What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected চক্ষে আমার তৃষ্ণা -উপন্যাস (2 Viewers)

বিলের মাছ কি করে বুঝলে?

কালো রঙ। বিলের মাছ কালো হয়। নদীর মাছ হয় সাদা। এই মাছ আজ তুই রাঁধবি। You are cooking.

তরু বলল, বাবা ভুলভাল ইংরেজি বলবে না। শুনতে খুবই খারাপ লাগে। বিলের মাছ আমি রাঁধব না। মাছটা নষ্ট হবে। আমি রাঁধতে পারি না।

কোনো চিন্তা করবি না। আমি ডিরেকশন দেব।

তুমি রাঁধতে জানো?

অবশ্যই জানি। দিনের পর দিন বেঁধেছি। তুই রান্নার জন্যে মেন্টাল প্রিপারেশন নিয়ে নে। আমি মাছ কাটিয়ে আনছি।

খালেক মহাব্যস্ত ভঙ্গিতে বের হয়ে গেলেন। তরু সঙ্গে সঙ্গে ছাদে উঠে গেল। ওসমান ঠিক আগের জায়গাতেই আছেন। চোখ বন্ধ করে গায়ে রোদ মাখাচ্ছেন। তরুর পায়ের শব্দে চোখ মেললেন। তরু বলল, আপনি তো সৰ্ববিদ্যা বিশারদ। মাছ রাঁধতে পারেন?

কি মাছ?

বোয়াল মাছ।

সাইজ কি?

বিশাল সাইজ।

ওসমান বললেন, বোয়াল মাছের প্রধান সমস্যা তার আঁশটে গন্ধ অন্য মাছের চেয়ে বোয়াল মাছের আঁশটে গন্ধ বেশি। এই গন্ধ দূর করার জন্যে প্রথমেই সামান্য লবণ এবং লেবু দিয়ে মাছটাকে কচলে আঁশটে গন্ধ বের করে ফেলবে। কয়েকবার গরম পানিতে ধুবে।

তারপর?

যেহেতু মাছের সাইজ অনেক বড়, মাংসের মশলা কিছু লাগবে।

তরু বলল, পুরো রেসিপি বলুন। আজ আমি বোয়াল মাছ রাধব।

পাতিলে তেল দিবে। তেল যখন গরম হবে তখন পেঁয়াজ বাটা দেবে। পেঁয়াজ বাটা ভাজা ভাজা হবার পর সামান্য হলুদ, শুকনা মরিচ দেবে। খুব সামান্য জিরা বাটা দিতে পারো। বড় মাছ বলেই জিরা বাটা। সামান্য আদা বাটা। চায়ের চামচে এক চামচ মেথি দিলে সুন্দর ফ্লেবার হবে। মশলা কষানো হলে পানি দেব। এরপর মাছ দেবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাছ সেদ্ধ হয়ে যাবে, তখন ধনে পাতা দিয়ে হাঁড়ির মুখ বন্ধ করে চুলা বন্ধ করে দিতে হবে।

লবণ লাগবে না?

অবশ্যই লাগবে তবে বোয়াল মাছ কিছুটা লবণাক্ত। লবণ কম দিতে হবে। এই রান্নাতে যদি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির ফ্লেবার দিতে চাও তাহলে চায়ের চামচে আধা চামচ চিনি দিতে পারো। ঠাকুরবাড়ির মহিলারা ঝাল খাবারে চিনি মেশানো শুরু করেছিলেন। অনেকেই তাদের অনুসরণ করে। আমার মতে চিনি না মেশানোই ভালো। তবে আমি একটা বিশেষ ইনগ্রেডিয়েন্ট দিতে বলব। যদি দাও অসাধারণ জিনিস হবে।

কি ইনগ্রেডিয়েন্ট?

মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট। চায়নিজ খাবারে স্বাদ বর্ধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। টেস্টিং সল্ট বলে।

তরু বলল, আপনি রান্না শিখলেন কোথায়?

ওসমান বললেন, বই পড়ে। যারা বেড়াতে যেতে পারে না তারা ভ্রমণের বই পড়ে। যারা রাঁধতে পারে না তারা রান্নার বই পড়ে।

তরু বলল, ভাত ঝরঝরা করার উপায় কি? আমি রান্না করলেই একটার গায়ে একটা ভাত লেগে যায়।

ওসমান বললেন, প্রতিটি চাল একটা একটা করে আলাদা সিদ্ধ করবে। তারপর একত্র করে পরিবেশন করবে।

ঠাট্টা করলেন?

হ্যাঁ।

আগের রেসিপিটা কি ঠাট্টা না রিয়েল?

আগেরটা রিয়েল। আমি সাধারণত ঠাট্টা করি না। পঙ্গুরা ঠাট্টা-তামাশার ব্যাপারে খুব সাবধান।
 
তরুর বাবা আগ্রহ করে বোয়াল মাছ খেলেন এবং বিস্মিত হয়ে বললেন, তুই এত ভালো রান্না কার কাছে শিখেছিস? আমি আমার লাইফে এত ভালো বোয়াল মাছের ঝোল খাই নাই।

তরু বলল, বাবা বেশি বেশি হচ্ছে না?

খালেক বললেন, বেশি বেশি হচ্ছে না। কম কম হচ্ছে। তোকে গোল্ড মেডেল দেয়া দরকার। রান্নায় স্বর্ণপদক।

মেডেলে কি বোয়াল মাছের ছবি আঁকা থাকবে?

ঠাট্টা না আমি সিরিয়াস। সত্যি আমি তোকে একটা গোল্ড মেডেল দেব। তুই কি মাংস রান্না করতে পারিস? খাসির মাংস রান্না করতে পারবি?

চেষ্টা করে দেখতে পারি। আচ্ছা বাবা, মায়ের রান্নার হাত কেমন ছিল?

খালেক বললেন, সে যা রাঁধত সবই অখাদ্য। সেই অখাদ্য রান্না নিয়ে কিছু বললে মুখ ভোঁতা করে রাখত।

তরু বলল, তোমার কি তখন ইচ্ছা করত মুখে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলি!

খালেক খাওয়া বন্ধ করে বললেন, এটা কেমন কথা?

তরু বলল, কথার কথা বললাম।

খালেক বললেন, এটা কি ধরনের কথার কথা? তোর সমস্যাটা কি?

কোনো সমস্যা নেই।

সমস্যা অবশ্যই আছে। সমস্যা ছাড়া কেউ এ ধরনের কথা বলে না।

সরি বাবা।

সবসময় সৃরিতে কাজ হয় না। এমন একটা ভয়ংকর কথা তোর মাথায় এলো কিভাবে?

