What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected গর্ভধারিণী - সমরেশ মজুমদার (3 Viewers)

নিরাপদ বিছানায় শুয়ে জয়িতারও ঘুম আসছিল না। হাওয়া বইছে কিংবা বেড়ে যাওয়া ঠাণ্ডার জন্যে নয় ওর শরীর এবং মনে অস্বস্তি কাজ করছিল। সময় এসে গিয়েছে। কলকাতায় থাকতে এই ব্যাপারটা কোন গুরুত্বই পেত না। সে স্থির করে নিল যে প্রয়োজনে বন্ধুদের বলবে। এই কদিনে তাপল্যাঙের মানুষদের সঙ্গে মিশে সে অনেক কিছু জেনেছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত। এই পাহাড়ি মানুষরা সুদীপ আনন্দর সঙ্গে দূরত্ব রেখেছে, তার সঙ্গে রাখেনি। বোধহয় মেয়েরা খুব চট করেই বিশ্বাস কিংবা আস্থাযযাগ্য হতে পারে। জয়িতা কৌতূহলী হয়েছিল এখানকার মেয়েরা তাদের ওই সমস্যার সমাধান কিভাবে করে তা জানতে। জানার পর শিউরে উঠেছিল। অল্পবয়েসীরা সেই কয়দিন প্রায় ঘরের বাইরে যায় না। স্বেচ্ছাবলী হয়ে সবার আড়ালে থেকে যায়। কার লেখা মনে নেই, জয়িতা পড়েছিল বাংলাদেশের মেয়েরাও এক সময় ওই একই জীবনযাপন করত। ওই কদিন বিছানায় শুতো না, মাথায় তেল দিত না। তারও আগে ঘর ছেড়ে বের হত না। নিজেদের অশুচি মনে করত। এখনও পুজোপার্বণে বাংলাদেশের মেয়েরা যোগ দিতে চায় না। এ হীনমন্যতা বোধ কি কারণে তা কেউ ভাবেনি। যেন প্রকাশ্যে বললে সেটা অশ্লীলতার পর্যায়ে চলে যাবে। দিন পালটেছে কলকাতায়। এখানকার বয়স্কা মেয়েরা যেভাবে নিজেদের সামলায় তা আদৌ অস্বাস্থ্যকর নয়। বোধহয় সেই কারণেই এদের অসুখবিসুখ অনিবার্য ঘটনা। সে নিজে না হয় কিছুদিন সামলে নিতে পারবে। কল্যাণ যখন গেল তখন তাকেও বিজ্ঞাপিত সাহায্য আনতে বলতে পারত কিন্তু তাই বা কদিন সাহায্যে আসত? একটা উপায় বের করতেই হবে।



ওদিকে সুদীপের নাক ডাকছে। আনন্দ চুপচাপ। সুদীপটাকে জয়িতা আজকাল ঠিক বুঝতে পারছে। সারাক্ষণ এত কি ভাবে? গ্রামের পুরুষদের চেয়ে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার প্রবণতা ওর মধ্যে। কিন্তু এখনও এখানকাব ভাষা শেখার ইচ্ছে ওর নেই। গ্রামটা ছোট। মানুষগুলো সরল। আর যে ব্যাপারটা সবচেয়ে ভাল লেগেছে জয়িতার সেটা হল পুরুষরা মেয়েদের পদানসীন করে রাখে না। বরং বলা যায় মেয়ে পুরুষ সমানতালে কাজ করে, মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে সমান অধিকার আছে। শুধু বিবাহের বেলায় তাদের পরিবারের নির্দেশ মানতেই হয়। অথচ বিবাহের আগে যে যৌনাভ্যাস নেই এমন নয়। সেটা সবাই জানেও কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামায় না যতক্ষণ না সন্তানসম্ভবা হচ্ছে কেউ। কিন্তু এখানকার মেয়েদের মধ্যে নানা ব্যাপারে যে সংস্কার তা মূলত অজ্ঞতা থেকেই। এদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করতে হলে ওই অজ্ঞতা আগে দূর করতে হবে। দ্বিতীয়ত শারীরিক কারণে এদের অনেকেই সন্তানসম্ভবা হতে পারছে না। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গলগণ্ড রোগের ব্যাপক শিকার হচ্ছে। এইটে বাদ দিয়েও তাপল্যাঙকে মিনি ভারতবর্ষ ভাবা যায় না। কিন্তু তাপল্যাঙের মানুষগুলো যারা এখনও আধাআদিম যুগে বাস করছে তাদের জীবন বিপ্লব পরবর্তী স্বপ্নের সমাজ ব্যবস্থায় নিয়ে যাওয়ার অবাধ সুযোগ রয়েছে। ভারতবর্ষে মানুষের জীবনয়াব্রা পালটে যাওয়ার সে স্বপ্ন নকশালরা দেখেছিল, সি পি এম মুখে বললেও কাজে যার উলটো করেছে, চে গুয়েভারা অথবা মাও কিংবা হো চি মিন যে স্বপ্ন দেখতেন সেই কাজ এখানে করা সম্ভব। কয়েক কোটি না হোক কয়েকশ মানুষকে জীবনের স্বাদ এবং স্বাধীনতা পাইয়ে দিয়ে স্বনির্ভর করলে পৃথিবীতে বেঁচে থাকা অর্থপূর্ণ হবে। এই ব্যাপারে সে একমত অনন্দের সঙ্গে জয়িতা চোখ বন্ধ করতেই কল্যাণের মুখটা দেখতে পেল। কল্যাণের ফেরার সময় হয়ে গিয়েছে। ঝুঁকিটা অবশ্য কাউকে না কাউকে নিতেই হত। কিন্তু কল্যাণ যদি ধরা পড়ে যায়? পুলিশ যদি কল্যাণের পরিচয় জানতে পারে তা হলে মৃত্যুদণ্ড অনিবার্য। জয়িতা জানে কল্যাণ বাঁচতে বড় ভালবাসে। এবং আর একটা জিনিস ইদানীং সে কল্যাণের মধ্যে লক্ষ্য করছিল। তার সঙ্গে ব্যবহারে যেন পরিবর্তন এসেছিল। কিরকম চোখে মাঝে মাঝে তাকাত কল্যাণ। এবং তখনই তার মনে হত সে যে মেয়ে এটা কল্যাণের দৃষ্টিতে এসেছে। ভাল লাগত না, অস্বস্তি বাড়ত। কিন্তু ওইটুকু ছাড়া আর কোন প্রিটেনশন বা বুজরুকি কল্যাণের ছিল না। বরং বুদ্ধি দিয়ে সব কিছু সামলে নেবার ক্ষমতার অভাব বড় চোখে পড়ত। সেই কল্যাণ দার্জিলিং-এ নিশ্চয়ই পৌঁছেছে। কিন্তু গোঁছবার পর কতটা বোকামি করল তার ওপর নির্ভর করছে ওর ফিরে আসা। সুদীপটা তো প্রসঙ্গ উঠলেই বলে, ও শালা ফিরবে না। ঠিক হাওয়া হয়ে যাবে। সুদীপ কল্যাণকে, ঠিক কল্যাণ নয়, ওই ক্লাসটাকেই অবিশ্বাস করে।

হঠাৎ আনন্দ কথা বলল, জয়ী, জেগে আছিস?

জয়িতা নড়ল না। বলল, হুঁ।

আনন্দ বলল, আজ রাত্রে মেয়েটা মরে যাবে। তারপর কি হবে কে জানে?

জয়িতা বলল, আমি কল্যাণের কথা ভাবছি।

আনন্দ বলল, কল্যাণ পালাবে না। ও আসবেই। কাল নয় পরশু। কিন্তু জানিস, আমাদের মধ্যে কেউ যদি ডাক্তার হত তা হলে এখানে আরও ভাল কাজ করতে পারতাম।

জয়িতা প্রশ্ন করল, কল্যাণ ফিরবেই এই বিশ্বাস হল কেন তোর?
 
