What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected গর্ভধারিণী - সমরেশ মজুমদার (3 Viewers)

জয়িতা এবার ছুটে গেল। সত্যি এটা স্নো-লেপার্ড। এবং বেশ বড়সড়। সারা শরীরে মেরুভালুকের মত পুরু লোম এবং থাবাতেও লোমের গদি আছে যাতে বরফের ওপর সহজে হাঁটতে পারে। সাদাটে চামড়ার কালো ছোপ এদের লুকিয়ে থাকতে নিশ্চয়ই সাহায্য করে। জয়িতা পড়েছিল পৃথিবীতে ঠিক এই সময় কতগুলো স্নো-লেপার্ড আছে যার হিসেব নেওয়া সম্ভব হয়নি। একটা বিশেষজ্ঞ দল রাশিয়ার বরফাচ্ছাদিত পাহাড়ে চারটে শীত কাটিয়েও একটি স্নো-লেপার্ডের দর্শন পায়নি। এই জন্তু সাধারণ বাঘ কিংবা চিতা নয় তা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। এর মৃত্যু হয়েছে সামান্য আগে। এখন আসার পথে রক্ত ঝরিয়ে এসেছে ও। জয়িতার বুঝতে অসুবিধে হল না সুদীপ কার উদ্দেশ্যে গুলি খরচ করেছে। এই বিরল জাতের প্রাণীটিকে মারা সুদীপের উচিত হয়েছে কিনা এ নিয়ে তর্ক করা যেতে পারে। কিন্তু তার আগেই সাওদের লেপার্ডটিকে ধরে টানতে লাগল। কিন্তু ওর একার পক্ষে ওজন অনেক বেশী। জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, কি করতে চাইছ ওটাকে নিয়ে?

উঃ, তুমি বুঝতে পারছ না! এই এলাকাটা রোলেনদের। ওরা যদি এটাকে দ্যাখে তাহলে কিছুতেই আমাদের নিয়ে যেতে দেবে না। তুমি হাত লাগাও, তাড়াতাড়ি ঝরনার ওপারে নিয়ে যাব।

সাওদেরকে খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছিল।

কি করবে এটাকে নিয়ে?

কি আর করব, খাব! এরকম বাঘের কথা শুধু শুনেই এসেছি। তোমরা আসার পর ইয়াকের মেয়ে বাচ্চা হচ্ছে, সাদা বাঘ এসে মরে পড়ে থাকছে। রো ধরো।

ঠিক সেই সময় অত্যন্ত সাবধানে সুদীপ নিচের জঙ্গল সরিয়ে বেরিয়ে এল রক্তচিহ্ন ধরে। জয়িতাকে লেপার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে হতভম্ব। জয়িতা চেঁচিয়ে বলল, কনগ্রাচুলেশন, পৃথিবীর রেয়ার একটা প্রাণীকে তুই মারতে পেরেছিস!

রেয়ার প্রাণী? ওটা তো বাঘ! মরে গেছে? সুদীপ দৌড়ে ওপরে উঠে এল।

এর নাম স্লো-লেপার্ড!

সুদীপ কাঁধ নাচাল। ততক্ষণে মেয়েটি আর একটি ছেলে ওপরে উঠে এল। সুদীপ বলল, খুব ভুগিয়েছে লেপার্ডটা। চমরী খুঁজতে বনে ঢুকেছিলাম, পেয়ে গেলাম এটাকে। গুলি খেয়ে এতটা ছুটে আসবে ভাবিনি। একেবারে হার্টে লেগেছে। শক্তি আছে বটে। কিন্তু তোরা এখানে?

পৃথিবীর সমস্ত চিড়িয়াখানায় এই প্রাণীর সংখ্যা মাত্র তিনশো।

তাতে আমার কিছু এসে যাচ্ছে না। আর একটু সময় পেলে ওটাই আমাকে এতক্ষণে আরাম করে খেত। ফালতু সেন্টিমেন্ট ছাড়। সুদীপ ওদের ইঙ্গিত করল। সাওদের তো তৈরি হয়েই ছিল। বাকি দুজন হাত লাগাতে লেপার্ডটাকে নড়ানো সম্ভব হল। টানতে টানতে ওরা ওকে ঝরনার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। সুদীপ হাসল, তোর চামচেটাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?

চামচে?

সুদীপ সাওদেরকে দেখাল।

চামচে বলছিল কেন?

তোকে দেখলে ওর মুখ কেমন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে লক্ষ্য করেছিস?

জয়িতা দাঁড়াল না। তার মেজাজ খিচরে যাচ্ছিল। সম্প্রতি সুদীপের কথাবার্তায় সামান্য সৌজন্য থাকছে না। সুদীপ দৌড়ে এসে ওর কাঁধে হাত রেখে থামাল, তুই এত ক্ষেপা হয়ে গেলি কেন?

ছেড়ে দে আমাকে। এক ঝটকায় নিজেকে আড়াল জয়িতা।

তুই শালা খুব কাঠখোটা। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সুদীপ বলল।

সঙ্গে সঙ্গে কাঁপুনিটা ফিরে এল। সুদীপ বলছে কাঠখোট্টা, অথচ একটু আগেই সে শুনেছে, তুমি কি নরম! কোটে সত্যি?

হঠাৎ সুদীপ বলল, শোন, মালপত্র কমে আসছে। আনন্দ বলছে চ্যাঙথাপু থেকে কিনে আনা দরকার। আমি নিজে যাব বলেছি। তোর জন্যে কিছু আনতে হবে?

তুই তাপল্যাঙের বাইরে যাবি? অজান্তে প্রশ্নটা মুখ থেকে বের হল।

হ্যাঁ। তার পরেই হো হো করে হেসে উঠল সুদীপ, তুই কল্যাণের কেসটা ভাবছিস? আমি শালা কখনও মরব না। তাছাড়া চ্যাঙথাপুতে পুলিশফাড়ি নেই।
 
জয়িতা কোন কথা না বলে নীরবে হাঁটছিল। সুদীপ বলল, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সোজা কলকাতায় চলে যাই। একবার দেখে আসি সেখানকার মানুষগুলো কে কেমন আছে!

কে কেমন আছে সেকথা জানতে যেতে হবে কেন? পুরু চামড়ার নখদন্তহীন চোখের পর্দা ছেড়া আত্মসম্মানহীন কয়েক লক্ষ বাঙালী গর্তে মুখ লুকিয়ে এ ওকে গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে। আমরা কি করেছিলাম তা অর্থহীন ওদের কাছে। আর এই যে আমরা তাপল্যাঙে যেজন্যে পড়ে আছি তা জানতে পারলে পেছনে একটা ধান্দ খুঁজবে। রগরগে মশলা না পেলে আমাদের কথা শুনতেও চাইবে না। ওদের দেখার জন্যে কষ্ট করার কি দরকার! জয়িতা ক্লান্ত গলায় বলল।

হঠাৎ সুদীপ বলল, জয়ী?

জয়িতা তাকাল। সুদীপ হাসল, তোকে অনেকদিন বাদে এই নামে ডাকলাম।

কি বলছিলি?

ধর, আমরা যা চাইছি সব হল। তাপল্যাঙের মানুষদের নির্দিষ্ট আয় হল। কো-অপারেটিভ ডেয়ারি, ফার্ম এবং অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে মানসিক সুস্থিতিও এল। তখন আমরা কোথায় যাব?

