What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected অপেক্ষা (হুমায়ুন আহাম্মেদের উপন্যাস) (3 Viewers)

১১.


সুরাইয়া তাঁর পুত্র এবং কন্যাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। দুজনকে এক সঙ্গে তিনি সচরাচর ডাকেন না। যখন ডাকেন তখন বুঝতে হবে গুরুতর কিছু বলবেন। গুরুতর ধরণের কথা বলার মত নতুন কোন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। কমলাপুর রেল ষ্টেশন থেকে তিনি শান্ত ভঙ্গিতেই ফিরেছেন। রাতে ভাত খেয়েছেন। ফাতেমা এসে তার কথাবাতাঁর জন্যে ক্ষমা চেয়েছেন। ক্ষমা প্রার্থনা আন্তরিকই ছিল। ফাতেমা বলেছেন, সুরাইয়া, দেখ আমি বোকা একটা মেয়ে। বোকার কথা ধরতে নাই। তোমার যেমন স্বামীর সন্ধান নাই। আমার তেমন ছেলে মেয়ের সন্ধান নাই। ছেলে দুটা কোথায় আছে জানি না। তারা কি খায় কোথায় ঘুমায়–কিছুই জানি না। আমার মেয়ে মিতু আমার সঙ্গে কথা বলে না। বোকা মা তার সঙ্গে আবার কি কথা? তোমার ভাই সাত দিনে, দশ দিনে একটা কথা বলে। আমি কোন গল্প করতে শুরু করলে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে। এখন সুরাইয়া তুমি যদি আমার কথা ধর, আমি কি করব?

বলেই ফাতেমা কাঁদতে শুরু করলেন। কোন মেকি কান্না না। হাউ মাউ করে। কান্না। সুরাইয়া বললেন, তিনি কিছুই মনে করেন নি। ভাবীর উপর তাঁর কোন রাগ নেই। রাগ থাকলে তিনি ফিরে আসতেন না। তিনি ছেলেমেয়েদের উপর রাগ করে চলে গিয়েছিলেন।

কাজেই বাড়ির পরিস্থিতি এখন খুবই স্বাভাবিক বলা চলে। এই স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পুত্ৰ-কন্যাকে ডেকে পাঠানোর অর্থ সুপ্ৰভা এবং ইমন কেউই বুঝতে পারছে না। দুজনই এক সঙ্গে ঘরে ঢুকল। সুপ্রভার চোখে ভয়। ইমনকে দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

সুরাইয়া চুল আচড়াচ্ছিলেন। এক সময় তার মাথা ভর্তি চুল ছিল। এখন চুল খুবই পাতলা হয়ে গেছে। চিরুনী ধরতেই ভয় লাগে। মাথায় চিরুনী ছোয়ালেই গাদা গাদা চুল উঠে আসে। তিনি সুপ্রভার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা বোস।

ইমন খাটে এসে বসল। সুপ্ৰভা দরজা ধরে আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইল।

কেমন আছ তোমরা?

ইমন বলল, ভাল।

সুপ্ৰভা মনে মনে বলল, আসল কথা বলে ফেল মা। টেনশান লাগছে। বেশীক্ষণ এরকম টেনশানে থাকলে আমারো তোমার মত চুল পেকে যাবে।

সুরাইয়া সুপ্রভার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে না বসতে বললাম, তুমি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছ কেন?

সুপ্ৰভা ভাইয়ের পাশে বসল এবং মনে মনে বলল, তোমার ভয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছি মা। যাতে বিপদ দেখলেই দৌড়ে পালাতে পারি।

সুরাইয়া বললেন, তোমাদের দুই ভাই-বোনকে ডেকেছি একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার জন্যে। তোমরা সত্যি জবাব দেবে। তোমাদের কি ধারণা আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে? গাদাখানিক কথা বলার দরকার নেই। হ্যাঁ কিংবা না।

ইমন বলল, না।

আমাকে ভয় পেয়ে কিছু বলার দরকার নেই। তোমাদের কি ধারণা সেটা খোলাখুলি বল।

সুপ্ৰভা মনে মনে বলল, খোলাখুলি বললে তুমি আমাকে মোরব্বা বানিয়ে ফেলবে। সত্যি কথা তোমাকে বলা সম্ভব না।

সুরাইয়া বললেন, কিছুদিন ধরে আমার মনে হচ্ছে আমার মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তোমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছি। করছি না? সুপ্ৰভা তুমি বল, আমি কি তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি?

সুপ্ৰভা বলল, হ্যাঁ মা কর। তবে খারাপ ব্যবহারটা এখন গা সহা হয়ে গেছে। খারাপ ব্যবহার তুমি যখন কর তখন মনে হয় সব ঠিক আছে। যখন ভাল ব্যবহার কর তখন মনে হয় কোন একটা গন্ডগোল হয়েছে। এই যে এখন সুন্দর করে কথা বলছি এখন খুব ভয় লাগছে। ভয়ে আমার পানির পিপাসা পেয়ে গেছে।

সুপ্ৰভাকে বিষ্মিত করে সুরাইয়া হেসে ফেললেন। শব্দ করে হাসলেন। সুপ্ৰভা এবং ইমন অবাক হয়ে মার খিলখিল হাসি শুনল।

সুরাইয়া ছেলের দিকে ফিরে হাসিমুখে বললেন, তোর বোনটাতো ভাল রসিক হয়েছে। মজা করে কথা বলা শিখেছে। বিয়ের আগে আমিও খুব রসিক ছিলাম। ক্লাসে আমি যা বলতাম তাই শুনে আমার বন্ধুরা হেসে গড়াগড়ি খেত। বিয়ের পর সব মেয়ে কিছুটা বদলায়। আমিও বদলালাম। তোদের বাবাতো খুব গম্ভীর ধরণের মানুষ ছিলেন তাঁর সঙ্গে থেকে থেকে তার স্বভাবের খানিকটা আমার মধ্যে ঢুকে গেল। আমিও গম্ভীর ধরণের হয়ে গেলাম।

সুপ্ৰভা বলল, বাবা কি ইমন ভূইয়ার মত ছিল?

সুরাইয়া বলল, না ইমন বেশী গম্ভীর।

মা ঠিক বলেছ। ইমন ভাইয়াকে মজার কিছু বল দেখবে সে হাসার বদলে ভুরু কুঁচকে ফেলছে।

ভুরু কুঁচকানোর অভ্যাস তোদের বাবারও ছিল। তবে মজার কথা বললে সে খুব হাসতো। একবার রাতে ভাত খেতে বসে তোদের বাবাকে কি যেন বলেছি সে এমন হাসতে শুরু করল যে শেষে শ্বাসনালীতে ভাত ঢুকে গেল। প্রায় মারা যাবার জোগাড়।

সুপ্ৰভা বলল, কি সর্বনাশ! তুমি বাবাকে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করেছিলে? বলেছিলে কি?

কি বলেছিলাম মনে নেই। মনে করার চেষ্টা করতো মা। আমার খুব শুনতে ইচ্ছে করছে। বাবার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি খুঁটি নাটি জিনিসইতো তোমার মনে থাকে। এটাও নিশ্চয় মনে আছে।

সুরাইয়া হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। মার এই পরিবর্তন পুত্র এবং কন্যা কারোই চোখ এড়াল না। সুপ্ৰভা চুপ করে গেল। তিন নম্বর দূরবতী বিপদ সংকেত। নৌযানগুলিকে নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরতে বলা হচ্ছে।

ইমন বলল, মা তুমি আমাদের কি জন্যে ডেকেছ? গল্প করার জন্যে ডেকেছি। গল্প করার জন্যে ডাকলে কি কোন সমস্যা আছে।

না, সমস্যা নেই।

সুরাইয়া এতক্ষণ ছেলেমেয়েদের তুই তুই করে বলছিলেন, এখন তুমিতে চলে গেলেন। অর্থাৎ অবস্থা সুবিধার না। সুরাইয়া বললেন, তোমরা থাকো তোমাদের মত। আমি থাকি আমার মত। মাঝে মাঝে গল্প করার ইচ্ছাতো হতে পারে। না-কি পারে না। না-কি ইচ্ছা হওয়াটা অপরাধ?

ইমন বিব্রত গলায় বলল, অপরাধ হবে কেন?

তুমি ভুরু কুঁচকে এমন–মূর্তির মত বসে আছ—দেখে মনে হচ্ছে আমার কথাবার্তা তোমার অসহ্য লাগছে।

তোমার যদি এমন মনে হয়ে থাকে তাহলে খুব ভুল মনে হয়েছে। অনেক দিন পর তোমার কথা শুনে ভাল লাগছিল।

এখন আর ভাল লাগছে না?

হঠাৎ কেন রেগে যাচ্ছ মা?

হঠাৎ রাগ উঠছে বলে রাগছি।

ইমন বলল, মা তোমার কথা যদি শেষ হয়ে থাকে তাহলে আমি যাই। আমার ক্লাসের একটা ছেলে এসেছে। ও একা বসে আছে।

থাকুক একা বসে। আমার কথা শেষ হয় নি। আমি তোমাদের ডেকেছি একটা জরুরী কথা বলার জন্যে। জরুরী কথাটা হচ্ছে, আমি এই বাড়িতে থাকিব না।

ইমন বলল, কোথায় যাবে?

আলাদা বাসা ভাড়া করে তোমাদের নিয়ে থাকব।

ইমন মায়ের দিকে তাকাল। কিছু বলল না। সুরাইয়া বললেন, ইত্তেফাক পত্রিকায় অনেক বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন ছাপা হয়। আমি বিজ্ঞাপনগুলি পড়েছি। ঢাকার আশে-পাশে তিন হাজার টাকার মধ্যে দুই রুমের বাসা পাওয়া যায়। তিন হাজার টাকায় বাসা ভাড়া করলাম, আর বাসার খরচ যদি পাঁচ হাজার টাকা ধরি–তাহলে মাসে আট হাজার টাকা হলেই আমাদের হয়ে যায়।

সুপ্ৰভা বলল, মাসে আট হাজার টাকা পাবে কোথায়?

সুরাইয়া বললেন, আমি যেখান থেকে পারি জোগাড় করব। সেই দায়িত্ব তোমাদের না। সেই দায়িত্ব আমার।

ইমন বলল, তবু শুনি টাকাটা তুমি পাবে কোথায়?

আমি এখনো চিন্তা করিনি।

সুপ্ৰভা বলল, মা ভাইয়া আগে পাশ করুক। ভাইয়া যা ভাল ছাত্র সে পাশ করার সঙ্গে সঙ্গে ইউনিভার্সিটির টিচার হয়ে যাবে। কোয়াটার পাবে। তখন আমরা কোয়াটারে উঠব। আর বাসা ভাড়া করতে হবে না।

এতদিন আমি অপেক্ষা করতে পারব না। তোমাদের নিয়ে আমি আলাদা থাকব। নিজে রান্না করব। ঘর পরিষ্কার করব। গোছাব। ফুলের টবে গাছ লাগাব। সংসারটা হবে। আমার নিজের। কলমি শাকের মত ভেসে ভেসে বেড়ানো সংসার না।

ইমন বলল, নিজের আলাদা সংসার চাচ্ছ খুব ভাল কথা–এখনতো সম্ভব হচ্ছে না। প্রতি মাসে আট হাজার টাকা তুমি নিশ্চয়ই ভিক্ষা করে জোগাড় করতে পারবে না?

যদি জোগাড় করতে পারি তুই কি আলাদা বাসা করবি?

হ্যাঁ করব।

বেশ আমি কম পক্ষে তিন বছর আলাদা বাসা ভাড়া করে থাকার মত টাকা তোকে জোগাড় করে দেব, তুই বাসা ভাড়া করবি। তোর বাবার অফিস থেকে একটা পয়সা আমি আজ পর্যন্ত নেইনি—এখন নেব।

টাকা পেতে হলে বাবা মারা গেছেন এই জাতীয় কাগজপত্র দিতে হয়। তুমিতো সেটা কখনো করতে চাও নি–এখন করতে চোচ্ছ কেন?

এখনও করতে হবে না। পনেরো বছরের বেশী নিখোঁজ থাকলে–ডেথ সাটিফিকেট লাগে না। ভাইজান অফিস থেকে খোঁজ এনেছেন।

ও আচ্ছা।

সব মিলিয়ে পাঁচ লাখের মত টাকা পাওয়া যাবে। এই টাকায় তোর চাকরি না হওয়া পর্যন্ত আমরা বাসা ভাড়া করে থাকতে পারব। পত্রিকায় একটা বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন উঠেছে। আমার খুব পছন্দ হয়েছে। দাগ দিয়ে রেখেছি। মন দিয়ে শোন, পড়ে শুনাচ্ছি।

সুরাইয়া পত্রিকা হাতে নিলেন। সুপ্ৰভা মনে মনে বলল, কি সর্বনাশ, মা আবার আমাদের কি যন্ত্রণায় ফেলার ব্যবস্থা করছে!

তোরা মন দিয়ে শোন –দুই রুম, দুই বাথ রুম। ড্রয়িং, ডাইনিং। উত্তরে বারান্দা। খোলামেলা, প্রচুর আলো হাওয়া। ভাড়া গ্যাস ও পানি সহ ৩৫০০ টাকা। ৬ মাসের অগ্ৰীম আবশ্যক। কি, ভাল না?

সুপ্ৰভা বলল, হ্যাঁ ভাল।

চল দেখে আসি।

ইমন বলল, এখন দেখে আসবে?

হ্যাঁ এখন দেখে আসব। একটা বেবীটেক্সি ডাক দে। তিনজন মিলে চলে যাই। দুটা রুমতো। একটাতে আমি আর সুপ্ৰভা থাকিব, একটাতে ইমন থাকবে। উত্তরের বারান্দায় আমি ফুল গাছের টব রাখব। অবশ্যি শীতকালে খুব ঠাণ্ডা লাগবে। উত্তুরে হাওয়া।

ইমন বলল, এখন দেখেতো মা লাভ নেই। বাসা পছন্দ হলেও তুমি নিতে পারবে না। তোমার সঙ্গে টাকা নেই। টাকাটা আসুক তারপর আমরা বাড়ি দেখে বেড়াব।

সুরাইয়া ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললেন, আচ্ছা তোরা যা।

ইমন সঙ্গে সঙ্গে বিছানা থেকে নেমে চলে গেল।

মার মুখের দিকে তাকিয়ে সুপ্রভার খুব মায়া লাগছে। কি রকম হতাশ মুখ করে বসে আছেন। মনে হচ্ছে এক্ষুনি কেঁদে ফেলবেন। সুপ্ৰভা বলল, মা চল তুমি আর আমি—আমরা দুজনে মিলে দেখে আসি।

সুরাইয়া আনন্দিত গলায় বললেন, তুই যাবি?

হ্যাঁ যাব।

বাড়ি পছন্দ হলেতো কোন লাভ হবে না। বাড়ি ভাড়া নিতে পারব না।

নিতে পারবে না কেন? পছন্দ হলে বড় মামার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ছয় মাসের অ্যাডভান্স দিয়ে দেবে। বাবার টাকাটা পেলে মামার টাকা ফেরত দিলেই হবে।

সুরাইয়া বললেন, চল যাই।

মিতু আপাকে সঙ্গে নেব। মা?

কাউকে সঙ্গে নিতে হবে না। তুই আর আমি যাই। তোর বুদ্ধিটা আমার পছন্দ হয়েছে। ঠিকই বলেছিস, ভাইজানের কাছ থেকে ধার নিলেই হবে।

সুপ্রভার ইচ্ছে করছে জিজ্ঞেস করে।–এতদিন পর তোমার হঠাৎ আলাদা বাড়ি নেবার ইচ্ছা হল কেন?

জিজ্ঞেস করল না। মার মেজাজ এখন ভাল। সেই ভালটা বজায় থাকুক। প্রশ্ন শুনে মা যদি আবারো উল্টে যান তাহলে সমস্যা হবে। সুপ্রভার ধারণা তার মার মগজের ভেতরে মাকড়শার মত দেখতে কিছু পোকা বাস করে। পোকাগুলি হল মেজাজ খারাপের পোকা। এরা মাঝে মধ্যে গর্তের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে। তখন মা অন্য মানুষ হয়ে যান। পোকাগুলি এখন গর্তের ভেতর লুকিয়ে আছে। থাকুক। খুঁচিয়ে এদের গর্ত থেকে বের করার কোন দরকার নেই।

বাসা দেখে সুরাইয়ার খুবই মন খারাপ হল। এক তলায় অন্ধকার ছাতা পড়া স্যাতস্যাতে ঘর। এক চিলতে বারান্দা। সেই বারান্দার সামনে পাহাড় সমান বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। দিনের বেলাতেও বারান্দা অন্ধকার।

সুপ্ৰভা বলল, বাদুরদের থাকার জন্যে এই বাড়িটা খুব ভাল মা। চব্বিশঘন্টা অন্ধকার। এই বাড়ির নাম হওয়া উচিত বাদুর-ভিলা।

সুরাইয়া বিরক্ত গলায় বললেন; তাহলে আলো হাওয়া এইসব মিথ্যা কথা কেন লিখলো?

সুপ্ৰভা বলল, মিথ্যা কথা বললে দোষ হয় মা। লিখলে দোষ হয় না। ঔপন্যাসিকরা যে ক্রমাগত মিথ্যা কথা লিখেন তাদেরতো দোষ হয় না।

সুরাইয়া বললেন, চল ফিরে যাই।

সুপ্ৰভা বলল, বের হয়েছি। যখন চট করে ফিরব কেন? চল রিকশা নিয়ে ঘুরতে থাকি। টুলেট দেখলেই রিকশা থেকে নেমে পড়ব।

এটা মন্দ না। ভাড়া বাড়ি সম্পর্কে একটা ধারণা হবে।

পিপাসা পেয়েছে মা। ঠান্ডা এক ক্যান কোক কিনে দেবে?



রাতে ঘুমুতে যাবার সময় ইমন দেখে বিদেশী টিকিট লাগানো একটি খাম বালিশের উপর পড়ে আছে। ইমনের বুক ধ্বক করে উঠল। কার চিঠি—ছোট চাচার? নিশ্চয়ই দুপুর বেলা এসেছে। কেউ একজন লুকিয়ে রেখেছে। এক সময় রেখে দিয়েছে তার বালিশের উপর যেন ঠিক ঘুমুতে যাবার সময় তার চোখে পড়ে এবং সে আনন্দে অভিভূত হয়। সেই একজনটা কে? মিতু? অবশ্যই মিতু। মিতু ছাড়া এই কান্ড আর কে করবে!

কতদিন পরে ছোট চাচার চিঠি এসেছে! ইমনের খাম খুলতেও মায়া লাগছে। খাম খুললেইতো চিঠি শেষ। এরচে যতক্ষণ পারা যায় খাম হাতে নিয়ে বসে থাকা যাক। ছোট চাচাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। কেমন হয়েছেন। ছোট চাচা কে জানে? হুট করে কোন একজন মেম সাহেবকে বিয়ে করে ফেলেননিতো? ইমনের ধারণা ছোট চাচার কোনদিন বিয়ে হবে না। কারণ ছোট চাচাকে স্বামী হিসেবে পাবার জন্যে যে পূণ্যবল দরকার সেই পূণ্যবল খুব কম মেয়ের আছে।

চিঠির সম্বোধন ইংরেজীতে হলেও চিঠিটা বাংলায় লেখা। এমন ভাবে লেখা যেন বাচ্চা ছেলেকে লেখা হচ্ছে। যেন ইমন আগের মতই আছে তার বয়স বাড়ে নি।

My dear hard nut

কেমন আছিসরে ব্যাটা—ভুলভুলি, গুলগুলি। অনেক দিন তোদের খোঁজ খবর নিতে পারিনি কারণ আমার হয়েছে মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা। ভুল বললাম। শুধু মাথার ঘা না, সর্বাঙ্গে ঘা। জেল টেল খেটে একাকার। দুটা ব্ৰাজিলিয়ান ছেলের সঙ্গে রুম শেয়ার করে থাকতাম। ওরা ড্রাগ ডেলিভারীর সঙ্গে যুক্ত ছিল। ওদের পুলিশ ধরল সঙ্গে আমাকেও ধরল। ওদের সাজা হল দশ বছর করে। আমার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ নেই তারপরেও ঝাড়া তিন বছরের জেলা। তবে ওদের জেলখানাগুলি ভাল। যতটা কষ্ট হবে ভেবেছিলাম ততটা হয়। নি। তোদের কিছু জানাই নি তোরা শুনে কষ্ট পাবি তাই। এমিতেই তোদের কষ্টের সীমা নেই। গোদের উপর বিষ ফোড়া, সরি, গোদের উপর ক্যানসার করে লাভ কি।

জেলে থাকার সময় প্রায়ই তোকে স্বপ্ন দেখতাম। একটা স্বপ্নে দেখি তুই রিকশা থেকে পড়ে পা ভেঙ্গে ফেলেছিস। আমি ছোটাছুটি করে তোকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। তুই কান্নাকাটি কিছুই করছিস না। মুখ ভোতা করে আমার গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছিস। স্বপ্ন দেখে খুবই মনটা খারাপ হয়েছিল।

জেল থেকে বের হয়েছি। সঙ্গে বেশ কিছু টাকা নিয়ে। এ দেশের জেলে কয়েদীরা নানান ধরণের কাজ কর্ম করে, তার জন্যে পারিশ্রমিকও পায়। সেই পারিশ্রমিক জমা থাকে। কয়েদবাস শেষ হলে টাকাটা দিয়ে দেয়া হয়। জেল খাটা মানুষতো আর চট করে চাকরি জোগাড় করতে পারে না। এই টাকাটা তখন কাজে লাগে।

যাই হোক, আমার জেল রোজগার থেকে তোকে কিছু পাঠালাম। তুই সুপ্ৰভাকে দামী একটা কোন উপহার কিনে দিবি। ভাবীকে অবশ্যই একটা ভাল শাড়ি কিনে দিবি। তোর যত বন্ধুবান্ধব আছে সবাইকে কিছু না কিছু গিফট দিবি। শুধু তুই নিজে কিছু নিবি না। টাকাটা

কি রে ব্যাটা, তোকে কেমন প্যাচে ফেলে দিয়েছি। তোর উপহার আমি নিজে নিয়ে আসব।

ব্যাটারে তুই ভাল থাকিস। তোকে একটা কথা বলি, আমি যখন খুব বড় রকমের ঝামেলায় পড়ি — চোখে অন্ধকার দেখি তখন তোর ছোটবেলার ছবিটা মনে করার চেষ্টা করি। গম্ভীর ধরণের একটা শিশু—অসম্ভব বুদ্ধি। যে বুদ্ধির সবটাই সে গোপন করে রাখে। বুদ্ধির চেয়েও বেশী যার মায়া। যে মায়াও সে কাউকে দেখতে দেয় না। গোপন করে রাখে। যখন সেই সুন্দর ছবিটা মনে ভেসে উঠে তখন দুঃখ কষ্ট আর গায়ে লাগে না।

ব্যাটা আজ যাই। পরে তোকে আরো লম্বা চিঠি দেব।

ইতি
ছোট চাচা

চিঠির সঙ্গে একশ ডলারের দুটা নোট। ইমন বাতি নিভিয়ে মশারির ভেতর ঢুকে গেল। ছোট চাচার চিঠিটা সে গালে চেপে ধরে রাখল। তার কেন জানি মনে হচ্ছে–ছোট চাচা অনেক দূর থেকে হাত বাড়িয়ে তার গাল ছুঁয়ে রেখেছেন–এবং মুখে বলছেন — লক্ষ্মী সোনা, চাঁদের কণা, ভুনভুন, খুনখুন, সুনসুন। ভুলভুলি, গুলগুলি, পুলপুলি।



রাত প্ৰায় একটা বাজে। জামিলুর রহমান সাহেব বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছেন। তাঁর ঘুম আসছে না, মাথা দপদপ করছে। মাথায় পানি ঢাললে ভাল হত। একা একা মাথায় পানি ঢালা যায় না। এত রাতে কাউকে ডেকে তুলতেও ইচ্ছা করছে না।

ঘুম না এলে মানুষ কি করে? তার জানা নেই। ঘুমের সমস্যা তার কখনো হয়নি। সারাদিন পরিশ্রমের পর, রাতে ঘুমুতে যেতেন—সঙ্গে সঙ্গে ঘুম আসতো। বয়স বাড়লে মানুষের ঘুম কমে যায়। তাঁর বয়স বাড়ছে। ঘুম কমার এটাও একটা কারণ হতে পারে। শোভন এবং টোকনের কান্ডকারখানাও তার মনে হয়তবা চাপ দিচ্ছে। শোভন, টোকনের ব্যাপারটা অবশ্যি তুচ্ছ করার মত নয়। তিনি তুচ্ছ করে যাচ্ছেন। যে কোন ঘটনাই বড় করে দেখলে বড়, ছোট করে দেখলে ছোট। পুরো জিনিসটাই নির্ভর করছে কিভাবে দেখা হচ্ছে তার উপর। সুরাইয়ার স্বামী হারিয়ে গেছে। এই ঘটনাটাকে অনেক বড় করে দেখছে বলে আজ সুরাইয়ার এই অবস্থা। মানুষ হারিয়ে যাওয়া তেমন কোন বড় ব্যাপার না। যুবক ছেলে বিগড়ে যাওয়াও কোন বড় ব্যাপার না।

সুত্রপুর থানার ওসি সাহেবকেও তিনি তাই বললেন। ওসি সাহেব তার অফিসে এসেছিলেন। মাই ডিয়ার ধরণের অমায়িক ভদ্রলোক। পায়জামা পাঞ্জাবী পরে এসেছিলেন বলে মনে হচ্ছিল, কোন কলেজের বাংলার শিক্ষক। পান খাচ্ছিলেন বলে, ঠোঁটও লাল হয়ে আছে। চোখে মোগলী ফ্রেমের চশমা। কে বলবে পুলিশের লোক? কথা বার্তাও অত্যন্ত ভদ্র। শান্ত স্বরে বললেন, আপনার দুই ছেলে সম্পর্কে কিছু কথা বলার জন্যে এসেছিলাম।

জামিলুর রহমান বললেন, বলুন।

ওসি সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, সোসাইটি কোন দিকে যাচ্ছে দেখুন–ইয়াং সব ছেলে। ব্ৰাইট, এনার্জেটিক ইয়াং ম্যান। সব বিগড়ে যাচ্ছে। বাবা মা কিছু করতে পারছে না। আমরা পুলিশের লোক। আমাদের হাত পা বাধা। আমরা হচ্ছি হুকুমের চাকর। যে রকম হুকুম সে রকম কাজ।

জামিলুর রহমান বললেন, আপনার কথাবার্তা ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনার উপর হুকুমটা কি?

আপনার দুই ছেলের নামেই ওয়ারেন্ট বের হয়েছে।

ওরা কি করেছে?

কয়েকটা মামলাই আছে। আর্মড রবারি। একটা খুনের মামলাও আছে।

ও আচ্ছা।

তবে চিন্তার কিছু নেই।

চিন্তার কিছু নেই কেন?

অ্যারেস্ট না হওয়া পর্যন্ত চিন্তা কি বলুন। অবশ্যি অ্যারেস্ট হলে চিন্তার ব্যাপার আছে। ননবেলেরল ওয়ারেন্ট। জামিন হবে না। দীর্ঘদিন মামলা চলবে। অবশ্যি মামলাতে শেষটায় কিছু হবে না। এইসব মামলায় সাক্ষি পাওয়া যায় না। কেউ সাক্ষি দিতে চায় না। সব বেকসুর খালাস। সেটাও দুতিন বছরের ধাক্কা। সবচে ভাল বুদ্ধি হচ্ছে অ্যারেস্ট না হওয়া। শুধু দেখতে হবে যেন অ্যারেস্ট না হয়।

আপনারা তাদের খুঁজে বের করবেন না?

ওসি সাহেব গলা নিচু করে বললেন, আপনার সঙ্গে একটা এ্যারেঞ্জমেন্টে আসা যাক। মাসে আপনি পঞ্চাশ হাজার করে টাকা দেবেন। বাকিটা আমরা দেখব।

প্ৰতি মাসে আপনাদের পঞ্চাশ হাজার করে টাকা দিতে হবে?

জ্বি।

এই টাকাটা দিলে আপনারা কি করবেন? তাদের দেখলেও না দেখার ভান করবেন?

