What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected এই বসন্তে - উপন্যাস (4 Viewers)

সাইফুল ইসলামের রাতে ভালো ঘুম হয় না।

তার ঘরটি ছোট। একটিমাত্র জানালা, তাও বন্ধ করে রাখতে হয়। কারণ জানালার ওপাশে মুন্সি সাহেব গরুর গোবর পাবার ব্যবস্থা করেছেন। জানালা ভোলা থাকলে পচা গোবরের গন্ধ বুকের ওপর চাপ হয়ে থাকে। সাইফুল ইসলাম বন্ধ ঘরের গরমে হাঁসফাঁস করে। অর্ধেক রাত পর্যন্ত তালপাতার পাখায় হাওয়া খায়। দু-তিন বার বাইরের মাঠের একটা পরিষ্কার জায়গা দেখে বসে থাকে। বসে থাকতে থাকতে যখন ঘুমে চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, তখন শুতে যায়। প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরমে ঘুম চটে যায়। তালপাখা দত নাড়াতে নাড়াতে ভাবে–এই জায়গায় থাকা যায় না। খোলামেলা একটা জায়গা নিতে হবে।

অবশ্যি সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। মুন্সি সাহেবের এই ঘরটায় সে বিনা ভাড়ায় থাকতে পারে। তার বদলে মুন্সি সাহেবের একটি নাতিকে পড়াতে হয়। নাতিটির নাম বজলুর রশিদ। পড়াশোনায় কোনোমন নেই। কিছু বললেই বিকট সুরে চিৎকার করে। সে চিৎকারে আশেপাশে ভূমিকম্প হয়ে যায়। ছেলেটির মা পর্দার আড়াল থেকে চিকন সুরে বলে, কি হয়েছে রে বজলু?

আমারে মারছে।

বজলুর মার চিকন গলা আরো চিকন হয়ে যায়, মাষ্টার সাব, পুলাপান মানুষরে মাইরধোইর কইরেন না।

সাইফুল ইসলাম প্রতিবারই বলে, জ্বি-না, মারি নাই। আরব কেন?

কিন্তু ছেলেটির মা বিশ্বাস করে না। কারণ সে দীর্ঘ সময় পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে। পর্দার নিচ দিয়ে তার ফর্সা পা দেখা যায়। এরকম ফর্সা পা সাইফুল ইসলাম আর দেখে নি। ছেলেটি অবশ্যি তার মার মতো হয় নি। শ্যামলা রঙ। দাঁতগুলো বের হয়ে আছে। কে জানে তার মার দাঁতও উচু কিনা। উচু হওয়াই স্বাভাবিক। এমন টকটকে যার গায়ের রঙ, তার কোনো খুঁত না থাকলে হয় না। মেয়েদের সঙ্গে থেকে থেকে সে এই সব জিনিস খুব খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শিখেছে। সে দেখেছে খুব ফর্সা মেয়ের ঠোটের কাছে অস্পষ্ট একটা গোঁফের রেখা থাকে, পায়ের লোমগুলো হয় বড়ো বড়ো। ইঞ্জিনীয়ার সাহেবের এক শালীকে সে গান শেখাত। সে মেয়েটি ছিল অসম্ভব ফর্সা। কিন্তু বড়ো বড়ো কুৎসিত লোম ছিল পায়ে। লোমগুলো লালচে ধরনের। বাদামীও হতে পারে। ভালো মতো লক্ষ করা যায় নি। মেয়েটি ঝট করে শাড়ি টেনে দিয়েছে। মেয়েদের বোধহয় ঘাড়ের কাছে অদৃশ্য এক জোড়া চোখ থাকে। মাথা না ঘুরিয়েও অনেক কিছু টের পায়।

লোম থাকুক আর যাই থাকুক, ফর্সা মেয়েদের সাইফুল ইসলামের বড়ো ভালো লাগে। সার্কেল অফিসার সাহেবের হোট মেয়েটিও ফর্সা। তাকেও সাইফুল ইসলামের ভালো লাগে।

যে-সব রাত্রিতে তার ঘুম আসে না, সে-সব রাত্রিতে সে ধবধবে ফর্সা কোনো একটা মেয়ের কথা চিন্তা করে–যার গায়ের চামড়া অসম্ভব মসৃণ। যেন সেই মেয়েটি পাতলা একটা শাড়ি (হলুদ বা কমলা রঙের) পরে রাতে ঘুমাতে এসেছে। সাইফুল ইসলাম বলল, এত সকাল সকাল ঘুমাও কেন গগা, একটু চা-টা কর না।

চা খেলে তো তোমার ঘুম আসবে না। না আসুক, কর একটু।

মেয়েটি হাসিমুখে চা বানিয়ে আনল। রাগ করে (কপট রাগ) বলল, চা খাওয়াটা কমাও। বড়ো বেশি চা খাও তুমি, ভালো না। এই গরমে কেউ চা খায়। আমি তো সেদ্ধ হয়ে গেলাম।

সাইফুল ইসলাম রহস্য করে বলল, বেশি গরম লাগলে কাপড় খুলে ফেললেই হয়, হা হা হা।

ছিঃ, কী অসভ্যতা যে কর! ভাল্লাগে না।

অসভ্যতা কী করলাম, কেউ তো দেখতে আসছে না।

মেয়েটি তখন সত্যি রাগ করে ঘুমাতে গেল। সাইফুল ইসলাম চা শেষ করে মশারির ভেতর ঢুকে দেখে মেয়েটি কাপড়চোপড় খুলেই শুয়েছে। গত দু-তিন রাত সে এই জাতীয় কিছুই ভাবতে পারছে না। বারবার থানার পাশ দিয়ে আসবার সময় শোনা বীভৎস চিৎকার মনে আসছে। চিৎকার যে এত কুৎসিত হয়, কে জানত!

তার জানতে ইচ্ছা করে চিৎকারটা দিয়েই লোকটা মরল কিনা। লেকটা অবশ্যি মস্ত চোর ছিল। বাজারের চুরিগুলো সেই করিয়েছে। দবির মিয়া বলেছে, তার জিনিসপত্র কিছু কিছু পুলিশ উদ্ধার করেছে। চোর-ডাকাত যত কমে ততই ভালো। থানায় দু-একটা চোর-ডাকাত মারা পড়ার ভালো দিক আছে। চোর-ডাকাত সতর্ক হয়ে যায়। ওসি সাহেব খুব কড়া লোক, এইটা প্রচার হয়। কিন্তু তবু সাইফুল ইসলাম চিৎকারটার কথা ভুলতে পারে না। সে এক রাত্রে হাতের লেখাটা অন্যরকম করে নীলগঞ্জ থানার ওসি সাহেবকে একটা সুদীর্ঘ চিঠি লিখে ফেলে। চিঠির বক্তব্য হচ্ছে, মানুষকে পিটিয়ে মারা অত্যন্ত গৰ্হিত কাজ। তার জন্য তাকে অবশ্যই শাস্তি ভোগ করতে হবে ইত্যাদি। চিঠির শেষে নাম লেখে জনৈক পথিক।

চিঠিটা সে অবশ্যি পাঠানর জন্যে লেখে নি। এ রকম চিঠি সে তার ছাত্রীদের প্রায়ই লেখে এবং কখনো পাঠায় না। কারণ সুদীর্ঘ সেই সব চিঠির প্রায় সবটাই সীমাহীন অশ্লীলতা। পাঠানর প্রশ্নই ওঠে না। ওসি সাহেবের চিঠিতেও খানিকটা অশ্লীলতা ছিল। দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় সে লিখেছে কি করে ওসি সাহেবকে খুশি করা হবে এবং বিচি দুটি ফেলে দিয়ে রসুনের কোয়া ভরে দেওয়া হবে।

না পাঠানর জন্যে লেখা হলেও শেষ পর্যন্ত চিঠিটা পাঠিয়ে দিল। অনিদ্ৰা নোগটা তার খুব বাড়ল তার পরপরই। থানার পাশ দিয়ে সে হাঁটা ছেড়ে দিল।

পঞ্চম দিনে ওসি সাহেব লোক পাঠিয়ে তাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। এবং অত্যন্ত গম্ভীর মুখে বললেন, কি, আপনাকে তো আজকাল দেখিই না?

