What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক (1 Viewer)

ঝড়-বৃষ্টি থেমে গেছে। রাত এগারটা পাঁচ। রাস্তায় নামলেই বাংলাদেশ দেখা যাবে। বাইশ বছরে কী হল দেশটার ববাঝা যাবে। তাতে তাঁর কিছু কি আসে যায়? না আসে যায় না। কিছুই আসে যায় না।

মির্জা সাহেব রুম সার্ভিসকে খবর দিয়ে একটা স্যান্ডউইচ এবং গরম এক কাপ কফি খেয়ে শুয়ে পড়লেন। কফি খেলে বেশিরভাগ লোকই ঘুমুতে পারে না। তাঁর ক্ষেত্রে উল্টোটা হয়। ঝিমুনি আসে। ঘুমুতে ইচ্ছা করে।

কফি খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেই হল। আজও যে সে রকম হবে তেমন কথা নেই। জেট লেগ হয়েছে। শরীরের নির্দিষ্ট ঘুমের সাইকেলে গণ্ডগোেল হয়ে গেছে। বিছানায় শুয়ে হয়ত জেগে থাকতে হবে।

তাঁর একটু শীতশীত লাগছে। আরামদায়ক শীত যা ঘুম নিয়ে আসে। গায়ের উপর চাদর টেনে বাতি নিভিয়ে দিলেন। বাতি নেভানোর সঙ্গে-সঙ্গে ঘুম কেটে গেছে। মাথা দপদপ করতে লাগল। ইনসমনিয়ার পূর্ব লক্ষণ। এখন তৃষ্ণা পাবে। পানি খাবার সঙ্গে-সঙ্গে বাথরুমে যেতে হবে। আবার তৃষ্ণা পাবে। আবার পানি। আবার বাথরুম।

তিনি বাতি জ্বালাতেই পলিন বলল, বাবা।

ঘুম ভেঙে গেছে?

হুঁ।

শরীর কেমন?

শরীর ভালো। ক্ষিধে পেয়েছে বাবা।

ক্ষিধে পেলে বুঝতেই হবে শরীর ভালো। কী ভাবে? স্যান্ডউইচ ছাড়া তো আর কিছু পাওয়া যাবে না।

স্যান্ডউইচ ছাড়া—আর যাই পাওয়া যায় তাই খাব।

রুম সার্ভিসকে জিজ্ঞেস করে দেখি।

আমেরিকায় এখন কটা বাজে বাবা?

ঠিক বলতে পারছি না—সকাল আটটা-নটা হবে। মার সঙ্গে কি কথা বলতে ইচ্ছা করছে?

পলিন হ্যাঁ না কিছুই বলল না। মির্জা সাহেব বললেন, দাঁড়াও একটু খোঁজ করছি, ডিরেক্ট ডায়ালিং কি-না তাও তো জানি না।

জানা গেল ডিরেক্ট ডায়ালিং। দ্বিতীয় বার ডায়াল ঘুরাবামাত্র পাওয়া গেল। মির্জা সাহেব মেয়েকে কথা বলার সুযোগ দেবার জন্যে বাইরে চলে গেলেন। বলে গেলেন, সিগারেট শেষ হয়ে গেছে মা, সিগারেট কেনার জন্যে যাচ্ছি।

পলিন কোমল গলায় বলল, কেমন আছ মা?

পলিনের মা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, আমি কেমন আছি তা মমাটেই জরুরি নয়। তুমি কেমন আছ?

ভালো।

ভালো থাকার তো কথা না। নিশ্চয়ই শরীর খারাপ করেছে। ঘর থেকে বেরুলেই তোমার শরীর খারাপ করে। সব জেনে শুনেও তোমার বাবা তোমাকে নিয়ে এত দূরে গিয়েছে। যতই দিন যাচ্ছে ততই দেখি মানুষটা মূর্খ হচ্ছে।

আমি ভালো আছি মা।

বাজে কথা বলবে না। আমি তোমার গলা শুনেই বুঝতে পারছি। তোমার শরীর বল সত্যি করে-জ্বর আসে নি?

এসেছিল। এখন ভালো। তুমি ফিরে আসা মাত্র আমি যা করব তা হচ্ছে তোমাকে আমার কাস্টডিতে নিয়ে আসা। পিটার খুবই বদমেজাজী কিন্তু সে তোমার বাবার মতো অবিবেচক নয়। অভিভাবক হিসেবে তোমার বাবার চেয়ে সে ভালো হবে।

আমি বাবার সঙ্গেই ভালো আছি।

তুমি মোটেও ভালো নেই। এই তো কাশির শব্দ শুনছি। তোমার কি কাশিও হয়েছে?

মির্জা সাহেব সিগারেটের জন্যে যান নি। দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। হোটেলটার একুয়াষ্টিকস ভালো। দরজা সামান্য খোলা তবুও কিছুই শোনা যাচ্ছে না। তিনি হোটেলের লবিতে নেমে এলেন।

পকেটে সিগারেট নেই। এক প্যাকেট সিগারেট পেলে ভালো হত। এখানে ভেন্ডিং মেশিন জাতীয় কিছু নেই। বারে নিশ্চয়ই সিগারেট পাওয়া যাবে। বার কোথায় কে জানে? কাউকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে না।

লবি থেকে সদর দরজা ঠেলে তিনি হোটেলের বাইরে পা রাখলেন। দারোয়ান যথারীতি স্যালুট দিল।

আশে পাশে ছোটখাটো দোকানপাট আছে? যেখানে পান সিগারেট বিক্রি হয়।

সিগারেট হোটেলে পাবেন স্যার।

পান? পান নিশ্চয়ই পাওয়া যায় না?

জ্বি না।

দেখি কিছু পাওয়া যায় কি-না।

ট্যাক্সি ডেকে দিব।

না, ট্যাক্সি লাগবে না।

সন্ধ্যায় যে প্রবল ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল তার চিহ্নমাত্র নেই। আকাশ পরিষ্কার। ঝকঝকে চাঁদ উঠেছে। ভেজা রাস্তার এখানে-ওখানে পানি জমে আছে। পানিতে চাঁদের ছবি। চমৎকার দৃশ্য। তাঁর মনে হল, এক শহরের চাঁদের সঙ্গে অন্য শহরের চাঁদের কিছু মিল নেই।

হাঁটতে চমৎকার লাগছে। রাস্তা ফাঁকা। মাঝেমাঝে দ্রুত গতিতে কিছু গাড়ি যাওয়া-আসা করছে। রাত বারটা এখনো বাজে নি। ঝড়-বৃষ্টি হবার কারণেই হয়ত রাস্তায় লোকজন তেমন নেই। রাস্তাঘাট একই সঙ্গে পরিচিত এবং অপরিচিত লাগছে। একবার মনে হচ্ছে তিনি নিতান্তই অচেনা একটা শহরে আছেন। পরমুহূর্তেই মনে হল তাঁর সারাজীবন এই শহরেই কেটেছে।

তিনি গুনগুন করে গানের কিছু কলি বলছেন। যার প্রথম লাইন–প্রজাপতি প্রজাপতি রে।…
 
০৪.
স্টেডিয়ামের যে রেস্টুরেন্টে আলম এবং মজিদ বসে আছে সেখানেও আলো নেই। ক্যাশিয়ারের টেবিলে একটি মাত্র ইমার্জেন্সি বাতি জ্বলছে। আর একটি মামবাতি জ্বলছে হাত দেয়ার জায়গায়। বাইরের ঝড়-বৃষ্টি থেমে গেলেও ইলেকট্রিসিটি এখনো আসে নি। রেস্টুরেন্টের সামান্য আলোতেও খাওয়া-দাওয়া চলছে। মজিদ দু প্লেট বিরিয়ানি এবং ঠাণ্ডা পেপসির অর্ডার দিয়েছে। আলম বলল, টাকা কোথায় পেলি?