তরু বলল, বাবা আমি একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস লিখছি। সেখানে এক ভদ্রলোক তার প্রথম স্ত্রীকে খুন করে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তারপর দ্বিতীয় স্ত্রীকেও খুন করেন। সারাক্ষণ উপন্যাসের প্লট নিয়ে ভাবি তো এই জন্যেই মুখ ফসকে বলে ফেলেছি।

খালেক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তোর ডিটেকটিভ উপন্যাস লেখার দরকার কি? লেখালেখি হচ্ছে মাথার পোকা, খবরদার মাথায় পোকা ঢুকাবি না।

আচ্ছি।

একটা কথা বলে খাওয়ার আনন্দটাই নষ্ট করে ফেলেছিস।

সরি বাবা।

খালেক প্লেট রেখে উঠে পড়লেন। দ্বিতীয় মাছের পেটিটা তিনি মাত্র নিয়েছেন। এখনো মুখে দেন নি। এতে তরুর খুব যে মন খারাপ হলো তাও না। সে নিজে মাছ খেল না। তার গা দিয়ে বোয়াল মাছের বোটকা গন্ধ বের হচ্ছে। সে এক ঘন্টা সময় নিয়ে গরম পানি দিয়ে গোসল করল, তাতেও গা থেকে বোটকা গন্ধ দূর হলো না। দুপুরে সে কিছুই খেল না। দুপুরে তার ঘুমানোর অভ্যাস নেই। তবে ছুটির দিনে সে কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করে। তার মোবাইলে সুডোকু নামে অংকের একটা খেলা আছে। এই খেলাটা খেলে। সুডোকুতে সে ভালোই এক্সপার্ট হয়েছে। জাপানের টোকিওতে প্রতি বছর সুডোকু উৎসব হয়। তার ধারণা বাংলাদেশ থেকে কেউ তাকে সুডোকু উৎসবে পাঠালে সে প্রাইজ নিয়ে ফিরত।

তরু সুডোকু খেলতে খেলতেই ঘুমিয়ে পড়ল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই স্বপ্ন দেখল। স্বপ্নে ওসমান সাহেব খোলা দরজা দিয়ে তার ঘরে ঢুকেছেন। হেঁটে হেঁটে ঢুকেছেন। তরু বলল, আপনার অসুখ সেরে গেছে?

তিনি বললেন, হুঁ।

বোয়াল মাছ রান্না করে পাঠিয়েছিলাম। খেয়েছেন?

হুঁ।

খেতে কেমন হয়েছে বললেন না তো!

তোমাকে অতি জরুরি একটা কথা বলতে এসেছি। হাতে সময় নেই।

স্বপ্নের এই পর্যায়ে দেখা গেল তিনি চক-ডাস্টার হাতে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়ানো। গম্ভীর গলায় বক্তৃতা দিচ্ছেন।

স্ট্যাটিসটিক্স বলছে দশ দশমিক দশ ভাগ স্ত্রী স্বামীর হাতে খুন হয়। তিন রকম খুন আছে। ক শ্রেণীর খুন, খ শ্রেণীর খুন এবং গ শ্রেণীর খুন।

ক শ্রেণীর খুন অনিচ্ছাকৃত। স্বামীর ধাক্কা খেয়ে স্ত্রী উল্টে পড়ে মাথায় ব্যাথা পেলেন। সেখান থেকে রক্তক্ষরণজনিত কারণে মৃত্যু।

খ শ্ৰেণী খুন Impulse-এর বশবর্তী হয়ে খুন। হঠাৎ প্রচণ্ড রেগে গিয়ে স্বামী এই কাজটি করেন। রাগ কমে যাবার পর তার দুঃখের সীমা থাকে না। তখন সে নিজেও আত্মহত্যা করতে চায়।

গ শ্রেণীর খুন। এরা ঠাণ্ডামাথায় একের পর এক খুন করে। এদের বলা হয় Serial Killer, যেমন তোমার বাবা খালেক সাহেব।

তরু বলল, স্যার (স্বপ্নে মনে হচ্ছিল ওসমান সাহেব তার শিক্ষক। কিছুক্ষণের জন্যে লেকচার বন্ধ রাখবেন। আমার একটা কল এসেছে জাপানের রাজধানী টোকিও থেকে। সুডোকু কম্পিটিশনে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ।

তরুর ঘুম ভাঙল মোবাইল ফোনের শব্দে। সে টেলিফোন ধরে বলল,?

আমি সনজু।

কি চাও?

আমার বুবুকে দুলাভাই ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। সে কলতলায় বসে আছে। তাকে একটু ঘরে নিয়ে যান।

তুমি বলো আমাদের ঘরে আসতে।

সনজু ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, বুবুর গায়ে কোনো কাপড় নাই। বুবুকে উনি নেংটো করে ঘর থেকে বের করে দিয়েছেন।

কি বলছ এসব?

সত্যি কথা বলছি। একটা চাদর নিয়ে কলতলায় যান।

তরু চাদর নিয়ে কলতলায় গিয়ে দেখে সনজুর বোন সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। থরথর করে কাঁপছে। সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে গভীর লজ্জাবোধের বাইরেও কিছু আছে যা চট করে ব্যাখ্যা করা যায় না। তরু চাদর দিয়ে মহিলাকে ঢেকে দিল।

তরু বলল, আপনি ঘরে আসুন।

মহিলা তাকালেন। তরুর কথা বুঝতে পারলেন বলে মনে হলো না। সনজুকে দেখা যাচ্ছে। সে কলতলার দক্ষিণে পেয়ারা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে। সে তাকিয়ে আছে গেটের দিকে। কলতলায় কি ঘটছে তা সে জানে না, এরকম একটা ভঙ্গি।

তরু আবার বলল, আসুন।

ভদ্রমহিলা নড়ে উঠলেন। কিন্তু আগের মতোই জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলেন। সনজু পেয়ারা গাছের নিচ থেকে বলল, বুবু যাও। উনার সঙ্গে যাও।
 
বেশিরভাগ দিন খালেক বাসায় খেতে আসেন না। দুপুর বেলাটা ব্যবসাবাণিজ্যের জন্যে কঠিন সময়। জটিল সমস্যার সমাধান হয় দুপুরে মানুষ যখন ক্ষুধার্ত থাকে তখন। ঝামেলা মিটিয়ে মানুষ তখন খেতে বসতে চায়। ক্ষুধার্ত মানুষ ঝামেলা নিতে পারে না। খালেক নিয়ম করে রেখেছেন বড় ধরনের ঝামেলা ছাড়া তিনি দুপুরে বাসায় থাকবেন না। আজ বাসায় এসেছেন। কারণ জ্বরে তার শরীর পুড়ে যাচ্ছে।

জ্বর উঠেছে কাঠের দোকানে। একশ সিএফটি সেগুন কাঠ কিনতে গিয়েছেন। দরদাম ঠিক করছেন। হঠাৎ তার মাথায় চক্কর দিয়ে উঠল। তিনি ধপ করে বসে পড়লেন। কাঠের দোকানের মালিক আনিস বলল, কি হয়েছে?

মাথাটা হঠাৎ চক্কর দিয়ে উঠল।

পানি খাবেন। একটু পানি খান।

খালেক পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে পানি নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, পানি তিতা লাগছে।

আনিস বলল, বাসায় যান। বাসায় গিয়ে শুয়ে থাকেন। সঙ্গে কি গাড়ি আছে?

জি না।

গাড়ি দিচ্ছি। আপনাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসবে। কাঠ আরেকদিন কিনবেন।

খালেক বললেন, কাঠ আজই কিনব। আমি কাজ ফেলে রাখি না।

আনিস বলল, ক্যাশিয়ারের কাছে টাকা জমা দিন। আপনার একশ সিএফটি কাঠ আমি আমার দায়িত্বে জায়গামতে পৌছায়ে দিব। আপনি অসুস্থ মানুষ, আপনি আমার উপর ভরসা করেন।

খালেক বললেন, ভরসা করলাম। আনিস নামের যুবকটাকে তার পছন্দ হয়েছে। চেহারায় কাঠিন্য আছে। কথাবার্তায় নেই। সব ব্যবসায়ীর মধ্যেই কাস্টমারের সামনে হাত কচলানো স্বভাব আপনাতেই চলে আসে। এর মধ্যে নেই।

আনিস বলল, আপনি কিছুক্ষণ শুয়ে থাকুন আমি ডাক্তার খবর দিয়েছি। আপনার প্রেসারটা দেখবে।

খালেক বলল, কোনো দরকার নাই।

আনিস বলল, দরকার আছে কি নাই সেটা ডাক্তার বুঝবে। আপনার কি ডায়াবেটিসের কোনো সমস্যা আছে?

