What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক (1 Viewer)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
325
Messages
5,984
Credits
44,713
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক
[FA]pen[/FA] লেখক: হুমায়ুন আহমেদ



০১.

শামসুল আলম।

সে তিন বছর আগে সোসিওলজিতে এম. এ. পাশ করেছে। তার বয়স পঁচিশ। একহারা গড়ন। লম্বাটে মুখ। চোখ দুটি বড় বড় বলেই সব সময় সে বিস্মিত হয়ে চেয়ে আছে—এরকম মনে হয়। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে ডাকা হত খোকা বাবু বলে। এই নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে, তার চরিত্রে শান্ত ভাবটি প্রবল।

তিন বছর ধরে শামসুল আলম চাকরি খুঁজছে। এই তিন বছরে একবার সে চাকরির নিয়োগপত্র পেল। একটি প্রাইভেট কোম্পানির সেলস রিপ্রেজেনটেটিভ। চাকরির শর্ত হচ্ছে, নিয়োগের আগে দুজন গেজেটেড অফিসারের ক্যারেক্টর সার্টিফিকেট এবং জামানত হিসেবে নগদ কুড়ি হাজার টাকা জমা দিতে হবে। কুড়ি হাজার টাকার ব্যবস্থা না হওয়ায় চাকরি হল না। ভাগ্যিস হয় নি! কারণ কোম্পানিটা ছিল ভূয়া। আলমের পরিচিত এক জন কুড়ি হাজার টাকা জমা দিয়েছিল। তাকে কাগজপত্র দিয়ে চিটাগাং অফিসে যেতে বলা হল। দেখা গেল টিচাগাং-এর ঠিকানায় একটা রেস্টুরেন্ট চলছে। ঐ কোম্পানির নামও কেউ শোনে নি।

আলমের বাবা সাইফুদ্দিন সাহেব ছোটাখাটো মানুষ। তিনি একটি ইনস্যুরেন্স কোম্পানির মাঝারি ধরনের অফিসার। ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে যারা চাকরি করে, তারা সহজে কারো উপর রাগ করে না। সাইফুদ্দিন সাহেবও করতেন নাশান্তশিষ্ট নির্বিরোধী মানুষ ছিলেন তবে ইদানীং তাঁরও ধৈর্য-চ্যুতি হয়েছে। তিনি প্রায়ই বলছেন যে, আলমের মতো বড় গাধা তিনি তাঁর জীবনে দেখেন নি। তিন বছরে যে একটা চাকরি জোগাড় করতে পারে না সে তো গাধারও অধম। অবশ্যি এই কথাগুলো তিনি সরাসরি আলমকে বলেন না, কারণ, তাঁর বড় ছেলেকে তিনি বেশ পছন্দ করেন।

শেষ পর্যন্ত আলম একটা চাকরি পেল। কোনোরকম ইন্টারভ ছাড়াই চাকরি। ফরিদপুর আবু নসর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক। স্কুল কমিটির সেক্রেটারি তাকে জানালেন যে, স্কুলটি অতি মনোরম স্থানে অবস্থিত। স্কুলের আর্থিক অবস্থাও ভালো। প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহেই বেতন হয়। শিক্ষকদের থাকার জায়গা আছে। পল্লী বিদ্যুতায়ন প্রকল্পে অতিসত্বর স্কুলে বিদ্যুৎ চলে আসবে, ইত্যাদি।

আলমের এই চাকরি নেবার কোনো ইচ্ছা নেই। তার মন বলছে, একবার এই চাকরিতে ঢুকলে আর বের হওয়া যাবে না। তবে সাইফুদ্দিন সাহেব তাকে প্রবল চাপের মধ্যে রাখছেন। রোজই বোঝাচ্ছেন—স্কুল মাস্টারি খারাপ কী? এড়ুকেশন লাইন হচ্ছে বেস্ট লাইন, দেশের সেবা হবে। পড়াশোনা নিয়ে থাকবি। স্কুল টিচারদের এখন নানান রকম সুযোগ-সুবিধা। গ্রামের মধ্যে টাকা খরচের জায়গা নেই। বেতন যা পাবি সবটাই জমবে। শহরের পাঁচ হাজার টাকা আর গ্রামের দুহাজার টাকা হচ্ছে ইকুভেলেন্ট। তাছাড়া মাস্টারি করতে করতে বি. সি.এস-এর প্রিপারেশনও নিতে থাক। বইপত্র সঙ্গে নিয়ে যা। নিরিবিলিতে পড়বি। এদিকে খোঁজ খবরতো আমরা করছি। আমেরিকাতে তোর ছোট মামাকে বলা আছে, কোনো ব্যবস্থা করতে পারলে তাকে নিয়ে যাবে।

আমেরিকার ছোট মামা হচ্ছে আলমদের পরিবারের বাতিঘর। কোনো সমস্যা হলেই তাঁর কথা সবার মনে পড়ে। সবার ধারণা, তাঁকে চিঠি লিখলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। চিঠি লেখা হয়—কখনো কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। ছোট মামা নববর্ষ উপলক্ষে চমৎকার সব কার্ড পাঠান। সেই সব কার্ডের কোণায় লেখা থাকে–কার কী লাগবে জানাও। এই পর্যন্তই।
 
সাইফুদ্দিন সাহেব আলমকে সকাল-বিকাল-সন্ধ্যা এই তিন বেলা বোঝাতে চেষ্টা করেন, স্কুল মাস্টারি ব্যাপারটা যে কত ভালো। সকালের যুক্তি বিকাল এবং সন্ধ্যাতেও দেন। আলম মাথা নিচু করে শোনে। কিছু বলে না।

বিসমিল্লাহ বলে জয়েন করে ফেল। একবার মাস্টারি শুরু করলেই যে সারাজীবন করতে হবে এমন কথা নেই। আমিওতো মাস্টারি দিয়ে শুরু করেছিলাম। দুমাস মাস্টারি করেছি। এই দুই মাস ছিল আমার জীবনের বেষ্ট পাৰ্ট। বেতন ছিল ত্রিশ টাকা। তোকে কত দিবে?

একুশ শ।

মেলা টাকা। গ্রামে থাকবিতো, কাজেই দেখবি পুরো টাকাটা সেভ হয়ে গেছে। মন খারাপ করিস না। আল্লাহর নাম নিয়ে চলে যা।

আচ্ছা।

দশটা টাকাও যদি সংসারে আসে তাহলেও সংসারে সুসার হয়। অবস্থাতে নিজের চোখেই দেখছি। দেখছি না?

