What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

সত্তা (2 Viewers)

যতোক্ষনে সোয়েব বান্দরবন শহরে ফিরে আসে ততক্ষনে রাত হয়ে গেছে। এতোক্ষনে কবিরের নির্দোষ হওয়ার ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ নেই সোয়েবের, কিন্তু এখনো একটি প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, সাদিয়ার মা বাবা কেন মুখ বন্ধ রেখেছে। সেই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে সোয়েবকে বগুড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। কিন্তু সপ্তাহ জুড়ে লাগাতার জার্নিতে শরীরটা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে, একটু রেস্ট দরকার, কিন্তু শেষটা না দেখে ছাড়বে না বলে মনস্থির করে। বান্দরবান থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়, চট্টগ্রাম থেকে আবার বগুড়ার বাসে রওনা দেয়। বারো ঘন্টার জার্নি শেষে সোয়েব যখব বগুড়ায় এসে পৌঁছায় ততক্ষনে পরেরদিন দুপুর বারোটা বেজে যায়। কবিরের দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী সাদিয়াদের বাড়ি খুঁজে পেতে আরো এক ঘন্টা লেগে যায় ওর।
সামনে দোতলা বাড়ি, বাড়ির কলাপসেবল গেটের সামনে এসে সোয়েব কলিংবেল টেপে। ওর চোখ দুটো ঢুলু ঢুলু করছে একটু শুয়ে পড়লেই ঘুমিয়ে পড়বে, বাসে ঘুম কখনোই পরিপুর্ন হয় না, ক্লান্তি থেকেই যায়, একটু শুয়ে পড়লেই ঘুমিয়ে পড়বে সে। ক্লান্তি জনিত কারনেই কিনা সোয়েবের মনে হচ্ছিল কেউ তার ওপর নজর রাখছে, সোয়েব একটু সচকিত হয় এবং আড়চোখে লক্ষ্য করে একটু দুরে চায়ের দোকানে দুজন ছেলে তার দিকে বারে বারে তাকাচ্ছে। সোয়েব আরেকবার কলিংবেল চাপে, এবার একটি কমবয়সী মেয়ে এসে দরজা খুলে দেয়।
"কাকে চাই?" মেয়েটি বলে।
"মিসেস শিরিন আক্তার।" সোয়েব বলে।
"ওনারা তো ওপর তলা থাকেন।" মেয়েটি বলে।
"থ্যাংক ইউ।" বলে সোয়েব সিঁড়ি বেয়ে ওপর তলা উঠে যায়।
আবারও কলিং বেল টেপে সে, কয়েক সেকেন্ড পর দরজাটা খুলে যায়, অন্যপাশে একজন মধ্যবয়সী মহিলা।
"আপনি মিসেস শিরিন আক্তার?"
"হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে তো চিনতে পারলাম না!" শিরিন বলে।
"আমি এএসপি সোয়েব মাহমুদ। মিরপুর থানা থেকে এসেছি।"
মিরপুর থানার কথা শুনে শিরিনের চোখ চকচক করে ওঠে, পরমুহুর্তেই আবার নিরাশায় ভরে ওঠে। শান্ত স্বরে বলে "ভেতরে আসুন।"
সোয়েবকে ড্রয়িরুম দেখিয়ে বলে "আপনি বসুন। আমি একটু আসছি" বলে শিরিন চলে যায়।
সোয়েব ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে যায়, মিনিট খানেক পর শিরিন ফিরে আসে হাতে একটি ট্রে, তাতে ফলমুল আর সরবত। সোয়েব এক ঢোঁকে সরবতটুকু খেয়ে নিয়ে বলতে শুরু করে "আমি এসেছি সাদিয়ার অপহরনের বিষয়ে তদন্তে। আপনাকে কিছু প্রশ্ন করব, আশা করি আপনি আমাদেরকে তদন্তে সহায়তা করবেন।"

"জি বলুন।"
"সাদিয়ার অপহরনের বিষয়ে আপনি জানলেন কবে?"
"তারপরের দিন। সজল আমাকে কল করে জানায় স্নিগ্ধাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।" শিরিন বলে।
"নিখোঁজ! ডাকাতি বা অপহরনের বিষয়ে কিছু জানায় নি?"
"না। হয়তো আমরা খুব টেনশন করব ভেবে বলেই নি।" শিরিন বলে।
"তা তো হতেই পারে। আচ্ছা স্নিগ্ধা নিখোঁজ হবার পর সে কি কোন ভাবে আপনাদের সাথে যোগাযোগ করেছিল?"
প্রশ্নটা শুনে শিরিন কিছুটা চমকে ওঠে, "না।" বলতে গিয়ে কন্ঠ কেপে ওঠে শিরিনের। সোয়েব স্পষ্ট বুঝতে পারে যে মিথ্যা বলছে সে।

"আচ্ছা, স্নিগ্ধার ওর স্বামীর সাথে সম্পর্ক কেমন ছিল? আই মিন ওদের মাঝে কোন ঝগড়া বিবাদ ছিল কিনা?"
"ছোটখাট ঝগড়া বিবাদ তো সব সংসারেই থাকে। স্নিগ্ধা অবশ্য আমাকে কখনো তেমন কিছু জানায়নি। তবে একবার কিছু না জানিয়ে হঠাত করে বাড়ি চলে আসে। অবশ্য পরের দিনই ও ফিরে গিয়েছিল। আমার মনে হয় ও কিছু লুকোচ্ছিল, জিজ্ঞাসা করলেও কিছু বলেনি আমাকে।" শিরিন বলে।
"আচ্ছা, সেই দিন কি আরো এমন কিছু হয়েছিল যা রোজ রোজ হয় না, মনে করে বলুনতো?"
"হ্যাঁ, সেইদিন স্নিগ্ধার বাবা ছিনতাইকারীদের খপ্পরে পড়েছিল।"
"তাই নাকি, কোথায়, কিভাবে?" সোয়েব বলে।
"ওর অফিসের সামনেই নাকে রুমাল চেপে অজ্ঞান করে কয়েকজন যুবক ওকে তুলে নিয়ে যায়। পরের দিন সকালে যখন ওর জ্ঞান ফেরে তখন ও হাসপাতালে। ওর মানিব্যাগে তিন হাজার টাকা ছাড়া আর কিছু নেয়নি।"
"সাতরাস্তার মতো জনবহুল যায়গা থেকে কাউকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেল মাত্র তিনহাজার টাকার জন্য? বিষয়টা আজব না?"
"আজব। কিন্তু এর সাথে এই কেসের কি সম্পর্ক?" চিন্তিত কন্ঠে বলে শিরিন।
"সম্পর্ক তো আছেই, জীবনে প্রত্যেকটি ঘটনা একটির সাথে অন্যটি সম্পৃক্ত। যাই হোক, এবার মুল প্রসঙ্গে আসি। শাহরিয়ার কবির খানকে আপনি নিশ্চয়ই চেনেন?"
শিরিন হ্যাঁবোধকভাবে মাথা নাড়ে।
"শুনেছি কবির ছোটবেলায় অনাথ হয়ে যায়, আপনারাই ওকে লালন পালন করেছেন?"
"হ্যাঁ।"
"আপনাদের স্নেহ ভালবাসার প্রতিদান ঐ বেইমান শুয়োরটা এভাবে দিল? আপনাদেরই মেয়েকে অপহরণ ও ধর্ষণ করে?" বলতে বলতে শিরিনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সোয়েব। শিরিনকে তার কাছে খুব নরম মনের মানুষ বলে মনে হয়, এমন মানুষের কাছে থেকে সত্যটা বের করে আনা কঠিন ব্যাপার নয়, সোয়েব তারই চেষ্টা করে।

শিরিন কোন কথা না বলে মাথা নিচু করে থাকে। সোয়েব বলতে থাকে "ত্রিশটার ওপরে খুন, চল্লিশটার ওপরে ধর্ষনের অভিযোগ আছে। ফাঁসি তো হবেই পিশাচটার, যদি আমার ক্ষমতা থাকতো তবে ফাঁসি না দিয়ে শুয়োরটাকে হাত পায়ে পেরেক মেরে কোন উঁচু টাওয়ারে ঝুলিয়ে দিতাম। কাক শকুন যখন জ্যান্ত অবস্থায় চোখ উপড়ে খেত তখন উপযুক্ত শাস্তি পেত।"
"দয়া করে চুপ করুন আপনি।" মিনতি করে বলে শিরিন।
"কেন? আপনার কি কবিরের প্রতি এখনো মায়া আছে। যদি ঐ পিশাচটার প্রতি মায়া দয়া কিছু অবশিষ্ট থাকে তবে শুনুন, পুলিশের তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী কবির তার দলবল নিয়ে হোটেলে হামলা করে স্নিগ্ধাকে অপহরন করে। নিজের আস্তানায় নিয়ে গিয়ে বন্দি করে স্নিগ্ধাকে দিনের পর দিন ধর্ষন করে। শুধু নিজে ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, নিজের দলবল দিয়ে দিনের পর দিন গণধর্ষন করায়। স্নিগ্ধার প্রতি এতো শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন করে যে ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।" তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে সোয়েব।
"সব মিথ্যা, সব বানোয়াট। আমার কবির ডাকাত হতে পারে না, ও কারো ক্ষতি করতে পারে না। ও স্নিগ্ধাকে অপহরণ করেনি। স্নিগ্ধা নিজের ইচ্ছায় ওর সাথে গেছে। ওরা একে অপরকে ভালবাসে। স্নিগ্ধা নিজে আমাকে কল করে বলেছে।"
"এ কথা আমাকে আগে বলেন নি কেন?"
"কি করে বলি বাবা, ওরা যে স্নিগ্ধাকে খুন করবে তাহলে। কি করব বাবা, না পারছি মুখ খুলতে না পারছি চুপচাপ সইতে।" বলতে বলতে কেঁদে ফেলে শিরিন।
"কাঁদবেন না মা, শক্ত হোন।"
"আমি আর চুপ থাকবনা, সত্যি সত্যি সবকিছু বলে দেব। তাতে আমার মেয়ের যা হয় হবে।" চোখ মুছতে মুছতে বলে শিরিন।
"দেখুন, আমি এই কেসের ইনচার্জ নই। এর তদন্তের দায়িত্ব আমার কাঁধে ছিল না। কিন্তু এই কেসের পেছনে বিশাল ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরে আমি ছুটি নিয়ে নিজের তাগিদে তদন্তে নেমে পড়ি। এখানে আসার আগেই আমি কবিরের নির্দোষ হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত ছিলাম। আপনার মুখ থেকে সত্য শোনার জন্যই এই নাটকটি আমি করেছি, ক্ষমা করবেন। আপনি আমার প্রতি ভরসা রাখতে পারেন। আমি আমার সবটা দিয়েই চেষ্টা করব যেন কবির আর স্নিগ্ধার কোন ক্ষতি না হয়। তবে আপনার এই মুহুর্তে চুপ থাকাই উচিত, পুলিশ বা মিডিয়া সবার কাছেই। তবে কখনো যদি আদালতে কথা বলার সুযোগ আসে তবে সবকিছু সত্যি সত্যি খুলে বলবেন। মনে রাখবেন আদালতে সত্যটা খুলে বললে ওরা স্নিগ্ধার ক্ষতি করার সাহস পাবে না।"
একটু থেমে পকেট থেকে ভিজিটিং কার্ড বের করে বলে সোয়েব, "এই কার্ডটি রাখুন, যেকোন সমস্যায় যোগাযোগ করবেন। আর আমার বিষয়ে কাউকে বলবেন না। না আপনার স্বামীকে না জামাইকে। বিশেষ করে জামাইয়ের ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন। জিল্লুর রহমান ওনাকে কোম্পানির সিইও পদে প্রমোশন দিয়েছে। কেন তা আশা করি আন্দাজ করতে পারবেন।"

সোয়েবের ঘুম ভেঙে যায় রিংটোনের আওয়াজে। ফোনটা রিসিভ করার আগেই কেটে যায়। সোয়েব বিছানায় বসে এক হাতে চোখ ডলতে ডলতে হাতে নেয় ফোনটা, আটটা মিসডকল, সবগুলোই সুমির। সোয়েব কল ব্যাক করে।
"সেই কখন থেকে কল করছি, রিসিভ করছ না কেন?" সুমি বলে।
"ঘুমিয়েছিলাম।"
"এই অবেলায় ঘুম? শরীর খারাপ নাকি?"
"শরীর খারাপ না তবে খুব ক্লান্ত। একটা দিন জার্নির ওপর ছিলাম তো তাই। এখন ঠিক আছে, লম্বা ঘুম দিলাম তো, শরীরটা এখন ঝরঝরে লাগছে।"
"আমাকে নিতে আসবে কবে?" সুমি বলে।
"আর কয়েকটা দিন থাকোই না। ওখানে ভাল লাগছে না?"
"তা নয়, কিন্তু বাইরের খাবার খেয়ে খেয়ে আবার তুমি অসুখ বাধিয়ে ফেলবে।"
"কয়েকদিন বাইরের খাবার খেলে কিচ্ছু হবে না। তবে তোমাকে ছাড়া আমার একদম ভাল লাগছে না, পরশুদিন তোমাকে নিয়ে আসব।" একটু থেমে সোয়েব আবার বলে।
"মা কোথায়?"
"পাশের বাসায় গেছে। একটু আগে ফোন ধরলেই পেতে। আচ্ছা রাখি, আর বাইরের হাবিজাবি একদম খেও না, আর নিজের যত্ন নিও।"
"তুমিও।" বলে সোয়েব কেটে দেয়। তারপর বিছানা ছেড়ে ওঠে সে। ওয়াসরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে বাংলোর সামনের বাগানে গিয়ে হাঁটাহাটি করে কিছুক্ষন। গতকাল বগুড়া থেকে যখন সাভারে তার বাংলোয় ফিরে এসেছে তখন রাত এগারোটা, এসেই কোন মতো পোশাক ছেড়ে রাত পোশাক পরে বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে যায়। ঘুম থেকে যখন ওঠে তখন দুপুর বারোটা। গোসল ও লাঞ্চ সেরে আবার ঘুমিয়ে পড়ে সোয়েব, ওঠে বিকেল পাঁচটায়।
বাগানে হাঁটতে হাঁটতে কবিরের কেসটার ব্যাপারেই ভাবছিল সে, জিল্লুর রহমানের মতো ক্ষমতাবান ধনী ব্যাক্তির সাথে টক্কর দিয়ে সফল হওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার না। প্রতিটি পদক্ষেপ চিন্তাভাবনা করে নিতে হবে। অন্যদিকে কবিরের রিমান্ডের আজকেই শেষ দিন, এরমধ্যে যদি ওর স্বীকারোক্তি যোগাড় করে নেয় তবে কেসটা আরো জটিল হয়ে যাবে। সোয়েব তার ইউনিফর্ম পরে নিয়ে বেরিয়ে যায় মিরপুর থানার উদ্দেশ্যে। থানায় পৌঁছে সোয়েব মইনুলকে তার চেয়ারে বসে মনোযোগ দিয়ে ফাইল ঘাঁটাঘাটি করতে দেখে। সোয়েবকে দেখে দাঁড়িয়ে সেলুট দেয় সে। সোয়েব তার ডেস্কের সামনের চেয়ারে বসে পড়ে।
"ভাল আছেন স্যার? ছুটি কেমন কাটল?" মইনুল বলে।
"ভাল। তা তোমার জিজ্ঞাসাবাদ কেমন চলছে?" সোয়েব বলে।
"জিজ্ঞাসাবাদ! ও ঐ ডাকাতের কেসটার কথা বলছেন স্যার? খুব ঘাঘু মাল স্যার, মেরে ফাটাফাটা করে ফেলি তবু মুখ খোলে না। মনে হচ্ছে আরো সাতদিন লাগবে। রবিবার কোর্টে তুলে রিমান্ড চাইব। তারই ফাইলপত্র তৈরী করতেছি।" মইনুল বলে।
"বেশি মারোনি তো আবার, মরে গেলে আবার অন্য ঝামেলা।" সোয়েব বলে।
"মরবে না স্যার, এদের কই মাছের জান।" মইনুল বলে
"তোমার তো ডিউটি শেষ?"
"জি স্যার।"
"যাবার আগে নাইট ডিউটির ফাইলটা আমার চেম্বারে দিয়ে যেও।"
"জি স্যার।"
 
সোয়েব উঠে নিজের চেম্বারের দিকে যায়। মইনুল চলে যাওয়ার পর সোয়েব কবিরের সেলে যায়। কবির তার বেডে চাদর মুড়ে শুয়ে ছিল। এতো গরমে চাদর মুড়ে থাকাটা অস্বাভাবিক। সোয়েব কাছে গিয়ে বুঝতে পারে জ্বরে কাঁপছে ও বেহুঁশ অবস্থায় প্রলাপ বকছিল কবির। "আমাকে ছেড়ে যাসনে স্নিগ্ধা।" "তোকে ছাড়া বাঁচব না রে" এমন আরো কিছু প্রলাপ বলে যাচ্ছিল জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে। কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিল।
সোয়েব চাদরটা শরীর থেকে সরিয়ে দেয়। খালি গায়েই ছিল কবির, সারা গায়ে যায়গায় যায়গায় জখম। গালে হাত দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। কবির চোখ মেলে তাকায়, চিনতে কয়েক সেকেন্ড লাগে।
"স্যার, আপনি?" উঠে বসতে বসতে বলে কবির।
"তোমার গায়ে তো অনেক জ্বর।" সোয়েব বলে।
"ও কিছু না স্যার, এমনিই ঠিক হয়ে যাবে। আপনি ভাল আছেন স্যার? কিছু দিন যে আপনাকে দেখিনি?"
"এই সপ্তাহটা ছুটিতে ছিলাম, যেমনটা বলেছিলাম, তোমার দেয়া প্রত্যেকটা তথ্য আমি খতিয়ে দেখেছি।" সোয়েব বলে।
"সত্যি বলছেন স্যার? আমি ভাবতে পারিনি আমার বিষয়ে আপনি এতো সিরিয়াস হবেন।" কবির বলে।
"আমি জানি, তুমি নির্দোষ। মনে সাহস রাখ, তোমার কিছু হবে না। আমি তোমার পাশে আছি।" সোয়েব বলে।
"আমি নিজের কথা ভাবছি না স্যার। স্নিগ্ধার কোন খোঁজ জানেন স্যার? ও কোথায়, কেমন আছে?" কবির বলে।
"যদিও আমি ওর সাথে দেখা করিনি। আমার জানা মতে ও ল্যাবএইড হসপিটালে আছে।" সোয়েব বলে।
"স্নিগ্ধা হসপিটালে নেই স্যার। আমার মন বলছে ওরা ওকে কোথাও বন্দি করে রেখেছে।" কবির বলে।
সোয়েব একমুহুর্ত ভেবে বলে "তাও হতে পারে, আমি খুঁজে দেখব।"

