What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

pinuram রচনাসমগ্র (1 Viewer)

একাদশ পর্বঃ অপ্রকাশিত বন্ধন।

কাজের চাপ ভীষণভাবে বেড়ে যায়, প্রায় দিন অফিসে রাত কাটাতে হয়। বাড়ি ফিরলেও শুধু মাত্র স্নান আর একটু ঘুমানোর জন্য। পুনে থেকে ফিরে ঝিলামের সাথে দেখা করা হয়ে ওঠে না। ওর সান্নিধ্যে যদি ঝিলামের প্রতি কোন বিরূপ আচরন করে সমীর, তাহলে ঝিলাম বুধাদিত্যকে দোষারোপ করবে ওদের সুখের সংসারে আগুন লাগানোর জন্য। মাথার মধ্যে শুধু ঝিলামের চিন্তা ঘুরে বেড়ায়। একবারের জন্য মনে হয় যে মোবাইলে তোলা ছবি, ভিডিও আর ওদের কথোপকথন ঝিলামকে শুনিয়ে দেয়। কিন্তু ভয় হয়, সব শুনে ঝিলাম যদি আত্মহত্যা করে ফেলে তাহলে? বেশ কিছু দিন এমন ভাবে কেটে যায়। কোনদিক থেকে কোন খবরাখবর আসে না। প্রত্যেক দিন ভাবে এই ঝিলামের ফোন আসবে, কিন্তু সেই খবর আর আসে না। একবার ভাবে যে সমীরের বাড়ি যাবে দেখে আসবে ঝিলামকে, কিন্তু সমীরের শেষ বাক্য ওকে বাধা দেয়। সমীর সেই আগের তেলু নেই, অনেক বদলে গেছে, অনেক হিংস্র আর কুটিল হয়ে উঠেছে।

গ্রীষ্মকাল, সকাল বেলার কাঠ ফাটা রোদ শান্ত পরিবেশ ঝলসে দেয়। সবে অফিস পৌঁছেছে বুধাদিত্য, এমন সময়ে ঝিলামের ফোন আসে। গলার স্বর শুনে মনে হলো, খুব ক্লান্ত। ওর ক্লান্ত গলার আওয়াজ শুনে বুধাদিত্যের বুক হুহু করে ওঠে। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে ঝিলাম কোথায়? ঝিলাম জানায় যে স্কুলে এসেছে কিন্তু স্কুল করার ইচ্ছে নেই ওর। ব্যাগ হাতে করে বেরিয়ে পড়ে বুধাদিত্য, ঝিলামের গলার স্বর শুনে মনে হয় আর অফিস করে দরকার নেই, এবারে কিছু একটা বিহিত করা উচিত।

ঝিলাম স্কুলের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল, কাঁধে ব্যাগ, পরনে হাল্কা নীল রঙের সুতির শাড়ি। দূর থেকে দেখলে সবাই সুন্দরী বলবে, কিন্তু শুধু বুধাদিত্য জানে যে ওই কাজল কালো দু’চোখের পেছনে লুকিয়ে আছে হৃদয় ভাঙার শত সহস্র টুকরো। বুধাদিত্যের গাড়ি দেখে ছোটো পায়ে এগিয়ে এসে, গাড়ির দরজা খুলে সামনের সিটে এসে বসে পড়ে। চোখের পাতা ভিজে, ফর্সা গাল লাল, নাকের ডগা লাল। চোখে দেখে মনে হলো যেন ঘুম হয়নি গত রাতে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে বুধাদিত্য। ঝিলাম মাথা নিচু করে আঙুলের নখ খোঁটে কিছুক্ষণ। তারপরে ওর দিকে জলভরা চোখে তাকিয়ে বলে, “একটু বিষ দিতে পারো আমায়?”

চোয়াল শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্যের, চাপা গলায় বলে, “শুয়োরের বাচ্চাটা কোথায়?”

ঝিলাম উলটো হাতে চোখের কোল মুছে উত্তর দেয়, “আজ সকালের ফ্লাইটে বম্বে গেছে, এবারে নাকি অনেক লম্বা টুর। বম্বে থেকে আরও অনেক জায়গা নাকি যাবার আছে। ফিরবে সাত আট দিন পরে।”

ঝিলাম রাতের কথা বলতে শুরু করে। বেশ কয়েকদিন ধরে সমীর রোজ রাতে মদে চুর হয়ে আসে। ঝিলাম কিছু বলতে গেলেই ওকে বলে যে, ঝিলাম নিজের মতন থাকতে পারে আর ওকে যেন ওর কোন চালচলন নিয়ে না ঘাঁটায়। সমীর সোজাসুজি ঝিলামকে জানিয়ে দেয় যে পরস্পরের যৌনজীবন যেন কেউ আঘাত না করে। ঝিলামের সাথে তুমুল ঝগড়া হয় সমীরের, সারা রাত দুজনের কেউ ঘুমায়না। রাতে একবার বুধাদিত্যের কথা মনে পড়েছিল ঝিলামের, ফোন করতে যায়। কিন্তু সমীর ধমকে ওঠে, হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বলে বুধাদিত্য ওর মাথা খেয়েছে, এর মধ্যে যেন ওকে না ডাকা হয়।

ডুকরে কেঁদে ওঠে ঝিলাম, শেষ পর্যন্ত সমীর ওকে বলে যে যদি ডিভোর্স চায় তাহলে সমীর ওকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে। সেই শুনে ওর পায়ের নিচের মাটি সরে যায়। আত্মহত্যা করার ভয় দেখিয়েছিল; সেই শুনে সমীর বলে আত্মহত্যা করতে হলে যেন ও চলে যাবার পরে করে। সকালবেলা চলে যাবার আগে জানিয়ে যায়, যে টুর থেকে এসে বাড়ির লোকজন ডেকে একটা বিহিত করবে। ঝিলাম জানায় যে ওর বাবা মা হয়তো সব শুনে ওকে বলবে চাকরি ছেড়ে স্বামীর সেবা করতে। এত সব হয়ে যাবার পরে সেটা করতে পারবে না ঝিলাম।

দুচোখে অঝোর ধারায় জল পড়ে যায়, কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমার আজকাল ওর সাথে কথা বলতে, এক ছাদের নিচে থাকতে পর্যন্ত খারাপ লাগে। মনে হয় দুটি অজানা অচেনা প্রাণী এক ঘরের মধ্যে আটকে পড়ে আছে। দম বন্ধ হয়ে যায় আমার।”

বুধাদিত্য চুপ করে সব কথা শুনে তারপরে বলে, “শুয়োরের বাচ্চাটা আসুক তারপরে একটা বিহিত করা যাবে।”
বুধাদিত্য গাড়ি চালিয়ে ঝিলামের বাড়ির নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। ঝিলাম চুপ করে গাড়িতে বসে থাকে। বুধাদিত্য ওর কাঁধে হাত রাখে, ওর হাতের পরশে কেঁপে ওঠে ঝিলাম।

চোখে জল, ঠোঁটে একটু খানি হেসে নিয়ে বুধাদিত্যের দিকে তাকিয়ে বলে, “খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার। তোমাকে বলে মনের দুঃখ কেটে গেছে। আমাকে আবার স্কুলে পৌঁছে দিয়ে এসো।”

বুধাদিত্য হেসে ফেলে, “পাগলি মেয়ে কোথাকার।” কাঁধের গোলায় আলতো চাপ দিয়ে বলে, “ঠিক করে বলো, আবার স্কুলে গিয়ে বলবে যে বাড়ি নিয়ে যাও তাহলে কিন্তু রাস্তার মাঝে ছেড়ে দেবো।”

চোখের জল মুছে হেসে ফেলে ঝিলাম, “না সত্যি বলছি। ফালতু একটা সি.এল মেরে লাভ নেই, আমাকে স্কুলে ছেড়ে দাও প্লিস।” ঝিলামের চোখ মুখ কুঁচকে “প্লিস” বলাতে, বুধাদিত্যের মনে হলো জড়িয়ে ধরে ওই লাল গোলাপের কুঁড়ির মতন ঠোঁটে চুমু খায়।

অগত্যা বুধাদিত্যকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে আবার স্কুলে ফিরে যেতে হয়। স্কুলের গেটের সামনে নামিয়ে দিয়ে বুধাদিত্য ঝিলামকে পেছন থেকে ডেকে বলে, “ঝিল্লি, স্কুল শেষ হলেই অফিসে চলে এসো।”

ঝিলাম ওর কথা শুনে মাথা নাড়ায়, হ্যাঁ। কিন্তু পরক্ষনে কানে বেজে ওঠে “ঝিল্লি” নাম। থমকে দাঁড়িয়ে বুধাদিত্যের দিকে তাকায় বড় বড় চোখ করে। বুধাদিত্যের খেয়াল হয় যে ঝিলামকে আদর করে “ঝিল্লি” বলে ডেকে ফেলেছে, দাঁত চেপে হেসে ফেলে। ঝিলাম নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে চোখের লাজুক ভাব লুকিয়ে গেটের ভেতরে ঢুকে যায়।

সারা সকাল কাজে মন বসাতে পারে না বুধাদিত্য, ল্যাপটপ সামনে খোলা। অগুনতি মেইল আসে, কয়েকটার উত্তর দেয়। মাঝে মাঝেই ঘড়ি দেখে, কখন দুটো বাজবে আর ঝিলাম ওকে এসে ডাক দেবে। সময় যেন কাটতে চায় না আর। অফিসের কয়েকজনের সেই ইতস্তত ভাব চোখে পড়ে যায়। অনেকেই জিজ্ঞেস করে, সুকৌশল উত্তর দিয়ে এড়িয়ে যায় সবার প্রশ্ন।

ঠিক লাঞ্চের পরেই ঝিলামের আবির্ভাব। চেহারার বিষণ্ণ ভাব কেটে বেশ খুশির জোয়ার খেলে বেড়ায়। স্কুল থেকে রোদে হেঁটে আসার ফলে ফর্সা ঝিলাম লাল হয়ে গেছে। বুধাদিত্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওর গালের লালিমা উপভোগ করে। বড় বড় চোখ করে ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে যে কি দেখছে? মিচকি হেসে ফেলে বুধাদিত্য। গাড়িতে করে ঝিলামকে বাড়িতে নিয়ে যায়।

বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে ঝিলামকে বলে, “একা একা বাড়িতে থাকবে?”

ঝিলাম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “কি করবো আর, এর পর থেকে একাই হয়তো কাটাতে হবে।”

সেই দীর্ঘশ্বাস বুধাদিত্যের বুকে বড় বাজে, একটু নিচু গলায় বলে, “যদি কিছু মনে না করো তাহলে একটা কথা বলতে পারি।” ঝিলাম ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কি কথা? বুধাদিত্য একটু ইতস্তত করে বলে, “জামা কাপড় প্যাক করে আমার বাড়িতে চলে এসো।”

বুধাদিত্যের সাহস দেখে ক্ষণিকের জন্য থমকে যায়। তারপরে হেসে ফেলে বলে, “বিকেলে অফিস ফেরত আমাকে নিয়ে যেও, আমি তৈরি থাকবো।”

উত্তর শুনে বুধাদিত্যের হৃদয় খুশিতে নেচে ওঠে। দু’চোখ চকচক করে ওঠে, কিন্তু চোয়াল শক্ত করে সেই অভিব্যক্তি চেহারার ওপরে আনতে দেয় না। ঝিলামের চোখ এড়ায় না, ওর দুই চোখের ভাষা। ঝিলাম ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজের খুশি চেপে রাখে। ঝিলাম ফ্লাটে ঢোকার জন্য পা বাড়ায়, বুধাদিত্য দাঁড়িয়ে থাকে গাড়ির কাছে। সুন্দরী অপ্সরা যতক্ষণ না দরজা দিয়ে ঢুকে যায়, ততক্ষণ চেয়ে থাকে ওর যাওয়ার পথে। অফিসে ফিরে কাজে মন বসাতে চেষ্টা করে বুধাদিত্য। এর মাঝে সি.টি.ও ডাক আসে, কিছু প্রেসেন্টেসানের জন্য। এক ঝটকায় ঝিলামকে মাথার থেকে বের করে আবার কাজে ডুবে যায়। হাতে দু’দুটো প্রোজেক্ট, একটা অস্ট্রেলিয়ার, একটা পুনের, মাথায় বাজ পড়েছে। দ্বিতীয় অর্ধে কাজে ডুবে গিয়ে সময়ের দিকে আর খেয়াল থাকে না বুধাদিত্যের।

সময়ের খেয়াল পড়ে ঝিলামের ফোনে। ওপাশ থেকে ধমকে ওঠে “ঝিল্লি”, “সাড়ে ছটা বাজে, সময়ের খেয়াল আছে? আমাকে নাকি নিতে আসছিলে? কোথায় মরতে বসেছো?” বুধাদিত্যের তখন খেয়াল পরে যে ঝিলামকে নিয়ে বাড়ি যেতে হবে। একদম ভুলে গেছিল সে কথা। বুধাদিত্য ক্ষমা চাইতেই ঝিলাম অভিমানী সুরে ধমক দেয়, “সব পুরুষ মানুষ এক রকমের। দেরি হবে তা একবার ফোন করে জানাতে পারোনি? আর আসতে হবে না তোমাকে।” ভীষণ রেগে গেছে ঝিলাম, রেগে মেগে ফোন রেখে দেয়।

বুধাদিত্য তড়িঘড়ি করে ব্যাগ কাঁধে ফেলে গাড়ি ছুটিয়ে দেয়। খুব ভয়ে ভয়ে দরজায় টোকা মারে। অভিমানিনী ঝিলাম দরজা খুলে ভেতর দিকে হাঁটা দেয়। ঝিলামের চুড়িদারের ওড়না দরজার ছিটকিনিতে আটকে টান পড়ে যায়। ঝিলাম কেঁপে ওঠে এক অজানা ভয়ে, একা পেয়ে বুধাদিত্য ওর সতীত্ব হরন করতে চলেছে? রেগে মেগে চেঁচিয়ে ওঠে ঝিলাম, “তোমার এত সাহস যে আমাকে একা পেয়ে শেষ পর্যন্ত...” হাত উঠিয়ে বুধাদিত্যকে থাপ্পড় মারতে যায়। থাপ্পড়টা হাওয়ায় ঘুরে দরজায় লাগে। বুধাদিত্য কিছুই বুঝতে পারেনা। পেছনে দাঁড়িয়ে ঝিলামের এই অদ্ভুত আচরনের মানে খুঁজতে চেষ্টা করে। ঝিলাম দরজায় থাপ্পড় মারার পরে বুঝতে পারে যে ওড়না ছিটকিনিতে আটকে গেছে। লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে ওড়না ছিটকিনি থেকে খুলে নেয়। বুধাদিত্য হেসে ফেলে ওর লাল নাকের ডগা দেখে।

বুধাদিত্য, “তোমার মারা পেটা হয়ে গেলে, একটু বাড়ির দিকে রওনা দিতে পারি।”

খিলখিল করে হেসে ফেলে ঝিলাম, পেছনে সরে গিয়ে ওকে সোফার ওপরে বসতে বলে। মাথা তুলে বুধাদিত্যের চোখে চোখ রাখতে লজ্জা করে, নিজের আচরনের জন্য। রান্না ঘর থেকে দু’কাপ কফি নিয়ে এসে ওর হাতে ধরিয়ে দেয় এক কাপ। মিষ্টি লাজুক গলায় ওকে বলে, “একটু বসো, আমি এখুনি তৈরি হয়ে আসছি।”

বুধাদিত্য, “আর কি তৈরি হবে, ভালোই তো কাপড় পরে আছো বেশ তো লাগছে। একে গাড়িতে তো যাবে, পায়ে হাওয়াই চটি পরে গেলেও কেউ জানতে পারবে না।”

হেসে ফেলে ঝিলাম, “দাঁড়াও বাবা, এখুনি অফিস থেকে এসেছো, একটু তো বসবে নাকি?”

বুধাদিত্য, “সে তো ওই বাড়ি গিয়েও বসা যাবে।”

ঝিলাম মাথা নাড়ায়, “তুমি না সত্যি... ঠিক আছে চলো।” নিজের ঘর থেকে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

সারাটা রাস্তা ঝিলামের কল্লোলে বুধাদিত্যের কান গুঞ্জরিত হয়। সারাদিনের স্কুলের গল্প বলতে শুরু করে। গাড়ি চালায় আর আড় চোখে দেখে ঝিলামকে। অর্ধেক কথা কানে যায়, অর্ধেক কথা কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। বুধাদিত্য শুধু তাকিয়ে থাকে ওর লাল ঠোঁটের দিকে, তোতাপাখীর মতন কিচিরমিচির করে কথা বলছে আর নড়ছে, সেই সাথে নরম পাতলা আঙুলের নড়াচড়া। শরীরের সুগন্ধে গাড়ির ভেতর ভরে গেছে, ওই মাদকতাময় রুপের কাছে হার মেনে গেছে বুধাদিত্য। পুরানো ঝিলাম ফিরে এসেছে এক নতুন ভাবে। পারলে বুকের এক কোনায় লুকিয়ে রেখে দেবে এই তরঙ্গিণীকে।

প্রচন্ড গরম, ঘরে ঢুকেই এসি চালিয়ে দেয় বুধাদিত্য। ঝিলামের থাকার জন্য বুধাদিত্য নিজের শোয়ার ঘর ছেড়ে দেয়। প্রথমবার নিজের শোয়ার ঘরে অন্য একজনের পায়ের ছাপ। ঝিলাম ওকে জিজ্ঞেস করে কোথায় শোবে, উত্তর বুধাদিত্য জানায় যে গেস্ট রুমে থাকবে এই কটা দিন। বুধাদিত্য ওর ব্যাগ আলমারিতে ঢুকিয়ে রেখে নিজের জামা কাপড় নিয়ে বেরিয়ে যায়। ঝিলাম বাথরুমে ঢুকে পড়ে। বুধাদিত্য মনের মধ্যে আনন্দের খই ফোটে, অবশেষে ভালোলাগার রমণী ধরা দিয়েছে। কয়েকটা দিনের জন্য হলেও, চোখের সামনে থাকবে “ঝিল্লি”। হাত মুখ ধুয়ে বারমুডা আর গেঞ্জি পরে বসার ঘরে বসে থাকে। মন বারেবারে উঁকি মারে শোয়ার ঘরে, ঝিলামের অপেক্ষায় এক মিনিট যেন এক বছর বলে মনে হয়। কাঁধে তোয়ালে, চোখ মুখ তরতাজা, সকালের বিষণ্ণতার লেশমাত্র নেই শরীরে। সারা অঙ্গে এক নতুন মাদকতা, এক নতুন প্রাণশক্তি নিয়ে ঝিলাম বেরিয়ে আসে বাথরুম থেকে। পরনে একটা ঢিলে টপ আর গাড় নীল রঙের স্লাক্স। ওর যৌবনের ডালি ফুলে ফুলে ভরা। সেই রুপসুধা দুই চোখে আকণ্ঠ পান করে বুধাদিত্য।

ঝিলাম ফ্রিজ খুলে বলে, “কাঁচা বাজার তো কিছু নেই, একটু বাজারে গিয়ে কিছু নিয়ে এসো।”

বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে, “খাসির মাংস নিয়ে আসি?”

ঝিলাম আলতো ধমক দেয়, “এই গরমে খাসির মাংস খেতে হবে না। পারলে সি.আর.পার্ক না হয় গোবিন্দপুরি থেকে ট্যাঙরা মাছ নিয়ে এসো।”

বুধাদিত্য, “আমি ট্যাঙরা ফ্যাংরা চিনিনা, কাটা কাতলা না হলে রুই নিয়ে আসবো।”

ঝিলাম, “চেনোটা কি, তাহলে? বাঙালি হয়ে মাছ চেনো না?”

বুধাদিত্য, “ছোটোবেলা থেকে হস্টেলে মানুষ, মাছ চেনাবার মতন কেউ কোনদিন পাশে ছিলো না।”

ঝিলামের মনে পড়ে যায় বুধাদিত্যের অতীতের কথা। মন কেমন করে ওঠে ওর চোখ দেখে, মিষ্টি গলায় বলে, “আজ তাহলে সামনে থেকে কিছু কাঁচা বাজার করে নিয়ে এসো, কাল মাছের বাজার যাওয়া যাবে।”

বুধাদিত্য, “যথাআজ্ঞা ঝিল্লিরানী।” খিলখিল করে হেসে ফেলে ঝিলাম, ওর মুখে “ঝিল্লি” নাম শুনে বুকের ভেতরে প্রজাপতি পাখা মেলে নেচে ওঠে। বুধাদিত্য গায়ে একটা টিশার্ট পরে বাজারে বেরিয়ে যায়। সাধারণত সপ্তাহে একদিন বাজার করলে ওর চলে যায়, কিন্তু এবার থেকে মনে হয় ঝিলাম প্রত্যকে দিন বাজারে পাঠাবে। কাঁচা সবজি কিনে বাড়ি ফিরে দেখে রান্না ঘরে ঝিলাম। ঘরে যা ছিল তাই দিয়ে রাতের খাবার তৈরি করে ফেলেছে প্রায়। বুধাদিত্যকে দেখে বলে, সবজিগুলো ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিতে। রাতে তাড়াতাড়ি খেতে হবে। বুধাদিত্য মুখ কাঁচুমাচু করে জানায় যে রাত দশটা এগারোটার আগে ও খায় না। ধমকে দেয় ঝিলাম, রাতে তাড়াতাড়ি খেতে হয় তারপরে না হয় টিভি দেখতে পারে বা নিজের কাজ করতে পারে। ঝিলামকে সকালে উঠতে হয় স্কুল যাবার জন্য। পরেরদিন শনিবার, ছুটি, কি করবে অত সকালে উঠে, সেই শুনে ঝিলাম একটু শান্ত হয়। বুধাদিত্য কাতর চোখে এক কাপ কফির আবেদন করে, ঝিলাম কপট রেগে জানিয়ে দেয় এত রাতে কফি খেলে ভাত খেতে পারবে না। বুধাদিত্য বুঝতে পারে যে ওর জীবনের অঙ্ক এক নতুন খাতায় আঁচড় কাটতে শুরু করেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিলামকে দেখে যায়। হাঁটুর নিচ থেকে গোড়ালি পর্যন্ত খালি, ফর্সা পায়ের গুলির মসৃণ ত্বক আলোতে চকচক করছে, পরনের কাপড় এঁটে বসে ওর কোমরের নিচে। জড়িয়ে ধরে ওর ফর্সা গোলাপি গালে চুমু খেতে ইচ্ছে করে। কোনোরকমে সেই মনোবৃত্তি সামলে নেয়।

রাতের খাওয়া দাওয়া ঝিলামের চাপের ফলে তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে হয়। খাওয়ার পরে নিজের ঘরে ঢুকে যায় ঝিলাম।

ঝিলাম, “এসি বন্ধ করে দাও, এই দুদিনে এসিতে থেকে আমার অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে। পরে তো আর এসি পাবো না।”

বুধাদিত্য, “আমার অভ্যেস খারাপ করে দিচ্ছ যে? অত সকালে উঠতে পারবো না আমি।”

ঝিলাম, “ঠিক আছে, শুধু ছুটির দিনে ছুটি, উইক ডেইসে কিন্তু আমার সাথে উঠতে হবে।”

বুধাদিত্য, “অত সকালে উঠে আমি কি করবো?”

ঝিলাম, “কাজের লোক সকালে আসে তার সাথে দাঁড়িয়ে থেকে ঘর পরিষ্কার করাবে।”

বুধাদিত্য, “বাপরে, ওই সব আমার দ্বারা হয় না। কুতুব মিনার থেকে লাফ দিতে বললে লাফ দিয়ে দেবো।”

ঝিলাম, “ঠিক আছে তোমাকে দেখতে হবে না। কাল এলে আমি ওকে বলে দেবো বিকেলে আসতে। আমিও স্কুল থেকে ততক্ষণে ফিরে আসবো, তারপরে ওকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেবো।”

বুধাদিত্য, “তাহলে আমার টিফিনের কি হবে?”

ঝিলাম, “স্কুল বের হবার আগে তোমার টিফিন বানিয়ে দিয়ে যাবো।”

বুধাদিত্য ম্লান হেসে বলে, “কতদিন ঝিলাম, কতদিন করবে?”

হটাত ওই কথা শুনে হারিয়ে যায় ঝিলাম। বুকের ভেতর হুহু করে কেঁদে ওঠে, কতদিন এই সুখ? হয়তো ক্ষণিকের। দুজনেই মনের ভাব ব্যক্ত করে না। শুধু চোখে চোখে কথা হয়। ঝিলাম চোখ নিচু করে ঘরের আলো বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। বুধাদিত্য চুপচাপ বসার ঘরে বসে টিভি চালিয়ে দেয়। চোখের সামনে বিশাল টিভির স্ক্রিনে আলাস্কার সবুজ, নীল অদ্ভুত সুন্দর নর্দান লাইটস ঝকমক করছে, মনের ভেতরে ঝিলামের চোখের জল ভেসে যায়। চুপ করে সিগারেট জ্বালিয়ে একটার পর একটা সিগারেট টানতে থাকে। সময়ের খেই হারিয়ে ফেলে বুধাদিত্য, ডিসকভারি চ্যানেলে কি চলছে, কি চলছে না, কিছুই মাথায় ঢোকে না। চিন্তাশক্তি লোপ পেয়ে গেছে ওর, মাথা শূন্য। কি করে ওই ইতর, নীচ, বিশ্বাসঘাতক সমীরের কবল থেকে মুক্ত করা যায় এই ফুলের কুঁড়িকে। একমাত্র উপায়, যদি ওদের ডিভোর্স হয়, না হলে এই জীবনে ঝিলামকে বুকে পাওয়ার স্বপ্ন শুধুমাত্র স্বপ্ন থেকে যাবে। অতি সযত্নে রাখা সেই সুন্দর ইভিনিং ড্রেসিংগাউন আলমারির কোনায় পড়ে থাকবে।

“কি হলো এখন ঘুমাতে যাওনি?” ঝিলামের ঘুম জড়ানো কণ্ঠস্বর শুনে বুধাদিত্য আচমকা সোজা হয়ে বসে। শোয়ার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ঘুমঘুম চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “পারে বটে মানুষটা। রাত একটা বাজে যাও ঘুমাতে যাও। ডিসকভারিতে আর কিছু নতুন দিচ্ছে না।” নিরুপায় বুধাদিত্য, ঝিলামের আদেশের সামনে নিজেকে সমর্পণ করে শুতে চলে যায়।

এতদিন সকাল বেলা একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারতো বুধাদিত্য। সুন্দরী এক নদীর ঝঙ্কারে সকাল থেকে বাড়ি মুখরিত। কাজের লোক সকাল বেলা এসে যায়। তাকে নিয়ে ব্যস্ত বাড়ির নতুন রাজ্ঞী “ঝিল্লি”। বিছানায় শুয়ে আধোঘুমে আধজাগরন, “ঝিল্লি”র কলতান কানে ভেসে আসে, “সারা বরতন ধোকে পেহেলে স্লাব পে রাখ দেনা, ফির পানি ঝড়নে কে বাদ উঠাকে রাখনা।” “ইয়ে সোফাকে নিচে ঠিক সে ঝাড়ু লাগা, উওহ কোনে মে ক্যায় হ্যায়, উধর নেহি কিয়া ক্যা? ইয়হান পোছা মার ঠিক সে, নেহি দুবারা মার।” সেই কলতান মধুর করে তোলে পায়ের নুপুরের আওয়াজ। গতকাল ছিল না, সকালে হয়তো পরেছে। বুধাদিত্য টের পায়, ওর ঘরে ঢুকে ওর গায়ের ওপরে চাদর একটু টেনে দেয়। এসি বন্ধ করে, ফ্যান চালিয়ে দেয়। নিচু স্বরে কাজের লোককে আদেশ দেয়, “সাব কা বিস্তর কে নিচে ঠিক সে ঝাড়ু পোছা লাগা দেনা।” বুধাদিত্য আধাচোখ খুলে নতুন রাজ্ঞীর রুপ দর্শন করে। সকালেই মনে হয় স্নান সেরে নিয়েছে, ভিজে চুল পিঠের ওপরে মেলে ধরা, চেহারায় ভোরের সূর্য ঝলমল করছে পরনে ঢিলে প্যান্ট, গায়ে ঢিলে একটা জামা। ওর চোখ খোলা দেখে মিষ্টি হেসে, ঘুম থেকে উঠতে বলে। মুক্তো সাজানো দাঁতের ঝিলিক দেখে বুধাদিত্য কাতর চোখে আবেদন করে, একটু ঘুমাতে দাও? মাথা নাড়ায় ঝিলাম, ঠিক আছে, কিন্তু মাত্র এক ঘন্টা, ন’টার সময়ে উঠিয়ে দেবে। তাই সই, মাথার নিচের বালিস মাথার ওপরে চেপে ধরে আবার স্বপ্নের মধ্যে ডুবে যেতে চেষ্টা করে বুধাদিত্য। স্বপ্নে তলিয়ে যায় প্রান, তরঙ্গিণীর সুরে তালে নেচে ওঠে পাগল বুধাদিত্য। তপ্ত বালুকাবেলায় আবার জেগে ওঠে ভালোবাসার মরূদ্যান।

“দাঁত মেজে নাও এবারে, কফি বানিয়ে ফেলেছি।” দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আদেশ দেয় ঝিলাম, “কি হলো, ওদিকে ফিরে আর শুতে হবে না। কাল মাংস খাবে বলছিলে? আনতে যাবে না?”

অগত্যা বুধাদিত্য উঠে পড়ে। অর্ধখোলা চোখের সামনে ঝিলামকে দেখে মনে হয় ভাসাভাসা মেঘের আড়ালে দাঁড়িয়ে স্বর্গের অপ্সরা ওর দিকে তাকিয়ে হাসে। কফি হাতে বসার ঘরে বসে ঝিলামকে দেখে, সারা ঘর নেচে বেড়ায় সেই সুন্দরী তরঙ্গিণী। থেকে থেকেই কানে ভেসে আসে ঝিলামের কণ্ঠস্বর, “চা খাও না? শুধু কফি! ধুর, আমার কফি একদম ভালো লাগে না। বিকেলে আমাকে নিয়ে একটু বাজারে বেরিও, অনেক কিছু কেনার আছে।” “শুধু রান্না ঘরটা বড়, হাড়ি কড়া বলতে কিছুই নেই। কি করে কাটালে এত দিন?” “একি, জ্যামটা শুকিয়ে চিনির দলা হয়ে গেছে? খাও না যখন ফালতু কিনতে যাও কেন?” “বরফের ট্রে ভেঙে গেছে, একটা কিনতে পারো না?” “স্টাডি টেবিল সিগারেট খেয়ে পুড়িয়ে দিয়েছো? মরন আমার, অ্যাশট্রে কোথায়?” “ওয়াশিং মেশিনের কভার কোথায়? দাগ পড়ে গেছে সারা গায়ে। বাড়িতে একটা কলিন্স নেই।” একটা কাগজ পেন ছুঁড়ে দেয় ওর দিকে, “একটা লিস্ট বানাও আমি বলছি, বিকেলে কিনতে যেতে হবে।” “জিরে, ধনে, শুকনো লঙ্কা, লঙ্কা গুঁড়ো, কালা মিরচ, যইত্রি, জায়ফল, গোলাপ জল, কালো জিরে, মুগ ডাল, মটর ডাল, ছোলার ডাল, অরহর ডাল, সানফ্লাওয়ার তেল, সরষের তেল...”

বুধাদিত্য লিখে চলে চুপচাপ, ফর্দ তৈরি হয়ে গেলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “আর কিছু বাকি আছে? না না, মনে করে নাও।”

ঝিলাম, “মনে পড়লে আবার বলবো, কাগজটা ওখানে রেখে দিয়ে এবারে দই আর মাংস নিয়ে এসো।”

বুধাদিত্য, “তোমার দরকার পড়লে নিজে লিখে নিও, আমাকে জ্বালাতে যেও না।”

ঝিলাম হেসে বলে, “আহা রাগ দেখ। ঠিক আছে আমি লিখে নেব। উঠে পড়ো আর মাংস আনতে যাও।”

দুপুরে খাওয়ার পরে ঝিলাম বুধাদিত্যকে বলে বিকেলে বাজার করার পরে ওর বাড়িতে নিয়ে যেতে। জানায় যে ওই বাড়ি থেকে আরও জিনিসপত্র আনতে হবে, বুধাদিত্যের রুকস্যাক আর একটা সুটকেস খালি করতে বলে। ঝিলাম জানায় যে ওর একটা বড় আলমারি চাই। বুধাদিত্য বড় আলমারি খুলে দেয়, সারিসারি সুট টাঙানো আর ওর কিছু জামাকাপড় ছাড়া আর কিছু নেই। একপাশে ভাঁজ করে রাখা ঝিলামের দেওয়া সুট পিস। সেটা দেখে ঝিলাম একটু রেগে যায়, বুধাদিত্য জানায় যে সময়ের অভাবে আর সেটা বানানো হয়নি। ফের আদেশ হয় যে বিকেলে বেরিয়ে বাজার করে, সুটের মাপ দিয়ে ওকে যেন একবার ওর বাড়িতে নিয়ে যায়। ঝিলাম ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র বের করে আলমারি সাজিয়ে নেয়।

বিকেল বেলা ঝিলামের সাথে বাজার করতে যেতে হয় অগত্যা বুধাদিত্যকে, তারপরে কালকাজির একটা নামকরা সুটের দোকানে ঢুকে ওর সুটের মাপ দেওয়া হয়। সবশেষে ঝিলামের বাড়ি গিয়ে ব্যাগ আর সুটকেস ভর্তি করে নিজের জিনিস। দুটি ব্যাগ, একটা সুটকেস, একটা মেকআপ বাক্স, সব নিয়ে ভালো করে তালা দিয়ে ঝিলাম বেরিয়ে পড়ে। ওর মুখ দেখে মনে হয় যেন এই বাড়িতে আর পা রাখার মন নেই। সমীর এলে ওর সাথে একটা বিহিত করতে চায়। এই একদিনে ওর মনের জোর অনেক বেড়ে গেছে, ওর পাশে ওর সব থেকে বড় শক্তি দাঁড়িয়ে, বুধাদিত্য।

রাতের খাওয়ার পরে ঝিলাম শোয়ার ঘরে ঢুকে বুধাদিত্যকে ওর মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে। বলে যে সমীরের কাছে শুনেছিল যে ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ে ওর মা মারা যান। সেই শুনে ঝিলাম সেদিন পায়েস বানিয়ে এনেছিল। বুধাদিত্য চুপ করে মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে, ছোটো বেলার কথা মনে পড়ে যায়, মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। চোখের কোনে একচিলতে জল ছলকে আসে। ঝিলাম ওর কাঁধে হাত রাখতেই শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্য। হেসে জানায় যে পুরানো ব্যাথা জাগিয়ে কি হবে। ঝিলাম ওই চোখের আড়ালে ঘন কালো মেঘের দেখা পায়। জিজ্ঞেস করে ওর বাবা কোথায়? চোয়াল শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্যের, ক্রুর চোখে তাকায় ঝিলামের দিকে, মনে হয় যেন ইচ্ছে করেই ধাক্কা দিল ঝিলাম। সুবির গুহকে যত বার ভুলে যেতে চায় ততবার কেউ কেন ওকে মনে করিয়ে দিতে আসে। আরও রেগে যায় যখন দেবস্মিতার মুখ ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। চোয়াল চেপে ঝিলামকে বলে, যে এক সুন্দরী নারীর কবলে পড়ে ওর বাবা ওকে ছেড়ে, ওর মাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। ঝিলামের বুক কেঁপে ওঠে বুধাদিত্যের ব্যাথার কাহিনী শুনে। হাত বাড়িয়ে ওকে ছুঁতে যায়, কিন্তু বুধাদিত্য কারুর অনুকম্পায় বাঁচতে নারাজ। গত চোদ্দ বছরে একা থেকে ওর হৃদয় পাথরের মতন কঠিন হয়ে গেছে। বুধাদিত্য বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। ঝিলাম চুপ করে থাকে, ভাবে একি করে ফেললো।

ঝিলাম ওর পাশে বসে নিচু গলায় বলে, “আমি সরি, আমি জানতাম না এই সব। সত্যি বলছি জানলে আমি আঘাত দিতাম না তোমাকে।”

ম্লান হেসে বলে, “জানি তুমি জানতে না, ঠিক আছে ছেড়ে দাও ও সব কথা। আমি মিস্টার সুবির গুহর ব্যাপারে কোন কথা বলতে চাই না।”

ঘরের আবহাওয়া সেই পুরানো ব্যাথার কাঁপুনিতে বদ্ধ হয়ে ওঠে। ঝিলাম চেষ্টা করে সেই বদ্ধ ভাব কাটিয়ে দিতে, বুধাদিত্যকে বলে, “এই, আইস্ক্রিম খেতে যাবে?”

বুধাদিত্য, “পাগল হলে নাকি? এত রাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আইস্ক্রিম খাবে?”

ঝিলাম, “ধুর বোকা, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কে আইস্ক্রিম খাবে। ইন্ডিয়া গেট গিয়ে আইস্ক্রিম খাবো, প্লিস চলো না, একদম না করবে না।”

কাষ্ঠ হাসি হাসে বুধাদিত্য, “সবাই তাদের বউ না হয় গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ওখানে আইস্ক্রিম খেতে যায়।”

ঝিলাম, “বাঃরে, আমি তোমার বান্ধবী নই? আমি মেয়ে আবার বান্ধবি, ব্যাস ইংরাজি মানে গার্লফ্রেন্ড।” ঝিলাম ইংরাজির শিক্ষিকা, সেও জানে সে কি বলেছে আর বুধাদিত্য জানে সে কি শুনেছে। দু’জনের মুক ভাষা পরস্পরের বুকের মাঝে হাজার বাক্য রচনা করে চলে। ঝিলাম দৌড়ে গিয়ে ঘর থেকে নিজের জন্য একটা স্টোল আর বুধাদিত্যের জন্য একটা টিশার্ট নিয়ে আসে। স্টোল নিজের গলায় জড়িয়ে ওর হাতে টিশার্ট ধরিয়ে দিয়ে বলে, “চলো।”

হাঁ করে তাকিয়ে থাকে বুধাদিত্য, “সত্যি তুমি যাবে?” আপাদমস্তক একবার ঝিলামকে দেখে নেয়। ঢিলে প্যান্ট ঢিলে শার্ট, মাথার চুল একটা রবার ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে নেয়। ঝিলাম ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে বলে, চলো, দাঁড়িয়ে কেন? নিজের পরনে শুধু একটা বারমুডা আর টিশার্ট।

ইনোভা দাঁড় করায় রাজপথে। রাত প্রায় এগারোটা বাজে, সারা দিল্লী ঘুমিয়ে শুধু রাজপথে লোকের ভিড়, সবাই গাড়ি চেপে এসেছে এখানের হাওয়া খেতে আর আইস্ক্রিম খেতে। হলদে আলো সাড় বেঁধে দাঁড়িয়ে, ইন্ডিয়াগেটের অমর জওয়ান জ্যোতি থেকে সেই প্রেসিডেন্ট ভবন পর্যন্ত। চারদিকে লোকের ভিড়। গাড়ি থেকে নেমেই ছোটো মেয়ের মতন দৌড় লাগায় আইস্ক্রিম ঠেলা দেখে। বুধাদিত্য গাড়ি বন্ধ করার আগেই দুটি আইস্ক্রিম কিনে আনে। ঝিলাম গাড়ির পাশে ঠেস দিয়ে মনের আনন্দে আইস্ক্রিম চাটে আর সামনের দিকে তাকিয়ে আলো আর মানুষ দেখে। বুধাদিত্য ভাবে আইস্ক্রিম চাটবে না ঝিলামের ফর্সা গাল। গোলাপি নরম গালে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করে, একটু ছুঁতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছেটা বড় প্রবল হয়ে ওঠে বুধাদিত্যের, ওর দিকে হাত বাড়িয়ে ওর গাল থেকে চুলের গোছা সরিয়ে দেয়। আচমকা গালের ওপরে উষ্ণ হাতের পরশে কেঁপে ওঠে ঝিলাম, ভুরু কুঁচকে বুধাদিত্যের দিকে তাকায়।

বুধাদিত্য মিচকি হেসে বলে, “গালের পাশে একটা কিছু লেগে ছিল সেটা সরিয়ে দিলাম।”

ঝিলাম ছোটো মেয়ে নয়, ওর বোঝার ক্ষমতা আছে যে কোন অছিলায় বুধাদিত্য ওর একটু পরশ চায়। বুকের মাঝে এক অব্যক্ত টান অনুভব করে, বৈধ না অবৈধ জানেনা। ঝিলাম ওর উষ্ণ আঙ্গুলের পরশে একটু গলে যায়, ওর পাস ঘেঁসে দাঁড়ায়। বাজুর সাথে বাজু ছুঁয়ে যায়, শরীরের সাথে শরীর মৃদু চেপে যায়। দুই তৃষ্ণার্ত নরনারীর শরীরে উত্তাপ ছড়াতে বেশি দেরি হয় না। বুধাদিত্যের কঠিন বাজু্র পেশির ওপরে মাথা হেলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বুকের ভেতরে এক নিরাপত্তার ভাব জেগে ওঠে।

ঝিলামকে আলতো ধাক্কা মেরে বলে, “আরও কয়েকটা আইস্ক্রিম কিনে নিয়ে এসো, যাও।”

ঝিলামের মুখে হাসি আর ধরে না, প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, “সত্যি!!!”

বুধাদিত্য মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ সত্যি... যাও তারপরে গাড়ি ওঠ।”

ঝিলাম দৌড়ে গিয়ে আরও দুটি আইস্ক্রিম কিনে নিয়ে আসে। ততক্ষণে বুধাদিত্য গাড়ির মধ্যে উঠে পড়ে। ঝিলাম কাতর চোখে তাকিয়ে অনুরোধ করে যে এখুনি বাড়ি যেতে চায় না। বুধাদিত্য বলে, বাড়ি ওরা যাবে না, আজ একটা লম্বা ড্রাইভে যাবে। সেই শুনে উচ্ছল তরঙ্গিণীর মতন নেচে উঠে গাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে।

ঝিলামের চোখে মুখে আনন্দের ফোয়ারা, প্রানবন্ত সুরে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় যাবো?”

বুধাদিত্য, “সকালে উঠে তোমার স্কুল যাবার তাড়া নেই, আমার অফিস যাবার তাড়া নেই। কাজের লোক আসার তাড়া নেই, ছেলে পিটিয়ে ঘোড়া বানানোর তাড়া নেই, পয়সার পেছনে দৌড়ানোর তাড়া নেই। একদিন সব তাড়া ছাড়িয়ে, এমনি সারা রাত গাড়ি চালাবো, ব্যাস।”

বুধাদিত্যের গাঢ় গলার আওয়াজ ঝিলামকে নিয়ে যায় এক স্বপ্নপুরীতে। চোখের কোনা চিকচিক করে ওঠে, “চলো নিয়ে, দাঁড়িয়ে কেন?”

গাড়ি ছুটিয়ে দেয়, বিকাজিকামা পেরিয়ে, জয়পুর হাইওয়ে ধরে। ঝিলাম গিয়ারের পাস ঘেঁসে বসে থাকে। খালি রাস্তায়, রাত বারোটা, গাড়ি উদ্দাম গতি নিয়ে ছুটতে শুরু করে। বুধাদিত্যের ইচ্ছে করে এই গাড়ি না থামিয়ে ওকে নিয়ে এই সব সংসারের পাঁক থেকে দুরে কোথাও নিয়ে চলে যায়। ঝিলামের শরীরের উত্তাপ ওর কাঁধে এসে লাগে, ঝিলামের মাথার চুল উড়ে এসে ওর চোখে মুখে কালো পর্দা ফেলে দেয়। নাকে ভেসে আসে সুন্দর মাদকতাময় এক ঘ্রান। এসি বন্ধ করে দেয় ঝিলাম, গাড়ির কাঁচ নামিয়ে দিয়ে রাতের হাওয়ায় নিজেকে ভাসিয়ে দেয়। গাড়ি প্রথম টোলগেট পার হবার পরে একশো ছুঁয়ে যায়। সামনের সারি সারি ট্রাক, একের পর এক বাসের লাইন, বুধাদিত্যের গাড়ি আজ উন্মাদ ঘোড়ার মতন ছুটছে। একের পর এক গাড়ি পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়। দ্বিতীয় টোলগেট পার হবার পরে স্পিডমিটারের কাঁটা একশো কুড়ি, একশো তিরিশের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে। ঝিলামের বুকে জেগে ওঠে এক নব মুক্তির স্বাদ, পাশে বসা এই উন্মাদ ঘোড়ার সাথে হারিয়ে যাবার ইচ্ছে প্রবল ভাবে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।

হটাত গুনগুন করে গান গেয়ে ওঠে ঝিলাম, “কেন কিছু কথা বলো না... শুধু চোখে চোখ রেখে, যা কিছু চাওয়ার আমার নিলে চেয়ে, একি ছলনা, একি ছলনা... কেন কিছু কথা বলো না... যত দূর দূর থাকো, শুধু চেয়ে চেয়ে থাকো, সে চাওয়া আমার, আকাশ আমার বাতাস ভরে রাখো, একি ছলনা, একি ছলনা... কেন কিছু কথা বলো না...”

