What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected গর্ভধারিণী - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

আর তখনই তার নজরে পড়ল দুটো মানুষ এগিয়ে আসছে। ওদের হাঁটার ভঙ্গি স্বাভাবিক নয়। একটু কাছাকাছি হতে সে বুঝল দুজনের একজন নারী, পুরুষটিকে সে ধরে ধরে নিয়ে আসছে। আনন্দ অপেক্ষা করল। হাত দশেক দূরে পৌঁছে ওরা দাঁড়াল। পুরুষটি সোজা হতে পারছে না। বোঝাই যাচ্ছে লোকটা বেশ অসুস্থ। নারীটি হাত নেড়ে আনন্দর দিকে তাকিয়ে অনর্গল কিছু বলে পুরষটিকে দেখাল। ওদের পায়ের তলায় ঘাসে কুচি কুচি বরফ অথচ পুরুষটি সেখানেই বসতে চাইছে দেখে আনন্দ উঠে দাঁড়িয়ে ইঙ্গিত করল বারান্দায় উঠে আসতে। ওরা কৃতজ্ঞ ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে বসে পড়ল। এবার আনন্দ বুঝল দুজনেরই বেশ বয়স হয়েছে। সমস্ত শরীর ছেড়া গরম কাপড়ের আড়ালে থাকায় এতক্ষণ বোঝা যাচ্ছিল না। বৃদ্ধ মাথা গুঁজে বসে আছে। মাঝে মাঝে তার শরীর কেঁপে উঠছে। বৃদ্ধা দুহাত তুলে আনন্দকে অনুনয় করছিল। ভাষা বুঝতে না পারলেও বক্তব্য জানতে অসুবিধে হল না। পরে পড়ল আনন্দ। বৃদ্ধের কি হয়েছে সে বুঝতে পারছে না। বা বুঝলেও কোন্ ওষুধ দেওয়া উচিত এবং তা সঙ্গে নাও থাকতে পারে। সে হাঁটুমুড়ে বসে বৃদ্ধের কপালে হাত রাখল। না, জ্বর নেই কিন্তু শরীর কাঁপছে। এবং তখনই তার গলগণ্ডটি নজরে এল। ওই কারণেই শরীর অসুস্থ কিনা কে জানে? পেটের যন্ত্রণাও হতে পারে, কারণ মাঝে মাঝেই বৃদ্ধের মুখ কুঁচকে যাচ্ছিল। বারংবার কানে ঘষার পর অচেনা শব্দও চেনা হয়ে যায়। আনন্দ বৃদ্ধাকে ইঙ্গিত করল বৃদ্ধকে শুইয়ে দিতে। তারপর ঘরে ঢুকে ওষুধের বাক্সটার দিকে সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। নিজেকে ভীষণ নির্বোধ মনে হচ্ছিল। এক্ষেত্রে ওষুধ দিলে যদি বিপরীত প্রতিক্রিয়া হয়? চিকিৎসার এক্তিয়ার একমাত্র চিকিৎসকের। কিন্তু এক্ষেত্রে সে কি করতে পারে? বোঝাই যাচ্ছে পালদেমের ছেলের সুস্থ হওয়ার খবর পেয়ে এরা অনুপ্রাণিত হয়েছে। আনন্দ একটা অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট এনে বৃদ্ধার হাতে দিয়ে খাইতে দিতে বলল। এমন কি তাকে ট্যাবলেটটাকে কাগজমুক্ত করে জলের ব্যবহারের কথাও বলতে হল।

ওদের ওখানে রেখে সে ভিতরে ঢুকল। কেরোসিন পোড়াতে আর সাহস হচ্ছে না। সে আবার বাইরে বেরিয়ে এসে উনুনটার সামনে কেটলি রাখল। কাঠ নেই। আশেপাশে তাকাল আনন্দ। সুদীপ গতকাল কোথায় কাঠ পেয়েছিল? এই সময় বৃদ্ধা বারান্দা থেকে নেমে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে হাসল। পৃথিবীর সর্বত্র বোধ হয় স্নেহের হাসি একরকম হয়। বৃদ্ধা হাত নেড়ে যা বলল, তার মানেটা বোধ হয় এই রকম, তুমি সরে যাও, যা করার আমিই করছি। কৃতজ্ঞ আনন্দ উঠে এল ওপরে। বৃদ্ধ চুপচাপ শুয়ে আছে। তার চোখ খোলা কিন্তু শরীর কাঁপছে না আগের মত। নিজেকে একটি প্রতারক বলে মনে হচ্ছিল। চিকিৎসাশাস্ত্রের বিন্দুমাত্র না জেনে আগ বাড়িয়ে সাহায্য করার ফল হাতে হাতে পাওয়া যাবে। হয়তো যা দরকার তার বিপরীত ওষুধ বৃদ্ধকে দেওয়া হল। ও মারা গেলে এখন তাকেই নিমিত্তের ভাগী হতে হবে। সে বৃদ্ধের পাশে বসল। তারপর কপালে হাত রাখল। ধীরে ধীরে বৃদ্ধের মুখে হাসি ফুটল। অজস্র শিরা ওঠা কাঁপা হাতে বৃদ্ধ আনন্দর হাত ধরল। কে বলে শুধু যৌবনেই উত্তাপ থাকে!



বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোক বাড়তে লাগল। এখন আকাশ পরিষ্কার। রোদ আছে কিন্তু তার তেজ নেই। ওদের আস্তানার সামনে এখন অন্তত সত্তরজন মানুষ। প্রত্যেকেই অসুস্থ। প্রত্যেকেই ওষুধ চায়। অথচ কেউ কথা বলছে না। এই রকম মূক অসুস্থ মানুষদের মুখোমুখি হয়ে ওরা হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। জয়িতাকে নিয়ে সুদীপরা ফিরে এসেছিল এর আগে। মেয়েটির অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। জয়িতার ধারণা ঘা ওর পাজরার ভেতরে চলে গেছে। বড় হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ ছাড়া এই মেয়েটিকে বাঁচানো মুশকিল। ওরা যে ওষুধ দিচ্ছে তাতে ওপরে ওপরে কাজ হচ্ছে। বিস্ময়ের ব্যাপার, এই বিকট ঘা নিয়ে মেয়েটি কি করে এতদিন হেঁটে চলে বেড়াতো? সুদীপের যুক্তি হল ওটা অনেকটা ক্যানসারের মত। বেশ আছে, হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে, যেই বায়োপসি করা হল, খোঁচানো হল, অমনি দুদ্দাড় করে বেড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে রোগী বিছানায়, যন্ত্রণার শুরু।
 
ওরা চা খেয়েছে। বৃদ্ধাকেও দিয়েছে। বৃদ্ধ এখন ঘুমাচ্ছে। বৃদ্ধা মাঝে মাঝে দেখে যাচ্ছে তাকে। তার মুখের উদ্বেগ এখন অনেক কমে গেছে। আনন্দর আনা আটা হাতে মেখে সে তালি দিয়ে দিয়ে রুটির আকারে নিয়ে গিয়ে উনুনের ওপর ফেলে দিচ্ছে সেঁকার জন্যে। আর এই সব কাজ বৃদ্ধা করছে আনন্দিত হয়েই। তার পাশে আরও কয়েকটি মেয়ে ভিড় করেছে। তারা অবশ্য সুদীপদের দিকে তাকিয়ে মন্তব্যসহযোগে হাসছিল। সেই হাসি উঁচুতে উঠলে বৃদ্ধার গলায় ধমক বাজছিল। কিন্তু চারজনের লক্ষ্য ওদিকে ছিল না। এতগুলো মানুষ অসুস্থ হয়ে চুপচাপ বসে থাকবে অথচ।

আনন্দ পালদেমকে বলল, আমাদের কাছে এত ওষুধ নেই, কি করি বল তো? তাছাড়া প্রত্যেকের এক এক রকম রোগ। সব রোগের কি ওষুধ হবে তাও আমরা জানি না।

পালদেম বলল, আমি ওদের দুবার বলেছি কিন্তু কেউ কথা শুনতে চাইল না। এদের ধারণা তোমরা দেবদূতের মত এখানে এসেছ এবং ওদের সারিয়ে তুলতে পার।

মিথ্যে কথা। আমরা চিকিৎসার কিছুই জানি না। অর্কপটে বলল আনন্দ।

পালদেম হাসল, একথা কেউ শুনবে না। তোমরা আমার ছেলেকে সারিয়েছ।

আনন্দ মাথা নাড়ল, কিন্তু আমাদের বন্ধু বলছে মেয়েটিকে বাঁচানো হয়তো সম্ভব হবে না।

পালদেম চুপ করে গেল। ওর মুখ খুব শক্ত দেখাচ্ছিল। আনন্দ বলল, ওর কিছু হলে তো তোমরা আমাদের ছাড়বে না। কেন আর বিপদ বাড়াব বল!

