What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected গর্ভধারিণী - সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

সঙ্গে সঙ্গে রক্ত উঠে গেল মাথায়। আনন্দ হাত তুলল। সঙ্গে সঙ্গে পালদেমের শরীরটা বরফের ওপর আছড়ে পড়ল। যে-যুবকটি পালদেমের বউকে নিয়ে গিয়েছিল যৌথগৃহে সে বেরিয়ে এসেছিল এই সময়। পালদেমের অভিযোগ তার কানে পৌঁছেছিল। তাই ওর পড়ে যাওয়া দেখেও হাসি সামলাতে পারল না সে। বরফের ওপর পড়ে গিয়ে এখন পালদেম টানটান হয়ে শুয়ে আছে। আনন্দ যুবকটিকে বলল, ওকে টেনে ভেতরে নিয়ে যাও। এখানে পড়ে থাকলে জমে যাবে। যুবকটি চটপটে পায়ে কাছে গিয়ে পালদেমের হাত ধরে শরীরটাকে টেনে নিয়ে গেল। তাপল্যাঙের বেশির ভাগ মানুষ যৌথগৃহে আশ্রয় নিয়েছে। যাদের ঘর মজবুত তারা সেখানেই থেকে গেছে। মৃত্যুর সংখ্যা আপাতত চার। অবশ্য ঝড় থামলে সঠিক বোঝা যাবে। শেষ যাকে আবিষ্কার করল তাকে আশা করেনি কেউ। নিজের ঘরের খুব কাছাকাছি জমে থাকা বরফে মুখগুঁজে শরীরটা পড়েছিল। আবিষ্কৃত হওয়ার পর চেঁচামেচি করে সবাই ধরাধরি করে তাকে তুলে নিয়ে এল। প্রায় লোহার মত শক্ত হয়ে গেছে পালার দেহ। আনন্দ দেখল, মৃত্যুসংবাদ পাওয়ামাত্র তামাম তাপল্যাঙ চোখের জল ফেলছে। কেউ কেউ গলা খুলে কাঁদছে। যৌথগৃহের মাহলারা সুর করে একটানা কাঁদতে আরম্ভ করল। পালা এই গ্রামের প্রধান। অন্যতম বয়স্ক ব্যক্তি। জরা তাকে আক্রমণ করেছিল। কিন্তু দীর্ঘকাল মানুষটাকে সবাই পালার সম্মান দিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে ঝড় শুরু হওয়ার পর যখন তার ঘরে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল তখন পালা আশ্রয়ের খোঁজে বাইরে রেরিয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। তার শরীরের ওপর তুষার জমে ওঠায় চট করে কারও নজরে পড়েনি।

যৌথগৃহের আগুন এখন অত্যন্ত দুর্লভ বস্তু। সবাই তার চৌদিকে ভিড় করছে। কিন্তু আনন্দ ঢোকামাত্র কেউ কেউ তাকে আগুনের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দিল। নিজেকে কোনরকমে সেখানে নিয়ে গিয়ে চোখ বন্ধ করে বুকভরে বাতাস নিতে লাগল সে। মনে হচ্ছিল শরীরে একফোঁটা, শক্তি

অবশিষ্ট নেই। তার নাক দিয়ে অসাড়ে জল পড়ছিল। মুখের খোলা জায়গাগুলোতে কোন সাড়া নেই। এই যৌথগৃহে এখন কান্না এবং শিশুদের চিৎকার সমানে চলছে। এই সময় একটা হাত আনন্দর কাঁধে উঠে এল। আনন্দ তাকাচ্ছিল না। আগুনের গনগনে তাপ শরীরে ছড়িয়ে দিতে উন্মুখ ছিল সে। হাতের মালিকের গলা শুনতে পেল সে, তোমরা যা করলে তার তুলনা নেই। প্রত্যেক বছর শীত শুরু হবার ঝড়ে অন্তত জনা সাতেক বুড়োবুড়ি মরে যায়। তোমরা আমাদের বাঁচালে। ভগবান তোমাদের মঙ্গল করবেন।

এবার আনন্দ চোখ তুলল। ভেনা। পালদেমের ভগ্নীপতি। এই ভেনাই সেদিন অসহযোগিতা করেছিল। তাপল্যাঙের সচ্ছল মানুষের সঙ্গে এক হয়ে আপত্তি তুলেছিল। কিন্তু ভেনা কেন যৌথগৃহে? ধরেই নেওয়া যায় ভেনার ঘরবাড়ি অনেক মজবুত। কিন্তু আনন্দ কোন কথা বলল না। আসলে কিছু বলার মত শক্তি সে খুঁজে পাচ্ছিল না। এত তীব্র ঠাণ্ডা এবং হাওয়ার ধার সে কোনদিন কল্পনাতেও আনেনি। পশ্চিমবাংলার মানুষের কাছে এই প্রকৃতি অচেনা। এবং যা অচেনা তাই অবাস্তব নয়। কলকাতার ঠাণ্ডায় যারা দারুণ শীত বলে অভ্যস্ত তাদের কাছে এই আবহাওয়ায় মৃত্যু স্বচ্ছন্দে উপস্থিত হতে পারে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও আর এক ধরনের সুখ চুইয়ে আসছিল আনন্দর মনে, সে অন্তত গ্রামের লোকগুলোকে আপাতত একটা নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসতে পেরেছে।
 
এখন দুপুর। হাওয়া কমেছে। তুষারমাখা ঠাণ্ডা বাতাস গুনগুনিয়ে ফিরছে। এই চেহারা দেখলে কে বলবে যে গত তিন রাতে কি ঘটেছিল! এখন বরফ পড়ছে না। জয়িতা শেষ পর্যন্ত পালদেমের বাচ্চাটাকে স্বাভাবিক নিঃশ্বাসে ঘুমাতে দেখল। পালদেম আর তার বউ এখনও মড়ার মত পড়ে আছে। এই যৌথগৃহের অনেকেই মদ খেয়েছে। বস্তুত শীতের হাত থেকে বাঁচার সহজতম হাতিয়ার এদের কাছে মদ। যে বাচ্চাগুলো ঘ্যানর ঘ্যানর করছে তাদের যে খিদে লেগেছে তা বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, মায়েরা প্রায় নির্বিকার। বৃদ্ধরা পালার শোকে কেঁদে চলেছে এখনও। এই কান্না চলবে যতক্ষণ পালার শরীর মাটির ওপরে থাকবে। জয়িতা আনন্দকে খুঁজল। আনন্দ বসে আছে যে ভঙ্গিতে তা দেখে আপাতত ওকে না ডাকার সিদ্ধান্ত নিল সে। তারপর তিনজন যুবকসঙ্গীকে নিয়ে বাইরে বের হল। চমৎকার হলদে বোদ নেতিয়ে আছে বরফের ওপরে। আকাশের ফাঁক গলিয়ে সূর্য আপাতত এটুকুই তাপল্যাঙকে দিতে পারছে। এ এক অপরূপ দৃশ্য। সমস্ত পাহাড় আর তার গায়ের বরফগুলো হলুদে মাখামাখি এখন। আর এসব দেখার মুহূর্তে জয়িতার কল্যাণের কথা মনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর একটা মোচড়, টপটপ করে জল ঝরতে লাগল গাল বেয়ে। এই কান্নার একটুও প্রস্তুতি ছিল না। এই সময় হালকা হিম-বাতাস বয়ে যেতেই দুটো গাল জুড়িয়ে গেল। ফেটে যাওয়া চামড়ায় একটা নরম আরাম ছড়িয়ে পড়ল। এবং সেটা টের পেতেই বুক নিংড়ে নিঃশ্বাস বের হল।

বাকি যৌথগৃহগুলোয় মানুষ উপচে পড়ছে। লা-ছিরিঙ একা তাদের দেখাশোনা করছে। জয়িতাকে দেখতে পেয়ে সে লাল দাঁত বের করে হাসল, আরও তিনটে এই রকম বাড়ি তৈরি করলে ভাল হত।