আমাদের অনেক সিস্টেম আছে। সেসব আপনার না জানলেও চলবে। এই ধরণের ছেলেদের নিরাপত্তার ব্যাপারও আছে। দলে দলে রাইভ্যালরি আছে। আমরা এক ধরণের প্রটেকশানও দেব।

ব্যাপারটা কি এই দাড়াচ্ছে যে মাসে মাসে পঞ্চাশ হাজার করে টাকা দিলে আপনারা আমার দুই পুত্রকে অ্যারেস্ট করবেন না এবং প্রটেকশন দেবেন। পাহারা দিয়ে রাখবেন?

ওসি সাহেব হাসলেন। জামিলুর রহমান বললেন—আমি কোন টাকা পয়সা দেব না। আপনারা দয়া করে ছেলে দুজনকে গ্রেফতার করুন।

ওসি সাহেব। আবারো হাসলেন। আগের চেয়েও মধুর ভঙ্গিতে হোসে বললেন, এখন বলছেন অ্যারেস্ট করুন। তারপর যখন সত্যি সত্যি করব তখন ছুটে আসবেন। দীর্ঘদিন এই লাইনে আছি। পিতামাতার ঘটনাগুলো আমি জানি। যখন ছুটে আসবেন তখন আর পথ থাকবে না।

ওসি সাহেব, আমি ছুটে আসব না।

ওদের বিরুদ্ধে মামলা খুব শক্ত। খুন যদি প্রমাণ হয়—ফাঁসি টাসিও হয়ে যেতে পারে।

অপরাধ করলে শাস্তি হবে।

ঠিকই বলেছেন। ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট। দস্তয়োভস্কির লেখা অসাধারণ বই। ছাত্র জীবনে পড়েছিলাম। পুলিশে ঢোকার পর—পড়াশোনা বন্ধ। ভাই তাহলে উঠি? পরে আসব। আপনার সঙ্গে আরো আলাপ আছে।

জ্বি আচ্ছ।

জামিলুর রহমান বিরক্ত মুখে সারা দুপুর অফিসে বসে রইলেন। বিরক্ত এবং চিন্তিত। পুলিশ যখন বলে—আরো আলাপ আছে তখন শঙ্কিত হওয়া ছাড়া পথ থাকে না। কারণ পুলিশের আলাপ শেষ হতে চায় না। আলাপ চলতেই থাকে-আলাপের শাখা প্ৰশাখা বের হতে থাকে।

তিনি বাড়ি ফিরলেন সকাল সকাল। বলতে গেলে সারাটা সন্ধ্যা বারান্দায় কাঠের চেয়ারে ঝিম ধরে বসে রইলেন। তার মন ভাল নেই। তিনি চিন্তিত—তাকে দেখে এটা কেউ বুঝল না। ফাতেমা তাকে চা দিতে এসে নিত্যদিনের মত ঝগড়া বঁধিয়ে দিলেন। থমথমে গলায় বললেন—তোমার সঙ্গে আমার একটা ফাইন্যাল কথা আছে।

জামিলুর রহমান ক্লান্ত গলায় বললেন, বল।

আমি এই বাড়িতে থাকব না। তুমি আমাকে আলাদা ফ্ল্যাট করে দেবে। আমি সেই ফ্ল্যাটে আমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে থাকব।

এখানে থাকতে সমস্যা কি?

এখানে আমি কেন থাকব? এখানে আমার কে আছে? ছেলেরা আছে? না মেয়ে আছে? না-কি তুমি আছ? তাহলে থাকব। কেন? জীবনে তুমি কি একটা মিষ্টি কথা আমাকে বলেছ? একটা শাড়ি কিনে আমাকে বলেছি-ফাতেমা তোমার জন্যে এই শাড়িটা কিনলাম। বলেছ? কথা বলছি না। কেন?

খুব মাথা ধরেছে। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।

মাথাতো ধরবেই। আমাকে দেখলেই সবার মাথা ধরে যায়। এক কাজ কর। আমাকে বাদ দিয়ে দাও। বাদ দিয়ে এমন কাউকে নিয়ে আস যাকে দেখলে মাথা ধরবে না। যাকে দেখলে গলা মিষ্টি হয়ে যাবে। মিষ্টি মিষ্টি গলায় বলবে-চান সোনা, ময়না সোনা।

ফাতেমা কথা বলে যাচ্ছেন জামিলুর রহমান চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। মনে হচ্ছে তিনি অদৃশ্য একটা গোলকের ভেতর বসে আছেন। গোলকের বাইরে যারা আছে তাদের কারো সঙ্গেই তার যোগ নেই।

এখন নিশুতি রাত। তিনি বারান্দার এ মাথা থেকে ও মাথায় যাচ্ছেন। মাথা দীপ দাপ করছে। কিছু ভাল লাগছে না। তাঁর ছেলেরা খুনের মামলায় জড়িয়ে গেছে। খুন? তিনি নিজে অর্থ-বিত্তের পাহাড় বানাতে বসেছেন। কার জন্যে? এবং কেন?

হঠাৎ তাঁর ইচ্ছা করল পা থেকে স্যাণ্ডেল জোড়া খুলে ফেলে হাঁটতে শুরু করেন। গেট খুলে বাইরে নামবেন। তারপর রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করবেন। কখনোই পেছন ফিরে তাকাবেন না। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় হয়ত সমুদ্রের কাছে পৌঁছে যাবেন।

জামিলুর রহমান তাঁর শরীরে এক ধরণের উত্তেজনা অনুভব করলেন। তাকালেন গেটের দিকে। সামান্য হাঁটলেই গেট। গেট খুললেই রাস্তা। তিনি ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি বুঝতে পারছেন তাঁর এই উত্তেজনা সাময়িক। কিছুক্ষণের মধ্যেই উত্তেজনা কমে যাবে। তিনি হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় ঘুমুতে যাবেন। ফাতেমার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়বেন। ঘরে জুলবে জিরো পাওয়ারের আলো। সেই আলোয় সব কিছু ঘোলাটে এবং অস্পষ্ট দেখায়। তিনি এমনভাবে শুবেন যেন ফাতেমার মুখ দেখতে না হয়। ফাতেমার নাকে কি সমস্যা হয়েছে। নাক দিয়ে শ্বাস নিতে পারে না। হা করে ঘুমায়। হা করা মুখ দেখতে কদাকার লাগে। ফাতেমার বিশাল শরীর হয়েছে। নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রকান্ড ভুড়ি ওঠানামা করে। সেটা দেখতেও কদাকার লাগে।

অনেক অনেককাল আগে ফাতেমা নামের একটা কিশোরী মেয়েকে তিনি বিয়ে করেছিলেন। মেয়েটা তাঁর বুকের কাছে মাথা এনে দুহাতে তাঁকে জড়িয়ে না ধরে ঘুমুতে পারত না। কোথায় গিয়েছে সেই সব দিন? আজ তাঁর পাশে মৈনাক পর্বত হা করে ঘুমিয়ে থাকে। ঘুমের ঘোরে ফাতেমা যখন হাত বাড়ায় তিনি অতি সাবধানে সেই হাত সরিয়ে দেন। যেন ফাতেমার ঘুম না ভাঙে।
 
১২.


সুপ্ৰভাকে হেডমিসট্রেস ডেকে পাঠিয়েছেন। কেন ডেকেছেন সুপ্ৰভা জানে। সে খুব চেষ্টা করছে স্বাভাবিক থাকতে। পারছে না। অদৃশ্য হবার মন্ত্র জানা থাকলে সে অদৃশ্য হয়ে যেত। কেউ কোনদিন তাকে দেখত না। সে সবাইকে দেখতে পারছে, অথচ তাকে কেউ দেখছে না। এরচে আনন্দের জীবন আর কি হতে পারে? পৃথিবীতে অদৃশ্য হবার মন্ত্র নেই বলে সে এখন দৃশ্যমান হয়ে হেডমিসট্রেস আপার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার পা কাঁপছে। বুকের ভেতরটা খালি খালি লাগছে। ইসলামিয়াতের স্যার একটা দোয়া শিখিয়ে দিয়েছিলেন। যে দোয়া পড়লে ভয় কাটে। সুপ্ৰভা কিছুতেই সেই দোয়া মনে করতে পারছে না।

হেডমিসট্রেস আপা গোলগাল ধরনের মহিলা। গায়ের রঙ মিশমিশে কালো। ছাত্রীরা আড়ালে তাকে ডাকে মিস বিলেক পটেটো। ব্ল্যাক ভেঙ্গে বিলেক বানানোর কারণ কেউ জানে না এবং তিনি মিসও নন, বিবাহিতা—মিসেস। স্কুলে একটা কথা প্রচলিত আছে—মিস বিলেক পটেটো দূর থেকে রক্ত চোষা গিরগিটির মত রক্ত চুষে খেয়ে নিতে পারেন। রক্ত খাবার কারণেই তার এমন ভর-ভরন্ত শরীর।

সুপ্রভার এখন মনে হচ্ছে রক্ত খাবার ব্যাপারে স্কুলে যে কথাটা প্রচলিত সেটা সত্যি। সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না, হাত পা কেমন যেন করছে। তাঁর শরীর কেমন যেন করছে।

সুপ্ৰভা!

জ্বি, আপা।

তুমি তিনটা সাবজেক্ট ফেল করেছি। অংক, ইংরেজি সেকেন্ড পেপার এবং ভূগোলে। কারণটা কি?

সুপ্ৰভা মাথা নীচু করে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে থাকা ছাড়া তার আর কি করণীয় সে বুঝতে পারছে না। কাঁদতে পারলে ভাল হত। কাঁদতে পারছে না।

তোমাকে এই বছর প্রমোশন দেয়া হবে না। বুঝতে পারছি?

পারছি।

কিছু বলার আছে?

জ্বি না।

তোমাদের ক্লাসে তুমিই একমাত্র মেয়ে যাকে প্রমোশন দেয়া হল না। শুধু সাজসজ্জা করে পরী সাজলে হবে না। পড়াশোনাও করতে হবে। আমি ঠিক করেছি। সাজুনি মেয়েগুলিকে স্কুলে রাখব না, টিসি দিয়ে বিদায় করে দেব। তুমি তোমার গার্জিয়ানকে বলবে— আমার সঙ্গে দেখা করতে।

জি আচ্ছা।

যাও, এখন যাও। ঠোঁটে আরো বেশি করে লিপস্টিক দাও।

সুপ্ৰভা হেডমিসট্রেস আপার ঘর থেকে বের হল। সে এখন কি করবে? বাসায় ফিরে মাকে সে ফেল করার কথা বলতে পারবে না। মা তাকে খুন করে ফেলবেন। অবশ্যই খুন করে ফেলবেন। কিংবা দোতলার বারান্দা থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেবেন। মা পুরোপুরি সুস্থ মানুষ না। বাবা থাকলে হয়ত তিনি মাকে সামলাতেন। বাবারা না-কি মেয়েদের অনেক বেশি আদর করেন। ব্যাপারটা সে তাদের স্কুলেও দেখেছে। মারা যখন মেয়েদের নিতে আসেন তখন মেয়েরা মার সঙ্গে গল্প করতে করতে বাড়ি যায়। বাবারা যখন আসে তখন মেয়েরা যায় বাবার হাত ধরে। সুপ্রভার কাছে ব্যাপারটা এত ভাল লাগে। সুপ্ৰভা অনেকবার ভেবেছে তার যদি বাবা থাকতো তাহলে তিনি তাকে নিতে এলে সুপ্ৰভা বাবার হাত তার কাধে রেখে দুহাতে সেই হাত ধরে রাখত এবং স্কুল থেকে বের হয়েই বলতো বাবা আমাকে আইসক্রিম কিনে দাও। আইসক্রিম আর দুই ক্যান কোক। কোক দুটা আমি ফ্রিজে রেখে দেব, পরে খাব। সুপ্ৰভা মার কাছে শুনেছে তার বাবা গম্ভীর ধরণের মানুষ ছিলেন। যত গম্ভীর হোক–তার কাছে এইসব চলবে না। মেয়ের কাছে বাবা গম্ভীর থাকবে। কেন? গম্ভীর থাকবে অফিসে, মার সঙ্গে— মেয়ের সঙ্গে কখনো না।

স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সুপ্ৰভা তার অদেখা অচেনা বাবার জন্যে চোখের পানি ফেলতে লাগল। স্কুলের সব মেয়ে আজ কত আনন্দ করছে। নতুন ক্লাসে উঠেছে— তাদের হৈ চৈ চিৎকারে কানে তালা লেগে যাচ্ছে। আর সে কি-না। চোখের পানি ফেলছে। শুধু সে না, তার মত আরো কিছু মেয়ে নিশ্চয়ই কাঁদছে। ফেল করা মেয়েরা সবাই একটা খালি ক্লাসরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে কাঁদলে ভাল হত। সেই ঘরটার নাম হত। কান্নাঘর।

সুপ্ৰভা!

সুপ্ৰভা দেখল তার পেছনে অংক মিস দাঁড়িয়ে আছেন। অংক মিস ভয়ংকর রাগী। তাঁর সামনে কোন ছাত্রী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে আপনা। আপনি তার দমবন্ধ হয়ে যায়। আজ অংক আপার মুখটা এত কঠিন লাগছে না। হয়ত চোখ ভর্তি পানির কারণে অংক আপার মুখটা কোমল দেখাচ্ছে।

অংক আপা কিছু বলার আগেই সুপ্ৰভা বলল, আপা আমি ফেল করেছি।

অংক আপা সুপ্রভার কাধে হাত রাখলেন। কোমল গলায় বললেন, কেঁদো না, যাও, বাসায় যাও। সামনের বছর খুব ভালমত পড়াশোনা করবে। প্রতিদিন স্কুলের শেষে আমার কাছে অংক করবে। ঠিক আছে?

জি আচ্ছ। আপা।

আমি হেডমিসট্রেস আপাকে অনুরোধ করেছিলাম তোমাকে প্রমোশন দিয়ে দেয়ার জন্যে। বলেছিলাম, অংকটা আমি টেক কেয়ার করব। আপাকে রাজি করাতে পারিনি। এসো, আমার কাছে এসো, তোমাকে আদর করে দি।

সুপ্রভা বিস্ময়ে অভিভূত হল। এই আপাকে তার মনে হত–পৃথিবীর কঠিনতম মহিলা। অথচ তিনি ফেল করা একটা মেয়েকে এই ভাবে জড়িয়ে ধরতে পারেন? চোখের পানি মুছে মাথায় চুমু দিতে পারেন? মানুষ এত ভাল হয়? সুপ্ৰভা ঠিক করে ফেলল। সে আর কখনো মানুষের বাইরের রূপ দেখে মানুষকে বিচার করবে না। মানুষের বাইরের রূপ এবং ভেতরের রূপ। কখনোই এক রকম না।



জামিলুর রহমান সাহেব আজ অফিসে দেরী করে এসেছেন। অফিসে ঢুকতেই তাঁর ম্যানেজার বলল, স্যার আপনার ভাগ্নি এসেছে। আপনার ঘরে বসে আছে। খুব কান্নাকাটি করছে।

কেন?

জানি না। স্যার। জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিছু বলে না। শুধু কাঁদে।

ফ্রিজে কোক আছে?

জি স্যার।

তাকে কোক দাও। গ্লাসে বরফ দিয়ে দিও। মেয়েটা আবার খুব ঠাণ্ডা না হলে খেতে পারে না।

জামিলুর রহমান ঘরে ঢুকলেন। সুপ্ৰভা চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। মার সঙ্গে ঝগড়া টগড়া নিশ্চয়ই হয়েছে। জামিলুর রহমানের অত্যন্ত মন খারাপ হল। আহা বেচারি, গালে চোখের পানি শুকিয়ে বসে গেছে। কি অসহায় লাগছে মেয়েটাকে। অন্য দিন অফিসে ঢুকে সে নিজেই কোকের ক্যান বের করে। আজ তাও করে নি।

ঘরের ভেতরটা গরম গরম লাগছে। শীতকাল হলেও দুপুরে ঘর তেতে উঠে। মেয়েটা নিশ্চয়ই গরমেও কষ্ট পাচ্ছে। জামিলুর রহমান অতি সাবধানে ফ্যানটা ছাড়লেন। শব্দ শুনে মেয়েটা জেগে না যায়। ঘুমুচ্ছে ঘুমাক। সুপ্ৰভা ফ্যানের সামান্য আওয়াজেই জেগে উঠল।

জামিলুর রহমান বললেন, তোকে কতবার বলেছি অফিসে না আসতে। আবার এসেছিস?

সুপ্ৰভা জবাব দিল না। তিনি কোকের ক্যান এগিয়ে দিতে দিতে বললেন—কোক খেতে খেতে বল, কান্নাকাটি কিসের। কি এমন হয়েছে যে কেঁদে বুক ভাসিয়ে দিতে হবে। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়তে হবে।

সুপ্ৰভা নিচু গলায় বলল, মামা আজ আমাদের রেজাল্ট হয়েছে।

ফেল করেছিস?

হুঁ।

ফেলতো করবিই। পড়াশোনার সঙ্গে কোন যোগ নাই। সারাদিন হাসোহাসি। ঝাপাঝাপি। দৌড়াদৌড়ি। অফিসে ঘোরাঘুরি। এখন আর কেঁদে কি হবে?

বাসায় মাকে কি বলব?

এই দুঃশ্চিন্তাটা আগে করলেতো আর পরীক্ষায় ফেল করতি না। ভাল সমস্যা হল।

মাকে আমি কি বলব। মামা?

তুই কিছু বলিস না। যা বলার আমি বলব।

মামা, তুমি আমাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাও। সেখানে কোন একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবে। শুধু তুমি আর আমি থাকব।

ভাগ্নির কথা শুনে জামিলুর রহমান দীর্ঘ দিন পর প্রাণ খুলে অনেকক্ষণ হাসলেন। হাসতে হাসতেই দুঃশ্চিন্তগ্রস্ত হলেন—বোকা মেয়ে। বড় হয়ে দারুণ সমস্যায় পড়বে। যেখানে সব মানুষের পেট ভর্তি শুধু চালাকি সেখানে এই সরল সোজা মেয়েটা করবে কি?

সুপ্ৰভা, তুই বাসায় চলে যা। তোর মাকে কিছু বলার দরকার নেই। আমি ব্যবস্থা করব।

মা যদি জিজ্ঞেস করে কি রেজাল্ট?

জিজ্ঞেস করবে না। সেতো দিন রাত ঝিম ধরেই থাকে। আর যদি জিজ্ঞেস করেও বলবি সন্ধ্যার পর আমি এসে বলব।

আমার রেজাল্ট—তুমি কেন বলবে?

আমি বলব। কারণ তোদের হেড মিসট্রেস, তোর সম্পর্কে আলাপ করবার জন্যে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তোর রেজাল্ট কার্ড আমার কাছে দিয়েছেন।

তুমি মিথ্যা কথা বলবে?

জামিলুর রহমানের মন আরো খারাপ হল। কি বোকা মেয়ে। তিনি মিথ্যা কথা বলবেন শুনে সে আৎকে উঠেছে। বোকা মেয়ে জানে না যে জগৎটাই চলছে মিথ্যার উপরে। সত্যি কথা এখন শুধু বলে পাগলরা।

কোক খা।

কোক খেতে ইচ্ছা করছে না মামা।

খেতে ইচ্ছা করবে না কেন? খা। দে গ্রাসে খানিকটা আমাকেও ঢেলে দে। খেয়ে দেখি কি এমন জিনিস যে রোজ খেতে হয়।

কোক খেতে খেতে জমিলুর রহমান ঠিক করে ফেললেন তিনি সুপ্রভার স্কুলে যাবেন। হেড মিসট্রেসকে বলবেন, আমি আপনার স্কুলে কিছু ডােনেশন করতে চাই। আমি দরিদ্র মানুষ আমার সাধ্য সীমিত। পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা চেক সাথে করে এনেছি। যদি গ্রহণ করেন। খুশী হব। পরে আরো বেশি। কিছু করার ইচ্ছা আছে। আপাতত এইটা নিন।

এতেই কাজ হবার কথা। এরচে কমেও কাজ হবে। তবে তিনি কোন রিস্ক নেবেন না। সুপ্রভার প্রমোশনটা দরকার। মেয়ে ফেল করেছে শুনলে তার মা অত্যাচার করবে। যত দিন যাচ্ছে সুরাইয়া ততই যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। আজকাল কথা বললেও মন দিয়ে শুনে না-কেমন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মাথা পুরোপুরি নষ্টই হয়ে গেছে। তার জন্যে কিছু করা দরকার। কি করবেন। তাও তিনি জানেন না। নিজের কাজ কর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকেন সংসারের দিকে তাকানো হয় না।



রাত আটটার দিকে আকাশ অন্ধকার করে বৃষ্টি নামল। একতলার বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে সুপ্ৰভা বৃষ্টি দেখছিল। আসলে বৃষ্টি দেখছিল না, অপেক্ষা করছিল তার মামার জন্যে। তিনি এত দেরি করছেন কেন? সুরাইয়া এখনো তার মেয়েকে ডেকে কিছু জিজ্ঞেস করেন নি। সুপ্ৰভা জানে এই কাজটা তার মা করবেন। এক্ষুণি হয়ত ডাকবেন। তার আগে আগেই মামার বাড়িতে আসা খুব দরকার। মামা কিছু করতে পারবেন বলে তার মনে হয় না। মিনিস্টার টিনিষ্টার হলে হয়ত পারতেন। গত বৎসর মিনিস্টারের এক মেয়ে ফেল করেছিল। মিনিস্টার সাহেব স্কুলে এসেছিলেন। তাঁকে ফুলের মালা দেয়া হল। চা খাওয়ানো হল। এবং মেয়ে পাশ হয়ে উপরের ক্লাসে উঠে গেল।

সুপ্ৰভা!

সুপ্ৰভা তাকিয়ে দেখে মিতু। হাসি হাসি মুখ।

তুই এখানে মুর্তির মত বসে আছিস। দারুণ ব্যাপার হচ্ছে—শিল পড়ছে। আয় শিল কুড়াই।

ইচ্ছা করছে না, আপা।

ইচ্ছা না করলেও আয়—তোর হয়েছে কি? সারাদিন মুখ ভোতা করে আছিস।

আমার খুব মাথা ধরেছে।

আমি শিল কুড়াবার জন্যে ছাদে যাচ্ছি—ঢং করিস না, তুইও আয়। মাথা ব্যথা কমানোর জন্যে তোকে পাঁচ মিনিট সময় দিলাম। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ছাদে না এলে কঠিন শাস্তি দেব।

মিতু চলে যাবার পর পরই বুয়া এসে সুপ্রভাকে বলল, আপনারে আপনের

আম্মা ডাকে।

সুপ্ৰভা মার ঘরের দিকে রওনা হল। তার পা কাপছে। কিন্তু আশ্চর্য কারণে মনটা শান্ত।

সুরাইয়া খাটে পা ঝুলিয়ে বসেছিলেন। গত রাতে তার এক ফোঁটা ঘুম হয় নি বলে চোখের নিচে কালি পড়েছে। তাকে খুবই ক্লান্ত এবং অসুস্থ লাগছে। তার সামনে খবরের কাগজ। সেখানে বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপনগুলি তিনি পড়ছেন এবং দাগ দিচ্ছেন। একটা বিজ্ঞাপন তার পছন্দ হয়েছে। শরীরটা ভাল লাগলে দেখে আসতেন। সারাদিন শরীর ভাল লাগেনি–এখন একটু ভাল লাগছে। এত রাতেতো আর বাড়ি দেখতে যাওয়া যায় না। সুরাইয়া মেয়েকে ঢুকতে দেখে বললেন—আজি না তোদের রেজাল্ট হবার কথা, রেজাল্ট হয়েছে?

সুপ্ৰভা বলল, হ্যাঁ।

হ্যাঁ-টা খুব সহজভাবে বললেও সুপ্রভার বুক ধ্বক ধ্বক করছে। এখনই প্রশ্নটা করা হবে—রেজাল্ট কি? সুপ্ৰভা মনে মনে উত্তর ঝালিয়ে নিল। উত্তরটা হচ্ছে রেজাল্ট কি আমি জানি না মা। বড় মামা জানেন। হেডমিসট্রেস বড় মামাকে স্কুলে ডাকিয়ে নিয়ে গেছেন। তাঁর কাছে রেজাল্ট দেবেন। তবে আমার ধারণা পাশ করেছি।

সুরাইয়া রেজাল্ট কি জানতে চাইলেন না। খবরের কাগজটা মেয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আগ্রহের সঙ্গে বললেন, বাসা ভাড়ার এই বিজ্ঞাপনটা পড়ে দেখ। সস্তার মধ্যে খুব ভাল।

সুপ্ৰভা বিজ্ঞাপন পড়ল। দুই রুম, ড্রয়িং ডাইনিং, প্রশস্ত বারান্দা। সাউথ ফেসিং প্রচুর আলো বাতাস। ভাড়া—লাইট, গ্যাসসহ তিন হাজার টাকা।

কিরে ভাল না?

হুঁ।

আমি আর তুই আমরা একটা ঘরে থাকলাম। ইমনের জন্যে একটা ঘর ছেড়ে দিলাম।

বাসাটা কোন তলায়?

সেটাতো লেখেনি। টেলিফোন নাম্বার আছে। টেলিফোন করে দেখতো বাড়িওয়ালাকে পাওয়া যায় কি-না।

আচ্ছা।

সব ডিটেল জেনে নিবি। ফ্ল্যাট বাড়ি কি-না, কয়জন ভাড়াটে থাকেন—এইসব। কথাবার্তা ভাল মনে হলে, কাল তোকে নিয়ে যাব।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সুপ্ৰভা চলে যাচ্ছিল, সুরাইয়া হঠাৎ ডাকলেন—

সুপ্ৰভা শোন।

সুপ্ৰভা থমকে দাঁড়াল। সুরাইয়া বললেন, তোর রেজাল্ট কি?

সুপ্ৰভা নীচু গলায় বলল, মা আমি ফেল করেছি।

ফেল করেছিস!

হ্যাঁ। তিন সাবজেক্টে ফেল করেছি। প্রমোশন দেয় নি।

ফেল করেছি। কথাটা এত সহজভাবে বলতে পারলি? মুখে একবারও আটকাল না?

সুপ্ৰভা দাঁড়িয়ে রইল। কিছু বলল না। তার পা এখন আর কাঁপছে না। কেমন যেন শান্তি শান্তি লাগছে। বুকের উপর পাষাণ চেপে ছিল। সেই পাষাণ নেই। সুরাইয়া সহজ গলায় বললেন, তোর মত মেয়ের আমার দরকার নেই। তুই একটা কাজ কর—ছাদে উঠে যা। তারপর ছাদ থেকে নিচে লাফ দিয়ে পড়ে যা।

সুপ্ৰভা আগের মতই দাঁড়িয়ে রইল। একবার শুধু মার দিকে তাকাল। মায়ের মুখ কি শান্ত। কত সহজ ভাবেই না। তিনি কথাগুলি বলছেন। সুপ্ৰভা মনে মনে বলল, মা সামনের বছর থেকে আমি খুব মন দিয়ে পড়ব। ফাস্ট সেকেন্ড হয়ত হব না, কিন্তু প্রতিটি সাবজেক্ট পাশ করব। তাছাড়া আমাদের অংক মিস রোজ আমাকে অংক শেখাবেন।

সুরাইয়া তীব্র এবং তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, এখনো দাঁড়িয়ে আছিস? এক কথা আমি বার বার বলতে পারব না। যা ছাদে যা! ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়ে আমাকে উদ্ধার করা।

সত্যি ছাদ থেকে লাফ দিতে বলছে!

