What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected চক্ষে আমার তৃষ্ণা -উপন্যাস (3 Viewers)

আনিস সিগারেটের প্যাকেট বের করল। তরু সহজ ভঙ্গিতেই সিগারেট নিয়ে ব্রাল। লম্বা টান দিয়ে বলল, বাবার বন্ধু ঐ পঙ্গু মানুষটার নাম ওসমান। তিনি একা থাকেন। কালেভদ্রে তাঁর স্ত্রী তাকে দেখতে আসেন। আর্ট কলেজের এক তরুণী তাঁকে ছবি আঁকা শেখাত। তার বিয়ে হয়ে গেছে। সেও আসে না। জৈবিক কারণেই এখন এই বৃদ্ধ যে কোনো তরুণীর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকাবে। তাই না?

আনিস বলল, তুমি এইসব কি বলছ!

তরু বলল, উনি কেন অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন সেটা ব্যাখ্যা করলাম। আমাকে আংটি পরিয়ে দেবার ব্যাপারটা উনার একেবারেই পছন্দ হয় নি। এখন বুঝতে পারছেন?

আনিস বলল, বুঝতে পারছি, তুমি অদ্ভুত মেয়ে।

আমি একজন ঔপন্যাসিক। ঔপন্যাসিকরা কিছুটা অন্য রকম হন। এটাই স্বাভাবিক।

ঔপন্যাসিক মানে? তুমি উপন্যাস লিখছ নাকি।

হুঁ। একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস লিখছি।

ছাপা হয়েছে?

না। বিয়ের পর স্বামীর পয়সায় ছাপব। প্রকাশকরা নতুন লেখকের লেখা ছাপে না।

আনিস ইতস্তত করে বলল, কিছু মনে করো না। আমাকে কি তোমার পছন্দ হয়েছে?

তরু বলল, না।

না কেন?

আপনার সঙ্গে বিয়ে হলে আপনি আমাকে সিগারেট খেতে দেবেন না। কেউ আমার দিকে তাকালে ঈর্ষায় জ্বলে যাবেন। আপনার সঙ্গে জীবন-যাপন হবে যন্ত্রনার। আমাকে আরেকটা সিগারেট দিন। ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকবেন না। আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো চেইনস্মোকার। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে চেনেন তো? কবি এবং ঔপন্যাসিক।

আনিস বলল, এখন সিগারেট খাওয়াটা ঠিক হবে না। যে কোনো মুহূর্তে চাচা বের হয়ে আসবেন। সিগারেট হাতে তোমাকে দেখলে ধাক্কার মতো খাবেন।

আপনি ধাক্কা খাচ্ছেন না?

কিছুটা তো খাচ্ছিই।

তরু হাসি হাসি মুখে বলল, আংটি খুলে দেব? খুলে দেই? গোপনে। পকেটে করে নিয়ে চলে যান।

আনিস কিছু বলার আগেই তার চাচা বের হয়ে এলেন। আনন্দিত গলায় বললেন, মাগো! যাই? মোটামুটি সব ফাইন্যাল করে গেলাম। বাকি আল্লাহর ইচ্ছা।



তরু ঘড়ি দেখল। তার হাতে ঘড়ি নেই। মোবাইল ফোন। ফোন টিপে ঘড়ি দেখা। এখন বাজছে এগারোটা বিশ।

সনজুর দুলাভাইকে গেট খুলে বাসায় ফিরতে দেখা যাচ্ছে। তার এক হাতে দড়িতে বাধা কিছু সাগর কলা অন্য হাতে ব্রাউন পেপারের ব্যাগ। তার পেটে কেউ ছুরি বসায় নি।

দুলাভাইকে দেখে সনজু ছুটে এসে হাতের বাজার নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। দুলাভাইকে সুস্থ অবস্থায় দেখে সে আনন্দিত না দুঃখিত তা এত দূর থেকে বুঝা যাচ্ছে না। তরু আরো কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে থাকবে না-কি ঘরে ঢুকে উপন্যাসে হাত দেবে বুঝতে পারছে না। নতুন উপন্যাস শুরু করার চেয়ে ছোটগল্প লেখাটা মনে হয় সহজ। আশেপাশে যা ঘটছে তা নিয়ে ছোটগল্প। একটা গল্পের নাম কনে দেখা। সেখানে একটি মেয়েকে পছন্দ করে হাতে আংটি পরিয়ে দেয়া হবে। তারপর দেখা যাবে মেয়েটা ড্রাগ এডিক্ট। পাত্রপক্ষ পিছিয়ে যাবে শুধু পাত্র পিছাবে না। সে আধাপাগল হয়ে যাবে মেয়েটাকে বিয়ে করার জন্যে।

চিন্তা শেষ করার আগেই সুনজু উপস্থিত হলো। তরু বলল, ঘটনা তো ঘটে নাই।

সনজু বলল, আগামী বুধবার ঘটবে। আজ হারুন ভাইয়ের একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে। উনার বড় বোনের মেয়েটা খাট থেকে পড়ে মাথায় ব্যথা পেয়েছে। তাকে হাসপাতালে নিতে হয়েছে। বাচ্চাটার বয়স দেড় বছর। হারুন ভাই তাকে খুবই পছন্দ করেন।

তরু বলল, বুধবারে ঘটনা ঘটবে তো?

অবশ্যই। উনাকে কিছু খরচও দিয়েছি। এক হাজার টাকা দিয়েছি। অনোর কাছ থেকে উনি অনেক বেশি টাকা নেন। আমি বন্ধু বিধায় নামমাত্র টাকা নিয়েছেন। আপনার কোনো কাজ লাগলে বলবেন করায়ে দেব।

তরু হাই তুলতে তুলতে বলল, ক্ষুর চালাচালির কাজ লাগবে না তবে অন্য একটা কাজ করে দিলে ভালো হয়।

বলেন কি কাজ। কাল দিনের মধ্যে করে ফেলব।

একটা নকল ছবি বানিয়ে দিতে হবে। কম্পিউটারে খুব সহজেই কাজটা করা যায়। আমি আমার একটা ছবি দিব আর ওসমান চাচার একটা ছবি দেব। দুটা ছবি মিলিয়ে এমন করতে হবে যে নকল ছবিটাতে দেখা যাবে আমি ওসমান চাচার কোলে বসে আছি। পারবে না?

