মনে কী দ্বিধা…
এদেশে হায়েশা নেকড়ের পাল,
গোখরো, শকুন, জিন কি বেতাল
উটলা পাকায় রাস্তার ধারে।
জ্যান্ত মানুষ ঘুমায় ভাগাড়ে।
অথচ তোমার চুল খুলে দাও তুমি।
-শামসুর রাহমান
রুদ্রা ভাবির বাসা থেকে ফিরে শুয়ে পড়লাম। কেন জানি না, এখন, নিজেকে শূন্য মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, খুব বড় কিছু জয় করে এলাম, এখন আর সামনে কোন লক্ষ্য নেই, কোন তাড়া নেই। ঘড়িতে কেবল সাড়ে সাতটা বাজে। কী করব এখন?
রুদ্রা ভাবির সংসার আছে, আমার কাছ থেকে ভালোমতো গাদন খেয়ে এখন নিশ্চয়ই স্নেহময়ী মায়ের মতো সৈকতকে পড়াতে বসিয়েছেন, স্বামী এলে হয়ে যাবেন সোহাগী গৃহবধূ! আর আমি? যেমন ছিলাম গতকাল, আছি তেমনই। জীবনে কোন অর্জন নেই, নেই পরাজয়। এভাবে লক্ষ্যহীন হয়ে চলবে কতোদিন?
শুয়ে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছে, কিছুই করছি না আমি। এভাবেই হয়তো উদ্দেশ্যহীন ভাবে চলতে চলতে, চাকরিবাকরি করে, বিয়ে থা করে মরে যাব হুট করে, সবার অলক্ষ্যে। বৌ বাচ্চা মনে রাখবে কিছুদিন, তারপর তারাও মানিয়ে নেবে, জগতে আমি ছিলাম, আমার অবস্থান ছিল কোথাও, ভুলে যাবে সবাই! জীবনটা এমন হবে ভাবিনি তো কোনদিন!
শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করল না আর। আটতলা থেকে নেমে বেরিয়ে পড়লাম। কোথায় যাওয়া যায় এখন? ইচ্ছে করলে ফোন করে অনেকের সাথে দেখা করতে পারি। সুদীপ্ত হয়তো জগন্নাথ হলের মাঠে বসে গাঞ্জা টানছে বা টিএসসিতে গান গাইছে, ওর সাথে গিয়ে ভিড়তে পারি। নীলাকে ফোন দিয়ে আসতে বলতে পারি টিএসসি। ক্যাম্পাসে গেলে দেখা পাব কারো না কারো!
অথচ কারো সাথে দেখা করার ইচ্ছে করছে না। এই যে হাঁটছি উদ্দেশ্যহীন, লাগামছাড়া- ভ্যাঁপসা গরমে ভিড়ের একজন হয়ে ধাক্কাধাক্কি করে পেরিয়ে আসছি মোড়্গুলো আর মাঝেমাঝে বাতাস এসে লাগছে, ভালো লাগছে এটাই।
এভাবে হাঁটতে হাঁটতে কখন ইডেন কলেজের সামনে চলে এসেছি, খেয়াল করিনি! নীলক্ষেতের সিগনাল ছেড়ে দিয়েছে বোধহয়, আজিমপুরের বাসগুলো ষাঁড়ের মতো ছুটছে। হঠাত কাঁধে হাত পড়ল কারো।
চমকে পিছন ফিরে দেখি, ধ্রুব!
ও বলল, “কীরে কতক্ষণ থেকে ডাকছি, শুনছিসই না!”
ধ্রুবর পাশে বেমানান রকমের খাটো একটা মেয়ে। ধ্রুব আমার থেকেও লম্বা। এই পিচ্চি মেমোরি কার্ডকে এ জোটাল কবে। বললাম, “শুনতে পাইনি। যা শব্দ!”
ধ্রুব বলল, “দুই যেভাবে আকাশের দিকে দেখে দেখে হাঁটছিস! শুনবি কীকরে?”
