What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Self-Made ছাতিম ফুল 💮🏵💮🏵💮🏵💮🏵💮🏵 (1 Viewer)

Fahima

Senior Member
Joined
Apr 8, 2019
Threads
137
Messages
539
Credits
32,076
অনার্স সেকেন্ড ইয়ার। জুলাই মাসের তের তারিখ। হ্যাঁ আমার খুব ষ্পষ্ট মনে আছে। সেদিন ছিল জুলাই মাসের তের তারিখ। শুক্রবার। খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো। বৃষ্টি থামার কোন নাম গন্ধ নেই। আমি অপেক্ষা করছি তো করছি। শেষে সেই বৃষ্টির মধ্যে আমি বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সেকেন্ড ইয়ারে পড়াকালীন জুলাই মাসের তের তারিখ শুক্রবার মুষলধারে হওয়া বৃষ্টির মধ্যে আমি সাজিদের সাথে পালিয়ে গেলাম। আমি অনার্স পড়ি যুক্তিবিদ্যায়। এই বিষয়ে পড়তে আমি একটুও চাইনি। আব্বাই বললেন এই বিষয়ে পড়তে। আমার প্রিয় বাংলা। ভর্তির সময় আব্বা আমার মাথায় হাত রেখে বলল, বাংলা নিয়ে পড়ার দরকার নেই তুমি যুক্তিবিদ্যা নিয়ে পড়।



আব্বার কথা শুনে আমি আর না করতে পারলাম না। শেষে আমি যুক্তিবিদ্যা নিয়ে পড়া শুরু করলাম। সত্যি সত্যি এই বিষয়টা আমার খুব ভালো লেগে গেল। আমার ইচ্ছে এই বিষয় নিয়ে আমি অনেকদুর পড়ব। অথচ সেই আমি সেকেন্ড ইয়ারেই পড়ালেখার চিন্তা বাদ দিয়ে পালিয়ে সাজিদকে বিয়ে করে ফেললাম।



আমার বড় ফুপুর ছেলে আফজাল ভাই ব্যবসাপাতি করে খুব নাম করেছেন। বেকারির ব্যবসা। কিসব বিস্কুট টিস্কুট নাকি বানায়। বিশাল বড় বেকারি। সবাই শুধু আফজাল ভাইয়ের সুনাম আর সুনাম। আমি জানি এই আফজাল ভাই আমাকে বেশ পছন্দ করেন। আমি, একটুও না। কেন জানিনা। তিনি দেখতে শুনতে বেশ ভালো। তারপরও আমি এড়িয়ে চলি। ওসব আফজাল ভাই টাফজাল ভাই দিয়ে আমার কাজ নেই। আমার তখন প্রিয় মানুষ সাজিদ। এই সাজিদ বলতেই আমি অজ্ঞান। সাজিদও আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। আমাদের কত কত স্বপ্ন। রোজ এটা ওটা স্বপ্ন দেখি। দুজন মিলে কত পরিকল্পনা করি রোজ রোজ। পৃথিবীর সবকিছু কেমন আপন আপন লাগে। শুধু ঐ আফজাল ভাই ছাড়া। লোকটাকে আমাদের বাসায় দেখলেই আমার কেমনজানি বমি বমি লাগে। ইচ্ছে করেই সব সময় রাগ দেখিয়ে কথা বলি তার সাথে। তিনি শুধু হাসেন। লোকটার হাসি দেখে আমার খুব ঘেন্না লাগে। প্রায় নানা অজুহাতে তিনি আমাদের বাসায় এসে বসে থাকেন। আফজাল ভাই ভীষণ বেহায়া। এমন বেহায়া মানুষ আমি একটুও দেখতে পারিনা। পুরুষ মানুষ এত বেহায়া হয় কি করে!!!!



একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনি আমার আর আফজাল ভাইয়ের মধ্যে বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে। দুই পরিবারের সবাই বেশ খুশি। আব্বাতো উঠতে বসতে আফজাল ভাইয়ের নানা গুণের কথা বলে বেড়াচ্ছেন। এসব শুনতে আমার খুব খারাপ লাগছে। সবাই দেখি আফজাল ভাইয়ের পক্ষে। এভাবে সবাইকে তার প্রতি দূর্বল দেখে আমার আর কিছু বলার সাহসে কুলোয় না। আফজাল ভাইকে আমার একটুও পছন্দ না। এই নিয়ে আম্মার কাছে একটু করে বলতে গিয়েছি মাত্র অমনি আম্মা ক্ষেপে গিয়ে বললেন, হারামজাদীর শরীরে তেল জমছে। এত সুন্দর আর ভদ্র ছেলেটারে নিয়ে এমন কথা কেউ বলে। আরে তোর চেয়ে হাজার গুন ভালো মেয়ে আফজাল বিয়ে করতে পারে। তোর হইলো রানীর কপাল। এই কপাল ভালো করে যত্ন আত্তি কর। এমন হেলাফেলা করা বাদ দে। এই কথা তোর বাপে শুনলে বাসায় কেয়ামত লেগে যাবে।



আম্মার হাক ডাক শুনে আমি চুপসে গেলাম। বিষয়টা সাজিদকে নিয়ে সমাধা করতে হবে। পরের দিন আমি আর সাজিদ ঠিক করলাম আমরা পালিয়ে বিয়ে করব। ঠিক পরের শুক্রবার আমি বাসা থেকে পালিয়ে গেলাম। ঐদিন সন্ধ্যায় আমাদের বিয়ে হলো। আমি ভীষণ খুশি। সাজিদও। প্রথম দুইদিন গিয়ে উঠলাম সাজিদের ছোট খালার বাসায়। আমি বিনুকে দিয়ে আমাদের বাসায় খবর পাঠালাম। বিনু আমার সাথেই পড়ে। খবর শুনে আব্বা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাড়ি সবাই আমার উপর প্রচন্ড ক্ষেপে উঠলো। বিনুর মাধ্যমেই জানিয়ে দিলো, আমি যেন কিছুতেই তাদের সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ না করি।



প্রথমদিকে একটু খারাপ লাগলেও সাজিদকে পেয়ে নিজেকে ভীষণ সুখী মনে হলো। ভাবলাম কিছুদিন গেলেই পরিবারের সাথে আমার সর্ম্পক ঠিক হয়ে যাবে। এদিকে দুইদিন পর খবর পেয়ে সাজিদের মা এসে আমাদের বরণ করে বাসায় নিয়ে গেলেন। সাজিদ তাদের একমাত্র ছেলে। ছেলের পছন্দকে তারা আর বাধা দিলেন না।



সময় পেরুতে থাকে। সাজিদের সাথে আমার বিয়ের প্রায় দেড় বছর হতে চললো। আমি বহুবার আমার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছি কিন্তু তারা আমাকে কোন প্রকার ছাড় দিতে রাজি নন। বুঝলাম তারা বেশ কষ্ট পেয়েছেন। এরই মধ্যে আমি মা হলাম। আমার ছেলে তমালের বয়স ছয় মাস। আস্তে আস্তে আমার বাবা মা আর পরিবারের সাথে বিচ্ছিন্নতার স্বাদ পাওয়া আমি শুরু করলাম।



বিয়ের ছয়মাস যেতেই সাজিদ এবং তার পরিবারের মানুষগুলো আমাকে কেনজানি অসহায় আর দূর্বল হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলল। সাজিদও কেমন পাল্টে গিয়েছে। পরিচিত অনেকের কাছে সাজিদকে নিয়ে নানা রকমের কথাবার্তা শুনতে লাগলাম। সাজিদ বাসায় সময় দেওয়া কমিয়ে দিয়েছে । আমি জানতে চাইলে এড়িয়ে চলে। দিন দিন আমার সাথে তার দুরত্বটা বাড়তে থাকে। আমি জোর করে কিছু জানতে চাইলে আমার উপর বেশ রাগারাগি করে। এই রাগ আস্তে আস্তে গায়ে হাত তোলা পর্যন্ত পৌঁছে গেল। দিনের পর দিন আমি লড়াই করি। শেষে আমি চুপসে থাকি। ভয় আর শংকায়। মাঝে মাঝে নিজের ভেতরটা জেগে উঠলে সাজিদকে প্রশ্ন করি। সাজিদ আবার খুব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। এই সাজিদকে আমি কিছুতেই চিনতে পারিনা। আমারতো কেউ নেই। পরিবারের মানুষগুলো ঘৃণা, ক্ষোভে আমার কাছ থেকে মুখ সরিয়ে নিয়েছে। এই পরিবারের লোকগুলো ছাড়া আমার যে আর কেউ নেই। এই ভয় আর শংকা নিয়ে আমার ক্ষিপ্ত মন শান্ত হয়ে যায়। ক্ষিপ্ত আর কঠোর হওয়ার মত সাহস আর শক্তি আমার কোনটাই নেই।