সোয়েব বেরিয়ে যায় কবিরের সেল থেকে। নিজের চেম্বারে ফিরে এসে মোবাইল হাতে নিয়ে কল করে।
"হ্যালো পরিতোষ, কেমন আছিস?" সোয়েব বলে।
"এই তো ভালই, তুই কেমন আছিস?" পরিতোষ বলে।
"চলছে কোনরকম। তুই এখন কোথায়? বাসায়?"
"না রে, এখনো যেতে পারিনি। চেম্বারে।" পরিতোষ বলে।
"তুই একটু মিরপুর দুইয়ের দিকে আসতে পারবি? এখনি।"
"কেন?"
"আমার এক আত্মীয়ের শরীর খুব খারাপ। একশ চার ডিগ্রী জ্বর আর সারা গায়ে ব্যাথা। হাসপাতালে নিতে হবে কিনা বুঝতে পারছি না। তোর চেম্বার তো কাছেই, যদি পারিস চলে আয়।"
"ঠিক আছে আমি আসছি।" পরিতোষ বলে।
ডক্টর পরিতোষ রায় সোয়েবের স্কুলের বন্ধু, মিরপুর ১ এ তার চেম্বার। পরিতোষের আসতে আরো আধাঘন্টা লেগে যায়।
"আমাকে থানায় ডেকে আনলি কেন?" পরিতোষ বলে।
"তোকে জেলে পুরবো বলে, চল" বলে ওর হাত ধরে টেনে সেলের দিকে নিয়ে যায়।
"আমার শ্বশুর কিন্তু দৈনিক মহাকালের সম্পাদক, আমার বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র করলে কিন্তু তোকে বাঁশ দিয়ে দেবে।" পরিতোষ বলে।
"আগে চল তো, সেসব পরে দেখা যাবে।" বলে সোয়েব কবিরের সেলে নিয়ে যায়। কবির তখন আবার চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিল, ঘুমায়নি, তবে তখনো জ্বরে কাঁপছিল।
"ওকে দেখ।" সোয়েব বলে।
"তাহলে তুই আমাকে তোর থানার আসামীর চেকআপ করতে নিয়ে এসেছিস? শালা বাটপার কোথাকার।" পরিতোষ বলে।
"আসামী না অভিযুক্ত। অভিযুক্ত বলে কি ও মানুষ না? তুই না ডাক্তার? মানুষের সেবা করাই না তোর ধর্ম?"
"নে নে, আর লেকচার দিতে হবে না।" বলে কবিরের দিকে এগিয়ে যায় পরিতোষ। প্রথমে থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মাপে, তার পর ব্লাড পেশার। শরীরে আঘাতগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। তারপর প্যাড বের করে প্রেসক্রিপশন লিখে সোয়েবের হাতে দেয়।
"প্রচুর টর্চার হয়েছে, কিন্তু জখমগুলো তেমন গভীর না। আশা করি এমনিতেই সেরে যাবে। জ্বর এসেছে ব্যাথার কারণে। ব্যাথার একটি ইনজেকশন এবং কিছু ওষুধ প্রেসক্রাইব করেছি। ইনজেকশনটা আমিই দিয়ে দিচ্ছি।" পরিতোষ বলে।

সোয়েব পরেরদিন সকালবেলা রওনা দেয় ল্যাবএইড হসপিটালের উদ্দেশ্যে। রিসেপশন থেকে স্নিগ্ধার কেবিন নাম্বার শুনে নেয় সোয়েব, চারশ একুশ নম্বর কেবিন। স্নিগ্ধার কেবিনের সামনে দুজন কনস্টেবল গার্ড হিসাবে রাখা ছিল, তারা কেবিনের সামনে চেয়ার পেতে বসে সকালের নাস্তা করছিল। সোয়েবকে দেখে উঠে সেলুট দেয় তারা, সোয়েব তাদেরকে এড়িয়ে গিয়ে কেবিনের দরজায় নক করে। কনস্টেবল দুজন কিছু বলতে গিয়েও বলার সাহস পায় না। দ্বিতীয়বার নক করার পর কনস্টেবলদের উদ্দেশ্যে বলে "পেশেন্ট কি এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি?"
"না স্যার, এখনো ওঠেনি।" একজন কনস্টেবল বলে।
"থাক। ডাকার দরকার নেই, আমি শুধু একবার দেখেই চলে যাব।" বলে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢোকে সোয়েব। পরিপাটি করে গোছানো কেবিন, কিন্ত কেউ নেই সেখানে। সোয়েব রুম থেকে বের হয়ে আসে।
"পেশেন্ট কোথায়? কেবিনে পেশেন্ট নেই আর তোমরা নিশ্চিন্তে বসে ব্রেকফাস্ট করছো?" ধমকে উঠে বলে সোয়েব।
"না মানে স্যার, পেশেন্টকে তো ওনার গারজিয়ান নিয়ে গেছে।" একজন কনস্টেবল আমতা আমতা করে বলে।
"গারজিয়ান মানে? পেশেন্টের স্বামী?"
"জি স্যার। যেদিন এখানে এনেছিল, তার পরেরদিনই নিয়ে গেছে, খুব চিতকার চেঁচামেচি করছিল তো।" অন্যজন বলে।
"তাহলে তোমরা এতদিন এখানে কি করছ? এখানে বসে বসে ডিউটিতে ফাঁকি দিচ্ছ?" আবারও ধমকে বলে সোয়েব।
"না স্যার, ডিসিপি স্যার আমাদেরকে এখানে গার্ড দিতে বলেছেন, আর বলেছেন যেন পেশেন্ট যে এখানে নেই সেটা যেন কেউ না জানে।"
"আর ডিসিপি স্যার আমাকে পাঠিয়েছেন যে তোমরা ঠিকভাবে ডিউটি দিচ্ছ কিনা চেক করার জন্য। নাহ তোমাদের পারফরমান্স একেবারেই সন্তোষজনক নয়। যখন আমি ভেতরে ঢুকতে চাইলাম তখন তোমাদের আমাকে নিষেধ করা উচিত ছিল। নাহ ডিসিপি স্যারকে জানাতেই হবে।" সোয়েব বলে।
"না স্যার, দয়া করে ওনাকে কিচ্ছু বলবেন না। আমাদের চাকরি থাকবে না!"
"ঠিক আছে, কিন্তু এরপর থেকে সাবধান।" বলে সোয়েব চলে যায়।
হসপিটাল থেকে বেরিয়ে সোয়েব একটি লোকাল বাসে উঠে পড়ে। বহুদিন পর সে লোকাল বাসে উঠেছে, সেই কলেজের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। মাত্র পাঁচ টাকা বাঁচানোর জন্য এসব লোকাল বাসে কতো ঝুলে ঝুলে গেছে সে। জানালার পাশের একটি সিটে বসে বাইরে তাকিয়ে সেসব দিনের কথাই ভাবতে থাকে সোয়েব। দীপার কথাও খুব মনে পড়ে তার, ফার্মগেটের কাছে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে। দুই বছর হল ডিভোর্স হয়েছে, সাত বছরের এক মেয়েকে নিয়ে একাই থাকে দীপা। ডিভোর্সের পরপরই সোয়েব দীপাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় সোয়েব, অনেক অনুনয় বিনয় সত্তেও কিছুতেই অভিমানের বরফ গলাতে পারেনি।
সোয়েব ফার্মগেটেই নেমে যায়। সেখান থেকে একটি রিক্সা নিয়ে দীপার এপার্টমেন্টে পৌঁছায় সোয়েব। এপার্টমেন্টের ফোর্থ ফ্লোরে দীপার ফ্ল্যাট, সোয়েব কলিংবেল চাপে। মিনিট খানেক পর দরজাটা খুলে যায়। দরজা খোলে এক কিশোরী মেয়ে, বেশভুষায় কাজের মেয়ে বলে মনে হয়।
"কে আপনি, কারে চান?" মেয়েটি বলে।
"এটা এডভোকেট দীপালী ব্যানার্জির বাসা না?"
"বিউটি, কে এসেছে?" ভেতর থেকে দীপার কন্ঠ শুনতে পায়, ততোক্ষণে দীপা দরজার সামনে চলে এসেছে।
"ও, তুমি মানে আপনি? হঠাত?" সোয়েবকে দেখে অবাক হয়ে বলে দীপা।
"তোমাকে দেখতে ইচ্ছা হল তাই চলে এলাম। কিন্তু আমি আবার তুমি থেকে আপনি হয়ে গেলাম কবে?" সোয়েব বলে।
"ভেতরে এসো।" দীপা বলে।
সোয়েব আগেও এখানে এসেছে, দুই রুমের ছোট্ট সাজানো গোছানো একটি ফ্ল্যাট। সোয়েবকে সোফায় বসতে বলে দীপা কিচেনের দিকে যায়। দীপার মেয়ে অংকিতা সোফায় বসে টিভিতে কারটুন দেখছিল।
"কি দেখ মামনি?" সোয়েব বলে।
"ডোরেমন দেখছি?" অংকিতা জবাব দেয়।
"আজ স্কুল নেই?" বলতে বলতে অংকিতাকে কোলে তুলে নিয়ে ওর গালে চুমু দেয়।
অংকিতা না বোধকভভাবে মাথা নাড়ে। ততোক্ষনে দীপা চলে এসেছে, হাতে একটি ট্রে, তাতে চা বিস্কুট আর ফল।
"অংকিতা, যাও ও ঘরে গিয়ে পড়তে বস। আমি আসছি।" দীপা বলে।
সোয়েবের কোলে বসতে অস্বস্তি লাগছিল অংকিতার, ছাড়া পেয়ে ছুটে অন্য রুমে চলে যায়।
"তা হঠাত কি মনে করে? "
"তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছা করল তাই চলে এলাম, এভাবে কি আসতে পারি না? আর একটা কাজও আছে অবশ্য, সে কথা একটু পরই বলি।"
"তা তো আসতেই পার। সাথে তোমার বউকে আনতে পারলে না?" দীপা বলে।
"পরে কখনো আনব। এতো করে বললাম, বিয়েতে তো এলে না।" সোয়েব বলে।
"তোমার বিয়েতে আমি আসতাম, কিন্তু হঠাত অংকিতার শরীর খারাপ হয়ে গেল যে?" একটু থেমে আবার বলে দীপা, "তোমার কাছে ছবি আছে? দেখি একটু?"
সোয়েব তার সেলফোনে বিয়ের ছবি বের করে দেখায়।
"বাহ ভীষন মিষ্টি মেয়ে তো, তোমার সাথে খুব মানিয়েছে। নামটা যেন কি?"
"সুমি।"
"নামটাও মিষ্টি।" দীপা বলে।
"এবার কাজের কথায় আসি। কিছু দিন আগে একটি খবর নিয়ে বেশ হইচই হয়েছিল মিডিয়াতে, কিবরিয়া ডাকাত গ্রেফতার ও অপহৃতা উদ্ধার।" সোয়েব বলে।
"হ্যাঁ, পড়েছিলাম খবরটা। কিন্তু কেন বলতো?" দীপা বলে।
"কোন আজব বিষয় লক্ষ্য করেছ?"
"কিছুটা তো আজবই। গল্পে নাটকীয়তা একটু বেশিই, প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে ডাকাত হয়ে যাওয়া, মেয়েটির স্বামীর বন্ধুর মেয়েটিকে উদ্ধার করতে গিয়ে শহীদ হওয়া। কিন্তু হঠাত এসব বিষয়ে আমাকে বলছ কেন?" দীপা বলে
"আমি চাই তুমি কেসটা নাও। কবির ছেলেটা পুরোপুরি নির্দোষ। অনেক বড় ষড়যন্ত্র সাজানো হয়েছে।" সোয়েব বলে।
"কি বলছ এসব, তুমি কিভাবে জানলে?"
"আমি কিছুই অনুমানের ওপর নির্ভর করে বলছি না। বিগত সাত দিন এ নিয়ে তদন্ত করেছি।" এরপর সোয়েব তদন্তের প্রথম থেকে শেষ অবদি বর্ণনা করে। পুরোটা শোনার পর দীপা বলে, "দেখ, আমি একজন ছোট খাট উকিল। ডিভোর্স, জায়গা জমি বিবাদ, চুরি, স্ত্রী নির্যাতন এসব ছোটখাট কেস লড়ি। এতো বড় কেস আমার পক্ষে নেয়া সম্ভব না। তুমি বরং ভাল কোন উকিলের সাথে কথা বল।"
"আমি এই মুহুর্তে কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না, টাকা ও ক্ষমতার সামনে যে কেউ বিকিয়ে যেতে পারে। আমি জানি অন্তত তুমি বিকোবে না।" সোয়েব বলে।
একমুহুর্ত চুপ থেকে দীপা বলে "আমাকে একটু সময় দাও ভেবে দেখার জন্য।"
"কাল কবিরকে কোর্টে তোলা হবে আরো এক সপ্তাহ রিমান্ড চেয়ে, অন্তত রিমান্ডের বিরুদ্ধে আপিল করে দাও, এরপর কেস চালিয়ে যাবে কিনা সিদ্ধান্ত জানিও।"
"ঠিক আছে।" এক মুহুর্ত ভেবে বলে দীপা।
 
পরেরদিন ওসি মইনুল কবিরকে কোর্টে তুলে আরো সাতদিনের রিমান্ডের জন্য আবেদন করলে দীপা পাল্টা আপিল করে। যেহেতু সাতদিনের রিমান্ড আগেই দেয়া হয়েছে এবং আসামীর মেডিকেল রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে আদালত রিমান্ডের আবেদন নাকচ করে আসামীকে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেয়।
রিমান্ড নাকচ হওয়ায় সোয়েব কিছুটা স্বস্তির নিঃশাস ফেলে, সেদিন বিকালেই সে স্ত্রীকে আনতে মুন্সিগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। মুন্সিগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলার একটি গ্রামে সোয়েবদের বাড়ি, সুমিও সেই গ্রামেরই মেয়ে।
সোয়েব যতোক্ষনে তাদের বাড়িতে পৌঁছায় ততক্ষনে রাত হয়ে দশটা বেজে গেছে। পরেরদিন সকালবেলা হাতমুখ ধুয়ে গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। সকাল সকালই রওনা দিতে চায় ঢাকার উদ্দেশ্যে, কিন্তু যাবার আগে একজনের সাথে দেখা না করলেই নয়। সোয়েবদের বাড়ি থেকে খানিকটা দুরে একটি শাণ বাঁধানো পুকুরের পাশে তিনটি ঘরের ছোট একটি বাড়িতে স্ত্রীকে নিয়ে থাকে পারভেজ। পুকুরের সামনে মাচায় বসে দাঁত ব্রাস করছিল পারভেজ।
"আরে! সোয়েব ভাই, কখন এলেন?" পারভেজ বলে।
"কাল রাতেই এসেছি।" মাচায় বসে বলে সোয়েব। পারভেজ পুকুরের পানিতে মুখ ধুয়ে ফিরে আসে।
"কেমন আছিস?" সোয়েব বলে।
"এইতো ভাই, ভাল। আছেন তো কিছুদিন?"
"না রে, চলে যাব আজকেই।"
"কয়েকদিন থাকতে পারেন না?"
"জানিসই তো, পুলিশের চাকরিতে কোন ছুটি নেই। তোর কি খবর বল? পুকুরে কি কি ছেড়েছিস এবার?"
"রাজপুঁটি, মৃগেল আর মিররকার্প। ভালই হয়েছে, সামনের মাসে জাল ফেলব।" পারভেজ বলে।
"আর জমিতে কি লাগিয়েছিস?"
"পাঁচ বিঘায় ধান, আর দুই বিঘায় পটল, বেগুন, ঝিংগা আর আদা।"
"আবার জমি কিনেছিস? নিজের টাকায়? নাকি বাসা থেকে টাকা এনেছিস?" অবাক হয়ে বলে সোয়েব।
"গত দুই বছর যা লাভ হয়েছে তা দিয়ে এক বিঘা কিনে ফেললাম।" পারভেজ বলে।
"ভালই তো চাষবাস করছিস। যদি বিসিএসে না টিঁকতাম তবে আমিও গ্রামে এসে খেতখামারী করতাম। অবশ্য আমার প্ল্যান ছিল গরু ছাগলের খামার দেয়ার।"
ততোক্ষনে পারভেজের স্ত্রী শিমু উঠনে এসে দাঁড়িয়েছে, "আরে দুলাভাই যে! কখন এলেন।" শিমু বলে।
সুমি শিমুর খালাতো বোন, সুমি ও সোয়েবের বিয়ের ঘটকালিটা মুলত শিমুই করেছে।
"কাল রাতেই এসেছি ঢাকা থেকে।"
"সুমিকে আনতে পারলেন না? দুপুরে না খেয়ে কিন্তু যাইতে পারবেন না।" শিমু বলে।
"সকাল সকালই রওনা দেব, রাস্তায় যা জ্যাম হয় আজকাল।"
"তাহলে অন্তত সকালের নাস্তা করে যান, লুচি পরোটা ভাজতেছি আমি।" শিমু বলে।
"ঠিক আছে।" সোয়েব বলে। শিমু রান্না ঘরের দিকে যায়।
"শহরের জীবন কি মিস করিস এখনো? তোর তো জন্মই শহরে, এই অজ পাড়াগাঁয়ে ভাল লাগছে?" সোয়েব বলে।
"শহরের জীবন যে মিস করি না তা নয়। কিন্তু এখন অনেক শান্তিতে আছি ভাই। আমার জীবনটা তো প্রায় নষ্টই হয়ে গিয়েছিল, নতুন করে যে জীবনটা শুরু করতে পেরেছি তা তো আপনার জন্যই।" পারভেজ বলে।
"আমি শুধু পথ দেখিয়েছি। তোর মনোবল আছে বলেই পেরেছিস। কতোজনই বা পারে ড্রাগের নেশা থেকে ফিরে আসতে।"
একটু থেমে আবার বলে "আচ্ছা, সজল নামের কাউকে চিনিস? বুয়েট গ্র্যাজুয়েট, আমার হিসাবে তোর ব্যাচেই পড়ত।"
"আমাদের ব্যাচে তো সজল নামে দুজন ছেলে ছিল। একজন সজল আহমেদ অন্যজন সজল হাসান।"
"সজল হাসান সম্ভবত। রোয়ান গ্রুপ অব কোম্পানিতে চাকরি করে গ্র্যাজুয়েশনের পর থেকেই।"
"চিনি তো, খুব ভাল করেই চিনি। আমার রুমমেট ছিল এক বছর।"
"কেমন জানিস ওকে?"
"এমনিতে বোঝা যায় না কিন্তু খুব ডেঞ্জারাস।" পারভেজ বলে।
"কেমন ডেঞ্জারাস?"
"নরপিশাচ বলতে পারেন। এমন কোন কাজ নেই যা করতে পারে না। লিপি নামের একটি মেয়েকে প্রাইভেট পড়াতো সে। তার সাথে গোপনে সেক্সুয়াল রিলেশন করে। মেয়েটা প্রেগন্যান্ট হলে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। তখন মেয়েটাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দেয়। সবকিছু এমনভাবে সাজায় যে সেটাকে আত্মহত্যা বলেই মনে হয়।"
"এসব তুই জানলি কিভাবে?"
"আমিও তো নরপিশাচই ছিলাম। ড্রাগ আসক্তি আমাকে অমানুষ করে তুলেছিল। একজন নরপিশাচ অন্য নরপিশাচকে নিজের অপকর্মের কথা বলতেই পারে। সজল আমাকে কন্ট্রাক্ট করেছিল এক লাখ টাকার বিনিময়ে একটি ছেলেকে খুন করতে।"
"কি বলছিস! তুই খুন করেছিস?"
"না খুন করিনি। হঠাত করে ছেলেটা গায়েব হয়ে যায়।"
"গায়েব হয়ে যায় মানে?"
"যেদিন ওকে খুন করে সুইসাইড সাজানোর কথা ছিল সেদিন ছেলেটা মেস ছেড়ে বের হয়, মেসে আর ফিরে আসেনি। তারপর থেকে একেবারেই নিখোঁজ।"
"ছেলেটা কে? কেন ওকে মারতে চাইত সজল?"
"ছেলেটার নাম মনে নাই। তবে মিরপুর ৬ এ এক মেসে থাকতো। কেন ওকে মারতে চাইত সজল তা বলেনি। তবে মনে হয় কোন মেয়েলী ব্যাপার ছিল।" পারভেজ বলে।
"ছেলেটাকে দেখলে চিনতে পারবি?"
"পারব।" এক মুহুর্ত ভেবে বলে পারভেজ।
"তুই এখানেই থাক, আমি এখনি আসছি।" বলে সোয়েব বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। পাঁচ মিনিট পর ফিরে আসে। পারভেজকে কবিরের ছবিটি দেখালে সে চিনতে পেরে বলে "এটাই তো সেই ছেলে। একে কোথায় পেলেন? পুরো বিষয়টা একটু পরিষ্কার করে বলেনতো। আমি বুঝতে পারছি না।"
তখন আবার শিমু এসে দাড়িয়েছে উঠানে।
"চল আগে নাস্তাটা সেরে নেই, তারপর বলছি।" সোয়েব বলে।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে পত্রিকার দিকে চোখ বুলাতে থাকে পারভেজ। কোন ইন্টারেস্টিং খবর খুঁজে পায় না। পত্রিকাটা ভাঁজ করে রেখে চায়ে চুমুক দিতে দিতে আসেপাশে চোখ বুলায় সে। গুলশান রোডের পাশে একটি ছোট চায়ের দোকানে বসে আছে সে। পারভেজ বহুদিন পর এসেছে শহরে, শহরের কর্মচাঞ্চল্য তার কাছে ভালই লাগছে। এই শহরেই তার জন্ম, এখানেই সে বড় হয়েছে। উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম পারভেজের। তার বাবা ব্যাবসায়ী, তার একটি ট্র্যাভেল এজেন্সি ও একটি কুরিয়ার সার্ভিস আছে। ইংলিশ মেডিয়ামে ও লেভেলস এবং এ লেভেলস শেষ করে পারভেজ বুয়েটে এডমিশন নেয়। মেধাবী ছাত্র ছিল সে, প্রথমবারেই টিঁকে যায়।
দুটো বছর ভালই চলল, প্রবলেম শুরু থার্ড সেমিস্টারে। স্বপ্না নামের এক গার্লফ্রেন্ড ছিল পারভেজের, সে তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফাইনাল ইয়ারের এক ছেলের সাথে রিলেশন করে। এরপর পারভেজের জীবন পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে যায়। নেশা যে সে আগে ছুঁতো না এমন নয়, মাঝে মাঝেই বন্ধুদের সাথে কিংবা গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে বিয়ার বার কিংবা নাইট ক্লাবে যেত। মাসে দুএকবার বন্ধুদের সাথে গাঁজা কিংবা ইয়াবার আসরেও বসত। কিন্তু প্রেমে ছ্যাঁকা খাবার পর প্রচন্ড রকমের ইয়াবার প্রতি আসক্তি পেয়ে বসে পারভেজকে। লেখাপড়া শিকেয় উঠে যায়, ইয়াবাসহ ক্যাম্পাসে ধরা পড়ার ফলে ইউনিভার্সিটি থেকে রাস্টিকেট হয়। ছয়মাস মাদক পুনর্বাসন কেন্দ্রে থেকে কিছুটা শুধরেছিল, কিন্তু তিনমাস পর আবার শুরু হয়। শেষমেষ বাবা বাড়ি থেকে বের করে দেয় পারভেজকে।
তখন মেসে মেসে থাকত এবং খরচ যোগাতে রাতের বেলা ছিনতাই করতে শুরু করে। সাথে আরো দু' একজন মাদকাসক্ত ছিনতাইকারী বন্ধুও জুটিয়ে ফেলে। এভাবেই কেটে যেতে পারত জীবন, কিন্তু পারভেজের জীবনে আবারও এক মোড় আসে। সেদিন রাত একটায় সে তার এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে মহাখালীর কাছে একটি গলিতে অপেক্ষা করছিল শিকারের জন্য। একটা শিকার পেয়েও যায়, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে একটি ছেলে হেঁটে যাচ্ছিল একা। দুজন মিলে ঘিরে নিয়ে ভয় দেখিয়ে টাকা পয়সা, ব্যাগ কেড়ে নিতেই কোথা থেকে এক পুলিশ জীপে করে চার পাঁচজন সশস্ত্র পুলিশ এসে ঘিরে নেয় ওদের, পালানোর কোন সুযোগ পায় না। পরে বুঝতে পারে ওটা পুলিশের টোপ ছিল, যাকে ছিনতাই করেছে সে পুলিশের কনস্টেবল।
সেদিনের কিছু মুহুর্ত এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে পারভেজের। রিমান্ড সেলে বসে ছিল সে, তার সামনে পুলিশের একজন অফিসার তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পাশের রুম থেকে তার সঙ্গীর চিতকার ভেসে আসছিল।
"নাম কি?" দশ মিনিট চুপ থাকার পর মুখ খোলে অফিসার।
"পারভেজ।" কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জবাব দেয় পারভেজ।
"পুরো নাম?"
"পারভেজ হোসেন চৌধুরি।"
"বাড়ি কোথায়?"
"শান্তিনগর, ঢাকা।" পারভেজ বলে।
"কতোদিন থেকে এই পেশায় নেমেছিস?"
"আর করবনা স্যার, ক্ষমা করে দেন স্যার।" কাকুতি মিনতি করে বলে পারভেজ।
"যাকে আমার বেস্ট স্টুডেন্ট বলে গর্ব করতাম একসময়, তাকে এই রিমান্ড সেলে দেখতে কতো কষ্ট হচ্ছে জানিস?" অফিসারটি বলে।
সোয়েবকে চিনতে এক মিনিট লেগে যায় পারভেজের। বাচ্চা ছেলের মতো ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলে সে। সোয়েব পারভেজকে ও লেভেল থেকে বুয়েট এডমিশন পর্যন্ত তিন বছর ম্যাথ টিউশনি পড়িয়েছে। ছয় বছর পর দেখা তাদের।
এরপর সোয়েব পারভেজের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে, নিজের চেষ্টায় কেস থেকে বের করে আনে পারভেজকে। পারভেজকে আরো তিন মাস মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে চিকিতসা করায়। খানিকটা সুস্থ্য হলে ওকে সোয়েবের গ্রামে নিয়ে যায়, সেখানে বাড়ি ও চার বিঘা জমি কিনে দেয়। গ্রামেরই এক মেয়ের সাথে বিয়ে দেয়। সেখানে নতুন করে জীবন শুরু করে পারভেজ।
হঠাত হর্নের আওয়াজে পারভেজের সম্বিত ফেরে। সামনে রোয়ান কনস্ট্রাকশনের করপোরেট অফিসের সামনে একটি গাড়ি দাঁড়িয়েছে। পারভেজ উঠে গেটের দারোয়ানদের দিকে যায়।
"সিইও স্যার কি এসেছেন?" পারভেজ সিকিউরিটি গার্ডদের জিজ্ঞাসা করে।
"এখনো আসেননি। কেবলই এমডি স্যার এলেন।" একজন গার্ড জবাব দেয়। তখনই সাদা রঙের একটি গাড়ি এসে দাড়ায় গেটের সামনে।
"ঐতো সিইও স্যার এলেন।" সিকিওরিটি গার্ড বলে।
পারভেজ গাড়িটির দিকে এগিয়ে যায়, গাড়ির জানালায় টোকা দেয় সে। কয়েক সেকেন্ড পর জানালা খুলে যায়।
"আমাকে চিনতে পারছিস? আমি পারভেজ।" পারভেজ বলে।
"তুই হঠাত! কোথায় থেকে উদয় হলি? আর কোথায় গায়েব হয়ে গিয়েছিলি?" সজল বলে।
"ধরা পড়েছিলাম। জেল হয়েছিল পাঁচ বছরের। একমাস আগে বেরিয়েছি।"
"তা কি চাস তুই?"
"তুই তো অনেক উন্নতি করেছিস, অনেক বড় চাকরি করিস। একটা চাকরীর ব্যবস্থা করে দে না। পিওন টিওন হলেও চলবে।" পারভেজ বলে।
সজল তার কার্ড বাড়িয়ে দিয়ে বলে "অফিস আওয়ার শেষে কল দিস, কিন্তু আর অফিসে এসে যোগাযোগের চেষ্টা করবি না।" বলে গাড়ির জানালার কাঁচ উঠিয়ে দেয় সজল। সজলের সাথে দেখা করে ঢাকা শান্তিনগরে তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় পারভেজ।
 
