গ্রামের ঠিক শেষ সীমায় একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে ওদের নিয়ে এল পালদেম। পাহাড়ের গায়ে কাঠ গুঁজে এটিকে তৈরি করা হয়েছিল। অবশ্য বাড়ি বলতে যা বোঝায় তার ধারেকাছে নয় আস্তানাটা। কাঠের মেঝে ভেঙে গেছে। দেওয়ালটায় অনেকখানি ফাঁক। তবে ছাদটা সম্ভবত অটুট আছে। কোন আসবার নেই, কিন্তু একটা বোঁটকা গন্ধ সমস্ত ঘরে চেপে বসে আছে। সুদীপ দেখেশুনে বলল, এখানে থাকার চেয়ে তাঁবু টাঙিয়ে থাকা ঢের ভাল। কি গন্ধ, বাপরে বাপ!
আনন্দ বলল, বাইরে তাবুতে শুলে ঠাণ্ডা সহ্য হবে না। একবার জোরে বাতাস বইতে শুরু করলেই টের পাবি। বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। এখানেই কোনমতে কাজ চালাতে হবে। কিন্তু মুশকিল হল এখানে কোন বাথরুম বা ল্যাট্রিন নেই। স্নান করার প্রশ্নও ওঠে না এই ঠাণ্ডায়। কিন্তু ও দুটোর জন্যে।
ওরা যখন এইসব আলোচনা করছিল তখন ওদের মালপত্র পৌঁছে গেল। দুটো লোক অবলীলায় ওইসব ওজন বয়ে নিয়ে এল অথচ তাদের স্বাস্থ্য মোটেই ভাল নয়। কল্যাণ পালদেমকে বলল, এখানে জল পাওয়া যাবে কোথায়? আমরা বাঙালিরা খুব জল খাই।
পালদেম কল্যাণকে ঘরের বাইরে নিয়ে গেল। সেখান থেকেই দেখা যায় একটা ছোট জলের ধারা নেমে যাচ্ছে পাহাড়ের শরীর বেয়ে। সে জিজ্ঞাসা করল, এই ঘরে কে থাকত?
কেউ না। গ্রামের কারও অসুখ হলে এই ঘরে এসে থাকে। আবার বিয়ের পর যতদিন নতুন ঘর তৈরি না করতে পারে ততদিন এই ঘরে তাদের থাকতে দেওয়া হয়। তোমরা অতিথি বলে এই ঘরে থাকতে দেওয়া হল। ঠিক আছে, আমি এখন যাচ্ছি। তোমাদের নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে। আমার বাড়ি থেকে তোমাদের খাবার দিয়ে যাবে। আমরা খুব গরীব। ভাল খাবার দিতে পারব না। সত্যি বলতে কি, তোমাদের এক বেলা খাওয়াচ্ছি বলে আমাদের একজনের চার বেলার খাওয়া কমে যাবে। পালদেম যাওয়ার জন্যে পা বাড়াল। তখনও অন্তত জনা কুড়ি ছেলেমেয়ে খানিকটা দূরে বসে এই বাড়ির দিকে তাকিয়েছিল। পালদেম তাদের চিৎকার করে কিছু বললেও কোন প্রতিক্রিয়া হল না।
কল্যাণ পালদেমকে ডাকল, শোন, তোমাদের খাবার কমে যাবে না। আমরা তোমাকে টাকা দিচ্ছি।
টাকা? এখানে টাকা দিয়ে কি হবে? টাকা দিয়ে জিনিস পাওয়া যায় চ্যাঙথাপুতে। সেখানে যেতে গেলে অনেক ঝামেলা। তা ছাড়া অতিথিদের কাছ থেকে টাকা নিলে লোকে আমায় বলবেটা কি! ও হ্যাঁ, তোমাদের সঙ্গে কি তোম্বা কিংবা ছাং আছে? যদি দরকার হয় তাহলে সেটা পাঠিয়ে দিতে পারি।
পালদেম প্রস্তাবটা জানাতে সুদীপ বেরিয়ে এল, হ্যাঁ, ওগুলো দিলে তো খুব ভালই হয়।
পালদেম চলে গেলেও দর্শকরা নড়ল না। কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, জিনিস দুটো কি রে?
মদ। একদম দিশি মতে তৈরি। সুদীপ নিচে নামল। ওপাশে খুব দ্রুত কুয়াশা আসছে। হিমালয়ের কোন চুড়ো দেখা যাচ্ছে না। যেন ভালুকের মত সন্ধ্যা নেমে আসছে।
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কল্যাণ চিৎকার করল, এই মদ খাবি? হাই অলটিচুডে ড্রিঙ্ক করলে হার্ট অ্যাটাকড় হয়, জানিস না?
