What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected গর্ভধারিণী - সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

আনন্দ জয়িতার মুখ দেখে বুঝতে পারছিল ও এখনই রাগে ফেটে পড়বে। সে হাত বাড়িয়ে জয়িতাকে স্পর্শ করল, রাগ করে কোন লাভ নেই। ও এখন যা ইচ্ছে তাই বলতে পারে। এখানকার সত্যিটাও আমরা জানি না। কিন্তু পালদেম, তোমাদের ওই দৈত্যটাকে কেউ চোখে দেখেছে?

অনেকবার। ওর মুখ কেউ দেখতে পায় না, কিন্তু শরীর দেখেছে অনেকেই। তবে যারা দেখেছে তাদের শরীরে লোগ ঢুকে যায়। আমাদের এখানে অনেকের গলায় যে অসুখ সেটা ওর জন্যে। ও কাদলে সেই কান্না আমাদের গলা ফুলিয়ে দেয়। কাল তোমরা এলে আর ও কাদল। আমরা মেয়েটার জন্যে ভয় পাচ্ছি তাই। পালদেমকে খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। মনে হল ও পূর্ণ বিশ্বাস থেকেই কথা বলছে।

কিন্তু দৈত্যটাকে দেখতে কেমন? কল্যাণ বেশ কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞাসা করল।

গায়ে বড় বড় লোম, বিশাল চেহারা। কখনও চার হাত পায়ে কখনও দুই পায়ে হাঁটে। সব সময় বরফের মধ্যে থাকতে ভালবাসে। ঝড় বৃষ্টি ঠাণ্ডাতেই ওদের আরাম হয়। আমি ওর পায়ের ছাপ দেখেছি—এত বড় বড়! মাঝে মাঝে ওরা সবচেয়ে উঁচু বরফের পাহাড়ের ওপরে উঠে যায়।

কি করে বুঝলে?

পাহাড়ের চুড়োটা কালো হয়ে যায় আর পৃথিবী তখন কাঁপতে থাকে থর থর করে।

অনেক কষ্টে হাসি চাপল সুদীপ। বলল, তোমরা পাহাড়ি ভাল্লুককে দেখেছ!

ব্যঙ্গের হাসি ফুটল পালদেমের মুখে, আমাকে ভালু চেনাতে এসো না। এই দানোদের তিনজন মাঝে মাঝে এখানে আসে। যখন চলে যায় তখন খুব জোরে শিস বাজায়। কাল ওরা শিস দেয়নি, মানে এখনও এই এলাকাতেই আছে।

কল্যাণ বলল, ইয়েতি। ওটা নিশ্চয়ই ইয়েতি।

সুদীপ ধমকালো, ভাগ। ইয়েতি বলে কিছু নেই। হিলারি সমস্ত হিমালয় চষেছেন একটা ইয়েতির সন্ধানে। কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি শুধু পায়ের ছাপ ছাড়া। ওটা পরে পাহাড়ি ভাসুকের বলে মনে করা হয়েছে। ফালতু সংস্কার। কিন্তু পালদেম, আমরা তোমাদের ওই দানোকে মেরে ফেলতে পারতাম যদি তোমরা কাল আমাদের অস্ত্র চুরি না করতে।

সুদীপ আচমকা এই প্রসঙ্গে আসায় আনন্দ আর জয়িতা পালদেমের প্রতিক্রিয়া দেখার চেষ্টা করল। পালদেম মাথা নাড়ল, তোমরা যাতে এখানে কোন খুনোখুনি না করতে পার তাই এই কাজ করতে হয়েছে। জানো আমাদের সঙ্গে বহু যুগ থেকে আছে।

এতক্ষণ কিশোর চুপচাপ শুনছিল। সে কিছু বলতেই পালদেম জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের কোথায় যাওয়ার ইচ্ছে ছিল অত অস্ত্র নিয়ে? তোমাদের মতলব ভাল নয় বলে মনে হচ্ছে।

আনন্দ বলল, আমরা খারাপ লোক নই। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমাদের বয়স বেশি নয়?

তাতে কিছু এসে যায় না। তোমরা কি ডাকাতি করে পালিয়ে এসেছ? পালদেমের চোখে সন্দেহ।

না, আমরা ডাকাত নই। তোমাদের কোন ক্ষতি আমরা করব না।

ঠিক আছে। মেয়েটার কি হয় তা আগে দেখা যাক।

পালদেম কিশোরকে ইশারা করতেই সে রওনা হচ্ছিল, জয়িতা তাকে থামাল,, দাঁড়াও। বিছানা হওয়া ছাড়াও মেয়েদের অনেক কাজ থাকে। ওকে বল আমি ওর সঙ্গে যাব মেয়েটাকে দেখতে।

পালদেম বেশ বিস্মিত, তুমি ওর বাড়িতে যাবে?

হ্যাঁ। কেন, তোমাদের কি আমার সম্পর্কেও ভয় আছে? ও কেন রাত্রে ঘুমায়নি দেখতে চাই।

জয়িতা কথা শেষ করে ঘরে ঢুকে গেল। তারপর ফার্স্টএইডের ব্যাগটা নিয়ে নেমে এল, ওকে বলে দাও আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে।

খানিকটা ইতস্তুত করে পালদেম ছেলেটাকে কথাগুলো জানাতে সে অবাক হয়ে জয়িতাকে দেখল। আনন্দ বলল, কেন যাচ্ছিস বুঝতে পারছি কিন্তু সাবধানে থাকিস। বেশি দেরি করিস না।
 
জয়িতা কোন কথা না বলে ছেলেটিকে অনুসরণ করল। পালদেমের কথাগুলো শোনার পর থেকেই তার শরীর ঘিনঘিন করছিল। সেই মুহূর্তে ইচ্ছা হয়েছিল লোকটাকে গুলি করে মারে। তার কাছে যে আর একটা রিভলভার আছে তা কেউ জানে না। কিন্তু পালদেমকে মেরে ফেললে এই গ্রামে বাস করা যাবে না। আর একটা রিভলভার কতক্ষণ পুরো গ্রামটাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে! সমস্ত যুদ্ধের ফলাফল নির্ভর করে কি কৌশলে যুদ্ধ করা হচ্ছে তার ওপরে। এর বদলা সে নেবেই। জয়িতা তার সামনে হেঁটে যাওয়া ছেলেটাকে লক্ষ্য করল। বেশ বিভ্রান্ত হয়ে ও হাঁটছে। ওর শরীরের গড়ন বলে দিচ্ছে কিছুতেই কুড়ির কাছে পৌঁছাতে পারে না। অথচ ও ওই বালিকার বাপ এবং শেষ-যুবতীর স্বামী। কি করে সম্ভব? এখানে কি মেয়েদের চেয়ে ছেলে কম? সে অনেক কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক করে পেছনে তাকাল। তাদের আস্তানা বা বন্ধুদের কাউকে দেখা যাচ্ছে না। জয়িতা হিন্দীতে ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করল, এই যে ভাই, তোমার নাম কি?

ছেলেটি মুখ তুলে তাকাল। ওর পরিষ্কার সরল মুখে হাসি ফুটল। তারপর দুবার নিচু গলায় সে উচ্চারণ করল, বাই, বাই! জয়িতা বুঝল ও ভাই শব্দটাকে ধরতে পেরেছে। পথ চলতে ওয়াংদের কাছে শেখা শব্দ ব্যবহার করল সে, তিমরো নাম?

দুগদুপ। নিজের বুকে হাত রেখে ছেলেটি বলল, মেরো নাম। এটা বুঝতে কোন অসুবিধে হল না জয়িতার। তার মনে হল কান খাড়া করে শুনলে আর ওরা যদি একটু ধীরে কথা বলে তাহলে অনেক কথাই বোঝা যেতে পারে।