যতোদুর চোখ যায় দিগন্তজোড়া সবুজ মাঠ, লোকালয়ের কোন চিহ্ন নেই, মাঠের বুক চিরে চলে গেছে একটি পাকা রাস্তা। সেই রাস্তাটির পাশে একটি পাঁচ তলা বাড়ি। বাড়িটির পাঁচতলার ব্যালকনিতে বসে বাইরের দৃশ্য দেখছিল স্নিগ্ধা। একটি ঘর, ঘরের সাথে বেলকুনি আর এটাচড বাথরুম, এর মাঝেই বন্দি সে একমাস যাবত। কবির কোথায় আছে কেমন আছে কিচ্ছু জানেনা। কবিরের কথা মনে পড়লেই মনটা কেঁদে ওঠে ওর। অনেক কেঁদেছে, কাকুতি মিনতি করেছে সে, কিন্তু তাতে আর লাভ নেই, জানে স্নিগ্ধা। হঠাত ইঞ্জিনের শব্দ পায় সে, তাকিয়ে দেখে একটি ট্রাক এসে থেমেছে বাড়িটির প্রাঙ্গনে। নিস্তব্ধ বাড়িটায় হঠাত কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়ে গেছে, আট দশ জন শ্রমিক বড় বড় কার্টন নামাচ্ছে। স্নিগ্ধার মনে হয় এটি কোন কারখানা, কিন্তু কিসের তা জানেনা।
স্নিগ্ধা পেটের কাছ থেকে কাপড় সরায়, ওর গর্ভে তিন মাসের সন্তান, এখন পর্যন্ত পেট একটুও বাড়েনি। তবে স্নিগ্ধা নিজের মাঝে আরেকটি অস্তিত্ব অনুভব করে। কবিরের কাছে শুনেছিল একা থাকার একটি ভাল উপায় হল নিজের সাথে নিজে কথা বলা। কিন্তু স্নিগ্ধা নিজের গর্ভে সন্তানের সাথে কথা বলে। মসৃণ পেটে হাত বুলাতে বুলাতে কথা বলতে শুরু করে।
"কিগো সোনা কেমন আছিস?" স্নিগ্ধা বলে।
"ভাল তো থাকবিই। তোর তো আর চিন্তা নেই, শুধু খাস আর ঘুমাস। আর আমি চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছি।"
"কিসের চিন্তা, জানিস না? এ জগতটা তো রাক্ষস খোক্ষসে ভরা। তারা তোর আব্বুকে মেরে ফেলতে চায়, আর তোকেও।"
"না না ভয় নেই সোনা, আমি আছি না, তোর আব্বু আছে না। তোর কোন ক্ষতি হতে দেব না।"
একজন মধ্যবয়সী মহিলা এসে কখন দাড়িয়েছে তা লক্ষ করেনি স্নিগ্ধা।
"আপনের খাওন আনছি। খাইয়া লন।"
স্নিগ্ধা কিছু না বলে উঠে যায়।
"আমাকে আজ বিকেলে একটু ছাদে যেতে দিবে।" খাবার শেষে স্নিগ্ধা বলে মহিলাটিকে।
"না, আপনের এই ঘর থেইকা বাইর হওয়া নিষেধ, বড় সাহেব নিষেধ করছে। আর তাছাড়াও আপনের মাথায় সমস্যা আছে।" বলে মহিলাটি ঘর থেকে বের হয়ে দরজায় তালা দেয়।

"গাজিপুর নিহিলীন টেক্সটাইল প্রজেক্টটার কি খবর?", জিল্লুর রহমান পায়ে পা তুলে বসতে বসতে জিজ্ঞাসা করে সজলকে।
"ফিনিশিংয়ের কাজ চলছে, আর একমাস লাগবে।" সজল জবাব দেয়।
"একমাস নয় আর বিশ দিনের ভেতর কমপ্লিট চাই, দরকার পড়লে ম্যানপাওয়ার বাড়িয়ে দাও।"
"ওকে স্যার।"
"কালকে তো মামলার প্রথম শুনানি। সব কিছু ঠিক আছে তো?"
"জি স্যার। সব ঠিক।" সজল জবাব দেয়।
"কেসটা যত দ্রুত সম্ভব মিটে যায় ততই ভাল। সামনে পার্লামেন্ট ইলেকশন, সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে।" জিল্লুর বলে।
"স্যার, একটা ছোট্ট প্রবলেম। দীপালি ব্যানার্জি নামের একজন মহিলা উকিল কবিরের পক্ষে লড়বে।"
"কি বলছ? কে দাঁড় করিয়েছে। আমাকে আগে জানাওনি কেন?"
"আমার মনে হয় না সে নিয়ে চিন্তার কোন কারণ আছে। আমি খোঁজ নিয়েছি, পাতি উকিল, জমি জমা আর ডিভোর্স কেস লড়ে সাধারণত।" সজল বলে।
"শত্রুকে দুর্বল ভাবে বোকারাই। খোঁজ নাও এর পেছনে কে আছে। এর পিছে তোমার শ্বশুর শাশুড়িদের হাত নেই তো?"
"না সে সম্ভব না। আমি দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা ওনাদের ওপর নজর রাখছি। তবে আমি খোঁজ নিচ্ছি এর পিছে কে আছে।"
"হ্যাঁ খোঁজ নিয়ে আমাকে জানাও। আর এখন যাও।" জিল্লুর বলে।
সজল তবু চুপ করে বসে থাকে।
"কিছু বলবে?" জিল্লুর রহমান জিজ্ঞাসা করে।
"স্নিগ্ধা কোথায় স্যার?"
"ও যেখানে আছে এখন পর্যন্ত ভাল আছে। কোথায় আছে সেটা তোমার জেনে কাজ নেই।"
"স্নিগ্ধা আমার স্ত্রী, ও কোথায় কিভাবে আছে তা আমার জেনে কাজ নেই?"
"স্নিগ্ধা প্রকাশ্যে এলে আমাদের সব প্ল্যান ফেল হয়ে যাবে। আমি সেটা হতে দেব না।"
"আমার ওপর ভরসা রাখুন স্যার, আমি ওকে লুকিয়ে রাখব। কেউ জানবে না।"
"আমি কোন রিস্ক নিতে চাই না। সামনে পার্লামেন্ট ইলেকশন। এই মুহুর্তে কোন অঘটন ঘটে গেলে আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার এখানেই শেষ।"
"আমি শুধু একবার দেখা করব ওর সাথে।"
"কেন অযথা মায়া বাড়াবে?"
"তার মানে আপনি ওকে...!" বলতে গিয়ে থেমে যায় সজল।
"না, সে বিষয়ে এখনো ভাবিনি।"
একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে জিল্লুর, "তুমি আমার ছেলের মতো। তোমার ভালোর জন্যই বলছি আমি। যখন আমাকে শিল্প মন্ত্রনালয় সামলাতে হবে তখন তো আর বিজনেস সামলাতে পারবনা। আমার বিজনেস তো তোমাকেই সামলাতে হবে। আর তাছাড়া স্নিগ্ধার গর্ভে যে সন্তান তা তো তোমার নয়, তুমি কি অন্যের সন্তান মেনে নিতে পারবে?"
ড্রয়ার থেকে একটি মেয়ের ছবি বের করে সজলের সামনে টেবিলে রাখে, "এশিয়ান ফুড প্রোডাক্স এন্ড বেভারেজের ভাইস চেয়ারম্যান আজিম উদ্দিনের একমাত্র কণ্যা সিন্থিয়া। সাইমনের সাথে ওর বিয়ে ঠিক করেছিলাম। তুমি চাইলে তোমার ব্যাপারে কথা বলি। আমার কথা ফেলবে না।"
সজল ছবিটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যায়, গেইট থেকে বের হয়ে ছবিটা কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলে। হাত ঘড়িতে সময় দেখে সে, রাত দশটা পনের বাজে। গাড়ি স্টার্ট দিতেই রিংটোন বেজে ওঠে। অচেনা নাম্বার, সজল রিসিভ করে।
"হ্যালো সজল, চিনতে পারছিস?"
"হ্যাঁ, বল পারভেজ।"
"ভাই একটা কাজের ব্যাবস্থা করে দে না।" পারভেজ বলে।
"তুই কোথায় আছিস?"
"উত্তরায়, এক ফ্রেন্ডের মেসে। ফ্রী ফ্রী রাখতে চাইছে না, বের করে দিবে।"
"এখনই দেখা করতে পারবি?"
"কোথায় আসব?"
"গুলশান চত্তর, সেরেনা টাওয়ার।"
"ঠিক আছে।" বলে কেটে দেয় ফোন।
সজল ফোন রেখে দিয়ে গাড়ী স্টার্ট দেয়। ধানমন্ডি থেকে গুলশানে আাসতে বিশ মিনিট লেগে যায় সজলের। সজল বেসমেন্টে গাড়ি পার্ক করে সেরেনা টাওয়ারের ছাদে উঠে আসে। সেখানে ছাউনিতে টেবিল চেয়ার পাতা, সজলের যখন মন খারাপ থাকে তখন এখানে এসে বসে থাকে। চোখের সামনে ঝলমলে ঢাকা শহর, সে দৃশ্য দেখতে দেখতে সজল সিগারেট টানতে থাকে। দশ মিনিট পর কল আসে পারভেজের।
"কিরে এসেছিস।" রিসিভ করে বলে সজল।
"হ্যাঁ বস, সেরেনা টাওয়ারের সামনে।"
"ছাদে চলে আয়।"
"একেবারে ছাদে?"
"হ্যাঁ, চলে আয়।" বলে কেটে দেয় সজল।
আরো তিন মিনিট লেগে যায় পারভেজের।
"কি খবর তোর? কেমন আছিস?"
"খুব প্যাড়ার মধ্যে আছি দোস্ত, মনে হচ্ছে এর চেয়ে জেলেই ভাল ছিলাম।" পারভেজ বলে।
"একবার শুনলাম তুই ধরা খেয়েছিস, ভেবেছিলাম তোর বাপ তোকে ছাড়িয়ে আনবে।"
"ছাড়িয়ে আনা তো দুরের ব্যাপার, কখনো দেখাও করেনি। তুইও তো কখনো খোঁজ নিলি না।"
"দেখা করবো কিভাবে? খুব ব্যাস্ত ছিলাম কয়েক বছর।"
"তা অবশ্য ঠিক, পরিশ্রম ছাড়া এমনি এমনি তো আর এই পজিশনে আসিস নি।"
"শুধু পরিশ্রম দিয়ে কাঁচকলা হয়, বুদ্ধি লাগে, ভাগ্য লাগে আর কিছু দামও মেটাতে হয়।" বলতে বলতে দীর্ঘশ্বাসকে গোপন করে সজল।
"তুই তো চাইলেই একটা চাকরীর ব্যাবস্থা করে দিতে পারিস। দে না একটা কাজের ব্যাবস্থা করে।"
"তুই কি কাজ করবি? তোকে তো একটা কাজ দিয়েছিলাম তাও করতে পারিস নি।"
"আমি তো চেষ্টা করেছিলাম। ভাগ্য খারাপ ছিল, পাখিটা উড়ে গেল।"
"পাখিটা ফিরে এসে আমার লাইফের বারোটা বাজিয়ে দিল।"
"মানে? কি হয়েছে?"
"যাহ ওসব কথা বাদ দে। তোর সাথে দেখা হবে আগে জানলে সবজি কিংবা গুটির ব্যাবস্থা করতাম। তোর কাছে আছে নাকি কিছু?"
"না বস, ওসব কিছু নাই।"
"আমার কাছে কিছু আছে, তবে অন্য জিনিস।" বলে সজল উঠে দাঁড়ায় সিঁড়ির ঘরের দিকে যায়, পিছে পিছে পারভেজও। সিঁড়ির ঘরটা প্রায় অব্যাবহৃতই, তার এক কোনায় একটি ফ্রিজ রাখা আছে।
"ওরে বাবা, তুই তো দেখি পুরো বার তুলে রেখেছিস ফ্রিজে।" ফ্রিজে স্তরে স্তরে মদ আর সোডার বোতল সাজানো দেখে বলে পারভেজ।
"কি খাবি বল? বিয়ার আছে, ব্র্যান্ডি আছে, রাশিয়ান ভোদকা আছে, হুইস্কি আছে স্কচ।"
"স্কচ! আমি কখনো চেখে দেখিনি।" পারভেজ বলে।
 