তাহলে এরা কেউ বেঁচে থাকত না। কথাটা বলে কাছে যেতে বাচ্চাগুলো উঠে দাঁড়াল। ওদের সঙ্গে যে দুজন বয়স্ক রয়েছে তাদের দিকে তাকাতে গলগণ্ড দেখতে পেল সুদীপ। বেশি বয়স্কজনের গলায় ফুটবলের মত ঝুলে আছে। দ্বিতীয়জনের বোধ হয় সবে শুরু হয়েছে। বাচ্চাগুলোর প্রত্যেকের পা খালি। এবং সেগুলো ফেটে এমনভাবে শক্ত হয়ে গেছে যে দেখলে শিউরে উঠতে হয়। তারপরেই সুদীপের চোখ পড়ল মেয়েটার ওপরে। মুখের একপাশ থেকে বিশ্রী ঘা প্রায় গলা পর্যন্ত নেমেছে। মাঝে মাঝে রস গড়াচ্ছে তা থেকে। অথচ মেয়েটির মুখের গড়ন খুব মিষ্টি। অন্য পাশটায় তাকালে মুগ্ধ হতে হয়। কিন্তু মুখ ফেরালেই বীভৎস ক্ষত মেয়েটিকে ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। অথচ মেয়েটি এমন সরল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে যে ওই ক্ষতের কষ্ট ওকে পীড়া দিচ্ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। সে আঙুল তুলে মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার মুখে ওটা কি হয়েছে?
ব্যবধান বড় জোর বারো ফুটের, প্রশ্নটা শোনামাত্র মেয়েটির চোখের কৌতূহল উড়ে গেল। এবং সেই সঙ্গে অন্য বাচ্চাদের হাসির শব্দ কানে এল। সুদীপ আবার জিজ্ঞাসা করল, কতদিন হয়েছে ওটা? এবার মেয়েটি এমনভাবে মুখ ফেরাল যাতে ক্ষত না দেখা যায়। একটি বাচ্চা নেপালিতে বলে উঠল তড়বড় করে। সুদীপ কথাগুলোর পুরোটা বুঝতে না পারলেও অনুমান করল বাচ্চাটা ক্ষত সম্পর্কেই বলছে এবং সেই বলার মধ্যে বেশ ঠাট্টা মেশানো রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে অন্য বাচ্চারাও হেসে উঠল শব্দ করে। মেয়েটি কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। তারপর চিৎকার করে বাচ্চাগুলোকে ধমক দেবার চেষ্টা করল। বাচ্চারা হঠাৎ তাকে ঘিরে নাচতে লাগল ছড়া কাটতে কাটতে। মেয়েটি যখন কেঁদে ফেলেছে তখন সুদীপ মর্মোদ্ধার করল। বাচ্চারা বলছে, পাহাড় থেকে ভালুক এসে ওর মুখে চুমু খেয়েছে।
সুদীপ এগিয়ে গিয়ে খপ করে মেয়েটার হাত ধরে বলল, তুমি আমার সঙ্গে এস।
আনন্দ বলল, বাইরে তাবুতে শুলে ঠাণ্ডা সহ্য হবে না। একবার জোরে বাতাস বইতে শুরু করলেই টের পাবি। বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। এখানেই কোনমতে কাজ চালাতে হবে। কিন্তু মুশকিল হল এখানে কোন বাথরুম বা ল্যাট্রিন নেই। স্নান করার প্রশ্নও ওঠে না এই ঠাণ্ডায়। কিন্তু ও দুটোর জন্যে।
ওরা যখন এইসব আলোচনা করছিল তখন ওদের মালপত্র পৌঁছে গেল। দুটো লোক অবলীলায় ওইসব ওজন বয়ে নিয়ে এল অথচ তাদের স্বাস্থ্য মোটেই ভাল নয়। কল্যাণ পালদেমকে বলল, এখানে জল পাওয়া যাবে কোথায়? আমরা বাঙালিরা খুব জল খাই।
পালদেম কল্যাণকে ঘরের বাইরে নিয়ে গেল। সেখান থেকেই দেখা যায় একটা ছোট জলের ধারা নেমে যাচ্ছে পাহাড়ের শরীর বেয়ে। সে জিজ্ঞাসা করল, এই ঘরে কে থাকত?
