পানিতে ভিজতে ভিজতে দুজনেরই হাত পা প্রায় শিঁটকে আসার উপক্রম হচ্ছিল। তারা নিজেদের শরীর মুছে নিতে লাগল খড় দিয়ে।
"সবকিছুই দেখি পুর্বপরিকল্পিত।" খড় দিয়ে গা মুছতে মুছতে বলে কবির।
"নিখুঁত প্ল্যান ছাড়া এতো রিস্কের কাজ করা যায় না।" তুহিন বলে।
"আমি কি এই প্ল্যানের ভেতরে ছিলাম? নাকি হঠাত করে ঢুকে পড়েছি?" কবির বলে।
"আপনি তো প্রথম থেকেই ছিলেন, কবির ভাই।"
"আমরা এখন যাচ্ছি কোথায়?"
"এই ট্রাক যাচ্ছে খুলনার দিকে।" তুহিন বলে।
হঠাত ট্রাকটা থেমে যায়।
"কি হল মনসুর ভাই? ট্রাক থামাইলা কেন?" ট্রাকের দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে তুহিন।
"স্যার ফোন দিছে, এই নাও।" ট্রাক ড্রাইভার একটি ফোন আর সাথে একটি কাপড়ের পোঁটলা ও পানির বোতল ট্রাকের জানালা দিয়ে বাড়িয়ে দেয়।
"হ্যালো বস। আমরা একেবারে ঠিক আছি, কোন চিন্তা করবেন না। এখন পর্যন্ত সবকিছু একেবারে প্ল্যান মোতাবেক হয়েছে।"
একটু থেমে তুহিন বলে "ঠিক আছে বস, রাখি।"
ফোন কেটে দিয়ে তুহিন পোঁটলাটা খোলে। পোঁটলার ভেতরে দুটো হাফ হাতা শার্ট আর দুটি লুঙ্গি আর একটি পলিথিন ব্যাগে মুড়ি ও গুড় ছিল।
"শার্ট আর লুঙ্গিটা পইরা নেন, কতোক্ষন আর কয়েদিদের পোশাকে থাকবেন।" বলে একটি শার্ট ও লুঙ্গি এগিয়ে দেয় কবিরের দিকে।
দুজন গুড় মুড়িটুকু খেয়ে নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে। কবিরের মনে অনেক প্রশ্ন খেলে যাচ্ছিল, কিন্তু এখন আর সেসব নিয়ে ভাবতে ইচ্ছা করছিল না।
কবিরের ঘুম ভাঙে যখন ততোক্ষনে রোদ উঠে গেছে। তুহিন ঘুম থেকে উঠেছে আগেই, হেলান দিয়ে বসে সিগারেট টানছিল, কবিরকে দেখে বাড়িয়ে দেয়।
"নো, থ্যাংক্স। আর কত দুর?"
"এই তো আইসাই গেছি। আর ঘন্টা খানেক।"
দেড় ঘন্টা পর ট্রাকটা থেমে যায় খুলনার একটি মফস্বল এলাকায়। শহর থেকে খানিকটা দুরে, তবে একেবারে অজ পাড়াগাঁ নয়। ট্রাক থেকে নেমে আরো পনেরো মিনিট হাঁটতে হল ওদেরকে। একটি বাড়ির সামনে এসে তুহিন থেমে যায়, মোবাইল বের করে ফোন দেয়।
"হ্যালো বস, আমরা এসে গেছি।"
অন্যপাশ থেকে কিছু একটা বলে যা কবির শুনতে পায় না। তুহিন সিকিউরিটি গার্ডদের দিকে এগিয়ে গিয়ে কিছু একটা বলে, তারপর কবিরকে ইশারা করে আসার জন্য।