সনজু জবাব দিল না। তাকিয়ে রইল। তরু বলল, আমি অনেকগুলো ছবি দেব যেটা কাজে লাগে। সকালে এসে ছবি নিয়ে যেও।
 
০৮.
বিয়ে ঠিক হয়ে যাবার পর থেকে খালেক মেয়েকে তরু ডাকছেন না। ভালো নামে মিষ্টি করে ডাকছেন–মা, শামসুন নাহার। মেয়ের সঙ্গে তিনি আগের চেয়ে অনেক বেশি সময় নিচ্ছেন। বাইরে কাজে গেলে টেলিফোন করছেন। ঘুমুতে যাবার আগে মেয়ের ঘরে বসে পান খাচ্ছেন। তরু নিজেও বাবার সঙ্গে পান খাচ্ছে। তরু রাতের পান খাওয়ার একটা নামও দিয়েছে—নৈশকালিন পান উৎসব।

পান উৎসবে কথাবার্তা যা হয় সবই বিয়ে নিয়ে। খালেকের মাথায় মেয়ের বিয়ের নানান পরিকল্পনা। পরিকল্পনা নিয়ে মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে তার ভালো লাগে। তখন তাঁকে যথেষ্ট উত্তেজিত মনে হয়। যদিও শুরু বেশিরভাগ পরিকল্পনাই বাতিল করে দেয়।

শামসুন নাহার, মা চল বাপ-বেটি মিলে কোলকাতা যাই।

তরু বলল, এই গরমে কোলকাতা যাব কেন?

বিয়ের বাজার করব। তোর শাড়ি, জামাইয়ের জন্যে পাঞ্জাবি। স্যুটের কাপড়।

শাড়ি-পাঞ্জাবি, স্যুটের কাপড় সবই দেশে পাওয়া যায়। খামাখা কোলকাতা যাবার দরকার কি?

সবাই তো যায়।

আমি এর মধ্যে নাই।

না গেলে দেশেই কেনাকাটা শুরু করে দে। সময় তো বেশি নাই। কাল থেকে শুরু কর। কাল দিন ভালো—বৃহস্পতিবার।

তরু বলল, আচ্ছা। শুরু করব।

বিয়ের রান্নার জন্যে সিদ্দিক বাবুর্চিকে খবর দিয়েছি। তার মতো ভালো কাচ্চি পাক-ভারত উপমহাদেশে কেউ রানতে পারে না।

কাচ্চি বিরানি খাব না বাবা।

কি খেতে চাস?

খাসির রেজালা–মুরগির রোস্ট।

গরুর ঝাল মাংস থাকবে?

থাকুক।

কিছু বুড়ো মানুষ আছে—বিয়ে বাড়ির রেজালা পোলাও খেতে চায় না। তাদের জন্যে সাদা ভাত, সজি, ডাল, মুরগির ঝোল। ঠিক আছে না?

ঠিক আছে।

বাচ্চাদের জন্যে চায়নিজ আইটেম করব? বাচ্চারা চায়নিজ পছন্দ করে। ফ্রয়েড রাইস, চায়নিজ আর স্প্রিং ফ্রায়েড দিবেন।

আইসক্রিম থাকবে না?

সবার জন্যে থাকবে না। শুধু বাচ্চাদের জন্যে। সবাইকে আইসক্রিম খাওয়া পুষাবে না।



খালেক নিজেই দশ বারোটা দাওয়াতের কার্ড দেখে একটা কার্ড ছাপিয়ে এনেছে। কার্ডের ছবি একটা ঘড়ি পরা ছেলের হাত সোনার চুড়ি পরা একটা মেয়ের হাত ধরে আছে। দুজনের হাত থেকে ফুলের একটা মালা ঝুলছে। এখানেই শেষ না, দুই হাতের উপর রঙিন প্রজাপতি উড়ছে। প্রজাপতির ডানায় লেখা শুভ বিবাহ।

আনিস নামের যুবকটির সঙ্গে একদিন তরু চায়নিজ খেয়ে এসেছে। সব হবু স্বামী স্ত্রীকে মুগ্ধ করার চেষ্টায় থাকে। আনিস তার ব্যতিক্রম না। সে রীতিমত কুইজ প্রোগ্রাম শুরু করল।

তরু আফগানিস্তান সম্পর্কে কি জানো?

তেমন কিছু জানি না।

আফগানিস্তান হচ্ছে এমন এক দেশ যাকে কোনো বিদেশি দেশ দখল করতে পারে নি।

তরু বলল,ও রকম দেশ তো আরো আছে। চীন এবং আবিসিনিয়া। এই দুটি দেশকেও কেউ দখল করতে পারে নি।

আনিস বলল, কে বলেছে তোমাকে?

পঙ্গু বলেছে।

পঙ্গুটা কে?

ছাদে যিনি থাকেন। পঙ্গু চাচা।

তাকে তুমি পঙ্গু চাচা ডাকো না-কি?

তরু বলল, যে পঙ্গু তাকে পঙ্গু ডাকব না?

খাবার চলে এসেছে। আনিস আবারো কুইজ প্রোগ্রামে চলে গেল।

তরু চায়নিজ রান্নায় বিশেষত্ব কি জানো?

তরু বলল, বিশেষত্ব হচ্ছে ঠাণ্ডা হলে এই খাবার খাওয়া যায় না।

আনিস বলল, ভালো ধরেছ।

তরু বলল, আপনি কি বলতে পারবেন ঠাণ্ডা হলে কেন এই খাবার খাওয়া যায় না?

না।

তরু বলল, চায়নিজ খাবার মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট নামের লবণ দেয়া হয়। ঠাণ্ডা হলে লবণটা জমাট বেঁধে যায়। খাবারের স্বাদ নষ্ট করে দেয়।

আনিস বলল, কে বলেছেন? তোমার পঙ্গু চাচা?

হুঁ।

তিনি কি তোমার টিচার না-কি?

জ্ঞানী মানুষ সবারই টিচার। আপনি তার কাছে গেলে আপনাকেও তিনি অনেক কিছু শেখাবেন।

আনিস বলল, বুড়োটার নাম আমার সামনে উচ্চারণ করবে না। বুড়োটাকে কেন জানি সহ্য করতে পারছি নি। বুড়ো ছাড়া অন্য যে কোনো প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ করো। তোমার একটা লেখা আনতে বলেছিলাম এনেছ?

এনেছি। গল্প এনেছি। গল্পের নাম সিন্দাবাদের দৈত্য।

রূপকথার গল্প?

আধুনিক রূপকথার গল্প। মুখে বলব?

বলো।

তরু বলল, অল্পবয়েসি একটা মেয়ে একজন বৃদ্ধের প্রেমে পড়েছে। কঠিন প্রেম। মেয়েটা বুদ্ধিমতী সে বৃদ্ধকে বিয়ে করবে না। কিন্তু প্রেমের কারণে বৃদ্ধটাকে ঘাড় থেকে ফেলতেও পারছে না। বুড়োটা এখন তার কাছে সিন্দাবাদের দৈত্য। গল্পের আইডিয়া সুন্দর না?

