What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected গর্ভধারিণী - সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

কথাটা যে বলল তাকে চিনতে পারল সুদীপ। পালদেমের বউ। সে হাসল, আচ্ছা, আগুনে হাত দিলে পুড়ে ফোসকা পড়ে তাই বলে কেউ আগুন জ্বালবে না? কি বল তোমরা?

সঙ্গে সঙ্গে সবাই মাথা নাড়ল, ঠিক ঠিক। এর পরে পালদেম আসল প্রসঙ্গে এল। পথ চলতে চলতে যে গ্রামে ওরা থেমেছে, যে মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে তারা যখনই জেনেছে তারা উত্তরের পাহাড় থেকে এসেছে তখনই জানতে চেয়েছে সেই ডাকাতরা এখনও ওখানে আছে নাকি যাদের পুলিশ ধরতে পারলে অনেক টাকা দেবে। যে ডাকাতরা নাকি একটা গ্রামে দুহাতে টাকা বিলিয়ে যাচ্ছে। সেই ডাকাতদের মধ্যে একটা মেয়ে আছে যাকে ভোগ করতে পারলে যে-কোন পুরুষ ভাগ্য মনে করবে। পালদেমরা সমানে জবাব দিয়ে গিয়েছিল, ডাকাতরা এসেছিল কিন্তু অনেকদিন আগে, যখন পুলিশ হামলা করেছিল তখনই আরও উত্তরের বরফের পাহাড়ে ওরা পালিয়ে গিয়েছে। অনেকে কথাটা বিশ্বাস করেছে, বেশির ভাগ সন্দেহের চোখে তাকিয়েছে। কিন্তু ওরা যে হঠাৎ গ্রাম থেকে জিনিসপত্র বিক্রি করতে বের হল এতে সবাই অবাক হয়েছে। ডাকাতরা থাকলে তাদের টাকা দিয়েই খচ্চরওয়ালাদের কাছ থেকে জিনিসপত্র কিনত? তারা নেই বলেই ওরা বাইরে পা বাড়িয়েছে। কেউ কেউ রসিকতা করেছে, টাকার স্বাদ বড় মারাত্মক। একবার টের পেলে আর রক্ষে নেই। নাহলে যারা কোনকালে গ্রাম ছেড়ে বের হত না তারা জিনিসপত্র বিক্রি করতে আসে। খচ্চরওয়ালাদের সঙ্গে মানেভঞ্জনে দেখা হয়েছিল। তারা তো দেখেশুনে অবাক। এই গ্রীষ্মে তাদের দরকার পড়বে না তাপল্যাঙে জেনে খুব রেগে গিয়েছে। ওরাই সমস্ত জিনিসপত্র কিনে নেবে এখানে এসে, কষ্ট করে আসতে হবে না নিচে, এই রকম বলেছিল। কিন্তু তাতে নারাজ হওয়ায় ওরা খুব হতাশ হয়েছে। ফেরার পরে ওয়ালাংচুরে লোকরা গল্প শুনেছে তাদের কাছে। তারাও ঠিক করেছে জিনিসপত্র নিয়ে নিচে যাবে বিক্রি করতে। সবচেয়ে মারাত্মক ঘটনাটা সবশেষে বলল পালদেম। শেষরাত্রে তাদের সবাইকে ধরে রেখেছিল ফুলিয়াপোকরির পুলিশ। না, মারধোর করেনি। কিন্তু কোত্থেকে আসছে, কেন আসছে, কে তাদের আসতে বলেছে এইসব প্রশ্ন করেছে। এবং পুলিশ দেখে ভয় পেয়ে ওরা শেষ পর্যন্ত বলেছে ডাকাতরা ওদের যাওয়ার আগে শিখিয়ে দিয়েছে কিভাবে নতুন করে বাঁচতে হয়। এই যৌথগৃহ, যৌথরান্না, যৌথ রোজগার এসবের হদিস পেয়েছে ডাকাতদের কাছ থেকেই। ডাকাতদের ওরা কখনই ভয়ঙ্কর মানুষ মনে করেনি। বরং বেশ বন্ধু বলেই মনে হয়েছে। পুলিশ ওদের অনেক প্রশ্ন করলেও ওরা কেউ বলেনি এই মুহূর্তে তাপল্যাঙে ডাকাতরা রয়েছে। পুলিশ ছেড়ে দেবার আগে বলেছে যদি ওই ডাকাতরা আবার গ্রামে আসে তাহলে যে করেই হোক ধরে ফেলে যেন ওরা। তাহলে ওদেশের সরকার অনেক অনেক টাকা তাদের উপহার দেবে। সমস্ত পাহাড়ে পাহাড়ে এই ঘোষণা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেহেতু তাপল্যাঙ অনেক দূরে তাই খবরটা পোঁছয়নি। পুলিশ জিজ্ঞাসা করেছিল ডাকাতদের কাছে ভারী ভারী অস্ত্র আমরা দেখেছি কিনা! আমরা বলেছি সেসব কিছুই দেখিনি।

সবাই চুপচাপ শুনছিল। পালদেম কথা শেষ করামাত্র সুদীপ বলল, আমাদের নিয়ে তোমরা দেখছি দারুণ ঝামেলায় পড়েছ। এখন তোমরাই ঠিক কর আমরা এই গ্রামে থাকব কিনা! তোমরা চাইলে আমরা এক্ষুনি চলে যেতে পারি।

পালদেম বলল, কিন্তু কোথায় যাবে তোমরা? পাহাড়ের যে-কোন গ্রামে গেলেই লোকে তোমাদের চিনে ফেলবে।

সুদীপ কাঁধ নাচাল, তাহলে সোজা ব্যাপারটা করে ফেল। আমাদের ধরিয়ে দিলে তোমরা প্রচুর টাকা পাবে।

হঠাৎ সাওদের উঠে দাঁড়াল, দ্রিমিত, তোমার বন্ধুকে বলে দাও আমরা বেইমার নই। বন্ধুর বন্ধুত্ব রাখতে জানি।
 
সুদীপ সঙ্গে সঙ্গে হাততালি দিল, সাবাস! আমি এই চেয়েছিলাম। বলে উঠে দাঁড়াল, নেপালের পুলিশের কথা জানি না কিন্তু ইন্ডিয়ান পুলিশ এত সরল হবে মনে করার কোন কারণ নেই। এখান থেকে পাথর ফেলে যাদের হঠিয়ে দেওয়া হয়েছে তারা হাতের মুঠোয় গ্রামের লোকদের পেয়েও ছেড়ে দেবে

এটা আমি ভাবতে পারছি না। ইম্পসিবল!

কিন্তু ছেড়ে যে দিয়েছে তা তত দেখতেই পাচ্ছিস। জয়িতা জবাব দিল।

পাচ্ছি। আর সেইটেই সন্দেহজনক। সুদীপ বাংলায় কথা বলছিল।

হঠাৎ আনন্দ চিৎকার করে উঠল, সুদীপ, সব কিছুর একটা সীমা আছে। নিজেকে ছোট করিস না।

কে কাকে ছোট করে! অঙ্কের হিসেবে গোঁজামিল আছে বলে দিলাম। সুদীপ আর দাঁড়াল না।

সাওদের ওর যাওয়া দেখল। তারপর বেশ জোরেই বলল, ওকে আমি ঠিক বুঝতে পারি না। মাঝে মাঝেই মনে হয় ও ঠিক তোমাদের মত নয়। এখন ও রেগে গেল কেন?

