What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected গর্ভধারিণী - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

দমদমের কাছে বাগডোগরাকে এয়ার পোর্ট বলে মনে হয় না। এমন কি নিরাপত্তা ব্যবস্থাও খুব হালকা। জয়িতাকে লক্ষ্য রেখে কল্যাণ প্লেন থেকে নেমে ছোট্ট বিল্ডিংটায় চলে এল। তার একটা হাত এখনও অকেজো, অন্যটায় মাল বইতে হবে। এখান থেকে শিলিগুড়ি কত দূর? এসব অঞ্চলে সে কখনও আসেনি। ঘড়িতে দুটো পনেরো। আনন্দদের ট্রেন নিউ জলপাইগুড়িতে পৌঁছবে চারটের পর। ওদের ওপর নির্দেশ আছে সোজা সিনক্লেয়ার নামের একটা হোটেলে গিয়ে উঠতে। কিন্তু ওদের বলতে আর যাকে বোঝাচ্ছে তিনি তো এখনও চেনার ভান করছেন না। মালপত্র খালাস করে কাঁধে স্ট্র্যাপ ঝোলানো যেহেতু এক হাতে সম্ভব নয় তাই ভারী হলেও হাতেই নিল কল্যাণ। তারপরেই জানল এখান থেকে একটা বাস সোজা ওই হোটেলটাতেই নিয়ে যায়। অনুসরণ করে সেই বাসটায় উঠে বসল সে। মোটামুটি ভরতি হলে বাসটা যখন ছাড়ল তখন জয়িতা নেই। এবার উদ্বিগ্ন হল কল্যাণ। সে শুনেছে রাগ করলে মেয়েরা নাকি অন্ধ হয়ে যায়। তখন কোন যুক্তি বা সম্পর্কের কথা খেয়ালেই রাখে না। সে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে যতটা দেখতে পেল তার মধ্যে জয়িতার অস্তিত্ব নেই। গুম হয়ে বসে রইল সে। সুন্দর পিচের রাস্তা দিয়ে বাস ছুটছে। দুপাশে এয়ারফোর্সের ক্যান্টনমেন্ট। সাইকেলে সৈনিকরা আসা যাওয়া করছে। হঠাৎ জয়িতাকে ছাপিয়ে কল্যাণের মাথায় অন্য চিন্তা প্রবল হল। এইসব তরুণ যারা এখানে য়ুনিফর্ম পরে সাইকেলে কর্তব্য করতে যাচ্ছে তারা কি শুধুই পেটের জন্য চাকরি করতে এসেছে না দেশের প্রতি ভালবাসাও কাজ করছে?

শিলিগুড়ি শহরে ঢোকার আগেই বাঁ দিকে হোটেলটা। সুন্দর সাজানো। দেখলেই বোঝা যায় দক্ষিণা কম হবে না। আনন্দরা যে টাকা দিয়েছিল তা ওরা ভাগ করে নিয়েছিল কিন্তু ভি. আই. পি. রোডের গেস্ট হাউসের টাকা কল্যাণই মিটিয়েছিল। এখন পকেটে পড়ে রয়েছে সামান্য এবং এখানকার ভাড়াটাও অজানা। বাস থেকে নেমে ইতস্তত করল কল্যাণ। তারপর ব্যাগটাকে বয়ে রিসেপশনের দিকে এগোতেই জয়িতাকে দেখতে পেল। খুব সহজ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে কাউন্টারের পাশে। ওকে দেখে যে কায়দায় হাই বলে হাত তুলল তাতে ঘাবড়ে না গিয়ে পারল না। যেন কতকাল পরে দেখা হয়েছে, সেই ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে বলল, ওঃ, শেষ পর্যন্ত তোমাকে দেখলাম। আমি ভাবছিলাম যদি তুমি না আসো ওই ফ্লাইটে। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে রিসেপশনের লোকটিকে বলল, ওয়েল! হি ইজ হিয়ার।

লোকটি তার শেখা হাসিটি হাসল। নিজেরা নয়, বেয়ারা তাদের ঘরে মালপত্র পৌঁছে দিলে জয়িতা বলল, বাঃ, তুই বেশ সাবালক হয়ে গেছিস তো!

বেয়ারা চলে গিয়েছিল। কল্যাণ বলল, এভরিথিং হ্যাজ লিমিট জয়িতা। তুই আমাকে অকারণে এভাবে অপমান করতে পারিস না। আমি ওদের কাছে সমস্ত ব্যাপারটা বলব।

জয়িতা হাসল, কি বলবি? কলকাতা থেকে পালাতে হচ্ছে বলে তোর আফসোস হচ্ছিল! কেন এই অ্যাকশনে জড়িয়ে পড়লি! তাই নিয়ে আমি তোকে ঠাট্টা করেছিলাম। তুই এত জোরে চেঁচিয়েছিলি যে পুলিশ আসতে পারত। তারপর তোর সঙ্গে আমি কথা বন্ধ করেছিলাম, এই তো?
 
কল্যাণ হতভম্ব হয়ে তাকাল। সে যে এতক্ষণ অভিমান এবং ঈর্ষা থেকে অসহায় হয়ে পড়েছিল এবং তার জন্যেই এক ধরনের ক্রোধ বড় হয়ে উঠছিল আচমকা সেটা গুটিয়ে গেল। কোনরকমে সে বলতে পারল, জয়িতা, আমি তোকে খুব মিস করছিলাম।

জয়িতা কাঁধ নাচাল। তারপর বলল, ঘণ্টাখানেক চোখ বন্ধ করে বিছানায় পড়ে থাক, দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। যেন কোথাও বেড়াতে এসেছে এমন ভঙ্গি করে সে বাথরুমে ঢুকে গেল। নরম বিছানায় বসে কল্যাণের শরীরে হঠাৎ কাঁপুনি এল। সে কি খুব ভীরু? খুব মেরুদণ্ডহীন? জয়িতার ভাষায় নাবালক? মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তদের যাবতীয় দোষ তার মধ্যে? কেন কলকাতা থেকে পালাতে গিয়ে তার মনে হল যা করেছে তার কোন মানে হয় না মানে কি সত্যিই হয়? আর করবে বলে যখন নেমেছিল, রাজী হয়েছিল, তখন করার পর তাই নিয়ে আফসোস কেন এল মনের মধ্যে? সেটা কি কাপুরুষতার জন্যে? আর এখানেই আনন্দ-সুদীপ-জয়িতার থেকে সে পিছিয়ে! কি অভিযোগ করবে সে জয়িতার বিরুদ্ধে? গেস্ট হাউস থেকে বের হবার পর কথা বলেনি, না চেনার ভান করেছে, একা হোটেলে চলে এসেছে? কিন্তু হোটলে তো এসেছে, আগে থেকে ঘর বুক করে রেখেছে। অভিযোগ টিকবে? সত্যি কি কারও বিরুদ্ধে তার অভিযোগ করার কিছু আছে? যদি কাউকে অভিযুক্ত করতেই হয় তাহলে–! মুখ তুলল কল্যাণ। আর তখনই আয়নায় নিজেকে দেখতে পেল। এই মুখ সে কখনও দ্যাখেনি।



নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে ওরা শুনতে পেল জলপাইগুড়ি থেকে যে ট্রেনটা এইমাত্র এসেছে সেটা শিলিগুড়ির জংশন স্টেশনে যাচ্ছে। শিলিগুড়িতে যেতে হলে মিনিবাস অথবা রিকশা ভরসা। এই ট্রেনটাকে সবসময় পাওয়া যায় না। কাঞ্চনজঙ্ঘা ঠিক সময়ে আসায় ছাড়ব-ছাড়ব ট্রেনটাকে দেখা যাচ্ছে। পুরোনো আমলের ইঞ্জিন, কামরা আরও খারাপ। তবে মিনিট কুড়ি পঁচিশের বেশি যাত্রা নয়, ওরা ওতেই উঠে বসল। সুদীপ এখন ফিট। সমস্ত ট্রেনে ওরা দুজন পাশাপাশি বসেনি। এখানেও বেশ কিছুটা দুরত্ব রেখে এক কামরায় বসল। এবং তখনই আলোচনা শুনতে পেল। রেডিওতে খবর হয়ে গেছে। বারংবার মন্ত্রীর মৃত্যুর খবরটা বলছে। রাজ্য মন্ত্রীসভার জরুরী মিটিং বসেছে আজ দুবার। মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকে সতর্ক করেছেন, অবিলম্বে হত্যাকারীদের ধরার জন্যে। প্রধানমন্ত্রী নার্কি মুখ্যমন্ত্রীকে টেলিফোন করে ব্যাপারটা জানতে চেয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর মতে, এটা কোন সুগঠিত রাজনৈতিক দলের কাজ নয়। চারজন বিপথগামী তরুণ এই কাণ্ড করে বেড়াচ্ছে। তার মতে বিকৃত রাজনৈতিক চিন্তার ফসল। এদের পেছনে কোন দল বা জনসাধারণের সমর্থন নেই। শুধুই ঘাতক ছাড়া কোন আখ্যা দেওয়া যায় না। দুপুরের খবরে বলা হয়েছে ডায়মন্ডহারবার থেকে আনন্দ নামে একটি যুবকের মাকে পুলিশ আরও জেরা করার জন্যে লালবাজারে নিয়ে এসেছে। ওই মহিলার স্বামী নকশালপন্থী ছিলেন। পুলিশের অনুমান চারজনের ওই দলের নেতা হল আনন্দ। মহিলাকে তার ছেলের হোস্টেলে যেতে দেখা গিয়েছে। পুলিশের ধারণা হত্যাকারীরা এখনও শহরে আছে। তাদের সম্ভাব্য আস্তানা খুঁজে বের করা হচ্ছে। জনসাধারণকে সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে যারা ওই রকম তিনটে ঘটনা ঘটিয়েছে এবং দুটো ঘটনা ঘটাবার পরও শহর ছেড়ে যায়নি তাদের সম্পর্কে সামান্য সংবাদও পুলিশকে জানাতে হবে। এরা অত্যন্ত বিপজ্জনক। অনুমান করা হচ্ছে সব সকমের ভারী অস্ত্র এদের কাছে আছে।