দেখছি।

সংসারের অবস্থা আলম দেখবে না কেন দেখছে, সে তো অন্ধ না। সংসারের অবস্থা ভয়াবহ। আগে এ রকম ছিল না, দেখতে দেখতে হয়ে গেল। আলমের ছোট ভাই কামরুল বি. এ. পরীক্ষার দুমাস আগে প্রায় ছফুট লম্বা, ভীষণ ফর্সা এক মেয়ে নিয়ে এসে উপস্থিত। মেয়েটিকে সে না-কি কোর্ট ম্যারেজ করেছে। না করলে উপায় ছিল না। মেয়েকে জোর করে তার বাবা-মা বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিল।

সাইফুদ্দিন সাহেব হুংকার দিয়ে উঠলেন, হারামজাদাকে জুতিয়ে বাড়ি থেকে বের কর। হারামজাদার ছায়া যেন আমি না দেখি।

তাঁর সংহার মূর্তি দেখে জড়সড় হয়ে থাকা লম্বা মেয়েটি কেঁদে-কেটে অস্থির। সাইফুদ্দিন সাহেবের হৃদয়ে এই দৃশ্যও কোনো ছায়াপাত করল না। তিনি হুংকার দিয়ে বললেন, লম্বুকে নিয়ে এক্ষুনি বের হ। এক্ষুনি। ইমিডিয়েট।

তারা অবশ্যি কোথাও গেল না। যাবে কোথায়? যাবার জায়গা নেই। কামরুল শুধু পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে লাগল। নতুন মেয়েটি দেখা গেল কাঁদার ব্যাপারে খুব এক্সপার্ট। সারাক্ষণই কাঁদছে। এই ঘটনার তিন মাসের মধ্যে খুলনা থেকে আলমের বড় বোন রীতা এসে উপস্থিত।

তার সঙ্গে চারটা বড় বড় সুটকেস এবং তিন মেয়ে। রীতা এমিতেই বেশ হাসি-খুশি। দেখা গেল তার এবারের হাসি-খুশির মাত্রা অন্যবারের চেয়েও বেশি। সব কিছু নিয়েই হাসছে, মজা করছে। মাকে বলল, তোমার সঙ্গে কয়েক মাস থাকব মা। খুলনার লোনা পানি সহ্য হচ্ছে না।

মা বললেন, বেশত থাকবি। তোর মেয়েদের স্কুলের ক্ষতি হবে না তো?

না। ওদের বাবা এসে ওদের নিয়ে যাবে।

তুই থাকবি?

হুঁ।

তুই একা থাকবি কী ভাবে?

বললামতো মা, খুলনার লোনা পানি সহ্য হচ্ছে না। মাথার চুল পড়ে যাচ্ছে। এক সময় দেখবে মাথায় টাক পড়ে যাবে।

তোর কী হয়েছে সত্যি করে বলতে?

বললামতো কিছু হয় নি। লোনা পানি সহ্য হচ্ছে না।

রীতা কিছু না বললেও জানা গেল ব্যাপার জুটিল। বেশ জটিল। রীতার স্বামী কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজার মুখলেস সাহেব দুমাসের মধ্যে কোনো খোঁজ খবর করলেন না। শুধু মনি অর্ডার করে রীতার মার নামে আড়াই হাজার টাকা পাঠালেন। রীতা কাঁদতে কাঁদতে বলল, এই টাকা যদি তোমরা রাখ তাহলে আমি ট্রাকের সামনে লাফিয়ে পড়ব। আল্লাহর কসম আমি ট্রাকের সামনে ঝাঁপ দেব। টাকা ফেরত গেল। কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজার মুখলেস সাহেব আর কোনোরকম খোঁজ খবর করলেন না। সাইফুদ্দিন সাহেব উকিলের চিঠির মারফত জানতে পারলেন, চারিত্রিক দোষের কারণে মুখলেসুর রহমান তাঁর স্ত্রী মাসুদা রহমান ওরফে রীতাকে ইসলামী বিধি মোতাবেক তালাক দিয়েছেন। তার তিন কন্যা বয়োপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত মাসুদা রহমানের সঙ্গেই থাকবে এবং তাদের খরচপত্র দেয়া হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। সাইফুদ্দিন সাহেব হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেন।

প্রথমবার বি. এ. ফেল করার পর কামরুল দ্বিতীয়বারও ফেল করল। যেদিন রেজাল্ট হল তার পরদিন তার স্ত্রী দুটি জমজ বাচ্চা প্রসব করে মর-মর হয়ে গেল। মেয়ে মানুষের জীবন সহজে বের হয় না বলেই সে কোনক্রমে টিকে গেল। কামরুলের বর্তমানে একমাত্র কাজ হচ্ছে দুই বাচ্চাকে কোলে করে ঘুম পাড়ানো এবং রাতে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করা। ঝগড়ার এক পর্যায়ে বলা, খবরদার আমি কিন্তু খুন। করে ফেলব। সত্যি খুন করে ফেলব। খুন করে ফাঁসি যাব।

তার স্ত্রী এই কথার উত্তরে খুবই ঠাণ্ডা গলায় বলে, দয়া করে তাই কর। খুন করে দেখাও যে একটা কাজ তুমি করতে পার। একেবারে অপদাৰ্থ তুমি না।

কি আমাকে অপদার্থ বললি?

হ্যাঁ বললাম। অপদার্থকে অপদার্থ বললে দোষ হয় না।

ঘরে তখন হুটোপুটির শব্দ শোনা যায়। জমজ বাচ্চা দুটি এক সঙ্গে কাঁদতে থাকে। সাইফুদ্দিন সাহেব চটি ফটফটিয়ে এগিয়ে আসেন। দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলেন, হচ্ছে। কী এসব? এই হারামজাদা জুতিয়ে তোকে ঠাণ্ডা করব। এক্ষুনি তুই তোর লম্বুকে নিয়ে বেরিয়ে যা। এই মুহূর্তে। খোল হারামজাদা, দরজা খোল।

কামরুল দরজা খোলে না। তবে হুটোপুটির শব্দ থেমে যায়। জমজ বাচ্চা দুটি শুধু চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে কাঁদে। সাইফুদ্দিন সাহেব চোখে অন্ধকার দেখেন। আলমও অন্ধকার দেখে। গাঢ় অন্ধকার।
 
আজ আশ্বিন মাস।

বারই আশ্বিন। পূর্ণিমার সন্ধ্যা। শহরে পূর্ণিমার চাঁদ সন্ধ্যা মেলাবার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা যায় না। বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। শহরের মানুষ পূর্ণিমার চাঁদ নিয়ে মাথা ঘামায় না। পূর্ণিমা অমাবস্যা শহুরে ব্যাপার নয়।

আলম আজকের পূর্ণিমার ব্যাপারটা বুঝতেই পারল না। সন্ধ্যা মেলাবার পর সে যথারীতি প্রাইভেট টিউশনিতে বেরিয়ে গেল। তাদের বাসার কাছেই তিথি নামের একটা মেয়েকে সেইংরেজি পড়ায়। মেয়েটি দুবছর ধরে এস. এস. সি. দিচ্ছে। এইবার নিয়ে হবে তৃতীয় দফা। মনে হচ্ছে এবারও কোনো উনিশ-বিশ হবে না। তিথির চেহারাটা মিষ্টি, তার চোখের মণি দুটিতে এক ধরনের স্নিগ্ধতা আছে। সে কথাও বলে গানের মতো সুরে। মাঝেমাঝে মাথা নিচু করে এমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসে যে, আলমের ইচ্ছে করে তার পিঠে হাত রেখে বলতে— এই কী হয়েছে? এত হাসি কিসের?

