[HIDE]
১১
সেদিন স্কুল থেকে একটু তাড়াহুড়া করেই ফিরছিলাম। উদ্দেশ্য একটাই, যদি সেই গেঁজো দাঁতের মেয়েটিকে আবারো দেখতে পাই। আমি মনে মনে অনেক পরিকল্পনাও করতে থাকলাম। মেয়েটিকে যদি দেখি, তাহলে কিভাবে কাছে ডাকলে মেয়েটিও আমার কাছাকাছি আসবে। মেয়েটিকে দেখলেই বলবো, তুমি খুব সুন্দর! নাহ, এমন বললে, মেয়েটি গর্বিত হয়ে আর কাছেই আসবে না। মেয়েটির সাথে ঝগড়ার সূত্রপাতই করতে হবে। ঝগড়া করতে চাইলেই সবাই ঝগড়া করার জন্যে কাছাকাছি আসে। কি নিয়ে ঝগড়া করবো? পরিচয়ই তো হলো না। তাহলে বলবো, এই মেয়ে, তোমার দাঁত গেঁজো কেনো?
আমি আনমনেই ভাবছিলাম। হঠাৎই মেয়েলী একটা কন্ঠ কানে এলো। খুবই শান্ত গলা, এই শোনো?
আমি পেছন ফিরে তাঁকালাম। দেখলাম, সেই মেয়েটি! যে সদ্য কোথা থেকে ট্রান্সফার হয়ে এসে আমাদের স্কুলে ক্লাশ নাইনে ভর্তি হয়েছে। সায়েন্সে পড়ে, তাই প্রতি ক্লাশেই দেখা হয়। মেয়েটির দাঁতও গেঁজো।
খুবই মায়াবী অপরূপ চেহারা। এ ধরনের মেয়েদের সামনে আমি খুব সহজে কথা বলতে পারি না। আমি ইতস্ততঃ করেই বললাম, আমাকে ডাকছো?
মেয়েটি বললো, কালকে রসায়ন ক্লাশটা দেখিয়ে দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ। তোমার ডাক নাম বুঝি খোকা? আমার ডাক নাম সাথী।
আমি আসলে জেলে পাড়ায় যাবার জন্যেই তাড়া করছিলাম। শুকনো গলাতেই বললাম, ও, সাথী? ধন্যবাদ এর কি দরকার? তুমি নুতন এসেছো, তাই অনেক কিছু না জানাই থাকার কথা। আসি হ্যা?
সাথী পোলটার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো, বাবা সরকারী অফিসার। প্রতি তিন বছর পর পর ট্রান্সফার হয়। এবার এখানে আসতে হলো। এই এলাকাটা খুবই সুন্দর! সমুদ্রের কাছাকাছি। জানো, কখনো সমুদ্র দেখিনি।
আমি বললাম, সমুদ্র দেখার কি আছে? শুধু পানি আর পানি। জেলেরা মাছ ধরে জীবীকা নির্বাহ করে।
সাথী বললো, তোমাকে যতটা রোমান্টিক ভেবেছিলাম, ততটা রোমান্টিক মনে হচ্ছে না। বোধ হয় অনেক দিন ধরে সমুদ্রের কাছাকাছি আছো। জানো, যারা কখনো সমুদ্র দেখেনি, তারা সমুদ্র দেখলে কি আনন্দটাই না পায়!
আমি বললাম, তাই নাকি? কি করে জানলে? বললে তো সমুদ্র কখনো দেখোনি।
সাথী আমার দিকে কিছুক্ষণ শান্ত চোখেই তাঁকিয়ে থাকলো। তারপর বললো, হুম দেখিনি। বান্ধবীদের মুখে শুনেছি। সেবার পিকনিকে সবাই এখানে এসেছিলো, আমি আসতে পারিনি। শেষ পর্য্যন্ত যে এভাবেই আসতে হবে ভাবতেও পারিনি।
আমি বললাম, প্রথম প্রথম সব কিছুই ভালো লাগে। পুরনো হয়ে গেলে নিরামিষ লাগে। আমি যাই।
সাথী বললো, এত যাই যাই করো কেনো? বললাম না, আমরা নুতন এসেছি। কাউকেই চিনিনা, কিছুই জানিনা। একই ক্লাশে পড়ি। বন্ধুই তো! একটু ঘুরে দেখাবে না জায়গাটা!
