What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected গর্ভধারিণী - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

সুদীপের বিছানাটা বের করে সে একপাশে বিছিয়ে দিয়ে সুদীপকে ডাকল, সুদীপ আয়। মাথা নাড়ল সুদীপ। মুখে কিছু বলল না। ভঙ্গিও পালটাল না। আর এতেই খুশী হল জয়িতা। অন্তত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ও। অর্থাৎ স্বাভাবিক হবে একসময়। বুকের ভেতর জমে থাকা পাহাড়টা যেন আচমকা সরে গেল জয়িতার। সে দেখল ভালকুটাকে ওরা অনেকটা দূরে টেনে নিয়ে গিয়েছে। লা-ছিরিঙ কোমর থেকে একটা ছুরি বের করে চিৎ-করা ভালুকের বুকের চামড়া কাটতে লাগল। এখন গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। জয়িতা চোখ বন্ধ করল। তার শরীর গোলাতে লাগল। সারারাত জেগে, ভোরে এই পরিশ্রম করে এখন সমস্ত শরীরে বমি-ভাব ছড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ খুব অসুস্থ মনে হল নিজেকে। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। কোনরকমে বাইরে এসে ভালুকটার বিপরীতে গিয়ে পেটে হাত রেখে বমি করল। শুধু তেতো জল ছাড়া আর কিছু বের হল না। ওরা সবাই ভালুকটাকে নিয়ে ব্যস্ত এখন। দমক আসছে জয়িতার কিন্তু মুখ থেকে কিছুই বের হচ্ছে না। এবং এখানে আসার পর সম্ভবত এই প্রথম তার হিমবাতাস ভাল লাগল। মুখের খোলা ফাটা জায়গাতেও তার স্পর্শ অনেক রমণীয় মনে হচ্ছে। সে চোখ বন্ধ করে নিজের শরীরটা ঠিক করে নিতে চেষ্টা করছিল। বমি-ভাবটা কমে এলে সে চোখ মেলল। চারপাশে শুধু বরফ আর বরফ। তার ওপর কচি কলাপাতার মত রোদের চাদর বিছানো। সুন্দর যেন সুন্দরতর হয়ে এসে দাঁড়াল সামনে। মুগ্ধ হয়ে দেখছিল জয়িতা। এবং হঠাৎ তার মনে হল কিছু একটা নড়ছে ওপাশের বরফের ঢিপির গায়ে। জিনিসটা কি সঠিক বোঝা গেল না। কিন্তু নিশ্চয়ই কোন প্রাণী রয়েছে আশেপাশে। এই জায়গা খুব নিরাপদের নয় তা বোঝাই যাচ্ছে। জন্তুটা ঠিক কি প্রকৃতির তা দেখার জন্যে এগিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না। জয়িতা গুহার পাশে পাথরের ওপর থেকে বরফ সরিয়ে বসতে গিয়ে দেখল সেটা অসম্ভব। অতএব বাধ্য হয়ে সেখানেই বসে পড়ল।

অন্তত সতেরো হাজার ফুট উঁচুতে ওরা এখন। তাপল্যাঙে থাকতে থাকতে ঠাণ্ডা অনেকটা সহ্যের মধ্যে এসে গেছে। কলকাতায় বসে এই পরিবেশে থাকার কথা কল্পনাতেই আসত না। জয়িতার হঠাৎ মনে পড়ল সে অনেককাল নিজের মুখ দ্যাখেনি। আয়নার কথা মনেই ছিল না তার। কতকাল স্নান করা হয়নি এবং সেটা হয়নি বলে অসুবিধে যে খুব হচ্ছে তাও নয়। অথচ কলকাতায় স্নান না করে একটা দিন কাটানোর কথা সে কল্পনা করতে পারত না।

জয়িতা চোখ তুলল। চ্যামলা, বারুনৎসে, নুপসে, ললাসে, এভারেস্ট, মাকালু, ঘোমোলা এখন চোখের সামনে। দু-একটা পেজা মেঘ ছাড়া কোন আড়াল নেই। এত সুন্দর তবু সুন্দর শব্দটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই বুক কাপে। একেই কি ভয়ঙ্কর সুন্দর বলে? কে জানে! পৃথিবীর কোথাও কোনও অশান্তি নেই, শুধু স্থির হয়ে থাকা, সময় মুঠোয় নিয়ে বসে থাকা। শুধু অনন্ত নিঃসঙ্গতায় হৃদয় ধুয়ে নেওয়া।

আনন্দর ডাকে চমক ভাঙল। পেছন থেকে আনন্দ বলল, কিরে, ধ্যান শুরু করে দিলি? উঠে আয়, চা হয়ে গেছে। চা শব্দটা শোনামাত্র শরীরে একটা আরাম এল যেন। জয়িতা কৃতজ্ঞ চোখে আনন্দকে দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করল সে ফিরে গেছে। সে উঠে এল।

গুহার সামনে ভালুকটার অস্তিত্ব নেই। শুধু তার বিশাল চামড়াটা পরিষ্কার করে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। গুহার মুখেই চাপ চাপ মাংসের স্তুপ ঠিক করছে লা-ছিরিঙ। ওকে দেখে সরল হাসল সে, পুরো গ্রামের মানুষ একবেলা এটা খেতে পারবে।

তোমরা ভালুকের মাংস খাও? হতভম্ব হয়ে গেল জয়িতা।

কেন নয়? ভালুকের মাংস পাওয়া কত কষ্টের তা তো জানো না।

খেতে কেমন?

চমৎকার। তুমি কখনও খাওনি?

দ্রুত মাথা নাড়ল জয়িতা। লা-ছিরিঙ বলল, আজ খেয়ে দেখো, মজা লাগবে।

জয়িতা মনে মনে বলল, রক্ষা কর। তারপর গুহাতে ঢুকতেই মেয়েটা এক পাত্র চা এগিয়ে দিল। জিভে সেটা ঠেকাতে মনে হল এর নাম অমৃত। সে চেঁচিয়ে আনন্দকে বলল, থ্যাঙ্কস।

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, কয়েকটা বিস্কুট এখনও পড়ে আছে, খাবি?

না থাক।

থাক কেন? ওটা তো শেষ হবেই। আনন্দ ওর হাতে বিস্কুট ধরিয়ে দিল। তারপর চাপাগলায় বলল, সুদীপ চা খাচ্ছে, যদিও এখনও নর্মাল হয়নি। ওকে বুঝতে দিস না যে আমরা চিন্তিত।
 
জয়িতা সুদীপের দিকে তাকাল। সুদীপ এখন গুহার দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার চোখ খোলা কিন্তু কোনদিকেই দৃষ্টি নেই। চায়ের পাত্র পাশে রয়েছে। সেখানেই ওর হাত। মেয়েটি গুহার এক কোণে মাংসগুলো রাখছিল। জয়িতা চট করে আনন্দর দিকে তাকাল, ভালুকের মাংস কে খাবে?

আনন্দ বলল, বেশির ভাগটাই গ্রামের মানুষের কাছে দফায় দফায় নিয়ে যাবে লা-ছিরিঙ। কিছুটা আমাদের জন্যে রেখে দেওয়া হয়েছে।

ইস! তুই ওই মাংস খাবি?

