যতোক্ষনে সোয়েব বান্দরবন শহরে ফিরে আসে ততক্ষনে রাত হয়ে গেছে। এতোক্ষনে কবিরের নির্দোষ হওয়ার ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ নেই সোয়েবের, কিন্তু এখনো একটি প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, সাদিয়ার মা বাবা কেন মুখ বন্ধ রেখেছে। সেই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে সোয়েবকে বগুড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। কিন্তু সপ্তাহ জুড়ে লাগাতার জার্নিতে শরীরটা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে, একটু রেস্ট দরকার, কিন্তু শেষটা না দেখে ছাড়বে না বলে মনস্থির করে। বান্দরবান থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়, চট্টগ্রাম থেকে আবার বগুড়ার বাসে রওনা দেয়। বারো ঘন্টার জার্নি শেষে সোয়েব যখব বগুড়ায় এসে পৌঁছায় ততক্ষনে পরেরদিন দুপুর বারোটা বেজে যায়। কবিরের দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী সাদিয়াদের বাড়ি খুঁজে পেতে আরো এক ঘন্টা লেগে যায় ওর।
সামনে দোতলা বাড়ি, বাড়ির কলাপসেবল গেটের সামনে এসে সোয়েব কলিংবেল টেপে। ওর চোখ দুটো ঢুলু ঢুলু করছে একটু শুয়ে পড়লেই ঘুমিয়ে পড়বে, বাসে ঘুম কখনোই পরিপুর্ন হয় না, ক্লান্তি থেকেই যায়, একটু শুয়ে পড়লেই ঘুমিয়ে পড়বে সে। ক্লান্তি জনিত কারনেই কিনা সোয়েবের মনে হচ্ছিল কেউ তার ওপর নজর রাখছে, সোয়েব একটু সচকিত হয় এবং আড়চোখে লক্ষ্য করে একটু দুরে চায়ের দোকানে দুজন ছেলে তার দিকে বারে বারে তাকাচ্ছে। সোয়েব আরেকবার কলিংবেল চাপে, এবার একটি কমবয়সী মেয়ে এসে দরজা খুলে দেয়।
"কাকে চাই?" মেয়েটি বলে।
"মিসেস শিরিন আক্তার।" সোয়েব বলে।
"ওনারা তো ওপর তলা থাকেন।" মেয়েটি বলে।
"থ্যাংক ইউ।" বলে সোয়েব সিঁড়ি বেয়ে ওপর তলা উঠে যায়।
আবারও কলিং বেল টেপে সে, কয়েক সেকেন্ড পর দরজাটা খুলে যায়, অন্যপাশে একজন মধ্যবয়সী মহিলা।
"আপনি মিসেস শিরিন আক্তার?"
"হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে তো চিনতে পারলাম না!" শিরিন বলে।
"আমি এএসপি সোয়েব মাহমুদ। মিরপুর থানা থেকে এসেছি।"
মিরপুর থানার কথা শুনে শিরিনের চোখ চকচক করে ওঠে, পরমুহুর্তেই আবার নিরাশায় ভরে ওঠে। শান্ত স্বরে বলে "ভেতরে আসুন।"
সোয়েবকে ড্রয়িরুম দেখিয়ে বলে "আপনি বসুন। আমি একটু আসছি" বলে শিরিন চলে যায়।
সোয়েব ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে যায়, মিনিট খানেক পর শিরিন ফিরে আসে হাতে একটি ট্রে, তাতে ফলমুল আর সরবত। সোয়েব এক ঢোঁকে সরবতটুকু খেয়ে নিয়ে বলতে শুরু করে "আমি এসেছি সাদিয়ার অপহরনের বিষয়ে তদন্তে। আপনাকে কিছু প্রশ্ন করব, আশা করি আপনি আমাদেরকে তদন্তে সহায়তা করবেন।"
"জি বলুন।"
"সাদিয়ার অপহরনের বিষয়ে আপনি জানলেন কবে?"
