একাদশ পর্বঃ অপ্রকাশিত বন্ধন।
কাজের চাপ ভীষণভাবে বেড়ে যায়, প্রায় দিন অফিসে রাত কাটাতে হয়। বাড়ি ফিরলেও শুধু মাত্র স্নান আর একটু ঘুমানোর জন্য। পুনে থেকে ফিরে ঝিলামের সাথে দেখা করা হয়ে ওঠে না। ওর সান্নিধ্যে যদি ঝিলামের প্রতি কোন বিরূপ আচরন করে সমীর, তাহলে ঝিলাম বুধাদিত্যকে দোষারোপ করবে ওদের সুখের সংসারে আগুন লাগানোর জন্য। মাথার মধ্যে শুধু ঝিলামের চিন্তা ঘুরে বেড়ায়। একবারের জন্য মনে হয় যে মোবাইলে তোলা ছবি, ভিডিও আর ওদের কথোপকথন ঝিলামকে শুনিয়ে দেয়। কিন্তু ভয় হয়, সব শুনে ঝিলাম যদি আত্মহত্যা করে ফেলে তাহলে? বেশ কিছু দিন এমন ভাবে কেটে যায়। কোনদিক থেকে কোন খবরাখবর আসে না। প্রত্যেক দিন ভাবে এই ঝিলামের ফোন আসবে, কিন্তু সেই খবর আর আসে না। একবার ভাবে যে সমীরের বাড়ি যাবে দেখে আসবে ঝিলামকে, কিন্তু সমীরের শেষ বাক্য ওকে বাধা দেয়। সমীর সেই আগের তেলু নেই, অনেক বদলে গেছে, অনেক হিংস্র আর কুটিল হয়ে উঠেছে।
গ্রীষ্মকাল, সকাল বেলার কাঠ ফাটা রোদ শান্ত পরিবেশ ঝলসে দেয়। সবে অফিস পৌঁছেছে বুধাদিত্য, এমন সময়ে ঝিলামের ফোন আসে। গলার স্বর শুনে মনে হলো, খুব ক্লান্ত। ওর ক্লান্ত গলার আওয়াজ শুনে বুধাদিত্যের বুক হুহু করে ওঠে। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে ঝিলাম কোথায়? ঝিলাম জানায় যে স্কুলে এসেছে কিন্তু স্কুল করার ইচ্ছে নেই ওর। ব্যাগ হাতে করে বেরিয়ে পড়ে বুধাদিত্য, ঝিলামের গলার স্বর শুনে মনে হয় আর অফিস করে দরকার নেই, এবারে কিছু একটা বিহিত করা উচিত।
ঝিলাম স্কুলের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল, কাঁধে ব্যাগ, পরনে হাল্কা নীল রঙের সুতির শাড়ি। দূর থেকে দেখলে সবাই সুন্দরী বলবে, কিন্তু শুধু বুধাদিত্য জানে যে ওই কাজল কালো দু’চোখের পেছনে লুকিয়ে আছে হৃদয় ভাঙার শত সহস্র টুকরো। বুধাদিত্যের গাড়ি দেখে ছোটো পায়ে এগিয়ে এসে, গাড়ির দরজা খুলে সামনের সিটে এসে বসে পড়ে। চোখের পাতা ভিজে, ফর্সা গাল লাল, নাকের ডগা লাল। চোখে দেখে মনে হলো যেন ঘুম হয়নি গত রাতে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে বুধাদিত্য। ঝিলাম মাথা নিচু করে আঙুলের নখ খোঁটে কিছুক্ষণ। তারপরে ওর দিকে জলভরা চোখে তাকিয়ে বলে, “একটু বিষ দিতে পারো আমায়?”
চোয়াল শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্যের, চাপা গলায় বলে, “শুয়োরের বাচ্চাটা কোথায়?”
ঝিলাম উলটো হাতে চোখের কোল মুছে উত্তর দেয়, “আজ সকালের ফ্লাইটে বম্বে গেছে, এবারে নাকি অনেক লম্বা টুর। বম্বে থেকে আরও অনেক জায়গা নাকি যাবার আছে। ফিরবে সাত আট দিন পরে।”
ঝিলাম রাতের কথা বলতে শুরু করে। বেশ কয়েকদিন ধরে সমীর রোজ রাতে মদে চুর হয়ে আসে। ঝিলাম কিছু বলতে গেলেই ওকে বলে যে, ঝিলাম নিজের মতন থাকতে পারে আর ওকে যেন ওর কোন চালচলন নিয়ে না ঘাঁটায়। সমীর সোজাসুজি ঝিলামকে জানিয়ে দেয় যে পরস্পরের যৌনজীবন যেন কেউ আঘাত না করে। ঝিলামের সাথে তুমুল ঝগড়া হয় সমীরের, সারা রাত দুজনের কেউ ঘুমায়না। রাতে একবার বুধাদিত্যের কথা মনে পড়েছিল ঝিলামের, ফোন করতে যায়। কিন্তু সমীর ধমকে ওঠে, হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বলে বুধাদিত্য ওর মাথা খেয়েছে, এর মধ্যে যেন ওকে না ডাকা হয়।
ডুকরে কেঁদে ওঠে ঝিলাম, শেষ পর্যন্ত সমীর ওকে বলে যে যদি ডিভোর্স চায় তাহলে সমীর ওকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে। সেই শুনে ওর পায়ের নিচের মাটি সরে যায়। আত্মহত্যা করার ভয় দেখিয়েছিল; সেই শুনে সমীর বলে আত্মহত্যা করতে হলে যেন ও চলে যাবার পরে করে। সকালবেলা চলে যাবার আগে জানিয়ে যায়, যে টুর থেকে এসে বাড়ির লোকজন ডেকে একটা বিহিত করবে। ঝিলাম জানায় যে ওর বাবা মা হয়তো সব শুনে ওকে বলবে চাকরি ছেড়ে স্বামীর সেবা করতে। এত সব হয়ে যাবার পরে সেটা করতে পারবে না ঝিলাম।
দুচোখে অঝোর ধারায় জল পড়ে যায়, কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমার আজকাল ওর সাথে কথা বলতে, এক ছাদের নিচে থাকতে পর্যন্ত খারাপ লাগে। মনে হয় দুটি অজানা অচেনা প্রাণী এক ঘরের মধ্যে আটকে পড়ে আছে। দম বন্ধ হয়ে যায় আমার।”
বুধাদিত্য চুপ করে সব কথা শুনে তারপরে বলে, “শুয়োরের বাচ্চাটা আসুক তারপরে একটা বিহিত করা যাবে।”
বুধাদিত্য গাড়ি চালিয়ে ঝিলামের বাড়ির নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। ঝিলাম চুপ করে গাড়িতে বসে থাকে। বুধাদিত্য ওর কাঁধে হাত রাখে, ওর হাতের পরশে কেঁপে ওঠে ঝিলাম।
চোখে জল, ঠোঁটে একটু খানি হেসে নিয়ে বুধাদিত্যের দিকে তাকিয়ে বলে, “খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার। তোমাকে বলে মনের দুঃখ কেটে গেছে। আমাকে আবার স্কুলে পৌঁছে দিয়ে এসো।”
বুধাদিত্য হেসে ফেলে, “পাগলি মেয়ে কোথাকার।” কাঁধের গোলায় আলতো চাপ দিয়ে বলে, “ঠিক করে বলো, আবার স্কুলে গিয়ে বলবে যে বাড়ি নিয়ে যাও তাহলে কিন্তু রাস্তার মাঝে ছেড়ে দেবো।”
চোখের জল মুছে হেসে ফেলে ঝিলাম, “না সত্যি বলছি। ফালতু একটা সি.এল মেরে লাভ নেই, আমাকে স্কুলে ছেড়ে দাও প্লিস।” ঝিলামের চোখ মুখ কুঁচকে “প্লিস” বলাতে, বুধাদিত্যের মনে হলো জড়িয়ে ধরে ওই লাল গোলাপের কুঁড়ির মতন ঠোঁটে চুমু খায়।
অগত্যা বুধাদিত্যকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে আবার স্কুলে ফিরে যেতে হয়। স্কুলের গেটের সামনে নামিয়ে দিয়ে বুধাদিত্য ঝিলামকে পেছন থেকে ডেকে বলে, “ঝিল্লি, স্কুল শেষ হলেই অফিসে চলে এসো।”
ঝিলাম ওর কথা শুনে মাথা নাড়ায়, হ্যাঁ। কিন্তু পরক্ষনে কানে বেজে ওঠে “ঝিল্লি” নাম। থমকে দাঁড়িয়ে বুধাদিত্যের দিকে তাকায় বড় বড় চোখ করে। বুধাদিত্যের খেয়াল হয় যে ঝিলামকে আদর করে “ঝিল্লি” বলে ডেকে ফেলেছে, দাঁত চেপে হেসে ফেলে। ঝিলাম নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে চোখের লাজুক ভাব লুকিয়ে গেটের ভেতরে ঢুকে যায়।
সারা সকাল কাজে মন বসাতে পারে না বুধাদিত্য, ল্যাপটপ সামনে খোলা। অগুনতি মেইল আসে, কয়েকটার উত্তর দেয়। মাঝে মাঝেই ঘড়ি দেখে, কখন দুটো বাজবে আর ঝিলাম ওকে এসে ডাক দেবে। সময় যেন কাটতে চায় না আর। অফিসের কয়েকজনের সেই ইতস্তত ভাব চোখে পড়ে যায়। অনেকেই জিজ্ঞেস করে, সুকৌশল উত্তর দিয়ে এড়িয়ে যায় সবার প্রশ্ন।
ঠিক লাঞ্চের পরেই ঝিলামের আবির্ভাব। চেহারার বিষণ্ণ ভাব কেটে বেশ খুশির জোয়ার খেলে বেড়ায়। স্কুল থেকে রোদে হেঁটে আসার ফলে ফর্সা ঝিলাম লাল হয়ে গেছে। বুধাদিত্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওর গালের লালিমা উপভোগ করে। বড় বড় চোখ করে ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে যে কি দেখছে? মিচকি হেসে ফেলে বুধাদিত্য। গাড়িতে করে ঝিলামকে বাড়িতে নিয়ে যায়।
বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে ঝিলামকে বলে, “একা একা বাড়িতে থাকবে?”
ঝিলাম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “কি করবো আর, এর পর থেকে একাই হয়তো কাটাতে হবে।”
সেই দীর্ঘশ্বাস বুধাদিত্যের বুকে বড় বাজে, একটু নিচু গলায় বলে, “যদি কিছু মনে না করো তাহলে একটা কথা বলতে পারি।” ঝিলাম ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কি কথা? বুধাদিত্য একটু ইতস্তত করে বলে, “জামা কাপড় প্যাক করে আমার বাড়িতে চলে এসো।”
বুধাদিত্যের সাহস দেখে ক্ষণিকের জন্য থমকে যায়। তারপরে হেসে ফেলে বলে, “বিকেলে অফিস ফেরত আমাকে নিয়ে যেও, আমি তৈরি থাকবো।”
উত্তর শুনে বুধাদিত্যের হৃদয় খুশিতে নেচে ওঠে। দু’চোখ চকচক করে ওঠে, কিন্তু চোয়াল শক্ত করে সেই অভিব্যক্তি চেহারার ওপরে আনতে দেয় না। ঝিলামের চোখ এড়ায় না, ওর দুই চোখের ভাষা। ঝিলাম ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজের খুশি চেপে রাখে। ঝিলাম ফ্লাটে ঢোকার জন্য পা বাড়ায়, বুধাদিত্য দাঁড়িয়ে থাকে গাড়ির কাছে। সুন্দরী অপ্সরা যতক্ষণ না দরজা দিয়ে ঢুকে যায়, ততক্ষণ চেয়ে থাকে ওর যাওয়ার পথে। অফিসে ফিরে কাজে মন বসাতে চেষ্টা করে বুধাদিত্য। এর মাঝে সি.টি.ও ডাক আসে, কিছু প্রেসেন্টেসানের জন্য। এক ঝটকায় ঝিলামকে মাথার থেকে বের করে আবার কাজে ডুবে যায়। হাতে দু’দুটো প্রোজেক্ট, একটা অস্ট্রেলিয়ার, একটা পুনের, মাথায় বাজ পড়েছে। দ্বিতীয় অর্ধে কাজে ডুবে গিয়ে সময়ের দিকে আর খেয়াল থাকে না বুধাদিত্যের।
সময়ের খেয়াল পড়ে ঝিলামের ফোনে। ওপাশ থেকে ধমকে ওঠে “ঝিল্লি”, “সাড়ে ছটা বাজে, সময়ের খেয়াল আছে? আমাকে নাকি নিতে আসছিলে? কোথায় মরতে বসেছো?” বুধাদিত্যের তখন খেয়াল পরে যে ঝিলামকে নিয়ে বাড়ি যেতে হবে। একদম ভুলে গেছিল সে কথা। বুধাদিত্য ক্ষমা চাইতেই ঝিলাম অভিমানী সুরে ধমক দেয়, “সব পুরুষ মানুষ এক রকমের। দেরি হবে তা একবার ফোন করে জানাতে পারোনি? আর আসতে হবে না তোমাকে।” ভীষণ রেগে গেছে ঝিলাম, রেগে মেগে ফোন রেখে দেয়।
বুধাদিত্য তড়িঘড়ি করে ব্যাগ কাঁধে ফেলে গাড়ি ছুটিয়ে দেয়। খুব ভয়ে ভয়ে দরজায় টোকা মারে। অভিমানিনী ঝিলাম দরজা খুলে ভেতর দিকে হাঁটা দেয়। ঝিলামের চুড়িদারের ওড়না দরজার ছিটকিনিতে আটকে টান পড়ে যায়। ঝিলাম কেঁপে ওঠে এক অজানা ভয়ে, একা পেয়ে বুধাদিত্য ওর সতীত্ব হরন করতে চলেছে? রেগে মেগে চেঁচিয়ে ওঠে ঝিলাম, “তোমার এত সাহস যে আমাকে একা পেয়ে শেষ পর্যন্ত...” হাত উঠিয়ে বুধাদিত্যকে থাপ্পড় মারতে যায়। থাপ্পড়টা হাওয়ায় ঘুরে দরজায় লাগে। বুধাদিত্য কিছুই বুঝতে পারেনা। পেছনে দাঁড়িয়ে ঝিলামের এই অদ্ভুত আচরনের মানে খুঁজতে চেষ্টা করে। ঝিলাম দরজায় থাপ্পড় মারার পরে বুঝতে পারে যে ওড়না ছিটকিনিতে আটকে গেছে। লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে ওড়না ছিটকিনি থেকে খুলে নেয়। বুধাদিত্য হেসে ফেলে ওর লাল নাকের ডগা দেখে।
বুধাদিত্য, “তোমার মারা পেটা হয়ে গেলে, একটু বাড়ির দিকে রওনা দিতে পারি।”
খিলখিল করে হেসে ফেলে ঝিলাম, পেছনে সরে গিয়ে ওকে সোফার ওপরে বসতে বলে। মাথা তুলে বুধাদিত্যের চোখে চোখ রাখতে লজ্জা করে, নিজের আচরনের জন্য। রান্না ঘর থেকে দু’কাপ কফি নিয়ে এসে ওর হাতে ধরিয়ে দেয় এক কাপ। মিষ্টি লাজুক গলায় ওকে বলে, “একটু বসো, আমি এখুনি তৈরি হয়ে আসছি।”
বুধাদিত্য, “আর কি তৈরি হবে, ভালোই তো কাপড় পরে আছো বেশ তো লাগছে। একে গাড়িতে তো যাবে, পায়ে হাওয়াই চটি পরে গেলেও কেউ জানতে পারবে না।”
হেসে ফেলে ঝিলাম, “দাঁড়াও বাবা, এখুনি অফিস থেকে এসেছো, একটু তো বসবে নাকি?”
বুধাদিত্য, “সে তো ওই বাড়ি গিয়েও বসা যাবে।”
ঝিলাম মাথা নাড়ায়, “তুমি না সত্যি... ঠিক আছে চলো।” নিজের ঘর থেকে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
সারাটা রাস্তা ঝিলামের কল্লোলে বুধাদিত্যের কান গুঞ্জরিত হয়। সারাদিনের স্কুলের গল্প বলতে শুরু করে। গাড়ি চালায় আর আড় চোখে দেখে ঝিলামকে। অর্ধেক কথা কানে যায়, অর্ধেক কথা কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। বুধাদিত্য শুধু তাকিয়ে থাকে ওর লাল ঠোঁটের দিকে, তোতাপাখীর মতন কিচিরমিচির করে কথা বলছে আর নড়ছে, সেই সাথে নরম পাতলা আঙুলের নড়াচড়া। শরীরের সুগন্ধে গাড়ির ভেতর ভরে গেছে, ওই মাদকতাময় রুপের কাছে হার মেনে গেছে বুধাদিত্য। পুরানো ঝিলাম ফিরে এসেছে এক নতুন ভাবে। পারলে বুকের এক কোনায় লুকিয়ে রেখে দেবে এই তরঙ্গিণীকে।
প্রচন্ড গরম, ঘরে ঢুকেই এসি চালিয়ে দেয় বুধাদিত্য। ঝিলামের থাকার জন্য বুধাদিত্য নিজের শোয়ার ঘর ছেড়ে দেয়। প্রথমবার নিজের শোয়ার ঘরে অন্য একজনের পায়ের ছাপ। ঝিলাম ওকে জিজ্ঞেস করে কোথায় শোবে, উত্তর বুধাদিত্য জানায় যে গেস্ট রুমে থাকবে এই কটা দিন। বুধাদিত্য ওর ব্যাগ আলমারিতে ঢুকিয়ে রেখে নিজের জামা কাপড় নিয়ে বেরিয়ে যায়। ঝিলাম বাথরুমে ঢুকে পড়ে। বুধাদিত্য মনের মধ্যে আনন্দের খই ফোটে, অবশেষে ভালোলাগার রমণী ধরা দিয়েছে। কয়েকটা দিনের জন্য হলেও, চোখের সামনে থাকবে “ঝিল্লি”। হাত মুখ ধুয়ে বারমুডা আর গেঞ্জি পরে বসার ঘরে বসে থাকে। মন বারেবারে উঁকি মারে শোয়ার ঘরে, ঝিলামের অপেক্ষায় এক মিনিট যেন এক বছর বলে মনে হয়। কাঁধে তোয়ালে, চোখ মুখ তরতাজা, সকালের বিষণ্ণতার লেশমাত্র নেই শরীরে। সারা অঙ্গে এক নতুন মাদকতা, এক নতুন প্রাণশক্তি নিয়ে ঝিলাম বেরিয়ে আসে বাথরুম থেকে। পরনে একটা ঢিলে টপ আর গাড় নীল রঙের স্লাক্স। ওর যৌবনের ডালি ফুলে ফুলে ভরা। সেই রুপসুধা দুই চোখে আকণ্ঠ পান করে বুধাদিত্য।
ঝিলাম ফ্রিজ খুলে বলে, “কাঁচা বাজার তো কিছু নেই, একটু বাজারে গিয়ে কিছু নিয়ে এসো।”
বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে, “খাসির মাংস নিয়ে আসি?”
ঝিলাম আলতো ধমক দেয়, “এই গরমে খাসির মাংস খেতে হবে না। পারলে সি.আর.পার্ক না হয় গোবিন্দপুরি থেকে ট্যাঙরা মাছ নিয়ে এসো।”
বুধাদিত্য, “আমি ট্যাঙরা ফ্যাংরা চিনিনা, কাটা কাতলা না হলে রুই নিয়ে আসবো।”
ঝিলাম, “চেনোটা কি, তাহলে? বাঙালি হয়ে মাছ চেনো না?”
বুধাদিত্য, “ছোটোবেলা থেকে হস্টেলে মানুষ, মাছ চেনাবার মতন কেউ কোনদিন পাশে ছিলো না।”
ঝিলামের মনে পড়ে যায় বুধাদিত্যের অতীতের কথা। মন কেমন করে ওঠে ওর চোখ দেখে, মিষ্টি গলায় বলে, “আজ তাহলে সামনে থেকে কিছু কাঁচা বাজার করে নিয়ে এসো, কাল মাছের বাজার যাওয়া যাবে।”
বুধাদিত্য, “যথাআজ্ঞা ঝিল্লিরানী।” খিলখিল করে হেসে ফেলে ঝিলাম, ওর মুখে “ঝিল্লি” নাম শুনে বুকের ভেতরে প্রজাপতি পাখা মেলে নেচে ওঠে। বুধাদিত্য গায়ে একটা টিশার্ট পরে বাজারে বেরিয়ে যায়। সাধারণত সপ্তাহে একদিন বাজার করলে ওর চলে যায়, কিন্তু এবার থেকে মনে হয় ঝিলাম প্রত্যকে দিন বাজারে পাঠাবে। কাঁচা সবজি কিনে বাড়ি ফিরে দেখে রান্না ঘরে ঝিলাম। ঘরে যা ছিল তাই দিয়ে রাতের খাবার তৈরি করে ফেলেছে প্রায়। বুধাদিত্যকে দেখে বলে, সবজিগুলো ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিতে। রাতে তাড়াতাড়ি খেতে হবে। বুধাদিত্য মুখ কাঁচুমাচু করে জানায় যে রাত দশটা এগারোটার আগে ও খায় না। ধমকে দেয় ঝিলাম, রাতে তাড়াতাড়ি খেতে হয় তারপরে না হয় টিভি দেখতে পারে বা নিজের কাজ করতে পারে। ঝিলামকে সকালে উঠতে হয় স্কুল যাবার জন্য। পরেরদিন শনিবার, ছুটি, কি করবে অত সকালে উঠে, সেই শুনে ঝিলাম একটু শান্ত হয়। বুধাদিত্য কাতর চোখে এক কাপ কফির আবেদন করে, ঝিলাম কপট রেগে জানিয়ে দেয় এত রাতে কফি খেলে ভাত খেতে পারবে না। বুধাদিত্য বুঝতে পারে যে ওর জীবনের অঙ্ক এক নতুন খাতায় আঁচড় কাটতে শুরু করেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিলামকে দেখে যায়। হাঁটুর নিচ থেকে গোড়ালি পর্যন্ত খালি, ফর্সা পায়ের গুলির মসৃণ ত্বক আলোতে চকচক করছে, পরনের কাপড় এঁটে বসে ওর কোমরের নিচে। জড়িয়ে ধরে ওর ফর্সা গোলাপি গালে চুমু খেতে ইচ্ছে করে। কোনোরকমে সেই মনোবৃত্তি সামলে নেয়।
রাতের খাওয়া দাওয়া ঝিলামের চাপের ফলে তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে হয়। খাওয়ার পরে নিজের ঘরে ঢুকে যায় ঝিলাম।
ঝিলাম, “এসি বন্ধ করে দাও, এই দুদিনে এসিতে থেকে আমার অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে। পরে তো আর এসি পাবো না।”
বুধাদিত্য, “আমার অভ্যেস খারাপ করে দিচ্ছ যে? অত সকালে উঠতে পারবো না আমি।”
ঝিলাম, “ঠিক আছে, শুধু ছুটির দিনে ছুটি, উইক ডেইসে কিন্তু আমার সাথে উঠতে হবে।”
বুধাদিত্য, “অত সকালে উঠে আমি কি করবো?”