আমি বললাম, না মানে, একটু জরুরী কাজ আছে। অন্য কোন দিন ঘুরে দেখাবো।
সাথীও কেমন যেনো এক রোখা। বললো, ঘুরিয়ে দেখাতে চাইলে অন্য কোন দিনে আমারও আপত্তি নেই। কিন্তু, সুন্দর একটা বিকেল। বাসায় ফিরে গেলে খুব বোর লাগবে। কি কাজ তোমার?
খুব জরুরী?
আমার জরুরী কাজটা তো সেই জেলে পাড়ায় যাওয়া। সেই গেঁজো দাঁতের মেয়েটিকে যদি আরেক নজর দেখতে পারি। সেই কথা সাথীকে বলি কি করে? আমি বললাম, না, তেমন খুব জরুরী না। বন্ধুরা অপেক্ষা করে বসে থাকবে। একটু আড্ডা, এসব আর কি?
সাথী হাঁটতে থাকলো। হাঁটতে হাঁটতেই বললো, তোমার বুঝি অনেক বন্ধু?
মেয়েটা এত কথা প্যাচায় কেনো?
সাথী স্কুল ব্যাগটা কোলের উপর রেখে পাহাড়ী ঢালটার উপরই বসলো। হাত দুটি পেছনে চেপে, দেহটা পেছন হেলিয়ে বললো, জানো, আমার কোন বন্ধু নেই। আবার বলতে পারো অনেক বন্ধু। বাবার ট্রান্সফার এর চাকরী। আমাকেও স্কুল বদলাতে হয়। নুতন অনেক বন্ধু বান্ধব পাই। বছর তিন পর, সবাইকে ভুলেও যেতে হয়।
সাথীর কথা শুনে আমার খুব হিংসেই হলো। বললাম, তুমি আসলেই খুব ভাগ্যবতী। কত জায়গায় ঘুরে বেড়াতে পারো! আমি এই সমুদ্রের পার ছাড়া কিছুই চিনিনা, কিছুই জানিনা। একবার শুধু মামার বাড়ী গিয়েছিলাম। জীবনে প্রথম ট্রেনে চলেছিলাম। কি ভালো লেগেছিলো ট্রেনে চড়তে! আবারো খুব চড়তে ইচ্ছে করে।
সাথী বললো, ট্রেনে চড়ায় কোন আনন্দ আছে? কত যে চড়লাম, একদম নিরামিষ!
সাথী কি আমার কথাটাই ফিরিয়ে দিলো নাকি? আমি বললাম, নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ওপারেতে সর্ব সুখ আমার বিশ্বাস।
সাথী উঠে দাঁড়ালো। বললো, ঠিকই বলেছো, যা মানুষ অভ্যস্থ হয়ে যায়, তা আর ভালো লাগে না। তাহলে এই কথাই রইলো, তুমি আমাকে সমুদ্র দেখাতে নিয়ে যাবে।
এই বলে, বিদায় জানিয়ে সাথী তার নিজের পথেই এগুতে থাকলো। আর আমি এগুতে থাকলাম জেলে পাড়ার দিকে।
সাথী সত্যিই চমৎকার একটি মেয়ে। গায়ের রং খুবই ফর্সা। ভদ্র চেহারা, গাল দুটি চাপা, ঠোটগুলো চৌকু। দাঁতে গেঁজ আছে, হলকা।
আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকতে ছোট খালার চেহারাটাই। সেবার মামার বাড়ীতে প্রথম গিয়েছিলাম। ছোট খালাকে কখনোই দেখিনি। সেবারই প্রথম দেখেছিলাম। আমার ঠিক সময় বয়েসী। সাথীর গাল দুটি যদি আরো একটু ফুলা ফুলা হতো, তাহলে বোধ হয় ছোট খালার মতোই লাগতো। সাথীর গেঁজো দাঁত দুটি যদি আরো গভীরে থাকতো, তাহলে বোধ হয় ছোট খালার মতোই লাগতো। সাথীর নীচ ঠোটটা যদি আরো একটু ফুলা হতো, তাহলে বোধ হয় ছোট খালার মতোই লাগতো। সাথী যদি আরো একটু খাট হতো, তাহলে বোধ হয় ছোট খালার মতোই লাগতো। সাথীর স্বাস্থ্যটা যদি আরো একটু মোটা থাকতো, তাহলে বোধ হয় ছোট খালার মতোই লাগতো!