কোথায় যাব মানে? এখানেই থাকব, এদের সঙ্গে।

সুদীপ মাথা নাড়ল। কিন্তু কোন কথা বলল না। ওরা গ্রামে ফিরে আসছিল। এর মধ্যে খবর পৌঁছেছে। দলে দলে লোক ছুটছে মো-লেপার্ডটাকে নিয়ে আসার জন্যে। এবং তখনই জয়িতা আনন্দদের দেখতে পেল। দশ-বারোজন লোক কাঠের বোঝা বরফের ওপর দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে আসছে। আনন্দ একটু ঝুঁকে হাঁটছে। জয়িতার মনে হল এই কয় মাসে আনন্দ যেন অনেক বয়স্ক হয়ে গিয়েছে। ওর শরীরেও ভাঙন এসেছে। সে চমকে সুদীপের দিকে তাকাল। এবং মনে হল সুদীপের চেহারায়ও সেই জেল্লা নেই। নিজেকে অনেকদিন দ্যাখেনি জয়িতা। সে এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছিল তার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হবার কোন কারণ নেই। আনন্দর দিকে তাকিয়ে হঠাৎই বুকের মধ্যে একটা ছটফটানি টের পেল জয়িতা।

সে ছুটে এগিয়ে এল। আনন্দ হাসল, গ্রেট ডিসকভারি! কাঠ তো ছিলই, এই অঞ্চলে প্রচুর বড়এলাচের গাছ আছে। বরফ গললে বড়এলাচ সাপ্লাই দেওয়া যাবে। আর নিচের দিকে বেতের বন দেখতে পেলাম। এত ওপরে বেত, ভাবা যায় না। পালদেম বলছে গ্রামের অনেকেই বেতের কাজ জানে। ব্যাপারটা অর্গানাইজ করতে হবে।

তুই ভাল আছিস আনন্দ? জয়িতা প্রশ্নটা করে ফেলল।

কেন? আমাকে খারাপ দেখাচ্ছে? আনন্দ অবাক হল।

না, ঠিক আছে।

তোদের মাথায় কখন কি ঢোকে কে জানে! আর হ্যাঁ, চমরীদের একটা দল এসেছে এদিকে। পায়ের ছাপ দেখলাম। জ্যান্ত ধরব বলে ফাঁদ পেতে এলাম। রান্না হয়ে গেছে?

আমি দেখছি। জয়িতার মনে পড়ল তার কাজটার শেষ না দেখেই বেরিয়ে পড়েছিল।

এই সময় আনন্দর নজরে পড়ল। সে চিৎকার করে সুদীপকে ডাকল, কিরে, এখনও খাঁচাগুলো তৈরি করিসনি?

সুদীপ জবাব দিল, আমি একটু শিকারে গিয়েছিলাম।

শিকার! তোকে কে শিকারে যেতে বলেছিল? পশু মারার চেয়ে পশু বাঁচানোই তো জরুরী। আমরা যদি নিজেদের কাজগুলো না করি–। বিরক্তিতে আনন্দ মুখ ফেরাল। জয়িতা আশঙ্কা করছিল সুদীপ হয়তো একটা কড়া জবাব দেবে। কিন্তু সুদীপ কিছুই করল না। চুপচাপ চলে গেল খাঁচার কাছে। ব্যাপারটা অভিনব লাগল জয়িতার। আনন্দ ততক্ষণে চলে গেছে যৌথগৃহের দিকে।

জয়িতা খাবারের ব্যবস্থা দেখার আগে সুদীপের কাছে গিয়ে বলল, তুই হঠাৎ এত ভাল হয়ে গেলি কি করে রে?

সুদীপ বলল, ফোট! ন্যাতানো কথা বলিস না।

কথাটা খুব বিশ্রী লাগল জয়িতার। হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হল সুদীপ কখনও তাকে বলেনি সে ভিজে কথা বলে! সে কি তাই বলছে! এবং তখনই সেই তিনটে শব্দ কানের মধ্যে প্রতিধ্বনি তুলল, তুমি কি নরম।
 
৪৮.
দুবার বরফ গলে গেল কিন্তু সেই অদৃশ্য জন্তুটির অস্তিত্ব চাক্ষুষ হল না। যাকে এরা দানো বলে, যাকে ইয়েতি বলে ওদের মনে হয়েছিল। গেল গ্রীষ্মে পাহাড়টার যতদূর যাওয়া সম্ভব বন্দুক হাতে ঘুরেছে সুদীপ। ইয়েতি তো দূরের কথা, আর একটাও স্নো-লেপার্ড চোখে পড়েনি। দ্বিতীয়বার বরফ গলবার আগে যে পর্যাপ্ত সময় পাওয়া গিয়েছিল তা চমত্ত্বার কাজে লাগানো গিয়েছে। দুবছরে তাপল্যাঙের চেহারা ব্যাপক পালটে গিয়েছে।

বৃষ্টি এখানে সারা বছর হয়। কোথাও জল দাঁড়ায় না। শীতের প্রকোপ এত বেশি যে সমতলের সব শস্য এখানে ফলতে পারে না। কিন্তু আনন্দ এদের নিজস্ব ফসল ছাড়াও বাড়তি কিছুর জন্য ধাপে ধাপে পাহাড় কাটিয়েছে। এই গ্রীষ্মে কিছুই লাগানো হয়নি সেখানে। কারণ অনবরত আগাছা বের হচ্ছিল নবীন মাটি থেকে। সেগুলো তুলে ফেলা, মাটিটাকে সহজ করার কাজ চলেছে এতকাল। ডুঙডুঙ এবং গুঢুকের চাষ হয়েছে প্রচুর পরিমাণে। সেগুলো রোদে শুকিয়ে জমিয়ে রাখা হয়েছে বরফের সময়ের জন্যে। আর ব্যাপক ফলন হয়েছে ভুট্টার। দানাগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে পিষলে চমৎকার আটা হয়। গম হবে কি হবে না এমন একটা অনিশ্চয়তা রয়েছে। আনন্দ চাইছে সামনের গ্রীষ্মে পরীক্ষা করতে।

জমির পরিধি বিস্তৃত হয়েছে। পরিশ্রম, উৎসাহ এবং পরিকল্পনা যদি জোরদার হয় তাহলে সারা বছর আর অভুক্ত থাকতে হয় না এই বিশ্বাস এসে যাওয়ায় ব্যক্তিগত সীমানা নিয়ে তিনজন ছাড়া আর কেউ জেদ ধরে থাকেনি। অবস্থাপন্ন সেই তিনজন বস্তুত এখন একঘবে। আনন্দরা ঠিক এইটে চায়নি। কিন্তু স্বার্থবিরোধী ভূমিকায় কাউকে দেখলেই মানুষের প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক ভাবেই আসে। যদিও ওই তিনজন সমস্ত গ্রামের বিরোধী কোন ভূমিকা নেয়নি। যেভাবে তারা প্রতিবছর তাদের জমিতে চাষ করে এবারও তাই করেছে। সমস্ত গ্রামের মত মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়নি। আমার জমি এবং তোমার পরিশ্রম মানে ফসলের আধাআধি, এই নীতি তাদের পক্ষে গ্রহণ করা অসম্ভব। আনন্দ গ্রামের সবাইকে অনুরোধ করেছিল, যারা সঙ্গী হচ্ছে না তাদের যেন কেউ বিরক্ত না করে। কারও কারও মনে তাই দেখে যদি আলাদা হবার প্রবণতা এসেও থাকে ফসলের পর তা দূর হয়ে গেল। দেখা গেল জমির ফলন সম্মিলিত উদ্যোগে অনেক ব্যাপক। সুদীপ কিংবা জয়িতা আশাই করতে পারেনি এত সহজে সাধারণ মানুষ একত্রিত হবে। আনন্দর উদ্যোগ, পরিশ্রম এবং এদের জন্যে নিজেকে নিয়োগ করার চেষ্টা ক্রমশ তাকে প্রায় কাহুনের সমগোত্রীয় করে ফেলেছে বলে ধারণা হচ্ছিল। আনন্দ যে কাজই করতে বলল তা করলে ভাল ফল পাওয়া যাচ্ছে ফলে বিশ্বাস আরও বেড়ে যাচ্ছিল। কাহুনের সঙ্গে পার্থক্য একটাই ওরা আনন্দকে ভয় করে না, এড়িয়ে চলে না। জয়িতা ঠাট্টা করেছিল, ক্ষমতা যেহেতু মানুষের চরিত্রবদল করে সেইহেতু নিজেকে প্রায় দেবদূতের ভূমিকায় নিয়ে যাওয়ার নেশা আনন্দ পেয়ে বসেছে। এবং সেখান থেকেই আর একজন মিনি ডিক্টেটারের জন্ম নেওয়া বিচিত্র নয়। তার বক্তব্য ছিল, প্রতিটি পুরে নিজেরা এগিয়ে না গিয়ে গ্রামের ছেলেমেয়েদেরই নেতৃত্ব নিয়ে কাজ শেষ করতে দেওয়া উচিত।

আনন্দ কোন জবাব দেয়নি, হেসেছিল। জয়িতাও ভাল করে উত্তরটা জানত। এই গ্রামের ব্যাপক মানুষের মধ্যে নেতৃত্ব নেওয়ার ক্ষমতা বা ইচ্ছা একেবারেই নেই। এদের মানসিক গঠনও নেই পর্যায়ের নয়। এমনকি পালদেম, লা-ছিড়িঙ কিংবা সাওদের পর্যন্ত চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানসিকতা রাখে না। কয়েকজনের উৎসাহ আছে প্রচুর কিন্তু কুমটা অন্যের মুখ থেকে শুনতে চায় এরা।
 
