What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

pinuram রচনাসমগ্র (3 Viewers)

অনেক অ
কাবেরি সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারদের ফোন করে দেয়। সেই রাতেই ডাক্তারেরা দিলিপ বাবুর বাড়িতে ওকে দেখতে চলে আসে। দিলিপ বাবু সোমেশ, পারমিতাকেও ফোন করে জানিয়ে দেয় যে দেবায়নের জ্ঞান ফিরে এসেছে। রাতের মধ্যে দিলিপ বাবুর বাড়িতে লোক জনের সমাগম বসে যায়, খুশির ছোঁয়া লাগে সবার বুকে। অবশেষে দেবায়ন আবার ওদের মাঝে ফিরে এসেছে। ডাক্তারেরা পরীক্ষা করে জানায়, এইবারে অপারেশান করা যেতে পারে। দেবায়নের ডান পায়ের হাড় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। হাড়ের বদলে স্টিল রড অথবা টাইটেনিয়াম রড বসাতে হবে, না হলে দেবায়ন আর কোনোদিন হাঁটতে পারবে না। সেই শুনে সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ে। টাইটেনিয়াম রড বসাতে অনেক খরচ পড়ে যাবে বলে ডাক্তারেরা জানায়। টাকার ব্যাপারে সেই সময়ে কারুর মাথা ব্যাথা ছিল না। দিলিপ বাবু, সোমেশ বাবু সমস্বরে জানিয়ে দেয় টাকার চেয়ে দেবায়নের উঠে দাঁড়ানো ওদের কাছে বেশি জরুরি। বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা করার পরে দেবশ্রী জানায় হাড়ের বদলে টাইটেনিয়াম রড বসানোর জন্য। দিন দুয়েক পরে দেবায়নের পায়ের অপারেশান করা হয়। তারপরে ওর শরীরে বেশ কয়েক জায়গায় অপারেশান করা হয়, শিরদাঁড়ার, হাতের। এই অপারেশান করতে করতে আরও বেশ কয়েকদিনে লেগে যায়। ডাক্তারেরা জানায়, দেবায়নের উঠে দাঁড়াতে বেশ সময় লাগবে। কোলকাতা ফিরে যেন এক ফিজিওথেরাপিস্ট নিযুক্ত করে যাতে দেবায়ন আবার চলাফেরা করতে পারে। দেবায়ন চোখ খোলার পরের দিন শ্রেয়া কোলকাতায় খবর দিয়ে জানিয়ে দেয়।

সোমেশ বাবুর অফিস আর অঙ্কনের কলেজের পড়াশুনার ব্যাঘাত ঘটার জন্য অনুপমা ওদের বাড়ি ফিরে যেতে বলে দেয়। সোমেশ বাবু, অঙ্কন আর পায়েলকে নিয়ে কোলকাতা ফিরে আসে।

বেশ কয়েকদিন পরে রূপক ব্যাঙ্গালোর চলে আসে। ততদিনে দেবায়ন বেশ সুস্থ হয়ে ওঠে কিন্তু তাও শয্যাশায়ী। দেবায়ন অনুপমাকে একদিন জিজ্ঞেস করে, “আমাকে কে ঠেলে দিয়েছিল রে, জানিস?”

অনুপমা মাথা দোলায়, “হ্যাঁ, আততায়ী এতদিনে ধরা পড়েছে। অগ্নিহোত্রীর বাবা সমীর বাবু।”

রূপক উত্তরে জানায়, আততায়ী শেষ পর্যন্ত ওদের জালে ধরা দেয়। রূপক ইমেল করে উত্তরে জানিয়েছিল যে কোন এক কারনে ওদের ট্রেকিং সুখকর হয়নি, কিন্তু ওই জায়গার সম্বন্ধে আগন্তুক ওদের খবর দিয়েছিল বলে রূপক ওর সাথে দেখা করে ধন্যবাদ জানাতে চায়। সমীর বাবু ভাবতে পারেনি যে রূপক ওকে চিনে ফেলবে তাই রূপকের ইমেলের উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন যে দেখা করবেন। সেই সাথে তিনি জানান যে তিনি বাঙ্গালী নন, উত্তর ভারতের লোক তাই মুসৌরির কাছে ধনোল্টি নামক এক জায়গায় দেখা করার কথা ব্যক্ত করেন। রূপক, পরাশর, নিরঞ্জন বাবু, ঘন সিয়ালির ইনস্পেকটর রোহন সবাই তক্কেতক্কে ছিল। ওদের পরিকল্পনা মাফিক আগে থেকে নিরঞ্জন বাবু আর রোহন ধনোল্টি পৌঁছে যায় আর জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। রূপক একাই ধনোল্টি যায় সমীর বাবুর সাথে দেখা করতে। সমীর বাবু গোঁফ দাড়ি লাগিয়ে, নিজের পরিচয় লুকিয়ে পাঞ্জাবী সেজে ওর সাথে দেখা করতে আসে। সেইখানে রূপককে দেখে সমীর বাবু ছুরি বের করে রূপককে আক্রমন করতে যায় আর সেই সময়ে রোহন আর নিরঞ্জন বাবু ওকে ধরে ফেলে। ধরা পড়ে যাওয়াতে সমীর বাবু মুষড়ে পড়ে। ছেলের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়া আর হলো না। নিরঞ্জন বাবু বলেন, সমীর বাবুর ছেলে নিজের দোষে নিজের পাপে প্রান হারিয়েছে। অগ্নিহোত্রী পাপী, অগ্নিহোত্রী দোষী, দেবায়ন আর রূপক নয়।

ধরা পড়ার পরে সমীর বাবুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে সমীর বাবু জানান, ছেলের মৃত্যুর পর থেকেই সমীর বাবু ফাঁক খুঁজছিলেন কি করে প্রতিশোধ নেওয়া যায়। তিনি কাউকে না জানিয়ে একাই এক বিশাল ষড়যন্ত্রের রচনা করেন। নির্জন স্থান খোঁজার জন্য এক বছর ধরে বিভিন্ন দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়ে কাটিয়ে দেন। তারপরে কম্পিউটার, ইন্টারনেট শেখেন যাতে রূপক অথবা দেবায়নের সাথে নিজের পরিচয় লুকিয়ে ইমেল করতে পারে। এই ট্রেকিং বিষয়ের বেশ কয়েকটা ইমেল দেবায়নকে প্রথমে পাঠিয়েছিলেন সমীর বাবু, কিন্তু দেবায়ন তার কোন উত্তর দেয়নি দেখে পরে রূপকের কাছে পাঠায়। রূপক তার জালে ফেঁসে যায় আর উত্তরে জানায় ট্রেকিংয়ে যেতে রাজি। ইমেলের মাধ্যমে রূপকের সাথে প্রথমে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে আলোচনা চলে সমীর বাবুর, শেষ পর্যন্ত একটা ট্রেকিংয়ের সাইটের খবর দেয় সমীর বাবু। আগে থেকে সমীর বাবু সেই ওয়েব সাইটে লগিন করে একটা ভুয়ো নামের একাউন্ট বানিয়ে রেখেছিলেন। রূপকের সাথে সেই ভুয়ো নামের একাউন্ট থেকে চ্যাটিং করেন আর এই ভাবে জানতে পারেন যে রূপক ঠিক কোথায় ট্রেকিংয়ে যাবে। সমীর বাবু ওদের ওপরে নজর রেখেছিল, আর আগে থেকেই একা একাই ঘুট্টু পৌঁছে গিয়েছিল। গা ঢাকা দেওয়ার জন্য তিনি জঙ্গলের মধ্যে তাঁবু খাটিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

নিউ তেহেরিতে, কুমার নামের পাহাড়ি ছেলেটার সাথে আলাপ হয়। তিনি কুমারকে সঙ্গে নিয়ে বলেছিলেন যে খাটলিং যেতে চায়। কুমারকে আসল উদ্দেশ্য জানায়নি সমীর বাবু, দেবায়ন আর রূপকের ছবি দেখিয়ে বলেছিলেন যে এদের একজনকে ডেকে আনতে আর ডেকে আনার পরে যেন পালিয়ে যায়। কুমার ওদের তাঁবুর কাছে গিয়ে দেবায়নকে ডাকে। সমীর বাবু ভেবেছিলেন, যেহেতু রূপক আর দেবায়ন ভালো বন্ধু সুতরাং দুইজনে একসাথেই আসবে। সমীর বাবু চেয়েছিলেন দুইজনকে একসাথে সেদিন রাতে খুন করবেন কিন্তু দেবায়ন একাই কুমারের সাথে আসে। তাই ওকেই প্রথমে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়। খুন করার আগে সব কিছু খুলে বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার আগেই দেবায়ন ওই খাদের মধ্যে হারিয়ে যায়। তারপরে সমীর বাবু জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে পাহাড় থেকে নেমে আসেন। কোলকাতা ফিরে খবরের কাগজে দেবায়নের নিখোঁজ হওয়ার খবর পড়ে নিশ্চিন্ত হয়ে যান।

এরপরে তক্কে থাকেন কি ভাবে রূপকের ওপরে প্রতিশোধ নেওয়া যায়। শেষ পর্যন্ত একদিন রূপককে চিঠি পাঠিয়ে জানায় যে তিনি দেবায়নের আততায়ীর খবর জানেন। রূপক সেই ফাঁদে পা দেবে সেটা নিশ্চিত ছিলেন। সমীর বাবু চেয়েছিলেন রাস্তার মধ্যেই রূপকের গাড়ির এক্সিডেন্ট ঘটাতে। সাধারনত লাভা যেতে সবাই কালিম্পং হয়েই যায় আর ভোরের দিকে রাস্তায় কুয়াশা থাকে। কিন্তু রূপক কালিম্পং হয়ে লাভা যায়নি দেখে মুষড়ে পড়েন। তিনি কোলকাতা ফিরে এসে আবার সুযোগের অপেক্ষা করেন। তারপরে রূপক ইমেল করে জানায় সে দেখা করতে চায়। ইমেল পড়ে সমীর বাবুর প্রত্যয় হয় যে রূপক এখন আসল আততায়ীকে চিনতে পারেনি। তাই তিনি নিজের পরিচয় একজন পাঞ্জাবী হিসাবে দিয়ে নির্জন ধনোল্টিতে দেখা করার কথা জানায়। তিনি ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেন নি যে ওরা আগে থেকেই ওর পরিচয় জেনে ফেলেছে। কুমারকে হত্যা করার দায়ে আর দেবায়নকে খুন করার দায়ে রোহন সমীর বাবুকে গ্রেফতার করে। এই কেস উত্তরাখন্ডে ঘটেছে তাই উত্তরাখণ্ডের আদালতে এই মামলা চলবে।

পঞ্চাশ লাখ টাকার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে, রূপক কিছুতেই জানাতে নারাজ কোথা থেকে ওই টাকা যোগাড় করেছে। অনুপমার দৃঢ় প্রত্যয়, এক কথায় পঞ্চাশ লাখ টাকা দিয়ে দেবে এমন মানুষ শুধুমাত্র দুইজন আছে, এক ওর বাবা, কিন্তু বাবা দিলে ওর মা ওকে জানিয়ে দিতো, আর দ্বিতীয় নিবেদিতা। কিন্তু অনুপমা যেটা বুঝে উঠতে পারে না, রূপক কেন নিবেদিতার কাছে গেল।

অনুপমা শেষ পর্যন্ত রূপককে বলে, “আম জানি কে তোকে টাকা দিয়েছে।” রূপক জিজ্ঞেস করাতে অনুপমা উত্তর দেয়, “নিবেদিতা তোকে টাকা দিয়েছে, তাই না। কিন্তু নিবেদিতাকে তুই কোথায় পেলি?”

শেষ পর্যন্ত শ্রেয়া ওর হয়ে উত্তর দেয়, “আমাদের আর কিছু মাথায় আসছিল না, কোথায় যাবো কি করবো কিছুই ভেবে উঠতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত নিবেদিতার কথা মনে পড়ে গেল। তুই এনুয়াল মিটে সবার সামনে জানালি যে নিবেদিতা তোর ভালো বন্ধু। তাই ওর কাছে গিয়ে সব কিছু খুলে বলাতে সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চাশ লাখ টাকা দিয়ে দিলেন আর সেই সাথে আমরা যারা যারা টাকা দিয়েছিলাম তাদের টাকা ফেরত দিয়ে দেওয়া হলো।”

সব কিছু বলার পরে শায়িত দেবায়নকে দেখে রূপক ওকে বলে, “শালা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়া, বিয়ে করতে হবে না?”