তারপর পাশের মেয়েটাকে দেখিয়ে বলল, “এই হচ্ছে কেয়া। আমার গার্লফ্রেন্ড। আর এ আমার ছোটবেলার বন্ধু রিদম!”
আমি কেয়ার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। এতক্ষণ কেয়ার হাইটটাই খেয়াল করেছি শুধু, মুখটা দেখিনি। বেশ গোলগাল চেহারা। গৃহপালিত গৃহপালিত ভাব আছে একটা।
ধ্রুব আমাকে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাচ্ছিস? অনেকদিন কোন খোঁজখবর নাই, কী অবস্থা!”
কোথায় যাচ্ছি? কোথায় যেতে পারি আমি? এই বাস্তব শহরে নিজের ছোট্ট চিলেকোঠা ছাড়া কোথাও যাওয়ার নেই আমার! এসব কাব্যিক কথা বলা যায় না ওকে।
বললাম, “নীলক্ষেতে যাব একটু। কয়েকটা জিনিস কেনা লাগবে!”
ধ্রুব আর কিছু বলল না। বিদায় নিয়ে চলে গেলো। আসলে ওকে বলার কিছু নেইও আমার, সম্পর্কটাই এমন। যার সাথে কোন স্মৃতি নেই, তার সাথে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ আলাপ করা চলে?
যাক, ওর সাথে দেখা হয়ে নিজের গন্তব্য তো পেলাম! নীলক্ষেতে গিয়ে বই খোঁজা যেতে পারে।
হোম ইকো কলেজের সামনে মেয়েরা ভিড় করে আছে, ফুটপাত ওদের কেনার জিনিসে ঠাসা। হকারদের ঠেলায় ঢাকার রাস্তায় হাঁটারও যো নেই। একটা মেয়ে প্রায় বুক দিয়ে ঠেলে চলে গেল আমাকে। “তোমার কীসের এত তাড়া! রাস্তা পাড় হবে সাবধানে!”
নীলক্ষেতকে আমার আলাদা একটা বিশ্ববিদ্যালয় মনে হয়। গাইড বইয়ের দোকানগুলোর চাপেও, এখনো বাতিঘরের মতো কিছু অপাঠ্য বইয়ের দোকান বাতিঘরের মতো জ্বলছে। তাদেরই একটায় বই খুঁজতে লাগলাম।
হাসনাত আব্দুল হাই এর একটা বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছি, খুব চেনা কারো স্বরে চমক ভাঙ্গল। মৃণ্ময়ীর গলা নয়?
মাথা ফিরে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখলাম, আমার উল্টো দিকে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে মৃণ্ময়ী।
নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এলো আমার। এখন এভাবে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে হাঁটতে এসে, ওর দেখা পেয়ে যাবো, ভেবেছিলাম কল্পনাতেও?
ওর সাথে কথা বলব এখন? এখন যাওয়া কী ঠিক হবে? হঠাত নিজেকে শরীরটা ঘিনঘিন করে উঠল। আধঘণ্টা আগেই আমার দেহে লেপ্টে ছিলো একজন, তার দেহের রস এখনো হয়তো আমার দেহ থেকো শুকোয়নি!
এমন অপবিত্র অবস্থায় যাওয়া সম্ভব সাক্ষাৎ পবিত্রতার সামনে! অশুদ্ধ অবস্থায় যায় কেউ প্রার্থনা করতে মসজিদ কিংবা মন্দিরে?
এসব ভাবছি, মৃন্ময়ীই তাকালো আমার দিকে। চেনা কাউকে দেখতে পেয়েছে বলে স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হলো ওর চোখ। স্বভাবসুলভ হাসল আমাকে দেখে।
আমি সম্মোহিতের মতো এগিয়ে গেলাম ওর দিকে। শেষবার যেদিন কথা হয়েছিলো, কী যেন জিজ্ঞেস করেছিলো ও। আমি ক’টা সিগারেট খাই, জানতে চেয়েছিলো ও। এখন আমার আঙ্গুলের ফাঁকে সিগারেট নেই, ধোঁয়া উড়ছে না, সিগারেটছাড়া আমাকে দেখে বিস্মিত হবে কি মৃন্ময়ী?