সাইফুল ইসলাম ঢোক গিলল।

তা আছেন কেমন?

জ্বি, ভালে।

এসপি সাহেব আসছেন ময়মনসিংহ থেকে। একটা আসামী যে মারা গেছে। সেই তদন্তে।

সাইফুল ইসলাম ছাইবর্ণ হয়ে গেল।

এসপি সাহেব আবার গান-বাজনার খুব সমঝদার। একটু গান-বাজনার ব্যবস্থা করতে পারবেন?

জ্বি জ্বি, তা তা…

দেখেন যদি পারেন। এই শহরে আপনি ছাড়া আর কেউ তো নেই। এই, একে চা-মিষ্টি দে।
 
মাঝরাত্রে হঠাৎ করে বৃষ্টি নামল। জহুর বিছানা টেনেটুনে এক পাশে নিয়ে এল। তাতেও শেষরক্ষা হল না। তোষকের অনেকখানি ভিজে চুপসে গেল। মশারি উড়তে লাগল নৌকার পালের মত। বাড়ির লোকজনদের না জাগিয়ে ভেতরে ঢোকার উপায় নেই। জহুরের কাউকে ডাকতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। যেরকম বাতাস হচ্ছে, এমনিতেই কারো-না-কারো ঘুম ভাঙবে।

ঘুম অবশ্যি ভাল না। জহুর পা গুটিয়ে বেঞ্চির উপর বসে বৃষ্টি দেখতে লাগল। তার সিগারেট রাবার ইচ্ছা করছিল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে আগুনের স্পর্শের জন্যে মন কাঁদে। সিগারেট নেই, শেষ সিগারেটটি ঘুমাবার আগে ধরিয়েছে। এরকম একটি ঝড়-বাদলের রাত একা-একা জেগে কাটান কষ্টকর। জহুরের শীত লাগছিল। গায়ে দেবার কিছু নেই। চারটি ভিজে ন্যাতান্যাতা।

মামা।

জহুর চমকে উঠে দেখল কোনো রকম শব্দ না করে অঞ্জু দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। বাতাসে তার লম্বা চুল উড়ছে। অজুর চুল যে এত লম্বা, সে আগে লক্ষ করে নি। জহুর বলল, ভালো বর্ষণ শুরু হয়েছে, দেখলি?

তুমি ডাকলে না কেন আমাদের?

তোরা নিজে থেকে উঠবি, তাই ভেবে ডাকি নি।

অঞ্জু ভারি স্বরে বলল, তুমি এমন ভাব কর, যেন তুমি বেড়াতে এসেছ আমাদের এখানে।

জহুর জবাব দিল না। অঞ্জু বলল, ছোটমার সঙ্গেও তুমি বেশি কথা বল না। শুধু হাঁ-হুঁ কর। ছোটমার ধারণা তুমি তাকে দেখতে পার না।

দেখতে পারব না কেন?

অঞ্জু বেঞ্চির এক পাশে বসল। জহুর বলল, বসলি কেন? ঘুমাতে যা।

তোমার সঙ্গে বসে বসে একটু বৃষ্টি দেখি।

ঘরের ভেতরে বাবলু জেগে উঠে চেঁচাতে শুরু করেছে। দবির মিয়া চাপা গলায় কী একটা বলল। বাবলুর চিৎকার আরো তীক্ষ্ণ ও তীব্র হল। প্ৰচণ্ড একটা চড় কল দবির মিয়া। মুহূর্তে সব চিৎকার-চেঁচামেচি থেমে গেল। শুনশান নীরবতা। জহুর বলল, ঘুমাতে যা।

আরেকটু বসি।

দুলাভাইয়ের সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট এনে দে।

অঞ্জু উঠে চলে গেল। সিগারেট নিয়ে চলে এল সঙ্গে সঙ্গে। তার পিছে পিছে এল বাবলু। জহুর অবাক হয়ে বলল, কি রে বাবলু? কী হয়েছে?

ঘুম আসে না, ভয় লাগে।

ভয়ের কী আছে?

বাবলু উত্তর না দিয়ে বয়স্ক লোকের মতত গম্ভীর হয়ে বসল বেঞ্চিতে। জহুর হাসিমুখে বলল, বাবলু, বৃষ্টিতে ভিজে যাবি।

বাবলু সে কথার উত্তর দিল না। সে খুবই স্বল্পভাষী।

অঞ্জু বলল, টুনী আপার বিয়েটা ভেঙে গেছে, তুমি শুনেছ নাকি মামা?

না তো! কী জন্যে ভাঙল?

তা জানি না। বাবা তো কাউকে কিছু বলে না।

বৃষ্টির বেগ খুবই বাড়ল। জহুর দেখল, বাবলু ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। অঞ্জু ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মেয়ে হয়ে জলে খুব মুশকিল।

মুশকিল কেন?

অঞ্জু জবাব দিল না।

বাবলুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়।

অঞ্জু উঠে বাবলুকে কোলে নিয়ে বসল। হালকা গলায় বলল, টুনী আপা আজ সারা দুপুর কেঁদেছে।

কেন? আমি তো জানতাম ছেলে তার পছন্দ হয় নি।

তা হয় নি।

তবে কান্নাকাটি কি জন্যে?

অঞ্জু জবাব দিল না। প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল। বাতাসের বেগ বাড়তে লাগল। অঞ্জু অস্পষ্ট সুরে বলল, মামা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

কী কথা?

তুমি নাকি বলেছিলে, জেল থেকে ফিরে এসে চৌধুরী সাহেবকে খুন করবে?

মনে নেই, বলতে পারি।

সত্যি সত্যি করবে না নিশ্চয়ই

জহুর জবাব না দিয়ে সিগারেট ধরাল। ঘরের মধ্যে এবার বাহাদুরের চিৎকার এবং দবির মিয়ার গর্জন শোনা যেতে লাগল, হারামজাদাদের যন্ত্রণায় শান্তিতে ঘুমানব উপায় নাই। সব কটাকে কচুকাটা করা দরকার।

মামা।

উঁ।

তুমি নাকি বদি চাচার বাসায় গিয়েছিলে?

জহুর খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কার কাছ থেকে শুনলি?

বাবা বলছিল ছোটমাকে। আড়াল থেকে শুনে ফেললাম।

জহুর চুপ করে গেল।

গিয়েছিলে নাকি মামা?

হুঁ।

ওদের ছেলেটাকে দেখেছ? খুব সুন্দর না?

খুব কিন্তু পাজি। দেখলে বোঝা যায় না। বিন্দু একেবারে।
 
এশার নামাজের পর চৌধুরী সাহেব বাড়ি ফিরবার সময় লক্ষ করলেন জহুর হনহন করে বাজারের দিকে যাচ্ছে। চৌধুরী সাহেব গলা খাকারি দিলেন। জহুর তাঁর দিকে তাকাল, কিন্তু থামল না। যেমন যাচ্ছিল, তেমনি যেতে লাগল। তিনি ডাকলেন, এই

যে, জহুর না?

