What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected এই বসন্তে - উপন্যাস (1 Viewer)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
330
Messages
6,279
Credits
48,462
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
এই বসন্তে
লেখক- হুমায়ূন আহমেদ

সে ছাড়া পেল বসন্তকালে।

কড়া রোদ চারদিকে। বাতাস উষ্ণ। গেটের বাইরে প্রকাণ্ড শিমুল গাছে লাল লাল ফুল। বসন্তকালের লক্ষণ এই একটিই। সে একটা সিগারেট ধরিয়ে উদাস চোখে শিমুল গাছের দিকে তাকিয়ে রইল। এ্যাসিস্টেন্ট জেলার সাহেব তাকে শম্ভুগঞ্জ পর্যন্ত রেলের একটি পাস এবং ত্রিশটি টাকা দিয়েছেন। এবং খুব ভদ্রভাবে বলেছেন, জহুর, তালোমতো থাকবে। ছাড়া পাবার দিন সবাই খুব ভালো ব্যবহার করে।


জহুর আলি ছ বছর তিন মাস পর নীলগঞ্জের দিকে রওনা হল। কড়া বোদ। বাতাস উষ্ণ ও আর্দ্র। বসন্তকাল।




দবির মিয়া নীলগঞ্জের বাজারে দশ মণ ডাল কিনতে গিয়েছিল। ডাল কেনার কথা ছিল পনের মণ। কিন্তু টাকার যোগাড় হয় নি। টাকাটা দেবার কথা তার শ্বশুরের। শেষ মুহূর্তে তিনি খবর পাঠিয়েছেন-এখন কিছুই দিতে পারবেন না, হাত টান। বৈশাখ মাসের দিকে চেষ্টা করবেন। বৈশাখ মাসে টাকা দিয়ে সে কী করবে? দবির মিয়া ডালের আড়তে ঘুরতে ঘুরতে তার শ্বশুরকে কুৎসিত একটা গাল দিল। এই লোকের ওপর ভরসা করাটা মস্ত বোকামি হয়েছে। শালা মহা হারামী।

দবির মিয়া মুখ কালো করে ডালের বাজারে হাঁটাহাঁটি করতে লাগল। দুই দিনে বাজার চড়ে গেছে। সরসটা হয়েছে দু শ পঁচিশ। এত দাম দিয়ে ডাল কিনে রাখলে কয় পয়সা আর থাকবে? ডালের পাইকারও বেশি আসে নি। সেতাবগঞ্জের কোনো বেপারী নেই। সেখানে কত করে বিক্রি হচ্ছে কে জানে?

সে বিষণ্ণ মুখে এক চায়ের স্টলে ঢুকে পরপর দু কাপ চা খেয়ে ফেলল। পঞ্চাশ পয়সা করে কাপ। কোনো মানে আছে? কী আছে এর মধ্যে যে পঞ্চাশ পয়সা দাম হবে? তার মেজাজ ক্রমেই উষ্ণ হতে লাগল। এই অবস্থায় সে খবর পেল জহুর ছাড়া পেয়ে বাড়ি এসেছে। খবরটা প্ৰথমে সে বিশ্বাস করতে পারল না। জহুরের মেয়াদ হয়েছেন বছরের। এখনোছ বছরও হয় নি। জেল ভেঙে পালিয়েছে নাকি? দবির মিয়া তৃতীয় কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে সিগারেট ধরাল।

এই মুহূর্তে বাড়ি ফিরে যাওয়া দরকার, কিন্তু পরের হাটে দাম আরো চড়বে। এই বছর ডালের ফলন কম হয়েছে। কিনতে হলে এখনই কিনে ফেলা উচিত। সেতাবগঞ্জের খবরটা তার আগে জানা দরকার।

দবির মিয়া শেষ পর্যন্ত দু শ উনিশ টাকা দরে ন মণ ডাল কিনল। আগামীকাল ডালের বেপারী বস্তাগুলো পৌছে দেবে।

বাড়ি ফিরতে তার অনেক রাত হল। আজ সকাল সকাল ফেরা দরকার ছিল অথচ আজই দেরি হল। জুমাঘর পার হতেই দবির মিয়া দেখল সমস্ত অঞ্চলটা অন্ধকার। ঝড় নেই, বাদল নেই অথচ কারেন্ট চলে গেছে। এর মানে কী? সেই যদি রোজ হারিকেনই জ্বালাতে হয় তাহলে টাকাপয়সা খরচ করে লাইন আনার মানে কি? এই সব ফাজলামি না?

দবির মিয়ার বাড়ির সামনের বারান্দায় জহুর বসে ছিল। তার সামনের মোড়াতে যে বসে আছে সে খুব সম্ভব অ–অন্ধকারে ভালো দেখা যাচ্ছে না। দবির মিয়া বলল, কে? অঞ্জু উঠে ভেতরে চলে গেল। জহুর অস্পষ্টভাবে বলল, দুলাভাই, ভালো আছেন?

এ্যাঁ, কে?

আমি, আমি জহুর।

আরে জহুর তুমি, তুমি কোত্থেকে?

দবির মিয়া এমন ভঙ্গি করল যেন জহুর আসার খবর সে আগে পায় নি।

এ্যাঁ, কী সর্বনাশ, আমি তো কিছুই জানি না। থাক থাক, সালাম করতে হবে না। টুনী, এই টুনী, ঘর অন্ধকার–বিষয় কি? কারেন্ট নেই নাকি? এ্যা।

দবির মিয়া অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

চা-টা কিছু দিয়েছে? টুনী, এই টুনী। এরা কোন কাজের না। একটা বাতিটাতি তো দিতে পারে। হাত-মুখ ধুয়েছ জহুর?

জ্বি-না।

কোনো খোঁজখবর করে নাই। অপদার্থের গুষ্টি। যাও, গোসল করে ফেল। অল্প পানি দিয়ে গোসল করবে। টিউবওয়েলের পানি ঠাণ্ডা, ফস করে সর্দি লেগে যাবে। হা-হা-হা।

দবির মিয়া হাসিটা মাঝপথে গিলে ফেলল। টিউবওয়েলের পানি ঠাণ্ডা, এর মধ্যে হাসির কিছু নেই। খামাকা হাসছে কেন সে?

জহুর বলল, আপনারা সবাই ভালো ছিলেন তো?

আর ভালো থাকাথাকি। বলবসব। তুমি গোসল-টোসল সার–আমি বালতি–গামছা আনি। আগে বরং চা খাও।

চা খেয়েছি আমি।

আরেক কাপ খাও। চায়ে না নাই।

দবির মিয়া আবার হাসি গিলে ফেলল। হয়েছেটা কি তার? কথায় কথায় হেসে উঠছে কেন? টুনী হারিকেন হাতে ঢুকল। দবির মিয়া ধমকে উঠল, অন্ধকারে বসিয়ে রেখেছিস মামাকে, বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু আছে মাথায়?

টুনী মৃদুস্বরে বলল, একটা মাত্র হারিকেন। ছোট মা আবার ফিট হয়েছেন।

কুপি জ্বাললেই হয়। অন্ধকারে বসে থাকবে নাকি?

জহুর বলল, কোনো অসুবিধা হয় নাই দুলাভাই।

বললেই হল অসুবিধা হয় নাই। এদের কোনো কাণ্ডজ্ঞান নাই। সব কয়টা গরু।
 
দবির মিয়া ঘরে ঢুকে গেল। অনুফা এই গরমের মধ্যেও লেপ গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে। তার চুল ভেজা। অর্থাৎ মাথায় পানি ঢালা হয়েছে। যন্ত্রণা আর কাকে বলে। বার মাসের মধ্যে ন মাস বিছানায় পড়ে থাকলে সংসার চলে। দ্বিতীয় বার বিয়ে করাটা চরম বোকামি হয়েছে। অনুফা ক্ষীণ স্বরে বলল, বাজার এনেছ?

হুঁ।

মাছ-টাছ আছে?

আছে।

টুনীর কাছে দাও। তাড়াতাড়ি রান্না শুরু করুক।

দবির মিয়া বাজারের ব্যাগ টুনীর হাতে দিয়ে দিল।

আইড় মাছ আছে। কয়েক টুকা ভাজি করিস টুনী।

অনুফা ক্ষীণ স্বরে বলল, আইড় মাছের ভাজি হয় না।


দবির মিয়া ফোঁস করে উঠল, হবে না আবার কি, হওয়ালেই হয়। যত ফালতু কথা।

বাবলু আর বাহাদুর নিঃশব্দে একটা স্কেল নিয়ে টানাটানি করছিল। দবির মিয়া দুজনের কানে ধরে প্রচণ্ড শব্দে মাথা ঠুকে দিল। দু জনের কেউ টু শব্দ করল না। অঞ্জু মশারি খাটাচ্ছিল, দবির মিয়া তার গালেও একটা চড় কষাল।

পড়াশোনা নাই?

অন্ধকারে পড়ব কীভাবে?

আবার মুখে-মুখে কথা?

দবির মিয়া দ্বিতীয় একটি চড় কসাল। অনুফা মাথা উচু করে বলল, এত বড় মেয়ের গায়ে হাত তোলা ঠিক নয়।

তুই চুপ থাক।

তুইতোকারি করছ কেন?

বললাম চুপ।

অঞ্জুর গালে আঙুলের দাগ বসে গেছে। সে এমনভাবে মশারি খাটাচ্ছে যেন কিছুই হয় নি। টুনী ভয়ে-ভয়ে বলল, মাছটা মনে হয় একটু নরম।

দবির মিয়ার মুখ তেতো হয়ে গেল। দেখেশুনে কেনা হয় নি। দেখেশুনে না কিনলে এই হয়। ঈমান বলে কোন জিনিস মাছওয়ালার মধ্যে নেই। অনুফা ক্লান্ত গলায় বলল, কয়েকটা লেবুর পাতা দিস তরকারিতে।



মামা, আপনার গোসলের পানি দিয়েছি।

জহুর দেখল এই মেয়েটি ঘুরেফিরে তার কাছে আসছে। কথা-টথা বলতে চেষ্টা করছে। অন্যরা সবাই দূরে-দূরে। এই মেয়েটির খুব কৌতূহল।

মামা, আমি কল টিপছি, আপনি পানি ঢালেন।

কল টিপতে হবে না। তুই যা।

অঞ্জু মামার কথায় কান দিল না।

তুই কোন ক্লাসে পড়িস?