আনিস শুকনো মুখে বলল, হুঁ।

তরু বলল গল্পের শেষটা বলব? মেয়েটা চায়ের সঙ্গে সায়ানাইড মিশিয়ে বুড়োটাকে খেতে দেয়।

সায়ানাইড?

হ্যাঁ সায়ানাইড। পটাশিয়াম সায়ানাইড। কেমিক্যাল ফর্মুলা হচ্ছে KCN. জানেন আমার কাছে এক কৌটা পটাশিয়াম সায়ানাইড আছে। দশ গ্রামের মতো। আমার এক বান্ধবী কেমিস্ট্রি পড়ে। তার কাছ থেকে নিয়েছি। নিজে কখনো খাব না। অন্যদের খাওয়াব।

আনিস বলল, এখন আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে তুমি বিয়েটা ভেঙ্গে দেবার চেষ্টা করছ। সরাসরি বলো তো তুমি কি চাও বিয়েটা হোক?

না।

কারণ কি ঐ পঙ্গু বুড়ো? সিন্দাবাদের ভূত?

হুঁ। চা দিতে বলুন তো। দুপুরে খাবার পর আমি সবসময় চা খাই।

আনিস গম্ভীর মুখে চায়ের অর্ডার দিল।

তরু বলল, আপনি তো কিছুই খান নি।

আনিস বলল, আমার খাবার নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। চা শেষ করো। চলো তোমাকে বাসায় নামিয়ে দেই। তরু আরেকটা কথা শোনো। বিয়ে কিন্তু আমি ভাঙব না। বিয়ে ভাঙতে হলে তোমাদের ভাঙতে হবে।

তরু বলল, আমি একজন বুড়ো মানুষের প্রেমে খাবি খাচ্ছি এটা শুনেও বিয়ে ভাঙবেন না?

আনিস বলল, না। কারণ তুমি বুড়োর প্রেমে খাবি খাওয়ার মেয়ে না। আমার সঙ্গে জটিল খেলা শুরু করেছ। আমি যথেষ্ট বেকুব বলে খেলাটা ধরতে পারছি না। ভালো কথা, তোমার ঐ ছেলে এসেছিল আমার কাছে।

কোন ছেলে?

নাম সনজু। দুটা ছবি নিয়ে উপস্থিত! একটাতে তুমি বুড়োটার কোলে বসে আছ। আরেকটাতে বুড়ো তোমার গলা জড়িয়ে ধরে আছে। ফটোশপের কাজ, খুবই খারাপ হয়েছে। দেখেই বুঝা যায় নকল ছবি।

ছবি দেখার পর আপনি কি করলেন?

আমি ঐ ছেলের গলা চেপে ধরলাম। এমন চাপ দিলাম যে তার চোখ কোঠর থেকে বের হবার জোগাড়। সে সঙ্গে সঙ্গে সব স্বীকার করল। কোন ফটোগ্রাফের দোকান থেকে কাজটা করেছে তার নাম বলে চোখের পানি, নাকের পানিতে একাকার।

আপনি তো মহাগুণ্ডা।

মহাগুণ্ডা না। ছোটখাটো গুণ্ডা। চল উঠি—

তরু বলল, আপনার তাড়া থাকলে আপনি চলে যান। আমি আরো কিছুক্ষণ বসব। পরপর চার কাপ চা খাব। এদের চা-টা খুব ভালো হয়েছে। আপনি এই ফাঁকে আমার গল্পটা পড়ে ফেলুন।
 
তরু চা খাচ্ছে। বিরক্ত মুখে আনিস গল্প পড়তে শুরু করেছে। গল্পের নাম-সিন্দাবাদের দৈত্য না। নাম—-মুন্সিগঞ্জের হেমন্ত। আঠারো-উনিশ বছরের একটা ছেলে যে হেমন্তের মতো গান গায়। কনট্রাক্টে মানুষের পেটে ছুরি বসিয়ে দেয়।

গল্প শেষ করে আনিস বলল, খুবই সুন্দর গল্প। বিশ্বাসই হচ্ছে না তোমার লেখা। গল্পটা দিয়ে নাটক বানালে অসাধারণ নাটক হবে। আমি করব। মুন্সিগঞ্জের হেমন্তের রোল। তরু তুমি নাটক লিখতে পারো?

না। আমার চা খাওয়া শেষ। আমি এখন উঠব।

আনিস আগ্রহ নিয়ে বলল, কিছুক্ষণ বসে গল্প করি।

তরু বলল, একজন লেখকের সঙ্গে আমার এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। উনি একটা হোটেলে আছেন। হাতে-কলমে আমাকে গল্প লেখা শেখাবেন। এই কাণ্ড যে তিনি করবেন তা লেখকের স্ত্রী জানেন না। তবে তাকে খবর দেয়া হয়েছে। তিনি যথাসময়ে উপস্থিত হবেন। আমার ধারণা তিনি লেখককে কানে ধরে নিয়ে যাবেন। অসাধারণ একটা দৃশ্য। আপনি দেখতে চাইলে হোটেল করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন।

কি বলছ তুমি?

আপনার মোবাইল টেলিফোনে ক্যামেরা আছে না। ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলতে পারেন।

তোমার কথা আমার একবিন্দু বিশ্বাস হচ্ছে না।

তরু ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।



লেখকের নাম শাহেদ খান। বেল টেপার পর তিনি দরজা খুলে দিলেন। তরু ঢোকা মাত্র দরজা বন্ধ করে দিলেন। তার নিশ্বাস কিছুটা ভারী। কপালে ঘাম।

তরু! কিছু খাবে? চা দিতে বলব। চা খাবে?

না।

না চা খেয়ে এসেছি।

হাতে সময় নিয়ে এসেছ তো। সাহিত্যের জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা অনেক সময় লাগে।

আপনি যতক্ষণ থাকতে বলবেন থাকব।

গুড। ভেরি গুড।

আমি একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস লেখা শুরু করেছি। খাতাটা নিয়ে এসেছি। পড়ে শুনাব?

অবশ্যই পড়ে শুনাবে। তবে তরু শোনো ডিটেকটিভ উপন্যাস কিন্তু সাহিত্য না। ডিটেকটিভ উপন্যাস হচ্ছে Craft. পৃথিবীর কোনো মহান লেখক ডিটেকটিভ উপন্যাস লেখেন নি।

এডগার এলেন পো তো লিখেছেন। তিনি বড় লেখক না।

উনি বড় লেখক। তবে বিপর্যস্ত লেখক। মেয়েদের সঙ্গ পছন্দ করতেন।

আপনিও তো পছন্দ করেন।

নারী হচ্ছে চালিকা শক্তি। প্রাচীন মানুষ যখন গুহায় ছবি আঁকত তখন আলো ধরে রূপবতী নগ্ন পরীরা দাঁড়িয়ে থাকত।

নগ্ননারী দাঁড়িয়ে থাকত জানলেন কিভাবে?

