What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

বন্দিনী (Completed) (1 Viewer)

[HIDE]সাঁইত্রিশ পর্ব-[/HIDE][HIDE][/hide][HIDE]

আজ দিন তিনেক হল সুমিত দিল্লী গেছে। সেই যে প্রথম দিন পৌঁছে ওকে ফোন করেছিল, তারপর আর ফোন করেনি। নীলিমা যতবারই ওকে ফোন করেছে, প্রতিবারই হয় সুইচড্ অফ্ আর নয়তো এনগেজড্। মাঝেমাঝে নট্ রিচেবল্। গত দু’দিনে একবারের জন্যও সুমিতের সঙ্গে ওর কথা হয়নি। সুমিতেরও দোষ নেই। ও তো আর দিল্লী বেড়াতে যায়নি বরং অফিসের কাজে গেছে। হয়তো কাজের চাপে ফোন করার সময় পায়নি। আর রাত্রিবেলা? কাজের চাপে ক্লান্ত হয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ছে। নিজের মনকে প্রবোধ দিয়ে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যায় ও। ও বিশ্বাস করে সুমিত জেনেশুনে এভাবে ওকে ফোন না করে থাকবে না। কিন্তু আজ সকাল থেকেই মনটা উচাটন হয়ে আছে। কিছুই যেন ভাল লাগছে না। কোন কাজেই মন বসছে না। বারবার চোখ চলে যাচ্ছে মোবাইলটার দিকে, এই আশায় যদি একবার সুমিত ফোন করে। ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য মনটা উতলা হয়ে উঠেছে। কিন্তু ওর আশাকে ব্যর্থ প্রমাণ করে একবারও ফোনটা বাজল না। ও নিজেও কয়েকবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু যথারীতি হয় এনগেজড্ আর নয়তো নট্ রিচেবল্। মনটা খুব খারাপ লাগছে। হঠাৎ করে নিজেকে কেমন যেন একা বোধ হচ্ছে। যদি ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলে কিছু থাকে, তবে সেটা বলছে আজ কিছু ঘটতে চলেছে। বড় কিছু একটা। তবে সেটা ভালো নাকী খারাপ সেটা বুঝতে পারছে না। ফোনটা এল দুপুরের একটু পরে। ও বিশ্রাম নেওয়ার জন্য একটু শুয়েছে। অন্যদিন শুলেই তন্দ্রা মত এসে যায়। কিন্তু আজকে সেসব কিচ্ছু আসছে। ও বিছানায় চুপচাপ শুয়ে ছিল। হঠাৎ ফোনে সেতারের সুর মধুর কণ্ঠে বেজে উঠল। ও ভাবল সুমিত হয়তো ফোনটা করেছে। ও তাড়াতাড়ি উঠে ফোনটা ধরতে গেল। কিন্তু মোবাইলের নীলচে স্ক্রিনে ওর পরিচিত নম্বরটার বদলে ফুটে উঠছে Private Number লেখাটা। একটা হতাশা আর ঘৃণা মিশ্রিত ভাব ফুটে উঠল ওর মনে। ও ফোনটা ধরল না। লাইনটা কেটে গেল। কয়েক মুহুর্ত পড়েই আবার বাজতে লাগল ফোনটা। এবার আর পারল না নীলিমা। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ্ করল।

“H…hello.”
“How dare you, not to take my call?” ও পাশের গলাটা যে রেগে গেছে, তা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
“I was late. It has been cut already.” শান্ত স্বরে জবাব দিল নীলিমা।
“Ok. Now listen. There’s good news for you.” ও পাশের গলাটা বলল।
“What good news?” জিজ্ঞাসা করল নীলিমা।
“You have finished the game properly. And you follow my every instruction passionately. So I’ve to give you a reward.”
“I don’t want any. Please leave me alone.”
“Oh, don’t worry. Surely I will. This final time you have to obey my instruction. After then I’ll never bother you. I promise.” বলল ও পাশের গলা।
“What I have to do?”
“Nothing. I know that, you like the sea very much. So today afternoon, you have to come to sea-beach to collect your reward.”
“And, what is that?”
“I know very well, you eagerly want to see me. So let it be happened. Come to sea-beach at sharp 5.30 pm and see me. This will your most precious reward of all.”
“And what’s the guaranty that you will not force me to do anything wrong.”
“I promised you earlier that, I won’t touch you. I want to see you from face to face. That’s all.”
“Ok. I’ll come. But you’ve to keep your promise. You’ll not bother me anymore.”
“I’ll obviously keep my promise. Believe me.”
“But how can I recognize you?”
“It’s not a problem. I’ll recognize you. And by the way, please wear your most favorite saree. I love to see you in saree.”

লাইনটা কেটে গেল। নীলিমা গিয়ে বিছানায় বসল। ওর কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু কান্না পাচ্ছেনা। অন্য একটা অনুভূতি জাগছে মনের মধ্যে। এই শেষবার। তার পরেই সে মেঘনাদের ছায়া থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। না জানি মানুষটা কোন অলৌকিক শক্তিবলে নীলিমার মনের ইচ্ছাগুলোকে টের পেয়ে যায়। ও সত্যি করেই মেঘনাদকে দেখতে চায়। দাঁড়াতে চায় তার মুখোমুখি। তাকে প্রশ্ন করতে চায়, সে কেন ওর সঙ্গেই এই খেলাটা খেলল? নিজেকে বড্ড ছোট মনে হচ্ছে। সে যেন অন্য কারোর হাতের পুতুল। তার অদৃশ্য সুতোর টানে সে নেচে চলেছে। ব্যাস। আর নয়। এখানেই এর ইতি। আজকেই এই নাটকের যবনিকা পতন ঘটবে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল চারটে বেজে সতেরো মিনিট। তার মানে হাতে আর এক ঘন্টা সময়। তার মধ্যে ওকে তৈরী হতে হবে। মনের সমস্ত সাহসকে সঞ্চয় করে ও উঠে দাঁড়াল।

ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় প্রতিফলিত হওয়া নারী মূর্তিটা কে? নিজেকে প্রশ্ন করল ও। নীলিমা? নীলিমা সেন? সুমিত সেনের অর্ধাঙ্গিনী? না, আজ ও কেবলই এক নারী। নামগোত্রহীনা। যে আজ মুখোমুখি হতে চলেছে তার প্রতিপক্ষের। এমন এক প্রতিপক্ষ, যে ওর জীবনটাকে পরিণত করেছে নিছকই এক খেলায়। ওর কোন পুরষ্কার চাইনা। ওর কেবলই চাই প্রতিশোধ। চরম শাস্তি। যার পরে ও নিজের স্বামীর কাছে, পরিচিতদের কাছে, এই সমাজের কাছে মাথা তুলে বলতে পারবে, যে আমার লজ্জা, আমার সম্ভ্রম নিয়ে এভাবে খেলা করবে, তাকে আমি এইভাবেই উপযুক্ত শাস্তি দেবো। ধীরে ধীরে নিজেকে পরণের কাপড় থেকে বের করে আনল। তারপর পরে নিল ওর সবথেকে প্রিয় শাড়িটা। সেই নীল শাড়ীটা। এই শাড়ীটা ওকে সুমিত গিফ্ট দিয়েছিল। ওর সবথেকে পছন্দের শাড়ি। প্রথম যেদিন ও এই শাড়িটা পরেছিল, সেদিনই কাকতালীয়ভাবে শুরু হয়েছিল এই খেলার। আর আজ ও আবার এই শাড়ীটাই পরেছে। কারণ ও চায় আজকেই এই খেলার শেষ হোক। তৈরী হবার পর ও আরেকবার সুমিতকে ফোন করার চেষ্টা করল। কিন্তু বারবার সুইচড্ অফ্ বলছে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। না, এখন দূর্বলতার সময় নয়। শেষ মুহুর্তে এভাবে হেরে গেলে চলবে না। ওকে মেঘনাদের মুখোমুখি হতেই হবে। ওর নিজের জন্য। ওর সুমিতের জন্য। ওদের দুজনের সুরক্ষিত ভবিষ্যতের জন্য। যাওয়ার আগে ও শেষবার নিজেকে আয়নায় দেখল। হ্যাঁ, ও তৈরী। মোবাইলটা হাতে তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়ার জন্য তৈরী হল। তবে তার আগে আর একটা জিনিস ও নিজের সাথে নিয়ে নিল। ওটার আজকে দরকার লাগবে। রান্নাঘর থেকে তরকারী কাটার ধারালো ছুরিটা শাড়ীর আঁচলের ভাঁজে লুকিয়ে নিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে পড়ল নীলিমা। মেঘনাদের খোঁজে। [/HIDE]
 
