[HIDE]ঊনত্রিশ পর্ব-[/HIDE][HIDE][/hide][HIDE][/hide]
[HIDE]
“আমার তুমি আছো, আছো আমার মনেতে,
সকল কাজে, সকল খেলাতে,
আমার তুমি আছো.......”
কিছুক্ষণ কাঁদার পর নীলিমা শান্ত হল। কিন্তু সে যেন কেন কাঁদছে, সেটা বারবার নিজের মনকে জিজ্ঞাসা করেও কোনও উত্তর পেল না। কয়েক মুহুর্ত আগেও নিজেকে বড্ড অসহায়, অসুরক্ষিত বোধ হচ্ছিল। কিন্তু সামনে সুমিতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজেকে সামলাতে পারল না। মনে হল এই মানুষটার উপর সে কতটা নির্ভরশীল। এই মানুষটা ছাড়া নিজেকে কেন এতটা অসহায় মনে হচ্ছিল? আচ্ছা, এটাই কী কারোকে ভালবাসার ইঙ্গিত? এটাই কী বিশ্বাসযোগ্যতার প্রথম পরিচয়? এসবের উত্তর ওর কাছে অজানা। কতকটা নিষ্প্রয়োজনও বটে। কারণ ও জানে এই মুহুর্তে ওর কাছে সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি হচ্ছে সুমিত। একমাত্র ভরসা স্থল। নীলিমার মনে হল গত বেশ কয়েকদিন ধরে ওর মন বারবার নানারকম ভাঙ্গাগড়ার মধ্যে দিয়ে যাত্রা করেছে। চিন্তাভাবনার উত্থান-পতন ঘটেছে। ভাল-খারাপের পলকা বেড়াটাকে সরে যেতে দেখেছে। কিন্তু আজকে এই প্রথমবার ও যখন সুমিতের বুকে মাথা রেখে কাঁদছে, তখন অন্য কোনও রকম অনুভূতি টের পাচ্ছেনা। বরং একটা শান্তি পাচ্ছে। মনের সব ভার, সব চিন্তা, সব গ্লানি তার চোখের জলের ধারায় ধুয়ে, মুছে, পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। চোখের জলের বৃষ্টিতে ভিজে ওর মনের পৃথিবী পাচ্ছে নতুন রূপ। তার পরিচিত পৃথিবীর রূপটাই যাচ্ছে বদলে। তৈরী হচ্ছে নতুন সংজ্ঞা। ভালবাসার। বিশ্বাসের। আত্মিকতার। এর আগে কখনও এমন অনুভূতি হয়নি। বিয়ের এতদিন পরেও তাদের দুজনের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম, অদৃশ্য দেওয়াল মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। সেটা মনে মনে বেশ ভালোই বুঝতে পারত নীলিমা। এবং সেটার জন্য নিজেকেও অনেকাংশে দায়ী করত সে। আর কিছুটা সুমিতের উদ্দামতা, উশৃঙ্খলতাকে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সবকিছু মিথ্যা। তার সনাতনী ধ্যানধারণা। তার চিন্তাভাবনা। তার চারপাশের জগৎ। সবকিছু। সত্যিটা কেবল তারা দুজনে। সত্যি তাদের ভালবাসা। সত্যি তাদের পারষ্পরিক বিশ্বাস। এখন সুমিতের চেয়ে বড় আপনজন এই পৃথিবী কেউ নেই। একটা নতুন বিশ্বাস, একটা ভরসার জায়গা তৈরী হচ্ছে মনে মনে। যাই হোক না কেন, এই মানুষটা কখনও ওকে একলা ছেড়ে দেবেনা। প্রতি পলে, প্রতি মুহুর্তে পাশে পাবে এই মানুষটাকে। যে এইভাবে তাকে সব বিপদ থেকে বুকে আগলে রাখবে। ওকে রক্ষা করবে। বিশ্বাসটা যত দৃঢ় হচ্ছে, ততই শান্তি পাচ্ছে সে।
কিন্তু নীলিমার হঠাৎ করে এই কান্নার কারণ পরিষ্কার নয় সুমিতের কাছে। ওর কাছে এমন অভিজ্ঞতা একদমই নতুন। কিন্তু ও নীলিমাকে থামাল না বা বাধা দিল না। যদি কিছু ঘটেই থাকে এবং ও যদি কেঁদে নিজের মনটাকে হাল্কা করতে চায়, তাহলে কাঁদুক। অবশেষে নীলিমা একটা সময় শান্ত হল। তারপরেও কিছুটা সময় নিল সুমিত। তারপর আস্তে আস্তে নীলিমার মুখটাকে দুহাতে ধরে সামনের দিকে তুলে ধরল। জল টলটলে ভিজে চোখদুটো যেন কোন শান্ত