What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected গর্ভধারিণী - সমরেশ মজুমদার (3 Viewers)

৪২.
চাপ দিতেই দরজাটা খুলে গেল। চোখের সামনে কোন দৃশ্য নেই। ঘরের কোণে তিন পাথরের মধ্যে যেটা জ্বলছিল সেটা শেষ পর্যায়ে। অন্ধকারকে ঘোলাটে করে দেওয়া ছাড়া তার কোন ভূমিকা নেই। শব্দগুলো কিন্তু থামছিল না। একজন বেপরোয়া, অন্যজন সমানে তাকে শান্ত করে চলেছে। জয়িতা যে দরজায় তাও খেয়াল নেই দুজনের।

মাচার ওপর সুদীপকে চেপে ধরে রেখেছে মেয়েটা। জয়িতা আরও একটু এগোল। সুদীপ গোঙাচ্ছে। তার দুটো হাত যে দুর্বল তা বোঝা যাচ্ছে এখন, নইলে ও মেয়েটির শরীরে অমন নেতিয়ে পড়ে থাকত না। মেয়েটি তার দিকে পেছন ফিরে বসে। হঠাৎ জয়িতার মনে হল এই সুদীপকে সে চেনে না। সুদীপের মুখ দেখা যাচ্ছে না কিন্তু চট করে জয়িতার কালীঘাটের পটে আঁকা ছবিব কথা মনে পড়ল। বাবু বেশ্যাবাড়িতে যাবেনই, সতীসাধ্বী স্ত্রী মাতাল স্বামীকে দুহাতে আটকে রাখতে চেষ্টা করছেন। এখনই যেন সুদীপ উঠে লাথি মেরে ফিটনে চেপে বউবাজারে রাত কাটাতে যাবে। নিজেকে অনেক কষ্টে সংযত করল জয়িতা। সে শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, কি হচ্ছে?

মেয়েটি মুখ ফেরাল, ফিরিয়ে হাসল, ও তুমি! দ্যাখো না, বেচারা মাতাল হয়ে গিয়েছে! জয়িতা এবার সোজা সুদীপের পাশে এসে দাঁড়াল, সু-দী-প!

সুদীপের মাথাটা নড়ল। যেন আবছা সে বুঝতে পারল। তারপর জড়ানো গলায় বলল, কল্যাণ?

তোর লজ্জা করছে না? ছিঃ সুদীপ ছিঃ! তুই এখানে এসেছিস মদ খেয়ে মাতলামি করতে?

সুদীপ উঠতে গেল। তার দুটো হাত শক্তি সংগ্রহের জন্যে মেয়েটির শরীর এমনভাবে জড়িয়ে ধরল যে রাগে জয়িতার শরীর রি রি করে উঠল। সে মেয়েটির মুখের দিকে তাকাল। বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ বা লজ্জা সেখানে নেই। জয়িতা আর দাঁড়াতে পারল না।

অন্ধকারে সমস্ত মাঠটা সে ডিঙিয়ে এল, কিভাবে এল তা সে নিজেই জানে না। চোখের সামনে সুদীপের ভঙ্গিটা যেন সেঁটে আছে। নারী-পুরুষের ঘনিষ্ঠ মুহর্তের সঙ্গে সে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পরিচিত। সুদীপ যা করছে তা সে ইচ্ছায় করছে না। কিন্তু কিন্তু..

দড়াম করে দরজাটা খুলে যেতেই আনন্দ চমকে তাকাল।.জয়িতার দিকে তাকিয়েই সে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে? তোর চেহারা এরকম হয়েছে কেন?

দরজাটা বন্ধ করে সুদীপের বিছানায় বসে পড়ল জয়িতা। এই মুহূর্তে তার কোন কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। আনন্দ ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিল। এবার জিজ্ঞাসা করল, সুদীপ কোথায়?

ঠোঁট কামড়াল জয়িতা। তারপর বলল, আছে, ভালই আছে।

ভাল আছে মানে? কি হয়েছে বল তো? সুদীপ তোকে অপমান করল নাকি? গেল কোথায় সে?

ও মেয়েটির ঘরে আছে।

তোর ঘরে বল্‌।

আমার ঘর আর হল কোথায়!

ওখানে কি করছে ও?

মাতাল অবস্থায় সুদীপ মেয়েটির সঙ্গে কি করছে তা দেখার জন্য তুই আমাকে নিশ্চয়ই দাঁড়িয়ে থাকতে বলবি না। আমি ভাবতে পারছি না, বিশ্বাস কর। মুখ ফেরাল জয়িতা।

আনন্দ চুপ করে গেল। সে জয়িতার মুখ দেখতে পাচ্ছে না।

হঠাৎ জয়িতা চিৎকার করে উঠল, আনন্দ, আমরা এসব করবার জন্যে এখানে আসিনি।

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু সুদীপ মদ পেল কোথায়? ওর সঙ্গে তো মদ নেই। মেয়েটি খাইয়েছে?

কাঁধ নাচাল জয়িতা, হতে পারে। যারা মদ খায় তাদের আমি বিশ্বাস করতে পারি না। আমি আমার বাবা-মাকে কখনও বিশ্বাস করতে পারিনি এই কারণে।

হঠাৎ আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, ওরা কি শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করেছে?

জয়িতা অত্যন্ত বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, আস্ক দেম। আমাকে জিজ্ঞাসা করে কি লাভ!

ওর বলার ভঙ্গি দেখে হেসে ফেলল আনন্দ, তুই বোধ হয় বেশি উত্তেজিত হচ্ছিস।
 
তুই হাসছিস আনন্দ! আমার উত্তেজনাকে তোর বেশি বলে মনে হচ্ছে! জয়িতা যেন আনন্দকে বিশ্বাস করতে পারছিল না, আমি ঘরে গিয়ে দেখলাম সুদীপ মাতাল। মেয়েটি ওকে জড়িয়ে ধরে উঠতে নিষেধ করছে। আমার গলা শুনে সুদীপ মেয়েটিকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরল-এর পরে আমি উত্তেজিত হব না?

কিন্তু তা সত্ত্বেও তুই জানিস না ওদের সম্পর্কটা কি? মেয়েটি ওকে মদ খাইয়েছিল কিনা অথবা ওরা ঘনিষ্ঠ হচ্ছে কিনা, তাও তো কল্পনায় দেখছিস? অতএব সুদীপের কষ্টের কথা না বলে অযথা উত্তেজিত হয়ে মাথা গরম করার কোন মানে আছে?

আমি এ সব সহ্য করতে পারি না। অসম্ভব। মাথা নাড়ল জয়িতা।

কেন?

বিকজ আই ডোন্ট লাইক ইট। শুধু শরীরের জন্যে দুটো নারীপুরুষ একত্রিত হলে ঘেন্না ছাড়া আর কিছু জন্ম নেয় না। আমাকে বোঝাতে আসিস না।

আনন্দ হাসল, তোর প্রকাশটা বড় বেশি উগ্র হয়ে যাচ্ছে জয়িতা!

জয়িতা সপাটে মুখ ফেরাল, কি বলতে চাইছিস?

আনন্দ বলল, এই মহিলাটির স্বামী মৃত, তাকেই সুদীপের পাশে বেশ অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল, একেই পাশের গ্রামের মানুষ ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, এই মেয়েটির সঙ্গে একটা সমঝোতা করে তুই একসঙ্গে আছিস–গ্রামের লোকজন কেউ ওর ব্যাপারে চিন্তিত নয়। সুদীপ প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে। ওর আচরণ যদি আমাদের কাজের কোন ক্ষতি না করে তা হলে কিছু বলার নেই। এটা ওর ব্যাপার, ওদের ব্যাপার।

মাথা নাড়ল জয়িতা, তোর এই মহাপুরুষের মত কথাবার্তা আমি টলারেট করতে পারি না। আমরা এখানে এসে যদি এসব করি তা হলে কলকাতা কি দোষ করেছিল? কেন আমরা প্যারাডাইস পোড়াতে গিয়েছিলাম? কল্যাণের জীবন দেওয়াটা কি নিরর্থক?

না, মোটেই না। কিন্তু পৃথিবীর শ্রদ্ধেয় বিপ্লবীরা কি ব্যক্তিজীবনে প্রেম ভালবাসার মর্যাদা দিতেন না? লেনিন কি রোবট ছিলেন?