কেউ না। গ্রামের কারও অসুখ হলে এই ঘরে এসে থাকে। আবার বিয়ের পর যতদিন নতুন ঘর তৈরি না করতে পারে ততদিন এই ঘরে তাদের থাকতে দেওয়া হয়। তোমরা অতিথি বলে এই ঘরে থাকতে দেওয়া হল। ঠিক আছে, আমি এখন যাচ্ছি। তোমাদের নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে। আমার বাড়ি থেকে তোমাদের খাবার দিয়ে যাবে। আমরা খুব গরীব। ভাল খাবার দিতে পারব না। সত্যি বলতে কি, তোমাদের এক বেলা খাওয়াচ্ছি বলে আমাদের একজনের চার বেলার খাওয়া কমে যাবে। পালদেম যাওয়ার জন্যে পা বাড়াল। তখনও অন্তত জনা কুড়ি ছেলেমেয়ে খানিকটা দূরে বসে এই বাড়ির দিকে তাকিয়েছিল। পালদেম তাদের চিৎকার করে কিছু বললেও কোন প্রতিক্রিয়া হল না।
কল্যাণ পালদেমকে ডাকল, শোন, তোমাদের খাবার কমে যাবে না। আমরা তোমাকে টাকা দিচ্ছি।
টাকা? এখানে টাকা দিয়ে কি হবে? টাকা দিয়ে জিনিস পাওয়া যায় চ্যাঙথাপুতে। সেখানে যেতে গেলে অনেক ঝামেলা। তা ছাড়া অতিথিদের কাছ থেকে টাকা নিলে লোকে আমায় বলবেটা কি! ও হ্যাঁ, তোমাদের সঙ্গে কি তোম্বা কিংবা ছাং আছে? যদি দরকার হয় তাহলে সেটা পাঠিয়ে দিতে পারি।
পালদেম প্রস্তাবটা জানাতে সুদীপ বেরিয়ে এল, হ্যাঁ, ওগুলো দিলে তো খুব ভালই হয়।
পালদেম চলে গেলেও দর্শকরা নড়ল না। কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, জিনিস দুটো কি রে?
মদ। একদম দিশি মতে তৈরি। সুদীপ নিচে নামল। ওপাশে খুব দ্রুত কুয়াশা আসছে। হিমালয়ের কোন চুড়ো দেখা যাচ্ছে না। যেন ভালুকের মত সন্ধ্যা নেমে আসছে।
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কল্যাণ চিৎকার করল, এই মদ খাবি? হাই অলটিচুডে ড্রিঙ্ক করলে হার্ট অ্যাটাকড় হয়, জানিস না?
তাহলে এরা কেউ বেঁচে থাকত না। কথাটা বলে কাছে যেতে বাচ্চাগুলো উঠে দাঁড়াল। ওদের সঙ্গে যে দুজন বয়স্ক রয়েছে তাদের দিকে তাকাতে গলগণ্ড দেখতে পেল সুদীপ। বেশি বয়স্কজনের গলায় ফুটবলের মত ঝুলে আছে। দ্বিতীয়জনের বোধ হয় সবে শুরু হয়েছে। বাচ্চাগুলোর প্রত্যেকের পা খালি। এবং সেগুলো ফেটে এমনভাবে শক্ত হয়ে গেছে যে দেখলে শিউরে উঠতে হয়। তারপরেই সুদীপের চোখ পড়ল মেয়েটার ওপরে। মুখের একপাশ থেকে বিশ্রী ঘা প্রায় গলা পর্যন্ত নেমেছে। মাঝে মাঝে রস গড়াচ্ছে তা থেকে। অথচ মেয়েটির মুখের গড়ন খুব মিষ্টি। অন্য পাশটায় তাকালে মুগ্ধ হতে হয়। কিন্তু মুখ ফেরালেই বীভৎস ক্ষত মেয়েটিকে ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। অথচ মেয়েটি এমন সরল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে যে ওই ক্ষতের কষ্ট ওকে পীড়া দিচ্ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। সে আঙুল তুলে মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার মুখে ওটা কি হয়েছে?
ব্যবধান বড় জোর বারো ফুটের, প্রশ্নটা শোনামাত্র মেয়েটির চোখের কৌতূহল উড়ে গেল। এবং সেই সঙ্গে অন্য বাচ্চাদের হাসির শব্দ কানে এল। সুদীপ আবার জিজ্ঞাসা করল, কতদিন হয়েছে ওটা? এবার মেয়েটি এমনভাবে মুখ ফেরাল যাতে ক্ষত না দেখা যায়। একটি বাচ্চা নেপালিতে বলে উঠল তড়বড় করে। সুদীপ কথাগুলোর পুরোটা বুঝতে না পারলেও অনুমান করল বাচ্চাটা ক্ষত সম্পর্কেই বলছে এবং সেই বলার মধ্যে বেশ ঠাট্টা মেশানো রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে অন্য বাচ্চারাও হেসে উঠল শব্দ করে। মেয়েটি কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। তারপর চিৎকার করে বাচ্চাগুলোকে ধমক দেবার চেষ্টা করল। বাচ্চারা হঠাৎ তাকে ঘিরে নাচতে লাগল ছড়া কাটতে কাটতে। মেয়েটি যখন কেঁদে ফেলেছে তখন সুদীপ মর্মোদ্ধার করল। বাচ্চারা বলছে, পাহাড় থেকে ভালুক এসে ওর মুখে চুমু খেয়েছে।
সুদীপ এগিয়ে গিয়ে খপ করে মেয়েটার হাত ধরে বলল, তুমি আমার সঙ্গে এস।