গানটা শুনে বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, গাড়ির গতি ধিরে করে ঝিলামের দিকে তাকায়। ঝিলাম, গাড়ির অন্যদিকের জানালা দিয়ে ছোটো মেয়ের মতন মাথা বের করে গান গেয়ে চলেছে। এ যেন এক অন্য ঝিলামকে দেখছে, বুধাদিত্য। হটাত বাঁপাশ দিয়ে একটা গাড়ি খুব জোরে হর্ন দিয়ে ছুটে আসে। বুধাদিত্য জোরে ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে দেয়। বাঁ হাতে ঝিলামের জামা টেনে ধরে ভেতর ঢুকিয়ে নিয়ে আসে। টানের ফলে ঝিলাম সোজা বুধাদিত্যের বুকের ওপরে আছড়ে পড়ে। গাড়ির গা ঘেঁসে পাশের গাড়িটা ছুটে বেরিয়ে যায়। ঝিলামের হাত ভেঙে যেতো একটু হলে, বুধাদিত্যের জামার কলার চেপে ধরে কেঁপে ওঠে ঝিলাম। ঝিলামের কোমল শরীর ওর বুকের ওপরে চেপে যায়, সারা শরীরে বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে চলে। আসন্ন বিপদ দেখতে পেয়ে ঝিলামের বুক ভয়ে দুরুদুরু কাঁপে। মুখ লুকিয়ে রাখে বুধাদিত্যের প্রসস্ত বুকের ওপরে। নরম গাল চেপে থাকে বুকের পেশির ওপরে, কানে ভেসে আসে বুধাদিত্যের বুকের ধুকপুক শব্দ। সেই শব্দ যুদ্ধের দামামার মতন প্রবল। বুধাদিত্য বাঁ হাতে ঝিলামকে প্রগাড় ভাবে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে থাকে। চিবুক দিয়ে চেপে ধরে ওর মাথা, বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফেলতে চায় এখুনি। সময় থমকে দাঁড়িয়ে পরে দুজনের বুকের মাঝে। চোখ বন্ধ করে সেই উষ্ণতার রেশ সারা অঙ্গে মাখিয়ে নিতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে ঝিলাম, কিন্তু পারেনা শুধু বিবেকের টানাপোড়েনে।

কিছু পরে জামা ছেড়ে ওর বাহু পাশ ছেড়ে নিজেকে ঠিক করে নেয় ঝিলাম। বুধাদিত্যের বুকের ওপরে ওর মিষ্টি গন্ধ, নরম শরীরের পরশ লেগে থাকে। অলঙ্ঘনীয় কোন স্বাদের দিকে হাত বাড়ানোর ছায়া বুকের মধ্যে বিঁধে যায়। গান থামিয়ে, জানালার বাইরে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকে ঝিলাম। চুপচাপ আবার গাড়ি চালাতে শুরু করে দেয় বুধাদিত্য, গাড়ির গতি কমিয়ে দেয়। মনের ভেতরে একটা উদ্দাম ভাব ছিল সেটা হটাত করে উধাও হয়ে গেল। ঝিলামের দিকে তাকানোর শক্তি হারিয়ে ফেলে বুধাদিত্য। সামনের দিকে তাকিয়ে শূন্য বুকে গাড়ি চালায়। কিছু পরে রাস্তা অনেকটা ফাঁকা হয়ে আসে, রাত অনেক গভীর, সামনে আলো যায় কিন্তু ফিরে আসেনা এমন কালো অন্ধকার। উলটো দিক থেকে শুধু ট্রাকের সারি আর গুমগুম আওয়াজ। হুহু করে ওঠে বুকের মাঝে, শূন্য হৃদয় নিয়ে গাড়ি চালাতে থাকে। অনেক পরে মনে হয় একটু ঝিলামকে দেখে। ঘাড় ঘুড়িয়ে লক্ষ্য করে যে ঝিলাম জানালায় হাত রেখে তার ওপরে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। চোখের কোল বেয়ে সরু একটা শুকনো জলের রেখা নাক পর্যন্ত বয়ে গেছে। রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে একটা সিগারেট জ্বালায়। বুক ভরে ধোঁয়া টেনে নেয়, চোয়াল শক্ত করে বলে, এই বুকে এই ধোঁয়া ছাড়া আর কিছু নেই।

বুধাদিত্যের সম্বিৎ ফিরে আসে ঝিলামের মৃদু ডাকে, “সকাল চারটে বাজে, বাড়ি ফিরবে না?”

কেউই পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে পারেনা। ঝিলাম এখনো সমীরের বউ, জানেনা ঝিলামের মনে কি আছে, সোজাসুজি জিজ্ঞেস করার মতন সাহস নেই বুধাদিত্যের। আয়েশার সাথে সঙ্গমের সময়ে বুধাদিত্যের সেই অবৈধ প্রেম বুকের ভেতরে চরম উত্তেজনা জাগিয়ে তুলেছিল। ঋজু বুধাদিত্য, গত চোদ্দ বছর ধরে দুঃসাহসের সাথে লড়াই করে গেছে জীবনের সঙ্গে, কোন বাধা তাকে আজ পর্যন্ত আটকাতে পারেনি, সেটা নারীসঙ্গ হোক, বা জীবনযুদ্ধ হোক। আজ এই ফুলের মতন ললনার সামনে বুধাদিত্য অতিব ভীতু হয়ে যায়। মাথা নিচু করে গাড়িতে উঠে পড়ে বুধাদিত্য। সারা রাস্তা দুজনে চুপচাপ, শুধু মাত্র গাড়ির আওয়াজ ছাড়া আর কিছু কানে যায় না। গাড়ির আওয়াজ ছাড়া দুজনের কানে অন্য এক আওয়াজ ভেসে আসে, ফাঁকা এক হৃদয়বিদীর্ণ কান্নার আওয়াজ।

বাড়ি ফিরে দু’জনে নিজের নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। বুধাদিত্যের ঘুম আর আসেনা, বুকের বেদনা প্রবল হয়ে ওঠে। দরজা, জানালা বন্ধ করে এসি চালিয়ে দেয়, চেষ্টা করে দিনের আলো সরিয়ে দিয়ে রাত নামিয়ে আনতে। চেষ্টা করে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়তে। কিন্তু বাথরুম থেকে জলের আওয়াজে আর ঘুম হয় না। বুঝতে পারে যে ঝিলাম এক জ্বালায় জ্বলছে, জলে ভরা নদী কিন্তু নিজের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য জল তার কাছে নেই। বুধাদিত্য বিছানায় শুয়ে শুনতে পায় ওর নুপুরের আওয়াজ। ঝিলামের চোখে ঘুম নেই, বাড়ির কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে প্রবল চেষ্টা করে। সারা বাড়ি যেন আজ চকচকে করে দেবে। নিজেই ঝাড়ু পোছা শুরু করে দেয়। আলমারি খুলে সব নোংরা বিছানার চাদর, বালিশের কভার, সোফার কভার নিয়ে কিছু ওয়াশিং মেশিনে কিছু নিজের হাতে কাচতে শুরু করে। নিজের ওপরে অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে চলে, মন কিছুতেই শান্ত হয় না। চোয়াল শক্ত করে চোখ বন্ধ করে বিছানায় পড়ে থাকে বুধাদিত্য। বুঝতে পারে যে ওর ঘরে ঢুকে আলমারি খুলে কাপড় চোপড় নিয়ে গেছে। চোখ খুলে ওকে দেখার শক্তিটুকু নেই।

অনেকক্ষণ পরে ঝিলাম ওর ঘরের দরজায় টোকা মেরে বলে, “স্নান সেরে নাও, খাবার তৈরি হয়ে গেছে।”

বুধাদিত্য চুপচাপ বিছানা ছেড়ে উঠে স্নান সেরে খাবার টেবিলে বসে পড়ে। বাড়ির চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখে, অনেক দিন আগে অনিন্দিতাদি এসে সোফার কভার আর ঘরের পর্দা কিনে দিয়ে গেছিলো। সেইগুলো কোথায় পড়েছিল জানতো না, ঝিলাম সেই সবগুলি আলমারি থেকে বের করে ঘর সাজিয়ে ফেলেছে। মেঝে চকচক করছে, টেবিল চকচক করছে, ব্যালকনিতে একগাদা কাপড় মেলে রাখা। আড় চোখে ঝিলামের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করে যে তাঁর মুখ থমথমে, গম্ভির, চোখের কোন চিকচিক, দুই চোখ একটু লাল। টেবিলে একটা থালা তাতে বুধাদিত্যের খাবার বাড়া।

বুধাদিত্য গম্ভির স্বরে জিজ্ঞেস করে, “তোমার থালা কোথায়?”

ঝিলাম গম্ভির স্বরে উত্তর দেয়, “তুমি খেয়ে নাও আমি পরে খাবো।”

বুধাদিত্য, “সকাল থেকে কিছু খাওনি তো, বসলে কি ক্ষতি আছে?”

ঝিলাম ওর কথার উত্তর না দিয়ে বলে, “ভাত ভাঙো, ডাল দেব।”

বুধাদিত্য, “কালকের মাংসের কিছু বেঁচে ছিল সেটা কোথায়?”

ঝিলাম, “সারা রাত ঘুমাও নি, রাতভর গাড়ি চালিয়েছো, সকালে বাড়ি ফিরে ঘুমাও নি। শরীর খারাপ করে মরার ইচ্ছে আছে?”

বুধাদিত্য আর ঘাঁটাতে সাহস পায়না ঝিলামকে। চুপচাপ খেতে শুরু করে। ঝিলামকে উলটো দিকের চেয়ারে বসে ওকে খেতে দেয়। কেউ কারুর চোখের দিকে সোজাসুজি তাকায় না, একজন যখন তাকায় তখন অন্যজনের মুখ অন্যদিকে থাকে। নিঃশব্দে কথা বলে মানসিক দ্বন্দ।

বুধাদিত্য কিছু পরে জিজ্ঞেস করে, “তোমার গরমের ছুটি কবে থেকে?”

ঝিলাম, “কেন?”

বুধাদিত্য, “না, বাড়ি যাবে বলছিলে, তা টিকিট কাটা হয়ে গেছে?”

ঝিলাম, “আসছে শুক্রবার, তারপরের শুক্রবার থেকে ছুটি। সমীরকে বলেছিলাম টিকিট কাটতে, এর মাঝে...” কথাটা বলেই ফর্সা মুখখানি বেদনায় পাংশু হয়ে যায় ঝিলামের। উলটো হাতে নাক মুছে নেয়, চোখের কোনে যে জলের ফোঁটা চিকচিক করছিল সেটা ওর চোখের লম্বা পাতা ভিজিয়ে দেয়। একটু ধরা গলায় বলে, “খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি।”

বুধাদিত্য চুপচাপ খেয়ে উঠে চলে যায়। স্টাডিতে ঢুকে ল্যাপটপ খুলে বসে পড়ে অফিসের কাজ করতে। কাজে মন ডুবিয়ে দিতে চেষ্টা করে। কিছুতেই মন বসাতে পারেনা, চোখের সামনে ল্যাপটপ খোলা পড়ে থাকে। কিছু পরে জল খাবার জন্য খাবার ঘরে এসে দেখে, ঝিলাম একা একা বসে খাবার খাচ্ছে। খেতে খেতে বারেবারে নাক, চোখ মুছে চলেছে। বুধাদিত্য ওকে না ঘাঁটিয়ে জলের বোতল নিয়ে স্টাডিতে ঢুকে পড়ে।

প্রজেক্টের কাজে নিজেকে ডুবিয়ে দেয় বুধাদিত্য, সময়ের খেয়াল থাকেনা। দুপুর গড়িয়ে, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে যায়। খেয়াল পড়ে যখন ঝিলাম ওর ঘরে ঢুকে ওর সামনে এক কাপ কফি রেখে চলে যায়। পেছন থেকে দেখে ঝিলামের চলে যাওয়া। হটাত চুড়িদার কামিজ পড়েছে, সাধারণত বাড়িতে থাকলে এই কাপড় পরে না। একবার মনে হলো জিজ্ঞেস করবে কিন্তু আর জিজ্ঞেস করা হয় না। অফিসের কয়েকজনের ফোন, প্রেসেন্টেসানের কাজ, কিছু সারভার খুলে দেখা, এই করতে করতে সময় কেটে যায়। মাঝে মাঝে কান পেতে ঝিলামের পায়ের আওয়াজ শুনতে চেষ্টা করে। কিন্তু সেই নুপুরের রিনিঝিনি শব্দ আর শুনতে পায়না। কিছু পরে সামনের দরজা বন্ধ করার আওয়াজ শুনতে পেয়ে চমকে ওঠে। বাইরে বেরিয়ে দেখে, হাতে একটা প্লাস্টিক, ঝিলাম জুতো খুলে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে।
জিজ্ঞেস করে ঝিলামকে, “কোথায় গেছিলে?”

উত্তর দেয় ঝিলাম, “মাছের বাজারে। দুপুরে নিরামিষ খেয়েছো তাই ভাবলাম একটু মাছ আনি।”

বুধাদিত্য, “আমাকে বললেই পারতে আমি নিয়ে আসতাম।”

ঝিলাম, “তুমি কাজে ব্যাস্ত ছিলে তাই আর তোমাকে বিরক্ত করিনি।”

বুধাদিত্য, “আচ্ছা, তোমার প্লেনের টিকিট কেটে দিলে হবে?”

ঝিলাম, “দুর্গাপুরে প্লেন নামে না। পূর্বাতে তৎকালে টিকিট কেটে নেবো।”

বুধাদিত্য, “প্লেনের টিকিট কেটে দেবো খানে। কোলকাতা থেকে গাড়ি ঠিক করে দেবো, তোমাকে দুর্গাপুর পৌঁছে দেবে। আসার দিনেও সেই গাড়ি তোমাকে নিয়ে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দেবে।”

ঝিলাম ঘাড় ঘুরিয়ে বুধাদিত্যের চোখের দিকে তাকায়, অনেকক্ষণ পরে পরস্পরের চার চোখ এক হয়। ঝিলাম ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, দুই চোখ তখন চিকচিক করে। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে থাকে, বুকের ঝড়কে শান্ত করার প্রবল চেষ্টা। ঝিলাম কিছু পরে ওকে বলে, “দেখি ভেবে দেখবো খানে।”

আবার সারা বাড়ি নিস্তব্ধতায় ঢেকে যায়। টিভি দেখতে মন করে না, সোফায় বসে খবরের কাগজে মুখ ডুবিয়ে বসে থাকে বুধাদিত্য। কানে ভেসে আসে অতিপরিচিত নুপুরের ঝঙ্কার, কিন্তু সেই নদীর কলতান যেন হারিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে খবরের কাগজ থেকে মাথা তুলে দেখে ঝিলামকে। সময়ের সাথে সাথে নিজেদের স্বত্তায় ফিরে আসে দুজনে। রাতে দু’জনে এক সাথে খেতে বসে।

ঝিলাম ওকে বলে, “বাড়ির ডুপ্লিকেট চাবিটা দিও।”

বুধাদিত্য, “কেন?”

ঝিলাম, “তোমার অফিসে অনেক কাজ থাকে, রোজ দিন অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায় আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। আমি অটো করে একাই চলে আসবো।”

বুধাদিত্য কিছু বলে না, মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় যে দিয়ে দেবে। কিছু পরে বলে, “কাল দেখি, একটা ড্রাইভারের ব্যবস্থা করে নেবো।”

ঝিলাম, “খাবার পরে একটু ল্যাপটপটা দিও তো, একটু মেইল দেখার আছে আর স্কুলে কিছু কাজ করার আছে।”

একটু অবাক হয়ে যায় বুধাদিত্য, ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার ল্যাপটপ নেই?”

ঝিলাম চিবিয়ে উত্তর দেয়, “তোমার মতন বড়লোক নই যে ল্যাপটপ কিনতে পারবো।”

বুধাদিত্যের সহ্যের বাঁধ ভেঙে যায়, চাপা গলায় বলে, “কি করেছি একবার বলতে পারো? কেন এমন করে কথা বলছো?”

ঝিলাম থালা থেকে মুখ উঠিয়ে ওর চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তারপরে চাপা গম্ভির গলায় বলে, “কিছু করোনি। আমার ভুল, আমি তোমার সাথে এখানে এসেছি। ঠিক আছে, আমি ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসো।”

ঝিলামের চাপা কান্না বুকে বেঁধে রাখে, বুধাদিত্য চেপে যায় বুকের ব্যাথা, ওর কথার কোন উত্তর দেয় না।
পরেরদিন সকাল বেলা উঠে দেখে যে ঝিলাম স্কুলের জন্য বেরিয়ে গেছে। ফ্রিজের ওপরে একটা হলদে স্টিকনোটে লেখা, “কফি, মাইক্রোতে রাখা, কুড়ি সেকেন্ড গরম করে নেবে। উপমা বানিয়ে রেখে গেছি, একটু গরম করে খেয়ে নিও। টিফিন তৈরি করে খাবার টেবিলে রাখা, লাঞ্চের আগে পারলে একবার গরম করে নেবে।”

অফিসে গিয়ে জানতে পারে যে বুধবার অফিসের কাজে চন্ডিগড় যেতে হবে। নিজেকে সেই কাজে ডুবিয়ে দেয়। দুপুরে একবার ভাবে ঝিলামকে ফোন করবে, কিন্তু ইতস্তত ভাবে আর করা হয়না। প্রোডাক্টের ম্যানেজার, রাকেশ সান্ডিল্য, ওকে মজা করে জিজ্ঞেস করে যে ওর গার্লফ্রেন্ড এলো না। ওর কথা হেসে উড়িয়ে দেয়। অফিসের মোটামুটি সবাই আঁচ করে ঝিলাম আর বুধাদিত্যের সম্পর্কের ব্যাপারে। কিন্তু রাকেশ ছাড়া অন্য কেউ ওকে ঘাঁটানোর বিশেষ সাহস করেনি কোনদিন। মাঝেমাঝেই রাকেশ মজা করে, কিন্তু বুধাদিত্য ওর সব কথা মজার ছলে উড়িয়ে দেয়। লাঞ্চের কিছু পরে নেহেরু প্লেসে গিয়ে ঝিলামের জন্য একটা দামী ল্যাপটপ কেনে। রমণীর অভিমান কিছু করে ভাঙাতে হবে, না হলে বাড়ির পরিবেশ দমবন্ধ হয়ে আসছে।

বিকেল পাঁচটায় ঝিলামের ফোন আসে, ফোন ধরতে গিয়ে এক অন্য উত্তেজনায় হাত কেঁপে ওঠে। বুধাদিত্য, “কি হয়েছে?”

ঝিলাম, “কখন বাড়ি ফিরবে?” গলার স্বর অনেক স্বাভাবিক হয়ে গেছে “ঝিল্লি”র।

বুধাদিত্য চাপা হেসে বলে, “কফি বানাও, আমি এই এখুনি আসছি।”

হেসে ফেলে ঝিলাম, “কফি গরম থাকতে থাকতে না পৌঁছালে কিন্তু কফি পাবে না।”

বুধাদিত্যের মন নেচে ওঠে ঝিলামের হাসি শুনে, “একটা সারপ্রাইস গিফট আছে তোমার জন্য।”

ঝিলাম হেসে বলে, “আগে বাড়ি এসে আমাকে উদ্ধার করো, তারপরে দেখবো খানে।”

বুধাদিত্য আর দাঁড়ায়না, ব্যাগ উঠিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। দরজা খুলে দাঁড়ায় ঝিলাম, সেই পুরাতন ঝিলাম, উজ্জ্বল দুই চোখে হাসি ফিরে এসেছে, গালের লালিমা ফিরে এসেছে। উচ্ছল তরঙ্গিণী আবার নিজের মত্ততায় মেতে উঠেছে।

হেসে বলে বুধাদিত্যকে বলে, “কফি বানানোর আগেই উপস্থিত দেখছি। অফিসে কাজ ছিল না নাকি?”

বুধাদিত্য ওর দিকে ঝুঁকে বলে, “কফির কথা শুনে আর থাকতে পারলাম না।”

ঝুঁকে পড়ার জন্য ঝিলামের মুখের ওপরে উষ্ণ শ্বাস বয়ে যায়, বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলে, “হ্যাঁ অনেক হয়েছে।”
“একটা সারপ্রাইস আছে” বুধাদিত্য ওর হাতে ল্যাপটপের বাক্স ধরিয়ে দিয়ে বলে, “তোমার জন্য।”

হাতে ল্যাপটপের বাক্স নিয়ে একটু অবাক হয়ে যায়, তারপরে হেসে ফেলে ঝিলাম, “হটাত কি মনে করে? তোমাকে কিছু বলা মানে তুমি সারা পৃথিবী নিয়ে আসবে মনে হচ্ছে।”

বুধাদিত্য ঘরে ঢুকে বলে, “আমার ল্যাপটপে যাতে আর হানা না দেওয়া হয় তাই নিয়ে এলাম।”

ঝিলাম মজা করে বলে, “কেন তোমার গার্লফ্রেন্ডেদের সাথে কবে কোথায় কি কি কেচ্ছাকলাপ কি করেছো সেই সব ছবি তুলে রেখেছো নাকি? চিন্তা নেই আমি চোখ বন্ধ করে নিতাম ওই ফটো দেখলে।”

চাপা হেসে ফেলে বুধাদিত্য, শুধু মাত্র আয়েশার কয়েকটা ফটো আছে ল্যাপটপে তা ছাড়া অসংখ্য পর্ণ মুভি তো আছেই। ঝিলামের কাঁধে একটু ধাক্কা মেরে বলে, “দেখার সখ আছে নাকি?”

কপট রাগ দেখিয়ে বলে, “যাঃ শয়তান।” বুধাদিত্যের পিঠে আলতো করে চাঁটি মেরে বলে, “যাও ফ্রেস হয়ে নাও, আমি তোমার সঙ্গে চা খাবো বলে বসেছিলাম।”

বুধাদিত্য তাড়াতাড়ি জামাকাপড় ছেড়ে বসার ঘরে এসে বসে। শনিবার রাতে বাজার থেকে চা কিনে আনা হয়েছিল। ঝিলাম নিজের জন্য চা বানায় আর বুধাদিত্যের জন্য কফি।

চা খেতে খেতে ঝিলাম জিজ্ঞেস করে, “কত দাম নিয়েছে ল্যাপটপের?”

বুধাদিত্য, “কেন দাম দেবে নাকি?”

ঝিলাম ভুরু কুঁচকে বলে, “হ্যাঁ টাকা জমিয়ে নিয়ে তোমাকে ফিরিয়ে দেবো।” তারপরে হেসে বলে, “শয়তান, আমাকে নিয়ে যেতে পারলে না, ল্যাপটপ কেনার সময়ে, একটু দেখে নিতাম।”

বুধাদিত্য, “একদম ভালোটা এনেছি, এইচ.পি’র বেশ ভালো ল্যাপটপ। অফিস থেকে সব লোড করে নিয়ে এসেছি। নিয়ে আসো সব দেখিয়ে দিচ্ছি।”

ঘরের পরিবেশ আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়, দু’জনে ল্যাপটপ খুলে বসে পড়ে, ঝিলামের হাজার প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়, “এটা কি? ওটা কি করে খুলতে হয়? একটা হেডফোন আনতে পারোনি, একটু কানে লাগিয়ে গান শুনতাম।”

বুধাদিত্য বলে, “বাড়িতে দামী ফাইভ পয়েন্ট অয়ান মিউসিক সিস্টেম আছে, কবার গান শুনেছো বলতে পারো?”

ঝিলাম ওর কাঁধে আলতো চাঁটি মেরে হেসে বলে, “পরশু দিন কাজে চলে গেল। কাল থেকে মাথার ওইতো খিচুরি করে রেখে দিয়েছিল। তার মধ্যে গান, হ্যাঁ।”

বুধাদিত্য হেসে বলে, “ওকে বাবা সরি। আচ্ছা একটা কথা আছে, বুধবার সকাল বেলা আমাকে চণ্ডীগড় যেতে হবে।”

ঝিলাম, “গাড়িতে যাবে না শতাব্দীতে?”

বুধাদিত্য, “গাড়িতে যাবো, মিটিং শেষ হলেই আবার যাতে ফিরতে পারি।”

ঝিলাম ধমকে ওঠে, “না অত দূর গাড়ি চালিয়ে যেতে হবে না, শতাব্দী করে যেও।”

বুধাদিত্য কোনদিন চণ্ডীগড় ট্রেনে যায়নি, যেতেও চায় না। গাড়ি চালাতে খুব ভালোবাসে বুধাদিত্য। মিটিংয়ে কেউ না কেউ ওর সাথে যায়, পথে তাই কোন কষ্ট হয় না। এবারে রাকেশ যাবে ওর সাথে। বুধাদিত্য ওকে বলে, “না কোন প্রবলেম নেই গাড়ি চালাতে।”

ঝিলাম, “ড্রাইভার খুঁজে পেয়েছো?”

বুধাদিত্য একদম ভুলে গেছিল ড্রাইভারের কথা, জিব কেটে বলে, “যাঃ একদম ভুলে গেছি।”

ঝিলামের আরও এক চাঁটি বুধাদিত্যের পিঠের ওপরে, রেগে মেগে বলে, “আগে একটা ড্রাইভার খুঁজবে। যদি কালকের মধ্যে ড্রাইভার পাও তাহলে গাড়িতে যাবে না হলে ট্রেনে যাবে। একা গাড়িতে আমি যেতে দেবো না। ব্যাস শেষ কথা।”

বুধাদিত্য, “আচ্ছা বাঃবা, আমি ফোন করে দেখছি।”

ঝিলাম, “ড্রাইভার পঁয়তাল্লিশ পঞ্চাসের কাছাকাছি হতে হবে, তাঁর পুলিস ভেরিফিকেশান করাতে হবে।”

বুধাদিত্য ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “অত বয়স কেন?”

ঝিলাম, “একটু বয়স্ক ড্রাইভার ভালো গাড়ি চালায়, ধিরে সুস্থে গাড়ি চালায়, আর অন্তত এদিক ওদিক তাকায় না।”

হেসে ফেলে বুধাদিত্য, বুঝতে পারে ঝিলাম কি বলতে চায়, “তুমি আর বোলো না, তুমি রাস্তা দিয়ে হাঁটলে, আবালবৃদ্ধবনিতা তোমার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। সে আমি বুড়ো আনি কি জোয়ান ড্রাইভার আনি।”

ঝিলাম লজ্জায় লাল হয়ে যায়, “ধুত, অনেক হয়েছে তোমার। যা বলছি সেটা করো। আমি রান্না করতে চললাম।”

ঝিলাম উঠে পরে রান্না করতে চলে যায়। অগত্যা বুধাদিত্যকে বেশ কয়েকজনকে ফোন করতে হয় ড্রাইভারের জন্য, না হলে আর গাড়ি নিয়ে যেতে দেবে না। এমনিতে একটা ড্রাইভারের দরকার ছিল, ঝিলামকে স্কুল থেকে আনার জন্য। আগে যখন ছেড়ে আসতে হতো তখন মাঝে মাঝে বুধাদিত্যকে মিটিং ছেড়ে বা কোন কাজ ছেড়ে আসতে হতো। ড্রাইভার থাকলে সেই অসুবিধেগুলো হবে না। যাদের ফোন করেছিল, তারা জানায় যে পরেরদিন বিকেলের মধ্যে ড্রাইভার যোগাড় করে দেবে।

পরেরদিন যথারীতি কেটে যায় কাজে কর্মে। বিকেলবেলায় দুটি ড্রাইভার আসে, তাদের মধ্যে একজনের কথাবার্তা শুনে আর কাজের কথা শুনে ঝিলাম তাকে কাজে নিযুক্ত করে। ড্রাইভার বিহারী নাম কালিনাথ, বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ। ঝিলাম ওকে কাজ বলে দেয়, যে সকালবেলা, বুধাদিত্যকে অফিসে ছেড়ে দিতে হবে, তারপরে দুপুরে ওকে স্কুল থেকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আবার অফিসে যেতে হবে। বিকেলে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তবে ছুটি, যদি কখন বিকেলে কাজ থাকে তাহলে দেরি করে ছুটি পাবে। বুধাদিত্য চুপচাপ ঝিলামকে দেখে, অতি নিপুণ হস্তে সব কিছু করে চলেছে। ড্রাইভার চলে যাবার পরে বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে যে এবারে ওর মন শান্ত হয়েছে কিনা। হেসে ফেলে ঝিলাম, বলে যে তাড়াতাড়ি খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়তে, পরেরদিন চণ্ডীগড় যেতে হবে।

পরেরদিন বুধবার, সকালবেলা ঝিলাম ঠেলে বুধাদিত্যকে উঠিয়ে দেয়। ঘুম চোখে উঠে স্নান সেরে তৈরি হয়ে নেয়। ঝিলাম ওর আগেই উঠেছে দেখে একটু অবাক হয়ে যায়। অবশ্য ওর অনেক সকালে ওঠার অভ্যাস আছে। কফি বানিয়ে দেয়। কালিনাথকে বারবার বলে দেয় ঠিকভাবে গাড়ি চালাতে। ম্যাডামের কথা অমান্য করে না। বুধাদিত্যের আঁকাবাঁকা রেখার জীবন সরল রেখায় চলতে শুরু করে। চণ্ডীগড় পৌঁছানো মাত্র ঝিলাম ফোন করে জেনে নেয় যে ঠিকভাবে পৌঁছেছে কিনা। সারাদিন কাজের মধ্যে খুব ব্যস্ত থাকে, সারাদিনে আর ফোন করা হয়ে ওঠেনি। রাখেশ ফেরার পথে ফোঁড়ন কাটে, কিরে শালা, গার্লফ্রেন্ডকে ফোন করে জানাবি না? তখন বুধাদিত্যের মনে পড়ে ঝিলামকে ফোন করা হয়নি। সন্ধ্যে হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি ফোন করে ঝিলামকে। ঝিলাম ফোন তুলেই একটু সাবধান বানী শুনিয়ে দিল, যে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে আর কালিনাথকে ধিরে সুস্থে গাড়ি চালাতে। ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়, ঝিলাম ওর জন্য না খেয়ে বসে থাকে। বাড়ি ফিরে ঝিলামের মুখের হাসি দেখে সারাদিনের ক্লান্তি কেটে যায় এক নিমেষে। ঝিলাম ওর হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে স্টাডিতে রেখে দেয়, ওর জন্য জল এনে দেয়। বুধাদিত্যের বড় ইচ্ছে করে নিবিড় আলিঙ্গনে বাঁধতে, আবার ওই পুরানো দ্বিধা বোধ ওকে আটকে দেয়। ওই মিষ্টি হাসি হারাতে চায় না, সময়ের ওপরে সব ছেড়ে দেয়।

শুক্রবার সকালবেলা ঝিলাম যথারীতি স্কুলে বেরিয়ে গেছে। এই কদিনের মধ্যে সমীরের বা অন্য কারুর ফোন আসেনি, ঝিলামের খোঁজ নেবার জন্য। ঝিলামকে জিজ্ঞেস করেনি, সমীরের কথা, ফোন করেছিল কিনা সেটাও জানা হয়নি। বুধাদিত্য অফিসের কাজে ব্যস্ত, ঠিক লাঞ্চের পরে ঝিলামের ফোন আসে। গলা শুনে মনে হলো খুব ত্রস্ত আর উদ্বেগ মাখা।

ঝিলামের গলা কাঁপছে, “বাড়ি আসতে পারো এখুনি?”

বুধাদিত্য, “তুমি কোথায়?”

ঝিলাম, “আমি বাড়িতে, গাড়ি তোমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।”

বুধাদিত্য, “কি হয়েছে?”

ঝিলাম, “সমীর এসেছে বাড়িতে, তুমি প্লিস এখুনি বাড়ি আসো।”

সমীরের নাম শুনেই মাথায় রক্ত চড়ে যায় বুধাদিত্যের। চোয়াল শক্ত করে ঝিলামকে বলে, “সামনের দরজা খোলা রেখে দেবে, আর বসার ঘরে বসিয়ে রাখবে। ফোন অন রাখো, কিছু হলে যেন আমি শুনতে পাই।”

ঝিলাম কাতর কণ্ঠে ডাক দেয়, “প্লিস, তাড়াতাড়ি এসো।”

তাড়াতাড়ি ব্যাগ নিয়ে কালিনাথকে গাড়ি চালাতে বলে। বাড়িতে ঢোকার আগে, প্যাসেঞ্জার সিটের নীচ রাখা বাক্স থেকে পিস্তলটা বের করে প্যান্টের পেছনে গুঁজে নেয়। একটু এদিক ওদিক করলে সমীরের মাথার মধ্যে সব কটা গুলি নামিয়ে দেবে, তারপরে যা হবার হবে, যদি মরতে হয় তাহলে বুকের মাঝে ঝিলামের ভালোবাসা নিয়ে মরবে। দৌড়ে তিনতলার সিঁড়ি চড়ে। বাড়িতে এসে দেখে, ঝিলাম কথা মতো বাড়ির সদর দরজা হাঁ করে খুলে রেখেছে। সমীর মাথা নিচু করে সোফার ওপরে বসে আর ঝিলাম বেশ কিছু দুরে খাবার টেবিলের পাশে চেয়ারে বসে। বুধাদিত্য একবার সমীরের দিকে তাকায়, একবার ঝিলামের দিকে তাকায়। ওকে দেখে, ঝিলাম প্রানে বল পায়। সমীর ওর দিকে মাথা তুলে তাকায়, চোখ মুখ বিধ্বস্ত পরাজিত সৈনিকের মতন। দুই চোখ লাল, কিন্তু সেই করুন চোখ, মিনতি ভরা চাহনি বুধাদিত্যকে শান্ত করতে পারে না।

ওর সামনের সোফায় বসে ধির গম্ভির গলায় সমীরকে জিজ্ঞেস করে, “কি মনে করে এখানে আসা হয়েছে?”

সমীর মাথা নিচু করে উত্তর দেয়, “আমি বড় পাপী, ঝিলামকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। তার প্রায়শ্চিত্ত করতে এসেছি।”

বুধাদিত্য চোয়াল চেপে দাঁত পিষে জিজ্ঞেস করে, “হটাত এই বোধোদয় হওয়ার কারন? নন্দিতা কি লাথি মেরেছে তোর গাঁড়ে?”

সমীর আলতো মাথা দুলিয়ে বলে, হ্যাঁ। বুধাদিত্য ঘাড় ঘুড়িয়ে ঝিলামের দিকে তাকায়। ওর চোখে জল, একবারের জন্য ভেবেছিল যে সমীর অন্য কারুর সাথে শুতে পারে। কিন্তু সেই কথা স্বামীর মুখে শুনে স্থম্ভিত হয়ে গেছে ঝিলাম। স্বামী এক অন্য মেয়ের প্রেমে পড়ে ওকে ছেড়ে দিয়েছিল, আর সেই স্বামী আবার ফিরে এসেছে। কি করবে ঝিলাম, কিছু বুঝে উঠতে পারে না।

বুধাদিত্য, “তোর বাবা মা’র সাথে কথা বলতে চাই, তারপরে ঝিলামকে এই বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে পারবি।”

সমীর নিচু গলায় বলে, “বাবা মায়ের সাথে কথা হয়েছে আমার। আমার কার্যকলাপে তারা মর্মাহত।”

বুধাদিত্য চিবিয়ে বলে, “এই বোকা... আমাকে গরু পেয়েছো? তুই শুয়োরের বাচ্চা, বললি আর আমি বিশ্বাস করে নিলাম। এখুনি শালা ফোন লাগা কোলকাতায়, লাউডস্পিকারে দে, আমি কথা শুনতে চাই।” ঝিলামকে ইঙ্গিত করে যে পাশের সোফায় এসে বসতে। ঝিলাম ধির পায়ে বুধদিত্যের পাশের সোফায় এসে বসে পড়ে।

নিরুপায় সমীর প্রথমে ইতস্তত করে, কিন্তু বুধাদিত্যের লাল চোখের সামনে ঝুঁকে যায়। ফোন লাগায় কোলকাতায়, সমীরের মা ফোন ধরেন। ফোন ধরা মাত্রই ঝিলাম ওর হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সব কিছু বলে দেয়। সমীরের মা চুপ করে কিছুক্ষণ শোনেন সব কথা। তারপরে সমীরকে উত্তমমধ্যম বকা দিতে শুরু করেন। বলেন যে, ঝিলাম যদি চাকরি করতে চায় সে ভালো কথা, ওকে চাকরি করতে দিতে হবে, আর ঝিলামকে যদি কোনদিন কষ্ট দেয় তাহলে এক কথায় ত্যাজ্যপুত্র করে দেবেন। সমীরের বাবা প্রচন্ড রেগে যান, এক কথায় জানিয়ে দেন, যে মা লক্ষ্মীর মতন মেয়ে ঝিলামকে যদি একটুও চোখের জল ফেলতে দেখে তাহলে সমীরকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। সমীরের চোখে জল, মুখ থমথমে, বুকের মাঝে পরিতাপের ছায়া। সব কথা শোনার পরে লুটিয়ে পড়ে ঝিলামের পায়ের কাছে।

পা ধরে বলে, “শেষ বারের মতন ক্ষমা করে দাও ঝিলাম। দয়া করে আমাকে ফিরিয়ে নাও।”

সমীরের বুক ফাটা কান্না দেখে ঝিলাম কেঁদে ফেলে, একবার বুধাদিত্যের মুখের দিকে তাকায়। বুধাদিত্যে সামনে ওর ভালোবাসা চলে যায়, বুধাদিত্য চোয়াল শক্ত করে ঠোঁটে হাসি আনে। মাথা দুলিয়ে সমীরের সাথে যাবার সম্মতি দেয়। বুক ভেঙে আবার টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ভেবেছিল সময়ের সাথে সাথে ঝিলামকে ওর কোলে টেনে নেবে, কিন্তু সমীরের কান্না আর পরিতাপের ডাক শুনে সেই স্বপ্ন দূর অস্ত। ঝিলাম চুপচাপ উঠে নিজের ঘরে চলে যায় কাপড় পরার জন্য আর ব্যাগ গুছানোর জন্য।

সমীর চোখের জল মুছে হাত জোর করে বুধাদিত্যের সামনে বসে থাকে। বুধাদিত্য গর্জে ওঠে ওর মুখ দেখে, “মাদা... ওই কুমিরের কান্না আমাকে দেখাবি না। শালা তোকে আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস হয় না, শুধু মাত্র ঝিলামের মুখ দেখে তোকে ছেড়ে দিলাম।” পিস্তল বের করে টেবিলে ওপরে রেখে দেয়। সমীরের নাকের সামনে তর্জনী নাড়িয়ে বলে, “ভাবিস না তোকে ছেড়ে দিলাম আমি। ঝিলামের চুল যদি বাঁকা হয়, আমি প্রতিজ্ঞা করছি, এই পিস্তলের সব গুলি তোর মাথার মধ্যে নামিয়ে দেবো। আমার আগে পেছনে কাঁদার কেউ নেই, বুঝলি। আমি তোকে খুন করে জেলে যেতে রাজি।”

ত্রস্ত চোখে তাকিয়ে থাকে সমীর, কাতর কণ্ঠে বলে, “না রে, আমি তোর পায়ে ধরে ক্ষমা চাইছি।”

বেশ কিছু পরে ঝিলাম শাড়ি পরে, হাতে একটা সুটকেস নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। জল ভরা চোখে বুধাদিত্যের দিকে তাকায়, একবার সারা বাড়ির দেয়ালের দিকে তাকায়। বুধাদিত্য চুপ করে বসে থাকে, চোখের সামনে ঝিলামকে ছেড়ে দিতে বুক কেঁপে ওঠে। কালিনাথকে ডেকে বলে ওদের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আসতে। ঝিলাম ওর সামনে এসে দাঁড়ায়, কিন্তু কথা বলতে পারে না, দু’চোখে অঝোর ধারায় বন্যা বয়ে চলে। বুধাদিত্য মাথা তুলে তাকাতে পারেনা ঝিলামের মুখের দিকে। ঝিলাম ওর মাথায় আলতো করে হাত ছোঁয়ায়, তারপরে ধির পায়ে সমীরের পেছন পেছন ঝিলাম বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। কালিনাথ ঝিলামের ব্যাগ নিয়ে আগেই নিচে নেমে যায়। ঝিলাম চলে যাবার পরে দরজা খোলা পড়ে থাকে। স্বপ্ন দেখেছিল বুধাদিত্য, ঝিলামকে ওই দরজা দিয়ে এই বাড়ির গৃহিণী করে আনার। সেই ঝিলামকে শেষ পর্যন্ত সমীরের হাতে সঁপে দিতে হয়। মন মানে না, কিন্তু ঝিলাম যে সমীরের বিয়ে করা, আইনসিদ্ধ স্ত্রী। বাড়ির চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে বুধাদিত্য, বাড়ির আনাচে কানাচে ঝিলামের হাতের ছোঁয়া লেগে। সব জায়গায় ঝিলামের নাম লেখা। একবার মনে হয় এই শোয়ার ঘর থেকে ঝিলাম বেরিয়ে আসবে।

খানিক পরে দেখে ঝিলাম ওর দরজায় দাঁড়িয়ে। মৃদু হেসে মাথা নাড়ায় বুধাদিত্য, সত্যি পাগল হয়ে গেছে ঝিলামের প্রেমে, দরজায় দাঁড়িয়ে ঝিলামের ছায়া। সম্বিৎ ফিরে পায় যখন রক্ত মাংসের ঝিলাম দৌড়ে এসে ওর বুকের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরে। বুধাদিত্যের বুক সেই প্রেমের পরশে হুহ করে কেঁপে ওঠে। প্রানপন শক্তি দিয়ে ঝিলামকে জড়িয়ে ওর মাথার ওপরে ঠোঁট চেপে ধরে। ঝিলাম দুই হাতে আঁকড়ে ধরে থাকে বুধাদিত্যের ঋজু দেহ। এই বুকের ওপর থেকে যেন মৃত্যুই ওকে ছিনিয়ে নেয় আর কারুর ক্ষমতা থাকে না ওকে বিচ্ছিন্ন করার।

বেশ কিছু পরে ধরা গলায় ঝিলাম ওকে বলে, “সুটটা কিন্তু কাল দেবে, মনে করে নিয়ে এসো যেন। বড় আলমারির লকারে আমার সব গয়না আর আমার সার্টিফিকেটগুলো রাখা। আমার জিনিসগুলো ছড়িয়ে দিও না আবার। দরকার পড়লে নিয়ে যাবো, না হলে এখানেই থাক।” বুকের ওপরে ঠোঁট চেপে ধরে ঝিলাম, কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমি চলে যাবার পরে প্লিস আর মদ খেও না।” বহু কষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, “আমি চললাম বুধো, ভালো থেকো।”

“বুধো” নাম শুনে চোখ বন্ধ করে নেয় বুধাদিত্য, আলতো করে ওর গালে হাত দিয়ে বলে, “চলি বলতে নেই ঝিল্লিরানি, বলে আসছি।”

“ঝিল্লিরানী” কোন রকমে “বুধো”র হাত ছাড়িয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। বেরিয়ে যাবার আগে একটু বহু কষ্টে ঠোঁটে হেসে টেনে বলে, “সোমবার গাড়ি পাঠাতে ভুলোনা, আমি অপেক্ষা করে থাকবো।”
 
দ্বাদশ পর্বঃ কলুষিত দেবী।

ঝিলাম চলে যাবার পরে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে বুধাদিত্য। চোখের সামনে থেকে চলে যায়নি ভেবে ওর বুকে এক নব পল্লব অঙ্কুরিত হয়। নিজের না হোক, দূর থেকে দেখে অন্তত শান্তিতে থাকতে পারবে। পরের দিন বিকেলে ঝিলামের বাড়িতে যায়। ওকে দেখে ঝিলামের মন খুশিতে ভরে যায়। বুধাদিত্য সমীরকে জিজ্ঞেস করে, ঝিলামকে নিয়ে দুর্গাপুর কবে যাবে? ওকে জানায় যে সামনের সপ্তাহে ঝিলামের গরমের ছুটি পড়ে যাবে। সমীর ওকে জানায় যে এই সবের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য দুর্গাপুর যাবার আগে ঝিলামকে নিয়ে ঘুরতে যাবে, আবার একবার হানিমুন করার ইচ্ছে আছে। জানায় যে ট্রেকিং যাবার ইচ্ছে আছে, যেখানে শুধু সমীর আর ঝিলাম, আর কেউ ওদের সাথে থাকবে না। সব ভুলের মাশুল গোনার জন্য তৈরি সমীর, তাই কোন দূর পাহাড়ের কোলে ওকে নিয়ে গিয়ে ওর সাথে কয়েকটা দিন কাটাবে। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে যে কোথায় যেতে চায়, তার উত্তরে সমীর জানায় যে জায়গা এখনো ঠিক নেই তবে কিছুদিনের মধ্যে ঠিক করে নেবে। বুধাদিত্যের মনে জাগে অপার শূন্যতা। ঝিলাম শেষে সমীরের সাথে, একা দূর পাহাড়ের কোলে, ঠিক ভেবে উঠতে পারেনা বুধাদিত্যের মাথা। বেশ কিছু সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।

রাতের বেলা বুবাইয়ের ফোন, “মামু নেক্সট উইক আমার গরমের ছুটি। মাম্মা বলেছে এবারে আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে।”

ভাগ্নির গলার আওয়াজ শুনে ফাঁকা মন আনন্দে ভরে যায়। বুবাইকে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তোর মা?”

