What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

অধ্যায় আগে পরে হয়ে গেছে, সমস্যা নেই, মিলিয়ে নিয়েছি। পরের পরবের অপেক্ষায়।
 
“একমাস সতেরো দিন পর!”


মৃন্ময়ীকে দেখে হতচকিয়ে গেল নীলা। ওকে আশা করেনি এসময়ে। নীলা বোধহয় সমস্যায় পড়লেই চুল টানে, রাস্তায় শুকাতে দেয়া খড়ের মতো যথেচ্ছা এলোমেলো ওর চুল। নীলা মৃন্ময়ীকে দেখে হাসার চেষ্টা করল একটু। সে চেষ্টায় ঠোঁটটা কাঁপল শুধু, হাসি ফুটল না।
আমাকে ইশারা করে একদিকে টেনে নিয়ে গেল নীলা। বলল্ “বোকাচোদা, ওকে আনছিস কেন?”
“কী হয়েছে বল তো? ও জানলে সমস্যা নাই, অনেক ওপেন মাইন্ডেড মেয়ে ও!”
নীলা তারপর কী মনে করে বলল, “ও জানলেই বা কী? জানবেই তো!”
মৃন্ময়ী অবাক চোখে আমাদের দেখছে। খানিকটা কি বিব্রতও?
নীলা মৃন্ময়ীর কাছে গেল হেঁটে। আমি বললাম, “তুই কিন্তু বলছিস না! কী সমস্যা বলবি তো নাকি?”
নীলা বলল, “লর্ডকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে!”
“মানে?”, আমি প্রতিক্রিয়া জানানোর আগেই বিচলিত প্রশ্ন করল মৃন্ময়ী। জিজ্ঞেস করল, “ওকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে কেন?”
নীলা আমাদের সামনেই বিক্ষিপ্ত পদক্ষেপে হাঁটতে লাগল। বলতে লাগল, “সবাই এখন আমাকে নিয়ে কী ভাববে বলতো?”
“কেন পুলিশ ধরেছে?”, বিস্মিত আমার জিজ্ঞাসা!
“তুই আবার জিজ্ঞেস করছিস কেন? বুঝিস না, বোকাচোদা?”, ক্ষেপে নিয়ে চিৎকার করে বলল নীলা। আমাদের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল বৃদ্ধা একজন। ভ্রুকুটি করে তাকালেন তিনি নীলার দিকে।
মৃন্ময়ী বলল, “আই ক্যান হেল্প, নীলা। আমার ভাইয়া পুলিশে আছে!”
নীলা বলল, “কাল রাতে ধরেছে ওকে। আমি জানতাম না। আজ কোর্টে চালান করে দিছে!”
বললাম, “করেছেটা কী? মার্ডার টার্ডার করল নাকি? তুই ক্লিয়ারলি বলবি, প্লিজ, এমন সাসপেন্সে না রেখে?”
মৃন্ময়ী আছে বলেই বোধহয় নীলা বলতে চাইছে না সরাসরি। বললাম, “মৃন্ময়ী কাউকে কিছু বলবে না, নীলা। তুই বল!”
নীলা ইতস্তত করল খানিক। তারপর বলল, “কাল রাতে, আমি শুনেছি আজ দুপুরে, লর্ড নাকি কোন ছেলেকে নিয়ে হোটেলে গেছিলো। বুঝলি তো? হোটেলের কর্মচারী নাকি পুলিশকে ফোন দিয়েছে। পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেছে!”
মৃন্ময়ী অবাক হয়ে বলল, “পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে কেন? কী করেছে ওরা?”
নীলা প্রায় চিৎকার করে বলল আবার, “লর্ড গে, মৃন্ময়ী। বোঝো না, দুইটা ছেলে ঢাকায় বাসা থাকতেও হোটেলে যায় কেন?”
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল মৃন্ময়ী। কিছুক্ষণ কথাই বলল না ও। আমি বললাম নীলাকে, “তুই এটা নিয়ে চিন্তা করছিস কেন?”
নীলা বলল, “তুই এতো বোকা কেন, রিদম? এখন আমার কথা উঠবে! সবাই জেনে যাবে ব্যাপারটা। এই খবরটা কার থেকে পাইছি, জানিস? আমার খালাতো বোনের কাছ থেকে। কেউ জানে না, আমরা ব্রেকাপ করছি। ও ফোন দিয়ে বলল যখন…” বাক্যটা শেষ করল না নীলা। বিক্ষিপ্ত হাঁটতে লাগল আবারও।
মৃন্ময়ী লর্ডের গে হওয়ার ব্যাপারটা এখনো বিশ্বাস করতে পারেনি বোধহয়। বলল, “ও গে হলে… আমার মাথাতে আসছেই না ব্যাপারটা…!”
কিছু বললাম না আমি। নীলা বলল, “এই বালের দেশে, বুঝলি, আমি আর থাকবোই না!”
হাতপা ছুঁড়তে লাগল নীলা। বলতে লাগল, “এখন সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করবে, তোর বফ গে, তুই জানতি না? তুই গে এর সাথে প্রেম করেছিস! আমি কী করব, রিদম?”
নীলার কথা কানেই আসছে না আমার। রাগ হচ্ছে খুব, কার উপর রাগ হচ্ছে, জানি না। এদেশে শিশুকে ধর্ষণ করে ধর্ষকেরা ঘুরে বেড়ায় প্রকাশ্য, নির্বাচন পর্যন্ত করে। আর দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নিজের পূর্ণ সম্মতিতে বদ্ধ ঘরের ভেতর কী করেছে, তাই নিয়ে পুলিশের, সমাজের, ধর্মের মাথাব্যথা? কী ক্ষতি করেছে লর্ড? চাঁদাবাজি, ছিনতাই করেনি, দুর্নীতি করেনি, ঘুষ খায়নি, মারপিঠ করেনি। কেন আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াবে অপরাধী হয়ে? যৌনতা পুরোপুরি নিজেস্ব ব্যাপার, এ নিয়ে রাষ্ট্রের মাথাব্যথা কেন?