ক্রমশ ওরা গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়ল। চারপাশে কৌতূহলী মেয়েপুরুষের ভিড়। এমন হতশ্রী চেহারা সত্ত্বেও মানুষের স্বাভাবিক বৃত্তিগুলো ওরা আঁকড়ে আছে। পেছন পেছন মেয়েরা আসছে আর দুগদুপকে প্রশ্ন করে যাচ্ছে। দুগদুপ যেন হঠাৎ নিজেকে বেশ ক্ষমতাবান মনে করেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে একটা নিচু দরজার সামনে উপস্থিত হল। ততক্ষণে গতকালের সেই রমণীটি দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। তার চোখেমুখে বিস্ময়। দুগদুপ তাকে জড়িয়ে কিছু বলল। জয়িতা সেই শব্দাবলীর মধ্যে শুধু পাদেমের নামটাই বুঝতে পারল। রমণীটি মাথা ঝুকিয়ে তাকে ভেতরে যেতে ইশারা করতে জয়িতা নিচু হয়ে পা বাড়াল। ঘরটা মাঝারি। কাঠ বাঁশ আর বড় খুঁটি দিয়ে শক্ত করে তৈরি। ঘরটির মাঝখানে একটা পার্টিশন। মেয়েটি শুয়ে আছে পার্টিশনের এপাশে একটা মাচার ওপরে। ওর শরীরের তলায় গরম বস্ত্র এবং বিছানা হিসেবে যা ব্যবহার করা হচ্ছে তার চেহারা দেখে আঁতকে উঠল জয়িতা। মেয়েটা তার ওপরে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। ঘরে আরও মেয়ে বাচ্চা ঢুকেছিল। সেদিকে খেয়াল না করে জয়িতা মেয়েটার কপালে হাত রাখল। যদিও খুবই সামান্য ব্যান্ডেজের বাইরে ভোলা রয়েছে কিন্তু তাতে কোন উত্তাপ পেল না সে। অর্থাৎ মেয়েটার জ্বর আসেনি, শরীরে কোন অ্যালার্জি বের হয়নি। যদিও ওর হাতে পায়ে চর্মরোগের চিহ্ন ছড়িয়ে। সে দেখল ব্যান্ডেজের অনেকখানি ভিজে গেছে। ঘা-এর রস গড়িয়ে ভিজিয়েছে ব্যান্ডেজ। অথচ গতকাল যখন ওকে দেখেছিল তখন কোন রস গড়াচ্ছিল না। গতরাতে ওর না ঘুমানোর কারণ সে বুঝতে পারল। ময়লায় শক্ত হয়ে জমে থাকা আচ্ছাদনটা সরে যাওয়ায় ঘা নরম হয়ে রস গড়াচ্ছে। এটা অবশ্যই ভাল লক্ষণ। কিন্তু আজ আবার ব্যান্ডেজ পালটে ওষুধ লাগানো দরকার। কিন্তু কাল ওরা বলে গেছে যে ব্যান্ডেজ খুললে যদি দেখা যায় ওটা বেড়ে গেছে তাহলে! নরম ঘাকে ওদের বেড়ে যাওয়া বলেই মনে হবে। হোক, তবু যা করা উচিত তা করবে বলে ঠিক করল জয়িতা। কিন্তু মেয়েটার ঘুম না ভাঙা পর্যন্ত অপেক্ষা করা দরকার। সে ইশারায় রমণীটিকে বলল ভিড় সরিয়ে দিতে। জয়িতা যেভাবে মেয়েটিকে পরীক্ষা করছিল তাতে নিশ্চয়ই আন্তরিকতা দেখতে পেয়েছিল রমণীটি। তাই সে এবারে চিৎকার করে ঘরের সবাইকে বের করে দিয়ে কিশোরটিকে কিছু নির্দেশ দিল। জয়িতা দেখল কিশোর-স্বামী বাইরে পাহারায় থাকল।

চিৎকার চেঁচামেচিতে মেয়েটির ঘুম ভাঙলেও সে কিছু শব্দ বিড় বিড় করে পাশ ফিরে আবার শুলো। রমণীটি ছুটে এল তার কাছে। উদ্বিগ্ন হয়ে দেখল। তারপর জয়িতার দিকে তাকিয়ে হাসল। জয়িতা হাসিটা ফিরিয়ে দিয়ে নিচু গলায় বলল, কোন ভয় নেই। রমণীটি সেটা বুঝতে পারল না। জয়িতা হিন্দীতে ডর শব্দটা উচ্চারণ করে হাতের ইশারায় বাকিটা বোঝাল। এবার ইশারায় কথা বলা শুরু হল। দেখা গেল অসুবিধে হচ্ছে, বারংবার বিভিন্ন কায়দায় বোঝাতে হচ্ছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত উভয়পক্ষ বুঝতে পারছে। এই ঘরটা দুগদুপের দাদার। সে মারা গেছে এক বছর আগে। গ্রামের নিয়ম মেনে ছোটভাইকে বিয়ে করতে হয়েছে রমণীকে। পাশের খোপে তারা শোয়। রমণী তিনবার ক্ষেতি শব্দটা উচ্চারণ করার পর জয়িতা বুঝতে পারল জমি যাতে ভাগ না হয়ে যায় তাই এই ব্যবস্থা।

সে জিজ্ঞাসা করল হিন্দীতে এবং ইশারায়, ছেলের বয়সী একটা ছোকরাকে স্বামী হিসেবে তোমার কেমন লাগছে?

রমণী হেসে গড়িয়ে পড়ল। তারপর চটপট জামা সরিয়ে কাধের কাছটা জয়িতার সামনে আনল। নগ্ন সাদা চামড়ায় দাঁতের দাগ স্পষ্ট। মেয়েটি খুব গর্বের সঙ্গে সেখানে আঙুল বুলিয়ে ঠোঁটে ছোঁয়ল শব্দ করে।

জয়িতা হতভম্ব হয়ে বাইরে দাঁড়ানো দুগদুপের দিকে তাকাল। ওই সরল নির্দোষ কিশোরকে ওই ভূমিকায় সে কল্পনাও করতে পারছিল না। আর এই সময় মেয়েটি চোখ মেলে উঠে বসতেই জয়িতা এগিয়ে গেল। মেয়েটির হাত দুটো হাতে জড়িয়ে ধরতেই সে লজ্জা পেয়ে হাসল। জয়িতা এবার ওর কপালে হাত বোলাল। মেহ বড় সংক্রামক, মেয়েটি আক্রান্ত হল।
 
৩৪.
যতটা সাহস এবং উৎসাহ নিয়ে জয়িতা মেয়েটিকে দেখতে এসেছিল, ব্যান্ডেজ খোলার পর সেটা দূর হয়ে শরীর গোলানো অনুভূতি তৈরি হল। তার মনে হচ্ছিল বমি হয়ে যাবে। অত্যন্ত ভেপসে গিয়েছে ঘা, ওষুধ দেওয়া সত্ত্বেও আজ দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। গতকাল কিন্তু গন্ধটা এমন ছিল না অথবা থাকলেও পাওয়া যায়নি। এখন আরও কুৎসিত দেখাচ্ছে মেয়েটির মুখ, গলা। দাঁতে দাঁত চেপে ঘা পরিষ্কার করতে লাগল জয়িতা। মেয়েটির মা উদ্বিগ্ন মুখে পাশে দাঁড়িয়ে। আঙুলে তুলে নিয়ে ঘা স্পর্শ করার সময় প্রথমে যে অস্বস্তিটা প্রবল হয়েছিল ধীরে ধীরে সেটা মিলিয়ে গেল। নতুন করে মলম বুলিয়ে আবার ব্যান্ডেজ করল জয়িতা। পুরোনোটাকে কোনরকমে মুড়ে নিয়ে সে মেয়েটির মাকে ওষুধ খাওয়াতে ইঙ্গিত করে বেরিয়ে এল বাইরে।

ঘরের বাইরে তখনও ভিড়। সবাই জয়িতার দিকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে। সে বেরিয়ে আসামাত্র কয়েকজন ঢুকে গেল ভেতরে। জয়িতা আর দাঁড়াল না। হন হন করে সে হাঁটতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে যখন একদম একা, পাহাড়ের একটা রাস্তার শেষে দাঁড়িয়ে, তখন ব্যান্ডেজটার কথা খেয়াল হল। সেটাকে যাদের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলতেই পেট গুলিয়ে উঠল। হাঁটু মুড়ে বসে জয়িতা বমি করতে লাগল। এই ঠাণ্ডাতেও কপালে ঘাম জমছিল। শরীরে সেই তৈলাক্ত অনুভূতি।