এভাবেই চলছে। সময় আরো পেরিয়ে গেল দুই বছর। এই দুই বছরে আমি অনেক পাল্টে গেলাম। কতটা সহনশীল আমি হয়েছি তা আমি নিজেও জানিনা। সাজিদ পাল্টেছে ভয়ানকভাবে। আমিতো সাজিদকে চিনতেও পারিনা। স্বামী হিসেবে তার সাথে আমার সর্ম্পকটা এখন ভীষণ দূর্বল। আমি প্রতিনিয়ত প্রাণপণ চেষ্টা করছি সেই পুরনো সাজিদকে ফেরাতে। সাজিদ ফেরার নয়। আমার ব্যাপারে তার বেশ অনীহা। শুনেছি আমেরিকান প্রবাসী একটি মেয়ের সাথে তার সর্ম্পক হয়েছে। মেয়েটা প্রায় দেশে আসে। নানা অজুহাতে ঐ মেয়ের সাথেই তার বেশি সময় কাটে। সাজিদ স্বপ্ন দেখছে আমেরিকা যাওয়ার। এই নিয়ে তার পরিবারেরও দেখি মত আছে। এখন তাকে দেওয়ার মত আমার কিছুই নেই। আমি শুধু আমার ছেলে তমালের দিকে তাকিয়ে সবকিছু মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছি।



হ্যাঁ, এভাবে চলতে পারে না। কিছুতেই চলতে পারে না। আমার প্রাণ প্রিয় ছেলে তমালের দিকে তাকিয়ে প্রতিটা দিন আমি পার করি। ভাবি কালকের প্রহরটা আমার জন্য নিশ্চয় আনন্দের হবে। এই ভাবনা, এই স্বপ্ন রোজ দিনই ভুল হয়। আমার জন্য প্রতিটা দিনই বিভীষিকাময়। এই বিভীষিকাময় জীবন আমি আর টানতে পারছি না। আমার মনে হয়েছে, যে সন্তানের দিকে তাকিয়ে আমি সাজিদের সবকিছু মেনে নিচ্ছি সেই সন্তানের জন্যই আমার কিছু একটা করা বেশ জরুরী। এই সন্তান ভালো মন্দ উপলব্ধি করার ক্ষমতা অর্জনের আগেই আমাকে কিছু একটা করতে হবে।



আমি দিন দিন প্রতিবাদী হতে থাকলাম। সাজিদ আরও নিষ্ঠুর। সত্যি বলতে আমি আর পেরে উঠছি না। সাজিদের বাবা মা দেখি সবসময় ছেলের দিকটাই দেখছেন। সবকিছু ছেড়ে আসা এই আমি যেন ভেসে যেতে লাগলাম গভীর সমুদ্রে। একটা, একটা খড়কুটো নেই যেটা ধরে আমি আটকে থাকতে পারব এই স্রোতের মাঝে। সাজিদের মূল লক্ষ্য এখন একটাই। আমাকে ছুঁড়ে ফেলা। আমি প্রতিনিয়ত অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি একটা মানুষের এত দ্রুত আর্বজনা আর নগন্য কীটে পরিণত হওয়া দেখে।



এভাবে টানাপোড়নের মধ্যে তমালের বয়স প্রায় সাড়ে তিন বছর । দিন দিন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। আমার যাওয়ার কোন জায়গা নেই। আমার উপর প্রতিনিয়ত অত্যাচারের গল্পগুলো জানে শুধু বিনু। বার বার করে তাকে অনুরোধ করি এসব যেন আমার বাবা বাড়ির কেউ না জানে।



বিনু ভীষণ রাগী। মাঝে মাঝে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। বলে ধুর, লাথি মার এই সংসার। এভাবে কেউ জীবন পার করে?



