Chapter 7: তমসা উদ্ঘাটন। (#2)
অভির হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো, “কেন এসেছে তোমার মা?”
এই প্রশ্ন শুনে সবাই অভির দিকে তাকিয়ে। অভি কি উত্তর দেবে ভেবে পেলনা, চুপ করে থাকে।
সুব্রতঃ “আমাকে বলতে দে। আমি হলফ করে বলতে পারি যে আমাদের ফ্যামিলির মধ্যে যা কিছু ঘটেছে তার জন্য আমার দিদিরা; ইন্দ্রানিদি আর চন্দ্রানিদি দায়ী। বড় লোকের বাড়িতে বিয়ে হয়ে যাবার পরে দেমাকে ওদের পা আর মাটিতে পড়ে না। অতীতে যারা আমাদের সাহায্য করেছিল তাদের সবাইকে ওরা ভুলে গেছে। উলুপিদি যে কারনেই হোক আজ আমাদের বাড়িতে এসেছেন, আমি তার পাশে আছি।”
অগত্যা অভিকে শেষ পর্যন্ত মুখ খুলতে হলো, “মা পরীর জন্য এ বাড়িতে এসেছেন। পরী এম.এস.সি পড়তে চায় এবং মায়ের মতন টিচার হতে চায়। কিন্তু তোমার ফ্যামিলির দিক থেকে অনেক বাধা আছে বিশেষ করে তোমার দিদিদের কাছ থেকে।”
সুব্রত অভির পিঠ চাপড়ে উত্তর দেয়, “আরে কোন চিন্তা কোরোনা। পরী যা চায় তা করবে। আমি আজ পর্যন্ত চুপ করেছিলাম কিন্তু আজ আমি মুখ খুলব। আজ দিদিরা আমাকে থামিয়ে রাখতে পারবে না।”
ঠিক সেইসময়ে দুষ্টু দৌড়ে এসে জানায় যে সুব্রতর আর অভির বাড়িতে ডাক পড়েছে। বাড়িতে খাবার ঘরে কিছুর আলোচনা চলছে। ওর মুখে এই কথা শুনে সুব্রতর আর অভির নেশার ঘোর একদম কেটে গেল। দু’জনে একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে দৌড় লাগাল বাড়ির দিকে।
খাবার ঘরে ঢুকে দেখে বাড়ির সব বড়রা একত্রিত। বাবা, মা, তার পাশে দিদা, তার পাশে ইন্দ্রানি মাসি আর চন্দ্রানি মাসি। ওদের সাথে ওদের স্বামিরাও উপস্থিত। তার পরে শশাঙ্ক মামা আর মেঘনা বসে। সব শেষে বসে আছেন সুমন্ত মামা। পরী, মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মায়ের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।
ইন্দ্রানিঃ “দেখ উলুপিদি, আমাদের পরিবারের কেউই গ্রাজুইয়েশান করেনি তাও আমরা পরীকে পড়িয়েছি। পরীর বিয়ের বয়স হয়ে গেছে, এবারে ওর বিয়ে করা উচিত। আমরা ওর জন্যে ছেলে খুঁজছি। এতে ক্ষতি কি? দেখ আমাকে আর চন্দ্রানিকে, আমাদের বিয়ে ঠিকঠাক বাড়িতে হয়েছে।”
মাঃ “আমি শুধু এইটুকু বলতে চাই যে, পরী যদি হাইয়ার পড়াশুনা করতে চায় তাতে ক্ষতি কি?”
চন্দ্রানি ঝাঁজিয়ে ওঠে, “না করবে না। ওর বয়সে আমার বিয়ে হয়ে বাচ্চা হয়ে গেছিল।”
সুব্রতল “উলুপিদি যা বলছেন ঠিক বলছেন। পরীকে হাইয়ার পড়াশুনা করতে দেওয়া উচিত।”
ওর কথা শুনে সবাই হতবাক হয়ে ওর দিকে তাকালো। ইন্দ্রানি আর চন্দ্রানি হয়তো ভাবতে পারেনি যে সুব্রত এর মাঝে কথা বলতে পারে।
শশাঙ্কঃ “তুই চুপ কর সুব্রত। এই সব ব্যাপারে তুই কথা বলিস না।”
চন্দ্রানিঃ “তোর মতামত কি কেউ জানতে চেয়েছে? তুই চুপ করে থাক।”
সুব্রতঃ “কেন আমি চুপ করে থাকব কেন? আমি কি এই পরিবারে কেউ নই?”