পারভেজ ও সজল ফিরে আসে ছাদে। মদ খেতে খেতে তারা গল্প জুড়ে দেয়, গল্পের বেশিরভাগটা জুড়েই তাদের কলেজ জীবন। পারভেজ যতটা সম্ভব ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছিল, নেশাটা বেশি চড়ে যেতে দিতে চায় না, অপেক্ষা করছিল সজলের আরেকটু নেশায় বুঁদ হবার।

"তুই কিন্তু আমার প্রশ্নটার উত্তর দিলি না।" ছোট একটা চুমুক দিয়ে বলে পারভেজ।
"কোন প্রশ্ন দোস্ত?"
"সেই পাখিটা তোর কি ক্ষতি করেছে?"
"সেই পাখিটা হঠাত কোত্থেকে উড়ে এসে আমার জানপাখিটাকে নিয়ে উড়ে চলে গেল।" অপ্রকৃতস্থর মতো করে বলে সজল। পারভেজ বুঝতে পারে বেশ নেশা হয়ে গেছে।
"জানপাখি!" অবাক হবার ভান করে বলে পারভেজ।
"আমার জানপাখি, আমার বউ, মাই সুইটহার্ট।" বলতে বলতে মোবাইলটা বের করে স্নিগ্ধার ছবি দেখায় তারপর মোবাইল স্ক্রিনে চুমু দেয়।
"খুঁজে পাসনি?"
"খুঁজতে পাঠিয়েছিলাম সাইমন্ডকে। খুঁজেও পেয়েছিল, কিন্তু মাদারচোদ খানকির পুত সাইমন্ড আমার স্নিগ্ধাকে ধর্ষণ করতে চেয়েছিল, কবির ঐ শুয়োরটাকে মেরে স্নিগ্ধাকে নিয়ে ওখান থেকে পালিয়ে যেতে চায়, কিন্তু পুলিশের কাছে ধরা পড়ে।"
"তুই এতসব কিভাবে জানিস?"
"আমি ঐ ক্রাইম প্লেসে গেছি, দেখেই সব বুঝতে পারছি কি হইছিল ঐখানে। আর একটা জিনিস আমি পাইছি, দাঁড়া দেখাচ্ছি তোকে।" বলে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায় সজল, সিঁড়ির ঘরে ফ্রিজের পাশে লকার খুলে দেখায় পারভেজকে, একটা পিস্তল সেখানে।
"শুওরটা নিজের পিস্তলের গুলিতেই মরেছে।" বলে আবার টলতে টলতে ফিরে এসে ধপাস করে বসে।
"তাহলে এখন প্রবলেম কি?" পারভেজ বলে।
"প্রবলেম ঐ বুড়োটা, খ্যাপা ষাঁড় হয়ে আছে। কবিরকে ডাকাত সাব্যস্ত করে ফাঁসিতে চড়াতে চায়। তা চড়াক, কিন্তু স্নিগ্ধাকেও নিজের ছেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী মনে করে। স্নিগ্ধাকে বুড়োটা কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। ওকেও ছাড়বে না, স্নিগ্ধাকেও মেরে ফেলবে কষাই বুড়োটা।"
হঠাত পারভেজের কাঁধে মাথা রেখে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলে সজল, "বাড়ি গাড়ি ধন দৌলত কিছু চাই না আমি, শুধু আমার বৌকে এনে দে। আমি ওকে ছাড়া বাঁচব না।" কাঁদতে কাঁদতে বলে সজল।

সজল তার বিছানায় উপুড় হয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। পারভেজ একটু আগে ওকে প্রায় টেনে এনে শুইয়ে দিয়েছে। তার আগে ড্রাইভ করেছে পারভেজই। পারভেজ সজলকে খুব ভাল চেনে, এমনিতে যতোই সেয়ানা হোক, পেটে খানিকটা মদ পড়ে গেলে হুঁস হারিয়ে ফেলে। পারভেজ লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসে সজলের ফ্ল্যাট থেকে। ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে সোয়েবকে কল করে সে। দ্বিতীয় রিংয়ে রিসিভ হয়।
"হ্যালো পারভেজ, কোথায় তুই?"
"ঢাকাতেই।" পারভেজ বলে।
"তোকে না দুপুরেই বলেছি লাগেজ গুছিয়ে নিয়ে মুন্সিগঞ্জ রওনা দিতে। কথা কানে যায়নি?" ধমকের সুরে বলে সোয়েব।
"আমি যখন একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি তখন কাজটা শেষ না করে পিছু হঠছি না।"
"কে তোকে স্পাইগিরি করতে বলেছে? কেন অন্যের জন্য নিজের জীবন ঝুঁকির মাঝে ফেলছিস?"
"আপনিও তো চাকরির ঝুঁকি সত্তেও আমাকে কেসটা থেকে বের করে আনলেন। আমার মতো বখে যাওয়া ছেলে যদি নতুন করে জীবন শুরু করার সুযোগ পায়, ওরা নির্দোষ হয়ে কেন তা পাবে না?"
"ওরা নিশ্চয়ই পাবে, কিন্তু তার জন্য তোর এর ভেতর জড়ানোর দরকার ছিল না।" সোয়েব বলে।
"এখন আর পিছু হটা যাবে না। একটু আগে সজলের সাথে দেখা করেছি। কিছু ইনফরমেশনও পেয়েছি, এখনই দেখা করতে পারবেন?"
"কোথায় আছিস?"
"বনানি।"
"ওখানেই থাক, আমি আসছি।"
রাতের ফাঁকা রাস্তায় পুলিশ জীপ নিয়ে আসতে সোয়েবের পনেরো মিনিট লাগে। পারভেজকে উঠিয়ে নিয়ে একটি ফাঁকা যায়গায় গাড়ী থামায় সোয়েব।

"এবার বল কি কি জানতে পারলি?" সোয়েব বলে।
"প্রথমত, সাইমন্ড রহমানের মৃত্যু যে পিস্তলে হয়েছে সেটি সজলের কাছেই আছে। কোথায় রেখেছে আমি জানি, আপনি চাইলে এনে দিতে পারি।"
"বাহ। প্রথম বলেই ছক্কা মেরে দিয়েছিস, শুধু ঐ পিস্তলটা দিয়েই কবিরকে নির্দোষ সাব্যস্ত করা যায়।" উচ্ছসিত কন্ঠে বলে।

"আর দ্বিতীয়ত, মেয়েটির খোঁজ সজলও জানে না। জিল্লুর রহমান ওকে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। সম্ভবত মেয়েটির জীবনও হুমকির মুখে, জিল্লুর রহমান তার ছেলের মৃত্যুর জন্য স্নিগ্ধাকেও দায়ী মনে করে।" পারভেজ বলে।
কথাটি শুনে সোয়েবের মুখ কিছুটা গম্ভীর হয়ে যায়, কয়েক সেকেন্ড ভেবে বলে "তাহলে আর পিস্তলটা আনার দরকার নেই। কবির নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারলে বুড়োটা প্রতিহিংসা বশত মেয়েটির ক্ষতি করে ফেলতে পারে। আর তাছাড়া সজলের মতো ধড়িবাজ মানুষ যে তোকে সব সত্য বলেছে তা নিশ্চিত হচ্ছিস কিভাবে?"
"আমি ওকে খুব ভালভাবে চিনি। এমনিতে খুব চালু মাল, কিন্তু পেটে মদের ডোজ একটু বেশি পড়লেই হুঁস হারিয়ে ফেলে। অনেক বেফাঁস কথা বলে ফেলে, হুঁস ফিরলে তার কিছুই ওর মনে থাকে না।"
"তাহলে আমার মাথায় একটা প্ল্যান আছে, কিন্তু তা বলার আগে আমি আরো একবার মনে করিয়ে দিতে চাই। তুই চাইলে এখনই ফেরত চলে যেতে পারিস। আর এক পা এগোলেই তোর জীবন ঝুঁকির মাঝে পড়ে যাবে।"
"না ভাই, কাজটা না সেরে ফিরে যাবার চিন্তা আমার নেই।"

সজলের ঘুম ভেঙে যায় মোবাইলের রিংটোনের শব্দে। রিসিভ করে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে "হ্যালো, কে?"
"আমি পারভেজ।"
"পারভেজ, তুই এত সকালে?"
"সকাল কোথায়, সাড়ে এগারোটা বাজে।"
দেয়াল ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে বলে সজল "হ্যাঁ, বল পারভেজ।"
"কাল তোর সাথে দেখা করেছিলাম।" পারভেজ বলে।
"হ্যাঁ, তো?" বিরক্তির সাথে বলে সজল।
"আমি তোর কাছে একটা চাকরীর ব্যাবস্থা করে দিতে বলেছিলাম, তুই বলেছিলি যে তুই নিজেই আমাকে চাকরি দিবি। আমি তোর হয়ে কাজ করে দিব আর তুই মাসে মাসে পনেরো হাজার করে টাকা দিবি। আমাকে একমাসের এডভান্স দিয়েছিলি আর কাজও দিয়েছিলি একটা। মিতালী ব্যানার্জি নাকি কি নামের যেন এক মহিলা উকিলের ওপর নজর রাখতে হবে।"
একমুহুর্ত চুপ থেকে আবার বলে পারভেজ "তোর কি মনে আছে সেসব? তুই যদি স্বেচ্ছায় টাকাগুলো না দিয়ে থাকিস তবে আমি ফেরত দিয়ে দিতে পারি।"
"মনে থাকবে না কেন। সেই মহিলা উকিলের নাম মিতালী না বরং দিপালী ব্যানার্জি। ফার্মগেইটের কাছে থাকে। আজ সারাদিন ওনাকে জজকোর্টে পাবি। তিনি কোথায় কোথায় যায়, কে কে তার সাথে দেখা করে, এসব ইনফরমেশন আমার চাই। টাকা আরো লাগলে আমাকে বলবি। কাজে লেগে যা।" সজল বলে।
"ঠিক আছে, বস।" বলে কেটে দেয় পারভেজ।

গত রাতের কথা সজল অনেক কিছুই মনে করতে পারেনা। পারভেজের সাথে দেখা করে একসাথে বসে মদ খাচ্ছিল আর আড্ডা দিচ্ছিল মনে আছে তার, কিন্তু পারভেজকে টাকা বা কাজ দিল কখন, আর সেরেনা টাওয়ার থেকে তার বেডরুমে এল কিভাবে তাও মনে করতে পারে না। আর পারভেজকে এর মাঝে জড়ানোটা ঠিক হল কিনা সে নিয়ে ভাবছিল সজল। চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে তড়িঘড়ি করে রেডি হয়ে নেয় সজল, তাকে একটার মাঝে কোর্টে উপস্থিত হতে হবে।
কেসের প্রথম শুনানির দিন আজ। প্রথমে কবিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করে পাবলিক প্রসিকিউটর এডভোকেট মাহতাব মুন্না। শহরের অন্যতম নামি উকিল সে। এরপর চারজন সাক্ষী বয়ান দেয়, তাদের মাঝে একজন পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের এসপি, অন্যজন বান্দরবান থানার ওসি, আর দুজন সাব ইনসপেক্টর। তারা কিবরিয়া ডাকাতকে গ্রেফতার ও স্নিগ্ধাকে উদ্ধারের অভিযানের কাল্পনিক বর্ননা দেয়। দীপার জেরার মুখে ওসি এবং একজন এস আই কিছুটা ভড়কে গেলেও মাহতাব চতুরতার সাথে তা সামলে নেয়। পরবর্তী শুনানীর দিন ধার্য করা হয় দুই সপ্তাহ পরে।

দুই দিন পর। রাত দশটা বাজে, সজল ও পারভেজ জিল্লুর রহমানের বাড়িতে আসে। গাড়িটা পার্ক করে ওরা ড্রয়িং রুমে আসে, সেখানে সোফায় এক মধ্যবয়স্ক লোককে বসে থাকতে দেখে। লোকটার গায়ের রং কালো, বেঁটে, মোটাসোটা, পরনে শার্ট ও লুংগি। লোকটা বসে থেকে পত্রিকা নাড়াচাড়া করছিল, সজল সেদিকে এগিয়ে যায়।
"আরে মজনু মামা, কি খবর? ঢাকায় আইলা আর আমার সাথে দেখা করলা না?" সজল বলে।
"আইলাম তো কেবলই, দেখা তো হইতই। তোমার খবর কি?" উঠে হাত মেলাতে মেলাতে চওড়া হাসি দিয়ে বলে মজনু।
"এইত চলে কোনরকম, তোমার ব্যাবসা বাণিজ্য কেমন চলে?"
"চলতাছে ভালই, তয় মুরগির ব্যাবসায় একটু ঝামেলা হইছে।" মিটি মিটি হাসতে হাসতে বলে মজনু।
"হ, শুনলাম টাংগাইলে গন্ডগোল হইছে।" মাথা নেড়ে বলে সজল।
"তয়, বিদেশে মুরগি সাপ্লাই দিয়া ভাল লাভ হইছে। তা ভাইগ্না তোমার লাগব নাকি কচি মুরগি? বিদেশী কচি মুরগি আছে, খাইয়া মজা পাবা, কও তো পাঠাইয়া দেই।" চওড়া হাসি নিয়ে বলে মজনু।
"এখন লাগব না। লাগলে বলমুনি। তা তোমার আটা ময়দা, চাউলের বিজনেস ঠিক ঠাক চলে তো?"
"এমনিতে ঠিক ঠাকই চলতাছিল, তয় গত কাল পুলিশ আটকাইছে এক প্যাকেট চাউল, সেই জন্যেই স্যারের কাছে আইছি।" মজনু বলে।
ঠিক তখনই জিল্লুর রহমান চলে আসে।
"সজল, ও কে?" পারভেজকে উদ্দেশ্য করে সজলকে জিজ্ঞাসা করে বলে জিল্লুর।
"ও আমার পিএ।"
"ও আচ্ছা।" তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পারভেজের দিকে তাকাতে তাকাতে সোফাতে বসে জিল্লুর, সজল ও মজনুকে বসার জন্য ইশারা করে সে।
"তা কি খবর সজল?" জিল্লুর বলে।
"নিহীলিন টেক্সটাইল প্রজেক্টে ম্যানপাওয়ার বাড়িয়েছি দ্বিগুন, আশা করি আর পনের দিনের মধ্যে কাজ শেষ হবে।"
"গুড।"
"আর সেই মহিলা উকিলের বিষয়ে খোঁজ নিয়েছি। ওনার পেছনে কে আছে তা মনে হয় বুঝতে পেরেছি। মিরপুর থানার এএসপি সোয়েব মাহমুদ।"
"কেন সে হঠাত এই কেসের পেছনে পড়লো?" জিল্লুর বলে।
"কবিরকে মিরপুর থানাতে রাখা হয়েছিল, তো হতে পারে সে কোনভাবে তাকে কনভিন্স করেছে যে সে নির্দোষ।" সজল বলে।
"হতে পারে। এখন থেকে অফিসারটির দিকেও নজর রেখ। আর আমিও দেখছি। আর কিছু বলবে?"
"না স্যার।"
 
"বস ঐ লোকটা কে? এরকম চাষাভুষা টাইপের লোক জিল্লুর রহমানের সাথে কিসের মিটিং করে?" গাড়ি চালাতে চালাতে বলে পারভেজ। পারভেজের কথা শুনে খিক খিক করে হেসে ওঠে সজল।
"কি বললি! চাষাভুষা!" বলতে বলতে আবার খিক খিক করে হেসে ওঠে সজল। কোনরকম হাসি থামিয়ে বলে "কালা মজনুর নাম শুনিস নি কখনো? উত্তরবঙ্গের ত্রাস, ভাড়ায় খুনখারাপি আর চাঁদাবাজি করতো একসময়। র‍্যাবের কাছে ধরা পড়েছিল। ক্রসফায়ারে মারা পড়তো হারামিটা, জিল্লুর ওকে বাঁচিয়েছে।"
"জিল্লুর রহমান ওকে বাঁচালো কেন?" পারভেজ বলে।
"দুর সম্পর্কের আত্মীয় হয়, শুনেছি। কিন্তু ওকে জিল্লুর বাঁচিয়েছে নিজের কাজে লাগাবে বলে। আমাকে দিয়ে যেমন জিল্লুর ওর সাদা বিজনেসগুলো সামলায়, মজনুকে দিয়ে ওর কালো বিজনেসগুলো সামলায়।"
"কালো বিজনেস?" অবাক হয়ে বলে পারভেজ।
"তুই কি ভেবেছিস, মজনু পোল্ট্রি ফার্ম আর চাউল আটা, ময়দার বিজনেস সামলায়? নারী ব্যাবসা, দেশে বিদেশে নারী পাচার করে, কোড ওয়ার্ডে মুরগির বিজনেস। চাউল হল ইয়াবা, আটা ময়দা হল হিরোইন, কোকেইন। শুনেছি জিল্লুর রহমানের ইয়াবা ফ্যাকটরি আছে বেশ কয়েকটা।"
"কি বলছিস তুই?"
"অবাক হওয়া বাদ দিয়ে গাড়ি চালা মনযোগ দিয়ে।" সজল বলে। ঠিক তখনই সজলের মোবাইলে রিংটোন বেজে ওঠে, সজল রিসিভ করে।
"হ্যালো মামা, কই আছ?"
সজল বলে, "এখনই জিল্লু সাহেবের বাড়ি থেইকা বাইর হইলাম।"
"যাইবা নাকি নাইট ক্লাব কিংবা বার?"
সজল বলে, "নাহ আইজ আর না।"
"জরুরি কথা আছে, ভাইগনা ঐ যায়গাতে দেখা কর।" মজনু বলে।
"ঠিক আছে, আমি বিশ মিনিটের মধ্যে আসতেছি।" বলে ফোন কেটে দেয় সজল।
"উত্তরার দিকে গাড়ি ঘোরা।" সজল পারভেজকে বলে।
"উত্তরায় কোথায়?" পারভেজ জিজ্ঞাসা করে।
"তোর মেস।"
পারভেজকে তার মেসের সামনে নামিয়ে দিয়ে সজল গুলশানের দিকে রওনা দেয়।

দেখতে দেখতে পরের শুনানির দিন চলে এল, এবার সোয়েব ও দীপা কবিরের পক্ষে সাক্ষী পেশ করে। কবিরের নিখোঁজ হওয়া ছয় বছরের কোথায় কোথায় ছিল তার বিবরণ এবং তার সপক্ষে সাক্ষী পেশ করে দীপা, আর যুক্তি পেশ করে যে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে কিবরিয়া ডাকাতের প্রকোপ যেখানে পাঁচ বছর ধরে চলছে সেখানে কবির কোনভাবেই কিবরিয়া ডাকাত হতে পারে না। এই যুক্তি মেনে নেয়া ছাড়া বাদি পক্ষের কোন উপায় ছিল না। বাদী পক্ষের উকিল মাহতাব স্বীকার করে যে কবির হয়তো ডাকু কিবরিয়া নয় কিন্তু পুলিশ প্রথম থেকেই এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেনি যে আসামীই সেই কিবরিয়া ডাকাত নাকি ডাকু কিবরিয়ার কোন ঘনিষ্ট সহযোগী। আর তাছাড়া কেসটির মুল প্রতিপাদ্য ডাকাতি নয় বরং সাদিয়া অপহরণ ও ধর্ষণ এবং সাইমন্ড ও রকি হত্যা। দীপা তখন দাবী করে যে এখন পর্যন্ত ভিক্টিমের সাক্ষ্য নেয়া হয়নি, তাই আসামীর বিরুদ্ধে আরোপিত অভিযোগের কিছুই প্রমাণ হয় না।
মাহতাব তখন সাদিয়ার মেডিকেল রিপোর্ট পেশ করে এবং দাবি করে যে শারিরীক ও মানষিক নির্যাতনের দরুন স্নিগ্ধা মানসিকভাবে অসুস্থ এবং সাক্ষ্যদানে অপারগ। মেডিকেল রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে দীপার আবেদন নাকচ করে দেয় আদালত। তখন দীপা আবেদন করে ভিক্টিমের অভিভাবকদের সাক্ষ্য পেশ করার। আদালত এবার দীপার আবেদন মঞ্জুর করে, সাদিয়ার বাবা, মা এবং স্বামীকে পরবর্তী শুনানিতে উপস্থিত করার নির্দেশ দেয়। আর পরের সপ্তাহেই পরবর্তী শুনানী ধার্য হয়।