ঝিলাম, “কাজের লোক সকালে আসে তার সাথে দাঁড়িয়ে থেকে ঘর পরিষ্কার করাবে।”
বুধাদিত্য, “বাপরে, ওই সব আমার দ্বারা হয় না। কুতুব মিনার থেকে লাফ দিতে বললে লাফ দিয়ে দেবো।”
ঝিলাম, “ঠিক আছে তোমাকে দেখতে হবে না। কাল এলে আমি ওকে বলে দেবো বিকেলে আসতে। আমিও স্কুল থেকে ততক্ষণে ফিরে আসবো, তারপরে ওকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেবো।”
বুধাদিত্য, “তাহলে আমার টিফিনের কি হবে?”
ঝিলাম, “স্কুল বের হবার আগে তোমার টিফিন বানিয়ে দিয়ে যাবো।”
বুধাদিত্য ম্লান হেসে বলে, “কতদিন ঝিলাম, কতদিন করবে?”
হটাত ওই কথা শুনে হারিয়ে যায় ঝিলাম। বুকের ভেতর হুহু করে কেঁদে ওঠে, কতদিন এই সুখ? হয়তো ক্ষণিকের। দুজনেই মনের ভাব ব্যক্ত করে না। শুধু চোখে চোখে কথা হয়। ঝিলাম চোখ নিচু করে ঘরের আলো বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। বুধাদিত্য চুপচাপ বসার ঘরে বসে টিভি চালিয়ে দেয়। চোখের সামনে বিশাল টিভির স্ক্রিনে আলাস্কার সবুজ, নীল অদ্ভুত সুন্দর নর্দান লাইটস ঝকমক করছে, মনের ভেতরে ঝিলামের চোখের জল ভেসে যায়। চুপ করে সিগারেট জ্বালিয়ে একটার পর একটা সিগারেট টানতে থাকে। সময়ের খেই হারিয়ে ফেলে বুধাদিত্য, ডিসকভারি চ্যানেলে কি চলছে, কি চলছে না, কিছুই মাথায় ঢোকে না। চিন্তাশক্তি লোপ পেয়ে গেছে ওর, মাথা শূন্য। কি করে ওই ইতর, নীচ, বিশ্বাসঘাতক সমীরের কবল থেকে মুক্ত করা যায় এই ফুলের কুঁড়িকে। একমাত্র উপায়, যদি ওদের ডিভোর্স হয়, না হলে এই জীবনে ঝিলামকে বুকে পাওয়ার স্বপ্ন শুধুমাত্র স্বপ্ন থেকে যাবে। অতি সযত্নে রাখা সেই সুন্দর ইভিনিং ড্রেসিংগাউন আলমারির কোনায় পড়ে থাকবে।
“কি হলো এখন ঘুমাতে যাওনি?” ঝিলামের ঘুম জড়ানো কণ্ঠস্বর শুনে বুধাদিত্য আচমকা সোজা হয়ে বসে। শোয়ার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ঘুমঘুম চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “পারে বটে মানুষটা। রাত একটা বাজে যাও ঘুমাতে যাও। ডিসকভারিতে আর কিছু নতুন দিচ্ছে না।” নিরুপায় বুধাদিত্য, ঝিলামের আদেশের সামনে নিজেকে সমর্পণ করে শুতে চলে যায়।
এতদিন সকাল বেলা একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারতো বুধাদিত্য। সুন্দরী এক নদীর ঝঙ্কারে সকাল থেকে বাড়ি মুখরিত। কাজের লোক সকাল বেলা এসে যায়। তাকে নিয়ে ব্যস্ত বাড়ির নতুন রাজ্ঞী “ঝিল্লি”। বিছানায় শুয়ে আধোঘুমে আধজাগরন, “ঝিল্লি”র কলতান কানে ভেসে আসে, “সারা বরতন ধোকে পেহেলে স্লাব পে রাখ দেনা, ফির পানি ঝড়নে কে বাদ উঠাকে রাখনা।” “ইয়ে সোফাকে নিচে ঠিক সে ঝাড়ু লাগা, উওহ কোনে মে ক্যায় হ্যায়, উধর নেহি কিয়া ক্যা? ইয়হান পোছা মার ঠিক সে, নেহি দুবারা মার।” সেই কলতান মধুর করে তোলে পায়ের নুপুরের আওয়াজ। গতকাল ছিল না, সকালে হয়তো পরেছে। বুধাদিত্য টের পায়, ওর ঘরে ঢুকে ওর গায়ের ওপরে চাদর একটু টেনে দেয়। এসি বন্ধ করে, ফ্যান চালিয়ে দেয়। নিচু স্বরে কাজের লোককে আদেশ দেয়, “সাব কা বিস্তর কে নিচে ঠিক সে ঝাড়ু পোছা লাগা দেনা।” বুধাদিত্য আধাচোখ খুলে নতুন রাজ্ঞীর রুপ দর্শন করে। সকালেই মনে হয় স্নান সেরে নিয়েছে, ভিজে চুল পিঠের ওপরে মেলে ধরা, চেহারায় ভোরের সূর্য ঝলমল করছে পরনে ঢিলে প্যান্ট, গায়ে ঢিলে একটা জামা। ওর চোখ খোলা দেখে মিষ্টি হেসে, ঘুম থেকে উঠতে বলে। মুক্তো সাজানো দাঁতের ঝিলিক দেখে বুধাদিত্য কাতর চোখে আবেদন করে, একটু ঘুমাতে দাও? মাথা নাড়ায় ঝিলাম, ঠিক আছে, কিন্তু মাত্র এক ঘন্টা, ন’টার সময়ে উঠিয়ে দেবে। তাই সই, মাথার নিচের বালিস মাথার ওপরে চেপে ধরে আবার স্বপ্নের মধ্যে ডুবে যেতে চেষ্টা করে বুধাদিত্য। স্বপ্নে তলিয়ে যায় প্রান, তরঙ্গিণীর সুরে তালে নেচে ওঠে পাগল বুধাদিত্য। তপ্ত বালুকাবেলায় আবার জেগে ওঠে ভালোবাসার মরূদ্যান।
“দাঁত মেজে নাও এবারে, কফি বানিয়ে ফেলেছি।” দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আদেশ দেয় ঝিলাম, “কি হলো, ওদিকে ফিরে আর শুতে হবে না। কাল মাংস খাবে বলছিলে? আনতে যাবে না?”
অগত্যা বুধাদিত্য উঠে পড়ে। অর্ধখোলা চোখের সামনে ঝিলামকে দেখে মনে হয় ভাসাভাসা মেঘের আড়ালে দাঁড়িয়ে স্বর্গের অপ্সরা ওর দিকে তাকিয়ে হাসে। কফি হাতে বসার ঘরে বসে ঝিলামকে দেখে, সারা ঘর নেচে বেড়ায় সেই সুন্দরী তরঙ্গিণী। থেকে থেকেই কানে ভেসে আসে ঝিলামের কণ্ঠস্বর, “চা খাও না? শুধু কফি! ধুর, আমার কফি একদম ভালো লাগে না। বিকেলে আমাকে নিয়ে একটু বাজারে বেরিও, অনেক কিছু কেনার আছে।” “শুধু রান্না ঘরটা বড়, হাড়ি কড়া বলতে কিছুই নেই। কি করে কাটালে এত দিন?” “একি, জ্যামটা শুকিয়ে চিনির দলা হয়ে গেছে? খাও না যখন ফালতু কিনতে যাও কেন?” “বরফের ট্রে ভেঙে গেছে, একটা কিনতে পারো না?” “স্টাডি টেবিল সিগারেট খেয়ে পুড়িয়ে দিয়েছো? মরন আমার, অ্যাশট্রে কোথায়?” “ওয়াশিং মেশিনের কভার কোথায়? দাগ পড়ে গেছে সারা গায়ে। বাড়িতে একটা কলিন্স নেই।” একটা কাগজ পেন ছুঁড়ে দেয় ওর দিকে, “একটা লিস্ট বানাও আমি বলছি, বিকেলে কিনতে যেতে হবে।” “জিরে, ধনে, শুকনো লঙ্কা, লঙ্কা গুঁড়ো, কালা মিরচ, যইত্রি, জায়ফল, গোলাপ জল, কালো জিরে, মুগ ডাল, মটর ডাল, ছোলার ডাল, অরহর ডাল, সানফ্লাওয়ার তেল, সরষের তেল...”
বুধাদিত্য লিখে চলে চুপচাপ, ফর্দ তৈরি হয়ে গেলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “আর কিছু বাকি আছে? না না, মনে করে নাও।”
ঝিলাম, “মনে পড়লে আবার বলবো, কাগজটা ওখানে রেখে দিয়ে এবারে দই আর মাংস নিয়ে এসো।”
বুধাদিত্য, “তোমার দরকার পড়লে নিজে লিখে নিও, আমাকে জ্বালাতে যেও না।”
ঝিলাম হেসে বলে, “আহা রাগ দেখ। ঠিক আছে আমি লিখে নেব। উঠে পড়ো আর মাংস আনতে যাও।”
দুপুরে খাওয়ার পরে ঝিলাম বুধাদিত্যকে বলে বিকেলে বাজার করার পরে ওর বাড়িতে নিয়ে যেতে। জানায় যে ওই বাড়ি থেকে আরও জিনিসপত্র আনতে হবে, বুধাদিত্যের রুকস্যাক আর একটা সুটকেস খালি করতে বলে। ঝিলাম জানায় যে ওর একটা বড় আলমারি চাই। বুধাদিত্য বড় আলমারি খুলে দেয়, সারিসারি সুট টাঙানো আর ওর কিছু জামাকাপড় ছাড়া আর কিছু নেই। একপাশে ভাঁজ করে রাখা ঝিলামের দেওয়া সুট পিস। সেটা দেখে ঝিলাম একটু রেগে যায়, বুধাদিত্য জানায় যে সময়ের অভাবে আর সেটা বানানো হয়নি। ফের আদেশ হয় যে বিকেলে বেরিয়ে বাজার করে, সুটের মাপ দিয়ে ওকে যেন একবার ওর বাড়িতে নিয়ে যায়। ঝিলাম ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র বের করে আলমারি সাজিয়ে নেয়।
বিকেল বেলা ঝিলামের সাথে বাজার করতে যেতে হয় অগত্যা বুধাদিত্যকে, তারপরে কালকাজির একটা নামকরা সুটের দোকানে ঢুকে ওর সুটের মাপ দেওয়া হয়। সবশেষে ঝিলামের বাড়ি গিয়ে ব্যাগ আর সুটকেস ভর্তি করে নিজের জিনিস। দুটি ব্যাগ, একটা সুটকেস, একটা মেকআপ বাক্স, সব নিয়ে ভালো করে তালা দিয়ে ঝিলাম বেরিয়ে পড়ে। ওর মুখ দেখে মনে হয় যেন এই বাড়িতে আর পা রাখার মন নেই। সমীর এলে ওর সাথে একটা বিহিত করতে চায়। এই একদিনে ওর মনের জোর অনেক বেড়ে গেছে, ওর পাশে ওর সব থেকে বড় শক্তি দাঁড়িয়ে, বুধাদিত্য।
রাতের খাওয়ার পরে ঝিলাম শোয়ার ঘরে ঢুকে বুধাদিত্যকে ওর মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে। বলে যে সমীরের কাছে শুনেছিল যে ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ে ওর মা মারা যান। সেই শুনে ঝিলাম সেদিন পায়েস বানিয়ে এনেছিল। বুধাদিত্য চুপ করে মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে, ছোটো বেলার কথা মনে পড়ে যায়, মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। চোখের কোনে একচিলতে জল ছলকে আসে। ঝিলাম ওর কাঁধে হাত রাখতেই শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্য। হেসে জানায় যে পুরানো ব্যাথা জাগিয়ে কি হবে। ঝিলাম ওই চোখের আড়ালে ঘন কালো মেঘের দেখা পায়। জিজ্ঞেস করে ওর বাবা কোথায়? চোয়াল শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্যের, ক্রুর চোখে তাকায় ঝিলামের দিকে, মনে হয় যেন ইচ্ছে করেই ধাক্কা দিল ঝিলাম। সুবির গুহকে যত বার ভুলে যেতে চায় ততবার কেউ কেন ওকে মনে করিয়ে দিতে আসে। আরও রেগে যায় যখন দেবস্মিতার মুখ ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। চোয়াল চেপে ঝিলামকে বলে, যে এক সুন্দরী নারীর কবলে পড়ে ওর বাবা ওকে ছেড়ে, ওর মাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। ঝিলামের বুক কেঁপে ওঠে বুধাদিত্যের ব্যাথার কাহিনী শুনে। হাত বাড়িয়ে ওকে ছুঁতে যায়, কিন্তু বুধাদিত্য কারুর অনুকম্পায় বাঁচতে নারাজ। গত চোদ্দ বছরে একা থেকে ওর হৃদয় পাথরের মতন কঠিন হয়ে গেছে। বুধাদিত্য বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। ঝিলাম চুপ করে থাকে, ভাবে একি করে ফেললো।
ঝিলাম ওর পাশে বসে নিচু গলায় বলে, “আমি সরি, আমি জানতাম না এই সব। সত্যি বলছি জানলে আমি আঘাত দিতাম না তোমাকে।”
ম্লান হেসে বলে, “জানি তুমি জানতে না, ঠিক আছে ছেড়ে দাও ও সব কথা। আমি মিস্টার সুবির গুহর ব্যাপারে কোন কথা বলতে চাই না।”
ঘরের আবহাওয়া সেই পুরানো ব্যাথার কাঁপুনিতে বদ্ধ হয়ে ওঠে। ঝিলাম চেষ্টা করে সেই বদ্ধ ভাব কাটিয়ে দিতে, বুধাদিত্যকে বলে, “এই, আইস্ক্রিম খেতে যাবে?”
বুধাদিত্য, “পাগল হলে নাকি? এত রাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আইস্ক্রিম খাবে?”
ঝিলাম, “ধুর বোকা, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কে আইস্ক্রিম খাবে। ইন্ডিয়া গেট গিয়ে আইস্ক্রিম খাবো, প্লিস চলো না, একদম না করবে না।”
কাষ্ঠ হাসি হাসে বুধাদিত্য, “সবাই তাদের বউ না হয় গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ওখানে আইস্ক্রিম খেতে যায়।”
ঝিলাম, “বাঃরে, আমি তোমার বান্ধবী নই? আমি মেয়ে আবার বান্ধবি, ব্যাস ইংরাজি মানে গার্লফ্রেন্ড।” ঝিলাম ইংরাজির শিক্ষিকা, সেও জানে সে কি বলেছে আর বুধাদিত্য জানে সে কি শুনেছে। দু’জনের মুক ভাষা পরস্পরের বুকের মাঝে হাজার বাক্য রচনা করে চলে। ঝিলাম দৌড়ে গিয়ে ঘর থেকে নিজের জন্য একটা স্টোল আর বুধাদিত্যের জন্য একটা টিশার্ট নিয়ে আসে। স্টোল নিজের গলায় জড়িয়ে ওর হাতে টিশার্ট ধরিয়ে দিয়ে বলে, “চলো।”
হাঁ করে তাকিয়ে থাকে বুধাদিত্য, “সত্যি তুমি যাবে?” আপাদমস্তক একবার ঝিলামকে দেখে নেয়। ঢিলে প্যান্ট ঢিলে শার্ট, মাথার চুল একটা রবার ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে নেয়। ঝিলাম ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে বলে, চলো, দাঁড়িয়ে কেন? নিজের পরনে শুধু একটা বারমুডা আর টিশার্ট।
ইনোভা দাঁড় করায় রাজপথে। রাত প্রায় এগারোটা বাজে, সারা দিল্লী ঘুমিয়ে শুধু রাজপথে লোকের ভিড়, সবাই গাড়ি চেপে এসেছে এখানের হাওয়া খেতে আর আইস্ক্রিম খেতে। হলদে আলো সাড় বেঁধে দাঁড়িয়ে, ইন্ডিয়াগেটের অমর জওয়ান জ্যোতি থেকে সেই প্রেসিডেন্ট ভবন পর্যন্ত। চারদিকে লোকের ভিড়। গাড়ি থেকে নেমেই ছোটো মেয়ের মতন দৌড় লাগায় আইস্ক্রিম ঠেলা দেখে। বুধাদিত্য গাড়ি বন্ধ করার আগেই দুটি আইস্ক্রিম কিনে আনে। ঝিলাম গাড়ির পাশে ঠেস দিয়ে মনের আনন্দে আইস্ক্রিম চাটে আর সামনের দিকে তাকিয়ে আলো আর মানুষ দেখে। বুধাদিত্য ভাবে আইস্ক্রিম চাটবে না ঝিলামের ফর্সা গাল। গোলাপি নরম গালে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করে, একটু ছুঁতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছেটা বড় প্রবল হয়ে ওঠে বুধাদিত্যের, ওর দিকে হাত বাড়িয়ে ওর গাল থেকে চুলের গোছা সরিয়ে দেয়। আচমকা গালের ওপরে উষ্ণ হাতের পরশে কেঁপে ওঠে ঝিলাম, ভুরু কুঁচকে বুধাদিত্যের দিকে তাকায়।
বুধাদিত্য মিচকি হেসে বলে, “গালের পাশে একটা কিছু লেগে ছিল সেটা সরিয়ে দিলাম।”
ঝিলাম ছোটো মেয়ে নয়, ওর বোঝার ক্ষমতা আছে যে কোন অছিলায় বুধাদিত্য ওর একটু পরশ চায়। বুকের মাঝে এক অব্যক্ত টান অনুভব করে, বৈধ না অবৈধ জানেনা। ঝিলাম ওর উষ্ণ আঙ্গুলের পরশে একটু গলে যায়, ওর পাস ঘেঁসে দাঁড়ায়। বাজুর সাথে বাজু ছুঁয়ে যায়, শরীরের সাথে শরীর মৃদু চেপে যায়। দুই তৃষ্ণার্ত নরনারীর শরীরে উত্তাপ ছড়াতে বেশি দেরি হয় না। বুধাদিত্যের কঠিন বাজু্র পেশির ওপরে মাথা হেলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বুকের ভেতরে এক নিরাপত্তার ভাব জেগে ওঠে।
ঝিলামকে আলতো ধাক্কা মেরে বলে, “আরও কয়েকটা আইস্ক্রিম কিনে নিয়ে এসো, যাও।”
ঝিলামের মুখে হাসি আর ধরে না, প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, “সত্যি!!!”
বুধাদিত্য মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ সত্যি... যাও তারপরে গাড়ি ওঠ।”
ঝিলাম দৌড়ে গিয়ে আরও দুটি আইস্ক্রিম কিনে নিয়ে আসে। ততক্ষণে বুধাদিত্য গাড়ির মধ্যে উঠে পড়ে। ঝিলাম কাতর চোখে তাকিয়ে অনুরোধ করে যে এখুনি বাড়ি যেতে চায় না। বুধাদিত্য বলে, বাড়ি ওরা যাবে না, আজ একটা লম্বা ড্রাইভে যাবে। সেই শুনে উচ্ছল তরঙ্গিণীর মতন নেচে উঠে গাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে।
ঝিলামের চোখে মুখে আনন্দের ফোয়ারা, প্রানবন্ত সুরে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় যাবো?”
বুধাদিত্য, “সকালে উঠে তোমার স্কুল যাবার তাড়া নেই, আমার অফিস যাবার তাড়া নেই। কাজের লোক আসার তাড়া নেই, ছেলে পিটিয়ে ঘোড়া বানানোর তাড়া নেই, পয়সার পেছনে দৌড়ানোর তাড়া নেই। একদিন সব তাড়া ছাড়িয়ে, এমনি সারা রাত গাড়ি চালাবো, ব্যাস।”
বুধাদিত্যের গাঢ় গলার আওয়াজ ঝিলামকে নিয়ে যায় এক স্বপ্নপুরীতে। চোখের কোনা চিকচিক করে ওঠে, “চলো নিয়ে, দাঁড়িয়ে কেন?”
গাড়ি ছুটিয়ে দেয়, বিকাজিকামা পেরিয়ে, জয়পুর হাইওয়ে ধরে। ঝিলাম গিয়ারের পাস ঘেঁসে বসে থাকে। খালি রাস্তায়, রাত বারোটা, গাড়ি উদ্দাম গতি নিয়ে ছুটতে শুরু করে। বুধাদিত্যের ইচ্ছে করে এই গাড়ি না থামিয়ে ওকে নিয়ে এই সব সংসারের পাঁক থেকে দুরে কোথাও নিয়ে চলে যায়। ঝিলামের শরীরের উত্তাপ ওর কাঁধে এসে লাগে, ঝিলামের মাথার চুল উড়ে এসে ওর চোখে মুখে কালো পর্দা ফেলে দেয়। নাকে ভেসে আসে সুন্দর মাদকতাময় এক ঘ্রান। এসি বন্ধ করে দেয় ঝিলাম, গাড়ির কাঁচ নামিয়ে দিয়ে রাতের হাওয়ায় নিজেকে ভাসিয়ে দেয়। গাড়ি প্রথম টোলগেট পার হবার পরে একশো ছুঁয়ে যায়। সামনের সারি সারি ট্রাক, একের পর এক বাসের লাইন, বুধাদিত্যের গাড়ি আজ উন্মাদ ঘোড়ার মতন ছুটছে। একের পর এক গাড়ি পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়। দ্বিতীয় টোলগেট পার হবার পরে স্পিডমিটারের কাঁটা একশো কুড়ি, একশো তিরিশের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে। ঝিলামের বুকে জেগে ওঠে এক নব মুক্তির স্বাদ, পাশে বসা এই উন্মাদ ঘোড়ার সাথে হারিয়ে যাবার ইচ্ছে প্রবল ভাবে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।
হটাত গুনগুন করে গান গেয়ে ওঠে ঝিলাম, “কেন কিছু কথা বলো না... শুধু চোখে চোখ রেখে, যা কিছু চাওয়ার আমার নিলে চেয়ে, একি ছলনা, একি ছলনা... কেন কিছু কথা বলো না... যত দূর দূর থাকো, শুধু চেয়ে চেয়ে থাকো, সে চাওয়া আমার, আকাশ আমার বাতাস ভরে রাখো, একি ছলনা, একি ছলনা... কেন কিছু কথা বলো না...”