জহুর দাঁড়াল।

তোমার দুলাভাইয়ের সঙ্গে একটা জরুরী কথা ছিল।

বলব তাঁকে।

জহুর আর দাঁড়াল না। চৌধুরী সাহেব হটতে শুরু করলেন। জহুরের ভাবভঙ্গি তাঁর মোটও ভালো লাগছে না। এই সব ভালো লক্ষণ নয়। তিনি জহুর কী করছে না-করছে, সে সম্পর্কে কিছু খোঁজখবর নিয়েছেন। কিছুই করছে না। ঘরেই বসে সময় কাটাচ্ছে। কোনো মতলব পাকাচ্ছে নিশ্চয়ই। তাঁর নিজের কোনো ঝামেলায় জড়াতে এখন আর ইচ্ছা করছে না। বয়স হয়ে গেছে। শান্তিতে সময় কাটাতে ইচ্ছা হয়।

চৌধুরী সাহেব বাড়ির কাছে এসে দেখেন সাইফুল ইসলাম গেটের কাছে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

স্লামালাইকুম চৌধুরী সাব।

ওলায়কুম সালাম। কি ব্যাপার?

আপারে একটা কথা বলতে এসেছি, চৌধুরী সাব।

বল।

শুনছেন বোধ হয় এসপি সাব আসতেছেন তদন্তে।

হ্যাঁ, জানি।

এসপি সাবের সাথে একটা কথা বলতে চাই চৌধুরী সাব।

বলতে চাইলে বল। আমাকে বলছ কেন?

জ্বি?

আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন?

সাইফুল ইসলাম হাত কচলাতে লাগল।

কী বিষয়ে কথা বলতে চাও?

এ্যাঁই ইয়ে—আপনার গান-বাজনা নিয়ে। এসপি সাবে গান বাজনার খুব সমঝদার।

তোমার কথাবার্তা বুঝতে পারছি না। ব্যাপারটা কি?

সাইফুল ইসলাম আমতা-আমতা করতে লাগল। চৌধুরী সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, ভেতরের কথাটা কি বল তো।

সাইফুল ইসলাম রুমাল দিয়ে ঘাড় মুছতে মুছতে বলল, থানাওয়ালারা লোকটারে খুন করছে চৌধুরী সাব।

বলছে কে তোমাকে? সাইফুল ইসলাম জবাব দিল না।

জহুর বলছে নিশ্চয়ই। শোনো সাইফুল ইসলাম, তুমি বিদেশী মানুষ, কিছু জান-টান না। জহুরের স্বভাব-চরিত্ৰ তুমি জান না। সে যে খুন করেছিল সেইটা জান?

জ্বি, শুনছি।

মুক্তিযুদ্ধের সময় কমাণ্ডার আছিল, অনেক কাজকারবার করছে, বুঝলে? ডেঞ্জারাস লোক। যে যেটা বলে, সেটাই বিশ্বাস করতে হয় না। চিন্তা-ভাবনা করতে হয়। চিন্তা-ভাবনা করবার জন্যে আল্লাহ একটা মাথা দিয়েছে। বুঝলে?

চৌধুরী সাহেব হাঁপাতে লাগলেন। হঠাৎ করেই মেজাজ খারাপ হয়ে যেতে শুরু করেছে। সাইফুল ইসলাম বলল, জহুর ভাই আমাকে কিছু বলেন নাই।

চৌধুরী সাহেব চোখ লাল করে তাকালেন।

বিষয়টা আমার নিজের মনে আসল।

নিজের মনে আসল?

জ্বি।

কী করতে চাও তুমি?

সাইফুল ইসলাম রুমাল দিয়ে ঘনঘন নাক মুছতে লাগল।

কী করতে চাও তুমি?

কিছু করতে চাই না চৌধুরী সাব।

তাহলে খামোকা বকবক করছ কি জন্যে?

সাইফুল ইসলাম খকখক করে কাশতে লাগল।

যাও আমার সামনে থেকে।

সাইফুল ইসলাম অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল।

চৌধুরী সাহেবের ধৈর্যচ্যুতি হল। তিনি প্রচণ্ড একটা চিৎকার করলেন, যাও, ভাগ।

সাইফুল ইসলাম তাড়াতাড়ি পা ফেলতে গিয়ে বড় রকমের একটা হোঁচট খেল।
 
নবীনগর থেকে মনসুরের বাবা এসে হাজির। বরকত আলি। দবির মিয়ার ধারণা ছিল, মনসুরের নিকট আত্মীয় কেউ নেই। মনসুর প্রায়ই বলত, একলা মানুষ আমি, একটা মুটে পেট। কিন্তু মনসুরের বাবার কাছে জানা গেল–মনসুরের পাঁচ বছর বয়সের একটা ছেলে আছে। ছেলেটা তার নানাবাড়ি থাকে। তার মার বিয়ে হয়ে গেছে অন্য জায়গায়। দবির মিয়া শুকনো গলায় বলল, আপনি কী করেন?

কিছু করি না জনাব। সামান্য জমিজিরাত আছে। টুকটাক ব্যবসা আছে।

দবির মিয়া দেখল বরকত আলির মধ্যে একটা সচ্ছল ভাব আছে। গায়ের নীল রঙের পাঞ্জাবিটা বেশ পরিষ্কার। পায়ে স্যাণ্ডেল।

কিসের ব্যবসা আপনার?

ওষুধের। আমার একটা কানপাকার ওষুধ আছে। চালু ওষুধ।

নিজের আবিষ্কার?

জ্বি না, আমার আজানের। হেকিম শরিয়ত আলির।

দবির মিয়া ঈষৎ কৌতূহলী হয়। বাবলুর কানপাকার ঝামেলা আছে। ঠাণ্ডা লাগলেই তার কান দিয়ে পুঁজ পড়ে।

ওষুধ কি রকম?

ভালো ওষুধ, খুব চালু।

বরকত আলি তার চামড়ার ব্যাগ খুলে ফেলল। ব্যাগভর্তি ছোছোট শিশি। শিশিতে সবুজাভ একটি তরল পদার্থ। সঙ্গে ছাপান হ্যাণ্ডবিল আছেঃ শরিয়ত আলির স্বপ্নপ্রাপ্ত কর্ণশুদ্ধি আরক।

কত করে?

দামটা একটু বেশি। পাঁচ টেকা! আপনে একটা ফাইল রাখেন। টেকা লাগব না।

দবির মিয়া চা আনতে লোক পাঠাল। বরকত আলিকে তার ছেলের ব্যাপারে মোটই বিচলিত মনে হল না। চা খেতে খেতে বলল, কর্মফল, বুঝলেন ইসাব? ছেলেটারে কত কইলাম ব্যবসাপাতি দেখ। সূতিকা রোগের একটা ওষুধ আছিল, একটা আছিল বাতের, বাতনাশক কালে বড়ি। কিছুই শুনা না। মাথা খারাপ ছোট বয়স থেকেই।

ছেলের মরার খবর পেয়েছেন কবে?

বিষ্যুত বারে।

কে দিল খবর?

ললাকের মুখে শুনলাম। খুব আফসোসের কথা।

হুঁ।

তা শুনলাম, ওসি সাহেব দশ হাজার টেকা দিবে ক্ষতিপূরণ। ক্ষতিপূরণ টেকায় তো হয় না। তা কী করা বলেন?

ক্ষতিপূরণের কথাটা শুনলেন কোথায়?

লোকজনের মুখে শোনা। কথাটা কি সত্যি?

