What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

সত্তা (3 Viewers)

তৃতীয় পর্বঃ অপূর্নতার গল্প

স্নিগ্ধা ক্লাসে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল। তখন শুভংকর স্যার ম্যাথ ক্লাস নিচ্ছিলেন, স্নিগ্ধার সেদিকে মনযোগ নেই। জানালার ওপাশে কৃষ্ণচুড়া গাছ টকটকে লাল ফুলে ছেয়ে গেছে, তার একটি ডালে দুটি শালিক পাখি বসে কিচির মিচির করছে। স্নিগ্ধার দৃষ্টিটা সে দিকে, কিন্তু মনটা সম্ভবত সেদিকেও নেই।
স্নিগ্ধাকে অমনোযোগী দেখে শুভংকর তাকে ডাকেন। কিন্তু স্নিগ্ধা কোন সাড়া দেয়না। পাশ থেকে শিল্পী ওর কাঁধে হাত রাখে। তখন স্নিগ্ধা ফিরে তাকায়, শুভংকর স্যার তাকে ডেকেছেন তা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লেগে যায় তার। স্নিগ্ধা তখন উঠে দাড়ায়।

"দাড়াতে হবেনা, বসো। অংকটা বুঝেছ? পারবে করতে", ব্লাকবোর্ডে করে দেয়া রিগোরাস উপপাদ্যের অংকটার দিকে নির্দেশ করে স্নিগ্ধাকে জিজ্ঞাসা করেন শুভংকর স্যার।
"জি স্যার।" আত্মবিশ্বাসের সাথে জবাব দেয় স্নিগ্ধা।
"স্নিগ্ধা, তুমি মেধাবী ছাত্রী, পরীক্ষায় সবসময় ভাল কর। ক্লাসেও তো মনোযোগী ছিল। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি তুমি ক্লাসে মনযোগী নও। কোন সমস্যা?"
"না স্যার, তেমন কিছু নয়।" স্নিগ্ধা বলে।
"পড়াশোনার প্রতি মনোযোগী হও। শেষ পর্বে এসে মনোযোগ হারিয়ে ফেলো না।" শুভংকর স্যার স্নিগ্ধার উদ্দেশ্যে বলেন। তারপর কন্ঠ আরেকটু উচ্চ করে বলেন "তোমাদের সবার উদ্দেশ্যে বলছি, বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, 'শেষ ভাল যার, সব ভাল তার'। তোমরা এই শেষ পর্বে তোমাদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবে। আজকে ক্লাস এই পর্যন্তই।"
প্রফেসর শুভংকর দাশগুপ্ত ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতেই সব ছাত্রছাত্রী বেরিয়ে আসে, স্নিগ্ধা ও শিল্পী একসাথে বের হয়।

"স্যার ঠিকই বলেছেন, তুই কেমন যেন বদলে গেছিস। শুধু কিছু দিন থেকে নয়, তোর বিয়ের পর থেকেই দেখছি সারাক্ষন কেমন যেন মনমরা হয়ে থাকিস।" ক্যামপাস দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শিল্পী বলে।
"কই নাতো।" স্নিগ্ধা বলে।
"একদম লুকাবি না। তোদের মধ্যে কোন ঝামেলা চলছে নাকি?" শিল্পী বলে।
"কই, কোন ঝামেলা নেই।" উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলে স্নিগ্ধা।
"তাহলে নিশ্চয়ই তোর বর তোকে সুখ দিতে পারেনা।" ফিস ফিস করে কৌতুকের সুরে বলে শিল্পী।
"একটা থাপ্পড় খাবি।" রাগত স্বরে বলে স্নিগ্ধা।
ততক্ষনে ক্যাম্পাসের গেটে চলে এসেছে ওরা।
"বাসায় গিয়ে কি করবি এখন? তারচেয়ে চল না মেসে গিয়ে আড্ডা দেই।" শিল্পী প্রস্তাব দেয়।
"আজ না, অন্য কোন দিন।"
"কেন? আজ কি তোর বর তাড়াতাড়ি ফিরবে?"
"সেই সম্ভাবনা খুব কম। ও খুব ব্যাস্ত, প্রতিদিনই ওর ফিরতে ফিরতে রাত দশটা এগারোটা বেজে যায়।"
"তাহলে এখন গিয়ে কি করবি?"
"তুই বুঝবিনা। তোর তো আর রান্নাবান্না করা লাগে না, মেসের বুয়া এসে রান্না করে দিয়ে যায়। আমার অনেক কাজ আছে। আমি এখন যাই।" বলে স্নিগ্ধা একটি রিক্সা নিয়ে নেয়। রিক্সা করে বাস স্টপেজে আসে সে। বাসের জন্য বেশী অপেক্ষা করতে হয় না স্নিগ্ধার, প্রায় সাথে সাথেই বাস পেয়ে যায়। বাসের একটি সিটে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে।
দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে গেল, এর মাঝে স্নিগ্ধার জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। হঠাত করে ওর আর সজলের বিয়ে হয়ে গেল। এরপর কবিরের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া। স্নিগ্ধার বাবা মা ও শাফাকাত আঙ্কেল অনেক খুঁজেছেন কবিরকে, যত বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন সবার কাছে খোঁজ নেয়া হয়েছে, পত্রিকায় নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিও দেয়া হয়েছে মাস খানেক ধরে। কিন্তু কোথাও কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি কবিরের। এরপর স্নিগ্ধার শাশুড়ি জাহেদা বেগমের মৃত্যু। অপারেশন থিয়েটারেই জাহেদা বেগমের মৃত্যু হয়, খুব ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশন ছিল, ডাক্তাররা তাকে বাঁচাতে পারেনি।

স্নিগ্ধা যখন তার বাসায় পৌঁছে তখন বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। স্নিগ্ধা ওর ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে দেখে সেখানে তিনটি মিসড কল। একটি সজলের আর দুটি ওর বাবার। স্নিগ্ধা ওর বাবাকে কল দেয়। একবার রিং হওয়ার পর রিসিভ হয়।
"হ্যালো মামনি, ভাল আছ?" জামান বলে।
"হ্যাঁ আব্বু, তোমরা কেমন আছ?" স্নিগ্ধা বলে।
"আমি তো ভালই আছি, কিন্তু তোমার আম্মুর প্রেশার একটু বেড়েছে।" জামান বলে।
"তাই? ডাক্তার দেখিয়েছ আব্বু?"
"আমি নিয়ে যেতে চাইলাম। কিন্তু তোমার আম্মু রাজি হলনা। অবশ্য সামান্য বেড়েছে, এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা কোরো না আম্মু।" একটু থেমে আবার প্রশ্ন করে জামান "জামাই ফিরেছে?"
"এখনো ফেরেনি। ও তো খুব ব্যাস্ত, প্রতিদিনই দেরি করে ফেরে।"
"জামাইয়ের ব্যাস্ততা একটু কমলে একদিন সময় করে চলে এসো জামাইকে সাথে নিয়ে। তোমাকে কতোদিন দেখি না মামনি।" জামান বলে।
"তোমার জামাইয়ের যা চাকরি, ও ছুটি পাবেনা। তার চেয়ে বরং তুমি আম্মুকে নিয়েই চলে এসো না।" স্নিগ্ধা বলে।
"আচ্ছা দেখি ছুটি পাই কিনা।"
"আম্মুকে দাওতো।" স্নিগ্ধা বলে।
জামান সেলফোনটা শিরিনের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
"হ্যালো আম্মু, কেমন আছ?" স্নিগ্ধা বলে।
"ভাল আছি মা, তুই কেমন আছিস?" শিরিন বলে।
"আমি ভাল আছি। কিন্তু শুনলাম তোমার শরীর খারাপ।" স্নিগ্ধা বলে।
"এখন ভাল আছি মা, চিন্তা করিস না।" একটু থেমে শিরিন আবার জিজ্ঞাসা করে "কবিরের কোন খোঁজ পেলি?" বলতে গিয়ে শিরিনের কন্ঠ কেঁপে ওঠে।
"না মা।" একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে স্নিগ্ধা।
"তুমি ওকে নিয়ে একদমই চিন্তা কোরোনা, ও যেখানে আছি নিশ্চয়ই ভাল আছে। ওকে নিয়ে টেনশন করে করেই তুমি অসুখ বাঁধিয়ে ফেলছ।" স্নিগ্ধা বলে।
"তুই যদি মা হতি তাহলে আমার অবস্থানটা বুঝতে পারতি। সন্তান যদি একপলক চোখের আড়াল হয় তাহলেই মায়ের আত্মা উড়ে যেতে চায়। সেখানে দুই দুটো বছর হল, ছেলেটা কোথায় আছে, কিভাবে আছে, বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে, কিছু জানিনা।" বলতে বলতে শিরিনের গলা ধরে আসে।
"তুমি আবার শুরু হলে?" ওর বাবার কন্ঠে শুনতে পায় স্নিগ্ধা।
"রাখি মা।" বলে ফোনটা কেটে দেয় শিরিন।
স্নিগ্ধা আরো মিনিট খানেক মোবাইলটা কানে ধরে রাখে। ওর চোখের কোনে অশ্রু চিকচিক করছে। বিগত দুটি বছর ধরে ও ভেতরে ভেতরে কেঁদে যাচ্ছে। ওর মনের কষ্ট প্রকাশ করার মতো কেউ নেই।

বাবা মার সাথে কথা বলার পর স্নিগ্ধা সজলকে ফোন করে। একবার রিং হওয়ার পর রিসিভ হয়।
"হ্যালো জান, কি করো?" সজল বলে।
"কিছু না। এখন রান্না করব। কি খাবে বল?" স্নিগ্ধা বলে।
"আজকে পাবদা মাছ চচ্চড়ি খেতে ইচ্ছা করছে।" সজল বলে।
"ফ্রিজে তো পাবদা মাছ নেই। তাহলে তুমি আসার সময় কিনে এনো।"
"আমার ফিরতে দেরি হবে। যা আছে তা দিয়েই কিছু একটা রেঁধে ফেল।"
"ঠিক আছে। বেশি দেরি কোরো না যেন।" স্নিগ্ধা বলে।
"ঠিক আছে জান। চেষ্টা করব তাড়াতাড়ি ফেরার।"
স্নিগ্ধা ফোন কেটে দিয়ে, রান্নাবান্না শুরু করে। এক ঘন্টার মধ্যে রান্নাবান্না শেষ করে স্নিগ্ধা, এরপর ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখতে থাকে।

সজল যখন ফেরে তখন রাত এগারোটা বাজে।
"ফ্রেস হয়ে এসো, আমি খাবার দিচ্ছি।" স্নিগ্ধা বলে।
সজল বেডরুমে গিয়ে কাপড় বদলায়, তারপর ওয়াসরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে আসে। ততোক্ষনে স্নিগ্ধা ডাইনিং টেবিলে খাবার বেড়েছে। দুজন একসাথে খেতে বসে।

"বুঝলে জান, পুরো কোম্পানিটাই চোর ছ্যাঁচর দিয়ে ভরে গেছে, যে যেমন করে পারে লুটেপুটে খাচ্ছে।" খেতে খেতে বলে সজল।
"কেন, কি হল আবার?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে।
"তুমি তো জানই, সেরিনা টাওয়ার প্রজেক্টের কাজ প্রায় শেষ, এখন শুধু ফিনিশিং চলছে। ঐ প্রজেক্টের জন্য কেনা তিন হাজার পঁয়ত্রিশ বস্তা সিমেন্ট বেঁচে গিয়েছে। আমি চেক করে দেখেছি সিমেন্টের কোয়ালিটি এখনো যথেষ্ট ভাল আছে। কিন্তু প্রজেক্ট ইনচার্জ পুরো সিমেন্টটাকেই ওয়েসটেজ দেখিয়ে একাই হাতিয়ে নিয়েছে। পুরো ষোল লক্ষ টাকার সিমেন্ট।"
"তুমি কর্তৃপক্ষকে বিষয়টা জানাও।" স্নিগ্ধা বলে।
"তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? এই প্রজেক্টের ইনচার্জ হলেন এজিএম স্যার নিজেই। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে ওনার সাথে ঝামেলায় জড়াবো?" সজল বলে।
"চুপ করে থেকেও তো তুমি ঝামেলায় জড়িয়ে যেতে পারো। ধর তুমি কিছু বললে না, কিন্তু তারপরও কর্তৃপক্ষ কোনভাবে জেনে গেল। তখন কি হবে ভেবে দেখেছ? ওনারা কিন্তু ভেবে নেবেন যে এই চুরির সাথে তুমিও জড়িত।"
"তুমি ঠিকই বলেছ জান। আমি জিনিসটা এভাবে তো ভেবে দেখিনি।" সজল বলে।
"তুমি বিষয়টা কর্তৃপক্ষকে জানাও, তবে এমন কাউকে জানাবে যিনি যথেষ্ট সৎ এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা রাখেন।" স্নিগ্ধা বলে। কিন্তু সজল শুনতে পেয়েছে বলে মনে হল না, গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছে সে।
স্নিগ্ধা ওর কাঁধে হাত রেখে সম্বিত ফেরায়।
"কি ভাবছো অতো?" স্নিগ্ধা বলে।
"কিছু না, জান।" বলে খাওয়ার দিকে মন দেয় সজল।
"তার চেয়ে বরং তুমি চাকরিটাই ছেড়ে দাও। তুমি তো চাইলে যেকোন মুহুর্তেই চাকরি যোগাড় করতে পারবে।" স্নিগ্ধা বলে।
"যেখানে যাব সেখানে যে এমন চোরবাটপার থাকবে না তার গ্যারান্টি কি? জীবনে উন্নতি করতে হলে একটি যায়গা ধরে রাখতে হবে।" সজল বলে।
ততক্ষনে ওদের খাওয়া হয়ে গেছে। এরপর ওরা শুতে যায়।
 
"চলনা কয়েকদিনের জন্য বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।" স্নিগ্ধা বলে।
"এখন ছুটি পাব না গো, সেরেনা টাওয়ার প্রজেক্টটা শেষ হলে ছুটি পেতে পারি।" সজল বলে।
"কবে শেষ হবে?" স্নিগ্ধা বলে।
"এই মাসের মধ্যেই হয়ে যাবে। দুই তারিখে শুভ উদ্বোধন।" বলে স্নিগ্ধাকে পেছন থেকে জড়িয়ে নিয়ে ওর গলায় ঠোঁট ঘষতে থাকে সজল।
"ছাড়ো আমায়, দুষ্টুমি কোরোনা প্লিজ, অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়। সকালে অফিস যেতে হবেনা? " স্নিগ্ধা বলে।
"অন্তত একবার না করলে আমার ঘুমই আসবে না।"

