What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected গর্ভধারিণী - সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

৪৫.
সারারাত ঘুমোতে পারেনি জয়িতা। না, শীত কিংবা বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ নয়, স্রেফ ভালুকবাচ্চাদের কুঁইকুঁই ডাক কানের পর্দা থেকে অস্বস্তিটা মুছতে দিচ্ছিল না। প্রথম দিকে আনন্দ ওই ডাকটা থামাবার ব্যবস্থা করতে বলেছিল। কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল ও দুটোর খিদে পেয়েছে এবং তরল কিছু না পেলে ওদের ক্ষুধার্ত থাকতেই হবে। এখন পর্যন্ত চিবিয়ে খাওয়ার আভ্যেস তৈরী হয়নি।

দ্বিতীয়ত, গুহায় আগুন জ্বলছিল, উত্তাপ ছিল। যে যার নিজের নিরাপদ বিছানায় শুয়েও পড়েছিল, শুধু মেয়েটির শোওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। সে প্রথম দিকে আগুনের পাশে বসেছিল। পায়ের তলায় বিছানো তার কাপড় এর মধ্যেই স্যাঁতসেতে হয়ে গেছে! মনে মনে ওর জন্যে একটা উপায় বের করার চেষ্টা করিছিল জয়িতা। কিন্তু শেষ পযন্ত এই ভেবে আশ্বস্ত হয়েছিল যে ঠাণ্ডার সঙ্গে ওদের লড়বার ক্ষমতা আছে। মাঝরাতের পর যখন হাওয়ারা পাহাড় কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে, গুম গুম শব্দ হচ্ছে চার ধারে, নিভে আসা আগুনের শরীরেও যে হিম ঢুকে পড়েছে তখন সে চমকে উঠেছিল। মেয়েটি শুয়ে আছে সুদীপের শবীর ঘেঁষে। নিরাপদ বিছানায় ঢুকে থাকায় সুদীপের শরীরে ঠাণ্ডা কম লাগছে এবং তাকে জড়িয়ে কিছুটা উত্তাপ নেওয়ার চেষ্টা করছে মেয়েটা। ভালুকের বাচ্চাদুটো সম্ভবত স্থানচ্যুত অথবা ক্ষিদের কারণে সুদীপের আশ্রয় ছেড়ে কাঁপা পায়ে ঘুরছে গুহার মধ্যে। নিবন্ত আগুনের কাছে পৌঁছে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকছে।

মেয়েটির দিকে একদৃষ্টিতে চেয়েছিল জয়িতা। কোন সঙ্কোচ অথবা আড় নেই। ক্রমশ ওর দুটো হাত সুদীপকে জড়িয়ে ধরল। যেন এই করলেই সে শীতের হাত থেকে পরিত্রাণ পাবে এমন মনে হচ্ছিল। খানিক তাকিয়ে জয়িতা মুখ ফিরিয়ে নিল। সে দ্বিতীয় অস্বস্তিব অস্তিত্ব টের পেল। এবার কানে নয়।

অথচ সুদীপের কোন প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না। সে ঘুমিয়ে আছে শিশুর মতন। যদিও মেয়েটিকে ঠিক মা বলে মনে হচ্ছে না। সুদীপের মুখ অবশ্য জয়িতা ভাল করে দেখতে পাচ্ছিল না! নরনারীর আলিঙ্গন মানেই যে অবধারিত যেীনতা এমন ভাবার কারণটা দূর হতে সময় লাগল। দুটো শরীর পরস্পরের উত্তাপ নিয়ে বেঁচে থাকার যে চেষ্টা করছে সেটাকে সে কি বলবে? কিন্তু তার মনে হচ্ছিল মেয়েটি অনেক সহজ। এতদিন সুদীপকে জেনেও সে কোন হিমের রাতে এইভাবে জড়িয়ে শুয়ে থাকতে পাবত না। অথচ মেয়েটি সামান্য পরিচয়ে যৌনতাহীন আলিঙ্গনের তাপ নিতে পারছে। ঘুম এল জয়িতার। এবং তখনই তার মনে হল মেয়েটি আনন্দর দিকে সামান্য দৃষ্টিপাত করেনি। তার যা কিছু করার সুদীপকে নিয়েই করছে। এই মুহূর্তে সুদীপ জড়তাক্রান্ত। শুধু শারীরিক প্রয়োজন হলে মেয়েটি আনন্দকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করত। মেয়েটি অবশ্যই সুদীপের সম্পর্কে দুর্বল হয়েছে। একেই কি ভালবাসা বলে? বুকের ভেতর জমে ওঠা অস্বস্তিটা এবার টনটনানির পর্যায়ে চলে গেল।

সকালে রোদ উঠল না, সূর্যের হদিস নেই। গুহার বাইরে মুখ বের করে আতঙ্কিত হল ওরা। একটা ময়লা আলো নেতিয়ে রয়েছে বরফের ওপরে। কাল সারারাত প্রচুব তুবপাত হয়েছে এখানে। যে গাছগুলোর ন্যাড়া ডাল গতকাল দেখা গিয়েছিল সেগুলো এখন সাদায় সাদা। বীভৎস আকাশটা নেমে এসেছে যেন মাথার ওপরে। আর থম ধরে আছে চৌদিক।
 
শরীরের বাড়তি ভার কমিয়ে ফেলতে যেদিকে আনন্দ গেল তার বিপরীতে পা ফেলল জয়িতা। একটু আগেই সুদীপকে নিয়ে মেয়েটি বেরিয়েছিল। ওদের দিকে পিছন ফিরেছিল সুদীপ, কিন্তু বুঝতে অসুবিধে হয়নি মেয়েটি ওর প্যান্টের বোতাম খুলে জলবিয়োগ করতে সাহায্য করেছে। আজ সকালে কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা মাথায় আসেনি। যেমন করে একজন নার্স তার ভূমিকা পালন করেন সেইভাবে মেয়েটি কর্তব্য করছে বলে মনে হয়েছিল। সুদীপের হয়ে গেলে মেয়েটি ওর পাশেই বরফের ওপর বসে পড়ে ভারমুক্ত হল। এটাই জয়িতার নার্ভে ধাক্কা মারল। গতকালও মেয়েটি একটা আব্রু রেখেছিল। আজ সেটিও বর্জিত হয়েছে। অথবা এখন ওই ভালুকছানা এবং সুদীপের মধ্যে তার কাছে কোন ফারাক নেই। কিন্তু ও জানত পিছনে গুহার মুখে আনন্দ এবং জয়িতা দাঁড়িয়ে আছে। ও যখন সুদীপকে ধরে ধরে ফিরিয়ে নিয়ে এল তখন মুখে কোন অন্যায়বোধ নেই। অনেকটা আড়ালে এসে জয়িতা চারপাশে তাকাল। পাহাড়ের চূড়োগুলো এখন দেখা যাচ্ছে না। ঘোলাটে হয়ে আছে সব কিছু। নিজেকে মুক্ত করার মুহূর্তে তার মনে হল মেয়েটির ওপর রাগ করার কোন মানে হয় না। এই মুহূর্তে সে ধরে নিয়েছে কোন মানুষ আশেপাশে নেই। একটি পুরুষ যা পারে একটি মেয়ের পক্ষে তা শোভনীয় নয় তাই আজন্ম জেনে এসেছে। সেই কারণেই নির্জন জায়গা বেছে নেওয়া। কিন্তু এটাও তো এক ধরনের দুর্বলতার প্রকাশ। মেয়েটি ধরে নিয়েছে সে কোন অন্যায় কাজ করছে না, কোন অশালীন দৃশ্য তৈরি হলে যে দেখছে সে-ই তৈরি করে নিচ্ছে তখন তার বাধা কোথায়? ছেলেদের বেলায় যা স্বাভাবিক তা মেয়েদের ক্ষেত্রে দৃষ্টিকটু হবে কেন? এ সবই মধ্যবিত্ত মানসিকতা থেকে রক্তে মেশা সংস্কার। এই মেয়েটি অন্তত অনেক স্বাভাবিক। জয়িতা চারপাশে তাকাল। একটা রাত কেটে গেল গুহার মধ্যে চারপাশে বরফ রেখে। আর এখানেও সে বয়ে চলেছে কলকাতার মানসিকতা।