অনুমান করছি। একজন লেখকের অনুমান সত্যের খুব কাছে থাকে। বাহ্ তোমার হাতের আঙ্গুল তো খুব সুন্দর। সাহিত্যের ভাষায় এই আঙ্গুলকে বলে চম্পক আঙ্গুলি। দেখি তোমার হাতটা।

|||||||||| তরু হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, স্যার আমি আপনার এখানে আসার আগে ম্যাডামকে টেলিফোন করে অনুমতি নিয়েছি। ম্যাডামও মনে হয় আসবেন।

শাহেদ খান হাত ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তার মুখ হঠাৎ ছাই বর্ণ হয়ে গেল। কলিংবেল বাজছে। ঘন ঘন বাজছে। কেউ মনে হয় এসেছে। তরু বলল, স্যার! ম্যাডাম মনে হয় এসেছেন। দরজা কি খুলব?
 
০৯.
রাত তিনটা।

ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। তরুদের বাসার সামনে আধমরা কাঁঠাল গাছের ডাল মড়াৎ করে ভাঙল। ভাঙা ভাল পড়ল ড্রাইভার, দারোয়ানদের একতলা টিনের চালে। তাদের হৈচৈ এবং বজ্রপাতের শব্দে খালেক জেগে উঠলেন। ইলেকট্রিসিটি নেই, চারদিক ঘন অন্ধকার। শুধু তরুর ঘরে মোমবাতি জ্বলছে। খালেক মেয়ের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিলেন। ব্যাকুল গলায় বললেন, তরু কি হয়েছে রে মা? টেনশনের কারণে তিনি ভুলে গেলেন যে মেয়েকে ইদানীং তিনি পোশাকি নামে শামসুন নাহার ডাকছেন।

তরু দরজা খুলল। হাই তুলতে তুলতে বলল, তেমন কিছু হয় নি বাবা। ঝড়ে কাঁঠাল গাছের একটা ডাল ভেঙে পড়েছে। এখন আর হৈচৈয়ের শব্দ আসছে না কাজেই সব ঠিক ঠিক। পশ্চিম রণাঙ্গন শান্ত।

খালেক বিস্মিত হয়ে বললেন, পশ্চিম রণাঙ্গন শান্ত মানে কি?

একটা উপন্যাসের নাম। লেখক জার্মান। তাঁর নাম এরিখ মেরিয়া রেমার্ক! তার আরও একটা বিখ্যাত বই আছে নাম থ্রি কমরেডস। এই বইটা পড়তে হলে বড় সাইজের টাওয়েল লাগে।

টাওয়েল লাগবে কেন?

বই পড়তে শুরু করলে খুব কাদতে হবে। এমনই কষ্টের বই। টাওয়েল লাগবে চোখের পানি মুছতে।

তুই রাত জেগে কি করছিস?

লিখছি।

কি লিখছিস?

একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস। এখন খুব ক্রিটিক্যাল জায়গায় আছি। এক স্বামী তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে মারছেন। বেচারি ছটফট করছে আর তিনি বলছেন, সীমা! আর একটু কষ্ট করো। এক্ষুনি তোমার কষ্টের শেষ হবে। তুমি শান্তিতে ঘুমাবে। এই বলেই তিনি ঘুমপাড়ানি গান গাইতে শুরু করলেন—

ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি মোদের বাড়ি এসো
খাট নাই পালংক নাই পিঁড়ি পেতে বস।

খালেক বললেন, তোর তো মাথা খারাপ হয়ে গেছে। যতই দিন যাচ্ছে তুই ততই তোর মার মতো হয়ে যাচ্ছিস।

মার মাথা খারাপ ছিল?

অবশ্যই ছিল।

কখনো তো বলো নি।

অসুখ-বিসুখের কথা কি বলে বেড়ানো ঠিক। তাছাড়া আমি নিজেও শুরুতে ধরতে পারি নি।

তরু বলল, বাবা আমার ঘরে এসে বসো। কিছুক্ষণ গল্প করি। চা খাবে? চা বানিয়ে আনি? চা খেতে খেতে বাপ-বেটিতে গল্প।

খালেক বললেন, শামসুন নাহার, তোমার আচার-আচরণ আমার কাছে মমাটেই ভালো মনে হচ্ছে না।

তরু বলল, বাবা আমাকে শামসুন নাহার ডাকার আর প্রয়োজন নেই। আমার বিয়ে ভেঙে গেছে। আনিস সাহেব বিয়ে ভেঙে দিয়েছেন।

বলিস কি? গত পরশু না চায়নিজ খেতে গেলি। উলটপালট কি করেছিস?

তেমন কিছু করি নি। তবে উনার ধারণা আমি ডেনজারাস মেয়ে। আমাকে বিয়ে করলে পদে পদে বিপদে পড়তে হবে।

কেন এ রকম ধারণা হলো? কি সর্বনাশের কথা।

তরু বলল, এই প্রসঙ্গটা নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগছে না বাবা। তুমি মার কথা বলো।

খালেক বললেন, তার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।

তরু বলল, তাহলে পঙ্গু চাচার কথা বলো।

পঙ্গু চাচাটা কে?

ওসমান চাচা।

তাকে তুই পঙ্গু ডাকিস?

বাবা সরি। হঠাৎ হঠাৎ ডাকি।

খালেকের বিস্ময়ের সীমা রইল না। বিস্ময়ের প্রধান কারণ তরুর মা উনাকে হঠাৎ হঠাৎ ডাকত পঙ্গু ভাই। এই নিয়ে তিনি স্ত্রীর সঙ্গে অনেক রাগারাগি করেছেন। সে হাসতে হাসতে বলেছে, আচ্ছা যাও এখন থেকে আর পঙ্গু ভাই ডাকব না। ডাকব গঙ্গু ভাই।

খালেক বললেন, গঙ্গু ভাইটা কি?

তরুর মা হেসে ভেঙে পড়তে পড়তে বললেন, গঙ্গু হচ্ছে পঙ্গুর কাজিন।

মহিলার কথাবার্তার কোনো ঠিকঠিকানা ছিল না। তরু অবিকল তার মার মতো হয়েছে। তার কথাবার্তারও কোনো ঠিকঠিকানা নেই। মা ছাড়া সংসারে বড় হয়েছে। কিছু সমস্যা তো হবেই। তাই বলে এতটা? তার বিয়ে ভেঙে গেছে বলে যা বলছে তাও মনে হয় ঠিক না। খালেক ঠিক করলেন সকালে নাশতা খেয়েই তিনি আনিসের কাছে যাবেন। গোলমাল কিছু হয়ে থাকলে ঠিক করবেন।
 
ঘরের মোমবাতি তলানিতে চলে এসেছে। তরু নতুন নোম আনতে গেছে। ফিরতে দেরি করছে। খালেক অস্থির বোধ করছেন।

বাবা নাও চা খাও। চা বানাতে গিয়ে দেরি করেছি।

মোমবাতি পাস নাই?