নীলা বলল, “আমি লর্ডের সাথে দেখা করব!”
অবাক হয়ে বললাম, “কী করবি দেখা করে?”
নীলা বলল, “জানি না কী করব!”
মৃন্ময়ী বলল, “তুমি ভেঙ্গে পড়ো না, নীলা! সব ঠিক হয়ে যাবে!”
নীলা ক্ষেপে গিয়ে বলল, “বাল ঠিক হবে। বাল। আমি ভেবেছিলাম, কেউ জানবে না ও গে। এখন কী হবে? সবাই যে আমাকে জিজ্ঞেস করবে?”
মুখটা করুণ হয়ে গেল মৃন্ময়ী। নীলা এত জোরে চিৎকার করে কথাটা বলেছে! কিন্তু মৃন্ময়ী আবার স্বাভাবিক হতে সময় নিল না। বলল, “তুমি কি লর্ডকে ব্লেইম করছো, নীলা?”
নীলা বলল, “আমার সাথে প্রেম করার জন্য ওকে ব্লেইম করব না?”
মৃন্ময়ী বলল, “সেটা ও খুব ভুল করেছে। কিন্তু ওর সমকামী হওয়াটাকে দোষের কিছু ভাবছো না তো?”
নীলা বলল, “না। করি না। এটায় ওর হাত নেই!”
মৃন্ময়ী বলল, “তাহলে শান্ত হও, নীলা। গে হওয়া নিয়ে লজ্জা পাওয়াই উচিত না, জানো? ভারতেই তো সমবিবাহ লিগ্যাল। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে লর্ডকে গে হওয়ার জন্য লজ্জিত হতে হতো না!”
নীলা বলল, “আমার ভাল লাগছে না কিছু!”
“একটু র্যাশনালি চিন্তা করো, নীলা!”, বলল মৃন্ময়ী। “গে হওয়ার জন্য কারো লজ্জিত হওয়া উচিত নয়!”
নীলা বলল, “এটা ইউরোপ নয়, মৃন্ময়ী! এটা বাংলাদেশ! একটা সাম্প্রদায়িক খোঁয়াড়!”
আমি নীলাকে জিজ্ঞেস করলাম, “দোস্ত, তুই কি বোরকা পরে আছিস?”
নীলা আমার দিকে বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে বলল, “মানে?”
বললাম, “মানে, তুই বোরখা পরে নাই। তুই জিন্স পরে আছিস। এদেশের বেশিরভাগ মানুষ, ৮০% মানুষ, তারও বেশি হতে পারে, তোর বোরখা সাপোর্ট করবে না। তুই কি লজ্জা পাচ্ছিস?”
নীলা বলল, “না!”
বললাম, “৯৯% মানুষ হয়তো লর্ডকে সাপোর্ট করবে না এদেশে। কিন্তু তার মানে এটা না ও ভুল, ওর লজ্জা পাওয়া উচিত। এদেশের বেশিরভাগ মানুষ ব্যক্তিস্বাধীনতা, যৌনস্বাধীনতা কী জানেই না। সেই মূর্খ লোকেরা কী ভাববে, সেটা ভেবে প্যানিকড হচ্ছিস কেন?”
মৃন্ময়ী বলল, “Let them think whatever they want! You don’t need to be ashamed because of their ignorance!”
নীলা বলল, “অনেকেই জানে, লর্ড আমার বফ। ওরা ওর গে হওয়ার খবরটা যখন পাবে, আমার সম্পর্কে কতকিছু বলে বেড়াবে ভাব!”
মৃন্ময়ী বলল, “ওদের বলতে দাও! যাদের কাজ কাম নাই, তারাই এসব নিয়ে মাথা ঘামাবে। ওরা এমনিতেও অনেক কথা বলবে কারণ বিচিং করাই ওদের প্যাশন!”
মৃন্ময়ীর কথায় কিছুটা শান্ত হলো নীলা। বলল, “লর্ডকে দেখতে যাব না তাহলে?”
মৃন্ময়ী বলল, “ও কোথায় আছে, আমরা জানি না। আর গেলে তোমাকে দেখে ও আরো বিব্রত হবে!”
নীলাকে মাঝে রেখে হাঁটতে লাগলাম আমরা। লাইব্রেরির সামনে এসে মৃন্ময়ী বলল, “লাইব্রেরিতে এত লোক পড়ছে! ওদের উপর একটা জরিপ চালালে দেখবে, যৌনস্বাধীনতায় কেউ বিশ্বাসই করে না! এত পড়ে লাভ কী তাহলে?”
কেউ জবাব দিলাম না মৃন্ময়ীর কথায়।
অনেকক্ষণ এই পুঁজিবাদী সমাজের বাস্তবতা নিয়ে আলোচনা করলাম আমরা। মৃন্ময়ী একসময় বলেই বসল, “আমার মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে, এই দেশ ছেড়ে চলে যাই! অন্য কোথাও!”
আকাশে অদ্ভুত এক আলো তখন।
ভাবছিলাম, কোন অপরাধ না করেও, শুধু মাত্র রাষ্ট্রের মূর্খতায় একজন এই আকাশ দেখতে পারছে না। কারাগারের অন্ধকারে হয়তো অভ্যস্ত হয়ে গেছে তার চোখ। এমন আঁধারেই লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল সে তার পরিচয়, হয়তো চেয়েছিল, এ জন্মটা লুকিয়ে চুরি করে কাঁটিয়ে পরের জন্মে নাগরিক হবে স্বাধীন মুক্ত দেশের। রাষ্ট্র তাকে দাঁড় করিয়ে দিল ঘৃণাভরা একগাদা চোখের সামনে…

