What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected গর্ভধারিণী - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

জয়িতাকে অনুসরণ করে আনন্দ হলঘরটায় এল। রামানন্দ রায় এখানে নেই। শূন্য ঘরটায় আলো জ্বলছে। টেলিফোনের পাশের চেয়ারটায় বসে আনন্দ সর্বাধিক প্রচারিত কাগজটির নাম্বার গাইড থেকে খুঁজে বার করে জয়িতাকে বলল, বাকি তিনটে কাগজের নাম্বার বের করে রাখ।

জয়িতা আবার হাসল, গড়িয়াহাটার টেলিফোনটা পেয়ে কাজ হত না। তুই সেখানে গাইড পেতিস। তোর উচিত ছিল আগে থেকে নাম্বারটা নোট করে রাখা।

কলকাতায় রাত্রে সবকিছু ঠিকঠাক থাকে। একবারেই লাইন পেয়ে গেল। ওপাশ থেকে হ্যালো শুনে আনন্দ বলল, আমি একটা জরুরি খবর দেব। দায়িত্ববান কেউ কিংবা নিউজ এডিটার আছেন?

আপনি কে বলছেন?

আমার পরিচয় পরে দিচ্ছি, আপনি কে?

আমি এই কাগজের রিপোর্টার। নাইট ডিউটিতে আছি। বলতে পারেন যা বলবার।

শুনুন, খানিক আগে বড়বাজারের সত্যনারায়ণ পার্কের পাশে মোহনলালজীর বিরাট ওষুধের কারখানা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ওটাতে আগুন লেগেছে। মোহনলাল দুটো জাল ওষুধের কারবার করতেন। যার একটা খেলে ক্ষতি হত না কাজও দিত না। দুটো খেলে প্রাণহানির সম্ভাবনা থাকত। আমরা মনে করেছি এই ধরনের মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। মোহনলাল অক্ষত আছেন, তার নিরীহ কর্মচারীরাও সম্ভব–, কিন্তু কারখানা ধসে গেছে।

আপনারা কারা?

আমরাই ডায়মন্ডহারবার রোডে প্যারাডাইস ধ্বংস করেছি। আইনের ফাঁক ব্যবহার করে যারা সাধারণ মানুষের সর্বনাশ করছে তাদের আমরা একে একে ধ্বংস করব। মোহনলালের জাল ওষুধ স্টক করা আছে ব্র্যাবোর্ন রোডের এস পি অ্যান্ড কোম্পানির স্টোর রুমে। ওখান থেকে ওটা সরিয়ে নেওয়ার আগেই আপনারা খবর নিন। আপনাদের কাগজের মাধ্যমে আমরা সেইসব মানুষকে সতর্ক করে দিচ্ছি, যাতে তারা হাত পোটায়, নইলে একটির পর একটি এই ধরনের অ্যাকশন নেব আমরা। আমরা চাই একটি সুষম সমাজব্যবস্থা। বর্তমান সংবিধানের আশ্রয়ে তা সম্ভব নয়। এই সব কাজগুলো সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করুক এটাই কাম্য।

রিসিভার নামিয়ে রেখে পর পর তিনটি কাগজে একই কথা বলল আনন্দ। শেষের কাগজের এডিটার স্বয়ং ফোন ধরেছিলেন। রাজনৈতিক রচনা লিখে তিনি খুব জনপ্রিয়। ফোন নামাবার আগে প্রশ্ন করলেন, আপনারা কি নকশালপন্থী?

আনন্দ বলল, না। আমাদের আগে কেউ এই পথে হাঁটেননি।

এডিটার প্রশ্ন করলেন, আপনাদের নেক্সট অ্যাকশন জানতে পারি?

রেসকোর্স। রিসিভার নামিয়ে রেখে আনন্দ বলল, এক গ্লাস জল খাওয়াবি জয়?

জয়িতা চাপা গলায় বলল, তোর কি মাথাখারাপ হয়ে গেছে? রেসকোর্সের কথাটা বলে দিলি? আনন্দ উঠে সুদীপদের ঘরের দিকে এগোতে এগোতে বলল, রবীনহুডের মত কায়দা আর কি। না , আমাদের সেই রঘু ডাকাতই তো এমন করত। আমরা এই মুহূর্তে রেসকোর্সকে কিছু করতে পারব। যত সহজে দুটো কাজ করেছি রেসকোর্সে তা সম্ভব হবে না। কাগজে যদি বের হয় খবরটা তাহলে তার নিশ্চয়ই প্রতিক্রিয়া হবে, সেটাই দেখার।

জল খেয়ে আনন্দ বন্ধুদের কাছে ফোনের কথা বলল। অন্তত কাল সকালে কাউকে আর অনুমানের মধ্যে থাকতে হবে না, কে বা কারা কেন এই কাজ করল। জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট বোঝা যাবে। রেসকোর্সের ব্যাপারটা সে খুলে বলল। সরকারের প্রত্যক্ষ মদত পাচ্ছেন রেসকোর্সের কর্মকর্তারা। কারণ প্রচুর ট্যাক্স আসছে ওখান থেকে। বোমা বা গ্রেনেড ছুঁড়ে রেসকোর্স উড়িয়ে দিলে কোন কাজ হবে না। আস্তাবল থেকে যে ঘোড়াগুলো রেস করতে মাঠে আসে তাদের ক্ষতি করে কি লাভ! কিন্তু একটা ভয়ের আবহাওয়া তৈরি করতে হবে। প্রথমেই তার শিকার হবে দামী ঘোড়ার মালিকরা। তারা যদি এখান থেকে বোড়া বোম্বে ব্যাঙ্গালোরে নিয়ে যায় তাহলে এখানকার রেসে ভিড় কমবে।

সুদীপ বলল, তাতে আমাদের কোন লাভ হচ্ছে না। শুনেছি বোম্বেতে ঘোড়া ছুটছে আর কলকাতা রেসকোর্সে তার রিলে শুনে লোকে টাকা লাগাচ্ছে। লাগাতার একটা প্যানিক তৈরি করতে পারলে ওখানকার ভিড় কমবে। কিন্তু কলকাতা না, হয় বন্ধ হল, বোষে-মাদ্রাজ-ব্যাঙ্গালোরে তো চলবে!

আনন্দ মাথা নাড়ল, কলকাতায় আমাদের দৃষ্টান্ত অন্যান্য শহরের ছেলেদের উদ্বুদ্ধ করবে, দেখিস।
 
কল্যাণ চোখ বন্ধ করে পড়েছিল। মাঝে মাঝে যন্ত্রণাটা যে পাক দিয়ে উঠছে তা ওকে দেখে বোঝ যাচ্ছিল। একটু সামলে নিয়ে সে বলল, কলকাতার রেস যদি ভয়ে বন্ধও হয়, পাড়ায় পাড়ায় যে স্লিপ খেলা চলে তা কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। সেটা বন্ধ করবি কি করে?

আনন্দ বলল, সেটা সরকারই বন্ধ করবে। কারণ তা থেকে কোন ট্যাক্স পাবে না।

জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, তুই তাহলে সরকারের ওপর এখনও আস্থা রাখিস, সিনেমা হলে যে টিকিট ব্ল্যাক হয় তা থেকে তো সরকার একটা পয়সাও ট্যাক্স পায় না, বন্ধ করছে?

কল্যাণ কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় বাইরে থেকে রামানন্দ রায়ের গলা শোনা গেল, জয়!

জয়িতা বন্ধুদের দিকে তাকাল। সুদীপ বলল, তুই ওঁকে এখানেই আসতে বল্ না।

জয়িতা মুখ ফেরাল, কেন?

সুদীপ কাঁধ ঝাঁকাল, উই ক্যান হেল্প ইউ। ঠিক মাঝরাত্তিরে লাগে ঘোর চিত্তিরে, কি বলতে কি বলে ফেলবি তার কোন ঠিক নেই। সবাই মিলে ম্যানেজ করব এই শেলটারটার জন্যে।

জয়িতা আনন্দকে বলল, আমি একথার প্রটেস্ট করছি। এতে আমার ওপর অনাস্থা প্রকাশ পাচ্ছে। ওয়েল, আমি বাবাকে ডাকছি। জয়িতা দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল, ডাকছ?

রামানন্দ রায় শান্ত গলায় বললেন, তুমি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাও?

