।। বিশ ।।
মহিলাটি যেন আশাই করতে পারেনি যে এই উটকো লোকটির সাথে আবার কোন মহিলা এসেছে। সিরিজা কাছে এসে দাঁড়াতেই উনি বেশ অবাক হয়ে গেলেন। যেন ভাবখানা এমন এ আবার কে? সিথিঁতে সিদূঁর নেই, হাতে শাঁখা নোওয়াও নেই অথচ মেয়েটাকে দেখে তো এই লোকটার বউ মনে হচ্ছে। মেয়েটা বেশ মনোরমা, রেশমির চেয়ে কোন অংশে সুন্দরী কম নয়।
সিরিজা বেশ সুন্দর করে নিজের পরিচয় দিল, "মাসীমা আমি সিরিজা। ওনার স্ত্রী আর রেশমির বন্ধু। আপনি ভালো আছেন?"
এবার আরও অবাক হলেন মহিলাটি। অবাক গলায় বললেন, "তুমি রেশমির বন্ধু? কোনদিন শুনিনি তো তোমার নাম? ইনি বলছেন উনি নাকি রেশমির আত্মীয়, আর তুমি বলছো বন্ধু। কি ব্যাপার বলো তো? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।"
- "আসলে আপনি আমাদের আগে দেখেননি তো? তাই ঠিক ধরতে পারছেন না। রেশমি কোথায় আছে বলুন না? ঠিকানাটা দিন। আমরা ঠিক খুঁজে চলে যাবো।"
অবাক হয়ে যাচ্ছিলো রজত। সিরিজা কেমন স্মার্টলি উত্তর দিচ্ছে। যেন যে কোনো লোককে কথা দিয়েও বশ মানাতে পারে ও।
মহিলাটি বললেন, "আমি তো একটু আগেই ওনাকে বললাম, রেশমিকে ফোন করে ওনার নম্বর দিয়ে দেব। রেশমিই কথা বলে নেবে। আপনাদের অত টেনশন নিতে হবে না।"
সিরিজা এবার রজতকে আরও অবাক করে ভদ্রমহিলাকে একটা সাংঘাতিক আবদার করে বসলো। বললো, "তাহলে ওকে ফোনটা এখনই করুন, আমি কথা বলছি।"
টেনশনে রজতের গায়ের লোমগুলো সব খাড়া হয়ে যাচ্ছিলো। কি বলছে টা কি সিরিজা? ও রেশমির সাথে কথা বলবে? মাথা খারাপ হয়ে গেছে? সব গুবলেট হয়ে যাবে তাহলে। সিরিজাকে যেন ইশারায় মানা করতে গিয়েও পারলো না। এক্ষুনি যদি ফোনটা করে বসে মহিলা। তাহলে এতদূর রেশমির খোঁজে আসা সব জল হয়ে যাবে।
- "ঠিক আছে তুমি যখন রেশমিকে ফোনটা করতে বলছো। তখন ফোনটা তোমাদের সামনেই করি।"
ভদ্রমহিলা মোবাইল আনতে আবার ওপরে যাচ্ছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে সিরিজা রজতের হাত থেকে মোবাইলটা ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে বললো, "এইটা থেকেই করুন না? আবার কষ্ট করে উপরে যাবেন কেন?"
-- "তোমার ফোন থেকে ওকে লাইন মেলাবো বলছো? ওকি ধরবে?"
- "ঠিক ধরবে। আপনি কথা বলুন না।"
ভদ্রমহিলা রজতের মোবাইল হাতে নিয়ে কথা বলছে। নম্বরটা মোবাইলে উঠে যাচ্ছে। সিরিজা ইশারা করছে রজতকে, যেন কথা হয়ে গেলেই তুমি নম্বরটা সেভ করে রাখবে। ওদিকে রজত বুঝতে পারছে না সিরিজা রেশমির সাথে কি কথা বলবে? রেশমিকে কি পরিচয় দেবে নিজের? রজতের বউ? সব তো তাহলে মাঠে মারা যাবে।
- "কে রেশমি বলছো?"
-- "হ্যাঁ কে?"
- "আমি মাসীমা বলছি। তোমার পুরোনো বাড়ী থেকে। দোতলার মাসীমা।"
-- "ও মাসীমা? বলো। কেমন আছো?"