তাপল্যাঙে এখন গৃহপালিত পশু এবং প্রাণীর সংখ্যা বেড়েছে। মুশকিল হল আধুনিক জীবনের কোন সুবিধে এখনই পাওয়া সম্ভব নয়। মুরগী চাষের জন্যে বিদ্যুতের দরকার এবং এখানে তা আকাশকুসুম চিন্তা বলেই মা-মুরগীদের ওপর ডিমে তা দেওয়ার আদ্যিকালের নিয়মটার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ফলে উৎপাদন যতটা বাড়া উচিত ছিল ততটা বাড়েনি। কিন্তু উপযুক্ত সংরক্ষণ সংখ্যাকে কয়েকগুণ বৃদ্ধি করেছে। গত গ্রীষ্মে দশটা গরু কেনা হয়েছিল ওয়ালাঙচু থেকে। কয়েকটা চমরীর বাচ্চাকে জঙ্গল থেকে ধরে ভাল পোষ মানানো হয়েছে। সম্প্রতি তিনটে বাচ্চা হয়েছে। ফলে অত্যন্ত অসুস্থ বা দুর্বল শিশুরা কিছু দূধ পাচ্ছে। আর এইসব ব্যাপার গ্রামের তাবৎ মানুষের মনে একটা বৈপ্লবিক প্রতিক্রিয়া এনেছে। নতুন জমি আমাদের পেটে খাবার দেবে, মুরগীর ডিম প্রত্যেকের শরীরে শক্তি দেবে এবং আমার শিশু দুধ পাচ্ছে যে কারণে সেই কারণটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে—এমত ধারণা প্রত্যেকের। সেইসঙ্গে এই গ্রামটা আমাদের, এই মাটি আমাদের এবং আমরা সবাই ঠিকঠাক খেয়ে আছি যেহেতু বাইরের তিনটি মানুষ আমাদের একত্রিত হতে শিখিয়েছে।

গত গ্রীষ্মে আশেপাশে যতটা দূর যাওয়া সম্ভব ততটা দূর গিয়ে বড়এলাচ সংগ্রহ করে আনিয়েছে আনন্দ। এই বস্তুটাকে কোন গুরুত্ব দেয়নি তাপল্যাঙের মানুষ এতকাল। প্রস্তাব শুনে ওরা খুব বিস্মিত হয়েছিল। যখন জানল বড়এলাচ সমতলে ভাল দামে বিক্রি হয় তখনও চাড় আসেনি কারও। কিন্তু তারা যখন বুঝতে পারল খচ্চরওয়ালার কাছ থেকে এখানে যেমন জিনিসপত্র কেনা হয় ঠিক তেমনি ওই জিনিস সমতলের মানুষের কাছে বিক্রি করা যায়, তখন উৎসাহ বেড়ে গেল। খচ্চরওয়ালারা গত গ্রীষ্মেও এসেছে। তাপল্যাঙের এই পরিবর্তনে তারা আরও চমকিত। গতবছরও অর্থের বিনিময়ে জিনিসপত্র কিনেছে পালদেমরা। পরিকল্পনা কাজে লাগাতে বেশ কিছু আবশ্যকীয় জিনিস পালদেমদের মারফত জানিয়ে খচ্চরওয়ালাদের দিয়ে আনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এবং সেইসঙ্গে এই তথ্যটি পাওয়া গিয়েছে, চ্যাঙথাপু, ফালুট, সান্দাকফু ছাড়িয়ে মানেভঞ্জন পর্যন্ত খবর ছড়িয়েছে কয়েকজন ডাকাত এই গ্রামে দেদার টাকা ছড়িয়ে লুকিয়ে রয়েছে। গতবার পুলিশের সঙ্গে এখানকার লোকজন যুদ্ধ করেছে বলে একটা শঙ্কা চালু হয়েছে যে পুলিশ বদলা নেবে।

মজার ব্যাপার, খবরটা পালদেমদের আদৌ বিচলিত করেনি। বরং তারা খচ্চরওয়ালাদের সঙ্গে রসিকতা করেছিল, পুলিশদের বলে দিও এবার যখন আসবে তখন জানিয়ে আসে, চোরের মত আসাটা ভাল কথা নয়।

ব্যাপারটা আনন্দর কাছে বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়েছিল। ইদানীং তাপল্যাঙের মানুষজন এত বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে যে তাদের সম্পর্কে কোন আড়াল রাখতে চাইছে না। গত গ্রীষ্মেও ওরা তিনজন খচ্চরওয়ালাদের গ্রামটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল। এখন যৌথগৃহের সংখ্যা বেড়েছে। যারা অসুস্থ তাদের জন্যে আলাদা ঘর তৈরি হয়েছে। যখন বরফ নেই, ঝড়বৃষ্টির আশঙ্কা কম তখন যে যার নিজের ঘরে চলে যায়। সেই ঘরগুলোর চেহারাও পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু খচ্চরওয়ালারা সুদৃষ্টিতে এদের খামার এবং মুরগীর খাচাগুলো দেখেছে। সেই মুহূর্তে বাধা দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না কিন্তু এই খবর যে পাহাড়ে পাহাড়ে বিস্তৃত হবে এ বিষয়ে ওরা নিঃসন্দেহ হয়েছিল।

শরীর এবং সামর্থানুযায়ী কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি কাজের জন্য নির্দিষ্ট মানুষ দায়ী থাকবে। তার কাজ ভাল হলে পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই ব্যাপারটা তাপল্যাঙের মানুষের কাছে নতুন। ফলে প্রত্যেকেই সচেষ্ট নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে। চাষের মাটিতে যারা আটমাস কাজ করছে তারা জঙ্গল থেকে কাঠ আনা ছাড়া অন্য কোন কাজ করবে না। বাকি সময়টা তাদের পুরো বিশ্রাম। মুরগী এবং গরুর প্রতিপালনের জন্যে দুটো দল নির্দিষ্ট হয়েছে। গ্রামের সমস্ত বাড়িঘর রক্ষণাবেক্ষণের এবং নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে একটা দলকে। গ্রামের বৃদ্ধাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অসুস্থদের দেখাশোনা করার জন্যে। নিজেকে প্রয়োজনীয় আবিষ্কারের পর মানুষগুলোর উদ্যম বেড়ে যাচ্ছে। যৌথরা এখন হচ্ছে না। বরফের সময় অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া তিন-চারটি পরিবার একত্রিত হয়ে খাবারের ব্যবস্থা করেছে। মেয়েদের ব্যাপারে সমস্ত কর্তৃত্ব জয়িতার। বিনা ওষুধে ফাস্ট এইড দেওয়া বা অসুস্থকে প্রাথমিক আরাম দেওয়ার প্রক্রিয়াগুলো সে মেয়েদের রপ্ত করাতে পেরেছে। জঙ্গল থেকে বেত কেটে এনে জলে ভিজিয়ে নরম করে এখানকার মেয়েরা নিজস্ব কায়দায় যে ঝুড়ি বানাতে পারত জয়িতা ভেবে ভেবে তার কিছুটা উন্নতি করতে পেরেছে। এক ধরনের বেঁটে মোটা গাছের গুড়ি কেটে সমান করে তাই দিয়ে টেবিল তৈরি করার একটা কায়দা বের করতে পেরেছে সে। তাপল্যাঙের মানুষ এই প্রথম টেবিল ব্যবহার করতে শিখল। বেতের জিনিস এবং এই টেবিল সমতলে পাঠাতে পারলে অর্থ আসবেই বলে তার ধারণা।
 
তিনটি পরিবার এবং একটি মানুষ এই ব্যাপক কর্মকাণ্ড থেকে নিস্পৃহ হয়ে রয়েছে। কানকে নিয়ে এদের দুশ্চিন্তা ছিল। গত গ্রীষ্মের শেষদিকে আরও তিনটি গ্রামের কাহনরা জমায়েত হয়েছিল এই মন্দিরে। দুদিন ধরে তাদের পুজো চলেছিল। সুদীপের ধারণা ওটা মন্ত্রণা সভা। তৃতীয় কাহনের আহ্বানে গ্রামের সব মানুষ জমায়েত হয়েছিল মন্দির প্রাঙ্গণে। সেইসময় কাহুনের এক শিষ্য এসে জানিয়েছিল ওই জমায়েতে যেহেতু এরা তিনজন বাহিরের মানুষ এবং তাদের ধর্মাদর্শ নিয়ে সন্দেহ আছে তাই ওরা যেন উপস্থিত না হয়। সুদীপ খুব খেপে গিয়েছিল কথাটা শোনামাত্র। কিন্তু আনন্দ তাকে বাধা দিয়েছিল। এখনও পর্যন্ত গ্রামের মানুষ তাদের বিদেশী বলে মনে করে। কাহুনের নির্দেশ তারা জেনেছে কিন্তু কেউ এর প্রতিবাদ করেনি। অতএব এখনই মাথা গরম করে এগিয়ে গেলে বোকামি হবে। শিষ্যটি আরও জানিয়েছিল, যদি তারা কাহুনের কাছে গিয়ে দীক্ষিত হয় তাহলেই ওই সভায় উপস্থিত থাকতে পারে। সুদীপ বলেছিল, এ শালা শ্রুড পলিটিসিয়ান। এতকাল চুপচাপ থেকেছে এখন একটা ধান্দা বের করে আমাদের টুপি পরাতে চায়।

জয়িতা বলেছিল, গেলে কেমন হয়?