মজিদ গম্ভীর গলায় বলল, রিচু করেছি।

রিচু করেছিস মানে?

চুরি করেছি। ফুপার একটা আটার বস্তা বেচে দিয়েছি।

বলিস কি।

চিনির বস্তা মনে করে ঝেড়ে দিয়েছিলাম, অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারি নি। শেষে দেখি শালা আটার বস্তা। গ্রেট লস।

ধরতে পারে নি।

পারবে না কেন? ধরেছে।

আলম চিন্তিত মুখে বলল, তোকে কিছু বলল না?

না। কোলে নিয়ে আদর করেছে। গালে চুমু খেয়েছে।

তাদের খাওয়া শেষ হবার আগেই ইলেকট্রিসিটি চলে এল। মজিদ বিরিয়ানির সঙ্গে রেজালার অর্ডার দিল।

আলম বলল, তোর পায়ের ব্যথাটা কি কমেছে।

মজিদ বলল, ছেমেক, ছেমেক।

আবার উল্টো করে বলছিস, শালা চড় খাবি কিন্ত।

মজিদ ভুরু কুঁচকে ফেলেছে হঠাৎ চিন-চিনে ব্যথা হচ্ছে।

আলম বলল, এই এরকম করছিস কেন?

কী রকম করছি?

মুখ-টুখ কুঁচকে বসে আছিস। ব্যথা হচ্ছে?

হুঁ।

ডাক্তার-টাক্তার দেখানো দরকার। সেপটিক-ফেপটিক হয়ে গেছে কি-না কে জানে।

মজিদ বিরক্ত স্বরে বলল, খাওয়া শুরু কর। বিরিয়ানি খেতে হয় গরম গরম। এই যে ভাইয়া, ঝাল দেখে কাঁচা মরিচ দিতে পারেন? কী কাঁচা মরিচ দিয়েছেন খেতে মিষ্টি আলুর মতো লাগছে।



তারা সেক্রেটারিয়েটের সামনে দিয়ে প্রেস ক্লাবের দিকে এগুচ্ছে। দুজনের হাতে দুটা সিগারেট। মজিদ সিগারেট খায় না। একেকটা টান দিচ্ছে আর খুক-খুক করছে। প্রোটিন হাউজ পার হয়ে তারা চায়নিজ রেস্টুরেন্টের কাছাকাছি চলে এল। আর তখন আলম খুশি খুশি গলায় বলল, মাহিন শালাকে পাওয়া গেছে। শালার কারবারটা দেখ না।

মাহিন অদ্ভুত কিছুই করছে না। একটা সেলুনে চুল কাটাচ্ছে। চুল কাটানো হয়ে গেছে। নাপিত এখন মাথা মালিশ করছে। আরামে মাহিনের চোখ বন্ধ হয়ে আছে।

মজিদ বলল, শালা রাত দুপুরে চুল কাটাচ্ছে ব্যাপারটা কি? চলতো চুপি-চুপি গিয়ে শালার গালে ঠাস করে একটা চড় মারি, দেখি শালা কী বলে।

আলম বলল, কিছুই বলবে না। টাকা ধার চাইবে।
 
মাহিনের সম্প্রতি এই রোগ হয়েছে, বন্ধু-বান্ধব কারোর সঙ্গে দেখা হলেই চোখ-মুখ করুণ করে টাকা ধার চাইবে। অথচ তাদের বন্ধু মহলে মাহিনের অবস্থাটা সবচে ভালো। তার বাবা পুলিশের রিটায়ার্ড ডি. এস. পি। মাহিনের বড় দুই ভাইয়ের এক জন কাস্টমস ইন্সপেক্টর, অন্যজন জগন্নাথ কলেজের ইকনমিক্সের প্রফেসর। ভাই-বোন সবার মধ্যে মাহিন ছোট। আলমের সঙ্গে সে এম এ পাশ করেছে। এখনো চাকরি-বাকরি কিছু হয় নি। অস্ট্রেলিয়া চলে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কী একটা লাইন না-কি পাওয়া গেছে। লাইনটা কী তা সে ভেঙে বলছে না।

মাহিনের স্বাস্থ্য চমৎকার, চেহারা তারচেয়েও চমৎকার। দারুণ আডবাজ। একটাই দোষ সে হাড় কেপ্লন। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সে কাউকে এক কাপ চা কিনে খাওয়ায় নি এ রকম একটা গুজব প্রচলিত আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনটা সে পার করে দিয়েছে অন্যের উপর দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নববর্ষে ছাত্রদের নামের টাইটেলে সে যে সব নাম পেয়েছে সেগুলো হচ্ছে রক্তচোষা, চিনেজোক, পরগাছা, দি বেগার।

আলম এবং মজিদ নাপিতের দোকানে ঢুকে পড়ল। মাহিন চোখ মেলে দেখল। তার মুখের ভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হল না। সে গম্ভীর গলায় বলল, দোস্ত দশটা টাকা দিতে পারবি? দশটা টাকা হলে মাথাটা শ্যাম্পু করিয়ে ফেলি। বাড়িতে গিয়ে তাহলে আর গোসলের ঝামেলা করতে হয় না।

আলম বলল, বাড়িতে যাওয়া-যাওয়ি নেই, তুই চল আমাদের সাথে।

কোথায়?

রাস্তায় হাঁটব।

রাস্তায় হাঁটবি? পাগল হলি না-কি? আমি এর মধ্যে নেই, আমাকে দশ মিনিটের মধ্যে বাসায় ফিরতে হবে। ভাইয়ের ব্যাটার জন্যে গ্রাইপ ওয়াটার নিয়ে যেতে হবে। ব্যাটা পেটের ব্যথায় পোঁ-পোঁ করে কাঁদছে।

কাঁদুক। কাঁদলে হার্ট স্ট্রং হয়।

ভাবি আমাকে ছোঁচে ফেলবে। তোরা আছিস সখে। তোদের ফ্যামিলিতে তো আর বড় ভাইয়ের স্ত্রী নেই। আমার কপালে দুই খান। এক জন আবার ইংরেজির ছাত্রী। মিষ্টি সুরে ইংরেজিতে এমন কঠিন কঠিন কথা বলে যে…..