- "ভালো আছি, এই দেখ না তোমার খোঁজে দুজন এসেছেন। বলছেন তোমার আত্মীয়। একজন আবার তোমার বন্ধু। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। তাই তোমার সাথে কথা বলার জন্য ফোন মেলালাম।"
অপর প্রান্ত থেকে অবাক হয়ে রেশমি বলছে, "আত্মীয়? বন্ধু? মাসীমা আপনি কার কথা বলছেন?"
রজত পুরো টেনশনে কাঠ। কথা বেরোচ্ছে না মুখ দিয়ে। সিরিজা ঝট করে হাতটা বাড়িয়ে দিল, মোবাইলটা মহিলার হাত থেকে নেবার জন্য। বললো, "মাসীমা আমাকে দিন না? আমি কথা বলছি।"
এবার ফোনের এ প্রান্তে সিরিজা, আর অপর প্রান্তে রেশমি। রজত একটু দূরে সরে গেল যদি কিছু অঘটন ঘটে। মহিলাটি কৌতূহলের সাথে শোনার চেষ্টা করছেন, সিরিজা কি কথা বলে এবার রেশমির সাথে, সেটাই দেখার।
ফোনটা কানে নিয়ে সিরিজা বললো, "রেশমি, আমি সিরিজা বলছি।"
-- "সিরিজা? কে আপনি?"
- "বিয়ের আগে যাকে মনে ছিল এতদিন? বিয়ের পরেই তাকে ভুলে গেলে?"
-- "কার বিয়ে? আমি তো ঠিক মনে করতে পারছি না।"
- "এই হয়। কাছের বন্ধুকে সবাই এভাবেই ভুলে যায়। কতদিন দেখা হয়নি আমাদের। আমি তো সেই থেকে তোমার সঙ্গে দেখা হবে বলে ছটফট করছি।"
-- "আপনি কে বলছেন আমি এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। এই নামে আমার তো কোনো বন্ধু নেই।"
- "আগে বলো তোমার সাথে কোথায় দেখা হবে? তাহলেই প্রিয় বন্ধু কে তুমি মনে করতে পারবে।"
কিছুক্ষণ চুপ করে রেশমি বললো, "আপনি কে বলছেন সত্যি করে বলুন তো। আমি এখনও বলছি এই নামে আমার সত্যি কোনো বন্ধু নেই।"
- "ঠিক আছে রেশমি, তোমার কথাও আমি মেনে নিলাম, তোমার সাথে দেখা হলেই তো সব পরিষ্কার হয়ে যাবে, তখন তুমিই বলবে, আমি যা বলেছি তা ঠিক বলেছি কিনা? এখন বলো, তোমার সাথে কোথায় দেখা হবে?"
মাথামুন্ডু ভেবে না পেয়ে রেশমি কি জবাব দেবে বুঝতে পারছিল না। সিরিজাকে বললো, "ঠিক আছে, আপনারা যেখানে আমার খোঁজে এসেছেন, সেইখানেই আসুন। আমি দেখা করবো।"
- "কবে?"
-- "আগামী রবিবার।"
ফোনটা মহিলাটিকে একবার দেওয়ার আগে সিরিজা কায়দা করে বললো, "ঠিক আছে তুমি বরং মাসীমার সাথেও একবার কথা বলে নাও। ওনাকে বুঝিয়ে দাও, নয়তো উনি চিন্তা করবেন।"
ফোনটা মহিলাটির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, "নিন, আপনিও কথা বলে নিন। আসলে আমাকে অনেকদিন দেখেনি তো। তাই মনে করতে পারছে না।"
রেশমীর বাড়িওয়ালি কিছু না বুঝেই ফোনটা আবার ধরলো।
- "হ্যাঁ রেশমি। বলো। কথা হয়েছে?"
-- "হ্যাঁ হয়েছে। ঠিক বুঝতে পারছি না। হয়তো আমার কলেজের কোনো পুরোনো বন্ধু হবে। ঠিক আছে মাসীমা, তোমাকে আর একদিন একটু কষ্ট দেব। আমি বলেছি রবিবার তোমার ওখানেই ওকে আসতে। তুমি থাকবে তো?"