জয়িতা বলল, আমাদের তো ধারণাই ছিল না। তোমার দেখা পেয়ে ভাল হয়েছে। আমরা যেসব চাল ডাল কিনে রেখেছিলাম সেগুলো বের করে রান্নার ব্যবস্থা কর! সন্ধ্যের আগেই প্রত্যেককে খাবার দিয়ে দাও।

লা-ছিরিঙ মাথা নাড়ল, আমি এই কথাই ভাবছিলাম।

হাওয়া বন্ধ হতে অনেকেই বেরিয়েছে যৌথগৃহ ছেড়ে। জয়িতা লক্ষ্য করল যে মানুষই তার সামনে পড়ছে সে-ই খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে মাথা নামিয়ে তাকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছে। যারা ঘর ছেড়ে বের হয়নি এবার তাদের খোঁজ নেওয়া শুরু হল। বৃদ্ধরা বলছে আজ রাত্রে আরও ভারী বরফ পড়বে। অতএব এখন থেকেই সাবধান হওয়া উচিত। কিন্তু যারা ঘরে রয়ে গেছে তারা জানে আপাতত কোন বিপদ নেই। তাদের উনুনে আগুন পড়েছে। স্পষ্টত এখন গ্রামে দুটো শ্রেণীর অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে। এটা হতে দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু জোর করে এক করার চেষ্টা বোকামির নামান্তর হবে। সে প্রত্যেক দরজায় গিয়ে বলে এল যদি কোন অসুবিধে হয় তাহলে বিনা দ্বিধায় যেন সবাই যৌথগৃহে চলে যায়।

এই সময় কানকে দেখতে পেল সে। শিষ্যদের পেছনে নিয়ে তিনি মন্দির থেকে নেমে আসছেন। তাকে দেখে সবাই জড়ো হল। কাহন ঘঘাষণা করলেন পালার অন্ত্যেষ্টিকাজ আগামীকাল হবে। তারপর তিনি তাকালেন জয়িতার দিকে। এক মুহূর্ত যেন চিন্তা করলেন। তার শক্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি চাও? নিজেদের জীবন বিপন্ন করে এই গ্রামের মানুষদের সাহায্য করছ কেন?

জয়িতা বলল, এই গ্রামের মানুষরা আমাদের আশ্রয় দিয়েছে। আশ্রয়দাতারা আমাদের বন্ধু।

খুব ভাল উত্তর। কিন্তু তোমাদের জন্যে পুলিস এসেছিল এই গ্রামে। আমিও জীবনে পুলিশ এই প্রথম দেখলাম। শুনেছি তারা একবার আসলে বার বার আসে। আবার এলে কি হবে? কাহুনের মুখে হাসি।

এবার লা-ছিরিঙ জবাব দিল। তার গলায় যেন আঁঝ মেশানো, এবার এলে আমরা সবাই লড়াই করব। আমাদের এই পাহাড়ে বাইরের পুলিশ কি করতে পারে! এরা না থাকলে আজ আমরা কোথায় যেতাম বলতে পারেন?
 
জয়িতা মাথা নাড়ল। তারপর এগিয়ে গিয়ে বলল, কাহুন, আপনি ঈশ্বরের সেবক। সত্যি কথা বলছি, ঈশ্বরের সঙ্গে আমাদের কোন বিরোধ নেই। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব মানুষের সঙ্গে। এই গ্রামের মানুষরা যদি মানুষের মত বাচার পথ খুঁজে পায় তাহলে আমাদের বন্ধুত্ব মূল্যবান হবে। আপনার ঈশ্বর কি চান না যে এরা মানুষের মত বেঁচে থাকুক!

কাহুন মাথা নাড়লেন। কি যেন বিড়বিড় করে বললেন। বোঝা গেল তিনি জয়িতার কথার অর্থ ধরতে পারছেন না। যাওয়ার আগে বললেন, মৃতদের নিয়ে এস মন্দিরে। ওদের জন্যে প্রার্থনা করতে হবে।

শুধু চাল এবং ডালের ঘাট যে মানুষের কাছে উপাদেয় লাগে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যেত না। জয়িতার গলা দিয়ে বস্তুটাকে নামাতে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু ক্ষুধা এমন জিনিস যে শরীরকে বাধ্য করে একটু রসের লালা নিঃসরণ করাতে, যা খাদ্যদ্রব্যটিকে পেটে পৌঁছে দিতে সাহায্য করে। অথচ চারপাশের মানুষ গোগ্রাসে খেয়ে যাচ্ছে। সেই সম্মিলিত শব্দ শুনতে শুনতে জয়িতার মনে হল এই মানুষগুলো পৃথিবীর অনেক লোভনীয় খাবারের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়ে আছে। যারা বছরে এক আধবার চালের স্বাদ পায় তাদের কাছে এই খাবার অমৃত। আসলে আরও পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাই মানুষের মনে অসন্তোষের বীজ বোনে।

আনন্দ এখন সহজ। কিন্তু সামান্য কাশি হয়েছে ওর এর মধ্যেই। জয়িতা ওকে বলল, তুই আজ এখান থেকে বের হোস না। আমি একবার আস্তানা থেকে তোর বিছানা আর ট্যাবলেট এনে দেব।

ট্যাবলেট কি হবে? আনন্দ হাসল।

বলা যায় না, এ যা ঠাণ্ডা কি থেকে কি হয়ে যায়! জয়িতার আবার কল্যাণের মুখ মনে পড়ল। ওর পাঠানো ওষুধের ঝোলায় ঠাণ্ডা থেকে তৈরি জ্বর এবং কাশির ওষুধ ছিল।

আনন্দ বলল, ঠিক আছে। অনেকক্ষণ সুদীপের খবর পাইনি। ওরা কিছু খেল কিনা তাও জানি না। কাউকে পাঠালে ভাল হয়।

জয়িতা মাথা নাড়ল, দরকার নেই। আস্তানায় যা আছে তাই দিয়ে মেয়েটা খাবার বানিয়ে নিতে পারবে। এখন কি কি কাজ বাকি আছে চিন্তা কর।

আনন্দ চারপাশে তাকিয়ে নিল। তারপর বলল, লোকগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করতে হবে। একটাতে বাচ্চা আর মেয়েরা থাকবে। আর একটায় বুড়োবুড়ি। জোয়ানরা আলাদা। মেয়েদের একটা দল তৈরি করে তাদের ওপর রান্না আর সেবাশুশ্রুষার ভার দে। বুড়োবুড়িদের আপাতত কোন কাজ করতে হবে না। আজ আর সম্ভব হবে না, কাল থেকে ছেলেদের নিয়ে কাজে বের হতে হবে আমাদের।

লা-ছিরিঙ পাশে দাঁড়িয়েছিল। সে বাংলা বোঝে না। জয়িতারা কথা বলছিল বাংলায়। অতএব সে উদ্বিগ্ন মুখে শুনছিল সব। শেষ হতে বলল, তিনটে মুরগি মারা গিয়েছে। একটা ছাগল খুব চোট পেয়েছে। যে মেয়েটা তোমাদের সঙ্গে আছে তার ঘরে ওদের নিয়ে গিয়েছি। মুশকিল হল বরফ পড়ার পর ওদের খবর পাওয়া যাচ্ছে না। কি করা যায় বল তো?