“ভালোবাসা চলে যায় একমাস সতেরো দিন পর
অযথা বৎসর কাটে, যুগ, তবু সভ্যতা রয়েছে আজও তেমনি বর্বর
তুমি হও নদীর মতো গভীরতা, ঠাণ্ডা, দেবদূতী
কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে।

-হিমযুগ/ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

রুদ্রাভাবী তার ছেলের স্কুলের সামনে আমাকে যেতে বলেছিলেন এগারোটায়। বারোটায় আমার ক্লাস আছে। এগারোটায় ওর স্কুলের সামনে যেতেই দেখলাম ভাবি তার বয়সী আরো কয়েকজনের সাথে গল্প করছেন।
আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন। বললেন, “শুকিয়ে গেছো!”
“জ্বর ছিল দুতিনদিন ধরে। কেমন আছেন আপনি?”
বললেন, “ভালো। বাসাটা গোছাগুছি করতে গিয়ে অবস্থা নাজেহাল!”
সুখী সুখী লাগছে আজ রুদ্রাভাবিকে। পরেছেন ঝলমলে এক শাড়ি। দুধদুইটা ব্লাউজের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে লাল কাপড় দেখা ষাঁড়ের মতো।
ভাবি বললেন, “তোমার ওখানে যেতে চাচ্ছি কয়েকদিন ধরে। কিন্তু সময়ই পাইনি!”
নিজেকেই অবাক করে দিয়ে আমি বললাম, “আমাদের বোধহয় থামা উচিত!”
রুদ্রাভাবি অবাক বিস্ময়ে বললেন, “মানে?”
বললাম, “আমার আর ভাল লাগছে না এভাবে।”
রুদ্রাভাবির সুখী সুখী মুখটা অন্ধকার হয়ে এলো নিমেষেই। বললেন, “আমাকে ভাল লাগছে না আর?”
আমি বলার মতো পেলাম না খুঁজে। আমার শুধু মনে হচ্ছিল, এই যে গল্প করছি দাঁড়িয়ে ভাবির সাথে পুরান ঢাকার এক স্কুলের সামনে, একজোড়া চোখ আড়াল থেকে দেখছে আমায়। অবিশ্বাস ঘনিয়ে এসেছে সেই চোখে। বিস্ফোরিত সেই চোখ আহত, ব্যথিত ও নির্বাক। আমার অস্বস্তি লাগছে, ইচ্ছে করছে, ছুটে চলে যাই ভাবির সামনে থেকে।
রুদ্রাভাবি বললেন, “কারো প্রেমে পড়েছো?”
অন্যদিকে তাকালাম আমি। ভাবি বললেন, “বুঝেছি।”
তারপর বললেন, “অনেক কথা বলার ছিলো তোমাকে। থাক সেসব আর বলবো না।”
রুদ্রাভাবির গলা ভাঙ্গা শোনাচ্ছে কী একটু? মনে হচ্ছে, বিষণ্ণ ঘুঘুর ডাক শুনছি ঘোর দুপুরে। বললেন, “বেস্ট অফ লাক! আমি তোমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করব না কোনদিন!”
উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করলেন রুদ্রাভাবি। রুদ্রাভাবির মন খারাপ থাকবে আজ।
 
“সমাপ্তি”