"তারপরের দিন। সজল আমাকে কল করে জানায় স্নিগ্ধাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।" শিরিন বলে।
"নিখোঁজ! ডাকাতি বা অপহরনের বিষয়ে কিছু জানায় নি?"
"না। হয়তো আমরা খুব টেনশন করব ভেবে বলেই নি।" শিরিন বলে।
"তা তো হতেই পারে। আচ্ছা স্নিগ্ধা নিখোঁজ হবার পর সে কি কোন ভাবে আপনাদের সাথে যোগাযোগ করেছিল?"
প্রশ্নটা শুনে শিরিন কিছুটা চমকে ওঠে, "না।" বলতে গিয়ে কন্ঠ কেপে ওঠে শিরিনের। সোয়েব স্পষ্ট বুঝতে পারে যে মিথ্যা বলছে সে।
"আচ্ছা, স্নিগ্ধার ওর স্বামীর সাথে সম্পর্ক কেমন ছিল? আই মিন ওদের মাঝে কোন ঝগড়া বিবাদ ছিল কিনা?"
"ছোটখাট ঝগড়া বিবাদ তো সব সংসারেই থাকে। স্নিগ্ধা অবশ্য আমাকে কখনো তেমন কিছু জানায়নি। তবে একবার কিছু না জানিয়ে হঠাত করে বাড়ি চলে আসে। অবশ্য পরের দিনই ও ফিরে গিয়েছিল। আমার মনে হয় ও কিছু লুকোচ্ছিল, জিজ্ঞাসা করলেও কিছু বলেনি আমাকে।" শিরিন বলে।
"আচ্ছা, সেই দিন কি আরো এমন কিছু হয়েছিল যা রোজ রোজ হয় না, মনে করে বলুনতো?"
"হ্যাঁ, সেইদিন স্নিগ্ধার বাবা ছিনতাইকারীদের খপ্পরে পড়েছিল।"
"তাই নাকি, কোথায়, কিভাবে?" সোয়েব বলে।
"ওর অফিসের সামনেই নাকে রুমাল চেপে অজ্ঞান করে কয়েকজন যুবক ওকে তুলে নিয়ে যায়। পরের দিন সকালে যখন ওর জ্ঞান ফেরে তখন ও হাসপাতালে। ওর মানিব্যাগে তিন হাজার টাকা ছাড়া আর কিছু নেয়নি।"
"সাতরাস্তার মতো জনবহুল যায়গা থেকে কাউকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেল মাত্র তিনহাজার টাকার জন্য? বিষয়টা আজব না?"
"আজব। কিন্তু এর সাথে এই কেসের কি সম্পর্ক?" চিন্তিত কন্ঠে বলে শিরিন।
"সম্পর্ক তো আছেই, জীবনে প্রত্যেকটি ঘটনা একটির সাথে অন্যটি সম্পৃক্ত। যাই হোক, এবার মুল প্রসঙ্গে আসি। শাহরিয়ার কবির খানকে আপনি নিশ্চয়ই চেনেন?"
শিরিন হ্যাঁবোধকভাবে মাথা নাড়ে।
"শুনেছি কবির ছোটবেলায় অনাথ হয়ে যায়, আপনারাই ওকে লালন পালন করেছেন?"