ক্লাস নাইন, সায়েন্স গ্রুপ।

আর টুনী?

বড়োপা পড়া ছেড়ে দিয়েছে। ম্যাট্রিক পাশ করতে পারে নাই। তাই বাবা বলল–আর পড়তে হবে না।

ও।

বড়আপার বিয়ের চেষ্টা হচ্ছে।

ও।

আগামী সোমবার দেখতে আসবে।

তাই নাকি?

জ্বি, বড়োআপার ইচ্ছা নাই বিয়ের।

ইচ্ছা নাই কেন?

কী জানি কেন। আমাকে কিছু বলে না। না বললে কি আর জানা যায় মামা?

জহুর জবাব দিল না। টিউবওয়েলের পানি সত্যি সত্যি ভীষণ ঠাণ্ডা। শরীর কাঁপছে। অঞ্জু মৃদু স্বরে বলল, মামা, তুমি এখন কী করবে?

কিছু ঠিক করি নাই।

তোমার কথা কিন্তু মামা আমার মনে ছিল। তুমি একটা গান গাইতে,–মাটিমে পৌরণ মাটিমে শ্রাবণ।

জহুর সারা মুখে সাবান মাখতে মাখতে হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠল।

অঞ্জু মৃদু স্বরে বলল, তোমার মনে নাই, না?

না। কিছু মনে নাই।

আমার কথাও মনে নাই?

নাহ।
 
নান্টুর চায়ের দোকানে রাজনৈতিক আলোচনা নিষিদ্ধ। দক্ষিণ দিকের দেয়ালে সে বড়ো করে নটিশ ঝুলিয়েছে–কোনো রাজনীতির আলাপ করিবেন না। রাজনীতির আলোচনার জন্যে কেউ চায়ের দোকানে যায় না। সেখানে আজানের সময়টা বাদ দিয়ে সারাক্ষণই গান বাজে। হিন্দী গান নয়–পল্লীগীতি। নান্টু পল্লীগীতির বড়ো ভক্ত। চায়ের স্টলটি মোটামুটি চালু। সন্ধ্যার আগে আগে এখানে পেঁয়াজু ভাজা হয়। পেঁয়াজু খাবার জন্যে অনেকে আসে। নীলগঞ্জ থানার সেকেণ্ড অফিসার সেপাই পাঠিয়ে রোজ এক টাকার পেঁয়াজু কিনিয়ে নেন। নান্টু অন্যদের টাকায় দশটা দেয় কিন্তু থানাওয়ালাদের জন্যে বারটা।

আজ নান্টুর দোকানে গান হচ্ছিল না। পেঁয়াজুও ভাজা হচ্ছিল না। ভাজাভাজির কাজ যে করে তার জলবসন্ত হয়েছে। নান্টুর মেজাজ এ জন্যেই ঠিক নেই। মেজাজ ঠিক না থাকলে গান-বাজনা জমে না। নাট্ গান বাজায় নিজের জন্যে, কাস্টমারের জন্যে নয়। তাছাড়া তার নিজের শরীর বেজুত লাগছে। তারও সম্ভবত জলবসন্ত হবে। অনেকেরই হচ্ছে। সে ঠিক করল রাত আটটার ট্রেন চলে গেলেই দোকানের ঝাঁপ ফেলে দেবে। কিন্তু আটটার ট্রেন আসতে আজ অনেক দেরি করল। থানার ঘড়িতে নটার ঘন্টা পড়ারও অনেক পরে ট্রেনের বাতি দেখা গেল।

নান্টু দোকানের ঝাঁপ ফেলে বাইরে এসে অবাক হয়ে দেখল জহুর আলিকে। মাথা নিচু করে হাঁটছে। জহুর আলি ছাড়া পেয়েছে নাকি? তার ধারণা ছিল যাবজ্জীবন হয়েছে। নান্টু এক বার ভাবল ডাক দেয়। কিন্তু মনস্থির করতে করতে জহুর আলি জুমাঘরের আড়ালে পড়ে গেল। জহুর আলির হাতে একটা দুই ব্যাটারির টর্চ। সে মাঝে মাঝে টর্চের আলো ফেলছে। চেহারা আগের মতই আছে। একটু অবিশ্যি ভারি হয়েছে। হাঁটছে মাথা নিচু করে কুঁজো হয়ে। আগে বুক ফুলিয়ে হাঁটত।

নান্টু একটা বিড়ি ধরাল। ভালো লাগল না। মাথা ঝিমঝিম করে উঠছে। অর্থাৎ জ্বর আসছে। জ্বর আসার প্রথম লক্ষণই হচ্ছে প্রিয় জিনিসগুলো বিস্বাদ লাগে। পান মুখে দিলে পানটাকে এখন ঘাসের মতো লাগবে। নান্টু বিড়ি ফেলে দিয়ে গণপতির দোকান থেকে এক খিলি পান কিনল। গণপতি বলল, স্টল বন্ধ করে দিলেন?

হুঁ।

রফিকের নাকি বসন্ত?

জলবসন্ত।

ও, আমি শুনলাম আসল জিনিস।

নান্টু পানের পিক ফেলে বলল, জহুর আলি ছাড়া পেয়েছে।

গণপতি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, কার কাছে শুনলেন?

দেখলাম নিজের চোখে।

নান্টু বাড়ির পথ ধরল। অলকা ডিসপেনসারির কাছে তার সাথে দেখা হল সাইফুল ইসলামের। সাইফুল ইসলাম রাত দশটার দিকে তার স্টলে এক কাপ চা আর একটা নিমকি খায়। নান্টু বলল, দোকান বন্ধ আজকে।

এত সকালে?

শরীরটা ভালো না, জ্বর।

ও।

নান্টু মুখ থেকে পানটা ফেলে দিল। বিস্বাদ। জ্বর তাহলে সত্যি-সত্যি আসছে। সাইফুল ইসলাম সিগারেট ধরাল। নান্টুর বমি-বমি লাগছে। ধোঁয়াটাও অসহ্য লাগছে। নান্টু একদলা থুথু ফেলে বলল, জহুর আলি ছাড়া পেয়েছে, জানেন নাকি?

জহুর আলি কে?

নান্টু কিছু বলল না। এ নতুন লোক। দু বছর আগে এসেছে। এরা কিছুই জানে না। সাইফুল ইসলাম আবার জিজ্ঞেস করল, জহুর আলিটা কে?

নান্টু জবাব দিল না। তার মাথা ঘুরছে। পানের মধ্যে জর্দা ছিল নিশ্চয়ই।

জহুর আলিটা কে?

আপনে চিনবেন না। বাদ দেন।

বলেন না শুনি।

নান্টু বড় বিরক্ত হল। সাইফুল ইসলামকে কথাটা বলাই ভুল হয়েছে। এই লোকটি পিছলা ধরনের। ঘ্যানঘ্যান করতে থাকবে। নান্টু চাপা স্বরে বলল, পরে শুনবেন। এখন বাড়িতে যান।

এত সকালে বাড়িতে গিয়ে করব কী?

যা ইচ্ছা করেন। গান-বাজনা করেন।

গান-বাজনা কি অৰ্ডারি জিনিস? বললেই হয়? সিগারেট খাবেন?

নাহ্‌।


খান-না রে ভাই। নেন একটা।

বললাম তো–না।
 
দেশের উন্নতি হচ্ছে না কথাটা ঠিক নয়।

নীলগঞ্জ জায়গাটাকে চেনা যাচ্ছেনা। থানার উত্তর দিকের জংলা জায়গায় দশবারটা বড়ো বড়ো বিল্ডিং উঠে গেছে। রাইস মিল, অয়েল মিল, সুরভি লজেন্স ফ্যাক্টরি, আইস ফ্যাক্টরি। জহুরের বিস্ময়ের সীমা রইল না। রেলস্টেশনে যাওয়ার রাস্তাটা পর্যন্ত পাকা হয়ে গেছে। বাজারের সীমানার পরই সাদা রঙের দোতলা একটা দালান–খায়রুন্নেসা খানম ডিগ্রী কলেজ। খায়রুন্নেসা খানমকে জর চিনতে পারল না। কাউকে সঙ্গে আনা দরকার ছিল। চিনিয়েটিনিয়ে দিত। কিন্তু একা-একা হাঁটতেই ভালো লাগছে।

প্রচুর রিকশা চারদিকে। ফাঁকা রাস্তাতেও এরা সারাক্ষণ টুনটুন করে ঘন্টা বাজায়। এত রিকশা কেন? রিকশা করে যাবার জায়গা কোথায়? আগে ছিল ঘোড়া। ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে দূর দূর থেকে মাল আনত। ধনুকের মতো বেঁকে যেত পিঠ। কিন্তু ঘোড়াগুলো গাধার মতোই নিরীহ ছিল, কিছুই বলত না। জহুর বড়বাজারে উঠে এল। বড়োবাজারে দবির মিয়া নতুন একটা ঘর রেখেছে। জহুরের সেখানে যাওয়ার কথা। দবির মিয়া তার জন্যে অপেক্ষা করছে, দুজনে একসঙ্গে বাড়ি ফিরবে।

বড়োবাজারের তেমন কোন পরিবর্তন হয় নি। ছোট-ঘোট ঘুপচি ধরনের টিনের ঘর। ঘর জুড়ে খাট-চৌকি পাতা। এক কোণায় কুৎসিতদর্শন একটা ক্যাশবাক্স। আগরবাতির গন্ধের সঙ্গে আলকাতরার গন্ধ মিশে একটা দম আটকান মিশ্ৰ গন্ধ চারদিকে। মোটামুটি চিত্রটি এই। অবশ্যি দবির স্টোরটি বেশ বড়ো। দেয়ালের র্যাক ভর্তি শাড়ি, লুঙ্গি এবং লংক্ৰথ। দোকানে পা দিলেই মনে হয় দবির মিয়া এই ক বছর প্রচুর পয়সা করেছে। জহরকে ঢুকতে দেখেই সে ক্যাশবাক্স থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট বের করল, দুইটা চা আর পান নিয়ে আয়।

যে-লোকটিকে পান আনতে বলা হল সে বেশ বয়স্ক। পরিস্কার কাপড়চোপড় গায়ে। এদেরকে এত সহজে তুই বলা যায় না। কিন্তু দবির অনায়াসে বলছে। লোকটি জহুরের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাই সাহেব, শরীরটা ভালো?

