[HIDE]
“এসো হে গোপনে”
ছাদটা আমার ছাদের সমানই। কিন্তু আমার ছাদ থেকে সূর্যাস্ত দেখা যায়, এখানে, সূর্য ডুবছে আরেকটা বিশাল বিল্ডিং এর আড়ালে। ছাদজুড়ে চেনা অচেনা বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। একটা আমগাছে বেশ গুটি ধরেছে।
মৃন্ময়ী বলল, বাড়ির ছাদের এতক্ষণ আম্মু উঠে গেছে। আমার ছোটবোন হয়তো বই নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে!”
আমি মৃন্ময়ীর দিকে তাকালাম। হালকা বাতাসে উড়ছে ওর চুল। বললাম, “তুমিও ছাদে পড়তে?”
বলল, “ভোরে পড়তাম। তারপর রোদ উঠলে ঘরে চলে যেতাম!”
তারপর আবার বলল, “আমাদের বাড়ির পিছন থেকে যতদূর চোখ যায় মাঠ। এখন তো ধানের সিজন। যতদূর চোখ যায় সবুজ। আর সূর্য যখন উঠত, লাল গোল বলের মতো…”
বাক্যটা শেষ করল না মৃন্ময়ী! বললাম, “সদ্যোদিত সূর্যের লাল কিরণ তোমার মুখে যখন পড়ত, কেমন দেখাতো তোমাকে?”
মৃন্ময়ী বলল, “কীভাবে জানব? আমি কি দেখেছি নাকি!”
বললাম, “আমার দেখার ইচ্ছে করছে!”
মৃন্ময়ী বলল না কিছু। একটা গোলাপ গাছের দিকে তাকিয়ে রইল। গোব্দা ছেলেটা মৃন্ময়ীকে বলল, “ফুপি, তুমি যেখানে থাকো, ওখানে ছাদে বাগান আছে?”
মৃন্ময়ী ওকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, “নাই, বাবা। ওখানে ছাদে কাপড় শুকায়!”
“উনিশে বিধবা মেয়ে কায়ক্লেশে উনতিরিশে এসে
গর্ভবতী হলো, তার মোমের মতো দেহ
…যন্ত্রণার বন্যা এলো, অন্ধ হলো চক্ষু, দশ দিক,
এবং আড়ালে বলি, আমিই সে সুচতুর গোপন প্রেমিক।”
হঠাত করে সুনীল গাঙ্গুলির এই কবিতাটা মনে পড়ল। ছ্যাঃ ছ্যাঃ এখন মৃন্ময়ীর সাথে আছি, ছাদে, সূর্যাস্ত দেখা না গেলেও এসেছে তার আভা, বাতাস দিচ্ছে বেশ, এখন এমন কবিতা মনে পড়তে হবে? রবীন্দ্রনাথের ছাদ নিয়ে কবিতা নেই কোন? এতো বিষয় নিয়ে লিখলেন, আকাশ পাতাল মাটি, বাদ রাখলেন না কিছু আর ছাদ নিয়ে নেই? নাকি আমিই পড়িনি?
মৃন্ময়ী আমার কাছাকাছি এলো? কাছাকাছি এলো নাকি এগিয়ে এলো? এমন দূরত্বে তো আসেই সবসময়। এখন এখানে, এই ছাদে নিরালা, যদিও গোব্দাটা আছে, এই স্বাভাবিক দূরত্বকেই কাছাকাছি মনে হলো কেন?
বলল, “চুপ করে আছো যে? ভাবছো কিছু?”
বললাম না, “সুনীলের একটা কবিতা মনে পড়েছিল। তাড়িয়ে দিলাম কবিতাটা!”
মৃন্ময়ী বলল, “কবিতা তাড়ানো যায়?”
“যায় না?”
মৃন্ময়ী মাথা নেড়ে বলল, “উঁহু। আমার মাথায় একটা কবিতা ঘুরছে সকাল থেকে। তাড়াতে পারছি না!”