কখনো মাপি নাই।

একটা বয়সের পরে শরীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা মাঝে মধ্যে করা উচিত। আমার বাবার ছিল হাই ডায়াবেটিস, হাই প্রেসার। কোনোদিন পরীক্ষা করান নাই। একদিন আমি জোর করে পরীক্ষা করালাম। সব অসুখ-বিসুখ একসঙ্গে ধরা পড়ল। ছয় মাসের মধ্যে মৃত্যু। আমি ব্যবসা করা টাইপ ছেলে না। বাবার ব্যবসা হঠাৎ এসে মাথার মধ্যে পড়েছে।

আগে কি করতেন?

পাস করার পর কিছুই করতাম না। অভিনয়ের সখ ছিল। যারা প্যাকেজ নাটক করে এদের পিছে পিছে অনেক ঘুরেছি। খুবই ফালতু ধরনের কয়েকটা ক্যারেক্টারে অভিনয়ও করেছি। এখন সব বাদ।

বিয়ে করেছেন।

জি না।

খালেকের হঠাৎ মনে হলো তরুর পাশে এই ছেলেটাকে খুবই মানায়। দুজনের চেহারায় কোথায় যেন একটা মিলও আছে।

ডাক্তার চলে এসেছে। প্রেসার নরমাল পাওয়া গেল। সুগারও মাপা হলো। র্যানডমে ৬.২ এসব কিছু না। আনিসের গাড়িতে করে তিনি বাসায় ফিরলেন। বত্রিশ ভাগা ব্যবসায়ীর লক্কর গাড়ি না। কালো রঙের ঝকঝকে গাড়ি। গাড়ির ভেতর বেলি ফুলের গন্ধ। খালেক ভেবেছিলেন এয়ার ফ্রেশনার দেয়া। পরে লক্ষ করলেন পেছনের সিটে বেতের ছোট্ট ঝুড়ি ভর্তি বেলী ফুল।

খালেক বাসায় ফিরলেন জ্বর নিয়ে। তার চোখ লাল। শরীর কাপছে। দৃষ্টি সামান্য উদ্ভ্রান্ত। তরু বলল, বাবা কি হয়েছে?

খালেক বললেন, সব ঠিক আছে। ডাক্তার চেক করেছে।

তরু বলল, শরীর পুড়ে যাচ্ছে। ডাক্তার কি চেক করেছে বুঝলাম না।

তুই ইউনিভার্সিটিতে যাস নাই?

না। বাসায় একটা ঝামেলা হয়েছে এই জন্যে যেতে পারিনি।

কি ঝামেলা?

কি ঝামেলা পরে শুনবে। এখন বিছানায় এসো। গা স্পঞ্জ করে দিব। তুমি তো ঠিকমতো হাঁটতেও পারছ না। আমার ঘাড়ে হাত রাখো।

খালেক বললেন, দরজা-জানালা বন্ধ করে দে। চোখে আলো লাগছে।
 
তরু বাবার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। সিলিং ফ্যান হালকা করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। জানালা বন্ধ। খোলা দরজা দিয়ে সামান্য আলো আসছে। খালেক তার মাথার কাছে বসা মেয়েকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন এবং এই প্রথম মনে হলো এমন রূপবতী মেয়ে তিনি তার জীবনে দ্বিতীয়টা দেখেন নি।

খালেক বললেন, তোর জন্যে আজ একটা ছেলে দেখলাম।

ভালো করেছ।

আমার খুবই পছন্দ হয়েছে।

তরু জলপট্টি বদলাতে বদলাতে বলল, বিয়ের কথা পাকা করে চলে এসেছ নাকি বাবা?

না তোর পছন্দটা তো জানি না। তোর কি রকম ছেলে পছন্দ?

শায়লা ভাবীর হাসবেন্ডের মতো ছেলে আমার পছন্দ।

শায়লা ভাবী কে?

আমাদের ভাড়াটে। সনজুর বুবু।

খালেক অবাক হয়ে বললেন, সনজুর দুলাভাইয়ের মতো ছেলে তোর পছন্দ?

হুঁ।

কেন? সে তো শুনেছি তার স্ত্রীর সঙ্গে খুবই খারাপ ব্যবহার করে।

এই জন্যেই তো তাকে আমার পছন্দ। আমার হাসবেন্ড আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে আর আমি তাকে শায়েস্তা করব। এতেই আমার আনন্দ।

তোর কথাবার্তার কোনো মা-বাপ নাই।

সনজুর দুলাভাই কি করেছে জানো। আজ তার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। এমন এক নোংরা কারণে তালাক দিয়েছে যে শুনলে তোমার ইচ্ছা করবে লোকটাকে খুন করতে।

কি কারণ?

কি কারণ তোমাকে বলতে পারব না। তোমাকে কেন কাউকেই বলতে পারব না। বাবা শোনো, ঐ মহিলার কোথাও যাবার জায়গা নেই। তার এক ফুপু আছেন সেখানেও তিনি যেতে চাচ্ছেন না। উনি আছেন আমাদের এখানে। গেস্টরুমটা উনাকে ছেড়ে দিয়েছি।

খালেক বিরক্ত গলায় বললেন, কি বলিস তুই, আমার এখানে কেন থাকবে?

যাবে কোথায়?

যাবে কোথায় সেটা তো আমার দেখার কথা না।

তরু বলল, বাবা! তোমার জ্বর আরো বাড়ছে। এই সময় কথাবার্তা বন্ধ রাখো। জ্বর থামুক। তারপর যদি মহিলাকে এ বাড়িতে রাখতে না চাও ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় বের করে দেবে। আমি কিছুই বলব না। এখন ঘুমুতে চেষ্টা করো। চোখ বন্ধ করো।

খালেক সাহেব চোখ বন্ধ করলেন। প্রবল জ্বরের ঘোরে তিনি বিকট সব দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। একটি স্বপ্নে তিনি কাঠের একটা বাক্সে শুয়ে আছেন। তার গায়ে চায়ের পাতা ঢালা হচ্ছে। তিনি বলছেন, শুধু চায়ের পাতায় হবে না। বরফ দিতে হবে। তরু বলল, বরফ দিলে তোমার ঠাণ্ডা লাগবে বাবা। কপুর দিচ্ছি। চা পাতা এবং কর দিলেই হয় আর কিছু লাগে না। এখন চোখ বন্ধ রাখো আমি বাক্সের ডালা বন্ধ করব।

হাতুড়ি-পেরেক এনেছিস?

হুঁ।

সাবধানে পেরেক পুতবি। হাতে যেন না লাগে।

আচ্ছা।

তরু বাক্সের ডালা বন্ধ করল। বাক্সটা এখন অন্ধকার। খালেক একটু পর পর পেরেক পোঁতার শব্দ শুনতে শুনতে গভীর ঘোরে চলে গেলেন। তাঁর ঘোর ভাঙল হাসপাতালে।

অপরিচিত একজন তরুণী তাঁর গায়ের চাদর ঠিকঠাক করে দিচ্ছে। খালেক বললেন, কে?