মিনিট পাঁচেক পরে যখন বমিটা বন্ধ হল তখন শরীরে প্রচণ্ড ক্লান্তি। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে জয়িতা একটা বড় পাথরের ওপরে শরীর এলিয়ে দিল। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ পড়ে রইল সে। এবং তখনই তার মনে হল এই পৃথিবীতে সে এখন একা। একটিও মানুষের কাছে কিছু আশা করার নেই। যখন সে কলেজে পড়ত, কলকাতায় ব্যস্ত থাকত তখন এই চিন্তাটা এমন ভাবে তাকে পীড়িত করেনি। সীতা রায় অনেক দূরের মানুষ, রামানন্দ রায়ের জন্যে হঠাৎ তার কান্না পেয়ে গেল। এই কান্না ঠিক রামানন্দ রায় না নিজের জন্যে তা সে জানে না। সচেতন মানুষ হিসেবে রামানন্দ রায়কে অপছন্দ করার যথেষ্ট কারণ আছে, ঘেন্না করারও। কিন্তু কন্যা হিসেবে হঠাৎ সে রামানন্দ রায়ের অভাব বোধ করতে লাগল। হয়তো রুটিন তবু ওই যে দিনে একবার এসে তাকে জিজ্ঞাসা করতেন, এভরিথিং অল রাইট, সেইটে করার আর কেউ রইল না। জয়িতার মনে হচ্ছিল, একটি মানুষ জীবনে সব কিছু পেতে পারে তার ক্ষমতা দিয়ে, চেষ্টা দিয়ে কিন্তু একটু স্নেহ না পেলে তার বড় জিনিস হারিয়ে যায়। রামানন্দ রায় কি তাকে খুব স্নেহ করতেন? সেই সময় সে কোন গুরুত্ব দেয়নি, বরং ধান্দা বলেই মনে হয়েছে। আজকে কেউ তাকে এসে ওই গলাতেও কথা বলবে না। চোখ খুলে ঘোলাটে আকাশটাকে দেখতে দেখতে ক্রমশ এইসব চিন্তার বাইরে বেরিয়ে এল জয়িতা। গম্ভীর মেজাজের মেঘগুলো যেন নাকের ডগায় ঝুলছে। এখানে ওই আকাশটা কত কাছে। যেন হাত বাড়ালেই নাগাল পাওয়া যায়। চুপচাপ শুয়ে রইল জয়িতা।

ট্রাঞ্জিস্টারটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল কল্যাণ। উনুন তৈরি করা হয়েছে পাথর সাজিয়ে, তাতে কাঠ জ্বলছে। যতটা না আগুন তার চেয়ে বেশি ধোঁয়া। সুদীপ মত পালটে খিচুড়ি বসিয়ে দিয়ে বলল, একটা রান্নার বই কিনে আনলে হত। আমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল যোল বছর বয়সে। জয়িতা তা থেকে অনেক বড় হয়েও রান্নার র জানে না। আজকালকার মেয়েদের কাছে তুই কোন কিছু আশা করতে পারিস না।

আনন্দ কথাগুলো শুনে একবার চোখ তুলে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। কয়েকটা নেহাতই বাচ্চা কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে জুলজুল চোখে এদিকে তাকিয়ে আছে। আনন্দ লক্ষ্য করল ওদের দৃষ্টি উনুনটার দিকে। চোখেমুখে ক্ষুধা প্রকট হয়ে উঠেছে। এই গ্রামের মানুষগুলোর বেশির ভাগই সারা বছর আধপেটা খেয়ে বেঁচে থাকে। হয়তো কোন কোন দিন খেতেই পায় না। কিন্তু এই অবস্থার সঙ্গে ওরা এমন অভ্যস্ত যে খুব একটা মাথা ঘামায় বলেও মনে হচ্ছে না। কোন সরকারি সাহায্য এখানে পৌঁছয় না। মাঝে মাঝে কেউ কেউ কিছু জিনিস নিয়ে পাহাড়ি পথ ভেঙে যে টাকা রোজগার করতে যায় না এমন হতে পারে না। কারণ প্রত্যেকটা মানুষের শরীরে যে পোশাক আছে তা তাহলে এল কোত্থেকে? পালদেমকে প্রশ্নটা করেছিল সে। পালদেম বলেছে প্রত্যেক বছর দুটো লোক খচ্চরের পিঠে জিনিসপত্র চাপিয়ে এই গ্রামে আসে। তারা টাকা নেয় না কিন্তু সেগুলোর বিনিময়ে জিনিসপত্রই নিয়ে থাকে। গ্রামের লোকেরা পোশাক, নুন, চিনি এবং চাল কিনে থাকে এইভাবে। ব্যাপারটা হয়তো ঘটে থাকে কিন্তু নিজের প্রয়োজনে মানুষ গ্রাম থেকে বেরিয়ে যোগাযোগ করবে না এ অসম্ভব। যে লোকটা ওদের দেবতার মূর্তি চুরি করে পালাচ্ছিল সে নিশ্চয়ই এই গ্রামের লোক। তার সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল, পালদেম কিন্তু কিছুই বলতে চায়নি। পৃথিবীর কিছু মানুষ একটি দুর্গম পাহাড়ি গ্রামে প্রায় জন্তুর মত জীবনযাপন করছে এবং তা নিয়ে কারও মাথা ঘামাবার কোন দায় নেই। চুপচাপ ভাবতে ভাবতে আনন্দর মাথায় দ্বিতীয় চিন্তা চলকে উঠল। সে বন্ধুদের দিকে উত্তেজিত হয়ে তাকাল। কল্যাণ এখনও কানে ট্রাঞ্জিস্টার চেপে স্টেশন ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সুদীপ উনুনে বসানো পাত্রটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আনন্দ উঠে বাচ্চাগুলোর দিকে এগিয়ে যেতেই ওরা সরে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ল। আনন্দ বন্ধুর মত হাসতে চেষ্টা করল। বাচ্চাগুলো সেই হাসি ফিরিয়ে দিল না। আরও তিন পা এগিয়ে গিয়ে হাত মুখ তুলে খাবার ভঙ্গি করেই দূরের জ্বলন্ত উনুনটাকে ইঙ্গিতে দেখাল। বাচ্চাগুলো খানিকটা থতমত হয়ে ওর দিকে তাকাল। এবার কারও কারও মুখে হাসি ফুটে উঠল। দুজন একসঙ্গে মাথা নেড়ে জানাল তারা খেতে সম্মত। আনন্দ হাত তুলে তাদের আশ্বস্ত করল। তারপর ফিরে এল বন্ধুদের কাছে। সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, কেসটা কি?

আনন্দ বলল, আরও সাত আট জনের জন্যে খিচুড়ি করতে হবে। দেখে মনে হল ওরা ক্ষুধার্ত।

কল্যাণ ট্রানজিস্টারটা বন্ধ করে বলল, মাথা খারাপ নাকি! যা স্টক আছে তা আমাদেরই বেশি দিন কুলোবে না, তার ওপর দানছত্র করলে এখনই না খেয়ে মরতে হবে।

আনন্দ হেসে বলল, যখন এগুলো শেষ হয়ে যাবে তখন কি খেয়ে থাকবি?

কল্যাণ উত্তর দিল না প্রথমে। তারপর চুপচাপ উঠে ঢুকে গেল ঘরে।

সুদীপ বলল, অত খিচুড়ি একসঙ্গে রান্না করার জায়গা নেই। একটু খিচুড়ি একবার খাইয়ে ওদের ভালবাসা পাওয়া যাবে বলে তোর মনে হচ্ছে? ইমপসিল। মেয়েটার কিছু হলে আমাদের টুকরো টুকরো করে ফেলবে ওরা।

জানি না। তবে একদল ক্ষুধার্ত ছেলের সামনে বসে খেতে পারব না আমি।

একদল? তুই ভেবেছিস ওই কটি ছেলেই ক্ষুধার্ত? খবর পেলে সমস্ত গ্রাম চলে আসবে খেতে।

খাবে। আমাদের সঙ্গে যা আছে তাই ওদের খেতে দেব। আনন্দ নির্লিপ্ত মুখে উত্তর দিল।

সুদীপ উঠে দাঁড়াল, তোর মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?

মাথা আমার ভালই আছে সুদীপ। আমি এই লোকগুলোর সঙ্গে একটু ভাব করতে চাই।

হোয়াট ফর? এরা আমাদের কোন উপকারে আসবে না। দেখলি না, পালদেম কি কাণ্ডটা করল!
 
আনন্দ আকাশের দিকে তাকাল। তার মাথায় যে চিন্তাটা এসেছে সেটাকে গুছিয়ে বলার মত সে কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। বলতে গেলেই নিজের কাছে কেমন খেলো মনে হচ্ছে। ওরা এর মধ্যে একটা মতলবের গন্ধ খুঁজে পেতে পারে আর সেই মতলবটাকে সমর্থন করবে এমন ভাববার কোন কারণ নেই।

খিচুড়ি হয়ে গিয়েছিল। সুদীপ তাড়াতাড়ি পাত্রটাকে নামিয়ে ঘরে নিয়ে গেল। আনন্দ দেখল বাচ্চাগুলো আরও কয়েক পা এগিয়ে এসেছে। ওদের প্রত্যেকের মুখে আকাঙক্ষা স্পষ্ট। ঠিক তখনই ড্রাম বাজার শব্দ কানে এল। সে অবাক হয়ে দেখল বাচ্চাগুলো পলকে পিছন ফিরে ছুটতে লাগল উলটো দিকে। আনন্দ দুরেও কিছু লোককে ছুটে যেতে দেখল। বেশ বোঝা যাচ্ছিল সমস্ত গ্রামে ড্রামের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। শব্দ শুনেই সুদীপ বাইরে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কিসের আওয়াজ রে?