খেতে খারাপ লাগলে খাব না। আগে থেকে নাক সিঁটকোবার কি আছে! আমরা অনেকদিন মাংস খাইনি। মুখের স্বাদ পালটাবার জন্যে একটা চেষ্টা করা দরকাব, বুঝলি! আনন্দ চা শেষ করল।

অসম্ভব! আমার দ্বারা হবে না। আমি ওই মাংস খেতে পারব না। জয়িতা তীব্র প্রতিবাদ করল। ওর গলার স্বর এতটা জোরে উঠেছিল যে আনন্দ লক্ষ্য করল সুদীপের মুখ এপাশে ফিরল। যেন কিছু বোঝার চেষ্টা করল। তারপর আগের অবস্থায় ফিরে গেল।

চা শেষ করে লা-ছিরিঙ স্তুপ করে রাখা মাংসের কয়েকটা থেকে দুটো ঘাড়ে তুলে নিল। লাঠির দুটো প্রান্তে ঝুলিয়ে নেওয়া বাঁকের মত দেখাচ্ছিল। সে জয়িতার দিকে তাকিয়ে বলল, যদি কোন খবর থাকে তাহলে আজই ফিরে আসব নইলে আগামীকাল। তোমরা কেউ নিচে নেমো না।

আনন্দ বলল, পালদেমকে বলবে জঙ্গল থেকে কাঠ কাটা যেন আজ বন্ধ না হয়। ঘর তৈরির কাজ যেমন চলছিল তেমন চলবে।

ওর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে আনন্দর মনে হল ওই ওজন কাঁধে নিয়ে তার পক্ষে তিন পা হাঁটা অসম্ভব ছিল। এখনও যে মাংস পড়ে আছে তা নিয়ে যেতে ওকে দুবার নিচে নামতে হবে। মেয়েটা এখন বরফ দুহাতে তুলে সেই পড়ে থাকা মাংস চাপা দিচ্ছে। এই ঠাণ্ডায় পচনের কোন আশঙ্কাই নেই। হয়তো জন্তুদের চোখ যাতে ওগুলোর ওপরে না পড়ে তার জন্যেই বরফ দিয়ে ঢেকে রাখা হচ্ছে।

কিছু কাঠ দরকার। রাত্রে নিশ্চয়ই এখানে ঠাণ্ডা বাড়বে। তাছাড়া স্টোভের শেষ তলানিটুকু আর নষ্ট করা উচিত হবে না। রান্না এবং উত্তাপ দুটোই কাঠে করতে হবে। জলের প্রশ্ন নেই। বরফ গলিয়ে সেটা পেতে হবে। বড় একটা দা সঙ্গে নিয়ে আনন্দ হাঁটতে লাগল। বরফ ভেদ করে যে গাছ এখানে ছড়িয়ে আছে সেগুলো বেশ ভেজা এবং পাতাও নেই বললেই চলে। জায়গাটা এমন যে লুকোবার কোন উপায় নেই। অবশ্য বিপদ আসতে পারে একমাত্র নিচে থেকে। আর সেটা এলে নিশ্চয়ই গ্রামের মানুষ আগেভাগে জানাবে। মাথার ওপর যদি হেলিকপ্টার আসে তাহলে গুহার ভেতরে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। একটু নিচের দিকে এসে আনন্দ একটা ঝকড়া গোছের গাছ দেখতে পেল। এর শরীরে এখনও পাতা আছে তবে বরফে মাখামাখি হয়ে আছে গাছটা। আনন্দ ডাল কাটতে শুরু করল। গাছটা খুব বেশি লম্বা নয়। তাছাড়া পাহাড়ের গা ঘেঁষে বলেই অনেকটা নাগালের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। নির্জন পাহাড়ে গাছ কাটার শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে। বেশ কয়েকটা ডাল কাটার পরেও আনন্দর মনে হচ্ছিল এটা দুদিনের পক্ষে পর্যাপ্ত নয়। আজ আবহাওয়া পরিষ্কার আছে এখনও, কিন্তু কতক্ষণ থাকবে তা ঈশ্বর জানেন। অন্তত দুদিনের ব্যবস্থা করে রাখা দরকার। মাঝে মাঝে সে হাঁপিয়ে পড়ছিল কিন্তু তার জেদ কমছিল না। যখন তার মনে হল অনেক হয়েছে তখনই ভাবনা শুরু হল। এত কে ওপরে বয়ে নিয়ে যাবে! গাছ কাটতে কাটতেই অনেকটা শক্তি খরচ হয়ে গেছে। সে জিরোতে সময় নিল। এখান থেকে নিচের দিকে তাকালে কিছুই দেখা যায় না। জঙ্গল দেওয়ালের কাজ করছে।

এই সময় পায়ের আওয়াজ পেয়ে চমকে সোজা হয়ে দাঁড়াল আনন্দ। আর দাঁড়িয়ে হেসে ফেলল। মেয়েটা এসে দাঁড়িয়েছে। আনন্দ তাকে জিজ্ঞাসা করল, কে পাঠাল তোমাকে?

মেয়েটি হাসল, শব্দ শুনে চলে এলাম। কিন্তু এই শব্দ তো গ্রাম থেকেও শোনা যাবে!

কথাটা মাথায় আসেনি আনন্দর। সে অবিশ্বাসে তাকাল নিচের দিকে। গ্রাম এখান থেকে অনেক দূরে। অবশ্য শব্দের গতির কথা সে জানে তবে–।

মেয়েটি বলল, ওটা আমাকে দাও, কিভাবে কাটতে হয় দেখিয়ে দিচ্ছি।
 
খানিকটা কাত করে দা চালাল মেয়েটি। শব্দটা মৃদু হয়ে গেল কিন্তু কাজ হচ্ছিল বেশি। আনন্দ মাথা নাড়ল, ঠিক আছে, বুঝতে পেরেছি। আর কাটার দরকার নেই। এখন এগুলো নিয়ে যাওয়াই কষ্টকর হবে।

মেয়েটি বলল, ডালগুলো টুকরো কবে বাঁধতে হবে।

সেই কাজেই লেগে গেল সে। হঠাৎ আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, তুমি আমাদের সঙ্গে এত কষ্ট করছ কেন?

মেয়েটি হাত না থামিয়ে জবাব দিল, আর কিছু করার নেই বলে।

চারপাশে রক্তের গন্ধ। অতবড় একটা জন্তু মরে গিয়েও বাতাসে নিজের অস্তিত্ব ছড়িয়ে দিয়েছে। জয়িতা গুহার ভেতরে ঢুকল। সুদীপ বসে আছে একা। মেয়েটা একটু আগেই বেরিয়ে গেল। জয়িতা সুদীপের সামনে বসে জিজ্ঞাসা করল, সিগারেট খাবি?

সুদীপ তাকাল। তার বুক কেঁপে একটা নিঃশ্বাস বের হল। জয়িতার কষ্টটা ফিরে এল। তার মনে হচ্ছিল সে কিছুতেই আর সুদীপের কাছে পৌঁছাতে পারছে না। সে জিজ্ঞাসা করল, তোর কি কষ্ট হচ্ছে রে সুদীপ?।

সুদীপ ধীরে ধীরে উঠে পঁড়াল। তার পর জড়ানো গলায় কিছু বলতে চাইল। কথাগুলো স্পষ্ট নয়। জয়িতা দেখল কাঁপা পায়ে সূদীপ এগিয়ে যাচ্ছে বাইরে। ওর ইচ্ছে করছিল জড়িয়ে ধরতে। আর ইচ্ছেটা হওয়ামাত্র সে ছুটে গেল সামনে। দুহাতে সুদীপকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল, কথা বল্। টেল মি

এনিথিং, এনি ড্যাম ওয়ার্ড!