বাইরে থেকে যেটাকে একটি বাড়ি বলে মনে হচ্ছে, গেট পেরিয়ে সেটাকে বড়সড় গুদাম বলেই মনে হল। গুদামটির একপাশে একটি দোতলা রেস্টহাউস, তুহিন সেদিকে এগিয়ে যায়। সিঁড়ি পেরিয়ে দোতলায় উঠে এসে কলিংবেল চাপে এবং সাথে সাথে দরজা খুলে যায়।
ভেতরে লম্বা চওড়া একজন ব্যাক্তি হাসিমুখ নিয়ে দাড়িয়ে ছিল।
"যাক, তোরা পেরেছিস তাহলে। আমি তো খুব চিন্তায় ছিলাম।"
"আগে ভেতরে আসতে দাও, বস। বাইরে প্রচুর গরম।" বলে প্রায় ঠেলে ঢুকে যায় তুহিন।
লোকটাকে চিনতে কবিরের একটুও কষ্ট হয় না।
"সোয়েব স্যার! আপনি?" কবির বিষ্মিত কন্ঠে বলে।
"কবির, ভেতরে এসো। একেবারে ঘেমে গেছ যে।" সোয়েব বলে।
"তার মানে তুহিন আপনার লোক?" সোফায় বসতে বসতে বলে কবির।
"তোমার এই প্রশ্নটির উত্তর একইসাথে হ্যাঁ এবং না। তুহিনকে আমি চিনি অনেকদিন ধরে। ছয় বছর আগে একটি জুয়েলারি দোকান চুরির ঘটনায় তুহিন ও তার দলের তিনজনকে হাতে নাতে ধরেছিলাম। তুহিনের পাঁচ বছরের জেল হয়েছিল। কিন্তু ছয়মাস পরই ও পালিয়ে যায়। ওকে ধরার দায়িত্ব আবারও আমার ঘাড়েই পড়েছিল। দুই মাস লেগেছিল ওকে ধরতে। যখন তোমার ফাঁসির রায় দেয় আদালত তখন তুহিনেরও সাত বছরের জেল হয়েছিল। এবং তোমরা দুজনকেই কাশেমপুর জেলে পাঠানো হয়েছে, এটা একটা কো ইন্সিডেন্স। আমি তুহিনের সাথে যোগাযোগ করে একটি ডিল করে ফেলি।"
"ভাল কথা মনে করে দিলে, বস। আমার পেমেন্ট এখনো অর্ধেক বাকি।" তুহিন বলে ওঠে।
"তোর পেমেন্ট রেডিই আছে।" বলে সোয়েব উঠে যায় পাশের রুমে। একটি ব্রিফকেস এনে টেবিলের ওপর রাখে।
"পুরো পাঁচ লাখ আছে। গুনে নে।" সোয়েব বলে।
"এতো টাকা....."
"আমি দেইনি। ডক্টর শাফাকাত হোসেনকে তুমি চেন?" কবিরকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে সোয়েব।
"শাফাকাত আংকেল?"
"তিনি আমার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। তোমাকে যে করেই হোক ছাড়িয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেছিলেন। তুহিনকে পেমেন্ট তিনিই করেছেন, আর এই যায়গাটাও ওনারই।" একটু থেমে আবার বলে সোয়েব "তোমরা যে ঠিক ঠাক পৌঁছিয়েছ তা স্যারকে জানাতে ভুলে গেছি।"
সোয়েব তার ফোন বের করে শাফাকাত সাহেবকে ফোন করে, দ্বিতীয়বার রিং হওয়ার সাথে সাথে রিসিভ হয়।
"স্যার, ওরা ঠিকঠাকভাবে এসে গেছে। সবকিছু প্ল্যান মোতাবেক হয়েছে।" সোয়েব বলে।
"থ্যাংকস গড! কবির ঠিক আছে তো?" জীর্ণ কন্ঠে বলে শাফাকাত।
"নিন কথা বলুন।" বলে সোয়েব ফোনটি কবিরকে দেয়।
"কবির, তুমি ঠিক আছ তো?"