বিনুর কথা শুনে আমি অসহায়ভাবে হাসি। আমার নিজেরও ভীষণ অবাক লাগে। এই আমি কতটা নির্মম জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। মাঝে মাঝে ভাবি, হয়তো এই জায়গাটায় আমার জন্য নির্ধারিত ছিল। মানুষ কখনও নিজের শুদ্ধতার জায়গাটা দেখতে পারে না। দেখতে পারলে কেউ কখনো ভুল করতে পারত না।



শেষ পর্যন্ত বিনু আমার অনুরোধ রাখেনি। আমার প্রতি নির্মমতা আর অবহেলা দেখে আমার পরিবারকে সত্যি সত্যি একদিন সবকিছু জানিয়ে দিলো।



বিনুর কাছে ঘটনা শুনে একদিন সকালে দেখি আব্বা এসে হাজির। আমাকে দেখেই আব্বা ঠিক বাচ্চাদের মত করে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। যেখানে আমি চিৎকার করে কাঁদবো সেখানে বাবা কাঁদছেন। আমি ঝাপিয়ে পড়লাম আব্বার বুকে। মনে হচ্ছে শত বছর পর আমার লুকোনোর একটা জায়গা আমি পেয়ে গেছি। এত নিরাপদ, এত শান্ত, এত স্বস্তির একটা জায়গা আমি দিনের পর দিন খুঁজে ফিরছি। আব্বা এসে আমাকে সেই জায়গা দিয়ে দিল।



আব্বা আমার কাছে কিছুই জানতে চাইল না। সেদিনই তমাল আর আমাকে এক প্রকার জোর করে নিয়ে গেল। সাজিদ এবং তার পরিবার আমাকে যেতে দিলেও তমালকে রেখে দিতে চাইল। কিন্তু আমার আর তমালের কান্না দেখে সেটা আর রাখতে পারেনি।



বাসায় আসার প্রায় তিনদিন পর আফজাল ভাইয়ের সাথে আমার দেখা। আমাকে দেখে তিনি বেশ অবাক হয়েছেন মনে হল। তিনি বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। আমার ক্লান্ত চেহারা, রোগা শরীর আর কন্ঠ শুনে তিনি বেশ রেগে গিয়েছেন। মনে হচ্ছে সাজিদকে কাছে পেলে তিনি কিছু একটা করে ছাড়বেন। বুঝলাম আমাকে দেখে তিনি বেশ কষ্ট পেয়েছেন। সেদিন আমার সাথে কোন কথায় বললেন না। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন। তারপর কাউকে কিছু না বলে চলে গেলেন।



আফজাল ভাইকে দেখে আমার ভীষণ লজ্জা হয়। ভীষণ। একটা মানুষকে এতটা অবহেলা আর অপমান করে চলে যাওয়া এই আমার জন্য তার সহানুভূতি দেখে। আমার সত্যিই ভীষণ লজ্জা লাগে। আসলেই লোকটা ভীষণ ভালো। মনে মনে চিন্তা করি সত্যি আফজাল ভাইয়ের স্ত্রীটা বেশ ভাগ্যবতী। শুনেছি মাস ছয়েক আগে আফজাল ভাই বিয়ে করেছেন। বউ দেখতে বেশ সুন্দরী।



আমি আব্বার বাড়িতে প্রায় পনের দিন। ভেবেছিলাম সাজিদের সাথে সহজেই মিটমাট হয়ে যাবে। সাজিদ তার ভুল বুঝতে পারবে। কিন্তু সাজিদ এবং তার পরিবার বিষয়টা সহজ করল না। তারা আমাকে ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে আগ্রহী না। এখন তারা শুধু তমালকে ফিরিয়ে নিতে চায়। এটা অসম্ভব। আমার কাছ থেকে তমালকে ছিনিয়ে নেয়া কোন ভাবেই সম্ভব না। তমালের জন্য তারা কোর্টে গেল। কিসব মিথ্যা, কুরূচিপূর্ণ নানা অজুহাত দেখিয়ে দিন দিন মামলা আমার বিপক্ষে নিয়ে যেতে লাগলো। আমি অসহায় হয়ে পড়লাম। ছেলে তমালকে হারানোর ভয়ে আমি একটি রাতও ঘুমাতে পারি না। এদিকে মামলাও যেন আমার বিপক্ষে যেতে চাইছে।



