What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected গর্ভধারিণী - সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

কিন্তু তারপরেই সব চুপচাপ। একমাত্র জলেব শব্দ কানে। সুদীপ উঠল। পাথরের আড়ালে আড়ালে কিছুটা এগোতেই সে থমকে দাঁড়াল। একটা লোক ঝরনার ওপাশে নিজেকে যতটা সম্ভব লুকিয়ে রেখে ওপরদিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ দেখার পর মুখ ফিরিয়ে নিচে কাউকে কিছু বলল। তারপর আবার মুখ তুলতেই সুদীপের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল।

একটু হতভম্ব ভাব, তারপরেই ঝট করে আড়ালে চলে গেল মূর্তিটা। এবং সেইসঙ্গে দ্রুত পায়ের আওয়াজ ওপাশের পাহাড়ে মিলিয়ে গেল। লোকটা ভাবভঙ্গি খুব সন্দেহজনক! চেহারাতেও বিশেষত্ব আছে। সরু দুটো গোঁফ মুখের দুপাশে অনেকটা ঝুলে আছে। সুদাপেব ইচ্ছে হচ্ছিল ওকে অনুসরণ করে। কিন্তু ঝরনাটা পার হবার কথা চিন্তা করে সে থমকে গেল। তাছাড়া ওই লোকটা একা ছিল না। একা একা পাগল কিংবা প্রেমে পড়া মহিলা ছাড়া কেউ কথা বলে না। এই অবস্থায় ঝরনা পাব হতে পারলেও অনুসরণ করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

কিন্তু ওরা কারা? এই গ্রামের কেউ লুকিয়ে দেখবে কেন? তাকে দেখামাত্র পালাবার কোন কারণ নেই। তাছাড়া এই কদিনে গ্রামের যত মানুষ দেখেছে তাদের কাবও অমন ছুঁচলো ঝোলা গোঁফ চোখে পড়েনি। ব্যাপারটা অবশ্যই সন্দেহজনক।

সুদীপ ধীরে ধীরে গ্রামে উঠে এল। এখন হেঁটে গেলে গ্রামের মানুষ আগের মত অবাক হয়ে তাকায়। কিন্তু তাদের দেখার মধ্যে যে কৌতূহল নেই তাও বলা যায় না। সুদীপকে দেখে বাচ্চা ছেলে আঙুল তুলে দূরের একটা বাড়ি দেখাল। খানিকটা যেতেই সে আনন্দ আর পালদেমকে দেখতে পেল। আনন্দর মুখ গম্ভীর। পালদেমও অন্যদিকে তাকিয়ে। এই সময় কাহুন ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে পালদেমকে কিছু বলতেই সে মাথা নাড়ল নিঃশব্দে। সুদীপ সামনে দাঁড়াতেই আনন্দ মুখ তুলে ওকে দেখল, মেয়েটাকে আর বাঁচানো গেল না। মনে হচ্ছে লাস্ট স্টেজ। আমি খুব ভুল করেছি।

কি ভুল? সুদীপ নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল।

ওকে প্রথম দিনেই এদের দিয়ে দার্জিলিং-এ পাঠানো উচিত ছিল। এই কদিনে তো পৌঁছে যেত। হসপিটাল ট্রিটমেন্ট পেলে হয়তো বেঁচে যেত।

ওরা দার্জিলিঙে যেত না। এই গ্রামে মৃত্যু নিশ্চয়ই নতুন ব্যাপার নয়। কিন্তু যারা কখনই গ্রামের বাইরে যায়নি তাদের দার্জিলিঙে অসুস্থকে নিয়ে যাওয়া সংস্কারে আটকাবে। কথাটা বলে সুদীপ দরজার দিকে তাকাল। সেখানে মোটামুটি ছোট ভিড়। সেই ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এল মেয়েটির মা। এবার তার চোখ পড়ল সুদীপের ওপর। পড়ামাত্র তার চোখ জ্বলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের পাশে রাখা একটা মোটা ডাল তুলে তীব্র চিৎকার করে সে ছুটে এল সামনে। কিছু বোঝার আগে সে আঘাত করল সুদীপকে। একটা হাত তুলে কোনরকমে ডালটা ধরলেও সুদীপের মনে হল তার আঙুলগুলো বোধহয় ভেঙে গেল। পাগলের মত মহিলা এবার ঝাঁপিয়ে পড়ল খালিহাতে সুদীপের ওপর। সেইসঙ্গে চিৎকার আর কান্না চলছিল। পালদেমরা ওকে জোর করে সরিয়ে না নিলে কি হত বলা যায় না। কারণ সুদীপ এতটা হকচকিয়ে গিয়েছিল যে আত্মরক্ষা করাও অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। শোক থেকে জন্ম নেওয়া ক্রোধ মহিলার শরীরে হাতির শক্তি এনে দিয়েছিল। সে এটুকু বুঝতে পেরেছিল আশেপাশের বেশির ভাগ মানুষের সহানুভূতি রমনীটি পাচ্ছে। অতএব পালটা আঘাত করে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করলে হিতে বিপরীত হবে। রমণীটিকে ওরা যখন খানিকটা দূরে নিয়ে গেল তখন তার বিলাপ শুরু হল। ভাষা বুঝতে না পারলেও মেয়েটির চলে যাওয়ার সম্ভাবনার জন্যে তাকে দায়ী করা হচ্ছে অনুমান করল সে। এখন রাগ করে কোন লাভ নেই। সুদীপ নিজের মুখে হাত দিল! প্রচণ্ড জ্বলছে। এবং সেইসঙ্গে সে কয়েক ফোঁটা রক্ত আঙুলে উঠে আসতে দেখল। এবার পালদেম এগিয়ে এল, মেয়েটা হয়তো এমনিতেই মরত কিন্তু বেঁচে থাকত। তবে যতক্ষণ না ওর প্রাণ বের হচ্ছে ততক্ষণ কিছু কবার নেই। কাহুন এখন প্রার্থনা করবে ওর জন্যে।


কিন্তু সুদীপের মনে হল পালদেম বলছে এখন নিজেদের জন্যে প্রার্থনা কর। মেয়েটি মরে গেলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে বলে যে হুমকি দেওয়া হয়েছে তা এখনও প্রত্যাহার করেনি ওরা। সে আনন্দর দিকে তাকাল। আনন্দ কথা বলছে না। তাকে যে আক্রমণ করল রমণীটি তা দেখেও আনন্দ এক চুলও নড়েনি।

এই সময় কাহুনের দুই শিষ্য ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে যাত্রা শুরু করল। কানের পিছু পিছু সমবেত জনতা উঠে যাচ্ছিল মন্দিরের দিকে। সুদীপ অবাক হয়ে দেখল আনন্দ ওদের সঙ্গ নিয়েছে। গম্ভীর মুখে পালদেমের পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে। ক্রমশ ভিড় সরে গেল। সুদীপ দখল রমণীটি তখন ঘরের সামনে উবু হয়ে বসে আছে। সে কিছু না ভেবে এগিয়ে গিয়ে হিন্দিতে বলার চেষ্টা করল, আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন, আমি আপনার মেয়ের উপকার করতে চেয়েছিলাম।

রমনীটি চোখ খুলল। যেন সে সুদীপকে দেখল না, দেখতে পেল না। তারপর আবার মুখ নামিয়ে নিল। সুদীপ আর পড়ল না। নিজেকে হঠাৎ খুব ফালতু বলে মনে হচ্ছিল তার।
 
দার্জিলিং শহরের বাসস্ট্যান্ডে যখন কল্যাণ নামল তখন তাকে দেখে যে কেউ বলে দিতে পারত পুবে হিমালয়টা হেঁটে এসেছে। রিম্বিকের নিচে বাসে ওঠার পর থেকে সে ঘুমিয়েছে আর এই ঘুম তার ঘোর আরও বাড়িয়েছে। তাপল্যাঙ থেকে ফালুট, ফালুট থেকে সান্দাকফু হয়ে বিকেভঞ্জন পর্যন্ত হেঁটে আসার সময় অনেকরার গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করেছিল ওর। কুঁচকি পর্যন্ত পা ফুলে ঢোল, শরীরে আর রক্ত নেই, দুটো রাত পাহাড়ের খাঁজে হিমে জমে থাকা। তারপর বিকেভঞ্জন থেকে ঢালু পাহাড়ী জঙ্গল দিয়ে একা একা প্রায় গড়িয়ে রিম্বিকে চলে আসা। যা হিসেব ছিল তার চেয়ে একটা দিন বেশি লাগল কিন্তু কল্যাণের মনে হল সে ছিবড়ে হয়ে গিয়েছে।