স্নিগ্ধার ঘুম ভাঙে খুব ভোরে, এলার্মের শব্দে। ছটার এলার্ম দিয়ে রেখেছে মোবাইলে। স্নিগ্ধা প্রথমে এলার্মটা অফ করে, তারপর নগ্ন দেহে বিছানা থেকে নেমে আসে। আলনা থেকে সালোয়ার কামিজ নিয়ে বাথরুমে যায় সে। চটপট স্নান সেরে রান্না করতে লেগে যায় স্নিগ্ধা, স্বামীকে টিফিন দিতে হবে। চুলোয় রান্না চড়িয়ে দিয়ে স্নিগ্ধা বেডরুমে যায়, সজল তখনও চাদর মুড়ে নিয়ে উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে।
"ওঠো ওঠো, অফিসে যাবে না?" গায়ে হাত দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করে বলে স্নিগ্ধা।
"আর একটু ঘুমাতে দাওনা।" ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে অন্য পাশ হয় সজল। স্নিগ্ধা তখন হাত ধরে টেনে তোলে সজলকে।
"সকাল সাতটা বাজে, উঠে গোসল করতে যাও।" শাসনের ভঙ্গিতে বলে স্নিগ্ধা।
সজল উঠে বাথরুমে যায়, স্নিগ্ধা আবারও রান্নায় মনযোগ দেয়।
সকালের নাস্তা সেরে সজল যখন অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয় তখন সকাল সাড়ে আটটা বাজে।
আজকে স্নিগ্ধার ক্লাস নেই। যেদিন ক্লাস থাকেনা সেদিন ওর সময় কাটতে চায়না। স্নিগ্ধা টিভি দেখতে বসে যায়। কিছুক্ষন এ চ্যানেল ও চ্যানেল পাল্টিয়ে পাল্টিয়ে তারপর অফ করে দেয়। ঠিক তখনই ওর মোবাইলের রিংটোন বেজে ওঠে। স্নিগ্ধা ফোনটি হাতে নিয়ে দেখে অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। কবিরের হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে অচেনা নাম্বার থেকে কল এলেই ওর হৃদস্পন্দন কিছুটা বেড়ে যায়।
"হ্যালো, কে বলছেন?" ফোন রিসিভ করে বলে স্নিগ্ধা।
"আপনি কি স্নিগ্ধা?" মেয়ে কন্ঠে ভেসে আসে।
"জি। আপনি কে বলছেন?"
"আমার নাম শারমিন। আমাকে আপনি চিনবেন না হয়তো। আপনি শাহরিয়ার কবিরকে চেনেন?"
"হ্যাঁ অবশ্যই, কবির আমার বন্ধু। ওকে কি খুঁজে পাওয়া গেছে? ও ঠিক আছে তো?" স্নিগ্ধা নিজের কন্ঠে উত্তেজনাকে লুকানোর চেষ্টা করেনা।
"আপনাকে নিরাশ করতে আমার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমি ওর খোঁজ সেভাবে জানিনা। কবির আর আমার স্বামী একই মেসে থাকত। সেই সুত্রে ওর সাথে পরিচয়।"
"ও, আপনি কি সোহরাব ভাইয়ার স্ত্রী?"
"আপনি চিনতেন ওকে?"
"হ্যাঁ। উনি আমার বড় ভাইয়ের মতো ছিলেন, আপনি আমাকে তুমি করে বললেই খুশি হব।" স্নিগ্ধা বলে।
"ঠিক আছে। তোমার সাথে দেখা করতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু উপায় নেই," কথা শেষ না হতেই ফোনটা কেটে যায়। স্নিগ্ধা সাথে সাথে কলব্যাক করে।
"স্যরি, আমার ফোনে ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেছে।" শারমিন বলে।
"আমার ফোনে প্রচুর ব্যালেন্স, বলুন ভাবি।"
"পুরো বিষয়টা খুলে না বললে হয়তো তুমি বুঝবে না, যদি তুমি ব্যাস্ত হও তাহলে পরেই বলি।" শারমিন বলে।
"নিশ্চিন্তে বলুন, আমার এখন কোন কাজ নেই।"
"সোহরাবের মৃত্যুর পর পর অমি বাচ্চাদের নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসি। আমার তো শশুর, শাশুড়ি কেউ নেই। ভাসুর আর দেবরদের কাঁধে বোঝা হতে চাইনি। কিন্তু কয়েকমাস পরই বাবা ও ভাইরা আমাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে শুরু করল। আমি আবারও বিয়ে করতে চাইনি। একসময় এমন পরিস্থিতি দাঁড়াল যে আমি বাধ্য হয়ে বাড়ি ছেড়ে আবার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে উঠলাম। তখন আমার পরিস্থিতি খুব খারাপ। বাচ্চাদেরকে দুবেলা খেতে দিতেও পারছিলাম না, না পারতাম কারো কাছে চাইতে। কয়েকদিন পর আমার বিকাশ একাউন্টে কিছু টাকা এলো, ষোল হাজার টাকা। কে পাঠালো জানিনা। আমার মনে হয়েছে আমার ভাইদের কেউ টাকাটা পাঠিয়েছে। আমি অবশ্য বাবা ও ভাইদের ওপর অভিমান করে এসেছিলাম। তাদের সাথে কোন যোগাযোগ রাখিনি। কিন্তু আমার অভিমান এতোটাও গভীর ছিল না যে ঐ অবস্থায় টাকাগুলো নিবনা বা ফিরিয়ে দিব। এরপর থেকে প্রতি মাসেই দশ থেকে আঠারো তারিখের ভেতর টাকা আসতো। সেই টাকা দিয়েই বাচ্চাদের নিয়ে কোনভাবে বেঁচে ছিলাম। এক বছরের ভেতর নিজের চেষ্টায় একটি চাকরি যোগাড় করেছি। রাজবাড়ি জেলায় একটি স্কুলে পড়াই, পাশাপাশি টিউশনি করিয়ে বেশ ভালই চলে যায়। কিন্তু এখনো প্রতিমাসে সেই টাকাটা এসেই চলেছে। অনেক আগেই ভাইদেরকে জিজ্ঞাসা করেছি, ওরা সবাই অস্বীকার করেছে। আমার এক কলিগের স্বামী বিকাশের কাস্টমার কেয়ারে কাজ করে। এই মাসের বারো তারিখে টাকা পাওয়ার পর আমি ওনাকে দিয়ে খোঁজ করি যে টাকাটা পাঠাচ্ছে কে। উনি জানান যে টাকাটা এসেছে যশোর বেনাপোল বর্ডার এলাকার এক এজেন্ট নাম্বার থেকে। কিন্তু ঐ এলাকায় আমার কোন আত্মীয় থাকার কথা না। আমি আগের ট্রানজেকশনগুলোরও খোঁজ নিয়েছি। প্রথম দিককার নাম্বারগুলো সিলেট অঞ্চলের, তারপর কুড়িগ্রাম, রংপুর, পঞ্চগর অঞ্চলের, এরপর খুলনা, যশোর, বাগেরহাট অঞ্চলের নাম্বার। সবগুলোই এজেন্ট নাম্বার।" একটু বিরতি নেয় শারমিন তারপর আবার বলে "আমি শিওর না, কিন্তু আমার মনে হয় টাকাগুলো কবির পাঠাচ্ছে।"
"আপনি এতোদিন বলেন নি কেন?" স্নিগ্ধা বলে।
"আমি খুব লজ্জিত। আমি ভেবেছিলাম আমার ভাইদের কেউ পাঠাচ্ছে টাকাটা। আর তাছাড়া কবিরের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কথা শুনেছি মাত্র কয়েকমাস আগে।" শারমিন বলে।
"স্যরি ভাবি, ওভাবে বলা আমার উচিত হয়নি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি জানেন না ভাবি, এরকম একটি খবরের জন্য আম্মু কতোদিন ধরে অপেক্ষা করছে।" স্নিগ্ধা বলে।
"কবির আমার ছোট ভাইয়ের মতো। ওকে খুঁজে পেতে যদি কোনভাবে সাহায্য করতে পারি তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করব।" একটু থেমে আবার বলে, "শুনলাম তুমি নাকি বিয়ে করেছ।"
"জি।"
"তোমার স্বামীর নাম কি সজল হাসান?"
"আপনি ওকে চেনেন? " অবাক হওয়ার ভান করে বলে স্নিগ্ধা।
"ওনার বাড়ি তো আমার শশুর বাড়ির পাশে। তাছাড়া উনি একসময় আমাকে টিউশনি পড়াতেন। এখন তাহলে রাখি, পরে কথা হবে।"

স্নিগ্ধা তার ব্যালকনিতে বসে উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশে তখন লালচে ও গোলাপি রঙের মেঘের মেলা চলছে। কিছুদিন আগেও ওর জীবনটা ঐ রঙিন মেঘগুলোর মতোই ছিল, কিন্তু আজ যেন সবকিছু বর্নহীন। কবিরের সন্ধানের আভাস পেয়ে শিরিন ও জামান ছুটে গিয়েছিল যশোর বেনাপোল এলাকায়। যদিও জামান কিছুটা আপত্তি জানিয়েছিল, কিন্তু স্ত্রীর জিদের কাছে তা ধোপে টেঁকেনি। প্রায় দু' সপ্তাহ ধরে অনেক খোঁজাখোঁজির পর নিরাশ হয়ে ফিরে এসেছে তারা। স্নিগ্ধার এ কটা দিন কেটেছে খুব অস্থিরতার মাঝে। যদিও ও জানত যে ধরা দিতে চায় না, তাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু ওর মন বলতো যে কবিরকে এবার খুঁজে পাওয়া যাবেই।
স্নিগ্ধা ব্যালকনি ছেড়ে তার রুমে চলে আসে, রুমে এসে কলিংবেলের শব্দ শুনতে পায় । স্নিগ্ধা দরজা খুলে দেয়। সেখানে সজল দাড়িয়ে।
কখন থেকে দাড়িয়ে আছি, এতোক্ষন লাগে দরজা খুলতে?" রাগত স্বরে বলে সজল।
"স্যরি। ব্যালকনিতে বসে ছিলাম, কলিংবেল শুনতে পাইনি।" নরম স্বরে বলে স্নিগ্ধা।
"ঠিক আছে। তুমি দেখি এখনো রেডি হওনি। বলেছিলাম না রেডি হয়ে থাকতে, একসাথে শপিং করতে যাব?" ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে সজল বলে।
"আমি কোথাও যাব না। আমার খুব মাথা ব্যাথা করছে।" স্নিগ্ধা বলে।
"তা বললে হবে? কাল পার্টিতে কি পরে যাবে?" সজল বলে।
"আমি পার্টিতে যাবই না।" স্নিগ্ধা বলে।
"যাবে না মানে? অফিসের প্রত্যেক বিবাহিত স্টাফ তাদের স্ত্রী সঙ্গে নিয়ে আসবে। তাদের সামনে কি আমাকে অপমান করতে চাও?" ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে বলে সজল।
"কালকে পার্টিতে নাহয় গেলাম, কিন্তু আজ নয়। যা আছে তার ভেতরেই কিছু একটা পরে যাব।" স্নিগ্ধা বলে।
"তা বললে হয়? পার্টিতে পরে যাওয়ার মতো কোন পোশাকই তো নেই তোমার।" সজল বলে।
"আমার খুব মাথা ব্যাথা করছে, সম্ভবত মাইগ্রেন।" স্নিগ্ধা বলে।
"সেকি! ওষুধ খেয়েছ?" উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে সজল।
"ওষুধ খেয়ে নিয়েছি। তুমি বরং শপিংয়ে একাই যাও।" স্নিগ্ধা বলে।
"ঠিক আছে। কিন্তু আমার পছন্দ তো তোমার সাথে মেলে না। আমি যা আনব তা কি তুমি পরবে?" সজল বলে।
"কেন পরব না? অবশ্যই পরব।" স্নিগ্ধা বলে।
"ঠিক আছে আমি যাচ্ছি। তুমি বিশ্রাম নাও, আজ আর রান্নাবান্না করতে যেও না, আমি আসার সময় খাবার নিয়ে আসব।" বলে সজল বের হয়ে যায়।
স্নিগ্ধা মিথ্যা বলেছে, তার মাথা ব্যাথা করছে না। তবে আজ ওর জন্য একটি বিশেষ দিন, এই সময়টা সে শপিংয়ে কাটাতে চায় না। আজ কবিরের জন্ম দিন। স্নিগ্ধা তার বেডরুমে গিয়ে আলমারী খুলে একটি এ্যালবাম বের করে নেয়। বিছানায় বসে ছবি দেখতে থাকে। কতো স্মৃতি কবিরকে নিয়ে, শৈশবের যতোটুকু মনে পড়ে ওর তাতেও আছে কবির। ওরা পুতুলের বিয়ে খেলতো, তার কিছু ছবি আছে তাতে। স্নিগ্ধার কৈশোর জুড়েও আছে ওর স্মৃতি। ওদের জন্মদিনে ওদের প্রিয় খেলা ছিল একে অন্যের মুখে কেকের ক্রীম মাখিয়ে দেয়া। ক্রীমে মাখামাখি অবস্থায় বেশ কিছু ছবি আছে এ্যালবামটিতে। সেগুলো দেখতে দেখতে ওর ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে, সাথে চোখে অশ্রু।

সজল যখন ফিরে আসে তখন রাত নটা বাজে। হাতে দুটি শপিং ব্যাগ। স্নিগ্ধা সেগুলো দেখতে চাইলে সজল মানা করে, আগে খাওয়াদাওয়া সেরে ফেলতে চায় সে। রাতের খাবার সেরে ব্যাগ খুলে দেখায় সজল। সজল নিজের জন্য একজোড়া জুতা, হাতঘড়ি আর টাই কিনেছে। স্নিগ্ধার জন্য শাড়ি, একজোড়া হিল, একজোড়া এয়ার রিং আর নেকলেস কিনেছে।
"এগুলো কি ইমিটেশন?" জুয়েলরি নির্দেশ করে বলে স্নিগ্ধা।
"নাহ, গোল্ড, ২২ ক্যারেট।" সজল বলে।
"এতো টাকা কোথায় পেলে?" চিন্তিত কন্ঠে বলে স্নিগ্ধা।
"আগে বলো তোমার পছন্দ হয়েছে কিনা।"
"পছন্দ তো হয়েছে, কিন্তু....."
"যাও তাহলে এগুলো পরে এসো।" স্নিগ্ধাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে সজল।
স্নিগ্ধা শাড়ি গহনা নিয়ে অন্য রুমে যায়। নেভী ব্লু অর্ধস্বচ্ছ শাড়ি, সাথে ম্যাচিং করে স্লীভলেস লোকাট ব্লাউজ। ব্লাউজ এতোটাই টাইট ও লোকাট যে অর্ধস্বচ্ছ শাড়ি ভেদ করে বুকের খাঁজ স্পষ্ট বোঝা যায়।
"তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? এটা কেমন শাড়ি কিনেছ? এই শাড়ি পরে আমি বাইরে বেরোব কিভাবে?" রাগত স্বরে বলে স্নিগ্ধা।
"কি সমস্যা, ডার্লিং?"
"কি সমস্যা, বুঝছ না। ঠিক আছে, এই শাড়ীও আমি পরব না, আর না তোমার অফিসের পার্টিতে আমি যাব।"
"রাগ করছো কেন? পার্টিতে মেয়েরা এরকম পোশাকেই যায়। এদিকে এসো।" বলে স্নিগ্ধাকে হাত ধরে টেনে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। পেছন থেকে হালকা করে জড়িয়ে নিয়ে বলে "দেখোতো, আমার বউকে কি কোন বলিউড সেলেব্রিটির চেয়ে কম লাগছে? আমার এতো সুন্দর বউ, তাকে কি ঘরের কোনে লুকিয়ে রেখে মন ভরে? আমি চাই তোমার রুপের আগুনে সবার বুক পু্ড়ে ছারখার হয়ে যাক।"
 
পরেরদিন সজল ও স্নিগ্ধা সন্ধ্যা সাতটার সময় তাদের এপার্টমেন্ট থেকে বের হয়। সজল আগেই একটি টেক্সিক্যাব ভাড়া নিয়ে রেখেছে। ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিতেই সজল তার পাশের জানালা খুলে দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে নেয়।
"তুমি আবার শুরু করলে?" স্নিগ্ধা বলে।
আগামী তিন চার ঘন্টা তো আর সিগারেট ধরাতে পারবনা, নো স্মোকিং জোন।" বলে সিগারেটে টান দিতে দিতে ওর পাশের অপ্সরীকে দেখতে থাকে সজল। ঠিক স্বর্গ থেকে নেমে আসা অপ্সরীর মতোই লাগছে স্নিগ্ধাকে। কিন্তু এমন সাজসজ্জায় বাইরে বের হতে স্নিগ্ধার কিছুটা অস্বস্তি লাগছে। ট্যাক্সি ড্রাইভারও বারবার লুকিং গ্লাসে ওকে দেখছে। সজল একবার ভাবল ড্রাইভারকে কিছু বলবে, পরের মুহুর্তে নিজেকে নিবৃত করল সে। এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তার এখন মাথা ঘামালে চলেনা।
আধা ঘন্টার মাঝে তারা গুলশান ২ চত্তরে পৌঁছে যায়। সেখানে তাদের কোম্পানির এযাবতকালের সবচেয়ে বড় প্রজেক্ট সেরেনা টাওয়ারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। তেতাল্লিশ তলা বিশাল আকারের বিল্ডিং যা পুরোটাই আলোকসজ্জায় সাজানো হয়েছে। একুশ তলায় সেমিনার হলে কনসার্ট আয়োজন করা হয়েছে। এতে বেশ কিছু নামিদামি শিল্পী ও ব্যান্ড অংশ নিবে। এরপর টুয়েন্টি ফিফথ ফ্লোরে পার্টি। অফিসের কর্মচারী, কর্মকর্তা ও মালিক কর্তৃপক্ষ আমন্ত্রিত এতে।
সজল ও স্নিগ্ধা যখন পৌঁছায় ততোক্ষনে কনসার্ট শুরু হয়ে গেছে। তিনঘন্টার কনসার্ট, কিন্তু স্নিগ্ধা এক ঘন্টা পরই বের হয়ে আসতে চায়। খুব ঝাঁঝালো গান স্নিগ্ধার পছন্দ নয়। বাধ্য হয়ে সজলও বের হয়ে আসে। পঁচিশ তলায় পার্টিপ্লেসে চলে আসে ওরা। সেখানে ওদের মতোই আরো বেশ কিছু কাপল এসেছে, তারা গল্প জুড়ে দিয়েছে। সজল স্নিগ্ধাকে ওর কিছু কলিগ ও তাদের স্ত্রীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। স্নিগ্ধা এ দেখে কিছুটা স্বস্তি পায় যে আরো অনেকেই ট্রান্সপারেন্ট শাড়ি ও স্লীভলেস ব্লাউজ পরে এসেছে। কিন্তু বাকি সবাইকে ছাপিয়ে দৃষ্টিসমুহ যে তার দিকেই বারবার উঁকি দিচ্ছে তা ও ভালভাবেই বুঝতে পারে। কনসার্ট শেষ হতে হতে পার্টিপ্লেসে লোকসমাগম বাড়তে থাকে। এর কিছুক্ষন পর কোম্পানির এমডি এবং চেয়ারপার্সনরা আসতে থাকে। কোমপানির এমডি কর্নেল চিরঞ্জিত অধিকারী একটি ছোট বক্তৃতা দেন কোম্পানির এই সাফল্যে সবাইকে ধন্যবাদ ও স্বাগতম জানিয়ে।
সজল বারের এক কোনায় বদরুল ভুইয়াকে দেখতে পায়। বদরুল ভুইয়া কোম্পানির এজিএম এবং এই প্রজেক্টের ইনচার্জ। তিনি একাই এসেছেন, তিন বছর আগে তার স্ত্রীর সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে, তার চরিত্র নিয়ে নানারকম দুর্নাম প্রচলিত আছে। তিনি হুইসকির গ্লাস নিয়ে বারের এক কোনায় বসে ছিলেন।
"আরে, সজল যে, এদিকে আসো।" সজলকে দেখে ডেকে নেয় বদরুল।
"ও আমার স্ত্রী স্নিগ্ধা, উনি বদরুল স্যার, এজিএম এবং প্রজেক্ট ইনচার্জ।" সজল পরিচয় করিয়ে দেয়।
"হাই, গর্জিয়াস।" স্নিগ্ধাকে উপর থেকে নিচ অব্দি একবার পর্যবেক্ষন করে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে।
স্নিগ্ধা কি করবে বুঝতে পারেনা, অনিশ্চিত ভাবে হাত বাড়িয়ে দেয়। বদরুল স্নিগ্ধার হাতটা ধরে ব্রিটিশ কায়দায় চুমু দেয় হাতে। হঠাত গায়ে তেলাপোকা উড়ে এসে পড়লে যেমনিভাবে শিউরে ওঠে মেয়েরা, তেমনি শিউরে ওঠে স্নিগ্ধা। কিন্তু তা প্রকাশ হতে না দিয়ে ঠোঁটে হাসি ধরে রাখে স্নিগ্ধা।
"কি খাবে বিউটিফুল লেডি, হুইস্কি নাকি ব্রান্ডি?" আড়চোখে ওর শরীরটা মাপতে মাপতে বলে বদরুল।
"না না ওসব কিছু খাইনা আমি।" স্নিগ্ধা বলে। বদরুলের নোংরা দৃষ্টির সামনে খুব অস্বস্তি লাগে স্নিগ্ধার, কোনভাবে সরে পড়তে পারলে বেঁচে যায়।
"তুমি নাও সজল। কি খাবে? হুইস্কি?" সজলকে উদ্দেশ্য করে বলে।
"না স্যার।" ভদ্রতামুলক আপত্তি করে সজল।
"আরে নাও তো।" বলে নিজ হাতে সজলের জন্য পেগ বানায় বদরুল।
সজল গ্লাসটি হাতে নিয়ে ছোট চুমুক দেয়।
"এই কি হচ্ছে এটা?" স্নিগ্ধা ফিসফিস করে বলে।
"তোমার জন্য জুস কিংবা কোল্ড ড্রিংক অর্ডার দিব?" সজল জিজ্ঞাসা করে।
"দরকার নেই। আগে জানলে তোমার সাথে আসতামই না।" বলে স্নিগ্ধা হন হন করে হেঁটে চলে যায়। কিন্তু সজল এবার ওর পিছু নেয়না বরং বদরুলের সাথে আলাপ চালিয়ে যায়।
তখন হলরুম ভর্তি মানুষের অধিকাংশের হাতেই মদের গ্লাস। শুধু পুরুষরা নয়, মহিলাদের অনেকেই ড্রিংক করছে। স্নিগ্ধা ব্যালকনির দিকে যায়। সেদিকটা কিছুটা নির্জন।