মজিদ বলল, আমাদের সঙ্গে থাকলে কুড়ি টাকা পাবি, রাজি আছিস কি-না। বল।

একশ টাকা দে-ভেবে দেখি। বিরাট ক্রাইসিস যাচ্ছে।

পঁচিশ পাবি, ভেবে দেখ। আছেই মোটে পঁচিশ।

তাহলে তোরা বস এখানে। গ্রাইপ ওয়াটারটা কিনে দিয়ে চলে আসব। দে, টাকাটা দে।

পাগল, তোকে আমরা চিনি না—একবার গেলে তোর আর টিকির দেখা পাওয়া যাবে না।

মাহিনের মুখ বিমর্ষ হয়ে গেল।
 
বিমর্ষ ভাব দীর্ঘস্থায়ী হল না। রাস্তায় নেমেই তাঁর মধ্যে ফুর্তির ভাব দেখা গেলসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, সুপার একটা চাঁদ মামা উঠেছে। দেখেছিস?

আলম বলল, আমরা দেখেছি, তুই দেখ।

কবির দল বোধহয় কাগজ-কলম নিয়ে বসে গেছে, কী বলিস?

জানি না।

মাহিন চাঁদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, মামা ভাগ্নেদের কথা মনে রেখ।

তারা এগিয়ে যাচ্ছে কাকরাইলের দিকে। মজিদের পায়ের ব্যথা এখন অনেক কম। স্যান্ডেল পায়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল বলে সে বাঁ পায়ের স্যান্ডেল খুলে ফেলে দিয়েছে। এক পায়ে স্যান্ডেল পরে সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। বন্ধুরা ব্যাপারটা দেখেও কেউ কিছু বলল না।

মজিদ বলল, মাহিন ভোর অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কী হল?

হবে।

কখন হবে?

ধর মেরে-কেটে এক মাস। আগেও হতে পারে। ইমিগ্রেশন ভিসার জন্যে এপ্লাই করেছি।

আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবি?

তুই ওখানে গিয়ে কবি কী? শালা অশিক্ষিত মূর্খ।

ঐ দেশে সবাই মহাজ্ঞানী?

মহাজ্ঞানী না হলেও তোর মতো মূর্খ কেউ নেইশালা তুই মেট্রিক পাশ করতে পারলি না। তোর সঙ্গে হাঁটাওতো লজ্জার ব্যাপার।

মজিদ কিছু বলল না।

মাহিন সিগারেট ধরাল। তার প্যান্টের পকেটে ছটা সিগারেট। প্যাকেট সে বের করে নি। পকেটে হাত ঢুকিয়ে ম্যাজিসিয়ানদের মতো একটা সিগারেট বের করে এনেছে। বন্ধু-বান্ধবদের সামনে সে কখনো প্যাকেট বের করে না। প্যাকেট বের করা মানে এক ধাক্কায় সব শেষ। যে খাবে না সেও হাত বাড়াবে।

মাহিন বলল, আমার কথায় রাগ করলি না-কি, এই শালা?

না।

রাগ করেছিস। তোর মুখ দেখেই মনে হচ্ছে তুই রাগ করেছি।

মজিদ বলল, রাগ করলে ক্ষুর দিয়ে তোর পেটটা ফাঁক করে দিতাম। বলতে বলতে মজিদ প্যান্টের পকেট থেকে চকচকে একটা ক্ষুর বের করল। খাপ। থেকে খুলে চাঁদের আলোয় উঁচু করে ধরল। দলটা থমকে দাঁড়াল।

আলম বলল, তুই ক্ষুর পেলি কোথায়?

আমার সাথেই থাকে।

সাথেই থাকে? ফাজলামীর জায়গা পাস না। তুই এটা নাপিতের দোকান থেকে গাপ করেছি।

হুঁ।

তুইতো বিরাট চোর হয়ে গেছিসরে ব্যাটা।

হুঁ।

হুঁ হুঁ, করছিস কেন? ক্ষুর চুরি করলি কেন?

দাড়ি কামাব। রোজ রোজ দাড়ি কামাবার পয়সা পাব কই?

মাহিন বলল, দোস্ত ক্ষরটা বন্ধ করে রাখ। ভয়-ভয় লাগছে। মজিদ সঙ্গে-সঙ্গে ক্ষুর খাপে ঢুকিয়ে পকেটে রেখে দিল। মাহিন বলল, তুই কি না আমার উপর রেগে আছিস। আচ্ছা তোকে সত্যি কথাটা বলি, অস্ট্রেলিয়ার ব্যাপারটা বোগাস।

বোগাস?

হুঁ। কোথাও কিছু হচ্ছে না বলতে লজ্জা লাগে—তাই অস্ট্রেলিয়ার কথা বলি।

মন্দ না।

আমার কথা শুনে অনেকের আবার হিংসাও হয়। খুব মজা লাগে। খুব অশান্তিতে আছিরে দোস্ত।

তোর আবার অশান্তি কি?

আছে। বলে শেষ করা যাবে না। দুই রোজগারী ভাইয়ে ভাইয়ে লেগে গেছে–ধুন্ধুমার অবস্থা। দুজনেই আলাদা বাসা করছে। আমাদের অবস্থা যে কী হবে অনলি গড় নোজ।

তোর বাবারতো টাকা-পয়সা আছে।

বাবার টাকা-পয়সা কোত্থেকে আসবে? তাঁর অনেস্ট বাতিক ছিল। ঘুষ নিতেন। না। আসলে ভীরু টাইপের লোক ছিলেন। ঘুষ নিতে সাহস লাগে। সাহস ছিল না, বাইরে প্রচার করেছেন—অনেস্ট। পেনসনের টাকা-পয়সা দিয়ে মিরপুরে জমি কিনেছেন। সেই জমির দখল পাচ্ছেন না। পুলিশের লোক হয়েও জমির দখল পাচ্ছেন। না, বুঝে দেখ অবস্থা। ঐ দিন দেখে এসেছি ঐ জমিতে তিন তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে একখানা বাড়ি তুলছে। বিরাট সমস্যায় খাবি খাচ্ছি। বুঝলি।
 
তারা চুপচাপ হয়ে গেল। তিনজনেই নিঃশব্দে এগুচ্ছে। রাত এগারটার মতো বাজে। রাস্তা নির্জন। এই দিকে রিকশার চলাচল এমিতেই কম। আজ আরও কমে গেছে। মাঝে-মাঝে হুম করে অতি দ্রুত এক আধটা প্রাইভেট কার চলে যাচ্ছে।

আলম বলল, কেমন যেন ভয়ভয় লাগছে। ছিনতাই পার্টির হাতে পড়তে পারি।

মজিদ বলল, তোর আছে কী যে ছিনতাই পার্টির হাতে পড়বি?

