What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected গর্ভধারিণী - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

সুদীপ অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়াল। যদিও সে কোন শব্দ উচ্চারণ করল না কিন্তু মুখচোখে প্রশ্নটা স্পষ্ট। কল্যাণ অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, আমরা চারজনেই একসঙ্গে এই ঘরে থাকব।

বাট হোয়াই? সুদীপ অবাক শুধু কল্যাণের কথায় নয়, তার বলার ধরনেও।

তাই কথা ছিল। কল্যাণ চোখে চোখ রাখতে চাইছিল না।

আমি বুঝতে পারছি না তুই কি বলতে চাইছিস! আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি?

আমি জানি না। কিন্তু পুলিশ অ্যাটাক করলে তুই সেটা পারিস বাইরে গেলে, আমরা পারব না। একসঙ্গে মুখোমুখি হওয়া ভাল। কল্যাণ ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল। হঠাৎ মনে হল সান্দাকফুর শীতল অপরাহে যে ঠাণ্ডা বাতাস সমস্ত উপত্যকায় বয়ে যাচ্ছে তার থেকে বহুগুণ শীতলতম অনুভূতি ওই শব্দগুলো থেকে ছিটকে এল।

ওঃ গড! ইউ ডোন্ট বিলিভ মি কল্যাণ। সুদীপের গলা থেকে একটা কাতর শব্দ বেরিয়ে এল। কল্যাণ কোন উত্তর দিল না। চুপচাপ ভাল হাতটায় গ্রেনেড নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল। তোরা? তোদেরও কি একই ধারণা? সুদীপ আনন্দর দিকে তাকাল। আনন্দ হাসল। তার চোখ কল্যাণের ওপর ঘোরাফেরা করছিল। তারপর ধীরে ধীরে সে ওর কাছে এগিয়ে গেল, আমি বুঝতে পারছি না তুই এত নার্ভাস হয়ে পড়েছিস কেন?

নার্ভাস! কল্যাণ কাঁধ ঝাঁকাল।

অবশ্যই নার্ভাস। খুব ভয় পেলে মানুষ অনেক সময় নিজেকেও অবিশ্বাস করে। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই তুই সুদীপের সঙ্গে এই ধরনের—! দ্যাখ কল্যাণ, কেউ যদি পালাতে চায় তো তাকে আমরা ধরে রাখতে পারব না। আমি এখনও বলছি, ওয়েলকাম! সে স্বচ্ছন্দে চলে যেতে পারে। আমরা ধরে নেব যে-কটা বাধা আমরা পেরিয়েছি সে-কটাই তার নার্ভের পক্ষে যথেষ্ট ছিল। কিন্তু সান্দাকফু ছাড়াবার পর আর কোন সুযোগ কেউ পাবে না। কল্যাণ, তুই যদি ফিরে যেতে চাস তাহলে আমার কোন আপত্তি নেই। কথাটা শেষ করে আনন্দ ইঙ্গিত করল জয়িতাকে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতে।

কল্যাণের মুখ অন্যরকম হয়ে গেল, আমাকে চলে যেতে বলছিস কেন? হাসল কল্যাণ, চলে আমি যাবই বা কোথায়! সবকটা দরজা তো জেলখানার দিকেই শেষ হয়েছে। আমি ভয় পাই না নিজের জনন্য আনন্দ, কিন্তু ওদের ওই ক্লাসটাকে আমি বিশ্বাস করি না। এবার সোজাসুজি সুদীপের দিকে তাকাল কল্যাণ।

আমাকে তুই বিশ্বাস করিস না? সুদীপ তখনও স্বাভাবিক হতে পারছিল না।

তোকে নয়, যে ক্লাস থেকে তুই এসেছিস সেই ক্লাসটাকে।

সুদীপ এগিয়ে এল কল্যাণের সামনে, এখানে আমি একাই আছি। অ্যান্ড লিন, আমি কোন ক্লাসের প্রতিনিধি হয়ে এখানে আসিনি। আর তাই যদি বলিস, বিখ্যাত সব মানুষ চিরকাল বলে গেছেন মধ্য বা নিম্নবিত্তরাই চিরকাল সুবিধেবাদী। তুই নিজে যে ক্লাস থেকে এসেছিস সেই ক্লাসটার কথা আগে চিন্তা কর। তুই সুবিধেবাদী নস?

আমি? হ্যাঁ, সুবিধে পেলে কে না ছাড়ে বল।

সুদীপ ঝুঁকে কল্যাণের প্লাস্টার করা হাতটা খপ করে ধরল, আমাকে বিশ্বাস করার দরকার নেই, আনন্দকে করতে হবে। সেটাই ঠিক হয়েছিল কলকাতায়। নইলে আমি তোকে বিব্রত করব। ও কে। সুদীপ সোজা হয়ে দাঁড়াল। কল্যাণের প্লাস্টারের রঙ এর মধ্যে বেশ নোংরা হয়ে গেছে। সুদীপ সেদিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ওটাকে আর বয়ে বেড়িয়ে কি লাভ! আনন্দ, আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরছি। অবশ্য ততক্ষণ যদি বাইরে থাকা যায়। আমার মনে হয় ওরা জিপ নিয়ে আসবে না। সাবধানে থাকবি।

গ্লাভস দুটো হাতে গলিয়ে ও পেছনের দরজা খুলে হাঁটতে হাঁটতে দেখল ওয়াংদে তখনও পড়ে আছে। লোকটার নেশা না ভাঙানোই ভাল। সে দ্বিতীয় দরজাটা খুলতেই সোঁ সোঁ হাওয়ার অস্তিত্ব টের পেল। একটু সময় নিল সে। ঠাণ্ডাটা সইবার অবস্থায় এলে সে চটপট বাইরে বেরিয়ে এল। এই দিকটা সান্দাকফুর বাংলোগুলোর উলটো দিকে। ওপাশ থেকে কারও নজরে আসবে না। সুদীপ দৌড়ে যেতে গিয়ে পিছলে পড়তে পড়তে কোনরকমে সামলে নিল। জুতোর তলায় চকচকে বরফ ঝরা কাচের মত ছড়ানো। শ্যাওলা পড়া উঠোনের চেয়েও পিছল। একটু ঝুঁকে সে এক টুকরো বরফ তুলে নিল। এখনও পাতলা, ফিনফিনে। সে চারপাশে তাকাল। একটা পায়ে চলা পথ রয়েছে নিচে যাওয়ার। ওপাশে আর একটা চলে গেছে যেটা দিয়ে গেলেই সবার সামনে প্রকাশিত হতে হবে। প্রকাশিত শব্দটা নিয়ে খেলল সে মনে মনে। এখন হিমালয়ের সব মুখ ঘোমটার আড়ালে। এমন কি কাছাকাছি পাহাড়গুলোতেও গাঢ় কুয়াশা নেমে পড়েছে। হয়তো আরও কিছুক্ষণ পরে পায়ের তলার সব ঘাস বরফের আড়ালে চলে যাবে। এরকম একটা অপ্রকাশিত প্রকৃতিতে কল্যাণ প্রকাশিত হয়ে পড়ল এমন ভাবে যে বুকের মধ্যে এখনও পাথরটা চেপে রয়েছে। জয়িতা ভাঙতে চায়নি, কিন্তু যেটুকু ইঙ্গিত পেয়েছিল তাতে সুদীপের মনে হয়েছে কল্যাণের হাতে মারাত্মক কিছু হয়নি। যা হয়েছে তা ভাল করে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বাঁধলেই চলে যেত। হাড়ে একটু চাপ আর কয়েকটা লিগামেন্ট ছেড়ার জন্যে যদি কল্যাণ জোর করে ডাক্তারকে দিয়ে প্লাস্টার করিয়ে নেয় তাহলে অনেক সুবিধে। ডাক্তার কি বলেছিল তা রামানন্দ রায় এবং কল্যাণ ছাড়া কেউ জানে না। রামানন্দ মেয়েকে কতটা কি বলেছেন সেটা জয়িতা হয়তো ভদ্রতায় বলবে না। কিন্তু অত তাড়াতাড়ি সব হয়ে গেল, কল্যাণও আর হাতের ব্যথার কথা বলল না, ব্যাপারটায় খটকা লাগে। তখন তো যে কোন মুহূর্তে পুলিশের খপ্পরে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। হাতে প্লাস্টার থাকায় নিশ্চয়ই কল্যাণ খানিকটা সুবিধে পেত। তাছাড়া তারপর থেকে তো ওকে কোন ঝুঁকিতে যেতে হচ্ছে না। সুদীপ চোখ বন্ধ করল। সে কি খুব ছোট হয়ে যাচ্ছে? হিমালয়ের এত ওপরে এসে এইরকম চিন্তাকে প্রশ্রয় দেওয়ার মধ্যে কি এক ধরনের নীচতা কাজ করে না?

