহুর জবাব দিল না।

আপনি আমার সঙ্গে যদি আসেন তাহলে নিজের চোখে দেখবেন। আসেন জহুর ভাই।

আজকে আর যাব না কোথায়ও।

জহুর ভাই, একা-একা তো বাড়ি যেতে পারব না। ভয় লাগে। একটু এগিয়ে দেন।
 
জহুর হাঁটতে শুরু করল। সারা পথে আর কোনো কথাবার্তা হল না। কবরখানার পাশ দিয়ে যাবার সময় সাইফুল ইসলাম মৃদু স্বরে বলল, আজকে নাই।

জহুর বলল, এখন যেতে পারবেন একা-একা?

জ্বি।

যান, ঘুমিয়ে পড়েন গিয়ে। সকালে কথা বলব।

আমার সকালে ঘুম আসে না।

কী করেন এত রাত পর্যন্ত?

চিঠি লেখি।

রোজ চিঠি লেখেন?

সাইফুল ইসলাম ফ্যাকাসে হয়ে গেল।



জহুর বাড়ি ফিরে দেখে দবির মিয়া বারান্দার বাতি জ্বালিয়ে গম্ভীর মুখে বসে আছে।

এত রাতে তুমি গিয়েছিলে কোথায়?

সাইফুল ইসলাম এসেছিল, ওর সঙ্গে একটু গিয়েছিলাম।

বিছানপত্র এইভাবে ফেলে রেখে গেছ? চোরের উপদ্ৰব।

জহুর চুপ করে রইল। দবির মিয়া রাগী স্বরে বলল, ঐ হারামজাদা সাইফুল ইসলাম ঘুরঘুর করছে কী জন্যে?

কি জানি দেখেছে।

দেখবে আবার কী? শালা চালবাজ। আমার সাথে ফাজলামি করে।

কী করেছে আপনার সাথে?

বলে বিনা পয়সায় গান শিখাবে। মিয়া তানসেন এসেছে। চড় দিয়ে দাঁত খুলে ফেলব।

জহুর ঘুমাবার আয়োজন করল। দবির মিয়া বাতি নিভিয়ে দিল, কিন্তু সেই রইল বাইরে। জহুর বলল, শুয়ে পড়েন গিয়ে দুলাভাই।

দবির মিয়া সিগারেট ধরাল। ক্লান্ত স্বরে বলল, রাতে বারান্দায় ঘুমানটা ঠিক না। সময় খারাপ।

জহুর চুপ করে রইল। দবির মিয়া সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ক্রমাগত কাশতে লাগল। জহুর বলল, দুলাভাই, আপনি কি কিছু বলবেন?

হুঁ।

জহুর মশারি থেকে মাথা বের করল।

ব্যাপার কি দুলাভাই?

আমার সময়টা ভালো যাচ্ছে না। দোকানে চুরি হয়েছে আরেক বার।

শুনেছি।

শুনে মানে, কার কাছ থেকে শুনেছ?

এত লুকানর কী আছে এর মধ্যে?

আছে, আছে, তুমি বুঝবে না।

থানার পেটাঘড়িতে বারটার ঘন্টা পড়ল। দবির মিয়া বলল, চৌধুরী সাহেব যে কাজটা দিতে চায়, সেই কাজটা তুমি নেও জহুর। পুরনো কথা ভুলে যাওয়াই ঠিক।

জহুর বিছানা থেকে বের হয়ে বেধির ওপর বসল। দবির মিয়া বলল, আমরা অনেক কিছু হজম করি। টিকে থাকার জন্য করতে হয়। কি, ঠিক না।?

জহুর জবাব দিল না। দবির দ্বিতীয় একটি সিগারেট ধরিয়ে ধীর স্বরে বলল, চৌধুরী সাহেব এখন মনে হয় কিছুটা লজ্জিত। তোমার খোঁজখবর করছে এই জন্যই। সুযোগটা নেওয়া দরকার, বুঝলে? আর ঐ যে একটা মেয়ের কথা বলেছিলেন, দেখলাম মেয়েটাকে। বেশ ভালো মেয়ে। ম্যাট্রিক সেকেণ্ড ডিভিশনে পাস করেছে। কলেজে আর ভৰ্তি হয় নাই। একটু খাটো, কিন্তু ফর্সা গায়ের রঙ। চুলও দেখলাম। চৌধুরী সাহেব বলেছেন বিয়ের খরচপাতি দেবেন।

তার সাথে আপনার আজকেই কথা হয়েছে?

হুঁ। টুনীরবিয়েরও একটা প্রস্তাব দিলেন। ছেলেরকাপড়ের ব্যবসা, সৈয়দবংশ। গ্রামে দোতলা পাকা দালান।

চৌধুরী সাহেবের আত্মীয়?

না, তবে চেনা-জানা। মঙ্গলবার মেয়ে দেখতে আসবে।

ছেলের পড়াশুনা কেমন?