জ্বি ভালো। আপনি ভালো?

জ্বি-জ্বি। আমাশা হয়েছিল, এখন আরাম হয়েছে।

দবির মিয়া প্ৰচণ্ড ধমক দিল, চা না আনতে কইলাম?

লোকটি কাঁচুমাচু ভঙ্গি করে চা আনতে গেল। দবির মিয়া বিরক্ত মুখে বলল, যার তার সাথে আপনি-আপনি করাটা ঠিক না। ভদ্রলোকের সাথে ভদ্রলোকের ব্যবহার। ছোটলোকের সাথে ছোটলোকের। এই রামজাদারে যে থাকতে দেই এই তার বাপের ভাগ্য।

লোকটা কে?

কেউ না, পাহারা দেয়। রাত্রে দোকানের ভিতরে ঘুমায়। নীলগঞ্জ কেমন দেখলা?

অনেক জমজমাট। নতুন নতুন দালান-কোঠা।

দালান-কোঠা পর্যন্তই সার–আর কিছু নাই। ব্যবসাপাতি বন্ধ। টাকাপয়সার নাড়াচাড়া নাই। অবস্থা সঙ্গিন।

তাই নাকি?

এতটুক জায়গার মধ্যে দুইটা আইস মেশিন। মাছ যা ঘাটে ওঠে তার সবটাই। বরফ দিয়ে ঢাকা পাঠিয়ে দেয়।

দবির মিয়া থু করে ঘরের মধ্যে একদলা থুথু ফেলল।

আসছ যখন, নিজেই বুঝবে। এক ভাগ পাবদা মাছ দশ টাকা চায়। খাওয়াখাদ্য এখন নাই বললেই হয়।

চা এবং পান এসে পড়ল। লোকটি জহুরের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বলল, আপনে যে আইছেন, সবাই জানে। ছোট চৌধুরী খুব ভয় খাইছে।

দবির মিয়া প্রচণ্ড ধমক দিল।

কত বার বলছি, ফালতু কথা বলবি না। চুপ। একদম চুপা লোকটি চুপ মেরে গেল। জহুর দেখল লোকটির গায়ে ফর্সা পায়জামা-পাঞ্জাবি আছে ঠিকই কিন্তু খালি পা। যারা খালি পায়ে চলাফেরা করে তাদের সহজেই তুই সম্বোধন করা যায়।

বাড়ি ফিরবার পথে দবির মিয়া নানা কথা বলতে লাগল।

কি হয়েছে না-হয়েছে, এইসব মনে রাখা ঠিক না। নতুন করে সব কিছু শুরু করা দরকার। ঠিক না জহর?

হুঁ।

বয়স তোমার এমন কিছু হয় নাই। বিয়ে-শাদি করা দরকার। মেয়ের জন্য। চিন্তা করবে না। এই দেশে মেয়ের অভাব আছে এই কথাটা ভুল। হা-হা-হা।

জহুর চুপ করে থাকল।

রুজি-রোজগারের চেষ্টা করা দরকার। সেইটাও আমি ব্যবস্থা করব। একটা লঞ্চ কিনার চেষ্টায় আছি। বিশ্বাসী লোকজন আমার নিজেরই দরকার। বুঝলে নাকি জহুর?

জহুর হঠাৎ অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। ফস করে জিজ্ঞেস করল, বদি ভাইয়ের বৌ কি এখনন নীলগঞ্জেই থাকে?

কেন?

এমনি জিজ্ঞেস করছি।

থাকে।

শ্বশুরবাড়িতেই থাকে?

হুঁ।

সংসার চলে কীভাবে?

কি জানি কীভাবে। কে খোঁজ রাখে?

দবির মিয়া বিরক্ত হয়ে একদলা থুথু ফেলল। থেমে থেমে বলল, পুরান জিনিস ঘাঁটাঘাঁটি করা ঠিক না।

দবির মিয়ার বাড়ির আলো দেখা যাচ্ছে। বাহাদুর আর বাবলুর তাড়স্বরে পড়া শোনা যাচ্ছে। দবির মিয়া গলা খাঁকারি দিয়ে আবার বলল, পুরান জিনিস ঘাঁটাঘাঁটি করা ঠিক না।

তাকে ঈষৎ চিন্তিত মনে হল।

সেদিনও সে ঈষৎ চিন্তিত হয়েছিল।



রাত সোয়ানটার সময় নীলগঞ্জ থানার দারোগা শামসুল কাদের তাকে থানায় ডাকিয়ে নিয়েছিলেন। জহুর আলি সংক্রান্ত কী-একটা গোলমাল। এরকম গোলমাল জহুরকে নিয়ে লেগেই আছে। নিৰ্ঘাত কাউকে ধমকামকি করেছে। দবির মিয়া থানায় যাবার আগে স্ত্রীর সঙ্গে খুব রাগরাগি করল, আর এইসব ঝামেলা নিতে পারব না। যথেষ্ট হয়েছে। মানসম্মান সব গেছে। ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে যদি না দিই তাহলে আমার নাম……

থানায় গিয়ে দবির মিয়া আকাশ থেকে পড়ল। জহুর আলিকে শম্ভুগঞ্জে খুনের দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। খুন হয়েছে বদি। ব্যাপারটি এমনই অবিশ্বাস্য যে দবির মিয়া ঘটনার উপর তেমন গুরুত্ব দিল না। ভুল হয়েছে বলাই বাহুল্য। কিন্তু সমস্তটাই অল্প সময়ের মধ্যে জট পাকিয়ে গেল। তাজ বোর্ডিংয়ের মালিক বলল, জহরকে সে ৯ নম্বর ঘর থেকে বের হতে দেখেছে, তার শার্ট রক্তমাখা ছিল। এবং সে তাজ বোর্ডংয়ের মালিককে দেখে ঘুট করে সরে পড়ে। কী সর্বনাশের কথা!

দবির মিয়া শম্ভুগঞ্জ থানা হাজতে দেখা করতে গেল। উকিল-টুকিল দিতে হয়, শতেক ঝামেলা। জহুরকে খুব বিচলিত মনে হল না। সে বেশ স্বাভাবিকভাবে বলল, মিথ্যা মামলা দুলাভাই। হোট চৌধুরীর কারবার। কিছু হবে না। বদি ভাইকে আমি খুন করব কেন?

তুই তার হোটলে গেছিলি কি জন্য?

গল্প করবার জন্যে গেছিলাম।

দবির মিয়া কপালের ঘাম মুছে ক্লান্ত স্বরে বলল, এখন আমি করি কি?

কিছু করতে হবে না, বসে থাকেন চুপচাপ। বড়োআপা কেমন আছে?

দবির মিয়া তার জবাব না দিয়ে ভোঁ ভেউ করে কেঁদে ফেলল।

যান, ঘোট চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন। কাঁদবার তো কিছু হয় নাই।

কাঁদবার কিছু হয় নাই, বলিস কি তুই! আমার কি টাকাপয়সা আছে?

টাকাপয়সার কী দরকার? টাকাপয়সা ছাড়া মামলা-মোকদ্দমা হয়?

দুলাভাই, আপনি চৌধুরী সাহেবের কাছে যান।

ছোট চৌধুরী দবির মিয়ার উপর দারুণ রেগে গেলেন।

খুন হয়েছে বলি, ধরেছে তোমার শালাকে, আমি এর মধ্যে কে? তোমার শালার মাথা আধা-খারাপ আমরা জানি, তোমারটাও যে খারাপ, তা তো জানতাম না।

দবির মিয়া আমতা-আমতা করতে লাগল।

যাও, ভালোমতত উকিল-টুকিল দেও। পয়সাপাতি খরচ কর। অপরাধ একটা করে ফেলেছে, কী আর করা। চেষ্টাটা তোকরাই লাগে।

খুন সে করে নাই চৌধুরী সাহেব।

তুমি আমি বললে তো হবে না–দেখবে কোর্ট।

দবির মিয়া দীর্ঘ সময় চুপচাপ থেকে বলল, জহুরের মাথাটা গরম, আপনার সঙ্গে বেয়াদপি করেছে অনেক বার……

কথার মাঝখানে তাকে থামিয়ে দিয়ে চৌধুরী সাহেব রাগী গলায় বললেন, এই জন্যে আমি তারে খুনের আসামী দিয়ে দিলাম? অন্য কেউ এই কথা বললে আমি তারে জুপিটা করতাম। নেহায়েত দুঃখে-ধান্ধায় তোমার মাথার ঠিক নাই, তাই কিছু বললাম না।

দবির মিয়া বাসায় ফিরে দেখে তার স্ত্রীর এবরশন হয়েছে। এখন-তখন অবস্থা। দুপুররাতে তাকে নিয়ে ময়মনসিংহ সদর হাসপাতালে যাবার জন্যে ট্রেনে উঠতে হল। কপাল খারাপ থাকলে যা হয়। যে ট্রেনের চার ঘন্টার মধ্যে ময়মনসিংহ পৌছার কথা, সেটা পৌছল ন ঘন্টা পর। ময়মনসিংহ স্টেশনে মরা লাশ নিয়ে দবির মিয়া গলা ফাটিয়ে কাঁদতে লাগল। তার চারপাশে লোক জমে গেল।





...... চলবে
 
Last edited:
অঞ্জু খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে। যত রাতেই ঘুমাতে যাক সূর্য ওঠার আগে তার ঘুম ভাঙবেই। এত ভোরে আর কেউ ওঠে না। অঞ্জু তাই একা-একা বারান্দার বেঞ্চিটায় বসে থাকে। অবশ্যি গত কয়েক মাস ধরে তাকে একা-একা বেঞ্চিতে বসে থাকতে হচ্ছে না। অঞ্জু পাশের বাড়ি থেকে চেয়ে তিনটি গোলাপের কলম এনেছে। কলম তিনটি বহু যতে লাগান হয়েছে বাড়ির পেছনের ফাঁকা জায়গায়। অঞ্জু সকালবেলাটা গাছগুলোর পাশে বসে কাটায়। পানি দেয়। মাটি কুপিয়ে দেয়। এবং যেদিন মন-টন খুব খারাপ থাকে, তখন কথা বলে। হঠাৎ শুনলে মনে হবে সে গাছগুললার সঙ্গেই কথা বলছে। আসলে তা নয়, সে কথা বলে নিজের মনে। যেমন আজ সকালে সে বলছিল, মেয়েরা বড়ো হলে তাদের গায়ে হাত ভোলা ঠিক না। খুব খারাপ। রাগ হলে বুঝিয়ে বলতে হয়। বোঝালে সবাই বোঝে। বোঝলে যখন। বোঝ তখনই তো সবাই বড়ো হয়। ঠিক না?