ব্যালকনির দিকটাকে যতটা নির্জন ভেবেছিল স্নিগ্ধা সেটা তার চেয়েও বেশি নির্জন। মাত্র একজন ব্যাক্তি ব্যালকনিতে পাতা চেয়ারে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। যদিও এই পরিস্থিতিও কিছুটা অস্বস্তিকর, কিন্তু এখন পার্টিপ্লেসে ফিরে যেতে চায়না। স্নিগ্ধা একবার পেছনে ফিরে তাকায়, সজলকে দেখতে পায় হাতে ড্রিংকের গ্লাস নিয়ে বদরুল সহ আরো কয়েকজনের সাথে আলাপ জুড়ে দিয়েছে। স্নিগ্ধার ভীষন রাগ হয় স্বামীর প্রতি। স্নিগ্ধা সেখানে একটি চেয়ারে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাইরে ঝলমলে শহর আর তার উপরে আকাশে একফালি চাঁদ ও কিছু তারা দেখতে ভালই লাগে স্নিগ্ধার।
"এক্সকিউজ মি ম্যাম, যদি আপনার আপত্তি না থাকে আপনার পাশে বসতে পারি?" ব্যালকনির অন্যপাশে বসে থাকা লোকটি স্নিগ্ধাকে উদ্দেশ্যে বলে। স্নিগ্ধা উপর থেকে নিচ অব্দি একবার দেখে নেয়। লম্বা চওড়া, শক্তসমর্থ পুরুষ, মুখে ভদ্রতামুলক হাসি, মাথার কাঁচাপাকা চুলগুলো শুধু বয়সের জানান দেয়।
"নিশ্চয়ই, বসুন।" স্নিগ্ধা বলে।
"আপনি নিশ্চয়ই মিস্টার সজল হাসানের ওয়াইফ?" লোকটি স্নিগ্ধার পাশের চেয়ারে বসে জিজ্ঞাসা করে।
"জি। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে।
"আমার নাম ইরফান আহমেদ।" লোকটি বলে।
"ও, স্যার আপনি! সজল আমাকে আপনার সম্পর্কে অনেক বলেছে।" স্নিগ্ধা বলে।
ইরফান আহমেদ কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার। নম্র, ভদ্র, সৎ এবং নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা হিসাবে তার যথেষ্ট খ্যাতি আছে।
"স্যার আপনি কি একা এসেছেন?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে।
"হ্যাঁ।" ইরফান বলে।
"আপনার স্ত্রী আসেননি?"
"দশ বছর আগে একটি কার এক্সিডেন্টে ও মারা গেছে।" ইরফান বলে।
"আমি খুব দুঃখিত।"
"ইট্স ওকে।"
কাছ দিয়ে এক ওয়েটার যাবার সময় ইরফান তাকে হাত নেড়ে এদিকে আসার জন্য ইশারা করে।
"কি খাবেন? জুস নাকি সফ্ট ড্রিংক?" স্নিগ্ধার উদ্দেশ্য বলে ইরফান বলে।
"সফ্ট ড্রিংক।" স্নিগ্ধা বলে।
ইরফান দুটি নন-এলকোহল বিয়ার অর্ডার দিয়ে দেয়।
"স্যার, আপনি কিন্তু আমাকে সেই কখন থেকে আপনি করে বলছেন। এটা কিন্তু ঠিক নয়, আমাকে তুমি করে বললেই খুশি হব।"
"তুমিও তো আমাকে স্যার স্যার করে বলছ। তাতে মনে হচ্ছে তুমি আমার অফিস স্টাফ। আমি আমার অফিস স্টাফদের সবসময় আপনি করেই বলি, হোক সে পিওন, ওয়ার্কার কিংবা ক্লিনার।" ইরফান বলে।
"তাহলে আপনাকে কি বলব?"
"তোমার বয়সী আমার এক ছেলে আছে, সে হিসাবে আঙ্কেল বলতেই পার। কিন্তু তোমার মতো গর্জিয়াস লেডির কাছে থেকে আঙ্কেল শুনতে আমার মোটেই ভাল লাগবে না, তারচেয়ে বরং স্যারই ঠিক আছে।" ইরফান বলে।
স্নিগ্ধা তাতে খিলখিল করে হেসে ওঠে। স্নিগ্ধা ঠিক মনে করতে পারবেনা কতোদিন পর ও এমন প্রান খুলে হেসেছে।
তখন ওয়েটার চলে আসে দুটি বিয়ারের মগ নিয়ে। ইরফান স্নিগ্ধার হাতে একটি মগ ধরিয়ে দেয় ও নিজে একটি মগ নেয়।
"ওয়াও! চকোলেট ফ্লেভার! আমার ফেভারিট।" বিয়ারে চুমুক দিয়ে বলে স্নিগ্ধা।
"আরো আছে বানানা ফ্লেভার, অরেঞ্জ ফ্লেভার। চাইলে টেস্ট করে দেখতে পারো।" ইরফান বলে।
"দরকার নেই। স্যার আপনি কি ড্রিংক করেন না? নাকি আমি আছি বলেই?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে।
"তুমিও একটা কারন, আরেকটি কারন হল আজ আমার ড্রাইভার আসেনি। ড্রিংক করে ড্রাইভিং করা উচিত হবেনা।" ইরফান বলে।
"তোমার হাজবেন্ড তোমাকে খুঁজছে সম্ভবত। চল ভেতরে যাই।" একটু থেমে আবার বলে ইরফান। ততোক্ষনে পার্টি হল অনেকটাই ফাঁকা হয়ে গেছে। দেয়াল ঘড়িতে দেখতে পায় রাত সাড়ে বারোটা বাজে।
স্নিগ্ধাকে দেখে সজল এগিয়ে আসে।
"কোথায় ছিলে এতোক্ষন।" সজল বলে।
"আমি যেখানেই থাকি তাতে তোমার কি? তুমি আমার একটা কথাও শোন?" নিচু স্বরে বলে স্নিগ্ধা।
সজল কিছু একটা বলতো কিন্তু তখন জেনারেল ম্যানেজার ইরফান আহমেদকে এগিয়ে আসতে দেখে চেপে যায় সজল।
"স্যার ও আমার স্ত্রী স্নিগ্ধা, আর উনি....."
"আপনার স্ত্রীর সাথে পরিচয় আগেই হয়ে গেছে। আপনারা তো এখন বাসায় ফিরবেন?" ইরফান বলে।
"জি স্যার।"
"এতো রাতে আপনারা ট্যাক্সি পাবেন না। যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে, আমি আপনাদের পৌঁছে দেই।"
"কিন্তু স্যার, আপনি অযথা কষ্ট করবেন।" সজল বলে।
"কোন কষ্ট নয়। আপনারা তো বনানিতে থাকেন। আমাকে তো ওদিক দিয়েই যেতে হবে।"
সজল আর আপত্তি করেনা।
ইরফান আহমেদ তার মারসিডিজ বেঞ্জ জিএলএ গাড়িটি সজলের এপার্টমেন্টের সামনে দাঁড় করায়।
স্নিগ্ধা ও সজল নেমে যায়।
"স্যার অসংখ্য ধন্যবাদ। যদি স্যার আরেকটি রিকুয়েস্ট রাখেন।"
"হ্যাঁ, বলুন।"
"যদি এক্ষুনি আমার বাসায় আসেন।"
"তা সম্ভব নয় আমাকে বাসায় ফিরতে হবে।"
"তাহলে স্যার যদি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করেন। আমি আপনাকে একটি জিনিস দেখাতে চাই, যাষ্ট পাঁচ মিনিট।" সজল বলে।
"ঠিক আছে।"
সজল দ্রুত তার ফ্ল্যাটে গিয়ে আলমারি থেকে একটি ফাইল বের করে আনে। তারপর সেটা ইরফানের হাতে তুলে দিয়ে বলে,
"স্যার এই ফাইলে সেরেনা টাওয়ার প্রজেক্টের যাবতীয় চুরির বিবরন প্রমান সহকারে আছে।"
"কি বলছেন আপনি!" চমকে উঠে বলে ইরফান।
"আপনি ফাইলটা খুলে দেখলেই বুঝতে পারবেন। কিন্তু দয়া করে কাউকে বলবেন না যে এটি আমি আপনাকে দিয়েছি।" সজল বলে।
"অবশ্যই, এবং আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।" বলে ইনজিন স্টার্ট দেয় ইরফান।
 
প্রায় আধাঘন্টা ধরে জ্যামে আটকে আছে সজল। তার মেজাজটা বেশ খারাপ। রাত সাড়ে আটটা বাজে, সাইট থেকে সবে ফিরছে সে, এখন অফিসে যেতে হবে তারপর ছুটি তার। নতুন কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ার তার অধীনে দিয়েছে কোম্পানি, তাদেরকে কাজ বুঝিয়ে দিতে দিতে মাথা ব্যাথা ধরে গেছে, স্নিগ্ধার হাতের কড়া এক কাপ চা না খেলে এই ব্যাথা ছাড়বে না। জ্যামটা ছেড়ে দিতেই সজল বাইক স্টার্ট দিয়ে ফার্মগেটের সিগনালটা পার হয়ে আসে। সাথে সাথে তার পকেটে ভাইব্রেশন সহ রিংটোন বেজে ওঠে। সজল বাইকটা সাইড করে ফোনটা রিসিভ করে।
"হ্যালো সজল, কোথায় তুমি?" বদরুলের কর্কশ কন্ঠ শুনতে পায়।
"স্যার, মতিঝিলের সাইট থেকে ফিরছি, এখন ফার্মগেটের পার হলাম।"
"জরুরি কথা আছে, এক্ষুনি দেখা করতে পারবে?"
"ওকে স্যার, আমি অফিসে আসছি।"
"অফিসে নয়। আমি ঠিকানা দিচ্ছি, চলে এসো।" বদরুল বলে।
সজল কলম ও পকেট ডায়েরি বের করে ঠিকানা লিখে নেয়।
বনশ্রীর একটি ঠিকানা। মনে মনে দুশ্চিন্তায় ভুগতে থাকে সজল, কিছুদিন আগে সেরেনা টাওয়ারের স্ক্যামের রিপোর্ট ও যাবতীয় প্রমান জেনারেল ম্যানেজারের হাতে তুলে দিয়েছে। সে কথা তার কানে যায়নি তো। দুশ্চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সজল বাইক চালানোর দিকে মন দেয়।
বনশ্রীতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সজলের আরো আধা ঘন্টা লেগে যায়। সজল বাইকটা থামিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে, স্নিগ্ধার তিনটি মিসডকল। সজল কল ব্যাক করে।
"স্নিগ্ধা, আমার বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হতে পারে।" সজল বলে।
"কেন?"
"একটি জরুরি মিটিং রয়েছে, রাখি।" বলে সজল ফোন কেটে দেয়।
তারপর সামনের ছয়তলা বাড়িটার দিকে যায় সজল। গেটের পাশে শ্বেতপাথরে খোদাই করে বাড়ির নাম ও মালিকের নাম লেখা। মালিকের নাম দেখে অবাক হয়ে যায় সজল। আগে জানত ঢাকা শহরে বদরুল ভুঁইয়ার দুইটি ফ্ল্যাট রয়েছে, ধানমন্ডিতে একটি, অন্যটি তেজগাঁ। কিন্তু বনশ্রীতে আস্ত ছয় তলা বাড়ি! আরো কত কি আছে কে জানে!
সজল দারোয়ানকে গিয়ে নিজের নাম ও কার কাছে এসেছে তা বলতেই গেট খুলে দেয় এবং বলে ফিফ্থ ফ্লোরে যেতে। সজল ফ্ল্যাটটির সামনে এসে কলিংবেল চাপতেই খুলে যায় দরজা। দরজার সামনে এক মহিলা দাঁড়িয়ে, সম্ভবত গৃহকর্মী।
"বদরুল স্যার আছেন?" সজল জিজ্ঞাসা করে।
মহিলাটি ভেতরে আসতে বলে, তারপর অন্যপাশে একটি রুম দেখিয়ে দেয়। সজল সেদিকে যায়। রুমে বদরুল সোফায় বসে আছে, বদরুল ওকে পাশে বসতে বলে।
"কি খবর? কেমন চলছে কাজকর্ম?"
"স্যার, ভালই। এইমাত্র পরিবাগের সাইট থেকে ফিরছি, সেখানে সুপারভাইজারদের আগামি দিনের কাজকর্ম বুঝিয়ে দিয়েছি।"
"গুড, আর বাসাবোর সাইটের কি খবর।"
"ওটার এখন পেইন্ট ও টাইলসের কাজ চলছে।" সজল বলে।
"ডিনার করেছ?"
"না স্যার।"
"আজকে আমার সাথে ডিনার করবে।" বদরুল বলে।
"না স্যার।"
সজলের আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে শামিমা নামের গৃহকর্মীকে ডেকে খাবার দিতে বলে বদরুল।
খাবার শেষে বদরুল আর সজল আবারও ড্রয়িংরুমে ফিরে আসে।
"কি খাবে বলো, হুইস্কি, ভোদকা নাকি ব্রান্ডি? আমার আবার ডিনারের পর দু এক পেগ গলায় না ঢাললে রাতে ঘুম আসে না।" টেবিলের উপর স্তরে স্তরে সাজানো মদের বোতল ও গ্লাস, সেখান থেকে হুইস্কির বোতল আর গ্লাস টেনে আনতে আনতে বলে বদরুল।
"না স্যার।" ভদ্রতামুলক আপত্তি জানায় সজল।
"আরে, লজ্জা কোরো না। হুইস্কি চলবে তো?" বদরুল বলে।
সজল আর আপত্তি করেনা।
"খবর শুনেছ?" বদরুল বলে।
"কি খবর, স্যার?"
"আমার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। সেরেনা টাওয়ার প্রজেক্টে অনিয়ম আর দুর্নিতির অভিযোগ উঠেছে আমার বিরুদ্ধে।" এক চুমুকে এক পেগ শেষ করে আবার হুইস্কি ঢালতে ঢালতে বলে বদরুল।
"কি বলছেন স্যার!" অবাক হওয়ার ভান করে বলে সজল।
"ইরফানটা শালা বিশাল জোচ্চোর! বললাম এক কোটি দেব। উল্টো আমাকে চোর বলে, বলে কিনা আমাকে জেলে পুরবে।" একটু থেমে আবার বলতে থাকে বদরুল।
"আমি ওর চেয়ে কমসে কম পাঁচ বছরের সিনিয়র। শ্যালা চেয়ারম্যানদের চামচামি করে আমার চেয়ে আগে চলে গেছে, আর এখন আমাকেই হুমকি দেয়। শালা বজ্জাত! আমাকে চেনেনি ও। আমি ওকে ছাড়ব না। শালাকে আমি খুন করব।" আরো এক পেগ গলায় ঢালার পর কন্ঠটা গম্ভীর করে বলে "তোমাকে যে কারনে ডেকেছি তা হল, আমার সিক্স সেন্স বলছে কেউ আমার সাথে বেইমানি করেছে, আমার ডিপার্টমেন্টেরই কেউ।"
"আরে না স্যার, তা হবে কেন?" সজল কন্ঠটা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে।
"কেউ বেইমানি না করলে ইরফানটা এতো সহজে বোঝার কথা না। কেউ আমার নামে কম্প্লেইন করেছে, শুধু কম্প্লেইনই করেনি অনেক গোপন ডকুমেন্ট হাতে তুলে দিয়েছে। তোমার কি মনে হয়, কে করতে পারে কাজটা?"
"আমি তো নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না, কিন্তু গোপাল হতে পারে। ও তো শালা জিএমের চামচা।" সজল বলে।
"জিএমের চামচা ঠিক আছে, কিন্তু জিএমের কাছে যেসব ডকুমেন্ট দেখেছি সেগুলো গোপালের হাতে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।" একটু থেমে বদরুল আবার বলে "সজল, তুমি আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক। আমার বিশ্বাস তুমি এমনটা করতে পারোনা। খোঁজ নাও, কে করেছে এটা। আমি বেইমানদের কখনো ক্ষমা করিনা।"
"জি স্যার, আমি দেখছি। আসি স্যার।" সজল বলে।
"আচ্ছা, এসো।"

এরপর একটি মাস কেটে যায়। এই একমাসে স্নিগ্ধা ও সজলের পারিবারিক জীবনে তেমন কোন পরিবর্তন না এলেও সজলের অফিসের চিত্র পুরো ১৮০ ডিগ্রী পরিবর্তন হয়ে যায়। বদরুলের সাথে সজলের সেই মিটিংয়ের তিনদিন পরই একটি দুর্ঘটনায় জেনারেল ম্যানেজার ইরফান আহমেদের মৃত্যু হয়। পরের দিন বোর্ড মিটিংয়ে দুর্নীতির তদন্তের রিপোর্ট পেশ করার কথা, তারই ডকুমেন্ট রেডি করতে করতে ইরফান সাহেবের অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। যখন তিনি অফিস থেকে বের হন তখন রাত একটা বাজে। উত্তরায় একটি স্পিডব্রেকারের কাছে একটি কার্গো ট্রাক তার গাড়িকে পেছন থেকে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে তার গাড়িটি দুমড়ে মুচড়ে যায়, হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই ইরফান সাহেবের মৃত্যু হয়। ঘাতক কার্গো ট্রাক আর তার ড্রাইভারকে পুলিশ আটক করে। পুলিশ অনেক তদন্তের পর ঘটনাটিকে এক্সিডেন্ট হিসাবে রিপোর্ট দিয়েছে। পুলিশের ধারনা স্পিডব্রেকারের অবস্থান বুঝতে না পারায় ট্রাকটি ইরফান সাহেবের গাড়িতে আঘাত করেছে। ইরফান সাহেবের মৃত্যুর সাথে সাথে সেরেনা টাওয়ার দুর্নীতির তদন্তের রিপোর্ট ফাইলগুলো গায়েব হয়ে যায়। শুধু তাই নয় একমাসের ভেতর জেনারেল ম্যানেজার পদে প্রমোশন পায় বদরুল ভুইয়া। এর পেছনে কোম্পানির চেয়ারম্যানদের একজন এবং পনেরো পার্সেন্ট শেয়ার হোল্ডার জিল্লুর রহমানের হাত আছে বলে অনেকে মনে করে। জিল্লুর রহমান বদরুল ভুঁইয়ার দুর সম্পর্কের আত্মীয়। জিল্লুর সাহেবের সাথে বদরুলের বেশ দহরম মহরম চলে, তেল মালিশের কোন সুযোগ মিস করেনা সে। সে যাই হোক বর্তমানে ফিরে আসা যাক।