তরুণী জবাব না দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল এবং তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঢুকল তরু। তরু বলল, বাবা একটু কি ভালো লাগছে?

খালেক বললেন, ঐ মেয়ে কে?

তরু বলল, সনজুর বোন।

সনজুটী কে?

জামান সাহেবের স্ত্রীর ছোট ভাই। শালা শব্দটা বলতে খারাপ লাগে বলে স্ত্রীর ছোট ভাই বললাম।

খালেক বললেন, জামান সাহেবটা কে?

তরু বলল, আমাদের এক তলার ভাড়াটে। বাবা এত কথা বলতে হবে। রেস্ট নাও। তোমার শরীর যে কতটা খারাপ তুমি জানো না। অজ্ঞান ছিলে চার ঘণ্টা।

খালেক বললেন, ঐ মহিলা এখানে কি করছে?

তরু বলল, সারাক্ষণ তোমার পাশে কাউকে থাকার কথা। আমি একা তো পারি না। উনি মাঝে মাঝে আমাকে সাহায্য করেন।

তার নাম কি?

শায়লা। বাবা প্রশ্ন শেষ হয়েছে? এখন চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করো। ক্ষিদে লেগেছে? কিছু খাবে? কমলার রস দেব?

না।

এক কাপ দুধ খাবে বাবা? কিংবা চিকেন স্যুপ। চামচে করে স্যুপ দেই? খেতে না পারলে খাবে না।

খালেক বললেন, আচ্ছা দে।

শুরু বড় চামচে করে স্যুপ খালেক সাহেবের মুখে ধরন্থে। তিনি খাচ্ছেন। খেতে ভালো লাগছে। টক-ঝাল স্যুপ। কোনোটাই বেশি না। টকও না ঝালও না। স্যুপ থেকে ধনিয়া পাতার গন্ধ আসছে। গন্ধটাও ভালো লাগছে।

স্যুপ কে বানিয়েছে, তুই?

শায়লা নামের মেয়েটা বানিয়েছে?

হুঁ। খেতে কি ভালো লাগছে বাবা?

লাগছে। তোর মা-ও ভালো সুপ বানাত। এই একটা জিনিসই সে ভালো পারত। এক গাদা ধনে পাতা দিত।

তরু ফট করে বলে ফেলল, বাবা এই মহিলাকে তুমি বিয়ে করে ফেললে তোমার সেবা-যত্ন খুব ভালো হবে। উনি খুব সেবা করতে পারেন।

খালেক মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর নিজের মেয়ে এ ধরনের কথা তার বাবাকে বলতে পারে তা তিনি স্বপ্নেও চিন্তা করেন নি। তাঁর উচিত এই মুহূর্তে মেয়ের গালে কষে চড় লাগানো। চড় না দিতে পারলেও কঠিন কঠিন কিছু কথা বলা দরকার। কথা বলার সুযোগ হলো না। শায়লা ঘরে ঢুকছে, সঙ্গে ডাক্তার। ডাক্তার ব্লাড প্রেসার দেখার জোগাড় করছে। খালেক অস্বস্তি নিয়ে শায়লার দিকে তাকালেন। মেয়েটা রূপবতী তবে নাক মোটা। তরুর মার নকিও মোটা ছিল। তার দ্বিতীয় স্ত্রী তরুর খালার নাকও ছিল মোটা। এই মেয়েটার নাকও মোটা। তার কপালে কি শুধুই মোটা নাকের মেয়ে?

খালেক চমকে উঠলেন। এই সব কি ভাবছেন?অসুখে ভুগে কি তাঁর মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে! সুস্থ মাথার কেউ তো কখনো এরকম ভাববে না।
 
০৬.
তরুর লেখা ডায়েরি।

পঙ্গু চাচার (ওসমান সাহেব) পরামর্শ আমার পছন্দ হয়েছে। ঠিক করেছি ডিটেকটিভ উপন্যাসই লিখব। নির্ভেজাল একজন ভালো মানুষের হাতে খুন হয়েছে দুজন তরুণী। তারা দুই বোন। এই দুজনকেই ভদ্রলোক বিয়ে করেছিলেন। ছোট বোনের গর্ভে একটি মেয়ে জন্মায়। মেয়েটিকে ভদ্রলোক অত্যন্ত পছন্দ করেন। এই মেয়েটিই হত্যা রহস্যের সমাধান করে।

আমি কিছু খোঁজখবর নেয়া শুরু করি। বড় মামাকে টেলিফোন করি। তিনি থাকেন রাজশাহীতে। ফিসারিতে কাজ করেন। হঠাৎ আমার টেলিফোন পেয়ে তিনি খুবই অবাক।

তরু মা! কেমন আছ গো?

ভালো আছি মামা।

হঠাৎ টেলিফোন কেন গো মা?

একটা ইনফরমেশন জানতে চাচ্ছি। আচ্ছা মামা আমার মা কিভাবে মারা গিয়েছিলেন?

তুই তো জানিস কিভাবে মারা গেছেন।

জানি। হার্টফেল করেছেন। বাবা ঘুম থেকে উঠে দেখেন তার প্রাণপ্রিয় পত্নী চেগায়ে পড়ে আছে।

এইভাবে কথা বলছ কেন মা? তোমার সমস্যা কি?

কোনো সমসায় নেই। আচ্ছা মামা বড় খালা কিভাবে মারা গিয়েছিলেন?

এইসব কেন জিজ্ঞেস করছিস?

তিনিও তো হার্টফেল করে মারা গেছেন। ঠিক না? বাবা ঘুম থেকে উঠে দেখেন বড় খালা মরে চেগায়ে পড়ে আছেন।

তরু প্রোপার ল্যাংগুয়েজ প্লিজ।

মামা তোমাদের কি একবারও মনে হয় নি—এই দুজনের মৃত্যুই স্বাভাবিক না!

স্টপ ইট।

মামা এরকম কি হতে পারে যে বাবা এই দুই মহিলাকেই খুন করেছেন। তোমরা আমার কথা ভেবে চুপ ক্রে গেছ। পুলিশ বাবাকে ধরে নিয়ে গেলে আমার কি গতি হবে এটা ভেবে।

তরু! মাথা থেকে উদ্ভট চিন্তাভাবনা দূর করে।

আচ্ছা যাও দূর করলাম। এখন বলো তুমি কখনোই আমাদের বাসায় আস না। এর কারণ কি। নানিজনও আসেন না।

মা আসবে কিভাবে। মা মারা গেছে না?

যখন বেঁচেছিলেন তখনো তো আসেন নি। আমাকে দেখতে ইচ্ছা করলে গাড়ি পাঠাতেন। গাড়ি আমাকে নিয়ে যেত।

তরু কোনো কারণে তোমার কি মনটন খারাপ? আমার কাছে চলে আসো। কয়েক দিন থাকবে। তোমাকে নিয়ে পদ্মার পারে ঘুরব। পদ্মার চড়ে ক্যামপ ফায়ার করব। তোমার মামির সঙ্গে কথা বলবে?