অঞ্জু কথাগুলো বলছিল ফিসফিস করে। যেন খুব গোপন কিছু বান্ধবীকে বলা হচ্ছে। টিউবওয়েলে পানি নিতে এসে জহুর অবাক হয়ে ব্যাপারটা লক্ষ করল। অঞ্জু নিচু গলায় গাছের সঙ্গে কথা বলছে।

আমি কখনন আমার ছেলেমেয়ের সঙ্গে রাগ করব না। রাগ করলে কষ্ট পায় না? মন খারাপ হয় না? রাগ করার দরকার কী?

জহুর অবাক হয়ে ডাকল, এই অঞ্জু।

অঞ্জু চমকে পেছন ফিরল।

গাছের সঙ্গে কথা বলছি নাকি রে?

যাও মামা, গাছের সঙ্গে কথা বলব কেন?

অঞ্জু লজ্জায় বেগুনী হয়ে গেল।

রোজ এত সকালে উঠিস?

হুঁ। তুমিও ওঠ?

উঠি। জেলখানার অভ্যেস।

অঞ্জু উঠে দাঁড়াল। জহুর দেখল এই মেয়েটি দেখতে বেশ হয়েছে। ছোটবেলায় কদাকার ছিল। নাক দিয়ে সব সময় সর্দি পড়ত। বুকের পকেট ভর্তি থাকত রেললাইন থেকে আনা পাথরের টুকরোয়। জহুর যত বারই জিজ্ঞেস করত, পকেটে পাথর নিয়ে কী করিস তুই? তত বারই সে নাকের সর্দি টেনে বলত, পাথর না মামা, গোগেলের ডিম।

জহুর মুখে পানির ঝাপ্টা দিতে দিতে বলল, গোগেলের ডিমের কথা মনে আছে তোর? অঞ্জু লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসতে লাগল।

কি রে, আছে?

আছে।

এখন আর গোগেলের ডিম আনিস না?

অজু সে কথার জবাব না দিয়ে বলল, চা খাবে মামা?

চা?

হুঁ, একটা হিটার আছে। চট করে বানাব।

ঠিক আছে আন। তুই এ রকম সকালবেলা উঠে একা-একা চা-টা খাস নাকি?

না, তোমার জন্যে বানাব।


অঞ্জু চা নিয়ে আসবার পর জহুর একটা জিনিস লক্ষ করল, অঞ্জু যেন খুঁড়িয়ে। খুঁড়িয়ে হাঁটছে।

চিনি ঠিক আছে মামা?

ঠিক আছে।

অঞ্জু মামার পাশে বসে নরম গলায় বলল, তুমি কি আবার কলেজে ভর্তি হবে?

নাহ্‌।

তুমি কী করবে?

জহুর জবাব দিল না। অজু বলল, বাবা বলছিলেন তুমি তার সঙ্গে লঞ্চের ব্যবসা করবে।

জহুর হালকা গলায় বলল, দুলাভাইয়ের অনেক টাকা হয়েছে নাকি রে?

হুঁ।

ঘর-দুয়ার তো কিছু ঠিকঠাক করে নাই।

বাবা টাকা খরচ করে না।

তাই নাকি?

হুঁ। সবাই বলছিল বড়োপাকে দুই-একটা গানটান শেখাতে। তাহলে চট করে বিয়ে হবে। তা বাবা শেখাবে না। হারমোনিয়াম কিনতে হবে যে!

এখন বিয়ে হবার জন্যে গান শিখতে হয়?

হুঁ, হয়। যাদের গায়ের রঙ কালো তাদের হয়।

এখানে গান শেখায় কে?

কে আবার, বগা ভাই।

বগা ভাইটা কে?

তুমি চিনবে না, সাইফুল ইসলাম। বকের মত হাঁটে, তাই নাম বগা ভাই।

অঞ্জু মুখ নিচু করে হাসল। পরমুহূর্তেই হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, অনেকে আবার ডাকে জেলি ফিশ। খুব মজার লোক মামা।

জহুর কিছু বলল না। বাবলু এবং বাহাদুরের কান্ন শোনা যেতে লাগল। দবির মিয়ার গর্জনও ভেসে এল, খুন করে ফেলব। আজকে আমি দুটাকেই জানে শেষ করে দেব।

জহুর বলল, ব্যাপার কি অঞ্জু?

ওরা আজ আবার বিছানা ভিজিয়ে ফেলেছে।

দবির মিয়ার রাগ ক্রমেই চড়ছে : হারামজাদাদের আজ আমি বাপের নাম ভুলিয়ে দেব। ধামড়া ধামড়া একটা, আর কাণ্ডটা দেখ।

জহুর বলল, আমি একটু ঘুরে আসি অঞ্জু।

কোথায় যাও?

এই এনি একটু হাঁটব।

নাস্তা খেয়ে যাও।

এসে পড়ব, বেশি দেরি হবে না।



ছোট চৌধুরী নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মাজছিলেন। দাঁত মাজার পর্বটি তাঁর দীর্ঘ। বাড়ির সামনে হাঁটাহাঁটি করেন এবং দাঁত মাজেন। তাঁর পরনে একটি লুঙ্গি এবং পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির বোম সবগুলো খোলা। মুখ থেকে কম পড়ে পাঞ্জাবির জায়গায় জায়গায় ভিজে উঠেছে। তিনি এটা তেমন গ্রাহ্য করছেন না। কারণ দাঁত মাজা শেষ হলেই তিনি গোসল করেন। গোসলের পানি গরম হচ্ছে।

বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে যে-ই হেঁটে যাচ্ছে, তাকেই তিনি দু-একটা ছোটখাটো প্রশ্ন করছেন, কে, জলিল না? আছ কেমন? বড়োছেলের চিঠিপত্র পাও? মনু মিয়া, তোমার বাতের ব্যথা কি কমতির দিকে? এ্যাঁ, আরো বাড়ছে? বল কি!

আজকের রুটিন অন্য রকম হল। তিনি দেখলেন, জহুর আলি হনহন করে আসছে। জহুর আলিকে দেখতে পেয়ে তিনি তেমন অবাক হলেন না। সে যে ছাড়া পেয়েছে এবং এখানে এসে পৌছেছে সে খবর তাঁর জানা। কিন্তু তার হনহন করে হাঁটার ভঙ্গিটা চোখে লাগে। কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া কেউ এ রকম হাঁটে না। কিন্তু এই সকালবেলা তার কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?

চৌধুরী সাহেব ভালো আছেন?

চৌধুরী সাহেব চট করে জবাব দিতে পারলেন না। কিছুক্ষণ সময় লাগল।

জহুর না?

হ্যাঁ।

ছাড়া পেয়েছ নাকি?

হ্যাঁ, ছাড়া পেয়েছি।

ভালো, ভালো। খুব ভালো।

ছোট চৌধুরী লক্ষ করলেন জহুর আলি যেন হাসছে। নাকি চোখের ভুল? ইদানীং তিনি চোখে ভালো দেখতে পান না।

জহুর, বসবে নাকি?

নাহ।

জহুর না বলেই গেট ধরে দাঁড়িয়ে রইল। এর মানে কী? কী বোঝাতে চায় সে?

নীলগঞ্জের অনেক পরিবর্তন হয়েছে, কি বল জহুর?

জহুর তার উত্তরে থেমে থেমে বলল, চৌধুরী সাহেব, কিছু-কিছু জিনিসের কোনো পরিবর্তন হয় না।

বলতে চাও কী তুমি?

না, কিছু বলতে চাই না।

জহুর আলি লোহার গেটে ভর দিয়ে দাঁড়াল। চৌধুরী সাহেবের গোসলের পানি। গরম হয়েছে খবর আসতেই তিনি ভেতরে চলে গেলেন। জহুর গেটে হেলান দিয়ে তবু দাঁড়িয়ে রইল। চৌধুরী সাহেবের পানি গরম হবার খবর যে দিতে এসেছিল সে বলল, কিছু চান মিয়াভাই?