যেন ব্যাপারটাকে ঝেড়ে ফেলার জন্যেই সুদীপ একটা সিগারেট ধরাল। কল্যাণ যতক্ষণ সরাসরি বিপদ না ডেকে আনছে ততক্ষণ ওকে বন্ধু ভাবাই ভাল। কিন্তু এদিকে সময় বেশী নেই। বড় জোর মিনিট তিরিশের মধ্যেই অন্ধকার নেমে আসবে। সুদীপ হাঁটা শুরু করল। যতটা পারে ঝোপঝাড়ের আড়াল ব্যবহার করতে লাগল সে। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর পি ডর ডি বাংলোটা নজরে পড়ল। এখন অদ্ভুত মায়াবী এক আলো নেমেছে পৃথিবীতে। বিষণ্ণ শব্দটার শুরুতেও যদিও বিষ তবু তাতে জ্বালা থাকে না। এই আলোয় মন আরও বিষণ্ণ হয়ে যায়।
 
মিনিট তিনেক হাঁটার পর ও ডি আই বাংলোর সামনেটা দেখতে পেল। সবকটা দরজা বন্ধ। ওখানে কোন মানুষ আছে কিনা বোঝা অসম্ভব। সেটা অবশ্য ইয়ুথ হোস্টেলের দিকে তাকালেও মনে হবে। সতর্ক ভঙ্গিতে সে আরও একটু এগোতে বাংলোর পেছনদিকটা নজরে এল। জিপ এখনও দাঁড়িয়ে আছে। অন্তত শখানেক গজ দূরে রয়েছে বাংলো। কেউ যদি খুঁটিয়ে না দেখে তাহলে সুদীপকে আবিষ্কার করতে পারবে না। অন্তত চলিশ গজ ফাঁকা জায়গা পার হলে একটা বড় পাথরের আড়াল পাওয়া যাবে। কিন্তু বাইরে যখন কেউ নেই তখন এই সুযোগটা নেওয়াই ভাল। সুদীপ দৌড়োল। দু-তিনবার পড়তে পড়তে সামলে নিয়ে সে পেীছে গেল পাথরটার আড়ালে। এইটুকু দৌড়তেই নিঃশ্বাস দ্রুত হয়েছে। নাক মুখ দিয়ে বাষ্প বের হচ্ছে। শালা সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দেব—মনে মনে আর একবার উচ্চারণ করল সে। তারপর একটু স্থির হয়ে বাংলোটার দিকে তাকাল। আর তখনই এপাশের দরজাটা খুলে গেল। আপাদমস্তক ওভারকোটে মুড়ি দিয়ে একটি লোক বেরিয়ে এল। লোকটার দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ বলে দেয় স্বাস্থ্য ভাল। হাঁটার ভঙ্গিতে হুকুম করার চরিত্র আছে। লোকটার পিছু পিছু আর একজন বেরিয়ে এল। এই লোকটাই ড্রাইভার। তার হাতে লোহার শিক গোছের কিছু। ওরা পি ডর ডি বাংলোর দিকে হাঁটছিল। সুদীপ চোখ রাখল। খানিকটা ওপরে উঠে লোক দুটো সুন্দর বাংলোর দরজায় পৌঁছে গেল। ওরা তালা ভাঙছে। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর লোকটা সফল হল। তারপর দুজনেই ভেতরে ঢুকে গেল। সুদীপ ডি আই বাংলোর দিকে তাকাল। কেউ আসছে না ওখান থেকে। এবার জিপের দিকে ভাল করে তাকাতে সে শক্ত হল। এটার গায়ে সরকারি লেবেল লাগানো। ড্রাইভারটা দৌড়ে দৌড়ে ফিরে আসছিল। ওর গায়ে শীতবস্ত্র আছে ঠিকই তবে অন্য লোকটির মত নয়। ড্রাইভারটা এসেই জিপের পেছনের দিকের ঢাকনা খুলে ফেলে গাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। একভাবে এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। সুদীপ, আবিষ্কার করল তার গায়েও সাদাটে ভাব এসেছে। তুষার পড়ছে সমানে।

এই সময় ড্রাইভারের সঙ্গে সেই লোকটা বেরিয়ে এল যার সঙ্গে ওয়াংদে কথা বলেছিল। ওদের দুজনের হাতেই চেলাকাঠের বোঝ। সেগুলোকে জিপের পেছনে ওরা তুলে দিল দুবারে। তারপর লোকটা ভেতরে চলে গেলে সুদীপ চমকিত হল। মেয়েদের পোশাক বুঝতে অসুবিধে হল না। মেয়ে দুটি লম্বা, শীতে অত্যন্ত কাবু বোঝা যাচ্ছিল। কোনরকমে দরজা থেকে বেরিয়ে এসে জিপে উঠে বসল। ড্রাইভার এবার গাড়িটাকে চালিয়ে নিয়ে গেল পি ডর ডি বাংলোর দরজার গায়ে। মেয়ে দুটো মুরগীর মত ছটফটিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে। জিনিসপত্র ভেতরে চালান করে দিয়ে ড্রাইভার বোধ হয় হুকুমমত গাড়ি নিয়ে ফিরে এল ডি আই বাংলোতে। অর্থাৎ যারা এসেছে তারা ডি আই বাংলোতে থাকতে চায়নি। সুদীপ নিঃশ্বাস ফেলল। বহুৎ বরাতজোর থাকায় তারা পি ডর ডি বাংলোর দরজা খোলা পায়নি। কিন্তু একটা ব্যাপারে এখন নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, এরা পুলিশ নয়। অর্থাৎ আজকের রাতটা আরামে না হোক স্বস্তিতে কাটানোনা যাবে। এই সময় আর কোন মানুষের পক্ষে নীচ থেকে আসা সম্ভব নয়। সুদীপ এবার আড়াল ছাড়ল। তারপর খুব স্বাভাবিক পায়ে হেঁটে চলে এল ডি আই বাংলোর দরজায়। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। কয়েকবার শব্দ করার পর ওয়াংদের পরিচিত লোকটা সেটা খুলল। কোন ভূমিকা না করে ভেতরে ঢুকল সুদীপ। মনে হচ্ছিল আর মিনিট পাঁচেক থাকলেই শরীর জমে যেত। লোকটাও সেটা বুঝতে পারল। দরজা ভেজিয়ে জিজ্ঞাসা করল হিন্দীতে, বলুন!

সুদীপ বোঝাবার চেষ্টা করল, আমরা আজ বিকেলেই এসেছি। ইয়ুথ হোস্টেলে আছি। কিন্তু ওয়াংদে, যে আমাদের সঙ্গে এসেছে সে নেশা করে পড়ে আছে। খাবার তৈরি করতে পারেনি। এখানে কি কিছু খাবার পাওয়া যাবে? আর আমাদের কিছু কাঠ চাই। ওখানে কাঠ নেই।
 
লোকটা মন দিয়ে শুনল। একটা কালি পড়া হ্যারিকেন জ্বলছে বাংলোয় আর যারা আছে তাদের অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছিল না। শীত মানুষকে চিরকালই নিস্তব্ধ করে দেয়। লোকটা এবার জিজ্ঞাসা করল, সাহেবরা তো চারজন। আমি দশখানা রুটি আর সবজি দিতে পারি। কাঠ ও খাবারের জন্যে লাগবে কুড়ি টাকা আর দশ-তিরিশ টাকা, কাঠের জন্যে আরও দশ, মোট চল্লিশ। সাহেব রাজী?

সুদীপ যেন মুক্তি পেল। দ্রুত ঘাড় নেড়ে বলল, ঠিক আছে। কিন্তু কতক্ষণ সময় লাগবে?

লোকটা হাসল। ওর মুখে দিশি মদের গন্ধ বের হচ্ছিল ভুরভুর করে। ড্রাইভারটাও ধারে কাছে নেই। হাসি নিয়েই লোকটা বলল, শিলিগুড়ি থেকে পুলিশের সাহেব এসেছেন একটু আগে। ওঁরা খাবেন ভেবে আটা মেখেছিলাম। পরে শুনলাম সাহেবরা খাবার সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। ওটাই আপনাদের জন্যে করে দেব। আধা ঘণ্টা টাইম চাইছি। সাহেব চলে যান আমি পেীছে দেব। সাহো. র কি মদ চাই? দিশি বিলিতি দুই আমার কাছে আছে।

সুদীপ এক মুহূর্ত ভাবল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, বিলিতি কি আছে?