ঘরের পরিবেশ বেশ গরম হয়ে উঠেছে। অভি পরীর দিকে তাকিয়ে দেখলো, পরীর চোখে জল। দিদা এক বার পরীর দিকে তাকালো। পরী মাকে শক্ত করে ধরে আছে যেন কেউ ওর প্রানটাকে ওর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে পালিয়ে যেতে চাইছে।
দিদা সুমন্তকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোর কি মতামত?”
সুমন্ত উত্তর দিলেন, “আমার মনে হয় পরীকে পড়াশুনা করতে দেওয়া উচিত। এর মাঝে আমরা পরীর জন্য ছেলে খুঁজি, এমন ছেলে যে কিনা পরীকে বিয়ের পরেও পড়াশুনা করতে দেয় আর ও যেন ভবিষ্যতে চাকরি করতে পারে।”
পরী জোরে মাথা নাড়ায়, “না আমি বিয়ে করবো না। তোমরা সবাই চাও যে আমি এখান থেকে চলে যাই।” মা পরীকে শান্ত হতে বললেন।
ইন্দ্রানি মাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এতদিন পরে আমাদের পারিবারিক ব্যাপারে নাক গলাতে কেন এসেছো?”
দিদা ইন্দ্রানিকে এক বকুনি দিয়ে বললেন, “তুই চুপ কর, আর কোনদিন এইরকম ভাবে উলুপির সাথে কথা বলবি না। আমি শশাঙ্ককে বলেছিলাম উলুপিকে নিমন্ত্রন করতে।”
ইন্দ্রানি থামতে নারাজ, “আমরা দুই বোন এই পরিবারের জন্য অনেক কিছু করেছি। উলুপিদি কি করেছে আমাদের জন্য যে আজ উলুপিদি সতের বছর পরে আমাদের পারিবারিক ব্যাপারে কথা বলতে এসেছে?”
ওর কথা শুনে মনে হলো যেন কেউ ঘরের মধ্যে একটা অ্যাটম বম্ব ফেলে দিয়েছে। সবাই চুপ। মায়ের দু’ চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরে পড়ছে।
গুরু গম্ভির স্বরে বলে উঠলেন মা, “আমি কি করেছি না করেছি সেটা জিজ্ঞেস করিস না। আমি এখানে শুধু মাত্র পরীর জন্য এসেছি আর আমি তোদেরকে আমার কথা মানিয়ে ছাড়বো। জানতে চাস আমি কি করেছি এই পরিবারের জন্য?”
দিদা কেঁদে উঠে মাকে থামতে বললেন, “উলুপি দোহাই আমার, তুই চুপ কর। আমি পরীকে পড়াশুনা করতে দেব, কিন্তু তুই চুপ কর।”
মা রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “তোরা কি জানিস? তোদের কি আর মনে আছে? মেসোমশাই মারা যাবার সময়ে পরী কোলের বাচ্চা আর অভি আমার পেটে। তোদের দেখার কেউ ছিলনা, তোরা সবাই ছোটো ছোটো। মাসিমা সবসময়ে কাঁদতো, কি হবে ওনার পরিবারের। সুমন্ত স্কুল ছেড়ে দেয়, ধান কলে কাজ নেয় যাতে তোদের মুখে দু' গ্রাস ভাত জোটে। আমার জীবনের সেই পাঁচ বছর আমি এই পরিবারকে দিয়েছি। আমার আয় আমার ভালবাসা সব কিছু। তোদের খাওয়া পরা তোদের জামা কাপড়। আজ তোরা একসাথে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস সেটা আমার ওই পাঁচ বছরের জন্য।”
দিদা মায়ের হাত ধরে কাতর মিনতি করেন, “দয়া করে চুপ কর, উলুপি।” পরী নিস্পলক চোখে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। সমানে গাল বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে চলেছে। অভি আর সুব্রত একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। মায়ের কথা শুনে কারুর মুখে কোন কথা নেই।