চমৎকার। এই ঘটনাকে কি তুই প্রেম ভালাবাসা বলছিস? সুদীপের স্ট্যাটাস, ওর মানসিকতা, শিক্ষার সঙ্গে মেয়েটির কয়েক লক্ষ মাইলের ফারাক। এমন কি ওরা পরস্পরের ভাষাও বোঝে না।

কোথায় যেন পড়েছিলাম, ভালবাসার একটা নিজস্ব ভাষা আছে।

র‍্যাবিশ।

বেশ। অনেকক্ষণ থেকে তোকে যে কথাটা বলতে চাইছিলাম সেটাই বলি। প্রেমহীন শারীরিক সম্পর্ক যদি ওদের হয়ে থাকে তাহলে আমি সেটা সমর্থন করি না। কিন্তু লক্ষ্য করে দ্যাখ, ব্যাপারটা আমাকে যতটা না ভাবাচ্ছে, তোকে তার চেয়ে অনেক বেশি বিচলিত করছে। কেন?

কেন মানে? আমার রুচিতে লাগছে বলে।

তাই কি?

তুই কি বলতে চাইছিস?

তুই সুদীপের বন্ধু। মেয়ে হিসেবে তুই আরও বেশি কাছাকাছি। ব্যাপারটা তোর ইগোতে ঘা দিয়েছে।

মোটেই না। তুই কি মনে করিস আমি সুদীপের সঙ্গে–!

আমি কিছুই মনে করি না। ছেলে প্রেমে পড়লে বাবা যতটা না চটে মা তার চেয়ে বেশি খেপে যায়। কেন? অনেকটা সেইরকমই ধর। মিছিমিছি উত্তেজিত হচ্ছিস। ছেড়ে দে। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে, পালদেমের ওখানে চ। আনন্দ বাইরে বেরুবার জন্যে তৈরি হল।

জয়িতা বলল, তুই কিন্তু আমাকে আজ অপমান করলি আনন্দ।

মোটেই না। আমি শুধু বলতে চেয়েছি সুদীপের ব্যাপারটা তোর আমার ব্যক্তিগত বিষয় নয়।

আনন্দ ওর হাত ধরল। জয়িতা কিছু বলল না। কিন্তু দৃশ্যটা যেন সে কিছুতেই ভুলতে পারছিল না। তার কেবলই মনে হচ্ছিল যে নোংরামির প্রতিবাদ করার জন্যে ওরা এতদূরে আসতে বাধ্য হল সেই নোংরামিই সুদীপের মধ্যে এসেছে। এবং সেই মুহূর্তে মেয়েটিকে কি ভীষণ অহঙ্কারী মনে হচ্ছিল। জয়িতা নিজের ভাবনাটা ঘোরাতে চাইল। আনন্দর ইঙ্গিত যদি সত্যি হয়? না, সে তো জ্ঞানত সুদীপকে ভালবাসেনি। তাহলে?
 
বাইরে বেরোতেই ঝাঁপটা লাগল হাওয়ার। এবং খোলা আকাশের নিচে পা দিতেই যেন কুচি কুচি পাথরের টুকরো শরীরে বিধতে লাগল। জয়িতা যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠতেই আনন্দ বলল, মুখ নিচু করে দৌড়ো। মনে হচ্ছে বরফ পড়ছে।

বরফ পড়ছে। অথচ আকাশে মেঘ নেই, বৃষ্টি নেই। যেন হিমালয়ের কোল থেকে আঁজলা করে বরফ তুলে বাতাস ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে তাপল্যাঙের ওপরে। ওরা টলতে টলতে দৌড়তে লাগল। শীত এখন সর্বাঙ্গে। এবং এই পরিবর্তিত প্রাকৃতিক অবস্থা জয়িতার মন থেকে সুদীপ সংক্রান্ত ভাবনাটাকে চাপা দিয়ে দিল। তার গাল জ্বলছিল।

পালদেমের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই মনে হল এযাত্রায় বাঁচা গেল। ঘরের ঠিক মাঝখানে আগুন জ্বালিয়ে ওরা বসে আছে। যথেষ্ট উত্তাপ এখানে। আনন্দ আগুনের শরীরে প্রায় নিজের শরীর ঠেকিয়ে বলল, বাইরে কি বরফ পড়ছে।

পালদেম বলল, ঠিক বরফ নয়। কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবে মাটি চকচকে কাচের তলায় ঢাকা পড়ে আছে। রোদ উঠলেই অবশ্য গলে যাবে। কিন্তু এটা হয় বরফ পড়ার ঠিক আগে। তুমি কখনও বরফ পড়া দ্যাখোনি, না?

প্রশ্নটা জয়িতার দিকে তাকিয়ে। জয়িতা মাথা নেড়ে না বলল। সঙ্গে সঙ্গে হেসে উঠল পালদেমের বউ। কোন মানুষ বরফ পড়া দ্যাখেনি এটা যেন তার বিশ্বাসে আসছে না। এমন কি ওদের ছেলেটাও হাসি হাসি মুখ করে আছে, হয়তো কিছু না বুঝেই।

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল সাতদিন সময় পাওয়া যাবে?

তা যেতে পারে। কিন্তু বরফ পড়া মানে ঘরে বসে থাকা তো নয়। আমরা তো এই করেই বছরের পর বছর বেঁচে আছি। পালদমে আগুনটা খুঁচিয়ে দিচ্ছিল।

আনন্দ বলল, কিন্তু আমি চাইছি যারা বয়স্ক, অশক্ত বা শিশু তাদের জন্যে একটা ব্যবস্থা করে রাখতে। শেষ পর্যন্ত তোমার ভেনার সঙ্গে গ্রামের কটা পরিবার যোগ দিতে পারে বলে মনে হয়?

অন্তত দশ-বারোটা তো বটেই। তবে যাদের জমি বেশি নেই কিংবা থাকলেও চলে না তারা এসে তোমাদের প্রশংসা করেছে এইরকম একটা রাস্তা ভাবতে পারার জন্যে।

কিন্তু ওই দশ-বারোটা পরিবারের হাতেই কি বেশির ভাগ জমি?

অনেকটা। কিন্তু ওদের জমি চাষ করে দিই তো আমরা। এবার যদি আমরা আমাদের জমি বা কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি তাহলে ওরা বিপদে পড়বে। পালদেম হাসল, তাছাড়া আরও একটা ব্যাপার আছে। ওরা তোমাদের ভয় পাচ্ছে।

ভয়? কেন? আনন্দ অবাক হল। কারও আচরণে তার একথা মনে আসেনি।

তোমাদের কাছে অস্ত্র আছে যার ভয়ে পাশের গ্রামের মানুষরা পালিয়েছে।

আনন্দ কাঁধ ঝাঁকাল। এই জিনিসটা সে কখনই চায় না। সে বলল, যারা মনে করে আমরা ভয় দেখিয়ে তাদের দলে টানব তারা ভুল করছে। তুমি ওদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দিও।

জয়িতা বলল, পালদেমকে দিয়ে না বলিয়ে আমরাই যদি ওদের সঙ্গে কথা বলি তাহলে ভাল হয়।

আনন্দ আপত্তি করল, না। সে ক্ষেত্রেও ওরা ভাবতে পারে আমরা প্রকারান্তরে ভয় দেখাচ্ছি।