শার্টের গায়ে চকচকে নতুন বোতামের মতো আকাশের গায়ে সেটে আছে তারারা। মৃন্ময়ী বলল, “আপু-মৃন্ময়ী নাকি অপু-লীলা?”
“কঠিন প্রশ্ন!”
“উত্তর দিতেই হবে। স্কিপ করার উপায় নেই!”
মৃন্ময়ীর মুখ দেখতে পাচ্ছি না তরল অন্ধকারে। আছি কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের নির্জনতায়। গার্ড এসে কয়েকবার উঠতে বলেছে, আমরা নাছোড়বান্দা, তারা না ফোঁটা পর্যন্ত উঠব না।
মৃন্ময়ী শুয়ে পড়েছিল, ঘাসে মাথা রেখে। বলেছিলো, “শুয়ে পড়ো তুমিও!”
আমিও শুয়ে পড়েছিলাম ওর পাশে। সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হচ্ছিল ধীরে, আকাশটা নেমে এসেছিলো কালো চাদর জড়িয়ে। দূরে, মাঠের গেটে একটা উজ্জ্বল লাইট জ্বলছিল শুধু।
একটা একটা করে তারা ফুটতে শুরু করেছিলো। মৃন্ময়ী বলেছিল, “মনে হচ্ছে জীবনানন্দের কবিতা রিলাইভ করছি আমরা!”
“কোন কবিতা?”

“…আধ ফোটা জ্যোৎস্নায়; তখন ঘাসের পাশে কতোদিন তুমি
হলুদ শাড়িটি বুকে অন্ধকারে ফিঙ্গার পাখনার মতো
বসেছ আমার কাছে এইখানে- আসিয়াছে শটিবন চুমি
গভীর আঁধার আরো- দেখিয়াছি বাদুড়ের মৃদু অবিরত
আসা-যাওয়া আমরা দুজনে বসে- বলিয়াছি ছেঁড়াফোঁড়া কতো
মাঠ ও চাঁদের কথাঃ ম্লান চোখে একদিন সব শুনেছে তো।”