হঠাৎ বাঁ দিকে মুখ ফেরাতেই সে চমকে উঠল। যেন বিশাল বরফের ঢেউ পাহাড় থেকে গড়িয়ে নামছে নিচে। জয়িতা দৌড়তে লাগল আতঙ্কিত হয়ে। তার মনে হচ্ছিল সমস্ত পাহাড় এখন গলছে। আর তখনই হাওয়া উঠল। সে যখন গুহায় পৌঁছল তখন আকাশে ধুন্ধুমার কাণ্ড। ঘনঘন বাজ পড়ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আর ক্ষুব্ধ ষাঁড়ের মত বরফ মেশানো বাতাস আছড়ে পড়ছে গুহার বাইরে। ওদের তাঁবুর কাপড় দিয়ে বানানো গুহার আড়ালটা থরথরিয়ে কাঁপছে। যেহেতু পাহাড় আড়াল করে আছে এবং বাতাসের মুখ এদিকে নয় তাই ওটা এখনও টিকে আছে কোনমতে। ভেতরে ঢুকে জয়িতা দেখল, আনন্দ জল গরম করছে। সে উত্তেজিত হয়ে বলল, বাইরে প্রলয় হচ্ছে।

আনন্দ জয়িতার দিকে তাকিয়ে হাসল, তোর চেহারাটা যা হয়েছ না, একদম শ্বেত ভালুক!

জয়িতা নিজের দিকে তাকাল একবার তারপর চিৎকার করে বলল, বোকার মত কথা বলিস না। আমরা যে কোন মুহূর্তে বরফচাপা পড়তে পারি। মনে হচ্ছে পাহাড়টা নেমে আসছে।

আনন্দ বলল, কিছু করার নেই। বাইরে বের হলে যখন মৃত্যু অনিবার্য তখন এখানে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। আমাদের এবার চায়ের নেশাটাও ছাড়তে হবে, পাতা ফুরিয়ে আসছে।

শরীরের ওপর জমে-যাওয়া বরফগুলো ঝেড়ে জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, তুই এরকম ঠাণ্ডা গলায় কথা বলছিস?

কী করব? চা ঢালল আনন্দ, মেয়েটা বলল গ্রামে বরফ পড়ার ঠিক আগে নাকি প্রতি বছর এই রকম কাণ্ড হয়। এর পরে ব্লিজার্ড বইবে। তুই ভাবতে পারিস, বাঙালির ছেলে ব্লিজার্ডের মুখোমুখি হচ্ছে?

বাইরে বের হলে থ্রিন্সটা টের পাবি।

সেই জন্যেই ভেতরে বসে আছি। নে, চা খা। ব্রেকফাস্ট কাম লাঞ্চ, মাংস।
 
চায়ে চুমুক দিতে বিস্বাদ হল মুখ। চিনি কম আর কষা হয়েছে পদার্থটা। কিন্তু তবু গরম পানীয় বলে কথা, জয়িতা নিজেই একটা আরাম বানিয়ে নিচ্ছিল। প্রত্যেককে চা দেওয়ার পর আনন্দ ভান্সকুছানা দুটোকে নিয়ে পড়ল। একদম নেতিয়ে পড়েছিল ওরা, গরম চা মুখে পড়তে প্রথমে প্রতিবাদ, তার পরে গোগ্রাসে গিলতে লাগল। জয়িতা বাচ্চাদুটোকে খেছিল। পেটভরে খাওয়ার পর ওদের মুখে চমৎকার আরাম। দুজন দুজনের শরীরে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল এবার। আনন্দ বলল, পশুর সঙ্গে মানুষের এখানেই প্রভেদ। মানুষ অল্পে সন্তুষ্ট হবার মনটা হারিয়ে ফেলেছে।

দুপুরের পর থেকেই আকাশ পরিষ্কার। এমন কি মোলায়েম একটা আলো ফুটল পৃথিবীতে। দেখা গেল বরফ জমেছে প্রচুর। ন্যাড়া গাছগুলোর অনেককেই আর দেখা যাচ্ছে না। আকাশে ছিটেফোঁটাও মেঘ নেই। এমন কি চোখ মেলতেই মাকালু ঝকমকিয়ে উঠল। কিন্তু যে পথে ওরা এসেছিল এবং যে পথে লা-ছিরিঙ ফিরে গিয়েছিল সেই পথটাই নেই। আনন্দ বলল, যাক, এযাত্রায় বাঁচা গেল। মনে হয় লা-ছিরিঙ খবর নিয়ে আসতে পারে এবার।

জয়িতার কথাটা ভাল লাগল না। বলল, ওর জন্যে অপেক্ষা না করে আমরা যদি নেমে যাই তাহলে সন্ধ্যের আগে গ্রামে পৌঁছতে পারব। গ্রামে ঢুকেই বুঝতে পারব পুলিশ এসেছে কিনা।

যখন বুঝবি তখন কিছু করার থাকবে না হয়তো। রিস্ক নেওয়া ঠিক হবে না।

তুই ক্রমশ কেমন ভীতু হয়ে যাচ্ছিস। জয়িতা বিরক্ত গলায় বলল।

আনন্দ চোখ তুলে তাকাল। তারপর ঠাণ্ডা গলায় বলল, আমরা চারজন এখানে এসেছিলাম। একজন পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছে। আর একজন বেঁচে থেকেও অকেজো। এই অবস্থায় আর একটা দুর্ঘটনা ঘটাবার কোন মানে হয় না। তাছাড়া আমরা তো জলে পড়ে নেই।

আনন্দ খুব একটা ভুল বলছে না। কিন্তু জয়িতার মনে হল এরকম কথা সেই সব মানুষেরাই বলে থাকে যারা উদ্যম হারিয়ে ফেলে। সে বলল, কিন্তু এইভাবে আটকে থেকে আমরা কি করতে পারি। পুলিশ গ্রামে এসে আমাদের কথা জানতেই পারবে। বলা যায় না, হয়তো এর জন্যে আমাদের কাছাকাছি মানুষদের ওপর ওরা অত্যাচার করতে পারে। আমার মনে হয় যতদূর সম্ভব নেমে গিয়ে একটু হদিশ নেওয়া যাক। বিপদ বুঝলে ফিরে আসব।

আনন্দ এবার দোনমনা করল, এত বরফের মধ্যে সুদীপকে নিয়ে নামা যাবে?

সুদীপ ওই মেয়েটার সঙ্গে এখানেই থাক। যদি ফিরে আসি তত ভাল, নইলে লা-ছিরিঙ নিশ্চয়ই ওকে নামিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। মেয়েটি তো ওকে যত্ন করছে বেশ।

আনন্দ জয়িতার দিকে তাকাল। গতরাত্রে মেয়েটির ব্যবহার তারও চোখে পড়েছে। সুদীপের যা অবস্থা তাতে মেয়েটির এই ব্যবহার তার কাছে দৃষ্টিকটু মনে হয়নি। কিন্তু এখন মনে হল জয়িতা বোধ হয় ব্যাপারটা ঠিক সহ্য করতে পারছে না। ও বুঝতে পারছিল না মেয়েরা কেন এত অসহনীয় হয়ে ওঠে একটি পুরুষকে ঘিরে? বিশেষ করে যার সঙ্গে হৃদয়ের সম্পর্ক নেই এমন পুরুষের সঙ্গে কোন মেয়ে ঘনিষ্ঠ হলেও সেই দৃশ্যের কাছাকাছি থাকাটা তাদের কাছে কেন অস্বস্তির হয়? শেষবার সে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু আমরা চলে গেলে ভালুকটালুকও তো আসতে পারে। গুহাটার কথা নিশ্চয়ই পাহাড়ি জন্তুদের জানার কথা।

এইটে মাথায় আসেনি। জয়িতা এক মুহূর্ত ভাবল। তারপর সোজা গুহায় ফিরে গেল। সুদীপ বসে আছে। আর মেয়েটি গুনগুন করে গান শোনাচ্ছে। জয়িতাকে দেখে মেয়েটি থেমে গেল। সে সরাসরি সুদীপের দিকে চলে এল, কেমন আছিস সুদীপ?
 