সুদীপ হাঁপাচ্ছিল। ওর শীতে ফাটা মুখ করুণ দেখাচ্ছিল। হঠাৎ জয়িতা স্থির হয়ে গেল। তারপর ধীরে ধীরে সুদীপের গালে ঠোঁট রেখে ফিসফিসিয়ে বলল, সু-দী-প?

সুদীপ বলল, ঠিক-– ঠিক আ-ছি!

জয়িতা দুটো হাত সরিয়ে নিয়ে দেখল সুদীপের ঠোঁটে হাসি এল কি এল না। মুক্ত হয়ে সে বেশ কয়েক পা এগিয়ে গেল। তারপর বরফের ওপর দুটো পা ছড়িয়ে বসে পড়ল। জয়িতা চুপচাপ গুহার মধ্যে দাঁড়িয়ে সুদীপকে দেখতে লাগল। ওর সমস্ত চেতনায় একটা সুখ ছড়িয়ে পড়ছিল, সুদীপ কথা বলেছে, যেভাবেই হোক বলেছে।

আর তখনই সে চমকে উঠল। দুটো নাদুসনুদুস ভালুকের বাচ্চা গুড়গুড় করে এগিয়ে আসছে সুদীপের কাছে। এরাই মায়ের সঙ্গে গুহা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। প্রথমে ভয় পেলেও সে বুঝতে পারল বাচ্চা দুটো এত শিশু যে ওদের কিছু করার ক্ষমতা নেই। বরং ওদের ভাবভঙ্গি এবং হাঁটা দেখে মজা লাগছিল তার। বাচ্চা দুটো খানিকটা দূরে এসে থমকে দাঁড়াল। তারা সুদীপকে লক্ষ্য করছিল। কুঁই কুঁই শব্দ করে নিজেরা সম্ভবত সুদীপ সম্পর্কে কিছু বলাবলি করে নিল। তারপর দ্বিধাভরে এগিয়ে গেল সুদীপের পাশে। সুদীপের গায়ের কাছে এসে ওরা স্থির হতে জয়িতা সবিস্ময়ে দেখল পরম আদরের দুটো হাত ওদের গায়ে স্পর্শ রাখল। আর বাচ্চা দুটো যেন আশ্রয় পেয়ে সুদীপের শরীরে মুখ গুঁজল।
 
৪৪.
দুপুর না গড়াতেই এখানে অন্ধকার ঘনিয়ে এল। চাপ কুয়াশা, মেঘ আর কনকনে ঠাণ্ডায় বাইরে দাঁড়ানো অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু জয়িতার মনে হল গুহার ভেতর যে আরাম তা তাদের আস্তানায় ছিল না। এখানে অন্তত চোরা হাওয়ার কামড় নেই। তবুটা পায়ের তলায় বিছিয়ে রাখা সত্ত্বেও স্যাঁতসেঁতে ঠাণ্ডা উঠছেই। কিন্তু আগুন জ্বলার পর চমৎকার ওম ছড়িয়েছে গুহাতে। ভালুকটার নির্বাচন সঠিক ছিল। ওকে উৎখাত না করলে এই গুহার দখল পাওয়া যেত না। পৃথিবীর নিয়মই এই রকম।

জয়িতা মেয়েটিকে দেখছিল। লা-ছিরিঙ কিংবা পালদেম ওর সম্পর্কে সন্তুষ্ট নয়। অথচ রোলেন বলেছিল ও নাকি বাচ্চা তৈরি করবার পক্ষে উপযুক্ত। এখনও এই মানুষেরা মেয়েদের একটি বিশেষ প্রয়োজনের সামগ্রী মনে করে। পালদেমরা কেন সেই সম্মান একে দিচ্ছে না সেটা অবোধ্য। তার মনে পড়ল লা-ছিরিঙ অত্যন্ত বাধ্য না হলে ওর সঙ্গে কথা বলেনি। এখন মেয়েটি পাথরের উনুনে মাংস সেদ্ধ করছে। ভালুকের মাংস। মাঝে মাঝে সে তাকাচ্ছে সুদীপের দিকে। সুদীপ তার বিছানায় পা ঢুকিয়ে চুপচাপ বসে। এবং তার শরীরে মুখ ডোবানো ভালুকের বাচ্চা দুটোর দেহ তিরতিরিয়ে কাঁপছে। আনন্দ চোখ বন্ধ করে শুয়ে। এই গুহায় কেউ কোন কথা বলছে না এখন। জয়িতা উঠল। সে উঠতেই আনন্দ চোখ মেলল, কোথায় যাচ্ছিস?

মাংসের গন্ধটা অসহ্য মনে হচ্ছে।

অনভ্যাস। আনন্দ এমন গলায় কথা বলল যেন ওই মাংস সে দীর্ঘদিন ধরে খাচ্ছে।

আড়াল সরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল জয়িতা। এবং চোখের সামনে বরফ পড়া দেখল। কুয়াশাগুলো উধাও। ঝুরঝুর বরফ মাটিতে জমা হচ্ছে। বস্তুত মাটি বলে কিছুই আর চোখে পড়ছে না। ঠাণ্ডাটা যেন সামান্য কমেছে। তার খুব মজা লাগছিল। মাথার ওপর পাথরের আড়াল। সেটা ছেড়ে বাইরে বেরোতে ইচ্ছে করছিল না। সাহসও হচ্ছিল না।

লা-ছিরিঙ আজ ফেরেনি। তাপল্যাঙে পুলিশবাহিনী পৌঁছেছে কিনা কে জানে! কিন্তু এটা তাদের জানা উচিত ছিল। যারা তাপল্যাঙ পর্যন্ত আসবে তারা জানবেই ওখানে তারা ছিল। শোনার পর হাল ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে এমন ভাবার কোন কারণ নেই। আর যদি সত্যি সত্যি হদিশ পেয়ে যায় তাহলে তাদের পালাবার পথ থাকবে না। অস্বস্তিটা বেড়ে গেল ওর। রাত হয়ে গেলে এখান থেকে বের হওয়া আর আত্মহত্যা করা একই ব্যাপার হবে। জয়িতা কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। যদি লুকিয়ে লুকিয়ে গ্রামে পৌঁছানো যায় তাহলে রাত্রের আগে এখানে ফেরা যাবে না। এবং এই সময় সে একটি তীব্র শিস শুনল।

চমকে চারপাশে তাকাল। তুষারপাতের জন্যেই বেশিদূর দৃষ্টি যাচ্ছে না। কিন্তু ওই শিস যেদিক থেকে ভেসে এল সেইদিকটা লক্ষ্য করল সে। তার আগেই কুকুরের ডাক শুনতে পেল। কুকুরটাকে সঙ্কেত করার জন্যেই সম্ভবত শিস বেজেছিল। কুকুরের ডাকটা এখন স্পষ্ট, খুবই কাছাকাছি। পুলিশ কি শিকারী কুকুর নিয়ে উঠে আসছে? এই সময় তার পেছনে শ নেই সে–ননকে দেখতে পেল। চিঞ্জিত মুখ আনন জিজ্ঞাসা করল কুকুরের ডাক শুনতে পেলাম, ন

হ্যাঁ! আমি বুঝতে পারছি না, এখানে কুকুর আসবে কোত্থেকে? পুলিশ নয়তো?