মাঃ “ওই অভির সাথে, বুকের রক্ত আর দুধ দিয়ে আমি পরীকে বড় করেছি। তোরা সবাই বলতিস যে পরী অভিশপ্ত বলে দূর দূর করতিস, কেননা ওর জন্মাবার পরেই মেসোমশাই দেহ রাখেন। আমি বুক কেটে দু' টুকরো করে দিয়েছিলাম যাতে পরী বাঁচে।”
সুব্রত চুপ করে মায়ের পায়ের কাছে গিয়ে বসে পড়ে। ঘরের মধ্যে সবার চোখে জল। ইন্দ্রানি, চন্দ্রানি আর তাদের স্বামীরাও হতবাক। বাবা এর মাঝে চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে গেলেন নিজের মনের অভিব্যাক্তি লুকানোর জন্য।
মাঃ “যদি আমি বুক কেটে দেখাতে পারতাম তাহলে আজ সেটাও তোদের দেখিয়ে দিতাম আমি। পরী আমার মেয়ে নয় কিন্তু আমার মেয়ের চেয়ে অনেক বেশি। আমি এখানে তোদের জন্য আসিনি। আমি জানি তোরা সবাই এখন বড়লোক হয়ে গেছিস, পয়সার দেমাকে মাটিতে তোদের পা পড়েনা।”
পরী আর দিদা সমানে কেঁদে চলেছে, অভির ও দু’চোখ জ্বালা করছে কিন্তু ছেলে বলে সবার সামনে কাঁদতে পারছে না।
মাঃ “কাল বিয়ে বউভাত শেষ হয়ে যাবার পরে, আমি পরীকে নিয়ে কোলকাতা চলে যাব। আমি ওর এডমিশান কোলকাতা উনিভারসিটিতে করাব এবং ওর পড়াশুনার দায়িত্ব আমার। তোদের কোন পয়সা আমার চাইনা আর আমি তোদের কোন কথার ধার ধারিনা।”
মায়ের বুক থেকে এক দীর্ঘশ্বাস নিসৃত হলো। পরী মায়ের পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিল। শশাঙ্ক আর সুমন্ত দুজনেই উঠে গিয়ে মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করলো। অভির মনে হলো যেন একটা বিশাল পারিবারিক নাটক শেষ হলো এইমাত্র। চারদিকে যেন চোখের জলের ছড়াছড়ি।
অবশেষে সুমন্ত বললেন, “উলুপিদি যা বলেছেন ঠিক বলেছেন। পরীর ওপরে আমাদের চেয়ে বেশি অধিকার উলুপিদির আর তাঁর অধিকার আছে পরীকে নিয়ে যাওয়ার। আমরা সবাই ভুলে গেছিলাম যে উলুপিদি আমাদের পরিবারের জন্য কি করেছিলেন।” কিছুক্ষণ থেমে সবার দিকে একবার দেখে বললেন, “কাল বাদে পরশু, আমি এই বাড়ির ভাগ করবো। এই বাড়ি সাত ভাগে ভাগ হবে।”
ইন্দ্রানি জিজ্ঞেস করলো, “সাত ভাগে কেন? আমরাতো ছয় ভাই বোন?”
যেন একটা সিংহ গর্জে উঠল, “তুই একদম চুপ করে থাকবি। ছয় ভাগ আমাদের ছয় ভাই বোনের আর এক ভাগ মায়ের। মা যাকে ইচ্ছে তাকে দিয়ে যাবেন।” শশাঙ্ক সুমন্তর কথায় সায় দিলেন।
সুমন্তঃ “আমি চাইনা এই কথা এই চার দেওয়ালের বাইরে যাক। কাল সুব্রতর বউভাত, আমি চাইনা ওর বউভাত মাটি হোক। কথা শেষ, আর যেন এই নিয়ে বাড়িতে কোন কথা না ওঠে।”
এই সব তর্ক বিতর্কে অনেকটা সময় কেটে গেছে। অভি, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, রাত ন’টা বাজে।
অভির হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো, “কেন এসেছে তোমার মা?”