আনন্দ মাথা নাড়ল, বুঝতে পারছি না। সবাই খুব উত্তেজিত হয়ে ওই পাশে যাচ্ছে।

সুদীপ ফ্যাকাশে মুখে বলল, মেয়েটা মরে গেল না তোর জয়িতা কোথায়? মেয়েটা মরে গেলে আর দেখতে হচ্ছে না। এদিকে তো কেউ নেই, পালাবি?

আনন্দ বলল, জয়িতাকে ফেলে পালাতে পারব না। আর পালিয়ে যাবই বা কোথায়? তার চেয়ে চল দেখে আসি ব্যাপারটা। কল্যাণকে ডাক।

কল্যাণ পিছনেই ছিল। সে গলা তুলে বলল, আমি আগ বাড়িয়ে ধরা দিতে পারব না। জ্বলন্ত উনুনে এসে পড়লাম কড়াই এড়াতে গিয়ে। পুলিশকে বলতে পারতাম, আইনের আশ্রয় নিতে পারতাম কিন্তু এখানে সেসব— পালাতে হলে পালা, আমি রাজী আছি। শেষ কথাগুলো সুদীপের দিকে তাকিয়ে বলল সে।

সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, পুলিশকে কি বলতিস? আমার হাত ভাঙা ছিল, আমি একটাও খুন করিনি, গুলিও ছুঁড়িনি। অতএব আমি অপরাধী নই, এই তো? চল, আনন্দ, যা হবার হবে, ব্যাপারটা দেখেই আসা যাক। সুদীপ নেমে হাঁটতে লাগল।

কল্যাণ খানিকটা ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে চিৎকার করল, তোরা ঘুরে আয়, আমি এইসব পাহারা দিচ্ছি। তাড়াতাড়ি আসতে চেষ্টা করিস।

সুদীপ যেতে যেতে বলল, আমি কল্যাণকে বিশ্বাস করি না, ও আমাদের ফাঁসিয়ে দিতে পারে।

আনন্দ হাসল, কার কাছে? এখানে নিজেরাই যদি নিজেদের গলায় ফাঁস পরাই তাহলে অন্য কথা।

ড্রামের আওয়াজ বাড়ছিল। যত এগোচ্ছে তত জায়গাটা জনমানবশূন্য ঠেকছে। ছেলেবুড়ো সবাই দৌড়চ্ছে বোঝা যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ওরা মন্দিরটার কাছে পৌঁছে গেল। সমস্ত গ্রামের মানুষ জড়ো হয়েছে এক জায়গায়। কাহুন উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কিছু বলল। সঙ্গে সঙ্গে সমবেত জনতা চিৎকার করে যেন সমর্থন জানাল। এবার ওরা লোকটাকে দেখল। দুটো হাত পিছু মোড়া করে বাঁধা। এর পর আগে কাহুন হেঁটে যাচ্ছে, পিছনে দুটো লোক হাতবাঁধা লোকটিকে নিয়ে। পালদেমও ওই দলে রয়েছে।

সুদীপ ফিসফিস করে বলল, আমাদের জন্যে নয়, মূর্তি চুরি করা লোকটাকে বোধ হয় শাস্তি দেবে আজ। কি শাস্তি দিতে পারে?
 
আনন্দ কোন কথা বলল না। একটা গোল ড্রাম ধরে রেখেছে দুটো লোক, আর তার মাঝখানে তালে তালে পিটিয়ে যাচ্ছে মিছিলের একটি লোক। ওরা সোজা পাহাড়ের খাড়াই বেয়ে উঠছিল। আনন্দ সুদীপকে ইশারা করল বাঁ দিকে সরে আসতে। আড়ালে আড়ালে খানিকটা দূরে যাওয়ামাত্র জয়িতাকে দেখতে পেল সুদীপ। একটা বড় পাথরের ওপরে জয়িতা বসে চারপাশে তাকাচ্ছে। ওদের দেখে নেমে এসে জিজ্ঞাসা করল, কিসের আওয়াজ হচ্ছে রে?

সুদীপ বলল, শাস্তির। তুই এখানে কি করছিলি?

জয়িতা কাঁধ নাচাল। যেন সেটাই উত্তর হয়ে গেল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, কার শাস্তি?

আনন্দ বলল, মূর্তিচোর লোকটার। ওরা ওকে নিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের চুড়োতে। এদিক দিয়ে গেলে মনে হয় আড়াল থেকে দেখা যাবে।

একেবারে চূড়োয় ওঠার পর ড্রামের আওয়াজ থামল। গ্রামের সমস্ত মানুষ এখন চুপচাপ। কাহুন চারপাশে তাকিয়ে পালদেমের উদ্দেশ্যে কিছু বলতেই সে বক্তৃতা দেওয়া শুরু করল।

সুদীপ বলল, যে করেই হোক এদের ভাষাটা তাড়াতাড়ি শিখতে হবে। পালদেমটা মনে হচ্ছে, নেতা।

জয়িতা বলল, এখানে সবাই রাজা। মনে হচ্ছে লোকটাকে মেরে ফেলবে।

সুদীপ মাথা নাড়ল, দূর! একটা মূর্তি চুরির জন্যে ওরা মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে নাকি!

পালদেম বক্তৃতা চালাচ্ছিল।

জয়িতা বলল, অন্ধ ধর্মবিশ্বাস মানুষকে নরকেও নিয়ে যেতে পারে। ওরা লোকটাকে যদি মেরে ফেলতে চায় তাহলে কি আমরা বাধা দেব?

সুদীপ নিঃশ্বাস ফেলল, ইমপসিবল। খালি হাতে কিছু করতে যাওয়া বোকামি হবে।

বক্তৃতা শেষ করে পালদেম চিৎকার করে কাউকে ডাকতেই একটি যুবতীকে দেখা গেল এগিয়ে যেতে। যুবতী সুগঠনা, দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে সে রূপসী এবং সেই বিষয়ে সে বিশেষ সচেতন। পালদেমের সামনে গিয়ে যুবতী মাথা নিচু করে দাঁড়াতে কাহুন তাকে প্রশ্ন করল একটার পর একটা। যুবতী যেই উত্তর দিচ্ছে অমনি মূর্তিচোর চিৎকার করে যেন প্রতিবাদ করে যাচ্ছে। কিন্তু তার চিৎকার ড়ুবে যাচ্ছে জনতার চিৎকারে। বেশ কিছুক্ষণ এই চলার পর পালদেম কাহনকে ইশারা করল। আনন্দ চোখের পলক ফেলার আগেই দেখল ওরা লোকটাকে শূন্যে ছুঁড়ে দিল। সামান্য শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করার সুযোগ পেল না লোকটা, শরীরটা যেন পাক খেতে খেতে নেমে যেতে লাগল নিচে। কয়েক হাজার ফুট তলায় পাথরের ওপরে যখন আছড়ে পড়বে তখন এই গ্রামের সঙ্গে তার আর কোন সম্পর্ক থাকবে না। ওরা তিনজন স্তব্ধ হয়ে দেখল গ্রামবাসীরা নিচে নেমে যাচ্ছে। এখন কেউ কোন কথা বলছে না। অনেকটা শোক মিছিলের মতো দেখাচ্ছে, শুধু অদ্ভুত আওয়াজ বের হচ্ছে ড্রাম থেকে। অনেকটা বিজয়া দশমীর ঢাকের বোলের মত।

জয়িতা বলতে পারল শেষ পর্যন্ত, কি নৃশংস!

সুদীপ বলল, কোন বিচার হল না, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেল না লোকটা, পাহাড় থেকে ছুড়ে ফেলে মেরে ফেলা হল। জানতে হবে সিদ্ধান্তটা কে নিল!

জয়িতা বলল, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কি লাভ! ফিরে চল। তারপর নামতে নামতে বলল, আমরা যখন নানুভাই আর মন্ত্রীকে খুন করি তখনও নিশ্চয়ই কেউ কেউ বলেছে কি নৃশংস! আমরাও অবশ্য বিচার ব্যবস্থার সুযোগ দিইনি ওদের!
 
সুদীপ ক্ষেপে গেল, কার সঙ্গে কার তুলনা করছিস! ডাইরেক্ট ইনফ্লুয়েন্স অফ কল্যাণ! যারা বিচার ব্যবস্থাকে কবজা করে রেখেছে ক্ষমতার জোরে, যারা ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করবে সেই পুলিশ পারচেজড যেখানে ওদের সুযোগ নিতে দেওয়া মানে সসম্মানে বেরিয়ে আসতে বলা। আজ অবধি কটা কমিশনে বা ক্রিমিনাল কেসে অপরাধীকে চিহ্নিত করা হয়েছে বলতে পারিস? খোদ পুলিশের এক কর্তা মারা গেল কনস্টেবল সমেত অথচ অপরাধী ধরা পড়ল না। যাকে সাজানো হল সে মারা গেল লকআপে। সঞ্জীব তীর্থঙ্করের কেসটা ভাব? এখানে তো তেমন সমাজব্যবস্থার রাষ্ট্রীয় যন্ত্র নেই।

রাষ্ট্রীয় যন্ত্র নেই, সমাজব্যবস্থার কথা জানলি কি করে?