সুদীপের চোখের পাতা পড়ল। জয়িতার মনে হল ওর মাথায় একটা কিছু এসেছে নইলে মুখ অমন উজ্জ্বল হত না। ঠোঁট ফাঁক হল সুদীপের। তারপর অনেক কষ্টে কিছু বলল। কিন্তু সেই শব্দগুলো বোধগম্য হল না জয়িতার। সে মেয়েটির দিকে ফিরল, আমরা একবার গ্রামের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছি। যদি পোঁছতে না পারি, তাহলে ফিরে আসব। পারলে ওরা আসবে তোমাদের নিয়ে যেতে। ঠিক আছে?

মেয়েটি মাথা নাড়ল। কতটা সে বুঝতে পারল তা অনুমানে এল না। জয়িতা শেষ প্রশ্নটা উচ্চারণ করল, কিন্তু কোন জন্তু-জানোয়ার এলে কি করবে তোমরা?

মেয়েটি এক মুহূর্ত চিন্তা করল। তারপর উঠে সুদীপের বিছানার নিচু থেকে একটা লাঠি বের করে সামনে রাখল। জয়িতা বুঝল কিছু করার নেই। ওর হাতে রিভলবার দিয়ে যাওয়া যায় না। এই তুষারঝড়ের পর কোন পাহাড়ি জন্তুর আবির্ভাব হবে বলে মনে হয় না, হলে ওই লাঠি যে কোন কাজেই লাগবে না তা এই মেয়েটি কি জানে না!

জয়িতা আবার বাইরে বেরিয়ে এল। আনন্দর সঙ্গে ভালুকছানা দুটো এবার খেলা করছে। ব্যাপারটা চোখে পড়ামাত্র চিড়বিড়িয়ে উঠল মন, এটা কি খেলার সময়?

ওকে দেখতে পেয়ে আনন্দ চিৎকার করল, কি ঠিক করলি?

আমি একাই যাব। জয়িতা শক্ত গলায় বলল।

আর ইউ ম্যাড? আনন্দ দাঁড়িয়ে পড়ল।

জয়িতা মাথা নাড়ল, ভেবেচিন্তেই বলছি। লা-ছিরিঙ আর পালদেমকে আমাদের সাহায্য করার জন্য পুলিশ আরেস্ট করতে পারে, সে ক্ষেত্রে কে খবর দেবে আমাদের?

কোন পুলিশ? ইন্ডিয়ান পুলিশ ওদের আরেস্ট করতে পারে না।

এই নির্জন পাহাড়ে আইন কতটা সক্রিয় আমার সন্দেহ আছে। নেপালী পুলিশ সঙ্গে থাকতে পারে।

আনন্দ এক মুহূর্ত কিছু ভাবল। তারপর নিচু গলায় বলল, ঠিক আছে, যা। আমি সুদীপকে এইভাবে ছেড়ে যেতে পারছি না।

বেশ সাহস নিয়ে নামা শুরু করল জয়িতা। মাঝে মাঝেই হাঁটু ড়ুবে যাচ্ছে নরম বরফে। কয়েক মিনিটের মধ্যে আনন্দ অথবা গুহা চোখের আড়ালে চলে গেল। এখন নির্জন সাদা পাহাড়ে সে একা। কোথাও কোন শব্দ নেই। এমনকি একটি পাখিও কোথাও ডাকছে না। খুব সাবধানে জয়িতা কমলারঙের রোদ গায়ে মেখে পা ফেলছিল। পাথর এবং তার খাজগুলো এখন বরফের আড়ালে। সামান্য অসাবধানতা যে বিপদ ডেকে আনবে তা থেকে উদ্ধার পাওয়া অসম্ভব। কিছুক্ষণ নামবার পর সে হাঁপাতে লাগল। এমন একটা বরফশূন্য জায়গা নেই যেখানে বসে জিরোতে পারে। যে পথ দিয়ে ওরা উঠে এসেছিল সে পথ উধাও। হাতে পায়ে যাচাই করে জয়িতা নামছিল। এখন তাকে পথ করে নিতে হবে। এবং তখনই তার পতন হল। যে বরফকে তার শক্ত মনে হয়েছিল তা তাকে টেনে নিয়ে গেল অনেকটা নিচে। কোনরকমে দুটো হাতে ভর রেখে নিজেকে সামলাল সে। থরথর করে কাঁপছে বুক। আর একটু ওপাশে পড়লেই এই জীবনে উঠে দাঁড়াতে হত না। যেখানে পড়েছিল সেই বরফের ওপরে বসে রইল সে কিছুক্ষণ। এখান থেকে নামার জায়গা নেই। কিন্তু নিচের জঙ্গলের মাথাগুলো দেখা যাচ্ছে। সেখানেও সাদাটে তুষার জড়ানো। বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর শরীর ধাতস্থ হল। একমাত্র হাঁটু এবং কনুইতে ব্যথা ছাড়া অন্য অস্বস্তি নেই। সে উঠে দাঁড়াল। এখনও সবুজের কোন চিহ্ন নেই। ক্যাপ্টেন স্কট অথবা হান্ট এইরকম বা এর চেয়ে বীভৎস বরফের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলেন। সেইসব কাহিনী পড়ার সময় যে উত্তেজনা আসত তার বিন্দুমাত্র এখন নেই। বরং একটা শীতল ভয় ছড়িয়ে পড়ছে মনে—যদি আরও বরফ পড়ে, যদি এখান থেকে বেব হতে না পারে। ডান দিকে একটি চাতালের মত বরফ রয়েছে দেখতে পেল সে। ওটা শক্ত না নরম তা এখান থেকে বোঝা অসম্ভব। কিন্তু ওইটে ছাড়া কোন রাস্তা নেই। জয়িতা ইতস্তত করল খানিক, তারপর মরিয়া হয়ে লাফ দিল। শূন্য থেকে শরীরটা চাতালে পড়ার পর পা-দুটো যখন অতলে তলিয়ে গেল না তখন হাসি ফুটল তার মুখে। এপাশে একটা পথ বের হতে পারে। সাবধানে এগোতে সে চমকে উঠল। এবং নিজের অজান্তে একটা আর্তনাদ ছিটকে বেরুল শরীর থেকে। দুহাতে মুখ ঢাকল জয়িতা। এখন তার সমস্ত শরীরে শীত-ছাড়ানো কম্পন। খানিকটা সময় যাওয়ার পর চোরের মত আঙুল সরিয়ে আবার সামনের দিকে তাকাল। লোকটা পড়ে আছে পা ছড়িয়ে। দুটো চোখ খোলা। নিঃসাড়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ডান হাতের মুঠোয় আটকে আছে। পাত্রটি, যে পাত্রে জল নিয়ে এসেছিল সে পর্বতশৃঙ্গ থেকে অসুস্থ মাকে সুস্থ করার বাসনায়। এই মানুষটির সঙ্গে গতকাল তারা কথা বলেছিল। এর জেদে বিস্মিত হয়েছিল, আন্তরিকতার প্রতি শ্রদ্ধা জেগেছিল। কিন্তু যে অত বড় পর্বত থেকে নেমে আসতে পারল সে এখানে মরে পড়ে থাকবে কেন? তারপরেই জয়িতার মনে পড়ল কুকুরটার কথা। লোকটার সঙ্গে ওরই তো থাকার কথা। কিন্তু কোথাও কুকুরটার হদিশ পেল না সে। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা নয়। পাহাড়ি কুকুরের বিশ্বস্ততার গল্প সে অনেক পড়েছে। লোকটা পড়ল কি করে তা বুঝতে পারছে না জয়িতা। কিন্তু ওর মৃত্যু যে পতন থেকেই হয়েছে তা স্পষ্ট। মাথার পেছনে অনেকটা রক্ত ছড়িয়ে আছে এখনও। রক্ত জমে গেলে বীভৎস দেখায়।