আনন্দ মাথা নাড়ল, সবার মন মেজাজ সব সময় এক রকম থাকে না। যা হোক, প্রথম যাত্রায় বেশ ভাল কাজ হয়েছে আমাদের। চারশো আশি টাকা তোমরা রোজগার করেছ, আমার খুব আনন্দ হচ্ছে।

পালদেম টাকাগুলো আনন্দর দিকে বাড়িয়ে দিল। আনন্দ দ্রুত মাথা নাড়ল, না। এই টাকা আমার কাছে থাকবে না। দুজন মানুষ নির্বাচন কর, তারা টাকার হিসাব রাখবে।

পালদেম বলল, গ্রামের মানুষ বেশি হিসাব জানে না।

আনন্দ লা-ছিরিঙকে ডাকল, লা-ছিরিঙ, তুমি দ্রিমিতের কাছে হিসেব শিখে নাও। এখন টাকাগুলো এমনভাবে রাখবে যাতে তুমি আর পালদেম দায়ী থাকো। মাটির নিচে পুঁতবে না। যাও, তোমরা এবার বিশ্রাম করো।

সভা ভেঙে যাওয়ার পর জয়িতা বলল, তুই তো বেশ এদের সামনে আমাকে দ্রিমিত বলে ডাকতে শুরু করেছিস! আমারও না সবার মুখে দ্রিমিত দ্রিমিত শুনতে শুনতে মনে হচ্ছে কোনকালে কলেজে পড়িনি। তুই আর আলাদা করে জয়িতা বলে ডাকিস না।

আনন্দ মুখ ঘুরিয়ে জয়িতার মুখ দেখল। ইদানীং ওই মুখে অন্য ধরনের লাবণ্য এসেছে। সেই শহুরে পালিশটা নেই। মুখ ফেটেফুটে একাকার কাণ্ড ঘটেছিল একসময়। এখন একটা বুনো পাহাড়ি ছাপ পড়ে গেছে সর্বত্র। জয়িতার চুল বড় হয়েছে। কিন্তু বেদম রুক্ষ। এই চুল নিয়ে ও মরে গেলেও কলকাতার রাস্তায় পা বাড়াত না। চেহারা তাদেরও কম পালটে যায়নি। পোশাক জীর্ণ, গালে দাড়ি বেরিয়েছে, আরও রোগা হয়ে গেছে সে। চেহারা খারাপ হয়েছে সুদীপেরও, কিন্তু সবচেয়ে পরিবর্তন হয়েছে ওর মেজাজের। কোন কিছুকেই আর ভাল দ্যাখে না সুদীপ।

কথাটা তুলল আনন্দ। জয়িতা বলল, দেখতে দেখতে কেমন অচেনা হয়ে যাচ্ছে ও। সেই যে মদ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল তার পর থেকেই এই অবস্থা। তুই ভাবতে পারিস, ও মাঝে মাঝে পাহাড়ে ঘুরাফেরা করে কেন?

প্রশ্নটা শুনে অবাক হয়ে মাথা নাড়ল আনন্দ। জয়িতা বলল, সেই ভালুকছানাদের দেখতে। ওর ধারণা ওরা ওকে দেখলেই চিনতে পারবে। পাহাড়ে ছেড়ে দেবার পর ওরা বেঁচে আছে কি-না তারই ঠিক নেই, আর বেঁচে থাকলেও যে এত বছরে মনে রাখার কথা নয় এটাই উধাও হয়ে গেছে ওর মাথা থেকে। আমি বলছি আনন্দ, এজন্যে ওই মেয়েটাই দায়ী।

কি রকম? আনন্দ হাসল, তোর ওই মেয়েটাকে প্রথম থেকেই পছন্দ হয় না।

জয়িতা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, হয় না। মেয়েটা এই গ্রামেই থাকে অথচ গ্রামের মানুষের কোন কাজে হাত মেলায় না। আজ সমস্ত গ্রাম একজোট হয়ে কাজ করছে, তুই কখনও দেখেছিস ওকে এগিয়ে আসতে! গ্রামের মানুষও ওকে পছন্দ করে না। শুধু সুদীপের সঙ্গে লেপটে থাকা ছাড়া অন্য কোন ধান্দা নেই ওর। শী ইজ স্পয়েলিং হিম!

ইম্পসিবল। সুদীপকে যতটা জানি তাতে বিশ্বাস করি, কোন মেয়ে ওকে নষ্ট করতে পারে না।

তুই ওই আনন্দেই থাক। মেয়েটার কখনই বাচ্চা হবে না, এখানকার সবাই একথা জানে।

তুই মিছিমিছি উত্তেজিত হচ্চিস জয়িতা।

কল মি দ্রিমিত।

এবার আনন্দের মুখে কৌতুক ফুটল, তুই নামটাকে পছন্দ করছিস?

অফ কোর্স। আমি ভুলে যেতে চাই আমার নাম জয়িতা। রামানন্দ রায় সীতা রায় আমাকে পৃথিবীতে এনেছেন। অতীতের একটা জিনিস শুধু মনে রাখতে চাই এবং সেটা হল শিক্ষা। এদের সঙ্গে সারা জীবন এদের হয়ে থাকতে চাই আমি। সুদীপ যা করছে তা বাইরে থেকে আসা স্বেচ্ছাসেবকের মত। ব্রাণসামগ্রী ফুরিয়ে গেলেই চলে যাবে যেন। এখন আর আমি ওই ভূমিকায় থাকতে চাই না। কথা বলতে বলতে জয়িতা আনন্দর সঙ্গে হাঁটছিল।

ওরা এতক্ষণ আস্তানার কাছে চলে এসেছে। আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, যে কোন রেফারেলে তুই সুদীপকে টানছিস, হোয়াট ড়ু ইউ থিংক অ্যাবাউট মি?

জয়িতা বলল, তোকে অ্যাসেসমেন্ট করতে পারব না। ইট ইজ ইউ হু গেভ মি ইন্সপিরেশন। এখানকার সমস্ত পরিকল্পনাই তোর মাথা থেকে বেরিয়েছে। গ্রামের মানুষ তোকে শ্রদ্ধা করে। কিন্তু আমাকে মনের কথা খুলে বলে।
 
কথাটা শুনে আনন্দ অনেকদিন বাদে হো হো করে গলা খুলে হাসল। কিন্তু জয়িতার মনে হল হাসিটা মোর্টেই স্বাভাবিক নয়। একটানা অনেকটা উঠে আসায় ওর বুকে হাঁপ ধরল। কদিন থেকে এটা প্রায়ই হচ্ছে। মাথা ঘুরছে, এক ধরনের অস্বস্তি বেশ কিছুদিন সেঁটে থাকে শরীরে।

আনন্দ আর কথা বলল না। মেয়েটা দাঁড়িয়েছিল সামনে। ওদের দেখে বলল, খাবার হয়ে গিয়েছে। খাবে তো চলে এস। আনন্দ তাকে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। কনকনে জল মুখে কপালে দিতে জয়িতা যেন আরাম পেল। সে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। শরীরটা গোলাচ্ছে। সকাল থেকে কিছু পেটে না দেওয়ায় এরকমটা হচ্ছে। লিভারটার কি অবস্থা কে জানে! আজকাল একটা ভয় তার খুব করে। ভাল এবং নিয়মিত খাবারের অভাবে তার কি প্রেসার কমে যাচ্ছে? নাহলে মাথা ঘোরে কেন? সে একবার মুখ ফিরিয়ে দেখল মেয়েটা তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। চোখাচোখি হতে সে ঘরের ভেতর চলে গেল।

দুটো পা সামনে ছড়িয়ে জয়িতা বসল। সামনেই বরফচূড়ো থেকে একটা হিম বাতাস নেমে এল তখনই। খুব ভাল লাগল জয়িতার। সে নিজের পোশাক দেখল। এগুলো পালটানো দরকার। খুব বেশিদিন টিকবে না। সুদীপের কাছে যে অর্থ অবশিষ্ট আছে তাতে আর হাত দেওয়া হবে না বলে ঠিক হয়েছে। এখন গ্রামগত উপার্জনে প্রত্যেককে বেঁচে থাকতে হবে। গ্রামের যে-কোন মেয়ে যা পোশাক পরে সে তাই পরবে। সে মুখ তুলে গ্রামটার দিকে তাকাল। এমনভাবে চেহারা পালটে যাবে তা কে ভেবেছিল! কলকাতা থেকে পালাবার সময়েও তাদের কল্পনায় ছিল না। পাথরের দেওয়ালে প্রাণশক্তি এতকাল আটকে ছিল। সবে ছিদ্রপথ পেয়েছে বাইরে বের হবার। এবং যে কোন তরল পদার্থের মত সেই ছিদ্র বড় করার চেষ্টায় ব্যস্ত সমস্ত গ্রাম। শুধু দেখতে হবে উৎসাহের আতিশয্য যেন সমস্ত কাজ ভণ্ডুল না করে দেয়। যে কোন সুপ্রাপ্তিই মনে আশঙ্কা আনে। সুখের গন্ধ পাওয়ার মুহূর্তে গ্রামবৃদ্ধরা বলতে শুরু করেছে, এসব যাদের জন্যে হল তারা যদি চলে যায় তাহলে কিছুদিন পরে আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে গ্রামটা। মাঝখানে এই স্বাদ বদলের স্বাদ নতুন বিপদ ডেকে আনবে। হয়তো ঠিক, কিন্তু জয়িতা ভাবে ব্যাপারটা ফুটবল টিম কোচিং-এর মত হয়ে যাচ্ছে। তারা সূত্রপাত করতে পারে মাত্র, কিন্তু এগিয়ে যেতে হবে সাধারণ মানুষকেই। নেতৃত্ব নিতে হবে তাদেরই। নির্ভরতা এক্ষেত্রে কখনই কাম্য নয়। কিন্তু তাকে তো এই গ্রামেই থেকে যেতে হবে। একটা বাসযোগ্য পৃথিবী চেয়েছিল সে। এখন তো জয়িতা নেই, এখন সে দ্রিমিত। এই গ্রামটিকে ক্রমশ সেই জায়গায় পৌঁছে দেবে গ্রামবাসীদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। রোলেনদের গ্রামেও এখন তাপল্যাঙের ছোঁয়াচে ভাব গেছে। সেখানেও যৌথহ, যৌথখামার তৈরির চেষ্টা চলছে। কিন্তু এখানে অভাব এবং অসুখ এত প্রবল ছিল যে বাধা আসেনি তেমন কিন্তু ওখানে সচ্ছল মানুষের সংখ্যা বেশি বলে প্রতিবন্ধকতা আসছে। কিন্তু গত বরফের সময় যে তাপল্যাঙের মানুষ কম কষ্ট পেয়েছে এটা ওরা লক্ষ্য করেছে। সেইটেই ওদের যৌথগৃহ নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করেছে। এই সময় আনন্দ তাকে খেতে ডাকল।