নিচুমানের একটা হোটেলে পেটভর্তি ভাত খেয়ে সে সারা দুপুর ঘুমল। বিকেলে যখন তার হুঁশ ফিরল তখন সমস্ত শরীরে বেদনা। বিছানা ছাড়ার বিন্দুমাত্র বাসনা হচ্ছিল না। কল্যাণের মনে হল এইভাবেই যদি সারাজীবন শুয়ে থাকা যেত। ছেলেটা যেমন বলা হয়েছিল, সান্দাকফুর কাছেই রয়ে গেল পাহাড়ের আড়ালে। ওই বকম একটা জায়গায় কি করে একটা মানুষ কাটাতে পারে তা তখন খেয়াল হয়নি, এখন মনে হল তাকে যদি কয়েক লক্ষ টাকাও দেওযা হয় সে থাকত না। ওরকম বীভৎস ঠাণ্ডা সে কখনও কল্পনা করেনি। তাই ওকে ছেড়ে আসার সময় সে আনন্দর নির্দেশ অমান্য করেছে। টেন্ট এবং খাবারদাবারের সবটাই দিয়ে এসেছে ছেলেটাকে। ছেলেটা কৃতজ্ঞ হয়েছে কিন্তু সে নিজে বেঁচেছে। যেখানে নিজের শরীরের ওজনই শত্রুতা করছিল সেখানে ওই বোঝা বইবার কোন ক্ষমতা আর অবশিষ্ট ছিল না। অনেকগুলো আতঙ্ক ছিল অবশ্য কিন্তু তখন মনে হয়েছিল ছেলেটাকে না দিয়ে দিলে মাঝপথে তাকেই ওসব ফেলে যেতে হত। সান্দাকফু থেকে রিম্বিকে পৌঁছতে পুরো দিন লেগে গিয়েছিল। ওই সময় কিছুই খায়নি সে খাবার না থাকায়। যদি পথ ভুল হত, যদি রিম্বিকের ইয়ুথ হোস্টেলে জায়গা না পাওয়া যেত তাহলে আর দার্জিলিং-এ জীবনে পৌঁছানো যেত না। দুনম্বর ঝামেলা ছিল মানেভঞ্জনের সেই ব্যবসায়ীকে নিয়ে যে তাদের টেন্ট ভাড়া দিয়েছিল। ওয়াংদের কাছে খবর পেয়ে লোকটা নিশ্চয়ই ওৎ পেতে আছে। ফালুটের রাস্তায় ওঠার পর থেকেই সে অবশ্য আশঙ্কা করেছিল যে কোন মুহূর্তে ভারতীয় পুলিশকে দেখতে পাবে। ওরকম নির্জন সরু পাহাড়ি পথে পুলিশের সামনে পড়লে দুটো হাত আকাশে তুলে দেওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না। অথচ কিছুই হল না। একটা লোকও তাকে চ্যালেঞ্জ করেনি। রিম্বিকের ফরেস্ট অফিসার তাকে ট্রেকার বলেই ভেবেছেন এবং মিনিবাসটা যখন মানেভঞ্জনে থামল তখন পেছনের সিটে বসে কল্যাণ চোখ বন্ধ করে মাথা হেলিয়ে বসেছিল। অনেক লোক নামল উঠল, ব্যবসায়ী গাড়িতে তল্লাস করতে উঠেছিল কিনা জানা নেই কিন্তু কেউ তাকে টেনে নামায়নি।

আজ হোটেলের ঠাণ্ডা জলেই স্নান করেছে কল্যাণ এবং তখন নিজেকে দেখে সে আঁতকে উঠেছে। সমস্ত শরীরে গুড়ি গুড়ি অ্যালার্জি, পায়ে ফোস্কা, চুলে এত আঠা যে আঙুল পর্যন্ত ভাল করে ঢুকছে না। কম্বলের তলায় শুয়ে কল্যাণের মনে হল এখন পৃথিবীতে সমস্ত মানুষ আরাম করছে, প্রত্যেকে সামান্য সুখের জন্যে একটুও স্বার্থত্যাগ করতে রাজি নয় যেখানে সেখানে মূখের মত এইভাবে কষ্ট যন্ত্রণা সংগ্রহ করার কোন মানে হয় না। এবং তখনই তার মনে হল সে নিজে মুখদের সেরা। কি দরকার ছিল উট দেখিয়ে আগ বাড়িয়ে দার্জিলিং-এ আসার জেদ ধরার? আনন্দ আসছিল, আসত। আর এসে হাড়ে হাড়ে বুঝত। নিজেকে হিরো প্রমাণ করতে গিয়ে এখন মাশুল দিতে হচ্ছে। মাশুলই, না হলে এখন বিছানা ছাড়তে এত কষ্ট হবে কেন? তাছাড়া শরীরের ব্যথার সঙ্গে মনে হচ্ছে জ্বর আসছে।

কল্যাণ চোখ বন্ধ করতেই সুদীপকে দেখতে পেল। ওখানে একটাই কষ্ট, খাবারের। কিন্তু ওছাড়া সুদীপ নিশ্চয়ই বেশ আরামে আছে। আচ্ছা, জয়িতাটা শেষ মুহূর্তে অমন ছুটে এল কেন? জয়িতার ভাব বেশি সুদীপের সঙ্গে। কিন্তু ওই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল তাকে যেন কিছু বলতে চেয়েছিল। সাত দিন সাত দিনে ফিরতে বলা হয়েছে তাকে। অসম্ভব। এবং ফেরার কথা মনে হতেই সে স্থির হয়ে গেল। ওই পথে অত ঠাণ্ডায় এবং সভ্যতাবর্জিত পর্বতে আবার তাকে ফিরে যেতে হবে বিছানার এই আরাম ছেড়ে? কেন? কল্যাণের মনে তীব্র অনিচ্ছা জন্মাল। সাতদিনের চারটে দিন শেষ হয়ে গেছে। নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছানো যাবে না। এমনও হতে পারে সেই মেয়েটি মারা গেছে, সাত দিনের মধ্যে সে ওষুধ নিয়ে না ফেরায়। ক্ষিপ্ত গ্রামবাসী ওদের মেরে ফেলেছে। আর এই অবস্থায় সে যদি ফিরে যায় তাহলে জ্বলন্ত কড়াই-এ পা বাড়ানো। জেনেশুনে কেউ ফাঁদে পড়ে!
 
আরও কিছুক্ষণ স্থির হয়ে পড়ে থাকার পরে কল্যাণ আবিষ্কার করল তার ঘুম আসছে না। অথচ ক্লান্তি চেপে বসেছে সমস্ত শরীরে। যতক্ষণ হেঁটেছে ততক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিল, এখন আরাম পাওয়ামাত্র সবকিছু বিকল হতে বসেছে। নিজের জন্যেই কিছু ওষুধ দরকার। কোনমতে উঠে বসল সে।

বাস থেকে নেমে দালালের সঙ্গে এই হোটেলে আসার সময় থানার সামনে দিয়ে আসতে হয়েছিল। কয়েকটা অস্ত্রধারী সেপাই দাঁড়িয়েও ছিল সেখানে। কিন্তু কেউ কিছু বলেনি তাকে। এখন কি দার্জিলিং শহরে তাদের খোঁজ চলছে না? একটা খবরের কাগজ পেলে হত। আসবার সময় পথে একটা ওষুধের দোকান চোখে পড়েছিল। কোনরকমে পোশাক পরে দরজায় তালা দিয়ে কাঁধে ব্যাগটা নিয়ে বের হল কল্যাণ। অনেকদিন বাদে চটি পরায় মনে হচ্ছে ফুলের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পায়ের ফোসকাগুলো অবশ্য জানান দিচ্ছে। সে বাইরের ঘরে আসতে একটা গলা শুনতে পেল, খুব ঘুম হল ভাস্করবাবু। সে প্রথমে বুঝতে পারেনি। এবার ডাকটা জোরে এল, ও ভাস্করবাবু!

এবং তখনই কল্যাণের মনে পড়ল হোটেলের খাতায় সে ওই নামটা লিখিয়েছে। অতএব ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকে হাসতে হল, ওহো বলুন।

কি ভাবছিলেন মশাই? ম্যানেজার চশমার ফাঁকে তাকালেন।

না, শরীরটা খারাপ। একটা কিছু ওষুধ কিনব বলে বেরিয়েছি।

দার্জিলিং-এ এসে শরীর খারাপ করে ফেললেন! খুব হেঁটেছেন?

অ্যাঁ! কল্যাণ চমকে উঠল।

আপনাকে দেখেই বুঝতে পেরেছি ট্রেক করে এলেন। কোনদিকে? সান্দাকফু?