দীঘির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। কারোকে কারোকে কাঁদলে মোটেও সুন্দর লাগেনা। কিন্তু একথাটা যে নীলিমার পক্ষে একদমই খাটেনা, সেটা আজ বুঝতে পারল সুমিত। নীলিমাকে এইরূপেও খুব সুন্দর লাগছে। এক দৃষ্টে কিছুক্ষণ ওর কান্নাভেজা চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে থাকার পর সুমিত জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে নীলিমা, কাঁদছো কেন?” ঘাড় নেড়ে উত্তর দিল, “কিছু না, এমনি।” মুচকি হেসে সুমিত বলল, “এমনি এমনি আবার কেউ কাঁদে নাকী?” বলে ওর চোখদুটো মুছিয়ে দিল। নীলিমা হঠাৎ বলল, “তুমি কখনও আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না তো সুমিত?” সুমিত অবাক হয়ে বলল, “এ আবার কী কথা? আমি তোমাকে ছেড়ে কোথায় যাবো?” নীলিমা একগুঁয়ে সুরে বলল, “আমার গা ছুঁয়ে বলো, যাই হোক না কেন, তুমি কখনও আমাকে ভুল বুঝবে না। আর সবসময় আমার সাথে সবসময়ে এইভাবে থাকবে?” “এসব কী ছেলেমানুষী হচ্ছে নীলিমা?” “কিছু ছেলেমানুষী নয়। তুমি বলো।” অবশেষে হার মানল সুমিত। নীলিমার গা ছুঁয়ে বলল, “আচ্ছা বাবা, এই নাও। আমি তোমার গা ছুঁয়ে বলছি, আমি তোমাকে কখনও ভুল বুঝব না। আর সারাজীবন এইভাবে তোমার সাথেই থাকবো। এথন বলোতো তুমি এরকম ভিজলে কী ভাবে?” এতটা সময় পর সুমিতের খেয়াল পড়ল নীলিমার ভিজে শাড়ীর উপর।
সুমিতের প্রশ্ন কিছুটা হলেও নাড়া দিয়ে গেল নীলিমাকে। ও কিছুতেই আসল কারণটা সুমিতকে বলতে পারবে না। তাই কিছুটা আমতা আমতা করে বলল, “ও কিছু না। এমনি।” সুমিত পরিষ্কার বুঝতে পারল নীলিমা ওর কাছে কিছু লুকিয়ে যাচ্ছে। ও বলল, “তুমি কী কিছু লুকাচ্ছো, নীলিমা?” সামান্য হলেও চমকে উঠল নীলিমা। যেটা সুমিতের দৃষ্টি এড়াল না। নীলিমা বলল, “তুমি রাগ করবে বলে, তোমাকে বলতে চাইছিলাম না। বিকালে বৃষ্টিটা শুরু হতেই মনের মধ্যে একটা ইচ্ছা জাগল। মনে হল, একবার অন্তত বৃষ্টিতে ভিজি। তাই টেরিসে গিয়েছিলাম বৃষ্টিতে ভিজতে।” করুণ মুখে নীলিমার এই স্বীকারোক্তি শুনে সুমিত না হেসে পারল না। ও শব্দ করে হেসে উঠল। সুমিতের হাসির আওয়াজ শুনে নীলিমা আশ্চর্য হয়ে ওর মুখের দিকে তাকাল। তারপর যখন বুঝতে পারল যে ও ওর কথা শুনেই হাসছে, তখন সামান্য রেগে বলল, “এতে এত হাসির কী হল?” সুমিত হাসতে হাসতে জবাব দিল, “স্যরি, স্যরি। তুমি এমনভাবে কথাটা বললে যেন তুমি কাউকে মার্ডার করে এসেছো। এতে আমার রাগ করার প্রশ্ন আসে কোথা থেকে? তোমার মন চেয়েছিল, তাই তুমি বৃষ্টিতে ভিজেছো। ঠিক আছে।” নীলিমা বুঝতে পারল সুমিত ওর সাথে মজা করছে। ও কপট রাগ করে বলল, “যাও, আর কোনোদিন তোমাকে কোনো কথা বলব না।” বলে ও যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াল। ঠিক সেই সময় সুমিত খপ করে ধরে গেয়ে উঠল, “সুন্দরীগো, দোহাই দোহাই মান কোরোনা, আজ নিশীথে কাছে থাকো, না বলো না। সুন্দরীগো, দোহাই দোহাই মান কোরোনা.......” তারপর ওকে নিজের দিকে টানল। টাল সামলাতে না পেরে ও হুমড়ি খেয়ে পড়ল সুমিতের বুকে। সলজ্জ কণ্ঠে বলল, “ধ্যাত্, পাগল একটা!” তারপর নীলিমা মুখ লুকালো সুমিতের চওড়া বুকের গভীরে।
[/HIDE]