পালদেম সময় নিল কথা বলতে, মেয়েটার মা বলেছে, তোমাদের বন্ধু যা করেছে তার তুলনা নেই। কিন্তু মেয়েটার মরণ ঘা হয়েছে। এদের কি বলবে এখন?

আনন্দ চুপচাপ লোকগুলোকে দেখল। জয়িতা বলল, ফালতু এক্সপেরিমেন্ট করে ওদের বিপদ বাড়িয়ে লাভ নেই। লেট দেম সাফার ইন দেয়ার ওন ওয়ে।

হঠাৎ দ্বিতীয় একটা পথ দেখতে পেল আনন্দ। সে পালদেমকে জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের কেউ ফালুট পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারবে আমাদের?

ফালুট! ফালুটে আমরা কেউ কখনও যাইনি। কেন?

রাস্তাটা তত চেনো। তোমরা আমাদের ওই পর্যন্ত পৌঁছে দিলে আমরা চেষ্টা করব দার্জিলিং যেতে। দার্জিলিং-এর কোন ভাল ডাক্তারকে যদি প্রত্যেকটা লোকের অসুখের বর্ণনা দেওয়া যায় তিনি নিশ্চয়ই কোন ওষুধ দরকার বলে দেবেন। সেগুলো কিনে ফালুটে ফিরে এলে তোমাদের লোক আবার পথ চিনিয়ে এখানে আসবে। এ কাজের জন্যে বড় জোর সাতদিন সময় লাগতে পারে। কিন্তু লোকগুলোর অসুখে ঠিকঠাক ওষুধ পড়বে।

আনন্দ উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথাগুলো বলতে পালদেম ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকাল, তোমরা কজন যাবে?

আনন্দ বলল, একজন। সে প্রশ্নটায় সন্দেহের গন্ধ সহজেই পেল।

মাথা নাড়ল পালদেম, ঠিক আছে।


সঙ্গে সঙ্গে কাজে লেগে গেল চারজন। চারটে কাগজে আলাদা করে প্রতিটি মানুষকে পালদেমের সাহায্যে জিজ্ঞাসা করা হল, তার কি কষ্ট হচ্ছে, রোগের উপসর্গ কি, ব্যথা কোথায়, জ্বর আছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রায় আড়াই ঘণ্টা লাগল সব জেনে নিতে। পালদেম তাদের বলে দিল সাতদিন পরে ওষুধ পাওয়া যাবে। সঙ্গে সঙ্গে মানুষগুলোর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ গুঞ্জনের পর তারা ঢালু পথ বেয়ে চলে গেল যে যার ঘরে। এই সময় বৃদ্ধা এসে দাঁড়াল আনন্দর সামনে। বৃদ্ধর দিকে হাত বাড়িয়ে সে অভিমানের সুরে কিছু বলে আনন্দর হাতের কাগজটি দেখাল। হেসে ফেলল আনন্দ। তারপর পালদেমের সাহায্যে বৃদ্ধকেও জেরা করে করে উত্তরগুলো লিখে নিতে বৃদ্ধা খুশী হল।

আজ পালদেম এবং বৃদ্ধা ওদের সঙ্গে খেল। খাওয়া শেষ হয়ে গেলে পালদেম বলল, সামনের চাদের পর এখানে রোজ বরফ পড়বে। তখনই হবে মুশকিল।

মুশকিল কেন? জয়িতা প্রশ্ন করল।

প্রত্যেক বছর এই সময় ব্যাপারী আসে খচ্চর নিয়ে। এ বছর এখনও এল না ওরা। ওদের কাছেই শীতের জন্যে জিনিসপত্র পাই আমরা। পালদেম উঠে দাঁড়াল, তোমাদের মধ্যে কে যাবে বাইরে?

আনন্দ মাথা নাড়ল, আমি।

তাহলে এখনই রওনা হও। আমি একটি ছেলেকে দিচ্ছি তোমাদের সঙ্গে। সে অল্প অল্প হিন্দী বলতে পারে। আমার ছেলের অসুখ না হলে আমি নিজেই যেতাম।

এখন রওনা হলে ফালুটে পৌঁছাবার অনেক আগেই রাত নামবে না?

নামুক। পাহাড়ে রাত কাটানোর জায়গা পাবে। দেরি করে কি লাভ! পালদেম যাওয়ার জন্যে পা বাড়াল, আমি মিনিট পনেরোর মধ্যে ওকে নিয়ে আসছি।

সুদীপ এবার কথা বলল, দার্জিলিং-এ যাচ্ছিস, কতটা রাস্তা হাঁটতে হবে খেয়ালে আছে?

এছাড়া কোন উপায় নেই। আনন্দ উঠে কিছু জিনিসপত্র সঙ্গে নিল। সেই সঙ্গে টেন্টটাও। নিয়ে বলল, মানেভঞ্জনের মাড়োয়াড়ি দোকানদারটা তো আমাকে ছিঁড়ে খাবে টেস্টের জন্যে। দুটোই নিয়ে নিই, কি বল?

সুদীপ বলল, দুটো টেস্টের দাম আর কত হবে! ওগুলো আমাদের কখন লাগবে ঠিক নেই। তুই বরং দাম দিয়ে দিস।
 
সুদীপ আর জয়িতা আর একটা লিস্ট তৈরি করল। যতটা সম্ভব ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয় জিনিস ফেরার সময় আনতে বলল। সুদীপ আনন্দর হাতে পনেরো হাজার টাকা দিল, টাকাটা সাবধানে নিয়ে যাবি। একা যাচ্ছিস, সঙ্গে অস্ত্র নেই।

কল্যাণ এতক্ষণ চুপচাপ ওদের লক্ষ্য করছিল। এবার উঠে দাঁড়াল, আনন্দ, তোর যাওয়ার দরকার নেই, আমি দার্জিলিং-এ যাব।

তিনজনেই চমকে উঠল, আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, তুই যাবি?

হ্যাঁ।

কিন্তু।

কিন্তু কি? আমি কোন কাজ করতে পারি না? যা করার তোরাই করবি? চমৎকার! এতটা অপদার্থ ভাবার কোন কারণ নেই। আমিই যাচ্ছি। কল্যাণ উঠে নিজের জিনিস গুছিয়ে নিল।

সুদীপ বলল, কিন্তু কল্যাণ–।

না সুদীপ, আমি পালাব না। পালিয়ে যাবই বা কোথায়? এখানকার অসুস্থ মানুষদের জন্যে কিছু করতে পারলে আমার ভাল লাগবে। সে নিজের হাতটা তুলে ধরল, এটা কেটে দে।

কল্যাণের হাতের প্ল্যাস্টার এখন কালো হয়ে যেন চামড়ার সঙ্গে মিশে গেছে। ওদের নজরেও পড়ত আলাদা করে। একটা ধারালো ছুরি দিয়ে সেটাকে কাটতে অনেক সময় লাগল। নীরক্ত সাদা হাত বেরিয়ে এলে কল্যাণ সেটা ঘুরিয়ে দেখল। কোন কোন জায়গায় ঘা-এর মত হয়ে গেছে। প্ল্যাষ্টারটা তুলে সে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, ওটার মধ্যে ছারপোকার বাসা হয়ে গিয়েছে।

এই সময় পালদেম একটা অল্পবয়সী ছেলেকে নিয়ে ফিরে এল। বোঝা যাচ্ছে ছেলেটি যতটা সম্ভব তার সেরা সাজ পরে এসেছে। তার পিঠে একটা কিছু দড়ি দিয়ে বাঁধা। আনন্দ শেষবার চেষ্টা করল, কল্যাণ, এখনও ভেবে দ্যাখ।

ভাবনার কিছু নেই। তোরা তো আমাকে একটাও বোমা ছুঁড়তে দিলি না। মানুষ না মারতে পারি মানুষ বাঁচাবার কাজে লাগি। আমি সাতদিনের মধ্যে ফিরে আসব, টাকাটা মেরে দিয়ে পালিয়ে যাব না, কথা দিচ্ছি। কল্যাণকে খুব সিরিয়াস, খুব স্থির মনে হচ্ছিল।

জয়িতা এবার কাছে এগিয়ে এল, কল্যাণ, তোর নেচার আমি জানি, তুই এই কষ্ট সহ্য করতে পারবি না। ওটা তোর কাজ নয়।

ভাগ। কল্যাণ জিনিসপত্র তুলে নিচ্ছিল।

জয়িতা বলল, তাছাড়া পুলিশ আমাদের জন্যে ওয়েট করছে। ধরা পড়লে কি অবস্থা হবে ভেবে দেখেছিস? তুই একটু চিন্তা করে দ্যাখ।

ও! আনন্দ গেলে পুলিশ জামাই আদরে দার্জিলিং-এ খেতে দেবে, না? আসলে তোরা আমাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছিস! আমি তো কথা দিয়েছি, বিশ্বাস কর না।

অতএব আনন্দ কল্যাণকে সুদীপের টাকাটা দিয়ে দিল। লিস্টগুলোও সে নিয়ে নিল। পালদেম জিজ্ঞাসা করল, তুমি যাচ্ছ না কেন?