- "হ্যাঁ থাকবো। তুমি আসবে?"
-- "হ্যাঁ আসবো। তুমিও ওকে আসতে বলে দাও। সামনা সামনি দেখি, তাহলে হয়তো চিনতে পারবো।"
লাইনটা অপরপ্রান্ত থেকে ছেড়ে দিল রেশমি। সিরিজা মহিলাটিকে বললো, "কি মাসীমা এবার চিন্তা দূর হলো তো? বলেছিলাম না? দেখবেন, রবিবারই ও আমাকে দেখতে পেয়ে কেমন আনন্দ করবে।"
-- "এটাই ভালো হলো গো। নইলে আমি আবার দোষের ভাগীদার হয়ে যেতাম। সামনা সামনি কথা বলে তোমরা নিজেরাই পরিষ্কার হয়ে নাও।"
মোবাইলটা আবার হাতে ফেরত নিয়ে সিরিজা বললো, "এটাই তো ভালো হলো। আপনারও আর কিছু চিন্তা রইলো না। আমি রবিবার আসছি। রেশমিকে বলবেন, আমি বিকেল চারটেয় আসছি।"
অবাক হয়ে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে রজত। সিরিজা বললো, "ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়ে আছে যে। এবার চলো।"
রজত ট্যাক্সিতে উঠে হাঁ করে চেয়ে রইলো সিরিজার দিকে। যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না, একটা অসাধ্য সাধন করেছে সিরিজা। অবাক হয়ে ওকে বললো, "তোমার তারিফ না করে পারছি না সিরিজা। এমন কঠিন কাজটা তুমি করলে কি করে? রেশমিকে রাজী করিয়ে নিলে? আমি তো এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না।"
মুচকী মুচকী হাসছিল সিরিজা। রজতকে বললো, "সবই তো দেখলে। তোমার চোখের সামনেই করলাম। এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না?"
কৌশলে রেশমির মতন স্মার্ট মেয়েকেও কথাচ্ছলে রাজী করিয়ে নিয়েছে সিরিজা, এর থেকে খুশির সংবাদটা আর কি আছে? এক্ষুনি খবরটা দিবাকরকে দিতে হবে। শুনে ও খুশ হয়ে যাবে।
রজত সিরিজাকে বললো, "তুমি সত্যিই বু্দ্ধিমতী। এটা তোমার জন্যই সম্ভব হলো। একেবারে জাদু জানো তুমি।" মনে মনে একটা খটকা এখনও রয়েছে। ও তবু বললো, "কিন্তু সিরিজা?"
- "কি?"
মনে যেন একটা নয়, হাজারটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে রজতের মনে। সিরিজাকে বললো, "তোমার সাথে রবিবারই রেশমির সামনাসামনি দেখা হবে। তখন তুমি ওকে কি বলবে, সেটাই ভাবছি।"
- "সত্যি কথাটাই বলবো।"
রজত আরও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সিরিজার দিকে। সিরিজা বললো, "আমি কিন্তু ওকে বোকা বানাইনি। শুধু ওর সামনাসামনি হতে চেয়েছিলাম। আমার কাজ সফল। এবার সত্যি কথাটাই বলবো ওকে।"
ট্যাক্সিওয়ালা গাড়ী আবার পেছন দিকে ঘুরিয়ে ধর্মতলার দিকে যাওয়া শুরু করেছে, রজতের ওদিকে হুঁশ নেই। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সিরিজার দিকে। রেশমির সাথে দেখা হলে সিরিজা কি সত্যি কথাটা বলবে, সেটাই ভেবে পাচ্ছে না।
-- "রেশমিকে কি বলবে তুমি সিরিজা?"
- "ভয় হচ্ছে? মাটি করে দেব সব? দিবাকরদার জন্য এত চেষ্টা সব বৃথা হয়ে যাবে, তাই ভাবছো?"
