What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected অপেক্ষা (হুমায়ুন আহাম্মেদের উপন্যাস) (2 Viewers)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
330
Messages
6,273
Credits
48,429
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
০১.

সুরাইয়া অবাক হয়ে তার ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে।

ছেলের নাম ইমন। বয়স পাঁচ বছর তিনমাস। মাথা ভর্তি কোকড়ানো চুল। লম্বাটে ধরণের মুখ। মাঝে মাঝে সেই মুখ কোন এক বিচিত্র কারণে গোলগাল দেখায়, আজ দেখাচ্ছে। ইমন তার মায়ের বিস্মিত দৃষ্টির কারণ ধরতে পারছে না। সে ভুরু কুঁচকে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ভুরু কুঁচকানোর এই বদঅভ্যাস সে পেয়েছে তার বাবার কাছ থেকে। ইমনের বাবা হাসানুজ্জামান অতি তুচ্ছ কারণে ভুরু কুচকে ফেলেন। সেই কুঁচকানো ভুরু সহজে মসৃন হয় না।

সুরাইয়া বলল, ইমন একটা কাজ কর। আমার শোবার ঘরে যাও। ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটার সামনে দাঁড়াও। দাঁড়িয়ে সুন্দর করে হেসে আবার আমার কাছে চলে এসো।

ইমন বলল, কেন?

আমি যেতে বলছি। এই জন্যে যাবে। সব কিছুতে কেন কেন করবে না।

ইমন সরু গলায় বলল, সবকিছুতে কেন কেন করলে কি হয়?

সুরাইয়া বিরক্ত গলায় বলল, খুব খারাপ হয়। বড়রা কোন কথা বললে কেন কেন না বলে সেই কথা শুনতে হয়। তোমাকে আয়নার সামনে যেতে বলছি তুমি যাও। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খুব সুন্দর করে হাসবে। মনে থাকে যেন।

হাসলে কি হবে?

হাসলে খুব মজার একটা ব্যাপার হবে।

ইমন আয়নার দিকে যাচ্ছে। খুব যে আগ্রহের সঙ্গে যাচ্ছে তা না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাসলে মজার কিছু হবে বলে তার মনে হচ্ছে না। বড়রা যে প্রায়ই অর্থহীন কথা বলে এই সত্য সে ধরতে শুরু করেছে।

ইমন আয়নার সামনে গেল। ঠোঁট টিপে ভুরু কুঁচকে নিজের দিকে তাকিয়ে রইল। মা হাসতে বলেছেন। না হাসলে মজার কিছু ঘটবে না। কাজেই সে সামান্য হাসল। এত সামান্য যে ঠোঁট পর্যন্ত ফাঁক হল না। মজার কিছু ঘটল না। ঘটবে না তা সে জানতো। বড়রা ছোটদের ভুলাবার জন্যে মিথ্যা কথাও বলে। ইমন আয়নার সামনে থেকে সরে গেল। রওনা হল তার দাদীর ঘরের দিকে। মিথ্যা কথা বলায় মার কাছে তার এখন আর যেতে ইচ্ছা করছে না। সে ঠিক করল মায়ের সামনে দিয়েই সে দাদীর ঘরে যাবে তবে মার দিকে ফিরে তাকাবে না। শুধু শুধু আয়নার সামনে দাঁড় করানোয় মার উপর তার রাগ লাগছে।

সুরাইয়া মিথ্যা কথা বলে নি। ইমন যদি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাসত তাহলে সত্যি মজার একটা ব্যাপার ঘটত। ইমান দেখতে পেত। তার সামনের পাটির একটা দাঁত পড়ে গেছে। সামান্য একটা দাঁত পড়ে যাবার জন্যে তার চেহারা গেছে পাল্টে। তাকে চেনা যাচ্ছে না।

সুরাইয়া আগ্রহ নিয়ে বারান্দায় অপেক্ষা করছে। এই বুঝি ছেলের বিকট চিৎকার শোনা যাবে—মা, আমার দাঁত পড়ে গেছে। মা আমার দাঁত পড়ে গেছে। সেরকম কিছুই হল না। ছেলেকে গম্ভীর ভঙ্গিতে বারান্দায় আসতে দেখা গেল। মার সামনে দিয়েই সে যাচ্ছে অথচ সে তার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। সুরাইয়া ডাকল, এই ব্যাটা। এই। ইমন মায়ের ডাক সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ঢুকে গেল দাদীর ঘরে। সুরাইয়ার মনটা খারাপ হয়ে গেল। এই ছেলে কি পুরোপুরি তার বাবার মত হয়ে যাচ্ছে? রোবট মানব? কোন কিছুতে কোন আগ্রহ নেই, কৌতূহল নেই। বিস্মিত হবার ক্ষমতা নেই। প্রথম দাঁত পড়া যে কোন শিশুর জন্যে বিরাট রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, অথচ ইমন কেমন নির্বিকার।

দাদীর ঘরে ঢোকার আগে ইমন তার ছোট চাচার ঘরের সামনে দাঁড়াল। ছোট চাচাকে তার বেশ ভাল লাগে। ছোট চাচা বড় মানুষ হলেও বড়দের মত না। ছোট চাচার ঘরের দরজা খোলা। তিনি ইমনকে দেখে ডাকলেন–এই যে মিষ্টার স্ট্রং ম্যান, শুনে যা। ইমনের তখন আর ঘরে ঢুকতে ইচ্ছে করল না। সে রওনা হল দাদীর ঘরের দিকে। ইমনের ছোট চাচা ফিরোজ ঘর থেকে বের হল। সুরাইয়ার কাছে গিয়ে হাই তুলতে তুলতে বলল, ভাবী একটু চা খাওয়াওতো।

ফিরোজের বেশ কদিন ধরে জ্বর চলছে। তার চোখ লাল। শেভ করছে না বলে খোচা খোচা দাড়িতে তাকে ভয়ংকর লাগছে। অসুখ বিসুখ তাকে খুব কাবু করে। এই কদিনের জ্বরে সে শুকিয়ে চিমসা হয়ে গেছে।

সুরাইয়া বলল, তোমার জ্বরের অবস্থা কি?

জ্বরের অবস্থা জানি না ভাবী। আমার জল বসন্ত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। শরীরে গোটা গোটা কি যেন উঠেছে।

বল কি, চিকেন পক্স হয়েছে?

ফিরোজ হাসি মুখে বলল, হয়েছে। এবং আমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেটাও জল বসন্তের মতই ভয়াবহ। আমি এম এ পরীক্ষা দিচ্ছি না ভাবী।

ড্রপ দিচ্ছ?

ড্রপ ট্রপ না। পড়াশোনার পাঠ শেষ করে দিলাম। এম এ পাশ বেকার শুনতে খুব খারাপ লাগে। বি এ পাশ বেকার শুনতে তত খারাপ লাগে না। শ খানিক টাকা দিতে পারবে ভাবী? দিতে পারলে দাও।

অসুখ নিয়ে কোথায় বের হবে?

ফিরোজ গম্ভীর মুখে বলল, সব বন্ধু-বান্ধবের বাসায় যাব। এম এ পরীক্ষা যে দিচ্ছি না। এই খবরটা দেব এবং জল বসন্তের জীবাণু ডিসট্রিবিউট করে আসিব। ওরা বুঝবে কত ধানে কত চাল। ভাবী শোন, চা যে আনবে শুধু লিকার, নো মিল্ক, নো সুগার। আচ্ছা থাক, চা লাগবে না।

লাগবে না কেন?

চা খাব ভেবেই কেমন বমি বমি লাগছে। চায়ের বদলে টাকা দাও। একশ না পারলে পঞ্চাশ। পঞ্চাশ না পারলে কুড়ি।

সুরাইয়া শান্ত গলায় বলল, টাকা আমি দিচ্ছি, তুমি আমার কথা শোন। কোথাও বের হয়ো না। শুয়ে রেস্ট নাও। কয়েকদিন আগে জণ্ডিস থেকে উঠেছ।

ফিরোজ শোবার ঘরের দিকে চলে গেল। বিছানায় শুয়ে থাকার জন্যে গেল না। কাপড় বদলাবার জন্যে গেল। চারদিন ঘরে থেকে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। নিঃশ্বাস ফেলার জন্যে তাকে বাইরে যেতেই হবে। জল বসন্তের জীবাণু ডিসট্রিবিউটের ব্যাপারেও সে রসিকতা করছে না। সে আসলেই ঠিক করে রেখেছে। সব বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে দেখা করবে। যতদূর সম্ভব ঘসা ঘসি করে আসবে।

আকলিমা বেগমের ঘর থেকে তার এবং ইমনের হাসির শব্দ আসছে। ইমন হাসতে হাসতে প্ৰায় ভেঙ্গে পড়ে যাচ্ছে। হেচকির মত উঠছে। সুরাইয়া ভুরু কুঁচকে ফেলল। তার কোন কথায়তো ছেলে এমন করে হাসে না। শাশুড়ির ঘরে এমন কি ঘটল যে হাসতে হাসতে ছেলের হেঁচকি উঠে গেল? বাচ্চারা বাচ্চাদের সঙ্গ পছন্দ করবে। সত্ত্বর বছরের একজন বৃদ্ধার সঙ্গ তার এত পছন্দ হবে কেন? সুরাইয়ার সবচে যেখানে আপত্তি তা হচ্ছে ছেলে তার দাদীর সঙ্গে থেকে থেকে গ্রাম্য কথা শিখে যাচ্ছে। আকলিমা বেগম বিশুদ্ধ নেত্রকোনার ভাষায় কথা বলেন–বিছুন আইন্যা বাও দে অর্থাৎ পাখা এনে বাতাস কর জাতীয় অদ্ভুত ভাষা। শিশুরা অদ্ভুত ভাষাটাই সহজে গ্রহণ করে। ইমন এর মধ্যেই তার দাদীর কাছ থেকে বিকট বিকট কিছু শব্দ শিখেছে। খুব স্বাভাবিক ভাবে সে শব্দগুলি বলে। আর সুরাইয়া আতংকে অস্থির হয়।

এইতো কয়েকদিন আগে ইমন খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল, ব্যথা করছে।

সুরাইয়া বলল, কোথায় ব্যথা করে—পেটে?

ইমন বলল, না পেটে না।

তাহলে কোথায়?

ইমন ভুরু কুঁচকে বলল, পুন্দে ব্যথা।

সুরাইয়া হতভম্ব। পুন্দে ব্যথা মানে? এটা কোন ধরনের ভাষা? সুরাইয়া প্ৰায় কেন্দে ফেলার উপক্রম করল—এই ছেলে কি সব ভাষা শিখছে?

ইমন সরু চোখ করে মার দিকে তাকিয়ে আছে। তার কোথাও কোন ব্যথা নেই। সে একটা নতুন শব্দ শিখেছে। মার উপর সে এই শব্দের প্রভাব লক্ষ্য করছে। বুঝতে পারছে প্রভাব ভয়াবহ। কাজেই এই শব্দ তাকে আরো ব্যবহার করতে হবে।

সুরাইয়া শাশুড়িকে এই সব নিয়ে কিছু বলতে পারছে না। তিনি যদি স্থায়ী ভাবে তাদের সঙ্গে থাকতেন তাহলে সুরাইয়া অবশ্যই বলত। তিনি প্রতিবছর মাসখানিকের জন্যে ছেলের কাছে থাকতে আসেন। সম্মানিত একজন অতিথিকে নিশ্চয়ই মুখের উপর বলা যায় না–আপনি আমার ছেলেকে আজে বাজে ভাষা শেখাবেন না। তিনি যখন পান খেয়ে মেঝেতেই পিক ফেলেন তখন তাকে বলা যাবে না-মা, আপনি পানের পিক মেঝেতে না ফেলে বেসিনে ফেলবেন। তার শাশুড়ির যে ব্যাপারটা সুরাইয়ার অসহ্য লাগে তা হচ্ছে—তিনি শাড়ির নিচে ব্লাউজ-ট্রাউজ কিছুই পরেন না। তার নাকি দমবন্ধ লাগে। সুরাইয়া লক্ষ্য করেছে ইমন কৌতূহলী চোখে তার দাদুর আব্দুল গায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই বয়সের বাচ্চাদের কৌতূহল থাকে তীব্ৰ। ইমন যে তার দাদুর ঘরে যাবার জন্যে এত ব্যস্ত, এটাও তার একটা কারণ হতে পারে।

এখন বাজছে এগারোটা। ফিরোজ জ্বর নিয়েই বের হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে সে তার এম এ পরীক্ষা সত্যি দেবে না। ফিরোজের এই একটা ব্যাপার আছে। হাসি তামাশা করেও যা বলে তাই। সুরাইয়া গম্ভীর মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে ক্রিমের একটা কৌটা। কোটায় ইমনের দাত। দাতটা সুরাইয়া সকাল বেলায় বিছানা ঠিক করতে গিয়ে পেয়েছে এবং অতি মূল্যবান বস্তুর মত কোটায় ভরে রেখেছে। ইমন নিশ্চয়ই দাতটা পেয়ে খুব খুশী হবে। একটা বস্তু নিজের শরীরের অংশ ছিল এখন নেই। ব্যাপারটার মধ্যে বিরাট নাটকীয়তা আছে। ইমন তার দাদীর ঘর থেকে বের হচ্ছে না। আকলিমা বেগম ডাকলেন, বৌমা হুইন্যা যাও।

সুরাইয়া তার শাশুড়ির দরজার সামনে দাঁড়াল। তার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। কি বিশ্ৰী ব্যাপার-আকলিমা বেগমের শরীরের উপরের অংশে আজ কোন কাপড় নেই। শাড়ির উপরের অংশটা তিনি কোমরে প্যাচ দিয়ে পরে আছেন। আকলিমা বেগম হাসি মুখে বললেন, কারবার দেখছ? ইমাইন্যার দাঁত পড়ছে।

সুরাইয়ার গা কাটা দিয়ে উঠল। ইমাইন্যা। ইমাইন্যা। আবার কি? তার ইমন কি কাজের ছেলে যে তাকে ইমাইন্যা ডাকতে হবে!

বান্দরডারে কি সুন্দর লাগিতাছে দেখ। বান্দর আবার ফোকলা দীতে হাসে। ও বান্দর তুই হাসস ক্যান? ইমাইন্যা বান্দর হাসে। ভ্যাকভ্যাকাইয়া হাসে।

ইমন কি হাসবে আকলিমা বেগম হেসে হেসে কুটি কুটি হচ্ছেন। তিনি পা লম্বা করে মেঝেতে হেলান দিয়ে বসেছেন। ইমান বসে আছে তার ছড়ানো পায়ের উপর। তিনি মাঝে মাঝে পা নাড়ছেন ইমনের আনন্দ তাতেই উথলে উঠছে। আকলিমা বেগম হাসি মুখে ছড়া কাটলেন,

দাঁত পরা কুলি পরা
মধ্যিখানে খাল
বুড়ি বেটি হাইগ্যা থুইছে
বাইশ হাত লম্বা নাল।

এইবার হাসার পালা। ইমনের। এমন মজার ছড়া মনে হয় সে তার ইহ জীবনে শুনেনি। সুরাইয়া কঠিন গলায় বলল, ইমন আসতো।

আকলিমা বেগম বললেন, থাউক না খেলতাছে খেলুক। তুমি তোমার কাম কর। ও ইমাইন্যা দাতের ফাঁক দিয়া ছেপ ফেল দেখি।

ইমন দাঁতের ফাঁক দিয়ে পিচ করে থুথু ফেলল। সেই থুথু পড়ল তার দাদীর গায়ে। তিনি হেসে কুটি কুটি হচ্ছেন। তাঁর নাতীও হেসে ভেঙ্গে পড়ছে। আনন্দের আজ যেন বান ডেকেছে।

সুরাইয়া তাকাল ছেলের দিকে। ছেলে চোখ বড় বড় করে মাকে দেখছে। সুরাইয়ার বুকের ভেতর হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠল। আহারে, ছেলেটাকে কি সুন্দর লাগছে। সত্যি সত্যি কাঁচা হলুদ গায়ের রঙ। সুরাইয়া নিজে এত ফর্সা না। তার বাবাও না। ছেলে এমন গায়ের রঙ পেল কোথায়? দাঁত পড়ায় ছেলের চেহারা আজ আরো সুন্দর হয়ে গেছে। দাতপড়া ছেলেটার অদ্ভুত মুখটায় ক্রমাগত চুমু খেতে ইচ্ছা করছে। শাশুড়ির পায়ের উপর থেকে ছেলেটাকে জোর করে ধরে নিয়ে এলে কেমন হয়? খুব ভাল হয়। কিন্তু সম্ভব না। সুরাইয়া চলে এল। তার ইচ্ছা করছে ইমনের বাবার অফিসে একটা টেলিফোন করতে। টেলিফোন করাও সমস্যা। তাদের টেলিফোন নেই। বাড়িওয়ালার বাসা থেকে টেলিফোন করতে হয়। বাড়িওয়ালা বাসায় থাকলে কিছু বলেন না। কিন্তু তিনি বাসায় না থাকলে তাঁর স্ত্রী খুব বঁকা ভাবে কিছু কথা শুনিয়ে দেয়। তাছাড়া কারণে অকারণে টেলিফোন করা ইমনের বাবা পছন্দ করে না। হাসানুজ্জামান অনেকবার বলেছে এক্সট্রিম ইমার্জেন্সি ছাড়া টেলিফোন করবে না। আমার টেবিলে টেলিফোন থাকে না, বড় সাহেবের টেবিলে টেলিফোন। উনার সামনে এসে কথা বলতে হয়। উনি মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। খুব অস্বস্তি লাগে।

টেলিফোনে ইমনের বাবার সঙ্গে কথা বলতে সুরাইয়ার খুব ভাল লাগে। তার গলাটা টেলিফোনে সম্পূর্ণ অন্যরকম শোনা যায়। খুব আন্তরিক লাগে। মনে হয় গম্ভীর ধরনের একজন মানুষ মায়া মায়া গলায় কথা বলছে। সুরাইয়ার একটা ছেলেমানুষী স্বপ্ন হচ্ছে কোন একদিন তাদের টেলিফোন আসবে এবং সে তখন রোজ একঘন্টা করে ইমনের বাবার সঙ্গে কথা বলবে। মানুষটা বিরক্ত হোক বা রাগ হোক কিছুই যায় আসে না। সে কথা বলবেই।

ছেলের দাঁত পড়ে যাওয়া নিশ্চয়ই কোন এক্সট্রিম ইমার্জেন্সি না। টেলিফোনে এই খবর দিলে ইমনের বাবার রেগে যাবার সম্ভাবনা। তবে রাগটা সে প্ৰকাশ করবে না। যত রাগই হোক মায়া মায়া করে কথা বলবে। ফিরোজের জল বসন্ত এটাও দেবার মত খবর। সে এম এ পরীক্ষা দেবে না এটাও বলা যেতে পারে। অনেক কিছুইতো আছে বলার মত।

অবশ্যি আরেকটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খবর আছে। সেই খবরটা টেলিফোনে দেয়া যাবে না। সব খবর কি আর টেলিফোনে দেয়া যায়? সুরাইয়া টেলিফোন করা ঠিক করল।

ভারী এবং রাগী গলার এক ভদ্রলোক টেলিফোন ধরলেন, কাকে চাই এমন ভাবে বললেন যেন কাউকে চাওয়াটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সুরাইয়া হকচাকিয়ে গিয়ে বোকার মত বলল, দয়া করে ইমনের বাবাকে দিন।

ইমনের বাবার নামটা জানতে পারি?

সুরাইয়া লজ্জিত গলায় নাম বলল। ভদ্রলোক বললেন, আপনি ধরে থাকুন, লাইন ট্রান্সফার করে দিচ্ছি। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ইমনের বাবা মায়া মায়া গলায় বলল, কে সুরাইয়া? কেমন আছ?

সুরাইয়ার এত ভাল লাগলো যে চোখে প্রায় পানি এসে গেল। সে বোকার মত বলে বসল, এখনো আসছ না কেন?

অফিস ছুটি হোক তারপর আসব।

শোন, ইমনের দাঁত পড়ে গেছে। উপরের পাটির দাঁত, তাকে যে কি অদ্ভুত দেখাচ্ছে।

ছয় বছরে দাঁত পড়ে, ওর পাঁচ বছর তিনমাস।

ও আচ্ছা।

তোমার ভাইয়ের গায়ে গোটা গোটা কি যেন উঠেছে। ওর ধারণা জল-বসন্ত। সে জল-বসন্ত নিয়েই বাইরে গেছে।

ও আচ্ছা।

আমাকে বলছিল। সে এম এ পরীক্ষা দেবে না।

নিশ্চয়ই ঠাট্টা করেছে।

আমার কাছে ঠাট্টা বলে মনে হয় নি। আচ্ছা শোন, এই যে হঠাৎ টেলিফোন করলাম রাগ করানিতো।

না, রাগ করব কেন? টেলিফোন করাটাতো কোন ক্রাইম না।

তোমার বড় সাহেব, উনি কি তোমার দিকে তাকিয়ে আছেন?

উনি তাকিয়ে থাকবেন কেন? টেলিফোনতো আমার টেবিলে। আমাকে টেলিফোন দিয়েছে।

বল কি, কবে দিয়েছে?

গত সপ্তাহে। ডিরেক্ট লাইন না। পি বি এক্স লাইন।

গত সপ্তাহে টেলিফোন দিয়েছে তুমি আমাকে বলনি কেন?

এটা কি বলার মত কোন ব্যাপার?

অবশ্যই বলার মত ব্যাপার। আশ্চর্য তুমি এরকম কেন? আমাকে কিছুই বলনা। আচ্ছা শোন, তুমি আমাকে কার্ডফোনের একটা কার্ড করিয়ে দেবে, আমি রোজ তোমাকে টেলিফোন করব।

সুরাইয়া শুনল ইমনের বাবা হাসছে।

আজ কিন্তু অনেকক্ষণ তোমার সঙ্গে কথা বলব। তোমার কাজ থাকুক। আর যাই থাকুক।

সুরাইয়া আজ চারটার সময় আমাদের একটা মিটিং আছে। আমাকে সেই মিটিং এর ফাইল তৈরী করতে হবে তিনটার মধ্যে। কাজেই তোমাকে টেলিফোন রাখতে হবে।

সুরাইয়া দুঃখিত গলায় বলল, ও আচ্ছা।

আমি এক কাজ করি আজ সকাল সকাল চলে আসি। তারপর কোন একটা স্টুডিওতে নিয়ে গিয়ে ইমনের একটা ছবি তুলে রাখি। বড় হয়ে দেখলে মজা পাবে।

আচ্ছা।

সুরাইয়া রাখি?

ইমনের বাবা টেলিফোন রেখে দিল। সুরাইয়া তারপরেও বেশ কিছু সময় টেলিফোন কানে ধরে রাখল। পো পো শব্দ হচ্ছে। শব্দটা শুনতে এমন খারাপ লাগছে।

আর কাউকে কি টেলিফোন করা যায়? ছেলের দাঁত পড়েছে এই খবরটা নিশ্চয়ই অন্যকে দেবার মত। বড় ভাইজানকে কি খবরটা দেব? সুরাইয়া মনস্থির করতে পারছে না। তার বড় ভাই জামিলুর রহমান শুকনা ধরণের মানুষ। নিজের ব্যবসা ছাড়া অন্য কিছুই বুঝেন না। তিনি কোন কিছুতে বিরক্তও হন না, বা আনন্দিতও হন না।

সুরাইয়া ভাইজানের বাড়িতে টেলিফোন করল। জামিলুর রহমান টেলিফোন ধরলেন এবং গম্ভীর গলায় হ্যালো বলার বদলে বললেন, কে?

সুরাইয়া বলল, ভাইজান আমি সুরাইয়া।

কি ব্যাপার?

না কিছু না, এমনি খবর নেয়ার জন্যে টেলিফোন করলাম। আপনারা ভাল আছেন?

হ্যাঁ।

ভাবী—ভাবী ভাল আছেন?

হ্যাঁ।

ইমনের আজ একটা দাঁত পড়েছে।

ও আচ্ছা।

মিতুর কি দাঁত পড়েছে? মিতুর বয়সতো ইমনের কাছাকাছি। ইমনের দুই মাসের ছোট। মিতুর দাঁত পড়ে নি?

জানিনাতো।

আপনার শরীর ভাল আছে ভাইজান?

হুঁ।

হজমের যে সমস্যা ছিল সমস্যা মিটেছে?

না আছে। সুরাইয়া এখন রাখি-আমাকে একটু পুরোনো ঢাকায় যেতে হবে। তোরা একদিন চলে আসিস। জামাইকে নিয়ে আসিস। তোর শাশুড়িকেও নিয়ে আসিস।

সুরাইয়া কিছু বলার আগেই তিনি টেলিফোন রেখে দিলেন। সুরাইয়া তারপরেও টেলিফোন কানে দিয়ে রাখল। পো পো শব্দ হচ্ছে। মন খারাপ করা শব্দ। তারপরেও আজ কেন জানি শব্দটা শুনতে ভাল লাগছে। মানুষের জীবনে একেকটা দিন একেক রকম হয়ে আসে। কোন কোন দিনে মন খারাপ হবার মত ব্যাপার ঘটলেও মন খারাপ হয় না। বরং মন ভাল হয়ে যায়। আজি মনে হয়। সে রকম একটা দিন।

ব্যাপারটা কি? রাত এগারোটা বাজে ইমনের বাবা এখনো আসছে না। সুরাইয়া প্রাণপণ চেষ্টা করছে দুঃশ্চিন্তা না করতে। যেদিন সকাল সকাল বাড়ি ফেরার কথা থাকে সেদিন দেরি হয় এটা জানা কথা। তার কোন বন্ধু হয়তো তাকে বাসায় ধরে নিয়ে গেছে। তার ছেলের জন্মদিন বা এই জাতীয় কিছু। রাতে না খাইয়ে ছাড়বে না। খাওয়া দাওয়া শেষ করে গল্প করতে করতে দেরি

হচ্ছে।

সুরাইয়া বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছে। একবার ফিরোজের ঘরে উঁকি দিল। ফিরোজও ফিরে নি। তাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করার কিছু নেই। সে প্রায়ই রাত বিরেতে বাড়ি ফেরে। একবার ফিরে ছিল রাত তিনটায়। কিন্তু ইমনের বাবাতো কখনো এত দেরি করে না। সত্যিকারের কোন বিপদ হয়নিতো? বড় শহরের বিপদগুলিও হয় বড় বড়। কোন কারণ ছাড়াই হঠাৎ গণ্ডগোল লেগে যায়। গাড়ির কাচ ভাঙ্গা হতে থাকে, ককটেল ফুটতে থাকে। এক সময় পুলিশের গাড়ি আসে। বেশির ভাগ সময়ই পুলিশরা গাড়ি থেকে নামে না। যদি নামে তাহলে নিরীহ মানুষ যারা সাতেও নেই পাচেও নেই তাদের দিকে হুংকার দিয়ে ছুটে যায়। লাঠি পেটা করে। মাথা ফাটিয়ে দেয়। যেদিন কোথাও কোন গণ্ডগোল থাকে না সেদিন ফুটপাতে ট্রাক উঠে পড়ে। এই অদ্ভুত শহরে নিশ্চিন্ত হয়ে ফুটপাথ দিয়েও হাঁটার উপায় নেই।

আজ কি শহরে কোন গণ্ডগোল হচ্ছে?

পত্রিকায়তো কিছু লেখেনি। পত্রিকাটা অবশ্যি সুরাইয়ার ভালমত পড়া হয়নি। এখন বারান্দায় বসে পত্রিকাটা পড়া যায়। এতে সময়টা কাটবে। সুরাইয়ার কেন জানি মনে হচ্ছে রাত বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই ইমনের বাবা আসবে। তার আবার যা মনে হয় তাই হয়। সুরাইয়া পত্রিকা নিয়ে বসল। রাত বারোটা পাঁচ পর্যন্ত সে পত্রিকা পড়ল। কেউ এল না। সুরাইয়ার বমি বমি লাগছে। এই বমি, উদ্বেগ জনিত বমি না। এর কারণ ভিন্ন। তার শরীরে আরো একজন মানুষ বাস করছে। সে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। মানুষটার কথা হাসানকে এখনো বলা হয়নি। আজ বলে ফেললে কেমন হয়। শুধু তার শাশুড়ি জানেন। ছেলের বাড়িতে পা দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি নিচু গলায় বললেন, ও বউ, তোমার কয় মাস? সুরাইয়া হতভম্ব। তার মাত্র তিনমাস চলছে। কারো কিছু বোঝার কথাই না। তিনি কি করে বুঝলেন? পুরানো দিনের মানুষদের চোখ এত তীক্ষ্ণ?

আকলিমা বেগম ঘুমিয়ে পড়েছেন। তিনি জেগে থাকলে সুরাইয়া তার উদ্বেগের খানিকটা তার সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারত। তাকে কি ডেকে তুলবো? না, আরো আধাঘন্টা যাক। তাকে না জাগানোই ভাল। তিনি জেগে গেলে ঝামেলা করবেন। কান্নাকাটিও শুরু করতে পারেন। এই বয়সের মানুষদের মাথার ঠিক থাকে না। আকলিমা বেগমের মাথা একটু মনে হয় বেশী রকমের বেঠিক। তিনি রাতে ভাত খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েন। রাত একটা দেড়টার দিকে জেগে ওঠেন। শুরু হয় একা একা কথা বলা, বারান্দায় হাঁটা। মাঝে মধ্যে গানের মত সুর করে কি জানি বলেন। শুনতে ভাল লাগে। প্রথমবার শুনে সুরাইয়া চমকে ওঠে বলেছিল, আম্মা গান গাচ্ছেন নাকি? হাসান বিরক্ত গলায় বলেছে, গান গাইবে কেন? টেনে টেনে কথা বলছে।

কথাগুলি কি বুঝতে পারছি?

না।

উনি কি সব সময় এ রকম করেন–না। আজই করছেন?

প্রায়ই করেন। ফালতু আলাপ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা কর।

সুরাইয়া বারান্দায় বসে আছে। বারান্দা থেকে রাস্তা দেখা যায় না। বাড়িওয়ালা তার বাড়ির চারদিকে খুব উঁচু করে দেয়াল দিয়েছে। দেয়ালে আবার সূচালো লোহার শিক বসানো—যেন চোর দেয়াল টপকে ঢুকতে না পারে। গেট আছে। গেটে দারোয়ান নেই। সব ভাড়াটের কাছে একটা করে চাবি দেয়া। রাতে বিরেতে কেউ ফিরলে চাবি দিয়ে গেট খুলে ঢুকতে হবে। তিন তলা বাড়ির এক তলায় দুজন ভাড়াটে থাকেন। তিন তলায়ও দুজন ভাড়াটে। দুতলার সবটা নিয়ে থাকেন বাড়িওয়ালা। এদের কারোর সঙ্গেই সুরাইয়ার কোন যোগ নেই। যোগ থাকলে ভাল হত— আজি এই বিপদের সময় এদের কাছে ছুটে যাওয়া যেত। বিপদে তারা কি করত না করত সেটা পরের কথা। সুরাইয়াদের পাশের ডান দিকের ফ্ল্যাটে থাকেন আব্দুল মজিদ সাহেব। বেঁটে খাট মানুষ। গাউী গোট্টা চেহারা। মুখে সব সময় পান। সকালে যখন ব্রিফ কেস হাতে বের হন তখন ভুর ভুর করে জর্দার গন্ধ পাওয়া যায়।

সুরাইয়ার সঙ্গে দেখা হলো থমকে দাঁড়ান। অকারণে গলা খাকাড়ি দেন। তার চোখের দৃষ্টি গা বেয়ে নামতে থাকে। ভয়ংকর ব্যাপার। সুরাইয়ার কয়েকবারই ইচ্ছে করেছে বলে-আপনি এই ভাবে তাকান কেন? এ ভাবে তাকাবেন না। আমি নিতান্তই ভদ্র মেয়ে বলে কিছু বলছি না। কোন একদিন কঠিন কোন মেয়ের পাল্লায় পড়বেন, সে উলের কাটা দিয়ে আপনার চোখ গেলে দেবে। বিপদ যত বড়ই হোক-আব্দুল মজিদ সাহেবের কাছে যাওয়া

যাবে না।

কোথাও কি টেলিফোন করা যায়? বাড়িওয়ালা সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়লেও তাদের ছোট মেয়েটা এবার এস. এস. সি. পরীক্ষা দিচ্ছে। বলতে গেলে প্রায় সারা রাত জেগে পড়ে। দরজায় ধাক্কা দিলেই সে দরজা খুলে দেবে। কোথায় টেলিফোন করবে?

ভাইজানের বাড়িতে? তাঁকে কি বলবে? ভাইজান দশটার ভেতর ঘুমিয়ে পড়েন। একবার ঘুমিয়ে পড়লে তাকে জাগানো নিষেধ। ভয়ংকর বিপদ এই কথা বললে তাকে হয়ত ডেকে দেবে-তিনি সব শুনে হাই তুলতে তুলতে বলবেন—এত রাতে কোথায় খোজ করবি? সকাল হোক। তাছাড়া পুরুষ মানুষ এরা এক দুই রাত বাইরে থাকেই।

অফিসে? অফিস কি কেউ রাত একটা পর্যন্ত খোলা রাখে। হাসপাতালে? এক্সিডেন্ট করে কেউ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে কি-না জানতে চাওয়া। নাম হাসানুজ্জামান বয়স বত্রিশ। পরনে চেক ফুল সার্ট, খয়েরী প্যান্ট। পায়ে স্যাণ্ডেল। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। গায়ের রঙ ফর্সা। দেখতে সুন্দর-হালকা পাতলা। টেলিফোনে তার গলার স্বর খুব মিষ্টি।

সুরাইয়া চমকে উঠল। ছিঃ ছিঃ এইসব সে কি ভাবছে? হাসপাতালের কথা মনে আসছে কেন? মানুষটা হাসপাতালে কেন যাবে? কু চিন্তা মনে আসা ঠিক না। যে চিন্তা মনে আসে তাই হয়। ভাল কোন চিন্তা মনে আনতে হবে। সুন্দর কোন চিন্তা।

বৌমা! বারিন্দায় বইসা আছ কেন?

সুরাইয়া উঠে দাঁড়াল। আকলিমা বেগমের ঘুম ভেঙ্গেছে। তিনি বারান্দায় চলে এসেছেন। বাকি রাতটা বারান্দায় হাঁটাহাটি করে এবং গান গেয়ে কাটাবেন। সুরাইয়া বলল, আম্মা ও এখনো ফেরেনি।

রাইত কত হইছে?

দুটা বাজতে পাঁচ মিনিট।

রাইতাতো মেলা হইছে।

জ্বি।

তুমি ভাত খাইছ?

জ্বি না।

যাও, তুমি গিয়া ভাত খাও। চিন্তার কিছু নাই—পুরুষ মানুষ দুই এক রাইত দেরী করেই। এইটা নিয়া চিন্তার কিছু নাই। বন্ধু-বান্ধবের বাড়িত গেছে, টাশ খেলতাছে।

ও তাস খেলে না মান।

খেলে না বইল্যা যে কোনদিন খেলব না এমুন কোন কথা নাই। বিলাই আর পুরুষ মানুষ এই দুই জাতের কোন বিশ্বাস নাই। দুইটাই ছোকছুকানি জাত। যাও, ভাত খাইতে যাও—আমি বসতেছি। যাও কইলাম।

সুরাইয়া রান্নাঘরের দিকে রওনা হল। রান্নাঘরে না যাওয়া পর্যন্ত তার শাশুড়ি এই একটা বিষয় নিয়েই কথা বলতে থাকবেন—ভাত খাও, ভাত খাও। গ্রামের মানুষদের কাছে ভাত খাওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ইমনকে রাতে খাওয়ানোর সময় সুরাইয়ার প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছিল। ক্ষিধের যন্ত্রনায় নাড়ি পাক দিচ্ছিল। এখন একেবারেই ক্ষিধে নেই। বরং বমি বমি ভাব হচ্ছে। এক গ্লাস লেবুর সরবত বানানো যায়। ঘরে আর কিছু থাকুক না থাকুক লেবু আছে। ইমনের বাবা লেবু ছাড়া ভাত খেতে পারে না। গরম ভাত ছাড়া খেতে পারে না। পাতে যখন ভাত দেয়া হবে তখন সেই ভাতে ফ্যান মাখা থাকতে হবে। ফ্যান ভাত থেকে ধোঁয়া উঠতে হবে। এমন গরম ভাত মানুষ কপি কপ করে কি ভাবে খায় কে জানে।

সুরাইয়া চুলা ধরাল। রাতের বেলা হাসান যখন বলে–ভাত বার, ক্ষিধে লেগেছে। তখনই সে চুলা ধরিয়ে আধাপটি চাল দিয়ে দেয়। হাসানের হাত মুখ ধুয়ে টেবিলে খেতে আসতে আসতে চাল ফুটে যায়। আজকের অবস্থা, ভিন্ন। ভাত রাধা থাকুক। কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকা। ভাত রাধতেওতো কিছু সময় যাবে।

আকলিমা বেগম মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসেছেন। তিনি চেয়ারে বসতে পারেন না, খাটে বসতে পারেন না। রাতে ঘুমুবার সময়ও মেঝেতে চাদর বিছিয়ে ঘুমান। সুরাইয়া মেঝের মশারি খাটিয়ে দিতে চেয়েছে, তিনি রাজি হন নি। মশারা নাকি তাকে কামড়ায় না।

বুড়া মাইনষের রক্তে কোন টেস নাই গো বউ। শ‍ইল্যে মশা বয় ঠিকই–কামুড় দেয় না।

আজ আকলিমা বেগমকে মশা কামড়াচ্ছে। তিনি এর মধ্যে কয়েকটা মশা মেরে ফেলেছেন। মৃত মশাগুলি জড় করছেন। যেন এরা মহামূল্যবান কোন প্রাণী, এদের মৃতদেহগুলির প্রয়োজন আছে। আকলিমা বেগমের বুক ধড়ফড় করছে। এত রাত হয়ে গেল ছেলে বাসায় ফিরছে না কেন? এই বয়সে সবচে খারাপটাই আগে মনে হয়। ভয়ংকর কিছু ঘটে গেছে কি? আজকের রাতটা কি ভয়ংকর কোন রাত? তার সত্তর বছরের জীবনে অনেক ভয়ংকর রাত এসেছে— এবং চালেও গেছে। হাসানের বাবার মৃত্যুর কথাই ধরা যাককবুতরের খুপড়িতে হাত দিয়েছে। কবুতর ধরবে। নতুন আলু দিয়ে কবুতরের মাংস রান্না হবে। হাত দিয়েই হাত টেনে নিল-রাঙ্গা বউ ইন্দুরে কামড় দিছে। কবুতরের বাসাত ইন্দুর।

না, ইঁদুর না—সাপ। বিরাট এক সাপ। তাদের চোখের সামনেই কবুতরের খোপ থেকে বের হয়ে এল। দুজনই হতভম্ব। আকলিমা বেগম দিশা হারালেন না, সঙ্গে সঙ্গেই পাটের কোষ্টা দিয়ে হাত বাধলেন। ওঝা আনতে লোক পাঠালেন। কালা গরুর দুধে হাত ড়ুবিয়ে রাখলেন। শাদা বর্ণের দুধ যদি কালচে হয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে জীবনের আশা নেই। দুধ কালচে হল না। আকলিকা বেগম আশায় আশায় বুক বাধলেন। ওঝা এসে পড়ল দুপুরের মধ্যে। ঘন্টা খানিক ঝাড়ফুকের পর বাঁধন খোলা হল। মানুষটা শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, হাত জুইল্যা যাইতেছিল–এখন ব্যথা কমছে। পানি খাব বউ। পানি দাও। পানি আনা হল। পানির গ্লাস হাতে নিয়ে মুখে দেবার আগেই লোকটা মারা গেল।

এইসব কথা আকলিমা বেগম মনে করতে চান না, তবু মাঝে মধ্যেই মনে পড়ে। লোকটা পানি খেয়ে মরতে পারল না— ভরা গ্লাস হাতে নিয়ে ধড়ফড় করে মরে গেল এই দুঃখও কম কি? জগতের কোন দুঃখই কম না। ছোট দুঃখ, বড় দুঃখ, সব দুঃখই সমান।

আজ তাঁর জন্যে কি দুঃখ অপেক্ষা করছে কে জানে। মন শক্ত করে রাখতে হবে। বাচ্চা বউটার দিকে তাকিয়ে মন শক্ত করতে হবে। বাচ্চা মানুষ দুঃখ পেয়ে অভ্যাস নেই। বউটাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাত পার করতে হবে। দিনের বেলা যে কোন কষ্টই সহনীয় মনে হয়–রাতে ভিন্ন ব্যাপার। কিছু কিছু রাতকে এই জন্যে বলে কাল-রাত। কালদিন বলে কিছু নেই। এটাও একটা আশ্চর্য ব্যাপার, তিনি তার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন-নরম মেয়েগুলি কঠিন বিপদ সামাল দিতে পারে। শক্ত মেয়েগুলি পারে না। চিৎ হয়ে পড়ে যায়। এই শক্তের একটা গেরাইম্যা নাম আছে-চিৎ শক্ত।

আম্মা, চা নেন।

আকলিমা বেগম চায়ের কাপ হাতে নিলেন। শহরে এলে তার চা খাবার রোগে ধরে। বেঁটা এই ভয়ংকর সময়েও চা বানিয়েছে, এটা ভাল লক্ষণ। মন শক্ত আছে। আসল বিপদ সামাল দিতে পারবে।

বৌমা বাজে কয়টা?