কথাটা কানে যাওয়ামাত্র আনন্দ ভেতরে চলে গেল তার পরেই ফিরে এল রিভলভার নিয়ে। চা! গলায় বলল, শেষ পর্যন্ত অপেশ করব। আমরা অনেক বেটার জায়গায় আছি।

ওরা প্রায় দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। যতটুকু দেখা যাচ্ছে কোন প্রাণের চিহ্ন নেই। যেই আসুক তাকে প্রথমে ওই খোলা জায়গায় পা রাখতে হবে।
 
কুকুরের ডাকটা এগিয়ে আসছে। হঠাৎ যেন-তাব স্বর বদলে গেল। এখন ওই ডাকে উত্তেজনা। এবং তার পরেই ওরা উত্তেজিত কুকুরটাকে দেখতে পেল। ওপর থেকে নেমে এল খোলা জায়গাটায়, ওর মুখ গুহার দিকে ফেরানো, অনর্গল ডেকে চলল এক জায়গায় দাঁড়িয়ে। জয়িতা রিভলভারে হাত রেখেছিল। কুকুরটার দাঁত সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। দ্বিতীয়বার শিসটা শুনতে পেল। শিস শোনার পর আবার ওপরে ছুটে গেল কুকুরটা। আনন্দ চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, ওপর থেকে নামছে কি করে? পুলিশ এলে তো নিচ থেকে আসার কথা।

এবং তখনই প্রথমে কুকুর তার পর ওর মালিককে দেখতে পেল ওরা। ছেড়া গরমজামায় যতটা সম্ভব শরীর ঢেকে লোকটা ধীরে ধীরে খোলা জায়গায় এসে ক্লান্ত ভঙ্গিতে গুহার দিকে তাকাল। কুকুরের গলা থেকে গোঁ গোঁ শব্দ বের হচ্ছে। লোকটা টলছিল। এবার মুখ ঘুরিয়ে চারপাশে তাকিয়ে নিল। ও আর একটু এগোলেই জয়িতাদের দেখতে পাবে। ওর হাতে একটা লাঠি আর ছোটপাত্র। পাত্রটিকে সে অত্যন্ত যত্নে আঁকড়ে আছে। সে আবার শিস দিতে কুকুররটা সোৎসাহে তেড়ে এল গুহার দিকে। একদম মুখোমুখি হয়ে ও জয়িতাদের দেখতে পেল। পেয়েই ছুটে গেল মালিকের কাছে। তার আচরণে আচমকা পরিবর্তন এসে গেছে যেন বুঝতে পারল নোকটা। সে লাঠিতে ভর করে কয়েক পা এগোতেই দেখতে পেল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না লোকটা। আনন্দর মনে হল লোকটা অসুস্থ। যে কোন মুহূর্তেই বরফের ওপর গড়িয়ে পড়তে পারে। সে পা বাড়াল। কুকুরটার চিৎকার বেড়ে গেল তাই দেখে। মুখোমুখি হয়ে আনন্দ বলল, প্রথমে ওটাকে চুপ করতে বল। এখানে কুকুর ডাকুক আমরা চাই না।

লোকটা অন্য ধরনের শব্দ করল জিভে। সেটা শুনে কুকুরটা যন্ত্রের মত থেমে গেল। এবার আনন্দ লোকটার দিকে স্পষ্ট তাকাল। সমস্ত শরীরে সাদা তুষার লেপটে রয়েছে। ঠোঁট নাক এখন একদম সাদা। এই অবস্থায় ও কি করে হেঁটে আসছে?

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, তুমি কে?

লোকটা হাত নেড়ে নিচের দিকটা দেখাল। ও নাড়ল লাঠি ধরা হাতটা। পাত্রটিকে সে ওই অবস্থায় সামান্য নাড়াচ্ছিল না। আনন্দ বুঝল এ তাপল্যাঙের একজন সাধারণ মানুষ। কিন্তু ওর যা অবস্থা এখন যদি হাঁটা শুরু করে তাহলে তাপল্যাঙে পৌঁছাতে পারবে না। শেষ শক্তিটুকুও এখন ফুরিয়ে যাওয়ার মুখে। তুমি যদি আগুনের পাশে বসতে চাও তাহলে গুহায় আসতে পার। হাত বাড়িয়ে দেখাল আনন্দ।

লোকটার ঠোঁট কাঁপল। চোখ বড় হল। তারপর কোন রকমে উচ্চারণ করল, ভালু!

শব্দটা বুঝল আনন্দ, ভালু নেই। আমরা মেরে ফেলেছি।

ওইটুকু পথ আসতে লোকটার অনেক সময় লাগল। গুহার মধ্যে ঢুকে আগুন দেখে তার চোখ বিস্ফারিত হল। নিজের শরীর আগুনের পাশে নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তেও কিন্তু সে হাতের পাত্রটি সম্পর্কে সচেতন ছিল। কুকুরটা মালিকের সঙ্গে গুহায় ঢুকেই গলা খুলে চিৎকার শুরু করল। জয়িতা দেখল সুদীপের শরীরের মধ্যে ভালুকবাচ্চা দুটো মিশে যেতে চাইছে কুঁই কুঁই শব্দ করতে করতে। কুকুরটার লক্ষ্য ওরাই। এক একবার তেড়ে গিয়ে আবার ফিরে আসছে সে মালিকের কাছে। আনন্দ লোকটাকে বলল, ওকে সামলাও।
 
লোকটা আবার শব্দ করল। কুকুরটা এবার আগুনের কাছে ফিরে এসে জিভ বের করে লোভী চোখে বাচ্চা দুটোর দিকে তাকিয়ে রইল।

লোকটাকে দেখামাত্র মেয়েটা উঠে দাঁড়িয়েছিল। তার চোখে বিস্ময়। সেটা লক্ষ্য করে জয়িতা ওকে জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের গ্রামের মানুষ?

ঘাল নাড়ল মেয়েটা, না। রোলেনদের গ্রামে থাকে। ও বেঁচে আছে?

কেন, ওর কি হয়েছিল? এবারের প্রশ্নটা আনন্দের।

ওর পায়ের দিকে তাকাও, দ্যাখো ওর পায়ের অবস্থা। মেয়েটা যেন বিস্ময়ের শেষ সীমায়। জয়িতা চমকে উঠল। এই বরফের ওপর দিয়ে হেঁটে এসেছে কিন্তু লোকটার পায়ে কোন জুতো নেই। আঙুলগুলো বেঁকে বেঁকে ফুলে দুটো পা এখন গোল হয়ে গিয়েছে। অনেকটা হাতির পায়ের আকার নিয়েছে ওদুটো। মাঝে রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে রয়েছে।

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, তোমার পায়ের এই অবস্থা কি করে হল?

লোকটা তখন সমস্ত শরীরে উত্তাপ নিচ্ছে। যেন মরুভূমির মাঝখানে পথ হারানো মানুষের সামনে জল ধরে দেওয়া হয়েছে। ওর চোখ বোজা ছিল। আনন্দর প্রশ্ন যেন কানেই ঢুকল না। মেয়েটা এবার চিৎকার করে নিজস্ব ভাষায় জড়ানো গলায় কিছু বলতেই লোকটা চমকে চোখ মেলল। মেয়েটাকে যেন সে এখানে দেখবে ভাবতে পারেনি। একগাল হেসে সে জড়ানো গলায় উত্তর দিল। মেয়েটি এবার জয়িতার দিকে তাকিয়ে বলল, ও পেরেছে, ও পেরেছে!