হ্যাঁ। কল্যাণ আর কোন উত্তর খুঁজে পাচ্ছিল না।

ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছেন কেন? আমার এখানে চুরিচামারি হয় না মশাই।

কাধে ব্যাগ বওয়া আমার অনেকদিনের অভ্যেস।

অ। কিন্তু অমন আলপটকা ওষুধ খাচ্ছেন কেন? একজন ডাক্তার দেখিয়ে প্রেসক্রাইব করিয়ে নিন। আজকাল সবাই যেন ডাক্তার হয়ে গেছে। বিদেশবিভুঁই-এ বড় অসুখ বাধানোর কোন মানে আছে? সোজা বেরিয়ে হলুদ একটা বাড়ি দেখতে পাবেন। সেটা ছাড়িয়ে ডান হাতে হরেকৃষ্ণ ডাক্তারের চেম্বার। আমার কথা বলবেন, যত্ন করে দেখবে।

অতএব কল্যাণ বেরিয়ে এল, এখনও দার্জিলিং-এ সন্ধ্যে হয়নি। রাস্তায় কিছু পর্যটকের আনাগোনা। হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছিল কল্যাণের। কিন্তু পা বাড়িয়ে ক্রমশ ভাল লাগা শুরু হল। জিপের হেলপার চিৎকার করে আগামী কাল টাইগার হিলে যাওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে। দার্জিলিং-এর ওপরে মেঘ নেই, ফলে পাহাড়গুলো বড় সুন্দর দেখাচ্ছে এখান থেকে। শহরটাকে ছবির মত মনে হচ্ছে। সে এই প্রথম দার্লিলিং-এ এল। শহরটাকে ঘুরে দেখার লোভ হচ্ছিল তার। কিন্তু কেবলই মনে হচ্ছিল কেউ না কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে। আর কিছু না হোক প্রচুর টাকা আছে তার কাছে। আচ্ছা, এখন যদি কোন বাস ধরে সোজা নিউ জলপাইগুড়িতে চলে যাওয়া যায়। তার পরে ট্রেন ধরে কলকাতা। যাওয়ামাত্র কি তাকে অ্যারেস্ট কববে? কলকাতার বদলে যদি কানপুরে যাওয়া যায়? সঙ্গে যা টাকা আছে তাতে বেশ কিছুদিন সময় পাওয়া যাবে একটা চাকরি খুঁজে পাওয়ার। কথাটা মাথায় আসামাত্র স্থির হয়ে দাঁড়াল সে। জীবন মানে যদি এই তাহলে তো সেটা কলকাতায় বসেই পাওয়া যেত। কোন প্রয়োজন ছিল না এত ঝামেলা তৈরি করার।

হাঁটতে হাঁটতে ক্রমশ কল্যাণের মনে একটা জেদ চেপে বসছিল। কিছুই হবে না তার। কেউ তাকে ধরবে না। পুলিশ জানে তারা নেপালে আশ্রয় নিয়েছে। এবং তখনই তার জয়িতার মুখ মনে পড়ল। সে আনন্দকে থামিয়ে দায়িত্বটা নেবার পর জয়িতার ঠোঁটে কি হাসি ফুটেছিল? সুদীপ নিশ্চয়ই ভাবছে এই সুযোগে কল্যাণ হাওয়া হয়ে যাবে। না। যাই হোক না কেন, ওষুধগুলো নিয়ে তাপল্যাঙে ফিরে যেতেই হবে। এবং এই যাওয়াটা তাকে চিরকাল বাকি তিনজনের থেকে আলাদা প্রতিপন্ন করবে। তবে যাওয়ার সময় আর হাঁটা নয়। সান্দাকফু পর্যন্ত একটা জিপ ভাড়া করবে সে। জিপ ছাড়া মালপত্র বইবার প্রশ্ন ওঠে না।



হঠাৎ কল্যাণের খেয়াল হল ম্যানেজারের নির্দেশিত হলুদ বাড়িটা সে ছাড়িয়ে এসেছে। সে আর একটু এগোল। রাস্তাটা এখান থেকে খাড়াই উঠেছে। কিন্তু উঁচুতে উঠতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করছিল না তার। সে আর একটু হাঁটামাত্র নিরিবিলি জায়গায় চলে এল। ক্রমশ আলো নিভে আসছে। এখানকার শীতকে আর শীত বলে মনেই হচ্ছে না। এপাশে কোন দোকানপাট নেই। দুধারে বাগানওলা বাড়ি। এবং একটি বাড়ির নেমপ্লেটে ডাক্তারের নাম দেখতে পেল। ডক্টর এস. কে. দস্তিদার। এই লোকটা কিসের ডাক্তার? কল্যাণ থমকে দাঁড়াল কয়েক মুহূর্ত। তারপর গেট খুলে ভেতরে ঢুকল। পর্দা ঢাকা দরজার ওপাশে আলো জ্বলছে। কল্যাণ ডাকল, ডাক্তারবাবু!

ভেতর থেকে গলা ভেসে এল, কে? ভেতরে আসতে পারেন।

পর্দা সরিয়ে কল্যাণ দেখল একজন বৃদ্ধ সাহেবী প্যাটার্নের মানুষ টেবিলে বসে সানডে পড়ছিলেন। চোখ তুলে ইঙ্গিত করলেন বসতে। চেয়ার টেনে কল্যাণ বসে বলল, আমি এই শহরে নতুন। অসুস্থবোধ করছি, নেমপ্লেটটা দেখে এলাম।

অ। আমি তো রিটায়ার করেছি। আজকাল প্র্যাকটিস করি না। তবে নিজে থেকে কেউ এলে–। বলুন কি প্রব্লেম? আমার ফি কিন্তু বত্রিশ টাকা।

কল্যাণ তার অসুবিধের কথা জানাল। ডাক্তার নাড়ি দেখলেন। তারপর বললেন, অতিরিক্ত পরিশ্রম থেকে এমনটা হয়েছে। আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি। তবে আপনাকে সাজেস্ট করব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিচে নেমে যেতে। বৃদ্ধ ডাক্তার প্যাড টেনে জিজ্ঞাসা করলেন, নাম?

ভাস্কর দস্তিদার।

আঁ। বাঃ, আপনিও দস্তিদার! ওষুধের নাম লিখে ডাক্তার বললেন, আপনি আমাকে বরং পঁচিশ দিন। সেম টাইটেল!

কল্যাণ প্রেসক্রিপশনটা দেখল। তারপরে সেটাকে ভাঁজ করে পকেটে পুরে ব্যাগ খুলল, আপনাকে আমি আর একটু বিরক্ত করব।

কি ব্যাপার?

আমি একটা গ্রাম থেকে আসছি। সেখানকার মানুষ খুব অসুস্থ। আমি তাদের অসুস্থতার বিবরণ লিখে এনেছি। এক এক জন সম্পর্কে শুনে আপনি নাম্বার দিয়ে প্রেসক্রাইব করে যান। সেইমত ওষুধ কিনে আমি পৌঁছে দিয়ে আসব।

হোয়াট ড়ু থু মিন? আমি রোগী দেখলাম না আর প্রেসক্রাইব করব?

হ্যাঁ। কারণ ওদের ওষুধ দরকার।

কজন রোগী?

অনেক। নিন, শুরু করছি।

পার পেশেন্ট বত্রিশ করে লাগবে।

এই যে পঁচিশে ঠিক হল।

সেটা আপনার জন্যে। তাছাড়া আমি সব ডিটেলস না জেনে–।

যেটুকু জানছেন তাতেই লিখতে হবে। কল্যাণেব চোয়াল শক্ত হল, কেউ কথা না শুনলে আমার খুন চেপে যায়।

ডাক্তার বিড়বিড় করলেন, এ কি অন্যায় জুলুম! কলকাতার সেই চারটে ছেলে-মেয়ে কি আপনাদের মাথা খারাপ করে দিয়েছে?

এবার হেসে ফেলল কল্যাণ, না। কাদের কথা বলছেন আমি জানি না। কিন্তু আপনার প্রেসক্রিপশন আমার দরকার। সে রোগবৃত্তান্ত শুরু করল।
 
৩৮.
কল্যাণ যখন ডাক্তারের গেট পেরিয়ে রাস্তায় নামল তখন দার্জিলিং-এ চমৎকার সন্ধ্যে নেমে গেছে। দরজা পাব হওয়ামাত্র ঝুপ করে আলো নিবে গেল গোটা শহরের আর হিম বাতাসের সঙ্গে একটা কালো আলখাল্লা নেমে এল শহরটার শরীরে। এবং এই অন্ধকারটা তাকে স্বস্তি দিল। জীবনে সম্ববত এই প্রথমবার সে অন্ধকারকে স্বাগত জানাল।