আমি জানি না। আপনি দেখেন খোঁজ নিয়ে।

আপনারে সাথে নিয়া একটু যাইতে চাই।

দবির মিয়া গভীর হয়ে বলল, যান, আপনে একাই যান।

কয়েকটা দিন আপনার এইখানে থাকা লাগতে পারে। আপনার কোনো অসুবিধা নাই তো জনাব?

না, অসুবিধা নাই। মনসুর আপনার ছেলে তো?

জ্বি, প্রথম পক্ষের সন্তান। অজুর পানি কই পাওয়া যায়, আছরের নামাজের সময় হইছে মনে হয়।

দবির মিয়া তাকে মসজিদটা দেখিয়ে দিল। ঠাণ্ডা গলায় বলল, জুঘরের গোরস্থানে মনসুরের কবর আছে। বললে ওরা দেখিয়ে দেবে।

বরকত আলিকে ছেলের ব্যাপারে খুব একটা চিন্তিত বলে মনে হল না। সে কালো ব্যাগ হাতে নিয়ে বাজারের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করল। নান্টুর দোকানে চা খেল। বিকালের ট্রেনে বরফ বোঝই বাক্সে যে-সব মাছ যায় সে-সব মাছ দর-দাম করল। নীলগঞ্জ শহরে একটা হেকিমী ওষুধের দোকান চলবে কিনা, সেই সম্পর্কে খোঁজ-খবর করল।

ওসি সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেল মাগরেবের নামাজের পর। ওসি সাহেব ছিলেন না। সেকেণ্ড অফিসার তাকে বিশেষ সমাদর করলেন। নান্টুর দোকান থেকে পিয়াজু এনে খাওয়ালেন। নগদ পয়সা দিয়ে দু ফাইল শরিয়ত আলির স্বপ্নপ্রাপ্ত কৰ্ণশুদ্ধি আরক কিনে রাখলেন। বরকত আলি অভিভূত হয়ে পড়ল। চার পাশে এমন সব হামদর্দ লোকজন। আজকালকার যুগে এমন দেখা যায় না।
 
দবির মিয়া বিছানায় শোওয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়তে পারে। আজ রাতে নিয়মের ব্যতিক্রম হল। বিছানায় গড়াগড়ি করতে করতে রাত দুটা বাজল-ঘুম এল না। তার পাশে অনুফা ঘুমাচ্ছে মড়ার মত। মরেই গেছে কিনা, কে জানে। শ্বাস ফেলার শব্দ পর্যন্ত নেই। দবির মিয়া চাপা স্বরে বলল, এ্যাই, এ্যাই। কোনো সাড়া নেই। মেয়েরা বড় হয়েছে। এখন আর মাঝরাতে স্ত্রীকে ঘুম থেকে ডেকে ডেকে তোলা যায় না। মেয়েরা শুনে কি-না-কি ভেবে বসবে। দবির মিয়া অনুফাকে বড়ো কয়েকটি ঝাঁকুনি দিল। অনুফা বিড়বিড় করে পাশ ফিরল। তার ঘুম ভাঙল না। দবির মিয়া বিছানা ছাড়ল রাত দুটার দিকে। শুয়ে থাকার কোন মানে হয় না। যে-কোন কারণেই হোক ঘুম চটে গেছে। সে কাতালায় পরপর দুটি সিগারেট শেষ করল। বাইরেউলপাথাল হাওয়া। খালি গায়ে থাকার জন্যে শীতশীত করছে। এরকম হওয়ায় বারান্দায় বিছানা পেতে জহুর ঘুমায় কী করে কে জানে? দিনকাল ভালো না। এরকম খোলামেলা ভাবে বারান্দায় ঘুমান ঠিক না। জহুরের শত্রুর তো অভাব নেই। কিন্তু জহুর যেটা মনে করবে, সেটাই করবে। অন্যের কথা শুনলে কি আর আজ এই অবস্থা হয়? দবির মিয়া আরেকটি সিগারেট ধরাল।

জহুরের ব্যাপারে কিছু একটা করা দরকার, কিন্তু করবেটা কী? একটা লঞ্চের যোগাড় দেখার কথা ছিল, সেটা সম্ভব না। একা-একা লঞ্চ কেনা তার পক্ষে সম্ভব না। সফদর শেখের সঙ্গে কথা হয়েছিল, সে টাকা দিতে রাজি, কিন্তু জহুরকে রাখতে রাজি না।

বুঝেন তো দবির ভাই, নানান লোকে নানান কথা বলবে।

কী কথা বলবে?

সফদর শেখ তা আর পরিষ্কার করে বলে না, দাড়ি চুলকায়।

জহুর একটা নির্দোষ লোক, সেইটা জানেন আপনি সফদর সাব?

আরে ছিঃ ছিঃ, তা জানব না কেন? আমি কত আফসোস করলাম। এখন করি।

দবির মিয়া গম্ভীর হয়ে বলল, আফসোসে কোন ফয়দা হয় না।

ফয়দা হয় না ঠিকই, তবু আফসোস থাকাটা ভালো। লোকজনের তত আফসোস পর্যন্ত নাই। এই যে ছেলেটা আসল, কেউ কি বাড়িতে এসে ভালো-মন্দ কিছু বলেছে? না, বলে নাই। মানুষের কিছুই মনে থাকে না। চৌধুরী সাহেব তো ভালো মতেই আছেন। কয়েক দিন আগে ডিগ্রী কলেজের জন্যে অনেকখানি জমি দিলেন। নিজের পয়সার গার্লস স্কুলের একটা হোস্টল তৈরি করে দিলেন। বিরাট হলস্থুল। ময়মনসিংহের ডিসি সাহেব আসলেন। কত বড়ো বড়ো কথা; কৰ্মযোগী, নীরব সাধক, নিবেদিতপ্রাণ–দূর শালা।

দবির মিয়া কলতলা থেকে উঠে এসে বারান্দায় বসল। জহরকে কিছু একটাতে লাগিয়ে দেওয়া দরকার। বিয়ে-শাদি দেওয়া দরকার। বিয়ে দেওয়াটাও তো মুশকিল। কে মেয়ে দেবে? দেশে মেয়ের অভাব নেই। কিন্তু খুন করে ছ-সাত বছর জেল খেটে যে-ছেলে এসেছে, তার জন্য মেয়ে নেই। চৌধুরী সাহেব অবশ্যি একটি মেয়ের কথা বলেন। সম্পর্কে তাঁর ভাতিজী। মেয়েটিকে দেখেছে দবির মিয়া। শ্যামলা রঙ, বেশ লম্বা। দেখতে-শুনতে ভালোই। কিন্তু জহরকে বলারই তার সাহস হয় না। পুরনো কথা সব ভুলে গিয়ে নতুন করে সব কিছু শুরু করাই ভালো। বরফের মেশিনে ম্যানেজারীর চাকরিটা নিয়ে নিলে মন্দ কি?

বাহাদুর জেগে উঠেছে। বিকট চিৎকার শুরু করেছে অভ্যাস মতো। দবির মিয়া নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে প্রচণ্ড একটা চড় কল। কান্না থেমে গেল সঙ্গে সঙ্গে। অনুফা বলল, কেন বাচ্চা দুইটারে মার?