জয়িতা দ্রুত মৃত্যুর গন্ধ এড়িয়ে যেতে চাইল। সে ওই মানুষটির জন্যে কিছুই করতে পারে না। এবং তখনই তার নজর গেল পাত্রটির ওপর। প্রাণ বের হবার মুহর্তে লোকটি সতর্ক ছিল যাতে ঐ পাত্রটি ঠিক থাকে। সে ধীরে ধীরে পাত্রটি লোকটির আঙুলের বাঁধন থেকে ছাড়াবার চেষ্টা করল। ঠাণ্ডায় জমে ওগুলো এখন লোহার মত শক্ত। অনেক কষ্টে পাত্রটিকে মুক্ত করে সে আবার এগোল। হঠাৎ তার মনে হল এখন দায়িত্ব দুটো। নিজের শরীরকে ঠিক রাখার সঙ্গে এই পাত্রটিকে মৃতের মায়ের কাছে তাকে পৌঁছে দিতে হবে। এইভাবে হয়তো এক জীবনের আধো শেষ কাজ আর এক জীবন এগিয়ে নিয়ে যায় শেষ করতে। অতএব তার গন্তব্য তাপল্যাঙ নয়, পাশের গ্রামে তাকে যেতে হবে। রোলেন বলে লোকটাকে সে কথা দিয়েছিল তাদের গ্রামে যাবে। কিন্তু তারপর পালদেমদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকায় আর সময় পাওয়া যায়নি।
 
নিচের দিকে বরফ অপেক্ষাকৃত কম। মাঝে মাঝে পাথরের মুখ দেখা যাচ্ছে। সাবধানে হাঁটছিল সে। এখন গাছের মাথার কাছাকাছি নেমে এসেছে সে। দিনের আলো রেণু রেণু হয়ে ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। সন্ধ্যে হতে খুব বেশি দেরি নেই। ঠিক তখনই সম্মিলিত সারমেয়ধ্বনি কানে এল। জয়িতা দাঁড়িয়ে পড়ল। নিচ থেকে কুকুরগুলো ডাকতে ডাকতে উঠে আসছে। তাহলে কি পুলিশ কুকুর নিয়ে উঠে আসছে তাদের সন্ধানে। বাঁ হাতে কোমরের রিভলভারটায় হাত দিতে গিয়ে চমকে উঠল সে। সেটা কোমরে নেই। অথচ বের হবার আগে সেটা কোমরেই ছিল। নতুন একটা ভয় আক্রমণ করল তাকে। কোথায় গেল রিভলভারটা? সে যখন পা পিছলে নিচে পড়েছিল তখনই কি ছিটকে গেছে সেটা? হঠাৎ খুব অসহায় বোধ করতে লাগল জয়িতা। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলাল। এখন তার পক্ষে আর ওপরে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। শরীরের সমস্ত শক্তি খরচ হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া পুলিশের কুকুর নির্ঘাৎ তাকে খুঁজে বের করবে। এদের হাত থেকে কোনভাবেই পরিত্রাণ নেই। জয়িতা চট করে চারপাশে তাকিয়ে নিল। তারপর কোনরকমে একটা বড় পাথরের আড়ালে নিজেকে লুকোল। এবং তখনই দুটো কুকুরকে দেখতে পেল। ডাকতে ডাকতে তারা ওপরে উঠে এসে এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল। সন্দেহের চোখে পাথরটার দিকে তাকাল। একজন খানিকটা এগিয়ে এসে ডাকতে লাগল। আর দ্বিতীয়জন নেমে গেল নিচে। অর্থাৎ সে ধরা পড়ে গেছে। কুকুরটার বীভৎস দাঁতের দিকে তাকিয়ে সিরসির করে উঠল শরীর। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার চেয়ে মৃত্যু ঢের ভাল। কেন যে সে আনন্দর কথায় অবাধ্য হল! আর তখনই দলটাকে উঠে আসতে দেখল। ওদের দেখতে পাওয়ামাত্র শরীরে প্রাণ ফিরে পেল জয়িতা। না, এরা পুলিশ নয়। গ্রামবাসীরা উঠে আসছে কুকুর নিয়ে হয়তো তাদেরই খুঁজতে। কিন্তু এত লোকের তো তাদের খুঁজতে আসার কথা নয়। পালদেমরা তো ব্যাপারটাকে গোপন রাখতে চেয়েছিল? তবু আশান্বিত হয়ে জয়িতা আড়াল ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসামাত্র কুকুরগুলো চিৎকার দ্বিগুণ করে লাফাতে লাগল। যারা উঠছিল তারা সম্ভবত জয়িতাকে ওখানে দেখতে পাবে ভাবতে পারেনি। এইসময় শিস বাজল। বাজতেই যখন কুকুরগুলো বাধ্য হল তখন জয়িতা গতকালের কুকুরটাকে দেখতে পেল। সে অনেকটা পিছিয়ে কাতর গলায় ডেকে যাচ্ছে। এমনকি শিসের আদেশও তাকে থামাতে পারেনি। এক মুহূর্ত চুপচাপ, তারপর জঙ্গলটা থেকে লোকটাকে বের হতে দেখল জয়িতা। শক্ত শরীরে বিশ্বসের পা ফেলে এগিয়ে আসছে সামনে। কাছাকাছি হতেই জয়িতা চিনতে পারল, রোলেন। তাহলে এরা তাপল্যাচের মানুষ নয়? পাশের গ্রামের লোক কুকুর নিয়ে ওপরে উঠছে। রোলেন সামনে দাঁড়িয়ে মাখা একবার ঝুঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুমি এখানে কি করছ জানতে পারি কি?

জয়িতা মুখ উঁচু করে ওপরের দিকে তাকাল একবার, তারপর বলল, আমি ওপর থেকে নেমে আসছি। রোলেন কি বুঝল সেই জানে, মাথাটা দুবার নাড়াল। এই অভ্যাস পাহাড়ি মানুষের মধ্যে প্রায়ই দেখতে পাচ্ছে জয়িতা। সে জিজ্ঞাসা করল, তোমরা দল বেঁধে কোথায় যাচ্ছ?

রোলেন জবাব দিল, আমাদের গ্রামের একটি ছেলে তার মায়ের জন্য ভগবানের জল আনতে পাহাড়ে গিয়েছিল কিছুদিন আগে। সে ফেরেনি কিন্তু তার কুকুরটা ফিরে এসেছে। ওর ভাবভঙ্গিতে বুঝতে পারছি লোকটি খুব কাছাকাছি আছে। হয়তো অসুস্থ, হয়তো হাঁটতে পারছে না। কুকুরটা আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

জয়িতা ঠোঁট কামড়াল, তারপর দুঃখিত গলায় বলল, আমি তাকে দেখতে পেয়েছি। সে বেঁচে নেই!

কি বলছ তুমি? তাকে দেখতে পেয়েছ? অত ওপর থেকে আসছ?