মৃন্ময়ী মৃদু স্বরে বলেছিল কবিতাটা। আমি বলেছিলাম, “শটিবন আর নেই!”
“ফিঙ্গা দেখিনি কোনদিন আমিও!”
আকাশের তারারা ভোরের পাখিদের মতো ঘুম ভেঙ্গে উঠছিলো যখন মেঘ ফুঁড়ে, তাকিয়েছিলাম তার দিকে। বলেছিলাম, “একশো বছর আগে যদি কোন জোনাকি জ্বলা শটিবনে দেখা হতো আমাদের!”
মৃন্ময়ী আমার দিকে তাকিয়েছিল, বলেছিল, “আর আমার পরনে থাকতো হলুদ শাড়ি!”
মৃন্ময়ীর মুখ তখনও দেখতে পাচ্ছিলাম না আমি। শুধু বুঝতে পারছিলাম, তার মুখের নিকটত্ব। চোখ বন্ধ না করেই, ওর অন্ধকার মুখের তরল অবয়বের দিকে তাকিয়ে কল্পনায় দেখেছিলাম সেই দৃশ্য!
তারা ফুটলে, মৃন্ময়ী আমাকে তারাগুলো দেখিয়ে বলেছিল, “এর মধ্যে কোনটা তারাটা চেনো?”
বলেছিলাম, “সন্ধ্যাতারা ছাড়া কোনটাই না!”
মৃন্ময়ী বলেছিল, “আমিও!” তারপর বলেছিল, “আমার দাদু আমাকে সপ্তর্ষিমন্ডল চিনিয়েছিল। দাদু মারা গেছেন অনেকদিন। আমি ভুলে গেছি!”
ব্যথিত হয়েছিলাম আমি। বলিনি কিছুই। শুধু মনে হয়েছিল, কী যে মনে হয়েছিলো…
তখনই প্রশ্নটা করলো মৃন্ময়ী- “আপু-মৃন্ময়ী নাকি অপু-লীলা?”
আমি বলেছি, “কঠিন প্রশ্ন!”
উঠে বসল মৃন্ময়ী। বলল, “কী হলো, বল!”
আমি কোনদিন তুলনা করিনি এভাবে। বললাম, “অপু-মৃন্ময়ী! তবে মত পাল্টে যেতে পারে যে কোন মুহূর্তে!”
আমি উঠে দাঁড়ালাম। মৃন্ময়ী বলল, “আমিও পারব না কোন একটা বেছে নিতে। কেন যে এমন অদ্ভুত প্রশ্ন মাথায় আসে!”
“যত অদ্ভুতই হোক, সব প্রশ্ন দ্বিধাহীন করো আমাকে!”
মৃন্ময়ী বলল, “সমাপ্তির একটা অংশ আছে না, যেখানে নৌকায় বাবার কাছে পালিয়ে যাওয়ার সময় মৃন্ময়ী যা দেখে সেটা নিয়েই অপুকে প্রশ্ন করে আর অপু জানুক না জানুক সে প্রশ্নের উত্তর দেয়? মৃন্ময়ী সেটা সত্য সরল মনে বিশ্বাস করে?”
বললাম, “হ্যাঁ। আছে।”
মৃন্ময়ী বলল, “তুমি আবার আমাকে অপুর মতো সব প্রশ্নের উত্তর দেবে না তো? জানা বা না জানো?”
“মৃন্ময়ী কিন্তু অপুর সব কথা বিশ্বাস করেছিল। তুমি আমার সব উত্তর বিশ্বাস করবে সন্দেহাতীতভাবে?”
মৃন্ময়ী বলল না কিছু। হাঁটতে লাগলো গেটের দিকে। মাঠ ত্যাগ করার আগে তাকিয়ে দেখলাম আকাশের দিকে। কোটি কোটি বছরের পুরনো আকাশ- আমার আগে, কতজন- কত বেদুঈন, কত কবি, কত বাঙ্গালী কিশোরী আর কিশোর এবং বিধবারা তাকিয়েছে এ আকাশের দিকে। কেউ ভেবেছে আরেক জগতের কথা, কেউ কাল্পনিক ঈশ্বরে ছায়া আকাশে দেখে হয়েছে ভীত। সেই সব আদিম ও আধুনিক লোকেরা, মিলিয়ে গেছে ছেলেবেলার মতো।
বেড়িয়ে এলাম আমরা খেলার মাঠ থেকে।
মৃন্ময়ী হঠাত আমার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে, যেন পথরোধ করেছে ও, জিজ্ঞেস করলো, “হেমলতাকে মনে আছে তোমার?”
আমি নামটা শুনে হতচকিয়ে যাই। নামটা খুঁজতে চেষ্টা করি স্মৃতি মেলে, বলি, “কোন হেমলতার কথা বলছো?”
মৃন্ময়ী বলে, “অপরাজিততে অপু একটা কারখানার উপরতলায় বাসা নিয়েছিল। ওর পাশের বাড়ির একটা মেয়ে, দেখত ওকে প্রতিদিন। একদিন ও জানালায় লিখেছিল, “হেমলতা আপনাকে বিবাহ করিবে”। মনে আছে?”
হঠাত মনে পড়ায় আনন্দিত হয়ে উঠি আমি। বলি, “হ্যাঁ, মনে আছে!”
মৃন্ময়ী আমার রাস্তা ছেড়ে দিয়ে বলে, “আমি না খুব চাইতাম অপু ওকে বিয়ে করুক!”
জিজ্ঞেস করি, “কেন চাইতে?”
মৃন্ময়ী বলে, “জানি না। কী রোম্যান্টিক না?”
আমি কিছু বলি না। মৃন্ময়ী আমার পাশাপাশি হাঁটতে থাকে।
“এই যে প্রতিদিন তোমাকে ডাকি বিকেলবেলা। প্রতিদিন সন্ধ্যাটা আমি আজব সব কথা বলে নষ্ট করি। বিরক্ত লাগে তোমার?”, আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে মৃন্ময়ী।
“বিরক্ত? তোমার মনে হয় বিরক্ত হই আমি?”, উল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেই।
মৃন্ময়ী মাথার চুল দুলিয়ে বলে, “উঁহু!”