"হ্যাঁ।"
"আপনাদের স্নেহ ভালবাসার প্রতিদান ঐ বেইমান শুয়োরটা এভাবে দিল? আপনাদেরই মেয়েকে অপহরণ ও ধর্ষণ করে?" বলতে বলতে শিরিনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সোয়েব। শিরিনকে তার কাছে খুব নরম মনের মানুষ বলে মনে হয়, এমন মানুষের কাছে থেকে সত্যটা বের করে আনা কঠিন ব্যাপার নয়, সোয়েব তারই চেষ্টা করে।
শিরিন কোন কথা না বলে মাথা নিচু করে থাকে। সোয়েব বলতে থাকে "ত্রিশটার ওপরে খুন, চল্লিশটার ওপরে ধর্ষনের অভিযোগ আছে। ফাঁসি তো হবেই পিশাচটার, যদি আমার ক্ষমতা থাকতো তবে ফাঁসি না দিয়ে শুয়োরটাকে হাত পায়ে পেরেক মেরে কোন উঁচু টাওয়ারে ঝুলিয়ে দিতাম। কাক শকুন যখন জ্যান্ত অবস্থায় চোখ উপড়ে খেত তখন উপযুক্ত শাস্তি পেত।"
"দয়া করে চুপ করুন আপনি।" মিনতি করে বলে শিরিন।
"কেন? আপনার কি কবিরের প্রতি এখনো মায়া আছে। যদি ঐ পিশাচটার প্রতি মায়া দয়া কিছু অবশিষ্ট থাকে তবে শুনুন, পুলিশের তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী কবির তার দলবল নিয়ে হোটেলে হামলা করে স্নিগ্ধাকে অপহরন করে। নিজের আস্তানায় নিয়ে গিয়ে বন্দি করে স্নিগ্ধাকে দিনের পর দিন ধর্ষন করে। শুধু নিজে ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, নিজের দলবল দিয়ে দিনের পর দিন গণধর্ষন করায়। স্নিগ্ধার প্রতি এতো শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন করে যে ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।" তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে সোয়েব।
"সব মিথ্যা, সব বানোয়াট। আমার কবির ডাকাত হতে পারে না, ও কারো ক্ষতি করতে পারে না। ও স্নিগ্ধাকে অপহরণ করেনি। স্নিগ্ধা নিজের ইচ্ছায় ওর সাথে গেছে। ওরা একে অপরকে ভালবাসে। স্নিগ্ধা নিজে আমাকে কল করে বলেছে।"
"এ কথা আমাকে আগে বলেন নি কেন?"
"কি করে বলি বাবা, ওরা যে স্নিগ্ধাকে খুন করবে তাহলে। কি করব বাবা, না পারছি মুখ খুলতে না পারছি চুপচাপ সইতে।" বলতে বলতে কেঁদে ফেলে শিরিন।
"কাঁদবেন না মা, শক্ত হোন।"
"আমি আর চুপ থাকবনা, সত্যি সত্যি সবকিছু বলে দেব। তাতে আমার মেয়ের যা হয় হবে।" চোখ মুছতে মুছতে বলে শিরিন।
"দেখুন, আমি এই কেসের ইনচার্জ নই। এর তদন্তের দায়িত্ব আমার কাঁধে ছিল না। কিন্তু এই কেসের পেছনে বিশাল ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরে আমি ছুটি নিয়ে নিজের তাগিদে তদন্তে নেমে পড়ি। এখানে আসার আগেই আমি কবিরের নির্দোষ হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত ছিলাম। আপনার মুখ থেকে সত্য শোনার জন্যই এই নাটকটি আমি করেছি, ক্ষমা করবেন। আপনি আমার প্রতি ভরসা রাখতে পারেন। আমি আমার সবটা দিয়েই চেষ্টা করব যেন কবির আর স্নিগ্ধার কোন ক্ষতি না হয়। তবে আপনার এই মুহুর্তে চুপ থাকাই উচিত, পুলিশ বা মিডিয়া সবার কাছেই। তবে কখনো যদি আদালতে কথা বলার সুযোগ আসে তবে সবকিছু সত্যি সত্যি খুলে বলবেন। মনে রাখবেন আদালতে সত্যটা খুলে বললে ওরা স্নিগ্ধার ক্ষতি করার সাহস পাবে না।"
একটু থেমে পকেট থেকে ভিজিটিং কার্ড বের করে বলে সোয়েব, "এই কার্ডটি রাখুন, যেকোন সমস্যায় যোগাযোগ করবেন। আর আমার বিষয়ে কাউকে বলবেন না। না আপনার স্বামীকে না জামাইকে। বিশেষ করে জামাইয়ের ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন। জিল্লুর রহমান ওনাকে কোম্পানির সিইও পদে প্রমোশন দিয়েছে। কেন তা আশা করি আন্দাজ করতে পারবেন।"
সোয়েবের ঘুম ভেঙে যায় রিংটোনের আওয়াজে। ফোনটা রিসিভ করার আগেই কেটে যায়। সোয়েব বিছানায় বসে এক হাতে চোখ ডলতে ডলতে হাতে নেয় ফোনটা, আটটা মিসডকল, সবগুলোই সুমির। সোয়েব কল ব্যাক করে।
"সেই কখন থেকে কল করছি, রিসিভ করছ না কেন?" সুমি বলে।
"ঘুমিয়েছিলাম।"
"এই অবেলায় ঘুম? শরীর খারাপ নাকি?"