হ্যাঁ। আমরা ওপরে একটা গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমরা ভয় পাচ্ছিলাম পুলিশ হয়তো আমাদের খোঁজে গ্রামে আসতে পারে। গতকাল লোকটা জল নিয়ে আমাদের গুহায় নেমে এসেছিল। ওই কুকুরটাও সঙ্গে ছিল। ও খাওয়াদাওয়া করে আবার রওনা হয়েছিল বিকেলে। আজ একটু আগে ওর মৃতদেহ দেখতে পেলাম আমি। এখান থেকে খানিকটা ওপরে গিয়ে খুঁজলেই তোমরা পেয়ে যাবে ওকে। জয়িতা মুখ তুলে দেখার চেষ্টা করেও ঠিক হদিশ পেল না জায়গাটার। রোলেন চিৎকার করে খবরটা সঙ্গীদের জানিয়ে দিতেই একটা হতাশ শব্দ একসঙ্গে উচ্চারিত হল, কিন্তু কেউ কাঁদল না।

রোলেন বলল, ওর দেহ আমাদের তুলে আনা কর্তব্য। আজ পর্যন্ত অনেকেই ভগবানের জল আনতে পাহাড়ে উঠেছে কিন্তু খুব কম মানুষই ফিরে আসতে পেরেছে। ও যখন এতটা ফিরতে পেরেছিল তখন বোঝা যাচ্ছে ভগবানের আশীর্বাদ ছিল ওর সঙ্গে।
 
হঠাৎ জয়িতার মনে পড়তে পাত্রটা তুলে ধরল, এইটে ওর হাতে ছিল মৃত্যুর মুহর্তেও। এইটে করে যে জল এনেছিল তা বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিল সে।

সঙ্গে সঙ্গে রোলেনের চোখমুখ পালটে গেল। পরম বিস্ময়ে সে পাত্রটির বরফ দেখেই উল্লসিত হয়ে উঠল। সে উল্লাস ছড়িয়ে পড়ল দলটার মধ্যে। একটি মৃত্যুশোককে ছাপিয়ে যে খুশি বড় হয়ে উঠতে পারে একটি প্রাপ্তির সংবাদে তা জয়িতার জানা ছিল না। হঠাৎ সমস্ত দলটা নতজানু হয়ে বসল জয়িতার সামনে। মাথা নিচু করে রোলেনও তাদের সঙ্গে বসে মৃদু স্বরে কিছু আওড়ে গেল। এই মুহূর্তে নিজেকে যেন ঈশ্বরীর মত মনে হচ্ছিল জয়িতার। পৌরাণিক ইংরেজি ছবিতে এমন দৃশ্য দেখেছে সে। বোঝাই যাচ্ছে এরা এই পবিত্ৰজলের উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। কিন্তু তার ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছিল না।

প্রার্থনা শেষ হলে রোলেন সঙ্গীকে নির্দেশ দিল। কুকুরগুলো নিয়ে দলটা ওপরের দিকে রওনা হতে রোলেন বলল, তোমাকে এবার আমাদের গ্রামে যেতে হবে।

কেন? জয়িতার কপালে ভাঁজ পড়ল।

ভগবানের কাছ থেকে পাওয়া ওই জল কাহুনের কাছে পৌঁছে দিতে হবে তোমাকে। তুমি ওই মৃত মানুষটিকে প্রথম দেখেছ। ওই জল তুমি ওর কাছ থেকে না নিয়ে এলে হয়তো আমরা কোনদিন খুঁজে পেতাম না।

জয়িতা মাথা নাড়ল। এ ব্যাপারে তার কোন আপত্তি নেই। পাশের গ্রামে পৌঁছলে তাপল্যাঙের খবর জানা যাবে। সে রোলেনের সঙ্গে হাঁটতে লাগল। এখন পথ অনেক সহজ। কিন্তু বরফ ছড়ানো সর্বত্র। এই দুটো রাতের মধ্যে প্রকৃতি এমনভাবে চেহারা পালটে ফেলবে কে জানত!

হঠাৎ রোলেন বলল, তোমাদের কাছে অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও পুলিশকে ভয় পাও?

জয়িতা শক্ত হল। তার কাছে যে অস্ত্র নেই সেই কথাটা মনে এল। কিন্তু পুলিশের কথা তো রোলেনের জানার কথা নয়! সে কোন উত্তর দিল না। রোলেন খানিক চুপ করে থেকে নিজের মনেই বলে যেতে লাগল, গতকাল পুলিশ এসেছিল তোমাদের ধরতে তাপল্যাঙে। খুঁজে না পেয়ে পালদেমকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। তাপল্যাঙের নোক এমন ভেড়য়া যে চুপচাপ সেটা দেখছিল। আমরা পাহাড় থেকে পাথর ফেলে ওদের তাড়িয়ে দিলাম। কাল থেকে তো বরফ নেমে গেছে। মনে হয় বরফ গলার আগে আর ওরা এদিকে আসতে সাহস পাবে না।

পালদেমের কি হয়েছে? জয়িতার গলায় উদ্বেগ।

ওকে ছেড়ে দিয়েছে ওরা। তোমরা পালিয়ে গেলে কেন? পুলিশদের লড়াই করে হারিয়ে দিতে পার না অথচ ওই সব বন্দুক ছুঁড়ে আমাদের ভয় দেখাও! যে লোকটাকে তুমি আঘাত করেছিলে সে এখনও ভাল করে হাঁটতে পারে না। বড় বন্দুক নেই তোমাদের সঙ্গে? রোলেনের গলায় কৌতূহল।

সবসময় সামনাসামনি লড়াই করতে নেই। আমরা চাইনি পুলিশরা আমাদের কথা জানুক। তোমরা ডাকাত? খারাপ কাজ করে এখানে লুকিয়ে আছ?

জয়িতা চোখ তুলল। রোলেনের দৃষ্টি সরলরেখায় এল। হঠাৎ সমস্ত শরীরে কাঁপুনি এল জয়িতার। কোনরকমে সে বলতে পারল, আমাদের দেখে তোমাদের কি তাই মনে হয়?

রোলেন কাঁধ নাচাল, তারপর বলল, কি জানি?

পাহাড় শেষ হতেই দুটো পথ। একটা চলে গেছে তাপল্যাঙের ভেতরে, অন্যটা পাশের গ্রামে। পুলিশ এসেছিল এবং চলে গিয়েছে জানতে পারার পর একটা নিশ্চিন্তিবোধে আচ্ছন্ন ছিল জয়িতা। হঠাৎ রোলেন তার হাত ধরে টানতে সে চমকে সামনের দিকে তাকাল। লা-ছিরিঙ এবং পালদেম খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। এবং ওদের মুখ গম্ভীর। জয়িতা এগোতে যাচ্ছিল কিন্তু রোলেন বাধা দিল, না, যাবে না। তোমার কাছে আমাদের জন্যে আনা ভগবানের জল আছে।

তার সঙ্গে আমার যাওয়ার কি সম্পর্ক?

ওরা জানতে পারলে ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করবে। আর তাই যদি হয়, তোমার কাছে যে অস্ত্রই থাক আমি জীবন থাকতে ওদের নিতে দেব না। আচমকা রোলেনকে অত্যন্ত রাগী দেখাচ্ছিল।

পালদোমের গলা পাওয়া গেল, ওরা কোথায়?

জয়িতা হাসবার চেষ্টা করল, ওরা এখনও ওপরে। শুনলাম পুলিশ তোমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল!
 
কথাটা পালদেমের পছন্দ হল না। সে চুপ করে রইল, কিন্তু লা-ছিরিঙ বলল, আমরা পুলিশদের পেছনে পেছনে ওয়ালাংচুঙ পর্যন্ত গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছে আর ওরা ফিরে আসবে না।

জয়িতা বলল, তোমাদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।

কিন্তু কথাটা পালদেমের কানে গেল না। সে নিরাসক্ত গলায় বলল, আমরা ওপরে যাচ্ছি। আকাশ পরিষ্কার থাকলে রাত্রেই ফিরে আসব। তুমি কি একা একা গ্রামে ফিরতে পারবে?