হ্যাঁ বলছি। যদি সাহস থাকে, যা করতে বলছি করা। সঙের মত দাঁড়িয়ে থাকিবি না। সং দেখতে আর ভাল লাগে না।



মিতু ছাদে শিল কুড়াচ্ছিল। হঠাৎ দেখল। সুপ্রভা ছাদে ঢুকল। মিতু হাসিমুখে বলল, শেষ পর্যন্ত তাহলে এলি। শিলগুলি রাখার জন্যে একটা পাত্র নিয়ে আয়তো।

সুপ্ৰভা দাঁড়িয়ে আছে, নড়ছে না। হঠাৎ মিতুর মনে হল সুপ্রভার দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। সুপ্ৰভাকে খুবই অস্বাভাবিক লাগছে। মনে হচ্ছে কিছুক্ষনের মধ্যেই ভয়ংকর কিছু ঘটতে যাচ্ছে।

মিতু চট করে উঠে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে সুপ্ৰভাকে ধরতে গেল। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রেলিং বিহীন ছাদের শেষ মাথা পর্যন্ত সুপ্রভা ছুটে গেল। মিতু দেখল। সে ছাদে একা দাঁড়িয়ে আছে। সুপ্ৰভা নেই।



মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করিডোরে জমিলুর রহমান সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর পকেটে সুপ্রভার স্কুলের হেড মিসট্রেসের দেয়া কাগজ। সেখানে লেখা বিশেষ বিবেচনায় সুপ্ৰভাকে অষ্টম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করা হল। হেড মিসট্রেসের চিঠি তিনি পেয়েছেন দুপুরেই। একবার ভাবলেন তখনই বাসায় ফেরেন-তারপর মনে হল খালি হাতে বাসায় ফেরা ঠিক হবে না। পাশের মিষ্টি কিনে ফেরা দরকার। রসমালাই সুপ্রভার পছন্দ। এক কেজি রসমালাই কেনা দরকার। বিকেলে নিজেই রসমালাই কিনতে গিয়ে বৃষ্টিতে আটকা পড়লেন। সেই রসমালাই খাবার ঘরের টেবিলে সাজানো আছে। জামিলুর রহমান সাহেব বা রান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছেন। বৃষ্টি দেখতে তাঁর ভাল লাগছে, অথচ কিছুক্ষণ আগে একজন ডাক্তার এসে বলে গেছেন, মেয়ের অবস্থা ভাল না। ব্রেইন হেমারেজ হচ্ছে। আমাদের কিছু করার নেই।

জামিলুর রহমান যন্ত্রের মত বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে।

আপনি যান। ভেতরে গিয়ে মেয়ের বিছানার পাশে বসুন।

জামিলুর রহমান সহজ গলায় বললেন, কোন দরকার নেই।

তিনি হাসপাতাল থেকে বের হলেন। তাঁর কেন জানি বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে হচ্ছে। ছোটবেলায় সুযোগ পেলেই বৃষ্টিতে ভিজতেন। সুযোগ পাওয়া যেত না। এখন প্রচুর সুযোগ কিন্তু বৃষ্টিতে নামতে ইচ্ছা করে না। আজ নামতে ইচ্ছা করছে। তিনি পথে নামতেই বৃষ্টি থেমে গেল। মেঘ কেটে আকাশে তারা দেখা গেল। জমিলুর রহমান সাহেব হাঁটছেন। চারপাশের পরিচিত ঢাকা নগরী তার কাছে আজ বড়ই অপরিচিত লাগছে। যেন তিনি এই নগরীকে চেনেন না। নগরীও তাঁকে চেনে না।

মৃত্যুর ঠিক আগে আগে সুপ্রভার পূর্ণ জ্ঞান ফিরে এল। সে তার মার দিকে তাকিয়ে বলল, মা আমি ছাদ থেকে লাফ দিয়ে বিরাট একটা ভুল করেছি। তুমি কিছু মনে করো না। আমাকে ক্ষমা করে দিও।

সুরাইয়া মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে কি ঘটছে তিনি বুঝতে পারছেন না।

সুপ্ৰভা বলল, মা আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দাও।

সুরাইয়া মেয়ের গায়ে হাত রাখলেন। সুপ্ৰভা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বড় মামা যদি আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দেয় তাহলে আমার ব্যথাটা কমবে। বলার পর পরই সে মারা গেল।

মিতু ছুটে গেল করিডোরের দিকে, করিডোর শূন্য। সেখানে কেউ নেই। করিডোরের এক প্রান্তে রাখা টুলে ইমন বসেছিল। মিতু ইমনের কাছে গেল। শান্ত স্বরে বলল, এইভাবে চুপচাপ বসে থাকবি না। চিৎকার করে কাদ। আমাকে জড়িয়ে ধরে কাদ। কে কি মনে করবে। এইসব ভাবার কোন দরকার নেই।

ইমন উঠে মিতুকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠল।

অভিমানী ছোট্ট মেয়েটি জানলও না—এই পৃথিবীতে তার জন্যে কত ভালবাসাই না জমা ছিল।



ছোট্ট সুপ্রভা। তোমার প্রসঙ্গ অপেক্ষা উপন্যাসে আর আসবে না। কারণ তোমার জন্যে কেউ অপেক্ষা করে থাকবে না। মৃত মানুষদের জন্যে আমরা অপেক্ষা করি না। আমাদের সমস্ত অপেক্ষা জীবিতদের জন্যে। এই চরম সত্যটি না জেনেই তুমি হারিয়ে গেলে।
 
১৩.


রাত তিনটার দিকে জামিলুর রহমানের ঘুম ভেঙ্গে গেল। তলপেটে অসহ্য ব্যথা। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কেমন নিশ্চিন্ত হয়ে ফাতেমা ঘুমুচ্ছে। এইত পােশ ফিরল। ইচ্ছা করছে ফাতেমাকে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিতে। ব্যথার এমন যন্ত্রণা তিনি তার জীবনে আর পেয়েছেন বলে মনে করতে পারলেন না। কি ভয়ংকর ব্যাপার, মনে হচ্ছে কামারশালার কামার গরম গানগনে লাল কাস্তে পেটে ঢুকিয়ে পেটের নাড়িভুড়ি টেনে বের করার চেষ্টা করছে। বের করে ফেললেও শান্তি ছিল, বের করতে পারছে না। পেটের ভেতর সব কিছু জট পাকিয়ে যাচ্ছে। তিনি চাপা গলায় ডাকলেন, ফাতেমা এই ফাতেমা।

ফাতেমা গভীর ঘুমে। হালকা ভাবে তার নাক ডাকছে। জামিলুর রহমান বিছানা থেকে নামলেন। পানি খেতে ইচ্ছা করছে। শোবার ঘরে পানির বোতল দেখলেন না। পানি খেতে হলে খাবার ঘর পর্যন্ত যেতে হবে। ফ্রীজের দরজা খুলে পানির বোতল বের করতে হবে। এত শক্তি কি তার আছে?

জামিলুর রহমান দরজা খুলে বারান্দায় চলে এলেন। বারান্দার বেতের চেয়ারে আপাতত কিছুক্ষণ বসে থাকবেন। ছোটবেলায় পেট ব্যথা হলে পেটের নিচে বালিশ দিয়ে মা উপুড় করে শুইয়ে রাখতেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যথা চলে যেত। শৈশবের সেই চিকিৎসা কি এখন চলবে? না চলবে না। জমিলুর রহমানের মনে হল কিছুক্ষণের মধ্যে এই বেতের চেয়ারেই তাঁর মৃত্যু হবে। মৃত্যুর সময় পাশে কেউ থাকবে না। তিনি পানির তৃষ্ণায় ছটফট করবেন। কেউ তাকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি এগিয়ে দেবে না।

বারান্দায় আলো জুলছে। চল্লিশ পাওয়ারের একটা বাম্ব বারান্দার দক্ষিণ মাথায় অথচ এতেই সারা বারান্দা আলো হয়ে আছে। শুধু বারান্দা না আলো চলে গেছে উঠানেও। জমিলুর রহমানের মনে হল মৃত্যুর আগে মানুষের চেতনা তীক্ষ্ণ হয়ে যায়। নয়ত বারান্দায় জুলা একটা চল্লিশ পাওয়ারের বাম্বে তিনি গোট পর্যন্ত দেখতে পারতেন না। বাড়ির কোথায় কি শব্দ হচ্ছে তাও শুনতে পাচ্ছেন। ফাতেমার নাক এখন ডাকছে না। সে থেমে থেমে ভারী নিঃশ্বাস ফেলছে। শোবার ঘরের লাগোয়া বাথরুমে পানির ট্যাপ নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষীণ ধারায় ট্যাপ থেকে পানি পরার শব্দ কানে আসছে। শোবার ঘর থেকে রান্নাঘরে যাবার জন্যে যে করিডোর আছে সেখানে কি কেউ হাঁটছে? খালি পায়ে হাঁটার শব্দ আসছে। কেউ একজন মনে হয় এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে। তিনি বললেন কে? শব্দটা তার কাছাকাছি এসে থেমে গেল। জমিলুর রহমানের অস্পষ্টভাবে মনে হল সুপ্ৰভা নয়তো? খুবই হাস্যকর চিন্তা। প্রচণ্ড ব্যথায় কাতর থাকা অবস্থায় মানুষ অনেক হাস্যকর চিন্তা করে।

এ বাড়িতে অবশ্যি বেশ কিছুদিন ধরেই সুপ্ৰভাকে নিয়ে নীচু গলায় আলোচনা হচ্ছে, ফিসফাস হচ্ছে। দুজন বুয়াই দাবী করছে তারা সুপ্ৰভাকে দেখেছে। একজনের ভাষ্য হচ্ছে সে ছাদে কাপড় শুকাতে দিয়েছিল। আনতে ভুলে গেছে। সন্ধ্যার পর কাপড়ের কথা মনে হতেই সে আনতে গেল। দড়িতে ঝুলানো কাপড় তুলছে হঠাৎ দেখে ছাদের এক কোণায় পা ঝুলিয়ে কে যেন বসে আছে। তার বুকে ধ্বক করে একটা ধাক্কা লাগল। সে একটু এগিয়ে গেল। অবাক হয়ে দেখে— সুপ্ৰভা। আপন মনে পেয়ারা খাচ্ছে। কাজের বুয়া বলল, ছোট আফা! সুপ্ৰভা তার দিকে তাকাল। তারপরই পেয়ারা ছাদে ছুঁড়ে ফেলে বাতাসে মিলিয়ে গেল।

বানানো গল্প। বেশি বয়সের বুয়ারা প্ৰায় বাড়িতেই এ জাতীয় গল্প বানায়। কেন বানায় কে জানে। জমিলুর রহমান ভেবেছিলেন, বুয়াকে ডেকে কঠিন ধমক দেবেন। তার আগেই আরেকজন ঘোষণা করল, সেও ছোট আপাকে দেখেছে। সিঁড়িতে চুপচাপ বসে ছিল। তাকে দেখেই সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল। ফাতেমাও এক রাতে শোবার সময় গলা নীচু করে বলল, কোন বড় মওলানা এনে দোয়া পড়ালে হয় না? জামিলুর রহমান বিরক্ত গলায় বললেন, কেন?

ঐ যে সুপ্ৰভাকে সবাই দেখছে। আমিও একবার দেখেছি।

তুমি কখন দেখলে?

রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে দেখি মশারির পাশ দিয়ে হাঁটছে। মাথা নীচু। দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে হাঁটছে।

জামিলুর রহমান বিরক্ত গলায় বললেন, কেন মিথ্যা কথা বলছ?

ফাতেমা বিড়বিড় করলেন, মিথ্যা বলছি না। শুধু শুধু মিথ্যা বলব কেন? আমার মিথ্যা বলার দরকারটা কি?

সামান্য আরশোলা দেখলে তুমি চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তোল— এত বড় একটা ঘটনার পর তুমি কিছুই করলে না, চিৎকার না, কিছু না। আমি পাশে ঘুমিয়ে আছি আমাকে ডেকেও তো তুললে না।

তুমি সারাদিন পরিশ্রম করে এসে ঘুমাও এই জন্যে তোমাকে ডাকি নি।

জামিলুর রহমান রাগী গলায় বললেন, আজে বাজে মিথ্যা আমার সঙ্গে বলবে না। মৃত একটা মেয়েকে নিয়ে এইসব কি আজে বাজে কথা চালু করলে। ভাগ্যিস সুরাইয়া এখানে নেই। সে থাকলে কি রকম মনে কষ্ট পেত।

প্রায় চারমাস হল সুরাইয়া চলে গেছেন। জুলাই মাসের ৭ তারিখে গিয়েছেন এখন নভেম্বর মাস। শীত পড়তে শুরু করেছে।

সুরাইয়া ছেলেকে নিয়ে ঝিকাতলায় ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকেন। এক দিকে ভালই হয়েছে। সুরাইয়া ভাল আছে। নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। প্রবল শোক ভুলে থাকতে পারছে এটা মন্দ কি। এইভাবে চলতে চলতে সুরাইয়া যদি স্বাভাবিক হয় তাহলে এরচে ভাল ব্যাপার। আর কি হতে পারে? এ বাড়িতে থাকলে সুপ্ৰভা সম্পর্কে আজগুবি সব গল্প সুরাইয়ার কানো যেত। মাথা আরো খারাপ হয়ে যেত।

করিডোরে আবারো পায়ের শব্দ। এখন মনে হচ্ছে স্যান্ডেল পরে কে যেন হাঁটছে। ছোট ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলছে। সেই নিঃশ্বাসের শব্দও আসছে। ব্যাপারটা কি?

জামিলুর রহমান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। পেটের ব্যথাটা এখন একটু কম লাগছে। না-কি মাথায় অন্য চিন্তা ঘুরছে বলে ব্যথা টের পাচ্ছেন না? তিনি খাবার ঘরে ঢুকলেন। করিডোরের বাতি জ্বলিয়ে রান্নাঘর পর্যন্ত গেলেন। কেউ নেই। রান্নাঘরে দুজন বুয়া কথা বিছিয়ে ঘুমুচ্ছে। তাদের নিঃশ্বাসের শব্দই হয়ত শুনেছেন। এই বাড়িতে বুয়াদের জন্য আলাদা ঘর আছে, তারপরেও তারা কেন জানি রান্নাঘরে ঘুমায়। তিনি ফ্ৰীজ খুলে ঠাণ্ডা পানির বোতল খুলে পানি খেলেন। ঠাণ্ডা পানি খেলেই তার সুপ্রভার কথা মনে হয়। শুধুমাত্র এই মেয়েটার জন্যেই তিনি অফিসে ফ্রীজ কিনেছিলেন। মেয়েটা যখন তখন অফিসে চলে এসে ফ্ৰীজ খুলে কোক খেত। তার জন্যে কেনা পাঁচটা কোকের ক্যান এখনো ফ্রীজে আছে। মাঝে মাঝে সুপ্রভার জন্যে তার বুক হু হু করে। তিনি অফিসের ফ্ৰীজ খুলে কোকের ক্যানগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকেন। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। বয়স যত বাড়ছে, মন তত দুর্বল হচ্ছে। চোখ-বগাপসা রোগ হয়েছে। যখন তখন চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।

ঠান্ডা পানি খেতে খেতেও তার চোখ ঝাপসা হল। তিনি কি মনে করে। ছাদের দিকে রওনা হলেন। এই পৃথিবীতে অনেক অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে। তাঁর জীবনে কখনো কোন অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে নি। তাই বলে যে কোনদিন ঘটবে না, তাতো না। হয়ত তাঁর জীবনেও অবিশ্বাস্য কোন ঘটনা ঘটবে। হয়তো আজ রাতেই ঘটবে। তিনি ছাদে উঠে দেখবেন ছাদে পা ঝুলিয়ে সুপ্ৰভা বসে আছে। তিনি কোমল গলায় ডাকবেন, সুপ্ৰভা!

সুপ্ৰভা তার দিকে তাকিয়ে হাসবে। তিনি বলবেন, কেমন আছিসরে মা? সুপ্ৰভা বলবে, তুমি কেমন আছ বড় মামা। তিনি বলবেন, আমি ভাল আছি। সুপ্ৰভা রাগি রাগি গলায় বলবে, তুমি মোটেও ভাল নেই। তোমার পেটে ব্যথা হচ্ছে। এ রকম ব্যথা নিয়ে তুমি ছাদে এলে কেন? মামা তোমার কি কান্ডজ্ঞান নেই?

তোকে দেখতে এসেছিরে মা।

আমাকে কিভাবে দেখবে? আমিতো মরে গেছি।

মা কেন এই কান্ডটা করলি?

ভুল করে ফেলেছি মামা। মানুষ ভুল করে না? ভুল করে বলেইতো সে মানুষ। শুধু শুদ্ধ করলে কি সে মানুষ হয়? সে হত রোবট।

জামিলুর রহমান ছাদে উঠার ঠিক আগে থমকে গেলেন–ছাদে হাঁটতে হাঁটতে কে যেন গান গাইছে। নিশুতি রাতে ছাদে গান করবে কে? সুপ্রভার গলা না? হ্যাঁ সুপ্রভার গলাতো বটেই। মিষ্টি রিনারিনে বিষাদময় গলা। ব্যাপারটা কি? জামিলুর রহমানের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। তার মনে হল তিনি মাথা ঘুরে এক্ষুনি পড়ে যাবেন। আসলেই সুপ্ৰভা গান গাইছে। গানের কথাগুলো স্পষ্ট না। টানা সুরের গান বলে কথা স্পষ্ট হচ্ছে না। ফুলে ফুলে এই দুটা শব্দ শুধু পরিষ্কার।

জামিলুর রহমান ছাদে পা রাখলেন। সুপ্ৰভা বলে ডাকতে গিয়ে থমকে গেলেন, কাপড় শুকানোর দড়ি দু হাতে ধরে যে মেয়েটি গান গাইছে সে সুপ্ৰভা নয়— মিতু। ছাদে গান গাইছে মিতু।

মিতু শব্দ শুনে বাবাকে দেখে সহজ গলায় বলল, বাবা তুমি? তুমি ছাদে কি করছ।

জামিলুর রহমান বিস্মিত হয়ে বললেন–রাত তিনটার সময় তুইই বা কি করছিস?

বাবা আমিতো ছাদেই থাকি।

ছাদে থাকিস মানে? ছাদে কোথায় থাকিস?

চিলেকোঠার ঘরটায়। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেছে। তাই হাঁটাহাঁটি করছি।

হাঁটাহাঁটি কোথায় তুইতো গান করছিলি।

হুঁ করছিলাম।

চিলেকোঠার ঘরে কবে থেকে থাকিস?

অনেক দিন থেকেই থাকি। সবাই জানে। তুমি বাড়ির কোন খোঁজ খবর রাখ না বলে তুমি জান না।

একা একা ছাদে থাকিস আশ্চর্য কান্ড। ভয় লাগে না?

ভয় লাগবে কেন? ভয় লাগার কি আছে। এই যে তুমি হঠাৎ এসে উপস্থিত হলে— আমি কি তোমাকে দেখে ভয় পেয়েছি?

জামিলুর রহমানের পেটের ব্যথাটা আবার শুরু হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে তিনি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন না। খোলা ছাদেই শুয়ে পড়তে হবে। মিতু বলল, কি হয়েছে। বাবা? তুমি এ রকম করছি কেন?

তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।

মিতু ছুটে এসে বাবার হাত ধরল। চিন্তিত গলায় বলল, তোমার শরীরতো। কাঁপছে বাবা। এসো আমার ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে থাক।

পানি খাব।

তোমাকে পানি দিচ্ছি–তুমি এসোতো।

জামিলুর রহমান মিতুর ঘরে শুয়ে আছেন। এক চিলতে ছোট্ট অদ্ভুত একটা ঘর। মুখের কাছে গ্রামের রেলস্টেশনের টিকিট ঘরের মত জানালা। সেই জানালার হাওয়া এসে শুধু মুখের উপর পড়ছে। ভাল লাগছে। মিতুর চিলেকোঠার এই ঘরটা এমন মজার তিনি জানতেন না। বাড়ির অনেক কিছুই তিনি জানেন না। তেমনি তার নিজের জগতের অনেক কিছুই বাড়ির কেউ জানে না। তিনি যেমন তার ব্যাপারগুলো জানানোর প্রয়োজন মনে করেন না। তারাও তেমনি তাদের ব্যাপারগুলো জানাবার প্রয়োজন মনে করে না।

শোভন পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে এই খবর তিনি বাড়িতে কাউকে দেন। নি। দেয়ার প্রয়োজন মনে করেন নি। পুলিশ শোভনের উপর শারিরীক নির্যাতন করছে। এই খবরও তিনি পেয়েছেন। শারিরীক নির্যাতন খবরাখবর বের করার জন্যে করছে না। নির্যাতনটা করছে যেন খবর পেয়ে ছেলের বাবা জামিলুর রহমান পুলিশকে বড় অংকের টাকা দেবার ব্যবস্থা করেন। এই ব্যবস্থা জামিলুর রহমান করেছেন। বড় অংকের টাকাই পুলিশকে দিয়েছেন। মার বন্ধ হয়েছে। ওসি সাহেব এই সুসংবাদ নিজে এসে দিয়ে গেছেন। সিগারেট টানতে টানতে বলেছেন, আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আপাতত জামিন হচ্ছে না। কিন্তু মূল কেইস এমন ভাবে সাজানো হবে যেন তাসের ঘর। সব ঠিক ঠাক-কোর্টে গিয়েই-ধপাস। ঘর ভেঙ্গে পড়ে গেল। কেউ কিছু বুঝল না। আসামী বেকসুর খালাস। হা হা হা।

এমন বিশ্ৰী করে জামিলুর রহমান কাউকে হাসতে দেখেননি। তিনি শুকনা গলায় বললেন, ওসি সাহেব আজ চলে যান। আরেকদিন আসুন। আমি বের হব, জরুরী কাজ আছে।

এক কাপ চ খেয়ে তারপর যাই। আপনার এখানে চা-টা ভাল করে।

জামিলুর রহমান চা দিতে বললেন। একজন মানুষের সামনে মুখ সেলাই করে মূর্তির মত বসে থাকা যায় না। টুকটাক কথা বলতে হয়। তিনি কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না।

ওসি সাহেব বললেন, দেশের ইয়াং ছেলে।পুলেরা যে কোন দিকে যাচ্ছেভাবলে গা শিউরে ওঠে। আমার তিন মেয়ে, ছেলে নেই। আমার স্ত্রীর এই নিয়ে আফসোস আছে। আমি তাকে বললাম, শাহানা তুমি আল্লাহর কাছে শুকুর গুজার কর যে তোমার ছেলে নেই।

হলেতো আপনাদের ভাল। নষ্ট ছেলেমেয়ের বাবা-মার কাছ থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা পান। অনেক বাবা-মাদের সঙ্গেই নিশ্চয় আপনাদের মাসকাবারি বন্দোবস্ত আছে। আছে না?

খুব কঠিন কথা। এই কঠিন কথা শুনেও ওসি সাহেব হাসছেন। যেন মজাদার রসিকতা শুনে বিমলানন্দ পেলেন। তিনি আরাম করে চা খেলেন।

চায়ের খুব প্রশংসাও করলেন। চায়ের পাতা কোন দোকান থেকে কেনা হয়। জানতে চাইলেন। ক্লোন চা, না ডাস্ট চা তাও জিজ্ঞেস করলেন।

মিতু পানি নিয়ে এসেছে। বাবার মাথায় হাত দিয়ে সে বাবাকে তুলে

বসালো।

ব্যথা কি একটু কম লাগছে। বাবা?

উহু।

বাবা চল তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।

সকাল হোক তারপর দেখা যাবে।

না এখুনি চল। তোমার চোখ মুখ কালো হয়ে গেছে। আমার ভাল লাগছে না। বাবা।

ব্যথাটা এখন একটু কম।

এখন কম?

হুঁ। এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়াতে পারবি মা?

অবশ্যই পারব। চল নিচে চলে যাই।

আমি এখানেই থাকি— তুই চা বানিয়ে নিয়ে আয়।

মিতুর ঘর ছেড়ে তাঁর নড়তে ইচ্ছা করছে না। মিতুকে বলে তাঁর ঘরটা কি তিনি নিজের জন্যে নিয়ে নেবেন। অফিস থেকে এসে এই ঘরে থাকবেন। ঘরেতো বাথরুম নেই। বাথরুমের জন্যে নিচে যেতে হবে। মিতুর ঘরটা নেয়া ঠিক হবে না। বেচারীর শখের ঘর। মিতুকে একটা বাথরুম বানিয়ে দিতে হবে। রাজমিস্ত্রীকে সকালবেলাই বলে দেবেন। মিতুর ঘরের সঙ্গে সুন্দর একটা বাথরুম হবে। আর ছাদের চারদিকে রেলিং হবে।

চা খেতে গিয়ে জমিলুর রহমান লক্ষ্য করলেন— তার ব্যথা একটুও নেই। শরীর ঝড়ঝড়ে লাগছে। শরীর ভাল থাকলে যা হয়— সব কিছুই ভাল লাগে। এখনো তাই লাগছে। এই যে তার পাশে মিতু বসে আছে। বিস্মিত চোখে তাকে দেখছে এই দৃশ্যটাও দেখতে ভাল লাগছে।

তুই কি পড়াশোনাও এখানে করিস?

না। এটা হচ্ছে আমার ঘুম-ঘর শুধু ঘুমুবার সময় এখানে আসি। ঘরট সুন্দর না বাবা?

হুঁ সুন্দর।

তোমার ব্যথা কি এখনো আছে?

না-ব্যথা সেরে গেছে।

সেরে গেলেও, তুমি সকালে কোন একজন ভাল ডাক্তারকে তোমার শরীরটা দেখাও।

ডাক্তার দেখাতে হবে না। আমি খুব পরিশ্রম করিতো। পরিশ্রমী মানুষের অসুখ বিসুখ হয় না। এই যে সুরাইয়া এখন স্বাভাবিক আচরণ করছে। কেন করছে? পরিশ্রম করছে বলেই এই উন্নতিটা হয়েছে।

ফুপু কি এখন ভাল হয়ে গেছেন?

আমারতো মনে হয় সে আগের চেয়ে অনেক ভাল। কথাবার্তা ও স্বাভাবিক। তোর কাছে মনে হয় না?

আমিতো বাবা জানি না। ফুপুদের বাড়িতে কখনো যাইনি।

কেন?

যেতে ইচ্ছা করে নি।

ইমন? ইমন আসে না?

না।

কেন?

জানি না বাবা।

সে আসে না বলেই কি তুই যাস না?

মিতু হেসে ফেলে বলল, এইসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে তুমি মাথা ঘামিওনাতো। মা-পুত্র নতুন সংসার পেতেছে, ওদের বিরক্ত করতে ইচ্ছা করে না বলেই যাই না।

ওরা কেন আসে না?

আমি কি করে বলব ওরা কেন আসে না?

আচ্ছা আমি বলে দেব।

তোমাকে কিছু বলতে হবে না। বাবা।

মনের ভেতরের আকাশ মেঘে মেঘে ঢেকে গেলে— গলা এমন ভারী হয়। কেন তার মেয়ের মনে এত মেঘা জমবে? তিনি যেমন একা একা জীবন যাপন করেন তার মেয়েটাও কি তাই করে? এটা ঠিক না। এই বয়সেই একা জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেলে বাকি জীবন কাটানো খুব কষ্টকর হবে।

বাবা!

হুঁ।

সকাল হয়ে যাচ্ছে। ছাদ থেকে সরকাল হওয়া দেখা খুব ইন্টারেস্টিং, দেখবো?

আয় দেখি।

জামিলুর রহমান মেয়ের সঙ্গে সকাল হওয়া দেখতে গেলেন। ব্যাপারটা তাঁর এত ভাল লাগবে তিনি নিজেও ভাবেন নি। গ্রামের সকাল সুন্দর, কিন্তু শহরের সকালও এত সুন্দর হয়? এত পাখি ডাকে? দিনের প্রথম আলোয় এত রহস্য?

জামিলুর রহমানের খুব ইচ্ছা করল মেয়েকে বলেন, মা তুমি আমাকে সুন্দর একটা জিনিস দেখালে। এখন তুমি বল আমার কাছে কি চাও। যা চাইবে তাই আমি দেব। তাঁর নিজেকে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আলাদীনের চেরাগের দৈত্যের মত মনে হল। মনে হল তার ক্ষমতা অসীম। মিতু নামের মেয়েটি এই মহেন্দ্রক্ষণে যা চাইবে তাই তিনি তাকে দিতে পারবেন।

মিতু কিছু চাচ্ছে না। সুন্দর করে হাসছে। আশ্চর্য! তাঁর নিজের মেয়ে এত সুন্দর করে হাসে আর তিনি জানেন না। শোভনের ব্যাপারটা কি মিতুর সঙ্গে আলাপ করবেন? এমন সুন্দর সকালে কুৎসিত কিছু নিয়ে আলাপ করতে ইচ্ছা করে না।

মিতু!

জ্বি বাবা।

শোভন পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। থানা হাজতে আছে।

বাবা আমি জানি।

তুই জানিস?

হুঁ।

তোর মা। তোর মা-কি জানে?

হ্যাঁ মাও জানেন। টোকন ভাইয়া এসে বলে গেছে।

জামিলুর রহমান চুপ করে গেলেন। সবাই সব কিছু জানে। অথচ সবাই এমন ভাব করছে যেন কেউ কিছু জানে না। বদলে যাচ্ছে, সবাই বদলে যাচ্ছে।

মিতু!

জ্বি বাবা।

তুই যে একটা গান করছিলি। ঐ গানটা করতো শুনি।

মিতু বিস্মিত গলায় বলল, আমি গান করছিলাম মানে? আমি কি গান জানি না-কি যে গান করব?