কি পেরেছে ও?

মেয়েটি বলল, ডান দিকের যে পাহাড়, সেই পাহাড়ের মাথার ওপর থেকে জল এনে যদি কোন অসুস্থ মানুষের মুখে বুলিয়ে দেওয়া যায় তাহলে তার অসুখ সেরে যাবেই। ওর মা বাঁচবে না বলে ও সেই জল আনতে বেরিয়েছিল। এর আগে অনেকেই প্রিয়জনকে বাঁচাবার জন্যে ওখানে গিয়েছে জল আনতে। আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন একজন ফিরেছিল, কিন্তু অন্তত দশজনের পর ওকে আমি ফিরতে দেখলাম। ও ভগবানের দেখা পেয়েছে। কথাগুলো বলার সময় মেয়েটির মুখে একটা উজ্জ্বল আলো খেলা করে যাচ্ছিল।

লোকটা হাসল। তারপর সস্নেহে নিজের পায়ের ওপর হাত বোলাল। বোঝা যাচ্ছে, ওখানে কোন সাড় নেই ওর। আনন্দ তাকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি ওই পাহাড়ের ওপর উঠেছিলে?

পরম তৃপ্তিতে মাথা নাড়ল লোকটা। তারপর উঁচু করে পাত্রটা দেখাল। আনন্দ জয়িতার দিকে তাকাল। এদিকে পাহাড়গুলোর সবচেয়ে নিচু শৃঙ্গ অন্তত সতেরো হাজার ফুট। সেই অবধি কোনরকম আধুনিক হাতিয়ার ছাড়া একটা লোক নগ্ন পায়ে হেঁটে উঠতে পারে তা সে কল্পনা করতে পারছিল না। বোঝাই যাচ্ছে অত্যন্ত ঠাণ্ডায় ওর পা বেঁকে গেছে। এবং এ জীবনে আর সে নিজের পা ফিরে পাবে না। ওর হাতের আঙুলগুলোও স্বাভাবিক নয়, নাকের ডগায় বেশ বড় ঘা। জয়িতা চাপা গলায় বলে উঠল, অসম্ভব, আমি বিশ্বাস করি না। ও চেষ্টা করতে পারে কিন্তু ওপরে উঠতে পারে না।
 
আনন্দ বলল, সত্যি অবিশ্বাস্য কিন্তু এরা মিথ্যে কথা বলে না। অন্ধ বিশ্বাস মানুষকে কি শক্তি দেয় তার গল্প পড়িসনি? খোড়া পাহাড় ডিঙায়!

কিন্তু ওই বরফ গলিয়ে মুখে মাখালে কারও অসুখ সারবে? তাহলে তো প্রতি বছর এভারেস্ট ক্লাইম্বাররা ফিরে এসে হাজার হাজার মানুষকে সারিয়ে তুলতে পারত। ওঃ, ধর্ম মানুষকে কিভাবে এক্সপ্লয়েট করে দ্যাখ। জয়িতা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল।

যা হোক, এক্ষেত্রে তো আমাদের কিছু করার নেই। শুধু বিস্মিত হওয়া ছাড়া। আনন্দ বলল।

লোকটা ততক্ষণে সেদ্ধ হয়ে আসা মাংসের দিকে নজর দিয়েছে। ইঙ্গিতে সেটা দেখাচ্ছেও। মেয়েটা খানিকটা তুলে একটা ডিসে এগিয়ে ধরতেই কুকুরটাও চিৎকার করে উঠল। ওর দিকে বিন্দুমাত্র নজর না দিয়ে লোকটা মাংস গিলতে লাগল প্রাণপণে। মেয়েটা উঠে খানিকটা কাঁচা মাংস কুকুরটার সামনে রাখতে সেও একই ভঙ্গিতে খেতে শুরু করল। একটু অপরাধীর ভঙ্গিতে মেয়েটি বলল, আমি না হয় আজ মাংস খাব না।

জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, কেন?

যারা ওপরের পাহাড় থেকে জল নিয়ে ফিরে আসে কাহুন পর্যন্ত তাকে সম্মান দেখায়। আমি আমার ভাগটা ওকে দিয়ে দিলাম। মেয়েটি জানাল।

থাক, তোমাকে আর স্যাক্রিফাইস করতে হবে না। জয়িতা মন্তব্য করল।

বোধ হয় অভূক্ত ছিল লোকটা। কারণ দ্বিতীয়বার নেওয়ার পরও যেন তার চাহিদা কমছিল না।

কিন্তু সে লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। মাথা ঝুঁকিয়ে কৃতজ্ঞতা জানাল। তারপর পাত্রটি সযত্নে বুকের কাছে নিয়ে এসে কুকুরটাকে শিস দিয়ে ডাকল।

আনন্দ তাকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কোথায় যাচ্ছ?

লোকটা হাত বাড়িয়ে নিচের দিকটা দেখাল। ওর মুখ এখন প্রায় স্বাভাবিক, শুধু নাকের কাটা থেকে রক্ত বের হচ্ছে। আনন্দ চমকে উঠল, এখন তো বাইরে অন্ধকার, তুমি গ্রামে পৌঁছাবার আগেই মরে যেতে পার।

লোকটা চটপট মাথা নাড়ল। তারপর পাত্রটা দেখিয়ে বলল, ভগবান আমাকে বাঁচিয়ে রাখবেন। ওর গলার স্বর জড়ানো কিন্তু শব্দগুলো বুঝতে পারল ওরা।

আনন্দ এবার মেয়েটিকে বলল, ওকে পাগলামি করতে নিষেধ কর। এতক্ষণ যা করেছে করেছে, এই রাতটা এখানে কাটিয়ে কাল সকালে যেন ও গ্রামে ফিরে যায়।

মেয়েটি খানিক ইতস্তত করে লোকটির সামনে এসে দাঁড়াল। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই লোকটি মাথা নাড়ল, আমার মা মরে গেছে কিনা জানি না। কিন্তু মনে হয় এই জল যখন আনতে পেরেছি তখন ভগবান নিশ্চয়ই ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে। একটা রাত দেরি করলে ভগবান ওকে নিয়ে নিতে পারে। আমি যাচ্ছি।

হঠাৎ মেয়েটা তাকে ডাকল। লোকটা মুখ ফেরাতে গলায় অনেক আকৃতি নিয়ে বলল, আমাকে একটু জল দেবে? এই একটুখানি!

লোকটি সজোরে মাথা নাড়ল, না। এই জল কেউ চাইতে পারে না।

আমি জানি, তবু তুমি দয়া কর। ওখান থেকে একটুখানি দিলে তোমার মায়ের জন্যে কম পড়বে না।

মেয়েটি প্রায় প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলছিল এবার।

হঠাৎ লোকটির খেয়াল হল যেন, তুমি এখানে কেন? এরা কারা?