মনে হয়। নইলে লোকটার বউ ওর বিরুদ্ধে অন্তত কথা বলত না। বউটাকে দেখে তোর দুঃখী মনে হয়েছে? শালা, মেয়েছেলে–।

সুদীপকে শেষ করতে দিল না জয়িতা, নো মোর, তোর ওপর কল্যাণের প্রভাব কম নয়।

ওরা নিচে নেমে হাঁটতে লাগল আস্তানার দিকে। আনন্দ জিজ্ঞেস করল, মেয়েটার ঘা কেমন দেখলি? কোন উন্নতি হয়নি?

জয়িতা বিশদ বলল। আনন্দ বলল, ঠিক আছে, গুড সাইন।

আস্তানায় এসে ওরা দেখল কল্যাণ নেই। কিন্তু সেই বাচ্চা কটা দাঁড়িয়ে আছে। সুদীপ বলল, আনন্দ, তুই কি ফ্যাচাং বাধালি বল তো! ওরা তোকে দেখে আপনজনের মত হাসছে।

আনন্দ জয়িতাকে বলল, আমি ওদের খাওয়াব বলেছিলাম। ওরা ক্ষুধার্ত।

জয়িতা বলল, আমিও। আমাকে কে খাওয়াবে?

আনন্দ হেসে ফেলল, সবাই মিলে খাওয়ানো যাক সবাইকে।

সুদীপ বলল, ঠিক আছে, আমি আবার উনুন ধরাচ্ছি কিন্তু তুই বাচ্চাগুলোকে ঘরের ভেতর নিয়ে গিয়ে খাওয়া। নইলে মেম্বার বেড়ে যাবে পিলপিল করে।

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, আমাদের জন্যে যেটা রাঁধলি সেটা দিয়ে দিতে বলছিস?

কাঁধ ঝাঁকাল সুদীপ, কি আর করা যাবে। তারপর জয়িতাকে বলল, আগের খিচুড়িটা খুব ধূর হয়েছিল। এক্সপেরিয়েন্স মেকস এ ম্যান এফিসিয়েন্ট। এবার দারুণ রাঁধব। তুমি পটের বিবি হয়ে বসে থাকবে তা চলবে না, এসো হাত লাগাও।

জয়িতা হেসে ফেলল, একটা মানুষের মৃত্যু দেখেও তুই ঠাট্টা করছিস। পটের বিবিরা শুনেছি খুব সুন্দরী হয়। যেমন পটেশ্বরী বউঠান। আমি খুব গর্বিত বোধ করছি।



আনন্দ বাচ্চাগুলোকে দেখছিল। সুদীপ যাকে ধূর রান্না বলেছে তাই ওরা খাচ্ছে পরম তৃপ্তি নিয়ে। ঘরের মধ্যে সসপ্যানটাকে মাঝখানে রেখে ওরা কয়েক সেকেন্ডে শেষ করে ফেলল খিচুড়ি। কিন্তু ওই পরিমাণে ওদের কিছুই হয়নি বোঝা গেল। তবু প্রতিটি মুখেই এখন খুশীর ছাপ। আনন্দ এবার ইঙ্গিত করল পাত্রটাকে ধুয়ে আনতে। সঙ্গে সঙ্গে দুজন ওটাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। বাকিরা আর কিছু করার নেই বুঝতে পেরে একে একে উঠে দাঁড়াল। আনন্দ চেষ্টা চালাচ্ছিল ওদের সঙ্গে কথা বলার। বাচ্চাগুলো লজ্জা পাচ্ছিল, নিজেদের মধ্যে হাসছিল এবং শেষ পর্যন্ত ওদের দুই সঙ্গী পাত্র নিয়ে ফিরে এলে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। আনন্দ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল।

ভারতবর্ষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং তথাকথিত সামাজিক চেহারার যে পরিবর্তন অধিকাংশ মানুষ মনে মনে কামনা করেন অথচ অংশ নেন না সক্রিয়ভাবে ওরা সেখানে আঁচড় কাটতে চেয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে সেটা আঁচড়ও ছিল না। একটা মধুচক্রের মারফত মুনাফাখোরকে ধ্বংস, জাল ওষুধের কারবার বন্ধ করা অথবা অসৎ মন্ত্রীকে খুন করলে অত বড় দেশের কোন উপকার করা হয় না। তার ধারণা ঘটনার মধ্যে দাঁড়িয়ে যত তীব্র ছিল বেরিয়ে এসে সেটাই এখন পানসে ঠেকছে। যে দেশের প্রতিটি মানুষকে বাঁচতে হয় কোন না কোন ভাবে অসৎ হয়ে অথবা অসৎ ছায়ার সঙ্গে তাল রেখে সেখানে ওই ঘটনা কোন রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া যদি সৃষ্টি করে তা অত্যন্ত সাময়িক। হয়তো এতদিনে আরও দশটা জাল ওষুধের কারখানা তৈরি হয়ে গিয়েছে। সাধারণ মানুষমাত্রই চাইবে অন্যের ওপর দিয়ে ঝড়টা যাক, আমি যেন নিরাপদে থাকি। তা ছাড়া দেশের সিস্টেমটাই এমনভাবে তৈরি যে কয়েকটা রাজনৈতিক দল, কিছু ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং তথাকথিত বুদ্ধিজীবী যা করবে মিলেমিশে তাই মেনে নেবে সাধারণ মানুষ। এই মেলামেশাটাও যদিও আপাতচোখে দেখা যায় না, ফলে কৃত্রিম রেষারেষি ছড়িয়ে দেওয়া যায়। সহজেই। ব্যক্তিহত্যা অথবা প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে ধ্বংসের মধ্যে ব্যক্তিগত আনন্দ থাকতে পারে কিন্তু তা করে গণজাগরণ সম্ভব নয়। বস্তুত ভারতবর্ষে সেই ঘটনাটি আদৌ যাতে না ঘটে তার জন্যে ডান এবং বামপন্থীরা সুচতুর চেষ্টা চালিয়ে বেশ স্থিতাবস্থায় এসে গেছে। এই ভাবনা যদি সত্যি হয় তাহলে সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া হবে কল্যাণের। সে নিশ্চয়ই জানতে চাইবে এখন করণীয় কি? সে কেন আগে থেকে খতিয়ে দ্যাখেনি? আনন্দ ছটফট করছিল। তিন-তিনটে ঘটনা ঘটার পর ওরা হিমালয়ে বসে আছে। দেশে কি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তার খানিকটা আন্দাজ নিয়েই এসেছিল কিন্তু সেটা এখন কোন্ অবস্থায় আছে তা জানা যাচ্ছে না। তবে পুলিশ ওদের খুঁজে বেড়াচ্ছে, ধরা পড়লে খুনের দায়ে খুন হতে হবে এবং অধিকাংশ মানুষ সেটাকেই স্বাভাবিক বলে মেনে নেবে। যদি অন্ততপক্ষে একশজন লোক।

এই সময় সুদীপ ডাকল, আনন্দ একবার বাইরে আয়।
 
আনন্দ দরজায় এসে দৃশ্যটা দেখল। কল্যাণ দৌড়ে দৌড়ে পাহাড় থেকে নামছে আর তার পিছনে ও পাশে কয়েকজন যুবক। যেভাবে জন্তুকে তাড়িয়ে নিয়ে আসা হয় ওরা কল্যাণকে সেইভাবেই নিয়ে আসছে। আস্তানার কাছে পৌঁছে কল্যাণ ধপ করে বসে পড়ল। আনন্দ ছুটে গেল ছে, কি হয়েছে? কল্যাণ কোন কথা বলতে পারল না। সে হাঁপাচ্ছে, এই শীতেও তার শরীর ঘামে ভেজা।

এই সময় পালদেমকে দৌড়ে আসতে দেখা গেল। পিছু ধাওয়া করে আসা যুবকদের কাছে ঘটনাটা শুনে পালদেম এগিয়ে এসে কল্যাণকে দেখল, তারপর আনন্দকে প্রশ্ন করল, ওকে তোমরা কোথায় পাঠিয়েছিলে? আমি বলেছিলাম এই গ্রাম ছেড়ে তোমাদের না যেতে, তোমরা শুনলে না!