দবির মিয়া উত্তর দিল না।

বাচ্চা দুইটা তোমারে যমের মতো ডরায়।

দবির মিয়া তারও উত্তর দিল না। আবার বাইরে গিয়ে বসল। তৃতীয় সিগারেট ধরিয়ে দবির মিয়া কাশতে লাগল। নাহু, আবার বিয়ে করাটা ভুল হয়েছে। মস্ত বোকামি। অনুফার আগের পক্ষের ছেলে দুটি তার বাপের কাছে থাকবে, এরকম কথা ছিল। কিন্তু সাত দিন পার না হতেই বাবলু আর বাহাদুর এসে হাজির। তারা কাউকে কিছু না বলে আট মাইল রাস্তা হেঁটে চলে এসেছে। তাদের দ জনকে পাওয়া গেল নীলগঞ্জের বাজারে। কোথায় কার বাড়ি যাবে কিছু বলতে পারে না। শুধু জানেনীলগঞ্জে তাদের মা থাকে। দুটি যমজ ছেলে নিমাইয়ের মিষ্টির দোকানে বসে কাঁদছে শুনে দবির মিয়া কৌতূহলী হয়ে দেখতে গেছে। তারপর মুখ গম্ভীর করে বাড়ি নিয়ে এসেছে। বাচ্ছা দুটি খালি হাতে আসে নি, প্যান্টের পকেট ভর্তি। করে তাদের মায়ের জন্যে কাঁচামিঠা আম নিয়ে এসেছে।

ছেলে দুটি বিন্দু। মহা বিচ্ছু। তাদের নানা খবর পেয়ে এসে নিয়ে গিয়েছিল। তিন দিন পরই রাত নটায় দু মূর্তি এসে হাজির। দবির মিয়া তক্ষুণি ফেরত পাঠাবার জন্যে ব্যবস্থা করল। বাদ সাধন টুনী।

না বাবা, থাকুক।

থাকুক মানে?

মায়ের সাথে থাকুক।

দবির মিয়ার বিরক্তির সীমা রইল না।

থাকার জায়গাটা কোথায়?

জায়গা না থাকলেও থাকবে। মাকে ছাড়া থাকতে পারে!

ধামড়া ধামড়া ছেলে, মাকে ছাড়া থাকতে পারে না–একটা কথা হল!

দবির মিয়া মহা বিরক্ত হল। কী যন্ত্রণায় বিরক্তির সঙ্গে-সঙ্গে টুনীর সাহস দেখেও সে অবাক হল। বাপের মুখে-মুখে কথা বলে, বেয়াদপির একটা সীমা থাকা দরকার।

দবির মিয়া ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। খুট করে শব্দ হল একটা। দবির মিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, বাবলু বের হয়ে আসছে।

কী চাস তুই?

পেশাব করব।

শোয়ার আগে সারতে পারি না? বাঁদর কোথাকার। এক চড় দিয়ে দাঁত সবগুলো ফেলে দেব।

বাবলু বারান্দার এক কোণে প্যান্ট খুলে বসে রইল। দবির মিয়া আড়চোখে দেখল বাবলু ভীত চোখে বারবার দবির মিয়ার দিকে তাকাচ্ছে।

বারান্দায় বসে পেশাব করতে নিষেধ করি নাই?

বাবলু পাংশু মুখে উঠে দাঁড়াল।

পেশাব শেষ হয়েছে?

না।

শেষ কর।

বাবলু আবার বসল। দবির মিয়া বলল, স্কুলে যাস তো রোজা

যাই।

পড়াশোনা করিস তো ঠিকমতো?

হুঁ।

হুঁ আবার কি? বল জ্বি।

জ্বি।

পড়াশোনাটা ঠিকমতত করা দরকার।

বাবলু ঘরের দিকে যাচ্ছিল। দবির মিয়া হঠাৎ কী মনে করে মৃদু স্বরে বলল, এই বাবলু, বস দেখি এখানে।

বাবলু অবাক হয়ে পাশে এসে বসল।

কিচ্ছা শুনবি নাকি একটা? পিঠাপুলি রাক্ষসের কিচ্ছা?

স্তম্ভিত বাবলু কোনো উত্তর দিল না।

তুই আমারে ডরাস নি?

হুঁ।

হুঁ কিরে ব্যাটা? বল জ্বি।

জ্বি।

ডরাইস না। ডরের কিছু নাই। কিচ্ছা শুনবি?

হুঁ।

আবার হুঁ।

জ্বি। দবির মিয়া পিঠাপুলি রাক্ষসের কিচ্ছা শুরু করে।

অনুফা ঘুম ভেঙে অবাক হয়ে দেখল, দবির মিয়া মৃদু স্বরে বাবলুকে কী যেন বলছে। গল্প নাকি? তার চার বছরের বিবাহিত জীবনে এমন অদ্ভুত ঘটনা সে দেখে নি।
 
সাইফুল ইসলাম ভোরবেলা গলা সাধে। তার গলা ভালো। গানের মাষ্টারদের মতো কর্কশ এবং শ্লেষ্ম-জড়ান নয়। চৌধুরী সাহেব সাইফুল ইসলামকে সহ্য করতে না পারলেও ভোরবেলায় তার ঘরের সামনে দিয়ে হাঁটার সময় তাঁর কান উত্তর্ণ হয়ে থাকে। এবং নিজের মনেই বলেন–মন্দ না। আজও শুনলেন–

যা যারে কাগণ্ডয়া পিয়াকে পাস
কহিও খবরিয়া নৈ নহি ঘড়ি পল উন বিন…

চৌধুরী সাহেবের হাঁটার গতি কমে গেল। মনে-মনে বললেন-বাহু, ব্যাটা তো ভালো গাইছে। গান থেমে গেল সঙ্গে সঙ্গে। খুট করে দরজা খুলে সাইফুল ইসলাম বের হয়ে এল। তার চোখ লাল। মুখ শুকিয়ে লম্বাটে হয়ে গেছে। সে দ্রুত এগিয়ে এল চৌধুরী সাহেবের দিকে। চৌধুরী সাহেব লক্ষ করলেন সে আসছে খালি-পায়ে।

মালিকুম চৌধুরী সাব।

ওলায়কুম সালাম।

আমি জানালা দিয়ে দেখলাম আপনি আসছেন। একটা কথা ছিল আপনার সঙ্গে।

তোমার শরীর খারাপ নাকি?

জ্বি। রাতে আমার ঘুম হয় না।

যা গরম, ঘুম না হওয়াই স্বাভাবিক।

চৌধুরী সাব, আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।

বল।

একটু ভেতরে এসে যদি বসেন।

বল, এইখানেই বল।

সাইফুল ইসলাম বিড়বিড় করতে লাগল। চৌধুরী সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, বিষয়টা কী?

চৌধুরী সাব, গতকাল রাত্রে আমি জুমাঘরের পাশ দিয়ে আসছিলাম। মনসুরের যে কবর আছে তার ধার দিয়ে আসবার সময় একটা জিনিস দেখলাম।

কি জিনিস?

দেখলাম মনসুর বসে আছে কবরের পাশে। আমাকে দেখে সে হাসল।

কে বসে আছে বললে?