সুদীপ যার নাম দিয়েছে খিচুড়ি তার স্বাদ এখন ওদের সয়ে গেছে। কিন্তু এখানে উনুনে থাকতে থাকতেই খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যায়। ওরা চারজন খাচ্ছে গোল হয়ে বসে। আনন্দ চটপট কিছু পেটে চালান করে দিয়ে বলল, জর খিদে পেয়েছিল।

সুদীপ ওর দিকে তাকাল। তারপর বাংলায় বলল, আমার মনে হচ্ছে এবার আমাদের কলকাতায় ফেরা দরকার। পুলিশ সম্পর্কে আমরা হয়তো মিছিমিছি আতঙ্কিত হয়ে আছি। অ্যাপ্লিনে কলকাতায় অনেক খুন হয়েছে, অনেক ডাকাতি, এখন আর আমাদের জন্যে কেউ নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে বসে নেই। লেটস গো ব্যাক।

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, হঠাৎ একথা তোর মনে হচ্ছে কেন?

কলকাতা থেকে বেরুবার আগে তুই বলেছিলি কিছুদিন গা-ঢাকা দিয়ে আবার আমরা ফিরে আসব। কথাটা নিশ্চয়ই তোর মনে আছে? সুদীপের গলায় সামান্য ঝাঁঝ।

আছে। কিন্তু বল, কি উদ্দেশ্যে আমরা কলকাতায় যাব? আরও কয়েকটা মন্ত্রী অথবা চোর খুন করে কিছু লাভ হবে না। ব্যক্তিহত্যা কখনই সাধারণ মানুষের উৎসাহ আনে না। তাছাড়া মধ্যবিত্ত বঙ্গবাসী কখনই আঙুল তুলবে না। ওরা রাজনীতি করে কিছু পাওয়ার লোভে এবং ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগই গর্তে মুখ গুঁজে থাকা পছন্দ করে। ভারতবর্ষে যদি কখনও বিপ্লব হয় তাহলে গ্রামে আগুন জ্বলবে প্রথমে। সেই আগুনে রোস্ট হয়ে শহরের মানুষের যদি চৈতন্য জাগে। আমরা ওখানে গিয়ে কিছুই করতে পারব না। বরং এখানে তিল তিল করে এই নবজাগরণ চলছে, আমাদের উচিত এর সঙ্গী হওয়া। আনন্দ খুব সিরিয়াস গলায় বলল।

এই জন্যেই এখানে থাকা উচিত নয়, এদের উচিত আমাদের হাত ধরে নয়, নিজেদের পায়ে নিজেরা যাতে দাঁড়াতে পারে তার চেষ্টা করা। নাহলে এরা কখনই স্বাবলম্বী হবে না। তাছাড়া তোদের কথা আমি জানি না, বাট আই অ্যাম রিয়েলি টায়ার্ড। সুদীপ একবার তার পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসা মেয়েটির দিকে তাকাল। যেন ক্লান্তিটা উভয় অর্থে তা বুঝিয়ে দিল।

আনন্দ প্রথমে কিছু বলল না। তারপর সবাই চুপচাপ দেখে বলল, নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা তোর আছে। তবে কিছু করার আগে তোর উচিত ভেবে দ্যাখা।

সুদীপ কাঁধ নাচাল। জয়িতা দুটো দলা পেটে দেবার পর আর খেতে পারছিল না। সে ওদের কথাবার্তা শুনছিল। কিন্তু ক্রমশ তার শরীরের অস্বস্তিটা বেড়ে যাচ্ছিল। শরীর গোলাচ্ছে, মোটেই খেতে ইচ্ছে করছে না। যে বিষয় নিয়ে সুদীপ প্রশ্ন তুলেছে সেটা তারও ভাবনায় এসেছিল কিন্তু যেভাবে সুদীপ সমাধান চাইছে তা মানতে সে নারাজ। কিন্তু এখন তার তর্ক করতে মোটেই ইচ্ছে করছে না। খাবার ছেড়ে দিয়ে সে উঠে পড়তেই সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, কি হল? জয়িতা কোন জবাব না দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। ঠাণ্ডা বাতাস মুখে লাগতে সামান্য স্বস্তি হল কিন্তু পৃথিবীটা টলছে তার। হাত ধুয়ে মুখে জল দিতে দিতেই মনে হল গলার কাছে অস্বস্তি। সে বসে পড়তেই খাবার বেরিয়ে এল হুড়হুড় করে। শব্দ করে কয়েকবার বমি হল তার। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে সে হাঁপাচ্ছিল। মুখ হাঁ এবং চোখ বন্ধ। সে ওই অবস্থায় চোখের কোলে জলের অস্তিত্ব টের পেল। প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগছে, একটু শুয়ে পড়লে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে বলে মনে হল তার। সে চোখ খুলতেই মেয়েটাকে দেখতে পেল। আস্তানার দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মেয়েটা অবাক চোখে এদিকে চেয়ে আছে। ক্রমশ তার মুখে একটা আশ্চর্য আলো ফুটে উঠল। এক ঝটকায় সে ভেতরে চলে গেল। ও রকম কেন ও করল জয়িতা ঠাওর করতে পারল না। সে অবসন্ন শরীরটা টেনে তুলল, তারপর জল ঢালতে লাগল বমি পরিষ্কার করতে।
 
মেয়েটার ছুটে আসার ভঙ্গি সুদীপকে অবাক করল। আনন্দ দেখল নিজের খাবারের সামনে বসে মেয়েটা হাসিমুখে খাবার মুখে পুরছে আর মাথা দুলিয়ে মজার ভঙ্গি করছে। সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, অ্যাই, তুমি অমন করছ কেন? কি হয়েছে?

মেয়েটা সেইভাবেই জবাব দিল, ভাল খবর, খুব ভাল খবর!

ভাল খবর? বাইরে আবার কি ভাল খবর হল? সুদীপের বিরক্তি বাড়ছিল। মেয়েটি আচমকা তার এঁটো মুখ সুদীপের কানের কাছে নিয়ে ফিসফিসিয়ে কিছু বলে খিল খিল করে হেসে উঠল। কি বলল সে আনন্দ ঠাওর করতে না পারলেও লক্ষ্য করল সুদীপ অবাক হয়ে গেছে। চকিতে সুদীপ আনন্দর দিকে তাকাল। তারপর সেই অবস্থায় উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খুলে সুদীপ দেখল জয়িতা তখনও মাথা নিচু করে জল ঢালছে। এর মধ্যেই ওর চেহারা অত্যন্ত বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঠোঁট কামড়াল। তারপর নিজের মনে উচ্চারণ করল, না। ইটস ইম্পসিবল। আমি বিশ্বাস করি না।

সেই সময় দূরে চিৎকার শোনা গেল। একটা লোক ছুটতে ছুটতে ওপরের পাহাড় থেকে নেমে আসছে। তার কথা শুনতে গ্রামের লোকজন বেরিয়ে এল। লোকটি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে কিছু বলছিল। সুদীপ অবাক হয়ে এবার সেদিকে তাকাল। পুলিশ নয়তো! এবার লোকগুলো আস্তানার দিকে ছুটে আসছে। লা-ছিরিঙ এবং পালদেম ওদের সঙ্গে রয়েছে। লা-ছিরিঙ সুদীপকে দেখতে পেয়ে বলল, বহুৎ মারপিট চলছে, তিন চার জন লোক ঠিক মরে যাবে।

কোথায়? সুদীপের স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। যাক, পুলিশ নয়।

পাশের গ্রামে।

এই উত্তেজনা সম্ভবত জয়িতাকে আচমকা সুস্থ করে দিল। সে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে লা-ছিরিঙ?