আনন্দর হাসি শোনা গেল অন্ধকারে, মধ্যবিত্ত বলে। মধ্যবিত্তরা সব সময় পালায়। কিন্তু বীরত্ব দেখাবার সুযোগ পেলে সেটা মরে না যাওয়া অবধি হাতছাড়া করে না।

ঠিক সেই সময় চিৎকারটা উঠল। যেন কেউ প্রচণ্ড আহত হয়ে কাঁদছে। কান্নাটা গোঙনি বললে কম বলা হয়, কারণ কোন মানুষ অত জোরে গোঙাতে পারে না। এখানে আসার পর আজ দ্বিতীয় রাত ওই গোঙানিটা হচ্ছে। আনন্দ উঠে বসল। বাতাসের দাপট ছাপিয়ে কান্নার শব্দ হচ্ছে। আনন্দ বলল, মানুষের নয়, অসম্ভব। এটাই পালদেমের দান।

জয়িতা বলল, বাইরে বেরিয়ে দেখবি? হেভি ঠাণ্ডা কিন্তু।

দেখব? ইম্পসিবল। পালদেম যাই বলুক এ দানব নয়। দানব বলে কিছু নেই। হিলারী সাহেব পঁচিশ হাজার ফুট উঁচুতে উঠেও কোন জন্তুর হদিশ পাননি। এরা যাই বলুক তার পেছনে কোন সত্যি নেই। আনন্দ উঠে শীতবস্ত্র জড়িয়ে নিচ্ছিল। জয়িতা ওকে অনুসরণ করল। কান্নাটা এখনও একটানা চলছে। ঘরে মোমবাতি জ্বালাল আনন্দ। শিখাটা কাঁপছে। এই সময় সুদীপ মুখ তুলল, কি ব্যাপার? চললি কোথায়?

আনন্দ বলল, একবার দেখব বস্তুটি কি। এত জোরালো গলা কার?

সুদীপ আবার শুয়ে পড়ল, নেই কাজ তো খই বাছ!

ওরা আর কথা বাড়াল না। দরজা থরথর করছিল। কোনমতে সেটা খুলে বাইরে দাঁড়াতে একসঙ্গে ঠাণ্ডা এবং হাওয়ার চাপ পড়ল শরীরে। বাইরে ঘন অন্ধকার নয়, একটা পাতলা আলো আঁধারে মিশে অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করেছে। আকাশে মেঘ আছে কিন্তু তার আড়ালে চাঁদও রয়েছে এটা বোঝা যায়। ওরা দুজনই কাঁপছিল। কান্নাটা ভেসে আসছে উত্তরের পাহাড় থেকে। কিছুক্ষণ একটানার পর কিছুক্ষণ যেন জিরিয়ে নিচ্ছিল। সমস্ত তাপল্যাঙ এখন চুপচাপ। কোন প্রাণের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে না। ওরা ঢালু জমি বেয়ে নেমে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ হাঁটার পর ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল। মনে হচ্ছে সমস্ত শরীর জমে যাচ্ছে। আনন্দ বলল, দৌড়ে। দৌড়লে ঠাণ্ডা কম লাগবে। ওরা উত্তরের পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যেতেই পায়ের তলায় বরফ পেল। এর মধ্যে এখানে বরফ পড়তে শুরু করেছে। আর দৌড়োনো যাচ্ছে না। এর পরেই খাড়া পাহাড়। পাহাড়ের ওপরে বরফ ছিলই, এখন তা নেমে এসেছে অনেক নিচে। আর এখানে আসার পরই চিৎকার অথবা কান্না থেমে গেল। ওরা যত এগিয়ে এসেছিল তত স্পষ্ট হচ্ছিল কোন মানুষ নয়, এ আওয়াজ কোন জন্তুর গলা থেকে বের হচ্ছে। সম্ভবত জটি ওদের দেখতে পেয়েছিল এবং সে কারণেই চুপ করেছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আনন্দ বলল, না, ফিরে যাই চল।

জয়িতা বিরক্ত হল, এলি কেন? যেন তোর জন্য চিড়িয়াখানার খাঁচায় বসে থাকবে ইয়েতি।

ওরা চুপচাপ এগিয়ে আসছিল। শরীরের যেসব অংশ বাইরে বেরিয়ে আছে সেখানে কোন সাড়নেই। এখন আর কোন আওয়াজ আসছে না উত্তরের পাহাড় থেকে। সমস্ত চরাচর নিস্তব্ধ। ওরা যখন মাঝামাঝি তখন আনন্দ হাত বাড়িয়ে জয়িতাকে থামতে বলল। গোটা আটেক লোক ওপাশের পাহাড় থেকে নেমে আসছে নিঃশব্দে। ওদের লক্ষ্য অবশ্যই গ্রাম এবং প্রত্যেকেই সশস্ত্র। ওদের চলাফেরা দেখে বোঝা যাচ্ছে কোন গোপন মতলব হাসিল করতে ওরা এসেছে। আনন্দরা দাঁড়িয়েছিল একটা বড় পাথরের আড়ালে। পাথরটা হাওয়ার দাপট সামলাচ্ছে। একেই পাতলা অন্ধকার তার ওপর ওরা এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে যেখানে চট করে আগন্তুকদের দৃষ্টি পড়ার কথা নয়। আনন্দ ফিসফিসিয়ে বলল, লোকগুলো কারা বুঝতে পারছি না।

জয়িতা বলল, আর একটু লক্ষ্য করা যাক।
 
আটজনের দলটা গ্রামের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। ওপাশ থেকে একটা কুকুর ডেকে উঠতেই ওরা থমকে দাঁড়াল। কুকুরটাকে শান্ত হবার সময় দিল। তারপর দলটা দুটো ভাগে দু পাশ দিয়ে এগোতে লাগল। একটা ভাগ চলল কানের মন্দিরের দিকে আর একটা গ্রামের ভেতরে। ওরা যখন আর দৃষ্টির সীমায় রইল না তখন আনন্দ বলল, মনে হচ্ছে পাশের গ্রামের মানুষ। পালদেম এদের কথাই বলছিল। এরা তাপল্যাঙের কোন ক্ষতি করতে এসেছে। গ্রামের লোকদের সতর্ক করে দিতে হবে। চল্।

জয়িতা বলল, দাঁড়া। তাড়াহুড়ো করিস না। আগে দেখা যাক ওরা কি করে।

আনন্দ প্রতিবাদ করল, না। তারপর সামলানো যাবে না।

জয়িতা মাথা নাড়ল, যাবে। আমার কাছে রিভলভার আছে।

আনন্দ এই পরিবেশেও হতভম্ব হয়ে গেল, এতদিন বলিসনি কেন?

জয়িতা বলল, বলার কোন কারণ ঘটেনি তাই। এবার এগিয়ে চল।

হাঁটা শুরু করতে আনন্দ ওর দিকে বারংবার তাকাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করেই ফেলল, তোরটা পালদেম নিয়ে যেতে পারেনি?

জয়িতা বলল, পারলে আমার কাছে থাকত কি করে!

ঠিক এই সময় একই সঙ্গে দু জায়গায় চিৎকার শুরু হল। মন্দিরের চিৎকার থেমে গেল আচমকা। আর গ্রামের ভেতর থেকে দুটো মানুষ একটা শরীরকে কাঁধে নিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে। মন্দির থেকেও চারটে লোক নেমে এল। সেই চিৎকার চেঁচামেচি এবার সমস্ত তাপল্যাঙে ছড়িয়ে পড়ল। দলে দলে লোক বেরিয়ে আসছে ঘর ছেড়ে।

কিন্তু মাঝরাতে ঘুম আচমকা ভেঙে যাওয়ায় হাওয়ার দাপট এবং শীতের প্রাব্যল্যে মানুষগুলো সচল হবার অনেক আগেই আটটা লোক কাজ সেরে দূরত্ব বাড়িয়েছিল। কি ঘটনা ঘটেছে তাই নিয়ে যখন বোঝাবুঝির পালা চলেছে তখন কয়েকজন তেড়ে আসছিল লোকগুলোকে ধরতে। কিন্তু তারা নিরঞ্জ, সশস্ত্র হানাদারদের সামনে এসে আর এগোতে সাহস পাচ্ছিল না। ঠিক তখন পাহাড়ের ওপাশে যে পথ দিয়ে হানাদাররা ঢুকেছিল সেখানে ঢাক জাতীয় বাজনা বেজে উঠল। বোঝা গেল হানাদাররা একা নয়, তাদের মদত দেবার জন্যে আরও অনেকে অপেক্ষা করছে। নিজেদের লোক কাজ হাসিল করে ফিরে আসছে দেখে তারা যে উল্লসিত সেটা চিৎকারে বোঝা গেল। আনন্দ বলল, আমরা পালদেমদের সাহায্য করব জয়ী। ওদের কোন দামী জিনিস চুরি যাচ্ছে। তুই আমাকে রিভালভারটা দে। গুলি আছে তো ওতে?