পেয়েছি। জ্বালাব না। অন্ধকারে তোমার সঙ্গে গল্প করব। বাবা তুমি জানো অন্ধকারে মিথ্যা কথা বলা যায় না।

জানি না তো। কে বলেছে?

সাইকিয়াট্রিস্টরা বলেন। পুলিশের যাবতীয় ইনটারোগেশন এই কারণেই রাতে হয়।

চা খেলে রাতের ঘুমের দফা রফা হবে তার পরেও খালেক চায়ে চুমুক দিলেন। মোম নিভে গেছে। হঠাৎ অন্ধকার হবার জন্যেই কি বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে?

তরু বলল, বাবা তোমার কাছে একটা ইনফরমেশন চাই। মামার বাড়ির কেউ কখনো এ বাড়িতে আসেন না কেন?

খালেক বললেন, সেটা তারা জানে কেন আসে না। তাদেরকে কোলে করে এ বাড়িতে আনার তো আমার দরকার নাই। আমি তাদের খাইও না, পরিও না। মোমবাতি জ্বালা। মোমবাতি ছাড়া অন্ধকারে বসে থাকতে ভালো লাগছে না। নিজেকে চোর চোর লাগছে।

তরু মোমবাতি জ্বালাল আর তখনই বসার ঘরের দরজায় ডাকাত পড়ার মতো শব্দ হতে লাগল। দরজা ভেঙে ফেলার মতো অবস্থা।

খালেক উঠে গেলেন। মোমবাতি হাতে পেছনে পেছনে গেল তরু। দরজা খুলে দেখা গেল সনজু তার বোনকে নিয়ে এসেছে। বোন থরথর করে কাঁপছে। অপ্রকৃতস্থের মতো তাকাচ্ছে। তার মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে।

খালেক বললেন, কি হয়েছে।

সনজু বলল, দুলাভাই মারা গেছেন।

কি সর্বনাশ, কখন মারা গেছে।

সন্জু বলল, কখন মারা গেছেন জানি না। এই মাত্র মোবাইলে খবর এসেছে। কে যেন তার পেটে ছুরি মেরেছে। লোকজন ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেছে, সেখানে মারা গেছেন।

খালেক হতভম্ব গলায় বললেন, ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্নাইলাইহে রাজিউন। ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলো। চলো হাসপাতালে যাই। ধৈর্য ধরো। বিপদে ধৈর্যের মতো কিছু নাই।



ইলেকট্রিসিটি চলে এসেছে। বৃষ্টি থামে নি। তরু বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে বৃষ্টি দেখছে। চারটার মতো বাজে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সকাল হবে। তরু ঠিক করেছে বারান্দায় বসেই আজ সকাল হওয়া দেখবে। একজন ঔপন্যাসিকের সকাল হওয়া দেখা খুব জরুরি। সে কখনো সকাল হাওয়া দেখে নি। তার ঘুম নটার আগে ভাঙে না। রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই সূর্য ওঠার আগেই ঘুম থেকে উঠতেন। আয়োজন করে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির বারান্দায় বসে সূর্য ওঠা দেখতেন। কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থেকে বিখ্যাত সব কবিতা লিখতেন যেগুলি পাঠ্য হয়ে যেত।

আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান

কবিতা ছাপিয়ে কাজের মেয়ের গলা পাওয়া গেল। আফা আপনে এইখানে, আমি সারাবাড়ি খুঁজতেছি। এত ঘটনা যে ঘটছে আমি কিছুই জানি না। ঝড়-তুফান যে হইছে হেই খবরও নাই। আফা মার্ডার নাকি হইছে?

হুঁ।

কেমন দেশে বাস করি দেখছেন আফা? পথেঘাটে মার্ডার। চা খাবেন আফা।

খেতে পারি।

গত কাইলই লোকটারে দেখছি চায়ের কাপে টোস্ট বিসকুট ড়ুবায়া চা খাইতেছে—আইজ মার্ডার। বারান্দায় বইসা আছেন কেন আফা, বৃষ্টির ছিট আসতাছে।

আসুক তুমি চা নিয়ে এসো।
 
সনজুদের বাসার দরজা খোলা। ভেতরে হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল। কেউ যেন সুইচ টিপে বাতি জ্বালাল। ঐ বাসায় কেউ নেই। সবাই হাসপাতালে। তাহলে বাতি কে জ্বালাবে? ঘরের ভেতর থেকে কুচকুচে কালো রঙের একটা বিড়াল এসে বারান্দায় আলোতে বসেছে। এই বিড়ালটাকে তরু আগে দেখেনি। মনে হচ্ছে ভৌতিক বেড়াল। বিড়ালটাই কি ঘরের ভেতরের বাতি জ্বালিয়ে বারান্দায় এসে আলোতে বসেছে? এডগার এ্যালেন পোর বিড়াল?

আফা! চা নেন। মোবাইলটা ধরেন। একটু পরে পরে বাজতাছে।

তরু চায়ের কাপ এবং মোবাইল হাতে নিল। কাজের মেয়ে বলল, কারেন্ট আসছে আফা। বারিন্দার বাতি জ্বালায়ে দিব?

তরু বলল, না।

সে চায়ের কাপে চুমুক দিল। বিড়ালটা তাকাচ্ছে তার দিকে। তরু ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। বেড়ালটাকে ঘিরে যে রহস্যময়তা তৈরি হয়েছিল তার অবসান হয়েছে। কারেন্ট এসেছে বলেই সনজুদের ঘরের বাতি জ্বলে উঠেছে। বেড়ালের এখানে কোনো ভূমিকা নেই। তরুর মোবাইল টেলিফোন আবার বেজে উঠেছে।

সনজু হবার সম্ভাবনী। হত্যাকাণ্ড কিভাবে ঘটল তার বর্ণনা দেবার জন্যে সনজু নিশ্চয়ই ব্যস্ত হয়ে আছে। হত্যাকারী মৃতদেহের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে পছন্দ করে। মুন্সিগঞ্জের হেমন্ত হয়তো হাসপাতালের সামনেই হাঁটাহাঁটি করছে। সনজু এক পর্যায়ে হেমন্ত বাবুকেও টেলিফোনে ধরিয়ে দিতে পারে।

তরু টেলিফোনের বোতাম টিপে বলল, হ্যালো কে?