মনসুর।

কি ছাগলের মতত কথাবার্তা

সাইফুল ইসলাম বিড়বিড় করতে লাগল। চৌধুরী সাহেব ভারি গলায় বললেন, তুমি ডাক্তার-ফাক্তার দেখিয়ে ঘুমের ওষুধ-টষুধ খাও।

চৌধুরী সাহেব আর দাঁড়ালেন না। তাঁর অবশ্যি ব্যাপারটি ভালো করে শোনার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সময় নেই। ময়মনসিংহ থেকে এসপি সাহেব এসেছেন গত রাতে। তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে ডাকবাংলায়। তাঁর খাবার-দাবার চৌধুরী সাহেবের বাড়ি থেকে যাচ্ছে। গত রাতে কথা হয়েছে চৌধুরী সাহেব সকালবেলা ডাকবাংলায় এসে চা খাবেন। দেরি করা যায় না। এসপি সাহেব লোকটিকে একটু কড়া ধাঁচের বলে মনে হয়েছে। সিএসপি অফিসারদের মতো। কিন্তু লোকটি দারোগা থেকে এসপি হয়েছে। এরা ভোঁতা ধরনের হয়ে থাকে, কিন্তু এ সেরকম নয়।

এসপি সাহেব একটা লুঙ্গি এবং হাতকাটা পাঞ্জাবি পরে বারান্দায় চেয়ারে, বসেছিলেন। টুর করতে আসা এসপি জাতীয় অফিসাররা লুঙ্গি পরে বসে থাকলে মানায় না। চৌধুরী সাহেব হাসিমুখে বললেন, কখন উঠলেন স্যার?

সকালেই উঠেছি।

রাতে ঘুম ভালো হয়েছিল?

হ্যাঁ।

খাওয়াদাওয়ার অসুবিধা হয় নাই তো স্যার?

খানিকটা হয়েছে। পোলাওটোলাও এখন খেতে পারি না। ইনডাইজেশন হয়।

স্যার, এখন থেকে সাদা ভাত পাঠাব।

ভাত পাঠানর তো আর দরকার নেই। আমি এগারটার ট্রেনে চলে যাচ্ছি।

চৌধুরী সাহেব অবাক হয়ে বললেন, রাত্রে আপনার জন্যে একটু গান-বাজনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

না, রাত্রে থাকব না।

তদন্ত শেষ হয়ে গেছে নাকি স্যার?

কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করব। পোস্ট মার্টেম রিপোর্টটা দেখলাম। নরম্যাল ডেথ।

এসপি সাহেব চায়ে চুমুক দিতেদিতে বললেন, দেশে চোর-ডাকাতের সংখ্যা কচুগাছের মততা বাড়ছে। এরা কিভাবে মরল, সেই সব নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। আমি তো ভেবেছিলাম মিছিলটিছিল হবে, থানা ঘেরাওটোও হবে।

নীলগঞ্জ খুব ঠাণ্ডা জায়গা স্যার।

তাই দেখলাম। ঠাণ্ডা জায়গা এক বার গরম হয়ে গেলে কিন্তু মুশিবত হয়।

এসপি সাহেব সঙ্গের পিয়নটিকে সিগারেট দিতে বললেন। চৌধুরী সাহেব লক্ষ করলেন সাধারণ দেশী সিগারেটের একটি প্যাকেট দেওয়া হয়েছে। এর মানে কী? তিনি নাস্তার সঙ্গে দু প্যাকেট ফাইভ ফিফটি ফাইভ দিয়ে দিয়েছেন। সিগারেট মেরে দিচ্ছে নাকি? কী সর্বনাশ! ব্যাপারটা খোলাসা হওয়া প্রয়োজন। সরাসরি জিজ্ঞেস কাটা ঠিক হবে কিনা চৌধুরী সাহেব বুঝতে পারলেন না। এসপি সাহেব হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে বললেন, আমি একটা বেনামী চিঠি পেয়েছি।

চৌধুরী সাহেব নড়েচড়ে বসলেন।

চিঠিতে বলা হয়েছে মনসুর নামের লোকটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। বেনামী চিঠির কোনো গুরুত্ব আমি দিই না।

চিঠিটা একটু দেখব স্যার?

না। আপনি দেখবেন কেন?

দেখলে বুঝতে পারতাম কে লিখেছে?

তার কোন দরকার নেই।
 
চৌধুরী সাহেব দেখলেন দবির মিয়া হনহন করে আসছে। তিনি বললেন, দবির মিয়াকে আসতে বলেছেন নাকি স্যার?

দবির মিয়া কে?

মনসুর থাকত যার বাড়িতে।

হ্যাঁ, বলেছি। আপনি এখন তাহলে উফ চৌধুরী সাহেব। আর শোনেন, দুপুরে ভাত পাঠাবেন না।

চৌধুরী সাহেব অস্বস্তি নিয়ে উঠে পড়লেন। সিগারেটের কথাটা তাঁর আর জিজ্ঞেস করা হল না। সাইফুল ইসলাম গলা সাধছে।

যা যারে কাগওয়া, পিয়াকে পাস।
কহিও খবরিয়া চৈন নহি ঘড়ি পল উন বিন…।

ব্যাটা গায় মন্দ না। দাঁড়িয়ে শুনতে ইচ্ছে করে। তিনি দাঁড়ালেন না, বাড়ি চলে এলেন। বসার ঘরে দু-তিন জন লোক বসে আছে। নিশ্চয়ই কোনো দরবাররবার। চৌধুরী সাহেব বলে দিলেন তাঁর শরীর ভালো নয়। এক জনকে পাঠালেন দবির মিয়ার দোকানে, অবশ্যি যেন দবির তাঁর সঙ্গে দেখা করে।



মনসুর আলি আপনার দোকানে কাজ করত।

জ্বি স্যার।

সে যে চোর, সেটা জানতেন?

জ্বি না। পরে জানলাম।

মনসুর ধরা পড়ার পরে চুরি ডাকাতি শুনলাম বন্ধ।

জি স্যার, এখনো হয় নাই।

দারোগা সাহেবের কাছে শুনলাম আপনার ছোট ভাই এক জন এসেছে।

ভাই না স্যার, আমার শ্যালক।

সে এখন করছে কী?

দবির মিয়া কপালের ঘাম মুছে শুকনো গলায় বলল, সে একটা নির্দোষী লোক। লোকজনের ষড়ুযন্ত্র এই অবস্থা স্যার।

এসপি সাহেব কিছু বললেন না। দবির মিয়া বলল, ছেলেটার জীবনটা নষ্ট হয়েছে স্যার। শুধু তার একার না, আমারও নানান ঝামেলা হচ্ছে। বড় মেয়েটার বিয়ে হচ্ছে না।

মেয়ের বিয়ের সাথে এর কী সম্পর্ক।

যে বাড়িতে এমন খুন-খারাবি করার লোক আছে সে বাড়িতে বিয়ে-শাদি কেউ করতে চায় না।

এসপি সাহেব আচমকা প্রসারে চলে গেলেন।

এই চিঠিটা কি আপনার শালার লেখা?

দবির মিয়া অবাক হয়ে চিঠিটা পড়ল।

মাননীয় এসপি সাহেব সমীপেবু,

জনাব,

বিনীত নিবেদন এই যে, গত বুধবার দিবাগত রাত্রে নীলগঞ্জ থানায় মনসুর আলি নামক এক নিরপরাধ ব্যক্তিকে খুন করা হইয়াছে। এই বিষয়ে আপনি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। নচেৎ ফল খারাপ হইবে। আমরা ঘাস খাইয়া জীবন ধারণ করি না। থানা পুলিশকে নীলগঞ্জের লোকেরা ভয় পায় না। পূর্বেও এই অঞ্চলে এই জাতীয় অন্যায় হইয়াছে। থানার যোগসাজসে নিরাপরাধ ব্যক্তিকে খুনের দায়ে জেল খাটিতে হইয়াছে।



দীর্ঘ চিঠি। দবির মিয়া চিঠিটা দু বার পড়ল। এসপি সাহেব আবার বললেন, চিঠিটা কি আপনার শালার লেখা?

স্যার বলতে পারলাম না। তার হাতের লেখা আমি চিনি না। তবে…?

তবে কি?