রাত বারোটা বাজে অথচ সজল বাসায় ফেরেনি। স্নিগ্ধা উদ্বিগ্নভাবে সজলের মোবাইলে কল করেই যাচ্ছে। এতোক্ষন রিং হচ্ছিল, রিসিভ হচ্ছিল না, শেষবার নাম্বার বন্ধ পেল। স্নিগ্ধার চিন্তাটা আরো বেড়ে গেল। আবারও কল দেয় স্নিগ্ধা, আবারও বন্ধ। মিনিট খানেক পর স্নিগ্ধার মোবাইলে রিংটোন বেজে ওঠে, সাথে সাথে রিসিভ করে ও।
"হ্যালো গোপালদা, কোন খোঁজ পেলেন সজলের?" স্নিগ্ধা উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে।
"হ্যাঁ বৌদি, আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমি সজল ভাইকে নিয়ে ফিরছি।" গোপাল বলে।
"আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দিব!" একটু থেমে স্নিগ্ধা আবার বলে "ও কি আবারও মদ খেয়ে মাতলামো করছিল?"
"আর কিছুক্ষনের মধ্যে আমরা পৌঁছে যাব, আপনি টেনশন করবেন না।" প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলে গোপাল।
গোপাল সজলের একজন সহকর্মী। সজল ফিরতে দেরি করছিল আর ফোন ধরছিল না বলে স্নিগ্ধা গোপালকে কল করে। গোপাল সজলকে গুলশান ২ এর একটি বারে খুঁজে পায় মাতাল অবস্থায়। এটাই প্রথম নয়, এক সপ্তাহ আগেও একই ঘটনা ঘটেছিল।
গোপাল সজলকে নিয়ে একটি সিএনজিতে করে সজলের ফ্ল্যাটের সামনে আসে। সজলকে ধরাধরি করে ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেয়।
"গোপালদা, আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ জানাবো বুঝতে পারছি না। আপনি আমাদের জন্য এতো কষ্ট করলেন!" স্নিগ্ধা বলে।
"কি বলছেন বৌদি, এ তো আমার কর্তব্য।" বিনয়ের সাথে বলে গোপাল।
"ওকে নিয়ে যে কি করি! এক সপ্তাহ হল দেখছি ও সবসময় কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে থাকে, জিজ্ঞাসা করলে কিছু বলতো না। আমি নিশ্চিত অফিসে কোন সমস্যা হয়েছে। আপনি কিছু বলতে পারেন?"
"না বৌদি, আমাকে তো কিছু বলেনি। কিংবা অফিসে কারো সাথে কোন ঝামেলা চোখে পড়েনি।" গোপাল বলে।
"আমি আসি, বৌদি।" বলে গোপাল বের হয়ে যায়। স্নিগ্ধা দরজাটা বন্ধ করে তাদের বেডরুমে ফিরে আসে। সেখানে তার স্বামী বিছানায় উপর হয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। স্নিগ্ধা লাইট নিভিয়ে দিয়ে পাশের রুমে ঘুমাতে যায়।
 
পরেরদিন সকাল সাতটার সময় প্রতিদিনের মতো সজলকে জাগানোর চেষ্টা করে স্নিগ্ধা। কিন্তু আজ কিছুতেই জাগাতে পারেনা। প্রায় আধা ঘন্টা ধরে জাগানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দেয় স্নিগ্ধা। সজল যখন ঘুম থেকে ওঠে তখন এগারোটা বাজে। সজল ঘুম থেকে উঠে ব্রাশে টুথ পেস্ট ভরে নিয়ে ব্যালকনিতে বসে দাঁতব্রাস করতে থাকে।
"আজ অফিস নেই?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে।
সজল কোন জবাব দেয়না, একমনে দাঁতব্রাস করতে থাকে।
"কাল রাতে ড্রিংক করেছিলে?" আবারও জিজ্ঞাসা করে স্নিগ্ধা।
সজল এবারও কিছু বলে না। বেসিনে হাতমুখ ধোয় সে।
"আমি কিছু জিজ্ঞাসা করেছি। শুনতে পাচ্ছ না?" স্নিগ্ধা প্রায় চেঁচিয়ে বলে।
"সকাল সকাল কি শুরু করলে। সবই যখন জানোই তখন জিজ্ঞাসা করছো কেন?"
"তুমি রোজ রোজ মদ খেয়ে অজ্ঞান হয়ে থাকবে, আমি চিন্তায় পাগল হতে থাকব, আর গোপালদা তোমাকে খুঁজে টেনে ছেঁচড়ে নিয়ে আসবে। আর তোমাকে কিছুই বলা যাবেনা!" স্নিগ্ধা বলে।
"আমার ইচ্ছা হয়েছে, আমি মদ খেয়েছি। তোমারও যা ইচ্ছা হয় তাই বল, আমি শুনছি।" সজল বলে।
"তুমি তো আগে এমন ছিলে না। কি হয়েছে খুলে বলছো না কেন? যদি অফিসে কোন প্রবলেম হয় তো চাকরিটা ছেড়েই দাও। তুমি বুয়েট গ্রাজুয়েট, একমাসের ভেতরেই চাকরি যোগাড় করতে পারবে।"
"চাকরী ছেড়ে দিলেই যদি সব প্রবলেম সল্ভ হয়ে যেত তাহলে কবেই চাকরী ছেড়ে দিতাম।"
"প্রবলেমটা কি বলবে তো।" স্নিগ্ধা বলে।
"তোমার কাছে লুকিয়ে আর লাভ নেই। আমি ফেঁসে গেছি স্নিগ্ধা, আমি খুব খারাপভাবে ফেঁসে গেছি।" দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে সজল।
"কি হয়েছে?" উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে স্নিগ্ধা।
"তোমার তো মনে আছে কোম্পানির দুর্নীতির প্রমানপত্র সহ একটি ফাইল আমি ইরফান স্যারকে দিয়েছিলাম। আমি জানতাম যে হারামি বদরুল যদি জানতে পারে তবে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। আমার সে নিয়ে চিন্তা ছিলনা তেমন একটা, ভেবেছিলাম বড়জোর চাকরি হারাবো। সে আমি তুড়ি মেরে আরেকটা যোগাড় করতে পারি। কিন্তু হারামিটা যে এমন কিছু করতে পারে আমি ধারনাও করিনি।"
"কি করেছে সে?" আবারও উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে স্নিগ্ধা।
"বলছি শোনো। ইরফান স্যারের মৃত্যুর দুইদিন আগে বদরুল আমাকে তার চেম্বারে ডেকে নেয়। আমার হাতে একটি ব্রিফকেস ধরিয়ে দিয়ে বলে যে ওটাতে পঁচিশ লাখ টাকা আছে তা একটা ঠিকানায় পৌঁছাতে হবে। আমি কারন জিজ্ঞাসা করি। ও বলে যে পঞ্চাশ কোটি টাকার একটি প্রজেক্ট পাওয়ার জন্য ক্লায়েন্ট কোম্পানির জিএমকে টাকাটা দেয়া হচ্ছে। আমি জানতাম যে এইধরনের দুইনাম্বারি হরহামেশাই হয়ে থাকে, কিন্তু সেসব ডিল করে মার্কেটিং অফিসাররা। সেই প্রশ্ন করাতে আমাকে বলে যে সব মার্কেটিং অফিসাররা অন্যান্য ডিল নিয়ে ব্যাস্ত। তারপর আমি টাকাটা নিয়ে যাই। আমাকে বলা হয়েছিল ক্লায়েন্ট কোম্পানির জিএমের ড্রাইভার টাকাটা নিতে আসবে। একটি রেস্টুরেন্টের ঠিকানা। আমি টাকাটা দিয়ে আসি। কিন্তু আমি জানতাম না যে ওটা কোন প্রজেক্টের ডিল ছিলনা বরং জিএম স্যারের হত্যার ডীল আর ওইখানে লুকানো ক্যামেরা ছিল যাতে স্পষ্ট রেকর্ড হয়েছে যে আমি ঘাতক ট্রাক ড্রাইভারকে টাকাটা দিয়েছি।"
"কি বলছ তুমি!" অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলে স্নিগ্ধা।
"গত বুধবার আমাকে ডেকে নিয়ে রেকর্ডটা দেখিয়েছে। শুধু ভিডিও ক্লিপ নয়। দুর্নিতির রিপোর্টটা এমনভাবে সাজিয়েছে যে সব চুরি ও দুর্নীতির জন্য দায়ী আমি।" সজল বলে।
"ও পুলিশকে বলার আগেই তুমি সবকিছু খুলে বলে দাও পুলিশকে।" স্নিগ্ধা বলে।
"লাভ নেই তাতে। জানোয়ারটার হাতে এতো পোক্ত প্রমান যে তাতে লাভ নেই। আমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।" দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে সজল।
একটু থেমে আবার বলে "আগামীকাল পুলিশ আসবে আমাকে নিতে। তারপর থেকে আমার স্বাধীন জীবন শেষ। হয় ফাঁসি হবে নয়তো যাবজ্জীবন কারাদন্ড।"
"না এ আমি হতে দিবনা।" সজলকে জড়িয়ে ধরে বলে স্নিগ্ধা।
একটু থেমে আবার বলে "কিন্তু জানোয়ারটা তোমাকে এক সপ্তাহ সময় দিল কেন? ও কি তোমাকে ব্লাকমেইল করছে?"
সজল হ্যাঁ বোধকভাবে মাথা নাড়ে সজল।
"কি চায় ও?"
"তোমাকে চায়, চব্বিশ ঘন্টার জন্য।"
"কি বলছ তুমি!" ভীষনভাবে চমকে ওঠে স্নিগ্ধা, সাথে সাথে বদরুলের নোংরা দৃষ্টির কথা মনে পড়ে যায়।
তিন মিনিট নিরবতায় কেটে যায়।
"আচ্ছা, মনে কর আমি ওর শর্তে রাজি হলাম। কিন্তু কি নিশ্চয়তা আছে যে শয়তানটা তোমাকে ফাঁসিয়ে দেবে না?" শীতল কন্ঠে বলে স্নিগ্ধা।
"কোন নিশ্চয়তা নেই। শুয়রের বাচ্চাটা যা কিছু করতে পারে। আমি গত এক সপ্তাহ ধরে একটি রিভলবার খুঁজছিলাম, পাইনি। তবে একটা জিনিস পেয়েছি।" বলে নিজের ব্যাগের পকেট থেকে ছোট একটা শিশি বের করে বলে "এই দেখ, পটাশিয়াম সাইনাইড"।
"এই কি পাগলামো করো!" স্নিগ্ধা আঁতকে উঠে বলে।
"ভয় পেয়ো না। আত্মহত্যা করব না। দেখাচ্ছি।" বলে রান্নাঘরে যায় সবজি কাটার নিতে। তারপর বলে "এখনই অফিসে যাব, গিয়ে শুয়োরটার ভুঁড়ি এটা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেব। আমার হয়তো ফাঁসি হবে কিন্তু শুয়োরটাও বাঁচবে না।"
স্নিগ্ধা সজলের হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় জানালা দিয়ে।
"কি পাগলামো করছো!"
আরো এক মিনিট নিরবতায় কেটে যায়।
"শয়তানটার রাগ আছে তোমার প্রতি, সেই রাগ হয়তো আমার ওপর মেটাবে। ও হয়তো চাইবে না যে কেইস এক্সিডেন্ট কেস হিসাবে চাপা পড়ে গেছে তা পুনরায় জেগে উঠুক। তাতে ওর ফেঁসে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকবে।" শান্ত স্বরে বলে স্নিগ্ধা। ওর ফর্সা গালদুটি অশ্রুজলে ভিজে গেছে।

বিকেল চারটা বাজে, স্নিগ্ধা ও সজল বদরুলের বনশ্রীর বাড়িটির সামনে এসে দাড়িয়েছে। ওরা বদরুলের কথা মতো এখানে এসেছে।
"স্নিগ্ধা, প্লিজ, কথা শোন, এ আমি হতে দিতে পারিনা।" স্নিগ্ধার হাতটা টেনে ধরে সজল বলে।
"এ ছাড়া কোন উপায় নেই। তুমি চলে যাও সজল, তুমি থাকলে জানোয়ারটা তোমাকে অপমান করবে।" বলে সজলের কাছে থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।
লিফটে করে ফিফথ ফ্লোরে এসে স্নিগ্ধা কলিংবেল টেপে, এক মিনিট পর দরজা খুলে যায়। দরজার ওপাশে চওড়া হাসি নিয়ে দাড়িয়ে আছে বদরুল। সেই হাসির সামনে নিজেকে খুব অসহায় লাগে স্নিগ্ধার।
"এসো স্নিগ্ধা, তোমারই অপেক্ষায় আছি অনেক্ষন ধরে।" মুখে হাসি ধরে রেখে বলে বদরুল। স্নিগ্ধা ভেতরে আসে।
"সজল আসেনি? না এনে ভালই করেছ।" পেছনে উঁকি দিয়ে বলে বদরুল।
স্নিগ্ধাকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে বসতে বলে বদরুল। স্নিগ্ধা এগিয়ে যায় ড্রয়িংরুমের দিকে। দরজা লাগিয়ে দিতে দিতে পেছন থেকে স্নিগ্ধাকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে বদরুল। গোলাপি একটি কামিজ পরে এসেছে স্নিগ্ধা, মুখে মেকাপের বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। চুলগুলো ছেড়ে দেয়া, দীঘল কালো রেশমী চুল সারা পিঠ জুড়ে।
দরজা লাগিয়ে দিয়ে বদরুল স্নিগ্ধার পাশে এসে বসে।
"কি খাবে বলো? চা নাকি কফি?" বদরুল বলে।
"কিছু না।" স্নিগ্ধা যতোটা সম্ভব শান্ত স্বরে বলে।
"তুমি চাইলেও এনে দিতে পারতাম না। চাকরবাকর সবাইকে তো ছুটি দিয়ে দিয়েছি।" বলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বদরুল।
হাসি থামিয়ে আবার বলে "তবে ড্রিংকস বানাতে পারি। কি খাবে বল? হুইস্কি নাকি ব্র্যান্ডি?"
"আমি ওসব খাইনা।" স্নিগ্ধা বলে।
"আগে খাওনি, ভাল কথা, অন্তত ওয়াইন নাও। শরীরের জন্য খুব ভাল।"
স্নিগ্ধা মাথা নেড়ে আপত্তি জানায়।
"তাহলে তোমার পাশে বসে ড্রিংক করলে কোন আপত্তি নেই তো।" বদরুল বলে।
স্নিগ্ধা কোন জবাব দেয়না। বদরুল জবাবের অপেক্ষা না করে টেবিলের অন্যপাশ থেকে হুইস্কি আর সোডার বোতল টেনে নেয়। এমনিতে সে সাধারনত দিনের বেলা ড্রিংক করেনা। কিন্তু আজ আর দশটা দিনের মতো নয়। আজ তার অধীনস্থ কর্মচারীর সুন্দরী স্ত্রী তার পাশে বসে আছে, সে চায় তাকে মন ভরে ভোগ করতে। দু পেগ স্কচ পেটে না ঢাললে ঠিক মুড আসবে না।
"জানো স্নিগ্ধা, আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে তুমি। তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম সেদিনই তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। তোমাকে একটু কাছে পাবার জন্য কেমন যেন পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। শুধু আমি নয়, আমার যায়গায় যেকোন পুরুষ থাকলে তাই করতো যা আমি করেছি।" এক পেগ স্কচ পেটে চালান করে দিয়ে বলে বদরুল।
স্বামীকে বাঁচানোর জন্য যেকোন ধরনের নির্যাতন, লাঞ্ছনা সহ্য করার জন্য নিজের মনকে প্রস্তুত করছিল স্নিগ্ধা, কিন্তু বাবার বয়সী এক নোংরা পুরুষের মুখে এমন কিশোরসুলভ ফ্লার্ট শুনে স্নিগ্ধার গা ঘিন ঘিন করে উঠলো। এবার আর চুপ থাকতে পারল না সে।
"অধীনস্থ কর্মচারীকে ব্ল্যাকমেইল করে তার স্ত্রীকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্ষন করতে চাইছেন, আর মুখে মিষ্টি মিষ্টি বুলি! আপনার ঐ নোংরা মুখে প্রেমের মতো পবিত্র শব্দ মানায় না।" তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে স্নিগ্ধা।
"কি বলছ এসব? আমি ব্ল্যাকমেইল করেছি?" ভীষন অবাক হয়ে বলে বদরুল।
"আপনি সজলকে ফাঁসিয়ে দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করেন নি?" স্নিগ্ধা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে।
"সজল তোমাকে এ কথা বলেছে?" বলে পকেট থেকে মোবাইল বের করে সজলকে কল দেয়।
"সজল, কোথায় তুমি? এক্ষুনি আমার ফ্ল্যাটে চলে এসো।" বলে ফোন কেটে দেয় বদরুল।
সজলের পৌঁছাতে আরো আধা ঘন্টা লেগে যায়।
"সজল, কি বলেছ স্নিগ্ধাকে আমার নামে? আমাকে তুমি বি-গ্রেড সিনেমার ভিলেন বানিয়ে দিলে? আমি তোমাকে ব্ল্যাকমেইল করেছি?" রাগত স্বরে বলে বদরুল।
"আসলে স্যার, ও তো রাজি হতো না।" সজল আমতা আমতা করে বলে।
"ওকে সব সত্যি সত্যি বলে দাও, আমার সৌন্দর্যের প্রতি দুর্বলতা থাকতে পারে, কিন্তু আমি ধর্ষক হতে চাই না।" একটু থেমে বদরুল বলে "আমিই বলছি। সজল আর আমার মধ্যে একটি ডিল হয়েছে। আমি ওর প্রমোশনের ব্যবস্থা করে দেব, আর ও তার বিনিময়ে একটা দিনের জন্য। ডিলটা একেবারেই খারাপ নয়, মাত্র দুই তিন বছরের এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে কেউ এজিএম হতে পারে এমনটা কখনো দেখেছ?"
একটু থেমে আবার বলে "আমি কিছু ভুল বললাম, সজল?"
স্নিগ্ধা ওখানেই চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। ওর গাল বেয়ে অশ্রুধারা বয়ে যাচ্ছে।
"স্নিগ্ধা প্লিজ লেট মি এক্সপ্লেইন।" সজল অনুরোধের সুরে বলে।
"আমাকে কিচ্ছু বোঝাতে হবেনা তোমার। আমি সব বুঝে গেছি। তোমার মতো নিচ, নরকের কীটকে যে আমি ভালবেসেছিলাম, ভেবে নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে।" বলে স্নিগ্ধা হন হন করে হেঁটে যেতে চায়।
"প্লিজ, দাড়াও।" বলে সজল ওর হাত টেনে ধরে। স্নিগ্ধা অন্য হাত দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে চড় বসিয়ে দেয় সজলের গালে। তারপর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে "আমাকে ছোঁবেনা তুমি। তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আই ওয়ান্ট ডিভোর্স।" তারপর ফ্লাট থেকে বেরিয়ে যায়।
 
বদরুলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্নিগ্ধা একটি সিএনজি নিয়ে নেয়। প্রথমে ভেবেছিল ওদের বনানির ফ্ল্যাট ফিরে গিয়ে ওর জিনিস পত্র গুছিয়ে নিয়ে বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। কিন্তু ওখানে ফিরে যেতে স্নিগ্ধার মন টানলো না। স্নিগ্ধা মহাখালি বাস টার্মিনালে নেমে যায়। সেখান থেকে বগুড়ার একটি বাসের টিকিট কেটে উঠে পড়ে সে। স্নিগ্ধা জানালার পাশে একটি সিট নিয়ে নেয়। পনেরো মিনিট পর বাস ছেড়ে দেয়।
উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বাইরের দিকে। হয়তো আজকের দিনটি স্নিগ্ধা হয়তো জীবনে কখনো ভুলতে পারবে না। ঘন্টা খানেক আগেও সে তার স্বামীর বিপদে উদ্বিগ্ন ছিল, স্বামীকে বাঁচাতে নিজের আত্মসম্মানকে বিসর্জন দিতেও পিছপা হয়নি। আর এখন ভীষণ ঘৃণা হচ্ছে সজলের প্রতি, ওর আবেগ নিয়ে এমন নোংরা খেলা সে খেলতে পারলো? এরকম একটি লোভী, মিথ্যুক, দুশ্চরিত্র মানুষকে সে কখনো ভালোবাসতো ভাবতে নিজের প্রতিও ঘৃণা হচ্ছে। স্নিগ্ধার মনে আরেকটি প্রশ্নও জাগছে, ইরফান স্যারের মৃত্যুর পেছনে বদরুলের হাত থাকার যে গল্পটা সজল বলেছিল তার পুরোটাই কি বানানো? এমনিতে ইরফান স্যার আর সোহরাব ভাইয়ের মৃত্যুর সাদৃশ্য দেখে অবাক স্নিগ্ধা। সজল লোভী, দুশ্চরিত্র হতে পারে, কিন্তু তাই বলে খুনি! আর এমনিতে ইরফান স্যারের মৃত্যুতে সজলের কিই বা লাভ থাকতে পারে? সজল বদরুলের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমান সহ ফাইলটি দিয়েছিল স্নিগ্ধার সামনেই।
স্নিগ্ধা মাথা থেকে চিন্তাগুলো সরিয়ে ফেলে। ওসব নিয়ে ভেবে আর কাজ নেই। বিবাহবিচ্ছেদটা ভালোয় ভালোয় সেরে ফেলে সে পড়াশোনায় মন দিতে চায়। অনার্স ফোর্থ ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে সে, তবে ফলাফল প্রকাশ হয়নি। বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে তাকে।
স্নিগ্ধা তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে মোবাইলটি বের করে দেখে তাতে দশটি মিসকল সজলের। মোবাইলটি হাতে নিতেই আবারও কল আসে সজলের। স্নিগ্ধা কেটে দিয়ে ফোন সুইচ অফ করে দেয়। ভেবেছিল বাসায় ফোন করে জানিয়ে দেবে, তা আর হলনা।

সজল ভেবেছিল স্নিগ্ধা হয়তো বাসায় ফিরবে। কিন্তু বাসায় ফিরে সে স্নিগ্ধাকে পায়না, ফ্ল্যাটটি সাজানো গোছানো যেমনটা আগে ছিল। ব্যালকনিতে পাতা চেয়ারে বসে একটি সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে থাকে সজল। এমন কিছু যে ঘটতে পারে তা আগেই অনুমান করেছিল সজল, এর জন্য বি প্ল্যান আগেই ভেবে রেখেছিল সে। সেই বি প্ল্যান ফেইল হওয়ার কি কি সম্ভাবনা আছে, আর সেক্ষেত্রে কি করনীয় তা ভাবছে সজল। এমনিতে সজলের সকল প্ল্যানের পেছনে বি, সি, ডি পর্যন্ত প্ল্যান থাকে। সজলের প্ল্যান ছিল জেনারেল ম্যানেজার ইরফান আহমেদের কাছে বদরুলের কীর্তি ফাঁস করে দিয়ে বদরুলকে হটানো ও সততার পুরষ্কার হিসাবে নিজের প্রমোশনের পথ সুগম করা। কিন্তু ইরফান আহমেদ সজলের দেয়া ডকুমেন্টের ভরসায় না থেকে নিজে তদন্তে নেমে যায়। এতে স্ক্যামের সাথে যে সজল নিজেও জড়িত তা প্রকাশ পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তাই সজলকে বাধ্য হয়ে বি প্ল্যানের দিকে যেতে হয়। তা হল বদরুলের সাথে হাত মিলিয়ে ইরফানকে সরিয়ে দেয়া এবং বদরুলকে সাফল্যের সিঁড়ি হিসাবে ব্যাবহার করা। সজল জানতো যে মাতাল হয়ে বড় বড় বুলি ঝাড়তে পারলেও বদরুলের মতো ভীতু মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় তেমন কিছু করা, যা করার তাকেই করতে হবে। সজল নিজেই জিএমকে হত্যার প্ল্যান ও ডিল করে, তবে টাকাটা ছিল বদরুলের।
সিগারেটটা শেষ হতেই সজল তার মোবাইলটা বের করে ফোন করে লিটুকে। লিটু্কে দিয়েই কাজটা করাতে চায় সে।

স্নিগ্ধা যখন বাস থেকে নামে তখন রাত দশটা বাজে। বাস স্টপেজে কিছুক্ষন দাড়িয়ে থেকে একটি রিক্সা নিয়ে নেয়, বাসায় পৌঁছাতে ওর আরো বিশ মিনিট লেগে যায়। কলিংবেল টিপতে প্রায় সাথে সাথে দরজা খুলে যায়। দরজার ও পাশে শিরিন দাড়িয়ে, মেয়েকে দেখে তার যেন কিছুটা আশাভঙ্গই হল, মুখে হাসি টেনে এনে বলে "স্নিগ্ধা! তুই হঠাত কিছু না জানিয়ে একা এভাবে চলে এলি যে?"
স্নিগ্ধা ভেতরে ঢুকে বলে "পরে বলছি আগে কিছু খেতে দাও তো, খুব খিদে পেয়েছে।" স্নিগ্ধা বলে।
"সেকি, হাতমুখ ধুয়ে ডাইনিংরুমে গিয়ে বোস, আমি খাবার দিচ্ছি।" বলে শিরিন রান্নাঘরের দিকে যায়।
স্নিগ্ধা ওয়াসরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে ডাইনিং টেবিলে খাবার রেডি। স্নিগ্ধা খেতে বসে।
"আব্বুকে দেখছি না? ঘুমিয়েছে?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে।
"তোর আব্বু এখনো বাড়ি ফেরেনি।" শিরিন বলে, তাকে খুব উদ্বিগ্ন মনে হয়।
"এখনো ফেরেনি! রাত এগারোটা বাজে। অফিসে কি খুব কাজের চাপ?" চিন্তিত কন্ঠে বলে স্নিগ্ধা।
"অফিসে কল দিয়েছিলাম, ও সন্ধা সাতটায় অফিস থেকে বেরিয়েছে। ওর মোবাইলটাও বন্ধ। তবে চিন্তা করিস না মা, ও হয়তো ওর কোন বন্ধুর বাসায় গিয়ে আড্ডা দিচ্ছে, আর মোবাইলে চার্জও শেষ।"
"আমার খুব চিন্তা হচ্ছে আম্মু, তুমি আব্বুর বন্ধুদের ফোন দাওনা!" স্নিগ্ধা বলে।
"ওর কয়েকজন কলিগ আর বন্ধুকে কল দিয়ে শুনেছি। ওরাও কিছু বলতে পারেনি। আমারও খুব চিন্তা হচ্ছেরে মা।" শিরিন বলে।
স্নিগ্ধা আর খেতে পারেনা উঠে হাত ধুয়ে নেয়।
"মাত্র এটুকু খেলি?" শিরিন বলে।
"আর খেতে ইচ্ছা করছে না।" স্নিগ্ধা বলে।
"তাহলে শুতে যা, জার্নি করে এসেছিস, খুব ক্লান্ত। চিন্তা করিস না মা, তোর আব্বু ঠিক চলে আসবে।" শিরিন বলে।
স্নিগ্ধা তার রুমে যায়, তবে শুয়ে পড়ে না। ব্যালকনিতে পাতা চেয়ারে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে, ওর বাবার ফেরার অপেক্ষায়। হঠাত ওর মোবাইলের রিংটোন বেজে ওঠে। স্নিগ্ধা তার রুমে ফিরে কল রিসিভ করে, অচেনা নাম্বার।
"হ্যালো, কে বলছেন?"
"কেমন আছো খুকি?" বিদ্রুপের স্বরে শুনতে পায়।
"কে? সজল?" স্নিগ্ধা অনিশ্চিত ভাবে বলে।
যদিও মোবাইল সফ্টওয়ার ব্যাবহার করে সজল কন্ঠ চেঞ্জ করেছে, তবু কন্ঠ চিনতে সমস্যা হয়না স্নিগ্ধার।
"আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না তো। আমার মনে হয় তুমি ভাল নেই। আব্বু বাসায় ফেরেনি বুঝি?"
"তুমি কিভাবে জানলে? তার মানে তুমি!"
"শেষবার বাবাকে কবে দেখেছ মনে আছে? ভালো করে মনে করে নাও, কারন আর দেখতে পাবে না।" সজল বলে।
"প্লীজ আব্বুকে কিছু কোরো না প্লীজ!" অনুরোধ করে স্নিগ্ধা।
"তুমি আমার গায়ে হাত তুলেছ, আমাকে অপমান করেছ! আমি তোমাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেব ভেবেছো? তুমি আমাকে চেননি স্নিগ্ধা। কেউ আমার পথে কাঁটা হয়েছে আর আমি তাকে উপড়ে ফেলিনি এমনটা কখনো হয়নি। আমি তিন তিনটা খুন করেছি, আর দু-একটা করতে হাত কাঁপবে না। তোমার বাবাকে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দেব।" সজল বলে।
"তোমায় অপমান আমি করেছি। আমায় খুন কর, কেটে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দাও, কিন্তু আমার বাবাকে ছেড়ে দাও। প্লীজ!"
"আমি তোকে এতো সহজে মরতে দেব ভেবেছিস? তুই আমার পোষা বেশ্যা হবি। কি হবি বল?"
"বেশ্যা!" কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে স্নিগ্ধা।
"হ্যাঁ, বেশ্যা। আর আমি তোর মালিক। যদি আমার বসের নিচে শুতে বলি তাই শুবি, যদি চাকর বাকরের নিচে শুতে বলি তাই শুবি। মনে থাকবে?"
"তুমি যা বলবে তাই করব। কিন্তু প্লিজ আমার বাবাকে তুমি মেরো না।" কাতর কন্ঠে বলে স্নিগ্ধা।
"তাহলে শোন, কাল সকালে তোর বাবাকে পাবি, আর বিকালের বাসে সোজা ঢাকা চলে আসবি। খবরদার কাউকে কিচ্ছু বলবি না। মনে রাখবি সাতরাস্তার মতো জনবহুল এলাকা থেকে তোর বাবাকে কিডন্যাপ করেছে আমার লোকেরা। তোদের বাড়িতে ঢুকে তোর মা বাবাকে জবাই করে আসা আমার লোকদের কাছে কোন ব্যাপার না।" বলেই কেটে দেয় সজল।
স্নিগ্ধা সাথে সাথে কলব্যাক করে, কিন্তু নাম্বার বন্ধ পায়। সজলের নাম্বারে কল দেয়, সেটিও বন্ধ। স্নিগ্ধা বিধ্বস্তের মতো বসে পড়ে বিছানায়। ও ভেবে পায়না এই মানবরুপী দানবের কাছে থেকে কি করে নিস্তার পাবে সে, নিস্তার কি সম্ভব!
 
চতুর্থ পর্বঃ রুপকথার দেশে

কবিরের ঘুম ভেঙে যায় খুব ভোরে, মোটরের আওয়াজে। সম্ভবত কাছে দিয়ে কোন নৌকা গেছে। কবির তার নিমের ডালের মেসোয়াকটি হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে, বাইরে ঝলমলে দিন। কবির দাঁতে মেসওয়াক ঘষতে ঘষতে চারিদিকে দেখে। যমুনা নদীর একটি ছোট চর, তার মাঝামাঝিতে একটি খড়ের ছাউনির ঘর। ঘরটি কবির নিজের হাতে বানিয়েছে। কবির হেঁটে হেঁটে নদীর কিনারায় যায়।
"কিরে কবির, কি দেখছিস?"
"আকাশ পরিষ্কার, ঝকঝকে, হালকা ফুরফুরে বাতাস বইছে, নদীর স্রোতও তেমন একটা নেই, নৌকা ভাসানোর জন্য পারফেক্ট দিন।"
"নৌকা ভাসাবি নাকি?"
"এখন না পরে।"
কবির নিজের সাথেই কথা বলে। এখানে তার সাথে কথা বলার কেউ নেই, এই পুরো চরে সে একা।
কবির নদীর পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ঘাসের উপর বসে দুর দিগন্তের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
"একসময় যমুনা ব্রীজের উপর দিয়ে বাসে করে যাওয়ার সময় নিচের এই চরগুলোর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম।" উদাস কন্ঠে বলে কবির।
"এখন কি সেই মুগ্ধতা আর নেই?" নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে কবির।
"মুগ্ধতা এখনো আছে কিন্তু সাথে কেমন যেন বিষন্নতা ঘিরে ধরেছে।"
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কবীর।
"চৈত্র মাসের তো প্রায় শেষের দিকে, এখন এই চর ছেড়ে না বের হলে কি পরিণতি হতে পারে জানিস? এখানে কালবৈশাখী কতো ভয়ংকর হতে পারে জানা আছে?" আবারও নিজেকে প্রশ্ন করে কবির।
"জানি। যদি কালবৈশাখী থেকে বেঁচেও যাই, এই চর ডুবে গেলে বাঁচতে পারব না।" আবারও নিজেই উত্তর দেয়।
"চর ডুবে যাবে?"
"হ্যাঁ প্রতিবছর হেমন্ত-শীতে এই চর জেগে ওঠে আর গ্রীষ্ম-বর্ষায় ডুবে যায়।"
"তাহলে তো শিঘ্রই এই চর ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত।"
"কেন যাব? আমার জীবনের সমাপ্তি যদি এখানেই হয় তবে এ জগতে কার বা কি এসে যাবে?" বলতে বলতে কবির উঠে নিজের ঘরের দিকে হেঁটে যেতে থাকে।
কবির তার ঘরে গিয়ে মাছ ধরার জাল নিয়ে আসে। ঘরের উত্তর দিকে নদীর পানি জমে একটি পুকুরের মত সৃষ্টি হয়েছে। সেই পুকুরটায় জাল ফেলে কবির।
"তোর জীবনটা তো এমন নাও হতে পারতো। আর দশটা মানুষের মতো সুখে ঘর সংসার করতে পারতি। স্নিগ্ধা না হল, ঐশী তো তোকে খুব ভালবাসত।" জাল ফেলতে ফেলতে ভাবে।
"ওটাকে ভালবাসা বলে না, ওটা ছিল কৈশোরের পাগলামি। এতোদিনে হয়তো আমাকে ভুলেই গেছে।" কবির বলে।
"আর স্নিগ্ধা? ওরটাও কি কৈশোরের পাগলামি ছিল? এতোদিনে ও কি তোকে ভুলে গেছে?"
"না। ওর চোখে আমি সবসময় আমার জন্য ভালবাসা দেখেছি।"
"ও কি তোকে ভুলে গেছে?" নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে কবির।
"আমি জানি না। তবে জানতে চাই। অন্তত আর একটিবার ওর সাথে দেখা করতে চাই।"
"তো সোজা গিয়ে দেখা কর।"
"না এভাবে নয়। আমি ওর সাথে দেখা করতে যাব না। পৃথিবীটা গোল, কোন না কোনভাবে, পথে চলতে চলতে দেখা হয়েই যাবে। সেই দিনটি পর্যন্ত আমাকে বেঁচে থাকতে হবে।"
জালে শুধু কিছু টেংরা, পুঁটি আর খলসা উঠেছে। সেগুলোকে নিয়ে কবির তার ঘরে ফিরে যায়। কেটে কুটে মাছগুলো লবন আর গুঁড়ো মরিচ দিয়ে মাখিয়ে আগুনে ঝলসিয়ে নেয়। চাল, ডাল, তেল মসলা সহ অনেক কিছুই এনেছিল কবির। দুই মাসের মধ্যে সব ফুরিয়ে গেছে। একমাস হল শুধু ঝলসানো মাছ খেয়ে বেঁচে আছে সে। কবির খেতে খেতে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল যে এই চরে আর নয়। কিন্তু কোথাও যেতে হলে টাকার প্রয়োজন যা কবিরের কাছে নেই।
কবির উঠে তার জালটা নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়ে। এবার তীরে খুঁটির সাথে বাঁধা তার ডিঙি নৌকাটা নিয়ে মাছ ধরতে খোলা নদীতে বেরিয়ে পড়ে।