মামির সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না মামা।

আজেবাজে চিন্তা করবে না। খবর্দার না।

এই পর্যন্ত লেখার পর তরুকে উঠতে হলো। কারণ বাসায় আনিস নামের কে যেন এসেছে। কার্ড পাঠিয়েছে। কার্ডে লেখা–

আনিসুর রহমান
বি এ (অনার্স)
শৌখিন অভিনেতা।
টিভি, বেতার এবং চলচ্চিত্র

তরু ভেবেই পাচ্ছে না একজন শৌখিন অভিনেতা তার কাছে কি চায়। ভদ্রলোকের বুদ্ধিবৃত্তি নিম্ন পর্যায়ের বলেই মনে হচ্ছে। শৌখিন অভিনেতার ভিজিটিং কার্ড ছাপায়ে এবং নামের শেষে বি এ অনার্স লিখবে কি জন্যে। বিএ অনার্স কি এমন কোনো বিদ্যা যে কার্ড ছাপিয়ে জাহির করতে হবে!

তরুকে দেখে আনিসুর রহমান বিএ অনার্স উঠে দাঁড়াল। তরু বলল, বাবার কাছে এসেছেন?

জি। শুনেছি উনার শরীর খারাপ। হাসপাতালে ছিলেন। দেখতে এসেছি।

তুরু বলল, খালি হাতে এসেছেন? হরলিক্সের কৌটা, ডাব, কমলা এইসব কিছু আনেন নি?

আনিস বিস্মিত হয়ে বলল, জি না।

তরু বলল, আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করছিলাম। কিছু মনে করবেন না।

আমি কিছু মনে করি নি। তবে খালি হাতে আশা অবশ্যই ঠিক হয় নি।

তরু বলল, বাবা ভালো আছেন। কাজকর্ম করে বেড়াচ্ছেন। এখন আপনাকে আমি চিনতে পারছি। বাবা আপনার কাঠের দোকানে অসুস্থ হয়ে পড়েন। আপনি তার যথেষ্ট সেবাযত্ন করেছেন।

তেমন কিছু কিন্তু করি নি।

তরু বলল, বাবা জ্বরের ঘোরে ছিলেন তো। আপনার সমস্যাটাই তার কাছে অনেক বড় মনে হয়েছে। বাবা ৰাসায় ফিরেই আমাকে বলেছেন—তোর জন্যে একটা ছেলে দেখে এসেছি।

আনিস পুরোপুরি হকচকিয়ে গেল। কি সহজভাবেই মেয়েটা এইসব কথা বলছে। কোনো দ্বিধা নেই—কোনো সংকোচ নেই।

তরু বলল, চা খাবেন।

আনিস বলল, খেতে পারি।

তরু বলল, খেতে পারি বলার অর্থ অনিচ্ছার সঙ্গে খেতে রাজি হচ্ছি। আপনি আগ্রহের সঙ্গে চা খেতে চাইলেই আপনাকে চা দেব।

আনিস বলল, আমি আগ্রহের সঙ্গেই চা খেতে চাচ্ছি।

তরু বলল, আপনি হয়তো ভেবেছেন চা খেতে খেতে কিছুক্ষণ আমার সঙ্গে গল্প করবেন। তা হচ্ছে না। আমি এক্ষুনি আপনার কাছ থেকে বিদায়। নিয়ে চলে যাব। কাজের মেয়ে আপনাকে চা দেবে। আপনি একা একা চা খাবেন। উঠে চলেও যেতে পারবেন না। নিজেকে মনে হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গাধা। আমি যাচ্ছি, আপনার চা এক্ষুনি চলে আসবে।

আনিসকে চা দেয়া হয়েছে। সে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। সত্যি সত্যি নিজেকে সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গাধা ভাবছে। একটাই সান্ত্বনা মেয়েটা তাকে চমকে দিয়েছে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও এরকম একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলার আনন্দ তুচ্ছ করার মতো না।
 
তরু ছাদে এসেছে। ওসমান সাহেব হুইল চেয়ারে ছাদে ঘুরপাক করছেন। তিনি তরুকে দেখেই বললেন, হ্যালো মিসট্রি।

তরু বলল, হ্যালো।

কিছু বলতে এসেছ? না-কি এম্নি সৌজন্য সাক্ষাৎ।

তরু বলল, আমি ডিটেকটিভ উপন্যাস লেখা শুরু করেছি।

ভেরি গুড।

ধার করা উপন্যাস।

ধার করা মানে?

আপনার প্লটটা নিয়ে লিখছি। এক ভদ্রলোকের হাতে দুই স্ত্রী খুন। তিনি তৃতীয় একজনকে বিয়ে করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখনই গল্পের শুরু।

ইস্টারেস্টিং প্লট।

তরু বলল, ইন্টারেস্টিং প্লটে আপনার ভূমিকাটা বুঝতে পারছি না।

ওসমান বললেন, আমার ভূমিকা মানে?

ডিটেকটিভ উপন্যাসে আপনিও একটা চরিত্র। আপনাকে কিভাবে ফিট করব বুঝতে পারছি না।

আমাকে ফিট করার দরকার কি?

এত বাড়িঘর থাকতে আপনি আমাদের এখানে থাকতে এলেন কেন? বাবার সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা কি? বাবা অবশ্যই আপনার বন্ধু মানুষ না। বাবাকে কখনোই আপনার সঙ্গে গল্প করতে দেখি না। দুজনের যোগাযোগটা কিভাবে হলো।

তোমার উপন্যাসে এই সব তথ্য দরকার?

অবশ্যই দরকার।

ওসমান দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, খুঁজে বের করো। একজন ডিটেকটিভ এই কাজটাই করেন।

তরু বলল, আপনি কি আমার মা বা বড় খালাকে চিনতেন?

তোমার মাকে চিনতাম।

তরু বলল, আপনি কি আপনার স্ত্রীর টেলিফোন নাম্বার দেবেন। আমি তার সঙ্গে কথা বলব।

কি কথা বলবেঃ ঠিক আছে যে কথা বলতে ইচ্ছা করে বললো। টেলিফোন নাম্বার দিচ্ছি।

তরু বলল, আপনার অস্বস্তি বোধ করার কোনো কারণ নেই। আমি আপনার সামনেই কথা বলব।



কে?

আমার নাম তরু?

তরুটা কে?

ওসমান চাচা আমাদের বাড়ির ছাদে থাকেন। আমার বাবার নাম খালেক।

কি চাও তুমি?

অনেক দিন আপনি আসেন না। এই জন্যে টেলিফোন করেছি। আবীর কি ভালো আছে?

হ্যাঁ সে ভালো আছে। রাখি কেমন। এখন একটু ব্যস্ত। বাসায় গেস্ট।

ওসমান বলল, ডিটেকটিভ কর্মকাণ্ডে কিছু পেয়েছ। কোনো ক্লু?

তরু বলল, পেয়েছি।

কি পেয়েছ? একজন ডিটেকটিভ কারো সঙ্গে শেয়ার করেন না।

ওসমান বললেন, শায়লা মেয়েটা তোমাদের বাড়িতে কি স্থায়ী হয়ে গেছে?

তরু বলল, সে রকমই মনে হচ্ছে।



খালেক রাতে খেতে বসে বললেন, আনিস এসেছিল?

তরু বলল, হ্যাঁ।

ছেলে কেমন? ভালো।

খালেক বললেন, এ রকম একটা ছেলের সন্ধানেই আমি আছি। Good person. Very good person. আমি খোঁজ লাগায়েছি।

কি খোঁজ?

চব্বিশ ঘণ্টা আমার স্পাই তার পিছে ঘুরবে। কোথায় যায়, কি করে, কাদের সঙ্গে মিশে—সব খোঁজ আনবে। যদি দেখি সব ঠিক তাহলে বিসমিল্লাহ শুভ বিবাহ। তোর আপত্তি আছে?