কবীরের মুখে তখন উদ্বেগের ভাবটা স্পষ্ট। সিরিজাকে বেশ টেনশন নিয়েই বললো, "আমি যা ভাবছি, তুমি নিশ্চয়ই তাই ভাবছো না। তবে তুমি কি ভাবছো, আমার ভীষন জানতে ইচ্ছে করছে।"
সিরিজা গাড়ীর মধ্যেই রজতের একটা হাত নিজের বুকের ওপর নিলো। হাতটা বুকে চেপে ধরে রজতকে বললো, "তোমার জীবনে রেশমি আগে এসেছে না সিরিজা?"
রজত ওর মুখের দিকে তাকিয়ে চটপট উত্তর দিল, "রেশমি।"
- "আর যদি সিরিজা তোমার জীবনে আগে আসতো? তাহলে কি করতে?"
-- "তাহলে সিরিজাই থেকে যেত জীবনে। রেশমি আর কোনওদিন আসতো না জীবনে।"
- "আর যদি ধরে নাও, উল্টোটা হয়?"
-- "উল্টোটা মানে?"
- "মানে আগেরটা পরে, আর পরেরটা আগে।"
-- "কি বলতে চাইছো সিরিজা? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।"
- "ধরো আমি যদি রেশমিকে বলি, তোমার সাথে আমার অনেক আগে থেকেই সম্পর্ক ছিল, তোমার সাথে রেশমির দেখা হওয়ার অনেক আগে থেকেই। ওকি সেটা তখন মেনে নেবে না?"
-- "অবাস্তবকে বাস্তব করার চেষ্টা করছো সিরিজা। এ বড়ই কঠিন কাজ।"
রজতের হাতটা নিজের বুকের সাথে আরও নিবিড় ভাবে জড়িয়ে নিয়ে সিরিজা বললো, "তুমি তোমার বন্ধুর জন্য স্বার্থত্যাগ করেছো, এটা বললেও কি সে মেনে নেবে না?"
-- "কে, দিবাকর?"
- "তুমি তোমার বন্ধু দিবাকরদার জন্য স্বার্থত্যাগ করেছে। বলিদান দিয়েছ, ভালোবাসার। এটা বললেও কি রেশমির মন তাতে গলবে না? নাকি তোমারই ভালোবাসার দাম বোঝে সে। দিবাকরদার নয়?"
বাকরুদ্ধ হয়ে ট্যাক্সির মধ্যেই সিরিজাকে জড়িয়ে ধরলো রজত। এই মূহূর্তে নিজেকে যেন স্থির রাখতে পারছে না রজত, সিরিজাকে একটু আদর না করে।
- "এই কি করছো? ছাড়ো ছাড়ো। দেখেছো কি করছে? গাড়ীর মধ্যে এরকম কেউ করে?"
রজত শুনছে না সিরিজার কথা। অল্প একটু আদর করে ফেলেছে সিরিজার গালে। ঠোঁটটায় স্পর্শ করতে পারেনি ঠোঁট দিয়ে। একেবারে মুখের কাছে মুখটা রেখে রজত ওকে বললো, "আচ্ছা সিরিজা সত্যি করে বলো তো? আমার নিজের মনকে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে। তুমি কি সত্যি গ্রাম থেকে এসেছ? না অন্য কোথাও?"
হাসছিল সিরিজা। বললো, "গ্রামের মেয়েদের একদম বুদ্ধি হয় না, তাই না? শহুরে মেয়েরা অনেক চালাক হয়। আমি তো সরলই। সরল মনেই বলবো রেশমিকে। তারপর ও যদি মেনে নেয়।"
-- "ওফ দিবাকর ব্যাপারটা শুনলে দারুন খুশি হবে। দাঁড়াও, ওকে ফোনটা করি।"
ট্যাক্সিতে যেতে যেতে রজত লাইন মেলালো দিবাকরকে। ফোনের ও প্রান্তে তখন দিবাকর।
রজত খুশি চেপে রাখতে পারছে না। দিবাকরকে শুধু বললো, "আসছে আসছে সে আসছে। আর চিন্তা নেই।"
- "কে আসছে?"
-- "তোমার রেশমি। আবার কে?"
- "বলো কি? কোথায় পেলে রেশমিকে?"
-- "রেশমি ঐ বাড়ীতেই আসছে রবিবার, সিরিজার সাথে দেখা করতে।"
- "রেশমি সিরিজার সাথে দেখা করতে আসছে? কি করে করলে ব্যাপারটা?"