আলোচনা চলছিল। পরিবারগুলোকে কয়েক ভাগে ভাগ করে এক একটা কমিউনিটি কিচেন গড়ে ভোলা হবে। প্রতিটি কিচেনের জন্যে বরফের সময়টা মেপে খাদ্যবস্তুর ব্যবস্থা করা হবে। যারা বরফের সময়ে নিজের ঘরে থাকতে চায় তারা থাকবে কিন্তু বাকিদের জন্যে যে বিশেষ ঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছে সেখানে আগুন এবং অন্যান্য সুবিধে যাতে থাকে সেদিকে নজর দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে জ্বালানি হিসেবে প্রচুর কাঠ সংগ্রহ করা হয়েছে। আরও কাঠ জঙ্গল থেকে এনে চেরাই করে রোদে শুকিয়ে তৈরি করে রাখা হবে। এইসঙ্গে যুবকদের নিয়ে একটা দল তৈরি করা হবে যাদের ওপর দায়িত্ব থাকবে বরফের সময় যে কোন বিপদের মোকাবিলা করার। ভালুক এবং নেকড়ে ছাড়া কোন পশুর দেখা সে সময় পাওয়া যায় না। এই গ্রামের মানুষ তাই শিকার করে পেট ভরায়। বিকল্প ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত আনন্দ এই শিকার বন্ধ করতে চাইল না। পরবর্তী পর্যায়ে গ্রামের মানুষদের আয় বাড়াবার জন্যে ডেয়ারি, পোলট্রি, জঙ্গল থেকে এলাচ সংগ্রহ করে জমানো থেকে শুরু করে চাষযোগ্য জমিগুলোর অবস্থার উন্নতি করিয়ে ফসল ফলানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাপারটা পালদেমের কাছেও অভিনব। একটা আঙুল যেটা ধরতে পারে না, একটা হাত সেটা স্বচ্ছন্দে পারে। কিন্তু কাহুনকে কোনভাবে বিব্রত করতে চাইল না আনন্দ। এই মানুষটি যখন প্রচলিত অর্থে শোষক নয় তখন তার প্রতি গ্রামের মানুষদের বংশানুক্রমে যে শ্রদ্ধা রয়েছে সেখানে হস্তক্ষেপ অবাঞ্ছনীয় হবে। কাহুন যতক্ষণ নির্লিপ্ত ততক্ষণ তাকে নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। ওরা যখন খাওয়া শেষ করল তখনই বাইরে শব্দ হল। পালদেম দরজাটা খুলতেই ছেলেগুলোকে দেখতে পেল। তারা প্রত্যেকে ভারী ভারী বস্তাগুলো পিঠে করে এই কুচি বরফের মধ্যে পাহাড় ভেঙে এইমাত্র এল। আনন্দ ওদের ঘরের ভেতব ডাকল এবং জয়িতা লক্ষ্য করল এটা পালদেম পছন্দ করল না। বোঝাগুলো নামিয়ে ছেলেগুলো আগুনের সামনে বসতে পেরে যেন বেঁচে গেল। পালদেম দাঁড়িয়েছিল আনন্দর পাশে। আনন্দ চাপা গলায় বলল, মনে রেখো ওরা তোমার কথায় এতদূর গিয়েছে। আর ওরা যা বয়ে নিয়ে এসেছে তা গোটা গ্রামের উপকারে লাগবে।

পালদেম একই গলায় বলল, কিন্তু আমার বউ ব্যাপারটা মানতে পারছে না।

ওকে বুঝিয়ে বলো পরে। আনন্দ আড়চোখে পালদেমের বউকে দেখল। হঠাৎ বাচ্চাকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত সে।
 
আগুন পেয়ে কিছুটা ধাতস্থ হবার পর ওরা পালদেমকে গল্প শোনাচ্ছিল। দোকানদার ওদের কাছে অত টাকা দেখে কিরকম ঘাবড়ে গিয়েছিল। এর আগে খচ্চরওয়ালারাও নাকি বলেছে এখন তাপল্যাঙের মানুষের কাছে প্রচুর টাকা এসেছে। ওরা সবাই উৎসটা জানতে চাইছিল। কিন্তু ওরা যে গল্প বলেছে তা হল একজন ডাকাত তাপল্যাঙের কাছে দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল, এইসব টাকা তার কাছ থেকেই পাওয়া গিয়েছে। কথাগুলো কেউ কেউ বিশ্বাস করলেও যারা করেনি তারা অন্য কিছু খুঁজেও পায়নি। কিন্তু ওখানে থাকতেই ওরা একটা কথা শুনতে পেয়েছিল যার জন্যে দোকানদার তাদের গল্পটাকেই সমর্থন করেছিল। একটা পুলিশবাহিনী নাকি চ্যাঙথাপুর কাছে পৌঁছে গিয়েছে। ওরা নিশ্চয়ই আসছে সেই ডাকাতটির সন্ধানে। কিন্তু চ্যাঙথাপু থেকে যারা ওয়ালাংচাঙে এসেছে তারা শুনেছে যে একটা ডাকাত নয়, অনেক ডাকাত এই তল্লাটে লুকিয়ে আছে। আর তাপল্যাঙের লোকন যে টাকা পেয়ে গেছে এ খবরও খচ্চরওয়ালাদের কাছ থেকে পুলিশেরা জানতে পেরেছে। কথাটা শোনামাত্র ওরা রওনা হয়ে পড়েছিল। ওদের বিশ্বাস পুলিশ এলে দোকানদারও তাদের কথা বলবে।

আনন্দর চোয়াল শক্ত হল। এই পুলিশ দল নিশ্চয়ই ফালুটের ফাড়ি থেকে আসছে না। যাই হোক, ভারতীয় পুলিশের কাছে এখন খবরটা চাপা নেই। তারা মরীয়া হয়ে ওদের ধরবার জন্য বাহিনী পাঠাচ্ছে এখানে। কল্যাণের মৃত্যু বোধহয় ওদের টনক নড়িয়েছে। কিন্তু আর যাই হোক এই তল্লাটে পুলিশরাও তাদেরই মত নবাগত। এক্ষেত্রে বিনা যুদ্ধে ধরা দেওয়ার কোন প্রশ্ন নেই। এবং যারা এতদুরে তাদের ধরতে আসছে তারা নিশ্চয়ই জেলে বসিয়ে খাবার খাওয়াবে না। আর সেভাবে জীবন কাটাবার চেয়ে মরে যাওয়া ঢের ভাল।

আনন্দ জয়িতাকে ডাকল, চল, উই মাস্ট বি রেডি।

জয়িতা ভাবছিল, ওর গলার স্বর শুনে মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করল, কিভাবে?

ওরা কখন এই গ্রামে পৌঁছাবে জানি না। কিন্তু তার আগে আমাদের সতর্ক হতে হবে যাতে আচমকা ধরা না পড়ি। সুদীপটাকে তুলতে হবে। এই সময় মাল খেয়ে আউট হয়ে পড়ে রইল। আনন্দকে চিন্তিত দেখাচ্ছিল।

মাথা নাড়ল জয়িতা, না, আমরা যুদ্ধ করব না।

সেকি! আনন্দ হতভম্ব, তুই ধরা দিতে চাইছিস?

না। জয়িতা বলল, আমি কিছুই করতে চাইছি না। আমার মনে হয় ওদের মুখোমুখি না হওয়াই ভাল। সরাসরি মোকাবিলা করা মানে, অসম যুদ্ধ। দ্বিতীয়ত, ওরা আমাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হবে। তৃতীয়ত, এযাত্রায় যদি আমরা জিতেও যাই তবু পরিত্রাণ পাব না। ওরা আরও বড় বাহিনী নিয়ে ফিরে আসবে। একটা সুশিক্ষিত সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে আনাড়ি হাতে লড়াই করা মানে আত্মহত্যা করা। মরে গেলে তাপল্যাঙের মানুষের জন্যে যা করতে চাইছি তা তুই করবি কি করে?

কথাগুলো হচ্ছিল বাংলায় যা পালদেমের বোঝার কথা নয়। কিন্তু সে মন দিয়ে শুনছিল। জয়িতা থামতে সে বলল, আমাদের এই গ্রামে পুলিশ কখনও আসেনি। এরা যা বলছে তা যদি সত্যি হয় তাহলে আর দেরি নেই তাদের এখানে আসতে। তোমাদের একটা কথা বলি, গ্রামের কোন মানুষই চাইবে না এখানে লড়াই হোক। তোমরা ওদের সঙ্গে লড়াই করতে চেও না। তোমাদের সঙ্গে লড়াইয়ে গ্রামের মানুষের যে ক্ষতি হবে না তা কে বলতে পারে! তাছাড়া লড়াইয়ে এক পক্ষকে হারতেই হয়। তোমরা হারলে এতক্ষণ যেসব কথাবার্তা ঠিক হল সব বেঠিক হয়ে যাবে। তোমরা তোমাদের ঘরে ফিরে যাও। আমি পালার সঙ্গে কথা বলে দুতিনজনকে নিয়ে আসছি।

বেরিয়ে যাওয়ার সময় আনন্দ ছেলেগুলোকে বলল বস্তাগুলো কোথায় রাখতে হবে। এখন পায়ের তলায় কুচি বরফ জমাট হতে চলেছে। হাওয়া বইছে। তবে সেই হাওয়ায় বরফ ভেসে আসছে না বলে কষ্টটা কম হচ্ছে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল আনন্দ, তারপর জয়িতাকে বলল, তুই আস্তানায় যা, আমি সুদীপকে দেখে আসি। ওকে যে করেই হোক তুলতে হবে।

জয়িতা বলল, তুই একা পারবি না। সে আর কথা না বাড়িয়ে মেয়েটির ঘরের দিকে রওনা হল। সমস্ত শরীর থরথরিয়ে কাঁপছে। দাঁতে দাঁতে একনাগাড়ে শব্দ বাজছে।

আনন্দ দরজাটা ঠেলতে কোন মানবিক আওয়াজ শুনতে পেল না। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ডাকল, সুদীপ।

কোন সাড়া এল না ভেতর থেকে। জয়িতা ভেতরে ঢুকে পড়ল। আনন্দ দাঁড়িয়েছিল। এই সময় অন্ধকারে জয়িতার গলা শোনা গেল, ওরা এ ঘরে নেই।

সেকি রে? আনন্দ অবাক। একটা পরিপূর্ণ মাতাল এমন অবস্থায় বাইরে যাবে কেন?