ওপাশে ধরেছেন লেখক স্যার। তিনি থমথমে গলায় বললেন, তরু! তুমি এই কাজটা কেন করলে?

তরু বলল, কোন কাজটা স্যার?

কোন কাজটা তুমি জানো না? স্টুপিড মেয়ে।

গালাগালি করছেন কেন স্যার। লেখকের মুখে গালাগালি মানায় না। লেখকরা মিষ্টি করে কথা বলবেন। স্যার আপনি কল্পনা করুন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কারো উপর রাগ করে বললেন—এই শালা। দূর হ! তখন কেমন লাগবে?

তরু! তুমি অতিরিক্ত চালাক সাজার চেষ্টা করছ। তোমাকে দোষ দিচ্ছি। এই সময়কার তরুণী মেয়েদের জেনারেল স্টাইল অতিরিক্ত চালাকি করা। তারা বন্ধুবান্ধবদের সামনে অবলীলায় বলবে—পাঁচটা মিনিট অপেক্ষা কর। আমি মুততে গেলাম। বলে বাথরুমে ঢুকবে এবং ভাববে অতি স্মার্ট একটা কাজ করা হলো।

ঠিক বলেছেন স্যার।

শোনো তরু! আমাকে উদ্ধার করো। আমার স্ত্রী যে কি সমস্যা তৈরি করেছে এবং ভবিষ্যতে কি ভয়ংকর কাজকর্ম করবে বা তোমার কল্পনাতেও নেই। আমার অনুরোধ তুমি আমাকে উদ্ধার করো।

কিভাবে উদ্ধার করব?

আমার স্ত্রীকে বলবে সবই তোমার সাজানো। তুমি একবার আমাকে প্রেম নিবেদন করেছিলে, আমি তখন খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলাম বলেই এইভাবে শোধ নিয়েছ।

বললেই বিশ্বাস করবেন?

অবশ্যই বিশ্বাস করবে। সে বিশ্বাস করার জন্যেই অপেক্ষা করছে। বিশ্বাস করা ছাড়া তার আর কোনো সেকেন্ড অপশন নেই।

স্যার আমি আজ দিনের মধ্যেই বলব।

থ্যাংক য়্যু। ফ্রম মাই হার্ট থ্যাংক য়্যু।

তরু বলল, স্যার আপনার সঙ্গে আমি যা করেছি তার জন্যে এখন লজ্জা লাগছে। আপনি চাইলে আমি কিছু নিরিবিলি সময় আপনার সঙ্গে কাটাব। এবার আর ম্যাডাম উদয় হবেন না। ঐ হোটেলেও যেতে পারি। আপনার নিশ্চয়ই বুকিং আছে। বুকিং আছে না স্যার?

হুঁ।

তরু গলা নামিয়ে বলল, ম্যাডাম স্বপ্নেও ভাববেন না যে ঘটনার পরদিনই আবার আপনি হোটেলে যাবেন এবং কাউকে ডেকে পাঠাবেন। স্যার আজ কি আসব?

তোমার কথা বিশ্বাস করতে পারছি না।

স্যার বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহু দূর। আপনি ইশারা করলেই আমি আসব।

আগে তুমি তোমার ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলে তাকে ঠিক করে তারপর দেখা যাবে।

যদি কথা বলে ঠিক করতে পারি তাহলে কি আসব? কখন আসব বলুন?

বিকালের দিকে আসতে পারো If You really want that.

বিকাল মানে কখন? সময়টা বলুন।

হঠাৎ তুমি এত ব্যস্ত হলে কেন?

আপনার উপর যে অন্যায়টা আমি করেছি তার প্রতিকার করতে চাই। তাছাড়া স্যার, আমি আপনার চোখে তৃষ্ণা দেখেছি। লেখকের চোখের তৃষ্ণা খুব খারাপ জিনিস। চোখে তৃষ্ণা নিয়ে লেখক লিখতে পারেন না।

তুমি চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে চলে এসো।

থ্যাংক য়্যু স্যার।

তরু টেলিফোন নামিয়ে ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশে ভোরের আলো ফুটছে। তরু আগ্রহ নিয়ে ভোর হওয়া দেখছে।
 
খালেক বিকালের মধ্যে সব ঝামেলা মিটিয়ে ফেললেন। ডাক্তারের রিপোর্ট, সুরতহাল, কবর দেয়ার জন্যে ওসি সাহেবের অনুমতি সব জোগাড় হয়ে গেল। আজিমপুর গোরস্থানে কবর দিয়ে তিনি বাসায় ফিরে মোটামুটি হাসিমুখে তরুকে বললেন, কড়া করে এক কাপ চা দে তো মা। চা খেয়ে গরম পানিতে হেভি গোসল দেব।

তরু বলল, বাবা! তোমাকে আনন্দিত মনে হচ্ছে কেন?

খালেক বললেন, অস্বাভাবিক মৃত্যু কত ভয়াবহ এটা জানিস? নানান ফ্যাকড়া। পুলিশ থাকে টাকা খাওয়ার ধান্ধায়। তাদের সামাল দেয়া বিরাট ব্যাপার।

তরু বলল, তুমি An expert হেডমাস্টারের মতো সব ঝামেলা শেষ করে দিয়েছ? কনগ্রাচুলেশন।

খালেক সরু চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেয়ের তাকানোর ভঙ্গি, কথাবার্তার ভঙ্গি সবই কেমন অদ্ভুত লাগছে।

তরু বাবাকে চা এনে দিল। মগ ভর্তি চা। তরু বলল, আরাম করে চা খাও বাবা। গিজার কাজ করছে না। চুলায় গরম পানি হচ্ছে। দশ মিনিট পরেই গোসল করতে পারবে। এই দশ মিনিট আমার সঙ্গে গল্প করো।

কি গল্প করব?

পঙ্গু চাচা তোমার বাড়িতে কেন থাকেন? তার টাকা-পয়সা ভালোই আছে। তারপরেও এখানে কেন পড়ে আছেন। এই ব্যাপারটা বলো। খালেক বললেন, আজকের দিনে এইসব কথা কেন তুলছিস?

তরু বলল, প্রায়ই তুলতে চাই। ভোলা হয় না। অনেকগুলি খটকা নিয়ে বড় হয়েছি তো বাবা। খটকা ভালো লাগে না।

কি খটকা?

এই যেমন পঙ্গু চাচা এত জায়গা থাকতে তোমার বাড়ির ছাদে থাকেন কেন? এটা ছাড়াও খটকা আছে।

আর কি?