-- "আমি করিনি। যা করার সিরিজাই করেছে। ওই তো অসাধ্য সাধন করেছে।"
- "সিরিজা করেছে!"
দিবাকর আনন্দে কথা বলতে পারছে না। অবাক হয়ে গেছে ও।
-- "এই তো সিরিজা আমার পাশে আছে। কথা বলো।"
সিরিজার হাতে ফোনটা দিয়ে রজত একদৃষ্টে চেয়ে আছে ওর দিকে। দিবাকরের সাথে কথা বলছে সিরিজা। যেন খুশিতে ডগমগ হয়ে ফুটছে রজত। ওদিকে দিবাকরকে ফোনে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছে সিরিজা, "সবই ঠিকঠাক হয়ে যাবে। চিন্তার কিছু নেই। দেখবেন, আপনার রেশমি ঠিক আপনার কাছেই ফিরে আসবে। রেশমিকে রাজী করাবই আমি। এটা আমি কথা দিলাম আপনাকে।"
ফোনটা সিরিজার হাত থেকে ফেরত নিয়ে রজত দিবাকরকে বললো, "কি এবার খুশি তো? সিরিজা আর আমার জন্য বাড়ীতে এবার একটা পার্টি দিও। আর রেশমি যদি রাজী হয়ে যায়, তাহলে আমাদের বাইরে বেড়াতে যাবার ব্যাপারটা চারজনে একসাথেই হবে কি বলো? মজা হবে প্রচুর।"
কথা বলতে বলতেই হঠাৎই বৃষ্টি নেমেছে রাস্তায়। জানালার কাঁচ দিয়ে জলের ছিটে লাগছে সিরিজার শাড়ীতে। রজত বললো, "আমি তোমাকে পরে ফোন করছি দিবাকর। খুব জোরে বৃষ্টি নেমেছে এখন। আমরা দুজনে ট্যাক্সিতেই আছি।"
কলকাতার রাস্তায় ভর সন্ধেবেলা বৃষ্টি। এই বৃষ্টিতে সিরিজাকে নিয়ে একসাথে ভিজলে যেন কত ভালো হতো। ট্যাক্সির কাঁচটা ইচ্ছে করে তুলছিল না রজত। হঠাৎই বৃষ্টির ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিয়েছে সিরিজার বুক।
রজত মজা পাচ্ছে। সিরিজা বললো, "দাও না তুলে কাঁচটা। দেখ কেমন ভিজিয়ে দিল আমাকে।"
রজত বললো, "থাক না একটু। তুমিও ভেজো, আর সেই সাথে আমিও।"
ট্যাক্সিওয়ালা বললো, "স্যার কোথায় যাবে বলুন? বৃষ্টি তো খুব জোরে পড়ছে, ধর্মতলায় তো আবার চলে এলুম। এবার?"
রজতের কারুর কথাই কানে যাচ্ছে না। হঠাৎই ট্যাক্সির মধ্যে সিরিজার ঠোঁট দুটোকে আঁকড়ে ধরেছে ঠোঁট দিয়ে। বৃষ্টির ছাঁট তোয়াক্কা না করে সিরিজার সাথে অনেকক্ষণ পরে রোমান্স, এই প্রথমবার ট্যাক্সিতে। রজতের জোরালো চুমুটা সিরিজার ঠোঁটের ওপর পুরো আছড়ে পড়ছিল। আচমকা সিরিজাও বুঝতে পারেনি। নিজেকে নিয়ে নড়াচাড়াও করতে পারছে না, বৃষ্টির ছাঁটকে উপেক্ষা করে রজত আরও গভীর ভাবে আঁকড়ে ধরেছে ওর ঠোঁট। ট্যাক্সিওয়ালাও যেন দেখেও দেখছে না। রজতেরও কোন ভ্রুক্ষেপ নেই ওদিকে। গাড়ীর মধ্যে সিরিজার ঠোঁটের সাথে ঠোঁট আবদ্ধ করে থাকাটা রজতের কাছে কোনো ব্যাপার নয়, শুধু আদর করার জন্য সিরিজার অনুমতিটা পেলেই হলো।
