What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected গর্ভধারিণী - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

গ্রামের ঠিক শেষ সীমায় একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে ওদের নিয়ে এল পালদেম। পাহাড়ের গায়ে কাঠ গুঁজে এটিকে তৈরি করা হয়েছিল। অবশ্য বাড়ি বলতে যা বোঝায় তার ধারেকাছে নয় আস্তানাটা। কাঠের মেঝে ভেঙে গেছে। দেওয়ালটায় অনেকখানি ফাঁক। তবে ছাদটা সম্ভবত অটুট আছে। কোন আসবার নেই, কিন্তু একটা বোঁটকা গন্ধ সমস্ত ঘরে চেপে বসে আছে। সুদীপ দেখেশুনে বলল, এখানে থাকার চেয়ে তাঁবু টাঙিয়ে থাকা ঢের ভাল। কি গন্ধ, বাপরে বাপ!

আনন্দ বলল, বাইরে তাবুতে শুলে ঠাণ্ডা সহ্য হবে না। একবার জোরে বাতাস বইতে শুরু করলেই টের পাবি। বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। এখানেই কোনমতে কাজ চালাতে হবে। কিন্তু মুশকিল হল এখানে কোন বাথরুম বা ল্যাট্রিন নেই। স্নান করার প্রশ্নও ওঠে না এই ঠাণ্ডায়। কিন্তু ও দুটোর জন্যে।

ওরা যখন এইসব আলোচনা করছিল তখন ওদের মালপত্র পৌঁছে গেল। দুটো লোক অবলীলায় ওইসব ওজন বয়ে নিয়ে এল অথচ তাদের স্বাস্থ্য মোটেই ভাল নয়। কল্যাণ পালদেমকে বলল, এখানে জল পাওয়া যাবে কোথায়? আমরা বাঙালিরা খুব জল খাই।

পালদেম কল্যাণকে ঘরের বাইরে নিয়ে গেল। সেখান থেকেই দেখা যায় একটা ছোট জলের ধারা নেমে যাচ্ছে পাহাড়ের শরীর বেয়ে। সে জিজ্ঞাসা করল, এই ঘরে কে থাকত?

কেউ না। গ্রামের কারও অসুখ হলে এই ঘরে এসে থাকে। আবার বিয়ের পর যতদিন নতুন ঘর তৈরি না করতে পারে ততদিন এই ঘরে তাদের থাকতে দেওয়া হয়। তোমরা অতিথি বলে এই ঘরে থাকতে দেওয়া হল। ঠিক আছে, আমি এখন যাচ্ছি। তোমাদের নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে। আমার বাড়ি থেকে তোমাদের খাবার দিয়ে যাবে। আমরা খুব গরীব। ভাল খাবার দিতে পারব না। সত্যি বলতে কি, তোমাদের এক বেলা খাওয়াচ্ছি বলে আমাদের একজনের চার বেলার খাওয়া কমে যাবে। পালদেম যাওয়ার জন্যে পা বাড়াল। তখনও অন্তত জনা কুড়ি ছেলেমেয়ে খানিকটা দূরে বসে এই বাড়ির দিকে তাকিয়েছিল। পালদেম তাদের চিৎকার করে কিছু বললেও কোন প্রতিক্রিয়া হল না।

কল্যাণ পালদেমকে ডাকল, শোন, তোমাদের খাবার কমে যাবে না। আমরা তোমাকে টাকা দিচ্ছি।

টাকা? এখানে টাকা দিয়ে কি হবে? টাকা দিয়ে জিনিস পাওয়া যায় চ্যাঙথাপুতে। সেখানে যেতে গেলে অনেক ঝামেলা। তা ছাড়া অতিথিদের কাছ থেকে টাকা নিলে লোকে আমায় বলবেটা কি! ও হ্যাঁ, তোমাদের সঙ্গে কি তোম্বা কিংবা ছাং আছে? যদি দরকার হয় তাহলে সেটা পাঠিয়ে দিতে পারি।

পালদেম প্রস্তাবটা জানাতে সুদীপ বেরিয়ে এল, হ্যাঁ, ওগুলো দিলে তো খুব ভালই হয়।

পালদেম চলে গেলেও দর্শকরা নড়ল না। কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, জিনিস দুটো কি রে?

মদ। একদম দিশি মতে তৈরি। সুদীপ নিচে নামল। ওপাশে খুব দ্রুত কুয়াশা আসছে। হিমালয়ের কোন চুড়ো দেখা যাচ্ছে না। যেন ভালুকের মত সন্ধ্যা নেমে আসছে।

সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কল্যাণ চিৎকার করল, এই মদ খাবি? হাই অলটিচুডে ড্রিঙ্ক করলে হার্ট অ্যাটাকড় হয়, জানিস না?

তাহলে এরা কেউ বেঁচে থাকত না। কথাটা বলে কাছে যেতে বাচ্চাগুলো উঠে দাঁড়াল। ওদের সঙ্গে যে দুজন বয়স্ক রয়েছে তাদের দিকে তাকাতে গলগণ্ড দেখতে পেল সুদীপ। বেশি বয়স্কজনের গলায় ফুটবলের মত ঝুলে আছে। দ্বিতীয়জনের বোধ হয় সবে শুরু হয়েছে। বাচ্চাগুলোর প্রত্যেকের পা খালি। এবং সেগুলো ফেটে এমনভাবে শক্ত হয়ে গেছে যে দেখলে শিউরে উঠতে হয়। তারপরেই সুদীপের চোখ পড়ল মেয়েটার ওপরে। মুখের একপাশ থেকে বিশ্রী ঘা প্রায় গলা পর্যন্ত নেমেছে। মাঝে মাঝে রস গড়াচ্ছে তা থেকে। অথচ মেয়েটির মুখের গড়ন খুব মিষ্টি। অন্য পাশটায় তাকালে মুগ্ধ হতে হয়। কিন্তু মুখ ফেরালেই বীভৎস ক্ষত মেয়েটিকে ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। অথচ মেয়েটি এমন সরল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে যে ওই ক্ষতের কষ্ট ওকে পীড়া দিচ্ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। সে আঙুল তুলে মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার মুখে ওটা কি হয়েছে?

ব্যবধান বড় জোর বারো ফুটের, প্রশ্নটা শোনামাত্র মেয়েটির চোখের কৌতূহল উড়ে গেল। এবং সেই সঙ্গে অন্য বাচ্চাদের হাসির শব্দ কানে এল। সুদীপ আবার জিজ্ঞাসা করল, কতদিন হয়েছে ওটা? এবার মেয়েটি এমনভাবে মুখ ফেরাল যাতে ক্ষত না দেখা যায়। একটি বাচ্চা নেপালিতে বলে উঠল তড়বড় করে। সুদীপ কথাগুলোর পুরোটা বুঝতে না পারলেও অনুমান করল বাচ্চাটা ক্ষত সম্পর্কেই বলছে এবং সেই বলার মধ্যে বেশ ঠাট্টা মেশানো রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে অন্য বাচ্চারাও হেসে উঠল শব্দ করে। মেয়েটি কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। তারপর চিৎকার করে বাচ্চাগুলোকে ধমক দেবার চেষ্টা করল। বাচ্চারা হঠাৎ তাকে ঘিরে নাচতে লাগল ছড়া কাটতে কাটতে। মেয়েটি যখন কেঁদে ফেলেছে তখন সুদীপ মর্মোদ্ধার করল। বাচ্চারা বলছে, পাহাড় থেকে ভালুক এসে ওর মুখে চুমু খেয়েছে।

সুদীপ এগিয়ে গিয়ে খপ করে মেয়েটার হাত ধরে বলল, তুমি আমার সঙ্গে এস।
 
সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি বেঁকেচুরে হাত ছাড়াবার চেষ্টা করল। সেটায় সক্ষম হতে না পেরে সে মাটিতে বসে পড়ে পরিত্রাহি চিৎকার শুরু করল। দৃশ্যটা দেখে অন্য বাচ্চারা ঠাট্টা বন্ধ রেখে খানিকটা দূরে সরে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। সুদীপের জেদ চেপে গিয়েছিল। নিজের পায়ের ব্যথা সামলে সে মেয়েটাকে টেনে তুলতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু মেয়েটা প্রায় শুয়ে পড়ার ভঙ্গি করতে তা সম্ভব হচ্ছিল না। এই চিৎকার চেঁচামেচিতে আনন্দরা বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। জয়িতা নেমে এল কাছে, ওকে ধরেছিস কেন? কি করেছে ও? ছেড়ে দে সুদীপ ওকে। ইস, ওর মুখে কি হয়েছে?