রম। ছোট বোতল আশি টাকা। সাহেবের চাই?

সুদীপ মাথা নাড়তেই লোকটা ভেতরে চলে গেল। এখানে টুরিস্টরা এলেই কি মদ খায়? ওর মনে হল মদ কিনে লোকটাকে পয়সা পাইয়ে দেওয়াটা ভালই হল। ও ওদের টুরিস্ট ভাববে। জিপটা তাহলে পুলিশ অফিসারের সঙ্গে মহিলা রয়েছে যখন তখন নিশ্চয়ই অন ডিউটিতে নেই। মদের বোতলটা নিয়ে সুদীপ বলল, তুমি যখন খাবার দিতে যাবে তখন এর টাকাটা নিয়ে নিও। অবশ্য আমাকে যদি বিশ্বাস কর।

লোকটা হাসল, বিশ্বাস তো করতেই হয়। আমাকে টাকা না দিয়ে কেউই সান্দাকফু থেকে পালিয়ে যেতে পারে না। গণেশের কাছে আমি তিনশো টাকা পাই, টাকা দিচ্ছিল না, অসুখ হয়ে গেল। সাহেবরা কি এখানে এই প্রথম এলেন?

হ্যাঁ। ওই বাংলোটা কি খুব ভাল? তোমাদের পুলিশ সাহেব ওখানে চলে গেলেন তাই বলছি।

ওটা ইন্দিরা গান্ধীর জন্যে তৈরি হয়েছিল। যেসব সাহেব মেয়ে নিয়ে এখানে ফুর্তি করতে আসেন তারা সবাই চান ওই বাংলোয় থাকতে। ঠাণ্ডা ঢোকে না, ভাল ফায়ার প্লেস, নরম বিছানা—কত আরাম। এই সাহেব তালা ভেঙেও ঢুকে গেল সেই আরামের জন্যে।

সাহেবের সঙ্গে কারা এসেছেন?

এদের কি কোন পরিচয় থাকে সাহেব! কেউ ওদের পাঠিয়েছে, সাহেবকে আনন্দ দিতে। কারও কারও তো একজন মেয়ে পাশে থাকলে একা লাগে তাই দুজন এসেছে। কথাগুলো বলে হঠাৎ যেন সচেতন হল লোকটা। ঘুরে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় বলল, আমি কিন্তু এসব কথার একটাও বলিনি। কোথাও আমার এইসব কথা বললে আমি অস্বীকার করব। এই জন্যেই মা বলত ভগবান চোখ দিয়েছে দেখবার জন্যে, কান দিয়েছে শোনার জন্য, আর মুখ দিয়েছে খাবার জন্যে। কেন যে ভূলে যাইআফসোসের ভঙ্গিতে কয়েকবার মাথা নেড়ে লোকটা বলল, কথাটা যে কেন ভুলে যাই! ঠিক আছে, আমাকে দরজাটা বন্ধ করতে হবে। খাবার তৈরি করতে হবে। ঠিক আছে!

ইঙ্গিতটা বুঝেই বেরিয়ে এল সুদীপ। বাইরের আলো আরও মরে এসেছে। এখন প্রায় সন্ধ্যা। পৃথিবীর অনেক উঁচুতে দাঁড়িয়ে দিনের চলে-যাওয়া এক পলক দেখল সুদীপ। এখন সেই তেজী বাতাসটা নেই। কিন্তু কাঁপুনি দেওয়া ঠাণ্ডা উঠে আসছে পৃথিবীর গভীর থেকে, আকাশের ছাদ গড়িয়ে। মদের বোতলটা হাতে নিয়ে দৌড়াল সুদীপ। এর মধ্যে পায়ের তলার তুষারগুলো বরফের চেহারা নিয়ে নিয়েছে। প্রতিটি পদক্ষেপে বিশেষ ধরন নেওয়ার পর আর পা পিছলে যাচ্ছে না। সে ক্রমশ উঠে এল পি ডর ডি বাংলোর দরজায়। পায়ের তলায় বরফ থাকলে কিভাবে দৌড়াতে হয় তার কায়দাটা আবিষ্কার করে সে আপ্লুত হল। তারপর সমস্ত উপত্যকার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। ঢালু হয়ে নিচে গড়িয়ে যাওয়া সান্দাকফুকে এই বিশেষ জায়গা থেকে এখন অপরূপ দেখাচ্ছিল। রাত আসছে নিচ থেকে কালো পোশাকে ঢাকা ডাইনির মত হামাগুড়ি দিয়ে। মাথা নাড়ল সুদীপ। ঠিক হল না। রাতকে কোন বাঙালি কবি কালো খামের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। সান্দাকফু সেই খামের মধ্যে ঢুকে আছে।
 
রঙিন বাংলোটা পৃথিবীর সব নির্জনতা নিয়ে চুপচাপ। সুদীপ দরজাটার কাছ থেকে সরে এল। প্রতিটি জানলার ভেতরে ভারী পর্দা। তিনটে মানুষ ভেতরে আছে অথচ কোন দৃশ্য দেখা যাচ্ছে না, কোন শব্দও! প্রথম প্রথম সুদীপ সাবধান হবার চেষ্টায় ছিল। কিন্তু তারপর মনে হল যে লোকটা এখানে মেয়েদের সঙ্গে আরাম করছে সে নিশ্চয়ই সতর্ক প্রহরী হবে না। বাড়িটার শরীর ধরে সুদীপ পেছনের দিকে চলে এল। মূল বাংলোর পেছনেই বোধ হয় চৌকিদার-এর থাকার জায়গা। সেটা মোটেই মজবুত নয়। কাঠের নড়বড়ে দরজাটায় একটা জোরে চাপ দিতেই খুলে গেল। ভেতরটা অন্ধকার। একটা স্যাতসেঁতে গন্ধ। মাথা ঢুকিয়েও ফিরে আসতে গিয়ে থমকে গেল সুদীপ। মানুষীর গলা কানে আসছে। বোধ হয় কয়েকটা বন্ধ দরজা পার হয়ে আসায় গলার শব্দ প্রায় মিলিয়ে যাওয়ার অবস্থায়। কিন্তু দুটো হাসি একত্রিত হওয়ায় তাকে চিনতে অসুবিধে হল না।

তিনবার আছাড় খেয়ে সুদীপ ইয়ুথ হোস্টেলের দরজায় যখন ফিরে এল তখন তার শরীর প্রায় নীরক্ত। বোধ হয় জানলা দিয়ে নিয়ত লক্ষ্য রাখায় আনন্দ দরজা খুলেছিল। ওর ওপর নির্ভর করে সুদীপ ঘরে ফিরে এল। ফায়ারপ্লেসের আগুন নিবু নিবু, তবু তার ওপর হামলে পড়ল সুদীপ। জয়িতা ওর উইন্ডচিটারটা খুলে নিতে চাইছিল, এটা খোল। সাদা ভূত হয়ে গেছিস। কোন রকমে সেটা থেকে মুক্ত হয়ে হাত এবং মুখে রক্ত ফিরে পাওয়ার পর সুদীপ দেখল আনন্দ মদের বোতলটা চোখের সামনে তুলে দেখছে। আগুনের পাশে বসে পড়ে সুদীপ হাসল, ওটা চৌকিদারের কাছ থেকে কিনতে হয়েছে। লোকটার সঙ্গে ভাব জমছিল হঠাৎ কি যেন হয়ে গেল। শোন, কোন পুলিশ আমাদের সন্ধানে আসেনি। ওই গাড়িটা একজন শৌখিন পুলিশ অফিসারের। তিনি দুজন উর্বশীর সঙ্গে এই বাংলোয় এসেছেন আরাম করতে। সুতরাং কল্যাণ, তোর এবার শান্ত হওয়া উচিত।

জয়িতা চাপা গলায় বলল, সুদীপ! ডোন্ট স্টার্ট দ্যাট। ও-কে!