মাথার উপর গনগনে সুর্য যেন আগুন ঝরাচ্ছে, কবিরের গা বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরে পড়ছে। কবির তার পানির মগ দিয়ে নদী থেকে এক মগ পানি তুলে মাথায় ঢেলে দেয়। তারপর নৌকাতে গুটিয়ে রাখা জালটি দুহাতে যতটা সম্ভব ছড়িয়ে নিয়ে নদীতে ফেলে কবির। জাল ফেলাটাও একটি আর্ট, একে রপ্ত করতে কবিরের বেশ সময় লেগেছে। মিনিটখানেক পর কবির জাল গোটানো শুরু করে। কয়েকটা পাবদা, টেংরা আর কায়াকাটা উঠেছে জালে।
"তোর ভাগ্য আজ ভাল না কবির।" নিজেই নিজেকে বলে কবির।
"খুব খারাপও না। মাত্র চার পাঁচ ঘন্টায় ভালই মাছ উঠেছে। তবে বড় মাছ ওঠেনি এখন অব্দি।" জবাব দেয় কবির।
"মাত্র এটুকু ছোট মাছ বিক্রি করে কতো টাকা পাবি? তোর তো অনেক টাকার প্রয়োজন। কমপক্ষ এক দেড় হাজার টাকা তো লাগবেই।"
"দেখা যাক কি হয়। মাত্র কয়েক ঘন্টায় হাল ছেড়ে দিলে তো চলবে না।"
"দুপুর হয়ে গেছে, চল কিছু খেয়ে আসা যাক।"
"হ্যাঁ ফিরব। তবে আরেকটু সামনে গিয়ে দুএকবার জাল ফেলে আসি।" বলে কবির দাঁড় বাইতে থাকে।

"ইচ্ছে হলে হারিয়ে যাও ব্যাস্ততার দেশে,
ঘর সংসার বাড়ি গাড়ির জানালার ওপাশে।
কথা দাও আসবে ফিরে, ফিরবে অবশেষে,
তোমায় নিয়ে উড়াল দেব রুপকথার দেশে।"

নৌকা বাইতে বাইতে আনমনে গেয়ে ওঠে কবির। কয়েক দিন আগে এই চরে বসে বসে কবির কবিতাটি লিখেছিল, কিন্তু এখন সেই কবিতাটি গানে পরিনত হল। তবে সুরটি কবিরের বেশ পছন্দ হল। কবির বাকি অংশটিও একই সুরে গাইতে থাকে।

"ইঁট পাথরের জঞ্জাল ছেড়ে যমুনা নদীর চর,
সেথায় হবে খড়ের ছাউনির তোমার আমার ঘর।
নদীর বুকে নাও ভাসিয়ে কাটবে বিকেল বেলা,
জোসনা রাতে উঠোন পারে বসবে স্মৃতির মেলা।"

"তোর কি মনে হয় স্নিগ্ধা ওর ঘর সংসার ছেড়ে তোর কাছে আসবে এই ডুবন্ত চরে মরার জন্য!" জাল ফেলতে ফেলতে কবির বলে।
"এখানে না হল অন্য কোথাও। নাইবা এলো ও, নাইবা হল দেখা। এই ইচ্ছেকে বয়ে বেড়াবো চিরকাল।" বলতে বলতে কবির জাল গুটাতে থাকে। এবার জালটা অনেক ভারী মনে হয়, নদীর তলদেশের কোন লতা পাতায় আটকে গেছে নাকি! কবির জালটা টেনে নদী পৃষ্ঠের কাছাকাছি তুলতে বুঝতে পারে জালে ভারী এবং ছটফটে কিছু একটা উঠেছে। কবীর সর্বশক্তি দিয়ে জাল টেনে তোলে। জালে বেশ বড়সর একটি আইড় মাছ উঠেছে, ওজন পাঁচ থেকে ছয় কেজি হবে। কবির মাছটাকে নৌকার ছইয়ের নিচে রেখে যতটা সম্ভব দ্রুত কিনারার দিকে ছুটতে থাকে। চরে পৌঁছে কবির তার ঘর থেকে একটি কোদাল এনে একটি গর্ত খুঁড়ে ফেলে, তাতে নদী থেকে পানি এনে ঢেলে দিয়ে ছোট একটি পুকুরের মতো তৈরী করে। তাতে মাছটিকে এনে ছেড়ে দেয়। মাছটা জ্যান্ত রাখতে পারলে বেশ ভাল দাম পাবে।

সারাদিন নদীতে মাছ ধরা শেষে কবির শীতলপাটি বিছিয়ে নদীর ধারে শুয়ে থাকে।
আকাশের মাঝামাঝি একফালি চাঁদ, আর সমগ্র আকাশ জুড়ে অজস্র তারা। তারা বা চাঁদ কারো সাথেই আজ কথা বলতে ইচ্ছা করছে না কবিরের। কবির পাশ ফিরে নদীটির দিকে তাকায়। নদীটি জোছনার আলোয় চিক চিক করছে।
"কেমন আছেন যমুনা ম্যাডাম?" নদীর উদ্দেশ্য বলে।
"ভাল আছেন তো?"
"কথা বলছেন না কেন?"
"আপনি কি আমার সাথে রাগ করেছেন?"
"আপনাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি বলে?"
"সত্যিই আমি খুব অকৃতজ্ঞ। এতোগুলো দিন আপনার আশ্রয়ে থাকলাম আর আপনাকে একটিবার ধন্যবাদ পর্যন্ত জানালাম না।"
"না ধন্যবাদ জানিয়ে আপনাকে ছোট করব না ম্যাডাম। নিন এ জীবন আপনাকে উত্সর্গ করে দিলাম। আপনি এই কুল ভেঙে কিংবা বড় কোন স্রোত এনে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যান।"
"একটাই রিকোয়েস্ট এ দেহটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ভেসে তুলবেন না। তার চেয়ে বরং আপনার স্নেহের মাছদের খাইয়ে তাদের প্রাপ্য প্রতিশোধ মিটিয়ে দিবেন।"
"নিন, এই রাতটি আমি এখানেই আছি।"
একটু আগে হু হু করে বয়ে চলা বাতাসটি বদলে গেল ঝিরিঝিরি বাতাসে। কবির তাতে ঘুমিয়ে পড়ে।

পরের দিন কবির ঘুম থেকে ওঠে খুব ভোরে। তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। আগেরদিন সারাদিন মাছ ধরে সে প্রায় আড়াই কেজি ওজনের ছোট ও মাঝারি মাছ, একটি পাঁচ থেকে ছয় কেজি ওজনের আইড় মাছে এবং দুই থেকে তিন কেজি ওজনের একটি রুই মাছ যোগাড় করেছে। কবির মাছগুলোকে তার ডিঙি নৌকায় তোলে, তারপর ঘর থেকে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস ব্যাগে তুলে রওনা দিয়ে দেয়। প্রথমে সে নদীর কিনারায় একটি মাছের আড়তে গিয়ে ছোট ও মাঝারি মাছগুলো বিক্রি করে। বড় মাছ এখানে বিক্রি করেনা, কারন তাতে ভাল দাম পাবেনা সে। এরপর আবারও নদীর কুল বরাবর নৌকা বেয়ে কিছুদুর এগিয়ে একটি ফার্নিচারের দোকানে যায় কবির। সেখানে ফার্নিচারের পাশাপাশি নৌকাও তৈরী হয়। কবির নৌকাটি দেড় হাজার টাকায় বিক্রি করে, অথচ চারমাস আগেই একই মিস্ত্রির কাছে থেকে নৌকাটি কিনেছিল ছয় হাজার টাকায়। কবির মাছের ডালাটি মাথায় নিয়ে রওনা দিয়ে দেয়। কিছুদুর হেঁটে, তারপর বাসে করে টাঙ্গাইল শহরে চলে আসে। টাঙ্গাইল বড়বাজারের রাস্তার পাশে তার মাছের ডালাটা নিয়ে বসে পড়ে। তবে কবিরকে মাছের ডালা নিয়ে বেশিক্ষন বসে থাকতে হয়না। দুঘন্টা পরই গাড়ি থামিয়ে একজন মহিলা দুটি মাছই কিনে নেয়। ততোক্ষনে দুপুর হয়ে গেছে, কবির তার টাকা গুনে নেয়। তার রোজগার আট হাজার পাঁচশ টাকা। এরপর সে একটি সস্তা রেস্টুরেন্টে গিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নেয়। কবির খেতে খেতে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় যে সে এরপর কক্সবাজার যাবে। এমনিতে সমুদ্রের প্রতি টান কবিরের কখনোই ছিল না। এর আগে বান্দরবনের পাহাড়ে ছয় মাস থেকে এলেও কাছে কক্সবাজারে যায়নি সে। কিন্তু হঠাত কেন যেন নীলিমার প্রতি টানের সৃষ্টি হল তার।
 
রাত একটা বাজে, কবির তার সাইডব্যাগটা মাথার নিচে গুঁজে দিয়ে বেঞ্চে শুয়ে ছিল নাম না জানা এক বাস স্টপে। প্রায় এক সপ্তাহ হল সে কক্সবাজারে এসেছে। টাকাপয়সা যা ছিল তা ইতিমধ্যে শেষ, কবির চেষ্টা করছিল একটা কাজ জুটিয়ে নেয়ার। আসেপাশে অনেকগুলো হোটেল রয়েছে, কবির চেষ্টা করছে সেগুলোর কোনটিতে কাজ যোগাড় করার। কিন্তু একজন অচেনা অজানা লোককে কেউ কাজে রাখতে চায়না। কবির শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছে কি করা যায়। এমন সময় হঠাত বাসের আওয়াজ পায় কবির, স্টপেজে কোন বাস থেমেছে, সম্ভবত কোন যাত্রী নেমেছে। কবির ওপাশ হয়ে শোয় এবং আড়চোখে নেমে পড়া যাত্রীকে দেখতে থাকে। একজন মধ্যবয়স্ক লোক, নিম্ন মধ্যবিত্ত গোছের। কবির অনুমান করে লোকটি আসেপাশে কোন হোটেলে বাবুর্চি কিংবা ওয়েটার হিসাবে কাজ করে। লোকর্টি কয়েক মিনিট এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা খোঁজে, সম্ভবত রিক্সা খোঁজে, তারপর ডান দিকের রাস্তাটি ধরে হাঁটতে শুরু করে। কবির অনেকটাই নিশ্চিত যে লোকটি বিপদে পড়বে। আধাঘন্টা আগে কবির ঐ রাস্তাতে দুজন ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়েছিল, অবশ্য টাকা পয়সা কিছুই ছিলনা কবিরের কাছে। মিনিট খানেক পর কবির উঠে ডান দিকের রাস্তায় হাঁটতে থাকে। খানিকটা হাঁটতেই কিছু ফিসফিস আওয়াজ পায় রাস্তার পাশে গলি থেকে। নিশ্চয়ই হিরোইনখোর দুটো লোকটাকে চাকুর ভয় দেখিয়ে পাশের গলিতে নিয়ে গেছে। আরেকটু এগুতে স্পষ্ট কথার আওয়াজ শুনতে।
"দয়া করো ভাই, আইজকাই বেতন পাইছি, বাসাতেও টাকা পাঠাতে পারি নাই ভাই। অন্তত দুই হাজার টাকা ফেরত দেন ভাই। বাসায় বউ বাচ্চা না খেয়ে থাকবে ভাই।" লোকটি এক ছিনতাইকারীর পা জড়িয়ে ধরে কাকুতি মিনতি করে বলে।
"পা ছাড় বলছি, পা ছাড়। নাহলে দিমু কিন্তু শ্বাসী কাইটা।" পা ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে বলে।
"দে না কাইটা, বহুদিন হল খুন খারাপি করি না।" পাশ থেকে অন্যজন বলে।
লোকটা এতো করে কাকুতি মিনতি করছে, কিছু টাকা তো ফেরত দে।" কবির গলির সামনে দাড়িয়ে বলে।
"ঐ ভিখারীর বাচ্চা, তুই আবার আইছস? তোর কি মরার সাধ হইছে?" বলে একজন চাকু নিয়ে কবিরের দিকে ধেয়ে আসে।
এরকম পরিস্থিতি কবিরের জন্য নতুন নয়, কবির ঘাবড়ে না গিয়ে সতর্কতার সাথে ধেয়ে আসা লোকটার গতিবিধি লক্ষ করে। লোকটা তার ছুরি দিয়ে কবিরকে ফ্যাঁস দেয়ার ভঙ্গিতে আঘাত করার চেষ্টা করে। কবির দ্রুত পেছনে সরে যায়। আবারও আঘাত করার চেষ্টা করলে তার হাতটা বাঁ হাত দিয়ে ধরে মুচড়ে দিয়ে ডান হাত দিয়ে চাকুটি নিয়ে প্রায় বিদ্যুতগতিতে লোকটির উরুতে গেঁথে দেয়। সাথে সাথে গগনবিদারী চিতকার দিয়ে গড়াগড়ি খেতে থাকে ছিনতাইকারী।
"কিরে শালা, তোর দোস্ত ব্যাথায় মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর তুই দাড়িয়ে দাড়িয়ে তামাশা দেখছিস? দুইজন একসাথে এলে তাও চান্স ছিল তোদের। তোর দোস্ত তো বাম পাছায় চাকু নিয়েছে, তুই কোন পাছায় নিবি?" বলে অন্যজনের দিকে হাত নেড়ে এগিয়ে আসতে ইশারা করে কবির।
কবিরের দিকে তেড়ে আসার বদলে উল্টো দিকে দৌড় দেয় সে।
"আপনার টাকা নিয়্যা ভাগছে নাকি?" মধ্য বয়স্ক লোকটির উদ্দেশ্যে বলে কবির।
"না ভাই, টাকা অর কাছে।" বলে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া লোকটির দিকে ইশারা করে।
কবির লোকটির প্যান্ট হাতিয়ে মানিব্যাগটা খুঁজে পায়। লোকটাকে তা ফেরত দেয়।
"ভাই! আপনারে কি বইলা যে ধইন্যবাদ দিব। আপনে না থাকলে কি যে হইত!"
"ধইন্যবাদ দিয়ে কি প্যাট ভরে নাকি? যদি পারেন এক বেলা পেট ভইরা খাইতে দেন, আইজ সারাদিন কিচ্ছু খাই নাই।" কবির বলে।
লোকটা তার মানিব্যাগ থেকে এক হাজার টাকার একটা নোট বের করে দেয়।
"আমারে কি আপনার কাছে ছিনতাইকারী মনে হইতেছে?" গলি থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে কবির বলে।
"আরে না ভাই। আমি এইটা খুশি মনে দিচ্ছি!" লোকটা একটু ইতস্তত করে বলে।
"আপনারে দেইখা কিন্তু সেই মাপের বড়লোক মনে হইতাছে না যে আপনি খুশি মনে এক হাজার টাকার নোট দিবেন। তারচেয়ে চলেন সামনে একটা রেস্টুরেন্ট আছে, রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা খোলা থাকে। দুইজন বইসা কিছু খাই। মনে হচ্ছে আপনিও রাতে কিছু খান নাই।" কবির বলে
"চলেন তাইলে।" বলে লোকটি কবিরের সাথে রওনা দেয়।

"আপনি তো সাংঘাতিক মানুষ, ক্যামনে ঐ দুইটারে ধরাসাই করলেন!" রেস্টুরেন্টে বসে খাবার অর্ডার দিয়ে লোকটা বলে।
"ওসব হিরোইনখোরদের গায়ে শক্তি থাকে নাকি? আপনিই পারতেন যদি আপনার মনে ভয় না থাকতো। আপনার কিছু হলে আপনার বউয়ের কি হবে! ছেলে মেয়ের কি হবে! আমার এসব ভয় নাই।"
"কেন? ও আপনের তো নামই শোনা হয় নাই।"
"আমার নাম করিম। আমাকে তুমি করে বললেই খুশি হমু।" কবির বলে।
"আমি মনসুর আলী। এইখানে সী সেল রেস্টুরেন্টে কাজ করি। অফিসের কাজে চট্টগ্রাম গেছিলাম, ফিরতে রাত হইল।" লোকটি বলে।
ততোক্ষনে খাবার চলে এসেছে। মনসুর খেতে খেতে বলে "আপনি মানে তুমি কিন্তু তোমার বিষয়ে কিছু কইলা না। কই থাকো? কি কর?"
"আমার বাড়ি বান্দরবানে, গ্রামের নাম অনসুং। বাপ জন্মের আগেই মইরা গেছে, এক মা-ই ছিল। তাও মরল এক বছর আগে। মা মরার পর গ্রামে আর মন টিঁকে না, তাই শহরে চইলা আইলাম।" কবির বলে। যেকোন যায়গায় গেলে কবির সাধারণত এরকম গল্প বানিয়ে বলে।
"আহারে! মা মারা গেল ক্যামনে?"
"জানিনা চাচা। একদিন উঠান ঝাড় দিতে গিয়া মাথা ঘুইরা পইড়া গেছে, তারপর শেষ।" কবির বলে
"স্টোক করছে। আমার বাপেও একইভাবে মারা গেছে। তয় তুমি আমারে চাচাই ডাইকো, ভাল লাগে। তুমি এখানে কই থাক আর কি কর?"
"ভাবছিলাম শহরে আইসা কোন একটা কাজ জুটাইয়া নিমু, এক সপ্তাহ হইল এখানে ওখানে ঘুরতাছি কিন্তু কাজ পাই নাই। আর থাকি যেখানে যায়গা পাই। আজ রাতে বাস স্ট্যান্ডে আছি।"
"বাস স্ট্যান্ড থাকার যায়গা হইল? তুমি আমার সাথে চল, আমি যে হোটেলে কাজ করি এইখানে তোমার একটা কাজের ব্যাবস্থা কইরা দিমু। বেতন বেশী পাইবা না, কিন্তু থাকা খাওয়া কোম্পানির।" মনসুর বলে।
ততক্ষনে কবিরের খাওয়া হয়ে গেছে, হাত ধুতে উঠে যায় সে, মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে।