জয়িতা কিছু বলতে যাচ্ছিল, আনন্দ তাকে বাধা দিল, লা-ছিরিঙ, ওই জীবগুলো এই গ্রামের সম্পত্তি। ওদের সংখ্যা বাড়লে এই গ্রামের উপকার হবে। অতএব ওদের বাঁচিয়ে রাখা তোমাদের কর্তব্য। কিভাবে সেটা করবে তা তোমরাই ঠিক করবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা বলব এটা ঠিক নয়।

লা-ছিরিঙ হাসল, আজ আমি ওদের ভাতডাল সেদ্ধ খেতে দিয়েছি।

না, তুমি অন্যায় করেছ। আনন্দ রেগে গেল, তুমি অন্যায় করেছ। মানুষের জন্যে খাবার ব্যবস্থা করা যেখানে কষ্টকর ব্যাপার সেই খাবার ওদের দেওয়া উচিত হয়নি। তুমি এখনই কিছু ছেলেকে পাঠিয়ে দাও জঙ্গলে। ছাগলরা যেমন পাতা খায় তা যেন সন্ধ্যের আগেই ওরা কেটে নিয়ে আসে। আর ঘরে ঘরে খোঁজ নিয়ে দ্যাখো মকাই-এর নষ্ট হয়ে যাওয়া দানা কার কাছে কত আছে। সেগুলো মুরগিদের জন্যে রাখ।

লা-ছিরিঙ মাথা নেড়ে বেরিয়ে যেতে জয়িতা বলল, ওর ওপর ছেড়ে দিয়েও তো নিজে না বলে পারলি না। একটু আগে কানের সঙ্গে কথা হল। আজ লোকটার হাবভাব ঠিক মনে হল না।

চমকে উঠল আনন্দ, কেন? কি বলেছে কাহুন?

প্রশ্ন করছিল। কেন এসব করছি আমরা? পুলিশের দায় কে বইবে, এই সব।

লোকটাকে খাবার দেওয়া হয়েছে?

জানি না।

না দেওয়া হলে তুই নিজে দিয়ে আয়। এখনই ওকে চটানো ঠিক হবে না। এদের জন্ম-মৃত্যু ওই লোকটার সঙ্গে বাঁধা হয়ে আছে। এতবড় একটা দুর্যোগের পর বোধহয় কান্থন আশা করছিল গ্রামবাসীরা ওর কাছে প্রার্থনার জন্যে যাবে। আমার ভুলও হতে পারে, কি জানি। শেষদিকে অন্যমনস্ক দেখাল আনন্দকে।
 
জয়িতা আর সময় নষ্ট করল না। একটা পাত্রে খাবার নিয়ে সে মন্দিরের দিকে রওনা হল। ধাপে ধাপে ওপরে উঠে সে দেখতে পেল শিষ্যরা মন্দিরের চত্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে একই খাবার খাচ্ছে। অর্থাৎ এখানেও খাবার পৌঁছে গেছে। জয়িতা ফিরে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই কাহুন বেরিয়ে এলেন শুন্য পাত্র হাতে। এবং তখনই তিনি জয়িতাকে দেখতে পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে জয়িতার মাথায় মতলবটা খেলে গেল। সে ধীরপায়ে কাহুনের সামনে গিয়ে পাত্রটা এগিয়ে ধরল। এক পাত্র শেষ করার পরও যে কাহুনের তৃপ্তি আসেনি তা বোঝা গেল তিনি যে তৎপরতায় জয়িতার হাত থেকে পাত্রটি নিলেন তা দেখে। খেতে খেতে কাহুন মাথা নাড়লেন, আমাকে একথা বলতেই হবে যে তোমরা গ্রামের মানুষদের উপকার করছ। ভগবান তোমাদের মঙ্গল করুন।

জয়িতা বলল, আজ সবাইকে খাবার দেওয়া হচ্ছে। কাল ঠিক হয়েছে, যারা গ্রামের মানুষের জন্যে পরিশ্রম করবে তাদেরই খাবার দেওয়া হবে।

পরিশ্রম! কানের মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল, কেন, পরিশ্রমের কথা উঠছে কেন?

যারা কাজ করবে না তাদের খাওয়ানো হবে না, তাই।

কাজ বলতে কি বোঝ তোমরা?

যা করলে গ্রামের মানুষের উপকার হবে তাই।

এবার কাহুনের মুখে হাসি ফুটল, তাই বল। আমি যে প্রতিনিয়ত ভগবানের কাছে গ্রামের মানুষের জন্যে প্রার্থনা করে যাচ্ছি সেটাও তো একটা কাজ। গ্রামের উপকারের জন্যেই করা।

জয়িতা বলতে যাচ্ছিল যে-উপকার চোখে দেখা যায় না, অনুভব করা যায় না তাকে স্বীকার করা যাচ্ছে না। কিন্তু আনন্দর পরামর্শ মনে রেখে সে চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। পাত্রটি শেষ করে ফিরিয়ে দিয়ে কান মালা জপতে জপতে ফিরে গেলেন ভেতরে। এঁটো হাত ধোওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না।

আস্তানায় ঢোকার আগেই চমকে উঠল জয়িতা। তীব্র গন্ধটা নাকে লাগছিল। দরজা খুলে ভেতরে পা দিতেই সে হতবাক হয়ে গেল। মেয়েটি হাসছে। মাঝে মাঝে হাততালি দিচ্ছে। সুদীপ উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে, কিন্তু সেই চেষ্টার সময়েই বোঝা যাচ্ছিল ও প্রকৃতিস্থ নয়। সুদীপ এমনিতেই আপাতত সুস্থ নয়। কিন্তু এই ভঙ্গি সেই ছবিটা থেকে ভিন্ন। চিলের মত ছোঁ মেরে মাটিতে পড়ে থাকা গ্লাসটা যে ক্ষিপ্রতায় সে তুলে নিল তা অনেকদিন সুদীপের কাছ থেকে আশা করেনি কেউ। দু ঢোক গলায় নিয়ে মেয়েটার হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল সুদীপ। তারপর চিৎকার করে বলল, আঃ!

জয়িতা যে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তা দুজনের কারোর লক্ষ্যে নেই। দুবার টলে সুদীপ হাঁটু মুড়ে আবার বসে পড়ল মাটিতে। তার মাথা এবার মেয়েটার পাশে এলিয়ে পড়তে সে সযত্নে তাকে তুলে নিল কোলে। তারপর ঝুঁকে পড়ে উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞাসা করল, ভাল লাগছে? তোমার ভাল লাগছে?

খু-উ-ব। খু-উ-ব। চোখ বন্ধ করে শব্দ দুটো বিভিন্ন স্বরে উচ্চারণ করে মাথা নাড়ল সুদীপ। জয়িতা আরও অবাক। এখন সুদীপের কথা বুঝতে একটুও কষ্ট হচ্ছে না। মেয়েটা সুদীপের কপালে হাত বোলাচ্ছে। কিন্তু এই দুর্যোগের মধ্যে ও মদ পেল কোথায়? বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটি জোগাড় করে এনেছে। তীব্র মদ সুদীপের চেতনা মুছে দিয়েছিল। সেই মদই কি আবার চেতনা ফিরিয়ে আনছে? বিষে বিষক্ষয়? এই সময় মেয়েটি ঝুঁকে পড়ল। তারপর ধীরে ধীরে ঠোঁট চেপে ধরল সুদীপের কপালে। হঠাৎ জয়িতা আবিষ্কার করল তার শরীরে রক্ত সচল হয়েছে। আচমকা অস্বস্তি হচ্ছে তার। সুদীপ পড়ে রয়েছে স্থির হয়ে। মেয়েটি মুখ তুলল। আলতো হাত বোলাল সুদীপের গালে। তারপর ধীরে ধীরে ঠোঁট ছোঁয়াল সুদীপের বন্ধ চোখের পাতায়। প্রথমে বাম তারপরে ডান। সুদীপ নড়ছে না। কোন প্রতিক্রিয়া নেই। মুখ তুলে মেয়েটি সুদীপের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর খিলখিলিয়ে হাসল। সেই হাসির ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছিল তারও বেশ নেশা হয়েছে।
 