আমিতো স্পষ্ট শুনলাম তুই গান করছিস।

বাবা আমি কখনো গান করি না। অনেকে বাথরুমে গুনগুন করে গান করে। আমি তাও করি না। আমার গলায় কোন সুর নেই। গান করতো। সুপ্ৰভা। যখন তখন গান।

জামিলুর রহমান চুপ করে গেলেন। তিনি তাহলে সুপ্রভার গানই শুনেছেন।
 
১৪.


ইমন খেতে বসেছে। সুরাইয়া খুব আগ্রহ করে ছেলের খাওয়া দেখছেন। টেবিলে তিন রকমের তরকারি—সজনে ডাটা এবং আলু দিয়ে একটা ভাজি, ইলিশ মাছের ডিম, ডাল। ইমন কেমন যেন অনাগ্রহের সঙ্গে খাচ্ছে। সজনে ডাটা নিল, তার সঙ্গে ইলিশ মাছের ঝোল মেশালো। এর মধ্যে এক চামচ ডাল দিয়ে দিল।

সুরাইয়া বললেন, খেতে কেমন হয়েছে রে?

ভাল হয়েছে।

ভাল হয়েছে।তো এমন ভাবে খাচ্ছিস কেন? সব মিশিয়ে ঘ্যাট বানাচ্ছিস। আরাম করে খা।

আরাম করেই খাচ্ছি।

ইমন আরাম করে খাচ্ছে না। খাবার মোটেই ভাল হয়নি। প্রতিটি তরকারিতে লবণ বেশি। সামান্য বেশি হলেও খেয়ে ফেলা যেত। অনেকখানি বেশি। ইমনের ধারণা তার মার লবণের আন্দাজ নষ্ট হয়ে গেছে। হয় লবণ খুব বেশি হচ্ছে নয় লবণ হচ্ছেই না।

ইলিশ মাছের ডিম কেমন হয়েছে?

ভাল।

তোর বাবার খুব প্রিয় ছিল। লোকজন বাজার থেকে ডিম ছাড়া ইলিশ আনে–তোর বাবা আনতো ডিমওয়ালা ইলিশ। মাছ কোটার সময় তোর বাবা পাশে থাকতো। যদি দেখতে ডিম নেই। ওমি তার মুখটা কালো হয়ে যেত।

ইমন গল্প শুনে যাচ্ছে। হ্যাঁ হুঁ। কিছুই করছে না। বাবার গল্প এখন আর তার কাছে ভাল লাগে না। অসহ্য বোধ হয়। ইলিশ মাছের ডিম তার বাবার পছন্দের খাবার ছিল এই গল্প সে এর আগে অনেক অনেক বার শুনেছে। ভবিষ্যতেও আরো অনেকবার শুনতে হবে। মার আলোচনা কোন খাতে যাবে। ইমন এখন বলে দিতে পারে। ইলিশ মাছের ডিমের প্রসঙ্গ যখন এসেছে তখন

মাছের ঝোলের গল্প।

ইমান।

জ্বি।

বাজারে দেখিসতো মাষকলাইয়ের ডাল পাস কি-না। খোসা ছড়ানো ডাল না, খোসাওয়ালা ডাল। তোর বাবার খুব পছন্দ ছিল। অনেকে মাষকলাইয়ের ডালে মাছ টাছ দিয়ে রান্না করে। তোর বাবার তা পছন্দ না। মাছ দিলেই তার কাছে আঁষটে গন্ধ লাগতো। তোকে একদিন মাছ দিয়ে ডাল রান্না করে দেব। তোর বাবার পছন্দ ছিল না বলে যে তোরও পছন্দ হবে না। এমনতো কথা না। হয়ত তোর ভাল লাগবে। মাষকলাইয়ের ডাল নিয়ে আসিসতো।

আচ্ছা।

নতুন সর্ষে শাক উঠেছে কি-না খেয়াল রাখিস।

আচ্ছা।

সর্ষে শাক দিয়ে কৈ মাছও তোর বাবার প্রিয়। কোন বন্ধুর বাসা থেকে খেয়ে এসে একদিন আমাকে রাধতে বলল। সর্ষে শাক দিয়ে কৈ মাছের ঝোল-আমি জন্মে শুনিনি। একদিন ভয়ে ভয়ে রাধলাম। সেই রান্নাই কাল হল। দুদিন পর পর সর্ষে শাক আর কৈ মাছ। আমি আবার কৈ মাছ খেতে পারি না। কাঁটার ভয়ে। কৈ মাছের কাটা বরাশির মত একটু বাকানো, একবার গলায় আটকালে আর যাবে না। তোর বাবার মত কৈ মাছ খাওয়া লোকও যা বিপদে পড়েছিল— শোন কি হয়েছে …

ইমনের খাওয়া হয়ে গেছে। সে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, মা তোমাকে একটা অনুরোধ করি। তুমি দয়া করে অন্য গল্প কর। বাবার গল্প শুনতে আমার এখন আর ভাল লাগে না। তাছাড়া গল্পগুলিতো নতুনও না, পুরানো।

সুরাইয়া আহত চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ইমন এ ধরণের কথা বলবে তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করেন নি। ছেলেটা দ্রুত বদলে যেতে শুরু করেছে। নিজেদের ফ্ল্যাটে আসার পর পড়াশোনাও করছে না। সময়ে অসময়ে ছেলের ঘরে ঢুকে দেখেছেন সে বিছানায় শুয়ে আছে। মাথার নিচে বালিশ নেই। সে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে। মানুষ একটু আধটু বদলায়। সেই বদলানোটাও খুব ধীরে হয় বলে চোখে পড়ে না— ইমনেরটা দ্রুত হচ্ছে বলেই চোখে পড়ছে।

হারিয়ে যাওয়া বাবার গল্প সুরাইয়া ইচ্ছা করেই করেন, যাতে মানুষটা পুরোপুরি হারিয়ে না যায়। সেই গল্প ইমন শুনতে চাচ্ছে না। মার সঙ্গে সে কঠিন গলায় কথা বলতে শুরু করেছে, এই গলা ভবিষ্যতে আরো কঠিন হবে। তখন কি হবে? সুরাইয়া বুকে চাপ ব্যথা বোধ করতে শুরু করলেন। এটা তাঁর পুরানো ব্যথা। আজকাল ঘন ঘন হচ্ছে।

সুরাইয়া দেখলেন ইমন সার্ট গায়ে দিচ্ছে। চিরুনী নিয়ে বাথরুমে ঢুকল। সে কি কোথাও বের হচ্ছে? আজ ছুটির দিন। আজ কোন ঘর থেকে বের হবে? ছুটির দিনগুলি ঘরে থাকার জন্যে। বাইরে ছোটাছুটি করার জন্যে না। ইমন বাথরুম থেকে বের হতেই সুরাইয়া বললেন, কোথাও যাচ্ছিস?

ইমন বলল, হ্যাঁ।

কোথায় যাচ্ছিস?

কাজ আছে মা।

কাজটা কি?

ইমন বিরক্ত গলায় বলল, তুমি সব কিছু জানতে চাও কেন? এত জেরা করারতো কিছু নেই।

জেরা করছি না। কোথায় যাচ্ছিস জানতে চাচ্ছি। আমি জানতেও পারব না!

না।

তোর সমস্যাটা কি?

আমার কোন সমস্যা নেই। মা। সমস্যা তোমার। তুমি খুব বিরক্ত কর। মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে।

কোথায় যাচ্ছিস জানতে চাওয়াটা কি বিরক্ত করা?

হ্যাঁ বিরক্ত করা।

আর কি ভাবে বিরক্ত করি?

রাতে তুমি পঞ্চাশবার আমাকে দেখতে আস এটাও বিরক্তিকর।

দরজা বন্ধ করে তুই শুয়ে পড়িস তোকে পঞ্চাশবার দেখতে আসব কি ভাবে?

দরজা বন্ধ করলেওতো তোমার হাত থেকে নিস্তার নেই। তুমি একটু পর পর দরজার ফুটো দিয়ে তাকাবে। আমি এতদিন কিছু বলিনি-আজ বললাম। আমার ভাল লাগে না।

তুই মশারি ঠিকমত ফেলেছিস কি-না এটা দেখার জন্যে ফুটো দিয়ে তাকাই।

দয়া করে আর তাকবে না।

সুরাইয়া থমথমে গলায় বললেন, আমাকে আর কি কি করতে হবে এক সঙ্গে বলে দে। চেষ্টা করব তুই যা চাস সে রকম করতে—যদি না পারি চলে যাব।

কোথায় চলে যাবে?

সেটা তোর জানার বিষয় না। তুই কোথায় যাস সেটা যেমন আমার জানার বিষয় না। আমি কোথায় যাই সেটাও তোর জানার বিষয় না।

ইমন এর জবাব দিল না। সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বের হয়ে গেল, যেন কিছুই হয়নি।

সুরাইয়ার বুকে ব্যথার সঙ্গে সঙ্গে শ্বাস কষ্টও শুরু হল। শ্বাসকষ্টের এই উপসর্গ তাঁর নতুন! মাঝে মাঝে হয়। ডাক্তারের কাছে যেতে ইচ্ছা করে না। কপালে কষ্ট থাকলে কষ্ট ভোগ করতেই হবে। ডাক্তার কবিরাজ কিছু করতে পারবে না।

সুরাইয়া দুপুরে খেলেন না। চাদর গায়ে ঘুমুতে গেলেন। বুকের ব্যথা এবং শ্বাস কষ্টের জন্যে ঘুম আসছে না। সেটাই ভাল, শরীরের কষ্ট নিয়ে জেগে। থেকে নিজের জীবনের কথা ভাবা। ভাবতে ভাবতে চোখের পানি ফেলা।

বারান্দায় রাখা ফুলের টবে আজ পানি দেয়া হয়নি। ভালই হয়েছে, গাছগুলিও কষ্ট করুক। তিনি একা কেন কষ্ট করবেন? তার সঙ্গে যারা বাস। করবে। তাদেরও কষ্ট করতে হবে। তারপর কোন একদিন ইমনের বাবার মত তিনিও ঘর ছেড়ে চলে যাবেন। আর কেউ কোনদিন তার খোঁজ পাবে না। ইমন থাকুক একা একা। ইমনের এখন তাঁকে দরকার নেই।— তিনি কেন শুধু শুধু ছেলের জন্যে ভাববেন? তাঁর এত কি দায় পড়েছে? ইমনের একটা বিয়ে দিয়ে যেতে পারলে ভাল হত। ইমনের দিকে লক্ষ্য রাখবে এমন একজন দরকার।

একটা মেয়েকে তাঁর পছন্দ হয়েছে। বাড়িওয়ালার দূর সম্পর্কের আত্মীয়া। মুন্নী। এই বাড়িতে থেকে ইডেন কলেজে পড়ে। দুনিয়ার কাজ করে। মেয়েটাকে তিনি পাঁচ মিনিটের জন্যেও বসে থাকতে দেখেন না। মেয়েটা দেখতে তত ভাল না। গায়ের রঙ কালো। সৌন্দর্যের প্রথম শর্তই গায়ের রঙ। সেই রঙ কালো হলে সবই মাটি। এমিতে অবশ্যি মেয়েটার খুব মায়া মায়া চেহারা। মাথা ভর্তি চুল, লম্বা একহারা গড়ন। গলার স্বর খুব মিষ্টি এবং হাস্যমুখি। হাসি ছাড়া কথা বলতে পারে না। মেয়েটা তাকে খালা ডাকে এবং অবসর পেলেই তার সঙ্গে গল্প করতে আসে। ইমনের বাবার সব গল্পই তিনি ইতিমধ্যে মেয়েটার সঙ্গে করেছেন। গল্প বলার সময় কয়েকবার তার চোখে পানি এসেছে। তিনি আনন্দের সঙ্গে লক্ষ্য করেছেন মেয়েটার চোখেও পানি এসেছে।

মেয়েটার কথা বার্তা বলার ভঙ্গিও সুন্দর। খুব মজা করে কথা বলে! ঐতো সেদিন হাসতে হাসতে বলল, আচ্ছা খালা আপনার পুত্র কি সব সময় এমন গম্ভীর থাকে? সব সময় ভুরু কুঁচকে আছে। গম্ভীরানন্দ।

তিনি হাসতে হাসতে বললেন, মা এটা হল ওদের বংশগত রোগ। তার বাবাও ছিল গম্ভীর।

আমার উনাকে দেখলে কি মনে হয় জানেন? মনে হয় এই বুঝি উনি ভুরু টুরু কুঁচকে আমাকে বলবেন-এই মেয়ে নিউটনের সেকেন্ড ল টা কি বুঝিয়ে বল।

মুন্নী হাসে, তিনিও হাসেন।

খালা আমি একটা প্ল্যান করেছি। উনাকে আমি একদিন খুব ভড়কে দেব। কি করব জানেন? আপনার বাসায় ঘাপটি মেরে বসে থাকব। উনি যখন বাসায় ফিরবেন, দরজা খোলার জন্যে কলিং বেল টিপবেন তখন আমি দরজা খুলে বলব, আপনি কে কাকে চান? উনি খুব ভড়কে যাবেন না!

না। ও ভড়কবার ছেলে না।

মুন্নীদের বাড়িতে আত্মীয় স্বজন এলে মুন্নীর ঘুমুবার জায়গার সমস্যা হয়। সে চলে আসে সুরাইয়ার কাছে। আদুরে গলায় বলে, খালা আজ রাতটা কি আমি আপনার সঙ্গে ঘুমুতে পারি?

সুরাইয়া বলেন, অবশ্যই পার মা।

আমি ঘুমুতে এলে আপনার জন্যে ভালই হবে। আমি খুব সুন্দর করে চুলে বিলি কাটতে পারি। চুলে বিলি কোিট আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে দেব।

তোমাকে চুলে বিলি কাটতে হবে না। তুমি এসে আমার সঙ্গে ঘুমাও। দুজনে গল্প করব। ছেলেটা এমন হয়েছে যে তাকে দশটা কথা বললে সে একটা কথার জবাব দেয়। তার সঙ্গে কথা বলা আর একটা গাবগাছের সঙ্গে কথা বলা এক। গাব গাছের তাও পাতা নড়ে। তার তাও নড়ে না।

মুন্নী যতবার এ বাড়িতে থাকতে এসেছে ততবারই তিনি প্রায় সারারাত গল্প করেছেন। মুন্নীর জন্যে রাতগুলি কেমন ছিল তিনি জানেন না, কিন্তু তাঁর জন্যে রাতগুলি ছিল আনন্দময়।

মাঝে মাঝে মেয়েটা তাকে অদ্ভুত ধরণের কথাও বলে। অদ্ভুত এবং ভয়ংকর। পুরোপুরি ভেঙ্গে বলে না বলে তিনি ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারেন। না। যেমন একরাতে অনেকক্ষণ গল্প গুজবের পর তিনি বললেন, মা এখন ঘুমুতে যাও। ফজরের আজান হতে বেশি দেরি নেই। মুন্নী তখন বিছানায় উঠে বসে সম্পূর্ণ অন্যরকম গলায় বলল, খালা আপনি কি আমাকে পছন্দ করেন?

উনি বললেন, অবশ্যই পছন্দ করি।

আপনার কি ধারণা আমি একটা ভাল মেয়ে?

অবশ্যই তুমি ভাল মেয়ে।

খালা আমি কিন্তু ভাল মেয়ে না। আমি ভয়ংকর খারাপ মেয়ে। ভয়ংকর খারাপ মেয়েরা যা করে আমিও তাই করি। মাঝে মাঝে তারচে বেশিই করি। নিজের ইচ্ছায় করি না। করতে বাধ্য হই।

বাধ্য হয়ে অনেকেই অনেক কিছু করে।

ভাল মেয়েরা করেনা খালা। ভালমেয়েরা ভেঙ্গে যায় কিন্তু মাচকায় না। আমি ভাঙ্গি না মাচকাই। আমার জন্ম হয়েছে মাচকাবার জন্যে।

ভয়ংকর যে কাজটা কর সেটা কি?

আপনি আন্দাজ করুনতো?

আন্দাজ করতে পারছি না।

একদিন পারবেন।

মুন্নী শুয়ে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে। তিনি জেগে থাকেন। এবং বারবারই তাঁর মনে হয়—বড় ভাল একটা মেয়ে। গায়ের রংটা আর যদি একটু ভাল হত। তিনি সরাসরি ইমনের সঙ্গে মেয়েটার বিয়ের কথা বলতেন। কালো মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিলে নাতী নাতনীগুলি কালো হবে। সেই কালো নাতনীগুলির বিয়ের সমস্যা হবে। বিয়ে অনেক বড় ব্যাপার হুট করে দিয়ে দিলেই হয় না। অনেক ভেবে চিন্তে দিতে হয়।
 
১৫.


ইমন হাঁটছে। হাঁটতে তার ভাল লাগে। হাঁটার সময় চারদিকে খেয়াল রাখতে হয় বলে মাথায় অন্য চিন্তা আসে না। রিকশায় উঠতেই উদ্ভট উদ্ভট সব চিন্তা আসে। আজ রাস্তায় হাঁটতে ইমনের ভাল লাগছে না। ঘুম পাচ্ছে। কাল রাতে এক ফোঁটা ঘুম হয় নি। সেই ঘুমে এখন শরীর প্রায় জমে যাচ্ছে। এমন কোন উদাহরণ কি আছে যে হাঁটতে হাঁটতে একজন মানুষ ঘুমিয়ে পড়ল, এবং ঘুমের মধ্যেই হাঁটতে থাকল? উদাহরণ না থাকলে সে তৈরি করবে। গিনিস বুক অব রেকর্ডে নাম উঠবে।-বাংলাদেশের ইমন ঘুমন্ত অবস্থায় তিন কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে তার ছাত্রীকে পড়াতে যান। ঘুমন্ত অবস্থাতেই তাকে এক ঘন্টা পড়ান এবং ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে আসেন। গিনিস বুক অব রেকর্ডে নাম উঠার পর বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ইন্টার্ভূ ছাপা হতে থাকলে বিভিন্ন সংগঠন পুরস্কার দেয়া শুরু করবে। উপাধিও দিতে পারে। বীর শ্রেষ্ঠের মত ঘুম শ্ৰেষ্ঠ জাতীয়।

আচ্ছা এইসব সে কি ভাবছে? ঘুম কাটাবার জন্যে ইমন রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে থামল। পর পর দুকাপ চা খেল। টাকা দিতে গিয়ে দেখে ভাংতি নেই। একটা পাঁচশ টাকার নোট। দুপ্যাকেট সিগারেট কিনলে টাকার ভাংতি পাওয়া যাবে। দুপ্যাকেট সিগারেটই দরকার। একজনকে দিতে হবে। আচ্ছা তিন প্যাকেট সিগারেট কিনলে কেমন হয়? তার নিজের জন্যে এক প্যাকেট।

রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সিগারেট টানবে। মা হঠাৎ ঘরে ঢুকে আতংকিত গলায় বলবেন, কি করছিস? সে বলবে, সিগারেট খাচ্ছি মা।

বিছানায় আধশোয়া হয়ে সিগারেট খেতে খেতে গল্পের বই পড়তে নিশ্চয়ই খুব ভাল লাগবে। নবনীদের ঘর ভর্তি গল্পের বই।

আজ ফেরার পথে নবনীর কাছ থেকে কিছু গল্পের বই চেয়ে নিয়ে আসতে হবে। বই ধার চাইলেই সে আহ্লাদী ধরণের কোন একটা কথা বলবে। নবনী সহজ ভাবে কোন কথা বলতে পারে না। তার কাছে প্ৰকান্ড একটা কাচের জার আছে, জার ভর্তি তরল আহ্লাদী। নবনী প্রতিটি কথা বলার আগে আহ্লাদী জারে ড়ুবিয়ে বলে। নবনীকে যে ছেলে বিয়ে করবে তার প্রথম করণীয় কাজটা হচ্ছে বিয়ের রাতেই আহ্লাদীর জারটা ভেঙ্গে ফেলা। আচ্ছা এইসব সে কি ভাবছে? নবনীর আহ্লাদীতে তার কিছু যায় আসে না। নবনী যা ইচ্ছা করুক। তার দায়িত্ব নবনীকে অংক শেখানো।

নবনীকে সে সপ্তাহে তিনদিন পড়ায়-সন্ধ্যার পর এক ঘন্টা। পড়ানোর টাইম টেবিলের ঠিক নেই। হুট করে নবনী বলবে, স্যার আগামী কাল আসবেন না। পরশু দিন আসুন। দুপুর দুটার সময়। যদি আপনার কাজ না থাকে।

স্যার শুনুন, আগামী এক সপ্তাহ আসবেন না। আমরা দলবেধে টেকনাফ যাব। না গিয়ে থাকলে আমাদের সঙ্গে চলুন। প্লীজ, প্লীজ, প্লীজ।

ইমন ঠিক সাড়ে তিনটায় নবনীদের বাড়ির সামনে উপস্থিত হল। নবনী দরজা খুলে আকাশ থেকে পড়ার ভঙ্গি করে বলল, ওমা! স্যার আপনি!

ইমন বিস্মিত হয়ে বলল, তুমিতো সাড়ে তিনটার সময় আসতে বলেছিলে।

ও আল্লা আমার কি হবে? কিছু মনে নাই। আজকেও বোরিং ম্যাথ নিয়ে বসতে হবে। ছুটির দিনেও ম্যাথ?

তোমার ইচ্ছা না করলে থাক।

উহু, থাকবে কেন? এসেছেন যখন তখনতো পাশা খেলতেই হবে।

পাশা খেলতে হবে মানে কি?

পাশা খেলার গান শুনেন নি? হিট গান—আইজ পাশা খেলবারে শ্যাম। স্যার, আপনি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করুন। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে বই-খাতা নিয়ে চলে আসব। এই পাঁচ মিনিট বরং খবরের কাগজ পড়ুন। আজকের কাগজ পড়েছেন।

না।

আমিও পড়ি নি। পড়তে ভাল লাগে না—সব সময় বিশ্ৰী বিশ্ৰী সব নিউজ ছাপা হয়। স্যার আমি যাই—জাস্ট ফাইভ মিনিটস।

ইমন কুড়ি মিনিট ধরে বসে আছে। নবনীর খোেজ নেই। বিশাল বাড়িতে নিজেকে ক্ষুদ্র এবং তুচ্ছ মনে হচ্ছে। বড় বড় সোফা, সোফার সামনে কাচের টেবিল। পায়ের নিচের কার্পেটটা এতই সুন্দর যে এর উপর দাঁড়াতে মায়া লাগে। ড্রয়িং রুমের দুই কোনার কাচের তিনকোণা টেবিলে দুটা শ্বেত পাথরের নারী মৃতী। গায়ের কাপড় গায়ে থাকছে না, খুলে পড়ে যাচ্ছে। মুতী দুটার দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না, আবার দৃষ্টিও ফিরিয়ে নেয়া যায় না। ইমনের নিজেকে বসার ঘরের অনেক আসবাবের মত একটা আসবাব বলে মনে হচ্ছে।

স্যার, আপনাকে চা দেয় নি। কি আশ্চর্য, আমি বলে গেলাম চা দিতে। ছিঃ ছিঃ স্যার আপনি কি রাগ করেছেন?

না। রাগ করব কেন?

একা একা এতক্ষণ বসেছিলেন এই জন্যে। কেন দেরি হয়েছে জানেন স্যার। আমি বাথরুমে ঢুকে হাত মুখ ধুয়ে বের হব। এমন সময় টেলিফোন-আমার এক বান্ধবী, ওর নাম-শম্পা, টেলিফোন করেছে। শম্পা একবার টেলিফোন ধরলে ছাড়ে না।

ইমন তাকিয়ে আছে। নবনী শম্পার সঙ্গে কথা বলছিল এটা মিথ্যা। নবনী এতক্ষণ সাজগোজ করছিল। যে সাজ সে দিয়েছে সেই সাজের জন্যে বিশ মিনিট খুব কম সময়। মেরুন রঙের সবুজ পাড় শাড়ি। মেরুন স্যান্ডেল। গাঢ় সবুজ ব্লাউজ। চুলেও কিছু একটা করা হয়েছে। ঢেউ-এর মত ফুলে আছে। চোখে কাজল দেয়া হয়েছে। নবনীর চোখ এখন যতটা টানা মনে হচ্ছে। আসলে ততটা টানা না।

নবনী বলল, স্যার কি দেখছেন?

ইমন বলল, চল পড়তে বসি।

স্যার আজ পড়ব না। এ রকম সাজগোজ করে পড়তে ভাল লাগে না। এমন সাজের পর ইটিস পিটিস করতে ভাল লাগে।

ইটিস পিটিস কি?

কিছু না স্যার। রসিকতা করলাম। আসলে কি হয়েছে জানেন-শম্পা টেলিফোন করেছে তার বাসায় যাবার জন্যে। তার বড়বোনকে বর পক্ষের লোকজন দেখতে আসবে এই উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান। আমাকে যেতে বলেছে। বলেই সেজেছি।

তাহলে তুমি যাও। আমি সোমবারে আসব।

সেখানে যাব সন্ধ্যাবেলা, সাড়ে ছটায়। এখনতো না। আপনি একদিন গল্প করুন। সবদিন অংক করতে হবে এমন কোন কথা আছে? All work and no play make Jack a dull boy. এ কথাটা আমার বাবা সব সময় বলেন। আমি যখন ফাইভ সিক্সে পড়তাম তখন খুব ভিডিও গেম খেলার শখ ছিল। বাবা তখন নিয়ম করে দিয়েছিলেন, এক ঘন্টা পড়লে এক ঘন্টা ভিডিও গেম খেলতে পারব। কাজেই আজ আমি আপনার সঙ্গে গল্প করব। একটু বসুন আপনার জন্যে চা নিয়ে আসি।

নবনী পট ভর্তি করে চা নিয়ে এল। একটা বাটিতে পায়েস, একটা বাটিতে হালুয়া জাতীয় কিছু, অন্য একটা প্লেটে আলুর চাপ।

স্যার, এই যে খাবারগুলি দেখছেন সব আমার বানানো। আজ সারাদিন কষ্ট করে বানিয়েছি—আপনাকে খাওয়াব এই জন্যে।

ইমন বিরক্ত মুখে বলল, আমি যে আসব সেটাইতো তুমি ভুলে গিয়েছিলে।

না ভুলে যাইনিতো। আমার খুব মনে আছে। আপনাকে মিথ্যা করে বলেছি। ভুলে গেছি। স্যার খেয়ে দেখুনতো কেমন হয়েছে। যেটা দেখতে আলুভতাঁর মত সেটা আসলে আলু ভর্তা না, বুটের ডালের হালুয়া।

ইমন হালুয়া মুখে দিল। জিনিসটা দেখতে অখাদ্য হলেও খেতে ভাল হয়েছে।

নবনী বলল, আপনার জন্যে সামান্য গিফটও এনে রেখেছি স্যার। যাবার সময় নিয়ে যাবেন।

গিফট কি জন্যে?

আজ আপনার জন্মদিন।

কে বলল তোমাকে?

মিতু আপা বলেছেন। অনেক আগেই মিতু আপার কাছ থেকে আপনার ডেট অব বাৰ্থ জেনে নিয়েছি। স্যার হ্যাপী বাৰ্থ ডে।

ইমন গম্ভীর গলায় বলল, থ্যাংক য়্যু।

স্যার আপনি সব সময় গম্ভীর হয়ে থাকেন। প্লীজ—জন্মদিনের দিন গম্ভীর হয়ে থাকবেন না। পায়েসটা খান। পায়েসটা খুব ভাল হয়েছে। কাওনের চালের পায়েস।

ইমন পায়েসের বাটি হাতে নিল। আজ তার জন্মদিন ঠিকই। তারিখ তার নিজেরই মনে ছিল না।

হ্যাঁ।

পায়েস বানানো আমি আজই শিখেছি। মাকে বললাম, মা পায়েস বানানো শিখিয়ে দাও। মা শিখিয়ে দিল। পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইনস্ট্রাকসন দিল-আমি রাধলাম।

পায়েসটা বেশ ভাল হয়েছে।

মা বললেন, এত যত্ন করে পায়েস রাধছিস কার জন্যে-আমি বললাম স্যারের জন্যে। ওমি মার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। মা আপনাকে।্য করতে পারে না।

কেন?

মার ধারণা আমি আপনাকে মার চেয়ে বেশি পছন্দ করি এই জন্যে। তবে মার পছন্দে কিছু যায আসে না। বাবার পছন্দ অপছন্দটাই গুরুত্বপূর্ণ। এই বাড়ির স কিছু চলে বাবার চোখের ইশারায়। বাবা যদি কোন একটা ব্যাপারে হ্যাঁ বলেন—তাহলে পৃথিবীর কেউ সেই হ্যাকে না বানাতে পারবে না।

ও আচ্ছা।

আর সেই কঠিন বাবাকে কে কনট্রোল করে বলুনতো?