দেবায়নের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে অনুপমা স্মিত হেসে বলে, “আর ওকে চোখের আড়াল করছি না।”

-----সমাপ্ত-----

অনেক অনেক অনেক চমৎকার একটি লেখা।
ধন্যবাদ।
 
ভালবাসার রাজপ্রাসাদ

সূচিপত্র

Part 1: প্রথম প্রেম।
Chapter 1: নিমন্ত্রন। ( #1 )
Chapter 2: প্রথম দেখা। ( #1 )
Chapter 3: বিমোহিত সৌন্দর্য। ( #1 )
Chapter 4: প্রথম চুম্বন। ( #1 )
Chapter 5: মেঘ রোদ্দুর। ( #1 , #2 )
Chapter 6: প্রত্যাবর্তন। ( #1 )
Chapter 7: তমসা উদ্ঘাটন। ( #1 , #2 )
Chapter 8: শুভরাত্রি। ( #1 , #2 , #3 )
Chapter 9: খুঁজে পাওয়া বাল্যকাল। (#1)
Chapter 10: নতুন মুখ। ( #1 )
Chapter 11: বিস্ময়। ( #1 )
Chapter 12: বিদায় চুম্বন। ( #1 )
Chapter 13: অশ্রুভরা বিদায়। ( #1 )
End of Part - 1
*****************************
Part 2: হিম-আঁচলের ছায়ায়।
Chapter 1: অদৃশ্য চিঠি। ( #1 )
Chapter 2: অপরিজ্ঞাত যাত্রা। ( #1 , #2 , #3 )
Chapter 3: অপ্রত্যাশিত রজনী। ( #1 )
Chapter 4: তুষারে অগ্নিপাত। ( #1 , #2 , #3 )
Chapter 5: পরবর্তী অভিযান। ( #1 , #2 , #3 , #4 , #5 )
Chapter 6: বাঁধা চোখের জল। ( #1 )
End of Part - 2
*****************************
Part 3: গঙ্গাবক্ষে জোয়ার ভাঁটা।
Chapter 1: জলপরীর স্বপ্ন। ( #1 , #2 , #3 , #4 )
Chapter 2: দেবীকথা-অরুন্ধুতি। ( #1 , #2 )
Chapter 3: মাতৃময়ী মূর্তি। ( #1 , #2 )
Chapter 4: অনাধিকার প্রবেশ। ( #1 , #2 )
Chapter 5: মেনকার রথ। ( #1 )
Chapter 6: রম্ভার বাঁশি। ( #1 )
Chapter 7: সর্পকন্যের হাতছানি। ( #1 , #2 , #3 )
Chapter 8: অপরাধ স্বীকার। ( #1 )
End of Part - 3
*****************************
Part 4: দিবস রজনীর গল্প।
Chapter 1: জলপরীর আগমন। ( #1 , #2 )
Chapter 2: অপ্সরা দেবাঙ্গনার সমাবেশ। ( #1 )
Chapter 3: অশ্রুহীন বিদায়। ( #1 , #2 )
Chapter 4: সুকৌশল প্রতিজ্ঞা। ( #1 , #2 )
Chapter 5: লাহুল স্পিতি ভ্রমন। ( #1 , #2 , #3 , #4 , #5 , #6 )
Chapter 6: স্পিতির তীরে জুঁই ফুল। ( #1 , #2 )
Chapter 7: বীরের প্রত্যাবর্তন। ( #1 , #2 , #3 , #4 )
Chapter 8: দাবার 64 ছক। ( #1 , #2 , #3 , #4 )
Chapter 9: দিবস, রজনীর খেলা। ( #1 , #2 , #3 , #4 )
Chapter 10: ময়ুর সিংহাসন। ( #1 , #2 )
****************************
Part Omega: বুকভাঙা অশ্রু। ( #1 , #2 )

দেখি নাই ফিরে। ( #1 )
****************************
 
Part 1: প্রথম প্রেম।

Chapter 1: নিমন্ত্রন।

সন ২০০০। শীতকাল ঠিক দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে হাতছানি দিচ্ছে। নভেম্বর মাসের ঠাণ্ডা শীত তখন ঠিক মতন পড়েনি। । বাইশটা বসন্ত পেরিয়ে, আভিমন্যু তখন কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। আবছা কুয়াশা মাখা মিষ্টি রোদ আর ঘাসের ডগায় শিশিরের চিকমিক যেন মনটাকে ব্যাকুল করে তোলে এক অজানা আনন্দের খোঁজে। দিনটা ছিল রবিবার। অভিমন্যু বসার ঘরে বসে আপনমনে খবরের কাগজটা পড়ছিল, না ঠিক পড়ছিল নয়, দেখছিল আর গরম চায়ে সুরত সুরুত করে চুমুক দিচ্ছিল। ওর মা রান্না ঘরে রান্না করছিলেন আর বাবা বাজারে গেছিলেন।

ঠিক সেই সময়ে কলিং বেল বেজে ওঠে। মা বললেন এক বার দেখতে, হয়তো পেপারওয়ালা মাসের টাকা নিতে এসেছে। অভি দৌড়ে নিচে গিয়ে দেখে যে দরজায় একজন মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোক এবং এক ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে। অভি তাদের কাউকেই চেনেনা।

ভদ্রলোক অভিকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার মা বাড়িতে আছেন?”

মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয় অভি যে মা বাড়িতে আছেন। ভদ্রলোক নিজের পরিচয়ে বললেন যে তিনি মায়ের দূর সম্পর্কের ভাই হন। অভি ওদেরকে বাড়ির মধ্যে আসার জন্য বললো এবং বসার ঘরে বসতে বলে মাকে ডাকতে গেল।

মা বসার ঘরে ঢুকে অবাক, “আরে শশাঙ্ক, কি ব্যাপার? অনেক দিন পরে। এটা তোর বউ, মেঘনা? ভাল ভাল, তা অনেক দিন পরে কি মনে করে আসা হলো?”

কথাবার্তায় জানা গেল যে, শশাঙ্ক অভির মায়ের খুব দূর সম্পর্কের ভাই হন। তাঁরা তিন ভাই, তিন বোন। ছোটো ভাই সুব্রতর বিয়ে উপলক্ষে নিমন্ত্রন করতে এসেছে। কথাবার্তার পরিপ্রেক্ষিতে জানা গেল যে, শশাঙ্কর ছোটো বোন তখন অবিবাহিতা আর তাঁরা এক উপযুক্ত পাত্রের খোঁজে করছেন। তাঁরা সবাই গ্রামের বাড়িতে এক যৌথ পরিবারে থাকে, গ্রামের নাম বসিরহাট। অভির মা একজন শিক্ষিকা, মায়ের স্কুলও বসিরহাটে। মা যখন স্কুলের চাকরি শুরু করেন তখন তিনি ওদের বাড়িতে থাকতেন। অভির জন্মের বছর দুই আগে, মায়ের ছোটো মাসি, শশাঙ্কের মা, এক কন্যে সন্তানের জন্ম দেন। মায়ের ছোট্ট কুট্টী বোন, শুচিস্মিতা। মায়ের মুখে অভি তার কথা অনেক শুনেছে, কেমন করে অভিকে নিয়ে সারাদিন খেলে বেড়াতো শুচিস্মিতা।

অভিমন্যুর যখন দুষ্টুমি করার বয়স হলো এবং স্কুল যেতে শুরু করলো তখন অভির বাবা মা, কলকাতা চলে আসেন। অভির মনে সেই ছোটো বেলার কোন কথাই মনে নেই। সব তাই যেন এক স্বপ্ন ধোঁয়াটে।

অভির মা অভিকে বললেন যে, শুচিস্মিতা বাড়ির ছোটো মেয়ে সেই জন্য সব থেকে দুষ্টু ছিল। ওর চেয়ে শুধু অভি ছোটো ছিল তাই অভিকে নিয়ে ওর যত খেলাধুলা চলত। টানতে টানতে নিয়ে যেতো আমের বাগানে, পুকুর পাড়ে, ধানের ক্ষেতে। অভি ছিল তার জলজ্যান্ত খেলার পুতুল, যাকে নিয়ে ওর সারাদিন কেটে যেতো শুধু খেলায়।

গ্রামে সবারই বড় এবং যৌথ পরিবার হয়ে থাকে। শশাঙ্কেরদেরও যৌথ পরিবার এবং ওদের এক ছেলে, নাম নীলাঞ্জন, ক্লাস ফোরে পড়ে।

মা শশাঙ্কের নিমন্ত্রন স্বীকার করলেন আর জানালেন যে তাঁরা সবাই সুব্রতর বিয়েতে যাবেন।
 
Chapter 2: প্রথম দেখা।

বিয়ের দিন ছিল ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। এক সুন্দর সকালে ওরা বেরিয়ে পড়লো মায়ের মাসির বাড়ি, বসিরহাটের উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস কোলকাতা ছেড়ে, ধান খেতের মাঝ দিয়ে ছুটে চলতে লাগল। অভি জানালার পাশে বসে পুরানো স্মৃতি রোমন্থন করার প্রবল চেষ্টা চালিয়ে গেল। কেমন দেখতে হবে সেই শুচিস্মিতা যে ওকে কোলে নিয়ে ছোটো বেলায় অনেক খেলা করেছে, শীতের রাতে ওকে জড়িয়ে ধরে ঠাণ্ডা থেকে বাঁচিয়েছে। এই সব ভাবতে ভাবতে অভি একসময়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

অভির ঘুম ভাঙলো মায়ের ডাকে, “এই ওঠ। বসিরহাট এসে গেছে প্রায়। এর পরের স্টপেজে আমাদের নামতে হবে।”

বাস থেকে নামার পরে মা জানালেন যে শশাঙ্কর বাড়ি বড় রাস্তা থেকে প্রায় মাইল দুই তিন ভেতরে, এতটা রাস্তা হাঁটতে হবে তবে গিয়ে গ্রামে পৌঁছান যাবে। অভি জিজ্ঞেস করলো যে কোন রিক্সা পাওয়া যায় কিনা।

প্রতি উত্তরে অভির বাবা বললেন যে, “ব্যাটা, গ্রামের হাওয়া বাতাসে অনেক অক্সিজেন। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে নে, এই শুদ্ধ হাওয়া বাতাস কোলকাতায় পাবি না। এখানে তুই মাটির অনেক কাছে আছিস, হেঁটে চল।” বাবার কথার আর অমান্য করা যায় না, অগত্যা অভি হাঁটতে শুরু করে।

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মা ওকে শুচিস্মিতার গল্প শুনালেন। সেই শুনে অভির মনে শুচিস্মিতাকে দেখার এক প্রবল ইচ্ছে জেগে উঠল।

অনেকক্ষণ হাঁটার পরে ওরা সবাই মায়ের মাসির বাড়ি পৌঁছে গেল। বাড়িটা বিশাল। মায়ের মেসোমশাই বেশ বড় চাষা ছিলেন, অনেক জমি জমা ছিল এককালে। অনেকদিন আগেই তিনি দেহরক্ষা করেছেন। মেসোমশাই মারা যাবার পরে, বড় ভাই সুমন্ত পরিবারের দায় দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেন। সংসারের জোয়াল কাঁধে পড়াতে তিনি আর বেশি পড়াশুনা করতে পারলেন না, তিনি চাষ বাস করে বাকি ভাই বোনেদের পড়াশুনা করিয়েছেন এবং বোনেদের বিয়ে থা দিয়েছেন।

বাড়িতে ঢোকা মাত্রই মনে হলো যেন এক জন সমুদ্রের মাঝে এসে পড়েছে অভি। চারদিকে লোকজনের হইহুল্লোড়, চেঁচামেচি, দৌড়াদৌড়ি লেগে আছে। অভি সেই পরিবেশে একদম নতুন, কাউকেই সে চেনে না। মায়ের মাসিমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল মা। ঝুঁকে প্রনাম করলো অভি। দিদু পরিবারের সবাইকে ডেকে অভির পরিবারের সাথে সবার আলাপ করিয়ে দিল। অভির চোখ থেকে থেকে শুচিস্মিতাকে খোঁজে, তার কোন দেখা নেই। অভির বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে, জিজ্ঞেস করবে কি করবেনা যে শুচিস্মিতা কোথায়, জিজ্ঞেস করাটা বাতুলতা হতে পারে সেই ভয়ে জিজ্ঞেস করলো না অভি। মা মেঘনাকে শুচিস্মিতার কথা জিজ্ঞেস করলেন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল অভি। মেঘনা উত্তর দিলেন যে যেহেতু শুচিস্মিতা বাড়ির সব থেকে ছোটো মেয়ে তাই ছোটবেলা থেকেই অনেক চঞ্চল। ওর বাড়ির বিয়ে, হয়তো কোথাও ওর বান্ধবীদের সাথে ঘুরছে বা আড্ডা মারছে।

ঠিক সেইসময়ে ওদের পাশ দিয়ে একদল মেয়ে গল্প করতে করতে আর ফুল হাতে নিয়ে কোথাও যাচ্ছিল। মেঘনা ওদের মধ্যে একজনকে ডাক দিল, “পরী এই দিকে শোনো। উলুপিদি ডাকছে তোমাকে।”

মেয়েদের দলের মাঝ থেকে একটি সুন্দরী তরুণী এগিয়ে এলো। লাল ঠোঁটে লেগে আছে মনমোহক হাসি। মেয়েটি ঝুঁকে মায়ের পায়ে প্রনাম করলো। অভির মা, দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো মেয়েটিকে। তারপর মেয়েটির চিবুক ছুঁয়ে আদর করে কপালে একটা চুমু খেলেন।
মাতৃ সুলভ স্বরে বললেন, “পরী, আমার ছোট্ট মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গেছে। অনেক দিন তোকে দেখিনি রে।”

অভি নিস্পলক চোখে মেয়েটির সৌন্দর্য সুধা পান করে চলেছে। মেয়েটির গায়ের রঙ বেশ ফর্সা যেন একটু আলতা ছোঁয়ানো। পরনে একটি ছোটো হাতার হাল্কা গোলাপি রঙের জমকালো সালোয়ার কামিজ পরেছে। মাথার লম্বা ঘন কালো চুল একটা হাত খোঁপা করে ঘাড়ের কাছে আলতো করে বাঁধা। খোঁপায় জুঁই ফুল গোঁজা, আর সেই জুঁই ফুলের গন্ধে চারপাশ মাতোয়ারা করে তুলেছে। শীতের মিষ্টি রোদ্দুর যেন ওর ত্বকের ওপরে পেছল খাচ্ছে। ডিম্বাকৃতি মুখাবয়ব, হাসলে দু’গালে টোল পড়ে, আর তাতে যেন হাসিটার সৌন্দর্য আরও শত গুন বেড়ে যায়। মেয়েটির রুপে মোহিত হয়ে যায় অভিমন্যু, হাঁ করে চেয়ে থাকে ওর দিকে।

পরী একবার অভির হাঁ করা মুখের দিকে চেয়ে, মাকে প্রশ্ন করলো, “এটি তোমার পুত্র অভিমন্যু, তাই না?”