"জি আংকেল।"
"কবির, সবসময় তোমাকে আমি নিজের ছেলের মতো ভেবেছি, কিন্তু তুমি হয়তো আমাকে কখনো আপন ভাবতে পারনি। এতো কিছু হয়ে গেল আর আমাকে কখনো কিছু জানানোর চেষ্টা করলে না! আমি যখন তোমার বিপদের বিষয়ে শুনি তখন আমি মেলবোর্নে আর আদালতে তোমার ফাঁসির আদেশ দিয়ে দিয়েছে। আগে জানলে হয়তো তোমাকে আইনত ছাড়িয়ে আনতে পারতাম। যাই হোক, এখন তোমাকে কিছুদিন লুকিয়ে থাকতে হবে, যতদিন না স্নিগ্ধাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে এবং মামলা নিস্পত্তি হচ্ছে। সোয়েব একজন দায়িত্ববান পুলিশ অফিসার, সবসময় ওর কথামতো চলবে।"
"জি আংকেল।" বলে ফোনটি কেটে দেয় কবির।
"স্যার, স্নিগ্ধার কোন খবর পেলেন?" কবির বলে।
"আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি স্নিগ্ধাকে খুঁজে বের করার জন্য।"
স্নিগ্ধা বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে ছিল, শরৎচন্দ্রের একটি উপন্যাস পড়ছিল। গল্প পড়ছিল বললে হয়তো কিঞ্চিত ভুল হয়, গল্প পড়ার চেষ্টা করছিল, কিন্তু বারবার মন অন্য কোথাও হারিয়ে যাচ্ছিল। স্নিগ্ধার দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে এভাবেই, শুয়ে বসে। গর্ভে সন্তানের বয়স প্রায় ছয় মাস হতে চলল, এ অবস্থায় খুব সাবধানে চলা ফেরা করতে হবে, কোন রকম ভারী কাজ করা যাবে না, কোনরকম টেনশন করা চলবে না - তার শাহেদা আন্টির কড়া নির্দেশ। সন্তানের কথা ভেবে টেনশন থেকে দুরে থাকতে কখনো কখনো বই পড়ার চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুতেই টেনশন থেকে দুরে থাকতে পারে না। প্রায় দেড় মাস হল স্নিগ্ধা এই বাড়িতে আছে। বাড়িটি শাহেদা বেগমের। তিনি স্থানীয় গার্লস স্কুলের প্রিন্সিপাল, পঞ্চাশোর্ধ ব্যাক্তিত্বময়ী একজন নারী।
থানা থেকে ফিরে আসার পর স্নিগ্ধা চেয়েছিল তার বাবা মার সাথে যোগাযোগ করতে। তার বাবা মা দুজনার মোবাইল নাম্বারই বন্ধ পেয়েছে সে। তখন সে মজিদকে সাথে নিয়ে তার বাড়িতে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু শাহেদা মানা করে, সেই অবস্থায় স্নিগ্ধার লং জার্নি করা একেবারেই উচিত হতো না। মজিদ একাই রওনা দেয় বগুড়ার উদ্দেশ্যে, স্নিগ্ধাদের বাড়িটি তালাবদ্ধ পায় সে। প্রতিবেশীদের কাছে থেকে জানতে পারে স্নিগ্ধার মা বাবা চিকিৎসার জন্য ভারতে গেছে, তিন মাস পরে ফিরবে তারা। এরপর প্রায় দেড় মাস কেটে গেছে কবিরের কোন খবর পায়নি, আর না মা বাবার কোন খবর। কখনো কখনো ভাবে সেখান থেকেও পালিয়ে যাবে সে, আর কবিরের খোঁজ করবে, কিন্তু সন্তানের জীবন ঝুঁকির মাঝে ফেলে দিতে চায় না স্নিগ্ধা।
হঠাত কলিংবেলের শব্দে ভাবনার জগত থেকে ফিরে আসে স্নিগ্ধা।
"শিমলী, এই শিমলী দেখতো কে এল।" স্নিগ্ধা উচ্চস্বরে বলে
শিমলী তেরো চোদ্দ বছর বয়সী মেয়ে, শাহেদার দুর সম্পর্কের আত্মীয়।
শীমলীর সারা শব্দ না পেয়ে স্নিগ্ধা নিজেই উঠে দরজা খুলে দেয়।
"মজিদ কাকা যে। ভেতরে আসুন।" মিষ্টি করে হেসে বলে স্নিগ্ধা। মজিদ ব্যাগভর্তি বাজার টেনে আনে।
"ভাল আছ তো, মা?" মজিদ বলে।
"জি ভাল আছি। আপনি ভাল আছেন? বসুন কাকা।"
"আল্লার দয়ায় ভালই আছি। আজ আর বসমু না। আপা বাজার পাঠাইছে। এখন আসি, কাইল আসমুনি একবার।" বলে মজিদ বেরিয়ে যায়।
স্নিগ্ধা উঠে মসলার খালি কৌটাগুলো এনে তাতে মসলা ঢালতে শুরু করে।
"আরে আপা, কর কি! খালায় আপনারে কাজ করতে মানা করছে না?" শিমলী ছুটে আসতে আসতে বলে।