দুইটা পঁচিশ।

রাইত কাটতে বেশী দিরং নাই–তুমি ভাত খাইছ?

হুঁ।

তুমি ভাত খাও নাই–মিছা কথা বলছি। মুরুব্বির সাথে মিছা কথা বলা ঠিক না। যাই হউক, চেয়ার টান দিয়া আমার সামনে বও, তোমার লগে আলাপ আছে।

সুরাইয়া চেয়ার টেনে বসল। কেন জানি তার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।

বউমা মন দিয়া শোন–আমি একটা গনা গনছি। গনার মধ্যে পাইছি হাসান ভাল আছে। কাজেই মন খারাপ করবা না। সে আসব সক্কালে।

কি গনা-গুনেছেন?

সেইটা তুমি বুঝবানা—আমি পুরান কালের মানুষ আমি অনেক গনা জানি।

আকলিমা বেগম কোন গনা জানেন না। বাচ্চা মেয়েটার মন শান্ত করার জন্যে কিছু মিথ্যা কথা বলা। এই মিথ্যা বলার জন্যে তাঁর পাপ হচ্ছে—আবার মেয়েটার মন শান্ত করায় পূণ্য হচ্ছে। পাপ-পূণ্যে কাটাকাটি হয়ে সমান সমান।

ইমন জেগে উঠেছে। কাঁদছে। তাকে বাথরুম করাতে হবে। সুরাইয়া ছেলের কাছে গেল। আকলিমা বেগম আরাম করে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। ছেলে ফিরছে না। এই দুঃশ্চিন্তা এখন আর তার মাথায় নেই। গনার ব্যাপারে যা বলেছেন তা সর্বৈব্য মিথ্যা। বাচ্চা মেয়েটাকে শান্ত করার জন্যেই বলা। বউটা তাকে দেখতে না পারলেও তিনি তাকে খুবই পছন্দ করেন। মেয়েটার মনে দরদ আছে। স্বামীর জন্যে সে খুবই ব্যস্ত। আকলিমা বেগমের ঘুম পাচ্ছে। তিনি বারান্দা থেকে উঠলেন। কিছুক্ষণ ঘুমালেও কাজে আসবে। সকালে কোন ভয়ংকর সংবাদ এসে উপস্থিত হয় কে জানে।

ইমন বাথরুম করল। পানি খেল। সব কিছুই ঘুমের মধ্যে। সুরাইয়া তাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। ঘুমের মধ্যেই সে বিড় বিড় করে কথা বলছে। আবার মাঝে মাঝে দাঁত কট কট করছে। পেটে কৃমি হয়েছে না-কি? যে ভাবে চিনি খায় পেটে কৃমি হওয়া বিচিত্র না। সুরাইয়া ক্লান্ত গলায় ডাকল—ও বাবু, ও বাবু! ইমন ঘুমের মধ্যেই বলল, কি ৷

তোমার বাবা এখনো আসছে না কেন গো বাবু?

উঁ।

আমার খুব অস্থির লাগছে গো সোনা।

ইমন আবারো বলল, উ। আর তখনি বারান্দায় রাখা পানির বালতি থেকে পায়ে পানি ঢালার শব্দ হল। এই শব্দ সুরাইয়ার পরিচিত শব্দ। ইমনের বাবা বাইরে থেকে এলেই প্রথম যে কাজটা করে-বালতি থেকে পানি নিয়ে পায়ে ঢালে। তার জন্যে বালতি ভরতি পানি এবং একটা মগ বারান্দায় রাখা থাকে।

সুরাইয়ার শরীর ঝিম ঝিম করছে। ছুটে গিয়ে যে দেখবে সেই শক্তিও তার নেই। বারান্দায় যেতে ভয় লাগছে। গিয়ে যদি দেখে সে না, ইমনের দাদী নামাজের অজু করছেন। রাত বিরাতে অজু করার অভ্যাস।

নামাজের জন্যে অজু করবেন, তারপর নামাজ পড়তে ভুলে যাবেন।

সুরাইয়া উঠল। বারান্দায় এসে দাঁড়াল।

ইমনের বাবা না, ফিরোজ। বালতি থেকে পানি নিয়ে পায়ে ঢালছে। ফিরোজ বলল, কি হয়েছে ভাবী? এ ভাবে তাকিয়ে আছ কেন?

সুরাইয়া জবাব দিতে পারল না, তার মাথা ঘুরে উঠল। সে হাত বাড়িয়ে দেয়াল ধরতে চেষ্টা করল। ধরতে পারল না। ফিরোজ ছুটে এসে ধরে ফেলার আগেই মেঝেতে পড়ে গেল।
 
০২.

ইদানীং ফিরোজের একটা সমস্যা হচ্ছে—রিকশায় চড়তে পারে না। রিকশায় চড়লেই মনে হয় কান্ত হয়ে রিকশা পড়ে যাবে। সে ছিটকে পড়বে রিকশা থেকে। তাকে রাস্তা থেকে টেনে তোলার আগেই পেছনে সমগ্র বাংলাদেশ সাত টন লেখা একটা ঘাতক ট্রাক তাকে চাপা দিয়ে চলে যাবে। মৃত্যুর আগ মুহতে সে পট-পট জাতীয় মুড়িভাজার মত শব্দ শুনবে। শব্দটা ট্রাকের চাকার নিচে তার মাথার খুলি ভাঙ্গার শব্দ। মৃত্যুর আগের মুহুর্তে যে গন্ধ তার নাকে ঢুকবে সে গন্ধটা হল— পেট্রোলের গন্ধ এবং ট্রাকের চাকার গন্ধ। শেষ দৃশ্য হিসেবে দেখবে ট্রাকের মাডাগার্ড।

ফিরোজ বুঝতে পারছে তার মানসিক কিছু সমস্যা হচ্ছে। সমস্যাটা মনে হয় বাড়ছে। রিকশায় উঠেই সে সারাক্ষণ পিছন দিকে তাকিয়ে থাকে। এই বুঝি ট্রাক এল। বিদেশে এ জাতীয় সমস্যা হলে লোকজন আতংকে অস্থির হয়ে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে চলে যেত। বাংলাদেশে এরচে ভয়াবহ সমস্যা নিয়ে লোকজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো ঘোরাফেরা করে। সে যেমন করছে। ফিরোজের ধারণা সে পুরোপুরি না হলেও অস্বাভাবিক একজন মানুষ যে রিকশা পছন্দ করে না, তারপরেও প্রায় সারাদিনই রিকশার উপর থাকে। রিকশা ভাড়া করে ঘণ্টা হিসেবে। সারাদিনের জন্যে ভাড়া করলে সস্তা পাওয়া যায়। সূর্যোদয় থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভাড়া ২০০ টাকা। দুপুরের খাবার, বিকেলের নাস্তা এবং মাঝে মধ্যে চা এই ২০০ টাকার বাইরে। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার ফিরোজ সারাদিনের জন্যে রিকশা ভাড়া করেছে। আজও করেছে। গত কয়েক মাস ধরে তাকে বিচিত্র সব জায়গায় অদ্ভুত অদ্ভুত সময়ে যেতে হচ্ছে। আজ দুপুর দুটািয় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে সে দেখা করবে। ভদ্রলোকের নাম রকিব। তিনি নাকি থিওসফিক্যাল সোসাইটির সদস্য। বিখ্যাত মিডিয়াম। হারানো মানুষ সম্পর্কে অনেক কিছু বলতে পারেন। অনেকের অনেক হারানো ছেলে পুলে সম্পর্কে নির্ভুল সংবাদ দিয়েছেন। ভদ্রলোক ফ্রড না, কারণ তিনি টাকা পয়সা নেন না। তবে ফ্রড না হলেও বিরক্তিকর মানুষতো বটেই। কয়েকদিন পর পর আসতে বলেন, এবং অদ্ভুত অদ্ভুত সময়ে আসতে বলেন। দুপুর দুটা, বিকাল সাড়ে তিনটা। ভদ্রলোক কথা বলতে পছন্দ করেন। সব কথাবার্তাই পরকাল, মন্ত্র-তন্ত্র, ভূত-প্ৰেত বিষয়ক। দুপুর বেলা ভূত-প্রেতের কথা শুনতে ভাল লাগে না। ফিরোজ গম্ভীর মুখে শুনে যায়। গরজটা তার।

গত কয়েক মাসে ফিরোজের কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। তার ধারণা এই অভিজ্ঞতা না হলেও কোন ক্ষতি ছিল না। প্রথম অভিজ্ঞতা হল— মানুষের মূল্য খুবই সামান্য। দশ হাজার টাকা হারিয়ে গেলে কুড়ি বছর পরেও সেই টাকার শোকে মানুষ কাতর হয়। মানুষ হারিয়ে গেলে কুড়ি দিন পরই আমরা মোটামুটিভাবে তাকে ভুলে যাবার চেষ্টা করি।

দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা হচ্ছে হারানো মানুষ খুঁজে বের করার কোন পদ্ধতি বাংলাদেশে নেই। থানায় গেলে পুলিশ অফিসার বিরক্ত মুখে বলেন– জিডি এন্ট্রি করুন। বলেই তিনি হাই তুলেন। মানুষ হারানোর সংবাদ পুলিশের কাছে হাই তোলার মত ব্যাপার। ফিরোজ থানার সেকেন্ড অফিসারের হাই অগ্রাহ্য করেই জিডি এন্ট্রি করিয়েছিল। তারপর জিজ্ঞেস করেছিল, এখন কি?

সেকেন্ড অফিসার বিস্মিত হয়ে বললেন, এখন কি মানে?

জিডি এন্ট্রিতো করানো হল— এখন আপনারা কি করবেন?

আমরা একশান নেব।

কি একশান নেবেন?

কি একশান নেব সেটাতো আমাদের ব্যাপার। আপনার কিছু না।

ফিরোজ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল— আমি আসলে জানতে চাচ্ছি।–নিখোঁজ মানুষের বিষয়ে আপনারা কি করেন।

সব থানায় ইনফর্ম করা হয়।

তারপর?

তারপর মানে?

সব থানায় আপনারা জানালেন-তারপর থানাগুলি থেকে কি করা হয়।

সেকেন্ড অফিসার বিরক্ত হয়ে বললেন, সত্যি কথা জানতে চান? কিছুই করা হয় না।

কিছুই করা হয় না?

কি করা হবে? আপনার কি ধারণা থানার স্টাফ হারিকেন জ্বলিয়ে আপনার ভাইকে খুঁজতে বের হবে? খুন-ধর্ষণ-ডাকাতি দেখেই এরা কুল পায় না মানুষ খুঁজে বেড়াবে কখন?

রেকর্ডের জন্যে দেই! একটা রেকর্ড থাকল। থানার রেকর্ডের গুরুত্ব অনেক বেশী। এই রেকর্ড থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বের হয়ে আসে। এমনওতো হতে পারে যে আপনি আপনার ভাইকে খুন করে ডেডবডি গুম করে থানায় এসে জিডি এন্ট্রি করালেন ভাই মিসিং। হতে পারে না?

জ্বি না, হতে পারে না।

আপনার কাছে হতে পারে না, কিন্তু অনেকের কাছে হতে পারে। আমার চাকরি বেশীদিন হয় নি—এর মধ্যেই এ ধরনের কেইস গোটা দশেক দেখেছি।

বলেন কি?

খুব বেশী দুঃশ্চিন্তা করবেন না। অল্প বয়েসী মেয়ে-টেয়ে হারিয়ে গেলে টেনশানের ব্যাপার থাকে। মেয়েরা ব্রেথেলে চলে যায়। বিদেশে চলে যায়। যৌনকামী হিসেবে বিদেশে বাংলাদেশী মেয়েদের সুনাম আছে।

কি বলছেন এসব?

শুনতে খারাপ লাগছে? সত্যি কথা শুনতে সব সময় চিরতার পানির মত লাগে। চিরতার পানি খেয়েছেন? না খেলে খাবেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খেতেন। শরীরের জন্যে ভাল। শরীরটা ভাল রাখুন—Health is Wealth.

তাহলে আমি কি ধরে নেব— আপনারা আমার নিখোজ ভাই সম্পর্কে কিছু করবেন না?

কিছুই ধরে নেবেন না। একটা ভাল উপদেশ দেই শুনুন— ভাইয়ের ছবি দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে থাকুন। চালু পত্রিকাগুলিতে প্রতিদিন বিজ্ঞাপন দিন। খবৰ্দার, কোন পুরস্কার ঘোষণা করবেন না। পুরস্কার ঘোষণা করেছেন কি মরেছেন। জীবন অতিষ্ট হয়ে যাবে। ভাল একটা উপদেশ ফি ছাড়া আপনাকে দিলাম।

গত কয়েক মাসে ফিরোজের অন্যতম ও প্রধান কাজ হয়েছে উপদেশ শোনা। এবং প্রতিটি উপদেশ মানার চেষ্টা করা। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে। শুরুতে প্রতিদিন। তারপর সপ্তাহে একদিন। তারপর একটি পত্রিকায় প্রতি পনেরো দিনে একবার। শুধু দেশী পত্রিকায় না—একজনের উপদেশ শুনে কোলকাতার আনন্দবাজার এবং স্টেটসম্যানেও বিজ্ঞাপন দিয়েছে।

আরেকজনের উপদেশ শুনে জাতিসংঘের মিসিং পারসন বুরোতে কুড়ি ডলার খরচ করে নাম এন্ট্রি করিয়েছে। এরা যুদ্ধ বিধ্বস্ত অঞ্চল এবং শরণার্থী মিসিং পারসনের তালিকা তৈরী করে।

একজন ফিরোজকে বলল ( ফিসফিসানি গলায় ) পাসপোর্ট অফিসে খোজ নাও তোমার ভাই রিসেন্টলি কোন পাসপোর্ট করিয়েছে কি-না। মানুষের ভেতরে অনেক জটিলতা থাকে— চট করে বোঝা যায় না। আমি একজনকে জানি ফ্যামিলী ম্যান। স্ত্রী-পুত্ৰ-কন্যার জন্যে অসীম মমতা। হঠাৎ সে মিসিং পারসন হয়ে গেল। পাসপোর্ট অফিসে খোজ নিয়ে জানা গেল সে পাসপোর্ট করিয়েছে। সেই পাসপোটের সূত্র ধরে জানা গেল সে চলে গেছে অস্ট্রেলীয়ায়। খুব পাকাপাকিভাবে গিয়েছে ইমিগ্রেশন নিয়ে। অন্য একটা মেয়েকে বউ হিসেবে নিয়ে গেছে। কাজেই আমার মতে পাসপোর্ট অফিসে খোজ নেয়া খুবই জরুরী। অফিসিয়েলী এইসব কাজে অনেক সময় লাগে। দালাল ধরলে এক সপ্তাহের মধ্যে জানতে পারবে। হাজার খানিক টাকা খরচ হবে।

হাজার খানিক না— ফি রোজের তিন হাজার টাকা খরচ হল। তিন হাজার টাকার বিনিময়ে জানা গেল— হাসানুজ্জামানের নামে কোন পাসপোর্ট ইসু হয়নি।

একজন গম্ভীর মুখে বলল— মেডিক্যাল কলেজগুলির ছাত্ৰ-ছাত্রীদের জন্যে ডেড বডি কেনা হয় আপনি জানেন? সাধারণত কেনা হয় বেওয়ারিশ লাশ। বেওয়ারিস লাসের একটা ভাল মার্কেট বাংলাদেশে আছে। ঐসব জায়গায় খোজ নিয়েছেন? খোজটা নিতে হবে গোপনে। ডোমদের মাধ্যমে। এইসব বিজনেসে অনেক হ্রস হাস ব্যাপার আছে।

তুস হাস ব্যাপার মানে?

ফিসি ব্যাপার। আমার এক দূর সম্পর্কের রিলেটিভ, সম্পর্কের চাচা-তাঁর বড় ছেলে হঠাৎ হারিয়ে গেল। ওদের টাকা পয়সার কোন অভাব ছিল না। বিরাট ক্ষমতাবান। এরা প্ৰায় তোলপাড় করে ফেলল। যাকে বলে কম্বিং অপারেশন। শেষে ছেলেটার ডেড বডি কোথায় পাওয়া গেল জানেন?

কোথায়?

মেডিক্যাল কলেজের ডিসেকসান রুমে। ছাত্ৰ-ছাত্রীরা ডেডবডি কাটাকুটি করছে— লিভার এক জায়গায়, কিডনী আরেক জায়গায়। হার্ট আরেক গামলায়। কাজেই খোঁজ খবর যখন করছেন ভালমত করেন— Leave no stone unturned.

ফিরোজ এখন ক্লান্ত এবং বিরক্ত। বিরক্তিটা কার উপর সে জানে না। সম্ভবত তার ভাইয়ের উপর। মানুষটা হারিয়ে গিয়ে সবচে বড় বিপদে তাকে ফেলে দিয়ে গেছে। দুপুর দুটায় ক্ষিধে পেটে পৃথিবীর সবচে বোরিং মানুষটার সামনে তাকে হাসিমুখে বসে থেকে— পরকাল, ইএসপি, ক্লেরিওভান্স, এসট্রেল, প্রজেকসন সম্পর্কে গল্প শুনতে হচ্ছে। কোন মানে হয়? কোন মানে হয় না। ফিরোজের এখন ইচ্ছা করে নিজেরই নিরুদেশ হয়ে যেতে। এক সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে চা খাবে। চায়ের সঙ্গে সিগারেট। তারপর ভাল একটা পায়জামা পাঞ্জাবী পরে হাসি মুখে ঘর থেকে বের হওয়া এবং আর ফিরে না আসা।



রকিব সাহেব বাসায় ছিলেন। একটা বাচ্চা ছেলে এসে বলল, আব্ববুর জ্বর শুয়ে আছে। ফিরোজ বলল, আমি কি চলে যাব? ছেলেটি বলল, আপনাকে বসতে বলেছে।

রকিব সাহেব এক ঘণ্টা পর গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে উপস্থিত হলেন। ফিরোজ উঠে দাঁড়িয়ে বিনয়ের সঙ্গে বলল, আপনার নাকি জুর?

রকিব সাহেব বললেন, শরীরটা একটু খারাপ যাচ্ছে। পর পর কয়েকদিন রাত জাগলাম। বয়স হয়েছে আগের মতো রাত জগতে পারি না।

ফিরোজ বলল, আমার ভাইয়ের ব্যাপারে কোন ইনফরমেশন কি পেয়েছেন?

রকিব সাহেব হাসি মুখে বললেন—— চেষ্টা করছি। মনে হচ্ছে পেয়ে যাব। আমাদের ইনফরমেশন গোদারিং টেকনিকটা একটু আলাদা। আমাদেরতো ফ্যাক্স মেইল, ই মেইল নেই। আমাদের যোগাযোগটা হয় মানসিক ভাবে সময় লাগে।

জ্বি, বুঝতে পারছি।

না, বুঝতে পারছেন না। বোঝাটা এত সহজ না। একটা ঘটনা বলি শুনুন। ঘটনা শুনলে আমাদের যোগাযোগ পদ্ধতিটা সম্পর্কে আপনার ধারণা হবে।

রকিব সাহেবের যোগাযোগ পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা নেবার কোন ইচ্ছা! ফিরোজের নেই। সে এখন পুরোপুরি নিশ্চিত পুরো ব্যাপারটাই ভাওতাবাজি। ক্ষিধেয় তার নাড়িভুড়ি হজম হয়ে আসছে। মাথা ঘুরছে। তার উচিত এই বাড়ি থেকে বের হয়েই সোজা কোন রেস্টুরেন্টে ঢুকে গরুর ভুনা মাংস এবং গরম গরম পরোটার অর্ডার দেয়া। সঙ্গে কাটা পেয়াজ থাকবে। মাঝে মধ্যে পেয়াজে কামড়। প্রচন্ড ক্ষিধের সময় হঠাৎ হঠাৎ কিছু খাবার খেতে ইচ্ছে করে। আজ পরোটা গোসত খেতে ইচ্ছা করবে। অন্য কোনদিন অন্য কোন খাবার খেতে ইচ্ছে করবে।

ফিরোজ সাহেব!

জ্বি।

আপনার কি শরীর খারাপ না-কি? চেহারা কেমন যেন মলিন লাগছে।

জ্বি না, শরীর ভাল আছে।

চা খান। চা খেতে খেতে গল্প করি। আপনার মনের শান্তির জন্যে বলে রাখি–আপনার ভাই-এর ব্যাপারে। আমি অনিতাকে বলেছিলাম। অনিতা আমাদের থিওসফিক্যাল সোসাইটির সদস্য, অত্যন্ত পাওয়ারফুল মিডিয়াম। সে আমাকে জানিয়েছে এক সপ্তাহের মধ্যে পজিটিভ কিছু বলতে পারবে।

আমি কি এক সপ্তাহ পরে আসব?

আসুন। আগামী বুধবারে আসুন। রাত দশটার পর আসুন। অসুবিধা হবে নাতো?

জ্বি না।

ঐ রাতে আমাদের একটা সিয়েন্সও হবে। ইচ্ছে করলে অবজার্ভার হিসেবে থাকতে পারেন। সোসাইটির বাইরের কারোর থাকার অবশ্যি নিয়ম নেই। তবে আপনার ব্যাপারে আমি বলে টলে ব্যবস্থা করে রাখব।

জি আচ্ছা।

এখন শুনুন, আমার জীবনের একটা অদ্ভুত ঘটনা। চার বছর আগের কথা। অক্টোবর মাস। তারিখটা হল ৯ তারিখ। সন্ধ্যাবেলা এক ভদ্রলোক এসে উপস্থিত হলেন। বছর দুই আগে তাঁর একটা মেয়ে মারা গেছে। কিছুদিন হল রোজ মেয়েটাকে স্বপ্ন দেখছেন। মৃতা মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চান। আমরা কোন ব্যবস্থা করে দিতে পারি কি-না। তিনি সঙ্গে করে মেয়ের কিছু ব্যবহারী জিনিসপত্র নিয়ে এসেছেন। মেয়ের ছবি এনেছেন। তার হাতে লেখা ডাইরী এনেছেন। আমি বললাম, রেখে যান দেখি কিছু করা যায় কি-না। মৃত মানুষের আত্মাকে চক্রে আহবান করা কঠিন কিছু না। তবে অল্প বয়সে মারা গেলে সমস্যা হয়। প্লানচেটে বা চক্রে শিশুদের আহবান করার নিয়ম নেই।

আহবান করলেও তারা আসে না।

ফিরোজ জড়ানো গলায় বলল— ও। ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসছে। মনে হচ্ছে যে কোন মুহুর্তে সোফায় সে এলিয়ে পড়বে এবং তার নাক ডাকতে শুরু করবে। ভদ্রলোক একটা ভয়ংকর গল্প ফেদেছেন, এরমধ্যে নাক ডাকানো ভয়াবহ ব্যাপার হবে। ঘুম কাটানোর কিছু পদ্ধতি সে ব্যবহার করছে – লাভ হচ্ছে না। উল্টা আরো ঘুম পাচ্ছে। সব পদ্ধতিই কোন না কোন সময়ে ব্যাক ফায়ার করে–উল্টো দিকে চলা শুরু করে। তার বেলায় এখন তাই হচ্ছে।

ভয়ংকর কোন ঘটনার কথা ভাবলে ঘুম কেটে যায়। সে ভাবছে— বাসায় পৌঁছেই দেখবে তার মা আকলিমা বেগম আঁকা বঁকা অক্ষরে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন–চিঠির প্রতিটি সংবাদই দুঃসংবাদ। বাবা ফিরোজ, তুমি জমি বিক্রি করিয়া টাকা পাঠাইতে বলিয়াছ। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করিতেছি। লোকজনের হাতে এখন টাকা নাই। জমি কিনিবার ব্যাপারে কাহারো আগ্ৰহ নাই। তুমি মহা বিপদে পরিয়াছ ইহা আমি জানি– কিন্তু কি করিব আমি নিরুপায়।…

ফিরোজ সাহেব!

জ্বি স্যার।

আপনার জুর-টির আসছে না-কি? চোখ লাল।

বোধ হয় জ্বর আসছে–আজি বরং উঠি।

গল্পের শেষটা শুনে যান। শেষটা না শুনলে মনের উপর চাপ থাকে। এই চাপ মানসিক শান্তির জন্যে ক্ষতিকর। তারপর কি হল শুনুন— আমরা কয়েকটা সিয়েন্স করলাম এবং প্রতিবারই রিডিং পেলাম মেয়েটা জীবিত। মৃত নয়। বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা?

জ্বি।

আমার নিজের ধারণা হল আমরা কিছু ভুল করছি। আত্মার অনেকগুলি স্টেট থাকে। নানান স্তরে তাদের বাস। পৃথিবীর কাছাকাছি যারা থাকে তাদের

ফিরোজ বাসায় পৌঁছল। জ্বর নিয়ে। তার ঝোঁপে জ্বর এসেছে। জ্বর আসায় একটা সুবিধাও হয়েছে—পরোটা গোসতের ব্যাপারটা মাথা থেকে চলে গেছে। এখন ইচ্ছা করছে কাঁথার ভেতর ঢুকে পড়তে। দরজা জানালা বন্ধ করে কাঁথার ভেতরে ঢুকে কুণ্ডুলী পাকিয়ে যাওয়া। মোটামুটি মাতৃগর্ভের মত একটা পরিবেশ তৈরি করে জন্মের আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া। এই স্টেটেরও নিশ্চয় কোন নাম আছে। থিওসফিস্ট রকিব সাহেব বলতে পারবেন।

দরজা খুলে দিল ইমন। সে দরজা খোলা শিখেছে। চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে সিটিকিনি খুলতে পারে। এবং এই কাজটা খুব আগ্রহের সঙ্গে করে। ফিরোজ বলল, খবর কিরে?

ইমন বলল, মা তোমাকে ডাকে।

ফিরোজ বিরক্তমুখে বলল, মা আমাকে ডাকবে কিরে ব্যাটা, আমিতো এইমাত্র ঢুকলাম। ভাবীতো জানেই না। আমি এসেছি।

ইমন আবারো বলল, মা তোমাকে ডাকে।

ইমনের মধ্যে রোবট টাইপ কিছু ব্যাপার আছে। মাথার ভেতর কিছু ঢুকে গেলে সেটাই বলতে থাকে। ফিরোজ বলল, যাচ্ছি। হাত মুখ ধুয়ে তারপর যাই। বুঝলিরে ব্যাটা, শরীর ভাল না। থার্মোমিটার না দিয়েও বুঝতে পারছি— একশ তিন জ্বর।

মা তোমাকে এখনই ডাকে।

ফিরোজ সুরাইয়ার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। খাটে বিছানো শাদা চাদর রক্তে মাখামাখি। চাদর থেকে গড়িয়ে মেঝেতেও ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে। সুরাইয়ার মুখ ছাই বর্ণ। প্রচণ্ড ব্যথা সে নিজের মধ্যে চেপে রাখছে তা বোঝা যাচ্ছে শুধু তার কণ্ঠার হাড়ের ওঠানামা দেখে।

ভাবী, কি হয়েছে?

সুরাইয়া ফিস ফিস করে বলল— বুঝতে পারছি না। বোধ হয় এবোরশন হয়ে যাচ্ছে।

কি সর্বনাশের কথা। ভাবী আমি এক্ষুনি এম্বুলেন্স নিয়ে আসছি। তুমি আর কিছুক্ষণ। এইভাবে থাক।

সুরাইয়া জবাব দিল না। ঘোলাটে চোখে তাকাল। সেই ঘোলাটে চোখের দিকে তাকিয়ে ফিরোজের মনে হল— এম্বুলেন্স আনতে গিয়ে সময় নষ্ট করা যাবে না। এত সময় হাতে নেই। তাকে যা করতে হবে তা হচ্ছে ভাবীকে পাজাকোলা করে নিয়ে এক্ষুনি রাস্তায় চলে যেতে হবে।— কোন একটা বেবী টেক্সিতে উঠে বেবী টেক্সীওয়ালাকে বলতে হবে–তাড়াতাড়ি মেডিকেলে নিয়ে যাও। তাড়াতাড়ি।



কোলে নিয়ে বসে আছে। ফিরোজের পাশে ইমন। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে না–সে খুব ভয় পাচ্ছে। সে অবশ্যি তার মায়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছেও না। সে বেবীটেক্সীর সাইডের আয়নাটার দিকে তাকিয়ে আছে। এই আয়নায় বেবীটেক্সীওয়ালার মুখ দেখা যাচ্ছে। বেবীটেক্সীওয়ালার মুখ দেখতে ভাল লাগছে। কেমন গোল মুখ। চোখ দুটিও মার্বেলের মত গোল। এর মধ্যে একবার সে শুধু তার ছোট চাচার দিকে তাকিয়েছে। ছোট চাচা খুব কাঁদছেন। শব্দ করে কাঁদছেন না–তবে তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। ছোট চাচার কান্না দেখে তার মনে হচ্ছে— মা মারা গেছেন। এখন থেকে সকালে কে তাকে স্কুলে নিয়ে যাবে? ছোট চাচা? স্কুল থেকে ফেরত নেবার সময় ছোট চাচা সময় মত আসবে তো? দেৱী করে এলে তার খুব খারাপ লাগবে। কষ্ট হবে।



সুরাইয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল সন্ধ্যা ছটায়। রাত তিনটায় ডাক্তাররা তাকে অপারেটিং রুমে নিয়ে গেলেন। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল না। রুগী সম্পর্কে তারা খুব আশাবাদী। কিছু একটা করতে হয় বলেই অপারেটিং রুমে নিয়ে যাওয়া।

ইমন একটা বেঞ্চে একা একা বসেছিল-এত রাত হয়েছে তারপরেও সে জেগে আছে। ঘুম পাচ্ছে না। ছোট চাচা তাকে একটা কলা একটা বনরুটি কিনে দিয়েছেন। সে কলা এবং বনরুটি হাতে বসে আছে। ছোট চাচা খুব দৌড়াদৌড়ির মধ্যে আছেন। একবার ডাক্তারের কাছে যাচ্ছেন, একবার ওষুধ কিনতে যাচ্ছেন, একবার যাচ্ছেন রক্তের জন্যে। তবে কিছুক্ষণ পর পর এসে ইমানকেও দেখে যাচ্ছেন।

ভোর চারটায় ছোট চাচা এসে ইমানকে বললেন–ইমন তোর একটা বোন হয়েছে। তোর বোনটা ভাল আছে, তোর মাও ভাল আছে। আর কোন চিন্তা নেই।

ইমন বলল, বোনটার নাম কি?

নাম এখনো রাখা হয় নি।

নাম রাখা হয় নি কেন?

ছোট চাচা সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ক্লান্ত গলায় বললেন— আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। বেঞ্চিতে লম্বা হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ব। তুই কলাটা এখনো খাস নি?

না।

আমাকে দে খেয়ে ফেলি–ক্ষিধেয় চোখে অন্ধকার দেখছি।

ফিরোজ কলা খেয়ে বেঞ্চিতে শুয়ে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়েও পড়ল। ইমন ছোট চাচার মাথার কাছে জেগে বসে রইল। তার মনে হচ্ছে জেগে থাকাটা খুব দরকার। বেঞ্চটার পাশে চওড়া কম। ছোট চাচা যে কোন সময় গড়িয়ে পড়ে যেতে পারেন। পাহারা দেয়ার জন্যে তাকে জেগে থাকতে হবে।

তার একটা বোন হয়েছে। অথচ তার নাম রাখা হয় নি এই চিন্তাটাও তাকে অভিভূত করছে। সবারই নাম আছে শুধু তার বোনটার কোন নাম নেই। যদি নাম রাখতে ভুলে যায়, যদি কোনদিনই তার নাম না রাখা হয় তাহলে কি হবে? মন খারাপ করে বেচারী ঘুরে বেড়াবে। কেউ তাকে খেলতে ডাকবে না— কি করে ডাকবে, মেয়েটারতো নামই নেই।

চোখে এক ফোঁটা পানি আসে নি—এখন এই ভোর রাতে বোনটার দুঃখে। তার চোখে পানি এসে গেল। সে যতবারই সার্টের হাতায় চোখ মুছে ততবারই চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে যায়। তার একটা বোন হয়েছে সেই বোনটার নাম নেই কেন?
 
০৩.


ইমন ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তার হাতে চিকন করে কাটা এক টুকরা শশা। ছোট চাচা বলেছেন কচ্ছপের বাচ্চারা শশা খায়। ইমনের ধারণা কচ্ছপের বাচ্চারা শশা খায় না। সে অনেকক্ষণ ধরেই শশা হাতে বসে আছে তার কাছ থেকে তো খাচ্ছে না। বরং শশার টুকরা মুখের কাছে ধরতেই এরা মুখ হাত পা খোলসের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলছে। মনে হচ্ছে শশা ওদের জন্যে ভয়ংকর কোন খাবার। মানুষের বাচ্চাদের কাছে দুধ যেমন ওদের কাছে শশাও তেমন।

কচ্ছপের বাচ্চা দুটা ইমনের জন্যে এনেছে তার ছোট চাচা। এরা বেশীর ভাগ সময় থাকে বাথরুমে লাল প্লাষ্টিকের বালতিতে। মাঝে মাঝে ইমনের যখন খেলতে ইচ্ছে করে তখন সে বালতি থেকে তুলে আনে। পানি থেকে তোলার সময় তার একটু ভয় ভয় করে। কামড় দেয় কি-না। এখন পর্যন্ত কামড় দেয়নি। ছোট চাচা বলেছেন–কচ্ছপের বাচ্চাদের দাঁত নেই বলে তারা কামড়ায় না। যখন তারা বড় হবে, দাঁত উঠবে তখন কামড়াবে। তখন তাদের আর বালতিতে রাখা যাবে না–নদীতে ফেলে দিয়ে আসতে হবে। যে নদীতে কচ্ছপ ফেলা হবে সেই নদীর নাম বুড়িগঙ্গা। ঢাকা নগরী বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত।

ইমনের আজ স্কুল নেই। সে সকাল থেকেই কচ্ছপের বাচ্চা নিয়ে খেলছে। এদের সে নামও দিয়েছে—বড়টার নাম টম, ছোটটার টমি। এরা দুজন একসঙ্গে থাকলেও দুজনের মধ্যে কোন মিল নেই। শুকনায় ছেড়ে দেয়া মাত্র দুজন দুদিকে হাঁটতে থাকে। ইমন বই এ পড়েছিল কচ্ছপরা আস্তে হাঁটে। এখন সে জানে এটা মিথ্যা কথা। এরা চারপায়ে বেশ দ্রুত হাঁটে। মুহুর্তের মধ্যে ঘরের কোনায় চলে যায়। তাদের তখন খুঁজে পাওয়াই মুশকিল হয়। সবচে বেশী দ্রুত হাটে টমি। ইমন ভেবে রেখেছে তার ছোট বোনটা যখন আরেকটু বড় হবে তখন তাকে সে একটা কচ্ছপের বাচ্চা দিয়ে দেবে। ইমনের ছোট বোনের নাম— সুপ্ৰভা। মা বলেছেন, সুপ্ৰভা নামের মানে হচ্ছে—সুন্দর সকল! Good Morning, কিন্তু ছোট চাচা বলেছেন সুপ্ৰভা মানে সুন্দর আলো। কারটা ঠিক সে জানে না। ইমন ঠিক করে রেখেছে কোন একদিন সে তাদের মিসকে জিজ্ঞেস করবে।

সুপ্ৰভা এখনো খুবই ছোট। বেশীর ভাগ সময় সে ঘুমিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে তার কাঁদতে ইচ্ছে করে তখন সে কাদার জন্যে জাগে। খানিকক্ষণ কেঁদে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ইমন তার সারা জীবনেও এমন কাদুনে বাচ্চা দেখেনি। সবচে মজার ব্যাপার হচ্ছে সুপ্ৰভা কারো উপর রাগ করে বা ব্যথা পেয়ে কাঁদে না। কোন রকম কারণ ছাড়া কাঁদে। সুপ্রভার কান্না দেখতে ইমনের খুব ভাল লাগে। সে মাঝে মাঝে সুপ্রভার কান্না দেখতে যায়। কিন্তু বেশীক্ষণ দেখতে পারে না, কারণ তার মা কঠিন গলায় বলেন, এখানে কি করছ? যাওতো—অন্য খানে যাও। আশ্চর্য, এত বিরক্ত করে।

আগে ইমন কখনো তার মাকে ভয় পেত না, এখন পায়। কারণ মার মেজাজ। সারাক্ষণ খারাপ থাকে। আগে মা তাকে পড়াতে বসতো—এখন বসায় না। সে যদি বই খাতা নিয়ে মার কাছে যায়—ম বলে, অনেক বিরক্ত করেছ। এখন যাও তো। অথচ সে কাউকেই বিরক্ত করে না। এমন কি কচ্ছপগুলিকেও না। কোন কচ্ছপ যদি দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকে—সে তাকে লুকিয়ে থাকতে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বের করে আনে না। ওরা কচ্ছপ হলেও ওদেরও হয়ত লুকোচুরি খেলতে ইচ্ছা করে। সে কেন ওদের খেলা নষ্ট করবে?

হোম ওয়ার্ক করার জন্যে সে এখন যায় ছোট চাচার কাছে। ছোট চাচা তাকে মোটামুটি আদরই করেন। তিনি তার নাম দিয়েছেন—হার্ড নাট। হার্ড মানে হচ্ছে শক্ত, আর নাট হল বাদাম। হার্ড নাট হল শক্ত বাদাম। ছোট চাচা তাকে কেন শক্ত বাদাম বলে তা সে জানে না। কখনো জিজ্ঞেস করে নি। কোন একদিন জিজ্ঞেস করবে। ছোট চাচা পড়াতে পড়াতে প্রায়ই বলে—কিরে হার্ড নাট, মন খারাপ?