জহুর বলল, কিছু চাই না।
 
অমাবস্যার রাতে নীলগঞ্জ বাজারে চুরি হবে, এটা জানা কথা। থানাওয়ালা সে জন্যেই অমাবস্যার রাতে নীলগঞ্জ বাজারে একজন পুলিশ রাখে। তবু চুরি হয়। বাজার সমিতির দারোয়ানের নাকের ডগায় চুরি হয়। দবির মিয়া অতিরিক্ত সাবধানী। সে বাজার সমিতির দারোয়ানের ওপর ভরসা না করে এক জন লোক রেখেছে, যে রাতে দোকানের ঝাঁপ ফেলে সজাগ ঘুম ঘুমায়। কিন্তু শেষরক্ষা হয় নি। গত রাতে দবির মিয়ার দোকানে চুরি হয়েছে। ক্যাশবাক্সের কোনো টাকা নিতে পারে নি, কারণ সেখানে কোনো টাকা ছিল না। দুই থান ছিটের কাপড়, দশ গজ লংক্ৰথ। এবং পপলিনের কাটা পিসগুলো নিয়ে গেছে। ক্যাশবাক্সের পাশে গাদা করা ছিল নীল এবং সাদা রঙের মশারি। সবগুলো কাঁচি দিয়ে কুচি কুচি করে কেটেছে।

দবির মিয়া দোকানে এসে কেঁদে ফেলল। ছাপ্পান্নটা নতুন মশারি পরশু দিন ময়মনসিংহ থেকে এসেছে। নাইটগার্ডকে দেখা গেল পান খেয়ে মুখ লাল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং যে-ই আসছে তাকেই মহা উৎসাহে ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ দিচ্ছে, ছাপ্পান্নটা মশারি, নটা শাড়ি, পনেরটা লুঙ্গি আর আপনের কাপড়ের থান সব মিলাইয়া…….

দবির মিয়া প্রচণ্ড একটা চড় কষিয়ে দিল নাইটগার্ডের গালে। পুলিশ এল বেলা বারটার দিকে।

দবির মিয়া তখন দোকানে ছিল না। পুলিশ খানিক জিজ্ঞাসাবাদ করে নাইটগার্ডের কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় নিয়ে গেল। নাইটগার্ডটির বিস্ময়ের সীমা রইল না। এমন একটা কিছু হতে পারে, তা তার ধারণার বাইরে ছিল। সে রাস্তায় যার সঙ্গে দেখা হল তাকেই ভাঙা গলায় বলতে লাগল, দবির চাচাজীরে এটু খবর দেন। আপনের পাওডাও ধরি।

বিকেলের মধ্যে নাইটগার্ড আধমরা হয়ে গেল। রুলের বাড়ি খেয়ে তার নিচের পার্টির একটি দাঁত নড়ে গেল। স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্যে এক পর্যায়ে তার অণ্ডকোষ চেপে ধরায় সে তীব্র ব্যথায় বমি করে ফেলল এবং ক্ষীণ স্বরে অর্থহীন কথাবার্তা বলতে লাগল। জমাদার সাহেব বললেন, কি, চুরি করেছিল?

জ্বি।

একাই করেছি, না আরো লোক ছিল?

ছিল। কে কে ছিল?

জ্বি ছিল।

হারামজাদা, ছিল কে?

জ্বি?

তোর সাথে আর কে ছিল?

কয় জন ছিল?

স্যার স্মরণ নাই।

আচ্ছা, অরণের ব্যবস্থা করি, দেখ।

সন্ধ্যাবেলায় দবির মিয়া এসে দেখল থানা হাজতে এক কোণায় কুণ্ডলী পাকিয়ে সে শুয়ে আছে। দবির মিয়া ডাকল, এ্যাই মনসুর, এ্যাই।

মনসুর শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল, কিছু বলল না।

মনসুর ভয় নাই, তরে নিতে আইছি, উইঠা দাঁড়া।

মনসুর উঠে দাঁড়াল না।

হাজতের জন্য প্রান্তে লম্বা দাড়িওয়ালা যে-লোকটা দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছিল সে বলল, এই শালার পুতে কাপড়চোপড় নষ্ট কইরা দিছে, গন্ধে থাকন দায়।

দবির মিয়াও তখন একটি তীব্র কটু গন্ধ পেল। ওসি সাহেব এলেন রাত নটায়। দবির মিয়া মনসুরকে ছাড়িয়ে নিতে এসছে শুনে তিনি গম্ভীর হয়ে পড়লেন।

ডেফিনিট চার্জ আছে, ওকে ছাড়াবেন কি?

কী চার্জ আছে?

চুরির, আর কিসের? শক্ত প্যাদানি দিলে আগের চুরিগুলোরও খোঁজ পাওয়া যাবে, বুঝলেন?

আগেরগুলোও তার করা নাকি? কী যে বলেন ওসি সাহেব বোকাসোকা মানুষ।

আরে রাখেন রাখেন। ধোলাই দিলেই দেখবেন নাম-ধাম বের হয়ে যাবে। খোলাইয়ের মতো জিনিস আছে?

দবির মিয়া ফিরে আসার সময় দারোগা সাহেব অপ্রাসঙ্গিকভাবে বললেন, শুনলাম আপনার ভাই ছাড়া পেয়েছে।

ভাই না। ছোট শ্যালক।

একই কথা। সে আপনার সঙ্গেই থাকবে?

জ্বি।

ভালো। খেয়ালটেয়াল রাখবেন। জেলখানা জায়গাটা খারাপ। অসৎসঙ্গ। এক বার জেলে গেলে অনেক রকম ফন্দি-ফিকির লোকজন শেখে। বুঝলেন?

দবির মিয়া কিছু বলল না। দারোগা সাহেব একটা দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে কানের ময়লা আনতে আনতে প্রসঙ্গ শেষ করলেন, খেয়ালটেয়াল রাখবেন, বুঝলেন। দিনকাল খারাপ।

মনসুরের ব্যাপারটা কী করবেন?

দেখি।

বেচারা নির্দোষ।

দেখি।

দবির মিয়া অত্যন্ত মনমরা হয়ে দোকানে ফিরে এল। দোকান খোলার পরপর আর একটি খারাপ খবর পেল। ডালের দাম পড়ে গেছে, সরসটা দু শ তিন টাকা দরে বিকোচ্ছে। চৌধুরী সাহেব সত্তর মন ডাল কিনে রেখেছেন। সেগুলো নাকি ছেড়ে দেবেন, এরকম গুজব। চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে কথা বলা দরকার।

চৌধুরী সাহেব বাজারের মসজিদে এশার নামাজ পড়তে আসেন। কিন্তু নামাজ রাত আটটায় শেষ হয়ে গেছে। আগে আসতে পারলে হত। দবির মিয়া তবু মসজিদের সামনে দিয়ে এক পাক হাঁটল।

মসজিদে ওয়াজ হচ্ছে। মৌলভী আবু নসর সাহেব টেনে টেনে বলছেন, এই দুনিয়াদারী অল্পদিনের। হাশরের ময়দানে আল্লাহ্ পাক সব মুর্দা জিলা করে তুলবেন। ভাইসব, কারো গায়ে একটা সূতা পর্যন্ত থাকবে না। পুরুষ এবং স্ত্রী উলঙ্গ অবস্থায় উঠে আসবে ভাইসব। কিন্তু কেউ কারো লজ্জাস্থান দেখবে না। তখন সূর্য থাকবে আধ হাত মাথার উপর। ভাইসব জিনিসটা খেয়াল রাখবেন……
 
সাইফুল ইসলাম সন্ধ্যার আগেই বাঁয়া-তবলা নিয়ে দবির মিয়ার বাড়ি উপস্থিত হল। তার কিছুক্ষণ পর ন-দশ বছরের একটা ছেলে মাথায় একটা সিঙ্গেল রীড হারমোনিয়াম নিয়ে ঘামতে ঘামতে এসে উপস্থিত। দবির মিয়া দুজনের কাউকে। কিছু বলল না। অতিরিক্ত গম্ভীর মুখ করে সে বসে রইল।

আজ টুনীকে দেখতে আসবে। বরপক্ষের কেউ যদি গান শুনতে চায়, সেজন্যই এ-ব্যবস্থা। দবির মিয়া কাল রাতেই জানতে পেরেছে টুনী বনের তাপস কুমারী আমি গো এই গানটি হারমোনিয়াম বাজিয়ে নিজে নিজে গাইতে পারে। শোনার পর থেকেই সে গম্ভীর হয়ে আছে। সিও সাহেবের মেয়ের সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে গান শেখার মানেটা কি? এত যদি গানের সখ, তাকে বললেই হত। অবশ্য বললেই যে সে গান শেখার ব্যবস্থা করত, তা নয়। নিতান্তই বাজে খরচ। হারমোনিয়াম সামনে নিয়ে মুখ বাঁকা করে চ্যাঁচ করার কোন মানে হয়? তাছাড়া শরিয়তেও গান-বাজনা নিষেধ আছে। কঠিন নিষেধ।

দবির মিয়া মুখ গম্ভীর করে থাকলেও আজকে গানের ব্যাপারে কোনো আপত্তি করে নি। এই মেয়েটি পার করা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। ইদানীং নতুন একটা টং হয়েছে, মেয়ে দেখতে এসে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করা, তা গানটান কিছু জানে নাকি?

কি আমার গানের সমঝদার একেক জন। বিয়ের পরপরই ঢুকিয়ে দেবে রান্নাঘরে অথচ কথাবার্তা এ-রকম–যেন মিয়া তানসেন।

সাইফুল ইসলাম বলল, ইনারা দেরি করবেন নাকি?