আনন্দ কল্যাণের দিকে তাকাল। সে চোখ বন্ধ করে তখনও নিঃশ্বাস ফেলছে জোরে জোরে। আনন্দ বলল, ওকে আমরা কোথাও পাঠাইনি। মনে হয় ও পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিল।

না। পালদম প্রায় চিৎকার করে উঠল, ও আমাদের শত্রুপক্ষের গ্রামের দিকে যাচ্ছিল। আমাদের লোক ওকে দেখামাত্রই দৌড়তে আরম্ভ করে। অপরাধী ছাড়া কেউ পালাবার চেষ্টা করে না। তোমাদের বলে দিচ্ছি এই ঘটনাটা যেন দ্বিতীয়বার না ঘটে।

আনন্দ এবারে অবাক। কল্যাণ পালাচ্ছিল? কাউকে কিছু না বলে? কিন্তু ওর সঙ্গে পরে কথা বলা যাবে। সে পালদেমকে জিজ্ঞাসা করল, এখানে তোমাদের শত্রুপক্ষ আছে?

আছে। মাঝে মাঝেই ওরা আমাদের ওপর হামলা করে।

কেন?

পালদেম প্রশ্নটা শুনে এবার হাসল, ওদের যখন খাবার দরকার হয় অথবা মেয়ের প্রয়োজন হয় তখন চলে আসে। শত্রুতা কয়েক পুরুষ ধরেই চলছে। মেয়েটা কি ভাল হয়ে যাবে?

শেষ প্রশ্নের জবাবে প্রশ্ন জয়িতার উদ্দেশে।

ওরা নির্বাক হয়ে বসে ছিল। উত্তরে জয়িতা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

পালদেম বলল, তাহলে তোমাদের মঙ্গল। শোন, আর কদিনের মধ্যে জোর বৃষ্টি হবে। তারপর বরফ পড়বে এখানে। একবার বরফ পড়া শুরু হলে আর পায়ে হেঁটে যাওয়া আসা করা অসম্ভব। তোমরা তাড়াতাড়ি মেয়েটাকে সারিয়ে তোল।

আনন্দ মাথা নাড়ল, আমরা চেষ্টা করছি। আমি কথা দিচ্ছি এখান থেকে কেউ পালাবার চেষ্টা করবে না। যদি কেউ করে তাহলে সে নিজের দায়িত্বে করবে। আর একটা কথা, তোমাদের বেশির ভাগ মানুষের গলাতে যে রোগ হয়েছে তার ওষুধ আমাদের কাছে আছে। যদি চাও আমরা দিতে পারি।

পালদেমের মুখে অবিশ্বাস ফুটে উঠল, এসব বলে তুমি সুবিধে চাইছ? আমার ছেলে দুদিন ধরে শুয়ে আছে। তাকে তুমি সারিয়ে দিতে পারবে কালকের মধ্যে?

আনন্দের বুকে কাঁপুনি এল, কিন্তু সে ঝুঁকি নিতে রাজী হল, কি হয়েছে তোমার ছেলের?

কথা বলছে না, সমস্ত শরীর আগুনের মত গরম আর মাঝে মাঝে শরীর কাঁপছে।




বর্ণনা শুনে আনন্দর একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। গ্রামে তাদের পাশের বাড়ির শিশুটির একই উপসর্গ হয়েছিল। প্রায় কান্নাকাটি পড়ে গিয়েছিল তখন। ডাক্তার এসে বলেছিলেন ওটাকে তড়কা বলে। তিনি শরীর থেকে সমস্ত গরম কাপড় খুলে ফেলে মিনিট দশেক ধরে জল ঢালতে বলেন। তাতে শিশুটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে জ্বর এবং খিচুনি না হবার ওষুধ দিলে সে ভাল হয়ে ওঠে। পালদেমের ছেলের একই অসুখ হয়েছে কিনা সে বুঝতে পারল না। তা ছাড়া শিশুর জন্যে যে ওষুধের প্রয়োজন তা তাদের সঙ্গে নেই। খিচুনি বন্ধের ওষুধ আনার কথা, ভাবারও কোন কারণ ছিল না। সঙ্গে জুরের ট্যাবলেট এবং ক্যাপসুল আছে। সে জিজ্ঞেস করল, তোমার ছেলের বয়স কত?

পাঁচ।

আনন্দ ভেতরে ঢুকে ওষুধের বাক্স খুলল। এই সময় জয়িতার গলা পেল সে, তুই যাবি?

আনন্দ বলল, হ্যাঁ। একটা চান্স নেওয়া যাক। ওয়ান-থার্ড ট্যাবলেট দিলে কাজ হবে বোধ হয়।

জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, কল্যাণ কি পালাতে চেয়েছিল?

আনন্দ বলল, ওটা ওকেই জিজ্ঞাসা কর। কেন যে এমন বোকামি করে। সে ওষুধ নিয়ে উঠে দাঁড়াল।

জয়িতা বলল, আমি তোর সঙ্গে যাব?

আনন্দ মাথা নাড়ল, না। সুদীপ আর কল্যাণ অন্তত এই মুহূর্তে একা থাকুক আমি চাই না।

পালদেমের পাশে হাঁটছিল আনন্দ। সেই সময় টিপটিপ বৃষ্টি নামল। আনন্দ বলল, তোমরা শেষ পর্যন্ত লোকটাকে মেরে ফেললে? অন্য শাস্তি দেওয়া যেত না?

সবাই চাইল। ওর বউ পর্যন্ত বলল এমন স্বামীর সঙ্গে ঘর করতে চায় না।

আনন্দ রমণীটিকে মনে করল। সে জিজ্ঞাসা করল, ওদের ছেলেমেয়ে নেই?

না। আমাদের গ্রামে ছেলেমেয়ের সংখ্যা এমনিতেই কম। লোকটার কোন ভাইও নেই যাতে বউটা বিয়ে করতে পারে। এখন ওকে নিয়ে আবার সমস্যা দেখা দেবে। পালদেম বলল।

আবার কেন?

এর আগে মেয়েটাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল আমাদের শত্রুরা। অনেকে বলে ওরও নাকি যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। এসো।

পালদেমের ঘরে নিচু হয়ে ঢুকল আনন্দ। দুজন রমণী ছেলেটির পাশে বসে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে। পালদেম ঢুকেই তাদের ধমক দিল। সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে গেল ওরা। পালদেম বলল, এই আমার ছেলে। ওকে দেখে যদি মনে কর সারাতে পারবে তাহলেই হাত দাও। নইলে ফিরে যেতে পার।

আনন্দ দেখল বাচ্চাটাকে অনেক কিছু চাপা দেওয়া সত্ত্বেও বারংবার কাঁপছে। মুখ টকটকে লাল। সে জিজ্ঞাসা করল, অসুখ হলে তোমরা কি কর?

পালদেম বলল, কাহন এসে মন্ত্ৰপড়া শেকড় দিয়ে যায়। এবার তাতে কমেনি। তা ছাড়া ওর শরীরে পাহাড়ের দানোটা এসে ঢোকার পর থেকে আমি আর কানকে ডাকিনি।

পাহাড়ের দানো? হতভম্ব হয়ে গেল আনন্দ।

নইলে ওর শরীর অমন করবে কেন? গ্রামের লোকজন যদি জানতে পারে তাহলে দানোটাকে মারবার জন্যে ছেলেটাকেই পুতে দেবে মাটিতে।

চাপা সরিয়ে ছেলেটার নগ্ন শরীরে হাত দিতে অবাক হয়ে গেল আনন্দ। প্রচণ্ড উত্তাপ, ঠিক কতটা জ্বর বোঝা যাচ্ছে না। তবে চারের কম তো নয়ই। ঘাড় শক্ত। চিকিৎসা বিদ্যা সম্পর্কে তার কোন স্বচ্ছ ধারণা নেই। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে তার মনে হল সঙ্গে অন্তত কিছু ওষুধ আছে, এদের তো তাও নেই। ডায়মন্ডহারবারের গ্রামের শিশুটিরও ঘাড় এমন শক্ত ছিল। কিন্তু এই ঠাণ্ডায় যদি জল ঢাললে নিমোনিয়া হয়ে যায়? হলে হবে, কিন্তু এ ছাড়া তো সে কোন রাস্তা জানে না। পাসদেমকে দিয়ে জল আনিয়ে সে নিজের হাতে ন্যাকড়া ভিজিয়ে তাই দিয়ে ছেলেটির শরীরে জল বোলাতে শুরু করল। মিনিট দশেক পরে ওর মনে হল ছেলেটার ঘাড় নরম হচ্ছে, একটু একটু করে খিচুনি কমছে, শেষ পর্যন্ত ছেলেটা চোখ মেলল একবার, তারপর ঘুমিয়ে পড়ল। আনন্দ বুঝল ওর আরাম হচ্ছে। শরীরটা পরিষ্কার করে মুছিয়ে দিয়ে ও ট্যাবলেট তিন টুকরো করল। টুকরোটা গুড়ো করে নিয়ে জলের সঙ্গে মিশিয়ে ছেলেটার মুখে জোর করে ঢেলে দিল সে। ঘরের তিনটে মানুষ চুপচাপ তার কাজ দেখছিল।

পালদেম বলল, দানোটা বোধ হয় ওর শরীর থেকে বেরিয়েছে, না?