রাত দশটা ত্রিশ বাজে, জিল্লুর রহমান তার বাড়ির বাগানে বসে আছে। তার একপাশে সজল ও পারভেজ অন্যপাশে মাহতাব।
"তোমরা তো দেখি কেসটা কফিনে ঢুকিয়ে ফেলেছো? পেরেকটা মারা বাকি রেখেছ কেন?" চিবিয়ে চিবিয়ে বলে জিল্লুর।
"কেসটা এখনো আমাদের হাত থেকে বেরোয় নি।" মাহতাব বলে।
"পুরোপুরি বের হয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলছ? বেওকুফ!" ধমকে বলে জিল্লুর। একটু থেমে সজলের উদ্দেশ্যে বলে, "তোমাকে না বলেছি ওদের দিকে নজর রাখতে? ওরা এতোগুলো সাক্ষী হাজির করল কিভাবে?"
"দেখুন স্যার, কবিরকে কিবরিয়া সাব্যস্ত করা অনেক কঠিন ব্যাপার, তারচেয়ে বরং খুনি ও ধর্ষক প্রমান করা যায়। এ কারণেই পুলিশ রিপোর্টেও বিষয়টা নিশ্চিতভাবে বলতে দেইনি।"
"তোমার সাহস কি করে হল আমার সিদ্ধান্তের ওপর মাতব্বরি করার?" খেঁকিয়ে ওঠে জিল্লুর রহমান। তারপর বিড়বিড় করে বলতে থাকে, "একটাও কাজের না, ওদিকে মজনু সব কিছু পেঁচিয়ে ফেলেছে, সেদিকে যেতে হবে।"
"তোমাদেরকে আরেকটা সুযোগ দিচ্ছি, আগামী শুনানীর মধ্যেই কেসটা সীল করে ফেলা চাই। আমি কয়েক দিনের জন্য ঢাকার বাইরে যাচ্ছি, এর মধ্যে ঠিক করে ফেল যে তোমরা কিভাবে কি করবে।"

স্নিগ্ধা তার বেডে শুয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিল। বাইরে নিকষ অন্ধকার, জোছনা নেই, চারিদিক কেমন যেন নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে। সেই নিস্তব্ধতা চিরে মাঝে মাঝে খেঁকশিয়ালের চিতকার শোনা যাচ্ছে। রাত কত হয়েছে জানেনা সে, একটি দেয়াল ঘড়িও নেই ঘরটাতে। কতোদিন এখানে বন্দি হয়ে আছে তা ও নিশ্চিতভাবে বলতে পারে না স্নিগ্ধা। শুয়ে শুয়ে কবিরের কথা ভাবছিল সে, কোথায় আছে, কেমন আছে, আবার কি দেখা হবে ওর সাথে? কি হবে ওদের ভবিষ্যত? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্নিগ্ধা, চারিদিকে তাকায় সে। খুব অদ্ভুত একটি অনুভুতি হয় তার, মনে হয় কেউ যেন তাকে দেখছে। চিন্তাটা মাথা থেকে সরিয়ে ফেলে সে।
"কিগো সোনা কেমন আছিস? ঘুমোসনি?" পেটে হাত দিয়ে বলে স্নিগ্ধা। পেটটা কিছুটা ফুলে উঠে ভেতরের সত্ত্বাটির অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।
"ঘুম পাচ্ছে না? জানিস আমার আম্মু আমাকে ছোটবেলায় গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন। গল্প শুনবি সোনা?"
"কিসের গল্প শুনবি? রাজা রানি আর রাক্ষসের গল্প?"
"রাক্ষস কি মা?" যেন শুনতে পায় স্নিগ্ধা।
"রাক্ষস দুই ধরনের হয়। একটি হচ্ছে রুপকথার রাক্ষস, সে জিরাফের মতো লম্বা, হাতির মতো মোটা, বড় বড় দাঁত আর নখ থাকে, মানুষকে জ্যান্ত গিলে খায়। আরেকটি হল বাস্তব রাক্ষস, সে দেখতে হুবহু মানুষের মতো কিন্তু নৃশংসতার দিক দিয়ে রুপকথার রাক্ষসদেরও হার মানায়।"

জিল্লুর রহমান হুইস্কির পেগে ছোট ছোট চুমুক দিতে দিতে টিভি স্কিনে মেয়েটির দিকে লোভী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। "মেয়েটির রুপের তেজ আছে, সাইমন্ড তো আর এমনি এমনি পাগল হয়নি।" মনে মনে বলে জিল্লুর। যদি প্রেগনেন্ট না হত তাহলে আজকেই বিছানায় তুলতো তাকে। চাইলে এবরশন করাতে পারে, কিন্তু তা করতে চায়না জিল্লুর। সে স্নিগ্ধাকে সন্তান জন্ম দিতে দেবে। সেই সন্তানের বয়স যখন ছয় মাস হবে তখন তাকে নিজ হাতে খুন করবে। "পারফেক্ট রিভেঞ্জ।" মনে মনে বলে ওঠে জিল্লুর রহমান।
মেয়েটি বিড়বিড় করে কিছু বলছিল, কিন্তু ঘরে তো আর কেউ নেই। স্নিগ্ধার ঘরে তিনটি লুকনো ক্যামেরা আছে, কিন্তু সাউন্ড রেকর্ডের ব্যাবস্থা নেই। জিল্লুর রহমান এক ঢোঁকে এক পেগ শেষ করে উঠে পাশের রুমের তালা খুলে ভেতরে ঢোকে। জিল্লুর রহমানকে দেখে উঠে বসে স্নিগ্ধা।
"কেমন আছ রুপসী?" ঘরে ঢুকে সোফায় পায়ে পা তুলে বসে জিল্লুর বলে।
"কি চান আপনি? কেন বন্দি করে রেখেছেন আমাকে? কবির কোথায়?" স্নিগ্ধা বলে।
"তুমি আর তোমার সেই প্রেমিক মিলে আমার একমাত্র পুত্রকে হত্যা করেছ আর তোমাদেরকে আমি এমনি এমনি ছেড়ে দিব?" হিসহিসিয়ে বলে জিল্লুর।
"আমি কিংবা কবির আপনার ছেলেকে খুন করিনি। তবে যদি সুযোগ পেতাম নিশ্চয়ই খুন করতাম শুয়োরটাকে।" তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে স্নিগ্ধা।
"তোমার এই স্পর্ধার পরিনাম কতো ভয়ংকর হবে সে সম্পর্কে কোন ধারণা নেই তোমার।" বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে দরজা লক করে দেয়।
"দেখেছিস সোনা মানুষরুপী রাক্ষস!" স্নিগ্ধা বলে।
"ও আমাকে মেরে ফেলবে মা।" স্নিগ্ধা যেন শুনতে পায়।
"না সোনা, তোর কোন ভয় নেই। আমি আছি না? আমি বেঁচে থাকতে তোর কোন ক্ষতি হতে দেব না।"

"কেসের পরবর্তী শুনানি আগামী পরশুদিন। আমি বলেছিলাম যে পরবর্তী শুনানিতে কেসটা হাতের মুঠোয় চলে আসা চাই। সেই লক্ষে তোমরা কি কি প্রস্তুতি নিয়েছ একে একে বল।" জিল্লুর রহমান আদেশের ভঙ্গিতে বলে। বিকেলে ঢাকায় ফিরেই মিটিং ডেকেছেন তিনি। মিটিংয়ে সজল, পারভেজ এবং মাহতাব উপস্থিত।

প্রথমে সজল বলতে শুরু করে, "পরবর্তি শুনানীতে স্নিগ্ধার মা বাবার সাক্ষ্য দেবার কথা ছিল। কিন্তু সেটা আমাদের জন্য রিস্ক হয়ে যেত, বিশেষ করে স্নিগ্ধার মা কবিরের প্রতি একটু বেশিই সেনসিটিভ। কোর্টে যদি সত্যিটা বলে দেয় তবে বিপদ। তাই ওনাদেরকে গত সোমবারেই দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছি। কোর্টে বলা হবে স্নিগ্ধার মা'র হৃদরোগের চিকিতসার জন্য ভারতে গেছেন।"
"ওয়েল ডান সজল। এক্সেলেন্ট! কিন্তু এতকিছু এত কম সময়ে করলে কিভাবে?" জিল্লুর রহমান উচ্ছসিত কন্ঠে বলে।
"স্যার, আমি যেকোন কিছু ভেবে চিন্তে করি। এরকম পরিস্থিতি যে হতে পারে তা আগেই অনুমান করেছি, তাই মাস খানিক আগেই ওনাদের পাসপোর্ট করে রেখেছি। অল্প সময়ের মধ্যে ভিসা পাওয়ার জন্য টাকা ঢালতে হয়েছে খানিকটা।" সজল বলে।
"আর মাহতাব, তোমার প্ল্যান কি বল?" জিল্লুর বলে।
"আমি চার পাঁচজন সাক্ষী প্রস্তুত করছি যারা সাক্ষ্য দেবে যে তারা কবিরকে কিবরিয়া ডাকাতের দলে দেখেছে। আর প্রত্যক্ষদর্শী পলাশ ওরফে পল্টু এবং মুহিত তালুকদারের সাক্ষী পেশ করার ব্যাবস্থা করেছি।" মাহতাব বলে।
"ওয়েলডান মাহতাব।" জিল্লুর বলে।
"কিন্তু ঐ দুই ক্যাবলাকে কোর্টে উপস্থিত করা রিস্কের ব্যাপার। জেরার মুখে বেফাঁস কথা উগরে দিতে পারে।" সজল আপত্তি তোলে।
"তাহলে এমন ব্যাবস্থা করো যেন কোন জেরাই না হয়।" একটু থেমে আবার যোগ করে, "আমি কি বলছি তা বুঝেছ সজল?"
"অর্থাত আসামী পক্ষের উকিল কোর্টে উপস্থিত থাকবে না।" সজল বলল।
"ঠিক। কিন্তু কিভাবে করবে?" জিল্লুর বলে।
"উকিলের মেয়ে কিডন্যাপ হবে।" সজল বলে।
"এক্সেলেন্ট। আমি মজনুকে বলে দিচ্ছি, ও তোমাকে সাহায্য করবে।"
"দরকার নেই স্যার, এমন ছোটখাট ব্যাপার সামলানোর অভ্যাস আমার আছে।" সজল বলে।
"সব ঠিক আছে, কিন্তু একটা জিনিস বাকি রয়ে গেল। আসামীর স্বীকারোক্তি। সেটার ব্যবস্থা আমিই করব। আর আইনমন্ত্রীকে দিয়ে চাপ প্রয়োগ করব যেন কেসের রায় যত দ্রুত সম্ভব দিয়ে দেয়। আজকের মতো মিটিং সমাপ্ত, গুড নাইট।"
 
কবির তখন গোসলের লাইনে দাড়িয়েছিল। পরেরদিন কেসের শুনানি। গোসলের সাথে সাথে কিছু কাপড়ও কেচে নিতে চায় সে। একঘন্টা লাইনে দাড়িয়ে যখন সুযোগ পায় তখনই ডাক পড়ে তার।
"এখানে শাহরিয়ার কবির - পিতা মাসুদ খান, কে?" একজন কন্সটেবল চেঁচিয়ে বলে।
কবির লাইন ছেড়ে এসে প্রহরীর সামনে দাড়ায়।
"চল, তোকে জেলার স্যার ডাকেন।"
"আমি আবার কি করলাম?" অবাক হয়ে বলে কবির।
"কি করেছিস, তা তুই জানিস। চল এখন।" কন্সটেবল বলে।
কবিরের পরনে লুঙ্গি ও স্যান্ডো গেঞ্জি ছিল। সে ঝটপট ধুতে আনা শার্টপ্যান্ট পরে নেয়, তারপর প্রহরীর পিছে পিছে যেতে থাকে।
জেলারের রুমে জেলার ছাড়াও স্যুট বুট পরিহিত মধ্যবয়স্ক ব্যাক্তিকে দেখতে পায়। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, সেই দৃষ্টির মাঝে যেন নিষ্ঠুরতা আর অবজ্ঞার মিশ্রণ রয়েছে।
"জেলার সাহেব, আমি কবিরের সাথে একটু একা কথা বলতে চাই।" লোকটি বলে।
"কিন্তু স্যার এমন ডেঞ্জারাস আসামীর সাথে আপনাকে একা ছেড়ে দেয়া উচিত হবে না।" জেলার বলে।
"আমার নিরাপত্তা নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না।" তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে জিল্লুর রহমান। জেলার বেরিয়ে যায় রুম থেকে।
"আমি বলেছি একা, পুরোপুরি একা।" কন্সটেবলটিকে ওখানেই দাড়িয়ে থাকতে দেখে খেঁকিয়ে ওঠে জিল্লুর রহমান। কনস্টেবলটিও চলে যায়।
জিল্লুর রহমান উঠে জেলারের চেয়ারে পায়ে পা তুলে বসে।
"বসো কবির।" জিল্লুর রহমান বলে।
"তুমি কি আমাকে চেনো?" আবারও বলে জিল্লুর।
"আপনাকে আমি দেখিনি কখনো, কিন্তু অনুমান করতে পারি, আপনি জিল্লুর রহমান।" কবির জবাব দেয়।
"যেমনটা ধারনা করেছিলাম, বুদ্ধিমান ছেলে তুমি কবির। তোমার জন্য একটি উপহার এনেছি আমি।" বলতে বলতে ব্রিফকেস থেকে একটি খাম বের করে এনে কবিরের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
কবির খামটি খোলে, ভেতরে ভাঁজ করা পত্রিকার ফ্রন্ট পেইজ। পত্রিকাটি খুলতেই নজরে পড়ে একটি খবর, "হাসপাতালে সাদিয়ার আত্মহত্যা", শিরোনাম দেখেই যেন কবির দিক বিদিক হারিয়ে ফেলে, পরমুহুর্তে লক্ষ্য করে যে পত্রিকার তারিখ দুই দিন পরের। কবির নিজেকে সামলে নেয়, জিল্লুর রহমান কি ইঙ্গিত করছে তা বুঝতে কবিরের বাকি নেই।
"কি ভাবছ কবির? পত্রিকাটি ফেইক, কিন্তু হেডলাইনটির মতো একটি খবর পরশুদিনের পত্রিকায়ও থাকতে পারে। কি মনে হয় থাকতে পারে কিনা?"
কবিরের জবাবের অপেক্ষা না করে নিজেই বলতে থাকে জিল্লুর, "অবশ্য সেটা নির্ভর করে তোমার ইচ্ছার ওপর। তুমি কি চাও এমন একটা খবর পরশুদিনের পত্রিকায় দেখতে?"
"আপনি কি চান স্যার? সাইমন্ডকে খুন আমি করেছি, প্রতিশোধ আমার ওপর নিন। নিষ্পাপ একটি মেয়েকে হত্যা করতে চান কেন?"
"হত্যা কেন আমি কখনো কোন মেয়ের গায়ে হাত পর্যন্ত তুলিনি। প্রতিবছর নারীবাদী সংগঠনগুলোতে লাখ লাখ টাকা ডোনেশন দেই। কিন্তু কি করব, আমি যে নিরুপায়। তুমি তো উকিল ধরেছ। তুমি যে কিবরিয়া নও তা তো সে প্রমান করেই দিয়েছে, শিঘ্রই তোমাকে নির্দোষ প্রমাণও করবে হয়তো। আমি কি চুপচাপ বসে বসে দেখব? আমিও একটা প্ল্যান করেছি, ইমোশনাল ইস্যু তৈরীর। ধর্ষণও ইমোশোনাল ইস্যু, কিন্তু ধর্ষিতার আত্মহত্যা আরো বড় ইস্যু। প্রথমে স্নিগ্ধাকে খুন করে আত্মহত্যা সাজানো, তারপর সাংবাদিক ও অনলাইন ব্লগারদের দিয়ে মিডিয়ায় ঝড় তুলে দিতে হবে, নারীবাদী সংগঠনগুলোকে দিয়ে সারা দেশে মানববন্ধন কর্মসুচি করাতে হবে, জজকে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে চাপ দিতে হবে। আরো বহু ঝামেলা।" একটু থেমে আবার বলে "আমার মনে হয় পরশুদিনের পত্রিকায় এই খবরটা না দেখতে চাইলে তোমাকে কি করতে হবে তা বুঝতে পেরেছ। তবুও একবার স্পষ্টভাবে বলছি, কালকে শুনানিতে তোমার ওপর আনিত সব অভিযোগ স্বীকার করে নাও, নাহলে আমাকে সেই ঝামেলার পথ বেছে নিতে হবে।"

রাত সাড়ে এগারোটা বাজে, পারভেজ তার এপার্টমেন্টের ছাদে উঠে পায়চারি করছিল। কিছুতেই ঘুম আসছে না তার। সোয়েবকে কল করে সে, সাথে সাথেই রিসিভ হয়।
"ভাই, পরিস্থিতিটা কিন্তু একেবারেই বুঝতে পারছি না। কালকে আমাকে অংকিতাকে কিডন্যাপ করতে হবে।" উদ্বিগ্ন স্বরে বলে পারভেজ।
"কিডন্যাপ করবি, একটা বাচ্চা মেয়েকে একদিনের জন্য সামলাতে পারবি না?" সোয়েব বলে।
"তা নাহয় করলাম, জিল্লুর বলেছে সে কবিরের স্বীকারোক্তি আদায়ের ব্যাবস্থা করবে।" পারভেজ বলে।
"খবর পেয়েছি জিল্লুর রহমান আজ দুপুর জেলে গিয়ে কবিরের সাথে দেখা করেছে, সম্ভবত স্নিগ্ধাকে জিম্মি করে কবিরের স্বীকারোক্তি আদায় করতে চায়।" সোয়েব বলে।
"বুঝতে পারছি না ভাই, সবকিছু জেনেবুঝেও আমরা চুপচাপ দেখে যাচ্ছি কেন?" পারভেজ বলে।
"কে বলেছে আমরা চুপচাপ বসে আছি। তুই যেদিন মজনুর ব্যাপারে বলেছিলি সেদিনই আমি মজনুর পেছনে লোক লাগিয়ে দিয়েছি, ওদের প্রতি নজর রাখছি। মজনু বেশ বড়সর ড্রাগ র‍্যাকেট চালায় উত্তরবঙ্গে। আমি ডিজি স্যারকে রাজি করাতে পেরেছি এব্যাপারে একশন নেবার জন্য। খুব গোপনে স্কোয়াড গঠন করেছি আমার বাছাই করা অফিসারদের নিয়ে। তদন্ত অনেক দুর এগিয়েছে, আমরা সাফল্যের খুব কাছে। উত্তরবঙ্গে মজনুর তিনটি ঘাঁটি আবিষ্কার করেছি, আমি অনেকটাই নিশ্চিত যে এই তিনটি ঘাঁটির কোন একটিতে ওরা স্নিগ্ধাকে লুকিয়ে রেখেছে। আমরা এ্যাটাকের জন্য প্রস্তুত, শুধু নিশ্চিত হতে হবে স্নিগ্ধাকে ঠিক কোন ঘাঁটিতে রেখেছে। প্রথম এটাকটা সেই ঘাঁটিতেই করতে হবে। আশা করি কালকের ভেতরই স্নিগ্ধার অবস্থান নিশ্চিত হতে পারব।" সোয়েব বলে।
"কিন্তু ওরা কেইসটা যেভাবে সাজাচ্ছে তাতে তো কবিরের ফাঁসির আদেশ দিয়ে দেবে কোর্ট।" পারভেজ বলে।
"স্নিগ্ধা একবার আমাদের হাতে চলে এলে কবিরকে ছাড়িয়ে আনা মুশকিল হবে না। এখন ঘুমিয়ে পড় অনেক রাত হয়েছে।" একটু থেমে আবার বলে সোয়েব "কাল কিন্তু খুব সাবধান, অংকিতার যেন কোন ক্ষতি না হয়।"
"চিন্তা করবেন না ভাই, আমি বেঁচে থাকতে ওর কোন ক্ষতি হবে না।" পারভেজ বলে।

