What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected দুটি গল্প (1 Viewer)

7vV9ae3.jpg


বাঘ

নিজের অতীত হঠাৎ কখনো ফিরে আসে। আগাম কোনো সংকেত না দিয়ে কখনো হয়তো বিস্মৃতপ্রায় এক প্রেমের উপাখ্যান আচমকা ফিরে আসে। এত অপ্রত্যাশিতভাবে এবং এত ভয়ংকর রূপে, যেন বহুকালের পুরোনো জঙ্গল থেকে ঘরের দরজায় এসে পড়েছে একটা বাঘ।

একবার এটাই ঘটল।

দরজায় ঠক ঠক শব্দ। মনে হচ্ছে অসহিষ্ণু কেউ বেশ জোরেশোরে কড়া নেড়ে যাচ্ছে। দরজা খুলে দেখলাম, একটা ডোরাকাটা বাঘ, বেশ মলিন ও রোগা। সে আমারই দিকে তাকানো।

আমি চিনতে পেরে জিজ্ঞেস করলাম, 'কী খবর? কেন এসেছ?'

সে বলল, 'আমি চাই না, তুমি আমাকে ভুলে যাও।'

'বেশ! ভুলব না', বলে আমি দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিলাম, সে আমার পাশ দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। ভাগ্যিস বাসায় কেউ ছিল না, না হলে কী কাণ্ড যে হতো!

আমার মুখে ভয় ও অন্ধকার দেখে সে বলল, 'ভয় পেয়ো না, আমি কামড়াব না। থাবা বসানোর কোনো ইচ্ছা আমার নেই।'

তার কথাটা সত্য মনে হলো। একটুও হিংস্র দেখাচ্ছে না তাকে। অতীতের গহ্বর থেকে এত দূর আসতে আসতে হয়তো সে তার ব্যাঘ্রত্ব হারিয়ে ফেলেছে।

যেহেতু সে আমারই অতীত, তাই তাকে অস্বীকার না করে থাকতে দিলাম। তার আশ্রয় হলো খাটের নিচে। যখন কেউ বাসায় থাকে না, ঠিক তখন সে বেরিয়ে আসে। আমরা কথা বলি। অতীতের ঘটনাবলি নিয়ে কথা বলতে আমার খারাপ লাগে না। কিন্তু সে এমন সব বিষয়ে কথা বলে, যার সম্পর্কসূত্র খুঁজে পেতে আমার বেশ বেগ পেতে হয়। অনেক তথ্যই ভুলে গেছি, মনে হয় ভাঙা ভাঙা কিছু সেতু পার হয়ে এগোচ্ছি, যেন বহু বছর পর ফিরে গেছি কোনো পরিচিত গ্রামে, যার কিছুই আর আগের মতো নেই।

বাঘটা খাটের নিচে ঘুমায়। তার গা থেকে উৎকট গন্ধ এসে ঘরের বাতাসকে সন্দেহজনকভাবে ভারী করে তোলে। এয়ার ফ্রেশনারের গন্ধ আমার সহ্য না হলেও বাতাসে স্প্রে করি সব সময়। তার নাক ডাকার ক্ষীণ আওয়াজ যাতে কেউ শুনতে না পায়, সে জন্য আওয়াজ বাড়িয়ে টিভি দেখি, নয়তো গান শুনি উচ্চ শব্দে।

যখন আমি ছাড়া ঘরে অন্য কেউ নেই, সে তখন খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে আসে রাজসিক ভঙ্গিতে; ঘুরে বেড়ায় আসবাবের জঙ্গলে। তখন বাসাটাকে মনে হয় একটুকরা বন। সে যখন বারান্দায় বসে রোদ পোহায়, মনে হয় যেন শীতের বিকেলে কোনো নদীর কিনারে আধশোয়া ভঙ্গিতে বসে আছে।

কখনো কথা বলতে বলতে সে কিছুটা হিংস্র হয়ে ওঠে, যেন কোনো শিকারকে তাড়া করে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে, এমনইভাবে সে লাফিয়ে পড়ে আমার ওপর। আমি ভয়ে আঁতকে উঠি। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, বাঘটাকে তুলাভরা খেলনা বাঘের মতো লাগে, গায়ে একেবারেই জোর নেই।

একসময় তাকে নিয়ে ক্লান্ত বোধ করি। মনে হয় অতীতের এক দমবন্ধ গহ্বরে আটকা পড়ে গেছি। তার সঙ্গে কথা বলতে, তাকে সময় দিতে আমার একেবারেই ইচ্ছা করে না। আমি তাকে চলে যেতে বলি।