তুমি করা?

হ্যাঁ, আমি করি। আমি বাবাকে যা করতে বলব, বাবা তাই করবে।

ভালতো।

ঐ দিন আমি বাবাকে বললাম, বাবা। আমি কিন্তু নিজের ইচ্ছামত বিয়ে করব। আমি যদি কাউকে পছন্দ করি তুমি কিন্তু না বলতে পারবে না। বাবা হাসিমুখে বললেন—আচ্ছা না বলব না। পছন্দের কেউ ইতিমধ্যেই কি জোগাড় হয়ে গেছে? আমি বললাম, হুঁ। বাবা বললেন, তার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিবি না? আমি বললাম, দেব।

ইমন বলল, নবনী আজ থাক। অন্য একদিন পরিচয় করব। আজ আমার ইমনের চা খাওয়া হয়ে গেছে।

সে উঠতে যাবে নবনী বলল, স্যার উঠবেন না। বাবার সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দি। আপনি এতদিন ধরে আমাকে পড়াচ্ছেন। কিন্তু এখনো বাবার সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি। আজ বাবা বাসায় আছেন, ঘুমুচ্ছেন। ঘুম ভাঙ্গলেই বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব।

ইমন বলল, নবনী আজ থাক। অন্য একদিন পরিচয় করব। আজ আমার একটা কাজ আছে।

বাবার ঘুম এক্ষুণি ভাঙবে। চারটার পর বাবা বিছানায় থাকেন না। এখন বাজছে চারটা দশ।

ইমন দাঁড়িয়ে পড়ল। নবনী আহত গলায় বলল, স্যার আপনি সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছেন?

হ্যাঁ। আমার জরুরী কাজ আছে।

কি জরুরী কাজ?

আমার এক ভাইকে পুলিশে ধরেছে। সে থান সাজতে আছে—তার সঙ্গে দেখা করব।

আপনার ভাই থানা হাজতে? উনি কি করেছেন?

অনেক কিছু করেছে।

পুলিশের এডিশনাল ইন্সপেক্টর জেনারেল আমার মেজো মামা। উনাকে বলব?

না তাকে কিছু বলতে হবে না।

আপনার গিফটটা নিয়ে যান।

আরেকদিন এসে নিয়ে যাব। গিফট নিয়ে হাজতে যাওয়া যায় না, তাই না?

স্যার—আসুন আপনাকে একটা গাড়ি দিয়ে দি। গাড়ি নিয়ে যাবেন।

গাড়ি লাগবে না।

ইমন ঘর থেকে বের হল। নবনীর চোখ সঙ্গে সঙ্গে পানিতে ভর্তি হয়ে গেল। সে যে তার স্যারের জন্যে এই প্ৰথম চোখের পানি ফেলল তা না। প্রায়ই ফেলে। প্রতি রাতেই ঘুমুতে যাবার সময় সে বালিশে মুখ গুঁজে কিছুক্ষণ কাঁদে।

হাজতে গাদাগাদি ভিড়। এক কোনায় শোভন গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। তার চুল লম্বা, মুখ ভর্তি দাড়ি গোফের জঙ্গল। চোখ লাল হয়ে আছে। জিন্সের প্যান্টের সঙ্গে কটকট হলুদ রঙের উইন্ড ব্রেকারে তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে।।

ইমন হাজাতের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। শোভনকে চিনতে পারছে না। তাকে বিস্মিত করে জঙ্গলামুখের এক যুবক বলল, ইমন সিগারেট এনেছিস। আমি যে এখানে খবর কার কাছে পেয়েছিস?

টোকন ভাইয়ার কাছে।

ও তোকে টাকা পয়সা দেয় নি?

পাঁচশ টাকার একটা নোট দিয়েছে।

মাত্ৰ পাঁচশ! বলিস কি? আমার দরকার হাজার হাজার টাকা।

তোমাকে কি ওরা মেরেছে?

প্রথম দুদিন ধোলাই দিয়েছে, এখন ধোলাই বন্ধ।

শোভন আনন্দিত মুখে সিগারেট ধরাল। পা নাচাতে নাচাতে বলল, তোর মুখ এত শুকনা কেন? তোর প্রবলেম কি?

কোন প্রবলেম নেই।

ফুপু ভাল আছেন?

হুঁ।

ঘর সংসার নিয়ে ব্যস্ত আছে, এটা ভাল। তোর পরীক্ষা কবে?

সাত তারিখ থেকে শুরু হচ্ছে।

প্রিপারেশন কেমন?

ভাল।

শোভনের সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। সে আরেকটা সিগারেট ধরাল। ইমন দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। অন্যান্য হাজতিরা শুরুতে তাদের কথাবার্তা শুনছিল। এখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। মাঝে মাঝে তারা তৃষিত চোখে তাকাচ্ছে শোভনের সিগারেটের দিকে। তাদের আগ্রহ সীমাবদ্ধ হয়ে এসেছে।

ইমন!

হুঁ।

এবারো নিশ্চয়ই ফাস্ট সেকেন্ড হবি?

হুঁ হব।

ভাল ভাল। ভেরী গুড।

তোমাকে কি এরা থানা হাজতেই রাখবো?

নিয়ম নাই। জেল হাজতে পাঠানোর কথা। পাঠাচ্ছে না। নিয়ম কানুন. সব কাগজে কলমে। তুই মাঝে মাঝে এসে খোঁজ নিয়ে যাবি।

আচ্ছা। জিনিসটা সাবধানে রাখবি।

আচ্ছা।

কখনো হাতছাড়া করবি না। এইসব জিনিস। সচরাচর পাওয়া যায় না। যদি ছাড়া পাই, জিনিসটা লাগবে। বেপারীকে শিক্ষা দেব। জন্মের শিক্ষা।

বেপারী কে?

আব্দুল কুদ্দুস বেপারী। ঐ হারামজাদা আমাকে ধরিয়ে দিয়েছে। হারামীর বাচ্চাকে আমি শিয়ালের শিং দেখাব। হারামী দেখবে শিয়ালের শিং কেমন। হরিণের মত ডালপালাওয়ালা, না-কি গরুর মত প্লেইন।

ইমন চুপ করে রইল। শোভন গলা নামিয়ে বলল, ভয় পাস না। ভয়ের কিছু নেই। তোর কাছে এই জিনিস আছে এটা কেউ সন্দেহ করবে না। মা

কেমন আছে?

জানি না। অনেক দিন যাই না।

যাস না কেন? মাঝে মধ্যে যাবি। মা কি জানে। আমি ধরা খেয়েছি?

মনে হয় জানেন না।

না জানলেই ভাল। নষ্ট ছেলে পুলে সম্পর্কে যত কম জানা যায় ততই ভাল।

তোমার কেইস আদালতে কবে যাবে?

দেরী আছে। পুলিশকে আগে কেইস সাজাতে হবে। পুলিশের এত সময় কোথায়? তাদের সব গুছিয়ে আনতে বছর দুই সময় লাগবে। এই দুই বছরে কত কি হবে। আলামত হারিয়ে ফেলবে। সাক্ষি ট্যাপ খেয়ে যাবে। ফাইল খুঁজে পাওয়া যাবে না।

ইমন কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল, তুমি কি খুন করেছ?

শোভনের দ্বিতীয় সিগারেটটিও শেষ হয়েছে। শিকের বাইরে সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে সে আরেকটি সিগারেট হাতে নিল, ধরাল না। ইমনের ধারণা হল শোভন প্রশ্নের উত্তর দেবে না। প্রশ্নের উত্তর না দেওয়াও এক ধরণের উত্তর। তবে ইমনের ধারণা ভুল প্রমাণ করে শোভন বলল, খুন করেছি। একা করিনি, সঙ্গে আরো লোকজন ছিল। এইসব নিয়ে তুই মাথা ঘামাবি না। সবই কপালের লিখন। যার কপালে যা লেখা থাকে তার তাই হয়। যা চলে যা।
 
১৬.


গভীর রাতে সুরাইয়ার ঘুম ভেঙ্গে গেল। কোন কারণ ছাড়াই তিনি ধড়মড় করে উঠে বসলেন। তাঁর কাছে মনে হল বাড়িঘর একটু যেন দুলছে। ঘরের পর্দা কাঁপছে। ভূমিকম্প না-কি? ইমনকে ডাকতে যাবেন-তখন তাঁর শরীর জমে গেল। বিছানায় সুপ্ৰভা শুয়ে আছে। কুণ্ডুলী পাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। ছোটবেলার মত করে ঘুমুচ্ছে—বুড়ো আঙ্গুল মুখের ভেতর। আঙ্গুল চুষতে চুষতে ঘুম। বড় হয়েও এই অভ্যাস যায় নি। কত মার খেল এই জন্যে। সুরাইয়া ভাঙ্গা গলায় ডাকলেন, ইমন ইমন। গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না। তিনি ফুসফুসের সমস্ত শক্তি একত্র করে ডাকলেন, ইমন ইমন। তিনি সুপ্রভার উপর থেকে দৃষ্টি ফিরাতে পারছেন না। মেয়েটা ঘুমুচ্ছেও না। এইত চোখ মেলে আবার চোখ বন্ধ করল। সুপ্ৰভা কোথেকে এল?

দরজায় ধাক্কা পড়ছে। ইমনের গলা শোনা যাচ্ছে—মা কি হয়েছে? দরজা খোল। দরজা খোল মা।

সুরাইয়া খাট থেকে নামলেন। মেঝেতে পড়ে যাচ্ছিলেন, দেয়াল ধরে টাল সামলালেন। কোন রকমে দরজার কাছে গেলেন। আবারো তাকালেন খাটের দিকে—ঐতো সুপ্রভা। পা গুটিয়ে শুয়েছিল, এখন পা সোজা করেছে।

মা দরজা খোল।

সুরাইয়া দরজা খুললেন। ইমন বলল, কি হয়েছে? সুরাইয়া তাকালেন খাটের দিকে। খািট শূন্য। কেউ সেখানে শুয়ে নেই। ইমন বলল, কি হয়েছে?

সুরাইয়া ক্ষীণ গলায় বললেন, ভয় পেয়েছি।

ভয় পেয়েছ। কেন?

মনে হচ্ছিল ভূমিকম্প হচ্ছে।

মা শুয়ে থাক, ভূমিকম্প হচ্ছে না।

তুই আমার সঙ্গে ঘুমো।

ইমন বিরক্ত গলায় বলল, পাগলের মত কথা বলো নাতো মা।

পাগলের মত কথা কি বললাম? ছেলে মার সঙ্গে ঘুমুতে পারে না।

একটা জোয়ান ছেলে মার সঙ্গে শুয়ে থাকবে এটা কেমন কথা?

মার কাছে ছেলে সব সময়ই ছেলে।

তোমার সঙ্গে ডিবেট করতে ভাল লাগছে না। মা! তুমি ঘুমাও আমি যাচ্ছি।

এ রকম বিরক্ত গলায় কথা বলছিস কেন? তোর বাবাতো জীবনে কখনো আমার সঙ্গে এমন বিরক্ত গলায় কথা বলে নি।

বাবা যদি এখন থাকতো তাহলে আমার চেয়ে অনেক বেশী বিরক্ত হত। তুমি আগে যেমন ছিলে এখন তেমন নেই। তুমি বদলে গেছ।

আমাকে ধমকাচ্ছিস কেন?

ধমকাচ্ছি না। তোমাকে ধমকাব এত সাহস আমার নেই।

ইমন চলে গেল। সুরাইয়া আবারো ভয়ে ভয়ে খাটের দিকে তাকালেন। না, খাটে কেউ নেই। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দিকে রওনা হলেন। পানির পিপাসা হয়েছে পানি খাবেন। মাথা দীপ দাপ করছে। নারিকেল তেলের সঙ্গে পানি মিশিয়ে মাথায় দিতে হবে। ঘরে কি নারিকেল তেল আছে? মনে করতে পারছেন না।

সুরাইয়া পানি খেলেন। মাথায় পানি দিয়ে চুলা ধরালেন। বাকি রাতটা তিনি জেগেই কাটাবেন। একা একা বিছানায় ঘুমুতে যাবার মত সাহস তাঁর নেই। চা নিয়ে বসার ঘরে চলে যাবেন। মোটাসোটা দেখে একটা গল্পের বই নিয়ে বসতে পারলে হত। গল্পের বই কি আছে? ইমনের কাছে থাকতে পারে। সুরাইয়া ইমনের জন্যেও এক কাপ চা বানালেন। মনে হয় খাবে না। না খেলে তিনি নিজেই পরে গরম করে খেয়ে নেবেন।

ইমনের ঘরের দরজার কড়া নাড়তেই ইমন দরজা খুলল। সুরাইয়া বললেন, চা খাবি?

ইমন কোন কথা না বলে চায়ের জন্যে হত বাড়াল। সুরাইয়া বললেন, তোর কাছে কোন গল্পের বই আছে?

এত রাতে গল্পের বই দিয়ে কি হবে?

রাতে আর ঘুমুতে যাব না। এই জন্যে।

ভূমিকম্পের ভয়ে জেগে থাকবে?

ভূমিকম্প না। অন্য ব্যাপার।

অন্য ব্যাপারটা কি?

সুরাইয়া ছেলের ঘরের বিছানার উপর চায়ের কাপ নিয়ে বসতে বসতে বললেন— হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে দেখি কি বিছানায় সুপ্ৰভা ঘুমুচ্ছে।

এটাতো নতুন কিছু না মা। এক সময় তুমি দেখতে বাবা তোমার পাশে ঘুমুচ্ছে।

তোর বাবাকে দেখে কখনো ভয় পেতাম না। সুপ্ৰভাকে দেখে ভয় পেয়েছি।

সুপ্ৰভাকে কি আজই প্রথম দেখলে না। আগেও দেখেছ?

সুরাইয়া জবাব দিলেন না। তিনি অন্য একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবছেন। ব্যাপারটা ছেলেকে এই মুহুর্তে বলা ঠিক হবে কি-না বুঝতে পারছেন না। সুরাইয়া হঠাৎ লক্ষ্য করলেন তিনি ছেলেকে কিছুটা হলেও ভয় পান। আশ্চর্য নিজের পেটের ছেলেকে তিনি ভয় পাচ্ছেন। ঐতো সেদিন এতটুকু ছিল। সিঁড়ি দিয়ে একা নামতে পারত না। কেমন পা লেছড়ে লেছড়ে নামত।

ইমন!

বল।

মুন্নী মেয়েটাকে তুই দেখেছিস না? মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে রাতে এসে থাকে।

হুঁ।

মেয়েটাকে তোর কেমন লাগে?

ভাল।

শুধু ভাল না, মেয়েটা আসলে খুবই ভাল। তুইতো তার সঙ্গে কথা বলিসনি কাজেই তুই জানিস না। আমার সঙ্গে অনেক কথা হয় আমি জানি। মেয়েটা তোকে খুব পছন্দ করে।

পছন্দ করলে তো ভালই।

ভাল হত।

ভাল হত কেন?

ভাল একটা মেয়ে-এই জন্যেই ভাল হত।

মেয়েটাকে তোমার যত ভাল মনে হচ্ছে সে তত ভাল না। কাছুয়া টাইপ মেয়ে।

কাছুয়া টাইপ মেয়ে মানে?

মানে তুমি বুঝবে না মা। বাদ দাও।

আমি বুঝব না, আর তুই সব বুঝে বসে আছিস? এত তাড়াতাড়ি এত লায়েক কি ভাবে হয়ে গেলি? তোর বাবাওতো এত লায়েক ছিল না।

কথায় কথায় বাবার প্রসঙ্গ টানবে নাতো মা। বাবার সঙ্গে আমার তুলনা করবে না। বাবা ছিল বাবার মত আমি আমার মত।

তোর বাবার কথা উঠলেই তুই রেগে যাস কি জন্যে? আমি ব্যাপারটা আগেও লক্ষ্য করেছি। তুইতো তাকে সহাই করতে পারিস না।

আমি তাকে সহ্য করতে পারি বা না পারি তাতে তো তাঁর কিছু যাচ্ছে আসছে না। তুমি কেন রাগ করছ?

এখন তোর বাবার কিছু যাচ্ছে। আসছে না। কিন্তু সে যখন ফিরে আসবে, আমাদের সঙ্গে থাকবে তখনতো যাবে আসবে।

বাবা আমাদের সঙ্গে থাকবে?

সে যাবে কোথায়?

ইমন চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বলল, তোমার এখনো ধারণা বাবা ফিরে আসবে?

অবশ্যই আসবে। আমি আলাদা বাসা নিয়েছি কি জন্যে? তোর বাবার জন্যে।

ও।

আমি চেষ্টা করছি তোর বাবা চলে যাবার সময় যে বাড়িতে ছিল সেই বাড়ি ভাড়া নিতে। বাড়িওয়ালাকে বলে রেখেছি— ঘর খালি হলেই তিনি আমাকে খবর দেবেন।

ঠিক আছে মা। তোমার যা ইচ্ছা কর।

মুন্নী মেয়েটার ব্যাপারে তুই ভেবে দেখা।

মা আমার ঘুম পাচ্ছে, আমি ঘুমুব।

অবশ্যই ফিরবে। তাকে ফিরতেই হবে।

আচ্ছা ঠিক আছে।

তোর বাবা ফিরে আসবে শুনে তুই মনে হয় বিরক্ত হচ্ছিস?

মোটেই বিরক্ত হচ্ছি না। মা। আমার আনন্দ হচ্ছে।

তোকেতো চিনতেই পারবে না। এতটুকু ছেলে রেখে গিয়েছিল ফিরে এসে দেখবে এত বড় জোয়ান ছেলে।

সুরাইয়া হাসছেন। ইমন তাঁর মার হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল।



ইমনের ঘুম আসছে না। মার সঙ্গে কথা বলে মাথা কেমন জানি করছে। চোখ জ্বালা করছে। একবার ঘুম আসবে না জানা হয়ে গেলে বিছানায় শুয়ে থাকা খুব কষ্টকর হয়। ইমন বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। বাকি রাতটা জেগেই কাটাতে হবে। চিঠি লিখলে কেমন হয়? ছোট চাচাকে একটা চিঠি লেখা যায়। তবে তিনি আবারো ঠিকানা বদলেছেন। চিঠি লিখলেও পাঠানো যাবে না। অবশ্যি চিঠি যে পাঠাতেই হবে এমনতো কথা নেই। চিঠি লেখাটাই প্রধান। পাঠানোটা প্রধান না। আচ্ছা সুপ্ৰভাকে একটা চিঠি লিখলে কেমন হয়? সুপ্ৰভা কোনদিন পড়তে পারবে না, আবার পড়তেওতো পারে। জগৎ রহস্যময়, সেই রহস্যময় জগতে কত কিছুই ঘটতে পারে। সে চিঠি লেখার সময় অশরীরি সুপ্ৰভা হয়ত উঁকি দিয়ে দিয়ে পড়বে। নিজের মনে পড়বে। আচ্ছা তারও কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে?

ইমন কাগজ কলম নিয়ে বসল। সম্বোধন কি হবে।— প্রিয় সুপ্ৰভা? না, প্রিয় লেখার দরকার নেই। যে প্ৰিয় তাকে প্ৰিয় সম্বোধন করার প্রয়োজনটা কি? আমরা যখন অপ্ৰিয় কাউকে চিঠি লিখি তখন কি লিখি অপ্ৰিয় করিম বা অপ্রিয় রহিম? ইমন কাগজের উপর ঝুকে পড়ল। চিঠিটা এমন করে লিখতে হবে যেন সুপ্ৰভা পড়ে মজা পায়। আচ্ছা এসব সে কি ভাবছে? সুপ্ৰভা পড়বে কি ভাবে যে মজা পাবে?

সুপ্ৰভা,

তুই কেমন আছিস? মনের আনন্দে খুব ঘুরে বেড়াচ্ছিস? চিন্তা নেই, ভাবনা নেই, স্কুলের ঝামেলা নেই।

তোর কথা খুব মনে হয়। আমি যখনই একা থাকি তখনি দুজন মানুষের কথা মনে হয়–একজন ছোট চাচা, আরেকজন তুই।

আর যখন অসুখ বিসুখ হয় তখন ছোট চাচা না, তখন শুধু তোর কথা মনে হয়। তোর যে অভ্যাস ছিল অসুখ হয়ে বিছানায় পড়ে গেলেই গল্পের বই পড়ে শুনানো। অসুখের সময় কিছু ভাল লাগে না। মাথায় যন্ত্রণা হয়। তখন কি আর গল্প শুনতে ভাল লাগার কথা? আমার কখনো ভাল লাগত না। তুই এত আগ্রহ করে গল্প পড়ে শুনাতি বলে চুপ করে থাকতাম।

কয়েকদিন আগে জ্বরে পড়েছিলাম। গায়ে হামের মত গোটা গোটা কি যেন বের হয়েছিল। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা। তখন তোর কথা খুব মনে পড়ছিল।

এখন আমাদের খবর বলি। শোভন ভাইয়াকে পুলিশ ধরে থানা হাজতে আটকে রেখেছে। আমি প্রায়ই তাকে দেখতে যাই—সিগারেট দিয়ে আসি। শোভন ভাইয়া সেদিন হঠাৎ বললেন, তোকে না-কি স্বপ্নে দেখেছেন। স্বপ্নটাও অদ্ভুত। তিনি হাজতে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। মশার হাত থেকে বাঁচার জন্যে নাক মুখ সব কম্বলে ঢাকা। হঠাৎ কে যেন টান দিয়ে কম্বল সরাল।

তিনি জেগে উঠে দেখেন— তুই। তিনি বললেন, সুপ্ৰভা তুই এখানে কেন? হাজতে এসেছিস কি মনে করে? তুই হাসতে হাসতে বললি, তোমাকে দেখতে এসেছি। শোভন ভাইয়া দারুণ রেগে গিয়ে বললেন, তুই তোর বিশ্ৰী অভ্যাসটা বদলা। যেখানে সেখানে উপস্থিত হবি। তুই একটা বাচ্চা মেয়ে, হাজতে তুই আসবি কেন?

তুই বললি, তোমাকে নিতে এসেছি ভাইয়া। এসো আমার সঙ্গে।

তিনি বললেন, এরা আমাকে যেতে দেবে না।

তুই বললি, অবশ্যই যেতে দেবে। আমার হাত ধর।

তিনি তোর হাত ধরতেই স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল।

স্বপ্নটা সুন্দর, কিন্তু তার কাছে মনে হল তিনি একটা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছেন। এটা নাকি মৃত্যু স্বপ্ন। কোন মৃত মানুষ যদি স্বপ্নে দেখা দিয়ে হাত ধরতে বলে এবং সেই হাত যদি ধরা হয় তাহলে ধরেই নিতে হবে অবধারিত মৃত্যু।

সুপ্ৰভা, তুই কি জানিস শোভন ভাইয়া এবং টোকন ভাইয়া তোকে অসম্ভব ভালবাসে। তোর কথা উঠলেই তাদের চোখে পানি আসে। আশ্চর্য কাণ্ড, তোর দেখি তলে তলে সবার সঙ্গেই খাতির ছিল। সবাই তোকে এত পছন্দ করে কেন? রহস্যটা কি?

আমাকে কিন্তু কেউ তেমন পছন্দ করে না। এটা ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি। ছোটবেলায় কেউ আমাকে খেলতে নিত না। তুই শুনে খুব অবাক হবি স্কুলের সব ছেলেরা একবার কোন কারণ ছাড়াই আমাকে মাটিতে ফেলে মেরে প্রায় ভর্তা বানিয়ে ফেলেছিল। আমাদের জিওগ্রাফি স্যার শেষে ছুটে এসে আমাকে উদ্ধার করেন।

এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি—এখানেও একই সমস্যা। ফাস্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে উঠার সময় ভাইবা পরীক্ষা হয়। ভাইবায় আমাকে যে সব প্রশ্ন করা হয়েছিল তার প্রতিটির উত্তর আমি দিয়েছি। তারপরেও নম্বর পেয়েছি মাত্ৰ ৫০, অথচ অন্যরা ৭০, ৭৫ পেয়েছে। ও তোকেতো বলা হয় নি ফাস্ট ইয়ার থেকে সেকেণ্ড ইয়ারে উঠার পরীক্ষায় আমি খুব ভাল করেছি। থিওরী পরীক্ষার প্রতিটায় খুব ভাল করেছি। স্যাররা এখন মনে হয় ভাইবায় আমাকে কম নাম্বার দেয়ায় নিজেরাই লজ্জিত।

স্যারদের ধারণা আমি রেকর্ড নাম্বার নিয়ে পাশ করব। আমার সে রকম ধারণা না। আমার মনে হচ্ছে। আমি শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা দেব না। আমার কিছুই ভাল লাগে না। প্রায়ই ইচ্ছা করে সব ছেড়ে ছুঁড়ে বাবার মত কোথাও চলে যাই।

এমন কোথাও যেখানে কেউ আমাকে খুঁজে পাবে না। কেউ আমাকে চিনবে না, আমিও কাউকে চিনতে পারব না। আমার কথাবার্তা কি তোর কাছে এলোমেলো লাগছে?

আমার মাথা খানিকটা এলোমেলো হয়েছে ঠিকই। প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখি। দুঃস্বপ্নগুলির মধ্যেও কোন ভেরিয়েশন নেই–একই দুঃস্বপ্ন—খালি গায়ে শুয়ে আছি, হঠাৎ গায়ের উপর দিয়ে কুৎসিত একটা মাকড়সা হেঁটে যেতে শুরু করল। আমি বিকট চিৎকার দিয়ে মাকড়সাটা হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করেও ফেলতে পারলাম না। সে আঙ্গুল কামড়ে ঝুলে রইল। আমার কি ধারণা জানিস? আমার ধারণা আমি যদি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাই তাহলে আমার ভুবন হবে মাকড়সাময়। আমার চারদিকে কিলবিল করবে। অসংখ্য মাকড়সা। আমাকে যে খাবার দেয়া হবে সে খাবার খেতে গিয়ে দেখব—মাকড়সার ঝোল আলু এবং সীম দিয়ে রান্না করা হয়েছে। এসব কি লিখছি? আমার গা ঘিনঘিন করছে।

মার কথাতো তোকে বলা হয় নি-মা ভাল আছে। খুব ভাল না, মোটামুটি ভাল। মা এখন আমাকে কিছুটা ভয় পায়। এটা বিরাট একটা ঘটনা না? তার এখনো ধারণা যেদিন আমার বিয়ে হবে সেদিন বাবা ফিরে আসবেন। তার অপেক্ষার শেষ হবে।

তিনি আমার জন্যে মনে মনে একটা পাত্রীও ঠিক করে ফেলেছেন। মেয়েটার নাম মুন্নী। মার ধারণা এই পৃথিবীতে মুন্নীর মত ভাল মেয়ের জন্ম হয় নি। আমার ধারণা অবশ্যি সে রকম না। নানা রকম দুঃখ কষ্ট, বঞ্চনার ভেতর দিয়ে সে বড় হয়েছে বলে তার ভেতর বেশ কিছু ধাপ্লাবাজী ঢুকে গেছে। এই জাতীয় মেয়েদের প্রধান ঝোক থাকে মানুষকে পটানো। মাকে সে ইতিমধ্যে পটিয়ে ফেলেছে। খুব শিগগীরই সে আমাকে পটানোর একটা চেষ্টা চালাবে বলে আমার ধারণা।

আচ্ছা সুপ্ৰভা, তুই কি নবনীর কথা জানিস? মিতু কি তোকে নবনী সম্পর্কে কিছু বলেছে? মনে হয় বলেনি। মিতু আবার কাউকেই কিছু বলে না। সব কথা পেটে রেখে দেয়। নবনীকে আমি অংক শেখাই। আমাদের এক স্যার এই প্রাইভেট টিউশ্যানিটা আমাকে জোগাড় করে দিয়েছেন। হুলুস্থুল টাইপের বড়লোকের মেয়ে। চেহারা জাপানী পুতুলের মত, ভাবভঙ্গিও পুতুলের মত। একমাত্র মেয়ে হলে যা হয়। আহ্লাদ না করে কোন কথা বলতে পারে না। আমি যদি তাকে জিজ্ঞেস করি।-অংকটা বুঝতে পেরেছ? সে কিছুক্ষণ এলোমেলো ভাবে হাসবে তারপর টেনে টেনে বলবে-জানি না। আমি যদি বলি-আবার বুঝিয়ে দেব? সে আগের মত টেনে টেনে বলবে, ইচ্ছে হলে বুঝাতে পারেন, ইচ্ছা না হলে নাই। ছাত্রী হিসেবে অত্যন্ত বিরক্তিকর।

নবনী টাইপ মেয়েরা করে কি জানিস? তারা পরিচিত অর্ধপরিচিত সব ছেলের সঙ্গেই প্ৰেম প্ৰেম ভাব নিয়ে কথা বলে। এ রকম করতে করতে অভ্যাস হয়ে যায়। তখন এই কান্ডটা সবার সঙ্গেই করে। বর্তমানে আমার সঙ্গে করছে। জন্মদিনে উপহার কিনে দিচ্ছে। আমি খুবই বিব্রত বোধ করছি। মেয়েটা সম্ভবত তার বাবা-মাকেও আমার বিষয়ে কিছু বলেছে। কারণ কয়েকদিন আগে মেয়েটির বাবা আমার সঙ্গে অনেক কথা টথা বললেন। দেশের বাড়ি কোথায়? ক ভাইবোন? এইসব। শেষটায় বললেন, তারা সিলেট হয়ে শিলং বেড়াতে যাচ্ছেন। আমি যদি শিলং না দেখে থাকি তাহলে যেন তাদের সঙ্গে যাই। আমার অবস্থাটা কি বুঝতে পারছিস? আমি নবনীদের বাড়ি যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। তবে খুব ভয়ে ভয়ে আছি কবে না জানি সে খুঁজে খুঁজে বাসায় উপস্থিত হয়!