বুবাই, “জানি না মামা, তবে সেখানে নাকি অনেক বড় একটা শিবের মন্দির আছে।”

অনিন্দিতাদি মেয়ের হাত থেকে ফোন নিয়ে বলে, “কিরে কেমন আছিস তুই?”

বুধাদিত্য, “এই বেশ ভালো আছি, তো হানিমুনে যাচ্ছো নাকি?”

অনিন্দিতাদি হেসে ফেলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, মেয়েটাকে তুই দেখ, তাহলে আমি যেতে পারি আমার বরের সাথে।”

বুধাদিত্য, “চলে এসো এখানে, ডালহৌসি নিয়ে যাবো তোমাকে।”

অনিন্দিতাদি, “যাবোরে, তবে এবারে সুব্রত নেপাল নিয়ে যাচ্ছে।”

বুধাদিত্য, “হুম, বেশ বেশ ঘুরে এসো।”

অনিন্দিতাদি একটু চুপ করে গলা নিচু করে বলে, “তোকে একটা কথা বলার আছে। সুবির পিসেমশাই আমাকে কয়েক দিন আগে ফোন করেছিল, তোর ঠিকানা জানতে চেয়েছিল।” কথা শুনে একটু থমকে যায় বুধাদিত্য। অনিন্দিতাদি বলে, “শোন বুধি, উনি তোর বাবা। একবার তো ঠিকভাবে কথা বলা উচিত ওনার সাথে, শোনা উচিত কি বলতে চান। গতবার ঠিকভাবে কথা না বলে চলে এসেছিলি। মনে হয় তোর ওখানে যেতে চায়, আমি পিসেমশাইকে তোর ঠিকানা দিয়েছি। মাথা ঠাণ্ডা করে একটু ভেবে দেখিস বুধি।”

বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, “তোমরা, মা মেয়েতে কি শুরু করেছো বলতে পারো? আমার ফোন নাম্বার একজন বারোয়ারী বানিয়ে দিয়েছে, আর তুমি আমার ঠিকানা দিয়ে আমার বাড়িটাকে ধর্মশালা বানিয়ে দেবে।” রাগ হজম করে হেসে বলে, “আমার পমুসোনা কেমন আছে?”

অনিন্দিতাদি হেসে বলে, “মা ভালো আছে, আমাকে এবারে বলছিল কেদার বদ্রি নিয়ে যেতে।” অনিন্দিতাদি আরও কিছুক্ষণ বাড়ির কথা, মা বাবার কথা বলে ফোন রেখে দেয়।

সোমবার যথারীতি বুধাদিত্য নিজে যায় ঝিলামের স্কুলে, ওকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেয়। ওর পাশে দাঁড়িয়ে ঝিলামের বুকে নিরাপত্তার এক বাতাস বয়ে যায়। হয়তো পাশে দাঁড়ানোর অধিকার নেই, কিন্তু মনে প্রানে জানে যে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকবে বুধাদিত্য। গাড়িতে সারা রাস্তা ঝিলাম বুধাদিত্যের পাশ ঘেঁসে বসে থাকে। ঝিলাম জানায় যে সমীরের আচরন অনেক বদলে গেছে, গতকাল ওকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিল। মনের মধ্যে একটু সংশয় ছিল কিন্তু সমীর ফিরে আসাতে ঠিক খুশি হবে না দুঃখিত হবে ভেবে পাচ্ছে না ঝিলাম। বুধাদিত্য চুপ করে শুনে যায় ওর কথা। ঝিলামের চোখ দুটি ভাসাভাসা, ঝিলামের মনের দ্বন্দ বুঝতে দেরি হয় না। নিচু গলায় ওকে জানায় যে সমীর যখন বদলে গেছে তখন ওর কাছেই ফিরে যেতে। ঝিলামকে জিজ্ঞেস করে যে কোথায় বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে, ঝিলাম মাথা নাড়িয়ে জানায় যে জানেনা। সমীর বলেছে যে একটা বড় চমক দেবে ওকে, একদম নতুন কোন জায়গায় নিয়ে যাবে, যেখানে মানুষ কম যায়। ঝিলামকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দেবার সময়ে বলে বুধাদিত্য সবসময়ের জন্য ওর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকবে। ঝিলামের চোখ দুটি ছলছল করে ওঠে, ধির পায়ে বাড়ির মধ্যে চলে যায়।

মাঝে একবার সমীরের অফিসে যায় বুধাদিত্য। সমীরকে জিজ্ঞেস করে যে ওরা কোথায় ঘুরতে যেতে চায়। বুধাদিত্যের প্রশ্নের সামনে সমীর জানায় যে ঝিলামকে একটা চমক দিয়ে চায় এক নতুন জায়গায় নিয়ে গিয়ে। ভালো কথা, কিন্তু বুধাদিত্যকে পুরো যাত্রার পরিকল্পনা না জানালে ঝিলামকে ওর সাথে ছাড়বেনা। বুধাদিত্য জানায় যে সমীরের ওপর থেকে ওর বিশ্বাস উঠে গেছে। সমীর ওকে জায়গার নাম, দিনক্ষণ সব জানায়, আর অনুরোধ করে যে ঝিলামকে যাতে না জানায় ওর পরিকল্পনা। বুধাদিত্য কথা দেয় যে ঝিলামকে জানাবে না, কিন্তু সেই সাথে সাবধান করে দেয় যে কোনরকম চালাকি যেন না করে। সমীর করজোড়ে জানায় যে ফিরে পেয়েছে যখন তখন ঝিলামকে আগলে রাখবে। দিন কয়েক আর দেখা করে না ঝিলামের সাথে, তবে সকাল বিকেল ফোনে খবরাখবর জেনে নেয়। ঝিলাম বারবার বলে দেখা করতে, কিন্তু ইচ্ছে করেই পিছিয়ে যায় বুধাদিত্য, ঝিলাম যদি চোখের সামনে ওকে বারবার দেখে তাহলে হয়তো সমীরকে আবার নিজের করে নিতে পারবে না। ঝিলাম একটু খুশি, সমীর ওকে নিয়ে বেড়াতে যাবে। প্রত্যকে বিকেল ফাঁকা হৃদয় নিয়ে বাড়ি ফেরে বুধাদিত্য। মনে মনে ঠিক করে নেয় যে একবার সমীরের সাথে ঝিলামের সম্পর্ক ঠিক হয়ে গেলে, দিল্লী ছেড়ে, দেশ ছেড়ে অন্য কোন জায়গায় চাকরি নিয়ে চলে যাবে।

একদিন বিকেলে বুধাদিত্যের কাছে এক অপ্রত্যাশিত ফোন আসে, ওপর পাশে দেবস্মিতার কণ্ঠস্বর শুনে অবাকের সাথে একটু বিরক্ত হয়ে যায়। অনিন্দিতাদির কথা মনে পড়ে ধির স্থির গলায় জিজ্ঞেস করে কারন।

দেবস্মিতা বলেন, “যদি বিশেষ কাজ না থাকে, তাহলে কি একবার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এসে দেখা করা যেতে পারে?”

বুধাদিত্য অবাক, দেবস্মিতা দিল্লীতে আর তিনি হোটেলে উঠেছেন। উলটে জিজ্ঞেস করে বুধাদিত্য, “মিস্টার সুবির গুহ কি সাথে এসেছেন?”

দেবস্মিতা, “না, আমি আর বাপ্পা এসেছি। ব্যস্ত কি খুব? একটু সময় বের করে দেখা করলে বড় ভালো হতো।”

বুধাদিত্য, “কবে আসা হয়েছে?”

দেবস্মিতা, “আজ রাজধানিতে। দুপুরে ভেবেছিলাম ফোন করবো কিন্তু পরে ভাবলাম যে বিকেলে ফোন করা নিরাপদ।”

বুধাদিত্য, “হটাত এই রকম ভাবে না জানিয়ে দিল্লী আসা আর এসে হোটেলে থাকা, কারন জানতে পারি কি?”

দেবস্মিতা একটু হেসে বলেন, “এমনিতে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকা হয়, বারেবারে চেষ্টা করেও ধরতে পারলাম না। তাই একবার ভাবলাম যে না জানিয়ে গিয়ে যদি একটু দর্শন পাওয়া যায় এই ব্যস্ত মানুষের। কিছু কথা ছিল, আসলে বড় ভালো হতো।”

দেবস্মিতার হাসি আর নরম কণ্ঠস্বর শুনে একটু নরম হয়ে যায় বুধাদিত্য। যতই এড়িয়ে যেতে চায় ততই যেন কাছে ডাকে ওর ফেলে আসা অতীত। ভাবে যে বাড়িতে নিয়ে আসাই ভালো তাই দেবস্মিতাকে বলে, “আচ্ছা ঠিক আছে। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে হোটেল পৌঁছে যাবো। চেক আউট করে নিলে ভালো হয়, আমি বাড়িতে নিয়ে আসবো বাপ্পাকে।”

শুনে একটু খুশি হন দেবস্মিতা, ওকে বলেন, “ঠিক আছে আমি ব্যাগ গুছিয়ে বাপ্পাকে নিয়ে তৈরি থাকবো। লবিতে এসে জানিয়ে দিলে আমরা নেমে আসবো।”

আধা ঘন্টার মধ্যে হোটেলে পৌঁছে যায় বুধাদিত্য। লবিতে গিয়ে দেবস্মিতাকে ফোন করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেবস্মিতা বাপ্পাদিত্যর হাত ধরে নেমে আসেন। বুধাদিত্যকে দেখেই মায়ের পেছনে লুকিয়ে যায় বাপ্পাদিত্য। বাপ্পাদিত্যের জন্য বুধাদিত্য চকলেট এনেছিল, সেগুলো এগিয়ে দিতে, ছোটো ছোটো পায়ে এগিয়ে আসে বুধাদিত্যের কাছে। দেবস্মিতা চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখে ওদের। বুধাদিত্য ধরে ফেলে সেই শিশুশাবককে, খিলখিল করে হেসে ওঠে বুধাদিত্যের কোলে উঠে। বুধাদিত্য আপাদমস্তক দেবস্মিতাকে নিরীক্ষণ করে। পরনের শাড়ি বেশ দামী, সাজগোজ আড়ম্বরহীন নেই অথচ অদ্ভুত সুন্দরী দেখতে। এই বয়সে নিজের দেহের গঠন বেশ সুন্দর করে রেখেছেন। ভদ্রমহিলাকে দেখতে দেবীপ্রতিমার মতন, তা সত্তেও ভদ্রমহিলাকে মন থেকে মেনে নিতে কষ্ট হয়। মুখে হাসি মাখিয়ে ওকে গাড়িতে উঠতে বলে। হোটেলের লোক গাড়িতে ওদের ব্যাগ রেখে দেয়।

গাড়িতে উঠে দেবস্মিতা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, “নিজের গাড়ি?”

মাথা নাড়ে বুধাদিত্য, “হ্যাঁ” তারপরে জিজ্ঞেস করে, “মিস্টার গুহ জানেন যে বাপ্পা এখানে এসেছে?”

দেবস্মিতা, “হ্যাঁ জানেন, তিনি আসতে চাইছিলেন। কিন্তু শরীর একটু খারাপ তাই ঠিক সাহস পেলাম না নিয়ে আসার। মনে একটু ইতস্তত ভাব ছিল যে দেখা আদৌ হবে কি না, তাই।”

হেসে ফেলে বুধাদিত্য, দেবস্মিতাকে বলে, “কেন এলে তাড়িয়ে দিতাম নাকি?”

বাড়ি পৌঁছে কালীনাথকে ব্যাগ নিয়ে যেতে বলে। বাড়ি ঢুকে দুই ঘরের এসি চালিয়ে দেয়। দেবস্মিতা একটু অবাক হয়ে চেয়ে থাকেন এত বড় বাড়ি দেখে, “এত বড় বাড়িতে একা থাকা হয়? বিয়েথা করা হয়নি?”

কাষ্ঠ হেসে উত্তর দেয় বুধাদিত্য, “মনে হয় আমার কপালে বিয়ের কথা ভগবান লিখতে ভুলে গেছেন।”

দেবস্মিতা, “চা খাবে?” সেই প্রথম ভাববাচ্য ছেড়ে বুধাদিত্যকে “তুমি” বলে সম্বোধন করেন দেবস্মিতা। বুধাদিত্য তাকিয়ে থাকে দেবস্মিতার দিকে। দেবস্মিতা “তুমি” বলে ফেলার পরেই হেসে বলেন, “আর ভাব বাচ্যে কথা বলতে পারছি না। আপত্তি থাকলে আপনি বলে ডাকতে পারি।”

বুধাদিত্য হেসে দেয়, “না তুমি শুনতে আপত্তি নেই, যদি তোমার না থাকে। আমি চা খাই না, তবে অতিথিদের জন্য চা রাখা আছে। তুমি বসো, আমি বানিয়ে দিচ্ছি।”

দেবস্মিতা, “একটু দুধ পেলে ভালো হয়, বাপ্পাকে খাইয়ে দিতাম।”

বাপ্পাকে কোল থেকে নামিয়ে দেয় দেবস্মিতা। বাপ্পা বায়না ধরে টিভি দেখবে, বুধাদিত্য টিভি চালিয়ে দেয়। দেবস্মিতাকে গেস্টরুম দেখিয়ে দেয়, দেবস্মিতা ঢুকে যান গেস্টরুমে। বুধাদিত্য কালীনাথকে বাজার থেকে দুধের প্যাকেট নিয়ে আসতে বলে। বাপ্পার শিশু কলতানে ঘর ভরে ওঠে, বুধাদিত্যকে ওর হাজার প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়, “আমার বাড়িতে এত্ত বড় একটা টিভি আছে জানো।” “ড্যাডা টিভিতে শুধু তাইগার আর দিয়ারের লড়াই দেখে, আমার একদম ভালো লাগে না।” “তুমি আমাকে এত্তা বেনতেন কিনে দেবে, আমি উমঙ্গসর হয়ে সব দুত্তু লোককে মেরে দেব।” “তোমার ফ্রিজে ক্যাডবেরি আছে?” “আমার জন্য একটা কাইট এনে দেবে?” “রাতে তোমার বাড়িতে ব্ল্যাক বেবে আসে?” “তুমি দুধ খাও?” “দুধ খেলে হিম্যান হয়?”

দেবস্মিতা কাপড় বদলে প্রসাধন সেরে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখেন যে বুধাদিত্য আর বাপ্পাদিত্য মিলে গল্প শুরু হয়ে গেছে। বুধাদিত্য ভদ্রমহিলাকে যত দেখে তত যেন আশ্চর্য হয়ে যায়। দেবস্মিতার পরনে গাড় বেগুনি রঙের দামী সিল্কের জাপানি কিমোনো, গলা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা, অপেক্ষাকৃত পাতলা কোমরে একটা বেল্ট দিয়ে বাঁধা। বুধাদিত্যকে হেসে জিজ্ঞেস করেন, “খুব জ্বালাচ্ছে তাই না। একটু বসো আমি কফি বানিয়ে নিয়ে আসছি।” কালীনাথ দুধ এনে দেয়, দুধ গরম করে বাপ্পাকে দেন দেবস্মিতা। তারপরে নিজেদের জন্য চা আর কফি বানিয়ে আনেন।

বুধাদিত্যের সামনে বসে জিজ্ঞেস করেন, “তোমার বাড়ি সাজানোর রুচি বেশ আছে দেখছি।”

মনে মনে হেসে ফেলে বুধাদিত্য, বাড়ির আনাচে কানাচে ঝিলামের ছোঁয়া লেগে আছে। যেদিন চণ্ডীগড় গিয়েছিল বুধাদিত্য, ঝিলাম সেদিন নিজে লাজপত নগর গিয়ে শপিং করে এনেছিল, পর্দা, বিছানার চাদর, বেশ কিছু উইন্ড চাইম, বেশ কয়েকটা কাঁচের ফুলদানি। একটা ফল রাখার বেশ বড়সড় হাল্কা নীল রঙের কাঁচের বাটি, আরও অনেক কিছু। বুধাদিত্য হাসে চুপ করে। কিছু পরে জিজ্ঞেস করে দেবস্মিতাকে, “রাতে কি খাবে? বাইরে যাবে? যে হোটেলে ছিলে তার নিচে বেশ ভালো একটা বাঙালি রেস্টুরেন্ট আছে।”

দেবস্মিতা হেসে বলেন, “তোমাকে সেদিন রাতে খাওয়াতে পারিনি তাই আজ নিজে হাতে রান্ন করে খাওয়াবো। বলো কি খাবে।”

বাপ্পাদিত্য ওদিক থেকে চেঁচিয়ে বলে, “মাম্মা, মিত্তি খাব।” দেবস্মিতা মৃদু ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেন। বাপ্পার কান্না ভরা চোখ দেখে বুধাদিত্যের খুব খারাপ লাগে। ওকে কোলে টেনে বলে, “চল বাজারে, যেখানে হাত রাখবে সেটা তোমার।” বাপ্পা খুব খুশি হয়ে, দেবস্মিতাকে চোখ পাকিয়ে বলে, “আঙ্কেল আমাকে মিত্তি কিনে দেবে আমি একা একা খাবো, তোমাকে মিত্তি দেব না।” ওর কথা শুনে দুজনেই হেসে ফেলে।

বুধাদিত্য, “তোমাকে আর হাত পুড়িয়ে রান্না করতে হবে না। প্রথম বার এসেছো, কাছেই একটা ভালো চাইনিজ রেস্টুরেন্ট আছে, ইচ্ছে থাকলে সেখানে অর্ডার দিয়ে দিতে পারি।”

বাপ্পাদিত্য বায়না ধরে, “মাম্মা ম্যাগি খাবো।”

দেবস্মিতা ধমক দিতে যান বাপ্পাকে, বুধাদিত্য বাধা দিয়ে বলে, “আর বোকো না, আমি চাইনিজ অর্ডার দিচ্ছি। পারলে মিস্টার গুহকে ফোন করে জানিয়ে দাও যে আমি তোমাকে বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছি।”

দেবস্মিতা হেসে ফেলেন ওর কথা শুনে, মাথা নাড়িয়ে বলেন, করে দিচ্ছি। বুধাদিত্য বাপ্পাকে নিয়ে বেরিয়ে যায়, মিষ্টি, ঘুড়ি, কিছু খেলনা, কিছু চকলেট আর সি.আর.পার্কে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থেকে খাবারের অর্ডার দিয়ে আসে। বাড়ি ফিরে বুধাদিত্য চুপ করে বসার ঘরে বসে দেবস্মিতার আসার কারন খুঁজতে চেষ্টা করে। মাথার মধ্যে ঠিক খুঁজে পায় না কারন। বাপ্পাদিত্য খেলনা পেয়ে খুব খুশি, সে তার খেলনা নিয়ে খেলতে ব্যস্ত। বুধাদিত্যের মন উৎকণ্ঠায় ভরে আসে, মনের ভেতরে হাজার প্রশ্ন ভিড় করে কিন্তু ঠিক কোথা থেকে শুরু করবে ভেবে পায়না।

দেবস্মিতা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারেন যে বুধাদিত্যের মনের ভেতরে হাজার প্রশ্নের ভিড় করে এসেছে। সোজাসুজি জিজ্ঞেস করেন বুধাদিত্যকে, “তোমার নিশ্চয় কিছু জিজ্ঞেস করার আছে আমাকে, স্বচ্ছন্দে জিজ্ঞেস করতে পারো।”

বুধাদিত্য তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেবস্মিতার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কেন এসেছো এখানে?”

দেবস্মিতা ম্লান হেসে বলেন, “আমার উপরে নিশ্চয় তোমার খুব রাগ আছে, তাই না?” পাশে বাপ্পাদিত্য তার বেনটেন পুতুল আর গাড়ি নিয়ে খেলায় ব্যাস্ত। দেবস্মিতা বাপ্পার দিকে তাকিয়ে বলেন, “ওর নাম আমি দিয়েছি, তোমার নামের সাথে মিলিয়ে।”

বুধাদিত্যের মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে যায়, তাঁর মানে ভদ্রমহিলা সব আগে থেকে জানতেন। চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, রাগ বিদ্বেষ কোনোরকমে গিলে উত্তর দেয়, “তোমার উপরে রাগ করবো না কি করবো কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।”

দেবস্মিতা ধির গলায় জিজ্ঞেস করেন, “তুমি মিস্টার গুহকে কতটুকু চেনো?”

বুধাদিত্য দাঁত পিষে উত্তর দেয়, “তুমি বলতে চাও যে আমার চেয়ে তুমি ভালো করে মিস্টার গুহকে চেনো?” দেবস্মিতা মাথা নাড়েন, হ্যাঁ। বুধাদিত্য চিবিয়ে উত্তর দেয়, “আমি শুধু এইটুকু জানি যে যখন আমার দরকার ছিল, তখন আমার বাবা আমার পাশে ছিলেন না। সুতরাং আমার কাছে তিনি মৃত।”

দেবস্মিতার চোখের কোনে একটু জল চলে আসে, “তুমি নিশ্চয় ভাবছো যে আমি মিস্টার গুহকে তোমার কাছ থেকে, মঞ্জুষাদির কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি?” বুধাদিত্যের মনে সেই ধারনাই ছিল এতোদিন। দেবস্মিতা বলেন, “সত্যি বলো, বুধাদিত্য, কতটুকু তুমি মিস্টার গুহকে চেনো? আমি তোমার সাথে এখানে ঝগড়া করতে আসিনি, আমি শুধু এসেছি কিছু পর্দা সরাতে, আমি নিজের দিক স্পষ্ট করতে এসেছি বুধাদিত্য।” গলা ধরে আসে দেবস্মিতার।

বুধাদিত্য, “সত্যি বলতে মিস্টার গুহকে আমি কাছে কোনদিন পাইনি। ছোটবেলায় তিনি কোনদিন আমার কাছে ছিলেন না, আমি ছিলাম হস্টেলে, বাড়ি ফিরে তাকে সবসময় মদে ডুবে থাকতে দেখেছি। মা আমাকে নিয়ে কোলকাতায় চলে আসেন, পরবর্তী জীবন মামাবাড়িতে আর মায়ের কাছে মানুষ হলাম।” চোয়াল শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্যের, “আজো এই বুকের মধ্যে মায়ের কান্না বাজে, আজো মনে পড়ে আমাকে বুকে করে মা লেকটাউনের ফ্লাটে চলে আসেন আর ধানবাদ ফিরে যাননি।” দেবস্মিতার চোখের দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে বলে, “হ্যাঁ, আমার ধারনা যে তুমি আমার মায়ের কাছ থেকে মিস্টার গুহকে ছিনিয়ে নিয়েছো।”

বুধাদিত্যের কথা শুনে দেবস্মিতা চোখের জল মুছে বলেন, “সত্যি কথা শুনতে চাও?” বুধাদিত্য মাথা নাড়ায়, হ্যাঁ।

দেবস্মিতা বলেন, “মিস্টার গুহর সাথে আমার দেখা হয় প্রায় বারো বছর আগে, ঠিক মঞ্জুষাদি, তোমার মায়ের মারা যাবার দুই বছর পরে। আমি তখন ধানবাদ রেল হস্পিটালের একজন নার্স। তন্বী, সুন্দরী, সবে চব্বিশে পা রেখেছি। বুকের মাঝে অনেক স্বপ্ন গাঁথা, চোখের সামনে অনেক প্রজাপতি ডানা মেলে থাকতো। আমার বাড়ি চিত্তরঞ্জনে, আমি বাড়ির ছোটো মেয়ে ছিলাম। আমার বাবা, চিত্তরঞ্জন লোকোতে সাধারন একটা চাকরি করতেন। আমরা বিশেষ বড়োলোক ছিলামনা।”

বুধাদিত্য চুপ করে শুনে যায় দেবস্মিতার কথা, “একদিন একটা কয়লার খনি দেখতে গিয়ে হটাত হার্ট এটাক হয় মিস্টার গুহর। পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে যায় তাঁর। হস্পিটালে ভর্তি হন তিনি। আমি সেই কার্ডিয়াক ওয়ার্ডে নার্স ছিলাম। সেখানে আমাদের প্রথম দেখা, একজন নার্স আর একজন রোগীর সম্পর্ক ছিল, তাঁর চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। সেই সময়ে তাঁর বয়স পঁয়তাল্লিশ প্রায়, আমার থেকে কুড়ি বছরের বড়, আমার ওনাকে দেখে শ্রদ্ধা হতো, ভালোবাসা জাগেনি। আমি সেই সময়ে একজনকে ভালবাসতাম, তার নাম রথিন। মিস্টার গুহ অনেক বড়লোক ছিলেন। হস্পিটাল থেকে ছুটি পাওয়ার পরেও ঘরের জন্য একজনের দরকার ছিল তাঁর। হস্পিটালের একজন ডাক্তারের সাথে তাঁর চেনাজানা ছিল, তিনি আমাকে মিস্টার গুহর বাড়ি গিয়ে ওনার ড্রেসিং করতে বলেন। আমি মত দিয়েছিলাম।”

“মিস্টার গুহ চেয়েছিলেন একজন হাউস নার্স, আমি প্রথমে না করে দিয়েছিলাম। মিস্টার গুহ বলেছিলেন যে হস্পিটালের চেয়ে বেশি মাইনে দেবেন। সেই সময়ে আমার পয়সার দরকার ছিল, বাবা মাকে আমার পড়াশুনার খরচ ফিরিয়ে দেবার ছিল। বাবা অনেক ধারদেনা করে আমাকে নারসিং পড়িয়েছিলেন। হসপিটালে থাকতে আমার যেন কেমন মনে হতো, সবাই যেন আমার দেহটাকে খাবলে খুবলে দু’চোখে ধর্ষণ করছে। এতসব ভেবে, শেষ পর্যন্ত সেই ডাক্তারের কথা শুনে আর মিস্টার গুহর কথা শুনে আমি হসপিটালের চাকরি ছেড়ে দিলাম। সেই সাথে আমাকে হস্পিটালের কোয়ার্টার ছেড়ে দিতে হয়। আমার থাকার জায়গা ছিলোনা, মিস্টার গুহ আমাকে তাঁর বাড়িতে থেকে যেতে বলেন। সেই সময়ে নতুন বাড়ি তৈরি করেছেন তিনি, বিশাল বাড়ি, বেশ কয়েকজন চাকর বাকর। আমি নিচের একটা ঘরে থাকতাম আর মিস্টার গুহ ওপরের ঘরে থাকতেন। ওই বাড়িতে আমি নিজেকে নিরাপদ বলে মনে করি। চাকর থাকা সত্তেও তিনি আমার হাতে ছাড়া আর কারুর হাতে ওষুধ খাবেন না। কয়েক মাস আমার যত্নে ধিরে ধিরে সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি।”

“সুস্থ হবার পরে আমি চিন্তায় পড়ে যাই যে আমার কাজ এই বাড়িতে শেষ, আমাকে আবার পথে নামতে হবে। হস্পিটাল আমাকে ফিরিয়ে নেবে কিনা সেই সংশয়ে ছিলাম। মিস্টার গুহ সেই সময়ে একটা নতুন ব্যাবসা শুরু করে, হেভি আরথ মুভারস ভেহিকেলেসে ব্যবসা। অনেক টাকা ঢেলে দিয়ে সেই ব্যবসা শুরু করেছিলেন, কয়লার খনিতে, বড় বড় কস্ট্রাক্সানে গাড়ি আর মেসিনারি ভাড়া দিতেন তিনি। মিস্টার গুহ আমাকে প্রস্তাব দিলেন যে আমি নারসিং ছেড়ে ওনার ব্যাবসাতে সাহায্য করি। আমি ব্যবসার কিছুই জানতাম না, তিনি আমাকে সেক্রেটারি হিসাবে নিযুক্ত করেন, প্রথমে। নতুন কাজ, নতুন জীবন, বুকের মাঝে এক নতুন দিগন্ত মেলে ধরে। আমি তাঁর কথা মেনে কাজে যোগ দিলাম।”

“মিস্টার গুহ, কোনদিন তাঁর অতীতের কথা কাউকে বলতেন না। আমি সেই ডাক্তারের কাছে শুনেছিলাম যে মিস্টার গুহর পত্নি ছিলেন আর এক পুত্র আছে। মিস্টার গুহ যখন বাড়িতে থাকতেন না, তখন আমি লুকিয়ে লুকিয়ে সারা বাড়ি তাদের চিহ্ন খুঁজে বেড়াতাম, কিন্তু সেই বাড়িতে মঞ্জুষাদির চিহ্ন বা তোমার কোন চিহ্ন ছিলোনা।”

বুধাদিত্যের খুব খারাপ লাগে সেই কথা শুনে, যে মিস্টার গুহ, জীবন থেকে তাঁর মাকে তাকে মুছে দিয়েছে। দেবস্মিতা বলতে থাকেন, “সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার পরে তিনি স্বকীয় রুপ ধারন করেন। দিনে রাতে আবার মদ খেতে শুরু করে দেন। কাজের অছিলায় মাঝে মাঝে বাড়ির বাইরে থাকতেন। বেশির ভাগ দিন বাড়িতে তাঁর বন্ধুরা আসতো, তাদের সাথে বসে মদ খাওয়া হতো, আমি চুপ করে নিজের ঘরে বসে কোম্পানির কাজে ডুবে থাকতাম। মিস্টার গুহর প্রচুর নারীসঙ্গ ছিল। আমি নিজে চোখে অনেককে ওই বাড়িতে দেখেছি। এমন দেখেছি যে, কোন ম্যানেজারের বউ মিস্টার গুহর বিছানায় পড়ে মদে চুর। রাগে দুঃখে, ব্যাথায় আমার বুক ভেঙে যেতো। শুধু ভগবানকে ডাকতাম, যে এই নরক থেকে নিয়ে যাও। ভয় হতো যে একদিন হয়তো নেশায় মত্ত হয়ে আমার শ্লীলতাহানি করবেন।”

পিতার আসল পরিচয় চোখের সামনে ভেসে ওঠে বুধাদিত্যের। ঘৃণায় শরীর রিরি করে ওঠে। দেবস্মিতা বলেন, “আমি বুঝতে পারতাম যে আমার কমনীয় আকর্ষণীয় দেহটাকে মাঝে মাঝেই আড় চোখে মিস্টার গুহ দেখেন। কিন্তু মিস্টার গুহ একবারের জন্যেও আমার দিকে হাত বাড়াননি। মনে হয় আমার সেবার ফল যে তাকে বাধা দিতো আমার দেহখানি ছিন্নভিন্ন করতে। মিস্টার গুহর কাজে যোগ দেবার পরে আমি সেই খোলামেলা জীবন থেকে বঞ্চিত হয়ে গেলাম। আমার বয়ফ্রেন্ড, রথিন, একদিন আমাকে ছেড়ে চলে যায়। হ্যাঁ, বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে যেতে পারতাম আমি। মিস্টার গুহর এতই বদনাম ছিল যে বাইরে বের হলে মানুষ আমাকে কেমন একটা চোখে দেখতো। রথিন আমার বাড়িতে সেই সব কথা বলে দেয়। আমি নিস্পাপ নিষ্কলঙ্ক ছিলাম কিন্তু বাড়ির কেউ আমার কথা শুনতে নারাজ ছিল। আমার যাবার আর কোথাও জায়গা ছিলোনা, অগিত্যা আমাকে ফিরে আসতে হয় সেই জীবনে, যা ছিল আমার কপালে লেখা।”

“সেদিনের কথা আমার মনে আছে, কালী পুজোর দিন। বিকেলবেলা রথিনের সাথে হিরাপুরে দেখা করার কথা ছিল। মিস্টার গুহ আমাকে গাড়িতে করে হিরাপুরে নিয়ে যান। গাড়ি থেকে নামার সময়ে আমার হাত ধরে বলেন, আমি যেন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরি, তিনি আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবেন। সেই প্রথমবার মিস্টার গুহ আমাকে ছুঁয়েছিলেন, কিন্তু সেই কথা বাইরের লোক জানতো না। সেই দৃশ্য দেখে রথিন রেগে যায়। আমার কথা শোনার আগেই আমার ওপরে চেঁচামেচি শুরু করে দেয়, আমাকে নীচ, জঘন্য, মিস্টার গুহর রক্ষিতা বলে গালাগালি দেয়। এতই বদনামী ছিলেন মিস্টার গুহ, যে তাঁর হাতের একটু ছোঁয়া আমার দুই বছরের সম্পর্ক ভেঙে দেয়। রথিন আমার কোন কথা শুনলো না, চলে গেল মুখ ঘুরিয়ে। সেদিন বুঝেছিলাম, বিস্বাসের আসল মানে। হয়তো আমাদের ভালোবাসার মধ্যে সেই বিশ্বাস ছিল না তাই ভেঙে গেল।”

বুধাদিত্য মাথা নিচু করে দেবস্মিতার ধরা গলার কাহিনী শুনে যায়। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেবস্মিতার দিকে তাকিয়ে দেখে দুই চোখ জলে ভরা, গাল বেয়ে টসটস করে বড়বড় ফোঁটায় শ্রাবনের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। মাথা দোলায় বুধাদিত্য, সত্যি এই ভদ্রমহিলাকে অনেক ভুল বুঝেছে সে। চোখের জল মুছে বুক ভাঙা হাসি টেনে বলে, “ভাবছো যে এই মেয়েটা তোমার সামনে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলছে, তাই না। কি দরকার আমার এত দূর এসে তোমাকে বানিয়ে গল্প শুনানোর, বলো বুধাদিত্য?”

বুধাদিত্য চুপ করে থাকে, ভাষা হারিয়ে এক নতুন রুপ দেখছে এই দেবী প্রতিমার। ঠিক সেই সময়ে কলিংবেল বাজে, চাইনিজ খাবার নিয়ে লোক এসে যায়। বুধাদিত্য টাকা মিটিয়ে খাবারের প্যাকেট দেবস্মিতার হাতে ধরিয়ে দেয়। বাপ্পাদিত্য ম্যাগি দেখে খুব খুশি। বাপ্পাকে কোলে নিয়ে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে থাকে বুধাদিত্য, বুকের ভেতরে এক শীতল মনোরম বাতাস বয়ে যায়। এই ছোট্ট শিশুর মুখে হাসি দেখে সব দুঃখ, সব কষ্ট নিভে যায় বুধাদিত্যের। চাইনিজ খেতে খেতে বাপ্পার গল্প শুরু হয়, উমংসর নাকি অনেক “ফাইত” করে, অনেক “রাইত” খায়, মাম্মা ওকে বলে পড়াশুনা করলে বড় হয়ে ওকে উমংসরের কাছে নিয়ে যাবে। খাবার পরে বাপ্পাকে নিয়ে শুতে চলে যায় দেবস্মিতা। বুধাদিত্য চুপচাপ বসে থাকে বসার ঘরে, সব কিছু ঠিক, কিন্তু এইসব কথা তাকে এত দিন পরে জানানোর কি দরকার? সেই অঙ্ক মিলাতে পারছে না, বুধাদিত্য। সে তো মিস্টার গুহর সম্পত্তিতে ভাগ বসানোর জন্য হাত পাতেনি। বারেবারে অঙ্ক মিলাতে চেষ্টা করে বুধাদিত্য।

“ব্ল্যাক কফি খাবে?” দেবস্মিতা বুধাদিত্যকে জিজ্ঞেস করেন। তাঁর গলার স্বর শুনে অঙ্ক মিলাতে ভুলে যায় বুধাদিত্য। মাথা নাড়িয়ে ইঙ্গিত করে যে, হ্যাঁ। দেবস্মিতা রান্না ঘরে ঢুকে দু কাপ ব্ল্যাক কফি বানিয়ে আনেন। আবার বসে পড়েন বুধাদিত্যের সামনের সোফায়।

বুধাদিত্য চেয়ে থাকে দেবস্মিতার দিকে, জিজ্ঞেস করে, “বাপ্পা ঘুমিয়ে গেছে?” মাথা নাড়ায় দেবস্মিতা, হ্যাঁ। বুধাদিত্য বড় শ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এমন কি হলো যে চোদ্দ বছর পরে আমার কথা মনে পড়েছে, মিস্টার গুহর? তাঁর জীবন তো ভালোই চলছিল, তবে?”