সকাল আটটা, সজল তার গাড়ি নিয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডে জ্যামে আটকে আছে। পেছনের সিটে পারভেজ বসে আছে, ওর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে অংকিতা। প্রতিদিনের মতো ভোর সাতটায় আয়ার সাথে স্কুলে যাচ্ছিল, বাড়ি থেকে একটু সামনে গাড়ি থামিয়ে নকল পিস্তলের ভয় দেখিয়ে গাড়িতে তুলে নেয় ওকে পারভেজ। সজল একটু সুযোগ পেতেই টঙ্গির একটি গলির ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। এ গলি সেগলি ঘুরে অবশেষে একটি চারতলা বাড়ির সামনে দাঁড় করায় সজল। বাড়িটির দোতলায় সজলের চাচাত বোন রেবেকা থাকে স্বামী সংসার নিয়ে। অংকিতাকে সেখানে রেখে ওরা ফিরে আসে।
"এখন তুই চালা।" সজল বলে।
"কিন্তু বস, এ দিকের রাস্তা তো আমি চিনি না।" পারভেজ বলে।
"আমি বলে দিচ্ছি।" সজল বলে।
পারভেজ আর আপত্তি করে না। সজলের কথা মতো গাড়ি চালাতে থাকে। টঙ্গি থেকে উত্তরা হয়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছায়।
"বস, হঠাত এয়ারপোর্টে কেন? কেউ কি আসবে নাকি?" গাড়ী পার্ক করতে করতে বলে পারভেজ।
"না, আমরা যাব সৈয়দপুর।" সজল বলে।
"সৈয়দপুর কেন বস?"
"একটা কাজ আছে, চল।"
পঁচিশ মিনিটের এক ফ্লাইটে ওরা ঢাকা থেকে সৈয়দপুর এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছায়। সজল এয়ারপোর্টের পার্কিং লটে এসে একটি চকচকে টয়োটা এভালন দেখিয়ে বলে "দুই দিন আগে কিনে ফেললাম। কেমন? এখনো টেস্ট ড্রাইভও নেয়া হয়নি।"
পারভেজ কিছু না বলে ইশারায় বুঝিয়ে দেয় যে খুব ভাল। সজল ড্রাইভিং সিটে বসে, পারভেজ পাশে। আবারও ছুটতে থাকে সজল। আধা ঘন্টা চলার পর হঠাত গাড়ীটি থামিয়ে দেয় সজল।
"কি হল বস?" পারভেজ বলে
"এ এস পি কে কল লাগা।" সজল বলে।
"কোন এ এস পি?" কণ্ঠ যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলে পারভেজ।
হঠাত খিক খিক করে হেসে ওঠে সজল। "তুই এতোদিন এই চিনলি আমাকে? তুই কার হয়ে কাজ করছিস, কিসের জন্য কাজ করছিস কিছুই জানি না ভেবেছিস?"
"কি চাস তুই?" পারভেজ বলে।
"সাহায্য চাই।" কন্ঠে সিরিয়াসনেস ফিরে এনে বলে সজল।
"সাহায্য!" অবাক হয়ে বলে পারভেজ!
"যখন জানতে পারি তুই পুলিশের স্পাই তখন খুব রাগ লেগেছে আমার, ইচ্ছা করছিল তোকে খুন করে ফেলি। কিন্তু আমি আমার রাগকে কন্ট্রোল করি এবং চুপ থেকে বোঝার চেষ্টা করি যে তোরা কি চাস। আমি জানি তোরা কি চাস, তোরা স্নিগ্ধাকে উদ্ধার করতে চাস। আমিও তো তাই চাই, স্নিগ্ধার এক্সাক্ট লোকেশন জানার জন্য আমি মজনুর সাথে মেলামেশা করছি মাস খানেক হল। এক সপ্তাহ আগেই আমি স্নিগ্ধার লোকেশন জেনে ফেলি। তখন থেকেই একটি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম আমি। আজ সেই সুযোগ এসেছে, মজনু ঢাকায় এখন, জিল্লুর, মাহতাব, ডিসিপি নুরুল হুদা সকলেই ব্যাস্ত কেইসটা নিয়ে। এটাই পারফেক্ট সময় হামলা করার। কিন্তু একা আমার পক্ষে তা করা অসম্ভব, তোদের সাহায্য প্রয়োজন। আমি জানি এ এস পি সোয়েব মাহমুদ মজনুর ঘাঁটিগুলোতে আক্রমনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু মনে হয় বুঝতে পারছে না যে ওরা স্নিগ্ধাকে কোথায় রেখেছে। আমি বলে দিচ্ছি, তুই ফোন করে আসতে বল।" সজল বলে।
"শুধু স্নিগ্ধা নয়, আমরা কবিরকেও বাঁচাতে চাই। ওদেরকে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে চাই। যদি স্নিগ্ধা তোর কাছে ফিরে আসতে না চায়? মেনে নিতে পারবি?" পারভেজ বলে।
"আমি জানি স্নিগ্ধা আমাকে ঘৃণা করে, ও হয়তো কখনোই আমার কাছে ফিরবে না। জীবন হয়তো একাই কাটাতে হবে, তবুও সান্তনা থাকবে যে আমি পেরেছি, আমার প্রেম সুখে আছে শান্তিতে আছে, হয়তো আমার হয়ে নয়, অন্য কারো হয়ে।" দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে সজল।
"তোর মুখে এসব কথা একেবারেই মানাচ্ছে না। সেই শয়তানটার আজ এমনতর দশা কেন?" কৌতুকের সুরেই বলে পারভেজ।
"তোর কাছেও কি মানায়? সামান্য কটা টাকার জন্য যাকে খুন করতে রাজি হয়ে গিয়েছিলি, তাকে বাঁচানোর জন্য আজ এতো বড় রিস্ক নিচ্ছিস। তুই যদি এত পরিবর্তন হতে পারিস তবে আমি কেন নই।" একটু থেমে সজল বলে "তোর সাথে তর্ক করার সময় নেই। যদি আমাকে বিশ্বাস করতে না পারিস তবে তোদের দরকার নেই আমি একাই যাব। যদি বিশ্বাস করতে পারিস তবে কল করে বলে দে যেন লালমনিরহাট জেলার অদিতমারি উপজেলায় আরশাদচর নামক যায়গায় সার কারখানার নামে ইয়াবা কারখানা আছে মজনুর, সেখানেই স্নিগ্ধাকে রেখেছে ওরা। আমরা এখন সেদিকে যাচ্ছি।"
পারভেজ কল দেয় সোয়েবকে।

স্নিগ্ধা তার বিছানার ওপর বসে এক দৃষ্টে দরজাটির দিকে তাকিয়ে ছিল। আজ সে যা করতে চলেছে তা রীতিমত ভয়ংকর রকমের ঝুঁকিপুর্ন। সে পালিয়ে যাবে বলে ঠিক করেছে, যদিও জানে এতে সে নিজের এবং নিজের অনাগত সন্তানের জীবন ঝুঁকির মাঝে ফেলে দিচ্ছে। কিন্তু এই বন্দি অবস্থায় মানসিক অস্থিরতার মাঝে থাকতে পারছিল না। মিনিট খানিক আগেই বেলকুনি থেকে মহিলাটিকে বোরকা পরে আসতে দেখেছে এবং সাথে সাথে মনস্থির করে ফেলেছে স্নিগ্ধা। দরজায় খুট খুট শব্দ শুনেই টেবিলের ওপর রাখা ফুলদানিটা নিয়ে নিশব্দে দরজার আড়ালে সরে গেল। মহিলাটি ভেতরে ঢুকতেই দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে পেছন থেকে হাতের ফুলদানি দিয়ে সজোরে আঘাত করে মহিলাটিকে। "ও মা গো!" বলে চিতকার করে উঠল মহিলাটি। স্নিগ্ধা তাতে থামল না, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় আঘাতে ফুলদানীটা ভেঙে গেল, সাথে সাথে মহিলাটিও অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। স্নিগ্ধা হাতে ভাঙা ফুলদানী নিয়ে দরজার বাইরে এপাশ ওপাশ তাকাল, চিতকার শুনে কেউ ছুটে এলো কিনা। কেউ ছুটে আসছে না দেখে স্নিগ্ধা বুঝতে পারে মেশিনের যান্ত্রিক শব্দে মহিলাটির চিতকার ঢাকা পড়ে গেছে। স্নিগ্ধা মহিলাটির হার্টবিট চেক করে, বুঝতে পারে এখনো জীবিত। কিন্তু কপাল চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে, আঘাতটি গুরুতর, দ্রুত হাসপাতাল না নিলে হয়তো বাঁচানো যাবে না। স্নিগ্ধা মনকে শক্ত করে, এখন আর সেসব ভাবার সময় নেই। টেনে হিঁচড়ে মহিলাটির গা থেকে বোরকাটি খুলে নেয় ও ঝটপট নিজে পরে নেয়। মহিলাটি সকালের নাস্তা এনেছিল, সিদ্ধ রুটি আর সবজি। স্নিগ্ধা রুটিগুলো বোরকার পকেটে নিয়ে নেয়, তারপর রুম থেকে বেরিয়ে দরজা তালা লাগিয়ে দেয়। খুব সতর্কভাবে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে গেইটের কাছে এসে হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার মতো অবস্থা, যতোটা সম্ভব স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে যেতে থাকে গেইটের দিকে। দুজন সিকিউরিটি গার্ড, বসে বসে মোবাইলে গান শুনছিল, স্নিগ্ধার দিকে তেমন একটা ভ্রুক্ষেপ করল না। স্নিগ্ধা হেঁটে হেটে গেট থেকে বেরিয়ে গেল। রাস্তাটি ধরে কিছু দুর এগিয়ে যাবার পর রাস্তা ছেড়ে জমির আইল দিয়ে হাঁটতে থাকে স্নিগ্ধা।
 
নির্জন প্রান্তরের মাঝে এঁকেবেঁকে যাওয়া একটি সরু পাকা রাস্তা তার পাশে একটি পাঁচতলা ভবন, স্থানীয়রা সেটিকে সার কারখানা বলেই জানে। সজল ভবনটি থেকে এক কিলোমিটার দুরে গাড়ী থামায়। পারভেজকে দেখিয়ে বলে যে সেখানে স্নিগ্ধাকে বন্দী করে রেখেছে।
"তোর পুলিশবাহিনী কোথায়?" সজল বলে।
"আমি কল দিচ্ছি" পারভেজ বলে।
"আমাদের হাতে সময় নেই। আজকেই ওরা স্নিগ্ধাকে ওরা সরিয়ে ফেলবে এখান থেকে। তার আগেই ওকে উদ্ধার করতে হবে। একটা কাজ কর, তুই এখানে নেমে যা আর এ এস পি সাহেবের জন্য অপেক্ষা কর। আমি যাচ্ছি, ভেতরের হালচাল বুঝতে হবে।" সজল বলে।
"না, আমিও যাব।" পারভেজ বলে।
"ঠিক আছে চল।" বলে গাড়ি স্টার্ট দেয় সজল।
গেটের সামনে গাড়ি থামায় সজল, গাড়ির ড্রয়ার থেকে রিভলবার বের করে জুতায় গুঁজে নেয়। তারপর বেরিয়ে আসে গাড়ি থেকে। গাড়ি থামানো দেখে একজন সিকিউরিটি গার্ড এগিয়ে আসে।
"কে আপনারা? কি চাই?" গার্ড বলে।
"জিল্লুর সাহেব আমাদের পাঠিয়েছে। ক্লায়েন্ট আছে সাথে, ফ্যাক্টরি ঘুরে দেখবেন।" সজল বলে।
"তেমন কিছু হলে তো বস আমাদের জানাতেনই। নাহ ঢোকা যাবে না।" গার্ড বলে।
"ঠিক আছে।" বলে সজল সেখান থেকে একটু সরে গিয়ে তার মোবাইল বের করে জিল্লুরকে ফোন করে। সাথে সাথে রিসিভ হয়।
"সজল, কোথায় তুমি?" জিল্লুর বলে।
"স্যার আমি আপনার আশুলিয়ার বাগানবাড়িটায়, উকিলের মেয়েটিকে সাথে এনেছি, যেমনটা আপনি বলেছিলেন। কিন্তু একটা ছোট প্রবলেম। সিকিউরিটি প্রবলেম করছে, সম্ভবত আমাকে চিনতে পারছে না।" সজল বলে।
"সিকিউরিটি ইনচার্জকে ফোনটা দাও।" জিল্লুর বলে।
সজল সিকিউরিটি গার্ডটির দিকে ফিরে এসে বলে "তোমাদের ইনচার্জকে পাঠিয়ে দাও, বল যে জিল্লুর রহমান স্যার ফোন দিয়েছেন।"
গার্ডটি ভেতরে যায়, সাথে একজন মধ্যবয়সী লোককে আনে। সজল ফোনটি তার হাতে দেয়।
"সামান্য একজন সিকিউরিটি গার্ড হয়ে তোমার স্পর্ধা হয় কি করে আমার লোককে প্রবেশে বাধা দেওয়ার!" গর্জে ওঠে জিল্লুর।
"স্যরি স্যার, মাফ কইরা দেন। নতুন ছেলে তো, চিনতে পারে নাই।" মধ্যবয়স্ক লোকটি বলে।
সজল ফোন নিয়ে বলে "স্যার, ওদিকের খবর কি? সবকিছু ঠিক ঠাক চলছে তো?"
"এখন পর্যন্ত সবকিছু প্ল্যান মোতাবেকই চলছে। আসামী পক্ষের উকিল কোর্টে অনুপস্থিত, আমরা আমাদের সাক্ষী প্রমান পেশ করছি, আসামী স্বীকারোক্তি দিতেও রাজি। "
সজল ফোন কেটে দিয়ে তার গাড়িতে ফিরে আসে।
"শালা, তুই চিজই একখান।" খিক খিক করে হাসতে হাসতে বলে পারভেজ।
"শালা কি? আমি না তোর বস?"
"সরি বস।"
ভবনটির প্রাঙ্গনে গাড়ি পার্ক করে সিঁড়ি দিয়ে সন্তর্পনে উঠে আসে দুজন, পাঁচতলায় উঠেই জুতোয় গুঁজে রাখা পিস্তল হাতে নিয়ে নেয় সজল। সিঁড়ির ঘর পেরিয়ে ড্রয়িং রুমে আসতেই রক্ত হীম হয়ে আসে দুজনের। জিল্লুর রহমান আর মজনু সোফায় পাশাপাশি বসে আছে তাদের আশে পাশে আরো ছয় সাত জন গুন্ডা দাড়িয়ে। জিল্লুর ব্যাতিত সবার হাতেই অস্ত্র।
"ড্রপ ইওর গান, সজল" খেঁকিয়ে ওঠে জিল্লুর।
সজলের হাত থেকে রিভালবারটি পড়ে যায়।
"তুমি এখানে কি করছ সজল? তোমার তো এখন আশুলিয়ার বাগান বাড়ীতে থাকার কথা। এতো বড় সাহস তোমার, আমার খেয়ে আমার পরে আমারই পীঠ পিছে ছুরি বসাবে? নিমকহারাম, বাস্টার্ড! দু পয়সার ইঞ্জিনিয়ার থেকে আমি তোকে কোম্পানির সিইও বানিয়েছি, আর আমার সাথে বেইমানি!"
"এই দুই নিমকহারামকে গুলি করে এক্ষুনি ঝাঁঝরা করে দে।" মজনুর উদ্দেশ্যে বলে জিল্লুর। এবং সাথে সাথে মজনুর পিস্তল গর্জে ওঠে, গুলিটি বিঁধে যায় পারভেজের বুকে, সাথে সাথে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে সে।
"মজনু, থামলি কেন, এই বেইমানটাকেও মার।" জিল্লুর বলে।
"মাথা ঠান্ডা করেন জিল্লুর সাহেব। ভাইগ্না ইচ্ছা কইরা বেইমানি করে নাই, আপনিই বাধ্য করছেন। আপনে ওর বউটারে লুকাইয়া রাখছেন, কাজটা ঠিক করেন নাই।" মজনু বলে।
"শুওর! তোর কাছে থেকে আমাকে শিখতে হবে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল?" বলে জিল্লুর থাপ্পড় বসিয়ে দেয় মজনুর গালে।
"জিল্লুর সাহেব, আপনি ভুলে যাচ্ছেন যে আপনি কার আস্তানায় বসে আছেন।" শীতল গলায় বলে মজনু।
"তোর এতবড় সাহস যে তুই আমাকে হুমকি দিচ্ছিস? কি করবি তুই? আমাকে মারবি? এর জন্য তোরে রাস্তা থেকে তুলে এনেছি, আমি না এলে তো তোকে কুকুরের মতো গুলি করে মারতো।" জিল্লুর বলে।
"সেইটা আমি ভুলি নাই, কিন্তু আমিও কম করি নাই আপনার জন্যে। আপনে যে টাকার পাহাড় বানাইছেন তার চৌদ্দ আনা আমার রোজগারে।" মজনু বলে।
"কি বললি খানকির পো? তোর রোজগার আমি খাই? আমার সাপোর্ট ছাড়া মুরোদ ছিল তোর এসব র‍্যাকেট চালানোর?" বলতে বলতে মজনুর কলার চেপে ধরে জিল্লুর।
"কলার ছাড়েন বলতাছি।"
"কি করবি শুওরের বাচ্চা?"
মজনু ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দেয় জিল্লুরকে তারপর গুলি চালায়। গুলিটি জিল্লুরের কপাল সোজা ভেদ করে যায়, তারপর নিথর দেহটি পড়ে থাকে সোফায় হেলান দেয়া অবস্থায়।
মজনু গা থেকে রুমাল দিয়ে রক্ত মুছতে মুছতে সজলের দিকে এগিয়ে যায়।
"ইয়ে ভি গায়া অর বো ভি গায়া, আব তেরা কেয়া হোগা কালিয়া?" বলতে বলতে খিক খিক করে হেসে ওঠে মজনু।
"ভাইগ্নার তো ভয়ে গলা শুকাই গেছে, কেউ পানি খাওয়া।" মজনু বলে। সত্যি সত্যি একজন এক গ্লাস পানি আনে আর সজল এক ঢোঁকে খেয়ে নেয়।
"মামা, তুমি যা খেল দেখাইলা না, আসলেই ভয় পাইছি। আমাকে বললা আইসা বউকে নিয়া যাইতে, আবার জিল্লুর সাহেবকেও সব জানাইয়া নিয়া আসছ, আবার আমার সামনেই তারে মাইরা ফালাইলা। জটিল চাল চালছ।" সজল বলে।
"প্ল্যান কি তুমি একাই করতে জান ভাইগ্না। তুমি তোমার বউরে নিয়া গেলে বুড়াটা তো ক্ষেইপা উল্টাপাল্টা কিছু কইরা বসতো। আর তাছাড়া বুইড়াটা আমারে জ্বালাইতেছে বহুদিন থেইকা, অরে মারার চিন্তা আমি বহুদিন থেকে করতেছি। ভাবলাম দুই শুভ কাজ একই দিনে সাইরা ফেলি, তুমিও তোমার বউরে নিয়া যাও, আমিও এই বুইড়াটা থেকে রেহায় পাই। আর পুলিশের এই টিকটিকিটারও তো মরা দরকার ছিল।"
"কিন্তু পুলিশ আবার ঝামেলা পাকাইব না তো?" চিন্তিত কন্ঠে বলে মজনু।
"ঝামেলা একটু করতেই পারে। কিন্তু তারা এখন লালমনিরহাটে যাইয়া ঘুরপাক খাইতেছে।" সজল বলে।
সজল পারভেজের দিকে এগিয়ে যায়।
"সরি দোস্ত। তোকে মারতে চাইনি। কিন্তু কি করব, স্নিগ্ধা আমার ছাড়া অন্য কারো হবে এটা কখনোই বরদাস্ত করতে পারব না। আজ পর্যন্ত আমার পথে কেউ কাঁটা হয়েছে আর আমি তাকে উপড়ে ফেলিনি এমনটা হয়নি, আর হবেও না।" সজল বলে পারভেজের অচেতন দেহটিকে উদ্দেশ্য করে।
এমন সময় একজন যুবক ছুটে এসে মজনুকে উদ্দেশ্য করে বলে "সর্বনাশ! বস, পুলিশ। দুই ট্রাক পুলিশ আসছে সামনের রাস্তা দিয়ে!"
"এএসপি সাহেবকে যতো বড় আহাম্মক ভেবেছিলাম ততোবড় আহাম্মক তিনি নন। গন্ধ শুঁকে শুঁকে ঠিক চলে এসেছে।" সজল বলে।
"মামা তুমি তোমার দলবল আর জিল্লুর লাশটা নিয়ে পেছনের রাস্তা দিয়ে পালিয়ে যাও, তার আগে বল স্নিগ্ধা কোথায়?"
"ঐ রুমে" বলে চাবিটা ছুঁড়ে দেয় সজলকে। "কিন্তু এই লাশ দিয়া কি হইব?" মজনু বলে।
"জিল্লুর সাহেবের লাশটা তার রংপুরের বাগানবাড়িতে নিয়ে যেতে হবে। মৃত্যুকে আত্মহত্যা সাজাতে হবে।" বলে সজল স্নিগ্ধার রুমের দিকে যায়। রুমের দরজা খুলে দেখে মেঝেতে একজন মধ্যবয়সী মহিলা অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে।