হ্যাঁ। এই ঘরে এসো। জয়িতা সরে দাঁড়াল। রামানন্দ বিস্মিত হলেন। তারপর ধীরপায়ে ভেতরে ঢুকলেন। তিনজনেই ওঁর দিকে কিছুটা সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে তাকাল। জয়িতা পরিচয় করিয়ে দিল, সুদীপকে তুমি দেখেছ, এ হল কল্যাণ আর ও আনন্দ।

আনন্দ ঠিক বুঝতে পারছিল না এই লোকটিকে উঠে দাঁড়িয়ে কতটা সম্ভম জানানো যায়। কিন্তু রামানন্দ রায় কোনদিকেই তাকাচ্ছিলেন না। তাকে বেশ চিন্তিত এবং কাহিল দেখাচ্ছিল। আনন্দ বলল, বসুন। সে উঠে সুদীপের পাশে বসে জায়গা খালি করে দিল।

রামানন্দ রায় বসলেন না। বললেন, কিছু মনে করো না, এত রাত্রে তোমরা যেভাবে ঘোরাফেরা করছ তাতে সন্দেহ হচ্ছে এমন কোন কাজ করছ যা খুব স্বাভাবিক নয়। আমি কোন মন্তব্য করছি না, কিন্তু জয়, তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি, যা করছ তা কি ঠিক মনে করছ?

নিশ্চয়ই। জয়িতা খুব দৃঢ়তার সঙ্গে জবাব দিল।

রামানন্দ রায় চোখ তুলে মেয়ের দিকে তাকাতেই কল্যাণকে দেখতে পেলেন। সেই মুহূর্তে আর একটা যন্ত্রণার ঢেউ পাক খেয়ে ওর হাত থেকে শরীরে গড়াচ্ছিল। দাঁতে দাঁত চেপে সামলাচ্ছিল সে। তিনি দ্রুত কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে তোমার?

সেই অবস্থায় কল্যাণ একটু জোরে মাথা নাড়ল, কিছু না, কিছু হয়নি।

সুদীপ আনন্দর দিকে তাকাল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, একটু আগে ও আছাড় খেয়ে পড়ে গিয়েছিল। সিরিয়াস কিছু নয় বলে মনে হচ্ছে।

তুমি কি ডাক্তার? রামানন্দ রায় ধমকে উঠলেন, ও তো হাতটা নাড়তেই পারছে না! দেখি ঠিক কোন্‌খানে ব্যথা? জখম হাতটা ধরতেই ককিয়ে উঠল কল্যাণ। ভয় পেয়ে হাত ছেড়ে দিলেন রামানন্দ।

সুদীপ মন্তব্য না করে পারল না, আপনিও ডাক্তার নন।

সেটা আমি জানি। কিন্তু এই ছেলেটিকে এইভাবে রেখে দিয়েছ তোমরা? ওর হাতের হাড় ভেঙেছে বলে সন্দেহ হচ্ছে আমার। ইমিডিয়েটলি ডাক্তার ডাকা দরকার। কটা বাজে এখন? ওহহো, রাত দুটো বেজে গেছে! কাকে ডাকা যায়? নিজের সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি।

এবার আনন্দ বলল, এখন বোধ হয় কাউকে না ডাকাই উচিত। আপনার কাছে ঘুমের ওষুধ আছে? ও যদি ঘুমোতে পারে তাহলে সকালবেলায় আমি হাসপাতালে নিয়ে যাব।
 
রামানন্দ রায় কথা না বলে সোজা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। সুদীপ জয়িতাকে বলল, দ্যাখ উনি কোন ডাক্তারকে ফোন করছেন কিনা। ডাক্তার এসে যদি আমাদের ওর সঙ্গে দেখে, তাহলে কাল সকালে কাগজ পড়ার পর দুই-এ দুই-এ চার করতে দেরি হবে না। আচ্ছা লোক।

জয়িতাকে একটু অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। সে বলল, তোদের হয়তো খারাপ লাগছে কিন্তু আমি খুশি। মানুষটা যে এত গুরুত্ব দিয়ে ব্যাপারটা দেখবেন তা কল্পনা করিনি। কখনও কেউ যখন কারও জন্যে কেয়ার নেয় তখন আমার ঈর্ষা হয়। আজ সেটা একটুও হচ্ছে না। ওই মানুষটি এভরিথিং অলরাইট ছাড়া কখনও আমার মনের কথা জানতে চাননি।

এমন একটা বিষণ্ণ সুর ছিল যে সুদীপ পর্যন্ত চুপ করে গেল। এই সময় রামানন্দ ফিরে এলেন, জয়, ওকে এক গ্লাস জল দাও। এই ট্যাবলেট দুটো খেয়ে নাও তুমি। পেনকিলার, ঘুমিয়ে পড়বে?

ট্যাবলেট! কল্যাণ আনন্দর দিকে তাকাল। তারপর বলল, আমাকে একটা ট্যাবলেট দিন।

কেন? দুটো খেলে সকালের আগে ব্যথাটা টের পাবে না—দুটোই খেয়ে নাও।

না, আমি কোন রিস্ক নেব না।

রিস্ক? এতে রিস্কের কি আছে। রামানন্দ বুঝতে পারছিলেন না।

আনন্দর হাসি পাচ্ছিল। কিন্তু এখন কিছু বলা ঠিক হবে না। কল্যাণের মত শিক্ষিত ছেলেও ওই ব্যাপারটা জানার পর থেকে যে কোন সরষের মধ্যেই ভূত দেখছে। জয়িতা কল্যাণকে একটি ট্যাবলেট খাইয়ে দিল। রামানন্দ রায় মাথা নাড়লেন, মনে হয় কোন কাজ হবে না। এরকম কথা কখনও শুনিনি, দুটো ট্যাবলেট খাওয়া মানে রিস্ক!

খালি সোফাটায় বসলেন রামানন্দ। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, জয়, তোমার কিছু বলার আছে?

জয়িতা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

এখন কেউ কোন শব্দ করছে না। অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ঘরে। রামানন্দ রায় মুখ তুলছিলেন না।

শেষ পর্যন্ত জয়িতা বলল, তুমি কি আমার কাছ থেকে কিছু আশা কর?

আমি রামানন্দ রায় মেয়ের দিকে তাকালেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, তুমি ভাল থাক, এইটুকু।

তুমি কি মনে কর ভারতবর্ষের এই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, এবং সামাজিক অবস্থায় কেউ ভাল আছে? যারা বলে আছে তারা চোখ বন্ধ করে ভাল থাকার ভান করে রয়েছে। বাবা, আমার পক্ষে চিরায়ত নিয়মগুলো মেনে জীবনযাপন করা সম্ভব নয়। সুতরাং আমি হয়তো, হয়তো কেন, নিশ্চয়ই যে কোন দিন এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারি। ডোন্ট আস্ক মি কোথায় যাচ্ছি। শুধু জেনো আমরা একটা কাজ করতে চাইছি, যা কেউ করে না। আমরা মানুষের বিবেকের অটল পাথরটাকে নাড়াতে চাইছি। প্রতিবাদ করলে, এক সময় সেই ভাষাটা সাধারণ মানুষের রপ্ত হয়ে গেলে, এই গণতন্ত্রের সুবিধেভোগী শক্তিগুলো ভয় পাবে বলে বিশ্বাস করি। না, কোন রাজনৈতিক দলের কার্যসূচী আমরা অনুসরণ করছি না। পণ্ডিতরা আমাদের আচরণকে পাগলামো বলবেন, ছেলেমানুষী কিংবা অশিক্ষাপ্রসূত বলে উড়িয়ে দেবেন। অনেক তো দেখলাম। বিখ্যাত বিখ্যাত তত্ত্ববিদ অনেক থিয়োরি শুনিয়েছেন, ময়দানের বক্তৃতায়, পার্টির বুলেটিনে কিংবা সাপ্তাহিকের পাতায়। আর এইসব শুনিয়েই তারা বৃদ্ধ হয়ে মরে যাবেন। ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ যেখানে ছিল সেখানেই থাকবে। এই থিয়োরির ভাষা ওদের অজানা থাকবেই। কিন্তু ওরা চোখের সামনে দেখবে এই লোকগুলো অন্যায় করছিল, শাসকদলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শোষণ করছিল আর কয়েকটা ছেলেমেয়ে সরাসরি তাদের আঘাত করছে। এই আঘাত করা যায়। নকশালবাড়ির আন্দোলনের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু তাদের পথ আমরা মানি না। আমাদের দুর্ভাগ্য যে ভারতবর্ষ আজ ব্রিটিশ রাশিয়া কিংবা আমেরিকার পরাধীন নয়। তাহলে দ্রুত আগুন জ্বলত। প্রতিটি মানুষের বুক ভিয়েৎনাম হয়ে যেত। আমাদের প্রতিপক্ষ যেহেতু আমরা তাই সময় লাগছে। আমরা কি করে ভাল থাকব, বল? জয়িতা বড় বড় নিঃশ্বাস নিল।
 
আনন্দ অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। জয়িতা যে এইভাবে মুখের ওপরে কথাগুলো বলতে পারবে তা সে ভাবতে পারেনি। সুদীপ খুব অস্বস্তি বোধ করছিল। উত্তেজিত হয়ে জয়িতা যে ভঙ্গিতে কথা বলছে। তা তার মোটেই ভাল লাগছে না। এই লোকটির কাছে সব কথা ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখনও কেউ কোন কথা বলল না। কল্যাণ চোখ বন্ধ করে সোফায় হেলান দিয়ে পড়ে ছিল, একইভাবে থাকলে বোধ হয় তার যন্ত্রণা কম হচ্ছিল। রামানন্দ পূর্ণ দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, আমি দুঃখিত। আমি তোমার বন্ধুদের সঙ্গে জড়িয়ে তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম। আমার সম্পর্কে তোমার বক্তব্য?