মা মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ। তোর মনে আছে, ছোটো বেলায় তুই এর সাথে খেলতিস। তুই যেখানে যেতিস, তোর সাথে একেও টেনে নিয়ে যেতিস।”

পরী অভির দিকে আঙুল দেখিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলো, “বাঃবা, অভিমন্যুত অনেক বড় হয়ে গেছে।”

অভির দিকে তাকিয়ে এক মিষ্টি হাসলো পরী। সেই হাসি দেখে অভির বুকের ভেতরের রক্ত ছলকে উঠল। আওয়াজ শুনে মনে হলো যেন ওর কানে কেউ মধু ঢেলে দিয়েছে।
মাকে জড়িয়ে ধরে পরী বললো, “উলুপিদি, আমার না খুব তাড়া আছে। আমি এখন যাচ্ছি, পরে তোমাদের সাথে কথা বলবো।” তারপরে অভির দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি আমাকে পরী বলে ডাকতে পারো। আমাকে বাড়ির সবাই পরী বলেই ডাকে। আমার এখন খুব তাড়া আছে, আমি তোমার সাথে পরে দেখা করবো।”

মেঘনা পরীকে বললো, “তোমার কোন তাড়া নেই, পরী। তুমি শুধু আড্ডা মেরে বেড়াবে আর কিছু না।”

পরী মেঘনাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “অঃ বৌদি, এইতো সময় আমার আড্ডা মারার আর মজা করার।”

তারপরে পরী ওর বান্ধবীদের সাথে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল। অভি নিস্পলক চোখে পরীর চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল। নাসারন্ধ্রে তখন শুধু জুঁইয়ের গন্ধ মম-মম করছে।

অভির মা অভিকে বললেন যে ঘুরে ফিরে সবার সাথে আলাপ পরিচয় করে নিতে। নিজেরা চলে গেলেন ভেতরে। অভি একা একা কি করবে ঠিক ভেবে পেল না। একেবারে নতুন পরিবেশ নতুন মানুষজন, কাউকেই ও চেনেনা।

এক কাপ কফি নিয়ে ছাদে উঠে গেল অভি। পড়ন্ত দুপুরের রোদে ছাদের ওপরে একা একা ঘুরতে ঘুরতে এক কোনায় দাঁড়িয়ে গ্রামের শোভা দেখতে লাগল। হটাত করে চোখ গেল নিচে উঠানে। সেই মেয়েদের দল উঠানে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারছে। পরীকে দেখতে ঠিক এক রাজকুমারী, যেন সখী পরিবেষ্টিত হয়ে রয়েছে সেই রকম লাগছে। অভির চোখ আবার যেন পরীর শরীরের আঁকিবুঁকি মাপার জন্যে আনচান করছে। পরীর গঠন যেন প্রাচিন এক বালি-ঘড়ির মতন। তিন তলার ছাদ থেকে অভি পরীর রুপ, ব্যাস এইটুকুই দেখে মন শান্তি করতে হলো।

পরীর অপরূপ সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে প্রেমে পড়ে গেছে অভি। এক অদৃশ্য চুম্বকীয় শক্তি বা ভাললাগা যেন ওকে পরীর দিকে টানছে। কিছু পরে মেয়েদের দলটি উঠান ছেড়ে অন্য দিকে চলে গেল।
 
Chapter 3: বিমোহিত সৌন্দর্য।

অভি পুনরায় পরীর চিন্তায় হারিয়ে গেল, যদি পরী ওর সাথে দেখা করতে না আসে? কিন্তু না আসার তো কোন কারন খুঁজে পাচ্ছে না। অভি তো পরীর আত্মীয় হয় মাত্র, দেখা করতে আসা বা কথা বলা দৃষ্টিকটু নয়।

সূর্যি পশ্চিম আকাশের দিকে ঢলে চলেছে। বাড়ির সকলে নিজেদের সাজসজ্জা নিয়ে ব্যাস্ত। বিয়ে বলে কথা তাই সবাই নিজেদেরকে নিঁখুত করে তুলতে তৎপর। অভি বরযাত্রী। অভি জানতে পারলো যে কনের বাড়ি বসিরহাট থেকে অনেক দূর, রানাঘাট নামক এক জায়গায়, বাসে প্রায় ঘন্টা চারেক লাগবে যেতে। বিয়ের লগ্ন মাঝ রাতে।

বাঙালীর প্রিয় পোশাক ধুতি পাঞ্জাবী। সাধারনত অভি ধুতি পাঞ্জাবী পরেনা, কিন্তু খুব কাছের কারুর বিয়ে হলে ধুতি পাঞ্জাবী পরে। অভি একটি ধাক্কা পাড়ের ধুতি আর তসরের পাঞ্জাবী পরে। গায়ে জড়িয়ে নেয় ঘিয়ে রঙের কাশ্মিরি শাল। এই জন সমুদ্রে অভিকে একদম আলাদা লাগছে ওর পোশাকের জন্য। এককোনে দাঁড়িয়ে থাকে অভি, চারদিকে সাজ সাজ কোলাহল।

সূর্যি পশ্চিম দিগন্তে পাটে চলে গেছে। বিয়ে বাড়ি সহস্র আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে। বিয়ের ভিড়ে অভি আবার একা সাথে শুধু পরীর মুখাবয়াব চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে। এমন সময়ে হটাত করে কেউ অভির পাঞ্জাবির হাতা ধরে টান মারে। পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখে একটা বাচ্চা ছেলে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসছো।

অভি ওকে জিজ্ঞেস করে, “কি হলো?”

ছেলেটি উত্তর দিল, “আমি নীলাঞ্জন। সবাই আমাকে দুষ্টু নামে ডাকে, আমি তোমার শশাঙ্ক মামার পুত্র।”

অভি হাত বাড়িয়ে হাত মেলায় দুষ্টুর সাথে, “তোমার সাথে দেখা করে বেশ ভাল লাগল।”

দুষ্টু উত্তর দিল, “আমার ছোটো পিসি, পরী, তোমাকে উঠানে ডাকছে।”

অভি ওকে জিজ্ঞেস করে, “কেন ডাকছে?” ওদিকে মনে তখন ওর নাচন ধরেছে।

দুষ্টু একটি শয়তানি হাসি হেসে বলে, “দেখা করে নিজেই জিজ্ঞেস করে নিও কেন ডাকছে।” এই বলে দুষ্টু পালিয়ে গেল।

অভি উঠানের দিকে পা বাড়ালো। প্রত্যেক পদে ওর বুকের ধুকপুকানি শতগুন বেড়ে গেছে, হৃদয়টা যেন পাঁজর ফেটে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। সেই শীতের রাতে অধির ব্যাকুলতায় অভির ঘাম দিয়ে দিল।

উঠানে পা রাখতেই অভি দেখতে পেল যে পরী আর কিছু মহিলাদের সাথে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। সেই মহিলাদের মাঝে অভির মাও বর্তমান। মাকে দেখে অভির বুকটা বেলুনের থেকে হাওয়া বেরিয়ে যাওয়ার মতন চুপসে গেল।

মা ওকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, “এদিকে আয়। সারা দিন কোথায় ছিলিস তুই?”

পরী ওর দিকে দুষ্টুমি মাখা হাসি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “হ্যাঁ অভিমন্যু, সারাদিন কোথায় ছিলে?”

ওই হাসি দেখে, অভির মনে হলো বলে ফেলে, “তোমার খেয়ালে ডুবে ছিলাম সারাদিন।”

মা ওকে জানিয়ে দিলেন যে বাস বিকেল ছ’টার মধ্যে ছেড়ে যাবে, যেখানেই থাকুক না কেন অভি যেন ঠিক সময়ে বাসে উপস্থিত থাকে।

পরী অভির পাশে এসে ওর মাকে বললো, “কোন চিন্তা কোরোনা উলুপিদি। ছোটো বেলায় ওকে যেমন দেখতাম ঠিক তেমনি করে দেখব আমি।”

পরীর দিকে তাকালো অভি। পরীর পরনে কালো রঙের জমকালো শাড়ি তাতে সোনালি সুতোর ভারী কাজ। রুপ দেখে মনে হলো যেন আকাশ থেকে একটুকরো তারা মাটিতে নেমে এসেছে। পাশে দাঁড়িয়ে অভির বাজুতে হাত ছোঁয়ালো পরী। হাতের ছোঁয়ায় অভির সারা অঙ্গে যেন বিদ্যুত খেলে গেল। অভির নাকে পরীর সেই মনমাতানো জুঁইয়ের গন্ধে ভরে উঠল। ওর দিকে তাকিয়ে দেখলো ওর মুখ। টিয়ে পাখীর মতন নাক, টানা টানা কাজল কালো দুই চোখ, দুই ভুরু যেন কালো দুই চাবুক। ঠোঁট জোড়া যেন রসালো কোন ফল।

অভির দিকে তাকিয়ে পরী ইশারা করলো ওর সাথে হাঁটতে। নির্বাক হয়ে এতক্ষণ অভি শুধু পরীকে দেখে যাচ্ছিল, ওর কথা শুনে হতবাকের ন্যায় ওর পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করলো।

পরী ওকে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার কি ছোটবেলার কোন কথাই মনে নেই?”

নির্বাক অভি মাথা নাড়লো, “না নেই।”

পরীঃ “তুমি নাকি পড়াশুনায় বেশ ভাল।”

অভি আবার মাথা নাড়লো, “হুম।”

পরীঃ “তোমাকে না এই ধুতি পাঞ্জাবিতে দারুন হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে। তুমি কি সবসময়ে ধুতি পাঞ্জাবী পরো?”

নির্বাক অভি আবার মাথা নাড়লো, “না”। কথা কি বলবে অভি ওর বাক শক্তি হারিয়ে শুধু পরীর কথা শুনে যাচ্ছে।

পরীঃ “আমি গ্রাজুয়েসান ফিসিক্সে করেছি। শুনলাম তুমিও নাকি ফিসিক্সে গ্রাজুয়েসান করছো?”

অভি আবার মাথা নাড়লো, “হ্যাঁ।”

পরীঃ “আমি আরও পড়তে চাই। আমার মা আমার বিয়ের জন্যে ছেলে দেখছে। আমি অনেক বলে কয়ে উলুপিদিকে ডাকিয়েছি। উলুপিদি হাইয়ার পড়াশুনা করে এখন স্কুলে চাকরি করেন। উনি যে স্কুলে চাকরি করেন সেই স্কুলে আমি ছোটো বেলায় পড়তাম। আমি আশা করে আছি যে তোমার মা আমার মাকে বলে বুঝাবে যাতে আমি আগেও পড়াশুনা করতে পারি আর উলুপিদির মতন আমিও স্কুলে টিচার হতে চাই।”

অভি চুপচাপ মাথা নাড়িয়ে ওর পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। পাশাপাশি হাঁটার ফলে মাঝে মাঝে পরীর হাত অভির হাতের সাথে ছুঁয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝ আঙুলগুলি একে অপরকে ছুঁচ্ছে। আঙুলের সেই কোমল স্পর্শে অভির শিরদাঁড়ায় যেন বিদ্যুত খেলে যায়। বারে বারে অভির নজর পরীর মুখের দিকে চলে যায়।

পরীঃ “তোমার মাকে আমি সব বুঝিয়ে বলেছি। উলুপিদি বলেছেন যে ঠিক সময়ে আমার মাকে সব বুঝিয়ে বলবে যাতে আমার মা আমাকে আগেও পড়াশুনার জন্য বারন না করে। আমি জানি যে আমার মা তোমার মায়ের কথা উপেক্ষা করতে পারবে না। আমি মায়ের মুখে শুনেছি যে তোমার মা নাকি আমাকে নিজের মেয়ের মতন ভালবাসতো আর আমার মা তোমার মায়ের সব কথা শুনতো। সেইসব দিন চলে গেছে, আর আমাদের মাঝের ব্যাবধান অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু কিছুদিন আগে তোমার মায়ের কথা উঠতে আমার মায়ের চোখে জল চলে আসে। আজও আমার মা উলুপিদির কথা মনে করে শ্রদ্ধায় মাথা নত করে। সেইসব শুনে আমার মনে হলো যে আমি যদি উলুপিদিকে আমার মনের কথা খুলে বলি আর উলুপিদি যদি আমার মাকে বলে তাহলে আমার মা তোমার মায়ের কথা ফেলতে পারবে না।” অভির দিকে তাকিয়ে পরী জিজ্ঞেস করে, “তোমার কি মনে হয় অভিমন্যু? মা আমাকে পড়াশুনা করতে দেবে?”