[HIDE]আটত্রিশ পর্ব-[/HIDE][HIDE][/hide][HIDE][/hide]​
[HIDE]
“এই বালুকাবেলায় আমি লিখেছিনু,
একটি সে নাম আমি লিখেছিনু,
আজ সাগরের ঢেউ দিয়ে
তারে যেন মুছিয়া দিলাম.....”
সময়ের কিছুটা আগেই গন্তব্যে পৌঁছে গেছে নীলিমা। সাড়ে পাঁচটা বাজতে এখনও কিছুটা দেরী আছে। মুম্বাইয়ে বেশ দেরী করেই সন্ধ্যা হয়। লোকজন এক এক করে আসতে শুরু করেছে সমুদ্র-তটে। যে যার নিজের কাজে ব্যস্ত। কয়েকটি ছোট ছোট ছেলে একসঙ্গে জোট বেঁধে খেলছে। কিছু উঠতি ছেলে মেয়েকে একসাথে হাত ধরাধরি করে ঘুরতেও দেখা যাচ্ছে। কয়েকজন বয়স্ক ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলাকেও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এদের কাউকেই মেঘনাদ বলে মনে হচ্ছে না। ও চুপচাপ একদিকে দাঁড়িয়ে আছে আর সবার দিকেই একবার করে তাকিয়ে দেখছে। কিন্তু কাউকেই তেমন সন্দেহ করা যাচ্ছে না। ও সমুদ্রের খুব কাছে না গিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল। তবে সমুদ্রের গর্জন বেশ ভালমতোই কানে আসছে। সমুদ্রের দিকে ভাল করে তাকাল। ও অনেকদিন হল এখানে আছে। কিন্তু সমুদ্রের ধারে এই প্রথমবার এল। সময় একটু একটু করে এগিয়ে চলছে। সূর্য পশ্চিমদিকে পাটে বসছে। সমুদ্রের পিছনে সূর্যটা লাল আবীরের থালার আকার নিয়েছে। প্রায় মেঘহীন আকাশটা সেই থালা থেকে কিছুটা আবীর নিয়ে হয়ে উঠছে লাল। সেই লালের আঁকাবাঁকা প্রতিবিম্বটা সমুদ্রের জলে পড়ছে। ও মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই লালের দিকে। লাল। খুব ভয়ঙ্কর রং। বিপদের রং। আবার প্রেমিকের গোলাপের রংও তো লাল। রক্তের রং লাল। আবার সিঁদুরের রংও তো লাল। অদ্ভুত এক উলোট-পূরাণ। একদিকে বিপদ। অন্যদিকে ভালবাসা। দু’য়ের রং মিলেমিশে এক। অন্যদিন হলে আকাশ আর সমুদ্রের এই রং-মিলান্তী খেলাটা আরোও উপভোগ করতে পারত। কিন্তু আজ ওর মনে কেবলই একজন। মেঘনাদ।
প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট কেটে গেছে। কিন্তু কেউই ওর দিকে তাকাচ্ছে না। বা ওর দিকে এগিয়ে আসছে না। হাতে ধরা মোবাইলটার দিকে তাকাল এক ঝলক। বিশ্বাসঘাতকটা পুরোপুরি চুপচাপ এখন। সাড়ে পাঁচটার থেকে সময় অনেকটাই এগিয়ে গেছে। মেঘনাদের তো সাড়ে পাঁচটায় আসার কথা ছিল? তাহলে এখনও আসছে না কেন? অবশ্য ঐসব মানুষের কাছে পাংচুয়ালিটী আশা করা বৃথা। কিন্তু মনে হচ্ছে একটু যেন বেশী দেরীই করছে মেঘনাদ। একটু আগে মনের কোণে জমা থাকা রাগটা ফিকে হতে হতে এখন তীব্র ঘৃণায় পরিণত হচ্ছে। যতটা না মেঘনাদের উপর, তার থেকে অনেক অনেক বেশী নিজের উপর। হ্যাঁ। নিজের উপর ধৃণা বা রাগ বেশ বুঝতে পারছে ও। ও কীভাবে একটা অচেনা অজানা মানুষের পাতা ফাঁদে অনায়াসে ধরা দিল? তার মত বুদ্ধিমতী, উচ্চশিক্ষিতা মেয়ের পক্ষে এটা করাটা একান্তই নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। ও অনেক আগেই এসব কথা সুমিতকে খুলে বলতে পারত। তা না করে ও একের পর এক ভুল পদক্ষেপ নিয়ে গেছে। বিশ্বাসঘাতকতা করে গেছে সুমিতের সঙ্গে। ওর চোখে, নিজের চোখে নিজেকে ক্রমশ ছোট, ক্রমশ সস্তা করে তুলেছে। আজকের এই পরিস্থিতির জন্য যতটা না মেঘনাদ দায়ী, তার থেকেও বেশী দায়ী সে। আজও ও সেই অচেনা মানুষটার মুখের কথায় বিশ্বাস করে এখানে চলে এল। অথচ ওর প্রতি সুমিতের যে বিশ্বাস, যে ভালবাসা তার কী বিন্দুমাত্র দাম ওকে দিয়েছে? দেয়নি। কারোর কাছে ক্ষমা চাইলে, তার কাছে ক্ষমা হয়তো পাওয়া যায়, কিন্তু আত্মগ্লানি তাতে একবিন্দুও কমে না। সবকথা জানলে সুমিত হয়তো ওকে ক্ষমা করে দেবে। কিন্তু ও নিজেকে কী ক্ষমা করতে পারবে? পারবে না। সারাজীবন ও একটাই আত্মগ্লানি নিয়ে বাঁচবে যে, ও সুমিতের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এই আত্মগ্লানি থেকে রেহাই পাওয়ার একটাই উপায়। প্রায়শ্চিত্ত।
আর তার পন্থাটা ওর চোখের সামনেই আছে। একবার সুমিতের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু ফোনটা করতে পারছে না। তাই নিজের মনের কথাটা মোবাইলে লিখতে লাগল। “I know, you love me very much. And trust me too. Bu I’ve to confess that I’ve betrayed you. Please forgive me for that. I am going to punish myself. I also love you very much. - Your Neelima.” তারপর লেখাটা SMS করে পাঠিয়ে দিল সুমিতের নম্বরে। কয়েক মুহুর্ত পরে Message Sent কথাটা ফুটে উঠতেই মোবাইলটাকে সুইচড্ অফ্ করে দিল ও। এখন ওর মনে একটুও আত্মগ্লানি নেই। ও ধীরপায়ে এগিয়ে গেল সমুদ্রের দিকে। সমুদ্রের কাছে এসে একমুহুর্তের জন্য থামল ও। একটা বড় ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিয়ে গেল ওর পায়ের পাতা। মনটা এক মুহুর্তে চলে গেল অনেক দূরে। ছোটবেলায় একবার বাবার সঙ্গে দীঘা বেড়াতে গিয়েছিল। খুব মজা হয়েছিল। আজ অনেকদিন পর বাবার মুখটা মনে পড়ছে। বাবা, তোমার এই অবোধ মেয়েটাকে ক্ষমা কোরো। মনে পড়ল সুমিতের মুখটাও। ভিজে আসা চোখের কোলদুটোকে মুছে নিল। এখন দূর্বল হওয়ার সময় নয়। মনটাকে দৃঢ় করে সামনের দিকে এগিয়ে চলল। সমুদ্রের জল ওর পায়ের পাতা, হাঁটু বয়ে কোমর ছুঁইছুঁই। হাতে ধরা মোবাইলটা গায়ের জোরে ছুঁড়ে দিল সামনের দিকে। ভুস করে ডুবে গেল সেটা। এবার ওর পালা। ও আরোও এগোতে লাগল। পিছনে একটা গুঞ্জন উঠছে, “দেখো বো ডুব্ রহী হ্যায়। কোই তো বাঁচাও উসে।” তাতে বিশেষ পাত্তা দিল না ও। আরোও এগিয়ে চলল। সমুদ্রের ঢেউ বারবার ধাক্কা খাচ্ছে ওর বুকে। তারপর গলা, নাক। অবশেষে চোখ। অনেকটা নোনতা জল পেটে গেল। গা’টা গুলাচ্ছে। গোলাক। একটু পরেই সব শান্তি। কিন্তু সেসব কিছুই ঘটল না। হঠাৎ করে একটা শক্ত হাত ধরল ওর হাতটাকে। তারপর ক্রমশ ওকে তীরের দিকে টেনে নিয়ে চলল। ও হাত পা ছুঁড়তে লাগল। তাতে বিশেষ কিছু লাভ হলো না। হাতটা ওকে বেশ শক্ত করেই ধরে আছে। ও ক্রমশ তীরের দিকে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু ও নিজে ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। একসময় ও তীরে এসে পৌঁছাল। একরাশ অচেনা মুখের সারির মাঝে ওর রক্ষকর্তার মুখটাই চেনা লাগল। সুমিত। তারপরেই রাশি রাশি কালো অন্ধকারকে সঙ্গে নিয়ে জ্ঞান হারালো নীলিমা।
[/HIDE]
 
[HIDE]ঊনচল্লিশ পর্ব-[/HIDE][HIDE][/hide][HIDE]