জয়িতা এক মুহূর্তের দ্বিধা কাটিয়ে উঠল, আমি তোমাকে আর মাকে একদিন চিল্কার করে বলেছিলাম, ঘেন্না করি, তোমরা কিছুই করোনি আমার জন্যে। নিজেদের পার্থিব আনন্দ আর শারীরিক তৃপ্তির জন্য টাকা রোজগার করে গেছ। তুমি যা মাইনে পাও তা দিয়ে এত পার্টি এত মদ আর মায়ের এত বিলাস মেটানো যায় না। এসব তোমাদের ব্যাপার। আমাকে পড়াশুনার সুযোগ আর খাওয়াপরার স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েই তোমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে গিয়েছে। তোমাদের মত এই দেশের সব বাবা-মা একই চিন্তা করে, কেউ ভাবে না পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি করার দায়িত্ব তাদের। এই দেশের জন্যে আগামী প্রজন্মকে শিক্ষিত করতে তাদের সময় দিতে হবে। নিজেকে ভীষণ অবহেলিত মনে হত এক সময়। এখন আর কিছু মনে করি না। যার কাছে কোন আশা করার নেই তার সম্পর্কে কোন ভাবনাও থাকে না। তোমাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগের সুতোটা কখন ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।

জয়িতা চুপ করলে রামানন্দ কোন কথা বললেন না। হঠাৎ কল্যাণ চোখ খুলে ধীরে ধীরে বলল, ঠিক কথা। এ কথা আমারও। তবে তোর বাবা-মায়ের অর্থ ছিল আর আমার বাবা-মা ঠিক উলটো অবস্থায় থেকে একই আচরণ করেছিল।

শেষ পর্যন্ত রামানন্দ উঠে দাঁড়ালেন, আমি তোকে বুঝতে পারছি না। তুই কোথায় এইসব কথা শিবাল? এই মানসিকতা কি করে হল তোর? আমার অজান্তে কখন তুই এত দূরে পৌঁছে গেলি?

এ প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না জয়িতা।

হঠাৎ রামানন্দ সুদীপের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি আজ রাত্রে কোন কিছু করেছ?

সুদীপ ঠোঁট কামড়াল, আপনার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করুন। আপনি তো ওর সঙ্গেই কথা বলছেন।

রামানন্দ বললেন, তোমরা সবাই একই সঙ্গে পড়, না?

আনন্দ জবাব দিল, হ্যাঁ।

রামানন্দ বললেন, জয়, তোমার মা এইসব কথা জানেন না। আমার মনে হয় ওঁকে জানানোর দরকার নেই। উনি ঠিক মানতে পারবেন না। তবে জেনো তঁাকে দোষ দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ সব মেয়ে একই ধরনের মা হতে পারে না। যে যার নিজের মত তা হয়ে থাকে। বাইরের জগতের ওপর ওঁর এই আকর্ষণের জন্যে আমারও দায়িত্ব ছিল। তোমরা এখন এই বাড়িতে এসেছ তাও তার জানা নেই। নীতিহীনতা যদি তোমাদের লক্ষ্যবস্তু হয় তাহলে তোমরা আমাদেরও খুন করতে পারো। পাশের ঘরে গিয়ে তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় পেয়ে যাবে, কিন্তু আমি বলছি এটাও সঠিক পথ নয়। কিন্তু নিজে যেহেতু কিছু করতে পারিনি তাই তোমাদের বাধা দেব না। দু হোয়াটএভার ইউ লাইক, আমি বাধা দেব না। কিন্তু একটা কথা বলব। একটি শিক্ষিত রাষ্ট্রের পুলিস এবং সংগঠিত সামরিক শক্তির চোখ এড়িয়ে বেশিদিন তোমরা এসব করতে পারবে না। অবশ্য তোমরা ঠিক কি করছ তা আমি জানি না। আমি সীতাকে বলব তোমাদের যেন বিরক্ত না করে। আর হ্যাঁ, ওই ছেলেটির ইমিডিয়েটলি ট্রিটমেন্ট হওয়া দরকার। কাল সকালে আমি আমার এক বন্ধুর নার্সিং হোমে নিয়ে যাব।

রামানন্দ রায় চলে গেলেন। হঠাৎ খুব বয়স্ক মনে হচ্ছিল তাকে। পিঠটা কুঁজো হয়ে গেছে। প্রায় নিঃশব্দে তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পর সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, এবার কি হবে?

আনন্দ পা ছড়াল, আমার বিশ্বাস ভদ্রলোকের কাছ থেকে কোন ক্ষতির আশঙ্কা নেই।

সুদীপ প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল, কিন্তু উনি যদি একটা টেলিফোন করেন তাহলে আমাদের কয়েক বছর জেল তো অবশ্যই, ফঁসিও হতে পারে। সেটা যেচে চাইছি কেন?

জয়িতার হঠাৎই নিজেকে খুব দুর্বল বলে মনে হচ্ছিল। সে মাথা নাড়ল, আনন্দ ঠিকই বলছে। রামানন্দ রায় আমাদের কোন ক্ষতি করবেন না। ভয় হচ্ছে আমার জননীকে।

আগামীকাল সেটা চিন্তা করা যাবে। আমার মনে হয় প্রোগ্রাম চেঞ্জ করা উচিত। এখন এই রাত্রে রাস্তায় কোন গাড়ি আছে বলে মনে হয় না। সেই লোকটা যদি থানায় জানায় তাহলে আমরা ঠাকুরপুকুরে যাওয়ার সময় সহজেই ধরা পড়তে পারি। ওয়েল, আমি ধরছি চান্স ফিফটি ফিফটি। তাছাড়া গাড়িটা রাখবি কোথায়? ভোরবেলা অবধি লোকটা যদি অপেক্ষাও করে তাহলে প্রিয়া সিনেমার কাছে না পেয়ে সোজা থানায় যাবে। আমরা গাড়িটা ঠাকুরপুকুরে নিয়ে গেলে আর দেখতে হবে না। দ্বিতীয়ত, কল্যাণকে ফেলে রেখে আমরা যেতে পারি না। ঠাকুরপুকুরে ওর ট্রিটমেন্ট কেমন হবে তা আমরা জানি না। এসব ঝুঁকি আমাদের হয়তো নিতেই হত কিন্তু জয়ের বাবাকে আমার এখন বিশ্বাস করা যায় বলে মনে হচ্ছে। ঝুঁকি নিবি কিনা ভেবে দ্যাখ। আনন্দ জানাল।

সুদীপ বলল; গাড়িটা আমি ঠাকুরপুকুরে নিয়ে যেতাম না। খুব ভোরে প্রিয়া সিনেমার আশপাশে পার্ক করে ওখান থেকেই ট্যাকসি নিতাম। ওয়েল, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।তোরা দেখছি টায়ার্ডও হচ্ছিস। কিন্তু কোথায় ঘুমাব? যে যেখানে শোও আমি বিছানাটা নিচ্ছি। এনি বডি ক্যান শেয়ার উইথ মি।
 
জুতোটা খুলে টয়েলেটের দিকে এগোচ্ছিল কিন্তু জয়িতা বাধা দিল, তুই একটা ব্যাপার একদম ভুলে যাচ্ছিস।

কোন ব্যাপার? সুদীপ দাঁড়াল।

গাড়িটাকে নিচে রেখে এসেছিল। ওটাকে এখান থেকে অবিলম্বে বিদায় করা দরকার।

ওঃ গড। তোদের উচিত ছিল ড্রাইভিং শিখে নেওয়া। কাহাতক গাড়ি চালানো যায়! জয়, তুই ট্রাই করবি এখন? খুব ঘুম পাচ্ছে আমার। সুদীপ হাই তুলল।

আনন্দ বলল, না রে সুদীপ, ওর যাওয়া ঠিক হবে না। শেষ রাত্রে কলকাতার রাস্তায় কোন মেয়ে একা গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে এ-দৃশ্য অনেকের সহ্য হবে না। চল তোতে আমাতে এখনই বেরিয়ে পড়ি। প্রিয়া সিনেমার কাছাকাছি যেতে হলে আর দেরি করা ঠিক হবে না। কে জানে ভোরে আমাদের জন্যে কোন ট্র্যাপ পাতা থাকবে কিনা!