কথাটা শোনার পর সব থেকে স্বস্তিতে এসেছিল কল্যাণ। এবং সুদীপের খোঁটাটা সে গায়ে মাখল। সে অনেকক্ষণ থেকে ট্রাঞ্জিস্টারে কান রাখছিল। এখনও কোন স্টেশন খোলেনি যার ভাষা সে চেনে। অদ্ভুত সব গলা আসছে কাঁটা ঘোরালে। হয়তো লাসা কিংবা পিকিং বা ওইরকম কোন রেডিও স্টেশন ধরা পড়ছে ওতে। সেটা দেখে কল্যাণকে আনন্দ বলল, তোকে বললাম কলকাতা এখান থেকে ধরা যাবে না। ব্যাটারি নষ্ট করছিস।

কল্যাণ বোধ হয় ইতিমধ্যেই বিরক্ত হয়ে পড়েছিল। ট্রাঞ্জিস্টারকে সরিয়ে বলল, তোদের খিদে পায়নি?

জয়িতা বলল, পাচ্ছে, কিন্তু স্টকে হাত দেব কিনা ভাবছি।

সুদীপ বলল, একটু ওয়েট কর। খাবার আসছে।

কোত্থেকে? জয়িতা হাসল।

হাসি নয়, তোদের জন্যে আর কত করব বল! খাবার আসছে, কাঠ আসছে আগুন জ্বালার জন্যে। মোট একশ কুড়ি টাকা লাগবে। রেডি করে রাখ। লোকটাকে দরজা থেকে বিদায় করতে হবে।

চারজনের খাবারের দাম এখানে একশ কুড়ি? প্রায় চিৎকার করে উঠল কল্যাণ।

ওইটে সুদ্ধ। মদের বোতলটা দেখাল সুদীপ, যে লোকটার সঙ্গে ওয়াংদে কথা বলেছিল সেই দিয়ে যাবে। মিনিট দশেক অপেক্ষা কর।

জয়িতা ওর পাশে বসল, থ্যাঙ্কস। লোকটা অন্তত টাকার জন্যে আসবে, কি বল্? তুই কখনও মদ। খেয়েছিস সুদীপ?

মদ! হাসল সুদীপ, স্কুলের মেয়ের মত কথা বলিস না। একটু আগেও তো খেলাম।

ওঃ, ওই খাওয়ার কথা বলছি না। বেশ নেশা করার মতন খাওয়া, খেয়েছিস?

না। চান্স পাইনি বলব না, ইচ্ছে হয়নি।

সুদীপ কথা শেষ করামাত্র আনন্দ বলল, কারও যদি খুব ঠাণ্ডা লাগে তাহলে অল্প খেয়ে দেখতে পারিস। নেশা করার কথা মাথা থেকে তাড়া।

সুদীপ উঠল। ওয়াংদের রেখে দেওয়া জলের জাগ আর গেলাস নিল। মদের বোতলটা আনন্দ এগিয়ে দিতে সেটাকে একটু চেষ্টার পর খুলে ফেলল। তারপর গেলাসে ঢালতে গিয়ে থামল, ভারতবর্ষের জনসাধারণ যদি জানতে পারে চারটে ছেলেমেয়ে দেশের মানুষের যারা শত্রু, তাদের ধ্বংস করতে চেষ্টা করার পর মদ খেয়েছে তাহলে তারা কি ভাববে?

জয়িতা বলল, অর্ধেক মানুষ ছি ছি করবে আর অর্ধেক চুপ করে থাকবে।

আনন্দ বলল, এখানে কোন দর্শক নেই। তোর শীত করলে তুই খাবি। দ্যাটস অল।

সুদীপ ঘ্রাণ নিয়ে মুখ বিকৃত করল, কুৎসিত গন্ধ। খেলেই বমি হয়ে যাবে। স্টিল আই অ্যাম ট্রাইং।

জয়িতা বলল, যদি দুনম্বরী মাল হয়! সান্দাকফুতে বিষাক্ত মদ খেয়ে উগ্রপন্থীর মৃত্যু-খবরের কাগজে হেডিং হবে।

সুদীপ কোন কথা না বলে জল মিশিয়ে খানিকটা মুখে ঢালল। তারপর চোখ বন্ধ করে বলল, কান গরম হয়ে যাচ্ছে, বুক জ্বলে গেল। আঃ, বেশ আরাম লাগছে এখন। তোরা খেতে পারিস।
 
কল্যাণ খেল না। সে কারণ দেখাল তার ঠাণ্ডা লাগছে না। কিন্তু তার চোখ তিনজনের ওপর ঘুরছিল। ও বুঝতে চাইছিল কেউ মাতাল হচ্ছে কিনা। এমন সময় জয়িতা বলল, দূর? আমার যে একটুও নেশা হচ্ছে না। মনে হল ওষুধ খেয়ে গা গরম করলাম।

কল্যাণ খুব হতাশ হল। এবং তখন তার মনে হল একটু খেয়ে দেখলে হত! এখন আর চাওয়া যায়। কেন যে মাঝে মাঝে স্রোত থেকে সরে দাঁড়াবার ভূত চাপে মাথায়—! তখনই দরজায় শব্দ হল। সুদীপ উঠে সোজা পায়ে দরজা খুলে ভেতরের ঘরে চলে গেল। তারপর চিৎকার করল, আনন্দ, টাকাটা নিয়ে আয়।

শব্দটা শোনামাত্র টাকা বের করেছিল আনন্দ। মদ পেটে যাওয়ার পর সত্যি শীতটা উবে গেছে যেন। সে বেরিয়ে এসে ওয়াংদেকে একবার দেখল। তারপর দ্বিতীয় দরজার কাছে এসে টাকাটা এগিয়ে ধরল।

কাঠের বোঝা নামিয়ে খাবারের পাত্র হাত বদল করে লোকটা হাসল। একটাও কথা না বলে টাকাটা নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

সকালের জন্যে কিছু কাঠ রেখে ওরা ফিরে এল ঘরে। ফায়ারপ্লেসে কাঠ খুঁজে ব্লোয়ারটা ব্যবহার করার পর আগুন জ্বলল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে উত্তাপ এবং আলো উজ্জ্বল হল। ঠিক গুনে গুনে দশখানা রুটি। আর সবজি বলতে যে বস্তুটি তাতে আর যাই থাক কোন স্বাদ নেই। ওরা দুটোর বেশি রুটি গিলতে পারল না। ফায়ারপ্লেসের আগুনের সামনে বসে দুটো করে রুটি হাতে নিয়ে একই পাত্র থেকে সবজি তুলে খাচ্ছিল ওরা। কোথাও কোন শব্দ ছিল না এতক্ষণ। শুধু কাঠ ফাটছিল আগুনে। আনন্দ বলল, কিসের শব্দ হচ্ছে বল তো?

ওরা কান পাতল। দূর থেকে একটা ডাক ভেসে আসছে। প্রথমে কুকুরের চিৎকার বলে মনে হচ্ছিল। তারপর কুকুরের সঙ্গে পার্থক্যটা ধরা পড়ল। ডাকগুলো কাছে এসে থমকে গেল। না, কুকুর নয়। আরও ভয়ঙ্কর কিছু। এইসব জায়গায় শেয়াল হায়েনার আসার কথা নয়। এত উঁচুতে এবং ঠাণ্ডায় আসবে কি করে ওরা? হঠাৎ সুদীপের মনে পড়ল তুষার-নেকড়ের কথা। ওরা সেই হিংস্র তুষার-নেকড়ে নয় তো? সে উঠে দরজাটা বন্ধ আছে কিনা দেখতে গেল বাইরের ঘরে। দুটো দবজা দেখে ঘরে এসে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে ছুটে গেল এমন ভঙ্গিতে যে সঙ্গীরা চমকে উঠল। বিছানা থেকে ট্রাঞ্জিস্টারটা তুলে নিয়ে সে বোম টিপল। সঙ্গে সঙ্গে আকাশবাণী শিলিগুড়ির সংবাদ পাঠকের গলা ভেসে এল, মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেছেন কেন্দ্র যদি রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে তাহলে এরপরে তিনি জনসাধারণের সাহায্য চাইবেন।

প্রতিদিন যেসব বস্তাপচা সংবাদ পরিবেশিত হয় বিভিন্ন নেতার সংলাপ হিসেবে আজকের সংবাদে তার ব্যতিক্রম কিছু ছিল না।

চারজন উগ্রপন্থী সম্পর্কে আকাশবাণী নীরব রইল। অবশ্য কল্যাণ ভাবছিল যদি আগে থাকে, তখন ট্রানজিস্টার খোলা হয়নি। এবং তখনই নখের শব্দ পাওয়া গেল। কেউ বা কারা বাইরের দেওয়াল।
 