"সারাদিন তো বসেই আছি, এইটুকু কাজ করলে কিচ্ছু হবে না।" কাজ না থামিয়ে বলে স্নিগ্ধা।
কাগজে মোড়ানো গরম মসলা কৌটায় ভরে কাগজটি ফেলে দিতে গিয়ে হঠাত থেমে যায় স্নিগ্ধা। কাগজটি ছিল একটি পত্রিকার টুকরো, যাতে কবিরের ছবি। উস্কোখুস্কো বাবড়ি চুল আর মুখ ভর্তি দাড়ি সত্তেও কবিরকে চিনতে স্নিগ্ধার একটুও অসুবিধা হয় না। ছবিতে কবিরের হাতে হাতকড়া ও তার আসেপাশে পুলিশ, প্রিজন ভ্যানে তোলার আগের মুহুর্তের ছবি। নিচে হেডলাইন লেখা "চাঞ্চল্যকর মামলা সাদিয়া ধর্ষন এবং সাইমন হত্যা মামলার আসামী শাহরিয়ার কবিরের ফাঁসির রায়"।
মুহুর্তের মাঝে স্নিগ্ধার জগতটি যেন আঁধারে ছেয়ে গেল। এক মুহুর্ত নিশ্চুপ থেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে স্নিগ্ধা।
"কি হইছে আপা? কি হইছে?" শিমলী বলে।
শিমলীর কথার কোন জবাব দেয় না, ছুটে যায় তার রুমের দিকে।
বিকেলবেলা যখন শাহেদা ফিরে আসে তখন শিমলী তাকে দুপুরের ঘটনাটি খুলে বলে। শাহেদা স্নিগ্ধার রুমে যায়।
স্নিগ্ধা বিছানায় বসে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল, তার গাল বেয়ে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর দাগ। শাহেদা যে তার পাশে বসেছে তা সে লক্ষ করেনি।
"কি হয়েছে মা? শিমলীর কাছে শুনলাম তুমি দুপুরে কিছু খাওনি, শুধু কাঁদছ।"
স্নিগ্ধা আবারো ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। শাহেদা ওকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলে "কিছু না বললে কি করে বুঝব? কি হয়েছে মা?"
স্নিগ্ধা খবরের কাগজের টুকরোটি শাহেদার হাতে দেয়। স্নিগ্ধা কথা বলতে পারছিল না, বাচ্চা মেয়ের মতো ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।
"খবরটা তো আগেও পড়েছি। কিন্তু কি হয়েছে তা তো..." বলতে গিয়ে থেমে যায় শাহেদা। সে যেন একটু একটু বুঝতে পারছে।
"এই কি সেই কবির যার কথা তুমি বলেছিলে? যাকে তুমি ভালবাস?" শাহেদা বলে।
"স্নিগ্ধা হ্যাঁ বোধক ভাবে মাথা নাড়ে।
"যে মেয়েটিকে ধর্ষিতা বলা হচ্ছে, সে আমি। আমার পুরো নাম সাদিয়া আক্তার স্নিগ্ধা।" কোনরকম বলে ফেলে স্নিগ্ধা।
শাহেদা খবরটির দিকে একবার চোখ বুলায়।
"আর এই সায়মন?" শাহেদা জিজ্ঞাসা করে।
স্নিগ্ধা শাহেদা আর মজিদের কাছে সায়মনের বিষয়টা চেপে গিয়েছিল, এবার স্নিগ্ধা পুরো ঘটনাটাই খুলে বলে।
"এতোদিন শুনেছি যে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে অনেক অপরাধীরা বেরিয়ে যায়। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি অপরাধীদের সাহস এতো বেড়ে গেছে যে আইনকেই ব্যাবহার করে রাতকে দিন আর দিনকে রাত করছে।"
"কি করব আমি, বুঝতে পারছি না। আন্টি সত্যি সত্যি বলুনতো ও কি বেঁচে আছে? নাকি ওরা ওকে..." বলতে গিয়ে কথা আটকে যায় স্নিগ্ধার।
"কয়েকদিন আগে খবর শুনেছিলাম যে কবির জেল থেকে পালিয়েছে। আশা করি বেঁচে আছে এখনো। তবে আমাদের যা করার তা যতোটা সম্ভব তাড়াতাড়ি করতে হবে। আমার মনে হয় সবাইকে সত্যটা জানানো উচিত। এ জন্য সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করতে পারি আমরা।" শাহেদা বলে।
"সবকিছুই দেখি পুর্বপরিকল্পিত।" খড় দিয়ে গা মুছতে মুছতে বলে কবির।
"নিখুঁত প্ল্যান ছাড়া এতো রিস্কের কাজ করা যায় না।" তুহিন বলে।
"আমি কি এই প্ল্যানের ভেতরে ছিলাম? নাকি হঠাত করে ঢুকে পড়েছি?" কবির বলে।
"আপনি তো প্রথম থেকেই ছিলেন, কবির ভাই।"
"আমরা এখন যাচ্ছি কোথায়?"