“কয়টা সিগারেট খাই, গুনিনি!”, নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম আমি।
আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে মৃন্ময়ী বলল, “মানে?”
হাতের বইটা মুড়ে ফেলল ও। শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতাসমগ্র। বললাম, “কিছু না!”
ও বলল, “সিগারেটের কথা কী একটা যেন বললে!”
শুনেছি তবে। আমি লজ্জিতভাবে হেসে বললাম, “সেদিন সিগারেট কয়টা খাই জিজ্ঞেস করেছিলে। আমি বলেছিলাম, গুণে বলব। আজ তোমার দেখা হয়ে গেল। অথচ গুনিনি!”
ফিক করে হেসে ফেলল মৃন্ময়ী। ওর অবাধ্য চুল দস্যি বালকের মতো এসে পড়ল ওর মুখে। হাত দিয়ে সরাতে সরাতে বলল, “সেদিন কী বলেছিলাম মনে আছে তোমার?”
“তোমার সবকিছু মনে থাকে আমার, মৃন্ময়ী! সবকিছু!”, বলতে ইচ্ছে হলো আমার। কিন্তু সেটা না বলে বললাম, “কী বই দেখছো?”
ও হাতের বইটা দেখিয়ে বলল, “শামসুর রাহমানে শ্রেষ্ঠ কবিতাসমগ্র!”
হঠাত করেই শামসুর রাহমান প্রিয় হয়ে উঠলেন আমার। ওর কবিতা আগে থেকেই পড়ি। এখন থেকে হয়তো পড়ব ধর্মগ্রন্থের মতো নিয়মিত সকাল সন্ধ্যা।
কিছু বলার আগে ও আবার বলল, “এসেছিলাম আরেকটা বইয়ের খোঁজে! পেলাম না!”
জিজ্ঞেস করলাম, “কী বই?”
মৃন্ময়ী হাতের বইটা রেখে, বলল, “মুনীর চৌধুরীর রচনাসমগ্র। বাংলা একাডেমির। নতুনটার অনেক দাম, ভাবলাম দেখি, নীলক্ষেতে যদি পাই!”
মৃন্ময়ী বইটার নাম বলার সাথে সাথেই মনে হলো, লটারি জিতে গেছি আমি! বইদুটো তো আছে আমার কাছে। বললাম, “আমার কাছে আছে বই দুটা। রচনাসমগ্র এক আর দুই। একটায় মৌলিক নাটক আরেকটায় অনুবাদ। তবে তুমি যদি ওর গদ্য চাও, তাহলে নেই। ওগুলা বোধহয় অন্য কোন খন্ডে আছে!”
সূর্যোদয়ে যেভাবে রক্তিম আলোয় উদ্ভাসিত হয় প্রকৃতি, সেভাবেই আলোকিত ও আনন্দিত হয়ে উঠল ওর মুখ! বলল, “সত্যি? আমাকে ওর অনুবাদ নাটকের খণ্ডটা দেবে? আই মিন, ধার দেবে?”
বললাম, “অবশ্যই। কাল শফিকুল স্যারের ক্লাসে নিয়ে যাব!”
ধার কেন, ও যদি আমার পুরো লাইব্রেরিই বিনামূল্যে চেয়ে বসে, দিয়ে দেব আমি, বিনিময়ে ওর সূর্যোদয়ের মতো উদ্ভাসিত মুখটা দেখতে চাই আমি!
মৃন্ময়ী বাচ্চাদের মতো মুখ করে বলল, “কাল? আজই দিতে পারবে? ওর একটা অনুবাদ নাটক পড়েছিলাম অনেকদিন আগে। আবার পড়তে ইচ্ছে করছে। আজ পারবে না দিতে? প্লিজ?”