লা-ছিরিঙ বোঝাল পাশের গ্রামে কদিন থেকেই ঝামেলা চলছিল। আজ দস্তুরমত মারামারি শুরু হয়েছে। এর মধ্যে তিন-চারজনের লাস পড়ে গেছে। ওই ছেলেটি গরু চরাতে পাশের গ্রামের কাছে গিয়ে স্বচক্ষে দেখে ছুটে এসেছে। জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, লড়াইটা কাদের সঙ্গে হচ্ছে?

এবার পালদেম জানাল, নিজেদের মধ্যে।

এই সময় আনন্দ বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। খবরটা শোনামাত্র সে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। এমন কি কারণ ঘটতে পারে যে একটা গ্রামের মানুষ নিজেদের মধ্যে মারামারি করবে! বরং গ্রামে গ্রামে রেষারেষি থাকায় এরা জোট বেঁধে থাকাটাই পছন্দ করে। সুদীপ বলল, ও নিয়ে মাথা ঘামাবার কোন দরকার নেই। তাপল্যাঙে কিছু হলে না-হয় আমরা ভাবতাম।

হঠাৎ জয়িতা ফোঁস করে উঠল, কেন, তাপল্যাঙের ভাল-মন্দের ইজারা নিয়েছিস নাকি তুই?

সুদীপ হতভম্ব হল। জয়িতার সেই ক্লান্ত অবসন্ন ভঙ্গিটা নেই। মেয়েটির কাছে যে ইঙ্গিত সে পেয়েছিল তার কোন হদিস পাচ্ছে না এখন। বরং জয়িতা যেন তাকে এদের সবার সামনে হেয় প্রতিপন্ন করতে মরীয়া হয়ে উঠেছে। সে কোনরকমে বলতে পারল, কি ভ্যানতারা করছিস?

জয়িতা ওর কথায় কান দিল না। আনন্দর সামনে এগিয়ে এসে বলল, রোলেনদের গ্রামে নিশ্চয়ই কোন গোলমাল হয়েছে। ওরা আমাদের সাহায্য করেছিল এক সময় এটা ভুলে যাস না।

সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে ফেলেছিল আনন্দ! সে ভেতরে ঢুকে রিভলভারটা তুলতে গিয়ে মাথা নাড়ল। এর কর্মক্ষমতা এখন কতটা সন্দেহ আছে। কিন্তু তবু সঙ্গে থাকলে ভরসা হয়।

বোলেনদের গ্রামের ধার-বরাবর পৌঁছে দৃশ্যটা দেখতে পেল ওরা। তাপল্যাঙের অন্তত জনাবিশেক যুবক এসেছে ওদের সঙ্গে। পাহাড়ের একটা ঢালে দাঁড়িয়ে ওরা সমস্ত গ্রামটাকে দেখতে পাচ্ছিল। কয়েকটা বাড়িতে দাউ দাউ আগুন জ্বলছে। চারদিকে এখনও ছোটাছুটি চলছে। যে যৌথগৃহ রোলেনরা তাপল্যাঙের অনুসরণে বানিয়েছিল সেটি এখন মুখথুবড়ে রয়েছে। এখনও টানা কঁদছে কেউ কেউ। থমথমে হয়ে আছে পুরো গ্রামটা। এই মুহূর্তে অবশ্য কোন মারামারি চোখে পড়ল না। আনন্দ অনেকটা নিজের মনেই বলল, ব্যাপারটা কি!

সুদীপ বলল, যাই হোক না কেন, এটা ওদের সমস্যা আমি আবার বলছি।

আনন্দ সুদীপের দিকে তাকাল। তারপর নিচুগলায় বলল, তুই এরকম পালটে গেলি কি করে?

পালটে গেছি আমি? সুদীপ হাসল, হয়তো পরোপকার করার ঠেলায়।

আনন্দ আর কথা বাড়াল না। আরও খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর ওরা কয়েকটি যুবককে দেখল, দূরে দাঁড়িয়ে আগুন দেখছে বেশ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে। এছাড়া তাদের চোখের সামনে যে দৃশ্য সেখানে কোন মানুষের চলাফেরা নেই। জয়িতা বলল, আমাদের যাওয়া উচিত।

আনন্দ বলল, তোরা এখানে অপেক্ষা কর, আমি যাচ্ছি। কিছু হলে আমি আত্মরক্ষা করতে পারব।

জয়িতা মাথা নাড়ল, আমিও যাচ্ছি। ওরা আমাকে কিছু বলবে না। রোলেনকে খুঁজে বের করা দরকার।

তাপল্যাঙের যুবকদের সঙ্গে সুদীপ ওপরেই রয়ে গেল। আনন্দ আর জয়িতা সাবধানে নিচে নামতে লাগল। নিজের শরীরের অস্বস্তিটাকে এখনও টের পাচ্ছিল জয়িতা। কিন্তু বাইরের উত্তেজনা সেটাকে অনেক দমিয়ে দিয়েছে। ওরা নিচে এসে দাঁড়াতেই যুবকরা ওদের দেখতে পেল। প্রথমে ভয় তারপর সন্দেহ ওদের চোখে ফুটে উঠল। নিজেদের মধ্যে কিছু বলাবলি করে দুজন ছুটে চলে গেল আড়ালে। জয়িতা হাত তুলে চিৎকার করল, কি হয়েছে তোমাদের গ্রামে?

খানিকটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদুটো কোন জবাব দিল না। জয়িতা আবার চিৎকার করল, আমরা তোমাদের বন্ধু। তোমাদের সাহায্য করতে এসেছি।
 
এবার দুজন নিচু গলায় কথা বলল। তারপর ওরা এগিয়ে এল থমকে দাঁড়ানো আনন্দর সামনে। প্রথম লোকটি বলল, এখানে আজ কেউ চেঁচিয়ে কথা বলছে না। তোমরাও বলো না।

এইরকম কথা শুনবে কল্পনা করেনি ওরা। আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে?

লোকটি বলল, এই গ্রামের কয়েকটি পরিবার চায়নি যৌথগৃহ হোক, তাপল্যাঙের মানুষদের মত আমরা একসঙ্গে চাষ করি, বাইরে জিনিসপত্র বিক্রি করে টাকা নিয়ে আসি। ওরা বাধা দিচ্ছিল খুব। আজ সকালে ওরা আমাদের একজনকে লুকিয়ে খুন করে। সেটা জানার পরে সমস্ত গ্রামের লোক ওদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়, ওদের তিনজনকে খুন করে বদলা নেওয়া হয়। লোকটা নিঃশ্বাস ফেলল, এখন আর আমাদের সামনে কোন বাধা নেই।

এই সময় দুজন লোক ফিরে এল আরও কয়েকজনকে নিয়ে। তাদের মধ্যে একজনকে চিনতে পারল জয়িতা। রোলেনদের সঙ্গে এ তাপল্যাঙে ডাকাতি করতে গিয়েছিল। সে জয়িতাকে বলল, এই প্রথম আমরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করলাম, তোমরা কি তাই দেখতে এসেছ?

জয়িতা মাথা নাড়ল, না। আমরা জানতাম না কি হয়েছে এখানে, তাই ছুটে এসেছিলাম।

লোকটা বলল, ও! আমাদের আর কোন ঝামেলা নেই। অত্যন্ত নির্লিপ্ত দেখাচ্ছিল লোকটাকে। আনন্দ বুঝল ওরা চাইছে না কেউ নাক গলাক। গ্রাম থেকে, সরাসরি না বললেও, চলে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। ওর ভাল লাগল। প্রতিবন্ধক দূর করার জন্য এই রক্তপাত ওদের অনেক কাজে লাগবে। বলতে গেলে একত্রিত হবার প্রথম পদক্ষেপ এরা নিজেরাই অর্জন করল। ঠিকঠাক যদি এগিয়ে যেতে পারে তাহলে তাপল্যাঙের মানুষদের চেয়ে এরা অনেক বেশি স্বাবলম্বী এবং সংগঠিত হবে। আনন্দর মনে হল, তাপল্যাঙের যদি কিছু মানুষ প্রতি রূক হয়ে দাঁড়াত তাহলে ওদের অগ্নিপরীক্ষাটা সম্পন্ন হত।

সে জয়িতাকে বলল, চল ফিরে যাই। তারপর যুবকদের বলল, যদি কখনও কোন সাহায্যের দরকার হয় আমাদের বলল।

যুবকরা ঘাড় নাড়ল। আনন্দ ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে দেখল জয়িতা ফিরছে না। সে শুনল জয়িতা জিজ্ঞাসা করছে, রোলেন কোথায়?