"এই ট্রাক যাচ্ছে খুলনার দিকে।" তুহিন বলে।
হঠাত ট্রাকটা থেমে যায়।
"কি হল মনসুর ভাই? ট্রাক থামাইলা কেন?" ট্রাকের দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে তুহিন।
"স্যার ফোন দিছে, এই নাও।" ট্রাক ড্রাইভার একটি ফোন আর সাথে একটি কাপড়ের পোঁটলা ও পানির বোতল ট্রাকের জানালা দিয়ে বাড়িয়ে দেয়।
"হ্যালো বস। আমরা একেবারে ঠিক আছি, কোন চিন্তা করবেন না। এখন পর্যন্ত সবকিছু একেবারে প্ল্যান মোতাবেক হয়েছে।"
একটু থেমে তুহিন বলে "ঠিক আছে বস, রাখি।"
ফোন কেটে দিয়ে তুহিন পোঁটলাটা খোলে। পোঁটলার ভেতরে দুটো হাফ হাতা শার্ট আর দুটি লুঙ্গি আর একটি পলিথিন ব্যাগে মুড়ি ও গুড় ছিল।
"শার্ট আর লুঙ্গিটা পইরা নেন, কতোক্ষন আর কয়েদিদের পোশাকে থাকবেন।" বলে একটি শার্ট ও লুঙ্গি এগিয়ে দেয় কবিরের দিকে।
দুজন গুড় মুড়িটুকু খেয়ে নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে। কবিরের মনে অনেক প্রশ্ন খেলে যাচ্ছিল, কিন্তু এখন আর সেসব নিয়ে ভাবতে ইচ্ছা করছিল না।
কবিরের ঘুম ভাঙে যখন ততোক্ষনে রোদ উঠে গেছে। তুহিন ঘুম থেকে উঠেছে আগেই, হেলান দিয়ে বসে সিগারেট টানছিল, কবিরকে দেখে বাড়িয়ে দেয়।
"নো, থ্যাংক্স। আর কত দুর?"
"এই তো আইসাই গেছি। আর ঘন্টা খানেক।"
দেড় ঘন্টা পর ট্রাকটা থেমে যায় খুলনার একটি মফস্বল এলাকায়। শহর থেকে খানিকটা দুরে, তবে একেবারে অজ পাড়াগাঁ নয়। ট্রাক থেকে নেমে আরো পনেরো মিনিট হাঁটতে হল ওদেরকে। একটি বাড়ির সামনে এসে তুহিন থেমে যায়, মোবাইল বের করে ফোন দেয়।
"হ্যালো বস, আমরা এসে গেছি।"
অন্যপাশ থেকে কিছু একটা বলে যা কবির শুনতে পায় না। তুহিন সিকিউরিটি গার্ডদের দিকে এগিয়ে গিয়ে কিছু একটা বলে, তারপর কবিরকে ইশারা করে আসার জন্য।
বাইরে থেকে যেটাকে একটি বাড়ি বলে মনে হচ্ছে, গেট পেরিয়ে সেটাকে বড়সড় গুদাম বলেই মনে হল। গুদামটির একপাশে একটি দোতলা রেস্টহাউস, তুহিন সেদিকে এগিয়ে যায়। সিঁড়ি পেরিয়ে দোতলায় উঠে এসে কলিংবেল চাপে এবং সাথে সাথে দরজা খুলে যায়।
ভেতরে লম্বা চওড়া একজন ব্যাক্তি হাসিমুখ নিয়ে দাড়িয়ে ছিল।