না।

তোর নিজের পছন্দের কেউ থাকলেও হিসাবে ধরব। আছে কেউ?

আছে।

খালেক ভুরু কুঁচকে বললেন, কে সে। কি করে?

টিচার।

তোদের পড়ায়?

হুঁ। চর্যা স্যার। আমাদের চর্যাপদ পড়ায়। বিবাহিত। চার ছেলেমেয়ে। বড় মেয়েটার বিয়ে হয়েছে।

খালেক মেয়ের দিকে বেশ কিছু সময় তাকিয়ে থাকলেন। মেয়ের ঠাট্টাতামাশা করার বাজে স্বভাব হয়েছে। বাবার সঙ্গেও ঠাট্টা-তামাশা।

তিনি খাবারে মন দিলেন।

তরু! কোপ্তা কে বেঁধেছে।

শায়লা ভাবী।

আমিও তাই ভেনেছিলাম, কাজের মেয়ের রান্না আর ঘরের মহিলার রান্না—-ডিফারেন্স আছে। গ্রেট ডিফারেন্স। মুখে দিলেই বুঝা যায়।

তরু বলল, ভালো রান্না বেশিদিন ক্ষেতে পারবে না বাবা। শায়লা ভাবী যে কোনোদিন চলে যাবে।

কোখায় যাবে?

তার স্বামী তাকে আয় তুতু করে ডাকবে। সে ছুটে চলে যাবে।

খালেক বললেন, এই মহিলা কোনোদিনই যাবে না। কিছু জিনিস বুঝা যায়। এই মহিলার শিকড় এই বাড়িতে বসে গেছে। ঐ দিন দেখলাম ফার্নিচার ঝাড় পোছ করছে। যেন নিজের বাড়ি।

তোমার জন্য তো ভালোই।

কি ভালো?

তরু বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসল। খালেক মেয়েকে কঠিন কিছু কথা বলতে গিয়েও বললেন না। যে মেয়ের বিয়ের কথা হচ্ছে তীকে কঠিন কথা বলা যায় না।
 
০৭.
জামান বারান্দায় মোড়ার উপর শিরদাঁড়া বাঁকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসা। তার সামনে আরেকটা মোড়া। সেখানে টিফিন ক্যারিয়ারে সকালের নাশতা। ছোট লাল ফ্লাস্কে চা। সনজু ভীত ভঙ্গিতে একটু দূরে দাঁড়ানো। প্রতিবারই নাশতা নিয়ে তাকে দুলাভাইয়ের কঠিন কথা শুনতে হয়। আজ মনে হয় আরো বেশি শুনতে হবে। পরোটা, বুটের ডাল আর সবজি আনার কথা। সে এনেছে সবজি আর ডিমের ওমলেট। বুটের ডাল পায় নি।

জামান টিফিন ক্যারিয়ার খুলল। খাওয়া শুরু করল। বুটের ডাল নাই কেন এই নিয়ে হম্বিতম্বি শুরু করল না। মনে হয় বুটের ডালের কথা তার মনে নাই।

সনজু বলল, চা কাপে ঢেলে দিব দুলাভাই?

দাও। চিনি ছাড়া এনেছ তো?

জি।

চা কাপে ঢালতে গিয়ে সমস্যা হলো। কিছু চা মেঝেতে পড়ে গেল। সনজু নিশ্চিত দুলাভাই এখন গর্জে উঠে বলবেন, সামান্য কাজটাও ঠিকমতো করতে পারো না। সেরকম কিছু বলল না। বরং চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জামান তৃপ্তির শব্দ করল।

চা কোত্থেকে এনেছ? বিসমিল্লাহ হোটেল?

সনজু বলল, না। রাস্তার পাশে ছোট একটা দোকান আছে। চা ভালো বানায়।

এখন থেকে এই চা আনবে।

জি আচ্ছা।

তোমার বোনের সঙ্গে কথাবার্তা হয়?

জি না। এটা মিথ্যা। সনজুর সঙ্গে তার বোনের প্রতিদিনই কথা হয়।)

জামান বলল, যদি কোনোদিন ঐ মাগীর সঙ্গে কথা বলতে দেখি তাহলে টান দিয়ে জিহ্বা ছিঁড়ে ফেলব। এটা যেন মনে থাকে।

জি আচ্ছা।

আমার চোখের সামনে ঐ মেয়ে অন্য লোকের বাড়িতে উঠে গেল। বাজারের মেয়ের যতটুকু লজ্জা-শরম থাকে তার তো তাও নাই। ঠিক বলেছি কি-না বলো।

জি।

কি শাস্তি দেয়া যায় বলো। তুমিই বলো! তোমার স্ত্রী যদি এ রকম ঘটনা ঘটাত তুমি কি করতে?

জানি না দুলাভাই।

দুলাভাই দুলাভাই করবে না। আমি আর তোমার দুলাভাই না।

জি আচ্ছা।

বেশ্যা মেয়েটাকে এমন এক শাস্তি দিতে হবে যেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনে থাকে। পাড়ার মাস্তান ছেলেগুলিকে দিয়ে রেপ করালে কেমন হয়? ছয়সাত জন মিলে রেপ করলে জন্মের শাস্তি হয়ে যাবে। ঠিক বলেছি?

সনজু জবাব দিল না। জামানের চায়ের কাপ শেষ হয়েছে। সনজু আবার কাপে চা ঢেলে দিল। ফ্লাঙ্কে তিন কাপ চা ধরে। জামান খায় দু কাপ। শেষ কাপটা সনজুর।



জামান সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, তুমি এক কাজ করো, মাগীটার কাছে যাও। তাকে বলো শেষ সুযোগ কানে ধরে আমার সামনে দশ বার উঠবোস করবে। চাটা দিয়ে আমার জুতার ময়লা খাবে। একবার চাটলেই হবে। আমি অতীত ভুলে যাব।

এখন বলব?

হ্যাঁ এখনই যাও। খালেক সাহেব হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন?

জি।

উনার সামনে বা উনার মেয়ের সামনে কিছু বলবে না। আড়ালে ডেকে নিয়ে বলবে। সময় বেঁধে দিবে। যদি ফিরে আসতে চায় তাহলে সকাল দশটার মধ্যে আসতে হবে। আর একটা কথা বলবে, সেটা হলো—রাগের মাথায় তালাক কোনো তালাক না। সে যেন ভেবে না বসে যে তালাক হয়ে গেছে।

সনজু বের হয়ে গেল। জামান পুরোপুরি নিঃসন্দেহ শায়লা এক্ষুনি চলে আসবে। তার যাবার কোনো জায়গা নেই। খালেক সাহেব বাসা থেকে বের করে দিলে প্রথম কয়েক দিন থাকবে ফুটপাথে। তারপরে স্থান হবে চন্দ্রিমা উদ্যানে। নিজের ভাই হবে দালাল। কাস্টমার ধরে আনবে। দরদাম ঠিক করবে।



শায়লা বলল, এখন যেতে বলেছে?

সনজু বলল, সকাল দশটার মধ্যে যেতে বলেছে। তুমি যাবে?

হুঁ। অন্যের বাড়িতে কত দিন থাকব?

সনজু বলল, দশবার কানে ধরে উঠবোস করতে হবে। জুতা চাটতে হবে। তারপরেও যাবে?

শায়লা বলল, আমি নিরুপায়। তুই নিজেই বল আমরা দুইজনই নিরুপায় না?