পড়াশুনা তেমন কিছু না। সব মিলিয়ে কি পাওয়া যায়। তবে ছেলে দেখতে। সুন্দর। লম্বা-চওড়া।

ভালোই তো।

ছেলের টাকা আছে। টাকাটা খুব দরকারী জিনিস। টাকা থাকলে সব কিছু হয়। যখন বয়স কম থাকে, তখন মনে হয় টাকাটা বড়ো কিছু না, কিন্তু যখন বয়স বেশি হয়, সত্যি কথাটা বোঝা যায়।

জহুর মৃদু স্বরে বলল, টুনীর সম্ভবত গান-বাজনার শখ।

দবির মিয়া উঠে পড়ল। জহুর অন্ধকারে বেঞ্চির ওপর অনেক রাত পর্যন্ত বসে রইল।
 
বরকত আলি রাতে নীলগঞ্জ স্টেশনের ওয়েটিং রুমে ঘুমিয়েছিল। সকালবেলা সে জেগে উঠে দেখে তার চামড়ার ব্যাগটি চুরি গেছে। তার পাঞ্জাবির পকেটে একুশ টাকা চল্লিশ পয়সা ছিল, সেগুলোও নেই। সে তার দুঃখের কথা বলার জন্যে দবির মিয়ার বাড়ি গেল। দবির মিয়া তাকে হাঁকিয়ে দিল।

বরকত আলিদুপুর পর্যন্ত নেজামুদ্দিনের ডিসপেনসারিতে বসেরইল। নেজামুদ্দিন এক জন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার। তার সঙ্গে বরকত আলির বেশ খাতির হয়েছিল। নেজামুদ্দিন তিন ফাইল কানপাকার ওষুধ কিনেছিল, বরকত আলি তার কোন দাম নেয় নি। কিন্তু আজ বরকত আলির দুঃখের গল্প শুনে নেজামুদ্দিনের মুখ লম্বা। হয়ে গেল। সে বরকত আলিকে বসিয়ে রেখে দুপুরে ভাত খেতে গেল। ফিরল বিকালে।

বরকত আলি চোখে অন্ধকার দেখছিল। সে ক্ষুধা একেবারেই সহ্য করতে পারে না। আজ সারা দিন তার তিন কাপ চা, দুটি টোষ্ট বিসকিট ছাড়া কিছুই খাওয়া হয় নি।

সন্ধ্যার আগে-আগে সে থানার ওসি সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেল। ওসি সাহেবের সঙ্গে দেখা হল না। তাঁর শরীর বেশি ভালো নয়। তিনি থানায় আজ আর আসবেন না। সেকেণ্ড অফিসার তাকে এক কাপ চা খাওয়ালেন এবং বললেন খামোকা ঘোরাঘুরি না করে বাড়ি ফিরে যেতে।

রাতের বেলা বরকত আলিকে দেখা গেল ছেলের কবরের কাছে উবু হয়ে বসে আছে।

সাইফুল ইসলাম নান্টুর দোকানের চা খেয়ে ফিরবার পথে তাকে দেখতে পেল। সে চেচিয়ে উঠল, কে, কে? মনসুর নাকি? এ্যাই–এ্যাই।

বরকত আলি উঠে দাঁড়াল। ধরা গলায় বলল, জি আমি। আমি বরকত আলি।

এইখানে কী করেন আপনি?

বরকত আলি বলল, আজকে আমার খাওয়া হয় নাই সাব।

খাওয়া হয় নাই?

জ্বি না ভাইসাব। আমার জিনিসপত্র সব চুরি গেছে। একটা পয়সাও নাই সাথে।

আরে, এ তো সিরিয়াস মুসিবত।

এই বয়সে খিদার কষ্ট সহ্য হয় না ভাইসাব।

হুঁ, না হওয়ারই কথা।

সাইফুল ইসলাম কুঞ্চিত করল। মসজিদ থেকে আবার ওয়াজ শুরু হয়েছে, নবীজীর সাফায়াত পাওয়া সহজ না, এই কথাটা মনে রাখবেন। দুনিয়াদারী কঠিন। জায়গা ভাই সব। বড় কঠিন স্থান। দীন-দুনিয়ার মালিক গাফুরুর রহিম ইয়া জাল জালাল ওয়াল্ ইকরাম এরশাদ করেছেন…

সাইফুল ইসলাম তাঁকে নিজের ঘরে নিয়ে এল। সেই রাত্ৰেই নীলগঞ্জ থানার ওসি সাহেবের কাছে তিন পাতার একটা চিঠি লিখল। চিঠির শুরু এরকম।

ওসি সাহেব, আপনার কি ধারণা নীলগঞ্জের অধিবাসীরা ঘাস খাইয়া জীবনধারণ করে। সমস্ত জারিজুরি ফাঁস হইয়া গিয়াছে। খুনের দায়ে এখন হাতকড়া পরিবার জন্যে তৈরী হওয়ার সময় আসিয়াছে। শালা, তুই কি ভাবিয়াছিস…
 
ভাত বেড়ে দিচ্ছি অনুফা। অঞ্জু স্কুলে গিয়েছে। টুনীর শরীর খারাপ, শুয়ে আছে। জহুর অস্বস্তি বোধ করছিল। অনুফা মৃদু স্বরে বলল, পেট ভরে খান ভাইসাব।

জহুরের মাথা আরো খানিকটা নিচু হয়ে গেল। অনুফার সঙ্গে দেখা হলেই সে কোনো-একটা বিচিত্র কারণে লজ্জা বোধ করে। অনুফা ডালের বাটি এগিয়ে দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল, টুনীর গান-বাজনার শখ। সৈয়দ বাড়িতে বিয়া হইলে কিছুই হইত না। আপনে আপনার ভাইরে কম।

জহুর বলল, জ্বি, বলব।

আমার কথা শুনে না। আমি মূর্খ মেয়েমানুষ।

জ্বি, বলব আমি।

জহুর লক্ষ করল অনুফা দারুণ অসুস্থ। গালটাল ফুলে আছে। চোখ রক্তাভ। দুলাভাই বোধহয় চিকিৎসা করাচ্ছে না ঠিকমত। পানি পড়াট খাওয়াচ্ছে কিংবা হোমওপ্যাথি করছে। অনুফা ইতস্তত করে বলল, আর একটা কথা ভাইসাব। হনলাম আপনে মিনুর কাছে মাঝেমধ্যে যান। আর যাইয়েন না।

জহুর ভাত মাখা বন্ধ করে অনুফার দিকে তাকাল। অনুফা বলল, আপনে রাগ। কইরেন না ভাইসাব।

না, রাগ করি নি। দুলাভাই কি আপনাকে বলেছেন আমাকে এই সব বলার জন্যে?