“কী কবিতা?”, জিজ্ঞেস করলাম আমি।
“আবুল হাসানের নিঃসঙ্গতা কবিতাটা পড়েছো?”
“অতটুকু চায়নি বালিকা, এই কবিতাটা?”
মৃন্ময়ী বলল, “হ্যাঁ। “এক জলের খনি/ তাকে দিক তৃষ্ণা এখনি, চেয়েছিলো/ একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী!”
বললাম, “এই কবিতাটা কেন ঘুরছে? তোমারও ইচ্ছে করছে, কেউ তোমাকে রমণী বলুক?”
মৃন্ময়ী বলল, “আরে না না। এমনি। অকারণে মনে পড়ছে সকাল থেকে। আমি অনেকদিন আবুল হাসান পড়িই নাই!”
হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারি মৃন্ময়ীকে, এতোটা কাছে ও। অথচ ছুঁতে পারব না! পাখিদের ভাষা নেই, নিঃসঙ্গ কোন ঘুঘু যখন ডাকে দুপুরবেলা, পুরুষ ঘুঘু বুঝে যায়, খুঁজছে তাকেই। তাদের যোগাযোগের জন্য শব্দের দরকার হয় না। আর বাংলা ভাষার এতো শব্দ থাকতেও, নিজেকে মৃণ্ময়ীর সামনে প্রকাশ করতে পারছি না! এত শব্দ, এত ব্যাকরণ, এত শব্দ, বাক্য, ভাষার ত্বত্ত থেকে লাভ কী?
মৃন্ময়ী বলল, “গরমকালের বিকেল এতো দীর্ঘ হয়!”
“ছোট হলে ভাল লাগত?”
মৃন্ময়ী আমার সামনে পায়চারী করতে করতে বলল, “আগে, মানে ছোটবেলায় ভাবতাম, দিন হলো স্বামী আর রাত তার স্ত্রী! বিকেল ছোট হলে দিন তার স্ত্রীর কাছে তাড়াতাড়ি যেতে পারে!”
হেসে ফেললাম আমি। বললাম, “এখনো ওমন ভাবো?”
মৃন্ময়ী বলল, “ভাবিনা। মাথায় চলে আসে। কে যে আমাকে ওটা শিখিয়েছিল!”
পুরো ছাদে শুধু একটাই ফুলের গাছ, সেটাও গোলাপ। ছাদজুড়ে বিভিন্ন ফলের গাছ। পেয়ারা থেকে লেবু পর্যন্ত আছে। মৃন্ময়ীর ধার্মিক ভাই যে ফুলের সৌন্দর্য বুঝতে অপারগ, সে আর বলতে হয় না। এই কাঠমোল্লা পরিবারে মৃন্ময়ীর জন্ম হলো কী করে?
লেবুগাছটায় অসময়ে ফুল ফুটেছে। তীব্র মিষ্টি সুগন্ধ এসে ঢুকছে নাকে। মৃন্ময়ী লেবু গাছটার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, “আমার বাগানে আমি বাতাবীলেবুর গাছও লাগাব একটা। বাতাবীলেবুর ফুলের গন্ধ কেমন নেশা লাগানো, জানো?”
মৃন্ময়ীর চিন্তা এত সহজ কেন? ও ধরেই নিয়েছে, বিশাল বাগান হবে ওর আর সেখানে একটা বাতাবীলেবুর গাছ হবে! আমি কেন পারিনা এত সহজ করে ভাবতে? কেন মনে হয়, জীবনটা সহজ হবে না?
মৃন্ময়ীকে প্রজাপতির মতো লাগছে এখন। ও যেন ছাদের গাছেগাছে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এ গাছের পাতা ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে অন্য গাছে!
অন্ধকার নামতে শুরু করেছে পৃথিবীতে। দিন রাত্রির সন্ধিক্ষণের অদ্ভুত মৃদু লালচে আলোয় মৃণ্ময়ীর মুখটা মোমের আলোর মতো আদুরে।
“আরেকটু পর অস্ত যেও সূর্য, ওকে দেখতে দাও প্রাণভরে!”