দেবস্মিতা ওর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলেন, “হ্যাঁ, এই তবের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি এসেছি, বুধাদিত্য। রথিনের সাথে সম্পর্ক ভেঙে যায়, আমি নিজেকে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে দিলাম। মাস পার হয়ে বছর ঘুরে যায়। দিনেদিনে মিস্টার গুহর মদের নেশা আর নারীসঙ্গ বেড়ে যায়। আমি চোখ কান বন্ধ করে নিচের ঘরে পড়ে থাকতাম আর বাড়ির চাকরদের তদারকি করতাম। মিস্টার গুহর ব্যাবসার ম্যানেজার, তরুন সিনহা আমাকে কাজ শিখতে অনেক সাহায্য করেন। কোম্পানির কাজ আমার ঘাড়ে এসে পড়ে, কেননা মিস্টার গুহ তাঁর মহিলাসঙ্গ আর মদ নিয়ে পড়ে থাকতেন। দিনে দিনে আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। একদিন মিস্টার গুহর সাথে এই নিয়ে প্রচন্ড মনমালিন্য হয়। আমি কড়া গলায় জানিয়ে দিয়েছিলাম, যে আমাকে যদি কাজে রাখতে হয় তাহলে বাড়িতে মেয়ে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। নেশায় চুর মিস্টার গুহ আমাকে সেদিন আমার জায়গা দেখিয়ে বলেছিলেন যে এক বেতনভুক্ত চাকর। আমি ওই বাড়িকে নিজের বলে ভাবতাম। মিস্টার গুহর কথা শুনে আমি ভেঙে যাই। নিজের ঘরে ঢুকে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করি আমি।”

“ঠিক সেই সময়ে চাকর এসে আমার দরজা ধাক্কা দেয়, চেঁচিয়ে বলে যে দিদিমনি বড়বাবুর কিছু হয়েছে। আমি আত্মহত্যার কথা ভুলে দৌড়ে উপরের ঘরে গিয়ে দেখি যে মিস্টার গুহ রক্তাক্ত অজ্ঞান অবস্থায় মেঝেতে পড়ে। চারদিকে কাঁচ ছড়ানো, গ্লাস বোতল ভাঙা। মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। আমি ওনার মাথা কোলের ওপরে তুলে শাড়ির আঁচল দিয়ে বেঁধে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে চাকরকে বললাম তরুন বাবু আর এম্বুলেন্সকে খবর দিতে। মিস্টার গুহকে হসপিটালে ভর্তি করা হলো। এবারে আর কাছ ছেড়ে যেতে পারলাম না আমি। চোখের সামনে দেখতে পেলাম যে আমার ভবিষ্যৎ মিস্টার গুহর সাথে বাঁধা। আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম আমি, কিন্তু ভগবান আমাকে তাঁর পাশে দাঁড় করিয়ে দেন। আমি চোখ বন্ধ করে মেনে নিলাম আমার ভবিতব্যের লেখন।”

“দ্বিতীয় বার ফিরিয়ে আনলাম মিস্টার গুহকে, কিন্তু এবারে মন শক্ত করে নিলাম, আমি মিস্টার গুহকে আর বিপথে যেতে দেবো না। তাঁর মদ খাওয়া, নারীসঙ্গ সব বন্ধ করে দিলাম। সুস্থ হয়ে ওঠার পরে তিনি অফিস যেতে শুরু করেন। ড্রাইভারের প্রতি কড়া নির্দেশ ছিল যে শুধু মাত্র অফিস আর বাড়ি ছাড়া আর কোথাও যেন না নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথমে একটু দোনামনা ভাব দেখিয়ে ছিলেন কিন্তু আমি তাঁর মিনতির সামনে নরম হয়ে যাইনি। সময়ের সাথে সাথে মিস্টার গুহ বদলে যান। অফিস থেকে ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরতেন। ওনার প্রতি যে শ্রদ্ধা ভাব ছিল আমার মনে, সেটা এক ভালোবাসায় পরিনত হয়। মাঝে মাঝে অফিস থেকে আসার সময়ে অহেতুক ফুলের তোড়া, আমি চকলেট খেতে ভালবাসতাম, তাই মাঝে মাঝে চকলেট কিম্বা কোন উপহার নিয়ে আসতেন। আমাদের সম্পর্কে এক নতুন মোড় নেয়। আমি জানতাম যে আমাদের বয়সের ব্যবধান অনেক, আমি জানতাম ভালোভাবে যে আমি কোন পথে চলেছি, কিন্তু আমি সেই ভালোবাসা উপেক্ষা করতে পারিনি। ওনার চোখে, ওনার আচরনে আমি আমার ভালোবাসা পুনরায় খুঁজে পাই। সেই পুরানো কচি মেয়েটা আবার আমার মধ্যে জেগে ওঠে, বুক ভরে মুক্তির শ্বাস নিলাম আমি।”

“মিস্টার গুহর সাথে দেখা হওয়ার প্রায় দু’বছর পরে, একদিন বিকেলে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। আমি তাঁর ভালোবাসা উপেক্ষা করতে পারলাম না, সম্মতি জানালাম তাঁর প্রস্তাবে। আমি মিস্টার গুহর সামনে একটা শর্ত রাখলাম, আমাকে বিয়ে করতে হলে আমাকে তাঁর অতীত জানাতে হবে। তিনি রাজি হলেন যে আমাকে তাঁর অতীতের কথা, মঞ্জুষা’দির কথা, তোমার কথা, সব বলবে। আমরা দু’জনে আমার বাড়ি চিত্তরঞ্জনে গেলাম, বাবা মা আমাদের বিয়ের ব্যাপারে সম্মতি দেন না। বলেন যে, মিস্টার গুহ আমার চেয়ে কুড়ি বছরের বড়, সেমত অবস্থায় এই বিয়ে হতে পারে না। আমার দৃঢ়সঙ্কল্পর সামনে বাবা মা শেষ পর্যন্ত ঝুঁকে যান, এবং আমাদের বিয়েতে আসেন। আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান খুব ছোটো করে হয়েছিল, গোটা কুড়ি বাইশ জন খুব কাছের লোক ছাড়া কাউকে বলা হয়নি সেই অনুষ্ঠানের ব্যাপারে। আমার স্বপ্ন ছিল আমার খুব বড় করে বিয়ে হবে, কিন্তু পাশে যখন ভালোবাসার মানুষকে পেলাম তখন আর সেই অলিক স্বপ্ন ছেড়ে মিস্টার গুহকে বুকে টেনে নিলাম।”

“সেই প্রথম রাতে আমি মিস্টার গুহকে তাঁর প্রতিজ্ঞার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলাম। তাকে জানিয়েছিলাম যে তাঁর অতীতের কথা না জানালে তিনি আমাকে চিরতরে হারাবেন। আমার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে আমার হাত দুটি নিজের হাতে নিয়ে তাঁর অতীতের কালো পাতা মেলে ধরে। টাকা-পয়সা, প্রতিপত্তি আর নারীসঙ্গের পেছনে ছুটতে ছুটতে নিজেকে এই পাঁকের মধ্যে ডুবিয়ে ফেলেছেন। মঞ্জুষাদির শত বারন সত্তেও কোন কথা কানে দেননি তিনি। নিজের মনে যা ইচ্ছে হতো তাই করতেন, শেষ পর্যন্ত মঞ্জুষাদিকে একদিন বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেন; বলেন যে সে আর তাঁর পুত্র তাঁর চাহিদার মাঝে দাঁড়িয়ে, তাদের তিনি মুখ দেখতে চাননা। তোমাকে তাঁর আগেই হস্টেলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। চোখে জল, বুকে অনুতাপ, কাঁধে অসীম পাপের বোঝা, ঝুঁকে পড়েছেন মিস্টার গুহ। আমার হাত ধরে কাতর মিনতি করেন তাকে সেই পাপের বোঝা থেকে মুক্ত করতে। আমি তাঁর চোখের জলে, তাঁর নতুন রুপের সামনে গলে গিয়ে বুকে টেনে নিলাম। আমি তাকে বলি যে সেদিন থেকে তাঁর সব কষ্ট সব দুঃখ আমি বরন করে নিলাম। সেইদিন আমি বাড়ির নাম মঞ্জুষা মন্দির রাখি। সেটাই আমার উচিত মনে হয়েছিল।”

“একটা অতি পুরানো কাঠের বাক্স থেকে একটা এ্যালবাম বের করে আমার হাতে দিয়ে বলেন, তাঁর অতীত সেই হলদে কাগজে আটকা পড়ে আছে। আমাকে মঞ্জুষাদির ছবি আর তোমার ছবি দেখিয়ে বললেন যে তিনি সব হারিয়েছেন। আমি বুকে টেনে বলি যে আমি তাঁর হারিয়ে যাওয়া জীবন হয়তো ফিরিয়ে দিতে পারবোনা, তবে ওনার ভবিষ্যৎ নিজে হাতে সুন্দর করে তুলবো।”

“দিন যায়, বাড়ির নতুন রানী আমি। আমি ব্যবসার কাজে ডুবে গেলাম, নিজে হাতে সেই কোম্পানির ভার নিলাম। মিস্টার গুহর দুই দুই বার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, তাই তাকে শুধু অফিস আর বাড়ি করতে নির্দেশ দিলাম। একটি নরম মেয়ে ধিরে ধিরে এক কোম্পানির কর্ণধারে পরিনত হলো। আমি আমার সংসার আমার কাজ নিয়ে মেতে উঠলাম। আমাদের ভেতর থেকে মঞ্জুষাদি হারিয়ে গেল। বিয়ের পাঁচ বছর পরে বাপ্পার জন্ম হয়। আমি বাপ্পার নাম রেখেছিলাম তোমার নামের সাথে মিলিয়ে, হয়তো কোনদিন ওর দাদার সাথে দেখা হবে না, তবে নামের মধ্যে হয়তো জানবে যে ওর একটা দাদা এই পৃথিবীতে আছে। বাপ্পা জন্মাবার পরে মিস্টার গুহ চাকরি থেকে ভলেন্টারি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে নিলেন, সারাদিন বাড়িতে থাকতেন আর বাপ্পার সাথে সময় কাটাতেন। কোন কোন দিন দুপুরে যদি অফিস থেকে বাড়ি আসতাম তাহলে দেখতাম যে বাপ্পা মিস্টার গুহর পেটের ওপরে শুয়ে ঘুমিয়ে। ওদের দুজনকে দেখে আমার খুব ভালো লাগতো।”

বুধাদিত্য ঘাড় ঘুরিয়ে গেস্টরুমের ভেতরে তাকিয়ে দেখে, কচি শিশু বাপ্পা, বিশাল বিছানায় উলটে শুয়ে, লাল পদ্মের মতন গোল মুখ, টোপা টোপা নরম গাল, ঠোঁট জোড়া ঈষৎ খোলা, গায়ের ওপরে চাদর। দেবস্মিতার চোখের কোনা চিকচিক করছে, বাপ্পাকে আর বুধাদিত্যকে দেখে।

দেবস্মিতা চোখের কোল মুছে বুধাদিত্যকে বলেন, “গত বছর, জুলাই মাসে, আমি অফিসের কাজে একটু ব্যস্ত ছিলাম। বাপ্পা আমার পায়ের কাছে, টেবিলের নিচে খেলছিল। খুব বায়না ধরে লুকোচুরি খেলার জন্য, ওর সাথে বিশেষ সময় কাটাতে পারতাম না, তাই লুকোচুরি খেলতে বসে গেলাম। বাপ্পা লুকিয়ে গেল একটা আলমারির ভেতরে। আমি খুঁজতে গিয়ে সেই আলমারির নিচে খুঁজে পেলাম সেই পুরানো কাঠের বাক্স। বাক্স খুলে এ্যালবাম হাতে নিয়ে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। পাতা উলটাতেই আমার সামনে মঞ্জুষাদির ছবি আর তোমার ছবি চলে এলো। কাগজের ভেতর থেকে তোমার আর মঞ্জুষাদির চোখ আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে হাসছে। সেই ছবি দেখে আমার চোখে জল চলে আসে, আমি বাপ্পার দিকে তাকালাম। এই বিশাল পৃথিবীতে কোন এক কোনায় এক মাতৃহীন ছেলে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই নিস্পাপ ছেলেটা যদি আমার বাপ্পা হতো তাহলে...” কেঁপে ওঠে দেবস্মিতার গলা, মুখে হাত চেপে কোনোরকমে নিজেকে সামলে নেন তিনি।

দেবস্মিতা ধরা গলায় বলেন, “সেই ছেলেটার কি দোষ, সেও চেয়েছিল এক সুন্দর জীবন, সেও চেয়েছিল ভালোবাসা নিয়ে বাঁচতে, অন্যের পাপের বোঝা ঘাড়ে করে কেন সেই ছেলেটা এই বিশাল পৃথিবীতে একা একা ঘুরে বেড়াবে। আমি সেদিন সেই ছবি নিয়ে মিস্টার গুহর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মিস্টার গুহর হাত বাপ্পার মাথায় রেখে বললাম, যে তোমার সাথে যোগাযোগ করতে, তোমাকে ডাকতে, তোমার প্রাপ্য তোমাকে ফিরিয়ে দিতে। মিস্টার গুহ ইতস্তত করেন, তিনি জানান যে তিনি তোমার কোন খবর জানেন না। আমি তাঁর কথা মানতে পারলাম না, আমি জানিয়ে দিলাম যে তিনি যদি তোমার সাথে পুনরায় যোগাযোগ স্থাপন না করেন তাহলে আমি বাপ্পাকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। মিস্টার গুহ বাপ্পাকে বুকে জড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে, বলেন যে তিনি সচেষ্ট হবেন তাঁর পুত্রের সাথে যোগাযোগ করতে। সাথে সাথে তিনি এটাও জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তাঁর পুত্র তাকে ক্ষমা করে দেবে না। আমি জানিয়ে দিলাম, যে ক্ষমার প্রশ্ন এখানে উঠছে না। তাঁর অতীতের জন্য আমি তাকে ক্ষমা করতে পারিনা, কেউ যদি পারে তিনি মঞ্জুষাদি আর বুধাদিত্য।”

“অনেক জোর করার পরে মিস্টার গুহ রঞ্জন বাবুকে ফোন করেন। তোমার মামিমা ফোন ধরে অবাক হয়ে যান, বেশ কিছুক্ষণ তিনি কথা বলতে পারেন না। আমি বুঝতে পারি তোমার মামিমার রাগ আর বিদ্বেষ। আমি মিস্টার গুহকে তাঁর সামনে অনুরোধ করতে বললাম, যে একবারের জন্য তিনি যেন তোমার ফোন নাম্বার দেন। তোমার মামিমা, শেষ পর্যন্ত তোমার ফোন নাম্বার দিলেন। আমি মিস্টার গুহকে সেইক্ষণেই তোমাকে ফোন করতে বললাম। হাত কাঁপছিল তাঁর, চোখে অনুতাপের অশ্রু নিয়ে ফোন করেছিলেন তিনি। তাঁর পরের ঘটনা তুমি জানো ভালো করে। তোমার সাথে কথা বলার সময়ে তিনি জানতেন যে তুমি মিস্টার গুহকে ছেড়ে কথা বলবে না, সব দোষ আমার ওপরে পড়বে আর আমার ছেলে বাপ্পার ওপরে পড়বে।”

বুধাদিত্য বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়, চোখে জল নেই, বুক ফাঁকা, ধিরে ধিরে জীবনের অঙ্ক মিলছে চোখের সামনে। বুধাদিত্যের সামনে এক কলুষিত দেবী বসে, সমাজ অনেক ঘৃণ্য নাম দিয়েছিল তাঁকে। সেই সব পার করে, এক পাপী আত্মাকে বুকে করে পাঁকের জীবন থেকে টেনে তুলেছে এই দেবী। দেবস্মিতা দেবীর মতন হেসে ওর দিকে জল ভরা চোখে তাকিয়ে বলেন, “তুমি আমাদের বাড়িতে এলে, তোমার আচরন দেখে মনে হলোনা যে তুমি আমাদের ক্ষমা করতে পেরেছো। আমি তোমার চোখ দেখে বুঝতে পারি যে তুমি আমাকেই দোষী সাব্যস্ত করেছো। আমি মিস্টার গুহর যখন অর্ধাঙ্গিনী তখন তাঁর পাপ ভাগ করে নিয়েছি আমি। আমি শেষ চেষ্টা করতে তৎপর হয়ে উঠলাম, শেষবারের জন্য তোমার সাথে দেখা করে সব কথা খুলে বলার জন্য। তোমার ঠিকানা জানার জন্য মিস্টার গুহকে দিয়ে অনিন্দিতাকে ফোন করালাম। তোমাকে এখানে না জানিয়ে আসার একটাই কারন, তোমাকে জানালে তুমি হয়তো আমাদের আসতে বারন করতে। তাই ভাবলাম একবারে এখানে এসে তোমার সাথে যোগাযোগ করা, চোখের সামনে দেখে অন্তত ফেলে দিতে পারবে না আমাদের।”

বুধাদিত্যের সামনে মিনতির সুরে ধরা গলায় বলেন, “আমি যখন মিসেস গুহ হবার জন্য সম্মতি দিয়েছিলাম, সেই সময়ে আমি জানতাম মিস্টার গুহ কি রকম মানুষ ছিলেন। তিনি বদলে গেছেন, বুধাদিত্য। আজ তিনি এক অন্য মানুষ। আমি জানিনা, তুমি তাঁকে ক্ষমা করতে পারবে কিনা, কেননা তিনি তোমার অতীত তোমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন না।” দুই হাত জোর করে কেঁদে বলেন, “আমার ছেলেটা কোন পাপ করেনি, বুধাদিত্য। তোমার বিদ্বেষের অভিশাপ যেন ওর কাছে না আসে। শুধু তোমার একটু আশীর্বাদ চাইতে এসেছি, বুধাদিত্য, দয়া করে ফিরিয়ে দিও না আমাকে। আমি ভিক্ষে চাইছি, বুধাদিত্য।” দুই হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলেন দেবস্মিতা।

বুধাদিত্য ঘাড় ঘুরিয়ে বাপ্পাকে দেখে, এই শিশু কি সত্যি পাপ করতে পারে? ছোট্ট একটি ফুলের কুঁড়ি, এখনো জীবন পড়ে আছে সামনে। বুধাদিত্য তো ভুলেই গিয়েছিল ওর বাবার কথা, তাঁর নতুন জীবনের কথা। সামনে বসা এই দেবী প্রতিমা যদি এগিয়ে না আসতো, তাহলে হয়তো কোনদিন যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হতো না।

বুধাদিত্য কিছু পরে দেবস্মিতাকে বলে, “চিন্তা কোরো না, আমি তোমাদের মাঝে কোনদিন আসবো না।”

চাপা আঁতকে ওঠেন দেবস্মিতা, “না, তুমি আমাদের ছেড়ে যেতে পারো না। ধানবাদের যা কিছু আছে তাতে বাপ্পার যেমন অধিকার তোমার সেই এক অধিকার। আমি তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি।”

বুধাদিত্য ম্লান হেসে বলে, “আমি কোথাও যাইনি, আমাকে কোথায় ফিরিয়ে নেবে?”

দেবস্মিতা, “তোমার বাবার কাছে, মিস্টার গুহর কাছে।”

বুধাদিত্য ম্লান হেসে চুপ করে মাথা দোলায়, কিছু পরে বলে, “তুমি সত্যি একজন দেবী। সব কিছু জেনেশুনে একজন পাপী আত্মার বিষ বুকে টেনে তাঁকে শুদ্ধ করে দিয়েছো। তোমার কথা কি করে ফেলবো। ঠিক আছে আমি ছুটি পেলে নিশ্চয় যাবো ধানবাদ। আমি তোমাদের সাথে যোগাযোগ রাখবো। কিন্তু আমি মিস্টার গুহর এক পয়সা নেবো না, ক্ষমা করে দিও। আমার সম্পত্তি আমার মা, আমার সাথে আছেন, তাতেই আমি শান্তিতে আছি। আমাদের এই নতুন সম্পর্কের মাঝে টাকা পয়সা নিয়ে না আসাটাই শ্রেয়।”

দেবস্মিতা চোখের জল মুছে ধরা গলায় বলেন, “আমি বড় আশা করে এসেছিলাম, তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য।”

বুধাদিত্য, “না ম্যাডাম, সেটা সম্ভব নয়। দয়া করে সেই অনুরোধ দ্বিতীয় বার কোরো না, আমি মায়ের সামনে মুখ দেখাতে পারবো না তাহলে।”

দেবস্মিতা, “আর বাপ্পা?”

বুধাদিত্য হেসে ফেলে, “বুধাদিত্যের ভাই বাপ্পাদিত্য, আমার আশীর্বাদ সব সময়ে ওর সাথে। সত্যি বলছি, আমি ধানবাদ না গেলে জানতেই পারতাম না যে আমার একটা ভাই আছে।”

দেবস্মিতা অবশেষে চোখের জল মুছে হেসে বলেন, “আমি তাহলে মিস্টার গুহকে ফোন করে জানিয়ে দেই যে আমি শেষ পর্যন্ত আমার কাজে সফল হয়েছি।”

বুধাদিত্য ঠিক বুঝতে পারে না, জিজ্ঞেস করে, “মানে?” ঘড়ি দেখে সকাল প্রায় চারটে বাজে, “তুমি এখন ফোন করবে?”

দেবস্মিতা, “হ্যাঁ, তিনি জেগে আছেন। তিনি খুব চিন্তায় ছিলেন, দাঁড়াও একটু কথা বলো তাঁর সাথে। তোমার গলার আওয়াজ শুনে হয়তো একটু ঘুমাতে পারবেন।”

হেসে ফেলে বুধাদিত্য, “বয়স হয়েছে, ফোন করে ঘুমাতে বলো এখন। কাল কথা হবে।”

দেবস্মিতা ফোন করেন সুবির বাবুকে, “ওষুধ খেয়েছিলে? রতন ঠিকঠাক খাবার দিয়েছিল?” “হ্যাঁ, বাপ্পা ঘুমাচ্ছে।” “হ্যাঁ, আমার সামনে বসে আছে।” “চিন্তা কোরো না। আমি কথা দিয়েছিলাম, ফিরিয়ে এনেছি আমি।” “না, সেটা আর হলো না। তোমার ছেলে অনেক ঋজু, নিজের আত্মসন্মান আছে।” “তুমি এখন শান্তিতে ঘুমাও, পরে ফোন করবো।” “কথা বলবে? ঠিক আছে দিচ্ছি।” ফোন বুধাদিত্যের হাতে ধরিয়ে বলেন, “একটু কথা বলো না হলে ঘুমাবেন না।”

সুবির বাবুর গলা কেঁপে ওঠে, “কেমন আছো?”

বুধাদিত্য হেসে বলে, “এক প্রশ্ন কয় বার করবে। ঘুমাতে যাও, আর পারলে কালকে বা পরশুর ফ্লাইট ধরে চলে এসো।”

কেঁদে ফেলেন সুবর বাবু, “তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।”

বুধাদিত্য, “ঠিক আছে, চলে এসো। এখন তো ঘুমাও” ফোন দেবস্মিতাকে ফিরিয়ে দেয়।

ভোরের নবীন ঊষার আলো, খোলা জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে আসে।

দেবস্মিতা ফোন রেখে ওর দিকে হেসে বলেন, “মিসেস গুহ হিসাবে যে সম্পর্ক আমাদের হওয়া উচিত সেই মর্যাদা তুমি দেবে না আমি জানি আর সেটা চাইতেও আসিনি।” হাঁ করে থাকিয়ে থাকে বুধাদিত্য। আবার কোন নতুন হেঁয়ালি শুরু করল দেবস্মিতা, সেই ভাবতে থাকে। দেবস্মিতা বলে, “আমি বাড়ির ছোটো ছিলাম, খুব ইচ্ছে ছিল আমার একটা ভাই হোক। কিন্তু সেই সম্পর্ক আমাদের মাঝে হতে পারে না। তাই না?”

বুধাদিত্য বুঝতে পারে কি বলতে চায় দেবস্মিতা। হেসে বলে, “তুমি দেবী, সুতরাং তুমি আমার নাম ধরে ডাকবে আমি তোমাকে দেবী বলে ডাকবো ব্যাস। আর সম্পর্কের অলিগলিতে ঘুরতে চাই না।”

স্বস্তির শ্বাস নিলেন দেবস্মিতা, জিজ্ঞেস করেন “কফি খাবে?”

বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে, “তোমার ঘুম পাচ্ছে না?”

দেবস্মিতা হেসে বলেন, “দশ বছর অপেক্ষা করেছিলাম এই দিনটার জন্য। আমার না ঘুমালেও চলবে, তুমি ঘুমাতে যেতে পারো।”

দেবস্মিতা রান্না ঘরে ঢুকে দু’কাপ কফি বানিয়ে এনে বুধাদিত্যের সামনে বসে। কফির কাপে চুমুক দিয়ে বুধাদিত্যকে প্রশ্ন করে, “একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি, যদিও প্রশ্নটা অনেক ব্যক্তিগত, তাও উত্তর জানালে একটু খুশি হবো।”
বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে, “কি?”

দেবস্মিতা মৃদু হেসে বলে, “তোমার রান্নাঘর, সোফার কভার, বাড়ির দেয়াল ইত্যাদি দেখে মনে হয় তোমার জীবনে কেউ আছে, সত্যি কি না জানিনা।”

হেসে ফেলে বুধাদিত্য, শেষ পর্যন্ত দেবীর কড়া নজরে ধরা পড়ে গেছে। হেসে বলে, “কি জানি ঠিক জানিনা, আছে কি নেই।”

দেবস্মিতা, “কি ব্যাপার, কি অসুবিধে একটু জানতে পারি কি?”

বুধাদিত্য একটু খানি চুপ করে থেকে বলে, “আমি একজনকে ভালোবাসি।” শেষ পর্যন্ত নিজের হৃদয়ের কথা ভালোবাসার মানুষকে না জানিয়ে অন্য কাউকে জানাতে হচ্ছে। বুকের ভেতর চিনচিন করে এক অব্যক্ত ব্যাথা শুরু হয় বুধাদিত্যের।

দেবস্মিতা বড় বড় চোখ করে হেসে বলে, “বেশ ভাল কথা, কবে বিয়ে করছো?”

বুধাদিত্যের মুখ শুকিয়ে যায় ঝিলামের কথা ভেবে, “বিয়ে হয়তো হবে না আমাদের।” ঝিলাম কিছুদিন পরে সমীরের সাথে বেড়াতে যাবে, ঝিলাম আর সমীরের সুখের সংসার থেকে দুরে সরে যেতে যায়।

দেবস্মিতা, “কেন? অসুবিধে কোথায়?” বুধাদিত্য মাথা নিচু করে বসে থাকে। দেবস্মিতা ওর পাশে বসে ওর পিঠের ওপরে হাত রেখে মৃদু সুরে বলে, “দেবী বলে ডেকেছো, আর নিজের মনের কষ্ট একটু জানাবে না?”

নরম হাতের পরশে মায়ের কথা মনে পড়ে যায় বুধাদিত্যের, চোখের কোন চিকচিক করে ওঠে বেদনায়। কোনোরকমে আবেগ সামলে বলে, “বড় প্যাঁচালো সম্পর্ক, দেবী। জানিনা শুনলে তুমি আমাকে কি বলবে। আমি যাকে ভালোবাসি সে আমার বন্ধুর বৌ, নাম ঝিলাম। সমীরের সাথে বিয়ে হয় বছর তিন আগে। এই গত বছর দিল্লীতে দেখা, এখন দিল্লীতে থাকে। সমীর আর ঝিলামের মধ্যে সম্পর্ক বেশ কিছুদিন ধরে খুব টানাপোড়েনের মধ্যে চলে। সমীর কাউকে ভালোবাসে বা ভালবাসতো। আমি ভেবেছিলাম যে হয়তো ওদের মাঝে ডিভোর্স হয়ে যাবে আর আমি ঝিলামকে আমার করে নিতে পারবো। কিন্তু কিছুদিন আগে সমীর ফিরে আসে ঝিলামের জীবনে। আমি সেই একা।”

দেবস্মিতা পিঠের ওপরে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কোনদিন তোমার মনের কথা ঝিলামকে জানিয়েছো?” বুধাদিত্য মাথা দোলায়, “না।” দেবস্মিতা জিজ্ঞেস করে, “ঝিলাম তোমাকে ভালোবাসে?” বুধাদিত্য শূন্য চোখে দেবস্মিতার দিকে তাকিয়ে থাকে। দেবস্মিতা বুঝে যায় যে বুধাদিত্য অথবা ঝিলাম কেউ পরস্পরকে মনের কথা জানায়নি। চিন্তায় পড়ে যায় দেবস্মিতা, “সত্যি বড় প্যাঁচালো সম্পর্ক। এখানে কিছু করা মানে সবার চোখে পাপী, ব্যাভিচারি হয়ে যাওয়া, এক অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া। কি করবে ভেবেছো?”

বুধাদিত্য মাথা দোলায়, “জানিনা, দেবী। আমি সত্যি নিজের কাছে হেরে গেছি। ওদের মাঝে যেদিন বুঝবো যে ভালোবাসা ফিরে এসেছে, সেদিন আমি দিল্লী ছেড়ে, দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চাকরি নিয়ে চলে যাবো। আমি জানি, আমি যদি ঝিলামের চোখের সামনে থাকি তাহলে সমীরকে মেনে নিতে ঝিলামের বড় কষ্ট হবে। আমি চাই না ওদের ভালোবাসার মাঝে কাটা হয়ে দাঁড়াতে।”

দেবস্মিতা মিষ্টি হেসে বলে, “তুমি হারতে পার না, বুধাদিত্য। আমার মন বলছে, একদিন এই কালো মেঘের মাঝখান থেকে এক নতুন সূর্য উঠবে, তোমার মনের সব কালিমা দূর করে দেবে। সত্যি যদি তোমাকে কোথাও যেতে হয়, তুমি আমার কাছে চলে এসো। আমার বাড়ি, তোমার বাবার বাড়ির দরজা তোমার অপেক্ষায় দিন গুনছে বুধাদিত্য।”

বুধাদিত্য ম্লান হেসে বলে, “ভেবে দেখবো দেবী। যাও একটু বিশ্রাম করো, আমাকে নিজের ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দাও।”

সকাল বেলায় বুধাদিত্য মামাকে ফোন করে সব কথা বলে। প্রমীলা দেবীর মন একটু খারাপ হয়ে যায়। বুধাদিত্য বুঝতে পারে যে মামিমা ভাবছেন যে ছেলে বাবা পেয়ে হয়তো তাকে ভুলে যাবে। বুধাদিত্য মামিমাকে আস্বস্ত করে, “পমুসোনা”র জায়গা ওর জীবনে অন্য কেউ নিতে পারবে না। বাবাকে হয়তো ফিরে পেয়েছে, কিন্তু রঞ্জনবাবুকে জানায় যে সুবিরবাবু কর্মে নয়, শুধু মাত্র জন্ম দিয়েছেন বলে তাঁর বাবা। তৎক্ষণাৎ প্লেনের টিকিট কেটে পাঠিয়ে দেয় মামা মামীকে। বিকেলের মধ্যে প্রমীলাদেবী আর রঞ্জনবাবু দিল্লী আসেন। প্রমীলাদেবী দেবস্মিতাকে দেখে তার সাথে কথা বলে আস্বস্ত হন। বাপ্পাকে দেখে বেশ খুশি হন। রাতের মধ্যে সুবিরবাবু দিল্লী পৌঁছান। বাড়ি লোকজনের সমাগমে মুখর ওঠে, ছোট্ট বাপ্পা মায়ের কোলে চেপে নতুন লোকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

সুবিরবাবু অনেক চেষ্টা করেন ছেলেকে ধানবাদে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার। বুধাদিত্য সুবিরবাবুকে শোয়ার ঘরে মায়ের ছবির সামনে দাঁড় করিয়ে জানিয়ে দেয় যে ওর মা ওর সাথেই আছে, আর এই সম্পত্তি নিয়ে অথবা ধানবাদ যাওয়া নিয়ে যেন কথা না বলে। জানায় যে, নতুন সম্পর্কে টাকা পয়সা না আসলেই ভালো, মায়ের আত্মা শান্তি পাবে না। বুধাদিত্যের জীবনে সব আছে নতুন আর কিছু চায় না।
 
ত্রয়োদশ পর্বঃ পুনরুজ্জীবিত।

কয়েকদিন আগেই বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেছে। দেবস্মিতা আর সুবিরবাবু ধানবাদ ফিরে গেছেন। বুধাদিত্য তাদের কথা দিয়েছে যে আগামি ছুটিতে ধানবাদ গিয়ে কয়েকদিন থেকে আসবে। রঞ্জনবাবু আর প্রমীলাদেবীকে থেকে যেতে বলে, বলে যে কেদার বদ্রি ঘুরাতে নিয়ে যাবে। প্রমীলাদেবী জানান যে অনিন্দিতাদি নেপাল থেকে ফিরে এলে পরের বার সবাই মিলে যাওয়া যাবে।

ঝিলামের গরমের ছুটি শুরু হয়ে গেছে। বুধাদিত্যকে ফোন করে জানিয়ে দেয় যে সমীর ওকে নিয়ে কয়েকদিনের মধ্যে কোথাও একটা ঘুরতে যাবে। সমীর বুধাদিত্যকে জানিয়েছিল যে ঝিলামকে নিয়ে অরুনাচলের তাওয়াং উপত্যকা দিন পাঁচেকের জন্য ঘুরতে যাবে। সমীরের অনুরোধ রাখে বুধাদিত্য, ঝিলামকে ওর পরিকল্পনা জানায়নি। ভেবেছিল যে স্বামী যখন তাঁর স্ত্রীকে ভালোবেসে একটা চমক দিতে চলেছে, তাহলে সেই আনন্দে বাধা দিয়ে তার লাভ নেই। সেই সাথে বুধাদিত্যের মনে সন্দেহ জেগে ওঠে, পাঁচ দিনে অরুনাচল ঘুরে ফিরবে? সমীরকে জানিয়ে দেয় যে কোন রকম দুরাভিসন্ধি মাথায় রাখলে মেরে ফেলবে সমীরকে। সমীর হেসে জানায় যে ওর মাথায় কোন বাজে পরিকল্পনা নেই। তাও সমীরকে ঠিকভাবে বিশ্বাস করে উঠতে পারে না বুধাদিত্য। ঝিলামের হাসি মুখ দেখে সন্দেহের বীজ বুকের মধ্যে রেখে দেয়।

সকালে অফিস বের হবার আগে ঝিলাম জানায় যে রাতে নাকি ওর বেরিয়ে যাবে। ঝিলাম ঘুরতে যাওয়ার জন্য তৈরি, ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছে। কণ্ঠস্বরে একটু উদ্বেগের ছোঁয়া, বুধাদিত্য আস্বস্ত করে নিরুদ্বেগে বরের সাথে ঘুরতে যেতে, কিছু হলে বুধাদিত্য দেখে নেবে। রাতের বেলা ঝিলামের এসো.এম.এসো আসে, “আমরা বেরিয়ে গেছি। ভালো থেকো।” বুধাদিত্য সেই এসো.এম.এসো পড়ে স্তব্ধ হয়ে যায়, ভালোবাসার পাত্রী “ঝিল্লি” তাঁর স্বামীর সাথে মনের আনন্দে ঘুরতে বেরিয়ে গেছে। মোবাইলে ওর ছবি খুলে দেখে, বুকের বাঁ দিকটা চিনচিন করে ওঠে, ঝিলামকে এই জীবনে এই বুকের মধ্যে আর পাওয়া আর হলো না। ঘুম আসেনা বুধাদিত্যের, চোখ বন্ধ করলেই ঝিলামের মিষ্টি মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বুকের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঝিলাম, কিন্তু আটকাতে পারেনি বুধাদিত্য। বুকের ওপরে ওর ঠোঁটের পরশ এখনো লেগে। আলমারি খুলে ওর জামা মুখের ওপরে মেলে ধরে গায়ের গন্ধ বুকে টেনে নেয়।

ঘন্টা চারেক পরে আবার একটা এসো.এম.এসো, “আমারা গড়গঙ্গা পার হচ্ছি। জানিনা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তবে খুব খুশি আমি।” খবরটা পড়ে মাথা ঘুরে যায় বুধাদিত্যের, সমীর জানিয়েছিল যে ঝিলামকে নিয়ে অরুনাচল ঘুরতে যাবে। দিল্লী ছাড়ার চার ঘন্টা পরে, ঝিলাম গড়গঙ্গার কাছে কি করছে? সমীরের পরিকল্পনার সাথে অঙ্ক মেলাতে পারে না। ঝিলামকে একটা এসো.এম.এসো করে জিজ্ঞেস করে গাড়ির নাম্বার আর গাড়িতে কে কে আছে। পরের এসো.এম.এসে’-র কোন উত্তর না পেয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে বুধাদিত্য।

রাত প্রায় বারোটা বাজে, সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভার কালীনাথকে ফোন করে ডেকে নেয়। বুধাদিত্য তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পরে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরে। কালীনাথ জিজ্ঞেস করে কারন, কোথায় যেতে হবে। বুধাদিত্য সংক্ষেপে জানায় যে গন্তব্য স্থলের ঠিক নেই তবে ঝিলাম বিপদে। কালীনাথ এতদিন বুধাদিত্যের সাথে থেকে বুঝে গেছে, যে সাহেবের জীবনে ঝিলাম মেমসাহেব খুব বড় স্থান দখল করে রেখেছে। দরজার তালা ভেঙে সমীরের বাড়ি ঢোকে। সব ঘর তছনছ করে ফেলে, সমীরের দুরাভিসন্ধি ধরার জন্য। শেষ পর্যন্ত ওদের শোয়ার ঘরের বিছানার তলায় একটা বড় হলদে খামে দুটি প্লেনের টিকিট, সমীরের পাসপোর্ট আর ভিসার কাগজ, বেশ কয়েক হাজার ডলার পায়। প্লেনের টিকিট, একটা সমীরের নামে অন্যটা নন্দিতার নামে। তারিখ পনেরো দিন পরের, গন্তব্য স্থান, মরিশাস। তার মানে, ঝিলামকে পথ থেকে সরিয়ে দিয়ে দেশের বাইরে চলে যেতে চায় সমীর। চোয়াল শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্যের, পুরানো বন্ধু না শত্রু বলা ভালো, এক ভয়ঙ্কর ধূর্ত সমীর হয়ে ফিরে এসেছে। মাথায় রক্ত চড়ে যায় বুধাদিত্যের, ঝিলামের সাথে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা। ঝিলাম না জেনে হাসতে হাসতে বিপদের দিকে পা বাড়িয়ে দিয়েছে, সারা শরীর টানটান হয়ে ওঠে বুধাদিত্যের। খামটা নিজের সাথে নিয়ে নেয়। ঝিলামকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, সেট জানার জন্য সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়ায় কোন সুত্র যদি পায় কিন্তু তার চিহ্ন পায় না। মাথা চেপে বসে পড়ে, কেন মরতে সমীরের কথায় বিশ্বাস করে ঝিলামকে পাঠিয়েছিল। বড় অনুশোচনা হয় বুধাদিত্যের। একবারের জন্য মনে হয় নিজের মাথার মধ্যে পিস্তলের সব কটা গুলি নামিয়ে দিতে। দরজার শব্দে বাড়ির মালিক পৌঁছে যায় কি হচ্ছে দেখার জন্য। বুধাদিত্য তাঁকে ঝিলাম আর সমীরের কথা জিজ্ঞেস করে। বাড়ির মালিক জানায়, যে এই কদিনে ওদের বাড়িতে বাইরের লোক কেউ আসেনি। সমীরের আচরনে কোনোরকমে মনে হয়নি যে সমীর আর ঝিলামের মাঝে কোন দ্বন্দ আছে। দুজনে বেশ ভালোই ছিল এই কটা দিন। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে যে কোথায় বেড়াতে গেছে, সেই ব্যাপারে কিছু জানে কি না। উত্তরে বাড়ির মালিক বলেন যে, একটা সাদা সুমো ভাড়ার গাড়ি চেপে ওরা বেড়াতে বেরিয়েছে, গাড়িতে দিল্লীর নাম্বার। কোথায় বেড়াতে গেছে কিছু বলে যায়নি সঠিক, তবে দিন পাঁচেক পরে ফিরবে বলে গেছে। বাড়ির দরজায় একটা নতুন তালা লাগিয়ে বেরিয়ে পড়ে বুধাদিত্য।

চার ঘন্টা পেরিয়ে গেছে, এতক্ষণে ঝিলামকে নিয়ে অনেক দূর পার হয়ে গেছে সমীর। গা হাত পা জ্বলছে বুধাদিত্যের, রাগে থরথর কাঁপতে শুরু করে। সমীরকে একবার হাতের কাছে পেলে মেরে ফেলবে। ফুলের মতন সুন্দরী মেয়েটা মনে প্রানে স্বামীর কথায় বিশ্বাস করে আবার ফিরে যায়, সেই বিশ্বাস ভেঙে দেয় ব্যাভিচারি ইতর সমীর। বুধাদিত্য ঝিলামকে ফোন করে, কিন্তু ফোন সুইচ অফ বলে, উন্মাদ হয়ে ওঠে বুধাদিত্য। পিস্তল বের করে কোমরে গুঁজে নেয়। সাথে দুটো অতিরিক্ত ম্যাগাজিন। কিছু দূর যাবার পরে কালীনাথকে পাশে বসতে বলে নিজেই গাড়ি ছুটিয়ে দেয়, প্রথম গন্তব্যস্থল গড়গঙ্গা। বুকের মাঝে একটাই আশা এর মাঝে যেন ঝিলামকে আঘাত না করে। ঘন্টা আড়াইয়ের মধ্যে গড়গঙ্গা পৌঁছে যায়। দুই তিনটে ধাবা খোলা ছিল, তাদের জিজ্ঞেস করে যে একটা সাদা সুমো গাড়ি থেমেছিল কিনা। একটা ধাবার লোক জানায় যে কয়েক ঘন্টা আগে একটা সাদা সুমো থেমেছিল তার ধাবায়। বুধাদিত্য মোবাইলে ঝিলামের ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে যে সেই গাড়িতে এই মহিলা ছিলো কিনা? ধাবার লোক জানায় যে হ্যাঁ, ওই গাড়িতে ছবির ভদ্রমহিলা ছিলেন। গাড়িতে স্বামী স্ত্রী ছাড়া আর কেউ ছিল না। সমীর ধাবার মালিকের কাছে মুরাদাবাদের রাস্তা আর আলমোড়ার রাস্তা জিজ্ঞেস করেছিল। সমীরের হাতে একটা উত্তরাখণ্ডের ম্যাপ ছিল। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে ওদের দেখে কি কোন রকম সন্দেহ হয়েছিল ধাবার মালিকের? মাথা নাড়িয়ে বলে, না, এক নববিবাহিত দম্পতির মতন পরস্পরের সাথে হেসে খেলে গল্প করছিল। চোয়াল শক্ত করে সব তথ্য মাথার মধ্যে এঁকে নেয় বুধাদিত্য। মুরাদাবাদ পর্যন্ত পাগলের মতন গাড়ি চালায়, কিন্তু সেই সাদা সুমোর দেখা পাওয়া যায়না কিছুতেই। সে গাড়ি যে অনেক আগে বেরিয়ে গেছে। ঝিলাম আর সমীরকে বারেবারে ফোনে ধরতে চেষ্টা করে, কিন্তু কিছু পরে দুটো ফোন সুইচ অফ বলে। প্রবল এক ঝড় বুকের রক্ত উথাল পাতাল করে তোলে। চোখের সামনে বারেবারে ঝিলাম এসে দাঁড়িয়ে পড়ে, কানে ভেসে আসে ঝিলামের মিষ্টি হাসি, রাঙা পায়ের নুপুরের রিনিঝিনি সঙ্গীত, উচ্ছল তরঙ্গিণীর মধুর ঝঙ্কার।

কালীনাথ বারন করা সত্তেও বুধাদিত্য গাড়ি চালিয়ে যায়। ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালিয়ে ভোরের দিকে নইনিতাল পৌঁছায়। নইনিতাল পেরিয়ে একটা চায়ের দোকান দেখে সেখানে দাঁড়ায়। আলমোড়া যাবার একটাই রাস্তা, চা খাবার সময়ে দোকানিকে সমীরদের গাড়ির কথা জিজ্ঞেস করে। দোকানি জানায়, যে একটা সাদা সুমো কয়েক ঘন্টা আগে ওর দোকানে থেমেছিল। গাড়ির ভদ্রমহিলা বেশ হাসি খুশি ছিলেন, গাড়ির ভদ্রলোকের সাথে বেশ গল্প করছিলেন। দোকানি জানায় যে রাতে ওর দোকানের পেছনের হোটেলে রাত কাটিয়েছে। বুধাদিত্য গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল আবার। চোখে ঘুমে নেই, কিন্তু সারা রাত গাড়ি চালিয়ে একটু ক্লান্তি ভর করে আসে শরীরে। কালীনাথ নিপুণ হাতে পাহাড়ি রাস্তার মধ্যে গাড়ি চালাতে শুরু করে। পাহাড়ি রাস্তায় একটু ধিরে ধিরে গাড়ি চালাতে হয়। গাড়ি ধিরে ধিরে এঁকে বেঁকে, পাহাড়ের চড়াই উঠতে সুরু করে। বেশ কিছু দূর যাবার পরে একটা গাড়ি ওদের পেছন থেকে হর্ন দেয়। কালীনাথ পেছনের গাড়িটাকে আগে যাবার জন্য জায়গা ছেড়ে দেয়। পেছনের গাড়ি পাশ দিয়ে যাবার সময়ে গাড়ির ভেতরে আচমকা চোখ যায় বুধাদিত্যের। ভেতরে নন্দিতা আর একজন লোক বসে। মাথার মধ্যে সমীরের পরিকল্পনার ছবি আঁকতে শুরু করে দেয়। চোখের সামনে কুয়াশা কেটে দুরাভিসন্ধির কুটিল জল্পনা কিছুটা পরিষ্কার দেখা দেয়, সেই ছবি দেখে বুক কেঁপে ওঠে বুধাদিত্যের। বুধাদিত্য কালীনাথকে সামনের নন্দিতাদের গাড়ির পিছু নিতে বলে। কালীনাথ জিজ্ঞেস করাতে বুধাদিত্য জানায় যে সামনের গাড়িতে সমীরের গার্লফ্রেন্ড নন্দিতা বসে। কালীনাথের বয়স হয়েছে, অনেক কিছু দেখেছে। বুধাদিত্যের ওই কথা শুনে সব বুঝে যায়।

দুপুরের কিছু আগে আলমোড়া পৌঁছে যায়। বুধাদিত্য লক্ষ্য করে যে একটা খাবারের হোটেলের সামনে নন্দিতাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে। বুধাদিত্য গাড়ি থেকে নামে না, নন্দিতা ওকে পুনেতে দেখেছিল, আবার দেখতে পেয়ে চিনতে পেরে যাবে, সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। এখানে যদি দেখে তাহলে ওদের গাড়ির পিছু করতে পারবে না। কালীনাথ সেই গাড়ির ড্রাইভারের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে খবর নেয় যে নন্দিতাদের গাড়ি মুন্সিয়ারি যাবে। বুধাদিত্য চুপ করে বসে কিছুক্ষণ ভাবতে চেষ্টা করে পরবর্তী পদক্ষেপ। বেশ কয়েকটা সিগারেট জ্বলে যায়। মনে মনে ঠিক করে যে সমীরকে এখুনি যদি ধরে, তাহলে সমীর সব কিছু এড়িয়ে যাবে। এতক্ষণে ভালোবাসার প্রবল নাটক রচে, ঝিলামের নরম হৃদয় গলিয়ে নিজের করে নিয়েছে। সেই পর্দা এক ঝটকায় সরানো একটু কঠিন হবে, তবে দেখা যাক কত নীচ পর্যন্ত নামতে পারে সমীর। কালীনাথ দুই কাপ চা নিয়ে আসে। চা খেতে খেতে বুধাধিত্যকে বলে, “সাহেব, একটু দূর থেকে গাড়ি ফলো করবো। যখন কান পেয়ে গেছি, তাহলে মাথা পেতে দেরি হবে না। কানের পেছনে যাই।” কালীনাথ আরও জানালো যে কথাবার্তা শুনে মনে হলো নন্দিতার সাথের লোক সমীরকেও চেনে। চা খেয়ে আবার যাত্রা শুরু, মুন্সিয়ারি পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে যায়। পাহাড়ি রাস্তায় বিশেষ চৌমাথা আসেনা, তাই কালীনাথ আবার ঘোড়ার গতিতে গাড়ি চালিয়ে দেয়। নন্দিতাদের গাড়ি টপকে বুধাদিত্যের গাড়ি আগেই মুন্সিয়ারি পৌঁছে যায়।

সন্ধ্যেবেলায় মুন্সিয়ারি পৌঁছায় বুধাধিত্য। সামনে তুষারে ঢাকা পাঁচমাথা পঞ্চচুলি দাঁড়িয়ে, তাঁর নিচে, পাহাড়ের কোলে খুব ছোটো শহর মুন্সিয়ারি। গরমের ছুটির জন্য সেই জায়গায় লোকের সমাগম, কিলবিল করছে পর্যটক, রাস্তায় গাড়ির ভিড়, হোটেলে মানুষের ভিড়। বুধাদিত্যের চোখ সমীরকে খুঁজে বেড়ায় আর কালীনাথের চোখ সেই সাদা সুমো খুঁজে বেড়ায়, কিন্তু চারপাশে সাদা রঙের ভাড়ার গাড়ির সমাগম। হতাশ হয়ে যায় দুজনেই, এর মধ্যে কোন গাড়িটা সমীরদের বুঝে উঠতে পারেনা। কয়েকটা হোটেলে গিয়ে ফটো দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে, কিন্তু বেশির ভাগ হোটেলের লোক যাত্রীদের নাম বলতে পরিচয় জানাতে নারাজ। কিছু পরে নন্দিতাদের গাড়ি দেখে আস্বস্ত হয় বুধাদিত্য, সমীর মুন্সিয়ারিতে আছে, অন্য কোথাও যায়নি। নন্দিতাদের গাড়ি মুন্সিয়ারি ছাড়িয়ে একটু নিচের দিকে চলে যায়। কালীনাথ খবর নিয়ে আসে, যে নিচের দিকে কিছু ছোটো হোটেল আছে, সেখানে হয়তো সমীর ঝিলামকে নিয়ে উঠেছে।