আমার পড়াশোনার কথা তোকে চিঠির শুরুতে একভাবে লিখেছিলাম। এখন অন্যভাবে বলি, তোর মৃত্যুর পর থেকে আমি পড়াশোনা করতে পারছি না। কেন জানি বই পড়তে ভাল লাগে না। ঘরে থাকতেও ভাল লাগে না। তিনটা ক্লাস এসাইনমেন্ট জমা দেই নি। নিয়মিত যে ক্লাসে যাচ্ছি তাও না। ঘরে যখন থাকি বিছানায় শুয়ে থাকি। বাইরে যখন থাকি রাস্তায় রাস্তায় হাঁটি। এর নাম হন্টন-সিনড্রোম।

রাস্তায় যখন হাঁটি তখন আমার গায়ে থাকে চাদর। এখন শীতকাল কাজেই চাদর থাকতেই পারে। চাদরের নিচে, প্যান্টের পকেটে ভয়াবহ একটা বস্তু থাকে। এই ভয়াবহ বস্তুটা আমাকে লুকিয়ে রাখতে দিয়েছেন শোভন ভাইয়া। আমি লুকিয়েই রাখি। হঠাৎ হঠাৎ পকেটে নিয়ে বের হই। তখন খুব অন্যরকম লাগে। পৃথিবীটাকে নিজের পায়ের নিচে মনে হয়। এমিতেই পৃথিবী আমাদের পায়ের নিচে, যদিও তা কখনো মনে হয় না। ঐ বস্তুটা পকেটে থাকলেই শুধু মনে হয়। এবং কি ইচ্ছা করে জানিস? ইচ্ছা করে আশে পাশের সব দুষ্টলোক মেরে ফেলি। এখন তুই কি বুঝতে পারছিস বস্তুটা কি? যা ভাবছিস তাই-পিস্তল। পিস্তলের নাম ধামতো জানি না—তবে পিস্তলের গায়ে রাশিয়ান ভাষায় কি সব লেখা দেখে মনে হচ্ছে রাশিয়ায় তৈরি। জিনিসটা ছোট্ট এবং সুন্দর। হাতের মুঠোর মধ্যে আটে। ধরার বাটটা রূপালী। মনে হয় রূপার তৈরি। বাটে সুন্দর সুন্দর ছবি, গাছ-লতা-পাতা-ফুল এইসব।

সেদিন কি হল শোন। কাকরাইলের দিকে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি তিনটা ছেলে (আমার মত বয়েসী) আধাবুড়ো এক রিকশাওয়ালাকে কিল চড় ঘুসি মারছে। রিকশাওয়ালা নাকি তাদের সঙ্গে কি বেয়াদবী করেছে। রিকশাওয়ালার নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে, মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। অনেক লোকজন গোল হয়ে দাঁড়িয়ে রিকশাওয়ালাকে মারের দৃশ্য দেখছে। কেউ কিছু বলছে না।

এক পর্যায়ে রিকশাওয়ালার লুঙ্গি খুলে পড়ে গেল। লুঙ্গি টেনে শরীরে জড়ানোর মত শক্তিও তার নেই। নগ্ন একজন মানুষ মার খাচ্ছে-কুৎসিত দৃশ্য। আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমার প্যান্টের পকেটে লতা-ফুল-পাতা আঁকা পিস্তল। অথচ আমিও কিছু বলছি না। আমি কি খুব সহজেই বলতে পারতাম না—যথেষ্ট হয়েছে। এখন সব বন্ধ। তোমরা তিনজন কানে ধরে দশবার ওঠবোস কর এবং বুড়ো মানুষটার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। আমি কিছুই করলাম না। মাথা নিচু করে চলে এসেছি।

সুপ্ৰভা শোন, মা যেমন রাতে ঘুমায় না, আমিও ঘুমাই না। মা জেগে থাকে তার ঘরে। আমি জেগে থাকি আমার ঘরে। মার জেগে থাকার তাও একটা অর্থ আছে। তিনি অপেক্ষা করেন। মার অপেক্ষা বাবার জন্যে। আমিতো কোন কিছুর জন্যে অপেক্ষা করি না।

রাত জেগে আমি অনেক কিছু ভাবি। সেই অনেক ভাবনার একটা হল—মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে অপেক্ষা নামের ব্যাপারটির খুব প্রয়োজন। অপেক্ষা হচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার টনিক। মার শরীরের যে অবস্থা তাতে তার বেঁচে থাকার কথা না, তারপরেও আমার ধারণা তিনি দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকবেন কারণ তিনি অপেক্ষা করছেন। বড় মামা বেশী দিন বাঁচবেন না, কারণ তিনি এখন আর কোন কিছুর জন্যে অপেক্ষা করছেন না।

ইমন লেখা বন্ধ করল। ফজরের আজান হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারদিক ফর্স হতে শুরু হবে। দিনের আলোয় এই চিঠি লেখা যাবে না। ইমনের হাই উঠছে, ঘুম পাচ্ছে। কিছুদিন হল ঠিক ফজরের আজানের পর পর তার ঘুম আসে। ইমন লেখা কাগজগুলি হাতে নিয়ে এখন কুচি কুচি করে ছিড়ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, এখন তার চেষ্টা কত ছোট কাগজের কুচি করা যায় তা দেখা। কাগজের কুচিগুলিকে এখন দেখাচ্ছে জুই ফুলের মত। সারা ঘরময় ছড়িয়ে তার উপর দিয়ে হাঁটতে হবে—কুসুমে কুসুমে চরণ চিহ্ন।
 
১৭.


শীতকালের সকাল। মিতু মন খারাপ করে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। আশৈশবের চেনা ছাদটাকে চেনা যাচ্ছে না। ছাদের চারদিকে রেলিং হয়েছে। রেলিং এর ধার ঘেসে ফুলের টব। জমিলুর রহমান সাহেবের হঠাৎ করে গাছের নেশা হয়েছে। তিনি রোজই ফুলের টব কিনে আনছেন। বস্তা ভর্তি মাটি আনছেন, সারা আনছেন। মহা উৎসাহে মাটি এবং সার মাখিয়ে মিকচার তৈরি হচ্ছে। সেই মিকচার টবে ভরা হচ্ছে। তাঁর একত্ৰিশটা টাব আছে শুধুই গোলাপের। ফুটন্ত গোলাপের সংখ্যা সাতচল্লিশ। জামিলুর রহমান রোজ সকালে এসে একবার করে গোলাপের সংখ্যা গুণেন। ব্যবসায়ী মানুষ বলেই হয়ত সাতচল্লিশকে মনে মনে পাঁচ দিয়ে গুণে ফেলেন। দুইশ পয়ত্রিশ। অর্থাৎ ছাদের বাগানের গোলাপের বর্তমান বাজার দর পাঁচ টাকা করে পিস ধরলে দুইশ পয়ত্ৰিশ টাকা। তাকে তখন অত্যন্ত আনন্দিত দেখায়। তিনি যে শুধু ফুটন্ত গোলাপের হিসাব রাখেন তাই না, কতগুলি কুড়ি আছে তারও হিসাব রাখেন। কুড়ির বর্তমান সংখ্যা বাষট্টি।

মিতুর এইসব ভাল লাগে না। ছাদটা নষ্ট হয়ে গেল। এই ভেবে তার মন খারাপ হয়। আগের খোলামেলা মাঠ মাঠ ভাব নেই। চারদিকে রেলিং উঠায় ছাদের চরিত্র বদলে গেছে। এখন মনে হয় মিনি জেলখানা। মিতু এক সময় ছাদের শেষ প্রান্তে পা ঝুলিয়ে বসে থাকত, সেটা আর হবে না। তাছাড়া ছাদে উঠলেই একা হয়ে যাবার যে ব্যাপার ছিল তা এখন ঘটছে না। জমিলুর রহমান সাহেবকে সকাল বিকাল দুবেলাই ছাদে পাওয়া যাচ্ছে। মিতুর আশংকা তার বাবার উৎসাহ যে ভাবে বাড়ছে তাতে কিছুদিন পর দেখা যাবে তিনি দিনরাত ছাদেই পড়ে আছেন। মানুষ অদ্ভুত প্ৰাণী, কখন কোন নেশা ধরে যায় বলা কঠিন।

শীতের এই সকালে জামিলুর রহমানকে একটা গেঞ্জি গায়ে দেখা যাচ্ছে। তার নাক-মুখ রুমাল দিয়ে বাধা। তিনি গোলাপের গাছে ইনসেকটিসাইড স্প্ৰে করছেন। গোলাপের গাছে কীট পতঙ্গের সংক্রমণ দ্রুত হয়। সুন্দরের প্রতি শুধু যে মানুষের আকর্ষণ তা না, কীট পতঙ্গেরও তীব্র আকর্ষণ।

মিতু বাবার দিকে এগিয়ে গেল। জমিলুর রহমান স্পে করা বন্ধ করে বললেন, কাছে আসিস না মা। দূরে থাক। তীব্ৰ বিষ।

মিতু দাঁড়িয়ে গেল। জামিলুর রহমান বললেন, মিতু তুই একটু নিচে যা, তোর মা ডাকছে। আমার জন্যে এক কাপ চা পাঠিয়ে দিস।

মিতুর নিচে যেতে ইচ্ছে করছে না। কারণ আজ তাকে দেখতে লোক এসেছে। মিতু চায়ের ট্রে নিয়ে যাবে এবং কাপে করে সবাইকে চা তুলে তুলে দেবে। ছেলে নিজেও এসেছে। মিতুর রাগে শরীর জুলছে। ছেলেটার কি লজ্জা বলেও কিছু নেই। বাড়ি বাড়ি মেয়ে দেখে বেড়াচ্ছে। এর আগেও নিশ্চয়ই সে অন্য সব মেয়েদের বাসায় গিয়েছে। মেয়ের হাতে বানানো চা খেয়েছে। গল্প গুজব করেছে। মিতুকে দেখার পরেও আরো অনেকের বাড়িতে যাবে। তারপর বাছাই প্রক্রিয়া শুরু হবে। এই মেয়েটা ফর্সা। তবে একটু খাটো। ঐ মেয়েটা লম্বা আছে। তবে শ্যামলা। মগবাজারের মেয়েটার সবই ভাল ছিল শুধু একটা দাঁত ভাঙ্গা। ঝিকাতলার মেয়েটার চুল। লালচে। লালচে চুলের মেয়ের স্বভাব চরিত্র ভাল হয় না।

জামিলুর রহমান বললেন, দাঁড়িয়ে আছিস কেন মা? নিচে যা।

মিতু বলল, ওরা কি এসে গেছে?

জামিলুর রহমান বললেন, জানি না। নটার মধ্যেতো আসার কথা।

তুমি যাবে না?

উহুঁ। আমার যাবার দরকারও নেই। তোর মেজো খালা আছে। সে একাই একশ।

ছেলে কি করে তুমি কি জান?

পেট্রোবাংলায় কাজ করে। ইনজীনিয়ার। স্কলারশীপ নিয়ে বাইরে যাচ্ছে। তোর মেজো খালা বলছিল ছেলে খুব সুন্দর।

তাহলেতো ভালই। যে সব ছেলে খুব সুন্দর তারা আবার রূপবতী মেয়ে পছন্দ করে না। সুন্দরী মেয়েদের তারা নিজেদের রাইভ্যাল মনে করে। কাজেই আমার ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে।

জামিলুর রহমান বিস্মিত হয়ে বললেন, তুই কি অসুন্দর না-কি? তোর মত সুন্দরী মেয়ে বাংলাদেশে কাঁটা আছে? মিতু হাসতে হাসতে নিচে নামল।

ছেলের নাম জুবায়ের। দেখতে সুন্দর। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকার মতই সুন্দর। কথাবার্তাও ভাল। রসবোধ আছে। মজা করে কথা বলতে পারে। একসময় হাসতে হাসতে বলল, আমার এক বন্ধু আছে। ওরস্যালাইন টাইপ…

মিতু বলল, ওরস্যালাইন টাইপ মানে?

দেখেই মনে হয় পেটের অবস্থা এ রকম যে ওরস্যালাইন খেয়ে ঘর থেকে বের হয়েছে। ফিরে গিয়ে আবারো খাবে।

মিতু হেসে ফেলল।

ভদ্রলোক বললেন, চা-টা খুব ভাল হয়েছে। আমি কি আরেক কাপ চা পেতে পারি?

মিতু পট থেকে চা ঢালল। সে নিজের জন্যেও চা নিল। ভদ্রলোক বললেন, আপনার অনার্স পরীক্ষা কেমন হচ্ছে?

বেশি সুবিধার হচ্ছে না।

ভদ্রলোক খুবই গম্ভীর গলায় বললেন, ফেল করবেন?

মিতু আবারও হেসে ফেলল।

মেয়ে দেখতে আসা লোকজন চা-টা খাওয়া হবার পর হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। চলে যাবার জন্যে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মুরুদ্ৰব্বীদের একজন গলা নীচু করে, ষড়যন্ত্র করছেন এমন ভঙ্গিতে বলেন, ভাইসাহেব পরে যোগাযোগ করব। আপনাদের মেয়ে মাশাল্লাহ ভাল।

এদের বেলা সে রকম হল না। তারা যাবার আগে মিতুর মেজো খালাকে বললেন, মেয়ে তাদের খুবই পছন্দ হয়েছে। আগামী শুক্রবার খুব ভাল দিন। ঐ দিন পান-চিনি করতে চান। বিয়ে অনার্স পরীক্ষা শেষ হবার পর হবে। তাদের কোন দাবি দাওয়া নেই। শুধু মেয়ের বাইরে যাবার টিকিটাটা যদি করে দেন তাহলে ভাল হয়। আর না দিলেও ক্ষতি নেই।

মিতুর মেজো খালা বললেন, টিকিট আমরা করে দেব কোন সমস্যা নেই।

শুক্রবারের পান-চিনির তারিখটা ফাইন্যাল করে দিন। আমাদের আত্মীয় স্বজনদের খবর দিতে হবে।

এখনই দিতে হবে?

বিয়ে সাদীর ব্যাপারটা এমন যে, যত দেরি হবে তত প্যাঁচ লেগে যাবে। কি দরকার?

মিতুর মেজো খালা বললেন, পান চিনি শুক্রবার করতে চান করুন। আমাদের কোন আপত্তি নেই।

ফাতেমা আয়োজন করে কাঁদতে বসলেন। মেজো খালা মিষ্টি কেনার জন্যে লোক পাঠালেন। তিনি টেলিফোন করে সবাইকে খবর দিতে লাগলেন—বললে বিশ্বাস করবেন না, মিতুর কি ভাগ্য। প্রথম যারা দেখতে এসেছে তারাই পছন্দ করে ফেলেছে। এ রকমতো কখনো হয় না। তাছাড়া বললে বিশ্বাস করবেন না, মিতু কোন রকম সাজগোজ করে নি। কোন মেকাপ না, কিছু না। শাড়ি যেটা পরেছিল সেটাও খুব সিম্পল শাড়ি। সূতি শাড়ি। হালকা সবুজ জমিনের উপর সামান্য কাজ।

বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ায় মিতুকেও খুব আনন্দিত মনে হল। এই উপলক্ষ্যে আনা মিষ্টি সে দুটা খেয়ে ফেলল। একটা সাদা মিষ্টি আরেকটা কালো মিষ্টি। মিষ্টি খেতে খেতে হাসি মুখে বলল, আমার বিয়েটাতো ব্ল্যাক এণ্ড হোয়াইট। এই জন্যে সাদা-কালো মিষ্টি খেলাম।

মেজো খালা বিস্মিত হয়ে বললেন, তোর বিয়ে ব্ল্যাক এণ্ড হোয়াইট মানে?

বর ফর্সা, আমি কালো। এই জন্যেই বিয়েটা ব্ল্যাক এণ্ড হোয়াইট।

তোরাতো আশ্চর্য মেয়ে, এখনো বিয়ে হয়নি। বর ডেকে যাচ্ছিস।

আমরা হচ্ছি। এই যুগের স্মার্ট মেয়ে। আমাদের মুখে কোন লাগাম নেই। যা ইচ্ছা বলতে পারি।

রকিব যদি টেলিফোন করে, কথা বার্তা একটু সাবধানে বলবি। বিয়েটা হয়ে যাক তারপর যা ইচ্ছা বলবি।

টেলিফোন করবে না-কি?

টেলিফোন করবেই। কথা বার্তা যা বলবি, সাবধানে বলবি, রেখে ঢেকে বলবি। পান-চিনির পরেও বিয়ে ভাঙ্গে।



মিতু তার ঘরে পড়ছে। সুন্দর একটা উপন্যাস-টমাস হার্ডির Tress of the durbervilles। পরীক্ষার জন্যে পড়া বলেই ব্যাকরণ বইয়ের মত লাগছে। অথচ টেস এর চরিত্র লেখক কি সুন্দর করেই না তুলে এনেছেন। এই সুন্দরে কাজ হবে না। এই সুন্দরকে চালুনী দিয়ে ছাকতে হবে। মাইক্রোসকোপের নিচে ফেলতে হবে। চরিত্র চিত্ৰনে লেখক কি কি ভুল করেছেন তা বের করতে হবে। লেখকের মানস কন্যা কি সমাজের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠতে পেরেছে? লেখক কি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে চরিত্রটি দেখেছেন না তার প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেছেন? লেখকের উদ্দেশ্য কি ছিল? নিছক গল্প বলা? না-কি গল্প বলার ফাঁকে ফাঁকে তিনি লেখকের সামাজিক দায়িত্বও পালন করছেন? Of all the great English novelists, no one writes more eloquently of tragic destiny than Hardy. ব্যাখ্যা কর।

আচ্ছা হার্ডি যদি টেসকে শান্ত, ভদ্র এবং বিনয়ী একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিতেন তাহলে কেমন হত? উপন্যাস হিসেবে সেটা দাড়াত না, তবে মেয়েটার জীবনতো সুন্দর হত।

মিতু বই বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। মাথার কাছের ছোট্ট জানোলা দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে। পিঙ্গল আকাশ। কোন মেঘ নেই। এই পিঙ্গল আকাশে যদি সাদা মেঘের বিশাল একটা স্তুপ থাকতো তাহলে সুন্দর দেখাতো। মিতু চোখ বন্ধ করে ফেলল। পিঙ্গল আকাশ দেখতে ইচ্ছা করছে না, বরং চোখ বন্ধ করে অন্য কোন বিষয় নিয়ে ভাবা যাক।

বিয়ে নামক ইন্সটিটিউশনটা নিয়ে ভাবা যাক। বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে কুৎসিত লাগছে। সম্পূর্ণ অচেনা একটি মেয়ে এবং একটা ছেলে। দুজনকে দুপ্রান্ত থেকে এনে বলা হল এখন থেকে তোমরা এক সঙ্গে থাকবে। তারা দু জন প্রথমবারের মত একসঙ্গে ঘুমুতে গেল। প্রশস্ত খাট, ফুল তোলা চাদরে কিছু ফুল। খাটটা সাজানো হয়েছে জরির মালায়। ছেলেটা মেয়েটার গায়ে হাত রাখবে। মেয়েটা লজ্জা এবং ভয়ে চুপ করে থাকবে। আতংক নিয়ে অপেক্ষা করবে–তারপর কি হয়।

আফা ও আফা।

মজিদের মা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ ভর্তি হাসি। পান খাওয়া লাল দাঁত সবকটা বের হয়ে আছে।

ও আফা টেলিফোন।

কার টেলিফোন?

নতুন দুলাভাই। হিহিহি।

হি হি করতে হবে না। নিচে যাও, আমি আসছি।

মিতু টেলিফোন হাতে নিয়ে খুব সহজ ভঙ্গিতে বলল আপনি কেমন আছেন?

জুবায়ের একটু ইতস্ততঃ ভঙ্গিতে বলল, ভাল। তুমি কেমন আছ? তুমি করে বললাম। আশা করি কিছু মনে করছ না?

জি না মনে করছি না।

টেলিফোন পেয়ে বিরক্ত হচ্ছি নাতো?

বিরক্ত হচ্ছি না।

আমি আবার খুব ভয়ে ভয়ে টেলিফোন করলাম।

ভয়ে ভয়ে কেন?

তুমি আবার কি মনে কর।

আমি কিছু মনে করছি না।

তোমার পরীক্ষাতো এখন চলছে—তাই না?

জ্বি।

মাঝে গ্যাপ আছে না?

আছে। কাল পরশু এই দুদিন পরীক্ষা নেই। আপনি কি আমাকে বাইরে লাঞ্চের দাওয়াত করতে চাচ্ছেন?

আশ্চর্য! তুমি বুঝলে কি করে?

আমার ই এস পি ক্ষমতা আছে। আমি মানুষের মনের কথা প্রায়ই ধরতে পারি।

তোমাকে বিয়ে করাতো তাহলে খুবই বিপদজনক!

কিছুটা বিপদজনকতো বটেই।

তুমি এমন ভাবে কথা বলছি যেন সত্যি সত্যি তোমার ই এস পি ক্ষমতা আছে।

আসলেই আছে। প্রমাণ দেব? আপনি এই মুহুর্তে সাদা একটা প্যান্ট পরে আছেন। ক্রিকেট খেলোয়াড়রা যেমন সাদা প্যান্ট পরে সে রকম সাদা প্যান্ট। হয়েছে?

হ্যাঁ হয়েছে। মাই গড—তুমিতো সত্যি সত্যি আমাকে ঘাবড়ে দিচ্ছি। মিতু শোন, আজতো তোমার পরীক্ষা নেই?

জি না নেই।

আজকে আমার সঙ্গে বাইরে খেতে চল। খেতে খেতে তোমার ই এস পি পাওয়ার নিয়ে গল্প করব।

জ্বি আচ্ছা।

তোমার পড়ার ক্ষতি হবে নাতো?

একটু হবে। কি আর করা। অবশ্যি আমার এখন পড়তেও ভাল লাগছে না।

তাহলে কাপড় পরে তৈরি হয়ে থোক। আমি এসে নিয়ে যাব।

জি আচ্ছা।

তোমার গলার স্বরটা এমন লাগছে কেন?

কি রকম লাগছে?

বিষাদময় লাগছে। ইংরেজীতে যাকে বলে Plaintive Voice. তোমার কি মন খারাপ?

জ্বি মন খারাপ। বেশ খারাপ।

কারণটা কি জানতে পারি? অবশ্যি বলতে যদি তোমার কোন আপত্তি না থাকে।

না। আমার কোন আপত্তি নেই। আপত্তি কেন থাকবে? আমার এক ফুপাতো ভাই আছে। সেও অনার্স পরীক্ষা দিচ্ছিল। আজই খবর পেয়েছি একটা পরীক্ষা দিয়ে সে আর পরীক্ষা দিচ্ছে না। মনটা খুব খারাপ হয়েছে।

পরীক্ষা দিচ্ছে না কেন?

জানি না। অনেকদিন ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই।

টেলিফোনে খোঁজ নেয়া যায় না?

ওদের টেলিফোন নেই।

তাহলে একটা কাজ করা যেতে পারে, দুপুরে লাঞ্চের পর ওদের বাসায় গিয়ে আমরা খোঁজ নিতে পারি। আমার সঙ্গে গাড়ি থাকবে, ট্রান্সপোর্ট কোন সমস্যা হবে না। আর তুমি যদি মনে কর তুমি একা যাবে-তাহলে গাড়িটা আজ সারাদিনের জন্যে তুমি রেখে দিতে পার।

না। তার দরকার নেই। আমি আসলে জানতেও চাচ্ছি না। যা হবার হবে।

তোমার ফুপাতো ভাই ছাত্র কেমন?

ও খুব ভাল ছাত্র। এস. এস. সি, এইচ. এস. সি. দুটাতেই ষ্ট্যান্ড করেছে।

ওর নামটা তুমি কি বলেছিলে? আমি ভুলে গেছি।

নাম আপনাকে বলিনি, ওর নাম ইমন।

তাকে কি তুমি খুব পছন্দ করা?

হ্যাঁ করি। তবে ও রোবট টাইপের তো কারো পছন্দ অপছন্দের ধার ধারে না। পছন্দ করলেও ক্ষতি নেই। না করলেও ক্ষতি নেই।

বললে তো আপনি আবার রাগ করবেন।

না মোটেই রাগ করব না, তবে তুমি এই যে আপনি আপনি করে কথা বলছ এতে রাগ করছি। সামান্য হলেও রাগ করছি। তুমি কি দয়া করে আমাকে তুমি করে বলবে?

আপনি বললে বলব।

আমি বলছি।

বালছ যখন তখন অবশ্যই তুমি করে বলব।

এখন বল আমি কোন টাইপের মানুষ?

তুমি গায়েপড়া ধরণের মানুষ। একদল পুরুষ আছে যারা মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে খুব পছন্দ করে। তুমি সেই টাইপ।

ও।

রাগ করলে?

না রাগ করিনি।

মিতু হাসল।

জুবায়ের বলল, হাসছ কেন?

মিতু বলল, আমার কথা শুনে তুমি খুব হকচকিয়ে গেছে। এই জন্যে হাসি আসছে।

ও আচ্ছা।

আরেকটা মজার ব্যাপার কি জান? তোমার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত কিন্তু আমার বিয়ে হবে না।

কেন?

কেন ঠিক জানি না। আমার সিক্সথ সেন্স তাই বলছে।

তোমার বিয়েটা কার সঙ্গে হবে? ঐ যে ইমন না-কি যেন নাম তার সঙ্গে?

বাহ তোমার সিক্সথ সেন্সও তো খুব ভাল।

মিতু খিলখিল করে হাসছে। সে শুনল ওপাশে টেলিফোন রিসিভার নামিয়ে রাখা হয়েছে। তারপরেও সে হাসছে। কেন জানি তার খুব মজা লাগছে। তার সিক্সথ সেন্স বলছে ভদ্রলোক তাকে নিয়ে লাঞ্চে যাবার উৎসাহ এখন আর পাচ্ছেন না। তিনি এখন মিতু নামক মেয়ের ব্যাপারে খোঁজ খবর শুরু করবেন। এবং শুক্রবারের পান চিনি উৎসব বাতিল হয়ে যাবে।
 
১৮.