প্রশ্নটা শোনামাত্র লোকগুলো মাথা নিচু করল। জয়িতার গলার স্বর এক পর্দা উঠল, কি হল, কথা বলছ না কেন?

লোকটি যে এতক্ষণ কথা বলছিল গম্ভীর গলায়, দ্বিতীয়বার প্রশ্নটা শোনামাত্র হঠাৎ হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। কান্নাটা সংক্রামিত হল তার সঙ্গীদের মধ্যে। ততক্ষণে গ্রামের আরও মানুষ ভিড় করেছে পেছনে। সম্মিলিত চাপা ক্রন্দনে ছেয়ে গেল গোটা চত্বর। জয়িতা পাথরের মত দাঁড়িয়েছিল। এমন অসাড় চেহারায় জয়িতাকে কখনও দ্যাখেনি আনন্দ। সে চাপা গলায় ডাকল, জয়িতা।

জয়িতা মাথা নাড়ল, আমি দ্রিমিত, দ্রিমিত।

আনন্দ মাথা নাড়ল। তারপর গ্রামবাসীকে জিজ্ঞাসা করল, রোলেন কোথায়?

লোকগুলো দুটো ভাগ হয়ে গেল। একজন সেই রাস্তা দিয়ে ওদের নিয়ে এল গ্রামের মাঝখানে। পথ চলতে ওরা পোড়া গন্ধ পেয়েছে বারংবার। ছাই হয়ে যাওয়া বাড়ি নজরে এসেছে।

রোলেনকে চিনতে পারল আনন্দ। সুগঠিত শরীর নিয়ে সে শুয়ে আছে। চোখ বন্ধ। মাথার পাশ দিয়ে রক্ত ঝরে শুকিয়ে কালো হয়ে আছে। ওকে ঘিরে কয়েকজন গ্রামবৃদ্ধা হাঁটু গেড়ে বসে সমানে কেঁদে যাচ্ছেন। আনন্দ মাথা নিচু করে দাঁড়াল। যে লোকটি নিয়ে এসেছিল পথ দেখিয়ে সে বলল, কাল রাত্রে ওরা রোলেনকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল চুপিচুপি। আজ সকালে ওকে এই অবস্থায় পাই। রোলেন ওদের বারংবার অনুরোধ করেছে আমাদের সঙ্গে আসতে। সেই রাগে ওরা ওকে মেরেছে। ওর মৃতদেহ দেখে গ্রামের মানুষ খেপে গিয়ে–। লোকটা আর কথা শেষ করল না।

যে কোন কাজ শুরু হয় কারও উদ্যম থেকেই। সেই উদ্যম যদি সে অন্যের মনে সঞ্চারিত করতে পারে জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায় তাহলেই সে সফল। আনন্দ হাঁটু গেড়ে বসে চোখ বন্ধ করল। যে কাজ তারা ভারতবর্ষের বিরাট প্রেক্ষাপটে করার কথা ভেবেছিল, যে কাজ তারা তাপল্যাঙের ছোট্ট পরিধিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছে সেই ভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়ে যোলেন নিজেকে শহীদ করল। চকিতেই তার মনে পড়ল রোলেন তো কখনই তার এবং সুদীপের সঙ্গে আলোচনা করতে আসেনি। তাকে তাপল্যাঙ গ্রামেও দেখা যেত না। তাহলে এই প্রেরণা সে কোত্থেকে পেল? আনন্দ উঠে দাঁড়িয়ে জয়িতার দিকে তাকাল। জয়িতা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যোলেনের মৃতমুখের দিকে। আনন্দ শিহরিত হল। জয়িতা যে কখন রমণী হয়ে গিয়েছে তা সে আগে লক্ষ্য করেনি। ওর ঠোঁট এখন থর থর করে কাপছে। এবং এই প্রথম আনন্দ জয়িতার দুচোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়া দেখল।

আশ্চর্য গলায় জয়িতা বলল, আনন্দ, তুই ফিরে যা। আমি ওর শেষ কাজ পর্যন্ত থাকব।

আনন্দ বলল, আমি ফিরে যাচ্ছি সবাইকে ডেকে আনতে। তাপল্যাঙ আর এই গ্রামের মানুষ এক হয়ে শেষ কাজ শুরু করবে।
 
৫০.
লা-ছিরিঙ আর জয়িতা কথা বলতে বলতে আসছিল। গত সপ্তাহে যারা এই গ্রাম থেকে সুখিয়াপোকরিতে গিয়েছিল তারা ভাল ব্যবসা করছে। ওখানে একজন পাইকার তাদের কাছ থেকে নিয়মিত এলাচ কিনবে। মুরগি এবং বেতের ঝুড়ি যদি বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় অন্তত কালিয়াপোকরি পর্যন্ত তাহলে লাভ বেশি থাকবে। খচ্চরওয়ালারা যা যা জিনিস গ্রামে আনত তা অনেক সস্তায় ওরা কিনে এনেছে নিচু থেকে। এভাবে চললে আগামী বরফে প্রত্যেকের শরীরে গরমজামা একটা না একটা থাকবেই। আনন্দ চাইছে এ বছরের মধ্যে অন্তত তিনটে গরু কিনে আনতে নিচে থেকে। গরুর যা দাম তা শেষপর্যন্ত ব্যবস্থা করা যাবে কিনা কে জানে! যদি জিনিসপত্র বিক্রির টাকা উদ্ধৃত্ত না থাকে তাহলে আনন্দই ব্যবস্থা করবে। সুদীপের টাকা এখনও রয়ে গেছে অনেকটা। আনন্দ চাইছে এখানে একটা বেশ বড় ডেয়ারি করতে। পোলট্রি এবং ডেয়ারি যদি চালু করা যায় তাহলে সামনের বছর থেকে দুধ ডিম ও মুরগি চালান দিলে অর্থনৈতিক কাঠামো মজবুত হবে। তবে এখন সুদীপের টাকা ঋণ হিসেবে নেওয়া হবে। লাভ হবার পর শোধ করার দায় থাকবে। পাশের গ্রামের সঙ্গে তাপল্যাঙের এখন প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। যেহেতু ওরা আনন্দ কিংবা জয়িতার সাহায্য সরাসরি নিচ্ছে না তাই এখনও পিছিয়ে। কিন্তু তাপল্যাঙ যা করছে ওরা সেই পথে এগোচ্ছে। লা-ছিরিঙের বিশ্বাস গরু কিনলে ওদের ওপর টেক্কা দেওয়া যাবে। এ বছর ওরা যাই রোজগার করুক গরু কেনার মত সামর্থ্য হবে না।

ওরা যখন আস্তানার কাছাকাছি তখন সুদীপকে দেখতে পেল জয়িতা। খানিকটা দূর থেকে দেখা বলেই জয়িতাব মনে হল সুদীপ খুব রোগা হয়ে গিয়েছে। ইদানীং খুব খিটখিটে এবং সন্দেহপরায়ণ হয়েছে সুদীপ। বারংবার সে বোঝাবার চেষ্টা করছে, অনেক হয়েছে এবার ফেরা যাক। কিন্তু ফিরলে কি হবে তা নিয়ে মোটেই ভাবছে না। হঠাৎ লা-ছিরিঙ জিজ্ঞাসা করল, তোমরা কি তাপল্যাঙ ছেড়ে চলে যাবে?

জয়িতা হাসল, হঠাৎ একথা তোমার মনে হচ্ছে কেন?