আনন্দর মুখের কোন পরিবর্তন হল না। মাকে ওরা লালবাজারে নিয়ে গিয়ে নিশ্চয়ই অত্যাচার করবে। এখান থেকে সে তার কোন প্রতিকারই করতে পারবে না। একমাত্র ধরা দেওয়া ছাড়া। কলকাতায় থাকলেও অবস্থার কোন হেরফের হত না। আর এ ব্যাপারে সহানুভূতি দেখানো সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করবেন মা নিজে। যে মানুষটা সারাজীবন কারও সহানুভূতির তোয়াক্কা না করে একা সংগ্রাম করে গেল তার এসবে কোন প্রতিক্রিয়া হবে না। তিনি স্বামীর কর্মকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, পুত্রের কাজের জন্যেও নিজেকে ছিবড়ে করতে হচ্ছে। কিন্তু আনন্দ নিজেকে অপরিবর্তিত রাখল। হঠাৎ সে শুনল সুদীপ তার পাশের লোককে বলছে, এসব নকশালরা করছে না তো!
 
লোকটা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করল, দূর! এসব করার হিম্মত কজনের আছে? পাবলিকলি বলা উচিত নয় কিন্তু ওদের কাজকে আমি সমর্থন করি। শালা, এদেশে আইনফাইন আন্দোলন করে কিছু হবে না। ওরা প্যারাডাইস পুড়িয়েছে ঠিক করেছে। বড়বাজারে বোমা ফেলার হিম্মত দেখিয়েছে জাল ওষুধের কারখানা ধ্বংস করে। কোন অন্যায় করেনি। নিজেদের স্বার্থে কিছু করেনি। আর মন্ত্রী-হত্যা? লোকটা সময় নিল একটু, এই হত্যাকাণ্ড অবশ্য বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে কিন্তু মন্ত্রীমশাই সুবোধ বালক ছিলেন না।

সুবোধ বালক কি মশাই! বহুৎ দুনম্বরি লোকছিল! পার্টি কি করে ওকে এতদিন সহ্য করেছিল তাই বিস্ময়ের ব্যাপার! স্বনামে বেনামে যা সম্পত্তি করেছে, সাতপুরুষ খেয়ে যাবে।

আর একজন বলল, ওটা পার্টির ব্যক্তিগত ব্যাপার। কোনরকম রাজনৈতিক শিক্ষা ছাড়া ধরে ধরে মানুষ খুন করলেই হল? কি না, পাবলিকের উপকার করতে চান! রবিনহুড। এরা বিপ্লবের শত্রু।

সঙ্গে সঙ্গে আর একজন চিৎকার করে উঠল, রাখুন মশাই বিপ্লব! ওই কথাটা শুনতে শুনতে কান পচে গেল। এদেশে বিপ্লব করবে কে? আপনারা? টাটা বিড়লাকে আদর করে ব্যবসা করতে ডাকছেন, এক লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের মানুষকে গরিব বলছেন, এয়ারকন্ডিশনড অফিস না হলে পাটির মিটিং করতে পারবেন না যারা তারাই বিপ্লব বিপ্লব করে চেঁচাবেন। লাস্ট লোক ছিলেন প্রয়োদ দাশগুপ্ত, তার পরে আর কেউ নেই। এ ছোকরাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য যাই থাক না কেন, এরা প্রমাণ করছে এদের মেরুদণ্ড আছে। দেশটা কেন্নোয় ভরে যায়নি।

তপ্ত আলোচনার মাঝখানে টাউন স্টেশন এল। সেখানে নেমে গেল বেশিরভাগ মানুষ। জংশন স্টেশনে এলে ওরা প্লাটফর্মে নামল। অযত্ন শব্দটা স্টেশনের সঙ্গে পোস্টারের মত সাঁটা। এমনকি টিকিট চেকার নেই টিকিট নেবার জন্যে। ওরা একটা তিন চাকার রিকশা নিল। সুদীপ প্রথম কথা বলল, মাসিমাকে অ্যারেস্ট করেছে বোধ হয়।

আনন্দ জবাব দিল, শুনলাম। কালকের কাগজ দেখলে বোঝা যাবে।

তোর কোন চিন্তা হচ্ছে না? সুদীপ আনন্দর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল।

হচ্ছে। একটি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করল আনন্দ।

দিল্লি হোটেলে ওরা একটা ঘর নিল। মধ্যবিত্তদের হোটেল। খাতায় উলটোপালটা নামধাম লিখে ঘরে ঢুকে সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, এখনই বের হবি?

আনন্দ মাথা নাড়ল, না। সন্ধ্যে হোক তারপর। ওরা দুজন ঠিকঠাক এলে হয়।

সুদীপ বলল, কল্যাণটাকে নিয়ে কোন চিন্তা নেই। ওর মধ্যে টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত ভালমানুষী আছে যেটা ক্যামোফ্লেজ করবে। কিন্তু জয়িতার চেহারার বর্ণনা পেলে ওকে লোকেট করতে একটা হাবা কনস্টেবলেরও অসুবিধে হবে না।

আনন্দ বলল, চিন্তা করে কোন লাভ নেই। ফ্রেস হয়ে নে, তোর সঙ্গে আলোচনা আছে।

সুদীপ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, একবার ওদের হোটেলে টেলিফোন করবি?

না। সন্ধ্যের পর গেলেই ভাল। তুই যাবি?

আপত্তি নেই। তুই যাবি না?
 
দুজনে একসঙ্গে ওদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়াটা ঠিক হবে না। খোলাখুলি বলছি, ওরা যদি কলকাতায় ধরা পড়ে থাকে তাহলে আমাদের পক্ষে এই শহরে থাকাটাই বিপজ্জনক। চাপের মুখে কল্যাণ কতটা স্থির থাকবে বলা মুশকিল। আমিই ওদের হোটেলে উঠতে বলেছি, শেষ মুহর্তে পুলিশ আমাদের জন্যে সেখানে অপেক্ষা করতে পারে। এক্ষেত্রে তোর যদি যেতে আপত্তি থাকে তাহলে। আনন্দ কথাটা শেষ করল না।

আগেই বলেছি আপত্তি নেই। সুদীপ উঠে পড়ল। স্নান করা দরকার। সমস্ত শরীর বড় নোংরা হয়ে রয়েছে। গায়ে জল না দেওয়া পর্যন্ত স্বস্তি পাওয়া যাবে না।

সন্ধ্যের পর আনন্দ আর সুদীপ একসঙ্গে বের হল। আনন্দ গেল রকেট বাস স্টেশনের কাছে। কাল খুব ভোরে একটা জিপ ভাড়া করতে হবে। যদি অন্ধকার থাকতেই বেরিয়ে পড়া যায় তাহলেও ঘণ্টা সাড়ে তিন-চার লাগবে। সুদীপের সঙ্গে কথা হল যে কোন অবস্থাতেই ও রাত নটায় হোটেলে ফিরে আসবে। সময়টা অতিক্রান্ত হলে আনন্দ নিজের মত সিদ্ধান্ত নেবে। সুদীপ একটা রিকশা নিল। মনে হল এদিকটা যেহেতু শহরের প্রান্ত তাই ব্যাপক হারে জনবসতি গড়ে ওঠেনি। নেপালী-পাঞ্জাবী একটু বেশি চোখে পড়ছিল। শহর থেকে বেরিয়ে ডানদিকে ঘুরতেই হোটেলটা দেখতে পেল সুদীপ। রিকশা ছেড়ে দিয়ে সে পায়ে পায়ে হোটেলে ঢুকতেই জয়িতাকে দেখতে পেল। এ মেয়ে জয়িতা না হয়ে যায় না। এখন রাত। বাতাসে গরম ভাবটা নেই। হোটেলের সামনেও লনে টিমটিমে আলো জ্বলছে। সেই লনে চুপচাপ পায়চারি করছে জয়িতা। একা একা। সুদীপের বিরক্তি হল। মেয়েটা গর্দভ নাকি! এইভাবে লনে ঘুরে ঘুরে নিজেকে পাঁচজনের সামনে তুলে ধরছে।