আলম তিথিকে পড়াতে গেলেই ভাবে—এরকম চমৎকার একটা মেয়ে পড়াশোনায় এত গাধা হল কী করে? দুমাস ইংরেজি টেনস পড়াবার পরেও আমি ভাত খাই—এর ইংরেজি সে লেখে—I am rice eating.

আলম তিথিদের বাড়ির দরজার কলিং বেলে হাত রাখার আগেই তিথি বেরিয়ে এসে বলল, আজতো স্যার পড়ব না।

পড়বে না কেন?

আজ পূর্ণিমা!

পূর্ণিমাতে পড়া যায় না না-কি?

যায়। যাবে না কেন? তবে আমার মামাতো বোনরা সবাই এসেছে। আমরা ঠিক করেছি শাড়ি পড়ে আজ সারা রাত ছাদে বসে গান করব।

তুমি গানও জান?

আমিতো স্যার ছায়ানটে গান শিখি। আমার এবার থার্ড ইয়ার। থার্ড ইয়ারে আমি ফার্স্ট হয়েছি।

পড়াশোনা ছাড়া আর সবই দেখি তুমি ভালো জান।

তিথি মিষ্টি করে হাসল। আলম বলল, আমি কি তাহলে চলে যাব?

স্যার, এক মিনিট দাঁড়ান। আপনার বেতন আরা আমার কাছে দিয়ে গেছেন।

মাসতো এখনো শেষ হয় নি। আব্বা সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন, পনেরদিন পরে ফিরবেন।

টাকা নেবার সময় তিথির আঙুলের ছোঁয়া লেগে গেল। তিথি এমন চমকে উঠল যে আলম অবাক হয়ে তাকাল। তিথি মাথা নিচু করে আছে। তার শরীর কাঁপছে। তিথি ক্ষীণ স্বরে বলল, স্যার একটু চা খেয়ে যান।

না থাক।

চা বানানই আছে। যাব আর নিয়ে আসব। একটু বসুন। আমার মামাতো বোনেরা আপনাকে দেখতে চায়।

আলম বিস্মিত হয়ে বলল, আমাকে দেখতে চায় কেন?

তিথির ঠোঁটে ক্ষীণ একটা হাসির রেখা। কিছু একটা বলতে গিয়েও সে বলল না। আলম বলল, আজ আমার একটু কাজ আছে। আজ যাই। তোমরা যাও ছাদে বসে গান কর।

আমরা স্যার আজ সারারাত গান করব। আমার ফুফাতো বোনরাও আসবে।

ভালো। খুব ভালো।
 
তিথিদের বাড়ি থেকে বের হয়েই আলম টাকা গুনল। তিনশ টাকা করে দেবার কথা। প্রায়ই টাকা কম থাকে। গত মাসে বিশ টাকা কম ছিল। এর আগের মাসে ছিল দশ টাকা কম। দশ বিশ টাকা কম হলে সেটা আর বলা যায় না। মেজাজ শুধু অসম্ভব খারাপ হয়ে যায়। আজ হিসেব ঠিক আছে। দুটা একশ টাকার নোট, দুটা পঞ্চাশ টাকার নোট। আলম একটা পঞ্চাশ টাকার নোট আলাদা করে রাখল। বাকি টাকাটা মাকে দিয়ে দিতে হবে। ঘরে টাকা পয়সার অবস্থা খুবই খারাপ। সকালে পুরানো খবরের কাগজ এবং টিনের কৌটা বিক্রি করে বাজার হয়েছে। তাও চিনি কেনা হয় নি। চিনির অভাবে ভোরবেলা চা হয় নি।

বাড়িতে পা দিতেই আলমের মা বললেন, তোর কাছে টাকা আছে নাকিরে আলম। বৌমার বাচ্চাগুলির দুধ শেষ হয়ে গেছে। বাকির দোকানে পাঠিয়েছিলাম। বাকি দিচ্ছে না। তোর বাবা নিজে গিয়েছিলেন। দোকানদার তাকে কী সব বলেছে, ঘরে এসে উনি কামরুলের সঙ্গে আজে-বাজে সব কথা বললেন। বউটা তখন থেকে কাঁদছে।

কী বলেছেন বাবা?

সব সময় যা বলেন তাই বলেছেন। কামরুলকে বলেছেন—তুই তোর তালগাছ নিয়ে বেরিয়ে যা। নিজের পথ দেখ। বউটা তখন থেকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে। তুই কোনোখান থেকে কিছু টাকা আনতে পারবি?

আলম আড়াই শ টাকা মার হাতে দিয়ে শান্ত গলায় বলল, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি মা। ফিরতে দেরি হবে।

যাবি কোথায়?

এই রাস্তায় ঘুরব। যাব আবার কোথায়?

তুই কি স্কুলের চাকরিটা নিবি?

জানি না। নিতেও পারি।

নিয়ে নে বাবা। না নিলে সৰ্বনাশ হয়ে যাবে—এদিকে রীতার আবার……

তিনি কথা শেষ করলেন না। আলম বলল, বড় আপার আবার কী হয়েছে?

না কিছু না। তুই কি রাতে ভাত খাবি?

হ্যাঁ, খাবার ঢাকা দিয়ে রেখো।

আলম এসে বারান্দায় এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল। লম্বা মেয়েটা বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার গাল ভেজা, ভেজা গালে চাঁদের আলো পড়েছে। সমস্ত মুখ চিকচিক করছে। আলমের ইচ্ছা হল বলে—তুমি বাবার কথায় কিছু মনে করো না। অভাবে অনটনে বাবার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। তুমি তোমার বাচ্চা দুটির কাছে যাও।

কথাগুলো বলা হল না। এই মেয়েটির সঙ্গে আলমের কখনো কথাবার্তা হয় না। কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগে।

আলম রাস্তায় নেমেই পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিল পঞ্চাশ টাকার নোটটা ঠিক আছে কি-না। ঠিক আছে। নোটটা খরচ করা যাবে না। এ মাসের কয়েকটা দিন এবং সামনের মাসের ত্রিশ দিন পড়ে আছে।

আলম আকাশের দিকে তাকাল। তখনি প্রথম বারের মতো চোখে পড়ল আকাশে বিশাল চাঁদ উঠেছে। চট করে যে কথাটা তার মনে হল তা হচ্ছে—তিথিরা কি গান শুরু করেছে?