রিস্টওয়াচ আছে।

মজিদ বলল, সাথে ক্ষুর আছে, আমরাই এখন ছিনতাই পার্টি। দাঁড়িয়ে দেখ এক্ষুনি একটা ছিনতাই করব।

পাগলামী করি না মজিদ।

ছিনতাই না করলেও ভয় দেখিয়ে দেই। ভয় দেখাতে তো অসুবিধা নেই।

বাদ দে। বরং চল করিমের ওখানে তাস খেলব।

মজিদ বলল, দুনিয়ার এক নম্বর মজা কিসে হয় জানিস? এক নম্বর মজা হল ভয় দেখানোয়। পৃথিবীর মানুষ সারাক্ষণ এক জন আরেক জনকে ভয় দেখায় কেন? মজা পায় বলেই ভয় দেখায়। ভয়ের মধ্যেই আসল মজা।

কাকরাইলের দিক থেকে হুডতোলা একটি রিকশা আসছে। আলম বা মাহিন কিছু বুঝবার আগেই মজিদ রাস্তায় নেমে তীব্র গলায় বলল, যায় কেডা? থাম দেহি।

তার গলার স্বর সে কর্কশ করে ফেলেছে। পুরান ঢাকার ছেলেপুলেদের মতো ঢাকাইয়া স্বর বের করেছে। রিকশাওয়ালা হকচকিয়ে থেমে গেল।

মজিদ বলল, আতের মইদ্যে এইটা কী, ক দেহি? এই জিনিসের নাম কি?

চাঁদের আলোয় ক্ষুরের ফলা চকচক করতে লাগল। রিকশাওয়ালা বুড়ো। সে রিকশা থেকে নেমে গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছছে। শুরুতে একবার মাত্র মজিদের দিকে তাকিয়েছিল, এখন আর তাকাচ্ছে না। মনে হয় এ রকম পরিস্থিতিতে এর আগে

সে আর পড়ে নি।

পুরো ব্যাপারটাই এত আকস্মিক যে আলম এবং মাহিন হকচকিয়ে গিয়েছে। আলম ভীত স্বরে ডাকল, এই মজিদ এই। সেই স্বর এতই ক্ষীণ যে মজিদের কানে পৌঁছল না।

মজিদ হুংকার দিল, রিকশার বিতরে কোন্ হালা? মাতা বাইর কর। চাঁন মুখ খান দেহি।

রিকশার আরোহী দুজন। মধ্য বয়স্ক এক জন ভদ্রলোক সঙ্গে তাঁর স্ত্রী। তার বয়স উনিশ-কুড়ির বেশি হবে না। এই মেয়েটি ভয়ে ও আতংকে সাদা হয়ে গেছে। পুরুষটি নামতে চেষ্টা করতেই মেয়েটি সজোরে তার হাত আকড়ে ধরল। পুরুষটি বেশ বলশালী। পরনে স্ট্রাইপ দেয়া হাফ শার্ট। মাথার চুল ছোট-ছোট করে কাটা। সে ভয় পেলেও চেহারায় তা বোঝা যাচ্ছে না। সে মোটামুটি স্বাভাবিক গলায় বলল, ভাই আপনি কী চান?

নামতে কইছি কথা কানে ঢুকে না? না-কি ক্ষুর হালাইয়া দিমু?
 
লোকটি স্ত্রীর সমস্ত বাধা অগ্রাহ্য করে রিকশা থেকে নেমে পড়ল। নিচু গলায় বলল, টাকা বিশেষ কিছু আমাদের সঙ্গে নাই ভাই সাহেব। বলেই সে পকেটের মানিব্যাগ বের করল।

মজিদ খেকিয়ে উঠল, ট্যাকা-পয়সা তোর কাছে চাইছিরে হারামী? তুই মানিব্যাগ বাইর করলি কোন কামে?

ভুল হয়ে গেছে কিছু মনে করবেন না।

আমার ওস্তাদ ঐখানে খাড়াইয়া আছে ওস্তাদরে সালাম দে।

লোকটি আলমের দিকে তাকিয়ে সালামের মতো ভঙ্গি করল। মুখে বিড় বিড় করে কী যেন বলল।

মজিদ বলল, ওস্তাদ পিস্তলডা বাইর করেন। এই হালা ফকিরের পুলা পিস্তল দেখবার চায়।

রিকশায় বসে থাকা মেয়েটি এইবার ফুঁপিয়ে উঠল। রিকশাওয়ালা অসহায় ভাবে একবার মেয়েটির দিকে একবার মজিদের দিকে তাকাচ্ছে। দূরে গাড়ির হেড লাইট দেখা গেল। লোকটি প্রবল আশা নিয়ে হেড লাইটের দিকে তাকাচ্ছে। গাড়ি কিন্তু আমল না। হুস করে বের হয়ে গেল। মজিদ বলল, রিকশার মইদ্যে ঐ মাইয়া কে?

আমার স্ত্রী।

বিহা করা ইসতিরি?

জ্বি।

লাইছেন আছে? বিহার লাইছেন আছে।

ভাই আমার সাথে তিন শ টাকা আছে এইটা নেন আর আমার স্ত্রীর একজোড়া। কানের দুল আছে খুলে দিচ্ছি। এইগুলি নিয়ে আমাদের যেতে দিন ভাই আমার এক আত্মীয়ের অসুখের খবর পেয়ে যাচ্ছি। নয়ত এত রাতে স্ত্রীকে নিয়ে বের হতাম না।

হারামী তুই কচ কী? টাকা-পয়সা তোর কাছে চাইছি? কানের দুল চাইছি? ঐ হারামজাদা আমার একটা ইজ্জত নাই?

ভাই, কী চান বলেন?

তুই কানে ধর। কানে ধইরা মাফ চা।

জ্বি, কী বললেন?

কী কইলাম হুনস নাই—কানে ধর।

লোকটি কানে ধরল। রিকশায় বসে থাকা মেয়েটি ক্রমাগত ফুপাচ্ছে। রিকশাওয়ালা ক্ষীণ স্বরে বলল, শব্দ কইরেন না আম্মা, আল্লাহর নাম নেন।

হারামজাদা কানে ধরছস?

জ্বি।

তুই কী করস?

রেলওয়েতে চাকরি করি।

রেলওয়ের মইদ্যে সব চোরের আড্ডা। তুইও হালা চোর। হুনস কী কইলাম?

জ্বি।

আর চুরি করিস না।

জ্বি আচ্ছা।

যা অখন ভাগ।

লোকটি মজিদের কথা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। এখনো কান ধরে আছে।

কথা কানে ঢুকে না? কী কইলাম তোরে? বউ লইয়া ভাগ। অমন ছুন্দর বৌ লইয়া বাইর হবি না।

জ্বি আচ্ছা।

আমার দুই ওস্তাদরে সেলাম দে। সেলাম দিয়া ভাগ।

লোকটি স্পষ্ট স্বরে দুবার বলল, স্লামালিকুম। তারপর রিকশায় উঠে বসল। রিকশায় উঠার সঙ্গে-সঙ্গে মেয়েটি তার গায়ে এলিয়ে পড়ে গেল। বুড়ো রিকশাওয়ালা ঝড়ের চেয়ে দ্রুত গতিতে রিকশা নিয়ে উড়ে গেল।
 
দীর্ঘ সময় তিন বন্ধু কোনো কথা বলল না। আলম এবং মাহিন দুজনেই খুব ঘামছে। বুক ধড়ফড় করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ।

প্রথম কথা বলল মাহিন। প্রায় ফিস ফিস করে বলল, শালা তুইতো ভেলুকি দেখিয়ে দিলি। এখনো আমার শরীর কাঁপছে।

মজিদ বলল, মজা পেয়েছি কি-না বল?