প্লিজ? মৃন্ময়ী যেভাবে আদুরে মুখ করে বলছে, তাতে পাষাণও গলে যাবে। আর আমি ওকে বই ধার দেব না!
বললাম, “তাহলে তো তোমাকে আমার বাসায় যেতে হবে! তুমি নিচে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি চট করে উপর থেকে নিয়ে আসব!”
মৃন্ময়ী প্রায় লাফিয়ে উঠে হাততালি দিয়ে বলল, “খুব হবে, চলো… তোমার দেখা না পেলে আজই আমি আজিজ থেকে নতুন বইটা কিনতাম!”
বললাম, “তাহলে তো হাজার টাকার কেস! বাঁচিয়ে দিলাম। তোমার তো আমাকে খাওয়ানো উচিত!”
“খাবে?” জিজ্ঞেস করলো ও। জবাবের প্রত্যাশা না করে, নিজেই বলল, “চল সিগারেট খাওয়াচ্ছি তোমাকে!”
নীলক্ষেতের চিকনগলিগুলো আমার পিছনে পিছনে পেরিয়ে এলো মৃন্ময়ী। নীলক্ষেতের বাইরে নিউমার্কেট থেকে আসা মানুষদের ভিড়। এই ভীরে মানায় না মৃন্ময়ীকে। কোন নিরালা নদী তীরে সকালে কিংবা পাহাড়চূড়ায় বুনো ফুলের সুবাসছড়ানো রাতে, স্বপ্নচারিণীর মতো উদাস অবস্থান হওয়া উচিত ওর। \
আমি ওকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ভিড় ঠেলে হোম ইকো পেরিয়ে এলাম। এদিককার ফুটপাতে ভিড় তুলনামূলক কম, পাশাপাশি হাঁটা যায় দুজন। আমার পাশেপাশে হাঁটতে লাগল মৃন্ময়ী। আমি মাঝেমাঝে তাকাচ্ছি ওর দিকে, ওর নিষ্কলুষ, নিষ্পাপ মুখে রাস্তার উজ্জ্বল আলো। নিয়ন আলো হলে ভালো হতো!
বললাম, “হেঁটেই যাবে? অনেক দূর কিন্তু!”
মৃন্ময়ী বলল, “হেঁটেই চল! কতদূর হবে!”
বললাম, “দুই কিলো তো হবেই!”
মৃন্ময়ী বলল, “আমি তোমার সাথে না থাকলে কী হেঁটেই যেতে?”
“হ্যাঁ।”
ও বলল, “তাহলে হেঁটেই চলো… আমার সমস্যা নেই!”
মুনীর চৌধুরীর বইটা প্রায় দুই বছর ধরে আমার কাছে আছে। কিচুহ নাটক পড়েছি মোলিক, অনুবাদে হাত দেইনি। কী এমন আছে সেসবে, যে এতো উতলা হয়ে উঠল মৃন্ময়ী? জিজ্ঞেস করলাম সে প্রশ্নটাই।
মৃন্ময়ী বলল, “আমি জানি না। আমি নাটক পড়ি না খুব একটা। কিন্তু হঠাত ওর একটা অনুবাদ রোম্যান্টিক নাটকের কথা মনে পড়ে গেল। অনেক আগে পড়েছিলাম, নাইন টেনে হয়তো! আর তখন থেকেই পড়তে ইচ্ছে করছে!”
“এত পড়তে ইচ্ছে করছে যে, সাথে সাথেই নীলক্ষেত চলে এলে এই গরমে?”, বললাম আমি!
ও আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “হ্যাঁ! চলে এলাম!”
হাঁটতে লাগলাম আমরা। এখন কি বৃষ্টি আসতে পারে না? বা একটু বুনো এলো বাতাস? ভিজতে পারে না পৃথিবীটা আমার আনন্দে?
আজিমপুর মোড়ে চলে এলাম আমরা? পথ এতো দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে কেন? আর তো কয়েকটা মোড় পেরুলেই আমার বাসা। তারপর বই নিয়ে চলে যাবে ও!