আনন্দ বলল, আমাদের এই বন্ধু যাচ্ছে বলে। ছেলেটাকে বলে দাও যেন সন্ধ্যের মধ্যে একটা ভাল আস্তানা খুঁজে নেয়। ও যদি দার্জিলিং পর্যন্ত যায় তাহলে ভাল হয়।

না, আমরা কেউ বড় শহরে যাই না। সান্দাকফুর কাছে ওকে ছেড়ে দিয়ে ছেলেটা অপেক্ষা করবে সাতদিন। আমরা পাহাড়ের মানুষ ঠিক থেকে যেতে পারি পাহাড়ে। তোমার বন্ধুকে বলে দাও যেন সাতদিনের মধ্যে ওই জায়গায় ফিরে আসে।



নতুন করে বলার কিছু ছিল না। কিছু চাল ডাল আলু সঙ্গে নিল কল্যাণ। তারপর বন্ধুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ঢালু পথে নামল। ওরাও সঙ্গ নিল। খানিকটা দূরে যাওয়ার পর দেখল গ্রামের অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে পথের ধারে। ছেলেটির মা এসে গায়ে হাতে হাত বুলিয়ে খানিকটা কথা বলে নিল। জয়িতার মনে হল সবাই জানে কল্যাণ কেন যাচ্ছে। প্রত্যেকেই চাইছে ওরা নিরাপদে ফিরে আসুক। এই সময় কাহুনকে দেখা গেল দুজন শিষ্য নিয়ে এগিয়ে আসতে। ওদের দাঁড় করিয়ে দু-মিনিট মালা ঘুরিয়ে মন্ত্রপাঠ করে কাহুন সশিষ্য নীরবে ফিরে গেল।

ওরা এগিয়ে চলল সেই জায়গা পর্যন্ত যেখানে এসে প্রথম দিন ওরা গ্রামটাকে দেখতে পেয়েছিল। জয়িতার কেবলই মনে হচ্ছিল কল্যাণের সঙ্গে তার এই শেষ দেখা। শেষ পর্যন্ত সবাই যখন দাঁড়িয়ে পড়ল তখন ওরা দল ছেড়ে এগোল। হঠাৎ জয়িতা একা দৌড়ে কল্যাণের কাছে পৌঁছাল, সাবধানে যাস।

তুই ভাল থাকিস জয়ী। কল্যাণ ওর গালে আঙুল রাখল এক মুহূর্ত। তারপর হন হন করে হাঁটতে লাগল পাহাড় ভেঙে। কয়েক পলকের মধ্যে ওরা চোখের আড়ালে চলে গেলে জয়িতা আবিষ্কার করল তার চোখ ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হল কল্যাণকে রিভলভারটা দিয়ে দিলে হত। কিন্তু সেই সময় একটা উল্লাসের চিৎকার উঠল জনতার মধ্যে।

জনতার থেকে আলাদা একা দাঁড়িয়ে জয়িতা দেখল দূরে সাদা পাহাড়ের পটভূমিতে কয়েকটা কালো বিন্দু দেখা যাচ্ছে। বিন্দুগুলো গ্রামের দিকে এগিয়ে আসছে।
 
৩৬.
মানুষগুলো নেমে যাচ্ছে নিচে তাড়াহুড়ো করে। এই গ্রামে যাওয়া আসার পথ তাহলে দুটো। একটা দিয়ে তারা এসেছিল, কল্যাণরাও গেল। দ্বিতীয়টি ওই বিন্দুগুলো ব্যবহার করছে। এখন অবশ্য আর ঠিক বিন্দু নেই। কয়েকটা জন্তু এবং মানুষ যে গ্রামে আসছে বোঝা যাচ্ছিল। আনন্দ চিৎকার করে জয়িতাকে ডাকল, এই জয়, চটপট চলে আয়।

যেদিকে মানুষের ঢল এগোচ্ছে তার বিপরীত দিকে যাচ্ছিল সুদীপ আর আনন্দ। নেমে আসতে কখনই অসুবিধে হয় না যদি ব্যালেন্স ঠিক রাখা যায়। জয়িতা ওদের ধরে ফেলে জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার, কোথায় যাচ্ছিস? কারা আসছে ব তো?

আনন্দ হাঁটছিল এখন। জনতাকে দেখা যাচ্ছে না এখান থেকে। বলল, কেউ না কেউ আসছে, তবে যেই আসুক আমাদের দেখে নিশ্চয়ই অবাক হবে। এমনও হতে পারে নেপাল সরকারের অনুমতি নিয়ে পুলিশ আসছে আমাদের উদ্দেশ্যে। তাই যতক্ষণ ব্যাপারটা না বোঝা যাচ্ছে ততক্ষণ আড়ালে থাকাই উচিত। ওরা গ্রামের মধ্যে হাঁটছিল।

সুদীপ বলল, পুলিশ দেখে এত আনন্দিত পৃথিবীর কোন দেশের মানুষ হয়নি বলেই জানি। আমার মনে হচ্ছে এরা সেই লোক যারা শীতের আগে এখানে ব্যবসা করতে আসে।

আনন্দ বলল, তাহ। কিন্তু আমাদের সতর্ক হতে তো ক্ষতি নেই।

এই সময় জয়িতার আবার মনে হল আনন্দ কি ভাবে সতর্ক হবে? কোন অস্ত্র সঙ্গে নেই যে আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ করতে পারবে একমাত্র তার কাছেই—কিন্তু না, এখনও কিছু বলার দরকার নেই।

আস্তানায় পৌঁছে জয়িতার আবার কল্যাণের কথা মনে পড়ল। আজ ও থাকবে না। দলের সবচেয়ে ভীতু, আশ্রয় খোঁজা দুর্বলচিত্তের ছেলে সবচেয়ে সাহসী হবার জন্যে বেরিয়ে গেল। মানুষ কখনও কখনও এমন বিপরীত আচরণ করে থাকে বলেই তাকে দুর্বোধ্য বলা হয়। কিন্তু জয়িতারও সংশয় আছে কল্যাণ শেষ পর্যন্ত দার্জিলিং-এ পোঁছাতে পারে কিনা। ও যদি ঘুম থেকে কলকাতায় ফিরে যায় তাহলেও যেমন অবাক হওয়ার কিছু নেই, তেমনি মাথা গরম করে মানেভঞ্জনে কোন নাটক করে ফেলাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এই কষ্ট ও সইবে? একা?

সুদীপ বলল, আমি আজ মাল খাব, তোদের কারও আপত্তি আছে?

আনন্দ অবাক হল, মাল! মাল কোথায় পাবি?

সুদীপ হাসল, স্টকে আছে। তারা ভুলে গেছিস।

জয়িতা মুখ ফেরাল, হঠাৎ এত মধুর বাসনা?

সুদীপ চোখ বড় করল, যাঞ্চলে! তুই বাংলা বলছিস? কি হল মাইরি! খাবি?

জয়িতা উত্তর দিল না। সে আনন্দকে জিজ্ঞাসা করল, এখানে বসে থাকলে আমরা নিরাপদ? কে এল দেখা দরকার। আমি যাচ্ছি, তুই আসবি?