জয়িতা বলল, প্রিয়া সিনেমার কাছাকাছি যেতে হবে কেন? তোরা বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের কোথাও রেখে আয়। গাড়িটা দূরে থাকলেই তো হল।

সুদীপ মাথা নাড়ল, নোআই মাস্ট গো দেয়ার। লোকটা নির্ঘাত কাল সকাল পর্যন্ত মন স্থির করতে পারবে না। যদি এসে গাড়িটা পেয়ে যায় তাহলে স্রেফ চেপে যাবে। পুলিশ জানতেই পারবে না। ওরা ভাববে আমরা ইলিয়ট রোডের কাছাকাছি শেলটার নিয়েছি। তুই যেটা বলছিস আনন্দ সেটারও সম্ভাবনা আছে। ফঁদ পাতা থাকতে পারে। তবে তার সময় এখনও হয়নি। কিন্তু কথা হল এখন ওখানে পৌঁছে ফিরব কি করে?

হেঁটে। পায়ে পায়ে। পণ্ডিতিয়া দিয়ে শর্টকাট করে এলে মাইলখানেকও হবে না। লেটস গো।

আনন্দর সঙ্গে বের হবার আগে সুদীপ জয়িতার দিকে তাকিয়ে বলল, কল্যাণ ঘুমিয়ে পড়লে আপত্তি নেই। কিন্তু তুমি বিছানায় বডি ফেলল না। আমরা ফিরে আসা পর্যন্ত জেগে থাকবে। নইলে বেল বাজালে তোর মা হয়তো দরজা খুলে ডাকাত বলে চেঁচাবে।

কল্যাণের ঝিমুনি আসছিল। ওর কনুই-এর কাছটায় জখম হয়েছে। জয়িতা ওকে বিছানায় শুয়ে পড়তে বলল। তারপর আলো নিবিয়ে নিজের ঘরে চলে এল। আসবার সময় দেখল রামানন্দ এবং সীতা রায়ের ঘরের দরজা বন্ধ। এবং তখনই জয়িতার মনে হল তার স্নান করা দরকার। সন্ধ্যে থেকে একটার পর একটা টেনশনে শরীর আর বইছে না। দারুণভাবে টানছে বিছানা। অথচ ওরা যখন এত করার পরও আবার বের হতে বাধ্য হল তখন তার ঘুমানোটা অপরাধ। জানলার কাছে পৌঁছে পান্না দুটো খুলে দিতে ঠাণ্ডা বাতাস এল। ঝিম ধরে আছে কলকাতা। এত ওপর থেকে শেষ রাতের দিকে এগোনো শহরটার ঘুমন্ত চেহারাটা দেখে জয়িতার মনটা হঠাৎ নরম হয়ে এল। একটাও গাড়ির হেডলাইট নেই, হলদে আলোয় রাস্তাগুলো আরও নির্জন হয়ে গেছে। কাছে কিংবা দূরে কোন বাড়ির খোপে আলো জ্বলছে না। হঠাৎই দৃশ্যটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। কল্যাণ পড়ে গেছে এবং লোকগুলো ওকে জাপটে ধরেছে। সেই মুহূর্তে কি তার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল? নইলে হঠাৎ তার শরীরে কোন শক্তি ভর করেছিল? কল্যাণকে মুক্ত করতেই হবে—শুধু এই চিন্তাটাই তাকে উদ্দাম করে তুলেছিল। কিন্তু সে পেরেছিল। গ্রেনেডটা ছোড়ার কোনরকম মানসিক প্রস্তুতি ছাড়াই তার হাত সক্রিয় হয়েছিল। নইলে কল্যাণকে কোনদিন আর ফেরত পাওয়া যেত না। নিজেকে তার অন্য রকম লাগছিল। সেই জয়িতা, যে কেবল দুঃখ পেত, এত বড় ফ্ল্যাটে একা একা থেকে নিজেকে যে শুধু অবহেলিত ভাবত সে কোথায় হারিয়ে গেল। এখন আমার একটু স্নান চাই। জয়িতা বাথরুমে ঢুকে পড়ল।

মাথায় ঠাণ্ডা জলের ধারা, সারা শরীর বেয়ে তা গড়িয়ে পড়ছে, জয়িতার মনে হল এর চেয়ে শান্তি আর কোথাও নেই। রামানন্দ রায়ের মুখটা মনে পড়ল তার। এই প্রথম সে ওঁর মুখের ওপর কথাগুলো বলতে পারল। কিন্তু তার পর থেকেই একধরনের ক্ষরণ শুরু হয়েছে মনে। কিরকম কুঁকড়ে গেল রামানন্দ রায়ের মুখ। অমন অসহায় সে কোনদিন হতে দ্যাখেনি মানুষটাকে। যে কোনভাবে আসা অর্থের স্রোত এবং নিমেষে সমশ্রেণীর মানুষের দ্রুতগতির জীবন রামানন্দকে প্রলুব্ধ কবেছে যৌবনকে ধরে রাখতে। আজ যেন এক নিমেষেই মানুষটা অতিরিক্ত প্রৌঢ় হয়ে গেল।
 
পরিষ্কার হয়ে ঘরে ফিরে সেই জমকালো শাড়িটা বের করল সে। হঠাৎ তার ইচ্ছে করল শাড়ি পরতে। শেষবার প্যারাডাইসের কাণ্ডটা হবার পর সে গাড়িতে বসে শাছি খুলেছিল। ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য কিনা এখনই সন্দেহ হচ্ছে। কিন্তু খুলতে তত পেরেছিল আবু রেখ। কত কি না হাস্যকর ব্যাপার এক জীবনে মানুষকে করতে হয়। এমন কি সেই পরচুলাটা! জয়িতার মনে পড়ল সেটাকে কোথায় রেখেছে। না, ফেলে দিতে হবে। সুদীপের পরামর্শে কিনতে হয়েছিল কন্তু পরচুলা আর নকল দাড়ি তার কাছে একই ব্যাপার। শাড়ি ব্লাউজ পরে জয়িতা ঘড়ি দেখল। খদের ফিরতে চারটে তো বাজবেই। এবং এই সময়টা তাকে জেগে থাকতে হবে। কি করা যায়! সেফ থেকে একটা বই নিয়ে বসল সে। ঘাড়ে হাওয়া লাগায় বেশ আরামবোধ হচ্ছে। কয়েক লাইনে চোখ বুলিয়ে পড়তেই ইচ্ছে করল না বইটা। সে ওটাকে সেলফে রেখে আর একটা তুলে নিয়ে পাতা ওলট তে লাগল।

সারাদিন মিছে কেটে গেল,
সারারাত বড় খারাপ
নিরাশায় ব্যর্থতায় কাটবে; জীবন
দিনরাত দিনগত পাপ
ক্ষয় করবার মতো ব্যবহার শুধু
ফণীমনসার কাটা তবুও তো স্নিগ্ধ শিশিরে
মেখে আছে; একটিও শূন্যে নেই;
সব জ্ঞানপাপী পাখি ফিরে গেছে নীড়ে।

জীবনানন্দের কবিতার বইটি হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল জয়িতা। বুকের মধ্যে অদ্ভুত একটা কষ্ট থম ধরে আছে। এখন কলকাতার, এই কলকাতার সব জ্ঞানপাপী ফিরে গেছে নীড়ে। তারপরেই এক ঝটকায় সোজা হয়ে বসল সে। কবিতার বইটি রেখে দিল সেলফে। না, শুধু দিনগত পাপক্ষয় করার জন্যে সে বেঁচে থাকবে না। এই হতাশা তার জন্যে নয়। বরং যে সব জ্ঞানপাপী সুবিধেমত নীড়ে ফিরে যায় তাদের টেনেহিঁচড়ে বের করে না আনা পর্যন্ত শান্তি নেই। কবিতাটিকে ভোলবার চেষ্টা করতেই যেন সে উঠে দাঁড়াল।

এই বাড়ির কোথাও কোন শব্দ নেই। যে বিদেশী বাজনা বাজছিল কোন ফ্ল্যাটে সেটাও এখন বন্ধ হয়ে গেছে। রামানন্দ রায়ের মুখটা মনে পড়ল জয়িতার। এইরকম ভাবে তিনি কোনদিন তাকাননি। জয়িতার হঠাৎ খুব ইচ্ছে হল বাবার কাছে গিয়ে বসে। তার বক্তব্য বলার জন্যে হয়তো সে সঠিক শব্দ নির্বাচন করেনি। আমরা যখন কথা বলি তখন বেশির ভাগ সময়েই বক্তব্যটাই জানাবার চেষ্টা করি কিন্তু আপাতনিরীহ কোন শব্দ যে শ্রোতার কানে মারাত্মক অর্থবহ হয়ে দাঁড়ায় তা ভাবার প্রয়োজন বোধ করি না। মুখে কোন ক্ষমা চাইতে পারবে না সে। কারণ সে বিশ্বাস করে ক্ষমা চাইবার মত কোন অপরাধ সে করেনি। কিন্তু চুপচাপ কিছুক্ষণ পাশে বসে থাকলে এক ধরনের আন্তরিকতা পৌঁছে দেওয়া যায়। জয়িতার স্থির বিশ্বাস রামানন্দ এখনও ঘুমাননি। তাছাড়া সে অবশ্যই কৃতজ্ঞতা বোধ করছে। তিনি তাকে এবং তার বন্ধুদের এই ফ্ল্যাটে আশ্রয় দিয়েছেন। এখন নিশ্চয়ই তার পক্ষে অনুমান করতে বাধা নেই কিন্তু তা সত্ত্বেও পুলিস ডেকে তাদের ধরিয়ে দেননি। বরং তার ভঙ্গিতে প্রকাশ পেয়েছে তিনি পারলে উপকারই করবেন।