ড্রয়িংরুমে পাশাপাশি বসে সুমিত আর মি. মেহরা। ভিতরে বেডরুমে নীলিমার কাছে আছেন মিসেস মেহরা। কিছুক্ষণ আগে অজ্ঞান অবস্থায় ওকে নিয়ে এসেছে সুমিত। ড. দেশাইকে ফোন করেছিল। উনি এসে চেক্ করে গেছেন। বলে গেছেন। ভয়ের কিছু নেই। শকেতে অজ্ঞান পড়েছে। যেকোনো সময় জ্ঞান চলে আসবে। যদি কিছু অসুবিধা হয়, তাহলে সুমিত যেন ওনাকে অবশ্যই ফোন করে। সুমিত কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর অঘটনটার কথা ভাবছিল। যদি আর ও একমুহুর্ত দেরী করত ওখানে পৌঁছাতে, তবে কি যে ঘটে যেত সেটা ভাবতে গেলে শিউড়ে উঠছে। ও একটা SMS পাঠিয়েছিল, যাতে লিখেছিল, ও নিজেকে শাস্তি দিতে যাচ্ছে। কথাটার মানে ওর বুঝতে বিশেষ একটা অসুবিধা হয়নি। তবে ও কী করবে, সেটা বুঝে উঠতে পারেনি। ও নীলিমাকে সাতদিনের পর ফিরবে বলে গেলেও, কাকতালীয়ভাবে আজই ফিরেছে। ফ্লাইটের কারণে ফোনটাকে সুইচড্ অফ্ করে রেখেছিল। তারপর অন্ করতে ভুলে গেছে। বাড়িতে ঢোকার মুখে ও ফোনটা অন্ করে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে SMS টি ঢোকে ওর ফোনে। প্রথমে না পারলেও, পরে বুঝতে পারে এর অর্থ কী। একটা আশঙ্কা মনের মধ্যে পাক খেয়ে ওঠে। কিন্তু ফ্ল্যাটের দরজায় চাবি। একমুহুর্ত সময় নষ্ট না করে ও মি. মেহরার ফ্ল্যাটে যায়। সেখানেই মিসেস মেহরা ওকে জানান প্রায়ঘন্টা খানেক আগে ওনার সঙ্গে নীলিমার দেখা হয়েছিল। ওনার প্রশ্নের উত্তরে নীলিমা জানায় যে সে সি-বিচে যাচ্ছে। উনি আর কোনও প্রশ্ন করেননি। ওনার কথা শুনে সুমিত প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে হাজির হয় সি-বিচে। হঠাৎই একটা জায়গায় জটলা চোখে পড়ে। ও সেখানেই দৌড়ে যায়। ওখানে পৌঁছে জানতে পারে কোনও এক মহিলা জলে ডুবে যাচ্ছে। নীলিমা নয়তো? আবার একটা আশঙ্কা জমা হয় বুকের মাঝে। কয়েকজন জলে নেমেও পড়েছে ততক্ষণে। সুমিতও কালক্ষেপ না করে জলে নেমে পড়ে। সাঁতার জানা থাকায় কোন অসুবিধা হয়না ওর। ও-ই সাঁতরে সবার আগে গিয়ে পৌঁছায় মহিলাটির কাছে। তখনই ও বুঝতে পারে মহিলাটি আর কেউ নয়, নীলিমা। তারপর ওকে কোনরকমে ধরে তীরে নিয়ে আসে সুমিত। তীরে এসে পৌঁছবার পরেই জ্ঞান হারায় নীলিমা।

নীলিমার এইরকম পদক্ষেপের কারণ অন্যদের কাছে ধোঁয়াশা হলেও, তার কাছে ব্যাপারটা পুরোপুরি পরিষ্কার। এবং আজকের এই ঘটনার জন্য ও নিজেকেও দোষারোপ করছে। ঘটনাটা অনেকদিন আগেই ও জেনে গিয়েছিল। তবুও ও নীলিমাকে কোন কথাই জিজ্ঞাসা করতে পারেনি বা ওকে এ বিষয়ে কিছু বলতেও পারেনি। আসলে ব্যাপারটা নিয়ে নিজেই কিছুটা ধোঁয়াশায় ছিল। ও ভেবেছিল ব্যাপারটা যখন নিজে বুঝতে পারবে, তখনই বিষয়টা নিয়ে কথা বলবে নীলিমার সঙ্গে। এবং ওকে সব জিনিসটা বুঝিয়ে দেবে। তাই ও সেমিনারে যাবার নাম করে এখান থেকে চলে গিয়েছিল। এবং গিয়েছিল এই বিষয়টা সম্বন্ধে জানতেই। ও জেনেছেও। আগে ওর মনে যেটুকু দ্বিধা বা দ্বন্দ্ব ছিল, এখন তার ছিটেফোঁটাও নেই। ও এখন অনেকটাই নিশ্চিন্ত। সেই নিশ্চিন্ত ভাবটা নিয়েই আজকে বাড়ি ফিরেছিল এই ভেবে যে, এবার ও নীলিমাকে গোটা বিষয়টা সবিস্তারে বোঝাতে পারবে। কিন্তু আজকের ঘটনাটা ওকে বেশ দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। এখন কি ও নীলিমাকে সব বোঝাতে পারবে? নাকি নীলিমাই সব বুঝতে পারবে বা চাইবে? নীলিমা ওকেই সন্দেহ করে বসবে নাতো? আর যাই হোক, ও নীলিমার সন্দেহের পাত্র কোনমতেই হতে চায়না। ওকে বোঝাতেই হবে। আর নীলিমাকে সব বুঝতেই হবে। “উসকো হোঁশ আ গয়া হ্যায়। তুমহে ঢুন্ঢ্ রহী হ্যায়।” মিসেস মেহরার ডাকে ওর চিন্তার জালটা ছিঁড়ে গেল। ও ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়াল। মি. মেহরা বললেন, “সুমিত, তুম্ যাও। উসকে সাথ অকেলে মে বাত করো।” সুমিত একবার মি. মেহরার দিকে নীরব চাহনি মেলে বেডরুমে ঢুকে গেল।

একটু আগেই ওর জ্ঞানটা ফিরে এসেছে। চোখটা খুলে প্রথমে বুঝতে পারল না, ও কোথায় আছে। একটা বিছানায় শুয়ে আছে ও। যখন ও অজ্ঞান হয়েছিল, তখন ও সমুদ্রের ধারে ছিল। সমুদ্রে ও ডুবতে যাচ্ছিল। কিন্তু কেউ ওকে বাঁচিয়ে তীরে নিয়ে আসে। জ্ঞান হারাবার আগে এক ঝলক সুমিতের মুখটা দেখেছিল। তার মানে সুমিতই ওকে বাঁচিয়েছে। কেন বাঁচাল ওকে? এইভাবে আস্তে আস্তে দগ্ধে মরার চেয়ে, একেবারে মরাই ভাল ছিল। তার থেকেও বড় কথা সুমিত তো দিল্লী গিয়েছিল! ওর তো সাতদিন পরে আসার কথা! ও আজকেই ফিরে পড়ল কেন? ওর চিন্তার মাঝেই সুমিত ঘরে ঢুকল। ওকে দেখতে নীলিমা উঠে বসতে গেল। সুমিত বাধা দিয়ে বলল, “উঁহু, এখন উঠো না। শুয়ে থাকো কিছুক্ষণ।” সুমিত ওর পাশে বিছানায় গিয়ে বসল। কিছুক্ষণ কারোর মুখেই কোন কথা নেই। প্রথম কথা নীলিমাই বলল। “কেন আমাকে বাঁচালে, সুমিত? বেশ তো মরতে যাচ্ছিলাম।” কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সুমিত বলল, “তুমি বোকার মত এই কাজটা কেন করতে গেলে?” নীলিমা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। কেঁদে ফেলল। আর কোন উপায় নেই। সুমিতকে সব কথা খুলে বলতে হবে। ওর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। “আমি পাপ করেছি, সুমিত। তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি।”

“বিশ্বাসঘাতকতা? আমার সঙ্গে? কিভাবে?” আশ্চর্য হয়ে বলল সুমিত।
“হ্যাঁ। তোমার সঙ্গে। তোমার কাছে নিজেকে ছোট করে তুলেছি।”
“সব কথা খুলে বলো আমাকে।”

নীলিমা এবার ওকে সমস্ত কথা খুলে বলল। মেঘনাদের প্রথম SMS থেকে শুরু করে ওকে ফোন করে ব্ল্যাকমেলিং এবং আজকের ফোন করে ওকে সি-বিচে ডেকে পাঠানো। সব কথা। সুমিত সবকিছু চুপচাপ শুনে গেল। সবকিছুই ওর আন্দাজের সাথে মিলে যাচ্ছে। আর তাই ও ভয় পাচ্ছে। কারণ নীলিমাকে সত্যিটা বোঝানো যাবে কি? নীলিমার কথা বলা শেষ করে কাঁদতে শুরু করেছে। সুমিত ওর চোখদুটো মুছিয়ে দিয়ে বলল, “কেঁদো না, নীলিমা। তুমি একদম ঠিক করেছো। আমি তোমার জায়গায় থাকলে হয়তো এটাই করতাম। কিন্তু তুমি এই কথাগুলো তুমি আমাকে আগে বললে ভালো করতে। এতসব কিছুই ঘটত না।”

“বিশ্বাস করো। আমি অনেকবার ভেবেছি, তোমাকে সবকথা খুলে বলি। কিন্তু তোমাকে বলতে গিয়েও পারিনি, কারণ আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমার ভয় ছিল তোমাকে সবকথা বলে দিলে, মেঘনাদ হয়তো তোমার চরম ক্ষতি করে দিতে পারে। এবং সেটা আমি কখনই সহ্য করতে পারতাম না। তোমার কোনরকম ক্ষতি হোক, সেটা আমি চাইনি।”

“চাইলেও মেঘনাদ আমার কোন ক্ষতি করতে পারত না।” শান্তস্বরে বলল সুমিত।
“কেন?”
“কারণ তুমি আমার সাথে ছিলে।”
“তার মানে?”
“বলব। তোমাকে সব বলব এবং বোঝাব। তার আগে বলি, আমি কিন্তু মেঘনাদের কথা জানতাম।”
“তুমি জানতে?” নীলিমার গলায় বিস্ময় ঝরে পড়ছে।
“হ্যাঁ। তবে বেশীদিন নয়। অসুস্থতার কারণে তোমাকে যখন নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়, তখন।”
“কীভাবে?”
“যখন তোমাকে নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়, তীব্র জ্বরের কারণে তুমি অজ্ঞান ছিলে। পরে জ্বর সামান্য কমলে তোমার জ্ঞান ফিরে আসে। তখন তোমার কেবিনে উপস্থিত ছিলেন ডা. শর্মা। তিনিই আমাকে বলেন যে, জ্ঞান হতে জ্বরের ঘোরে তুমি বারবার কেবল একটা কথাই বলছিলে।”