গানটা শুনে বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, গাড়ির গতি ধিরে করে ঝিলামের দিকে তাকায়। ঝিলাম, গাড়ির অন্যদিকের জানালা দিয়ে ছোটো মেয়ের মতন মাথা বের করে গান গেয়ে চলেছে। এ যেন এক অন্য ঝিলামকে দেখছে, বুধাদিত্য। হটাত বাঁপাশ দিয়ে একটা গাড়ি খুব জোরে হর্ন দিয়ে ছুটে আসে। বুধাদিত্য জোরে ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে দেয়। বাঁ হাতে ঝিলামের জামা টেনে ধরে ভেতর ঢুকিয়ে নিয়ে আসে। টানের ফলে ঝিলাম সোজা বুধাদিত্যের বুকের ওপরে আছড়ে পড়ে। গাড়ির গা ঘেঁসে পাশের গাড়িটা ছুটে বেরিয়ে যায়। ঝিলামের হাত ভেঙে যেতো একটু হলে, বুধাদিত্যের জামার কলার চেপে ধরে কেঁপে ওঠে ঝিলাম। ঝিলামের কোমল শরীর ওর বুকের ওপরে চেপে যায়, সারা শরীরে বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে চলে। আসন্ন বিপদ দেখতে পেয়ে ঝিলামের বুক ভয়ে দুরুদুরু কাঁপে। মুখ লুকিয়ে রাখে বুধাদিত্যের প্রসস্ত বুকের ওপরে। নরম গাল চেপে থাকে বুকের পেশির ওপরে, কানে ভেসে আসে বুধাদিত্যের বুকের ধুকপুক শব্দ। সেই শব্দ যুদ্ধের দামামার মতন প্রবল। বুধাদিত্য বাঁ হাতে ঝিলামকে প্রগাড় ভাবে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে থাকে। চিবুক দিয়ে চেপে ধরে ওর মাথা, বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফেলতে চায় এখুনি। সময় থমকে দাঁড়িয়ে পরে দুজনের বুকের মাঝে। চোখ বন্ধ করে সেই উষ্ণতার রেশ সারা অঙ্গে মাখিয়ে নিতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে ঝিলাম, কিন্তু পারেনা শুধু বিবেকের টানাপোড়েনে।
কিছু পরে জামা ছেড়ে ওর বাহু পাশ ছেড়ে নিজেকে ঠিক করে নেয় ঝিলাম। বুধাদিত্যের বুকের ওপরে ওর মিষ্টি গন্ধ, নরম শরীরের পরশ লেগে থাকে। অলঙ্ঘনীয় কোন স্বাদের দিকে হাত বাড়ানোর ছায়া বুকের মধ্যে বিঁধে যায়। গান থামিয়ে, জানালার বাইরে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকে ঝিলাম। চুপচাপ আবার গাড়ি চালাতে শুরু করে দেয় বুধাদিত্য, গাড়ির গতি কমিয়ে দেয়। মনের ভেতরে একটা উদ্দাম ভাব ছিল সেটা হটাত করে উধাও হয়ে গেল। ঝিলামের দিকে তাকানোর শক্তি হারিয়ে ফেলে বুধাদিত্য। সামনের দিকে তাকিয়ে শূন্য বুকে গাড়ি চালায়। কিছু পরে রাস্তা অনেকটা ফাঁকা হয়ে আসে, রাত অনেক গভীর, সামনে আলো যায় কিন্তু ফিরে আসেনা এমন কালো অন্ধকার। উলটো দিক থেকে শুধু ট্রাকের সারি আর গুমগুম আওয়াজ। হুহু করে ওঠে বুকের মাঝে, শূন্য হৃদয় নিয়ে গাড়ি চালাতে থাকে। অনেক পরে মনে হয় একটু ঝিলামকে দেখে। ঘাড় ঘুড়িয়ে লক্ষ্য করে যে ঝিলাম জানালায় হাত রেখে তার ওপরে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। চোখের কোল বেয়ে সরু একটা শুকনো জলের রেখা নাক পর্যন্ত বয়ে গেছে। রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে একটা সিগারেট জ্বালায়। বুক ভরে ধোঁয়া টেনে নেয়, চোয়াল শক্ত করে বলে, এই বুকে এই ধোঁয়া ছাড়া আর কিছু নেই।
বুধাদিত্যের সম্বিৎ ফিরে আসে ঝিলামের মৃদু ডাকে, “সকাল চারটে বাজে, বাড়ি ফিরবে না?”
কেউই পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে পারেনা। ঝিলাম এখনো সমীরের বউ, জানেনা ঝিলামের মনে কি আছে, সোজাসুজি জিজ্ঞেস করার মতন সাহস নেই বুধাদিত্যের। আয়েশার সাথে সঙ্গমের সময়ে বুধাদিত্যের সেই অবৈধ প্রেম বুকের ভেতরে চরম উত্তেজনা জাগিয়ে তুলেছিল। ঋজু বুধাদিত্য, গত চোদ্দ বছর ধরে দুঃসাহসের সাথে লড়াই করে গেছে জীবনের সঙ্গে, কোন বাধা তাকে আজ পর্যন্ত আটকাতে পারেনি, সেটা নারীসঙ্গ হোক, বা জীবনযুদ্ধ হোক। আজ এই ফুলের মতন ললনার সামনে বুধাদিত্য অতিব ভীতু হয়ে যায়। মাথা নিচু করে গাড়িতে উঠে পড়ে বুধাদিত্য। সারা রাস্তা দুজনে চুপচাপ, শুধু মাত্র গাড়ির আওয়াজ ছাড়া আর কিছু কানে যায় না। গাড়ির আওয়াজ ছাড়া দুজনের কানে অন্য এক আওয়াজ ভেসে আসে, ফাঁকা এক হৃদয়বিদীর্ণ কান্নার আওয়াজ।
বাড়ি ফিরে দু’জনে নিজের নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। বুধাদিত্যের ঘুম আর আসেনা, বুকের বেদনা প্রবল হয়ে ওঠে। দরজা, জানালা বন্ধ করে এসি চালিয়ে দেয়, চেষ্টা করে দিনের আলো সরিয়ে দিয়ে রাত নামিয়ে আনতে। চেষ্টা করে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়তে। কিন্তু বাথরুম থেকে জলের আওয়াজে আর ঘুম হয় না। বুঝতে পারে যে ঝিলাম এক জ্বালায় জ্বলছে, জলে ভরা নদী কিন্তু নিজের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য জল তার কাছে নেই। বুধাদিত্য বিছানায় শুয়ে শুনতে পায় ওর নুপুরের আওয়াজ। ঝিলামের চোখে ঘুম নেই, বাড়ির কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে প্রবল চেষ্টা করে। সারা বাড়ি যেন আজ চকচকে করে দেবে। নিজেই ঝাড়ু পোছা শুরু করে দেয়। আলমারি খুলে সব নোংরা বিছানার চাদর, বালিশের কভার, সোফার কভার নিয়ে কিছু ওয়াশিং মেশিনে কিছু নিজের হাতে কাচতে শুরু করে। নিজের ওপরে অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে চলে, মন কিছুতেই শান্ত হয় না। চোয়াল শক্ত করে চোখ বন্ধ করে বিছানায় পড়ে থাকে বুধাদিত্য। বুঝতে পারে যে ওর ঘরে ঢুকে আলমারি খুলে কাপড় চোপড় নিয়ে গেছে। চোখ খুলে ওকে দেখার শক্তিটুকু নেই।
অনেকক্ষণ পরে ঝিলাম ওর ঘরের দরজায় টোকা মেরে বলে, “স্নান সেরে নাও, খাবার তৈরি হয়ে গেছে।”
বুধাদিত্য চুপচাপ বিছানা ছেড়ে উঠে স্নান সেরে খাবার টেবিলে বসে পড়ে। বাড়ির চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখে, অনেক দিন আগে অনিন্দিতাদি এসে সোফার কভার আর ঘরের পর্দা কিনে দিয়ে গেছিলো। সেইগুলো কোথায় পড়েছিল জানতো না, ঝিলাম সেই সবগুলি আলমারি থেকে বের করে ঘর সাজিয়ে ফেলেছে। মেঝে চকচক করছে, টেবিল চকচক করছে, ব্যালকনিতে একগাদা কাপড় মেলে রাখা। আড় চোখে ঝিলামের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করে যে তাঁর মুখ থমথমে, গম্ভির, চোখের কোন চিকচিক, দুই চোখ একটু লাল। টেবিলে একটা থালা তাতে বুধাদিত্যের খাবার বাড়া।
বুধাদিত্য গম্ভির স্বরে জিজ্ঞেস করে, “তোমার থালা কোথায়?”
ঝিলাম গম্ভির স্বরে উত্তর দেয়, “তুমি খেয়ে নাও আমি পরে খাবো।”
বুধাদিত্য, “সকাল থেকে কিছু খাওনি তো, বসলে কি ক্ষতি আছে?”
ঝিলাম ওর কথার উত্তর না দিয়ে বলে, “ভাত ভাঙো, ডাল দেব।”
বুধাদিত্য, “কালকের মাংসের কিছু বেঁচে ছিল সেটা কোথায়?”
ঝিলাম, “সারা রাত ঘুমাও নি, রাতভর গাড়ি চালিয়েছো, সকালে বাড়ি ফিরে ঘুমাও নি। শরীর খারাপ করে মরার ইচ্ছে আছে?”
বুধাদিত্য আর ঘাঁটাতে সাহস পায়না ঝিলামকে। চুপচাপ খেতে শুরু করে। ঝিলামকে উলটো দিকের চেয়ারে বসে ওকে খেতে দেয়। কেউ কারুর চোখের দিকে সোজাসুজি তাকায় না, একজন যখন তাকায় তখন অন্যজনের মুখ অন্যদিকে থাকে। নিঃশব্দে কথা বলে মানসিক দ্বন্দ।
বুধাদিত্য কিছু পরে জিজ্ঞেস করে, “তোমার গরমের ছুটি কবে থেকে?”
ঝিলাম, “কেন?”
বুধাদিত্য, “না, বাড়ি যাবে বলছিলে, তা টিকিট কাটা হয়ে গেছে?”
ঝিলাম, “আসছে শুক্রবার, তারপরের শুক্রবার থেকে ছুটি। সমীরকে বলেছিলাম টিকিট কাটতে, এর মাঝে...” কথাটা বলেই ফর্সা মুখখানি বেদনায় পাংশু হয়ে যায় ঝিলামের। উলটো হাতে নাক মুছে নেয়, চোখের কোনে যে জলের ফোঁটা চিকচিক করছিল সেটা ওর চোখের লম্বা পাতা ভিজিয়ে দেয়। একটু ধরা গলায় বলে, “খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি।”
বুধাদিত্য চুপচাপ খেয়ে উঠে চলে যায়। স্টাডিতে ঢুকে ল্যাপটপ খুলে বসে পড়ে অফিসের কাজ করতে। কাজে মন ডুবিয়ে দিতে চেষ্টা করে। কিছুতেই মন বসাতে পারেনা, চোখের সামনে ল্যাপটপ খোলা পড়ে থাকে। কিছু পরে জল খাবার জন্য খাবার ঘরে এসে দেখে, ঝিলাম একা একা বসে খাবার খাচ্ছে। খেতে খেতে বারেবারে নাক, চোখ মুছে চলেছে। বুধাদিত্য ওকে না ঘাঁটিয়ে জলের বোতল নিয়ে স্টাডিতে ঢুকে পড়ে।
প্রজেক্টের কাজে নিজেকে ডুবিয়ে দেয় বুধাদিত্য, সময়ের খেয়াল থাকেনা। দুপুর গড়িয়ে, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে যায়। খেয়াল পড়ে যখন ঝিলাম ওর ঘরে ঢুকে ওর সামনে এক কাপ কফি রেখে চলে যায়। পেছন থেকে দেখে ঝিলামের চলে যাওয়া। হটাত চুড়িদার কামিজ পড়েছে, সাধারণত বাড়িতে থাকলে এই কাপড় পরে না। একবার মনে হলো জিজ্ঞেস করবে কিন্তু আর জিজ্ঞেস করা হয় না। অফিসের কয়েকজনের ফোন, প্রেসেন্টেসানের কাজ, কিছু সারভার খুলে দেখা, এই করতে করতে সময় কেটে যায়। মাঝে মাঝে কান পেতে ঝিলামের পায়ের আওয়াজ শুনতে চেষ্টা করে। কিন্তু সেই নুপুরের রিনিঝিনি শব্দ আর শুনতে পায়না। কিছু পরে সামনের দরজা বন্ধ করার আওয়াজ শুনতে পেয়ে চমকে ওঠে। বাইরে বেরিয়ে দেখে, হাতে একটা প্লাস্টিক, ঝিলাম জুতো খুলে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে।
জিজ্ঞেস করে ঝিলামকে, “কোথায় গেছিলে?”
উত্তর দেয় ঝিলাম, “মাছের বাজারে। দুপুরে নিরামিষ খেয়েছো তাই ভাবলাম একটু মাছ আনি।”
বুধাদিত্য, “আমাকে বললেই পারতে আমি নিয়ে আসতাম।”
ঝিলাম, “তুমি কাজে ব্যাস্ত ছিলে তাই আর তোমাকে বিরক্ত করিনি।”
বুধাদিত্য, “আচ্ছা, তোমার প্লেনের টিকিট কেটে দিলে হবে?”
ঝিলাম, “দুর্গাপুরে প্লেন নামে না। পূর্বাতে তৎকালে টিকিট কেটে নেবো।”
বুধাদিত্য, “প্লেনের টিকিট কেটে দেবো খানে। কোলকাতা থেকে গাড়ি ঠিক করে দেবো, তোমাকে দুর্গাপুর পৌঁছে দেবে। আসার দিনেও সেই গাড়ি তোমাকে নিয়ে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দেবে।”
ঝিলাম ঘাড় ঘুরিয়ে বুধাদিত্যের চোখের দিকে তাকায়, অনেকক্ষণ পরে পরস্পরের চার চোখ এক হয়। ঝিলাম ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, দুই চোখ তখন চিকচিক করে। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে থাকে, বুকের ঝড়কে শান্ত করার প্রবল চেষ্টা। ঝিলাম কিছু পরে ওকে বলে, “দেখি ভেবে দেখবো খানে।”
আবার সারা বাড়ি নিস্তব্ধতায় ঢেকে যায়। টিভি দেখতে মন করে না, সোফায় বসে খবরের কাগজে মুখ ডুবিয়ে বসে থাকে বুধাদিত্য। কানে ভেসে আসে অতিপরিচিত নুপুরের ঝঙ্কার, কিন্তু সেই নদীর কলতান যেন হারিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে খবরের কাগজ থেকে মাথা তুলে দেখে ঝিলামকে। সময়ের সাথে সাথে নিজেদের স্বত্তায় ফিরে আসে দুজনে। রাতে দু’জনে এক সাথে খেতে বসে।
ঝিলাম ওকে বলে, “বাড়ির ডুপ্লিকেট চাবিটা দিও।”
বুধাদিত্য, “কেন?”
ঝিলাম, “তোমার অফিসে অনেক কাজ থাকে, রোজ দিন অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায় আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। আমি অটো করে একাই চলে আসবো।”
বুধাদিত্য কিছু বলে না, মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় যে দিয়ে দেবে। কিছু পরে বলে, “কাল দেখি, একটা ড্রাইভারের ব্যবস্থা করে নেবো।”
ঝিলাম, “খাবার পরে একটু ল্যাপটপটা দিও তো, একটু মেইল দেখার আছে আর স্কুলে কিছু কাজ করার আছে।”
একটু অবাক হয়ে যায় বুধাদিত্য, ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার ল্যাপটপ নেই?”
ঝিলাম চিবিয়ে উত্তর দেয়, “তোমার মতন বড়লোক নই যে ল্যাপটপ কিনতে পারবো।”
বুধাদিত্যের সহ্যের বাঁধ ভেঙে যায়, চাপা গলায় বলে, “কি করেছি একবার বলতে পারো? কেন এমন করে কথা বলছো?”
ঝিলাম থালা থেকে মুখ উঠিয়ে ওর চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তারপরে চাপা গম্ভির গলায় বলে, “কিছু করোনি। আমার ভুল, আমি তোমার সাথে এখানে এসেছি। ঠিক আছে, আমি ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসো।”
ঝিলামের চাপা কান্না বুকে বেঁধে রাখে, বুধাদিত্য চেপে যায় বুকের ব্যাথা, ওর কথার কোন উত্তর দেয় না।
পরেরদিন সকাল বেলা উঠে দেখে যে ঝিলাম স্কুলের জন্য বেরিয়ে গেছে। ফ্রিজের ওপরে একটা হলদে স্টিকনোটে লেখা, “কফি, মাইক্রোতে রাখা, কুড়ি সেকেন্ড গরম করে নেবে। উপমা বানিয়ে রেখে গেছি, একটু গরম করে খেয়ে নিও। টিফিন তৈরি করে খাবার টেবিলে রাখা, লাঞ্চের আগে পারলে একবার গরম করে নেবে।”
অফিসে গিয়ে জানতে পারে যে বুধবার অফিসের কাজে চন্ডিগড় যেতে হবে। নিজেকে সেই কাজে ডুবিয়ে দেয়। দুপুরে একবার ভাবে ঝিলামকে ফোন করবে, কিন্তু ইতস্তত ভাবে আর করা হয়না। প্রোডাক্টের ম্যানেজার, রাকেশ সান্ডিল্য, ওকে মজা করে জিজ্ঞেস করে যে ওর গার্লফ্রেন্ড এলো না। ওর কথা হেসে উড়িয়ে দেয়। অফিসের মোটামুটি সবাই আঁচ করে ঝিলাম আর বুধাদিত্যের সম্পর্কের ব্যাপারে। কিন্তু রাকেশ ছাড়া অন্য কেউ ওকে ঘাঁটানোর বিশেষ সাহস করেনি কোনদিন। মাঝেমাঝেই রাকেশ মজা করে, কিন্তু বুধাদিত্য ওর সব কথা মজার ছলে উড়িয়ে দেয়। লাঞ্চের কিছু পরে নেহেরু প্লেসে গিয়ে ঝিলামের জন্য একটা দামী ল্যাপটপ কেনে। রমণীর অভিমান কিছু করে ভাঙাতে হবে, না হলে বাড়ির পরিবেশ দমবন্ধ হয়ে আসছে।
বিকেল পাঁচটায় ঝিলামের ফোন আসে, ফোন ধরতে গিয়ে এক অন্য উত্তেজনায় হাত কেঁপে ওঠে। বুধাদিত্য, “কি হয়েছে?”
ঝিলাম, “কখন বাড়ি ফিরবে?” গলার স্বর অনেক স্বাভাবিক হয়ে গেছে “ঝিল্লি”র।
বুধাদিত্য চাপা হেসে বলে, “কফি বানাও, আমি এই এখুনি আসছি।”
হেসে ফেলে ঝিলাম, “কফি গরম থাকতে থাকতে না পৌঁছালে কিন্তু কফি পাবে না।”
বুধাদিত্যের মন নেচে ওঠে ঝিলামের হাসি শুনে, “একটা সারপ্রাইস গিফট আছে তোমার জন্য।”
ঝিলাম হেসে বলে, “আগে বাড়ি এসে আমাকে উদ্ধার করো, তারপরে দেখবো খানে।”
বুধাদিত্য আর দাঁড়ায়না, ব্যাগ উঠিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। দরজা খুলে দাঁড়ায় ঝিলাম, সেই পুরাতন ঝিলাম, উজ্জ্বল দুই চোখে হাসি ফিরে এসেছে, গালের লালিমা ফিরে এসেছে। উচ্ছল তরঙ্গিণী আবার নিজের মত্ততায় মেতে উঠেছে।
হেসে বলে বুধাদিত্যকে বলে, “কফি বানানোর আগেই উপস্থিত দেখছি। অফিসে কাজ ছিল না নাকি?”
বুধাদিত্য ওর দিকে ঝুঁকে বলে, “কফির কথা শুনে আর থাকতে পারলাম না।”
ঝুঁকে পড়ার জন্য ঝিলামের মুখের ওপরে উষ্ণ শ্বাস বয়ে যায়, বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলে, “হ্যাঁ অনেক হয়েছে।”
“একটা সারপ্রাইস আছে” বুধাদিত্য ওর হাতে ল্যাপটপের বাক্স ধরিয়ে দিয়ে বলে, “তোমার জন্য।”
হাতে ল্যাপটপের বাক্স নিয়ে একটু অবাক হয়ে যায়, তারপরে হেসে ফেলে ঝিলাম, “হটাত কি মনে করে? তোমাকে কিছু বলা মানে তুমি সারা পৃথিবী নিয়ে আসবে মনে হচ্ছে।”
বুধাদিত্য ঘরে ঢুকে বলে, “আমার ল্যাপটপে যাতে আর হানা না দেওয়া হয় তাই নিয়ে এলাম।”
ঝিলাম মজা করে বলে, “কেন তোমার গার্লফ্রেন্ডেদের সাথে কবে কোথায় কি কি কেচ্ছাকলাপ কি করেছো সেই সব ছবি তুলে রেখেছো নাকি? চিন্তা নেই আমি চোখ বন্ধ করে নিতাম ওই ফটো দেখলে।”
চাপা হেসে ফেলে বুধাদিত্য, শুধু মাত্র আয়েশার কয়েকটা ফটো আছে ল্যাপটপে তা ছাড়া অসংখ্য পর্ণ মুভি তো আছেই। ঝিলামের কাঁধে একটু ধাক্কা মেরে বলে, “দেখার সখ আছে নাকি?”