সুদীপ বলল, দেখাদেখিতে আমি নেই, তোরা ঘুরে আয়।

যতটা সম্ভব আড়াল রেখে ওরা এগোচ্ছিল। আনন্দ বলল, জয়ী, আমরা যেন কেমন অলস হয়ে যাচ্ছি। কাজ না করলে যা হয়। সুদীপ কেন মদ খাবে না তার যুক্তি তো আমি পেলাম না।
 
তিনটে লোক আর ছটা খচ্চর। জন্তুগুলো মালপত্রের আড়ালে পড়ে গেছে প্রায়। তিনজনের মুখে হাসি। ওদের দেখলে সিকিমিজ কিংবা টিবেটিয়ান বলেই মনে হবে। কারণ নেপালীরা অত লম্বা হয় না, নাকের গড়ন মোটেই চ্যাপটা নয়। গ্রামবাসীরা ওদের স্বাগত জানাচ্ছিল। যে মানুষটির বয়স হয়েছে তাকেই নেতা বলে ভাবতে অসুবিধে হল না। ছোট্ট যে মাঠটি এই গ্রামের মাঝখানে সেখানে চলে এল লোক তিনটে। বৃদ্ধ সবাইকে কুশল জিজ্ঞাসা করছে হাত নেড়ে। অন্তত সেইরকম মনে হল এদের কাণ্ড দেখে। আনন্দ জয়িতাকে বলল, গ্রামে যেন উৎসব শুরু হয়ে গেল। কে বলবে একটু আগে লোকগুলো ওষুধের জন্যে হাঁ করে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এই তিনটে লোক আসছে কোত্থেকে?

জয়িতা উত্তর দিল, দার্জিলিং থেকে। নইলে জিনিসপত্র পাবে কোথায়? সামনে যাবি?

আনন্দ বলল, না। আর একটু অপেক্ষা করা যাক। এই সময় দেখা গেল কাহুন আসছে তার সাকরেদদের সঙ্গে নিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধ আর তার দুই সঙ্গী নতজানু হয়ে কান্থাকে শ্রদ্ধা জানাল। ব্যাপারটা কানের খুব পছন্দ হয়েছে বলে মনে হল মুখ দেখে। এই সময় বৃদ্ধ উঠে গিয়ে বোঁচকা খুলে একটা ঠোঙা খুলে চাল মুঠোয় নিয়ে দেখাল। সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের লোক সোৎসাহে সাধুবাদ দিয়ে উঠল যেন।

কয়েকটা কথা বলার পর কাহুন ফিরে গেল। আনন্দ বলল, যাক, লোকগুলো পাসপোর্ট পেয়ে গেল। সর্বত্র ঘুষ দেবার এই প্রথাটি রয়েছে। এখন যত ইচ্ছে ব্যবসা করতে পারবে।

জয়িতা বলল, গ্রামে ঢোকার সময় আমাদেরও ভেট দেওয়া বোধহয় উচিত ছিল। যে দেশের যা নিয়ম। আমাদের মেজাজ সব জায়গায় চলবে কেন?

এই সময় আগন্তুকরা বিশ্রাম শেষ করে কাজ শুরু করল। খচ্চরগুলোর পিঠ থেকে বোঝা নামিয়ে খুলতে লাগল ওরা। তারপর মোটামুটি দোকান সাজিয়ে ফেলল। একটা জায়গায় প্রচুর জামা প্যান্ট শাড়ি থেকে শুরু করে গরম চাদর কোট সোয়েটার স্তুপ করে রাখা হয়েছে। আর একটা জায়গায় চাল ডাল নুন থেকে আরম্ভ করে প্রয়োজনীয় কিছু না কিছু রয়েছে। কেনাবেচা শুরু হয়ে গেল। একটা ছাগল দিয়ে শার্ট-প্যান্ট আর শাড়ি পেল একজন। শার্ট-প্যান্টকে খুব নতুন বলে মনে হল না এবং শাড়িটিও বেশ সাধারণ। বিনিময় প্রথায় প্রচণ্ড লাভ করছে ব্যবসায়ীরা। এই দুর্গম অঞ্চলে জিনিসপত্রগুলো অনেক কষ্ট করে ওরা নিয়ে এসেছে এটাই যদি একমাত্র যুক্তি হয় তাহলে ওরা যা ইচ্ছে চাইতেই পারে। ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছায় তা দেখবার জন্য ওরা অপেক্ষা করবে বলে স্থির করল।



হাঁটার সময় শরীরের উত্তাপ বেড়ে যাওয়ায় স্বভাবতই ঠাণ্ডা কমে যায়। কিন্তু কল্যাণ গরম জামা খোলার কথা চিন্তা করছিল না। প্রাথমিক উদ্যমের পর তার হাঁটার গতি কমে এসেছিল। এখন চারদিকে পাহাড় আর পাহাড়। ঘন কুয়াশারা দলবেঁধে আসা যাওয়া করছে। তার সঙ্গী বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাঁটছিল। চড়াই ভাঙতে যেখানে তার জিভ বেরিয়ে আসার উপক্ৰম সেখানে ছেলেটা মুখ ঘুরিয়ে মাঝে মাঝে হেসেছে। ক্রমশ দূরত্ব বেড়ে যাওয়ার কারণে এখন ছেলেটা দাঁড়িয়ে পড়ছে মাঝে মাঝে। ও যে কতটা হিন্দি বোঝে তা ইতিমধ্যে জেনে গেছে কল্যাণ। একটা কথা চারবার বললে তবে যদি ও সেটা আন্দাজ করতে পারে। লক্ষ্যহীন হাঁটায় কোন তাড়াহুড়ো থাকে না? কিন্তু এখন তার কেবলই মনে হচ্ছে অনেকটা পথ সামনে পড়ে আছে। ফালুটের রাস্তা পর্যন্ত কোন চিন্তা নেই, কিন্তু তারপর প্রতি মুহূর্তে পুলিশের চোখ এড়াতে হবে। অবশ্য ওই রাস্তায় পুলিশের থাকার কথা নয়। ভারতবর্ষের পুলিশের দায় পড়েনি ওই পাণ্ডববর্জিত পথে বারো তেরো হাজার ফুট পায়ে হেঁটে উঠে এসে টহল দেবে।

মুশকিল হল ও যখন বিশ্রামের জন্যে কোথাও বসতে চাইছে তখনই ছেলেটা বিরক্ত হচ্ছে। অনর্গল নিজের ভাষায় কিছু বলে আকাশে হাত তুলে সম্ভবত সূর্য দেখাচ্ছে। একটি শব্দ ওর ঠোঁটে লেগেই আছে, জলদি।

কেন জলদি তা কল্যাণ জানে। ছেলেটা চাইছে অন্ধকার হবার আগেই এমন কোথাও পোঁছাতে যেখানে রাতের আস্তানা আছে। কিন্তু পাহাড় ভাঙতে যে ইতিমধ্যে তার পায়ে ব্যথা শুরু হয়েছে সেটা প্রকাশ করা যায় না! ওর মনে হল সুদীপরা আরাম করে বসে আছে। সঙ্গে সঙ্গে সে চিন্তাটাকে বাতিল করল। তাকে দার্জিলিং-এ পৌঁছাতেই হবে। একটি ভাল ডাক্তারের সঙ্গে বসে প্রেসক্রাইব করাতেই হবে। তারপর ওষুধগুলো গ্রামে পৌঁছে দিতেই হবে। এবং এটা না করলে সে বন্ধুদের-মা, এটা করার পর সে এমন ভাব করবে যেন কিছুই করেনি। জ্ঞান হবার পর সে জেনেছে অন্য বেলেমেয়েরা তাদের বাবামায়ের কাছ থেকে যে সাহায্য পায় তা সে পায়নি। তাকে নিজের চেষ্টায় পড়াশুনা করতে হয়েছে। এবং সেটা করতে গিয়ে এতকালের সব চিন্তা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছে। অন্যের জন্যে কোন ভাল কাজ করার কথা মাথায় আসেনি অথবা সুযোগও পাওয়া যায়নি। এই প্রথম একা সম্পূর্ণ একা সে ওইরকম একটা কাজ করতে যাচ্ছে। কাজটা শেষ করতেই হবে। অবশ্য এটাও যদি নিম্নমধ্যবিত্ত মানসিকতা হয় তাহলেও সে খুশি।