অনেকটা সময় কেটেছে বৃদ্ধ ডাক্তারের সঙ্গে। একটার পর একটা অসুখের বর্ণনা, যার মধ্যে অবশ্য অনেকগুলো একরকম, পড়তে পড়তে কাহিল হয়ে পড়েছিল সে নিজেই, অতএব ডাক্তারের তো কথাই নেই। ভদ্রলোক বারংবার জিজ্ঞাসা করছিলেন এই অসুখগুলো যাদের তাদের সে কোথায় পেল? এগুলো তো মূলত পাহাড়ি মানুষের অসুখ। তিনি নিজে কখনও চিকিৎসা করেননি কিন্তু জানেন যে খুব উঁচুতে যেসব পাহাড়ি গ্রাম আছে সেখানে এই ধরনের রোগ হয়ে থাকে। তাদের সঙ্গে কল্যাণের যোগাযোগ থাকার সম্ভবনা কম। ওষুধের নামগুলো লেখার সময় তিনি মাঝে মাঝে নেপালী শব্দ উচ্চারণ করেছেন ইচ্ছে করেই। ভদ্রলোক স্পষ্ট বুঝে গেছেন যে কল্যাণ নেপালী জানে না। এটা জানার পর থেকেই ভদ্রলোক মাঝে মাঝেই থমকে গেছেন, প্রশ্নও করেছেন। কিন্তু কল্যাণের উত্তরের মধ্যে এমন একটা জেদ ছিল যে শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোককে শেষ করতে বাধ্য হতে হয়েছিল। পকেট থেকে টাকা বের করে ওঁর দাবী মতন দক্ষিণা মিটিয়ে দিয়েছিল কল্যাণ। ভদ্রলোক বোধহয় এটাও আশা করেননি। কিন্তু কৌতূহলী মানুষমাত্রই বিপজ্জনক। অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে কল্যাণের মনে হল আনন্দর সমস্ত পরিকল্পনায় একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। একজন ডাক্তারের কাছে এতগুলো অসুখের ওষুধ চাওয়ার কথা ওর মাথায় না আসলে সন্দেহ জন্মাত না। ও যেমন বলেছে সে তেমনই করেছে। দার্জিলিং শহরে ঘুরে ঘুরে ডাক্তার খুঁজে বের করে সাত-আটটা করে অসুখের প্রেসক্রিপশন নেওয়ার কথা অবশ্য তার নিজের মাথাতেও আসেনি আর এলে সেটা কতটা সম্ভব হত, তাতেও সন্দেহ আছে। অতএব এই পরিকল্পনাটা নিয়ে আনন্দ ভুল করেছে। তাছাড়া এই ডাক্তারও একটা ভুল ধরিয়ে দিল। ওষুধগুলো পেটে পড়ামাত্র রোগীরা সেরে যাবে, এমন কথা কেউ বিশ্বাস করে না। কোন কোন রোগীর অন্য উপসর্গ দেখা দিতে পারে। সেই সময় হাতের কাছে ডাক্তার না থাকলে নতুন ওষুধ দেওয়া সম্ভব হবে না। এতে রোগীর অন্য বিপত্তি ঘটতে পারে। কোন কোন অসুখ দীর্ঘদিনের এবং তার চিকিৎসাও সময়সাপেক্ষ। ডাক্তার নিয়মিত তাকে না দেখলে প্রথম ওষুধে তেমন কাজ হবে বলে মনে হয় না। অতএব আনন্দর এই পরিকল্পনাতেও ফাঁকি থেকে যাচ্ছে। কল্যাণের মনে হল অনেক কিছু তারা বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়েছে। স্পষ্ট প্রতিবাদ করে ভুলগুলো ধরিয়ে দিতে পারলে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের সমস্যা এড়ানো সম্ভব হত। কিন্তু তাহলে অন্য দুজন তাকে পাতি মধ্যবিত্ত বলত। পাতি মধ্যবিত্তরাই নাকি প্রতি পদে পদে বাগড়া দিয়ে থাকে। এখন অবশ্য এই নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কোন লাভ নেই। ওকে যেমন করেই হোক ওষুধ নিয়ে ফিরতে হবে। কিন্তু যে ব্যাপারটা তাকে চিন্তিত করছে সেটা হল ডাক্তার সম্ভবত এতক্ষণে তার সম্পর্কে একটা তথ্য জেনে গিয়েছেন। একেবারে শেষদিকে ডাক্তারের যে দুজন আত্মীয় আত্মীয় ভেতরে ঢুকেছিল তাদের একজন তার দিকে তাকিয়ে যেন চমকে উঠেছিল। ব্যাপারটা যদি ঠিক হয় তাহলে কথাই নেই। ডাক্তার এতক্ষণে পুলিশকে জানাবে তার হদিশ। মেয়েটি কি প্রেসিডেন্সিতে পড়ে? নিশ্চয়ই কলেজের সমস্ত মেয়ে এবং ছেলে তাদের ঘটনা জেনে গিয়েছে। এই মেয়েটি যদি ওখানকার ছাত্রী হয় তাহলে ওরও না জানার কথা নয়। অতএব তাকে সতর্ক হতে হবে। অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে সে একটা মোড়ের কাছে চলে এল। এখন সামনে অদ্ভুত দৃশ্য। সমস্ত পাহাড় জুড়ে জমাট অন্ধকারে টিমটিমে হ্যারিকেনের প্রায় অদৃশ্য আলো ভৌতিক মেজাজ এনেছিল। আচমকা আবার আলো জ্বলে উঠতেই মনে হল ধাপে ধাপে ঝকমকিয়ে চুমকি বসানো শাড়ি ছড়িয়ে পড়ল চৌদিকে। কল্যাণ চারপাশে তাকাল। রাস্তায় লোকজন কম।
 
দোকানপাট এখনও অবশ্য খোলা। চটপট কোন দোকান থেকে ওষুধ নিতে হবে। তারপরই মত পালটে সে স্থির করল একটা নয় একাধিক দোকান থেকে ওষুধ নেবে যাতে দোকানদারের সন্দেহ না হয়। ওষুধ ছাড়া বন্ধুদের ফরমায়েশও আছে। সেগুলোও নেওয়া দরকার। দার্জিলিং-এ পৌঁছানোর পর যে ভয়টা সঙ্গে ছিল সেটা এখন আরও জোরদার। ম্যালের রাস্তায় খানিকটা এগিয়ে সে একটা ওষুধের দোকানে ঢুকে জনা দশেক রোগীর জন্যে ওষুধের অর্ডার দিতেই কাউন্টারে বসা লোকটি হাঁ করে তাকে দেখল। লোকটি নেপালী। জিজ্ঞাসা করল, এত ওষুধ আপনি একসঙ্গে নেবেন? প্রশ্নটা হিন্দীতে। উত্তরটা ঘাড় নেড়ে জানাল কল্যাণ। দাম মেটানোর পর সে বুঝতে পারল হাতে করে বয়ে নিয়ে যাওয়া আপাতত সম্ভব কিন্তু সত্তরজনের হলে নয়। সে একটা বড় চটের থলে কিনে ওষুধগুলো সেটায় ফেলে সুদীপের সিগারেট কিনল। তিনটে দোকান থেকে ওষুধ নেওয়ার পর দেখা গেল আরও সমান ওষুধ তাকে কিনতে হবে। এতক্ষণে ঝাঁপ বন্ধ হওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। এইভাবে ঘুরে কিনতে গেলে কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তাছাড়া দার্জিলিং-এর আর কোথায় ওষুধের দোকান আছে তা কে জানে। আগামীকাল দিনের বেলা এই শহরে থাকার ঝুঁকি নিতে চায় না সে। ক্রমশ ভয়টা আতঙ্কের চেহারা নিয়ে যেন তাকে তাড়া করছিল। লাডেন লা রোডের বাঁকে সে একটা ওষুধের দোকানের সামনে দাঁড়াল। এখন দোকানে ভিড় নেই। কাউন্টারে একজন প্রৌঢ়া মহিলা। তিনি কিছু লিখছেন। সাইনবোর্ড এবং মহিলাকে দেখে সে নিঃসন্দেহ হল ইনি বাঙালী। ইতস্তত ভাবটা কাটিয়ে কল্যাণ ভেতরে ঢুকতেই মহিলা চোখ তুলে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, বলুন!

কল্যাণ ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে কাউন্টারে হাত রাখল, আমার অনেক ওষুধ চাই এবং এখনই!