জ্বি-না, আপনের দুলাভাই আমারে কিছু কইতে কয় নাই। নিজের থাইক্যা কইলাম।

আচ্ছা ঠিক আছে, আর যাব না।

মাইয়াটার খুব বদনাম। বিধবা মাইনষের খুব অল্প বদনাম হয়। আর চাইটা ভাত নেন।


সন্ধ্যাবেলা মেয়ে দেখতে আসবার কথা। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সন্ধ্যার আগে আগে চৌধুরী সাহেব এসে হাজির। দবির মিয়া অতিরিক্ত রকমের ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

চৌধুরী সাহেব সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসার ঘরের চেয়ারে বসে রইলেন।

ছেলে নিজেই এল মেয়ে দেখতে। মুররির মধ্যে ছেলের বড়োভাই। ছেলে দেখে জহুর বেশ অবাক হল। সুন্দর চেহারা। কথায়বার্তায়ও চমৎকার। চুনীকে দেখে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকল না বা বন্ধুবান্ধবকে খোঁচা দিয়ে ভ্যাভ্যাক করে হাসল না। বেকুবের মতো জিজ্ঞেস করল না, এক সের বেগুন ড়ুবাতে কত সের পানি লাগে?

টুনী চলে যাবার পর ছেলের বড়ভাই বললেন, চৌধুরী সাহেব, মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে।

চৌধুরী সাহেব বললেন, আপনার পছন্দ হয়েছে বুঝলাম, ছেলের মত জিজ্ঞেস করেন।

হয়েছে, ছেলের হয়েছে। এখন আপনাদের যদি ছেলে পছন্দ হয় তাহলে দিনতারিখ করেন।

চৌধুরী সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, আমাদের একটা শর্ত আছে। যদি শর্তে স্বীকার হন, তাহলেই সম্বন্ধ হবে।

দবির মিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ছেলের বড়োভাই নড়েচড়ে বসল।

শর্তটা কি?

মেয়ে বড়ো গায়িকা। তার গান শুনলে বুঝবেন। শর্ত হল মেয়েকে গান-বাজনা শিখাতে হবে। কি বল দবির?

দবির মিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। চৌধুরী সাহেব বললেন, তোমার মেয়েকে ডেকে আন তো দবির। খালিগলায় একটা গান শুনিয়ে দিক।

টুনীকে আবার আসতে হল। গান শোনাতে হল। ছেলের বড়োভাই বললেন, আমাদের সাধ্যমত আমরা চেষ্টা করব।

কথা দিচ্ছেন তো?

জ্বি, কথা দিলাম।

তাহলে হাত তোলেন, মুনাজাত হোক।
 
বিয়ের তারিখ হল আষাঢ় মাসে। ছেলেদের দাবিদাওয়া কিছু নেই। মেয়েকে খুশি হয়ে যদি কিছু দেন, তাহলে সেটা তাদের ইচ্ছা।

দবির মিয়া চৌধুরী সাহেবকে এগিয়ে দিতে গেল। চৌধুরী সাহেব বললেন, ছেলে তোমার পছন্দ হয়েছে তো?

জ্বি, পছন্দ হয়েছে।

পছন্দ হওয়ারই কথা। বনেদি ঘরের ছেলে। এদের আচার-ব্যবহারই অন্য রকম।

তা ঠিক।

আর ছেলের পড়াশোনার কথা যা বলেছিলাম, তা ঠিক না। আই এ পাস করেছে।

দবির মিয়া অভিভূত হয়ে পড়ল। চৌধুরী সাহেব বললেন, আমি জহুরের চাকরিটার কথা বলে রেখেছি, জহুরকে লাগিয়ে দাও।

দবির মিয়া জবাব দিল না। চৌধুরী সাহেব অস্পষ্ট স্বরে বললেন, পুরনো কথা মনে রেখে লাভ নাই। আমার কিছু কিছু দোষ-ত্রুটি হয়েছে। সবারই হয়। ভুলের সংশোধন করার চেষ্টা করছি।

দবির মিয়া অস্পষ্ট স্বরে কী বলল, ঠিক বোঝা গেল না। চৌধুরী সাহেব বললেন, বহু ঝামেলা করতে হয়েছে, বুঝলে দবির। তিন বার মরতে মরতে বাঁচলাম। এক বার তো ঘরে ঢুকে কোপ দিয়েছিল। জান তো সব। জান না?

জ্বি, জানি।

টাকাপয়সা থাকলেই ঝামেলা হয়। এখন আর এই সব ভালো লাগে না।

দবির মিয়া বলল, আমি জহুরকে বলব, চৌধুরী সাহেব। আজ রাতেই বলব।

বাজারের বড় রাস্তায় উঠে আসার মুখে সাইফুল ইসলামের সঙ্গে দেখা হল। তার দৃষ্টি উদ্ভ্রান্ত। সে চৌধুরী সাহেবকে দেখে প্রায় ছুটে এল।

চৌধুরী সাব, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে।

কী ব্যাপার?