মার এবং খালা দুজনের মৃত্যুদিন তুমি ঘটা করে করো। মিলাদ হয়। কাঙালি ভোজ হয় এবং তোমার বিখ্যাত তওবা অনুষ্ঠান হয়। তওবার বিষয়টা আমি বুঝতে পারি না। তওবা কেন? তুমি কি বড় কোনো পাপ করেছ? ভালো কথা, পানি মনে হয় গরম হয়েছে। তুমি গোসল করতে যাও।

খালেক বাথরুমের দিকে রওনা হলেন। তিনি অপ্রকৃতস্থের মতো পা ফেলছেন। এক তলা থেকে শায়লার চিৎকার করে কান্নার আওয়াজ আসছে। তার ঘরের দরজা-জানালা বন্ধু। তারপরেও আওয়াজ আসছে। বন্ধ দরজার সামনে সনজু মোড়ায় মাথা নিচু করে বসে আছে। মৃত মানুষের বাড়িতে আত্মীয়-অনাত্মীয় অনেকে ভিড় করে থাকে। এই বাড়ি খালি। দুপুরে ভাড়া করা ট্যাক্সি করে দুই মহিলা এসেছিলেন। অল্প কিছুক্ষণ থেকে সেই ট্যাক্সিতেই বিদায় নিয়েছেন।

তরু বারান্দা থেকে সনজুকে ইশারায় ডাকল। সনজু আসছে। তার হাঁটার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে নিতান্ত অনিচ্ছায় আসছে।

সনজু মাথা নিচু করে তরুর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একবারও চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। তরু বলল, মুন্সিগঞ্জের হেমন্ত বাবুর খবর কি? উনি ভালো আছেন?

সনজু জবাব দিল না।

তরু বলল, ঘটনা কি সেই ঘটিয়েছে?

সনজু এই প্রশ্নের উত্তর দিল না।

তরু বলল, তোমার আপা একা কাঁদছেন। তুমি কাঁদছ না এটা কেমন কথা? কান্নাতেও সঙ্গী লাগে। আপার সঙ্গে কাঁদো। নকুল কান্না হলেও কাঁদো। তোমার আপা কিছুটা শান্তি পাবেন।

সনজু চলে যাচ্ছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে কাঁদবে। শরীর ফুলে ফুলে উঠছে।

তরু লেখকের স্ত্রীকে টেলিফোন করল। পাঁচ মিনিটের মাথায় ভদ্রমহিলা পুরোপুরি নিশ্চিত হলেন যে লেখকের কোনো দোষ নেই। বাজে একটা মেয়ের পাল্লায় পড়ে এই সমস্যা হয়েছে। তিনি তরুকে ক্ষমা করে দিলেন। এবং বললেন, এ রকম কাজ সে আর যেন না করে। তরু কাঁদতে কাঁদতে বলল, আর কখনো করব না ম্যাডাম।

ম্যাডাম বললেন, তুমি একদিন বাসায় এসে আমার সঙ্গে এক কাপ চা খেয়ে যাবে।

তরু বলল, জি আচ্ছা ম্যাডাম।

আমি তোমাদের মতো মেয়েদের সমস্যাটা যে বুঝি না, তা-না। বুঝি। ওর লেখা পড়ে মাথা ঠিক থাকে না। না থাকাই স্বাভাবিক। ঠিক আছে কান্না বন্ধ করো। আমি পুরোপুরি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।

তরু এরপর টেলিফোন করল আনিসকে। মিষ্টি করে বলল, আমি তরু।

আনিস বলল, নাম বলতে হবে না। টেলিফোনে তোমার নাম্বার উঠেছে। বলো কি ব্যাপার।

আপনি কি আমার ছোট্ট একটা কাজ করে দেবেন?

কি কাজ?

আমার স্বামী হিসেবে পাঁচ মিনিট অভিনয় করতে পারবেন?

আনিস বলল, রহস্য করবে না। কি বলতে চাও পরিষ্কার করে বলো।

ঐ দিন যে লেখক স্যারের কাছে গিয়েছিলাম তার কাছে আবার যাব। আপনাকে নিয়ে যাব। আপনাকে দেখিয়ে লেখক স্যারকে বলব যে উনি আমার হাসবেন্ড। আমরা দুজন আপনার দোয়া নিতে এসেছি। তারপর দুজন মিলে তাকে কদমবুসি করব।

আনিস কঠিন গলায় বলল, তোমার কোনো পাগলামির সঙ্গে আমি যুক্ত থাকতে চাচ্ছি না। তুমি দয়া করে আর কখনো আমাকে টেলিফোন করবে না।

জি আচ্ছা। আংটিটা ফেরত নিতে আসবেন না?

আংটি তুমি নর্দমায় ফেলে দাও।

তরু বলল, এরকম কঠিনভাবে কথা বলছেন কেন? সম্পর্ক শেষ হয়ে গেলেই যে কঠিন কঠিন কথা বলতে হয় তা তো না। আমরা বন্ধুর মতো থাকতে পারি। আপনার যে কোনো সমস্যায় আমি থাকব। আমার সমস্যায় আপনি থাকবেন।

আনিস বলল, তোমার কি ঐ লেখকের কাছে যেতেই হবে?

তরু বলল, হ্যাঁ।

আনিস বলল, কখন?

বিকাল চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে।

আনিস বলল, ঠিক আছে আমি আসছি। স্বামীর ভূমিকায় অভিনয় করে আসব।

তরু বলল, সত্যিকার স্বামী হিসেবে গেলে কেমন হয়। প্রথমে আমরা দুজন কাজি অফিসে গেলাম, বিয়ে করলাম। সেখান থেকে গেলাম লেখক স্যারের কাছে। আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিলাম উনি আমার হাসবেন্ড। এর বড় একটা সুবিধা আছে।

কি সুবিধা?

লেখক স্যারকে মিথ্যা কথা বলতে হলো না। লেখকদের কাছে মিথ্যা বললে পাপ হয়। আমি জানি আপনি রাজি না। কিন্তু একটা কথা বললেই আপনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাবেন।

আনিস অবাক হয়ে বলল, এমন কি কথা যে বললেই আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাব।

তরু বলল, কথাটা খুবই সাধারণ।

আনিস বলল, সাধারণ কথাটা শুনি?

তরু বলল, বলতে আমার লজ্জা লাগছে। তারপরেও বলি। আমি রাতে যখন ঘুমুতে যাই তখন আমার বালিশের পাশে একটা বালিশ রেখে দেই। এবং কল্পনা করি—সেখানে মাথা রেখে তুমি শুয়ে আছ।

তরু টেলিফোন ধরে আছে। ওপাশ থেকে কেউ কথা বলছে না। পৃথিবী হঠাৎ শব্দহীন হয়ে গেছে। তরু বলল, তুমি আছ না চলে গেছ?