আনন্দ মাথা নাড়ল, তুমি আমার বন্ধুদের বল খেয়ে নিতে। আমাকে এখানে বসে থাকতে হবে, নইলে তোমার দানো আবার ফিরে আসতে পারে।

পালদেম বলল, আমি তোমার খাবার এখানে এনে দিচ্ছি। তুমি উঠো না।

আনন্দ বাচ্চাটার কপালে হাত রাখল। জ্বর সামান্য কমেছে বলে মনে হল। সে একমনে প্রার্থনা করছিল ওষুধটা যেন জাল না হয়, যেন কাজ দেয়।
 
৩৫.
ঠায় সাত ঘণ্টা এক জায়গায় চুপচাপ বসে রইল আনন্দ।

তার চোখের সামনে একটু একটু করে বাচ্চাটা সহজ হচ্ছে, জল এবং ওষুধ যে কাজ করছে তা জানার পর থেকেই এক ধরনের উত্তেজনা যেন নেশার মত পেয়ে বসেছিল তাকে। পরে সে এই ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছে। শরীরের লক্ষণ বিচার করে অসুখের স্বরূপ নির্ধারণ করা হয়। বিশেষজ্ঞরা তা চিকিৎসকদের জন্যে করে গেছেন। সেই নির্দেশ অনুযায়ী সঠিক বুঝে নিয়ে ওষুধ দেওয়া হয়। মানব শরীরের জটিল জগতের গোলমেলে জায়গাটায় ঠিক ওষুধ পড়লেও যে সব সময় প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক হবে এমন ভাবার কারণ নেই। কারণ সব মানুষই এক নিয়মে চলে না। যদি ওষুধে চমৎকার কাজ করে তাহলে সেই মুহূর্তে চিকিৎসক প্রায় ঈশ্বরের সমতুল্য হয়ে যান রোগীর চোখে। আর সাফল্যের আনন্দ তাঁকেও উৎসাহিত করে। কিন্তু যদি ওষুধ মাথা ঠোকে তাহলে তার অবস্থা হয় অত্যন্ত করুণ। হাতড়াতে হাতড়াতে কোনরকমে ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টা চলে তখন। অর্থাৎ মানুষের শরীরের কর্মকাণ্ড চোখের আড়ালে রেখেও প্রখর অনুমান শক্তির সাহায্যে সঠিক ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়। এইভাবে একটা দেশের অসুখ সারাবারও চেষ্টা চলেছে। কিন্তু মুশকিল হল প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনুমান ভুল হয়ে যাওয়ায় ওষুধ কোন কাজেই লাগে না। বিশেষজ্ঞরা মানুষের মুক্তির যেসব ফর্মুলা তৈরি করে দিয়েছেন তাও ওই শরীরের মতই দেশে দেশে একইভাবে কাজে লাগে না। সেদিন যেভাবে বাচ্চাটার ঘাড় নরম হয়েছিল, একটু একটু করে জ্বর কমেছিল এবং সাত ঘণ্টার পরে সহজ হয়ে হেসেছিল সেইভাবে যদি একটা দেশকে সুস্থ করা যেত!

পালদেম ওর হাত চেপে ধরল। ওর মুখ চোখে কৃতজ্ঞতা। পালদেমের স্ত্রী একটা পোড়াটে মোটা রুটি আর জল এনে সামনে রাখল। খবরটা চারপাশে ছড়িয়েছে। এর আগে পালদেম আস্তানা থেকে আনন্দর অংশের খিচুড়ি নিয়ে এসেছিল। কিন্তু সেটা ছোঁয়া হয়নি। এখন অত্যন্ত ক্ষুধার্ত বোধ করল সে। কাল রাত্রের রুটির অভিজ্ঞতায় ওই ঠাণ্ডা শক্ত হয়ে যাওয়া খিচুড়ি অনেক শ্রেয়। কিন্তু পালদেমের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে সে রুটি তুলে নিল। সত্যিই অখাদ্য কিন্তু বালির অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না। বাচ্চাটা আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। আনন্দ পালদেমের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল দিনের চিহ্ন কোথাও নেই। পালদেমদের ঘরে দিনরাত এখন কাঠের আগুন জ্বলছে। কেরোসিনের ব্যবহার এই গ্রামে নেই। কিন্তু লাঠির গায়ে এক ধরনের ছাল শক্ত করে জড়িয়ে সেটাকে মশালের মত ব্যবহার করা হয়।

কনকনে ঠাণ্ডায় আনন্দ আর পালদেম হাঁটছিল। আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, সেই মেয়েটা কেমন আছে এখন?

পালদেম জবাব দিল, নিশ্চয়ই মারা যায়নি। তাহলে জানতে পারতাম।

আনন্দ বলল, পালদেম, আমরা যদি এখানে কিছুদিন থাকি তাহলে তোমাদের আপত্তি হবে?

কথাটা শুনে পালদেম অবাক হয়ে বলল, এখানে থাকতে যাবে কেন? এখানে খুব কষ্ট!

জানি। কষ্ট পৃথিবীর সব জায়গায় আছে তবে এক এক রকম। আমি কথা দিচ্ছি আমাদের কাছ থেকে তোমাদের কোন বিপদ আসবে না।

আনন্দর কথায় কোন জবাব দিল না পালদেম। চুপচাপ তাকে আস্তানা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বলল, আমার ছেলের জন্যে তুমি যা করেছ তা আমি মনে রাখব। তারপর চলে গেল।

দরজায় শব্দ করতে সুদীপ সেটা খুলল, কেমন আছে?

ভাল। কিছু খেতে দিবি? আমি আর দাঁড়াতে পারছি না। আনন্দ ভেতরে এসে নিজের বিছানায় সেঁধিয়ে গিয়ে চোখ বন্ধ করল। সে ঢোকার সময় দেখেছিল এই ঘরেও ওই মশাল জ্বলছে। জয়িতা নেই। কল্যাণ শুয়ে আছে। সুদীপ এসে ডাকতেই আনন্দ চোখ খুলে চমকে উঠল, এ কিরে!

তার সামনে খানিকটা শক্ত খিচুড়ি আর একটা মুরগীর ঠ্যাং, সম্ভবত পোড়ানো। সুদীপ বলল, স্মাকড চিকেন। পালদেমের বাড়ি থেকে পাঠিয়েছিল মুরগীটা। একটু ধোঁয়ার গন্ধ হয়ে গেছে গুরু কিন্তু টেস্ট দারুণ। বাপের জন্মে এমন রাঁধব কে ভেবেছিল!

খাবার শেষ করে তৃপ্ত আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, জয়িতা কোথায়?

ও সেই মেয়েটার কাছে গিয়েছে। তোরা দুজন যা আরম্ভ করেছিস!

কিন্তু ওখান থেকে এত রাত্রে একা ফিরবে কি করে?

বিকেলে আমি গিয়েছিলাম খবর নিতে। বলল, রাত হয়ে গেলে ওখানেই থেকে যাবে। মেয়েটার ঘা আমি দেখেছি। কিস্যু করার নেই। কেন যে ছাই আগ বাড়িয়ে উপকার করতে গেলাম। সুদীপ ট্রানজিস্টার বের করল।
 
আনন্দ দেখল কল্যাণ চোখ বন্ধ করে মড়ার মত পড়ে আছে। সকালে ও পালাতে চেয়েছিল। রাগের বদলে ওর জন্যে কষ্ট হচ্ছিল আনন্দর। কিন্তু এখন কিছু বলতে যাওয়া মানে সেটা খুব বানানো শোনাবে। হয়তো সেটা ওর ভালও লাগবে না। ঠিক তখনই কিছু বিচিত্র শব্দ বের করার পর অত উচ্চারণে বাংলায় খবর শুরু হল, জোট নিরপেক্ষ দেশগুলি একযোগে ব্রিটেনের বৈদেশিক নীতির সমালোচনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী মিসেস মার্গারেট থ্যাচারকে আজ হিথরো এয়ারপোর্টে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন যে, তাঁর সরকার ব্যাপারটি নজরে রেখেছেন। আমাদের নয়াদিল্লিস্থ সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী সে দেশের সংসদে ঘোষণা করেছেন, যে কোন বিচ্ছিন্নতাকামী শক্তিকে তার সরকার কঠোর হাতে দমন করবেন। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, গোখাল্যান্ডের দাবী মানার কোন প্রশ্ন ওঠে না। আমাদের সংবাদদাতা আরও জানাচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর রাজ্যে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ধ্বংসাত্মক কাজের জন্যে চারজন বিপথগামী তরুণকে দায়ী করেছেন। এরা এখন ভারতবর্ষের সীমানা ছাড়িয়ে নেপালে আশ্রয় নিয়েছে বলে তার কাছে খবর আছে। এ ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এবার আসুন আপনাদের নিয়ে যাই লন্ডনের বইমেলায়। শব্দটাকে কমিয়ে দিয়ে সুদীপ চিৎকার করল, শুনেছিস?