৩০.
পাখিরা যেমন শক্ত ফলের গায় নখের দাগ রেখে যায় তেমনি হয়তো ইয়ুথ হোস্টেলের একটা দেওয়ালে ক্রুদ্ধ প্রাণীদের আফসোস আঁকা হয়ে আছে। ওরা ভেবে পাচ্ছিল না এটা ঠিক কোন প্রাণী! রাত্রে চোখে দেখার উপায় ছিল না। চাপা গর্জনে ক্ষোভ গলছিল। এত ওপরে বাঘ আসতে পারে কিনা তা-ও ওরা বুঝতে পারেনি। সকাল যখন দশটা তখন থাবা বলে ক্লি আর যাই হোক প্রাণীগুলোর শরীর বিশাল নয়। ওয়াংদে পর্যন্ত যা বোঝাতে চাইল হিন্দী এবং নেপালিতে মিশিয়ে তাতে প্রাণীটির নাম আবিষ্কার করা মুশকিল হল। তবে ওয়াংদের মতে ব্যাপারটা কিছু ভয়াবহ নয়। মানুষের রক্তের গন্ধে ওদের উত্তেজনা হয় ঠিকই কিন্তু ধমক দিলে পালিয়েও যায়। সাহেবরা যদি কাল রাত্রে গলা তুলে ধমকাতেন তাহলে ওরা এত সাহস পেত না।

আজ সকালে ওয়াংদে তাদের ঘুম ভাঙিয়েছে চায়ের কাপ হাতে ধরিয়ে। আনন্দ বিস্ময়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে ছিল। একটি সরল হাসি সমস্ত অপরাধ স্বীকার করে মার্জনা প্রার্থনা করতে পারে তা ওয়াংদেকে না দেখলে বোধহয় কোনদিন জানা হত না। কাল রাত্রেই ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এই নিয়ে খামোকা ঝামেলা করার কোন মানে হয় না। লোকটা বেশি মদ খেয়ে নিশ্চয়ই অন্যায় করেছে, তাদের রাতের খাবার এবং জ্বালানী কাঠ এনে দেয়নি কিন্তু এখনও অনেকটা পথ সামনে পড়ে আছে। তবে আনন্দ তাকে সতর্ক করে দিল এরকম যেন আর না হয়।

সকাল দশটা অবশ্যই রওনা হবার পক্ষে উপযুক্ত সময় নয়। কিন্তু কাল রাত্রে ওই প্রাণীগুলোর থেমে যাওয়া এবং রাত্রের আকাশবাণীর শেষ খবর পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর যখন ঘুম এল তখন প্রায় মৃতদেহের মত পড়েছিল ওরা। এই কদিনের প্রতিনিয়ত মানসিক উত্তেজনা, শারীরিক পরিশ্রম এবং এখানকার শীতল আবহাওয়া ওদের সমস্ত সতর্কতা মুছে দিয়েছিল। এরকম ঘুম বোধহয় অনেককাল বাদে ওরা ঘুমিয়েছে। যদি ওয়াংদে না ডাকত তাহলে সকাল দশটাতেও রওনা হওয়া যেত না। তবু ওয়াংদে বলেছে যদি জোর পা চালানো যায় তাহলে ফালুটে পৌঁছবার আগে সন্ধ্যে নামবে না।

সকাল দশটাতেও আজ সান্দাকফু কুয়াশায় ঢাকা। সামনের পাহাড়গুলো অদৃশ্য, একফোঁটা রোদ নেই। ওপরের বাংলোগুলোর পাশ কাটিয়ে ওরা যখন নির্জনে চলে এল তখন কোন মানুষ চোখে পড়েনি। কিন্তু জিপটা এখনও আছে। সুদীপের খুব ইচ্ছে ছিল যাতে জিপের মালিক আর ফিরে যেতে পারে তার একটা ব্যবস্থা করা। কিন্তু আনন্দ আপত্তি করেছিল। এটা নিছকই ব্যক্তিহত্যা হবে। আর এই ঘটনাই পুলিশকে স্পষ্ট ইঙ্গিত দেবে তারা এখানে এসেছে। ওয়াংদেই সাক্ষী দেবে। গতরাত্রের শেষ খবরেও তাদের কথা কিছু বলেনি। তার মানে নিশ্চয়ই পুলিশ হাত গুটিয়ে নেয়নি। একজন মন্ত্রী মারা যাওয়ার পর ওরা তা করতেও পারে না। কিন্তু যেটা সত্যি সেটা হল তাদের নিয়ে কোন খবর তৈরি হচ্ছে না যা পরিবেশন করা যায়।

আকাশটা মাথার ওপর অনেকটা নেমে এসেছে, পায়ের তলার মাটি যেন অনেক উঁচুতে এইরকম একটা অনুভূতি হচ্ছিল হাঁটতে হাঁটতে। ওয়াংদে যাচ্ছে আগে আগে। তার পিঠে যে বোঝ সেটার দিকে তাকিয়ে কল্যাণের মনে হল সে মরে যেত এত উঁচুতে এই ওজন বইতে হলে। ওয়াংদের ঠিক পেছনে ছিল সুদীপ, তারপর কল্যাণ। জয়িতা আর আনন্দ হাঁটছিল শেষে, পাশাপাশি। আনন্দ বলল, আমরা খুব লাকি যে আজ ফালুটে কোন ট্রেকার যাচ্ছে না।

জয়িতা কোন কথা বলল না। যদিও চারপাশে গভীর কুয়াশা তবু তার খুব ভাল লাগছিল। গতকাল জিপে আসার সময় আর যাই হোক এইভাবে পাহাড়ের মধ্যে থাকা হয়নি। যদি আকাশ পরিষ্কার থাকত তাহলে নিশ্চয়ই আরও ভাল লাগত কিন্তু এই বা খারাপ কি! স্বপ্নের মধ্যে হেঁটে যাওয়া! মাঝে মাঝে সামনের বন্ধুরা মিলিয়ে যাচ্ছে কুয়াশায়। যদিও আনন্দের পরিকল্পনামত তারা ফিরে আসবে অবস্থা শান্ত হলেই, কিন্তু জয়িতার মনে হচ্ছিল এই পথে আর হাঁটা হবে না। হয়তো কোনকালেই কলকাতায় যাওয়া হবে না তাদের। অন্তত এই মুহূর্তে সেই কারণে তার কোন আফসোস নেই। কলকাতা তাকে কিছুই দেয়নি। ওর বয়সের নব্বইভাগ মেয়েই কোন না কোন উপায়ে জীবনটাকে ভাল লাগায়। ঈশ্বর তাকে যে শরীর দিয়েছেন তা কোন পুরুষকে বোধহয় কোনদিন আকর্ষণ করবে না। কিন্তু উলটো দিকে কেন হল না কিছু? সমস্ত শারীরিক অর্থে যখন সে একজন মেয়ে, তখন কোন পুরুষকে তার প্রেমিক হিসেবে পেতে ইচ্ছে হয়নি কেন? মাঝে মাঝে তাই নিজেকেই খুব দুর্বোধ্য লাগে জয়িতার।
 
এখন এই আকাশের মধ্যে হেঁটে যাওয়া চমৎকার লাগছিল। কাল রাত্রের পরে শীতের সঙ্গে তাদের প্রত্যেকের একটা সমঝোতা হয়ে গেছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত কোথাও অনাবৃত নেই। গ্লাভস পরার পর যে অস্বস্তিটা ছিল সেটাও এখন কেটে গেছে। জয়িতা সামনের দিকে তাকাল। কল্যাণ একা একা হাঁটছে। কাল রাত্রে ও সুদীপের সঙ্গে যে কাণ্ডটা করল সেটা নিয়ে আর কথা হয়নি। কিন্তু সুদীপ নিশ্চয়ই সহজে ভুলতে পারবে না। সুদীপের ওপর কল্যাণের একটা চাপা ঈর্ষা ছিল বলে অনুমান করত জয়িতা। অথচ ব্যাপারটার কোন প্রমাণ ছিল না। নিম্ন-মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্ট বলে সুদীপ এড়িয়ে যেত ওর অনেক কিছু। কিন্তু কাল কল্যাণের হঠাৎ কেন মনে হল সুদীপ পালিয়ে যেতে পারে? এত তাড়াতাড়ি যদি অবিশ্বাস ঢুকে যায় প্রত্যেকের মনে তাহলে বিপর্যয় আসতে বাধ্য। জয়িতা ভেবেছিল আনন্দ এই নিয়ে কথা বলবে। মাঝে মাঝে আনন্দটাও কেমন অচেনা হয়ে যায়। ও যেন ব্যাপারটা দ্যাখেইনি এমন ভাব করে আছে। কিন্তু আজ সকালেও তো কল্যাণ সুদীপের সঙ্গে সহজ গলায় কথা বলছে না। জয়িতা জোরে পা চালাল। রাস্তা সমতল নয়। মাঝে মাঝে ওপরে উঠতে রীতিমত হাঁপাতে হচ্ছে। জয়িতা কল্যাণের পাশে পৌঁছে হাসবার চেষ্টা করেই সামলে নিল। এখন তো মুখের বেশির ভাগ ঢাকা। হাসলে কেউ বুঝতেই পারবে না। কল্যাণ জয়িতার দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না। খানিকটা পথ পাশাপাশি হেঁটে জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, তোর কেমন লাগছে?