সাবধানে রাস্তা পাড় হলাম আমরা। ঘণ্টাখানেক আগেই উদ্দেশ্যহীন সুতোছেড়া ঘুড়ির মতো লাগছিল নিজেকে। অবহেলে জীবনের কিচ্ছু পরোয়া না করে পাড় হয়ে গেছি মোড়টা। জীবন তখন নিজের কাছেই ছিল মূল্যহীন। অথচ এখন, মৃন্ময়ীর সাথে হাঁটতে হাঁটতে, মনে হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের কথা একটু এডিট করে বলে উঠতে পারি, “মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে/ মৃন্ময়ীর মাঝে আমি বাঁচিবার চাই!”
ভিকারুন্নিসা না কী যেন নাম, স্কুলটার নাম কোনদিন মনোযোগ দিয়ে পড়িনি, তার পরে কলোনি আছে একটা, গিজগিজ করছে লোক, রাস্তার পাশে ভ্যানে বিক্রি হচ্ছে শাকসবজি। ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।
মৃন্ময়ী মাঝেমাঝে এটা সেটা বলছে।
“এদিকে কোনদিন আসিইনি আমি! ঢাকারই কতো জায়গা এখনো অদেখা!”
“আমিও তো দেখতে পারলাম না। তুমি ধানমন্ডি কততেঁ থাকো?”
“৩২। বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে কিছু দূরে!”
“আমি বঙ্গবন্ধুর ৩২ এর বাসায় যাইনি কোনদিন! আগ্রহ জাগেনি!”
“আমারও। ওর মেয়ে যেভাবে দেশ চালাচ্ছে, আগ্রহ পাই না!”
রাজনৈতিক আলোচনা করব এখন? অন্য কোন বান্ধবী হলে আমি নিজেই আগ্রহী হয়ে সরকারের সমালোচনা শুরু করে দিতাম। কিন্তু মৃন্ময়ীর সাথে কলুষিত রাজনীতি নিয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাই না আমি।
মৃন্ময়ী বলল, “কতজন মিলে থাকো তুমি? সাবলেট?”
বললাম, “একা থাকি!”
মৃন্ময়ী অবাক হয়ে বলল, “একা? এত টাকা ভাড়া দাও তুমি!”
বললাম, “আরে তোমাদের ধানমন্ডির বাসার মতো ভাড়া অতো বেশি নয়। আমি থাকি চিলেকোঠায়। একটা মাত্র রুম। ভাড়া ২৭০০।”
মৃন্ময়ী বলল, “কমই! আমি তোমার মতো ছেলে হলে, এমন বাসাই খুঁজতাম! একা। রুমমেটদের সাথে ভালো লাগে না আর। এতো বকে ওরা!”
বাসার সামনে চলে এলাম আমি। বললাম, “তুমি এখানে ১৫ মিনিট অপেক্ষা করো। আমি নিয়ে আসছি!”
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। আমি ওর চোখে একবার চোখ রেখে ফিরে হাঁটতে লাগলাম দ্রুত।
“রিদম!”, হঠাত পিছন থেকে ডেকে উঠল মৃন্ময়ী!
আমি পিছনে ফিরলাম। ও এগিয়ে আসছে আমার দিকে। বলল, “এখানে একা দাঁড়িয়ে থাকতে কেমন কেমন লাগছে আমার!”
আশেপাশের ঘিঞ্জি গলিগুলোর দিকে ভয়েভয়ে তাকাল ও। বলল, “আমি তোমার সাথে যাই?”
আবার সেই আদুরে চাহনি! আমি বললাম, “সমস্যা নেই। চলো…আটতলা উঠতে হবে কিন্তু!”
মৃন্ময়ী দাঁড়িয়ে বলল, “আটতলা?”
তারপর আবার হাঁটতে আরম্ভ করে বলল, “আচ্ছা চলো, ব্যাপার না!”