জয়িতা নড়তে সাহস পাচ্ছিল না। এই দৃশ্যকে অশ্লীল বলা যায় না। অথচ এককালে যা অবশ্যম্ভাবী বলে সে আশঙ্কা করেছিল তা চোখের সামনে দেখে স্থবির হয়ে পড়েছিল। সেইসঙ্গে তার মনে দ্বিতীয় একটা ইচ্ছে জন্ম নিল। সুদীপ সাড়া দিক, মেয়েটি যে কামনার আগুন জ্বালতে চাইছে তাতে উদ্দীপ্ত হোক। এবং তা হলেই ও স্বাভাবিক সুদীপে ফিরে আসবে। মেয়েটির বোধহয় দেখা শেষ হল। তার মাথা আবার ঝুঁকে পড়ল সুদীপের ওপরে। খুব যত্নে সে নিজের ঠোঁট দুটো ছোঁয়াল সুদীপের ঠোঁটে। প্রথমে আলতো। তারপর নিচের ঠোঁট বোলাল। ওর সাপের মত জিভ দেখতে পেল জয়িতা এবং এই প্রক্রিয়ার পর সে প্রচণ্ড শক্তিতে চেপে ধরল ঠোঁট সুদীপের ঠোঁটে। যেন সুদীপের ঠোঁট কামড়ে তুলে নিতে চায় এমন মনে হচ্ছিল তার ভঙ্গিতে।

এবং তখনই ঝটপট করে উঠে বসল সুদীপ। দুহাতে নিজের ঠোঁট ঢাকল। মুখ থেকে উচ্চারিত হল, আঃ! শোনামাত্র মেয়েটি আবার খিলখিলিয়ে হাসল। হেসে মদের গ্লাস তুলে ধরল। সুদীপ সেদিকে একবার তাকাল। তারপর ঢকঢক করে তরল পদার্থটি গলায় চালান করে দিয়ে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করল, হোয়াট ড়ু ইউ ওযান্ট? ঠিক এতটার জন্যে প্রস্তুত ছিল না জয়িতা। সুদীপের চেতনা ফিরছে বোঝা যাচ্ছিল কিন্তু ও যে অত স্পষ্ট ইংরেজী বলতে পারবে এবং সেই একই ভঙ্গিতে তা বিশ্বাসে ছিল না। ওর এত আনন্দ হচ্ছিল যে ছুটে গিয়ে সুদীপকে জড়িয়ে ধরতে পারলে তৃপ্তি পেত। সুদীপ সুস্থ হওয়া মানে জীবনটাকে সচল দেখা।

মেয়েটা সুদীপের ইংরেজী বুঝতে পারল না। কিন্তু ওই প্রশ্ন উচ্চারণ করার ধরন হয়ত অনুমান করতে পারল। সে চোখ বন্ধ করে নিজের মুখটা এগিয়ে নিয়ে গিয়ে দুটো ঠোঁট তুলে ধরল। সুদীপ এক মুহূর্ত তাকিয়ে বলল, গুড। তারপর দায়সারা গোছের একটা চুমু খেয়ে উঠে দাঁড়াল, দ্যাটস এনাফ। কিন্তু দাঁড়ানো মাত্র তার শরীর টলতে লাগল। নিজের মনে সুদীপ বিড়বিড করল, যাঃ শালা! আই অ্যাম ড্রাঙ্ক? শী ওয়ান্টস টু শ্লিপ উইথ মি! শু্যড আই? কৃতজ্ঞতা বলেও তো একটা জিনিস আছে। লুক, আই হ্যাভ নেভার প্টে বিফোর। আমি যে শোব কিন্তু আমার বন্ধুরা কি বলবে? আনন্দ, কল্যাণ—! হঠাৎ হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল সুদীপ। মাটিতে বসে পড়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল। মেয়েটি এমন হতভম্ব হয়ে গেল যে তার মুখ থেকে সমস্ত বাসনার চিত্র উধাও হয়ে গেল। দূর থেকেই সে সুদীপের পায়ের ওপর একটা হাত আলতো করে রাখল। জয়িতার মনে হল ওই হাতের যে স্পর্শ তা যে কোন মায়ের হতে পারত।

বাইরে বেরিয়ে এসে স্বস্তি পেল জয়িতা। যাক, সুদীপ এখন সুস্থ হয়েছে। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে, ওই মেয়েটির সঙ্গে সুদীপ কাল নয় পরশু শারীরিক সম্পর্কে আসবে। এটা ন্যায় না অন্যায় সে জানে না। মেয়েটি যে দিনের পর দিন সুদীপের সেবা করে গেছে তা সবাই দেখতে পেয়েছে। সুদীপও সেটা জানে। নইলে বলত না কৃতজ্ঞতা বলে একটা জিনিস আছে। হঠাৎ মাথার ভেতর সব গোলমাল হয়ে গেল জয়িতার। সটান ফিরে এল আস্তানায়। শব্দ করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে চিৎকার করে উঠল, কি অবলার মত কাঁদছিস! তোর লজ্জা করছে না?

মুখ তুলে তাকাল সুদীপ। তার মুখে হাসি ফুটল। তারপর অদ্ভুত গলায় বলল, এই যে জোয়ান অফ আর্ক এসে গেছে! নাকি লক্ষ্মীবাঈ! আমি কাঁদছি তো কার কি? তুই তো একটা মরুভূমি, এক ফোঁটা জল নেই যে কাঁদবি। তাকাচ্ছিস কি, তুই কাঁদতে পারিস?

জয়িতা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল, আমি মরুভূমি!

নোস? টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল সুদীপ, তাহলে দাঁড়া। দেখি তোকে।

কোনরকমে এগিয়ে এল সুদীপ। তারপর জয়িতার মুখের দিকে ঝুঁকে সোজা হয়ে হাসল। একটা হাত তুলে আঙুল দিয়ে জয়িতার চিবুক থেকে কিছু তুলে নিয়ে চোখের সামনে ধরল, এটা কিরে? ভাত? তুই এখানে এসে জংলী হয়ে গেছিস জয়! খেয়েদেয়ে মুখ ধুতে হয় ভুলে গেছিস! আমাকে তোর খুব ঘেন্না দিতে ইচ্ছে করছে, না?

বাংলাটা ঠিক করে বল। মরুভূমি দেখলি?

মাথা নাড়ল সুদীপ। তারপর বলল, তোর দুটো হাত আমার গালে রাখবি জয়?

নাড়া খেল জয়িতা। তারপর ধীরে ধীরে সে দুটো হাতে সুদীপের মুখ ধরল। পবিত্র আলো ফুটে উঠল সুদীপের মুখে, আঃ! জন্মদিনে এত আরাম কখনও পাইনি রে!
 