মহাপ্রস্থানের পথে যাচ্ছি। তুই দ্রৌপদী, একজন পাণ্ডব মিসিং। আমি, নকুল না সহদেব বুঝতে পারছি না। কোনদিন বেঁচে ফিরে আসব ভেবেছিস? নেভার! এই পাহাড়েই আমাদের জমে মরতে হবে। এসব বললে তো তোরা আমাকে দলবিরোধী বলবি! যত দোষ তো আমার। কল্যাণ কথা শেষ করে ভার মেশা ছিল হঠাৎ আলাপের পরামর্শ নহর মধ্যেই শিশু মুখ ফেরাল। শেষ শব্দগুলো বেশ ভার মেশা ছিল।

জয়িতা ওর কনুই-এ হাত রাখল, তুই নিজেকে হঠাৎ আলাদা করে ভাবছিস কেন?

ভাবব না? চমৎকার! যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে হলে আনন্দ সুদীপের পরামর্শ নিচ্ছে। অনেকসময় তো সুদীপ নিজেই আমাদের ওপর হুকুম চালাচ্ছে। আমি যে দলে আছি সেটা ওরা গ্রাহের মধ্যেই নিচ্ছে না। যেন আমার কোন ভূমিকাই থাকতে পারে না। এসব তোর চোখে পড়ে না, না?

সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলে তো মুশকিল হবে। ওরা তো আমাকেও কিছু জিজ্ঞাসা করে না।

তোর কথা আলাদা।

আলাদা কেন?

কল্যাণ জবাবটা দিতে গিয়েও থমকে গেল। জয়িতা জানত ও কি বলতে পারে। মনে মনে অত্যন্ত বিরক্ত হলেও সে প্রকাশ করল না। জবাবটার জন্যে চাপও দিল না। পশ্চিমবাংলার বেশির ভাগ মানুষের মনই কল্যাণের মানসিকতায় গড়া। এখনও ট্রামে বাসে উঠলে তারা বলে থাকে, ভিড় বাসে কেন যে মেয়েছেলে ওঠে! মেয়েছেলে শব্দটা শুনলেই শরীর গুলিয়ে ওঠে। শব্দটার সমস্ত শরীর জুড়ে অপমান।

সান্দাকফুতে সন্ধ্যেবেলায় যে চকচকে তুষার পড়েছিল সকাল দশটায় তার হদিস ছিল না পায়ের তলায়। কিন্তু আড়াই কিলোমিটার হাঁটার পর ওরা বরফ পেয়ে গেল। এর মধ্যেই বিশ্রামের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল চারজনের। বড় পাথরের আড়াল দেখে ওয়াংদে স্টোভ জ্বালাল। কল্যাণ বেঞ্চির মত পড়ে থাকা একটা পাথরে ধপ করে বসে পড়তেই সুদীপ বলল, বসিস না। বইতে পড়েছি পাহাড়ে ট্রেকিং-এর সময় বসলে আরও বেশি ক্লান্তি লাগে।

কল্যাণ কাঁধ নাচাল। তারপর জয়িতার দিকে তাকাল। এই তাকানো যে অর্থবহ তা বুঝতে অসুবিধে হল না জয়িতার। কিন্তু এসবে আমল না দিয়ে ও এগিয়ে গেল সামনে। এখন বরফের ওপর দিয়ে হাঁটতে হবে। আঃ দারুণ! ছোটবেলা থেকে কত ইংরেজি বই-এ এইরকম হাঁটার কথা সে পড়ে আসছে। সাইবেরিয়ার কনসেন্ট্রেসন ক্যাম্প থেকে একজন এর চেয়ে আরও ভয়াবহ বরফের মধ্যে দিয়ে কাটিয়েছিল একুশ দিন। সেই বর্ণনা তার ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। তার সামনে এখন যে কুয়াশায় ঢাকা বরফ পড়ে আছে তাকে দেখে অবশ্য খুব নিরীহ মনে হচ্ছে।
 
সে ফিরে আসতেই কল্যাণ বলল, এখান থেকে সাপ্লাই পেলে কলকাতায় সস্তায় আইসক্রিম বিক্রি করা যেত। প্রাকৃতিক আইস উইদ ক্রিম।

সুদীপ শুনে বলল, তোর কলকাতায় একটা ঘাসের দোকান খোলা উচিত ছিল।

সঙ্গে সঙ্গে কল্যাণের গলা চড়ল, আমি তোর সঙ্গে কথা বলছি না। কেউ গায়ে পড়ে আমাকে জ্ঞান দিলে আমি কিন্তু বেশিক্ষণ সহ্য করব না।

সুদীপ অত্যন্ত অবাক গলায় বলল, হোয়াটস্ দিস! আমি তোর সঙ্গে ঠাট্টা করতে পারব না?

না। তোর ঠাট্টা, তোর হুকুম, এসব আমি মানতে বাধ্য নই।

ও। সারাটা পথ কিন্তু তোর বোঝা আমিই বয়ে এলাম। ঠিক আছে, তোর যখন কোন কম্‌প্লেক্স কাজ করছে তখন আর কিছুই বলব না। কিন্তু তার আগে আমি জানতে চাই কমপ্লেক্সটা কি?

কল্যাণ কোন জবাব দিল না। সুদীপ এগিয়ে গেল ওর কাছে, কল্যাণ, আমার প্রশ্নের জবাব দে।

খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আনন্দ এবং কাছাকাছি জয়িতা ওদের দেখছিল। চট করে যে উত্তেজনাটা তৈরি হয়েছে তার জন্যে জয়িতা ভীত হয়ে পড়ল। সে আনন্দর দিকে তাকাতে আনন্দ নিষেধ করল ইঙ্গিতে কিছু না বলতে। কল্যাণ একপাশে মাথা ঘুরিয়ে বসে আছে। সুদীপ কিছুক্ষণ ওর সামনে দাঁড়াল। তারপর ডান হাত আলতো করে কল্যাণের কাঁধে রেখে বলল, সরি। তোকে যদি হার্ট করে থাকি তাহলে দুঃখিত। বলে এগিয়ে যাচ্ছিল সামনের দিকে উদ্দেশ্যহীন ভাবে। জয়িতা লক্ষ্য করল কল্যাণ তার বসার ভঙ্গি পালটাল না।

এইসময় ওয়াংদে ওদের চা দিয়ে গেল। ধোঁয়া উঠছে অথচ চুমুক দেবার পর মনে হল ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। নিজের মগে চুমুক দিয়ে ওয়াংদে বলল, আজ যদি ফালুটে পৌঁছাতে হয় তাহলে আর একটু জোরে পা চালাতে হবে। মনে হচ্ছে আজ রোদ উঠবে না এবং সন্ধ্যে নামবে আগেই। ও কথাগুলো বলল আনন্দকে। লোকটা নিজেই বুঝে নিয়েছে কার সঙ্গে কথা বলতে হবে।

ঘড়িতে যখন তিনটে তখন জয়িতার মনে হল আর এক পা-ও হাঁটতে পারবে না। ছেলেরা কেউ কিছু বলছিল না বটে কিন্তু একমাত্র সুদীপ ছাড়া বাকী দুজনও বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিল। এমন নয় ওরা সমস্তটা পথে বরফ পেয়েছে। কিন্তু চড়াই উত্রাই ক্রমাগত ভাঙতে ভাঙতে মনে হচ্ছিল বুকের ভেতর আর বাতাস নেই, থাই থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত প্রচণ্ড বেদনা ওঠানামা করছে। ওয়াংদে আর সুদীপ এগিয়ে গিয়েছিল। কুয়াশায় ওদের দেখা যাচ্ছে না। আনন্দ চিৎকার করতে সুদীপের নাম পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হল। কিন্তু ওপাশ থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। আনন্দ কল্যাণকে বলল, আমার গলায় লাগছে, তুই ডাক।