কপট রাগ দেখিয়ে বলে, “যাঃ শয়তান।” বুধাদিত্যের পিঠে আলতো করে চাঁটি মেরে বলে, “যাও ফ্রেস হয়ে নাও, আমি তোমার সঙ্গে চা খাবো বলে বসেছিলাম।”
বুধাদিত্য তাড়াতাড়ি জামাকাপড় ছেড়ে বসার ঘরে এসে বসে। শনিবার রাতে বাজার থেকে চা কিনে আনা হয়েছিল। ঝিলাম নিজের জন্য চা বানায় আর বুধাদিত্যের জন্য কফি।
চা খেতে খেতে ঝিলাম জিজ্ঞেস করে, “কত দাম নিয়েছে ল্যাপটপের?”
বুধাদিত্য, “কেন দাম দেবে নাকি?”
ঝিলাম ভুরু কুঁচকে বলে, “হ্যাঁ টাকা জমিয়ে নিয়ে তোমাকে ফিরিয়ে দেবো।” তারপরে হেসে বলে, “শয়তান, আমাকে নিয়ে যেতে পারলে না, ল্যাপটপ কেনার সময়ে, একটু দেখে নিতাম।”
বুধাদিত্য, “একদম ভালোটা এনেছি, এইচ.পি’র বেশ ভালো ল্যাপটপ। অফিস থেকে সব লোড করে নিয়ে এসেছি। নিয়ে আসো সব দেখিয়ে দিচ্ছি।”
ঘরের পরিবেশ আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়, দু’জনে ল্যাপটপ খুলে বসে পড়ে, ঝিলামের হাজার প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়, “এটা কি? ওটা কি করে খুলতে হয়? একটা হেডফোন আনতে পারোনি, একটু কানে লাগিয়ে গান শুনতাম।”
বুধাদিত্য বলে, “বাড়িতে দামী ফাইভ পয়েন্ট অয়ান মিউসিক সিস্টেম আছে, কবার গান শুনেছো বলতে পারো?”
ঝিলাম ওর কাঁধে আলতো চাঁটি মেরে হেসে বলে, “পরশু দিন কাজে চলে গেল। কাল থেকে মাথার ওইতো খিচুরি করে রেখে দিয়েছিল। তার মধ্যে গান, হ্যাঁ।”
বুধাদিত্য হেসে বলে, “ওকে বাবা সরি। আচ্ছা একটা কথা আছে, বুধবার সকাল বেলা আমাকে চণ্ডীগড় যেতে হবে।”
ঝিলাম, “গাড়িতে যাবে না শতাব্দীতে?”
বুধাদিত্য, “গাড়িতে যাবো, মিটিং শেষ হলেই আবার যাতে ফিরতে পারি।”
ঝিলাম ধমকে ওঠে, “না অত দূর গাড়ি চালিয়ে যেতে হবে না, শতাব্দী করে যেও।”
বুধাদিত্য কোনদিন চণ্ডীগড় ট্রেনে যায়নি, যেতেও চায় না। গাড়ি চালাতে খুব ভালোবাসে বুধাদিত্য। মিটিংয়ে কেউ না কেউ ওর সাথে যায়, পথে তাই কোন কষ্ট হয় না। এবারে রাকেশ যাবে ওর সাথে। বুধাদিত্য ওকে বলে, “না কোন প্রবলেম নেই গাড়ি চালাতে।”
ঝিলাম, “ড্রাইভার খুঁজে পেয়েছো?”
বুধাদিত্য একদম ভুলে গেছিল ড্রাইভারের কথা, জিব কেটে বলে, “যাঃ একদম ভুলে গেছি।”
ঝিলামের আরও এক চাঁটি বুধাদিত্যের পিঠের ওপরে, রেগে মেগে বলে, “আগে একটা ড্রাইভার খুঁজবে। যদি কালকের মধ্যে ড্রাইভার পাও তাহলে গাড়িতে যাবে না হলে ট্রেনে যাবে। একা গাড়িতে আমি যেতে দেবো না। ব্যাস শেষ কথা।”
বুধাদিত্য, “আচ্ছা বাঃবা, আমি ফোন করে দেখছি।”
ঝিলাম, “ড্রাইভার পঁয়তাল্লিশ পঞ্চাসের কাছাকাছি হতে হবে, তাঁর পুলিস ভেরিফিকেশান করাতে হবে।”
বুধাদিত্য ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “অত বয়স কেন?”
ঝিলাম, “একটু বয়স্ক ড্রাইভার ভালো গাড়ি চালায়, ধিরে সুস্থে গাড়ি চালায়, আর অন্তত এদিক ওদিক তাকায় না।”
হেসে ফেলে বুধাদিত্য, বুঝতে পারে ঝিলাম কি বলতে চায়, “তুমি আর বোলো না, তুমি রাস্তা দিয়ে হাঁটলে, আবালবৃদ্ধবনিতা তোমার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। সে আমি বুড়ো আনি কি জোয়ান ড্রাইভার আনি।”
ঝিলাম লজ্জায় লাল হয়ে যায়, “ধুত, অনেক হয়েছে তোমার। যা বলছি সেটা করো। আমি রান্না করতে চললাম।”
ঝিলাম উঠে পরে রান্না করতে চলে যায়। অগত্যা বুধাদিত্যকে বেশ কয়েকজনকে ফোন করতে হয় ড্রাইভারের জন্য, না হলে আর গাড়ি নিয়ে যেতে দেবে না। এমনিতে একটা ড্রাইভারের দরকার ছিল, ঝিলামকে স্কুল থেকে আনার জন্য। আগে যখন ছেড়ে আসতে হতো তখন মাঝে মাঝে বুধাদিত্যকে মিটিং ছেড়ে বা কোন কাজ ছেড়ে আসতে হতো। ড্রাইভার থাকলে সেই অসুবিধেগুলো হবে না। যাদের ফোন করেছিল, তারা জানায় যে পরেরদিন বিকেলের মধ্যে ড্রাইভার যোগাড় করে দেবে।
পরেরদিন যথারীতি কেটে যায় কাজে কর্মে। বিকেলবেলায় দুটি ড্রাইভার আসে, তাদের মধ্যে একজনের কথাবার্তা শুনে আর কাজের কথা শুনে ঝিলাম তাকে কাজে নিযুক্ত করে। ড্রাইভার বিহারী নাম কালিনাথ, বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ। ঝিলাম ওকে কাজ বলে দেয়, যে সকালবেলা, বুধাদিত্যকে অফিসে ছেড়ে দিতে হবে, তারপরে দুপুরে ওকে স্কুল থেকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আবার অফিসে যেতে হবে। বিকেলে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তবে ছুটি, যদি কখন বিকেলে কাজ থাকে তাহলে দেরি করে ছুটি পাবে। বুধাদিত্য চুপচাপ ঝিলামকে দেখে, অতি নিপুণ হস্তে সব কিছু করে চলেছে। ড্রাইভার চলে যাবার পরে বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে যে এবারে ওর মন শান্ত হয়েছে কিনা। হেসে ফেলে ঝিলাম, বলে যে তাড়াতাড়ি খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়তে, পরেরদিন চণ্ডীগড় যেতে হবে।
পরেরদিন বুধবার, সকালবেলা ঝিলাম ঠেলে বুধাদিত্যকে উঠিয়ে দেয়। ঘুম চোখে উঠে স্নান সেরে তৈরি হয়ে নেয়। ঝিলাম ওর আগেই উঠেছে দেখে একটু অবাক হয়ে যায়। অবশ্য ওর অনেক সকালে ওঠার অভ্যাস আছে। কফি বানিয়ে দেয়। কালিনাথকে বারবার বলে দেয় ঠিকভাবে গাড়ি চালাতে। ম্যাডামের কথা অমান্য করে না। বুধাদিত্যের আঁকাবাঁকা রেখার জীবন সরল রেখায় চলতে শুরু করে। চণ্ডীগড় পৌঁছানো মাত্র ঝিলাম ফোন করে জেনে নেয় যে ঠিকভাবে পৌঁছেছে কিনা। সারাদিন কাজের মধ্যে খুব ব্যস্ত থাকে, সারাদিনে আর ফোন করা হয়ে ওঠেনি। রাখেশ ফেরার পথে ফোঁড়ন কাটে, কিরে শালা, গার্লফ্রেন্ডকে ফোন করে জানাবি না? তখন বুধাদিত্যের মনে পড়ে ঝিলামকে ফোন করা হয়নি। সন্ধ্যে হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি ফোন করে ঝিলামকে। ঝিলাম ফোন তুলেই একটু সাবধান বানী শুনিয়ে দিল, যে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে আর কালিনাথকে ধিরে সুস্থে গাড়ি চালাতে। ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়, ঝিলাম ওর জন্য না খেয়ে বসে থাকে। বাড়ি ফিরে ঝিলামের মুখের হাসি দেখে সারাদিনের ক্লান্তি কেটে যায় এক নিমেষে। ঝিলাম ওর হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে স্টাডিতে রেখে দেয়, ওর জন্য জল এনে দেয়। বুধাদিত্যের বড় ইচ্ছে করে নিবিড় আলিঙ্গনে বাঁধতে, আবার ওই পুরানো দ্বিধা বোধ ওকে আটকে দেয়। ওই মিষ্টি হাসি হারাতে চায় না, সময়ের ওপরে সব ছেড়ে দেয়।
শুক্রবার সকালবেলা ঝিলাম যথারীতি স্কুলে বেরিয়ে গেছে। এই কদিনের মধ্যে সমীরের বা অন্য কারুর ফোন আসেনি, ঝিলামের খোঁজ নেবার জন্য। ঝিলামকে জিজ্ঞেস করেনি, সমীরের কথা, ফোন করেছিল কিনা সেটাও জানা হয়নি। বুধাদিত্য অফিসের কাজে ব্যস্ত, ঠিক লাঞ্চের পরে ঝিলামের ফোন আসে। গলা শুনে মনে হলো খুব ত্রস্ত আর উদ্বেগ মাখা।
ঝিলামের গলা কাঁপছে, “বাড়ি আসতে পারো এখুনি?”
বুধাদিত্য, “তুমি কোথায়?”
ঝিলাম, “আমি বাড়িতে, গাড়ি তোমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।”
বুধাদিত্য, “কি হয়েছে?”
ঝিলাম, “সমীর এসেছে বাড়িতে, তুমি প্লিস এখুনি বাড়ি আসো।”
সমীরের নাম শুনেই মাথায় রক্ত চড়ে যায় বুধাদিত্যের। চোয়াল শক্ত করে ঝিলামকে বলে, “সামনের দরজা খোলা রেখে দেবে, আর বসার ঘরে বসিয়ে রাখবে। ফোন অন রাখো, কিছু হলে যেন আমি শুনতে পাই।”
ঝিলাম কাতর কণ্ঠে ডাক দেয়, “প্লিস, তাড়াতাড়ি এসো।”
তাড়াতাড়ি ব্যাগ নিয়ে কালিনাথকে গাড়ি চালাতে বলে। বাড়িতে ঢোকার আগে, প্যাসেঞ্জার সিটের নীচ রাখা বাক্স থেকে পিস্তলটা বের করে প্যান্টের পেছনে গুঁজে নেয়। একটু এদিক ওদিক করলে সমীরের মাথার মধ্যে সব কটা গুলি নামিয়ে দেবে, তারপরে যা হবার হবে, যদি মরতে হয় তাহলে বুকের মাঝে ঝিলামের ভালোবাসা নিয়ে মরবে। দৌড়ে তিনতলার সিঁড়ি চড়ে। বাড়িতে এসে দেখে, ঝিলাম কথা মতো বাড়ির সদর দরজা হাঁ করে খুলে রেখেছে। সমীর মাথা নিচু করে সোফার ওপরে বসে আর ঝিলাম বেশ কিছু দুরে খাবার টেবিলের পাশে চেয়ারে বসে। বুধাদিত্য একবার সমীরের দিকে তাকায়, একবার ঝিলামের দিকে তাকায়। ওকে দেখে, ঝিলাম প্রানে বল পায়। সমীর ওর দিকে মাথা তুলে তাকায়, চোখ মুখ বিধ্বস্ত পরাজিত সৈনিকের মতন। দুই চোখ লাল, কিন্তু সেই করুন চোখ, মিনতি ভরা চাহনি বুধাদিত্যকে শান্ত করতে পারে না।
ওর সামনের সোফায় বসে ধির গম্ভির গলায় সমীরকে জিজ্ঞেস করে, “কি মনে করে এখানে আসা হয়েছে?”
সমীর মাথা নিচু করে উত্তর দেয়, “আমি বড় পাপী, ঝিলামকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। তার প্রায়শ্চিত্ত করতে এসেছি।”
বুধাদিত্য চোয়াল চেপে দাঁত পিষে জিজ্ঞেস করে, “হটাত এই বোধোদয় হওয়ার কারন? নন্দিতা কি লাথি মেরেছে তোর গাঁড়ে?”
সমীর আলতো মাথা দুলিয়ে বলে, হ্যাঁ। বুধাদিত্য ঘাড় ঘুড়িয়ে ঝিলামের দিকে তাকায়। ওর চোখে জল, একবারের জন্য ভেবেছিল যে সমীর অন্য কারুর সাথে শুতে পারে। কিন্তু সেই কথা স্বামীর মুখে শুনে স্থম্ভিত হয়ে গেছে ঝিলাম। স্বামী এক অন্য মেয়ের প্রেমে পড়ে ওকে ছেড়ে দিয়েছিল, আর সেই স্বামী আবার ফিরে এসেছে। কি করবে ঝিলাম, কিছু বুঝে উঠতে পারে না।
বুধাদিত্য, “তোর বাবা মা’র সাথে কথা বলতে চাই, তারপরে ঝিলামকে এই বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে পারবি।”
সমীর নিচু গলায় বলে, “বাবা মায়ের সাথে কথা হয়েছে আমার। আমার কার্যকলাপে তারা মর্মাহত।”
বুধাদিত্য চিবিয়ে বলে, “এই বোকা... আমাকে গরু পেয়েছো? তুই শুয়োরের বাচ্চা, বললি আর আমি বিশ্বাস করে নিলাম। এখুনি শালা ফোন লাগা কোলকাতায়, লাউডস্পিকারে দে, আমি কথা শুনতে চাই।” ঝিলামকে ইঙ্গিত করে যে পাশের সোফায় এসে বসতে। ঝিলাম ধির পায়ে বুধদিত্যের পাশের সোফায় এসে বসে পড়ে।
নিরুপায় সমীর প্রথমে ইতস্তত করে, কিন্তু বুধাদিত্যের লাল চোখের সামনে ঝুঁকে যায়। ফোন লাগায় কোলকাতায়, সমীরের মা ফোন ধরেন। ফোন ধরা মাত্রই ঝিলাম ওর হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সব কিছু বলে দেয়। সমীরের মা চুপ করে কিছুক্ষণ শোনেন সব কথা। তারপরে সমীরকে উত্তমমধ্যম বকা দিতে শুরু করেন। বলেন যে, ঝিলাম যদি চাকরি করতে চায় সে ভালো কথা, ওকে চাকরি করতে দিতে হবে, আর ঝিলামকে যদি কোনদিন কষ্ট দেয় তাহলে এক কথায় ত্যাজ্যপুত্র করে দেবেন। সমীরের বাবা প্রচন্ড রেগে যান, এক কথায় জানিয়ে দেন, যে মা লক্ষ্মীর মতন মেয়ে ঝিলামকে যদি একটুও চোখের জল ফেলতে দেখে তাহলে সমীরকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। সমীরের চোখে জল, মুখ থমথমে, বুকের মাঝে পরিতাপের ছায়া। সব কথা শোনার পরে লুটিয়ে পড়ে ঝিলামের পায়ের কাছে।
পা ধরে বলে, “শেষ বারের মতন ক্ষমা করে দাও ঝিলাম। দয়া করে আমাকে ফিরিয়ে নাও।”
সমীরের বুক ফাটা কান্না দেখে ঝিলাম কেঁদে ফেলে, একবার বুধাদিত্যের মুখের দিকে তাকায়। বুধাদিত্যে সামনে ওর ভালোবাসা চলে যায়, বুধাদিত্য চোয়াল শক্ত করে ঠোঁটে হাসি আনে। মাথা দুলিয়ে সমীরের সাথে যাবার সম্মতি দেয়। বুক ভেঙে আবার টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ভেবেছিল সময়ের সাথে সাথে ঝিলামকে ওর কোলে টেনে নেবে, কিন্তু সমীরের কান্না আর পরিতাপের ডাক শুনে সেই স্বপ্ন দূর অস্ত। ঝিলাম চুপচাপ উঠে নিজের ঘরে চলে যায় কাপড় পরার জন্য আর ব্যাগ গুছানোর জন্য।
সমীর চোখের জল মুছে হাত জোর করে বুধাদিত্যের সামনে বসে থাকে। বুধাদিত্য গর্জে ওঠে ওর মুখ দেখে, “মাদা... ওই কুমিরের কান্না আমাকে দেখাবি না। শালা তোকে আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস হয় না, শুধু মাত্র ঝিলামের মুখ দেখে তোকে ছেড়ে দিলাম।” পিস্তল বের করে টেবিলে ওপরে রেখে দেয়। সমীরের নাকের সামনে তর্জনী নাড়িয়ে বলে, “ভাবিস না তোকে ছেড়ে দিলাম আমি। ঝিলামের চুল যদি বাঁকা হয়, আমি প্রতিজ্ঞা করছি, এই পিস্তলের সব গুলি তোর মাথার মধ্যে নামিয়ে দেবো। আমার আগে পেছনে কাঁদার কেউ নেই, বুঝলি। আমি তোকে খুন করে জেলে যেতে রাজি।”
ত্রস্ত চোখে তাকিয়ে থাকে সমীর, কাতর কণ্ঠে বলে, “না রে, আমি তোর পায়ে ধরে ক্ষমা চাইছি।”
বেশ কিছু পরে ঝিলাম শাড়ি পরে, হাতে একটা সুটকেস নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। জল ভরা চোখে বুধাদিত্যের দিকে তাকায়, একবার সারা বাড়ির দেয়ালের দিকে তাকায়। বুধাদিত্য চুপ করে বসে থাকে, চোখের সামনে ঝিলামকে ছেড়ে দিতে বুক কেঁপে ওঠে। কালিনাথকে ডেকে বলে ওদের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আসতে। ঝিলাম ওর সামনে এসে দাঁড়ায়, কিন্তু কথা বলতে পারে না, দু’চোখে অঝোর ধারায় বন্যা বয়ে চলে। বুধাদিত্য মাথা তুলে তাকাতে পারেনা ঝিলামের মুখের দিকে। ঝিলাম ওর মাথায় আলতো করে হাত ছোঁয়ায়, তারপরে ধির পায়ে সমীরের পেছন পেছন ঝিলাম বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। কালিনাথ ঝিলামের ব্যাগ নিয়ে আগেই নিচে নেমে যায়। ঝিলাম চলে যাবার পরে দরজা খোলা পড়ে থাকে। স্বপ্ন দেখেছিল বুধাদিত্য, ঝিলামকে ওই দরজা দিয়ে এই বাড়ির গৃহিণী করে আনার। সেই ঝিলামকে শেষ পর্যন্ত সমীরের হাতে সঁপে দিতে হয়। মন মানে না, কিন্তু ঝিলাম যে সমীরের বিয়ে করা, আইনসিদ্ধ স্ত্রী। বাড়ির চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে বুধাদিত্য, বাড়ির আনাচে কানাচে ঝিলামের হাতের ছোঁয়া লেগে। সব জায়গায় ঝিলামের নাম লেখা। একবার মনে হয় এই শোয়ার ঘর থেকে ঝিলাম বেরিয়ে আসবে।
খানিক পরে দেখে ঝিলাম ওর দরজায় দাঁড়িয়ে। মৃদু হেসে মাথা নাড়ায় বুধাদিত্য, সত্যি পাগল হয়ে গেছে ঝিলামের প্রেমে, দরজায় দাঁড়িয়ে ঝিলামের ছায়া। সম্বিৎ ফিরে পায় যখন রক্ত মাংসের ঝিলাম দৌড়ে এসে ওর বুকের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরে। বুধাদিত্যের বুক সেই প্রেমের পরশে হুহ করে কেঁপে ওঠে। প্রানপন শক্তি দিয়ে ঝিলামকে জড়িয়ে ওর মাথার ওপরে ঠোঁট চেপে ধরে। ঝিলাম দুই হাতে আঁকড়ে ধরে থাকে বুধাদিত্যের ঋজু দেহ। এই বুকের ওপর থেকে যেন মৃত্যুই ওকে ছিনিয়ে নেয় আর কারুর ক্ষমতা থাকে না ওকে বিচ্ছিন্ন করার।
বেশ কিছু পরে ধরা গলায় ঝিলাম ওকে বলে, “সুটটা কিন্তু কাল দেবে, মনে করে নিয়ে এসো যেন। বড় আলমারির লকারে আমার সব গয়না আর আমার সার্টিফিকেটগুলো রাখা। আমার জিনিসগুলো ছড়িয়ে দিও না আবার। দরকার পড়লে নিয়ে যাবো, না হলে এখানেই থাক।” বুকের ওপরে ঠোঁট চেপে ধরে ঝিলাম, কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমি চলে যাবার পরে প্লিস আর মদ খেও না।” বহু কষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, “আমি চললাম বুধো, ভালো থেকো।”
“বুধো” নাম শুনে চোখ বন্ধ করে নেয় বুধাদিত্য, আলতো করে ওর গালে হাত দিয়ে বলে, “চলি বলতে নেই ঝিল্লিরানি, বলে আসছি।”
“ঝিল্লিরানী” কোন রকমে “বুধো”র হাত ছাড়িয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। বেরিয়ে যাবার আগে একটু বহু কষ্টে ঠোঁটে হেসে টেনে বলে, “সোমবার গাড়ি পাঠাতে ভুলোনা, আমি অপেক্ষা করে থাকবো।”
কাজের চাপ ভীষণভাবে বেড়ে যায়, প্রায় দিন অফিসে রাত কাটাতে হয়। বাড়ি ফিরলেও শুধু মাত্র স্নান আর একটু ঘুমানোর জন্য। পুনে থেকে ফিরে ঝিলামের সাথে দেখা করা হয়ে ওঠে না। ওর সান্নিধ্যে যদি ঝিলামের প্রতি কোন বিরূপ আচরন করে সমীর, তাহলে ঝিলাম বুধাদিত্যকে দোষারোপ করবে ওদের সুখের সংসারে আগুন লাগানোর জন্য। মাথার মধ্যে শুধু ঝিলামের চিন্তা ঘুরে বেড়ায়। একবারের জন্য মনে হয় যে মোবাইলে তোলা ছবি, ভিডিও আর ওদের কথোপকথন ঝিলামকে শুনিয়ে দেয়। কিন্তু ভয় হয়, সব শুনে ঝিলাম যদি আত্মহত্যা করে ফেলে তাহলে? বেশ কিছু দিন এমন ভাবে কেটে যায়। কোনদিক থেকে কোন খবরাখবর আসে না। প্রত্যেক দিন ভাবে এই ঝিলামের ফোন আসবে, কিন্তু সেই খবর আর আসে না। একবার ভাবে যে সমীরের বাড়ি যাবে দেখে আসবে ঝিলামকে, কিন্তু সমীরের শেষ বাক্য ওকে বাধা দেয়। সমীর সেই আগের তেলু নেই, অনেক বদলে গেছে, অনেক হিংস্র আর কুটিল হয়ে উঠেছে।
গ্রীষ্মকাল, সকাল বেলার কাঠ ফাটা রোদ শান্ত পরিবেশ ঝলসে দেয়। সবে অফিস পৌঁছেছে বুধাদিত্য, এমন সময়ে ঝিলামের ফোন আসে। গলার স্বর শুনে মনে হলো, খুব ক্লান্ত। ওর ক্লান্ত গলার আওয়াজ শুনে বুধাদিত্যের বুক হুহু করে ওঠে। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে ঝিলাম কোথায়? ঝিলাম জানায় যে স্কুলে এসেছে কিন্তু স্কুল করার ইচ্ছে নেই ওর। ব্যাগ হাতে করে বেরিয়ে পড়ে বুধাদিত্য, ঝিলামের গলার স্বর শুনে মনে হয় আর অফিস করে দরকার নেই, এবারে কিছু একটা বিহিত করা উচিত।
ঝিলাম স্কুলের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল, কাঁধে ব্যাগ, পরনে হাল্কা নীল রঙের সুতির শাড়ি। দূর থেকে দেখলে সবাই সুন্দরী বলবে, কিন্তু শুধু বুধাদিত্য জানে যে ওই কাজল কালো দু’চোখের পেছনে লুকিয়ে আছে হৃদয় ভাঙার শত সহস্র টুকরো। বুধাদিত্যের গাড়ি দেখে ছোটো পায়ে এগিয়ে এসে, গাড়ির দরজা খুলে সামনের সিটে এসে বসে পড়ে। চোখের পাতা ভিজে, ফর্সা গাল লাল, নাকের ডগা লাল। চোখে দেখে মনে হলো যেন ঘুম হয়নি গত রাতে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে বুধাদিত্য। ঝিলাম মাথা নিচু করে আঙুলের নখ খোঁটে কিছুক্ষণ। তারপরে ওর দিকে জলভরা চোখে তাকিয়ে বলে, “একটু বিষ দিতে পারো আমায়?”
