সকালবেলা বলেই বোধ হয় ট্যাকসিওয়ালা ঠাকুরপুকুরে যেতে আপত্তি করল না। গলিটার মোড়ে এসে ওরা গাড়িটাকে ছেড়ে দিল। কয়েক মিনিট ভেতরে ঢোকার পর জায়গাটা বেশ ফাঁকা হয়ে এল। এ দিকটায় প্রচুর গাছগাছালি, দুতিনটে পুকুর চোখে পড়ল। গলিটার মধ্যে দুটো মুদীর দোকান, একটা কয়লার এবং রেশনের। সুদীপের আত্মীয়ের বাড়িটিতে ঢোকার পথ দুটো। একটা ভাড়াটেরা ব্যবহার করেন, অন্যটায় সব সময় হুড়কো লাগানো থাকে। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা সেই অংশে উঠোন আছে, উঠোনের ওপর ঝাঁপড়া কাঁঠালগাছ। এখন দশটা বেজে গেছে। রোদ কড়া হয়েছে। একগাদা বাচ্চা তারস্বরে চিৎকার করছে বাড়িটার সামনে মার্বেল নিয়ে। সুদীপ বন্ধ দরজায় শব্দ করল। সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাদের চিৎকার থেমে গেল। ওরা যেন এখনই কিছু ঘটবে এমন আশায় চেয়ে রইল সুদীপদের দিকে। সুদীপ সেটা লক্ষ্য করে বলল, কেসটা কি? এই খোকা, কি হয়েছে?
ওদের মধ্যে একটি ছেলে জবাব দিল, বুড়ি এবার খিস্তি করবে। আমরা দরজায় ধাক্কা দিলেই করে।
সুদীপ আনন্দর দিকে তাকিয়ে বলল, শুনলি! হার্ডলি আট দশ বছর বয়স কিন্তু কি স্বচ্ছন্দে খিস্তি শব্দটা উচ্চারণ করল! টেনে চড় মারব?
না। এখানে কোন ঝামেলা করব না আমরা। এমনিতেই ছেলেগুলোর নজরে পড়ে গেছি। টোটাল অবক্ষয়ের শিকার এরা। এই দেশের পরবর্তী প্রজন্ম। হয়তো যাকে চড় মারতে চাইলি সে-ই একদিন পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী হবে। আর তখন খিস্তিটাই স্বাভাবিক ভাষা হবে। এককালে শালা শব্দটা বড়দের সামনে উচ্চারণ করা অপরাধ ছিল, এখন তো স্বাভাবিক। আনন্দ আবার দরজায় শব্দ করল।
আবার, আবার হাড়হাবাতের দল, গুখেগোর দল আমাকে জ্বালাচ্ছিস! তোদের মরণ হয় না? বাপ মা তোদের পৃথিবীতে আনল কেন? আমায় একটুও শান্তিতে থাকতে দেবে না গো! দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা—। দরজাটা খুলে গেল। আনন্দ বৃদ্ধাকে দেখল। খালি গা, থানকাপড়টি শরীরে জড়ানো। মুখের চামড়ায় অজস্র ভাজ। চুল ছেলেদের মত করেই কাটা। হাতে একটা ঝটা। তিনি অবশ্য থমকে দাঁড়ালেন। ক্রোধের বদলে বিস্ময় ফুটল মুখে। সুদীপ হাসল, আমরা এসে গেছি।
অবনীর ছেলে না? অ! আমি ভাবলাম–! জ্বলন্ত চোখে বৃদ্ধা দূরে দাঁড়ানো ছেলেগুলোর দিকে তাকালেন একবার। তারপর একটু সরে দাঁড়িয়ে বললেন, এসো। দরজা বন্ধ করতে হবে।
ওরা ভেতরে ঢুকতেই আবার বাচ্চাদের চিৎকার শুরু হল। দরজা বন্ধ করে বৃদ্ধা বললেন, বুঝতে পেরেছি, অবনীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। কিন্তু সেই অভাগীর কি দোষ? তাকে ছেড়ে এলে কেন?