আমার ঘরে সন্ধ্যারাতে চুরি হয়েছে।

আছে কি তোমার ঘরে, যে চুরি হবে?

আমার হারমোনিয়ামটা চুরি হয়ে গেছে চৌধুরী সাব। ডবল রিডের হারমোনিয়াম।

দবির মিয়াকে স্তম্ভিত করে সাইফুল ইসলাম হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। চৌধুরী সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, এর মধ্যে কাঁদার কী আছে? যাও, থানায় গিয়ে ডাইরি করিয়ে আসা থানায় গিয়েছিলে?

জ্বি-না। আপনার বাড়িতে বসে ছিলাম।

আমার বাড়িতে কেন? আমি কে? যাও, থানায় যাও। এক্ষুণি যাও। সন্ধ্যারাতে চুরি-ডাকাতি হচ্ছে, এটা ভালো কথা না।



টুনী এবং অঞ্জু দুজনে এক খাটে শোয়। খাটটি প্রস্থে ছোট, দু জনের চাপাচাপি। হয়। এদের ঘরে কোনো ফ্যান নেই। বড় কষ্ট হয় গরমের সময়। সন্ধ্যার আগে। আগে বৃষ্টি হওয়ায় আজ অবশ্যি তেমন গরম লাগছে না। তবু টুনী বলল, গরম পড়েছে খুব। অঞ্জু কিছু বলল না। টুনী বলল, বাবা খাটটা একটু বড় করে বানালে পারতেন। তার সব কিছুতেই পয়সা বাঁচানর চেষ্টা।

অঞ্জু বলল, আমার একার জন্য খাটটা ঠিক আছে। আষাঢ় মাস পর্যন্ত কষ্ট করতে হবে।

টুনী কিছু বলল না। অঞ্জু বলল, ছেলেটাকে পছন্দ হয়েছে তো আপা?

মন্দ কী?

আমার কাছে ভালোই লাগল। ব্যবসা করে মনেই হয় না।

কেন, ব্যবসা করলেই মানুষ খারাপ হয় নাকি? সবাই তো আর বাবার মতো না।

কথার কথা বললাম, রাগছ কেন?

রাগছি না।

তোমার গানও থাকল।

ঐ সব থাকবে-টাকবে না। বলতে হয় তাই বলেছে। টুনী শুয়ে পড়ল। শোবার আগে জানালা বন্ধ করার নিয়ম। আজ আর কেউ জানালা বন্ধ করল না। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে, বেশ লাগছে। অঞ্জু এক বার বলল, জানালা খোলা থাকলে বাবা রেগে যাবে।

যাক রেগে।

অঞ্জু মৃদু স্বরে বলল, বিয়েটা তোমার ভালোই হবে আপা।

ভালো হলেই ভালো।

চৌধুরী সাহেব সম্পর্কটা ভালো এনেছেন, তাই না আপা?

কি জানি।

মানুষ তো আর চিরকাল খারাপ থাকে না।

হুঁ।

তোমার কি মনে হয়, মামা চৌধুরী সাহেবের চাকরিটা নেবে?

আমার কিছু মনেটনে হয় না। বকবক করিস না, ঘুমা।

অঞ্জুর হঠাৎ মনে হল টুনী কাঁদছে। সে অবাক হয়ে বলল, আপা কাঁদছ না-কি?

টুনী জবাব দিল না।
 
নীলগঞ্জ রেলস্টেশনের উত্তরের ফাঁকা জায়গাটায় চার-পাঁচ জন লোক কী যেন করছে। খুঁটি পোঁতা হচ্ছে। এক জনের হাতে কাগজ-পেন্সিল। সে গরমের মধ্যেও একটা হলদে রঙের কোট পরে আছে। চৌধুরী সাহেব রেলস্টেশন থেকে ব্যাপারটা দেখতে পেলেন। হচ্ছেটা কি? কোনো সরকারী অফিস-টফিস নাকি? তাঁর তো তাহলে জানার কথা। অবশ্যি আজকাল আর আগের মত খোঁজখবর রাখতে পারেন না। কিছুদিন আগেই হঠাৎ শুনলেন নীলগঞ্জে একটা অয়েল মিল বসান হয়েছে। বিদেশী লোকজন হুট-হাট করে কাজ করে। আগেভাগে কাউকে কিছু বলে না। চৌধুরী সাহেব খবর নিয়ে জানলেন, জন খাঁ অয়েল মিল দিয়েছে। ভাটি অঞ্চলের নতুন ধনী। জলমহালে পয়সা করে এখানে পয়সার গরম দেখাতে এসেছে। চৌধুরী সাহেব এক দিন গেলেন অয়েল মিল দেখতে। মিলের কাজকর্ম এখনন শুরু হয় নি, ভিত পাকা করা হচ্ছে। জনু খাঁ খুবই খাতির করল। দাঁত বের করে বলল, গরিবের ঘরে থতির পা।

আসলাম আপনার মিল দেখতে।

দেখবার কিছু নেই জনাব। গরিবী হালতে শুরু করলাম।

গরিবী হালত বলে অবশ্যি মনে হল না। নানান কিসিমের লোকজন দেখা গেল। জনু খাঁ পানির দেশ থেকে দলবল নিয়ে এসেছে। চৌধুরী সাহেব বললেন, শুকনার দেশে বসত করবেন মনে হয়।