এই পথেই ওরা এসেছিল কিন্তু এখন পথটাকে সে মোটই চিনতে পারছে না। যদি এই ছেলেটা সঙ্গে না থাকে তাহলে তার পক্ষে গ্রামে ফেরাও অসম্ভব। এবার ছেলেটা ভাঙা হিন্দিতে যা বলল তার অর্থ, আপনি যদি এইভাবে হাঁটেন তাহলে আর কখনও ফিরে আসতে পারবেন কিনা সন্দেহ। অতএব কল্যাণ আবার পা চালাল। তার মনে পড়ল আসার সময় গুহার বাইরে হিংস্র জন্তুদের অস্তিত্ব ছিল। একটাকে গুলি করে মারাও হয়েছিল। এখন তার কাছে কোন অস্ত্র নেই। তাছাড়া রাত্রে এখানে যে জন্তুর কান্না শুনতে পাওয়া যায় তার দর্শন পাওয়াও অসম্ভব নয়। ছেলেটাকে জোরপায়ে সে অনুসরণ শুরু করল। এখন শুধু অন্ধের মত হেঁটে যাওয়া।
 
চুপচাপ তিন পেগ ব্র্যান্ডি খেয়ে মেজাজী লাগছিল বেশ। বিলিতি ছবিতে সুদীপ দেখেছে কেউ জল দিয়ে মদ খায় না। তাপল্যাঙে যে ঠাণ্ডা বিলেতে নিশ্চয়ই তার চেয়ে বেশি নয়। অতএব সুদীপ বিলিতি কায়দা অনুসরণ করেছিল। ফলে খুব দ্রুত তার মাথায় বিপরীত ঢেউ বইতে শুরু করল। ব্রান্ডির বোতলটা হাতে নিয়ে সে দরজায় এসে দাঁড়াল। সে খুশি হল এই ভেবে যে তার হুঁশ আছে। নইলে ওইটুকু আসতে যে তিনবার পা টলেছে তা টের পেত না। মাতালদের কোন জ্ঞান থাকে না। তিন পেগ ব্রান্ডি খেলে কেউ মাতাল হয় না। অবশ্য সে তো আন্দাজে ঢেলেছে। এই গ্লাসের কতটায় এক পেগ হয় তা বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন কিন্তু তার যে মনে হচ্ছে তিন পেগ সেটাই যথেষ্ট। আনন্দরা কোথায়? সে চোখ মেলে সামনের উপত্যকায় কাউকে দেখতে পেল না। আবছা মনে পড়ল কেউ এসেছিল এই গ্রামে। তারা কারা? যদি পুলিশ হয় তাহলে এখানে বসে থাকা উচিত নয় এই বোধটুকু মাথায় ঢুকে গেল।

কিন্তু সেইসঙ্গে সুদীপের মনে দুঃখ এল। সে মদ খেয়েছে বলে আনন্দরা তাকে ত্যাগ করে গেল? সে নেশা করে না জেনেও? এত কনজারভেটিভ হবে কেন ওরা? দেশের জন্যে যারা কাজ করে তাদের কেন সন্ন্যাসী হতে হবে? জয়িতাটাও কেন আনন্দর সঙ্গে চলে গেল? দুঃখটা ভারী হয়ে উঠতেই সুদীপের বুক থেকে নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল। তার মনে হল আপাতত কোথাও লুকিয়ে থাকা দরকার।

সুদীপ ধীরে ধীরে নামতে চাইছিল কিন্তু তার পা দ্রুত চলছিল। ঠিক কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল না কিন্তু সে গ্রামের উলটো দিকে নেমে যাচ্ছিল। একটা গায়ে চলা পথ পেয়ে সে খুশি হল। তার ডান হাতে এখনও বোতলটা সযত্নে ধরা যদিও সে ও ব্যাপারে সচেতন ছিল না। একসময় খেয়াল হতে সে মুখ ফিরিয়ে দেখার চেষ্টা করল কিন্তু আস্তানাটা চোখে পড়ল না। কয়েকটা পাথর ডিঙিয়ে সে খুব সাবধানে এগোচ্ছিল। এবং তখনই জলের শব্দ কানে এল। তার মনে হল সে ভুল শুনছে! এখানে নদী কোথায় যে জলের শব্দ হবে। তিন পেগ ব্র্যান্ডি খেয়েই শেষ পর্যন্ত নেশা হয়ে গেল? অথচ শব্দটা কান লেগেই আছে। সুদীপ খুব সন্তর্পণে এগোল। এবং গাছপালা ও পাথরের আড়াল শেষ হলে সে জল দেখতে পেল। প্রথমে তার মনে হল এটা মরীচিকা। তারপরেই খেয়াল হল মরীচিকা শুধু মরুভূমিতে দেখা যায়। অতএব ওই যে হাত পনেরো চওড়া তীব্র জলের ধারা নিচে নেমে যাচ্ছে সেটা সত্যি। তার ঝরনা শব্দটা মনে পড়ায় খুশি হল। পাহাড়ি ঝরনার ধারে বসে সুরা হাতে জীবন কাটিয়ে দেবার কথাটা কে যেন বলেছিল? কোন কবি? তার এখানে আসা উচিত। এইখানে।

একটা পাথরে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে আরাম করে বসল সুদীপ। আর তখনই তার মনে পড়ল কল্যাণের মুখটা। সঙ্গে সঙ্গে দুঃখটা কমে গেল সুদীপের। দার্জিলিং-এ যেতে প্রচণ্ড কষ্ট হবে কল্যাণের। এখন আর জিপ নেই। টানা সাড়ে তিনদিন হাঁটলে তবে দার্জিলিং। অথচ সাতদিনে ফিরে আসবে বলে গেছে। ইম্পসিবল। তোর যাওয়ার কি দরকার ছিল? না, আমি মানুষ মারতে পারিনি বলে মানুষ বাঁচাতে চাই। এটা একদম লোয়ার মিডলক্লাস সেন্টিমেন্ট। হিরো হবার জন্যে একেবারে হেদিয়ে মরছিল শালা। কিন্তু তা সত্ত্বেও কল্যাণ ইজ কল্যাণ। ও সঙ্গে থাকলে মাঝে মাঝেই অস্বস্তি আসে, দূরে চলে যাওয়ায় এখন মোটেই স্বস্তি হচ্ছে না। আচ্ছা, কল্যাণ যদি আর না ফিরে আসে? সুদীপের হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল। এবং সেইসঙ্গে তার মনে হল কান্নাটা প্রকাশ করা উচিত নয়। তাহলে নেশা হয়ে গেছে প্রমাণিত হবে। কিন্তু ওই পালদেম লোকটাকে টাইট দেওয়া দরকার। চুরি করে সমস্ত মাল নিয়ে গিয়েও কেমন দাঁত কেলিয়ে বারংবার আসছে। মালগুলো ফেরত না পেলে ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে থাকতে হবে। সুদীপ আর একবার বোতলের মুখ খুলল। তারপর বিলিতি ছবির হিরোর মত খানিকটা গলায় ঢালল। এখন আর বুক জ্বলছে না। তবে চোখের সামনে নদীটা মাঝে মাঝেই অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ওর মনে হল একটু শুয়ে পড়লে কেমন হয়? মাথাটা বড় হালকা লাগছে। সে কোনরকমে পাথরের ওপর শরীর বিছিয়ে দিতেই আরাম বোধ করল। চোখ বন্ধ করতেই হুট করে চলে গেল কলকাতায়। কেউ একজন তার দিকে এগিয়ে আসছে। খুব সন্তর্পণে। তাকে লক্ষ্য করে যাচ্ছে। এবার মুখটা সামান্য ঝুঁকল। সুদীপ হেসে বলল, মা, তুমি কেমন আছ?