পুরুষের পোশাকে মেয়েলি গলা শুনে মেয়েটি এক মুহূর্ত স্থির হল। তখনও তার হাত সুদীপের মুঠোয় ধরা। সুদীপ বলল, এরকম বীভৎস ঘা কোথাও দেখেছিস? এখনই ওষুধ না পড়লে মেয়েটা মরে যাবে।

তা ঠিক, কিন্তু ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে তুই ওষুধ দিবি ধরে বেঁধে! জয়িতা খেপে গেল, আমরা এখানে একটা রাত কাটাতে এসেছি, ওদের জন্যে আমাদের না ভাবলেও চলবে।

ঠিক তখনই একটি মহিলার পিছু পিছু আরও কয়েকজনকে ছুটে আসতে দেখা গেল। সবাই চিৎকার করছে। ওদের ভঙ্গি দেখে সুদীপ হাত ছেড়ে দেওয়ামাত্র মেয়েটি ছিটকে সরে গিয়ে দৌড়তে লাগল। মহিলার কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল মেয়েটা। সঙ্গে সঙ্গে মারমুখী হয়ে মহিলা তার দলবল নিয়ে ছুটে এল। ওরা চিৎকার করে যে দ্রুত কথা বলছে তা যে গালাগালি এটা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। পারলে মহিলা যেন সুদীপকে মেরেই ফেলে। জয়িতা ওকে আটকাবার চেষ্টা করছিল। আনন্দ সুদীপকে বলল, চটপট ঘরে চলে যা। ব্যাপারটার অন্যরকম মানে হয়েছে ওদের কাছে।

আরও লোক ছুটে আসছে দেখে কল্যাণ বারান্দায় ডেকে আনল সুদীপকে। নবাগতদের মধ্যে পালদেমকেও দেখা গেল। সে উত্তেজিত মহিলার কাছে অভিযোগ শুনে আনন্দর সামনে এসে জিজ্ঞাসা করল, ওই লোকটা এতটুকু বাচ্চার হাত ধরে টানছিল কেন? ও তো এখনও বাচ্চা, মেয়েও হয়নি। তোমাদের সঙ্গেই তো একজন মেয়ে আছে তাহলে এই মতলব হল কেন?

আনন্দ পালদেমের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিজেকে সংবরণ করল। এখন সব চিৎকার থেমে গেছে। জমে ওঠা জনতা সাগ্রহে অপেক্ষা করছে একটা বিহিতের জন্যে। আনন্দ লক্ষ্য করল পালদেমের মুখের চেহারা পালটে গেছে। অপমানিত এবং নিষ্ঠুর দেখাচ্ছে তাকে এখন। উত্তেজিত পালদেম বলল, তোমাদের কাছে বন্দুক আছে বলে ভেবেছ যা ইচ্ছে করবে? ওই বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকাওনি? ঘাটা গলা ছাড়িয়ে গেলেই ও মারা যাবে। এর আগে ওই অসুখে তিনজন মরে গেছে। এসব দেখেও তোমাদের ইচ্ছে হল?

জয়িতা এগিয়ে এল পালদেমের সামনে, তোমরা ওকে ভুল বুঝেছ! মেয়েটা ওরকম বীভৎস ঘা-এ কষ্ট পাচ্ছে দেখেই আমাদের বন্ধু ওকে ডেকেছিল ওষুধ দেওয়ার জন্যে। ওইটুকুনি বাচ্চার অন্য কোন ক্ষতি করার মত মতলব ওর নেই। ওষুধ দিলে যদি মেয়েটার উপকার হয় তাহলে ও মারা যাবে না। এখানে আমাদের কথা আর কে বুঝতে পারে জানি না, কিন্তু ওই বাচ্চাটা ভয় পেয়ে না বুঝে চিৎকার করেছে। আমি তো একটা মেয়ে, আমার কথা তুমি বিশ্বাস করো।

ওষুধ? বাজে কথা! যারা প্রাণ-হত্যা করার জন্যে বন্দুক রাখে তাদের কাছে ওষুধ থাকবে কেন? এসব এখন তোমরা বানিয়ে বলছ। তোমরা, শহরের লোকরা অত্যন্ত ধান্দাবাজ।

এবার আনন্দ কথা বলল, তুমি আমাদের যা ইচ্ছে ভাবতে পার। কিন্তু আমাদের কাছে যে ওষুধ আছে তা দিলে ওই মেয়েটি ভাল হয়ে উঠতে পারে। আজেবাজে কথা না বলে তুমি ওর মাকে জিজ্ঞাসা কর যে আমাদের ওষুধ দিতে দেবে কিনা!
 
আনন্দর গলার স্বরে এমন একটা কর্তৃত্ব ছিল যে পালদেম কিছুক্ষণ ইতস্তত করল। তারপর সে মহিলার কাছে এগিয়ে গেল। মহিলা তখন মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়েছিল। পালদেম তাকে সব কথা বলে চুপ করে দাঁড়াল। মহিলা প্রথমে দ্রুত মাথা নাড়তে লাগল। আনন্দ সুদীপকে বলল ওষুধের বাটা বারান্দায় নিয়ে আসতে। পালদেম এবার আনন্দর কাছে এসে বলল, ওর মা রাজী হচ্ছে না। বলছে ওষুধ লাগালে ওর মেয়ে আজ রাত্রেই মরে যাবে।

আনন্দ বলল, কি অদ্ভুত কথাটা! তুমি তো বুঝতে পারছ ব্যাপারটা। ওকে বল, ওষুধ না লাগালে তো মেয়েটা আর বেশিদিন বাঁচবে না। আমরা ওর শত্রু নই ও কথা বল। প্রথমে যে ধারণা তৈরি হয়েছে সেটাই মনে থেকে যাবে।

পালদেম বলল, তাও আমি বলেছি। ও বলল আজ রাত্রে মরার চেয়ে যে কদিন বেঁচে থাকে সে কদিনই তো লাভ। তোমরা ওর হাত ধরে টেনে ভাল করেনি। এখন কেউ বিশ্বাস করছে না তোমাদের অন্য কোন মতলব ছিল না। মেয়েটিকে ওর বাবার মত ছাড়া ওষুধ দিতে মা পাঠাবে না।

ওর বাবা কোথায়? তাকে ডাকো। আনন্দর মনে হল এ ব্যাপারে একটি পুরুষকে বোঝানো ঢের সহজ। মেয়েটির ঘা-এ ওষুধ না দিতে পারলে ওদের ধারণা পালটাবে না। তার ফলে আর কোন সাহায্য এই গ্রামে পাওয়া অসম্ভব হবে।

পালদেম বলল, আপনাদের কি দরকার গায়ে পড়ে মানুষের উপকার করার! এখানে যাতে রাত কাটিয়ে চলে যেতে পারেন সেই ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

এই সময় মহিলা চিৎকার করে কিছু বলতে আরম্ভ করল। আনন্দ দেখল একটি কিশোর গম্ভীর মুখে এগিয়ে আসছে এবং মহিলা তার উদ্দেশ্যেই কথা বলছে। কিশোর কোমরে হাত দিয়ে ওদের কথা শুনল। তারপর চট করে ঘুরে আনন্দর দিকে তাকাল। তারপর তার গলায় আওয়াজ উঠল। বোঝা যাচ্ছিল সে পালদেমকে গালাগালি করছে। বোধহয় আক্রান্ত হতেই পালদেম আত্মরক্ষার জন্যে পালটা গলা তুলল। কিছুক্ষণ এইরকম চলার পর পালদেম বলল, ওরা কেউ তোমাদের কথা বিশ্বাস করছে না। কিভাবে ওই মেয়েটির মুখের ঘা সারাতে চাইছ তোমরা? ওর শরীরে হাত না দিয়ে যদি সেটা সম্ভব হয় তাহলে–।

আমরা ওর শরীরে হাত দেব না। আনন্দ চটপট ওকে থামিয়ে বলল, ওর ভাইকে বল কাছে নিয়ে আসতে।

পালদেম বলল, কাকে ভাই বলছ? ছেলেটি মেয়েটার বাবা। না জেনে কোন কথা বলতে যেও না। তারপর সে চিৎকার করে কিশোরের উদ্দেশ্যে কিছু বলল। আনন্দ এতটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল যে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না।

জয়িতা এগিয়ে এল পালদেমের কাছে, কি যা-তা বলছ! ওইটুকু ছেলে ওই মেয়ের বাবা? ওরা তো নির্ঘাৎ ভাইবোন!