ভদ্রমহিলার চোখে বিস্ময় ফুটল। কিন্তু সেই অবস্থায় হাত বাড়ালেন, প্রেসক্রিপশন! ডাক্তারের লেখা কাগজটা এর মধ্যে কয়েক টুকরো হয়েছে। বাকিটা কল্যাণ এগিয়ে দিতে মহিলা কল্যাণের মুখের দিকে একবার তাকালেন। তারপর সেটা নিয়ে ব্ল্যাক থেকে ওষুধ নামাতে লাগলেন। কল্যাণ চুপচাপ দেখছিল। ভদ্রমহিলার মুখ দেখে এখন বোঝা যাচ্ছে না ওঁর মতলবটা কি। দোকানটা ফাঁকা কিন্তু বেশ বড়। সঙ্গে যদি একটা গ্রেনেড অথবা রিভালভার থাকত তাহলে জোর পেত সে। এইভাবে চোখে সন্দেহ ফুটিয়েও আর প্রশ্ন না করে উনি ওষুধ নামাচ্ছেন। ব্যাপারটা কি? সে সতর্ক চোখে লক্ষ্য করছিল। ওপাশেই একটা টেলিফোন আছে। সেটার দিকে নজর যেতেই আচমকা এমন বেজে উঠল যে হৃৎপিণ্ডটা যেন গলার কাছে চলে এল কল্যাণের। ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে রিসিভারটা তুলে বললেন, ইয়েস।

কল্যাণ কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। ফোনটা যদি পুলিশের হয়? যদি থানা থেকে সতর্ক বার্তা পাঠানো হয়? ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ হুঁ হাঁ করে রিসিভার নামিয়ে রেখে আবার ওষুধ নামাতে শুরু করলে কল্যাণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মিলিয়ে মিলিয়ে ক্যাশমেমো লিখে টাকার অঙ্কটা উচ্চারণ করলেন ভদ্রমহিলা। কল্যাণ চটপট সেটা বের করে কাউন্টারে রাখতে গুনে নিয়ে ব্যালেন্সটা ফিরিয়ে দিলেন তিনি। তারপর ওষুধগুলো কাউন্টারে রেখে গালে হাত রেখে দাঁড়ালেন। কল্যাণ চটের থলিতে ওষধগুলো চালান করল। এই শীতেও তার মুখে ঘাম জমেছে। হঠাৎ ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, কতজন মানুষ অসুস্থ?

অনেক। সত্তরজনের ওষুধ নিচ্ছি। বলে সে দোকান থেকে নামতে যাচ্ছিল।

হঠাৎ ভদ্রমহিলা তাকে ডাকলেন, আপনি দার্জিলিং-এ কোথায় উঠেছেন?

উঠেছি মানে? আমি তো এখানেই থাকি।

না থাকেন না। এই শহরের সবাইকে আমি চিনি।

আপনি কি বলতে চাইছেন?

কিছু না। মনে হচ্ছে পাহাড়ি মানুষদের উপকার করতে যাচ্ছেন। একটু আগে থানা থেকে আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এরকম কেউ এলে তাকে আটকে রাখতে। যাদের জন্যে ওষুধ নিয়ে যাচ্ছেন তারা যেন ওষুধটা পায়।
 
কল্যাণের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেল। সে কোনরকমে প্রশ্ন করল, আপনি হঠাৎ এমন সহযোগিতা করলেন কেন? মানে, করার তো কোন কারণ ছিল না।

না। সত্তরজনের মধ্যে দশজনও যদি ওই ওষুধে সুস্থ হয় তাদের জীবনের দাম আপনার চেয়ে দশগুণ বেশি, তাই না? আপনি যেখানে উঠেছেন সেখানে না ফিরলেই বুদ্ধিমানের কাজ করবেন। আচ্ছা! কথাটা সেখানেই শেষ করে ভদ্রমহিলা ভেতরদিকে ফিরলেন। কল্যাণ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কেমন একটা ঘোর লাগল তার। এই মহিলা কি স্বাভাবিক আচরণ করলেন? কথাটা মাথায় আসতেই তার হাসি পেল। সে নিজেই কি স্বাভাবিক আচরণ করছে? সম্বিৎ ফিরতেই সে দ্রুত হাঁটতে লাগল। ব্যাগটা বেশ ভারী হয়ে গেছে এর মধ্যে। কিন্তু তার তো হোটেলে ফেরা দরকার। নিজস্ব জিনিসপত্র সবই পড়ে আছে সেখানে। দার্জিলিং-এ নিশ্চয়ই কয়েকশ হোটেল আছে। তাদের সবাইকে সতর্ক করা বা গিয়ে হদিশ নেওয়ার সময় কি পেয়েছে পুলিশ। কিন্তু ভদ্রমহিলার কথাগুলো কানে সেঁটে আছে এখনও। না, আর কোন ঝুঁকি নেবে না সে। এই ওষুধগুলো যাদের জন্যে তাদের কাছে পৌঁছে দিতেই হবে।

কিন্তু হোটলে না ফিরলে আজকের রাত সে কোথায় কাটাবে? দার্জিলিং-এ আকাশের তলায় শুলে আর ওষুধগুলো পোহাতে হবে না। নতুন কোন হোটেলেও ওঠা এখন সোজা থানায় যাওয়ার সমান হবে। স্টেশনের সামনে পৌঁছে খুব অসহায় বোধ করছিল কল্যাণ। কি করবে সে বুঝতে পারছিল না। তার একবার মনে হল যা হবার হোক, হোটেলেই ফিরে যাবে। সেখানে তার জিনিসপত্রের মধ্যে শীতবস্ত্রও রয়েছে যেগুলো শরীরে না থাকলে সান্দাকফু পার হওয়া অসম্ভব। ঠিক সেই সময় একটা পুলিশের জিপ বেশ জোরে সামনের রাস্তা দিয়ে ছুটে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সে সিদ্ধান্ত পাল্টাল।

জিপ ভাড়া করে যদি দাজিলিং ছাড়তে হয় তাহলে বাজারের দিকে যেতেই হবে। সেখানেও যে পুলিশ ওৎ পেতে নেই তা কে বলতে পারে! তাছাড়া এত রাত্রে কোন ড্রাইভার যেতে চাইবে কিনা সন্দেহ আছে। কল্যাণের মনে হল যদি ঘুম পর্যন্ত যাওয়া যেত তাহলে অনেকটা স্বস্তি হত। এই মুহূর্তে দার্জিলিং শহরটা এড়ানোই প্রয়োজন। ঘুম থেকে দার্জিলিং কত মাইল? সে আর কিছু না ভেবে স্টেশনটাকে ডান দিকে রেখে হাঁটতে লাগল। শহর থেকে বেরিয়ে রাস্তাটা যেখানে বাঁদিকে বাঁক নিয়েছে সেখানে পৌঁছাতেই তার পায়ে ব্যথা শুরু হল। শরীরটা ভীষণ ভারী মনে হচ্ছে। এবং সেই সঙ্গে খিদে। এই অবস্থায় তার পক্ষে বেশি দূর যাওয়া সম্ভব নয়। কল্যাণ পিছন ফিরে শহরটাকে দেখল। সে হেরে যাচ্ছে। অসম্ভব। তাকে প্রমাণ করতে হবে সুদীপ বা আনন্দর চেয়ে তার ক্ষমতা মোটেই কম নয়! কল্যাণ আবার হাঁটতে লাগল। মাঝে মাঝে ওপর থেকে গাড়ি নামছে নিচের দিকে, নিচ থেকেও উঠছে। অর্থাৎ রাত্রেও গাড়ি চালানো বন্ধ হয় না। গাড়ির আলো দেখামাত্র সে পথ থেকে সরে কোন একটা আড়াল বেছে নিচ্ছে। ক্রমশ তার শরীর আরও ভারী হয়ে এল। কল্যাণ আর পারল না। তার মনে হচ্ছিল একটু ঘুমিয়ে নিলে সে ঠিক হয়ে যাবে। এই সময় সে একটা শুকনো ঝরনার পাশে চালা দেখতে পেল। সম্ভবত রাস্তা সারাইএর কাজের সময় শ্রমিকরা এই চালা করেছিল আচমকা বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচবার জন্যে। চারটে খুঁটির ওপর ওই আচ্ছাদনের তলায় পৌঁছাতে বেশ কয়েকটা পাথর তাকে ডিঙিয়ে যেতে হল। ঘোরের মধ্যেই সেটুকু পেরিয়ে বড় পাথরের ওপর শরীরটাকে ছেড়ে দিল সে। আর তখনই চেতনা উধাও।
 
কালিয়াপোকরিতে যখন সে ট্রেকার থেকে নামল তখন বিকেল। সুকিয়াপোকরি থেকে কালিয়াপোকরি পর্যন্ত এই ট্রেকারগুলো যাত্রী নিয়ে যাওয়া আসা করে মাঝে মাঝে। ভোরেবেলায় ঘুম থেকে উঠে সে নিজেকে বেশ হালকা বোধ করেছিল প্রথমে। খিদে ছাড়া অন্য অনুভূতি ছিল না। তার ওষুধের ব্যাগ এবং টাকাগুলোও কেউ নিয়ে যায়নি। অতএব কল্যাণ আবার হাঁটতে শুরু করেছিল। এবং তার পরেই টের পেল বুকে লাগছে। একটু রোদ উঠতেই কাশি শুরু হল। তারপর শীত-শীত ভাবটা আসতে মনে হয়েছিল ঠাণ্ডার জন্যে এমন মনে হচ্ছে। সকাল হতে ওই পথে প্রচুর গাড়ি চলছিল। কল্যাণকে মাঝে মাঝেই সেই কারণে লুকিয়ে পড়তে হচ্ছিল। সে বুঝতে পারছিল তার ঠাণ্ডা লেগেছে। এবং সেই ঠাণ্ডা তার শরীরে জ্বর আনতে পারে। কেনা ওষুধ থেকে হাতড়ে হাতড়ে সে একটা ওই ধরনের ট্যাবলেট বের করে ঝরনার জল মুখে পোরার পর একটু স্বস্তি হল। সে যখন সুকিয়াপোকরিদার্জিলিং বাসটা দেখতে পেল তখন রোদ বেশ চড়েছে। সুকিয়াপোকরিতে বেশ বড় একটা বাজার আছে। সেখানে বাস থেকে নেমে সে পেটভরে পুরি তরকারি খেয়ে নিল। পেটে খাবার পড়ার পর তার স্বস্তি হল এবং বেশ ঘুম পাচ্ছিল। সেই সময় কা.ি যা, করির ট্রেকারটা পেয়ে যেতে সে তার এককোণে উঠে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিল। পুরো রাস্তাটা কিভাবে এসেছে তা সে জানে না। কালিয়াপোকরিতে যখন পোঁছাল তখন সূর্য নেই, সময় তিনটে। আশে মেঘ। ট্রেকারটা থেকে নেমে সে যখন চারপাশে তাকাচ্ছে তখন একটা সিড়িঙ্গে মত লোক এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোথায় যাবেন? সান্দাকফু?