সুদীপ মাথা নেড়েছিল, ইম্পসিবল! ধর্মেটর্মে আমার কোন বিশ্বাস নেই। জন্মেছি হিন্দুর ছেলে হয়ে, শালা আজ পর্যন্ত কোন্ ধর্মটা করলাম? এসব বুজরুকিতে আমি নেই।

আনন্দ বলেছিল, কথাটা সত্যি কিন্তু মিথ্যেও। আমরা মন্দিরে যাই না, পুজোপার্বণে ফুর্তি করি, হিন্দুধর্মের সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু মুশকিল হল কেউ মারা গেলে শ্মাশানে নিয়ে গিয়ে মুখাগ্নি করি। ওখানে কেন যে হিন্দু হয়ে যাই!

সুদীপ চকিতে মুখ ফিরিয়েছিল, তোর এও মনে আছে নিশ্চয়ই আমি মায়ের শ্রাদ্ধ করিনি, মাথার চুল কামাইনি। ওসবে আমি বিশ্বাস করি না। মুখাগ্নি করেছিলাম কারণ মৃতদেহ চিরকাল বাঁচিয়ে রাখা। যায় না। দাহ করাটাই সবচেয়ে বেশি সায়েন্টিফিক।

দাহ করা আর মুখাগ্নি করা এক নয়। থাক সেকথা। এটা ঠিক আমরা, এখনকার ছেলেমেয়েরা আর বিশেষ কোন ধর্ম-বোধে বিশ্বাসী নই। অন্তত হিন্দুরা তো নয়ই। একটি ক্রিশ্চান কিংবা মুসলমান ছেলেকে যে নিয়মের খাতে শৈশব থেকে এগিয়ে যেতে হয় তা আমাদের জন্যে করা হয়নি। বোধহয় সেই কারণে রাজনীতি আমাদের সহজেই অধিকার করে। আনন্দ বলেছিল।

জয়িতা বলেছিল, আমি কিন্তু এক্ষেত্রে এসব বলছি না। আমি এই গ্রামের মানুষের আস্থা পুরোপুরি পেতে চাই। এখনও পর্যন্ত আমরা বিদেশী, এটা আমার ভাল লাগে না। ধর্ম ব্যাপারে তোদের সঙ্গে আমি একমত। কিন্তু এখানে আমি একটা সমঝোতা চাই।

কিসের সমঝোতা? সুদীপ চোখ ছোট করেছিল।

আমি কাহুনের কাছে দীক্ষা নিচ্ছি। চমকে যাস না। ধরে নে এটা একটা ছলনা। জন্মইস্তক যে উত্তরাধিকারসূত্রে আরোপিত ধর্মটাকেই জানল না তার কোন আগ্রহ নেই নতুন নতুন ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হবার। কিন্তু এই ব্যাপারটা আমাদের একধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। নাথিং ইজ আনফেয়ার। আস্তানার ভেতর ঢুকে গিয়েছিল জয়িতা। তারপর প্যান্ট পালটে তাপল্যাঙের মেয়েদের পোশাক পরে বেরিয়ে এসেছিল। এই পোশকটা সে ইদানীং প্রায়ই শখ করে পরে। দীর্ঘকাল চুলে হাত না পড়ায়, শহুরে বাতাস শরীরে না লাগায় তার চেহারায় ওই পোশাক পরলে একটা পাহাড়ি আদল এসে যায়। শিষ্যটির সঙ্গে যখন জয়িতা চলে গেল তখন সুদীপ আর একটা সত্য আবিষ্কার করল। সে ধর্মান্ধ নয়। কোন গোঁড়ামি নেই তার। নিজেকে হিন্দু বলে কোন গর্ব করার কারণও খুঁজে পায় না। কিন্তু জয়িতার এই ধর্মবদল করতে যাওয়াটা তার খারাপ লাগছে। কেন? ব্যাপারটা ধরা পড়তেই নিজেকে গালাগাল দিয়ে সে বলে উঠেছিল, মানুষের আচরণ অনেক সময় এত ক্রেজি হয়ে যায়!

আনন্দ কথাটা শুনে মুখ ফিরিয়েছিল, কিন্তু মুখে কিছু বলেনি।
 
এক বরফের আগে ওরা এখানে এসেছিল। তারপর টানা একটা গ্রীষ্ম এবং দ্বিতীয় বরফের সময় শেষ হল। এইরকম ধর্মসভার আয়োজন কখনও করেনি কাহুন। অন্য গ্রামের কাহুনদেরও দেখা যায়নি। আনন্দদেরও প্রয়োজন পড়েনি ওদের প্রার্থনা বা সভায় যাওয়ার। জয়িতা সাহস দেখাল। কিন্তু তবু আনন্দর মনে অস্বস্তি থেকে গিয়েছিল।

আর কেউ নয় শুধু জয়িতা কাহুনের কাছে দীক্ষা নিতে এসেছে দেখে কাহুন তো বটেই গ্রামসুষ্ঠু সবাই অবাক হয়েছিল। এবং সেইসঙ্গে খুশী। সাওদের তো ওকে দেখামাত্র ছুটে এসেছিল। এসে বলেছিল, তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। গ্রামের অন্য যুবতীরা ওকে ঘিরে হইচই করে উঠেছিল। সে যখন কানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল তখন কান বলেছিলেন, তুমি কি আমাদের মানুষ হতে এসেছ?

জয়িতা হেসে বলেছিল, আমি, আমরা আপনাদেরই মানুষ। এতদিন একসঙ্গে আছি এবং আমাদের ব্যবহারে নিশ্চয়ই সেটা প্রমাণিত হয়। কিন্তু আপনি যখন চাইছেন তখনই আমি দীক্ষা নিতে পারি।

কাহুন বললেন, রক্ত ধর্ম এবং মাটি এক না হলে মানুষ অনাত্মীয় থাকে। তোমার সঙ্গীরা কি তোমার সঙ্গে একমত নয়? মুখে জবাব না দিয়ে জয়িতা মাথা নেড়ে না বলেছিল।

কাহুন তার দুই সঙ্গীর সঙ্গে বাক্যবিনিময় করে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি আগে কখনও দীক্ষা নিয়েছ?

জয়িতা মাথা নাড়ল, আমাদের ওসব কিছু করতে হয় না। আমি সেই অর্থে খ্রিস্টান, মুসলমান, জৈন, বৌদ্ধ কিংবা হিন্দু নই। অতএব আপনি স্বচ্ছন্দে দীক্ষিত করতে পারেন।

সেকি? তুমি কখনও ধর্মাচারণ করনি? কাহুন যেন খুব অবাক হলেন। জয়িতা মাথা নাড়তে আবার প্রশ্ন ছিটকে এল, জন্মাবার পর তোমাদের কাহুন তোমার কানে ঈশ্বরমন্ত্র শুনিয়ে যাননি?