আজো দারোয়ানটা ওর বিশ্রি দাঁত বের করে হাসলো। নির্ঘাত ভেবে নিচ্ছে, মৃন্ময়ীকেও আমি বিছানায় তোলার জন্য নিয়ে যাচ্ছি। শুয়োরের বাচ্চাটার কানে লাগিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে আমার।
মৃন্ময়ী পিছনে পিছনে আসতে শুরু করল। পাঁচতলা এসে বলল, “আর কত উপরে, রিদম? এত উপরে লিফটা ছাড়া যাওয়া যায়?”
আমি বললাম, “একটু রেস্ট নেবে? আর তিনটা তলা শুধু!”
মৃন্ময়ী বলল, “না না। চলো। তোমার রুমে গিয়েই বসবো একবারে!”
কী অবস্থায় আছে রুমটা? সেদিন জান্নাত কিছু ফেলে যায়নি তো? ব্রা টাইপের কিছু? সিগারেটের মোতা দিয়ে ভর্তি হয়ে আছে মেঝেটা, যেখানে সেখানে ঝুল। মৃন্ময়ী গিয়ে সেই আবর্জনায় দাঁড়াবে কোথায়?
রুমের সামনে চলে এলাম! তালাটা খুলে তাড়াতাড়ি ঢুকে ঘরটাকে পরিপাটি করতে শুরু করলাম আমি। তোষকের উপর আন্ডারওয়ার পরে ছিল, সরিয়ে দিলাম। নাহ, খুব খারাপ অবস্থায় নেই! মৃন্ময়ী চাইলে বসতেও পারে।
আমি আমার পড়ার চেয়ারটা এগিয়ে দিলাম মৃন্ময়ীর দিকে। আমার হন্তদন্ত্য ভাব দেখে মৃন্ময়ী হেসে বলল, “আরে, চাপ নিতে হবে না। ব্যাচেলরদের রুম কেমন হয় আমি জানি! আমিও সিঙ্গেল রুমে থাকি। কেউ ঢুকলে বলবে, “কোন জংলী এখানে থাকে!”
ওর কথা বলার ধরণে হেসে উঠলাম আমি। বললাম, “তুমি কিন্তু খুব এডভেঞ্চারাস!”
মৃন্ময়ী বলল, “কেন?”
বললাম, “এই যে, হুট করে একটা বইয়ের জন্যে আমার রুমে চলে এলে। আমি কিন্তু খারাপ লোকও হতে পারতাম। কিংবা সিরিয়াল কিলার!”
মৃন্ময়ী বলল, “সিরিয়াল কিলার? হা হা… ডেক্সটার দেখার পর, আমার আর সিরিয়াল কিলারদের ভয় লাগে না। মনে হয়, সবাই ওর মতো খারপ মানুষদের মারে আর মোটামুটি রোম্যানটিক!”
বললাম, “তুমিই বোধহয় পৃথিবীর একমাত্র মানুষ, যে সিরিয়াল কিলারদের রোম্যান্টিসাইজ করেছে!”
মৃন্ময়ী জবাব না দিয়ে আমার বইয়ের ঢিবিটাকে দেখছে। আমি ব্যালকোনির দরজাটা আর ঘরের একটামাত্র জানালাটা খুলে দিলাম। ঘরের গুমোট ভাবটা দূর হয়ে, বাতাস এসে ঢুকল ঘরে। ব্যালকোনির দরজা আর জানালে খুলে দিলে আমার রুমে ফ্যানের দরকার হয় না।
মৃন্ময়ীর চুল উড়ছে বাতাসে। এই মুহূর্তটা চিরস্থায়ী করে রাখা যায় না? কেন আমি ছবি আঁকা শিখলাম না, ছোট বেলা থেকে।
আমি মুনীর চৌধুরীর অনুবাদ নাটকের খণ্ডটা দিলাম ওর হাতে। মৃন্ময়ী সূচীপত্রটা দেখে নিয়ে বলল, “এটা খুঁজছিলাম আমি। মুখরা রমণী বশীকরণ। শেক্সপিয়ারের নাটকের অনুবাদ!”