মৃন্ময়ী আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “চুপচাপ কী দেখছো?”
“কিছু না!”
আকাশের দিকে হঠাত তাকিয়ে মৃন্ময়ী বলল, “ঐ দেখ, এক ঝাঁক বক! ঢাকায় ওরা কী করে বলতো? এখানে তো পুকুর নেই কোন?”
আমি জবাব দিলাম না কোন। এসব প্রশ্নের জবাব দিতে নেই। মৃন্ময়ী সারাজীবন, প্রতিদিন প্রতিবিকেলে আমাকে এমন অবাক প্রশ্ন করতে পারে না? কেন পারে না?
গোব্দা ছেলেটা বলল, “ফুপি, আম্মুর কাছে যাব!”
“দুদু খাবে?”, বলতে ইচ্ছে করল আমার। বয়স হয়েছে সাতআট বছর, আর বলছে আম্মুর কাছে যাবে! গ্রামের এই বয়সের ছেলেদের বাপমায়েরা মারতে মারতে সন্ধের পর বাড়িতে নিয়ে আসে খেলার মাঠ থেকে। আর ছেলেরা মায়ের থেকে দূরে দূরে হেঁটে বাড়ি ফিরে মারের হাত থেকে বাঁচতে। আর এ সন্ধ্যে হতে না হতেই “আম্মুর কাছে যাব!”
মৃন্ময়ী বলল, “চল, ভাইয়া এসেছে নাকি দেখি!”
মৃন্ময়ীর পিছন পিছন আমি ওদের বসার ঘরে গিয়ে বসলাম। মৃন্ময়ীর গলা শুনতে পেলাম, কিচেনে গিয়ে ভাবিকে বলছে, “তুমি কী শুরু করেছো এসব? এখন মাছ কুটছো মানে? এসব করতে হবে কেন?”
মৃন্ময়ী ফিরে এসে বলল, “ভাইয়া ইলিশ মাছ নিয়ে এসে দিয়ে নাকি আবার নিচে গেছে। ভাবি এখন সেই মাছ রান্না করবে, খাবো আমরা, যাব তার পরে!”
আমি আঁতকে উঠে বললাম, “এতক্ষণ থাকতে হবে?”
মৃন্ময়ী বলল, “উপায় নেই!”
মৃন্ময়ী ভাবিকে সাহায্য করতে কিচেনে চলে গেলো। আমি এখন করব কী? গোব্দা জুলফিকার মায়ের মোবাইল নিয়ে ঘুতাঘুতি করছে, আমি ওর গালটা টিপে দেব?
অনেকক্ষণ সিগারেট খাইনি। নিচে গিয়ে একটা সিগারেট টেনে আসা যায়। মৃন্ময়ীকে বলে নিচে নামলাম আমি।
বাসায় নিচেই একটু দূরে দোকান। সিগারেটটা ধরিয়েছি, নীলা কল দিল।
“মৃণ্ময়ীর সাথে রিক্সায় কোথায় গেলি রে?”
বললাম, “তুই জেলাস গার্লফ্রেন্ডদের মতো করছিস কেন রে?”
নীলা বলল, “ভাট শালা। তোকে নিয়ে আবার জেলাসি। শোন, তোর কাছে লুতফার নাম্বার আছে?”
“আছে। কেন?
“ওর নাম্বারটা টেক্সট কর তো আমাকে!”
ফোন কেটে কন্টাক্টস থেকে লুতফার নাম্বার বের করছি, কীসের ধাক্কায় ফোনটা রাস্তায় পড়ে গেলো!
যে শালা ধাক্কা দিয়েছে তার থামার নাম নেই কোন। ফোনটা চট করে তুলে বললাম, “এই যে ভাই, চোখের সমস্যা থাকলে ডাক্তার দেখান। অন্ধের মতো রাস্তায় হাঁটাচলা করেন কেন?”
লোকটা থামল এবারে। আমার দিকে ক্ষিপ্ত নয়নে তাকিয়ে বলল, “কী বললেন?”