জয়িতা মাথা নাড়ল। তারপর ছুটে গেল খোলা জায়গায় যে পথ দিয়ে আটটা লোক এখন এক হয়ে ছুটে আসছে। প্রথম যে লোকটা ওদের লক্ষ্য করল সে চিৎকার করে উঠতেই দলের বাকিরা এইদিকে তাকাল। ওরা কাউকে কাঁধে ঝুলিয়ে আনছিল। একজনের দুটো হাত বুকের ওপর। বাকি পাঁচজন অস্ত্র ঘুরিয়ে এদের পাহারা দিতে দিতে এগিয়ে আসছিল। এই সময় দূর থেকে সুদীপের চিৎকার ভেসে এল, জয়ী, সরে যা।

জয়িতা একবার মুখ ঘুরিয়েই ফিরিয়ে নিল। সুদীপ তাদের আস্তানার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আনন্দ চিৎকার করল সেই সময়ে। তার গলার স্বরে হানাদারেরা এবার থমকাল। ওদের হাতের অস্ত্র বলতে যা দেখা গেল তা প্রাগৈতিহাসিক যুগেই ব্যবহার করা হত। দুটি নিরীহ মানুষ সামনে দাঁড়িয়ে মনে করায় ওরা দ্বিগুণ উৎসাহে তেড়ে এল সেই অস্ত্র উঁচিয়ে। জয়িতা তখন শূন্যে গুলি ছুঁড়ল।

হঠাৎ যেন সমস্ত পৃথিবী কেঁপে উঠল। পাহাড়ে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে শব্দটা বহুগুণ বেড়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে লোকগুলো থমকে গেল। পেছনে পাহাড়ের উল্লাসও থেমে গেল। ততক্ষণে সুদীপ ছুটে এসেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে জয়িতার পাশে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে গেল কিন্তু জয়িতা তাকে হাত নেড়ে নিষেধ করল। হানাদাররা সাময়িক স্থবিরতা কাটিয়ে উলটো পথ ধরার চেষ্টা করছিল কিন্তু জয়িতা দ্বিতীয়বার গুলি করতে তারা থেমে গেল। গুলিটা লেগেছে সামনে দাঁড়ানো হানাদারটির পায়ের কাছে মাটিতে। কিছুটা মাটি তার ফলে ছিটকে উঠেছে। ওরা ব্যাপারটা বোঝার পর যেন পাথর হয়ে গেল।
 
জয়িতা যে উত্তেজিত এবং অত্যন্ত নার্ভাস তা তার গলার স্বরে বোঝা গেল, পালদেমকে ডাক। তার হাত সামনে প্রসারিত, কালো রিভলভারটা সামান্য কাপছে সেই হাতে। দু-দুবার শব্দ হওয়ার পর হানাদাররা এখন পাথরের মত চুপচাপ। সম্ভবত এ জীবনে তারা এমন শব্দ শোনেনি। দুই থেকে তিন দাঁড়ানো অন্য চেহারার মানুষরা যে শব্দ করছে তার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না থাকায় ওরা কি করবে বুঝতে পারছিল না। শুধু হানাদার নয়, দূরে দাঁড়ানো তাপল্যাঙের মানুষরাও শব্দ শোনার পর বোবা হয়ে গিয়েছিল। এই কদিন যাদের তারা সাধারণ চোখে দেখেছে, প্রতিদিন লক্ষ্য রেখেছে যাতে না পালিয়ে যায় তাদের শক্তিসামর্থ্য সম্পর্কে যে অন্ধ ছিল তা স্পষ্ট হওয়ায় তারাও চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। এই সময় সুদীপ চিৎকার, করল পা-ল-দে-ম। তার সঙ্গে গলা মেলাল আনন্দ। আর এই চিৎকারটা হওয়ামাত্র যার দুটো হাত বুকের ওপর সে আচমকা দৌড়তে শুরু করল। জয়িতা এক মুহূর্ত ইতস্তত করল। তারপর লোকটার পা লক্ষ্য করে গুলি করল। কিন্তু তার হাত কাঁপছে। গুলি সম্ভবত সাত হাত দূর দিয়ে বেরিয়ে গেল। মরীয়া হয়ে সে দ্বিতীয়বার গুলি করা মাত্র লোকটা আছাড় খেয়ে পড়ল। কোথাও আর কোন শব্দ নেই। শুধু গুলির শব্দটা মিলিয়ে যাওয়ার পরেও কানে সেঁটে আছে। এবার জয়িতা নিজেই চিৎকার করল, পা-ল-দে-ম!

তারপরে নেই মূর্তিটাকে পেছনের ভিড় ছেড়ে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। খুব ভীরু পায়ে আসছে পালদেম। যেন তার আসার মোটেই ইচ্ছে নেই। হানাদারদের দলটাকে অনেকটা এড়িয়ে খানিকটা দূরে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। জয়িতা তাকে বলল, লোকগুলোকে মাটিতে বসে পড়তে বপালদেম সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে গলা তুলে হুকুমটা জানিয়ে দিতেই পাঁচজন পুতুলের মত মাটিতে বসে পড়ল। তাদের ভূতগ্রস্তর মত দেখাচ্ছিল। কাঁধে মানুষ নিয়ে যে লোক দুটো দাঁড়িয়েছিল তারা সময় নিল। যাকে ওরা কাঁধে তুলেছিল তার মুখ বাঁধা। কিন্তু হাত পা খোলা। তা সত্ত্বেও এই সময় পর্যন্ত কোন প্রতিবাদ করেনি। মাটিতে নামিয়ে দেওয়ার পর মেয়েটি সোজা হয়ে বসল খানিকটা তফাতে। সাতজন লোক তখন বসে দূরে পড়ে থাকা লোকটিকে দেখছে। সম্ভবত শব্দের ক্ষমতা চাক্ষুষ করে আরও কাহিল হয়ে পড়েছে তারা। জয়িতা পালদেমের সামনে এগিয়ে গেল, আমরা তোমাদের বন্ধু। এরা এই গ্রামে কি করতে এসেছিল?

পালদেম বলল, ওরা আমাদের দেবতার মূর্তি চুরি করেছে। ওই যে লোকটা মাটিতে পড়ে আছে। ওর কাছে আছে মূর্তি। আর এরা ওই মেয়েটাকে নিয়ে যেতে এসেছিল।

জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, এরা কারা?

পাশের পাহাড়ে ওদের গ্রাম। আমাদের শত্রু। বহু বছর ধরে ওদের সঙ্গে আমাদের ঝগড়া। আমাদের দেবতার ওপর ওদের খুব লোভ। আমাদের মেয়েদের ওপরেও। আমরা ফসল তুললে ওরা হানা দেয়। সাধারণত ওরা এসব করে বরফ পড়লে। এবার ওরা আগেই সাহস দেখাল। কথা বলতে বলতে এতক্ষণে পালদেমকে উত্তেজিত দেখাল।

জয়িতা বলল, তুমি কি চাও আমরা তোমাদের ওদের হাত থেকে বাঁচাই?