সনজু কিছু বলল না। চোখ-মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল। বড় বোনের গালে চড় দিতে ইচ্ছা করছে। তা সম্ভব না। বড় বোন মায়ের অধিক।

শায়লা উঠে দাঁড়াল। সনজু বলল, তরুকে কিছু বলে যাবে না?

শায়লা বলল, না। ওকে বললে ও হয়তো যেতে দিবে না। নানান কথা বলবে। কি দরকার? তোর দুলাভাই কি বলেছে? কানে ধরে দশ বার উঠবোস আর জুতা চাটলেই হবে?

হুঁ।

জানালা দিয়ে দেখলাম বারান্দায় বসে নাশতা খাচ্ছে। এখন মেজজি কেমন?

ভালো।

শায়লা বলল, তুই আমার সঙ্গে আসবি না। একটু পরে আয়। তোর সামনে কানে ধরে উঠবোস করতে লজ্জা লাগবে।

সনজু বলল, তুমি একাই যাও। আমি দশ মিনিট পরে আসব।

সনজু বাড়ির ছাদে উঠে গেল। ওসমান সাহেবের কিছু লাগবে কি-না খোঁজ নেবে। প্রতিদিন সকালে সে এই কাজটা করে। মাসের শেষে ওসমান সাহেব পাঁচশ করে টাকা দেন। টাকাটা সে খরচ করে না, জমায়। সে তার তোষকে একটা ফুটো করেছে টাকা জমানোর জন্যে।
 
সিঁড়িঘরের সামনে সনজু থমকে দাঁড়াল। তরু চা খেতে খেতে ওসমান সাহেবের সঙ্গে গল্প করছে। ওসমান সাহেবের হাতেও চা। দুজনের মুখ হাসি হাসি। সনজুর হঠাৎ প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ করল। কোমর ভাঙা এই বুড়োর এত কি গল্প তরুর সঙ্গে? সনজু যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে একটু সরে গেল। এখন আর তরু বা ওসমান সাহেব তাদের দেখতে পাবেন না। অথচ সে দরজার ফাঁক দিয়ে ঠিকই দেখবে।

ওসমান বললেন, আজ তোমাকে অন্যদিনের চেয়েও বেশি আনন্দিত মনে হচ্ছে। কারণ কি?

তরু বলল, কারণ আজ আমাকে দেখতে আসবে।

দেখতে আসবে মানে কি? বিয়ের কনে দেখা?

হুঁ।

ছেলে করে কি?

কাঠুরিয়া। কাঠ কাটে।

ওসমান বললেন, টিম্বার মার্চেন্ট?

তরু বলল, ভদ্র ভাষায় তাই। বাবার উনাকে খুবই পছন্দ। ছেলের নাম আনিস।

আনিস?

তরু বলল, হ্যাঁ আনিস। আমার খুবই অপছন্দের নাম। আমাদের ক্যান্টিনের বয়ের নাম আনিস। তার প্রধান চেষ্টা কোনো এক অপার গায়ের সঙ্গে হাত লাগিয়ে দেয়া যায় কি-না। ভাবটা এরকম যে ভুলে লেগে গেছে।

ওসমান বললেন, বয়কে দোষ দিয়ে লাভ নেই সমাজের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির এই স্বভাব আছে।

তরু হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে গলা নিচু করে বলল, আনিস সাহেব বিকেলে চা কোথায় খাবেন জানেন? আপনার এখানে। আপনার মতামত বাবার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই আপনি আনিস সাহেবকে ভালোমতো লক্ষ করবেন। তার আইকিউ-এর অবস্থা বুঝবেন।

তুমি বিয়ে করতে চাচ্ছ?

চাচ্ছি। ভালো ঔপন্যাসিকের বিয়ের অভিজ্ঞতা দরকার।

সত্যি সত্যি ঔপন্যাসিক হবার জন্যে বিয়ের অভিজ্ঞতা চাচ্ছ?

হুঁ। আমি কিছুদিন জেলেও থাকতে চাই। জেলের অভিজ্ঞতা লেখালেখিতে সাহায্য করে।

কে বলেছে?

স্যার বলেছেন। যে স্যার চর্যাপদ পড়ান—ড. আখলাক। তাঁর নিক নেম হলো ছোঁক ছোঁক স্যার। তিনি মেয়ে দেখলেই ছোঁক ছোঁক করেন। টিউটোরিয়েলে মেয়েরা সবসময় তার কাছে বেশি নাম্বার পায়।

মেয়েদের জন্যে তো ভালো।

হ্যাঁ ভালো। আপনাকে একটা মজার কথা বলব?

বলো।

সুতাকৃমি অর্থাৎ সনজু অনেকক্ষণ থেকে দরজার ফাঁক দিয়ে আমাদের দেখছে।

কতক্ষণ?

বেশ অনেকক্ষণ। আমি এখন কি করব জানেন? ওর দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটব।

ভেংচি কাটবে কেন?

ওর মধ্যে টেনশন তৈরি করার জন্যে। ভেংচি খেয়ে সে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাবে এবং সারাক্ষণ চিন্তা করবে ঘটনাটা কি। সাহস করে আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারবে না। সনজু প্রতিদিন চার-পাঁচ বার করে মারা যায়।

ওসমান বললেন, তোমার কথার অর্থ ধরতে পারলাম না। প্রতিদিন চারপাঁচবার করে মারা যায় মানে?

তরু বলল, আপনার কাছ থেকেই শুনেছি শেক্সপিয়ার সাহেব বলেন Cowards die many times before their death. সেই অর্থেই সনজু তিন-চার বার মারা যায়।

তরু সিঁড়িঘরের দরজার দিকে মুখ ফিরিয়ে বিকট ভেংচি কাটল।

ওসমান বললেন, তুমি বেশ ইন্টারেস্টিং মেয়ে। যে তোমাকে বিয়ে করবে সে কখনো বোরও হবে না। তবে তুমি যাকেই বিয়ে করবে তাকে নিয়েই বোরড হবে।

তরু হাতের কাপ নামিয়েই বলল, যাই।

ওসমান বললেন, চা তো শেষ হয়নি। চা শেষ করে যাও।

তরু বলল, আমি এখনই যাব। আমার ক্ষীণ সন্দেহ সুতাকৃমি চলে যায় নি। দরজার আড়ালে লুকিয়ে আছে, তাকে হাতেনাতে ধরব।

সনজু চলে যায় নি। দরজার আড়ালেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। তরুর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে বলল, বড় আপা চলে গেছে।

তরু বলল, কোথায় গেছে? তোমার দুলাভাইয়ের কাছে?

হুঁ।

তালাক না হয়েছিল?

সনজু বলল, মুখের তালাক তো। রাগের মাথায় তালাকে কিছু হয় না। দুলাভাই বলেছেন তালাক হতে কোর্টের অর্ডার লাগে।

তরু বলল, সব ভালো যার শেষ ভালো। ঠিক আছে তুমি যাও। আড়াল থেকে উঁকি দিও না। আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করা খুব বাজে ব্যাপার।

সনজু বলল, আপনাকে একটা খবর দেবার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি! আজ দুলাভাইকে শিক্ষা দেয়া হবে।

তুমি শিক্ষা দেবে?

আমার বন্ধুরা দিবে। মেরে তক্তা বানাবে। পেটে একটা ছুরিও ঢুকাবে। এমনভাবে ঢুকাবে যেন কোনো ক্ষতি না হয়। মারা যাবে না।

ঘটনা কখন ঘটবে?