না।

কাহুনের মুখে এবার হাসি ফুটল। কিন্তু অন্য দুইজন কাহুন তাকে কিছু বলতে তিনি মাথা নাড়লেন। তারপর বললেন, তোমার আগ্রহ আমাদের খুশী করেছে। কিন্তু দীক্ষা নেবার মত উপযুক্ত হয়েছ কিনা তা আমাদের জানা দরকার। তাছাড়া তোমার শরীর এবং আত্মা এখনও ঈশ্বরের আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত। আগামী গ্রীষ্ম প্রান্তি তুমি প্রত্যহ একটি করে ফুল আমার কাছে দিয়ে যাবে। আমি তোমার নাম করে ভগবানের কাছে নিবেদন করব।

চেষ্টা করে নিজেকে সংবণ করল জয়িতা। সুদীপ এখানে থাকলে কেসটা জমত। কিন্তু তার বিনীত ভঙ্গি দেখে কাহুন লোকটার চেহারাই যেন পালটে যাচ্ছে। ক্ষমতা মানুষকে চিরকালই অন্য চেহারা দেয়। সে সম্মতি জানাতে সময় গ্রামবাসী একটা খুশীর ধ্বনি উচ্চারণ করল। কাহুন হাত তুলে তাদের শান্ত হতে বলে আদেশ দিলেন এই অবস্থায় জয়িতা এখানে থাকতে পারে। তবে তাকে আজ থেকে সবাই দ্রিমিত বলে ডাকতে পারে।

সঙ্গে সঙ্গে সর্বত্র দ্রিমিত দ্রিমিত উচ্চারিত হল। মজা লাগছিল জয়িতার। অ্যাপ্রেন্টিস থাকাকালীন নামকরণ হয়ে গেল। কিন্তু সে লক্ষ্য করল চেনা মুখগুলোয় কেমন একটা নরম ছাপ এসেছে। ওরা যখন তাকে দেখছে তখন সেই দূরত্বটা যেন নেই।

পর্ব চুকলো কাহুন কিছুক্ষণ তার নিজস্ব ভাষায় মন্ত্র উচ্চারণ করলেন। শিষ্যরা বাজনা বাজাল। গ্রামের বৃদ্ধরা সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল। বেশ একটা ধর্মধর্ম ভাব ফুটে উঠল। জয়িতার মনে হল হিন্দু-বৌদ্ধ পদ্ধতির একটা শঙ্কর রূপ এই উপাসনা।

এসব চুকে যাওয়ার পর কান কথা শুরু করলেন, ভগবান আমাদের পাঠিয়েছেন এই মাটিতে। তিনি আমাদের জন্যে মাটি দিয়েছেন, গাছ দিয়েছেন। আমাদের সহ্যশক্তি বাড়াবার জন্যে যেমন বরফ এবং বৃষ্টি দিয়েছেন তেমন বোদও তার সৃষ্টি। যুগযুগান্তর থেকে আমরা এইভাবেই আছি তাঁর আশীর্বাদ নিয়ে। ওই যে পাহাড় যার মাথায় প্রতিদিন ঈশ্বরের পায়ের চিহ্ন পড়ে সে আমাদের আড়াল করে থাকে কারণ ওই পাহাড়ের ওপারে রয়েছে অনন্ত বরফ এবং ঠাণ্ডা হাওয়া। কিন্তু আমরাই হলাম ভগবানের প্রথম সন্তান। এই কথাটা বলামাত্র পিছনে বসে থাকা দুজন অন্য গ্রামের কাহুন কিছু বললেন চাপা গলায়। সেদিকে একবার তাকিয়ে তাপল্যাঙের কাহন তড়িঘড়ি বললেন, এই আমরা কারা? আমরা বলতে আমি পাহাড়ের সমস্ত মানুষকেই বোঝাচ্ছি যারা বরফে কষ্ট পায়, প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে যারা বেঁচে থাকে। বলে আবার অন্য কাহুনদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন দুবার।
 
আমাদের উচিত আমাদের মত বেঁচে থাকা। ইয়াক যদি মুরগীর মত বাঁচতে চায় তাহলে কি সেটা তাকে মানায়? মানায় না। অনেকদিন হল আমাদের গ্রামে চারজন বিদেশী এসেছিল। এরা, তোমরা একটু আগেই শুনলে ভগবানের সঙ্গে এদের কোন সম্পর্ক নেই। এই মানুষরা নিজেদের স্বার্থে তোমাদের সাহায্য করছে। কিন্তু এদের সাহায্য আমরা কদিন নেব? এরা কেউ ভগবানের সন্তান নয়। আমাদের ধর্ম আমাদের রক্ত আমাদের মাটির সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই! এই অবধি বলে কান চুপ করলেন। জয়িতা চমকে উঠেছিল। এতদিন চুপচাপ থেকে আজ এমন কি কারণ ঘটল যাতে কান প্রকাশ্যে তাদের বিরোধিতায় নামলেন? কিন্তু গ্রামবাসীরা চুপচাপ কেন? পালদেম, লা-ছিরিঙ, সাওদের? ঠিক এইসময় একটি কণ্ঠ ভেসে এল, দ্রিমিত। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেমেয়েরা চিৎকার করল, দ্রিমিত, দ্রিমিত, দ্রিমিত!

হ্যাঁ, দ্রিমিত। কিন্তু মনে রাখতে হবে দ্রিমিত এখন পরীক্ষিত হয়নি। এই অবস্থায় আমার বন্ধুরা, এই দুই কাহুন আমার কাছে এসেছেন। আমাদের গ্রাম যেসব কাণ্ড হচ্ছে তার খবর ওঁদের গ্রামেও পৌঁছেছে। এই যে আমরা সাময়িক খেতে পাচ্ছি, বরফে গতবার কম কষ্ট পেয়েছি তা ওদের গ্রামের সরল মানুষদের প্রলুব্ধ করছে। কিন্তু আমরা জানি হাতের পাঁচটা আঙুল সমান হয় না। আজ খিদের তাগিদে কিংবা নতুন একটা ঝোকে তাপল্যাঙের মানুষেরা একসঙ্গে বিদেশীদের নির্দেশে কাজ করছে। কিন্তু আগামী কালই যে একটা পরিবারের মনে হবে না ও আমার চেয়ে বেশি পাচ্ছে, যার জমি নেই সে আমার জমি থেকে পেট ভরাচ্ছে তা কে বলতে পারে? আর তখন নিজেদের মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে যাবে। আর তাছাড়া এই বিদেশীরা বেশিদিন আমাদের মধ্যে থাকবে না, তখন কি হবে? আমরা জানি একজন বিদেশী এর মধ্যেই মারা গিয়েছে পুলিশের গুলিতে। পুলিশ একবার এখানে এসেছিল এদের খোঁজে। আমার কাহুবন্ধুরা বলছেন পাহাড়ে পাহাড়ে বিচিত্র সব মানুষ আসা-যাওয়া করছে এদের খবর নেবার জন্যে। সেবার পাশের গ্রামের মানুষ পুলিশকে নাজেহাল করে অন্যায় করেছে। তখন ওরা তৈরি হয়ে আসেনি। কিন্তু আবার যদি পুলিশ এই গ্রামে আসে তাহলে বিদেশীদের নিস্তার নেই। শুধু তাই নয়, তারা তোমাদেরও ছেড়ে দেবে না।

জয়িতা আর পারল না। সে এক পা এগিয়ে যেতেই কাহুন তাকালেন। জয়িতা গ্রামবাসীদের দিকে মুখ ফিরিয়ে চিৎকার করল, কাহন যা বলছেন সেটা তার বিশ্বাসে সত্যি। কিন্তু একটা কথা জেনো, পুলিশ এখানে এলে আমরা এমন কিছু করব না যাতে তোমাদের ক্ষতি হবে। ধর্ম রক্ত এবং মাটির কথা উনি বলছেন। কিন্তু ভালবাসার কথা তো উনি বলেননি! আমাদের যে বন্ধু পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছে সে তত দিব্যি বেঁচে থাকত আমাদের মত যদি তোমাদের ভালবেসে দার্জিলিং থেকে ওষুধ না আনতে যেত। আমাকে এই গ্রামের প্রতি ট মা বোন বন্ধু বলেছে যে আমরা আসার আগে তারা ভাবতে পারত না এইভাবে বাঁচতে পারা যায়। যে পরিশ্রম এবং কষ্ট তোমরা করেছ তার মূল্য সবে পেতে শুরু করেছ।পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে যার লক্ষ লক্ষ মানুষের মুখের খাবার কেড়ে নিয়ে কয়েকটা পরিবার আনন্দ করে থাকে। কিন্তু আমি এখনও বিশ্বাস করি যে কাহুন তাদের দলে পড়েন না। তার বন্ধুরা বিচলিত হয়ে ছুটে এসে অনুরোধ করায় তিনি এইসব কথা বলছেন। আমরা এতদিন এখানে রয়েছি। কিন্তু কখনও কাহুনকে অসম্মান করিনি। আমরা এও বলিনি তার ইয়াকের দুধ সবাইকে দিতে হবে। কারণ তিনি শুধু তোমাবে র্ম এবং ঈশ্বর নিয়েই এতকাল ছিলেন। মনে হয়, অন্য দুজন কাহুনের অন্য ক্ষমতা আছে। গ্রামের লোকেরা যদি তাদের বিরুদ্ধে যায় সেই ভয়ে ওঁরা ছুটে এসেছেন। তাপল্যাঙের সহায়সম্বলহীন মানুষ যেমন সুস্থভাবে বাঁচবে ঠিক তেমনি সমস্ত পাহাড়ি গ্রাম, সমতলের নিঃস্বমানুষের সেই একই ভাবে বাঁচবার অধিকার আছে। বিরোধিতা করে নয়, কাহুনরা যদি সহযোগিতা করেন তাহলে তারাই উপকৃত হবেন। আর হ্যাঁ, আমরা আপনাদের কাছে আশ্রয় পেয়েছিলাম। আপনাদের গ্রামের সামাজিক আইনের মর্যাদা আমরা সবসময় মেনে চলেছি। এবং বাধ্য না হলে কেউ এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাব না। কখনও না। আমরা একই সঙ্গে থাকব। একজন বাইরের লোক চিরকালই বিদেশী থাকতে পারে না।


সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার আরম্ভ হল। চিৎকার উল্লাসের। সেই সঙ্গে দ্রিমিত দ্রিমিত ডাক। উল্লসিত মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে তাপল্যাঙের কাহন বসে পড়লে অন্য গ্রামের কাহুন দুজন উঠে দাঁড়ালেন। তাদের অত্যন্ত অপমানিত এবং ক্রুদ্ধ দেখাচ্ছিল। উত্তেজিত ভঙ্গিতে তারা কিছু কথা তাপল্যাঙের কাহুনকে বলে সদলবলে চলে গেলেন দুভাগ হওয়া জনতার মধ্যে দিয়ে। জয়িতা দেখল এর কোন প্রতিক্রিয়া হল না সাধারণ মানুষের মধ্যে। শুধু যে তিনটে পরিবার জনতা থেকে আলাদা হয়ে কানের কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিল তারা ভীত হল। এবং উল্লাসের সুযোগে কখন যে তারা জনতার সঙ্গে মিশে গেল তা বোঝা গেল না। এইসময় সাওদের ছুটে এল জয়িতার সামনে। তার হাতে সদ্য ভেঁড়া একটা ফুল। হাসি হাসি মুখে সেটি এগিয়ে ধরল সে, দ্রিমিত, নাও।

ফুলটা নিয়েছিল জয়িতা। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়েছিল কানের সামনে। সসম্ভ্রমে বলেছিল, আমার হয়ে ভগবানকে দিয়ে দেবেন কাহুন।

বিধ্বস্ত মানুষটার মুখে প্রচণ্ড বিস্ময়। যেন তার হিসাব মিলছিল না। তিনি কাঁপা হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
 
দুবার বরফ গলে গেল। একটি পুরো গ্রীষ্ম যেমন এই গ্রামের অনেক পরিবর্তন এনেছে তেমনি সম্পর্কেরও। আস্তানার আয়তন বেড়েছে। একটির বদলে তিনটি ঘর তৈরি হয়েছে। কথা ছিল খাওয়াদাওয়া একসঙ্গে হবে এবং ওরা তিনজন তিনটি ঘরে থাকবে। মেয়েটির স্বভাবতই জয়িতার সঙ্গে থাকার কথা। কিন্তু প্রথম রাত্রেই সে বিদ্রোহ করে বসল। সুদীপকে ছেড়ে সে কিছুতেই থাকবে না। আনন্দ এবং জয়িতার কাছে ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু ঠেকলেও তার ওসব কিছুই মনে হচ্ছে না। সে মুখের ওপর পালদেম, লা-ছিরিঙ এবং সাওদেরকে বলল, আমাকে কেউ কখনও ভালবাসেনি। আমিও কাউকে ভালবাসিনি। কিন্তু এই মানুষটাকে আমি যখন ভালবেসে মুখে কথা ফিরিয়ে দিয়েছি তখন কেন ওকে ছেড়ে থাকব? ও আমার মনের মত মানুষ, ওর সঙ্গে না থাকতে দিলে আমি মরে যাব, ব্যাস।

জয়িতার মনে হয়েছিল পাঁচ বছরের মেয়ে চকোলেট আবদারে গলায় কথা বলছে এবং এর উত্তর হল ঠাস করে নরম গালে চড় কসানো। কিন্তু পালদেম অন্য কথা বলল। সে জিজ্ঞাসা করল সুদীপকে, এই মেয়েটার কপাল সত্যি খারাপ। ও তোমার সঙ্গে থাকতে চাইছে, তুমি কি করবে?

সুদীপ কাঁধ নাচিয়েছিল। তারপর বাংলায় বলেছিল, আমি শালগ্রাম শিলা, শোওয়াবসা যার সকলি সমান তারে নিয়ে রাসলীলা। বহুৎ ধুর হয়ে গেছি এখন।

জয়িতা অবাক হয়ে গিয়েছিল। সুদীপের মত শাণিত ছেলে এসব কি বলছে! কিন্তু তখন আনন্দ জিজ্ঞাসা করেছিল, ওরা একসঙ্গে থাকবে, এতে তোমাদের আপত্তি নেই?

পালদেম বলেছিল, এখন তোমরা আমাদের বন্ধু। ও তো তোমাদের তিনজনের সঙ্গে এখানে এতকাল ছিলই। তবে যদি ও মা হয় তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে!

সর্বনাশ হবে কেন? জয়িতা প্রশ্নটা করেছিল, ওরা বিয়ে করবে তখন।

আজ পর্যন্ত আমাদের গ্রামের কোন মেয়ের বাইরের লোকের সঙ্গে বিয়ে হয়নি।

পালদেমের কথাটা শুনে সুদীপ বলেছিল, স্টে টুগেদার, নো বিয়ে, নো বাচ্চা। গুড। কিন্তু ব্রাদার, এতদিনেও যদি আমরা বিদেশী তাহলে আর জবাব নেই। কথাগুলোকে বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে বলায় পালদেমরা বুঝতে পারেনি। কিন্তু সুদীপের কথায় যে ঝাঝ ছিল তা টের পাওয়া গেল। এবং সেই থেকে মেয়েটি সুদীপের ঘরে। জয়িতা লক্ষ্য করছিল মেয়েটি মোটা হচ্ছে? মুখচোখে একটা লালিত্য ফুটছে। এত পরিশ্রম করে এত কম খেয়েও এইরকম উন্নতি হয় কি করে সে জানে না। এবং আলাদা থাকার ফলে ওর ব্যবহারেও পরিবর্তন এসেছে। যেন নিজেরটা আলাদা করে ভাবার প্রবণতা এসেছে। অথচ সুদীপের কোন বিকার নেই। সে যেমন ছিল তেমনি আছে। আর এই ব্যাপারটা নিয়ে কেন কেউ জানে না, ওরা কোন কথা তোলে না আর।



ঘুম ভেঙেছে অনেকক্ষণ কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করছিল না সুদীপের। এখনও ঘরে অন্ধকার পাতলা হয়ে ঝুলে রয়েছে। একটা বাসী গন্ধ পাক খাচ্ছে। একটু আগে মেয়েটাকে উঠে যেতে দেখেছে সে। সে যে দেখছে তা অবশ্য বুঝতে দেয়নি। বুঝলেই কথা বলত মেয়েটা। বড় কথা বলে। ওকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় কেন সে জোর করে সুদীপের সঙ্গে থাকছে তাহলে যে উত্তর দেবে তাতে অনায়াসে একটা রাত কাটিয়ে দেওয়া যায়। ও এত বিশ্বস্ত এবং সবসময় এমন আঠার মত লেগে থাকে যে মাঝে মাঝে বিরক্তি আসে, বলেওছে, কিন্তু কমলী ছাড়বার পাত্র নয়।