আলম হাঁটছে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে। সে কোথায় যাবে এখনো ঠিক করে নি। হয়ত কোথাও যাবে না। রাস্তায় রাস্তায় হাঁটবে। একা হাঁটতে ইচ্ছা করছে না। মজিদের কাছে গেলে কেমন হয়? মজিদের কাছে গেলে সময়টা ভালো কাটবে। তবে মজিদ অনেকটা দূরে থাকে। উত্তর শাহজাহানপুরে। এত দূরে সে যাবে? যাওয়া যায়। মজিদের কাছে গেলে ভালো লাগবে। মনটা কেমন হয়ে আছে। মজিদের সঙ্গে গল্প গুজব করলে মনটা ভালো হবে।
 
০২.
দ্বিতীয় যুবকের নাম মজিদ। আবদুল মজিদ। আবদুল মজিদের কাছে এলে তার বন্ধু-বান্ধবদের সময় ভালো কাটে এই তথ্য মজিদের ফুপু এবং ফুপা দুজনের কেউই জানেন না। তারা মজিদকে চেনেন এক জন অপদাৰ্থ, অকৰ্মণ্য স্বল্পবুদ্ধির মানুষ হিসেবে ইতোমধ্যেই চোর হিসেবে যার কিঞ্চিৎ অখ্যাতি রটেছে।

মজিদ ছোটাখাটো এক জন মানুষ। সাধারণত ছোটখাটো মানুষের স্বাস্থ্য ভালো হয়, মজিদের তা না। সে বেশ রোগা। স্কুলে তার নাম ছিল স্কু ড্রাইভার। এই বিচিত্র নামের তেমন কোন ইতিহাস নেই। স্কুলে প্রতিভাবান ছেলে হিসেবে তার খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তা দুই-ই ছিল। তবে তার প্রতিভা পড়াশোনার খাতে বয় নি। তার প্রতিভার সবটাই ছিল অনুকরণে। সে যে কোন মানুষের চরিত্র একটি কথা বা ক্ষুদ্র একটি ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলতে পারত। আর পারত উল্টো কথা বলতে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে উল্টো করে জবাব দিত এবং তা এত দ্রুত বলে দিত যে মনে হত সে এই ভাবেই কথা বলে। যেমন কেউ যদি বলত, কেমন আছিস মজিদ। সে বলত, লোভা, ইতু নমকে। অর্থাৎ ভালল, তুই কেমন?

তার উল্টো কথা বলার খ্যাতি স্কুলের হেড স্যারের কানেও পৌঁছেছিল। তিনি তাকে একদিন ডাকিয়ে নিয়ে অনেকক্ষণ তার উল্টো কথা বলার বিদ্যা পরখ করলেন এবং শেষ মেষ বললেন, তুই একটা অসাধারণ ছেলে। ভালো মতো পড়া লেখা করিস। আর কোনো অসুবিধা হলে আমাকে বলিস।

মজিদ ঘাড় কাত করে চলে এল তবে তার অসুবিধার কথা স্যারদের বা বন্ধু-বান্ধবদের কাউকে বলল না। যে দিন তার বাবা মারা গেল তার পরদিনও সে স্কুলে। এল এবং অন্যান্য দিনের চেয়েও অনেক বেশি হাসি তামাশা করতে লাগল। সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে গানটি সঠিক সুরে উল্টো করে গেয়ে সারা স্কুলে একটা হৈ-চৈ ফেলে দিল।

তার এত প্ৰতিভা তেমন কাজে লাগল না। মেট্রিক পরীক্ষায় পরপর দুবার ফেল করার পর মজিদের ফুপা তাকে তাঁর রেশন সপে ঢুকিয়ে দিলেন। বর্তমানে তার কাজ হচ্ছে চাল, চিনি এবং গম ওজন করা এবং তার ফুপা জমির সাহেবের কাছে গাল খাওয়া। জমির সাহেবের ধারণা মজিদের মতো বড় গাধা বাংলাদেশে আর জন্মে নি। ভবিষ্যতেও যে জন্মাবে সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ।

ইদানীং তাঁর মনে হচ্ছে মজিদ শুধ যে গাধা তাই নয় খানিকটা হাত-টানের অভ্যাসও আছে। মাঝে-মধ্যে রেশন সপে চিনি কম পড়ছে। একবার কম পড়ল পাঁচ সের, আরেকবার তিন সের। তার কিছু দিন পর দেখা গেল আটার একটা বস্তা উধাও।

তিনি মজিদের হাতে একটা কোরাণ শরীফ দিয়ে বললেন, সত্যি কথা বল। হারামজাদা। সত্যি কথা না বললে তাকে খুন করে ফেলব। কস্তা গেল কোথায়?

মজিদ নিরীহ ভঙ্গিতে বলল, আমি জানি না।

হাতে কোরাণ শরীফ আছে, খবরদার মিথ্যা কথা বলবি না।

মিথ্যা কথা শুধু শুধু কেন বলব?

তুই বস্তা বিক্রি করে দিস নাই?

না।

সত্যি কথা বল।

বলেছি তো।

বস্তা কোথায় গেল তুই জানিস না?

জ্বি না।

জমির সাহেব আর রাগ সামলাতে পারলেন না, প্রচণ্ড একটা চড় কষলেন। মজিদ উলটে পড়ে গেল। মজিদের ফুপু বললেন, থাক বাদ দাও।

জমির সাহেব বললেন, বাদ দাও মানে? একটা আটার বস্তায় কত আটা থাকে তুমি জান? এই হারামজাদা আমাকে শেষ করবার জন্যে এসেছে। এই শোন, তুই এক্ষুনি বিদায় হ। এক্ষুনি। তোকে যেন এই বাড়ির ত্রিসীমানায় না দেখি।

মজিদ মেঝে থেকে উঠতে উঠতে বলল, জ্বি আচ্ছা।

জমির সাহেব ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, আবার জ্বি আচ্ছা বলে? এত বড় সাহস আবার বলে জ্বি আচ্ছা।

তিনি আরেকটি চড় কষলেন। এই চড়ের জন্যে মজিদ প্রস্তুত ছিল বলে সে পড়ল না।

বেরিয়ে যা, এক্ষুনি বেরিয়ে যা। বিছানা বালিশ নিয়ে যা। চোরের চোর। আমার দোকান ফাঁক করে দিচ্ছে।
 
মজিদ বিছানা-বালিশ নিয়ে বের হয়ে গেল। রাতটা কাটাল রেশন সপের বারান্দায়। পরদিন যথারীতি কাজ করতে লাগল। রেশন কার্ডে দাগ দিয়ে দিয়ে জিনিস ওজন করা। জমির সাহেব কিছু বললেন না। মজিদকে বিদায় করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। সে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে। তার জন্যে তাকে কোনো বেতন দিতে হয় না। মজিদ কোনো হাত খরচ চায় না। সাপ্তাহিক ছুটি চায় না। মাঝেমাঝে জমির সাহেব যখন নতুন কাপড় কিনে দেন সে এমন ভঙ্গি করে যেন নিজের সৌভাগ্য সে বিশ্বাস করতে পারছে না। নতুন কাপড় পড়ে প্রতিবারই সে ফুপা এবং ফুপুকে কদমবুসি করে।