সে বলে, না। কারণ তার মন খারাপ থাকে না, আবার মন ভালও থাকে না। সুপ্রভার সঙ্গে সে যদি গল্প করতে পারত। তাহলে তার মন ভাল থাকতো। বা মার সঙ্গে গল্প করতে পারলেও মন ভাল থাকতো। মা গল্পতো করেই না, সামনে গিয়ে দাঁড়ালেও বলে–যা ভাগ। সামনে থেকে যা। শুধু বিরক্ত শুধু বিরক্ত। একদিন ঠাশ করে একটা চড় ও মারলেন, আচমকা মারলেন বলে সে মেঝেতে পড়ে গেল। ঠোঁট কেটে রক্ত বের হতে লাগল। তারপরেও সে একটুও কাঁদে নি, শুধু ডাক্তার যখন ঠোঁট সেলাই করতে গেলেন—তখন কাঁদল। তারপরেও ডাক্তার বললেন, বাহ দারুণ ছেলেতো। ছেলের খুব সাহস। ছোট চাচা বললেন, সাহস হবে না, এ হল হার্ড নাট! এ মোটেই সহজ জিনিস না।

রিকশায় ফেরার পথে ছোট চাচা তাকে আইসক্রিমের দোকানে নিয়ে গেলেন। কাপ আইসক্রীম কিনে দিয়ে বললেন, শোন হার্ড নাট। তোর মার মেজাজতো এখন খুব খারাপ থাকে। এখন তাকে বিরক্ত করবি না।

ইমন অবাক হয়ে বলল, আমিতো তাকে বিরক্ত করি না।

জানি তুই বিরক্ত করিস না। তারপরেও যখন বিরক্ত হয় তখন আমাদের উচিত একটু দূরে দূরে থাকা।

মার মেজাজ কখন ঠিক হবে চাচা?

তোর বাবা ফিরে এলেই মেজাজ ঠিক হবে।

বাবা কখন ফিরবে?

এখনো ঠিক বলা যাচ্ছে না। তবে ফিরবেতো বটেই। কত দিন আর বাইরে থাকবে?

বাবা এখন কোথায়?

আমরা এখনো ঠিক জানি না।—মনে হয় ইণ্ডিয়ায়।

ইণ্ডিয়াতে?

হুঁ। ইণ্ডিয়ার মধ্যপ্রদেশে। সেখানে খুব জঙ্গলতো। আমার মনে হয় বনে জঙ্গলে ঘুরছে। বাসার কথা একসময় মনে পড়বে তখন হুট করে চলে আসবে।

ইমনের ধারণা ছোট চাচা ঠিক কথা বলছেন না। বাবা ইণ্ডিয়ার মধ্যপ্রদেশে থাকলে ছোট চাচা গিয়ে বাবাকে নিয়ে আসতেন। বাবা অন্য কোথাও আছেন। খুব কাছেই কোথাও। ইমন যখন রিকশা করে স্কুলে যায় তখন তিনি হয়ত আড়াল থেকে দেখেন। তাদের স্কুলে যখন টিফিনের ছুটি হয় তারা মাঠে খেলতে থাকে তখনও তিনি দেখে যান। একদিন তিনি • চলে আসবেন এ ব্যাপারে ইমন নিশ্চিত। এত দেরী হচ্ছে কেন সে বুঝতে পারছে। না। বেশী দেরী হলে কচ্ছপগুলি দেখতে পারবেন না। কচ্ছপগুলি বড় হয়ে যাবে। তাদের ফেলে দিয়ে আসতে হবে বুড়িগঙ্গায়। ওরা নদীর পানির সঙ্গে ভাসতে ভাসতে চলে যাবে সমুদ্রে। বঙ্গোপসাগরে। সেখান থেকে ভারত মহাসাগরে। ভারত মহাসাগর থেকে প্ৰশান্ত মহাসাগরে। ছোট চাচা তাই বলেছেন।

বাবা সম্পর্কে লোকজন প্রায়ই তাকে জিজ্ঞেস করে। তাদের প্রশ্নের জবাব দিতে তার ভাল লাগে না। ভাল না লাগলেও সে সহজ ভাবেই জবাব দেয়। তাদের ক্লাসের মিস (মিস ফারজানা, দেখতে খুব সুন্দর।) একদিন টিফিন টাইমে তাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ইমন তোমার বাবা না-কি তোমাদের ছেড়ে চলে গেছেন?

ইমন বলল, উনি বেড়াতে গেছেন।

বেড়াতে গেছেন? কোথায় বেড়াতে গেছেন?

ইণ্ডিয়াতে— মধ্যপ্রদেশে।

মিস ফিক করে হেসে ফেলে বললেন, মধ্যপ্রদেশে? এত জায়গা থাকতে মধ্যপ্রদেশে কেন?

মধ্যপ্রদেশে অনেক বড় বড় জঙ্গল। বাবা জঙ্গল দেখতে গেছেন।

ও আচ্ছা, খুব ভাল কথা। উনি কি তোমার মার সঙ্গে রাগ করে চলে গেছেন?

জ্বি-না। বাবা কারোর সঙ্গে রাগ করে না।

তোমার মা, তিনি রাগ করেন?

জ্বি করেন।

কার সঙ্গে রাগ করেন?

বুয়ার সঙ্গে করেন, ছোট চাচার সঙ্গে করেন। মা রোগাতো এইজন্যে মার অনেক রাগ। রোগা মানুষদের খুব রাগ থাকে।

রোগা মানুষদের খুব রাগ থাকে এটা কে বলল?

ছোট চাচা বলেছেন। উনিও রোগা এই জন্যে উনারও খুব রাগ।

আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যাও।

ইমন মার রাগের জন্যে খুব ভয়ে ভয়ে থাকে। টিভিতে কার্টুন দেখার সময় সাউণ্ড খুব কমিয়ে দেয়। মা খুব যখন হৈ চৈ করতে থাকেন তখন সে টিভির সাউণ্ড পুরোপুরি অফ করে দেয়। সাউন্ড ছাড়া কার্টুন দেখতে তার খারাপ লাগে না। সাউন্ডগুলি ভেবে নেয়। কোন দৃশ্যে কি রকম সাউন্ড হবে এখন সে মোটামুটি জানে।

মা যখন অন্যদের উপর রাগ করে তখন ইমনের তেমন খারাপ লাগে না, কিন্তু যখন সুপ্রভার উপর রাগ করেন তখন খুব খারাপ লাগে, কাঁদতে ইচ্ছা করে। সুপ্রভার উপর মা প্রায়ই রাগ করেন।

সুপ্ৰভা কেঁদে গলা ফাটিয়ে ফেলছে–মা ফিরে তাকাচ্ছেন না। বুয়া এসে যদি বলে—আপু কানতাছে। তখন মা তীব্রগলায় বলেন, কাঁদছে। কাদুক তুমি তোমার কাজ কর। কাজ ফেলে চলে এসেছ কেন? ছোট চাচা এক সময় উঠে এসে বলেন, ভাবী বাচ্চাটার কি হয়েছে? মা তখন বিরক্ত গলায় বলেন, জানি না কি হয়েছে। ওর মনের খবর আমি জানব কি ভাবে?

কাঁদতে কাঁদতেতো গলা ভেঙ্গে ফেলছে।

গলা ভেঙ্গে মরুক।

ভাবী এইসব কি কথা বলছেন?

আমার যা মনে আসছে বলছি, তোমাদের অসুবিধা হচ্ছে?

হ্যাঁ, অসুবিধা হচ্ছে। বাচ্চাটা পেটের ক্ষিধেয় কাঁদছে, আপনি ফিরে তাকাচ্ছেন না, এটা কেমন কথা।

তুমি এমন চোখ মুখ শক্ত করে কথা বলছি কেন? তোমার ভাইতো কখনো মুখ শক্ত করে এমন ভাবে কথা বলেনি।

চোখ মুখ শক্ত করে কথা বলার জন্যে আমি সরি। ভাবী শুনুন, ফর গডস সেক, স্বাভাবিক ভাবে বাঁচার চেষ্টা করুন।

ভাইজানের জন্যে কষ্ট শুধু আপনি একা পাচ্ছেন আর কেউ পাচ্ছে না। এটা আপনি কি করে ভাবছেন? কষ্ট পাচ্ছেন ভাল কথা-কিন্তু একটা দুধের শিশুকে কষ্ট দেবেন। কেন? তার অপরাধটা কোথায়?

খবৰ্দার, তুমি আমার সঙ্গে চোখ লাল করে কথা বলবে না।

ভাবী আমি চোখ লাল করে কথা বলছি না, আমি আপনার কাছে হাত জোড় করছি— ওকে দুধ খেতে দিন।

নাটক করবে না। নাটক আমার ভাল লাগে না—একে তোমরা নিয়ে কোথাও পালক দিয়ে দাও।

আচ্ছা ভাবী ঠিক আছে, তাই করব। আপাতত আপনি একে সামলান।

এই পর্যায়ে মা সুপ্ৰভাকে কোলে নেন। সঙ্গে সঙ্গে তার কান্না থেমে যায়। তখন কান্না পেয়ে যায় ইমনের। সে ছোট চাচার ঘরে ঢুকে কাঁদতে শুরু করে। ছোট চাচা গম্ভীর গলায় বলেন, ইমন তোকে কেউ মেরেছে?

ইমন ফোঁপাতে ফোপাতে বলে, না। মারে নি।

তোকে কেউ বকা দিয়েছে?

না।

জানি না। পুরুষ মানুষ কি কাঁদতে পারে?

না।

ফোঁস ফোঁস করতে পারে?

না।

হেঁচকি তুলতে পারে?

না।

তুইতো একই সঙ্গে কাঁদছিস, ফোঁস ফোঁস করছিস এবং হেঁচাকি তুলছিস। তিনটা নিষিদ্ধ জিনিশ করছিস। চোখ মুছে কচ্ছপ নিয়ে আয়—একটা মজা দেখাব।

কি মজা?

আগে নিয়ে আয়, তারপর দেখবি।

ইমন কচ্ছপ নিয়ে এল। ফিরোজ কচ্ছপ দুটা উল্টা করে মেঝেতে রেখে দিল। এরা খোলসের ভেতর থেকে মাথা এবং পা বের করে সোজা হবার চেষ্টা করছে, পারছে না। ফিরোজ হৃষ্ট চিত্তে বলল, এই হচ্ছে মজা।

কি মজা?

যত চেষ্টাই করুক, এরা এখন আর সোজা হতে পারবে না। ছটফট করবে। কিন্তু পারবে না। বাইরের কোন সাহায্য লাগবে। তুই বা আমি যদি সোজা করে দি, তাহলেই সোজা হতে পারবে। মজাটা এইখানেই। মানুষেরও মাঝে মাঝে কচ্ছপের মত অবস্থা হয়। মানুষ উল্টে যায়। ঠিক হবার জন্যে ছটফট করতে থাকে, ঠিক হতে পারে না। বাইরের সাহায্য ছাড়া ঠিক হওয়া তখন সম্ভব না। তোর মার এখন এই অবস্থা চলছে। সে উল্টে গেছে। ঠিক হবার জন্যে ছটফট করছে, কিন্তু পারছে না। কাজেই তোর মার উপর রাগ করেও কোন লাভ নেই। মার উপর তোর রাগ নেইতো?

না নেই।

ভেরীগুড। আরেকটা কথা–যদি কোন কারণে খুব মন খারাপ হয় তখন কচ্ছপ উল্টে দিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকবি–তখন দেখবি মন ভাল হয়ে যাচ্ছে।

কেন?

কেন কেন করবি না। চড় খাবি।

আচ্ছা করব না।



আজি ইমনের মন সামান্য খারাপ। বেশী না সামান্য। এই সামান্য মন খারাপ নিয়ে কচ্ছপ উল্টানো যায় না বলে সে উল্টাচ্ছে না–শশার টুকরা কেটে খেতে দিচ্ছে। এরা খাচ্ছে না। হাতে ধরে থাকলে এরা খায় না, কিন্তু পানিতে ছেড়ে দিলে মুখ বের করে কুট কুট করে খায়।

ইমন। এদিকে শুনে যাও।

ইমনের বুক ধ্বক করে উঠল। আগে মা ডাকলে আনন্দ লাগতো, এখন মা ডাকলেই বুক ধ্বক করে উঠে। ইমন কচ্ছপ দুটা বালতিতে রেখে মার ঘরের দরজা ধরে দাঁড়াল। মা সুপ্রভার গায়ে তেল মালিশ করে দিচ্ছেন। তিনি চোখ সরু করে তাকালেন। ইমনের বুক শির শির করতে লাগল।

দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কাছে আস।

ইমন ঘরে ঢুকল।

হাত ভেজা কেন? আবার কচ্ছপ নিয়ে ঘাটাঘাঁটি করছিলে? হাত ধুয়ে এসেছ?

হ্যাঁ।

সাবান দিয়ে হাত ধুয়েছ?

ইমন সাবান দিয়ে হাত ধোয়নি-তারপরেও ভয়ে ভয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। সে জানে এই মিথ্যা মাথা নাড়ার জন্যে তার বা কাধের ফেরেশতা পাঁচটা বদি লিখেছে। ফেরেশতার নাম কেরামান কাতে।বিন। তার কাজ মানুষের খারাপ কাজগুলি লেখা এবং কোন খারাপ কাজের জন্যে কয়টা বদি হয়েছে তার হিসাব রাখা। দাদীজান তাকে বলেছেন।

দেখি হাত কাছে আন। সাবানের গন্ধ আছে কি-না দেখি।

ইমন হাত এগিয়ে দিল। মা গন্ধ শুকলেন। মনে হল তিনি সাবানের গন্ধ পেয়েছেন। কারণ কিছু বললেন না। সাবানের গন্ধ পাওয়ার কথা না। সে হাতে সাবান মাখে নি। কচ্ছপ ঘাটা ঘাটি করেছে। মনে হয় কচ্ছপের গায়ে সাবানের গন্ধ আছে। কচ্ছপ শুকে দেখতে হবে।

সুরাইয়া বলল, তোমার বোনটা দেখতে কি রকম হয়েছে? কার মত হয়েছে?

ইমন ভয়ে ভয়ে বলল, ছোট বাচ্চাদের মত হয়েছে।

বোকার মত কথা বলছ কেন? ছোট বাচ্চাতো ছোট বাচ্চার মতই হবে। বুড়োদের মত হবে নাকি? দেখতে কার মত হয়েছে? তোমার মত, না আমার মত, নাকি তোমার বাবার মত?

জানি না মা।

জানবে না কেন? দেখতে হয়েছে অবিকল তোমার বাবার মত। তোমার বাবার নাক অনেকটা চাপা। এই দেখ এর নাকিও চাপা! চাপা না?

ইমন বুঝতে পারছে না, নাক চাপা কি চাপা না। তার কাছেতো নাকটা সুন্দরই লাগছে। তারপরেও বলল, হুঁ।

সুরাইয়া ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এখন তোমাকে আমি কি বলব। মন দিয়ে শুনবে। আমরা এই বাড়িতে থাকব না।

ইমন ভয়ে ভয়ে বলল, কোথায় যাব?

তোমার বড় মামার বাড়িতে গিয়ে থাকব। তোমার বড় মামা তার বাড়ির একটা ঘর আমাকে দিয়েছেন। একটা ঘরইতো আমাদের জন্যে যথেষ্ট। কি, যথেষ্ট না?

হুঁ।

এ রকম মুখ শুকনা করে ই বলছি কেন? বড় মামার বাড়িতে থাকতে তোমার অসুবিধাটা কি? আর যদি অসুবিধা থাকেও কিছু করার নেই। তোমার বাবার কোন খোঁজ নেই–কাজেই তোমাদের কপাল ভেঙ্গেছে। আমাদের জীবন কি ভাবে কাটবে জান? আজ এই বাড়ি, কাল ঐ বাড়ি।

ইমন ভয়ে ভয়ে বলল, এই বাড়িতে কেন থাকবনা মা?

এই বাড়িতে থাকব না, কারণ তোমার ছোট চাচার কোন চাকরি বাকরি নেই। এতদিন সংসার চলেছে গ্রামের বাড়ির ধানী জমি বিক্রি করে। এই ভাবে আর কতদিন চলবে? তাছাড়া তোমার ছোট চাচা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। চোখ লাল করে আমার দিকে তাকায়। তার এত সাহস কেন হবে? যেখানে তোমার বাবা কোনদিন আমার দিকে চোখ লাল করে তাকায় নি–সেখানে সে তাকাবে কেন?

বড় মামার বাসায় কবে যাব মা?

এক সপ্তাহের মধ্যেই যাব। তোমার বই খাতা তুমি নিজে সব গুছিয়ে নেবে। ঐখানে গেলে তোমার ভালই লাগবে। খেলার সঙ্গি-সাথী পাবে। তোমার বড় মামার দুই ছেলে আছে। টোকন আর শোভন। ওদের সঙ্গে খেলবে। এখানে একা একা থাক, তোমার বড় মামা তোমাকে পছন্দও করেন। করেন না?

ইমন বুঝতে পারছে না তার বড় মামা তাকে পছন্দ করেন কি-না। তার বড় মামার চেহারাটা রাগি রাগি। চশমা পরেন। চশমার ফাঁক দিয়ে তাকান। কেমন করে জানি তাকান। তিনি বাসায় এলেই ফুলের গন্ধ পাওয়া যায়। সেই গন্ধে গা কেমন জানি ঝিম ঝিম করে। পরে সে জেনেছে এটা ফুলের গন্ধ না। জর্দার গন্ধ। বড় মামা পান খান না-শুধু শুধু জর্দা খান। তিনি যখনই এ বাসায় আসেন এক প্যাকেট বিসকিট নিয়ে এসে গম্ভীর গলায় বলেন-ইমন নিয়ে যা। ইমন বিসকিট নিয়ে যায়, কিন্তু তার কোন আনন্দ হয় না, কারণ বিসকিট তার পছন্দ না। শুধু চায়ে ড়ুবিয়ে বিসকিট খেতেই তার ভাল লাগে। অন্য সময় ভাল লাগে না। বিসকিট খাবার জন্যে কেউতো আর তাকে চা বানিয়ে দেবে না। সে ছোট মানুষ। কলেজে যখন পড়বে তখনই সে শুধু চা খেতে পারবে।

সুরাইয়া বললেন, কথার জবাব দিচ্ছিস না কেন? তোর বড় মামা তোকে পছন্দ করে না?

হুঁ।

মুখ এমন শুকনা করে ইহঁ বলছি কেন? মনে হচ্ছে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। যাও, এখন সামনে থেকে যাও। সারাক্ষণ ভোতা মুখ দেখতে ভাল লাগে না।

ইমন মার ঘর থেকে বের হল। বড় মামার বাড়িতে কি কচ্ছপ দুটা নিতে দেবে? মনে হয় দেবে না। কচ্ছপ দুটা এ বাড়িতেই রেখে যেতে হবে। মাকে একবার বলে দেখলে হয়। অবশ্যি বললেও লাভ হবে না। বড় মামার ছেলে টোকন আর শোভন হয়ত তার কাছ থেকে কেড়ে কচ্ছপ দুটা নিয়ে নেবে। একটা লাভ হয়তো হবে রাতে মার সঙ্গে ঘুমুতে পারবে। তাদের একটা ঘর দেয়া হবে। তারা সবাই সেই ঘরেই থাকবে। এখানে বেশীর ভাগ সময় তাকে ছোট চাচার সঙ্গে ঘুমুতে হয়। সে যখন ঘুমুতে যায়। তখনো ছোট চাচা বাইরে। একা একা ঘুমুতে তার খুবই ভয় লাগে। তবে অনেক রাতে ঘুম ভেঙ্গে যখন সে দেখে ছোট চাচা ঘুমুচ্ছেন তখন তার খুবই ভাল লাগে। সে যদি খুব নরম গলাতেও ডাকে-ছোট চাচা! তাহলেও ছোট চাচা উঠে বসেন, গম্ভীর গলায় বলেন, কি হয়েছেরে হার্ড নাট। বাথরুমে যাবি?

হুঁ।

আয় যাই। ঠিক সময় ডাক দিয়েছিস আমারো বাথরুম পেয়েছে। ছোটটা। তোর কি বড়টা না-কি?

আমারও ছোটটা।

চল যাই। কে আগে যাবে তুই না। আমি? বড় থেকে ছোট না ছোট থেকে বড়?

তুমি যা বলবে তাই।

তাহলে তুই বরং আগে যা। কোলে করে নিতে হবে না-কি?

হুঁ।

বাথরুম থেকে ফেরার পর ঘুম না। আসা পর্যন্ত ছোট চাচা গল্প বলেন। তাঁর গল্পের কোন আগা মাথা নেই, শুরু নেই শেষ নেই। তবু ঘুম ঘুম চোখে শুনতে এত ভাল লাগে। ছোট চাচার সব গল্পই শুরু হয় মাঝখান থেকে

তারপর ব্যাঙটা বলল, পানিতে থেকে থেকে আমার সিরিয়াস সর্দি হয়েছে। নাক ঝাড়তে ঝাড়তে অবস্থা কাহিল। অষুধ পত্র কিছু দিয়ে আমাকে বাঁচান ডাক্তার সাহেব। তবে আপনার কাছে একটা রিকোয়েষ্ট তেতো অষুধ দেবেন না। মিষ্টি অষুধ দেবেন। আবার বেশি মিষ্টিও দেবেন না। অষুধ বেশি মিষ্টি হলে আমার বাচ্চারা মেঠাই ভেবে খেয়ে ফেলবে।

ডাক্তার বলল, অষুধ দেব। তবে আমি খুবই অবাক হচ্ছি। কারণ ব্যাঙের কখনো সর্দি হয় না বলে বই পত্রে পড়েছি। আপনার কি সত্যি সর্দি হয়েছে?

ক্রমাগত হ্যাচ্চো হ্যাচ্চো করছি তারপরেও বিশ্বাস হচ্ছে না?

তা হচ্ছে। যাই হোক অষুধ দিচ্ছি। ভিজিটের টাকা এনেছেন?

এনেছি। এই নিন। আধুলি। আমার শেষ সম্বল— ব্যাঙের আধুলি।…



বড় মামার বাড়িতে কেউ তাকে এমন অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প শুনাবে না। রাতে বাথরুম পেলে কোলে করে বাথরুমে নিয়ে যাবে না। কি আর করা। বড় মামার বাড়িতেও নিশ্চয়ই অনেক মজার মজার ব্যাপার হবে। কিছু কিছু মজা সব বাড়িতেই থাকে। বড় মামার দুই ছেলে টোকন আর শোভনের সঙ্গে তার হয়ত খুবই ভাব হবে। ওদেরও একটা বোন আছে নাম মিতা, সবাই ডাকে মিতু। তার সঙ্গে ভাব হবে কিনা কে জানে। মনে হয় হবে না। মেয়েদের সঙ্গে হয় মেয়েদের বন্ধুত্ব। ছেলেদের সঙ্গে ছেলেদের।



গায়ে তেল মাখানোর ব্যাপারটায় সুপ্ৰভা মনে হয় খুব আরাম পায়। তেল মাখানোর মাঝখানে ঘুমিয়ে পড়ে। আশ্চর্যের ব্যাপার ঘুমের মধ্যে আবার নাকও ডাকে। এইটুকু ছোট বাচ্চা নাক ডাকিয়ে ঘুমাবে কেন? তার উপর মেয়ে মানুষ। সুরাইয়ার খুব রাগ লাগে। এখনো রাগ লাগছে। চড় দিয়ে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে। রাগ সামলে সুরাইয়া বারান্দায় গেল। ফিরোজ বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে খবরের কাগজ পড়ছে। তার সামনে গম্ভীর মুখে ইমন বসে আছে। ফিরোজ বলল, কেমন আছেন ভাবী?

একই বাড়িতে বাস করছে। অথচ দেখা হলে প্রথম বাক্যটি বলছে, কেমন আছেন ভাবী। এর মানে কি এই যে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া আপনি ভাল থাকেন না।

সুরাইয়া বলল, ফিরোজ তোমার সঙ্গে আমার কিছু জরুরী কথা আছে।

ফিরোজ খবরের কাগজ ভাজ করে পাশে রাখতে রাখতে বলল, বলুন।

ইমন উঠে চলে যাচ্ছে। সে জানে বড়রা যখন জরুরী কথা বলে সেখানে ছোটদের থাকার নিয়ম নেই। বড়রা তাদের জরুরী কথার আশে পাশে ছোটদের চায় না। অথচ ছোটদের সমস্ত জরুরী কথায় বড়দের থাকতে হয়।

সুরাইয়া বেতের মোড়া এনে ফিরোজের সামনে বসল। ফিরোজ শংকিত বোধ করছে। ভাবীর বসার ভঙ্গি কঠিন। ভাবী। কি বড় ধরণের ঝগড়ার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে? কি নিয়ে ঝগড়া করবে?

ভাবী চা খাবেন? চা দিতে বলি—চা খেতে খেতে কথা বলুন।

তোমার সঙ্গে আমার এমন কোন কথা নেই যে চা খেয়ে খেয়ে বলতে হবে। ফিরোজ শোন, আমি এখানে থাকব না। আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছি, আমি তার কাছে গিয়ে থাকব।

ফিরোজ বলল, আমি জানি। ইমন আমাকে বলেছে।

তুমি একটা ঠেলাগাড়ি এনে দাও। আমি কিছু জিনিস পত্র নিয়ে যাব। স্টিলের ট্রাংক, ইমনের পড়ার টেবিল-চেয়ার, আমার বড় কালো ট্রাংকটা।

কবে যাবেন ভাবী?

কবে মানে? আজই যাব। যত তাড়াতাড়ি যাওয়া যায় ততই ভাল। সবার জন্যেই ভাল। তোমার জন্যেও ভাল, আমার জন্যেও ভাল।

আমার জন্যে ভাল কেন?

তোমার চাকরি বাকরি কিছু নেই, এত বড় সংসার পুষতে হচ্ছে। বাড়ি ভাড়া দিতে হচ্ছে। গ্রামের বাড়ির সম্পত্তি বিক্রি করতে হচ্ছে। তুমি অকারণে এত কিছু করবে। কেন? তুমি কে?

ভাবী, আমি ইমনের চাচা।

বাপ যখন থাকে না তখন চাচা-ফাচা অনেক দূরের ব্যাপার।

আপনার সঙ্গে আমি কোন তর্কে যেতে চাচ্ছি না। তবে আমার মনে হয়এখানে থাকাটাই আপনাদের জন্যে ভাল হবে।

কেন ভাল হবে?

পরিবেশে অভ্যস্ত হবার ব্যাপার আছে। আপনি এই পরিবেশে থেকে অভ্যস্ত, ইমন অভ্যস্ত।

তুমি জমি বিক্রি করে করে আমাদের খাওয়াবে!

হ্যাঁ ভাবী।

সেটা কতদিন? তোমাদের কি জমিদারী আছে?

জমিদারী নেই। জমি জমা খুব সামান্যই আছে—ভাবী, আমি ব্যবসা শুরু করেছি। বোতল সাপ্লাইএর কাজ পেয়েছি। সামান্য হলেও কিছু টাকা-পয়সাতো পাচ্ছি। ব্যবসার নিয়ম কানুন বুঝতে শুরু করেছি—আমার ধারণা আমি ভালই করব।

ভাল করলে ভাল। ভাল করতে থাক। কোটিপতি হয়ে যাও। গাড়ি হোক। বাড়ি হোক। তোমরা সুখে থাক। তোমাকে যা বলেছি করা—আমাকে একটা ঠেলাগাড়ি এনে দাও।

ভাবী শুনুন, মার শরীর খুব খারাপ। মা চিকিৎসার জন্যে ঢাকায় আসছেন। মা আসুক তারপর যান।

উনার সঙ্গে আমার যাওয়ার সম্পর্ক কি? আমি আজই যাব।

আচ্ছা ঠিক আছে।

তুমি আরেকটা কাজ করবে–সুপ্ৰভাকে আমি পালতে পারছি না–তাকে পালক দেবার ব্যবস্থা করবে।

কি বলছেন বুঝতে পারছি না ভাবী।

বাংলাদেশে অনেক ফ্যামিলি আছে যাদের ছেলে।পুলে নেই, এমন কোন একটা ফ্যামিলীতে ওকে দিয়ে দাও। সেও সুখে থাকবে আমিও সুখে থাকব। এইসব যন্ত্রনা। আমার অসহ্য লাগছে।

ও আচ্ছা।

মেয়েটা হয়েছে অপয়া–ও পেটে আসার পর থেকে যত সমস্যা। আমার আর ভাল লাগে না।

ভাবী আপনি-আজই যাবেন?

হুঁ।

ইমনের স্কুলতো অনেক দূর হয়ে যাবে, স্কুল থেকে ওকে আনা নেয়া কে করবে?

জানি না। স্কুল বদলে দিব কিংবা ঘরে বসে থাকবে-বাপ নেই ছেলের আবার স্কুল কিসের? তার কি পড়াশোনা হবে? হবে না। বড় হয়ে ইট ভাঙ্গাবে কিংবা রিকশা চালাবে।

সুপ্রভার ঘুম ভেঙ্গেছে। কাঁদতে শুরু করেছে। সুরাইয়া উঠে চলে গেল। ফিরোজ বসে রইল। পত্রিকা পড়া হয়নি। এখন আর পড়তে ইচ্ছে করছে না। ভাবী যখন চলে যাবে বলে ঠিক করেছে তখন যাবেই। তাকে বুঝানোর কেউ নেই। সে কারো কথা শুনবে না।

ইমন ছোট ছোট পা ফেলে আসছে। ছোট চাচার দিকে একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল। ফিরোজ হাত ইশারায় কাছে ডাকল। ইমন আসছে কিন্তু অন্য দিকে তাকিয়ে এগুচ্ছে। একবারো তার চাচার দিকে তাকাচ্ছে না। ছেলেটা অদ্ভুত হয়েছে। অদ্ভুত কিন্তু অসাধারণ।

খবর কিরে ব্যাটা হার্ড নাট?

ভাল।

বড় মামার বাড়িতে চলে যাচ্ছিস তাহলে?

হুঁ।

গুড়। যাবার সময় কাঁদবি নাতো?

ভেরী গুড। বোকা ছেলেরাই কাঁদে–বুদ্ধিমানরা কাঁদে না। তুই বোকা না বুদ্ধিমান?

জানি না।

আয় পরীক্ষা করে দেখি–বোকা না, বুদ্ধিমান। কোলে এসে বোস। আমি তোর চুলে বিলি কেটে কেটে আদর করব। তখন যদি কেঁদে ফেলিস তখন বুঝব তুই বোকা। আর না কেঁদে থাকতে পারলে বুদ্ধিমান।

ইমন গুটিসুটি মেরে তার চাচার কোলে বসে আছে। তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে চোখের পানি আটকানোর, কোন লাভ হচ্ছে না। চোখ ভর্তি করে পানি আসছে সে সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুছে ফেলছে। ছোট চাচার কাছে সে বোকা প্রমাণিত হচ্ছে এই দুঃখবোধেও সে আক্রান্ত তবে সে জানে না-ছোট চাচাও তার মতই বোকা। ছোট চাচার চোখ ও ভিজে উঠছে। পানি জমতে শুরু করেছে।

হার্ড নাট!

হুঁ।

যেখানেই থাকিস, যে ভাবেই থাকিস—ভাল থাকবি।

আচ্ছা।

কোন কিছু নিয়েই মন খারাপ করবি না।

আচ্ছা।

গল্প শুনবি?

হুঁ।

একদেশে ছিল এক ব্যাঙ। কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ বেচারার সর্দি লেগে গেল। সর্দি এবং কফ। সারাদিন নাক ঝাড়ে আর খ্যক খ্যক করে কাশে। ব্যাঙের স্ত্রী বলল, ওগো ডাক্তারের কাছে যাও। তোমার কাশির শব্দে বাচ্চারা ঘুমুতে পারছে না। ব্যাঙ বলল, ডাক্তারের কাছে যে যাব ভিজিটের টাকা লাগবে না? তার স্ত্রী বলল, আধুলীটা নিয়ে যাও। ব্যাঙ বলল, আধুলীটাই আমাদের শেষ সম্বল সেটা নিয়ে যাব?

হ্যাঁ যাও। শরীরটাতো আগে দেখবে। টাকা গেলে টাকা পাওয়া যায়। শরীর গেলে কি আর পাওয়া যায়?

ব্যাঙ বলল, বউ কথাটাতো ভালই বলেছ। আচ্ছা যাই ডাক্তারকে বরং দেখিয়েই আসি।

ব্যাঙের স্ত্রী বলল, ব্লাড প্রেসারটাও একটু চেক করিও। আমার ধারণা তোমার প্রেসারও বেড়েছে। কাল রাতে বৃষ্টির সময় তুমি যখন ডাকছিলে তখন তোমার গলা কেমন যেন অন্য রকম শুনাচ্ছিল।

ছোট চাচা দম নেবার জন্যে থামতেই ইমন বলল, বাবা কি আর ফিরে আসবে না। চাচা?

বুঝতে পারছি না। ধরে নে ফিরে আসবে না। তাহলে কষ্ট কম পাবি। ফিরে আসবে ভেবে অপেক্ষা করছিস-মানুষটা ফিরছে না-কষ্ট বেশী না?

হুঁ।



তোর মা সারাক্ষণ ভাবছে—এই বুঝি মানুষটা ফিরল। রাতে ঘুমায় না। জেগে থাকে, গোটে সামান্য শব্দ হলে ছুটে আসে—এই অবস্থাটাতো ভয়ংকর।

সুপ্ৰভা খুব কাঁদছে। সুরাইয়া মেয়ের কান্না থামানোর কোন চেষ্টা করছে। না। কাদুক। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে এক সময় নিজেই থেমে যাবে। সে যখন কাঁদে তখনতো কেউ তার কান্না থামাতে আসে না। সে কোন যাবে? তার এত কি দায় পড়েছে?
 
০৪.


পৌষ মাস। প্রচণ্ড শীত পড়েছে। শীতের সঙ্গে কুয়াশা। ইমন বসে আছে তার বড় মামার বাড়ির দোতলার বারান্দায়। সে অবাক হয়ে দেখছে কুয়াশায় সব ঢেকে আছে। একটু দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। বাড়ির সামনে কাঁঠাল গাছটাকে মনে হচ্ছে ছোট একটা পাহাড়। তার ছোট চাচা বলেছিলেনকুয়াশা আসলে মেঘ। আকাশের মেঘ যখন মাটিতে নামে তাকে বলে কুয়াশা। ইমনের খুব অদ্ভুত লাগছে এই ভেবে যে সে মেঘের ভেতর বসে আছে। আজ ছুটির দিন, তার বারান্দায় চুপচাপ বসে থাকার কথা না। ছুটির দিনের সকাল বেলায় এই বাড়িতে নানান ধরণের খেলা হয়। টোকন আর শোভন টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলে। টোকনের খুবই কাদুনে স্বভাব। কিছু হতেই কান্না শুরু করে। আর শোভন মারামারিতে ওস্তাদ। হুট করে মারামারি শুরু হয়ে যায়। শোভন ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে ধমাধ্যম ভাইকে মারে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে কেউ কখনো নালিশ করে না। মারামারি এবং কান্নাকাটি কিছুক্ষণের মধ্যে থেমে যায়। আবার খেলা শুরু হয়। মিতু একা একা রান্না বাটিখেলে। ক্রিকেট খেলায় তাকে নেয়া হয় না, মিতুও রান্নাবাটি খেলায় তাকে নেয় না। একদিন শুধু বলেছিল, এই তুই চাকর হবি? তুই চাকর হলে খেলতে নেব। যা বাজার করে নিয়ে আয়। মনে করে কাঁচা মরিচ, আনবি। আর খবর্দার পয়সা সরাবি না।

ইমনের খেলতে ইচ্ছা করছিল, কিন্তু চাকর হওয়াটা মেনে নিতে পারছিল না বলে খেলে নি। তবে না খেললেও সে বেশির ভাগ সময় আশে পাশে ঘুর ঘুর করে।

আজি ইমন এখনো নিচে নামছে না। কারণ নিচে নামিয়ে নেয়ার জন্যে মিতু আসেনি। বড় মামার বাড়ির দোতলার সিঁড়ি পুরোপুরি শেষ হয় নি। রেলিং দেয়া বাকি। এ রকম সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে ইমনের অসম্ভব ভয় লাগে। মিতু বয়সে তার সমান হলেও, ঠিক সমান ও না, পাঁচ দিনের বড়। ভয়ংকর সাহসী। একবার সে চোখ বন্ধ করে সিঁড়ি দিয়ে উঠেছিল। মিতু শুধু যে চোখ বন্ধ করে সিড়ি দিয়ে উঠতে পারে তাই না। তিন তলার ছাদে পা ঝুলিয়ে বসতেও পারে। সেই ছাদেরও রেলিং নেই। ইমনের বড় মামা ছাদে রেলিং দেবেন না— শুধু শুধু বাজে খরচ। ইমনের ধারণা বাজে খরচ হলেও রেলিং দেয়া উচিত। তা না হলে কোন একদিন মিতু ছাদ থেকে পড়ে যাবে। ইমনের ধারণা দোতলার সিঁড়িতেও রেলিং দেয়া উচিত। রেলিং দেয়া না হলে সে নিজেই কোন একদিন পড়ে যাবে।

ইমন!

ইমন চমকে উঠে দাঁড়াল। মা ডাকছেন। আগে মা ডাকলেই আনন্দ হত, এখন হয় না। মার ডাকা মানেই কিছু একটা নিয়ে ধমকা ধমকি হবে। ধমক খাবার মত কিছু অবশ্যি সে করেনি। সকালে বই নিয়ে বসে অনেকক্ষণ পড়েছে। মা যখন বললেন, যথেষ্ট ঘ্যানঘ্যােনানি হয়েছে এখন যাও। তখনি শুধু সে উঠে এসেছে।

ইমন ভয়ে ভয়ে মার ঘরের দরজা ধরে দাঁড়াল। মার রাতে জ্বর ছিল, এখনো বোধ হয় জ্বর। মা শুয়ে আছেন। সুপ্ৰভা মার পাশে বসে নিজে নিজেই খেলছে। ইমনের কাছে খুবই আশ্চর্য লাগে যে সুপ্ৰভা নিজে নিজে বসতে পারে। হামাগুড়ি দিতে পারে। কিছু দেখলেই দুহাতের দুই আঙুল উঁচু করে বলে—যে যে যে মানুষ কাউকে কিছু দেখাতে চাইলে এক আংগুল দিয়ে দেখায়–সুপ্ৰভা দুহাতের দু আংগুলে দেখায়। এটাও তার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়।

সুপ্ৰভা ইমনকে দেখা মাত্র দুহাতের দুই আংগুল উঁচু করে তাকে দেখাল এবং ক্রমাগত বলতে লাগল, যে যে যে।

সুরাইয়া বলল, কোথায় ছিলি?

ইমন ভীত গলায় বলল, বারান্দায়।

রান্নাঘরে গিয়ে বলতো আমাকে চিনি দুধ ছাড়া লিকার দিয়ে এক কাপ চা দিতে। লেবু যেন না দেয়। চায়ের মধ্যে লেবুর গন্ধ—অসহ্য।

তোমার জ্বর কমেছে মা?