এই প্রশ্ন শুনে সবাই অভির দিকে তাকিয়ে। অভি কি উত্তর দেবে ভেবে পেলনা, চুপ করে থাকে।
সুব্রতঃ “আমাকে বলতে দে। আমি হলফ করে বলতে পারি যে আমাদের ফ্যামিলির মধ্যে যা কিছু ঘটেছে তার জন্য আমার দিদিরা; ইন্দ্রানিদি আর চন্দ্রানিদি দায়ী। বড় লোকের বাড়িতে বিয়ে হয়ে যাবার পরে দেমাকে ওদের পা আর মাটিতে পড়ে না। অতীতে যারা আমাদের সাহায্য করেছিল তাদের সবাইকে ওরা ভুলে গেছে। উলুপিদি যে কারনেই হোক আজ আমাদের বাড়িতে এসেছেন, আমি তার পাশে আছি।”
অগত্যা অভিকে শেষ পর্যন্ত মুখ খুলতে হলো, “মা পরীর জন্য এ বাড়িতে এসেছেন। পরী এম.এস.সি পড়তে চায় এবং মায়ের মতন টিচার হতে চায়। কিন্তু তোমার ফ্যামিলির দিক থেকে অনেক বাধা আছে বিশেষ করে তোমার দিদিদের কাছ থেকে।”
সুব্রত অভির পিঠ চাপড়ে উত্তর দেয়, “আরে কোন চিন্তা কোরোনা। পরী যা চায় তা করবে। আমি আজ পর্যন্ত চুপ করেছিলাম কিন্তু আজ আমি মুখ খুলব। আজ দিদিরা আমাকে থামিয়ে রাখতে পারবে না।”
ঠিক সেইসময়ে দুষ্টু দৌড়ে এসে জানায় যে সুব্রতর আর অভির বাড়িতে ডাক পড়েছে। বাড়িতে খাবার ঘরে কিছুর আলোচনা চলছে। ওর মুখে এই কথা শুনে সুব্রতর আর অভির নেশার ঘোর একদম কেটে গেল। দু’জনে একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে দৌড় লাগাল বাড়ির দিকে।
খাবার ঘরে ঢুকে দেখে বাড়ির সব বড়রা একত্রিত। বাবা, মা, তার পাশে দিদা, তার পাশে ইন্দ্রানি মাসি আর চন্দ্রানি মাসি। ওদের সাথে ওদের স্বামিরাও উপস্থিত। তার পরে শশাঙ্ক মামা আর মেঘনা বসে। সব শেষে বসে আছেন সুমন্ত মামা। পরী, মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মায়ের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।
ইন্দ্রানিঃ “দেখ উলুপিদি, আমাদের পরিবারের কেউই গ্রাজুইয়েশান করেনি তাও আমরা পরীকে পড়িয়েছি। পরীর বিয়ের বয়স হয়ে গেছে, এবারে ওর বিয়ে করা উচিত। আমরা ওর জন্যে ছেলে খুঁজছি। এতে ক্ষতি কি? দেখ আমাকে আর চন্দ্রানিকে, আমাদের বিয়ে ঠিকঠাক বাড়িতে হয়েছে।”
মাঃ “আমি শুধু এইটুকু বলতে চাই যে, পরী যদি হাইয়ার পড়াশুনা করতে চায় তাতে ক্ষতি কি?”
চন্দ্রানি ঝাঁজিয়ে ওঠে, “না করবে না। ওর বয়সে আমার বিয়ে হয়ে বাচ্চা হয়ে গেছিল।”
সুব্রতল “উলুপিদি যা বলছেন ঠিক বলছেন। পরীকে হাইয়ার পড়াশুনা করতে দেওয়া উচিত।”
ওর কথা শুনে সবাই হতবাক হয়ে ওর দিকে তাকালো। ইন্দ্রানি আর চন্দ্রানি হয়তো ভাবতে পারেনি যে সুব্রত এর মাঝে কথা বলতে পারে।
শশাঙ্কঃ “তুই চুপ কর সুব্রত। এই সব ব্যাপারে তুই কথা বলিস না।”
চন্দ্রানিঃ “তোর মতামত কি কেউ জানতে চেয়েছে? তুই চুপ করে থাক।”
সুব্রতঃ “কেন আমি চুপ করে থাকব কেন? আমি কি এই পরিবারে কেউ নই?”