এরা আমাদের বন্ধু। এদের খুব শক্তি। বিরাট ভালুক মেরেছে যার মাংস তুমি খেলে। ওই যে, তাকিয়ে দ্যাখো, ওর জন্যে একটু জল দাও। নাহলে ও কখনও ভাল হবে না। মেয়েটি হাত উঁচু করল।


লোকটা সুদীপের দিকে তাকাল। কিন্তু তার সামান্যও দয়া হল না। সে আর কথা না বাড়িয়ে বাইরে পা বাড়াল। সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটাও উধাও। মেয়েটা তখন দরজায় দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছিল। জয়িতা তাকে ধমক দিল, সুদীপের জন্যে জল চাইবার কি দরকার ছিল?

নইলে ও বাঁচবে না, ভাল হবে না। কেউ কি কখনও শুনেছে ভালবাচ্চা মানুষের শৰ্য্যরে ঘুমিয়ে পড়ে! ওর মধ্যে দালোটা বোবা হয়ে ঢুকে পড়েছে। ভগবানের দয়া ছাড়া সেটা বের হবে না।

মেয়েটা হতাশ গলায় কথাগুলো বলল।

আনন্দ জয়িতাকে ইশারা করল চুপ করতে। তারপর বাংলায় বলল, ওর ব্যক্তিগত বিশ্বাস যদি আমাদের কোন ক্ষতি না করে তাহলে এই নিয়ে মাথা ঘামাবাব কোন দবকার নেই। কিন্তু লক্ষ্য কর, ও সুদীপ সম্পর্কে সত্যি ইন্টাবেস্টেড়। শুনেছি ভালবাসাবাসি না হলে মেয়েরা ছেলেকে সম্পর্কে এতখানি সচেতন হয় না।

জয়িতা সুদীপ, মেয়েটি এবং সবশেষে আনন্দব দিকে তাকাল। তারপর পা গলায় বলল, মাঝে মাঝে তুইও ন্যাকাদের লাইনে গিয়ে দাঁড়াস কি করে তা বুঝি না।
 
লা-ছিঙি মাংস নিয়ে আসার পর গ্রামের মানুষ বেশ খুশ!। ভকে? তকপি বা খায়নি। তার পরেই প্রশ্ন উঠল ভালুকটা কত বড় ছিল। আরও মাংস পাহাড়ে আছে জানার পর সেটা আনবার জন্যে একটা দল তৈরি হয়ে গেল। লা-ছিরিঙ প্রথমে রাজী হয়েছিল, তার পর তার মনে পড়ল এরা গেলে গুহার মানুষদের অস্তিত্ব জেনে যাবে। সে অনেক বুঝিয়ে ওদের আটকাতে পারল। গুহাব সামনেই মাংস আছে এই সংবাদটা জানাল না। লোভ মানুষকে সব সময় বিপথগামী করে। সে আড়ালে ডেকে নিয়ে পালদেমকে সব বৃত্তান্ত জানাল। অত বড় একটা ভালুককে যারা মেরে ফেলতে পারে অনায়াসে তারা কেন পুলিশের ভয়ে লুকিয়ে আছে তা তাদের বোধগম্য হচ্ছিল না। তবে একথা ঠিক, ওরা এই গ্রামের উপকার করতে চায়। যতদিন ওরা সেটা করবে ততদিন ওদের সঙ্গে সহযোগিতা না করার কোন কারণ নেই। পালদেম লা-ছিরিঙকে উপদেশ দিয়েছিল সেদিনই পাহাড়ে ফিরে না যেতে। কারণ উৎসাহী গ্রামবাসী তাকে অনুসরণ করতে পারে। কিন্তু ওই চারজনের ব্যাপারে গ্রামবাসীদের সতর্ক করে দেওয়া উচিত কিনা সে বুঝতে পারছিল না। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। সে লা-ছিরিঙকে নিয়ে কানের সঙ্গে দেখা করতে গেল। কাহুন তখন মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েছিলেন। পালদেম এবং লা-ছিরিঙ তার সামনে হাঁটুমুড়ে বসল। কাহুন চোখ নামালেন। পালদেম বলল, আমরা বিদেশীদের সাহায্য করছি। কিন্তু কতখানি সাহায্য করা উচিত?

কাহুন বললেন, যতক্ষণ ওরা আমাদের শত্রুতা না করছে। দু-দুবার আমদেব দেবতা ওদের সাহায্যে ফিরে এসেছেন। আমরা এই ঋণ নিশ্চয়ই শোধ কবব।

পালদেম বলল, কিন্তু ওদের কাজকর্ম অনেকের পছন্দ হচ্ছে না। বরফের সময় যাতে সবাই তাল থাকে তার জন্যে ওরা চেষ্টা করছে। আমরা এভাবে কখনও ভাবিনি। কিন্তু মনে হচ্ছে ওদের কথা শুনলে আমাদের কোন ক্ষতি হবে না।

কোন ক্ষতি না হওয়া পর্যন্ত কথা শুনব। কান কথাগুলো বলে মুখ ফেরালেন, এই অসময়ে মনে হচ্ছে আরও কিছু বিদেশী আসছে। বিদেশী মানেই যে সন্দেহজনক মানুষ এই ধারণা অবশ্য এখন আমাদের ঠিক ততটা নেই। তোমরা যাও, ওদের অভ্যর্থনা কর।

ওরা দুজনেই সোজা উঠে দাঁড়িয়েই দেখতে পেল। যে পথে ব্যাপারীরা আসে সেই পথেই ঘোড়াগুলো দেখা যাচ্ছে। অন্তত গোটা দশেক ঘোড়া। কোন পদাতিক নেই। ওদের চলার গতি আছে। ইতিমধ্যে গ্রামের অনেকেই ওদের দেখতে পেয়েছে। বিন্দুর চেয়ে সামান্য বড় এখন। কিন্তু তাতেই গ্রামে কোলাহল শুরু হয়ে গেল। অনেকেই ভাবল ব্যাপারীরা এবার দলে ভারী হয়ে প্রচুর জিনিসপত্র নিয়ে ফিরে আসছে। কিন্তু পালদেম চাপা গলায় বলে উঠল, পুলিশ! ওরা বোধহয় পুলিশ।

লা-ছিরিঙ দেখার চেষ্টা করছিল, আমরা কি করব এখন?

কাহুন বললেন, যতক্ষণ আমরা ক্ষতিগ্রস্ত না হচ্ছি ততক্ষণ আমরা ওদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করব।

এখন ওদের স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দলে দুজন বিদেশী, তারাই আগে আগে আসছে। পেছনের মানুষেরা যে পাহাড়ের তা মুখ দেখেই বোঝা যায়। গ্রামের মুখে পৌঁছে ওরা সমবেত জনতার দিকে তাকিয়ে গতি রোধ করল। গ্রামবাসীরা এতক্ষণে বুঝে গিয়েছে আগন্তুকরা ব্যাপারী নয়। কি করা উচিত ওরা যেন বুঝতে পারছিল না। মন্দিরের চত্বর অনেকটা উঁচুতে বলে পালদেমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল ওদের। অশ্বারোহীদের একজন চিৎকার করে বলল, এই গ্রামের পালা কোথায়?

গ্রামবাসীরা ঠেলাঠেলি করে বৃদ্ধকে এগিয়ে দিল সামনে। পাহাড়ের একজন মানুষ জিজ্ঞাসা করল, তুমি এই গ্রামের পালা? তুমি বল, এই গ্রামে কোন বিদেশী আছে কিনা!