সুরাইয়া বিরক্ত গলায় বলল, আমার জ্বরের খবর তোকে নিতে হবে না। যা করতে বলছি কর। তোর গলা খালি কেন? মাফলার যে একটা দিয়েছিলাম সেটা কই? ঠাণ্ডা লাগিয়ে রাতে যদি খুক খুক করে কাশিস তাহলে গলা চেপে ধরব। তখন বুঝবি কত ধানে কত চাল। যা এখন সামনে থেকে।

ইমন দোতলা থেকে এক তলায় নামছে। নামতে গিয়ে সে লিজায় মরে যাচ্ছে কারণ সে নামছে বসে বসে। কেউ দেখলেই হাসবে। বিশেষ করে মিতু যদি দেখে তাহলে সর্বনাশ হবে। খুব হাসোহাসি করবে। এমিতেই মিতু তাকে নিয়ে খুব হাসোহাসি করে। তাকে ডাকে ক্যাবলা বাবা। এই অবস্থায় দেখে ফেললে হয়ত আরো ভয়ংকর কোন নামে ডাকবে।

ইমন ঠিকমতই নামল। কেউ তাকে দেখল না। রান্নাঘরে বুয়াকে চায়ের কথা বলল। বুয়া বিরক্ত গলায় বলল, আমার হাত বন্ধ, এখন চা দেওন যাইব না। বুয়ার কথা শুনে ইমনের ভয় ভয় লাগছে। বুয়া যদি চা না পাঠায় মা বুয়ার উপর রাগ করবে না। তার উপরই রাগ করবে। চড় মারবে বা চুলে ধরে ঝাকুনি দিবে। ইমন বিড় বিড় করে বলল, বুয়া মার খুব জ্বর। সকালে কিছু খায়নি—এই জন্যে চা চাচ্ছে। দুধ-চিনি-লেবু ছাড়া শুধু লিকার।

কইলাম না হাত বন্ধ।

ইমন মন খারাপ করে রান্নাঘর থেকে বের হল। বড় মামার বাড়িতে তারা খুব খারাপ অবস্থায় আছে। কেউ তাদের কোন কথা শুনে না। ইমন যদি কোন কাজের লোককে বলে এই আমাকে এক গ্রাস পানি দাও। সে অবধারিত ভাবে না শোনার ভান করে চলে যাবে। কিংবা দিতেছি বলে সামনে থেকে সরে যাবে কিন্তু আর ফিরে আসবে না। আগে এই নিয়ে তার খুব মন খারাপ লাগত। এখন লাগে না।

ইমন বারান্দায় এসে দেখে মিতু বারান্দার পিলারে হেলান দিয়ে কমলা খাচ্ছে। এই শীতে তার গায়ে পাতলা একটা ফ্রক। খুব যারা সাহসী মেয়ে তাদের বোধ হয়। শীতও কম লাগে। ইমনের খুব ইচ্ছা করছে মিতুর কাছে যেতে— তবে এখন সে যাবে না, একটু পরে যাবে। মিতুর কমলা খাওয়া শেষ হবার পর যাবে। এখন মিত্র পাশে গিয়ে দাড়ালে মিতু ভাবতে পারে সে কমলার লোভে কাছে এসেছে।

মিত্র কমলা খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকবে। এমন ভাব করবে যেন খুব মন দিয়ে কিছু দেখছে।

এই ক্যাবলা, এই।

মিতু ডাকছে। মিতুর কমলা শেষ হয়নি। হাতে এখনো কয়েকটা কোয়া রয়েছে। ইমন কাছে গিয়ে দাড়ালে–একটা দুটা কোয়া হয়ত তার হাতে দেবে। তখন ইমনকে লোভীর মত লাগবে। আবার নাও দিতে পারে। মিতুর কোন কিছুই ঠিক নেই। ইমন কাছে গেল।

মিতু তাকে কমলার কোন কোয়া দিল না। পুরো কমলা শেষ করে বলল, ক্যাবলা, আজ তোর ছোট চাচা আসবে না?

ইমন বলল, আসতে পারে।

ছোট চাচার কথা ওঠায় ইমনের মন ভাল হয়ে গেল। সে একটু হেসেও ফেলল। আজ শুক্রবার। ছুটির দিন। ছুটির দিনে ছোট চাচা আসে। গত শুক্রবার আসেনি। আজ হয়ত আসবে।

তোর ছোট চাচাকে দেখতে কেমন লাগে জানিস?

কেমন লাগে।

অবিকল রাম ছাগলের মত লাগে। দাড়ি রেখেছেতো এই জন্যে। রামছাগলেরও দাড়ি থাকে। হিহিহি।

ইমনের চোখে প্ৰায় পানি এসে যাচ্ছে। ছোট চাচাকে কেউ খারাপ বললে তার খুব মন খারাপ লাগে। তাছাড়া দাড়িতে ছোট চাচাকে খুবই সুন্দর লাগে।

মিতু বলল, আমি যখন কমলা খাচ্ছিলাম তখন তুই লোভীর মত তাকিয়ে ছিলি কেন?

তাকিয়ে ছিলামনাতো!

অবশ্যই তাকিয়েছিলি। লোভী কোথাকার। আবার মিথ্যা কথা বলে–মিথ্যুক।

আমি মিথ্যুক না। আমি সত্যুক।

অবশ্যই তুই মিথ্যুক। বাবা মারা গেছে আবার মিথ্যা কথাও বলে।

বাবা মরে নি। বেড়াতে গেছেন, চলে আসবেন।

চলে আসবে না হাতী। কোনদিন আসবে না।

আসবে।

তুই বললেই হবে? সবাই জানে আসবে না। তুই একেতো মিথ্যুক তার উপর বোকা।

আমি বোকা না।

অবশ্যই তুই বোকা। বোকা এবং ভীরু। সিঁড়ি দিয়ে বসে বসে পা ল্যাছড়ে নামিস। আমি দেখেছি।

ইমন চোখের পানি সামলাবার চেষ্টা করছে। পারছে না। মিতু বলল, একদিন তুই যখন সিঁড়ি দিয়ে বসে বসে নামছিলি তখন আমি তোর ইয়েটা দেখে ফেলেছি। দেখতে শাদা কেচোর মত-হি হি হি।

ইমনের চোখে এবার পানি এসে গেল। চোখ মুছে সে রওনা হল রান্নাঘরের দিকে। বুয়াকে আরেকবার অনুরোধ করে দেখবে যেন মাকে সে চা দিয়ে আসে।

মিতু তার ফ্রকের পকেট থেকে আরেকটা কমলা বের করেছে। মেয়েটার মুখ গোলগাল, মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল। অসম্ভব সুন্দর চেহারা। একবার তার দিকে চোখ পড়লে চোখ ফেরানো মুশকিল। এ হচ্ছে সেই ধরণের মেয়ে যাকে দেখলেই কথা বলতে ইচ্ছে করে। মজার ব্যাপার হল, আজ থেকে ঠিক বিশ বছর পর এই মেয়েটি তার বাবার ঘরে ঢুকে অত্যন্ত শান্ত ভঙ্গিতে বলবে-বাবা আমি ইমানকে বিয়ে করতে চাই।

মিতুর বাবা হতভম্ব হয়ে বলবেন, কি বললি?

যা বলেছি তুমি শুনেছ।

তোর কি মাথাটা খারাপ?

মিতু আগের চেয়েও শান্ত গলায় বলবে, বাবা আমার মাথা খারাপ না। তুমি ব্যবস্থা করে দাও।

সেই গল্প যথাসময়ে বলা হবে। আপাতত আমরা দেখতে পাচ্ছি। ইমন তার ছোট চাচার কোলে। সে চাচার ঘাড়ে মুখ লুকিয়ে আছে। নিঃশব্দে কাদছে। ফিরোজ বলছে–কেঁদে তুই আমার ঘাড় ভিজিয়ে ফেলছিস। তোর হয়েছেটা কি বলতো? পনেরো দিন পর এসেছি, কোথায় গল্প গুজব করবি–এ রকম করলে আর আসব না। দোতালা থেকে নিচে ফেলে দেব। দিলাম ফেলে দিলাম। এক মিনিটের মধ্যে যদি হাসির শব্দ না শুনি তাহলে কিন্তু সত্যি সত্যি ফেলে দেব!

ইমন হাসতে না পারলেও হাসির মত শব্দ করল। ছোট চাচার একটু মাথা খারাপের মত আছে। সত্যি সত্যি ফেলে দিতে পারে।



সুরাইয়ার জ্বর আরো বেড়েছে। জ্বরের আঁচে মুখ লালচে হয়ে আছে। চোখ জুল জ্বল করছে। ফিরোজ বসেছে তার সামনে একটা চেয়ারে। ফিরোজ বলল, ভাবী কেমন আছেন?

সুরাইয়া বলল, ভাল। খারাপ থাকিব কেন? খারাপ থাকার মত নতুন কিছুতো হয়নি।

আপনার জ্বর কি বেশী?

জানি না। তোমার খবর বল। ব্যবসা পাতির অবস্থা কি?

অবস্থা বেশী ভাল না। খারাপই বলতে পারেন। ব্যবসা করতে ক্যাশ টাকা লাগে। ক্যাশ টাকাতো নেই।

তোমার ভাইয়ের টাকা পয়সার খোঁজ নিতে বলেছিলাম খোঁজ নিয়েছ?

ফিরোজ কিছু বলল না, চুপ করে রইল। এই প্রসঙ্গে আলাপ করতে তার ইচ্ছা করছে না। অফিসে তার ভাইয়ের টাকা পয়সা ভালই আছে। টাকাটা পেতে হলে তার মৃত্যু হয়েছে এই মর্মে প্রমাণ সহ কাগজ পত্র দিতে হবে। ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে এ জাতীয় কোন কাগজ তার কাছে নেই। একটা মানুষ নিখোঁজ হয়ে গেছে। এই পর্যন্তই। তার আর কোন খোঁজ নেই।

ভাবী, ইমনের পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?

জানি না।

সুপ্ৰভাতো দেখতে খুব সুন্দর হচ্ছে।

ও সুন্দর হলেই কি আর অসুন্দর হলেই কি? তুমি কি এখনো মেসেই থাক?

জ্বি।

চিরজীবন কি মেসেই থাকবে? ঘর বাড়ি করবে না, বিয়ে টিয়ে করবে না।

ব্যবসার অবস্থা ভাবী। খুবই খারাপ।

খারাপ হলে কি আর করবে। মেসে মেসে জীবন কাটিয়ে দাও।

ফিরোজ একটু ঝুকে এসে বলল, ভাবী আপনার কাছে আমি একটা আব্দার নিয়ে এসেছি।

সুরাইয়া ভুরু কুচকে বলল, কি আব্দার?

মার শরীর খুব খারাপ, প্যারালাইসিস হয়ে গেছে। মনে হয়। বাঁচবেন না। আপনাকে খুব দেখতে চাচ্ছেন।

আমাকে দেখে কি হবে?

মনে হয়ত শান্তি পাবেন।

আমাকে দেখে শান্তি পাবার কিছু নেই। আমি কোন শান্তি-বড়ি না।

ভাবী, এই ভাবে কথা বলবেন না। আপনি আমার সঙ্গে চলেন। সবাইকে নিয়ে ঘুরে আসি। দীর্ঘ দিন একটা জায়গায় পড়ে আছেন, ঢাকার বাইরে গেলে ভাল লাগবে।

আমার ভাল লাগা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।

ভাবী, আমি হাত জোড় করছি।

সুরাইয়া বিরক্ত গলায় বলল, কথায় কথায় হাত জোড় করবে না। এইসব নাটক আমার ভাল লাগে না। আমি কোথাও যাব না।

তাহলে একটা কাজ করি, ইমনকে নিয়ে যাই?

না, ওকে আমি একা কোথাও পাঠাব না?

একা কোথায় ভাবী। আমিতো সঙ্গে যাচ্ছি। নিয়ে যাব, একটা দিন থাকব। তারপর চলে আসব।

না।

অনেক দিনতো হয়ে গেল ভাবী এখন একটু স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করা উচিত না?

আমি স্বাভাবিকই আছি। এরচে বেশী স্বাভাবিক হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। ফিরোজ, তুমি এখন যাও। শরীর ভাল লাগছে না–কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

আমি যাব বৃহস্পতিবার দুপুরে। সকালবেলা এসে একবার খোঁজ নিয়ে যাব?

কি খোঁজ নিয়ে যাবে?

যদি আপনি যান আমার সঙ্গে, কিংবা ইমনকে দেন।

একবারতো না বলেছি–তারপরেও চাপ দিচ্ছ কেন?

চাপ দিচ্ছি না ভাবী, অনুরোধ করছি। মার শরীর খুবই খারাপ। বাঁচবেন না। ইমনের জন্যে খুব অস্থির। ভাবী আজ উঠি, বৃহস্পতিবার সকালে আসব। যাওয়ার আগে দেখা করার জন্যে আসব। সুপ্ৰভা কি ঘুমুচ্ছে?

হ্যাঁ।

ওকে দিন একটু কোলে নিয়ে আদর করি।

কোলে নিয়ে আদর করতে হবে না। ঘুম ভেঙ্গে যাবে। ঘুম ভাঙ্গলে বিশ্ৰী করে কাঁদে। অসহ্য লাগে।

সুপ্রভার কান্না শুধু না সুরাইয়ার সব কিছুই অসহ্য লাগে। ইমন যখন পড়ার টেবিলে বসে গুনগুন করে সেই গুনগুন কিছুক্ষণ শুনলেই অসহ্য লাগে। আবার সে যখন নিঃশব্দে পড়ে তখন চারদিকের নৈশব্দও অসহ্য লাগে। সবচে বেশী অসহ্য লাগে তার বড় ভাই জামিলুর রহমানকে।

জামিলুর রহমান মাঝে মধ্যে বোনের ঘরে ঢুকেন। নানান বিষয় নিয়ে কথা বলেন। দুএকটা কথা শোনার পরই সুরাইয়ার মাথা ধরে যায়। সুরাইয়া সঙ্গে সঙ্গে বলে ভাইজান প্ৰচণ্ড মাথা ধরেছে। তিনি তারপরেও বসে থাকেন। এক প্ৰসঙ্গ থেকে আরেক প্রসঙ্গে যান এবং কথা বলতেই থাকেন। বলতেই থাকেন।

তারপর সুরাইয়া তুই আছিস কেমন বল।

ভাল।

দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা একটা ঘরের ভেতর থাকিস। এর নাম ভাল থাকা? তোরতো পাগল হতে বেশী বাকি নাই।

পাগল আমি হব না ভাইজান, পাগল হলে আগেই হতাম। আগে যখন হই নাই এখনো হব না। আশে পাশের সবাইকে পাগল বানাব, কিন্তু নিজে পাগল হব না।

এইত একটা কথার মত কথা বলেছিস। নিজে ভাল থাকিবি। নিজের ভাল থাকাটাই জরুরী। অন্যের যা ইচ্ছা হোক নিজে ঠিক থাকলে জগৎ ঠিক। শুনে ভাল লাগল। একটা ঘটনা ঘটলে চিৎ হয়ে পড়ে যেতে হবে না-কি? দুর্ঘটনা মানুষের জীবনে ঘটে না? সব সময় ঘটে।

ভাইজান, আমার খুবই মাথা ধরেছে।

দিন রাত একটা ঘরে বন্দি হয়ে থাকলে মাথা ধরবে না? মাথা ধরবেই।–আমার কথা শোন, মাথা থেকে সব কিছু বাদ দে—আয় আমরা তোর জীবন নিয়ে নতুন করে চিন্তা ভাবনা কবি।

নতুন চিন্তা ভাবনাটা কি? আমাকে বিয়ে দেবার কথা ভাবছেন?

যদি ভাবি–অসুবিধা কোথায়? তোর বয়স অল্প, সারাটা জীবন পড়ে আছে সামনে।

সুরাইয়া হতভম্ব গলায় বলল, ইমনের বাবা বেঁচে থাকতেই আমি আরেকটা বিয়ে করে ফেলব?

বেঁচে আছে তোকে কে বলল?

মরে গেছে সেটাই বা কে বলল? তা ছাড়া আমি জানি বেঁচে আছে। আর যদি নাও থাকে–বিয়েতো আমি করব না।

খুব ভাল একটা ছেলে পেয়েছিলাম। ইণ্ডেটিং-এর ব্যবসা করে। বয়স অল্প। রোড অ্যাকসিডেন্টে স্ত্রী মারা গেছেন।

আপনি চান আমি আমার দুই বাচ্চা নিয়ে তার ঘাড় ধরে ঝুলে পড়ি?

ভাইজান যখন আপনার মনে হবে আমাদের আর পালতে পারছেন না, অসুবিধা হচ্ছে, তখন বলবেন আমি চলে যাব।

কোথায় যাবি?

কোথায় যাব সেটা আমার ব্যাপার। ভাইজান এখন আপনি যান, আমার এমন মাথা ধরেছে যে ইচ্ছা করছে দেয়ালে মাথা ঠুকি।

জামিলুর রহমান সাময়িক ভাবে উঠে চলে যান। তবে কিছুদিন পর আবারো আরেকটি ছেলের সন্ধান নিয়ে উপস্থিত হন—

বুঝলি, ভদ্রলোকের বয়স সামান্য বেশী। মনে হয়। ফিফটি ক্রস করেছে তবে ভাল স্বাস্থ্য। চেহারাও সুন্দর। দেখলে মনে হয় বয়স থাটি ফাইভ, থাটি সিক্স। হাইলি এড়ুকেটেড। ইলীনয় ইউনিভার্সিটি থেকে এম. এস. করেছে। আমেরিকান এক মেয়ে বিয়ে করেছিল। বিয়ে টিকে নি। আমেরিকান মেয়ে বুঝতেই পারছিস–বিয়েটা ওদের কাছে একটা খেলা। কিছু দিন Honey Honey বলা তারপর সোপ-নেউলের খেলা।

মেয়ে না, আমি বাঙ্গালী মেয়ে এবং বিয়েটা আমার কাছে খেলা না। আমার একবার বিয়ে হয়েছে। আমার স্বামী আমাকে তালাকও দেয় নি—মরেও যায় নি। আমি আবার বিয়ে করব কেন?

কোন স্বামী যদি দুই বছর তার স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ না রেখে নিরুদেশ থাকে তাহলে সেই বিয়ে অটোমেটিক্যালি তালাক হয়ে যায়।

কে বলেছে?

মওলানা সাহেব বলেছেন।

মওলানা সাহেবদের বিয়ে হয়ত তালাক হয়ে যায়। ইমনের বাবাতো মাওলানা না।



ইমনের বাবা বেঁচে আছেন, তিনি একদিন ফিরে আসবেন এই বিষয়টা সুরাইয়া মনে প্ৰাণে বিশ্বাস করে। সুরাইয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো একজন বিশ্বাস করে সে সুরাইয়ার ভাবী–ফাতেমা।

জামিলুর রহমান যেমন অতিরিক্ত চালাক, তার স্ত্রী ফাতেমা তেমনি অতিরিক্ত বোকা। জগতের বোকারা ভালমানুষ ধরনের হয়। ফাতেমা বেগম তা না। ভােলমানুষী কোন ব্যাপারই তার মধ্যে নেই। সুরাইয়া তার পুত্র কন্যা নিয়ে এই সংসারে সিন্দাবাদের ভূতের মত চেপে আছে–এই ব্যাপারটা তার কাছে অসহনীয় লাগে। বোকা মানুষ বলেই তিনি মনের ভাব গোপন রাখেন না–সরাসরি বলেন। পানের পিক ফেলে গম্ভীর গলায় বলেন, একটা কিছু ব্যবস্থাতো নেওয়া দরকার। আর কত দিন। আমার ছেলেপুলে বড় হচ্ছে।

তারপরেও সুরাইয়া তার ভাবীকে খুব পছন্দ করে কারণ ফাতেমারও ধারণা ইমনের বাবা বেঁচে আছে। কোন একদিন ফিরে আসবে।

সেই কোন একদিনটা কবে? সেটা ফাতেমা জানেন না। সুরাইয়াও জানে না। সুরাইয়ার কেন জানি মনে হয় লোকটা ফিরবে গভীর রাতে। হয়ত ৰূপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে। এর মধ্যেই ভিজতে ভিজতে উপস্থিত হবে। সুরাইয়া দরজা খুলে দেবে। সে ঢুকবে খুব সহজ ভাবে। যে কোন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক থাকা হচ্ছে লোকটার স্বভাব। সে তার স্বভাব মত বলবে, দেখি, একটা তোয়ালে দেখি। মাথাটা ভিজে গেছে। সুরাইয়া তোয়ালে এগিয়ে দেবে। মানুষটা মাথা মুছতে মুছতে বলবে, তুমি কেমন আছ?

সে বলবে, ভাল।

এত রোগা লাগছে কেন, শরীর খারাপ?

সেও সহজ ভাবেই বলবে, না শরীর ঠিকই আছে। যে যেমন তার সঙ্গে সে রকম আচরণই করতে হয়। মানুষটা এক পর্যায়ে বিছানার দিকে তাকিয়ে বলবে, ইমনের পাশে শুয়ে আছে। এই ছোট মেয়েটা কে?

ওর নাম সুপ্ৰভা।

সুপ্ৰভা কে?

সুপ্ৰভা হল ইমনের ছোট বোন।

বল কি? সুন্দর হয়েছে।তো!

হ্যাঁ সুন্দর হয়েছে। ওকে ডেকে তুলব, কোলে নেবে?

না থাক, ঘুম ভাঙ্গিয়ে দরকার নেই। ইমানতো দেখি অনেক বড় হয়েছে।

বড়তো হবেই। তুমি কি ভেবেছিলে যে রকম রেখে গেছ ফিরে এসে সে রকম দেখবো?

মানুষটা কথা ঘুরাবার জন্যে বলবে, ঠাণ্ড লেগে গেছে, চা খাওয়াতে পারবে।

অবশ্যই পারব। কেন পারব না। তুমি ভাত খাবে না?

হ্যাঁ খাব। ভাতও খাব। গোসল করতে হবে, সাবান দাওতো।

ভাত খাবার আগেই চা খাবে, নাকি ভাত খাবার পর চা খাবে?

চা খেয়ে গোসল খানায় ঢুকব। আচ্ছা, এই বাড়িটা কার?

বাড়িতো বেশ বড়।

মানুষটা চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকবে–সুরাইয়া যাবে চা বানাতে। শুধু চা বানালে হবে না। ভাত চড়াতে হবে। গরম ভাত। ভাতে এক চামচ ঘি, ডিম ভাজা। ডিম ভাজার সঙ্গে শুকনো মরিচ ভাজা। নতুন আলু ডোবা তেলে মচমচে করে ভাজা! মানুষটার খুব প্রিয় খাবার।

সুরাইয়া রোজ রাতে দীর্ঘ সময় নিয়ে কাল্পনিক কথোপকথন চালায়। একেক রাতের কথা বার্তা হয় একেক রকম। রাতের এই কথোপকথন অংশটা তার বড় ভাল লাগে।

ইমন অন্ধকারে সিঁড়িঘরের নিচে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। জায়গাটা বিশ্রী রকমের অন্ধকার, সেই কারণে তার ভয় লাগছে। আবার অন্ধকার থেকে বারান্দায় আলোতে আসতে পারছে না। সে পেনসিল হারিয়ে ফেলেছে। স্কুলের ব্যাগ গুছাতে গিয়ে ধরা পড়েছে পেনসিল নেই। এই দুঃসংবাদ মাকে না দিয়ে উপায় নেই। সে মাকে বলল।

সুরাইয়া ধমক ধামক কিছুই দিল না। শান্তগলায় বলল, যেখান থেকে পার পেনসিল খুঁজে আন। পেনসিল না। এনে আজ ঘুমুতে পারবে না।

ঘন্টা খানিক আগে সে মার সরে উঁকি দিয়েছিল। সুরাইয়া তাকে দেখেই বলল, পেনসিল পেয়েছ?

ইমন বলল, না।

পেনসিল পাওনি তাহলে এসেছ কেন? বললাম না, পেনসিল না পেলে আসবে না। কথা কানে যায় না? বাঁদর ছেলে।

রাত দশটার মত বাজে। অন্যদিন এই সময়েও বাড়ি গমগম করে, আজ মনে হয় সবাই শুয়ে পড়েছে। বাড়ি নিঝুম। ইমন কি করবে বুঝতে পারছে না। এ বাড়িতে যদি ছোট চাচা থাকতেন তাহলে তাকে কানে কানে বললেই–যত রাতই হোক তিনি দোকান থেকে পেনসিল কিনে আনতেন। ছোট চাচা নেই। এখন যে সে কাঁদছে, ভয়ে কাঁদছে না–ছোট চাচার জন্যে কাঁদছে। কান্দতে কাঁদতেই তার মনে হল–বাবা থাকলে বাবা কি তার পেনসিল কিনে আনতেন? বলা যাচ্ছে না। বাবা কেমন ছিলেন, তিনি কি করতেন সে দ্রুত ভুলে যাচ্ছে। বাবার চেহারাও এখন তার মনে নেই, শুধু মনে আছে। বাবা খুব ফর্সা ছিলেন। আগের বাড়িতে বাবা-এবং মার একটা ছবি ছিল ড্রেসিং টেবিলে সাজানো। সেই ছবিটা এ বাড়িতেও নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু মা ট্রাংকে রেখে দিয়েছেন। ছবিটা সাজানো নেই। ছবি সাজানো থাকলে সে মাঝে মাঝে দেখত।

কে? কে বসে আছে?

ইমন চমকে উঠল— মিতু। অন্ধকারে পা টিপে টিপে কখন যে সামনে এসেছে সে বুঝতেই পারেনি।

ক্যাবলা, তোর কি হয়েছে?

চোখ মুছতে মুছতে ইমন বলল, পেনসিল হারিয়ে ফেলেছি।

পেনসিল হারিয়ে ফেললে এখানে বসে কাঁদছিস কেন?

ইমন জবাব দিল না। মিতু বলল, ফুপু বকা দিয়েছে?

হুঁ।

কি বলেছে পেনসিল না পেলে ঘরে ঢুকতে পারবি না!

হুঁ।

কি রঙের পেনসিল?

হলুদ।

আচ্ছা আমি এনে দিচ্ছি। একটা কথা শোন, তোর যদি কিছু হারিয়ে যায় আমাকে বলবি আমি এনে দেব। একা একা বসে কাঁদবি না।

ইমন ধরা গলায় বলল, আচ্ছা।

মিতু দুটা পেনসিল এনে দিল—একটা হলুদ, একটা সবুজ। হলুদটা স্কুল ব্যাগে রাখবে, সবুজটা কোথাও লুকিয়ে রাখবে। যদি আবারো পেনসিল হারায় তখন কাজে লাগবে।

সুরাইয়া ইমনকে ঘরে ঢুকতে দেখে বলল, পেনসিল পাওয়া গেছে? ইমন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। সুরাইয়া বলল, আবার যদি কিছু হারায় টেনে তোমার কান আমি ছিড়ে ফেলব, বাঁদর ছেলে। আমি বাবার নাম ভুলিয়ে দেব। বাবা নেই, বাবার নাম মনে রেখে কি হবে? যাও হাত মুখ ধুয়ে ঘুমুতে আস।

ইমন বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে ঘুমুতে এল। আগে মাঝখানে ঘুমুতেন। সুরাইয়া, তারা দুই ভাই বোন দুপাশে ঘুমুতো। এক রাতে সুপ্ৰভা গড়াতে গড়াতে খাট থেকে পড়ে গেল। তার পর থেকে সুপ্ৰভা মাঝখানে শোয়। শোয়ার এই ব্যবস্থােটা তার খুব ভাল লাগে। মাঝে মাঝে সুপ্ৰভাকে হাত দিয়ে ছোয়া যায়। সুপ্ৰভা যখন জেগে থাকে তখন তাকে হাত দিয়ে ছুলে খুব মজার একটা কাণ্ড হয়, সুপ্ৰভা খিল খিল করে হাসতে থাকে। সেই হাসি আর থামে না। যে কেউ হাত দিয়ে ছুলে সুপ্ৰভা এমন করে না। শুধু ইমান হাত দিয়ে ছুলেই এমন করে। যেন তার হাতে হাসির কোন ওষুধ আছে। ইমন নিজে যখন সুপ্রভার মত ছোট ছিল তখন সেও কি এরকম করতো? মাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছে না। ছোট চাচাকে জিজ্ঞেস করতে

হবে।

ইমন।

জ্বি মা।

স্কুলে পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?

ভাল।

আকাশ ইংরেজী কি?

স্কাই।

বানান কর।

এস কে ওয়াই।

আকাশ নীল ইংরেজী কি?

দ্যা স্কাই ইজ ব্লু।

মাঝে মাঝে যে আমি তোমার উপর খুব রাগ করি তখন কি মন খারাপ হয়?

না।

মিথ্যা কথা বলছি কেন? যদি মন খারাপ হয় বলবে, মন খারাপ হয়। কি হয়?

হ্যাঁ হয়।

শোন, আমি নিজে নানান দুঃখ কষ্টে থাকিতো এই জন্য এমন ব্যবহার করি। আদর করা কি জিনিস ভুলে গেছি। যে আদর পায় না, সে আদর করতেও পারে না। বুঝতে পারছি?

হুঁ।

তোমার বাবাও কিন্তু আদর করতে পারত না। সব মানুষ সব কিছু পারে না। তোমার বাবা কি ভাবে তোমাকে আদর করত মনে আছে?

না।

সে অফিস থেকে এসে তোমাকে কোলে নিয়ে পাঁচ মিনিট হাঁটাহাঁটি করত— এইটাই তার আদর। চুমু খাওয়া, কিংবা উপহার কিনে দেয়া এইসব তার স্বভাবে ছিল না। তুমি বড় হয়ে কার মত হবে তোমার বাবার মত হবে?

না।

তাহলে কার মত হবে?

ছোট চাচার মত।

কেউ কারো মত হতে পারে না। সবাই হয় তার নিজের মত। তুমি হাজার চেষ্টা করেও তোমার ছোট চাচার মত হতে পারবে না, কিংবা তোমার বাবার মত হতে পারবে না। সব মানুষই আলাদা।

কচ্ছপ, কচ্ছপরাও কি আলাদা?

হঠাৎ কচ্ছপের কথা এল কেন? আর কোন কথা না, ঘুমাও।

আচ্ছা।

ও ভালকথা, তোমার ছোট চাচা তোমাকে নিয়ে দেশের বাড়িতে বেড়াতে যেতে চায়। তুমি কি যেতে চাও?

আনন্দে ইমনের কথা বন্ধ হয়ে গেল। তার ইচ্ছা করছে। চিৎকার করে কেঁদে উঠতে। এমন চিৎকার যেন সুপ্রভারও ঘুম ভেঙ্গে যায়। ভয় পেয়ে সেও যেন কাঁদতে থাকে।

কথা বলছি না কেন, যেতে চাও না?

চাই।

একা একা যেতে ভয় লাগবে না?

না।

আমাকে ফেলে রেখে যাবে কষ্ট হবে না?

না।

সেকি —আমাকে, সুপ্ৰভাকে ফেলে চলে যাচ্ছ, কষ্ট হবে না?

সুপ্রভার জন্যে হবে। সুপ্ৰভাকে তোমার আদর লাগে?

হুঁ।

আচ্ছা অনেক কথা হয়েছে, এখন ঘুমাও। না-কি একটা গল্প শুনতে চাও?

ইমন গল্প শুনতে চাচ্ছে না, কিন্তু বুঝতে পারছে কোন একটা অদ্ভুত কারণে তার মার মন খুব ভাল। মা গল্প বলতে চাচ্ছেন। সেই অদ্ভুত কারণটা কি?

গল্প শুনতে চাও?

চাই।

একদেশে ছিল এক রাজ কন্যা। রাজকন্যা ছিল বন্দিনী। তার জীবনটা কাটছিল চারদেয়ালের মধ্যে। তার মুক্তির একটাই পথ—যদি কোন সাহসী রাজপুত্ৰ বাঘের চোখ দিয়ে মালা গেথে রাজকন্যার গলায় পরিয়ে দেয়। তবেই রাজকন্যা মুক্তি পাবে। গল্পটা কেমন লাগছে ইমন?

ইমন ফিস ফিস করে বলল, খুব ভাল লাগছে। আসলে গল্পটা তার মোটেই ভাল লাগছে না। বাঘের চোখের মালার কথা ভাবতেই তার ঘেন্না লাগছে। সে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে—অনেকগুলি বাঘ গভীর জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এদের কারোরই চোখ নেই। ভয়ংকর এক রাজপুত্র তাদের চোখ উপড়ে নিয়েছে। অন্ধ বাঘের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ঘুমিয়ে পড়েছ?

না।

তাহলে শোন—বন্দিনী রাজকন্যাকে উদ্ধারের জন্যে এক রাজপুত্র বের হল বাঘের সন্ধানে। তার খুব সাহস। সে দেখতেও খুব সুন্দর।

মা তার নাম কি?

ও আচ্ছা, তার নামতো বলা হয়নি। রাজপুত্র যেমন সুন্দর তার নামটাও খুব সুন্দর–রাজপুত্রের নাম ইমন কুমার। নামটা সুন্দর না।

ইমনের খুব লজ্জা লাগছে। রাজপুত্রের নাম আর তার নাম একই। ইমনের খুব ইচ্ছা করছে মার গায়ে হাত রেখে শুয়ে থাকতে। সেটা সম্ভব নামাঝখানে সুপ্ৰভা শুয়ে আছে।

ইমন।

হুঁ।

বাবা ঘুমাও। আমার গল্প বলতে আর ভাল লাগছে না।

সুরাইয়ার শুধু যে ভাল লাগছে না তা না, তার মনটাই খারাপ হয়ে গেছে। সে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিল গল্পের মাঝখানে ইমন বলবে–মা, এই গল্পটা আমি জানি। তুমি অন্য গল্প বল। এই গল্প ইমনের বাবা ইমনকে বলেছিলেন। ছেলের সেই গল্পের কথা মনে নেই। বাবাকে এত দ্রুত সে ভুলে যাচ্ছে। এত দ্রুত?
 
০৫.

নিজেকে ইমনের খুব বড় মনে হচ্ছে। যেন হুট করে একদিনে অনেক বড় হয়ে গেছে। সে সবাইকে রেখে একা একা গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছে। ছোট চাচা অবশ্যি সঙ্গে যাচ্ছেন তারপরেও সে একা একা যাচ্ছে—এটা ভাবা যায়! ইমনের হাতে ছোট্ট ব্যাগ। ব্যাগে জামা কাপড়। টুথপেষ্ট, টুথব্রাস। একটা চিরুনী।

সুরাইয়া ছেলের হাতে দুটা দশ টাকার নোট দিল। ইমন সেই নোট দুটা গম্ভীর ভঙ্গিতে সার্টের পকেটে নিল। সুরাইয়া বলল, খুব সাবধানে থাকবে।

ইমন মাথা কাত করল।

গ্রামে অনেক পুকুর-টুকুর আছে। সাবধান, একা একা পুকুরে যাবে না। জঙ্গল টঙ্গলেও যাবে না, সাপ খোপ আছে। মনে থাকবে?

হুঁ।

আচ্ছা তাহলে যাও। রাতে ছোট চাচার সঙ্গে থাকবে। বাথরুম পেলে তাকে জাগাবে—গ্রামের বাথরুম দূরে হয়

আচ্ছা।

বাহ, আমাদের ইমন কুমারকেতো খুব স্মার্ট লাগছে। কাছে এসো কপালে চুমু খেয়ে দি।

ইমন কাছে গেল। মা যখন কপালে চুমু খেলেন তখন হঠাৎ তার মনে হল–মা কে ছেড়ে সে থাকতে পারবে না। গ্রামেব বাড়িতে না গেলেই সবচে ভাল হয়। ইচ্ছাটা হল খুব অল্প সময়ের জন্যে।

টেনে উঠে ইমনের মনে হল সে শুধু বড় না, অনেক বড় হয়ে গেছে। কারণ ছোট চাচা তার ট্রেনের টিকিট তার হাতে দিয়েছেন। টিকিট দেয়ার সময় বলেছেন–হারাবি না, হারালে টিকেট চেকার ফাইন করে দেবে। ইমনকে ছোট চাচার কোলে বসতে হল না। তার জন্যে জানালার কাছে আলাদা সীট। ছোট চাচা চা খেলেন, সেও খেলো। ঠিক বড়দের মত আলাদা কাপে। ট্রেনের জানালা দিয়ে দৃশ্য দেখতে তার কি যে ভাল লাগছিল। মনে হচ্ছিল সে সারাজীবন টেনে কাটিয়ে দিতে পারবে। এরমধ্যে ছোট চাচা বললেন–এই যে মিষ্টার হার্ড নাট। আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমাব। তোর দায়িত্ব হচ্ছে ষ্টেশনের নোম পড়তে পড়তে যাওয়া। যখন দেখবি ষ্টেশনের নাম নান্দাইল রোড তখন আমাকে ডেকে তুলবি। ট্রেন ষ্টেশনে ঢুকতেই জানোলা দিয়ে মাথা বের করে ষ্টেশনের নোম পড়া কি রোমাঞ্চকর ব্যাপার।



গ্রামের বাড়ি দেখে ইমন আনন্দে অভিভূত হল। কি অদ্ভুত বাড়ি। টিনের চাল। ছোট ছোট জানালা। চারদিকে এত গাছপালা যেন মনে হয়। জঙ্গলের ভেতর বাড়ি। একটা কুমড়ো গাছ বাড়িটার চালে উঠে গেছে। সেই গাছ ভর্তি কুমড়ো। উঠোনে সত্যিকার একটা মা ভেড়া চারটা বাচ্চা নিয়ে বসে আছে। ইমন যখন তার সামনে দাঁড়াল ভেড়াটা একটুও ভয় পেল না। বাচ্চা ভেড়াদের একটা আবার এসে ইমনের গা শুকতে শুরু করল।

বিস্ময়ের উপর বিস্ময় বাড়িতে দুটা রাজ হাঁস। তারা গলা উঁচু করে কি গম্ভীর ভাবে হাঁটছে। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। ছোট চাচা অবশ্যি বললেন, রাজ হাঁস দুটা খুবই ত্যাদড়। খবরদার কাছে যাবি না। কামড় দেয়। কি অদ্ভুত কথা, হাঁস আবার মানুষকে কামড় দেয়। হাঁস কি কুকুর না-কি যে কামড়াবে?

আকলিমা বেগম নাতীকে দেখে ডাক ছেড়ে কাঁদতে শুরু করলেন। কাঁদেন আর একটু পর পর বলেন, আমার ইমাইন্যা আইছে। তোমরা কে কই আছ— দেইখ্যা যাও আমার ইমাইন্যা আইছে। দাদীর কান্না দেখে ইমনের লজ্জা লাগছে–আবার ভালও লাগছে। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। এমন বুড়ো একজন মানুষ তার মত ছোট্ট একজনকে এত ভালবাসে কেন। দাদীজানের শরীর অবশ। শুধু ডান হাতটা নাড়াতে পারেন। সেই হাতে তিনি ইমনকে ধরে আছেন। কিছুতেই ছাড়ছেন না। হাতে ন্যাপথলিনের গন্ধ। বুড়ো মানুষদের হাতে কি ন্যাপথালিনের গন্ধ হয়?

ইমনের সারাটা দিন কাটল ভয়াবহ উত্তেজনায়। দুবার তাকে রাজহাঁস তাড়া করল। এতে ভয় যেমন লাগছিল মজাও লাগছিল।

বড়ই গাছে উঠে সে নিজের হাতে পাকা বড়ই পেড়ে খেলো। বড়ই গাছে নিজে নিজে ওঠা কঠিন। তবে ছোট চাচা একটা টেবিল এনে গাছের সঙ্গে লাগিয়ে দিলেন। টেবিল থেকে চট করে গাছে ওঠা যায়। তবে খুব বেশী দূর ওঠা যায় না। গাছ ভর্তি কাঁটা।

ছোট চাচা কামরাঙ্গা গাছের ডালে একটা দোলন টানিয়ে দিলেন। খুব অদ্ভুত দোলন–চেয়ার দোলনা। একটা চেয়ারের হাতলের সঙ্গে দড়ি বেঁধে গাছের ডালে ঝলিয়ে দেয়া! কি যে মজার দোলনা। মনে হয় চেয়ারে বসে আছে, সামনে টেবিল। চেয়ার এবং টেবিল দুটাই দুলছে।

তারপর সে ছোট চাচার সঙ্গে গেল ছিপ ফেলে পুকুরে মাছ ধরতে। দুজনের হাতে দুটা ছিপ। ছোট চাচার বড় ছিপ, তার ছোট ছিপ। মাটি খুঁড়ে কেঁচো বের করে, কেঁচো দিয়ে টোপ দেয়া হল। খুবই ঘেন্নার কাজ। মাছ মারতে হলে একটু ঘেন্নার কাজ করতেই হয়। ঢাকার কেউ বিশ্বাস করবে না, কিন্তু ঘটনা একশ ভাগ সত্যি। ইমন তার ছিপে একটা সরপুটি মাছ ধরে ফেলল। মাছটা ধরে তার এত আনন্দ হল যে শব্দ করে কেঁদে ফেলল। ছোট চাচা বিরক্ত হয়ে বললেন, আরো গান্ধা! মাছ ধরে কাঁদছিস কেন? এখানে কাদার কি হল? মাছ ধরতে না পেরে কাদলেও একটা ব্যাপার ছিল। এত বড় মাছ ধরে ফিচ, ফিচ কান্না। ছিঃ!