মা নেই। সুদীপ খুব আস্তে শব্দ দুটো উচ্চারণ করল।
নেই? থমকে গেলেন বৃদ্ধা, কবে গেল? বেঁচে গেল। ভগবান এখনও মাথার ওপরে আছেন। তা অবনী তার কাজটাজ করেছে তো? এসেছ ভালই করেছ। সঙ্গে এটি কাকে জুটিয়েছ? দ্যাখো, আমি চিৎকার চেঁচামেচি একদম সহ্য করতে পারি না। কদিন থাকবে?
আসতে না আসতেই বিদায় করতে চাইছ! এই সেদিন এলাম তখন বললে কোন আপত্তি নেই।
আমি কি তাই বলেছি। যদ্দিন থাকবে থাকো কিন্তু তোমাদের খাটনের কি হবে? আমি বাবা রাত্রে চোখে দেখি না, মাছ মাংসের গন্ধ সহ্য করতে পারি না। তারপরে ও-পাশের যে ভাড়াটে কলেজে পড়াতো তার স্ট্রোক না কি বলে তাই হয়েছে। গত মাসের ভাড়া দেয়নি। আমার তো ওইটুকু সম্বল। দু-একদিন হলে ঠিক আছে, বেশিদিন আমি তোমাদের জন্যে হেঁসেল ঠেলতে পারব না।
বৃদ্ধার মাথাটা সবেগে দুলতে লাগল।
সুদীপ বলল, তোমাকে আমাদের জন্যে কিছুই করতে হবে না। আমার এই বন্ধু কবি। একটু নিরিবিলিতে কবিতা লিখতে চায় যেখানে কেউ ওকে বিরক্ত করবে না। তাই এখানে নিয়ে এলাম। খাবার-দাবারের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নেব। তুমি শুধু দেখো তোমার ভাড়াটেরা যেন ওপরে না যায়। কবিতা লেখা খুব সাধনার ব্যাপার তো!
কবিতা। তুমি কবিতা লেখো? বৃদ্ধা আনন্দর দিকে তাকাল, আমার কর্তা এককালে কবিতা লিখত! না, কেউ এ বাড়িতে ঢুকবে না। ভাড়াটেরা এদিকে আসে না, আসা নিষেধ। আর যত ধান্দাবাজ আত্মীয়দের বলে দিয়েছি মরে গেলে এই বাড়ি রামকৃষ্ণদেবের আশ্রমে যাবে। কেউ ভাগ পাবে না। যাও ওপরে চলে যাও। বিছানাপত্র নেই কিন্তু। সতরঞ্চি আছে। তোমাদের সঙ্গে কথা বলার সময় নেই আমার।
ওদের মধ্যে একটি ছেলে জবাব দিল, বুড়ি এবার খিস্তি করবে। আমরা দরজায় ধাক্কা দিলেই করে।
সুদীপ আনন্দর দিকে তাকিয়ে বলল, শুনলি! হার্ডলি আট দশ বছর বয়স কিন্তু কি স্বচ্ছন্দে খিস্তি শব্দটা উচ্চারণ করল! টেনে চড় মারব?