পালদেম এবার হাসল, দেখাচ্ছে বটে তাই কিন্তু এটাই সত্যি। ওরা মা মেয়ে আর এই ছেলেটা হল মেয়েটির মায়ের স্বামী। আমাদের কাছে বাপ্যারটা অবাক হওয়ার নয়। যে দেশের যা নিয়ম।

জয়িতার মুখে কথা নেই। সে কোন বিশ্বসেই কাছাকাছি আসতে পারছে না। মহিলার বয়স যদি পঁয়ত্রিশও হয় ছেলেটা যে যোল পার হয়নি তাতে সে নিঃসন্দেহ। অবশ্য পাহাড়ি ছেলেদের বয়স চট করে ধরা মুশকিল কিন্তু এক্ষেত্রে ওকে যুবক ভাবাই যাচ্ছে না।

দেখা গেল পালদেমের কথা শুনে মেয়েটিকে নিয়ে তার মা খানিক এগিয়ে এসে বসেছে। আনন্দ জয়িতাকে নির্দেশ দিতে সে এগিয়ে গেল। জয়িতা কাছে গিয়ে বলল, তুমি ভয় পেও না। আমরা তোমার উপকার করতে চাই। কিন্তু খুব একটা প্রতিক্রিয়া হল না। শুধু মহিলার মুখে এবার একটু হাসি ফুটল। জয়িতা দেখল ক্ষত বেশ পুরোনো এবং তা চামড়ার নিচেও বিস্তৃত হয়েছে বলে তার বোধ হল। আনন্দর কথায় সুদীপ স্টোভ জ্বেলেছে। এই গ্রামে আসামাত্র যে কাণ্ডটা ঘটল তার আতঙ্ক এখনও তাকে ছেড়ে যায়নি। মনে হচ্ছিল লোকগুলো তাকে মেরেও ফেলতে পারে। অথচ সে মেয়েটার অবস্থা দেখে। পাশের ঘরটা থেকে আনা জল গরম করতে গিয়ে তার এবার আরাম লাগছিল। এই ঠাণ্ডায় স্টোভের আগুন খুব আরামদায়ক।
 
গরম জল হয়ে গেলে জয়িতা খানিকটা তুলল তাতে ভিজিয়ে মেয়েটির মাকে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল কি করতে হবে। এখন সমস্ত গ্রামের মানুষ হুমড়ি খেয়ে দেখছে কাণ্ডটা। পালদেম আরও বিশদ করে বলার পর মহিলা গরম জলে ভেজানো তুলোটা নিয়ে মেয়েটার ক্ষতের ওপর চেপে ধরতে সে পরিত্রাহি চিৎকার করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে নিল মহিলা। দেখা গেল মেয়েটির তুলোয় চাপা জায়গাটা সাদা হয়ে গেছে। টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে এল। মেয়েটি আর কিছুতেই রাজী হচ্ছে না তার মাকে কাজ করতে দিতে। জয়িতা গ্লাভস খুলল। তারপর মেয়েটির পাশে হাঁটু মুড়ে বসে বলল, আমাকে হাত দিতে দাও। যদি একটুও ব্যথা লাগে তাহলে তুমি চলে যেও। মেয়েটি তীব্র দৃষ্টিতে জয়িতাকে দেখছিল। জয়িতা ওর মাথার প্রায় জট পাকানো চুলে হাত বুলিয়ে দিল। পালদেম জয়িতার কথাটা অনুবাদ করে দিলে মেয়েটির চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক হল। এবার জয়িতা আবার গরম তুললা তুলে খুব আলতো করে ক্ষতের ওপর বোলাতে লাগল। মেয়েটি কাঠ হয়ে বসেছিল যন্ত্রণার আশঙ্কায়, কিন্তু গরম জলের সংস্পর্শে এবং জয়িতার তর্ক আঙুল তাকে একটু একটু করে আরাম দিচ্ছিল। সে চোখ বন্ধ করে ফেলল। জল ঠাণ্ডা হয়ে আসছে কিন্তু বারংবার তুলো সেখানে ডোবাতে তার রঙ পালটে গেছে। অন্তত সোয়া ইঞ্চি ময়লা পুরু হয়ে আটকে ছিল বিরাট ক্ষতের ওপর। গরম জলে ধোওয়া হয়ে গেলে ক্ষতের চেহারা পালটে গেল। কালো হলদেতে মেশা ক্ষতের বদলে এখন পুরোটা লাল দগদগে হয়ে গেল। জয়িতা আনন্দকে জিজ্ঞাসা করল, সাধারণ ঘা, না রে? পাস বেশি নেই। কি ওষুধ দেব?

আনন্দ একটা টিউব এগিয়ে দিল বাক্স থেকে। এই মলম ঘা শুকিয়ে দেওয়ার কাজ খুব দ্রুত করে। কিন্তু আনন্দ অবাক হচ্ছিল জয়িতাকে দেখে। ওরকম ক্ষতে কি অবলীলায় হাত দিচ্ছে জয়িতা! মেয়েটা যেন ঘেন্না শব্দটার সঙ্গে কখনই পরিচিত নয়। একটু একটু করে মলমটা মেয়েটার ক্ষতের সর্বাঙ্গে ভাল করে লাগিয়ে দিল জয়িতা। মেয়েটি এখনও চুপ করে বসে আছে চোখ বন্ধ করে। জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, এটা ব্যান্ডেজ করতে তো অসুবিধে হবে। অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে।

সুদীপ জয়িতার কাজ দেখছিল, ব্যাভেজের দরকার নেই। ওকে বুঝিয়ে দে যেন ধুলো না লাগায়।

আনন্দ মাথা নাড়ল, না, ভোলা রাখবি না। আলতো করে ব্যান্ডেজ কর। ব্যাপারটা ওদের চোখের আড়ালে রাখা দরকার। ওর চিকিৎসা হচ্ছে এমন মানসিক স্বস্তি দেওয়া দরকার।

জয়িতা জমাট তুলো ক্ষতের ওপর বিছিয়ে তার ওপরে ব্যান্ডেজ করতে লাগল। গলায় অসুবিধে হল না কিন্তু বিপাক হল মুখের কাছে এসে। শেষ পর্যন্ত মুখের অনেকটাই ঢাকা পড়ল। এবার দর্শকদের মধ্যে হাসি শুরু হল। মেয়েটিকে এখন চেনা যাচ্ছে না এইটেই আলোচ্য বিষয়। রমণী মেয়েটিকে প্রশ্ন করতে সে মাথা নেড়ে না বলল। আনন্দ এবার দুটো ক্যাপসুল দিল পালদেমের হাতে।

মেয়েটিকে অনেক জোরজবরদস্তি করে একটা তখনই খাইয়ে দেওয়া হল। দ্বিতীয়টি আগামী ভোরে ঘুম থেকে উঠে খাওয়াতে বলল কিছু খাবার খাওয়ার পর। তার ভয় হচ্ছিল যার পেটে কোনদিন ওষুধ পড়েনি তার কি প্রতিক্রিয়া হয় কে জানে। তাই ইচ্ছে সত্ত্বেও ডোজ কমিয়ে দিল সে। পালদেম মারফৎ মেয়েটিকে বারংবার সতর্ক করে দেওয়া হল কোন অবস্থাতেই ব্যান্ডেজে হাত না দেয়। যেন ওটা খুলে ফেললেই মেয়েটি মরে যাবে। ব্যাপারটা মিটে যাওয়ার পর মহিলাকে খুব অপ্রস্তুত দেখাচ্ছিল। মা হিসেবে বোধহয় সে বুঝতে পারছিল যা করা হল তাতে তার মেয়ের উপকারই হবে। ভিড় এখন মেয়েটিকে ঘিরে। সবাই ওর ব্যান্ডেজে আঙুল ছোঁয়াতে চাইছে আর সে তার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। হঠাৎ দেখা গেল কয়েকজন বৃদ্ধ এবং মাতব্বর ব্যক্তিকে নিয়ে কাহুন এগিয়ে আসছেন। ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাহুন মেয়েটির মাকে কিছু জিজ্ঞাসা করাতে সে গড়গড় করে বলতে লাগল। কাহনের মুখে সন্দেহ এবং অবিশ্বাসের অনেকগুলো ভাজ ফুটে উঠল। তিনি ঝুঁকে মেয়েটির সঙ্গে কথা বললেন। মেয়েটি বারংবার মাথা নাড়তে আরম্ভ করল। তারপর কাহুন পালদেমকে প্রশ্ন করল জড়ানো গলায়। পালদেম সেটা আনন্দকে শোনাল, কান জিজ্ঞাসা করছেন, কেন মেয়েটির মুখ ঢেকে রাখা হয়েছে? এটা কি কোন মন্ত্রের কারণে?