মজা, এর মধ্যে মজা কী?

তুই বুকে হাত দিয়ে বলতো–তোর মজা লাগে নাই?

মাহিন কিছু বলল না, প্যান্টের জিপার খুলে রাস্তার পাশে দাঁড়াল-প্রস্রাবের প্রচণ্ড বেগ হচ্ছে। তার পাশে আলমও দাঁড়াল।

আলম বলল, গলা শুকিয়ে গেছে। কোথাও গিয়ে চা খাই চল। এইখানে বেশিক্ষণ থাকাও ঠিক না। পুলিশ আসতে পারে।

মজিদ বলল, পুলিশ আসবে কেন?

ওরা গিয়ে নিশ্চয়ই পুলিশে খবর দিয়েছে।

পাগলের মতো কথা বলিসনাত। পুলিশ? দেশে পুলিশ বলে কিছু আছে নাকি?

কাকরাইল মসজিদের কাছে রাস্তার পাশের একটা চায়ের দোকান পাওয়া গেল। দোকানী সব গুটিয়ে চলে যাচ্ছিল, কাস্টমার দেখে বিরক্ত মুখে কাপ ধুতে বসল।

আলম বলল, চা খেয়ে তারপর কী করবি? করিমের ওখানে যাবি নাকি?

মাহিন বলল, না, ঐ শালা আমাকে দেখতে পারে না।

করিম ওদের বন্ধুদের কেউ না। করিমের সঙ্গে তাদের পরিচয় রহমানের মারফত। রহমান ছিল তাদের অতি প্রিয় বন্ধুদের একজন। সে কী করে জানি এক সোনাচোরাচালানীর সঙ্গে ভিড়ে যায়। ব্যাংককে ধরা পড়ে। ঐখানের জেলেই এখন আছে। চার বছরের কয়েদ হয়েছে। রহমানের সঙ্গে তাদের এখন কোনো যোগাযোগ নেই। রহমানের বাসায় গেলে তার বড়বোন বের হয়ে আসে এবং অতি কঠিন গলায় বলে, কী চাও তোমরা?

রহমানের কোনো খবর আছে?

না, কোনো খবর নেই।

এই বলে খট করে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়। যেন তারা একদল ভিখিরি। ভিক্ষা চাইতে এসেছে।

রহমানই তাদের করিমের আড্ডায় বেশ কয়েকবার নিয়ে এসেছে। চমৎকার জায়গা। ব্যবস্থাও চমৎকার। আঠার তলা একটা বিল্ডিং-এর তিন তলায় করিমের থাকার ব্যবস্থা। বিল্ডিং-এর বাইরের স্ট্রাকচার সবে তৈরি হয়েছে। এখন কাজ বন্ধ আছে। করিমের দায়িত্ব হচ্ছে পাহারাদারির। পুরো জায়গাটা করোগেটেড টিন দিয়ে ঘেরা। ঘেরার ভেতর দুটি কংক্রিট মিকচার, রড সিমেন্টের স্থূপ। তিন জন দারোয়ান নিয়ে এইসব পাহারা দেয় করিম। ইসলাম ব্রাদার্স নামের যে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি বাড়িটা তৈরি করছে করিম হচ্ছে তার মালিকের দূর সম্পর্কের বোনের ছেলে। মালিকপক্ষীয় হাঁকডাক তার গলায় থাকলেও দারোয়ান তাকে মোটেই পাত্তা দেয় না।




পৃথিবীতে কিছু মানুষ এমন থাকে যারা কারো কাছেই পাত্তা পায় না। করিম তাদেরই এক জন। অতি অল্পতেই সে অসম্ভব রেগে যেতে পারে আবার সামান্য ধমকে ভয়ে কুঁকড়ে যায়। জগন্নাথ কলেজে নাইট সেকশনে সে পড়ে। বি. এ. সেকেন্ড ইয়ার তবে অনেকদিন কলেজে যাচ্ছে না। কারণ বেশ কিছু রড চুরি হয়েছে। ইসলাম ব্রাদার্সের মালিক নুরুল ইসলাম তাকে বলে দিয়েছেন এক মিনিটের জন্যেও যেন সে জায়গা না ছাড়ে। নুরুল ইসলাম সাহেবের কথা তার কাছে ঈশ্বরের আদেশের মতো। সে গত সাতদিন সত্যি-সত্যি এক মিনিটের জন্যেও বাইরে যায় নি।

তার সময় খুব যে খারাপ কেটেছে তাও না। ইসলাম সাহেবের বড় ছেলে মীরন তার ঘরে একটা ব্লাক লেভেলের বোতলের অর্ধেকের বেশি রেখে গিয়েছিল। ঐ বোতল শেষ করে দিয়েছে। মীরন এসে হয়ত চিৎকার চেঁচামেচি করবে। মীরনের বয়স মাত্ৰ উনিশ। এর মধ্যেই ফুর্তির নানান কায়দা-কানুন তার জানা হয়ে গেছে। গত মাসে পনের-ষোল বছরের একটা মেয়ে নিয়ে এসে উপস্থিত। ঝি শ্রেণীর মেয়ে, নাম কুসুম। কুসুম একটা ওড়নায় সারাক্ষণ মুখ ঢেকে রেখেছিল। মীরন করিমকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল, আপনার ঘরটা ঘন্টা খানেকের জন্যে একটু ছেড়ে দেন না করিম ভাই।

করিম ইতস্তত করে বলল, মামার কানে যদি যায়….

সঙ্গে-সঙ্গে মীরন তীক্ষ্ণ গলায় বলল, কানে গেলে কী হবে? আমাকে গিলে খাবে? যান আপনি গিয়ে বাবাকে বলে আসুন।

আরে না—বলাবলির ব্যাপার না মানে….

আপনি খালি প্যাচাল পারেন করিম ভাই। প্যাচাল আমার আলো লাগে না।

মেয়েটা কে?

মেয়েটা কে তা দিয়ে আপনার দরকার কি? ওর নাম কুসুম। আপনি একটা কাজ করুন তো আমাদের জন্যে কাবাব নিয়ে আসুন। মিরপুর রোডে একটা কাবাবের দোকান আছে। বটি কাবাব আনবেন অন্য কিছু না।

মীরন পাঁচ শ টাকার চকচকে একটা নোট বের করল। এই ছেলেটার হাত দরাজ। বাপের মতো পয়সা কামড়ে থাকে না। কিছু একটা কিনতে দিলে কখনো টাকা ফেরত চায় না।

তবে ছেলেটির মেজাজ বাপের চেয়েও খারাপ। রেগে গেলে কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। নুরুল ইসলাম সাহেবের চেয়ে তার ছেলেকে করিম বেশি ভয় পায়। মীরন যখন দুএকজন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে তার ঘরে আসে সে আতঙ্কে অস্থির হয়ে থাকে। সবচে বড় আতঙ্ক হচ্ছে ছেলের এইসব ব্যাপার ইসলাম সাহেবের কানে গেলে তিনি কী করবেন? তখন তার গতিটা কী হবে?
 
আলমরা যখন করিমের ঘরে ঢুকল তখন করিম কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে। গায়ে প্রবল জ্বর। আলম বলল, আপনার হয়েছে কী?