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে কবির ও মনসুর হেঁটেই রওনা দেয়। পথে মনসুরের সাথে কবিরের অনেক কথা হয়, যার অধিকাংশই কবির বানিয়ে বলে। অবশেষে যখন ওরা হোটেলটাতে পৌঁছায় তখন রাত তিনটে বাজে। কবির ভেবেছিল ছোটখাট কোন হোটেল হবে হয়তো, কিন্তু সেটি বিশাল আলিশান একটি ফাইভ স্টার হোটেল।
মনসুর গেটের সামনে গিয়ে চেক পোস্টের দিকে টর্চ লাইট দিয়ে সিগনাল দেয়, সাথে সাথে একজন গার্ড চলে আসে।
"আরে মনসুর মিয়া! ফিরতে এতো রাত হইল যে! তোমার সাথে ঐটা কে?" গার্ড গেইট খুলে দিতে দিতে বলে।
"এ আমার ভাইস্তা। দেখি কোন কাজে লাগাইয়া দিতে পারি কি না।"
"পথে আবার ভাইস্তা পাইলা কই থেইকা?" মিচকি হেসে বলে দারোয়ান।
"আমার সেই ভাই চট্টগ্রামেই থাকে, অফিসের কাজে যখন আইছি ভাবলাম ভাইয়ের সাথে দেখা কইরা যাই।"
"ও বুঝছি। আসার সময় সাথে কইরা ভাইস্তারে নিয়া আইছ।" বলে গেট খুলে দেয় সিকিউরিটি গার্ড।
মনসুর ভেতরে ঢোকে, পিছে পিছে কবির। হোটেলের একপাশে স্টাফদের কোয়ার্টার, মনসুর ও কবির সেদিকেই হাঁটতে থাকে।
"কক্সবাজারের সবচেয়ে বড় আর নামিদামি হোটেল এইটা। এর মালিক কে জানো? জিল্লুর রহমান। রোয়ান গ্রুপের মালিক, ঢাকা দক্ষিন সিটি কর্পোরেশনের নতুন মেয়র।" হোটেলের সামনে বাগান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলে মনসুর। কবির কোন জবাব দেয়না।
"আমাদের ম্যানেজার সাহেব খুব ভাল মানুষ, তারে বইলা একটা কাজে লাগাইয়া দিতে পারি কিনা দেখি।"
"তুমি লেখা পড়া কতদুর করছো?" আবারও জিজ্ঞাসা করে মনসুর।
"গ্রামের ইস্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ছি।" কবির বলে।
"এইখানে অনেক বড় বড় মানুষ আসে, তাদের সাথে সবসময় ভদ্রভাবে কথা বলতে হয়, আমি তোমারে সব শিখাইয়া দিমুনি।"
ততোক্ষনে স্টাফ কোয়ার্টার চলে এসেছে। মনসুর তার রুমের দিক যায়, পিছে পিছে কবিরও। সেদিন রাতটি কবির সেখানেই কাটিয়ে দেয়। পরের দিন মনসুর কবিরকে নিয়ে হোটেল ম্যানেজারের কাছে নিয়ে যায়। মনসুর মিয়া হোটেলের অনেক পুরনো স্টাফ, হোটেলের শুরু থেকে সে আছে। তাই তার সুপারিশে সহজেই চাকরী হয়ে গেল কবিরের, ওয়েটার হিসাবে।
আবারও কর্মব্যস্ত জীবনে ফিরে আসে কবির। কখনো ডে শিফট, কখনো নাইট শিফট, কিন্তু কোন ছুটি নেই। এরমাঝে যেটুকু সময় পাওয়া যায় কবির সমুদ্র সৈকতে কাটিয়ে। তবে একঘেয়ে কর্মব্যস্ততা কবিরের ভাল লাগে না। আবারও পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো কবির, কিন্তু কোথায় যাবে ঠিক করতে পারছিল না।

দেখতে দেখতে তিনটি মাস কেটে গেল। কবির হোটেল সী সেলে ওয়েটার হিসাবে কাজ করছে। এর মাঝে মনসুর চাচা ছাড়াও রফিক, তুহিন, বাচ্চু, শিপন সহ অনেক স্টাফের সাথে কবিরের ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কারো সাথে যে বৈরী সম্পর্ক হয়নি এমনও নয়, তবে কবির চেষ্টা করে তাদেরকে যতোটা সম্ভব এড়িয়ে চলার।

দুপুর একটা বাজে, কবির একটি রুম থেকে লাঞ্চ সার্ভ করে ফিরছিল। করিডরে বাচ্চুর সাথে দেখা হয় তার। বাচ্চুকে কেমন যেন বিব্রত দেখায়।
"করিম ভাই, প্লিজ লাঞ্চটা তিনশ চার নাম্বার রুমে সার্ভ করে দিয়ে এসো।" অনুরোধের সুরে নিচু স্বরে বলে বাচ্চু।
"না ভাই, আমার ডিউটি শেষ, এখন নিজের লাঞ্চ টাইম।" কবির বলে।
"ছোট সাহেব এসেছেন, কিছুক্ষন আগে। তুমি তো জানোই, গতবার ড্রিংকসের সাথে আইস কিউব আনতে ভুলে গেছিলাম বলে উনি আমাকে ভীষন মেরেছেন। পায়ে ধরে কান্নাকাটি করে চাকরিটা বাঁচিয়েছি। আমাকে আবার দেখলে উনি আবার চটে যাবেন।" বাচ্চু বলে।
"এবার যদি আমার উপর চটে যান?" কবির বলে।
"আজ পর্যন্ত তোমার উপর কখনো চটেননি উনি। তুমি খুব ভাল ম্যানেজ করতে পার ওনাকে।" একটু থেমে বাচ্চু আবারও ফিসফিস করে বলে "আর তাছাড়া ছোট সাহেবের সাথে কচি, মিষ্টি, পরীর মতো এক মেম সাহেবা আছে। যাওনা, ভালই লাগবে তোমার।" বলে চোখ টিপে দিয়ে সরে পড়ে বাচ্চু।
ছোট সাহেব অর্থাত হোটেলের মালিক জিল্লুর রহমানের একমাত্র ছেলে সাইমন রহমান। বয়স ত্রিশ/ পঁয়ত্রিশ। শিল্পপতির ছেলে হলেও ব্যাবসা বানিজ্যের প্রতি মনোযোগ নেই তার। তার কাছে লাইফ মানে ফুর্তি, মদ আর নারী। মাঝে মাঝেই সময় কাটাতে এই হোটেলে চলে আসে সে। তার জন্য তিনশ চার নাম্বার রুমটা সবসময় বুক করা থাকে। যদিও সে এখনো অবিবাহিত, কিন্তু অধিকাংশ সময়ই তার সাথে কোন মেয়ে থাকে। তাদের মাঝে কে কে তার গার্লফ্রেন্ড আর কে কে হাই সোসাইটি কলগার্ল তা বলা মুশকিল।
কবির তিনশ চার নাম্বার রুমের দরজায় নক করে। এক মিনিট পর দরজাটা খুলে যায়, সামনে এক মেয়ে দাড়িয়ে যাকে দেখে কবিরের রক্ত হিম হয়ে আসে। কোন দিন স্নিগ্ধার সাথে দেখা হবে তার, হয়তো সেই মুহুর্তটির অপেক্ষায় সে বেঁচে আছে। কিন্তু স্নিগ্ধাকে সে এভাবে দেখবে, কখনো কল্পনাও করতে পারেনি কবির। কবিরের বুকের ভেতর হৃদপিন্ডটি যেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল।
অন্যদিকে স্নিগ্ধার চোখ অশ্রুজলে টলমল করছিল, তা গাল বেয়ে ঝরে পড়ার আগেই ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কবিরকে।
"কবির! কোথায় ছিলি এতোদিন!" কবিরের বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে বলে স্নিগ্ধা।
কবির কিছু বলে না, তার দৃষ্টিটা ঘরের ভেতরে দাড়িয়ে ক্রোধে ফুঁসতে থাকা লোকটির দিকে।
সাইমন ছুটে এসে স্নিগ্ধাকে হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে দিয়ে কবিরকে পেছনের দেয়ালে চেপে ধরে ওর মুখে ঘুসি দিতে থাকে আর রাগে গর্জাতে থাকে, "স্কাউন্ড্রেল, সামান্য ওয়েটার হয়ে তোর সাহস কি করে হল আমার জিএফের দিকে হাত বাড়ানোর?"
স্নিগ্ধা সাইমনের পা চেপে ধরে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে "ওকে প্লিজ মেরো না, ওর কোন দোষ নেই।"
কবিরকে ছেড়ে দিয়ে সাইমন স্নিগ্ধার চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলে বলে "বারোভাতারী খানকি মাগী" বলে অন্য হাত সপাটে চড় বসিয়ে দিতে চায় সে, কিন্তু তার আগেই কবির হাতটি ধরে নেয় এবং অন্য হাত দিয়ে ওর কনুইতে প্রচন্ড আঘাত করে, সাথে সাথে মৃদু মড়মড় শব্দে সাইমনের হাত ভেঙে যায় কিন্তু সেই শব্দকে ছাপিয়ে যায় গগনবিদারী চিতকারে। মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে থাকা সাইমনের গলায় পাড়া দিয়ে বলে কবির "ইচ্ছে করছে তোর জিভটাও টেনে ছিঁড়ে ফেলি। কিন্তু আমি ছুঁচো মেরে হাত নষ্ট করতে চাই না।"
তারপর স্নিগ্ধার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় কবির। লোকসমাগম হওয়ার আগেই এখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে যেতে চায় তারা।
 
কবির স্নিগ্ধাকে নিয়ে হোটেলের বাগান ধরে ছুটতে থাকে, মেইন গেইটের দিকে না গিয়ে ওরা স্টাফ কোয়ার্টারের দিকে এগোয়। স্টাফ কোয়ার্টারের পেছন দিকে একটা গেইট রয়েছে, যাতে কোন গার্ড থাকে না। কবির ও স্নিগ্ধা সেই গেইট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। গেইটের ওপাশে সমুদ্র সৈকত, ওরা সৈকত বরাবর হাঁটতে থাকে। আরো কিছুদুর পর একটি ঝাউবন দেখতে পায়, দুপুরের এই সময় যা একেবারেই নির্জন, ওরা সেদিকেই যায়।
"তুই এখান থেকে চলে যা, দুরে কোথাও চলে যা, আমি সব সামলে নেব।" স্নিগ্ধা বলে।
"আমি তোকে এভাবে ছেড়ে যেতে পারি না।" কবির বলে।
"আমাকে ছেড়ে চলে যাসনি তুই? বেঁচে আছি না মরে গেছি কখনো খোঁজ নিয়েছিস? আমি তো তোকে কষ্ট দিয়েছি, কিন্তু আম্মু তো তোকে নিজের ছেলের মতো ভালবাসে, কখনো তার খোঁজ নিয়েছিস?" অভিমানের সুরে বলে স্নিগ্ধা।
"আমি মানছি যে আমি অপরাধ করেছি। তার যা শাস্তি দিবি আমি মাথা পেতে নেব, কিন্তু এভাবে তোকে ছেড়ে যেতে পারবনা আমি।" কবির বলে।
"তুই বুঝতে পারছিস না কবির, ওরা কতো ভয়ংকর। ওরা তোকে খুঁজে পেলে মেরে ফেলবে।" স্নিগ্ধা বলে।
"এইতো, এই মুহুর্তটির জন্য আমি বেঁচে আছি। তোকে আরেকটিবার দেখব, তোর চেখে চোখ রেখে তোর নিশ্বাসের সুবাস নিব মন ভরে।" বলতে বলতে স্নিগ্ধাকে একটি গাছের সাথে চেপে ধরে কবির, চোখে চোখ রেখে প্রাণ ভরে ওর নিশ্বাসের ঘ্রাণ নেয়। স্নিগ্ধার মিষ্টি মুখটিকে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিতে খুব ইচ্ছে করে ওর, কিন্তু নিজেকে সংবরন করে কবির, ওকে বাহুডোর থেকে মুক্ত করে দিয়ে সরে যেতে চায় কবির কিন্তু স্নিগ্ধা ওকে জড়িয়ে ধরে।
"তোকে হারানোর পর বুঝেছি তোকে কতোটা ভালবাসি আমি। আমি তোকে আবার হারাতে চাই না। ওরা তোকে খুঁজে পেলে মেরে ফেলবে। ওরা কতো ভয়ংকর তুই জানিস না। প্লিজ তুই কোথাও পালিয়ে যা।" কবিরকে জড়িয়ে ধরে বলে স্নিগ্ধা।
"তাহলে তুই ও চল আমার সাথে। তোকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবনা আর।"
"সে হয় না কবির।"
"কেন হয় না?"
স্নিগ্ধা তার কোন উত্তর দিতে পারে না। কবির ওর হাতটি বাড়িয়ে দেয়। স্নিগ্ধা ওর হাতে হাতটি রাখে।

ছোট মিনিবাস, তাতে গাদাগাদি লোক, যেন একটি সুঁই রাখারও যায়গা নেই। বাসটি আঁকাবাকা পাহাড়ি রাস্তায় ছুটে চলছে। স্নিগ্ধা জানালার পাশে একটি সিটে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর পাশের সিটে কবির, মুগ্ধ নয়নে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কবিরের কাছে সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে, এই বুঝি ঘুম ভেঙে যাবে আর উঠে দেখবে কোন অচেনা বাস স্টপের বেঞ্চে শুয়ে আছে সে একাকি।
"আমরা কোথায় যাচ্ছি?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে। এই প্রথমবার স্নিগ্ধা কিছু বলল।
"সেটা একটা সারপ্রাইজ, খুব সুন্দর যায়গা, তোর খুব পছন্দ হবে।"
"তুই যা, কিছুদিন লুকিয়ে থাক। আমি সামনে স্টপেজে নেমে যাই।" স্নিগ্ধা বলে।
কবির কিছু বলে না। ওর মুখে হতাশার ছাপ পড়ে।
কয়েক মিনিট পরই একটি বাস স্টপেজে বাস থেমে যায়। স্নিগ্ধার সাথে কবিরও নেমে যায়।
"তুই নেমে গেলি কেন?" কবিরকে জিজ্ঞাসা করে স্নিগ্ধা।
"চল, তোকে পৌঁছে দিয়ে আসি। তোকে আমি এভাবে একা ছাড়তে পারি না।"
"তুই কেন বুঝতে পারছিস না ওরা তোকে মেরে ফেলবে।"
"মেরে ফেলুক আমাকে, তবু এভাবে তোকে একা ছাড়তে পারব না।"
স্নিগ্ধা কবিরের হাতটি ধরে টেনে আনে যাত্রী ছাউনির দিকে, কবিরকে বেঞ্চে বসতে দিয়ে নিজে ওর পাশে বসে।
"আমি জানি তোর মনে অনেক প্রশ্ন জমা রয়েছে, সব প্রশ্নের উত্তর পাবি। তুই কি জানতে চাস হোটেলে ঐ লোকটার সাথে কেন আমি? তবে শোন, আমার স্বামী আমাকে বিক্রি করে দিয়েছে ঐ লোকটার কাছে।" বলতে বলতে গলা ধরে আসে স্নিগ্ধার।
"কি বলছিস তুই!"
"আমি মজা করছি না। সজলকে আমি চিনতে পারিনি কবির, ও কোন মানুষ নয়, পশু একটা। আমি ওকে চিনতে পেরেছি তিন মাস আগে। ও আমাকে মিথ্যা বলে বাধ্য করার চেষ্টা করেছিল ওর বসের বিছানায় যেতে, ওর প্রমোশনের জন্য। যখন ওর আসল রুপটা আমার সামনে আসে আমি চেয়েছিলাম ওর থেকে মুক্তি পেতে। কিন্তু মুক্তি আমার মেলেনি।"
"সেদিন আমি রওনা দিয়েছিলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে, বাসায় পৌঁছে শুনলাম আব্বু ফেরেনি অফিস থেকে। মাঝরাতে ফোন পেলাম সজলের। ও বলে যে ওর ভাড়াটে গুন্ডারা আব্বুকে কিডনাপ করেছে। আমি যদি ওর কথা মতো না চলি তাহলে ও আব্বুকে খুন করবে। আমি ওর শর্তে রাজি হয়ে যাই। পরের দিন সকালে আব্বুর খোঁজ পাওয়া যায়, মেডিকেল হসপিটালে তিনি। রাতে অফিস থেকে ফেরার সময় অফিসের সামনে কয়েকজন যুবক ঘিরে ধরে তাকে, তাদের একজন উনার মুখে রুমাল চেপে ধরে অজ্ঞান করে ফেলে।"
"পুলিশকে জানাসনি বিষয়টা?" কবির জিজ্ঞাসা করে।
"লাভ ছিল না। ও কাকে দিয়ে কাজটা করিয়েছে আমি জানি। ওর এক বন্ধু স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র নেতা। নাম শুনেছিস হয়তো, লিটু জাকের। ওর নামে এমনিতেই চার পাঁচটা চাঁদাবাজি আর খুনের মামলা ঝুলে আছে। একটা কিডন্যাপিংয়ের মামলা যোগ হলেও তাতে ওর কিছু হতো না। আর আসলে আমি সাহস হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি ওর কথা মতো ফিরে গিয়েছিলাম ওর কাছে, আম্মু আব্বুকে কিচ্ছু জানাইনি। আব্বু আম্মু হয়তো এখনো মনে করে আমি সুখেই আছি।"
"তারপর।"
"ওর বসের আর সাহস হয়নি আমাকে ছোঁয়ার। তবে সজল যা চেয়েছিল তা ওর বস বদরুল ভুঁইয়া করেছিল, সাইমন রহমানের সাথে ওকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। সাইমন রহমানের বাবা জিল্লুর রহমান কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। কিভাবে কিভাবে যেন সজল সাইমনের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলে। সাইমনের মাধ্যমে সজল প্রোমশনটাও পেয়ে যায়। তবে সজল শুধু সেই প্রমোশনটা পেয়ে খুশি থাকেনি। ওর লোভের কোন সীমা পরিসীমা নেই। ও শুরু থেকেই সাইমনের সামনে আমাকে সেজেগুজে লাস্যময়ী ভঙ্গিতে নিজেকে পরিবেশন করতে বাধ্য করে। ঐ লম্পট লোকটিও যখন তখন চলে আসত বাড়িতে, আমি যতোটা সম্ভব নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু আমি পারিনি। একদিন ঐ লোকটা বাসায় একলা পেয়ে..." বলতে বলতে ফুঁপিয়ে ওঠে স্নিগ্ধা। কবির ওকে জড়িয়ে নেয় বাহুডোরে, "আমি বুঝে গেছি, আর কিছু বলতে হবে না তোকে।"
"না কবির, আমাকে সবটা বলতে দে। ধর্ষণ আমার জন্য কোন নতুন বিষয় নয়। সজলের আসল রুপ প্রকাশিত হবার পর ওর সাথে শুতে আমার ঘৃণা হত। ওর সাথে শুতে না চাওয়াতে ও রোজ আমাকে মারধোর করতো, জোরপুর্বক ধর্ষণ করতো। কিন্তু সেদিনের ঐ ঘটনার পর বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা শেষ হয়ে গিয়েছিল। সিলিং ফ্যানের সাথে ওড়না পেঁচিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু ঝুলে পড়তে পারিনি, আমার মনে জ্বলতে থাকা ঘৃণার আগুন আমাকে মরতে দেয়নি। যতক্ষন পর্যন্ত পশুটাকে মৃত্যুর জন্য প্রার্থনা করতে না দেখব, আমি মরেও শান্তি পাব না। সাইমনের প্রতি আমার রাগ নেই, এ সবই সজলের চাল।
ঐ ঘটনাটির পর সজল কৃত্রিম রাগের অভিনয় শুরু করল। সাইমন তার বন্ধুর মান ভাঙানোর জন্য আরেকটি প্রস্তাব দেয়। রোয়ান রিয়েল এস্টেট থেকে রোয়ান কন্স্ট্রাকশন নামক একটি পৃথক কোম্পানি খোলার কথা হচ্ছে, সজলকে সেই কোম্পানির চিফ অব এক্সিকিউটিভ করার প্রতিশ্রুতি দেয় সে। সাথে আবদার করে আমাকে নিয়ে সাত দিনের জন্য কক্সেসবাজার ট্যুরে আসতে চায় সে। সজল রাজি হয়ে যায়। আমি পরিকল্পনায় ছিলাম সাইমনকে হাতে রেখে সজলের উপর প্রতিশোধ তুলব। কিন্তু এর মাঝে তুই চলে এলি।"
"তুই যে আগুন নিয়ে খেলতে চাইছিস তাতে তুই নিজেও পুড়ে যাবি।" কবির বলে।
"জানি আমি, কিন্তু উপায় নেই কোন।"
"তোকে সাথে নিয়ে বেঁচে থাকতে যে খুব সাধ জাগে এই বুকে। আর পাঁচটা সাধারন মানুষের মতো, যেখানে কোন ঘৃণার আগুন নেই, প্রতিশোধের আগুন নেই, শুধু ভালবাসা।"
"সেটা সম্ভব নয় কবির। ওরা আমাদেরকে বাঁচতে দিবে না।"
"সম্ভব, অবশ্যই সম্ভব। তুই আর আমি মিলে কোন উপায় বের করে নেব।" কবির বলে।
"আব্বু আম্মুর জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে আমার, সজল যদি কোন ক্ষতি করে।"
"আমি তোর কাছে থেকে শুনে যেটুকু বুঝলাম তাতে সজল যা কিছু করে ভেবে চিন্তে করে। যতোক্ষন না ও তোর সাথে যোগাযোগ করতে না পারছে ততোক্ষন আংকেল আন্টির কোন ক্ষতি করবে না। যখন তোর সাথে যোগাযোগ করবে তখন তোকে ব্ল্যাকমেইল করবে।
আমাদেরকে কিছুদিন লুকিয়ে থাকতে হবে। এরমধ্যে কোন উপায় খুঁজে বের করবই আমরা।"