রামানন্দ রায়ের দরজায় নক করতে গিয়েও সামলে নিল সে। একটু দ্বিধাগ্রস্ত হল। তার পর সেটা কাটিয়ে উঠে দরজায় চাপ দিল। খোলাই ছিল ওটা, জয়িতা ভেতরে পা বাড়িয়ে অবাক হল। টানটান বিছানা দেখে বোঝা যায় কেউ সেটা ব্যবহার করেনি। ঘবে আলো জ্বলছে। বামানন্দ রায় তঁাব ঘরে নেই। ছাত করে উঠল জয়িতার বুক। এতরাত্রে কোথায় গেলেন তিনি! যেভাবে মানুষটা বেরিয়ে এসেছিলেন তাতে তাঁর পক্ষে কিছু একটা করে বসা অসম্ভব নয়। কিন্তু এই ফ্ল্যাটে তো আর যাওয়ার কোন জায়গা নেই। জয়িতা বাথরুমে মুখ বাড়াল। না, তিনি সেখানেও যাননি।

তাহলে কি রামানন্দ রায় বেরিয়ে গেছেন? তারা যখন ঘরে বসে কথা বলছিল তখন কি নিঃশব্দে বাইরের দরজা খুলে চলে গেছেন? এতক্ষণ যে ধারণা তৈরি হয়েছিল তা কি ভুল? বাড়ির টেলিফোন পর্যন্ত ব্যবহার না করে রামানন্দ এই নিশুতি রাতে বেরিয়ে গেছেন পুলিসকে খবর দিতে? জয়িতার মনে হল অবিলম্বে কল্যাণকে সতর্ক করে দেওয়া দরকার। সুদীপ আনন্দ ফিরে আসার আগেই রাস্তায় ওদের সঙ্গে দেখা করা দবকার। জয়িতা কিছুই ভাবতে পারছিল না। তার পরেই পাশের ঘরটার কথা মনে পড়ল ওর। সীতা রায় তো আজ সারাদিন প্রায় স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে রয়েছেন। এমন কি বাড়িতে তিনটে অপরিচিত ছেলে এসেছে তা নিয়েও মাথা ঘামাননি। রামানন্দ তো ওই ঘরে যাননি? মনে হয় না। সীতা রায় রাত হলে স্বামীকে নিজের ঘরে ঢুকতে অনুমতি দেন না। বেশ কিছুদিন ধরে জয়িতা এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করছে। একসঙ্গে পার্টিতে যাচ্ছেন ওঁরা, হেসে কথা বলছেন অন্য ফ্ল্যাটের লোকদের সঙ্গে, গেস্ট এলে আপ্যায়নও করছেন এবং তখন দেখলে বোঝা যাবে না এই স্বামী-স্ত্রী রাত্রে পরস্পরের মুখ দেখেন না। আজ কি করে রামানন্দ সীতা রায়ের ঘরে যাবেন? অন্তত এই শেষরাত্রে? সীতা রায়ের তত জেগে থাকার কথা নয়, শরীরের প্রতি তার অত্যন্ত সতর্কতা।





হঠাৎ জয়িতার মনে পড়ল বাথরুমটার কথা। পাশাপাশি দুটো ঘরের জন্যেই একটাই বাথরুম। দুটো দরজা দিয়ে ওটায় যাওয়া যায়। জয়িতা নিঃশব্দে বাথরুমে ঢুকল। এবং ঢুকতেই বুঝতে পারল পাশের ঘরের মানুষ জেগে আছে। দরজার ফাঁক দিয়ে আলো আসছে। একটু সঙ্কোচ হল তার। কিন্তু রামানন্দ রায় ওখানে আছেন কিনা তা জেনে নিশ্চিত হতে চায় সে। সে ঠিক করল অন্তত একবার সে দরজার কাছে কান পেতে শুনবে রামানন্দ কথা বলছেন কিনা। হয়তো এটা অন্যায়, রুচিতেও বাধছে তার। কিন্তু নিজের সন্দেহটা নিজেই মিথ্যে প্রমাণ করতে চাইল সে। ধীরে ধীরে পাশের ঘরের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই কান্না শুনতে পেল জয়িতা। সঙ্গে সঙ্গে স্থির হয়ে গেল—মা কাঁদছে।

রামানন্দ বললেন, কেঁদো না সীতা, প্লিজ শান্ত হও।

সীতা রায় বললেন, তুমি, তুমি আমাকে ক্ষমা করো। বল ক্ষমা করবে?

রামানন্দ বললেন, আমিও যে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।

সীতা রায় একটু থামলেন। তারপর করুণ গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু জয়ী? জয়ী?

রামানন্দ বললেন, ওকে ওর মত থাকতে দাও। কখনও ওকে বাধা দিও না। ও আর ঠিক আমাদের নেই। আমি ওর জন্যে গর্বিত সীতা।

আর দাঁড়াতে পারল না জয়িতা। যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি বাইরে ছুটে এল। এবং হঠাৎই তার কান্না পাচ্ছিল। শূন্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে কাঁদছিল। অথচ তার চোখ থেকে এক ফোঁটাও জল পড়ছিল না। আর তখনই দরজা খোলার জন্যে অনুরোধের বেল বাজল।
 
২০.
বড়বাজারে উগ্রপন্থীদের আক্রমণ, জাল ওষুধের কারখানা ধ্বংস, প্যারাডাইসের পর বড়বাজার। তিনটে খবরের কাগজের শিরোনাম সকালবেলায় ওদের চোখে পড়ল। শেষরাত্রে এই ফ্ল্যাটে ফিরে সুদীপ ঘুমাবার চেষ্টা করেছিল। আনন্দ চুপচাপ শুয়েছিল। বাবার চিঠিটার কথা অন্ধকার ঘরে কেবলই মনে পড়ছিল তার। একটা মানুষ কোন অবস্থায় অমন চিঠি লিখতে পারে? বারংবার বাবা এবং তার সেই বান্ধবীকে ভুলতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু সে আবিষ্কার করেছিল ওই ভদ্রমহিলার বিরুদ্ধে তার কোন বিরূপ মানসিকতা তৈরি হচ্ছে না। এমন কি হয়তো তিনি মায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী, তবুও। আর এইভাবেই ঘরের অন্ধকারটা মিলিয়ে গেল, জানলার বাইরে আলো ফুটল। শরীরে বেশ ক্লান্তি থাকায় শুয়ে থাকতে ভাল লাগছিল তার। ওপাশে কল্যাণ বোধ হয় ঘুমিয়েছে ওষুধের প্রভাবে। সুদীপ ঘুমিয়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। যদিও সে কল্যাণের পাশে বিছানায় একইভাবে পড়ে আছে। পায়ের তলায় মোটা কার্পেট, দামী সোফা আর সুন্দর ছবিতে সাজানো ঘরটায় সকাল এল। জয়িতাদের কালা চাকরটা দামী পটে চা দিয়ে গেল। তারপর যখন জয়িতা এল কাগজ নিয়ে তখনও আলস্য পাক খাচ্ছে ঘরে। সুদীপ উঠে এসে শিরোনামগুলো পড়ল। পড়ে হাসল, উগ্রপন্থী বলে কেন রে কাগজগুলো? উগ্রপন্থী শব্দটা শুনলেই নরমপন্থী শব্দটাকে মনে পড়ে। ভারতবর্ষের সবকটা মানুষ নরমপন্থী হোক এটাই যেন ইঙ্গিতে থাকে। কিন্তু ওরা ধরেছে, প্যারাডাইসের পর বড়বাজার—তার মানে দুটো যে আমাদেরই কাজ তা বুঝতে পেরেছে। ধন্যবাদ। কি লিখেছে পড় তো!

তিনটে কাগজে খবরগুলো এক করলে ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায়, গতরাত্রে কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলের একটি ওষুধের কারখানায় উগ্রপন্থীরা আক্রমণ চালায়। সত্যনারায়ণ পার্কের পাশে মোহনলাল আগরওয়ালের এই ওষুধের কারখানাটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ ছিল না। ব্যবসায়ী হিসেবে মোহনলালজীর খ্যাতি আছে। মধ্যরাত্রে কয়েকজন উগ্রপন্থী কোন এক সূত্রে কারখানার ভেতরে প্রবেশ করে। তারা কর্মচারীদের একপাশে সরে যেতে বাধ্য করে। তারপর অত্যন্ত শক্তিশালী গ্রেনেড এবং পেট্রল বোমা ছুঁড়ে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে বিশাল কারখানাটিকে ধ্বংস করে দেয়। উগ্রপন্থীরা যখন পালাচ্ছিল তখন তাদের একজনকে জনসাধারণ ধরে ফেলতে গিয়েও পারে না। প্রকাশ, একজন মহিলা উগ্রপন্থী তাকে বাঁচিয়ে উধাও হয়। কোনরকম ডাকাতি হয়নি। দমকল এবং পুলিস দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে আসে। কিন্তু কারখানার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ক্ষতির পরিমাণ সঠিক না জানা গেলেও কয়েক কোটি টাকা বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কোন মানুষ যাতে মারা না যায় সে ব্যাপারে উগ্রপন্থীদের লক্ষ্য ছিল এটা বোঝা গেছে। তিনজন সামান্য আহত হয়েছেন বিস্ফোরণের ফলে। পুলিস সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শহরে জাল বিছিয়ে ফেলে—যে গাড়িটিতে উগ্রপন্থীরা অকুস্থল থেকে পালিয়েছিল সেটি ধরবার জন্যে। এই কপি প্রেসে দেবার সময় জানা যায় ইলিয়ট রোড এবং ওয়েলেসলির মোড়ে পুলিস পরিত্যক্ত গাড়িটিকে পেয়েছে। এই গাড়িটি একটি সিনেমা হলের সামনে থেকে চুরি গিয়েছিল কয়েক ঘন্টা আগে। পুলিস সন্দেহ করছে প্যারাডাইসের ঘটনাটির সঙ্গে এর যোগাযোগ আছে। উভয় ক্ষেত্রেই আক্রমণের কোন উদ্দেশ্য ধরা পড়েনি। এই দলে যে মহিলা আছে সে ব্যাপারে পুলিস নিঃসন্দেহ। এখন পর্যন্ত কেউ ধরা পড়েনি। জোর তদন্ত চলছে। পুলিসের একজন মুখপাত্র বলেছেন তারা সূত্র খুঁজে পেয়েছেন।
 
সংবাদটির মধ্যে একটি বক্স করে আর একটি সংবাদ দেওয়া হয়েছে তিনটি কাগজেই। তার ছোট শিরোনাম, এবার রেসকোর্স? ঘটনাটির পর আমাদের অফিসে টেলিফোনে উগ্রপন্থীদের একজন জানায় তারা এবার রেসকোর্স ধ্বংস করতে চাইছে। যেহেতু শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ওপর আর তাদের কোন আস্থা নেই তাই তারা জনস্বার্থবিরোধী বলে যাদের মনে করবে তাদেরই ধ্বংস করবে। বড়বাজারের ঘটনা জানিয়ে তারা বলে যে ওই কারখানায় মানুষের জীবননাশকারী জাল ওষুধ তৈরি হত। টেলিফোনে ওই কারখানার মালিকের গোপন গুদামের খবর আমাদের জানানো হয়। সূত্রটি ধরে পুলিস সেখানে হানা দিয়ে প্রচুর ওষুধ বাজেয়াপ্ত করেছে। এখন দেখা হবে এই ওষুধ আসল না জাল! সুনিপুণ অপারেশনের পরই উগ্রপন্থীদের খবরের কাগজের সঙ্গে এইভাবে যোগাযোগ করে খবর দেওয়া অভিনব বলে মনে হয়েছে।

সুদীপ চায়ের কাপটা তুলে নিল! খুব দামী চা খাস তো তোরা! আঃ।

আনন্দ সত্যি অবাক হল। এই সময় যে সুদীপ এত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে অন্য কথা বলতে পারবে তা তার ভাবনায় ছিল না। জয়িতা কথা বলল আনন্দর অভিব্যক্তি দেখে, তাহলে আমাদের উদ্দেশ্য বিফল হয়নি? এই সব খবর পড়ে পাবলিক যা ভাববে তাই তো আমরা চেয়েছিলাম!

সুদীপ মাথা নাড়ল, কিন্তু হোয়াই উগ্রপন্থী! ওই শব্দটা শুনলেই পাবলিক ভয় পাবে। তবে রেসকোর্স-অপারেশন আর এখন হবে না। খামোকা তুরুপের তাস তুলে দিলি—ওরা অনেক বেশি প্রটেকশন নেবে আর আমরা কাছে ঘেঁষতে পারব না!

আনন্দ এবার কথা বলল, এখনই আমরা রেসকোর্সে যেতে পারতাম না। ব্যাপারটা অত সোজা নয়। কিন্তু এই খবরটার কি প্রতিক্রিয়া হয় সেটাই এখন দেখার।

এই সময় কল্যাণ বলল, আমি এখন কি করব?

জয়িতা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, মানে?

আমি যে ধরা পড়েছিলাম সেটা কাগজগুলো লিখেছে।

কি আশ্চর্য, ওরা তো তোর নাম লেখেনি! তাছাড়া আমিও তো জড়িয়ে গেছি। কাগজে লিখেছে এইদলে যে মহিলা ছিল সে ব্যাপারে পুলিস নিঃসন্দেহ—এমন করছিস না! জয়িতা মুখ ফেরাল।

দূর! কল্যাণ খিঁচিয়ে উঠল, আমি আমার কথা ভেবে বলিনি। আমার জন্যে তোদের বিপদ হোক এটাই চাইছি না। আমি কিছু করা দূরে থাক, দৌড়তে পারব কিনা তাই বুঝতে পারছি না।

আনন্দ বলল, তোকে কিছু বুঝতে হবে না। এখন যন্ত্রণা কেমন আছে?

নড়তে ভয় পাচ্ছি। কিন্তু বাথরুমে যাওয়া দরকার।

জয়িতা এগিয়ে এল, আমি কি তোকে সাহায্য করব?

কল্যাণ বলল, তুই হাতটা দে, ব্যালেন্স রেখে উঠলে যদি ওপাশটায় কম চাপ পড়ে! জয়িতা হাত বাড়িয়ে দিল। কল্যাণ শরীরের ভর তার ওপর রেখে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নামতে নামতে কয়েকবার অস্ফুট চিৎকার করল। তারপর দুর্বল পায়ে বাথরুমে ঢুকে গেল।

সেদিকে তাকিয়ে জয়িতা বলল, ওকে এখনই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত।

সুদীপ সিগারেট ধরাল, তোর বাবা তো কাল ঘোষণা করে গেছে, জিজ্ঞাসা কর।

জয়িতা সুদীপের দিকে বিরক্তি নিয়ে একবার তাকিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু আনন্দ বলল, দাঁড়া। তোদের কাল একটা কথা বলিনি, আমার হোস্টেলে পুলিস এসেছিল।

সুদীপ হাসল, বাঃ, কখন?

কাল বিকেলে। ওরা আমার জন্যে ওয়েট করছিল—খুব জোর বেঁচে গেছি।

মহাপ্রভুরা খবর পেলেন কি করে?



গ্রাম থেকে। আমরা যে গ্রামে গিয়েছিলাম তা ওরা জেনে গেছে। আজ এবং আগামীকাল ছুটি। কিন্তু এর মধ্যেই ওরা নিশ্চয়ই জেনে যাবে আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু কারা। আমি জানি না সুদীপের বাড়িতে গেলে ওর বাবা বলবেন কিনা ও টাকা নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে। তবে গতকালের ঘটনা থেকে ওরা যখন জেনেছে একজন মহিলাও ছিল তখন তার বর্ণনাও নিঃসন্দেহে পেয়েছে। সেক্ষেত্রে আমার সঙ্গে তোর বন্ধুত্বের খবরটা জানতে পারা খুব স্বাভাবিক। আর সেটা হলেই তোর এইখানে পুলিস হাজির হবে। অতএব যতটা তাড়াতাড়ি এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে পারি ততই মঙ্গল। আমাদের হাতে সময় বেশি নেই।

সুদীপ বলল, তাহলে একটা কাজ করা যাক। তুই আর আমি এখনই ঠাকুরপুকুরে চলে যাই, এই সকালে রাস্তায় তেমন লোকজন নেই নিশ্চয়ই। কল্যাণকে জয়িতার বাবা ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধের ব্যবস্থা কিংবা প্লাস্টার করিয়ে রাখুন। রাত্রে জয়িতা ওকে নিয়ে বেহালার চৌরাস্তার মোড়ে চলে আসুক, ওখান থেকে আমরা নিয়ে যাব কল্যাণকে।

আনন্দ আপত্তি করল, না, এখন দু-তিনদিন জয়িতার আমাদের সঙ্গে রাস্তায় ঘোরাফেরা করার দরকার নেই। এই সময় কল্যাণ বেরিয়ে এল। এবং ওর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল বেচারা অনেক কষ্টে যন্ত্রণা চেপে রেখেছে। আনন্দ দ্রুত তাকে জানাল কি করতে হবে। বেহালার ট্রাম ডিপোর সামনে সুদীপ বাত দশটার সময় অপেক্ষা করবে। ও যেন বেশি দেরি না করে। তাহলে ঠাকুরপুকুরে যাওয়ার কোন বাস পাওয়া যাবে না।

কল্যাণ শুনল। তারপর বলল, তোরা ঠিকানাটা দে। আমি ডাক্তারের ওখান থেকেই সরাসরি চলে যাব।

সুদীপ প্রতিবাদ করল, দিনের বেলায় হাত প্লাস্টার করা কাউকে দেখলে ঠাকুরপুকুরেব সবাই মনে রাখবে। অতএব সন্ধ্যের পরেই যাওয়া ভাল।

অতএব সিদ্ধান্ত হল রাত দশটায় নয়, সন্ধ্যে সাতটার সময় সুদীপ কল্যাণের জন্যে অপেক্ষা করবে। জয়িতা চুপচাপ শুনছিল। এবার বলল, আমি কোথায় যাব?