তা ঠিক, চৌধুরী সাব। পানির দেশে ডাকাইতের ভয়টা বেশি।

চোর-ডাকাত তো সবখানেই আছে।

শুকনা দেশের ডাকাইত আর পানির দেশের ডাকাইত–কী যে আপনি কন চৌধুরী সাব! হেঁ-হেঁ-হেঁ।

বিদেশী লোকজন ঢুকে পড়ছে নীলগঞ্জে। লক্ষণ ভালো নয়। কিছু করা দরকার। সেই বছর চৌধুরী সাহেব সরিষার ব্যবসা করবেন ঠিক করলেন। পিডিপির ইঞ্জিনীয়ারদের কি-না-কি বললেন, যার ফলে একটা ট্রান্সমিটার নষ্ট হয়ে গেল। গোটা মাসে বাতি জ্বলল মিটমিট করে। জনু খাঁ ছ মাসের মাথায় অয়েল মিল বিক্রি করে ফেলল।

চৌধুরী সাহেব স্টেশনের উত্তরের ফাঁকা জায়গায় এসে হাজির হলেন। কড়া বোদ উঠেছে। ছাতা না আনায় তাঁর মাথা ঝাঁ-ব্য করতে লাগল। এই বছর বৃষ্টিবাদলা হচ্ছে না। খুব খারাপ লক্ষণ। চৌধুরী সাহেব গলা উচিয়ে ডাকলেন, এই যে, এই।

হলুদ কোট পরা লেকটা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। গায়ে কোট থাকলেও লোকটার চেহারা চাষাড়ে। সে উদ্ধত স্বরে বলল, কী চান?

নাম কি তোমার?

উদ্ধত ধরনের লোকদের আচমকা তুমি করে বললে তাদের প্রতিরোধ ভেঙে যায় এটি একটি বহু পরীক্ষিত তথ্য। চৌধুরী সাহেব আবার বললেন, নাম কি তোমার?

নাম দিয়ে কী করবেন?

এইখানে হচ্ছেটা কি?

সিনেমা হল হবে। বিউটি ছায়াঘর।

করছেটা কে?

নেসারউদ্দিন সাহেব।

নেসারউদ্দিন সাহেবটা কে?

ময়মনসিংহের। উনার আরো দুইটা সিনেমা হল আছে। নেত্রকোণায় একটা, ময়মনসিংহে একটা।

লোকটি চৌধুরী সাহেবের প্রশ্নে নার্ভাস বোধ করছিল। তা কাটাবার জন্যেই সে সিগারেট ধরাল।

বিদেশী লোজন আসতে শুরু করেছে। ছোট নীলগঞ্জ এখন আর ঘোট নয়। আর কিছু দিনের মধ্যেই হয়তো যে-কেউ ফস করে তার সামনে সিগারেট ধরাবে। চৌধুরী সাহেব ক্লান্ত পায়ে হাটতে শুরু করলেন। রোদ বড় কড়া। এই বয়সে এত রোদে হাঁটাচলা করা মুশকিল।
 
নীলগঞ্জ হাইস্কুলের কাছে আসতেই তার মনে হল আজ সকালে স্কুল কমিটির মিটিং ছিল, তিনি আসতে পারেন নি। এরকম ভুল তাঁর হয় না। হওয়াটা ঠিক নয়। বয়সের লক্ষণ। চৌধুরী সাহেব নীলগঞ্জ স্কুলে ঢুকে পড়লেন। হেডমাষ্টার সাহেবের ঘরে ফ্যান আছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রওনা হওয়া ভালো। মিটিংয়ে কিছু হয়েছে। নাকি তাও জানা দরকার। নীলগঞ্জ স্কুলের হেডমাষ্টার সাহেব লোকটি মহা চালবাজ এবং মহা ধূর্ত। ধূর্ত লোকজন সময়ে অত্যন্ত বিনয়ী হতে পারে। এইটি চৌধুরী সাহেবের ভালো লাগে। হেডমাষ্টার সাহেব খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, শরীরটা খারাপ নাকি চৌধুরী সাহেব?

নাহ্‌।

হেডমাষ্টার সাহেব স্কুলের দপ্তরীকে পাঠালেন ডাব আনতে।

চৌধুরী সাহেব বললেন, কাজে আটকা পড়েছিলাম। মিটিং হয়েছে?

জ্বিনা, আপনি ছাড়া মিটিং হবে কি? বুধবারে ডেট দিয়েছি। বুধবারে কোনো অসুবিধা নাই তো?

নাহ্‌।

হেডমাষ্টার সাহেব গলার স্বর দু ধাপ নিচে নামিয়ে বললেন, সোবাহান মোল্লা স্কুল ফাণ্ডে দশ হাজার টাকা দিয়েছে। নতুন পয়সা হয়েছে আর কি। হা-হা-হা।

চৌধুরী সাহেব ভ্রূ কুঁচকে বললেন, কবে দিল?

মিটিংয়ের সময় এসে বলে গেছে।

ও।

চৌধুরী সাহেব নড়েচড়ে বসলেন; লক্ষণ মোটই ভালো নয়। এই সব নতুন পয়সাওয়ালা লোকজন ভেসে উঠতে চেষ্টা করছে। চৌধুরী সাহেব মৃদুস্বরে বললেন, নীলগঞ্জে সিনেমা হল হচ্ছে।

আর বলেন কেন, দেশটা অধঃপাতে যাচ্ছে।

চৌধুরী সাহেব উঠে পড়লেন।

ডাব আনতে গেছে, একটু বসেন চৌধুরী সাহেব।

নাহ।

একটু বসেন। এসে পড়বে।

চৌধুরী সাহেব বসলেন না।

একটা রিকশা ডেকে দিই চৌধুরী সাহেব?