বললাম, “চোখকান খোলা রেখে হাঁটুন। ঢাকার রাস্তা, বোঝেন তো। অল্প বয়সে বৌ বিধবা হবে নাহলে!”
সে উদ্ধত ভঙ্গিতে আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, “চোখকান খোলা রাখব মানে? রাজার মতো করে রাস্তার অর্ধেক দখল করে সিগারেট টানবেন আর আমাকে আপনাকে সরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে?”
“আপনার তো সামান্য কমনসেন্সও নাই। ধাক্কা দিয়ে মোবাইল ফেলে দিলেন। সরি বলার ভদ্রতাটুকু দেখালেন না। রাজা তো আপনি!”, বললাম আমি।
ছেড়ে দেয়ার পাত্র আমিও নই। এই টেকো মধ্যবয়সী পার্ভাটটাকে ডাস্টবিনের ময়লায় পুতে রাখতে পারি, চাইলে।
“তোর বয়স কত রে, ছোকরা? সমস্যা কী তোর?”, অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে বলল লোকটা।
আমি সিগারেটে টান দিয়ে ভোঁস করে ধোঁয়া ছেড়ে বললাম, “তুই তুকারি করবি না, মাদারচোদ। বয়স যতই হোক, তোর মতো টাক্লাকে ট্যাকল করা জন্মের আগেই শিখে আসছি!”
লোক জড়ো হয়ে গেল সামান্য এই কয়েকটা কথা চালাচালিতেই। দুজন এলাকারই ছেলে এসে থামাল আমাকে, কয়েকজন মুরুব্বির কথায়, সে মধ্যবয়স্কও ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেলেন।
টং এর দোকানটা থেকে আরেকটা সিগারেট নিয়ে ধরালাম। কোন শালা যেন থামাতে এসে সিগারেটটা নিয়ে নিয়েছে! নীলাকে লুতফার নাম্বারটা পাঠালাম। ফোনের স্ক্রিনটায় স্ক্রাচ পড়েছে।
“আরে রিদম, তুই এইহানে?”, বলতেই চমকে তাকালাম পিছনে। রিক্ত সহাস্যবদনে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি প্রায় উচ্চস্বরেই বলে উঠলাম, “আরে দোস্ত, আসছিলাম একটা কাজে। একটা মাদারচোদের সাথে লাগছিল একটু আগে। তুই থাকলে ব্যাটার মুখটার ম্যাপ পাল্টে দিতাম!”
“কেন কী হইছে?”, জিজ্ঞেস করল রিক্ত।
ঘটনাটা বললাম পুরোটা। শোনার পর রিক্ত বলল, “আবে এহব ম্যাটার না। কমলাপুর এলাকার সব হালায় চোটঠা। স্টেশন এইহানে না? তোর মানিব্যাগ ঠিক আহে কিনা দেখ, অনেকসোমায় ধাক্কাটাক্কা দিয়া মানিব্যাগ নিয়া যায়গা। বুঝতাও পারবি না!”
বললাম, “না না। ঠিক আছে।”
রিক্ত ঢাকার স্থানীয়। ফিল্ম বানানোর ভূত মাথায় নিয়ে ঘোরে। আমার সাথে দেখা হলেই সিনেমার দুরবস্থা, বর্তমান ফিল্মমেকাররা যে কত নিচু মানসিকতার, এরা যে সিনেমার বালটাও বোঝে না, এসব নিয়ে ঝাড়া আধঘণ্টা লেকচার মারবে ঢাকাইয়া আঞ্চলিকে।
রিক্ত বলছিল, “সেদিন একটা নাটক দেখলাম বুঝলি। বাংলাদেশের থ্রিলার নাটক। ডেভিড ফিঞ্চাররে গোলাইয়া মাখাইয়া নাটক বানাইছে। ফিঞ্চারের গোয়াও মারছে, নাটকেরও মারছে!”