দবির মিয়া জবাব দিল না। সাইফুল ইসলাম মুখে পাউডার মেখে এসেছে। সেন্ট-দেওয়া রুমাল দিয়ে ঘন ঘন নাক ঘষছে। মাগীমার্কা এই অপদার্থটাকে সহ্য করা মুশকিল। দেখলেই মনে হয় এই হারামজাদা গান শেখাবার ছলে সুযোগ পেলেই মেয়েছেলের গায়ে হাত দেয়।

দবির মিয়া লক্ষ করল অঞ্জু যত বার বাইরে আসছে, তত বারই এই শালা সাইফুল ইসলাম চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে। এক বার আবার বলল, এই খুকি, এক গ্রাস জল খাওয়াবে? জল খাওয়াবে কিরে হারামজাদা? পানি আবার জল হল কবে থেকে? দুই ঢোক পানি গিলেই চিকন স্বরে বলল, ধন্যবাদ। দবির মিয়া বহু কষ্টে রাগ সামলে মাগরেবের নামাজ পড়তে গেল।

বরপক্ষের লোকজন এসে পড়ল নামাজের মাঝামাঝি সময়ে। দবির মিয়া ইচ্ছা করে নামাজে দেরি করতে লাগল। মেয়ের বাপ ধৰ্মভীরু হলে দেখায় ভালো।

মেয়ে দেখতে এসেছে চার জন। মুরব্বি হল ছেলের চাচা, নেত্রকোণার সাবরেজিস্ট্রি অফিসে চাকরি করেন। ছেলে নিজেও এসেছে, সঙ্গে তার দু জন বন্ধু। ছেলে অতিরিক্ত লম্বা। মুখে বসন্তের দাগ। ধূর্ত চোখ। আসার পর থেকেই শেয়ালের মতো এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কপালের কাছে বিরাট একটা আছিল–সেখান থেকে তিন-চারটা লম্বা কালো চুল ভুরু পর্যন্ত চলে এসেছে। অথচ প্রস্তাব যে এনেছে সে বলেছিল, রাজপুত্রের মতো গায়ের রঙ, খুব আদব লেহাজ। দবির মিয়া আদব-লেহাজের কিছুই দেখল না। আধা ঘন্টাও হয় নি এসেছে, এর মধ্যে বন্ধুদের নিয়ে তিন বার বারান্দায় গিয়ে সিগারেট টেনে এসেছে। অঙ্কুকে দেখে গলা খাকারি দিয়েছে। চড় দিয়ে এই হারামজাদার বিয়ের ইচ্ছা ঘুচিয়ে দিতে হয়।

দবির মিয়া অবশ্য ভদ্ৰভাবেই ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলল। ছেলের চাচার পাতে প্রবল আপত্তি সত্তেও দুটি সন্দেশ তুলে দিল। আয়োজন ছিল প্রচুর, তবু বেশ কয়েক বার বলল, যোগ্য সমাদর করতে পারলাম না। আমি খুবই শরমিন্দা ইত্যাদি। মেয়ের গান গাওয়ার সময় যখন এল তখন সে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। এইসব ছেলে-ছোকরার ব্যাপারে সে থাকতে চায় না। দবির মিয়া বারান্দায় এসে দেখে জহুর এসেছে। মোড়ায় বসে চা খাচ্ছে এক-একা।

জহুর, কোথায় ছিলে?

একটু বাইরে গিয়েছিলাম দুলাভাই।

লোকজন আসছে, ঘরে থাকলেই পারতে।

জহুর স্বাভাবিক স্বরেই বলল, দুলাভাই, আমি থাকলে নানা রকম জিজ্ঞাসাবাদ হবে। সেটা বিয়েটিয়ের জন্যে ভালো না।

দবির মিয়া চুপ করে গেল। জহুর বলল, যে বাড়িতে এক জন খুনী আসামী থাকে, সে বাড়ির মেয়ে বউ হিসেবে নিতে ভয়-ভয় লাগবে।

বলতে-বলতে জহুর মৃদু হাসল, আর ঠিক তখনি টুনীর গান শোনা গেল, আমি বন ফুল গো……। দবির মিয়া ঢোক গিলল। জহুর অবাক হয়ে বলল, টুনী গাইছে নাকি?

হুঁ?

গান শিখল কবে?

দবির মিয়া উত্তর দিল না। জহুর বলল, দুলাভাই, টুনী এত সুন্দর গান গায়। কী আশ্চর্য। আমি তো……

দবির মিয়া মিনমিন করে কী বলল ঠিক বোঝা গেল না। গান শেষে সাইফুল ইসলামের কথা শোনা গেল, মারাত্মক গলা। নিজের ছাত্রী বলে বলছিনা। হেঁ-হেঁ-হেঁ। খুব টনটনে গলা। খুব ধার।

ওরা মেয়ে পছন্দ করে গেল। মোটামুটিভাবে স্থির হল শ্রাবণ মাসে বিয়ে হবে। দেনা-পাওনা তেমন কিছু না। মেয়ের বাবা ইচ্ছে করে কিছু দিলে দেবেন–সেটা তাঁর মেয়েরই থাকবে। তবে ছেলের একটা মোটর সাইকেলের সখ। হোণ্ডা ফিফটি সিসি। তারা যাবার আগে টুনীকে ময়লা তেল চিটচিটে একটা এক শ টাকার নোট দিয়ে গেল।

দবির মিয়ার খুশি হওয়ার কথা, কিন্তু সে মনমরা হয়ে রইল। তার ওপর অনুফ যখন বলল, তার ছেলে পছন্দ হয় নি, তখন সে বেশ রেগে গেল। মেয়েছেলেরা ঝামেলা বাধার ওস্তাদ। পছন্দ না-হওয়ার আছে কী? ছেলের জমিজমা আছে। টুকটাক বিজনেস আছে। প্রাইমারি স্কুলের মাষ্টার, অসুবিধাটা কোথায়?

অনুফা মিনমিন করে বলল, ছেলেটা বেহায়া।

বেহায়া? বেহায়ার কী দেখলে? মেয়েমানুষ তো না যে ঘোমটা দিয়ে থাকবে।

অনুফা ঢক গিলে বলল, টুনীর পছন্দ হয় নাই।

টুনীর আবার পছন্দ-অপছন্দ কি? শুধু ফালতু বাত। একদম চুপ।

টুনী কানতাছে।

কান্দুক। তুই চুপ থাক।

তুইতকারি কর কেন?

বললাম চুপ।

দবির মিয়া দোকানে গেল মুখ কালো করে। যাবার পথে এক বার থানায় যাবে, এরকম পরিকল্পনা ছিল। মনসুরের ব্যাপারে কী হল জানা দরকার। কিন্তু থানায় যেতে আর ইচ্ছা করল না। যা ইচ্ছা করুক। মেরে তক্তা বানিয়ে দিক।

জুম্মাঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। চৌধুরী সাহেব যেন দেখেও দেখলেন না। এর মানেটা কী? দবির মিয়া বলল, চৌধুরী সাহেব না? মালিকুম।

ও, তুমি। এত রাইতে কী কর?

রাত বেশি হয় নাই চৌধুরী সাব। দোকানের দিকে যাই।

চৌধুরী সাহেব দাঁড়িয়ে পড়লেন।

তোমার সঙ্গে কথা আছে দবির।

কী কথা, বলেন।

রাস্তার মধ্যে তো কথা হয় না। এক দিন বাড়িতে আস।

এখন যাব? এখন অবসর আছি।

না, এখন না।

কালকে আসব? সকালে?

দিন-তারিখ করবার দরকার নাই। অবসর মতো এক বার আস।

দবির মিয়া অত্যন্ত চিন্তিত মুখে বাড়ি ফিরে গেল।
 
সাইফুল ইসলাম থানার পাশ দিয়ে বাজারে যাচ্ছিল। নান্টুর দোকানে সে এখন যাবে। একটা চা এবং নিমকি খাবে। মাসকাবারি ব্যবস্থা করা আছে। মাসের শেষে টাকা দিতে হয়। এ ছাড়াও নান্টু লোকটি গান-বাজনার সমজদার। চা খেতেখেতে তার সঙ্গে গান-বাজনা নিয়ে দু-একটা টুকটাক কথা হয়। সাইফুল ইসলামের বড় ভালো লাগে। এই অঞ্চলে গান-বাজনার কোনো কদর নেই। মূখের দেশ।

সাইফুল ইসলাম শব্দ করে করে পা ফেলছিল। তার খুব সাপের ভয়। রাতের বেলা হাঁটাচলা করবার সময় সে সাড়াশব্দ করে হাঁটে। আজও সে গুনগুন করছিল,–আসে বসন্ত ফুল বনে। কিন্তু হঠাৎ সে গান থামিয়ে পাথরের মূর্তির মতো জমে গেল। বিকট চিঙ্কার আসছে থানা থেকে। বিকট এবং বীভৎস। যেন কেউ লোটার একটা হাত টেনে ছিড়ে ফেলেছে। কিংবা একটা চোখ উপড়ে ফেলেছে।

বসন্তকালে রাতের ঠাণ্ডা হাওয়ার মধ্যেও সে কুলকুল করে ঘামতে লাগল। সাপের কথা আর তার মনে রইল না। টর্চ নিভিয়ে সে নিঃশব্দে বাজারের দিকে রওনা হল।

নান্টু মিয়া তার দোকান খোলৈ নি। তার জলবসন্ত হয়েছে। সাইফুল ইসলাম নার দোকানের সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ঘরের দিকে রওনা হল। নার দোকান ছাড়া অন্য কোন দোকানে সে চা খায় না। নান্টুর দোকানে সে নিজের পয়সায় একটা কাপ কিনে রেখেছে। এই কাপে নান্টু অন্য কাউকে চা দেয় না।



জহুরের বিছানা আজ বারান্দায় পাতা হয়েছে। টুনী মশারি খাটাতে এসে নরম গলায় বলল, বৃষ্টি হলে কিন্তু ভিজে যাবে মামা। বৃষ্টি হবে আজ রাতে। জহুরের মনে হল টুনীর চোখ ভেজাভেজা।

জহুর নিচু গলায় বলল, তুই তো ভালো গান শিখেছিস।

টুনী চুপ করে রইল। মশারি খাটাতে তার বেশ ঝামেলা হচ্ছে। দড়ি-বাঁধবার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। জহুর বলল, মশারি পরে খাটাবি, বস তুই। তোর সঙ্গে তো আমার কথাই হয় না।

রান্না হয় নাই, মামা।

রান্নাবান্না সব সময় তুই করিস নাকি?

মাঝে মাঝে অজু করে। অঞ্জুর রান্না বাবা খেতে পারে না।

তোদের ছোটমা করে না?

ছোটমার শরীর ভালো না। আগুনের কাছে যেতে পারে না।

ঘরের ভেতর থেকে ঠকাঠক শব্দ হতে লাগল। টুনী বলল, এই যে আবার লেগে গেছে।

মারামারি করছে?