কল্যাণের অবস্থা তখন বেশ কাহিল। নাকের ডগায় কোন সাড়া নেই। দাঁড়িয়ে থাকতেও ওর কষ্ট হচ্ছিল। জয়িতা মুখের কাছে আনন্দর অনুকরণে দুটো হাত নিয়ে ডাকতে যাচ্ছিল কিন্তু কল্যাণকে এড়িয়ে হাত নেড়ে আনন্দ তাকে নিষেধ করল। কল্যাণ চিৎকার করল সামনের ঘন নীল কুয়াশার দিকে তাকিয়ে। কিন্তু সুদীপের নাম ধরে নয়। ওয়াংদের সাড়া পাওয়া গেল বেশ দূর থেকে। জয়িতা অবাক চোখে কল্যাণের দিকে তাকাল। এই সময়েও মানুষ কি করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তা বিস্ময়েরই ব্যাপার। আর মিনিট দুয়েক অপেক্ষার পর কুয়াশার আড়াল ভেদ করে ওয়াংদে বেরিয়ে এল, লোকটাকে একটুও ক্লান্ত বলে মনে হচ্ছে না। ওর পিঠের বোঝা যেন কিছুই নয়। আনন্দ তাকে জিজ্ঞাসা করল, এখান থেকে ফালুট পৌঁছাতে আর কতক্ষণ সময় লাগবে? সে বুঝে গিয়েছিল দূরত্ব সময় দিয়ে মাপলে তবু এদের কাছ থেকে একটা আন্দাজ পাওয়া যায়।

ওয়াংদে একটু চিন্তা করল। তারপর বলল, এইভাবে হাঁটলে আরও এক ঘণ্টা। কিন্তু মনে হচ্ছে ফালুটে যাওয়া আজ সম্ভব হবে না।

কথাগুলো একই সঙ্গে বিস্মিত এবং আনন্দিত করল আনন্দকে। নিজেদের অক্ষমতার কথা সে কিভাবে ওয়াংদেকে বলবে তাই ভাবছিল, কিন্তু ওয়াংদে সেটাই সহজ করে দিল। বরং সে একটু কৌতূহলী হবার ভান করে জিজ্ঞাসা করল, কেন? মাত্র তো এক ঘণ্টার পথ বলছ!

কল্যাণ এই সময় বলল, অসম্ভব। ইম্পসিবল। আমার পক্ষে আর এক পা-ও হাঁটা সম্ভব নয়। যদি যেতে চাস তো আমাকে ফেলে রেখে তারা চলে যা।

ওয়াংদে বলল, আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই মনে হচ্ছে অন্ধকার নেমে আসবে আজ। সাহেবরা খুব খারাপ সময় পছন্দ করেছেন এখানে আসার জুন্যে। তাও যদি আমরা সকাল আটটার মধ্যে বের হতে পারতাম তাহলে এতক্ষণ পৌঁছে যেতাম। তাছাড়া ওই সাহেব আজকে আর যেতে পারবেন না।

কোন্ সাহেব? ওয়াংদের কথাটা ধরতে পারল না আনন্দ।

যে সাহেব আমার সঙ্গে হাঁটছিলেন। পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন। জোর কপাল নইলে খাদে চলে যেত শরীর। পায়ে চোট লেগেছে। আমি এতক্ষণ সাহেবের পা ম্যাসেজ করছিলাম।
 
আনন্দ দেখল কল্যাণ এগিয়ে যাচ্ছে কুয়াশার মধ্যে। সুদীপের খবরটায় যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল সেটা আচমকা থিতিয়ে গেল। জয়িতাও কল্যাণের পেছনে হাঁটছিল। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল আর চলা সম্ভব নয় অথচ খবরটা শোনামাত্র শরীরের ক্লান্তি চাপা পড়ে গেল। কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হাঁটার সময় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। জয়িতা সতর্ক করার জন্যে বলল, কল্যাণ, বাঁ দিক ঘেঁষে হাঁট।

কল্যাণ কি বলল বোঝা গেল না। কিন্তু জয়িতা চিৎকার শুনতে পেল ওর। সুদীপের নাম ধরে তিনবার ডাকল কল্যাণ। অনেকগুলো সুদীপ ছড়িয়ে পড়েছে ততক্ষণে পাহাড়ে পাহাড়ে। সেটা মিলিয়ে গেলে সুদীপের গলা পাওয়া গেল। সেটা লক্ষ্য করে খানিকটা খাড়াই পথ ভাঙার পর ওরা সুদীপকে দেখতে পেল। রাস্তার পাশে একটা পাথরে হেলান দিয়ে বসে আছে। ওর দুটো পা সামনের দিকে ছড়ানো। কল্যাণ বাকি অংশটুকু কোন রকমে দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে?

খাদটা কেমন দেখা হল না। পড়ে যাচ্ছিলাম কিন্তু পড়লাম না। সুদীপ হাসল।

ইয়ার্কি রাখ তো! কোথায় লেগেছে তোর? কল্যাণ ওর পাশে হাঁটু মুড়ে বসল।

গোড়ালিতে। সিরিয়াস কিছু নয়। ভাঙলে তো মালুম হত।

তোকে আমি বিশ্বাস করি না। নিজেকে নিয়েও তুই ঠাট্টা করতে পারিস। উঠে দাঁড়া।

কেন?

আমি দেখতে চাই তোর পা কতটা জখম।

তুই দেখতে চাস? থ্যাঙ্কস। আমি বলছি তো গোড়ালিটাই একটু মচকেছে। ব্যান্ডেজ বাঁধলে ঠিক হয়ে যেত। কিন্তু এই ঠাণ্ডায় আমি পা বের করতে পারব না। নো, নেভার।

জয়িতা ওদের কথা শুনছিল। কল্যাণের এই উত্তাপ ওকে চমৎকৃত করছিল। কোন্ কল্যাণ সত্য এইটেই অবশ্য তার মাথায় ঢুকছিল না। কল্যাণ তার এক হাতে ততক্ষণে সুদীপকে দাঁড় করিয়েছে। ডান পায়ের ওপর ভর রেখে দাঁড়িয়েছে সুদীপ কল্যাণকে ধরে। বাঁ পা সে তুলে রেখেছে খানিকটা ওপরে। তারপর ধীরে ধীরে পায়ের পাতা মাটিতে রেখে চাপ দিল। ওর মুখের দিকে তাকাল জয়িতা অভ্যেসে। চোখ এবং নাক ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। গোড়ালি মাটিতে রাখতে গিয়েই সরিয়ে নিল সুদীপ। শব্দ করে হাসল, ভোগাবে বলে মনে হচ্ছে। লিডার কোথায়?

আনন্দ আর ওয়াংদে এসে পড়ল তখনই। আনন্দ সুদীপকে জিজ্ঞাসা করল, পড়লি কি করে?

পেছল ছিল, বুঝতে পারিনি। গোড়ালিটাকে একটু রেস্ট দেওয়া দরকার। সুদীপ পায়ের পাতা নামাল।

ব্যথা আছে?

চাপ দিলে লাগছে।

আনন্দ ওয়াংদেকে বলল, কি করা যায়? আমাদের এখানেই থাকতে হবে, তবু কোথায় টাঙাবে? ওয়ংদে মুখ ঘুরিয়ে যেন পাহাড়টাকে জরিপ করল। তারপর বোঝাগুলো নামিয়ে দ্রুতপায়ে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল।

জয়িতা আনন্দকে জিজ্ঞাসা করল, এখানে তাঁবু ফেলে থাকা যাবে? রাত্রে তো আরও ঠাণ্ডা বাড়বে।

সুদীপ হাসল, লাস্ট নাইট টুগেদার।

আনন্দ মাথা নাড়ল, আমি তো কিছু ভেবে পাচ্ছি না। এনিওয়ে আমি চাইছিলাম না ফালুটের পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে থাকতে। ওখানেও আমাদের টেন্ট ফেলতেই হত। আর সেটা ওয়াংদের কাছে যুক্তিপূর্ণ বলে নিশ্চয়ই মনে হত না। সুদীপের পায়ে চোট না লাগলেও এখানে থাকার জন্যে ওয়াংদেকে বলতেই হত।