চোয়াল শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্যের, চাপা গলায় বলে, “শুয়োরের বাচ্চাটা কোথায়?”
ঝিলাম উলটো হাতে চোখের কোল মুছে উত্তর দেয়, “আজ সকালের ফ্লাইটে বম্বে গেছে, এবারে নাকি অনেক লম্বা টুর। বম্বে থেকে আরও অনেক জায়গা নাকি যাবার আছে। ফিরবে সাত আট দিন পরে।”
ঝিলাম রাতের কথা বলতে শুরু করে। বেশ কয়েকদিন ধরে সমীর রোজ রাতে মদে চুর হয়ে আসে। ঝিলাম কিছু বলতে গেলেই ওকে বলে যে, ঝিলাম নিজের মতন থাকতে পারে আর ওকে যেন ওর কোন চালচলন নিয়ে না ঘাঁটায়। সমীর সোজাসুজি ঝিলামকে জানিয়ে দেয় যে পরস্পরের যৌনজীবন যেন কেউ আঘাত না করে। ঝিলামের সাথে তুমুল ঝগড়া হয় সমীরের, সারা রাত দুজনের কেউ ঘুমায়না। রাতে একবার বুধাদিত্যের কথা মনে পড়েছিল ঝিলামের, ফোন করতে যায়। কিন্তু সমীর ধমকে ওঠে, হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বলে বুধাদিত্য ওর মাথা খেয়েছে, এর মধ্যে যেন ওকে না ডাকা হয়।
ডুকরে কেঁদে ওঠে ঝিলাম, শেষ পর্যন্ত সমীর ওকে বলে যে যদি ডিভোর্স চায় তাহলে সমীর ওকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে। সেই শুনে ওর পায়ের নিচের মাটি সরে যায়। আত্মহত্যা করার ভয় দেখিয়েছিল; সেই শুনে সমীর বলে আত্মহত্যা করতে হলে যেন ও চলে যাবার পরে করে। সকালবেলা চলে যাবার আগে জানিয়ে যায়, যে টুর থেকে এসে বাড়ির লোকজন ডেকে একটা বিহিত করবে। ঝিলাম জানায় যে ওর বাবা মা হয়তো সব শুনে ওকে বলবে চাকরি ছেড়ে স্বামীর সেবা করতে। এত সব হয়ে যাবার পরে সেটা করতে পারবে না ঝিলাম।
দুচোখে অঝোর ধারায় জল পড়ে যায়, কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমার আজকাল ওর সাথে কথা বলতে, এক ছাদের নিচে থাকতে পর্যন্ত খারাপ লাগে। মনে হয় দুটি অজানা অচেনা প্রাণী এক ঘরের মধ্যে আটকে পড়ে আছে। দম বন্ধ হয়ে যায় আমার।”
বুধাদিত্য চুপ করে সব কথা শুনে তারপরে বলে, “শুয়োরের বাচ্চাটা আসুক তারপরে একটা বিহিত করা যাবে।”
বুধাদিত্য গাড়ি চালিয়ে ঝিলামের বাড়ির নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। ঝিলাম চুপ করে গাড়িতে বসে থাকে। বুধাদিত্য ওর কাঁধে হাত রাখে, ওর হাতের পরশে কেঁপে ওঠে ঝিলাম।
চোখে জল, ঠোঁটে একটু খানি হেসে নিয়ে বুধাদিত্যের দিকে তাকিয়ে বলে, “খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার। তোমাকে বলে মনের দুঃখ কেটে গেছে। আমাকে আবার স্কুলে পৌঁছে দিয়ে এসো।”
বুধাদিত্য হেসে ফেলে, “পাগলি মেয়ে কোথাকার।” কাঁধের গোলায় আলতো চাপ দিয়ে বলে, “ঠিক করে বলো, আবার স্কুলে গিয়ে বলবে যে বাড়ি নিয়ে যাও তাহলে কিন্তু রাস্তার মাঝে ছেড়ে দেবো।”
চোখের জল মুছে হেসে ফেলে ঝিলাম, “না সত্যি বলছি। ফালতু একটা সি.এল মেরে লাভ নেই, আমাকে স্কুলে ছেড়ে দাও প্লিস।” ঝিলামের চোখ মুখ কুঁচকে “প্লিস” বলাতে, বুধাদিত্যের মনে হলো জড়িয়ে ধরে ওই লাল গোলাপের কুঁড়ির মতন ঠোঁটে চুমু খায়।
অগত্যা বুধাদিত্যকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে আবার স্কুলে ফিরে যেতে হয়। স্কুলের গেটের সামনে নামিয়ে দিয়ে বুধাদিত্য ঝিলামকে পেছন থেকে ডেকে বলে, “ঝিল্লি, স্কুল শেষ হলেই অফিসে চলে এসো।”
ঝিলাম ওর কথা শুনে মাথা নাড়ায়, হ্যাঁ। কিন্তু পরক্ষনে কানে বেজে ওঠে “ঝিল্লি” নাম। থমকে দাঁড়িয়ে বুধাদিত্যের দিকে তাকায় বড় বড় চোখ করে। বুধাদিত্যের খেয়াল হয় যে ঝিলামকে আদর করে “ঝিল্লি” বলে ডেকে ফেলেছে, দাঁত চেপে হেসে ফেলে। ঝিলাম নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে চোখের লাজুক ভাব লুকিয়ে গেটের ভেতরে ঢুকে যায়।
সারা সকাল কাজে মন বসাতে পারে না বুধাদিত্য, ল্যাপটপ সামনে খোলা। অগুনতি মেইল আসে, কয়েকটার উত্তর দেয়। মাঝে মাঝেই ঘড়ি দেখে, কখন দুটো বাজবে আর ঝিলাম ওকে এসে ডাক দেবে। সময় যেন কাটতে চায় না আর। অফিসের কয়েকজনের সেই ইতস্তত ভাব চোখে পড়ে যায়। অনেকেই জিজ্ঞেস করে, সুকৌশল উত্তর দিয়ে এড়িয়ে যায় সবার প্রশ্ন।
ঠিক লাঞ্চের পরেই ঝিলামের আবির্ভাব। চেহারার বিষণ্ণ ভাব কেটে বেশ খুশির জোয়ার খেলে বেড়ায়। স্কুল থেকে রোদে হেঁটে আসার ফলে ফর্সা ঝিলাম লাল হয়ে গেছে। বুধাদিত্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওর গালের লালিমা উপভোগ করে। বড় বড় চোখ করে ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে যে কি দেখছে? মিচকি হেসে ফেলে বুধাদিত্য। গাড়িতে করে ঝিলামকে বাড়িতে নিয়ে যায়।
বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে ঝিলামকে বলে, “একা একা বাড়িতে থাকবে?”
ঝিলাম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “কি করবো আর, এর পর থেকে একাই হয়তো কাটাতে হবে।”
সেই দীর্ঘশ্বাস বুধাদিত্যের বুকে বড় বাজে, একটু নিচু গলায় বলে, “যদি কিছু মনে না করো তাহলে একটা কথা বলতে পারি।” ঝিলাম ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কি কথা? বুধাদিত্য একটু ইতস্তত করে বলে, “জামা কাপড় প্যাক করে আমার বাড়িতে চলে এসো।”
বুধাদিত্যের সাহস দেখে ক্ষণিকের জন্য থমকে যায়। তারপরে হেসে ফেলে বলে, “বিকেলে অফিস ফেরত আমাকে নিয়ে যেও, আমি তৈরি থাকবো।”
উত্তর শুনে বুধাদিত্যের হৃদয় খুশিতে নেচে ওঠে। দু’চোখ চকচক করে ওঠে, কিন্তু চোয়াল শক্ত করে সেই অভিব্যক্তি চেহারার ওপরে আনতে দেয় না। ঝিলামের চোখ এড়ায় না, ওর দুই চোখের ভাষা। ঝিলাম ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজের খুশি চেপে রাখে। ঝিলাম ফ্লাটে ঢোকার জন্য পা বাড়ায়, বুধাদিত্য দাঁড়িয়ে থাকে গাড়ির কাছে। সুন্দরী অপ্সরা যতক্ষণ না দরজা দিয়ে ঢুকে যায়, ততক্ষণ চেয়ে থাকে ওর যাওয়ার পথে। অফিসে ফিরে কাজে মন বসাতে চেষ্টা করে বুধাদিত্য। এর মাঝে সি.টি.ও ডাক আসে, কিছু প্রেসেন্টেসানের জন্য। এক ঝটকায় ঝিলামকে মাথার থেকে বের করে আবার কাজে ডুবে যায়। হাতে দু’দুটো প্রোজেক্ট, একটা অস্ট্রেলিয়ার, একটা পুনের, মাথায় বাজ পড়েছে। দ্বিতীয় অর্ধে কাজে ডুবে গিয়ে সময়ের দিকে আর খেয়াল থাকে না বুধাদিত্যের।
সময়ের খেয়াল পড়ে ঝিলামের ফোনে। ওপাশ থেকে ধমকে ওঠে “ঝিল্লি”, “সাড়ে ছটা বাজে, সময়ের খেয়াল আছে? আমাকে নাকি নিতে আসছিলে? কোথায় মরতে বসেছো?” বুধাদিত্যের তখন খেয়াল পরে যে ঝিলামকে নিয়ে বাড়ি যেতে হবে। একদম ভুলে গেছিল সে কথা। বুধাদিত্য ক্ষমা চাইতেই ঝিলাম অভিমানী সুরে ধমক দেয়, “সব পুরুষ মানুষ এক রকমের। দেরি হবে তা একবার ফোন করে জানাতে পারোনি? আর আসতে হবে না তোমাকে।” ভীষণ রেগে গেছে ঝিলাম, রেগে মেগে ফোন রেখে দেয়।
বুধাদিত্য তড়িঘড়ি করে ব্যাগ কাঁধে ফেলে গাড়ি ছুটিয়ে দেয়। খুব ভয়ে ভয়ে দরজায় টোকা মারে। অভিমানিনী ঝিলাম দরজা খুলে ভেতর দিকে হাঁটা দেয়। ঝিলামের চুড়িদারের ওড়না দরজার ছিটকিনিতে আটকে টান পড়ে যায়। ঝিলাম কেঁপে ওঠে এক অজানা ভয়ে, একা পেয়ে বুধাদিত্য ওর সতীত্ব হরন করতে চলেছে? রেগে মেগে চেঁচিয়ে ওঠে ঝিলাম, “তোমার এত সাহস যে আমাকে একা পেয়ে শেষ পর্যন্ত...” হাত উঠিয়ে বুধাদিত্যকে থাপ্পড় মারতে যায়। থাপ্পড়টা হাওয়ায় ঘুরে দরজায় লাগে। বুধাদিত্য কিছুই বুঝতে পারেনা। পেছনে দাঁড়িয়ে ঝিলামের এই অদ্ভুত আচরনের মানে খুঁজতে চেষ্টা করে। ঝিলাম দরজায় থাপ্পড় মারার পরে বুঝতে পারে যে ওড়না ছিটকিনিতে আটকে গেছে। লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে ওড়না ছিটকিনি থেকে খুলে নেয়। বুধাদিত্য হেসে ফেলে ওর লাল নাকের ডগা দেখে।
বুধাদিত্য, “তোমার মারা পেটা হয়ে গেলে, একটু বাড়ির দিকে রওনা দিতে পারি।”
খিলখিল করে হেসে ফেলে ঝিলাম, পেছনে সরে গিয়ে ওকে সোফার ওপরে বসতে বলে। মাথা তুলে বুধাদিত্যের চোখে চোখ রাখতে লজ্জা করে, নিজের আচরনের জন্য। রান্না ঘর থেকে দু’কাপ কফি নিয়ে এসে ওর হাতে ধরিয়ে দেয় এক কাপ। মিষ্টি লাজুক গলায় ওকে বলে, “একটু বসো, আমি এখুনি তৈরি হয়ে আসছি।”
বুধাদিত্য, “আর কি তৈরি হবে, ভালোই তো কাপড় পরে আছো বেশ তো লাগছে। একে গাড়িতে তো যাবে, পায়ে হাওয়াই চটি পরে গেলেও কেউ জানতে পারবে না।”
হেসে ফেলে ঝিলাম, “দাঁড়াও বাবা, এখুনি অফিস থেকে এসেছো, একটু তো বসবে নাকি?”
বুধাদিত্য, “সে তো ওই বাড়ি গিয়েও বসা যাবে।”
ঝিলাম মাথা নাড়ায়, “তুমি না সত্যি... ঠিক আছে চলো।” নিজের ঘর থেকে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
সারাটা রাস্তা ঝিলামের কল্লোলে বুধাদিত্যের কান গুঞ্জরিত হয়। সারাদিনের স্কুলের গল্প বলতে শুরু করে। গাড়ি চালায় আর আড় চোখে দেখে ঝিলামকে। অর্ধেক কথা কানে যায়, অর্ধেক কথা কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। বুধাদিত্য শুধু তাকিয়ে থাকে ওর লাল ঠোঁটের দিকে, তোতাপাখীর মতন কিচিরমিচির করে কথা বলছে আর নড়ছে, সেই সাথে নরম পাতলা আঙুলের নড়াচড়া। শরীরের সুগন্ধে গাড়ির ভেতর ভরে গেছে, ওই মাদকতাময় রুপের কাছে হার মেনে গেছে বুধাদিত্য। পুরানো ঝিলাম ফিরে এসেছে এক নতুন ভাবে। পারলে বুকের এক কোনায় লুকিয়ে রেখে দেবে এই তরঙ্গিণীকে।
প্রচন্ড গরম, ঘরে ঢুকেই এসি চালিয়ে দেয় বুধাদিত্য। ঝিলামের থাকার জন্য বুধাদিত্য নিজের শোয়ার ঘর ছেড়ে দেয়। প্রথমবার নিজের শোয়ার ঘরে অন্য একজনের পায়ের ছাপ। ঝিলাম ওকে জিজ্ঞেস করে কোথায় শোবে, উত্তর বুধাদিত্য জানায় যে গেস্ট রুমে থাকবে এই কটা দিন। বুধাদিত্য ওর ব্যাগ আলমারিতে ঢুকিয়ে রেখে নিজের জামা কাপড় নিয়ে বেরিয়ে যায়। ঝিলাম বাথরুমে ঢুকে পড়ে। বুধাদিত্য মনের মধ্যে আনন্দের খই ফোটে, অবশেষে ভালোলাগার রমণী ধরা দিয়েছে। কয়েকটা দিনের জন্য হলেও, চোখের সামনে থাকবে “ঝিল্লি”। হাত মুখ ধুয়ে বারমুডা আর গেঞ্জি পরে বসার ঘরে বসে থাকে। মন বারেবারে উঁকি মারে শোয়ার ঘরে, ঝিলামের অপেক্ষায় এক মিনিট যেন এক বছর বলে মনে হয়। কাঁধে তোয়ালে, চোখ মুখ তরতাজা, সকালের বিষণ্ণতার লেশমাত্র নেই শরীরে। সারা অঙ্গে এক নতুন মাদকতা, এক নতুন প্রাণশক্তি নিয়ে ঝিলাম বেরিয়ে আসে বাথরুম থেকে। পরনে একটা ঢিলে টপ আর গাড় নীল রঙের স্লাক্স। ওর যৌবনের ডালি ফুলে ফুলে ভরা। সেই রুপসুধা দুই চোখে আকণ্ঠ পান করে বুধাদিত্য।
ঝিলাম ফ্রিজ খুলে বলে, “কাঁচা বাজার তো কিছু নেই, একটু বাজারে গিয়ে কিছু নিয়ে এসো।”
বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে, “খাসির মাংস নিয়ে আসি?”
ঝিলাম আলতো ধমক দেয়, “এই গরমে খাসির মাংস খেতে হবে না। পারলে সি.আর.পার্ক না হয় গোবিন্দপুরি থেকে ট্যাঙরা মাছ নিয়ে এসো।”
বুধাদিত্য, “আমি ট্যাঙরা ফ্যাংরা চিনিনা, কাটা কাতলা না হলে রুই নিয়ে আসবো।”
ঝিলাম, “চেনোটা কি, তাহলে? বাঙালি হয়ে মাছ চেনো না?”
বুধাদিত্য, “ছোটোবেলা থেকে হস্টেলে মানুষ, মাছ চেনাবার মতন কেউ কোনদিন পাশে ছিলো না।”
ঝিলামের মনে পড়ে যায় বুধাদিত্যের অতীতের কথা। মন কেমন করে ওঠে ওর চোখ দেখে, মিষ্টি গলায় বলে, “আজ তাহলে সামনে থেকে কিছু কাঁচা বাজার করে নিয়ে এসো, কাল মাছের বাজার যাওয়া যাবে।”
বুধাদিত্য, “যথাআজ্ঞা ঝিল্লিরানী।” খিলখিল করে হেসে ফেলে ঝিলাম, ওর মুখে “ঝিল্লি” নাম শুনে বুকের ভেতরে প্রজাপতি পাখা মেলে নেচে ওঠে। বুধাদিত্য গায়ে একটা টিশার্ট পরে বাজারে বেরিয়ে যায়। সাধারণত সপ্তাহে একদিন বাজার করলে ওর চলে যায়, কিন্তু এবার থেকে মনে হয় ঝিলাম প্রত্যকে দিন বাজারে পাঠাবে। কাঁচা সবজি কিনে বাড়ি ফিরে দেখে রান্না ঘরে ঝিলাম। ঘরে যা ছিল তাই দিয়ে রাতের খাবার তৈরি করে ফেলেছে প্রায়। বুধাদিত্যকে দেখে বলে, সবজিগুলো ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিতে। রাতে তাড়াতাড়ি খেতে হবে। বুধাদিত্য মুখ কাঁচুমাচু করে জানায় যে রাত দশটা এগারোটার আগে ও খায় না। ধমকে দেয় ঝিলাম, রাতে তাড়াতাড়ি খেতে হয় তারপরে না হয় টিভি দেখতে পারে বা নিজের কাজ করতে পারে। ঝিলামকে সকালে উঠতে হয় স্কুল যাবার জন্য। পরেরদিন শনিবার, ছুটি, কি করবে অত সকালে উঠে, সেই শুনে ঝিলাম একটু শান্ত হয়। বুধাদিত্য কাতর চোখে এক কাপ কফির আবেদন করে, ঝিলাম কপট রেগে জানিয়ে দেয় এত রাতে কফি খেলে ভাত খেতে পারবে না। বুধাদিত্য বুঝতে পারে যে ওর জীবনের অঙ্ক এক নতুন খাতায় আঁচড় কাটতে শুরু করেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিলামকে দেখে যায়। হাঁটুর নিচ থেকে গোড়ালি পর্যন্ত খালি, ফর্সা পায়ের গুলির মসৃণ ত্বক আলোতে চকচক করছে, পরনের কাপড় এঁটে বসে ওর কোমরের নিচে। জড়িয়ে ধরে ওর ফর্সা গোলাপি গালে চুমু খেতে ইচ্ছে করে। কোনোরকমে সেই মনোবৃত্তি সামলে নেয়।
রাতের খাওয়া দাওয়া ঝিলামের চাপের ফলে তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে হয়। খাওয়ার পরে নিজের ঘরে ঢুকে যায় ঝিলাম।
ঝিলাম, “এসি বন্ধ করে দাও, এই দুদিনে এসিতে থেকে আমার অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে। পরে তো আর এসি পাবো না।”
বুধাদিত্য, “আমার অভ্যেস খারাপ করে দিচ্ছ যে? অত সকালে উঠতে পারবো না আমি।”
ঝিলাম, “ঠিক আছে, শুধু ছুটির দিনে ছুটি, উইক ডেইসে কিন্তু আমার সাথে উঠতে হবে।”
বুধাদিত্য, “অত সকালে উঠে আমি কি করবো?”