হুঁ। এরা নিঃশব্দে মারামারি করে। আমি সামলাই গিয়ে।

টুনী উঠে চলে গেল।

জহুর পরপর দুটি সিগারেট শেষ করল। এ-দুটিই তার সর্বশেষ সিগারেট। দুলাভাইয়ের কাছ থেকে টাকা না চাইলে আর সিগারেট কেনা যাবে না। চাওয়াটা একটা ঝামেলার ব্যাপার। টাকাপয়সা আগে বড়োআপা দিত। দেবার সময় রাগীরাগী একটা ভাব করে বলত, ইশ, আর কত কাল জ্বালাবি? বড়োআপার কথা মনে হওয়ায় জহুরের সামান্য মন খারাপ হল। খুবই সামান্য। এটা লজ্জার ব্যাপার। আরো অনেক বেশি মন খারাপ হওয়া উচিত। চোখ দিয়ে পানি-টানি পড়া উচিত। কিন্তু সেরকম কিছুই হচ্ছে না। খুব লজ্জা এবং দুঃখের ব্যাপার। বড়োআপার মতো

একটা ভালো মেয়ে এই দেশে তৈরী হয় নি।

মামা, তোমার চা!

অঞ্জু চায়ের কাপ বেঞ্চির ওপর নামিয়ে রাখল।

চা তো চাই নি।

খাও একটু। রান্নার দেরি আছে।

অঞ্জু বসল বেধির এক পাশে।

পড়া নেই আজকে?

আছে। তোমার চায়ে চিনি ঠিক হয়েছে মামা?

ঠিক আছে।

অঞ্জু বসে রইল চুপচাপ।

তুই কি কিছু বলবি নাকি?

অঞ্জু ইতস্তত করে বলল, টুনী আপা তোমাকে একটা কথা বলতে বলেছে। মামা।

জহুর অবাক হয়ে বলল, সে বললেই তো হয়। উকিল ধরেছে কেন?

তার লজ্জা লাগছে।

কী ব্যাপার?

ঐ ছেলেটিকে আপার পছন্দ হয় নি। আমারও হয় নি।

জহুর অবাক হয়ে বলল, আমাকে বলছিস কেন? দুলাভাইকে বল।

বাবাকে বলে লাভ হবে না।

জহুর চুপ করে গেল। অঞ্জু মৃদু স্বরে বলল, বাবা কারো কথা শোনে না।

জহুর বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, দুলাভাইয়ের অনেক পয়সা হয়েছে, না?

হুঁ।

ছেলেটাকে পছন্দ হয় নি কেন?

জানি না। জিজ্ঞেস করি নি।

তোর নিজেরও তত পছন্দ হয় নি। সেটা কী জন্যে?

লোকটার চেহারা দেখলেই মনে হয় কোন একটা মতলব পাকাচ্ছে।

চেহারা দেখে কিছু বোঝা যায় না।

অঞ্জু উত্তর দিল না। জহুর ঘোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, জেলখানায় অনেক লোক দেখেছি ফেরেশতার মতো চেহারা, কিন্তু ভয়ংকর সব অপরাধ করে এসেছে। এক জনের নাম ছিল আব্দুল লতিফ, কলেজের প্রফেসর কী চমৎকার চেহারা, কী ভদ্র ব্যবহার। কিন্তু…

কী করেছিল ঐ লোক?

ঐ সব শুনে কাজ নেই।

কত দিনের জেল হয়েছিল ওর।

ফাঁসির হুকুম হয়েছিল।

অঞ্জু আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।

ঘরের ভেতরে আবার হুটোপুটি শুরু হল। লেগে গেছে দু ভাই। নিঃশব্দ যুদ্ধ চলছে। অঞ্জু ভাইদের সামলাতে চলে গেল।



দবির মিয়া ফিরল রাত এগারটায়।

তার মুখ থমথমে। বলল, ভাত খাব না, খিদে নাই।

ব্যপার কি দুলাভাই?

ব্যাপার কিছু না। তোমরা না খেয়ে বসে আছ কেন এত রাত পর্যন্ত?

আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।

অপেক্ষা করার দরকার নেই। খিদে লাগলে খাবে, ব্যস।

দবির মিয়া বালতি হাতে কলতলায় গা ধুতে গেল।

গায়ে মাখার সাবান নেই কথাটা সকালে বলা হয় নি কেন? এই নিয়ে গৰ্জাতে গর্জাতে প্রচণ্ড একটা চড় বসাল অজুকে।

সকালে আপনাকে এক বার বলেছিলাম বাবা।

আবার মিথ্যা কথা। বললে আমি শুনলাম না কেন? কান তত এখনন নষ্ট হয় নি। যা, যেখান থেকে পারিস সাবান নিয়ে আয়।

জহুর মোড়াটা উঠোনে নামিয়ে বসেছিল। সুন্দর বাতাস দিচ্ছে। পরিষ্কার জ্যোত্স। বেশ লাগছে বসে থাকতে।

মামা, একটা গায়ে-মাখা সাবান এনে দেবে?

জহুর দেখল, অজু কথা বলছে বেশ সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। যেন কিছুই হয় নি।

এনে দিচ্ছি। আমার কাছে কোনো টাকা নেই রে অঞ্জু। টাকা দিতে পারবি?

অঞ্জু একটা দশ টাকার নোট এনে দিল।



সাবান ছাড়াও জহুর এক প্যাকেট সিগারেট কিনল। কিন্তু দোকানদার দাম নিতে চাইল না।

জহুর ভাই, দাম দিতে হবে না।

দাম দিতে হবে না কেন?

জহুর ভাই, আপনি আমারে চিনতে পারছেন না?

দোকানদার লোকটির সমস্ত মুখভর্তি চাপ দাড়ি। মাথায় ফুলতোলা কিস্তি টুপি একটা।

জহুর ভাই, আমি আজমল।

ও, দাড়ি রাখলে কবে?

বেশি দিন না। আপনি আসছেন খবর পাইছি। কিন্তু লজ্জাতেই দেখা করতে যাই নাই।

লজ্জা কিসের?

আপনের বিপদে কোন সাহায্য করতে পারি নাই। অবশ্য সাহায্য করার মতো অবস্থা আমার ছিল না। আমারে জালিয়াতি কেইসের আসামী করছিল। শুনছেন সেটা? বলব আপনেরে। অনেক কথা আছে, জহুর ভাই।

সাবান নিয়ে এসে জহুর দেখল দবির মিয়া গোসলটোসল সেরে ঘুমিয়ে পড়েছে। জেগে আছে শুধু অজু এবং টুনী। অঞ্জু নাকি ভাত খাবে না, তার খিদে নেই। জহুর বলল, রাগ-টাগ করি না। ভাত খা।

রাগ না মামা, সত্যি খিদে নেই। আমি রাগ-টাগ করি না।

খাওয়ার মাঝখানে টুনী বলল, বাবার দোকানের যে নাইটগার্ডকে ওরা চোর মনে করে ধরেছিল, মনসুর নাম। ওকে থানায় পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।

জহুর হাত গুটিয়ে সোজা হয়ে বসল, কী বলছিস এসব!

হুঁ, সে জন্যেই বাবার এ রকম মেজাজ। মামা, আরেকটু ডাল দেব?

জহুর কোনো জবাব দিল না।
 
তুমি থানাওয়ালাদের বিরুদ্ধে কেইস করতে চাও?

জ্বি।

বেহুদা ঝামেলা করছ দবির।

চৌধুরী সাহেব, একটা নির্দোষ লোককে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।

পুলিশে ধরলে কোলে নিয়ে বসায় না, মার দেয়। তোমার ঐ লোক তো আগেই। আধমরা ছিল।

দবির মিয়া মুখ লম্বা করে বসে রইল।

চৌধুরী সাহেব সরু গলায় বললেন, বুদ্ধিমান লোক থানাওয়ালার সাথে বিবাদ করে না। কেইস করতে চাও কর। টাকা খরচ হবে। ফায়দা হবে না কিছু টাকা খরচ করতে পারবে?

টাকা কোথায় আমার?

হুঁ। তাহলে চুপ করে থাক। থানাওয়ালারা মিলে পাঁচ শ টাকা দেবে বলছে। ঐটা নিয়ে পাঠিয়ে দাও।

দবির মিয়া চুপ করে রইল। চৌধুরী সাহেব বললেন, দিনকাল খারাপ। খুব খারাপ। সবার সাবধান থাকা দরকার। বাজে ঝামেলায় যাওয়ার কোন দরকার নাই।

তা ঠিক।

আর তোমার শালাকে বলবে এইটা নিয়ে যেন একটা ঝামেলা পাকাবার চেষ্টা না করে। কথায়-কথায় আন্দোলন, এই সব বড় শহরে হয়। ছোট জায়গায় হয়। না। তোমার ভালোর জন্যেই বলা।

দবির মিয়া হোট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।

চৌধুরী সাব, তা হলে উঠি?

বস, চা খাও। এই চা দে।

চা আসতে অনেক দেরি হল। চৌধুরী সাহেব দেশের অবস্থা নিয়ে আলাপ করতে লাগলেন। আলাপের ফাঁকে একসময় বললেন, তোমার শালাকে কোনো কাজেটাজে ঢুকিয়ে দাও, বুঝলে। চুপচাপ ঘরে বসে থাকা ঠিক না। আইস মিলে এক জন স্টোর ইনচার্জ নেবে। তুমি চাও তো ব্যবস্থা করে দিই। পাঁচশ টাকা। মাসে পাবে। ঘরে বসে বসে এই টাকাটাই-বা মন্দ কি? আর কাজকাম ছাড়া ঘরে বসে থাকা যায় নাকি?

দবির মিয়া উত্তর দিল না।

কি, বলব চাকরিটার জন্যে?

চৌধুরী সাহেব, একটু জিজ্ঞেস করে দেখি।

তা দেখ। তবে আমাকে দু-এক দিনের মধ্যে বলবে।

জ্বি, বলব। কাজ ছাড়া মানুষ বাঁচে?