কবির বিছানায় শুয়ে জানালার দিকে কাত হয়ে ছিল, জানালা দিয়ে ফুরফুরে বাতাস আসছে। স্নিগ্ধা একই বিছানায় অন্যপাশ হয়ে শুয়েছিল। ওরা ভীষন ক্লান্ত, পাহাড়ি রাস্তায় চার পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে এসেছে। সন্ধ্যার সময় পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটা সহজ কাজ নয়, খুব সাবধানে চলতে হয়েছে ওদের।
স্নিগ্ধা অন্য পাশ হয়ে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল। হঠাত কিছু একটার হাঁটা চলার শব্দ পায় সে।
"কবির, ঘুমিয়েছিস তুই?" স্নিগ্ধা অন্যপাশ হয়ে বলে।
"নাহ, এখনো ঘুমাইনি। কেন কি হয়েছে?" ওপাশ হয়েই বলে কবির।
"ঘরে কিছু একটা আছে।" স্নিগ্ধা বলে।
"ইঁদুর হবে হয়তো। পাহাড়ি ইঁদুর, বেশ বড়সড় হয়। তবে চিন্তা করিস না, বিছানায় ওঠার সাহস পাবে না।" কবির বলে।
স্নিগ্ধা এগিয়ে আসে কবিরের দিকে, পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে ওকে।
"আমার কথা তো সবই শুনলি, তোর সম্পর্কে বল, কোথায় ছিলি এতোদিন?"
"আজ না, অন্য কোন দিন বলব। তুই খুব ক্লান্ত, ঘুমানোর চেষ্টা কর।" স্নিগ্ধার দিকে পাশ ফিরে বলে কবির।
কিছুক্ষন নিরবতায় কেটে যায়।
"কি অতো ভাবছিস, কবির?" স্নিগ্ধা আবারও বলে।
"ওরা এই মুহুর্তে কি করছে, কি ভাবছে সেটাই ভাবছি।" ভাবুক কন্ঠে জবাব দেয় কবির।
"কি করছে ওরা?"
"ওরা আমাদেরকে খোঁজার চেষ্টা করছে। হয়তো পুলিশে জানিয়েছে, কিডন্যাপিং কেস হিসাবেই হয়তো দেখছে তারা।" কবির বলে।
"কিডন্যাপ!" অবাক হয়ে বলে স্নিগ্ধা।
"তোর কিডন্যাপ।" কবির বলে।
"যদি আমরা পুলিশকে সবকিছু খুলে বলে দেই?" স্নিগ্ধা বলে।
"ভাল আইডিয়া। কিন্তু তোর কি মনে হয় পুলিশকে সবকিছু বলে দেয়ার পর ওদের কি ক্ষমতা নেই সবকিছু ধামাচাপা দেয়ার?" কবির বলে।
"তা তো আছে।" স্নিগ্ধা বলে।
"আর তাছাড়া আমরা তো নিশ্চিত নই যে ওরা পুলিশকে জানিয়েছে নাকি অন্য কোনভাবে আমাদের খোঁজ করছে।"
"আমার মনে হয় আমাদের কোন নিস্তার নেই। যে কটা দিন তোর সাথে আছি আমি মন প্রান ভরে উপভোগ করতে চাই। "বলে স্নিগ্ধা কবিরকে আরো ভালভাবে বাহুডোরে জড়িয়ে নেয় এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। বাহুডোরে স্নিগ্ধার উষ্ণ নরম দেহটি কবিরের দেহেও উষ্ণতা ছড়িয়ে দিতে থাকে। কবির নিজেকে কন্ট্রোল করে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করে।
 
কবিরের ঘুম ভেঙে যায় খুব ভোরে, হয়তো পাখির কিচির মিচির শব্দে। ওর বাহুডোরে মিষ্টি এক অপ্সরী ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে, ওর মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। স্নিগ্ধার কপালে আলতো করে চুমু দেয় কবির, তারপর ওর বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চায়, কিন্তু ছাড়িয়ে নিতে পারে না। ছাড়িয়ে নিতে চাইলে ও আরো জড়িয়ে নেয় শক্ত করে। কবির এখনই স্নিগ্ধার ঘুম ভাঙাতে চায় না, তাই আর ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে না। ওর নিষ্পাপ মুখটির দিকে অপলক চেয়ে থাকে কবির। ওর দেহের নরমত্ব মনপ্রান ভরে অনুভব করতে থাকে কবির।
কতোক্ষন এভাবে ছিল জানেনা কবির, একসময় জানালা দিয়ে রোদ আসে ঘরের ভেতর। এখন আর শুয়ে থাকা যায় না, কবির স্নিগ্ধাকে ডাকে। স্নিগ্ধা একবার চোখ মেলে তাকায় তারপর ওকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে। কবির তখন ওর মিষ্টি মুখটি চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিতে থাকে। স্নিগ্ধা আবারও চোখ মেলে তাকায়, তারপর মিষ্টি করে হাসে। এতো সুন্দর জাগরন ওর কখনো হয়নি।

"এ্যাই, তুই চুমু দিচ্ছিস কেন?" স্নিগ্ধা বলে।
"আমার স্লিপিং বিউটির ঘুম ভাঙালাম। গল্পে শুনিস নি?" কবির বলে।
"গল্পে তো ঠোঁটে চুমু দিয়ে ঘুম ভাঙায়।" দুষ্টুমি ভরা হাসি দিয়ে বলে স্নিগ্ধা।
"ও তাই! ঠিক আছে।" বলে ঠোঁটে চুমু দেবার জন্য এগিয়ে আসে কবির।
"উহু, এভাবে নয়। একটু একটু এগিয়ে আন, চোখ বন্ধ কর।"
কবির ওর কথা মত চোখ বন্ধ করতেই স্নিগ্ধা ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে নিজে সরে যায়, কবির ওকে ধরতে এলে বিছানা থেকে উঠে খিলখিল করে হাসতে হাসতে ঘর থেকে বের হয়ে যায় স্নিগ্ধা, কবির ওর পিছু নেয়।

"ওয়াও, কি অপুর্ব!" বাইরের দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে বলে স্নিগ্ধা।
একটি পাহাড়ের উপর খানিকটা সমতল যায়গায় কাঠ ও বাঁশের তৈরী দুটো ঘরের একটি ছোট্ট বাড়ি। বাড়ির সামনের দিকে একটি পাহাড়ি জলাশয়। বাড়িটির পেছনের দিকটায় পাহাড়ি বন। স্নিগ্ধা চারিদিক ঘুরে ফিরে দেখে।
"এটা কোন যায়গা? এই বাড়িটাই বা কার?" স্নিগ্ধা বলে।
"বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার অন্তর্গত। এখান থেকে প্রায় তিন-চার মাইল দুরে বানিয়াচং নামের একটি গ্রামে একটি ফার্নিচারের দোকানে আমি কাজ করতাম, প্রায় দেড় বছর আগে। বনে গাছ কাটতে এসে এই বাড়িটার খোঁজ পাই। তখন বাড়িটা ফাঁকা পড়ে ছিল, কার বাড়ি জানি না। তখন চাকরীটা বাদ দিয়ে এইখানে উঠে পড়ি, পাঁচ মাস ছিলাম এখানে।" কবির বলে।
"এখন যদি এই বাড়ির আসল মালিক চলে আসে, তখন?" স্নিগ্ধা বলে।
"আসবে না। এইটা অনেক পুরনো বাড়ি। আমি যখন এসেছিলাম তখন থাকার অযোগ্য ছিল, অনেক কষ্টে মেরামত করেছি।" কবির বলে।
"সবই বুঝলাম, কিন্তু ওয়াশরুম কোথায়? আমি হাতমুখ ধোব।" স্নিগ্ধা বলে।
"আয় আমার সাথে।" বলে কবির প্রথমে ঘরে ঢুকে একটা মাটির কলসি নেয় তারপর পেছনের বনের দিকে হাঁটতে থাকে। স্নিগ্ধা ওকে অনুসরণ করে। কিছুদুর গিয়ে কবির একটি নিম গাছের সামনে এসে থেমে যায়। কলসিটা স্নিগ্ধার হাতে দিয়ে, কবির গাছে উঠে যায়। গাছের একটি ডাল ভেঙে নেমে আসে।
"এই নে তোর টুথব্রাশ।" বলে ডালটির এক টুকরা স্নিগ্ধার হাতে তুলে দেয়।
"তুই তো ভালই গাছে উঠতে পারিস, আমাকে শেখাবি?" স্নিগ্ধা বলে।
"অন্য কোনদিন। এখন চল।" বলে কবির আবারও হাঁটতে থাকে। আর কিছুদুর যেয়ে ওরা একটা ঝরনা দেখতে পায়, ছোট্ট একটি ঝরনা।
"এইযে তোর ওয়াসরুম।" কবির বলে।
"আমি এরকম কিছুই ভেবেছিলাম, তবে আরো বড় ঝর্ণা আশা করেছিলাম। তবে এটাও মন্দ নয়।" বলে স্নিগ্ধা এগিয়ে গিয়ে ঝর্নার পানিতে হাতমুখ ধুয়ে নেয়।
কবির হাতমুখ ধুয়ে কলসিটা ভরে নেয়।

কলসিতে পানি ভরে নিয়ে ওরা ঘরে ফিরে আসে। ততোক্ষনে রোদের তেজ বাড়তে শুরু করেছে।
"আজ কি খাবি বল? মাছ নাকি অন্য কিছু?" কবির বলে।
"এখানে আসে পাশে বাজার আছে নাকি?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে।
"নাহ, সামনের ঐ লেক থেকে মাছ ধরব, অথবা অন্যকিছু।" কবির বলে।
"অন্য কিছু মানে?"
"পাখি ধরার চেষ্টা করতে পারি, আমার কাছে গুলতি আছে।"
"যাহ্, অতো সুন্দর পাখিগুলোকে তুই মারবি?"
"পশুপাখি, গাছপালা, মাছ সবই তো সুন্দর, তবু এখানে বেঁচে থাকতে কিছুটা নিষ্ঠুর হতেই হয়।" কবির বলে।
"তাহলেও পাখি নয়, তারচেয়ে বরং মাছ। কিন্তু কিভাবে ধরবি?" স্নিগ্ধা বলে।
"আমার কাছে জাল আছে। দেখাচ্ছি তোকে।" বলে কবির খাটের নিচে থেকে মাছ ধরার জাল টেনে বের করে।
"সর্বনাশ, জাল তো ইঁদুরে কেটেছে।" কবির বলে। জালটির মাঝামাঝি অনেকটাই কাটা।
"ইঁদুর ভর্তি ঘরে জাল রেখেছিস খাটের নিচে। ইঁদুর তো কাটবেই।" স্নিগ্ধা বলে।
"আমার কি আর ফিরে আসার প্ল্যান ছিল? সমস্যা নেই, এটা মেরামত করা যাবে। আর তাছাড়া আমার কাছে ছিপ বঁড়শিও আছে।" বলে কবির পাশের রুমে থেকে ছিপ নিয়ে আসে।
"তুই কি যাবি আমার সাথে মাছ ধরতে?"
"অবশ্যই।"
"তাহলে চুপ থাকতে হবে এবং ধৈর্য রাখতে হবে। বঁড়শি দিয়ে মাছ ধরতে অনেক ধৈর্য দরকার।" বলে কবির ছিপ বঁড়শি ও মাছ রাখার খাচি নিয়ে পাহাড়ি লেকটার দিকে যায়, সাথে স্নিগ্ধা। লেকের কিনারায় এসে কবির কিছু একটা খুঁজতে থাকে।
"কি খুঁজছিস কবির?" স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করে।
"বঁড়শির টোপ খুঁজছি।"
কিছুক্ষন খোঁজাখুঁজির পর কবির একটি শামুক খুঁজে পায়। লেকের ধারে একটি গাছের ছায়ায় বসে কবির বঁড়শি ফেলে লেকে। স্নিগ্ধা ওর পাশে বসে উদাস দৃষ্টিতে লেকের ওপারের পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। কবির ওকে আড়চোখে দেখে, স্নিগ্ধা একটি মিষ্টি রঙের ইয়েনজি পরে আছে। ইয়েনজি অনেকটা লং কামিজের মতো পোশাক, শুধু শার্টের মতো বোতাম রয়েছে সামনে। আসার সময় একটি মারমাদের গ্রাম থেকে কিছু পোশাক কিনেছিল ওরা। যদিও পোশাকটা একটু বেশি ঢিলে হয়েছে তবুও ওকে অপুর্ব লাগছে।
"কিরে, চুপ মেরে গেলি কেন?" কবির বলে।
"তুই না বললি মাছ ধরার সময় চুপচাপ থাকতে হয়।" স্নিগ্ধা বলে।
"আমি মানা করলাম আর তুই চুপ হয়ে যাবি, এমন মেয়ে তো তুই নস।" কবির বলে।
"খুব টেনশন হচ্ছেরে। আম্মু, আব্বু আমার জন্য খুব টেনশন করছে হয়তো।" স্নিগ্ধা চিন্তিত কন্ঠে বলে।
"টেনশন তো করবেনই। তুই তাদের একমাত্র মেয়ে, নয়নের মনি, এভাবে হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেলি, টেনশন করবেন না?"
"ভুল আমি করেছি সজলকে বিয়ে করে। সে ভুলের শাস্তি আমিই পেতাম। কিন্তু এর জন্য আম্মু আব্বুর কোন ক্ষতি হোক আমি তা চাই না। আম্মুর এমনিতে হাই ব্লাড পেশার, যদি টেনশনে কিছু হয়ে যায়!"
"ফিরে যেতে চাস?" দীর্ঘশ্বাসকে গোপন করার চেষ্টা করে বলে কবির।
"তুই যেতে দিবি?"
"কেন দেব না? তুই চাইলে তোকে তোর বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।" কবির বলে।
"আবারও সেই একই জেদ।"
"জেদ নয়, একা এক মেয়েকে অচেনা যায়গায় একা ছেড়ে দেব এতোবড় বিবেকহীন আমি নই। আমার জায়গায় তুই হলে পারতি?"
"আচ্ছা, যেতে না দিলি, আব্বু আম্মুর সাথে ফোনে কথা তো বলতে দিবি।"
"আমার মোবাইল নেই, তুইও মোবাইল আনিসনি। মোবাইল থাকলেও লাভ হতো না, নেটওয়ার্ক নেই এ অঞ্চলে। তিন চার মাইল দুরে একটি গ্রাম আছে, ওখানে নেটওয়ার্কও পাবি, মোবাইলের দোকানও। যেতে হলে এখনই রওনা দিতে হবে।"
"আজ নয়, কালকে যাব।"
"ঠিক আছে।" কবির বলে।
ঠিক তখনই স্নিগ্ধা দেখে কিছু একটা বঁড়শির শোলাটাকে নিচের দিকে টেনে নিচ্ছে।
"এই, এই, মাছ উঠেছে" উচ্ছসিত কন্ঠে বলে স্নিগ্ধা।
কবির ছিপটাকে টান দিয়ে তোলে, একটি মাঝারি আকৃতির সরপুঁটি উঠেছে বড়শিতে। স্নিগ্ধা উচ্ছাসে হাততালি দিয়ে ওঠে। কবির মাছটাকে বঁড়শি থেকে ছাড়িয়ে মাছ রাখার পাত্রে রাখে।
"এবার আমি মাছ ধরব।" স্নিগ্ধা আবদার করে বলে।
"ঠিক আছে, আয় বোস এখানে। তবে বঁড়শিতে মাছ ধরার কিছু কায়দা আছে।" কবির বলে।
"তাহলে শিখিয়ে দে।"
কবির ওকে বঁড়শিতে মাছ ধরার কায়দাগুলো শিখিয়ে দিতে লাগল।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top