পড়িনি বলে নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে। কিনে না পড়ে ফেলে না রাখলে, আজ, ওর সাথে এই নিয়ে কথা বলতে পারতাম!
মৃন্ময়ী অন্যান্য বইগুলোও ঝুঁকে দেখছে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের শেষ্ঠ গল্পের বইটা হাতে নিয়ে বলল, “এটাও নেই? পড়ে দিয়ে দেব!”
বললাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ। যা ইচ্ছে নাও তুমি… পরে যখন পড়া হয়ে যায়, দিয়ে দিও!”
মৃন্ময়ী অবশ্য আর বই নিলো না। মৃন্ময়ী আমার মুখের দিকে বলল, “তুমি তবে থাকো। আমি যাই। আটটা বেজে গেলো!”
চলে যাবে ও? এই সময়ে আকাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টি হতে পারে না? ভেসে যেতে পারে না ঢাকার রাস্তাঘাট? মাঝেমাঝেই তো বৃষ্টি হচ্ছে, এখন কেন নয়, নয় কেন ঠিক এই মুহূর্তে!
আমি বললাম, “চলো। তোমাকে নিচ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি…”
মৃন্ময়ী বলল, “না না। দরকার নেই। তোমাকে আবার ৮ তলা উঠতে হবে!”
আমি জোর করেই নামতে শুরু করলাম ওর সাথে। মৃন্ময়ী বেশ জোরে নামছে। এখন নামার সময় যদি ওর পা’টা মচকে যায়? ব্যথায় যদি না পারে হাঁটতে? আরো কিছুক্ষণ থেকে যাবে না ও আমার সাথে, অন্তত বিশ্রাম নিতে? কী সব ভাবছি আমি!
বাসার নিচে আসতেই ও বলল, “থ্যাংকিউ, রিদম! বেকার তোমাকে কষ্ট দিলাম। তোমাকে আবার উপরেও উঠতে হবে!”
রিক্সা নিজেই ডেকে নিলো ও। যাওয়ার আগে, চোখের দিকে চোখ রেখে, বললাম, “দেখা হবে আবার!”
মৃন্ময়ী কিছু না বলে হাসল শুধু। কী দ্রুত চোখের পাতা পড়ে ওর। যেন হামিংবার্ড ডানা ঝাপ্টাচ্ছে!
মৃন্ময়ীর রিক্সাটা মোড়ের অন্যান্য চলন্ত রিক্সার সাথে মিশে গেলো।
ঘোর
ঘরে এসে মনে হচ্ছে, নিজেকে লাগছে তুলোর মতো হালকা! বিশ্বাসই করতে পারছি না, আমার এই ঘরে মৃন্ময়ী এসে শ্বাস ফেলে গেছে। বসেছে আমারই চেয়ারে আর এই ঘোলাটে আলোয় তাকিয়েছে বইয়ের দিকে।
রুপকথার মতো লাগছে সবকিছু। ওর আসা ও চলে যাওয়া, আমার সাথে কথা বলা, সব যেন কোন শিল্পি তুলি দিয়ে এঁকে রেখেছে। কতো তারিখ আজ? কী বার? ডাইরিতে, যদিও আমার ডাইরি নেই, কালই কিনে ফেলব, লিখে রাখা উচিত আজকের সবকিছু।
বিছানায় মাথাটা রাখতেই ফোনের রিংটোনটা বেজে উঠল। জান্নাত। এই পবিত্র মূহুর্তে জান্নাতের সাথে কথা বলতে হবে? আমি ফোনটা এয়ারপ্লেন মুডে রাখলাম। এখন, অন্তত আজ রাতে, শুধু মৃন্ময়ী সত্য। রুদ্রা ভাবি কিংবা জান্নাত, এমনকি নীলার কথাও ভাবতে চাই না আজ।
আজ রাতটা শুধু মৃন্ময়ীর…