হ্যাঁ। আমি গ্রামের লোকদের বলছি ওদের বেঁধে ফেলতে।

না। তুমি আমাদের বন্ধু বলে ভাবতে পারেনি। অথচ তোমাদের আবার বলছি, আমরা বন্ধু বলেই মনে করি। তুমি চোরের মত আমাদের সমস্ত অস্ত্র চুরি করেছিলে কিন্তু এটা পারোনি। আর পারোনি বলেই আজ তোমাদের দেবতা এবং গ্রামের মেয়েকে বাঁচাতে পারলাম। আমি চাই এখনই তুমি আমাদের অস্ত্রগুলো ফেরত দেবে। যাও, চটপট কাজ করো।

পালদেম হাঁ হয়ে তাকিয়েছিল।
 
জয়িতা চিৎকার করল, তোমার একার বোকামির জন্যে গ্রামের সমস্ত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হোক তা আমি চাই না। এই ছোট্ট অস্ত্র দিয়ে আমরা বেশিক্ষণ লড়তে পারব না। আমি যা বলছি তা প্রত্যেকের ভালোর জন্যই বলছি। সুদীপ ওর সঙ্গে যা।

সুদীপ এগিয়ে যেতেই পালদেমকে নড়তেই হল। ওরা যাচ্ছে ঝরনার দিকে।

দৃশ্যটা এখন এই রকম। লোকগুলো এবং মেয়েটি বসে আছে নির্বাক হয়ে। গ্রামের মানুষগুলো দূরে দাঁড়িয়ে। পেছনে উল্লাস নেই। হাওয়া বইছে। কিন্তু শীত যে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও তীব্র হয়ে উঠেছে তা কারও খেয়ালে নেই। আনন্দ এগিয়ে গেল দূরে পড়ে থাকা লোকটার কাছে। পাশে দাঁড়িয়েই সে বুঝতে পারল লোকটা মরেনি। ওর শরীর কাপছে। এমন কি রক্তের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। সে লোকটাকে টেনে তুলতেই কোন রকমে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু ভয়ে থরথর করে কাপছে সে। গুলি তার গায়ে লাগেনি কিন্তু ভয়ে লোকটা কুঁকড়ে উঠেছে। ওর দুটো হাতে দেবতার সেই মূর্তিটা। সন্তর্পণে সেটি তুলে নিয়ে আনন্দ চিৎকার করল, কাহুন কাহন!

জনতার মাঝখান থেকে কাহুন তার শিষ্যসমেত বেরিয়ে এলেন। তাকেও খুব নার্ভাস মনে হচ্ছিল। আনন্দ তার হাতে মূর্তি দিতে তিনি আশীর্বাদ করলেন। গ্রামের মানুষরা তখন খুশীতে চিৎকার করে উঠল। আনন্দ কাহুনকে বোঝাতে পারল এই লোকগুলোকে বেঁধে ফেলতে হবে, এখনই। কাহুন সেই নির্দেশটা দেওয়ামাত্র কাজ শেষ হয়ে গেল।

আনন্দ এগিয়ে এল জয়িতার কাছে, দু-দুটো গুলি ছুঁড়েছিস কিন্তু একটাও গায়ে লাগেনি। প্লিজ একথা বলিস না যে তুই ইচ্ছে করে গুলি গায়ে লাগাসনি।

জয়িতা ঠোঁট কামড়াল, গুলি ছোঁড়ায় আমি অভ্যস্ত নই। কিন্তু এই লোকগুলোকে তুই বাঁধতে বললি কেন? এদের শাস্তি দিলে দুই গ্রামের শত্রুতা কোনদিন মিটবে না।

আনন্দ মাথা নাড়ল, ঠিক বলেছিস, তাহলে কি করা যায়?

সেইসময় সুদীপ আর পালদেম ফিরে এল। সুদীপের হাতে একটা বড় টুকরি। কাছে এসে বলল, মালগুলো ঠিক আছে কিনা কে জানে! পাথরের খাঁজে লুকিয়ে রেখেছিল। মেয়েটা কে? ওকে বেঁধেছে কেন? ও তো এই গ্রামের মেয়ে।

পালদেম মুখ নিচু করে দাঁড়িয়েছিল। আনন্দ তার পাশে গিয়ে বলল, ভুল বুঝো না, আমরা কোন শত্রুতা করব না। কিন্তু এগুলো তোমাদের উপকারেই লাগবে।

পালদেম মাথা নাড়ল কিন্তু সহজ হল না। জয়িতা তাকে জিজ্ঞাসা করল, ওই মেয়েটিকে বেঁধেছ কেন? ওকে তো এরা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিল।

এই নিয়ে দ্বিতীয়বার। ওকে ওই গ্রাম চায়। কিন্তু আমরা ওখানে মেয়ে দেব না। ওকে ওরা মুখ : বেঁধেছিল কিন্তু হাত পা বাঁধেনি। তবু ওরা যখন নিয়ে আসছিল তখন ও কোন প্রতিবাদ করেনি। দোষ আছে ওর। ওর শাস্তি ভয়ানক।

ভয়ানক কেন?

ও বেইমানি করেছে। ওর স্বামী নেই, আত্মীয়স্বজন নেই। স্বভাব মন্দ। ও অন্য গ্রামে গেলে ওর জমি নিয়ে যাবে, এ হতে পারে না।

কেন? গ্রামের কোন ছেলে ওকে বিয়ে করবে না?

না। কেউ যেচে নিজের সর্বনাশ করতে চায় না।

জয়িতা বলল, ঠিক আছে, এখন কোন শাস্তি দিও না। এই দলের মধ্যে কে নেতা তা ওদের জিজ্ঞাসা করো তো!

পালদেম বলল, ওই যে ডানদিকের সবচেয়ে বড় চেহারার লোকটা ওই নেতা।

জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, ও কি তোমাদের ভাষায় কথা বলে?

হ্যাঁ। কিন্তু লোকটা অত্যন্ত গোঁয়ার।

জয়িতা এগিয়ে গেল লোকটার সামনে। লোকটা মাথা নামিয়ে বসেছিল। জয়িতা সামনে এসে দাঁড়াতে চোখ তুলে তাকাল। লোকটার বয়স তিরিশের নিচে। স্বাস্থ্য যে কোনো পাহাড়িদের চেয়ে ভাল। নাক বেশ উঁচু। চোয়াল শক্ত হল লোকটার। চোখাচোখি হতেই চোখের দৃষ্টি পালটাল। লোকটা সত্যিই গোঁয়ার।

জয়িতা তার অল্প জানা শব্দ ব্যবহার করল, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে। পালদেম, এর বাধন খুলে দাও। তুমি আমার সঙ্গে এদিকে এস।
 
বন্ধুদের উপেক্ষা করে সে সোজা আস্তানার দিকে হাঁটতে লাগল। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর সে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখল পালদেম বাঁধন খুলে দেবার পরও লোকটা নড়ছে না। সে আস্তানার সিঁড়িতে বসে তাকাল। মেঘ সরছে। ঢলে পড়া চাঁদের শরীর থেকে একটু একটু করে জ্যোৎস্না বের হচ্ছে। দুরের লোকগুলোকে ঝাঁপসা দেখাচ্ছে এখান থেকে। এবং সেই ঝাঁপসা অন্ধকারের মধ্যে থেকে একটি সুগঠিত মানুষ ধীরে পায়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে।

লোকটি সামনে এসে দুটো পা ঈষৎ ফাঁক করে দাঁড়াল। তার ভঙ্গিতে এখনও স্বাভাবিকতা আসেনি কিন্তু ধীরে ধীরে যে সে স্বভাব ফিরে পাচ্ছে তা বোঝা যায়। সোকটা অবশ্যই জেদী। ওর তাকানন, শরীর দেখলে এমনি সময় কথা বলতে সাহস পেত না জয়িতা। কিন্তু এখন ক্ষমতার চাবি তার হাতে। জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, তোমার নাম কি?

লোকটার ঠোঁট একবার কুঁচকে উঠল। তারপর চোখ না সরিয়ে জবাব দিল, রোলেন।

জয়িতা একটু অবাক হল। নামটার মধ্যে বিদেশী গন্ধ। সে জিজ্ঞাসা করল, তোমরা এখানে চুরিডাকাতি করতে এসেছ কেন?