"শরীর খারাপ না তবে খুব ক্লান্ত। একটা দিন জার্নির ওপর ছিলাম তো তাই। এখন ঠিক আছে, লম্বা ঘুম দিলাম তো, শরীরটা এখন ঝরঝরে লাগছে।"
"আমাকে নিতে আসবে কবে?" সুমি বলে।
"আর কয়েকটা দিন থাকোই না। ওখানে ভাল লাগছে না?"
"তা নয়, কিন্তু বাইরের খাবার খেয়ে খেয়ে আবার তুমি অসুখ বাধিয়ে ফেলবে।"
"কয়েকদিন বাইরের খাবার খেলে কিচ্ছু হবে না। তবে তোমাকে ছাড়া আমার একদম ভাল লাগছে না, পরশুদিন তোমাকে নিয়ে আসব।" একটু থেমে সোয়েব আবার বলে।
"মা কোথায়?"
"পাশের বাসায় গেছে। একটু আগে ফোন ধরলেই পেতে। আচ্ছা রাখি, আর বাইরের হাবিজাবি একদম খেও না, আর নিজের যত্ন নিও।"
"তুমিও।" বলে সোয়েব কেটে দেয়। তারপর বিছানা ছেড়ে ওঠে সে। ওয়াসরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে বাংলোর সামনের বাগানে গিয়ে হাঁটাহাটি করে কিছুক্ষন। গতকাল বগুড়া থেকে যখন সাভারে তার বাংলোয় ফিরে এসেছে তখন রাত এগারোটা, এসেই কোন মতো পোশাক ছেড়ে রাত পোশাক পরে বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে যায়। ঘুম থেকে যখন ওঠে তখন দুপুর বারোটা। গোসল ও লাঞ্চ সেরে আবার ঘুমিয়ে পড়ে সোয়েব, ওঠে বিকেল পাঁচটায়।
বাগানে হাঁটতে হাঁটতে কবিরের কেসটার ব্যাপারেই ভাবছিল সে, জিল্লুর রহমানের মতো ক্ষমতাবান ধনী ব্যাক্তির সাথে টক্কর দিয়ে সফল হওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার না। প্রতিটি পদক্ষেপ চিন্তাভাবনা করে নিতে হবে। অন্যদিকে কবিরের রিমান্ডের আজকেই শেষ দিন, এরমধ্যে যদি ওর স্বীকারোক্তি যোগাড় করে নেয় তবে কেসটা আরো জটিল হয়ে যাবে। সোয়েব তার ইউনিফর্ম পরে নিয়ে বেরিয়ে যায় মিরপুর থানার উদ্দেশ্যে। থানায় পৌঁছে সোয়েব মইনুলকে তার চেয়ারে বসে মনোযোগ দিয়ে ফাইল ঘাঁটাঘাটি করতে দেখে। সোয়েবকে দেখে দাঁড়িয়ে সেলুট দেয় সে। সোয়েব তার ডেস্কের সামনের চেয়ারে বসে পড়ে।
"ভাল আছেন স্যার? ছুটি কেমন কাটল?" মইনুল বলে।
"ভাল। তা তোমার জিজ্ঞাসাবাদ কেমন চলছে?" সোয়েব বলে।
"জিজ্ঞাসাবাদ! ও ঐ ডাকাতের কেসটার কথা বলছেন স্যার? খুব ঘাঘু মাল স্যার, মেরে ফাটাফাটা করে ফেলি তবু মুখ খোলে না। মনে হচ্ছে আরো সাতদিন লাগবে। রবিবার কোর্টে তুলে রিমান্ড চাইব। তারই ফাইলপত্র তৈরী করতেছি।" মইনুল বলে।
"বেশি মারোনি তো আবার, মরে গেলে আবার অন্য ঝামেলা।" সোয়েব বলে।
"মরবে না স্যার, এদের কই মাছের জান।" মইনুল বলে
"তোমার তো ডিউটি শেষ?"