ঘরের পরিবেশ বেশ গরম হয়ে উঠেছে। অভি পরীর দিকে তাকিয়ে দেখলো, পরীর চোখে জল। দিদা এক বার পরীর দিকে তাকালো। পরী মাকে শক্ত করে ধরে আছে যেন কেউ ওর প্রানটাকে ওর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে পালিয়ে যেতে চাইছে।
দিদা সুমন্তকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোর কি মতামত?”
সুমন্ত উত্তর দিলেন, “আমার মনে হয় পরীকে পড়াশুনা করতে দেওয়া উচিত। এর মাঝে আমরা পরীর জন্য ছেলে খুঁজি, এমন ছেলে যে কিনা পরীকে বিয়ের পরেও পড়াশুনা করতে দেয় আর ও যেন ভবিষ্যতে চাকরি করতে পারে।”
পরী জোরে মাথা নাড়ায়, “না আমি বিয়ে করবো না। তোমরা সবাই চাও যে আমি এখান থেকে চলে যাই।” মা পরীকে শান্ত হতে বললেন।
ইন্দ্রানি মাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এতদিন পরে আমাদের পারিবারিক ব্যাপারে নাক গলাতে কেন এসেছো?”
দিদা ইন্দ্রানিকে এক বকুনি দিয়ে বললেন, “তুই চুপ কর, আর কোনদিন এইরকম ভাবে উলুপির সাথে কথা বলবি না। আমি শশাঙ্ককে বলেছিলাম উলুপিকে নিমন্ত্রন করতে।”
ইন্দ্রানি থামতে নারাজ, “আমরা দুই বোন এই পরিবারের জন্য অনেক কিছু করেছি। উলুপিদি কি করেছে আমাদের জন্য যে আজ উলুপিদি সতের বছর পরে আমাদের পারিবারিক ব্যাপারে কথা বলতে এসেছে?”
ওর কথা শুনে মনে হলো যেন কেউ ঘরের মধ্যে একটা অ্যাটম বম্ব ফেলে দিয়েছে। সবাই চুপ। মায়ের দু’ চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরে পড়ছে।
গুরু গম্ভির স্বরে বলে উঠলেন মা, “আমি কি করেছি না করেছি সেটা জিজ্ঞেস করিস না। আমি এখানে শুধু মাত্র পরীর জন্য এসেছি আর আমি তোদেরকে আমার কথা মানিয়ে ছাড়বো। জানতে চাস আমি কি করেছি এই পরিবারের জন্য?”
দিদা কেঁদে উঠে মাকে থামতে বললেন, “উলুপি দোহাই আমার, তুই চুপ কর। আমি পরীকে পড়াশুনা করতে দেব, কিন্তু তুই চুপ কর।”
মা রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “তোরা কি জানিস? তোদের কি আর মনে আছে? মেসোমশাই মারা যাবার সময়ে পরী কোলের বাচ্চা আর অভি আমার পেটে। তোদের দেখার কেউ ছিলনা, তোরা সবাই ছোটো ছোটো। মাসিমা সবসময়ে কাঁদতো, কি হবে ওনার পরিবারের। সুমন্ত স্কুল ছেড়ে দেয়, ধান কলে কাজ নেয় যাতে তোদের মুখে দু' গ্রাস ভাত জোটে। আমার জীবনের সেই পাঁচ বছর আমি এই পরিবারকে দিয়েছি। আমার আয় আমার ভালবাসা সব কিছু। তোদের খাওয়া পরা তোদের জামা কাপড়। আজ তোরা একসাথে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস সেটা আমার ওই পাঁচ বছরের জন্য।”
দিদা মায়ের হাত ধরে কাতর মিনতি করেন, “দয়া করে চুপ কর, উলুপি।” পরী নিস্পলক চোখে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। সমানে গাল বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে চলেছে। অভি আর সুব্রত একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। মায়ের কথা শুনে কারুর মুখে কোন কথা নেই।