জয়িতা বলল, পারব।

কথাটা শোনামাত্র পালদেম গম্ভীরমুখে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে লা-ছিরিঙকে নিয়ে ওপরে উঠতে লাগল। জয়িতা চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের কি হয়েছে?

পালদেম জবাব দিল না। কিন্তু লা-ছিরি দাঁড়াল, তুমি আমাদের শত্রুপক্ষের সঙ্গে হাঁটছ।

কিন্তু আমি তো তোমাদের বন্ধু।

তা ঠিক। কিন্তু ওর সঙ্গে তোমার থাকাটা আমরা পছন্দ করছি না।

কেন? ওর সঙ্গে থাকলে কি আমি তোমাদের বন্ধু হতে পারি না? ও তো তোমাদের উপকার করেছে। পুলিশের হাত থেকে পালদেমকে ছাড়িয়ে দিয়েছে।

এবার পালদেম কথা বলল, সেটা তোমার ঋণ শোধ দেবার জন্যে। এখন ও মুক্ত। এবার নতুন করে শত্রুতা চালাতে আর কোন মনের বাধা নেই। আমরা ওদের বিশ্বাস করি না।

রোলেন চুপচাপ শুনছিল। হঠাৎ সে কোমরে হাত রাখল। তারপর চিৎকার করে উঠল, আর একটা কথা বললে আমি কুকরি বের করব!

কথাটা শোনামাত্র পালদেম লাফিয়ে কয়েক পা এগিয়ে এল। এবং তারও হাত এবারে কোমরে। জয়িতা প্রমাদ গুনল। রোলেনের পক্ষে একা দুজন মানুষের সঙ্গে লড়াই করা সম্ভব কিনা তা বিস্মৃত হয়েছে। কিন্তু একটা খুনোখুনি হবেই। ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতন দুটো মানুষ সতর্কভঙ্গিতে পরস্পরের কাছাকাছি হচ্ছে। লা-ছিবিঙ উত্তেজিত। যে কোন মুহূর্তে সে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে।

হঠাৎ দৌড়ে ওদের মাঝখানে চলে এল জয়িতা। তারপর জলের পাত্রটা উঁচিয়ে ধরে চিৎকার করে উঠল, তোমরা যদি লড়াই কব তাহলে আমি এটা দূরে ছুঁড়ে ফেলব!

সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দ বের হল রোলেনের গলা থেকে, না! তার মুখে ভয় এবং অসহায় ছাপ পড়ল ক্রোধ সরিয়ে। যেন আচমকা পাথর হয়ে গেল সে।

জয়িতা শক্ত গলায় বলল, তোমরা যদি এইরকম মারামারি কর তাহলে ভগবানের জল পাওয়ার কোন অধিকার তোমার নেই।

ভগবানের জল? পালদেমের গলায় বিস্ময়।

হ্যাঁ। ওদের গ্রামের একটি মানুষ মায়ের অসুখ সারাবে বলে ওই উঁচু পাহাড়ের চুড়ো থেকে এই জল একা নিয়ে এসেছিল। বেচারা মারা গিয়েছে পথে কিন্তু জল ঠিক রেখেছিল এই পাত্রে।

জয়িতার কথা শেষ হওয়ামাত্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেল পালদেমের, তুমি যা বলছ তা সত্যি?

আমি কখনও মিথ্যে কথা বলি না পালদেম। তোমাদের যে মেয়েটি ওপরে আছে তাকে জিজ্ঞাসা করতে পার। কিন্তু তোমরা যদি পরস্পরকে আঘাত কর তাহলে এটা আমি ছুঁড়ে ফেলব।

জয়িতার কথা শেষ হবার আগেই পালদেম আর লা-ছিরিঙ হাঁটু গেড়ে বসে কিছু আওড়ে নিল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে পালদেম বিনীত গলায় জিজ্ঞাসা করল, এই জল আমরা পেতে পারি? আমাদের গ্রামে কখনও ভগবানের জল আসেনি।

জয়িতা দ্বিধায় পড়ল। সে কি করে বোঝায় এই জলের কোন ক্ষমতা নেই। পৃথিবীর নদনদী বা বরফের সঙ্গে এর কোন পার্থক্য থাকতে পারে না। একটা অন্ধ বিশ্বাস প্রশ্রয় দেওয়া মানে আধুনিক জীবনযাত্রার বিপরীত কাজ। তাপল্যাঙের মানুষের জীবনে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন তারা আনতে বদ্ধপরিকর তার সঙ্গে এই সংস্কার মিলতে পারে না। কিন্তু একটি বিশ্বাস তা যতই অন্ধ হোক যদি দুটি বিবদমান মানুষের প্রাণে শান্তি আনে তাহলে সে সেই সুযোগ নেবে না কেন? প্রথমে শান্তি, তারপর এগিয়ে যাওয়া। সে বলল, তোমাদের প্রতিজ্ঞা করতে হবে ভগবানের নামে, আর কখনও তোমরা অস্ত্রে হাত দেবে না।

প্রস্তাবটা শোনামাত্র রোলেন এবং পালদেম পরস্পরের দিকে তাকাল।
 
৪৬.
দরজা খুলতেই কাটার চাবুকের আঘাত। টলতে টলতে সামলে নিল আনন্দ। যতটা সম্ভব মুখচোখ থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে নেওয়া সত্ত্বেও শরীরে হিমঅনুভূতি। ঝড়টা বইছে এখনও। বরফের কুচিগুলো আর তীরের মত ছিটকে আসছে না এই যা। দরজা ভেজিয়ে আনন্দ সোজা হয়ে দাঁড়াল। এখন অন্তত সকাল দশটা। অথচ অন্ধকার পাতলা হয়ে ঝুলে আছে তাপল্যাঙের ওপরে। আকাশের রঙের বর্ণনা করা অসম্ভব। চরাচর দেখা যাচ্ছে কিন্তু সাদা তুষারের গায়ে যে ছায়া পড়েছে তাতে মনে হচ্ছে অন্য কোন গ্রহে চলে এসেছে ওরা। এখন তাপল্যাও বরফে মোড়া। যেদিকে তাকাও শুধু বরফ আর বরফ।

তিন রাত দুদিন ব্লিজার্ড বইছে। ব্লিজার্ড শব্দটার সঙ্গে বইয়ে পরিচয় ছিল। য়ুরোপ আমেরিকায় তুষারঝড়ে পথ হারানো বা মৃত্যুমুখে পড়া মানুষের গল্প অনেক পড়েছে সে। ব্লিজার্ড শব্দটার মধ্যে একটা রোমান্টিক ভাবনা সে আরোপ করে নিয়েছিল। কিন্তু গত তিনরাতের প্রতি মুহূর্তের আতঙ্কে সেসব শিকেয় উঠেছে। মনে হয়েছে যে কোন সময় আস্তানাটা উড়ে যাবে। কাঠের দেওয়ালে অনবরত বরফের কুচি নেকড়ের নখের আওয়াজ তুলেছে। ঠাণ্ডা নেমে গেছে এতটা যে আগুন জ্বালিয়েও মনে হয়েছে ওতে হাত ডোবালে ফোসকা পড়বে না। প্রাকৃতিক প্রয়োজনগুলোও চাপা পড়ে গিয়েছিল। দরজা খোলার সাহস হয়নি। নিরুপায় হলে বাইরের জানলার নিচে বসতে হয়েছে। এবং এইখানে, এই সময়ে তার এবং সুদীপের সঙ্গে জয়িতা মেয়েটির কোন পার্থক্য ছিল না।