"জি স্যার।"
"যাবার আগে নাইট ডিউটির ফাইলটা আমার চেম্বারে দিয়ে যেও।"
"জি স্যার।"
সামনে দোতলা বাড়ি, বাড়ির কলাপসেবল গেটের সামনে এসে সোয়েব কলিংবেল টেপে। ওর চোখ দুটো ঢুলু ঢুলু করছে একটু শুয়ে পড়লেই ঘুমিয়ে পড়বে, বাসে ঘুম কখনোই পরিপুর্ন হয় না, ক্লান্তি থেকেই যায়, একটু শুয়ে পড়লেই ঘুমিয়ে পড়বে সে। ক্লান্তি জনিত কারনেই কিনা সোয়েবের মনে হচ্ছিল কেউ তার ওপর নজর রাখছে, সোয়েব একটু সচকিত হয় এবং আড়চোখে লক্ষ্য করে একটু দুরে চায়ের দোকানে দুজন ছেলে তার দিকে বারে বারে তাকাচ্ছে। সোয়েব আরেকবার কলিংবেল চাপে, এবার একটি কমবয়সী মেয়ে এসে দরজা খুলে দেয়।
"কাকে চাই?" মেয়েটি বলে।
"মিসেস শিরিন আক্তার।" সোয়েব বলে।
"ওনারা তো ওপর তলা থাকেন।" মেয়েটি বলে।
"থ্যাংক ইউ।" বলে সোয়েব সিঁড়ি বেয়ে ওপর তলা উঠে যায়।
আবারও কলিং বেল টেপে সে, কয়েক সেকেন্ড পর দরজাটা খুলে যায়, অন্যপাশে একজন মধ্যবয়সী মহিলা।
"আপনি মিসেস শিরিন আক্তার?"
"হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে তো চিনতে পারলাম না!" শিরিন বলে।
"আমি এএসপি সোয়েব মাহমুদ। মিরপুর থানা থেকে এসেছি।"
মিরপুর থানার কথা শুনে শিরিনের চোখ চকচক করে ওঠে, পরমুহুর্তেই আবার নিরাশায় ভরে ওঠে। শান্ত স্বরে বলে "ভেতরে আসুন।"
সোয়েবকে ড্রয়িরুম দেখিয়ে বলে "আপনি বসুন। আমি একটু আসছি" বলে শিরিন চলে যায়।
সোয়েব ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে যায়, মিনিট খানেক পর শিরিন ফিরে আসে হাতে একটি ট্রে, তাতে ফলমুল আর সরবত। সোয়েব এক ঢোঁকে সরবতটুকু খেয়ে নিয়ে বলতে শুরু করে "আমি এসেছি সাদিয়ার অপহরনের বিষয়ে তদন্তে। আপনাকে কিছু প্রশ্ন করব, আশা করি আপনি আমাদেরকে তদন্তে সহায়তা করবেন।"
"জি বলুন।"
"সাদিয়ার অপহরনের বিষয়ে আপনি জানলেন কবে?"
"তারপরের দিন। সজল আমাকে কল করে জানায় স্নিগ্ধাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।" শিরিন বলে।
"নিখোঁজ! ডাকাতি বা অপহরনের বিষয়ে কিছু জানায় নি?"
"না। হয়তো আমরা খুব টেনশন করব ভেবে বলেই নি।" শিরিন বলে।
"তা তো হতেই পারে। আচ্ছা স্নিগ্ধা নিখোঁজ হবার পর সে কি কোন ভাবে আপনাদের সাথে যোগাযোগ করেছিল?"