হাঁটতে থাকি আমরা। এলোমেলো কথারা উড়ে আসে, ঘিরে ধরে, হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আমার কানে মৃন্ময়ীর স্বর লেগে থাকে। মাঝেমাঝে হাঁটার সময়, অসাবধানতা আমাদের দুজনের হাতের সংঘর্ষ বাঁধিয়ে দেয়, কাঁধের সাথে লেগে যায় কাঁধ। মৃন্ময়ী লজ্জিত চকিত আমার মুখের দিকে তাকায়। আমি তাকাই ওর বিচলিত বিস্মিত চোখের মেঘলা অন্ধকারে।
নীলা আর লর্ডের কথা মাঝেমাঝে আলোচনা করি আমরা। মৃন্ময়ী জিজ্ঞেস করে, “লর্ডের খবর জানো কিছু?”
বলি, “জানি না। খুব খারাপ হয়েছে ওর সাথে!”
মৃন্ময়ীর গতি মন্থর হয়, বলে, “আমরা কিছু করতে পারলাম না। আন্দোলন করা উচিত ছিল!”
কিছু বলি না আমি। মৃন্ময়ী নিজেই বলল, “কী হতো আন্দোলন করে? আমাদের কথা শুনতো কেউ? কিচ্ছু হতো না!”
বলি, “লর্ড ছাড়া পাবে মনে হয়। ভাল উকিল ধরলেই হবে!”
মৃন্ময়ী বলে, “সে জানি। কিন্তু ছাড়া পেতে মিথ্যের আশ্রয় নিতে হবে ওদের। বলতে হবে, যুক্তি দেখাতে হবে, ওরা কিছু করেনি, কোন কারণে হোটেলে ছিল। কিন্তু কেন? ওরা তো ক্ষতি করেনি কারোর! তাহলে মিথ্যে বলতে হবে কেন মুক্তির জন্য? আমরা একবিংশ শতকে এসেও কেন ব্রিটিশদেই সেই আদিম আইনে বাঁচব?”
লর্ডের কথা উঠলেই বিচলিত হয়ে যাই আমি, অপরাধবোধ কাজ করে। মনে হয়, এমন সময়ে আহমেদুল্লাহ বা অন্য কোন ছেলের হাত ধরে হাঁটতে পারত ও। অংশ হতে পারত এই কোলাহলের। কোন ক্ষতি হতো না কারো। ওর দেবতার মতো মুখ উজ্জ্বল হতে পারত হাস্যধারায়। কথা বলতো আমারই মতো এলোমেলো খাপছাড়া। অথচ… কোথায় ও?
আমি সাবধানে ও চাতুর্যের সাথে লর্ডের ব্যাপারটা মাথা থেকে তাড়িয়ে দেই আর মৃন্ময়ীকেও ধরিয়ে দেই অন্য প্রসঙ্গ। লর্ডের প্রসঙ্গ উঠলেই মৃন্ময়ীর মুখটা গনগণ করে, মনে হয়, অদৃশ্য কারোর সাথে ঝগড়া করে ও। বিতর্ক করে জোর গলায়। তখন ওর প্রতিবাদী মুখে কোমলতা থাকে না।
মৃন্ময়ী আঙ্গুল দিয়ে কী যেন নির্দেশ করে আকাশের দিকে। রোকেয়া হলের মাথায় চাঁদ ওঠেছে। বলে, “খুব চাঁদ দেখতে ইচ্ছে করছে আমার!”
“আমার ছাদে যাবে, মৃন্ময়ী?”, জিজ্ঞেস করি আমি।
মৃন্ময়ী আমার দিকে তাকায়। বলে, “যাব!”
আমরা একটা রিক্সা নেই। রিক্সা ছুটতে শুরু করে। মৃন্ময়ী বলে, “তোমার কি একটাই শার্ট?”
“না তো।”
মৃন্ময়ী বলে, “তাহলে একটা শার্টই বারবার পর কেন?”
আমার শার্ট লক্ষ্য করে ও? ও মনে মনে চায়, আমি পোশাক পাল্টে দেখা করি ওর সাথে? আমাকে কল্পনায় দেখার সময়, এই শার্টটা পছন্দ হয় না ওর?
“কাল অন্য শার্ট পরব!”
মৃন্ময়ী বলল, “তোমাকে একটা শার্ট গিফট করব আমি!”
আমার নিজেকে হুট করেই ব্যর্থ মনে হয়। আমার মনে হয়, আমি মৃন্ময়ীর যোগ্য নই! মৃন্ময়ীর গিফট করা শার্ট মানাবে না আমার দেহে! লর্ডের ব্যাপারটা নিয়ে ফেসবুকে অনেক লিখেছে ও। অনেক পত্রিকায় লেখা পাঠিয়েছে, যদিও ছাপা হয়নি সেসব। অনেক হুজুর ওকে হুমকি দিয়েছে, আমাদের ক্যাম্পাসেরই ইসলামের ইতিহাসের এক ছাত্র নগ্নভাবে অসংস্কৃত নোংরা ভাষায় আক্রমণ করেছে যুক্তিতে না পেরে। আমি কিছুই করিনি।
আমার বাড়িওয়ালার টুপি আর দাড়িওয়ালা মুখের অসহনীয় কুৎসিত হাসিটা মনে পড়েছিল। আমি তার হাত তরবারি দেখতে পেয়েছিলাম কল্পনায়। মনে হয়েছিল, সারাটা দেশ এদের মতো লোক দিয়েই ভরে গেছে। রাস্তায় মোড়ের দোকানদারকে আমার মনে হয়েছিল জল্লাদ, আমি রাস্তায়, মোড়ে, গলিতে, বাজারে, শপিংমলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, স্কুলে ও কলেজে, প্রেমিকার সাথে রিক্সায়, হোটেলে, বেশ্যাপাড়ায় শুধু ধার্মিক জল্লাদ দেখতে পাচ্ছিলাম। মনে হয়েছিল, বাংলাদেশটা হয়ে উঠেছে যেন আমার ধর্মপ্রাণদের উর্বর প্রজননক্ষেত্র।