জ্বর। গায়ে গোটা-গোটা কী যেন উঠেছে। মনে হচ্ছে জল বসন্ত।

এখন জল বসন্ত হয় কী ভাবে? কী যে বলেন।

হয়ে গেলে আমি কী করব। এই দেখেন না। করিম শার্ট উঁচু করে দেখাল। সত্যি সারা গায়ে লাল গুটি গুটি কী যেন উঠেছে।

মাহিন বিরক্ত মুখে বলল, আমরা এসেছিলাম আপনার সঙ্গে তাস-টাস খেলব।

করিম বলল, আপনারা নিজেরা খেলেন, আমি দেখি।

পাগল হয়েছেন, আপনার ঘর থেকে জল বসন্তের জীবাণু নিয়ে যাব?

একট বসেন। চারদিন ধরে শুয়ে আছি কথা বলার লোক নাই। দারোয়ান এসে খাবার দিয়ে যায়। দারোয়ানের সঙ্গে কতক্ষণ কথা বলা যায়? ভাই রিকোয়েস্ট, একটু বসেন।

মজিদ বিকৃত মুখে বলল, ইতু রম লাশা।

করিম দুঃখিত গলায় বলল, অসুস্থ মানুষকে এই সব কী বলছেন ভাই? মরার গালি দেয়া ভালো না।

মজিদ বলল, মরার গালি দিলে কী হয় জানেন না? আয়ু বাড়ে, আপনার আয়ু বাড়াবার জন্যে মরার গালি দিয়েছি। এখন যাই।

যাচ্ছেন কোথায়?

যাব আর কোথায়? চাঁদের আলোয় খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করব।

আপনারা কি সুখেই না আছেন। আমার কোনো খানে যাওয়ার উপায় নেই। শরীর ভালো থাকলেও এইখানে থাকতে হবে। মামার হুকুম।

তাহলে তাই করেন। মামার হুকুম পালন করেন।

করিম বলল, ঘরে একটা জিনের বোতল আছে। মীরন রেখে গেছে। খাবেন? খেলে বের করে দেই। কথা বলার লোক নেই ভাই, বড় কষ্টে আছি।

মজিদ অন্যদের দিকে তাকাল। তার জিনিসটা চেখে দেখতে ইচ্ছা করছে। সে অন্যদের দিকে তাকাল। কাউকেই তেমন উৎসাহী মনে হচ্ছে না। মাহিন বলল, আমি মাফ চাই ভাই। এই জিনিস আমার পেটে যদি যায় আর বাসায় যদি কেউ টের পায় আমার চামড়া খুলে নেবে। সেই চামড়া দিয়ে সবাই এক জোড়া জুতা বানাবে। আমি এর মধ্যে নেই। তোদের ইচ্ছা হলে তোরা খা। আমি বাবা ভদ্রলোকের ছেলে।

মজিদ বলল, এই সবলতা ভদ্রলোকেরই খাবার জিনিস।

ভদ্রলোকে-ভদ্রলোকে বেশ-কম আছে। আমরা হচ্ছি পীর বংশ। তুই আর আলম তোরা দুজন খা যদি ইচ্ছা হয়।

আলম বলল, না আমার ভালো লাগে না। মাথা ধরে।

করিম বলল, এইটায় মাথা ধরে না। ফরেন জিনিস একটু খেয়ে দেখেন।

আলম বলল, আমার অসুবিধা আছে।

করিম বলল, মজিদ ভাই আপনি তাহলে থাকেন। ওরা যাক গিয়ে। দুই জনে সুখ-দুঃখের গল্প করি।

না থাক। অন্য আরেক দিন।

অন্য আরেক দিন এই জিনিস থাকবে না। মীরন সব সময় রেখে যায় না।

রাখবে। না রেখে যাবে কোথায়?

দলটি বের হয়ে গেল। রাস্তায় নেমেই মজিদ বলল, একটা খুন করতে ইচ্ছা করছে। আয় একটা খুন করি।

বাকি দুজন হেসে ফেলল।

মজিদ বলল, কি অদ্ভুত ব্যাপার। অস্ত্ৰ হাতে নিলেই হাত নিশপিশ করে।

আলম বলল, তুই ছাগলের মতো কথা বলিস নাতো। ক্ষুর আবার একটা অস্ত্ৰ নাকি? তুই যদি ক্ষুর দিয়ে কাউকে মারিস লোকে তোকে মার্ডারার বলবে না, বলবে ক্ষৌরকার। এই অপমানের চেয়ে মরে যাওয়া ভালো না?

দলের সবাই আবার এক সঙ্গে হেসে উঠলে আর তখনি মির্জা সাহেবকে তাদের চোখে পড়ল।

মজিদ বলল, পোশাক-আশাক দেখে মনে হচ্ছে ফরেন মাল। একা একা ঘুরছে, ব্যাটার সাহসতো কম না। ব্যাটাকে ভয় দেখালে কেমন হয়।

মাহিন বলল, বাদ দেতো। এক জিনিস বার বার ভালো লাগে না। ভয়তো একবার দেখালি।

আবার দেখাব। অন্যরকম ভয়। শালার কলজে নড়িয়ে দেব। তারপর কাপড়-চোপড় খুলে নেংটা করে ছেড়ে দেব। যা ব্যাটা নেংটা বাবাজি ঘরে যা।

তোর মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে রে মজিদ।

মাথা খারাপ হবে কেন? ফাজিলটার কাণ্ড দেখ না—এই গরমে স্যুট পরে হাঁটছে। শালা স্যুট দেখাবার জায়গা পাও না। আমাদের কাছে মামদোবাজি। শুধু আন্ডারওয়ার পরে যখন বাসায় উঠবি তখন বুঝবি কত ধানে কত চাল।

বাদ দে তো মজিদ।

তুই মজাটা দেখ না। এরকম করছিস কেন? গরমের মধ্যে স্যুট পরার অপরাধে ব্যাটাকে আমি কানে ধরে এক শ বার উঠ-বোস করব। আমার সাথে ফাজলামী।

আলম বলল, স্যুটের উপর তোর এত রাগ কেন?

মজিদ সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, শুধু স্যুট না সব কিছুর উপর আমার রাগ। কেউ একটা ভালো শার্ট গায়ে দিলে আমার রাগে গা জুলে যায়। কোনো বাড়ি থেকে রান্নার সুন্দর গন্ধ এলেও আমার রাগ লাগে। একটা সুন্দর গাড়ি যখন রাস্তা দিয়ে যায় তখনো রাগে শরীর কাঁপতে থাকে।

তুইতো শালা কম্যুনিস্ট হয়ে যাচ্ছি।

মজিদ বলল, গরীব দেখলেও আমার রাগ লাগে। ঐদিন কী হয়েছে শোন। এক ফকিরনী আমাকে বলল, বাজান দুই দিন না খাওয়া। রাগে আমার মুখ তেতো হয়ে গেল। বললাম, ভাগগা। তুমি দুই দিন না খাওয়াতো আমার কী?