প্রশ্নটা শুনে শিরিন কিছুটা চমকে ওঠে, "না।" বলতে গিয়ে কন্ঠ কেপে ওঠে শিরিনের। সোয়েব স্পষ্ট বুঝতে পারে যে মিথ্যা বলছে সে।
"আচ্ছা, স্নিগ্ধার ওর স্বামীর সাথে সম্পর্ক কেমন ছিল? আই মিন ওদের মাঝে কোন ঝগড়া বিবাদ ছিল কিনা?"
"ছোটখাট ঝগড়া বিবাদ তো সব সংসারেই থাকে। স্নিগ্ধা অবশ্য আমাকে কখনো তেমন কিছু জানায়নি। তবে একবার কিছু না জানিয়ে হঠাত করে বাড়ি চলে আসে। অবশ্য পরের দিনই ও ফিরে গিয়েছিল। আমার মনে হয় ও কিছু লুকোচ্ছিল, জিজ্ঞাসা করলেও কিছু বলেনি আমাকে।" শিরিন বলে।
"আচ্ছা, সেই দিন কি আরো এমন কিছু হয়েছিল যা রোজ রোজ হয় না, মনে করে বলুনতো?"
"হ্যাঁ, সেইদিন স্নিগ্ধার বাবা ছিনতাইকারীদের খপ্পরে পড়েছিল।"
"তাই নাকি, কোথায়, কিভাবে?" সোয়েব বলে।
"ওর অফিসের সামনেই নাকে রুমাল চেপে অজ্ঞান করে কয়েকজন যুবক ওকে তুলে নিয়ে যায়। পরের দিন সকালে যখন ওর জ্ঞান ফেরে তখন ও হাসপাতালে। ওর মানিব্যাগে তিন হাজার টাকা ছাড়া আর কিছু নেয়নি।"
"সাতরাস্তার মতো জনবহুল যায়গা থেকে কাউকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেল মাত্র তিনহাজার টাকার জন্য? বিষয়টা আজব না?"
"আজব। কিন্তু এর সাথে এই কেসের কি সম্পর্ক?" চিন্তিত কন্ঠে বলে শিরিন।
"সম্পর্ক তো আছেই, জীবনে প্রত্যেকটি ঘটনা একটির সাথে অন্যটি সম্পৃক্ত। যাই হোক, এবার মুল প্রসঙ্গে আসি। শাহরিয়ার কবির খানকে আপনি নিশ্চয়ই চেনেন?"
শিরিন হ্যাঁবোধকভাবে মাথা নাড়ে।
"শুনেছি কবির ছোটবেলায় অনাথ হয়ে যায়, আপনারাই ওকে লালন পালন করেছেন?"
"হ্যাঁ।"
"আপনাদের স্নেহ ভালবাসার প্রতিদান ঐ বেইমান শুয়োরটা এভাবে দিল? আপনাদেরই মেয়েকে অপহরণ ও ধর্ষণ করে?" বলতে বলতে শিরিনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সোয়েব। শিরিনকে তার কাছে খুব নরম মনের মানুষ বলে মনে হয়, এমন মানুষের কাছে থেকে সত্যটা বের করে আনা কঠিন ব্যাপার নয়, সোয়েব তারই চেষ্টা করে।
শিরিন কোন কথা না বলে মাথা নিচু করে থাকে। সোয়েব বলতে থাকে "ত্রিশটার ওপরে খুন, চল্লিশটার ওপরে ধর্ষনের অভিযোগ আছে। ফাঁসি তো হবেই পিশাচটার, যদি আমার ক্ষমতা থাকতো তবে ফাঁসি না দিয়ে শুয়োরটাকে হাত পায়ে পেরেক মেরে কোন উঁচু টাওয়ারে ঝুলিয়ে দিতাম। কাক শকুন যখন জ্যান্ত অবস্থায় চোখ উপড়ে খেত তখন উপযুক্ত শাস্তি পেত।"
"দয়া করে চুপ করুন আপনি।" মিনতি করে বলে শিরিন।
"কেন? আপনার কি কবিরের প্রতি এখনো মায়া আছে। যদি ঐ পিশাচটার প্রতি মায়া দয়া কিছু অবশিষ্ট থাকে তবে শুনুন, পুলিশের তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী কবির তার দলবল নিয়ে হোটেলে হামলা করে স্নিগ্ধাকে অপহরন করে। নিজের আস্তানায় নিয়ে গিয়ে বন্দি করে স্নিগ্ধাকে দিনের পর দিন ধর্ষন করে। শুধু নিজে ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, নিজের দলবল দিয়ে দিনের পর দিন গণধর্ষন করায়। স্নিগ্ধার প্রতি এতো শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন করে যে ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।" তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে সোয়েব।
"সব মিথ্যা, সব বানোয়াট। আমার কবির ডাকাত হতে পারে না, ও কারো ক্ষতি করতে পারে না। ও স্নিগ্ধাকে অপহরণ করেনি। স্নিগ্ধা নিজের ইচ্ছায় ওর সাথে গেছে। ওরা একে অপরকে ভালবাসে। স্নিগ্ধা নিজে আমাকে কল করে বলেছে।"
"এ কথা আমাকে আগে বলেন নি কেন?"