এসব আমি কি ভাবছি? আমি এই জীবনে সবচেয়ে বেশী কাকে ভালোবেসেছি? ছোট খালাকে? কেনো? বার বার শুধু ছোট খালার চেহারাটাই চোখের সামনে ভেসে আসে কেনো?
জেলে পাড়ায় দেখা সেই মেয়েটি কি ছোট খালার চেয়েও সুন্দরী? অথবা সাথীর চাইতেও? গতকাল তো সাথীকেই প্রথম দেখে মনটা উদাস হয়ে গিয়েছিলো। সাথীকে দেখার পর থেকেই, সাথীর গেঁজো দাঁতের হাসি দেখার পর থেকেই ছোট খালার কথা বার বার মনে পরছিলো। অথচ, সেই সাথী খুব আগ্রহ করেই আমার সাথে কথা বলতে চাইলো, কিন্তু আমি পাত্তাই দিলাম না। শুধু মাত্র একটা জেলে পাড়ার মেয়ের মোহে। কি ছিলো মেয়েটার মাঝে? রোদে পুড়া তামাটে বর্ণের দেহ। গেঁজো দাঁত। তার চাইতে আমার ছোট খালা অনেক অনেক সুন্দরী! তার ঠোট দাঁত পাগল করার মতো। আমি বিড় বিড় করলাম, ছোট খালা, কেমন আছো? তোমাকে আমি ভুলতে পারিনা।
আমার চোখের সামনে ভেসে এলো ছোট খালার এক বিষন্ন চেহারা। ছোট খালা বলছে, খোকা, আর কদিন পরই মা হবো। ডাক্তার বলেছে একটি কন্যা সন্তান হবে। কি নাম রাখবো ভাবছি। নদী। কেনো যেনো মনে হয়, সেবার তোমার সাথে নদীর ধারে যেতেই খুব উদাস হয়ে গিয়েছিলাম। নদী সত্যিই মনকে খুব উদাস করে তুলে। আচ্ছা, নদীর সঠিক পরিচয় কি? নদীর মাও আমি, নদীর বাবাও আমি। ওসমান আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমার সাথে থাকবেই বা কেনো? মাত্র ক্লাশ নাইনে পড়ে। ওরও তো বাবা মা আছে, সুন্দর ভবিষ্যৎ আছে। পালিয়ে পালিয়ে আর কত দিন থাকা যায়। শেষ পর্য্যন্ত ওসমানদের বাড়ী গিয়েছিলাম। আমাদের ভালোবাসার কথা জানিয়েছিলাম, ওসমান এর মা বাবার কাছে। ওসমান এর মা আমাকে মেনে নিতে পারলো না। খুব গালাগাল করেছিলো। কুৎসিত গালাগাল। আমি ওসব তোমাকে বলতে পারবো না। ওসব গালাগাল আমার সহ্য হয়নি। তা ছাড়া ওসমান এরই বা কি দোষ? সে তো আমাকে শুধু ভালোবাসতো। আমার ভালোবাসা তো কখনো পায়নি। বাধ্য হয়ে বাড়ী ফিরে এসেছি।
ভেবেছিলাম, ভাইয়া ভাবী খুবই রাগ করবে। আশ্চর্য্য, কেউ রাগ করেনি। বরং ভাইয়া ভাবী অধিকার আদায় এর জন্যেই ওসমানদের বাড়ী গিয়েছিলো।
[/HIDE]
১১
সেদিন স্কুল থেকে একটু তাড়াহুড়া করেই ফিরছিলাম। উদ্দেশ্য একটাই, যদি সেই গেঁজো দাঁতের মেয়েটিকে আবারো দেখতে পাই। আমি মনে মনে অনেক পরিকল্পনাও করতে থাকলাম। মেয়েটিকে যদি দেখি, তাহলে কিভাবে কাছে ডাকলে মেয়েটিও আমার কাছাকাছি আসবে। মেয়েটিকে দেখলেই বলবো, তুমি খুব সুন্দর! নাহ, এমন বললে, মেয়েটি গর্বিত হয়ে আর কাছেই আসবে না। মেয়েটির সাথে ঝগড়ার সূত্রপাতই করতে হবে। ঝগড়া করতে চাইলেই সবাই ঝগড়া করার জন্যে কাছাকাছি আসে। কি নিয়ে ঝগড়া করবো? পরিচয়ই তো হলো না। তাহলে বলবো, এই মেয়ে, তোমার দাঁত গেঁজো কেনো?