রোলেন কোন জবাব দিল না। বুনো শুয়োরের মত মাটিতে পা ঘষল।

জয়িতা সেটা লক্ষ্য করে বলল, তাপল্যাঙের দেবতাকে তোমরা নিয়ে যাচ্ছ কেন?

এরা গতবার আমাদের ফসল লুঠ করে নিয়ে এসেছিল। ওই দেবতাই ওদের সৌভাগ্যের প্রতীক।

তোমরা দুই গ্রামের মানুষ একই ভাষায় কথা বল, পাশাপাশি থাকো, নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে লাভ কি? তোমরা কেউই আরামে থাকে না। জয়িতার নিজের কাছেই কথাগুলো জ্ঞান-জ্ঞান শোনাল।

রোলেন হাসল। হোট চোখ গোল মুখ সত্ত্বেও হাসিটা বেশ মোলায়েম। বলল, ওরা এখন বড়লোক। টাকা দিয়ে খচ্চরওয়ালার কাছ থেকে জিনিস কেনে। তোমরা ওদের বড়লোক করে দিয়েছ। বরফ পড়লে আমাদের না খেয়ে থাকতে হয়।

জয়িতা বুঝলো এরা সব খবর রাখে। অথচ দুই গ্রামের মধ্যে মুখ দেখাদেখি সম্পর্ক নেই। সে বলল, আমাদের কাছে তাপল্যাঙের মানুষও যা তোমরাও তাই। আমরা চাই পাহাড়ের মানুষ সুখে থাকুক। তোমাকে একটা অনুরোধ করব, রাখবে?

কি অনুরোধ?

এখন কিছুদিন তোমরা এই গ্রামে হামলা করো না। তোমাদের মোড়ল কে?

কাহুনের কথা আমরা শুনি।

বেশ, তোমাদের কানকে আমাদের কথা বল। আমরা তোমাদের গ্রামেও যেতে পারি। এই গ্রামের মানুষ যেসব সুবিধে পাবে তোমরাও তাই পাবে। শুধু তার বদলে আমাদের কথা শুনতে হবে, রাজী?

রোলেন কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, আমরা ভেবে দেখব।

ওই মেয়েটাকে তোমরা নিয়ে যাচ্ছ কেন?

ওর শরীরে ভাল বাচ্চা হবে। ওর স্বামীর বাচ্চা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু আমাদের গ্রামে স্বাস্থ্যবান মানুষ আছে। তা ছাড়া গ্রামে বাচ্চারও অভাব।

তোমাদের সঙ্গে যেতে ওর ইচ্ছে আছে?

তাই তো মনে হয়।

কিন্তু ওকে নিয়ে গেলে ওর জমিও তো তোমরা দাবী করবে!

তা তো করবই।

আপাতত ওকে এখানে রেখে যাও। তোমরা সবাই যেতে পারো এখন। কিন্তু মনে রেখো এখানে আর হামলা নয়। আমরা তোমাদের সঙ্গে ঝামেলা করতে চাই না। তোমরা তোমাদের গ্রামে ফিরে যাও।

জয়িতার কথাগুলো লোকটা যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, তোমরা আমাদের শাস্তি দেবে না?

না। ওরা ফসল চুরি করেছিল বলেই তোমরা এসেছিলে, শোধবোধ হয়ে গেছে।

লোকটা একবার আকাশে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করতে করতে ছুটে গেল সঙ্গীদের দিকে। সঙ্গীরা কথা শুনে চেঁচিয়ে উঠল। জয়িতার নির্দেশে পালদেম ওদের বন্ধন-মুক্ত করে দিলে ওরা পাহাড়ের আড়ালে মিলিয়ে গেল। মেয়েটি বসেছিল চুপচাপ। জয়িতা তাকে বলল, তুমি ঘরে ফিরে যাও।

মেয়েটি মাথা নাড়ল, না, আমি ধরে যাব না।

কোথায় যেতে চাও?

জানি না। গ্রামের কোন পুরুষ আমাকে নেবে না। ওরা নিয়ে যাচ্ছিল তোমরা বাধা দিলে কেন? আমি এখন কি করব! কেঁদে ফেলল মেয়েটা।

জয়িতা ওর কাঁধে হাত রাখল, তুমি একজন মানুষ। মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে হবে।

ছিটকে সরে গেল মেয়েটি। তারপর চিৎকার করে বলল, আমি একটা মেয়ে। জীবনে যদি একটা সত্যিকারের পুরুষমানুষ না পেলাম তা হলে বেঁচে থেকে লাভ কি।
 
৪০.
জয়িতা হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তার মনে হল সে বোধ হয় সব কথার অর্থ ঠিক বুঝতে পারছে না। কোন মেয়ে প্রকাশ্যে এই রকম আকাঙক্ষা নির্লজ্জ ভঙ্গিতে জানাতে পারে? আনন্দ এবং সুদীপ এগিয়ে এসেছিল। গ্রামের লোকেরাও ভিড় করে দাঁড়িয়েছে এখন। বন্দীদের ছেড়ে দেওয়াতে ওদের মুখে স্পষ্টতই অসন্তোষ। কিন্তু এখন এই যুবতীকে নিয়ে কি করা যায় সেটাও প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, ও কি বলছে রে? ওরা কি ওকে অসম্মান করেছে?

জয়িতা কোন উত্তর দিল না। ওর শরীর ঘিন ঘিন করছিল। মেয়েটাকে তার হঠাৎ খুব কুৎসিত বলে মনে হল। যেন একটা আকাঙক্ষা ওর সমস্ত সৌন্দর্যের ওপর কাদা ছড়িয়ে দিয়েছে। সে কোনরকমে জিজ্ঞাসা করতে পারল, তোমার এমন কথা বলতে লজ্জা করছে না?

লজ্জা করবে কেন? আমি কি বুড়ি হয়ে গেছি? আমি কি তোমার মত মেয়ে হয়েও ছেলে সেজে থাকি? প্রশ্নটা স্বাভাবিক গলায় নয়।

ওর তীব্র কণ্ঠ যেন সমস্ত চরাচরে ছড়িয়ে পড়ল। আর সেটা কানে যাওয়ামাত্র জয়িতার শরীরে যেন হিমালয়ের বাতাস ঢুকে পড়ল। তার কাঁপুনি এল। কোনরকমে পালদেমের দিকে তাকিয়ে সে বলতে পারল, একে তোমরা বোঝাও।

তারপর যেন শীতলতা অতিক্রম করতেই সে জোরে জোরে পা চালাল। সুদীপ এবং আনন্দ তো বটেই, গ্রামের তাবৎ মানুষ অবাক হয়ে ওর যাওয়াটা দেখল। এই যাওয়াটা যে স্বাভাবিক নয় তা প্রত্যেকের কাছেই স্পষ্ট কিন্তু কারণটা নিয়ে কেউ একমত হতে পারত না। আনন্দ দেখল জয়িতা তাদের আস্তানার ভেতরে ঢুকে গেল। সে পালদেমকে বলল, অনেক রাত হয়ে গেছে, এবার তোমরা শুয়ে পড়।

পালদেম এগিয়ে গেল গ্রামবাসীদের কাছে। ওরা নিচু গলায় কথা বলল কিছুটা সময়। তারপর পালদেম ফিরে এসে বলল, ওদের ছেড়ে দিয়ে ভাল কাজ করা হয়নি। আমাদের ভয় হচ্ছে ওরা আবার আক্রমণ করতে পারে চোরের মত। এখন আর সামনা-সামনি আসবে না তোমাদের জন্যে। তাছাড়া ওরা আমাদের দেবতাকে নোংরা হাতে স্পর্শ করেছে। এই অন্যায়ের জন্যেও ওদের শাস্তি হওয়া উচিত ছিল।

আনন্দ বলল, শাস্তি দিলে অপরাধ আরও বেড়ে যেত। তোমরা নিশ্চয়ই চাও শান্তিতে বসবাস করতে। ওরা যদি আবার আক্রমণ করে তাহলে আমরা কোন দয়া দেখাব না। আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখো তোমরা।


পালদেম তার গ্রামবাসীদের এই কথা জানালে তারা ধীরে ধীরে ঘরে ফিরতে লাগল। এখন আকাশে চমৎকার জ্যোৎস্না। ও-পাশে পাহাড়ের গায়ে যেন রুপোর ঢল নেমেছে। আনন্দরা দাঁড়িয়েছিল। দেখা গেল সমস্ত মানুষ চলে যাওয়ার পরেও মেয়েটি মাটি থেকে ওঠেনি। দুটো হাঁটুর ওপর মুখ রেখে সে চুপচাপ বসে আছে। সুদীপ তাকে ডাকল, এই যে, তুমি এখানে বসে আছ কেন?