"কি করে বলি বাবা, ওরা যে স্নিগ্ধাকে খুন করবে তাহলে। কি করব বাবা, না পারছি মুখ খুলতে না পারছি চুপচাপ সইতে।" বলতে বলতে কেঁদে ফেলে শিরিন।
"কাঁদবেন না মা, শক্ত হোন।"
"আমি আর চুপ থাকবনা, সত্যি সত্যি সবকিছু বলে দেব। তাতে আমার মেয়ের যা হয় হবে।" চোখ মুছতে মুছতে বলে শিরিন।
"দেখুন, আমি এই কেসের ইনচার্জ নই। এর তদন্তের দায়িত্ব আমার কাঁধে ছিল না। কিন্তু এই কেসের পেছনে বিশাল ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরে আমি ছুটি নিয়ে নিজের তাগিদে তদন্তে নেমে পড়ি। এখানে আসার আগেই আমি কবিরের নির্দোষ হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত ছিলাম। আপনার মুখ থেকে সত্য শোনার জন্যই এই নাটকটি আমি করেছি, ক্ষমা করবেন। আপনি আমার প্রতি ভরসা রাখতে পারেন। আমি আমার সবটা দিয়েই চেষ্টা করব যেন কবির আর স্নিগ্ধার কোন ক্ষতি না হয়। তবে আপনার এই মুহুর্তে চুপ থাকাই উচিত, পুলিশ বা মিডিয়া সবার কাছেই। তবে কখনো যদি আদালতে কথা বলার সুযোগ আসে তবে সবকিছু সত্যি সত্যি খুলে বলবেন। মনে রাখবেন আদালতে সত্যটা খুলে বললে ওরা স্নিগ্ধার ক্ষতি করার সাহস পাবে না।"
একটু থেমে পকেট থেকে ভিজিটিং কার্ড বের করে বলে সোয়েব, "এই কার্ডটি রাখুন, যেকোন সমস্যায় যোগাযোগ করবেন। আর আমার বিষয়ে কাউকে বলবেন না। না আপনার স্বামীকে না জামাইকে। বিশেষ করে জামাইয়ের ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন। জিল্লুর রহমান ওনাকে কোম্পানির সিইও পদে প্রমোশন দিয়েছে। কেন তা আশা করি আন্দাজ করতে পারবেন।"
সোয়েবের ঘুম ভেঙে যায় রিংটোনের আওয়াজে। ফোনটা রিসিভ করার আগেই কেটে যায়। সোয়েব বিছানায় বসে এক হাতে চোখ ডলতে ডলতে হাতে নেয় ফোনটা, আটটা মিসডকল, সবগুলোই সুমির। সোয়েব কল ব্যাক করে।
"সেই কখন থেকে কল করছি, রিসিভ করছ না কেন?" সুমি বলে।
"ঘুমিয়েছিলাম।"
"এই অবেলায় ঘুম? শরীর খারাপ নাকি?"