আরও খানিকটা সময় আলসেমির পর সুদীপ উঠল। এখন এখানে মোটামুটি একটা বাথরুমটয়লেটের ব্যবস্থা করে নেওয়া হয়েছে। বাইরের ঘোলাটে আকাশ দেখে ওর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সারাটা দিন আজ সন্ধে সন্ধে হয়ে থাকবে। সুদীপের প্রায়ই মনে হয় একটা জেনারেটার আনলে কেমন হয়? শিলিগুড়ি থেকে বস্তুটা কিনে যদি কোনমতে এখানে আনা যেত তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হত। কিন্তু জেনারেটারের রসদ এখানে নিয়মিত পাওয়ার কথা ভাবাই যায় না। কথাটা শুনলে জয়িতা ঠাট্টা করত। জয়িতার কথা মনে হতেই ও অন্যমনস্ক হল। আজকাল জয়িতা আর মোটেই প্যান্ট পরে না। বস্তুত ওদের জামাপ্যান্টগুলো দুর্দশার শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছে। নতুন শার্ট প্যান্ট অবিলম্বে কেনা দরকার। জয়িতা এখানকার পোশাকে লা-ছিরিঙ আর সাওদেরদের সঙ্গেই বেশিক্ষণ সময় কাটায়। আগের মত আর সুদীপের সঙ্গে আড্ডা মারতে পারে না। সুদীপ বুঝতে পারে না সে তাকে ঘৃণা করে কিনা। মেয়েটির সঙ্গে একত্রে থাকা যদি অপছন্দের ছিল তাহলে স্বচ্ছন্দে বলে দিতে পারত।

পরিষ্কার হয়ে বাইরে পা বাড়াল ও। খানিকটা হাঁটতেই আনন্দকে দেখতে পেল। পাশে জয়িতা। সামনে অন্তত জনাদশেক ছেলেমেয়ে। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে পালদেম। সুদীপের খিদে পাচ্ছিল। এখন এখানে তিনবার খাবার হয়। চা সিগারেট বা জলখাবারের অভ্যেস অনেক দিন দূর হয়ে গেছে। প্রথম দুটো ছাড়া জীবন কাটানোর কথা একসময় কল্পনা করা যেত না অথচ এখন স্বচ্ছন্দে সেটা মেনে নিচ্ছে সে। একেই হয়তো বলে অভ্যেসের দাসত্ব করা।

আনন্দ সুদীপকে দেখে হাসল, আমরা রেডি।
 
সুদীপ দেখল গোটা সাতেক এলাচের বোঝা তৈরি হয়েছে। মুরগি অন্তত পঞ্চাশটা। বেতের ঝাকায় ডিম। এই বোঝা নিয়ে মানুষজন তৈরি। ওরা যাবে সুকিয়াপোকরি বাজারে। চ্যাঙথাপু কিংবা ওয়ালাংচুঙে এলাচ বিক্রি হবে না। সেটা ফালুট সান্দাকফুতেও বিকোবে না। সুকিয়াপোকরির বাজার বেশ বড়। নানা জায়গার ব্যাপারীরা আসে সেখানে। সওদা নিয়ে যেতে হবে সেখানে। প্রতি সপ্তাহে এলাচ কেনার মত পাইকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটা ব্যবস্থা করতে হবে। মুরগি, ডিম কেনার ললাকের অভাব কখনও হবে না। পালদেমকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়েছে আনন্দ। গ্রামের প্রতিটি মানুষ উত্তেজিত। এই প্রথম তাপল্যাঙ থেকে কোন জিনিস বাইরে বিক্রির জন্য যাচ্ছে। এইসব বিক্রি হলে যে টাকা আসবে তা ভেবে সবাই রোমাঞ্চিত।

হঠাৎ সুদীপ ঘোষণা করল, আমি পালদেমের সঙ্গে যাব।

আনন্দ মাথা নাড়ল, ইম্পসিবল। তুই চ্যাঙথাপুতে পৌঁছনোমাত্র খবর চাউর হয়ে যাবে। পুলিশ তোকে ধরলে এদের ছেড়ে দেবে না। ব্যস, সারা জীবনের মত পরিকল্পনা ডকে উঠবে।

সুদীপ স্পষ্টত বিরক্ত হল, দূর! এইভাবে এখানে বন্দী হয়ে থাকা যায়? পাইকাররা এদের ঠকাবে। এরা সভ্য মানুষের হালচাল কিছুই জানে না। সবাই লুটেপুটে নেবে।

প্রথমবার নিতে পারে। কিন্তু অভিজ্ঞতা মানুষকে অভিজ্ঞ করে। এর পরের বার ওরা যখন যাবে তখন আর ভুলের পুনরাবৃত্তি করবে না। আনন্দ ঠাণ্ডা গলায় বলল।

এতক্ষণ পালদেম চুপচাপ শুনছিল। এবার সে সুদীপকে বলল, তুমি সঙ্গে যেতে চাইছ কেন?

সুদীপ মাথা নাড়ল, আর বলে লাভ কি হবে! যাও ঠকে এসো। ঠকে শেখো।

পালদেম হাসল, ঠকলে ক্ষতি নেই যদি তা থেকে কিছু শেখা যায়। মুশকিল হল এই এলাচের দাম কত তা তো আমরা জানি না, তোমরাও না। ওরা যা বলবে তাই মানতে হবে।

সুদীপ হকচকিয়ে গেল। জয়িতা তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। পালদেমের কথাটা মিথ্যে নয়। সে সত্যি জানে না এলাচ কি দরে বিক্রি হয়। এমনকি ডিম অথবা মুরগির বিক্রয়মূল্য তার জানা নেই। কিন্তু সে এগুলো যে শহুরে কায়দায় জেনে নিতে পারে তা পালদেম পারবে না। কিন্তু কথাটা বলল না সে। কারণ তাহলে বলতে হয়, পালদেম, তোমাদের চেয়ে আমরা শহরের মানুষরা অনেক বেশি ধূর্ত।

মালপত্র মাথায় চাপানো হল। বাঁশের দুপ্রান্তে ঝুলিয়ে নেওয়া হল। এই সপ্তাহে বিক্রির টাকায় কোন জিনিস কিনবে না এরা। যেতে আসতে অন্তত দিন পাঁচেক সময় ব্যয় হবে। এবং পরের সপ্তাহের জন্যে খদ্দের তৈরি করে আসবে এরা। তখন ফেরার সময় গ্রামের মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা হবে। পুলিশ কিংবা সাধারণ মানুষ যদি তাদের কথা জিজ্ঞাসা করে তাহলে বলবে অনেককাল আগেই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। কথাটা বিশ্বাসযোগ্য হলেও হতে পারে কারণ খচ্চরওয়ালারা পর্যন্ত ওদের দেখতে পায়নি। সুদীপের খুব ইচ্ছে করছিল পালদেমকে সিগারেট এবং চা-পাতার জন্যে টাকা দিতে। কিন্তু কিছু কেনা এযাত্রায় হবে না, এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যেতে চাইল না সে। তাছাড়া ওরা চা-পাতা এবং সিগারেট কিনতে দোকানে গেলে সন্দেহ বাড়বেই।

সম্মিলিত আনন্দধ্বনির মধ্যে পালদেমরা যাত্রা শুরু করল। গ্রামের বাইরে দীর্ঘপথ পাড়ি দিচ্ছে এরা। এই গ্রামের ইতিহাসে কখনও হয়নি। তাপল্যাঙের মানুষরা এখনও শঙ্কা এবং খুশিতে দুলছে। ওরা সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছিল। গ্রামের শেষপ্রান্তে এই সময় কয়েকটা মানুষকে দেখা গেল। এরা একটু থমকে দাঁড়িয়ে আবার চলা শুরু করল। রোলেন এবং তার গ্রামের চারজন এই যাত্রা দেখতে এসেছে। জয়িতা এগিয়ে গেল বোলেনদের কাছে।

সুদীপ এবং আনন্দ দুটো দৃশ্য দেখছিল। পালদেমরা যাচ্ছে এবং জয়িতা রোলেনদের সঙ্গে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেসে হেসে কথা বলছে। সুদীপের অস্বস্তি হচ্ছিল। সেই সময় শেষবারের মত হাত তুলে পালদেমরা পাহাড়ের আড়ালে মিলিয়ে গেল।