মেয়েটি কোন জবাব দিল না। তার বসার ভঙ্গিতে এক ধরনের অসহায়তা থেকে উত জেদ প্রকট হচ্ছিল। সুদীপ চিৎকার করে পালদেমকে ডাকল। পালদেম ফিরে যাচ্ছিল। বন্দী-মুক্তির কারণে সে যে। সন্তুষ্ট নয় তা বোঝা যাচ্ছিল। ডাক শুনে সে পেছন ফিরে তাকাল। সুদীপ চিৎকার করেই বলল, এই মেয়েটা যে এখানে একা পড়ে রইল।

পালদেম নিরাসক্ত গলায় বলল, তাতে আমার কি?

হঠাৎ মেয়েটি খিলখিলিয়ে হেসে উঠল, আমার কি, আমার কি!

সুদীপ চাপা গলায় আনন্দকে জিজ্ঞাসা করল, পাগল হয়ে গেল নাকি? তারপর পালদেমকে ইশারায় ডাকল। নিতান্ত বাধ্য হয়েই পালদেম ফিরে এল। সুদীপ বলল, একে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছ

কেন?

পালদেম বলল, কে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে? ওর সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। গ্রামের লোকের ধারণা ওর প্রশ্রয় না পেলে ওরা এখানে আসত না।

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, ধারণা, প্রমাণ তো নেই।

প্রমাণ আছে। ওকে যখন ওরা নিয়ে যাচ্ছিল তখন একটুও চিৎকার করেনি সাহায্যের জন্যে। তারপরেও ওর হুঁশ হয়নি জো-কে অপমান করেছে। পালদেম জানাল।

জো! সুদীপ অবাক হল, জো কে?

যে আমাদের সম্মান বাঁচাল। তোমাদের বন্ধু।

সুদীপ এবার হো হো করে হেসে উঠল, বাঃ, সুন্দর নাম দিয়েছ তো! জয়িতা থেকে জো!

আনন্দ বলল, ঠিক আছে। কিন্তু পালদেম, এভাবে পড়ে থাকলে তো ও মরে যাবে ঠাণ্ডায়। তোমরা ওকে অন্য গ্রামে যেতেও দেবে না, আবার গ্রামেও জায়গা দিতে চাইছ না, এটা কি রকম ব্যাপার?

হঠাৎ পালদেম বলল, এটাই এই গ্রামের নিয়ম। ও থাকবে নিজের মত। যতদিন গ্রামের কোন ছেলে ওকে বিয়ে না করছে ততদিন ও কোন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারবে না। অবশ্য যেহেতু ও একবার সংসার করেছে তাই বিয়ে না করেও কেউ যদি স্বীকৃতি দেয় তাহলে একই কথা হবে। এসব ও জানে। তাই নিজে থেকে ফিরে যাচ্ছে না ঘরে। আমি চলি।

ওকে চলে যেতে দেখে আনন্দ মন্তব্য করল, ভাগ্যিস বলেনি এটা আমাদের গ্রামের ব্যাপার, তোমরা নাক গলিও না।

সুদীপ বলল, এখন আর বলবে না। মালপত্তর হাতছাড়া হয়ে গেছে তো। কিন্তু একে নিয়ে কি করা যায়?

আনন্দ কয়েক পা এগিয়ে মেয়েটার সামনে দাঁড়াল, তুমি ঘরে ফিরে যাচ্ছ না কেন?

মেয়েটা মাথা নাড়ল। কিন্তু কিছু বলল না। আনন্দ আবার জিজ্ঞাসা করল, তুমি ওই গ্রামে যেতে চাও?

মেয়েটা এবার মুখ তুলে তাকাল। এখন তার চোখে জল। ঠোঁট কাপছে। কোনরকমে বলল, ওরাও আর আমাকে নেবে না। আমি মরে যেতে চাই। আমার কেউ নেই, কেউ নেই।

সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, কিভাবে মরবে?

মেয়েটা হাত তুলে দূরের পাহাড় দেখাল, ওই ওখান থেকে লাফিয়ে পড়ব।

সুদীপ বলল, ওটা কালকে করলে হয় না? আজকের রাতটা একটু ভাল করে ঘুমিয়ে নাও।

মেয়েটা এবার উঠে দাঁড়াল, আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছ, না? ঠিক আছে, আমি মরে দেখাচ্ছি। কথা শেষ করেই মেয়েটা পাহাড়ের দিকে ছুটতে লাগল।

আনন্দ উত্তেজিত হল, সর্বনাশ, ও সত্যি সত্যি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে সুদীপ, ইনস্যানিটি গ্রো করেছে। ওকে থামা। কেন যে ইয়ার্কি করিস।
 
সুদীপ হকচকিয়ে গিয়েছিল। এবার সে-ও ছুটল। খানিকটা উঁচু পথ ভাঙতেই তার হাঁফ ধরে গেল। কিন্তু এই নির্জন হিম-জ্যোৎস্না রাত্রে একটি মেয়ে পৃথিবীতে আর থাকতে চাইছে না শুধু তার রসিকতার কারণে এই বোধ তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। মেয়েটা কোনদিকে তাকাচ্ছে না। সুদীপ ক্রমশ দূরত্বটা কমিয়ে আনছিল। এই পথের শেষেই খাদ। সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়লে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে সে মেয়েটির হাত ধরল। স্পর্শ পাওয়ামাত্র তীব্র চিৎকার করে মেয়েটি ঝটকা মারল নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে। সুদীপ প্রথমে টালমাটাল হল। মেয়েটির শরীরে ভাল শক্তি আছে। ওর নখের আঘাতে তার মুখ জ্বলছে। মুহূর্তের জন্যে আলগা হয়েছিল মেয়েটি। এবং সেই সুযোগে আবার ছুটতে চাইল। আক্রমণ, বিশেষত নখের জ্বালায় মাথায় আগুন জ্বলে গেল সুদীপের। সে প্রচণ্ড জোরে মেয়েটিকে আঘাত করল। মেয়েটি টলে গেল, তারপর হুমড়ি খেয়ে আছড়ে পড়ল পাথরের ওপরে যেখান থেকে খাদের দূরত্ব খুব বেশি নয়। চাঁদের ঠিক নিচে দাঁড়িয়ে সুদীপ নিজের মুখে হাত বোলাচ্ছিল। তার গালের চামড়া ছড়ে গিয়ে রক্ত ঝরা এখনও বন্ধ হয়নি। শালা, মেয়েটার উপকার করতে গিয়ে এই হল! নিজের ওপর রাগ হচ্ছিল তার। সেই সময় আনন্দর গলা কানে এল, মেরে ফেললি নাকি? অত জোরে মারতে আছে?