ফিঞ্চারের হলিউডি গোয়ার নাগাল বাংলাদেশের পরিচালক কীকরে পেল ভাবতে ভাবতেই মৃন্ময়ী ফোন দিল। রিসিভ করতেই বলল, “তুমি কোথায়? ভাইয়া এসেছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে চলে যাব!”
ফোনটা দিয়ে রিক্তের ফিল্মক্লাস থেকে রেহাই দিল বলে, মৃন্ময়ীকে ধন্যবাদ জানাতে হবে!
রিক্তের থেকে বিদায় নিয়ে মৃণ্ময়ীর ভাইয়ের বাসার সিঁড়ি বেঁয়ে উঠতে লাগলাম। দরজা খুলে দিল মৃন্ময়ীই।
বলল, “কোথায় গিয়েছিলে? একটা সিগারেট টানতে এতক্ষণ লাগে?”
ওকে ঘটনাগুলো বলতে যাব, ঘরের সোফায় বসে থাকা ব্যক্তিটিকে দেখে মুখের কথা মুখেই রয়ে গেলো আমার। রাস্তার সেই টেকো লোকটা এখানে কী করছে!
মৃন্ময়ী লোকটাকে বলল, “ভাইয়া, এ রিদম। ও নিচে গিয়েছিলো একটু!”
আমার মনে হচ্ছিল, পা অবশ হয়ে গেছে আমার, একটুও নড়ার সামর্থ নেই। মাথাটা ঝিমঝিম করছে, শুকিয়ে গেছে গলা।
টেকোটাও তাকিয়ে আছে আমার দিকে বিস্মিত চোখে। ভয়ে ভয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকলাম। মৃন্ময়ীর ভাবি এসে বললেন, “খাবার রেডি। ডাইনিং এ আসো। মৃন্ময়ীর ছটফটানির জন্য মাছটা রান্নাই করতে পারলাম না। কী হবে একটু দেড়ি করে গেলে?”
মৃন্ময়ীর ভাই বলল, “ওরা খাক। আমি এত তাড়াতাড়ি খাব না!”
টেকোটার সাথে এক টেবিলে বসে খেতে হবে না জেনে বুকে বল পেলাম খানিকটা। ও বসলে, ভাতের দলা আমার গলা দিয়ে নামতো না।
মৃন্ময়ী আর আমি খেতে বসলাম। এত আইটেম কার জন্য রান্না করেছেন ভাবি? মাংসই আছে তিন প্রকার। মাছ ভাজা, ডিম, বেগুন ভাজা, বুটের ডাল, আচার, আলুর চপ! টেকোটা বোধহয় ভাবছে, ওকে প্রায় মারতে গিয়ে ওর টাকারই খাবার খাচ্ছি!
মৃন্ময়ী খেলো অল্প। খাব না খাব না করেও কয়েক প্লেট ভাত উড়িয়ে দিলাম। মাংসের বাটি অর্ধেক ফাঁকা হলো, ডিমের বাটিটা শূণ্য। মাছাভাজা আমি কম খাই বলে তিনচার পিস খেয়েছি। ভাবলাম, রাস্তার যা হবার হয়েছে। রান্না যেহেতু করেছে, ইগো দেখিয়ে না খেয়ে নষ্ট করে লাভ কী?
খাওয়া শেষ করে টেকোটার সামনে বসতে হলো। মৃন্ময়ীর ভাই আমাকে বলল, “একসাথে পড় তাহলে?”
“হ্যাঁ!”
“ভালোভাবে পড়াশুনা করো। এখনকার ছেলেপেলে তো পড়ার চেয়ে মাস্তানিটা বেশি করে। স্টুডেন্ট পাওয়ার! যেখানে সেখানে হই হট্টগোল। এসব করে পড়াশুনা করে কখন ওরা?”
কথাগুলা যে সাধারণ ছাত্রের উদ্দেশ্যে বলা নয়, এসব ন্যায়বাক্য বর্ষিত হচ্ছে আমার উপরেই, বুঝতে খুব জ্ঞানী হতে হয় না।
মৃন্ময়ী বলল, “ও ছাত্রলীগ করে না, ভাইয়া যে যেখানে সেখানে মারামারি করবে!”
ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে বাম করে? নাস্তিকদের সাথে গাঞ্জা খায়?”
মৃন্ময়ী বলল, “এমন করে কেন বলছো? বামরা শুধু নেশা করে, তোমাকে কে বলল? সময়ের সাহসী ছেলেরাই বাম করে। ও অবশ্য সক্রিয় নয়!”
মৃন্ময়ীর ভাই বলল, “ওসব বলিস না। বামদের আমার চেনা আছে।”
রাস্তায় ঝগড়া করার সময় টেকোটার দাড়ি লক্ষ্য করিনি আমি। এখন কথা বলতে বলতে যেভাবে দাড়িতে হাত বুলাচ্ছে, তাতে সেদিকে নজর না গিয়ে উপায় নেই। ব্যাটা নির্ঘাত ছাত্রজীবনে শিবির করত!
মৃন্ময়ীর ভাই উঠে ঘরের ভিতরে চলে গেল। মৃন্ময়ী বলল, “ভাইয়ার কথায় কিছু মনে করো না। ও একটু বেশি রক্ষণশীল!”
মৃন্ময়ী ভাইয়া ভাবির সাথে কথা বলতে ঘরের ভেতর চলে গেল আমাকে রেখে! জীবনে এমন পরিস্থিতে পড়তে হবে, কে জানত!
মৃন্ময়ী বেড়িয়ে এসে বলল, “চল যাই। রাত আটটা বেজে গেছে!”
মৃন্ময়ীর ভাবি “থেকে গেলে কী হয়”, “তুই তো আসিসই না” টাইপের কিছু কথা বললেন দরজায় দাঁড়িয়ে। ওর ভাই এলোই না মৃন্ময়ীকে বিদায় দিতে।
বাইরে বাতাস উঠেছে খুব। বৃষ্টি হবে নাকি? রিক্সায় উঠে কয়েকটা গলি পার হয়েছি, আমার ধারণা সত্যি করে বৃষ্টি নামলো হুড়মুড় করে। রিকশাওয়ালা মামা আমাদের তাড়াহুড়ো করে পলিথিন দিলেন বৃষ্টি থেকে বাঁচতে।
মৃন্ময়ী বলল, “এই ফিরে যাবে নাকি? এভাবে গেলে তো ভিজে যাব!”
বললাম, “কী হয়েছে শুনবে? তারপর বলো, ফিরে যাবে না এভাবেই যাবে!”
মৃন্ময়ী বলল, “কী হয়েছে?”
ঘটনাটা বললাম পুরো। মৃন্ময়ী বলল, “ও মাই… তাই তো ভাবি, ভাইয়া তোমার সাথে এভাবে কথা বলছে কেন? ছিছি… কী হলো বলতো!”
বললাম, “আমার কী দোষ? কে জানত ও তোমার ভাই হবে?”
মৃন্ময়ী বলল, “আরে দোষ কে দিচ্ছে। ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেল না? তোমাকে আনলাম ভাইয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। তুমি কিনা অলমোস্ট মারামারি করে বসে আছো ভাইয়ার সাথে!”
অপরাধীর মতো চুপচাপ থাকলাম আমি। বৃষ্টির তেজ বাড়ছে প্রতিনিয়ত। পলিথিন আমাদের পুরো ঢাকতে পারছে না। আর গলিগুলোতেও জ্যাম লেগেছে!
মৃন্ময়ী বলল, “আমার ভাবির রান্না কেমন লাগল?”
বললাম, “মার্ভেলাস। তোমার ভাই বাইরে বসে না থাকলে সব খেয়ে ফেলতাম!”
মৃন্ময়ী বলল, “পেটুক কার্তিক!”
মৃন্ময়ীর মুখে ফোঁটাফোঁটা পানিতে ভিজে গেছে। ওর দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল আমাদের। মৃন্ময়ী বলল, “কী?”
“তোমার মুখ ভিজে গেছে!”