রিকশা লাগবে না।

নীলগঞ্জ বদলে যাচ্ছে। রিকশা পাওয়া যায় এখন। রাস্তাঘাটে অচেনা লোকজন দেখা যায়। বড়ো বড়ো অফিসাররা এখন আর চৌধুরী সাহেবের বাড়ি এসে ওঠেন না। তাদের জন্যে সরকারী ডাকবাংলা হয়েছে।

প্রচণ্ড রোদ উপেক্ষা করে চৌধুরী সাহেব হাঁটতে লাগলেন। তৃষ্ণা পেয়েছে। ডাবটা খেয়ে এলে হত। পাশ ঘেঁষে খালি রিকশা যাচ্ছে একটিা চৌধুরী সাহেব ভারি গলায় বললেন, এই থাম।

রিকশা থামল না। রিকশাওয়ালা সরু গলায় বলল, ভাড়া যাইতাম না।

নীলগঞ্জে এখন অনেকেই তাঁকে চেনে না। তিনি প্রচণ্ড একটা ধমক দিতে গিয়েও দিলেন না।

মসজিদের কাছাকাছি এসে শুনলেন ওয়াজ হচ্ছে। মসজিদের ইমাম সাহেব নতুন এসেছেন। আগের ইমাম সাহেবের ঘর-সংসার ছিল। ইনি এখনো বিয়েটিয়ে করেন নি। হাতে সম্ভবত কাজকর্ম কিছু নেই। সময়ে-অসময়ে মাইক ভাড়া করে নিয়ে আসেন। চৌধুরী সাহেব শুনলেন, ভাইসব, হাদিস-কোরানের কথা আজকাল কেউ শুনে না। মেয়েরা পর্দাপুশিদা করেন। হাটে-ঘাটে গজে-গ্ৰামে যুবতী মেয়েরা নাভির নিচে কাপড় পরে ঘুরে বেড়ায়–

ইমাম সাহেব অল্পবয়স্ক বলেই যুবতী মেয়েদের কথা তার ওয়াজে বারবার আসে। ওয়াজের ফাঁকে-ফাঁকে কোরান শরীফের আয়াত পড়া হয়। তাঁর কণ্ঠ অসম্ভব মধুর বলেই শুনতে বড়ো ভালো লাগে। কিন্তু আজ লাগছে না। চৌধুরী সাহেবের ইচ্ছা হল ইমাম সাহেবকে ডেকে একটা ধমক দেন। কিন্তু তা দেওয়া সম্ভব নয়। লোকটি আল্লাহ-খোদার নাম নিচ্ছে।
 
জহুর কাঁঠাল গাছের নিচে মোড়া পেতে বসে ছিল। বাড়ির অন্য কেউ এখনন ঘুম থেকে ওঠে নি। জেলখানার অভ্যেস জহুরের এখনন আছে, সূর্য ওঠার আগে ঘুম। ভাঙে। জহুর দেখল এই সাতসকালে সাইফুল ইসলাম হনহন করে আসছে। এই নিয়ে পরপর তিন দিন এল।

স্লামালিকুম জহুর ভাই।

ওয়ালাইকুম সালাম। কি ব্যাপার?

জহুর ভাই, আজকে ঠিক করেছি থানায় গিয়ে একটা ডাইরি করাব।

বেশ তো, করান।

আপনার কাছে একটা পরামর্শের জন্যে আসলাম।

এর মধ্যে আবার পরামর্শ কি?

না, এই বিষয়ে না। অন্য বিষয়ে।

জহুর লক্ষ করল সাইফুল ইসলাম আজ আবার একটু বিশেষ সাজগোজ করে এসেছে। ঘাড়ের কাছে পাউডারের সূক্ষ প্রলেপ। মিষ্টি একটা সেন্টের গন্ধও আসছে গা থেকে। সাইফুল ইসলাম কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, ভাবছি পত্রিকার অফিসে একটা চিঠি লিখব।

হারমোনিয়াম চুরির খবর পত্রিকা ছাপবে না।

জ্বি-না, সেইটা না। থানাতে এত বড়ো একটা খুন হয়ে গেল, সেই বিষয়ে।

ও।

বেনামে একটা চিঠি দিয়ে দেই, কি বলেন জহুর ভাই?

বেনামী চিঠি ওরা ছাপবে না।

সেই জন্যেই একটা পরামর্শ করতে আসলাম। ইয়ে, অন্য কারোর নাম দিয়ে দিলে কেমন হয়?

কার নাম দেবেন?

তাও তো কথা। ইয়ে, আপনার দুলাভাই শুনম চন্দ্রপুর গেছেন?

হুঁ।

ফিরবেন কবে?

কাল-পরশু ফিরবেন।

সাইফুল ইসলাম একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

দুলাভাইকে কিছু বলতে চান?

জ্বি-না, জ্বি-না।

সাইফুল ইসলাম চুপচাপ বসে রইল। এক সময় বলল, টুনীকে বলেছিলাম সিও সাহেবের বাসায় গিয়ে গলাটা সাধতে। ইমনের সরগম দিয়ে দিয়েছিলাম, সে যায় না। আসলাম যখন, তাকে বলেই যাই, কি বলেন?