৪৭.
শীত এখন তুঙ্গে। পায়ের তলায় বরফের শরীর কাঠ। আস্তানার ছাদে তো বটেই, মাঝে মাঝে সিঁড়ির প্রথম ধাপেও বরফ উঠে আসে। ঝড় বা বৃষ্টির দেখা। নেই অনেকদিন। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া যখন বয়ে যায় তখন বরফের শরীরে আঁচড় পড়ে।

কিন্তু একটা পবিত্র রোদ তাপল্যাঙের ওপর মশারি টাঙিয়ে রাখে। শিশুরা সেই রোদে তুষার-বল নিয়ে খেলা করে, অশক্ত মানুষেরা আর একটা বছরের আশা নিয়ে সেই রোদে শরীর ড়ুবিয়ে বসে থাকে চুপচাপ। এই সব মানুষের অঙ্গে শীতবস্ত্র বলতে যা বোঝায় তার সঙ্গে কোন তুলনাই চলে না য়ুরোপ আমেরিকার নির্বান্ধব কোন গ্রাম্য মানুষেরও। অথচ এরা বেশ আছে, অন্তত শীতের কষ্ট প্রবল একথা কেউ মুখ ফুটে বোঝায় না।

আনন্দ সুদীপ এবং জয়িতা এতদিনে একটা নিয়মের মধ্যে আনতে পেরেছে তাপল্যাঙের মানুষকে। আরাম পেতে গেলে পরিশ্রম করতে হবে। ব্যক্তিগত সুখের জন্যে যে একক পরিশ্রম তা কখনই ফলপ্রসূ হতে পারে না এ সত্য তারা ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করেছে। যৌথগৃহেব সংখ্যা এখন বেড়েছে। মেয়ে শিশু এবং বয়স্ক মানুষেরা অনেক নিরাপদ বোধ করছে এখন। এমন কি সবল পুরুষেরা অনেক বেশি সহজ। শীতের সময় যখন একটা দিন কাটাতেই আর একটা দিনের শীতল নিঃশ্বাস গায়ে কনকনানি তোলে তখন এই যৌথগৃহে পরিবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। বরফ গললে যদি প্রাণ চায় তাহলে যে যার গৃহে ফিরে যাবে। নিজস্ব সংসারের টান যে বড় গভীরে তা বোঝা যায় এখন এই শীতের সময়েও মেয়েপুরুষেরা নিজেদের ঘর রোজ ঠিকঠাক করে আসে। নিজস্ব ঘরের এই বাঁধন ছিন্ন করতে পারলে ব্যক্তিগত স্বার্থের গণ্ডিটাকে দূর করা যেত। কিন্তু আনন্দ প্রথম থেকেই এত বড় আঘাতটা করতে চাইল না। এক শীতে অনেকটাই হল, আর এক শীত এলে এই তলানিটুকু দূর হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু এটা ঠিক, মানুষগুলো এর মধ্যে বুঝতে পেরেছে এভাবে কেউ জন্মাবধি নিশ্চিন্তে থাকেনি। কারও বাচ্চার অসুখ হলে অন্যের মা যে স্নেহের হাত বাড়ায়, সকাল-সন্ধ্যে পেট ভরাবার খাবার আসে যৌথ রান্না হয়ে, প্রবল শীতেও গায়ে উত্তাপ লাগে—এ তো স্বপ্নের মতো ব্যাপার কারও কারও কাছে।

কিন্তু সম্পন্ন নয় মানুষের সঙ্গে অন্তত দশটি পরিবার মেলেনি। তারা তুষারঝড়ের সময় থেকেই আলাদা, মজবুত ঘরের দরজা খুলে যৌথগুহের জোয়ারে গা মেশায়নি। এদের সবাই যে খুব আরামে আছে তা নয়, কিন্তু নিজেদের আলাদা দেখাবার একটা অহঙ্কারে ভুগছে। নিজস্ব মুরগী, ছাগল এবং সঞ্চিত শস্য নিয়ে কোনরকমে থেকে যাওয়া। এদের বিরক্ত করতে চায়নি আনন্দ। কিন্তু গ্রামের মানুষ এর মধ্যেই টের পেয়ে গেছে ওরা আলাদা। বহুযুগ একসঙ্গে থেকেও এতদিন এই বোধের শিকার হয়নি ওরা। এখন অর্থনৈতিক শ্ৰেণীবৈষম্যের ফসল হিসেবে দুটো জাত চিহ্নিত হল। সংঘাত শুরু হয়নি কিন্তু কথাবার্তায় খোঁচা দেবার প্রবণতা এসেছে। যৌথ রান্নাঘরের দায়িত্ব জয়িতার। যুবতী মেয়েদের নিয়ে সকাল থেকে তার কাজ শুরু হয়ে যায়। খচ্চরওয়ালাদের কাছ থেকে কেনা খাদ্যসামগ্রী এখন শেষের দিকে। সুদীপের টাকা যা এখনও রয়ে গেছে তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এই বরফ ডিঙিয়ে খচ্চরওয়ালারা আসবে না। আজ অবধি বরফের সময় কেউ ওয়ালাংচুঙ কিংবা চ্যাঙথাপুতে কখনও যাওয়ার চেষ্টা করেনি। প্রাথমিক ইতস্তত কাটানোর পর যে যার ঘরে জমানো শস্য এনে দিয়েছে যৌথরান্নাগৃহে। যুবতী মেয়েরা এখানে বসে রান্না করে আর গল্প বানায়। জয়িতা লক্ষ্য করছিল অবিবাহিত যুবতী মেয়ের সংখ্যা এখানে খুবই কম। বিবাহিতারা গল্প করে আর হাসে। আর সেই হাসির কারণ জিজ্ঞাসা করলে তাদের হাসি আরও বেড়ে যায়। নিমকিত নামের যুবতীটি বলল, ইনামিত বলছে ওর স্বামীর চেহারাটা ঠিক কিরকম তা এখন ভুলে গেছিল ও। কাল এই ঠাণ্ডার মধ্যে ঝরনার ধারে গিয়ে সেটা আবার জেনে এসেছে। কথাটা শেষ হওয়ামাত্র সম্মিলিত হাসির ঝড় উঠল। ইনামিত নামের মেয়েটি একটুও লজ্জা পেল না। তার সন্তান সবসময় পিঠেই বাঁধা থাকে। জয়িতা তার দিকে অবাক হয়ে তাকাচ্ছে দেখে সে বলল, আমি বাবা মাঝে মাঝে যাই। যদি তোমরা বন্ধ করতে বল তাহলে ভাঙাঘরেই ফিরে যাব।
 
জয়িতা কোন মন্তব্য করল না। কলকাতায় থাকলে হয়তো তার জিভে প্রতিবাদ ফুটত। পুরুষের শরীর ছাড়া নারীর আর কিছুতেই শান্তি পাওয়া সম্ভব নয় এটা ভাবতেই তার মনে ঘৃণা ফণা তুলত। কিন্তু এই না-সুন্দর, না-সচ্ছলা মেয়েটির মুখে যে অহঙ্কারের আরাম সেটাকেই বা এখন অস্বীকার করে কি করে?

নিমকিত বলল, তুমি বিয়ে করবে না? অমন সুন্দর দুটো পুরুষ তোমার সঙ্গে থাকে, ওদের তো মারপিটও লাগে না। ওদের মধ্যে কার সঙ্গে তোমার চলছে? প্রশ্নটা শেষ হওয়ামাত্র আবার হাসির ঝড় উঠল।

সঙ্গে সঙ্গে মুখে রক্তের চলাফেরা টের পেল জয়িতা। সে কোনরকমে বলতে পারল, তোমরা যা ভাবছ তা নয়। আমরা বন্ধু।

নিমকিত বলল, বন্ধু! ছেলেতে মেয়েতে বন্ধুত্ব হয় কখনও শুনিনি বাবা! ওরা তোমার সঙ্গে শুতে চায় না?

জয়িতা রাগ করতে পারল না। এদের প্রশ্নের মধ্যে সাবল্য স্পষ্ট। সে নিজেকে নিচে টেনে আনল যেন, আমরা এই নিয়ে কখনও ভাবিনি।

ইনামিত বলল, এখন তো সব সোজা হয়ে গিয়েছে! তোমাদেব যে বন্ধুর মাথা খারাপ হয়েছিল মদ খেয়ে সে তো একটা জাহান পেয়ে গেছে। তাহলে থাকল শুধু বড়সাথী। ওর মত ভাম মানুষটাকেই তুমি মায়ালু বানিয়ে নাও। মেয়ে হয়ে জন্মেছ আর পুরুষের স্বাদ নেবে না?