জয়িতা হেসে ফেলতে আনন্দ তাকে হাত তুলে থামাল। তারপর বলল, ওতে তাড়াতাড়ি অসুখ সারে।

পালদেম সেটা জানিয়ে দিতে কাহুন আবার প্রশ্ন করলেন। সেটা পালদেম জানাল, কাহুন জিজ্ঞাসা করছেন তোমাদের সঙ্গে আসা এই লোকটির হাতেও কি এইরকম ঘা হয়েছে?

কল্যাণ চুপচাপ শুনছিল। প্রশ্নটা শোনামাত্র তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল, যাঃ শালা!
 
আনন্দ কল্যাণের ব্যাপারটা বলল। কান শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর কিছু একটা ঘঘাষণা করে সদলে ফিরে গেলেন। পালদেম বলল, কান হুকুম দিয়েছেন যতক্ষণ না মেয়েটির মুখ থেকে ওটা না ভোলা হচ্ছে ততক্ষণ তোমাদের এই গ্রামে থাকতে হবে। মেয়েটার কিছু হলে তোমরা দায়ী হবে। তখন তোমাদের নিয়ে কি করা হবে তা পরে চিন্তা করবে গ্রামের মানুষ।

আনন্দর মুখে হাসি ফুটল। সে বলল, কাহুনের আদেশ শিরোধার্য। কিন্তু তুমি বলেছিলে এই গ্রামে কোন মোড়ল নেই। মোড়লকে তোমরা কি বল?

পালা। না নেই। কাহুন পালা নয়। কিন্তু কাহুন আমাদের ধর্ম বাঁচিয়ে রাখেন। তাই আমাদের জীবন সম্পর্কে তিনি যা বলেন তা আমরা শুনি। তোমরা এখান থেকে পালাবার চেষ্টা করো না। সেরকম হলে তোমাদের বিপদ হবে আর আমিও ছাড়া পাব না। তোমাদের সঙ্গে যে বন্দুক আছে তা আমি গ্রামের লোকদের বলে দিয়েছি। পালদেম চলে গেল। ততক্ষণে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। কোন মানুষ আর এখানে দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে নেই। এইসময় হাওয়া শুরু হল। সান্দাকফুতে যে বাতাস ওরা পেয়েছিল তার থেকে অনেক ধারালো, এত গরমজামা প্রায় ভেদ করে ফেলছে। ওরা চটপট ঘরে ফিরে এল। মোমবাতি জ্বেলে আনন্দ আর সুদীপ প্রথমে হাত লাগাল ফাঁকগুলো ঢাকতে। মোটামুটি ভদ্রস্থ করার পরও ঘর থেকে গন্ধটা দুর হল না। সুদীপ আবার স্টোভ জ্বেলেছে। চায়ের জল গরম করার সময় ওরা স্টোভটাকে ঘিরে বসল। কল্যাণ বলল, অতিরিক্ত স্মার্ট হলে কি হয় তার প্রমাণ আজ সুদীপ দিল। আর একটু হলে গণধোলাই-এ প্রাণ বেরিয়ে যেত।

সুদীপ কিছু বলতে গিয়েও বলল না। জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, কেরোসিন তেল কতটা আছে?

সুদীপ বলল, আর একবার ভরা যাবে। ওকে খুব গম্ভীর দেখাচ্ছিল।

আনন্দ বলল, সুদীপ কাজটা না করলে কাল সকালে ওরা আমাদের চলে যেতে বাধ্য করতো। এখন ভাগ্যগুণে কদিন সময় পাওয়া গেল। মেয়েটার ব্যান্ডেজ তাড়াতাড়ি খোলা যাবে না।

কল্যাণ আঁতকে উঠল, তুই এখানেই থেকে যাবি নাকি? আমাদের তো ওয়ালাং চাঙে যাওয়ার কথা।

আনন্দ উত্তর দিল, ওয়ালাং চাও যে ফুল ছড়ানো হবে তা তোকে কে বলল? যে কোন নতুন গ্রামে গেলে সেখানকার মানুষদের সঙ্গে ভাব জমাতে হয় থাকতে গেলে। এটা এখানে শুরু হয়েছে।

কল্যাণ বলল, শুরু হয়েছে? ওরা প্রথমে আমাদের মারতে এল, তারপর শাসিয়ে গেল। আর তুই বলছিস–?

ঠিকই বলছি। এই গ্রামটার নাম আমি ম্যাপে দেখিনি। আমাদের পক্ষে এখানে থাকাটাই সুবিধেজনক। এর আগে কোন বিদেশী এখানে রাত কাটায়নি। খুব কম মানুষের চ্যাঙথাপু পর্যন্ত নিয়মিত যাতায়াত আছে। আমাদের খবর ফালুটের পুলিশ ফাড়িতে পৌঁছাতে সময় লাগবে, আর পেীছালেও তারা তাদের এক্তিয়ারের বাইরে আসবে বলে মনে হয় না। আমরা বিদেশী রাষ্ট্রে রয়েছি এখন। সুদীপের বাড়ানো চায়ের কাপ আর বিস্কুট নিয়ে চুমুক দিল আনন্দ। দিয়ে বলল, আঃ, অমৃত।

কল্যাণ চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করল, চিনি লাগবে।

ওরা চুপচাপ কিছুক্ষণ কাটাল। চা বিস্কুট খাওয়ার পর খিদেটা যেন আরও চাগিয়ে উঠেছে। স্টোভ নিবিয়ে ফেলার পর ঠাণ্ডাটা আরও বেড়ে গেল। কাঠের দেওয়ালে বাতাসের শব্দ হচ্ছে। কান পাতলে মনে হয় যেন বুনো মোষ তেড়ে আসছে। কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল আচমকা, আমরা কবে ফিরে যাচ্ছি?

আনন্দ অবাক হয়ে বলল, কোথায়!

কল্যাণ বলল, কলকাতায়। আমরা চিরকাল এখানে থাকতে আসিনি।

আনন্দ অন্যমনস্ক গলায় বলল, যাব, তবে এখনই নয়।

কল্যাণ বলল, এখানে থাকলে আমাদের পুলিশের ভয় থাকবে না, জেলে যেতে হবে না। কিন্তু এই ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডায় থাকলে তো মরেই যেতে হবে। পুলিশ যদি সমস্যা হয় তাহলে আমরা চুপচাপ কলকাতায় ওসব না করে থেকে যেতে পারতাম।
 
আনন্দ বলল, মাথা ঠাণ্ডা রাখ কল্যাণ। তুই জয়িতার কাছে আফসোস করেছিলি আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিস বলে। আমরা সবাই জানতাম যা করেছি তা করে দেশের অবস্থা পালটানো যায় না। কিন্তু আমরা নাড়া দিতে চেয়েছিলাম। সাধারণ মানুষ যদি আমাদের কাজকর্মে থ্রিলারের আনন্দ পায় সেটা আমাদেরই অক্ষমতা। কিন্তু এসব আমরা জেনেশুনেই করেছিলাম। তোকে কেউ জোর করেনি আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে। দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে না। কলকাতাকে একটু শান্ত হতে দে। ধরা পড়লে আমাদের তো কিছুই করার থাকবে না। ধর যদি কলকাতায় ধরা পড়তাম তাহলে আজ বিকেলে এই মেয়েটির চিকিৎসা হত না। এভাবে সমস্যা বাড়িয়ে দিস না।

কল্যাণ এসব কথা শোনার পরও খুব সন্তুষ্ট মনে হচ্ছিল না। সে ঠাট্টার গলায় বলল, অসুখে সেবা করাই যদি লক্ষ্য হয় তাহলে ওসব করার কি দরকার ছিল, মাদার টেরেসার সঙ্গে কাজ করলেই তো হত।

হঠাৎ জয়িতা প্রশ্ন করল, তুই তো খুব বড় বড় কথা বলছিস। আজই যদি আমরা কলকাতায় ফিরে গিয়ে কোন অ্যাকশান করি এবং সেটা করতে গিয়ে আমাদের একজন মারা যায় এবং সেই সম্মানে তোকে সম্মানিত করি তাহলে তুই রাজী আছিস?