সে এরকম চিঠি-ফিঠি লিখবে না স্যার। সে গোঁয়ার ধরনের।

দবির মিয়া অত্যন্ত চিন্তিত মুখে দোকানে গেল। বরকত আলি কাশবাক্স সামনে নিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে আছে। তার ভাবভঙ্গি যেন দোকানটা তারই। সে টেনেটেনে বলল, আজকেও আসতে দেরি করছেন। সকাল সকাল দোকান খোলা দরকার।

দবির মিয়া জবাব দিল না।

চাইর জন কাস্টমার ফিরত গেছে। আমি বলছি ঘন্টাখানিক পরে আসতে।

ভালো করছেন।

কাস্টমার হইল আপনের হাতের লক্ষ্মী। কাস্টমার ফিরত যাওয়া খুব অলক্ষণ।

দবির মিয়া গম্ভীর হয়ে বলল, আপনার কাজ শেষ হয়েছে?

কোন কাজের কথা কন?

দাবোগা সাহেবের সাথে দেখা করার কথা ছিল যে।

ও, সেইটা। ওসি সাহেব চার-পাঁচ দিন পরে যাইতে কইছেন। এখন থানায় খুব ঝামেলা যাইতেছে।

আরো চার-পাঁচ দিন থাকবেন তাহলে?

জ্বি।

আমার এখানে না, অন্যখানে থাকেন গিয়ে।

বরকত আলি স্তম্ভিত হয়ে গেল।

যামু কই আমি ভাইসাব?

যেখানে ইচ্ছা সেখানে যান।

বিস্মিত বরকত আলি চা খেতে গেল নাড়ুর দোকানে। চা খেয়ে মাথাটা ঠাণ্ডা করা দরকার।

বেলা প্রায় দশটা হয়েছে। সিক্সটিন ডাউনের আসবার সময়। নান্টুর দোকানে কামারদের ভিড় এই সময় সবচেয়ে বেশি। কাজেই সাইফুল ইসলাম যখন এসে বলল, নান্টু, একটা জরুরী কথা আছে আমার। একটু বাইরে আসা তখন সেসঙ্গত। কারণেই বিরক্ত হল।

পরে আসেন।

পরে না, এখন।

কি, টাকাপয়সা দরকার?

সাইফুল ইসলামকে নান্টুর কাছ থেকে প্রায়ই টাকাপয়সা ধার করতে হয়।

না, টাকাপয়সা না।

নান্টু অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে দোকানের বাইরে এসে দাঁড়াল।

বলেন, কি বিষয়?

সাইফুল ইসলাম থেমেথেমে বলল, আমি জুমাঘরের পাশ দিয়ে আসছিলাম। হঠাৎ দেখি মনসুর তার কবরের পাশে বসে আছে।

কারে দেখছেন?

মনসুর। মনসুর আলিকে।

নান্টু অবাক হয়ে ঢাকাল, এই সব কী কন!

সত্যি। আত্মার কসম।

সাইফুল ইসলাম নান্টুর হাত চেপে ধরল। গাড়ি আসবার সময় হয়ে গেছে। এ সময় কীসব বাড়তি ঝামেলা।

আসেন ভিতরে, চা খান।

সাইফুল ইসলাম চা খাবার জন্য ভেতরে গেল না। এসপি সাহেবের সম্মানে গান-বাজনার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব তার। এখনন তার কিছুই করা হয় নি। গানবাজার আয়োজন কোথায় হয়েছে তা জানা দরকার। ওসি সাহেবের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন, কিন্তু থানায় যেতে তার সাহসে কুলাচ্ছে না।



চৌধুরী সাহেব খবর পেলেন এসপি সাহেব এগারটার গাড়িতে যাচ্ছেন না। রাতে গান-বাজনার আয়োজন করা হয়েছে। চৌধুরী সাহেবের বাড়িতেই গান-বাজনা হবে। সময় অল্প। স্থানীয় বিশিষ্ট সব লোকজনদের খবর দিতে হয়। চৌধুরী সাহেব অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
 
জহুরের শার্টের পকেটে কিছু ভাঙতি পয়সা ছিল। সিগারেটের দাম দেবার সময় জহুরের মনে হল পয়সার সঙ্গে একটা কাগজের নোটও যেন রয়ে গেছে। সত্যি তাই। ছোটখাটো কোন নোট না, এক শ টাকার একটা নোট। দুলাতাই কোনো এক ফাঁকে পকেটে রেখে দিয়েছেন বলাই বাহুল্য। এর দরকার ছিল কি? ডেকে হাতে দিয়ে দিলেই হত। সম্ভবত দিতে লজ্জাবোধ করেছেন। জাবোধ করার কী আছে এর মধ্যে?

জহুর একটি সিগারেটের বদলে দু প্যাকেট সিগারেট কিনে ফেলল। তাতেও টাকার ভাঙতি হয় না। জহুর বলল, টাকাটা থাক তোমার কাছে। মাঝে মাঝে আমি সিগারেট নেব। এক সময় এক শ টাকার সিগারেট নেওয়া হবে।

পান-বিড়ির দোকানের ছেলেটির বয়স অল্প। সে এরকম অদ্ভুত প্রস্তাব এর আগে শোনে নি। জহুর বলল, ঠিক আছে?

জি আইচ্ছা।

সন্ধ্যা হয়-হয় অবস্থা। জহুর স্টেশনের দিকে যাবে বলে ঠিক করল। হেঁটে বেড়াবার জন্য জায়গাটা চমৎকার। সারি সারি কৃষ্ণচূড়ার গাছ আছে। ফুল ফুটেছে। নিশ্চয়ই।

মামা।

জহুর তাকিয়ে দেখল টুনী সেজগুজে যাচ্ছে যেন কোথায়।

যাস কোথায়?

গান গাইতে যাই মামা। গানের আসর হচ্ছে একটা।

দুলাভাই জানেন তো?

হুঁ, জানেন। বাবাই যেতে বলল।

একা-একা যাচ্ছি?

একা যাচ্ছি না। তুমিও যাচ্ছ আমার সাথে। তোমাকে ঘর থেকে দেখেই বের হয়েছি। নয়ত বাবার সঙ্গে যাওয়া লাগত। বাবার সঙ্গে যেতে ভালো লাগে না।

আসটা হবে কোথায়?

বলে তো তুমি আবার যেতে চাইবে না।

চৌধুরী সাহেবের বাড়ি?

হুঁ। তোমাকে গিয়ে বসে থাকতে হবে না। পৌছে দিয়ে চলে আসবে।

ঠিক আছে।

জহুর হাঁটতে শুরু করল। টুনী তরল গলায় বলল, শার্টের পকেটে টাকা পেয়েছ মামা?

পেয়েছি।

বাবা আমার হাতে দিয়ে বলেছেন তোমার পকেটে রাখতে।

জহুর চুপ করে রইল।

হাতে দিয়ে দিলেই হয়। তা দেবেন না। শুধুশুধু ঢং।

জহুর আড়চোখে কাল টুনীর দিকে। বড়োআপার সাথে টুনীর চেহারার খুব মিল। হঠাৎ হঠাৎ চমকে উঠতে হয়। কথাও বলে বড়োআপার মতো।

বাবার দোকানে আবার চুরি হয়েছে, জান নাকি মামা?

জহুর আশ্চর্য হয়ে বলল, কই, জানি না তো।

জানবে কোত্থেকে? সে কাউকে বললে তবে তো জানবে?

তুই জানলি কীভাবে?

ছোটমার সঙ্গে গুজগুজ করছিলেন। আড়াল থেকে শুনলাম।

কী চুরি হয়েছে?