আমি না লিখতে পেরে, প্রতিবাদ না করতে পেরে বিমর্ষ হয়েছিলাম। নিজেকে বেড়ালের মতো নিরীহ মনে হয়েছিল। আমি আমার ঘরে, সেই চিলেকোঠায় ভয়ে ভয়ে লুকিয়ে ছিলাম।
এখন মৃন্ময়ীর পাশে বসে, মনে হচ্ছে, ও অক্ষম একটা ছেলের সাথে বসে আছে।
আমার নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে। মুখ ফুটে মৃন্ময়ীর কাছে ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে করছে, চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে।
রিক্সা ঠিক বাসার সামনে নামিয়ে দেয় আমাদের। আমরা আস্তে আস্তে সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠি। একটা নতুন কাপল উঠেছে আমার পাশের ফ্লাটে। স্বামীটার সাথে দেখা হয়ে যায় আমার। ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে গটগট করে নেমে যান।
ছাদে উঠতে মৃন্ময়ী বলে ওঠে, “ইসস, কী বাতাস!”
হাওয়ায় চুল ওড়ে ওর। একটা লাইট জ্বলছে। বলে, “আলোটা নিভিয়ে দাও। চাঁদের আলো আসবে দেখব!”
আমি ওর শান্ত মুখ দেখে, নিজের অক্ষমতা ও প্রতিবাদে অংশ না নেয়ার গ্লানির মথা ভুলে যাই। মনে হয়, একা কিছু করতে পারব না আমি। ভাবি, এখনো রাষ্ট্র মৃন্ময়ীকে কেড়ে নেয়নি আমার থেকে। এখনো চাঁদের আলো করেনি নিষিদ্ধ।
আলোটা নিভিয়ে দেই আমি। জিজ্ঞেস করি মৃন্ময়ীকে, “আজ কি পূর্নিমা?”
মৃন্ময়ী বলে, “জানি না। তবে এই চাঁদ শুক্লপক্ষের!”
জিজ্ঞেস করি, “কীভাবে বুঝলে?”
বলে, “মনে হচ্ছে। এত আলো, দেখছো না? মনে হচ্ছে, চাঁদ থেকে আলো অবিরল ঝড়ে পড়ছে!”
ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়াই আমরা। আমার হঠাত গান গাইতে ইচ্ছে করে। গুনগুনিয়ে উঠি, “চাঁদ নেমে আসে/ আমার জানলার পাশে/ ঘুম ছুঁয়ে ভাসে/ চাঁদেরই গান…”
মৃন্ময়ী বলে, “থামলে কেন? গাও!”
“তুমি শুনতে পেয়েছো? আমি তো ভাবলাম মনে মনে গাচ্ছি!”
মৃন্ময়ী হাসে। বলে, “তোমার কণ্ঠ ভাল না!”
বলি, “তোমার কণ্ঠ খুব সুরেলা। তুমি গাও না!”
মৃন্ময়ী বলে, “আমার গান শুনতে ইচ্ছে করছে। গাইতে না। তুমি বেসুরো গলাতেই গাও!”
আমি অর্ণবের গানটা, যেটা আমার মোটেও পছন্দের নয়, শুধু পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে গেয়ে উঠেছি, গাইতে শুরু করি। গলা মেলায় মৃন্ময়ী। আমি থেমে যাই। মৃন্ময়ী একা গাইতে থাকে। ওর কণ্ঠ ভেসে যায় হাওয়ায়। ভেসে ভেসে পাশের ফ্ল্যাটের দেয়ালে লাগে, হাওয়ায় হাওয়ায় দূরের বড় বিল্ডিংটায় চলে যায়। জানালায় মুখ রেখে যে কিশোর বা কিশোরী চাঁদ দেখছে, তার কানেও পৌঁছে যায়।
আমি বলি, “সরি, মৃন্ময়ী!”
মৃন্ময়ী বলে, “কেন?”
বলি, “সমকামীদের অধিকার নিয়ে যখন তুমি প্রতিবাদ করেছিলে, তখন আমি চুপ করে ছিলাম। আমি প্রতিবাদে অংশ নিলে, ফেসবুকে দুই লাইন লিখলেও হয়তো, অনেকেই প্রতিবাদ শুরু করত।”
মৃন্ময়ী বলে, “তোমার আজকের রাতটা কেমন লাগছে?”
“অদ্ভুত আর কাব্যিক!”
মৃন্ময়ী বলে, “তুমি লিখলে, প্রতিবাদ করলে, এমন কাব্যিক রাত দেখার জন্য বেঁচে থাকবে না! ধর্মপ্রাণরা তোমাকে জীবিত রাখবে না!”
আমি জিজ্ঞেস করি, “তুমি লিখছো যে!”
মৃন্ময়ী বলে, “আমিও লিখব না আর। আমাকেও হুমকি দিয়েছে। আমার ভাই সেদিন ফোন দিয়ে বকেছে!”
আমার মৃন্ময়ীর ভাইয়ের দাড়িওয়ালা মুখটা মনে পড়ে। ভয় করে হঠাত আমার। যদি মৃন্ময়ীর অবস্থা হয় অভিজিৎ রায়দের মতো? যদি এমন জোছনায় আর না থাকে ও? আমার সাথে না থাকুক, না থাকে যদি পৃথিবীতেই? যদি এই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে না নিঃশ্বাস নেয় আর?
আমার খুব ভয় করতে থাকে। আমার ইচ্ছে করে মৃন্ময়ীকে জড়িয়ে ধরতে। বলি, “তুমি আর লিখো না! লিখতে হবে না। তোমাকে বাঁচতে হবে, মৃন্ময়ী! মৃত বিপ্লবীদের দরকার নেই আর!”