সুদীপ বলল, তুই এখানেই থাক। পুলিস এলে পুরো ব্যাপারটা অস্বীকার করবি।

জয়িতার গলার স্বর শক্ত হল, সেটা যদি ওরা অবিশ্বাস করে? শোন সুদীপ, আমি মেয়ে বলে কি তোদের অসুবিধা হচ্ছে? আনন্দর কথায় হয়তো যুক্তি আছে, কিন্তু সেটা অপারেশনে নামবার আগে তোদের খেয়াল ছিল না কেন?

আনন্দ মাথা নাড়ল, সরি জয়ী, তুই কিছু মনে করিস না। কল্যাণের সঙ্গে তুইও আয়। যতটা পারিস মেয়েলি ব্যাপারগুলো পাবলিকের চোখে যাতে ধরা না পড়ে তা লক্ষ্য রাখিস।

দরজার বাইরে শব্দ হল। রামানন্দ রায় এসে দাঁড়ালেন। নির্বাক চারজনের মুখের দিকে খানিক তাকালেন। তারপর কল্যাণকে বললেন, ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছি। তুমি আমার ভাগ্নে, বাথরুমে পাড়ে গিয়ে ওই অবস্থা হয়েছে। তুমি কি একা আসবে, না কেউ এসকর্ট করবে?

কল্যাণ মাথা নাড়ল, আমি একাই যেতে পারব।

বেশ। এসো। ভদ্রলোক মুখ ফিরিয়ে এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন, আমি এইমাত্র রেডিওতে নিউজ শুনলাম। আমার অনুমান তোমরাই কাজটা করেছ। আমি তোমাদের কনডেম করতে পারছি না, আবার কনগ্রাচুলেশনও জানাতে পারছি না। আমরা কেউ রাস্তাটা চিনি না। ভারতবর্ষের মানুষের জটিল অবস্থায় পণ্ডিতদের কোন থিয়োরি কাজ করবে না। তবু ভুল পথটা তো বোঝা যায়। আই মাস্ট টেল ইউ, ইটস নট দ্য ওয়ে। তোমরা আত্মহত্যা করতে চাইছ—এক ধরনের হারাকিরি। এসো তুমি।

কল্যাণ একবার বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে ওঁকে অনুসরণ করল। ওরা চোখের বাইরে গেলে সুদীপ বলল, বাঙালী মাইরি জ্ঞান দিতে পারলে আর কিছু চায় না! লেটস মুভ।

জয়িতা দেখছিল। হঠাৎ সে বলল, বাট হি ইজ হেল্পিং আস, ইজন ট ইট?

আনন্দ মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আমি আগে যা শুনেছিলাম ওঁর ব্যবহার দেখে কিন্তু সেরকম মনে হচ্ছে না। যে মদ খায় খারাপ পাড়ায় যায় তারও তো বিপরীত চরিত্র থাকে। বাট উই আর রিয়েলি গ্রেটফুল টু হিম। জয়, তুই তাহলে কল্যাণকে নিয়ে ঠিক সময়ে চলে আসিস।

ওরা কোন জিনিস ফেলে রাখল না। সুদীপ বলল, এইসব মাল হটিয়ে কীটস বা রুকস্যাক কিনতে হবে। বেশ কয়েকটা জিনসের প্যান্টও দরকার।

জয়িতা হাসল, তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে কোন এক্সপিডিশনে যাচ্ছিস।

হু নোস! পেছনে ফেউ লাগলে ছুটে বেড়াতে হয়। টাকাকড়িগুলো কি তোরা ভাগ করে রাখবি?

না, আপাতত তোর কাছেই রাখ। আনন্দর হাতের ব্যাগের ওজন বেশি। সে খুব সাবধানে ওটা বহন করছিল। অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে মালগুলো যোগাড় করতে। এখন পর্যন্ত বিক্রেতা তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। ওরা দরজার দিকে এগোতেই পেছন থেকে গলা ভেসে এল, কি ব্যাপার?
 
সীতা রায় হলঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে। তার পরনে হাউসকোট, চুলগুলো চুড়ো করে বাঁধা, বোধ হয় ঘাড়ে হাওয়া লাগাতে চান। এই সকালেও তার মুখে হালকা প্রসাধন পড়েছে। জয়িতা জবাব, দিল, আমার এই দুই বন্ধু চলে যাচ্ছে। আর একজন, যাকে বাবা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে সে সন্ধ্যেবেলায় যাবে।

তোমার বাবা বলছিল ওরা এখানে থাকবে, দে নিড শেলটার!

আনন্দ সুদীপের দিকে তাকাল। শেলটার শব্দটা চট করে কানে লাগল। জয়িতা হাসল, না, আর তার দরকার নেই। ওরা কি যেতে পারে, না তোমার কিছু বলার আছে?

হ্যাঁ, তোমার নাম সুদীপ? কখনও যদি তোমার কোন সাহায্য দরকার হয় তাহলে জানাতে পার। আর হ্যাঁ, তোমরা, তোমরা কি ওই যাকে বলে নকশাল? সীতা রায় একই জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

না। আমরা কংগ্রেস, সি পি এম, নকশাল বা কোন ফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত নই। আমাদের সঙ্গে কোন বাজনৈতিক দলের সম্পর্ক নেই। সাহায্য চাইতে বললেন বলে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সুদীপ দরজাটা খুলল।

সীতা রায় যেন কিছুই বুঝতে পারছিলেন না, হঠাৎ খেয়াল হতে বললেন, তোমরা কিছু না খেয়ে চলে যাচ্ছ কেন? দশ মিনিট অপেক্ষা কর, তোমাদের ব্রেকফাস্ট রেডি হয়ে যাবে।

এবার আনন্দ মাথা নাড়ল, সো কাইন্ড অফ ইউ কাকীমা। কিন্তু আমাদের এমনিতেই খুব দেরি হয়ে গেছে। আপনার এই কথাটা আমাদের ভাল লাগল। বাই জয়।

তবু জয়িতা ওদের সঙ্গে লিফট পর্যন্ত এল। আজ ছুটির দিন বলেই এই বিশাল ফ্ল্যাটবাড়িতে এখনও আলস্য জড়ানো। জয়িতা বলল, সাবধানে যাবি, কোন ঝুঁকি নিবি না।

লিফটের বোতাম টিপেছিল সুদীপ, থাক, আর ঠাকুমাগিরি করিস না। কল্যাণটার হাত ঠিক হয়ে গেলে বাঁচি। আর শোন, তোর মায়ের যেন কিছু হয়েছে, আমি যেদিন কথা বলেছিলাম সেদিন উনি খুব অ্যাগ্রেসিভ ছিলেন, আজ বড় সাধারণ মনে হচ্ছিল। তোর দিনটা কাটাতে খুব অসুবিধে হবে না, বুঝলি?

জয়িতা মাথা নাড়ল, ওই দুটো মানুষ নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকলে আমি স্বস্তিতে থাকব। সেটাই এতদিন হয়ে এসেছে, এবাড়িতে তার ব্যতিক্রম হলেই—I।

লিফট এসে গিয়েছিল। দরজা খুলে রবীন সেন নামলেন। তার চোখে বিস্ময় ফুটল। দুই তরুণের দিকে তাকিয়ে তার বিশাল মুখটা জয়িতার দিকে ফিরল, এই যে, গুডমর্নিং! চললে কোথায়?

জয়িতা মাথা নাড়ল, কোথাও তো যাচ্ছি না। আপনি?

ওই যে, মিসেস রায়ের সঙ্গে একটা ব্যাপারে আলোচনা করব, উনি আছেন?