আস্তে আস্তে কিভাবে যেন সবকিছুতে আফজাল ভাই জড়িয়ে গেলেন। তিনি বেশ চেষ্টা করছেন। যদিও আমি চাই না আফজাল ভাই আমার এই মামলা মোকদ্দমার বিষয়ে জড়িয়ে পড়ুক। এই নিয়ে নানা জনে নানা কথা বলতে পারে। তারপরও তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন।



মামলার রায় হয়েছে। তমালকে তার বাবার কাছে রাখার রায় দিয়েছে কোর্ট। আমি জানিনা রায়টা শোনার পর আমার কি হয়েছিল। এটা জানি, শুধু একটা চিৎকার দিয়েছিলাম। তারপর আর কিছুই আমি জানিনা। দুইদিন হাসপাতালে থাকার পর বাসায় ফিরলাম। আমি শুধু কাঁদছি আর কাঁদছি। তমালকে ছাড়া আমার এক মুর্হূত যাবার নয়।



ঐদিন সারাটা রাত আমি জেগে থাকলাম। মাঝে মাঝে চিৎকার করে কাঁদছি। আমার বুকের ভেতরটা কেমন করছে আমি জানিনা। ঠিক ভোরের দিকে দেখি তমাল আমাদের বাসায় এসে মা মা বলে চিৎকার করছে। আমি জানিনা তমাল কোথা থেকে এলো। আমি বুকের ভেতর তমালকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছি। চিৎকার করে কাঁদছি। তমালও কাঁদছে। আমাদের মা ছেলের কান্না দেখে কাঁদছে সবাই । আফজাল ভাই তমালকে নিয়ে এসেছেন। তিনি আমাদের মা ছেলের কান্না দেখে লুকিয়ে চোখের পানি মুছলেন।



আমাদের মা ছেলের কান্নাকাটি একটু থামলেই জানতে পারলাম আফজাল ভাই সারাটা রাত সাজিদদের বাড়িতে বসেছিলেন। তমালকে আমার কাছে রাখার বিষয়টা নিয়ে সেই সন্ধ্যা রাত থেকে তাদের সাথে দেন দরবারে বসেছেন। আফজাল ভাইয়ের ইচ্ছা যে করেই হোক তমালকে নিয়ে তিনি বাসায় ফিরবেন।



আফজাল ভাই মেনে নিয়েছেন আদালতের দেয়া শর্তাবলী ছাড়াই কোন প্রকার দেয়া নেয়া ছাড়া আমার দিক থেকে সাজিদের সাথে ডিভোর্স হবে। আমার পক্ষ থেকে কোন দাবী দাওয়া নেই। তাছাড়া উল্টো বিশাল অংকের একটা টাকা তাদের দেওয়া হবে। যদি তমালকে আমাদের কাছে রাখার জন্য তারা রাজি হয়। এসব আফজাল ভাই আমাদের কিছু না জানিয়েই করলেন। আমি জানিনা জানালে কি হতো। হয়তো কিছুই করার ছিলনা আমার। আমি শুধু তমালকে চাইতাম। এসব নিয়ে আমার আর কিছুই ভাবার নেই। তমালকে পেয়ে আমি ভীষণ খুশি। সাজিদের কাছ থেকে আমি আর কিছুই চাই না। আমি আমার তমালকে পেয়ে গেছি।



আফজাল ভাইয়ের এত সব করা দেখে আমি খুব অবাক হলাম। এতবছর পর এসে তিনি কেন এমন করে আমাদের মা ছেলের জন্য এত সব করছেন। তাকে দেবার মত তেমন কিছুইতো আমাদের আর নেই। আস্তে আস্তে নিজের ভেতর সবকিছু উলট পালট হওয়া শুরু করল। নতুন একটা ভয় নিজের ভেতর দানা বাঁধতে শুরু করল। জানিনা কিসের ভয়। একটা মানুষকে ঠকানোর দায় আমি কখনো নিতে পারব না। তারপর থেকে নানা প্রশ্ন, নানা শংকা নিয়ে আমার দিন কাটতে লাগল।