ঘন কালো রাত নেমে আসে পাহাড়ের কোলে, সেই রাতের মধ্যে আর ভিড়ের মধ্যে মিশে যায় বুধাদিত্য। কালীনাথ একা একা নন্দিতাদের গাড়ির পেছনে যায়। বুধাদিত্য ইতিমধ্যে মুন্সিয়ারি শহর তদারকি করে আসে, দেখে আসে যে পুলিস আছে কিনা। বাজারের একদিকে একটা পুলিস পিকেট দেখে আস্বস্ত হয় বুধাদিত্য। কিছু হলে অন্তত পুলিস খবর পাবে। কিন্তু কাছের শহর বলতে বাগেশ্বর বা আলমোড়া সেখান থেকে অনেক দুরে। সাহায্য আসতে অনেক দেরি হবে। কিছু পরে কালীনাথ এসে জানায় যে, নন্দিতাদের গাড়ি নিচের একটা হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে। সেই হোটেলের আশেপাশের হোটেলের সামনে আরও বেশ কয়েকটা সাদা সুমো দাঁড়িয়ে। এর মধ্যে সমীরের গাড়ি চেনা অসম্ভব।

কালীনাথ উদ্বেগের সাথে বুধাদিত্যকে বলে, “সাহেব, সমীর যদি মেমসাবকে রাতে মেরে ফেলে তাহলে?” বুধাদিত্য চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, সমীর এত কাঁচা কাজ করবেনা। সমীরকে ছোটো বেলা থেকে চেনে বুধাদিত্য, খুব নিখুঁতভাবে নিজের কার্যসিদ্ধি করবে সমীর। সেই জন্য ঝিলামকে এত দুরে, এক পর্যটক ভর্তি জায়গায় বেড়াতে নিয়ে এসেছে। ভাবতে বসে যে সমীর ঝিলামকে কি ভাবে আক্রমন করতে পারে। মাথার সব শিরা উপশিরা জেগে ওঠে একসাথে, চঞ্চল হয়ে ওঠে গায়ের রক্ত। মুন্সিয়ারিতে মোবাইল ফোন চলছে না যে কাউকে খবর দেবে। সমীর বেশ নিখুঁত ফন্দি এঁটে ঝিলামকে বশ করেছে।

সারারাত কালীনাথ আর বুধাদিত্য পালা করে গাড়ির মধ্যে জেগে বসে থাকে। সকাল হলে কালীনাথ বুধাদিত্যের জন্য চা জল খাবার নিয়ে আসে। কোন রকমে হাত মুখ ধুয়ে চা জল খাবার খেয়ে গাড়ি অন্য জায়গায় নিয়ে যায় কালীনাথ। বুধাদিত্য পর্যটকদের সাথে মিশে যায়। কিছু পরে হোটেলের ভেতর থেকে নন্দিতা আর সাথের লোকটা ঘুরতে বের হয়। বুধাদিত্য আড় চোখে কালীনাথকে ওদের পিছু নিতে ইঙ্গিত করে। বুধাদিত্যের চোখ শুধু ঝিলাম আর সমীরকে খুঁজে বেড়ায়। প্রচন্ড বিদ্বেষে গায়ের রক্ত তরল লাভায় পরিনত হয়ে গেছে, এক বার হাতের নাগালে পেলে পিস্তলের গুলি মাথার মধ্যে পুরে দেবে।

কিছু পরে কালীনাথ বুধাদিত্যের কাঁধে হাত রাখে, কানেকানে জানায় যে নন্দিতা ফিরে এসেছে হোটেলে। কিন্তু ঝিলাম আর সমীরের দেখা পায়নি কালীনাথ। কিছু পরে হোটেল থেকে নন্দিতা আর সাথের লোক বেরিয়ে এসে মুন্সিয়ারির দিকে না হেঁটে অন্যদিকে পা বাড়ায়। সন্দেহ হয় বুধাদিত্যের, কালীনাথের সাথে ওরা নন্দিতার পিছু নেয়। বুকের মাঝে ধুকপুক বেড়ে ওঠে, মাথার রগ ফুলে ওঠে, কিছু একটা ভয়ঙ্কর ঘটতে চলেছে এই সুন্দর নির্মল পরিবেশে। বুধাদিত্য বাম পাশের পাহাড়ে উঠে যায়। ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে, উঁচু উঁচু গাছের পেছন দিয়ে এগিয়ে নন্দিতাকে অনুসরণ করে। একবার যখন কান পেয়েছে, মাথা পেতে দেরি হবে না। নিচের রাস্তায় অনেক লোকজন, সবাই ঘুরতে বেরিয়েছে।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা একটা ঝরনা পেরিয়ে যায়। পিচের রাস্তা শেষ, মাটির একটা রাস্তা একদিকে নিচে নেমে গেছে, অন্যদিকে একটি সরু রাস্তা পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেছে। সেই সরু পাথুরে রাস্তায় পর্যটকের ভিড় অনেক কম, কিছু সংখ্যক পর্যটক কোন একদিকে ট্রেকিংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। ঘন জঙ্গলের ভেতর থেকে বেশ কিছু দুরে এগিয়ে যায় বুধাদিত্য আর কালীনাথ। চারপাশে সবুজ ঝোপঝাড়, আর বড় বড় গাছ। মাথার ওপরে নীল আকাশ, আকাশে বাতাসে একটু ঠাণ্ডার আমেজ, আবহাওয়া বেশ মনোরম। ভেবে পায়না বুধাদিত্য, এই রকম মনোরম পরিবেশে একটা নৃশংস কোন ঘটনা ঘটবে। অনেকের হাতে ক্যামেরা, অনেকেই ছবি তুলছে, দুরে দাঁড়িয়ে থাকা পঞ্চচুলির। হটাত বুধাদিত্যের চোখ পড়ে কিছু দুরে হেঁটে যাওয়া সমীর আর ঝিলামের দিকে। ঝিলামের মুখ বেশ হাসিখুশি। চেহারা দেখে বোঝা যায় যে সমীর ফিরে আসাতে আর ওকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কারনে ওর মনের আনন্দ বহুগুন বেড়ে গেছে। সমীর ঝিলামের সাথে গল্প করতে করতে ধিরে ধিরে ওকে খাদের ধারে নিয়ে যায়। সরু রাস্তার ওইপাসে গভীর খাদ, নিচে বয়ে চলেছে একটা সরু পাহাড়ি নদী।

বুক কেঁপে ওঠে বুধাদিত্যের, আকাশ কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে ঝিলামের নাম ধরে, “ঝিল্লিরানী দাঁড়িয়ে যাও।”

সেই আওয়াজ ওদের কানে পৌঁছায়না। সমীর ঝিলামকে জড়িয়ে ধরে ওর কানে কানে কিছু বলে। ঝিলাম অবিশ্বাস্য বেদনা ভরা পাংশু চোখে সমীরের দিকে তাকায়। সমীর আলতো করে কনুই দিয়ে ঝিলামকে ঠেলে দেয়।

ঝিলাম চিৎকার করে ওঠে, “শেষ পর্যন্ত তুমি... নাআআআআআ...” কথা শেষ করতে পারেনা, পা পিছলে খাদের মধ্যে পড়ে যায় ঝিলাম।

সমীর কপট চিৎকার করে সাহায্যের জন্য নিচের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। বুধাদিত্য মাটি থেকে একটা বড় পাথর নিয়ে সমীরের পা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারে। হটাত পায়ের ওপরে পাথরের মার খেয়ে সমীর টাল সামলাতে পারেনা। ঝিলামের সাথে সাথে সমীর খাদের ভেতরে গড়িয়ে পড়ে যায়। চেঁচামেচি শুনে সবাই ছুটে আসে। বুধাদিত্য আর কালীনাথ পাহাড় বেয়ে নিচে দিকে নেমে আসে। বুধাদিত্য রোষকষিত চোখে একবার নন্দিতার দিকে তাকায়, সেই ভীষণ চোখের চাহনি দেখে নন্দিতার শরীরের রক্ত জল হয়ে যায়।

বুধাদিত্য কিছু না ভেবেই খাদের মধ্যে ঝাঁপ দেয়। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে যায় নিচের দিকে। কিছু দুরে নিচে একটা পাথরে আটকা পড়ে থাকে ঝিলামের দেহ। মাথা ফেটে গেছে, চেহারা রক্তাক্ত, ঘাড় একদিকে কাত, ঝিলামের ক্ষত বিক্ষত দেহ কাঁপতে থাকে। আরও কিছু নিচের দিকে একটা ছোটো ঝোপের ডাল ধরে ঝুলে রয়েছে সমীর। রাগে ঘৃণায় দুচোখ থেকে রক্ত বেরিয়ে আসার যোগাড় বুধাদিত্যের। ভগবানের কাছে কাতর আবেদন জানায়, ঝিলামকে কেড়ে নিও না। ঝিলামকে পাথরের উপর থেকে তুলে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে। বুকের ওপরে পিষে মিলিয়ে নেয় ওর রক্তাক্ত শরীর, বুকের কাছে কান পেতে শোনে ওর হৃদয়ের ধুকপুক। ঝিলাম বহু কষ্টে দু'চোখ মেলে বুধাদিত্যের দিকে তাকায়। ঠোঁট জোড়া নাড়িয়ে কিছু বলার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। রক্তাক্ত হাত উঠিয়ে বুধাদিত্যের জামা খামচে ধরে, ঝিলাম ওর বুকের ওপরে মুখ গুঁজে অজ্ঞান হয়ে যায়। গায়ের জামা খুলে ঝিলামের মাথায় বেঁধে দেয়, রক্তক্ষরণ কিছুটা কমে যায়। বুকের কাছে জড়িয়ে ওর মুখের ওপরে ঝুঁকে কপালে ঠোঁট চেপে ধরে ক্ষমা চায়।

বুধাদিত্য সমীরের দিকে তাকায়। খাদের মধ্যে গড়িয়ে পড়ার সময়ে সমীরের মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত বের হয়, হাত পা কেটে রক্ত বের হয়। রক্তাক্ত সমীর বুধাদিত্যের দিকে মিনতি ভরা চাহনি নিয়ে তাকিয়ে সাহায্যের ভিক্ষা চায়।

বুধাদিত্যের মাথা গরম হয়ে যায়, চাপা গর্জন করে ওঠে সমীরের দিকে, “তুই ফুলের মতন নিস্পাপ মেয়েটাকে মেরে ফেলার উপক্রম করবি সেটা ভাবতে পারিনি। তুই পাপী, এই জগতে তোর বেঁচে থেকে লাভ নেই। আজ তুই নন্দিতার জন্য ঝিলামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিস, কাল তুই অন্য কোন মেয়ের জন্য নন্দিতার সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করতে পিছপা হবি না। বেঁচে থাকার চেয়ে তোর মরাই ভালো।”

সমীরের আঁকড়ে থাকা ঝোপের গোড়াতে জুতো দিয়ে মারে বুধাধিত্য। ঝোপ উপড়ে যায়, সাথে সাথে সমীর সেই খাদের ভেতরে গড়িয়ে যায়। বুধাদিত্য কপট চেঁচিয়ে ওঠে, সাহায্যের হাত বাড়িয়েও যেন বাঁচাতে পারে না। ওপরের সবাই চেঁচিয়ে ওঠে, ততক্ষণে সমীরের প্রাণহীন দেহ নিচের পাহাড়ি নদী গ্রাস করে নেয়। ততক্ষণে কালীনাথ আর কয়েকজন স্থানীয় লোক নেমে আসে দড়ি বেয়ে। সবার অলক্ষ্যে কালীনাথ বুধাদিত্যের পেছন থেকে পিস্তল বের করে লুকিয়ে ফেলে।

ঝিলামের রক্তাক্ত অজ্ঞান দেহ বুকের কাছে জড়িয়ে উপরে উঠে আসে। চারপাশে লোকের ভিড় জমে যায়। সবার চোখের সামনে একটি দুর্ঘটনা ঘটে যায়। কেউ কেউ বলে যে একটু অসাবধানতার জন্য এই রকম ঘটনা মাঝে মাঝে ঘটে। পুলিস পিকেট থেকে পুলিস এসে যায়। বুধাদিত্যকে জিজ্ঞেস করে, ঘটনার কথা। বুধাদিত্য জানায় যে দম্পতিকে বুধাদিত্য চেনে। এরা দিল্লী থেকে এখানে ঘুরতে আসে। অসাবধানতার বশে দুজনে খাদে পড়ে যায়, স্বামী প্রান হারিয়েছে এবং স্ত্রী গুরুতর আহত। সাব ইন্সপেক্টার আখিলেশ আশেপাশের লোকেদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। সবাই মোটামুটি এক কথাই জানায় যা তারা চোখে দেখেছে। পুলিস সবার কথামত রিপোর্ট লিখে ফেলে। বুধাদিত্যকে জানায় যে লোক নামিয়ে খাদ থেকে সমীরের দেহ উদ্ধার করতে কিছু সময় লাগবে। বুধাদিত্য জানায় যে আগে আহত ঝিলামের কিছু ব্যাবস্থা করতে। শুধুমাত্র বুধাদিত্য আর নন্দিতা জানে এই দুর্ঘটনা কতটা কপট মস্তিষ্কের অভিসন্ধি। নন্দিতা সেই ভিড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে মুখ চাপা দিয়ে কেঁদে ফেলে। সেই কান্না বুধাদিত্যের মন গলাতে পারে না, একবার ভাবে সব সত্যি বলে নন্দিতাকে ধরিয়ে দেয়, কিন্তু একবার ভাবে যে, নন্দিতা বেঁচে গেছে সেটাই বড়। এই পৃথিবীর বুক থেকে একটা ধূর্ত লোকে কমিয়ে দিতে পেরেছে।

মুন্সিয়ারির ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া হয় ঝিলামকে। ডাক্তার ঝিলামকে পরীক্ষা করে জানায় মাথার আঘাত গুরুতর। এত উপর থেকে পড়ার ফলে হয়তো মাথার ভেতরে আঘাত লাগতে পারে, সিটি স্ক্যান করতে হবে আর সেইজন্য এখুনি ঝিলামকে নিয়ে আলমোড়া যেতে হবে। রক্তক্ষরণ থামানোর জন্য মাথায় স্টিচ করে দেন আর হাত পায়ের কাটায় ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেন।

সাব ইন্সপেক্টর অখিলেশকে সাথে নিয়ে বুধাদিত্য রওনা দেয় আলমোড়ার দিকে। বুধাদিত্যের কোলে অজ্ঞান ঝিলাম। দু’হাতে বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে গাড়ির পেছনের সিটে বসে থাকে। বারে বারে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। গোলাপি গাল ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, চোখের কোনে কালো হয়ে গেছে। ঠোঁট কেটে গেছে, লাল ঠোঁট জোড়া ফ্যাকাসে গোলাপি। নরম ঠোঁটের ওপরে ঠোঁট নামিয়ে ছোটো একটা চুমু খায় বুধাদিত্য। কেন সমীরের কথায় বিশ্বাস করে বুকের পাঁজর কেটে পাঠিয়ে দিয়েছিল ঝিলামকে? কালীনাথ উন্মাদ হয়ে গেছে, মেমসাহেবের প্রান যেন ওর স্টিয়ারিংয়ের ওপরে নির্ভর। মুন্সিয়ারি থেকে আলমোড়া অনেকটা পথ। সামনে পুলিসের জিপ, পেছনে বুধাদিত্যের ইনোভা পাহাড়ের গা বেয়ে ধেয়ে চলে।

সন্ধ্যের সময়ে আলমোড়া পৌঁছে যায়। সাব ইন্সপেক্টার অখিলেশ ওদের নিয়ে সোজা সদর হস্পিটালে চলে যায়। এমারজেন্সিতে ভর্তি করা হয় ঝিলামকে। হস্পিটালে শুধু মাত্র রেসিডেন্ট ডাক্তার ছাড়া আর কোন বড় ডাক্তার নেই সেই সময়ে। রেসিডেন্ট ডাক্তার প্রাথমিক পরীক্ষা করে বলে যে বড় ডাক্তার সকালে এসে দেখবে। বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, গর্জন করে ওঠে, রাতে যদি এই আহত ঝিলামের কিছু হয়ে যায় তাহলে? মন মানতে চায়না কিছুতেই। অখিলেশ ওকে শান্ত করে কোনোরকমে। বুধাদিত্যের খেয়াল হয় যে দেবস্মিতা একবার জানিয়েছিল যে ধানবাদের এম.পি ওর চেনাজানা, সেই সুত্রে যদি কিছু সাহায্য পাওয়া যায়। হটাত বুধাদিত্যের ফোন পেয়ে দেবস্মিতা অবাক। সংক্ষেপে জানায় দুর্ঘটনার ব্যাপার, সেই সাথে জানায় যে ঝিলাম গুরুতর আহত, কিছু সাহায্য চাই। সব শুনে দেবস্মিতা কিছুক্ষণ চুপ থাকে তারপরে জানায় যে কিছু একটা উপায় বের করবে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে আলমোড়ার এক রাজনৈতিক দলের নেতা, বেশ কয়েকজন ডাক্তার নিয়ে পৌঁছে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ঝিলামকে আই.সি.ইউ তে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু হয়।

দেবস্মিতাকে ফোন করে বুধাদিত্য, “দেবী আমি কি বলে তোমাকে ধন্যবাদ জানাবো ভেবে পাচ্ছি না।”

দেবস্মিতা, “এখন ঝিলাম কেমন আছে?”

বুধাদিত্য, “জানি না দেবী।”

দেবস্মিতা, “আমি আলমোড়া আসছি।” তখন রাত প্রায় একটা বাজে।

বুধাদিত্য বলে, “না না, তোমাকে আসতে হবে না, আমি সামলে নেবো। তোমার অনেক কাজ, অত কাজ ফেলে আসতে হবে না।”

দেবস্মিতা, “এমন কোন কাজ নেই যেটা তোমাদের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। তুমি ওখানে একা, নিশ্চয় পুলিস এসেছে, এর পরে ঝিলামের বাবা মা, সমীরের বাবা মা আসবে। সবাইকে সামলাবে কি করে?”

বুধাদিত্য বুক ভরে এক শ্বাস নিয়ে বলে, “দেবী, ঝিলামের জন্য আমি সবকিছু করতে রাজি।”

সি.টি স্কানে কিছু ধরা পড়ে না, ডাক্তার জানায় যে চোট যদিও একটু গভীর তবে ভয়ের কারন নেই। শুধু জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আই.সি.ইউ সামনে চুপ করে বসে থাকে বুধাদিত্য, মাথায় ভর করে আসে হাজার চিন্তা, ঝিলামের জ্ঞান ফিরে এলে কি করবে? বড় আঘাত পেয়েছে ঝিলাম, ধাক্কা মারার আগে সমীর মুখের মুখোশ খুলে ফেলে দিয়েছিল। চোয়াল শক্ত করে বসে থাকে বুধাদিত্য, এমন সময়ে সাব ইন্সপেক্টার অখিলেশ ওর পাশে এসে বসে।

অখিলেশ ওকে জিজ্ঞেস করে, “মিস্টার বুধাদিত্য, কিছু কথা ছিল আপনার সাথে।”

বুধাদিত্য অখিলেশের চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে, “জিজ্ঞেস করুন, সাধ্যমত উত্তর দেব।”

অখিলেশ, “আপনার এত জানাশোনা ছিল আগে বলেন নি তো?”

ম্লান হাসে বুধাদিত্য, “আমার দেবী, ধানবাদের খুব বড় ব্যবসায়ি সেই সুত্রে একটু উপর মহলে জানাশোনা আছে।”

মৃদু হাসে অখিলেশ, “আগে বললে একটু ভালো হতো। তাহলে ওখানেই গাড়ির ব্যাবস্থা করে দিতাম।”

বুধাদিত্য, “না তার দরকার ছিল না, আমার চোখের আড়াল করতে চাই না ওকে।”

অখিলেশ ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আরও কিছু প্রশ্ন আছে আমার।”

বুধাদিত্য, “কি?”

অখিলেশ, “ম্যাডামের জ্ঞান ফিরলে তার একটা স্টেটমেন্ট নিতে হবে। তবে আমার মনে হয়, যে এটা নিছক দুর্ঘটনা নয়।”

বুধাদিত্য অখিলেশের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে, “কি বলতে চাইছেন আপনি? সবার চোখের সামনে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে, আপনি কি দেখে বলছেন যে এটা নিছক দুর্ঘটনা নয়?”

অখিলেশ, “বন্ধুর বউ, কিন্তু আপনি যে ভাবে ম্যাডামকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে ছিলেন তাতে অঙ্ক মেলাতে একটু কষ্ট হয়। আর একটা ব্যাপার আমার চোখ এড়িয়ে যেতে পারেনি, ওই ভিড়ের মধ্যে লক্ষ্য করেছি একজন মহিলাকে কাঁদতে। এটা নিছক দুর্ঘটনা নয়, মিস্টার বুধাদিত্য, কি সত্যি বলছি?”

বুধাদিত্য চোয়াল শক্ত করে গম্ভির গলায় উত্তর দেয়, “না সেই রকম কিছু নেই। আমি ওদের চিনি, সমীর আমার ছোটোবেলার বন্ধু আর ঝিলাম আমার বন্ধু পত্নি ব্যাস। আর আপনি কাকে দেখেছেন সে কি করছিল সেটা লক্ষ্য করার মতন মানসিক অবস্থা আমার ছিল না।”

অখিলেশ ওর কাঁধে হাত রেখে বলে, “আমি পুলিস হয়ে নয়, একজন বন্ধু হিসাবে যদি জিজ্ঞেস করি তাহলে কি সঠিক উত্তর পাবো?”

অখিলেশকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারেনা বুধাদিত্য, “এটা নিছক একটি দুর্ঘটনা, সবাই সেই স্টেটমেন্ট দিয়েছে, ইন্সপেক্টার।”

অখিলেশ আস্বস্ত করে বলে, “আপনি যা বলছেন আর সবাই যা দেখেছে, সেটা পুলিস রিপোর্ট। এক অখিলেশ যদি এক বুধাদিত্যকে প্রশ্ন করে তাহলে কি উত্তর পাবে? কেননা, সমীরের মৃতদেহের ময়না তদন্ত হবে। সমীরের বাবা মা আসবেন তাঁরা নতুন করে এই কেসের ফাইল খুলে তদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন, তখন কিন্তু কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে যেতে পারে।”

বুধাদিত্য বুক ভরে এক শ্বাস নিয়ে অখিলেশের দিকে তাকায়, অখিলেশ চোখ টিপে ইঙ্গিত করে সব ঠিক হয়ে যাবে। বুধাদিত্য কালীনাথকে ডেকে গাড়ির পেছন দিক থেকে সেই হলুদ বড় খাম নিয়ে আসতে বলে। সেই হলুদ খাম অখিলেশের হাতে তুলে দিয়ে বলে, “এই খামে দুটি প্লেনের টিকিট আছে। একটা সমীরের অন্যটি সেই মহিলার যিনি কাঁদছিলেন, তাঁর নাম নন্দিতা।” অখিলেশ খাম খুলে টিকিট বের করে দেখে যে বুধাদিত্য সত্যি কথা বলছে। খামের মধ্যে কিছু ডলার আর সমীরের পাসপোর্ট পায়। সেই সব দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে এসবের মানে। বুধাদিত্য বলে, “সমীর আমার ছোটোবেলার বন্ধু। ঝিলামের সাথে প্রায় তিন বছর আগে সমীরের বিয়ে হয়। সমীর কোলকাতায় থাকতো, গত বছরের মাঝামাঝি দিল্লীতে কাজের সুত্রে আসে। দিল্লীর অফিস আবহাওয়া সমীরকে অনেক স্বপ্ন দেখায়, আর সমীর সেই অলিক স্বপ্নে হারিয়ে যায়। মদে ডুবে নারীসঙ্গে ডুবে নিজের বউকে উপেক্ষা করে। একদিন সমীর মদ খেয়ে একটা পার্টিতে এক নারীর সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয়, সেই দৃশ্য ঝিলাম দেখে ফেলে। তা সত্তেও ঝিলাম সমীরকে ক্ষমা করে দেয়, শুধু এই ভেবে যে মদের ঝোঁকে হয়তো করে ফেলেছে। কয়েকদিন পরে ঝিলাম আর সমীরের প্রচন্ড ঝগড়া হয়। সমীর ঝিলামকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করে, আমি যদি ঠিক সময়ে না পৌঁছাতাম তাহলে হয়তো ঝিলাম সেদিন আত্মহত্যা করতো। ঝিলাম তারপরে চাকরি করতে চায়, আর সেদিন থেকে ঝিলাম আর সমীরের সম্পর্কে চিড় ধরে। সমীর বউ ছেড়ে এই মহিলা, যার নাম নন্দিতা, তার সাথে প্রথমে শারীরিক পরে প্রেমের সম্পর্কে মেতে ওঠে। এই দুজনে মিলে ঝিলামকে নিজেদের মাঝখান থেকে সরিয়ে দিতে তৎপর হয়ে ওঠে। সমীর ঝিলামের সাথে ভালোবাসার নাটক করে এখানে নিয়ে আসে। ঝিলাম আমাকে জানায় যে ওকে নিয়ে সমীর কোথাও বেড়াতে যাবে। আমি ওদের পেছন পেছন এখানে আসি। হ্যাঁ, আমি ঝিলামকে ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি তাই ওর পেছন পেছন এখানে এসেছিলাম। ওদের চোখে চোখে রাখলাম, কি করে সেটা দেখার জন্য। মিলাম গ্লেসিয়ার যাবার পথে, সবার চোখের সামনে ঝিলামকে খাদে এমনভাবে ধাক্কা মারে যাতে মনে হয় যে ঝিলাম পা ফসকে খাদে পড়ে মারা গেছে। একদম নিখুঁত অভিসন্ধি, সাপ মরবে কিন্তু লাঠি ভাঙবে না। পথের কাঁটা, ঝিলাম সরে যাবে সমীর আর নন্দিতার মাঝখান থেকে। আমি উপরের পাহাড় থেকে ওদের লক্ষ্য করি আর সমীরের পা লক্ষ্য করে একটা পাথর ছুঁড়ে মারি। সমীর সেই পাথরের চোটে খাদে পড়ে যায়। আমি ঠিক সময়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি সেই খাদে। ভাগ্যক্রমে ঝিলাম একটা পাথরে আটকে ছিল তাই বেঁচে যায়। সমীর আমার পায়ের কাছে একটা ঝোপ ধরে আটকে ছিল। ওকে দেখে আমার শরীর ঘৃণায় রিরি করে ওঠে। সেই ঝোপে এক লাথি মারলাম আমি, ঝোপ মাটি থেকে উপড়ে গেল আর সমীরকে নিয়ে তলিয়ে গেল খাদের ভেতরে। বাকি আপনার সামনে।”

অখিলেশ ওর হাতে হলুদ খাম ফিরিয়ে দিয়ে বলে, “ম্যাডামের জ্ঞান ফিরলে একবার ম্যাডামের সই নিতে হবে স্টেটমেন্টে।”

বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, “আমি আপনাকে সব সত্যি বললাম আর আপনি শেষ পর্যন্ত...”

অখিলেশ ওর কাঁধে হাত রেখে হেসে বলেন, “আপনি কিছু বলছিলেন নাকি? কই শুনিনি তো। ম্যাডাম অসাবধানতায় পা ফসকে খাদে পড়ে গেছিলেন। সমীর ওকে বাঁচাতে গিয়ে খাদে পড়ে মারা গেছে আর আপনি ম্যাডামকে বাঁচিয়েছেন।” অখিলেশ টুপি হাতে বুধাদিত্যের কাঁধে হাত রেখে বলেন, “ম্যাডামের সই নিতে হবে, ব্যাস। আমি স্টেটমেন্টটা তৈরি করে আসি, আপনি বসুন।” বুধাদিত্য ওর সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ায়। অখিলেশ ওর হাত ধরে বলে, “মশাই, আপনি এই জগতে থেকে একটা পাপীর অবসান করিয়েছেন। আপনাকে তাঁর জন্য ধন্যবাদ জানাই।”

চুপচাপ আই.সি.ইউ সামনে বসে থাকে বুধাদিত্য, ঘড়ির কাঁটা যেন আর সরেনা। ডাক্তার এসে বলে যায় যে চিন্তার বিশেষ কারন নেই। ভাইটালস সব সাধারন আছে, ভয়ের কোন কারন নেই। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে যে জ্ঞান ফিরবে কখন, উত্তরে ডাক্তার জানায় যে রাতের মধ্যে জ্ঞান ফেরার আশা আছে। বুধাদিত্যের চোখে ঘুম আসেনা। অখিলেশ একবার এসে দেখা করে যায়, বলে রাতে ও সদর পুলিস স্টেসানে থাকবে, কিছু অসুবিধে হলে ফোন করতে। বুধাদিত্য বারান্দায় পায়চারি করে, কখন ঝিলাম একটু চোখ মেলে তাকাবে, সেই অধীর অপেক্ষায় প্রহর গোনে।

রাত প্রায় দুটো নাগাদ নার্স এসে জানায় যে ঝিলামের জ্ঞান ফিরেছে। বুধাদিত্য আস্তে করে আই.সি.ইউ তে ঢুকে পড়ে। ঝিলামের মাথায় ব্যান্ডেজ, মুখের কাটার দাগ, ঠোঁটে একটু ফেটে গেছে, হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ। একদিনে সেই উচ্ছল তরঙ্গিণী তার রুপ হারিয়ে এক স্রোতহীন চোরাবালির নদীতে পরিনত হয়ে গেছে। একটা টুল টেনে ওর পাশে বসে। ঝাপসা চোখের সামনে বুধাদিত্যকে দেখে ঠোঁট কেঁপে ওঠে ঝিলামের। বুধাদিত্য ওর কোমল হাত দুটি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে গালে চেপে ধরে। ঝিলাম জল ভরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। বুধাদিত্যের হাতখানি টেনে বুকের ওপরে চেপে ধরে ঝিলাম কেঁদে ফেলে। ঝিলাম পাশ ফিরে ওর হাত বুকের ওপরে চেপে চোখ বন্ধ করে দেয়। বুধাদিত্য হাতের তালুর উপরে ঝিলামের হৃদস্পন্দন অনুভব করে, ধুকধুক-ধুকধুক। ঝিলাম ওর হাত আরও আঁকড়ে ধরে থাকে, হাতের উষ্ণতা সারা বুকের ওপরে সারা শরীরে মাখিয়ে নিতে সচেষ্ট হয়।

ঝিলাম ঘুমিয়ে পড়ার পরে বুধাদিত্য ধিরে ধিরে হাত ছাড়িয়ে আই.সি.ইউ থেকে বেরিয়ে আসে। ডাক্তার জানায় যে ঝিলামের আর কোন বিপদ নেই। ঝিলাম একটু সুস্থ হলেই ওরা দিল্লী ফিরে যেতে পারে। শরীর বড় ক্লান্ত, হস্পিটাল থেকে বেরিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায় বুধাদিত্য। কালীনাথ গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। বুধাদিত্যের পায়ের আওয়াজ পেয়ে জেগে ওঠে। বুধাদিত্য জানায় যে ঝিলাম এখন ভালো আছে। কালীনাথ ভগবানের উদ্দেশ্যে একটা প্রনাম করে বলে, রাখে হরি মারে কে। গাড়ির পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বুধাদিত্য একটা সিগারেট জ্বালায়। মাথার ওপরে গাড় নীল রাতের আকাশ, সেই গাড় নীল আকাশের বুকে কোটি কোটি তারা চকমক করছে। এক নতুন দিগন্তের আলো দেখায় সেই তারামণ্ডল।

সকালবেলা বুধাদিত্য কোলকাতায় প্রমীলাদেবীকে ফোন করে সব সংক্ষেপে ঘটনা জানায়। প্রমীলাদেবী জানিয়ে দেন যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি দিল্লী পৌঁছে যাবেন। দেবস্মিতা সকাল বেলা বুধাদিত্যকে ফোন করে ঝিলামের খবর জানতে চায়। অখিলেশ সকালবেলা হস্পিটাল চলে আসে। ঝিলাম ঘুম থেকে ওঠার আগেই বুধাদিত্য ওর পাশে চলে যায়। অখিলেশ এসে ঝিলামকে কিছুই জিজ্ঞেস করে না, আগে থেকে লেখা একটা স্টেটমেন্টে সই দিতে বলে।

অখিলেশ বুধাদিত্যকে হেসে বলে, “এবারে এই হাত আর ছাড়বেন না যেন।” বুধাদিত্য হেসে ফেলে ওর কথা শুনে। অখিলেশ বলে, “রেডিওতে মুন্সিয়ারি পোস্টের সাথে কথা হয়ে গেছে। ওখান থেকে আপনাদের জিনিস নিয়ে বেরিয়ে গেছে, দুপুরের পরেই আপনার কাছে পৌঁছে যাবে বলে মনে হয়। আজ চেষ্টা করে দেখা হবে যদি বডি পাওয়া যায়।” কানের কাছে মুখ এনে খুব নিচু গলায় বলে, “সমীরের বডি পাওয়া যাবে না, কথা দিচ্ছি আপনাকে। ওর বাবা মা এলে আমি সামলে নেবো। আপনি বিচক্ষণ ব্যক্তি তারপরের ব্যাপার কিন্তু আপনাকে সামলাতে হবে।”

সকালবেলা আই.সি.ইউ থেকে ঝিলামকে রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সারাক্ষণ বুধাদিত্য ওর পাশে থাকে, এক মিনিটের জন্য চোখের আড়াল করে না ঝিলামকে। সমীরের বিশ্বাসঘাতকতার আঘাত ঝিলামের বুকের ভেতরে এত জোর বেজে ওঠে যে কথা বলার মতন শক্তি হারিয়ে ফেলে। যেই চোখ মেলে সেই যেন মনে হয় যে ওকে সমীর ধাক্কা মারছে। কেঁপে কেঁপে ওঠে বারংবার আর বুধাদিত্যের হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।

ঝিলামে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “এত বড় বিশ্বাস ঘাতকতা করল আমার সাথে?”

বুধাদিত্য ওর মাথার ওপরে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, “একটু ঘুমাও।”

ঝিলাম, “আমার যে আর ঘুম আসছে না। চোখ বন্ধ করলেই যে আমাকে ধাক্কা মারে?”

বুধাদিত্য, “ঝিল্লি, আমি এখানেই আছি।”

ঝিলাম কাঁপা গলায় বলে, “ও যখন আমাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল, তখন তুমি কোথায় ছিলে, বুধো?”

বুধাদিত্য, “আমি তোমার পাশেই ছিলাম, ঝিল্লিরানী, এখন ঘুমাও।”

ঝিলাম, “আমি ঘুমিয়ে পড়লে তুমি চলে যাবে না তো? এবারে হাত ছাড়লে আমার মরা মুখ দেখবে।”

বুধাদিত্য হেসে ওর কপালের ওপরে ঠোঁট চেপে বলে, “ছেড়ে যাবো বলে এই হাত ধরিনি আমি।”

ঝিলাম ওর হাত বুকের ওপরে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। ঘুমন্ত মুখের ওপরে শান্তির নির্মল ছায়া, বুধাদিত্য নিস্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে সেই সুন্দর মুখখানির দিকে। ওর শূন্য হৃদয় ভরিয়ে তুলতে এক উচ্ছল তরঙ্গিণী ফিরে এসেছে। পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয় সেই নিস্তেজ অপ্সরাকে। একটু ঝুঁকে ওই গোলাপি গালে চুমু খায় বুধাদিত্য।
 
চতুর্দশ পর্বঃ মুক্তির স্বাদ।

ইতিমধ্যে সমীরের বাবা মাকে খবর পাঠানো হয় পুলিসের তরফ থেকে। বুধাদিত্য ফোন করে জানায় সেই ঘটনা, সাথে সাথে জানায় ঝিলামের শারীরিক অসুস্থতা। দুই দিনের মধ্যে সমীরের বাবা, মা আলমোড়া পৌঁছে যান। সমীরের বাবা মা সোজা হসপিটালে এসে বুধাদিত্যের সাথে দেখা করে। বুধাদিত্যকে জড়িয়ে ধরে পুত্রশোকে সমীরের মা কেঁদে ফেলেন। বুধাদিত্য আসল ঘটনা চেপে শুধুমাত্র দুর্ঘটনার কথা জানায় সমীরের বাবাকে। সমীরের বাবার সাথে দেখা করার জন্য মুন্সিয়ারি থেকে অখিলেশ পৌঁছে যায় আলমোড়া। পুলিসের মুখে সবিস্তারে দুর্ঘটনার কথা শুনে খেই হারিয়ে ফেলেন সমীরের বাবা। অখিলেশ জানায় যে, পাহাড়ি নদী সমীরের মৃতদেহ গ্রাস করে নিয়েছে। দুই দিন লোক নামিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজে পাওয়া যায়নি ওর মৃতদেহ। সমীরের মা মর্মাহত হয়ে যান, পুত্রের শেষ দেখা দেখতে পাবেন না বলে আফসোস করেন। সমীরের বাবা, ঝিলামকে কোলকাতা নিয়ে যাবার কথা বলেন, সাথে এও জানায় যে ঝিলামের বাবা মাকে খবর দেওয়া হয়েছে। পরের দিন ঝিলামের বাবা আর দুই দাদা আলমোড়া পৌঁছে যান। সবাইকে সামাল দিতে দিতে বুধাদিত্য হিমসিম খেয়ে যায়। একদিকে অসুস্থ ঝিলাম বিছানায় পড়ে, অন্যদিকে ঝিলামের বাড়ির লোক আর সমীরের বাবা মা। হস্পিটালের বিছানায় শুয়ে চারপাশে নিজের লোকের ভেতরে ঝিলামের চোখ শুধু বুধাদিত্যকে খুঁজে বেড়ায়। সবার সামনে বুধাদিত্য ওর পাশে যেতে একটু দ্বিধা বোধ করে।

দিন চারেক পরে ঝিলাম সুস্থ হয়ে ওঠে। ঝিলামের বাবা ঝিলামকে দুর্গাপুরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। বাবার কথা শুনে ঝিলাম ভাষা হারিয়ে ফেলে, পুরানো জীবনে ফিরে যেতে নারাজ ঝিলাম। চোখ মেলে তাকালেই আশেপাশের লোকজন ওকে সমীরের কথা মনে করিয়ে দেয় আর সেই সাথে সমীরের বিশ্বাসঘাতকতার কথা মনে পড়ে যায়। মুখ চাপা দিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে বারেবারে। ঝিলাম কিছুতেই সেই মনোভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনা, তার ওপরে সবাই মনে করিয়ে দেয় যে ঝিলাম আর সেই ঝিলাম নেই। জল ভরা কাতর চোখে বুধাদিত্যর দিকে তাকিয়ে থাকে।

ঋজু বুধাদিত্য চোখ বন্ধ করে বুক ভরে এক লম্বা শ্বাস নিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে গম্ভির স্বরে বলে, “ঝিলাম কোথাও যাবে না। ঝিলাম আমার সাথে দিল্লী যাবে।”

সবার চোখে হাজার প্রশ্ন, কেন ঝিলাম বুধাদিত্যের সাথে থাকবে? বুধাদিত্য কিছু বলার আগে, ঝিলাম ধরা গলায় বলে, “সমীর আমার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে। আমাকে কথায় ভুলিয়ে প্রেমের ভান করে এখানে নিয়ে এসেছে। ওর অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে। আমাকে খাদের মধ্যে ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। ধাক্কা মারার আগে আমাকে বলে, যে আমি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম তাই আমাকে মারতে নিয়ে এসেছে এখানে।” সবাই হাঁ করে ঝিলামের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঝিলামের কথা কেউ বিশ্বাস করতে পারেনা। ঝিলাম বলে, “আমি ওর সাথে ঘুরতে যাবো, সেই খুশিতে ছিলাম। এত মিষ্টি করে আমাকে বললো যে আমাকে নিয়ে দুরে বেড়াতে যাচ্ছে তাই আমি যেন কাউকে কিছু না জানাই, আর সেই কথায় আমি ভুলে গেলাম। ও নিজের মোবাইল আর আমার মোবাইল নিয়ে বন্ধ করে দিল।” ঝিলাম বুধাদিত্যের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে, “ভাগ্য বশত ওকে আমি একটা এসো.এম.এসো পাঠিয়েছিলাম তাই আজ বেঁচে আছি।”

সমীরের মা চাপা আঁতকে ওঠেন, ধিক্কার দিয়ে ঝিলামকে বলেন, “আমার ছেলের নামে তুমি মিথ্যে কলঙ্ক রটাচ্ছো?”
ঝিলাম বলে, “আমি মিথ্যে বলছি না, শুধু মাত্র আমার কাছে কোন প্রমান নেই, আমি নিরুপায়।”

নিরুপায় বুধাদিত্য হলদে খাম থেকে প্লেনের টিকিট আর পাসপোর্ট সমীরের বাবার হাতে তুলে দেয়। মোবাইল থেকে সেই ফটো আর রেকর্ড করা কথোপকথন শুনিয়ে দেয়। সেই সব দেখে, শুনে আর ঝিলামের কথা শুনে ভেঙে পড়েন সমীরের বাবা মা। চোখের সামনে সমীরের ব্যাভিচারের অকাঠ্য প্রমান দেখে ভাষা হারিয়ে ফেলেন। অনেকক্ষণ পরে সমীরের মা, ঝিলামের মাথায় হাত রেখে বলেন, “আমার পেটের সন্তান গেছে বলে দুঃখ আছে, সেটা থাকবে। কিন্তু তোমার মতন লক্ষ্মীকে মেরে ফেলার কথা চিন্তা করতে পারে যে, সেই ছেলের আমার দরকার নেই। আমি তোমাকে আশীর্বাদ করি, ভবিষ্যতে তুমি সুখী হবে।” বুধাদিত্যের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুই ওর ছোটবেলার বন্ধু, একসাথে খেলা করেছিস, একসাথে বড় হয়েছিস। একবারের জন্য ওর মতিগতি ফেরাতে পারলি না?” এই বলে বুধাদিত্যের সামনে কেঁদে ফেলে সমীরের মা। বুধাদিত্য সমীরের মাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। সমীরের মা চোখের জল মুছে ওকে বলে, “তুই ভালো থাকিস। আমি চললাম রে। পারলে এই লক্ষ্মীকে দেখিস।” সমীরের বাবা মায়ের সাথে সেই শেষ দেখা। ঝিলামকে শেষ আশীর্বাদ করে, সমীরের বাবা মা চলে যান আলমোড়া ছেড়ে।

ইতিমধ্যে প্রমীলা দেবীর ফোন আসে, “তুই কোথায় রে? আমি দিল্লী পৌঁছে গেছি। তোর বাড়িতে তালা মারা।”

বুধাদিত্য ভাবতে পারেনি যে মামিমা এতো তাড়াতাড়ি চলে আসবেন, “আমি আলমোড়া, ঝিলামকে নিয়ে আজ রাতে দিল্লীর দিকে রওনা দেবো। কাল রাতের মধ্যে দিল্লী পৌঁছে যাবো। তুমি আজ রাতে হোটেলে থেকে যাও।”

বুধাদিত্য ঝিলামের বাড়ির লোককে বুঝিয়ে বলে সব কথা। বিকেল বেলায় ঝিলামকে নিয়ে দিল্লীর দিকে রওনা দেয়। ঝিলামের দাদাদের কাঠগোদামে নামিয়ে দিল, তাঁরা বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরে। সারা রাস্তা ঝিলাম চুপ করে পেছনের সিটে বাবার পাশে বসে থাকে। পরের দিন বিকেল বেলায় দিল্লী পৌঁছে যায়। প্রমীলাদেবী ছাড়া বুধাদিত্যের মনের কথা বোঝার এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। বুধাদিত্য প্রমীলাদেবীকে ঝিলামের ব্যাপার সব কথা খুলে বলে, জানায় যে ঝিলামকে ভালোবাসে।

ঝিলাম নিজেকে গুটিয়ে নেয় শামুকের খোলের মধ্যে। সারাদিন নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখে, কারুর সাথে কথা পর্যন্ত বলতে চায় না। আশেপাশে লোক দেখলে চমকে ওঠে, মানুষের ওপরে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে ঝিলাম। চোখে আতঙ্কের ছায়া, চোখ বন্ধ করলেই চমকে ওঠে, বারেবারে আঁতকে ওঠে, “শেষ পর্যন্ত তুমি... নাআআআআ”। প্রমীলাদেবী ঝিলামকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে সাড়া রাত জেগে থাকে। বাপ্পাকে সঙ্গে নিয়ে সুবিরবাবুর সাথে দেবস্মিতা দিল্লী চলে আসেন। ঝিলামের আঘাতের ফলে, বাড়ি ভর্তি লোকের চেহারায় চিন্তার ছাপ।

ঝিলামের বাবা কি করবেন কিছু বুঝে উঠতে পারেন না। প্রথমে ইতস্তত করেন অমিত বাবু, সমাজের দোহাই দিয়ে বলেন, যে মেয়েকে এখানে রাখা ঠিক হবে না। প্রমীলা দেবী অমিত বাবুকে সব কথা বুঝিয়ে বলাতে তিনি মেনে নেন বুধাদিত্য আর ঝিলামের সম্পর্ক। প্রমীলা দেবী জানিয়ে দেন যে ঝিলামের মানসিক অবস্থার উন্নতি হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

প্রমীলাদেবী সব কথা শুনে অমিত বাবুকে বলেন, “জীবন কখনো এক ধাক্কায় শেষ হয়ে যায় না। এই ভদ্রমহিলা” দেবস্মিতাকে দেখিয়ে বলেন “বুধাদিত্যের বাবাকে দ্বিতীয় বার বাঁচার সুযোগ দিয়েছে। তার অপার ভালোবাসা দিয়ে ফিরিয়ে এনেছে সেই লোককে যে একসময় প্রেম ভালোবাসা তুচ্ছ বলে মনে করতো। সমাজের সামনে আজ আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়ে, শুধু মাত্র এই দেবীর জন্য। আমি হলফ করে বলতে পারি যে আমার বুধি আপনার মেয়েকে ঠিক সেই রকম ভাবে রাখবে। বর্তমানে ঝিলাম মানসিক দিক থেকে খুব ভেঙে পড়েছে, তাই বুধাদিত্যের কাছে থাকা শ্রেয়। বুধাদিত্যের ভালোবাসা আর প্রেম ঝিলামকে সেই অন্ধকার খাদ থেকে টেনে তুলবে।”

বুধাদিত্য প্রমীলাদেবীকে জড়িয়ে ধরে বলে, “পরের বার কথা দিচ্ছি মামি, তোমার কোলে জন্ম নেবো।”

বাপ্পা বুধাদিত্যকে জিজ্ঞেস করে, “এই আন্টি আমার সাথে গল্প করবে না কেন? আন্টির মন খারাপ তাই? এই আন্টি তোমার কে হয়? আন্টি কবে ভালো হবে?”