আজ রাতে।

তরু বলল, ঘটনা যে ঘটাবে সে এনাটমি জানে তো? বেকায়দায় ছুরি ঢুকিয়ে মেরে না ফেলে।

সনজু বলল, সে এক্সপার্ট।

নাম কি?

হারুন। সবাই বলে ক্ষুর হারুন।

তরু বলল, ক্ষুরের কাজ ভালো জানে এই জন্যে ক্ষুর হারুন?

হুঁ। হারুন ভাই ভালো গান জানে।

তাই না-কি?

সনজু আগ্রহ নিয়ে বলল, তার আরেক নাম মুনসিগঞ্জের হেমন্ত। মুনসিগঞ্জে বাড়ি তো।

ভেরি গুড। গায়কের হাতে মৃত্যু।

মারা যাবে না। হারুন ভাই হাতের কাজে খুব সাবধান। ঘটনা ঘটামাত্র আপনাকে খবর দেব।
 
রাত নটা।

তরু বারান্দায় মোড়া পেতে বসে আছে। এখান থেকে বাড়ির গেট দেখা যায়। কে আসছে কে যাচ্ছে সেই খবরদারিও করা যায়। তরুর মেজাজ সামান্য খারাপ। সন্ধ্যাবেলা আনিস এসেছিল। একা না, তার চাচাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। তরুকে তাদের এতই পছন্দ হয়েছে যে চাচা মিয়া পাঞ্জাবির পকেট থেকে আংটি বের করে নিমিষেই তরুর হাতে পরিয়ে বলেছেন—সবাই হাত তোলেন। দোয়া হবে। নাটকীয় দোয়া ও দোয়ার মধ্যে গলা কাঁপানো বক্তৃতা আছে। অশ্রুজল আছে।

দোয়া শেষ হবার পর ওসমান বললেন, মেয়ে দেখী অনুষ্ঠানে আমরা সবসময় কিছু ভুল করি।

আনিসের চাচা (নাম কবিরুল ইসলাম চোখ সরু করে বললেন, কি ভুল করি?

ওসমান বললেন, পকেটে করে একটা আংটি নিয়ে যাই। মেয়ে পছন্দ হলে সঙ্গে সঙ্গে আংটি পরিয়ে দেয়া হয়। পছন্দ না হলে গোপনে আংটি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

কবিরুল ইসলাম বললেন, তাতে সমস্যা কি?

ওসমান বললেন, যে মেয়েটির বিয়ে হতে যাচ্ছে তার কিছুই বলার থাকে না। মেয়েটিরও তো পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার থাকতে পারে।

কবিরুল ইসলাম তখন শুরুর দিকে তাকিয়ে থিয়েটারে পাঠ গাইছেন ভঙ্গিতে বললেন, মা তরু। মা তুমিই বলো ছেলে কি পছন্দ হয়েছে? আলাপ খোলাখুলি হওয়া ভালো। আমি প্যাচের আলাপ পছন্দ করি না।

তরু সবাইকে চমকে দিয়ে স্পষ্ট গলায় বলল, বাবা যাকে পছন্দ করেছেন, আমি তাকে কখনো অপছন্দ করব না।

কবিরুল ইসলাম বললেন, মাশাল্লাহ্। মা তোমার কথা শুনে আনন্দ পেয়েছি। কথাবার্তা এরকমই হওয়া উচিত। পরিস্কার। সবাই আরেকবার হাত তুলেন্। দোয়া হবে।

তরুর হবু স্বামী এই পর্যায়ে বলল, চাচা দোয়া তো একবার হয়েছে। আবার কেন?

কবিরুল ইসলাম বললেন, দোয়া তো ভাত খাওয়া না। একবার ভাত খেয়েছি পেট ভরে গেছে আর খাওয়া যাবে না। দোয়া দশ বার করা যায়।

দ্বিতীয় দফার দোয়া আরো আবেগময় হলো। দোয়ার মধ্যে আনিসের বাবা মার কথা চলে এলো। এই শুভক্ষণে তার বড় ভাই অমীরুল ইসলাম জীবিত নাই। পরীর মতো ছেলের বৌ দেখে যেতে পারল না…।

আনিস নামের যুবকটিকে তরুর আসলেই পছন্দ হয়েছে। গম্ভীর ধরনের চেহারা। নির্বোধ তেলতেলে চেহারা না। জিনসের প্যান্টের উপর আকাশি রঙের পাঞ্জাবি পরেছে। দেখতে ভালো লাগছে।

তরু সবার জন্যে চা নিয়ে এসেছে। সবার চা ঠিকঠাক বানানো। শুধু আনিস নামের মানুষটার চায়ে শেষ মুহূর্তে এক টুকরা বরফ দিয়ে দিয়েছে। তার দেখার ইচ্ছা হিম শীতল চা খেয়ে মানুষটা কি করে। সে কি বলবে চাটা ঠাণ্ডা। না-কি এক চুমুক খেয়ে রেখে দেবে। না-কি কিছুই হয় নি এমন ভঙ্গিতে চা খেয়ে শেষ করবে।

আনিস চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়েই চমকে তরুর দিকে তাকিয়ে কাপ রেখে দিল। দ্বিতীয়বার চায়ের কাপে চুমুক দিল না।

আংটি পরানো অনুষ্ঠান এবং দ্বিতীয় দফা দোয়ার পর কবিরুল ইসলাম তরুর দিকে তাকিয়ে বললেন, মাগো! তোমরা দুজন যদি প্রাইভেট কোনো কথা বলতে চাও। ছাদে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলো। আমরা কাবিন নিয়ে প্রিলিমিনারি আলোচনা করি।

তারা দুজন ছাদে চলে এলো। আনিস সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে সিগারেট বের করে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, বাঁচলাম।

তরু বলল, আপনি কি গরম এক কাপ চা খেতে চান?

না, থ্যাংক য়্যু।

তরু বলল, প্রাইভেট কোনো কথা থাকলে বলুন।

আনিস বলল, হুইল চেয়ারে বসা ভদ্রলোক কে?

বাবার বন্ধু।

আনিস বলল, ভদ্রলোক সারাক্ষণ তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এর কারণটা কি?

তরু বলল, আপনি সারাক্ষণ ঐ ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে ছিলেন এর কারণটা আগে বলুন।

আমি সারাক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম তোমাকে কে বলল?

আপনি সারাক্ষণ তাকিয়ে না থাকলে কি করে বুঝবেন উনি সারাক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন।

আনিস বলল, মনে হচ্ছে তুমি কথার খেলা পছন্দ করো।

তরু বলল, হ্যাঁ করি।

আনিস বলল, আমি যে সিগারেট খাচ্ছি—সব ধোয়া যাচ্ছে তোমার দিকে, সমস্যা হচ্ছে না তো?

তরু সহজ গলায় বলল, আমি নন-স্মোকার হলে সমস্যা হতো। আমিও সিগারেট খাই।

বলো কি?

এমন চমকে উঠলেন কেন? যে জিনিস ছেলেরা খেতে পারে তা মেয়েরাও পারে। আমাকে একটা সিগারেট দিন।

আনিস বিস্মিত গলায় বলল, সত্যি সিগারেট খাবে?

হ্যাঁ খাব।

হঠাৎ ছাদে যদি কেউ আসে?

এলে দেখবে আমরা দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছি।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top