জ্ঞান দিস না। দ্যাখ, আমার মুখের কি অবস্থা করেছে! নেকড়ে মাইরি, পাহাড়ি নেকড়ে! সুদীপ ঝঝিয়ে উঠল।

আনন্দ ওর মুখের দিকে তাকাতে জ্যোৎস্নায় রক্ত দেখল। সে একটু উদ্বেগের সঙ্গে বলল, চটপট ঘরে গিয়ে ডেটল লাগা। মানুষের নখের বিষ তার ওপর। সে এগিয়ে গেল মেয়েটির কাছে। ঝুঁকে দেখল ওর নিঃশ্বাস পড়ছে। কিন্তু চেতনা নেই। আঘাত বোধ হয় বেকায়দায় হয়ে গেছে। এখন যদি মেয়েটার কিছু হয় তাহলে গ্রামবাসীরা উলটে তাদের দায়ী করবে। সুদীপটা এখানে আসার পর থেকে ইচ্ছে বা অনিচ্ছায় একটার পর একটা ঝামেলা বাধাচ্ছে। উঠে দাঁড়িয়ে আনন্দ উষ্ণ গলায় জিজ্ঞাসা করল, তুই এটা কি করলি? এত জোরে কাউকে মারতে আছে? এ মেয়েটা মরে গেলে কি হবে?

ও তো মরতেই যাচ্ছিল। সুদীপ এগিয়ে এল কাছে, ঠিক আছে, তুই যা, আমি দেখছি।

আনন্দ কাঁধ ঝাঁকাল। সে আর দাঁড়াল না। আর একটা নতুন ঝামেলা আসছে কিন্তু তার কিছু করার নেই। যাওয়ার আগে বলে গেল, মেয়েটার জ্ঞান ফিরলে বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে চলে আসিস। রাত শেষ হতে চলল।

সুদীপ কোন জবাব না দিয়ে মেয়েটার মাথার পাশে একটা পাথরে বসল। এখন তার আরও বেশি ঠাণ্ডা লাগছে। সে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে আনন্দর চলে যাওয়া দেখল। একটু ঝুঁকে সে মেয়েটার গালে চড় মারতে লাগল আলতো করে, আই অ্যাই মেয়েটা, উঠে পড়। বেশ খানিকটা চেঁচামেচির পর চোখ মেলল মেয়েটা। দৃষ্টি স্বচ্ছ হতেই সে আতঙ্কিত হতে গিয়ে অবাক হল। দুর্বোধ্য একটা শব্দ করে আঙুল তুলে সে সুদীপের মুখটাকে দেখতে চাইল। সুদীপ ঠোঁট ওল্টাল, এ তোমারই দান খুকী। এবার ঘরে যাও।

বাংলায় বলার জন্যেই সম্ভবত মেয়েটা কিছু বুঝতে পারল না। সুদীপ এবার তাকে হাত ধরে দাঁড় করাল। উঠে দাঁড়িয়েই মেয়েটা আবার কান্না শুরু করল। একটু নার্ভাস গলায় সুদীপ তাকে বলল, শোন, আত্মহত্যা করা খুব কাজের ব্যাপার নয়। কার জন্যে নিজেকে মাবছ? পৃথিবীটা কি ভাল, একে ছেড়ে যেতে হয়! ওই দ্যাখ, মাথার ওপর কি সুন্দর চাঁদ! তুমি একে আর দেখতে পাবে মরে গেলে? অবশ্য এখানে আর কিছুক্ষণ দাঁড়ালে আর খাদে ঝাঁপ দিতে হবে না, এমনিতেই পৃথিবী ছাড়তে হবে। তার চেয়ে আজ রাত্রে তোমার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়। চল। এসব কথাই সুদীপ বলছিল হিন্দীতেও নয়, কিন্তু মেয়েটা যেন তার অর্থ বুঝতে খুব চেষ্টা করছিল। এবং তার হাতের ইঙ্গিত বুঝে উঁদের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। সুদীপ ওর কাঁধ ধরে টানতে মেয়েটা সম্মোহিতের মত হাঁটতে লাগল। পুরোটা পথ কেউ কোন কথা বলল না। গ্রামের ভেতর ঢুকে সুদীপ ভাঙা শব্দ ব্যবহার করে জিজ্ঞাসা করল, তোমার ঘরটা কোথায়? মেয়েটা এবার চারপাশে তাকাল। তারপর একটা ভোলা দরজা আঙুল তুলে দেখাল। সেই দরজার কাছে ওকে পৌঁছে নিয়ে সুদীপ ফিরল। যেন হঠাৎ বিরাট একটা বোঝা তার মাথা থেকে নেমে গেল। অত্যন্ত হালকা পায়ে সে চাঁদ মাথায় নিয়ে হাঁটতে চোখ তুলল ওপরে। তারপর স্মৃতি থেকে শব্দ তুলে নিয়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারতে লাগল, এইখানে পৃথিবীর এই ক্লান্ত এ অশান্ত কিনারার দেশে/ এখানে আশ্চর্য সব মানুষ রয়েছে।

তাদের সম্রাট নেই, সেনাপতি নেই তাদের হৃদয়ে কোন সভাপতি নেই;/ শরীর বিবশ হলে অবশেষে ট্রেড-ইউনিয়নের কংগ্রেসের মত কোন আশা হতাশার কোলাহল নেই।
 
আস্তানায় ফিরে এসে ও দাঁড়িয়ে পড়ল। আনন্দ প্রায় চিৎকার করে বলছে, তোদের জন্যে আমি পাগল হয়ে যাব জয়িতা। একজন দার্জিলিং-এ গেল তো গেলই। আর একজন এমনভাবে মেয়েটাকে মেরেছে যে মরে গেলে আর দেখতে হবে না। তারপরে তুই-ও!

আমি কি? জয়িতার গলা তীক্ষ্ণ, আমি তোর কি অসুবিধে ঘটালাম?

এই ঠাণ্ডায় তুই আমাকে বাইরে যেতে বললি। আমি কারণ জিজ্ঞাসা করতে নিজেই যাচ্ছিল। ব্যাপারটা কি তা জানার প্রয়োজন বোধ করছিস না। হঠাৎ যে কি খামখেয়ালিপনা শুরু হল সবার।

তুই অযথা উলটাপালটা ভাবছিস।

অযথা? ও। তোর যদি প্রাকৃতিক প্রয়োজন থাকে সেটা বলতে পারতিস। প্রশ্ন করলে যা হোক জবাব দিতে কি হয়? উই ওয়ান্ট টু ড়ু সামথিং হেয়ার। নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হোক চাই না।

ঠিক আছে। আমি নিজে কিভাবে বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তুই ভুলে গেছিস আমি একটা মেয়ে। আই অ্যাম হ্যাভিং মাই পিরিওড়। এই ঘরে সবার সামনে! জয়িতার গলাটা থেমে গেল।

যাচ্চলে। এটা নিয়ে এত ভাবনা করার কি আছে! এতক্ষণ বলতে কি হচ্ছিল। তোরা না এখনও এইটিন সেঞ্চুরিতে থেকে গেলি। এটা অন্তত তোর কাছে আশা করিনি।

তুই এমন গলায় বলছিস যেন আমার হাত কেটে গেছে।

তার বেশি কি। শান, ওই ব্যাগটা এখানে আনার পর ভোলা হয়নি। ওটা তোর প্রয়োজনে লাগবে। আমি বাইরে যাচ্ছি।

কি আছে ওতে?

তোর প্রয়োজনীয় জিনিস।

মাই গড! তুই এসব এনেছিস? কখন আনলি?

আনন্দর গলা শোনা গেল না। কিন্তু দরজা খোলার শব্দ হল। জয়িতার চিৎকার কানে এল, আনন্দ, তুই খুব ভাল, খুব। আই অ্যাম গ্রেটফুল টু ইউ।

আনন্দকে দেখা গেল, থাক আর ন্যাকামো করতে হবে না। ছেলে বলেই ভেবে এসেছিস এতদিন, বন্ধু বলে নিতে পারিসনি। তারপরেই আনন্দ সুদীপকে দেখতে পেল। সুদীপ চুপচাপ সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। চোখাচোখি হতে আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, মেয়েটাকে পৌঁছে দিয়েছিস?

সুদীপ নীরবে ঘাড় নাড়ল। আনন্দ এগিয়ে এল, এই নে, আচ্ছা দাঁড়া, মুখ তোল, আমি লাগিয়ে দিচ্ছি। সুদীপ দেখল আনন্দর হাতে ডেটল আর তুলল। সে ঠোঁট কামড়াল। হঠাৎ তার শরীর সমস্ত জলকণা বুকের মধ্যে ছুঁড়ে দিচ্ছিল। প্রাণপণে নিজেকে শাসন করার চেষ্টা করছিল সে। আনন্দ ডেটলে ভেজানো তুলো মুখে চেপে ধরে জিজ্ঞাসা করল, কাঁদছিস। এত জ্বলছে?