না। এখানে কোন ঝামেলা করব না আমরা। এমনিতেই ছেলেগুলোর নজরে পড়ে গেছি। টোটাল অবক্ষয়ের শিকার এরা। এই দেশের পরবর্তী প্রজন্ম। হয়তো যাকে চড় মারতে চাইলি সে-ই একদিন পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী হবে। আর তখন খিস্তিটাই স্বাভাবিক ভাষা হবে। এককালে শালা শব্দটা বড়দের সামনে উচ্চারণ করা অপরাধ ছিল, এখন তো স্বাভাবিক। আনন্দ আবার দরজায় শব্দ করল।
আবার, আবার হাড়হাবাতের দল, গুখেগোর দল আমাকে জ্বালাচ্ছিস! তোদের মরণ হয় না? বাপ মা তোদের পৃথিবীতে আনল কেন? আমায় একটুও শান্তিতে থাকতে দেবে না গো! দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা—। দরজাটা খুলে গেল। আনন্দ বৃদ্ধাকে দেখল। খালি গা, থানকাপড়টি শরীরে জড়ানো। মুখের চামড়ায় অজস্র ভাজ। চুল ছেলেদের মত করেই কাটা। হাতে একটা ঝটা। তিনি অবশ্য থমকে দাঁড়ালেন। ক্রোধের বদলে বিস্ময় ফুটল মুখে। সুদীপ হাসল, আমরা এসে গেছি।
অবনীর ছেলে না? অ! আমি ভাবলাম–! জ্বলন্ত চোখে বৃদ্ধা দূরে দাঁড়ানো ছেলেগুলোর দিকে তাকালেন একবার। তারপর একটু সরে দাঁড়িয়ে বললেন, এসো। দরজা বন্ধ করতে হবে।
ওরা ভেতরে ঢুকতেই আবার বাচ্চাদের চিৎকার শুরু হল। দরজা বন্ধ করে বৃদ্ধা বললেন, বুঝতে পেরেছি, অবনীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। কিন্তু সেই অভাগীর কি দোষ? তাকে ছেড়ে এলে কেন?
মা নেই। সুদীপ খুব আস্তে শব্দ দুটো উচ্চারণ করল।
নেই? থমকে গেলেন বৃদ্ধা, কবে গেল? বেঁচে গেল। ভগবান এখনও মাথার ওপরে আছেন। তা অবনী তার কাজটাজ করেছে তো? এসেছ ভালই করেছ। সঙ্গে এটি কাকে জুটিয়েছ? দ্যাখো, আমি চিৎকার চেঁচামেচি একদম সহ্য করতে পারি না। কদিন থাকবে?
আসতে না আসতেই বিদায় করতে চাইছ! এই সেদিন এলাম তখন বললে কোন আপত্তি নেই।
আমি কি তাই বলেছি। যদ্দিন থাকবে থাকো কিন্তু তোমাদের খাটনের কি হবে? আমি বাবা রাত্রে চোখে দেখি না, মাছ মাংসের গন্ধ সহ্য করতে পারি না। তারপরে ও-পাশের যে ভাড়াটে কলেজে পড়াতো তার স্ট্রোক না কি বলে তাই হয়েছে। গত মাসের ভাড়া দেয়নি। আমার তো ওইটুকু সম্বল। দু-একদিন হলে ঠিক আছে, বেশিদিন আমি তোমাদের জন্যে হেঁসেল ঠেলতে পারব না।
বৃদ্ধার মাথাটা সবেগে দুলতে লাগল।
সুদীপ বলল, তোমাকে আমাদের জন্যে কিছুই করতে হবে না। আমার এই বন্ধু কবি। একটু নিরিবিলিতে কবিতা লিখতে চায় যেখানে কেউ ওকে বিরক্ত করবে না। তাই এখানে নিয়ে এলাম। খাবার-দাবারের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নেব। তুমি শুধু দেখো তোমার ভাড়াটেরা যেন ওপরে না যায়। কবিতা লেখা খুব সাধনার ব্যাপার তো!
কবিতা। তুমি কবিতা লেখো? বৃদ্ধা আনন্দর দিকে তাকাল, আমার কর্তা এককালে কবিতা লিখত! না, কেউ এ বাড়িতে ঢুকবে না। ভাড়াটেরা এদিকে আসে না, আসা নিষেধ। আর যত ধান্দাবাজ আত্মীয়দের বলে দিয়েছি মরে গেলে এই বাড়ি রামকৃষ্ণদেবের আশ্রমে যাবে। কেউ ভাগ পাবে না। যাও ওপরে চলে যাও। বিছানাপত্র নেই কিন্তু। সতরঞ্চি আছে। তোমাদের সঙ্গে কথা বলার সময় নেই আমার।