সুদীপ জয়িতার কাছে এগোল না। সে দূর থেকে জয়িতাকে লক্ষ্য করতে লাগল। মাঝে মাঝে গাড়ি ঢুকছে এবং বেরুচ্ছে। হোটলের বাইরেটায় আপাতত কোন চাঞ্চল্য নেই। বোধ হয় কিছুটা ক্লান্তি অনুভব করায় জয়িতা সিঁড়ি ভেঙে বারান্দার একটা চেয়ারে বসল। আর ঠিক তখনই ভেতর থেকে একটা লোক বেরিয়ে এল। ভাল স্বাস্থ্য, কাঁধদুটো বেশ চওড়া, সিগারেট খেতে খেতে হোটেল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে অলস ভঙ্গিতে একবার জয়িতার দিকে তাকাল। তারপর সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে গাড়িতে উঠতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। সুদীপ লোকটার এই পরিবর্তন লক্ষ্য করল। দরজাটা আবার বন্ধ করে লোকটা ফিরে দাঁড়াল। সেখানে থেকেও জয়িতাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যদিও আলোটায় তেমন তেজ নেই তবু বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। কিন্তু লোকটা যদি শুধু মেয়ে দেখবার বাসনায় দাঁড়ায় তাহলে বিশ্বাসযোগ্য হবে না। যে ধরনের নারী শরীরের দিকে একবার তাকালে পুরুষমানুষ মাছির মত আটকে যায় জয়িতা তা থেকে অনেক দূরে। ধীরে ধীরে লোকটা আবার হোটেলের সিড়ি ভাঙল। একটু ইতস্তত করে সোজা জয়িতার সামনে দাঁড়িয়ে লোকটা হাসল। জয়িতা যে একটু অবাক হয়েছে বোঝা গেল। লোকটা হেসে হেসে কথা বলছে। জয়িতা বারংবার মাথা নাড়ছে। হাসছে সেও। তারপর লোকটা চটপটে পায়ে ফিরে গেল তার গাড়ির কাছে। গাড়িটা যখন গেট পেরিয়ে সুদীপকে অন্ধকারে রেখে বেরিয়ে যাচ্ছে তখন খুব কাছাকাছি স্পষ্ট দেখতে পেল সে। এবং তৎক্ষণাৎ মনে হল এই লোকটা পুলিশ না হয়ে যায় না। ওই চোয়াল ওই শারীরিক গঠন পুলিশদেরই হয়। গাড়ির নম্বরটা দেখে কিছুই মনে হচ্ছে না। সুদীপ দেখল জয়িতা উঠে ভেতরদিকে এগোচ্ছে। সে আর দেরি করল না। যতটা সম্ভব দৌড়ে দূরত্ব কমিয়ে হোটলে ঢুকে পড়ল। রিসেপশনের লোকটা মাথা নিচু করে হিসাব করছি। একটা দারোয়ান এসে সিঁড়ির নিচে দাঁড়াল। সুদীপ গতি কমিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গি করে হাঁটতে লাগল। জয়িতাকে দোতলার সিঁড়ির শেষ প্রান্তে দেখা যাচ্ছে। কেউ তাকে কিছু বলল না বোধ হয় তার সহজ অভিব্যক্তির জন্যেই। ডানদিকের একটা ঘরের দরজা খুলে একবার পেছন ফিরতেই জয়িতার মুখ উজ্জ্বল হল। সুদীপ ইশারায় তাকে ভেতরে ঢুকতে বললে জয়িতা মুখের হাসিটা মুছল। ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে সুদীপ দেখল কল্যাণ শুয়ে আছে। ওকে দেখেই সে নিজের হাত বাঁচিয়ে উঠে বসল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, সব ঠিক আছে?

ঠিক ছিল। কিন্তু মনে হলে বেঠিক শুরু হল। তুই একা একা লনে কি করছিলি?

সুদীপের প্রশ্নটায় জয়িতার ঠোঁটে হাসি ফুটল, হাওয়া খাচ্চিলাম।

ইউ হ্যাভ ইনভাইটেড বাম্বু। লোকটা তোকে কি জিজ্ঞাসা করছিল?

কোন্ লোকটা?

উঃ, একটু আগে যার সঙ্গে তুই কথা বলছিলি!

ওঃ! ভদ্রলোক বললেন আমাকে ওর খুব চেনা-চেনা লাগছে। আমি কি বাই এনি চান্স শিলং-এ থাকতাম! আমি না বলতে উনি বললেন, দুঃখিত আপনাদের চেহারায় ভীষণ মিল। তখন উনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার নামটা জানতে পারি? আমি বললাম ইটস অ্যান ওন্ড ট্রিক। আপনি সোজাসুজি জানতে চাইলে পারতেন। শোনার পর চলে গেলেন। দ্যাটস্ অল। জয়িতা দুটো হাত নেড়ে কথা শেষ করল।

সুদীপ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল, প্যাক আপ। তোদের এখনই হোটেল ছাড়তে হবে। আমার বিশ্বাস লোকটা পুলিশ। তোকে দেখার পর ওর ভাবভঙ্গি দেখে আর যাই হোক কোন রোমিওকে আমার মনে পড়েনি। হি ইজ পুলিশম্যান। আই অ্যাম সিওর, আধঘণ্টার মধ্যে এখানে পুলিশ ফোর্স এসে যাবে। কুইক কুইক।

কল্যাণ ততক্ষণে তার ব্যাগ তুলে নিয়েছে একহাতে, উনি আমার সঙ্গে ঝগড়া করে বাইরে গেলেন হাওয়া খেতে। একেই বলে যেচে বাঁশ নেওয়া।

আমি তোর সঙ্গে ঝগড়া করিনি কল্যাণ। তোর কমপ্লেক্স থেকে এসব বলছিস।

ওঃ স্টপ ইট! বলছি সময় নেই। সুদীপ জয়িতাকে থামাল, তারপর হাত লাগাল ওদের জিনিসপত্র গুছিয়ে দেবার জন্যে। তৈরি হয়ে জয়িতা বলল, হোটেলকে কি বলব? হঠাৎ কেন ছেড়ে চলে যাচ্ছি? আমরা মাত্র কয়েক ঘণ্টা এখানে এসেছি।

আমরা কতক্ষণ হোটেলে থাকব সেটা আমাদের ইচ্ছে। একদিনের টাকা ওদের দিয়ে দে। লেটস গো। কল্যাণ তোর ব্যাগটা আমাকে দে। সুদীপ হাত বাড়াল।

কল্যাণ আপত্তি করল, আমিই নিতে পারছিলাম। সুদীপ আপত্তি শুনল না।
 
রিসেপশনের লোকটাকে জয়িতা সুন্দর বুঝিয়ে দিল। ওর ভাই খবর পেয়ে বাড়িতে নিয়ে যেতে এসেছে। কিছুতেই হোটেলে থাকতে দিতে রাজি নয়। সুতরাং তাদের ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। একদিনের ভাড়া মিটিয়ে দিল সে। কল্যাণ দেখল টাকাটা কম নয়। বাইরে বেরিয়ে সে বলল, তোর জন্যে ঝামেলা হল। বেশ আরামদায়ক ঘর ছিল।

যেহেতু কেউ কোন কথা বলল না তাই শব্দগুলোকে বড্ড ফাঁকা শোনাল। ওরা বাইরে কোন রিকশা পেল না। অতএব হাঁটা ছাড়া কোন উপায় নেই। খানিক পরে দুপাশে দোকান রেখে হাঁটছিল ওরা। এটাই একমাত্র সড়ক। সুদীপের খেয়াল হল এইভাবে হাঁটা ঠিক হচ্ছে না। পুলিশ নিশ্চয়ই এই পথেই হোটলে আসবে। সেক্ষেত্রে সামনাসামনি পড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। তাছাড়া চারজন একসঙ্গে থাকাও উচিত নয়। নিজেদের হোটেলে এদের নিয়ে যেতে সাহস হল না ওর। পুলিশ হোটলে গিয়ে জানতে পারবে এরা হোটল ছেড়ে গেছে। আর সময় নষ্ট করবে না ওরা। সন্দেহটা সত্যি বোঝা মাত্র পুলিশ ব্যাপক তল্লাসি চালাবে। কোন হোটেল বাদ দেবে না। সেক্ষেত্রে আনন্দ এবং তারও বিপদে পড়ার সম্ভাবনা। সুদীপ চটপট সিদ্ধান্ত নিল, তোরা রাত্রের খাওয়া খেয়েছিস?

জয়িতা উত্তর দিল, না। এই সন্ধ্যেবেলায় কি কেউ রাতের খাওয়া খায়?