সুদীপ কোন কথা বলল না। অনেক কষ্টে সে নিজেকে অতিক্রম করতে পারল। তারপর ছাউনির তলায় পা ভাজ করে বসল। আনন্দ বসতে বসতে বলল, যা ঠাণ্ডা, আমার স্কিন-ডিজিজ না হয়ে যায়। নাক-টাক সবার ফেটে গেছে।

সুদীপ কিছু বলল না। ওর কথা বলতে খুব ভয় হচ্ছিল। জ্যোৎস্না ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে আসছে। চাদের যেন আর সে তেজ নেই। সুদীপ লক্ষ্য করল আনন্দ জয়িতার ব্যাপারটা বলল না। একই বয়সী, অথচ এই মুহূর্তে সুদীপের মনে হল আনন্দ অনেক এগিয়ে আছে। সে এইভাবে কথা বলতে পারত না জয়িতার সঙ্গে।

আনন্দ বলল, আর কদিনের মধ্যে বরফ পড়বে। আমরা তো কেউ কখনও বরফের মধ্যে থাকিনি। বই-পড়া বিদ্যেগুলো কাজে লাগানো যাবে। কিন্তু এ বছর খুব দেরি হয়ে গেলেও, এর মধ্যে বুঝলি, যতটা পারি গুছিয়ে নিতে হবে যাতে লোকগুলো বরফের সময় কিছুটা আরাম পায়। সে যেন কিছু ভাবছিল, সুদীপ, কাল তুই একটা কাজ করিস। এই গ্রামে ঠিক কটা পরিবার আর পরিবার পিছু মানুষের সংখ্যা কাউন্ট করে নিস। সেই বুঝে আমাদের একটা হিসাব করতে হবে। এই গ্রামটার চেহারা একদিন পালটে দিতে হবে সুদীপ। প্রত্যেকটা মানুষ যেন বুঝতে পারে সে জন্মেছে শুধু মরে যাওয়ার জন্যে নয়।
 
আনন্দর স্বরে উত্তেজনা ছিল। সুদীপ ওর দিকে তাকাল। আনন্দর বাবা নকশাল রাজনীতি করতেন। আনন্দ একদিন বলেছিল ওর প্রপিতামহ গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনের শরিক ছিলেন, জেলও খেটেছেন। ওর রক্তে অনেক বিশ্বাস অবিশাস মোমেশি হয়ে নিজস্ব চেহারা তৈরি করে নিয়েছে। গোটা ভারতবর্ষের চেহারা ফেরানোর কথা অনেকেই ভাবে। কিন্তু সেটা ভাবনার পর্যায়ে থেকে যায় বুর্জোয়াদের সঙ্গে বাঁচার তাগিদে যারা আঁতাত করে তাদের ওরা গালাগাল দিয়ে থাকে। তত্ত্বের বাঁধা পথ থেকে সামান্য বিচ্যুতি ঘটলেই সংশোধনবাদের গালাগালি কপালে জোটে। কিন্তু কেউ এগিয়ে এসে বিপ্লবটাকে দেখিয়ে দেয় না। নিজের নিজের নিরাপদ বৃত্তে বাস করে ক্যুনিজমের তাকে কপচে যাওয়ার মধ্যে একটা বিপ্লবী চরিত্র প্রকাশ করাই এদের একমাত্র মুক্তি। এই সব চিন্তা শুধু রোবট তৈরি করায় বিশ্বাসী, মানুষ সৃষ্টিতে নয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে আনন্দ তারপর তারা অবশ্যই ব্যতিক্রম। এই দেশে ব্যক্তি হত্যা বা অস্ত্র ব্যবহার করে কখনও বিপ্লব আসবে না। বিপ্লব আসতে পারে ভালবাসা যদি প্লাবনের মত ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। একটা গ্রাম, একেকটা গ্রাম, সেই গ্রামগুলোর সমষ্টি একটা জেলা, সেই জেলাগুলোর সমষ্টি, একটা প্রদেশ এবং প্রদেশগুলো একত্রিত হয়ে গেলে পুরো একটা দেশ যখন একসঙ্গে হাত মেলাবে তখনই বিপ্লব। এই গ্রামে কোন মধ্যবিত্ত নেই। উচ্চবিত্ত থাকার প্রশ্নই ওঠে না। অনেক মানুষ আছে এইখানে। স্বাভাবিক মধ্যশ্রেণী, নিম্নশ্রেণী, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিধি থেকে ঝরে/এরা তবু মৃত নয়। জীবনানন্দের লাইনগুলো গুনগুন করল সে আনমনে।

সেটা কানে যাওয়ামাত্র আনন্দ মুখ ফেরাল, বাঃ, একটা পদ্য বল তো।

সুদীপ মাথা নাড়ল, না। কবিতার কথা মনে হলেই উলটোপালটা লাইন মাথায় আসছে। তুই বল।

আনন্দ মাথা নাড়ল। তারপর দরাজ হল, তোমাকে দেখার মত চোখ নেই তবু/গভীর বিস্ময়ে আমি টের পাই তুমি/আজও এই পৃথিবীতে রয়ে গেছ। কোথাও সান্ত্বনা নেই পৃথিবীতে আজ বহুদিন থেকে শান্তি নেই–কে আসছে?

শেষ শব্দ দুটো যেন কবিতারই মনে হয়েছিল সুদীপের। চোখ তুলতে দেখল মাঠ ভেঙে উঠে আসছে কেউ। এত রাত্রে, বলা যায় রাত শেষের রাত্রে, ওই রকম ক্লান্ত পায়ে কে আসে? সুদীপ বলল, বুঝতে পারছি না!

পেছন থেকে জয়িতার গলা ভেসে এল, থামলি কেন আনন্দ?

ওরা মুখ ফিরিয়ে দেখল, জয়িতা দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। মৃত জ্যোৎস্নায় তাকে যেন অশরীরী বলে মনে হচ্ছে। আনন্দ বলল, কেউ আসছে, কল্যাণ নয় তো!

সুদীপ বলল, দূর! ওই হাটা ছেলেদের হতেই পারে না।

জয়িতা টিপ্পনি কাটল, আমাদের সঙ্গে একজন মহিলা-বিশেষজ্ঞ আছে।

সুদীপ মাথা নাড়ল, বাংলাও বলতে পারিস না? ওই শব্দটার মানেও জানিস না।

এই সময় মেয়েটিকে ওরা দেখতে পেল। সুদীপ বলে উঠল, একি রে! এ যে আবার ফিরে এল। আনন্দ জয়িতার দিকে তাকিয়ে বলল, তুই কেসটা দ্যাখ তো!

জয়িতা এগিয়ে এল বারান্দার কোণায়। মেয়েটি ততক্ষণে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ওদের দিকে একবার তাকিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, আমি ও ঘরে একা থাকতে পারব না।

জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, কেন? তোর সঙ্গে কে থাকত এতদিন?

মেয়েটা উত্তর দিল না কথাটার। গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। জয়িতা বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, তোর সঙ্গে এতদিন কে ছিল বললি না, কিন্তু কেন থাকতে পারবি না সেটা বল।

আমার ভয় করছে।

ভয়। কেন ভয় করছে? তুই তো বেশ ওদের সঙ্গে চলে যাচ্ছিলি না!

সেই জন্যেই তো ভয় করছে। গেলামও না, আবার গ্রামের কোন পুরুষও আমার কাছে এখন ঘেঁষবে। এই সুযোগে দানোটা পাহাড় থেকে নেমে আসবে। দানো যে মেয়ের ওপর–।

দানোটা কে?

পাহাড়ে রাত হলে কেঁদে কেঁদে ডাকে, শোননি তোমরা?

তাহলে তুই কি চাস?

আমি তোমাদের সঙ্গে থাকব। এখানে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top