আছেন। কিন্তু কথা বলার মত অবস্থায় আছেন কিনা জানি না।

রবীন সেনের বিশাল দেহ জয়িতার কাছাকাছি হল। মুখটা সামান্য নামল, কি হয়েছে বল তো? ক্লাবে যাচ্ছেন না, কাউকে মিট করছেন না—দার্জিলিং-এ কিছু হয়েছিল?

আপনি ভেতরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করুন। দরজা তো খোলাই আছে। বাই। শেষ শব্দটি সুদীপদের দিকে ছুঁড়ে ভেতরে পা বাড়াতে বাড়াতে জয়িতা দেখল সীতা রায় একই জায়গায় তেমনি দাঁড়িয়ে আছেন। সে নিচু গলায় বলল, তোমার গেস্ট এসেছেন। তারপর নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল।



বালিগঞ্জ পার্ক রোডে কোন ট্যাকসি নেই। রোদ উঠেছে কিন্তু এখনও ছায়া পালায়নি। রাস্তাটায় দোকানপাট বলতে একদম মোড়ের কাছাকাছি, লোকজনও নেই ফুটপাতে। সুদীপ বলল, সুটকেস হাতে কলকাতার রাস্তায় হাঁটলে নিজেদের যেন অন্যরকম লাগে। যাবি কি করে?

ট্রামরাস্তায় গেলে ট্যাকসি পাব। আনন্দ জানাল।

ওরা ট্রামরাস্তায় কিছুক্ষণ দাঁড়াল। ট্যাকসি নেই, মিনিবাসগুলো বোধ হয় এখনও বের হয়নি। সুদীপ বলল, খিদে পেয়ে গেছে জব্বর। ব্রেকফাস্টটা ছেড়ে আসা উচিত হয়নি।

এ সময় একটা ট্রাম আসছিল পার্ক সার্কাসের দিক থেকে। আনন্দ বলল, চলে আয় সুদীপ, এই ট্রামটায় উঠব।

সেকি রে! এইসব নিয়ে ট্রামে উঠব? সুদীপ প্রতিবাদ করল। কিন্তু ততক্ষণে আনন্দ হাত নেড়ে ট্রামটাকে থামিয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠল ওরা। কন্ডাক্টর ছাড়া কোন যাত্রী নেই।

আনন্দ বলল, হঠাৎ মনে হল বালিগঞ্জ পার্ক রোড থেকে ট্যাকসিটা না ধরলেই ভাল হবে। তাছাড়া গড়িয়াহাটার মোড় থেকে কিছু খেয়ে নিতে পারবি। শোন, তোর ওই বৃদ্ধা আত্মীয়াকে বিরক্ত করতে চাই না। ওখানে আমাদের খাওয়া-দাওয়ার কি হবে?

অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। যদি বুড়ি অফার করে তাহলে অ্যাকসেপ্ট করব।
 
আরও ঘন্টাখানেক পরে ওরা ট্যাকসিতে ঠাকুরপুকুরের দিকে যাচ্ছিল। কয়েক পাউন্ড পাঁউরুটি, জ্যাম, বিস্কুট কিনে নিয়েছিল আনন্দ। মোড়ের কাছাকাছি একটা দোকানে বসে চা আর ডিম-রুটি খেয়ে নিয়েছে ওরা। এবং তখনই জানতে পেরেছিল কলকাতার শরীরে উত্তেজনার আগুন লেগেছে। চায়ের দোকানের প্রতিটি টেবিলে এখন ওই একটাই আলোচনা। প্যারাডাইসের পর বড়বাজার-আললাচকরা একটা ব্যাপারে নিশ্চিত যে এটি নকশালদের কার্যকলাপ নয়। কেউ কেউ অবশ্য নকশাল-পরবর্তী কিছু উগ্রমতাবলম্বী দলের নাম করল। কিন্তু কেউ প্রমাণ না থাকায় অদ্ভুত অদ্ভুত কল্পনা করছে। এবার রেসকোর্স। একজন বলল, আমার পূর্ণ সমর্থন আছে। দেশ থেকে রেস তুলে দেওয়া উচিত। কংগ্রেস থেকে একবার রেস বন্ধ করার কথা ভাবা হয়েছিল।

রেস বন্ধ হলে কত বুকি-পেন্সিলারের ইনকাম বন্ধ হবে তা জানেন?

আপনি যে অত চেঁচাচ্ছেন, এর পর যদি ওরা বলে যারা ঘুষ নেয় তাদের খতম করব, তাহলে? আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন? আমি কি ঘুষ নিই? কেউ প্রমাণ করতে পারবে?

বড়বাজারে জাল ওষুধ তৈরি হত কেউ প্রমাণ করেছে? বড় বড় কথা বলবেন না। এই পার্টি যদি পুলিসের চোখ এড়িয়ে কাজ চালায় তাহলে অনেক পাবলিকের জান কয়লা হয়ে যাবে।

যাই বল ভাই, ছোরাদের হিম্মত আছে। বড়বাজারে বোমা! আমার খুব ভাল লাগছে ওরা নিরীহ কর্মচারীদের আগেই সরে যেতে বলেছিল!

এটাকে কি বলবেন, বিপ্লব? সরকারের বিরুদ্ধে তো কিছুই করছে না। হরিদা, তুমি মাইরি আর দুনম্বর মাল চালিয়ে এক নম্বরের দাম নিও না, এই দোকানেও হামলা হতে পারে। চায়ের দোকানের প্রতিটি নিয়মিত খদ্দের হেসে উঠল।

ট্যাকসিতে বসে আনন্দ বলল, পুরো ব্যাপারটাই এই রকম হাসিঠাট্টার পর্যায়ে না পৌঁছে যায়! লোকগুলো কিরকম হ্যাঁ হ্যাঁ করে হাসছিল! এত তরলভাবে দেখছে কেন বল তো ব্যাপারটা?

ভাল খেলে মনটা ভাল থাকে। সুদীপ সিগারেট টানতে টানতে রাস্তা দেখছিল। আনন্দর কথায় হাসল, দূর! পৃথিবীর কোন দেশের পাবলিক কখনও সিরিয়াস হয়? কিন্তু আলোচনা হচ্ছে তো! দ্যাটস অল, এখনও ঠাট্টা চলছে কিন্তু এরকম কেস আরও কয়েকটা হলে ওই লোকগুলো আর হাসবে না, এখন চায়ের দোকানের মালিক দুনম্বর মাল এক নম্বর বলে চালাচ্ছে জেনেও কোন প্রতিবাদ করছে না। কিন্তু তখন করবে। তখন এরাই বাধ্য করবে ওই লোকটাকে ঘুষ না নিতে। আসলে পাবলিক এত দেখেছে যে কোন নতুন ব্যাপারে প্রথমেই আস্থা রাখতে পারে না। আমাদের কাজ আমরা করে যাব। পাবলিক জাগল তো বহুৎ আচ্ছা! ফলের জন্যে চিন্তা করো না, কাজ করে যাও।

ওর কথার ধরনে আনন্দ না হেসে পারল না। একটু চুপ করে বলল, রামানন্দ রায় আমার ধারণাটা বদলে দিল। ওই রঙিন মোড়ক দেওয়া লোকটা যে হঠাৎ এত চুপচাপ আমাদের সাহায্য করবে কে ভেবেছিল! আসলে সুদীপ, কোন মানুষকেই স্ট্যাম্প করে দেওয়া উচিত নয়। কে কখন কি ব্যবহার করে–।

মিডল ক্লাস, পাতি মিডল ক্লাস সেন্টিমেন্ট। রামানন্দ রায় এখন মোটা মাল কামাচ্ছেন, ফ্যাট স্যালারির চাকরি করছেন। বালিগঞ্জ পার্ক রোডে ফ্ল্যাট, গাড়ি, চারটে ক্লাবের মেম্বারশিপ, দশটা বউ-এর সঙ্গে ঘুমানো ওই সূত্রেই এসে যাচ্ছে। লক্ষ্য কর এরা কোন মেয়ের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলে বলে থাকেন আমি ওর সঙ্গে ঘুমিয়েছিলাম। সেই ঘুম কিন্তু চোখ বন্ধ করে নয়। কিন্তু বেসিকালি লোকটা এসেছে উত্তর কলকাতার এঁদো গলি থেকে। নিম্ন কিংবা মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্টগুলো গেঞ্জির মত শরীরে জাপটে আছে, ওপরে যতই পোশাক চাপুক। এঁরা খুব দ্রুত নিজেদের পালটাতে পারেন। হঠাৎ কোন ধাক্কা খেলে নড়বড়ে অবস্থায় বর্তমান চরিত্রের বিপরীত আচরণ করে ফেলেন। কিন্তু যারা বেশ কয়েক পুরুষ ধরে উচ্চবিত্ত, যাদের পেছনে কোন সেন্টিমেন্টাল অতীত নেই তারা এত সহজে টপকান না। শ্ৰীযুক্ত বাবু অবনী তালুকদার কখনই রামানন্দ রায়ের মত কল্যাণকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে যেতেন না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top