ঝিলাম, “কাজের লোক সকালে আসে তার সাথে দাঁড়িয়ে থেকে ঘর পরিষ্কার করাবে।”
বুধাদিত্য, “বাপরে, ওই সব আমার দ্বারা হয় না। কুতুব মিনার থেকে লাফ দিতে বললে লাফ দিয়ে দেবো।”
ঝিলাম, “ঠিক আছে তোমাকে দেখতে হবে না। কাল এলে আমি ওকে বলে দেবো বিকেলে আসতে। আমিও স্কুল থেকে ততক্ষণে ফিরে আসবো, তারপরে ওকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেবো।”
বুধাদিত্য, “তাহলে আমার টিফিনের কি হবে?”
ঝিলাম, “স্কুল বের হবার আগে তোমার টিফিন বানিয়ে দিয়ে যাবো।”
বুধাদিত্য ম্লান হেসে বলে, “কতদিন ঝিলাম, কতদিন করবে?”
হটাত ওই কথা শুনে হারিয়ে যায় ঝিলাম। বুকের ভেতর হুহু করে কেঁদে ওঠে, কতদিন এই সুখ? হয়তো ক্ষণিকের। দুজনেই মনের ভাব ব্যক্ত করে না। শুধু চোখে চোখে কথা হয়। ঝিলাম চোখ নিচু করে ঘরের আলো বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। বুধাদিত্য চুপচাপ বসার ঘরে বসে টিভি চালিয়ে দেয়। চোখের সামনে বিশাল টিভির স্ক্রিনে আলাস্কার সবুজ, নীল অদ্ভুত সুন্দর নর্দান লাইটস ঝকমক করছে, মনের ভেতরে ঝিলামের চোখের জল ভেসে যায়। চুপ করে সিগারেট জ্বালিয়ে একটার পর একটা সিগারেট টানতে থাকে। সময়ের খেই হারিয়ে ফেলে বুধাদিত্য, ডিসকভারি চ্যানেলে কি চলছে, কি চলছে না, কিছুই মাথায় ঢোকে না। চিন্তাশক্তি লোপ পেয়ে গেছে ওর, মাথা শূন্য। কি করে ওই ইতর, নীচ, বিশ্বাসঘাতক সমীরের কবল থেকে মুক্ত করা যায় এই ফুলের কুঁড়িকে। একমাত্র উপায়, যদি ওদের ডিভোর্স হয়, না হলে এই জীবনে ঝিলামকে বুকে পাওয়ার স্বপ্ন শুধুমাত্র স্বপ্ন থেকে যাবে। অতি সযত্নে রাখা সেই সুন্দর ইভিনিং ড্রেসিংগাউন আলমারির কোনায় পড়ে থাকবে।
“কি হলো এখন ঘুমাতে যাওনি?” ঝিলামের ঘুম জড়ানো কণ্ঠস্বর শুনে বুধাদিত্য আচমকা সোজা হয়ে বসে। শোয়ার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ঘুমঘুম চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “পারে বটে মানুষটা। রাত একটা বাজে যাও ঘুমাতে যাও। ডিসকভারিতে আর কিছু নতুন দিচ্ছে না।” নিরুপায় বুধাদিত্য, ঝিলামের আদেশের সামনে নিজেকে সমর্পণ করে শুতে চলে যায়।
এতদিন সকাল বেলা একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারতো বুধাদিত্য। সুন্দরী এক নদীর ঝঙ্কারে সকাল থেকে বাড়ি মুখরিত। কাজের লোক সকাল বেলা এসে যায়। তাকে নিয়ে ব্যস্ত বাড়ির নতুন রাজ্ঞী “ঝিল্লি”। বিছানায় শুয়ে আধোঘুমে আধজাগরন, “ঝিল্লি”র কলতান কানে ভেসে আসে, “সারা বরতন ধোকে পেহেলে স্লাব পে রাখ দেনা, ফির পানি ঝড়নে কে বাদ উঠাকে রাখনা।” “ইয়ে সোফাকে নিচে ঠিক সে ঝাড়ু লাগা, উওহ কোনে মে ক্যায় হ্যায়, উধর নেহি কিয়া ক্যা? ইয়হান পোছা মার ঠিক সে, নেহি দুবারা মার।” সেই কলতান মধুর করে তোলে পায়ের নুপুরের আওয়াজ। গতকাল ছিল না, সকালে হয়তো পরেছে। বুধাদিত্য টের পায়, ওর ঘরে ঢুকে ওর গায়ের ওপরে চাদর একটু টেনে দেয়। এসি বন্ধ করে, ফ্যান চালিয়ে দেয়। নিচু স্বরে কাজের লোককে আদেশ দেয়, “সাব কা বিস্তর কে নিচে ঠিক সে ঝাড়ু পোছা লাগা দেনা।” বুধাদিত্য আধাচোখ খুলে নতুন রাজ্ঞীর রুপ দর্শন করে। সকালেই মনে হয় স্নান সেরে নিয়েছে, ভিজে চুল পিঠের ওপরে মেলে ধরা, চেহারায় ভোরের সূর্য ঝলমল করছে পরনে ঢিলে প্যান্ট, গায়ে ঢিলে একটা জামা। ওর চোখ খোলা দেখে মিষ্টি হেসে, ঘুম থেকে উঠতে বলে। মুক্তো সাজানো দাঁতের ঝিলিক দেখে বুধাদিত্য কাতর চোখে আবেদন করে, একটু ঘুমাতে দাও? মাথা নাড়ায় ঝিলাম, ঠিক আছে, কিন্তু মাত্র এক ঘন্টা, ন’টার সময়ে উঠিয়ে দেবে। তাই সই, মাথার নিচের বালিস মাথার ওপরে চেপে ধরে আবার স্বপ্নের মধ্যে ডুবে যেতে চেষ্টা করে বুধাদিত্য। স্বপ্নে তলিয়ে যায় প্রান, তরঙ্গিণীর সুরে তালে নেচে ওঠে পাগল বুধাদিত্য। তপ্ত বালুকাবেলায় আবার জেগে ওঠে ভালোবাসার মরূদ্যান।
“দাঁত মেজে নাও এবারে, কফি বানিয়ে ফেলেছি।” দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আদেশ দেয় ঝিলাম, “কি হলো, ওদিকে ফিরে আর শুতে হবে না। কাল মাংস খাবে বলছিলে? আনতে যাবে না?”
অগত্যা বুধাদিত্য উঠে পড়ে। অর্ধখোলা চোখের সামনে ঝিলামকে দেখে মনে হয় ভাসাভাসা মেঘের আড়ালে দাঁড়িয়ে স্বর্গের অপ্সরা ওর দিকে তাকিয়ে হাসে। কফি হাতে বসার ঘরে বসে ঝিলামকে দেখে, সারা ঘর নেচে বেড়ায় সেই সুন্দরী তরঙ্গিণী। থেকে থেকেই কানে ভেসে আসে ঝিলামের কণ্ঠস্বর, “চা খাও না? শুধু কফি! ধুর, আমার কফি একদম ভালো লাগে না। বিকেলে আমাকে নিয়ে একটু বাজারে বেরিও, অনেক কিছু কেনার আছে।” “শুধু রান্না ঘরটা বড়, হাড়ি কড়া বলতে কিছুই নেই। কি করে কাটালে এত দিন?” “একি, জ্যামটা শুকিয়ে চিনির দলা হয়ে গেছে? খাও না যখন ফালতু কিনতে যাও কেন?” “বরফের ট্রে ভেঙে গেছে, একটা কিনতে পারো না?” “স্টাডি টেবিল সিগারেট খেয়ে পুড়িয়ে দিয়েছো? মরন আমার, অ্যাশট্রে কোথায়?” “ওয়াশিং মেশিনের কভার কোথায়? দাগ পড়ে গেছে সারা গায়ে। বাড়িতে একটা কলিন্স নেই।” একটা কাগজ পেন ছুঁড়ে দেয় ওর দিকে, “একটা লিস্ট বানাও আমি বলছি, বিকেলে কিনতে যেতে হবে।” “জিরে, ধনে, শুকনো লঙ্কা, লঙ্কা গুঁড়ো, কালা মিরচ, যইত্রি, জায়ফল, গোলাপ জল, কালো জিরে, মুগ ডাল, মটর ডাল, ছোলার ডাল, অরহর ডাল, সানফ্লাওয়ার তেল, সরষের তেল...”
বুধাদিত্য লিখে চলে চুপচাপ, ফর্দ তৈরি হয়ে গেলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “আর কিছু বাকি আছে? না না, মনে করে নাও।”
ঝিলাম, “মনে পড়লে আবার বলবো, কাগজটা ওখানে রেখে দিয়ে এবারে দই আর মাংস নিয়ে এসো।”
বুধাদিত্য, “তোমার দরকার পড়লে নিজে লিখে নিও, আমাকে জ্বালাতে যেও না।”
ঝিলাম হেসে বলে, “আহা রাগ দেখ। ঠিক আছে আমি লিখে নেব। উঠে পড়ো আর মাংস আনতে যাও।”
দুপুরে খাওয়ার পরে ঝিলাম বুধাদিত্যকে বলে বিকেলে বাজার করার পরে ওর বাড়িতে নিয়ে যেতে। জানায় যে ওই বাড়ি থেকে আরও জিনিসপত্র আনতে হবে, বুধাদিত্যের রুকস্যাক আর একটা সুটকেস খালি করতে বলে। ঝিলাম জানায় যে ওর একটা বড় আলমারি চাই। বুধাদিত্য বড় আলমারি খুলে দেয়, সারিসারি সুট টাঙানো আর ওর কিছু জামাকাপড় ছাড়া আর কিছু নেই। একপাশে ভাঁজ করে রাখা ঝিলামের দেওয়া সুট পিস। সেটা দেখে ঝিলাম একটু রেগে যায়, বুধাদিত্য জানায় যে সময়ের অভাবে আর সেটা বানানো হয়নি। ফের আদেশ হয় যে বিকেলে বেরিয়ে বাজার করে, সুটের মাপ দিয়ে ওকে যেন একবার ওর বাড়িতে নিয়ে যায়। ঝিলাম ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র বের করে আলমারি সাজিয়ে নেয়।
বিকেল বেলা ঝিলামের সাথে বাজার করতে যেতে হয় অগত্যা বুধাদিত্যকে, তারপরে কালকাজির একটা নামকরা সুটের দোকানে ঢুকে ওর সুটের মাপ দেওয়া হয়। সবশেষে ঝিলামের বাড়ি গিয়ে ব্যাগ আর সুটকেস ভর্তি করে নিজের জিনিস। দুটি ব্যাগ, একটা সুটকেস, একটা মেকআপ বাক্স, সব নিয়ে ভালো করে তালা দিয়ে ঝিলাম বেরিয়ে পড়ে। ওর মুখ দেখে মনে হয় যেন এই বাড়িতে আর পা রাখার মন নেই। সমীর এলে ওর সাথে একটা বিহিত করতে চায়। এই একদিনে ওর মনের জোর অনেক বেড়ে গেছে, ওর পাশে ওর সব থেকে বড় শক্তি দাঁড়িয়ে, বুধাদিত্য।
রাতের খাওয়ার পরে ঝিলাম শোয়ার ঘরে ঢুকে বুধাদিত্যকে ওর মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে। বলে যে সমীরের কাছে শুনেছিল যে ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ে ওর মা মারা যান। সেই শুনে ঝিলাম সেদিন পায়েস বানিয়ে এনেছিল। বুধাদিত্য চুপ করে মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে, ছোটো বেলার কথা মনে পড়ে যায়, মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। চোখের কোনে একচিলতে জল ছলকে আসে। ঝিলাম ওর কাঁধে হাত রাখতেই শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্য। হেসে জানায় যে পুরানো ব্যাথা জাগিয়ে কি হবে। ঝিলাম ওই চোখের আড়ালে ঘন কালো মেঘের দেখা পায়। জিজ্ঞেস করে ওর বাবা কোথায়? চোয়াল শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্যের, ক্রুর চোখে তাকায় ঝিলামের দিকে, মনে হয় যেন ইচ্ছে করেই ধাক্কা দিল ঝিলাম। সুবির গুহকে যত বার ভুলে যেতে চায় ততবার কেউ কেন ওকে মনে করিয়ে দিতে আসে। আরও রেগে যায় যখন দেবস্মিতার মুখ ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। চোয়াল চেপে ঝিলামকে বলে, যে এক সুন্দরী নারীর কবলে পড়ে ওর বাবা ওকে ছেড়ে, ওর মাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। ঝিলামের বুক কেঁপে ওঠে বুধাদিত্যের ব্যাথার কাহিনী শুনে। হাত বাড়িয়ে ওকে ছুঁতে যায়, কিন্তু বুধাদিত্য কারুর অনুকম্পায় বাঁচতে নারাজ। গত চোদ্দ বছরে একা থেকে ওর হৃদয় পাথরের মতন কঠিন হয়ে গেছে। বুধাদিত্য বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। ঝিলাম চুপ করে থাকে, ভাবে একি করে ফেললো।
ঝিলাম ওর পাশে বসে নিচু গলায় বলে, “আমি সরি, আমি জানতাম না এই সব। সত্যি বলছি জানলে আমি আঘাত দিতাম না তোমাকে।”
ম্লান হেসে বলে, “জানি তুমি জানতে না, ঠিক আছে ছেড়ে দাও ও সব কথা। আমি মিস্টার সুবির গুহর ব্যাপারে কোন কথা বলতে চাই না।”
ঘরের আবহাওয়া সেই পুরানো ব্যাথার কাঁপুনিতে বদ্ধ হয়ে ওঠে। ঝিলাম চেষ্টা করে সেই বদ্ধ ভাব কাটিয়ে দিতে, বুধাদিত্যকে বলে, “এই, আইস্ক্রিম খেতে যাবে?”
বুধাদিত্য, “পাগল হলে নাকি? এত রাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আইস্ক্রিম খাবে?”
ঝিলাম, “ধুর বোকা, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কে আইস্ক্রিম খাবে। ইন্ডিয়া গেট গিয়ে আইস্ক্রিম খাবো, প্লিস চলো না, একদম না করবে না।”
কাষ্ঠ হাসি হাসে বুধাদিত্য, “সবাই তাদের বউ না হয় গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ওখানে আইস্ক্রিম খেতে যায়।”
ঝিলাম, “বাঃরে, আমি তোমার বান্ধবী নই? আমি মেয়ে আবার বান্ধবি, ব্যাস ইংরাজি মানে গার্লফ্রেন্ড।” ঝিলাম ইংরাজির শিক্ষিকা, সেও জানে সে কি বলেছে আর বুধাদিত্য জানে সে কি শুনেছে। দু’জনের মুক ভাষা পরস্পরের বুকের মাঝে হাজার বাক্য রচনা করে চলে। ঝিলাম দৌড়ে গিয়ে ঘর থেকে নিজের জন্য একটা স্টোল আর বুধাদিত্যের জন্য একটা টিশার্ট নিয়ে আসে। স্টোল নিজের গলায় জড়িয়ে ওর হাতে টিশার্ট ধরিয়ে দিয়ে বলে, “চলো।”
হাঁ করে তাকিয়ে থাকে বুধাদিত্য, “সত্যি তুমি যাবে?” আপাদমস্তক একবার ঝিলামকে দেখে নেয়। ঢিলে প্যান্ট ঢিলে শার্ট, মাথার চুল একটা রবার ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে নেয়। ঝিলাম ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে বলে, চলো, দাঁড়িয়ে কেন? নিজের পরনে শুধু একটা বারমুডা আর টিশার্ট।
ইনোভা দাঁড় করায় রাজপথে। রাত প্রায় এগারোটা বাজে, সারা দিল্লী ঘুমিয়ে শুধু রাজপথে লোকের ভিড়, সবাই গাড়ি চেপে এসেছে এখানের হাওয়া খেতে আর আইস্ক্রিম খেতে। হলদে আলো সাড় বেঁধে দাঁড়িয়ে, ইন্ডিয়াগেটের অমর জওয়ান জ্যোতি থেকে সেই প্রেসিডেন্ট ভবন পর্যন্ত। চারদিকে লোকের ভিড়। গাড়ি থেকে নেমেই ছোটো মেয়ের মতন দৌড় লাগায় আইস্ক্রিম ঠেলা দেখে। বুধাদিত্য গাড়ি বন্ধ করার আগেই দুটি আইস্ক্রিম কিনে আনে। ঝিলাম গাড়ির পাশে ঠেস দিয়ে মনের আনন্দে আইস্ক্রিম চাটে আর সামনের দিকে তাকিয়ে আলো আর মানুষ দেখে। বুধাদিত্য ভাবে আইস্ক্রিম চাটবে না ঝিলামের ফর্সা গাল। গোলাপি নরম গালে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করে, একটু ছুঁতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছেটা বড় প্রবল হয়ে ওঠে বুধাদিত্যের, ওর দিকে হাত বাড়িয়ে ওর গাল থেকে চুলের গোছা সরিয়ে দেয়। আচমকা গালের ওপরে উষ্ণ হাতের পরশে কেঁপে ওঠে ঝিলাম, ভুরু কুঁচকে বুধাদিত্যের দিকে তাকায়।
বুধাদিত্য মিচকি হেসে বলে, “গালের পাশে একটা কিছু লেগে ছিল সেটা সরিয়ে দিলাম।”
ঝিলাম ছোটো মেয়ে নয়, ওর বোঝার ক্ষমতা আছে যে কোন অছিলায় বুধাদিত্য ওর একটু পরশ চায়। বুকের মাঝে এক অব্যক্ত টান অনুভব করে, বৈধ না অবৈধ জানেনা। ঝিলাম ওর উষ্ণ আঙ্গুলের পরশে একটু গলে যায়, ওর পাস ঘেঁসে দাঁড়ায়। বাজুর সাথে বাজু ছুঁয়ে যায়, শরীরের সাথে শরীর মৃদু চেপে যায়। দুই তৃষ্ণার্ত নরনারীর শরীরে উত্তাপ ছড়াতে বেশি দেরি হয় না। বুধাদিত্যের কঠিন বাজু্র পেশির ওপরে মাথা হেলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বুকের ভেতরে এক নিরাপত্তার ভাব জেগে ওঠে।
ঝিলামকে আলতো ধাক্কা মেরে বলে, “আরও কয়েকটা আইস্ক্রিম কিনে নিয়ে এসো, যাও।”
ঝিলামের মুখে হাসি আর ধরে না, প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, “সত্যি!!!”
বুধাদিত্য মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ সত্যি... যাও তারপরে গাড়ি ওঠ।”
ঝিলাম দৌড়ে গিয়ে আরও দুটি আইস্ক্রিম কিনে নিয়ে আসে। ততক্ষণে বুধাদিত্য গাড়ির মধ্যে উঠে পড়ে। ঝিলাম কাতর চোখে তাকিয়ে অনুরোধ করে যে এখুনি বাড়ি যেতে চায় না। বুধাদিত্য বলে, বাড়ি ওরা যাবে না, আজ একটা লম্বা ড্রাইভে যাবে। সেই শুনে উচ্ছল তরঙ্গিণীর মতন নেচে উঠে গাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে।
ঝিলামের চোখে মুখে আনন্দের ফোয়ারা, প্রানবন্ত সুরে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় যাবো?”
বুধাদিত্য, “সকালে উঠে তোমার স্কুল যাবার তাড়া নেই, আমার অফিস যাবার তাড়া নেই। কাজের লোক আসার তাড়া নেই, ছেলে পিটিয়ে ঘোড়া বানানোর তাড়া নেই, পয়সার পেছনে দৌড়ানোর তাড়া নেই। একদিন সব তাড়া ছাড়িয়ে, এমনি সারা রাত গাড়ি চালাবো, ব্যাস।”
বুধাদিত্যের গাঢ় গলার আওয়াজ ঝিলামকে নিয়ে যায় এক স্বপ্নপুরীতে। চোখের কোনা চিকচিক করে ওঠে, “চলো নিয়ে, দাঁড়িয়ে কেন?”
গাড়ি ছুটিয়ে দেয়, বিকাজিকামা পেরিয়ে, জয়পুর হাইওয়ে ধরে। ঝিলাম গিয়ারের পাস ঘেঁসে বসে থাকে। খালি রাস্তায়, রাত বারোটা, গাড়ি উদ্দাম গতি নিয়ে ছুটতে শুরু করে। বুধাদিত্যের ইচ্ছে করে এই গাড়ি না থামিয়ে ওকে নিয়ে এই সব সংসারের পাঁক থেকে দুরে কোথাও নিয়ে চলে যায়। ঝিলামের শরীরের উত্তাপ ওর কাঁধে এসে লাগে, ঝিলামের মাথার চুল উড়ে এসে ওর চোখে মুখে কালো পর্দা ফেলে দেয়। নাকে ভেসে আসে সুন্দর মাদকতাময় এক ঘ্রান। এসি বন্ধ করে দেয় ঝিলাম, গাড়ির কাঁচ নামিয়ে দিয়ে রাতের হাওয়ায় নিজেকে ভাসিয়ে দেয়। গাড়ি প্রথম টোলগেট পার হবার পরে একশো ছুঁয়ে যায়। সামনের সারি সারি ট্রাক, একের পর এক বাসের লাইন, বুধাদিত্যের গাড়ি আজ উন্মাদ ঘোড়ার মতন ছুটছে। একের পর এক গাড়ি পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়। দ্বিতীয় টোলগেট পার হবার পরে স্পিডমিটারের কাঁটা একশো কুড়ি, একশো তিরিশের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে। ঝিলামের বুকে জেগে ওঠে এক নব মুক্তির স্বাদ, পাশে বসা এই উন্মাদ ঘোড়ার সাথে হারিয়ে যাবার ইচ্ছে প্রবল ভাবে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।
হটাত গুনগুন করে গান গেয়ে ওঠে ঝিলাম, “কেন কিছু কথা বলো না... শুধু চোখে চোখ রেখে, যা কিছু চাওয়ার আমার নিলে চেয়ে, একি ছলনা, একি ছলনা... কেন কিছু কথা বলো না... যত দূর দূর থাকো, শুধু চেয়ে চেয়ে থাকো, সে চাওয়া আমার, আকাশ আমার বাতাস ভরে রাখো, একি ছলনা, একি ছলনা... কেন কিছু কথা বলো না...”