ছলছল চোখে তাকায় যেন সে আনন্দে কেঁদে ফেলবে। ফুপা ফুপুর প্রতি তার ভক্তি শ্রদ্ধার কোনোরকম ঘাটতি দেখা যায় না। তবে রাতে ঘুমুতে যাবার আগে সে বেশ কয়েকবার বলে, ন রেক বলফে যার মানে খুন করে ফেলব।

আজ আশ্বিনের এই পূর্ণিমার রাতে মজিদের হাতে কোনো কাজ ছিল না। রেশন সপ শুক্ৰ, শনি এই দুই দিন বন্ধ থাকে। আজ হচ্ছে শনিবার।

মজিদ বারান্দায় বসেছিল। আকাশের চাঁদের দিকে তার চোখ ছিল না। সে তাকিয়ে ছিল তার বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে। গতকাল পাল্লার দড়ি ছিঁড়ে দশ কেজি ওজনের বাটখারা তার নখে এসে পড়েছে। নখ একেবারে থ্যাতলে গেছে। গাঁদা ফুলের পাতা চিবিয়ে নখে বেশ কয়েক বার দেয়া হয়েছে। লাভ হয় নি। বাঁ পা আজ খানিকটা ফুলেছে। যন্ত্ৰণাও হচ্ছে প্রচণ্ডা মজিদ দুহাতে বাঁ পা চেপে ধরে মুখ কুঁচকে বুড়ো আঙুলের নখটার দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক এই সময় আলম বাইরের গেট থেকে ডাকল, এই মজিদ।

মজিদ মুখ না তুলেই বলল, রেভি য় (অর্থাৎ ভিতরে আয়)। আলম বলল, কী করছিস? মজিদ বলল, দেখছিস না কী করছি? পা ধরে বসে আছি। একেই বলে কপাল। নিজের পা নিজেকে ধরতে হয়।

আলম বলল, তোর পায়ে কী হয়েছে?

ছুকি না (কিছু না)।

চল বের হই।

বিনা বাক্য ব্যয়ে মজিদ উঠে দাঁড়াল। আলম তার অনেক দিনের বন্ধু। স্কুলে তারা এক সঙ্গে পড়েছে। তারা যখন রাস্তায় নামল ঠিক তখন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি ডি.সি. টেন ঢাকার আকাশে চক্কর দিচ্ছে। নামবার জন্যে ট্রাফিক কনট্রোলের অনুমতি চাচ্ছে।

আশ্চর্যের ব্যাপার আকাশের জোছনা ফিকে হয়ে আসছে। অতি দ্রুত মেঘ জমছে। আশ্বিন মাসে মাঝে-মাঝে এ রকম হয়। অতি দ্রুত ঝড় এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়। এই ঝড়ের সঙ্গে কালবোশেখীর কিছুটা মিল আছে।

দুই বন্ধু রাস্তায় হাঁটছে। মজিদ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, লাশা।

আলম বিরক্ত গলায় বলল, উল্টো করে কথা বলিসনাতো, চড় খাবি।

আচ্ছা আর বলব না। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে—তুই আমাকে কোলে নিয়ে নে। অনেকদিন কারো কোলে উঠি না।

আলম হো হো করে হেসে উঠল।

মজিদও হাসছে।

দুই বন্ধু হাসাহাসি করে খানিকটা এগিয়ে যাক আমরা এই ফাঁকে ডি. সি. টেন বিমানের ভেতর থেকে একটু ঘুরে আসি। বিমানের এক জন যাত্রীর সঙ্গে এই গল্পের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। যাত্রীর নাম মির্জা করিম। এই গল্পে আমরা তাঁকে মির্জা সাহেব বলব।
 
০৩.
মির্জা সাহেব কোমল গলায় ডাকলেন, এই পলিন, এই! পলিনের ঘুম ভাঙ্গল না। ঘুমের মধ্যেই বড় করে নিঃশ্বাস নিল। একটু যেন চমকাল। শীতের রাতে গায়ের উপর থেকে লেপ সরে গেলে যেভাবে শিশুরা চমকে উঠে আবার নিথর হয়ে যায় ঠিক সেরকম।

পলিন মা, আমরা এসে গেছি।

এয়ার হোস্টেস ঢাকা শহরের তাপমাত্রা বলছে, বায়ুর আর্দ্রতা বলছে। টেম্পারেচার টুয়েন্টি সেভেন ডিগ্রি সেলসিয়াস, হিউমিডিটি সিক্সটি ওয়ান পারসেন্ট, ক্লাউডি স্কাই। ব্রিটিশ এয়ার ওয়েজের প্লেন, ইংরেজ এয়ার হোস্টেস অথচ কথা বলছে বাঙালি উচ্চারণে। এই উচ্চারণের আরেকটি নাম আছে, ইন্ডিয়ান একসেন্ট ইংলিশ।

পলিন মা, আমাদের নামতে হবে তো।

পলিন চোখ মেলল। এদিক-ওদিক তাকাল। ঘুমিয়ে পড়ার জন্যে তাকে একটু যেন লজ্জিত মনে হচ্ছে। সে নিচু গলায় বলল, এটাই কি বাংলাদেশ?

হুঁ।

এখন থেকে বাংলায় কথা চলতে হবে?

চলতে হবে না মাচালাতে হবে। কিংবা বলতে হবে। চলতে শব্দটা এখানে হবে না।

পলিন মিষ্টি করে হাসল। মির্জা সাহেব তার সিট-বেল্ট খুলে দিচ্ছেন। তাঁর মোটা-মোটা আঙুল সিট-বেল্ট খুলতে গিয়ে কেমন যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। দেখতে এত ভালো লাগছে।

তোমার শরীরটা কি এখন ভালো লাগছে মা?

হুঁ।

জ্বর নেই তো?

না। কটা বাজে?

বুঝতে পারছি না। সন্ধ্যা সাতটা সাড়ে সাতটা হবে।

তিনি পলিনের কপালে হাত রাখলেন, গা ঠাণ্ডা। নাকের কাছটা ঘামছে–জ্বর নেমে গেছে। প্লেনের দরজা খোলা হয়েছে। দরজার পাশে প্রচণ্ড ভিড়, যেন সবাই ঠিক। করেছে এক সঙ্গে নামবে। পলিন বলল, আমরা সবার শেষে পড়লাম বাবা।

তাইতো দেখছি।

শেষে নামাই ভালো।

কেন ভালো?