পালা জড়ানো গলায় কিছু বলতে তাকে ধমকে উঠল লোকটা, ভাল করে কথা বল।

পালা এবার মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। সঙ্গে সঙ্গে আগন্তুকদের মুখে হাসি ফুটে উঠল। প্রত্যেকের শরীরে একই রকমের পোশাক। প্রতিটি ঘোড়ার শরীরে অস্ত্র বাঁধা। বিদেশী জিজ্ঞাসা করল, তারা কোথায়?

পালা হাত বাড়িয়ে একটা দিক নির্দেশ করতে লোকটা বলল, তুমি আমাদের পথ দেখাও।
 
পালার পক্ষে দ্রুত হাঁটা এখন অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু সে এবং অন্যান্য গ্রামবাসীরা বুঝতে পারছিল এই লোকগুলো সুবিধের নয়। এই সময় পাহাড়ী অশ্বারোহী চিৎকার করে বলল, আমরা পুলিশ। তোমাদের এখানে তিনজন ডাকাত লুকিয়ে আছে। এরা খুব খারাপ লোক। অনেক মানুষ খুন করে এখানে এসেছে তোমাদের খুন করবে বলে। এদের কাছে অস্ত্র আছে। এদের ধরিয়ে দিলে তোমরা নিজেদের উপকার করবে। কথাগুলো বলে লোকটা প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যে তাকাল।

গ্রামবাসীরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু কেউ নিজের ঘরে ফিরে যাচ্ছিল না। পালা যখন হাঁটতে শুরু করেছে তখন অশ্বারোহীরা এগোতে লাগল। আর তখনই একজন গ্রামবাসী চাপা গলায় বলে উঠল, মানুষ যারা খুন করে তাদের চেহারা ওরকম হয় না।

দ্বিতীয়জন বলল, ওরা খামোক মিথ্যে বলবে কেন? এখানে আসতেও তো কষ্ট হয়েছে?

এখন অশ্বারোহীদের প্রত্যেকের হাতে অস্ত্র! অত্যন্ত সতর্ক ভঙ্গিতে ওরা এগোচ্ছে। তাই দেখে লা-ছিরিঙের হাসি পেয়ে গেল। ওরা যদি জানতে পারে যাদের খোঁজে এসেছে তারা এখন গুহায় আছে এবং সেখানে পৌঁছাতে হলে পায়ে হেঁটে উঠতে হয় তাহলে কি করবে?

আস্তানাটা ঘিরে ফেলল ওরা। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পেল ওর ভেতরে কেউ নেই। বিদেশী অফিসার পালার কাঁধ চেপে ধরল। প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত মনে হচ্ছিল লোকটাকে, মিথ্যে কথা বললি কেন? কোথায় ওরা?

পালা থর থর করে কাঁপছিল, আমি জানি না। আমি জানি না।

তুই এই গ্রামের মোড়ল আর তুই জানিস না? সত্যি কথা বল্ নইলে মেরেই ফেলব।

পালার কাঁধে সম্ভবত যন্ত্রণা হচ্ছিল, আমি জানি না। বলতে বলতে সে কেঁদে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে সজোরে আঘাত করল লোকটা। ছিটকে মাটিতে পড়ে গেল পালা। লা-ছিরিঙের পেশী শক্ত হয়ে উঠল। কিন্তু তখনই তার হাত মুঠোয় নিল পালদেম, চুপ করে থাক। মাথা গরম করিস না।

এই সময় ভেতর থেকে দুজন বেরিয়ে এল, ওরা এখানে ছিল স্যার। এখানে অনেক জিনিস পড়ে আছে যা এই এলাকার মানুষ ব্যবহার করে না। এই খালি ব্র্যান্ডির বোতলটা দেখুন আর সিগারেটের প্যাকেট, ইনট্যাক্ট।

অফিসার পড়ে থাকা পালার শরীরটার দিকে তাকিয়ে মুখ ফেরালেন। তারপর কয়েক পা এগিয়ে ভীত গ্রামবাসীদের মধ্যে থেকে একজনকে বেছে নিলেন। পালদেম আশঙ্কিত হয়ে দেখল লোকটা তার ভেনা। অফিসার ভেনাকে প্রশ্ন করলেন, ওরা কবে এখান থেকে গিয়েছে?

ভেনার গলার স্বর কাপল, বোধ হয় আজই। কারণ কাল রাত্রেও ওরা এখানে ছিল।

কোথায় গিয়েছে?

আমি জানি না। বিশ্বাস করুন, আমি জানি না।

শোন, আমি সত্যি কথা জানতে চাই। তোমাদের মুখ দেখতে এতটা পথ আমি কষ্ট করে আসিনি। যে করেই হোক ওই তিনটে লোককে আমরা চাই।

ভেনা তো বটেই, গ্রামবাসীরাও কোন উত্তর দিল না। অফিসার আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ওরা এখানে কি কবত? তোমাদের সঙ্গে কথা বলত?

ভেনা অত্যন্ত নার্ভাস ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, না।

অফিসার তার মুখের কাছাকাছি মুখ নিয়ে গেল, তাহলে অত টাকা কে দিল? তোমরা দুটো গল্প চালু করেছ। অভিযাত্রীরা তোমাদের দিয়ে গিয়েছে আর এখানে একটা মরে যাওয়া ডাকাতের কাছে তোমরা টাকা পেয়েছ? এবার সত্যি কথা বল।

ভেনা এক পা সরে গেল, আমি জানি না। যা কিছু ব্যাপার সব পালদেম জানে।

পালমে! পালদেম কে? ডাকো তাকে।

মন্দিরের চাতালে দাঁড়িয়ে পালদেম নিজের নামটা মুখে মুখে সজোরে উচ্চারিত হতে শুনল। সে খানিকটা অসহায়ের মত নিচের দিকে তাকাল। তারপর লা-ছিরিঙকে বলল, আমার যদি কিছু হয় তাহলে ওদের খবর দিস। তুই কখনও সামনে যাস না। আমি যাচ্ছি।

পালদেমকে আসতে দেখে সবাই পথ ছেড়ে দিল। সামনে দাঁড়িয়ে পালদেম মাথা দোলাল।

ওরা কোথায়? দাঁতে দাঁত ঘষলেন অফিসার।

জানি না। সকালে উঠে দেখেছি হাওয়া হয়ে গিয়েছে।

কেন?

ওদের একজন মরে গেছে জানতে পেরে কাল থেকে নিজেরা পরামর্শ করছিল।

কি করে জানল? এখান থেকে অনেক দূরে ঘটনাটা ঘটেছে।

আমি সেটা বলতে পারব না।

কত টাকা ও দিয়েছে তোমাকে?

অনেক। তাই দিয়ে আমরা ব্যাপারীদের কাছ থেকে শীতের জন্য জিনিসপত্র কিনেছি।

কোথায় যেতে পারে ওরা?