সে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, যাবে না।

আমি কৌশল হিসেবে তাকে খাবার দেওয়া বন্ধ করে দিই। কিন্তু এমন একটা আশঙ্কা আমাকে অস্থির করে তোলে যে বাঘটা সবার সামনে বেরিয়ে আসবে এবং কী কাণ্ডটাই না ঘটবে তখন! তবে বাঘটা হয়তো গোপনীয়তায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, তাই কেউ ঘরে থাকলে বাইরে আসে না।

সে খাবার না পেয়ে ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে। সারাক্ষণ খাটের নিচে ঝিমায় আর তৃষ্ণা মেটাতে কখনো কখনো গোসলখানায় ঢুকে ভেজা মেঝে চাটতে থাকে।

তার রুগ্ণ দেহ আর করুণ চোখের দিকে আমি তাকাতে পারি না। কোনো কথাই আর বলে না সে, যেন কোনো শব্দ উচ্চারণ করার শক্তিটাও হারিয়ে ফেলেছে।

বুঝতে পারি, বাঘটা নির্ঘাত মারা পড়বে। তার আসন্ন মৃত্যু আমি চোখের সামনে দেখতে পাই, যা আমাকে বিষণ্ন করে। তদুপরি এই আতঙ্কও আমার ওপর এসে ভর করে, মৃত বাঘটাকে নিয়ে আমি কী করব? তাকে কোথায় লুকাব? তবে জরুরি যে প্রশ্ন আমাকে অস্থির করে তোলে, সেটা এই যে আমারই অতীত আমার কাছে কেন এমন অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠল? এতটাই দুর্বহ যে তাকে আমি মেরে ফেলছি। একইভাবে ভবিষ্যৎও কি এখনকার বর্তমানকে মেরে ফেলতে চাইবে?

কদিন পর, এক শুক্রবারে আমি ভীষণ অবাক হয়ে দেখি, বাঘটা নেই। মরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একদম অদৃশ্য হয়ে গেছে। তবে বাসার কেউ কেউ দু–একটা লোম এখানে–সেখানে পড়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, বাসায় বিড়াল ঢুকল কীভাবে?

ZEHocfW.jpg


ইশারা

আজিজ বলে, আকস্মিকতা বলে কিছু নেই। আমরা যে রহমতগঞ্জের পথে না গিয়ে সেদিন বেড়িবাঁধ ধরে স্কুলে যাচ্ছিলাম, সেটাই নাকি অনিবার্য ছিল; নিয়তিনির্ধারিত হয়েই আমরা বেড়িবাঁধের পথে গেছি। সে আরও বলে, সবকিছুতে নিয়তির ইশারা আছে, কিন্তু আমরা সেটা বুঝতে পারি না। তাই ভুল পথে গিয়ে বিপদগ্রস্ত হই। বুঝতে পারলে নাকি আমরা নিজেদের দুর্ভাগ্যকবলিত ভবিষ্যৎকে এড়িয়ে যেতে পারতাম।

আজিজের ক্ষেত্রে সে রকমই ঘটেছে কি না, আমি জানি না। কিন্তু বেড়িবাঁধ দিয়ে যেতে যেতে পুরাতন জেলখানার সামনে গিয়ে তার সাইকেলের চেইন পড়ে যায় এবং সে যখন রুকুর ভঙ্গিতে সাইকেলের চেইন ঠিক করায় ব্যস্ত, তখনই ধুলার মধ্যে পড়ে থাকা একটুকরা ছেঁড়া কাগজ তার চোখে পড়ে। কাগজের টুকরাটা হয়তো কোনো বইয়ের ছেঁড়া পাতার একটা অংশ, যাতে কিছু একটা লেখা ছিল, যা পড়ে আজিজ একটা ইশারা টের পায় এবং কাগজের সেই টুকরা থেকে ধুলা ঝেড়ে সেটাকে সে রেখে দেয় শার্টের পকেটে।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, 'কার চিঠি পড়িস?'

আজিজ জবাব দেয় না। তাকে খানিকটা আনমনা দেখায়।

রাস্তায় একটুকরা ছেঁড়া কাগজ পাওয়ার এই তুচ্ছ ঘটনা আমি শিগগিরই ভুলে যাই। তবে আজিজকে কিছুদিন খুব অন্যমনস্ক দেখায়। মনে হয় তার মাথার ভেতর অদ্ভুত কিছু একটা ঢুকে পড়েছে এবং সেই জিনিস তার মগজের সম্পূর্ণ দখল নিয়ে নিয়েছে।

একদিন পুরাতন জেলখানার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ছেঁড়া কাগজটার কথা আমার মনে পড়ে। আমি তাকে আবারও জিজ্ঞেস করি, 'এখানে যে কাগজের টুকরা পেলি, তাতে কী লেখা ছিল?'