কল্যাণ বলল, আমাকে কেন?

জয়িতা বলল, দেন স্টপ ইট। খামোকা মেজাজ নষ্ট করে দিচ্ছিস। সুদীপ ভাত রাঁধবি? হেভি খিদে পেয়ে গেছে।

বিকেলের ঘটনাটার পর সুদীপ খুব চুপচাপ হয়ে গেছে। এখন বলল, নো প্রব্লেম।

আনন্দ মনে করিয়ে দিল, পালদেম খাবার দিয়ে যাবে বলেছে।

জয়িতা বলল, তাহলে ওয়েট কর। আচ্ছা, এরা কি খায়? সোর্স অফ ইনকাম কি?

আনন্দ বলল, চাষ হয় দেখলাম। পাহাড়ে আর কত ফসলই বা হবে? গ্রামের বাইরে যায় না। বোঝাই যাচ্ছে অবস্থা খুব খারাপ। এখানকার জঙ্গলে ফলটলও হয় বলে মনে হয় না। মুরগী আর ছাগল দেখেছি। আমি জানি না এরা কিভাবে বেঁচে আছে।

ওই সময় পালদেম এল। একটা পাত্রেই খাবার এনেছে সে। বোঝা যাচ্ছে ঠায় তারও কাঁপুনি আসছিল। জয়িতা খাবার নিয়ে তাকাল। মারাত্মক দেখতে কয়েকটা রুটি আর তরকারি। তরকারিটা কিসের তা বুঝতে পারল না সে। কোন কথা না বলে পালদেম চলে গেলে ওরা খাবার নিয়ে বসল। আলু বলে যা মনে হয়েছিল তা যে আলু নয় মুখে দিয়েই মালুম হল। এত কুৎসিত স্বাদ ওরা কখনও পায়নি। রুটি ছিড়তেই কষ্ট হচ্ছিল এবং তাতে মোটামোটা দানা রয়েছে। জয়িতা লক্ষ্য করল মন্তব্য করতে করতে সবাই খাবারটা শেষ করল। করে কল্যাণ বলল, এই খেলে আর বাঁচব না।

আনন্দ বলল, কাল থেকে নিজেরাই চেষ্টা করব।

হাওয়ার তেজ আরও বাড়ছিল। এখন ঝড়ের মত শোনাচ্ছে। শীত থেকে বাঁচার জন্যে ওরা ব্যাগের ভেতরে ঢুকে গেল। জয়িতা এবার ট্রানজিস্টারটা বের করল। মোমবাতি নিবিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্ধকারে সে স্টেশন ধরার চেষ্টা করছিল। তিব্বত না চীন বোঝা যাচ্ছে না। হংকং কিনা তাই বা কে জানে। কোন ভারতীয় স্টেশন সে ধরতে পারছিল না। শুধু একটার পর একটা দুর্বোধ্য ভাষার গান বেজে যাচ্ছিল। এবং হঠাৎই সে বাংলা শব্দ শুনতে পেল। বাংলা শব্দ কিন্তু বলার ধরন অন্যরকম। কলকাতা কিংবা ঢাকা নয়। তারপরেই কানে এল বি বি সি-র সংবাদপাঠকের পরিচয়। আন্তর্জাতিক খবর দেওয়ার সময় স্টেশনটা হঠাৎ উবে গেল। নিজেদের কথা শোনার সুযোগ নেই বলে সে রেডিওটা অফ করল। এই সময় কল্যাণ বলল, আনন্দ, কাল আমার হাতের গয়নাটা খুলে দিবি?

আনন্দ বলল, দেব।

আর তখনই ঝড়ের শব্দের সঙ্গে আর একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার মিশে গেল। যেন দূরে এভারেস্টের গায়ে কেউ কাঁদছে থেমে থেমে। সেটা কান্না না আর্তনাদ তা টের পাওয়ার উপায় নেই অবশ্য, কিন্তু সেই অপ্রাকৃত শব্দ ওদের নিঃসাড় করে দিল।
 
৩৩.
প্রথম চোখ মেলল জয়িতা। কয়েকমুহূর্ত একটু অগোছালো, কোন কিছুই যেন ঠিক মাথায় আসছে না, তারপর খেয়াল হল। বাতাসের শব্দ নেই কিন্তু মনে হচ্ছে তার নাক অসাড় হয়ে গেছে। ওটা আছে এমন অনুভূতিও নেই। একদম চাপা দিয়ে শোওয়ার অভ্যেস নেই, দম বন্ধ হয়ে আসে বেশিক্ষণ থাকলে। কল্যাণটা কি আরামে ঘুমাচ্ছে। বাকি দুজনেরও জেগে থাকার কোন লক্ষণ নেই। অথচ এখন, জয়িতা ঘড়ি দেখল, সকাল আটটা বাজে। এ ঘরে এখনও আবছায়া। কাল সারারাত মড়ার মত ঘুমিয়েও ক্লান্তি জড়িয়ে আছে। জয়িতার ঘুম ভাঙার কারণটা তাকে ঘেরা-উত্তাপের বাইরে আনল। ঘরের ভেতরই প্রচণ্ড কাঁপুনি লাগছে, বাইরে গেলে কি হবে। অথচ বাইরে যেতে হবেই। ছেলেদের যে সুবিধেগুলো তারা ঈশ্বরের হাত দিয়ে করিয়ে নিয়েছে সেখানেই তাদের হার।

আপাদমস্তক ঢেকে বাইরে আসতেই সিঁটিয়ে দাঁড়াল সে। এখন হাওয়া নেই। রোদও নেই। মাটিতে ভিজে শিশির যেন জমে আছে। ওপাশের হিমালয় সাদা বরফের চুড়ো নিয়ে যেন সন্ন্যাসীর মত চুপচাপ। সাদা দাড়ির মত কিছু খুচরো মেঘ চুড়ার গায়ে গায়ে ঝুলছে। চট করে যেন সব শীত উধাও। জয়িতার আফসোস হচ্ছিল। কতবার শোনা সেই গল্পটা মনে পড়তেই রাগ হল নিজের ওপর। সাড়ে তিনটে নাগাদ ঘুম ভাঙল না কেন? সূর্য ওঠার এক ঘণ্টা আগে থেকে আকাশের সাজগোজ দেখতে দেখতে ব্রাহ্মমুহর্তে ঈশ্বর দর্শনের আরাম তাকে কালকে পেতেই হবে।

সে মুখ ফেরাল। কোথায় মুরগী ডাকছে কিন্তু এছাড়া কোন প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যাচ্ছে না। তাপল্যাঙের মানুষরা এখনও ঘরের বাইরে বের হয়নি। ঘোট ঘোট ঘরগুলো কাঠ এবং গাছের ডালপালা দিয়ে তৈরি। শীতকালে নিশ্চয়ই প্রচুর বরফ পড়ে, বর্ষায় বৃষ্টি হয়, পাহাড় বলে ঝড়ও ওঠে কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই ঘরগুলো কি করে টিকে থাকে? যদিও গ্রামটা একটা পাহাড়ের আড়াল নিয়ে তৈরি তবু ঘরগুলোর দিকে তাকালে তো আস্থা রাখা যায় না। জয়িতা প্রায় দৌড়ে ঘরের পেছনে চলে এল। ওপাশে সেই ঝরনা থেকে জল পড়ছে। কোনরকমে একটা আড়াল তৈরি করে নিয়ে সে ভারমুক্ত হয়। এবং তারপরেই সে অস্বস্তিটা টের পেল। মাসের একটি বিশেষ সময়ে এই অস্বস্তিটা শুরু হয়। দিন-দুয়েক থাকে যন্ত্রণাটা। তিনদিন ক্রমাগত রক্তপাতের পর যন্ত্রণাটা কমে আসে। জয়িতা কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আচমকা সে তিন বন্ধুর কাছ থেকে কয়েক লক্ষ মাইল দূরে সরে এল। এসব কথা কেবল মেয়েদেরই। তার প্রথম অভিজ্ঞতার পর সীতা রায় এমনভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যেন এটা অত্যন্ত গোপন ব্যাপার। ছেলেদের দৃষ্টি এবং কর্ণের সীমানায় আনা উচিত নয়। যদিও সীতা রায় মুখে বলেননি তবু ভঙ্গিতে মনে হয়েছে এটা মেয়েদের ওপর অর্পিত অপরাধ। রামানন্দ রায়কেও বলার প্রয়োজন নেই, শোভনও নয়। যতই সে সমস্ত সংস্কার ঝেড়ে ফেলতে পারুক ওই বয়সে ঢোকানো মায়ের মানসিকতা বোধ হয় এ জন্মে ত্যাগ করা সম্ভব হবে না। অথচ এখানে কোন আড়াল নেই। একই ঘরে তিনজন পুরুষের সঙ্গে তাকে চব্বিশ ঘণ্টা থাকতে হবে। মুখ ফুটে না বললে, নিজেরই বিপদ। এবং সেটা বলা মানে স্বীকার করে নেওয়া আমি তোমাদের থেকে আলাদা, যথার্থই মেয়ে। পৃথিবীর নিয়মটাই প্রকৃতি অনুকরণ করেছে এক্ষেত্রে। যাদের সুবিধে ভোগ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে তাদের জন্যে কোন কৃপণতা নেই কিন্তু যাদের মধ্যে বাধা তাদের আপাদমস্তক বেড়ি পরিয়ে দিতে কুণ্ঠিত হয়নি।

অন্তত দুদিন নিশ্চিন্ত, অবশ্য ঠাণ্ডার জন্যে যদি নিয়মের ব্যতিক্রম না ঘটে। ঘরের দিকে ফিরে আসতে আসতে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল সে। ছেলেদের যেটাকে সুবিধে বলে ভাবা হয়ে থাকে, সেটা তারা সহজ করে নিয়েছে বলেই তো। কাল রাত্রে ঠাণ্ডায় ওরা বাইরে আসেনি। দরজা থেকেই অন্ধকারে শরীরের ভার কমিয়েছে। কিন্তু সেটা ছিল প্রত্যক্ষ চোখের আড়ালে, কিন্তু ঘটনাটা বোধের মধ্যে ঘটলেও ওইটুকু আব্রুর কারণেই ওরা সহজ ছিল। এই সুবিধে যদি ওরা আদায় করে নিতে পারে তাহলে শুধু মেয়ে বলেই সে সঙ্কোচ করে নিজেকে কষ্ট দেবে? ওরা যা করছে তার কোন্টা সে কম করছে? পরিশ্রম বুদ্ধি এবং শিক্ষায় সে তো পিছিয়ে নেই! নারী-স্বাধীনতার ব্যাপারটা তার কাছে হাস্যকর। তথাকথিত আরোপিত নারীমুক্তিই মেয়েদের কাম্য হওয়া উচিত। বিশেষ এই কষ্টের দিনগুলোর জন্যে সে দায়ী নয়। উপায় নেই বলে তাকে সহ্য করতে হবে। কিন্তু এটা তার লজ্জা হবে কেন? সে পরিষ্কার বলতে পারে আমি অসুস্থ, তোমরা আমাকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দাও। জয়িতার মনে হল আমাদের অধিক সমস্যা বলতে না পারার জন্যে বেড়ে তীব্র এবং ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। কিন্তু একবার বলতে পারলে সেটার আর কোন ওজন থাকে না। মায়ের শেখানো বুলি এবার ঝেড়ে ফেলতেই হবে।

তোর কি হয়েছে? প্রশ্নটা শুনে জয়িতা চোখ তুলে তাকাল। সুদীপের মুখ ভাল করে দেখা যাচ্ছে পোশাকের প্রাবল্যে কিন্তু চেহারার আদলে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না।

জয়িতা পালটা প্রশ্ন করল, কিছু হয়েছে বলে মনে হচ্ছে কেন? আমার চেয়ে আমার ব্যাপারটা দেখছি তুই বেশি বুঝতে পারছিস।

সুদীপ বলল, যাঃ বাবা! তাহলে তো নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। মুখ গোমড়া করে মাথা নামিয়ে এক জায়গায় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছিস দেখে মনে হল তোর শরীর খারাপ, তাই প্রশ্ন করলাম। কিন্তু তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে কিছু চেপে যাচ্ছিস। তোর ওপর কল্যাণটার ইনফ্লুয়েন্স পড়ছে এবার। কমপ্লেক্স। ঝেড়ে ফেল জয়।

আমার কোন কমপ্লেক্স নেই। কল্যাণকে তুই পছন্দ করিস না এই কথাটা বার বার বোঝস কেন? জয়িতা উঠে এল।

ওই নাকিকান্না আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারি না। জেনেশুনে ঝাঁপ দিয়ে প্রতি পায়ে নাকিকান্না কাঁদছে। আমাদের উচিত ছিল ওকে কলকাতায় রেখে আসা। তুই লক্ষ্য করিস ও মনে মনে আমাকে ঈর্ষা করে। সুদীপ বলতে বলতে নেমে গেল নিচে। তারপর জয়িতা এবং বাড়িটার দিকে তাকিয়ে অবলীলায় ভারমুক্ত হল। সেদিকে তাকিয়ে জয়িতার জেদটা আরও বাড়ল। সম্ভ্রম, সঙ্কোচ, ভদ্রতা, আড়াল, মেয়েলি জগৎ, শালীনতা শব্দগুলো ছেলেরাই তৈরি করে নিজেদের সুবিধে মতন কোন এককালে মেয়েদের মধ্যে ঢুকিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছে। আর মেয়েরা তার বোঝা টেনে চলেছে। আসলে মেয়েদের শত্রু হল মেয়েরাই। নিজেদের কাচের বাসন করে রেখেই তাদের তৃপ্তি। অন্তত আমাদের দেশের মেয়েদের বটেই। ফাপা বেলুনের মত সম্ভ্রম শব্দটাকে আঁকড়ে ধরে বড় হচ্ছে মরে যাচ্ছে। অথচ প্রতি পায়ে জীবনের অন্য ক্ষেত্রে যে অসম্মান তার কথা ধর্তব্যে আনছে না। একটি নারী তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে স্বামীত্বের লাইসেন্স পাওয়া পুরুষটির দ্বারা ধর্ষিতা হলে সম্ভ্রমহানি হয়েছে বলে এদেশে মনে করে না, কিন্তু শরীরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা সহ্য করেও যাবে অথচ কোন অবস্থায় পথ চলতে গিয়ে কারও বাড়িতে নক করে বলবে না, আপনার টয়লেট ব্যবহার করতে চাই। ওটাতে সম থাকবে না বলে শৈশবে তাকে বোঝানো হয়েছে এবং সেই বোঝ সে টেনে বেড়াচ্ছে। মেয়েদের এসব সংস্কার যতটা না তাদের নিজেদের জন্যে তার চেয়ে বহুগুণ ছেলেদের খুশী করতে।

সূর্য উঠে গেছে, না? সুদীপ কাছে এসে দাঁড়াল।

তোর জন্যে বসে থাকবে? জয়িতা সহজ হতে চাইল।

খোঁচাটা গায়ে মাখল না সুদীপ। চারপাশে নজর বুলিয়ে বলল, জায়গাটা দারুণ, না রে?

কাল আর একটু হলে তোর এই দারুণ বেরিয়ে যেত!

ছাড়! আমি বাচ্চা মেয়েটার উপকার করতে গেলাম আর তার বদলে–! মানুষ কত সহজে ভুল বোঝে। কিন্তু ভাবছি অন্য কথা। এই লোকগুলো এখানে বেঁচে আছে কি করে?
 
সুদীপের প্রশ্ন শুনে জয়িতা আবার বাড়িগুলোর দিকে তাকাল। এখানে ফসল ফলানোটাই কঠিন ব্যাপার। যা ফলে তাতে সারা বছর চলে না। মুরগী, পাহাড়ী ছাগল আর ভেড়া আছে। তাই খেয়ে ফেললে তো হয়ে গেল। জঙ্গলে ফল হয় বলেও মনে হয় না। কোনরকম ব্যবসাবাণিজ্য কেউ করে না, শহর তো দূরের কথা। চ্যাঙগাপুতেও যাওয়া আসা নেই। তাহলে?—সুদীপ বলল, এই লোকগুলো বেশিদিন বাঁচবে না। কাল যে মেয়েটাকে আমরা ওষুধ দিলাম তার মায়ের স্বামীকে দেখেছিস? ভাবা যায়? মহিলাটি বিধবা হবার পর স্বেচ্ছায় একটি কিশোরকে বিয়ে করেছিল একথা অনুমান করা যায়। ব্যাপারটা ভাল করে জানতে হবে। সুদীপ হাসল।

জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, জেনে তোর কি লাভ?