প্রায় বিশ দিন পর আফজাল ভাই আমাদের বাসায় আসলেন। তাকে বেশ অস্তির দেখাচ্ছে। ভীতও। এমন করে আমি কখনও আফজাল ভাইকে দেখিনি। তিনি আমার সাথে কথা বলতে চাইছেন। আমার খুব ভয় হচ্ছে। কেন জানিনা।



আমি আর আফজাল ভাই বসে আছি আমাদের দুতলা বাড়ির ছাদে। আমাদের বাড়ি ছাদ লাগোয়া বিশাল একটা ছাতিম গাছ। গাছটার বেশির ভাগ ডালপালা বাড়ির ছাদটাকে ছায়া দিচ্ছে। প্রতিবছরই এই গাছে খুব ফুল হয়। এবার বোধহয় বেশি ফুল ধরেছে। গত তিনটা বছর আমি এই ছাতিম গাছের ফুল দেখিনি। এই ফুলের ঘ্রান আমার ভীষণ প্রিয়। যখন ফুল হতো আমি রোজ সন্ধ্যার পর এই ছাদে এসে বসে থাকতাম। আম্মা বলতেন, তোরে একদিন ভুতে ধরলে তবেই এই সন্ধ্যা রাতে ছাদে যাওয়া বন্ধ করবি।



আমার একটুও ভয় লাগেনা। ছাতির ফুলের মিষ্টি গন্ধের কাছে ভুত পেত খুব নস্যি। আম্মার কথা শুনে আমি শুধু হাসতাম।



ছাদের রেলিং লাগোয়া একটা টুলের মধ্যে আমি আর আফজাল ভাই বসে আছি। সন্ধ্যা রাতে ভুতের কথা শুনেও আমার ভয় লাগত না। অথচ আজ আমি ভয়ে কুঁকড়ে আছি। আফজাল ভাই একজন বিবাহিত মানুষ। আমি চাই না এই মানুষটাকে আমি নতুন করে কোন সমস্যায় জড়িয়ে ফেলি। সাড়ে তিন বছর আগে তাকে অপমানিত করার দায় এখনও আমার ভেতর বেশ পোড়াচ্ছে।



আফজাল ভাই চুপ করে আছেন। বেশ কিছুক্ষণ হলো তিনি চুপ করে আছেন। আমিও চুপ। আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। আমি ভেতরে ভেতরে মারাত্নক ভয় পাচ্ছি।



হঠাৎ করে আফজাল ভাই কোন প্রকার ভণিতা না করে আমাকে বলল, শিউলি আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।



হ্যাঁ, আমি যে ভয়টা পাচ্ছিলাম ঠিক সেটাই আফজাল ভাই বললেন। আমার মুখ দিয়ে সাথে সাথে শুধু না না না শব্দটা বেরুতেই লাগল।



আফজাল ভাই আমার কাছ থেকে এভাবে না শব্দটা শুনে চুপ করে আছেন। আমি আবার বললাম, এটা কখনও হতে পারে না। আপনার স্ত্রী আছে, সংসার আছে।



আমার কথা শুনে এবার আফজাল ভাই হো হো করে হেসে উঠলেন।

তার হাসি দেখে আমি আরও ভয় পেয়ে গেলাম। আমি বললাম, আপনি হাসছেন কেন?



আফজাল ভাই হাসি থামিয়ে বললেন, তুমি যদি আমার দ্বিতীয় বউ হতে না চাও তবে প্রথম বউ হতে পারো।



সত্যি এখন আমার ভীষণ অসহায় লাগছে। এখন আমাকে নিয়ে কেউ মজা করুক তা আমি চাই না। আমি খুব রাগ দেখিয়ে বললাম, ফাজলামি করবেন না আফজাল ভাই।



আফজাল ভাই এবার একটু সিরিয়াস হয়ে বলা শুরু করল, আমার বিয়ের বিষয়টা তুমি ভুল শুনেছ। আমি এখনও বিয়ে করিনি। আমি ইচ্ছে করেই তোমাকে আমার বিয়ের বিষয়টা মিথ্যে বলতে বলেছি তোমার বাড়ির লোকজনকে। শশুর বাড়ি থেকে বিশাল একটা কষ্ট নিয়ে তুমি এই বাসায় ফিরেছ। আমি চাইনি পুরাতন কোন বিষয় নিয়ে তোমার মধ্যে অপরাধবোধের কষ্ট জেগে উঠুক। আমি জানি, আমি এখনো বিয়ে করিনি শুনলে তোমার মধ্যে সব সময় একটা অপরাধবোধ কাজ করবে। তোমার এমন কষ্ট দেখতে আমার ভালো লাগবে না।