ঠিক আছে, বলে যান। চা-ও খেয়ে যান।

গানের মধ্যে সরগমটাই আসল। গলা যত ভালোই হোক, সাধনা না থাকলে সব শেষ।

জহুর জবাব দিল না। সাইফুল ইসলাম রুমাল দিয়ে নাক মুছতে মুছতে বলল, এই যে কয়েক দিন কিছু করি নাই–এতেই আমার গলা টাইট হয়ে গেছে। সঙ্গীতের মতো কঠিন কিছু নাই।



নাশতা নিয়ে এল অঞ্জু। বাইরের লোক আছে বলেই কিনা কে জানে, আজ একটু বিশেষ ব্যবস্থা দেখা গেল। রুটির বদলে পরোটা তৈরী হয়েছে। ডিম ভাজার সঙ্গে সেমাই দেওয়া হয়েছে। একটি পিরিচে আবার পাকা পেপে টুকরো করে কাটা। সাইফুল ইসলাম বলল, ইয়ে, টুনীর সঙ্গে একটা কথা বলার ছিল। ও আর গান শিখতে যায় না।

অঞ্জু হাসিমুখে বলল, আপার বিয়ে ঠিক হয়েছে তো, সে এখন কোথায়ও যায় না।

বিয়ে ঠিক হয়েছে, কবে?

এই তো, কয়েক দিন।

ও।

ছেলে খুব ভালো। খুব সুন্দর চেহারা।

সাইফুল ইসলাম অবাক হয়ে অঞ্জুর দিকে তাকিয়ে রইল। আমাকে কেউ কিছু বলে নাই। ইয়ে, তাকে বল একটু আসতে।
 
টুনী ঘরের ভিতর ঢুকল না। দরজার পাশে দাঁড়াল। অঞ্জুর কাছে মনে হল টুনীর চোখ দুটি অস্বাভাবিক ফোলা-ফোলা। যেন প্রচুর কান্নাকাটি করে এসেছে।

টুনী স্বরে বলল, স্যার ডেকেছিলেন?

হুঁ।

কিছু বলবেন?

না, বলব আর কি? সিও সাহেবের বাসায় যাও না। ভাবলাম…

টুনী তাকিয়ে রইল। সাইফুল ইসলাম কথার মাঝখানে থেমে গেল। যেন আর তার কিছু বলার নেই। টুনী বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে করে রান্নাঘরে চলে গেল।

অঞ্জু চায়ের চিনি আনতে গিয়ে দেখে টুনী রুটি বেলছে। তার চোখে সূক্ষ্ম জলের রেখা। অজু কিছু বলল না। তার নিজেরও কান্না আসতে লাগল।



চুরি তো তিন-চার দিন আগে হয়েছে, এত দিন পর আসলেন যে?

সাইফুল ইসলাম ঢোক গিলল। ওসি সাহেব বললেন, হারমোনিয়াম ছাড়া আর কী গেছে?

আর কিছু না।

চুরি-টুরি হলে সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্ট করা দরকার। সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্ট হলে আমরা খোঁজখবর করতে পারি। দাগী চোরদের ডেকে ধমকামকি দিলে বের হয়ে পড়ে। বুঝলেন?

জি স্যার।

আরে, চুরি তো ছোট জিনিস, খুনের খবর দিতেই লোক তিন-চার দিন দেরি করে।

সাইফুল ইসলাম কথা বলল না। ওসি সাহেব বললেন, কেন দেরি করে জানেন?

জ্বি-না।

কাকে কাকে আসামী দেবে, সেই শলাপরামর্শ করতে গিয়ে দেরি হয়। যত পুরনো শত্র আছে, সব আসামী দিয়ে দেয়। বুঝলেন?

জি স্যার।

তার ফলে আসল যে কালটি, তার কিছু হয় না। আরে ভাই, পুলিশ যে খারাপ তা তো সবাই জানে, আপনারাও যে খারাপ–এইটা সবাই জানে না।

ওসি সাহেব চুরির এফআইআর করলেন। হারমোনিয়াম কোন দোকানের, কবে কেনা, সব লেখা হলে বললেন, এর নিচে নাম সই করেন। ঠিকানা লেখেন। দেখব, কিছু হয় কিনা।

সাইফুল ইসলাম নাম সই করল। সেই নামের দিকে ওসি সাহেব দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থেকে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আপনাকে দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

জি স্যার, করেন।

মনসুরের ব্যাপারটা নিয়ে আপনি ঝামেলা পাকাবার চেষ্টা করছেন, এর কারণ বলেন তো?

সাইফুল ইসলাম তোক গিলল।

ওর বাবাকে কয়েক দিন রেখেছেনও আপনার এখানে। ঠিক না?

জ্বি স্যার।

ঐ টাউটটা এখন কোথায়?

বাড়িতে চলে গেছে।

আপনি তো বেনামী চিঠিপত্র ছাড়ছেন চারিদিকে। ঠিক না?

সাইফুল ইসলাম কপালের ঘাম মুছল। তারপর শুকনো গলায় বলল, স্যার, এক গ্রাস পানি খাব।

এই, এঁকে পানি দাও তো এক গ্লাস। পানি খেয়ে ঠাণ্ডা হন। ঠাণ্ডা হয়ে জবাব দেন।

সাইফুল ইসলাম কলকল করে ঘামতে লাগল।

হুঁ, এখন বলেন তো মতলবটা কী? শোনেন, দশ বছর ধরে পুলিশে আছি। আমাদের কারবারই খারাপ লোকদের সাথে। আপনার মতো লোক বহুত দেখেছি। মিচা শয়তান। আড়ালে কলকাঠি নাড়াবার আসল শয়তান।

আচমকা প্ৰচণ্ড একটা চড় কমিয়ে দিলেন ওসি সাহেব। সাইফুল ইসলাম স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার মনে হল পায়জামাটা ভিজে গেছে। প্রস্রাব হয়ে গেছে। সম্ভবত।

চলেন আমার সাথে। আপনার ঘর সার্চ করব।

জ্বি, কী বললেন স্যার?