“তোমারও!”
রাস্তার পাশের দোকানগুলো থেকে আসা আলোয় মৃণ্ময়ীর চোখগুলো দেখে গ্রামের দীঘির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আমার দিকেই মুখ করে আছে ও। আমার ঠোঁট আর ওর ঠোঁটের দূরত্ব কতো? এই দূরত্ব পেরুতে পারব কোনদিন?
মৃন্ময়ী বলল, “আমি তোমাকে কোথায় নামিয়ে দেব বলো?”
বললাম, “কোথাও না। রিক্সা সরাসরি ধানমন্ডি যাবে!”
মৃন্ময়ী বলল, “মানে? তারপর তুমি আসবে কীভাবে?”
বললাম, “আমার আসার চিন্তা করতে হবে না তোমাকে। আমি চলে আসব!”
“তোমাকে যেতে হবে না বেকার অতোদূর। আমি পারব যেতে!”
“বেঁকার যাচ্ছি না তো। তোমার কোম্পানি আরেকটু পেশি পাব, তাই যাচ্ছি! তোমার সাথে রিক্সায় আরেকটু বেশিক্ষণ থাকতে আমি তারচেয়ে কয়েকগুণ রাস্তা হেঁটে আসতে পারি মধ্যরাতে!”
মৃন্ময়ী আবার তাকাল আমার মুখের দিকে। বলল, “প্রায় কবিতার লাইন হয়ে গেল!”
গুলিস্তানে জ্যাম পাব ভেবেছিলাম। কিন্তু বৃষ্টির কারণে বোধহয় ফাঁকা হয়ে গেছে রাস্তাঘাট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এড়িয়ে পেরিয়ে রিক্সা চলল সায়েন্সল্যাবের দিকে। নিউমার্কেটের ভিড় নেই বললেই চলে, কিছু ক্রেতা ওভারব্রিজ দুইটায় ঠাই নিয়েছে। বাতাসে মাঝেমাঝেই আমাদের পলিথিন উড়ে যেতে চাইছে, ভালো করে ধরে রাখতে হচ্ছে তাই।
মৃন্ময়ী প্রায় লেগে আছে আমার দেহে। ওর ফরাসী পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছি। ও আছে গুটিসুটি মেরে, ঠাণ্ডা লাগছে কি?
বলল, “তুমি ফিরবে কেমন করে?”
বললাম, “তুমি বরং এটা না ভেবে আমাকে একটা কবিতা শোনাও।”
মৃন্ময়ী বলল, “কবিতা? আমি আবৃত্তি করতে পারি না যে?”
“তুমি বললেই আবৃত্তি হয়ে যাবে, মৃন্ময়ী। সেটা আবৃত্তির হবে মানদণ্ড!”
মৃন্ময়ী হাসল একটু। বলল, “তারচেয়ে গান গাই একটা?”
আমার বিস্মিত জিজ্ঞাসা, “গাইতে পারো?”
মৃন্ময়ী বলল, “উঁহু পারি না। কিন্তু গাইতে ইচ্ছে করছে!”
আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম শুধু। চোখ বন্ধ করল মৃন্ময়ী। বৃষ্টির ছাটায় ভিজে গেছে ওর চোখের পাপড়ি। আমাদের রিক্সার পাশ দিয়ে দ্রুত বেগে চলে গেল কয়েকটা বাস, ট্রাক, সিএনজি ও প্রাইভেট কার হর্ন বাজিয়ে। চোখ খুলল না মৃন্ময়ী। প্রার্থনার স্বরে, গাইতে শুরু করল ও-
“যখন সবাই মগন ঘুমের ঘোরে, নিয়ো গো, নিয়ো গো,
আমার ঘুম নিয়ো গো হরণ করে।
একলা ঘরে চুপে চুপে এসো কেবল সুরে রুপে-
দিয়ো গো, দিয়ো গো,
আমার চোখের জলের দিয়ো সাড়া।
আমার নিশীথরাতের বাদলধারা…”
[/HIDE]