সিরিজা ওকে আটকানোর প্রবল চেষ্টা করছিল, কিন্তু রজতের মন প্রাণ তখন ছেয়ে ফেলেছে সিরিজার এই অসাধারণ কৃতিত্ব। যেভাবে রেশমিকে রাজী করিয়ে নিয়েছে ও, সেটা একপ্রকার কেরামতি ছাড়া আর কিছুই নয়।
চুমুটা ওকে ভালোমতন খেয়ে রজত বললো, "থ্যাঙ্ক ইউ। আজ থেকে আমি তোমার কেনা গোলাম হয়ে গেলাম। সত্যি মানতে হবে তোমার মধ্যে কিছু আছে। নইলে, আমি তো ভেবেছিলাম, গেল বোধহয় সব মাটি হয়ে।"
বৃষ্টিটা তুমুল জোরে পড়ছে। বৃষ্টির ছাঁট এসে সিরিজার পিঠ ভালোমতই ভিজিয়ে দিচ্ছে। রজত ওকে তখনও জড়িয়ে রেখেছে, শরীরের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে সিরিজা জানালার দিকে যেতেও পারছে না। কারন তখনও জল আসছে তেড়ে।
ট্যাক্সিওয়ালা এবার বললো, "আপনারা জানালার কাঁচটা তুলে দিন, নয়তো পুরো ভিজে যাবেন।"
রজত সিরিজাকে বললো, "সরি সরি। এই তো আমি এবার কাঁচ তুলে দিচ্ছি, তুমি রিল্যাক্স করে বসো।"
সিরিজা ওকে বললো, "পকেট থেকে তোমার রুমালটা বের করো দেখি। আমার পিঠটা মুছে দাও রুমাল দিয়ে, একদম ভিজে গেছে।"
রজত পকেট থেকে রুমালটা বের করার সময় সিরিজা হাসছিল।
রজত বললো, "কি হলো, হাসছো কেন?"
সিরিজা তবু হাসছিল, এবার বললো, "তোমার ঠোঁটের নিচে আমার লিপস্টিক লেগে গেছে। দাও ওটা আমি মুছে দিই।"
-- "থাক না, ভালোই তো।"
- "ধ্যাত, খালি চ্যাংড়ামো মারে শুধু।"
ট্যাক্সি বৃষ্টির মধ্যেই ধর্মতলা চলে এসেছ অনেকক্ষণ। ট্যাক্সিওয়ালা আবার কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই সিরিজা বললো, "কোথায় যাবে এখন?"
-- "এই বৃষ্টিতে তোমাকে নিয়ে আর কোথায় ঘুরবো? চলো বাড়ীই ফিরে যাই। বেশ তো ভালোই কাটছিল সময়টা। হঠাৎই প্রকৃতি দেবতার কি যে হলো? বৃষ্টিটা এসে সব ঝামেলা পাকিয়ে দিল, নইলে তোমাকে নিয়ে তো আরও কিছুক্ষণ ঘোরা যেত।"
রজতের মুখের দিকে তাকিয়ে সিরিজা বললো, "দিবাকরদার ওখানে একবার গেলে হতো না?"
-- "দিবাকর?"
- "হ্যাঁ, চলো না যাই।"
-- "কিন্তু সিরিজা, বৃষ্টি যেভাবে পড়ছে, মনে হচ্ছে আরও অনেকক্ষণ চলবে। তারপর যদি ওখানেই আটকা পড়ে যাই? আর ফিরতে না পারি?"
- "ভালোই তো, রাত্রে ওখানেই থেকে যাবো।"
রজত কি যেন ভাবছিল। সিরিজা আবার বললো, "তুমিই তো আমাকে ওখানে পাঠানোর প্ল্যান করেছিলে, দিবাকরদার সাথে রাত্রে থাকার জন্য, এখন তো তুমি থাকবে সাথে, অসুবিধা কি?"
-- "না অসুবিধা কিছু নয়। আসলে....."
কি যেন বলতে থেমে গেল রজত। সিরিজা বললো, "আসলে কি?"