সুর্যটি পশ্চিম দিগন্তের দিকে হেলে পড়েছে কিছুক্ষন আগে, একটু পরই হয়ত অস্ত যাবে। স্নিগ্ধা গাছে হেলান দিয়ে বসে সুর্যাস্তের দৃশ্য দেখছিল। বাড়িটি থেকে বেরিয়ে স্নিগ্ধার লক্ষ ছিল বসতির দিকে যাবার, কিন্তু প্রান্তরটির এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে কোন কুল কিনারা করতে পারে না। শেষে কিছু গাছ এবং ঝোপঝাড়যুক্ত একটি যায়গা দেখতে পেয়ে সেখানে লুকিয়ে পড়ে।
হঠাত করে স্নিগ্ধা বুঝতে পারে যে এরকম যায়গায় রাত কাটানোর চিন্তা করা একেবারেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, তাকে লোকালয়ে পৌঁছাতেই হবে। সন্ধা ঘনিয়ে আসায় পুর্ব দিগন্তের কাছাকাছি মিটমিটে তারার মতো লোকালয়ের আলো দেখতে পায় স্নিগ্ধা। স্নিগ্ধা গাছে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, সেদিকেই যেতে হবে তাকে। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে বুঝতে পারে ভীষন ক্লান্ত সে, শরীরে যেন একটুও শক্তি অবশিষ্ট নেই যেন। সারাদিন মাত্র দুটি শুকনো রুটি খেয়েছে সে। স্নিগ্ধা সেদিকে হাঁটতে থাকে। সে কতোক্ষন হেঁটেছে বলতে পারবে না, কিন্তু যখন লোকালয়টিতে পৌঁছায় তখন বেশ গভীর রাত হয়েছে বলে মনে হল। চারিদিকে একেবারে নিস্তব্ধতা, পুরো গ্রামটিই যেন ঘুমে অচেতন। গ্রামের মেঠো পথে হাঁটতে হাঁটতে স্নিগ্ধা আশেপাশের সারি সারি ঘরগুলোর দিকে দেখছিল। হঠাত এক যায়গায় আলো চোখে পড়ল, একটু কাছে গিয়ে বুঝতে পারল সেটি একটি চায়ের দোকান। স্নিগ্ধা সেদিকে এগিয়ে যায়, ভীষন খিদে পেয়েছে তার, যদি কিছু খাবারের ব্যাবস্থা করা যায়। কিন্তু কাছে এসে বুঝতে পারে যে সে ভুল করে ফেলেছে। দোকানটিতে বেঞ্চে বসে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বয়সী তিনজন যুবক মদ খাচ্ছিল আর আড্ডা দিচ্ছিল। স্নিগ্ধাকে দেখে একজন এগিয়ে আসে।
"কেডা? এত রাইতে। ওমা! বিউটিফুল আছিস তো!" বলতে বলতে এক হাত চেপে ধরে স্নিগ্ধার।
"হাত ছাড়ুন। কি করছেন?" হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে করতে বলে স্নিগ্ধা।
"আয় না বস এখানে।" বলে জোর করে টেনে বেঞ্চে বসিয়ে দেয়।
"আমরা তিনজন, চলনা একেকজন তিনশ দিমু।" অন্যজন বলে।
"আপনারা ভুল ভাবছেন। আমি ওসব নই। দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন।" অনুরোধের সুরে বলে স্নিগ্ধা।
"অত নখরা করছিস কেন? আচ্ছা যা হাজার মিল কইরা দিমুনি।"
"আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ।" বলে স্নিগ্ধা হঠাত হুহু করে কাঁদতে শুরু করে।
অবস্থা বেগতিক দেখে দোকানদার উঠে আসে।
"দেখে তো ভদ্র বাড়ির মাইয়া মনে হচ্ছে, তার ওপর আবার পোয়াতি। তরা ছাড় অরে।"
"ক্যান কাকা, তুমিও লাগাইবা নাকি?" একজন বলে ওঠে, বাকি দুইজন খিক খিক করে হাসতে থাকে।
এতে দোকানদার খেপে ওঠে, দোকানের কপাট ঠেস দেয়া বাঁশটি খুলে হাতে নেয় তারপর গর্জে ওঠে "চুপ! বদমাইশের দল, ছাড় ওরে। নাইলে এক বাড়ি দিয়ে সবকয়টার ঘিলু বাইর কইরা দিমু।"
দোকানদারের এমন অগ্নিমুর্তি দেখে ওদের আর সাহস হয় না স্নিগ্ধাকে আটকে রাখার। ছাড়া পেয়ে স্নিগ্ধা দোকানদারের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়।
"আপনে কিন্তু খামোখাই চেইতা গেছেন, মজিদ কাকা। আমরা কিন্তু ইয়ারকি করছিলাম।" একজন মিন মিন করে বলে।
"চোপ বদমাইশ। তোদের ইয়ার্কি আমি বুঝি না? আমি কিছু না কইলে তোরা যে এই মাইয়াটার সর্বনাশ করতি সেইটা আমি বুঝি না? তোদের মতো কতো বদমাইশ রাজাকাররে একসময় বেয়োনেট দিয়া খুঁচাইয়া জাহান্নামে পাঠাইছি, আর তোরা তো হইলি সেদিনক্যা।" একটু থেমে আবার গর্জে ওঠে মজিদ, "চোপ। আর একটা কথা হইবে না। যার যার বাড়িত যা, নাহলে খুনাখুনি হয়ে যাবে।"
মাতালগুলো আর সাহস পায় না সেখানে থাকার, উঠে চলে যায় তিনজন।
 
"আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ জানাব! আপনি না থাকলে যে কি হত!" স্নিগ্ধা বলে।
"সব শুকরিয়া আল্লাহর, মানুষ তো মাত্র উছিলা। বসো মা।"
স্নিগ্ধা সাবধানে বসে।
"তুমি কে মা? তোমার বাড়ি কোন গেরামে? এতো রাতে এইখানে কি কর?" মজিদ জিজ্ঞাসা করে।
"কাকা, একটু পানি খাওয়ান না? " স্নিগ্ধা বলে।
মজিদ পানি এবং সাথে এক টুকরো পিচ কেক এনে দেয়।
"কিন্তু কাকা, আমার কাছে টাকা নেই যে?"
"টাকা লাগব না। খাও মা, মনে হয় রাইতে কিছু খাওনি।" মজিদ বলে।
স্নিগ্ধা খেতে খেতে ভাবতে থাকে সত্যিটা বলবে নাকি বানিয়ে বলবে, এতো বড় উপকার করল লোকটি, তাকে মিথ্যা বলা উচিত হবে না।
"আমার নাম স্নিগ্ধা। বাড়ি বগুড়ায়, তবে আমি ঢাকাতে থাকতাম।"
"তোমার কথা শুইনাই বুজছি, তুমি এই এলাকার নও। কিন্তু এখানে আসলে কেন আর কেমনে?"
"সে অনেক কথা, কাকা!" স্নিগ্ধা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু মজিদ তাকে থামিয়ে দেয়।
"থাক, এখন না, পরে শুনমুনি। এতো রাইতে বাইরে থাকা ঠিক হইব না। পারলে তো তোমারে নিজের বাড়িতে নিয়া যাইতাম, কিন্তু এই গরীবের দুইটা মাত্র ঘর। এক ঘরে আমি, বউ আর ছোট মাইয়া, অন্যটায় বড় বেটা আর বেটার বউ থাকে। আর তাছাড়া গাঁও গেরাম তো, নানা জনে নানা কথা কইব। তয় তোমারে মাস্টার্নির বাড়িতে নিয়া যাওয়া যায়। গেরামের হাই স্কুলের হেড মেডাম। খুব ভাল মানুষ। দুই পোলাই বিদেশে থাকে, স্বামীও মারা গেছে অনেক আগে। ম্যাডাম একাই থাকেন।" বলতে বলতে মজিদ দোকান বন্ধ করে ফেলে। তারপর স্নিগ্ধাকে নিয়ে হেঁটে যায় গ্রামের অন্য প্রান্তে। গ্রামের অধিকাংশ বাড়ি যেখানে ছন আর টিনের সেখানে এই বাড়িটি পাকা দোতালা, এবং গ্রাম থেকে একটু সরে সবুজ প্রান্তরের ধারে।
মজিদ কলিং বেল চাপে, মিনিট খানেক পর দরজা খুলে যায়।
"মজিদ চাচা, এতো রাতে আপনি? সাথে কে?"
"এই মাইয়াটা খুব বিপদে পড়ছে। কিছু বদমাইশ ওর পিছে পড়ছিল, ছাড়াইয়া আনছি, ভাবলাম আপনি যদি ওরে একটু আশ্রয় দেন।"
"ও, বুঝতে পেরেছি। ভেতরে আসুন চাচা, আর তুমিও এস মা।" মহিলাটি বলে।
"না ম্যাডাম, আমি যাই, দেরি হইয়া গেছে।" তারপর স্নিগ্ধার উদ্দেশ্যে বলে "তুমি যাও মা, এখানে কোন বিপদ নাই।"

সোয়েব হাসপাতালের করিডোরে বেঞ্চে ভীষন উদ্বিগ্ন হয়ে বসে ছিল। সামনে অপারেশন থিয়েটারে পারভেজের অপারেশন চলছে। সোয়েব একা নয়, পারভেজের বাবা, মা আর স্ত্রীও আছে সেখানে। সোয়েব উঠে দাড়ায় এবং খানিকটা সরে গিয়ে একটি সিগারেট ধরিয়ে নেয়।
এমন কিছু ঘটতে পারে তার আশংকা তার সবসময়ই ছিল, এজন্যই সে পারভেজকে এসবের মধ্যে জড়াতে নিষেধ করেছিল।
সজল যখন বলেছিল যে সে তাদের পক্ষেই আছে এবং স্নিগ্ধাকে কোথায় রেখেছে সেই ঠিকানা বলে দেয় তখন সোয়েব তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনি। তাই পারভেজ এবং সজলের মোবাইল ট্র্যাক করতে থাকে। সেই সন্দেহটা বিশ্বাসে পরিনত হয় যখন দেখে যে সজল নিলফামারী থেকে লালমনিরহাটের বদলে কুড়িগ্রামের দিকে মোড় নেয়। সোয়েব পারভেজকে কল করে সতর্ক করবে বলে ভেবেছিল, কিন্তু তাতে সজলও সতর্ক হয়ে যেত বলে করেনি। সেলফোন ট্র্যাক করে পিছু নিয়ে পৌঁছে যায় কুড়িগ্রামের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত সেই সার কারখানাটিতে। সোয়েব ভেবেছিল একটু সময় নিয়ে চারিদিক থেকে ঘিরে নিয়ে তারপর আক্রমণ করতে। তার আগে সে পারভেজকে কল করে। সাথে সাথে রিসিভ হয় এবং একটি গুলির শব্দ আর আর্তনাদ শুনতে পায়। সোয়েব বুঝতে পারে যে পারভেজের বিপদ হয়েছে, এবং সাথে সাথে সে সামনে দিয়েই এটাক করে দেয়। অভিযানে তারা এগারো কেজি ওজনের ইয়াবা এবং ইয়াবা তৈরীর ল্যাব ও সরঞ্জাম উদ্ধার করে। মজনু বা তার দলের কেউ আটক হয়নি। যারা আটক হয়েছে তারা সাধারন শ্রমিক, তারা জানতোও না যে তারা কি করছে। স্নিগ্ধাকে তারা উদ্ধার করতে পারেনি। ওপর তলায় আহত অবস্থায় একজন মহিলাকে পাওয়া যায়। মুমুর্ষ অবস্থায় পারভেজকে উদ্ধার করা হয়, তাকে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখান থেকে পরে রংপুর মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়।
অপারেশন থিয়েটার থেকে ডাক্তারকে বের হতে দেখে সোয়েব সিগারেটটা ফেলে দিয়ে এগিয়ে যায়।
সোয়েবকে এগিয়ে আসতে দেখেই ডাক্তার বলে "গুলিটা বের করে ফেলেছি। কিন্তু ব্লীডিংয়ের পরিমাণ অনেক বেশী। এখনো কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে আশা করি রোগীকে আমরা বাঁচাতে পারব।"

দীপা তার রিক্সাটি সাভার পুলিশ স্টেশনের কাছেই দাঁড় করায়। যদিও পুলিশ স্টেশনে আসা তার উদ্দেশ্য নয়। রিকশা থেকে নেমে চেকপোস্টের গার্ডের দিকে এগিয়ে যায় সে।
"বলতে পারেন এ এস পি সোয়েব মাহমুদ কোথায় থাকেন। আমার জানা মতে তিনি আসেপাশেই কোথাও থাকেন।"
"সরি ম্যাম, আমি ঠিক চিনিনা। তবে ঐ দিকে অফিসারদের কোয়ার্টার। হতে পারে সেখানেই থাকেন।" বলে দেখিয়ে দেয় গার্ডটি।
দীপা সেই দিকেই হাঁটতে থাকে। আরো দুজনকে জিজ্ঞাসা করায় দ্বিতীয়জন সোয়েবের কোয়ার্টারটি দেখিয়ে দেয়। দোতলা ছোট্ট একটি বাড়ি, বাড়ির সামনে একটি বাগান। দীপা কলিংবেল চাপে। প্রায় সাথে সাথে একজন বয়স্ক লোক দরজা খুলে দেয়।
"সোয়েব মাহমুদ সাহেব এখানে থাকেন?"
"জে। স্যার তো নাই তয় ম্যাডাম আছেন।" লোকটি বলে।
"চাচা কে?" বাগান থেকেই চেঁচিয়ে বলে সুমি। বলতে বলতে এগিয়ে যায় গেইটের দিকে।
"আমার নাম দীপালী, আমি একজন উকিল। একটি বিশেষ প্রয়োজনে সোয়েব সাহেবের সাথে দেখা করা দরকার।" দীপা বলে।
"ভেতরে আসুন প্লিজ। ও ঘন্টাখানেকের মধ্যে এসে যাবে।" সুমি বলে।
দীপা ভেতরে প্রবেশ করে, সামনে বাগানে বসার যায়গা দেখিয়ে বলে "এখানেই অপেক্ষা করি না?"
"সন্ধ্যা হয়ে আসছে, এই সময় এখানে বসা ঠিক হবে না। বেশ মশার উৎপাত এখানে। প্লিজ ভেতরে চলুন।" সুমি বলে।
ড্রয়িংরুমে বসে চারিদিকটা একবার ঘুরে দেখে দীপা, তারপর ভাবনার মাঝে ডুবে যায়। বিগত দুটি সপ্তাহে অনেকগুলো ঘটনা ঘটে যায় যার কতোগুলো হৃদয়বিদারক, কতোগুলো বিষ্ময়কর। সেদিন সকালবেলা দীপার মেয়েকে কিডন্যাপ করে কতোগুলো মুখোশধারী লোক, দিয়ে যায় একটি হুমকিপত্র। তখনই সোয়েবকে কল করে জানায় ব্যাপারটা, সোয়েব নির্বিকার কন্ঠে বলে চিন্তা না করতে, সে দেখছে বিষয়টা। সোয়েবের নির্বিকার কন্ঠ শুনে ভীষণ অবাক হয়ে যায় দীপা। প্রশ্ন করেই বসে যে সোয়েব কি আগে থেকেই জানতো যে অংকিতা কিডন্যাপ হবে। সোয়েব জবাবে বলেছিল যে সে জানত। আর কিডনাপারদের ওপর সে সবসময় নজর রাখছে তাই চিন্তা করতে মানা করে তাকে। আর আদালতে যেতেও মানা করে তাকে। খুব রাগ হয়েছিল সোয়েবের ওপর, সব জেনে শুনে তার ফুলের মতো মেয়েটিকে কিনা গুন্ডাদের হাতে তুলে দিয়েছিল সে। অবশ্য কিডন্যাপাররা অংকিতাকে বাড়ির কাছে একটি পার্কে রেখে যায় বিকেল বেলা। অংকিতা হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরে আসে। পরের সপ্তাহেই আদালত কবিরের ফাঁসির আদেশ দেয়। প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী আর কবিরের স্বীকারোক্তির পর আর কিছু করার ছিল না। সেদিন রাতেই দীপা সোয়েবকে ফোন করে হাইকোর্টে আপীল করার কথা বলে। সোয়েব না করে দেয়। দীপাকেও এর মাঝে আর জড়াতে মানা করে সোয়েব। দীপার কাছে ভীষণ রহস্যময় লাগে এই লোকটাকে, নিজের চারিদিকে কেমন যেন একটি রহস্যের দেয়ালে ঘিরে রাখে। তারপর থেকে আর কলই ধরছে না সোয়েব। দীপাও একবার ভেবেছিল এই ঝামেলায় আর জড়াবে না। কিন্তু বার বার ছেলেটির মুখটি ভেসে আসছিল চোখের সামনে। কিছুতেই বিবেকের ডাকে সাড়া না দিয়ে ঘরে চুপ করে থাকতে পারেনি।