ঠিক তখনই ওয়াংদে ফিরে এল প্রসন্ন মুখে। এসে জানাল পাশেই একটা চমৎকার থাকার ব্যবস্থা আছে। সাহেবরা ধীরে ধীরে উঠে গেলে সে মালপত্র নিয়ে যাবে। সকাল থেকে হাঁটার পথে ওরা দুটো গ্রামের পাশ কাটিয়ে এসেছে বটে কিন্তু এই নির্জন জায়গায় মনুষ্যবসতি আছে বলে কল্পনা করা যায় না। খবরটা কল্যাণকে খুশী করল। আর জয়িতা লক্ষ্য করল প্রাথমিক যে উত্তেজনা এবং উদ্বেগ কল্যাণকে সুদীপের কাছে ছুটিয়ে এনেছিল সেটা কেটে যাওয়ার পর ও আবার আগের মত শীতল হয়ে গিয়েছে সুদীপ সম্পর্কে।
 
জয়িতার কাঁধে হাত রেখে সুদীপ ওদের পেছন পেছন হাঁটছিল একটা পা আধা-ঝুলিয়ে, শুধু আঙুলের ডগায় যতটা ভার রাখা যায়। এতে ওর কষ্ট হচ্ছিল বেশ, গতিও কমে যাচ্ছিল। হঠাৎ সুদীপ বলল, তুই কাছে আসার পর যেন শরীরটা চাঙ্গা হয়ে গেল।

মানে? সুদীপের ভর রাখার জন্যেই জয়িতা তাকে প্রায় জড়িয়ে চলছিল।

মানুষের শরীরের উত্তাপ বোধহয় সবার সেরা। তোর মনে হচ্ছে না?

সুদীপের এই প্রশ্নটার কোন উত্তর দিতে পারল না জয়িতা। হঠাৎ ওর মনে হল এই মুহূর্তেও সে সুদীপের কাছে একটি মানুষমাত্র। মানুষী নয়। এবং কি আশ্চর্য, সে নিজেও তো মোটেই উত্তপ্ত হচ্ছে না।

ঠিক গুহা বলা চলে না, পাহাড়ের শরীরের কিছুটা অংশ ভেতরে ঢুকে থাকায় মাথার ওপর বেশ ছাদ হয়ে আছে, দুপাশে চমৎকার দেওয়াল। ওয়াংদে এটাকে আবিষ্কার করেছিল এর আগেই। অন্য শেরপাদের মুখ থেকে খবর পেয়ে আরও একবার সে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচবার জন্যে কয়েকজন ট্রেকারকে এখানে নিয়ে এসেছিল। মাথার ওপর জল পড়বে না, তিনদিক থেকে হু হু হাওয়া ছোবল মারবে না, এরকম জায়গায় এর চেয়ে আর কি কাম্য হতে পারে? শেষ পনেরো ফুট উঠতে সুদীপের কষ্ট হয়েছে বেশ। ওয়াংদেও হাত লাগিয়েছিল।

দিনের আলো নিবে গেছে বেশ কিছুটা আগেই। এর মধ্যে কিছুটা কায়দা করা হয়েছে বয়ে আনা তবু দুটো দিয়ে। একটাতে পাথরের ওপর বিছিয়ে বসেছে ওরা গা ছড়িয়ে। অন্যটা দিয়ে আনন্দ আর ওয়াংদে অনেক চেষ্টার পর সামনের খোলা দিকটা ঢাকতে পেরেছে। এখনও হাওয়া ওই দিক দিয়ে বইছে না, তেমন জোর বইলে ওটা কতক্ষণ থাকবে বলা মুশকিল। কিন্তু এর ফলেই জায়গাটা বেশ ঘর ঘর হয়ে গিয়েছে। এটা স্যাতসেঁতে গন্ধ থাকলেও খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ানোর চাইতে হাজারগুণ ভাল।

সমস্ত পাহাড় জুড়ে গাছ আছে, সুতরাং কাঠের অভাব নেই। কিন্তু ভিজে ভিজে সেই কাঠ আগুনকে আর তোয়াক্কা করছে না। আনন্দ তাদের আস্তানার বাইরে দাঁড়িয়ে ওয়ংদের উদ্যম লক্ষ্য করছিল। অনেক চেষ্টার পর বেচারা কিছু কাঠ থেকে ধোঁয়া বের করতে পেরেছে মাত্র। কিন্তু দুপাশে দুটো পাথর রেখে সে অন্য কটে আনা কাঠগুলোকে সেঁকে নিচ্ছে যেমন করে এখনও শিককাবাব বানায়। সেই প্রবচন, যেখানেই ধোঁয়া সেখানেই আগুন এক্ষেত্রে সত্যি কিনা সন্দেহ হচ্ছিল। কিন্তু লোকটার উদ্যম দেখে সত্যি অবাক হয়ে যাচ্ছিল আনন্দ। এতটা পথ হেঁটে এসেছে বোঝা কাঁধে চাপিয়ে, সবচেয়ে পরিশ্রান্ত হবার কথা ওরই। অথচ সামান্য ক টা টাকার জন্যে এখনও যে কাজ করে যাচ্ছে তাতে বিন্দুমাত্র আলস্য নেই।

কি তাড়াতাড়ি রাত হয়ে গেল, না?

আনন্দ মুখ ফিরিয়ে দেখল জয়িতা তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটা এমনিতেই বোগা, এখন যেন আরও রোগা দেখাচ্ছে অত গরম জামাকাপড়েও সেটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। আনন্দ ওর কাঁধে হাত রাখল, তোর খুব কষ্ট হচ্ছে, না? আসলে আমরা তো এই রকম পরিবেশে ঠিক অভ্যস্ত নই, তাই।

অভ্যস্ত হয়ে যাব ঠিক। ওয়াংদে কাঠ সেঁকছে এখনও?

গোটা রাত পড়ে আছে সামনে। ভেতরে কিরকম ঠাণ্ডা এখন?

একই রকম। শুধু হাওয়াটাই নেই। জয়িতা উত্তর দিয়ে চারপাশে তাকাল। শুধু কাঠ জ্বালানোর ছাড়া কোন শব্দ নেই, এমন নিস্তব্ধ পাহাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও ভয় করে। জয়িতার মনে হচ্ছিল বড় রকমের কিছু হবে বলেই এখন এই থম্ ধরা ভাব।

ওরা ভেতরে চলে এল। মোমবাতিটা স্থির হয়ে জ্বলছে পাথরের ওপরে। আর তাকে ঘিরে কিলবিল করছে অদ্ভুত সব পোকা। বোধহয় জীবনে প্রথমবার আলো দেখে বেরিয়ে এসেছে ফাটল থেকে। কল্যাণ তার বিছানায় সেঁধিয়ে পড়ে ছিল চুপচাপ। সুদীপ জুতো খুলে ফেলেছে। খুব সন্তর্পণে মোজা খোলার চেষ্টা করছিল, জয়িতা এগিয়ে গেল, তুই থাম, আমি খুলছি।

সুদীপ সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়ল পা এগিয়ে দিয়ে, সেবা পেতে আমার কোন আপত্তি নেই। কখনও পাইনি তো, তবে দেখি। খগেনবাবুর ছেলে করে দিস না।

খগেনবাবুর ছেলে জয়িতা অবাক হয়ে প্রশ্ন করতেই কল্যাণ সশব্দে হেসে উঠল। সেটা সংক্রামিত হল আনন্দতেও। জয়ি চা খেপে গিয়ে বলল, তুই আগে রহস্যটা পরিষ্কার কর, না হলে আমি হাত দেব না।

কল্যাণ বলল, ওঃ মাঝে মাঝে সুদীপটা–। শোন, লোকে বলে বাপের নাম খগেন করে দিস না। আর ও বলল খগেনবাবু ছেলে করে দিস না। অর্থাৎ এমন ব্যথা দিস না যা ওকে বাপের নাম ভুলিয়ে ছাড়বে। কথাটা অন্যভাবে শুনলাম বলে হাসি পেল।

বাট হোয়াই খগেন বাবু? তার নামটা কেন ব্যবহার করা হয়? জয়িতা ঠোঁট কামড়াল।

তা আমি জানি না ভাই। চিরকাল শুনে এসেছি ওই নাম। হয়তো লোকটা খুব গবেট ছিল।

সুদীপ বলল, কিংবা অত্যন্ত শয়তান।

জয়িতা মাথা নাড়ল, এটা কোন জোকই নয় যে অমন হাসতে হবে। আর তুই তো তোর বাবার নাম ভুলতেই চাইছিলি সুদীপ। বেশ ফুলেছে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top