“কী কথা?” উৎকণ্ঠায় দম বন্ধ হয়ে আসে নীলিমার। [/HIDE]
 
[HIDE]চল্লিশ পর্ব-[/HIDE][HIDE][/hide][HIDE]

“বলো সুমিত, কী কথা বলেছিলাম আমি জ্বরের ঘোরে?” সুমিতের নিস্তব্ধতা নীলিমাকে আরও উৎকণ্ঠিত করে তোলে।
“তুমি বলেছিলে, Meghnaad, please leave me alone. আর এটা একবার নয় বরং বেশ কয়েকবার বলেছিলে। ডা. শর্মা প্রথমে ভেবেছিলেন, তুমি হয়তো জ্বরের ঘোরে ভুল বকছো। কিন্তু ঐ একই কথা বারবার বলার ফলে ওনার সন্দেহ লাগে। উনি আমাকে ডেকে পাঠিয়ে এই বিষয়টা বলেন। এবং আমার কাছে জানতে এই মেঘনাদটি কে? সেদিন আমি ওনাকে কোন সদুত্তর দিতে পারিনি। কারণ সেদিন আমি মেঘনাদ সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। ওর বিষয়ে আমি ছিলাম একেবারেই অজ্ঞ। কিন্তু আজ আমি মেঘনাদের পরিচয় জানি। তাকে আমি চিনি।” একটানা বলে চুপ করল সুমিত।
সুমিত চুপ করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নীলিমা বলল, “তুমি ওর পরিচয় জানতে! তা সত্ত্বেও তুমি আমাকে কিছুই জানাওনি! আমাকে ওর বিষয়ে সতর্ক করে দাওনি! কেন, সুমিত?”
“কারণ, গোটা বিষয়টা তখন আমি নিজেই বুঝে উঠতে পারিনি। আর মেঘনাদের পরিচয় আমি মাত্র গতকাল বুঝতে পেরেছি। তাই আজই আমি ফিরেছি, ওর বিষয় নিয়ে তোমার সাথে কথা বলব বলে।”
“তুমি দিল্লীতে গিয়ে মেঘনাদের পরিচয় পেলে?”
“আমি দিল্লী যাইনি, নীলিমা। আমি গিয়েছিলাম কলকাতায়।” শান্তস্বরে উত্তর দিল সুমিত।
“কলকাতায় কেন? আর তাছাড়া আমাকে মিথ্যা কথাই বা বললে কেন?” আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল নীলিমা।
“কারণ আমি চেয়েছিলাম বিষয়টা আমি নিজে আগে বুঝব? তারপর তোমাকে সব কথা খুলে বলব। তাই তোমাকে আমার কলকাতায় যাবার বিষয়টা জানাইনি।”
“কোথায় গিয়েছিলে কলকাতায়? তাছাড়া কোথায় পেলে মেঘনাদের পরিচয়?”
“তোমাদের বাড়িতে। প্রথম আঁচ পেলাম তোমার বাবার কাছে। ওনার সঙ্গে কথা বলে বেশীরভাগটাই বুঝতে পারলাম। বাকিটা পারলাম আমার এক পুরানো বন্ধুর কাছে।”
“তুমি আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলে? আর বাবার সাথে মেঘনাদকে নিয়ে কথা বললে? বাবা তোমাকে মেঘনাদের পরিচয় দিল? তার মানে বাবা মেঘনাদ চেনে!” বিস্ময় ঝরে পড়ছে নীলিমার গলা থেকে।
“সেটা বলাটা একটু ভুল হয়ে যাবে। উনি মেঘনাদকে চেনেন না। মানে চিনতেন না। কিন্তু আমার কাছে সমস্ত বিষয় শোনার পর আন্দাজ করতে পারলেন মানুষটা কে। এবং তাকে কেবল উনিই নন, আমিও বেশ ভাল কর চিনি। ইন ফ্যাক্ট সে তোমারও খুব পরিচিত।”
“কে সে? বলো সুমিত কে সে?”
“বলছি। তার আগে তুমি একটা জিনিস বলোতো।”
“কী?”
“যখন তোমার ফোনে SMS বা কলগুলো আসত তখন তোমার আশেপাশে কেউ থাকত? আমি বা অন্য কেউ?”
“না। আমি একাই থাকতাম। তবে হ্যাঁ, নার্সিংহোমে ছিলাম তখন আমার কাছে মেহরা আন্টি ছিলেন। ওনার সামনেই ম্যাসেজটা আসে।”
“SMS গুলো আসার মুহুর্তে তুমি ঠিক কী করতে খেয়াল আছে?”
“মানে? কী আবার করবো? SMS গুলো তো যখন তখন আসত। আমি হয়ত চুপচাপ বসে থাকতাম বা বাড়ির কাজ করতাম। আর শেষবার মেহরা আন্টির সাথে গল্প করছিলাম।”
“তার মানে SMS বা কলগুলো আসার সময় তুমি আনমনা থাকতে বা কোন না কাজে ব্যস্ত থাকতে। তোমার মনোযোগ ফোনের প্রতি থাকত না।”
“হতে পারে। কিন্তু তাতে কী? আমি তো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।”
“আমি তোমাকে সব বুঝিয়ে বলব। উতলা হয়ো না। তার আগে আমি একটা শেষ প্রশ্ন করব। বলোতো মেঘনাদের গলাটা কিরকম?”
সুমিতের এই প্রশ্নটা নীলিমাকে কিছুটা ধন্ধে ফেলে দিল। ও মাত্র দু’বার গলাটা শুনেছে কিন্তু এই মুহুর্তে ওর মনে পড়ছে না। তাই ও কোন উত্তর দিতে পারল না। চুপ করে রইল। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে সুমিত বলল, “কী, মনে পড়ছে না? আচ্ছা, বাদ দাও। বলোতো SMS গুলো আসত কোন নম্বর থেকে?”
“কোন নম্বর উঠত না। কেবল Private Number কথাটা উঠত।”
“কিন্তু তোমার নম্বরটাও তো Private Number. আমি একসঙ্গে আমার আর তোমার Personal নম্বরটা Private Number করেছিলাম। তাই তোমার নাম্বারে SMS পাঠাতে গেলে বা ফোন করতে গেলে মেঘনাদকে তো তোমার ফোন নম্বরটা জানতে হবে। নাহলে সে তোমাকে SMS পাঠাতে পারবে না বা ফোনও করতে পারবে না। তাহলে মেঘনাদ তোমার ফোন নম্বরটা পেল কোথায়?”
নীলিমা বুঝতে পারল সুমিতের কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। সুমিতের যুক্তিই যদি ধরা হয় তবে সব সন্দেহ ওর উপরেই পড়বে। কারণ সুমিতই একমাত্র ওর নম্বরটা জানে। তবে কি.....? না, না, এটা কোনমতেই হতে পারেনা। সুমিত ওর মনের ভাব বুঝতে পেরে বলল, “ঠিকই ভাবছো। যদি আমার কথাটাই ধরা হয়, তবে মেঘনাদ, আমি ছাড়া অন্য কেউ হতে পারে না। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি মেঘনাদ নই। আর আমি ছাড়াও আর একজন তোমার ফোন নম্বর জানে।”
“কে সে?”

অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে সুমিত বলল, “তুমি নিজে।” সুমিতের কথাটা ওর বিশ্বাস হল না। কি বলতে চাইছে ও? নীলিমা বলল, “কী বলতে চাইছো তুমি? মেঘনাদ আমার পূর্বপরিচিত? আর আমিই ওকে আমার নম্বরটা দিয়েছি?” শান্ত স্বরে সুমিত বলল, “রাগ কোরোনা। আমি সেকথা বলতে চাইনি। এবার আমি যে কথাগুলো তোমাকে বলব, সেগুলো মাথা ঠাণ্ডা করে মন দিয়ে শোনো। তাহলেই বুঝতে পারবে আমি আসলে কি বলতে চাইছি।” নীলিমা চুপ করে রইল। এবং সুমিত বলতে শুরু করল মেঘনাদের ইতিবৃত্ত। [/HIDE]
 
[HIDE]একচল্লিশ পর্ব-[/HIDE][HIDE][/hide][HIDE]