গানটা শুনে বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, গাড়ির গতি ধিরে করে ঝিলামের দিকে তাকায়। ঝিলাম, গাড়ির অন্যদিকের জানালা দিয়ে ছোটো মেয়ের মতন মাথা বের করে গান গেয়ে চলেছে। এ যেন এক অন্য ঝিলামকে দেখছে, বুধাদিত্য। হটাত বাঁপাশ দিয়ে একটা গাড়ি খুব জোরে হর্ন দিয়ে ছুটে আসে। বুধাদিত্য জোরে ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে দেয়। বাঁ হাতে ঝিলামের জামা টেনে ধরে ভেতর ঢুকিয়ে নিয়ে আসে। টানের ফলে ঝিলাম সোজা বুধাদিত্যের বুকের ওপরে আছড়ে পড়ে। গাড়ির গা ঘেঁসে পাশের গাড়িটা ছুটে বেরিয়ে যায়। ঝিলামের হাত ভেঙে যেতো একটু হলে, বুধাদিত্যের জামার কলার চেপে ধরে কেঁপে ওঠে ঝিলাম। ঝিলামের কোমল শরীর ওর বুকের ওপরে চেপে যায়, সারা শরীরে বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে চলে। আসন্ন বিপদ দেখতে পেয়ে ঝিলামের বুক ভয়ে দুরুদুরু কাঁপে। মুখ লুকিয়ে রাখে বুধাদিত্যের প্রসস্ত বুকের ওপরে। নরম গাল চেপে থাকে বুকের পেশির ওপরে, কানে ভেসে আসে বুধাদিত্যের বুকের ধুকপুক শব্দ। সেই শব্দ যুদ্ধের দামামার মতন প্রবল। বুধাদিত্য বাঁ হাতে ঝিলামকে প্রগাড় ভাবে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে থাকে। চিবুক দিয়ে চেপে ধরে ওর মাথা, বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফেলতে চায় এখুনি। সময় থমকে দাঁড়িয়ে পরে দুজনের বুকের মাঝে। চোখ বন্ধ করে সেই উষ্ণতার রেশ সারা অঙ্গে মাখিয়ে নিতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে ঝিলাম, কিন্তু পারেনা শুধু বিবেকের টানাপোড়েনে।
কিছু পরে জামা ছেড়ে ওর বাহু পাশ ছেড়ে নিজেকে ঠিক করে নেয় ঝিলাম। বুধাদিত্যের বুকের ওপরে ওর মিষ্টি গন্ধ, নরম শরীরের পরশ লেগে থাকে। অলঙ্ঘনীয় কোন স্বাদের দিকে হাত বাড়ানোর ছায়া বুকের মধ্যে বিঁধে যায়। গান থামিয়ে, জানালার বাইরে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকে ঝিলাম। চুপচাপ আবার গাড়ি চালাতে শুরু করে দেয় বুধাদিত্য, গাড়ির গতি কমিয়ে দেয়। মনের ভেতরে একটা উদ্দাম ভাব ছিল সেটা হটাত করে উধাও হয়ে গেল। ঝিলামের দিকে তাকানোর শক্তি হারিয়ে ফেলে বুধাদিত্য। সামনের দিকে তাকিয়ে শূন্য বুকে গাড়ি চালায়। কিছু পরে রাস্তা অনেকটা ফাঁকা হয়ে আসে, রাত অনেক গভীর, সামনে আলো যায় কিন্তু ফিরে আসেনা এমন কালো অন্ধকার। উলটো দিক থেকে শুধু ট্রাকের সারি আর গুমগুম আওয়াজ। হুহু করে ওঠে বুকের মাঝে, শূন্য হৃদয় নিয়ে গাড়ি চালাতে থাকে। অনেক পরে মনে হয় একটু ঝিলামকে দেখে। ঘাড় ঘুড়িয়ে লক্ষ্য করে যে ঝিলাম জানালায় হাত রেখে তার ওপরে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। চোখের কোল বেয়ে সরু একটা শুকনো জলের রেখা নাক পর্যন্ত বয়ে গেছে। রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে একটা সিগারেট জ্বালায়। বুক ভরে ধোঁয়া টেনে নেয়, চোয়াল শক্ত করে বলে, এই বুকে এই ধোঁয়া ছাড়া আর কিছু নেই।
বুধাদিত্যের সম্বিৎ ফিরে আসে ঝিলামের মৃদু ডাকে, “সকাল চারটে বাজে, বাড়ি ফিরবে না?”
কেউই পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে পারেনা। ঝিলাম এখনো সমীরের বউ, জানেনা ঝিলামের মনে কি আছে, সোজাসুজি জিজ্ঞেস করার মতন সাহস নেই বুধাদিত্যের। আয়েশার সাথে সঙ্গমের সময়ে বুধাদিত্যের সেই অবৈধ প্রেম বুকের ভেতরে চরম উত্তেজনা জাগিয়ে তুলেছিল। ঋজু বুধাদিত্য, গত চোদ্দ বছর ধরে দুঃসাহসের সাথে লড়াই করে গেছে জীবনের সঙ্গে, কোন বাধা তাকে আজ পর্যন্ত আটকাতে পারেনি, সেটা নারীসঙ্গ হোক, বা জীবনযুদ্ধ হোক। আজ এই ফুলের মতন ললনার সামনে বুধাদিত্য অতিব ভীতু হয়ে যায়। মাথা নিচু করে গাড়িতে উঠে পড়ে বুধাদিত্য। সারা রাস্তা দুজনে চুপচাপ, শুধু মাত্র গাড়ির আওয়াজ ছাড়া আর কিছু কানে যায় না। গাড়ির আওয়াজ ছাড়া দুজনের কানে অন্য এক আওয়াজ ভেসে আসে, ফাঁকা এক হৃদয়বিদীর্ণ কান্নার আওয়াজ।
বাড়ি ফিরে দু’জনে নিজের নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। বুধাদিত্যের ঘুম আর আসেনা, বুকের বেদনা প্রবল হয়ে ওঠে। দরজা, জানালা বন্ধ করে এসি চালিয়ে দেয়, চেষ্টা করে দিনের আলো সরিয়ে দিয়ে রাত নামিয়ে আনতে। চেষ্টা করে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়তে। কিন্তু বাথরুম থেকে জলের আওয়াজে আর ঘুম হয় না। বুঝতে পারে যে ঝিলাম এক জ্বালায় জ্বলছে, জলে ভরা নদী কিন্তু নিজের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য জল তার কাছে নেই। বুধাদিত্য বিছানায় শুয়ে শুনতে পায় ওর নুপুরের আওয়াজ। ঝিলামের চোখে ঘুম নেই, বাড়ির কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে প্রবল চেষ্টা করে। সারা বাড়ি যেন আজ চকচকে করে দেবে। নিজেই ঝাড়ু পোছা শুরু করে দেয়। আলমারি খুলে সব নোংরা বিছানার চাদর, বালিশের কভার, সোফার কভার নিয়ে কিছু ওয়াশিং মেশিনে কিছু নিজের হাতে কাচতে শুরু করে। নিজের ওপরে অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে চলে, মন কিছুতেই শান্ত হয় না। চোয়াল শক্ত করে চোখ বন্ধ করে বিছানায় পড়ে থাকে বুধাদিত্য। বুঝতে পারে যে ওর ঘরে ঢুকে আলমারি খুলে কাপড় চোপড় নিয়ে গেছে। চোখ খুলে ওকে দেখার শক্তিটুকু নেই।
অনেকক্ষণ পরে ঝিলাম ওর ঘরের দরজায় টোকা মেরে বলে, “স্নান সেরে নাও, খাবার তৈরি হয়ে গেছে।”
বুধাদিত্য চুপচাপ বিছানা ছেড়ে উঠে স্নান সেরে খাবার টেবিলে বসে পড়ে। বাড়ির চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখে, অনেক দিন আগে অনিন্দিতাদি এসে সোফার কভার আর ঘরের পর্দা কিনে দিয়ে গেছিলো। সেইগুলো কোথায় পড়েছিল জানতো না, ঝিলাম সেই সবগুলি আলমারি থেকে বের করে ঘর সাজিয়ে ফেলেছে। মেঝে চকচক করছে, টেবিল চকচক করছে, ব্যালকনিতে একগাদা কাপড় মেলে রাখা। আড় চোখে ঝিলামের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করে যে তাঁর মুখ থমথমে, গম্ভির, চোখের কোন চিকচিক, দুই চোখ একটু লাল। টেবিলে একটা থালা তাতে বুধাদিত্যের খাবার বাড়া।
বুধাদিত্য গম্ভির স্বরে জিজ্ঞেস করে, “তোমার থালা কোথায়?”
ঝিলাম গম্ভির স্বরে উত্তর দেয়, “তুমি খেয়ে নাও আমি পরে খাবো।”
বুধাদিত্য, “সকাল থেকে কিছু খাওনি তো, বসলে কি ক্ষতি আছে?”
ঝিলাম ওর কথার উত্তর না দিয়ে বলে, “ভাত ভাঙো, ডাল দেব।”
বুধাদিত্য, “কালকের মাংসের কিছু বেঁচে ছিল সেটা কোথায়?”
ঝিলাম, “সারা রাত ঘুমাও নি, রাতভর গাড়ি চালিয়েছো, সকালে বাড়ি ফিরে ঘুমাও নি। শরীর খারাপ করে মরার ইচ্ছে আছে?”
বুধাদিত্য আর ঘাঁটাতে সাহস পায়না ঝিলামকে। চুপচাপ খেতে শুরু করে। ঝিলামকে উলটো দিকের চেয়ারে বসে ওকে খেতে দেয়। কেউ কারুর চোখের দিকে সোজাসুজি তাকায় না, একজন যখন তাকায় তখন অন্যজনের মুখ অন্যদিকে থাকে। নিঃশব্দে কথা বলে মানসিক দ্বন্দ।
বুধাদিত্য কিছু পরে জিজ্ঞেস করে, “তোমার গরমের ছুটি কবে থেকে?”
ঝিলাম, “কেন?”
বুধাদিত্য, “না, বাড়ি যাবে বলছিলে, তা টিকিট কাটা হয়ে গেছে?”
ঝিলাম, “আসছে শুক্রবার, তারপরের শুক্রবার থেকে ছুটি। সমীরকে বলেছিলাম টিকিট কাটতে, এর মাঝে...” কথাটা বলেই ফর্সা মুখখানি বেদনায় পাংশু হয়ে যায় ঝিলামের। উলটো হাতে নাক মুছে নেয়, চোখের কোনে যে জলের ফোঁটা চিকচিক করছিল সেটা ওর চোখের লম্বা পাতা ভিজিয়ে দেয়। একটু ধরা গলায় বলে, “খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি।”
বুধাদিত্য চুপচাপ খেয়ে উঠে চলে যায়। স্টাডিতে ঢুকে ল্যাপটপ খুলে বসে পড়ে অফিসের কাজ করতে। কাজে মন ডুবিয়ে দিতে চেষ্টা করে। কিছুতেই মন বসাতে পারেনা, চোখের সামনে ল্যাপটপ খোলা পড়ে থাকে। কিছু পরে জল খাবার জন্য খাবার ঘরে এসে দেখে, ঝিলাম একা একা বসে খাবার খাচ্ছে। খেতে খেতে বারেবারে নাক, চোখ মুছে চলেছে। বুধাদিত্য ওকে না ঘাঁটিয়ে জলের বোতল নিয়ে স্টাডিতে ঢুকে পড়ে।
প্রজেক্টের কাজে নিজেকে ডুবিয়ে দেয় বুধাদিত্য, সময়ের খেয়াল থাকেনা। দুপুর গড়িয়ে, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে যায়। খেয়াল পড়ে যখন ঝিলাম ওর ঘরে ঢুকে ওর সামনে এক কাপ কফি রেখে চলে যায়। পেছন থেকে দেখে ঝিলামের চলে যাওয়া। হটাত চুড়িদার কামিজ পড়েছে, সাধারণত বাড়িতে থাকলে এই কাপড় পরে না। একবার মনে হলো জিজ্ঞেস করবে কিন্তু আর জিজ্ঞেস করা হয় না। অফিসের কয়েকজনের ফোন, প্রেসেন্টেসানের কাজ, কিছু সারভার খুলে দেখা, এই করতে করতে সময় কেটে যায়। মাঝে মাঝে কান পেতে ঝিলামের পায়ের আওয়াজ শুনতে চেষ্টা করে। কিন্তু সেই নুপুরের রিনিঝিনি শব্দ আর শুনতে পায়না। কিছু পরে সামনের দরজা বন্ধ করার আওয়াজ শুনতে পেয়ে চমকে ওঠে। বাইরে বেরিয়ে দেখে, হাতে একটা প্লাস্টিক, ঝিলাম জুতো খুলে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে।
জিজ্ঞেস করে ঝিলামকে, “কোথায় গেছিলে?”
উত্তর দেয় ঝিলাম, “মাছের বাজারে। দুপুরে নিরামিষ খেয়েছো তাই ভাবলাম একটু মাছ আনি।”
বুধাদিত্য, “আমাকে বললেই পারতে আমি নিয়ে আসতাম।”
ঝিলাম, “তুমি কাজে ব্যাস্ত ছিলে তাই আর তোমাকে বিরক্ত করিনি।”
বুধাদিত্য, “আচ্ছা, তোমার প্লেনের টিকিট কেটে দিলে হবে?”
ঝিলাম, “দুর্গাপুরে প্লেন নামে না। পূর্বাতে তৎকালে টিকিট কেটে নেবো।”
বুধাদিত্য, “প্লেনের টিকিট কেটে দেবো খানে। কোলকাতা থেকে গাড়ি ঠিক করে দেবো, তোমাকে দুর্গাপুর পৌঁছে দেবে। আসার দিনেও সেই গাড়ি তোমাকে নিয়ে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দেবে।”
ঝিলাম ঘাড় ঘুরিয়ে বুধাদিত্যের চোখের দিকে তাকায়, অনেকক্ষণ পরে পরস্পরের চার চোখ এক হয়। ঝিলাম ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, দুই চোখ তখন চিকচিক করে। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে থাকে, বুকের ঝড়কে শান্ত করার প্রবল চেষ্টা। ঝিলাম কিছু পরে ওকে বলে, “দেখি ভেবে দেখবো খানে।”
আবার সারা বাড়ি নিস্তব্ধতায় ঢেকে যায়। টিভি দেখতে মন করে না, সোফায় বসে খবরের কাগজে মুখ ডুবিয়ে বসে থাকে বুধাদিত্য। কানে ভেসে আসে অতিপরিচিত নুপুরের ঝঙ্কার, কিন্তু সেই নদীর কলতান যেন হারিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে খবরের কাগজ থেকে মাথা তুলে দেখে ঝিলামকে। সময়ের সাথে সাথে নিজেদের স্বত্তায় ফিরে আসে দুজনে। রাতে দু’জনে এক সাথে খেতে বসে।
ঝিলাম ওকে বলে, “বাড়ির ডুপ্লিকেট চাবিটা দিও।”
বুধাদিত্য, “কেন?”
ঝিলাম, “তোমার অফিসে অনেক কাজ থাকে, রোজ দিন অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায় আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। আমি অটো করে একাই চলে আসবো।”
বুধাদিত্য কিছু বলে না, মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় যে দিয়ে দেবে। কিছু পরে বলে, “কাল দেখি, একটা ড্রাইভারের ব্যবস্থা করে নেবো।”
ঝিলাম, “খাবার পরে একটু ল্যাপটপটা দিও তো, একটু মেইল দেখার আছে আর স্কুলে কিছু কাজ করার আছে।”
একটু অবাক হয়ে যায় বুধাদিত্য, ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার ল্যাপটপ নেই?”
ঝিলাম চিবিয়ে উত্তর দেয়, “তোমার মতন বড়লোক নই যে ল্যাপটপ কিনতে পারবো।”
বুধাদিত্যের সহ্যের বাঁধ ভেঙে যায়, চাপা গলায় বলে, “কি করেছি একবার বলতে পারো? কেন এমন করে কথা বলছো?”
ঝিলাম থালা থেকে মুখ উঠিয়ে ওর চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তারপরে চাপা গম্ভির গলায় বলে, “কিছু করোনি। আমার ভুল, আমি তোমার সাথে এখানে এসেছি। ঠিক আছে, আমি ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসো।”
ঝিলামের চাপা কান্না বুকে বেঁধে রাখে, বুধাদিত্য চেপে যায় বুকের ব্যাথা, ওর কথার কোন উত্তর দেয় না।
পরেরদিন সকাল বেলা উঠে দেখে যে ঝিলাম স্কুলের জন্য বেরিয়ে গেছে। ফ্রিজের ওপরে একটা হলদে স্টিকনোটে লেখা, “কফি, মাইক্রোতে রাখা, কুড়ি সেকেন্ড গরম করে নেবে। উপমা বানিয়ে রেখে গেছি, একটু গরম করে খেয়ে নিও। টিফিন তৈরি করে খাবার টেবিলে রাখা, লাঞ্চের আগে পারলে একবার গরম করে নেবে।”
অফিসে গিয়ে জানতে পারে যে বুধবার অফিসের কাজে চন্ডিগড় যেতে হবে। নিজেকে সেই কাজে ডুবিয়ে দেয়। দুপুরে একবার ভাবে ঝিলামকে ফোন করবে, কিন্তু ইতস্তত ভাবে আর করা হয়না। প্রোডাক্টের ম্যানেজার, রাকেশ সান্ডিল্য, ওকে মজা করে জিজ্ঞেস করে যে ওর গার্লফ্রেন্ড এলো না। ওর কথা হেসে উড়িয়ে দেয়। অফিসের মোটামুটি সবাই আঁচ করে ঝিলাম আর বুধাদিত্যের সম্পর্কের ব্যাপারে। কিন্তু রাকেশ ছাড়া অন্য কেউ ওকে ঘাঁটানোর বিশেষ সাহস করেনি কোনদিন। মাঝেমাঝেই রাকেশ মজা করে, কিন্তু বুধাদিত্য ওর সব কথা মজার ছলে উড়িয়ে দেয়। লাঞ্চের কিছু পরে নেহেরু প্লেসে গিয়ে ঝিলামের জন্য একটা দামী ল্যাপটপ কেনে। রমণীর অভিমান কিছু করে ভাঙাতে হবে, না হলে বাড়ির পরিবেশ দমবন্ধ হয়ে আসছে।
বিকেল পাঁচটায় ঝিলামের ফোন আসে, ফোন ধরতে গিয়ে এক অন্য উত্তেজনায় হাত কেঁপে ওঠে। বুধাদিত্য, “কি হয়েছে?”
ঝিলাম, “কখন বাড়ি ফিরবে?” গলার স্বর অনেক স্বাভাবিক হয়ে গেছে “ঝিল্লি”র।
বুধাদিত্য চাপা হেসে বলে, “কফি বানাও, আমি এই এখুনি আসছি।”
হেসে ফেলে ঝিলাম, “কফি গরম থাকতে থাকতে না পৌঁছালে কিন্তু কফি পাবে না।”
বুধাদিত্যের মন নেচে ওঠে ঝিলামের হাসি শুনে, “একটা সারপ্রাইস গিফট আছে তোমার জন্য।”
ঝিলাম হেসে বলে, “আগে বাড়ি এসে আমাকে উদ্ধার করো, তারপরে দেখবো খানে।”
বুধাদিত্য আর দাঁড়ায়না, ব্যাগ উঠিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। দরজা খুলে দাঁড়ায় ঝিলাম, সেই পুরাতন ঝিলাম, উজ্জ্বল দুই চোখে হাসি ফিরে এসেছে, গালের লালিমা ফিরে এসেছে। উচ্ছল তরঙ্গিণী আবার নিজের মত্ততায় মেতে উঠেছে।
হেসে বলে বুধাদিত্যকে বলে, “কফি বানানোর আগেই উপস্থিত দেখছি। অফিসে কাজ ছিল না নাকি?”
বুধাদিত্য ওর দিকে ঝুঁকে বলে, “কফির কথা শুনে আর থাকতে পারলাম না।”
ঝুঁকে পড়ার জন্য ঝিলামের মুখের ওপরে উষ্ণ শ্বাস বয়ে যায়, বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলে, “হ্যাঁ অনেক হয়েছে।”
“একটা সারপ্রাইস আছে” বুধাদিত্য ওর হাতে ল্যাপটপের বাক্স ধরিয়ে দিয়ে বলে, “তোমার জন্য।”
হাতে ল্যাপটপের বাক্স নিয়ে একটু অবাক হয়ে যায়, তারপরে হেসে ফেলে ঝিলাম, “হটাত কি মনে করে? তোমাকে কিছু বলা মানে তুমি সারা পৃথিবী নিয়ে আসবে মনে হচ্ছে।”
বুধাদিত্য ঘরে ঢুকে বলে, “আমার ল্যাপটপে যাতে আর হানা না দেওয়া হয় তাই নিয়ে এলাম।”
ঝিলাম মজা করে বলে, “কেন তোমার গার্লফ্রেন্ডেদের সাথে কবে কোথায় কি কি কেচ্ছাকলাপ কি করেছো সেই সব ছবি তুলে রেখেছো নাকি? চিন্তা নেই আমি চোখ বন্ধ করে নিতাম ওই ফটো দেখলে।”
চাপা হেসে ফেলে বুধাদিত্য, শুধু মাত্র আয়েশার কয়েকটা ফটো আছে ল্যাপটপে তা ছাড়া অসংখ্য পর্ণ মুভি তো আছেই। ঝিলামের কাঁধে একটু ধাক্কা মেরে বলে, “দেখার সখ আছে নাকি?”