"শরীর খারাপ না তবে খুব ক্লান্ত। একটা দিন জার্নির ওপর ছিলাম তো তাই। এখন ঠিক আছে, লম্বা ঘুম দিলাম তো, শরীরটা এখন ঝরঝরে লাগছে।"
"আমাকে নিতে আসবে কবে?" সুমি বলে।
"আর কয়েকটা দিন থাকোই না। ওখানে ভাল লাগছে না?"
"তা নয়, কিন্তু বাইরের খাবার খেয়ে খেয়ে আবার তুমি অসুখ বাধিয়ে ফেলবে।"
"কয়েকদিন বাইরের খাবার খেলে কিচ্ছু হবে না। তবে তোমাকে ছাড়া আমার একদম ভাল লাগছে না, পরশুদিন তোমাকে নিয়ে আসব।" একটু থেমে সোয়েব আবার বলে।
"মা কোথায়?"
"পাশের বাসায় গেছে। একটু আগে ফোন ধরলেই পেতে। আচ্ছা রাখি, আর বাইরের হাবিজাবি একদম খেও না, আর নিজের যত্ন নিও।"
"তুমিও।" বলে সোয়েব কেটে দেয়। তারপর বিছানা ছেড়ে ওঠে সে। ওয়াসরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে বাংলোর সামনের বাগানে গিয়ে হাঁটাহাটি করে কিছুক্ষন। গতকাল বগুড়া থেকে যখন সাভারে তার বাংলোয় ফিরে এসেছে তখন রাত এগারোটা, এসেই কোন মতো পোশাক ছেড়ে রাত পোশাক পরে বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে যায়। ঘুম থেকে যখন ওঠে তখন দুপুর বারোটা। গোসল ও লাঞ্চ সেরে আবার ঘুমিয়ে পড়ে সোয়েব, ওঠে বিকেল পাঁচটায়।
বাগানে হাঁটতে হাঁটতে কবিরের কেসটার ব্যাপারেই ভাবছিল সে, জিল্লুর রহমানের মতো ক্ষমতাবান ধনী ব্যাক্তির সাথে টক্কর দিয়ে সফল হওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার না। প্রতিটি পদক্ষেপ চিন্তাভাবনা করে নিতে হবে। অন্যদিকে কবিরের রিমান্ডের আজকেই শেষ দিন, এরমধ্যে যদি ওর স্বীকারোক্তি যোগাড় করে নেয় তবে কেসটা আরো জটিল হয়ে যাবে। সোয়েব তার ইউনিফর্ম পরে নিয়ে বেরিয়ে যায় মিরপুর থানার উদ্দেশ্যে। থানায় পৌঁছে সোয়েব মইনুলকে তার চেয়ারে বসে মনোযোগ দিয়ে ফাইল ঘাঁটাঘাটি করতে দেখে। সোয়েবকে দেখে দাঁড়িয়ে সেলুট দেয় সে। সোয়েব তার ডেস্কের সামনের চেয়ারে বসে পড়ে।
"ভাল আছেন স্যার? ছুটি কেমন কাটল?" মইনুল বলে।
"ভাল। তা তোমার জিজ্ঞাসাবাদ কেমন চলছে?" সোয়েব বলে।
"জিজ্ঞাসাবাদ! ও ঐ ডাকাতের কেসটার কথা বলছেন স্যার? খুব ঘাঘু মাল স্যার, মেরে ফাটাফাটা করে ফেলি তবু মুখ খোলে না। মনে হচ্ছে আরো সাতদিন লাগবে। রবিবার কোর্টে তুলে রিমান্ড চাইব। তারই ফাইলপত্র তৈরী করতেছি।" মইনুল বলে।
"বেশি মারোনি তো আবার, মরে গেলে আবার অন্য ঝামেলা।" সোয়েব বলে।
"মরবে না স্যার, এদের কই মাছের জান।" মইনুল বলে
"তোমার তো ডিউটি শেষ?"
"জি স্যার।"
"যাবার আগে নাইট ডিউটির ফাইলটা আমার চেম্বারে দিয়ে যেও।"
"জি স্যার।"