জয়িতা আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল, তার জন্যে তো অনেক সময় পড়ে আছে। আগে আমরা সবাই একটু ভালভাবে বাঁচি, তারপর।

ভালভাবে বাঁচা! তা আর এ জীবনে হবে না। তোমরা এসেছিলে বলে এখন দুবেলা খেতে পাচ্ছি।

কেন হবে না? সবাই মিলে কাজ করব, ভালভাবে বেঁচে থাকার জন্যে যা যা প্রয়োজন তা যোগাড় করব। এবার বরফ গললেই এমন সব জিনিস তৈরি করতে হবে যা শহরে নিয়ে গেলে লোকে বেশি দাম দিয়ে কিনতে বাধ্য হবে। সেই টাকা দিয়ে জামাকাপড় খাবার ওষুধ কিনে নিয়ে আসা হবে। আমাদের সবসময় ভাবতে হবে এই গ্রামের সবাই এক পরিবারের।

জয়িতা কথা শেষ করতেই নিমকিত বলল, এসব কথা তো কেউ বলেনি। দেখা যাক, তোমরা রাস্তা দেখাচ্ছ, রাস্তাটা যদি ঠিক হয় তাহলে মন্দ কি!

এই সময় একটা বাচ্চা মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে উত্তেজিত গলায় খবর দিল একটা ইয়াকের বাচ্চা হয়েছে। আর বাচ্চাটা মেয়ে। সঙ্গে সঙ্গে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। সবাই ছুটতে লাগল কাহুনের মন্দিরের দিকে। নিমকিত ধরে নিয়ে এল জয়িতাকে। ভিড় জমে গেছে সেখানে। এরই মধ্যে কাহুনের শিষ্যরা বিশাল বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শুরু করেছে। সদ্যজাত ইয়াক শিশুটি এখনও পা-সোজা করতে পারছে না। তার শরীর পরিষ্কার করছে মা চেটেচেটে। এই ভিড়, যন্ত্রের আওয়াজে বিন্দুমাত্র ভীত নয় সে। বরং এই গ্রামের মানুষের জন্যে একটা শুভকাজ সে করতে পেরেছে বলে হয়তো আন্দাজও করতে পেরেছে। জয়িতার অন্তত ওর ভাবভঙ্গিতে তাই মনে হল। হঠাৎ একটা গলা চিৎকার করে উঠল, এই যে এতদিন পরে একটা মেয়ে ইয়াক জন্মাল, কেন জন্মাল কেউ জানো? জয়িতা ছেলেটাকে চিনতে পারল। তুষারঝড়ের সময় খুব পরিশ্রম করেছিল ছেলেটা। ব্যবহার বেশ ভাল। আনন্দ বলে এই রকম ছেলে কয়েকটা পেলে আর চিন্তা নেই। ওর নাম সাওদের।

সাওদেরের কথার জবাব কেউ দিতে পারল না। সে আবার গলা তুলল, ইয়াকের বংশ তো এই গ্রাম থেকে লোপ পেয়েই যাচ্ছিল। এবার আমাদের নতুন সাথীরা এসেছে বলেই ভগবান মুখ তুলল।

একসঙ্গে সবকটা দৃষ্টি পড়ল জয়িতার ওপরে। সবাই খুশিতে গুঞ্জন শুরু করল। কাহুন বললেন, আমি জানতাম এবার মেয়ে বাচ্চা হবে। ভগবান আমাকে প্রায়ই স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন।

গুঞ্জনটা থামল। বিপরীত দুটো বক্তব্যের কোটে সত্য তা নিয়ে ফাপরে পড়ল যেন সবাই। জয়িতা ধীরে ধীরে নিচে নেমে এল। এ সবই সংস্কার। মেয়ে-ইয়াকের জন্ম হওয়া প্রাকৃতিক ব্যাপার, এ তথ্য এদের বোঝানো মুশকিল। আর তাই কাহুনরা চিরকাল বহালতবিয়তে বেঁচে থাকেন।
 
আনন্দ এখন গ্রামে নেই। ভোরেই ও বেরিয়ে গেছে পালদেম লা-ছিরিদের সঙ্গে নিয়ে। খানিকটা নিচে চমৎকার জ্বালানি কাঠ ছড়ানো আছে। সেগুলো কেটে কেটে আনা দরকার। কাঠের সঞ্চয়ে টান পড়েছে। সুদীপের ওপর দায়িত্ব ছিল মুরগী-ছাগলগুলোর জন্যে বড়সড় একটা খাঁচা তৈরি করার। কয়েকটা ছেলে বরফ সরিয়ে মাটিতে খুঁটি পুঁতছে। তাদের জিজ্ঞাসা করে জয়িতা জানতে পারল সুদীপ একটু আগে একজনকে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গলে ঢুকেছে। বুনো চমরির একটা ঝাক নাকি এসেছে এদিকে। যদি দু-তিনটেকে মারতে পারে তাহলে সারা গ্রামের মানুষের পেটে মাংস পড়বে। ব্যাপারটা জয়িতার কাছে হঠকারিতার সমান মনে হল। চেতনা স্বচ্ছ হওয়ার পর সুদীপ আরও বেপরোয়া হয়ে গিয়েছে। বন্য জন্তুগুলোকে না মেরে বুদ্ধি খাটিয়ে যদি ধরতে চেষ্টা করত তাহলে আখেরে বেশি কাজ দিত। জয়িতা আস্তানায় ফিরে দরজা বন্ধ দেখল। সেই মেয়েটিও নেই—সুদীপের জাহান। আজকাল সব সময় সুদীপের সঙ্গে লেপটে থাকে ও। প্রথম দিকে যৌথরান্নায় হাত লাগাতে গিয়েছিল মেয়েটি। কিন্তু গ্রামের অন্য মেয়েরা তাকে প্রায় স্পষ্টই বলেছে ওখানে অনেক লোক, মেয়েটির সাহায্যের দরকার নেই। এখন বস্তুত গ্রামের অন্য মেয়েদের থেকে তাকে সবসময় আলাদা থাকতে হয়। এবং এজন্যে যেন ওর কোন আক্ষেপও নেই। সুদীপ যে কাজ করছে সেই কাজের সঙ্গী হচ্ছে সে আগবাড়িয়ে। সুদীপ ওকে ঠিক ভালবাসে কিনা বোঝা যায় না। যে গলায় কথা বলে তাতে আর যাই থাক ভালবাসা থাকে না। কিন্তু মেয়েটির ব্যবহারে কোন অস্পষ্টতা নেই। কাল রাত্রে সুদীপ আনন্দকে বলেছিল, আশা করি তোরা আমাকে ভুল বুঝছিস না। এ গ্রামের নিয়ম হল কোন নারীকে কেউ গর্ভবতী করলে স্ত্রীর সম্মান দিতেই হয়। এ জিন্দগীতে শালা আমার বিয়ে করার ধান্দা নেই, অতএব ঠিক আছি। মেয়েটার একটা শেলটার দরকার, দিয়ে যাচ্ছি।