মৃন্ময়ী আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। বলে, “আমি লিখব না আর। প্রতিবাদ করব না। আমি সাধারণ মানুষের মতো বেঁচে থাকব। এমন চাঁদের আলো দেখব!”
চাঁদ আজ অকৃপণ। যখন মাঠে ছিলাম দুজনে, তখন হয়ত প্রস্তুতি নিচ্ছিলো ওঠার। ছাদটা আলোয় ভরে যায়। মনে হয়, কত কিছু মনে হয়… পুকুরে গোসল করতে ইচ্ছে করে, গোল্লাছুট খেলতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে… ইচ্ছে করে…
মৃন্ময়ীর সাদা ওড়না উড়ছে। এসে লাগছে মাঝেমাঝে আমার গায়ে।
ও সঙ্গলোভী বিড়ালের মতো দাঁড়িয়েছে আমাকে গেছে। আমি দেখতে পাচ্ছি চুলের আড়ালে ওর মুখের একটা অংশ। ইচ্ছে করছে ওকে আমার দিকে তাকাতে বলি। যেন, দেখতে পাই ওর মুখটা এই অদ্ভুত অচেনা আলোয়।
“মৃন্ময়ী?”, ডাকি আমি।
“উম্মম”, জবাব দেয় ও। তাকায় আমার দিকে। আমি ওর মুখে হাত দেই। চুলগুলো সরিয়ে দেই ওর মুখ থেকে। বলি, “চাঁদ দেখতে ইচ্ছে করছে না আর। এখন তোমার মুখটা দেখব শুধু চাঁদের আলোয়!”
চোখ বন্ধ করে ও। মনে হয়, চাঁদের আলো শুধু পরেছে ওর মুখেই। বাকিসব, এই ছাদ, ছাদের উপরের কবুতরের খোপগুলো, দড়িতে টাঙ্গানো সায়া, শার্ট আর জাঙ্গিয়া, ঢেকে গেছে অন্ধকারে। আমি ঠোঁটটা এগিয়ে দিয়েও সরিয়ে নেই। সাহস পাই না। আমার নিঃশ্বাস লাগে ওর মুখে। চকিতে চোখ খুলে মৃন্ময়ী। আমার কাছ থেকে সরে গিয়ে, নিজের ওড়না ঠিক করতে করতে বলে, “ব্যালকোনিতে চলো!”
ভয় দানা বাঁধে আমার বুকে। বুকটা দুরুদুরু করে। রাগ করেনি তো মৃন্ময়ী? আমি কি খারাপ কাজ করেছি? আমার চুমু দিতে চাওয়ায় কি আহত হয়েছে ও?
আমরা দ্রুত নেমে আমার ঘরের সামনে আসি। হাত চালিয়ে দরজা খুলে আলো জ্বেলে দেই। মৃন্ময়ী খুব আস্তে ঘরের ভেতরে ঢোকে।
বলে, “আলো নিভিয়ে জানালা খুলে দাও! চাঁদের আলো আসুক ঘরে!”
আমি ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে জানালা খুলে দেই। জানালা দিয়ে ম্লান চাঁদের আলো ঘরে ঢোকে…
বলি, “ব্যালকনির লাইট নেভানো আছে। চাঁদ দেখা যাবে না। তবে চাঁদের আলো আসবে!”
অন্ধকারে মৃন্ময়ীকে দেখতে পাই না আমি। তবে বুঝতে পারি, আমার দিকে তাকিয়ে ও বলছে, “তুমি যাও। আমি আসছি!”
আমি ব্যালকনিতে আসি। চাঁদের আলোয় পবিত্র হচ্ছে চারপাশ। এ আলো কি গঙ্গাজল? এ আলোর দিকে যারা তাকাবে না, মুগ্ধ হবে না দেখে, তারা মানুষ খুন করতে পারে, দুর্নীতি করতে পারে, ধর্ষণ করতে পারে, বৃদ্ধকে ঠেলে ফেলে দিয়ে উঠতে পারে চলন্ত বাসে। চাঁদটাকে আকাশে স্থায়ী করে বসিয়ে দিতে ইচ্ছে করে আমার। আমার রাষ্ট্রের পতিদের এই চাঁদের আলো দেখাতে ইচ্ছে করে, চাঁদের আলোয় ওদের গা ধুইয়ে দিলে, শুদ্ধ হতে পারে ওরা…
মৃন্ময়ী কী করছে ঘরে? আসছে না কেন? বড় কোন অপরাধ করে ফেলেছি, চুমু দিতে চেয়ে?
হঠাত পায়ের শব্দে পিছনে ফিরে তাকাই আমি। আর পিছনে ফিরতেই, কীসের যেন মৃদু ধাক্কায় পিছিয়ে যাই একটু। একরাশ চুল আমার মুখে এসে লাগে, একটি ভেজা উষ্ণ ঠোঁট আজকের শুক্লপক্ষের চাঁদের মতো, দস্যুর মতো, অবিরল চুমু দিতে থাকে আমার মুখে আমাকে অবাক হওয়ার সুযোগ না দিয়ে।
মৃন্ময়ী বলে, “আমাকে বেঁচে থাকতে হবে! অনেকদিন বেঁচে থাকতে হবে!”
দ্রুত নিঃশ্বাস নিয়ে বলে মৃন্ময়ী। ওর নিঃশ্বাসের উত্তাপে আমার ঠোঁট পুড়ে যায়, আমি জড়িয়ে ধরি ওকে। ডুবে যেতে থাকি ওর দেহে। বলি, “তোমাকে আমার সাথে বেঁচে থাকতে হবে, মৃন্ময়ী! অনেকদিন, অনেকবছর!”
মৃন্ময়ী আমাকে জড়িয়ে ধরে আরো নিবিড়ভাবে।

***সমাপ্ত***

FB_IMG_16271629637413508.jpg
 
Last edited:
অপূর্ব দাদা আপনার আর কি আছে ঝুলিতে।
কামদেব রচিত- ফুলবনে এক মধুকর
পড়ুন-
 

Users who are viewing this thread

Back
Top