আমি আনমনেই ভাবছিলাম। হঠাৎই মেয়েলী একটা কন্ঠ কানে এলো। খুবই শান্ত গলা, এই শোনো?
আমি পেছন ফিরে তাঁকালাম। দেখলাম, সেই মেয়েটি! যে সদ্য কোথা থেকে ট্রান্সফার হয়ে এসে আমাদের স্কুলে ক্লাশ নাইনে ভর্তি হয়েছে। সায়েন্সে পড়ে, তাই প্রতি ক্লাশেই দেখা হয়। মেয়েটির দাঁতও গেঁজো।
খুবই মায়াবী অপরূপ চেহারা। এ ধরনের মেয়েদের সামনে আমি খুব সহজে কথা বলতে পারি না। আমি ইতস্ততঃ করেই বললাম, আমাকে ডাকছো?
মেয়েটি বললো, কালকে রসায়ন ক্লাশটা দেখিয়ে দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ। তোমার ডাক নাম বুঝি খোকা? আমার ডাক নাম সাথী।
আমি আসলে জেলে পাড়ায় যাবার জন্যেই তাড়া করছিলাম। শুকনো গলাতেই বললাম, ও, সাথী? ধন্যবাদ এর কি দরকার? তুমি নুতন এসেছো, তাই অনেক কিছু না জানাই থাকার কথা। আসি হ্যা?
সাথী পোলটার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো, বাবা সরকারী অফিসার। প্রতি তিন বছর পর পর ট্রান্সফার হয়। এবার এখানে আসতে হলো। এই এলাকাটা খুবই সুন্দর! সমুদ্রের কাছাকাছি। জানো, কখনো সমুদ্র দেখিনি।
আমি বললাম, সমুদ্র দেখার কি আছে? শুধু পানি আর পানি। জেলেরা মাছ ধরে জীবীকা নির্বাহ করে।
সাথী বললো, তোমাকে যতটা রোমান্টিক ভেবেছিলাম, ততটা রোমান্টিক মনে হচ্ছে না। বোধ হয় অনেক দিন ধরে সমুদ্রের কাছাকাছি আছো। জানো, যারা কখনো সমুদ্র দেখেনি, তারা সমুদ্র দেখলে কি আনন্দটাই না পায়!
আমি বললাম, তাই নাকি? কি করে জানলে? বললে তো সমুদ্র কখনো দেখোনি।
সাথী আমার দিকে কিছুক্ষণ শান্ত চোখেই তাঁকিয়ে থাকলো। তারপর বললো, হুম দেখিনি। বান্ধবীদের মুখে শুনেছি। সেবার পিকনিকে সবাই এখানে এসেছিলো, আমি আসতে পারিনি। শেষ পর্য্যন্ত যে এভাবেই আসতে হবে ভাবতেও পারিনি।
আমি বললাম, প্রথম প্রথম সব কিছুই ভালো লাগে। পুরনো হয়ে গেলে নিরামিষ লাগে। আমি যাই।
সাথী বললো, এত যাই যাই করো কেনো? বললাম না, আমরা নুতন এসেছি। কাউকেই চিনিনা, কিছুই জানিনা। একই ক্লাশে পড়ি। বন্ধুই তো! একটু ঘুরে দেখাবে না জায়গাটা!