জয়িতা চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। এবং তখনই রামানন্দ রায়ের কথা মনে পড়ল ওর। বাবা কেমন আছে এখন? বাবার কি ওর জন্যে খুব কষ্ট হচ্ছে? নাকি ওরা জেনে গেছে জয়িতা বেঁচে নেই। তাই বা হবে কেন? কল্যাণের মৃতদেহ পাওয়ার পর পুলিশ নিশ্চয়ই খবরের কাগজে কৃতিত্বের কথা বলেছে। কল্যাণের ভাইরা নিশ্চয়ই একটা লোকদেখানো শ্রাদ্ধ করেছে। আর যে পুলিশবাহিনী এখানে এসে শূন্য হাতে ফিরে গেছে তারা তিনজনের অস্তিত্বের কথা জানিয়েছে। আর তাই জেনে রামানন্দ রায়ের কষ্ট কি খুব বেড়ে গেছে। ওর হঠাৎ মনে হল মদ খাওয়া পার্টিতে যাওয়া বা অন্য রমণীতে আসক্তি প্রকাশের নামে যে ফার্টিলাইজারের স্রোতে রামানন্দ রায় গা ভাসিয়েছিলেন সেটার পাশাপাশি আর একটা ভালবাসার কাঙালও বেঁচে ছিল। যেচে পরা মুখোশটা এত সেঁটে বসেছিল যে সেটা টেনে খোলা আর সম্ভব হয়নি। কি জানি হয়তো ভুল, এসব ধারণাই বেঠিক। হয়তো এর মধ্যে চলে যাওয়া সময়টা ভরিয়ে দিয়েছে মনের খাদগুলো। তবু একবার রামানন্দ রায় যখন মধ্যরাতে মাতাল হয়ে একাকী বসে থাকেন তখন সামনে আচমকা গিয়ে দাঁড়িয়ে ওঁর মুখোনা দেখতে বড় ইচ্ছে করে। এসব মাথার মধ্যে পাক খেতেই ওর হাসি পেল। সে একনাগাড়ে রামানন্দ রায়কে ভেবে চলেছে। অথচ সীতা রায়, তার মা? কল্যাণের একটা কথা মনে পড়ল, জানিস, আজকালকার মায়েরা না ঠিক মায়েদের মতন নয়, বলতে পারিস দিদির মত। ব্যবহারে চেহারায়। মা মা অনুভূতিটা যদি না আসে তো আর কি করা যাবে? জয়িতা জিজ্ঞাসা করেছিল, কেন, তোর মা?

আমার মায়ের কেসটা আলাদা। অভাবের সঙ্গে লড়তে লড়তে ভদ্রমহিলাকে প্রায়ই বাড়িতে দলবদল করতে হয়। আর সেই কারণেই সন্তানদের শ্রদ্ধা থেকে বঞ্চিত হন। কল্যাণের এই বক্তব্য কতটা সত্যি ছিল তা সে-ই জানত কিন্তু সীতা রায়কে স্মরণ করে আজ জয়িতার মনে হল এখন পাশে থাকলে সে ওঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি করার চেষ্টা করত। মানুষ বারংবার কেচ্যুত হয়, ঘরবদল করে যে আত্মিক অভাবের তাড়নায় সেটাকে বুঝতে চেষ্টা করত সে। এই কয়মাস, সময়ের হিসেবে কিছুই নয়, কিন্তু জয়িতার মনে হল অনেক দরজা তার কাছে খুলে গেছে।
 
জয়িতা পাশের পাহাড়ে চোখ রাখল। এবং সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল বোলেনদের গ্রামে অনেকদিন যাওয়া হয়নি। আনন্দ অবশ্য এখনই ওখানে কোন উদ্যোগ নিতে রাজী নয়। রোলেনদের অর্থনৈতিক অবস্থা অবশ্যই তাপল্যাঙের মানুষের চেয়ে ভাল। একসঙ্গে দু-জায়গায় পরিশ্রম করা তিনটি মানুষের পক্ষে অসম্ভব। বরং সত্যি যদি তাপল্যাঙের চেহারা ওরা ফেরাতে পারে তাহলে রোলেনদের গ্রামের যারা নিঃস্ব মানুষ তারা নিজে থেকেই আকর্ষণ বোধ করবে। অন্তত একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত না রাখতে পারলে ওদের কাছে এগিয়ে যাওয়া অর্থহীন। জয়িতা ভগবানের পবিত্র জল উদ্ধার করে দিয়েছিল শুধু এই কারণেই সম্পর্কটা এখন সহজ হয়েছে। কিন্তু কাজ শুরু করতে চাইলে সংঘাত হবে না তা কে বলতে পারে।

তবু জয়িতা পা বাড়াল। ওর মনে হল রোলেনদের গ্রামটায় একবার যাওয়া উচিত। এতে আর যাই হোক সম্পর্কটা ঠিক থাকবে। পায়ের তলায় বরফ এখন শক্ত ইট। সাবধানে না হাঁটলে পিছলে পড়তে হবে। এই সময় সে সাওদেরকে দেখতে পেল। দ্রুতগতিতে পাশে এসে সাওদের জিজ্ঞাসা করল, তুমি ওভাবে চলে এলে কেন? আমি কি কিছু খারাপ কথা বলছি?

একটা ইয়াকের বাচ্চা হওয়ার সঙ্গে কোন মানুষের সম্পর্ক থাকতে পারে না।

বাঃ, তাহলে যে কানও বলল, ভগবান ওঁকে স্বপ্ন দিয়েছেন। তার বেলা?

সেই স্বপ্ন তো উনি ছাড়া কেউ দ্যাখেননি!

তার মানে তুমি বলছ কাহুন সত্যি কথা বলেন নি?

হয়তো তিনি যেটা বিশ্বাস করেন সেইটেই বলেছেন।

তুমি কোথায় যাচ্ছ এখন?

রোলেনদের গ্রামের দিকে যাব ভাবছি।

সাওদের এক মুহূর্ত ভাবল, তারপর বলল, আমি তোমার সঙ্গে যাব?

জয়িতা সম্মতি দিল। সঙ্গে কেউ থাকলে বরফের ওপর দিয়ে হাঁটতে সুবিধে হয়। বলা যায় না, যেখানে বরফ জমেনি সেখানে পা ফেলতে দুর্ঘটনা ঘটা বিচিত্র নয়। কিছুক্ষণ হাঁটার পর জয়িতা বলল, তুমি একা ওই গ্রামে কখনও গিয়েছ সাওদের?

লুকিয়ে লুকিয়ে গ্রামের পাশে গিয়েছি, ঢুকিনি। আমাদের মধ্যে মারপিট তো লেগেই ছিল এতদিন। কিন্তু তুমি যেভাবে হাঁটছ তাতে ওখান থেকে আজ রাত্রে ফিরে আসতে পারবে না। জোরে হাঁট, জোরে।

সাওদের গতি বাড়াতে জয়িতা চেঁচিয়ে উঠল, ওরে বাব্বা, অত জোরে আমি পারব না।

কেন? এইভাবে পা ফেল। সাওদের দেখিয়ে দিল শরীর কেমন রাখতে হবে।

জয়িতা অনুকরণ করতে চেষ্টা করল। গতি বাড়ছে কিন্তু অনভ্যাস তার পতন অনিবার্য করে তুলল। সে যখন হুমড়ি খেয়ে বরফের ওপর পড়ছে তখন ক্ষিপ্রহাতে সাওদের তাকে জড়িয়ে ধরল। বুকের ভেতর তখন হাতুড়ি পেটার শব্দ, নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হওয়ার আগেই সাওদেরের শরীরের বিদঘুটে গন্ধ টের পেল। এবং তারপরেই মনে হল যতটা সময় ধরে রাখা উচিত তার থেকে অনেক বেশি সময় এবং শক্তি ব্যয় করছে সাওদের। সেই অবস্থায় মুখ তুলল জয়িতা। সাওদেরের কিশোর মুখে যেন হোলি শুরু হয়ে গিয়েছে। নিঃশ্বাস ভারী। প্রবল অস্বস্তি নিয়ে জয়িতা বলল, ছেড়ে দাও সাওদের।

নাঃ, আর একটু, আর একটু থাকো। সাওদেরের গলার স্বর জড়ানো।

মানে? জয়িতার গলা থেকে শব্দটা ছিটকে এল।

এবার হাত শিথিল হল সাওদেরের, বিহুল দেখাল ওকে। তারপর বলল, তুমি কি নরম!

হতভম্ব হয়ে গেল জয়িতা, আমি নরম। নরম মানে?