নির্বাক অভি আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা গুনতে চেষ্টা করলো, কি উত্তর দেবে, ওর কানে তো একবর্ণও কথা ঢোকেনি।

পরী একটু রাগত ভাবে বললো, “কি হলো অভিমন্যু? তখন থেকে শুধু আমিই কথা বলে যাচ্ছি। তোমার কি জিব নেই নাকি না বোবা তুমি। তখন থেকে শুধু গরুর মতন মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিচ্ছো যে। কিছুতো উত্তর দেবে নাকি?”

আকাশের দিকে তাকিয়ে অভি বুক ভরে এক নিঃশ্বাস নিল। বুকের মধ্যে সাহস জুগিয়ে দুম করে বললে ফেললো, “পরী তুমি ভারী সুন্দরী।” কথাটা বলে ফেলেই চোখ বন্ধ করে নেই অভি, এই বুঝি পরী ওর গালে সপাটে এক চড় কষিয়ে দেয়।

পরী ওর কথা শুনে ওর হাত ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। অভির দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি তার মানে আমার কোন কথাই শোনোনি, তাইতো। তুমি একদম শয়তান ছেলে, মনে মনে আবার আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা হচ্ছে?” অভির হাতে সজোরে একটা থাপ্পড় মেরে বললো, “তুমি না খুব শয়তান।”

অভি মনের মধ্যে সাহস সঞ্চয় করে পরীর দিকে তাকিয়ে বললো, “না সেই কথা নয়। আমি তোমার কথা সব শুনেছি কিন্তু তুমি ভারী সুন্দরী দেখতে পরী।”

পরী লাজুক হেসে উত্তর দিল, “দুষ্টু ছেলে, যাই হোক, থ্যাঙ্কস ফর দা কমপ্লিমেন্টস।”

অভি জিজ্ঞেস করলো, “তোমার বান্ধবীরা কোথায়, তুমি তাদের সাথে কেন নয়?”

পরী উত্তরে জানালো যে, ওর বান্ধবীদের বউভাতে নিমন্ত্রন করা হয়েছে। যেহেতু পরী বাড়ির সবার ছোটো সেইজন্য এই ভিড়ে ওরও খুব একা একা লাগছে।

অভির মন ব্যাকুল হয়ে উঠল, একটু খানি পরীর ছোঁয়া পাওয়ার জন্য হাত বাড়ালো পরীর দিকে। ঠিক সেই সময়ে অভির মা ওদেরকে ডাক দিলেন, বললেন যে বাস ছাড়ছে ওরা যেন বাসে উঠে পড়ে। কপালে করাঘাত করলো অভি, “ধুর বাবা, এই সময়ে কি মাকে ডাক দিতে হতো, একটু পরে ডাক দিলে হতো না।”

পরী বুঝতে পারে অভির মনের কথা, বুঝতে পারে যে অভি ওর দিকে হাত বাড়াচ্ছিল। ওর দিকে তাকিয়ে চোখে মুখে দুষ্টুমি ভরা এক হাসি দিয়ে বললো, “আমি অপেক্ষা করে থাকব কিন্তু......”

এই বলে অভিকে ওখানে একা ছেড়ে বাসের দিকে দৌড়ে চলে গেল।
 
Chapter 4: প্রথম চুম্বন।

বাস ভর্তি বরযাত্রী, মা বাবা, মামা মাসি আরও অনেক আত্মীয় স্বজন। কোলাহলে বাসের ভেতরে থাকা দায়। অচির উৎসুক আঁখি ওই ভিড়ে শুধু পরীকে খুঁজে বেড়ায়। কিছু পরে দেখতে পায় যে পরী শেষের দিকের একটা সিটে বসে ওর জন্য অপেক্ষা করছে।

ওকে দেখেই জোরে ডাক দেয় পরী, “এদিকে অভিমন্যু। আমি একটা সিট রেখে দিয়েছি তোমার জন্য।”

অভি সুবোধ গাধার মতন মাথা নাড়িয়ে ওর পাশের সিটে গিয়ে বসে পড়ে। পরী জানালার দিকে বসে আর পাশে অভি। ভিড় ভর্তি বাস লোকজনের জন্যে গরম হয়ে ওঠে। সবাই যেন তারস্বরে চিৎকার করছে। কিছু পরে বরযাত্রীদের বাস রানাঘাট উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে।

রানাঘাট পৌঁছতে অনেক দেরি, সেইজন্য অভির মা প্রস্তাব দিলেন যে একটু নাচ গান হয়ে যাক। সবাই মায়ের কথা শুনে সম্মতি জানালো। কিন্তু প্রশ্ন উঠল যে শুরু কে করবে। বড়রা প্রস্তাব দিলেন যে ছোটোরা আগে শুরু করুক।

অভি আর পরী পাশাপাশি বসে, একজনের বাজু আরেক জনের বাজুর সাথে ঘসা খাচ্ছে। পরী বারে বারে এক প্রশ্নমাখা চোখ নিয়ে অভির দিকে তাকিয়ে দেখছো, কিন্তু মুখে কিছু বলছে না। অভির মনের ভেতরে যেন সমুদ্রের উথাল পাথাল ঢেউ বয়ে চলেছে, কেউকি কোন এটম বম্ব ফেলেছে নাকি, না চুপ করে থাকাটাই নিরাপদ।

বাসের সামনে থেকে কেউ ডাক দিল, “পরী কোথায়, পরী। অনেকক্ষণ পরীর আওয়াজ শোনা যাচ্ছেনা, কি ব্যাপার। পরীর তো এই রকম হবার কথা নয়।”

অভি মুখ নিচু করে পরীর কানে কানে বললো, “পরী, কি হয়েছে? আমি কি কিছু ভুল করে ফেলেছি? আমি ক্ষমা চাইছি যা ভুলে করেছি তার জন্যে। দেখ সারা বাসের লোক তোমাকে খুঁজছে পরী।”

পরী অভির মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিপাত করে উত্তর দিল, “আমি ভেবেছিলাম যে তুমি আমার কথা গুলো শুনেছ, কিন্তু তুমি আমার কোন কথাতেই কান দাওনি। তুমি বোঝো না, আমি পড়াশুনা করতে চাই।”

অভি, “আই আম সরি, পরী। আমি সত্যি বলছি যে আমি তোমার সব কথা শুনেছি। এবার প্লিস একটু হাসো, দেখ সবাই তোমাকে খুঁজছে পরী, উত্তর দাও।”

পরীর চোখ টলটল করে উঠল, কিন্তু ও অনেক বুদ্ধিমতী মেয়ে। মনের অবস্থা লুকিয়ে রাখার মতন যথেষ্ট বুদ্ধি রাখে।

চিৎকার করে উত্তর দেয়, “পরী এখানে...” পরী উঠে দাঁড়িয়ে অভির দিকে তাকিয়ে বললো, “আমাকে একটু যেতে দেবে নাকি?”

বাসের সিট একদম চাপা, যাবার জায়গা কম। পরীকে একটু কুঁকড়ে বের হতে হলো। ওর মসৃণ পিঠ অভির বাজুতে স্পর্শ করলো, চিবুক ছুঁয়ে গেল শিরদাঁড়ার ওপরে। মসৃণ ত্বক যেন মাখন। অভি হাত দিয়ে পরীর পাতলা কোমর ধরে ওকে বের হতে সাহায্য করে। নিরাভরন ত্বকের ওপরে অভির গরম হাতের স্পর্শে পরী একটু কেঁপে ওঠে। অভি দুষ্টুমি করে পরীর উন্মুক্ত পেটের ওপরে আলতো করে চাপ দেয়। অভির সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়।

নাক কুঁচকে অভির দিকে তাকিয়ে বলে, “একটু সবুর কর অভিমন্যু, আমি এখুনি আসছি।”

বরযাত্রী ভরা বাস, রাতের ঘন অন্ধকার কেটে দ্রুত গতিতে গন্তব্য স্থলের দিকে দৌড়ে চলেছে। আত্মীয় স্বজনের কোলাহলে বাস মুখরিত। পরীর সাথে সাথে অনেক লোক ওর চারদিকে নাচ গান শুরু করে দিল। পরী ওদের ভিড়ে হারিয়ে গেল। না ঠিক নয়, বারে বারে পরী আড় চোখে অভির দিকে তাকিয়ে দেখে। চোখ ইশারায় কাতর আহ্বান জানায় ওর সাথে অংশ গ্রহন করতে। কিন্তু অভি একটু ঘরকুনো প্রকৃতির ছেলে, বাইরের মানুষের সাথে মিশতে ওর একটু সময় লাগে। অনেকক্ষণ নাচার পরে সবাই ক্লান্ত হয়ে সিটের ওপরে এলিয়ে পড়ে। যাত্রীদের মধ্যে কেউ প্রস্তাব দেয় গানের খেলা খেলার।

পরী গান বাঁধে, “পিয়া তু আব তো আজা... শোলা সা মন দেহকে আকে বুঝা যা...” গান গাইতে গাইতে বারে বারে অভির দিকে তাকায় পরী।

পরীর চোরা চাহনি বাসের অনেকের লোকের চোখে পড়ে যায়। অভির মা বাবার মনে সেইরকম কিছু উদয় হয়না।

অভি ওর গান শুনে আর চুপ করে বসে থাকতে পারেনা। বুক ভরে, একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে সাহস জুগিয়ে গেয়ে ওঠে, “তুঝে দেখা তো ইয়ে জানা সনম, প্যার হোতা হ্যায় দিওানা সনম...”

ওর গান শুনে পরী অবাক হয়ে যায়। বাসের বাকি লোকের মুখে প্রশ্ন ওঠে কে এই ছেলেটা, আগে তো কোনদিন দেখিনি?

পরী ওদের উত্তর দেয়, “এ অভিমন্যু।” অভির মায়ের দিকে দেখিয়ে বলে, “উলুপিদির ছেলে।”

বড়রা মাকে বলে, “কিরে উলুপি তোর ছেলে যে অনেক বড় হয়ে গেছে।”

এই সব কথাবার্তার মাঝে পরী ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। পরী প্রস্তাব দেয় যে যেহেতু গানের খেলা চলছে সুতরাং সবাই নিজের নিজের সিটে বসে গান গাইতে পারে। অভির মন নেচে ওঠে, অনেকক্ষণ পরে ও আবার পরীর পাশে বসার সুযোগ পাবে।

পরী অভির কাঁধের ওপরে ভর দিয়ে ওর পেছনে সিটের ওপরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। কোমল বক্ষ যুগল অভির ঘাড়ের ওপরে পিষ্ট হয়। অভির মাথার ওপরে নিজের চিবুক রেখে গলার দু পাশ দিয়ে সামনের দিকে হাত নামিয়ে দেয় পরী।

গানের খেলা আবার শুরু হয়ে যায়। মাঝে মাঝেই পরী ওর সরু সরু আঙুল দিয়ে অভির চুলে বিলি কাটতে থাকে। আরামে অভির দু’ চোখ বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। অভির মা একবার আড় চোখে ওদের লক্ষ্য করে।

কিছু সময় যাবার পরে একে একে সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়ে, একে একে গান বন্ধ হয়ে যায়।

পরী সবাইকে জিজ্ঞেস করে, “কি হলো, আর কি কেউ গান টান গাইবে না?”

অভির মা উত্তর দেয়, “না পরী, আর নয়। সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সাড়ে ন’টা নাগাদ আমরা রানাঘাট পৌঁছে যাব, কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে নাও নাহলে বিয়ে বাড়িতে সবার চোখ মুখের অবস্থা খারাপ দেখাবে।”

মা স্কুলের শিক্ষিকা, তার গম্ভির গলার আওয়াজে কেউ কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।

পরী অভির পাশে জানালার দিকের সিটে আরাম করে বসে পড়লো। রাতের অন্ধকার কেটে এগিয়ে চলে বাস। সবাই চুপ, শুধু মাত্র বাসের ইঞ্জিনের শব্দ কানে আসে। পরী অভির ডান কাঁধে মাথা রেখে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। সাজ নষ্ট হয়ে যাবার ভয়ে পরী কোন শীতের কাপড় আনেনি। জানালার ফাঁক দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়ায় মাঝে মাঝে পরীকেঁপে ওঠে, অভি নিজের গায়ের শালখানি খুলে ওর গায়ে জড়িয়ে দেয়।

শাল পরানোর সময়ে কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, “এত চুপ কেন, পরী?”