“সুমিত সেন, সুমিত সেন।” নিজের নামটা দু’বার শোনার পর ও উঠে দাঁড়াল। আসলে ও একটা গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিল। তাই প্রথমবারে শুনতে পায়নি। নীলিমার বাবার কথাগুলো ওকে বেশ ধন্ধে ফেলে দিয়েছে। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। তখনই ওর একজনের কথা মনে পড়ে। সৈকত। সৈকত দত্ত। ওর সঙ্গে কলেজে পড়ত। পরে যা হয়, আর যোগাযোগ তেমন নেই। তবে ওর নম্বরটা জোগাড় করা তেমন অসুবিধার নয়। সৈকত এখন বেশ বিখ্যাত মানুষ। সহজেই নম্বরটা জোগাড় হয়ে গেল। কাল রাত্রেই ও ফোন করেছিল সৈকতকে। প্রথমে চিনতে পারেনি। তারপর মুম্বাইয়ের কথা বলতে চিনতে পারে। সুমিত ওর সাথে দেখা করবে বলে। সৈকতই ওকে আসতে বলে ওর চেম্বারে। সুমিত নির্দিষ্ট সময়ের আগেই চলে আসে। অ্যাটেন্ডেন্সটিকে জানায় যে সৈকতের সঙ্গে অ্যাপয়েন্ট আছে। অ্যাটেন্ডেন্সটি ওকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলে। ও তাই করে। বসে বসে কথাগুলোকে নিজের মনেই সাজিয়ে নেয়। যাতে সৈকতের সামনে সবকথা ঠিকঠাক বলতে পারে। একটু পরেই অ্যাটেন্ডেন্সটি ডাকে। আনমনা থাকায় শুনতে পায়নি। দ্বিতীয়বার বেশ বিরক্ত হয়েই ডাকে সে। “সুমিত সেন, সুমিত সেন।” ও ঝটপট উঠে দাঁড়ায়। তারপর সে যায় অ্যাটেন্ডেন্সটির কাছে। মেয়েটি বলে, “যান, স্যার আপনাকে ডাকছেন।” সৈকতের নেমপ্লেট লেখা দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢুকল সুমিত। সামনেই একটা চেয়ারে বসে সৈকত। বয়স বাড়লেও মুখশ্রীটা প্রায় একই আছে সৈকতের। সুমিতকে ঢুকতে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সৈকত। হাসি মুখে বলল, “এসো এসো বন্ধু। এই গরীবখানায় তোমাকে স্বাগত।” না, সৈকত এখনও সেইরকমই আছে। সুমিত হেসে হাত বাড়িয়ে দিল। সৈকত হ্যান্ডশেক করে ওকে চেয়ারে বসতে ইশারা করল। দু’জনে বসার পর সৈকতই প্রথম কথা বলল। “উফ্, কতদিন পর তোকে সামনাসামনি দেখলাম। গলাটা একদম পাল্টে গেছে। দেখতে কিন্তু সেইরকমই আছিস। একদম চিকনা।” বন্ধুর রসিকতায় মৃদু হেসে সুমিত বলল, “তুইও একইরকমই আছিস। আবার নামটামও করেছিস, দেখছি।” সৈকত সুর করে গেয়ে উঠল, “সকলি তোমারই ইচ্ছা/ইচ্ছাময়ী তারা তুমি/তোমার কর্ম তুমি করো মা/লোকে বলে করি আমি” বলে হাসতে থাকে। সুমিত বলল, “পেশেন্টদের কাছেও কী এইরকমই পাগলামি করিস?” সৈকত বলল, “ধুর। আমার পাগল হওয়ার সময় নেই।” সুমিত বলল, “ঠিকই তো বিখ্যাত সাইক্রিয়াটিস্ট ডা. সৈকত দত্ত পাগল হলে, রোগীদের কী হবে?” সৈকত বলল, “আমার কথা ছাড়। আগে বল্ কী খাবি? চা না কফি?” “আচ্ছা চা-টাই বল্।” সৈকত বেল বাজিয়ে ওর অ্যাটেন্ডেন্সটিকে ডাকল। অল্পক্ষণ পরে মেয়েটি এসে দাঁড়াতে সৈকত ওকে দু’কাপ চা দিতে বলল। মেয়েটি চলে গেলে সৈকত বলল, “এবার বল্, কালকে কী যেন সব প্রবলেমের কথা বলছিলি?” সুমিত বলল, “হ্যাঁ। একটা প্রবলেমে পড়েছি। তোর কথাই মনে পড়ল। তাই তোকেই ফোন করলাম।” সৈকত বলল, “গোটাটা খুলে বল্।” সুমিত কিছু বলার আগেই মেয়েটি দু’কাপ চা হাতে চেম্বারে ঢুকল। ওদেরকে চা দেবার পর সৈকত জিজ্ঞাসা করল, “বাইরে ক’জন আছে?” মেয়েটি বলল, “জনা চারেক।” সৈকত বলল, “ওনাদেরকে বলে দাও, ওনাদেরকে বিকেলের পর দেখবো। আর দেখো এখন যেন আমাকে কেউ যেন ডিস্টার্ব না করে।” মেয়েটি ঘাড় নেড়ে চলে গেল।



মেয়েটি চলে গেলে সুমিত চায়ের কাপে আলতো চুমুক দিয়ে বলতে শুরু করল, “আজ প্রায় একবছর আগে আমি বিয়ে করেছি নীলিমাকে। মুম্বাইয়ে নয়। এখানে। পশ্চিমবঙ্গে। মেয়েটি খুব ভাল। সব কাজ করে। আমার যত্নআত্তি করে। কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু ওর একটাই দোষ, দোষই বা বলি কি করে। ওর চরিত্রের একটা দিক হল ও খুবই চাপা স্বভাবের। নিজের মনের কথা চট করে কাউকে বুঝতে দেয়না। আমার কাছেও ও ঠিক সহজ হতে পারেনা কখনো কখনো। কিন্তু সে সব নিয়ে আমি ওকে কোনদিন কিছু বলিনি। যে যেমন, তাকে তেমনভাবে থাকতে দেওয়াই ভাল। তাছাড়া আমি ভেবেছিলাম, নিজের বাড়ি ছেড়ে, আত্মীয় পরিজনদের ছেড়ে ও হয়ত নতুন পরিবেশে ঠিক করে খাপ খাইয়ে উঠতে পারছে না। একটু সময় দিলে হয়ত নিজে থেকেই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তাই ঐসব নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাই নি। হঠাৎ মাস দেড়েক আগে থেকে ওর মধ্যে একটা বদল টের পেলাম।”

“কী রকম বদল?” সুমিতকে বাধা দিয়ে সৈকত জিজ্ঞাসা করল।

“বদল বলতে certain change নয়। বরং একটু একটু করে বদল ঘটছিল ওর মধ্য। আগে যে জিনিসগুলো করা ওর একদমই পছন্দ ছিলনা, ও সেগুলোই করতে শুরু করল। তোর কাছে লুকাবো না, তার ফলে আমাদের Sex life-এও একটা বদল ঘটতে শুরু করল। আমরা একটু একটু করে পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসতে লাগলাম। আমি সারাদিন অফিসে থাকি, ও সারাদিন বাড়িতে একা থাকে। তাই কিসের কারণে এই বদল, সেটা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তবে বদলটা positive হওয়ায়, সেটা নিয়ে আমি বিশেষ ঘাঁটাই নি। এমন সময় একদিন আমি অফিস থেকে ফিরেছি, সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছে, বাড়ি ফিরে দেখি নীলিমা বাড়িতে নেই। দরজায় চাবি। আমি ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ঘরে ঢুকলাম। কিছুক্ষণ পর ও এল। সর্বাঙ্গ ভিজে। জিজ্ঞাসা করতে বলল টেরিসে গিয়েছিল বৃষ্টিতে ভিজতে। আমি ওকে কিছু বললাম না। ইচ্ছা হয়েছে, তাই ভিজেছে। মুশকিলটা হল পরদিন থেকে। সকালবেলা উঠে দেখে জ্বরে বেহুঁশ হয়ে আছে। ডাক্তার ডাকলাম। দেখে বললেন নিউমেনিয়া। নার্সিংহোমে ভর্তি করলাম। বেশ কয়েকঘন্টা অজ্ঞান থাকার পর জ্ঞান এল ওর। তারপরই শুরু হল আসল ঘটনা। নীলিমার যখন জ্ঞান আসে তখন ওর কেবিনে ডা. শর্মা ছিলেন। উনি আমাকে ডেকে বললেন, জ্ঞান ফেরার পর নীলিমা বেশ কয়েকবার বলেছে, “Meghnaad, please leave me alone.” প্রথমে উনি ভেবেছিলেন জ্বরের ঘোরে ও হয়তো ভুল বকছে। কিন্তু বারবার একই কথা বলাতে ওনার সন্দেহ হয়। উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন মেঘনাদ কে? ওনার কথা শুনে আমি আশ্চর্য হয়ে যাই। কারণ মেঘনাদ কে তা আমি জানি না। নীলিমার মুখে তার আগে ঐ নাম শুনিনি। সে কি নীলিমার পূর্ব পরিচিত? তাও জানিনা। নীলিমাকেও জিজ্ঞাসা করার উপায় নেই। তখন হঠাৎ মনে হল নীলিমার ফোন থেকে ব্যাপারটা হয়তো জানতে পারব। হয়তো ওকে ফোনটোন করত। সেখান থেকে কিছু সূত্র পেলেও পেতে পারি। নীলিমার ফোন চেক করতে শুরু করি। যদিও কাজটা করতে আমার একদম ইচ্ছা ছিলনা, কিন্তু আমি নিরুপায়। মেঘনাদের পরিচয় জানতে গেলে আমাকে এটা করতেই হবে। মনকে শান্ত করে কাজ চালিয়ে গেলাম। প্রথমে চেক করলাম ওর phonebook. না, সেখানে মেঘনাদের নাম নেই। মনে হল মেঘনাদ হয়ত তার আসল নাম নয়, ছদ্মনাম। কিন্তু phonebook-র প্রায় প্রতিটি নামই আমার পরিচিত। তবুও হাল ছাড়লাম না। প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা করে কথা বললাম। কিন্তু মনে হল না তাদের মধ্যে কেউ মেঘনাদ হতে পারে বলে। তারপর ওর call list চেক করলাম। তাতেও সন্দেহজনক কিছু পেলাম না। তখন মনে হল একবার ওর Message Inbox টা চেক করি। কিছু পেলেও পেতে পারি। আর ঠিক তাই হল।”

[/HIDE]
 
[HIDE]বিয়াল্লিশ পর্ব-[/HIDE][HIDE][/hide][HIDE]

“চঞ্চল মন আনমনা হয়,
যেই তার ছোঁয়া লাগে......”

অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে আবার কথা বলতে শুরু করল সুমিত, “নীলিমাকে পাঠানো মেঘনাদ নামধারীর প্রত্যেকটা মেসেজই ওর ফোনে ছিল। হয়তো ও ডিলিট করেনি বা করতে ভুলে গিয়েছিল। তা যাইহোক মেসেজগুলো পড়ে মনটা একদম দমে গেল।” সুমিতকে থামিয়ে দিয়ে সৈকত বলল, “মেসেজগুলোতে কী লেখাছিল?” সুমিত পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে সৈকতকে দিয়ে বলল, “এতে সব লিখে এনেছি। আগে পড়। তারপর বলছি।” সুমিতের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে সৈকত পড়ল। তারপর কাগজটা রেখে বলল, “পড়ে যা মনে হল তোর বউ আগে থেকে একে চিনত না। বা লোকটা কে সেটা বুঝতে পারেনি। কিন্তু pen drive-র ব্যাপারটা কী?”

“সেটা আমিও বুঝতে পারিনি। যতদূর মনে হয় ঐ পেন ড্রাইভে এমন কিছু ছিল, যা দিয়ে মেঘনাদ নীলিমাকে হয়তো blackmail করছিল।”
“হুম্। তা হতে পারে। কিন্তু একটা জিনিস বুঝতে পারছি না। তুই এই বিষয়ে আমার কাছে কী সাহায্য আশা করছিস? আমি একজন ডাক্তার, পুলিশ বা গোয়েন্দা নই, যে মেঘনাদ কে তা খুঁজে বের করব।”
“এই তুইই একমাত্র সাহায্য করতে পারিস। কেন, সেটা আমার বাকী কথাগুলো শুনলে বুঝতে পারবি।”
“আচ্ছা বল্।”
“লক্ষ্য করলাম সব মেসেজগুলোই কোনও Private Number থেকে এসেছে। সুতরাং তাকে ট্রেস করার কোন উপায় আমার হাতে নেই। মনটা খারাপ হয়ে গেল। সত্যি বলছি, এতকিছুর পরেও আমি নীলিমাকে একবিশ্দুও অবিশ্বাস বা সন্দেহ করিনি। কারণ ওর উপর আমার যা বিশ্বাস আছে, তা আমার নিজের মধ্যেও নেই। মনে হল ও বেচারীকে হয়তো ফাঁদে ফেলা হয়েছে। অবশেষে অনেক ভেবে পুলিশের কাছে যাব বলে ঠিক করলাম। হঠাৎ একটা জিনিস আমার সমস্ত হিসাবকে ওলোট পালোট করে দিল।”
“কি সেটা?”
“মেসেজগুলো পড়ার পর হঠাৎ মনে হল দেখা যাক, নীলিমা মেঘনাদকে কিছু পাঠিয়েছে নাকি। SMS বা অন্যকিছু। যদিও নীলিমা এমন কিছু করবে না বলেই আমার বিশ্বাস। তবুও দেখাই যাক না। আমি ওর Sent Items ফোল্ডারটা চেক করতে গেলাম। তা করতে গিয়েই আমার অবস্থা যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল।”
“কেন কি ছিল ওখানে?”
“নীলিমার ফোনের মেসেজ অপশনের Sent Items ফোল্ডারে সেই সব মেসেজগুলোই আছে যেগুলো ওর Message Inbox ফোল্ডারে ছিল।”
“তার মানে? তোর বউয়ের ফোন থেকেই ওকে মেসেজগুলো পাঠানো হয়েছে।” অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল সৈকত।
“Exactly.”
“কিন্তু তুই যে বললি, মেসেজগুলো এসেছে কোনও Private Number থেকে।”
“ঠিক তাই। তার কারণটা বলছি। কয়েক মাস আগে আমি আমার নিজের আর নীলিমার Personal Number টা Private Number করে নিয়েছিলাম। তাই মেসেজগুলো পাঠানোর সময় ওর নাম্বারটা লিখতে হয়েছে, কিন্তু যখন ওর ফোনে সেটা ঢুকেছে সেটা Private Number হিসাবে দেখিয়েছে।”
“কিন্তু এটা কি ভাবে সম্ভব?”
“সেটা প্রথমে আমিও বুঝতে পারিনি। আমাদের বাড়িতে আমরা দু’জন ছাড়া কেউ নেই। একটা ঠিকে ঝি আছে। সে আসে কাজ করে দিয়ে চলে যায়। আর তাছাড়া ওর পক্ষে ইংরাজীতে মেসেজ পাঠানো অসম্ভব। আর আমাদের বাড়িতে লোকজনের যাতায়াত প্রায় নেই বললেই চলে। নীলিমার ফোন নম্বর আমি আর ও নিজে ছাড়া কেউ জানে না। তাই ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ রহস্যজনক মনে হল। ফোন নীলিমার কাছেই সবসময় থাকে। ওর ফোন থেকেই ওকে মেসেজ পাঠানো হচ্ছে অথচ কে পাঠাচ্ছে বুঝতে পারছে না। অখচ তার সমস্ত Instruction follow করছে। সেদিন বৃষ্টিতে ভেজার কথা কিন্তু SMS -তেই বলা ছিল। তাই ও ভিজেছিল। ব্যাপারটা কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তখন একটা সম্ভাবনা আমার মাথায় এল। যদিও সেটা সেই সময় নিজেই মেনে নিতে পারিনি। তা হল যখন কেউই ওর ফোন থেকে এসব করতে পারেনা, তখন নীলিমা নিজেই এসব করছে না তো? Intentionally বা Unintentionally? কিন্তু নীলিমা নিজেই নিজেকে এসব মেসেজ পাঠাবে? তাও কেন? তখন একটা প্ল্যান মাথায় এল। মনে মনে ঠিক করলাম ওর উপর নজরদারী রাখব। নার্সিংহোমে থাকাকালীন ওর হাতে একদিন মোবাইল তুলে দিলাম। সঙ্গে করে নিয়ে গেলাম আমাদের এক প্রতিবেশী মিসেস মেহরাকে। ওনাকে আগে থেকেই শিখিয়ে রেখেছিলাম যে, উনি যেন লক্ষ্য রাখেন যে নীলিমা ফোন নিয়ে কি করে। আমি sure ছিলাম না যে সেদিনই কিছু হবে। তাহলেও chance নিতে ক্ষতি কি? কিন্তু ভাগ্য আমার সহায়। সেদিনই ঘটনাটা ঘটল এবং তাও মিসেস মেহরার সামনে। উনি আমাকে জানালেন যে ওনার সাথে কথা বলতে বলতে একসময় ও চুপ হয়ে যায়। পুরোপুরি আনমনা। এমনকি পাশে যে মিসেস মেহরা আছেন সেটাও ও ভুলে যায়। মিসেস মেহরার সামনেই ও মেসেজ টাইপ করতে থাকে। তারপর সেটাকে পাঠিয়ে দেয় নিজেরই নম্বরে। মিসেস মেহরা চুপচাপ এসব দেখতে থাকেন। তারপরই যখন মেসেজটা ওর ফোনে ঢোকে তখনই যেন ওর হুঁশ ফেরে। মিসেস মেহরা আমাকে জানান সেকেণ্ডের মধ্যে নীলিমার মুখের expression পাল্টে যায়। ও যেন বিব্রত বোধ করে মেসেজটা আসাতে। মিসেস মেহরা পরে ওখান থেকে চলে যান। কিন্তু দরজার আড়াল থেকে ওকে দেখতে থাকেন। উনি দেখেন উনি চলে যাবার পরই নীলিমা মেসেজটা পড়ে এবং কাঁদতে থাকে। তখন দেখে এমন মনে হয় যে যেন এই প্রথম ও মেসেজটা পড়ছে। ও-ই যে মেসেজটা লিখেছে ওটা ওকে সেই মুহুর্তে দেখে বোঝা মুশকিল।”

একটানা কথা বলে চুপ করল সুমিত। তারপর আবার বলতে শুরু করল, “মিসেস মেহরার মুখে ঘটনাটা শোনার পর থেকেই আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম শুধু ঐ মেসেজটাই নয়, বরং মেঘনাদের সব মেসেজগুলো নীলিমাই করেছে। এবং তাও নিজেরই অজান্তে। এরপর থেকেই ওর উপর আমি নজর রাখা শুরু করি। আমি লক্ষ্য করলাম ও তখনই মেসেজগুলো পাঠাচ্ছে যখন ও একা থাকছে এবং অতিরিক্ত একাকিত্ব feel করছে। তাই ওকে আমি আগের থেকে বেশী সময় দিতে লাগলাম। আমি যখন অফিসে থাকি, তখনও মাঝে মাঝে ওকে ফোন করতাম, ওর সাথে কথা বলতাম। লক্ষ্য করলাম মেসেজ আসা বন্ধ হয়ে গেল। আমি নিশ্চিন্ত হলাম। কিন্তু এই জিনিসটার একটা পাকাপাকি বন্দোবস্ত না করা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিলাম না। একটা জিনিস বেশ বুঝতে পারলাম নীলিমার এ আচরণের কারণ ওর অতীতে কোথাও লুকিয়ে আছে। আর নীলিমার অতীত সম্বন্ধে আমাকে একটা মানুষই জানাতে পারেন। তিনি হলেন নীলিমার বাবা। আমার সাতদিন সেমিনার আছে এবং আমি দিল্লীতে যাচ্ছি বলে এখানে চলে এলাম। প্রথমেই গেলাম নীলিমার বাবার কাছে। ওনাকে সবকথা খুলে বললাম। এবং জানতে চাইলাম এসবের কারণ কী? উনি শোনালেন নীলিমার ইতিহাস।” [/HIDE]
 