আনিস বলল, তোমাদের বাড়ির পাশেই তো একটা কাজি অফিস আছে। আছে না?

তরু বলল, আছে। আমি কি শাড়ি পরে রেডি হব?

হ্যাঁ।

তরু কাঁদছে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এই কান্না মিথ্যা কান্না না। তার কান্নার শব্দে খালেক ছুটে এসে বললেন, মা কি হয়েছে?

ভুরু ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, বাবা আজ আমার বিয়ে। কাজি অফিসে বিয়ে হচ্ছে। তুমি তৈরি হও। তুমি এবং পঙ্গু চাচা বিয়ের সাক্ষী।

খালেক বললেন, কার সঙ্গে বিয়ে?

তরু চোখ মুছতে মুছতে বলল, জানি না।
 
১০.
কাগজ ছেঁড়ার শব্দে আনিসের ঘুম ভেঙেছে। চোখ না মেলেই সে বলল, তরু কি করছ?

তরু বলল, কাগজ ছিঁড়ছি। গল্প-উপন্যাস যা লিখেছিলাম সব কুটি কুটি।

আনিস ঘুম ঘুম চোখে একবার তাকাল। তরু চেয়ারে বসে আছে। তার সামনে মোমবাতি। সে শুধু যে কাগজ ছিড়ছে তা-না, কাগজ পুড়াচ্ছেও। আগুন ধরিয়ে টেবিলে রাখা এলুমিনিয়ামের গামলায় ফেলে দিচ্ছে। আগুনের হলুদ আভা পড়ছে তরুর চোখে-মুখে। কি সুন্দরই না তাকে লাগছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব রূপ নিয়ে বসে আছে রাঙা রাজকন্যা। আনিস বলল, লেখা ছিঁড়ে ফেলছ কেন?

তরু বলল, লেখক হবার অনেক যন্ত্রণা। কত কিছু জানতে ইচ্ছ করে। আমি এখন শুধু তোমাকেই জানব। আর কিছু জানব না। বুঝতে পারছ আমার কথা?

আনিস জবাব দিল না। তরু বলল, ঘুমিয়ে পড়েছ?

কোনো উত্তর নেই। তরু কাগজ ভেঁড়া বন্ধ করে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল আনিসের দিকে। ঘুমন্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলা খুব আনন্দের ব্যাপার। যার সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে সে পাশেই আছে অথচ কিছুই শুনছে না।

তরু বলল, আমি নানান জটিলতায় বাস করেছি। এখন জটিলতামুক্ত জীবনযাপন করতে চাচ্ছি। কি জটিলতা জানতে চাও? বাবাকে নিয়ে জটিলতা। তিনি প্রতি বছর মা এবং খালার মৃত্যুদিনে তওবা করেন কেন?

পঙ্গু চাচাকে নিয়ে জটিলতা। তিনি কেন আমাকে এমন একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস লিখতে বললেন যেখানে এক ভদ্রলোক তার দুই স্ত্রীকে হত্যা করেন। তিনি কি কিছু জানেন? পঙ্গু ভদ্রলোক এই বাড়িতে কেন পড়ে আছেন? তার অতি প্রিয় কেউ কি এই বাড়িতে বাস করে? সেই অতি প্রিয়জনটা কে? তরু নামের মেয়েটি? যাকে তিনি মিস্ট্রি ডাকেন? মেয়েটির মধ্যে রহস্য আছে এই জন্যেই কি তার নাম মিস্ট্রি? রহস্যটা কি?

এই নাই? আমার কথা শুনছ?

আনিস পাশ ফিরতে ফিরতে অস্পষ্ট গলায় বলল, হুঁ।

সুখে বাস করার সাধারণ নিয়ম জানো?

হুঁ।

তুমি ঘুমের মধ্যেই হুঁ হুঁ করছ। আমার কথা কিছু শুনছ না। শুনলেও বুঝতে পারছ না। আচ্ছা বলো তো, এমন কি হতে পারে আমি পঙ্গু ভদ্রলোকটার মেয়ে?

হুঁ।

তরু বলল, সম্ভাবনা আছে। তিনি লম্বা, গায়ের রঙ দুধে আলতায়। আমিও তাই। একজন ঔপন্যাসিকের জন্যে চমৎকার সাবজেক্ট। আমি এখন আর ঔপন্যাসিক না, কাজেই এইসব নিয়ে ভাবব না। মুন্সিগঞ্জের হেমন্ত এসেছিল। সনজু তাকে এনেছিল গান শুনাতে। তার গলা আসলেই সুন্দর। চোখ বন্ধ করে শুনলে মনে হয় হেমন্ত বাবুই গাইছেন–শিকল চরণে তার হয়েছে নূপুর। আমি মুগ্ধ হয়ে তার গান শুনেছি। একবারও জিজ্ঞেস করি নি, আপনার সঙ্গে কি ক্ষুরটা আছে? একটু দেখি তো!

আজ দুপুরে বাবাকে দেখেছি গলা নিচু করে সনজুর বোনের সঙ্গে কথা বলছেন। বাবার মুখ হাসি হাসি। ঐ মহিলার মুখ হাসি হাসি। ঐ মহিলার কোথাও যাবার জায়গা নেই বলে আমাদের সঙ্গেই থাকেন। প্রায়ই ইন্টারেস্টিং রান্না করে বাবাকে খাওয়ান। আজ দুপুরে তিনি বেঁধেছেন কলার থোড়ের বড়া। বাবা এখনো খান নি। খেলেই বলবেন–অসাধারণ।

আমার বাবাকে বলতে ইচ্ছা করে—বাবা তুমি কি এই মহিলাকে বিয়ে করবে? এবং কিছুদিন পর এই মহিলার একটি পেইনটিং আমার মা এবং খালার পেইনটিং-এর পাশে শোভা পাবে?

আমি কিছুই জিজ্ঞেস করি নি। যে তরু প্রশ্ন করত সে নেই। আমি অন্য তরু। আমার চক্ষে তৃষ্ণা। ভালোবাসায় ড়ুবে থাকার তৃষ্ণা। ড়ুব দিতে হয় চোখ বন্ধ করে। আমি চোখ বন্ধ করেছি।
 
ভালো হচ্ছে মশাই। পরের পর্ব আসবে কবে? কমেন্ট লিখতে লিখতে দেখি পরের পর্ব দিয়েও দিলেন।
শুধু আপনার জন্যই দিয়ে দিলাম। সাহিত্যে ভক্ত পাঠক আজকাল খুব কমই পাওয়া যায়।!
 

Users who are viewing this thread

Back
Top