পরী ওর দিকে বড় বড় চোখ করে উত্তর দেয়, “থ্যাঙ্কস। আমার এমনিতে একটু ঠাণ্ডা লাগছিল।” হেসে বলে, “আমি কি বোকা, শীত কালেও কোন ঠান্ডার কাপড় আনিনি।”

অভি মজা করে ওর সাথে, “না না, তুমি শুধু বোকা নও, তুমি একটি সুন্দরী বোকা মেয়ে।”

পরী লাজুক হেসে বলে, “ধুর দুষ্টু ছেলে, দূর হ।”

অভিঃ “কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি কি তোমাকে?”

পরীঃ “কি?”

অভিঃ “তোমার কলেজের কথা...”

পরীঃ “এই একরকম গেছে কলেজ। সেই রকম কিছু বলার মতন নেই।”

অভিঃ “তোমার কি কোন বয় ফ্রেন্ড আছে?”

প্রশ্নটা শুনে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো অভির দিকে, “এই কথা কেন জিজ্ঞেস করছো?” প্রশ্নটা করে মাথা উঠালো পরী, অভির চেহারা আর পরীর চেহারার ব্যাবধান কমে এসেছে। একে অপরের উষ্ণ নিঃশ্বাস অপরের মুখের ওপরে অনুভব করতে পারছে।

অভির গলা শুকিয়ে এলো, বাধো বাধো হয়ে উত্তর দিল, “না মানে এমনি জিজ্ঞেস করলাম। তুমি যা সুন্দরী তাতে তোমার একাধিক বয়ফ্রেন্ড থাকা কোন অসম্ভব ব্যাপার নয়।”

নাক কুঁচকে দুষ্টু হেসে পরী বললো, “আমি যেন কিছু জ্বলার গন্ধ পাচ্ছি মনে হচ্ছে? অভি, আমি কিন্তু সম্পর্কে তোমার মাসি হই, সেটা মনে থাকে যেন।”

“অভি!” নিজের নাম ছোটো করে পরীর ঠোঁটে শুনে অভিমন্যুর হৃদয় নেচে ওঠে।

দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয় অভি, “না না, আমি কেন ঈর্ষান্বিত হব।” কিন্তু মনে মনে অভি সেই অচেনা অজানা লোকের ওপরে ঈর্ষা বোধ করে।

পরীঃ “না গো। আমার কোন বয় ফ্রেন্ড নেই। আমার অনেক বন্ধু ছিল তাদের মধ্যে অনেক ছেলে বন্ধুও ছিল কিন্তু কাউকে মনে ধরেনি জানো। আজ পর্যন্ত, সেই রকম কাউকে পাইনি যাকে মন দিতে পারি।”

অভিঃ “তার মানে তুমি তোমার হৃদয়ের সব জানালা দরজা বন্ধ করে রেখেছো, এইতো।”
বাঁকা হাসি হাসে পরী, “না ঠিক তা নয়। আজ পর্যন্ত আমি পাইনি এটা বলতে চাই।” অভি কিছু বুঝতে না পেরে ওর মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি মেখে উত্তর দিল, “ধুর বোকা ছেলে। আজ পর্যন্ত পাইনি বলেছি, এখন পর্যন্ত পাইনিতো বলিনি।”

কথা শুনে মাথা ঘুরে গেল অভির, মানে পরী কি বলতে চায়? পরীও ওর প্রতি আকৃষ্ট? ওর কথার মানে বুঝে অভির বুকের মাঝে দুমদাম আওয়াজ শুরু হয়ে যায়।
নিজেকে একটু সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে অভি, “আচ্ছা একটা কথা বলো পরী। তুমি আজ বিকেলে আমাকে তোমার কথা গুলো বলতে গেলে কেন?”

পরী, “জানি না কেন, অভি। আমার মনে হলো তাই তোমাকে বলে ফেললাম। এবারে একটু চুপ করবে কি, আমি একটু রেষ্ট নেব।”

অভি ডান হাতে পরীর পাতলা কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে নিল। অভির কাঁধে মাথা গুঁজে চোখ বন্ধ করে চুপ করে রইল পরী। অভির নচ্ছার আঙুলগুলো, পরীর কোমরের পাশের উন্মুক্ত পেটের ওপরে আদর করতে থাকে। বাসের নিস্প্রভ আলোয় পরীকে ঠিক স্বর্গের অপ্সরার মতন দেখাচ্ছে।

বেশ কিছুক্ষণ পরে সামনের দিকে থেকে কেউ জানিয়ে দিল যে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস বিয়ে বাড়ি পৌঁছে যাবে।

অভি পরীর কাঁধে হাত রেখে জাগাতে চেষ্টা করে, “পরী ওঠো। আমরা কিছুক্ষণের মধেই বিয়ে বাড়ি পৌঁছে যাব।”

পরী, “উম্মম... এত তাড়াতাড়ি কেন, আমাকে একটু ঘুমতে দাও না... প্লিস...”

কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস বিয়ে বাড়ির সামনে পৌঁছে গেল। অভির মা ওদের সিটের সামনে এসে পরীকে ওঠালো। সেই সময়ে অভি বুঝতে পারলো যে ওর মা পরীকে ঠিক নিজের মেয়ের মতন ভালবাসে।

মা বললেন, “পরী সোনা মা আমার, উঠে পড়, আমাদের নামতে হবে।”

মায়ের গলা শুনে পরী নড়েচড়ে বসলো, আড়মোড়া ভেঙে মুখচোখ কচলে হাতের ব্যাগ খুলে মেকআপ করতে শুরু করলো। বাস থেকে সবাই নেমে গেছে, বাসের মধ্যে শুধু অভি আর পরী। পরী নিজের মেকআপ নিয়ে ব্যাস্ত।

অভি উঠে দাঁড়ালো, পরীর দিকে তাকিয়ে দেখলো একবার, বুকের মাঝে যেন একটা ফেরারি চলছে। ওর দিকে ঝুঁকে পড়লো অভি। মাথার ওপরে গরম নিঃশ্বাস অনুভব করে মুখ তুলে তাকালো পরী। চার চোখ এক হলো, পরীর দু’চোখ চকচক করছে এক অজানা আশঙ্কায়। অভি, সারা শরীরের শেষ শক্তিটুকু একত্রিত করে চোখ বন্ধ করে ঠোঁট নামিয়ে আনলো পরীর কপালের ওপরে। পরীর উষ্ণ কপালের ওপরে ভিজে ঠোঁটে একটি ছোট্ট চুমু খেয়ে এক লাফে বাস থেকে নেমে পড়লো অভি। ভয়ে আর পেছন দিকে তাকালো না।
 
Chapter 5: মেঘ রোদ্দুর। (#1)

অভি বাস থেকে নামতেই ওর মা ওকে এককোনে ডেকে নিয়ে যায়। মায়ের ডাক শুনে অভির তো আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে যাবার যোগাড়। বুকের মাঝে এক ঝড় ওঠে, মা কি বুঝতে পেরে গেল নাকি ওর আর পরীর হৃদ্যতা?

মা অভিকে বললেন যে রাতের খাবার যেন তাড়াতাড়ি খেয়ে নেয় অভি, বরযাত্রী নিয়ে বাস ফিরে যাবে রাত এগারটার মধ্যে। অভিকে জিজ্ঞেস করলেন যে ও কি করতে চায়, থাকতে চায় না বরযাত্রীরদের সাথে ফিরে যেতে চায়। ওর অনেক দিনের সখ বাঙালি বিয়ে দেখার, তাই অভি জানিয়ে দেয় যে ও রাতে থাকবে এবং পরের দিন বরের সাথে বাড়ি ফিরবে। মা সম্মতি দিয়ে দিলেন।

কনের বাড়িতে বরযাত্রী পৌঁছানো মাত্রই চারদিকে হইহই রব উঠল, বর এসেছে বর এসেছে। বিয়ে বাড়ির ভিড়ে আবার অভি একা। এখানে পরীকে খোঁজা বোকামো। পরীর ছোটো দাদার বিয়ে আর সে মজা করবে না সেটা ভাবা উচিত নয়। ওই আত্মীয় স্বজনের মাঝে পরী কোথাও হারিয়ে আছে। অভি বিয়ের মণ্ডপে একা, বর সুব্রতর সাথে বসে। ব্রাহ্মণ মন্ত্র পড়ে চলেছে।

মাঝে মাঝে পরীর দেখা পায় অভি, এদিক ওদিক নাচানাচি করছে, এমন দেখাচ্ছে যেন খুব ব্যাস্ত।

ওর অর্বাচীন ব্যাস্ততার মধ্যেই পরী একবার অভির কাছে আসে, অভির বুক ধুকপুক করছে, এই বুঝি কিছু বলে ফেলে। পরী ওর দিকে না তাকিয়েই বলে “এই কি গো, এই রকম গাধার মতন একা বসে কেন? এসো না আমার সাথে।”

অভিও ওর দিকে তাকাতে পারছে না, গলা শুকিয়ে এসেছে অভির। তোতলাতে তোতলাতে উত্তর দিল, “না মানে, তোমার সাথে সবসময়ে মহিলারা থাকেন, আর মহিলাদের সঙ্গ আমার একটু অস্বস্তিকর।”

পরী, “ঠিক আছে তাহলে, একা একা বসে থাকো এখানে। যাই হোক জানিয়ে গেলাম যে ডিনার খেতে ভুলে যেও না যেন। সবাই কিন্তু খাবার পরে চলে যাবে, শুধু মাত্র সুব্রতদার কয়েক জন বন্ধুরা রাতে থাকবে।”

অভি, “আমি রাতে থাকছি, মা আমাকে পারমিশান দিয়ে দিয়েছে।”

পরী এতক্ষণ পরে কৌতূহলী চোখ নিয়ে অভির দিকে তাকালো, “তুমি কি বলতে চাও যে আমিও রাতে থাকব?”

অভি, “সেটা তোমার ব্যাপার, পরী।”

পরী ওর কথা শুনে ঝাঁঝিয়ে উঠল, “ঠিক আছে, তোমাকে আমি দেখে নেব, আর তুমি অচিরেই জানতে পারবে আমি কি করতে পারি।” রেগে মেগে ওখান থেকে চলে গেল পরী।

রাতের খাবার পরে বরযাত্রী ফিরে যাবার জন্য তৈরি। অভি ওদের সাথে বাসের কাছে দাঁড়িয়ে। পরী ফিরে যেতে নারাজ।

অভির মা বারংবার পরীকে বোঝাতে চেষ্টা করে চলেছেন, “পরী, কোন মেয়েছেলেরা রাতে এই বাড়িতে থাকছে না। সেই মত অবস্থায় কি করে তোমাকে আমি রেখে যাই বল। মাসিমা কি বলবে?”

পরী মাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলে, “কেন, তুমিও তো একসময়ে আমাকে নিজের মেয়ের মতন ভালবাসতে। তুমি অনুমতি দিলে তো আর কোন কথা থাকে না। প্লিস প্লিস প্লিস, আমাকে রাতে থাকতে দাও।”

মা শেষ পর্যন্ত পরীর আব্দারের কাছে মাথা নোয়ালো। অভিকে কাছে ডেকে বললো, “এই ছেলে, পরী রাতে এখানে থাকবে। ওর দিকে নজর রাখিস। ওর যদি কিছু হয় তাহলে আমি তোকে আস্ত রাখব না।”

পরী রাতে থাকবে জেনে অভির মন খুশিতে ভরে উঠল। বাধ্য ছেলের মতন মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিল যে ও পরীর খেয়াল রাখবে। পরী মায়ের গলা জড়িয়ে আদর করে বললো, “আমার সোনা দিদি – মা। আমি ভাল করে থাকব একদম দুষ্টুমি করবো না।”

বরযাত্রী প্রস্থান করার পরে অভি আবার বিয়ের মন্ডপে গিয়ে বসে পড়লো। পরী আবার ভিড়ের মধ্যে কোথাও হারিয়ে গেল। অভি মাঝে মাঝেই দেখা পায় যে পরী ওর শালখানি গায়ে জড়িয়ে এদিক ওদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওর চলন দেখে অভির মনের ভেতরটা আকুলি বিকুলি করে উঠল, মনে হচ্ছিল যেন এই উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরে আর ওই রাঙা ঠোঁটে শত চুম্বন এঁকে দেয়।

ধিরে ধিরে রাত গভীর হতে থাকে। কনের বাড়ির অনেক লোকজন চলে গেছে। বরের বাড়ি থেকে শুধু সুব্রতর দুই বন্ধু, সুব্রতর বড়দা, সুমন্ত মামা আর অভি আর পরী। বিয়ের লগ্ন মাঝ রাতে, ধিরে ধিরে লগ্নের সময় ঘনিয়ে আসছে।

এর মধ্যে কোন এক সময়ে পরী চুপিচুপি এসে অভির পাশে এসে গা ঘেঁসে দাঁড়ায়। হাতের ওপর হাতের স্পর্শ, মাঝে মাঝে কোমল আঙুলের ছোঁয়া। কিন্তু কেউই কারুর দিকে তাকায় না, দু’জনেই চুপ করে দাঁড়িয়ে হোমের আগুনের দিকে এক ভাবে তাকিয়ে থাকে।

এরই মাঝে একজন মহিলা এসে পরীকে জিজ্ঞেস করে যে ও শুতে যেতে চায় কিনা। বরযাত্রীর জন্য আলাদা করে রাতে থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছে। পরী মাথা নেড়ে জানিয়ে দেয় যে ও শুতে যেতে চায় না।

অভি ওকে জিজ্ঞেস করলো যে একটু হাঁটা যেতে পারে কিনা। কিছু উত্তর না দিয়ে চুপচাপ অভির পাশে হাঁটতে শুরু করলো পরী। দু’জনে অন্ধকার রাস্তা ওপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। শীতের রাত, নিজেকে গরম রাখার জন্য অভির শালটা গায়ের ওপরে জড়িয়ে রেখেছোে। দুই হাত বুকের কাছে আড় করে, মাটির দিকে তাকিয়ে চুপ করে অভির পাশে হেঁটে চলেছে। দুজনেই একদম চুপ কারুর মুখে কোন কথা নেই। এই নিস্তব্ধতা বড় হৃদয় বিদারক হয়ে দাঁড়ায় দু’জনার পক্ষে। অভি ভাবতে থাকে যে কাউকে তো শুরু করতে হবে।

কিছু দোনামোনা ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “এত চুপ করে কেন পরী? কিছু কি হয়েছে?”