লা-ছিরিঙ জবাব দিল, গ্রামের সবাই বলাবলি করছে। সবাই ভয় পাচ্ছে যে তোমরা চলে যাবে।

ভয় পাচ্ছে? ভয় কেন? জয়িতা অবাক হল।

তোমরা আসার আগে আমাদের অবস্থা কি ছিল তা তো দেখেছ। তোমরা এলে বলেই এখন গ্রামের মানুষ কোনরকমে কিছু খেতে পাচ্ছে। আমরা সবাই বুঝতে পারছি এভাবে চললে আগামী তিন-চার বছরে আর কোন অভাব থাকবে না। আমরা কখনও ভাবতে পারিনি যে সবাই এক হয়ে লড়তে পারব। তোমরা চলে গেলে এসব ভেঙে যাবে। আমাদের বুদ্ধি দেওয়ার কে থাকবে? অত্যঙ্গ সরল গলায় বলল লা-ছিড়িঙ।

জয়িতা বলল, আমরা না হয় এখানে আছি কিন্তু পাশের গ্রামের মানুষরা কি করে পারছে?

লা-ছিরিঙ হাত নাড়ল, ওরা তো তোমরা যা করতে বলছ আমাদের তাই নকল করছে। এই গ্রামের ব্যাপার দেখার পরেই তো রোলেন ওদের বোঝাল। চোখের সামনে কারও ভাল না দেখলে ওরা এসব মানত না। শোনা কথাতে কে বিশ্বাস করে?

জয়িতা বলল, এটা ঠিক নয়। আমরা চলে গেলে যদি সব ভেঙে যায় তাহলে আমাদের সব পরিশ্রম অর্থহীন। তোমাদের উচিত নিজেরাই যাতে আরও এগিয়ে যেতে পার তা ভাবা।

হঠাৎ লা-ছিরিঙ প্রসঙ্গ পালটাল, তোমাদের ওই বন্ধু আগে পালাতে চায়, না? সুদীপকে দেখাল সে। সুদীপ হাঁটছিল কাহুনের মন্দিরের দিকে।

একথা কে বলল তোমাকে?

জানি। ওর ব্যবহার যেন কেমন কেমন। তাছাড়া ওই মেয়ের সঙ্গে বেশিদিন থাকলে ও মরে যাবে। এটা বুঝতে পেরেছে বলেই পালাতে চাইছে। মাথা নাড়ল লা-ছিরিঙ।
 
আজকাল অল্প হাঁটলেই বুকে হাঁপ ধরে। মাথা ঘোরে। কপালে ঘাম জমে। জয়িতা দাঁড়াল একটু। মেয়েটির সম্পর্কে যে ইঙ্গিত লা-ছিরিঙ দিল তাতে কথা বলার লোভ বাড়ে। সেই প্রসঙ্গে যেতে চাইল না সে। কিন্তু লা-ছিরিঙ যেন নিজের মনেই বলে চলল, ওকে ধরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল রোলেনরা। কারণ ও নাকি মা হবার পক্ষে খুব উপযুক্ত। কারও সঙ্গে বিয়ে দিলে গণ্ডায় গণ্ডায় বাচ্চা তৈরি করতে পারবে। নিয়ে গেলে হাড়ে হাড়ে টের পেত। ও একটা উকুন। যা দেখে তা শুষে নেবে। সেটা বুঝতে পেরেছে বলে তোমাদের বন্ধুটা পালাতে চাইছে। আর এই পালাতে চাওয়ার মতলবটা টের পেয়ে গেছে মেয়েটা। সে-ই সারা গ্রামে গাবিয়ে বেড়াচ্ছে।

পালাতে চাইলেই পালাতে দেবে কেন তোমরা, ধরে রেখো।

না, তা কি করে সম্ভব! তোমরা তো কোন অন্যায় করোনি। অন্যায় না করলে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায়? ওই মেয়েটার যদি বাচ্চা হত তাহলে ওকে পালাতে দিতাম না আমরা। কথাটা বলে কি ভাবল লা-ছিরিঙ আকাশের দিকে মুখ তুলে, তারপর মাথা নাড়ল, তাহলে হয়তো ও পালাতে চাইত না। আগুনে জল পড়লে তা আর গনগনে থাকে না।

গ্রামের সমস্ত সমস্থ পুরুষ এবং নারী আজ মন্দিরের চাতালে জড়ো হয়েছে। আনন্দ এবং কাহুন ওপরে বসে। কাহুনকে জোর করেই এনেছে আনন্দ। জনতার সঙ্গে যোগ দিয়ে জয়িতা দেখতে পেল সুদীপ খানিকটা দূরে একটা পাথরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। ওর খুব ইচ্ছে করছিল সুদীপের সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু দূরত্বটা ডিঙোতে গেলে অনেক মানুষেকে সরাতে হয়। পালমে উঠে এল আনন্দর পাশে। এসে দুহাত তুলে দাঁড়াতে জনতার গুঞ্জন বন্ধ হল। পালদেম যেন নিজের কৃতিত্বে খুশী হল, তার মুখে হাসি ফুটল, জয়িতার মনে হল, সারল্য মানুষকে কত অল্পে তৃপ্ত করে!

আনন্দ উঠল, তাপল্যাঙের ভাই এবং বোনেরা। আজকের এই জমায়েতের একটা নির্দিষ্ট কারণ আছে। তার আগে আমি জানতে চাই এই গ্রামের সমস্ত মানুষ এখানে উপস্থিত আছে কিনা। কেউ না থাকলে তাকে ডেকে আনতে হবে।

খানিকটা সময় গলা তুলে এ ওর নাম করে ডাকাডাকির পর সমস্বরে জানান দেওয়া হল, আছে, আছে। আনন্দ মাথা নাড়ল। তারপর প্রায় বক্তৃতা দেবার ঢঙে বলল, তোমরা জানো এই গ্রামে কোন পালা এখন নেই। যিনি ছিলেন তিনি বরফের সময় মারা গিয়েছেন। কাহুন আছেন কিন্তু তিনি তো পালা নন। আসলে এখন আর আমাদের একজন পালার কোন দরকার নেই। কারণ একজন পালা যে সবসময় ঠিক কাজ করবেন তার কোন স্থিরতা নেই। পৃথিবীর যেসব দেশে সমস্ত মানুষের পরিশ্রম একসঙ্গে যোগ হয় তাদের দেশের জন্যে, যেখানে প্রতিটি মানুষ একটি পরিবারের সদস্য সেখানে কোন একজন পালা সবার মাথার ওপরে থাকে না। থাকা উচিত নয়। অথচ সব কাজ ভাল ভাবে দেখার জন্যে, সবাই যাতে ঠিকঠাক সুবিধে পায় তা খেয়াল রাখার ব্যবস্থা থাকা চাই। কেউ কোন অন্যায় করে অথবা কেউ বা কারা যদি এমন কাজ করে যা সমস্ত গ্রামের ক্ষতি ডেকে আনবে তার শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার। এই শাস্তি কারা দেবে? সবাই মিলে? না, কখনও নয়। এর জন্যে দরকার দশজন মানুষের একটা দল। যাদের ওপর সমস্ত গ্রামের দায়িত্ব থাকবে। আগে আমরা গ্রামের বাইরে যেতাম না। এখন যাচ্ছি। সেখানে যাতে ভাল ভাবে ব্যবসা করা যায় তার দায়িত্ব থাকবে এই দলের ওপর। কিসে গ্রামের মানুষের আরও ভাল করা যায় তা ওরা দেখবে। এই দলে কারা থাকবে তা ঠিক করবে তোমরা। আর সেই জন্যে এই জমায়েত। দল ঠিক হওয়ার পর তারাই বুঝে নেবে কে কোন্ দায়িত্ব নিতে চায়। তোমরা এবার নাম বল। যে নামগুলো বেশি মানুষ বলবে তারাই দলে থাকবে। আনন্দ কথা শেষ করামাত্র সব চুপচাপ হয়ে গেল। যেন বুঝে নিতে সময় লাগছে সবার।

কান মাথা নেড়ে মুখ ফেরালেন, আমি কি দলে থাকব?