পালদেম চারপাশে তাকাল। তার পর কল্যাণ যে পথে গিয়েছিল সেই পথটা দেখাল, ওই দিক দিয়ে একটা রাস্তা আছে ফালুটে যাওয়াব।
 
অফিসার নির্দেশ দিতেই ছয়জন অশ্বারোহী সমস্ত গ্রামটার মধ্যে ছড়িয়ে গেল। একটু বাদেই চিৎকার চেঁচামেচি উঠল। ঘন ঘন বন্দুকের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। পালদো আর ভেনাকে দাঁড় করিয়ে রাখা। হয়েছিল। সমস্ত গ্রামটা লণ্ডভণ্ড করে তল্লাশ শেষ করে অশ্বারোহীরা ফিরে এসে বলল, ওরা এখন গ্রামের মধ্যেই নেই। কিন্তু এখানে বেশ জমিয়ে বসেছিল ওরা। কয়েকটা এমন ধরনের বড় ঘর বানানো হয়েছে যা এই পাহাড়ের কোন গ্রামে নেই।

বিরক্ত অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, ঘর কেন? প্রশ্নটা পালদেমের উদ্দেশ্যে।

যাতে বরফের সময় এখানে বুড়োদের কষ্ট না হয়। ভেনা উত্তরটা দিল।

অফিসার পালদেমের সামনে এসে দাঁড়ালেন, আমার মনে হচ্ছে তুমি জানো ওরা কোথায় আছে। আমি জানি না।

বলমাত্র রিভলভারের বাঁট দিয়ে ওর মুখে আঘাত হানল। সঙ্গে সঙ্গে দুহাতে মুখ চেপে ধরল পালদেম। গলগল করে রক্ত বের হচ্ছিল এখন। আঙুলের ফাঁক দিয়ে হাতে গড়িয়ে পড়ছিল। অফিসার তাঁর সঙ্গীদের বললেন, ওকে সঙ্গে নিয়ে চল। তাই দেখে যদি গ্রামের লোক হদিশ না বলে দেয় তাহলে ওকে আর বেঁচে এখানে ফিরতে হবে না। একজন পাহাড়ি অশ্বারোহী পলদেমের কোমরে দড়ি বেঁধে দিল। পালদেম অসহায়ের মত ওপরে চারপাশে তাকাচ্ছে। দূরে দাঁড়ানো ভীত গ্রামবাসী, পাশে মুখ নিচু করে থাকা তার ভেনা এবং ওপরে দাঁড়ানো কাহুনকে সে চুপচাপ দেখল।

অফিসারের নির্দেশে একজন অশ্বাবোহী চিৎকার করে জানাল, তোমরা যদি না জানাও ওরা কোথায় আছে তাহলে এই লোকটাকে আমরা মেরে ফেলব।

কোন সাড়া এল না। অফিসার আবার নির্দেশ দিতেই লোকটি জানতে চাইল, এর বউ কোথায়?

এই সময় ভিড়ের মধ্যে থেকে পালদেমের বউ বেরিয়ে এল।

লোকটা তাকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার স্বামী মরে যাবে তুমি চাও?

হঠাৎ মেয়েটি চিৎকার করে উঠল, কেন তোমরা ওর ওপর অত্যাচার করছ?

কারণ তোমরা বলছ না যাদের আমরা চাই বা কোথায়?

পালদেমের বউ বলল, আমি জানি না। আর জানলেও বলতাম না।

অফিসার এবার হতভম্ব হয়ে পড়লেন, তোমার স্বামীর জীবন বাঁচাবে?

যারা আমার ছেলেকে মৃত্যুর হাত থেকে বিয়ে এনেছে তাদের সঙ্গে বেইমানি কবর না!

পালদেমের বউ-এর কথা শেষ হওয়ামাত্র গ্রামবাসীদের মুখে একটা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। অফিসার চমকে তাকালেন। এই প্রথম গ্রামের মানুষেরা অসন্তোষ জানাচ্ছে। অবশ্য তিনি ভীত হলেন না! এতগুলো মানুষকে খালিহাতে কবজা কলার মত অস্ত্র তার সঙ্গে আছে। কিন্তু এই মের কাছাকাছি উগ্ৰপন্থীরা আছে জানা সত্ত্বেও তিনি। খালি হাতে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারছিলেন না।

নিজেদের মধ্যে পরামৰ্শ করার পর অফিসার ঠিক করলেন পালদেমকে মুক্তি দেওয়া উচিত হবে না।

আবার এই বিচ্ছিরি গ্রামে রাত কাটানো ওদের পছন্দ হচ্ছিল না। পালদেমকে নিয়ে গেলে আজ না হোক কাল খবর পৌঁছে দেবেই।

অশ্বারোহীরা ফিরে যাচ্ছি। পেছনে কোমরে দড়ি বাঁধা পালদেম টলতে টলতে উঠছিল! আর তার পেছনে গ্রামবাসীরা। তাদের গলায় কান্না। গ্রামের সীমা ছাড়ানোর পরই মেঘগুলো নেমে আসতে লাগল দ্রুত। মুহূর্তে সমস্ত চরাচর অন্ধকার হয়ে গেল! অশ্বরোহীরা তাদের গতি বাড়াবার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ ওপর থেকে একটা বড় পাথর গড়িয়ে এল তাদের সামনে। ঘোড়াগুলো চিৎকার শুরু করল। পাথরটা আঘাত করল ডানদিকের একটা ঘোড়ার শরীরে। আহত হয়ে মুখথুবড়ে পড়ল সেটা। মেঘ এবং অন্ধকাবে অশ্বাবোহীরা কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। অফিসার কয়েকবার ফাঁকায় গুলি চালালেন। এবার একটার পর একটা পাথর পড়তে লাগল। আরও দুটো ঘোড়া আহত হল তাতে। পালদেম দড়িবাঁধা অবস্থায় পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল। পাথর ড়াবার পর থেকে নিচের গ্রামবাসীরা আর উঠছে না। আহত ঘোড়াদের আরোহীরা তখন নিচে দাঁড়িয়ে। তাদের একজন ছুটে গেল সামনে। তার পরেই ফিরে এসে চিৎকার করল, স্যার, ওকে ছেড়ে দিন। নইলে আমরা এখান থেকে বের হতে পারব না।

অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, ওরা কারা?

লোকটি জবাব দিল, দেখতে পাচ্ছি না। তবে সমস্ত পাহাড় জুড়ে পাথর আছে, ঠেলে দিলেই হল। একজনের পোশাক দেখতে পেয়েছি। সে উগ্রপন্থী নয়।

অফিসার দাঁতে দাঁত ঘষলেন। তাঁর হুকুমে পালদেমের কোমর থেকে দড়ি খুলে দেওয়া হল।

অফিসার চিৎকার করলেন, ঘোড়াগুলোকে নিয়ে যাওয়া যাবে?

একজন উত্তর দিল, চেষ্টা করতে পারি স্যার।

তাহলে এই ঘটনাটার কথা ভুলে যাও। সবাই জানবে আমরা উগ্রপন্থীদের হদিস পাইনি। ওদের বল আমরা বন্দী নিয়ে যাচ্ছি না।

কথাটা জানানো হতেই পাথর গড়ানো বন্ধ হল। আহত ঘোড়াগুলোকে কোনমতে হাঁটিয়ে দলটা যখন অদৃশ্য হল তখন চারধার চুপচাপ। অন্ধকার আরও ঘনাচ্ছে। হতভম্ব পালদেম তখনও দাঁড়িয়ে। বেশ কিছুক্ষণ পারে পাহাড়ের ওপরে একটি শরীর অস্পষ্ট দেখা গেল। তার পর তার গলার চিৎকার ভেসে এল, মেয়ে বন্দুকবাজকে বলো আমরা তার ঋণ শোধ করলাম।

পালদেম কথা বলতে পারছিল না। এবার তার পেছনে লা-ছিরিঙের গলা শোনা গেল, লোকটা কে বুঝতে পারছ?

পালদেম মাথা নাড়ল, হুঁ, বোলেন।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top