"চা নিন না। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো! কি ভাবছেন এতো?" সুমির ডাকে সম্বিত ফিরে পায় দীপা।
"বাহ! চমতকার চা বানিয়েছ।" চায়ের কাপটি হাতে নিয়ে চুমুক দিয়ে বলে দীপা।
"সরি। তুমি করে বলে ফেললাম।" আবারও বলে দীপা।
"তুমিই শুনতে ভাল লাগছে। আপনি আমার চেয়ে বয়সে বড় হবেন।" সুমি বলে।
"অবশ্য সোয়েব আমার অনেক দিনের পরিচিত, সেই কলেজ লাইফ থেকে, ভাল বন্ধু বলতে পারো। সেই হিসাবে তোমাকে 'তুমি' বলাই যায়।" দীপা বলে।
"কিন্তু, আপনার সাথে আগে পরিচয় তো করায় নি ও?"
"বিয়েতে অনেক করে আসতে বলেছিল সোয়েব। কিন্তু এতো ঝামেলার মাঝে ছিলাম যে কিছুতেই সময় করতে পারিনি।" দীপা বলে।
তবে আমার বন্ধুটি খুব ভাগ্যবান যে তোমার মতো এমন মিষ্টি একটা বউ পেয়েছে।" দীপা আবারও বলে।
"আপনি বেশী বেশী বলছেন।" লাজুকভাবে হেসে বলে সুমি।
এমন সময় পাশের করিডোরে জুতার ঠক ঠক আওয়াজ পাওয়া যায়।
"ও বোধ হয় এসে গেছে।" বলে উঠে যায় সুমি। এক সেকেন্ড পর সাথে সোয়েব আসে ড্রয়িংরুমে।
"আরে দীপা যে! কখন এলে?" মুখে চওড়া হাসি নিয়ে বলে সোয়েব।
"এইতো, কিছুক্ষণ আগে।" দীপাও হাসি মুখে বলে। কিন্তু দৃষ্টিতে যেন তার আগুন জ্বলছে।
"অংকিতাকেও তো নিয়ে আসতে পারতে।" সোয়েব বলে।
"নিয়ে আসতে তো চেয়েছিলাম। কিন্তু ওর ছোট খালাকে পেয়ে আমার সাথে আর যেতে চাইল না।" দীপা বলে।
"ও, মিনু এসেছে? মিনু কি করছে এখন?"
"অনার্স কম্প্লিট করেছে, এখন এমবিএ করছে।"
এমন সময় সুমি উঠে দাড়ায়, "তোমরা গল্প করো, আমি রাতের খাবার রেডি করি। আপনাকে কিন্তু আমাদের সাথে খেতেই হবে।"
"না না, দেরি হয়ে যাবে। নাহয় অন্যদিন..." দীপা বলে।
"আমি কিন্তু কোন কথা শুনছি না।" বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সুমি।
"তুমি আমার ফোন ধরছ না কেন?" ফিস ফিস করে বলে দীপা।
"আসলে কয়েকদিন এতো ব্যাস্ত ছিলাম যে ফোন ধরারই সময় পাইনি।" আমতা আমতা করে বলে সোয়েব।
"একদম মিথ্যা কথা বলবে না।" গর্জে ওঠে দীপা। "তুমি কিছুদিন থেকে ইচ্ছা করে এভয়েড করছ আমাকে।" দীপা বলে।
"কারণ আমি জানি যে তুমি কি বলবে, আর তুমিও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমার উত্তর কি হবে।" সোয়েব বলে।
"বুঝতে পারছি তোমার উত্তর কি হবে, কিন্তু জানতে চাই কেন।" দীপা বলে।
"কারণ এই লড়াইটা আমরা হেরে গেছি। তুমি কেন বুঝতে চাইছ না?"
"আমি যাকে চিনতাম তুমি কি সত্যি সেই সোয়েব? তুমি তো এতো সহজে হার মেনে নেয়ার মানুষ নও।"
"আমি হার মেনে নিতে শিখে গেছি।"
"তুমি এতো সহজে হার মেনে নিতে পার, আমি নই। আমি কেইসটা রি-ওপেন করার জন্য আপীল করব পরশুদিন। কাগজপত্র সব তৈরী করে ফেলেছি।"
"তোমার আপীল ধোপে টিঁকবে না। আর যদি কেইসটা ওপেন করেও ফেল যদি ওরা আবার অংকিতাকে কিডন্যাপ করে তখন কি করবে।"
"যা কিছুই করি না কেন তোমার সাহায্য চাইব না। বাই দা ওয়ে, কাল আমি কবিরের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। তুমি কি যাবে? ছেলেটা হয়তো একটু মনোবল পেত।"
"আমার ট্রান্সফার হয়ে গেছে যশোর বেনোপোল। এক তারিখ থেকে জয়েন। এর মধ্যে আর কোন ঝামেলায় পড়তে চাই না।"
 
রৌদ্রদীপ্ত ঝলমলে সকাল, কবির কারাগার প্রাঙ্গনে একটি গাছের নিচে বসে ছিল। চারিদিক কোলাহল, কয়েদিদের একটি দল প্রাঙ্গনে মাটি খুঁড়ছে, পাশেই একটি গাছের নিচে কতোজন কয়েদি গল্পগুজব করছিল। কবিরের সেসব দিকে লক্ষ নেই, সে মাটির দিকে তাকিয়েছিল কিন্তু দৃষ্টিতে শুন্যতা। ফাঁসির রায় হবার তিন দিন পর কবিরকে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে এই কাশেমপুর কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
কখন অন্য একজন এসে কবিরের পাশে বসেছে কবির খেয়াল করেনি।
"হ্যালো বস, আমি তুহিন।" লোকটি কবিরের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে।
হটাত সম্বিত পেয়ে লোকটির দিকে তাকায়। শ্যাম বর্ন, লম্বাটে মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি, গায়ে কয়েদির পোশাক, দেখে কবিরের সমবয়সীই মনে হয়।
কবিরের কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না, একবার তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরে নেয়। ভদ্রতা, অভদ্রতা সবই এখন অর্থহীন তার কাছে। লোকটা তবু দমে যায় না।
"কি বস, যাবজ্জীবন নাকি ফাঁসি?" আবারও বলে তুহিন। কবির অবাক হয়ে তাকায় তার দিকে, কিন্তু কিছু বলে না।
"জানি বস। এখানে বছর বছর আসা যাওয়া চলতেই থাকে, ভাবসাব দেখেই বুঝতে পারি কে কেমন কেস খেয়েছে।" তুহিন বলে। সেই সময় হঠাত একজন মধ্যবয়সী হাবিলদার ওদের দিকে এগিয়ে আসে।
"কিরে, কাজ বাদ দিয়ে এখানে বসে আড্ডা দিচ্ছিস? এ কি মামার বাড়ি পেয়েছিস?" তুহিনকে দেখে খেঁকিয়ে ওঠে হাবিলদার।
"কাকা, অতো চটো কেন। কাজ করছি তো।" বলতে বলতে উঠে ঝাড়ু হাতে নিয়ে ঝাঁট দিতে লেগে গেল।
"ঐ দিকে ভাল করে ঝাঁট দে।" তুহিনকে দেখিয়ে দেয়। তারপর কবিরকে উদ্দেশ্য করে বলে "তোর নাম কবির?"
কবির হ্যাঁবোধকভাবে মাথা নাড়ে।
"চল, তোর ডাক পড়েছে।"
কবির হাবিলদারের পিছে পিছে যায়। গেইটের কাছে ছাউনি দেয়া একটা যায়গা আছে যাতে বেঞ্চ পাতা রয়েছে, এখানেই উকিলরা আসামীদের সাথে দেখা করে। কবির দীপাকে দুর থেকে দেখেই চিনতে পারে।
"কেমন আছ কবির?" মুখে হাসি টেনে এনে বলে দীপা।
"এইতো ভাল, ম্যাম। আপনি ভাল আছেন? আর আপনার মেয়ে ভাল আছে?" কবিরও মুখে হাসি টেনে বলে, যদিও হাসিটা মলিন দেখায়।
"হ্যাঁ আমরা ভাল আছি। আসলে সেদিন ওরা.." দীপাকে কথা শেষ করতে দেয় না কবির "জানি ম্যাম, আমার জন্য আপনি বিপদে পড়েছিলেন।"
"তোমার তো এতে দোষ নেই।" একটু থেমে আবার বলে "তুমি জানলে কিভাবে?"
"অনুমান করেছি।" কবির বলে।
দীপা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তারপর বলে "আগামীকাল কেইসটা রি-ওপেন করার জন্য হাইকোর্টে আবেদন করবো। আশা করি কেসটা রি-ওপন করতে পারব। তুমি একদম চিন্তা করবে না, তোমার কিচ্ছু হবে না।"
"আমি নিজের জন্য চিন্তা করি না, ম্যাম। স্নিগ্ধার কোন খোঁজ পেলেন?"
"এখনো পাইনি। তবে সোয়েব চেষ্টা করছে স্নিগ্ধাকে খুঁজে বের করার।"
"স্যারকে বলবেন ওকে যেন বাঁচান। আমি জানি এই কেসটা রি-ওপেন করা সহজ হবে না। আমার হাতে আর এক থেকে দেড় মাস সময় আছে, আমার যাই হোক না কেন, স্নিগ্ধাকে যেন কোন ক্ষতি না হয়। শুধু এটুকু অনুরোধ রইল আপনাদের কাছে।" বলে কবির উঠে চলে যায়।

সেদিন সকালবেলা স্নিগ্ধা মজিদকে সাথে নিয়ে নিকটবর্তী ভুরুঙ্গামারী থানার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এর আগে স্নিগ্ধা মজিদকে সবকিছু জানায়। মজিদই পরামর্শ দেয় পুলিশকে সবকিছু জানানোর জন্য। তবে নিকটতর পুলিশ স্টেশনও অনেক দুরে, দুই কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছে তারপর ভ্যানে খানিকটা পথ, এরপর আবার টেম্পুতে অনেকটা পথ। যতোক্ষনে তারা থানায় পৌঁছায় ততোক্ষণে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায়। থানার ক্যান্টিনে বসে হালকা নাস্তা সেরে স্নিগ্ধা ও মজিদ যখন বের হতেই থানার সামনে একটি সাদা রংয়ের গাড়ি থামতে দেখে, গাড়ি থেকে সাদা কোর্ট ও নীল সার্ট পরিহিত একজন লোক বের হয় যাকে দেখে মুহুর্তের জন্য হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায় স্নিগ্ধার।
সজল গাড়ি থেকে নেমে থানার ভেতরে হেঁটে যায়, স্নিগ্ধাকে দেখতে পায়নি সে।
মজিদের হাত ধরে টেনে আবারো ক্যান্টিনে ঢুকে যায় স্নিগ্ধা। ফিস ফিস করে বলে "সজল, আমার স্বামী।"
"অহ! এই সেই জানোয়ারডা? দেখতে তো ভদ্রলোকই মনে হয়।" মজিদ বলে।
"হ্যাঁ কাকা, দেখতে ভদ্রলোক, কিন্তু আসলে অমানুষ।" একটু থেমে স্নিগ্ধা আবার বলে, "মনে হয় না এখন আমাদের থানায় যাওয়া উচিত হবে।"
"ঠিক কইছ মা, থানায় যাওয়া উচিত হবে না, তার চেয়ে চল ফিইরা যাই। অন্য কোন উপায় ভাবতে হইব।" মজিদ বলে।
ওরা ক্যানটিন থেকে সন্তর্পনে হেঁটে বের হয়।

কবির তার বেডে শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়েছিল। কিছুতেই তার ঘুম আসছিল না। শুয়ে শুয়ে ও স্নিগ্ধার কথা ভাবছিল। কোথায় আছে, কেমন আছে কে জানে। একটি মাস তো কেটে গেল এই জেলে, আর কটা দিনই বা আছে জীবনে। মৃত্যুর আগে আর একটি বার যদি ওকে দেখে যেতে পারতো! দীর্ঘশ্বাস ফেলে কবির। ছোট্ট একটি সেল, তার মাঝে দুটি বেড। কবিরের পাশের বেডে তুহিন নামের ছেলেটি শুয়ে শুয়ে গুনগুন করে গান গাইছিল।
"আমার হৃদয় পিঞ্জিরার পোষা পাখি রে,
আমারে কান্দাইয়া পাওকি সুখ?"
ভাঙা ভাঙা গলায় টেনে টেনে গাইছিল তুহিন, খানিকটা অপেরার মতো শোনায়।
"কবির ভাই। ঘুমান নাই এখনো?" গান থামিয়ে বলে তুহিন।
"না ভাই। তোমার গান শুনছিলাম। খুব ভাল গাও তুমি।" কবির বলে।
"কি যে বলেন না ভাই। আপনার কাছে তো কিছুই না। একটা গান শুনান না ভাই, ঐযে আমার সোনার ময়না পাখি।"
"না ভাই, আমার গান হবে না এখন। তার চেয়ে তুমিই গাও।"
তুহিন আপন মনেই গাইতে থাকে "আমার সোনার ময়না পাখি,
কোনবা দোষে উইড়া গেলা রে, দিয়া মোরে ফাঁকি রে আমার সোনার ময়না পাখি।"
"কবির ভাই, কখনো প্রেম করেছেন?" গান থামিয়ে বলে তুহিন।
"নাহ" এক মুহুর্ত চুপ থেকে বলে কবির।
"মিথ্যা বলতাছেন।"
"আরে নাহ, তেমন কিছু ছিল না।"
"আমার ময়না পাখির কথা খুব মনে পড়ে গো ভাই। নাম ছিল তামান্না। কাঁচা দুধের মতো ফর্সা, আর চোখ দুটো একদম ঐশ্বরিয়ার মতো। দেখলেই কলিজাডা ঠান্ডা হইয়া যাইতো। গ্রামের স্কুলে ক্লাস টেনে পড়তো। ওর জইন্যে প্রতিদিন স্কুলের সামনে অপেক্ষা করতাম। কোন কোন দিন স্কুল ফাঁকি দিয়া বাইকে নিয়া ঘুরতে যাইতাম। কপালে ছিল নাকো ভাই। এসএসসির পরই ওর বিয়া হয়ে গেল, এক পুলিশ কনস্টেবলের সাথে। বলছিলাম দুজন পালাইয়া বিয়া করি, কিন্তু ও রাজি হয় নাই।"
"তাও ভাল যে রাজি হয় নাই। নাহলে তো চোরের বউ হতে হতো।" কবির বলে।
"ও যদি আমার ঘরে আসতো আমি কি আর চোর হতাম?"
"তুই যদি আমার হইতিরে,
বন্ধু, আমি হইতাম তোর।
যতনে বান্ধিয়া রাখিতাম অন্তরের ভেতর রে,
তুই যদি আমার হইতিরে।" আবারো আনমনে গাইতে থাকে তুহিন।
"খুব ঘুম পাচ্ছে ভাই। গুড নাইট।" হাই তুলতে তুলতে বলে তুহিন।
তুহিন চুপ হতেই কবির তার ভাবনার জগতে ফিরে আসে।
কবির চোখদুটো বন্ধ করে। একটি ছোট্ট মেয়ের মুখচ্ছবি ভেসে আসে। মেয়েটি পুতুল কোলে নিয়ে তার মুখে মেকাপ করে দিচ্ছিল। কবিরও ছিল ওখানে, সে তার খেলনা গাড়ি নিয়ে মেঝেতে ঘষছিল আর মুখে ব্রুম ব্রুম আওয়াজ করছিল।
"তুই আম্মুর মেকাপ নষ্ট করছিস। আম্মুকে বলে দেব।" স্নিগ্ধার দিকে এগিয়ে এসে বলে কবির।
"আমি আন্টিকে বলেই নিয়েছি। দেখনা আমার টিনাকে কি সুন্দর লাগছে।" স্নিগ্ধা বলে।
"যাহ, পচা লাগছে। তোর মতো।" কবির বলে।
"তুই আমার টিনাকে আর আমাকে পচা বললি? আমি আন্টিকে বলে দেব।" স্নিগ্ধা ঠোঁট ফুলিয়ে বলে।
"আহা, কাঁদিস না তো। নে আমি টিনাকে আমার গাড়িতে চড়তে দেব।"
শুনে স্নিগ্ধার ঠোঁটে হাসি খেলে যায়। কি মিষ্টি সেই হাসি!

স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিল কবির, হঠাত খুট খুট আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় কবিরের। পাশের বেডে তুহিন উঠে বসেছে, কিছু একটা করছে সে।
"তুহিন ভাই, ঘুমাওনি এখনো?" কবির বলে।
"চুপ ভাই, আমি এখন পালাব। আপনিও চলেন আমার সাথে।" তুহিন ফিসফিস করে বলে।
"কিন্তু কিভাবে?"
"এই রাতের জইন্যে আমি বহুদিন থেইকা অপেক্ষায় আছি। আজ ফজলু হাবিলদারের ডিউটি পড়ছে এইখানে। বেটা সারা রাত নাক ডাইকা ঘুমায়। আর তাছাড়া আমার জরুরি হাতিয়ারগুলা এসে গেছে।" বলে বেডের নিচে থেকে একটি কাঁচের শিশি বের করে। "নাইট্রিক এসিড। খুব কাজের জিনিস। শুধু এক ফোঁটা ঢাললে লোহা মাখনের মতো গইলা যায়।"
"এখানে পাইলা কিভাবে?"
"আমার লোক আছে। যায়গামতো টাকা খাওয়াইছি। কাশের ওষুধ কইয়া পাঠাইছে।"
একমুহুর্ত থেমে আবার বলতে শুরু করে তুহিন "যদি পালাইতে চান তবে শুইনা রাখেন। ধরা পড়লে কপালে দুর্ভোগ আছে। তাই যেভাবে বলছি সেভাবে চলবেন। একেবারে নিঃশব্দে চলবেন, পায়ের গোড়ালি আগে ফেলবেন, যেন কোন শব্দ না হয়। সবসময় আমার পিছে পিছে চলবেন। কথা হবে না, ইশারা বুঝতে হবে।"
"ঠিক আছে।"
এরপর তুহিন কবিরকে পুরো প্ল্যানটা শোনায়। এরপর তুহিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পকেটে পুরে দরজার দিকে এগোয়। লোহার শিকযুক্ত দরজা, পাশাপাশি দুটি শিকের ওপরে এবং নিচে দুই বিন্দুতে একফোঁটা করে নাইট্রিক এসিড ঢেলে দিল, মুহুর্তের মাঝে লোহা গলে গিয়ে দুটি শিক খুলে এল।
তুহিন এবং কবির কারোরই সেই ফাঁক দিয়ে গলে বের হতে সমস্যা হল না। জেলের করিডরের একপাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিল ফজলুল হাবিলদার। ওরা করিডর পেরিয়ে বাগানে ঝোপঝাড়ের পিছে লুকিয়ে পড়ে এবং চারিদিক লক্ষ রাখে। মিনিট খানেক পর বেরিয়ে মাঠের অন্যপাশে যায়। সেখানে একটি ড্রেন আছে যা লোহার নেট দিয়ে ঢাকা। নাইট্রিক এসিড দিয়ে নেটটির খানিকটা গলিয়ে ফেলে ড্রেনে নেমে পড়ে ওরা। কোমর পর্যন্ত দুর্গন্ধময় কাদা পানিযুক্ত সুড়ঙ্গ পথে ওরা হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে ড্রেনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যায়। একটি পিভিসি পাইপ দিয়ে ড্রেনের পানি তুরাগ নদীতে পড়ছে। তুহিন লাইটারের আগুন দিয়ে পাইপটার ওপরের অংশ ভেতর থেকে গলিয়ে ফেলে। তারপর ঢাল বেয়ে নেমে আসে নদীতে, তুহিনের পিছে পিছে কবিরও। গলা পানিতে নেমে দুজন চুপচাপ কান পেতে শোনার চেষ্টা করে যে কোনরকম সাইরেন বাজছে কিনা।
"এখনই ডাঙায় উঠলে বিপদ হইতে পারে। এই এলাকার সিকিউরিটি খুব টাইট। নদী দিয়াই যাইতে হইব। সাঁতার জানেন তো?" ফিস ফিস করে বলে তুহিন।
কবির হ্যাঁবোধকভাবে মাথা নাড়ে। ওরা নদীপথেই কখনো সাঁতার কেটে কখনোবা গলা পানিতে হেঁটে হেঁটে যেতে লাগল। কতক্ষন এভাবে গিয়েছে বলতে পারে না কবির। একসময় তুহিন ফিসফিস করে বলে "ভাই, ডাঙায় ওঠার সময় হয়ে গেছে।"
ওরা নদী ছেড়ে উঠে আসে। নদীর পাশেই রাস্তা, সেখানে একটি ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। ওরা ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে যায়।
"আপনি এখানেই থাকেন, আমি আসতেছি", বলে তুহিন ট্রাকটার দিকে এগিয়ে যায়। মিনিটখানেক পরেই ফিরে আসে,
"জলদি আসেন। এ আমারই লোক।" তুহিন বলে।
দুজন ট্রাকটায় উঠে পড়ে। সেটি একটি খড় বোঝাই ট্রাক, দুজন খড়ের মাঝে লুকিয়ে পড়ে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top