কপট রাগ দেখিয়ে বলে, “যাঃ শয়তান।” বুধাদিত্যের পিঠে আলতো করে চাঁটি মেরে বলে, “যাও ফ্রেস হয়ে নাও, আমি তোমার সঙ্গে চা খাবো বলে বসেছিলাম।”
বুধাদিত্য তাড়াতাড়ি জামাকাপড় ছেড়ে বসার ঘরে এসে বসে। শনিবার রাতে বাজার থেকে চা কিনে আনা হয়েছিল। ঝিলাম নিজের জন্য চা বানায় আর বুধাদিত্যের জন্য কফি।
চা খেতে খেতে ঝিলাম জিজ্ঞেস করে, “কত দাম নিয়েছে ল্যাপটপের?”
বুধাদিত্য, “কেন দাম দেবে নাকি?”
ঝিলাম ভুরু কুঁচকে বলে, “হ্যাঁ টাকা জমিয়ে নিয়ে তোমাকে ফিরিয়ে দেবো।” তারপরে হেসে বলে, “শয়তান, আমাকে নিয়ে যেতে পারলে না, ল্যাপটপ কেনার সময়ে, একটু দেখে নিতাম।”
বুধাদিত্য, “একদম ভালোটা এনেছি, এইচ.পি’র বেশ ভালো ল্যাপটপ। অফিস থেকে সব লোড করে নিয়ে এসেছি। নিয়ে আসো সব দেখিয়ে দিচ্ছি।”
ঘরের পরিবেশ আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়, দু’জনে ল্যাপটপ খুলে বসে পড়ে, ঝিলামের হাজার প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়, “এটা কি? ওটা কি করে খুলতে হয়? একটা হেডফোন আনতে পারোনি, একটু কানে লাগিয়ে গান শুনতাম।”
বুধাদিত্য বলে, “বাড়িতে দামী ফাইভ পয়েন্ট অয়ান মিউসিক সিস্টেম আছে, কবার গান শুনেছো বলতে পারো?”
ঝিলাম ওর কাঁধে আলতো চাঁটি মেরে হেসে বলে, “পরশু দিন কাজে চলে গেল। কাল থেকে মাথার ওইতো খিচুরি করে রেখে দিয়েছিল। তার মধ্যে গান, হ্যাঁ।”
বুধাদিত্য হেসে বলে, “ওকে বাবা সরি। আচ্ছা একটা কথা আছে, বুধবার সকাল বেলা আমাকে চণ্ডীগড় যেতে হবে।”
ঝিলাম, “গাড়িতে যাবে না শতাব্দীতে?”
বুধাদিত্য, “গাড়িতে যাবো, মিটিং শেষ হলেই আবার যাতে ফিরতে পারি।”
ঝিলাম ধমকে ওঠে, “না অত দূর গাড়ি চালিয়ে যেতে হবে না, শতাব্দী করে যেও।”
বুধাদিত্য কোনদিন চণ্ডীগড় ট্রেনে যায়নি, যেতেও চায় না। গাড়ি চালাতে খুব ভালোবাসে বুধাদিত্য। মিটিংয়ে কেউ না কেউ ওর সাথে যায়, পথে তাই কোন কষ্ট হয় না। এবারে রাকেশ যাবে ওর সাথে। বুধাদিত্য ওকে বলে, “না কোন প্রবলেম নেই গাড়ি চালাতে।”
ঝিলাম, “ড্রাইভার খুঁজে পেয়েছো?”
বুধাদিত্য একদম ভুলে গেছিল ড্রাইভারের কথা, জিব কেটে বলে, “যাঃ একদম ভুলে গেছি।”
ঝিলামের আরও এক চাঁটি বুধাদিত্যের পিঠের ওপরে, রেগে মেগে বলে, “আগে একটা ড্রাইভার খুঁজবে। যদি কালকের মধ্যে ড্রাইভার পাও তাহলে গাড়িতে যাবে না হলে ট্রেনে যাবে। একা গাড়িতে আমি যেতে দেবো না। ব্যাস শেষ কথা।”
বুধাদিত্য, “আচ্ছা বাঃবা, আমি ফোন করে দেখছি।”
ঝিলাম, “ড্রাইভার পঁয়তাল্লিশ পঞ্চাসের কাছাকাছি হতে হবে, তাঁর পুলিস ভেরিফিকেশান করাতে হবে।”
বুধাদিত্য ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “অত বয়স কেন?”
ঝিলাম, “একটু বয়স্ক ড্রাইভার ভালো গাড়ি চালায়, ধিরে সুস্থে গাড়ি চালায়, আর অন্তত এদিক ওদিক তাকায় না।”
হেসে ফেলে বুধাদিত্য, বুঝতে পারে ঝিলাম কি বলতে চায়, “তুমি আর বোলো না, তুমি রাস্তা দিয়ে হাঁটলে, আবালবৃদ্ধবনিতা তোমার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। সে আমি বুড়ো আনি কি জোয়ান ড্রাইভার আনি।”
ঝিলাম লজ্জায় লাল হয়ে যায়, “ধুত, অনেক হয়েছে তোমার। যা বলছি সেটা করো। আমি রান্না করতে চললাম।”
ঝিলাম উঠে পরে রান্না করতে চলে যায়। অগত্যা বুধাদিত্যকে বেশ কয়েকজনকে ফোন করতে হয় ড্রাইভারের জন্য, না হলে আর গাড়ি নিয়ে যেতে দেবে না। এমনিতে একটা ড্রাইভারের দরকার ছিল, ঝিলামকে স্কুল থেকে আনার জন্য। আগে যখন ছেড়ে আসতে হতো তখন মাঝে মাঝে বুধাদিত্যকে মিটিং ছেড়ে বা কোন কাজ ছেড়ে আসতে হতো। ড্রাইভার থাকলে সেই অসুবিধেগুলো হবে না। যাদের ফোন করেছিল, তারা জানায় যে পরেরদিন বিকেলের মধ্যে ড্রাইভার যোগাড় করে দেবে।
পরেরদিন যথারীতি কেটে যায় কাজে কর্মে। বিকেলবেলায় দুটি ড্রাইভার আসে, তাদের মধ্যে একজনের কথাবার্তা শুনে আর কাজের কথা শুনে ঝিলাম তাকে কাজে নিযুক্ত করে। ড্রাইভার বিহারী নাম কালিনাথ, বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ। ঝিলাম ওকে কাজ বলে দেয়, যে সকালবেলা, বুধাদিত্যকে অফিসে ছেড়ে দিতে হবে, তারপরে দুপুরে ওকে স্কুল থেকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আবার অফিসে যেতে হবে। বিকেলে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তবে ছুটি, যদি কখন বিকেলে কাজ থাকে তাহলে দেরি করে ছুটি পাবে। বুধাদিত্য চুপচাপ ঝিলামকে দেখে, অতি নিপুণ হস্তে সব কিছু করে চলেছে। ড্রাইভার চলে যাবার পরে বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে যে এবারে ওর মন শান্ত হয়েছে কিনা। হেসে ফেলে ঝিলাম, বলে যে তাড়াতাড়ি খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়তে, পরেরদিন চণ্ডীগড় যেতে হবে।
পরেরদিন বুধবার, সকালবেলা ঝিলাম ঠেলে বুধাদিত্যকে উঠিয়ে দেয়। ঘুম চোখে উঠে স্নান সেরে তৈরি হয়ে নেয়। ঝিলাম ওর আগেই উঠেছে দেখে একটু অবাক হয়ে যায়। অবশ্য ওর অনেক সকালে ওঠার অভ্যাস আছে। কফি বানিয়ে দেয়। কালিনাথকে বারবার বলে দেয় ঠিকভাবে গাড়ি চালাতে। ম্যাডামের কথা অমান্য করে না। বুধাদিত্যের আঁকাবাঁকা রেখার জীবন সরল রেখায় চলতে শুরু করে। চণ্ডীগড় পৌঁছানো মাত্র ঝিলাম ফোন করে জেনে নেয় যে ঠিকভাবে পৌঁছেছে কিনা। সারাদিন কাজের মধ্যে খুব ব্যস্ত থাকে, সারাদিনে আর ফোন করা হয়ে ওঠেনি। রাখেশ ফেরার পথে ফোঁড়ন কাটে, কিরে শালা, গার্লফ্রেন্ডকে ফোন করে জানাবি না? তখন বুধাদিত্যের মনে পড়ে ঝিলামকে ফোন করা হয়নি। সন্ধ্যে হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি ফোন করে ঝিলামকে। ঝিলাম ফোন তুলেই একটু সাবধান বানী শুনিয়ে দিল, যে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে আর কালিনাথকে ধিরে সুস্থে গাড়ি চালাতে। ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়, ঝিলাম ওর জন্য না খেয়ে বসে থাকে। বাড়ি ফিরে ঝিলামের মুখের হাসি দেখে সারাদিনের ক্লান্তি কেটে যায় এক নিমেষে। ঝিলাম ওর হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে স্টাডিতে রেখে দেয়, ওর জন্য জল এনে দেয়। বুধাদিত্যের বড় ইচ্ছে করে নিবিড় আলিঙ্গনে বাঁধতে, আবার ওই পুরানো দ্বিধা বোধ ওকে আটকে দেয়। ওই মিষ্টি হাসি হারাতে চায় না, সময়ের ওপরে সব ছেড়ে দেয়।
শুক্রবার সকালবেলা ঝিলাম যথারীতি স্কুলে বেরিয়ে গেছে। এই কদিনের মধ্যে সমীরের বা অন্য কারুর ফোন আসেনি, ঝিলামের খোঁজ নেবার জন্য। ঝিলামকে জিজ্ঞেস করেনি, সমীরের কথা, ফোন করেছিল কিনা সেটাও জানা হয়নি। বুধাদিত্য অফিসের কাজে ব্যস্ত, ঠিক লাঞ্চের পরে ঝিলামের ফোন আসে। গলা শুনে মনে হলো খুব ত্রস্ত আর উদ্বেগ মাখা।
ঝিলামের গলা কাঁপছে, “বাড়ি আসতে পারো এখুনি?”
বুধাদিত্য, “তুমি কোথায়?”
ঝিলাম, “আমি বাড়িতে, গাড়ি তোমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।”
বুধাদিত্য, “কি হয়েছে?”
ঝিলাম, “সমীর এসেছে বাড়িতে, তুমি প্লিস এখুনি বাড়ি আসো।”
সমীরের নাম শুনেই মাথায় রক্ত চড়ে যায় বুধাদিত্যের। চোয়াল শক্ত করে ঝিলামকে বলে, “সামনের দরজা খোলা রেখে দেবে, আর বসার ঘরে বসিয়ে রাখবে। ফোন অন রাখো, কিছু হলে যেন আমি শুনতে পাই।”
ঝিলাম কাতর কণ্ঠে ডাক দেয়, “প্লিস, তাড়াতাড়ি এসো।”
তাড়াতাড়ি ব্যাগ নিয়ে কালিনাথকে গাড়ি চালাতে বলে। বাড়িতে ঢোকার আগে, প্যাসেঞ্জার সিটের নীচ রাখা বাক্স থেকে পিস্তলটা বের করে প্যান্টের পেছনে গুঁজে নেয়। একটু এদিক ওদিক করলে সমীরের মাথার মধ্যে সব কটা গুলি নামিয়ে দেবে, তারপরে যা হবার হবে, যদি মরতে হয় তাহলে বুকের মাঝে ঝিলামের ভালোবাসা নিয়ে মরবে। দৌড়ে তিনতলার সিঁড়ি চড়ে। বাড়িতে এসে দেখে, ঝিলাম কথা মতো বাড়ির সদর দরজা হাঁ করে খুলে রেখেছে। সমীর মাথা নিচু করে সোফার ওপরে বসে আর ঝিলাম বেশ কিছু দুরে খাবার টেবিলের পাশে চেয়ারে বসে। বুধাদিত্য একবার সমীরের দিকে তাকায়, একবার ঝিলামের দিকে তাকায়। ওকে দেখে, ঝিলাম প্রানে বল পায়। সমীর ওর দিকে মাথা তুলে তাকায়, চোখ মুখ বিধ্বস্ত পরাজিত সৈনিকের মতন। দুই চোখ লাল, কিন্তু সেই করুন চোখ, মিনতি ভরা চাহনি বুধাদিত্যকে শান্ত করতে পারে না।
ওর সামনের সোফায় বসে ধির গম্ভির গলায় সমীরকে জিজ্ঞেস করে, “কি মনে করে এখানে আসা হয়েছে?”
সমীর মাথা নিচু করে উত্তর দেয়, “আমি বড় পাপী, ঝিলামকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। তার প্রায়শ্চিত্ত করতে এসেছি।”
বুধাদিত্য চোয়াল চেপে দাঁত পিষে জিজ্ঞেস করে, “হটাত এই বোধোদয় হওয়ার কারন? নন্দিতা কি লাথি মেরেছে তোর গাঁড়ে?”
সমীর আলতো মাথা দুলিয়ে বলে, হ্যাঁ। বুধাদিত্য ঘাড় ঘুড়িয়ে ঝিলামের দিকে তাকায়। ওর চোখে জল, একবারের জন্য ভেবেছিল যে সমীর অন্য কারুর সাথে শুতে পারে। কিন্তু সেই কথা স্বামীর মুখে শুনে স্থম্ভিত হয়ে গেছে ঝিলাম। স্বামী এক অন্য মেয়ের প্রেমে পড়ে ওকে ছেড়ে দিয়েছিল, আর সেই স্বামী আবার ফিরে এসেছে। কি করবে ঝিলাম, কিছু বুঝে উঠতে পারে না।
বুধাদিত্য, “তোর বাবা মা’র সাথে কথা বলতে চাই, তারপরে ঝিলামকে এই বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে পারবি।”
সমীর নিচু গলায় বলে, “বাবা মায়ের সাথে কথা হয়েছে আমার। আমার কার্যকলাপে তারা মর্মাহত।”
বুধাদিত্য চিবিয়ে বলে, “এই বোকা... আমাকে গরু পেয়েছো? তুই শুয়োরের বাচ্চা, বললি আর আমি বিশ্বাস করে নিলাম। এখুনি শালা ফোন লাগা কোলকাতায়, লাউডস্পিকারে দে, আমি কথা শুনতে চাই।” ঝিলামকে ইঙ্গিত করে যে পাশের সোফায় এসে বসতে। ঝিলাম ধির পায়ে বুধদিত্যের পাশের সোফায় এসে বসে পড়ে।
নিরুপায় সমীর প্রথমে ইতস্তত করে, কিন্তু বুধাদিত্যের লাল চোখের সামনে ঝুঁকে যায়। ফোন লাগায় কোলকাতায়, সমীরের মা ফোন ধরেন। ফোন ধরা মাত্রই ঝিলাম ওর হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সব কিছু বলে দেয়। সমীরের মা চুপ করে কিছুক্ষণ শোনেন সব কথা। তারপরে সমীরকে উত্তমমধ্যম বকা দিতে শুরু করেন। বলেন যে, ঝিলাম যদি চাকরি করতে চায় সে ভালো কথা, ওকে চাকরি করতে দিতে হবে, আর ঝিলামকে যদি কোনদিন কষ্ট দেয় তাহলে এক কথায় ত্যাজ্যপুত্র করে দেবেন। সমীরের বাবা প্রচন্ড রেগে যান, এক কথায় জানিয়ে দেন, যে মা লক্ষ্মীর মতন মেয়ে ঝিলামকে যদি একটুও চোখের জল ফেলতে দেখে তাহলে সমীরকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। সমীরের চোখে জল, মুখ থমথমে, বুকের মাঝে পরিতাপের ছায়া। সব কথা শোনার পরে লুটিয়ে পড়ে ঝিলামের পায়ের কাছে।
পা ধরে বলে, “শেষ বারের মতন ক্ষমা করে দাও ঝিলাম। দয়া করে আমাকে ফিরিয়ে নাও।”
সমীরের বুক ফাটা কান্না দেখে ঝিলাম কেঁদে ফেলে, একবার বুধাদিত্যের মুখের দিকে তাকায়। বুধাদিত্যে সামনে ওর ভালোবাসা চলে যায়, বুধাদিত্য চোয়াল শক্ত করে ঠোঁটে হাসি আনে। মাথা দুলিয়ে সমীরের সাথে যাবার সম্মতি দেয়। বুক ভেঙে আবার টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ভেবেছিল সময়ের সাথে সাথে ঝিলামকে ওর কোলে টেনে নেবে, কিন্তু সমীরের কান্না আর পরিতাপের ডাক শুনে সেই স্বপ্ন দূর অস্ত। ঝিলাম চুপচাপ উঠে নিজের ঘরে চলে যায় কাপড় পরার জন্য আর ব্যাগ গুছানোর জন্য।
সমীর চোখের জল মুছে হাত জোর করে বুধাদিত্যের সামনে বসে থাকে। বুধাদিত্য গর্জে ওঠে ওর মুখ দেখে, “মাদা... ওই কুমিরের কান্না আমাকে দেখাবি না। শালা তোকে আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস হয় না, শুধু মাত্র ঝিলামের মুখ দেখে তোকে ছেড়ে দিলাম।” পিস্তল বের করে টেবিলে ওপরে রেখে দেয়। সমীরের নাকের সামনে তর্জনী নাড়িয়ে বলে, “ভাবিস না তোকে ছেড়ে দিলাম আমি। ঝিলামের চুল যদি বাঁকা হয়, আমি প্রতিজ্ঞা করছি, এই পিস্তলের সব গুলি তোর মাথার মধ্যে নামিয়ে দেবো। আমার আগে পেছনে কাঁদার কেউ নেই, বুঝলি। আমি তোকে খুন করে জেলে যেতে রাজি।”
ত্রস্ত চোখে তাকিয়ে থাকে সমীর, কাতর কণ্ঠে বলে, “না রে, আমি তোর পায়ে ধরে ক্ষমা চাইছি।”
বেশ কিছু পরে ঝিলাম শাড়ি পরে, হাতে একটা সুটকেস নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। জল ভরা চোখে বুধাদিত্যের দিকে তাকায়, একবার সারা বাড়ির দেয়ালের দিকে তাকায়। বুধাদিত্য চুপ করে বসে থাকে, চোখের সামনে ঝিলামকে ছেড়ে দিতে বুক কেঁপে ওঠে। কালিনাথকে ডেকে বলে ওদের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আসতে। ঝিলাম ওর সামনে এসে দাঁড়ায়, কিন্তু কথা বলতে পারে না, দু’চোখে অঝোর ধারায় বন্যা বয়ে চলে। বুধাদিত্য মাথা তুলে তাকাতে পারেনা ঝিলামের মুখের দিকে। ঝিলাম ওর মাথায় আলতো করে হাত ছোঁয়ায়, তারপরে ধির পায়ে সমীরের পেছন পেছন ঝিলাম বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। কালিনাথ ঝিলামের ব্যাগ নিয়ে আগেই নিচে নেমে যায়। ঝিলাম চলে যাবার পরে দরজা খোলা পড়ে থাকে। স্বপ্ন দেখেছিল বুধাদিত্য, ঝিলামকে ওই দরজা দিয়ে এই বাড়ির গৃহিণী করে আনার। সেই ঝিলামকে শেষ পর্যন্ত সমীরের হাতে সঁপে দিতে হয়। মন মানে না, কিন্তু ঝিলাম যে সমীরের বিয়ে করা, আইনসিদ্ধ স্ত্রী। বাড়ির চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে বুধাদিত্য, বাড়ির আনাচে কানাচে ঝিলামের হাতের ছোঁয়া লেগে। সব জায়গায় ঝিলামের নাম লেখা। একবার মনে হয় এই শোয়ার ঘর থেকে ঝিলাম বেরিয়ে আসবে।
খানিক পরে দেখে ঝিলাম ওর দরজায় দাঁড়িয়ে। মৃদু হেসে মাথা নাড়ায় বুধাদিত্য, সত্যি পাগল হয়ে গেছে ঝিলামের প্রেমে, দরজায় দাঁড়িয়ে ঝিলামের ছায়া। সম্বিৎ ফিরে পায় যখন রক্ত মাংসের ঝিলাম দৌড়ে এসে ওর বুকের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরে। বুধাদিত্যের বুক সেই প্রেমের পরশে হুহ করে কেঁপে ওঠে। প্রানপন শক্তি দিয়ে ঝিলামকে জড়িয়ে ওর মাথার ওপরে ঠোঁট চেপে ধরে। ঝিলাম দুই হাতে আঁকড়ে ধরে থাকে বুধাদিত্যের ঋজু দেহ। এই বুকের ওপর থেকে যেন মৃত্যুই ওকে ছিনিয়ে নেয় আর কারুর ক্ষমতা থাকে না ওকে বিচ্ছিন্ন করার।
বেশ কিছু পরে ধরা গলায় ঝিলাম ওকে বলে, “সুটটা কিন্তু কাল দেবে, মনে করে নিয়ে এসো যেন। বড় আলমারির লকারে আমার সব গয়না আর আমার সার্টিফিকেটগুলো রাখা। আমার জিনিসগুলো ছড়িয়ে দিও না আবার। দরকার পড়লে নিয়ে যাবো, না হলে এখানেই থাক।” বুকের ওপরে ঠোঁট চেপে ধরে ঝিলাম, কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমি চলে যাবার পরে প্লিস আর মদ খেও না।” বহু কষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, “আমি চললাম বুধো, ভালো থেকো।”
“বুধো” নাম শুনে চোখ বন্ধ করে নেয় বুধাদিত্য, আলতো করে ওর গালে হাত দিয়ে বলে, “চলি বলতে নেই ঝিল্লিরানি, বলে আসছি।”
“ঝিল্লিরানী” কোন রকমে “বুধো”র হাত ছাড়িয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। বেরিয়ে যাবার আগে একটু বহু কষ্টে ঠোঁটে হেসে টেনে বলে, “সোমবার গাড়ি পাঠাতে ভুলোনা, আমি অপেক্ষা করে থাকবো।”