—বলা যাবে না।

—কেন?

আজিজ এ রকম একটা ব্যাখ্যা দেয়, 'বেড়িবাঁধ দিয়ে যাওয়া, সাইকেলের চেইন পড়া এবং ওখানেই তার সামনে কাগজের টুকরাটা পড়ে থাকা—এসবের মধ্যে গূঢ় এক ইশারা আছে এবং ওই কাগজে যা লেখা ছিল, সেটা আমার জন্যই একটা বার্তা, কারণ ওটা যাতে আমি দেখতে পাই, সেভাবেই সবকিছু ঘটেছে।'

আজিজের কথা শুনে আমি বিস্মিত হই এবং এক রকম মর্মপীড়া বোধ করি। একটা আকস্মিক ঘটনার মধ্যে সে নিয়তির ইশারা আবিষ্কার করছে এবং পুরো ব্যাপারটাকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করছে, যেন ওকে কেন্দ্র করেই সবকিছু ঘটে চলেছে।

দুই

প্রায় এক যুগ পর স্কুলের সুবর্ণজয়ন্তীতে আজিজের সঙ্গে দেখা হলো। তাকে এত প্রাণবন্ত আর উচ্ছল দেখাচ্ছিল যে আমি আগে দেখা আজিজের সঙ্গে তাকে মেলাতে পারছিলাম না। সবাই তার উপস্থিতি খেয়াল করছিল। আমিও তার দৃষ্টির দৃঢ়তা দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, অদ্ভুত এবং গোপন ইশারালব্ধ কোনো মিশন তাকে দারুণ আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে।

কেউ কেউ বলল, ভালো কিছু কাজ করছে আজিজ। কামারখন্দ এলাকায় গরিব নারী আর শিশুশ্রমিকদের নিয়ে নানা রকম প্রজেক্ট আছে তার।

তিন

একবার শহরে এসে শুনলাম, আজিজ উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিল, কিন্তু কী এক অজ্ঞাত কারণে সে এই পদে ইস্তফা দিয়েছে এবং সংসার ফেলে দেশান্তরি হয়ে গেছে। তাকে কোথাওই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

চার

আজিজ সম্পর্কে বহুদিন আর কিছু জানতে পারিনি।

একবার বন্ধুদের আড্ডায় কী করে আজিজের প্রসঙ্গ এলে একজন বলল, সে তো ফকির-দরবেশদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। কী নাকি খুঁজছে।

আমি বুঝে গেলাম, আজিজ যার ইশারামতো কাজ করে যাচ্ছিল, একদিন তারই খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে সে। সেই নিগূঢ় অদৃষ্টের গভীর রহস্য হয়তো সে উপলব্ধি করতে চায়।

পাঁচ

এক সন্ধ্যায় আজিজের দেখা পেলাম।

ছুটিতে বাড়ি এসেছি। সন্ধ্যাবেলা কালীবাড়ি রোড ধরে বেড়িবাঁধের দিকে যাওয়ার সময় দেখলাম, বাঁধের দিকে হেঁটে যাচ্ছে আজিজ। পরনে সাধুদের পোশাক, চোখে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি আর পেছন পেছন হাঁটছে ভক্তদের একটি দল।

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামল।

আমি পুরাতন জেলখানার সামনে দাঁড়িয়ে অন্ধকার নদীর দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। তখন এটাই শুধু ভাবছিলাম, একটা আকস্মিক ঘটনা কীভাবে এত কিছু করতে পারল! যা দেখা যায় না, সেই অদেখার অন্ধকারে কী ঘটে আসলে? এসব ভাবতে ভাবতে আমি নদীর আওয়াজ শুনছিলাম, যেন একটা গুঞ্জন আসছে অন্ধকার তলদেশ থেকে, নদীটাই যেন বলছে কিছু। আমি অস্পষ্ট কথাগুলো কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলাম, কী বলছে সে?

লেখক: রায়হান রাইন
 
These are the rules that are to be followed throughout the entire site. Please ensure you follow them when you post. Those who violate the rules may be punished including possibly having their account suspended.

যারা কমেন্ট করবেন, দয়া করে বানান ঠিক রাখুন। উত্তেজিত অবস্থায় দ্রুত কমেন্ট করতে গিয়ে বানান ভুল করবেন না। আমরা যারা কমেন্ট পড়তে আসি, আমাদের কমেন্ট পড়তে অনেক অসুবিধা হয়।

Users who are viewing this thread

Back
Top