এমনি বললাম। মনে হল তাই বললাম।

পলিন ইংরেজিতে কথা বলছে। বাংলায় ভুল ধরিয়ে দেয়ায় এটা হয়েছে। লজ্জা পেয়েছে। দীর্ঘ সময় এখন সে ইংরেজিতে কথা বলবে। তারপর হঠাৎ এক সময় বাংলায় কথা শুরু করবে। ছোট ছোট বাক্য। ক্রিয়াপদগুলো মাঝেমাঝে এলোমেলো হয়ে যাবে। বিশেষণপদগুলো ঠিক মতো বসবে না অথচ শুনতে অপূর্ব লাগবে। বাংলা ভাষাটাই হয়ত এরকম যে এলোমেলো করে বললে ভালো লাগে। গতবছর মিনেসোটা থেকে বাল্টিমোর যাবার পথে গাড়ির চাকা পাংচার হল। তিনি জ্যাক লাগিয়ে গাড়ি উঁচু করছেন। পলিন বসে আছে তার পাশে। অন্ধকারে কাজ করতে হচ্ছে। ইমার্জেন্সি লাইট কাজ করছে না। পলিন হঠাৎ বলল, আজ বিশেষ অন্ধকার—তাই না বাবা?

মির্জা সাহেব বললেন, বিশেষ অন্ধকার কথাটা ঠিক হবে না মা। খুব অন্ধকার বা গাঢ় অন্ধকার বলতে পার।

পলিন লজ্জা পাওয়া গলায় বলল, তাহলে বিশেষটা কখন বলব?

মির্জা সাহেব তার উত্তর দিতে পারেন নি। গাড়ি চালু হবার পর তিনি সারাপথ ভাবলেন, কিন্তু বিশেষ শব্দটি দিয়ে একটি বাক্যও মনে পড়ল না। দীর্ঘদিন বাংলা ভাষার সঙ্গে যোগাযোগ নেই। কে জানে এক সময় হয়ত তাঁর নিজের বাংলাও এলোমললা হয়ে যাবে।

প্লেন ফাঁকা হয়ে গেছে। হুইল চেয়ারে করে মাননা হচ্ছে। এই অথর্ব ব্রিটিশ বৃদ্ধা হুইলচেয়ারে করে বাংলাদেশে এসেছেন কেন কে জানে?

মির্জা সাহেব মেয়ের হাত ধরে এগুচ্ছেন। দরজা পর্যন্ত যাবার পর মনে মনে বললেন, আমার মনটা আজ বিশেষ ভালল নেই। এই এক যন্ত্রণা হয়েছে, কারণে-অকারণে বিশেষ শব্দটি ব্যবহার করে বাক্য রচনা করেন অথচ প্রয়োজনের সময় একটি সাধারণ বাক্য মনে আসে নি। মিনেসোটা থেকে বাল্টিমোরের দীর্ঘপথ তাঁকে বিষণ্ণ থাকতে হয়েছে।
 
আকাশ মেঘলা। মাঝে-মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বাংলাদেশের আকাশ কি এই সময় মেঘলা থাকে? আজ অক্টোবর মাসের সতের তারিখ। বাংলা মাসটা কী কে জানে। ইংরেজি মাস দিয়ে কিছু বোঝা যায় না। বাংলা মাস মানেই ছবির মতো দৃশ্য। শ্রাবণ-টিপ-টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। কুচুগাছের রঙ কোমল সবুজ। এখানে-ওখানে পানি জমে আছে। আকাশ ধূসরবর্ণ। চৈত্র মাস–ঝাঁ-ঝাঁ করছে রোদ, আকাশ ঘন নীল, চোখের দৃষ্টি পিছলে যাবার মতো স্বচ্ছ, আকাশে চিল উড়ছে।

শরীরটা কি এখন ভালো লাগছে মা?

হ্যাঁ ভালো। ঐ বুড়ো মহিলা বাংলাদেশে কেন এসেছেন বাবা?

জানি না তো। হয়ত ট্যুরিস্ট। শেষ বয়সে পৃথিবী দেখতে বের হয়েছে। পয়সাওয়ালারা তাই করে।

আমার কাছে কিন্তু তা মনে হচ্ছে না। ট্যুরিস্টরা নতুন দেশে এলে খুব আগ্রহ নিয়ে চারদিকে তাকায়—বুড়ি কেমন ঝিম ধরে আছে।

হয়ত শরীরটা ভালো লাগছে না।

আমি কি উনাকে জিজ্ঞেস করব?

সেটা কি মা ঠিক হবে? উনার ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো উনি হয়ত পছন্দ করবেন না।

উল্টোটাও তো হতে পারে। উনি হয়ত খুশিই হবেন। আগ্রহ করে জবাব দেবেন।

বেশ তে যাও– জিজ্ঞেস করে আস।

পলিন গেল না। বাবার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। এয়ারপোর্টের মূল ভবন পঞ্চাশগজের মতো দূরে। হেঁটেই যাওয়া যায় কিন্তু সবাই অপেক্ষা করছে ট্রানজিট বাসের জন্যে। হুইল চেয়ারে বসা বুড়ি পানির একটা বোতল খোলার চেষ্টা করছে। বুড়ির একটা হাত সম্ভবত অচল। সে বোতলটা বাঁ হাতে খোলার চেষ্টা করছে। হুইল চেয়ারের পেছনে এক জন অল্পবয়স্ক এয়ার হোস্টেস। সে দৃশ্যটি দেখছে কিন্তু সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে আসছে না।

বাবা!

কি মা?

উনি পানির বোতলটা খুলতে পারছেন না।

তাইতো দেখছি।

সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। কেউ সাহায্য করবার জন্যে এগিয়ে আসছে না।

সাধারণত অথর্ব বুড়ো-বুড়িরা খুব খিটখিটে মেজাজের হয়। কেউ সাহায্য করতে গেলে রেগে যায়।

তবু ভদ্রতা করে হলেও কারো উচিত সাহায্য করতে যাওয়া। আমি কি যাব?

তোমার ইচ্ছে করলে নিশ্চয়ই যাবে।

পলিনের যেতে হল না। বুড়ি পানির বোতলের মুখ খুলে ফেলেছে। এক ঢোক পানি খেয়েই আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বোতলের মুখ লাগানোর জন্যে। ট্রানজিট বাস এসে পড়েছে। পলিন এগিয়ে গেল বুড়ির দিকে। ছোট্ট করে বাউ করে বলল, গুড আফটারনুন ম্যাডাম।

বুড়ি ছলছলে ঘোলা চোখে তাকাল—কোনো উত্তর দিল না। পলিন জবাবের জন্যে কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করল। কোনো জবাব নেই। পলিনের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। পলিনের বয়স তের। তের বছরের বালিকারা অল্পতেই আহত হয়।