[HIDE]তেতাল্লিশ পর্ব-[/HIDE][HIDE][/hide][HIDE][/hide]​
[HIDE]
“তোমার ঘরে বাস করে কারা,
ও মন জানো না,
তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা,
ও মন জানো না,
তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা......”
সুমিত বলে চলল, “নীলিমার বাবা আমাকে বললেন, খুব ছোট বয়সে নীলিমার মা মারা যান। তখন ওর সাত কি আট বছর বয়স। ওইটুকু বয়সে মাকে হারিয়ে ও ওর এক পিসির কাছে মানুষ। পিসি ওকে নিজের মেয়ের মতনই মানুষ করেছেন। কিন্তু মায়ের একটা অভাব চিরকালই ও বোধ করে এসেছে। ওর মা মারা যাবার পর ওর বাবা ওনার কাজে এতটাই মগ্ন হয়ে পড়েন যে, উনি নীলিমাকে ঠিকমত সময় দিতে পারেন না। একদিকে মায়ের অভাব অন্যদিকে বাবার প্রতি একটা দূরত্ব তৈরী হওয়ার ফলে সবার মাঝেই ও একা একা বাঁচতে শুরু করে। একলা, চুপচাপ। অদৃশ্য একটা গণ্ডী কেটে নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে নেয়। আর তার ফলে ও ক্রমশ Depression-এ ভুগতে থাকে। ওর এই অবস্থাটা যখন ওর বাবার নজরে পড়ে তখন ওর বয়স চোদ্দ-পনেরো। উনি নীলিমাকে একজন মানসিক ডাক্তারকে দেখান। উনি নীলিমাকে কাউন্সেলিং করতে শুরু করেন। আস্তে আস্তে নীলিমার Depression কেটে যায়। ও সুস্থ হয়ে পড়ে। তারপর থেকে আর কখনও এমন ঘটেনি। আমি ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, উনি কেন আগে এসব ঘটনা জানান নি? উনি বললেন, উনি সমস্ত ঘটনা আমার মাকে জানিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও মা এই বিয়েতে রাজী হন। এবং মা-ই আমাকে এসব কথা বলতে ওনাকে বারণ করে। নীলিমার বাবার মুখে সব কথা শুনে একটা কথা আমি বুঝতে পারলাম, নীলিমার রোগটা মানসিক। তাই আমার একজন মানসিক চিকিৎসকের প্রয়োজন। তখনই আমার তোর কথা মনে পড়ল।এবার বল, সব শুনে তোর কী মনে হয়? নীলিমার বিষয়ে তোর Diagnosis কী” একটানা কথা বলে চুপ করল সুমিত।
এতক্ষণ চুপ করে মন দিয়ে সুমিতের কথা শুনছিল সৈকত। সুমিত কথা শেষ হতে সৈকত বলতে শুরু করল, “এভাবে মুখে শুনে তো আর Diagnosis হয়না। তার জন্য অনেক process আছে। তবে তোর সব কথা শুনে যেটুকু মনে হচ্ছে নীলিমার রোগটা আর ছোটখাট নেই। বরং ওর মনে ভালভাবেই ডালপালা মেলেছে। আমাদের মন সংক্রান্ত চিকিৎসার জনক ‘স্যার সিগমন্ড ফ্রয়েড’ বলেছেন, মানুষের মন একটা বিশাল হিমশৈলের চূড়া। যার কেবল উপরটাই জলে ভেসে আছে। যাকে আমরা অনুভব করতে পারি। সেই ছোট্ট অংশটুকু বাদে আরোও কতবড় অংশ জলের তলায় ডুবে তা আমরা বুঝতে পারি না। আমাদের মনের তিনটি অংশ Conscious mind, subconscious mind এবংunconscious mind. বাংলায় আমরা বলে থাকি সচেতন মন, অর্ধচেতন মন এবং অবচেতন মন। আমরা যা দেখি, শুনি বুঝি তা সবই Conscious mind বা সচেতন মনের মাধ্যমে। কিন্তু তার বিশেষ বিশেষ অংশগুলো store হয়ে থাকে আমাদের subconscious mind বা অর্ধচেতন মনে। আমরা রাত্রিবেলা যে স্বপ্ন দেখি তা এই অর্ধচেতন মনের সৌজন্যে। স্বপ্নের মাধ্যমে আমাদের অর্ধচেতন মন আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমাদের দেখা সেই সববিশেষ দৃশ্যাবলীকে, তবে কিছুটা বিকৃত রূপে। তারপরেও ঘটনা বা স্মৃতি যাইবলিস না কেন, তার কিছুটা অংশ জমা থাকে আমাদের unconscious mind বা অবচেতন মনে। সেটা অনেকটা ব্যাঙ্কের লকারের মত। সঠিক সময়ে সঠিক তথ্যটি আমাদের মনে করিয়ে দেওয়া তার কাজ। নীলিমা ছোটবেলা থেকেই একাকিত্বে ভোগে। তার ফলে ওর অবচেতন মনে একটা নতুন মানুষের জন্ম হয়। তবে সেটা ওর অজান্তে। একটা সময় সেটা বাড়তে থাকে। কিন্তু সেটা রুদ্র মূর্তি ধরার আগেই ওর বাবা এর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। ফলও পাওয়া যায়। তবে সেটা তাৎক্ষণিক। বলা যেতে পারে মানুষটা ঘুমিয়ে পড়ে। তারপর থেকে সব ঠিকঠাকই চলছিল। একসময় তোর সঙ্গে ওর বিয়েও হয়। কিন্তু ওর জীবনে একাকিত্বটা আবার বাড়ছিল। তুই ওকে হয়তো তোর যথাসাধ্য সময় দিতিস। কিন্তু সেটা ওর একাকিত্বটা কাটাবার পক্ষে যথেষ্ট নয়। ফলত ওর একাকিত্বের সঙ্গে ঘুম ভাঙছিল সেই মানুষটার। একটা সময় তার ঘুম ভেঙে গেল পুরোপুরি। হয়ে উঠল সে মেঘনাদ। ও আদেশ করতে লাগল নীলিমাকে আর ও সেই আদেশ মানতে লাগল। মেঘনাদ কিন্তু এমন কোন নির্দেশ নীলিমাকে দেয়নি যাতে তোর বা ওর কোন ক্ষতি হয়। কারণ তোর কোন ক্ষতি হোক সেটা মেঘনাদ হয়তো চাইলেও, নীলিমা কোনমতেই চায়না। মেঘনাদ নীলিমাকে সেইসব কাজই করতে দেয় যা ও নিজে করতে চায়।নীলিমা কখনও কখনও রূপ বদলে নিজে মেঘনাদ হয়ে যায়। একে আমরা Medical Term-এ বলি Paranoid Schizophrenia.খুবই জটিল প্রকৃতির একটি মানসিক রোগ। এতে রোগীদের ক্ষেত্রেDelusions বা Hallucinationsআকছার দেখা যায়। ইন্টারনেটে এর হাজার একটা উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে।”
“এই ধরনের রুগীদের ব্যবহার কেমন?”
“এমনিসময়েএকদম নর্মাল। তবে কখনও কখনও এদেরএকাধিক রূপগুলো প্রকাশ পায় একসঙ্গে। মনে কর্ ওরা কল্পনা করে নিল আমাকে কেউ ফোন করছে। অপরপক্ষের কথাটাওসে নিজের মনে মনে ঠিক করে নিল।আমরা জানি ফোনেরওপারে কেউ নেই। কিন্তু তার কাছে ওই কথাটা অন্যকেউ বলেছে। একেবলে Auditory Variety. নীলিমার ক্ষেত্রে পেন ড্রাইভের ঘটনাটা সেই রকমই কিছু।এককথায় মেঘনাদ হল নীলিমার Alter-ego বা দ্বিতীয়সত্তা। যে নির্দ্বিধায় আদেশ করে এবং নীলিমা নির্বিচারে সেই নির্দেশ পালন করে চলে। মেঘনাদের অস্তিত্বএই বাস্তব পৃথিবীতে হয়তো না থাকতে পারে, কিন্তু নিলীমার মনের গভীরে তার নিবাস।”
“তবে কি আমার নীলিমা পাগল?”
“মোটেও না। কোনও মানসিক রোগীই পাগল নয়।”
“তাহলে কি করা উচিত এখন?”
“ওকে কোনমতেই একাকিত্ব বোধ করানো যাবেনা। যতটা হাসিখুশী রাখা যায় ততই মঙ্গল। কিন্তু সেটা কোনও Permanent Solution নয়। তোকে এখনই সব কথা নীলিমাকে খুলে বলতে হবে। ওকে বোঝাতে হবে। এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওর চিকিৎসা শুরু করতে হবে।”
“ও কি সবকথা বুঝবে? উল্টে আমাকেই সন্দেহ করে বসবে না তো?”
“যদি ও তোকে সত্যি করে ভালবাসে, তাহলে তোকে কখনোই অবিশ্বাস করবে না।”
গোটা ঘর নিস্তব্ধ। কেবল ঘড়ির টিকটিক শব্দ। সময়েরনিস্তরঙ্গবয়েচলা।নীলিমা অবাক হয়ে সুমিতের কথা শুনছে আর অঝোর ধারায় কাঁদছে। সুমিত আজ ওকে কাঁদতে দিল। কাঁদুক। কাঁদলে মনের ভার হাল্কা হলে হোক। নীলিমার মনে পড়ে গেল নার্সিংহোমে বলা পাম্মী আন্টির কথাটা। “সুমিত খারা সোনা হ্যায়। বো তুমহে পাগলোঁ কি তরাহ্ প্যায়ার করতা হ্যায়।” সত্যিই সুমিত তাকে পাগলের মত ভালবাসে। না হলে সবকিছু জানা সত্ত্বেও ওর সমস্ত পাগলামিকে সহ্য করে এসেছে। নীলিমা সুমিতকে জড়িয়ে ধরল। বলল, “কেন সুমিত? আমার সব পাগলামি মুখ বুজে সহ্য করে এলে?” সুমিত বলল, “কারণ আমি তোমাকে ভালবাসি। মেঘনাদ আমার শত্রু নয়। বরং ও আমার উপকার করেছে। আমার মিষ্টি বউটাকে আবার আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। আর তাছাড়া আমি তোমাকে ছুঁয়ে প্রমিস করেছিলাম, যাই ঘটুক না কেন, আমি সারাজীবন তোমার পাশে থাকবো। আজকে আমাকে ছুঁয়ে তুমি একটা প্রমিস করো।” নীলিমা মুখটা তুলে জিজ্ঞাসা করল, “কী?” সুমিত বলল, “ভবিষ্যতে যাই ঘটুক না কেন, তুমি কখনোই আমাকে ছেড়ে যাবার কথা চিন্তাও করবে না।” নীলিমা আস্তে আস্তে সুমিতের বুকে মাথা রাখল। তারপর গাঢ় স্বরে বলল, “প্রমিস।” মৃদু হেসে পরম আদরে নীলিমার মাথায় হাত বোলাতে লাগল সুমিত। একটা স্বস্তির শ্বাস বেরিয়ে এল ওর বুক থেকে।
[/HIDE]
 