উত্তরটা পেয়ে গিয়ে কল্যাণ মাথা নেড়েছিল। লোকটা হিন্দীতে কথা বলছিল। সে বলল, এখন যদি হাঁটতে শুরু করেন তাহলে সান্দাকফু পৌঁছাতে পারবেন না। একটু পরেই রাত হবে। বৃষ্টি নামবে। এখানে যদি থাকতে চান তো আমার বাড়িতে থাকতে পারেন। কুড়ি টাকা দিতে হবে। সকালে উঠে রওনা হয়ে যেতে পারেন।

কল্যাণের মনে হল যেন হাতে স্বর্গ পাওয়া গেল। লোকটার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে সে একটা কাঠের বাড়ির কাছে চলে এল। লোকটা ঘরের দবজা খুলে তাকে বিশ্রাম করতে বলে বেরিয়ে গেল রাতের খাবারের বন্দোবস্ত করতে। কল্যাণের মনে হচ্ছিল এবার শুয়ে পড়লেই হয়। এই বাড়িতে দুটো ঘর। আর কোন লোকজন নেই। সে উঠে ভেজানো দরজা ঠেলে পাশের ঘরে ঢুকতেই চমকে উঠল, দেওয়ালে দুটো খাকি শার্ট প্যান্ট ঝুলছে। পাশেই একটা টুপি। মুহূর্তে সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। এই লোকটা নির্ঘাৎ পুলিশ। কালিয়াপোকরিতে নিশ্চয়ই পুলিশের চৌকি আছে। সে দ্রুত বাইরের ঘরে ফিরে এসে ব্যগটা তুলে নিল। তারপর চুপচাপ দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে চারপাশে নজর বুলিয়ে হাঁটতে শুরু করল। লোকটাকে কাছেপিঠে দেখা যাচ্ছে না। কুড়িটা টাকা রোজগারের লোভে কেউ একজন অচেনা মানুষকে ভোলা বাড়িতে রেখে বেরিয়ে যায় না। কল্যাণ নিঃসন্দেহ লোটা পুলিশ এবং তাকে সন্দেহ করেছে। এখন তার যে চেহারা হয়েছে তাতে চট করে চেনা মুশকিল। কিন্তু ওই ট্রেকার থেকে সে-ই একমাত্র প্যাসেঞ্জার নেমেছে যে বাঙালী। যারা সান্দাকফু বেড়াতে যায় তাদের কাছে যেসব জিনিসপত্র থাকে তাও তার কাছে নেই। একটা বড় থলি হাতে গাড়ি থেকে নেমে ইতস্তত করতে দেখে লোকটা নিশ্চয়ই আন্দাজ করে নিয়েছে। তার মানে তাদের সম্পর্কে খবর এ অঞ্চলেও এসে গিয়েছে।
 
একটু একটু করে কল্যাণ এগিয়ে যাচ্ছিল। কিছু লোক এই পথ ধরে হাঁটছে। এরা যাবে দিকেভঞ্জন। শীত বাড়ছে। এর আগের বার যাওয়ার সময় দিকেভঞ্জনে কয়েকটা ঘরবাড়ি সে দেখেছিল। ওই অবধি পোঁছাতেই রাত হয়ে যাবে। আর এখানে খোলা আকাশের তলায় রাত মানে নিশ্চিত মৃত্যু। দ্রুত পা চালাচ্ছিল কল্যাণ। সুকিয়াপোকরির খাওয়া আর গাড়িতে বসে পুরোটা পথ ঘুমিয়ে শরীর এখন অনেকটা তাজা। যদিও বুকে সর্দির ভাবটা বেশ জমাট। এটা জ্বালাবে। লামার বাড়ির সামনে দিয়ে সে কালিয়াপোকরি ছাড়িয়ে নির্জন পাহাড়ে নেমে পড়ল। অদ্ভুত আলো ছড়ানো পাহাড়ে, গাছেদের বুকে। পৃথিবীটা আচমকা অলৌকিক সুন্দরী হয়ে উঠেছে সেই আলো মেখে। কল্যাণের মন ভরে গেল সেদিকে তাকিয়ে। তার হাঁটার উৎসাহ বাড়ল। এবং সেই কারণেই সে গলা খুলে রবীন্দ্রনাথের একটা গান প্রায় নিজের সুরে গাইতে লাগল চেঁচিয়ে। আশেপাশে যারা হাঁটছে তারা খুশির চোখে তাকাল। যে মানুষ গান গায় তার সম্পর্কে লোকে চট করে খারাপ ধারণা করতে চায় না।

ঠিক ঘণ্টাখানেক চলার পর নিচ থেকে চিৎকারটা ভেসে এল। এখন আলো প্রায় নিবে এসেছে। দিকেভঞ্জন চোখের সামনে। ঘন কুয়াশা পাক খাচ্ছে পথের ওপর। চিৎকার শুনে পিছন ফিরল কল্যাণ। গোটা ছয়েক লোককে কয়েকশ ফুট নিচুতে দেখা যাচ্ছে। তারা চেষ্টা করছে যতটা সম্ভব দ্রুত ওপরে আসতে। এবং চকিতে এতদূরে দাঁড়িয়েও কল্যাণের নজরে এল মানুষগুলোর পরনে খাকি পোশাক এবং হাতে বন্দুক। ওরা অত নিচে থেকেও নিশ্চয়ই তাকে দেখতে পেয়েছে নইলে চিৎকার করে থামতে বলত না। কল্যাণ এবার মরীয়া হল। সঙ্গীরা দেখল গান বন্ধ করে সে ঝোলা নিয়ে দ্রুত পা চালাচ্ছে। এখনও ওরা অনেকটা নিচে আছে। পাহাড়ি পথ ঘুবে আসতে যে সময় লাগবে তাতে সে দূরত্ব বাড়াবাব সুযোগ পাবে। কিন্তু সে যখন কুয়াশার জঙ্গলে পড়ে গেল তখন অন্ধ। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কোনটা পথ কোনটা নয় তা ঠাওর করা অসম্ভব। শীত এখন হাড়ে, কাঁপুনিটা দুটো কারণেই হতে পাবে।

দিকেভঞ্জনে পৌঁছে মনে হল কলজেটা বুক থেকে বেরিয়ে আসবে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বোঝাঁটা সঙ্গে না থাকলে আরও দ্রুত যাওয়া যেত। কিন্তু এখন এটাই তার সম্মান। কল্যাণ পিছনদিকে তাকাল। এখন অন্ধকার মাটিতে এবং সেই সঙ্গে চাপ কুয়াশা। যাবা আসছে তাবাও তাকে চট করে খুঁজে পাবে না। কিন্তু দিকেভঞ্জনে থাকা চলবে না। সামান্য ওই কটা ঘরবাড়ি, যেই তাকে আশ্রয় দিক ওদের পক্ষে খুঁজে বের করতে অসুবিধে হবে না। টলতে টলতে কল্যাণ আবার হাঁটতে লাগল। কুয়াশা কিংবা অন্ধকারে তার কোন খেয়াল নেই। পায়ের তলার পথ এঁকেবেঁকে উঠে গেছে। হাঁটলে শরীরে উত্তাপ বাড়ে। কিন্তু পথ এবার এমন খাড়াই যে তাকে বারংবার দম নিতে হচ্ছিল। এখন আর চিৎকার শোনা যাচ্ছে না। ক্রমশ সে অনেকটা ওপরে উঠে এল। আর তখনই সর্বাঙ্গে একটা তৈলাক্ত অনুভূতি। চোখের সামনে সবকিছু ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছিল। একটা পাথরের গায়ে ধপ করে বসে পড়ল সে ঝোলাটাকে পাশে রেখে। পা থেকে কোমর পর্যন্ত এখন তীব্র যন্ত্রণা। কল্যাণ চোখ বন্ধ করল।