কথাটা বলেই আফজাল ভাই চুপ করে গেলেন। আমি জানিনা আমার কি হয়েছে। চারিদিকের সবকিছু যেন আমাকে চেপে ধরতে চাইল। আমি প্রাণপন চেষ্টা করে যাচ্ছি নিজেকে শান্ত রাখতে। নিজের ভেতর কেমন একটা কান্না আমার বুক ফেটে বেরিয়ে যেতে চাইছে। আমি মাথা নিচু করে বসে আছি।



আফজাল ভাই আবার বলা শুরু করলো, সত্যি সত্যি আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। যেদিন তুমি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলে সেদিন আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছি। এই কষ্ট তুমি আমাকে বিয়ে করোনি বলে না, এই কষ্ট ছিল আমি সত্যিকারভাবে তোমাকে আমার ভালোবাসার কথা জানাতে পারিনি বলে। একটা মানুষ তিল তিল করে ভালোবাসা পুষে। আমি তোমার জন্য সেই পোষা ভালোবাসার কথা তোমাকে বোঝাতে পারিনি। তুমি চলে যাওয়ার পর এই ভালোবাসা আর কাউকে দেবার মত সাহস আমার ছিলনা।



আফজাল ভাই খুব একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, তোমার এমন অবস্থা শুনেও মামা বসেছিলেন। তাদের ভেতর তোমাকে নিয়ে এত রাগ ক্ষোভ দেখে আমার ভীষণ খারাপ লাগে। মামা প্রথমে তোমার শশুরবাড়ি যেতে রাজি হয়নি। আমিই জোর করে পাঠিয়েছি। সবকিছু শুনে আমার ইচ্ছে করছিলো দৌড়ে গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসি।



শেষের কথাগুলো শুনে আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। একটা মানুষ এত নিস্বার্থভাবে ভালোবাসতে পারে। আমি হাউমাউ করে কাঁদছি। এমন চিৎকার করে আমি অনেকদিন কাঁদতে পারিনি। সব সময় ভয়, লজ্জা আর সংকোচে নিজের ভেতর লুকিয়ে থেকেছি। আজ মনে হচ্ছে আমার সেই সংকোচের জায়গা বিস্তৃত হয়ে গেছে। আমি চাইলেই চিৎকার করে কাঁদতে পারি। আমি কাঁদছি। নিজের কোলে মাথা গুজে কাঁদছি।



আফজাল ভাই আমার মাথায় হাত রাখলেন। আমি মাথা তুলে আফজাল ভাইয়ের দিকে তাকালাম। আফজাল ভাইয়ের চোখের কোণায় পানি জমে আছে। ভীষণ মায়া নিয়ে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।



এতক্ষণ ছাতিম ফুলের ঘ্রাণটা আমি একটুও পাইনি। এখন ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ আমি খুব পাচ্ছি। হঠাৎ করে এই মিষ্টি ঘ্রাণটা পেয়ে আমার ভীষণ ভালো লাগছে। আমি ইচ্ছে করেই আফজাল ভাইয়ের একটা হাত মুঠো করে ধরলাম। আফজাল ভাই সেই মায়া ভরা চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি তাকিয়ে আছি ছাতিম গাছের ফুলগুলোর দিকে। এখন আফজাল ভাইয়ের দিকে তাকানোর মত শক্তি আমার নেই।



যে মানুষটা দিনের পর দিন আমার জন্য ভালোবাসা পুষেছেন সেই মানুষের চোখের দিকে তাকানোর আগে আমাকে এমন ভালোবাসার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। এই ভালো মানুষটাকে অনন্তকাল ভালোবেসে সেই যোগ্যতা অর্জন করতে চাই আমি। সেদিন এই ছাতিম ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণের মত আমার ভালোবাসা চারিদিক ছড়িয়ে পড়বে।


(সমাপ্ত)
 

Users who are viewing this thread

Back
Top