জয়িতা ফিরে এল, আমি বুঝতে পারছি না। সুদীপের কোন হুঁশ ছিল না নিজের চোখে দেখেছি।

কিন্তু কোথায় ওর খোঁজ করি বল তো? পালদেমের সাহায্য চাওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই।
 
ওরা চুপচাপ প্রায় ছুটে আসছিল। জয়িতা রহস্যটার মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছিল না। ওর মনে এতক্ষণ যে অস্বস্তিটা নখ বসাচ্ছিল আচমকা সেটা জরাগ্রস্ত হয়ে ভয়ে রূপান্তরিত হল। যদি পাশের গ্রামের মানুষরা এমন রাতের সুযোগে মেয়েটিকে নিয়ে যেতে আসে এবং সুদীপকে খুন করে কোথাও ফেলে যায়? অসম্ভব নয়। কারণ সেই ঘটনার পর ওরা বন্ধুর হাত বাড়িয়ে দেয়নি। ওই সময় মাথা গরম না করলে এই ঘটনাটা ঘটত না। সুদীপ যাই করুক, এমন সোজা মনের ছেলে সে দ্যাখেনি। সোজা কিন্তু বেহিসাবী। আর শেষটাই ওর কাল হয়ে দাঁড়াবে তা কে জানত।

আস্তানার বারান্দায় উঠে আনন্দ বিস্মিত। ভেতরে আগুন জ্বলছে। এবং সেই সঙ্গে একটি নারীকণ্ঠে অবোধ্য ভাষায় সুর খেলা করে যাচ্ছে। সন্ধ্যা মুখোঁপাধ্যায়ের প্রথম দিকের সিনেমার একটি হিট গান যা কিনা ঠিক এই রকম মেলোডিয়াস। সে ধীরে ধীরে দরজাটা ঠেলতেই দৃশ্যটা দেখতে পেল। মেয়েটি আগুনের পাশে উবু হয়ে বসে চোখ বন্ধ করে গান গাইছে। আর তার সামনে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে সুদীপ। আগুনটাকে ওরাই জ্বালিয়েছে। কথা না বুঝলেও সুর মানুষের মনে ভাষা তৈরি করতে পারে যদি তা আন্তরিক হয়। সুখ এবং দুঃখের প্রান্তে এমন একটা অনুভূতি আছে যার প্রকাশ একটাই সুরে সম্ভব। এই গান শুনে আনন্দ বুঝতে পারছিল না মেয়েটি দুঃখী না সুখী!

জয়িতা এগিয়ে যেতেই মেয়েটি গান থামিয়ে চমকে মুখ তুলল। তারপর সরল হাসল। আনন্দ দেখল, জয়িতার মুখে আগুনের আভা লেগেছে। সে চটপট জিজ্ঞাসা করল, তোমরা কখন এসেছ এখানে?

মেয়েটির একটা হাত সুদীপের বুকের ওপরে তখনও। সেই অবস্থায় বলল, অনেকক্ষণ। তারপর জয়িতার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি চলে আসার পর ও আর আমার ঘরে থাকতে চাইল না।

হঠাৎ জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, তুমি ওর কাছে ঠিক কি চাও?

আমি? মেয়েটি মাথা নিচু করল এবার, তারপর চুপ করে বসে রইল।

জয়িতা আবার জিজ্ঞাসা করল, না, চুপ করে থাকলে চলবে না। তুমি সুদীপ–। আমি জানতে চাই সুদীপ তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে কিনা? আর তাই করে থাকলে সেটা তোমার প্রশ্রয়েই হয়েছে। ব্যাপারটা তোমাকে বলতে হবে!

আনন্দ জয়িতার দিকে তাকাল। জয়িতা এখন যে গুছিয়ে কথা বলতে পারছে না তা সে বুঝতে পারল। জয়িতা জানতে চাইছে সুদীপ মেয়েটির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে কিনা। কোন মেয়েকে এরকম প্রশ্ন সরাসরি করা যে অস্বস্তিকর তা এই মুহূর্তে জয়িতাও ভুলে গিয়েছে। সে এগিয়ে গিয়ে সুদীপের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে দুহাতে ঝাকাতেই সুদীপ চোখ মেলল। চোখ দুটো এখন টকটকে লাল। প্রথমে মনে হল সুদীপ চিনতে পারছে না। মেয়েটি বলল, ওকে ঘুমাতে দাও। ঘুমালে সব ঠিক হয়ে যাবে।

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, ও এখানে কিভাবে এল? মনে হচ্ছে হেঁটে আসেনি।

মেয়েটি মাথা নাড়ল, আমি নিয়ে এসেছি।

জয়িতা মেয়েটাকে ভাল করে দেখল আবার। সুদীপকে বয়ে নিয়ে আসার শক্তি ও ধরে?

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, সুদীপ তোমাকে কিছু বলেছে?

হ্যাঁ। মেয়েটি হাসল, ও বলেছে এখন থেকে আমরা বন্ধু।

আনন্দ উঠে এল জয়িতার কাছে। তারপর নিচু গলায় বাংলায় বলল, মাথা গরম করিস না। মনে হচ্ছে মেয়েটা ইনোসেন্ট। তবে পালদেমরা ব্যাপারটাকে কিভাবে নেবে বুঝতে পারছি না।

জয়িতা সুদীপের দিকে তখন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। ওর ঠোঁট বেঁকে যাচ্ছিল। এমনিতেই এই প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় অন্যদের মত তার ঠোঁটেও এখন ফাটল এবং সামান্য ক্ষতের চিহ্ন তবু এই বিকৃতিটা ধরা পড়ল।

জয়িতা অন্যমনস্ক গলায় বলল, মানুষ কেন মদ খায় যদি এই অবস্থা হয়।
 
এই সময় দরজায় শব্দ হল। আনন্দ গলা তুলে আসতে বললে পালদেমরা এল। ওরা দুজন, পালমে আর লা-ছিরিঙ। মেয়েটিকে দেখে পালদেমের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। এবং আশ্চর্য ব্যাপার, ওদের দেখামাত্র মেয়েটি আগুনের সামিধ্য ছেড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়াল। পালদেম আনন্দকে জিজ্ঞাসা করল, ও কি এখন এই ঘরেই থাকে?

আনন্দ মাথা নাড়ল, না। আমাদের এই বন্ধু অসুস্থ, তাই ওকে নিয়ে এসেছে।

লা-হিরিঙ বলল, ওর খুব নেশা হয়ে গিয়েছে।

পালদেম মেয়েটিকে দেখল, ওর সামনে তোমরা কথা বলতে চাও? আমি ওকে বিশ্বাস করি না, যতদিন ও আবার বিয়ে না করে।

জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, বিয়ে করার সঙ্গে বিশ্বাস অবিশ্বাসের কি সম্পর্ক?

পালদেম উত্তর দিল, আমাদের এখানে নিয়ম প্রত্যেক যুবতী মেয়ের স্বামী থাকবে। স্বামী হল তার চরিত্রের চারপাশে বেড়ার মতন। না হলে পাপের ঢুকতে দেরি হয় না।

বাজে কথা। জয়িতা চেঁচিয়ে উঠল, তাহলে তো তোমরা আমাকেও বিশ্বাস করো না।

তুমি বাইরে থেকে এসেছ। আমাদের নিয়ম তোমার ক্ষেত্রে খাটে না।

এসব তোমরা নিজেদের সুবিধেমত তৈরি করে নিয়েছ। একটা মেয়েকে বা পুরুষকে বিশ্বাস করা যায় তার কাজের মধ্যে দিয়ে। জয়িতা শক্ত গলায় জানাল।

বেশ। ওর কাজই কি বিশ্বাসের যোগ্য? স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করত। বাচ্চা হয়নি বলে স্বামীকে দোষ দিত। মানলাম লোকটা খারাপ ছিল। কিন্তু হাজার হোক স্বামী। সে মরে যাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে ও অন্য গ্রামের মানুষের সঙ্গে পালিয়ে যাচ্ছিল। কেন?

তোমরা ওকে একঘরে করে রেখেছিলে তাই।

তোমাদের এই বন্ধুর সঙ্গে ওর এত ভাব, ওর মতলব কি তা জানো?

জানি না। জানতেও চাই না। যতক্ষণ না ওর কাজের জন্যে গ্রামের অন্য মানুষগুলোর ক্ষতি হচ্ছে ততক্ষণ আমাদের নাক গলাবার কোন মানে হয় না। জয়িতা কথা শেষ করতে আনন্দ ওর দিকে সবিস্ময়ে তাকাল। এতক্ষণ জয়িতা মেয়েটিকে সহ্য করতে পারছিল না। অথচ এখন ওরই হয়ে সমানে লড়ে যাচ্ছে। তারপরেই খেয়াল হল, জয়িতা সমর্থন করছে একটি কোণঠাসা মেয়েকে। বিশেষ এই মেয়েটিকে নয়। সে বলল, এসব কথা বলে সময় নষ্ট করার দরকার নেই।

লা-ছিরিঙ জয়িতার দিকে তাকিয়ে হাসল, তোমাদের ধরতে পুলিশ আসছে? আমি কখনও পুলিশ দেখিনি। ওরা কি খুব নিষ্ঠুর?

জয়িতা ছেলেটির দিকে অবাক হয়ে তাকাল। এই সারল্যের কি জবাব দেবে সে?

পালদেম আবার মেয়েটিকে দেখল। তারপর একটু ইতস্তত করে বলল, পুলিশ এই গ্রামে হামলা করলে আমরা বিপদে পড়ব। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা তোমাদের সাহায্য করছি তোমরা আমাদের ভাল চাইছ। এখানে পুলিশ বেশিদিন থাকতে পারবে না। বরফ পড়ার আগেই ওরা চলে যেতে বাধ্য হবে। ততদিন তোমরা পাহাড়ে লুকিয়ে থাকবে। লা-ছিরিঙ তোমাদের এমন জায়গায় নিয়ে যাবে যেখানে বাইরের লোক কখনই পথ চিনিয়ে না দিলে পৌঁছাতে পারবে না। দিনের বেলায় এই গ্রাম ছেড়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না। কারণ গ্রামের সব মানুষই যে মুখ বন্ধ করে থাকবে এমন না-ও হতে পারে। পুলিশ যদি জিজ্ঞাসা করে তোমাদের কথা আমরা অস্বীকার করব না। কিন্তু বলব তোমরা চলে গেছ। অস্বীকার করে যে লাভ হবে না তা বুঝতেই পারছ। তোমাদের আপত্তি আছে?

আনন্দ বলল, না। কিন্তু যেখানে আমরা লুকিয়ে থাকব সেখানে থাকা যাবে তো?

কষ্ট হবে। তবে একটা চমৎকার গুহা আছে উত্তরের পাহাড়ে। সেখানে আগুন জ্বালালেও কেউ টের পাবে না। শুধু পাহাড়ি ভালুকের আর দানোর ভয় ছাড়া কিছু নেই।

ঠিক আছে। ওদের আমরা সামলে নেব। আনন্দ বলল।

অতএব স্থির হল ভোরের আগেই বেরিয়ে পড়া হবে। এই ঘরে যে সমস্ত জিনিসপত্র আছে তার কিছুটা পালদেমের কাছে রেখে বাকিগুলো ওরা সঙ্গে নিয়ে যাবে। ওদের সঙ্গে যাবে লা-ছিরিঙ। আনন্দ আর জয়িতা ছড়ানো সংসার গোছাতে লাগল। পালদেম জানাল পুলিশ গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ামাত্র সে খবর পাঠাবে ফিরে আসতে। আনন্দ তাকে বুঝিয়ে দিল গ্রামের মানুষদের নিয়ে তাকে কি কি করতে হবে। পালদেম চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই সমস্ত জিনিস গোছানো শেষ হলে হঠাৎ জয়িতা করে কেঁদে উঠে সামলে নেবার চেষ্টা করল প্রাণপণে।

আনন্দ দেখল জয়িতা কল্যাণের পড়ে থাকা জিনিসগুলোর ওপর হাত রেখেছে।
 
৪৩.
রোবট দ্যাখেনি জয়িতা স্বচক্ষে তবে যা বর্ণনা পড়েছে তার সঙ্গে এই মুহূর্তের সুদীপের কোন তফাৎ নেই। ও হাঁটছে যে ভঙ্গিতে সেটা মোটেই স্বাভাবিক নয়।

অনেক সাধ্য-সাধনার পরও যখন সুদীপের চেতনা পরিষ্কার হল না তখন লা-ছিরিঙ একটা গাছের পাতা এনেছিল। ওই শেষ রাতের ঠাণ্ডায় শরীরে তেমন শীতবস্ত্র না থাকা সত্ত্বেও ওরা যেভাবে চলাফেরা করে সেটা অভ্যেসের ফসল হতে পারে কিন্তু গাছপালা হাতড়ে পাতা খুঁজে আনা কম কথা নয়। সুদীপের মুখের ভেতর পাতাটা পুরে দিয়ে চোয়ালে দুহাতের চাপ দিয়ে সেটাকে নাড়াতে বাধ্য হয়েছিল লা-ছিরিঙ। পাতার রস পেটে যাওয়া মাত্র বমি হয়েছিল সুদীপের। সেই বমির রঙ দেখে চমকে উঠেছিল ওরা। কোন মানুষ এমন ঘন কালো রঙের বমি করতে পারে ওরা জানত না। বোধ হয় শরীরের অস্বস্তিটা সামান্য কমতেই আরও আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল সুদীপ। বোঝা যাচ্ছিল এখন ওর ঘুম দরকার। কিন্তু তাপল্যাঙে ঘুমিয়ে থাকার ঝুঁকি ওই সময় নেওয়া আর মৃত্যুকে ডেকে আনা একই ব্যাপার। আনন্দ সুদীপের মাথাটা দুহাতে তুলে প্রায় আর্তনাদ করেছিল, সুদীপ, উই আর ইন ট্রাবল, পালাতে হবে এখনই। সুদীপ চোখ তুলেছিল। হয়তো কথাগুলো বুঝতে পেরেছিল। কারণ সে উঠে বসতে চেষ্টা করেছিল। জয়িতা তার অন্যদিকটা ধরে তোলার চেষ্টা করার পর সে কাটা গাছের মত টলমল করতে লাগল। ওর নিজস্ব শক্তির এক ফোঁটাও অবশিষ্ট নেই।

সেই সময় মেয়েটি এগিয়ে এল। কোন কথা না বলে সুদীপের শরীরটা নিজের পিঠে তুলে নিল সে। জয়িতা হতবাক। সুদীপ বেশ স্বাস্থ্যবান অথচ মেয়েটি অবলীলায় তুলে নিল ওকে। সে শুনল লা-ছিরিঙ বিড় বিড় করে কিছু বলল। সেটা প্রশংসার না নিন্দের তা অবশ্য বোঝা গেল না।

ওরা যাত্রা শুরু করেছিল শুকতারা চোখে রেখে। বের হবার আগে সমস্ত ঘরটা জরিপ করে নিয়েছিল যাতে ওদের কোন স্মৃতিচিহ্ন না থাকে। লা-ছিরিঙ আর জয়িতা সামনে, সুদীপকে নিয়ে মেয়েটি মাঝখানে আর শেষে আনন্দ। ওরা যখন তাপল্যাঙ থেকে বেরিয়ে এল তখন কোন মানুষ জেগে নেই। এমন কি কুকুরগুলো পর্যন্ত আর চিৎকার করছে না। আলো জ্বলছে না কোথাও। আর ঠাণ্ডা এখন হায়েনার দাঁতের চেয়েও ধারালো। আনন্দ স্পষ্ট বুঝতে পারল ওর নাকের ডগা ফাটছে। ইতিমধ্যে যা ফেটেছিল তাতেই ভয় হচ্ছিল রস না গড়ায়। সেখানে হাওয়া লাগায় এখন আরও জ্বালা করছে।

ওরা যাচ্ছিল আরও উত্তরে। পায়ের তলায় এখন রীতিমত কাচ-বরফ। চাপে মচমচিয়ে ভাঙছে। ওরা এখন নামছে ঢালুতে। ফলে বেশি শক্তি খরচ হচ্ছে না। আনন্দ সুদীপের দিকে তাকাল। ওর মাথাটা মেয়েটির কাঁধের ওপর এতক্ষণ নেতিয়ে ছিল। এই পাহাড়ি পথে অতটা ওজন নিয়ে মেয়েটা ঝুঁকে হেঁটে যাচ্ছে। কেন? কি দরকার এত কষ্ট করার? ওর মনে হল জয়িতা যে রেগে গিয়েছিল তার পেছনে এই কারণটা ছিল। মেয়েটি মানসিকভাবে সুদীপের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে। যতদূর মনে পড়ে কোন মনস্তাত্বিক লেখেননি শুধু শরীরের প্রয়োজনে বা আপাত ভাল লাগায় কোন পুরুষ আর একজনের জন্যে এত কষ্ট করে না। সুদীপকে বাঁচাবার তাগিদ আছে মেয়েটার। আর এইভাবে জড়িয়ে পড়াটা জয়িতার পছন্দ নয়।

লা-ছিরিঙ আর জয়িতা দাঁড়িয়ে পড়ল চড়াই-এর মুখে এসে। ভোর হচ্ছে। যদিও সূর্যেদেবের কোন হদিশ নেই কিন্তু মাকালুর চুড়োটা রঙ পালটাচ্ছে। ওপাশে চ্যামল্যাঙের মাথায় সিঁদুর জমল। লোৎসেকে দেখা গেল তার পরেই। যেন হাতের মুঠোয় ওরা। ঠিক সেই সময় কোথেকে একটা সাদা মেঘের থাবা লুকিয়ে ফেলল এভারেস্টকে। জাগব জাগব করেও বেচারার জাগা হল না। এই সময় মেয়েটা ধীরে ধীরে নামিয়ে দিল সুদীপকে। খানিকটা টলমল করে সে স্থির হল। জয়িতা মালপত্র নামিয়ে রেখে দ্রুত এগিয়ে গেল তার কাছে, কেমন লাগছে এখন? বেটার ফিল করছিস? সুদীপ কথা বলতে গেল কিন্তু ওর ঠোঁট দুটো শুধু নড়ল। শেষপর্যন্ত সে স্থির হয়ে দাঁড়াল, ঠিক পুতুলের মত।

লা-ছিরিঙ তাড়া লাগাল, জলদি চল। এই পাহাড়টা ভাল করে আলো ফোঁটার আগেই পেরিয়ে যেতে হবে।

আনন্দ মুখ তুলে পাহাড়টা দেখল। খুব উঁচু নয়, কিন্তু মাথা তুলে দেখতে গেলে ঘাড়ব্যথা হয়ে যায়। সে বলল, ওকে নিয়ে এতটা উঁচু পেরোব কি করে?

লা-ছিরিঙ বলল, ওকে যে বয়ে এনেছে এতটা সেই নিয়ে যাবে। চল চল। সোজা উঠতে হবে না, ভেতরে ভেতরে রাস্তা আছে। গ্রাম থেকে এই জায়গাটা চেষ্টা করলে দেখা যায়। সে জিনিসপত্র আবার তুলে নিল। ওরা হাঁটা শুরু করতেই কাণ্ডটা ঘটল। লা-ছিরিঙকে অনুসরণ করে সুদীপ হাঁটতে লাগল। প্রথম দিকে সে টালমাটাল হচ্ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সামলে উঠল। পুতুল কিংবা রোবটের মত দেখতে লাগছিল ওকে তখন। মনে হচ্ছিল যে কোন মুহূর্তেই সে পড়ে যাবে। শরীর বাঁক নিচ্ছে না। কারও সঙ্গে কথা বলছে না। তার দুটো হাত শরীরের দুপাশে শক্ত হয়ে ঝুলছে। ওর দিকে তাকালেই মনে হয় পৃথিবীর কোন কিছুর সম্পর্কেই সে ভাবছে না। শুধু তার হেঁটে যাওয়া, সে তাই হাঁটছে। মেয়েটি ঠিক ওর পেছনে। বোধ হয় সতর্ক নজর রাখছে ও সুদীপের ওপর। জয়িতার খুব ইচ্ছে করছিল সুদীপের সঙ্গে কথা বলতে। এই সুদীপের সঙ্গে পরিচিত ছটফটে সুদীপের কোন মিল নেই। আর এটাই অত্যন্ত অস্বস্তির। চলতে চলতে লা-ছিরিঙও সুদীপকে ঘুরে ঘুরে দেখছিল। এবার সে জয়িতাকে বলল, তোমাদের এ বন্ধু খুব তাড়াতাড়ি ভাল হবে না। ওকে নিয়ে ওপরে উঠতেও অসুবিধে হবে?

জয়িতা উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইল, কি জন্যে তোমার মনে হচ্ছে ও তাড়াতাড়ি ভাল হবে না।

আমি যে পাতাটা খাইযেছিলাম সেটা পেটে গেলে নেশা কেটে যেতে বাধ্য। ওর উপকার হয়েছে, কিন্তু–।

কিন্তু কি? জয়িতার মনে হচ্ছিল লা-ছিরিঙ অকারণে রহস্য তৈরি করতে চাইছে।

আমাদের একটা পাহাড়ি মদ আছে। অল্প খেলে ঠিক আছে। বেশি খেলে সেটা মাথার মধ্যে চলে যায়। যতদিন সেটা মাথার মধ্যে থাকে ততদিন কোন কিছু চিন্তা করার শক্তি থাকে না। মদের জন্য এসে তার মাথায় বসে থাকে। অনেকেই তখন পাগল হয়ে যায়। কিন্তু তোমার বন্ধু যখন বিড়বিড় করছে না তখন পাগল হবে না। যার যা হবার তা তো হবেই। এই নিয়ে চিন্তা করার কি আছে? লা-ছিরিঙ হাসল।
 
মনে মনে শিউরে উঠল জয়িতা। এ রকম কেস সে শুনেছে। তবে তা তো ড্রাগসের কল্যাণে হয়ে থাকে। কথা বলতে পারে না, হাত পা কাপে। কিন্তু মস্তিষ্ক অসাড় হওয়ার ফলে পুতুলের মত চালচলনের কথা তত শোনেনি। ওর মনে হল লা-ছিরিঙ ঠিক বলছে না। অবশ্য ওর বানিয়ে বলেই বা কি লাভ। ভীষণ মনখারাপ হয়ে গেল জয়িতার। ওদের সঙ্গে এখনও প্রচুর ওষুধ আছে। কিন্তু এই রোগের উপশম করার কোন ওষুধ নেই। বুকের ভেতরটা কেমন কাঁপছিল জয়িতার। সে আবার লা-ছিরিঙের দিকে তাকাল। স্বাস্থ্যবান সুদর্শন। চোখাচোখি হতেই সরল হাসল ছেলেটা। জয়িতা এবার হাঁপাতে লাগল। ওরা অনেকটা এগিয়ে এসেছে। পিঠের এবং হাতের বোঝা এখন আরও ভারী বোধ হচ্ছে। দম নেবার জন্যে জয়িতা দাঁড়িয়ে পড়তেই লা-ছিরিঙ বলল, সকাল হয়ে গেছে, আমাদের এখনও একঘণ্টা হাঁটতে হবে।

এই পথে মানুষ যাতায়াত করে না। জন্তু-জানোয়ারের কথা বলা যাচ্ছে না কিন্তু গৃহপালিত পশু চোখে পড়ছে না। সরু পথটা এখন খাড়াই। নিচের বন্ধুদের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। লা-ছিরিঙ আবার বলল, তোমার যদি অসুবিধে হয় তাহলে আমার কাঁধে কিছু জিনিস দিতে পার।

জয়িতা মাথা নাড়ল। তারপর আবার চলা শুরু করল। একটা পাথর থেকে আর একটা পাথরে পা ফেলতে রীতিমতো কষ্ট করতে হচ্ছে। এবং তখনই তার চোখে পড়ল সামনেই বরফ। প্রথম সূর্যের আলো এখনও পড়েনি কিন্তু তার আভায় নীলাভ হয়ে রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ক্লান্তিটা চট করে কমে গেল। সব কিছু ভুলে গেল জয়িতা। বরফে পা রাখামাত্র গোড়ালি সামান্য বসে যাচ্ছিল এবং খানিক বাদেই আশপাশের কোথাও আর পাহাড় কিংবা পাথর দেখা গেল না। সর্বত্র সাদা তুষার ছড়ানো।

তাপল্যাঙে আসার পর অনিয়মিত আহার, মারাত্মক ঠাণ্ডা এবং উদ্বেগ জয়িতার শরীরে বিস্তর ছাপ ফেলেছে। সে কখনই স্বাস্থ্যবতী ছিল না কিন্তু দুর্বলতার কারণে নিজেকে আরও রোগা মনে হচ্ছে ইদানীং। তার মুখের ভোলা চামড়ায় শীতের হাপ হাঁসের পায়ের মত। কিন্তু এসব সত্ত্বেও নিজেকে একটি বিশেষ আদর্শে নিবেদিত মনে করায় প্রতিনিয়ত বাঁচার শক্তি খুঁজে পেত। ব্যক্তিগত ভাল লাগা বা নিজের জন্য আলাদা করে কিছু চিন্তা করা আর হয়ে উঠত না। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে হিমালয়ের তুষারধবল প্রান্তরে যেই প্রথম সূর্যের কটি আলো পড়ল তখনই সে তড়িতাহত হয়ে গেল। চোখের সামনে এক অপরূপ দৃশ্য যার বর্ণনা মানুষের মাথায় চট করে আসে না। সোনালি-সাদায় মেশামেশি বরফের ওপর দাঁড়িয়ে সে মুগ্ধ হয়ে গেল। আজন্ম কলকাতায় মানুষ জয়িতার বরফ সম্পর্কে যা কিছু ধারণা বই এবং চলচ্চিত্র থেকে। এক ধরনের রোমান্টিক মানসিক-অভিযান চলত তার সেই সব দৃশ্য দেখা বা পড়ার সময়। আজ তার চোখের সামনে বাস্তব বরফ, এই বরফ ক্যাপ্টেন কুককে মেরে ফেলেছিল। এই সময় লা-ছিরিঙ জিজ্ঞাসা করল, তুমি আমাদের সিগারেট খাবে?

বিহুল মুখ ফেরাল জয়িতা। লা-ছিরিঙকে দেখে মনে হল যেন আকাশ থেকে ঈশ্বরপুত্র নেমে এলেন। কোন মলিনতা নেই ওর হাসিতে। ঠিক এই সময় নিজেদের খুব ছোর্ট সংকীর্ণ বলে বোধ হল তার। কলকাতায় প্রতিটি মানুষ এবং প্রতিটি নারী অনুক্ষণ পরস্পরকে অবিশ্বাস করে বিশ্বাসী হয়ে থাকে। শহরসভ্যতা যে মেকী মানসিকতা তৈরি করে দেয় জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলনের মুহূর্তে তার থেকে মুক্তি পর্যন্ত নেই। ব্যতিক্রম যারা হতে চায়, যারা মানুষের সঠিক জায়গার খোঁজ দিতে বদ্ধপরিকর তাদের হয় পাগল নয় রাজনৈতিক মতলববাজ করে চিহ্নিত করে দেয় পেশাদারী রাজনৈতিক দলগুলো। আর লক্ষ লক্ষ মূখ সেই সব বাণী গপগপিয়ে গেলে। সৌন্দর্যের আর এক নাম যে সারল্য এটা শহরের মানুষ আজ বিস্মরিত।
 
এই সিগারেট শরীর গরম করে। লা-ছিরিঙের হাতে পাকানো সিগারেট। বরং বিড়ি বলাই ভাল। সিগারেট শব্দটা ও শিখল কখন কিভাবে এ নিয়ে মাথা ঘামাল না জয়িতা। হাত বাড়িয়ে সেটা নিল। তারপরে একটা কাণ্ড দেখল। পকেট থেকে দুটো চ্যাপটা পাথর বের করল লা-ছিরিঙ। চটজলদি সে-দুটো ঘষে আগুনের ফুলকি বের করছিল সে। সেই ফুলকি কয়েকবারের চেষ্টায় বিড়ির মুখে ঠিক লাগিয়ে নিল। গলার শিরা ফুলিয়ে টানতেই তা থেকে ধোঁয়া বের হল। চোখ বন্ধ করে প্রথম আরামটা শরীরে ছড়িয়ে দিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসল লা-ছিরিঙ। জয়িতা তার হাত থেকে বিড়িটা নিয়ে নিজেরটা ধরাল। একটা তিকুটে স্বাদ। সকালে কিছু পেটে না পড়া এবং রাত্রি-জাগরণের অবসাদে শরীর এই বিড়ির ধোঁয়া নিচ্ছিল না। কিন্তু জোর করে কয়েকটা টান দেবার পর আর এক ধরনের মাদক : শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। উষ্ণ হল শরীর। সে হাসল। দোকানের বিড়ি-সিগারেটের সঙ্গে এই হাতে পাকানো সিগারেটের পার্থক্য হল ওইটেই। সেই সঙ্গে একটা নেশা ধরানো গন্ধ। হয়ত যে গাছের পাতা থেকে এটি বানানো তা-ই নেশার কাজে ব্যবহৃত হয়। হোক, কিন্তু এই মুহূর্তে তার শরীর বেশ তরতাজা লাগছে। সে লা-ছিরিঙকে হাসিটা ফিরিয়ে দিল।



লা-ছিরি ওদের যে গুহাটার সামনে নিয়ে এল সেখানে পৌঁছতে হলে পৃথিবীর সেরা পুলিশদের তাপল্যাঙের মানুষদের সাহায্য লাগবে যারা জায়গাটা জানে। গুহার মুখে পৌঁছবার পর লা-ছিরিঙ ওদের একপাশে সরে দাঁড়াতে বলল। তারপর জিনিসপত্র নামিয়ে রেখে দলা দলা বরফ তুলে ছুঁড়ে মারতে লাগল গুহার ভেতরে চিৎকার করে। সেই চিৎকার অনেকগুণ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। তারপরেই–ভালুকটাকে দেখা গেল। অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে দুটো বাচ্চাকে নিয়ে সেটা বেরিয়ে এল বাইরে। হিমালয়ের ভালুকের গল্প পড়েছিল জয়িতা। চোখের সামনে দেখে তার সমস্ত শরীর অসাড় হয়ে গেল। লা-ছিরিঙ শুধু কয়েক পা পিছিয়ে এসেছে মা, কিন্তু তার হাতের লাঠি, যাতে মালপত্র বেঁধেছিল আসার সময় এখন সমানে ঘুরছে আর সেই সঙ্গে অত আক্রমণাত্মক শব্দ বের করছে মুখ থেকে। ভালুকটা কয়েকবার দাঁত বের করে এই স্পর্ধার প্রতি তার প্রতিবাদ জানাল। বাচ্চা দুটো মায়ের শরীর ঘেঁষে চুপটি করে দাঁড়িয়ে। তারপর নিতান্ত অনিচ্ছার মা এবং বাচ্চারা ওপাশে নেমে গেল। এবার লা-ছিরিঙ শান্ত হল। সে জয়িতাকে বলল, এই গুহাটাই সবচেয়ে ভাল। এখানে দানো ঢুকবে না।