নিজের মারা সরপুটি মাছ ভাজা দিয়ে সে দুপুরে ভাত খেল। আরো অনেক খাবার ছিল, মুরগীর মাংসের কোরমা ছিল, ডিমের তরকারী ছিল–তার আর কিছুই খেতে ইচ্ছে করল না।

পরদিন আরো বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল। ছোট চাচা বললেন, আয় তোকে সাঁতার শিখিয়ে দি। এক দিনে সাঁতার। আমি সাঁতার শিখানোর একজন ওস্তাদ।

সাঁতার শিখতে হলে প্রথম কোন কাজটা করতে হয় বল দেখি?

জানি না।

প্রথম পানিতে নামতে হয়। পানিতে না নেমেও সাঁতার শেখা যায়। সেই সাঁতারের নাম শুকনা সাঁতার। স্থলে বেঁচে থাকার জন্যে এই সাঁতার খুবই প্রয়োজনীয়। বেশীর ভাগ মানুষ শুকনা সাঁতার জানে না বলে স্থলে ভেসে থাকতে পারে না।

তুমি পার?

না, আমিও পারি না।

ইমন ভয়ে ভয়ে চাচার হাত ধরল। পুকুরটাকে খুব গভীর মনে হচ্ছে। পানি কি পরিষ্কার-টলটল করছে। ফিরোজ বলল, ঝুপ করে পানিতে নাম। একদিনে সাঁতার।

ইমন অবাক হয়ে বলল, সত্যি সত্যি একদিনে সাঁতার শিখব।

তোর যদি ইচ্ছা থাকে শিখতে পারবি। ইচ্ছা আছে?

আছে।

পানিতে আমার সঙ্গে নামবি কিন্তু পানিকে ভয় করতে পারবি না। পানিকে ভয় করলে একদিনে সাঁতার শিখতে পারবি না। শুধু মনে রাখবি আমি যখন আছি তখন তুই ড়ুববি না। আমি ধরে ফেলব। আমার উপর বিশ্বাস রাখতে হবে। পারবি বিশ্বাস রাখতে?

পারব।

তাহলে আয়। শুরু করা যাক। প্রথম এক ঘন্টা শুধু পানিতে দাপাদাপি করবি আমি তোর পেটে হাত দিয়ে তোকে ভাসিয়ে রাখব।

ফিরোজ ইমানকে ভাসিয়ে রাখছে। ইমন প্ৰাণপণে দাপাদাপি করছে। প্রথমে একটু শীত লাগছিল, দাপাদাপির কারণে এখন আর শীত লাগছে না। ইমনের মনে হচ্ছে সে তার বাকি জীবনটা পানিতে দাপাদাপি করে কাটিয়ে দিতে পারবে। সঙ্গে শুধু একজনকে লাগবে যে তাকে ভাসিয়ে রাখবে। ছেড়ে দেবে না।

ইমন দুঘন্টার মাথায় সত্যি সত্যি সাঁতার কাটল। ইমনের চেয়েও অনেক বেশী অবাক হল ফিরোজ। সে মুগ্ধ গলায় বলল—হার্ড নাট! তুইতো সত্যি হার্ড নাট! সত্যি সত্যি একদিনে সাঁতার শিখে ফেললি? তুইতো বড় হয়ে গেছিসরে ব্যাটা!

গ্রামের বাড়ি থেকে ফেরার সময় ইমনের এত মন খারাপ হল যে বলার নয়। বিদায়ের দিন আকলিমা বেগম নাতীকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন। এক ফোঁটাও চোখের জল ফেললেন না। বিদায়ের সময় চোখের জল ফেলতে নেই, অমঙ্গল হয়। এমিতেই এই পরিবারে অমঙ্গলের ছায়া পড়ে আছে। আকলিমা বেগম ধরা গলায় বললেন, ইমাইন্যা।

ইমন বলল, জ্বি দাদীমা।

তোরে একটা কথা বলি—তুই যখন বড় হইয়া বিয়া করবি তখন বউরে নিয়া আসবি। আমিতো বাঁইচ্যা থাকব না। তোরা দুইজনে আমার কবরের সামনে খাড়াবি।

ইমন মাথা কাত করে বলল, জি আচ্ছা।

তোর লাগি আমি আল্লাহ পাকের কাছে খাস দিলে দোয়া করছি। আমার দোয়া আল্লাহপাক কবুল করছেন।

আকলিমা বেগম নাতীর হাতে কাপড়ে মোড়া একটা ছোট্ট উপহার তুলে দিলেন।
 
০৬.

জামিলুর রহমান সাহেবের বাড়িতে আজ ভয়াবহ উত্তেজনা। তিনি অফিসে যাননি। বারান্দার বেতের চেয়ারে বসে আছেন। হাতে মোটা একটা দড়ি। তার সামনের টেবিলে চা দেয়া হয়েছে। তিনি চা খাচ্ছেন না। চা ঠান্ডা হচ্ছে। আজ টোকন-শোভন দুই ভাইকে শান্তি দেয়া হবে। এই শাস্তি মাঝে মধ্যেই দেয়া হয়। শাস্তি প্রক্রিয়া ভয়াবহ।

ফাতেমা চিন্তিত মুখে হাঁটাহাঁটি করছেন। শোভন টোকনকে ঘরে ঢুকিয়ে তালা মেরে দেয়া হয়েছে। যথা সময়ে তালা খুলে জমিলুর রহমান সেই ঘরে দড়ি হাতে ঢুকবেন। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেবেন। পরের এক ঘণ্টা ভেতর থেকে পশুর গোংগানীর মত শব্দ আসবে।

ফাতেমা স্বামীর সামনে দাঁড়ালেন। নিচু গলায় বললেন, চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। আরেক কাপ বানিয়ে দেব?

জামিলুর রহমান বললেন, না।

ওরা কি করেছে।

কি করেছে তোমার জানার দরকার নেই।

ফাতেমা প্রায় ফিস ফিস করে বললেন, ছেলেমানুষ।

জামিলুর রহমান বললেন, দুদিন পর এস.এস.সি পরীক্ষা দেবে। ছেলেমানুষ মোটেই না। দাড়ি গোফ উঠে গেছে–ছেলেমানুষ কি?

কর। তুমি বাবা, তুমিতো শাসন করতেই পার। আমার এই অনুরোধটা রাখ।

জামিলুর রহমান বললেন, যাও, চা আন। ফাতেমাকে যত বোকা মনে হয় তত বোকা তিনি বোধ হয় না। চা বানানোর কথা বলে তিনি সময় নিচ্ছেন। যত সময় যাবে রাগ তত পড়বে। চা বানিয়ে সুপ্রভার হাতে দিয়ে পাঠাতে হবে। মানুষটা এক মাত্র সুপ্রভার সঙ্গে সহজভাবে কথা বলে। সুপ্ৰভা হাত নেড়ে নেড়ে কি সব গল্প করে–মানুষটা আগ্রহ নিয়ে শুনে। সুপ্রভাকে বলতে হবে মজার কোন দীর্ঘ গল্প সে যেন শুরু করে।

ফাতেমা নিজেই চা বানাতে গেলেন। অনেক দিন চুলার পাশে যান না। শরীর ক্রমেই ভারী হয়ে যাচ্ছে। আগুনের আঁচ আজিকাল আর সহ্য হয় না। মাথা দপ দপ করে।

তালাবন্ধ ঘরের খাটে শোভন টোকন বসে আছে। শোভনকে মোটেই চিন্তিত মনে হচ্ছে না। তবে টোকন ভয় পেয়েছে। তার মধ্যে ছটফটানির ভাব স্পষ্ট। সে বারবারই বন্ধ দরজার দিকে তাকাচ্ছে।

তাদের অপরাধ মোটামুটি গুরুতর। এই অপরাধ আগে কয়েকবার করেছে, ধরা পড়ে নি। আজ সকালে ধরা পড়ে গেছে। ধরা পড়ার কোন কারণ ছিল না। দুই ভাইয়ের হিসেবে সামান্য গন্ডগোল হয়ে গেছে।

জামিলুর রহমান সকালবেলা বাথরুমে অনেকখানি সময় কাটান। তিনি খবরের কাগজ নিয়ে বাথরুমে ঢুকেন এবং কাগজ শেষ করে বের হন। খুব কম করে হলেও পনেরো মিনিট সময় লাগে। বাবার কোটের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে কিছু টাকা সরানোর জন্যে এই সময়টা যথেষ্ট। তারা তাই করল। কিন্তু সামান্য গন্ডগোল হয়ে গেল। মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করার সময় জামিলুর রহমান শোবার ঘরে ঢুকলেন। জমিলুর রহমান বললেন, তোরা আয় আমার সঙ্গে। তারা বাবার সঙ্গে গেল। এইখানে আরো একটা ভুল করা হল। তারা দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারত। পালিয়ে যাওয়া হল না। জামিলুর রহমান দুই ছেলেকে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা দিয়ে দিলেন।

শোভনের পানির পিপাসা পেয়েছে। শাস্তি কখন শুরু হবে বলা যাচ্ছে না, পানি খেয়ে নিতে পারলে ভাল হত। পেছনের দিকের জানালাটা খোলা। সেই জানোলা দিয়ে এক জগ পানি যদি কেউ দিত। শোভন খাট ছেড়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়াল। জানালায় লম্বা করে শিক বসানো। একটা শিক বাকানো কোন কঠিন কাজ না। শাবল দিয়ে চাড় দিলেই শিক বাঁকবে। দারোয়ান ভাইয়ের ঘরে শাবল আছে।

জানালার পাশে ইমনের মুখ দেখা গেল। ভয়ে তার মুখ শাদা হয়ে গেছে। টোকন-শোভন দুই ভাইই তার খুব প্রিয় মানুষ। রাতে সে এই ঘরে তাদের সঙ্গে ঘুমায়। এদের ভয়াবহ শাস্তি কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হবে। ভাবতেই তার বুক শুকিয়ে আসছে। এর আগের বার শোভন অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। ডাক্তার আনতে হয়েছে, স্যালাইন দিতে হয়েছে। আজও নিশ্চয়ই সে রকম হবে।

ইমন!

হুঁ।

যা–চট করে এক জগ পানি নিয়ে আয়।

ইমন ছুটে গেল পানি আনতে। পানির জগ শিকের ফাঁক দিয়ে ঢুকছে না। সে জগ বদলে দুটা পানির বোতল নিয়ে এল। শোভন বলল, বাবা কি করছে রে?

চা খাচ্ছেন।

হাতে দড়ি আছে?

হুঁ।

তুই একটা কাজ কর। দারোয়ান ভাইয়ের ঘর থেকে শাবলটা নিয়ে আয়। শাবল দিয়ে শিকে চাড় দিয়ে শিক বাকিয়ে ফেলবি। আমরা পগার পার হয়ে যাব। পারবি না?

পারব।

তাহলে দেরি করিস না।

ইমন শাবল আনতে ছুটে গেল। জানালার শিক বাঁকানোর কাজটা খুব সহজেই হয়ে গেল। দুই ভাই মুহুর্তের মধ্যেই উধাও হয়ে গেল।

জামিলুর রহমান তালা খুলে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শীতল গলায় ডাকলেন, ইমন।

ইমন ফ্যাকাশে মুখে ঘরে ঢুকল। জমিলুর রহমান বললেন, তুই কাপছিস কেন? তুই কি করেছিস? ওদের সাহায্য করেছিস?

ইমন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।

কি ভাবে সাহায্য করেছিস?

শাবল এনে দিয়েছি।

সার্ট খোল।

ইমন সার্ট খুলল।

বিছানায় উপুড় হয়ে থোক। আজ তোকে এমন একটা শিক্ষা দেব যে, জীবনে কখনো অপরাধীকে সাহায্য করবি না।

জামিলুর রহমান ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দড়ি হাতে নিলেন। ইমন দাঁত কামড়ে পড়ে আছে। তার মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে মারা যাবে। দরজা বন্ধ। ইচ্ছা থাকলেও কেউ তাকে বাচানোর জন্যে আসবে না। প্রচন্ড শারীরিক যন্ত্রণার সময় কোন প্রিয়জনকে ডাকতে ইচ্ছা করে। ইমান ফিস ফিস করে ডাকছে –ছোট চাচা। ও ছোট চাচা। বাতাস কেটে দড়ি শী শী শব্দে নিচে নেমে আসছে। এই শব্দে ইমনের ডাকাডাকি চাপা পড়ে যাচ্ছে। ইমন অজ্ঞান হয়ে যাবার আগমুহুর্তে দেখল— জানালার শিক ধরে মিতু এসে দাঁড়িয়েছে। মিতুর গোলাকার মুখ লালচে হয়ে আছে। মিতু তীব্র স্বরে— সারা বাড়ি কাঁপিয়ে চিৎকার করে বলল— বাবা বাবা।

এরপরে কি ঘটেছে ইমনের মনে নেই।

সন্ধ্যাবেলা ফিরোজ এসে হতভম্ব! ইমন অর্ধচেতনের মত পড়ে আছে। তার সারা গায়ে ব্যাণ্ডেজ। শরীরে জ্বর। ঠোঁট কেটে ফুলে উঠেছে।

ফিরোজ বলল, তোর কি হয়েছে?

ইমন বলল, কিছু হয় নি।

কিছু হয়নি মানে? কে তোকে মেরেছে?

বড় মামা।

তোর বড় মামা কি পাগল? এইভাবে কেউ কাউকে মারে? সে পেয়েছে কি? বাড়িতে জায়গা দিয়ে মাথা কিনে নিয়েছে? তোর এখানে থাকতে হবে না। তুই চলতো।

কোথায় যাব?

আমার সঙ্গে যাবি। আমার মেসে থাকবি। মেসে থেকে পড়াশোনা করবি। তোকে আমি এই বাড়িতে রাখব না।

মা যেতে দেবে না ছোট চাচা।

যেতে দেবে না মানে? অবশ্যই যেতে দিতে হবে। আমি ভাবীর সঙ্গে কথা বলছি।

ফিরোজ দোতলায় উঠে গেল। সুরাইয়া দোতলার বারান্দায় টুলের উপর বসে ছিলেন। তার হাতে একটা বই। বইটার নাম স্বপ্ন তথ্য। স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেয়া। স্বপ্নের ব্যাখ্যা পড়তে তাঁর ভাল লাগে। ফিরোজকে দেখে তিনি বই বন্ধ করলেন। তার চোখে ঈষৎ বিরক্তি দেখা গেল।

ভাবী কেমন আছেন?

ভাল।

ইমনের কি অবস্থা। আপনি দেখেছেন?

দেখিনি— শুনেছি। অপরাধ করেছে–শাস্তি পেয়েছে।

এইভাবে কেউ কাউকে মারে?

ভাইজানের রাগ বেশী। তিনি যা করেছেন, ঠিকই করেছেন। শাসনের দরকার আছে। শুধু আদরে কিছু হয় না।

ভাবী, আমিতো ইমনকে এখানে রাখব না।

তুমি তাকে রাখা না রাখার কে? তুমি তাকে কোথায় নিয়ে রাখতে চাও? তোমার মেসে? খামাখা রাগ দেখিও না। খামাখা আদরও দেখিও না।

ভাবী, আমি কোন রাগ দেখাচ্ছি না। আমার মনটা খুব খারাপ হয়েছে।

এইসব মন খারাপের কোন দাম নেই। মাসে দুই মাসে একবার আসবে। সাথে থাকবে সস্তার কিছু খেলনা। খানিকক্ষণ কচলা-কচলি করে চলে যাবে। এইসব আদরের মানে কি?

ভাবী আপনি আমার উপর কেন রাগ করছেন বুঝতে পারছি না।

আমি রাগ করছি নাতো। তোমার উপর রাগ করব কেন?

ফিরোজ হতাশ গলায় বলল, ভাবী, আজ রাতটা আমি এই বাড়িতে থেকে যাব। ওর খুব জ্বর। ইমনের সঙ্গে ঘুমিয়ে থাকি। ওর পাশে কারোর থাকা দরকার।

সুরাইয়া স্বপ্ন তথ্যের বই খুলতে খুলতে শুকনো গলায় বললেন, বাড়তি আদর দেখানোর কোন দরকার নেই। ওদের কপালে অনাদর লেখা–আমি চাই ওরা যেন অনাদরেই মানুষ হয়।

আপনি কি ইমনকে দেখেছেন?

না।

আপনার কি উচিত না, ওর পাশে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও বসা।

শোন ফিরোজ, আমার কি উচিত বা অনুচিত এই উপদেশ তুমি আমাকে দিতে এসো না। আমি কাউকে উপদেশ দেই না। আমিও চাই না কেউ আমাকে উপদেশ দিক। এক কাজ কর আজ তুমি চলে যাও। অন্য একদিন এসো। আজ তুমি উত্তেজিত। আমি নিজে সারাক্ষণ উত্তেজনার মধ্যে থাকি— অন্যের উত্তেজনা আমার ভাল লাগে না।

চলে যেতে বলছেন?

হ্যাঁ, চলে যেতে বলছি।

জামিল ভাইয়ের সঙ্গে একটু কথা বলে যাই।

অবশ্যই তুমি তার সঙ্গে কথা বলবে না।

সুরাইয়া স্বপ্নের বই খুলে বসলেন। সাপ দেখলে, শত্রু বৃদ্ধি পায়, সাপ কামড়াতে দেখলে, অসুখ হয়। সাপ মারতে দেখা শুভ–শত্রু বিনাস হয়। সাপ ও সাপিনিকে শঙ্খ লাগা অবস্থায় দেখলে— ধন প্রাপ্তি কিংবা পুত্ৰ সন্তান প্রাপ্তি।



ইমনের জ্বর কমেছে। দুপুরে একশ দুই ছিল, এখন একশ। ঘুমের ওষুধ দেয়ার কারণে সে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে। সারাদিনে কিছু খায়নি। কিছুক্ষণ আগে এক বাটি সুপ খেয়েছে। তার মাথার কাছে সুপ্ৰভা বসে আছে। সুপ্ৰভা তাকে গল্পের বই পড়ে শুনাচ্ছে। ইমনের গল্প শুনতে মোটেও ভাল লাগছে না। বেচারী এত আগ্রহ নিয়ে পড়ছে বলে ইমন কিছু বলছে না। সুপ্ৰভা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পড়ছে। ইমনের মনে হল— তার বোনটা ঐতো কিছুদিন আগেই হামাগুড়ি দিত— আজি এত বড় হয়ে গেছে। ভাইকে বই পড়ে শুনাচ্ছে— কি আশ্চর্য। সুপ্ৰভা রিনারিনে গলায় পড়ছে— লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু চোখের সামনে থেকে বইটা সরিয়ে ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, রামমোহন রায়ের নাতি ছিল সেটা জানতেন? ফেলুদার মুখের উপর রুমাল চাপা, তাই সে শুধু মাথা নাড়িয়ে না জানিয়ে দিল।
 
০৭.


সুরাইয়া আয়নার সামনে বসে আছে। তার চোখে মুখে হতভম্ব ভাব। আয়নায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সিঁথির কাছের কিছু চুল তামাটে হয়ে আছে। কি ভয়ংকর কথা! চুল পেকে যাচ্ছে? না-কি হলুদ-টলুদ জাতীয় কোন রঙ লেগেছে? হলুদ রঙ লাগবে কিভাবে? কত বছর হল সে রান্না ঘরে যায় না। সুরাইয়া তীক্ষ্ণ গলায় ডাকলেন— সুপ্ৰভা!

সুপ্ৰভা দরজা ধরে দাঁড়াল। সে আজ শখ করে তার মার শাড়ি পরেছে। নীল শাড়িতে সাদা সাদা বুটি। শাড়িটা যে এত সুন্দর আগে বোঝা যায় নি। পরার পর বোঝা যাচ্ছে। শাড়ি পরার জন্যে তাকে এত বড় লাগছে যে মনেই হচ্ছে না তার বয়স মাত্র তের। মনে হচ্ছে তরুনী এক মেয়ে যে সুযোগ পেলেই সবার চোখ এড়িয়ে তার ছেলে বন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনে গল্প করে। সুপ্ৰভা এমিতেই দেখতে সুন্দর-শাড়ি পরায় আজ তাকে অন্যরকম সুন্দর লাগছে। একটু আগে মিতু তাকে দেখে বলেছে—সুপ্ৰভা, খবৰ্দার শাড়ি পরবি না। হিংসায় আমার শরীর জুলে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখবি সারা গায়ে ফোসিকা উঠে যাবে।

সুরাইয়া মেয়েকে দেখে বলল, সুপ্ৰভা দেখতো আমার মাথার চুল পেকে যাচ্ছে নাকি?

সুপ্ৰভা বলল, হুঁ।

ই আবার কি ধরণের কথা। হয় বল হ্যাঁ, নয় বল না। চুল পেকেছে?

সুপ্ৰভা ক্ষীণ গলায় বলল, হ্যাঁ।

সুরাইয়া তীব্র গলায় বলল, চুল পাকবে কেন? এখনই কেন চুল পাকবে?

সুপ্ৰভা এই প্রশ্নের কি জবাব দেবে বুঝতে পারছে না। চুল পেকে গেলে সে কি করবে? সেতো আর একশ বছরের পুরানো ঘি মায়ের মাথায় মাখিয়ে তাঁর চুল পাকায় নি। এমিতেই সে মায়ের ভয়ে অস্থির হয়ে থাকে–আজ সকাল থেকে ভয় বেশী লাগছে। কারণ বান্ধবীর জন্মদিনে যাবার কথা যখন বলা হয়েছে মা বিশ্ৰী করে তাকিয়েছেন, কিছু বলেন নি। অথচ আগে ভাগে কথা ঠিক হয়ে আছে সবাই দল বেধে শাড়ি পরে যাবে। রাতে ঐ বাড়িতে থাকবে। সারা রাত গল্প করবে। তাদের বাড়িতে লেজার ডিস্ক প্লেয়ার আছে। সেই লেজার ডিস্কে ছবি দেখা হবে। যে ছবি দেখা হবে সেই ছবিও এনে রাখা হয়েছে, Sound of Music.

শাড়ি পরেছিস কেন?

সুপ্ৰভা খুবই অবাক হল। সে মাকে জানিয়েই শাড়ি পরেছে। আলমিরা থেকে মা নিজেই শাড়ি বের করে দিয়েছেন। এখন হঠাৎ এই কথা কেন?

শাড়ি পরার এইসব ঢং কোথেকে শিখলি? তুই কোথায় আছিস তুই জানিস না। পরের বাড়িতে দাসীর মত পড়ে আছিস-রঙ করতে লজ্জা লাগে না–বেহায়া মেয়ে?

সুরাইয়া দম নেবার জন্যে থামলেন। সুপ্ৰভা ভাবল এই ফাঁকে সে সরে যাবে। তবে এই কাজটা করাও ঠিক হবে না। সবচে ভাল হয় সে যদি মাকে রাগ ঝাড়ার পুরো সুযোগটা দেয়।

ঢং এর মেয়ে। ঢংতো ষোল আনার উপর দুআনা আঠারো আনা শিখেছিস ; যা শেখার তাতো শিখছিস না। অংকে পেয়েছিস এগারো। এমন কোন মেয়ে আছে যে অংকে এগারো পায়? বল, আছে কোন মেয়ে? দে, কথার জবাব দে। চুপ করে থাকলে টেনে জিভ ছিড়ে ফেলব?

সুপ্ৰভা মনে মনে মায়ের কথার জবাব দিল। এই কাজটা সে ভাল পারে। মা যখন প্রশ্ন করতে থাকেন তখন সে শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে ঠিকই। তবে মনে মনে প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দেয়। যে কোন প্রশ্নই মা তিনবার চারবার করে করেন। মার একই প্রশ্নের জবাব সুপ্ৰভা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দেয়। তার বেশ মজা লাগে।

কি সার্কাসের সংএর মত দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কথার জবাব দে? আছে কোন মেয়ে যে অংকে এগারো পায়?

সুপ্ৰভা মনে মনে বলল, হ্যাঁ মা আছে। নন্দিতা বলে একটা মেয়ে আমাদের ক্লাসে আছে। সে পেয়েছে নয়। তোমার যদি বিশ্বাস না হয় তুমি নন্দিতার কাছে টেলিফোন করে জেনে নিতে পার। ওরা দারুণ বড়লোক। ওদের বাড়িতে তিনটা টেলিফোন। নন্দিতাও আজ জন্মদিনে যাবে। নন্দিতা পারবে লাল সিস্কের শাড়ি। রাজশাহী সিল্ক। সেরিকালচার বোর্ডে তার এক মামা চাকরি করেন। তিনি এনে দিয়েছেন।

সুরাইয়া বললেন—তুই এক্ষুণি শাড়ি খোল। বই খাতা নিয়ে বোস। ইমনকে বল অংক দেখিয়ে দিতে।

সুপ্ৰভা মনে মনে বলল, দুপুর বেলা বই নিয়ে বসব কেন মা? ইমন ভাইয়াকেও অংক দেখিয়ে দিতে বলা যাবে না। তার জ্বর। সে বিছানায় শুয়ে কো কো করছে। শাড়ি খুলে ফেলতে বলছি খুলে ফেলছি কিন্তু কোন কাপড়টা পারব তাও বলে দাও। যা পরব সেটা নিয়েইতো তুমি কথা শুনাবে। এত কথা শুনতে কারোর ভাল লাগে না। বাবা যে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে, আমার ধারণা তোমার কথা শুনে পালিয়ে গেছে। এবং সে নিশ্চয়ই লক্ষ্মী টাইপ কোন একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে যে মেয়ে দশটা কথার উত্তরে একটা কথা বলে। তোমার মত ক্যাট ক্যাট করে না।

সুপ্ৰভা মার সামনে থেকে সরে গেল। তাকে দেখে মনেও হবে না সে মনে দুঃখ পেয়েছে বা মন খারাপ করেছে। বরং মনে হবে একটু আগে তার জীবনে মজার একটা ঘটনা ঘটেছে। সেই আনন্দেই সে ঝলমল করছে। সুপ্ৰভা একতলায় মিতুর ঘরে ঢুকাল। রাতে সে মিত্র সঙ্গে ঘুমায়। মিতুর ঘরটাই তার ঘর। মিতু আপার ঘরে থাকতে তার ভালই লাগে। তবে আরো ভাল লাগতো যদি তার নিজের কোন ঘর থাকতো। পুরো ঘরটা সে সাজাতো নিজের মত করে। ঘরে খাট রাখত না। নন্দিতার মত মেঝেতে একটা ফোম বিছিয়ে রাখতো। নিজের একটা সিডি প্লেয়ার থাকতো। সারাক্ষণ গান শুনত।

মিতু কাঁচাকলার ভর্তা বানাচ্ছিল। কাঁচাকলা কুচিকুচি করে কেটে তার সঙ্গে তেতুল, কাঁচামরিচ, লবন মিশিয়ে ভর্তা। কাঁচাকলার কষের সঙ্গে পরিমাণ মত তেতুল মিশাতে পারলে অসাধারণ একটা জিনিস তৈরী হয়। তেতুলের পরিমান ঠিক করাটাই জটিল। বেশী হলেও ভাল লাগবে না, কম হলেও ভাল লাগবে না। যে কোন ধরণের ভর্তা বানানোর ব্যাপারে মিতু মোটামুটি একজন বিশেষজ্ঞ। সুপ্ৰভা মিতুকে ডাকে ভর্তা রাণী।

সুপ্ৰভা হাত বাড়িয়ে বলল, দেখি আপা কেমন হয়েছে?

মিতু বিরক্ত গলায় বলল, আগে বানানো হোক তারপর দেখবি। তুই যা চট করে রান্নাঘর থেকে ধনে পাতা নিয়ে আয়। অল্প ধনে পাতা কচলে দিয়ে দি।

ধনে পাতা দিও না। আপা। কলা ভর্তায় ধনে পাতার গন্ধ ভাল লাগে না।

তোকে মাতব্বরী করতে হবে না। যা করতে বলছি কর।

সুপ্ৰভা ধনে পাতা আনতে গেল। মিতু কি মনে করে যেন মুখ টিপে হাসল। সব মানুষের কিছু বিচিত্ৰ স্বভাব আছে। মিত্রও আছে। তার বিচিত্র স্বভাবের একটা হচ্ছে যখন একা থাকে তখনই সে মুখ টিপে হাসে। আশে পাশে কেউ থাকলেই সে গম্ভীর। তখন তাকে দেখলে মনে হবে কাজ ছাড়া সে কিছু বুঝে না। কাজের বাইরের সব কিছুই তার অপছন্দ।

সুপ্ৰভা ধনে পাতা নিয়ে উপস্থিত হল। মিতু বলল, ইমনের জ্বর কত জানিস?

একশা চার। আমি ঠিক করেছি। ওর গায়ে পানি ভর্তি একটা কাপ ঘন্টা খানিক বসিয়ে রাখব। জ্বরের তাপে পানি গরম হবে। সেই পানি দিয়ে আমি চা বানিয়ে খাব।

সুপ্ৰভা খিল খিল করে হাসতে লাগল। মিতু আপাকে এই জন্যেই তার এত ভাল লাগে। গম্ভীর মুখে এমন মজার মজার কথা বলবে যে হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা শুরু হয়। হাসি দেখে মিতু আপা আবার বিরক্ত হয়ে ধমক দেয়। কি আশ্চর্য মেয়ে, নিজেই হাসাবে আবার নিজেই ধমকাবে।

সুপ্ৰভা হাসি থামা। বিশ্ৰী শব্দ করে হাসছিস কি ভাবে? তুই তো হায়ানা না, মানুষ। তোর হাসি শুনে মনে হচ্ছে একটা মহিলা হায়ানা হাসছে। হাসি বন্ধ করা।

সুপ্ৰভা হাসি বন্ধ করতে চেষ্টা করছে, পারছে না। মিতু আপাকে দেখতে সুন্দর লাগছে। মিতু আপা কোন রকম সাজগোজ করে না, অথচ তাকে দেখে মনে হয় সবসময় বাইরে যাবার জন্যে সেজে আছে।

সুপ্ৰভা আয় একটা কাজ করি—ইমনের কাছে একটা উড়ো চিঠি পাঠাই।

কি উড়ো চিঠি?

প্রেমের চিঠি। কোন একটা মেয়ে লিখেছে। এ রকম। ভুল বাংলায় আজে বাজে টাইপ। চিঠি পড়ে তার আত্মা কেঁপে উঠবে। কাউকে বলতেও পারবে না, মুখ শুকনা করে ঘুরবে। আমরা দূর থেকে মজা দেখব। আইডিয়াটা কেমন?

ভাল। খুব ভাল।

চিঠিটা আমরা পোষ্টাপিস থেকে রেজিষ্ট্রি করে পাঠাব।

চিঠিটা কে লেখবে? তুমি? তোমার হাতের লেখাতো চিনে ফেলবে।

আমার চার-পাঁচ রকম হ্যাণ্ড রাইটিং আছে। চেনার কোন উপায়ই নেই।

তাহলে আপ চল লিখে ফেলি।

বললেইতো লিখে ফেলা যায় না, চিন্তা ভাবনা করে লিখতে হবে। রাতে লিখব। শুরুটা হবে কিভাবে জানিস–ওগো আমার প্রাণপাখি বুলবুলি।

সুপ্ৰভা আবারো খিল খিল করে হেসে উঠল। মিতু বিরক্ত গলায় বলল, বললাম না হায়নার মত হাসবি না।

হাসি আসলে কি করব? হা

সি আসলে হাসি চেপে রাখবি। হাসলে মেয়েদের যত সুন্দর লাগে হাসি চেপে রাখলে তারচে দশগুণ বেশী সুন্দর লাগে।

তোমাকে কে বলেছে?

আমাকে কিছু বলতে হয় না। আমি হচ্ছি সবজান্তা। সব কিছু জানি। এবং ম্যানেজ মাষ্টার—সব কিছু ম্যানেজ করতে পারি।

তুমি কি মাকে বলে আমার বান্ধবীর বাসায় যাবার ব্যাপারটা ম্যানেজ করতে পারবে? আজ রাতে ওর বাসায় থাকার কথা।

অবশ্যই ম্যানেজ করতে পারব। আমার কাছে এটা কোন ব্যাপার না।

তাহলে তুমি আমাকে যাবার ব্যবস্থা করে দাও।

আমি কেন করে দেব? তোর সমস্যা তুই দেখবি।

সুপ্ৰভা মন খারাপ করা গলায় বলল, আপা আমার মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি খুব কঠিন হৃদয়ের মহিলা।

মিতু সহজ গলায় বলল, ভুল বললি। আমি কঠিন হৃদয়ের মেয়ে, এটা মাঝে মাঝে মনে হবার ব্যাপার না। সব সময় মনে হবার ব্যাপার।

মিতু উঠে দাঁড়াল। মিতুর সঙ্গে সঙ্গে সুপ্ৰভাও উঠে দাঁড়াল। মিতু বিরক্ত গলায় বলল তুই ছায়ার মত সারাক্ষণ আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকিসনাতো। বিরক্ত লাগে।

তুমি যাচ্ছ কোথায়? ছাদ পিছল হয়ে আছে আপা ছাদে যেও না। রেলিং নেই ছাদ, ধপাস করে পড়বে।

পড়ি যদি সেটা আমার সমস্যা। তোর সমস্যা না।

মিতু ছাদের দিকেই যাচ্ছে। যাবার আগে সে ফুপুর সঙ্গে দু একটা কথা বলে যাবে বলে ঠিক করল। শক্ত কিছু কথা। এই মহিলাকে তার ইদানীং অসহ্য বোধ হচ্ছে। মুশকিল হচ্ছে আগ বাড়িয়ে কঠিন কথা শুরু করা যায় না। ফুপু তার সঙ্গে কখনো কঠিন কিছু বলেন না। বললে সুবিধা হত। কোমর বেঁধে ঝগড়া করা যেত।

সুরাইয়া মিতুকে দেখে সহজ গলায় বলল, কি ব্যাপার মিতু?

মিতু বলল, কলার ভর্তা বানিয়েছি। খাবে?

না।

খেয়ে দেখ না। ভাল হয়েছে।

ইচ্ছে করছে না। তোর ইউনিভার্সিটি কেমন লাগছে?

ভালও লাগছে না, মন্দও লাগছে না—সমান সমান লাগছে।

আশ্চর্য, ঐ দিন দেখেছি লাল হাফ প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছিস— আজি একেবারে ইউনিভার্সিটি।

লাল হাফপ্যান্ট?

হ্যাঁ, লাল হাফপ্যান্ট। আমার সব পরিষ্কার মনে আছে। আমাকে দেখে জিভ বের করে ভেংচি কাটলি।

তোমার পুরানো দিনের কথা খুব মনে থাকে। তাই না ফুপু?

হ্যাঁ, মনে থাকে।

ফুপু তোমাকে একটা কথা বলার জন্যে এসেছি। আমিতো কাউকেই কোন অনুরোধ টনুরোধ করি না। তোমাকে করছি।

কি অনুরোধ?

সুপ্রভার এক বান্ধবীর জন্মদিন। সুপ্রভার খুব ইচ্ছা জন্মদিনে যায়। ওকে যেতে দিও।

যেতে চাইলে যাবে। যেতে না দেবার কি আছে?

রাতটা ঐ বাড়িতে থাকবে। বান্ধবীরা মিলে হৈ চৈ গল্প গুজব করবে।

সকালে চলে আসবে। আমি বিকেলে দিয়ে আসব সকালে নিয়ে আসব। কাল আমার ক্লাস নেই।

ঠিক আছে।

ফুপু কলা ভর্তা একটু খেয়ে দেখ না। ভাল লাগবে। একটু মুখে দিলেই আরো খেতে চাইবে।

সুরাইয়া খানিকটা ভর্তা হাতে নিলেন তবে মুখে দিলেন না। মিতু চলে গেল ছাদে। সুপ্রভার অনুমতি এত সহজে আদায় হয়ে যাবে সে ভাবে নি। তার ধারণা ছিল অনেক যুক্তি টুক্তি দাঁড়া করাতে হবে। আজ মনে হয় ফুপুর মনটা কোন কারণে ভাল।

ছাদে এখনো রেলিং হয় নি। প্রতি বছর জামিলুর রহমান একবার করে বলেন–এই শীতে রেলিং দিয়ে দেব। খোলা ছাদ কখন কি হয়। শীত চলে যায় রেলিং দেয়া হয় না।

বর্ষার পানিতে শ্যাওলা পড়ে ছাদ পিছল হয়ে আছে। বুড়ো আঙ্গুল টিপে টিপে হাঁটতে হয়। যে কোন মুহূর্তে ছাদ থেকে মাটিতে নেমে আসার সম্ভাবনা মাথায় নিয়ে হাঁটতে মিতুর অদ্ভুত ভাল লাগে। এটা এক ধরণের পাগলামীতো বটেই। মিতুর ধারণা সব মানুষের মধ্যে কিছু কিছু পাগলামী আছে–তার মধ্যেও আছে। এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। তার পাগলামী ক্ষতিকারক পাগলামী না। আজ সে ছাদে হাঁটাহাঁটি করল না। চিলেকোঠায় চলে গেল।

জামিলুর রহমান সাহেব সিঁড়ির পাশে এই ঘরটা বানিয়েছিলেন বাড়ির চাকর বাকিরদের থাকার জন্যে। ঘরটা মিতু নিয়ে নিয়েছে। দুটা নাম্বারিং লক দিয়ে ঘরটা তালা দেয়া। দু। দুটা তালা দেখে ধারণা হতে পারে ঘর ভর্তি মিত্র শখের জিনিস পত্র। আসলে ঘরটা প্রায় খালি। একটা চৌকি আছে। চৌকিতে পাটি পাতা। কোন বালিশ নেই। চৌকির পাশে ছোট্ট টেবিল। টেবিলে কিছু খাতা পত্র। কয়েকটা বল পয়েন্ট। দুটা ফাউন্টেন পেন। কয়েকটা পেনসিল। টেবিলের সঙ্গে কোন চেয়ার নেই, কারণ চেয়ার বসানোর জায়গা নেই। মিতু চৌকিতে বসেই গুটগুটি করে খাতায় কি সব লেখে। তবে বেশীর ভাগ সময় দরজা বন্ধ করে চৌকিতে শুয়ে থাকে। মাথার কাছের ছোট্ট জানালা দিয়ে হুহু করে হাওয়া খেলে। জানোলা দিয়ে আকাশ দেখা যায়। মনে হয় বাতাসটা আকাশ থেকে সরাসরি আসছে।

আজ মিতু দরজা বন্ধ করে ইমনকে উড়ো চিঠি লিখতে বসল। রুলটানা কাগজে লিখলে ভাল হত–এখানে রুল টানা কাগজ নেই। কিছু আনিয়ে রাখতে হবে।

মিতুর চিঠিটা হল এ রকম—

৭৭৬

হে আমার প্রাণসখা বুলবুল!

জানগো তোমাকে আমি প্রত্যহ কলেজে যাইতে দেখি এবং বড় ভাল লাগে। I love you very very much. Too much. So many love.

তোমার সঙ্গে কবে আমার পরিচয় হইবে? আমি বড়ই নিঃসঙ্গ। এখানে নতুন আসিয়াছি—কাহারো সঙ্গে পরিচয় হয় নাই। আগে যেখানে ছিলাম। সেখানে দুইটা অফার ছিল। তবে আমার পছন্দনীয় নহে। আমি দেখিতে মোটামুটি সুন্দরী। তবে একটু শর্ট। হাই হিল পরিলে বোঝা যায় না। সবাই বলে আমার চোখ খুবই সুন্দর। তুমি যেদিন বলিবে সেদিন আমার জীবন ধন্য হইবে।

জানগো তুমি রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় কুজো হয়ে হাঁট কেন? আমার বান্ধবীরা তোমাকে নিয়া হাসাহাসি করে। তাহারা তোমাকে দেখাইয়া আমাকে বলে–ঐ দেখ তোর কুজো বর যাচ্ছে। ঠাট্টা করিয়া বর বলে তবে ইনশাল্লাহ একদিন তুমি নিশ্চয়ই আমার বর হইবে। ইহা আমার বিশ্বাস। I Love Love Love You You You Many hundrad Kiss. এবার ৫০ + ৩০,

B দায়

Your WIFE

“A”

চিঠি শেষ করে মিতু অনেকক্ষণ খিল খিল করে হাসল। না। এই কাগজে চিঠি লিখলে হবে না—রুল টানা কাগজ আনাতে হবে এবং আরো কাঁচা হাতে লিখতে হবে। চিঠি হাতে পেয়ে ইমনের মুখের ভাব কি রকম হবে কল্পনা করতেই ভাল লাগছে। আজই যদি চিঠিটা দেয়া যেত ভাল হত। রেজিষ্ট্রি করে পাঠালে চিঠি আসতে আসতে সাতদিনের মত লাগবে। সাত দিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। উপায় নেই।



সুপ্ৰভা শাড়ি বদলেছে—এখন তাকে বাচ্চা একটা মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে শাড়ি না পরলেই তাকে ভাল দেখায়। সুরাইয়া বিছানায় আধশোয়া হয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। মেয়েকে দেখে কাগজ নামিয়ে বললেন, সুপ্ৰভা কাছে আয়।

সুপ্ৰভা মার কাছে গেল। সে কিঞ্চিৎ আতংকিত। যদিও আতংকিত হবার মত কিছু করেনি। শাড়ি খুলে ফেলতে বলা হয়েছে—সে তা করেছে। অংক নিয়ে বসা হয়নি। যার কাছে বসার কথা সে জ্বরে আধমরা হয়ে আছে। কাজেই তার পক্ষে কিছু যুক্তি আছে।

বিকেলে তোর বন্ধুর বাড়িতে দাওয়াত!

হুঁ।

রাতে হুল্লোড় করার জন্যে থেকে যাবার কথা?

হুঁ।

তুই যেতে চাচ্ছিস?

হুঁ।

সুপারিশের জন্যে মিতুকে পীর ধরেছিস? হুল্লোড় করতে লজ্জা লাগে না?

সুপ্ৰভা মনে মনে বলল, মোটেই লজ্জা লাগে না। বরং ভাল লাগে। ইচ্ছা করে সারাদিন হুল্লোড় করি।

বাসা থেকে যদি বের হোস আমি তোর ঠ্যাং ভেঙ্গে দেব, বদ মেয়ে কোথাকার। কতবড় সাহস পীর ধরেছে। পীরকে দিয়ে সুপারিশ করায়। আজ থেকে রাতে তুই আমার সঙ্গে ঘুমাবি।

না। তোমার সঙ্গে ঘুমাব না।

বলেই সুপ্ৰভা চমকে উঠল। তার ধারণা ছিল কথাগুলি সে মনে মনে বলেছে—এখন দেখা যাচ্ছে মনে মনে বলেনি, শব্দ করেই বলেছে। পেনসিলে আঁকা ছবি পছন্দ না হলে রাবার দিয়ে ঘসে তুলে ফেলা যায়। অপছন্দের কথা মুছে ফেলার কোন ব্যবস্থা নেই, থাকলে সুপ্রভার জন্যে খুব ভাল হত।

সুরাইয়া বিছানা থেকে নেমে মেয়ের চুলের মুঠি ধরলেন। তারপরই দেয়ালে মাথা ঠুকে দিলেন। তীব্র যন্ত্রণায় সুপ্ৰভা কিছুক্ষণের জন্যে চোখে অন্ধকার দেখল। তার কপালের চামড়া কেটে গেছে। গলগল করে রক্ত পড়ছে। সুরাইয়া মেয়েকে ছেড়ে দিলেন। তিনি রক্ত সহ্য করতে পারেন না। সুপ্ৰভা হাত দিয়ে কপাল চেপে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

জামিলুর রহমান একতলার বারান্দায় চিন্তিত মুখে হাঁটাহাঁটি করছেন। সম্প্রতি তিনি ট্রান্সপোটের ব্যবসা শুরু করেছেন। তার কাছে খবর এসেছে তার একটা ট্রাক দাউদকান্দির কাছে এক মহিলাকে ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলেছে। ট্রাকের ড্রাইভার পলাতক। পুলিশ ট্রাক জব্দ করে থানায় নিয়ে গেছে।

ট্রাক উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে হবে। মামলা মোকদ্দমায় টাকা যাবে। নানান ঝামেলা। ট্রান্সপোটের ব্যবসায় তাঁর আসাটা খুবই অনুচিত হয়েছে। বয়স হয়েছে। ব্যবসা পাতি এখন গুটিয়ে আনার সময়, তা না করে তিনি শুধু বাড়িয়েই চলছেন।

সুপ্ৰভাকে দেখে তিনি অবাক হয়ে বললেন, কি হয়েছে রে?

সুপ্ৰভা বলল, পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছি। মনে হয় কপাল ফেটে গেছে।

সারাদিন আছিস দৌড়ের উপর ব্যথাতো পাবিই। দেখি হাত নামা, কপালের অবস্থা দেখি।

সুপ্ৰভা হাত নামাল। জামিলুর রহমান আঁৎকে উঠলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, আয় আমার সঙ্গে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। সুপ্ৰভা বাধ্য মেয়ের মত বড় মামার পেছনে পেছনে রওনা হল।

জামিলুর রহমান সুপ্ৰভাকে পছন্দ করেন। শুধু পছন্দ না, বাড়াবাড়ি ধরণের পছন্দ। তিনি তাঁর এই পছন্দের ব্যাপারটা সযতনে গোপন রাখেন। সুপ্রভার সঙ্গে দেখা হলেই ধমকের সুরে কথা বলার চেষ্টা করেন। ভুরু কুঁচকে তাকান। তারপরেও মনে হয়। হৃদয়ের গোপন ভালবাসার ব্যাপারটা ঠিক গোপন রাখতে পারেন না। খুব হাস্যকর ভাবে মাঝে মাঝে তা প্ৰকাশ হয়ে পড়ে। তিনি তাতে অত্যন্ত অপ্ৰস্তুত বোধ করেন।

সুপ্ৰভাও তার রসকষহীন কাঠখোট্টা বড় মামাকে খুবই পছন্দ করে। যে দিন কোন কারণে আগেই স্কুল ছুটি হয়ে যায় সে অবধারিত ভাবে চলে যায় তার বড় মামার পুরানো পল্টনের অফিসে। জামিলুর রহমান অসম্ভব বিরক্ত হয়ে বলেন, অফিসে কি? তুই অফিসে আসিস কেন? তোকে কতবার নিষেধ করেছি। অফিসে আসতে?

এক্ষুণি চলে যাব মামা।

একা একা মেয়েদের এখানে সেখানে যাওয়া আমার অপছন্দ। তুই এসেছিস কি ভাবে? রিকশায় না হেঁটে?

হেঁটে।

ফ্যানের নিচে বোস—আর কোনদিন যদি অফিসে আসিস আমি কিন্তু সত্যি সত্যি আছাড় দেব।

আচ্ছা দিও, বড় মামা কোক খাব।

কোক খাবার জন্যে এসেছিস?

হুঁ।

আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাবি। এরপর থেকে স্কুলেই কোক কিনে খাবি। অফিসে আসবি না।

আচ্ছা।

জামিলুর রহমান বিরক্ত মুখে ভাগনিকে কোক এনে দেন। আগে দোকান থেকে আনাতে হত, এখন আনাতে হয় না। সুপ্ৰভা মাঝে মাঝে অফিসে এসে কোক খেতে চায় শুধুমাত্র এই কারণে তিনি অফিসের জন্যে একটা ফ্রিজ কিনেছেন। ফ্ৰীজ ভর্তি কোকের ক্যান। স্নেহ-মমতা-ভালবাসা এই ব্যাপারগুলি আসলেই খুব অদ্ভুত। কোন জাগতিক নিয়মকানুনের ভেতর এদের ফেলা যায়। না। জামিলুর রহমান এই মেয়েটিকে কেন এত পছন্দ করেন তা তিনি নিজে কখনো বলতে পারবেন না।



সুপ্রভার কপালে দুটা স্টিচ লাগল। ফেরার পথে জামিলুর রহমান সারাপথ ভাগ্নিকে বকতে বকতে এলেন। বকা এবং উপদেশের কম্বিনেশন।

সারাদিন ছোটাছুটি লাফালাফি করবি-ব্যথাতো পাবিই। নিয়ম নীতির ভেতর চলতে হয় না? এতবড় যে পৃথিবী সেও নিয়মের ভেতর দিয়ে চলে—সূর্যের চারদিকে একই পথে ঘুরে। পৃথিবী কি লাফালাফি ঝাপাঝাঁপি করে?

সুপ্ৰভা বলল, মামা তুমি এমন অদ্ভুত ধরণের কথা বলবেনাতো। আমার হাসি আসছে। আমি কি পৃথিবী না-কি যে লাফালাফি ঝাপাঝাঁপি করব না?

জামিলুর রহমানের ইচ্ছা করছে মেয়েটাকে কোন ভাল উপহার কিনে দিতে যাতে তার মনটা খুশী হয়। কাজটা করতে লজ্জা পাচ্ছেন। কিছু কিছু মানুষ স্নেহ এবং ভালবাসাকে চরিত্রের বিরাট দুর্বলতা মনে করেন। সেই দুর্বলতা প্রকাশিত হয়ে পড়লে তাদের লজ্জার সীমা থাকে না।



মিতু বলল, কিরে তোর কপালে ব্যান্ডেজ কেন?

সুপ্ৰভা হাসি মুখে বলল, কপাল ফাটিয়ে ফেলেছি। এইজন্যে কপালে ব্যান্ডেজ।

কপাল ফাটালি কি ভাবে?

সিঁড়ি দিয়ে নামছি হঠাৎ রেলগাড়ি ঝমোঝম, পা পিছলে আলুর দম।

ফাটা কপাল নিয়ে জন্মদিনে যাচ্ছিস?

যাচ্ছি না। আপা।

যাচ্ছিস না?

না। মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে জন্মদিনে যাবার দরকার কি?

মিতু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখ তীক্ষ। ভুরু কুঁচকে আছে। মনে হচ্ছে সে রেগে যাচ্ছে। সুপ্ৰভা বলল, এই ভাবে তাকিয়ে আছ কেন? মিতু বলল, সুপ্ৰভা তুই আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলবি না। কেউ মিথ্যা কথা বললে আমি সঙ্গে সঙ্গে টের পাই। এখন বল কপাল কি ভাবে ফাটল?

মা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।

ধাক্কা দিলেন কেন?

বান্ধবীর জন্মদিনে যেতে চাচ্ছিলাম-এই জন্যে।

এই কারণে জন্মদিনে যেতে চাচ্ছিস না?

হুঁ।

কাপড় পর–আমি তোকে দিয়ে আসব।

আপা থাক, আমার এখন যেতে ইচ্ছে করছে না।

কোন কথা না, আমি যেতে বলছি তুই যাবি।

আপা শোন, মা পরে বিরাট ঝামেলা করবে।

করুক ঝামেলা।

আপা প্লীজ, আমি যাব না।

সুপ্ৰভা, তুই আমার সঙ্গে ভবিষ্যতে আর কোন দিন কথা বলবি না, এবং অবশ্যই রাতে আমার সঙ্গে ঘুমুবি না।

সুপ্রভা, তাকিয়ে রইল। মিতু এখনো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাগে এখন তার শরীর কাঁপতে শুরু করেছে। সুপ্ৰভা বুঝতে পারছে না-মিতু আপা এত অল্পতে এমন রেগে যায় কেন।

সুপ্ৰভা।

জ্বি।

আমার ঘর থেকে তোর বালিশ, জিনিস পত্র সরিয়ে নিয়ে যা। আমি ঠাট্টা করছি না। আই মিন ইট।

তোমার সঙ্গে কথাও বলতে পারব না?

না।

লাস্ট একটা প্রশ্ন কি করতে পারি? ভাইয়াকে যে একটা উড়ো চিঠি দেবার কথা ছিল, সেই চিঠিটা কি লেখা হয়েছে?

মিতু প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চলে গেল। সুপ্রভার খুব মন খারাপ লাগছে। রাতে মার সঙ্গে ঘুমুতে হবে ভাবতেই জ্বর এসে যাচ্ছে।

ঠিক সন্ধ্যার আগে আগে ইমনের ঘুম ভাঙ্গল। বিকেলে ঘাম দিয়ে তার জ্বর সেরেছে। সকাল থেকে কিছু খায়নি-ক্ষিধেও হয়নি। জ্বর সারার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিধেয় পেট মোচড়াতে লাগল। গরম ভাত, ডিমভাজা এবং শুকনো মরিচ ভাজা দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে করল। সে যদি বিখ্যাত কোন ব্যক্তি হত তাহলে ইন্টারভু্যতে জিজ্ঞেস করত—আপনার প্রিয় খাবার কি? সে বলত চিকন চালের গরম ভাত, নতুন আলু দিয়ে শিং মাছের ঝোল।

সে বিখ্যাত কেউ নয়। ইচ্ছে করলেই সে তার পছন্দের খাবার খেতে পারে না। তার জ্বর এখন সেরেছে, প্রচন্ড ক্ষিধে লেগেছে—উপায় নেই। বিকেলে এই বাড়িতে ভাত থাকে না। দুপুরের খাবার শেষ হলেই বাড়তি ভাতে পানি দিয়ে দেয়া হয়। পরদিন সকালে তিনটা কাজের মেয়ে নাশতা হিসেবে পান্তা ভাত খায়। বিকেলে কাজের সময় তাদের কাছে চাইলেও তারা তার জন্যে গরম ভাত রাধবে না। মিতুকে কি বলে দেখবে? মিতুকে বললে সে ড্রাইভার পাঠিয়ে শিং, মাছ কিনিয়ে আনবে। আবশ্যি নাও আনতে পারে। মিতুর কোন ঠিক ঠিকানা নেই। হয়ত বলবে, শিং, মাছ খেতে হবে না। এক গ্লাস দুধ খেয়ে শুয়ে থাক।

ক্ষিধে কমাবার জন্যে ইমন পুরো দুগ্ৰাস পানি খেয়ে ফেলল। পানিতে তিতকুটে স্বাদ–তার মানে জ্বর ভাব পুরো সারেনি। খালি পেটে পানি বেশি খেলে-নেশা নেশা ভাব হয়। ঘুম পায়। ইমন আবারো শুয়ে পড়ল। বিছানার চাদর এবং কথাটা বদলাতে পারলে ভাল হত। চাদরে এবং কাঁথায় জ্বর জ্বর গন্ধ। অসুখ সেরে যাবার পরে অসুখের গন্ধ নিয়ে শুয়ে থাকতে ভাল লাগে না। যদি লাগে তাহলে বুঝতে হবে অসুখ সারে নি। ইমনের শুয়ে থাকতে ভালই লাগছে। বৃষ্টির মত ঝমোঝম শব্দ হচ্ছে। অথচ বৃষ্টি হচ্ছে না। শব্দটা আসছে কোত্থেকে?

ইমনের ঘরটা বেশ বড়। তবে ঘরটা তার একার না-জামিলুর রহমানের দুই ছেলে শোভন এবং টোকনের একই শোবার ঘর। শোভনকে আপাতত বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে বলে ঘরটা এখন ইমনের। দুই ভাইয়ের বয়স পচিশ। যমজ হলেও এদের চেহারা এবং স্বভাব চরিত্র আলাদা। শোভন ঠান্ডা স্বভাবের। টোকন উগ্ৰ। দুজন সারাক্ষণই একসঙ্গে থাকে। শোভনকে বের করে দেয়া হয়েছে বলে টোকনিও বের হয়ে গেছে। এরা জগন্নাথ কলেজে বাংলায় অনার্সে ভর্তি হয়ে কিছুদিন ক্লাস করেছিল। এখন কি করে বা কি করে না পুরোটাই রহস্যে ঘেরা। ইমন দুই ভাইকেই বেশ পছন্দ করে। যে সব রাতে তারা থাকে না সেই সব রাতে একা একা ঘুমুতে ইমনের একটু ভয় ভয়ও লাগে। শোভনকে কেন বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে ইমন জানে না। তার বড় মামা এক রাতে তার ঘরে এসে বলেছেন, শোভন যদি রাতে বিরাতে তার ঘরে থাকতে আসে আমাকে খবর দিবি। যত রাতই হোক আমাকে খবর দিবি। এই বাড়ির ত্রিসীমানায় তার আসা নিষিদ্ধ। ইমন শুধু হ্যাঁ সূচক মাথা কাত করেছে, বেশি কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস তার হয় নি। জামিলুর রহমান ইমনের ঘর থেকে শোভনের খাটের তোষক চাদর সব সরিয়ে নিয়েছেন। শোভনের আলমিরা খুলেও জিনিসপত্র সরানো হয়েছে। টোকনের খাট বিছানা সব ঠিক আছে। ইমন শুয়ে আছে টোকনের খাটে।

সন্ধ্যাবেলা ইমনের ঘুম ভাঙ্গল মশার কামড়ে। মশা কামড়ে তার মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। ঘর অন্ধকার। মনে হচ্ছে গভীর রাত। দরজা জানোলা বন্ধ বলে বোঝাই যাচ্ছে না মাত্ৰ সন্ধ্যা। গভীর রাত ভেবেই ইমনের একটু ভয় ভয় করতে লাগল। তার বাথরুমে যাওয়া দরকার। খাট থেকে নেমে বাতি জ্বলিয়ে বাথরুমে যেতেই ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে খাট থেকে নামলেই খাটের নিচ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে কেউ একজন এসে শীতল হাতে তার দুপা জড়িয়ে ধরবে। এই ভয় শৈশবের ভয়। শৈশবের কিছু কিছু ভয় মানুষের সঙ্গে থেকে যায়। মানুষের বয়স বাড়ে, শৈশবের অনেক কিছুই তাকে ছেড়ে যায়—ভয়টা ছাড়ে না। ভয় পেলে অবধারিত ভাবে ইমনের ছোট চাচার কথা মনে পড়ে। ছোট চাচার সঙ্গে তার দেখা হয় না প্রায় ছয় বছর। দাদীর মৃত্যুর পর পর হুট করে তিনি একদিন চলে যান সিঙ্গাপুর, সেখান থেকে মালয়েশিয়া, মালয়েশিয়া থেকে সুইডেন। তার শেষ পিকচার কার্ডটা সুইডেন থেকে পাঠানো। সুন্দরী নীলচোখা এক মেয়ে বরফ দিয়ে তুষার মানব বানাচ্ছে। পিকচার কার্ডের উল্টোদিকে এলোমেলো ভঙ্গিতে লেখা—

ইমন,

এখানে তেমন সুবিধা করতে পারছি না। স্পেনে এক বাঙ্গালী পরিবার থাকে। তাদের সঙ্গে ভাল যোগাযোগ হয়েছে। তারা স্পেনে–যেতে আমাকে উৎসাহিত করছেন। কি করব বুঝতে পারছি না। আমার সিদ্ধান্ত চিঠি দিয়ে জানাব। সুইডেনের ঠিকানায় আপাতত কোন চিঠি দিবি না, কারণ আমি আগামীকাল বাসা বদলাব। সুপ্ৰভাকে আমার স্নেহ দিবি। সে কত বড় হয়েছে?

ইতি তোর ছোট চাচা

ছোট চাচার কাছ থেকে আসা এই শেষ চিঠি। ইমনের ছোট চাচার কর্মকান্ডে সবচে বেশি আনন্দিত হয়েছেন সুরাইয়া। তিনি গম্ভীর গলায় এখন প্রায়ই বলেন—

বাড়ি ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া হচ্ছে তোদের বংশগত রোগ। তোর বাপ যেমন উধাও হয়েছে, তোর চাচাও তাই করেছে। তোদের পূর্ব পুরুষের উদাহরণ খুঁজলে দেখবি তারাও এই কান্ড করেছে। তোদের গুষ্টিই হল ভবঘুরের গুষ্টি। আমি যে গোড়া থেকেই বলছি-তোদের বাবা ভাল আছে, যথা সময়ে উপস্থিত হবে। এই কথাটা প্ৰমাণ হলতো?

মাঝে মাঝে ইমনের মনে হয়-মার কথা শেষটায় সত্যি সত্যি। ফলে যাবে। কোন এক গভীর রাতে বাবা এসে উপস্থিত হবেন।

ইউনিভার্সিটির ভর্তি ফরমে বাবার নাম লিখতে হয়। সেখানে সে লিখেনি। মরহুম হাসানুজ্জামান। মরহুম শব্দ লিখতে তার ইচ্ছে করে না। বাবা যদি কোনদিনই না ফেরে তাহলে হয়ত সে কোনদিনই লিখতে পারবে না বাবা মরহুম হাসানুজ্জামান। ইমনের বয়স যখন আশি হয়ে যাবে তখন কি পারবে? না, তখনো পারবে না। অদ্ভুতভাবে একজন মরণশীল মানুষ অমর হয়ে যাচ্ছে।



খুট্‌ করে দরজা খুলল। সুপ্ৰভা মাথা বের করে বলল, ভাইয়া ঘর অন্ধকার করে বসে আছ কেন? জ্বর কমেছে?

ইমন বলল, হুঁ।

কিছু খাবে? ক্ষিধে লেগেছে? স্যুপ খাবে?

স্যুপ?

আমার জন্যে বড় মামা স্যুপ আনিয়েছেন। আমার খেতে ইচ্ছা করছে না, তোমাকে গরম করে এনে দেব?

দে।

ভাইয়া তোমার মুখ কেমন যেন ফুলে লাল হয়ে আছে। মনে হয়। হাম উঠেছে।

হাম না, মশা কামড়েছে।

বাতি কি নিভিয়ে দিয়ে যাব না জ্বালা থাকবে?

জ্বালা থাকুক।

মিতু আপা কি তোমার ঘরে এসেছিল?

না।



ইমন বোনের ব্যান্ডেজ করা কপাল দেখছে। এর মধ্যে একবারও জিজ্ঞেস করেনি কপালে কি হয়েছে। সুপ্রভার ধারণা তার মা যেমন অদ্ভুত, তার ভাইয়াও অদ্ভুত। জগতের কোন কিছুতেই তার কিছু হয় না। সুপ্ৰভা যদি কোন কারণে হঠাৎ মরে যায়, সেই খবর ভাইয়ার কাছে পৌঁছলে সে এসে উঁকি দিয়ে দেখবে তারপর নিজের ঘরে ঢুকে দরজা টারজা বন্ধ করে বই নিয়ে বসবে। অন্যের বেলাতে সে যেমন উদাসিন তার নিজের বেলাতেও উদাসিন। প্রচন্ড জ্বর হলেও কাউকে বলবে না, আমার জ্বর। কাঁথা গায়ে দিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকবে। ক্ষিধে লাগলে বলবে না, আমার ক্ষিধে লেগেছে। সবচে যেটা ভয়ংকর—মুখে হাসি নেই। কত মজার মজার ঘটনা চারপাশে ঘটছে, সে দেখবে কিন্তু হাসবে না। সুপ্রভার প্রায়ই ইচ্ছে করে এমন অদ্ভুত কিছু তাদের সংসারে ঘটুক যা দেখে ইমন হো হো করে হেসে উঠবে। সেই হো হো হাসির ছবি সে চট করে ক্যামেরায় তুলে ফেলবে।

ভাইয়া!

হুঁ।

সুনামগঞ্জের পাগলা পীর সাহেবের কথা তোমার বিশ্বাস হয়?

তার কোন কথা?

ঐ যে সে মাকে বলে গেল, বাবা বেঁচে আছেন, তোমার যেদিন বিয়ে হবে সেইদিন ফিরে আসবেন।

না। পীররা এই জাতীয় কথা সব সময় বলে।

দিন তারিখ মিলিয়ে বলে না। তারা বলে ফিরে আসবে, কবে আসবে তা বলে না। পাগলা পীর সাহেব কিন্তু কবে ফিরবেন তা বলেছেন।

এই পীর অন্যদের চেয়ে বোকা।

আমার কেন জানি মনে হয়। পীর সাহেবের কথা সত্যি হবে। তোমার যেদিন বিয়ে হবে সেদিন বাবা সত্যি সত্যি উপস্থিত হবেন।

উপস্থিত হলেতো ভালই।

সুপ্ৰভা খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, সবচে ভাল হয় তুমি যদি এখন বিয়ে করে ফেল। বাবাকে আমরা তাহলে তাড়াতাড়ি পেয়ে যাব। তুমি যত দেরিতে বিয়ে করবে। বাবাকে তত দেরিতে পাব।

ইমন তার বোনের দিকে তাকাল, কিছু বলল না। তার তোকানো দেখে বোঝা যাচ্ছে প্রসঙ্গটা তার মনে ধরছে না। সুপ্ৰভা অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। চোখ মুখ গম্ভীর করে বলল, শোভন ভাইয়ারা কি রাতে মাঝে মধ্যে আসে?

না।

আমার সঙ্গে একদিন দেখা হয়েছিল। আমি রিকশা পাচ্ছিলাম না। রিকশার জন্যে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ দেখি লাল রঙের একটা গাড়ি এসে একেবারে আমার গা ঘেসে থেমেছে। প্ৰথমতো আমি ভয়ই পেয়ে গেলাম, তারপর দেখি পেছনের সিটে টোকন ভাইয়া, আর শোভন ভাইয়া। আমাকে দেখেই শোভন ভাই দিলেন এক ধমক, এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? শোভন ভাইয়ার কি যে স্বভাব, এমন ঠান্ডা মানুষ অথচ ধমক ছাড়া কথা বলতে পারে না। আমি বললাম, রিকশার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি। তারপর বললাম, শোভন ভাইয়া তোমার সাথে যখন গাড়ি আছে তখন গাড়ি করে আমাকে নামিয়ে দাও। শোভন ভাইয়া বললেন, আমার ঠেকা পরেছে। বলেই হুস করে গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। দুজনই দাড়ি রেখেছে, মুখ ভর্তি দাড়ি। দেখে চেনাই যায় না। চেহারা একদম বদলে গেছে। ছেলেদের কত মজা, ইচ্ছা করলেই দাড়ি রেখে তারা চেহারা বদলে ফেলতে পারে। আমরা মেয়েরা সেটা পারি না। ঠিক না ভাইয়া?

হুঁ।

মেয়েদেরও দাড়ি গোফ গজানোর সিস্টেম থাকলে ভাল হতো। হতো না ভাইয়া?

কি জানি। বুঝতে পারছি না।

আমার কথা শুনতে কি তোমার বিরক্ত লাগছে?

না।

তাহলে এ রকম বিরক্ত বিরক্ত ভাব করে বসে আছ কেন?

ইমন জবাব দিল না। সুপ্ৰভা তার সঙ্গে প্রচুর কথা বলে। ইমনের ইচ্ছা করে কথা বলতে। কেন জানি বলা হয় না। সে শুধু শুনেই যায়। সুপ্রভার কপালে ব্যান্ডেজ। কি ভাবে ব্যথা পেল জানতে ইচ্ছা করছে কিন্তু জানার জন্যে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে না। ইমন যখন ঠিক করল এখন সে জানতে চাইবে তখনি সুপ্ৰভা চলে গেল। ইমনের মনে হল ভালই হয়েছে, প্রশ্ন করতে হল না।

রাতে সুপ্ৰভা মার সঙ্গে ঘুমুতে এল। বালিশ নিয়ে এসে ঝুপ করে বিছানায় পড়ে গেল। পড়ার সময় শব্দ একটু বেশি হল। আতংকে সুপ্ৰভা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল—এই বোধ হয় মা একটা ধমক দিলেন। সুরাইয়া ধমক দিলেন না, বরং উলটো হল, স্বাভাবিক গলায় বললেন, সুপ্ৰভা আয় চুল বেঁধে দেই। রাতে টানটান করে চুল বেঁধে না দিলে চুল বড় হয় না।

সুপ্ৰভা মার কাছে চুল বাধতে গেল। মার মেজাজ এখন মনে হচ্ছে ভাল। এই ভালটা কতক্ষণ থাকবে বলা যায় না। এমন কোন যন্ত্রপাতি যদি থাকত যা আগে ভাগে মেজাজের খবর জানায়—তাহলে খুব ভাল হত। যন্ত্রটা সুপ্ৰভা ফিট করে রাখত। যন্ত্র আগে ভাগে ওয়ার্নিং দিচ্ছে

চার নম্বর দূরবতী বিপদ সংকেত। সাবধানে কথা বলতে হবে। সামনে না। যাওয়াই ভাল। দূরে দূরে থাকুন।

দশ নম্বর মহা বিপদ সংকেত। আশ্রয় কেন্দ্ৰে আশ্রয় নিন। মিতুর কাছে, কিংবা বড় মামার কাছে চলে যান।

সুপ্ৰভা!

কি মা।

এখন থেকে রাতে আমার সঙ্গে ঘুমুবি।

সুপ্রভার মুখ শুকিয়ে গেল। মা পেছন থেকে চুল আচড়াচ্ছেন বলে শুকনো মুখ দেখতে পেলেন না। সুপ্ৰভা নকল খুশী খুশী গলায় বলল, আচ্ছা।

একা ঘুমুলে হঠাৎ হঠাৎ খুব ভয়, লাগে। পরশু রাতে খুব ভয় পেয়েছি।

সুপ্রভা কিছু বলল না। মা কেন ভয় পেয়েছেন জানতে ইচ্ছে করছে না। টান টান করে বেণী বঁধছেন তার কষ্ট হচ্ছে কিন্তু মুখে বলতে পারছে না।

পরশু রাতে কি হয়েছে শোন। হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গল, শুনি বৃষ্টি হচ্ছে। মাথার কাছের জানালা দিয়ে হাওয়া আসছে, বৃষ্টির ছাটও আসছে। ভাবলাম উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করি। উঠতে ইচ্ছে করছিল না, তখন ভাবলাম তোর বাবাকে বলি জানালা বন্ধ করতে।

সুপ্ৰভা বিস্মিত হয়ে বলল, বাবাকে বলি মানে? বাবা কোথায়?

এটাইতে কথা। আমি পরিষ্কার দেখছি তোর বাবা উল্টো দিকে মুখ করে আমার পাশে ঘুমিয়ে আছে। সব সময় যেভাবে ঘুমায় সেই ভাবে ঘুমুচ্ছে, বালিশ থেকে মাথা নেমে গেছে। হাঁটু চলে এসেছে বুকের কাছে। চাদরটা কোমর পর্যন্ত দেয়া। সব কিছু এত পরিস্কার যে বাস্তবও এত পরিষ্কার না। তোর বাবা যে হারিয়ে গেছে তার কোন খোঁজ নেই। এইসব কিছুই তখন আমার মনে নেই। আমি হাত বাড়িয়ে তাকে ডাকতে যাব তখন বজপাত হল, আমি চমকে উঠলাম। হঠাৎ মনে পড়ল আরো তাইতো তোর বাবাকে এখানে দেখব কেন? তখন দেখি কিছু নেই। বিছানা খালি। প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম।

ভয় পাবারই কথা। আমারতো শুনেই ভয় লাগছে। বুক ধ্বক ধ্বক করছে।

সুরাইয়া সহজ গলায় বললেন, বিছানায় তোর বাবাকে শুয়ে থাকতে দেখা নতুন কিছু না। আমি প্রায়ই দেখি।

কি বলছি তুমি?

তোর যখন দুই মাস বয়স তখন পর পর কয়েক রাত দেখেছি।

সুপ্ৰভা মনে মনে বলল, মা তোমার মাথা খারাপ। পুরোপুরি খারাপ। রাতে তোমার সঙ্গে ঘুমুতে এই জন্যেই আমার ভয় লাগে। কোন একদিন তুমি হয়ত আমাকে ভূত মনে করে গলা টিপে ধরবে। কোন পীর ফকিরের কাছ থেকে তোমার জন্যে তাবিজ আনা উচিত কিংবা ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করানো উচিত। ছেলে পাগলের চেয়ে মেয়ে পাগল ভয়ংকর।

সুপ্রভার স্কুলের আশে পাশে একটা মেয়ে পাগল থাকে। সে প্রায়ই হাতে একটা থান ইট নিয়ে মানুষজনকে তাড়া করে। সুপ্ৰভা আর মিনা একদিন স্কুল ছুটির পর আসছিল পাগলীটা হঠাৎ থান ইট হাতে তাদের তাড়া করল। সুপ্ৰভা এক সময় হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। কি আশ্চর্য কান্ড পাগলিটা এসে তাকে টেনে তুলে গম্ভীর গলায় বলল, সাবধানে চলবি। বলেই সে ইট হাতে তাড়া করতে লাগল মিনাকে। তার মা পাগল হয়ে গেলে কি এই রকম কান্ড কারখানা করবে? থান ইট নিয়ে তাড়া করবে তাকে আর ভাইয়া কে। কি ভয়ংকর!

সুপ্ৰভা।

জ্বি মা।

তোর নাম তোর বাবার রাখা এটা কি জানিস।

বাবা কিভাবে রাখবেন? আমার জন্মই হল তার নিখোঁজ হবার পর।

ইমন যখন আমার পেটে তখন তোর বাবার ধারণা হল আমার মেয়ে হবে। সেই মেয়ের নাম কি রাখা হবে তার জন্যে সে অস্থির হয়ে পড়ল। অফিস থেকে প্রতিদিনই একটা দুটা নাম নিয়ে ফেরে। রাতে ঘুমুতে যাবার সময় বলে—এই নামটা তোমার কেমন লাগে। আমি শুধু হাসি।

হাস কেন?

তোর বাবার কান্ড দেখে হাসি। এ রকম গম্ভীর মানুষ অথচ ভেতরে ভেতরে ছেলেমানুষ। শেষটায় নাম ঠিক করল। সুপ্ৰভা। আমার সুরাইয়া থেকে সুনিয়ে সুপ্ৰভা।

সুপ্ৰভা হাই তুলতে তুলতে বলল, তোমার সুরাইয়া থেকে সু নিয়ে আর বাবার হাসানুজ্জামানের হা নিয়ে সুহা নাম রাখলে ভাল হত। নতুন ধরণের হত।

সুহার কি কোন অর্থ আছে না-কি?

তাহলে হাসু। হাসুর অর্থ আছে—যে হাসে। আর আমিতো সে রকমই-সব সময় হাসি।

তুই সব সময় হাসিস?

হুঁ। স্কুলে আমার নাম কি জান মা? আমার নাম মিস এল জি।

এলজি মানে?

এলজি হল লাফিং গ্যাসের সংক্ষেপ। আমাদের ক্লাসের আরেকটা মেয়ে আছে তার নাম মিস এইচ এম।

এইচ এম মানে?

এইচ এম মানে হনুমানমুখী। ওর মুখটা দেখতে হনুমানের মত।

তোরা কি স্কুলে পড়াশোনা বাদ দিয়ে সব সময় ঠাট্টা ফাজলামী করিস?

সুরাইয়ার গলা কেমন যেন কঠিন হয়ে আসছে। কথা বার্তা আর চালানো ঠিক হবে না। বিপদ মাপার যন্ত্রটায় একটু পর পর লালবাতি জুলছে। বিপদ মাপা যন্ত্র বলছে—দুই নম্বর সতর্ক সংকেত। ঘুমিয়ে পড়ার ভান কর। সুপ্ৰভা ঘুমের ভান করল। ভারী নিঃশ্বাস ফেলা শুরু করল। ঘুমের ভান সে খুব ভাল করতে পারে। ঘুমের মধ্যে মানুষ যেমন বিড়বিড় কথা বলে সে তাও পারে। মনে হয় বড় হলে সে খুব নামকরা অভিনেত্রী হবে।

দরজায় খুটি খুঁট শব্দ। ইমন ঘুমিয়ে পড়েছিল, খুটাখুটি শব্দে ঘুম ভাঙ্গল। দরজার ও পাশ থেকে টোকনের গলা শোনা গেল, ইমন দরজা খোল। রাত দুটা না বাজতেই ঘুমিয়ে পড়লি পরীক্ষায় ফাস্ট সেকেন্ড হবি কি ভাবে।

ইমন দরজা খুলল। দুই ভাই হাসি মুখে দাঁড়িয়ে। কাউকেই চেনা যাচ্ছেনা। মাথার চুল প্রায় কদম ছাট করা। দুজনেই দাড়ি রেখেছে। গোফ রেখেছে। শোভন বলল, চিনতে পারছিস? আমরাই আমাদের চিনিনা তুই চিনবি কি ভাবে? যা ফ্ৰীজ খুলে দেখ খাবার টাবার কিছু আছে কি না। ক্ষিধেয় জীবন যাচ্ছে।

ইমন বলল, রাতে থাকবে?

শোভন বলল, এখনো বুঝতে পারছি না। হেভী একটা গোসল দেব। সাত দিন গোসল করিনি। গা থেকে পাঠার গন্ধ আসছে। কাছে আয় শুকে দেখ।

শোভন হাসছে, তার সঙ্গে টোকনও হাসছে। ইমনেরও খুব মজা লাগছে। ইমনের মনে হচ্ছে এই দুই ভাইতো আসলে সুখেই আছে। মনের সুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যা করতে ইচ্ছা হয় করছে। এই দাড়ি রেখে ফেলছে, এই মাথা কামিয়ে ফেলছে। ঘর বাড়ির সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। ফ্রীজে বাসি খাবার যা পাওয়া যাবে তাই খাবে। ইচ্ছা হলে ঘুমুবে, ইচ্ছা না হলে রাতেই চলে যাবে।

শোভন বাথরুমে ঢুকে পড়েছে। বাথরুমের দরজা খোলা। শাওয়ার ফুল স্পীডে ছেড়েছে। ঝড়ের মত শব্দ হচ্ছে। ইমনের দায়িত্ব ফ্ৰীজ থেকে খাবার আনা। ইমন যাচ্ছে না। কারণ শোভন যখন বাথরুমে গোসল করে তখন ইমন বাথরুমের আশে পাশে থাকতে খুব পছন্দ করে। শোভনের স্বভাব হচ্ছে গায়ে পানি ঢালতে ঢালতে গান করা। কোন গানই সে পুরোটা জানে না। দুই লাইন, চার লাইনের গান। এই এক লাইনের রবীন্দ্র সংগীত-কুসুমে কুসুমে চরণ চিহ্ন তারপরই হিন্দী বাচুপানকে দিন ভুলানা দেনা

ইমনের ধারণা বাংলাদেশে শোভন ভাইয়ার চেয়ে ভাল গানের গলা আর কারোর নেই।

শোভন বাথরুম থেকে চেচিয়ে বলল, ইমন তোকে না খাবারের ব্যবস্থা করতে বললাম, তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

যাচ্ছি। ঐ গানটা গাও না—

কোনটা?

বাকের ভাইয়ের গানটা—হাওয়ামে উড়ত যায়ে…

কথা ভুলে গেছি। তোকে যা করতে বলছি করা। যদি দেখিস ফ্রীজে কিছু নেই তাহলে কাঁচা ডিম নিয়ে আসবি। কাঁচা ডিম লবন দিয়ে খেতে মারাত্মক টেস্ট।

ইমন তবুও যাচ্ছে না। শোভন ভাইয়া বাকের ভাইয়ের গানের এক দুলাইন অবশ্যই গাইবে। তারপর সে যাবে।

শোভন শীষ দিতে দিতে হাওয়ামে উড়ত যায়ে গানটা ধরল। ইমনের রীতিমত ঈর্ষা হচ্ছে—কাউকে কাউকে আল্লাহ এত ক্ষমতা দিয়ে পাঠান কেন?



ফ্রীজে অনেক খাবার ছিল। সকালের নাস্তা খিচুড়ি রাতেই রোধে ফ্রাজে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। খিচুড়ির সঙ্গে গোশত। জমে শক্ত হয়ে আছে। দুই ভাই তাই খুব তৃপ্তি করে খেল।

ইমন বলল, তোমরা কি আজ রাতেই চলে যাবে?

টোকন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। শোভন বলল, তোর কাছে একটা জিনিস রেখে যাব। কাপড় দিয়ে মোড়া। খবৰ্দার খুলে দেখবি না। ভেতরে কি। সাবধানে রাখবি।

ইমন বলল, আচ্ছা।

ইউনিভার্সিটিতে তোর কোন সমস্যা হচ্ছে নাতো?

কি সমস্যা?

ইউনিভার্সিটিটা হয়েছে রাজনীতির আখড়া। এ ওকে মারছে, ও তাকে ধমকাচ্ছে। তোকে যদি কেউ কিছু বলে আমাদের বলিস ভূড়ি গালিয়ে পেটের ফোটকা বের করে ফেলব।

ইমন হাসছে। শোভন বিরক্ত গলায় বলল, হাসছিস কেন?

ইমন বলল, মানুষের ফোটকা থাকে না। ফোটকা থাকে মাছের।

শোভন বলল, নাড়ি ভুড়ি এবং ফোটকা একই জিনিস।

খাওয়া শেষ করে দুই ভাই রাত তিনটার দিকে চলে গেল। বাকি রাতটা ইমনের ঘুম হল না। তার বার বার মনে হল সে একটা ভুল করেছে। তারও উচিত ছিল এই দুজনের সঙ্গে চলে যাওয়া।
 
০৮.


অনেক্ষণ ধরে টেলিফোন বাজছে।

মিতু টেলিফোনের পাশেই, ভুরু কুঁচকে আছে। ক্রিং ক্রিং শব্দটা থামলে তার ভুরু মসৃণ হবে। যে টেলিফোন করেছে সে একসময় বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেবে— মিতুর তাই ধারণা। ইদানীং খুব আজে বাজে কল আসছে। কথা বাতাঁর ধরণ থেকে মনে হয় নাইন টেনের ছাত্র। কুৎসিত বাক্য মুখে ঠিকমত আসছে না, আবার বলার ইচ্ছাও আছে। মিতুর ধারণা চার পাঁচজনের একটা দল আছে। কুৎসিত কথা। একজন বলে অন্যরা হাতে মুখ চাপা দিয়ে খিক খিক করে হাসে। যেমন একজন বলল, আচ্ছ। আপা আপনার বুকের সাইজ কত? ব্রার নাম্বার কত থাটি ফোর, না থাটি সিক্স? চারদিকে শুরু হল খিক খিক হাসি। এই জাতীয় একটা বাক্যেই সারাদিনের জন্যে মেজাজ খারাপ হয়ে থাকে। মিতু প্ৰতিজ্ঞা করেছে সে টেলিফোন ধরবে না।

আজ যে টেলিফোন করেছে তার ধৈৰ্য অসীম। সে বিরক্ত হয়ে লাইন কেটে দিচ্ছে না। ধরেই আছে। কিছুক্ষণ বিরতি নেয়। আবার করে। মিতু শেষটায় চোখ মুখ কঠিন করে রিসিভার হাতে নিল। ওপাশ থেকে মিষ্টি এবং কোমল গলায় একটি মেয়ে বলল–এটা কি ইমন ভাইয়াদের বাড়ি?

মিতু বলল, হ্যাঁ।

আপনি কে?

আমি ইমনের বড়বোন।

আপা স্লামালিকুম।

ওয়ালাইকুম সালাম।

ইমন ভাইয়া কি বাসায় আছে?

তুমি একটু ধরে থাক, আমি দেখছি ও আছে কি-না। তোমার নাম কি?

নবনী।

নবনী বললেই সে তোমাকে চিনবে?

জ্বি।

আচ্ছা তুমি ধরে থাক।

মিতু ইমনের ঘরে ঢুকল। ইমন পড়ছিল, মিতুকে দেখে শুধু তাকাল, কিছু বলল না।

মিতু বলল, দিনের বেলা দরজা জানালা বন্ধ করে তুই পড়িস কি ভাবে? অন্ধকারে চোখের বারোটা বাজবো।

ইমন কিছু বলল না। প্রশ্ন না করলে সে জবাব দেয় না। এখনো তাকে কোন প্রশ্ন করা হয় নি। মিতু বলল, চা খাবি? ইমনের চা খাবার কোন ইচ্ছা নেই। তবু সে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। ইমান লক্ষ্য করেছে সে চা খেতে চাইলেই মিতু ট্রেতে করে দুকাপ চা নিয়ে আসে। ইমনকে এক কাপ দিয়ে নিজে এক কাপ নেয়। চা খাবার সময়টা পা দুলিয়ে দুলিয়ে গল্প করে। মিতুর সেই গল্পগুলি হয় খুব মজার। চা খেতে ইচ্ছে না হলেও শুধুমাত্র গল্প শোনার লোভে ইমন চা খেতে চায়।

মিতু আবার এসে টেলিফোন ধরল।

হ্যালো নবনী!

জ্বি, আপা।

ইমনতো বাসায় নেই— মনে হয় সেলুনে চুল কাটাতে গেছে।

ও আচ্ছা।

তাকে কি কিছু বলতে হবে?

জ্বি না, কিছু বলতে হবে না।

নবনী নামের একটা মেয়ে টেলিফোন করেছিল এটা বলব? না-কি কিছুই বলব না।

আচ্ছা, বলতে পারেন।

আমি কি বলব তোমাকে টেলিফোন করতে?

জি না, দরকার নেই।

তবু সে হয়তো তোমাকে টেলিফোন করতে চাইবে তখন কি নিষেধ করব?

জি না, নিষেধ করার দরকার নেই।

ও কি তোমার টেলিফোন নাম্বার জানে?

আমি একবার কাগজে লিখে দিয়েছিলাম।

এক কাজ করতে পার আমাকে টেলিফোন নাম্বার দিতে পার , ও যদি আগের নাম্বার ভুলে গিয়ে থাকে। আমি দিতে পারব। তুমি বল আমি লিখে নিচ্ছি। আর আমার নিজেরো টেলিফোনে কথা বলতে ভাল লাগে। মাঝে মাঝে আমিও কথা বলতে পারি।

আশ্চৰ্যতো, আপনার সঙ্গে আমার খুব মিল। সামনা সামনি কথা বলতে আমার ভাল লাগে না। টেলিফোনে কথা বলতে ভাল লাগে।

তাহলে তুমি নিশ্চয়ই খুব রূপবতী। একমাত্র রূপবতীদেরই সামনা সামনি কথা বলতে ভাল লাগে না।

আপা আমি খুব রূপবতী না, মোটামুটি।

কোন ক্লাসে পড়?

ক্লাস টেন। এবার এস.এস.সি দেব।

ইমনের সঙ্গে পরিচয় হল কি ভাবে?

উনিতো আমার স্যার। সপ্তাহে তিনদিন আমাকে অংক করান।

ও আচ্ছা। ইমন আমাদের কিছু বলেনি। স্যারকে ভাইয়া ডাক?

স্যার ডাকতে ভাল লাগে না, এই জন্যে ভাইয়া ডাকি। আপা টেলিফোন নাম্বারটা লিখে রাখুন। আমার এক্ষুণি টেলিফোন ছেড়ে দিতে হবে। মা আসবে। আমি সারাক্ষণ টেলিফোনে কথা বলিতো, এটা মার খুব অপছন্দ।

নবনী টেলিফোন নাম্বার বলল। মিতু লিখে রাখল না। টেলিফোন নাম্বার মনে রাখার ব্যাপারে তার ভাল দক্ষতা আছে। একবার কোন নাম্বারা শুনলে তার সারাজীবন মনে থাকে। পড়াশোনা তেমন মনে থাকে না। মিতুর ধারণা টেলিফোন অপারেটরের চাকরি সে খুব ভাল করবে।

মিতু দুকাপ চা নিয়ে ইমনের ঘরে ঢুকল। চায়ের কাপ ইমনের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল, তারপর তোর খবর কি?

ইমন বলল, ভাল।

কেমন ভাল? মোটামুটি না খুব ভাল?

ইমন কিছু বলল না। মিতুর সঙ্গে সে খুব বেশী কথাবার্তায় যায় না। মেয়েটাকে তার একটু ভয় ভয় লাগে। তার সব সময় মনে হয় এই মেয়েটার সামনে যেই দাঁড়ায় তার সব রহস্য ফাস হয়ে পড়ে। মিতু কিছু বিশেষ ক্ষমতায় মনের সব কথা বুঝে ফেলে।

ইমন সাহেব?

হুঁ।

তুই কি প্রাইভেট টিউশানি করিস না-কি?

হুঁ।

কাউকেতো কিছু বলিস নি।

বলার কি আছে?

তাও ঠিক, বলার কি আছে। কত টাকা দেয়?

এক হাজার টাকা।

মাত্ৰ?

এক হাজার টাকা মাত্র হবে কেন?

আমার কাছেতো মাত্র বলেই মনে হচ্ছে। তোর মত ব্রিলিয়ান্ট একজন ছাত্র বাসায় গিয়ে পড়াচ্ছিস! ওরা কি নাশতা দেয়?

হ্যাঁ দেয়।

ভাল নাশতা?

ইমন বলল, এত কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?

মিতু সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে গলা নিচু করে বলল, তোর ছাত্রী দেখতে কেমন?

ইমন বলল, দেখতে ভাল।

পুতুল পুতুল চেহারা?

পুতুল পুতুল চেহারা কি-না। আমি জানি না। কোন চেহারাকে পুতুল পুতুল চেহারা বলে?

আমার দিকে দেখা। আমার চেহারা, পুতুল পুতুল না। আমার মধ্যে কোন মায়া নেই। আমি হচ্ছি। কঠিন একটা মেয়ে।

মিতুকে এখন সত্যি কঠিন দেখাচ্ছে। ইমন বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। মিতুর চেহারার এই হঠাৎ পরিবর্তনের কারণ সে ধরতে পারছে না। মিতু নিজেও বুঝতে পারছে না। সে হঠাৎ এমন রেগে গেছে কেন। নবনী নামের একটা মেয়েকে ইমন পড়ায় এটাই কি রাগের কারণ? এর মধ্যে রাগের কি আছে? ইমন পড়ার খরচ চালানোর জন্যে এটা করতেই পারে। করাটাই স্বাভাবিক। খবরটা গোপন রাখার জন্যে কি মিতু রাগ করেছে? তাওতো না। গোপন করা ইমনের স্বভাব। কোন কিছুই সে বলে না। তার বেশীর ভাগ খবর জানা যায় অন্যের মাধ্যমে।

ইমন, আজ বিকেলে কি তোর টিউশানি আছে?

না।

আজ বিকেলে তুই আমার সঙ্গে বনানী মার্কেটে যাবি। আমার এক বান্ধবীর হঠাৎ বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ওর বিয়ের গিফট কিনব।

আজতো যেতে পারব না।

কেন যেতে পারবি না?

আজি বিকেলে আমি আমাদের ক্লাসের এক ছেলের কাছে যাব। ওর সঙ্গে

কথা হয়ে আছে।

আজ না গিয়ে কাল যাবি। তোর এপয়েন্টমেন্টতো আর প্রাইম মিনিস্টারের এপিয়েন্টমেন্ট না যে রদবদল করা যাবে না।

ওর একটা কম্পিউটার আছে। আমি ওর কম্পিউটারে ল্যাবের কাজগুলি দেখি।

আরেক দিন দেখবি। একদিন প্র্যাকটিক্যাল না দেখলে কিছু হয় না।

আচ্ছা।

মিতু উঠে দাঁড়াল এবং তীব্র গলায় বলল, তোর যেতে হবে না। ঘর থেকে বের হবার সময় সে এত দ্রুত বের হল যে দরজায় বাড়ি খেয়ে মাথা ফুলে গেল। অন্য যে কোন ছেলে হলে পুরো ঘটনার আকস্মিকতায় হকচাকিয়ে যেত। ইমনের বেলায় তার ব্যতিক্রম হল। সে সঙ্গে সঙ্গে বই নিয়ে বসল। বই এ সে ঠিক মন বসাতে পারল না। এই বই এর ফাঁকেই একটা রেজিস্ট্রি চিঠি লুকানো আছে। চিঠিটা গত সপ্তাহে এসেছে। চিঠির হাতের লেখা অপরিচিত। চিঠির ভাষা অশালীন কিন্তু চিঠিটা যে পাঠিয়েছে সে পরিচিত। চিঠিটার লেখক মিতু এই ব্যাপারে সে একশ ভাগ নিশ্চিত। চিঠির একটা লাইন হচ্ছে— জনগো তুমি রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় কুজো হয়ে হাঁট কেন? এই লাইনটাই বলে দিচ্ছে চিঠি মিতুর লেখা। মিতু তাকে কয়েকবার বলেছে—এই তুই রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় কুজো হয়ে হাঁটিস কেন? তোকে দেখলে মনে হয়। হানচব্যাক অব নটরডাম।

মিতুর উদ্দেশ্য যদি হয় মজা করা তাহলে সে এই লাইনটি লিখে নিজেকে স্পষ্ট করে তুলল কেন? না-কি মিতু চাচ্ছে চিঠি পড়ে সে যেন পত্র-লেখক কে তা ধরতে পারে? মাঝে মাঝে ইমনের মনে হয় এই ব্যাপার নিয়ে সে মিতুর সঙ্গে কথা বলে, তারপরই মনে হয়, কথা বলে কি হবে? ইমন বই এর ভাজ থেকে আবার চিঠিটা বের করল। রুল টানা কাগজে মজার একটা চিঠি। আচ্ছ এমন কি হতে পারে যে এটা তাকে খুব চিন্তা ভাবনা করে লেখা মিতুর প্রথম প্ৰেম পত্র। এর একটা জবাব পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়? রেজিস্ট্রি করা জবাব। সম্বোধন হবে আমার প্রাণ পাখি বুলবুলি। চিঠিটা হবে অবিকল আগের চিঠির কপি। আগের চিঠিতে যেখানে জান লেখা সেখানে সে লিখবে জানের স্ত্রী লিংগ জানি। শুধু চিঠির শেষে নামের জায়গায় লিখবে–ইতি, হানচব্যাক অব নটরডাম।

ছিঃ এইসব সে কি ভাবছে। ইমান বই এ মন দেবার চেষ্টা করল। মন বসছে না। মিতুর সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে করছে। এই ইচ্ছাটা তার প্রায়ই হয়। মাঝে মাঝে এত প্রবল হয় যে সে আতংকগ্ৰস্থ হয়ে পড়ে। কয়েকবার সে স্বপ্নে মিতুকে দেখেছে। মানসিক ভাবে সে নিশ্চয়ই অসুস্থ নয়ত এমন স্বপ্ন দেখত না। একটা স্বপ্ন ছিল ভয়াবহ— সে খাটে বসে বই পড়ছে। অনেক রাত। মিতু ঘরে ঢুকে বলল, এই শোন চোখ বন্ধ করা। ইমন বলল, কেন? মিতু বলল, কেন মানে? আমি ঘুমাব না?

ঘুমুলে চোখ বন্ধ করতে হবে কেন?

আমি কি শাড়ি পড়ে ঘুমুতে যাব না-কি? নাইটি পরে ঘুমুব।

ইমন চোখ বন্ধ করল। এর মধ্যেও পিট পিট করে তাকাল। সত্যি মিতু খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে শাড়ি খুলে নাইটি পরে বিছানায় উঠে এসে বলল, ঘুমুতে এসো। এত বেশী পড়াশোনা করার দরকার নেই। শেষে আইনস্টাইন হয়ে যাবে।

ইমন স্বপ্নের মধ্যেই বুঝতে পারছে— মিতু তাকে তুই তুই করে বলছে না। মিতু তার স্ত্রী। স্ত্রীরা স্বামীকে তুই করে বলে না।

স্বপ্নটা দেখার পর প্রায় এক সপ্তাহ ইমন মিতুর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারে নি। তার কাছে মনে হয়েছে— মিতুর চোখে চোখ পড়লেই মিতু সবকিছু বুঝে যাবে।

একদিন মিতু নিজেই বলল, এই শোন, তুই আমাকে দেখলেই এমন পাস কাটিয়ে চলে যাস কেন? তোর সমস্যাটা কি? আমাকে তুই ভয় পাস না-কি?

ভয় পাব কেন?

ভয় কেন পাবি সেটাতো আমি জানি না। তোর ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হয়— হয় তুই আমাকে ভয় পাস, আর নয়তো তুই আমার প্রেমে পড়েছিস। প্রেমের প্রাথমিক পর্যায়ে ছেলেরা এমন করে।

তুই প্ৰেম বিশারদও হয়েছিস না-কি?

আমি সর্ববিদ্যা বিশারদ। আমার মাছির মত ত্ৰিশ হাজার চোখ।

ইমন বলল, চোখ বেশী থাকার সমস্যাও আছে। চোখ যত বেশী ভিশন তত পুওর। প্রকৃতি একটা দিলে আরেকটা দেয় না।

প্রকৃতি যাকে দেবার তাকে উজার করেই দেয়। যাকে দেবার না তাকে কিছুই দেয় না। এই জন্যেই একজন হয়। রবীন্দ্রনাথ একজন হয় ঠেলাগাড়ির ড্রাইভার মুকাদ্দেছ।

মিতুর মন সচরাচর খারাপ হয় না। আর খারাপ হলেও তা বোঝা যায় না। আজ মিতুর মন বেশ খারাপ। ইমনের ঘর থেকে বের হয়ে সে প্রথমে ছাদে গেল। বেশীক্ষণ থাকল না, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নেমে এল। তার মন খারাপ কি-না তা বোঝার উপায় হচ্ছে—সে রান্নাঘরে কি-না। যদি দেখা যায়। সে রান্নাঘরে ঢুকে কোন একটা রান্না নিয়ে ব্যস্ত তাহলে বোঝা যাবে তার মন বিশেষ খারাপ।

মার ঘরের পাশ দিয়ে রান্নাঘরে যাবার সময় ফাতেমা খুশী খুশী গলায় ডাকলেন, মিতু শুনে যা। তার খুশীর প্রধান কারণ হচ্ছে সুনামগঞ্জ থেকে পাগলা পীর সাহেব এসেছেন। আজ রাতে তিনি থাকবেন। নানান বিষয়ে গণা গুনবেন। বর্তমানে তিনি ফাতেমার ঘরে আছেন। ফাতেমার সঙ্গে পীর সাহেব ধর্ম বোন পাতিয়েছেন।

মিতু মার ঘরে উঁকি দিতেই পীর সাহেব মুখ ভর্তি হাসি দিয়ে বললেন—আম্মাজীর মুখ মলিন কেনে? মিতু পীর সাহেবকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে মার দিকে তাকিয়ে বলল, মা ডাকছ কেন?

ফাতেমা ঝলমলে গলায় বললেন, পীর সাহেবকে দিয়ে তোর বিয়ের গনাটা গনিয়ে নে। কোথায় বিয়ে হবে কবে হবে সব বলে দেবেন।

মিতু বলল, আমার কোথায় বিয়ে হবে, কবে হবে, আমি জানি। পীর সাহেবকে গুনে বের করতে হবে না।

পীর সাহেব মনে হল মিতুর কথা শুনে মজা পেয়েছেন। খিক খিক করে হাসছেন।

পীর সাহেবের বয়স চল্লিশের মত। দাড়ি গোফ নেই। সার্ট পেন্ট পরেন। মজার মজার কথা বলেন। তাঁর ভবিষ্যৎ গাণার পদ্ধতিটাও একটু ভিন্ন। এক টুকরা শাদা কাগজ নিয়ে নানান চিহ্ন আঁকেন। তারপর সুনামগঞ্জের ভাষায় হাসিমুখে বলেন— দরখাস্ত পেশ করেন।

অর্থাৎ কি জানতে চান বলুন।

যখন কিছু জানতে চাওয়া হয় তখন কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে নিজের মনে বিড়বিড় করেন। শাদা কাগজে আরো কিছু আঁকি বুকি কাটেন। তারপর বলেন, বিসমিল্লাহ, বইল্যা আংগুল ফেলেন।

তখন বিসমিল্লাহ বলে আঁকি বুকি কাটা কাগজে আংগুল ফেলতে হয়। ংগুল ফেলা মাত্র পীর সাহেব হড়বড় করে প্রশ্নের জবাব দিতে থাকেন।

মিতুর ধারণা এই মানুষ পীর ফকির কিছু না— অতি ধুরন্ধর। মানুষের প্রশ্ন থেকেই জবাবটা কি হলে ভাল হয় সেটা আঁচ করে নেয়। সেই দিকেই সে অগ্রসর হয়। মিতুর ধারণা সত্যি হবার সম্ভাবনা আছে। এই মুহুর্তে পীর সাহেব ফাতেমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। ফাতেমা বললেন, ভাই আমার ছেলে দুইটা সম্পর্কে বলেন। একজনের নাম শোভন একজনের নাম টোকন।

পীর সাহেব বললেন, ভইন দরখাস্ত পেশ করেন। হাই কোর্টে দরখাস্ত দেন।

ফাতেমা বললেন, ওরা আছে কেমন?

পীর সাহেব বললেন, ভাল আছে। খুব ভাল আছে।

ফাতেমা বললেন, কোন বিপদে পড়বেনাতো?

প্রশ্ন থেকে পীর সাহেব বিপদের আঁচ পেলেন। তিনি হাসিমুখে বললেন, বিপদের মধ্যেইতো আছে। নতুন কইরা পড়ব কি?

ফাতেমা পীর সাহেবের আধ্যাত্মিক ক্ষমতায় অভিভূত হলেন।

বিপদ থেকে উদ্ধারের পথ কি?

পীর সাহেব কাগজে আঁকি বুকি কাটতে লাগলেন। ফাতেমাকে দিয়ে তিনি কয়েকবার তর্জনী দিয়ে কাগজ ছোয়ালেন। প্রতিবারই তার মুখ গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হল। যেন জবাবটা পাচ্ছেন।

মাথার মধ্যে চাপ পড়তা ছেগো ভইন। চা খাব। চা খাওনের পর আরেকবার চেষ্টা কইরা দেখব।

এ বাড়িতে পাগলা পীর সাহেব এলে সবচে উত্তেজিত অবস্থায় যে থাকে তার নাম সুপ্ৰভা। সে সারাক্ষণ পীর সাহেবের সঙ্গেই থাকে। পীর সাহেবকে ডাকে পীর মামা। আজ সুপ্রভার দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। স্কুল থেকে ফিরে সে আতংকে অস্থির হয়ে আছে। তার কিছুই ভাল লাগছে না। স্কুল থেকে ফিরে সে ভাত খায়–ভাত খেতে পারে নি। খাবার নাড়াচাড়া করে রেখে দিয়েছে। কারণ সে ভয়ংকর বিপদে পড়েছে। এই বিপদ থেকে সে কি ভাবে উদ্ধার পাবে তা জানে না। দোয়া ইউনুস ক্রমাগত পড়তে থাকলে বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। দোয়া ইউনুস সে ক্রমাগত পড়ে যাচ্ছে। বিপদ থেকে উদ্ধারের কোন পথ দেখছে না। স্কুলে সে তার গলার চেইনটা হারিয়ে ফেলেছে। এক ভরী সোনার চেইন সুরাইয়া তার মেয়ের গলায় পরিয়ে দিয়েছিলেন । সোনার গয়না পরে স্কুলে যাওয়া এমনিতে নিষেধ। আজ ছিল প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন। সেই উপলক্ষে কিছু সাজগোজ করার অনুমতি ছিল। এই অনুমতি কাল হয়েছে। চেইন যে হারিয়েছে এটা সে টের পেয়েছে স্কুল থেকে আসার পর। স্কুলে থাকার সময় টের পাওয়া গেলে মাঠে যেখানে সবাই মেয়েরা মিলে দৌড়াদৌড়ি করেছিল সেখানে খোঁজা যেত।

সুপ্ৰভা দোয়া পড়েই যাচ্ছে। দোয়া যদি কবুল হয় তাহলে জিনিসটা কি ভাবে পাওয়া যাবে সে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ দেখা যাবে হারানো চেইন তার গলায় দুলছে? নাকি হঠাৎ স্কুলের দারোয়ান চাচা বাসায় উপস্থিত হয়ে বলবে–আপামনি আপনার চেইন পাওয়া গেছে। সমস্যা হচ্ছে স্কুলের দারোয়ানতো তার বাসার ঠিকানা জানে না।

জামিলুর রহমান লক্ষ্য করলেন সুপ্ৰভা সিঁড়ি ঘরের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। তিনি কাছে এগিয়ে গেলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, কাঁদছিস কেন?

সুপ্ৰভা জবাব না দিয়ে ছুটে এসে তার বড় মামাকে জড়িয়ে ধরল।

জামিলুর রহমান বিরক্ত গলায় বললেন, কান্না বন্ধ করে বল সমস্যাটা কি। মা বকা দিয়েছে?

না।

তাহলে হয়েছে টা কি?

সুপ্ৰভা ফুঁপাতে ফুঁপাতে তার সমস্যার কথা বলল। জামিলুর রহমান বললেন, কাপড় বদলে চল আমার সঙ্গে?

কোথায় যাব?

চল দেখি সমস্যার সমাধান করা যায় কি না। কেঁদোতো তুই আমার পাঞ্জাবী ভিজিয়ে ফেলেছিস। কান্না বন্ধ কর।

জামিলুর রহমানের মত কৃপণ মানুষ সুপ্রভাকে নিয়ে অনেক দোকান ঘুরে ঠিক আগের চেইনের মত দেখতে একটা চেইন কিনে দিলেন। সুপ্ৰভা বলল, মামা এটাতো বেশী চকচক করছে। মা যদি বুঝে ফেলে।

বুঝবে না। তোর মা খুঁটিয়ে আজকাল কিছুই দেখে না।

মামা একটা কাজ করলে কেমন হয়— চেইনটা নিয়ে তেতুল দিয়ে ধোয়া শুরু করি। মার সামনে ধুই। মা বুঝবে যে ধোয়ার জন্যে পরিষ্কার হয়েছে।

বুদ্ধিটা খারাপ না।

মামা কোক খাব।

কোক-ফোক না। আজে বাজে জিনিস খেয়ে শরীর নষ্ট।

কোকের একটা ক্যান জামিলুর রহমান কিনে দিলেন। কোক খেতে খেতে সুপ্ৰভা ফিরছে। হড়বড় করে অনবরত কথা বলছে। বড় মায়া লাগছে জামিলুর রহমান সাহেবের।
 
০৯.


জামিলুর রহমান সাহেব দশটার আগেই অফিসে চলে আসেন। অফিসের কর্মচারীদের দশটার সময় আসার কথা–ওরা তা করে কি-না সেটাই তার দেখার উদ্দেশ্য। মালিক দশটার আগেই চলে আসেন, কর্মচারীদের এই বোধটা মাথায় থাকলে তারাও সকাল সকাল আসবে। ঘটনা সে রকম ঘটে না, সবাই সবার ইচ্ছামত হেলতে দুলতে এসে উপস্থিত হয়। কেউ সাড়ে দশটায় কেউ এগারোটায়। এসেই চায়ের অর্ডার। যেন অফিসে এসেছে চা খেতে। বারোটা বাজতেই অফিসের পিওন সামছু মিয়া বের হয়ে যায় সিঙ্গাড়া আনতে। রাস্তার মোড়ে বিসমিল্লাহ রেস্টুরেন্টে সিঙ্গাড়া ভাজা হয়। সামছু মিয়া গরম সিঙ্গাড়া নিয়ে আসে। জামিলুর রহমান সাহেবের ধারণা ছিল সিঙ্গাড়া তারা নিজের টাকায় কিনে এনে খায়। কিছুদিন হল জেনেছেন ঘটনা তা না। খরচ যায় অফিস থেকে। ক্যাশিয়ার বিনয় বাবু সিঙ্গাড়ার দাম অফিস খরচে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন।

অফিসের হিসাবপত্র জমিলুর রহমান সাহেব খুব খুটিয়ে দেখেন না। হিসাবপত্র ঠিক থাকলেই হল। তিনি দেখেন ব্যাংকে জমা টাকার হিসাব। মাঝে মাঝে ক্যাশিয়ার বিনয় বাবু যখন বলেন, স্যার প্যাটি ক্যাশে টাকা নাই তখন চোখে চশমা দিয়ে প্যাটিক্যাশের বই এ চোখ বুলিয়ে যান। তাঁর প্রায়ই মনে হয়— মাসে মাসে ন হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া দিয়ে এমন একটা অফিস না হলেও তার চলত। হিসাব নিকাশ যা আছে নিজেই করতে পারতেন। যোগ এবং বিয়োগ অংক। যোগ বিয়োগ এমন কিছু জটিল অংক না। তার জন্যে মাইনে দিয়ে ক্যাশিয়ার পোষার দরকার কি? অফিস ম্যানেজার, ম্যানেজারের এসিসটেন্ট, সাইকেল পিওন, সাধারণ পিওন সবই বাহুল্য। লাভের গুড় এরাই চেটেপুটে খেয়ে ফেলছে। শুধু গুড় খেয়েই তৃপ্ত না। বেলা বারোটার সময় বিসমিল্লাহ রেস্টুরেন্টের সিঙ্গাড়াও খাচ্ছে।

আজ অফিসে আসতে জমিলুর রহমান সাহেবের বেশ দেরী হল। পাগলায় ইটের ভাটা দেয়ার একটা পরিকল্পনা তার আছে। ঢাকা শহরে লোকজন পাগলের মত বাড়িঘর বানাচ্ছে। যত একতলা বাড়ি আছে সব ভেঙ্গে রাতারাতি সেখানে দিশতলা বারতলা এপার্টমেন্ট হাউস হচ্ছে। ইটের দাম বাড়ছে হু হু করে। ইটের ভাটিগুলি ইট সাপ্লাই দিয়ে কুল পাচ্ছে না। ব্যবসার এই লাইনটা ধরা দরকার। এসব ব্যাপারে কারো সঙ্গে যে পরামর্শ করবেন। তাঁর সে উপায় নেই। বুদ্ধিদাতা কাছের মানুষ তার কেউই নেই। ফাতেমার সঙ্গে ব্যবসা সম্পর্কে কোন কথা তার কখনোই হয়নি। ফাতেমা রাতে ঘুমুতে যাবার সময় স্বামীর সঙ্গে যে সব গল্প করেন। তার বেশীর ভাগই রোগ ব্যাধি সম্পর্কে। শরীর ম্যাজ ম্যাজ করছে, হজম হচ্ছে না, চোখ ব্যথা হচ্ছে–রোদে তাকালে চোখ জ্বালা করে চশমা নিতে হবে, এইসব। জামিলুর রহমান শুনে যান, হঁহাঁ করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়েন। ছেলেমেয়ে কারো সঙ্গেই তার কথাবার্তা হয় না। এরা যখন ছোট ছিল তখন তিনি ছিলেন তার ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। একা মানুষের জন্যে এত বড় ব্যবসা দাঁড় করানো ভয়াবহ ব্যাপার। তিনি সেই ভয়াবহ কান্ডটা শান্তভাবে করেছেন। তা করতে গিয়ে সংসার থেকে দূরে সরে যেতে হয়েছে। মিতু, টোকন, শোভন এদের সঙ্গে দিনের পর দিন দেখাই হয় নি। বাসায় যখন ফিরেছেন তখন গভীর রাত। বাচ্চারা সবাই ঘুমিয়ে। তিনি ঘুম থেকে উঠে দেখেছেন— বাচ্চারা স্কুলে। আজ তাদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব অসীম। মিতু হয়ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে, তিনি বারান্দায় চেয়ার পেতে বসেছেন, মিতু তাকে দেখবে কিন্তু কিছু বলবে না।

একবার এ রকম তিনি বারান্দায় বসে ছিলেন। অপেক্ষা করছেন ম্যানেজারের জন্যে। ম্যানেজার এসে তাকে নিয়ে যাবে। তখন অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটল, মিতু এক কাপ চা নিয়ে এসে বলল, বাবা তোমার চা।

তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, চা চাইনিতো।

মিতু বলল, আমি বানিয়েছি, খাও।

তিনি চায়ে চুমুক দিলেন। তাঁর খুবই লজ্জা লজ্জা করতে লাগল। যেন মিতুর এই হঠাৎ মমতা গ্রহণ করার যোগ্যতা তাঁর নেই। তিনি একটা অন্যায় করছেন। চায়ের জন্যে মেয়েকে ধন্যবাদ জাতীয় কিছু বলা দরকার। কি ভাবে বলবেন তিনি ভেবে পেলেন না। বাইরের কাউকে থ্যাংক য়ু বলা যায়, নিজের মেয়েকে কি বলা যায়? চা খুব ভাল হয়েছে এই জাতীয় কথা বলা যায়। কথাগুলি গুছিয়ে বলার আগেই মিতু চলে গেল। কথাগুলি বলা হল না।

জামিলুর রহমান সাহেব বুঝতে পারছেন ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তার দূরত্ব কমানোর এখন সময় হয়ে এসেছে। বয়স হয়েছে, ঘুম কমে গেছে। বাড়িতে পা দিলেই ক্লান্তি লাগে। এই ক্লান্তি দূর করার জন্যে পরিবারের মানুষদের আশে পাশে দরকার। তা ছাড়া তিনি তার এক জীবনে কি করলেন না করলেন তাও তাদের জানা দরকার। কোন একদিন ঘুমের মধ্যে হঠাৎ মারা যাবেন। এরা কেউ জানতেও পারবে না, তার কত টাকা কোথায় খাটছে, কি কি ব্যবসা আছে, কয়টা ব্যাংকে একাউন্ট আছে। তাদের সম্ভবত ধারণা তিনি কষ্টে সৃষ্টি কোনমতে একটা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। ব্যবসার লাভে তিনতলা একটা বাড়ি হয়েছে—তাও পুরোটা শেষ হয়নি—ছাদে রেলিং হয়নি, দালান রং করা হয় নি। ব্যবসায় আয় যা হচ্ছে তা দিয়ে অফিস খরচ চালাতেই তিনি হিমসিম খাচ্ছেন। হঠাৎ করে ট্রাক কিনে ঝামেলায় পড়েছেন—লসের উপর লস যাচ্ছে।

ফাতেমা একবার বলেছিলেন, গাড়ি না-কি খুব সস্তা হয়েছে। সবাই গাড়ি কিনছে। তুমি একটা গাড়ি কিনতে পার না? তিন লাখ টাকা দিলেই না-কি একটা রিকন্ডিশান্ড গাড়ি পাওয়া যায়। তিনি কিছু বলেননি। শুধু অদ্ভুত দৃষ্টিতে স্ত্রীর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়েছিলেন। ফাতেমা এর পর আর গাড়ি প্রসঙ্গে কোন কথা বলেন নি।

কিছুদিন হল তাঁর গাড়ি কিনতে ইচ্ছে করছে। নিজের জন্যে না, বাড়ির জন্যে। হঠাৎ ঝকঝকে একটা নতুন গাড়ি দেখলে তাঁর ছেলেমেয়েদের মুখের ভাব কি হয় তা তার দেখার ইচ্ছা। এই ইচ্ছা তিনি চাপা দিয়ে রেখেছেন— গাড়ি কেনার অর্থই হচ্ছে গাড়ির সঙ্গে যন্ত্রণা কেনা। ড্রাইভার রাখা। ড্রাইভারের বেতন। সেই বেতনে তার চলবে না, সে তেল চুরি করবে। নতুন চাকা বিক্রি করে পুরানো চাকা লাগিয়ে রাখবে। তার ছিড়ে রেখে বলবে গাড়ি নষ্ট গ্যারেজে নিতে হবে। সেই গ্যারেজের সঙ্গে বন্দোবস্ত করা থাকবে। ফিফটি ফিফটি শেয়ার। হাজার টাকার কাজ করালে ড্রাইভার পেয়ে যাবে পাচিশ। কি দরকার?

ঢাকা শহর হচ্ছে রিকশার শহর। একেকটা শহরের সঙ্গে একেক জিনিস মানায়। ঢাকার সঙ্গে মানায় রিকশা। তিনি নিজে রিকশায় চলাফেরা করেন। তাঁর ভালই লাগে। গাড়িতে ছোটাছুটির দরকার কি? স্লো এন্ড স্টিডি উইনস দি রেস। দৌড় যখন শুরু হয় তখন খরগোস জেতে না, জেতে কচ্ছপ। তিনি জন্ম থেকেই কচ্ছপ।

ইটের ভাটির ব্যাপারে এক দালালের সঙ্গে কথা বলার জন্যে গোপীবাগ গিয়েছিলেন। দালাল শব্দটা শুনলেই মনে হয়— আজে বাজে টাইপ মানুষ, যার কাজই লোক ঠকানো। জামিলুর রহমান সাহেব খুব ভাল করে জানেন দালালদের ক্ষমতা কি পরিমাণ হতে পারে। ভাল একজন দালাল ধরা মানে ষোল আনা কাজের আট আনা কমপ্লিট। তিনি যে দালালের কাছে গিয়েছিলেন তার নাম মোখলেস। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স। ধূর্ত চেহারা। দুই চোখে সন্দেহ এবং অবিশ্বাস ছাড়া আর কিছুই নেই। শুরুতে সে কথাবার্তা শুরু করল তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে। জামিলুর রহমান সেই তাচ্ছিল্য গায়ে মাখলেন না।

ইটের ভাটি দিতে চান?

জ্বি।

কিয়লার না গ্যাসের?

গ্যাসের। কয়লা ব্যবহারতো নিষিদ্ধ।

কোন কিছুই নিষিদ্ধ না। বাংলাদেশে সবই সিদ্ধ। কোনটা বেশী সিদ্ধ। কোনটা অল্প সিদ্ধ।

ইটের ভাটির ব্যবসা আগে কখনো করেছেন?

নতুন নামবেন?

জ্বি।

মোখলেস অনেক সময় নিয়ে বিড়ি ধরাল। কোমরের লুংগীর খুঁট থেকে পানের বাটি বের করে জর্দা ভর্তি পান মুখে দিল। চোখ বন্ধ করে পান চিবুতে লাগল। জমিলুর রহমান সাহেব অপেক্ষা করতে লাগলেন।

এক সপ্তাহের নোটিশে দেড় কোটি টাকা ক্যাশ বাইর করতে পারবেন?

জামিলুর রহমান শীতল গলায় বললেন, পারব।

আমার খোঁজ আপনি কার কাছে পাইছেন?

কার কাছে খোঁজ পেয়েছি। এটা জানা কি আপনার দরকার?

না, দরকার নাই। আপনে পনেরো দিন পরে আবার আসেন। এই পনেরো দিনে আমি খোঁজ খবর করব।

জামিলুর রহমান উঠে দাঁড়ালেন। মোখলেসও তাঁর সঙ্গে ঘর থেকে বের হল। জামিলুর রহমানকে রিকশা খুঁজতে দেখে বিস্মিত হয়ে বলল, গাড়ি আনেন নাই?

আমার গাড়ি নাই। আমি রিকশায় চলাফেরা করি।

মোখলেস বলল, আমার প্রাইভেট বেবী আছে। আপনেরে দিয়া আসুক।

দরকার নেই। পেট্রোলের গন্ধ আমার সহ্য হয় না।

স্যার, আপনার ঠিকানা দিয়ে যান।

পনেরো দিন পর আমি নিজেই আসব। তখন ঠিকানা দেব।

জ্বি আচ্ছা।

মোখলেসের কাছ থেকে আসতে গিয়েই অফিসে তার দেরী হল। তিনি অফিসে পৌঁছলেন বারোটার দিকে। অফিসে পৌঁছেই মনে হল কোন একটা ঝামেলা হয়েছে সবার মুখ থমথমে। অফিসের পিওন দৌড়ে তার ঘর খুলে দিল। ফ্যান ছেড়ে দিল। পিরিচ দিয়ে ঢাকা ঠান্ডা এক গ্লাস পানি টেবিলে রাখল। অফিসে পা দিয়েই তিনি ঠান্ডা এক গ্রাস পানি খান।

পানির গ্লাস শেষ করে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে জমিলুর রহমান বললেন–সামছু মিয়া, কি ব্যাপার?

ক্যাশিয়ার সোব আপনেরে বলব।

তুমি বললে কোন অসুবিধা আছে? ঘটনা কি আগে তুমি বল— তারপর ক্যাশিয়ারের কাছ থেকে শুনব।

আমি কিছু জানি না। স্যার। ঘটনার সময় আমি বাইরে ছিলাম। ম্যানেজার সোব আমারে চিঠি পোস্ট করতে বলেছিলেন। আমি গিয়েছি। চিঠি পোস্ট করতে। তখন ঘটনা ঘটেছে।

ঘটনাটা কি?

ছোট সাব এসেছিল।

ছোট সাব মানে কে? শোভন?

জ্বি।

তারপর?

আপনে ক্যাশিয়ার সাবরে জিগান।

তোমাকে জিজ্ঞেস করছি তুমি বল—শোভন এসে টাকা চাইল?

জে।

টাকা নিয়ে চলে গেছে?

জে।

কত টাকা?

প্যাটি ক্যাশে যত ছিল সবই নিছে।

কত ছিল?

মনে হয় তিরিশ হাজার। আইজ একটা পেমেন্ট দেওনের কথা। চেক ক্যাশ করাইছে।

শোভন একা এসেছিল?

জ্বে না। টোকন ভাইয়াও ছেল। গাড়িতে বইস্যা ছেল। নামে নাই। নামছে খালি শোভন ভাইয়া।

শোভন টাকা চেয়েছে আর বিনয় বাবু আয়রণ সেইফ খুলে টাকা দিয়ে দিয়েছে?

উনি দিতে চান নাই। ম্যানেজার সাব উনারে দিতে বলছেন। ম্যানেজার সাব খুব ভয় পাইছেন।

ভয় পেয়েছে। কেন? শোভন পিস্তল বের করেছিল?

জ্বি।

আচ্ছা যাও।

ক্যাশিয়ার সাবরে আসতে বলি?

কাউকে আসতে বলতে হবে না। যখন ডাকব তখন আসবে।

স্যার, চা বানায়ে দিব?

না। দরজা লাগিয়ে দিয়ে যাও।

সামছু দরজা লাগিয়ে ভীত মুখে বের হয়ে গেল। জামিলুর রহমান চুপচাপ চেয়ারে বসে রইলেন। তার বুকে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে—শরীর ঘামছে। হার্ট এ্যাটাকের প্রাথমিক পর্যায় নাতো? না, তা না। এরকম তার আগেও কয়েকবার হয়েছে। চুপচাপ বসে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে। এখন তার করণীয় কি? পুলিশে খবর দেবেন? পুলিশকে বলবেন, আমার দুই ছেলে এসে ডাকাতি করেছে। আর্মড রোভারী। সঙ্গে পিস্তল ছিল। না, তা করা যাবে না। জামিলুর রহমান তার মন অন্যদিকে ফেরাবার চেষ্টা করছেন— পারছেন না। না পারলেও চেষ্টা করতে হবে। আজকের কাগজ পড়া হয় নি। কাগজ পড়া যেতে পারে। তিনি বেল টিপলেন। সামছু ঢুকল। তিনি বললেন, দেখি আজকের কাগজটা দেখি।

চা দিব স্যার?

দাও, চা দাও।

বুকের চিনচিন ব্যথাটা মনে হয় কমে আসছে। ব্যথা পুরোপুরি কমুক তখন বিনয়ের সঙ্গে কথা বলা যাবে। তিনি সিঙ্গাড়ার গন্ধ পেলেন। বারোটা বেজে গেছে। অফিসে সিঙ্গাড়া চলে এসেছে। কি এমন জিনিস যে প্রতিদিন খেতে হয়? তিনি নিজে আজ একটা খেয়ে দেখবেন না-কি?
 
১০.


ফাতেমার মেজাজ আজ খুব চড়ে গেছে। মেজাজ চড়ার মত তেমন কোন বড় ঘটনা ঘটে নি। মাঝে মাঝে অতি তুচ্ছ ব্যাপারে তাঁর মাথায় রক্ত উঠে যায়। তখন তিনি কি বলেন বা কি করেন নিজেই জানেন না। এখন তার চোখ রক্ত বর্ণ, কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। তিনি সুপ্রভার দিকে তর্জনী উচিয়ে বলছেন, তোর মাকে বল এক্ষুণি বাড়ি থেকে বের হতে। এক্ষুণি। অনেক দিন ফকির খাওয়ানো হয়েছে আর না। হোটেলের ফ্রি খাওয়া, ফ্রি থাকা যথেষ্ট হয়েছে। এখন পথে নামতে বল। গতির খাটিয়ে খেয়ে দেখুক কেমন লাগে।

এইখানে থেমে গেলে হত, তিনি এখানে থামলেন না। পথে নেমে কি ভাবে জীবন যাপন করলে খেয়ে পরে বাচা যায় তা বলতে শুরু করলেন। ইঙ্গিত টিঙ্গিতের ধার ধারলেন না। ভয়াবহ কথা বলতে শুরু করলেন।

মা-মেয়ে ঠোঁটে লিপস্টিক মেখে চন্দ্ৰিমা উদ্যানে হাঁটবি, কাস্টমার চলে আসবে। কোলে করে নিয়ে যাবে। কোলে কোলে থাকিবি। সুখে ভাড়া খাটবি। এইখানেতো কোলে করে কেউ রাখে না-পথে নামলেই কোল পাবি।

সুপ্ৰভা ভয়ে এবং লজ্জায় থারথার করে কাঁপছে। মনে মনে বলছে, আল্লা তুমি মামীকে থামাও। তুমি দয়া করে মামীকে থামাও। মামীর কথা শুনে সে যতটা ভয় পাচ্ছে, তারচে বেশী ভয় পাচ্ছে— মা এখন কি করবে। এই ভেবে। ফাতেমার প্রতিটি শব্দ সুরাইয়ার কানে যাচ্ছে। সুরাইয়া খুব সহজ পাত্র না। চুপচাপ সব হজম করবে। এই প্রশ্নই আসে না।

সুপ্রভার ধারণা কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মা বলবেন, সুপ্ৰভা ইমনকে বল একটা বেবীটেক্সি ডাকতে। আমরা চলে যাব। সুপ্ৰভা যদি বলে, মা কোথায় যাব? তিনি অবশ্যই বলবেন, চন্দ্ৰিমা উদ্যানে। ভাড়া খাটিব। এখন বাজে রাত দশটা। বড় মামাও বাসায় নেই। উপায়টা কি হবে? মিতু আপা আছেন। মার চিৎকার কথাবার্তা তিনি সব শুনছেন। কিন্তু কিছুই বলছেন না।

সুপ্ৰভা দেখল, মিতু আপা মগভর্তি চা নিয়ে ছাদে উঠে যাচ্ছে। এখন মা যদি সত্যি সত্যি বেবীটেক্সি আনায় তাহলে কেউ থাকবে না মাকে বুঝিয়ে দুটা কথা বলার। সুপ্রভার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কাঁদছে না। ভয়ে। কাঁদলে বড় মামী আরো রেগে যেতে পারেন।

যে ঘটনা থেকে এই আগ্নোৎপাতৃ সেই ঘটনা খুবই সামান্য। ফাতেমার পায়ে পানি এসে পা ফুলে গেছে। কাজের মেয়েকে বলেছেন এক গামলা গরম পানি এনে দিতে। গরম পানিতে পা ড়ুবিয়ে বসে থাকবেন। সে পানি আনতে অনেক দেরী করল। কারণ সে সুরাইয়াকে দোতলায় ভাত দিতে গিয়েছিল। ফাতেমা বললেন, ভাত ঘরে দিয়ে আসতে হবে কেন নিচে নেমে খেতে পারে না? কাজের মেয়ে বলল, আম্মা আমি ছোটমুখে অত বড় কথা বলি ক্যামনে? ভাত চায় ভাত দিয়া আসি, চা চায় চা দিয়া আসি, ফিরিজের ঠাণ্ডা পানি চায়, পানি দিয়া আসি। আমার কাম হইছে সিঁড়ি বাওয়া। আম্মা, আমারে ক্ষ্যামা দেন। চাকরি অনেক করছি, আর না।

ফাতেমার বারুদের বস্তায় আগুন লেগে গেল। প্রথমে গরম পানির গামলা লাথি মেরে উল্টে দিলেন। শুরু করলেন চিৎকার। দুর্ভাগ্যক্রমে সুপ্ৰভা তখন তার সামনে। সে সরে পরতে চেয়েছিল, ফাতেমা কঠিন গলায় বললেন, খবৰ্দার মেয়ে নড়বি না। খবর্দার বললাম।

ফাতেমার চিৎকার থামার পর সুপ্ৰভা খুব সাবধানে দোতলায় উঠল। মার ঘরে উঁকি দিল। মা রাতের খাওয়া শেষ করেছেন। দেয়ালে হেলান দিয়ে খাটে বসে আছেন। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, চিৎকার চেচামেচি সবই কানে গেছে। তার চোখ মুখ অস্বাভাবিক শান্ত। এই অস্বাভাবিক শান্ত ভাবটা মারাত্মক। আজ খুবই ভয়ংকর কিছু ঘটবে। সুরাইয়া মেয়ের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বললেন, সুপ্ৰভা রাতের খাওয়া খেয়েছিস?

সুপ্ৰভা ভয়ে ভয়ে বলল, হুঁ।

ইমন! ইমান খেয়েছে?

হুঁ।

আমাকে একটু পান সুপারি। এনে–দেতো, পান খেতে ইচ্ছে করছে। চুন আলাদা করে আনবি।

আচ্ছা।

সুপ্ৰভা পান আনতে নিচে গেল। মার ব্যাপারটা এখনো কিছু বোঝা যাচ্ছে না। অতি স্বাভাবিক আচরণ করছেন সেটাই অস্বাভাবিক। সুপ্রভার ভয় লাগছে। মিতু আপাকে ছাদ থেকে ডেকে নিয়ে আসতে ইচ্ছে করছে। মিতু আপা আশেপাশে থাকলেও একটা ভরসা।

পিরিচে করে দুটা বানানো পান সুপ্ৰভা মার জন্যে এনেছে। এক পাশে চুন, আরেক পাশে মৌরী, দুটা এলাচ। যেন পিরিচের দিকে তাকালেই মার মনটা ভাল হয়।

সুপ্ৰভা!

জ্বি মা।

ইমন কি করছে?

পড়ছে।

ওকে একটু ডাকতো। ওর সঙ্গে কথা আছে।

আচ্ছা।

তোর বড় মামা কি বাসায় আছে?

জ্বি না।

ভাইজান কখন ফিরেন?

এগারোটার মধ্যে সব সময় ফিরেন।

এখন কটা বাজে।

দশটা দশ।

তুই ইমনকে খবর দে।

সুপ্ৰভা ভাইকে ডাকতে গেল। তাকে বলে দিতে হবে যে তার সম্পর্কে মাকে সে একটা মিথ্যা কথা বলেছে। সে বলেছে ভাইয়া ভাত খেয়েছে। আসলে তারা দুজনের কেউই ভাত খায়নি।

ইমন পর্দা সরিয়ে মার ঘরে ঢুকল। শান্ত গলায় বলল, মা ডেকেছ?

দেখলেন, ইমনের বসার ভঙ্গি অবিকল তার বাবার মত। শুধু যে বসার ভঙ্গি তাই না, তাকানোর ভঙ্গিও সে রকম। ঐতো ভুরু কুঁচকে আছে। কপালের চামড়ায় সূক্ষ্ম ভাজ পড়েছে। এই বয়সেই কেমন গম্ভীর গভীর ভাব। গলার স্বরটাও কি তার বাবার মত? কখনো সে ভাবে লক্ষ্য করা হয় নি। একদিন ইমনকে বলতে হবে টেলিফোনে তার সঙ্গে কথা বলতে। টেলিফোনের কথা শুনে বলতে পারবেন। ইমনের গলার স্বর তার বাবার মত কি-না!

ইমন!

জ্বি।

তোর মামী যে সব কথাবার্তা বলছিল শুনছিলি।

হুঁ।

ভুরু কুচকে আছিস কেন? ভুরু সোজা করে কথা বল। তোর মামীর কথা শুনেছিস?

শুনেছি।

এরপরেও কি আমাদের এ বাড়ীতে থাকা উচিত?

হ্যাঁ উচিত।

সুরাইয়া বিস্মিত হয়ে বললেন, উচিত কেন?

উচিত কারণ আমাদের যাবার কোন জায়গা নেই।

সুরাইয়া তীক্ষ্ম গলায় বললেন, যাবার জায়গা থাকতেই হবে –রাস্তায় থাকব। রাস্তায় মানুষ বাস করে না?

পাগলের মত কথা বললেতো মা হবে না।

পাগলের মত কথা? কোন কথাটা পাগলের মত বললাম?

বেশীর ভাগ কথাই তুমি পাগলের মত বল।

তোর ধারণা আমি পাগল?

ইমন কিছু বলল না। চুপ করে রইল। সুরাইয়া চোখ মুখ লাল করে বললেন–খবৰ্দার চুপ করে থাকবি না। তোর ধারণা আমি পাগল? বল, আমি পাগল?

কিছুটা পাগলামী তোমার মধ্যে আছে।

এত বড় কথা তুই বলতে পারলি? পাগল যদি হয়েই থাকি কেন পাগল হয়েছি তুই জানিস না? কথার জবাব দে। চুপ করে থাকবি না।

কথার জবাব দেবার কিছু নেই। কথার জবাব দেয়া মানে— কথার পিঠে কথা বলা। আমি একটা কথা বলব, তুমি তার উত্তরে পাঁচটা কথা বলবে। আবার আমি বলবি. লাভ কি?

লাভ কি মানে, তুই কি সব সময় লাভ-লােকসান দেখে চলিস? তুই কি লাভ-লোকসানের দোকান খুলেছিস? একজন আমাকে আর আমার মেয়েকে বেশ্যা বলবে তারপরেও তার বাড়িতে আমি থাকিব? কোন যুক্তিতে থাকিব?

যুক্তি একটাই আমাদের যাবার জায়গা নেই। তা ছাড়া মামী রেগে গিয়ে কি বলেছেন সেটা বড় কথা না। রেগে গেলে আমরা সবাই কুৎসিত সব কথা বলি। মামী যেমন বলেন, তুমিও বল।

আমি বলি? কখন বলেছি? কি বলেছি?

কখন বলেছ, কি বলেছ সে সবাতো মা আমি লিখে রাখি নি। তবে অনেকবারই অনেক কুৎসিত কথা বলেছ। যখন বলেছি তখন লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করেছে।

ইচ্ছে করেছে। যখন তখন মরে গেলেই পারতিস। ছাদে উঠে ছাদ থেকে ঝাঁপ দিলেই পারতি। সেটা দিতে সাহস হয় না? মেনী বিড়াল হয়ে থাকতে ভাল লাগে।

তুমি কুৎসিত কথা বলা শুরু করেছ মা।

কথায় কথায় মা ডাকবি না। তোর মত ছেলের মুখ থেকে মা ডাক শুনতে চাই না। তোর জ্ঞান বেশী হয়ে গেছে। তুই মহাজ্ঞানী হয়ে যাচ্ছিস। মহাজ্ঞানী পুত্রের আমার দরকার নেই। শোন মহাজ্ঞানী, আমি এই বাড়িতে থাকিব না।

কোথায় যাবে?

কোথায় যাব সেটাও জানার দরকার নেই। সুপ্ৰভাকে নিয়ে আমি এখন, এই মুহুর্তে বিদেয় হব। তোর মামী যদি আমার পায়ে এসেও পড়ে থাকে তারপরেও থাকব না।

ঠিক আছে।

অবশ্যই ঠিক আছে। তুই এখন আমার সামনে থেকে যা। দয়া করে একটা বেবীটেক্সি এনে দে।

আচ্ছা।

ইমন মার ঘর থেকে বের হল। সুরাইয়া কাঁদতে শুরু করলেন। তিনি শব্দ করে কাঁদছেন, তার হাত পা কাঁপছে। দরজার আড়াল থেকে সুপ্ৰভা দেখছে। কিন্তু মাকে শান্ত করার জন্যে এগিয়ে আসছে না। তার শুধু মনে হচ্ছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। সুরাইয়া তীক্ষ্ণ গলায় ডাকলেন, সুপ্ৰভা সুপ্রভা। সুপ্ৰভা জবাব দিল না। সুরাইয়া বিছানা থেকে নামলেন। চটি পায়ে দিলেন। গায়ে একটা চাদর দিলেন, আর তখনি ইমন ঘরে ঢুকে বলল, মা তোমার বেবীটেক্সি এনেছি। তুমি যদি যেতে চাও যাও। আর যদি যেতে না চাও আমি বেবীটেক্সি বিদায় করে দেব। মা একটা কথা, তুমি কিন্তু একা যাবে। তোমার সঙ্গে সুপ্ৰভা যাবে না।

সুরাইয়া অবাক হয়ে দেখলেন, ইমন কঠিন গলায় কথা বলছে। ঐতো সেদিন এতটুক বাচ্চা ছিল— বিছানা ভিজিয়ে সেই ভেজা বিছানায় শুয়ে থাকত। একটু কাঁদতো না। ঠান্ডা লেগে জ্বর বাধাতো। একবার একটা উড়ন্ত মাছি হাত বাড়িয়ে খপ করে ধরে মুখে পুরে দিল। কিছুতেই আর মুখ খুলে না। অনেক সাধ্য সাধনা করে মুখ খুলানো হল— কি কান্ড! মুখ খুলতেই মাছি উড়ে বাইরে চলে গেল। আর মাছির শোকে ইমনের সে কি কান্না।

সুরাইয়া একাই বেবীটেক্সিতে উঠলেন। সুপ্ৰভা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, মা একটা কথা শুনবে? সুরাইয়া তীব্র গলায় বললেন, খবৰ্দার কোন কথা না। খবৰ্দার। তিনি বেবীটেক্সিওয়ালাকে বেবীটেক্সি চালাতে বললেন। বেবিটেক্সিওয়ালা বলল, কই যাইবেন?

তাইতে তিনি কোথায় যাবেন? অনেক চেষ্টা করেও তিনি কোন ঠিকানা মনে করতে পারলেন না। এমন কেউ কি আছে যার কাছে আজ রাতটা কাটানো যায়? থাকার তো কথা। তার দূর সম্পর্কের এক খালা—মিলি খালা থাকেন। যাত্ৰাবাড়িতে। মিলি খালার সঙ্গে এক সময় ভাল যোগাযোগ ছিল। যাত্রাবাড়িতে তাঁর বাসায় সুরাইয়া কয়েকবার গিয়েছে। কিন্তু এখন খুঁজে ঠিকানা বের করতে পারবে না। কলেজ জীবনের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিল। তারা এখন কে কোথায় আছে কিছু জানেন না। আগে যে বাড়িতে থাকতেন সেই বাড়িতে গেলে কেমন হয়? বাড়িওয়ালার স্ত্রীকে যদি বলেন, আজ রাতটা আমি আপনার বাড়িতে থাকব, তিনি নিশ্চয় তাকে বের করে দেবেন না। আগের বাড়ির ঠিকানা তিনি জানেন।

বেবীটেক্সিওয়ালা আবারো বলল, কই যাইবেন?

তিনি বললেন, মালিবাগ।

তিরিশ টাকা ভাড়া পরব।

তিরিশ টাকাই দেব।

তাঁর সঙ্গে টাকা আছে। খুব বেশী না। তবে আছে। সাতশ টাকার মত আছে। কিছু ভাংতিও থাকার কথা। আগের বাড়িওয়ালার বাড়িতে না গিয়ে কোন একটা হোটেলে কি উঠা যায় না? মাঝারি মানের কোন হোটেল। খুবই কি অস্বাভাবিক হবে। একা মেয়ে দেখে হোটেলওয়ালা কি তাকে ঘর দেবে না? আচ্ছা বেবিটেক্সিওয়ালাকে যদি বলেন, ভাই শুনুন, আজকের রাতটা আমি আপনার ফ্যামিলির সঙ্গে কাটিয়ে দিতে চাই। সকালবেলা আমি জায়গা খুঁজে নেব। তখন কি হবে?

খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার দীর্ঘদিন তিনি যে বাড়িতে ছিলেন— সেই বাড়ি খুঁজে পেলেন না। গলিতে ঢোকার মুখে মদিনা কাবাব হাউস বলে একটা দোকান ছিল। সেটা নেই। গলিটাও অন্য রকম লাগছে।

বেবিটেক্সিওয়ালা বলল, খালাম্মা বাড়ির নম্বর কত? তিনি বাড়ির নম্বর বলতে পারলেন না। বাড়িওয়ালার নামও মনে নেই।

আকাশের অবস্থা ভাল না। মেঘ ডাকছে। বোঝাই যাচ্ছে বৃষ্টি হবে। শ্রাবণ মাসের শুরু। রোজই বৃষ্টি হবার কথা। কয়েকদিন খরা গেল। আজ মনে হয় আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টি নামার আগে আগে কোন একটা আশ্রয়ে চলে যাওয়া উচিত। সেই আশ্রয়টা কি? বেবিটেক্সিওয়ালা বিরক্ত মুখে বলল— খালাম্মা আর কত ঘুরমু।

সুরাইয়া বললেন, কমলাপুর রেল স্টেশনে চল।

ঐদিকে বেবি যাইব না।

পথের মাঝখানে আমি কোথায় নামব?

বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। সুরাইয়ার মনে হল তাঁর জ্বর আসছে। জ্বর না এলে অল্প হাওয়াতেই এমন কেঁপে কেঁপে উঠতেন না।

খালাম্মা আমি কমলাপুর যামু না। ভাড়া মিটাইয়া দেন।

সুরাইয়ার মনে হল তিনি বিপদে পড়েছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে বিপদে পড়লেও তিনি অস্থির বোধ করছেন না। বরং ভাল লাগছে। খুব খারাপ সময়ের পরপরই খুব ভাল সময় আসে। এটা জগতের নিয়ম। বেবিটেক্সিওয়ালা রাস্তার মাঝখানে তাকে নামিয়ে দেবে। তিনি বৃষ্টিতে ভিজতে থাকবেন। পথে পানি জমে যাবে। পানি ভেঙ্গে তিনি এগুতে থাকবেন। কোন খোলা ম্যানহোলে ইচাট খেয়ে তিনি নোংরা পানিতে পড়ে যাবেন। তার হাত থেকে ছিটকে হ্যান্ডব্যাগটা পড়ে যাবে। তিনি আর সেই ব্যাগ খুঁজে পাবেন না। নোংরা কাদা পানিতে তাঁর শরীর মাখামাখি হয়ে যাবে। তখন দেখবেন-গুল্ড টাইপের কিছু মানুষ দূর থেকে তাঁকে দেখছে। তাদের মধ্যে একজন পানিতে ছপছপ শব্দ তুলে এগিয়ে আসছে। এরচে। খারাপ অবস্থাতো কিছু হতে পারে না। এ রকম খারাপ অবস্থার পরই ভাল অবস্থা আসে। সেই ভাল অবস্থাটা কি?

বৃষ্টি জোরেসোরে নেমেছে। বেবিটেক্সিওয়ালা তাকে নামিয়ে দেয়নি। বরং বেবিটেক্সি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মনে হয় কমলাপুর রেলস্টেশনের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে। তিনি কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। নিয়ে যাক, যেখানে খুশি নিয়ে যাক। বেবিটেক্সি থেকে বৃষ্টি দেখতে তাঁর ভাল লাগছে। শীত ভাবটা যদিও আরো প্রবল হয়েছে। আচ্ছা, আজ রাতে তাঁর জীবনের বিস্ময়কর কোন ঘটনা ঘটবে নাতো? কমলাপুর রেল স্টেশনে নেমেই যদি দেখেন ইমনের বাবা ট্রেন থেকে নেমেছে। রিকশা খুঁজছে। ঝড় বৃষ্টির রাত বলে রিকশা পাচ্ছে না। তাদের বেবিটেক্সি থামতে দেখেই মানুষটা এগিয়ে এল। তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বেবিটেক্সিওয়ালার সঙ্গে কথা বলছে, ভাড়া যাবে।

কোথায় যাবেন?

মালিবাগ যাব।

মালিবাগের কোন খানে?

রোলক্রসিং পার হয়ে গলিতে ঢুকতে হবে। গলির মোড়ে একটা কাবাবের দোকান আছে— মদিনা কাবাব হাউস নাম। কাবাব হাউস পার হয়ে অল্প একটু গেলেই হবে।

তখন পেছনের সীট থেকে সুরাইয়া বলবে— তোমার কি বাড়ির নাম্বার মনে আছে? বাড়ির নাম্বার কিংবা বাড়িওয়ালার নাম? মনে না থাকলে বাড়ি খুঁজে পাবে না।

তখন মানুষটা দারুণ অবাক হয়ে বলবে, আরে সুরাইয়া তুমি! তুমি কোথেকে?

সুরাইয়া ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলবেন, জানি না কোথেকে।

মানুষটা বলবে, তুমি এরকম কেঁপে কেঁপে উঠছি কেন? জ্বর না-কি?

বলেই হাত বাড়িয়ে কপাল ছুঁয়ে আঁৎকে উঠে বলবে–তোমারতো গায়ে অনেক জ্বর। শাড়িও ভিজিয়ে ফেলেছি।

সুরাইয়া বলবে, এই শাড়িটা দেখে তুমি কি কিছু বলতে পারবে? কোন স্মৃতি কি তোমার মনে পড়ে?

কিছু মনে পড়ছে নাতো।

মনে করার চেষ্টা কর। আচ্ছা, আমি তোমাকে সাহায্য করি তারিখটা হচ্ছে ১৫ই আগস্ট। তোমার জন্যদিন।

কিছুই মনে পড়ছে না।

আরো একটু চিন্তা কর। তোমার জন্মদিনে আমি তোমাকে একটা উপহার দিলাম। তুমি প্যাকেট খুলে দেখলে এই শাড়িটা। তুমি বিস্মিত হয়ে বললে— এটা আমার উপহার? শাড়ি? আমি বললাম, হুঁ। তুমি অবাক হয়ে তাকালে। তখন আমি বললাম, শাড়িটা তোমাকে দিলেও পরব। আমি। এবং এই শাড়ি পরে সুন্দর হয়ে তোমার সামনে উপস্থিত হব। কাজেই উপহারটা তোমার জন্যই হল, তাই না? তুমি চেয়ে বললে, হ্যাঁ। অবশ্যই আমার জন্যে।

এই শাড়ি আমি বৎসরে শুধু একবারই পরিা। তোমার জন্মদিনে। পনেরোই আগস্ট। আজ পনেরোই আগস্ট। মজার ব্যাপার কি জান, আজ যে তোমার জন্মদিন–তোমার ছেলেমেয়েরা তা জানে না। আজকের মত দিনে তাদের কারণে আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছি। এসে অবশ্যি ভালই হয়েছে। তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।



সুপ্ৰভা কাঁদছে। ইমন গম্ভীর মুখে বসে আছে। বোনকে সান্তুনা দিয়ে কোন কথা বলছে না। কিছুক্ষণ আগে মিতু এসেছিল। সে কিছুক্ষণ বসে উঠে চলে গেছে। সুপ্ৰভা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ভাইয়া, মা এখন কোথায়?

ইমন বলল, আমি কি করে বলব কোথায়?

তোমার দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে না?

হচ্ছে।

খুঁজতে যাবে না।

কোথায় খুজব?

সুপ্ৰভা চোখ মুছছে। ইমান বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ মুখ কঠিন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব রেগে আছে।

ভাইয়া বাইরে খুব ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে।

বর্ষাকালে ঝড়-বৃষ্টিতো হবেই।

তোমার একটুও দুঃশ্চিন্তা লাগছে না?

সুপ্ৰভা শোন, মায়ের পাগলামী যত দিন যাচ্ছে তত বাড়ছে। কেউ মাকে কিছু বলছে না। মাকে বলা উচিত না? সেই বলাটাই বলেছি। মা আজ একটা ধাক্কার মত খাবে। এতে তার লাভ হবে।

ক্ষতিওতো হতে পারে।

হ্যাঁ, ক্ষতিও হতে পারে। এই রিস্ক আমাদের নিতেই হবে। মা বাস করছে কল্পনার জগতে। মার জগতের সঙ্গে বাস্তবের জগতের কোন মিল নেই। বাস্তব পৃথিবীটা কেমন তাঁর দেখা উচিত।

তুমি টিচারদের মত করে কথা বলবে নাতো ভাইয়া। আমার ভাল লাগছে না। তুমি এ রকম শান্ত ভঙ্গিতে কি ভাবে বসে আছ আমি সেটাই বুঝতে পারছি না। তুমি সত্যি মাকে খুঁজতে যাবে না?

না।

আমি বড় মামাকে নিয়ে মার খোজে যাব।

বড় মামা সকালবেলা চিটাগাং গিয়েছে। আজ রাতে ফিরবেন না।

সুপ্ৰভা শোন, তুই আমার সামনে বসে কাঁদবি না দেখতে খারাপ লাগছে।

সুপ্ৰভা উঠে চলে গেল। যে ভঙ্গিতে গেল তাতে মনে হল এক্ষুণি সে একাই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে। সে গেল দোতলার বারান্দায়। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। তার চোখে মুখে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির পানিতে এবং চোখের জলে একাকার হয়ে যাচ্ছে।



অনেকক্ষণ ধরে টেলিফোন বাজছে। মিতু উঠে গিয়ে রিসিভার হাতে নিয়ে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে টেলিফোন রেখে দিল। কিছুক্ষণ পর আবার টেলিফোন। মিতু রিসিভার হাতে নিয়েই বলল, কে নবনী?

ওপাশে কিছুক্ষণের জন্যে নীরবতা। তারপরই নবনীর বিস্মিত গলা—আপনি মিতু আপা তাই না? কি করে বুঝলেন আমি টেলিফোন করেছি?

আমার ই এস পি পাওয়ার আছে। আমি আগে ভাগে অনেক কিছু বুঝতে পারি।

যান। আপনি ঠাট্টা করছেন।

মোটেই ঠাট্টা করছি না। মাঝে মাঝে আমি পারি—প্রমাণ দেব?

দিনতো।

এই মুহুর্তে তুমি একটা সাদা ড্রেস পরে আছ—শাড়ি পরেছ, না সালোয়ার কামিজ পরেছ তা বলতে পারছি না—তবে পোশাকের রঙ শাদা।

হয়েছে?

হয়নি।

ও আচ্ছা। আমি সব সময় বলতে পারি না। মাঝে মাঝে পারি।

বলুনতো আমি কানে কি রঙের পাথরের দুল পরেছি।

বলতে পারছি না।

সবুজ পাথরের দুল। পান্নার ইমিটেশন। আমার বড় চাচা অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। ইমিগ্রন্ট। উনি দেশে বেড়াতে এসেছেন। কারো জন্যে কিছু আনেন নি। শুধু আমার জন্যে সবুজ পাথরের দুল। এনেছেন। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম রিয়েল, পরে জানলাম ইমিটেশন।

তোমার একটু মন খারাপ হল?

জ্বি। তবে মন খারাপ ভাব বেশীক্ষণ থাকে নি। দুল জোড়া যে কি সুন্দর। দেখলেই আপনার মাথা ঘুরে যাবে।

আচ্ছা একদিন দেখব।

আপা শুনুন— আপনি কি করে বললেন যে আমি শাদা কাপড় পরে আছি।

আমিতো বলতে পারিনি।

না, পেরেছেন। আমি আসলে মিথ্যা করে বলেছি পারেন নি। আমি শাদা সালোয়ার কামিজ পরেছি। এই সেটটা আমার মা আমাকে কিনে দিয়েছেন। গতবার আমরা দিল্লী গেলাম।— দিল্লী থেকে কেনা। দিল্লীতে একটা আন্ডারগ্রাউন্ড মার্কেট আছে। পালিকা বাজার। মা পছন্দ করে কিনেছেন— আমার দুচক্ষের বিষ। শাদা রঙ হচ্ছে বিধবার রঙ, তাই না। আপা। আমার ফেভারিট কালার কি জানেন— আমার ফেভারিট কালার হচ্ছে রেড। আমি একটা বই এ পড়েছি লাল রঙ যাদের প্রিয় তারা মানুষ হিসেবে খুব ভাল হয়। আপা শুনুন, আমার এখন টেলিফোন রেখে দিতে হবে। আপনি কি আমার জন্যে ছোট্ট একটা কাজ করে দিতে পারবেন?

হ্যাঁ পারব। ইমনকে কিছু বলতে হবে?

জ্বি। আগামী পরশু উনার আমাকে পড়াতে আসার কথা—ঐদিন আমার ছোট খালার ছেলের বার্থডে। আমাকে বার্থডেতে যেতে হবে।

ইমনকে বলব সে যেন তোমাকে পড়াতে না যায়?

না না, আমি পড়া মিস দিতে চাই না। এমিতেই আমি খুব খারাপ ছাত্রী। আপনি শুধু বলবেন উনি যেন একটু দেরী করে আসেন।

একটু দেরী মানে কতক্ষণ দেরী? এক ঘণ্টা?

আচ্ছ একঘণ্টা। আপা আসলে আমি জন্মদিনে যেতেই চাচ্ছিলাম না— কিন্তু আমার ঐ কাজিন আমাকে খুব পছন্দ করে। খুব পছন্দ করে শুনে আপনি আবার অন্য কিছু ভেবে বসবেন না, ওর বয়স হল সাত বছর।

ও আচ্ছা।

তাহলে আপা আমি এখন রাখি? আপনার সঙ্গে কথা বলতে আমার এত ভাল লাগে। মনে হয়। কতদিনের যে চেনা। আচ্ছা। আপা আপনাদের ওদিকে কি বৃষ্টি হচ্ছে?

হচ্ছে।

আমাদের এদিকেও হচ্ছে। বর্ষাকাল আমার কাছে জঘন্য লাগে— বৃষ্টি, বৃষ্টি, বৃষ্টি। তবে সবচে জঘন্য লাগে শীতকাল। শীতকালে চামড়া ফেটে যায় এই জন্যে। আমার আবার খুব ড্রাই স্কিনা। আপা আপনার স্কিন কি রকম Oily না ড্রাই?

ঠিক জানি না। আমার মনে হয় মাঝারি ধরণের।

আপনার গায়ের রঙ তাহলে শ্যামলা। শ্যামলা মেয়েদের স্কিন হয় নরম্যাল। আর যারা খুব ফর্সা তাদের স্কিন হয় খুব ড্রাই হবে নয়ত খুব ওয়েলি হবে। এই জন্যে মাঝে মাঝে আমার কাছে মনে হয়—শ্যামলা হয়ে কেন জন্মালাম না। লোকে আমাকে কালো বলতো। লোকের বলায় কি যায় আসে। তাই না আপা?

হ্যাঁ তাই।

আচ্ছা এখন রাখি। খোদা হাফেজ। সরি সরি। আল্লাহ হাফেজ। আমার এক হুজুর আছেন উনি আমাকে বলেছেন কখনো যেন খোদা হাফেজ না বলি। সব সময় যেন আল্লাহ হাফেজ বলি।

দুটাতো একই।

না, এক না। কি যেন একটা ডিফারেন্স আছে। আচ্ছা আমি হুজুরকে জিজ্ঞেস করে আপনাকে জানাব।

টেলিফোন রেখে মিতু ঢুকল ইমনের ঘরে। সহজ স্বাভাবিক গলায় বলল, ইমন তুই উঠে কাপড় পড়তো। এক জায়গায় যাব?

কোথায়?

কমলাপুর রেল স্টেশনে। আমার সিক্সথসেন্স বলছে ফুপু কমলাপুর রেলস্টেশনে বসে আছেন।

ইমন বিরক্ত গলায় বলল, তুই তোর সিক্সথসেন্সের ফাজলামী আমার সঙ্গে করবি না। তোর ধারণা হয়েছে মা কমলাপুর রেল স্টেশনে— তুই সেই ধারণার কথা বলবি?

রেগে যাচ্ছিস কেন?

রাগছি না।

অবশ্যই রাগছিস। যত রাগছিস ততই কুজো হচ্ছিস। ঘাড় সোজা করে বসতে পারিস না। হ্যাঞ্চব্যাক অব ঢাকা।

বেবিটেক্সিতে উঠেই মিতু হাসি হাসি মুখে বলল, আচ্ছা শোন তোকে একটা জটিল প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি। তুইতো আবার ঠান্ডা মাথার ছেলে— ভেবে চিন্তে জবাব দে। মনে কর একটা ছেলে এবং একটা মেয়ে ছোটবেলা থেকে এক সঙ্গে বড় হয়েছে। তাদের মাঝে তুই তুই সম্পর্ক। বড় হয়ে তারা বিয়ে করল। বিয়ের পরে যদি মেয়েটা স্বামীকে তুই তুই করে বলে তাহলে স্বামী বেচারা কি রাগ করবে?

ইমন জবাব দিচ্ছে না। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। মিতু হালকা গলায় বলল, তোকে আরো কিছু হিন্টস দিয়ে দি। ধরে নে ছেলে এবং মেয়ে ফাস্ট কাজিন। একি, এরকম রাগি চোখে তাকিয়ে আছিস কেন? ঠাট্টা করছি। আমি ঠাট্টাও করতে পারব না?

ইমন বলল, এ ধরনের ঠাট্টা আমার পছন্দ না।

মিতু হাই তুলতে তুলতে বলল, ঠাট্টা পছন্দ না? তাহলে ঠাট্টা না। সত্যি কথাই বলছি। এখন বল বিয়ের পর তোকে যদি আমি তুই তুই করে বলি তুই কি রাগ করবি? আচ্ছা বাবা যাক জবাব দিতে হবে না। বিয়ের পর তুমি করেই বলব। বিয়ের পর কেন— এখন থেকেই বলব।

ইমন তাকিয়ে আছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মিতু বলল, এই তুমিতো ভিজে যােচ্ছ আরেকটু সরে এসে বোস।

বলেই মিতু হাসতে শুরু করল। তার হাসি আর থামেই না। ইমন খুব চেষ্টা করছে মিতুর উপর রাগ করতে। রাগ করতে পারছে না। বরং অন্য রকম মায়ায় সে অভিভূত হয়ে পড়ছে। তার কাছে মনে হচ্ছে সে তার একটা জীবন এই বিচিত্র মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিতে পারবে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top