আপনার ঘর সার্চ হবে।

ওসি সাহেব উঠে দাঁড়ালেন।

মিচকা শয়তান, ছিঁচকা শয়তান, সব শয়তান টাইট দেওয়ার ওষুধ আমাদের আছে। ওঠেন তো দেখি এখন।
 
ট্রেন থেকে নেমেই দবির মিয়া খবরটা শুনল–সাইফুল ইসলামকে বিশ বার কানে ধরে ওঠ-বস করা হয়েছে।

সে একটা কাণ্ড দবির ভাই, বাজারের সব লোক আসছিল মজা দেখতে। সাইফুল ইসলামের কান্দন যদি দেখতেন। হা-হা-হা-।

বিষয় কি?

আর বলেন কেন, মেয়েছেলেদের কাছে লেখা খারাপ খারাপ চিঠি পাওয়া গেছে। চৌধুরী সাহেবের কাছে সব আছে।

কানে ধরে উঠ-বস করিয়েছে কে?

সালিসি হয়েছে। চৌধুরী সাহেব ছিলেন। থানাওয়ালারা ছিল। মোক্তার সাব ছিল। সরদার বাড়ির লোকও ছিল। ধুন্ধুমার কাণ্ড।

দবির মিয়া নিজের দোকানে এসে পৌছাবার আগে আরো তিন বার সমস্ত ব্যাপারটা শুনল। পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হলেই হাসিমুখে জিজ্ঞেস করছে, ব্যাপার শুনছেন নাকি?

হুঁ, শুনেছি।

কানে ধরে উঠ-বস করয়েছে। হা-হা-হা।

শুনেছি।

আর কান্দা যদি দেখতেন। চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে দেখা করে যান। চিঠি সব। আছে তাঁর কাছে।

চিঠি দিয়ে আমি করব কি?

আপনার মেয়ের কাছে লেখা চিঠিও তো থাকতে পারে। সেও তো গান শিখেছে।

দবির মিয়া স্তম্ভিত হয়ে গেল। বলে কি।

কোনো ভদ্রলোকের ছেলে এমন চিঠি লেখতে পারে। চিঠিতে হাত দিলে হাত দেওয়া লাগে সাবান দিয়ে, বুঝলেন। হা-হা-হা।



সন্ধ্যার পর দবির মিয়া চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেল। চৌধুরী সাহেব বললেন, ঘটনা শুনেছ?

জ্বি, শুনলাম।

অনেকে বলছিল মাথা কামিয়ে দিতে। সেটা আবার বাড়াবাড়ি হয়ে যায়।

যেটা করেছেন, সেটাই বিরাট বাড়াবাড়ি হয়েছে চৌধুরী সাব।

বল কি তুমি দবির।

নিজের ঘরে বসে চিঠি লিখেছে, তাতে কী যায় আসে?

পড়ে দেখ তুমি। তোমার মেয়ের কাছে লেখা চিঠিও আছে।

থাকুক। চিঠি তো সে পাঠায় নাই।

চৌধুরী সাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন, সব চিঠি যে পাঠায় না, তা-ও ঠিক না। থানাওয়ালাদের কাছে দুইটা চিঠি লিখেছে। পত্রিকা অফিসে লিখেছে। আমার কাছে লিখেছে।

আপনার কাছে কী লিখেছে?

আমি নাকি খুনখারাবি করি। আমি নাকি বুড়া শয়তান। ছোটলোকের আস্পর্ধা দেখ!

চৌধুরী সাহেব একদলা থুথু ফেললেন। তাঁর ভাব দেখে মনে হল পুরনো শক্তিসামৰ্থ্য ফিরে পাচ্ছেন। তিনি শক্ত সুরে বললেন, একে আমি নীলগঞ্জ ছাড়া করব। আমার সাথে ফাইজামি।



দবির মিয়া বাড়ি ফিরল অনেক রাত্রে। ঘর অন্ধকার। ইলেকট্রসিটি নেই। রান্নাঘরে শুধু হারিকেন জ্বলছে। জহুর বারান্দায় বসে সিগারেট টানছিল। দুলাভাইকে দেখে ফেলে দিল। দবির মিয়া শান্ত সুরে বলল, বাজারের ঘটনা শুনেছ?

জি, শুনেছি।

বাজারে গিয়েছিলে?

জ্বি-না।

দবির মিয়া বেঞ্চির উপর বসল। ঠাণ্ডা গলায় বলল, এত বড়ো একটা অন্যায় হয়েছে, আর তুমি কিছুই করলা না?

জহুর চুপ করে রইল।

তুমি মাছের মতো হয়ে গেছ জহুর।

জহুর জবাব দিল না। দবির মিয়া দীর্ঘ সময় অন্ধকারে বসে রইল। একটি সিগারেট ধরিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল, সব মানুষ মাছের মত হলে বাঁচা যায় না। দুএক জন অন্যরকম মানুষ লাগে। জহুর অস্পষ্টভাবে কী বলল, পরিষ্কার বোঝা গেল না।

টুনী এসে বলল, ভাত দেওয়া হয়েছে বাবা।

দবির মিয়া নড়ল না, বসেই রইল।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top