আনন্দ বলল, নিশ্চয়ই থাকবেন, সবাই যদি দলে আপনাকে চায়।

কিছুক্ষণ কেটে গেল কিন্তু কেউ কোন কথা বলছে না। আনন্দর অস্বস্তি বাড়ছিল। কি ব্যাপার? ব্যবস্থাটা এদের মনঃপুত হচ্ছে না নাকি? এইসময় সে সুদীপকে এগিয়ে আসতে দেখল। ওপরে উঠে এসে সুদীপ বলল, অভ্যেস কখনও একদিনে তৈরি হয় না। উই শু্যড হেল্প দেম। সে চিৎকার করল, যারা এই দলে থাকতে চাও তারা ওপরে উঠে এস।
 
এবার নড়াচড়া শুরু হল। এ ওর দিকে তাকায়। কিন্তু উঠতে যেন সঙ্কোচ বোধ করছে সবাই। এইসময় সাওদের গুটি গুটি পায়ে ওপরে উঠে এল। তাকে দেখে লা-ছিরিঙ এগিয়ে গেল। এবং অমনি আরও পাঁচজন বিভিন্ন বয়সী মানুষ এগিয়ে এল। আনন্দ পালদেমকে ধরে নিয়ে গুনল, আটজন। সুদীপ হাঁকল, আরও দুজন চাই।

জনতার মধ্যে থেকে একজন চিৎকার করল, তোমরা দুজন তো আছ।

আনন্দ কিছু বলার আগেই সুদীপ জানাল, না, আমরা দলে থাকতে পারি না। আমরা বাইরের লোক। আমার নাম সুদীপ, ওর নাম আনন্দ, তোমাদের নামের সঙ্গেও মেলে না। এই গ্রামের মানুষের ভালমন্দ দেখাশোনা করবে গ্রামেরই মানুষ, বাইরের লোক নয়।

এইসময় কাহুন গিয়ে দাঁড়ালেন দলে। নজন হল। আর একজন চাই। হঠাৎ একটি মেয়ে বলল, দলে সব ছেলে থাকছে কেন? একজন মেয়ে চাই।

সুদীপ বলল, নিশ্চয়ই। মেয়েরা আগে আসছে না বলেই থাকছে না। দশ নম্বরের জন্যে তুমি এসো।

মেয়েটা মাথা নাড়ল, আমি কি কিছু জানি যে দলে যাব। দ্রিমিত কোথায়? দ্রিমিত যাবে। সঙ্গে সঙ্গে সম্মিলিত নারীকণ্ঠে ধ্বনিত হল, দ্রিমিত! দ্রিমিত! দ্রিমিত।

দুটি মধ্যবয়সিনী গিয়ে টানতে টানতে নিয়ে আসছিল জয়িতাকে। সুদীপ বাধা দিল, আরে ওকে আনছ কেন? ও তো আমাদের মতই বাইরের লোক!

যে মেয়েটা কথা বলছিল সে ফুঁসে উঠল, কে বলেছে বাইরের লোক? ওর নাম দ্রিমিত। দ্রিমিত আমাদের নাম। ওর পোশাক আমাদের পোশাক। তুমি নিজেকে এখনও বাইরের লোক ভাবতে পার কিন্তু দ্রিমিত তা ভাবে না। ওকে আমরা আমাদের লোক মনে করি।

কথাটার সমর্থন মিলল অনেক গলায়। সুদীপ কাঁধ নাচাল। ওরা ততক্ষণে জয়িতাকে ওপরে তুলে দিয়েছে। সুদীপ জয়িতার দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, চমৎকার! বলে নিচে নেমে পাথরে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল।

আনন্দ বলল, তাহলে এই দশজন আগামী বারোটা চাঁদ পর্যন্ত গ্রামের দায়িত্বে থাকবে। এই সময়ে যদি এরা ভাল কাজ করে তাহলে আবার দায়িত্ব পাবে। যদি কেউ খারাপ কিছু করে তাহলে গ্রামের সমস্ত মানুষ এক হয়ে তাকে দল থেকে সরিয়ে দেবে। তোমরা এ ব্যাপারে রাজী?

ঠিক কথা, ঠিক কথা। সবাই চেঁচিয়ে বলল।

আনন্দ এবার ঘোষণা করল, কে কোন্ দায়িত্ব নেবে তা এরা নিজেরা ঠিক করবে। এখন যে যার কাজে তোমরা যেতে পার।

জমায়েত যখন ভাঙব ভাঙব করছে উল্লসিত হয়ে তখন একজন, এক বৃদ্ধ, চিৎকার করল, সবাই বলছে তোমরা নাকি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে, কথাটা ঠিক?

কথাটা আনন্দর কানেও এসেছিল। সে মাথা নাড়ল, আমি জানি না।

বৃদ্ধ বলল, আমরা খুব খারাপ ছিলাম। তোমরা চলে গেলে আবার খারাপ থাকব।

আনন্দ প্রতিবাদ করল, কেন খারাপ থাকবে? তোমরা তো শিখে নিয়েছ ভালভাবে থাকতে গেলে কি কি করতে হয়। তোমাদের এই শেখাটা অনেক সভ্যদেশের মানুষ শিখতে পারেনি।
 
বৃদ্ধর কানে যেন কথাগুলো ঢুকল না, আগে কেউ গ্রামের বাইরে যেতে সাহস করত না, এখন যাচ্ছে। সেখানে অনেক ডাইনি ওৎ পেতে বসে আছে। তারা এদের যাদু করবে। তোমরা না থাকলে এরা গ্রামের কোন নিয়মকানুন মানবে না। তাছাড়া–।

আনন্দ দেখল বৃদ্ধ উদাস হয়ে তাকাচ্ছে আকাশের দিকে। সে জিজ্ঞাসা করল, তাছাড়া?

আমাদের বাপ মা যারা স্বর্গে গিয়েছে তারা আমাদের কিছু শেখায়নি। আমরাও এদের কিছু শেখাতে পারিনি। এরা, যেসব বাচ্চা এখন জন্মাচ্ছে তাদের কিছু না শিখিয়ে বড় করছে। আসলে আমরা কিছুই জানি না, শেখাতে পারব কি করে। আমরা যখন মরে যাব, এরা যখন মরে যাবে তখন একই অবস্থা চলবে। তোমবা থেকে গেলে এ অবস্থা চলতে পারত না।

আনন্দ কিছু বলার আগে পালদেম বলল, তাহলে এরা কি করে আমাদের বাচ্চাদের শেখাবে?

বৃদ্ধ জবাব দিল, কেউ রক্তের টানে শেখে, কেউ দেখে শেখে। ওরা চলে গেলে যারা আসবে তারা কিছুই শিখবে না। এখনও এই গ্রামের তিনটে পরিবার আলাদা রয়ে গেছে।

আনন্দ উৎসাহিত করল, তোমরা মিছিমিছি দুশ্চিন্তা করছ। আমরা যাচ্ছি না এখনই। তবে পুলিশ যদি আমাদের ধরে নিয়ে যায় তাহলে অন্য কথা।

বৃদ্ধ চিৎকার করল, পুলিশদের আমরা ঢুকতে দেব না।

প্রতিধ্বনিত হল অনেক গলা পাহাড়ে পাহাড়ে, দেব না, দেব না।

জমায়েত যখন ভেঙেছে, মানুষজন যখন চলে যাচ্ছে তখন আনন্দ এগিয়ে গেল জয়িতার দিকে, কনগ্রাচুলেশন জয়িতা।

জয়িতা মাথা নাড়ল, উঁহু, জয়িতা নয়, দ্রিমিত।

ও হ্যাঁ, দ্রিমিত। আনন্দ মাথা নেড়ে নিজেকে সংশোধন করল। এইসময় সেই মেয়েটা এসে দাঁড়াল সুদীপের পাশে। ও যে এতক্ষণ জমায়েতে ছিল তা কেউ লক্ষ্য করে নি। আনন্দ তখন পালদেমদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে নেমে গেছে।

জয়িতা গ্রামের তিনটে মেয়ের সঙ্গে গল্প করছে, হঠাৎ সুদীপ এগিয়ে এল তার সামনে, জয়িতা, তোর সঙ্গে আমার কথা আছে, এদিকে আয়।

জয়িতা ওর গলার স্বর শুনে চমকে তাকাল! অতান্ত রাগী দেখাচ্ছে সুদীপের মুখ। সে হাসবার চেষ্টা করল। জয়িতা এখন মরে গেছে সুদীপ, আমি দ্রিমিত।

এইসব ন্যাকামি রাখ। আই ওয়ান্ট টু আস্ক ইউ এ স্ট্রেট কোয়েশ্চেন!

বলে ফেল?

তোর শরীরে বাচ্চা আছে?

সঙ্গে সঙ্গে জয়িতা পাথর হয়ে গেল। তার রক্ত চলাচল যেন এক মুহূর্তের জন্যে বন্ধ হল। তারপরেই কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। সুদীপের গলার স্বর আর এক পর্দা উঠল, উত্তর দে। সরাসরি বল হ্যাঁ কি না?

সুদীপ কথা বলছিল বাংলায়। জয়িতা দুর্বল গলায় জবাব দিল, কি শুনলে খুশী হবি সুদীপ?