তা জানি না। বাবার দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। ডাল কিনে রেখেছিলেন, ইঁদুর নাকি বস্তা ফুটো করে কী সব করছে।

টুনী ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল।

আমি ভেবেছিলাম তুমি আসলে সব অন্য রকম হবে। কিন্তু তুমি আর আগের মতো নেই।

জহুর কথা বলল না।

তুমি তো দেখি দিনরাত বসেই থাক। কি ভাব বসেবসে?

কিছু ভাবিটাবি না।

কেন ভাব না? তোমাকে ভাবতে হবে।

ভাবতে হবে কেন?

টুনী চুপ করে গেল।



চৌধুরী সাহেবের বাড়ির সামনে বেশ ভিড়। স্থানীয় লোকজন সবাই মনে হয় এসে পড়েছে। গরমের জন্যেই হয়তো বারান্দায় চেয়ার সাজান হয়েছে। লোকজন বসে আছে চেয়ারে। জহুর ঘরের ভেতর ঢুকল না। টুনী মৃদু স্বরে বলল, তুমিও আস না মামা।

না, তুই যা।
 
জহুর স্টেশনের দিকে রওনা হল। বড়ো রাস্তার শেষ মাথায় এসে সে আরেকটি সিগারেট ধরাল। সাইফুল ইসলামকে এই সময় দেখা গেল দ্রুত পায়ে আসছে। তার হাতে তবলা এবং বাঁয়া। পোশাক-আশা আগের মতো ফিটফাট নয়। পাঞ্জাবিটাও ইস্ত্রি নেই। গা থেকে সেন্টের গন্ধও আসছে না। সাইফুল ইসলাম জহুরকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেল, জ ভাই, আপনার সঙ্গে একটা কথা বলতে চাই।

বলেন।

আজ তো সময় নাই। রাত্রে এক বার যার আপনার কাছে।

ঠিক আছে, আসবেন।

বিশেষ একটা জরুরী কথা।

ঠিক আছে।

আপনার কাছে একটা পরামর্শ চাই।

ঠিক আছে। এখন তাহলে যান, আপনার বোধহয় দেরি হয়ে যাচ্ছে।

জ্বি, দেরি হচ্ছে। তা ইয়ে, টুনী কি এসেছে চৌধুরী সাহেবের বাড়িতে?

এসেছে।

সাইফুল ইসলাম খানিক ইতস্তত করে বলল, আঙ্গুরীবালার মতো গলা টুনীর। আমি তাকে গান শিখাতে চাই জহুর ভাই। টাকাপয়সা কিছু দিতে হবে না।

সাইফুল ইসলাম বায়াটা নামিয়ে রেখে রুমাল দিয়ে ঘাড় মুছতে লাগল।

এইটাই কি আপনার জরুরী কথা নাকি?

জ্বি-না।

আপনার বোধহয় দেরি হয়ে যাবে।

না, দেরি আর কি?

সাইফুল ইসলাম একটা সিগারেট ধরাল। ক্লান্ত স্বরে বলল, দুই রাত ধরে আমার ঘুম হয় না।

জহুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। অন্ধকার হয়ে গেছে, মুখ দেখা যাচ্ছে না।

আপনি বাসায় থাকবেন জহুর ভাই?

আমি থাকব।



এসপি সাহেব মৃদু গলায় বললেন, তুমি মা আরেকটি গান গাও।

আর কোন গান তো জানি না।

এসপি সাহেব বড়ই অবাক হলেন, একটি গানই জান?

জ্বি।

আশ্চর্য।

চৌধুরী সাহেব নিজেও খুব অবাক হয়েছেন। গান-বাজনা তিনি বিশেষ বোঝন না, তবু তাঁর মনে হল এই মেয়েটির মতো সুন্দর গলা তিনি বহু দিন শোনেন নি। এসপি সাহেব বললেন, গানটি তুমি আরেকবার গাও। নাম কি তোমার মা?

টুনী।

দবির মিয়া বলল, ওর ভালো নাম সুলতানা খানম।

আপনার মেয়ে বুঝি?

জ্বি স্যার।

এই মেয়ে খুব নাম করবে। আপনি দেখবেন, নাম করবে।

দবির মিয়া ঠাণ্ডা গলায় বলল, গৃহস্থ ঘরের মেয়ে গান-বাজনা আর কী করবে? এই সব আমাদের জন্যে না স্যার।

এসপি সাহেব রাগী চোখে তাকালেন। কঠিন ও তীক্ষ্ণ চাউনি।
 
মিনু ভাবী খয়েরী রঙের একটা শাড়ি পরেছেন। লণ্ঠনের আলোয় তাঁর মুখখানি করুণ দেখাচ্ছে। তিনি মৃদু স্বরে বললেন, চা খাবেন জহুর ভাই?

জ্বি-না।

বৃষ্টি হবে আজ রাতে। ঘনঘন বিজলি চমকাচ্ছে। বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত, কিন্তু জহুর উঠল না। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘরের সাজসজ্জা দেখতে লাগল। চারদিকে মেয়েলি স্পর্শ আছে। দেখেই বোঝা যায়, এখানে বহুদিন ধরেই কোন পুরুষমানুষ থাকে না।

আপনার চলে কীভাবে ভাবী?

চৌধুরী সাহেব আমার জন্যে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

তাই নাকি?

হুঁ। আমার জন্যে অনেক করেছেন।

জহুর মৃদু হাসল। মিনু নরম স্বরে বলল, তাঁর সাহায্য নিতে ইচ্ছা হয় নি, কিন্তু না নিয়েও কী করব বলেন?

তা ঠিক।

মিনু খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল।

ঝড়-বৃষ্টি হবে, আমি উঠি ভাবী।

বসেন না। আরেকটু বসেন।

জহুর ইতস্তত করে বলল, আমার এ রকম আসা ঠিক না, লোকজন নানান কথা বলতে পারে।

বলুক। আমি এখন এই সব নিয়ে মাথা ঘামাই না। কত কথা রটল আমাকে নিয়ে, বুঝলেন জহুর ভাই। বিধবা মেয়েদের বড়ড়া কষ্ট।

জহুর উঠে দাঁড়াল।

ছাতা এনেছেন?

জ্বি-না।

আমারটা নিয়ে যান। বৃষ্টি আসবে।

না, থাক।

থাকবে কেন জহুর ভাই? নিয়ে যান।

হারিকেন হাতে মিনু চাপা স্বরে বলল, শহরে একটা ঝামেলা হচ্ছে, সেটা তো জানেন। একটা লোককে মেরে ফেলেছে।

জানি।

জহুর ভাই, এই সব নিয়ে আপনি কোনো কথাবার্তা বলবেন না।

এই কথা বলছেন কেন?

আপনি তাহলে আবার অসুবিধায় পড়বেন। জেলে-টেলে দিয়ে দেবে।

জহুর অস্পষ্ট স্বরে বলল, আমাকে জেলে দিলে কারো তো কোনো ক্ষতি নেই ভাবী।

মিনু সে-কথার জবাব দিল না। হারিকেনটা হাতে নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

ঘনঘন বিজলি চমকাচ্ছে। রাতে খুব ঝড়-বৃষ্টি হবে। জহুর একটা সিগারেট ধরিয়ে হালকা গলায় বলল, যাই ভাবী। মিনু ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।

বাতাস দিতে শুরু করেছে। ভেজা গন্ধ আসছে। দূরে কোথায়ও বৃষ্টি নেমেছে বোধহয়। জহুর মৃদু স্বরে বলল, যাই আজ।

মিনু কিছু বলল না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top