আমি বললাম, না মানে, একটু জরুরী কাজ আছে। অন্য কোন দিন ঘুরে দেখাবো।
সাথীও কেমন যেনো এক রোখা। বললো, ঘুরিয়ে দেখাতে চাইলে অন্য কোন দিনে আমারও আপত্তি নেই। কিন্তু, সুন্দর একটা বিকেল। বাসায় ফিরে গেলে খুব বোর লাগবে। কি কাজ তোমার?
খুব জরুরী?
আমার জরুরী কাজটা তো সেই জেলে পাড়ায় যাওয়া। সেই গেঁজো দাঁতের মেয়েটিকে যদি আরেক নজর দেখতে পারি। সেই কথা সাথীকে বলি কি করে? আমি বললাম, না, তেমন খুব জরুরী না। বন্ধুরা অপেক্ষা করে বসে থাকবে। একটু আড্ডা, এসব আর কি?
সাথী হাঁটতে থাকলো। হাঁটতে হাঁটতেই বললো, তোমার বুঝি অনেক বন্ধু?
মেয়েটা এত কথা প্যাচায় কেনো?
সাথী স্কুল ব্যাগটা কোলের উপর রেখে পাহাড়ী ঢালটার উপরই বসলো। হাত দুটি পেছনে চেপে, দেহটা পেছন হেলিয়ে বললো, জানো, আমার কোন বন্ধু নেই। আবার বলতে পারো অনেক বন্ধু। বাবার ট্রান্সফার এর চাকরী। আমাকেও স্কুল বদলাতে হয়। নুতন অনেক বন্ধু বান্ধব পাই। বছর তিন পর, সবাইকে ভুলেও যেতে হয়।
সাথীর কথা শুনে আমার খুব হিংসেই হলো। বললাম, তুমি আসলেই খুব ভাগ্যবতী। কত জায়গায় ঘুরে বেড়াতে পারো! আমি এই সমুদ্রের পার ছাড়া কিছুই চিনিনা, কিছুই জানিনা। একবার শুধু মামার বাড়ী গিয়েছিলাম। জীবনে প্রথম ট্রেনে চলেছিলাম। কি ভালো লেগেছিলো ট্রেনে চড়তে! আবারো খুব চড়তে ইচ্ছে করে।
সাথী বললো, ট্রেনে চড়ায় কোন আনন্দ আছে? কত যে চড়লাম, একদম নিরামিষ!
সাথী কি আমার কথাটাই ফিরিয়ে দিলো নাকি? আমি বললাম, নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ওপারেতে সর্ব সুখ আমার বিশ্বাস।
সাথী উঠে দাঁড়ালো। বললো, ঠিকই বলেছো, যা মানুষ অভ্যস্থ হয়ে যায়, তা আর ভালো লাগে না। তাহলে এই কথাই রইলো, তুমি আমাকে সমুদ্র দেখাতে নিয়ে যাবে।
এই বলে, বিদায় জানিয়ে সাথী তার নিজের পথেই এগুতে থাকলো। আর আমি এগুতে থাকলাম জেলে পাড়ার দিকে।
সাথী সত্যিই চমৎকার একটি মেয়ে। গায়ের রং খুবই ফর্সা। ভদ্র চেহারা, গাল দুটি চাপা, ঠোটগুলো চৌকু। দাঁতে গেঁজ আছে, হলকা।
আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকতে ছোট খালার চেহারাটাই। সেবার মামার বাড়ীতে প্রথম গিয়েছিলাম। ছোট খালাকে কখনোই দেখিনি। সেবারই প্রথম দেখেছিলাম। আমার ঠিক সময় বয়েসী। সাথীর গাল দুটি যদি আরো একটু ফুলা ফুলা হতো, তাহলে বোধ হয় ছোট খালার মতোই লাগতো। সাথীর গেঁজো দাঁত দুটি যদি আরো গভীরে থাকতো, তাহলে বোধ হয় ছোট খালার মতোই লাগতো। সাথীর নীচ ঠোটটা যদি আরো একটু ফুলা হতো, তাহলে বোধ হয় ছোট খালার মতোই লাগতো। সাথী যদি আরো একটু খাট হতো, তাহলে বোধ হয় ছোট খালার মতোই লাগতো। সাথীর স্বাস্থ্যটা যদি আরো একটু মোটা থাকতো, তাহলে বোধ হয় ছোট খালার মতোই লাগতো!