সাওদের সরল হাসল, তোমাকে বাইরে থেকে দেখলে খুব শক্ত মনে হত, কিন্তু আজ বুঝলাম তা ঠিক নয়। এখন দূরত্ব এক হাতের। মাথায় ওরা সমান সমান। জয়িতা অবাক। সাওদেরের বয়স বোঝ মুশকিল। দাড়ি এদের সবার বের হয় না। ঠোঁটের ওপর হালকা গোঁফের রেখা। একমাথা চুল আর চমৎকার চামড়ার জন্যে বয়সটা বোঝাও দুস্কর হয়। তাছাড়া সব সময় ওর দিকে তাকালে যে ইংরেজী শব্দটা মনে পড়ে সেটা হল ইনোসেন্ট। যা বয়স্ক মানুষেরা কিছুতেই পেতে পারে না। কিন্তু ওর দিকে তাকাতেই আচমকা কম্পন এল জয়িতার শরীরে। সে নরম! তার শরীরে এখন শীতের ভারী পোশাক। যে কথা কখনও আনন্দ বা সুদীপের মাথায় আসেনি সেই কথা কি বেমালুম উচ্চারণ করল সাওদের! অথচ নিজেকে তার মোটেই নরম ভাবতে ইচ্ছে করছিল না।
 
হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠল জয়িতা। আর হাসিটা যেহেতু শহুরে তাই সাওদের বুঝতে পারছিল না কি করা যায়। হাসি থামিয়ে জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, তুমি বুঝি গ্রামের মেয়েদের জড়িয়ে ধরে পরীক্ষা কর কে নরম আর কে শক্ত?

দূর। গ্রামে আমার বয়সী মেয়েই নেই যে তাকে জড়িয়ে ধরব। বড় মেয়েরা আমাকে জড়িয়ে ধরতে চায় কিন্তু আমার ওদের মোটেই ভাল লাগে না। সরল গলায় জানাল সাওদের।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। ওরা সব কেমন বড় বড়। অবশ্য বোলেনদের গ্রামে একটা আমার বয়সী মেয়ে আছে।

আচ্ছা? তাই তুমি আমার সঙ্গে যেতে চাইছ?

না, তা ঠিক নয়। কিন্তু মেয়েটার মুখ খুব খারাপ। অত সুন্দর দেখতে অথচ এমন গালাগাল দেয় যে কি বলব! একবার ওই ঝরনার পাশে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

তখন ওকে জড়িয়ে ধরেছিলে?

উঃ, তুমি বুঝতে পারছ না! চেয়ে আছি দেখে মেয়েটা চিৎকার করল, মেয়ে দ্যাখোনি কোনদিন যে চোখ বড় করেছ? ক্ষেতি আছে কতখানি? রোজ রোজ শেলরুটি খাওয়াতে পারবে? এই সব বলে চলে গেল। আমার তো ওসব কিছু নেই তাই ওর কথা ভাবি না। সাওদেরকে মোটেই দুঃখিত দেখাচ্ছিল না। জয়িতা আবার হাঁটা শুরু করেছিল। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সাওদের চাপা শিস দিচ্ছিল। আর গতি বাড়াচ্ছে না সাওদের। ক্রমশ ওরা চুপচাপ ঝরনার পাশে চলে এল। এরমধ্যে কখন ঝরনা জমে বরফ হয়ে গিয়েছে। এক ফোঁটা জল নেই কোথাও। এবং তখনই নিচে গুলির শব্দ পেল জয়িতা। শব্দটা প্রতিধ্বনিত হতে লাগল পাহাড়ে পাহাড়ে। সে সচকিত হল। সুদীপ! ব্যাপারটা খুব খারাপ লাগল জয়িতার। নিরীহ চমরী মারার জন্যে বন্দুকের গুলি খরচ করার কোন মানে হয় না। আওয়াজটা খুব দূরের নয়। সঙ্গে সঙ্গে মত পালটাল সে। সাওদের কান খাড়া করেছিল। ওর মুখের রেখাগুলো এখন অস্বাভাবিক। শব্দটা শোনার পর থেকেই আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে। জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, আওয়াজটা কোথেকে এসেছে তা কি তুমি বুঝতে পারছ সাওদের?

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল সাওদের। জয়িতা বলল, ওখানে আমাকে তুমি নিয়ে যেতে পারবে?

রোলেনদের গ্রামে যাবে না?

না। আগে দেখে আসি কি হচ্ছে ওখানে!

সাওদের বলল, এপাশ দিয়ে গেলে অনেক সময় লাগবে। এসো আমার হাত ধরো, ঝরনা পার হয়ে গেলে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাব আমরা। সাওদেরের বাড়ানো হাত ধরল জয়িতা। স্পর্শ পাওয়ামাত্র কেঁপে উঠল জয়িতা। তার মনে হল সাওদের হয়তো আবার ভাবতে শুরু করেছে জয়িতা কি নরম। কিন্তু ওর হাতের স্পর্শে বা ব্যবহারে সেসব কিছুই দেখতে পেল না জয়িতা। অত্যন্ত সতর্ক হয়ে বরফ পরীক্ষা করে করে ওকে নিয়ে ঝরনা পেরিয়ে এল সাওদের। ওপারে পৌঁছে ঢালু পথে সামান্যই হাঁটা। রোলেনদের গ্রামের ঠিক উলটো পথ এইটে। গাছপালাগুলো বরফে ঢাকা। কোথাও কোন শব্দ নেই। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিল, হঠাৎ সাওদের তার হাত চেপে ধরল। মুহূর্তেই তাকে অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিল। নিঃশব্দে সে দূরের একটা বরফের চাঁই দেখিয়ে দিল। প্রথমে ঠাহর করতে পারেনি জয়িতা। তারপর নজরে এল লম্বা একটা লোমশ লেজ অনেকটা আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে বরফের ওপর নেতিয়ে রয়েছে। শরীর দেখা যাচ্ছে না। সাদার ওপর কালো ছোপ ছোপ লেজ বরফের গায়ে যেন মিশে আছে। ঠোঁটে আঙুল চেপে কথা বলতে নিষেধ করে পেছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল সাওদেয়। কিন্তু জয়িতার মনে হল জন্তুটাকে না দেখে ফিরে যাওয়া বোকামি হবে। প্রায় মিনিটপাঁচেক সে সাওদেরকে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করল। এই সময় লেজটা একবারের জন্যেও জায়গা বদল করল না।

সময় সম্ভবত সাওদেরের সাহস ফিরিয়ে দিল। সে গোল করে অনেকটা জায়গা হেঁটে ঠিক উল্টোদিকে পৌঁছে গেল জয়িতাকে নিয়ে। এবং তখনই জন্তুটাকে স্পষ্ট দেখতে পেল ওরা। লম্বায় অন্তত ফুট সাতেক হবে। বরফের ওপর মুখথুবড়ে পড়ে আছে। এবং তার বুকের পাশ দিয়ে রক্তের ধারা বেরিয়ে থমকে দাঁড়াচ্ছে। শরীরে সামান্য কাঁপুনি নেই। স্নো-লেপার্ড? জয়িতা চমকে উঠল। সত্যি যদি স্নো-লেপার্ড হয় তাহলে এ তো প্রায় রূপকথার প্রাণী। হিমালয়ের চৌদ্দ পনেরো হাজার ফুট উঁচুতে এদের অবস্থান। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা সাম্প্রতিক কালে এদের খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়েছেন। জয়িতা একমুঠো বরফ ছুঁড়ল। কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া হল না। সাওদের দুহাতে মুখ ঢেকে চিৎকার করল। জিম করবেটের বইতে জয়িতা জেনেছে আহত চিতার কাছে পৌঁছানো অত্যন্ত বিপজ্জনক। সে আর এগোতে সাহস পাচ্ছিল না। কিন্তু মৃতবৎ পড়ে থাকতে দেখে সাওদের সাহস পেয়ে গেছে এখন। নিষেধ না শুনে এগিয়ে যাচ্ছিল পায়ে পায়ে। তারপর কাছাকাছি হয়ে চিৎকার করল, মরে গেছে, মরে গেছে!
 

Users who are viewing this thread

Back
Top