যে এসেছিল সে তার ভাষা বুঝতে পারল না। কিন্তু যখন দেখল সুদীপ আর চেতনায় নেই তখন লোভীর মত খপ করে বোতলটা তুলে নিল হাতে। তার লাল গালে আরও রক্ত জমল প্রথম টোক পেটে যাওয়ামাত্র।
 
ব্যাপারীরা আজ রাত্রে এই গ্রামেই থেকে যাবে, ওদের দেখে সেই রকম মনে হচ্ছিল। প্রাথমিক কেনাবেচা শেষ হবার পর গ্রামের মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে জিনিসপত্র দেখার জন্যে। প্রত্যেকের ইচ্ছে কিছু না কিছু কেনার। প্রয়োজন যে রয়েছে তা বোঝাই যাচ্ছে কিন্তু বিনিময়ে যা দিতে হবে তা দেওয়ার সঙ্গতি সবার নেই। আনন্দরা অনেকক্ষণ ব্যাপারটা লক্ষ্য করল। পালদেম দাঁড়িয়ে আছে দূরে। সে একটা ছোট জামা কিনেছে মুরগীর বিনিময়ে। সুতীর জামাটার দাম সাত/আট টাকার বেশি হবে না। আনন্দ এবং জয়িতা ঠিক করল ওরা কখনই ওই লোকগুলোর সামনে যাবে না। এরা নিশ্চয়ই কাল চলে যাবে এখান থেকে।

আনন্দ আড়াল থেকে সরে এসে রাস্তায় দাঁড়াতেই একটি বাচ্চাকে দেখতে পেল। ওই হট্টগোলের মধ্যে বাচ্চাটা যাচ্ছে না কিন্তু তার যে যাওয়ার এবং জিনিস কেনার খুব ইচ্ছে তা স্পষ্ট। সে আনন্দকে দেখামাত্র প্রথমে শঙ্কিত হয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। আনন্দ ওর দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর দূরে দাঁড়ানো পালদেমকে দেখিয়ে ডেকে আনতে ইশারা করল। এটা বুঝতে বাচ্চাটার সময় লাগল কিছুটা এবং তারপর দৌড়ে চলে গেল পালদেমের কাছে। আনন্দ দেখল পালদেম বাচ্চাটার কথা শুনে বিস্মিত হয়ে এদিকে তাকাল। ওখান থেকে সম্ভবত লক্ষ্য করা সহজ ছিল না তাদের অস্তিত্ব। পালদেম উঠে এলে আড়াল দূর হতেই বলল, ও তোমরা! কি ব্যাপার?

আনন্দ বলল, এদের কথাই তুমি বলেছিলে বুঝতে পারছি। একটা মুরগি দিয়ে ওই জামা কিনলে? তোমাকে তো ওরা ঠকিয়ে দিল!

কি করব! ওরা বলছে জিনিসপত্রের দাম নাকি কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। আমার যে ছেলের অসুখ সে বায়না ধরেছে একটা জামার। অথচ কত কিছুর দরকার ছিল, দাম শুনে–। পালদেম নিঃশ্বাস ফেলল। ওকে খুব করুণ দেখাচ্ছিল, দেখি, যাওয়ার সময় যদি দাম কম করে!

জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, তোমরা টাকা দিয়ে জিনিস কিনতে পার না?

টাকা? টাকা কোথায় পাব?

কোন্ টাকা এখানে চলে? নেপাল না ভারতের?

সব টাকাই এখানে চলে। চ্যাংথাপু ওয়ালাংচাঙে ইন্ডিয়ান টাকাই সবাই নেয়।

কথাটা শুনে আনন্দ জয়িতার দিকে তাকাল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ওরা মালপত্র কোথায় কেনে? দার্জিলিং-এ?

পালদেম বলল, না। বর্ডার থেকে কিনে ওরা সব কিছু এনে জমা করে চ্যাঙথাপুতে। তারপর গ্রামে গ্রামে বিক্রি করতে যায়।

ধর, যদি ওদের সব জিনিস বিক্রি হয়ে যায় তাহলে কি আজ ওরা ফিরে যাবে?

প্রশ্নটা শুনে পালদেম আকাশের দিকে তাকাল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, এখনও সময় আছে। শুধু শুধু এখানে বসে ওরা কি করবে!

আনন্দ বলল, আমরা এখানে আছি ওরা জেনেছে?

না। পালদেম দ্রুত মাথা নাড়ল।

বেশ, তাহলে তুমি মিনিট দশেক পরে আমাদের ওখানে চলে এস। দরকারি কাজ আছে। আনন্দ কথা শেষ করে জয়িতার সঙ্গে পেছন ফিরল।

খানিকটা যাওয়ার পর জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, মনে হচ্ছে তোর মাথায় কোন মতলব এসেছে, কি ব্যাপার?

আনন্দ বলল, টাকাটা এখনও সুদীপের, তাই ওর সঙ্গে কথা বলে নেওয়া দরকার। শোন, আমার ইচ্ছে ওই মুরগি ছাগলগুলো ওদের কাছ থেকে প্রথমে কিনে নিই। একটা মুরগির দাম দশ টাকা পড়বে এখানে। ছাগলের দাম জানি না। পালদেমকে বলব ব্যবসায়ীরা বিনিময়ে যা যা পেয়েছে তা খুব দরাদরি করে সব কিনে নিতে। তারপর বাকি যা মাল থাকবে সেগুলো টাকা দিয়ে কিনবে পালদেম। অর্থাৎ ব্যবসায়ীরা শুধু টাকা নিয়ে এখান থেকে ফেরত যাবে, জিনিসগুলো নিয়ে নয়।

জয়িতা বোঝবার চেষ্টা করল, কিন্তু তা থেকে দুটো সমস্যা তৈরি হবে। প্রথমত, ব্যবসায়ীরা খুব অবাক হবে। ওরা দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবসায় আছে। কখনও গ্রামের লোক টাকা দিয়ে জিনিসপত্র কেনে না। ওরা যা এনেছে তার দাম কয়েক হাজার তো হবেই। এত টাকা এই গ্রামের মানুষ কোথায় পেল নিশ্চয়ই জানতে চাইবে ওরা, তাই না?

আনন্দ বলল, জানতে নিশ্চয়ই চাইতে পারে কিন্তু জবাব দেওয়াটা তো এদের ইচ্ছেয়।
 
জয়িতা হাসল দ্বিতীয় সমস্যা হবে জিনিসপত্রগুলো নিয়ে। আমাদের টাকায় ওগুলো কিনে নেওয়ার পর মুরগি ছাগল এলাচের মালিক কে হবে? ব্যবসায়ীরা যা বিক্রি করতে পারেনি সেই মালপত্র কে ব্যবহার করবে?

আনন্দ সরল গলায় বলল, গ্রামবাসীরা। মুরগি ছাগল কেউ ফেরত পাবে না। ওগুলো এই গ্রামের পশু হিসেবে থাকবে, কোন ব্যক্তিগত মালিকানায় নয়। আর যারা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সঙ্গতির অভাবে কিনতে পারেনি তাদের মধ্যে জিনিসগুলো বিলি করে দেওয়া হবে।

জয়িতা চমকে তাকাল, তোর কথায় অন্য রকম গন্ধ পাচ্ছি আনন্দ।

আনন্দ এবার উত্তেজিত হল, হ্যাঁ। আমি তোর, তোদের সাহায্য চাই। এই গ্রামটার সঙ্গে সভ্য জগতের সম্পর্ক খুব ক্ষীণ। লোকগুলোর ক্রয়ক্ষমতা কম। দারিদ্রসীমার অনেক নিচে বাস করে। ধর্ম আছে কিন্তু মনে হচ্ছে সেটা নাগপাশের মত নয়। সবচেয়ে চমৎকার ব্যাপার এদের কেউ শোষণ করছে না, এরা শোষিত হচ্ছে নিজেদের অজ্ঞতার দ্বারাই। অর্থাৎ কেউ হয়তো এদের শোষণ করে কিছু পাওয়া যাবে না জেনেই থাবা বাড়ায়নি। কাহন নিশ্চয়ই গ্রামের প্রধান তবে তাকে আমার জোতদার বলেও মনে হচ্ছে না। লোকগুলো স্রেফ অভ্যেসে সংস্কার আঁকড়ে ধরে এই গ্রামে পড়ে আছে আধমরা হয়ে। সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ রাজনীতির নোংরা বাতাস পর্যন্ত এদের মানুষ বলে গুরুত্ব দেয়নি। প্রকৃত অর্থে এরাই মাটিব ডেলার মত। আমরা যে সমাজ ব্যবস্থার কল্পনা করতে ভালবাসি এবং ভারতবর্ষের মাটিতে যা কোনদিনই সম্ভব হবে বলে মনে হয় না সেই স্বপ্ন এদের নিয়ে দেখতে অসুবিধে নেই। আমার বিশ্বাস, বছর দশেকের মধ্যে এই গ্রামের মানুষদের সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পূর্ণ অধিকার দেওয়া সম্ভব। একটা কিছু কাজ করতে চেয়েছিলাম জয়িতা, আর না, এই কাজটাই করি।

জয়িতা মুখ তুলে তাকাল, আমি তৈরি। কিন্তু আমরা কিভাবে তা করব? আজ সমস্ত জিনিস ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে ওদের লোভ বাড়িয়ে দেওয়া হবে না? ওরা ভাববে আমরা ওদের চিকিৎসার টাকা দেব, জিনিসপত্রের দাম দিয়ে দেব, একটা মামার বাড়ি মার্কা ব্যাপার পেয়ে আরও অলস হয়ে যাবে না?