আমার খুশী অখুশীর ওপর কিছু নির্ভর করছে না।

তাহলে জিজ্ঞাসা করছিস কেন?

প্রয়োজন আছে। তোকে আমরা বন্ধু বলে মনে করতাম। আই ট্রিটেড ইউ অ্যাজ এ পাশন , তুই একটা মেয়ে এটা আমার মাথায় কখনও আসেনি। এবং তুই, তুই সবসময় নিজেকে তাই মনে করতিস। কিন্তু এই মেয়েটা বলছে তুই প্রেগন্যান্ট। এর আগেও ও আমাকে বলেছিল যেদিন তুই বমি করেছিলি। আমি বিশ্বাস করিনি। কিন্তু আজ ও বলছে তোর মধ্যে নাকি চিহ্ন দেখতে পাচ্ছে। আমি উত্তরটা চাই।

আমি বুঝতে পারছি না সুদীপ, এতে তোর উদ্বিগ্ন হবার কি আছে?

হু ইস দ্যাট ম্যান? সুদীপের চোয়াল শক্ত হল।

তুই তো বন্ধুর মত প্রশ্নটা করছিস না সুদীপ। তোর মুখ এখন কি হিংস্র হয়ে উঠেছে, অতএব আমি তোর কোন প্রশ্নের উত্তর দেব না। জয়িতা খুব শান্ত গলায় শব্দগুলো উচ্চারণ করল।

সুদীপ মুখ ফেরাল নিচের দিকে। তারপর বিড় বিড় করল, আই নো হিম।
 
জয়িতা এবার হেসে উঠল, মিছিমিছি এ ব্যাপারে তুই উদ্বিগ্ন হচ্ছিস। এটা এখন সম্পূর্ণ মেয়েলি ব্যাপার, মেয়েদের কিছু নিজস্ব ব্যাপার থাকে যেখানে তারা একেবারে অবাঞ্ছিত।

হঠাৎ সুদীপ চিৎকার করে উঠল বিশ্রী ভঙ্গিতে, বাদ দে! আমার সব জানা হয়ে গেছে।

কি জেনেছিস তুই?

চিৎকারটা করেই সম্ভবত সুদীপ চেতনায় এসেছিল। এবং এখন তার মধ্যে হতাশা স্পষ্ট হল। দুহাতে মাথা চেপে ধরে সে বলল, তোকে আমি এতদিন অন্যচোখে দেখে এসেছিলাম। কলকাতায় তুই কি ছিলি ভেবে দ্যাখ। মেয়েলি যে কোন ব্যাপার তুই ঘেন্না করতিস।

ঘেন্না? জয়িতা ওর কাছে এগিয়ে এল, সুদীপ, তোকে আমাদের ঘেন্না করা উচিত নয়?

আমাকে? হোয়াই? চোখ বড় হয়ে উঠল সুদীপের।

এতদিন তুই কি করছিস? একটা মেয়ের হ্যাংলামির সুযোগ নিচ্ছিস। ওকে বিয়ে করার কথা চিন্তাও করছিস না। বরং কি করে এখান থেকে চলে যাওয়া যায় তার ফন্দি ভাবছিস। কলকাতায় থাকলে তুই এই কাজটা করতে পারতিস?

চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সুদীপ। তারপর হাত নেড়ে মেয়েটিকে কাছে ডাকল। এখন নিতান্ত অনিচ্ছায় মেয়েটি সামনে এসে দাঁড়াল। সুদীপ তাকে জিজ্ঞাসা করল ওর ভাষায়, আমার বিরুদ্ধে তোর কোন নালিশ আছে?

সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, সেটা কি এখানে বল।

মেয়েটা এবার কেঁদে ফেলল দুহাতে মুখ ঢেকে। সুদীপ ওর কাঁধে হাত রাখল, ঠিক আছে, বল।

মেয়েটা এবার কোনমতে বলতে পারল, ও আমার সঙ্গে একদিনও শোয়নি। আমি অনেক চেষ্টা করেও পারিনি। বললেই বলে বন্ধুর সঙ্গে বন্ধু শোয় না। যদি কখনও আমাকে বিয়ে করে তবেই শোবে। আমাকে মেয়ে বলে যেন মনেই করে না ও। কথাগুলোর সঙ্গে কান্না জড়ানো ছিল। সবাই অবাক হয়ে মেয়েটিকে দেখছিল।

সুদীপ এবার জয়িতার দিকে তাকাল, পরে কথা হবে তোর সঙ্গে। বলে দৌড়ে নিচে নেমে গেল।

তার শরীর তরতর করে নিচে নামছিল। জয়িতা স্তব্ধ হয়ে ওর যাওয়া দেখছিল। এতক্ষণ যে নাটক এখানে চলছিল তার দর্শকরা ব্যাপারটা সম্পর্কে ধন্দে ছিল যেহেতু সংলাপ ছিল বাঙলা-ইংরেজিতে মেশানো। তবে ব্যাপারটা যে মারাত্মক পর্যায়ে গিয়েছে তাতে কারও সন্দেহ ছিল না। বিশেষ করে শেষ হল যখন মেয়েটির জবানবন্দীতে তখন তো বটেই। জয়িতা ওর আগে পাশের মেয়েদের দিকে তাকাল। সহজ সরল ঢলঢল মুখের মেয়েগুলোর নাম একই ধরনের রোমিত, ইনামিত, পাশাংকিত, পরমিত। এবার যে মেয়েটির নাম ইনামিত সে প্রশ্ন করল, কি হয়েছে? ও ওরকম রেগে গিয়েছিল কেন?

জয়িতা আবার বিন্দুতে মিলিয়ে আসা সুদীপকে দেখল। সুদীপ কোথায় যাচ্ছে? এইসময় কান্না থামিয়ে সুদীপের বান্ধবী চিৎকার করে উঠল, দ্রিমিতের পেটে বাচ্চা এসেছে!

সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসের শব্দ ছিটকে উঠল মুখগুলো থেকে। মেয়েরা উৎসাহে জয়িতাকে জড়িয়ে ধবল। ওরা এমন করছে যেন খুব বড় প্রাপ্তির খবর পেয়ে গেছে। এবং এই প্রথম অন্যধরনের লজ্জায় আক্রান্ত হল জয়িতা। সেই চিৎকার শুনে কাহুন নেমে এলেন মন্দির থেকে। মেয়েরা ছুটে গেল তার কাছে, দ্রিমিতের পেটে বাচ্চা এসেছে।


লোকটির মুখ দেখে মন বোঝা দায়। কিন্তু কথাটা শোনামাত্র একটা হাত প্রসারিত হল তাঁর। যেন আশীর্বাদ করছেন কথাটা শোনামাত্র। পরমিত জয়িতাকে ইঙ্গিত করল বসার জন্যে। নিতান্ত অনিচ্ছায় হাঁটু গেড়ে বসল সে। মাথার ওপর অনর্গল অবোধ্য মন্ত্র বর্ষিত হতে লাগল। এরপর সবাই মিলে ওকে তুলে ধরতেই কাহুন জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি তো বিবাহিত নও, অতএব তোমার ভাবী স্বামী কে? বিয়ের আয়োজন করতে হবে।

নাম বলাটা কি খুব জরুরী?

নিশ্চয়ই। কুমারী মেয়ের পেটে বাচ্চা এলে তার একটা পরিচয়ের ব্যবস্থা করাই নিয়ম।

আমি যদি না বলি।

তাহলে তোমাকে এই গ্রাম ছেড়ে যেতে হবে। শুধু তোমার ক্ষেত্রে নয়, এই গ্রামের যে কেউ এমন করলে একই শাস্তি দেওয়া হবে। পুরুষ হলে তা আরও ভয়ানক হত।

সেই বিচার কি আপনিই করবেন কাহুন?

যতদিন তাপল্যাঙের মানুষ আমাকে কাহুন বলে স্বীকার করবে ততদিন অবশ্যই আমি করব। তবে আজ দশজনের দল তৈরি হয়েছে, তাদের কথাও শুনতে হবে। কিন্তু ধর্মের সঙ্গে তোমাদের বন্ধুত্বের কোন সম্পর্ক নেই। কাহুন নির্লিপ্ত গলায় জানালেন।

জয়িতা মাথা নাড়ল। বন্দুক—এরা কেউ জানে না সমস্ত গুলিগুলো এখন অকেজো, আর এই গ্রামের মানুষদের দিকে বন্দুকের নল তোলা মানে নিজের গলায় ঠেকানো। সে কলল, আমাকে একটু সময় দিন কাহুন।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top