মাঃ “ওই অভির সাথে, বুকের রক্ত আর দুধ দিয়ে আমি পরীকে বড় করেছি। তোরা সবাই বলতিস যে পরী অভিশপ্ত বলে দূর দূর করতিস, কেননা ওর জন্মাবার পরেই মেসোমশাই দেহ রাখেন। আমি বুক কেটে দু' টুকরো করে দিয়েছিলাম যাতে পরী বাঁচে।”
সুব্রত চুপ করে মায়ের পায়ের কাছে গিয়ে বসে পড়ে। ঘরের মধ্যে সবার চোখে জল। ইন্দ্রানি, চন্দ্রানি আর তাদের স্বামীরাও হতবাক। বাবা এর মাঝে চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে গেলেন নিজের মনের অভিব্যাক্তি লুকানোর জন্য।
মাঃ “যদি আমি বুক কেটে দেখাতে পারতাম তাহলে আজ সেটাও তোদের দেখিয়ে দিতাম আমি। পরী আমার মেয়ে নয় কিন্তু আমার মেয়ের চেয়ে অনেক বেশি। আমি এখানে তোদের জন্য আসিনি। আমি জানি তোরা সবাই এখন বড়লোক হয়ে গেছিস, পয়সার দেমাকে মাটিতে তোদের পা পড়েনা।”
পরী আর দিদা সমানে কেঁদে চলেছে, অভির ও দু’চোখ জ্বালা করছে কিন্তু ছেলে বলে সবার সামনে কাঁদতে পারছে না।
মাঃ “কাল বিয়ে বউভাত শেষ হয়ে যাবার পরে, আমি পরীকে নিয়ে কোলকাতা চলে যাব। আমি ওর এডমিশান কোলকাতা উনিভারসিটিতে করাব এবং ওর পড়াশুনার দায়িত্ব আমার। তোদের কোন পয়সা আমার চাইনা আর আমি তোদের কোন কথার ধার ধারিনা।”
মায়ের বুক থেকে এক দীর্ঘশ্বাস নিসৃত হলো। পরী মায়ের পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিল। শশাঙ্ক আর সুমন্ত দুজনেই উঠে গিয়ে মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করলো। অভির মনে হলো যেন একটা বিশাল পারিবারিক নাটক শেষ হলো এইমাত্র। চারদিকে যেন চোখের জলের ছড়াছড়ি।
অবশেষে সুমন্ত বললেন, “উলুপিদি যা বলেছেন ঠিক বলেছেন। পরীর ওপরে আমাদের চেয়ে বেশি অধিকার উলুপিদির আর তাঁর অধিকার আছে পরীকে নিয়ে যাওয়ার। আমরা সবাই ভুলে গেছিলাম যে উলুপিদি আমাদের পরিবারের জন্য কি করেছিলেন।” কিছুক্ষণ থেমে সবার দিকে একবার দেখে বললেন, “কাল বাদে পরশু, আমি এই বাড়ির ভাগ করবো। এই বাড়ি সাত ভাগে ভাগ হবে।”
ইন্দ্রানি জিজ্ঞেস করলো, “সাত ভাগে কেন? আমরাতো ছয় ভাই বোন?”
যেন একটা সিংহ গর্জে উঠল, “তুই একদম চুপ করে থাকবি। ছয় ভাগ আমাদের ছয় ভাই বোনের আর এক ভাগ মায়ের। মা যাকে ইচ্ছে তাকে দিয়ে যাবেন।” শশাঙ্ক সুমন্তর কথায় সায় দিলেন।
সুমন্তঃ “আমি চাইনা এই কথা এই চার দেওয়ালের বাইরে যাক। কাল সুব্রতর বউভাত, আমি চাইনা ওর বউভাত মাটি হোক। কথা শেষ, আর যেন এই নিয়ে বাড়িতে কোন কথা না ওঠে।”
এই সব তর্ক বিতর্কে অনেকটা সময় কেটে গেছে। অভি, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, রাত ন’টা বাজে।