মির্জা সাহেব ঘটনাটা লক্ষ করলেন কিন্তু তিনি যে লক্ষ করেছেন তা পলিনকে জানতে দিলেন না। রাগে তাঁর শরীর জ্বলছে। তাঁর নিজের দেশে, তাঁর মেয়েকে অপমান করার অধিকার এই বিদেশিনী বৃদ্ধার নেই। কিন্তু এটা কি তাঁর নিজের দেশ? তাঁর পকেটে আমেরিকান নীলরঙ পাসপোর্ট। এই পাসপোর্ট হাতে পাবার আগে কোর্টে দাঁড়িয়ে বলতে হয়েছে—মহান আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান মেনে চলব… মাতৃভূমির মর্যাদা… মেয়েকে তিনি তাঁর দেশ দেখাতে এনেছেন। যে সাতটা দিন তিনি এখানে থাকবেন তিনি চান না, এই সাত দিনে কেউ তাঁর মেয়ের মনে আঘাত করার মতো কিছু করে। কারণ সামান্য মন খারাপ হলে পলিন অনেক দিন পর্যন্ত বিষণ্ণ থাকে।
 
ইমিগ্রেশনে মনে হচ্ছে অনেক সময় লাগবে। প্রচণ্ড ভিড়। তিনি শুনে এসেছিলেন। বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন নাকি খুব ঝামেলা করে। বাস্তবে সেরকম দেখছেন না। ছেলেগুলো ভদ্র ব্যবহার করছে। এক জন এক ডজন পন্ডস্ ক্রিম নিয়ে এসেছে। তাকে ইমিগ্রেশনের বাচ্চামতো ছেলেটি বলল, এই ক্রিম তো দেশেই তৈরি হচ্ছে। এতগুলো আনলেন কেন? আর এটা কি নাইলনের দড়ি? ব্যান্ড আইটেম। এইসব আজে বাজে জিনিস দিয়ে সুটকেস ভর্তি করেছেন। ব্যাপার কী ভাই?

উত্তরে লোকটি বোকার মতো দাঁত বের করে আসছে। ছেলেটি স্যটকেসে চক দিযে সাইন করে বলল, যান। মির্জা সাহেব মুগ্ধ হলেন। কী সব ভয়ঙ্কর গল্পই না প্রচলিত। এরা নাকি জাঙ্গিয়া পরিয়ে উঠবস করায়। কসমেটিকস অর্ধেক রেখে দেয়। নিচু গলায় বলে, কিছু ডলার ছেড়ে দিন।

এইসব গল্প বাঙালিদের কাছ থেকেই শোনা। প্রথম প্রথম আমেরিকায় আসার পর বাঙালিরা নিজের দেশ সম্পর্কে তীব্র ঘৃণা উগরে দেয়। ভয়াবহ একটি ছবি আঁকে। মনে হয় সেটা জঙ্গুলে একটা দেশ। যে দেশের সব মানুষ ঠগ, ফাঁকিবাজ। যে দেশে কিছুই পাওয়া যায় না। ঘুষ খাওয়ার জন্যে সবাই হা করে থাকে। রাত আটটার পর রাস্তায় বের হওয়া যায় না।

গল্পগুলো এমন ভাবে করা হয় যাতে মনে হয় দেশটা বঙ্গোপসাগরে তলিয়ে গেলেই তাঁরা সবচে খুশি হবেন।

এরা কেন এরকম করে? অপরাধ বোধর কারণে? দেশ ছেড়ে চলে এসেছে— সেই গ্লানি জমে আছে মনে। গ্লানি আড়াল করবার জন্যেই নিশ্চয়ই বলা। নিজেকেই সে বোঝায়।

ম্যাডাম, আপনার পাসপোর্ট?

পলিন হেসে ফেলল। আনন্দ ঝলমলে গলায় পরিষ্কার বাংলায় বলল, আমাকে ম্যাডাম বলছেন কেন? আমার বয়স তের। মীর্জা সাহেব লক্ষ করলেন, মেয়ের বিষণ্ণ ভাব কেটে গেছে। কী চমৎকার বয়স। মেঘ ও রৌদ্র অনবরত খেলা করে। এই অন্ধকার এই আলো। পলিনের মনে বিদেশিনীর স্মৃতি এখন আর নিশ্চয়ই নেই। মির্জা সাহেব কাস্টমস-এর এই যুবকটির প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করলেন। একটা কিছু উপহার এই ছেলেটিকে দিতে ইচ্ছা করছে। সেটা সম্ভব নয়।

আপনাদের আমেরিকান পাসপোর্ট?

জ্বি।

অনেকদিন পর দেশে ফিরছেন?

জ্বি।

প্রায় একুশ বছর পর।

ডিক্লেয়ার করার মতো কিছু কি আছে?

জ্বি না।

মির্জা সাহেব তাঁর সুটকেস খুললেন। ছেলেটি সুটকেসের দিকে না তাকিয়েই বলল, একুশ বছরে সব বদলে গেছে। কিছু চিনতে পারবেন না।

মির্জা সাহেব বললেন, আমি নিজে কিছু দেখতে আসি নি মেয়েকে দেশ দেখাতে এনেছি। মেয়ের নাম পলিন। মির্জা সাহেব দুটি ভুল কথা বললেন। তিনি মেয়েকে দেশ দেখাতে আনেন নি। নিজেই দেখতে এসেছেন। মেয়ের নাম পলিন নয়। নাম পোওলেন। তার মায়ের রাখা নাম। তিনি পলিন করে নিয়েছেন। নামটাকে বাঙালি করা হয়েছে। ই-কার যুক্ত শব্দগুলো কেন জানি বাংলা-বাংলা মনে হয়।

টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। টেম্পারেচার বোধহয় হঠাৎ খানিকটা নেমে গেছে। আশে পাশে শিলাবৃষ্টি হলে হঠাৎ করে ঠাণ্ডা পড়ে। পলিন অল্প অল্প কাঁপছে। মির্জা সাহেব ট্যাক্সির কাঁচ উঠিয়ে দিলেন। পলিন বলল, কাঁচ নামানো থাকুক দেখতে দেখতে যাই।

তোমার তো ঠাণ্ডা লাগছে। শীতে কাঁপছ।

তেমন ঠাণ্ডা লাগছে না।

দেশটা কেমন লাগছে মা?

ভালো। তবে তুমি যে বলেছিলে খুব সবুজ। তেমন সবুজ তো না।

বৃষ্টি হচ্ছে তো তাই বুঝতে পারছ না।

মির্জা সাহেব, ট্যাক্সি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলেন, এই রাস্তাটি কি নতুন করা হয়েছে?

ট্যাক্সি ড্রাইভার মাথা না ঘুরিয়ে বলল, না।

পৃথিবীর সব দেশের ড্রাইভাররা কথা বলতে ভালবাসে। একটা প্রশ্ন করলে হড়বড় করে একগাদা কথা বলে। এই ড্ৰাইভার সে রকম নয়। সমস্ত পৃথিবীর উপর সে বিরক্ত বলে মনে হচ্ছে। গাড়ি চালাচ্ছে খুব দ্রুত। বিপজ্জনক কয়েকটা ওভারটেক করল। বৃষ্টি-ভেজা পিচ্ছিল রাস্তায় সে যা করছে তা ঠিক না। কিন্তু লোকটা ওভারটেক করে মজা পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এটিই হয়ত তার জীবনের একমাত্র আনন্দ। পৃথিবীর সবাইকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে একটা প্রতীকী ব্যাপার আছে।

বারা।

কি মা?