তাপল্যাঙের সমস্ত মানুষকে স্বনির্ভর করতে প্রথম দলটি বাণিজ্যে বের হল।
 
৪৯.
পাঁচ দিন নয়, ওরা ফিরে এল দিন আটেক বাদে। এল উত্তেজিত হয়ে। দলের বেশির ভাগের উত্তেজনার কারণ নতুন জনপদ দর্শন। ফালুট পর্যন্ত ঠিক ছিল, তারপর যত ওরা নেমেছে তত বিস্মিত হয়েছে। সান্দাকফুর বাংলো বাড়ি, কালিয়াপোকরির বসতি দেখার পর সুকিয়াপোকরিতে গিয়ে তো একদম দিশেহারা। ডিমগুলো বিকেভঞ্জনে পৌঁছনোর আগেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। একটা বিরাট দল পাহাড় দেখার জন্য উঠছিল, তারাই কিনে নিয়েছে। সান্দাকফুতে মুরগিগুলো কিনেছিল কয়েকটা সাদা চামড়ার লোক। বুদ্ধি করে পালদেম চ্যাঙথাপু থেকে ওদের সম্ভাব্য দাম জেনে গিয়েছিল। বিদেশীদের কাছে তাই যেন অত্যন্ত সস্তা মনে হয়েছিল। সুকিয়াপোকরিতে এলাচ বিক্রি করতে অবশ্য ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল। সেই জন্যে তিন দিন দেরি হয়ে গেল। পরে জেনেছে এবারে ওরা জলের দরে এলাচ বিক্রি করেছে। কিন্তু পাইকার ঠিক করে এসেছে ওরা। সুকিয়াপোকরি পর্যন্ত যেতে হবে না, কালিয়াপোকরি পর্যন্ত নামিয়ে দিলেই চলবে। ওখান থেকেই পাইকার চার চাকার গাড়ি করে নিচে নিয়ে যাবে। গ্রাম ছাড়ার আগে পালদেম ভাল করে টাকা চিনে গিয়েছিল। সে কুড়ি করে করে গুনে যা ঘোষণা করল তার যোগফল চারশো আশি টাকা।

সুদীপ মন্তব্য করল, যে যেমন পেরেছে এদের টুপি পরিয়েছে।

আনন্দ হাত তুলে ওকে কথা বলতে নিষেধ করতেই সুদীপ খেপে গেল। সে বলল, দ্যাখ আনন্দ, দিনকেদিন তোর ধরন-ধারণ খোমনির মত হয়ে যাচ্ছে। আমরা বন্ধু, তুই আমার ধর্মযাজক নোস। আমি এতদিন কিছু বলিনি কিন্তু!

আমি ধর্মযাজক? আমাকে দেখে তাই মনে হয়? আনন্দ বিস্মিত হল।

এমন মুখ করে থাকিস যেন পৃথিবীর সব সমস্যা বুঝে গেছিস। জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন হয়ে গিয়েছে। ওয়াইন আর উওম্যান তো দূরের কথা, জাস্ট একটা খিস্তি উচ্চারণ করা মহাপাপ। তুই ছাড়া এখানে যেন কোন প্রাণ জাগত না! এরা তোকে আর জয়িতাকে অনেক আপন ভাবে কেন তা জানি না। তোর ভান এরা না বুঝতে পারলেও আমি বোকা নই। সুদীপ হঠাৎ উত্তেজিত হল।

ভান? কি ভান করি আমি?

পৃথিবীতে তোর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হল তাপল্যাঙের মানুষকে সুস্থভাবে বাঁচতে সাহায্য করা। আর সেটা ভাবতে গিয়ে তুই অন্য কিছু ভুলে যাস। এমন কি আমাকেও অপমান করিস!

জয়িতা চুপচাপ শুনছিল, আনন্দরটা বুঝলাম, আমি কি ভান করি সুদীপ?

সুদীপ জয়িতার দিকে তাকাল না, তুই শালা ছুপা রুস্তম! এদের মধ্যে এমনভাবে মিশে গেছিস যেন তোর বাপ-মা এখানেই জন্মেছিল! তাছাড়া ওই বোলেন লোকটার সঙ্গে এত ভাব কেন তোর? দেয়ার ইজ এ ধান্দা বিহাইন্ড দ্যাট, সেটা কি বুঝতে পারছি না। তোদের মনে রাখা উচিত আমরা চারজন এখানে লুকিয়ে থাকতে এসেছিলাম। এখানে থেকে যাওয়ার কোন পূর্ব পরিকল্পনা আমাদের ছিল না। গ্রামটাকে দেখার পর আমরা এদের সাহায্য করার কথা ভেবেছিলাম। এই দুবছরে আমরা অনেক করেছি। এবার ওদের চরে খেতে দে। কিন্তু তোদের ভাবভঙ্গি দেখে মনেই হচ্ছে না কখনও এদের ছেড়ে যাবি। সেইটেই বিভ্রান্তিকর।

আনন্দ বলল, সুদীপ, এ নিয়ে আলোচনা আমরা পরে করতে পারি। পালদেমের কাছ থেকে পুরো ঘটনাটা এখনও শোনা হয়নি। হ্যাঁ, পালদেম বল। তোমাদের জিনিসগুলো বিক্রি করতে কি কি অসুবিধে হয়েছে?

পালদেম এতক্ষণ সুদীপের দিকে তাকিয়েছিল। ওর চটজলদি উচ্চারণের বাংলা মাথায় ঢুকছিল না তার। তবে সে বুঝতে পারছিল এদের মধ্যে ঝগড়া চলছে। সে জিজ্ঞাসা করল, আমি কি খুব ঠকে গেছি? আসলে এত টাকা নিজেরা কখনও রোজগার করিনি তো, এর পরের বার এ রকম হবে না।

পালদেমের এক সহযোগী হেসে বলল, আমরা যে বেতের দুটো ছোট ঝুড়িতে ডিম নিয়ে গিয়েছিলাম তাও বিক্রি হয়ে গিয়েছে। সবাই জিজ্ঞাসা করছিল ওরকম ঝুড়ি আরও আছে কিনা।

আনন্দ জয়িতার দিকে খুশিমুখে তাকাল? জয়িতা বলল, বাঃ, তাহলে তো আমরা প্রতি বছর ভাল ঝুড়ি সাপ্লাই দিতে পারি। আহা এই বেতশিল্পটা যদি ভাল জানা থাকত!

কথা শুনলে লিভার ড্রাই হয়ে যায়। যেন মোটামুটি জানতিস কলকাতায় থাকাকালে। সুদীপ মন্তব্য করল। জয়িতার চোয়াল শক্ত হল।

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, রাস্তায় তোমাদের আর কোন অসুবিধের সামনে পড়তে হয়নি পালদেম?

কথা হচ্ছিল যৌথগৃহে বসে। প্রতিটি মানুষ ঠিকঠাক ফিরে এসেছে বলে গ্রামবাসীরা খুশিমুখে ভিড় করেছিল। পালদেম মাথা নাড়ল। চারপাশে একবার তাকাল। তারপর বলল, রাস্তায় বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছে। চট করে কেউ আমাদের থাকতে দেয়নি। নানান প্রশ্ন করেছে। তাপল্যাঙ নামটাই অনেকে শোনেনি। আমরা কেন এতদিন গ্রাম থেকে বের হইনি, গ্রামটা কি রকম, কি কি পাওয়া যায়—এই সব কথা জানতে চেয়েছে। আমার ভয় হচ্ছে বারবার গেলে ওদের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক হয়ে যাওয়ার পর ওরাও এখানে আসতে চাইবে। তখনই হবে মুশকিল।

ভয় হচ্ছে কেন?

চ্যাঙথাপু কিংবা ওয়ালাংচুঙের মানুষরা আমাদের মতন। কিন্তু নিচের মানুষদের হালচাল কেমন যেন! সবাই যেন সবসময় মতলব নিয়ে ঘোরাফেরা করে। আমাদের মদ আর মেয়েমানুষের আড্ডায় নিয়ে যেতে চাইছিল খুব। ছোকরারা প্রলোভিত হচ্ছিল কিন্তু আমি খুব সামলে রেখেছিলাম।

পালদেমের কথা শেষ হওয়ামাত্র একটি নারীকণ্ঠ প্রশ্ন করল, মেয়েমানুষের আচ্ছা? সেটা কি?

পালদেম বলল, সেখানে মেয়েরা মুখে রঙ মেখে পয়সা নিয়ে অচেনা পুরুষের সঙ্গে শোয়।

সঙ্গে সঙ্গে সম্মিলিত প্রতিক্রিয়া ছিটকে উঠল। পয়সা নিয়ে অচেনা পুরুষের সঙ্গে শোওয়ার মত জঘন্য ব্যাপার যে মেয়েরা করতে পারে তাদের সম্পর্কে বিরূপ আলোচনা শুরু হল। কেউ একজন চিৎকার করল, সত্যি বলছ তো, তোমরা তাদের কাছে যাওনি?

আমাদের কাছে তো পয়সাই ছিল না। আর এই বিক্রির টাকা তো খরচ করার জন্যে নয়।

যা হবার হয়েছে, এর পর আর সেখানে যেতে হবে না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top