অনেকদিন পর সুরাইয়াকে খুব আনন্দিত মনে হচ্ছে। তিনি পান খেয়েছেন। পান খাবার কারণে ঠোঁট লাল হয়ে আছে। মুখ হাসি হাসি। চোখ জ্বল জুল করছে। চাপা আনন্দের কোন ঘটনা ঘটলেই মানুষের চোখ এরকম জুলে। সুরাইয়ার আনন্দের কারণ হচ্ছে পুরানো ভাড়া বাড়িটা পাওয়া গেছে। আগের বাড়িওয়ালা যথেষ্ট ভদ্রতা করেছেন। লোক পাঠিয়ে খবর দিয়েছেন। ভাড়া বেশি, আগে যে ভাড়া ছিল তার দ্বিগুনেরও বেশি, তবু সুরাইয়ার কাছে মনে হচ্ছে তুলনামুলক ভাবে ভাড়া সস্তা। বড় টানা বারান্দার খোলামেলা বাড়ি আজকাল পাওয়াই যায় না। সবাই বড় বাড়িগুলিকেও খুপরি খুপরি বানিয়ে ফেলছে। শান্তিমত নিঃশ্বাস নিতে হলেও খানিকটা খোলা জায়গা দরকার—এই ব্যাপারটা শহরবন্দি মানুষ ভুলে যেতে বসেছে।

সুরাইয়া ঠিক করেছেন বাড়িটাকে তিনি ঠিক আগের মত করে সাজাবেন। বারান্দায় ফুলের টব থাকবে। একটা বেতের চেয়ার কিনতে হবে। চেয়ারের গাদিটা হবে সবুজ রঙের। চেয়ারের সামনে ছোট্ট কাঠের টেবিল থাকবে। ইমনের বাবা অফিস থেকে ফিরে যে রকম চেয়ারে বসত অবিকল সে রকম চেয়ার। যে কাঠের টেবিলে চা রাখা হত সে রকম একটা কাঠের টেবিল। শোবার ঘরের খাট এবং ড্রেসিং টেবিলটা এখনো আছে। খাটটা বেঁধে ছেদে ভাইজানের বাড়ির স্টোর রুমে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে উদ্ধার করতে হবে। দেয়ালে যে সব ছবি টানানো ছিল তার সব কটাই আছে। তিনি খবরের কাগজে মুড়ে ট্রাংকে রেখে দিয়েছিলেন। ছবিগুলি বের করে দেয়ালে লাগাতে হবে। নীল রঙের একটা প্লাস্টিকের বালতি কিনতে হবে। বালতিটা থাকবে। বারান্দা থেকে উঠোনে নামার সিড়ির গোড়ায়। বালতির কাছে একজোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল রাখতে হবে। ইমনের বাবা অফিস থেকে ফিরেই স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে পায়ে পানি ঢালত।

বাসন কোসনগুলিও আগের মত কিনতে পারলে হত। কি বাসন কোসন ছিল সুরাইয়ার মনে আছে। চীনামাটির থালাগুলি ছিল নীল বর্ডার দেয়া। আজকাল কি এরকম থালা পাওয়া যায়? খুঁজতে হবে। খুঁজলে পাওয়া যায় না। এমন জিনিস ঢাকা শহরে নেই। পর্দা কিনতে হবে। দরজা জানালায় হালকা গোলাপী এক রঙা পর্দা ছিল। ভাগ্যিস ডিজাইনওয়ালা পর্দা ছিল না। থাকলে ডিজাইন মিলিয়ে পর্দা পাওয়া কঠিন হত। সুরাইয়া ঠিক করলেন মুন্নীকে নিয়ে বের হবেন। সারাদিন ঘুরে ঘুরে জিনিসপত্র কিনবেন। ইমনকে নিয়ে বের হতে পারলে খুব ভাল হত, কিন্তু ইমন তার সঙ্গে যাবে না।

আজ সুরাইয়ার ভাগ্যটা অসম্ভব ভাল। মুন্নীকে নিয়ে বের হবার কথা ভাবতে ভাবতেই মুন্নী চলে এল। মুন্নী হাসি হাসি মুখে বলল, খালা কেমন আছেন?

সুরাইয়া আনন্দিত গলায় বললেন, ভাল আছি মা। তুমি কি আমার সঙ্গে একটু বের হতে পারবে?

অবশ্যই পারব।

নতুন বাসায় যাচ্ছি মা। আগে ইমনের বাবাকে নিয়ে যে বাড়িতে থাকতাম সেই বাড়িতে। কয়েকটা জিনিস কিনব। একটু হয়ত দেরি হবে।

হোক দেরি, আমি থাকব আপনার সঙ্গে। এবং আপনারা যখন নতুন বাড়িতে যাবেন আমিও আপনাদের সঙ্গে চলে যাব। আপনাদের নিশ্চয়ই ঝি লাগবে। লাগবে না?

ছিঃ মা, তোমার যে কি কথা।

খালা আমি কিন্তু ঠাট্টা করছি না। আমি এ বাড়িতে থাকতে পারছি না। আপনি যদি আমাকে না নেন, আমাকে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে।

তুমি থাকবে আমার সঙ্গে। কোন সমস্যা নেই।

আপনার ছেলে থাকতে দেবে তো? তাকে আমি খুবই ভয় পাই। তার তাকানোর মধ্যে হেডমাস্টার হেডমাষ্টার ভাব আছে।

মা এটা হল ওদের বংশের ধারা। ইমনের বাবাও এ রকম করে তাকাতো।

আপনার ভয় করতো না? প্রথম প্রথম করতো। মা তুমি যাও, কাপড়টা বদলে আস। চল আমরা বের হই।

আমি এই কাপড়েই বের হব। আপনার কি ধারণা আমার আলনা ভর্তি শাড়ি? আমার তিনটা মোটে শাড়ি। তার মধ্যে একটা শাড়ি যাকাতের। বহরে খাট বলে পরতে পারি না।

মা তোমাকে আজ আমি একটা শাড়ি কিনে দেব।

থ্যাংক য়ু খালা। আমাকে কেউ কিছু দিতে চাইলে আমি কখনো না বলি না। আমি প্রায় ফকিরনী হয়ে গেছি। কিছু দিন পর মনে হয় ভিক্ষা চাইতে শুরু করব। মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলব—আমাকে একটা শাড়ি দেবেন। প্লীজ।

কি যে অদ্ভুত কথা তুমি বল। শুনে দুঃখও লাগে, আবার হাসিও লাগে।

সুরাইয়া হাসছেন। মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে তাঁর সব সময় ভাল লাগে। আজ অন্যদিনের চেয়েও বেশি ভাল লাগছে। মেয়েটাকে কেন জানি খানিকটা ফর্সাও লাগছে। এর কারণ কি?

মুন্নী বলল, আচ্ছা খালা একটা কথা জিজ্ঞেস করি—আপনার ছেলে কি অনার্স পরীক্ষা ড্রপ করেছে?

কি যে তুমি বল মা, ও পরীক্ষা ড্রপ করার ছেলে? পৃথিবী একদিকে আর তার পরীক্ষা একদিকে।

খালা আপনি খোঁজ নিয়ে দেখুন। আমার মনে হয় তিনি অনার্স পরীক্ষা দিচ্ছেন না।

ও বাসাতেই আছে। দাঁড়াও জিজ্ঞেস করি।

আজ থাক খালা, আরেকদিন জিজ্ঞেস করবেন।

সুরাইয়া ছেলের ঘরের দিকে রওনা হলেন। ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। আগে রাতের বেলাতেই সে শুধু দরজা বন্ধ করে রাখতো। এখন দিনেও দরজা বন্ধ করে রাখে। সুরাইয়া দরজায় ধাক্কা দিতেই ইমন দরজা খুলে দিল। বিরক্ত মুখে বলল, কি চাও?

সুরাইয়া হতভম্ব গলায় বললেন, কি চাও মানে? মার সঙ্গে কেউ এই ভাবে কথা বলে?

ইমন বলল, আমার প্রচন্ড মাথা ধরেছে মা। কথা বলতে পারব না। তুমি কি জন্যে এসেছ বল।

মুন্নী বলছিল তুই না-কি অনার্স পরীক্ষা ড্রপ দিয়েছিস। সত্যি? হ্যাঁ সত্যি।

আমার সঙ্গে ঠাট্টা করিসন। সত্যি কথা বল।

মা আমি কারো সঙ্গেই ঠাট্টা করি না। সত্যি কথাই বলছি। পরীক্ষা ড্রপ দিয়েছি।

কেন?

পরীক্ষা দিলে ফেল করতাম সেই জন্যে।

তুই ফেল করবি মানে? তুই কি ফেল করার ছেলে।

ইমন জবাব দিল না। সুরাইয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, তুই এইসব কি বলছিস। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।

ইমন বলল, আমি সুপ্রভার মত হয়ে গেছি মা! ফেলটুস ছাত্র হয়ে গেছি। তোমার কথাতো শেষ হয়েছে এখন দরজাটা বন্ধ করি? ইমান দরজা বন্ধ করে क्रिीब्ल।

সুরাইয়া আহত গলায় ডাকলেন, ইমন ও ইমন!

ইমন দরজা খুলল না। সুরাইয়ার পা কাঁপছে। চোখে পানি আসছে। অন্য রকম ভয়ে শরীর যেন ছোট হয়ে আসছে। ইমন কোন কান্ড করে বসবে নাতো? সুপ্ৰভা যেমন করেছিল? না তিনি ইমনের উপর রাগ করবেন না। তাকে ধমক দেবেন না, কোন কড়া কথা বলবেন না। তার সঙ্গে সহজ স্বাভাবিক আচরণ করবেন। পরীক্ষার প্রসঙ্গ আর তুলবেনই না। তাকে যা বলার ইমনের বাবা এসে বলবেন। ছেলেরা মার চেয়ে বাবাকে বেশি মানে।

মানুষটার ফিরে আসার সময় যে হয়ে এসেছে তা সুরাইয়া বুঝতে পারছেন। কষ্টের পর সুখ আসে, অনেকগুলি কষ্ট তিনি পার করেছেন–এখন সুখ আসার সময়। আগের বাড়িটা গুছিয়ে নিয়ে বসার পরই সেই আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটবে। দরজার কড়া নড়বে। না, কড়া না-কলিং বেল বাজবে। একবার দুবার তিনবার। থেমে থেমে বেজেই যাবে। তিনি ভাববেন, ভিখিরী। ক্লান্তিহীন কলিং বেল একমাত্র ভিখিরীরাই বাজায়। তিনি নিতান্ত বিরক্ত হয়ে দরজা খুলবেন। ভিখিরী না, মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখেই মানুষটা কোমল গলায় বলবেন—ঘুমিয়ে পড়েছিলে?

তিনি বলবেন, না।

মানুষটা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলবে, ইমন কি ঘুমিয়ে পড়েছে?

না জেগে আছে। তুমি এসেছ ভাল হয়েছে, ইমনকে শাসন করতে হবে। ও কি রকম যেন হয়ে গেছে। পরীক্ষা দিচ্ছে না। দিন রাত দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। সিগারেটও ধরেছে। প্রায়ই তার ঘরে সিগারেটের গন্ধ পাই।

বল কি? আমি খুব চিন্তার ভেতর ছিলাম। তুমি এসেছি, এখন আর চিন্তা করছি না। সারাজীবন অনেক চিন্তা ভাবনা করেছি। এখন যা চিন্তা করার তুমি করবে। আমি রেস্ট নেব। খাব, দাব, ঘুমাব। সিনেমা দেখব। কতদিন হলে গিয়ে সিনেমা দেখা হয় না। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে।

তিনি চিন্তিত গলায় বলবেন, এখন সে কি আর আমার কথা শুনবে? একটা বয়সের পর ছেলেরা বাবা-মা কারো কথাই শুনতে চায় না। শুধু স্ত্রীর কথা শুনে। ওকে বিয়ে দিতে হবে।

সুরাইয়া আনন্দিত গলায় বলবেন, কি যে মজার কথা তুমি বল। ইমনের বিয়ে দিয়েছিতো।

সে কি! কবে বিয়ে হল?

আজই হয়েছে। আজ বাসর হচ্ছে, আমাদের শোবার ঘরটা ওদের ছেড়ে দিয়েছি।

মানুষটা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলবে, ভাল করেছ। বউমাকে ডাক একটু দেখি।

সর্বনাশ! এখন ওদের ডাকতে পারব না। সকালে দেখবে। তুমি বরং তোমার এই বেতের চেয়ারটায় বোস। চা খাবে?

বেতের চেয়ারটা এখনো আছে? আশ্চর্য! কত দিনের কথা। আচ্ছা! সুরাইয়া তুমিতো আমাকে দেখে এতটুকুও অবাক হও নি। তুমি কি জানতে আজ আমি আসব?

হুঁ জানতাম। বালতির পাশে স্পঞ্জের স্যান্ডেল আছে। পা ধুয়ে বসোতো, আমি চা নিয়ে আসছি।



দরজা খুলে ইমন বের হয়ে এল। সে বাইরে কোথাও যাচ্ছে-সার্ট প্যান্ট পরেছে। সুরাইয়া বললেন, কোথায় যাচ্ছিস? ইমন বলল, কোথাও না।

সুরাইয়া সহজ গলায় বললেন, ইমান শোন–পরীক্ষা দিচ্ছিস না, এই নিয়ে মন খারাপ করবি না। সামনের বছর দিলেই হবে।

আমি মন খারাপ করছি না।

তোর কি ফিরতে দেরি হবে? ফিরতে দেরি হলে চাবি নিয়ে যা। আমি মুন্নীকে নিয়ে বের হচ্ছি। কখন ফিরব ঠিক নেই।

আচ্ছা।

আমি কিছু কেনা কাটা করব। আগে যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম ঐ বাড়িটা পাওয়া গেছে। বুঝলি ইমন, বাড়িটা আমি ঠিক আগের মত করে সাজাব। তোর বাবা এসে যেন দেখতে পান কিছু বদলায় নি। সব আগের মত আছে। তুই তোর বড় মামার বাসা থেকে খাটটা এনে দিবি।

এখনি এনে দিতে হবে?

এখন না আনলেও হবে। নতুন বাসায় যেদিন যাব সেদিন এনে দিলেও হবে।

যখন বলবে। এনে দেব।

তুই যাচ্ছিস কোথায়?

বললাম তো কোথাও না।

ইমন হন হন করে বের হয়ে গেল। চাবি না নিয়েই গেল। সুরাইয়া চাবি সঙ্গে নেবার ব্যাপারটা আবারো মনে করিয়ে দেবার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারলেন না। আশ্চর্যের ব্যাপার, যতই দিন যাচ্ছে তিনি ছেলেকে ততই ভয় পেতে শুরু করেছেন।

বাসার গেটের কাছে মুন্নী দাঁড়িয়ে আছে। ইমনকে দেখে সে হঠাৎ বলল, ইমন ভাইয়া, ভাল আছেন?

ইমন থমকে দাঁড়িয়ে গেল। মুন্নীর মনে হল এক্ষুনি সে তার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাবে এবং প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বের হয়ে যাবে। মুন্নীকে অবাক করে দিয়ে ইমন বলল, আমি ভাল আছি।

মুন্নী বলল, আপনাকে আমি প্রায়ই দেখি কলাবাগান বাস স্ট্যান্ডের শিশু পার্কের বেঞ্চিতে চুপচাপ বসে আছেন। ওখানে যাবেন না।

কেন?

ঐ পার্কে একটা পাগল থাকে। ছুরি নিয়ে মানুষকে তাড়া করে। দুজনকে জখম করেছে। পত্রিকায়ও উঠেছে।

আমি জানি। পাগলটার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে।

আপনার ভয় লাগে না?

না।

আপনাকে আটকে রাখলাম, কিছু মনে করবেন না।

আমি কিছু মনে করি নি।

ইমন শিশুপার্কের দিকে হাঁটা শুরু করল। পার্কের বেঞ্চবীতে কোন কারণ ছাড়া চুপচাপ বসে থাকতে তার ভালই লাগে। ঘণ্টাখানিক চুপচাপ বসে থাকার পর তার নিজেকে গাছের মত মনে হতে থাকে। যেন সে এক সময় মানুষ ছিল, এখন গাছ হয়ে যাচ্ছে। তার শিকর চলে যাচ্ছে মাটির গভীরে। শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে যাচ্ছে আকাশে। যখন বৃষ্টি আসবে সে বৃষ্টির পানিতে স্নান করবে। যখন জোছনা নামবে সে তার সারা গায়ে জোছনা মাখবে। আহ। বৃক্ষের জীবনতো আসলেই আনন্দময়।
 
১৯.


ফাঁসি, যাবজীবন, সশ্রম কারাদন্ড কিছুই হল না। শোভনকে জাজ সাহেব বেকসুর খালাস করে দিলেন। চারজন সাক্ষীর মধ্যে দুজন আসেই নি। বাকি দুজন উল্টা পাল্টা কথা বলে সব এলোমেলো করে দিয়েছে। পুলিশের মামলা সাজানোও দেখা গেল অত্যন্ত দুর্বল। যথাসময়ে আলামতও হাজির হল না। জাজ সাহেব বিরক্ত মুখে রায় লিখলেন, তারচেয়েও বিরক্ত মুখে পড়লেন।

শোভনও জাজ সাহেবের মতই বিরক্ত মুখে বের হয়ে এল। ইমন তাকে নিতে এসেছে। আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। শোভন হাই তুলতে তুলতে বলল, আর কেউ আসে নি?

ইমন বলল, না।

আজ যে রায় হবে ওরা জানে?

জানে।

ফুলের মালা এনেছিস?

ইমন কিছু বলল না। শোভন সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, ফুলের মালা গলায় দিয়ে বের হতে পারলে ভাল হত। নেতা নেতা ভাব চলে আসতো। তোর কাছে টাকা আছে?

সামান্য আছে।

সামান্যটা কত? রেস্টুরেন্টে বসে চা সিঙাড়া খাওয়া যাবে?

হুঁ।

চল চা-সিঙ্গাড়া খাই। ফ্রী ম্যান হয়ে চা-সিঙ্গাড়া খাওয়ার আনন্দ মারাত্মক হবার কথা।

চল যাই।

তুই এমন মুখ শুকনা করে রেখেছিস কেন? আমাকে ছেড়ে দিয়েছে বলে কি মন খারাপ? ফাঁসি হলে ভাল লাগতো?

ইমন হাসল। শোভন বলল, খুব ভাল করে গোসল করতে হবে। গরম পানি ঢেলে হেভী গোসল। কিছু জামা কাপড় দরকার। চা খেয়ে নাপিতের দোকানে চল চুল কাটাব। মাথা কামিয়ে কোজাক হয়ে যাব।

আচ্ছা।

দিনের বেলা কি কোন ডেন্টিস্টের দোকান খোলা থাকে? প্রচন্ড দাতে ব্যথা। একবার যখন শুরু হয় কাটা মুরগীর মত ছটফট করি।

এখন ব্যথা আছে?

না। তবে শুরু হবে। শুরু হবার আগে দাঁতের গোড়া শিরশির করে। এখন করছে।

ছাড়া পেয়ে তোমার খুব ভাল লাগছে?

হুঁ লাগছে। আমিতো ভেবেছিলাম ফাঁসি টাসি না-কি হয়ে যায়। বাহ বাইরেতো বেশ ঠান্ডা-এখন কি শীতকাল নাকি? বাংলা মাসের নাম কি?

কার্তিক মাস। তোমার কি দিন তারিখের হিসেব নেই?

না।

কিতদিন হাজত খাটলে সেটা মনে আছে?

হ্যাঁ তা মনে আছে। আঠারো মাস। আঠারো মাসে জান কালি করে দিয়েছে। এর শোধ নেব। আব্দুল কুদ্দুস সাহেব যখন শুনবেন আমি ছাড়া পেয়েছি তখন তার খবর হয়ে যাবে।

শোভন হাসছে। অসুস্থ মানুষের মত হাসছে। চায়ের দোকানে ঢোকার আগেই একটা পানের দোকান। শোভন পানের দোকানের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে দুটা মিষ্টি এবং জর্দা দেয়া ডবল পান কিনে মুখে দিল। ইমন বলতে যাচ্ছিল এক্ষুণি তো চা খাবে পান মুখে দিচ্ছ কেন? শেষ পর্যন্ত বলল না। মুক্তির আনন্দে মানুষ অনেক উদ্ভট কান্ডকারখানা করে। শোভন তেমন কিছু করছে না, শুধু জর্দা এবং মিষ্টি দেয়া দুখিলি ডবল পান মুখে দিয়েছে।

চা এবং আলুর চপের অর্ডার দেয়া হয়েছে। দোকানে প্রচুর ভীড়। এই ভীড়টা শোভনের ভাল লাগছে। ফাঁকা চায়ের দোকান আর শশান এক জিনিস। গ্রামের হাট যেমন ভর ভরন্ত থাকলে ভাল লাগে, চায়ের দোকানেও গাদাগাদি ভীড় ভাল লাগে। পান মুখে থাকা অবস্থাতেই শোভন চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, ভাল চা বানিয়েছে। ইমন আরেক কাপ দিতে বল। তেহারীর গন্ধ পাচ্ছি। দুটা প্লেটে দুপ্লেট গরম তেহারী দিতে বল, খেয়ে দেখি কেমন। তবে খেতে ভাল হবে না। যে দোকানে চা ভাল হয়, সে দোকানে অন্য কিছুই ভাল হয় না।

ইমন বলল, তুমি বাড়ি যাবে না?

না। আমি যেমন ওদের কেউ না, ওরাও আমার কেউ না। টোকন, টোকন কোথায় আছে?

জানি না।

লাস্ট তোর সঙ্গে কবে দেখা হয়েছে?

জুন-জুলাই এ।

তারপর থেকে কোন খবর নেই?

না।

শোভন চিন্তিত মুখে বলল, আব্দুল কুদ্দুস বেপারী কিছু করেছে কি-না। খোঁজ নিতে হবে। সন্ধ্যার মধ্যে পাত্তা লাগিয়ে ফেলব। তোর কাছে জিনিসটা

আছে তো?

হুঁ।

যত্ন করে রাখিস। আমি কোন একদিন এসে নিয়ে যাব।

বাসায় না গেলে উঠবে কোথায়?

আমার উঠার জায়গা আছে। তোর বাসার ঠিকানা বল। রাতে ঘুমানোর জন্যে তোর কাছেও চলে আসতে পারি। কিছু বলা যায় না।

শোভনের এই দোকানের তেহারীও খুব পছন্দ হল। এক প্লেটের জায়গায় তিন প্লেট খেয়ে ফেলল। তৃপ্ত মুখে বলল, এই দোকানের বাবুর্চিতো মারাত্মক। এর হাত সোনা দিয়ে বঁধিয়ে রাখা দরকার। বাড়ি নিশ্চয়ই ফরিদপুর। ভাল বাবুর্চি মানেই ফরিদপুর।

ইমন বলল, শোভন ভাইয়া, তুমি বরং এক কাজ কর। আমার সঙ্গে চল তোমাকে বাড়িতে নিয়ে যাই। সেখানে ভালমত গোসল টোসল করে বিশ্রাম কর। বড় মামার শরীরও ভাল না।

বাবার কি হয়েছে?

গোলাপ গাছে আষুধ দেন, সেই অষুধ নাকে মুখে ঢুকে গিয়ে শ্বাস কষ্ট হয়েছিল। মুখ-টুখ ফুলে ভয়াবহ অবস্থা। হাসপাতালে নিয়ে অক্সিজেন দিতে হয়েছিল। এখন ভাল। বাসাতেই আছেন।

তাহলে তো বাসায় যাওয়াই যাবে না। আমাকে দেখলে আবার শ্বাস কষ্ট শুরু হয়ে যাবে। দৌড়াদৌড়ি করে অক্সিজেনের বোতল আনতে হবে। কি দরকার।

মামীমা তোমার জন্যে খুব কান্না-কাটি করেন। তোমাকে দেখলে খুশি হবেন।

খামাখা ভ্যানভ্যান করিসনাতো। মানুষকে খুশি করার দায় আমার না। আমি জোকার না যে রঙ ঢং করে মানুষকে খুশি করব। আমাকে দেখলে যাদের কলিজা শুকিয়ে পানি হয়ে যায়। আমি তাদেরকেই দেখা দেব। যেমন ধর কুদ্দুস। তুই এখন একটা কাজ করতো। রেক্টরেন্টের মালিককে জিজ্ঞেস করে আয়-তেহারীর বাবুর্চির দেশ কোথায়?

ইমন বাবুর্চির দেশ কোথায় জানার জন্যে উঠে দাঁড়াল। শোভনকে পেয়ে তার ভাল লাগছে। সে মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে—আজি সারাদিনই সে শোভনের সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। তার বাসায় ফিরতে ইচ্ছা করছে না।
 
২০.


রাত বাজছে নটা। ইমন পুরানো ঢাকার একটা বোর্ডিং হাউসে। বোর্ডিং হাউসের নাম ঢোকার সময় পড়া হয় নি, মনে হয়। এই বোর্ডিং হাউসের কোন নাম নেই। গলির ভেতর গলি, তার ভেতর গলি বেয়ে বেয়ে শোভনের সঙ্গে যে বাড়ির সামনে এসে সে দাঁড়িয়েছিল, সেই বাড়ি এখনো কিভাবে দাঁড়িয়ে আছে সেটাই রহস্য। ইমন বলল, ভাইয়া ভূতের বাড়ি না-কি?

শোভন বলল, ভূতের বাড়ি হবে কেন? বোর্ডিং হাউস।

তুমি কি আগে এখানে থাকতে?

মাঝে মাঝে থাকতাম। আমার কোন পার্মানেন্ট এড্রেস নেই। খুব যারা গুরুত্বপূর্ণ মানুষ তাদের পার্মানেন্ট এড্রেস থাকে না। আমি গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ।

বোর্ডিং হাউসে ঢোকার পর বোঝা গেল শোভন আসলেই একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। প্রায় ছোটাছুটি পরে গেল। ম্যানেজার এসে জড়িয়ে ধরলেন। বাকি যারা আসছে তাদের বেশির ভাগই পা ছুঁয়ে সালাম করছে। শোভন বলল, ঘর আছে?

ম্যানেজার হতভম্ব গলায় বলল, ঘর থাকব না কি কন?

গরম পানি লাগবে, গোসল করব।

খানা কখন দিব?

একটু রাত করে দিবেন। ঘর খুলে দেন। তিন নম্বর ঘর খালি আছে?

খালি নাই। খালি করতেছি। পাঁচটা মিনিট সময় দেন। একটা সিগারেট ধরান শোভন ভাইয়া। সিগারেট শেষ হওয়ার আগেই ঘর রেডি হয়ে যাবে।

ইমন তিন নম্বর ঘরের খাটের উপর বসে আছে। ঘরটা বড়। ডাবল খাট, চেয়ার টেবিল। মেঝেতে কাপেট। খাটের পাশের সাইড টেবিলে টেলিফোন। তবে ঘরের দেয়াল ময়লা, কার্পেট ময়লা, খাটে বিছানো চাদরও ময়লা। মাথার উপরে ছাদে মাকড়শার বুলি জমে আছে। সবচে আশ্চর্যের ব্যাপার এই ঘরে কোন জানালা নেই। দিনে আলো না জুলিলে কিছু দেখা যাবে না। তিন নম্বর ঘরের এত নাম ডাক কি জানালা না থাকার কারণে? নাকি এই বোর্ডিং হাউসের বিশেষত্ব হচ্ছে এর কোন ঘরেই জানালা নেই।

অনেকক্ষণ হল ইমন বসে আছে। ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বাথরুম নেই। গোসল করার জন্য শোভন তোয়ালে সাবান নিয়ে কোথায় যেন গিয়েছে, প্ৰায় এক ঘণ্টা হল এখনো ফিরছে না।

অসম্ভব রোগা একটা ছেলে কিছুক্ষণ আগে ঘরে ঢুকে টেবিলের উপরে কিছু জিনিসপত্র রেখে গেছে। যা দেখে ইমনের বুকের ধ্বক ধ্বকানি বেড়ে গেছে। দুটা গ্লাস, পানির বোতল, বরফ ভর্তি একটা বাটি এবং পেট মোটা চ্যাপ্টা সাইজের একটা বোতল। বোতলের ভেতর কি আছে তা লেবেল না পড়েও বলে দেয়া যাচ্ছে।

শোভন ঘরে ঢুকল মাথা মুছতে মুছতে, একটা তোয়ালে তার কোমরে জড়ানো, অন্য একটা তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছছে। সে আনন্দিত গলায় বলল, এমন আরামের গোসল আমি লাইফে করিনি। তুই গোসল করবি? গোসল করলে বল গরম পানি দিতে বলি।

ইমন বলল, না।

আরাম করে গোসল কর। আজ রাতে বাসায় ফিরে কোজ নেই, থেকে যা আমার সঙ্গে। গল্প করি।

মা চিন্তা করবে।

করুক কিছু চিন্তা। মাদের চিন্তা করা দরকার। চিন্তা না করলে তাদের হজমের অসুবিধা হয়।

ভাইয়া আমি চলে যাব।

আচ্ছা ঠিক আছে। খাওয়া দাওয়া করে যা। রাত যতই হোক কোন অসুবিধা নেই। সঙ্গে লোক যাবে। বাড়ির গেটের সামনে নামিয়ে দিয়ে আসবে। একটু গলা ভিজাবি?

না।

এই জিনিস আগে কখনো খেয়েছিস?