শিশুর প্রশ্নবাণে জর্জরিত বুধাদিত্য বাপ্পাকে কোলে করে বলে, “আন্টির শরীর খারাপ তাই। আন্টি ভাল হয়ে গেলে তোমার সাথে গল্প করবে, তোমার সাথে খেলবে।”

বাপ্পা বুধাদিত্যের কানে কানে বলে, “তুমি আন্টিকে জড়িয়ে ধরে পেটে কাতুকুতু দাও দেখবে আন্টি ঠিক হয়ে যাবে, আন্টি আবার হাসবে আর তোমার সাথে কথা বলবে।”

বুধাদিত্য ভুরু কুঁচকে বাপ্পাকে জিজ্ঞেস করে, “কে বলেছে তোমাকে?”

বাপ্পা, “বাঃ রে, আমি জানি। মাম্মা যখন খুব রেগে যায় তখন ড্যাডার সাথে কথা বলে না চুপ করে থাকে। আর ড্যাডা মাম্মাকে জড়িয়ে ধরে পেটের ওপরে কাতুকুতু দেয় আর মাম্মা হেসে ফেলে ব্যাস।”

বাপ্পার কানে কানে কথাটা বেশ জোরেই ছিল, আশেপাশের সবাই শুনতে পায়। বুধাদিত্য দেবস্মিতার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। দেবস্মিতা লজ্জা লুকানোর জন্য সুবির বাবুর দিকে তাকায়। চোখের ইশারায় জানায়, দেখেছো তোমার ছেলের কান্ড।

বুধাদিত্য কথা দেয় অমিত বাবুকে তাঁর মেয়েকে কোন আঘাত ছুঁতে পারবে না। মেয়ের মুখ দেখে পিতার হৃদয় শেষ পর্যন্ত বুধাদিত্যের কথা মেনে নেন। বাড়ির অনেকেই নিজের নিজের কর্মস্থলে ফিরে যান, কিন্তু অমিত বাবু আর প্রমীলা দেবী, ঝিলামের মুখ দেখে থেকে যান। ঝিলাম, বাবার উপস্থিতি দেখে আরো কুঁকড়ে যায়।

একদিন বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পরে ঝিলাম বুধাদিত্যকে ঘরের মধ্যে ডেকে নিয়ে যায়। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে?

ঝিলাম খুব নিচু গলায় জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি সত্যি আমাকে দুর্গাপুরে পাঠিয়ে দেবে?”

বুধাদিত্য ওর মুখ আঁজলা করে নিজের দিকে তুলে নিয়ে বলে, “কে বলেছে যে আমি তোমাকে দুর্গাপুরে পাঠিয়ে দেবো? তুমি সর্বদা আমার বুকের মধ্যে থাকবে। কেউ তোমাকে এই বুক থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না, ঝিল্লি।”

ওর উষ্ণ হাতের পরশে ঝিলাম গলে যায় বলে, “সবাইকে বাড়ি যেতে বলে দাও। শুধু তুমি পাশে থাকলেই আমি ঠিক হয়ে যাবো।”

বুধাদিত্য, “তোমার শরীর খারাপ তাই সবাই আছে। তা ছাড়া তোমার বাবা তোমার জন্য একটু চিন্তিত তাই আছেন, তুমি ঠিক হয়ে গেলেই তাঁরা চলে যাবেন।”

ঝিলাম ওর বুকের ওপরে মাথা চেপে ধরে বলে, “সেই রাতে তুমি না এলে আমি ওই ফার্ম হাউসে আত্মহত্যা করতাম। আমি যেদিন সত্যি আত্মহত্যা করতে গেছিলাম ওর সামনে, তখন তুমি দরজা ভেঙে ঢুকলে। আমি চাকরি করতে চেয়েছিলাম, বাড়ির সবাই আমাকে অনেক কথা শুনিয়ে আমাকে ক্ষান্ত করে দিল। শেষ পর্যন্ত তুমি এসে আমার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলে, তোমার শক্তি বুকে করে আমি স্বাধীনতার স্বাদ খুঁজে পাই। আমার এই জীবন তোমার দেওয়া। আমাকে যদি ভালো হতে হয়, তাহলে তোমার কাছেই হবো, আমাকে যদি মরতে হয় তাহলে তোমার কোলে মরবো। আমার আর কারুর দরকার নেই, বুধো।”

বুধাদিত্য ঝিলামকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বলে, “ঠিক আছে, তাই যদি চাও আমি সবাইকে বলে দিচ্ছি চলে যেতে।”

“হ্যাঁ রে, তোর কি সারা বিকেল এখানে দাঁড়িয়ে থাকবি” প্রমীলা দেবীর গলার আওয়াজে দুজনে পরস্পকে ছেড়ে দাঁড়ায়। ঝিলাম একটু লজ্জা পেয়ে প্রমীলা দেবীর পেছনে মুখ লুকিয়ে নেয়। বুধাদিত্য মামিমার দিকে এক বার তাকিয়ে মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। প্রমীলা দেবী বুধাদিত্যকে ডেকে হেসে বলেন, “আমি অজান্তেই তোদের কথোপকথন একটুখানি শুনে ফেলেছি। তোদের ভালতেই আমাদের ভালো, তোরা যাতে সুখে শান্তিতে থাকতে পারিস সেটাই হবে। আমি অমিতবাবুকে বলে দেবো খানে। তুই আমাদের বাড়ির ফেরার ব্যাবস্থা করে দে কাল।” পরেরদিন ঝিলাম আর বুধাদিত্যকে বিদায় জানিয়ে প্রমীলা দেবী আর অমিত বাবু বাসস্থলে ফিরে যায়। বুধাদিত্য ওদের প্লেনের টিকিট কেটে দেয়।

দিন দুই পরে, বুধাদিত্য ঝিলামকে জিজ্ঞেস করে যে ওদের বাড়ির জিনিসপত্রের কি করা যায়। ঝিলাম জানিয়ে দেয় যে ওই বাড়িতে ওর কোন কিছু নেই। যেদিন বুধাদিত্যের বাড়ি এসেছিল, নিজের সব জিনিস সাথে নিয়ে এসেছিল। সমীরের সাথে যাবার দিনে শুধুমাত্র কয়েক জোড়া জামা কাপড় নিয়ে গেছিল। ভেবেছিল পরে এসে সব নিয়ে যাবে, কিন্তু ভালোই হয়েছে যে দ্বিতীয় বার সেই কষ্ট করতে হয়নি। ঝিলাম জানিয়ে দেয় ওই বাড়ির সব কিছু বিক্রি করে তার টাকা কোন নারী শক্তির এন.জি.ও কে দান করে দিতে। এই দেশে অনেক মেয়েরা তাদের স্বামীর হাতে নিপীড়িত, হয়তো কিছুটা সাহায্য করতে পারবে ঝিলাম। বুধাদিত্য ওর কথা মত সমীরের বাড়ি সব জিনিস পত্র বিক্রি করে সেই টাকা একটা এন.জি.ওতে গিয়ে সব দান করে দেয়।

কাজের লোককে বলা হয় দিনে দুই বার আসার জন্য। ভোরবেলা এসে কাজের লোক রান্না বান্না করে রেখে যায়, দুপুরের পরে এসে বাকি ঘরের কাজ করে। সকালে উঠে ঝিলামের মাথার ব্যান্ডেজ করা, স্নান করিয়ে দেওয়া সব বুধাদিত্য নিজের হাতে করে। দিনে দিনে ঝিলামের মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। ঝিলামের গলায় সেই উৎফুল্লতা ফিরে আসেনি, সেই নিয়ে বুধাদিত্য বেশ চিন্তায় থাকে। ঝিলাম শোয়ার ঘরে ঘুমিয়ে পড়ার পরেও বুধাদিত্য চুপ করে স্টাডিতে বসে কান পেতে থাকে, যদি ঝিলাম মাঝ রাতে কেঁদে ওঠে তাহলে। অনেক রাত কেটে যায়, বুধাদিত্য এক নয় সোফায় ঘুমিয়ে পড়ে না হয় স্টাডির টেবিলে ঘুমিয়ে পড়ে। সকাল বেলায় লক্ষ্য করে যে গায়ের ওপরে চাদর টানা। বুঝে যায় যে ঝিলাম রাতের বেলা উঠে ওর গায়ের ওপরে চাদর দিয়ে চলে গেছে। ঝিলামের সেই মিষ্টি হাসির কলতান শোনার জন্য বুধাদিত্যের হৃদয় ছটফট করে, ভেবে পায় না কি করে ওই আঁধার চোখে আবার আলোর রেখা মাখাবে। মাঝে মাঝে বেড়াতে যেতে বললে, ঝিলাম মানা করে দেয়। বাড়ির বাইরে পা রাখতে নারাজ ঝিলাম, এমন কি সামনের বাজারে পর্যন্ত যেতে চায় না। সাধারনত ঝিলাম বাড়িতে যে রকম জামা কাপড় পরে থাকতো, সেই সব বদলে গেছে। চুড়িদার কামিজ বা শাড়ি ছাড়া আর কিছু পরে না আজকাল। উচ্ছল, উদ্দাম হাসি খুশি ঝিলামের জায়গায় বুধাদিত্যের সামনে অতীব শান্ত এবং সঙ্কুচিত এক নারী।

বুধাদিত্যের ভয় যে স্কুল শুরু হয়ে গেলে কি করে ঝিলাম স্কুলের সাথে মানিয়ে নেবে। ভিশাল স্যার আর শমিতা ম্যাডামকে সব জানিয়ে দেওয়া হয়। স্কুলের প্রিন্সিপাল এসে বাড়িতে দেখা করে যান। সব কিছু শুনে জানিয়ে দেন যে যত দিন ঝিলাম সম্পূর্ণ রুপে সুস্থ হয়ে না ওঠে ততদিন স্কুল ওকে ছুটি দিয়ে দেবে। স্কুল শুরু হতে তখন কিছু দিন বাকি, কিন্তু চিন্তায় বুধাদিত্যের রাতের ঘুম হয় না। বাড়ি থেকে কেউ ফোন করলে বিশেষ কারুর সাথে ঠিক করে কথা বলে না। ঝিলামের বাবা মা খুব চিন্তিত সেই নিয়ে, কিন্তু ঝিলামকে দুর্গাপুর নিয়ে আসবে তার উপায় নেই। একবার বুধাদিত্য চেষ্টা করেছিল ঝিলামের সাথে সেই বিষয়ে কথা বলতে, ঝিলাম চুপ করে ছিল কোন উত্তর না দিয়ে না খেয়ে দরজা বন্ধ করে বসেছিল দুইদিন। সেদিনের পর থেকে আর দুর্গাপুর যাবার কোন কথা বলেনি। সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিল বুধাদিত্য, যাতে কেউ ঝিলামকে বাড়ি ছাড়ার কথা না বলে।

সেদিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে বুধাদিত্যের একটু দেরি হয়ে যায়, রাত আটটা বেজে যায়। বুধাদিত্য ফোন করে ঝিলামকে জানিয়ে দেয় যে বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হবে। ঝিলাম কোন কথা না বলে চুপচাপ শুনে ফোন রেখে দেয়। দরজায় টোকা মারতে, চুপচাপ দরজা খুলে দেয় ঝিলাম। মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে যে ঝিলামের মুখ থমথমে, চোখের পাতা ভিজে, নাকের ডগা লাল। ঝিলামকে জিজ্ঞেস করে যে কেন কাঁদছিল, ঝিলাম কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ রান্না ঘরে ঢুকে ওর জন্য কফি বানাতে চলে যায়। সেই মুখের করুন চাহনি দেখে বুধাদিত্যের বুক কেঁপে ওঠে, ভয় হয় ঝিলাম কিছু না করে বসে। বুধাদিত্য জানায় যে অফিসে কাজের চাপের জন্য বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেছে। চুপ করে ওর কথা শুনে নেয়, কোন উত্তর দেয় না। ঝিলামের শীতল নিস্তব্ধতা বুধাদিত্যের বুকে বড় বেজে ওঠে। অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশি শান্ত ঝিলাম, খাওয়ার সময়ে কোন কথা না বলে চুপচাপ খেয়ে নেয়। বুধাদিত্য বসার ঘরে বসে চিন্তায় ডুবে যায়। একা একা রেখে যাওয়া ঠিক নয়, কিন্তু ঝিলামের কথা মত সবাইকে পাঠিয়ে দিয়েছিল, এখন যদি ঝিলাম আবার কিছু করে বসে। ঝিলাম নিজের ঘরে ঢুকে আলমারির খুলে কিছু খুঁজতে শুরু করে। আলমারির সব জিনিস বের করে তোলপাড় করে ফেলে। বুধাদিত্য অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করে যে ঝিলাম আলমারির মধ্যে কিছু খুঁজছে। কিন্তু যখন দেখে যে আলমারি খালি করার পরে আবার আলমারি গুছাতে বসেছে, তখন বুধাদিত্য আর চুপ করে বসে থাকতে পারে না।

বুধাদিত্য ওর পেছনে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রাখে, “ঠিক করে বলো, কি খুঁজছো।”

ওর দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলে, “তোমার ঝিল্লিকে খুঁজছি, কিছুতেই পাচ্ছি না।”

বুধাদিত্য ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে, ঝিলাম ওর বুকের ওপরে মুখ লুকিয়ে কেঁদে ফেলে। ঝিলামের মাথার ওপরে ঠোঁট চেপে বলে, “বোকা মেয়ে, নিজেকে খুঁজতে শেষ পর্যন্ত আলমারি খুলতে হয়।” ওর মুখ আঁজলা করে নিজের দিকে তুলে ধরে। ঝিলাম শক্ত করে চোখ বন্ধ করে থাকে। বুধাদিত্য দুই বুড়ো আঙুল দিয়ে নরম গালের ওপর দিয়ে জলের ফোঁটা মুছে দিয়ে বলে, “আমার চোখের দিকে তাকাও।” ভিজে চোখের পাতা ধিরে ধিরে খুলে যায়, পদ্ম ফুলের পাপড়ি মেলে ধরে ঝিলাম। বুধাদিত্য ওর দিকে ঝুঁকে বলে, “এই চোখের ভেতরে দেখো, নিজেকে খুঁজে পাবে, ঝিল্লিরানী।” ঝিলামের লাল নাকের ডগায় আলতো করে নাক ঘষে দেয় বুধাদিত্য। ঝিলামের উষ্ণ শ্বাস ভাসিয়ে দেয় বুধাদিত্যের ঠোঁট, চিবুক। ঝিলাম ওর বুকে দশ আঙ্গুলে খামচে ধরে। বুধাদিত্য ধিরে ধিরে ঠোঁট নামিয়ে আনে ঝিলামের লাল নরম ঠোঁটের ওপরে। আলতো করে ছুঁইয়ে দেয় ওই নরম গোলাপ পাপড়ির ওপরে। ঝিলাম ঠোঁট চেপে ধরে বুধাদিত্যের ঠোঁটে, আবেগের বশে দুই চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। চোখ বন্ধ করে প্রেমের চুম্বন ঘনীভূত করে নেয়। নিজেকে চেপে ধরে বুধাদিত্যের প্রশস্ত বুকের ওপরে চেপে ধরে নিজেকে। বুধাদিত্য ওর নিচের ঠোঁট নিজের ঠোঁটের মাঝে নিয়ে চুষতে শুরু করে। শরীর ছেড়ে যায় ঝিলামের, সারা শরীর সেই মধুর চুম্বনের ফলে অবশ হয়ে আসে। বুধাদিত্য ঝিলামের কোমল দেহ দু’হাতে জড়িয়ে নিজের শরীরের ওপরে পিষে ধরে। ঝিলাম বুক ছেড়ে দুই হাতে বুধাদিত্যের গলা জড়িয়ে ধরে। ভালোবাসার আলিঙ্গন বদ্ধ দুই চাতক চাতকির চারপাশে সময় থমকে দাঁড়ায়।

কিছু পরে ঝিলাম ঠোঁট ছেড়ে মিষ্টি হেসে বলে, “খুঁজে পেয়েছি... বুধোর ঝিল্লিকে।”

বুধাদিত্য হেসে ফেলে, “আইস্ক্রিম খেতে যাবে?” ঝিলাম মাথা নাড়ায়, হ্যাঁ। বুধাদিত্য বলে, “চলো কাপড় পরে নাও তাড়াতাড়ি।”

ঝিলাম বেশ সুন্দর একটা চুড়িদার কামিজ পরেছিল তাই ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “কেন, চুড়িদারে অসুবিধে কি?”

বুধাদিত্য ওর দেহে আলতো চেপে বালে, “এটা বুধোর ঝিল্লি নয়, এটা বুধাদিত্যের ঝিলাম। তুমি বলেছ যে বুধোর ঝিল্লি।”

ঝিলাম, “মানে?”

বুধাদিত্য ওকে ছেড়ে আলমারি থেকে একটা সাদা জিন্সের কাপ্রি আর একটা গোলাপি টপ হাতে ধরিয়ে বলে, “পরো। আর হ্যাঁ নুপুরটা পরে নিও, বড় মিষ্টি লাগে তোমার পায়ের রিনিঝিনি সুর, ঝিল্লিরানী।”

ঝিলাম লাজুক হেসে ওর হাত থেকে জিন্স আর টপ নিয়ে বলে, “ঘর থেকে বের হও তবে তো ড্রেস চেঞ্জ করবো।”

বুধাদিত্য ওকে জড়িয়ে ধরে বলে, “দেখলে ক্ষতি আছে।”

আদর করে বুকের ওপরে আলতো এক চাঁটি মেরে বলে, “শয়তানি করার সময় হয়নি, বুধো।” তারপরে ঠেলে ঘর থেকে বের করে দেয়। বুধাদিত্য গালের ওপরে একটা চুমু খেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

ঝিল্লির কণ্ঠস্বরে সেই উচ্ছল ঝঙ্কার ফিরে এসেছে। অবশেষে বেড়াতে যাবে, মন খুশিতে নেচে ওঠে বুধাদিত্যের। তাড়াতাড়ি একটা টিশার্ট গলিয়ে নেয়। গ্রীষ্ম কাল রাত দশটা বাজে, বাইরের আবহাওয়া একটু গুমোট। গাছের পাতা পর্যন্ত নড়ছেনা। বুধাদিত্যের যেন আর তর সইছেনা, কখন ঝিলামকে স্বমহিমায় দেখতে পাবে।

বুধাদিত্য রুমের দরজায় টোকা দিয়ে বলে, “তাড়াতাড়ি...”

ঝিলাম ওপর পাশ থেকে ধমকে ওঠে, “এতদিন পরে বয়ফ্রেন্ডের সাথে আইস্ক্রিম খেতে যাবো, একটু সাজতে দেবে না নাকি?”

বুধাদিত্য, “অনেক সাজ হয়েছে, প্লিস তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসো। আমার আর তর সইছে না। প্লিস প্লিস... ঝিল্লি।”

ঝিলাম দরজা খুলে বাঁ হাত কোমরে দিয়ে একটু বেঁকে দাঁড়ায়। ভুরু নাচিয়ে, নিচের ঠোঁট কামড়ে জিজ্ঞেস করে, কেমন?

বুধাদিত্য হাঁ করে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে স্বপ্নের সুন্দরীকে। মাথার চুল একপাস করে আঁচড়ানো, ভুরু জোড়া কালো চাবুকের মতন। চোখের কোনে একটু কাজল মেখে চোখের ভাষা দ্বিগুন করে নিয়েছে। গোলাপি ঠোঁট চকচক করছে গোলাপি লিপ্সটিকে। মরালী গর্দানে একটা সরু সোনার চেন, উন্নত বুকের খাঁজের মাঝে একটা লাল রুবির লকেট দুলছে। ছোটো হাতার গোলাপি টপ ওর উর্ধাঙ্গের সাথে চেপে বসে। দুই ফর্সা হাতের ত্বকে যেন মাখনের প্রলেপ দেওয়া। সাদা জিন্সের ক্যাপ্রি হাঁটুর কাছে এসে শেষ হয়ে গেছে। ফর্সা পায়ের গুলি এত মসৃণ মনে হয় যেন মাছি বসলে পিছলে পড়ে যাবে। রাঙা পায়ের গোড়ালিতে রুপোর নুপুর বাঁধা। আলতো পা দুলিয়ে ওকে ইচ্ছে করে শুনিয়ে দিল নুপুরের ছনছন আওয়াজ।

বুধাদিত্য ঝিলামকে জড়িয়ে ধরার জন্য ওর দিকে এগিয়ে যায়, ঝিলাম হেসে দৌড়ে পালিয়ে যায়। ফাঁকা বাড়ি আবার ভরে ওঠে ঝিলামের নুপুরের আওয়াজে। দেয়ালে প্রতিধ্বনি হয় মিষ্টি হাসির আওয়াজ। চাবির থোকা থেকে গাড়ির চাবি উঠিয়ে দরজা খুলে দাঁড়ায়।

খিলখিল করে হেসে বলে, “তুমি না এলে কিন্তু আমি গাড়ি চালিয়ে চলে যাবো। জানোই তো আমি গাড়ি চালালে কি হবে।”

বুধাদিত্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ঝিলাম তালা বন্ধ করে ওর বাঁহাত বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে হাঁটতে শুরু করে। পুরানো ঝিলামের নতুন রুপ দেখে মুগ্ধ বুধাদিত্য। ওর দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। বারেবারে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। গাড়িতে উঠে গাড়ি চালিয়ে দেয় ইন্ডিয়া গেটের দিকে। বুধাদিত্য ঝিলামের ডান হাত ধরে গিয়ারের ওপরে রেখে তাঁর ওপরে বাঁ হাত চেপে ধরে। ঝিলাম যত বার হাত ছাড়াবার চেষ্টা করে ততজোরে চেপে ধরে হাত।

ঝিলাম ওর হাতের ওপরে চিমটি কেটে বলে, “গাড়ি চালাও ঠিক করে, পাগলামি করতে হবে না।”

বুধাদিত্য, “উম্মম্মম্ম... তোমাকে যা সেক্সি লাগছে না। আমি চোখ ফেরাতে পারছি না, ঝিল্লি।”

ঝিলাম হাত ছাড়িয়ে বুধাদিত্যের গা ঘেঁসে বসে কানে কানে বলে, “সেক্সি আজ লেগেছে না যেদিন প্রথম দেখেছিলে সেদিন লেগেছিল, শুধু মুখে আজ বলছো, তাই তো।”

বুধাদিত্য হেসে ফেলে ওর কথা শুনে, “দুষ্টু মেয়ে, অনেক কিছু লক্ষ্য করো দেখছি, হ্যাঁ।”

ঝিলাম দুষ্টু মিষ্টি হেসে বলে, “সেদিন রাতে আমি যখন স্নান করে বেরিয়েছিলাম তখন অনেক কিছু দেখেছিলে তাই তো।”

বুধাদিত্য ধরা পড়ে গেছে, লজ্জা লুকিয়ে সামনে দেখে বলে “কবে কি দেখেছি, প্রায় দশ মাস আগের কথা মনে আছে দেখছি।”

ঝিলাম আলতো করে বুধাদিত্যের গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে, “ইসস, এই ছেলে আবার লজ্জা পায়। দেখ দেখ, কেমন লাল হয়ে গেছে মেয়েদের মতন। প্লিস আরও একটু লজ্জা পাও বুধো, তোমাকে না দারুন দেখায়।”

লজ্জায় বুধাদিত্যের কান গরম হয়ে যায় ঝিলামের কথা শুনে। ঝিলামের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে, “এবারে যদি না থামো তাহলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে।”

গাল টিপে ধরে নাড়িয়ে দেয় ঝিলাম, বলে, “কি করবে, হ্যাঁ শুনি।”

বুধাদিত্য, “গাড়ি থামিয়ে রাস্তার মাঝে তোমাকে একটা চুমু খাবো।”

ঝিলাম, “আচ্ছা তাই নাকি?”

বুধাদিত্য, “দেখতে চাও আমি কি করতে পারি।”

ঝিলাম বুধাদিত্যের নাকের ওপরে বুড়ো আঙুল টিপে, “তুমি ঘেঁচু কলা করতে পারো, ওই তো বুকের পাটা। আজ যদি আলমারি না খুলতাম তাহলে তো খুঁজেই পেতে না।”

বুধাদিত্য, “প্লিস ঝিল্লি গাড়ি চালাতে দাও না হলে এক্সিডেন্ট করে দেবো।”

ঝিলাম ওর গলা জড়িয়ে বলে, “ওকে বাবা, আমি আর ডিস্টার্ব করবো না, চলো।”

গাড়ি ইন্ডিয়া গেট পৌঁছে যায়। গাড়ি ঠিকভাবে পার্ক করার আগেই নেমে যায় ঝিলাম। দৌড়ে গিয়ে দুটি আইস্ক্রিম কিনে নিয়ে আসে। ওর দৌড়ানো দেখে বুধাদিত্যের মন চঞ্চল হয়ে ওঠে, মাথার চুল মেঘের মতন উড়ে যায়। অতীব আকর্ষণীয় দেহপল্লব দৌড়ানোর ফলে মদিরার ন্যায় ছলকে ওঠে। মাতাল হয়ে যায় বুধাদিত্য ওই তরঙ্গিণীর চাল দেখে। গোলাপি জিব বের করে আইস্ক্রিম খায় আর বুধাদিত্যের গাঁ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকে। মনে আগের সেই সঙ্কোচ নেই, নেই কোন দ্বিধা, সত্যি ভালোবাসার মানুষ আজ পাশে দাঁড়িয়ে। ঝিলামের মনে হয়, ওই কঠিন বুকের মাঝে লুকিয়ে পড়লে বেশ ভালো হতো, দুই বলিষ্ঠ বাহুর আলিঙ্গনে হারিয়ে যেতে বড় আনন্দ।

বুধাদিত্য বাঁ হাতে ঝিলামকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে, “ঝিল্লি, বেড়াতে যাবে।”

ঝিলাম, “কোথায়?”

বুধাদিত্য, “ওই সেদিনের মতন গাড়িতে, খালি তুমি আর আমি।”

ঝিলাম ওর বুকের ওপরে চিমটি কেটে বলে, “কেন কাল অফিস নেই?”

সেই চিমটিটা বড় ব্যাথা দেয়, তবে একদম বুকের বাম দিকে, বুধাদিত্য কঁকিয়ে বলে, “উফফফ... তোমার চিমটি খাবার জন্য কাল আর অফিস যেতে ইচ্ছে করছে না।”

ঝিলাম ভুরু নাচিয়ে দুষ্টু হেসে বলে, “বুঝতে পারছি বাড়ি ফিরলেই আমার কপালে বিপদ আছে। চলো বেড়াতে যাই...”

বুধাদিত্য ওর কথা ধরতে পেরে বলে, “ইসসসস... কেন যে মরতে লঙ ড্রাইভের কথা উঠাতে গেলাম...”

ঝিলাম গাড়ির দরজা খুলে গাড়িতে উঠে পড়ে। ওর দিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলে, “ভদ্রলোকের এক কথা বুধো সোনা, গার্লফ্রেন্ডকে এইরকম ভাবে ওয়েট করাতে নেই।”

বুধাদিত্য মাথা চুলকাতে চুলকাতে গাড়ি চালাতে শুরু করে। গাড়ি কিছুক্ষণের মধ্যে দিল্লী ছেড়ে বেরিয়ে চণ্ডীগড়ের হাইওয়ে ধরে। পানিপথ ছাড়াবার পরেই গাড়ি হাওয়ার সাথে গান করে। ঝিলাম ওর কাঁধ ঘেঁসে বসে থাকে আর মাঝে মাঝে ওর চুলের মধ্যে বিলি কেটে দেয়।

ঝিলাম কানের ওপরে ফুঁ দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আর সেদিন কি দেখেছিলে?”

বুধাধিত্য, “খুব জানতে ইচ্ছে করছে মনে হয়।”

ঝিলাম নিচের ঠোঁট কামড়ে বলে, “শুনি না একটু।”

বুধাদিত্য, “উম্মম্মম...ওই স্নান করার আগের দৃশ্য দেখেছিলাম।” চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই দৃশ্য, “উফফফ যা লাগছিল না।”

ঝিলাম মাথার পেছনে আদর করে চাঁটি মেরে বলে, “ছিঃ শুধু অন্য লোকের বউয়ের দিকে নজর। আয়েশা ছাড়া আর কটাকে? হ্যাঁ একটু শুনি তো।”

লজ্জায় বুধাদিত্যের কান মুখ গরম হয়ে যায়, কথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আজ আর গান গাইবে না...”

ঝিলাম হেসে ফেলে, “তুমি শুনতে চাইলেই গাইবো।”

বুধাদিত্য, “না আর গান গেয়ে কাজ নেই, এবারে এক্সিডেন্ট করে বসবো কিন্তু।”

ঝিলাম, “কেন আমি কি বেসুরা গাই নাকি?”

বুধাদিত্য, “না না, আমার কথার মানে সেটা নয়। আমি কব্জিতে বেলফুলের মালা জড়িয়ে মদ খাবো আর তুমি আমার সামনে বসে গান গাইবে, বেশ একটা অন্য আমেজ আসবে।”

ঝিলাম কানের লতিতে চুমু খেয়ে বলে, “ছেলের শখের বলিহারি, গার্লফ্রেন্ডকে শেষ পর্যন্ত বাইজি।”

ফাঁকা রাস্তার ওপর দিয়ে, ঘন কালো রাতের অন্ধকার চিরে গাড়ির বাতাসের সাথে খেলা করে চলে। খোলা জানালা দিয়ে ভেসে আসে মধ্যরাত্রের ঠাণ্ডা বাতাস। ঝিলাম দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বুকের মধ্যে সেই ঠাণ্ডা বাতাস ভরে নিয়ে প্রেমঘন সুরে বলে, “আজ মুক্তির স্বাদ পেলাম তোমার ছোঁয়ায়। আজ আমি সত্যিকারের মুক্ত, সত্যিকারের স্বাধীন।” হটাত ঝিলাম হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে সিটের ওপরে। বুধাদিত্যের দিকে ফিরে ওর মুখ আঁজলা করে ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। মাথা নামিয়ে আনে ওর মুখের ওপরে, গোলাপি নরম ঠোঁট চেপে ধরে পুরু ঠোঁটের ওপরে। চোখের সামনে ঝিলামের মুখ, চেহারার ওপরে ঝিলামের কালো রেশমি চুলের পর্দা ছাড়া রাস্তা দেখতে পারে না বুধাদিত্য। সমস্ত শক্তি দিয়ে ব্রেকে পা চেপে দেয়, গাড়ি জোর আওয়াজ করে ঘুরে গিয়ে রাস্তার পাশে থেমে যায়। ঝিলাম দুই হাতে বুধাদিত্যের গলা জড়িয়ে ধরে আরও জোরে ঠোঁট বুধাদিত্যর ঠোঁটের ওপরে চেপে ধরে। পরস্পরের মুখের লালা ভিজিয়ে দেয় পরস্পরের ঠোঁট, চোখ বন্ধ করে, প্রগাড় আলিঙ্গনে বদ্ধ হয়ে দুজনে ভেসে যায় প্রেমের জোয়ারে।
 
পঞ্চদশ পর্বঃ দ্বিতীয় অঙ্ক।

আগস্ট মাসের শেষের দিকে। দুপুরের পর থেকেই ঝড় শুরু হয়ে গিয়েছিল, এই বছর মনে হয় অন্য বছরের চেয়ে একটু বেশি বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা আছে। অফিসে ওর বস, শান্তনুর সাথে একটু মনোমালিন্য হয়েছিল, সেই নিয়ে একটু চিন্তায়। কাজের চাপের বুধাদিত্যকে কোনদিন ঝোঁকাতে পারেনি কিন্তু বসের সাথে মাঝে মাঝেই এই মনোমালিন্য ঠিক আর পেরে উঠছেনা বুধাদিত্য। প্রান প্রেয়সী, ঝিলাম আবার স্কুল কলিগদের নিয়ে লাজপত নগর গেছে, শপিং করতে। সাথে গাড়িটাও নিয়ে গিয়েছিল তাই বুধাদিত্যকে অটো করে বাড়ি ফিরতে হয়। শপিংয়ে বেরোনোর আগেই ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল ঝিলাম যে ফিরতে দেরি হতে পারে। বাড়ি ঢোকা মাত্রই ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। অগত্যা একা বসে টিভি দেখা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। রাত প্রায় নটা বাজতে চলল, বৃষ্টি যেন আরও জোরে শুরু হয়ে গেছে। দুই বার ফোন করে পেল না ঝিলামকে, একটু চিন্তায় পড়ে গেল বুধাদিত্য, এই বৃষ্টিতে কিছু হলো নাকি গাড়ির অথবা ঝিলামের? গাড়ির কিছু হলে কালীনাথ ফোন করে জানিয়ে দিতো। শেষ পর্যন্ত থাকতে না পেরে কালীনাথের ফোনে ফোন করে বুধাদিত্য।

কালীনাথ ঝিলামকে ফোন ধরিয়ে দেয়। বুধাদিত্য ফোন ধরেই বকা দেয়, “কি হলো সেই কখন থেকে ফোন করে যাচ্ছি। ফোন ধরতে পারো না তাহলে রেখেছো কেন?”

ঝিলাম বেগতিক দেখে রুদ্র রুপ ধারন করে, জানে এই রুপেই একমাত্র বুধাদিত্য বশ মানবে না হলে আরও চোটপাট শুরু করে দেবে তাই চেঁচিয়ে উত্তর দেয়, “চেঁচিও না, আমি আগেই বলে দিয়েছিলাম যে আমার ফিরতে দেরি হবে। আর ফোন ধরতে পারিনি কেননা আমার দু’হাতে মেহেন্দি লাগানো, তাই।”

বুধাদিত্য নরম হয়ে যায় রুদ্র দেবীর সামনে, “না মানে এতো রাত হয়ে গেল, এত বৃষ্টি তাই একটু চিন্তায় ছিলাম।”

ঝিলাম হেসে ফেলে, ওষুধে কাজ হয়েছে, “উম্ম কত চিন্তা যেন আমার জন্য। যাই হোক আমি রাস্তায়, মনামিকে বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে আসছি।”

বুধাদিত্য, “আজ হটাত মেহেন্দি লাগাতে গেলে, তাও আবার লাজপত নগর গিয়ে?”

ঝিলাম, “আরে বাবা, সব জেরা কি এখানে করবে নাকি। বাড়ি এসে বলছি সব কথা। ফ্রিজ থেকে খাবারগুলো বের করে গরম করে রেখো আর প্লিস সোনা, মিষ্টি সোনা, দুষ্টু সোনা, আমার জন্যে একটু স্যালাড বানিয়ে রেখো।”

বুধাদিত্য প্রশ্ন করে, “রাতে স্যালাড কেন খাবে?”

ঝিলাম কড়া সুরে উত্তর দেয়, “যেটা বলা হয়েছে সেটা করো, আমি বাড়ি ফিরে বাকি কথা বলবো।”

হেসে ফেলে বুধাদিত্য, “জি মালকিন, আপনার আদেশ শিরধার্য। আমি আপনার আদেশ মান্য করিব। শুধু আপনার চাঁদ মুখের কিঞ্চিত তাড়াতাড়ি দর্শন পাইলে আমি অতীব পুলকিত হইতাম। যদি দয়া করে আপনার সারথিকে একটু তড়িৎ বেগে বাহন চালাইতে আদেশ দেন তাহলে...”

হেসে ফেলে ঝিলাম, “ওকে, বাবা, আমি এখুনি আসছি, কিন্তু জানতো বৃষ্টি হলে রাস্তায় কত জ্যাম হয়।”

ঝিলাম স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে রান্না সেরে তারপরে ঘুরতে বেরিয়েছে। বুধাদিত্য ফোন রেখে ফ্রিজ খুলে দেখলো যে ভাত ডাল তরকারি সব বানানো। ডিপ ফ্রিজে খান চারেক মুরগির ঠ্যাঙ রাখা। বুধাদিত্য ভাবল এই বৃষ্টির রাতে নুডুলসের সাথে চিকেন লেগ বেশ ভালো জমবে। নুডুলস ঝিলামের খুব পছন্দের খাদ্য, বানিয়ে রাখলে ঝিলামকে একটু অবাক করে দেওয়া হবে। ওর জীবনে ঝিলাম পা রাখার পরে কোনদিন রান্না ঘরে ঢোকেনি বুধাদিত্য। বাইরে থেকে রান্না ঘর দেখে আর চেনা যায় না যে এটা তার ছন্নছাড়া রান্না ঘর ছিল।

রান্না ঘরে ঢুকে নুডুলস আর চিকেন রান্না করতে করতে গত কয়েক মাসের ছবি বুধাদিত্যের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ঝিলামকে সেই মৃত্যুর কবল থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। শামুকের খোলে লুকিয়ে থাকা ঝিলামকে প্রেয়সী “ঝিল্লিরানী”তে পরিবর্তন করা। নিজের জীবন তাঁর হাতে সঁপে এক নতুন “বুধো”র আগমন। বুক ভরে শ্বাস নেয়, বারেবারে “দেবী”র কথা মনে পড়ে যায়, দেবস্মিতা ওর বাবাকে পাঁকের জীবন থেকে তুলে এনে এক নতুন জীবন প্রদান করে এখানে দুজনে দুজনাকে আঁকড়ে নতুন জীবনের আস্বাদ নেয় প্রতিদিন। হারিয়ে যাওয়া প্রেয়সীকে পেয়ে বুধাদিত্য সব ভুলে নিজেকে ঝিলামের হাতে সমর্পণ করে দিয়েছে। এই নতুন খুঁজে পাওয়া মুক্তির স্বাদে ঝিলাম এক নতুন নারী, দ্বিতীয় জীবনে অবশেষে মনের মানুষ খুঁজে পেয়ে ঝিলাম অতীব আনন্দিত। ভাগ্য সবার হয়তো সহায় হয়না তাই ঝিলাম এই জীবন দু’হাতে আঁকড়ে ধরে থেকে, তিলেতিলে সাজিয়ে সুন্দর করে তুলতে তৎপর। ঘরের দেয়াল, বিছানার চাদর, জানালার পর্দা, সোফার কভার, টেবিলের থালা বাটি গ্লাস পর্যন্ত যেন এই বাড়ির নব রাজ্ঞীর অধীন, এই প্রাসাদের রানীর ছোঁয়ায় ঝলমল করছে সর্বদা। রান্না শেষ, খাবার টেবিলে তিনটে মোমবাতি রাখে, একটা বড় কাঁচের বাটির মধ্যে কিছু ছোটো ছোটো সুগন্ধি প্রদীপ ভাসিয়ে দেয়।

সোফার ওপরে বসে পড়ে বুধাদিত্য, চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই প্রেমের দৃশ্য আর চনমন করে ওঠে বুধাদিত্যের শরীর। পরের দিন আর অফিস যেতে পারেনি বুধাদিত্য। ঝিলামের তীব্র অধর দংশন ওকে নিয়ে যায় এক অচিন পুরীতে, এক স্বপ্নের রাজ্যে। সেই রাতে বাড়ি ফিরে পরস্পরকে প্রান ঢেলে, হৃদয় উজাড় করে ভালোবাসার শেষ কণাটুকু পরস্পরে অঙ্গে মাখিয়ে দিয়েছিল। বাড়ি ফিরতে সেদিন অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল, ঘরে ঢুকতেই পরস্পরকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরে যেন একটাই শরীর। দুই প্রেমে উন্মাদ নাগ আর নাগিনী পরস্পরকে ছাড়তেই চায়না। সে যেন প্রেমের এক নবীন যুদ্ধ, কে কাকে হারিয়ে দেয় এই ভালোবাসার খেলায়। কেউ কাউকে ছাড়তে চায়না, চুম্বনে, মর্দনে, পেষণে সোহাগে ভরিয়ে বারেবারে সেই সুখের সাগরে ভেসে গিয়েছিল দুই প্রান। রাগরস সারা অঙ্গে মাখিয়ে ভোরের দিকে পরস্পরকে আলিঙ্গনে বেঁধে শোয়ার ঘরের মেঝের ওপরে ঘুমিয়ে পড়েছিল দুই ক্লান্ত কপোত কপোতী। পরের দিন সকালে ঝিলামের শরীরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে এক নতুন রুপ অপার তৃপ্তিতে, বুধাদিত্য অবশেষে খুঁজে পায় তার ভালোবাসার শীতল মলয়।

কলিং বেল শুনে সম্বিৎ ফিরে পায়। দরজা খুলে প্রেয়সীকে সাদর আহবান জানায়। ফর্সা হাত দুটি মেহেন্দি ঢাকা, দুই কাজল কালো চোখে দুষ্টুমির হাসি। কালীনাথ পেছন পেছন ব্যাগ নিয়ে ঘরে রেখে চলে যায়। বুধাদিত্য চুপ করে দাঁড়িয়ে একবার ঝিলামের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে। ছাতার মতন বড় ঘেরের লম্বা সাদা রঙের কামিজ আর আঁটো চুড়িদার পরনে।

বুধাদিত্য হেসে জিজ্ঞেস করে, “কি ব্যাপার বলতো, হটাত মেহেন্দি লাগাতে গেলে?”

ঝিলাম ওর বুকের ওপরে কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে বলে, “এমনি ইচ্ছে হলো তাই সাজলাম একটু।” বুধাদিত্য ওর কোমর জড়িয়ে ধরে বুকের কাছে টেনে আনে। ঝিলাম চেঁচিয়ে ওঠে “এই ছাড়ো ছাড়ো, হাতের মেহেন্দি ঘ্যেচে যাবে যে।” বুধাদিত্য ওর গালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। ঝিলাম অগত্যা নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, “এবারে সত্যি বলছি হাতের মেহেন্দি কিন্তু মুখে মাখিয়ে দেবো, তখন বুঝবে।”

বুধাদিত্য হেসে উত্তর দেয়, “তুমি নিতাই গৌরাঙ্গ হয়েছো তাই তো একটু দুষ্টুমি করার সুযোগ পেলাম।”

ঝিলাম, “প্লিস সোনা, কোরো না।”

বুধাদিত্য, “তা কতক্ষণে এই মেহেন্দি তোমার হাত থেকে ছাড়াবে?”

ঝিলাম, “একটু লেবু কেটে নিয়ে এসো না, প্লিস।”

বুধাদিত্য, “এই সাদা ড্রেস পরে তুমি মেহেন্দি ছাড়াবে, যদি কাপড়ে লেগে যায় তাহলে?”