কতক্ষণ এইভাবে পড়েছিল সে জানে না। হঠাৎ স্রোতের বিপরীতে গিয়ে সে উঠে বসল। আর তখনই অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। দৃষ্টি এখনও তার পরিষ্কার নয়। কিন্তু মনে হল আশেপাশে কোথাও কুয়াশা নেই। সমস্ত আকাশটা চকমকে জ্যোৎস্নায় নিকানো। আর তারই উপচানো আলোয় পাহাড় বনানী মাখামাখি। দেখতে দেখতে বুকের ভেতর একটা আনন্দ জন্ম নিল যা তার হৃৎপিণ্ডের গায়ে নরম আদব ছড়িয়ে দিল। এবং তখনই নিচে চিৎকারটা শুনতে পেল সে। অর্থাৎ অনুসরণকারীরা হাল ছাড়েনি। যে সময়টা কল্যাণ পেল সেটা দিকেভঞ্জনের বাড়ি-বাড়িতে তল্লাশ চালানোর জন্যেই।

কল্যাণ উঠল। না, সে ধরা দেবে না। ওষুধগুলো তাকে পৌঁছে দিতেই হবে। শরীর টলছে কিন্তু সে এগোল। মুশকিল হল পথটা যেন আকাশে উঠে গেছে। আর একটু এগোলে সোজা চাদের ঘরে পৌঁছানো যাবে। একটা পা ফেলার পর এখন অন্য পা-কে টেনে আনতে হচ্ছে এগোতে। চিৎকারটা শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু তার মানে এই নয় অনুসরণকারীরা ফিরে গিয়েছে। কল্যাণ পিছন ফিরে তাকাল। এই ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় যে কেউ দূর থেকে মানুষ চিহ্নিত করতে পারবে। কুয়াশারা এখন নিচে নেমে গিয়েছে। তার সামনে আর আড়াল বালে কিছু নেই। যেটুকু সামর্থ্য ছিল তা উজাড় করে কল্যাণ যখন অপেক্ষাকৃত সমতলে উঠে এল তখন ওর অপুষ্ট শরীর আর তার রোগা হাড়গুলো কাঁপছে। এবং সেই সময় সে লোকগুলোকে দেখতে পেল। শিকার দেখতে পেয়ে ওরা এবার হইচই করতে করতে এগোচ্ছে। সামনের খোলা মাঠ জ্যোৎস্নায় ভাসছে। দূরে কয়েকটা বাড়ি। ওঃ, কল্যাণ চিনতে পারল, এই হল সান্দাকফু।
 
আর তারপরেই তার মনে পড়ল। তাপল্যাঙ থেকে যে ছেলেটা তার সঙ্গী হয়েছিল সে অপেক্ষা করে আছে একটু এগোলেই। ওর কাছে পৌঁছে গেলে নিশ্চয়ই একটা বিহিত হবে। আর কিছু না হোক এই ওষুধগুলো ওর হাতে তুলে দেওয়া যাবে। ভাবনটা মাথায় আসামাত্র শরীরে উদ্যম ফিরে এল। মুহূর্তে সমস্ত যন্ত্রণা ভুলে গেল সে। ঘোড়ার নালের মত রাস্তার শেষে পৌঁছানো মাত্র সে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল লোকগুলো এবার ওপরে উঠে এসেছে। দূরত্ব এখন কয়েক মিনিটের। সমস্ত সান্দাকফু আজ নিশূপ। কোনরকমে ওপরে রাস্তায় উঠে আসামাত্র গুলির আওয়াজ হল।

থমকে দাঁড়াল এক মুহূর্তের জন্যে কল্যাণ। এবং তারপরেই শরীরে অলৌকিক শক্তি ভর করল। পিছনের মানুষগুলো হিন্দীতে চিৎকার করছে, যদি সে পালাবার চেষ্টা করে তাহলে গুলি শরীরে বিধবে। কিন্তু সেসব কথা ওর কানে যাচ্ছিল না। নিচে পড়ে রইল সান্দাকফু। এখন সে ফালুটের রাস্তায়। এই মুহূর্তে তার শরীরে কোন শীত বোধ নেই, কোন ক্লান্তির কষ্ট নেই, একটা তীব্র জেদ তাকে ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। আর তখনই সমস্ত পৃথিবী কেঁপে উঠল গুলির আওয়াজে। কাঁধে তীব্র যন্ত্রণা বোধ করার আগেই সে ছিটকে পড়ল মাটির ওপরে। হাত থেকে ঝোলাটা পড়ে গেল মাটিতে। চোখ বন্ধ করে যন্ত্রণাটার সঙ্গে লড়ল কল্যাণ। এক হাতে কাঁধটা চেপে ধরতেই গরম স্রোত তার কনুই-এ নেমে এল। দ্বিতীয় গুলিটার শব্দ কানে আসতেই সে পেছনে ফিরে চাইল। যারা গুলি করেছে তারা কাছাকাছি এসেও সামনে আসছে না। কল্যাণ হাত বাড়িয়ে ঝোলাটা আঁকড়ে ধরল। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। টলতে টলতে সে যখন আরও কিছুটা পথ এগিয়েছে তখনই গলাটা শুনতে পেল। মুখ ফেরাতে সে অস্পষ্ট সেই ছেলেটার মুখ দেখতে পেল। ছেলেটা নেমে এসেছে পাশের পাহাড় থেকে। ওকে দেখামাত্র আছড়ে পড়ল কল্যাণ। ছেলেটা তাকে দুহাতে টানছিল। কিন্তু কল্যাণ সামান্য শক্তি পাচ্ছিল না ওর ডাকে সাড়া দেবার। সে কোনরকমে ঝোলাটাকে দেখিয়ে বলতে পারল, নিয়ে যাও ওষুধ। ওদের বলো আমি পেরেছি। জলদি ভাগো। আর কথাটা উচ্চারণ শেষ করামাত্র এক দমক উঠল। মুখ থেকে বেরিয়ে এল রক্ত। কল্যাণ সেই জ্যোৎস্নায় নিজের শরীরের রক্ত দেখল। লাল,—কি লাল। পৃথিবীর সব মানুষের রক্ত কি লাল? ওই যে যারা তাকে গুলি করেছে তাদেরও? সে চোখ তুলল আকাশে। এখন যেন কিছুই ভাবতে পারছে না সে। চাঁদটাকে অসম্ভব বড় দেখাচ্ছে। কিন্তু সে পেরেছে। ওষুধগুলোকে পৌঁছে দিতে পেরেছে। কিন্তু ছেলেটা দাঁড়িয়ে নেই তো! ঘাড় ঘুড়িয়ে সে ঝোলা বা ছেলেটিকে না দেখতে পেয়ে। নিঃশ্বাস ফেলল। ক্রমশ তার মুখ একটা তৃপ্ত মানুষের হয়ে গেল। আমি পেরেছি। সুদীপ, তোদের মত মানুষ মারতে পারিনি কিন্তু বাঁচাবার রসদ আনতে পেরেছি। দ্বিতীয়বার রক্ত বেরিয়ে আসতে সে সচেতন হল। ওরা কেউ ওপরে উঠে আসছে না কেন? ওরা কি তাকে জ্যান্ত ধরে নিয়ে যেতে চায়? নাকি ভয় পাচ্ছে যদি তার কাছে অস্ত্র থাকে? চিন্তাগুলো ছন্নছাড়া হয়ে আসা যাওয়া করছিল। পাথরে ঠেস দিয়ে বসতে আরাম হল। তারপর সে চিৎকার করে উঠল, কইরে শালা আয়, এগিয়ে আয়, আমাকে মেরে ফ্যাল। শেষের দিকে তার গলা জড়িয়ে গেল এবং কোন শব্দ বের হল না। হঠাৎ জয়িতার মুখ ভেসে উঠল কল্যাণের সামনে। সে মুখ তুলে চাদটাকে দেখতে পেল, হঠাৎ সে বিড়বিড় করতে লাগল, জয়ী, আমি ভীতু নই। জয়ী, আমি আমি। সেইসময় আবার গুলির শব্দ হল।