কেন? জয়িতার পুরো ব্যাপারটা এখন মজাদার লাগছিল। যেখানে ভালুক থাকে সেখানে দানো আসে না। দুজন দুজনের খুব শত্রু। সে এবার নির্ভয়ে চলে গেল গুহার ভেতরে। মিনিট দশেকের মধ্যে গুহাটা বেশ বাসযোগ্য হয়ে গেল। নিচে একটা টেস্ট পাতা হল। তার ওপর জিনিসপত্র বিছিয়ে আনন্দ আর লা-ছিরিঙ দ্বিতীয় টেস্টটা দিয়ে গুহার মুখটা আড়াল করার চেষ্টা করতে লাগল। ভেতরে বরফ নেই কিন্তু ভালুকের বোঁটকা গন্ধ বাতাসে ভাসছে। গুহাটা বেশ বড়, শেষদিকে আলো ঢুকছে না। এবং সবচেয়ে আরামের যেটা তা হল এখানে ঠাণ্ডা অনেক কম। আনন্দরা যখন গুহার মুখটায় পর্দার মত আড়াল ঝোলাতে পারল তখন বাতাসের পথ বন্ধ হল কিন্তু অন্ধকার বাড়ল।

এবার জয়িতা তাকাল সুদীপের দিকে। পুতুলের মত দাঁড়িয়ে আছে সে। এই খাড়াই পথটা ওকে বয়ে নিয়ে এসেছে মেয়েটা। এখন দুহাতে মুখ ঢেকে হাঁটুগেড়ে বসে হাঁপাচ্ছে মেয়েটা। ও না থাকলে সুদীপকে এখানে নিয়ে আসা অসম্ভব ছিল। জয়িতা সুদীপের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সুদীপের চোখের মণি স্থির। কিছু দেখছে বলে মনে হচ্ছে না। সে ধীরে ধীরে সুদীপের গালে হাত রাখল, সুদীপ!

কোন সাড়া এল না সুদীপের কাছ থেকে। জয়িতার বুকের কান্নাটা গলায় উঠে আসছিল। সে আবার ওর চোখের কাছে আঙুল নিয়ে গেল। এবার চোখের পাতা বন্ধ হল। হঠাৎ আবেগে শরীর কাঁপানোয় জয়িতা দুহাতে সুদীপকে জড়িয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল।
 
আনন্দ মুখ ফিরিয়ে দৃশ্যটা দেখল। এতটা পথ আসার সময় সে মেয়েটির কাছ থেকে যা জেনেছে তাতে সুদীপের মস্তিষ্কের অসাড়তা খুব অল্পে দূর হবে বলে মনে হয় না। কল্যাণটা চলে গেল, সুদীপ যদি এভাবে অকেজো হয়ে যায় তাহলে রইল তারা দুজন। কাজের পরিধি বিরাট অথচ মানুষ কম। পালদেমকে বোঝালে বুঝতে পারে কিন্তু নিজে থেকে কিছু করার ক্ষমতা ওর নেই। সুদীপকে যে ভঙ্গিতে জয়িতা জড়িয়ে ধরেছে তা স্বাভাবিক সময়ে হত না। কল্যাণের একটা ধারণা ছিল জয়িতা সুদীপকেই বেশি পছন্দ করে। এমন কি ওর সঙ্গে সুদীপের প্রণয়-সম্পর্ক খুঁজে বার করতেও চেষ্টা করত। এসব ভাবনা কখনও আনন্দর মাথায় আসেনি। কিন্তু এখন ওই ভঙ্গি চোখের সামনে দেখে আনন্দর বারংবার কল্যাণের কথা মনে পড়ছিল। কল্যাণ দৃশ্যটা সহ্য করতে পারত না।

ঠিক তখনই কাণ্ডটা ঘটল। ওরা কেউ পর্দাটার দিকে নজর দেয়নি। প্রত্যেকের দৃষ্টি তখন সুদীপ জয়িতার ওপরে। এমন সময় ঠিক ঘাড়ের পেছনে জান্তব চিৎকার আর মেয়েটির আর্তনাদ একই সঙ্গে শোনা গেল। চকিতে কয়েক পা সরে এসে আনন্দ দেখল মা ভালুটা বীভৎস দাঁত বের করে মেয়েটিকে আক্রমণ করতে যাচ্ছে। আনন্দর মস্তিষ্ক এবং হাত একসঙ্গে কাজ করল। রিভলবারটা বের করে সজাগ রেখেছিল সে গুহার মুখে ভালুকটাকে দেখার পর। সেইটাই কাজে লাগল। শব্দটা ভয়ঙ্কর ভাবে গুহাটাকে কাপাল। প্রথম গুলিটা ভালুকটার প্রথম পায়ে লাগতেই সে আহত হয়ে মেয়েটার কাছ থেকে সরে এল। খুব অল্পের জন্যে রক্ষা পেয়েও মেয়েটি যেন নড়বার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। আহত ভালুকটা এবার পেছনের দুই পায়ের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে লা-ছিরিঙের উদ্দেশ্যে এগোতেই দ্বিতীয় গুলিটা সরাসরি বুকে লাগল। একটা পাহাড়ের মত কাপতে কাপতে ভালুকটা লুটিয়ে পড়ল গুহার মুখে। পড়ার সময় টেস্টটাকে ছিঁড়ে নিয়ে এল শরীরের নিচে। শব্দটা এখন বহুগুণ। যেন সমস্ত পাহাড়ে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আনন্দ চিৎকার করে সবাইকে বাইরে বেরিয়ে আসতে বলল। পর্দাটা তো ছিলই না, ভালুকটার শরীর ডিঙিয়ে ওরা বাইরে এসে দাঁড়াল। আনন্দ যার ভয় পেয়েছিল তা হল না। বিদেশী সিনেমায় দেখেছিল এই ধরনের শব্দ আলগা পাথর বা বরফ নড়িয়ে ধস নামায়। কিন্তু এখানকার পাহাড় শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার পরও ঠিকঠাক আছে। ধাতস্থ হবার পর জয়িতার খেয়াল হল সুদীপ বের হয়নি। এবং তখনই মেয়েটা ছুটে গেল ভেতরে। কান্নটা শুনতে পেল সবাই। সুদীপ কাঁদছে। জয়িতা ওদের বাইরেই অপেক্ষা করতে বলে নিজে এগিয়ে গেল।

গুহার মধ্যে যেখানে সুদীপ দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই হাঁটু মুড়ে বসে রয়েছে এখন। আর সেই অবস্থায় ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। মেয়েটি এখন তার মাথার সামনে দাঁড়িয়ে। এই কান্না তাকেও অবাক করেছে। কিন্তু সে কোন কথা বলছে না, স্পর্শও না। জয়িতার সমস্ত শরীরে কদম ফুটল। সুদীপ কাঁদছে যখন তখন ওর অসাড় হওয়া মস্তিষ্ক এখন কাজ করছে। তার মানে ও আবার স্বাভাবিক হতে চলেছে। হয়তো ওই তীব্র শব্দ ওর চেতনা স্পষ্ট করতে সাহায্য করেছে। সে দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল, সুদীপ, অ্যাই সুদীপ, কি হয়েছে তোর?

সুদীপের কান্নাটা অর্কস্মাৎ থামল। তারপর সেই অবস্থায় চুপচাপ বসে রইল। জয়িতা এবার আনন্দর গলা শুনল, ওকে এখন ডিস্টার্ব করিস না জয়ী। বরং ও যদি ঘুমাতে পারে তাহলে ভাল হয়—সুদীপ, তুই কি ঘুমাবি? বিছানা ঠিক করে দেব?

সুদীপ কোন জবাব দিল না। তার বসার ভঙ্গিরও পরিবর্তন হল না। মেয়েটি তখনও পুতুলের মত দাঁড়িয়ে। আনন্দ দেখল লা-ছিরিঙ প্রাণপণে চেষ্টা করছে ভালুকটাকে বাইরে টেনে নিয়ে যেতে। কিন্তু তার একার শক্তিতে সেটা অসম্ভব। ভালুকটার দিকে তাকালে বোঝা যায় এর বয়স বেশি নয়। লা-ছিরিঙ তার নিজস্ব ভাষায় জড়িয়ে জড়িয়ে কিছু বলতেই মেয়েটি সাহায্যের জন্যে এগিয়ে গেল। ওই জানোয়ারটার শরীরে হাত দিতে জয়িতার ঘেন্না করছিল। তাছাড়া সুদীপের ব্যাপারটা তার ঠিক বোধগম্য হচ্ছিল না। ও যদি চেতনা ফিরে পেয়ে থাকে তাহলে এখনো সাড়া দিচ্ছে না কেন?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top