রজত যেন বলতে গিয়েও বলতে পারলো না সিরিজাকে। ওর ইচ্ছায় সাড়া দিতে ইচ্ছে করছে না, মন সায় দিচ্ছে না। তবু যেন বলতে পারছে না সিরিজাকে। কাল থেকে রেশমিকে নিয়ে যা টানাপোড়েন চলছে, এবারে যেন একটু হাঁপিয়ে পড়েছে রজত। দিবাকরের উপস্থিতি যেন ওর অবাধ যৌন স্বাধীনতাকে বিপাকে ফেলে দিয়েছে।
রজতের গালে একটা হাত রেখে সিরিজা বললো, "কি ভাবছ?"
-- "কই কিছু না তো?"
- "তুমি না বললেও আমি সব বুঝতে পারি।"
-- "কি?"
- "অনেক জোরাজুরি করছি না তোমাকে?"
-- "কই না তো?"
- "রেশমিকে নিয়ে আমি একটু বেশিই মাথাব্যাথা করে ফেলেছি। তোমার আর ভালো লাগছে না?"
-- "না না, তা কেন হবে। রেশমির সমস্যা তো তুমিই সমাধান করে ফেলেছে। আমি শুধু দিবাকরের ঐ করুন মুখটা আর দেখতে চাই না। ওর ওখানে গেলেই তো আবার সেই রেশমিকে নিয়ে আলোচনা। তার থেকে বরং রেশমি ফিরে আসুক। দিবাকরের একাকীত্ব ঘুচুক, তাহলে আমরা সবাই স্বস্তি পাবো।"
সিরিজার মন রাখার জন্য রজত তবু বললো, "তুমি যখন যেতে চাইছো, চলো। তুমি বললে আমি কখনও না করবো না।"
ট্যাক্সিওয়ালাকে গাড়ীটা অন্যদিকে ঘোরাতে বলতে যাচ্ছিলো রজত। সিরিজা বাধা দিয়ে বললো, "না থাক, বাড়ীই ফিরে চলো।"
-- "তুমি রাগ করলে আমার ওপর?"
- "ওমা, রাগ কেন করবো?"
-- "আমি তো যেতে চাইছি, চলো না। আমি বরং দিবাকরকে আর একটা ফোন করে দিচ্ছি। ও শুনে খুশিই হবে।"
ফোনটা দিবাকরকে আবার করতে যাচ্ছিলো রজত। সিরিজা ওর হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বললো, "বলছি না যাবার দরকার নেই। বাড়ীই ফিরে চলো। তাছাড়া বৃষ্টিটা প্রচন্ড জোরে পড়ছে। আমরা ওখানে গেলে সত্যিই ফিরতে পারবো না আজকে।"
ট্যাক্সিওয়ালা বুঝতে পারছে না গাড়ী কোনদিকে নিয়ে যাবে। গাড়ীটা আবার দাঁড় করিয়ে দিয়েছে রাস্তার একপাশে। মুখ ঘুরিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে ওদের দুজনের দিকে। সিরিজা রজতকে বললো, "ওনাকে বলে দাও, বাড়ী কিভাবে যেতে হবে। উনি জানতে চাইছেন।"
রজত গাড়ীটা ঘোরাতে বললো, "নর্থ এর দিকে। চলুন উল্টোডাঙা হয়ে দমদম ক্যান্টনমেন্ট। ওখানেই আমার বাড়ী।"
গাড়ীতে বাকী রাস্তাটুকু যেতে যেতে, সিরিজা তখন রজতের বুকে মুখ রেখে চোখটা একটু আধবোজা করে ফেলেছে। ট্যাক্সি তখন ভি আই পি রোড ধরে সাঁ সাঁ করে ছুটছে। সিরিজার কানের কাছে মুখটা নিয়ে গিয়ে রজত বললো, "একটা কথা বলবো সিরিজা?"
- "কি?"
-- "আমার যেটা মন বলছে, যদি মিথ্যা না হয়, তাহলে তুমি অন্তত আমাকে সত্যি কথাটা বলবে কি? আমি কিন্তু কিছু লুকোয় নি তোমার কাছে?"
রজতের বুকেই মাথা রেখে সিরিজা বললো, "কি জানতে চাইছো বলো?"
-- "আমি যখন ঘরে ছিলাম না, দিবাকর কি কোনো দূর্বলতা দেখিয়েছিল তোমার প্রতি?"
তৃতীয় অধ্যায় সমাপ্ত