বাঁ দিকে একটা চাইনিজ খাবারের দোকান নজরে পড়েছিল। সেটা দেখিয়ে সুদীপ বলল, তোরা ওখানে গিয়ে টিপিক্যাল খাবারের অর্ডার দিবি যাতে সার্ভ করতে বেশ সময় নেয়। আমি আর আনন্দ না আসা পর্যন্ত এখানেই অপেক্ষা করবি।

ওরা চাইনিজ রেস্টুরেন্টের দিকে এগিয়ে যেতে সুদীপ পা বাড়াল। মিনিট পাঁচেক লাগল তার হোটলে পৌঁছতে। আনন্দ তখনও ফেরেনি। হোটেলের ম্যানেজারকে সে সেই মিথ্যেটাই বলল যা জয়িতা ওর রিসেপশনে বলেছিল। টাকাপয়সা মিটিয়ে সে আবার রিকশটা নিয়ে শহরের দিকে যেতেই দেখতে পেল তিনটে পুলিশের গাড়ি হর্ন বাজাতে বাজাতে শহর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসছে। তিনটেতেই পুলিশ ভর্তি। আর সময় নেই। সুদীপের মনে হল ঈশরটিশর না থাকলেও ভাগ্য বলে একটা ব্যাপার আছে।

রকেট বাস স্টেশনের সামনে বেজায় ভিড়। কলকাতার অনন্য রকেট বাস ছাড়ছে। সুদীপ কলকাতা শটা পড়তে পারল। আর তখনই বুকের মধ্যে সামান্য নড়াচড়া হল তার। এখানে আনন্দকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। দাঁড়িয়ে থাকা একটা জিপকে দেখে তার ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করল, দার্জিলিং যাবে কিনা।

লোকটা মাথা নাড়ল। বলল, কাল সকাল সাতটায় যেতে পারে। তারপর হেসে বলল, আপনি এখন যেতে চাইছেন আর একজন এসেছিল চারটের সময় যাবে বলে। অত ব্যাপার হচ্ছে আজ।

প্রায় মিনিট পনেরো ঘোরার পর একটা মিষ্টির দোকানের সামনে আনন্দকে দেখতে পেল। একটি নেপালী ছেলের সঙ্গে কথা বলছে। সুদীপ কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার? এনি প্রব্লেম?

আনন্দ কাঁধ ঝাঁকাল, কেউ ভোরে যেতে রাজি হচ্ছে না। সকাল ছটায় বেরুতে হবে।

এখন কেউ যাবে? সুদীপ প্রশ্ন করল।

এখন? এখন কেন? গোলমাল হয়েছে? সুদীপের দিকে তাকাল আনন্দ।

পরে বলছি। আগে চেষ্টা কর এখন যদি কেউ যায়।

নেপালী ছেলেটি কথা শুনছিল। সে বলল, এখন যদি দার্জিলিং যান তো বীরবাহাদুরের গাড়িতে যেতে পারেন। ওকে কাল ভোরে টাইগার হিলে প্যাসেঞ্জার নিয়ে যেতে হবে দার্জিলিং থেকে। কিন্তু সকাল ছটার আগে কেউ যাবে না।

সুদীপ জবাব দিল, তুমি বীরবাহাদুরকে খবর দাও। ভোরে যেতে না পারলে আমরা এখনই যাব। কথাটা শোনামাত্র ছেলেটা লাফিয়ে ছুটে গেল।

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার? ও এতক্ষণ আমাকে জপাচ্ছিল যাতে বীরবাহাদুরের গাড়িটা নিয়ে এখনই রওনা হই। রাত্রে পাহাড়ে ওঠায় রিস্ক অনেক বলে আমি রাজি হইনি। কল্যাণরা কি শিড়িগুড়িতে আসতে পারেনি?

পেরেছে। সুদীপ মাথা নাড়ল। তারপর সংক্ষেপে ঘটনাটা জানাল। এখন পুলিশ হোটেলে ছুটেছে জেনে ওর চোয়াল শক্ত হল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, কল্যাণ আর জয়িতার মধ্যে কি নিয়ে লাগল?

কমপ্লেক্স। অন্তত জয়িতা বলেছে তাই। সুদীপ কথা শেষ করা মাত্র একটা ল্যান্ডরোভার সামনে এসে দাঁড়াল। নেপালী ছেলেটা বলল, দোশো লাগেগা।

আনন্দ সুদীপের দিকে তাকাল। সুদীপ বলল, রাজি হয়ে যা।

হোটেল থেকে মালপাত্র গাড়িতে তুলে নিয়ে ওরা সেই চাইনিজ রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়াতেই দেখল পুলিশের জিপগুলো শহরে ফিরে যাচ্ছে। সুদীপ গিয়েছিল ওদের ডেকে আনতে। বীরবাহাদুর নামের লোকটার চেহারা প্রায় পাখির মত। আনন্দ তাকে জিজ্ঞাসা করল, এত রাত্রে পাহাড়ের রাস্তায় কোন ভয় নেই?

বীরবাহাদুর বলল, ভয় আছে বলেই তো রাত্রে কেউ দার্জিলিং-এ যায় না। আমি না গেলে মালিক ফাঁসিয়ে দেবে বলেই যাচ্ছি। তবে আমি যতক্ষণ স্টিয়ারিং-এ আছি ততক্ষণ আপনাদের কোন ভয় নেই।

নেপালী ছেলেটা ড্রাইভারের পেছনে বসে আছে। আনন্দ একটা কথা ভেবে আশ্বস্ত হল, শিলিগুড়িতে কেউ নেই যে জানাবে তারা আজ রাত্রে দার্জিলিঙ-এ যাচ্ছে। অবশ্য দার্জিলিঙ তাদের গন্তব্যস্থল নয়। ম্যাপ অনুযায়ী তাদের ঘুম থেকে ঘুরে যাওয়ার কথা। এই সময় সুদীপ ওদের নিয়ে ফিরে এল। গাড়িতে উঠে কল্যাণ প্রথম অভিযোগ করল, সবে খাবার সার্ভ করেছে এই সময় সুদীপটা টেনে আনল। পেটে এখন ছুঁচোয় ভন মারছে।


সুদীপ হাসল, এখন চিকেন চাউমেন খেতে গেলে বাকি জীবন জেলের লপসি খেতে হত।

রাত্রের অন্ধকারে শিলিগুড়ি থেকে ল্যাভরোভারটা ছুটে যাচ্ছিল শুকনার দিকে।
 
২৭.
শুকনা পর্যন্ত গাড়ি ছুটেছিল জেট-এর গতিতে। রাস্তা ফাঁকা, দুপাশে চাবাগান, সন্ধ্যে পার হয়ে যাওয়ায় চারধারের নিঃসাড় নির্জনতা অনন্তে ছড়ানো। সুদীপ বসেছিল কল্যাণের সঙ্গে ড্রাইভারের পাশে, ওরা দুজন পেছনে। যেতে যেতে সুদীপ প্রথম মন্তব্য করল, ফ্যান্টাস্টিক!

আনন্দ বারংবার পেছনে তাকাচ্ছিল। কোন দ্রুতগতির হেডলাইট এখনও দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য যদি পুলিশ সামান্য আঁচ করতে পারে তাহলে অয়ারলেসে সামনের যে কোন পুলিশ স্টেশনকে জানিয়ে দিলেই হয়ে গেল। পথ একটাই। নির্দিষ্ট এলাকায় পৌঁছাতে গেলে এই পথেই যেতে হবে। সে চাপা গলায় একটু বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে বলল, তোর হাওয়া খাওয়ার জন্যে হোটেলের বাইরে আসার কি দরকার ছিল! এই সব ছেলেমানুষী কি রকম বিপদ ডেকে আনে দ্যাখ?

অন্ধকার ছিল বলে কেউ কারও মুখ দেখতে পাচ্ছে না। তবু জয়িতা আনন্দকে দেখার চেষ্টা করল, আই অ্যাম সরি। আসলে কল্যাণটা মাঝে মাঝে এমন বোর করে! স্টিল আই অ্যাম সরি।

আনন্দ মুখ ঘোরাল, আমি জানি না সামনে কি আছে!

কল্যাণ খোঁচাটা গায়ে মাখবে না বলে ঠিক করল, তুই রুটটা চেঞ্জ করতে পারিস না?

আনন্দ জবাব দিল, পাহাড়ের সঙ্গে চালাকি করে কোন লাভ নেই।

সুদীপ এবার বলল, আমার ওপর ছেড়ে দে। তারপর হিন্দিতে ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করল, আপনার বাড়ি কি দার্জিলিং শহরেই?

ড্রাইভার মাথা নাড়ল, আপনি বাংলায় বলুন, আমরা বাংলা বুঝতে পারি।

একটু অস্বস্তি হল সুদীপের, তারপর বলল, সরি, আমি বুঝতে পারিনি।

ড্রাইভার রাস্তার দিকে চোখ রেখে বলল, হ্যাঁ, আমার বাড়ি দার্জিলিং-এ।

এখন ওয়েদার কি রকম?

ঠিকই আছে। লাক থাকলে টাইগার হিলে সানরাইজ দেখতে পাবেন।

ড্রাইভারের সঙ্গী ছোকরাটা শিস দিচ্ছিল। আনন্দ ঘড়ি দেখল। শুকনা ছাড়িয়ে যাওয়ার পর মনে হল পৃথিবীতে কোথাও মানুষ নেই। এক জমাট অন্ধকার চারপাশে দেওয়াল তুলে দাঁড়িয়ে। সুদীপ ড্রাইভারের সঙ্গে আগবাড়িয়ে ভাব জমাতে গিয়ে এখন ঠাণ্ডা হয়ে বসে আছে। ওদের একটু আগের সংলাপ লোকটা কতটা শুনেছে অথবা শুনে কি বুঝেছে তা কে জানে! কপালে যা আছে তা হবে। এখন আর পিছিয়ে যাওয়ার পথ নেই। অসঙ্গত কিছু করলে এই ড্রাইভারই হয়তো পুলিশকে জানিয়ে দেবে তাদের কথা।

ধীরে ধীরে গাড়ি ওপরে উঠছে। হঠাৎ বাঁদিকে তাকাতেই অজস্র আলোর মালা চোখে পড়ল। যেন হীরে জ্বলছে দূরে পৃথিবীর গায়ে। সুদীপ বেশ উত্তেজিত হয়ে আবার বলল, ফান্টাস্টিক! শিলিগুড়ি, না?

ড্রাইভার বলল, হ্যাঁ।

শুধু ওইটুকুই। চোখের আড়ালে চলে গেলে গাড়ির হেডলাইট ছাড়া কোন জীবনের অস্তিত্ব নেই। এবং এই রাত্রে ড্রাইভার যে গাড়িতে স্বচ্ছন্দ হয়ে গাড়ি চালাচ্ছে তা ওদের মোটেই কাম্য নয়। কিন্তু লোকটা প্রতিটি বাঁক নেওয়ার আগেও যেন গতি কমানোর চেষ্টা করছে না। আনন্দ বলল, বাক ঘোরার আগে হর্ন দেওয়ার নিয়ম নয়? ওপাশ থেকে যদি গাড়ি আসে তাহলে টের পাবে না।


দিনের নিয়ম রাত্রে চলে না। ওপাশ থেকে খুব জরুরী, মানে আমাদের মত না হলে, গাড়ি নামবে না। আর কোন গাড়ি যদি আসত তাহলে বহুদূর থেকেই হেডলাইটের আলো দেখতে পেত। এখন তো গাড়ি চালানো আরাম। কোন রিস্ক নেই। একটু পরে যখন কুয়াশা নামবে তখনই ঝামেলা। ড্রাইভারের গলা এখন বেশ স্বাভাবিক।

তিনধারিয়াতেও যখন কেউ পথ আটকাল না তখন মনের চাপ কমল। এবার একটু ঠাণ্ডা লাগছে। ওরা প্রত্যেকেই ফুলসিভ পরে নিতে গিয়ে কল্যাণকে নিয়ে ঝামেলায় পড়ল। ওর প্লাস্টার করা হাতে সোয়েটার ঢুকবে না। আনন্দ একটা চাদর জয়িতার দিকে এগিয়ে দিল, এটা দিয়ে ওকে ভাল করে মুড়ে দে।

বিরক্ত হয়ে কল্যাণ বলল, এই ল্যাঠাটাকে সরাতে হবে এবার। আমার হাত ঠিক হয়ে গিয়েছে। কোন পেন যখন ফিল করি না, তখন অসুবিধে রেখে লাভ কি!

কথাটার জবাবে কিছুই বলল না কেউ। জয়িতা চাদরটা খুলে বলল, একটু হাত আলগা কর। চাদর মোড়া হয়ে গেলে কল্যাণ হাসল। জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, হঠাৎ কি হল?

কল্যাণ বলল, ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল। শীতকালে মা এইভাবে আমাকে আলোয়ানে মুড়ে দিত। খুব বাচ্চা ছিলাম তখন।

জয়িতা মন্তব্য করল, তোর শৈশবকাল তো এখনও চলছে।

পৌনে দুঘণ্টায় কার্শিয়াং এসে গেল।

ড্রাইভার গাড়িটাকে পার্ক করে বলল, পনেরো মিনিটের জন্যে ডিনার ব্রেক। ইচ্ছে হলে খেয়ে আসতে পারেন।

সুদীপ লাফিয়ে নামল। নেমে বলল, আঃ!

আনন্দ বলল, সবার একসঙ্গে খেতে যাওয়া উচিত হবে না। ব্যাগগুলো রয়েছে। তোরা যা, খেয়ে আয়।

জয়িতা বলল, সবার যাওয়ার কি দরকার? সুদীপ গিয়ে কিছু নিয়ে আসুক। মিনিট দুয়েক বাদে সুদীপ ঘুরে এসে বলল, হোটেল থেকে খাবার দিয়ে যাচ্ছে গাড়িতে। এখানে এত তাড়াতাড়ি সব দোকান বন্ধ হয়ে যায় কে জানত!

আনন্দ তাকিয়ে দেখে নিল চারপাশে। ড্রাইভার এবং ছোকরাটা ধারেকাছে নেই। সে বলল, আমরা দার্জিলিং-এ যাচ্ছি না।

কল্যাণ প্রশ্ন করল, তাহলে রাত্রে থাকব কোথায়?

ঘুম-এ। আনন্দ বলল, দার্জিলিং-এ যাওয়াটা রিস্কি হয়ে যাবে। বারবার কপাল পরিষ্কার নাও হতে পারে। সেখানকার হোটেলগুলোতে পুলিশ এর মধ্যে রুটিন ইনস্ট্রাকশন পাঠাতে পারে। তাছাড়া আমরা যেখানে যেতে চাইছি তার রুট ঘুম থেকেই। যদি এই জিপটা সুখিয়াপোখরি কিংবা মানেভঞ্জন পর্যন্ত পৌঁছে দিত!

সুদীপ বলল, ড্রাইভারটাকে রিকোয়েস্ট করব?

কোন লাভ হবে না মনে হচ্ছে। লোকটা এত রাত্রে উলটো পথে যাবে না। আর ওর কথাবার্তা শুনে মনে হয় ওকে জানিয়ে দেওয়া উচিত নয় আমরা কোথায় যাচ্ছি।

জয়িতা চুপচাপ শুনছিল। এবার বলল, ঘুম-এ নামবি কি বলে?

আনন্দ বলল, সেটা কোন প্রব্লেম নয়। বলব টাইগার হিলে সানরাইজ দেখে কাল দার্জিলিং-এ যাব। এখন দার্জিলিং-এ গিয়ে হোটেলে উঠতে না উঠতেই আবার বের হতে হবে। মিছিমিছি কষ্ট করে কি লাভ!

দ্যাখ! জয়িতা ছোট্ট মন্তব্য করল।

কার্শিয়াং ছেড়ে যত ওপরে উঠছিল তত শীত বাড়ছে। তবু গাড়ির ইঞ্জিন চালু থাকায় একটা তাপ ছড়াচ্ছে। আনন্দ কথা শুরু করল, আপনি কাল ট্যুরিস্ট নিয়ে কখন বের হবেন দার্জিলিং থেকে?

তিনটে নাগাদ। ড্রাইভার জবাব দিল।

তাহলে ঘুমাবেন কখন? এখনই তো দশটা বেজে গেছে।

কি করব, ডিউটি করতে হবে। মালিককে কথা দেওয়া হয়েছে। নইলে এই রাত্রে শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে ফিরি? ড্রাইভারের গলার স্বরে অখুশি ফুটে উঠল।

আনন্দ বলল, আমরা তো কাল টাইগার হিলে যাব। পরশু ফিরে আসছি। চার ঘণ্টা হোটেলে থেকে কি হবে? তাছাড়া এগারোটার সময় হোটেলে পৌঁছে তিনটেতে গাড়ি পাব?

ড্রাইভার বলল, এখন তো কোন ড্রাইভারকে পাবেন না। তবে তিনটের সময় ওয়েদার ভাল থাকলে পেয়ে যেতে পারেন। আপনারা কার্শিয়াং-এ থেকে গেলে ভাল করতেন। এখনই গাড়ি ঠিক করে রাখলে ওরা ভোরে আপনাদের ডেকে নিয়ে যেত।

যেন সত্যি বড় ভুল হয়ে গেছে এমন একটা শব্দ করল আনন্দ। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আপনি আমাদের এখন টাইগার হিলে পৌঁছে দেবেন? শুনেছি ওখানে নাকি ট্যুরিস্ট লজ আছে।

এখন? মাথা খারাপ। আমি আর কোথাও যেতে পারব না। ড্রাইভার বেশ জোরে বলল।
 
এরপর অনেকক্ষণ কথা হল না। সুদীপের ঠাণ্ডাটা ভাল লাগছিল। আনন্দ একটু কুঁকড়ে ছিল। জয়িতাকে দেখে ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু কল্যাণের বসার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তার খুব শীত করছে।

হঠাৎ আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, ঘুম-এ কোন হোটেল নেই?

এবার ড্রাইভার মাথা নাড়ল, ঘুম-এ থাকলে আপনাদের সুবিধে হবে। এখান থেকে টাইগার হিল হেঁটেও যাওয়া যায়। কিন্তু মুশকিল হল ঘুম-এ কোন হোটেল নেই। থাকবেন কোথায়? স্টেশনে থেকে যেতে পারেন যদি ঘর খোলাতে পারেন। তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে জিজ্ঞাসা করল, এক রাত্রের জন্যে পঞ্চাশ টাকা দেবেন?

কেন? আনন্দর মনে হল লোকটা সাহায্য করতে চাইছে।

তাহলে আমার এক বন্ধুকে বলতে পারি একটা ঘর ছেড়ে দিতে। ওর ভাই কালিম্পং-এ গিয়েছে। ঘরটা খালি আছে। যদি এক বাতের জন্যে পঞ্চাশ পেয়ে যায় খারাপ কি? ওরও লাভ হল, আপনাদেরও উপকার হল!

যেন স্বর্গ পাওয়ার সম্ভাবনা শুনল আনন্দ, দেখুন না, প্লিজ, বড় উপকার হয় তাহলে।

ঘুম স্টেশন ছাড়িয়ে একটা কাঠের বাড়ির সামনে গাড়িটা দাঁড়াল। এখন এখানকার কোন বাড়িতে আলো জ্বলছে না। কল্যাণের মনে হচ্ছিল তার হাড়ের ভেতরে ঠাণ্ডা ঢুকে গেছে। সুদীপ বলল, পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে রেলওয়ে স্টেশন হল ঘুম।

জয়িতা প্রতিবাদ করল, না। কাগজে দেখেছি আর একটা স্টেশন হয়েছে কোথাও!

কল্যাণ দাঁতে শব্দ করে বলল, তোদের এখনও তর্ক করার ইচ্ছে হচ্ছে! উঃ, কি ঠাণ্ডা রে বাবা! কলকাতায় এবকম ঠাণ্ডা তিনদিন পড়লে অর্ধেক পপুলেশন কমে যেত।

সুদীপ বলল, এতেই এই! ওয়ালাং চাঙ-এ গেলে তো খাবি খাবি?

কল্যাণ উত্তর দিল না। কিন্তু ওয়ালাং চাঙ নামক জায়গাটায় তো সুদীপও কোনদিন যায়নি। কেউ চাক্ষুষ করেনি। আনন্দ বইপত্র ঘেঁটে ওটাকে আবিষ্কার করেছে। তাই আগে থেকে সেটা সম্পর্কে ভীত হয়ে লাভ কি!

একটু বাদে ড্রাইভার ফিরে এল আর একটা লোককে নিয়ে। লোকটা নির্ঘাৎ ঘুমিয়ে পড়েছিল। কাছে এসে সেলাম করে দাঁড়াল। ড্রাইভার বলল, এ হল আমার বন্ধু। ওর ঘর খালি আছে। ওর সঙ্গে কথা বলুন।

সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, আপনার ঘরে আমরা চারজন থাকতে পারব?

লোকটা হিন্দিতে বলল, গরিবের ঘর। দোতলায় বলে খাট নেই। ওখানে ঠাণ্ডা লাগবে না। কিন্তু হুজুরেরা কাল চলে যাবেন তো?

সুদীপ বলল, কাল ভোরেই চলে যাব। শুধু রাতটা কাটাতে চাই।

লোকটা বলল, তাহলে ঠিক আছে। আমার ভাই কাল দুপুরে ফিরবে। তার আগে ঘর খালি করে দিলে চলবে। টাকাটা আগে দিতে হবে কিন্তু।

কেন?

আমার এই বন্ধুর কাছে তিরিশ টাকা ধার নিয়েছিলাম, সেটা ওকে এখনই শোধ করে দেব। আর আমি যে টাকা নিচ্ছি তা কাউকে বলবেন না।
ড্রাইভারকে চুক্তি মতন টাকা দিয়ে দিল সুদীপ। ঘরভাড়াও মিটিয়ে দিল। তারপর মালপত্র নামিয়ে লোকটাকে অনুসরণ করল। মাটিতে নেমে কল্যাণ হিহি করে কাঁপতে লাগল। ওর চাদর পেছন দিকে খুলে গিয়েছিল। আনন্দ সেটাকে ঠিক করে দিল। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে চলে যেতে সুদীপ বলল, ড্রাইভারটা খুব চালু। এই সুযোগে টাকাটা আদায় করে নিল। ব্যাটাকে ঘুম অবধি ভাড়া দিলে হত। সামনেই একটা কুকুর ডেকে উঠতে লোকটা শিস দিল।

দরজা খুলে লোকটা ওদের নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই একটা কাঠের সিঁড়ি দেখা গেল। একজন মহিলা লণ্ঠন হাতে নিচের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। এত ঠাণ্ডাতেও তার পরনে উলের ব্লাউজ আর সায়ার ওপরে মোটা কাপড় জড়ানো। লোকটা তাদের কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে নিয়ে এল। মাঝারি সাইজের ঘর। নিচে সতরঞ্চি পাতা। তবে সেটা পাতার ধরনে বোঝা যায় খানিক আগে সেখানে ছিল না। ঘরে একটা ছোট্ট ডিমলাইট জ্বলছে। লোকটা দাঁত বের করে হাসল, এই হল ঘর। অসুবিধে হবে নিশ্চয়ই কিন্তু এর চেয়ে ভাল কিছু নেই। আমার ভাই স্টেশনে কাজ করে।

আনন্দ বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে। এতেই হবে।

জয়িতা বলল, আপনাদের টয়লেটটা কোথায়?

লোকটা টয়লেট শব্দটা বুঝতে পারল না। আনন্দ ওকে সরল করা মাত্র সে নিচে নির্দেশ করল। তারপর মুখ বাড়িয়ে নেপালিতে কিছু বলতেই মহিলা সাড়া দিলেন। লোকটি বলল, ওর সঙ্গে যান, নিয়ে যাবে। আমার বউ।

জয়িতা নেমে গেলে ওরা মালপত্র রেখে আরাম করে সতরঞ্চিতে বসল। ঘরটা কাঠের কিন্তু ঠাণ্ডা কম। লোকটা ওদের দিকে তাকাল কিছুক্ষণ তারপর হাঁটুমুড়ে বসে জিজ্ঞাসা করল, টাইগার হিল যাওয়ার জন্যে কি জিপ দরকার?

আনন্দ বলল, হ্যাঁ। তবে বুঝতে পারছি না ভোর তিনটের সময় উঠে যেতে পারব কিনা। যদি সকাল ছটায় বের হই তাহলে কিছু দেখতে পাব?

লোকটা হাসল, না। তবে টাইগার হিলের দিন গিয়েছে। এখন সবাই সান্দাকফুতে সানরাইজ দেখতে যায়। কিন্তু সাহেবরা যদি ইচ্ছে করেন তাহলে কাল খুব ভোরে উঠে ওই জানালাটা খুলে দিতে পারেন। চোখের সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাবেন মেঘ না থাকলে। সাহেবরা কি কিছু খাবেন?

সুদীপ বলল, না ভাই, আমরা খেয়ে এসেছি। তোমার কাছে কম্বল আছে? নইলে আবার আমাদের ব্যাগ খুলতে হবে। সে টেবিলের ওপরে রাখা কিছু শীতবস্ত্র দেখিয়ে বলল, ওগুলো আমরা ব্যবহার করতে পারি?

সাহেবরা যদি ইচ্ছে করেন তাহলে করবেন।লোকটা চোখ বন্ধ করল, সাহেবদের কি ড্রিঙ্ক করার ইচ্ছে আছে?

আনন্দ মাথা নাড়ল, আমরা ড্রিঙ্ক করি না।

কিন্তু এই ঠাণ্ডায় ড্রিঙ্ক শরীর গরম করে দেয়। আমার বউ আজকাল কিছুতেই আমাকে ওসব খেতে দেয় না। আপনারা এসেছেন বলে একটা সুযোগ পাওয়া যেত।

লোকটার ধান্দা বোঝা গেল এতক্ষণে। চেহারা দেখলে খুব সুস্থ মনে হয় না। এখন ধরা যাচ্ছে সেটা লিভারের কারণে। সুদীপ বলল, একটু ব্রান্ডি হলে মন্দ হত না। আমি দুটো বোতল এনেছি ইমার্জেন্সির জন্যে। এখন খুলব না।

এবার লোকটা জিজ্ঞাসা করল, ওই মেমসাব কোন সাহেবের বউ?

এতক্ষণে লোকটার সঙ্গ ত্যাগ করতে চাইল আনন্দ। গায়ে পড়া স্বভাবটা আর ঢাকা নেই। সুদীপ বলল, ও কারও বউ না। আমরা বন্ধু।

লোকটা হাসল লাল দাঁত দেখিয়ে, হিন্দি ফিল্মস্টাররা এরকম হয় শুনেছি।

কথাটা শুনে হো হো করে হেসে ফেলল সুদীপ। আর সেই সময় জয়িতা উঠে এল। এসে জিজ্ঞাসা করল, হাসছিস কেন?