আনন্দ নির্লিপ্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, কোন্ স্টেশন রে?

ভয়েস অফ আমেরিকা অথবা বি বি সি। হ্যাঁ, বি বি সি।

যাক, আমরা তাহলে আন্তর্জাতিক সংবাদ হয়ে গেলাম। আনন্দ আবার চোখ বন্ধ করল।

তাতে কোন্ স্বর্গ পাওয়া গেল। আচমকা কল্যাণ কথাগুলো বলে উঠতেই দুজন ওর দিকে মুখ ফেরাল। কল্যাণ বলল, ওরা এখন টের পেয়ে গেছে আমরা এখানে এসেছি। এটা এমন একটা জায়গা

যে পালিয়ে বাঁচার রাস্তা খোলা নেই। এখন ওরা আমাদের গলা টিপে মারবে। উঃ!

অদ্ভুত শোনাচ্ছিল ওর গলা। আনন্দ উঠে বসল, ওরা এখনও জানে না আমরা কোথায় আছি।

সেই আনন্দেই থাক। ওয়াংদে নিশ্চয়ই ফিরে গিয়ে সব বলে দিয়েছে। আমি এখন কি করি?

সুদীপ এবার কথা বলল, কাল পালদেমকে বলব তোকে ফালুটের পথে পৌঁছে দেবে।

তা তো বলবিই। আমাকে মেরে ফেলতে পোরা চাইবিই।

কেন? আনন্দ বিস্মিত হল। তাদের কেউ এইরকম কথা বলছে ভাবতে পারছে না সে।

আমি তোদের সঙ্গে সুর মেলাতে পারছি না। আমি ওষুধপত্র জানি না, কোন ফালতু কাজ করতে চাইছি না, আমার জন্যে তোদের খাবার নষ্ট হচ্ছে। সুদীপ আর জয়িতা অবস্থাপন্ন, তুই মধ্যবিত্ত আর আমি বিত্তহীন। আমাকে তোরা পাত্তা দিবি কেন? শেষের দিকে কল্যাণের গলার স্বর অন্যরকম শোনাল। যেন আর একটু হলেই তার পক্ষে কেঁদে ফেলা অসম্ভব নয়।

সুদীপ বলল, তুই মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছিস কল্যাণ। তোর সম্পর্কে কেউ কিছু ভাবছে না। আমরা একসঙ্গে বেরিয়েছি, আমরা কেউ কারও শত্রু নই। তুই ঘুমিয়ে পড়।

আনন্দ কোন কথা বলছিল না। তার মনে পড়ল হোস্টেলের একটি ছেলের কথা। ও এসেছিল রায়গঞ্জ থেকে। খুবই গরীব। কারও সঙ্গে কথা বলত না। কলেজ ছাড়া কোথাও যেত না। দুবেলা হোস্টেলের খাবার ছাড়া অন্য কিছু খাওয়ার সামর্থ্য বোধ হয় ছিল না। কিন্তু সব সময় মনে করত অন্যান্য ছেলেরা বোধ হয় তাকে নিয়ে ঠাট্টা করছে। মনে মনে ব্যাপারটা বানিয়ে নিয়ে সে ক্রমশ এমন কমপ্লেক্সে ভুগতে শুরু করল যে বেচারার পড়াশুনাটাও হল না। এই ছেলেটার সঙ্গে কল্যাণের কথাবার্তা মিলে যাচ্ছে। অক্ষমতা মানুষকে অভিমান দেয় কিন্তু অভিমান কি সব সময় আত্মহননে সাহায্য করে? কিভাবে কল্যাণকে সাহায্য করা যায়?

এই সময় বৃষ্টি শুরু হল। বৃষ্টির সঙ্গে ঠাণ্ডা বাড়ছিল। ওরা আর কেউ কথা বলছিল না।
 
আনন্দরই ঘুম ভাঙল প্রথমে। মশালটা নিবে গেছে। ঘর অন্ধকার। শুধু মানুষের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া কোন আওয়াজ কানে আসছে না। অর্থাৎ বৃষ্টি থেমে গেছে। এই ঠাণ্ডায় শরীর বাইরে বের করা কঠিন ব্যাপার কিন্তু তলপেটের চাপ বাড়ায় আনন্দকে বেরুতে হল। হাতড়ে হাতড়ে সে দরজার কাছে পেীছে গেল। সেটা খুলতেই মনে হল সমস্ত শরীর জমে যাবে। দ্রুত কয়েক পা এগিয়ে সে ভারমুক্ত হল। তারপর ছুটে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার চোখ বিস্ফারিত।

সূর্য উঠছে। আকাশ এখন পরিষ্কার। সমস্ত চরাচরে অন্ধকারের পাতলা মশারি এখনও টাঙানো। কিন্তু পর্বতশৃঙ্গের (এই শব্দটি ছাড়া আনন্দর ওই মুহূর্তে অন্য কিছু মনে হল না) ওপর সূর্যের আলো পড়েছে। সূর্যটাকে কিন্তু এখনও দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু শৃঙ্গগুলোয় আমোর খেলা চলেছে মারাত্মকভাবে। ব্যাপারটা শুরু হয়েছে নিশ্চয়ই অনেক আগে। এখন শেষ মুহূর্ত, একটু বাদে তিনি প্রকাশিত হবেন। শৃঙ্গগুলো লক্ষ্য করল আনন্দ। ছামলা, বারুণৎসে, নাপসে, লোহসে, মাকালু, ছোমা এবং সবার পেছনে মহান উদ্ধত এভারেস্ট। সমস্ত রেঞ্জটা সাদা কমলায় মাখামাখি। আনন্দ চিৎকার করে বন্ধুদের ডাকল। ওদের উঠতে যত সময় লাগছে তত আলোর রঙ পালটাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে সুদীপ এসে দাঁড়াল। দাঁড়িয়েই বলল, আঃ!

আনন্দ দেখল কল্যাণ আসেনি। সে দ্রুত ভেতরে ঢুকল। কল্যাণ জেগেছে কিন্তু এখনও চুপচাপ শুয়ে আছে। আনন্দ ওর হাত ধরল, উঠে পড়। কি দারুণ সূর্যোদয় হচ্ছে।

তাতে আমার কি? নির্লিপ্ত গলায় বলল কল্যাণ।

সেটা না দেখলে বুঝবি না। আমি তোকে হুকুম করছি উঠতে।

যেন বাধ্য হল কল্যাণ। তারপর নিতান্ত অনিচ্ছায় ধীরে ধীরে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ঠিক সেই মুহূর্তে সুর্যের মুখ দেখা যেতেই কল্যাণ আচমকা শব্দ করে কেঁদে উঠল।

সুদীপ এবং আনন্দ চমকে উঠল। নিজেকে দ্রুত সামলে নিতে চাইছিল কল্যাণ। তারপর যেন একটা কৈফিয়ৎ দেওয়ার ভঙ্গিতেই বলল, কি অদ্ভুত সুন্দর, না!

ওরা কেউ জবাব দিল না। যতক্ষণ শৃঙ্গগুলো সাদা না হয়ে যায় ততক্ষণ সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর সুদীপ আনন্দকে বলল, আমাদের একবার জয়িতার খোঁজ নেওয়া উচিত।

আনন্দ মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। কল্যাণ, তুই সুদীপের সঙ্গে গিয়ে দেখে আয়। আমি চা করছি।

ওরা চলে গেলে আনন্দ কাঠের সিঁড়ির ওপর বসে পড়ল। যতই ঠাণ্ডা বাড়ক সেটাকে শরীর ঠিক সইয়ে নিতে পারে সময় পেলে। এবং তখনই আনন্দর নজরে পড়ল কাছাকাছি সব উঁচু জায়গা সাদাটে হয়ে গেছে, এমনকি ঘাসের ওপরেও কুচি কুচি বরফ। অর্থাৎ কাল রাত্রের বৃষ্টির পরে এই কাণ্ডটি ঘটেছে। শীত আসছে। ক্রমশ সমস্ত চরাচর সাদা বরফে ঢেকে যাবে। সময় বেশি নেই, যা করবার এখনই করতে হবে। কিন্তু কিভাবে, সেটাই প্রশ্ন।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top