গলা কেঁপে ওঠে পরীর, “তুমি বলতে চাও যে কিছুই হয়নি।”

অভিঃ “আমি কি করলাম?”

পরীঃ “তুমি এই বলতে চাও যে তুমি কিছুই করোনি। জানো আমি যেন একটা বিদ্যুৎ ঝটকা খাই। আমি অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিলাম সিটের ওপরে, নড়বার শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি, আর তুমি বলছো যে তুমি কিছু করো নি?”

কাঁপা গলায় বললো অভি, “না মানে, হটাত করে কেন জানিনা খুব ইচ্ছে হলো...”

পায়ের দিকে তাকিয়ে হেঁটে চলেছে পরী, “চোখের সামনে সবকিছু কালো অন্ধকার হয়ে গেছিল। এমন কি মনে হয়েছিল যেন আমি বিদ্যুৎস্পষ্ট হয়ে স্থাণুবৎ হয়ে গেছি।”

রাস্তার মাঝে পরীর কাঁধে হাত রেখে ওর সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো অভি। মাথা নিচু করে পরীর মুখের দিকে তাকালো। তর্জনী দিয়ে পরীর চিবুক স্পর্শ করে উঁচু করে নিল ওর মুখ। পরীর দু’ চোখ বন্ধ, অজানা এক আশঙ্কায় তিরতির করে কাঁপছে দু ঠোঁট। দু’ চোখের বড়বড় পাতা কাঁপছে তার সাথে। গায়ের শালখানি আরও আষ্টেপৃষ্টে নিজের গায়ের সাথে জড়িয়ে ধরলো পরী। অভির ঠোঁট ধিরে ধরে নেমে এলো, পরীর লাল ঠোঁটের কাছে। প্রেয়সীর গরম নিঃশ্বাস সারা মুখের ওপরে ঢেউ খেলে বেড়াচ্ছে। বুকের ভেতরে যেন হাঁপর টানছে। এক অনাবিল প্রত্যাশায় বুক কাঁপছে পরীর, নিঃশ্বাসে ঝরে পড়ছে আগুন। নাকে নাক ঠেকল প্রথমে। ডিসেম্বরের সেই শীতের রাতেও নাকের ডগায় ঘামের ফোঁটা অনুভব করলো দু’ জনেই। দুজনের ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে। ঠোঁটের মাঝে একচিলতে ব্যাবধান। এত কাছে আসার পরেও যেন সাহস কুলিয়ে উঠতে পারছে না অভি, কোন কিছু বলার ভাষাও যেন হারিয়ে ফেলেছে।

এক গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে, কাজল কালো দুচোখ খুললো পরী। চোখে জল টলমল করছে। নাকের ডগা লাল হয়ে উঠেছে। অবশেষে দুজনের মাঝের নিস্তব্ধতা ভাঙলো পরী। অশ্রু ভরা নয়নে অভির দিকে তাকিয়ে কম্পিত স্বরে বলে উঠল, “না অভি না। আমি পারব না অভি। আমার চোখের সামনে থেকে দূর যাও।” কথাটা বলেই বিয়ে বাড়ির দিকে দৌড়ে চলে গেল।

সেই শীতের রাতে একা অন্ধকার রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে অভিমন্যু তালুকদার। বড় একা মনে হলো নিজেকে, মনে হলো কেউ নেই তার পাশে। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে খুব বড় এক টান দিল। আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজেকে জিজ্ঞেস করলো, “আমি কে, আমি কি, কে এই অভিমন্যু?” বুকের কোন এক কোণ থেকে উত্তর এলো, “তুমি বিধ্বস্ত পরাজিত এক নাবিক।” চোখে জল চলে এলো অভির, নিজের মনকে বুঝাতে চেষ্টা করলো যে চোখের জল সিগারেটের ধোঁয়ার জন্য এসেছে, কিন্তু পাপী মন মানতে চায় না সে কথা। অস্ফুট চিৎকার করে উঠল অভি, “না আমার কোন অধিকার নেই কাউকে আঘাত করার। শুচিস্মিতাকে আঘাত দেবার কোন অধিকার আমার নেই।” যা কিছু ঘটে চলেছে বা ঘটে গেছে তা হয়তো ঘটা উচিত হয়নি। ওরা কি কোন পাপ করেছে? এই সমাজ ওদের দুজনকে সাংসারিক জীবনের বন্ধনে হয়তো বাঁধতে দেবে না। কিছু সম্পর্ক এই সমাজের কাছে অপবিত্র।

মাথা নিচু করে এই সব ভাবতে ভাবতে বিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল অভি। এক সময়ে দূর থেকে কেউ অভিকে ডাক দিল। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখলো সুব্রতর কোন একজন বন্ধু অভিকে বিয়ের মন্ডপে ডাকছে। বিয়ের পালা শেষ, সবাই খেতে বসবে তাই অভির খোঁজ পড়েছে।

বিয়ের মন্ডপে প্রবেশ করে অভি দেখতে পেল যে পরী মন্ডপের এক কোনায় চুপ করে বসে। থমথমে চোখ মুখ নিয়ে নিস্পলক দৃষ্টিতে এক ভাবে তাকিয়ে রয়েছে নিভে যাওয়া হোমের আগুনের দিকে। ফর্সা নাকের ডগা গোলাপের মতন লাল হয়ে উঠেছে। খানিক দূর থেকে অভি বুঝতে পারলো যে ওর চোখের পাতা ভিজে, পিঠের ওঠা নামা দেখে বুঝতে পারলো যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে পরী।

বড় ধাক্কা খেল অভি, কেন পরী কাঁদছে? এতো একদম ভাল কথা নয়, কেউ জানতে পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
 
Chapter 5: মেঘ রোদ্দুর। (#2)

কিছু পরে কনের মা এসে পরীর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে সোনা পরীর? তোমার নতুন বৌদি তোমার জন্য খাবার টেবিলে অপেক্ষা করছে আর তুমি এখানে একা একা বসে? কি ব্যাপার? যাও খেতে যাও, সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে।” পরী চোখ মুছে ভদ্রমহিলার দিকে হেসে তাকিয়ে ওনার সাথে খেতে চলে যায়।

অভি চুপচাপ খাওয়ার জায়গায় ঢুকে পড়ে। লক্ষ্য করে যে পরী ওর নতুন বউদির পাশে বসে হাসি মুখ নিয়ে খাচ্ছে। অভি খাবারে টেবিলে এক কোনায় বসে চুপ করে খেয়ে উঠে চলে যায়। খাবার সারাটা সময়ে কেউ কারুর মুখের দিকে তাকায় না। না দেখেও অভি ঠিক অনুমান করতে পারে যে ওর প্রান প্রেয়সী পরীর সেই অনুনাদশীল মেজাজ যেন কোন মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে।

খাবার পরে যে বিশ্রাম নেবার পালা। তখন রাত দুটো বাজে। অভি চুপচাপ বিয়ের মন্ডপে এসে এক কোনে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ে আর হোমের নিভে যাওয়া আগুনের থেকে যে ধোঁয়া উদ্গিরন হচ্ছে তার দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মাথা শূন্য, কোন কিছু ভাবতে পারছে না অভি। সময়ের ঠিকানা ভুলে গেছে, কতক্ষণ কেটে যায় তার কোন ঠিকানা থাকেনা। কিছু সময় পরে মাথা ভার করে ঝিমুনি আসে অভির।

অকস্মাৎ কাঁধের ওপরে নরম হাতের চাপ অনুভব করে। নাকে ভেসে আসে জুঁই ফুলের মনমাতান সুঘ্রাণ। অবশেষে পরী অভির কাছে এসেছে। ওর দিকে তাকিয়ে, একটা চেয়ার পাশে টেনে পরীকে বসতে বলে। পরী ওর সামনে ওর দিকে মুখ করে চেয়ারে বসে। অভি ভাবলেশহীন চোখ নিয়ে পরীর দুষ্টু মিষ্টি চোখের দিকে তাকালো।

পরী জিজ্ঞেস করলো, “তোমার ঠাণ্ডা লাগছে?”

অভি মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ।”

ওর দিকে একটা শাল এগিয়ে দিলে বলে, “এটা গায়ে জড়িয়ে নাও।”

অভিঃ “আমারটা আমাকে দিয়ে দাও।”

পরী সুন্দর একখানি হাসি দিয়ে বললো, “না। এটা আজ থেকে চিরদিনের জন্য আমার।”

অভিঃ “যথা আজ্ঞা রানী।”

পরীঃ “আমি লক্ষ্য করছি যে তুমি অনেক সিগারেট খেয়েছ। কেন খেয়েছ?”

অভি সিগারেটটা মাটিতে ফেলে নিভিয়ে দিয়ে বললো, “ঠিক আছে বাবা, এটাই শেষ সিগারেট।”

পরী জিজ্ঞেস করলো, “কেন থাকলে আজ রাতে?”

অভি উত্তর দিল, “আমি কোনদিন বিয়ের পুরো অনুষ্ঠান দেখিনি, দেখার খুব ইচ্ছে হলো তাই থেকে গেলাম।”

পরী অভিমান করে বললো, “আচ্ছা ঠিক আছে বুঝেছি। তুমি আমার জন্য থাকোনি তাহলে।”

অভিঃ “দেখ পরী, সেই সময়ে আমি জানতাম না যে তুমি থাকবে। কোন মহিলারা রাতে থাকবে না তো আমি কি করে জানব যে তুমি থাকতে?”

পরী অভির হাতে আলতো করে একটা থাপ্পড় মেরে বললো, “তুমি না একটা মস্ত গাধা। তুমি যখন থাকবে বলে ঠিক করেছিলে তাহলে আমাকে এক বার জানালে না কেন? তুমি একবারের জন্য এটা ভেবে দেখলে না যে এই রাতে বরযাত্রীর বাসে আমি একা একা কি করে বাড়ি ফিরব।”

অভিঃ “যাঃ বাবা। সত্যি আমি তোমাকে একদম বুঝে উঠতে পারছিনা জানো। বাসে সব আত্মীয় স্বজন, সবাই তোমার চেনা।”

পরীঃ “তুমি না একটা খুব বড় গাধা। তুমি মেয়েদের মন কোনদিন বুঝবে না। কোনদিন বুঝবে না তুমি।”

অভিমান করে উঠে যাবার উপক্রম করে পরী। অভি ওর দু’হাত নিজের হাতে নিয়ে অনুনয় করে বলে, “প্লিস চলে যেওনা।”

পরীঃ “আমি কেন বসতে যাব তোমার পাশে? তুমি তো আমার জন্য রাতে থাকোনি।”

অভিঃ “আই এম সরি বাবা। সোনামনা আমার, এবারে তো রাগ কমাও।”

হাত ধরে পরীকে পাশে বসিয়ে দেয় অভি। পরী ওর কাঁধে মাথা রেখে ওর দুহাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে আঙুল গুলো নিয়ে খেলা শুরু করে।

অভি বিড়বিড় করে বলে, “আমি জানিনা এই সম্পর্ক আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে। এই পরিণতি কি হবে তাও আমি জানিনা।”

পরীঃ “অভি, আমি জানতে চাইনা এই পরিণতি। আমি শুধু মাত্র বর্তমানে বাঁচতে চাই, বাঁচতে চাই তোমার সাথে। শুধুমাত্র এই টুকু জানি আমি।”

অভি বাঁ হাতে পরীর পাতলা কোমর জড়িয়ে ধরে নিবিড় করে কাছে টেনে নিল। পরী ওর বাজুতে নাক ঘষে আলিঙ্গনের উষ্ণতায় নিজেকে ধিরে ধিরে সঁপে দিল। পরীর নিরাভরন কোমরের ওপরে হাত বুলাতে লাগল অভি। ওর ডান হাতখানি ঠোঁটের কাছে এনে ছোটো ছোটো চুম্বনে ভরিয়ে দিল। কোমল তর্জনী ঠোঁটের ভেতর নিয়ে আলতো করে চুষে দিল। উষ্ণ লালায় সিক্ত হয়ে ওঠে পরীর তর্জনী।