"যাক, তোরা পেরেছিস তাহলে। আমি তো খুব চিন্তায় ছিলাম।"
"আগে ভেতরে আসতে দাও, বস। বাইরে প্রচুর গরম।" বলে প্রায় ঠেলে ঢুকে যায় তুহিন।
লোকটাকে চিনতে কবিরের একটুও কষ্ট হয় না।
"সোয়েব স্যার! আপনি?" কবির বিষ্মিত কন্ঠে বলে।
"কবির, ভেতরে এসো। একেবারে ঘেমে গেছ যে।" সোয়েব বলে।
"তার মানে তুহিন আপনার লোক?" সোফায় বসতে বসতে বলে কবির।
"তোমার এই প্রশ্নটির উত্তর একইসাথে হ্যাঁ এবং না। তুহিনকে আমি চিনি অনেকদিন ধরে। ছয় বছর আগে একটি জুয়েলারি দোকান চুরির ঘটনায় তুহিন ও তার দলের তিনজনকে হাতে নাতে ধরেছিলাম। তুহিনের পাঁচ বছরের জেল হয়েছিল। কিন্তু ছয়মাস পরই ও পালিয়ে যায়। ওকে ধরার দায়িত্ব আবারও আমার ঘাড়েই পড়েছিল। দুই মাস লেগেছিল ওকে ধরতে। যখন তোমার ফাঁসির রায় দেয় আদালত তখন তুহিনেরও সাত বছরের জেল হয়েছিল। এবং তোমরা দুজনকেই কাশেমপুর জেলে পাঠানো হয়েছে, এটা একটা কো ইন্সিডেন্স। আমি তুহিনের সাথে যোগাযোগ করে একটি ডিল করে ফেলি।"
"ভাল কথা মনে করে দিলে, বস। আমার পেমেন্ট এখনো অর্ধেক বাকি।" তুহিন বলে ওঠে।
"তোর পেমেন্ট রেডিই আছে।" বলে সোয়েব উঠে যায় পাশের রুমে। একটি ব্রিফকেস এনে টেবিলের ওপর রাখে।
"পুরো পাঁচ লাখ আছে। গুনে নে।" সোয়েব বলে।
"এতো টাকা....."
"আমি দেইনি। ডক্টর শাফাকাত হোসেনকে তুমি চেন?" কবিরকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে সোয়েব।
"শাফাকাত আংকেল?"
"তিনি আমার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। তোমাকে যে করেই হোক ছাড়িয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেছিলেন। তুহিনকে পেমেন্ট তিনিই করেছেন, আর এই যায়গাটাও ওনারই।" একটু থেমে আবার বলে সোয়েব "তোমরা যে ঠিক ঠাক পৌঁছিয়েছ তা স্যারকে জানাতে ভুলে গেছি।"
সোয়েব তার ফোন বের করে শাফাকাত সাহেবকে ফোন করে, দ্বিতীয়বার রিং হওয়ার সাথে সাথে রিসিভ হয়।
"স্যার, ওরা ঠিকঠাকভাবে এসে গেছে। সবকিছু প্ল্যান মোতাবেক হয়েছে।" সোয়েব বলে।
"থ্যাংকস গড! কবির ঠিক আছে তো?" জীর্ণ কন্ঠে বলে শাফাকাত।
"নিন কথা বলুন।" বলে সোয়েব ফোনটি কবিরকে দেয়।
"কবির, তুমি ঠিক আছ তো?"