সুদীপ বলল, তিনটে ছেলে একটা মেয়ে বন্ধু হিসেবে বাইরে এলে নাকি হিন্দি ফিল্মস্টারের মত দেখায়। ঠিক আছে ভাই। আমরা একটু ঘুমবো এবার।
 
লোকটার ওঠার ইচ্ছে ছিল না বোধহয়। কিন্তু নিচ থেকে মহিলার ডাক এলে সে উঠল। জয়িতা সতরঞ্চিতে বসে বলল, হরিবল এক্সপেরিয়েন্স। মানুষ যে এত নোংরা টয়লেট ব্যবহার করতে পারে তা আমার জানা ছিল না। খুব চেষ্টায় বমি করিনি। এখনও শরীর গুলোচ্ছে। নরক।

সুদীপ বলল, আমার প্রয়োজন পড়লে আমি রাস্তায় চলে যাব।

জয়িতা ঠোঁট কামড়াল, ঈশ্বর তোদের শুধু সুবিধেই দেননি, চক্ষুলজ্জা বস্তুটিও দিতে ভুলে গেছেন। মেয়েদের তো হাজারটা অসুবিধে দিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে।

কল্যাণ চুপচাপ বসেছিল এতক্ষণ। হঠাৎ উঠে টেবিল থেকে একটা কম্বল এক হাতে তুলে নিয়ে শরীরে বিছিয়ে শুয়ে পড়ে বলল, বাইরে কেমন ঠাণ্ডা রে?

বাঘ পালাবে। জয়িতা জবাব দিল।

এ অঞ্চলে বাঘ আছে? সুদীপ প্রশ্নটা ছুঁড়ল।

আমি আর বের হচ্ছি না। কল্যাণ এতক্ষণে যেন উত্তাপ পেল।

আনন্দ ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ঘুমিয়ে পড়িস না। আমি আর একবার ডিটেলস সবার সঙ্গে আললাচনা করে নিতে চাই।

তিনজোড়া চোখ এবার আনন্দর মুখের ওপর দৃষ্টি ফেলল। আনন্দ বলল, কিছুদিন আমাদের গাঢাকা দেওয়া প্রয়োজন। ভারতবর্ষের কোথাও আমরা নিরাপদ নই। ধরা পড়লে যাবজ্জীবন তো হবেই ফঁসি হওয়া বিচিত্র নয়। এতদূর পর্যন্ত পুলিশের নজর এড়িয়ে আমরা আসতে পারলাম এটা কম কথা নয় সুদীপ, দ্যাখ তো লোকটা এখনও সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে কিনা!

সুদীপ উঠল। তারপর নিঃশব্দে দরজায় গিয়ে নিচের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার ফিরে এল, বুঝতে পারছি না। সম্ভবত নেই। নিচটা অন্ধকার।

দরজাটা বন্ধ করে দে।

সুদীপ দরজাটা বন্ধ করে টেবিল থেকে আর একটা কম্বল তুলেই বলল, উরেব্বাস, কি দুর্গন্ধ! এই কল্যাণ, তুই ওটার তলায় শুয়ে আছিস কি করে? গন্ধ নেই?।

কল্যাণ বলল, আমার নাক বন্ধ। তাছাড়া ভিখিরির পছন্দ বলে কিছু থাকতে নেই।

সুদীপ কম্বলটা যেখানে ছিল সেখানেই রেখে দিয়ে ফিরে এসে সিগারেট ধরাল। আনন্দ বলল, কাল ভোরে আমরা এখান থেকে বের হব। ঘুম থেকে একটা রাস্তা চলে গেছে—দাঁড়া। আনন্দ ব্যাগ খুলে একটা ম্যাপ বের করল। ম্যাপটা মাঝখানে রেখে সে বলল, রাস্তাটা সুকিয়া পোকরি মানেভঞ্জন বলে দুটো জায়গা হয়ে চলে গেছে রিম্বিক রামাম। রামামে একটা হাইড্রো ইলেকট্রিকাল প্রজেক্ট হচ্ছে। এই অবধি বাস যায়। ফার্স্ট বাস আমরা ঘুম থেকে ধবতে পারি সকাল আটটায়। কিন্তু অতক্ষণ আমরা অপেক্ষা করব না। আমাদের একটা জিপ জোগাড় করতেই হবে। আমরা নামব মানেভঞ্জনে, যদি জিপ তার বেশি যেতে না চায়। আগে ওখান থেকেই ট্রেকাররা সান্দাকফু বেড়াতে যেত। এখন শুনছি জিপ পৌঁছে যাচ্ছে সান্দাকফু পর্যন্ত। কিন্তু তার পরে নয়। ফালুট যেতে হলে হেঁটে যেতে হয় সবাইকে। ম্যাপ বলছে ফালুটের কাছেই নেপাল বর্ডার। সেটা পার হলেই যে গ্রাম তার নাম চ্যাঙ্গথাপু। ওটা ফালুট থেকে মাত্র সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে। অনেক সময় ট্যুরিস্টরা ওই গ্রামে বেড়াতে যায়। আমরা সেটা ছাড়িয়ে আরও ভেতরে ঢুকব। আপাতত আমার টার্গেট ওয়ালাংচুঙ। আরও সাড়ে ছয় কিলোমিটার ওপরে। পথ দুর্গম। কোন সভ্য মানুষ যায় না। উনিশশো সাতান্নতে একজন অস্ট্রেলিয়ান ট্রেক করে ওখানে পৌঁছেছিলেন।

সুদীপ প্রশ্ন করল, পুলিশ স্টেশন?
 
আনন্দ ম্যাপটা ভাল করে আর একবার দেখল। যতরকম খবর সে সংগ্রহ করতে পেরেছিল সেগুলো বিভিন্ন চিহ্নের মাধ্যমে ম্যাপে লিখে রেখেছিল। দেখে টেখে সে বলল, সুখিয়া পোখরিতে আছে। মানেভঞ্জনে আছে কিনা জানি না। তারপর বিস্তৃত অঞ্চলে কোন থানা নেই। সেই ফালুটে একটা পুলিশ ক্যাম্প আছে। এই পুলিশরা মাঝে মাঝে চ্যাঙ্গথাপুতে বেড়াতে যেতে পারে কিন্তু তার ওপাশে কখনই নয়।

জয়িতা ম্যাপটা দেখছিল, ফালুট কি ওয়েস্ট বেঙ্গলের মধ্যে?

আনন্দ বলল, হ্যাঁ। মজা হল হিমালয়ের এই দিকটা এত নিরীহ যে ভারত নেপাল কেউ বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সকে এই অঞ্চলে নিয়মিত রাখেনি। যাতায়াতের পথ নেই, জনতি নেই, বছরে আট মাস বরফ পড়ে থাকে, অতএব আক্রমণেরও ভয় নেই। এইটে আমাদের সাহায্য করবে। এখন তোদের আমি শেষবার বলতে চাই, একবার আমরা ওদিকে পা বাড়ালে অনেক কষ্টকে ফেস করতে তৈরি থাকতে হবে। আমরা শুধু একটা নিরাপদ লুকোনোর জায়গা চাইছি। নেপাল পুলিশের চিহ্ন নেই ওখানে। ভারতীয় পুলিশ বর্ডার ক্রস করে ওখানে যাবে না। কিন্তু আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে ওখানে বেঁচে থাকতে হবে। এইটেতে যার আপত্তি থাকে সে বলতে পারে।

কল্যাণ চুপচাপ শুয়েছিল, আপত্তি থাকলে কি করা হবে?

আনন্দ একটু থমকাল, সে থেকে যেতে পারে। যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাওয়ার স্বাধীনতা তার থাকল। কিন্তু ধরা পড়ার পর আমাদের অস্তিত্ব জানাতে সে যেন কাল থেকে অন্তত পাঁচটা দিন সময় নেয়।

হঠাৎ সব চুপচাপ হয়ে গেল। কাঠের দেওয়ালে বাইরের বাতাস অদ্ভুত শব্দ তুলছে। সমস্ত পৃথিবীটা যেন আচমকা উধাও হয়ে গেল। প্রথমে কথা বলল জয়িতা, এসব কথা উঠছে কেন তাই আমি বুঝতে পারছি না। তোরা কি যেতে চাইছিস না? প্রশ্নটা সে সুদীপের দিকে তাকিয়ে করল। সুদীপ কাঁধ ঝাকাতে সে দৃষ্টিটা কল্যাণের দিকে ফেরাল।

কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে কল্যাণ বলল, প্রশ্ন করা মানেই যদি আপত্তি জানানো হয় তাহলে আমি আর কি বলব। কথা হল, বলছিস ওখানে আটমাস বরফ পড়ে। আমরা তাহলে থাকব কোথায়?