ঐ ব্রিটিশ মহিলা, আমার কথার জবাব দিলেন না কেন?

তিনি হয়ত তোমার কথা শুনতে পান নি।

আমারও তাই মনে হয়।

পলিন চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে পড়ে আছে। নতুন দেশ। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখার কথা। পলিন দেখছে না। তার কি ভালো লাগছে না? মির্জা সাহেবের মন খারাপ হয়ে গেল।

ট্যাক্সি একটা বড় ধরনের ঝাঁকুনি খেল। ড্রাইভার বলল, জিয়ার আমলে করা।

মির্জা সাহেবের বিস্ময়ের সীমা রইল না। দীর্ঘ সময় পর ড্রাইভার প্রশ্নের জবাব দিল। এতক্ষণ কি সে এই প্রশ্ন নিয়ে ভাবছিল? মনে করতে পারছিল না—কার আমলে রাস্তা হয়েছে? হয়ত বা।
 
পলিন চুপচাপ আছে। চোখ বন্ধ। ঘুমুচ্ছে হয়ত। জ্বর আসে নি তো? তিনি পলিনের গায়ে হাত দিলেন। গা গরম লাগছে। বেশ গরম।

মেয়েটির এই একটা অদ্ভুত ব্যাপার। ফার্গস ফলস্ এলাকা থেকে বেরুলেই শরীর খারাপ। যতক্ষণ সে ফার্গস ফল্স-এ আছে ততক্ষণ ভালো। স্কুলে যাচ্ছে, খেলছে, পড়াশোনা করছে শহরের গণ্ডি পেরুলেই জ্বর।

মির্জা সাহেব একজন সাইকিয়াট্রিষ্টের সাথে কথা বলেছেন। সাইকিয়াট্রিস্ট একগাদা থিওরি কপচিয়েছেন। সেই সব থিওরির মূল কথা হচ্ছে-পলিন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। নিজের বাড়ির কাছাকাছি যখন থাকে তখন এটা কম থাকে। বাইরে গেলেই বেড়ে যায়। ব্রোকেন ফ্যামিলির ছেলেমেয়েদের মধ্যে এটা খুব দেখা যায়। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, অনেক ব্রোকেন ফ্যামিলির ছেলেমেয়েদের আমি দেখেছি। তাদের কারোর মধ্যে এই ব্যাপার কিন্তু দেখি না।

সবার মানসিক গঠন তো এক রকম নয়। এক জন মানুষ যে অন্য এক জন মানুষের চাইতে কত আলাদা তা আমরা সবচে ভালো জানি।



স্যার আসছি। নামেন।

মির্জা সাহেব ড্রাইভারের এই কথায় খুব অপ্ৰস্তুত বোধ করলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার তিনি নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হোটেলের গাড়ি-বারান্দায় ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খোলা। রাজা-বাদশাদের মতো জমকালো পোশাকপুরা হোটেলের দারোয়ান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তিনি এবং তাঁর কন্যা—দুজনই গভীর ঘুমে।

বৃষ্টি পড়ছে অঝোর ধারায়। বাতাসও দিচ্ছে। এত অল্প সময়ে আবহাওয়ার একি পরিবর্তন! হোটেলের ভেতর ঢুকতেই সব আবার অন্যরকম হয়ে গেল। কে বলবে বাইরে এমন দুর্যোগ?

ফাইভ স্টার হোটেলগুলোর একটা মজা আছে। দেশের সঙ্গে এদের কোনো যোগ থাকে না। সব একরকম। হোটেলগুললই যেন আলাদা একটা জগৎ। বাংলাদেশের একটা হোটেলের ভেতরটায় যে গন্ধ ভেসে বেড়ায় সেই একই গন্ধ পাওয়া যায় লস এঞ্জেলস্-এর হোটলে। রিসিপশনিস্টরা মাছের মতো ভাবলেশহীন চোখে ধাতব গলায়। কথা বলে। সব মানুষের ভেতরই এক জন রোবট থাকে। বড় হোটলগুলো সেই সব রোবটদের বের করে নিয়ে আসে।

স্যার আপনাদের কি রিজার্ভেশন আছে?

হ্যাঁ আছে।

আপনাদের পাসপোর্টগুলো কি দেখতে পারি?

অবশ্যই পারেন। তার আগে দয়া করে এক জন ডাক্তারের ব্যবস্থা করতে পারবেন? আমার মেয়েটি অসুস্থ।

আপনারা ঘরে চলে যান। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার যাবেন। রুম নাম্বার দুশ এগার।

ধন্যবাদ।



হোটেলের রুমে ঢুকে প্রথম যে জিনিসটা দেখতে ইচ্ছা করে সেটা হচ্ছে—বাথরুম। বাথরুম দেখা হবার পর ইচ্ছা করে জানালার পর্দা সরিয়ে শহর দেখতে। মির্জা সাহেব প্রথমটা করলেন না তবে জানালার পর্দা সরিয়ে শহর দেখতে চেষ্টা করলেন। কিছুই দেখতে পেলেন না। গোটা শহর ঘন অন্ধকারে ঢাকা। এই হোটেলের নিশ্চয়ই নিজেদের পাওয়ার জেনারেটার আছে।

বাইরে হাওয়ার মাতামাতির কিছুই এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে না। এয়ার কুলারের শব্দে সব ঢাকা পড়েছে। এয়ার কুলার বন্ধ করে জানালার একটা পাট কি খুলে ফেলা। যায়?

হোটেলের ডাক্তার বিদেশি। চেহারা দেখে মনে হয় হংকং বা থাইল্যান্ডের কেউ হবেন। এরা কি বাংলাদেশি কোনো ডাক্তার খুঁজে পায় নি?

ডাক্তার সাহেব ঔষধপত্র কিছুই দিলেন না। গরম স্যুপ খেয়ে পলিনকে ঘুমিয়ে পড়তে বললেন। ডাক্তারের ধারণা ভ্রমণের ক্লান্তিতে এমন হয়েছে। বিশ্রাম নিলেই সেরে যাবে।

ডাবল রুম।

পাশের খাটে পলিন অঘোরে ঘমচ্ছে। গলা পর্যন্ত চাদর টানা। ধবধবে সাদা রঙের চাদর। সাদা চাদরে ঢাকা একটি বালিকার মুখ দেখতে ভালো লাগে না। সাদা চাদরের সঙ্গে কোথায় যেন মৃত্যুর সম্পর্ক আছে। সাদা কফিনের দীর্ঘ সংস্কার কাটানো মুশকিল। মির্জা সাহেব খুব সাবধানে নীলরঙ একটা উলের চাদর মেয়েটির গায়ে দিয়ে দিলেন। ঘুমের মধ্যেই পলিন একটু যেন চমকাল।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top