ঝিলাম নিচের ঠোঁট চেপে হেসে ফেলে, “সত্যি বলছো যে দুষ্টুমি করবে না?” বুধাদিত্য মাথা নাড়ায়, না করবো না। ঝিলাম কানে কানে বলে, “সালোয়ার নামিয়ে দাও।”

বুধাদিত্য ঝিলামের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ওর মুখের দিকে তাকায়। ঝিলামের মুখ লাল হয়ে যায় একটু লজ্জায়। বুধাদিত্যের হাত ওর পায়ের সালোয়ারের ওপর দিয়ে ওর বক্র পায়ের গুলির উপরে আদর করে কামিজ উপর দিকে উঠিয়ে দেয়। ঝিলামের শরীর শিরশির করে কেঁপে ওঠে সেই প্রেমের পরশে। বুধাদিত্য ওর কোমরে হাত নিয়ে ওর নগ্ন পেটের ওপরে আলতো করে চেপে ধরে। ঝিলাম আলতো কোমর নাড়ায়, আর বুধাদিত্য দুই পাশে হাত রেখে ওর পাতলা কোমর চেপে ধরে।

সারা অঙ্গে এক বিদ্যুৎ খেলে যায় ঝিলামের, কঠিন তপ্ত আঙুল ওর নরম পেটের ওপরে খেলা করতে শুরু করে। ঝিলাম মৃদু স্বরে আদেশ দেয়, “বুধো প্লিস, আমি কিন্তু খুব মারবো এবারে।”

বুধাদিত্য ধিরে ধিরে ওর চুড়িদারের দড়ি খুলে দেয়, গোড়ালির কাছে টেনে নামিয়ে দেয় পরনের চুড়িদার। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ঝিলাম, ওর নগ্ন কোমরে বুধাদিত্যের তপ্ত আঙুল নরম পেটের ওপরে খেলা করে চলে। কোমরবন্ধনীর পাশে হাত রেখে আলতো করে আঙুল দিয়ে চাপ দেয়। ঝিলামের সারা শরীর অবশ হয়ে আসে, চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে উত্তেজনায়। কোনরকম সামনে ঝুঁকে বুধাদিত্যের মাথার ওপরে কনুই দিয়ে ঠ্যালা মারে। বুধাদিত্যের হাত কোমর ছাড়িয়ে ঝিলামের কোমল নিটোল নিতম্বের তপ্ত ত্বক স্পর্শ করে। ঝিলামের দুই উরুতে কাপন ধরে, দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হারাতে থাকে ললনা। বুধাদিত্য দুই হাতের থাবার মধ্যে দুই সুডৌল নিটোল ভারী নিতম্বে আলতো চাপ দিয়ে ওর মুখের কাছে টেনে ধরে ঝিলামের পেট।

ঝিলামের সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে, মৃদু স্বরে বলে, “বুধো প্লিস, সোনা এখন না।” বুধাদিত্য কামিজের ওপর দিয়ে ওর নরম পেটের ওপরে সুগভীর নাভির ওপরে ঠোঁট চেপে ধরে। ঝিলাম মৃদু শীৎকার করে ওঠে, “শয়তান ছেলে, ছাড়ো প্লিস।”

বুধাদিত্য প্রেয়সীকে আরও উত্যক্ত করে তোলে, দুই হাতের দশ আঙুলে চেপে ধরে কোমল নিতম্বের মাংস। গরম ত্বকের ওপরে গরম আঙ্গুলের পেষণে ঝিলামের উরু কেঁপে ওঠে। ঝিলাম যদি নিজেকে এই প্রগাড় আলিঙ্গন থেকে নিজেকে না ছাড়িয়ে নেয় তাহলে এখুনি চেতনা হারিয়ে লুটিয়ে পড়বে বুধাদিত্যের কোলে। হাঁটু দিয়ে বুধাদিত্যের মুখের ওপরে ঠেলে দেয়, কোনোরকমে সরিয়ে দেয় বুধাদিত্যকে। বুধাদিত্য ওকে ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, আর সেই ক্ষণে ঝিলাম দৌড়ে পালিয়ে যায় ঘরের মধ্যে।

বাথরুমে ঢুকে মৃদু বকুনি দেয় দয়িতকে, “তুমি না, একদম জানো, মস্ত শয়তান।”

বুধাদিত্য, “উফফফ... তোমার ওই সেক্সি শরীর থেকে হাত সরাতে ইচ্ছে করে না যে।”

ঝিলাম, “আমি স্যালাড কেটে রাখতে বলেছিলাম, সেটা করেছো?”

বুধাদিত্য, “না, স্যালাড কেন খাবে? আমি নুডুলস আর চিকেন বানিয়েছি তোমার জন্য।”

ঝিলাম অবাক সুরে জিজ্ঞেস করে, “কি! তুমি রান্না ঘরে ঢুকেছিলে? জিনিসপত্র পেলে খুঁজে?”

বুধাদিত্য, “হ্যাঁ খুঁজে নিলাম।”

ঝিলাম, “দাঁড়াও আমি এখুনি আসছি।”

ঝিলাম হাত ধুয়ে কাপড় বদলে খাওয়ার ঘরে এসে দেখে যে টেবিলে মোমবাতি রাখা, একটা কাঁচের বড় বাটিতে সুগন্ধি গোলাপ জল আর তাঁর মাঝে কয়েকটা ছোটো ছোটো প্রদীপ জ্বালানো। টেবিলে দুটি প্লেট সাজানো। টেবিলের মাঝে দুটি কাঁচের বাটিতে নুডুলস আর চিলি চিকেন রাখা। ঝিলামের দুই চোখ ছলছল করে ওঠে। বুধাদিত্য ঝিলামকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। ঝিলাম ওর হাতের ওপরে হাত রেখে নিজের শরীরের শক্ত করে বেঁধে নেয় ওই দুই কঠিন হাতের বন্ধন। মাথা পেছন দিকে হেলিয়ে ওর কাঁধের ওপরে রাখে, শক্ত করে ঠোঁট চেপে কঠিন চোয়ালের ওপরে।

বুধাদিত্য ফিসফিস করে বলে, “মাঝে মাঝে প্রেমিকাকে একটু রেস্ট দিতে হয়, তাই ভাবলাম ডিনার আমি বানিয়ে রাখি।”

ঝিলাম, “তুমি রান্না করেছো, ঝাল হোক, পোড়া হোক। তুমি যদি বিষ দাও তাও খাবো আমি।”

বুধাদিত্য, “ঝিল্লিরানি প্লিস ওই কথা বোলো না। অনেক কষ্টে কুড়িয়ে পাওয়া এই দ্বিতীয় জীবন।”

ঝিলাম ছলছল চোখে দুই হাত ওর চোখের সামনে মেলে ধরে বলে, “দেখো, মেহেন্দির রঙ কত গাড় হয়েছে, তাই না।”

বুধাদিত্য ওর গালে গাল ঘষে বলে, “ফর্সা হাতের ওপরে দারুন মানিয়েছে। শালা যে লোকটা ওই হাত ধরে এঁকেছিল তাঁর ওপরে হিংসে হচ্ছে।”

ঝিলাম আলতো কামড় দেয় বুধাদিত্যের গালে, “ধুত, তুমি না, সত্যি...”

বুধাদিত্য, “কিন্তু তুমি স্যালাড কেন খেতে চেয়েছিলে?”

ঝিলাম একটু আহত সুরে বলে, “আমি মোটা হয়ে যাচ্ছি, জানো আমার ওজন বেড়ে গেছে, ছাপ্পান্ন কিলো হয়ে গেছে তোমার ঝিল্লিরানী।”

বুধাদিত্য ওকে দুই হাতের মধ্যে পিষে ধরে বলে, “না ঝিল্লি, কে বলেছে তুমি মোটা। তোমার ঠিক জায়গায় ঠিক ঠিক বেড়েছে, আমার সুবিধা হয়েছে একটু নরম নরম আদর করতে।”

ঝিলাম লাজুক হেসে বলে, “ইসসস... তুমি না... সবসময়ে উলটোপালটা ভাবো। ছাড়ো এখন।” বুধাদিত্যের আলিঙ্গনের মাঝে ওর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, “খেতে দেবে না তোমার প্রেমিকাকে? আমার যে ক্ষিধেতে পেট জ্বলছে গো।”

বুধাদিত্যের জীবনশৈলী আমুল বদলে দিয়েছে ঝিলাম, কড়া শাসন, রাত ন’টার মধ্যে রাতের খাওয়া সেরে ফেলতে হয়। ঝিলামকে সকাল সকাল উঠে স্কুল যেতে হয় তাই রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। শুধু মাত্র ছুটির দিন গুলোতে সেই নিয়ম একটু শিথিল হয়। খাওয়া শেষে বুধাদিত্য সোফার ওপরে গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে, আগামিকাল শনিবার, দুজনের ছুটি। বাইরে ঝড়ের তান্ডব বেড়ে যায়। বুধাদিত্যের হৃদয় আকুল হয়ে ওঠে প্রেয়সীকে ক্রোড়ে নিয়ে খেলার জন্য। ঝিলামের নুপুরের শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় ওর দিকে। পরনে একটা পাতলা মোলায়ম স্লিপ, সারা অঙ্গে মাদকতার ছন্দ তুলে ওর দিকে দুষ্টু মিষ্টি হেসে এগিয়ে আসে। চলনের তালে তালে দুই নিটোল ভারী নিতম্ব দোল খায়। স্লিপের নিচের অংশ বারেবারে জানুসন্ধি থেকে সরে গিয়ে দেখা দেয় পরনের গোলাপি ক্ষীণ প্যান্টি। নারীসুধার দ্বারে চেপে বসে অবয়ব ফুটে উঠেছে ওই পাতলা কাপড়ের ভেতর থেকে। দুই উরু যেন দুই মসৃণ স্ফটিকের থাম, বসার ঘরের মৃদু আলোতে চকচক করছে শরীরের ত্বক। ওর মুখের দিকে তাকাতেই ঝিলাম হেসে ফেলে। ঠোঁট দুটি অতীব গোলাপি আর মধুভরা। স্লিপের ভেতর থেকে দুই উন্নত বক্ষ সামনের দিকে ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। ভেতরে কোন বক্ষবন্ধনি পরেনি ঝিলাম, তাই দুই পীনোন্নত বক্ষের আবছা অবয়ব দেখা যায়। কোমল বক্ষের উপরে স্থিত দুই শক্ত বৃন্ত যেন দুটি ছোটো রসালো ফল, বুধাদিত্যের চুম্বনের অধীর প্রতীক্ষায় ওর দিকে উন্মুখ হয়ে চেয়ে।

ঝিলাম ওর পাশে বসে আলতো ঠেলে বলে, “এই একটু সরো, আমি শোব।”

বুধাদিত্য দুই হাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরে প্রেয়সীকে। ঝিলাম ওর বুকের ওপরে মাথা রেখে বুধাদিত্যের শরীরের ওপরে শুয়ে পড়ে। দয়িতার হাত নিজের হাতের মুঠির মধ্যে নিয়ে ছোটো ছোটো চুমু খায় ঝিলাম। বুধাদিত্য বাম হাতে ঝিলামের পেটের ওপরে রেখে জড়িয়ে ধরে থাকে। বুধাদিত্যের হাতের চাপে কেঁপে উঠে ঝিলাম ওর ডান হাত মুখের কাছে এনে আঙ্গুলে কামড় বসিয়ে দেয়। দুই হাতে আস্টেপিস্টে চেপে ধরে ঝিলামকে, সাপের মতন এঁকেবেঁকে নড়ে ওঠে ঝিলাম, নিটোল নিতম্বের নিচে উঁচিয়ে ওঠে বুধাদিত্যের সুদীর্ঘ কঠিন সিংহ। বুধাদিত্যের হাত ছাড়িয়ে ওর বুকের ওপরে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে ঝিলাম। নড়ার ফলে নিতম্ব থেকে স্লিপ উপরে উঠে কোমর চলে আসে। বুধাদিত্য এক হাতে ঝিলামের পিঠ ধরে নিজের বুকের সাথে স্তনজোড়া চেপে দেয় অন্য হাতে নিতম্ব চেপে জানুসন্ধিতে নিজের কঠিন সিংহ স্পর্শ করিয়ে দেয়। সেই তপ্ত শলাকার স্পর্শে ঝিলাম অবশ হয়ে যায়। আবেগের বশে গলা চেপে ধরে বুধাদিত্যের আর নিজের উরু মেলে ধরে নারীসুধার দ্বারে চেপে ধরে বুধাদিত্যের কঠিন সিংহ। বিশাল টিভি স্ক্রিনে কোন এক মারদাঙ্গা ইংরাজি সিনেমা চলছে, সেদিকে বিশেষ কারুর মন নেই, দুজনে পরস্পরের আদরে সোহাগে, অনুরাগে তরী ভাসাতে ব্যাস্ত।

ঝিলাম বুকের কাছে হাত ভাঁজ করে মাথা উঠিয়ে বুধাদিত্যের নাকের ডগায় আঙুল বুলিয়ে বলে, “বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে জানো।”

বুধাদিত্য, “হুম সেতো অনেকক্ষণ ধরে হচ্ছে।”

ঝিলাম, “তুমি আজ হটাত করে রান্না করতে গেলে?”

বুধাদিত্য, “তুমি হটাত করে সাজতে পা্রো তাহলে আমি রান্না কেন করতে পারি না।”

ঝিলাম, “গাড়িতে তেল শেষ নাহলে ঘুরতে নিয়ে যেতে বলতাম। বেশ কোথাও ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দু’জনে বৃষ্টিতে ভিজতাম।”

বুধাদিত্য, “তারপরে তোমার জ্বর হতো আর আমার অফিস মাঠে মারা যেতো।”

ঝিলাম, “ধুর পাগল বৃষ্টিতে ভিজলেই কি জ্বর হয় নাকি? ছোটো বেলায় অনেক ভিজেছি, দুর্গাপুরে বর্ষাকালে খুব বৃষ্টি হয়।”

ঠিক তখন ঝিলামের মোবাইল বেজে ওঠে, ভাটা পড়ে ওদের সোহাগের খেলায়। ওপাশে অনিন্দিতাদি, “কিরে তোরা কি ঘুমিয়ে পড়েছিস নাকি রে?”

ঝিলাম এক হাতে ফোন অন্য হাত বুধাদিত্যের হাত নিজের বুকের ওপরে টেনে ধরে বলে, “দিদিভাই, কেমন আছো তোমরা?”

অনিন্দিতাদি, “আমরা ভালো আছি। তোরা কি আমাদের একটু শান্তি দিবি।”

ঝিলাম অবাক, “কেন কি হলো?”

অনিন্দিতাদি হেসে ফেলে, “তোদের ছেলে কি শেষ পর্যন্ত তোদের বিয়ে খেতে যাবে?”

ঝিলাম লজ্জায় পড়ে যায়। বাবা মা গত মাসে এসে ঘুরে গেছেন, দেখে গেছেন মেয়ের নতুন রুপ। একটু ইতস্তত করেছিলেন ঝিলামের বাবা মা, বুধাদিত্য আর ঝিলামের এখন বিয়ে হয়নি এবং একসাথে আছে, এদের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু চিন্তিত ছিলেন। ঝিলাম নিজের বাবা মাকে বলেছিল যে, লাল চেলি আর সিল্কের জোড়ের বাঁধন শুধু কাপড়ের গিঁট মাত্র। নিজের জীবন দিয়ে সেই গিঁটের সত্যতা বুঝেছে। দুই হৃদয়ে যদি গিঁট না পড়ে তাহলে কাপড়ের গিঁট বেঁধে কি লাভ? বুঝিয়ে বলেছিল বিয়ে করলেই যে ছেড়ে যাবে না আর বিয়ে না করলেই যে মানুষের ছাড়াছাড়ি হয়ে যেতে পারে, সেই সব অবান্তর ধারনা। যেখানে দুই হৃদয়ের বন্ধন মজবুত হয় সেই সম্পর্কে বিয়ে হোক বা না হোক কিছু এসে যায় না। ওর বাবা মা, সমাজের একটু দোহাই দেন, ঝিলাম ওদের আস্বস্ত করে বলেছিল যে, সময় হলে ঠিক বিয়ে করে নেবে। ঝিলামের নতুন চাকরি আর দুই মাস আগে বুধাদিত্য ওর শরীর খারাপের সময় অনেক ছুটি নিয়েছিল, ছুটির ব্যবস্থা করে একদিন সবাইকে ডেকে রেজিস্ট্রি সেরে নেবে। মেয়ের জীবনে আনন্দ আর হাসি মুখ দেখে বেশি কথা বাড়ায়নি ওর বাবা মা।

ঝিলাম লজ্জায় পড়ে যায়, “না না সে রকম কিছু হবে না, চিন্তা নেই।”

অনিন্দিতাদি, “কেন রে ঝগড়া করেছিস নাকি তোরা?”

বুধাদিত্যের হাত দুটি ঝিলামের নিটোল নিতম্বের ওপরে খেলা করে, বুধাদিত্যের দিকে ঠোঁট কুঁচকে একটা চুমু খেয়ে অনিন্দিতাদিকে উত্তর দেয়, “বুধোর সাথে ঝগড়া তো আমাদের দিনের একটা নিত্য কাজ, সে আবার নতুন কি।”

অনিন্দিতাদি, “বাপরে, প্রেমে মরে গেলাম। এবারে বিয়েটা করে ফেল। ভাই কোথায়?”

বুধাদিত্য ঝিলামকে আদর করতে করতে বলে, “আমি এখানেই আছি, বল আমি সব শুনতে পাচ্ছি।”

অনিন্দিতাদি গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কোলে নিয়ে শুয়ে নাকি?”

ঝিলাম বুধাদিত্যের নাকের ওপরে নাক ঘষে বলে, “দিদিভাই, তুমি না, আবার শুরু করে দিলে।”

অনিন্দিতাদি, “আচ্ছা বাবা, এবারে বল কবে বিয়ে করছিস তোরা?”

ঝিলাম, “বিয়ে তো শুধু একটা অনুষ্ঠান মাত্র, অত তাড়াহুড়ো করার কি আছে। সময় হলেই হয়ে যাবে, আর আমাদের অতশত কিছু করার নেই, শুধু দু’জনে একটা সই দেব ব্যাস, কয়েক ঘন্টার ব্যাপার। জানিয়ে দেবো তোমাদের, চিন্তা নেই।”

অনিন্দিতাদি হেসে বলে, “তার মানে তোর ছেলে বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে যে বাবার বিয়ে দেখেছি।”

বুধাদিত্য, “তোমার কি শুরু করেছ বলতো।”

দেবস্মিতা, “বাপ্পা দাদার বিয়ে দেখতে চায়।”

ঝিলাম আর বুধাদিত্য দু’জনেই অবাক, অনিন্দিতাদির বাড়িতে দেবস্মিতা, ব্যাপার বুঝতে একটু কষ্ট হয়। অনিন্দিতাদি হেসে বলে, “কি রে চমকে গেলি নাকি? দেবস্মিতা আজ বিকেলে বাপ্পা আর পিসেমশায়কে নিয়ে বাড়িতে এসেছে। আমরা সবাই মায়ের বাড়িতে।”

ঝিলাম অবাক, “তোমার সবাই কি পন্ডিতিয়ায়? দাও দাও মাকে একটু ফোন দাও।” ঝিলাম প্রমীলা দেবীকে মা বলে ডাকে।

প্রমীলা দেবী ফোন ধরেই ঝিলামকে জিজ্ঞেস করে, “তোর শরীর কেমন আছে রে? ঠিক মতন আয়রন ট্যাবলেট খাচ্ছিস তুই? গত সপ্তাহে ডাক্তারের কাছে যাবার কথা ছিল, গিয়েছিলি কি?”

ঝিলাম বেমালুম ভুলে গেছিল গায়নকলজিস্টের কথা, তাই জিব কেটে বলল, “না মা, একদম ভুলে গেছিলাম। প্লিস রাগ কোরোনা সোনা মা। আমি পরের সপ্তাহে দেখিয়ে নেবো।”

প্রমীলাদেবী মৃদু বকুনি দিয়ে বলেন, “দে তো ছোঁড়াটাকে ফোন দে। তোকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যেতে পারলো না? কি এমন কাজ করে দেখি।”

ঝিলাম প্রমীলা দেবীকে বলে, “না না, বুধোর দোষ নয়। ওকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।”

বুধাদিত্য অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “শোনো পমুডার্লিং তোমার আর ঝিল্লীর কথার মধ্যে আমাকে একদম জড়াবে না। ঝিল্লি আমাকে ডাক্তারের ব্যাপারে কিছু বলেনি।”

ঝিলাম নাক কুঁচকে, বুধাদিত্যের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলে, “সরি বুধো।” তারপরে প্রমীলাদেবীকে জিজ্ঞেস করে, “কি ব্যাপার তোমরা বেশ মজা করছো তাই না।”

প্রমীলা দেবী, “জামাই ষষ্টির সময়ে সুব্রত বাইরে ছিল, আসতে পারেনি। সুবিরকেও কোনদিন ডেকে খাওয়ানো হয়নি। তাই ওদের সবাইকে একসাথে ডেকেছি। এমনিতে দেবস্মিতা খুব ব্যস্ত থাকে, সময় নিয়ে আসতে একটু দেরি হয়ে গেল এই আর কি।”

দেবস্মিতা, “না কি করে মজা করি বলতো, তোমরা দু’জনে যে নেই।”

ঝিলাম, “তুমি বাপ্পাকে নিয়ে চলে এসো এখানে।”

দেবস্মিতা, “আমার বুড়োটাকে কে দেখবে, তুমি? যদি বলি সাইটে গাড়ি পাঠাও তাহলে আমার গাড়ি সাইটে পাঠিয়ে দেয় আর ওয়ার্কারদের ভ্যান পাঠায় আমাকে আনতে, এই তো আমার বুড়ো। ছেড়ে কি আর যেতে পারি, বল।”

বুধাদিত্য, “তোমরা সবাই একসাথে বসে কি জল্পনা করছো বলতো?”

অনিন্দিতাদি, “তোদের এবারে বিয়েটা দিয়েই ছাড়বো আমরা, তাঁর পরিকল্পনা করা হচ্ছে বাড়ি বসে।”

প্রমীলাদেবী, “শোন রে, বুধি, ঝিলামের জন্মদিনের দুই দিন পরে একটা ভাল দিন আছে। ঠিক বিয়ের নয় তবে ভালো দিন, শুভ কাজ করা যায়। তোরা তো আর বিয়ের তারিখ মেনে বিয়ে করবি বলে মনে হয় না তাই ভাবলাম যে ওই দিনে যদি...”

ঝিলাম প্রমীলাদেবীর কথা টেনে নিয়ে বলে, “ঠিক আছে মা, তোমার এত ইচ্ছে তাহলে আমরা করেই নেবো।”

দেবস্মিতা, “উফফফ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম শেষ পর্যন্ত। তাড়াতাড়ি তাহলে সব শুরু করতে হয় আর তো মোটে দিন কুড়ি। বিয়ে কিন্তু ধানবাদ থেকে হবে।”

বুধাদিত্য ঝিলাম এক সুরে বলে ওঠে, “না, আমরা দিল্লীতেই বিয়ে করবো। আর বিয়েতে শুধু বাড়ির লোক ছাড়া কেউ আসবে না।”

প্রমীলা দেবী আঁতকে ওঠেন, “মানে? দিল্লীতে হলে আমরা যাবো কিকরে? তোর বাবা মা দাদারা দিদিরা কি করে যাবে? তুই নিয়ে যাবি?”

ঝিলাম ক্ষণিকের জন্য চিন্তায় পড়ে যায়, ওদের পরিবার অনেক বড়, দিল্লীতে নিয়ে আসা বেশ খরচ সাপেক্ষ। দেবস্মিতা হেসে বলে, “ঝিলাম এত চিন্তা করছো কেন? আমার বন্ধুর বিয়ে বলে কথা, বল তো রাজধানি বুক করে দেব।”

ঝিলামের চোখ বন্ধ করে দেবীর মুখ স্মরন করে, একবারের জন্য দেখেছিল সেই সময়ে। ধরা গলায় বলে দেবস্মিতাকে, “তুমি সত্যি দেবী।”

দেবস্মিতা, “তাহলে তারিখ সেটাই থাকলো, আমরা সবাইকে নিয়ে তোমার জন্মদিনের দিন পৌঁছে যাবো দিল্লী। বেশ মজা হবে তোমার জন্মদিন আর দুই দিন পরে তোমার বিয়ে।”

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি, আকাশে বর্ষার মেঘের খেলা একটু কমে গেছে। বাড়িতে দুই দিন আগে থেকেই লোকজন ভর্তি। ঝিলামের জন্মদিনের দিন কোলকাতা, ধানবাদ থেকে সবাই চলে আসে। বুধাদিত্য ঝিলামের ফ্লাট একটা রনক্ষেত্র হয়ে উঠেছে এই কদিনে। দুর্গাপুর থেকে ঝিলামের বাবা মা, দুই দাদা আর তাদের পরিবার, দুই দিদি আর তাদের পরিবার মিলিয়ে জনা পনের জন লোক। রঞ্জন বাবু, প্রমীলা দেবী, অনিন্দিতাদি, বুবাই, সুব্রতদা ওদিকে ধানবাদ থেকে দেবস্মিতা বাপ্পা আর সুবিরবাবু। সকাল থেকে বাড়িতে সাজসাজ রব, কোলাহল শুনে মনে হবে যেন এক রণক্ষেত্র। চার দিনের জন্য একটা হোটেলের তিনটে রুম ভাড়া করা হয়েছিল, পুরুষেরা ছাড়া সেই হোটেলে কেউ থাকেনি। বাড়ির মেয়েরা বাড়িতেই ছিল এই ক’দিন। এই ক’দিন বুধাদিত্য অফিসে গিয়েছিল কিন্তু ঝিলাম আর স্কুল করতে পারেনি। দেবস্মিতা ওকে নিয়ে পরপর দুই দিন লাজপত নগর, এসো.এন.মারকেট করে বেড়িয়েছে। ঝিলামের মা রান্না বান্নার ভার সামলে নিয়েছিলেন। দেবস্মিতা আর অনিন্দিতাদি এই কদিনে বাড়ির সব কিছু সামলে নিয়ে রেখেছে। ঝিলামের দিদিরা এই প্রথমবার রাজধানি চেপে দিল্লী এসেছে, তাই গত দুই দিন বর আর বাচ্চাদের নিয়ে দিল্লী ঘুরে বেড়িয়েছে।

সবাই বাড়ির লোক তাই আর বিশেষ কিছুই আয়োজন করা হয়নি। বাইরের মানুষ বলতে, ভিশাল স্যার আর শমিতা ম্যাডাম আর তাদের ছেলে বেদান্ত অন্যদিকে মনামি তার বর, নিরঞ্জনকে নিয়ে আসবে। ম্যারেজ রেজিস্ট্রার, নিরঞ্জনের চেনা, তাই নিরঞ্জনের সাথে সন্ধ্যে নাগাদ আসবে। মনামি সকালবেলাতেই পৌঁছে ঝিলামের বাড়ি পৌঁছে যায়। ঝিলামের বাবা, বুধাদিত্যের বাবা আর রঞ্জন বাবু একটু বয়স্ক তাই তারা বসার ঘরে এসব থেকে দুরে নিজেদের মতন গল্পে ব্যাস্ত। অনিন্দিতাদি বুধাদিত্যের জন্য ধুতি পাঞ্জাবী কিনে এনেছিল, বুধাদিত্য সেই কাপড় পড়তে নারাজ, জেদ করে বসে ঝিলামের উপহার দেওয়া সুট পরে বিয়ে করবে। বাপ্পা বুবাই আর বাকি বাচ্চারা লাফালাফি দৌড়াদৌড়ি করে ঘর মাতিয়ে তুলেছে। ঝিলামের বড়দির বড় মেয়ে, সঙ্গীতা, মিউসিক সিস্টেমে গান চালিয়ে নাচ শুরু করে দিয়েছে। ওর দেখাদেখি বাকি বাচ্চারা বসার ঘর দখল করে নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে।

বুধাদিত্য, সুব্রতদা আর ঝিলামের দাদারা আর দুই জামাইবাবু ওর স্টাডিতে বসে দরজা বন্ধ করে ড্রিঙ্কস করছিল। শোয়ার ঘর মেয়েদের দখলে চলে গেছে, দেবস্মিতা ঝিলামকে নিয়ে ব্যস্ত। ঝিলামের মা আর প্রমীলাদেবী দুপুরে খাওয়ার পরে গেস্ট রুমে একটু বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু বাচ্চাদের চেঁচামেচিতে সেই ঘুমের বারোটা বেজে গেল।

প্রমীলা দেবী একবার বুধাদিত্যকে জিজ্ঞেস করে গেলেন, “এই ছোঁড়া রাতের খাবারের ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবে তো?”

বুধাদিত্য বেরিয়ে এসে উত্তর দিল, “কেন, তার ব্যাপারে তো আমি কিছু জানিনা। ওটা তো দেবীর ডিপার্টমেন্ট। ওকে জিজ্ঞেস করো।”

দেবস্মিতা , “হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক সময়ে ওঃ ক্যালক্যাটা থেকে ডেলিভারি দিয়ে যাবে, চিন্তা নেই।”

অনিন্দিতাদি বুধাদিত্যকে এসে অনুরোধ করে, “আমি তোর জন্য সাধ করে ধুতি পাঞ্জাবী এনেছি আর তুই পরবি না?”

বুধাদিত্য, “না পরবো না। ওই বারো হাতি কাপড় সামলাতে পারবো না।”

ঝিলাম ওদিক থেকে চেঁচিয়ে বলে, “আরে ওকে জোর করে কাজ নেই, বেঁকে বসলে আবার বিয়ে পিছিয়ে যাবে। দেবী এত কষ্ট করে ওঃ ক্যালক্যাটা থেকে ইলিস পাতুড়ি আর ডাব চিংড়ি অর্ডার দিয়েছে সব মাটি হয়ে যাবে।” সবাই ওর কথা শুনে হেসে ফেলে। ঝিলাম অর্ধেক সাজা নিয়ে ওর ঘরে ঢুকে আদেশ করে, “তুমি সুট পরলে আমি কিন্তু অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা ইভনিং গাউন পরবো?”

বুধাদিত্য ঝিলামের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “তোমাকে সেই ড্রেসিং গাউনে কিন্তু দারুন দেখাবে, সেটাই পরে নাও।”

ঝিলাম চোখ পাকিয়ে বুধাদিত্যের দিকে রেগে চেঁচিয়ে বলে, “আমি শেষ বারের মতন বলছি।”

ঝিলামের মা উঠে চলে আসেন। মেয়ের রুদ্র রুপ দেখে বলেন, “কেন বকাবকি করছিস? ধুতি না পরলেও চলবে, সুট পরতে চাইছে, ঠিক আছে, পরুক না, ক্ষতি কি। আজকাল অনেকেই পরে।”

ঝিলাম মায়ের ওপরে ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “তুমি চুপ করো, ওকে চেনো না। না চেঁচালে কোন কথা শোনে না। তুমি তোমার বাকি জামাইদের মতন ননীর পুতুল ভেবোনা একে।”

সুব্রতদা ঝিলামের চোখ দেখে বুধাদিত্যকে বলে, “বউ কিন্তু ক্ষেপে গেছে, এবারে গুঁতো খাবে। তাড়াতাড়ি একটা কিছু স্থির করো।”

অগত্যা বুধাদিত্য সুব্রতদাকে বলে, “দেখো বাবা আমি ধুতি পরতে জানিনা, সুতরাং পরিয়ে দিতে হবে আমাকে।” ঝিলামের দিকে তাকিয়ে বলে, “মাঝখানে যদি ধুতি খুলে যায় তাহলে...”

ঝিলাম ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “তুমি ধুতি পরে কি একশো মিটার রেস দেবে? যাবে তো সেই এই ঘর থেকে অন্য ঘর। চুপ করে পরে নাও।”

অনিন্দিতাদি ঝিলামের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল, ঝিলামের কথা শুনে বুধাদিত্যকে বলে, “বেশ হয়েছে এবারে, এই হলো একদম স্কুল টিচারের মতন কথা। এবারে ছড়ি দিয়ে মারতে বলবো।”

সুব্রতদা অনিন্দিতাদিকে বলে, “অনু, কে কাকে কোন ছড়ি দিয়ে মারবে সেটা আর বলতে হবে না।” অনিন্দিতাদি লজ্জায় পড়ে যায়।

দেবস্মিতা ওদিক থেকে ঝিলামকে ডাক দেয়, “এই মেয়ে তাড়াতাড়ি এসো, বাকিটা শেষ করি।”

বুবাই মামিকে দেখে বায়না ধরে সেও বউ সাজবে। অনিন্দিতাদি বকা দিতে যায়, দেবস্মিতা ওকে বসিয়ে দিয়ে বলে যে ঝিলামকে সাজানোর পরে বুবাইকে সাজিয়ে দেবে। বাপ্পা একবার বুধাদিত্যর ঘরে ঢুকে ওদের ড্রিঙ্কস করতে দেখে বায়না ধরে কোল্ড ড্রিঙ্ক খাবে। সুব্রতদা শেষ পর্যন্ত একটা ছোটো গ্লাসে কোল্ড ড্রিঙ্ক দেয় খেতে।

সুবিরবাবু এক বার এসে দেখে যান সবার অবস্থা, “কি হলো, সন্ধ্যে হতে চললো। কিছু পরে তো নিরঞ্জন রেজিস্ট্রারকে নিয়ে এসে যাবে। তোমাদের সাজাগোজা হয়েছে?”

দেবস্মিতা, “তোমার এত তাড়া কিসের বলতো। মেয়েদের সাজতে একটু দেরি হয়। ঠিক সময়ে সব কিছু হয়ে যাবে। পারলে কাউকে নিয়ে সি.আর.পার্ক চলে যাও, একটু দই লাগবে আর মিষ্টির অর্ডার দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো নিয়ে এসো।”

অগত্যা সুবিরবাবু বউয়ের বকা খেয়ে চুপচাপ কালীনাথকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। অনিন্দিতাদির আনা গাড় বাদামি রঙের পাঞ্জাবী পরে বুধাদিত্য। সুব্রতদা বুধাদিত্যকে ধুতি পরিয়ে দেয়, সাথে কোমরের গিঁট বেশ আঁটো করে বেঁধে দেয় যাতে খুলে না যায়। দেবস্মিতা ঝিলামের জন্য একটা লাল পাড় ঘিয়ে রঙের দামী জামদানি শাড়ি এনেছিল, সেই শাড়িতে ঝিলামকে সাজিয়ে এক অপরূপ রানীর মতন সাজিয়ে তুলেছে। দেবস্মিতা সোনার গয়নায় সাজিয়ে তুলেছে ঝিলামকে। প্রমীলাদেবী ঝিলামের জন্য সুন্দর একটি লোহাবাঁধানো এনেছিল, সেটা হাতে পরিয়ে দেয়। বুধাদিত্য ঝিলামের মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে, কাছে গিয়ে কানে কানে বলে যে রাতে পাগল করে দেবে। ঝিলাম আলতো চাঁটি মেরে বলে সবার সামনে যেন কিছু দুষ্টুমি না করে বসে। বুবাই একবার মামার মুখের দিকে তাকায় একবার নতুন মামীর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে।

সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসে। নিরঞ্জন ম্যারেজ রেজিস্ট্রারকে নিয়ে উপস্থিত। বসার ঘর লোকে লোকারণ্য। বুধাদিত্য আর ঝিলাম পাশাপাশি দাঁড়ায়। অনিন্দিতাদি একটা কুলোতে সব সাজিয়ে নিয়ে আসে, পান পাতা, প্রদীপ ইত্যাদি। প্রমীলাদেবী কালীঘাটে পুজো দিয়ে মায়ের পায়ে ছোঁয়ানো সিঁদুর এনেছিলেন, সেটা অনিন্দিতাদির হাতে দিলেন। আগে সই তারপরে সিঁদুর না আগে সিঁদুর তারপরে সই। এর মাঝে সুব্রতদা বলে যে আগে আঙটি পরানো উচিত। অনিন্দিতাদি বুধাদিত্যকে জিজ্ঞেস করে, বউয়ের জন্য আঙটি কেনা হয়েছে কিনা? বুধাদিত্য আর ঝিলাম পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করে, এখন আঙটি পরাতে হবে নাকি, এই সব তো অনেক আগেই ওরা সেরে ফেলেছে। অনিন্দিতাদি, ঝিলামের বউদিরা সবাই চেপে ধরে যে সেই আঙটি খুলে আবার নতুন করে ওদের সামনে পরাতে হবে। ঝিলাম নিজের আঙটি খুলে বুধাদিত্যের হাতে দেয়, আর ঝিলামের দেওয়া আঙটিটা বুধাদিত্যের আঙ্গুলে চেপে বসে। সেই নিয়ে সবার মধ্যে হাসাহাসি, বিয়ের আগেই বউ খাইয়ে মোটা করে দিয়েছে। অনেক কষ্টে সাবান জল দিয়ে আঙটি খোলা হয়। সুব্রতদা, ঝিলামের জামাইবাবুরা সবাই বুধাদিত্যকে চেপে ধরে যে ঝিলামের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আঙটি পরাতে হবে। ঝিলাম হেসে ফেলে বুধাদিত্যের করুন অবস্থা দেখে। “এই না না, এটা ঠিক হচ্ছে না।” “বসে পড়ো শালা, একবার আমরা দেখি।” বলে ওঠে সুব্রতদা। সেই সাথে ঝিলামের জামাইবাবুরা বলে ওঠে, “এই যে বাবু, রোজদিন তো কান ধরে উঠ বোস করায়, তা আমাদের সামনে করতে লজ্জা কিসের।” বুধাদিত্য, “আমি হাঁটু গেড়ে বসে পরিয়ে দেবো একটা সর্তে, ও যদি আমার কোলে বসে আমাকে আঙটি পরিয়ে দেয়।” সেই শুনে সবাই হেসে ফেলে। ঝিলামের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে যায়। সুবিরবাবু আর রঞ্জনবাবু হেসে বলেন যে তারা কিছু শুনতে পাননি, এবারে কানে তুলো গুঁজে বসে থাকবেন তারা। ঝিলাম বুধাদিত্যর বাজুর ওপরে চাঁটি মেরে বলে যে সব দুষ্টুমির শোধ নেবে পরে। দেবস্মিতা হাতে কুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে, ওদের মেয়েলিপনা দেখে বলে যে তাড়াতাড়ি কর, হাত ব্যাথা করছে। সেই শুনে সুবিরবাবু বলেন যে, “হে প্রিয়তমা, কুলো আর তুমি দুজনেই আমার কোলে চলে এসো।” দেবস্মিতার ফর্সা মুখ লাল হয়ে যায়। প্রমীলাদেবী দেবস্মিতাকে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলেন, “কিরে তোরটা এই বয়সেও এমন নাকি? আমারটা যদি আমার দিকে একটু চোখ মেলে দেখতো।” ঝিলাম দেবস্মিতাকে জড়িয়ে ধরে প্রমীলাদেবীকে বলে, “তুমি দেবীর কাছ থেকে কিছু সাজার টিপস নিও তাহলে মামা তোমাকে নিয়ে আবার হানিমুন যাবে।”

বুধাদিত্য যথারীতি সবার চাপে পড়ে ঝিলামের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আঙটি পরিয়ে দেয়। আঙটি পরানোর সময় সবাই চেঁচিয়ে ওঠে যে একদম ইংরাজি স্টাইলে হাতে চুমু খেয়ে আংটি পরাতে হবে। বুধাদিত্য চেঁচিয়ে বলে এবারে আর না, বউ নিয়ে পালিয়ে অন্য কোথাও বিয়ে করে নেবে। ঝিলাম ওর চিবুকে হাত রেখে ছোট্ট একটা চুমু খায়। সেই দেখে সবার হর্ষধ্বনি দিয়ে ওঠে। ঠিক করা হয় যে সই দিয়ে তারপরে সিঁদুর পরানো হবে। সই দেওয়া শেষ, কে কে সাক্ষী হিসাবে সই দেবে সেটা নিয়ে একটু প্রশ্ন ওঠে। বুধাদিত্য বলে যে, ঝিলামের বাবা, মামা আর দেবস্মিতা সাক্ষী দিলে হবে। রঞ্জনবাবু এর মাঝে বলে ওঠেন, এই যাঃ বিয়ের মন্ত্র যে পড়া হলোনা, তাহলে বিয়ে কি করে সম্পন্ন হবে। সুবিরবাবু হেসে বলেন, তিনি মন্ত্র পড়ে দেবেন। তিনি ঋগ বেদের একটা মন্ত্র উচ্চারন করে বললেন বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেছে, ব্যাস বর বধু এবারে সিঁদুর পরাতে পারে। দেবস্মিতা কুলো এগিয়ে ধরে বুধাদিত্যের দিকে। ঝিলামের মা বলেন, বাবা আঙটি দিয়ে সিঁদুর পরাতে হয়। ঝিলাম বলে ওঠে, ধুর, একটা কিছু দিয়ে পরালেই হলো। দেবস্মিতা বুধাদিত্যকে বলে যে দুই আঙ্গুলে একটু সিঁদুর তুলে ঝিলামের সিঁথিতে লাগিয়ে দিতে। বুধাদিত্য এক চিমটে সিঁদুর উঠায়, ঝিলামের ঠোঁটে হাসি, দু’চোখ ছলছল করে ওঠে। মাথা নিচু করে দাঁড়ায় ওর সামনে, বুধাদিত্য কপালে থেকে সিঁদুর মাথার মাঝখানে পর্যন্ত টেনে দেয়। দেবস্মিতা ওকে বলে যে তিন বার লাগাতে হয়। বুধাদিত্য দ্বিতীয় বার সিঁদুর নিয়ে লাগিয়ে দেয়, বেশ কিছু সিঁদুর কপাল ছাড়িয়ে গালে আর নাকে মুখ পড়ে যায়। ঝিলাম মৃদু হেসে বকুনি দিয়ে বলে যে ঠিকভাবে সিঁদুর পরাতেও জানেনা। তৃতীয়বার একটু বেশি করে সিঁদুর নিয়ে প্রথমে ওর কপালে আর সিঁথিতে লাগিয়ে দেয়, তারপরে ইচ্ছে করে বাকিটুকু ঝিলামের নাকের ওপরে আর দুই গালে লাগিয়ে দেয়। ঝিলাম খুশির জোয়ারে প্রায় কেঁদে ফেলে। গালের থেকে একটুখানি সিঁদুর হাতে নিয়ে বুধাদিত্যের গালে আর কপালে লাগিয়ে দেয়। সবাই হেসে ওঠে ওদের সিঁদুর খেলা দেখে। ঝিলামের সারা গালে কপালে সিঁদুরে লাল হয়ে গেছে, সেই সাথে বুধাদিত্যের গালে ঝিলামের সিঁদুর লেগে। ভালোবাসার আবেগে আর নিজেকে সামলাতে পারেনা বুধাদিত্য, ঝিলামকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে। সুব্রতদা চেঁচিয়ে ওঠে, “শালাবাবু, নাউ ইউ মে কিস দা ব্রাইড।” বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে যে সপ্তপদীর পরে দিদিভাইকে মন্ডপে চুমু খেয়েছিল কি না? সিঁদুরের রঙে ঝিলামের মুখখানি লাল হয়ে ছিল, সুব্রতদার কথা শুনে লজ্জায় আরও লাল হয়ে ওঠে। বুধাদিত্য বাঁ হাতে ঝিলামের কাঁধ জড়িয়ে ধরে মাথায় ঠোঁট চেপে ধরে। ব্যাস, সেই দেখে অনিন্দিতাদি বলে, “হয়ে গেছে তোর কিস দেওয়া।” খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হলো বেশ হই হুল্লোড়ে, সবাই দেবস্মিতার গুণগান করে। অবশ্য দেবস্মিতা রান্না করেনি, কিন্তু ওর পছন্দের মেনু দেখে সবাই আপ্লুত। ঝিলামের দিদিদের হোটেল পাঠিয়ে দেওয়া হলো, কারন ঝিলাম আর বুধাদিত্য এবারে নিজেদের ঘর চায়। দেবস্মিতা আর প্রমীলা দেবী মিলে সবার রাতের ব্যবস্থা করে দিল।

নিজেদের শোয়ার ঘরে ঢুকতেই বুধাদিত্য ঝিলামকে জড়িয়ে ধরে। সদ্য বিবাহিতা, অপরূপ সুন্দরী প্রেয়সীকে অনেকদিন পরে একা পেয়েছে। ঝিলাম বুধাদিত্যের বুকের ওপরে মাথা চেপে হৃদপিণ্ডের ধুকপুক শোনে অনেকক্ষণ, বড় শান্তি এই বুকের, এই আলিঙ্গনে নিরাপত্তার ছোঁয়া। বুধাদিত্যের বাহুপাশে মনের শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তে পারে ঝিলাম, আনন্দে চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু বুধাদিত্যের পাঞ্জাবির বুক ভিজিয়ে দেয়। বুধাদিত্য ঝিলামের মুখ আঁজলা করে তুলে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। চোখে জল ঠোঁটে হাসি, চেহারায় অপার ভালোবাসা নিয়ে ঝিলাম বুধাদিত্যের গলা দুই হাতে জড়িয়ে ধরে। কাজল কালো চোখের ভেতরে প্রেয়সীর ছবি এঁকে নেয় বুধাদিত্য।
প্রেয়সীর পাতলা কোমর জড়িয়ে ধরে নাকের ওপরে নাক ঘষে কানে কানে বলে, “অনেকদিন পরে খুঁজে পেলাম।”
ঝিলাম মিষ্টি হেসে বলে, “এই রকম সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি?”