মাথা নেড়ে কৌতুকের গলায় সুদীপ বলল, এই গ্রামে মনে হচ্ছে পুরুষদের ডিম্যান্ড আছে।

জয়িতা ঠোঁট কামড়াল, মেয়েটার ঘা না শুকোলে ওরা আমাদের শেষ করে দেবে।

এই সময় আনন্দর গলা ভেসে এল, সুদীপ, জয়িতা তাড়াতাড়ি ভিতরে আয়।

ওরা ভেতরে ঢুকে দেখল আনন্দ বিভ্রান্তের মত চারপাশে তাকিয়ে দেখছে। সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার? কি হয়েছে?

আনন্দ ওদের দিকে তাকাল, ব্যাগটা নেই। অথচ কাল বিকেলে ওইখানে রেখেছিলাম।

কোন্ ব্যাগটার কথা আনন্দ বলছে বুঝতে অসুবিধে হল না। সুদীপ জিনিসগুলো উলটে-পালটে দেখল। তারপর বলল, আশ্চর্য! কে নেবে এখান থেকে!

কল্যাণ তখনও ঘুমোচ্ছ। সুদীপ চট করে যেখানে শুয়েছিল তার কাছে পৌঁছে হাতড়াল, আরে আমার রিভলভারটাও নেই। অদ্ভুত কাণ্ড।

আনন্দ বলল, আমারটাও পাচ্ছি না। যে গ্রেনেড এবং গুলির বাক্স নিয়ে গিয়েছে সে আমাদেরগুলো বাদ দেয়নি। একটা লোকের মুখই মনে পড়ছে। পালদেম।

ও কেন নেবে? এসব ব্যবহার করতে ও জানে না। তাছাড়া আমার জামাকাপড় এবং টাকার ব্যাগটায় হাত দেয়নি। শুধু বেছে বেছে আর্মস নিয়ে গেল? সুদীপ হতভম্ব।

ও প্রথম থেকেই ভয় পেয়েছিল আমাদের হাতে ওসব দেখে। ওগুলো থাকলে আমাদের কবজা করা যাবে না ও জেনেছিল। এখন কি করা যায়! আনন্দকে খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছিল।

সুদীপ বলল, কিছু করার নেই। যে নিয়েছে সে চাইলে ফেরত দেবে না। মুশকিল হল, পুলিশ এলে আমাদের আর লড়াই করার উপায় থাকল না। কি ঘুম ঘুমিয়েছি, একটুও টের পেলাম না। ওটাকে ডাক তো। এখনও নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে সহ্য করতে পারছি না।

এই সময় চোখ মেলল কল্যাণ, কটা বাজে রে? খুব খিদে পেয়েছে।

আনন্দ বলল, ওঠ। কাল রাত্রে এই ঘরে চোর এসেছিল। আমাদের রিভলভার, গুলি, গ্রেনেড় নিয়ে গেছে। তোর ব্যাগে যে রিভলভারটা রাখতে দিয়েছিলাম সেটা আছে কিনা দ্যাখ।

কল্যাণ তড়াক করে উঠে বসে ব্যাগ হাতড়াল। নিজের বিছানা দেখল। তারপর অদ্ভুত গলায় বলল, নেই।

সুদীপ বলল, এবার পেট ভরে খাও সবাই ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে। নিজের গালে নিজে চড় মারতে ইচ্ছে করছে।

কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। তারপর আনন্দ বলল, এ নিয়ে ভেবে আর কি হবে? আমরা এমন ভাব দেখার যেন কিছুই হয়নি। কেউ চুরি করেছে বলে জানি না। এই ঘটনায় আমরা বিন্দুমাত্র নার্ভাস হইনি। তাহলেই চোর অবাক হবে। ভাববে কিছু আমাদের কাছে এখনও রয়ে গেছে। ওরা অস্ত্রের ব্যবহার জানে না। শুধু ভয় হচ্ছে গ্রেনেডগুলো না ফাটিয়ে বসে।


ওরা যখন কথা বলছিল তখন জয়িতা ধীরে ধীরে হাত নিজের কোমরের ওপর নিয়ে এল। সে আঙুলের চাপ দিতেই শক্ত হল। কোমরের কাছে রিভলভারটা রয়ে গেছে। আনন্দ তাকে দেওয়ার পরই সে কোমরে রেখেছিল। চোর বোধহয় মেয়ে বলে তার কোমরে হাত দিতে সাহস পায়নি। সে রিভলভারটার আদল আঙুলে অনুভব করে হাত সরিয়ে নিল। থাক, তার কাছে যে একটা অস্ত্র বেঁচে আছে সেটা এখন বলার দরকার নেই। এবং হঠাই তার মনে হল এই মুহূর্তে সে তার তিন পুরুষবন্ধুর চেয়ে অনেকটা বেশি সুবিধেজনক অবস্থায় আছে।
 
চা খেয়ে ওরা চারজনে বাইরে বেরিয়ে এল। একটু আগে আকাশ যেটুকু পরিষ্কার ছিল এখন আর তা নেই। দলে দলে কুয়াশা উঠে আসছে নিচের খাদ থেকে। ওরা চারজন নিচে নেমে আসছিল। দুটো পাহাড়ের কোলে এই গ্রাম। বস্তুত হাওয়া যেদিক দিয়ে তেজী হয়ে আসে সেদিকটাই পাহাড় আটকে রেখেছে। আনন্দ বলল, চল, গ্রামটাকে ভাল করে দেখে আসি। ওরা চুরি করুক আর যাই করুক গত রাত্রে এখানেই আশ্রয় পেয়েছি আমরা, খাবারও দিয়েছে। এখান থেকে চলে যেতে হলে চট করে কোথায় আশ্রয় পাওয়া যাবে জানি না।

কল্যাণ বলল, কেন, ওয়ালাঙচুঙে আমাদের যাওয়ার কথা ছিল?

আনন্দ জানাল, উপায় না থাকলে সেখানেই শেষ পর্যন্ত যেতে হবে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এই জায়গাই আমাদের পক্ষে বেশি নিরাপদের।

এখন গ্রাম জেগেছে। বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা ঘর এবং ক্ষেতের সংলগ্ন কাজে নেমে পড়েছিল। তারা এখন ওদের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। একটি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দুটি মেয়ে হঠাৎ সুদীপের দিকে তাকিয়ে হাসিতে ভেঙে পড়ল। এই ঠাণ্ডাতেও ওদের পা খালি, মাথা এবং মুখে কোন আবরণ নেই। গায়ের রঙ টকটকে লাল হবার উপক্রম। এই মেয়েদুটোর গলগণ্ড নেই। সুদীপ দাঁড়িয়ে পড়ল। মেয়ে দুটো হেসে যাচ্ছে সমানে আর সেইসঙ্গে সম্ভবত মন্তব্য ছুঁড়ছে। হঠাৎ ওপাশ থেকে একটি পুরুষ কণ্ঠ ধমকে ওঠায় ওরা চুপ করল। কিন্তু সুদীপের মনে হল নিঃশব্দে ওরা হাসছে। চারজনের মধ্যে ওকে বেছে নেওয়ার কারণটা সে অনুমান করতে পারল। সে ওই বালিকার হাত ধরে টেনেছিল এই গল্পটাই বোধ হয় ওকে হাস্যকর করেছে এদের কাছে। কিন্তু শুধুই কি হাস্যকর? ভাষা অবোধ্য হলেও মেয়েদের ভঙ্গিতে যে নিজস্ব ভাষা থাকে তা পৃথিবীর সব দেশেই এক। সেটা যে অন্য কথা বলছে।

কল্যাণ ডাকল, কি হচ্ছে কি? আর একটা ঝামেলা বাধাবে দেখছি।

সুদীপ হাসল। তারপর বন্ধুদের সঙ্গী হয়ে বলল, মাথা খারাপ, আমি ঝামেলার ধারে কাছে নেই।

ক্রমশ ওদের পেছনে একটি দুটি করে বাচ্চা জমে গেল। কাটা তরমুজের মত গাল, নোংরা পোশাক এবং সমস্ত শরীরে অভাব খোদাই হয়ে আছে ওদের অথচ ঠোঁটে হাসি নিয়ে পেছন পেছন ঘুরতে উৎসাহের অভাব নেই। আনন্দ বলল, এককালে সাহেবরা কলকাতার গলিতে হাঁটলে এই দৃশ্য দেখা যেত। মানুষগুলো কিভাবে বেঁচে আছে দেখেছিস?