আনন্দ বলল, অলস হতে দেব না আমরা। কিন্তু এই বরফ পড়ার সময়টা আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে। আমাদের নিজেদের বেঁচে থাকার রসদ যোগাড় করতে হবে। এই এক বছরের অভিজ্ঞতা আমাদের কাজে দেবে সামনের বছরে। এখনও ওরা আমাদের সন্দেহ করছে, বিশ্বাস উৎপাদন করতে সব সময়ই সময় লাগে।

আস্তানায় এসে ওরা সুদীপকে পেল না। কিন্তু নাকে মদের গন্ধ এল। বোঝা গেল সুদীপ ওই ঘরে বসে মদ খেয়েছে। ব্যাপারটা আনন্দকে উষ্ণ করছিল কিন্তু জয়িতা তাকে বলল, এগুলো এড়িয়ে যা। সব সময় একটা ছেলে বিশেষ করে সুদীপের মত ছেলে একই নিয়মে চলবে তা আশা করা যায় না। তা ছাড়া তুই নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছিস এখানে আসার পর থেকেই ওর কথাবার্তা চালচলনের মধ্যে আগেকার ছটফটে বেপরোয়া ভাবটা ছিল না বললেই চলে। এখানে একদম চুপচাপ বসে থাকাটাও ওর কাছে শাস্তির মত। একটু ব্র্যান্ডি খেলে দোষ কি।

আনন্দ বলল, তুই ওর হয়ে এত কৈফিয়ৎ দিচ্ছিস কেন? আমি নিশ্চয়ই ওর সমস্যা বুঝতে পারছি। তবু সব কিছু যদি একটা সীমার মধ্যে থাকে তাহলেই ভাল।

অনেক খরচ হয়েছে কিন্তু এখনও যা সুদীপের কাছে রয়ে গেছে তা পর্যাপ্ত বলে মনে হল ওদের। আজকের ঘটনার পর এই টাকা সাবধানে রাখতে হবে। সেদিন পালদেমের নজরে এটা পড়েনি কিংবা হয়তো পড়লেও নেয়নি। তাই যদি হয় লোকটাকে সৎ বলে মনে করতেই হবে। আনন্দরা সুদীপের জন্যে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। সুদীপের পাত্তা নেই। শেষ পর্যন্ত জয়িতা গুনে গুনে হাজার পাঁচেক টাকা বের করল!

কিছুক্ষণ বাদেই পালদেম হাজির হল। প্রস্তাব শুনে সে প্রথমে হতভম্ব। এত টাকা যে এদের কাছে আছে এবং সেটা এইভাবে খরচ হবে তা বিশ্বাস করতে পারছিল না সে। অবাক গলায় সে জিজ্ঞাসা করল, এতে তোমাদের কি লাভ?

জয়িতা উত্তর দিল, তোমার ছেলেকে সারিয়ে আনন্দর কি লাভ হয়েছে?

প্রশ্নটা শোনামাত্র পালদেম কেঁদে ফেলল। ওকে বোঝাতে কিছুটা সময় লাগল। ওকে এও বলে দেওয়া হল আগে বিক্রিত মুরগি ছাগল কিনে নেবে দর করে। তারপরে অবিক্রিত জিনিসগুলো। যদি ওই লোকগুলো আরও জিনিস বরফ পড়ার আগে এই গ্রামে নিয়ে আসতে চায় তো আনতে বলবে। কোথেকে টাকা পেয়েছ তা জানাবে না পালদেম। আর কিনে নেওয়া মুরগি ছাগল আপাতত তার বাড়িতে রেখে দেবে।

ব্যবসায়ীরা এমন অবাক বোধ হয় কখনও হয়নি। ওরা ইচ্ছে করেই মুরগি ছাগলের দাম কমিয়ে বলেছিল কেনার সময়। সেই টাকায় এখন বিক্রি করতে বাধ্য হল। ওরা বারংবার জিজ্ঞাসা করছিল কোথায় পালদেম টাকা পেল। প্রশ্নটা গ্রামবাসীদেরও। কিন্তু পালদেম সুন্দর অভিনয় করল। ব্যবসায়ীরা টাকা নিয়ে যত শীগগির সম্ভব আবার জিনিস নিয়ে আসবে বলে গ্রাম ছাড়ল।

আনন্দরা আড়াল থেকে সমস্ত ব্যাপার দেখছিল। হঠাৎ ওরা লক্ষ্য করল সেই বাচ্চাটা যেন ওদের কিছু বলতে চেষ্টা করছে। ওরা তাকাতেই বাচ্চাটা বিপরীত দিকে দৌড়োতে লাগল ইশারা করে। কিছু একটা ঘটেছে এই অনুমানে ওরা ক্রমশ ঢালু পথ দিয়ে বাচ্চাটার পেছন পেছন চলে এল ঝরনাটার কাছে। সেখানেও আরও কয়েকটা বাচ্চা হি হি করে হাসছে। সুদীপ চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে জ্ঞান হারিয়ে। আর তার পায়ের ওপর মাথা রেখে বেহুশ একটি যুবতী। ওদের পাশেই বোতলটা যাতে এক ফেঁটা মদ নেই। আনন্দ যুবতীটিকে চিনতে পারল; যাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে এ তার স্ত্রী। বাচ্চাগুলো এদের দুজনকে ঘিরে হাততালি দিয়ে নাচছে তখন।
 
৩৭.
সুদীপের মাথায় ব্যাপারটা কিছুতেই ঢুকছিল না। সে মদ খেয়েছিল ঠিক, মদ খেয়ে আস্তানা ছেড়ে বেরিয়েও ছিল কিন্তু ওই মেয়েটা কি করে তার পায়ের ওপর এসে পড়েছিল? কখন ঘটেছিল ব্যাপারটা? মদের বোতলটা মেয়েটা পেল কি করে? সেই সঙ্গে তার খুব আফসোসও হচ্ছিল। সে নিশ্চয়ই পুরো বোতল খেতে পারে না। ওটায় যা ছিল তা মেয়েটা যদি শেষ করে না দিত তাহলে আর এক দিন। এই পর্যন্ত ভাবার পর সুদীপের মনে হয়েছিল মদ ততক্ষণই খাওয়া উচিত যতক্ষণ জ্ঞান ঠিক থাকে। তাহলে শীতবোধ থাকে না, বরং এক ধরনের মজা পাওয়া যায়।

বারান্দার দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছিল সে। এখনও মাথার ভেতরটা দপদপ করছে। এটাকেই বোধ হয় হ্যাংওভার বলে। সে দেখল জয়িতা আর একটা বাচ্চা মুরগিগুলোকে খাওয়াচ্ছে। শুধু মুরগি নয়, ছাগলও আছে। এদের চেহারা সমতলের মত নয়। স্বাস্থ্য বেশ ভাল। সে জয়িতার দিকে তাকাল। আজ সকালে ঝড় বইয়ে দিয়েছে জয়িতা। অবনী তালুকদার তাকে ওইভাবে শাসন করার সাহস পায়নি কখনও। মেয়েরা গালাগালি ব্যবহার না করেও কি করে কলজেচেরা শব্দ ছুঁড়তে পারে কে জানে? গতকাল যদি এই গ্রামের মানুষ তাকে পুঁতে ফেলত তাহলে কিছু বলার ছিল না। সে নাকি এই মানুষগুলোর কাছে তাদের ভাবমূর্তি একেবারে নষ্ট করে দিয়েছে। যারা দেশের বস্তাপচা সিস্টেমের প্রতিবাদ করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল তাদের একজন মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে আছে একটা মেয়েকে নিয়ে, ভাবা যায়? যেহেতু তাদের পোশাক ঠিক ছিল এবং মদ খাওয়া নিয়ে এদের কোন নাক কেঁচকানো ব্যাপার নেই তাই এযাত্রায় রক্ষে পেয়েছে সুদীপ। কিন্তু মেয়েটা যদি কল্যাণ ফেরার আগেই মারা যায় তো এসবই ওরা ব্যবহার করবে। জয়িতা সমানে বকে গিয়েছিল। মানুষের রুচি এত নিচে নেমে যায় কি করে? যেখানে ওরা চেষ্টা করছে একটা কিছু করার সেখানে সে মদ খাওয়া পছন্দ করল? ওই মেয়েটাকে জুটিয়ে? এই সুদীপকে তো সে কখনও জানত না। মেয়েদের সম্পর্কে এই দুর্বলতা তার মনে লুকিয়ে ছিল? এই শব্দবর্ষণ চুপচাপ শুনে গিয়েছিল সুদীপ। সে লক্ষ্য করেছিল আনন্দ তাকে কোন কথা বলেনি। একটু আগে পালদেমের সঙ্গে বেরিয়ে যাওয়ার আগে অল্প কথায় জানিয়ে গিয়েছিল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কি ভাবে সমস্ত জিনিসপত্র ওরা কিনে নিয়েছে। এই ছাগল মুরগি এবং অন্যান্য জিনিসপত্র এখন তাদের সম্পত্তি যা এই গ্রামের মানুষদের কাজে লাগবে।