কল্যাণ করুণার চোখে নিচের দিকে তাকাল। তারপর ধীরে ধীরে কাঁধ চেপে উঠে দাঁড়াল। সে সোজা হতে পারছে না। সমস্ত শরীর থরথর করে কাপছে। টলতে টলতে সে চলে এল পাহাড়ের বিপরীত দিকে যেখানে অতলান্ত খাদ। কল্যাণ চোখ তুলল। আহা, চাঁদের মুখটা অত দ্রুত পালটে যাচ্ছে কেন? ক্রমশ সেটা ক্ষয়াটে, রক্তশূন্য মায়ের মুখ হয়ে গেল। কল্যাণ তার বাঁহাত আকাশে বোলাল। মা-চাঁদটা তার মা হয়ে যাচ্ছে। যে মাকে সে কখনই নিজের করে পায়নি, এখন সেই মা তার সামনে। কি করুণ দেখাচ্ছে। কল্যাণ হেসে ফেলল, মা, আমি পেরেছি। জয়ীকে বলে দিও। আর তখনই তার শরীরটা আকাশে উঠেই মাটিতে পড়ে গেল। তীব্র শব্দ পাহাড় কাপাল। বুকের খাঁচাটা যেন চুরমার। কল্যাণ শেষবার দেখতে পেল অনেকগুলো শরীর ছুটে আসছে সোল্লাসে। সে শেষবার মাকে দেখবার জন্যেই সম্ভবত চাঁদের দিকে মুখ ফেরাতে যেতেই শরীরটা গড়িয়ে পড়ল খাদে। ছুটে আসা মানুষগুলো দেখল অসাড় শরীরটা শূন্যে ভেসে নিচের অতল খাদে নেমে যাচ্ছে। আর চন্দ্রদেব তার শরীরটাকে আলোকিত করার শেষ চেষ্টা করে যাবেন।
 
৩৯.
গত রাত হাওয়ার রাত ছিল। পালদেম বলেছিল বরফ পড়ার আগে হিমালয় হাওয়াদের পাঠায়। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল সব উড়িয়ে নিয়ে যাবে। সেই সঙ্গে বীভৎস আওয়াজ। রাগী জন্তুর গোঙানি। অথচ বৃষ্টি নেই। আকাশ ঘোলাটে। সেখানে চাপ মেঘও নেই। কিন্তু একটি নখ লক্ষ্য হয়েছে। শীত বাড়ছে হু হু করে। কাঠের ঘরে নিরাপদ বিছানায় শুয়েও মনে হচ্ছিল উত্তাপ চাই।

আনন্দ চুপচাপ পড়েছিল। দ্বিতীয়বার ব্যাপারীরা ঘুরে গেল এই গ্রাম থেকে।ওরা অবশ্য তাদের হদিশ পায়নি। কিন্তু তাপল্যাঙের মানুষ কি করে এত টাকা হাতে পেল তা নিয়ে চিন্তাগ্রস্ত হয়েছে। পালদেম শেখানো উত্তর বলেছে, চারজনের এক অভিযাত্রীদল এই গ্রামের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের যে টাকা দিয়ে গিয়েছিল তাই দিয়েই কেনাকাটা করছে ওরা। উত্তরটা ওরা কতটা বিশ্বাস করেছে সেটা বোঝা যায়নি। কিন্তু প্রচুর জিনিসপত্র পাওয়া গিয়েছে। সেগুলো রাখা হয়েছে গ্রামের আর একটি খালি ঘরে। সেইসঙ্গে আছে গৃহপালিত সেইসব জন্তু যা গ্রামবাসীরা ব্যাপারীদের কাছে বিক্রি করেছিল। আজ বিকেলে বন্ধুদের কাছে আনন্দ তার পরিকল্পনা খুলে বলেছে। জয়িতা উৎসাহিত হয়েছে। একটা অবহেলিত, বলা যায় সভ্যতার ছোঁয়াচবর্জিত গ্রামের মানুষদের একত্রিত করে বাঁচার পথ খুঁজে দেওয়া মানে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার মানে নতুনভাবে খুঁজে পাওয়া। সারা বছর এরা হয় আধপেটা, নয় অভুক্ত থাকে। সবচেয়ে আগে এদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এবং সেটা সম্মিলিতভাবে। কেউ কম বা বেশি নয়। রান্না হবে একত্রে। এর ফলে প্রত্যেকের সঙ্গে একটা নিকট সম্পর্ক তৈরি হবে। এ বছরের ব্যবস্থা না হয় সুদীপের আনা টাকায় হয়ে যেতে পারে কোনরকমে, কিন্তু আগামী বছর থেকে নিজেদের জন্যে প্রতিটি মানুষকে কাজ করতে হবে। চাষের ব্যবস্থায় আধুনিক সাহায্য নিতে হবে, ডেয়ারি এবং পোলট্রি ফার্ম পুরো গ্রামের জন্যে তৈরি করতে হবে। আর সেই সব জিনিস দার্জিলিং না থোক গৈরাবাস অথবা মানেভঞ্জনের বাজারে পৌঁছে দিয়ে তার বিনিময়ে দরকারী জিনিস আনতে হবে। এদের নিজস্ব লেখ্যভাষা আছে কিনা জানতে হবে। কিন্তু সেই সঙ্গে হিন্দী এবং ইংরেজী শিখতে হবে। অর্থাৎ সুস্থভাবে বাঁচতে হলে একা কিছু করা যাবে না, কাধে কাঁধ মিলিয়ে খাটতে হবে। এই বোধ ওদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে হবে। অবশ্য এর জন্যে বিশ্বাস অর্জন করা দরকার। বিদেশী বিভাষী মানুষকে চট করে কেউ বিশ্বাস করে না। তবু এখন যেন ওরা তাদের সঙ্গে অনেক সহজ ভঙ্গিতে কথা বলছে। ওই যে মেয়েটি যে মৃত্যুর দরজায় পৌঁছে গিয়েও কোন অজ্ঞাত কারণে এখনও মরে যায়নি তার জন্যে কেউ দায়ী করছে না এখনও। মরে গেলে কি হবে তা কে বলতে পারে। যাই হোক, এই গ্রাম ছাড়ার আপাতত কোন ইচ্ছে তার নেই। প্রথম কথা, পুলিশের রাইফেল এত দূরে পৌঁছাবে এমন সম্ভাবনা কম। দ্বিতীয়ত, আকৈশোর যে বাসনা ছিল তা সম্ভব হবে এমন সম্ভাবনা নেই। বাবাও যে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন তা একাত্তরেই মুখথুবড়ে পড়েছে। সে ভেবেছিল দেশের যারা শত্রু তাদের আঘাত করার শিক্ষা জনসাধারণকে দিলে তারা উদ্দীপ্ত হবে এগিয়ে আসতে। মনে হয়েছিল, ভারতবর্ষের মানুষ ভেতরে ভেতরে সমস্ত সিস্টেমটার বিরুদ্ধে প্রতি মুহূর্তে বঞ্চিত হওয়ায় রুষ্ট হয়ে উঠেছে, শুধু তার প্রকাশের দরজা খুলে দিতে পারলেই লাভাস্রোত বইবে। কিন্তু কলকাতায় থাকাকালীন তার কোন প্রতিক্রিয়া সে দেখতে পায়নি। অবশ্য ওরা চলে আসার পর কিছু হয়েছে কিনা তা জানা নেই। হলে অন্তত বি বি সি-র খবরে তার কথা শোনা যেত। অতএব ধরে নেওয়া যেতে পারে সে সবই ভস্মে ঘি ঢালা হয়েছে। কিন্তু বিখ্যাত গ্রন্থগুলো পড়ে তার তো মনে হয়েছিল পৃথিবীতে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে গেলে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিদের হঠাতে বিপ্লব দরকার। বিপ্লবের পরে মানুষকে তার অধিকারের জায়গায় পৌঁছে দিতে হবে। অর্থাৎ বিপ্লব উদ্দেশ্য নয়, ওই নয়া সমাজ ব্যবস্থাই আসল লক্ষ্য। সেই কাজ তো এখানেও শুরু করা যেতে পারে। এখানে তাদের চোখে কোন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির অস্তিত্ব চোখে পড়ছে না। কাহনকে কোনভাবেই, এমন কি সামান্য জোতদার বলেও ভাবা যাচ্ছে না। এদের শত্রু অজ্ঞতা এবং বিচ্ছিন্নতা থেকে অশিক্ষার ফসল দারিদ্র্য। কিন্তু এদের পক্ষে সবচেয়ে যে মূল্যবান সম্পদ তা হল রাজনীতির ধোঁয়াটে বিষ এখনও চেপে বসেনি। সামান্য পিছিয়ে নিয়ে গেলে পৃথিবীর আদিম যুগের মানুষের জীবনযাত্রায় এদের পৌঁছে দেওয়া যায়। অতএব এই মাটির ডেলাগুলো নিয়ে স্বপ্নের মূর্তি তৈরি করা যায়। বাধা যা আসবে তা ওদের অজ্ঞতা থেকে। এর মধ্যে আনন্দ কয়েকটি শব্দ শিখে ফেলেছে। এ ব্যাপারে জয়িতা তার থেকে এগিয়ে আছে। ও এখন ভাঙা ভাঙা বাক্য বলতে পারে। ভুল করে কিন্তু সেই ভুলটা ওদের মজা দেয়। নিরাপদ বিছানায় শুয়ে আনন্দ এক ধরনের উত্তেজনা বোধ করে। কল্যাণটা ফিরে এলেই এরা ওদের অনেক কাছে এসে যাবে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top