জায়গাটা অন্ধকার।

দুটি জড়াছড়ি করা লিচুগাছ চারদিক অন্ধকার করে রেখেছে। জহুর লিচু-গাছ দুটির নিচে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল। এ বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি নেই। বসার ঘরে হারিকেন জ্বলছে। হারিকেনের অস্বচ্ছ আলো আসছে জানালা গলে। জহুর একবার দেখল শাড়িপরা একটি মেয়ে জানালার ওপাশ দিয়ে হেঁটে গেল। কে? যদি ভাইয়ের বৌ মিনু ভাবী? একটি ছোট্ট ছেলে পড়ছে। বদি ভাইয়ের ছেলে নিশ্চয়ই। আর কেউ তো থাকবে না এখানে। জহুর একটু কাশল। বাড়ির ভেতর থেকে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তী কণ্ঠে কেউ বলল, কে, কে?

জহুর সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিতে পারল না। কত বার এসেছে এ বাড়িতে, প্রতি বারই তার এরকম হয়েছে। মিনু ভাবী যত বার বলেছেন, কে, কে? তত বারই সে অন্য এক ধরনের অস্বস্তি বোধ করেছে এবং প্রতি বারই ভেবেছে আর আসবে না এ বাড়িতে। তবু এসেছে। মিনু ভাবী বেশ কয়েক বার বলেছেন, আপনি সরাসরি আসেন না কেন? প্রায়ই দেখি লিচুগাছের নিচে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন, তারপর আসেন। অত্যন্ত সহজ এবং সাধারণ কথা। তবু জহুর কুলকুল করে ঘেমেছে।

মিনু দেখতে এমন কিছু আহামরি নয়। রোগামতো লম্বা একটি মেয়ে। গলায় পাতলা একটি চেইন। মুখে সব সময় পান। জহুর যত বার গিয়েছে তত বার বলেছে, পান দেব আপনাকে ভাই?

জ্বি-না, ভাবী।

না কেন? খেয়ে দেখেন। কাঁচা খয়ের আছে। ও কি, মাথা নিচু করে ফেললেন যো যা ভাবছেন তা না ভাই। পান-পড়া দিচ্ছি না।

মিনু খিলখিল করে হাসত। গলা ফাটিয়ে হাসতেন বদি ভাই। এই জাতীয় রসিকতা বড়ো পছন্দ ছিল বদি ভাইয়ের। কিন্তু শেষের দিকে কী হল কে জানে, জহুর লক্ষ করল বদি ভাই তাকে দেখলেই কেমন গম্ভীর হয়ে পড়তেন। এক দিন পুকুরপাড়ে ডেকে নিয়ে নিচু গলায় বললেন, তুই এত ঘনঘন আসিস না, বুঝলি?

কেন?

লোজন নানান কথা বলে। কী দরকার?

জহুর অবশ্যি তার পরেও গিয়েছে। যদি তাই শেষমেষ কথা বলাই বন্ধ করে দিলেন। শুধু বদি ভাই না, মিনু ভাবীও অস্বস্তি বোধ করত। বেশিক্ষণ থাকত না সামনে। ইশ, রাজ্যের কাজ পড়ে আছে বলেই চট করে উঠে পড়ত।

জহুর সিগারেটটা ফেলে দিল।

হারিকেন হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল মিলু। ভয়ার্ত স্বরে বলল, কে ওখানে? কে?

আমি। আমি জহুর।

মিনু বেশ খানিকক্ষণ কথা বলতে পারল না।

ভাবী, আমাকে চিনতে পারছেন তো?

মিনু মৃদু স্বরে বলল, ভেতরে আসেন জহুর ভাই।

জহুর ঘরের ভেতরে এসে দাঁড়াল।

আপনি ছাড়া পেয়েছেন শুনেছি। আপনি না আসলে আমি নিজেই যেতম।

ভালো আছেন ভাবী?

হুঁ।

এইটি আপনার ছেলে? কী নাম?

রতন। এই, চাচাকে মালিকুম দাও।

রতন কিছু বলল না। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইল। বদি ভাইয়ের মতো বড়ো বড়ো চোখ হয়েছে ছেলেটির।

জহুর ভাই, আপনি বসেন। এই চেয়ারটায় বসেন।

জহুর বসল না। হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবেই বলে ফেলল, ভাবী, আমি একটা কথা জানতে এলাম। আপনার মনে কি আমাকে নিয়ে কোনো সন্দেহ আছে? আপনি কি কোনো দিন ভেবেছেন আমি এই কাজটা করেছি?

মিনু ভাবী কঠিন স্বরে বললেন, ছিঃ জহুর ভাই, ছিঃ! আপনি আমাকে এত ছোট ভাবলেন?

জহুর ক্লান্ত স্বরে বলল, জেলখানাতে আমার একটা কষ্টই ছিল। আমি শুধু ভাবতাম, আপনি কি বিশ্বাস করেছেন আমি এই কাজটা করেছি?

মিনু লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলল। জহুর দেখল, মিনু ভাবীর চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে নি। শুধু মাথার ঘন চুল একটু যেন পাতলা হয়েছে। কপালটা অনেকখানি বড়ো দেখাচ্ছে। গায়ের রংটাও যেন একটু ফর্সা হয়েছে। বয়স বাড়লে গায়ের রং ফর্সা হয় নাকি, কে জানে?

জহুর ভাই, আপনি বসেন।

জহুর বসল। মিনু চলে গেল ভেতরে। শুধু ছেলেটি ঘুরঘুর করতে লাগল। মনে হয় গঙ্গট করতে চায়। জহুরের কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সে শুধু তাকিয়ে রইল। ভেতরে টুনটুন শব্দ হচ্ছে। চা বোধ হয়। চা এবংহালুয়া। জহুরের মনে হল সে অনন্তকাল ধরে এ বাড়ির কালো কাঠের চেয়ারে বসে আছে।
 
দবির মিয়া চৌধুরী সাহেবের বাড়ি থেকে তার দোকানে চলে গেল। সেখানেও বেশিক্ষণ বসল না, গেল থানায়। ওসি সাহেব ডিউটিতে ছিলেন না। সেকেণ্ড অফিসার অত্যন্ত অমায়িক ভঙ্গিতে তাকে বসতে বললেন। চায়ের ফরমাস করলেন।

জ্বি-না, চা খাব না।

আরে ভাই খান। ওসি সাহেব আপনাকে ডাকবার জন্যে লোক পাঠিয়েছিলেন। এসে ভালোই করেছেন।

ডেডবডির ব্যাপারে খোঁজ নিতে আসলাম। ওসি সাহেব সকালে আসতে বলেছিলেন।

ডেডবডি তো রাতেই সুরতহালের জন্য পাঠান হয়েছে।

দবির মিয়া কিছু বলল না। সেকেণ্ড অফিসার বললেন, বুঝলেন ভাই, রাত্রে ঘুমাচ্ছিলাম। যখন বলল মনসুর কেমন-কেমন করে যেন শ্বাস নিচ্ছে, তখনই বুঝলাম অবস্থা খারাপ।

ডাক্তার ডাকিয়েছিলেন?

আরে, ডাক্তার ডাকব না? বলেন কি আপনি। পুলিশের চাকরি করি বলেই কি অমানুষ হয়ে গেলাম নাকি ওসি সাহেব নিজে গিয়ে দুধ গরম করে আনলেন।

ডাক্তার এসেছিল?

বললাম তো তাই এসেছিল। আর আপনি যা ভাবছেন, পিটিয়ে মেরে ফেলেছি। আমরা, সেটাও ঠিক না। মারধোর হয়, কিন্তু মানুষ মেরে ফেলবার মতো মারধোর কি করা যায় নাকি? থানা কম্পাউণ্ডের মধ্যে ফ্যামিলি নিয়ে থাকি। ছেলেপুলে আছে। এর মধ্যে এরকম একটা কাণ্ড কি করা যায়? আপনিই বলেন।

তাহলে লোকটা মরল কীভাবে?

ভয়ে। স্রেফ ভয়ে, আর কিছু না। এখন যদি পাবলিক হৈ-চৈ শুরু করে, তাহলেই মুশকিল। পুলিশ সম্পর্কে পাবলিকের ধারণা খারাপ। এই যে মুক্তিযুদ্ধে এতগুলো পুলিশ আমরা মারা গেলাম–কেউ মনে রাখছে সে-কথা, বলেন? মিলিটারি অফিসার যে কজন মারা গেছে পুলিশ অফিসার মারা গেছে তার চার গুণ। সেই সব কথা আর কারো মনে নেই। ঠিক বলেছি কিনা বলেন?

দবির মিয়া জবাব দিল না।

এই জন্যেই ওসি সাহেব আপনাকে খবর পাঠিয়েছেন, পাবলিক যাতে হৈ-চৈ শুরু না করে।

আমার এইখানে কী করার আছে? কী বলছেন এই সব

সেকেণ্ড অফিসার হাসিমুখে বললেন, আপনি বলবেন মনসুর মিয়া চুরির মধ্যে ছিল। তার জন্যেই চুরি হচ্ছিল এত দিন।

কী বলছেন এই সব? চোর-ডাকাতের জন্যে মানুষের কোনো সিমপ্যাথি নেই। চোর-ডাকাত শেষ হলেই পাবলিক খুশি।

আমি একটা নিরপরাধ মানুষকে চোর বাবা

নিরপরাধ, বুঝলেন কী করে? ব্যাটা শুধু চুরি না, ডাকাতির মধ্যেও ছিল। প্রমাণ আছে রে ভাই। বিনা প্রমাণে তো বলছি না। মারাত্মক শয়তান পোক, এত দিন টের পান নি।

দবির মিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সেকেণ্ড অফিসার সাহেব বললেন, চা খান, ঠাণ্ডা হচ্ছে। চিনি ঠিক হয়েছে কিনা দেখেন তো। এরা চিনি দিয়ে একেবারে সরবত বানিয়ে রাখে। এককাপ চায়ে এক পোয়া চিনি দেয়। মনে করে মিষ্টি দিলেই চা ভালো হয়।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top