কাল সারারাত ঝড়ের দাপট ছিল মারাত্মক। মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সব বাতাস যেন একত্রিত হয়েছে। আর এভারেস্ট যেন আচমকা গলে এগিয়ে আসছে। কাল সারারাত ঘুম আসেনি কারও। এমন কি সুদীপেরও। ওর চেতনা এখন অনেক স্পষ্ট। মেয়েটি বিশ্বাস করে নোলেনদের গ্রাম থেকে চেয়ে আনা পর্বতশৃঙ্গের পবিত্র জলের কণা ওর কপালে মাখিয়ে দেওয়ায় এই পরিবর্তন। কিন্তু লা-ছিরিঙের মুখে সে শুনেছে গুহা থেকে নামিয়ে আনার সময় সুদীপ পা পিছলে অনেকটা পড়ে গিয়েছিল। নরম বরফে শরীর পড়ায় তেমন আঘাত লাগেনি, কিন্তু পড়ার পর আতঙ্কে চিৎকার করে উঠেছিল। আনন্দ ছিল অনেকটা আগে। চিৎকার শুনে পিছিয়ে গিয়ে দেখেছিল সুদীপ উঠে দাঁড়িয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। তখনও ওর মুখে মৃত্যুভয় সেঁটে আছে। আনন্দর প্রশ্নের উত্তরে মাথা নেড়েছিল সে। ওই আঘাত থেকে ওর চেতনা ফিরে এসেছে কিনা তা বোঝা যাচ্ছে না অবশ্য। এখনও সুদীপ কথা বলে না। কিন্তু অন্যরা কথা বললে আগ্রহ নিয়ে শোনে। এটা কম স্বস্তির নয়।

দরজাটা দ্বিতীয়বার খুলল। জয়িতার গলা শোনা গেল, উঃ বাবা।

আনন্দ কথা বলতে গিয়ে আবিষ্কার করল তার দাঁতে দাঁতে শব্দ হচ্ছে। যেন ঠাণ্ডায় স্বরনালী বিকল হয়ে গেছে। জয়িতা বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর ইশারা করে দৌড়াবার চেষ্টা করল সামনে। কিন্তু হাঁটু অবধি জমে থাকা নরম বরফে দৌড়ানো যে অসম্ভব ব্যাপার তা আবিষ্কার করে অসহায় চোখে তাকাল সে। আনল সাবধানী পায়ে ওর পাশে দাঁড়াল। হাওয়ার দাপটে শরীর সোজা রাখা প্রায় অসম্ভব। সে জয়িতার হাত ধরল।

কয়েক পা এগোতে ওরা একটা ঘরের ছাদকে বরফের ওপর মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে দেখল। আশেপাশে ঘর নেই। ভাঙচুর হওয়া ছাদটি কোত্থেকে উড়ে এসেছে বোধগম্য হচ্ছিল না। গ্রামের ভেতরে ঢোকার পর মনে হল কেউ যেন দুরমুশ করে দিয়েছে চৌদিক। অথচ কোন মানুষের শব্দ নেই। নবনির্মিত যৌথগৃহের প্রথমটির দরজা বন্ধ। আনন্দ দরজায় শব্দ করে যখন কোন সাড়া পেল না তখন চিৎকার করতে লাগল হাওয়ার দাপট ছাড়িয়ে।
 
দরজাটা খুলতে সময় লাগল। যে যুবকটি দরজা খুলেছিল সে তাদের দেখে যেন হতবাক। চটপট ভেতরে ঢুকে নিজেদের সামলে নেওয়ার আগেই অনেকগুলো গলা থেকে বিস্ময়সূচক শব্দ উচ্চারিত হল। তারপর একসঙ্গে অনেকেই কথা বলে উঠল। অন্তত জনা কুড়ি ছেলেমেয়ে বৃদ্ধ মাচার ওপরে স্কুপের মত বসেছিল। তারা আনন্দদের দেখে বিস্মিত এবং আনন্দিত। নিচে আগুন জ্বলছে। জঙ্গল থেকে কেটে এনে সঞ্চয় করে রাখা কাঠ এখন ওদের উত্তাপ দিচ্ছে। যুবকটি ওদের আগুনের কাছে নিয়ে আসার বেশ কিছুক্ষণ পরে দেহে সাড় এল। জীবনে প্রথমবার আনন্দ অনুভব করল শরীরে রক্ত চলাচল করার অনুভূতি কি রকম। দাঁতের কাঁপুনি থামেনি কিন্তু এখন অনেক কম। আনন্দ যুবকটিকে জিজ্ঞাসা করল, পালদেমরা কোথায়?

যুবকটি মাথা নাড়ল, আমরা জানি না। বরফঝড় শুরু হওয়ার পর আমরা কজন এখানে এসেছি।

একজন বৃদ্ধ চিৎকার করে বলল, তোমরা এই ঘর বানিয়ে দিয়েছ বলে আমরা বেঁচে গেলাম। ভগবান তোমাদের মঙ্গল করুন।

জয়িতা এতক্ষণ কোন কথা বলেনি। জ্বলন্ত কাঠের মধ্যে শরীর নিয়ে গিয়েছিল সে। সেই অবস্থায় মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, এই ঝড় কখন থামবে?

বৃদ্ধ উত্তর দিল, জানি না, এবার সবই অদ্ভুত। আমি জ্ঞান হবার পর এমন মারাত্মক ঝড় দেখিনি। এত বরফ ঝড়ের সঙ্গে কখনও পড়েনি।

আনন্দ যুবকটির দিকে তাকাল। এরা এখানে কি খাচ্ছে তা জিজ্ঞাসা করা বাহুল্যমাত্র। যৌথগৃহের সব আয়োজন শেষ করার সময় পাওয়া যায়নি। ঝড়টা এসে পড়েছে আচমকা। কিন্তু তার আগে দেখা দরকার গ্রামের সমস্ত মানুষ নিরাপদ কিনা। সে জয়িতাকে বলল, যতই ঝড় উঠুক একবার গ্রামটা ঘুরে আসা উচিত। মনে হয় কেউ বিপদে পড়তে পারে। তুই বরং এখানে থাক। ওদের ভাবতে দে আমরা ওদের সঙ্গে আছি। কোন আপত্তি আছে?

জয়িতা মাথা নাড়ল, বেঁচে গেলাম। ওই ঠাণ্ডায় আমি আবার বের হলে বেঁচে থাকতাম না।

আনন্দ যুবকটিকে জিজ্ঞাসা করল, কাহুন কোথায়?

যুবক বলল, মন্দিরে। মন্দিরে ঝড় ঢোকে না।

আনন্দর মনে হল শেষ তিনটে শব্দ খুব স্বাভাবিক গলায় বলা হল না। কানের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার ব্যাপারে এই যুবকের নিশ্চয়ই আপত্তি আছে। কিন্তু এখনই সে ওকে প্রশ্রয় দিল না। সে চিৎকার করে বলল, আপনারা যারা এখানে এসেছেন তারা ঝড়ের হাত থেকে বেঁচে গেছেন। কিন্তু গ্রামের অন্য মানুষেরা কি অবস্থায় আছেন তা আমাদের দেখা কর্তব্য। আপনাদের মধ্যে যেসব যুবক শক্ত এবং সমর্থ তাঁরা আমার সঙ্গে আসুন।

গুঞ্জন উঠল। আনন্দর চোখ তিন-চারজন যুবকের ওপর ছিল। তারা ইতস্তত করছে। মাচার ওপর গুড়িসুড়ি মেরে বসেছিল, প্রস্তাবটা শোনামাত্র সামান্য নড়ল। যে বৃদ্ধ আগবাড়িয়ে কথা বলছিল সে বলল, কি হল, কেউ মাচা থেকে নামছে না যে? বাইরের মানুষরা ঘর থেকে ঝড়ে বের হতে পেরেছে আর আমাদের হাত পা কি শরীরে ঢুকে গেল! কি হল?