বলতে বলতে মজিদ মির্জা সাহেবের দিকে এগিয়ে গেল। বাকি দুজন বাধা দেবার সময় পেল না। অবশ্যি বাধা দেবার তেমন ইচ্ছাও তাদের ছিল না চাঁদের আলোয় সামান্য মজা করলে অসুবিধা কী? তাছাড়া এই গরমে ঐ ব্যাটা স্যুট পরবেই বা কেন?
 
০৫.
মির্জা সাহেব ঘড়ি দেখলেন।

দুটা চল্লিশ। তিনি খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। দুটা চল্লিশ হবে কেন? ঘড়ির সময় কি বদলানো হয় নি? এ রকমতো কখনো হয় না। তিনি ঘড়ির ব্যাপারে খুব সজাগ। আজ নিশ্চয়ই পলিনের কারণে সব এলোমললা হয়ে গেছে। তাঁর সমস্ত ইন্দ্ৰিয় জুড়ে আছে মেয়েটি।

মির্জা সাহেব চারদিকে তাকালেন, কাউকে পেলে সময় জিজ্ঞেস করা যেত। রাত বেশি হলে হোটেলে ফিরে যাবেন। মেয়েটা একা আছে, ফিরে যাওয়াই উচিত অথচ ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না। এমন অদ্ভুত চাঁদের আলো তিনি অনেকদিন দেখেন নি। কেমন যেন নেশার মতো লাগছে। অস্থির লাগছে আবার এক ধরনের প্রশান্তিও বোধ করছেন।

কে একজন এগিয়ে আসছে। মির্জা সাহেব বললেন, কটা বাজে বলতে পারবেন?

লোকটি অপ্ৰস্তুত গলায় বলল, সাথে ঘড়ি নাই। আন্দাজ এগারটা।

আপনাকে ধন্যবাদ।

লোকটি অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। মির্জা সাহেবের মনে পড়ল, কথায়-কথায় ধন্যবাদ দেয়ার রেওয়াজ বাংলাদেশে নেই। এটি পশ্চিমী ব্যাপার। বাংলাদেশে কেউ কোনো ধন্যবাদের কাজ করলে তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে আসা হয়। এই হাসিতেই ধন্যবাদ লুকানো থাকে।

মির্জা সাহেব অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। অন্যমনস্ক না হলে লক্ষ করতেন তিনটি যুবক তার দিকে এগিয়ে আসছে। তিন জনের হাতেই জ্বলন্ত সিগারেট, তিন জনই কী নিয়ে যেন হাসাহাসি করছিল। হঠাৎ এক সঙ্গে তাদের হাসি থেমে গেল। হাসি এবং কান্না এমন জিনিস যে হঠাৎ করে থেমে গেলে অন্যমনস্ক মানুষের কানেও একটা ধাক্কা লাগে, ইন্দ্ৰিয় সজাগ হয়ে ওঠে। মির্জা সাহেব সচকিত হলেন। লক্ষ করলেন, তিন যুবকের মধ্যে এক জন বেশ খাটো। সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে এবং তার এক পায়ে স্যাভেল অন্য পায়ে কিছু নেই।

ছেলেটি তার হাতের সিগারেট অনেক দূরে ছুঁড়ে ফেলল। সঙ্গে-সঙ্গে অন্য দুই জনও একই ভঙ্গিতে সিগারেট খুঁড়ে ফেলল। দৃশ্যটি অস্বাভাবিক। সিগারেটের জ্বলন্ত অংশ আমরা আশে পাশেই ফেলি, এত দূরে ফেলি না। এক জন যে জায়গায় যে ভাবে সিগারেট ফেলবে অন্য দুই জনও ঠিক তাই করবে এটাই বা কেমন? এই তিন জনের মনে কিছু একটা আছে। সেই কিছুটা কী?

বেঁটে যুবকটি তার দিকে এগিয়ে আসছে। অন্যেরা দাঁড়িয়ে পড়েছে। বেঁটে যুবকটির হাতে লম্বা কোনো একটা জিনিস যা সে গোপন করতে চেষ্টা করছে। আশে পাশে কোনো স্ট্রিট ল্যাম্প নেই বলেই যুবকটির মুখের ভাব ধরা যাচ্ছে না। চাঁদের আলো যত তীব্রই হোক মানুষের মুখের ভাব তাতে ধরা পড়ে না। বেঁটে যুবকটি মেয়েদের মতো রিনরিনে গলায় বলল, আছেন কেন?

মির্জা সাহেব বিস্মিত গলায় বললেন, আমাকে জিজ্ঞেস করছ?

জ্বি না। আফনেরে না। আফনের কান্ধে যে দুই ফিরিস্তা আছে তাহারে জিগাই।

আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

সব কিছু কি বোঝা যায় চাচামিয়া? কিছু বোঝা যায়, কিছু যায় না। এই হইল জগতের নিয়ম।

মির্জা সাহেবের বিস্ময় আরো বাড়ল তবে তিনি তা প্রকাশ করলেন না। এই যুবকরা আসলে কী চায় তা তিনি বুঝতে চেষ্টা করছেন। বেঁটে যুবকটি তার সঙ্গে রসিকতা করার চেষ্টা করছে। নেশা করে আসে নি তো? এলকোহলের তিনি কোনো গন্ধ পাচ্ছেন না। এলকোহল ছাড়াও আরো সব নেশার জিনিস আছে। তেমন কিছু না তো? এমিটোফিন জাতীয় কোনো ড্রাগ। ঢাকা শহরে এসব কি চলে এসেছে?

তিনি সহজ স্বরে বললেন, কী ব্যাপার বলতো?

বেঁটে যুবকটি বলল, য়ভ য়পা না খিদে লাহা।

তিনি ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন। এই যুবকটি কি কোন সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করছে?

বাকি দুজন যুবকও এবার এগিয়ে আসছে। মির্জা সাহেব বললেন, তোমরা কারা?

স্বাস্থ্যবান যুবকটি বলল, তুমি তুমি করছেন কেন? আপনার কি ধারণা আমরা কচি খোকা।

অবশ্যই তোমরা কচি খোকা নও। আমার বয়স অনেক বেশি সেই কারণেই তুমি বলছি।

আপনি কথা বেশি বলেন। নো টক।

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

বেঁটে যুবকটি বলল, পেটের ভিতর যখন ক্ষুর হান্দাইব তখন বুঝবি বিষয় কি? হালা তুমি তুমি করে। হালার কত বড় সাহস।
 
লম্বামতো জিনিসটা যে একটা ক্ষুর তিনি তা আন্দাজে বুঝে নিলেন। সামান্য একটা ক্ষুর হাতে এই তিন যুবক তাঁকে ঘিরে ধরে আছে। এরা মাগার। পথচারীর টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়। অস্ত্রপাতির বল তেমন নেই। ক্ষুরের মতো সামান্য জিনিস নিয়ে পথে নেমেছে।