অন্তিম পর্ব-
“যদি এক মুহুর্তের জন্যেও আমায় চাও,
সেটাই সত্যি,
যদি এক মুহুর্তের জন্যেও আমায় চাও,
সেটাই সত্যি,
সেটাই সত্যি,
সেটাই সত্যি......”
কয়েক বছর পর......
আবার একটা বিকেল। আবার একটা সূর্যাস্ত। আবার একটা দিনের শেষ। গত কয়েক বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে নীলিমার জীবনে। কিন্তু বদলায়নি ওর বিকেলগুলো। এখনও নিয়মিত সূর্যাস্ত দেখতে ব্যালকনিতে হাজির হয়। চোখের সামনে সূর্যটা একটু একটু করে ছোট হতে হতে, একসময় হারিয়ে যায় দিগন্তরেখার অন্তরালে। তারপরেও গোটা আকাশটা থাকে লাল। তারপর ধীরে সেই লাল হতে থাকে ফিকে। একটু একটু করে আকাশের বুকে জমতে থাকে জমাটঅন্ধকার। তারপর দিনের সব রং, সব রূপ মুছে গিয়ে পড়ে থাকে কেবল কালো নিকষ অন্ধকার। নামতে থাকে রাত্রি। এখন অন্ধকারকে ও একদমই ভয় পায়না। কারণ ও জানে প্রতিটা রাতের অন্ধকারকে সরিয়ে দিয়ে, পৃথিবীর বুকে নতুন দিনের পদচিহ্ন এঁকে দেয় সূর্য। তার আলোর ঝলকানিতে পালিয়ে বাঁচে অন্ধকার। যেমন সুমিত। ওর জীবনের নতুন দিনের নতুন সূর্য। যার মায়াময় আলো কাটিয়ে দিয়েছে ওর জীবনের সমস্ত কালো অন্ধকারকে। ও এখন জানে আমাদের জীবনে অন্ধকারের গুরুত্বও সমান। কারণ অন্ধকারের পরেই যে আলোটা ফুটে ওঠে, তার উজ্জ্বলতাই হয় আলাদা। ও মনে মনে মেঘনাদকে ধন্যবাদ জানায়। কারণ ওর জীবনে মেঘনাদের প্রবেশের কারণেই ও সুমিতের এত কাছে আসতে পেরেছে। ওকে বিশ্বাস করতে পেরেছে। তার থেকেও বড় কথা, ওকে মনের সবটুকু দিয়ে ভালবাসতে পেরেছে। চিকিৎসার সময় ও বারবার ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করত মেঘনাদ আবার ফিরে আসবে কিনা। ডা. সৈকত বলতেন, “সেটা তোমার উপর নির্ভর করছে, নীলিমা। তুমি অন্ধকারকে অবলম্বন করে বাঁচবে, নাকি আলোকে অবলম্বন করে?” ওর জবাব ছিল, আলো। তখন সৈকত বললেন, “তাহলে মেঘনাদ আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়বে তোমার মনের অন্তরালে। এবার তার ঘুম হবে চিরকালের জন্য। সে কেবল একটা স্মৃতি হয়ে থাকবে তোমার কাছে। আসলে আমাদের প্রত্যেকের মনেই একটা মেঘনাদ ঘুমিয়ে থাকে। আমরাই তার ঘুম ভাঙিয়ে নিজেদেরকে করে তুলি অস্থির। তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব।”
সেই সময় হঠাৎ ওর পিছন থেকে কচি গলায় একজনবলে উঠল, “টুকি।” নীলিমা পিছন ফিরে তাকাল। পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ওদের তিন বছরের ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে। ঝিনুক। নামটা নীলিমারই দেওয়া। সমুদ্র সৈকতে অবহেলায় পড়ে থাকে অসংখ্য ঝিনুক। তাদের দেখেও দেখি না আমরা। অথচ আমরা ভুলে যাই ওই ঝিনুকের মধ্যেই জন্ম নেয় উজ্জ্বল মুক্তা। নীলিমা কনসিভ করার পর ওর নিজের ইচ্ছা ছিল ছেলে। কিন্তু সুমিতের ইচ্ছা কন্যাসন্তানের। অনেকটা নীলিমার মত। আরেকটা নীলিমা। নার্সিংহোমে কন্যাসন্তানের জন্ম হয়েছে শুনে সবথেকে খুশী হয়েছিল সুমিতই। তারপর দেখতে দেখতে পার হয়ে গেছে তিন তিনটে বছর। ছোট্ট, ফর্সা টুকটুকে তুলোর বলটা দেখতে দেখতে অনেকটা বড় হয়ে গেছে। টলমল পায়ে চলতে চলতে এখন ও গোটা বাড়িতে দৌড়াদৌড়ি করে বেরায়। অসম্ভব দুষ্টু। এটা ফেলছে, ওটা ভাঙছে। ওকে সামলাতে হিমশিম খেয়ে যায় নীলিমা। মাঝেমাঝে মেহরা আন্টিদের বাড়িতে পাঠিয়ে তবে শান্তি। মেহরা আন্টিরাও ঝিনুককে অসম্ভব ভালবাসেন। তবে ও নয়নের মণি হচ্ছে সুমিতের। অফিস থেকে ফিরে গভীর রাত পর্যন্ত বাপ-মেয়ের খেলা চলে। চলে ছেলেমানুষি। চলে খুনসুটি।
ব্যাগ থেকে ডুপ্লিকেট চাবিটা বের করে দরজা খুলে ভেতরে ঢোকে সুমিত। পা টিপেটিপে ব্যালকনিতে এসে পৌঁছায়। দেখে ওরজীবনেরবর্তমান আর ভবিষ্যৎ, দুজনে মিলে তাকিয়ে আছে আকাশের বুকে অতীত হয়ে যাওয়া সূর্যের দিকে। দৃশ্যটা যেন কোন এক ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। আকাশের লাল রংয়ের আভা এসে পড়ছে নীলিমার ফর্সা মুখে। শেষ বিকালের ফুরিয়ে আসা কনে-দেখা আলোয় ওকে লাগছে আরোও মোহময়ী। এই দিনটার জন্য অনেক অপেক্ষা করতে হয়েছে ওদের দুজনকে। যুদ্ধওকমকরতেহয়নি।নীলিমা আর ঝিনুককে দেখতে দেখতে মনে মনে একটা প্রতিজ্ঞা করে সুমিত। ওদের এই নিশ্চিন্ত জীবনে চিরদিন ও হয়ে থাকবে আলোর নিশানা। যাতে কোনও অন্ধকার যেন কখনোই ওদের নাগাল না পেতে পারে। হঠাৎ সুমিতের উপস্থিতি টের পায় নীলিমা।
“ওমা, তুমি কখন এলে?”
“অনেকক্ষণ।”
“তাহলে ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন?”
“দেখছিলাম।”
“কী?”
“তোমাদের দু’জনকে।”
বাবার গলার আওয়াজ পেয়ে মায়ের কোল থেকে বাবার কোলে চলে আসে ঝিনুক। নীলিমা বলে, “ওরে দুষ্টু মেয়ে, এতক্ষণ আমার কোলে বসেছিল। আর যেই বাবাকে দেখল অমনি বাবার কোলে চলে গেল।” মুচকি হেসে ঝিনুকের গালে চুমু খেয়ে সুমিত বলে, “Because, she’s my little pretty girl.” কপট রাগে নীলিমা বলে, “আর আমি কেউ নইবুঝি?” নীলিমা কাছে টেনে সুমিত বলে, You’re my life.” লজ্জা পেয়ে নীলিমা বলে, “ধ্যাত্, পাগল কোথাকার!” সুমিত নীলিমার পাশে গিয়ে বসে। নীলিমা আস্তে আস্তে মাথাটা হেলিয়ে রাখে সুমিতের কাঁধে। আরবসাগরের ঢেউ অট্টহাস্যে আছড়ে পড়ে তটের বুকে। আর দিনের শেষ আলোটা মুচকি হেসে মুখ লুকায় অন্ধকারের বুকে।
সমাপ্ত
 

Users who are viewing this thread

Back
Top