বুধাদিত্যের উষ্ণ শ্বাস ঝিলামের সারা মুখ ভরিয়ে দেয়, ঠোঁট নেমে আসে গোলাপি কোমল অধরে। তিরতির করে কেঁপে ওঠে ঝিলামের ঠোঁট, অল্প ফাঁক করে আহবান জানায় দয়িতের ভালোবাসার চুম্বন। আবেগে চোখ বন্ধ হয়ে যায় ঝিলামের, বুধাদিত্যের গভীর চুম্বনে অবশ হয়ে আসে শরীর। বুধাদিত্যের উষ্ণ হাত ঝিলামের মসৃণ পিঠে আদর করে দেয়। পরনের বসন একে একে দেহ চ্যুত হতে শুরু করে। শাড়ির প্যাঁচে ঢাকা প্রেয়সীর নধর দেহপল্লব বুধাদিত্যের চোখের সামনে উন্মোচিত হয় ধিরে ধিরে। বুধাদিত্য হাঁটু গেড়ে ঝিলামের সামনে বসে পেটের ওপরে চুমু খায়। শ্বাস ফুলে ওঠে ঝিলামের। বুধাদিত্য ঝিলামের নরম পেটের ওপরে ঠোঁট চেপে ধরে। ব্লাউসে ঢাকা পীনোন্নত বক্ষ যুগল প্রবল ঢেউ আছড়ে পড়ে। নাক চেপে বুক ভরে ঝিলামের গায়ের গন্ধে হৃদয় ভরিয়ে নেয় বুধাদিত্য। নিম্নাগের কটি বস্ত্রে ঢাকা নারীত্বের দ্বার সিক্ত হয়ে ওঠে, উরু জোড়ায় কাঁপন ধরে ঝিলামের। দশ আঙ্গুলে বুধাদিত্যের মাথা খামচে ধরে মিহি সুরে কঁকিয়ে ওঠে ললনা, “সোনা আর দুষ্টুমি কোরো না, এবারে আমাকে বুকে করে নাও...”

বুধাদিত্য উঠে পড়ে মেঝে থেকে, ঝিলামকে পেছন থেকে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরে। ঘাড়ের ওপরে মুখ নিয়ে কানের লতি, গাল ঘাড় চুম্বনে ভরিয়ে দেয়। ঝিলাম পেছনে হাত দিয়ে বুধাদিত্যের মাথা টেনে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দেয়। বুধাদিত্যের পুরুষাঙ্গ ঝিলামের নগ্ন নিতম্বের মাঝে আটকা পড়ে যায়। কোমল নিতম্ব কঠিন তপ্ত শলাকার পরশে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। শরীরের শেষ বস্ত্রটুকু দেহচ্যুত হয়ে যায়।

বুধাদিত্য পাগল হয়ে যায় ঝিলামের রুপে-

“বারে বারে হেরি, চঞ্চলা হরিণী মত্ত নয়না তুমি হে কামিনী,
তুমি আছো তাই, আছে মোর হিয়া, মোর বাহুপাশে তুমি হে যামিনী।
ওই বাঁকা চোখে তাকিও না আর, মরমে জ্বলিছে আগুন তোমার,
অধরের মধু দাও গো শুধু, সেচিয়া দাও গো হৃদয় আমার।
আলুলিত ওই কুন্তলরাশি, সর্পের ন্যায় যায় যে দুলিয়া
আসো মোর প্রিয়ে, ক্রোড়ে আমার, বসে আছি আমি দু বাহু মেলিয়া।
হে গজ গামিনী, তোমার চলনে, ছলকাইয়া ওঠে মদিরা পেয়ালা,
কণ্ঠধ্বনি কর্ণরন্ধ্রে, প্রবেশিলে পরে বেজে ওঠে যে বেহালা।
ও দেহ পরতে লুকিয়ে রেখেছো, কত সহস্র বিজলীর কণা,
সুগভীর বক্ষবিদলন মাঝে, যা কিছু আছে, তাই অজানা।
পীনোন্নত বক্ষোপরি শোভিতেছে দুই কঠিন নুড়ি,
সুকোমল দুই শৃঙ্গ যে ডাকে হাতছানি দিয়া, আমি কি করি?
হে মোর প্রেয়সী, হে মোর ললনা, দূর করো মোর বুকের যাতনা,
ও রাঙা চরনে, চুম্বিয়া আজ, আমি যে মিটাবো তোমার বাসনা।
প্রতি ওই শ্বাসে স্ফীত হয়ে আসে, সুকোমল ওই বক্ষযুগল,
কামাগ্নি ধায় নাসারন্ধ্রে তায় তপ্ত শ্বাস বয় অবিরল।
নিটোল জানু দেখিয়া ভাবি যে হেরিতেছি দুই কদলি কান্ড,
ওই জানুমাঝে করিলে চিন্তন, মস্তিষ্ক হয় লন্ডভন্ড।
কুম্ভের ন্যায় দুই নিতম্ব, পশ্চাতের শোভা করিয়া বর্ধন,
হৃদয় আকুলি বিকুলি করে, করিব কুচকুম্ভ মর্দন।
হে মোর কামিনী হে মোর ললনা মিটাও আজি মোর মনের বাসনা,
হে মোর প্রেয়সী কোরো না ছলনা।”


দুই প্রেমে বিভোর নর নারী পরস্পরের আলিঙ্গনে বদ্ধ হয়ে হারিয়ে যায় পরস্পরের মাঝে। শুরু হয় এক নতুন অঙ্ক, আগের সব অঙ্ক ভুলে।


!!!!!!! দ্বিতীয় অঙ্কের সুত্রপাত !!!!!!!
 
কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী

কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী (#1)

দেবেশের পড়াতে বিশেষ মন বসছিল না। এই দুপুর বেলা কি কারুর পড়তে ভাল লাগে, কিন্তু কি করা যাবে সামনে পরীক্ষা। বাড়ির পোষা বেড়ালটা বার বার কার্নিশে বসা কাকটাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। পাশের নারকেল গাছটায় একটা কাক বাসা বেঁধেছে। বাবার কড়া হুকুম এবারে আর একবার জয়েন্ট দিতে হবে, যদি এবারে না পারে তাহলে ওকে দোকানে বসতে হবে। বড় রাস্তার মাথায় ওর বাবার খুব বড় কাপড়ের দোকান।

খোলা জানালা দিয়ে দেবেশ একমনে আকাশ দেখছিল আর ভাবছিল সুকন্যার কথা। কলেজে প্রায় সব বন্ধুদের একটা একটা বান্ধবী আছে, শুধু ওই কাউকে ঠিক করে পটাতে পারলো না। তিনতলার ছাদের ঘরে একা দেবেশ ভাবছিল কি করে সুকন্যাকে পটানো যায়। এমন কিছু আহামরি দেখতে নয় যদিও সুকন্যা। গায়ের রঙ শ্যাম বর্ণ নয় তবে ফরসা বললে একটু বেশি বলা হয়। কিন্তু চোখ দুটি বেশ টানা টানা, নাকখানি বেশ টিকালো আর ঠোঁট দুটি বেশ রসালো। কোমর পর্যন্ত চুল যেন কালো মেঘের ঢল নেমেছে।

দেবেশ বালিশের নিচ থেকে বিড়ির প্যাকেটটা বের করে একটা বিড়ি ধরালো। মাসের শুরুতে গোল্ডফ্লেক আর শেষের দিকে বিড়িতে নামতে হয়। জানালার কাছে গিয়ে একটা সুখ টান মারলো, আহ কি আরাম। বুক ভরে ধোঁয়া নিয়ে গোল করে ছাড়লো। এই সেইদিন, সোমেন ওকে রিং বানানো শিখালো কলেজের ক্যান্টিনে বসে।

ধিরে ধিরে দেবেশের চোখ গেল সামনের বাড়ির দুতলার খোলা জানালার দিকে। ওটা মানব জ্যাঠার বাড়ি, মানব জ্যাঠা ওদের সম্পর্কে কেউ নয় তবে পাড়াতুতো জ্যাঠা। বাবার সাথে বেশ দহরম মহরম, আর জেঠিমার একমাত্র ছেলে প্রদিপ কাজের সুত্রে বাইরে তাই ওর দাম আরও বেশি ওই বাড়িতে। মাঝে মাঝেই ডাক পড়ে দেবেশের, বাবা এটা নিয়ে আয় বাবা ওটা নিয়ে আয়।

ঘরের ভেতরটা ওপর থেকে বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। মনিদিপাদি এই স্নান সেরে গায়ে গামছা জড়িয়ে ঘরে ঢুকেছে। মনিদিপাদিকে ওই অবস্থায় দেখে তো দেবেশের চোখ ছানা বড়া। তন্বি শরীরের সাথে লেপটে রয়েছে ভিজে লাল গামছা। নিটোল পাছা, সরু কোমর আর চওড়া পিঠের ওপরে চোখ গেল দেবেশের। গায়ের মসৃণ ত্বকের ওপরে যেন মাছি বসলে পিছলে যাবে। একটু ফর্সা রঙ মনিদিপাদির। ঘাড়ের ওপর থেকে চুল সরিয়ে সামনের দিকে করে মাথা মুছছে মনিদিপাদি। জানালার দিকে পিঠ তাই দেবেশ ঠিক করে ওর গোল মুখ আর নিটোল স্তন দুটি দেখতে পারছেনা। কিন্তু সুগোল পাছার খাঁজ দেখে দেবেশের প্যান্টের ভেতরের বাবাজি একদম খাড়া। অজান্তেই হাত চলে গেল টানটান হয়ে থাকা বাবাজির ওপরে। প্যান্টের ওপর দিয়েই মনিদিপাদির পাছা দেখে দেবেশ নিজের বাবাজিকে নাড়াতে শুরু করলো।

এই দুপুর বেলা কেউ যে ছাদে থাকবে সেটা মনিদিপা কল্পনা করতে পারেনি। দেবেশ দেখলো, মনিদিপাদি কিছুক্ষণ পরে হাতের তালুতে কিছু একটা ক্রিম নিয়ে নিজের পায়ে লাগাচ্ছে। পুরুষ্টু থাই দেখে দেবেশ তো আরও হতভম্ব। কলা গাছ যেন এর চেয়ে পাতলা এমন মাংসল থাই আর কি মসৃণ দেখতে। দিনের আলো যেন পিছল খাচ্ছে চামড়ার ওপর দিয়ে। সামনের দিকে একটু ঝুঁকে মনিদিপাদি পায়ের পাতা থেকে হাঁটু অবধি ক্রিম মাখলো, তারপরে আর একটু ক্রিম নিয়ে থাইয়ের ওপরে। এক এক করে দুই পায়ে মাখার পরে, মনিদিপাদি ক্রিম নিয়ে দুপায়ের মাঝে হাত দিয়ে বেশ আলতো করে বোলালো। দেবেশ ঠিক বুঝতে পারলো যে মনিদিপাদি হাতের তালু দিয়ে যোনির ওপরে হাত বোলাচ্ছে। এই সব দৃশ্য দেখে দেবেশের তো প্রায় হয় হয় অবস্থা। দেবেশ বিড়ি খাওয়া ভুলে মনিদিপাদির শরীরটাকে গোগ্রাসে গিলছে। এইরকম অবস্থায় মনিদিপাদিকে কোনদিন দেখেনি ও। দুপুর বেলা তো ও বাড়িতেই থাকেনা।

কিছু পরে দেবেশ দেখলো যে মনিদিপাদি জানালার দিকে ঘুরলো। দেবেশের মুখ থেকে হটাত করে অস্ফুট উফ... আওয়াজ বেরিয়ে গেল। দুটি গোল গোল নিটোল স্তনের ওপরে ভিজে গামছা লেপটানো, স্তনের বোঁটা দুটি তো ফুলে ফেটে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। স্তন যেন মাংস পিন্ড নয়, যেন দুটি শৃঙ্গ, যেমন কোমল তেমন নিটোল। পেটের ওপরে চোখ গেল দেবেশের, বেশ গোলগাল পেট, তার মাঝে সুগভীর নাভিদেশ। দেবেশ তো আর চোখ সরাতে পারছে না মনিদিপাদির শরীরের ওপর থেকে। পলক ফেলতেও বাধা বোধ করছে দেবেশ, যদি কিছু দৃশ্য অদেখা রয়ে যায় সেই আশঙ্কায়। দু' পায়ের ফাঁকে, ঠিক যোনির ওপরে ভিজে গামছা লেপটে একাকার। দেখে মনে হলো একটু চুল থাকলেও থাকতে পারে মনিদিপাদির যোনির কাছে। দুহাত মাথার ওপরে তুলে মনিদিপাদি চুলগুলো মাথার ওপরে চুড় করে বাঁধলো। মাথার ওপরে হাত ওঠানোর ফলে, সুগোল স্তন দুটি যেন আরও ফুলে ফেঁপে উঠলো। বগলে একফোঁটা রোম নেই মনিদিপাদির। দেবেশ ভাবলো ওই বগলে একবার মুখ দিতে পারলে জীবন ধন্য হয়ে যাবে।

বেড়ালটা এখন কাকের সাথে পাল্লা দিচ্ছে। বেড়ালের আওয়াজ শুনে মনিদিপার চোখ গেল ছাদের ওপরে। দেখলো যে দেবেশ ওর দিকে নিস্পলক ভাবে তাকিয়ে দেখছে। মনিদিপা নিজের উলঙ্গ শরীর আর তার ওপরে দেবেশের লেলিহান দৃষ্টিপাত দেখে ঘাবড়ে গেল। চকিতে জানালার পাল্লা ঠেলে দিয়ে বন্ধ করে দিল।

দেবেশ ধরা পড়ে গেছে। ওর মাথা ঘুরছে বনবন করে, ভয়ে নয়, আসন্ন বীর্যপাতের জন্য ও নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলো না। প্যান্টের চেন খুলে বাবাজিকে বের করার আগেই বাবাজি বমি করে দিল। লিঙ্গ চেপে ধরে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো দেবেশ। আর কি পড়াশুনা করা যায়, চোখের সামনে সুন্দরী তন্বি মনিদিপাদির উলঙ্গ শরীর ভেসে বেড়াচ্ছে। সুন্দর সুগোল স্তন, কি সুন্দর নিটোল পাছা, পাতলা কোমর আর পুরুষ্টু থাই। ওই দুই পায়ের ফাঁকের কথা মনে পড়লেই দেবেশের বাবাজিবন আবার খাড়া হয়ে যাচ্ছে।

“এই যে বাবু ওঠ, সন্ধ্যে হয়ে গেছে।” বাড়ির চাকর, জীবন কাকার ডাক শুনে দেবেশের ঘুম ভাঙলো। দেবেশ কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল সেটা আর ওর মনে নেই। নিচে নেমে দেখে যে জেঠিমা আর মা বসার ঘরে বসে চা খাচ্ছে আর পাড়ার লোকদের নিয়ে পরনিন্দা পরচর্চা করতে ব্যাস্ত। একবার ভাল করে দেখে নিলো যে মনিদিপাদি আছে কিনা। না, মনিদিপাদিকে না দেখে একটু শান্তি পেল। ওর সামনে যাবার সাহস নেই দেবেশের, দুপুরে অনেকটা সময় ধরে মনিদিপাদির উলঙ্গ শরীর দুচোখ ভরে পান করেছে।

“কি রে দুপুরে ঘুমিয়ে পড়লি, তোর কলেজ যাওয়াই ঠিক।” ওর মা ওকে দেখে বললো।

“না গো কাকি, কলেজে গিয়ে কি পড়াশুনা করবে ও!” পেছন থেকে মনিদিপাদির গলার আওয়াজ শুনে দেবেশ চমকে গেল। ওর কান মাথা গরম হয়ে গেল। এই বুঝি বাড়ির সব কাচের জানলা ঝনঝন করে ভেঙে যাবে। মনিদিপাদির দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না দেবেশ, কথা বলা তো দুরের কথা। মাথা নিচু চোখ বন্ধ করে পাথরের মতন ঠায় দাঁড়িয়ে। মনিদিপাদি ঠিক দেবেশের পেছনে দাঁড়িয়ে, ওর নাকে মনিদিপাদির সুন্দর গন্ধ ভেসে আসছে।
 
কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী (#2)

কাঁধের ওপরে হাত রাখলো মনিদিপাদি, ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো, “কি রে ছেলে, দুপুরে মনে হয় অনেক পড়াশুনা করেছিস তুই।”

ওর দিকে না তাকিয়েই আমতা আমতা করে উত্তর দিল দেবেশ, “না মানে আমি ওপরে....”

মাথার চুলে বিলি কেটে মনিদিপাদি ওকে বললো, “ঠিক আছে রে বাবা, অত ভাবার কি আছে...” তারপরে আওয়াজ নিচু করে কানে কানে বললো, “রাতের বেলা ছাদ টপকে চলে আসিস, তোর সাথে কথা আছে।”

মনিদিপাদির আস্বস্ত আহ্বান শুনে ধড়ে প্রান ফিরে এল দেবেশের। মুখ তুলে তাকালো দেবেশ মনিদিপাদির দিকে। মনিদিপাদির চোখে এক অদ্ভুত আগুন, ঠোঁটে লেগে আছে এক দুষ্টুমির হাসি। সাদা রঙের ট্যাঙ্ক টপ আর লম্বা স্কার্ট পরে আছে মনিদিপাদি। বুক দুটি যেন ফুলে ফেঁপে ফেটে বের হচ্ছে, ব্রার দাগ পরিস্কার দেখা যাচ্ছে এমন কি লাল রঙের ব্রার স্ট্রাপটাও কাঁধের পাশ থেকে উঁকি মারছে। সারা গা থেকে মমমম করা মন মাতানো এক সুগন্ধ। নধর পাছা দুলিয়ে হেঁটে চলে গেল মনিদিপা, দেবেশের মুখ হাঁ করে চেয়ে রইলো চলে যাওয়া মনিদিপাদির পাছার দুলুনির ওপরে।

রাত কতক্ষনে আসবে সেই চিন্তায় আর সময় কাটতে চায়না দেবেশের। রাতের খাবার কোন রকমে খেয়ে সোজা ছাদের ঘরে চলে গেল দেবেশ। বুকের ভেতরে হাঁপর টানছে যেন, কি হবে রাতে, কি করবে মনিদিপাদি ওর সাথে। উম্মম... যদি একবার ওই নধর পাছার ওপরে একটু হাত বোলানো যায় বা বুকের দুধ দুটো একটু হাতে নিয়ে খেলা করা যায় তাহলে দেবেশের তো পোয়াবারো।

এক এক করে বাড়ির সব আলো বন্ধ হলো, আকাশের তারা ঝকমক করছে। কি করবে কি করবে এই ভাবতে ভাবতে, মই লাগিয়ে এবাড়ি থেকে ও বাড়ির ছাদে লাফ দিল দেবেশ। সিঁড়ির ঘরের দরজা তো বন্ধ তাহলে কি করে? এমন সময়ে দরজা খোলার আওয়াজ শুনতে পেল দেবেশ।

“কি রে কখন এল তুই?” ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো মনিদিপা।

দেবেশের মুখ তুলে তাকাতে লজ্জা করছে, তাই না তুলেই উত্তর দিল, “এই মাত্র এলাম।”

চিবুকে আঙুল রাখল মনিদিপা, “কি হয়েছে তোর? এই রকম করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”

“না মানে...” কথাটা শেষ করতে পারলো না দেবেশ, খিল খিল করে হেসে উঠলো মনিদিপা। কাঁপা স্বরে উত্তর দিল, “আমি ভয়ে ছিলাম যে তুমি যদি মাকে বা জেঠিমাকে বলে দাও তাহলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে।”

“ধুর বোকা ছেলে...” দেবেশের হাত ধরে নিচে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে আসে মনিদিপা।

“তুমি সত্যি মাকে বলে দেবেনা?” এই প্রথম চোখ তুলে তাকালো মনিদিপাদির মুখের দিকে। মনিদিপাদি ঠিক ওর সামনে দাঁড়িয়ে। দেবেশের মুখের সামনে মনিদিপার সুগোল স্তন থল থল করছে। শুতে যাবার আগে ব্রা পরেনি মনিদিপা, স্তনের বোঁটা টানটান হয়ে ট্যাঙ্ক টপের ভেতর থেকে নিজেদের জানান দিচ্ছে। বিছানার ওপর একটু নড়ে চড়ে বসলো দেবেশ। মুখের সামনে রসালো ফল দেখলে যেমন শিয়াল হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, ঠিক সেই রকম ভাবে মনিদিপাদির বুকের দিকে তাকিয়ে দেবেশ।

মনিদিপা বেশ বুঝতে পারলো যে দেবেশের চোখ ওর বুকের প্রত্যেক বাঁক নিরীক্ষণ করে চলেছে। ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললো, “না রে... বলবো না... একটা কথা বল আমাকে?” দেবেশ বুক থেকে চোখ তুলে মনিদিপার মুখের দিকে তাকালো। মনিদিপা জিজ্ঞেস করলো, “তোর কোন গার্লফ্রেন্ড নেই?”

মাথা নাড়ালো দেবেশ, “না নেই?” তারপরে একটুখানি থেমে থেকে বললো, “মনিদি, তুমি না দেখতে ভারী সুন্দরী।”

“ধ্যাত! ইয়ার্কি মারা হচ্ছে আমার সাথে”, মনিদিপা ওর গালের ওপরে একটা টুসকি মেরে বললো।

“না গো মনিদি তুমি না সত্যি ভারী সুন্দরী।” দেবেশ আর যেন থাকতে পারছেনা।

“যাক অনেক হয়েছে, যা গিয়ে ওই চেয়ারে বস।” মনিদিপা ওকে একটা চেয়ার টেনে বসতে বললো আর নিজে উঠে গেল বিছানার ওপরে। হাঁটা চলায় মনিদিপার স্তনের দুলুনি দেখে দেবেশের বাবাজি আবার খাড়া। মনিদিপা একবার আড় চোখে দেখে নিলো দেবেশকে তারপর সামনের দিকে ঝুঁকে ওর দিকে পেছন করে বিছানার ওপর থেকে কিছু আনার ভান করলো।
চোখের সামনে, স্কার্টের নিচে সুন্দর সুগোল পাছা দেখে বুকটা ধক করে উঠলো দেবেশের। মনে হলো যেন এই লাফিয়ে পড়ে মনিদিপাদির ওপরে আর ছিঁড়ে কুটে নিংড়ে মুচড়ে দলা পাকিয়ে সব রস বের করে নেয় ওর শরীর থেকে।

কিছুক্ষণ পরে মনিদিপাদি ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি রে ওইরকম করে কি দেখছিস? আগে কোন দিন মেয়ে দেখিসনি।”

আমতা আমতা করে উত্তর দিল দেবেশ, “দেখেছি অনেক মেয়ে কিন্তু এত কাছ থেকে দেখিনি।”

“আর কি দেখেছিস মেয়েদের?” জিজ্ঞেস করলো মনিদিপা।

“না গো বিশেষ কিছু দেখার তো সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি আমার।” মুখ বেঁকিয়ে হেসে উত্তর দিল দেবেশ।

“আমাকে তো চুপিচুপি ছাদ থেকে দেখেছিস, তাই না।” দুষ্টুমির হাসি লেগে আছে মনিদিপার মুখে।

লাল হয়ে গেল দেবেশের মুখ, “না মানে বিশেষ কিছু দেখিনি তবে শুধু তুমি আর তুমি আমার মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”

“তাই নাকি রে? কিছু না দেখেই এত, তাহলে দেখলে কি করবি?” খিল খিল করে হেসে ফেললো মনিদিপা।

দেবেশ তো থ, মনিদিপাদি ওকে দেখাবে নাকি সত্যি, কথাটা যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা। হাঁ করে তাকিয়ে রইলো মনিদিপাদির দুষ্টুমি মাখানো চোখ দুটির দিকে। মনিদিপার চোখ সোজা দেবেশের চোখের ওপরে। দেবেশ ভাবছে মেয়েরা কিনা করতে পারে, দেখা যাক খেলা কত দূর এগোয়।

“হ্যাঁ রে, মেয়েরা কি শুধু ভোগের বস্তু?” হটাত দেবেশকে জিজ্ঞেস করলো মনিদিপা।

এই প্রশ্নের ঠিক উত্তর খুঁজে পেলনা দেবেশ, কি উত্তর দেবে। ওর সামনে ওর কামনার দেবী দাঁড়িয়ে যদি ওকে এইরকম প্রশ্ন করে তাহলে কি উত্তর দেবে দেবেশ।

“কি হলো, মুখের কথা কি মুখেই থেকে গেল।” হা হা করে হাসিতে ফেটে পড়লো মনিদিপা। “আমি তো এমনি তোর সাথে মজা করছিলাম রে।”
 
কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী (#3)

বিছানা থেকে নেমে এসে দেবেশের সামনে এসে দাঁড়ালো মনিদিপা। মনিদিপাদির কথা শুনে দেবেশের সব কিছু তালগোল পাকিয়ে গেল, হাঁ করে চেয়ে রইলো মনিদিপাদির মুখের দিকে। প্যান্টের ভেতরে লিঙ্গটি এতক্ষণ লোহার মতন শক্ত ছিল কিন্তু ওর হাসিঠাট্টা শুনে সবকিছু কেমন যেন হয়ে গেল।

“তুই আমার দিকে ওইরকম ভাবে তাকিয়ে আছিস কেন রে? কিছু বল।” মনিদিপা জিজ্ঞেস করলো দেবেশকে।

মাথা চুলকে উত্তর দিল দেবেশ, “কিছু না, আমি মানে....” চেয়ার ছেড়ে মনিদিপার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো দেবেশ, “তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারি মনিদি?”

মনিদিপা চুপ করে এক পা পেছনে সরে আসে। মনের মধ্যে একটা অজানা ভয় দানা বাঁধে দেবেশের, কি করবে জড়িয়ে ধরবে না চুপ করে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে যে ওর মনিদিপাদি ওর সাথে কি করে।

মনিদিপা ওর দিকে দু হাত বাড়িয়ে দিল, “আয় না, কিন্তু শুধু জড়িয়ে ধরবি আর কিছু না। আমি জানি তোর শয়তান মন কি লুকোচুরি খেলছে।”

দুবাহু খোলা, সামনে উদ্ধত স্তন আর ট্যাঙ্কটপ ফাটিয়ে স্তনের বোঁটা ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। দেরি করলোনা দেবেশ। দু হাত দিয়ে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরলো সাধের মনিদিপাদিকে। মনিদিপা দু হাত দিয়ে দেবেশের গলা জড়িয়ে ধরলো আর নিজেকে ঠেলে দিল দেবেশের বুকের ওপরে, পিষে দিল নিজের সুগোল স্তন যুগল। বুকের ওপর পিষে গেল সুগোল নরম স্তন, গরম ছোঁয়া পেয়ে দেবেশের লিঙ্গ বাবাজি আবার শক্ত হয়ে উঠেছে। স্তনের বোঁটা শক্ত নুড়ি পাথরের মতন দেবেশের বুকে বিঁধছে। সরু কোমরের ওপর দেবেশের হাত, আরও জড়ো করে নিবিড় করে নিলো আলিঙ্গন। লিঙ্গের ওপরে মনিদিপাদির নরম তুলতলে পেট চাপ দিচ্ছে। থাকতে পারছে না দেবেশ। দেবেশ ইচ্ছে করেই হাত নামিয়ে আনলো মনিদিপার নরম গোল পাছার ওপরে। মনিদিপা দেবেশের দিকে মুখ তুলে তাকালো, ঠোঁটে লেগে আছে দুষ্টুমির হাসি।

“না এত তাড়াতাড়ি নয়। তোকে অনেক কিছু শিখাতে হবে।” গলা ছেড়ে দেবেশের হাত দুটি ধরে পাছা থেকে আবার কোমরে নিয়ে আসে মনিদিপা। “নিজেকে শান্ত করতে শেখ আগে, নারীর শরীরকে ভোগের জন্য না ভেবে, ভাব একটা সুন্দর ফুল। আলতো করে ধর আর নারীর কোমল ছোঁয়াকে উপভোগ কর।”

মনিদিপাদি কি বলতে চাইছে তার কিছুই বুঝতে পারলো না দেবেশ। হাঁ করে তাকিয়ে আছে ওর মুখের দিকে। ওদিকে নিচের তলার বাবাজিতো তুলতুলে পেটের চাপে এই করে কি সেই করে অবস্থা।

“আমাকে ছাড় এখন, একটু দুরে গিয়ে দাঁড়া।” মনিদিপা ওর আলিঙ্গন ছাড়িয়ে দু’পা পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। দেবেশ প্রতীক্ষা করছে পরবর্তী আদেশের।

“গেঞ্জি প্যান্ট খুলে ফেল আগে...” একটু নরম সুরে আদেশ করলো মনিদিপাদি।

দেবেশ যেন এক অদ্ভুত ঘোরে আচ্ছন্ন, আস্তে আস্তে গেঞ্জি খুলে ফেললো। মনিদিপার চোখে চমক লাগলো দেবেশের পেটানো বুকের ছাতি দেখে। দেবেশের হাত চলে গেল প্যান্টের বোতামে, এক এক করে খুলছে আর মনিদিপাদির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মনিদিপার চোখে আগুন কিন্তু সংযত আগুন। দেবেশের বুকের মধ্যে ধিকধিক করে জ্বলছে কামনার আগুন। বোতাম খুলে প্যান্টটা কোমর ছাড়িয়ে মাটিতে নেমে গেল, পরনে শুধু জাঙ্গিয়া। কি করবে কি করবে, জাঙ্গিয়ার ভেতরে লিঙ্গটা একদম শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লিঙ্গের লাল মাথা জাঙ্গিয়ার ওপর থেকে উঁকি মারছে। লৌহ কঠিন লিঙ্গ দেখে মনিদিপার যেন জিভে জল এল, একদম আনকোরা লিঙ্গ এখন পরিপক্ক হয়নি। দেবেশ দাঁড়িয়ে আছে শুধু মাত্র জাঙ্গিয়া পরে।

তর্জনী নাড়ালো মনিদিপা “ওটাও খুলে ফেল এবারে, পুরো উলঙ্গ হয়ে যা।”

মনিদিপাদির আদেশ অমান্য করতে পারলো না দেবেশ, আস্তে আস্তে করে জাঙ্গিয়াটা কোমর ছাড়িয়ে হাঁটু ছাড়িয়ে নামিয়ে দিল। দেবেশ এই প্রথম কারুর সামনে পুরো উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে, সারা শরীর দিয়ে যেন আগুনের হল্কা বের হচ্ছে। কপালে ঘাম ছুটছে, সারা শরীর ঘামিয়ে গেছে। দুই হাত দিয়ে নিজের লিঙ্গ ঢেকে নিলো দেবেশ।

“বুক ভরে নিঃশ্বাস নে, মনটাকে শান্ত কর।” আদেশ দিল মনিদিপা।

বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো দেবেশ, কিন্তু মন যে আর শান্ত হতে চায় না। আবার নিলো, বারে বারে নিলো, হ্যাঁ একটু হাল্কা লাগছে দেবেশের। এবারে কি করনীয় তাই ভাবছে।

“সামনে থেকে হাত সরা, আমি দেখতে চাই তোর শক্ত ওটাকে...” মনিদিপার আদেশের সাথে সাথে চোখের আগুনে দেবেশ ঝলসে উঠছে। হাত সরিয়ে নিলো দেবেশ, টং করে লিঙ্গটা মনিদিপার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে গেল। লাল মাথাটা ভিজে উঠেছে।

কাঁপা আওয়াজে জিজ্ঞেস করলো, “আমি ন্যাংটো আর তুমি তো সব পরে, বাঃ রে এটাতো ঠিক হলো না।”

হেসে ওঠে মনিদিপা, গোলাপি ঠোঁটের আড়াল থেকে মুক্তোর মতন সাজানো দুপাটি দাঁত চমকে উঠলো, “বাপরে ছেলের তাড়া দেখ। আমি না বড়, আমার কথা তো আগে শুনবি তবে না মজা।”

মনিদিপা আস্তে আস্তে করে ট্যাঙ্কটপের নিচে হাত দিল, ধিরে ধিরে করে উঠাতে শুরু করলো টপ। দেবেশ হাঁ করে দেখছে সাধের মনিদিপাদির গোল পেট, একটু একটু করে উন্মোচিত হলো সুগভীর নাভিদেশ, আরও ওপরে উঠছে টপ, স্তনের ওপর দিয়ে একটানে খুলে ফেললো মনিদিপা। কোমরের ওপরে পুরোপুরি অনাবৃত মনিদিপা। দেবেশ হাঁ করে দেখছে, মনিদিপার সুগোল কোমল স্তন দুখানি, কালচে বাদামি রঙের স্তনের বোঁটা একদম ফুলেফুটে আছে, দুখানি স্তন যেন কাঞ্চনজঙ্ঘা শৃঙ্গ। গায়ের রঙ যেন মাখনের মতন, ঘরের আলোও ওই ত্বকে পেছল খাচ্ছে।

দুই হাত দিয়ে নিজের বুকের ওপরে আলতো করে বুলিয়ে নিয়ে দেবেশের দিকে মিষ্টি হেসে মনিদিপা জিজ্ঞেস করলো, “কিরে কেমন দেখছিস?”

কি বলবে দেবেশ, এত সুন্দর নারীকে এত কাছ থেকে দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্য ওর তো কোনদিন ঘটেনি। স্থানুর মতন দাঁড়িয়ে গরুর মতন মাথা নাড়লো দেবেশ। দেবেশের মুখ থেকে যেন জল পড়ছে, লিঙ্গটা চড়ক গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমতা আমতা করে উত্তর দিল দেবেশ, “মনিদি... আমি পাগল হয়ে যাবো গো...”

“পাগল তো তুই আমাকে করবি, সেই জন্য তো তোকে তৈরি করছি রে...” ঠোঁটে কামনার হাসি, চোখে আগুন নিয়ে বললো মনিদিপা।
 
কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী (#4)

কোমরে হাত দিল মনিদিপা, একটু একটু করে স্কার্টের এলাস্টিক নিচে নামতে থাকে। প্রথমে তলপেট তার পরে দেখা দিল হাল্কা রোমের আভাস, আরও নিচে নামছে স্কার্ট। দেবেশের হাত চলে গেল লিঙ্গের ওপরে, শক্ত মুঠিতে ধরে রইলো কঠিন লিঙ্গটিকে। স্কার্ট আরও নেমে যাচ্ছে, বেরিয়ে এল লাল ছোটো প্যান্টি। ফর্সা গায়ের রঙ তার ওপরে লাল প্যান্টিটা বেশ মানিয়েছে। কোমর একটু নাড়িয়ে স্কার্টটি মাটিতে ফেলে দিল মনিদিপা। পরনে শুধু মাত্র একটি ছোটো লাল প্যান্টি যা শুধু মাত্র কোন রকমে যোনি দেশ ঢেকে রেখেছে। আর থাকতে পারলো না দেবেশ, নিজের মুঠির মধ্যে লিঙ্গটিকে নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করে দিল।

মনিদিপা হেসে বললো, “করিস কি রে, সব কিছু তো শেষ হয়ে যাবে তাহলে...”
কঁকিয়ে উত্তর দিল দেবেশ, “না গো আর পারছিনা ধরে রাখতে.. তুমি যা দেখাচ্ছো তাতে আমার শুধু মাত্র দেখেই হয়ে যাবে গো..”

দু হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকল মনিদিপা, “আয় তোর মনিকে একটু জড়িয়ে ধরবিনা...”
ছুটে গেল দেবেশ, দুহাতে জড়িয়ে ধরলো সাধের মনিদিকে। মনিদিপার পেটের ওপরে দেবেশের গরম কঠিন লিঙ্গ মোচড় দিচ্ছে, প্যান্টিটা যোনির রসে ভিজে উঠেছে। নিজেকে সামলানোর জন্য নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো মনিদিপা। দেবেশের বুকে মাথা রেখে দুহাতে দেবেশকে জড়িয়ে ধরলো।

দেবেশের পেশী বহুল ছাতির ওপরে পিষ্ট হয়ে গেল মনিদিপার কোমল বুক জোড়া, স্তনের বোঁটা যেন দুটি উত্তপ্ত নুড়ি পাথর। দেবেশ নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলো না। মনিদিপাকে ঠেলে বিছানার ওপরে শুইয়ে দিল আর নিজে ওর ওপরে চড়াও হয়ে গেল। কঠিন লিঙ্গটি সোজা গিয়ে ঘসা খেল ঢেকে থাকা যোনির ওপরে। নগ্ন লিঙ্গের ওপরে দেবেশ অনুভব করলো মনিদিপার সিক্ততা। প্যান্টি ভিজে জবজব করছে।

“আস্তে রে, তাড়াহুড়ো করছিস কেন তুই...” পিঠের ওপরে নখের আলতো আঁচড় কেটে বললো মনিদিপা।

“আমি আর পারছিনা গো মনিদি...” গোঙানো স্বরে বলে উঠলো দেবেশ। কোমর নাড়াতে শুরু করলো সাথে সাথে মনিদিপার যোনির ওপরে ঘর্ষণ খেতে শুরু করলো কঠিন লিঙ্গ।
অস্ফুট স্বরে কঁকিয়ে উঠলো মনিদিপা, “আস্তে আস্তে... প্লিস... একটু আস্তে কর... আমি পুরো অনুভব করতে চাই তোকে...”

“কি করবো মনিদি?” জিজ্ঞেস করলো দেবেশ, “আজ থেকে আমি তোমার গোলাম...”

উত্তর দিল মনিদিপা, “আজ শুধু তুই আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাক, কিছু করতে হবে না তোকে...”

দেবেশ বললো, “আমি যে আর পারছিনা মনিদি। আমার যে হয়ে যাবে...” দেবেশ লিঙ্গ দিয়ে ধিরে ধিরে চাপ দিচ্ছে মনিদিপা যোনির ওপরে। ভিজে প্যান্টি চেপে ঢুকে গেছে মনিদিপার যোনির চেরায়, ফোলা ফোলা দুটি পাপড়ির মাঝে। দেবেশ নগ্ন লিঙ্গের ওপরে মনিদিপার পাপড়ি অনুভব করলো। মনিদিপার যোনি অনুভব করলো দেবেশের কঠিন লিঙ্গ, দেবেশ কাঁপছে মনিদিপার নিবিড় কামঘন আলিঙ্গনে। আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলোনা, ভলকে ভলকে বীর্যপাত ঘটিয়ে দিল দেবেশ।

সারা শরীরের সব শক্তিটুকু নিংড়ে নিয়ে দুইহাতে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরলো কামিনী মনিদিপাকে। মনিদিপার যোনিতে বান ডেকেছে, দশটা নখ বসিয়ে দিল দেবেশের পিঠের ওপরে। অস্ফুট শীৎকার করে উঠলো মনিদিপা, “ফেলে দে, তোর মনিদির পেটের ওপরে ফেলে দে তোর যা আছে... আমার শরীর তোর...”

“আহ আহ আহ... মনিদি তুমি আমাকে স্বর্গে নিয়ে গেলে যে...” কম্পিত গলায় শীৎকার করে উঠলো দেবেশ। বুকের ওপরে মাথা রেখে এলিয়ে পড়লো। মনিদিপা হাত বুলাতে লাগলো নিঃশেষ দেবেশের পিঠের ওপরে। ধিরে ধিরে শ্বাস আয়ত্তে এল দুজনার। শক্তিহীন দেবেশ এলিয়ে পড়ে আছে মনিদিপার বুকে মাথা রেখে আর মনিদিপা আঙুল দিয়ে ওর মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে ঘুমিয়ে পড়লো।

বাচ্চা ছেলের মতন সুন্দর মুখখানির দিকে তাকিয়ে মনিদিপা ভাবল, “কি যে ভুল করলাম এই ছেলেটাকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে, এর যে কি পরিণতি হবে ভগবান জানে।” দেহের ক্ষুধা মেটানোর জন্য কামনা তাড়িত মনিদিপা দেবেশকে নিজের ছলাকলায় জড়িয়ে নিয়ে পাড়ি দিয়েছে এক অজানা দিগন্তে।

ভোরের আলো ফোটার আগেই মনিদিপা ঘুম থেকে তুলে দিল দেবেশকে, “এই ছেলে ওঠ... আমাদের এই রকম ভাবে কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”

চোখ খুললো দেবেশ, কামঘন আলিঙ্গনে সারা রাত দুই নর নারী কাটিয়ে দিল। কপালে একটা ছোট্ট চুমু খেয়ে মনিদিপা বললো, “আজ থেকে তোর হাতেখড়ি শুরু, রোজ রাতে আমরা নতুন খেলা খেলব...”

গালে গাল ঘষে জিজ্ঞেস করলো দেবেশ, “তুমি এত সব জানলে কি করে!”

ফিসফিস করে উত্তর দিল, “আমার কাছে না একটা কামাসুত্রার বই আছে, সেইখান থেকে সব পড়েছি।”

নাকে নাক ঠেকিয়ে বললো দেবেশ, “ও বাঃবা মেয়ের দেখছি অনেক জ্ঞান!”

“যাঃ আমি তো শুধু জ্ঞান নিয়েছি তুইতো একদম প্রথমেই আমাকে দিয়ে ফিতে কেটে নিলি...” উত্তর দিল মনিদিপা, “কেউ জেগে যাবার আগে যা এবারে। রাতে আসিস আবার শুরু করবো আজ যেখানে শেষ করেছি।”

দেবেশ প্যান্ট গেঞ্জি পরে ঠিক যেই রকম ভাবে ছাদ টপকে এসেছিল, ঠিক সেইরকম ভাবে আবার চলে গেল।

সারাদিন মাথার মধ্যে শুধু মনিদি আর মনিদি ঘুরে বেড়ালো, না পড়াতে মন বসে না খাওয়াতে। কলেজেও ঠিক ভাবে ক্লাস করতে পারলো না দেবেশ।

সেইরাত থেকে শুরু হলো মনিদিপাদি আর দেবেশের রতি খেলার প্রথম ধাপ। প্রথমে শুধু মাত্র চুমু খেতে শিখালো মনিদিপা, কি রকম ভাবে মেয়েদের শরীরের নানান অঙ্গ প্রত্যঙ্গে চুমু খেতে হয়। মনিদিপা নিজের প্যন্টি খোলেনি একবারে জন্যও, দেবেশকেও এখন পর্যন্ত হাত লাগাতে দেয়নি নিজের যোনির কাছে। এইভাবে চুমুর খেলা চললো দিন চারেক, বেশ পোক্ত হয়ে উঠছে দেবেশ এই নতুন খেলায়। দিনে দিনে মনিদিপার মনের কোনে যা কামনার আগুন ছিল তা এক এক করে পূরণ করতে থাকলো দেবেশ।

পঞ্চম রাতে, দেবেশ মনিদিপাকে জিজ্ঞেস করলো, “মনিদি, তুমি কি করতে চাইছ বলতো, শুধু মাত্র আমি তোমার সারা শরীরে চুমু খেয়ে বেড়াবো আর তুমি মজা নেবে? আমি নিজের মজা কবে নেব।”
 

Users who are viewing this thread

Back
Top