এসব আমি কি ভাবছি? আমি এই জীবনে সবচেয়ে বেশী কাকে ভালোবেসেছি? ছোট খালাকে? কেনো? বার বার শুধু ছোট খালার চেহারাটাই চোখের সামনে ভেসে আসে কেনো?
জেলে পাড়ায় দেখা সেই মেয়েটি কি ছোট খালার চেয়েও সুন্দরী? অথবা সাথীর চাইতেও? গতকাল তো সাথীকেই প্রথম দেখে মনটা উদাস হয়ে গিয়েছিলো। সাথীকে দেখার পর থেকেই, সাথীর গেঁজো দাঁতের হাসি দেখার পর থেকেই ছোট খালার কথা বার বার মনে পরছিলো। অথচ, সেই সাথী খুব আগ্রহ করেই আমার সাথে কথা বলতে চাইলো, কিন্তু আমি পাত্তাই দিলাম না। শুধু মাত্র একটা জেলে পাড়ার মেয়ের মোহে। কি ছিলো মেয়েটার মাঝে? রোদে পুড়া তামাটে বর্ণের দেহ। গেঁজো দাঁত। তার চাইতে আমার ছোট খালা অনেক অনেক সুন্দরী! তার ঠোট দাঁত পাগল করার মতো। আমি বিড় বিড় করলাম, ছোট খালা, কেমন আছো? তোমাকে আমি ভুলতে পারিনা।
আমার চোখের সামনে ভেসে এলো ছোট খালার এক বিষন্ন চেহারা। ছোট খালা বলছে, খোকা, আর কদিন পরই মা হবো। ডাক্তার বলেছে একটি কন্যা সন্তান হবে। কি নাম রাখবো ভাবছি। নদী। কেনো যেনো মনে হয়, সেবার তোমার সাথে নদীর ধারে যেতেই খুব উদাস হয়ে গিয়েছিলাম। নদী সত্যিই মনকে খুব উদাস করে তুলে। আচ্ছা, নদীর সঠিক পরিচয় কি? নদীর মাও আমি, নদীর বাবাও আমি। ওসমান আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমার সাথে থাকবেই বা কেনো? মাত্র ক্লাশ নাইনে পড়ে। ওরও তো বাবা মা আছে, সুন্দর ভবিষ্যৎ আছে। পালিয়ে পালিয়ে আর কত দিন থাকা যায়। শেষ পর্য্যন্ত ওসমানদের বাড়ী গিয়েছিলাম। আমাদের ভালোবাসার কথা জানিয়েছিলাম, ওসমান এর মা বাবার কাছে। ওসমান এর মা আমাকে মেনে নিতে পারলো না। খুব গালাগাল করেছিলো। কুৎসিত গালাগাল। আমি ওসব তোমাকে বলতে পারবো না। ওসব গালাগাল আমার সহ্য হয়নি। তা ছাড়া ওসমান এরই বা কি দোষ? সে তো আমাকে শুধু ভালোবাসতো। আমার ভালোবাসা তো কখনো পায়নি। বাধ্য হয়ে বাড়ী ফিরে এসেছি।
ভেবেছিলাম, ভাইয়া ভাবী খুবই রাগ করবে। আশ্চর্য্য, কেউ রাগ করেনি। বরং ভাইয়া ভাবী অধিকার আদায় এর জন্যেই ওসমানদের বাড়ী গিয়েছিলো।
[/HIDE]
Last edited: