What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected সঞ্চয় (1 Viewer)

pqG7TOb.jpg


'আম্মা বললে না তো।' ছেলের কথায় চমকে ওঠেন নাসরিন। পড়ার টেবিলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ছেলের বাবার মেডিকেল রিপোর্ট।

ছেলের প্রশ্ন শুনে নাসরিন ভাবালুতায় ডুবে যান। তাকিয়ে থাকেন তার পরিশ্রমী ছেলেটির ঘামভেজা মুখের দিকে। কী উত্তর দেবেন? এখন দুজনের আয়ের একটা বড় অংশ থেকে যায়। হাত দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ছেলে ঢাকা ভার্সিটির জিওগ্রাফিতে পড়ে। বাপের মতোই পরিশ্রমী হয়েছে। সারা দিন টিউশনি করে বেড়ায়। এক টাকা তো চাইবে না, উল্টো এটা–ওটা নিয়ে আসে প্রায়। তার নাকি কয়েকটা ডিপিএস আছে। এমন একটা লক্ষ্মী ছেলে পেটে ধরার আনন্দে তার চোখে জল এসে যায়।

মেয়েটা আরও এক কাঠি সরেস। ইডেন থেকে মাস্টার্স করে শান্তিনিকেতনে গেছে স্কলারশিপে। নিজের টাকায় তার চলে যায়। বন্ধে বাড়ি এলে টুথপেস্ট থেকে মায়ের জন্য সায়া-ব্লাউজ পর্যন্ত নিয়ে আসে। তার বিয়ে-থা নিয়ে চিন্তা করতে বারণ করে দিয়েছে। বুঝদার মেয়ে, নিজের বিয়ের বিষয়ে নিশ্চয়ই নিজে ভেবে রেখেছে।

মা-বাবা কর্মজীবী হওয়ার কারণে ছোটবেলা থেকেই ছেলেমেয়ে দুটো আত্মনির্ভর হয়ে উঠেছে। মা–বাবার সীমিত আয় সম্পর্কে তাদের স্পষ্ট ধারণা ছিল। তাই কখনোই কোনো খরচের বোঝা যেন মা-বাবার ওপর না পড়ে, সেদিকে তাদের কড়া নজর।

নাসরিনের এখন দুকূল উপচে পড়া সুখ। অথচ আজ থেকে আঠারো-কুড়ি বছর আগে কী কষ্টের দিনটাই না গেছে। পিঠাপিঠি দুটো বাচ্চা। ছেলের বাবার 'উপরিবিহীন' ডিপার্টমেন্টে সামান্য স্টেনোগ্রাফের চাকরি। কম্পিউটার এসে যাওয়ায় তাদের গুরুত্বও কমে যায়। মাসের বেতনে অর্ধেকটা মাস যেত না। দুটো বাচ্চার দুধ-ডায়াপার-ডাক্তারের খরচ জুটাতেই নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা। তার ওপর বাড়িতে টাকা পাঠানো লাগত বুড়ো শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য। অসচ্ছল এক বোনের পরিবারকেও টানতে হতো। আর গ্রাম থেকে আসা মেহমান তো লেগেই থাকত।

উদ্ধারের একটা উপায় ছিল নাসরিনের চাকরিতে যাওয়া। এর অগেই ছেলের বাবার উৎসাহে টেনেটুনে ডিগ্রিটা পাস করেছিলেন। দুবারের চেষ্টায় প্রাইমারি স্কুলের চাকরিটাও হয়ে গেল। তখন সাকল্যে বেতন মাত্র তেত্রিশ শ টাকা। পাশের বাসার যে কুসুম সকালে অ্যালুমিনিয়ামের ক্যারিয়ার ঝুলিয়ে গার্মেন্টসে যেত, তার বেতন তখন পাঁচ হাজার।

এই সামান্য কয়েকটা টাকার জন্য উদয়াস্ত খাটতে হতো। তারপর সংসার সামলানো, একটা কাজের মানুষ রাখেননি কোনো দিন। ছেলের বাবা কখনোই তার বেতনে হাত দেননি। বলতেন, 'সামনে অনেক খরচ, ছেলে বড় হচ্ছে, মেয়ের বিয়েশাদি । তোমার পুরো বেতনটা জিপিএফে রেখে দাও।'

চাকরির পর একটা কাগজের দোকানে তিন ঘণ্টা বসতেন ছেলের বাবা। অফিসে টুকটাক এদিক–ওদিক করে আরও কিছু মিলত। এ দিয়ে গোঁজামিলের অঙ্কের মতো সংসারটা চলত। সকালবেলা শুকনো দুটো রুটি আর এক টুকরো আখের গুড় ক্যারিয়ারে নিয়ে অফিসে যেতেন। কোনো অভিযোগ ছিল না। দিন দিন পিঠের হাড় দুটো শার্ট ফুঁড়ে উঠে আসতে লাগল। নাসরিন যতই বলে, 'একটু ভালোমন্দ খান', তার একটাই কথা, 'সামনে অনেক খরচ।'

ভবিষ্যৎ খরচের কথা ভেবে যা জমেছে তা বিস্তর। এর মধ্যে নাসরিনের স্কেল বাড়ায় বেতন হয়েছে কয়েক গুণ। ছেলের বাবারও উন্নতি হয়েছে। তাই সঞ্চয়ে আর হাত দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি কখনো। খেয়ে না খেয়ে জমানো টাকাগুলো দিয়ে কী করবেন, সেটা নিয়ে গত দুবছর ধরে চিন্তার শেষ নেই।

ছেলের বাপের চাকরি বেশি দিন নেই। একটা ফ্ল্যাট কিনলে মন্দ হয় না। রায়ের বাজার, মোহাম্মদপুর, মগবাজার, মিরপুর, বাসাবো, কল্যাণপুর—বহু জায়গা তারা এ কয়ে ক দিন চষে বেড়িয়েছেন। এতগুলো টাকা এক জায়গায় দিতে মন সায় দেয় না। এ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনলে এ রকম তিন–চারটে ফ্ল্যাটের ভাড়া প্রতি মাসে দেওয়া সম্ভব। তাই সে পরিকল্পনা বাদ।

তার চেয়ে বরং গ্রামে একটা একতলা বাড়ি তোলা অনেক লাভজনক। শহরের সব সুবিধেই এখন গ্রামে আছে। অবসরের পর দুজন দিব্যি সেখানে থাকতে পারবে। কিন্তু ভিটের জমি নিয়ে শরিকানদের সঙ্গে লাগল ঝামেলা। মাত্র পৌনে ১ শতাংশ জমির বিবাদ। কিন্তু এ নিয়ে মন–কষাকষি গড়াল বহু দূর। যতটা না জমির ব্যাপার, তার চেয়ে বেশি আত্মসম্মানের। একসময় পরিস্থিতি এমন পর্যায় গেল, মন বিষিয়ে উঠল। বাড়ি করার ইচ্ছেই মরে গেল।

বিয়ের পর পর ভিসিআরে আরাধনা ছবি দেখেছিলেন নাসরিন। অনেক শখ ছিল টয় ট্রেনে করে দার্জিলিং যাওয়ার। কিছুদিন আগে ছেলের বাবাকে সেই শখের কথা বলেছিলেন। হিসাব-নিকাশ করে দেখা গেল চারজনের পাসপোর্ট–ভিসা, যাওয়া–আসা, হোটেলের খরচ মিলিয়ে লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। নাসরিন নিজে থেকে নিবৃত্ত হলেন। তার শখের মূল্য লাখ টাকা হতে পারে না। সামান্য পাহাড় দেখার জন্য এত টাকা খরচের কোনো মানে হয় না।

ছেলের বাবাই বললেন, 'তাহলে বান্দরবান চলো। পাহাড়ই তো দেখবে।'

আজ যাবে কাল যাবে করে কেটে গেছে অনেক দিন। এখন ছেলের বাবা অনেকটা গৃহবন্দী। ইচ্ছে হলেও বেরোবার উপায় নেই। কয়েকবার অফিসে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাওয়ায় তাকে বঙ্গবন্ধুর আউটডোরে দেখানো হয়েছিল। সেখান থেকে রেফার করা হয় স্নায়ুরোগে। তারপর হৃদ্রোগ বিভাগে। একগাদা টেস্ট। ছেলেই তার বাবাকে নিয়ে ছোটাছুটি করে। কিছু প্রশ্ন করলে গম্ভীরমুখে হ্যাঁ হু করে এড়িয়ে যায়। তখন নিজের পেটের সন্তানের সঙ্গে কথা বলতে ভয় হয় না সর িনের।

এখন মাঝেমধ্যে বিষণ্ন দুপুরে নাসরিন তার স্বামীর সঙ্গে স্মৃতি রোমন্থন করেন। বড় আক্ষেপ উঠে আসে ভেতর থেকে, 'কী দরকার ছিল নিজেদের এত বঞ্চিত করার?'

'এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি', ছেলের বাবা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।

'মাঝে মাঝে ভাবি জীবনভর মানুষ আসলে কী সঞ্চয় করে?'

'কষ্ট।'

চোখে চশমটা বসিয়ে পত্রিকায় মন দেন ছেলের বাবা। যেন নির্লিপ্ত মহাপুরুষ।

'আম্মা বললে না তো।' ছেলের কথায় চমকে ওঠেন নাসরিন। পড়ার টেবিলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ছেলের বাবার মেডিকেল রিপোর্ট। ছেলে ল্যাপটপে কী যেন দেখছে আর কথা বলছে।

'আছে, খারাপ না। কেন?'

'এক্সেক্ট ফিগারটা বললে ভালো হয়। প্ল্যান করতে সুবিধা...'

'কিসের প্ল্যান?'

'আব্বার বোধ হয় পেসমেকার বসানো লাগতে পারে। দেশে করাব না বিদেশে, সেটা ভাবছি।'

নাসরিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। মনে মনে ভাবেন ছেলের বাপের কথাটাই ঠিক। সুখের আশায় মানুষ শুধু কষ্ট জমায় জীবনভর।

লেখক: জয়দীপ দে
 

Users who are viewing this thread

Back
Top