"জি আংকেল।"
"কবির, সবসময় তোমাকে আমি নিজের ছেলের মতো ভেবেছি, কিন্তু তুমি হয়তো আমাকে কখনো আপন ভাবতে পারনি। এতো কিছু হয়ে গেল আর আমাকে কখনো কিছু জানানোর চেষ্টা করলে না! আমি যখন তোমার বিপদের বিষয়ে শুনি তখন আমি মেলবোর্নে আর আদালতে তোমার ফাঁসির আদেশ দিয়ে দিয়েছে। আগে জানলে হয়তো তোমাকে আইনত ছাড়িয়ে আনতে পারতাম। যাই হোক, এখন তোমাকে কিছুদিন লুকিয়ে থাকতে হবে, যতদিন না স্নিগ্ধাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে এবং মামলা নিস্পত্তি হচ্ছে। সোয়েব একজন দায়িত্ববান পুলিশ অফিসার, সবসময় ওর কথামতো চলবে।"
"জি আংকেল।" বলে ফোনটি কেটে দেয় কবির।
"স্যার, স্নিগ্ধার কোন খবর পেলেন?" কবির বলে।
"আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি স্নিগ্ধাকে খুঁজে বের করার জন্য।"
স্নিগ্ধা বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে ছিল, শরৎচন্দ্রের একটি উপন্যাস পড়ছিল। গল্প পড়ছিল বললে হয়তো কিঞ্চিত ভুল হয়, গল্প পড়ার চেষ্টা করছিল, কিন্তু বারবার মন অন্য কোথাও হারিয়ে যাচ্ছিল। স্নিগ্ধার দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে এভাবেই, শুয়ে বসে। গর্ভে সন্তানের বয়স প্রায় ছয় মাস হতে চলল, এ অবস্থায় খুব সাবধানে চলা ফেরা করতে হবে, কোন রকম ভারী কাজ করা যাবে না, কোনরকম টেনশন করা চলবে না - তার শাহেদা আন্টির কড়া নির্দেশ। সন্তানের কথা ভেবে টেনশন থেকে দুরে থাকতে কখনো কখনো বই পড়ার চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুতেই টেনশন থেকে দুরে থাকতে পারে না। প্রায় দেড় মাস হল স্নিগ্ধা এই বাড়িতে আছে। বাড়িটি শাহেদা বেগমের। তিনি স্থানীয় গার্লস স্কুলের প্রিন্সিপাল, পঞ্চাশোর্ধ ব্যাক্তিত্বময়ী একজন নারী।
থানা থেকে ফিরে আসার পর স্নিগ্ধা চেয়েছিল তার বাবা মার সাথে যোগাযোগ করতে। তার বাবা মা দুজনার মোবাইল নাম্বারই বন্ধ পেয়েছে সে। তখন সে মজিদকে সাথে নিয়ে তার বাড়িতে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু শাহেদা মানা করে, সেই অবস্থায় স্নিগ্ধার লং জার্নি করা একেবারেই উচিত হতো না। মজিদ একাই রওনা দেয় বগুড়ার উদ্দেশ্যে, স্নিগ্ধাদের বাড়িটি তালাবদ্ধ পায় সে। প্রতিবেশীদের কাছে থেকে জানতে পারে স্নিগ্ধার মা বাবা চিকিৎসার জন্য ভারতে গেছে, তিন মাস পরে ফিরবে তারা। এরপর প্রায় দেড় মাস কেটে গেছে কবিরের কোন খবর পায়নি, আর না মা বাবার কোন খবর। কখনো কখনো ভাবে সেখান থেকেও পালিয়ে যাবে সে, আর কবিরের খোঁজ করবে, কিন্তু সন্তানের জীবন ঝুঁকির মাঝে ফেলে দিতে চায় না স্নিগ্ধা।
হঠাত কলিংবেলের শব্দে ভাবনার জগত থেকে ফিরে আসে স্নিগ্ধা।
"শিমলী, এই শিমলী দেখতো কে এল।" স্নিগ্ধা উচ্চস্বরে বলে
শিমলী তেরো চোদ্দ বছর বয়সী মেয়ে, শাহেদার দুর সম্পর্কের আত্মীয়।
শীমলীর সারা শব্দ না পেয়ে স্নিগ্ধা নিজেই উঠে দরজা খুলে দেয়।
"মজিদ কাকা যে। ভেতরে আসুন।" মিষ্টি করে হেসে বলে স্নিগ্ধা। মজিদ ব্যাগভর্তি বাজার টেনে আনে।
"ভাল আছ তো, মা?" মজিদ বলে।
"জি ভাল আছি। আপনি ভাল আছেন? বসুন কাকা।"
"আল্লার দয়ায় ভালই আছি। আজ আর বসমু না। আপা বাজার পাঠাইছে। এখন আসি, কাইল আসমুনি একবার।" বলে মজিদ বেরিয়ে যায়।