মিনি ভারতবর্ষ। আর অবাক হওয়ার কিছু নেই। খোঁজ নিলে দেখবি এখানেও একজন জোতদার বা ধর্মযাজক আছেন যিনি শোষণ চালিয়ে যাচ্ছেন। ওই কাহন না কি বলে সে-ই হয়তো তাই।

সুদীপ বলতে বলতে থেমে গেল। কয়েকজন যুবক ওপরে পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে ওদের ওপর নজর রাখছে। হয়তো এতক্ষণ লক্ষ করেনি কিন্তু তাদের ঘর থেকে বের হবার পরই ওরা পাহারা দিয়ে চলেছে। সুদীপ বন্ধুদের কিছু বলল না। তার ধারণা ভুল হলে আর একটা রসিকতায় সামনে দাঁড়াতে হবে।

পুরো গ্রামটা ঘুরতে ঘন্টাখানেক সময় লাগল। অবশ্য পাহাড়ের অন্য ভাঁজে ঘর-বাড়ি থাকলে সেটা অজানা থাকল। জায়গা বেশি নয় কিন্তু বারংবার চড়াই ডেঙে ওদের বিশ্রামের প্রয়োজন হয়েছিল। খোলা একটা জমি পেয়ে ওরা চারজন বসে পড়ল। বাচ্চাগুলো খানিক দূরত্ব রেখে থেমে গিয়ে ওদের লক্ষ করছে। মাথার ওপর কুয়াশা ঝুলছে। রোদ নেই এক ফোঁটা। কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, তোদের কি খিদে পায় না? আমার নাড়িভুড়ি জ্বলছে। কলকাতাতেও এমন খিদে পেত না।

জয়িতা বলল, তুই এক কাজ কর। আমাদের আস্তানায় ফিরে গিয়ে যে খাবার আছে তাই দিয়ে কিছু একটা বানিয়ে ফেল। আমরা আসছি। ইচ্ছে করলে ভাতও রাঁধতে পারিস। খুব সোজা।

সবাই ভেবেছিল কল্যাণ প্রতিবাদ করবে। কিন্তু সে উঠে দাঁড়াল। তারপর দিক ঠিক করে হাঁটতে লাগল। বসে থাকা বাচ্চারা কল্যাণকে চলে যেতে দেখে কেউ কেউ পিছু নিল। কল্যাণ খানিকটা হেঁটে বাচ্চাগুলোকে ধমকাল, কি চাই? আমরা কি আজব চীজ? ভাগ!
 
তার গলায় যে ঝাঁঝ ছিল তাতে বাচ্চারা থমকাল কিন্তু সরল না। দুবার পথ গোলানোর পর শেষ পর্যন্ত সে আস্তানাটায় পৌঁছাতে পারল। পৌঁছে দেখল পালদেম আর একটি কিশোর সেখানে বসে আছে। পালদেমকে দেখেই কল্যাণের মেজাজ বিগড়ে গেল। এই লোকটাই ওদের অস্ত্র চুরি করেছে। পালদেম মুখোমুখি হওয়ামাত্র জিজ্ঞাসা করল, তোমরা কি গ্রাম দেখতে বেরিয়েছ?

হ্যাঁ। কিছু একটা করতে হবে তো। তোমাকে আমি একটা প্রশ্ন করব!।

নিশ্চয়ই। কিন্তু তার আগে তোমাকে জানাচ্ছি কাল রাত্রে তোমাদের ওইসব বাজে জিনিসগুলো আমি নিয়ে গেছি। ওগুলো তোমাদের সঙ্গে থাকলেই অযথা ভয় দেখাবে। যেদিন তোমরা এই গ্রাম ছেড়ে যাবে সেদিন সব ফেরত পাবে। এখানে তো আর ওসবের দরকার হচ্ছে না।

পালদেম যে সোজাসুজি স্বীকার করবে তা কল্যাণের অনুমানে ছিল না। সে এটা শোনার পর আর কি বলতে পারে! ঘরে ঢুকে ব্যাগ খুলে সে চাল আর আলু বের করল। হঠাৎ তার মনে হল স্টোভ ধরালে তেল শেষ হয়ে যাবে। পাথরের মধ্যে কাঠ জ্বেলে উনুন তৈরি করলে কেমন হয়! সে আবার বাইরে আসতে পালদেম জিজ্ঞাসা করল, তোমার বন্ধুরা কি এখনই ফিরবে?

হ্যাঁ। কোন দরকার থাকলে আমাকে বলতে পার। নিজেকে বেশ গুরুত্ব দিতে চাইল কল্যাণ।

ওর মেয়ে কাল সারারাত ঘুমাতে পারেনি। ওই ঘা হওয়ার পর এমন কখনও হয়নি। আমরা সবাই খুব ভয় পাচ্ছি। যদি মেয়েটির কিছু হয় তাহলে তোমরা মারা পড়বে। কেন ঘুমোয়নি?

পালদেম বেশ কড়া গলায় প্রশ্ন করতে কল্যাণ একটু থিতিয়ে গেল। মেয়েটা ঘুমোয়নি? মারা গেলেই হয়ে গেল আর কি! সে কোন উত্তর খুঁজে না পেয়ে বলল, আমি ঠিক জানি না। আনন্দ এসব বোঝে। এখন মেয়েটা কি করছে?

এখন ঘুমাচ্ছে মড়ার মত। ওর মা তাই খোঁজ করতে পাঠিয়েছে। সকালে কি যেটা খেতে দিয়েছ তা খাওয়াবে? ভেবেচিন্তে বলল।

পালদেম প্রশ্ন করতে কল্যাণ মুখ তুলে তাকাতে ওদের আসতে দেখল। সে বলল, ডাক্তারবাবু আসছে, ওকে আসতে দাও, বলার ওই বলবে।

দূর থেকে আনন্দ পালদেমকে কল্যাণের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছিল। ওরা সঙ্গে সঙ্গে স্থির করেছিল চুরির ব্যাপারটা নিয়ে কিছু বলবে না। কাছাকাছি এসে সুদীপ হাত তুলল, আরে পালদেম, কি খবর? তোমাকেই খুঁজছি। কাল রাত্রে চিৎকার করে কে কাঁদছিল বল তো? বাপরে বাপ!

পালদেমের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। সে প্রশ্নটার জবাব না দিয়ে কল্যাণকে ইশারা করল ব্যাপারটা জানাতে। আনন্দ লক্ষ করল আজ ওর ব্যবহারে বেশ কর্তৃত্ব এসে গেছে। কল্যাণ তাদের জানাল ব্যাপারটা। আনন্দ একটু চিন্তা করে বলল, এখন যখন ঘুমোচ্ছ তখন ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যেটা দিয়েছে তা এবার অর্ধেক করে খাইয়ে দাও। তোমরা মিছিমিছি চিন্তা করছ, মেয়েটা ভাল হয়ে যাবে। কিন্তু কান্নাটা কিসের?

পালদেম বলল, ওটা পাহাড়ের দানোর। মাঝে মাঝেই গ্রামের কাছে এসে ওইভাবে কাঁদে। আর যখনই দানোটা এমন করে তখনই গ্রামের কেউ না কেউ মরে যায়। কাহুন আজ পুজো শুরু করেছে তাই।

জয়িতা বিস্মিত, দানো? দৈত্য? তোমাদের ওই পাহাড়ে বরফের মধ্যে দৈত্য থাকে? পাগল!

সঙ্গে সঙ্গে মুখ শক্ত হয়ে গেল পালদেমের, যা জানো না তা নিয়ে ঠাট্টা করো না। তুমি মেয়েছেলে বলে আমি কিছু বললাম না, এরা কেউ পাগল বললে আমি ছাড়তাম না।

সুদীপ ঠাট্টা করল, মেয়েছেলে ও মেয়েছেলেদের তুমি পাত্তা দাও না?

না। মেয়েছেলেকে আমরা বিছানা আর বাচ্চা তৈরির ক্ষেত হিসেবে ব্যবহার করি। আমাদের এখানকার নিয়ম হল চাষের জমি পাহাড় থেকে ছিনিয়ে নাও, বরফের জন্য মকাই, কোদো জমিয়ে রাখ আর পেট ভরে ছাং খেয়ে মেয়েছেলের কাছ থেকে আনন্দ পাও। পালদেম হাসল লাল দাঁত বের করে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top