এখন সকাল। কিন্তু রোদ ওঠেনি। তবে শীত বাড়ছে। পা ছড়িয়ে বসেছিল সুদীপ। সকালে ওর ভাগ্যে চা জুটেছে। একনাগাড়ে কথা শুনিয়েও জয়িতা তাকে চা খাইয়েছে। সে দেখল জয়িতা মেয়েটার সঙ্গে কথা বলছে। অথচ দুজন দুজনের ভাষা স্পষ্ট বুঝছে না কিন্তু বলার চেষ্টায় খামতি নেই। জয়িতাকে মেয়ে বলে কোনদিনই মনে হয়নি তার। এখানে আসার পর কারোরই তো স্নান করা হয়নি। ফলে জয়িতার চেহারায় মেয়েদের বাকি কোমলতাটুকুও উধাও। ও শালা তো উলটোপালটা বলবেই। যেন বিবেকের কাজ করে মাঝে মাঝে। পৃথিবীতে যারা বিপ্লবের জন্যে জীবন দিয়েছে তারা কি কখনও মদ খায়নি? হ্যাঁ, মদ খেয়ে হুঁশ হারানোটা অবশ্য অন্যায় হয়ে গিয়েছে কিন্তু মদ খাওয়াটা যে অন্যায় এটা সে মানতে পারে না। এবং তখনই তার মেয়েটার কথা মনে পড়ল। সে মেয়েটাকে দ্যাখেনি। তাকে যখন ওরা এখানে তুলে এনেছিল তখন তার জ্ঞান ছিল না। সে নিশ্চিত যে জ্ঞান হারাবার আগে মেয়েটা তার কাছে আসেনি। তাজ্জব ব্যাপার! জয়িতাকে বোঝানো যাবে না যে মেয়েটা নিশ্চয়ই তক্কে তক্কে ছিল। সে বেহুঁশ হয়ে পড়েছে দেখে বোতলটা হাতিয়েছিল। কিন্তু একেবারে তার গায়ের ওপরে পড়বে কে ভেবেছে? আচ্ছা, মেয়েটাকে দেখতে কেমন? খুব হিম্মতওয়ালী বলে মনে হচ্ছে। সুদীপের খুব ইচ্ছে করছিল মেয়েটাকে দেখতে। গ্রামের লোকেরা নিশ্চয়ই মেয়েটাকে কোন শাস্তি দেয়নি। দিলে জয়িতা বলত। সে ইচ্ছেটা চেপে রাখতে পারল না। বসে বসেই ডাকল, এই জয়িতা, শোন!
 
জয়িতা একটু থমকে গেল। তারপর আবার মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে লাগল।

সুদীপ বিরক্ত হল, কি রে, শুনতে পাচ্ছিস না?

জয়িতা আবার কথা থামাল, আগে তোর খোয়াড়ি ভাঙুক তারপর কথা বলিস।

আমি এখন ঠিক হয়ে গিয়েছি। ব্যাপারটা ভুলে যেতে পারছিস না?

কি বলতে চাইছিস?

মেয়েটা কেমন দেখতে রে?

মানে? জয়িতার গলার স্বর চড়ায় উঠল। ওর চোখ ছোট হয়ে এল।

বাঃ, একটা মেয়ে আমার পায়ের ওপর উপুড় হয়ে রইল আর আমি তাকে দেখব না?

পালদেমকে জিজ্ঞাসা কর, ও তোকে চিনিয়ে দেবে। সুদীপ, তুই কি চাস?

কি চাস মানে?

তুই এখানে প্যারাডাইসের বিকল্প জীবন খুঁজছিস?

সুদীপ কোন উত্তর দিল না। সে উঠে নিচে নেমে এল! মাথার ভেতরটা এখনও দপদপ করছে। আর এক কাপ চা পেলে হত। কিন্তু নিজে বানিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে না! সে কোমরে হাত রেখে জন্তুগুলোকে দেখল। মালিকানা বদল হয়েছে কিন্তু ওদের কোন ভ্রক্ষেপ নেই। যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক আমরা আমাদের মত আছি এমন ভাব। গতকালই খুঁটি পুঁতে কিছুটা জায়গা ঘিরে ওদের আটকে রেখেছে আনন্দ। মাথার উপরে খুবই পলকা ছাউনি। মুরগিগুলোর জন্যে একটু আলাদা ব্যবস্থা। সারারাত এই ঠাণ্ডায় কাটিয়েও ওরা মরে যায়নি। আজ একটাকে কাটলে কিরকম হয়? এই সময় বুক চিতিয়ে বসা একটা মুরগি কোঁক কোঁক করে ডেকে উঠতেই বাচ্চা মেয়েটা চঞ্চল হল। তারপর চটপট ঘেরার মধ্যে ঢুকে যেতেই মুরগিটা অত্যন্ত আপত্তি জানিয়ে সরে দাঁড়াল। খপ করে মাটি থেকে একটা ডিম তুলে ছুটে ফিরে এল মেয়েটা। এনে হাত খুলে জয়িতাকে দেখাল। জয়িতা হাতে তুলে ডিমটাকে দেখল। সুদীপ এই প্রথম চোখের সামনে মুরগির ডিমপাড়া দেখল। সে খুব সিরিয়াস গলায় বলল, ডিমটা মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে বল। তাহলে আমরা আর একটা মুরগি পাব।

কথাটা শুনে জয়িতা বাচ্চাটার কাঁধে হাত বুলিয়ে ডিমটা ফিরিয়ে দিয়ে ইশারায় জানাল সে ওটা নিয়ে যেতে পারে।

সুদীপ হাঁটছিল। ওই মুহূর্তেই সে জয়িতার সামনে থেকে সরে এসেছে। এখন যা বলবে জয়িতা ঠিক তার উলটোটা করবে। একা একা হাঁটতে তার নোক চেপে যাচ্ছিল। সে কোন অন্যায় করেনি। খামোখা এরা তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে। হাঁটতে হাঁটতে সুদীপ ঢালু পথ বেয়ে সেই ঝরনার কাছে পৌঁছে গেল। একটা পাথবের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাতে তার আবছা আবছা মনে পড়তে লাগল। সে এই ঝরনা দেখেছিল। মেয়েটা তাহলে এখানেই কোথাও লুকিয়েছিল। সে ভাল করে তাকাল। একটা মেয়ে কেন খামোখা এখানে লুকিয়ে থাকতে যাবে? হয়তো কোন কাজে সে এখানে এসেছিল। আজও যদি কোন কাজ, সেই কাজটাই পড়ে যায়। কোন ভিত্তি নেই কিন্তু সুদীপের মনে হল অপেক্ষা করলে মেয়েটার দেখা পাওয়া যাবে। সে পাথরটার আড়ালে চুপচাপ বসে পড়ল। ঠিক পায়ের সামনে দিয়ে স্রোত নামছে নিচে। পাথরে ধাক্কা খেয়ে জল ছিটকে উঠছে, ওপরে। সুদীপ হাত বাড়িয়ে জল স্পর্শ করল। যতটা ঠাণ্ডা বলে ভেবেছিল ততটা নয়। সে মুখে চোখে ঘাড়ে জল বোলাতে বেশ আরাম লাগল। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল একইভাবে। শুধু জলের শব্দ, কোন পাখির গলাও নেই! ঠাণ্ডায় বোধহয় পাখিরাও ডাকে না। আর এই নিস্তব্ধতায় সুদীপের চোখ বন্ধ হয়ে এল। কিন্তু সেই সময় যেন পাতা মাড়ানোর আথবা মানুষের কথা বলার আওয়াজ তার কানে প্রবেশ করল। খুব চাপা গলা কেউ কথা বলছে। যেন সতর্ক করে দিচ্ছে একে অন্যকে। সুদীপ চোখ খুলে চারপাশে তাকাল। কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কাছাকাছি মানুষ আছে। সুদীপ আরও কিছুক্ষণ স্থির বসে বইল। যাবা কথা বলছে তারা। নিশ্চয়ই সামনে আসবে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top