দ্যাটস দ্য প্রব্লেম। আনন্দ হাসল, হোটেল কিংবা ধর্মশালা নেই ওয়ালাংচু-এ। একটা ছোট গ্রাম আর তার প্রাগৈতিহাসিক অধিবাসী যাদের সংখ্যা বেশি নয়। ওরা নিশ্চয়ই ঘর বেঁধে থাকে। আমি তেমন বিস্তারিত জানি না। তবে গিয়ে পড়লে কি আস্তানা জুটে যাবে না! ও নিয়ে আমি ভাবি না।

সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, ওয়ালাংচুঙ-এর উচ্চতা কত?

তেরো হাজার। মাপ দেখে সঠিক উচ্চতা জানাল আনন্দ।

শব্দদুটো শোনামাত্র তিনটে মুখ একসঙ্গে অবাক-হওয়া-আওয়াজ উচ্চারণ করল।

কল্যাণ শেষ প্রশ্নটা ছুঁড়ল, আমরা অতদূরে পৌঁছাতে পারব তো?

জয়িতা অবাক গলায় বলল, মানে?

পাহাড়ে ওঠার জন্য ট্রেনিং দরকার, তা আমাদের নেই। তাছাড়া তেরো হাজার ফুট উঁচুতে যে ঠাণ্ডা তা সহ্য করার মত—

গরমজামা আমাদের আছে। আনন্দ বলল, আমরা ক্লাইম্বিং-এ যাচ্ছি না। এটা জাস্ট ট্রেকিং। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাওয়া। উঁচু নিচু পথ পড়বে এই যা। সান্দাকফু-ফালুট পর্যন্ত মেয়েরা যাচ্ছে হেঁটে কোনরকম ট্রেনিং ছাড়া। ভয় পাওয়ার কিছু নেই কল্যাণ। আপাতত এছাড়া কোন উপায় নেই।

আমি ভয় পাচ্ছি তোকে কে বলল! বিস্তারিত জানতে চাওয়া মানে ভয় পাওয়া? তাহলে তো কোন কথাই বলা যাবে না। সে একটু ক্ষুন্ন হয়ে চোখ বন্ধ করল।

আনন্দ ব্যাপারটাকে উপেক্ষা করল, যাঃ, এগারোটা বেজে গেছে। রেডিও স্টেশন বন্ধ। আজ খবরটা শোনা হল না। জয়িতা, এখন থেকে তোর ওপর দায়িত্ব, প্রত্যেকটা নিউজ তুই শুনে আমাদের জানাবি। এবার শুয়ে পড় সবাই। কাল ভোরে দেখা যাক কপালে কি আছে! আনন্দ ব্যাগের দিকে হাত বাড়াল, এটা খুলতে ইচ্ছে করছে না। ওই কম্বলগুলোয় কি প্রচণ্ড দুর্গন্ধ?।

দারুণ। সুদীপ শব্দটা উচ্চারণ করে নিজের ব্যাগে হাত দিল। রাত যত বাড়ছে ঘুম-এ হাওয়ারা প্রবল হচ্ছে। আর সেই সঙ্গে ঠাণ্ডা আরও ঘন হয়ে চারপাশে ঘিরে ধরছে।
 
ঘুম থেকে টাইগার হিলে যাওয়ার শাটল জিপ পাওয়া যাচ্ছিল কিন্তু সুখিয়া পোখরি কিংবা মানেভঞ্জনের জিপ যোগাড় করতে ওদের সাতটা বেজে গেল। মানেভঞ্জন পৌঁছে দিয়ে চলে আসবে। সুদীপ ড্রাইভারকে রাজি করালেও আনন্দ খুশি হচ্ছিল না। মানেভঞ্জনের বাস পাওয়া যাবে আটটা নাগাদ। শুধু ওই অবধি পৌঁছে কি লাভ হবে!

বাস স্ট্যান্ড এলাকাটা এমন যে কোন ড্রাইভারকে অনুরোধ করলে আর পাঁচজনে তা জেনে নিতে দেরি করে না। সেই সাতসকালে রীতিমত ভিড় জমে গেল তাদের ঘিরে। প্রত্যেকেই সাহায্য করতে চায়। কিন্তু সেই সঙ্গে দাম উঠছে।

বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত সুদীপের ঠিক করা জিপেই উঠল ওরা। এখন ঘুমে ঘন কুয়াশা। আকাশের গায়ে একটা ঘোলাটে পর্দা টাঙানো। নির্ঘাৎ আজ যারা টাইগার হিলে যাবে তারা আফসোস করবে। রোদের চিহ্ন নেই, সূর্য উঠেছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। এই ড্রাইভারও একা নয়। তার সঙ্গী ছোকরাটা দেখতে হিন্দি ফিল্মের ভিলেনের মত। চালচলনও তাই। পোশাক দেখে অবাক হতে হয়। ভাড়াটে জিপ ড্রাইভারের হেলপার, কিন্তু পোশাক দেখলে তা মালুম হয় না।

ঘুম থেকে বের হবার মুখে গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়ল। ড্রাইভার বিনীত মুখে জানাল যে সকাল থেকে এক গ্লাসও চা খায়নি, সাহেবরা যদি খাওয়ান তো বড় ভাল হয়। আজ ঘুম ভাঙার পর তৈরি হবার সময় একটি আশাতীত ঘটনা ঘটেছিল। একটা থালায় চার গ্লাস ধূমায়িত চা নিয়ে প্রবেশ করেছিল লোকটা। সঙ্গে সঙ্গে তাকে খুব ভাল লেগে গিয়েছিল সবায়ের। মুহূর্তেই গতরাতের বিরক্তিটা উধাও হয়ে গিয়েছিল। অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও দাম নিতে চায়নি।

সুদীপ বলল, মন্দ হয় না আর এক গ্লাস পেলে। ঠিক আছে চা লাগাতে বল।

ওরা দুজন নেমে গেলে আনন্দ বলল, যত তাড়াতাড়ি সুখিয়া পোখরি পেরিয়ে যেতে পারি তত মঙ্গল। চায়ের জন্য খামোক সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না।

সুদীপ মাথা নাড়ল, লোক দুটোকে হাত করতেই হবে। আমার ওপর ব্যাপারটা ছেড়ে দে না। ভিড়ের মধ্যে কথা বলার সময় ও একবার চোখে ইশারা করেছে। মনে হয় অন্য কোন ধান্দা আছে। দেখা যাক।

এই রকম ভোরবেলায় এমন স্যাতসেঁতে প্রকৃতি ভাল লাগার কথা নয়। কিন্তু জয়িতার মন্দ লাগছিল। বিদেশী উপন্যাসের পটভূমিগুলো মনে পড়ছিল ওর। ঠাণ্ডা খুব কিন্তু বাচ্চা বাচ্চা মেয়েগুলো হালকা সোয়েটার পরে স্বচ্ছন্দে কাজকর্ম করছে। কুয়াশায় ভিজে গেছে রাস্তা, বাড়ির চাল এমন কি আকাশটাও। হাতে গরম চায়ের গ্লাস পেয়ে বেশ আরাম লাগল ওর। এখন কল্যাণ আর জয়িতা সামনে বসেছে। ড্রাইভাবের সঙ্গী আনন্দদের সঙ্গে পেছনে। বের হবার আগে সুদীপ আর আনন্দ অনেক কসরৎ করে কল্যাণকে পুলওভার পরাতে পেরেছে। প্লাস্টার-করা হাতটাকে বাইরে রেখেছে সোয়েটারের। তাই সেই হাতাটা ঝুলঝুল করছে। কিন্তু এতে অনেক বেশি আরাম বোধ করছে কল্যাণ। প্রত্যেকের পায়ে পাহাড়ে ওঠার কেডস। বের হবার সময় কল্যাণ মন্তব্য করেছিল, ঠিকঠাক পোশাক থাকলে ঠাণ্ডা কোন ব্যাপারই নয়।

সুদীপ হেসেছিল, এই তত বাঙালি জেগেছে, আর কোন ভয় নেই।

রাস্তাটা চমৎকার। ঘুম পেছনে পড়ে রইল। এই সকালেও কুয়াশার মধ্যে যদিও মাঝেমাঝে ফগলাইট জ্বালতে হচ্ছে তবু প্রকৃতির চটপট পরিবর্তনটা চোখে পড়ছিল। গাছগুলোর চেহারা অনেক ঝকঝকে। পথের ধারে বেশ কিছু ফুল ফুটে আছে। হঠাৎ জয়িতা চেঁচিয়ে উঠল, ওই. দ্যাখ লেডি স্লিপার।

কল্যাণ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, লেডি স্লিপার? মানে?

একটা ফুলের নাম। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে ছবি দেখেছিলাম।

কল্যাণ বুঝতে পারছিল না ঠিক কোন্ ফুলটা লেডি স্লিপার। তার মনে হল ষই ভাল নম্বর পাক না কেন জয়িতা তার থেকে অনেক বেশি জানে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি সে কখনও হাতে নিয়ে দেখার সুযোগ পায়নি।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top