কেঁপে ওঠে পরী, প্রেমঘন মৃদুকন্ঠে বলে ওঠে, “উম্মম্ম... প্লিস কোরোনা সোনা। আমার সারা শরীরে কেমন যেন করছে। বুক কেঁপে উঠছে সোনা, প্লিস ছাড়।”

ওর কবল থেকে নিজের আঙুল ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে পরী, কিন্তু সাথে সাথে অভির ঘাড়ের ওপরে নাক ঘষতে থাকে পরী। ভিজে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় অভির উষ্ণ ঘাড়ের ওপরে। ওদিকে অভি ওর তর্জনী মুখের মধ্যে পুরে চুষতে ছাড়ে না।

আলিঙ্গনে বদ্ধ হয়ে বারংবার কেঁপে ওঠে পরী। মৃদুকন্ঠে কাতর স্বরে বলে, “প্লিস অভি দুষ্টুমি করে না, ছেড়ে দাও।”

অভি নিজের চোয়ালের ওপরে পরীর ভিজে ঠোঁটের স্পর্শ অনুভব করে। পরী থেমে থাকেনা, ছোটো ছোটো চুম্বনে ভরিয়ে দেয় অভির গাল আর গলা। দু’জনার মাঝে প্রেমের বহ্নিশিখা জ্বলে ওঠে।

অভি পরীর তর্জনী ছেড়ে ওর দিকে তাকায়। গভীর আলিঙ্গনে বদ্ধ পরী, অভির পাঞ্জাবির কলার খামচে ধরে বুকের কাছে চলে আসে। কাজল কালো দু’ চোখে প্রগাড় প্রেমের আগুন যেন অভির হৃদয়কে জ্বালিয়ে দিয়েছে। হাত দিয়ে কোমল গাল ছুঁয়ে ঠোঁট নামিয়ে আনলো অভি, পরীর কপালের ওপরে। ভিজে উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়ায় কেঁপে ওঠে পরী। ছোটো ছোটো চুম্বনে ভরিয়ে দেয় ওর সুন্দর মুখখানি। প্রথমে কপাল, তারপরে বাঁকা ভুরুর ওপরে, আরও নিচে নামে অভির ঠোঁট, চোখের পাতার ওপরে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় অভি। দু’চোখ বন্ধ করে প্রেমের উষ্ণতায় নিজেকে সমর্পণ করে দেয় পরী। অভির ঠোঁট নেমে আসে পরীর নাকের ডগার ওপরে, বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে নাকের ডগায়। অভি আলতো করে চুমু খায় নাকের ডগায়। অনাস্বাদিত ভালোলাগায় ভরিয়ে দেয় পরীকে।

তিরতির করে কাঁপে পরীর ঠোঁট, কিছু পরেই যে দুই ঠোঁটের মিলন ঘটবে সেই প্রহর গোনে। কলার ধরে টেনে অভির ঠোঁটের ওপরে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় পরী। অভি থাকতে না পেরে চেপে ধরে ঠোঁট। প্রথমে হাল্কা ছোঁয়া, তারপরে পাগলের মতন একে অপরের ঠোঁট নিয়ে খেলা শুরু হয়ে যায়। জিব দিয়ে ঠোঁট চাটে কখন, কখন বা জিবের ডগা ঢুকিয়ে দেয় অভির উষ্ণ ঠোঁটের ভেতরে। দাঁতের ওপর দিয়ে আলতো করে বুলিয়ে দেয় জিবের ডগা। চুম্বনের ঘনত্ব পর্যায়ক্রমে বেড়ে ওঠে। অভি বা পরী কেউই এই প্রথম চুম্বনকে শেষ করে দিতে নারাজ। অভি হাত নিয়ে যায় পরীর মাথার পেছনে, ক্লিপে আঙুল দিয়ে খুলে ফেলতে চেষ্টা করে খোঁপা।

সুদীর্ঘ চুম্বনের রেশ কাটিয়ে উঠে পরী বল, “না সোনা, খোঁপা খুলো না। কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে আমাদের এই অবস্থায় যদি কেউ দেখে ফেলে।”

দু’জনেই প্রগাড় চুম্বনের খেলার পরে হাঁপাতে থাকে। যা ঘটে গেল মনে হলো যেন সমুদ্র তীরে যেন বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ে সব কিছু ভেঙে তছনছ করে দিয়ে চলে গেছে। পরীর গালে দেখা দেয় সেই পুরানো লালিমা, ঠোঁটে ভেসে ওঠে হৃদয় কাঁপানো হাসি। ওর মুখে হাসি দেখে আনন্দে অভির বুক ভরে ওঠে। অভির ঠোঁটে লেগে থাকে পরীর ঠোঁটের রঙ।

অভিঃ “উম্মম্মম্ম...... তোমার ঠোঁট দুটি ভারী মিষ্টি।”

উলটো হাতের পাতা দিয়ে নিজের ঠোঁট মুছে বলে, “তুমি না একদম যা তা। পাগল করে ছেড়ে দিলে একেবারে...” পরী উঠে দাঁড়িয়ে অভির হাত ধরে তুলতে চেষ্টা করে, “এইযে কিগো, সকাল চারটে বাজে সেটা খেয়াল আছে তোমার? একটু বিশ্রাম নেবার কথা কি মনে হয় না কখনো?”

অভিঃ “তুমি সাথে থাকলে কি আর বিসগ্রাম নেবার কথা মনে হয়, সোনা।”

পরীঃ “জানো বউদির মা বলছিল যে আমাদের জন্য একটা রুম দিয়েছে। দাদার বন্ধুরা তো বাসর জাগছে দাদার সাথে, রুমটা খালিই হবে এখন। চলো না সেখানে গিয়ে দুজনে একটু গড়িয়ে নেই।”

অভিঃ “পাগল হলে নাকি। তোমার বড়দা দেখ সেই ঘর দখল করে ভোঁসভোঁস করে ঘুমুচ্ছে হবে।”

পরীঃ “উফফফ... না দাদাকে নিয়ে আড় পারা গেল না। দাদার কথা আমি একদম গুলে খেয়ে নিয়েছিলাম। এখন কি কর্তব্য, এই ঠাণ্ডার রাতে তো এখানে বসে থাকা যায় না।”

অভি আবার পরীকে কোলে ওপরে টেনে বসিয়ে দেয়, “তুমি যতক্ষণ আমার সাথে আছো, ততক্ষণ আমার ঠাণ্ডাও লাগবে না আর ক্লান্তিও আসবেনা।”

পরীঃ “তুমি না একদম পাগল। কেউ যদি আমাদের এই অবস্থায় দেখে ফেলে না, তাহলে মস্ত এক কেলেঙ্কারি কান্ড ঘটে যাবে। উম্মম... আমি চাইনা এই রাত শেষ হয়ে যাক...”

অভি দুহাতে পরীর পাতলা কোমর জড়িয়ে ধরলো। পরী অভির গলা নিজের বাহুপাশে নিয়ে নিল, ওর কোল থেকে ওঠার কোন তাড়া নেই যেন। একে ওপরের বাহুপাশে বদ্ধ হয়ে বসে আদর খেতে লাগল।

আদর করে মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে পরী অভিকে বলে, “একটা গান গাও।”

অভিঃ “পাগলে গেলে নাকি তুমি? আমি গান গাইলে কুকুরগুলো মারতে শুরু করে দেবে আমাকে।”

পরীঃ “বাঃরে, বাসে তো আমাকে দেখে বেশ গান বের হচ্ছিল, এখন কি হলো...”

অভিঃ “বাসের কথা আলাদা।”

পুব আকাশে নবীন ঊষার ছটা দেখে অভি পরীকে বললো, “বাড়ির ভেতরে যাওয়া যাক।”

পুব দিকে একবার তাকিয়ে মৃদু স্বরে উত্তর দিল, “হ্যাঁ চলো, আমাদের বাড়ির ভেতর যাওয়া উচিত।”
 
Chapter 6: প্রত্যাবর্তন।

নবীন ঊষার সাথে সাথে এক নতুন দিনের আগমন ঘটে পরী আর অভির জীবনে।
একে একে কনের বাড়ির লোকজন জাগতে শুরু করেছে। সেই ভিড়ে পরী আবার হারিয়ে গেল। সুমন্ত মামা অভির কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো যে রাতে কোথায় ছিল। উত্তরে অভি জানিয়ে দিল যে সারা রাত ও বিয়ের প্যান্ডেলে বসে কাটিয়ে দিয়েছে। সেই শুনে মামা হেসে ওকে হাত মুখ ধুয়ে নিতে বললো। জানিয়ে দিল যে কয়েক ঘন্টা পরে বর কনেকে নিয়ে বসিরহাটের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। ধিরে ধিরে বিয়ে বাড়ির লোকজন জেগে উঠে মেতে উঠেছে।

গ্রামের হাওয়ায় এক বিশুদ্ধতার আমেজ, বুক ভরে সেই বিশুদ্ধ বাতাস বুকের মাঝে টেনে নিল অভি। কোলকাতায় এই বাতাস পাওয়া বড় কঠিন ব্যাপার। কিছু পরেই বরযাত্রীদের সকালের খাওয়ার ব্যাবস্থা হয়ে গেল। অভির চোখ থেকে থেকে শুধু পরীকে খুঁজে বেড়ায়, কিন্তু খুঁজলে কি হবে সেই কন্যের দেখা নেই।

সবে মাত্র খেতে বসেছে অভি, ঠিক এমন সময়ে মাথার পেছনে চাঁটি মারে পরী।

অভিঃ “আউচ...” পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখে রাতের পরী আর নেই। যে দাঁড়িয়ে সে যেন তরতাজা এক ফুল, সদ্য শিশিরে স্নান সেরে ওর কাছে দাঁড়িয়ে।

অভিমানি সুরে বলে, “আমাকে ছেড়েই খেতে বসে গেলে? লজ্জা করে না তোমার।”

অভিঃ “বাঃরে তোমার দেখা নেই। আর আমার কি খিদে পায় না নাকি।”

পরীঃ “কাউকে কি আমার কথা জিজ্ঞেস করা যেতো না নাকি।”

অভিঃ “আচ্ছা বাবা মাফ কর। এবারে বসে পড়তো, খেয়ে নাও। পেটে কিছু পড়েনি বলে মনে হয় মাথাটা একটু গরম।”

প্রাতরাশ সেরে পরী চলে গেল কনের কাছে। বিদায়ের সময় বর্তমান। এই সময়টা অভির একদম ভাল লাগেনা। কান্নাকাটি একদম সহ্য করতে পারেনা ও। বাড়ির ভেতরে ক্রন্দনের রোল উঠেছে, সেই শুনে বুঝে গেল যে কনে বিদায় নিতে সময় লাগবে।

অভি চুপ করে উঠানের এককোণে দাঁড়িয়ে থাকে। ঠিক সেই সময়ে পাঞ্জাবির হাতায় টান লাগে, পেছনে তাকিয়ে দেখে যে পরী ওর পেছনে মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুই হাতে অভির হাতখানি শক্ত করে ধরে ঘন ঘন পিঠের ওপরে নাক ঘষছে। মনে হলো যেন চোখের জল আটকানোর প্রবল চেষ্টা করে চলেছে।

অভিঃ “আরে বাবা, বোকা মেয়ে কাঁদে নাকি। তোমার বৌদি তোমার বাড়ি যাচ্ছে আবার কি চিন্তা।”

ফুঁফিয়ে ওঠে পরী, “তুমি বুঝবে না।”

বাঁ হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁধের গোলায় আলতো করে হাত বুলিয়ে অভি ওকে আস্বস্ত করতে চেষ্টা করে। পরী তখন অভির ঘিয়ে রঙের শাল খানি জড়িয়ে।

ফিরে যাবার জন্য দুটি গাড়ি প্রস্তুত।

পরী চোখ মুছে নিচু স্বরে বলে, “আমাকে বউদির গাড়িতে যেতে হবে। তুমি ওর বন্ধুদের গাড়িতে যেও। আমার সাথে গেলে কারুর নজরে চলে আসব আমরা।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই কনেকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো গাড়ি। অভি চাপলো সুব্রতর বন্ধুদের গাড়িতে আর পরী অন্য গাড়িতে। অভি সামনের সিটে চুপ করে বসে, পেছনে সুব্রতর বন্ধুরা বসে। দুই বন্ধু নিজেদের মধ্যে কথা বার্তা বলছিল, অভি বিশেষ কান দেয়নি ওদের কথাবার্তার মধ্যে। একসময়ে ওর কানে ভেসে আসলো শুচিস্মিতার নাম।

একজনঃ “কাল রাত থেকে শুচিস্মিতা কেমন যেন আলাদা আলাদা মনে হচ্ছে।”

দ্বিতীয় জনঃ “হ্যাঁ রে, ঠিক বলেছিস। আমারো সেটাই মনে হয়েছে। এমনিতে খুব হাসি খুশি থাকে মেয়েটা কিন্তু কাল রাতে বেশ গম্ভির ছিল। অনেক ক্ষণ ধরে ওর কোন পাত্তা পাইনি।”

একজনঃ “ব্যাবহারটা কেমন যেন লাগল আমার, কি ব্যাপার কিছু জানিস নাকি?”