এটা কি ঢাকা শহরের স্বাভাবিক কোনো দৃশ্য? তাঁর কাছে রাতের নিউইয়র্ক বলে মনে হচ্ছে। তিনি নিউইয়র্কে দুবার মাগারদের হাতে পড়েছেন। দুবারই ওদের হাতে ছিল আট ইঞ্চি হোরা। প্রথমবার দুজন কালো ছেলে এসে পথ আটকে দাঁড়াল। এক জন নেশার কারণে দাঁড়াতে পারছিল না। ঢলে পড়ে যাচ্ছিল। দ্বিতীয় জন নেশা করে নি। সে শীতল গলায় বলল, একটা ডলার দিতে পার। খুবই প্রয়োজন।

তিনি ওয়ালেট বের করলেন এবং নিশ্চিন্ত হলেন ছেলেটি ওয়ালেট ছিনিয়ে নিয়ে দৌড়ে পালাবে। তা সে করল না। শান্ত ভঙ্গিতে ডলারের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। মির্জা সাহেব ডলার বের করে দিলেন। ছেলেটি বলল, ধন্যবাদ। আমার এই বন্ধুকে কি তুমি এক শ ডলার দিতে পার? ওর এক শ ডলারের খব প্রয়োজন।

তিনি বললেন, এক শ ডলার আমার সঙ্গে নেই। সে এই ওয়ালেটটি নিতে পারে।

ধন্যবাদ। ঘড়িটা খুলে দাও।

তিনি ঘড়ি খুলে দিলেন। তখনি ছেলেছি প্রচণ্ড একটা ঘুষি তার পেটে বসিয়ে দিল। তিনি ছিটকে রাস্তায় পড়ে গেলেন। ছেলেটি ফিরেও কাল না। যেন কিছুই হয় নি এমন ভঙ্গিতে শিস দিতে দিতে এগিয়ে গেল। একবার পিছনে ফিরে তাকাল না। ভয়ংকর যে খুনী সেও অন্তত একবার তার খুনক মৃত দেহটির দিকে তাকায়।

এরাও কি সেই কালো ছেলেটির মতো? মনে হচ্ছে না। এদের চেহারা ভদ্র। অবশ্যি ঐ কালো ছেলেটির চেহারাও ভদ্র ছিল। কি সুন্দর করে কথা বলছিল।

মির্জা সাহেবকে চমকে দিয়ে বেঁটে ছেলেটি বলল, কিরে হালা কতা কচ না ক্যান?

বেঁটে জন বা হাতটায় একটা ঝাঁকি দিতেই খচ করে শব্দ হল। ক্ষুরের ফলা খুলে গেল। মির্জা সাহেব এই প্রথম বুঝলেন ক্ষুর একটা ভয়াবহ অস্ত্ৰ।

তোর পকেটে কী আছে?

ট্রাভেলার্স চেক। তোমরা এই চেক ভাঙাতে পারবে না।

মির্জা সাহেবের পেছনে দাঁড়ানো ছেলেছি বলল, চাচামিয়া তাইলে ফরেন মাল। আবুধাবি? না কি কুয়েত?

বেঁটে ছেলেটি খিকখিক শব্দ করছে। হায়োর হাসির সাথে এই শব্দের একটা মিল আছে। মির্জা সাহেব শান্ত স্বরে বললেন, তোমরা আমার ঘড়িটা নিতে পার। দামি ঘড়ি বিক্রি করলে কিছু পাবে।

তাঁর নিজের শান্ত গলার স্বরে তিনি নিজেই চমকে গেলেন। তিনি যেন বেশ মজা পাচ্ছেন কথা বলতে চাঁদের আলোয় এই তিন যুবককে কেন জানি মোটেই ভয়াবহ মনে হচ্ছে না। একটা খালি রিকশাকে এই সময় আসতে দেখা গেল। বুড়ো রিকশাওয়ালা, তাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ রিকশার গতি দুত করে দিল। এ রকম দৃশ্য সে মনে হয় আরো দেখেছে। এবং সে জানে এই সব ঘটনাকে পাশে রেখে দুত এগিয়ে যাওয়াই নিয়ম। পেছনের ছেলেটি মির্জা সাহেবের কাঁধে হাত রাখল। আগের মতো মেয়েলি গলায় বলল, চাচা মিয়া, চলেন এট্টু সামনে। আপনের লগে একখান কতা আচে।

কী কথা?

কথাটা হইল ব্যাঙের মাথা। কী ব্যাঙ? সোনা ব্যাঙ। কী সোনা…..

ছেলেটির কথা শেষ হল না। হাসতে হাসতে তার প্রায় গড়িয়ে পড়ার উপক্রম হল। যেন এ রকম মজার দৃশ্য অনেক দিন সে দেখে নি। মির্জা সাহেব বললেন, চল যাওয়া যাক।

এই কথায় যুবকদের মধ্যে একটু দ্বিধার ভাব দেখা গেল। বেঁটে যুবকটি বলল, তবসিমু লইহ।

আবার সেই সাংকেতিক ভাষা। মির্জা সাহেব আবার বললেন, চল কোথায় যাবে?

স্বাস্থ্যবান যুবকটি ধমকে উঠল, আবার তুমি?

তোমরা বয়সে আমার অনেক ছোট এই জন্যেই তুমি বলছি। অন্য কিছু নয়। তবে তোমাদের যদি অপমান বোধ হয় তাহলে আর বলব না।

বেঁটে যুবকটি চাপা গলায় বলল, নো টক। হাঁট। কুইক মার্চ। লেফট রাইট। লেফট।

যুবকরা দ্রুত পা ফেলছে। তিনিও প্রায় সমান তালে পা ফেলছেন। এই সব ক্ষেত্রে আচার-আচরণ খুব স্বাভাবিক রাখতে হয়। কথাবার্তা বলে টেনশন কমিয়ে দিতে হয়। তাই নিয়ম। এই তিনটি যুবকের মানসিকতা তিনি জানেন না। এরা কী পরিমাণ নিষ্ঠুর হতে পারে তাও জানা নেই। দীর্ঘ দিন পর দেশে ফিরেছেন। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক কিছুই ঘটে গেছে। এখন হয়ত এ রকম দলছুট তরুণেরা চাঁদের আলোয় অকারণেই মানুষের পেটে ক্ষুর বসিয়ে দেয়।

পলিনের জন্যে তিনি তেমন কোনো দুশ্চিন্তা বোধ করছেন না। পলিন কী করবে তিনি জানেন। মার সঙ্গে কথা শেষ করে বাথরুমে ঢুকে খানিকক্ষণ কাঁদবে। তারপর চোখ মুছে ডায়েরি লিখবে। ডায়েরি লিখতে অনেক সময় নেবে যদিও লেখা হবে একটা কি দুটো লাইন। সেই লাইনগুলোও তিনি জানেন মা মণি তুমি এত ভালো। বাবাও এত ভাল। অথচ দুজন একসঙ্গে থাকতে পারলে না কেন? এই লাইন কটি লিখে সে আবার কিছুক্ষণ কাঁদবে। তারপর চোখ মুছে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়বে। এখন সম্ভবত সে ঘুমুচ্ছে।

মির্জা সাহেব বললেন, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

বেঁটে যুবকটি সঙ্গে-সঙ্গে বলল, শ্বশুর বাড়ি। বলেই খিকখিক করে হাসতে লাগল। তার হাতে এখন ক্ষুর নেই। অস্ত্ৰটা সে তার প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top