আর একটি বৃদ্ধার গলা শোনা গেল, সবাই ঠিক আছে। নইলে এই ঝড়ে তারাও আশ্রয়ের খোঁজে আসত।

আনন্দ জবাব দিল, আপনি হয়তো ঠিক বলছেন মা কিন্তু তবু আমাদের নিজের চোখে দেখে আসা উচিত।

সম্ভবত মা শব্দটি কানে যাওয়ায় বৃদ্ধার গলার স্বর পালটে গেল, তা ঠিক, ঠিক। এই ছেলেরা, তোরা এখানে বসে আরাম করছিস, একটুও লজ্জা করছে না? তোদের বয়সী ছেলেমেয়েগুলো বাইরে বেরিয়ে আমাদের জন্যে কষ্ট করছে আর তোরা, নাম, নাম! বৃদ্ধার ঝাঝালো গলায় কাজ হল। তিন যুবক কোনরকমে শরীর মুড়ে নেমে এল এবং আসাটা যে নিতান্তই অনিচ্ছায় তা বোঝা যাচ্ছিল ওদের মুখের চেহারায়। আনন্দ ব্যাপারটাকে পাত্তা দিল না। দরজা খুলে সে এবং চারজন যুবক বেরিয়ে এল। যে যুবকটি প্রথম দরজা খুলেছিল সে এখন তার পাশে, পেছনে তিনজন। সোঁ সোঁ করে হাওয়া চলছে। বাতাসে যে আবার গুড়ি গুড়ি তুষার মিশছে তা কয়েক পা হাঁটতেই বোঝা গেল। শরীর সাদা হয়ে যাচ্ছে।
 
প্রথম যে ঘরটিকে মুখথুবড়ে পড়ে থাকতে দেখল সেটার সামনে দাঁড়াল ওরা। সঙ্গী যুবকটি নাম ধরে চিৎকার করে ডাকছে। কিন্তু সেই চিৎকার বেশিদূর পৌঁছানোব কথা নয় হাওয়ার দাপটে। কাঠের স্থূপ কোনমতে সরিয়ে ভেতরে পা রাখতেই ওরা চমকে উঠল। একটি শরীর চিৎ হয়ে পড়ে আছে। অনড়। মুখে চমৎকার শান্তি। যুবকটি দুহাতে তাকে ধাক্কা দিয়ে হাউমাউ করে উঠল। মধ্যবয়স্কা মহিলাটিব ভাবান্তর হওয়ার কথা নয়। আনন্দ যুবকটিকে টেনে তুলল। এই মাজাভাঙা ঘরে আর কোন মানুষ নেই। বোঝাই যাচ্ছে কাঠ চাপা পড়ে প্রৌঢ়া মারা গিয়েছেন। ওর পেটের ওপর থেকে এখন স্থূপটাকে সরিয়ে নেওয়ার কোন মানে হয় না।

কিন্তু ব্যাপারটা অন্য তিন যুবকের মধ্যে আচমকা পরিবর্তন আনল। এই দুর্যোগ মৃত্যুর কারণ হয়েছে জানার পর যেন তাদের সঙ্কোচ দুর হল। যতটা সম্ভব চটপট পায়ে তারা পরের ঘরে আঘাত করল। ভেতর থেকে সাড়া মিলল, কে?

যুবকটি বলল, তোমাদের যদি এখানে থাকতে অসুবিধে হয় তাহলে নতুন ঘরে চলে যাও, সেখানে আরামে থাকতে পারবে।

খানিক পরে এই ঝড়ের মধ্যে এক চমকপ্রদ দৃশ্যের অবতারণা হল। দলে দলে ছেলেবুড়ো ছুটছে মাথা নিচু করে যৌথগৃহের দিকে। যে কটি যৌথগৃহ এই গ্রামে বানানো হয়েছিল তা সম্ভবত এতক্ষণে ভরে উঠেছে। যাওয়ার আগে সবাই অবাক চোখে আনন্দকে দেখছিল। পালদেমের ঘরের সামনে এসে আনন্দ চিৎকার করল। এই সময় সে আবিষ্কার করল বিপরীত আবহাওয়া প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নেবার পর সহনীয় স্তরে পৌঁছে যায়। এখনও অবশ্য ঠাণ্ডা লাগছে, ঝড়ে কষ্ট হচ্ছে কিন্তু সেই কাঁপুনিটা নেই। ভেতর থেকে পালদেমের গলা পাওয়া গেল, কে, কে ডাকে?

দরজা খোল, আমি আনন্দ। আনন্দ এবার আঘাত করল।

দরজা খুলল পালদেমের বউ। আনন্দকে দেখে সে চমকে উঠল। তারপর তাড়াতাড়ি তাকে ঘরে ঢুকতে দিল। ভেতরে আসামাত্র বউটি হাউমাউ করে কিছু বলতে লাগল। পালদেম যে নেশায় চুর হয়ে বসে আছে তা বুঝতে অসুবিধে হল না। ঘরে আগুন নেই। বউটিও মদ খেয়েছে। বাচ্চাটা কুঁকড়ে একপাশে পড়ে আছে ছেড়া জামাকাপড় জড়িয়ে। একটা জীর্ণ কম্বল তার শরীরের ওপর চাপানো। আনন্দ এক মুহূর্ত চিন্তা করল। তারপর দুহাতে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিল। ওর ভারী শরীর কিন্তু ঠাণ্ডায় যে কাতর তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না। এই সময় যুবকদের একজন এসে পৌঁছতেই আনন্দ তাকে বলল, এর মাকে নিয়ে এস যেখান থেকে তোমরা এসেছ। তারপর মাথা নিচু করে দৌড়াতে লাগল ঝড়ের তাণ্ডব বাঁচি। বাচ্চাটা ককিয়ে কেঁদে উঠল। তারপর আনন্দ ছুটন্ত অবস্থায় আবিষ্কার করল, দুটো কচি হাত তাকে আঁকড়ে ধরেছে। আর মানুষের শরীরের উত্তাপ আনন্দকে এই মুহূর্তে উত্তপ্ত করল। এই আরামের কোন বিকল্প নেই। পথ বেশি দূরের নয় কিন্তু আনন্দর কাছে যেন ফুরাতেই চাইছিল না।

ভেতরে ঢোকামাত্র জয়িতা এগিয়ে এল। আনন্দ কোনরকমে ওর হাতে বাচ্চাটাকে তুলে দিয়ে বলতে পারল, একে বাঁচা। প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে জয়িতা বাচ্চাটাকে আগুনের পাশে রাখল। ঠাণ্ডায় নীল হয়ে গেছে ঠোঁট। মুখ নীরক্ত। সে উত্তাপ ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করছিল পরম মমতায়। এখন বৃদ্ধরা তার আশেপাশে। তারা নির্দেশ দিচ্ছিল কি করা উচিত এক্ষেত্রে। আনন্দ দম নিল। ঘর গিজগিজ করছে। মাচা নয়, এখন মাটিতেও মানুষ। অগ্নিকুণ্ড জ্বলছে দুধারে। সঞ্চিত কাঠ নিয়ে আসছে কেউ কেউ। এখন বেহিসাবী খরচ করা ঠিক নয়। কিন্তু কথাটা বলার সময়ও এটা নয়। এই সময় যুবকরা বাচ্চাটির মাকে নিয়ে এল। একনাগাড়ে কেঁদে চলেছে সে। এখনও তার হাবভাবে নেশার প্রতিক্রিয়া আছে। আনন্দ আবার বেরিয়ে এল। এবং আসতেই পালদেমকে দেখতে পেল। পালদেমের পা টলছে এবং সেটা যে ঝড়ের দাপটে নয় তা বোঝাই যাচ্ছে। আনন্দকে দেখামাত্র পালদেম বলল, আমার বাচ্চা-বউকে চুরি করে নিয়ে গেছে, মার শালাকে, মার।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top