অপর জনঃ “যাঃ বাবা আমি কি করে জানব।”

অভির দিকে একজন প্রশ্ন করে, “তুমি উলুপি ম্যাডামের ছেলে, তাই না।”

মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয় অভি, “হ্যাঁ।” ওদিকে বুকের ভেতরে আশঙ্কায় কাঁপুনি ধরে, পরী আর ওকে একসাথে দেখে ফেলেনি তো ওরা, দেখে ফেললেই এক কেলেঙ্কারি কান্ড হয়ে যাবে।

একজনঃ, “ভাই তোমার মা আমাদের স্কুলের টিচার। আমাদের পড়াতেন আর খুব কড়া ম্যডাম ছিলেন।”

হেসে ওঠে অভি, “বাড়িতেও ভীষণ কড়া আমার মা।”

দ্বিতীয় জনঃ “সুব্রত তোমার মামা হন, তাই না?”

অভিঃ “হ্যাঁ, কিন্তু মায়ের চেয় অনেক অনেক ছোটো ওরা।”

এর মধ্যে একজন একটা সিগারেট জ্বালিয়ে অভির দিকে বাড়িয়ে দেয়, “তুমি কলেজে পড় তার মানে সিগারেট খাওয়া চলে তোমার। আরে লজ্জা পেও না আমরা তোমার মামার বন্ধু হলে কি হবে, আমাদের দাদা বলে ধরে নিও।”

অভিঃ “না, আমি কাল রাত থেকে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।”

একজন হেসে বলে, “কনের বাড়ির কাউকে মনে ধরে নিয়েছ নাকি। আচ্ছা তুমি ড্রিঙ্ক করো?”

মাথা নাড়ায় অভি, “হ্যাঁ, তবে ভদকা আর রাম।”

একজনঃ “তাহলে বেশ জমবে। আজ রাতে বাড়ি ফিরে একসাথে বসা যাবে তাহলে। তুমিও চলে এসো আমাদের সাথে।”

কথা বার্তার পরিপ্রেক্ষিতে জানা গেল যে একজনের নাম সমির আর একজনের নাম মৃগাঙ্ক। দুজনেই সরকারি চাকুরিরত এবং অবিবাহিত। এও জানা গেল যে সুব্রতর নাকি প্রেম বিবাহ আর কনের নাম মৈথিলী। মৈথিলীর বয়স পরীর মতন কিম্বা পরীর চেয়ে এক দু' মাসের ছোটো বড় হবে। সুব্রত আর মৈথিলীর দেখা কোন এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে হয়েছিল, সেই থেকে দু’ জনের মাঝে প্রেম হয়। পরে সুব্রতর বড় দাদার মৈথিলীকে দেখে পছন্দ হয় এবং সুমন্ত মামা মৈথিলীর বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব করেন। এই ভাবে এই দুই প্রেমিক যুগল বিয়ের বন্ধনে বেঁধে যায়।
অভি মনে মনে ভাবে, “আমি খালি হাতে এসেছিলাম কিন্তু অনেক কিছু নিয়ে যাচ্ছি। আমার ভালবাসা, আমার পরী।”
 
Chapter 7: তমসা উদ্ঘাটন। (#1)

বাড়ির সবাই নববধুকে বরন করে নেবার জন্য আগে থেকেই দরজায় উপস্থিত ছিল। অভির মা, দিদা, মেঘনা এবং আরও অনেকে। গাড়ি থেকে নেমে অভি লক্ষ্য করলো যে পরী আর মৈথিলী দুজনের মধ্যে বেশ হৃদ্যতা গড়ে উঠেছে। পরীর হাসিখুসি মুখ দেখে অভির বেশ ভাল লাগল। উৎসুক নয়নে অভি তাকিয়ে ছিল পরীর দিকে কখন একবার চারচোখ এক হয়। মায়ের দিকে গুটি পায়ে এগিয়ে গেল অভি। বাবা এককোণে দাঁড়িয়ে ছিলেন, অভিকে দেখে কাছে ডাকলেন। কনের বাড়ির কুশল মঙ্গল আর রাতের কথা জিজ্ঞেস করলেন। অভি মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিল যে রাতে কোন অসুবিধা হয়নি।
মৈথিলীকে বরন করার পরে, পরী ওকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। বাড়িতে ঢুকে পড়ার আগে চোরা চাহনি দিয়ে গেল অভির দিকে।

কিছু পরে মৃগাঙ্ক এসে অভিকে ওদের সাথে যেতে বললো। মৃগাঙ্কর বাড়ি দিদার বাড়ির কাছেই। অভি উত্তরে জানালো যে ও জামা কাপড় বদলে ওদের সাথে ওদের বাড়ি যাবে।
বাড়ি ঢোকা মাত্রই মা জিজ্ঞেস করলেন যে ওর শালটার কি হলো। অভি জানিয়ে দিল যে রাতে পরীর খুব ঠাণ্ডা লাগছিল তাই ওর শাল পরী নিয়ে নিয়েছে। মা ওর কথা শুনে খুশি হয়ে বললেন যে ভাল কাজ করেছিস। বাথরুমে ঢুকতে যাবে অভি, ঠিক এমন সময়ে পরী এসে মাকে জড়িয়ে ধরলো। মায়ের কাঁধের পাশ থেকে অভির দিকে দুষ্টু মিষ্টি হেসে মায়ের গালে চুমু খেল। মা পরীকে এক মৃদু বকুনি দিয়ে বললো রাতের জামাকাপড় বদলে নিতে।

পরী মাকে জিজ্ঞেস করলো যে মা ওর মায়ের সাথে কথা বলেছেন কি না। মা উত্তর দিলেন যে রাতের বেলা সবকিছু মিটে যাবার পরে তিনি দিদার সাথে পরীর ব্যাপারে কথা বলবেন।

পরী আদর করে মায়ের গালে চুমু খেয়ে বললো, “তুমি আমার খুব ভাল দিদি। আজ থেকে আমি তোমাকে ছোটমা বলে ডাকব।”

মা ওর গালে আদর করে বললো, “তুই মা, চিরকাল আমার চোখের মনি ছিলিস। কতদিন তোকে দেখিনি। আয় কাছে বস, তোকে দুচোখ ভরে একবার দেখি।”

অভি বাথরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে মা মেয়ের আদর দেখতে থাকে। মা ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কিরে কি দেখছিস? চুপিচুপি মা মেয়ের কথা শুনছিস?”

পরী মায়ের কোলে মাথা রেখে বিছানায় শুয়ে পড়লো। মা ওর চুলে বিলি কাটতে থাকে আর ছোট্ট বিড়ালের মতন পরী মায়ের আদর খেতে থাকে।

মা মেয়ের অতিরিক্ত প্রেম আর সহ্য হলো না অভির। জামা কাপড় বদলানর জন্য বাথরুমে ঢুকে গেল। বেশ খানিকক্ষণ পরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখে, পরী মায়ের কোলে মাথা গুঁজে কাঁদছে আর মায়ের চোখেও জল। অভি মাকে জিজ্ঞেস করলো যে কি হয়েছে। মা কিছু উত্তর দিলেন না, শুধু বললেন চলে যেতে।

ঠিক সেই সময়ে বাইরে থেকে মৃগাঙ্কর ডাক শুনে অভি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ঘরের মধ্যে ক্রন্দন রত অভির ভালবাসার দুই প্রতিমা, এক মা এক পরী। মৃগাঙ্কর বাড়ির দিকে যেতে যেতে অভি ভাবতে চেষ্টা করে যে কি কারনে মা আর পরী কাঁদতে পারে। ওর মাথায় কোন কারন খুঁজে পেলো না। মৃগাঙ্ক জানালো যে কিছুক্ষণের মধ্যেই সুব্রতও ওদের সাথে ড্রিঙ্ক পার্টিতে যোগদান করবে।

মৃগাঙ্কর বাড়ি পৌঁছে অভি লক্ষ্য করলো যে সুব্রত আগে থেকেই বাড়িতে উপস্থিত। তিন তলার ঘরে মদের আসর বসেছে, সমির বারটেন্ডার, সবাইকে গ্লাসে মদ ঢেলে দিচ্ছে। সমির, মৃগাঙ্ক, সুব্রত আর অভির মাঝে শুধু মাত্র সুব্রতর বিয়ে হয়েছিল, বাকিরা অবিবাহিত। হাসি ঠাট্টা মজা মিলিয়ে মদ্য পান চলতে লাগল। সমির বেশ পটু হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিচ্ছে ওদেরকে। সুরার নেশা সুব্রতর আর মৃগাঙ্কর রক্তে লেগে গেছে।

মদের ঝোঁকে মৃগাঙ্ক বলে ফেললো, “গুরু, আমি শুচিস্মিতাকে ভালবাসি।”

সুব্রত ওর কাঁধ চাপড়ে বললো, “বোকা... তুই তো একটা মস্ত গাধা। এতদিন চুপ করে ছিলিস।”

কথা শুনে অভির মনে হলো যেন কেউ ওর কানের ওপরে গরম সিসে ঢেলে দিয়েছে। গ্লাসে চুমুক দিতে ভুলে গেল, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মৃগাঙ্কর দিকে, “শালা বলে কি?”

মৃগাঙ্ক সুব্রতকে বললো, “তোর বড়দার ভয়ে তো আমি কিছু বলতেই পারিনি।”

সুব্রতঃ “বড়দা আমাদের বাবার মতন। বড়দা যতই রাগি হোক না কেন, একদম নারকেল আমার বড়দা। ওপরটা শক্ত কিন্তু ভেতরটা একদম নরম আর জলে ভর্তি।”

মৃগাঙ্কঃ “ঠিক আছে তাই হবে। আমি তাহলে তোর বড়দার সাথে কথা বলবো।”

মৃগাঙ্কর কথা শুনে অভির মনে হলো যেন টেনে এক চড় কষিয়ে দেয় মৃগাঙ্কের গালের ওপরে, “শালার কিনা আমার প্রেমিকার ওপরে নজর?” কোন রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে, এক ঢোঁকে পুরো গ্লাসটা গলায় ঢেলে দেয়। রক্তের সাথে মদ মিশে গিয়ে মাথা ঝিনঝিন করে ওঠে।

সুব্রত অভির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, “এই ছেলে, এই অভিমন্যু। কিছু বল...”

ধুক করে ওঠে অভির বুক। হাতের সামনে ছিল রামের বোতল, একটানে ছিপি খুলে নিয়ে কিছুটা গলায় ঢেলে নিল। দাঁতে দাঁত পিষে জিজ্ঞেস করলো, “আমার কি বলার আছে?”

সুব্রত ওর দিকে হেসে উত্তর দিল, “যা কিছু। তোমার কথা, তোমার গার্লফ্রেন্ডের কথা।”

ওর কথা শুনে যেন অভির প্রানে বাতাস এলো, “যাক সুব্রত আমাদের সম্পর্কের কথা কিছু জানে না।” হেসে জবাব দিল অভি, “না আমার কোন গার্লফ্রেন্ড নেই। কলেজের সবাই খালি বই পড়া মাগি।”

ওই কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে।

মৃগাঙ্ক নাছোড়বান্দা, “ভাই সুব্রত, আমি শুচিস্মিতাকে বিয়ে করবো।”

ওর কথা শুনে সুব্রত বললো, “সে গুড়ে বালি। পরীর মাথায় নিশ্চয় কিছু একটা চলছে আর সেই জন্য...” অভির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো, “ওর মা, আমাদের উলুপিদি আমার বিয়েতে এখানে এসেছেন। আমি খুব ভাল ভাবে বুঝতে পারছি যে আজ কালের মধ্যে এক বিশাল ঝড় আসবে বাড়িতে। আর সেই ঝড়ে অনেক কিছু বদলে যাবে। আমার ছোটবেলার কথা বিশেষ কিছু মনে নেই তবে মায়ের মুখে শুনেছি যে উলুপিদি আমাদের সংসারটাকে নিজের সংসারের মতন করে ভালবাসতেন, বিশেষ করে পরীকে। বাবা মারা যাওয়ার পরে উলুপিদি আমাদের সংসারটাকে টেনেছিলেন। আমরা সবাই তখন খুব ছোটো। আমাদের ভাত কাপড়ের যোগাড় তিনি করেছিলেন সেই সময়ে। অনেক জল গড়িয়ে গেছে, অনেক দিন কেটে গেছে। আমাদের মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটেছিল যার জন্য আজ পর্যন্ত উলুপিদি আমাদের বাড়িতে আর পা রাখেননি। আমি হলফ করে বলতে পারি যে উনি যখন এ বাড়িতে পা রেখেছোেন তখন বিশাল কিছু একটা ঘটতে চলেছে।”

অভির মাথা থেকে মদের ঘোর কেটে গেল। কথা বলার মধ্যে সুব্রত গ্লাস নিচে রেখে দিয়েছে। দু’ চোখ লাল, কিঞ্চিত জলে টলটল করছে চোখ। সমির দেখলো পরিবেশ বেশ সঙ্গিন হয়ে উঠছে। একথা সেকথা বলে পরিবেশটাকে একটু হাল্কা করতে চেষ্টা করলো সমির। কিন্তু সুব্রত থামতে নারাজ, ওর রক্তে যেন আগুন লেগেছে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top