উহুঁ।

তাহলে চামচে করে এক চামচ খেয়ে দেখ। সব কিছুর অভিজ্ঞতা থাকা দরকার। খারাপের অভিজ্ঞতা থাকা দরকার। ভালর অভিজ্ঞতাও থাকা দরকার।

ভাইয়া তুমি খাও। আমি খাব না।

থাক খেতে না চাইলে খেতে হবে না। তুই বরং একটা ঝাল লাচ্ছি খা। কাঁচা মরিচ দিয়ে লবণ দিয়ে এরা অসাধারণ একটা লাচ্ছি বানায়। বলব দিতে?

বল।

শোভন লাচ্ছির কথা বলে খাটে আরাম করে বসল। বরফ, পানির বোতল গ্রাস সাজিয়ে সে বসেছে। ইমনের দেখতে ভাল লাগছে। বেশ ভাল লাগছে।

মদ খাওয়াটা মনে হচ্ছে বিরাট আয়োজনের ব্যাপার। শোভন ইমনের দিকে তাকিয়ে বলল, এমন হা করে কি দেখছিস?

ইমন বলল, তোমাকে দেখছি। গোসলের পর তোমার চেহারাটা সুন্দর হয়ে গেছে।

শোভন হো হো করে হেসে ফেলল। ইমন বলল, ভাইয়া তুমি একটা গান করা শুনি।

শোভন বলল, তুই কি পাগল হয়েছিস না-কি? আমি গান করব মানে, আমি কি হেমন্ত না-কি?

তোমার গলা হেমন্তের গলার চেয়েও সুন্দর।

এ রকম কথা বললে কিন্তু জোর করে তোকে মদ খাইয়ে দেব।

তুমি যে এতক্ষণ বাথরুমে গোসল করলে তখন গান করনি?

হুঁ করেছি।

ঐ গানগুলি কর।

শোভন সঙ্গে সঙ্গে গান শুরু করল–

মেঘের পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে।
আমায় কেন বসিয়ে রাখা একা দ্বারের পাশে।।
কাজের দিনে নানা কাজে থাকি নানা লোকের মাঝে
আজ আমি যে বসে আছি তোমারি আশ্বাসে।।

ইমনের চোখে সঙ্গে সঙ্গে পানি এসে গেল। মানুষের গানের গলা এত সুন্দর হয়? শোভন গান থামিয়ে গ্লাসে আবারো হুইস্কি নিল। ইমন কোমল গলায় ডাকল, ভাইয়া।

শোভন তাকাল। ইমন বলল, তোমার গানের গলা যে কত সুন্দর তা তুমি জান না।

আমার জানতে হবে না। তুই যে জেনে গেছিস তাতেই হবে। খাবি এক ঢোক?

খেলে হয় কি?

খেয়ে দেখ কি হয়। খানিকটা পেটে পড়লে আমার এই গান যত সুন্দর লাগছে তারচে হয়ত আরো বেশি সুন্দর লাগবে। হয়ত গান শুনতে শুনতে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদবি। তোর ভালবাসার কেউ থাকলে তার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করবে। সে রকম ইচ্ছা করলে কথা বলতে পারবি। টেলিফোন আছে।

ইমন বলল, গ্লাসে সামান্য একটু দাও খেয়ে দেখি।

খাবি যখন ভালমত খা, সাধ মিটিয়ে খা। আর কোনদিন না খেলেই হবে।

রাত দুটায় বেবীটেক্সী ইমনকে তাদের বাসার সামনে নামিয়ে দিল। সঙ্গে যে লোক এসেছিল সে বলল, স্যার, আপনাকে ধরে ধরে নিয়ে যেতে হবে না নিজে নিজে যেতে পারবেন?

ইমন বলল, খুবই বমি আসছে।

বমি আসলে বমি করেন, তারপর ঘরে যান। বসে পড়ুন। বসে বমি করুন।

বসতে পারছি না।

ইমন লক্ষ্য করল সে যে বসতে পারছে না। তাই না, সে দাঁড়িয়েও থাকতে পারছে না। চারদিক কেমন দুলছে। মনে হচ্ছে সে নৌকার ছাদে বসে আছে। পাল তোলা নৌকা। নৌকা দ্রুত চলছে, এবং খুব দুলছে। একবার ডান দিকে কাত হচ্ছে, একবার বাম দিকে।

লোকটা বলল, স্যার গলায় আঙ্গুল দিয়ে বমি করুন দেখবেন আপনার ভাল লাগছে। বাসায় গিয়ে গরম পানিতে গোসল করে কড়া করে এক কাপ কফি খাবেন।

বাসায় কফি নেই।

বলতে বলতে ইমন বমি করল। বমি খানিকটা পড়ল। রাস্তায়। খানিকটা তার গায়ে। লোকটা বলেছিল বমি করলে ভাল লাগবে, কিন্তু ভাল লাগছে না। বরং আরো খারাপ লাগছে। যে নৌকাটায় সে দাঁড়িয়ে আছে, সেই নৌকাটা এখন অনেক বেশি দুলছে। ইমন চোখ মেলে থাকতে পারছে না। চোখের পাতা অসম্ভব ভারী। বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। যে লোকটা তাকে নিয়ে এসেছে সে কলিং বেল টিপছে। বেবীটেক্সিওয়ালা তাকিয়ে আছে। সে সিগারেট ধরিয়েছে। সিগারেটের গন্ধে ইমনের পেটের ভেতর আবার পাক দিয়ে উঠল। সে আবারো বমি করল।

দরজা খুলেছে। ইমন দেখল। দরজার পাশে মা, মায়ের পাশে মিতু। মিতু এখানে কোথেকে এল। এত রাতে মিতুরতো এ বাড়িতে থাকার কথা না। মিতু লোকটার সঙ্গে কথা বলছে। মিতু এগিয়ে আসছে। না মিতু না, পাশের বাড়ির মেয়েটা। মেয়েটার নাম মনে পড়ছে না, তবে ম দিয়ে শুরু—ময়না, মায়া, মেরী, ও হ্যাঁ মুন্নী, মেয়েটার নাম মুন্নী।

মুন্নী এসে ইমনের হাত ধরল। ইমন বলল, মুন্নী কেমন আছ?

মুন্নী বলল, জ্বি আমি ভাল আছি। আসুন আপনি ঘরে আসুন।

দূর থেকে দেখে আমি ভাবলাম তুমি মিতু। মিতু হচ্ছে আমার মামাতো বোন।

জ্বি আমি জানি। আপনি দাঁড়িয়ে থাকবেন না—আসুন।

বেবীটেক্সীর ভাড়া দিতে হবে। মুন্নী তোমার কাছে টাকা আছে? লোকটা বলল, বেবীটেক্সীর ভাড়া আপনাকে দিতে হবে না। আপনি ঘরে যান।

সুরাইয়া হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি কোন কথা বলতে পারছেন না। ইমন মাকে দেখে সহজ গলায় বলল, তুমি এখনো জেগে আছ কেন মা? মুন্নী আছে-ও যা করার করবে। তুমি শুয়ে পড়।

সুরাইয়া বললেন, তুই কি খেয়ে এসেছিস?

ইমন হাসি হাসি মুখে বলল, তুমি যা সন্দেহ করছ, তাই খেয়েছি। এখন তুমি নিশ্চয়ই বিরাট বক্তৃতা শুরু করবে—তোর বাবা এই জিনিস কোনদিন ছয়ে দেখেনি। মা শোন, বাবা এই জিনিস ছুঁয়ে দেখেনি বলে যে আমিও ছুঁয়ে দেখব না। তাতো না। একেক মানুষ একেক রকম। এই মেয়েটা দেখতে মিতুর মত হলেও এ মিতু না। এর নাম মুন্নী।

মুন্নী বলল, খালা আপনি শুয়ে পড়ুন। আমি দেখছি।

সুরাইয়া চলে যাচ্ছেন। তিনি নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। মুন্নী ইমনকে বাথরুমে নিয়ে গেল। কঠিন গলায় বলল, আপনি ট্যাপের নিচে বসুন। আমি ট্যাপ ছেড়ে দিচ্ছি। খুব ভাল করে সাবান মেখে গোসল করুন। আপনার সারা গায়ে বমি।

ঠান্ডা লাগছেতো।

ঠাণ্ডা লাগলেও কিছু করার নেই। আমি বাথরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। আপনি গায়ের সব কাপড় খুলে গোসল করুন। আমি লুঙ্গি দিয়ে যাচ্ছি। গোসল শেষ হলে লুঙ্গি পরে আমাকে ডাকবেন। আমি আপনাকে বিছানায় শুইয়ে দেব।

তুমি এই ব্যাপারটা মিতুকে বলবে না। মিতু শুনলে খুব রাগ করবে। ও ভয়ংকর রাগী।

আমি মিতুকে কিছুই বলব না।

মুন্নী তুমি কি গান জান?

না।

শোভন ভাইয়া খুব ভাল গান জানে। পুরো গান অবশ্যি কোনটাই জানে না। দুই লাইন, চার লাইন।

আপনি খুব ভাল মত সাবান ডলে গোসল করুন।

লাইফবয়ের এডের মত করে?

হ্যাঁ।

মুন্নী!

জ্বি।

মিতু গত চার মাস ধরে আমার সঙ্গে কথা বলে না।

হয়ত কোন কারণে রাগ করেছেন। রাগ কমে গেলে কথা বলবেন।

ও কারো উপর রাগ করে না।

তাহলে হয়ত কোন কারণে উনার অভিমান হয়েছে।

মিতু খুবই ভাল মেয়ে। তোমার চেয়েও ভাল।

আমিতো বলিনি। আমি ভাল মেয়ে।

তুমি না বললেও মা বলেন। মার খুব ইচ্ছা তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে দেন।

আপনি রাজি হচ্ছেন না?

আমি কখনো বিয়ে করব না। মিতুকেও এটা বলেছি। সে বিশ্বাস করে নি। তার ধারণা আমার সঙ্গেই তার বিয়ে হবে।

আমারো তাই ধারণা।

তোমার ধারণা ভুল। মিতুর বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেছে। একটু ঝামেলা হয়েছিল, এক শুক্রবারে পান চিনির কথা হয়েছিল। বর পক্ষের কেউ আসে নি। পরের সপ্তাহে এসেছে। মিতুকে আঙটি পরিয়ে দিয়ে গেছে।

উনি আপত্তি করেন নি?

না, মিতু খুব অন্য ধরণের মেয়ে।

বুঝতে পারছি। আপনি এখন পানি ঢালা বন্ধ করে তোয়ালে দিয়ে গা মুছুন।

আচ্ছা।

আপনি কি বাথরুম থেকে নিজে নিজে বের হতে পারবেন?

অবশ্যই পারব।

তাহলে আপনি শোবার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন।

নোংরা কাপড়গুলো ধুয়ে তারপর যাই।

আপনাকে কাপড় ধুতে হবে না। আপনি গা মুছে বের হয়ে আসুন।

তুমি কি খুব কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে দিতে পারবে? দুধ চিনি ছাড়া।

পারব।

তুমিতো আসলেই খুব ভাল মেয়ে। তোমার প্রসঙ্গে খুব খারাপ কথা মাকে বলেছি। এখন তার জন্যে খারাপ লাগছে। দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দাও।

আমার সম্পর্কে কি খারাপ কথা বলেছেন।

তোমাকে কাছুয়া বলেছি।

কাছুয়াটা কি?

কাছুয়া হচ্ছে রক্ষিতা। রক্ষিতার ইংরেজি হল Kept. আমার ধারণা. আচ্ছা থাক তুমি রাগ করবে।

আপনি শোবার ঘরে যান। আমি চা নিয়ে আসছি।

মুন্নী চা বানাতে বানাতে খুব কাঁদল। চা বানানো শেষ করে চোখ মুছে কাপ নিয়ে ইমনের শোবার ঘরে ঢুকে দেখে ইমন মরার মত ঘুমুচ্ছে।



জামিলুর রহমান সাহেব আলাদা শোবার ব্যবস্থা করছেন। দোতলার একটা ঘর তাঁর জন্যে ঠিক করা হচ্ছে। ঘরে কিছু থাকবে না, শুধু একটা খাট। খাটের পাশে সাইড টেবিল। সাইড টেবিলে থাকবে পানির বোতল। তাঁর অষুধ পত্র। কাপড় চোপড় রাখার জন্যে একটা আলনা। খাটে তোষকের উপর চাদর থাকবে না। শীতল পাটি থাকবে। শীতল পাটিতে অনেক দিন ঘুমানো হয় না।

লোক লাগানো হয়েছে। তারা ঘর ধোয়া মুছা করছে। জামিলুর রহমান আজ অফিসে যান নি। বারান্দার চেয়ারে চুপচাপ বসে আছেন। ছাদে উঠে গাছে পানি দেয়া দরকার। ছাদে উঠার শক্তি সঞ্চয় করে উঠতে পারছেন না। মাথা সামান্য ঘুরছে। শীতল পাটিটা দোকানে গিয়ে নিজে পছন্দ করবেন বলে ভেবেছিলেন, এখন মনে হচ্ছে তাও পারবেন না।

ফাতেমা গ্লাসে করে ডাবের পানি নিয়ে বারান্দায় এলেন। বাড়ির পেছনে তিনটা নারকেল গাছে প্রচুর ডাব। তিনি লোক দিয়ে গত সপ্তাহে ডাব পাড়িয়েছেন। বাসায় কেউ ডাব খেতে চাচ্ছে না।

জামিলুর রহমান স্ত্রীর দিকে তাকালেন, কোন কথা না বলে গ্লাস হাতে নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে গ্লাস নামিয়ে রাখলেন। ফাতেমা বললেন, তোমার সঙ্গে আমার কিছু জরুরী কথা আছে।

জামিলুর রহমান স্ত্রীর দিকে না তাকিয়েই বললেন, বল।

ভেতরে চল।

যা বলার এখানেই বল। ভেতরে যেতে পারব না। চেয়ারে বস, তারপর বল।

তুমি ভেতরে যাবে না?

না।

ফাতেমা চেয়ারে বসলেন। তার মুখ থমথম করছে। তিনি কয়েক দিন থেকেই বড় রকমের ঝগড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ঝগড়া শুরু করার সময়টা বের করতে পারছিলেন না। আজ মনে হচ্ছে সময় হয়েছে। ফাতেমা বললেন, তুমি আলাদা শোবার ব্যবস্থা করছি কেন?

উপরের ঘরটা বড়, খোলামেলা। আলো বাতাস আসে এই জন্যে।

আসল কথাটা বলছি না কেন?

আসল কথাটা কি?

আমাকে তোমার আর সহ্য হচ্ছে না। আমার সঙ্গে ঘুমুতে তোমার এখন ঘেন্না লাগে।

ঘেন্না লাগবে কেন?

কেন ঘেন্না লাগছে সেটা আমি জানব কি ভাবে। সেটা তোমার জানার কথা।

তোমার ধারণা ভুল। ঘেন্নার কোন ব্যাপার না। একটা বয়সের পর মানুষ খানিকটা একা থাকতে চায়…

একা থাকতে চাইলে ঘরে পড়ে আছ কেন? বনে জঙ্গলে চলে যাও।

জামিলুর রহমান আরেক চুমুক ডাবের পানি খেয়ে স্ত্রীর উপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। ভাব এ রকম যে কথাবার্তা যা হবার হয়ে গেছে।

ফাতেমা বললেন, তুমি অন্যদিকে তাকিয়ে আছ কেন? আমার কথার জবাব দাও।

প্রশ্ন কর জবাব দিচ্ছি। প্রশ্ন না করলে জবাব দেব কিভাবে?

ফাতেমা হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। অনেক প্রশ্ন তাঁর করার ছিল, কান্নার জন্যে কোনটিই করতে পারলেন না। জমিলুর রহমান ডাবের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন। স্ত্রীর কান্নায় তাকে মোটেই বিচলিত মনে হচ্ছে না। ফাতেমা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তোমার টাকার অভাব নেই, তোমার অনেক টাকা। তুমি কিছু না বললেও আমি জানি। তুমি কি আমার একটা অনুরোধ রাখবে?

জামিলুর রহমান বললেন, রাখব। টাকা খরচ করে যদি অনুরোধ রাখা যায় তাহলে রাখব। অনুরোধটা কি?

আমাকে একটা ফ্ল্যাট কিনে দাও। ছেলে মেয়ে নিয়ে আমি ফ্ল্যাটে থাকব।

আচ্ছা কিনে দেব। পছন্দসই ফ্ল্যাটের খোঁজ এনে দাও আমি কিনে দেব।

মিতুর বিয়ের গয়না কিনব—সেই টাকা দাও। আমি গয়না দিয়ে আমার মেয়েকে মুড়িয়ে দেব।

কত টাকা লাগবে বল। আমি ব্যবস্থা করছি। ফরহাদকে বলে দিচ্ছি।

ফরহাদটা কে?

অফিসের নতুন ম্যানেজার।

ফাতেমার কান্না থেমে গেছে। তিনি কি করবেন বুঝতে পারছেন না। তার সব কথা মেনে নেয়া হয়েছে। ফাতেমার মনে হচ্ছে তিনি এখন যাই বলবেন তাই মানুষটা মেনে নেবে। কিন্তু তার পরেও নিজেকে পরাজিত মনে হবে। যুদ্ধে জয়ী হয়েও পরাজিত হওয়ার এই অভিজ্ঞতা তার ছিল না। ফাতেমা এখন কি বলবেন? মাথায় কিছুই আসছে না। তিনি ইতস্ততঃ গলায় বললেন, তোমার শরীরটা কি বেশি খারাপ লাগছে?

না, বেশি খারাপ লাগছে না। সামান্য খারাপ।

চল সিঙ্গাপুরে যাই ডাক্তার দেখিয়ে আসি। সিঙ্গাপুরে ভাল ভাল ডাক্তার আছে। দেশের বাইরে তো কোনদিন গেলাম না। এই সুযোগে বিদেশ দেখা হবে।

সিঙ্গাপুর বিদেশ না। সব সময় লোকজন যাচ্ছে। ভিসা লাগে না।

তুমি যেতে চাও আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আমি যাব না।

কেন তুমি যাবে না? আমার সঙ্গে যেতে কি তোমার ঘেন্না লাগে? আমি কি নর্দমার কেচো? না-কি কমোডের ভিতরে যে শাদা রঙের তেলাপোকা থাকে, সে রকম তেলাপোকা? তুমি আমাকে কি ভােব আজকে বলতে হবে। বলতেই হবে।

ফাতেমা আবারো কাঁদতে শুরু করলেন। জামিলুর রহমান স্ত্রীর কান্নার শব্দ পাচ্ছেন, কিন্তু সেই শব্দ তার মাথার ভেতরে ঢুকছে না। কান্নার অর্থ আছে, কান্নার পেছনে কারণ আছে, কান্নার ব্যাখ্যা আছে। অথচ ফাতেমার কান্নাটাকে তার কাছে অর্থহীন ধ্বনীর মত লাগছে—তিনি ভাবছেন সম্পূর্ণ অন্য কথা-গাজীপুর জঙ্গলের দিকে চল্লিশ বিঘা জমি কিনবেন। এক দাগের জমি। হিন্দুদের জমি না। তাদের জমিতে অনেক ভেজাল থাকে। একই জমি তিন চারজনের কাছে বিক্রি করে ইন্ডিয়া চলে যায়। মুসলমানের জমি, এবং কাগজপত্র ঠিক আছে এমন জমি দরকার। জমির দাম বাড়ছে। পৃথিবীতে মানুষ বাড়ছে, জমি বাড়ছে না। জমি কিনে এক বছর ফেলে রাখলেই হবে। খামার বাড়ির মত করা যেতে পারে। হাঁস মুরগি পালবেন, গরু ছাগল পালবেন। গাছ লাগানো হবে। আজ গাজীপুর থেকে লোক আসার কথা। জমির বায়না নিয়ে কথা হবে। অফিস থেকে টেলিফোন এলেই তিনি চলে যাবেন। তবে শরীরটা বেশি খারাপ লাগছে। বারান্দা থেকে নড়তে ইচ্ছা করছে

না।

ফাতেমা কেঁদেই যাচ্ছেন। জামিলুর রহমান সেই কান্নার ভেতরই টেলিফোনের শব্দের জন্যে অপেক্ষা করছেন। চল্লিশ বিঘা জমি— অনেকখানি জমি। এক মাথায় দাড়ালে আরেক মাথা দেখা যাবার কথা না… ।



অফিস থেকে টেলিফোন এসেছে। অফিসের নতুন ম্যানেজার ফরহাদ টেলিফোন করেছে। টেলিফোন ধরেছে মিতু।

কে কথা বলছেন? বড় আপা?

জ্বি আমি মিতু। আমাকে বড় আপা কেন বলছেন? বাসায় তো আর কোন আপা নেই।

স্যার কি বাসায় আছেন আপা?

হ্যাঁ আছেন। আপনি ধরে থাকুন বাবাকে দিচ্ছি।

না স্যারকে দেয়ার দরকার নেই। আমি আপনাকে একটা খবর দিচ্ছি। আপনি স্যারকে দিয়ে দেন।

ম্যানেজারের গলায় ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। কথাও যেন ঠিকমত বলতে পারছে না। জড়িয়ে যাচ্ছে। মিতু বলল, ভায়া মিডিয়াম কথা বলবেন কেন? বাবা আছেন, বারান্দায় বসে আছেন। আমি ডেকে দিচ্ছি।

আপা শুনুন, আমার ভয় লাগছে। আমি স্যারকে কিছু বলতে পারব না। আপনি বলে দিন—অফিসে কিছুক্ষণ আগে শোভন সাহেব এসেছিলেন। স্যারের বড় ছেলে শোভন।

ও আচ্ছা।

তিনি ক্যাশের টাকা নিয়ে গেছেন। অফিসের পিয়নকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছেন। পিওনের মাথা টাথা ফেটে একাকার। টাকা বেশি নিতে পারেন নি।

কত টাকা নিয়েছে?

প্যাটি ক্যাশে যা ছিল সবই নিয়েছেন। নয়। হাজারের অল্প কিছু বেশি। দাঁড়ান। আমি এগজেক্ট ফিগার বলছি।

এগজেক্ট ফিগারের দরকার নেই। ওর সঙ্গে আর কেউ ছিল, না ও একাই ছিল?

আরেকটা ছেলে ছিল। খুব সুন্দর চেহারা। নাম ইমন। উনাকে আমি আগে দেখিনি। ক্যাশিয়ার সাহেব বললেন উনি আপনার ফুপাতো ভাই।

ইমন কি করছিল? সেও কি পিওনকে মারছিল?

না। উনি কিছু করেন নি। চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। বড় আপা আপনি কি স্যারকে ঘটনাটা বলবেন। আমার বলতে সাহস হচ্ছে না। পিস্তল টিস্তল নিয়ে এসেছে। আমি প্ৰথমে ভাবলাম চাঁদাবাজ। স্যারের এই ছেলেকেও আমি আগে দেখিনি।

আচ্ছা আমি বাবাকে বলছি।

সবচে ভাল হয়। স্যারকে যদি অফিসে পাঠিয়ে দেন। গাজিপুর থেকে লোক এসেছে। ঘটনা ওদের সামনেই ঘটেছে।

আচ্ছা ঠিক আছে।

বড় আপা আমি রাখি।

মিতু টেলিফোন নামিয়ে বারান্দায় এল। জামিলুর রহমান একা বসে আছেন। তাঁর দৃষ্টি শূন্য। তবে তাঁর বসে থাকার মধ্যে অপেক্ষার একটা ভঙ্গি আছে। সেই অপেক্ষা কিসের অপেক্ষা? মৃত্যুর? জন্মের পর থেকে মানুষ এই একটি অপেক্ষাই করে। কিন্তু কখনো তা বুঝতে পারে না।

বাবা।

জামিলুর রহমান মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।

ঝিম মেরে বসে আছ কেন বাবা?

শরীরটা একটু খারাপ লাগছে। মাথা সামান্য ঘুরছে।

ঝিম ধরে বসে থাকলে মাথা আরো ঘুরবে।

অফিস থেকে কোন টেলিফোন এসেছে?

আসার কি কথা?

হুঁ। গাজীপুর থেকে লোক আসার কথা।

জমি কিনবে?

হুঁ।

টাকাওয়ালা মানুষদের এই সমস্যা। তারা সবকিছু কিনে ফেলতে চায়। কি হবে বলতো?

জামিলুর রহমান মেয়ের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন, তুই একটা কাজ করতো মা, অফিসে টেলিফোন করে জিজ্ঞেস কর গাজিপুর থেকে লোক এসেছে কি-না।

পারব না বাবা। আমার সিরিয়াস কাজ আছে।

কি কাজ?

তোমাকে খুব জরুরী কিছু কথা বলব।

বল।

এখানে না ছাদে গিয়ে বলব। চল ছাদে যাই।

শরীরটা ভাল লাগছে না।

তোমাকে ধরে ধরে ছাদে নিয়ে যাব। সব কথা সব জায়গায় বলা যায়

না।

জামিলুর রহমান উঠে দাড়ালেন। মেয়েটা তাকে হাত ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তার কাছে খুবই আশ্চর্য লাগছে। মেয়েটা অনেক দূরে বাস করতো। হঠাৎ সে কাছে চলে এসেছে। জামিলুর রহমানের চোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে অনেক দিন পর কোন এক অদেখা ভুবন থেকে সুপ্ৰভা চলে এসেছে। মিতু না, সুপ্ৰভাই তাকে ধরে ধরে ছাদে নিয়ে যাচ্ছে।

বাবা।

কি মা?

ধনবান মানুষরা একটা বড় সত্যি জানে না, সেই সত্যটা কি তোমাকে বলব?

বল।

পৃথিবীর সবচে আনন্দময় জিনিসগুলির জন্যে কিন্তু টাকা লাগে না। বিনামূল্যে পাওয়া যায়। যেমন ধর জোছনা, বর্ষার দিনের বৃষ্টি, মানুষের ভালবাসা…। তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করছ?

জামিলুর রহমান ক্লান্ত গলায় বললেন, ক্ষুধার্তা মানুষের কাছে জোছনা কোন ব্যাপার না মা। তারপরেও তোর কথা বিশ্বাস করছি—পৃথিবীর সবচে সুন্দর জিনিসগুলির বিকি-কিনি হয় না। কথাটাতো মা ভাল বলেছিস।

ছাদে উঠে জামিলুর রহমান মুগ্ধ হয়ে গেলেন। গোলাপে বাগান আলো হয়ে আছে। এক দিনে এত ফুল ফুটেছে। কি আশ্চর্য।

বাবা?

কি মা?

তুমি যখন প্রথম দিকে গোলাপের টব জোগাড় করতে শুরু করলে তখন আমার খুবই রাগ লাগছিল। মনে হচ্ছিল খোলামেলা ছাদটা তুমি নষ্ট করছ। এখন নিজেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি।

তোর জরুরী কথাটা কি বল শুনি।

মিতু খুব সহজ গলায় বলল, বাবা আমি ইমনকে বিয়ে করব বলে ঠিক করেছি।

জামিলুর রহমান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন। মিতু বলল, আমার ওকে তেমন দরকার নেই। কিন্তু ইমনের আমাকে দরকার।

তোর তো বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। গত সপ্তাহে পান চিনি হয়ে গেল।

মিতু হালকা গলায় বলল, আমাদের এই পৃথিবী কখনো স্থীর হয়ে থাকে না। সারাক্ষণ ঘুরছে। এই জন্যে পৃথিবীর কোন কিছুই ঠিক থাকে না। বাবা তোমার কি আপত্তি আছে?

তুই যা মনে করছিস, সেটার ভাল হবার সম্ভাবনা আছে।

বাবা শোন, তোমাকে একটা মিথ্যা কথা বলেছি। কেন বললাম বুঝতে পারছি না। আমি কখনো মিথ্যা বলি না।

মিথ্যা কথাটা কি?

আমি বলেছিলাম না-আমার ইমনকে দরকার নেই, ইমনের আমাকে দরকার। এটাই মিথ্যা। আসলে ইমনের আমাকে দরকার নেই, আমারই ওকে দরকার।

জামিলুর রহমান অবাক হয়ে দেখলেন তাঁর মেয়ে কাঁদছে। তার কাছে হঠাৎ মনে হল বাগান ভর্তি গোলাপ ফুলের দৃশ্যটা যেমন সুন্দর, তাঁর মেয়ের চোখ ভর্তি জলের দৃশ্যটাও তেমনি সুন্দর। গোলাপের টবগুলি কেনার জন্যে তাঁকে টাকা খরচ করতে হয়েছে। কিন্তু মেয়ের চোখের জলের অপূর্ব দৃশ্যটির জন্যে অর্থ ব্যয় করতে হয় নি।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top