স্নিগ্ধা উঠে মসলার খালি কৌটাগুলো এনে তাতে মসলা ঢালতে শুরু করে।
"আরে আপা, কর কি! খালায় আপনারে কাজ করতে মানা করছে না?" শিমলী ছুটে আসতে আসতে বলে।
"সারাদিন তো বসেই আছি, এইটুকু কাজ করলে কিচ্ছু হবে না।" কাজ না থামিয়ে বলে স্নিগ্ধা।
কাগজে মোড়ানো গরম মসলা কৌটায় ভরে কাগজটি ফেলে দিতে গিয়ে হঠাত থেমে যায় স্নিগ্ধা। কাগজটি ছিল একটি পত্রিকার টুকরো, যাতে কবিরের ছবি। উস্কোখুস্কো বাবড়ি চুল আর মুখ ভর্তি দাড়ি সত্তেও কবিরকে চিনতে স্নিগ্ধার একটুও অসুবিধা হয় না। ছবিতে কবিরের হাতে হাতকড়া ও তার আসেপাশে পুলিশ, প্রিজন ভ্যানে তোলার আগের মুহুর্তের ছবি। নিচে হেডলাইন লেখা "চাঞ্চল্যকর মামলা সাদিয়া ধর্ষন এবং সাইমন হত্যা মামলার আসামী শাহরিয়ার কবিরের ফাঁসির রায়"।
মুহুর্তের মাঝে স্নিগ্ধার জগতটি যেন আঁধারে ছেয়ে গেল। এক মুহুর্ত নিশ্চুপ থেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে স্নিগ্ধা।
"কি হইছে আপা? কি হইছে?" শিমলী বলে।
শিমলীর কথার কোন জবাব দেয় না, ছুটে যায় তার রুমের দিকে।
বিকেলবেলা যখন শাহেদা ফিরে আসে তখন শিমলী তাকে দুপুরের ঘটনাটি খুলে বলে। শাহেদা স্নিগ্ধার রুমে যায়।
স্নিগ্ধা বিছানায় বসে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল, তার গাল বেয়ে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর দাগ। শাহেদা যে তার পাশে বসেছে তা সে লক্ষ করেনি।
"কি হয়েছে মা? শিমলীর কাছে শুনলাম তুমি দুপুরে কিছু খাওনি, শুধু কাঁদছ।"
স্নিগ্ধা আবারো ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। শাহেদা ওকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলে "কিছু না বললে কি করে বুঝব? কি হয়েছে মা?"
স্নিগ্ধা খবরের কাগজের টুকরোটি শাহেদার হাতে দেয়। স্নিগ্ধা কথা বলতে পারছিল না, বাচ্চা মেয়ের মতো ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।
"খবরটা তো আগেও পড়েছি। কিন্তু কি হয়েছে তা তো..." বলতে গিয়ে থেমে যায় শাহেদা। সে যেন একটু একটু বুঝতে পারছে।
"এই কি সেই কবির যার কথা তুমি বলেছিলে? যাকে তুমি ভালবাস?" শাহেদা বলে।
"স্নিগ্ধা হ্যাঁ বোধক ভাবে মাথা নাড়ে।
"যে মেয়েটিকে ধর্ষিতা বলা হচ্ছে, সে আমি। আমার পুরো নাম সাদিয়া আক্তার স্নিগ্ধা।" কোনরকম বলে ফেলে স্নিগ্ধা।
শাহেদা খবরটির দিকে একবার চোখ বুলায়।
"আর এই সায়মন?" শাহেদা জিজ্ঞাসা করে।
স্নিগ্ধা শাহেদা আর মজিদের কাছে সায়মনের বিষয়টা চেপে গিয়েছিল, এবার স্নিগ্ধা পুরো ঘটনাটাই খুলে বলে।
"এতোদিন শুনেছি যে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে অনেক অপরাধীরা বেরিয়ে যায়। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি অপরাধীদের সাহস এতো বেড়ে গেছে যে আইনকেই ব্যাবহার করে রাতকে দিন আর দিনকে রাত করছে।"
"কি করব আমি, বুঝতে পারছি না। আন্টি সত্যি সত্যি বলুনতো ও কি বেঁচে আছে? নাকি ওরা ওকে..." বলতে গিয়ে কথা আটকে যায় স্নিগ্ধার।
"কয়েকদিন আগে খবর শুনেছিলাম যে কবির জেল থেকে পালিয়েছে। আশা করি বেঁচে আছে এখনো। তবে আমাদের যা করার তা যতোটা সম্ভব তাড়াতাড়ি করতে হবে। আমার মনে হয় সবাইকে সত্যটা জানানো উচিত। এ জন্য সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করতে পারি আমরা।" শাহেদা বলে।